কালরাত্রি

কালরাত্রি

চিত্তপ্রসাদবাবু নিবিষ্টচিত্তে যথারীতি দাবা খেলছিলেন আমাদের ক্লাবে। আমরা সবাই তাঁর ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে চারদিকে ঘিরে বসে পড়লুম। বললুম, ‘অনেকদিন আপনার জীবনের কাহিনি শুনিনি আমরা রায়মশাই, আজ একটা শোনাতেই হবে।’

চিত্তপ্রসাদ বিরক্ত মুখে বললেন, ‘উঃ, জ্বালিয়ে মারলেন আপনারা! আপনাদের এই ক্লাবে আসা দেখছি বন্ধ করতে হবে। যাহোক, গল্প শুনতে চাইছেন যখন, শোনাব, কিন্তু এই শেষ।’

আমরা সমবেতভাবে মাথা নেড়ে বললুম, ‘না, না, তা কী করে হয়? তবে এইটে শোনার পর আর মাসখানেক কিছু শুনতে চাইব না, কথা দিচ্ছি আমরা।’

চিত্তপ্রসাদ বললেন, ‘বেশ। মাসখানেক পরে আমাকে আর ইহজগতে দেখতে পাবেন কি না আপনারা কে জানে। এখন গল্প যে শুনতে চাইছেন, কীসের গল্প শুনতে চান, বলুন? আমার জীবনে অদ্ভুত আর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তো বড়ো কম হয়নি। কাজেই, কী ধরনের গল্প শুনতে চান, জানলে সুবিধে হয়।’

বিকাশ বলল, ‘আচ্ছা রায়মশাই, আপনি তো বিখ্যাত উকিল আবার আইনসভার সদস্যও ছিলেন। মানে, আপনি আইনের স্রষ্টা এবং বিখ্যাত, দুই-ই। আপনি জেনেশুনে, ইচ্ছে করে কোনোদিন আইন ভেঙেছেন?’

চিত্তপ্রসাদ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘আইন আমি অনেকবারই ভেঙেছি। সে জন্যে জেলও খেটেছি। তবে সে আইন ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীর, আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আইন। আপনি বোধ হয় সেরকম আইনের কথা বলছেন না। আপনি জানতে চাইছেন, আমি এমন কোনো অপরাধ করেছি কি না, যা সর্বদেশে সর্বকালের সামাজিক আইনের বিরোধী, তাই না? হ্যাঁ, করেছি। আমার চোখের সামনে ঘটা একটা হত্যাকাণ্ডের সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ লুপ্ত করেছি এবং হত্যাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দিইনি। এই কাজ কোনো দেশের আইন সহ্য করে না, তা দেশ স্বাধীন বা পরাধীন যাই হোক না-কেন।’

আমরা বিস্ফারিত চোখে সমস্বরে বললুম, ‘কী সর্বনাশ! এরকম কাণ্ড করতে গেলেন কেন?’

চিত্তপ্রসাদ দাবার বোর্ড সরিয়ে রেখে বললেন, ‘করেছিলুম, সে-কাহিনিই তাহলে শুনুন। তবে সেটা একটা এতই অবিশ্বাস্য ঘটনা যে আপনারা হয়তো সব শুনে বলবেন বুড়োর ডবল ভীমরতি হয়েছে। তা, যা খুশি আপনারা বলতে পারেন, আমার কিছুই যায়-আসে না। আগে এসব অভিজ্ঞতার গল্প বলতে ভয় পেতুম, আজ আর পাইনে। জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে সমালোচনা, প্রশংসা সবই আমার কাছে তুল্যমূল্য।

উনিশ-শো তিরিশ থেকে উনিশ-শো চল্লিশের মধ্যে আমি অজস্রবার জেল খেটেছিলুম। এই একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলুম, ধরে নিয়ে তিন মাস ঠুকে দিল। আবার বেরিয়ে এসে বিলিতি কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং করলুম, দু-মাসের জন্য ঢুকিয়ে দিল— এইরকম চলছিল। এরইমধ্যে আমার ওকালতিও চলছিল, নামও হচ্ছিল।

এই সময় বোধ হয় উনচল্লিশ কী চল্লিশ সাল হবে, হঠাৎ একদিন আমার কাছে আমার বন্ধু চন্দ্রশেখরের জরুরি তলব দিয়ে এক টেলিগ্রাম এসে হাজির। চন্দ্রশেখর ছিল বর্তমান মালদা জেলার বকুলপুর গ্রামের জমিদার, আমার ছোটোবেলাকার বন্ধু। তার আহ্বান অগ্রাহ্য করতে পারিনে। কাজেই, একদিন বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে বকুলপুর রওনা দিলুম।

এখানে বসন্ত সম্পর্কে দু-চার কথা বলে রাখা ভালো। কারণ এই গল্পে তার ভূমিকাই প্রধান বলা চলে।

বসন্তের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। আমি তখন সেখানে রাজবন্দি, বসন্ত আমার দেখাশুনো করত। শ্যামপুকুরের আদিত্য সিংহের বাড়ির লক্ষ টাকা দামের গৃহদেবতার মূর্তি চুরির জন্যে তার লম্বা সাজা হয়েছিল।

তা, সেসময় আমরা মনে করতুম, জাতীয় চরিত্রের উন্নতি না-হলে স্বরাজ আসতে পারে না। কাজেই দেশোদ্ধারের সঙ্গেসঙ্গে মানুষকে, বিশেষত পণ্ডিত মানুষের চরিত্র সংশোধন করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতুম আমরা। আর এই কাজের আদর্শ জায়গা তো জেল। আমাদের লেকচার শুনতে শুনতে অনেক চোর বোধ হয় চুরি করা ছেড়ে দিয়েছিল এই ভয়ে যে, ধরা পড়ে জেলে আবার না ওই লেকচার শুনতে হয়।

বসন্তকে এমনই লেকচার দিতে গিয়ে আমার খটকা লাগল। দেখি, লোকটা সাধারণ অপরাধী বলতে যা বোঝায়, তা নয়। লক্ষ করলুম যে, পারতপক্ষে মিথ্যে কথা বলে না, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে আর অবসর সময়ে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে খিস্তিখেউড় না-করে চুপ করে ধ্যানস্থ হয়ে বসে কীসব ভাবে। তখন তাকে দেখলে রীতিমতো সম্ভ্রম হয়। এমন লোককে উচিত-অনুচিত বা নীতি বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে লাভ কী? উলটে আমিই মাঝে মাঝে লেকচার শুনে ফেলতে লাগলুম।

এরকম মানুষটা হঠাৎ চুরি করতে গেল কেন? একদিন বসন্তের আড়ালে আর-এক কয়েদি কার্তিককে ডেকে ব্যাপারটা জানতে চাইলুম। কার্তিকও চোর ছিল কিন্তু সে দেখতুম বসন্তকে শ্রদ্ধাভক্তি করে থাকে।

কার্তিক বলল, ‘বসন্তদাদা চুরি করতেই পারে না, রায়বাবু। তাঁকে শ্যামপুকুরের সিঙ্গিরা অন্যায় করে ফাঁসিয়েছে।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘কেন? সিঙ্গিদের সঙ্গে তোর বসন্তদাদার শত্রুতা কীসের?’

সে বলল, ‘শত্রুতা নয় রায়মশাই, গেরোর ফের। ব্যাপারটা বলি শোনো। বসন্তদাদা সিঙ্গিদের বাড়ি চাকরের কাজ করত। খোদ বড়োবাবুর খাস চাকর ছিল তিনি। একদিন হঠাৎ সিঙ্গিদের মন্দির থেকে মা দুর্গার সোনার মূর্তি আর যত হিরে-জহরতের গয়না গায়েব হয়ে গেল। চুরিটা হয়েছিল দুপুররাত্রে, কিন্তু হতে না-হতেই এক দারোয়ান মন্দিরের দরজা খোলা দেখে মহা হইচই জুড়ে দিলে। তারপর তো হুলুস্থুল ব্যাপার। পুলিশ এসে তার ওপর তাণ্ডব জুড়ে দিলে। আর দেবে না-ই বা কেন? বড়োবাবু পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে বলেছিল, সেটি তো বড়ো কম টাকা নয়।

আর সবার সঙ্গে পুলিশ এসে বসন্তদাদাকেও ধরলে। জেরার পর জেরা। বসন্তদাদা সত্যি কথাই বলে, আমি চুরি করিনি। সে ঘরে বড়োবাবুও ছিল। তিনি দরোয়ানকে বলল, বসন্তকে আমি চিনি, ও কখনো মিথ্যে বলে না। বলে, হঠাৎ কী খেয়াল হল, বড়োবাবু বসন্তদাদাকে জিগ্যেস করে বসল, আচ্ছা, তুমি চুরি করোনি, তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু কে চুরি করেছে তুমি জানো?

ব্যস, বসন্তদাদা চুপ। আর কথা কয় না। পুলিশে বড়োবাবুতে কত চেষ্টা, কাকুতি, কাকুতি-মিনতি, ভয় দেখানো, বসন্তদাদা কোনো কথাই বলে না। তখন বড়োবাবুই আবার জিগ্যেস করল, চোরাই মাল কোথায় আছে, তুমি জানো? বসন্তদাদা বললে, জানি। বড়োবাবু জিজ্ঞাসা করল, কোথায়? বসন্তদাদা বললে, ছোটোরানিমার সিন্দুকে বেনারসি শাড়ির তলায়।

মাথায় বাজ পড়লেও বোধ হয় বড়োবাবু এত আশ্চর্য হত না, রায়বাবু। সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির ভেতরে খবর গেল। আর চোরাই মাল যেখানে বসন্তদাদা বলেছিল, সেখানেই পাওয়া গেল।

রাগে-দুঃখে-অপমানে বড়োবাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। আর সেই সবটুকুর ঝালটা গিয়ে পড়ল বসন্তদাদার ওপরে। বড়োবাবু বসন্তদাদার গলা টিপে ধরে বলল, তোমাকে বলতেই হবে কে চুরি করে ওখানে মালটা রেখেছে। ছোটোখোকার মহলে তুমি কোনোদিন যাওনি, ছোটোরানির ঘরে ঢোকা তো দূরস্থান, তুমি কী করে জানলে যে মালটা ওখানে আছে? বসন্তদাদা কিছুতেই বলবে না। তখন বড়োবাবু হান্টার দিয়ে বসন্তদাদাকে পিটতে শুরু করল। যখন আর সহ্য করতে পারে না, তখন বসন্তদাদা বলেই ফেলল, চুরি করেছে ছোটোবাবু। মদে, জুয়ায়, মেয়েমানুষে এত দেনা যে এমন একটা কিছু-না করলে আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। বড়োবাবু জিগ্যেস করল, তুমি কী করে জানলে, নিজের চোখে দেখেছ? বসন্তদাদা বলল, হ্যাঁ।

ছোটোবাবুকে ডেকে আনা হল। ছোটোবাবু বলল, সব বাজে কথা। যদি আমি চুরি করেই থাকি, ও নিজের চোখে দেখল কী করে? কারণ বসন্ত তো সেদিন রাত্রে দাদার শ্বশুরবাড়িতে কী কাজে সন্ধে বেলা গিয়ে পরদিন সকালে ফেরে। তাহলে, সে মিথ্যে কথা বলছে। আসলে সে রাত্রে বসন্তই গোপনে ফিরে এসে চুরি করে মাল সিন্দুকে রেখে আবার ফিরে গিয়েছিল।

কথাটা মন্দ নয়। বড়োবাবু বসন্তদাদাকে জিগ্যেস করল, তুমি সে-রাত্রে বেলেঘাটায় ছিলে? বসন্তদাদা বলল, ছিলুম। বড়োবাবু বলল, তাহলে তুমি দেখলে কী করে? বসন্তদাদা বলল, আমি মাঝে মাঝে দেখতে পাই।

আচ্ছা, একথা কে বিশ্বাস করবে, রায়মশাই? পুলিশ ছোটোবাবুর কথাই মেনে নিল। তারা বলল, বসন্তদাদা তাদের জেরায় নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে গেছে। বলে তাকে চালান করে দিল। বড়োবাবুও তাদের কষে পেট ভরে খাইয়ে দিল।। পরিবারের সম্মানটা তো বাঁচল। একটা বসন্ত গেলে পাঁচটা বসন্ত পাওয়া যাবে, কিন্তু ইজ্জত একবার খোয়ালে তাকে ফিরে পাওয়া বড়ো শক্ত, না কি বলেন রায়বাবু?’

আমি বললুম, ‘দ্যাখ কার্তিক, লালবাজারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তো এমন কিছু মধুর নয়, কিন্তু তবুও আমি বলব পুলিশ বোধ হয় খুব অন্যায় করেনি এক্ষেত্রে। তোর বসন্তদাদা বেলেঘাটায় বসে শ্যামপুকুরের চুরি দেখতে পায়, এ-কথা আমাকে স্বয়ং ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির এসে বললেও আমি বিশ্বাস করতুম না।’

কার্তিক হাত নেড়ে বলল, ‘তা বিশ্বেস করবে কেন? আপনারা তো লেখাপড়া শিখেছ, ইংরিজিতে কাগজ পড়ো, ফটফট করে বক্তৃতা দাও যার কোনো মাথামুণ্ডু হয় না, আপনারা বিশ্বেস করবে কেন? বসন্তদাদার তো ভর হয়। তখন বসন্তদাদা অনেক কিছু দেখতে পায়। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবে রায়বাবু, বসন্তদাদার পরিবার তান্ত্রিকের পরিবার। তাদের কত যুগের সাধনা। আজ তো আর সে সবের কোনো মূল্য নেই। পেটের দায়ে বসন্তদাদা চাকরের কাজ করে। চোর বলে জেল খাটে’। বলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কার্তিক।

তাতে অবশ্য কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করিনি আমি। আজকালকার দিন হলে স্বতন্ত্র কথা ছিল, হয়তো কৌতূহলী হয়ে উঠতুম। কিন্তু আজকের মতো সে যুগে তো আমরা এই একস্ট্রা সেনসরি পারসেপশন বা ক্লেয়ারভয়েন্স বা টেলিপ্যাথি ইত্যাদির নাম শুনিনি। তখন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুবক আমরা এসব তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-প্রেত, ভর-হওয়া ইত্যাদি সমস্তই বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিতুম। পাত্তাই দিতুম না।

আর বসন্তুও কোনোদিন আমাকে তার কোনো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার গল্পও করেনি, বা তার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। কেবল একদিন ছাড়া। সে কথায় পরে আসছি।

চন্দ্রশেখরের যেদিন টেলিগ্রাম এল, তার কিছুদিন আগেই আমি আর বসন্ত একসঙ্গে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। আমি তখন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে একটা ঘরভাড়া করে থাকি। বসন্তও এসে আমার সঙ্গে জুটে গেল। আমি ব্যাচেলার লোক, বসন্তের মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলুম।

সে যুগে বকুলপুর যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। কিছুটা ট্রেনে, কিছুটা বাসে আর শেষটুকু গোরুর গাড়িতে করে যেতে হত। বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় বেশ সুবিধেই হয়েছিল। এতটা দীর্ঘ পথ, সঙ্গে একজন সঙ্গী থাকলে পথের কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়, বিশেষ করে যদি বসন্তের মতো সঙ্গী হয়, যে সাহায্য করার জন্যে উন্মুখ হয়েই আছে।

চন্দ্রশেখর আমাকে নেওয়ার জন্য স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল। সে কিন্তু দেখলুম, বসন্তকে দেখে যেন একটু অসন্তুষ্টই হয়েছে। বুঝলুম, বাসে আর গোরুর গাড়িতে যেতে যেতে তার আমাকে কিছু বলবার ছিল, বসন্ত সঙ্গে থাকায় ব্যাপারটায় একটু অসুবিধে হয়ে গেল। সারাটা রাস্তাই দেখলুম, চন্দ্রশেখর কেমন যেন একটু গম্ভীর আর সন্ত্রস্ত হয়ে রইল।

চন্দ্রশেখর আজ বেঁচে নেই, থাকলে দেখতে পেতেন, তার মতো দিলখোলা আমুদে ফূর্তিবাজ মানুষ খুব কম দেখা যায়। তার চেহারাটা ছিল ছোটোখাটো, কিন্তু অন্তরটা ছিল মস্ত বড়ো। আজকের মতো সে যুগে ক্লাস-স্ট্রাগল বা ক্লাস-হেটরেড ব্যাপারটা খুব চালু হয়নি, তাই জমিদার হলেও তাকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতুম।

এ হেন একটা মানুষকে গম্ভীর আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলে একটু অস্বস্তি হয়-ই। আমি আর ওকে সারা রাস্তা ঘাটালুম না।

যখন বকুলপুরে এসে পৌঁছলুম, তখন প্রায় মাঝরাত। গ্রামের রাস্তা স্বভাবতই অন্ধকার জনমানবহীন। কিন্তু আপনারা শহুরে লোক বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, মাঝরাত্রেও গ্রামের রাস্তার কতগুলো শব্দ আছে, যারা তার সঙ্গে পরিচিত তাদের কানে সেই শব্দ ধরা পড়ে। আমি গ্রামের ছেলে, আমারও হঠাৎ মনে হল, কী অদ্ভুত শব্দহীন গ্রাম, মনে হয় যেন এখানে কোনো জীবিত প্রাণী বাস করে না। লণ্ঠনের আলোয় দেখলুম, চন্দ্রশেখরের মুখ বিবর্ণ, বোধ হয় খানিকটা আতঙ্কিত।

হঠাৎ সেই নির্জনতা ভেঙে গাড়ির সঙ্গে আসা চারজন পাইক সমস্বরে চিৎকার করে কথা বলতে আরম্ভ করল। ‘ওহে পঞ্চানন, ঠিক আছ তো হে?’ বা ‘মামু হে, কথা কও না-কেন?’ প্রভৃতি চিৎকার যার অর্থ স্পষ্টতই এরা সবাই ভয় পেয়েছে।

গাড়ি যখন প্রকাণ্ড জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, দেখি তার সামনে চত্বরে একগাদা হ্যাজাক জ্বালিয়ে একদল পাইক বসে আছে। আমরা ঢোকামাত্র তারা আলো নিয়ে সামনে এগিয়ে এসে আমাদের মালপত্র নামাতে শুরু করল।

বাড়ির ভেতরেও দেখি বারান্দায়, সিঁড়িতে আলো জ্বলছে। ওপরে উঠতে উঠতে চন্দ্রশেখর জিগ্যেস করল, ‘তোমার সঙ্গে লোকটি কি তোমার চাকর?’

আমার তখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে। বললুম, ‘না, চাকর নয়, ভ্যালে বলতে পারো।’

চন্দ্রশেখর হাসল না। বলল, ‘ও কি নীচে আমাদের চাকরদের মহলে শুতে পারে?’

আমি বললুম, ‘পারে।’

‘বেশ।’ বলে চন্দ্রশেখর একজন পাইককে বলল, ‘এঁর সঙ্গে যে লোকটি এসেছে, তাকে তোমাদের মহলে নিয়ে যাবে।’

বসন্ত আমার ব্যাগটা নিয়ে পেছনেই আসছিল। চন্দ্রশেখরের কথা শুনে দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমি রায়বাবুর ঘরের বাইরেই শোব। আমার কেমন যেন গোলমাল লাগছে।’

চন্দ্রশেখর ভয়ানক গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না। ঘরের বাইরে শোওয়া চলবে না। ওই মহালেই শুতে হবে তোমায়।’

বসন্ত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি তর্কাতর্কি থামানোর জন্যে বললুম, ‘ঘরের বাইরে শুলে তোমার আপত্তি। ভেতরে শুতে পারে?’

চন্দ্রশেখর স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘পারে, যদি তোমার কোনো আপত্তি না-থাকে।’

আমি বললুম, ‘আমার আবার আপত্তি কীসের? এসব ব্যাপারে আমার কোনোই প্রেজুডিস নেই, তুমি তো জানো।’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘বেশ। তাহলে সেই ভালো।’ তারপর যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘সমস্ত দরজা-জানলা ভালো করে বন্ধ করে শোবে, ভোর হওয়ার আগে দোর খুলবে না, কেউ ডাকলেও না, এমনকী আমি ডাকলেও না।’

এইবার আমার ঘুম ছুটে গেল। বললুম, ‘তার মানে? এসব রহস্যের মানে কী? আর জানলা না-খুলে আমি ঘুমোতেই পারি না।’

চন্দ্রশেখর ম্লান হেসে বলল, ‘রহস্যটা কাল শুনো। আর জানালা খুললে তোমারই অসুবিধে হবে, কারণ তোমার জানলার নীচেই পাইকরা আগুন জ্বেলে বসে বাকি রাতটুকু গল্পগুজব করবে। তুমি ঘুমুতে পারবে না।’

আমি প্রতিবাদ করে বললুম, ‘আমার জানলার নীচে পাইক? কেন? এসব তো আগে কখনো দেখিনি। বলি, ব্যাপারটা কী?’

চন্দ্রশেখর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কাল শুনো।’

বসন্ত ঘরের কোণায় দাঁড়িয়েছিল। আমি ওকে জিগ্যেস করলুম, ‘কিছু বুঝলে? ডাকাতি-ফাকাতির ব্যাপার নাকি?’

বসন্ত ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘না রায়বাবু ডাকাতির ব্যাপার নয়। ব্যাপার অনেক খারাপ। এই গ্রামে কালরাত্রি নেমেছে, আমি তার গন্ধ পাচ্ছি।’

কালরাত্রি নেমেছে, তার আবার গন্ধ? বুঝলুম, এতটা রাস্তার ধকল আর এতসব রহস্য একসঙ্গে হজম করা আমার দুঃসাধ্য। অতএব আমি আর বাক্যব্যায় না-করে লম্বা হলুম।

রাত্রে ঘুম বড়ো মন্দ হল না। ভোর বেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি চন্দ্রশেখর একটা চেয়ারে বসে আছে, তার সামনের টেবিলে দু-কাপ চা। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বলল, ‘এসো চিত্তপ্রসাদ, চা তৈরি।’

আমি বললুম, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু হে জমিদারনন্দন, তুমি কি স্রেফ আমাকে চা খাওয়াবে বলেই এই সাতসকালে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আছ?’

চন্দ্রশেখর স্মিতমুখে ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘না, তোমার সঙ্গে কথা বলব বলে বসে আছি। বেলা বাড়লে কথা বলার সুযোগ নাও পেতে পারি।’

আমি একটা চেয়ার টেনে ওর মুখোমুখি বসে বললুম, ‘ব্যাপারটা কী বলো তো? গোলমাল যে একটা পেকেছে, সেটা তো বুঝতেই পারছি। আমাকে ডেকেছ কি বন্ধু হিসেবে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে, না, উকিল হিসেবে কনসালটেন্সির জন্যে?’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘দুই-ই। ব্যাপার কী তোমাকে তা পুরোপুরি বোঝাতে পারব কি না জানি না, তবে চেষ্টা করতে হবে। ব্যাপারটা এতদূর অবিশ্বাস্য যে আমার তোমাকে বলতে অস্বস্তি হচ্ছে।’

আমি বললুম, ‘দ্যাখো চন্দ্রশেখর, ধানাইপানাই কোরো না। আমি উকিল, আমাকে নিঃসংকোচে তোমার মনের কথা খুলে বলো। ভণিতা যদি করো তো বলো, উঠে চলে যাই।’

চন্দ্রশেখর হাত নেড়ে বলল, ‘না, ভণিতা করব না।’ বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে আমাকে জিগ্যেস করল, ‘ভ্যামপায়ার কাকে বলে, তুমি জানো?’

এমন একটা অদ্ভুত আকস্মিক প্রশ্নের জন্যে আমি একদম প্রস্তুত ছিলুম না। থতমত খেয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ, জানি, দক্ষিণ আমেরিকার একরকম রক্তচোষা বাদুড়।’

চন্দ্রশেখর ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই বটে, তবে পুরোটা নয়। যেকোনো রক্তচোষা জীবকেই ভ্যামপায়ার বলা হয়। জাপানি উপকথায় একরকম ভ্যামপায়ার ক্যাট বা রক্তচোষা বেড়ালের কথা আছে, তেমনি ইউরোপে রক্তচোষা মানুষই শুধু ভ্যামপায়ার, যেমন কাউন্ট ড্রাকুলা।’

আমি বললুম, ‘সেসব উপকথা বা আষাঢ়ে গল্প। তা, আমাকে এতটা পথ ডেকে এনেছ কি তোমার ভ্যামপায়ার কথামৃত শোনাবার জন্যে নাকি?’

চন্দ্রশেখর মাথা নেড়ে বলল, ‘চিত্তপ্রসাদ, এতদিন আমিও তোমার মতো ভাবতুম যে ভ্যামপায়ার একটা কুসংস্কার বা আষাঢ়ে গল্প। কিন্তু আজ আর তা ভাবি নে। আমাদের এই বকুলপুর গ্রামে এমন একটা কিছুর আবির্ভাব হয়েছে, যেটাকে ভ্যামপায়ার ছাড়া আর অন্য কোনো বিশেষণেই অভিহিত করা চলে না।’

আমি চন্দ্রশেখরের কথা শুনে হাসতে শুরু করেছিলুম, কিন্তু সে একটা উজ্জ্বল স্থির দৃষ্টি দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে চলল, ‘তোমার খুব হাসি পাচ্ছে, নয়? তুমি থাকো কলকাতায়, সেখানে সন্ধে হলে হাজার আলোর রেশনাই, ট্রাম-বাসের ঘড়ঘড়ানি, সিনেমা আর থিয়েটারে মাঝরাত পর্যন্ত সরগরম। আর ওই সামনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। ওখানে শুধুই অন্ধকার, পদে পদে ভয়। দারিদ্র আর অশিক্ষা, অসুখ-বিসুখ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়, হিংস্র জানোয়ার আর বিষাক্ত সাপ, মৃত্যু যেন সবসময় ওঁত পেতে বসেই আছে। এখানে বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার জন্যে খরচ হয়। আমার বাবা, ঠাকুরদা তাঁদের গ্রামের দিকে তাকাননি, তোমাদের কলকাতা তাঁদের টেনে নিয়ে চলে গেছল। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। আমার সামান্য ক্ষমতায় আমার গ্রামের জন্যে কিছু করব, এই আশায় রয়ে গেছি এইখানে। দেখেছি, এখানকার প্রায় সব সমস্যাই মানুষের বিশেষত কলকাতার মানুষেরই সৃষ্টি। এখানে থেকে অবিচলভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে হয়তো একদিন এই সবেরই সমাধান সম্ভব হবে। কিন্তু চিত্তপ্রসাদ, আজ যে সমস্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, তা তোমাদের আলোকোজ্জ্বল কলকাতায় আসতে পারে না, এই অন্ধকার গ্রামই তার আশ্রয়, আর এই সমস্যার মোকাবিলা করা বোধ হয় আমার সাধ্যের বাইরে।’

আমি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘তুমি যে রীতিমতো সিরিয়াস হয়ে উঠলে হে! এত লেখাপড়া শিখে শেষপর্যন্ত এরকম একটা কুসংস্কারে বিশ্বাস আরম্ভ করলে? কী হয়েছে কী? গ্রামের কিছু লোক রক্তহীনতায় মারা গেছে আর গণকঠাকুর গুনে দিয়ে বলেছেন গ্রামে রক্তচোষা এসেছে, এই তো? ওটা যে অ্যানিমিয়া…’

চন্দ্রশেখর প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘থামো চিত্তপ্রসাদ, এবার তুমি আমাকে হাসালে। একটা সুস্থ জোয়ান লোক রাত্রি বেলা ঘরের বাইরে বেরোল আর তার পরদিন তার রক্তহীন ছিবড়ে হয়ে যাওয়া দেহটা পাওয়া গেল গ্রামের বাইরে ধান খেতের পাশে— এটা অ্যানিমিয়া, না? আর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠিক গুণেগুণে একুশ দিন পর পর— এটাও কি অ্যানিমিয়ার লক্ষণ?’

আমি বললুম, ‘তুমি কি নিজের চোখে এ-ঘটনা একটাও দেখেছ, না সবই তোমার শোনা কথা?’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘শেষ ঘটনাটা ঘটেছে আজ থেকে ষোলো দিন আগে আমারই বাড়িতে। আমার ধাইমাকে তোমার মনে পড়ে? তাঁর মৃত্যু ঘটে এমনিভাবেই আমাদের পেছনের উঠোনে।’

এইবারে আমাকে সামলে নিতে হল। বললুম, ‘কী সর্বনাশ! বলো কী? একেবারে তোমার বাড়ির ভেতরে? ব্যাপারটা আমাকে একটু বিশদভাবে বলবে?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রশেখর বলল, ‘আর কী বলব? রাত্রি বেলা ধাইমা যখন শুতে যান, তখন তিনি দিব্যি সুস্থ, আমাকে একটা পান খাওয়ালেন, সুমিত্রাকে একটা দিলেন, কোনো গোলমাল নেই। সকাল বেলা উঠোনের ওপর তাঁর মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কার করল আমাদের রাঁধুনি ঠাকুরণ। সেই একইরকম মৃত্যু। গলার ওপর দু-টি রক্তের ফোঁটা, যেন কিছু দাঁত ফুটিয়েছে আর শরীরের সমস্ত রক্ত জল।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তার মানে? রক্ত বের করে নেওয়া হয়নি?’

চন্দ্রশেখর মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। মানে, ব্যাপারটা কীরকম জানো? অনেকটা অ্যানিমিয়ার মতোই। যেন রক্তের সমস্ত লাল কণিকাগুলো কোনো অজ্ঞাত কারণে ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেটা হয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ফলে অ্যানিমিয়ার যেসব লক্ষণ, যেমন হাত-পা ফোলা, পেট ফুলে ওঠা, সেসব কিছু নেই। মৃত্যুর অব্যবহিত কারণ অক্সিজেনের অভাবে অ্যাজফিকসিয়া।’

‘এরকম হওয়ার কারণ?’

‘জানি না। গলার দাগ দু-টি দেখে মনে হয়, এই গ্রামে কোনো একটি নিশাচর জীবের আবির্ভাব হয়েছে, যে গলায় কামড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এমন একটা বিষ ঢুকে যায় যা সঙ্গেসঙ্গে রক্তের লাল কণিকাগুলো মেরে ফেলে। ফলে তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।’

‘কী বিষ?’

‘তা-ও জানি না। কোনো কেমিক্যাল বিষ হতে পারে, তবে তার সম্ভাবনা কম। কারণ সেক্ষেত্রে একজন দুর্বত্ত বা হত্যাকারী বা ক্রিমিন্যাল থাকার সম্ভাবনা। আবার সেইসঙ্গে এই অপরাধের একটা উদ্দেশ্য থাকা দরকার। কিন্তু এই হত্যাগুলো এতই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন যে, কোনো একটা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তাই মনে হয়, বিষটা জৈববিষ যেমন সাপের বা কাঁকড়াবিছের বিষ এবং নিহত লোকেদের এমনই বিষধর কোনো প্রাণীর কামড়েই মৃত্যু হয়েছে।

‘আর-একটা সম্ভাবনা হল, ভ্যামপায়ার জাতীয় কোনো প্রাণী এদের রক্ত চুষে খেয়ে তাদের শরীরের ভেতরে কোনো অজ্ঞাত একটা তরল পদার্থ ঢুকিয়ে রেখে যায়। কিন্তু সেখানে একটা অসুবিধে আছে।’

‘কী অসুবিধে?’

‘দ্যাখো, আমাদের এখানে প্রথমে মানুষ মরতে শুরু করেনি। সব রিপোর্ট তো পাইনি, তবে প্রথম মারা যায় একটা গোরু। আমাদের পাশের গ্রাম যদুতলির এক গাড়িওয়ালা অন্তা কাহার বলে একজনের গোরু ছিল সেটা। তারপর মরে আর-একটা গোরু, ওই যদুতলিরই আর এক গোয়ালার। এখন, গোরু মরা গাঁয়ের মানুষের কাছে সহজ ব্যাপার নয়। গোরু তাদের একটা সম্পদ। কাজেই হইচই পড়ে যায়। আমার কানেও কথাটা আসে। আমি তখন ভেবেছিলুম গোমড়ক লেগেছে বুঝি। তাই এ-গাঁয়ের লোকেদের ডেকে সাবধান করে দিই। কিন্তু তারপর অদ্ভুত অদ্ভুত সব খবর কানে আসতে লাগল। শুনলুম, ওরা নাকি এক গোবদ্যি ধরে এনেছে, সে বলছে অসুখ-বিসুখ কিছু নয়, গোরুগুলো মরেছে রক্তচোষার কামড়ে।

তোমারই মতো আমি ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু এর পরের আঘাতটাই এল যদুতলির পণ্ডিতমশাই নগেন ভট্টাচার্যি মশায়ের বাড়িতে। পণ্ডিতমশায়ের গোরু মঙ্গলা একইরকমভাবে মারা যায়। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে যা শুনলুম, তাতে তো আমার চক্ষুস্থির। গোবদ্যির কথা শুনে তিনি মঙ্গলাকে গোয়ালঘর থেকে বের করে এনে বাড়ির ভেতরের উঠোনে বেঁধে রেখেছিলেন আর নিজে শুতেন বারান্দার ওপর। যেদিন মঙ্গলা মরে, সেদিন তিনি অনেক রাত অবধি পড়াশুনো করে আলোটা নিয়ে বাড়ির পেছনে কুয়োতলায় গিয়েছিলেন হাত-পা ধুতে। সেখান থেকে মঙ্গলাকে দেখা যায় না। হঠাৎ তিনি একটা ধপ করে আওয়াজ শোনেন এবং তার পরেই তাঁর মনে হয় কিছু একটা রাঙচিতার বেড়া ভেঙে প্রচণ্ডবেগে ছুটে বাইরে চলে গেল। তিনি দৌড়ে এসে দেখেন, মঙ্গলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং আস্তে আস্তে তাঁর চোখের সামনে গড়িয়ে মাটির ওপর পড়ে যায়।

এখন, এর থেকে দুটো জিনিস প্রমাণ হয়। এক, রক্তচোষাই হোক বা যাই হোক, যে জীবটি বেড়া ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে মঙ্গলার রক্ত চুষে খায়নি। কারণ একটা গোরুর শরীরে কত সের রক্ত থাকে আমি জানি না, কিন্তু দুনিয়ায় বোধ হয় কোনো শক্তি নেই যা সেই পরিমাণ রক্ত এক মুহূর্তের মধ্যে চুষে খেয়ে সেই পরিমাণ তরল পদার্থ শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ মঙ্গলার মৃত্যু হয়েছে কোনো বিষে। দুই, জীবটি সাপ জাতীয় কোনো প্রাণী নয়, কারণ বেড়ার মধ্যে যে গর্ত হয়েছিল, তার মধ্যে দিয়ে কোনো বড়ো জানোয়ারই বেরিয়ে যেতে পারে, কোনো সরীসৃপ নয়। আর ধপ করে শব্দটাও তাই প্রমাণ করে।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তোমাদের পণ্ডিতমশাই লোক কেমন?’

‘অতিশয় সজ্জন। গাঁজা-ভাং তিনি খান না, কদাচ মিথ্যে কথা বলেন না, শুদ্ধাচারী নিষ্ঠাবান, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। তা ছাড়া, আমি নিজে মঙ্গলাকে দেখেছি, ভাঙা বেড়াটা দেখেছি। বীভৎস ব্যাপার।’

‘অন্যান্য মৃত্যুগুলো দেখোনি?’

‘দেখেছি। তবে সবগুলো নয়।’

‘তাদের সম্পর্কে কিছু বলো।’

‘দ্যাখো, পণ্ডিতমশাইয়ের ব্যাপারটার পর যদুতলির চণ্ডীমণ্ডপে আমি একটা মিটিং ডেকেছিলুম। ওখানে একটা নাইট ওয়াচের জন্যে ভলান্টিয়ার পার্টি তৈরি করেছিলুম, প্রত্যেক গোয়ালের সামনে যাতে সারারাত আগুন জ্বলে আর কেউ-না-কেউ জেগে পাহারা দেয়, তারও বন্দোবস্ত করেছিলুম। ফলে হিতে বিপরীত হল। অন্যদিকের গ্রাম পাখনায় গোরু মরতে আরম্ভ করল। পাখনায় লোকেরা যখন ভলান্টিয়ার পার্টি বানাল, তখন মানুষ মরতে শুরু করল।’

‘কীরকম?’

‘প্রথমে তো ভলান্টিয়ার পার্টির লোকই মরতে আরম্ভ করল। কেউ একটু একা হয়ে গেছে বা একটু অন্ধকারের দিকে চলে গেছে বা গাছতলায় বসে ঢুলুনি এসেছে, ব্যস, মরণ ছোবল তাকে একেবারে বৈতরণী পার করে দিয়েছে। এই সময়েই আমরা আবিষ্কার করলুম, এই ছোবলটা আসে প্রতি কুড়ি থেকে বাইশ দিনের মধ্যে।

‘ফলে, ভলান্টিয়ার পার্টি বন্ধ হয়ে গেল। গাঁয়ের লোক তাদের গোরুছাগল নিয়ে সন্ধে হতে-না-হতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে আগল আটকে দিতে লাগল। কিন্তু সারা রাতে একবারও ঘরের বাইরে বেরোবে না, এ তো হয় না। যে বের হয়, সেই মরে। ‘কিন্তু তারপরে যা শুরু হল, তা আরও অবিশ্বাস্য।’

‘কী?’ আমি জিগ্যেস করলুম।

চন্দ্রশেখর আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘নিশির ডাক।’

আমি আকাশ ফাটিয়ে অট্টহাস্য হেসে উঠতে যাচ্ছিলুম। চন্দ্রশেখর আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হেসো না চিত্তপ্রসাদ, হেসো না। তিনটে গাঁয়ের লোক যখন পেট খারাপ হলেও ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করল, তখন যার মরণ ঘনিয়ে এসেছে, তাকে একটা অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠ নাম ধরে ডেকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল। আর এখনও সেই রকমই চলছে। সেই ডাক নাকি অপ্রতিরোধ্য। যাকে ডাকে, তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেও সে নাকি সব ছিঁড়ে বেরিয়ে চলে যায়।’

‘যখন বেরিয়ে যায়, তখন তার আত্মীয়স্বজন তাকে অনুসরণ করে না— কেন?’

‘দ্যাখো, যারা আতঙ্কে অর্ধমৃত হয়ে আছে, তাদের কাছ থেকে তুমি এরকম বীরত্ব আশা করতে পারো না, পারো কি? আর অনুসরণ করেই বা কী হবে? গ্রামের পথ নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। সেই অন্ধকার কি হারিকেন লন্ঠনের আলো ভেদ করতে পারে?’

‘ওই নিশির ডাক কি তুমি শুনেছ?’

চন্দ্রশেখর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘না শুনিনি।’

এরপর আর কথা এগুল না। ভেতর বাড়ির থেকে ডাক এল চান করতে যাওয়ার, চন্দ্রশেখরের কাছারি যাওয়ার সময় হল। আমার কিন্তু মনের মধ্যে একটা সন্দেহ খচখচ করতে লাগল। চন্দ্র যা বলেছে সেটা সত্যি কী মিথ্যে জানিনে, কিন্তু সে সত্যি ভেবেই বলেছে। তবে সেটাও বড়ো কথা নয়। আমার সন্দেহ হল, সে কিছু কথা গোপন করে যাচ্ছে, আমাকে প্রাণ খুলে সবটা বলছে না। অর্থাৎ রহস্যাটা যে কেবল বাস্তব তাই নয়, ওপর থেকে যা মনে হয়, তার চেয়েও গুরুতর।

চন্দ্রশেখর কাছারি চলে গেল, আমি গ্রামটা ঘুরতে বের হলুম। বকুলপুর গ্রাম আমার বহুদিনের পরিচিত। ছোটোবেলায় অনেকবার এখানে এসেছি, বড়ো হয়েও বেশ ক-বার। শেষবার এসেছিলুম চন্দ্রশেখরের বিয়েতে বছরতিনেক আগে বরযাত্রী যাব বলে। তবে যাওয়া হয়নি, সন্ধে বেলা পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল। তাই নিয়ে মহাহাঙ্গামা হয়েছিল। তা সে অন্য কথা।

চন্দ্রশেখরের বিয়ে হয়েছিল মালদা জেলারই গঙ্গাযমুনা গ্রামের জমিদার ঘনশ্যাম রায়ের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে। ঘনশ্যামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। লোকটি যেন কেমন অদ্ভুত বলে তখন আমার মনে হয়েছিল। কখনো সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না, চেপে চেপে প্রতিটি কথা বিচার করে করে বলেন। আমার প্রথমেই ধারণা হয়েছিল লোকটি অত্যন্ত ঘুঘু।

তবে চন্দ্রশেখরের স্ত্রী সুমিত্রা অবশ্য তার বাপের মতো নয় বলেই শুনেছি। সে জমিদারবাড়ির বউ, অসূর্যম্পশ্যা, কিন্তু তার গৃহিনীপনার গল্প আমাদের কানে এসেছিল। আর কানে এসেছিল তার অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা। তাকে নিয়ে আর তার জমিদারিটি নিয়ে কত সুখেই না থাকতে পারত চন্দ্রশেখর। তা নয়, কোত্থেকে কী এক ভয়াবহ একটা প্রাণী এসে সব ছারখার করে দিলে। এইসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, চন্দ্রশেখর আমার বন্ধু, কেবল বন্ধু বলব কেন, আমার অনেক বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আমার সেই বন্ধুর এই দুঃসময়ে, সেটা সত্যি বা কাল্পনিক যাই হোক না-কেন, তার পাশে আমি দাঁড়াব, তাকে উদ্ধার করব।

এমন সময় হঠাৎ শুনি কে আমার নাম ধরে ডাকছে, ‘চিত্তবাবু, ও চিত্তবাবু!’ তাকিয়ে দেখি, বকুলপুরের বর্ধিষ্ণু চাষি সন্ন্যাসী কৈবর্তর ছেলে বিষ্ণুপদ কৈবর্ত। বিষ্ণুপদ কলকাতায় লেখাপড়া করতে গিয়েছিল, বেশিদূর সেটা চালাতে পারেনি বটে, তবে নিজের গ্রামের প্রতি অশ্রদ্ধাটা পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেছিল। হেদোর কাছে একটা ওষুধের দোকানে চাকরি করত আর গোয়াবাগানে একটা মেসে থাকত। মানিকতলার বাজারে তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার দেখা হত।

বিষ্ণুপদ বলল, ‘একী চিত্তবাবু, আপনি এখানে কী করছেন?’

আমি বললুম, ‘আমি তো এখানে আসতেই পারি বিষ্ণুপদ, এখানে আমার বন্ধুর বাড়ি। বরং তুমি এখানে কী করছ বলো তো? তোমার সঙ্গে তো যখনই দেখা হয়, তুমি বলো, গ্রামে নাকি ভদ্রলোকের থাকা অসম্ভব। তা, তুমি কি আবার ছোটোলোকদের দলেই ভিড়লে নাকি?’

বিষ্ণুপদ মাথা নীচু করে বলল, ‘ওসব কথা বাদ দিন, চিত্তবাবু। বাবা মারা গেছেন, এত জমিজমা ফেলে কোথায় থাকব? কলকাতায় পড়ে থাকলে তো পাঁচভূতে লুটে নেবে।’

আমি দুঃখিত হয়ে বললুম, ‘সন্ন্যাসীদা মারা গেছেন নাকি? কবে? কী হয়েছিল?’

বিষ্ণুপদ বলল, ‘বাবা মারা গেছেন মাসছয়েক হল। আর কী হয়েছিল? কেন, জমিদারবাবু আপনাকে কিছু বলেননি?’

আমি বললুম, ‘রক্তচোষা?’

বিষ্ণুপদ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, লোকে তাই বলে বটে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনে।’

‘তুমি কী বিশ্বাস করো?’

‘আমার ধারণা, এটা একটা কোনো নতুন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ, যা জীবজন্তু মানুষকে রক্তশূন্য করে ফেলে। আর এই রোগটা এমন একটা জীবাণু থেকে হয়, যা কোনো মানুষ বা জন্তুর শরীরে ঢুকলে কুড়ি-বাইশ দিন সময় নেয় তৈরি হওয়ার। যেমন, ধরুন ম্যালেরিয়া।’

‘ম্যালেরিয়া? না বিষ্ণুপদ, তোমার উপমাটা ঠিক হল না, তবে তুমি যে কী বলতে চাইছ, তা বুঝতে পারছি। তার মানে, ও-গাঁয়ের পণ্ডিতমশাই যা দেখেছেন বা এই তিনটে গাঁয়ের লোক যে নিশির ডাক-টাকের কথা বলছে, সেগুলো তুমি মনে করো মিথ্যে।’

‘ঠিক মথ্যে নয়, বলব কুসংস্কার। আর এসবের জন্যেই তো আমি গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে থাকি।’

আমাদের কথাবার্তা হতে দেখে ইতিমধ্যে চারপাশে কয়েক জন গ্রামবাসী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তাঁদের মধ্যে চন্দ্রশেখরের খাজাঞ্চি নিমাই পাটোয়ারির ছোটো ভাই গোবিন্দও ছিলেন। গোবিন্দ লেখাপড়া বেশি করেননি, কিন্তু সৎ সজ্জন লোক বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিষ্ণুপদর কথা শুনে হঠাৎ চটে উঠলেন। বললেন, ‘তোমার ওখানে গিয়েই থাকা উচিত বিষ্ণু । তোমার মতো অপদার্থ গাধার এ-গাঁয়ে ঢোকাই উচিত নয়।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কী হল গোবিন্দদা? এত চটে উঠলেন কেন?’

গোবিন্দ হাত নেড়ে বললেন, ‘চটব না? যেখানে আমাদের জীবন-মরণের সমস্যা, সেখানে উনি বলছেন কিনা, এটা আমাদের কুসংস্কার? এমন লোককে জুতোপেটা করতে ইচ্ছে করে কিনা তুমিই বলো চিত্তপ্রসাদ।’

আমি বললুম, ‘আপনি এই নিশির ডাক শুনেছেন?’

গোবিন্দর মুখের ভাবটা কেমন একরকম হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে একবার ভয়ে ভয়ে চারদিক চেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ শুনেছি।’

‘কীরকম শুনলেন?’

ফ্যাকাশে মুখে গোবিন্দ বললেন, ‘কীরকম? কীরকম আবার? অনেকটা এই মেয়েছেলের গলার মতো। আমাদের পাশের বাড়ির জগন্নাথকে ডাকলে, তখন শুনেছি। জগন্নাথ নেই, মরে গেছে।’

গোবিন্দর কথা শুনে আমার এইবার আর হাসি পেল না। গোবিন্দর কথা বলার মধ্যে এমন একটা স্বাভাবিকতা ছিল যে তার কথা অবিশ্বাস করা সম্ভব হল না। আমি বলতে যাচ্ছিলুম, ‘আপনি তো ভুলও শুনে থাকতে পারেন।’ কিন্তু তার আগেই ভিড়ের ভেতর থেকে অতুল মণ্ডল বলল, ‘হ্যাঁ গোবিন্দদা, মেয়েছেলের গলাই বটে। যেদিন বাঁদর কামড়ালে, সেদিন শুনেছিলুম। ইস! তখন যদি ছুটে বেরোতুম!’

আমি বললুম, ‘বাঁদর কামড়ালে মানে? কাকে বাঁদর কামড়াল? কী হয়েছিল?’

অতুল মণ্ডল মাথা নেড়ে বলল, ‘বাঁদর কাউকে কামড়ায়নি গো। তিনিই বাঁদরকে কামড়াল। সেই গতবার তো জমিদারবাবুর ধাইমা মারা গেল, তার আগের বার। সেদিন ছিল ঝড় বৃষ্টির রাত, আর তাঁর আসবারও সময় হয়েছিল। তাই গাঁ-সুদ্ধ লোক দু-দিন ধরে জেগে বসেছিল। আর নিশির ডাক শুরু হয়েছে তো, তাই সবাই চিৎকার করছিল, কোনো-কোনো বাড়িতে খানিক অন্তর অন্তর শাঁখ বাজছিল আর বৃষ্টি নেমেছিল বটে। নিশি ডাকলেও শোনা যেত কি না সন্দেহ।

তা, আমার বাড়ির পাশে একটা ঝুপসি বটগাছ আছে। কিছুদিন হল সেখানে একদল বাঁদর আশ্রয় নিয়েছিল। সে রাতে যখন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, হঠাৎ শুনি গাছের ওপর একটা ঝুটোপাটির আওয়াজ। আর তার পরেই ধপ! মনে হল যেন একটা ভারী কিছু ওপর থেকে পড়ল। তারপর আবার একটা ধপ! আর সঙ্গে সঙ্গে একটা মেয়েমানুষের গলায় চিৎকার। মানে ব্যথা পেলে তারা যেমন ককিয়ে ওঠে, তেমনি। আমি শুনে ছুটে বেরুতে যাচ্ছিলুম, আমার পরিবার আমার কাছা চেপে ধরলে, বেরুতেই দিলে না।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তারপর?’

অতুল বলল, ‘তারপর আর কী? পরদিন সকালে গাছতলায় গিয়ে দেখি একটা গোদা বানর মরে পড়ে আছে আর বটগাছ খালি। ভোর হতে-না-হতেই পুরো দলটা গাঁ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।’

শুনতে শুনতে আমার কেমন যেন মনের মধ্যে সব গোলমাল পাকিয়ে যেতে লাগল। এতগুলো শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা সম্পূর্ণ নিরক্ষর লোক একসঙ্গে জোট পাকিয়ে অনবরত মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে? কার স্বার্থে? আমাকে বোকা বানিয়ে মজা পাওয়া এর উদ্দেশ্য হতে পারে না। এর পেছনে কোনো একটা সত্য লুকিয়ে আছে, অশিক্ষা আর কুসংস্কারের গোলকধাঁধায় পড়ে হয়তো তা এমন একটা হাস্যকর রূপ তৈরি হয়েছে। সেই সত্যটা কী? এতগুলো প্রাণ গেছে, সেটা তো রসিকতা নয়। তা ছাড়া কাল শুতে যাওয়ার আগে বসন্তু একটা কথা বলেছিল, তার মানেই বা কী?

আমি হঠাৎ গোবিন্দদার দিকে ফিরে বললুম, ‘আচ্ছা গোবিন্দদা, কালরাত্রি কী?’

গোবিন্দ গম্ভীর মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘হুঁ, তুমিও শুনেছ কথাটা। পণ্ডিতমশাই বললেন, কালরাত্রি মানে যে রাত্রে মানুষের ঘরে মৃত্যু নেমে আসে। যে রাত ভীষণ বিপদের রাত। আমাদের গাঁয়ে সেই কালরাত্রি নেমেছে চিত্তপ্রসাদ, কেউ আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। একে-একে আমরা সবাই যাব। তবে হ্যাঁ, মৃত্যুটা বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি আসে। বেশি কষ্ট পেতে হয় না। সেটাই যা বাঁচোয়া।’

আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, ‘কালরাত্রি নেমেছে আর আপনারা সবাই মহানন্দে তার ছোবলের মুখে গলা বাড়িয়ে দেবেন? বাঁচবার চেষ্টা করবেন না? সবাই একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করবেন না?’

গোবিন্দ মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লেন, ‘কোনো লাভ নেই চিত্তপ্রসাদ। চেষ্টা কি আমরা করিনি? কিন্তু দৈব বড়োই প্রবল হে, তার সঙ্গে লড়াই করার সাধ্য আমাদের নেই।’

আমি বললুম, ‘দৈবকে হারানো যায় না, আমি তা বিশ্বাস করি না গোবিন্দদা। একটু চেষ্টা, একটু মনের জোর থাকা চাই। আর সাধ্য? টাকাপয়সা? আমি কলকাতায় গিয়ে আপনাদের এই বিপদের কথা বলে আন্দোলন করব, দেখবেন সমস্ত দেশের মানুষ আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। টাকাপয়সার যা দরকার আমি তার ব্যবস্থা করব। আর চন্দ্রশেখর তো আছেই।’

আমি চন্দ্রশেখরের নাম করতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। স্তম্ভিত হয়ে দেখি, চন্দ্রশেখরের নাম শুনেই সেই ভিড়ের প্রায় প্রত্যেকটি লোক মুখ বিকৃত করল। আমি তো অবাক। এতদিন আমার ধারণা ছিল বকুলপুর গ্রামের প্রত্যেকটি লোক চন্দ্রশেখরকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে। কিন্তু, এ কী হল? আমি এত আশ্চর্য হয়েছিলুম, যে বোধ হয় আমার মুখ দেখে সেটা সবাই বুঝতে পেরেছিল।

গোবিন্দ তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলানোর জন্যে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই। জমিদারবাবু আছেন, তুমি আছ, দেশের আর পাঁচজন আছেন। দ্যাখো, যদি কিছু করে উঠতে পারো।’

আমি ততক্ষণে বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠেছি। আর এ-ও বুঝেছি যে গোলমালটা অনেক গভীরে পৌঁছেছে। কাজেই সাবধানে বললুম, ‘নিশ্চয়ই করব গোবিন্দদা। আর আপনাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই করব। আজ সন্ধে বেলা আপনারা আসুন না চন্দ্রশেখরের বাড়িতে, একটা আলোচনা করা যাবে।’

গোবিন্দ বললেন, ‘আলোচনা? আলোচনা তো অনেক হল চিত্তপ্রসাদ, তাতে আর লাভ কী হবে? এর আগে পরামর্শ করে যা কিছু করা হয়েছে, তাতে সুরাহা তো কিছু হয়নি, উলটে কতগুলো প্রাণ বেঘোরে গেছে। তার চেয়ে এখন আমরা যেমনভাবে চালাচ্ছি, তেমনিভাবেই চলুক। তাঁর আসবার তো সময় হয়ে এসেছে। এখন সন্ধে হলেই যে-যার ঘরে দোর দিয়ে সারারাত জেগে শাঁখ আর কাঁসর বাজাবে, চিৎকার করবে যাতে বাইরের কোনো শব্দ শোনা না-যায়, আর কেউ যেন বাইরে না-থাকে। তা হলেই হবে। আর নতুন করে পরামর্শের কোনো দরকার দেখি না চিত্তপ্রসাদ। যদি তুমি নিজের বিবেচনায় কিছু করতে পারো তো করো।’ বলে গোবিন্দদা আস্তে আস্তে চলে গেলেন। ভিড়ের লোকজনও যে-যার চলে গেল। দেখে হতবাক আমি আর বিষ্ণুপদ কেবল দাঁড়িয়ে আছি।

বিষ্ণুপদ মৃদু হেসে বলল, ‘দেখলেন তো চিত্তবাবু, এই আমাদের গাঁয়ের লোক।’

আমি চটকা ভেঙে বললুম, ‘গাঁয়ের লোককে দোষ দিও না বিষ্ণুপদ। ওরা যে একটা ভয়ংকর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, এতে তো কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। ওদের সহানুভূতি দেখাতে না-পারো ঠাট্টা কোরো না। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার ভীষণ খটকা লাগছে। এরা চন্দ্রশেখরের ওপর অসন্তুষ্ট কেন? কী করেছে সে?’

বিষ্ণুপদ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘আপনি ওদের ওপর সহানুভূতি দেখাতে বললেন, না? কোত্থেকে সহানুভূতি আসবে বলতে পারেন? এমন একটা অকৃতজ্ঞ জাত! যে জমিদারবাবু নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে এখানে পড়ে থেকে এদের জন্যে এত কিছু করলেন, আজকে এরা তাঁকেই …’ বলতে-বলতে বিষ্ণুপদ থেমে গেল।

আমি বললুম, ‘থেমো না বিষ্ণুপদ। কী হয়েছে বলো। এরা চন্দ্রশেখরকে সন্দেহ করছে? ভাবছে, এই মৃত্যুগুলোর পেছনে চন্দ্রশেখরের হাত আছে?’

বিষ্ণুপদ নীরবে ওপরে-নীচে ঘাড় নাড়ল।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, ‘কিন্তু কেন? তার অপরাধ?’

বিকৃত মুখ করে বিষ্ণুপদ বলল, ‘অপরাধ? প্রথমত, তিনি যেসব নাইট ওয়াচ বসিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই মারা গেছে। দ্বিতীয়ত, যদিও তিনি প্রায় প্রত্যেক রাত্রে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় বন্দুক হাতে টহল দিয়ে বেড়ান, কিন্তু যেদিন মৃত্যুগুলো ঘটে সেদিন আর তাঁকে দেখা যায় না।

আচ্ছা, আপনিই বলুন, এসব কি কোনো যুক্তি? আরে, ওদের কথাই যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে জমিদারবাবুকে তো সন্দেহ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘ওদের কী কথা?’

বিষ্ণুপদ তিক্ত হাসি হেসে বলল, ‘জানেন না? সেই যে তিনি, মানে যিনি কামড়ে থাকেন, তাঁকে তো দু-তিনজন দেখেছে। তাঁর বর্ণনার সঙ্গে আর যার মিলই থাকুক, জমিদারবাবুর নেই।’

আমি উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম। বললুম, ‘বলো কী বিষ্ণুপদ? তাকে কেউ দেখেছে? বর্ণনাটা কীরকম?’

‘ওঃ, সে ভারি মজার! বর্ণনাটা মোটে কোনো গোটা মানুষেরই না। মানে, আধখানা মানুষের আর আধখানা গিরগিটির। মানে, একটা গিরগিটি যদি পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় তাহলে যেমন দেখাবে তেমনি। এমনকী একটা মোটা ল্যাজও আছে।’ বলে বিষ্ণুপদ হাসতে লাগল।

আমিও হেসে ফেললুম। বললুম, ‘তবু লোকে চন্দ্রশেখরকে সন্দেহ করে? কী ভাবছে তারা, এটা ওর ছদ্মবেশ?’

‘হ্যাঁ, তাই বটে।’

‘কারা কারা দেখেছে?’

‘এ-গাঁয়ের দু-জন, শ্যামচরণ আর নীলু আর পাখনার একজন, চৌকিদার গুপিচরণ।’

‘তাদের সকলের বর্ণনাই এক?’

‘হ্যাঁ, প্রায় এক।’

যখন বাড়ি ফিরলুম তখন বেশ বেলা হয়েছে। দেখি, বৈঠকখানা ঘরে আমাদের খাওয়ার জায়গা করছে বসন্ত। আমাকে আসতে দেখে বসন্ত বলল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন রায়বাবু? জমিদারবাবু অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে খুঁজছেন। আপনি চান করে আসুন, আমি কাছারি বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসি।’

আমি স্নান সেরে খাওয়ার জায়গায় এসে দেখি, চন্দ্রশেখর বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে মাথা নীচু করে আসনে বসে আছে। আমার পায়ের শব্দ শুনে মুখ তুলে বলল, ‘এসো চিত্তপ্রসাদ। কোথায় গিয়েছিলে?’

আমি ওর পাশে বসে বললুম, ‘এই, গ্রামটা একটু ঘুরতে গিয়েছিলুম।’

চন্দ্রশেখর একটু চুপ করে থেকে জিগ্যেস ককরল, ‘কিছু শুনলে?’

আমি চুপ করে রইলুম।

চন্দ্রশেখর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শুনেছ, না? এবার বুঝেছ, কেন আমি তোমাকে ডেকে এনেছি? তুমি আইনজ্ঞ, বুদ্ধিমান, আর আমার বন্ধু। এ-বিপদ থেকে তুমিই আমাকে উদ্ধার করতে পারো। আমার প্রজাদের জীবন আমি রক্ষা করতে পারিনি, আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি চিত্তপ্রসাদ।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘সংসার ভেঙে যাচ্ছে কেন?’

‘ওই যে। প্রজারা আমার নামে যে সন্দেহ করে, তা সুমিত্রার কানে পৌঁছেছে। তারপর থেকে সে আর এ-বাড়িতে থাকতে চায় না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে একঘরে থাকতে চায় না। তার ওপর, বাড়ির ভেতরে ধাইমা মারা যাওয়ার পর, সে তো প্রায় নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেছে। আমি বেশি কাছে গেলেই ভয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে। আর মুখে শুধু ওই এককথা, আমাকে বাপের বাড়ি রেখে এসো, আমি এখানে এক মুহূর্ত থাকতে চাই না। তুমি বলো চিত্তপ্রসাদ, আমি কী করতে পারি?’

‘ঘনশ্যাম রায়কে খবর দিয়েছ?’ আমি জিগ্যেস করলুম।

‘হ্যাঁ, শ্বশুরমশাইকে খবর দিয়েছি। তিনি আসবেন বলেছেন। কিন্তু তিনি ব্যস্ত লোক, চট করে চলে আসা তো সহজ নয় তাঁর পক্ষে। এদিকে সময় এগিয়ে আসছে। আর যতই সময় এগিয়ে আসছে, সুমিত্রা ততই আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।’

আমি বললুম, ‘তা, তুমি সুমিত্রাকে নিয়ে বাইরে কোনো জায়গা থেকে কিছুদিন ঘুরে এসো না। সুমিত্রার সন্দেহও কাটবে, তুমিও একটু বিশ্রাম পাবে।’

মাথা নেড়ে চন্দ্রশেখর বলল, ‘না চিত্তপ্রসাদ, তা হয় না। আমি যে এ কথাটা চিন্তা করিনি, তা নয়। কিন্তু মনে করো, আমার যেমন দুর্ভাগ্য, হয়তো বাইরে গেলুম, আর সেবারেই কিছু হল না। তখন কী হবে? আমি কি আর কোনোদিন এ-গাঁয়ে ঢুকতে পারব? ঢুকলে সবাই আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে না?’

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, তা বটে। তাহলে তুমি ঘনশ্যাম রায়কে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম পাঠাও!’

‘তা-ও পাঠিয়েছি। আশা করছি, কাল-পরশুর ভেতরেই উত্তর পাব।’

‘কিন্তু চন্দ্রশেখর, সুমিত্রা যদি আর না-ফিরে আসে?’

চন্দ্রশেখর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, ‘ও নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তুমি দেখো। এ রহস্যের জাল ছিঁড়ে ফেলে ও নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু কত দিনে?’

এ-প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। কাজেই চুপ করে রইলুম।

রাত্রি বেলা শুতে যাওয়ার সময় বসন্ত বলল, ‘রায়বাবু, গন্ধটা বাড়ছে, টের পাচ্ছেন?’

আমি মাথা নেড়ে বললুম, ‘কোন গন্ধটা বসন্ত? আমার নাকে তো নানারকম গন্ধ আসছে।’ বসন্ত স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘কালরাত্রির গন্ধ, মৃত্যুর গন্ধ।’

আমি শুয়ে পড়ে বললুম, ‘মৃত্যুর গন্ধ যে কেমন, তা তো আমার জানা নেই বসন্ত। কাজেই সেটা বাড়ছে না-কমছে, তা বলব কী করে?’

বসন্ত আমার কথার খোঁচাটা বুঝল কি না কে জানে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর আমার যখন প্রায় ঘুম এসে গেছে, তখন হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, ‘রায়বাবু, আমার চোখটা একটু দেখবেন।’

আমি একটু চটেই গেলুম। বললুম, ‘কী পাগলামো হচ্ছে, বসন্ত! শুয়ে পড়ো।’ আর বলতে-বলতেই ওর দিকে চোখ পড়ায় বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। দেখি ওর চোখ দুটোর মধ্যে মণি নেই, পুরোটাই সাদা! কোনোরকমে বললুম, ‘কী করছ, বসন্ত? এমন চোখ কপালে তুলে বসে আছ কেন?’

বসন্ত চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসল। বলল, ‘চোখ কপালে তুলিনি রায়বাবু। মণিদুটো দেখতে পাননি, না? যাক, ভালোই হয়েছে।’

‘ভালো হয়েছে মানে? কী ভালো হয়েছে? মণি না-দেখতে পাওয়ার মধ্যে ভালোটা কোথায়?’

‘আছে, রায়বাবু। একে আমরা বলি চক্ষুক্ষীর। এটা চোখের ওপর এলে, তখন চোখ আর দেখতে পায় না, দেখতে পায় বোধ হয় মন। কীভাবে হয় জানি না, তখন অনেক কিছু দেখতে পাই যা সাদা চোখে কখনো দেখা যায় না। সবসময় তো এটা আসে না, কখনো-সখনো কালেভদ্রে আসে। যখন আসে, তখন পৃথিবীর রূপই পালটে যায়। মনে মনে বড্ড চাইছিলুম, এটা যেন আসে। প্রার্থনা করছিলুম যদি কোনো পুণ্যফল আমার থাকে, তাহলে এই ভীষণ বিপদের দিনে যেন এটা পাই।’

আমি আবার লম্বা হয়ে বললুম, ‘দ্যাখো বসন্ত, সারাদিন ধরে নানারকম ভয়ংকর-ভয়ংকর সব কথা শুনতে হয়েছে, তার ওপর তুমি এলে তোমার চক্ষুক্ষীর না চক্ষুস্থির, কীসব নিয়ে। আর সহ্য করতে পারছি না। এবার ঘুমোতে দাও। কাল আবার সকাল বেলা বেরোতে হবে মোটা ল্যাজওয়ালা আধখানা মানুষ আর আধখানা গিরগিটির সন্ধানে। কী যে সব হচ্ছে কে জানে। বুঝতে পারছি না যে, আমি কি একটা পাগলা গারদের মধ্যে এসে পড়লুম না সবাই আসলে সুস্থ, কেবল আমিই পাগল হয়ে গেছি।’

বসন্ত বলল, ‘পাগল কেউই হয়নি রায়বাবু। কেবল একটা কথা মনে রাখা দরকার, আমরা রোজ যা চোখে দেখি বা কানে শুনি, তার বাইরেও অনেক কিছু হয় বা আছে, যা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব!’

আমি বললুম, ‘হুঁ, শেক্সপিয়রও এরকমই কী একটা কথা যেন বলেছিলেন বটে।’

পরদিন ভোর বেলা উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি, চন্দ্রশেখর বসে আছে। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে আমি স্তম্ভিত। কী এক প্রচণ্ড অন্তর্গূঢ় বেদনায় সে মুখ বিকৃত হয়ে রয়েছে। আমি জিগ্যেস করলুম, ‘কী হয়েছে?’

চন্দ্রশেখর ক্লিষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘সুমিত্রা আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে গতকাল। যেভাবেই হোক, আজ রাত্রের মধ্যে ও চলে যাবেই। আমি যতক্ষণ ব্যবস্থা না-করছি, ততক্ষণ সে অন্নজল স্পর্শ করবে না বলে দিয়েছে।’

আমি বললুম, ‘বলো কী? এ তো মহাবিপদ দেখছি। ঘনশ্যামবাবুর কাছ থেকে কোনো খবর পেলে?’

মাথা নেড়ে চন্দ্রশেখর বলল, ‘নাঃ। আজ আসবেন হয়তো।’

‘তবে তুমি ভেতরে গিয়ে বউঠানকে বলো যেন আজকের দিনটা অপেক্ষা করেন, তারপরে কাল না-হয় অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’

‘কী ব্যবস্থা নেবে তুমি? ধাইমা মারা গেছেন আজ সতেরো দিন হল। আর-একটা মৃত্যু আসছে আর দিন তিন-চারেকের মধ্যে। গাঁয়ের লোক রাত্রে বেরোনো বন্ধ করেছে। পাইকদের বা বেহারাদের কাউকে বললেও কেউ এখন বেরোবে না। কেটে ফেললেও না।’

‘দিনে দিনে যাবে, দিনে দিনে চলে আসবে। কী আছে তাতে?’

‘আরে, তুমি শুধু তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবছ। তাদের তো পরিবার রয়েছে। তারা তো তাদের কথা ভাবছে।’

‘হুঁ! সে কথা ঠিক। তাহলে কী করবে?’

‘তাই তো বুঝতে পারছি না। সুমিত্রা আমাকে যা-ই সন্দেহ করুক না-কেন, তার জন্যে যদি নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে ভয়ের চোটে একটা ভালো-মন্দ করে বসে, তাহলে আমি কোথায় যাব বলতে পারো?’

আমি বললুম, ‘সত্যি তো! এ তো মহা অসুবিধে দেখতে পাচ্ছি! তা এমন কেউ নেই, যার পরিবার-টরিবার নেই?’

চন্দ্রশেখর চিন্তিত মুখে বলল, ‘আছে। তার গোরুর গাড়িও আছে। আমাদের রামকেষ্ট গাড়োয়ান। কিন্তু সে ব্যাটা বদ্ধ মাতাল। অন্তত দুটো পাইক ছাড়া সুমিত্রাকে তার হাতে ছাড়ি কী করে? দু-দিনের পথ।’

‘তুমি সঙ্গে যাও না?’

‘না, চিত্তপ্রসাদ, তা হয় না। বললুম না, সময় হয়ে এসেছে।’

আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁক করে উঠল। বললুম, ‘তুমি এখন কিছুতেই যেতে পারো না?’

দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে চন্দ্রশেখর বলল, ‘না, অন্তত এই ক-টা দিন নয়।’

কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল আমার! কোথায় একটা গোলমাল লাগছে মনটা স্থির করে কিছুতেই একটা পরিষ্কার মীমাংসায় আসতে পারছি না। চন্দ্রশেখর কাছারি চলে গেল, অন্যমনস্কভাবে আমি বের হলুম শ্যামচরণ আর নীলুর খোঁজে।

নীলুর একটা মুদির দোকান ছিল। তাকে সেখানে গিয়ে ধরলুম; জিগ্যেস করলুম, ‘তুমি নাকি কীসব দেখেছ? কী দেখেছ?’

নীলু বা নীলকণ্ঠ আধবুড়ো মানুষ, আমার কথা শুনে কেঁপে-ঝেঁপে অস্থির। প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, আমি কিছু দেখিনি রায়বাবু। বুড়ো লোক আমি, অন্ধকারে কত ছায়া দেখি। সেসব কি ধরতে আছে?’

আমি বললুম, ‘আমাকে ভাঁওতা দিও না নীলকণ্ঠ। কী দেখেছ, বলো।’

কিছুতেই বলবে না। শেষটা হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। ওর পাশে রাখা হিসাব লেখার শ্লেটা আর পেনসিলটা তুলে নিয়ে বিজ্ঞান বইয়ে যে ডাইনোসোরের ছবি আঁকা থাকে সেরকম একটা মোটামুটি স্কেচ এঁকে ওকে দেখালুম। মুহূর্তের মধ্যে নীলকণ্ঠের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ফিসফিস করে আমাকে জিগ্যেস করল, ‘তবে তুমিও দেখেছ রায়দাদা?’

আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ দেখেছি। তবে অনেকদূর থেকে তো, কতটা উঁচু বুঝতে পারিনি। তুমি বলতে পারো?’

নীলকণ্ঠ বলল, ‘আমি তো খুব কাছ থেকে দেখিনি। আর এক লহমার জন্যে তো! তবে মনে হয় এক মানুষ কী তার চেয়ে একটু বেশি উঁচু হবে।’

শ্লেটটা ধার নিয়ে গেলুম শ্যামাচরণের কাছে। সে মাঠে কাজ করছিল। আমার ছবি দেখে সে আমার শিল্পপ্রতিভার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগল। আর তারও মত দেখলুম সেটা এক-মানুষ সমান উঁচু হবে। আর চক্ষের পলকে ছুটে বেরিয়ে যায়। শরীরটা যতই ভারী দেখাক না-কেন, অবিশ্বাস্য তার গতিবেগ।

শ্যামচরণের কাছ থেকে ফিরে আসতে আসতে দেখলাম মনটা কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। এটা কি দুঃস্বপ্ন? এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে নীলকণ্ঠ আর শ্যামাচরণ আলাদা আলাদা সময়ে সাদা চোখে, অবশ্য আবছায়া অন্ধকারে, একটা অতিকায় সরীসৃপের অবয়ব দেখেছে। তারা মিথ্যে কথা বলছে না কারণ আমার মতো ঘাঘু উকিলকে এরকম পর্বতপ্রমাণ ধাপ্পা দেওয়া তাদের সাধ্যাতীত। তা ছাড়া, এতে এদের কোনো স্বার্থও থাকতে পারে না।

তাহলে, এরকম একটা জীব দিন কুড়ি-বাইশ কোথায় লুকিয়ে থাকে? চারদিকে যে জঙ্গল আছে, সেগুলো এমন কিছু মারত্মক গভীর বা সেখানে একদম কোনো লোকজন চলাচল করে না, এমন নয়। আর জঙ্গলের দিকে যারা থাকে তারা তো তেমন মরেনি, বরং বেশি মারা গেছে তারা যারা গ্রামের ভেতরের দিকে থাকে। অতএব, ধরে নিতে হয়, সে প্রাণীটি গ্রামের ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে থাকে।

কিন্তু, সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে থাকে কোথায়? কেউ কি তাকে লুকিয়ে রাখে? আর দিন কুড়ি-বাইশ অন্তর অন্তর সে ক্ষুধার্ত হলে তাকে ছেড়ে দেয়? তাহলে নিশির ডাক? সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে কেউ সেই সরীসৃপটি সঙ্গে নিয়ে বেরোয়, তাকে শিকার ধরে নিতে সাহায্য করে। সে কে? আর, এরকম একটা অতিকায় সরীসৃপ লুকিয়ে রাখার মতো জায়গাই বা কোথায়? জমিদার বাড়ি?

অসম্ভব নয়। ও-বাড়ির তো মাত্র একটা অংশে চন্দ্রশেখর থাকে। আর বেশিরভাগ অংশই তো তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। ওদিকে কি কিছু আছে?

দুপুর বেলা খেতে বসে চন্দ্রশেখরকে আমার গবেষণার কথা বললুম। চন্দ্রশেখর স্থির উজ্জ্বল দৃষ্টিতে সবকথা শুনল। কিন্তু কোনো মতামত প্রকাশ করল না। খাওয়া শেষ হলে অন্দরের ভেতরে গিয়ে একটু বাদেই বেরিয়ে এল এক হাতে একটা রাইফেল আর অন্য হাতে একটা চাবির গোছা নিয়ে। বলল, ‘চলো, অন্য মহলগুলো একটু খুঁজে দেখি।’

আমি বললুম, ‘চলো।’ বসন্ত কাছেই ছিল। সে-ও জুটে গেল। কেবল জুটে গেল নয়, আঠার মতো আমার সঙ্গে সেঁটে গেল বলা যায়।

কিন্তু কোনো লাভ হল না। কিছুই পাওয়া গেল না। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে এলুম।

বৈঠকখানা ঘরে এসে বসতেই একজন পাইক একটা টেলিগ্রাম দিল চন্দ্রশেখরের হাতে। সেটা পড়ে চন্দ্রশেখরের মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

আমি ব্যস্ত হয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘কী হল?’

ভগ্ন কণ্ঠে চন্দ্রশেখর বলল, ‘শ্বশুরমশাইয়ের তার। উনি আসছেন, তবে আরও সাতদিন বাদে।’

সেদিন সন্ধে বেলা চন্দ্রশেখর আমাকে ওর অন্দরমহলের বসবার ঘরে ডেকে পাঠাল।

ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মাঝখানে চন্দ্রশেখর দাঁড়িয়ে রয়েছে, মুখটা লাল টকটক করছে আর এককোণে পেছন ফিরে ঘোমটা টানা একটা মেয়ে, বুঝলুম সুমিত্রা। আর এ-ও বুঝতে পারলুম, দাম্পত্যকলহে কিছুতেই জিততে না-পেরে চন্দ্রশেখর আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে সাহায্যের জন্যে।

চন্দ্রশেখর আমাকে দেখে চাপা গলায় বলল, ‘তোমার বউঠানকে একটু বুঝিয়ে বলো তো চিত্তপ্রসাদ যে আজ রাত্রে তার পক্ষে এ-গ্রাম ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনোমতেই সম্ভব নয়।’

ঘোমটার আড়াল থেকে সরোষ প্রশ্ন এল, ‘কেন সম্ভব নয়? সম্ভব করলেই সম্ভব!’

সরোষ প্রশ্ন বললুম বটে, কিন্তু কী গলা! মনে হল যেন একটা সেতার বেজে উঠল। এমন একটা আশ্চর্য মিষ্টি সুরেলা গলা আজ পর্যন্ত আর শুনিনি।

আবার সেতার বেজে উঠল, ‘কারোর সাহায্যেরও দরকার হত না। পা-টা যদি না-মচকাত, তাহলে আমি একাই হেঁটে চলে যেতাম।’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘তোমার পা মচকায়নি, হাড় ফেটে গেছে। এ অবস্থায় গোরুর গাড়ি করে এই অন্ধকারে কখনো কি কারোর যাওয়া সম্ভব? মেয়েমানুষের কথা বাদ দাও, কোনো পুরুষমানুষই কি এরকম অবস্থায় যেতে পারে? কেন তুমি এরকম করছ? তুমি আমাকে বিশ্বাস না-করো, ঘরে খিল দিয়ে থাকো, বাইরে দশটা পাইক বসিয়ে দিচ্ছি।’

‘না, না, না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তোমার পাইকদের বিশ্বাস করি না, কাউকে না। ধাইমা মারা গেছেন, এবার আমার পালা। এমনভাবে পড়ে পড়ে আমি মরতে পারব না। আমি চলে যাব, আজই চলে যাব।’

চন্দ্রশেখর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আতঙ্কের এমন ভয়ংকর রূপ এর আগে কখনো দেখেছ চিত্তপ্রসাদ?’

আমি কিন্তু তখন অন্যকিছু দেখছিলুম। মনে মনে একটা কুৎসিত ছবি এঁকে ফেলেছিলুম। আমি মোটামুটি শিক্ষিত লোক, ভদ্র সন্তান, একটা আদর্শের অনুগামী, যে আদর্শের একটা প্রধান ভিত্তি হচ্ছে সচ্চরিত্রতা, কিন্তু সেই আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত কুলষিত চিন্তা অবচেতনের ক্লেদাক্ত গহ্বর থেকে সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়াল। সুমিত্রার গলা শুনে আমার মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। আমি ভাবলুম, সুমিত্রা শুনেছি অপরূপ সুন্দরী, এমন কণ্ঠস্বর যার সে অসাধারণ না-হয়ে যায় না, তার ওপর তার পা ভাঙা, অতএব প্রায় চলচ্ছক্তিহীন বলা চলে। একটা মাতাল গাড়োয়ানের গাড়িতে একে নিয়ে অন্ধকার পথ দিয়ে যাওয়ার সুযোগ একটা পুরুষ মানুষের জীবনে দু-বার আসে না। চন্দ্রশেখর জাহান্নামে যাক, এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করব না এমন নির্বোধ বন্ধু আমি নই।

আমি বললুম, ‘ঠিক আছে, বউঠান যখন এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তখন আমিই না-হয় ওঁকে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

চন্দ্রশেখর অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুমি যাবে? বেশ, তাই হোক। তবে সঙ্গে বসন্তকে নিয়ে যাও।’

আমার মাথায় চড়াৎ করে রক্ত উঠে গেল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললুম, কেন বসন্ত কেন? তুমি কি মনে করো, আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি না?’

চন্দ্রশেখর স্থির গলায় বলল, ‘না, তা নয়। যদি তোমাদের কেউ আক্রমণ করে, তাহলে একজন পালিয়ে গিয়ে খবর দিতে পারবে। সুমিত্রা বা রামকেষ্টর পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না। আর তুমি যদি বিপদের মোকাবিলা করতে থাক, তাহলে বসন্ত পালিয়ে তো যেতে পারবে।’

আমি আবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু সুমিত্রার গলা শুনতে পেলুম আবার, ‘আপনি আপত্তি করবেন না, চিত্ত ঠাকুরপো। চলুক না আপনার বসন্ত আমাদের সঙ্গে। অসুবিধে কিচ্ছু হবে না, দেখবেন।’

সঙ্গেসঙ্গে আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা দ্রুত খেলে গেল। এক, যদি বসন্তকে নিয়ে গোলমাল পাকাই, হয়তো যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে। দুই, যদি বসন্ত যায়ও, ওকে তাপ্পি দিয়ে সরিয়ে দেওয়া অসুবিধে হবে না। তিন, বসন্ত যদি গোলমাল করে, ওকে না হয় খুনই করে ফেলা যাবে। পরে এসে বলব, রক্তচোষা মেরেছে।

কাজেই বললুম, ‘ঠিক আছে, বসন্ত চলুক আমাদের সঙ্গে।’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘বেশ, তাহলে তৈরি হয়ে নাও। আর অস্ত্রশস্ত্র কিছু সঙ্গে আছে, না একটা বন্দুক দিয়ে দেব সঙ্গে?’

আমি বললুম, ‘আমি তৈরিই আছি। আর অস্ত্রের দরকার কী? তোমার মতো অত ভয় আমার নেই। তা ছাড়া, আমি বন্দুক চালাতেই জানি না।’

চন্দ্রশেখর বলল, ‘না, অস্ত্র ছাড়া আমি তোমাদের কিছুতেই যেতে দেব না। তুমি না-নাও, বসন্ত নিক। ওকে ডাকো, দেখি অন্তত শড়কি চালাতে জানে কি না।’

বসন্ত ঘরে ঢুকেই একটা ঝাঁকানি দিয়ে শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে গেল। চন্দ্রশেখর একটু বিস্মিত হয়েই জিগ্যেস করল, ‘কী হল বসন্ত?’

বসন্ত একটা অস্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বলল, ‘গন্ধটা বড্ড বেশি!’

চন্দ্রশেখর আবার কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘তোমার ওই ন্যাকামো বন্ধ করো তো বসন্ত! জমিদারবাবু যা প্রশ্ন করছেন, তার জবাব দাও। গন্ধ-গন্ধ করে মাথা খারাপ করে দিল একেবারে।’

আমার রূঢ়তায় বসন্ত চমকে উঠল। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী প্রশ্ন?’ বলতে বলতে দেখি ওর চোখের ওপর একটা অস্বচ্ছ ঘন তরল আবরণ নেমে এসে মণিদুটোকে আড়াল করে দিচ্ছে। দেখে রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল, ওকে চিৎকার করে গালাগালি করতে ইচ্ছে হল।

কিন্তু আমি কিছু করার আগেই চন্দ্রশেখর জিগ্যেস করল, ‘তুমি কি বন্দুক চালাতে জানো, বসন্ত?’

বসন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

‘শড়কি চালাতে পারো? বা বর্শা?’

‘হ্যাঁ পারি। শড়কির খেলায় আমি গুরু যাদবচন্দ্র পালের শিষ্য।’ বলে দু-হাত জোড় করে মাথায় ঠেকাল বসন্ত।

চন্দ্রশেখর একটা দেওয়াল আলমারির ভেতর থেকে একটা রুপো-বাঁধানো লাঠি বের করে নিয়ে এল। সেটার মাথাটা খুলতেই ভেতর থেকে প্রায় একহাত লম্বা একটা চকচকে ইস্পাতের ফলা বেরিয়ে এল। সেই প্রাণঘাতী অস্ত্রটাকে বসন্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চন্দ্রশেখর জিগ্যেস করল, ‘এটা ব্যবহার করতে পারবে? এটা আমার ঠাকুরদাদার গুপ্তি, তাঁর বংশের মর্যাদা রেখেছে অনেকবার।’

বসন্ত গুপ্তিটা ভক্তিভরে নাড়াচাড়া করে বলল, ‘হ্যাঁ, এ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারব। কিন্তু কেন? কোথায় ব্যবহার করতে হবে?’

এবার আমি কথা বললুম, ‘বউঠাকুরানি আজ এখুনি বাপের বাড়ি যাবেন। গোরুর গাড়িতে যাবেন, সঙ্গে আমি থাকব। তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে।’

বসন্ত দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘না, আপনার যাওয়া হতে পারে না, রায়বাবু। গন্ধটা আজ বড্ড বেশি আর আপনার ভেতরে… সেকথা থাক। আমি আপনাকে কিছুতেই যেতে দেব না।’

বসন্তের কথায় রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। আমি চিৎকার করে বললুম, ‘তুমি আমায় যেতে দেবে না? কোথাকার লাটসাহেব তুমি? তুমি না-যাও, ওই গুপ্তি নিয়ে আমি একাই যাব। ওটা দাও আমাকে।’

বসন্ত বিনা বাক্যব্যয়ে অস্ত্রটা আমার হাতে দিয়ে দিল, কিন্তু আমি সেটা ভালো করে ধরার আগেই চন্দ্রশেখর আমার হাত থেকে টেনে নিল সেটা। বলল, ‘না, না, চিত্তপ্রসাদ, এ জিনিস চালানো বড়ো সহজ নয়। কায়দা জানা না-থাকলে, নিজেই আহত হয়ে পড়বে, এমনকী কোনো গুরুতর বিপদ কিছু ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়।’ তারপর বসন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাও না বসন্ত, আমি বউঠাকুরানিকে কথা দিয়েছি যে তাঁকে আজ বাপের বাড়ি রওনা করিয়ে দেবই।’

বসন্ত ঘাড় নীচু করে বলল, ‘না জমিদারবাবু, সেটা অসম্ভব।’

তখন ঘরের কোণ থেকে আবার সেই শততন্ত্রী বীণা বেজে উঠল, ‘কিন্তু যেতে যে আমাকে হবেই বসন্ত। তুমি না-নিয়ে গেলে আমি যাব কী করে?’

ঘরে যে একজন তৃতীয় ব্যক্তি রয়েছে, সেটা এতক্ষণ বসন্ত বুঝতে পারেনি। সুমিত্রার গলা শুনে পূর্ববৎ ঘাড় নীচু করেই একটু অস্বস্তিভরা গলায় বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন মা, আমি বুঝতে পারিনি আপনি ঘরেই আছেন। তবে ছেলের বেয়াদবি মাপ করবেন, আমি কিছুতেই যাব না, রায়বাবুকে যেতে দেব না। মানে, আমি জীবিত থাকতে উনি যেতে পারবেন না।’

শুনে আমি বলতে গেলুম যে জীবিত তুমি থাকবে না, কিন্তু তার আগেই সুমিত্রা বলে উঠল, ‘আমার অনুরোধ তুমি রাখবে না বসন্ত?’ বলতে বলতে এসে বসন্তের সামনে দাঁড়াল।

বসন্ত যথারীতি চোখ নীচু করে বলল, ‘না বউ ঠাকরুন, আমাকে মাপ করতে হবে। আজ গন্ধটা বড্ড বেশি।’

তখন সুমিত্রা একটা অদ্ভুত কাজ করল, এমন কাজ যা সে-যুগে কোনো জমিদারবাড়ির বউয়ের পক্ষে করা শুধু অদ্ভুত নয়, অসম্ভব ছিল। বসন্তের সামনে সে মুখের ঘোমটা সরিয়ে পিঠের ওপর ফেলে দিল। বলল, ‘আমার মুখের দিকে তাকাও বসন্ত। বলো, আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবে না?’

আমি আর চন্দ্রশেখর স্তম্ভিত বিস্ময়ে সুমিত্রার দিকে চেয়ে রইলুম। সে কী আশ্চর্য রূপ! একজন সীতার জন্যে যে লঙ্কা ধ্বংস হতে পারে, একজন হেলেনের জন্যে নিশ্চিহ্ন হতে পারে ট্রয় বা একজন দ্রৌপদীর জন্যে নির্বংশ হতে পারে কুরুরাজবংশ, তাতে আজ আর আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই রূপ আমার সর্বাঙ্গে বাসনার আগুন জ্বালিয়ে দিল। ইচ্ছে হল এই দেবভোগ্য সৌন্দর্যে অধিকার শুধু আমার, চন্দ্রশেখর আর বসন্ত দু-জনকেই গলা টিপে মেরে একে বুকে নিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে যাব, কেউ বাধা দিতে এলে শেষ করে দেব তাকেও।

আমার এই চিন্তার মধ্যেই সুমিত্রা আবার বীণায় ঝংকার তুলল, ‘তাকাও বসন্ত, আমার দিকে তাকাও।’

নতনেত্র বসন্ত আস্তে আস্তে মুখ তুলে ঘোলাটে চোখ রাখল সুমিত্রার মুখে। এক মুহূর্ত। তার পরেই মাতালের মতো তীক্ষ্ন-তীব্র চিৎকার করে উঠল, ‘কে তুমি? কে তোমাকে এখানে এনেছে?’

চন্দ্রশেখর এক পা এগিয়ে বিস্ময়-কম্পিত গলায় বলল, ‘উনিই বউ ঠাকুরানি বসন্ত। উনিই বাপের বাড়ি যাবেন।’

‘বাপের বাড়ি! কোথায় বাপের বাড়ি?’

‘ওঁর বাপের বাড়ি গঙ্গাযমুনা গ্রামে। এখান থেকে দু-দিনের রাস্তা।’

‘গঙ্গাযমুনা গ্রামে? দু-দিনের রাস্তা?’ হা-হা করে হেসে উঠল বসন্ত। ‘ওর বাপের বাড়ি নরকে জমিদারবাবু, পৃথিবীর পেটের মধ্যে,পাতালে— যেখানে গনগন করে আগুন জ্বলছে। এই পিশাচিরা উঠে আসে সেখান থেকে। এরা যা কিছু ছোঁয় তা-ই অপবিত্র হয়, যার দিকে তাকায় সে-ই অপবিত্র হয়ে যায়। এদের বেসাতি লালসার, এদের তৃপ্তি মৃত্যু আর ধ্বংসে। এদের গলার মধ্যে বিষ জমে ওঠে, সেই বিষ ঢেলে একটা প্রাণ না-নিলে এরা নিজেরাই সেই বিষের জ্বালায় জ্বলে মরে। তোর তো সেই বিষ ঢালার সময় হয়ে এল, না শয়তানি? এই বাড়ির মধ্যে পাইক পেয়াদায় আটকা পরে, ঠ্যাং ভেঙে অসুবিধে হচ্ছে, নয়? তাই ভেবেছিস বাইরে গিয়ে একজনের ওপর বিষ ঢালবি। তাই এত আকুলিবিকুলি, এত ছটফটানি?’

আমি বসন্তের কথা শুনে রাগে দিশেহারা হয়ে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছিলুম ওকে মারব বলে, চন্দ্রশেখর আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরল। নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে সুমিত্রার পায়ের দিকটা দেখাল। যেখানে একটু আগে দেখেছিলুম একজোড়া রাঙা পদ্মের মতো পা, সেখানে… কী দেখলুম!

বসন্ত তখনও বলে চলেছে, ‘আর তা হতে দিচ্ছিনে। আমি তোকে কিছুতেই বেরুতে দেব না। তুই নিজের বিষে জ্বলে পুড়ে মরবি, তাই আমি দেখব।’

সুমিত্রার গলা শুনলুম, ‘আমি মরব না রে… মরবি তুই। মর, তুই মর!’

বলতে-বলতেই ফড়ফড় করে কাপড় ছেঁড়ার শব্দ হল। আমি যে বিভীষিকা দু-টির দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে ছিলুম তারা ঢেকে গেল কতগুলো ছেঁড়া শাড়ি জামা আর ভাঙা গয়নায়। তারপর একসঙ্গে দুটো শব্দ শুনলুম, একটা বসন্তের ক্ষীণ হাহাকার আর-একটা খ্যাক করে আওয়াজ। মুখ তুলে দেখলুম, সেই ভয়ংকর আকৃতি, যেটা একটু আগে ছিল পরমা রূপসী সুমিত্রা, তার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব না; কারণ তাহলে আপনারা বলবেন বুড়ো বয়সে আমার কেবল ভীমরতিই ধরেনি, আমি গাঁজাও ধরেছি। কাজেই সেটা থাক। সেই ভীষণাকার একটা শরীর মৃত্যু-যন্ত্রণায় আছড়িপিছাড়ি খাচ্ছে। তার গলায় চন্দ্রশেখরের হাতের গুপ্তিটা আমূল গাঁথা। আমি সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম আর দেখতে লাগলুম সেই অতিকায় দংস্ট্রাকরাল বীভৎস মুখটা আকাশের দিকে উঁচু হয়ে খাবি খেতে খেতে আস্তে আস্তে স্থির হয়ে নেতিয়ে পড়ল। শেষ সংক্ষোভে শরীরটা বার কয়েক ঝাঁকানি খেল। তারপর সব স্তব্ধ।

তবে বিস্ময়ের এখানেই শেষ ছিল না। আবার আমাদের চোখের সামনে সেই নারকীয় দুঃস্বপ্নের একটা পরিবর্তন ঘটতে লাগল। বোধ হয় পাঁচ মিনিট। তার পরেই দেখি বসন্তের রক্তহীন মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে আর একটি নিরাবরণ শরীর, মৃত্যুযন্ত্রণায় বিকৃত হলেও সেই অসাধারণ রূপের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, আশ্চর্য এই যে, সেই রূপ দেখে এবার আমার মনের মধ্যে যে ভাব জেগে উঠল তা আতঙ্কের। মনে হল, এক্ষুনি পালিয়ে যাই। যদি ওটা আবার বেঁচে ওঠে, যদি গলায় বেঁধা গুপ্তিটা খুলে ফেলে উঠে দাঁড়ায়।

চন্দ্রশেখরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে তখনও আতঙ্ক, অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিস্ময় মেশানো বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মৃতদেহ দু-টির দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আমার সম্বিত ফিরে এল। আমার আইনজীবির মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ শুরু করে দিল। আমি এগিয়ে গিয়ে সুমিত্রার গলা থেকে গুপ্তিটা টেনে বের করে একটা চাদর দিয়ে দেহটা ঢেকে দিলুম। তারপর চন্দ্রশেখরের কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করলুম। সঙ্গেসঙ্গে সে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল।

চন্দ্রশেখরের যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন সে দীর্ঘকাল কোনো দুরারোগ্য অসুখের পর সদ্য সুস্থ হয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন গলায় বলল, ‘ব্যাপারটা যে এরকমই কিছু সে-সন্দেহ আমার বেশ অনেক দিনই হয়েছিল। মৃত্যুগুলো যে রাত্রে ঘটত সেই রাত্রিগুলোর কোনো স্মৃতিই আমার থাকত না। সেই রাত্রিগুলোর দু-একদিন আগে থেকেই সুমিত্রা কেমন অদ্ভুতভাবে ছটফট করে বেড়াত। ওর গায়ে আমি কতগুলো কাটা এবং আঁচড়ের দাগ দেখেছি যেগুলোর কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা ও দিতে পারেনি। আর, যেদিন বাঁদরটা মারা পড়ল সেদিন ওর পায়ের হাড় ভাঙার কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছিলুম না। বাথরুমে পড়লে ওরকম হতে পারে না। তারপর যখন ধাই-মা মারা গেলেন তখন আমি প্রায় নিঃসন্দেহ হয়েছিলুম। অন্তত এটুকু বুঝেছিলুম যে আমার বিয়ের পর থেকেই এখানে যে কাণ্ড শুরু হয়েছে তার শেকড়টা রয়েছে আমারই বাড়িতে। তবে ব্যাপারটা যে এমন ভয়ংকর, তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আর কিছু করতেও পারছিলুম না। কেমন যেন সম্মোহনের মধ্যে ছিলুম। তবে আমার অবচেতন বোধ হয় তৈরি হচ্ছিল। তাই আজ চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখেই আমার হাত গুপ্তিটা ছুড়ল লক্ষ্যস্থলে, কিন্তু তাকে আমার বোধশক্তি চালায়নি, চালিয়েছে আমার মগ্নচৈতন্য। আসলে আমার চিন্তা করার শক্তিই বোধ হয় চলে গিয়েছিল।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিগ্যেস করল, ‘এবার আমরা কী করব চিত্তপ্রসাদ? পুলিশে খবর দেব?’

আমি ততক্ষণে মনস্থির করে নিয়েছি। বললুম, ‘না। পুলিশে খবর দিলে তারা এসে তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে, আমরা যা দেখেছি তার শতাংশের একাংশও বিশ্বাস করবে না। করতে পারেও না। তুমি মানুষের কল্যাণ করে খুনি বলে পরিচিত হবে— এ আমি হতে দিতে পারি না, কেবল তোমার বন্ধু বলে নয়, একজন মানুষ বলে।’

‘তবে আমরা কী করব?’

‘তুমি এখুনি গাঁয়ের লোককে খবর দাও। বলো, এবার রক্তচোষার শিকার দু-জন, বউ ঠাকুরানি আর তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বসন্ত। বসন্তের মৃতদেহ দেখলে সবাই নিশ্চিন্ত হবে। সুমিত্রাকে তুমি স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও আর ঘোমটা আর কাপড় দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ ঢেকে দাও। সবাইকে বলে দাও, যত শীঘ্র সম্ভব দাহ শেষ করে যেন চলে আসে। কেউ কোনো সন্দেহ করবে বলে মনে হয় না। মৃত্যুভয় তার পরেও থাকবে। থাকুক। যখন অপঘাত মৃত্যুগুলো বন্ধ হবে, তখন আতঙ্কটা আস্তে আস্তে কেটে যাবে।’

‘তুমি আমার কাছে থাকবে তো?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। অন্তত যতদিন ঘনশ্যামবাবু না আসছেন।’

ঘনশ্যাম এসে নাক কুঁচকে বললেন, ‘রক্তচোষা মেরেছে? আমি এসবে বিশ্বাস করিনা। তোমরা ওকে খুন করেছ। আমি পুলিশে যাব, আমার মেয়েকে খুন করার জন্যে তোমাদের হাঁড়ির হাল করে ছাড়ব। ওই ফচকে উকিল সামনে ধরে তুমি পার পাবে না চন্দ্রশেখর।’

আমি বললুম, ‘ঘনশ্যামবাবু, আপনি অনেক মামলা-মোকদ্দমা লড়েছেন, আমি জানি। অতএব একথা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে খুনের মামলা বড়ো বিষম বস্তু, তাতে অনেক কিছু নিয়েই টান পড়ে। সে টানাপোড়েন সইতে পারবেন তো?’

ঘনশ্যাম রায় আমার দিকে অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার কী নিয়ে টান পড়বে, উকিল মহাশয়?’

‘আপনার স্ত্রী তো বেঁচে আছেন? ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে যদি তিনি নিঃসন্তান? সুমিত্রা আপনার মেয়ে নয়?’

‘তাতে কী হল? আমার মেয়ে না-হলেই তাকে খুন করতে হবে?’

‘আপনার কুলপুরোহিত শুনেছি দু-বার আপনার প্রায়শ্চিত করেছিলেন। এ-ও শুনেছি, শিশুহত্যা করতে গিয়েছিলেন তাই। কথাটা সত্যি নাকি?’

‘তাতে কী প্রমাণ হয়?’

‘কিছুই না, কিছুই না। তবে শুনেছি, সুমিত্রার এগারো বছর হওয়ার সময় থেকে আর তার বিয়ে হওয়া পর্যন্ত আপনার গাঁয়ের মুসলমান প্রজাদের ঘরে অনেকগুলো মৃত্যু হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে এখানকার অপঘাত মৃত্যুগুলোর অনেক মিল। তারা নাকি শপথ করেছে যে এ মৃত্যুগুলোর জন্যে যে বা যা কিছুই দায়ী হোক না-কেন, জান দিয়েও তারা তাকে শেষ করে ছাড়বে। এখন কেউ যদি তাদের গিয়ে এখানকার মৃত্যুগুলোর কথা বলে, তাহলে তারা কী ভাববে বলুন তো?’

ঘনশ্যাম গুম হয়ে গেলেন। বললেন, ‘কী ভাববে?’

‘ভাববে, আপনি জেনেশুনে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তারা ভাববে, আপনি ইচ্ছাকৃত নরহত্যাকারী, তাদের আত্মীয় পরিজন পরিবারের সর্বনাশের মূল কারণ। তখন, তাদের বিচারে আপনার কী শাস্তি হবে, তা ভেবে দেখেছেন?’

‘তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ। আপনি অতিজঘন্য অপরাধী। আপনাকে ভয় দেখানোর নীতিগত অধিকার আমার আছে। আপনার দুর্ধর্ষ লাঠিয়ালরা আপনার ওই মুসলমান প্রজারাই। আপনি তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এখন এসেছেন চন্দ্রশেখরের হাঁড়ির হাল করতে?’

‘তুমি এত কথা জানলে কোত্থেকে?’

‘ঘনশ্যামবাবু, আমি ফচকে উকিল হতে পারি, কিন্তু নির্বোধ নই। আপনাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি এবং আপনি যে এরকমই একটা কাণ্ড করবেন, তা আগেভাগে বুঝে নিয়ে, সুমিত্রার মৃত্যুর পরদিনই আমি আপনার গ্রামে চলে গিয়েছিলুম। সেখান থেকে সব খবরই নিয়ে এসেছি। আর খানিকটা ছেড়েছি আন্দাজে। তবে আমার ভুল হয়নি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘনশ্যাম বললেন, ‘না, তা হয়নি। ঠিক আছে। যা করেছ বেশ করেছ। আমি তাহলে এখন চলি।’

আমি বললুম, ‘দাঁড়ান। সুমিত্রা আপনার নিজের মেয়ে নয় তাতে সন্দেহ নেই, কার মেয়ে সে?’

ঘনশ্যাম বললেন, ‘আমি তার পরিচয় জানি না। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে একদিন একটা ভবঘুরে এসেছিল আমাদের গাঁয়ে তার ভেলকি দেখাতে। অতি অদ্ভুত ছিল তার খেলা। কিন্তু তার খেলার চেয়েও যেটা আমার সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হচ্ছে তার খেলার চুবড়ির পাশে ছেঁড়া ন্যাকড়ায় শোয়ানো একটি প্রায় সদ্যোজাত শিশু। অবাক করেছিল, কারণ লোকটি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের কুৎসিত, এত কদাকার যে তাকে দেখলেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে আর মেয়েটি ছিল তেমনই সুন্দর, ফুটফুটে। আমার নিজের সন্তান ছিল না। তাই লোকটিকে ডেকে বাচ্চাটা কিনে নিতে চাইলুম। পঞ্চাশ টাকায় রফা হয়েছিল।

পরে বাচ্চাটার স্বরূপ বুঝতে পারি। তাকে দু-বার মারতেও গিয়েছিলুম। কিন্তু কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলুম যে শেষ মুহূর্তে আর পারিনি।’

চন্দ্রশেখর কাতর কণ্ঠে জিগ্যেস করল, ‘তাহলে আপনি তার বিয়ে দিলেন কেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। আমার এমন সর্বনাশটা করলেন কেন?’

ঘনশ্যাম কাষ্ঠ হেসে বললেন, ‘ভেবেছিলুম, বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দেখছি ভুল করেছিলুম। তা সে যাক তো। সব তো চুকেবুকে গেছে। এখন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’

চন্দ্রশেখর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘হবে কী? বসন্ত যা বলে গেছে তা যদি ঠিক হয়, তবে তো এরা আবার উঠে আসবে আর আপনার মতো লোক যদি পায়, তবে তাকে আশ্রয় করে আবার এরা নিয়ে আসবে কালরাত্রি। তবে বসন্তের মতো লোকও নিশ্চয়ই থাকবে যারা কেবল চোখ দিয়েই দেখবে না, মন দিয়েও দেখবে। সেটাই ভরসা। তা না-হলে সুন্দর পৃথিবীটা তো কবেই বিষের জ্বালায় জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যেত।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *