অঙ্ক পরীক্ষা

অঙ্ক পরীক্ষা

ভোররাতে ডাক্তার সামন্ত জবাব দিয়ে চলে গেলেন। বললেন, ‘আমার আর কিছু করার নেই। আপনারা এবার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন। কিছু করবার থাকলে একমাত্র তিনিই করতে পারবেন।’

প্রতিবেশী কাশীনাথ ভট্টাচার্য রোজ কাকভোরে উঠে গঙ্গাস্নান করতে যান। ডাক্তার সামন্তকে মুখার্জির বাড়িতে ঢুকতে দেখে তাঁর পেছনে পেছনে ভেতরে এসেছিলেন। তিনি মৃদুলাকে বললেন, ‘যাও মা, তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও। গত তিনদিন দু-চোখের পাতা এক করোনি। এখন একটু শুয়ে নাও। আমি বরং বিজনের পাশে বসছি। ওর কানে তারক ব্রহ্ম নাম জপ করি। শেষমুহূর্ত যখন আসবে, আমি তোমাকে ডেকে দেব।’

মৃদুলা রাজি হচ্ছিল না। বিজনের ছোটোভাই সুজন প্রায় জোর করেই ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। মৃদুলা খুব শক্ত মানুষ। চীৎকার চেঁচামেচি না-করে স্বামীর নিথর নিস্তব্ধ দেহটা দেখতে দেখতে পাশের ঘরে চলে গেল। সেখানে একটা ক্যাম্পখাটের ওপর ওর এগারো বছরের ছেলে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে গলার মধ্যে ঠেলে ওঠা কান্না কোনোরকমে সামলে মৃদুলা বলল, ‘বড়ো অল্পবয়সে পিতৃহারা হল গৌতম, তাই না ঠাকুরপো? এখন কে ওকে ভালোবাসা দেবে, কে-ই বা শাসন করবে? ওর বাবাও অল্পবয়সে তার বাবাকে হারিয়েছিল, আজ ওরও তাই হল।’

সুজন অশ্রুসিক্ত গলায় বলল, ‘তুমি কিচ্ছু ভেব না, বউদি। আমার তো আছি। দিদিও আজ দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ওর যাতে কোনোরকম অভাব না-থাকে, তা আমরা সবাই মিলে দেখব, দেখো তুমি।’

মৃদুলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ খাটের ওপর উঠে বসল গৌতম। তারপরেই একটা ভরাট গম্ভীর বয়স্ক গলায় বলল, ‘বিজন কোথায়?’ বলে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।

ওর গলা শুনে ঘরের বাকি দু-জনেই স্তম্ভিত। সুজন কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘একী কাণ্ড! অবিকল বাবার গলা।’

গৌতম পূর্ববৎ তার কাকাকে সম্বোধন করে বলল, ‘বিজন কোন ঘরে আছে, সুজন?’

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সুজন একটা কম্পিত আঙুল তুলে পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিল। হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরা গৌতম দৃঢ় পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পেছনে পেছনে সন্ত্রস্ত পায়ে ওর নির্বাক মা আর কাকা বেরিয়ে এল। গম্ভীর গলায় গৌতম বলল, ‘বিজন, উঠে আয়। আমি তোকে নিতে এসেছি।’

ব্যাপার দেখে কাশীনাথ জোড়হাতে কম্পিতদেহে উঠে দাঁড়াল। বিড়বিড় করে বললেন, ‘বিজন, নিখিলবাবু এসেছেন তোমাকে নিয়ে যেতে।’

আস্তে আস্তে চোখ তুলে বিজন ঘাড় ঘুরিয়ে দৃশ্যটা দেখল তারপর কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল। গৌতম আবার বলল, ‘দেরি করছিস কেন, বিজন? চল, আমাদের যাবার সময় হল।’

এইবার বিজন খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। দু-পা হেঁটে ছেলের সামনে গিয়ে টেনে তার গালে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষিয়ে বলল, ‘হারামজাদা ছেলে! সক্কালবেলা বাপের সঙ্গে ফাজলামো হচ্ছে! নাম ধরে ডাকা আবার তুইতোকারি করা? ইশকুলে পড়ে এইসব শিক্ষা হচ্ছে? হতভাগা! পরশু না তোর অঙ্ক পরীক্ষা? ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে না-কেঁদে যা, পড়তে বোস নইলে চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দেব, বলে দিচ্ছি! উজবুক, বাঁদর!’

‘বুক ফার্ম’-এর প্রয়াস নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *