আতঙ্কের অবসান

আতঙ্কের অবসান

মাঘ মাসের সন্ধে বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে ঠান্ডাটা যা পড়েছে তা আর কহতব্য নয়। ক্লাবঘর প্রায় ফাঁকা, কেবল আমাদের মতো গুটিকয় পাঁড় আড্ডাবাজ ছাড়া। কিন্তু যা ঠান্ডা, তার মধ্যে আড্ডাটা ঠিক জমছিল না। এমনসময়, যেন আমাদের সকলের নীরব প্রার্থনার জোরেই, মাংকি ক্যাপ, গ্রেট কোট আর ছাতা সহ চিত্তপ্রসাদবাবু এসে ক্লাবঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধ উকিল, এককালে ইনি প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে ওকালতি আর রাজনীতি দুটোই সমানে চালিয়ে গেছেন। আজ বহুবছর হল, দুটো থেকেই অবসর নিয়েছেন। সকাল বেলা ভাগবত পাঠ আর সন্ধে বেলা আমাদের ক্লাবে দাবা, এই এখন ওঁর নিত্যকর্মপদ্ধতি।

চিত্তপ্রসাদবাবু ঘরে ঢুকেই অসন্তুষ্ট গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘একী, বাকি সবাই কোথায়? একটু ঠান্ডা পড়েছে কি না-পড়েছে, অমনি লেপের গর্তে গিয়ে সেঁধিয়েছে বুঝি?’

সোমেশ বলল, ‘কেন রায়সাহেব, আমাদের কি আপনার যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না?’

‘একেবারেই না। এসেছিলুম দাবা খেলব বলে অথচ…’

আমি বললুম, ‘একদিন দাবা না-খেললে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আপনি বসুন, চা খান আর আমাদের একটা গল্প বলুন।’

চিত্তপ্রসাদ একটা ইজিচেয়ারের ওপর বসতে বসতে বললেন, ‘জানতুম, আমি জানতুম।’

‘জানবেনই তো। আপনার মতো এমন রোমাঞ্চকর জীবন তো সকলের হয় না। তা, সেসব অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইব, এতে অন্যায়টা কী?’

‘চিত্তপ্রসাদ মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘না, অন্যায় নয়। তবে কিনা, বুড়ো হয়ে পড়েছি— সবকথা সবসময় মনে থাকে না। আচ্ছা, ঠিক আছে, বলব গল্প। বলুন, কীসের গল্প শুনতে চান।’

সোমেশ বলল, ‘আচ্ছা রায়সাহেব, আমরা শুনেছি আপনার দুর্দান্ত সাহস, কোনো কিছুতেই আপনি ভয় পান না….’

চিত্তপ্রসাদ বাধা দিলেন। বললেন, ‘ভুল শুনেছেন। ভয় আমি বহুবার পেয়েছি, প্রচণ্ড ভয়ও পেয়েছি। বুদ্ধিমান লোক মাত্রেই ভয় পেয়ে থাকেন, যখন তিনি বিপদের গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারেন। সেই ভয়কে জয় করে বিপদের মুখে এগিয়ে যাওয়ারই নাম সাহস। কোনো কিছু না-বুঝে দুম করে এগিয়ে যাওয়ার নাম গোয়ার্তুমি বা বোকামি।’

সোমেশ বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই। তবে আমি বলছিলুম কী, এমন কোনো ঘটনা কি আপনার জীবনে ঘটেছে, যখন বিপদ কেটে গেছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই, তখনই আপনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন?’

চিত্তপ্রসাদ তাঁর চশমার মোটা লেন্সের ভেতর দিয়ে ঘোলাটে চোখে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে সোমেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি যে সঠিক বুঝেছি তা বলতে পারি না। তবে একটা ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে, যেটা হয়তো আপনি যেরকম বলছেন, অনেকটা সেরকমই হবে। সেই কাহিনিই আপনাদের বলি শুনুন—

আজ থেকে বছর চল্লিশ আগেকার কথা। সালটা উনিশ-শো তেতাল্লিশ কী চুয়াল্লিশ হবে, আমার সঠিক মনে নেই। সেইসময় আমাকে একবার যেতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদ আর বীরভূমের বর্ডারে আমলকী বলে একটা গ্রামে। আমার দুটো উদ্দেশ্য ছিল সেখানে যাওয়ার— একটা প্রকাশ্য অন্যটা অপ্রকাশ্য। প্রকাশ্য কারণ ছিল, আমার সিনিয়ার মৃগাঙ্কবাবুর এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করা আর অপ্রকাশ্য কারণটা ছিল একটা রাজনৈতিক কর্তব্য গোপনে সম্পন্ন করা। দ্বিতীয় কারণটা সম্পর্কে আরও একটু বিশদভাবে বলা দরকার।

মৃগাঙ্কবাবুর যে মক্কেলের সঙ্গে আমি দেখা করতে যাচ্ছিলুম, তিনি আমলকী গ্রামের একজন বর্ধিষ্ণু বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর জমিজমা তো ছিলই, তা ছাড়া নানারকম ব্যাবসাপাতিও ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। ফলে, তাঁর মধ্যে আরও একটা জিনিস জন্মেছিল, যাকে বলতে পারেন, শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগ। তাঁর বাড়ি ভরতি অজস্র বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি থাকত, আর তাঁর দুই পুত্রবধূর নিয়মিত কর্তব্য ছিল, দু-বেলা সেইসব বই পড়ে শোনানো এবং তাদের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করা। বুঝতেই পারছেন, তিনি তাঁর দুই ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করেছিলেন আর পুত্রবধূদেরও এনেছিলেন লেখাপড়া জানা দেখেই। সেই ভদ্রলোকের নামও হয়তো আপনারা শুনে থাকতে পারেন। কলকাতার প্রভাময়ী গার্লস হাই স্কুল আর বহরমপুরের দিগ্বজয় বয়েস স্কুল এঁরই প্রতিষ্ঠিত। ভদ্রলোকের নাম দিগ্বজয় রায়।

আগেই বলেছি, ভদ্রলোকের দু-টি ছেলে। বড়োটি, অজয় রায়, কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন আর ছোটোজন, কাশীনাথ, ছিলেন পাটনার জনসন কলেজের অধ্যাপক। দু-জনেই প্রচণ্ড পণ্ডিত আর ভেতরে ভেতরে তেমনই দেশপ্রেমী। তাঁদের দেশপ্রেম মিটিংয়ে যাওযা, বক্তৃতা শোনা আর শ্লোগান দেওয়ার মধ্যে ছিল না। কাশীনাথ নানারকম বইটই পড়ে নিজের হাতেই পাটনার একটা ছাপাখানা বানিয়ে নিয়েছিলেন। অজয় অগ্নিবর্ষী সব প্রবন্ধ লিখতেন, কাশীনাথ ছাপতেন আর আমাদের পার্টির অফিসে দফায় দফায় সেইসব কাগজ নানা পোস্ট অফিস থেকে ডাকে পাঠাতেন। আমরা প্রথমটা তাঁদের চিনতুমই না, নামও জানা ছিল না। কিন্তু সেসব লেখা পড়ে বাঘা-বাঘা বিপ্লবীরও পিলে চমকে উঠত আর দেখতে-না-দেখতে সব বিলি হয়ে যেত, অফিসে পড়তে পেত না। সেসব লেখার কোনোটা যদি কোনো স্বদেশি কাগজ সাহস করে ছাপত তো তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে মহাহাঙ্গামা বাধিয়ে সম্পাদককে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। কাজেই এসব প্রবন্ধের লেখকের সম্বন্ধে আমাদের যে একটা প্রবল কৌতূহল ছিল, তা তো বুঝতেই পারছেন।

এ লেখাগুলো যে মাঝে-মাঝে আমলকী থেকে আসে, সে খবরটা যে কী করে আমরা পেয়েছিলুম সেকথা আজ আর মনে নেই। তবে খবরটা পেতেই আমাদের পার্টির কর্তাব্যক্তিরা আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি পত্রপাঠ ওখানে চলে যাও। খোঁজখবর নিয়ে দ্যাখো যে লেখককে খুঁজে পাও কি না।’

এখন প্রশ্ন উঠল, আমার একা যাওয়া সংগত কি না। যেমন আগুনের মতো লেখা, লেখকের স্বভাবও যদি তেমনই হয় তাহলে তাকে একা মোকাবিলা করতে যাওয়াটা উচিত হবে না বলেই সকলের মনে হল। যদি কোনোরকম ভুল বোঝাবুঝি হয় বা আমার সদুদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর মনে যদি কোনোরকম সন্দেহ জাগে, তাহলে কি সেই ভ্রম বা সন্দেহ নিরসন করার সুযোগ পাওয়া যাবে? তার চেয়ে সঙ্গে আর-একজনকে নিয়ে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু, যাবে কে? আর কী হিসেবেই বা যাবে? আমি তো জুনিয়ার উকিল, যাচ্ছি মক্কেল দিগ্বজয়বাবুর কাছে। এমন কে বেকার বসে আছে যে তস্য জুনিয়ার হয়ে ঘুরে বেড়াতে রাজি হবে?

তা, তেমন একজন লোকও পাওয়া গেল। তার নাম চন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। শোভাবাজার বোমার মামলার একজন আসামি, জেল ভেঙে পালিয়ে আমাদের পার্টি অফিসে গা ঢাকা দিয়ে বসেছিল। কোনো কাজকর্ম নেই, দিনরাত মুড়ি খায় আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে হিজিবিজি গান গায়। সবাই তিতিবিরক্ত। কর্তারা বললেন, তুমি চাঁদুকে নিয়ে যাও।

কিন্তু যাও বললেই তো আর নিয়ে যাওয়া যায় না। চাঁদুর চেহারাটা এমন যে, দিনের বেলা রাস্তায় বেরোলেই পুলিশ ক্যাঁক করে ধরে ফেলবে। ছ-ফুটের ওপর লম্বা, টকটক করছে ফর্সা গায়ের রং, প্রকাণ্ড চওড়া কাঁধ, আর হাতদুটো যেন দুটো থাবা। একে পশ্চিমবঙ্গের একটা গণ্ডগ্রামে কোন ছদ্মবেশে নিয়ে যাই? চাকর সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না, আমার ভাই হিসেবে নিয়ে গেলে কেউ বিশ্বাসই করবে না, মেয়ে সাজাব তার উপায় নেই। শেষপর্যন্ত ঠিক হল, ওকে আমার এক আর্টিস্ট বন্ধু সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। নাম ঠিক হল, অমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এতদিন শহরে বসে বসে ছবি আঁকতেন, এখন গ্রাম বাংলার ছবি আঁকতে চান। অতএব চাঁদুর ওপর আদেশ হল, ছবি আঁকা সম্পর্কে যথাসাধ্য জ্ঞান অর্জন করো আর দাড়ি গজাও।

শুনে চাঁদু কেঁদে অস্থির। বলে, জীবনে কখনো কোনো ছবি আঁকিনি, দাড়ি গজালে গলা কুটকুট করে। কিন্তু কোনো ওজর আপত্তিই শোনা হল না। শেষপর্যন্ত অমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ঢলঢলে আলখাল্লা, কাঁধে ঝোলার ভেতর ছবি আঁকার সরঞ্জাম, একটা ফ্লিপ ড্যাগার আর একটা ছোটো ছ-ঘরার রিভলভার নিয়ে আমার সঙ্গে আমলকী রওনা হলেন।

দিগ্বজয় রায়মশাইয়ের বাইরের ঘরে দুটো তক্তপোশ পেতে আমাদের রাত্রে শোওয়ার ব্যবস্থা হল। আমাদের ভাগ্যক্রমে তাঁর দুই ছেলেই তখন বাড়িতে। সকলে মিলে আমাদের যথেষ্ট যত্নআত্তি করলেন। কাশীনাথ ছিলেন আমার সমবয়সি আর অজয় সামান্য বড়ো, কাজেই প্রথম আলাপে ঘনিষ্ঠ হতে বেশি দেরি হল না।

তাতে লাভই হয়েছিল। প্রথমত, দেখা গেল যে অজয় আর কাশীনাথ, দু-জনেই ভারতীয় আর ইউরোপীয় শিল্পের ওপর যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করে বসে আছেন আর চাঁদু যে আবার সে বিষয়ে সবিশেষ অজ্ঞান তা-ও তাঁরা সম্যক উপলব্ধি করে ফেলেছেন। তবু চাঁদু সামলে নিয়েছিল। আর্টের থিয়োরিটিক্যাল দিকটা যে ওর বিশেষ সড়গড় নয়, সেটা প্রায় বুঝিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু সব ভেস্তে গেল রাত্রি বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর।

দিগ্বজয়বাবু তখন শুয়ে পড়েছেন। আমরাও শোওয়ার ব্যবস্থা করছি। এমন সময় দুই ভাই পান নিয়ে ঘরে এসে উপস্থিত। তখন আবার গল্প শুরু হল। একটু বাদেই কাশীনাথ বললেন, ‘দেখুন অমরেন্দ্রবাবু, আমরা যদি আপনাকে চন্দ্রনাথবাবু বা গাঙ্গুলীমশাই বলে সম্বোধন করি, তাতে কি আপনার বিশেষ আপত্তি হবে?’

বলাই বাহুল্য, আমরা দু-জনেই ভয়ানক চমকে উঠলুম।

কাশীনাথ হাত নেড়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘না, না, ভয় নেই। এখানে আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবে বড্ড রিস্ক নিয়েছেন, যেকোনো সময় ধরা পড়ে যেতে পারতেন।’

আমি বললুম, ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ কি না এখনও তো ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে, সম্প্রতি একটা লেখা নজরে পড়েছিল, তার নাম— হু আর ক্রিমিনালস, ইন্ডিয়ান রেভেলিউশনারিস অর ব্রিটিশ পাইরেটস? তার লেখকের নাম ছিল স্কন্দগুপ্ত। আপনাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কাকে সেই নামে সম্বোধন করব, সেটা জানতে পারলে তবেই আমরা কতদূর নিরাপদ সেটা বুঝতে পারব।’

আমার কথা শুনে দুই ভাই একসঙ্গে হেসে উঠলেন। অজয় বললেন, ‘আপনারা স্কন্দগুপ্তকে খুঁজতেই এখানে এসেছেন, তাই না?’

আমি মৃদু হেসে বললুম, ‘সে-কথাটা খানিকটা ঠিক, পুরোটা নয়। আসলে আমরা তো সবসময়েই স্কন্দগুপ্তকে খুঁজছি। ইলিসিয়ম রোর কর্তারাও খুঁজছেন, তবে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তবে আপনারা যদি বলেন, আপনাদের দু-জনের একজনও স্কন্দগুপ্ত নন, আমি সেকথা সানন্দে স্বচ্ছন্দে মেনে নেব। কারণ আমি জানি, হয়তো স্কন্দগুপ্ত আমাদের সকলের বিবেক, সমস্ত পরাধীন জাতির অন্তরাত্মা। সে কার মধ্যে দিয়ে কথা বলছে, সেটা কখনোই বড়ো কথা নয়। তবু আমরা তাকে খুঁজছি, এবং খুঁজব—’

কাশীনাথ সহাস্যে বললেন, ‘ আপনার কথা বুঝতে পারছি।’ বলে স্কন্দগুপ্ত সম্পর্কে সমস্ত কথা আমাদের বললেন।

আমি বললুম, ‘আমাদের যে সবকথা খুলে বললেন, ভালো করলেন না।’

কাশীনাথ আগের মতোই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমরা আপনাদের সম্পর্কে সবকথাই জানি চিত্তবাবু। এমনি-এমনি বিশ্বাস করে বসিনি। সে ব্যাপারে আমাদের কোনোরকম ভুল হয়নি। কিন্তু আপনারা এখানে এসে ভয়ানক ভুল করেছেন। আপনারা জানেন না যে আপনাদের কতখানি বিপদ।’

আমি উদবিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলুম, ‘তার মানে?’

‘তার মানে খুবই সরল। আপনাদের পার্টি যখন খোঁজ পেয়েছে যে আমলকী গ্রাম থেকে স্কন্দগুপ্তের লেখা মাঝে মাঝে ডাকে দেওয়া হয়, তখন সে খবরটি যে এখনও পুলিশের কানে যায়নি, এরকম অনুমান করাটা আপনাদের উচিত হয়নি। কাজেই এ গ্রামের ওপর যে পুলিশের নজর পড়বে, এটা ধরে নেওয়াই আপনাদের স্বাভাবিক ছিল। এ-গ্রামে দু-তিনজন বিপ্লবী ছেলে আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পুলিশের নজর আমাদের দুই ভাইয়ের ওপরেও যে পড়বেই এটা আপনারা ধরে নেবেন আশা করেছিলুম। কিন্তু তা না-করে, আপনি চন্দ্রনাথবাবুকে নিয়ে একেবারে আমাদের বাড়িতেই উঠলেন— এটা ঠিক হয়নি। আমাদের জন্যে চিন্তা করি না, কারণ আমরা ঠিক বেরিয়ে যাব। কিন্তু চন্দ্রনাথবাবু? তাঁর নিরাপত্তার কথাটা একবার ভেবে দেখেছেন?’

আমি মাথা নীচু করে বললুম, ‘আমার অন্যায় হয়ে গেছে।’

অজয় বললেন, ‘অন্যায় আপনাদের কিছু হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হবে। আপনাদের এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কলকাতায় ফিরে যাওয়া চলবে না, কারণ মাঝপথেই ধরা পড়ে যাবেন। তার বদলে কাছে-পিঠে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে, যাতে আমাদের সঙ্গে একটা যোগ থাকে।’

‘কোথায় যাব?’

‘সেটাও ভেবে রেখেছি। এখান থেকে মাইলচারেক দূরে ময়ূরাক্ষীর ধারে একটা পরিত্যক্ত নীলকুঠি আছে। সেখানে কেউ যায় না, কাছে-পিঠে কোনো গ্রামও নেই। তা ছাড়া, জায়গাটার একটা বদনাম আছে। আপনারা সেখানে থাকবেন, আমি বা কাশী রোজ গিয়ে আপনাদের খাবার সাপ্লাই করে আসব। কোনো চিন্তা করবেন না। ওখানে একটা ঘর পরিষ্কার করাই আছে। আমরা মাঝে মাঝে ওখানে যাই তো। সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। গোলমাল কেটে গেলে আপনারা ফিরে যাবেন-খন।’

‘গোলমাল তবে একটা বেধেছে?’

‘হ্যাঁ। আপনারা আসার পরেই এ-গ্রামের মাতব্বরদের একজন— দয়ালহরি দাস, দু-বার নানা ছুতোয় এ-বাড়ি ঘুরে গেছেন। দয়ালকাকা জানেন না যে তিনি যে গভর্নমেন্টের চর সে সংবাদ আমাদের কাছে অজানা নেই।’

‘আমাদের কী করতে হবে?’

‘আমাদের বিশ্বাস, পুলিশ কাল অথবা পরশু ভোরে আমাদের বাড়িতে আসবে। অতএব আজ ঠিক মাঝরাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব। আপনাদের নীলকুঠিতে ছেড়ে ভোর হওয়ার আগেই আমরা ফিরে আসব। সাইকেল চালাতে পারেন তো দু-জনেই?’

‘পারি।’

‘তবে তো চিন্তাই নেই। চাঁদের আলো আছে, কোনো অসুবিধে হবে না।’

চাঁদু বলল, ‘চিত্তদার যাওয়ার কী দরকার? আমি একাই যাই।’

আমি বললুম, ‘না। তোকে এনেছি আমি, ফেরতও নিয়ে যাব আমি। কলকাতায় গিয়ে যা-খুশি করিস, কিন্তু এখানে তোকে আমার কথা শুনে চলতে হবে, মনে থাকে যেন।’

কিছু বাঁশবন, আমবন পেরিয়ে নীলকুঠিতে পৌঁছানো গিয়েছিল। দূর থেকে দেখলে বাড়ি বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছিল যেন একটা অতিকায় অশুভ অন্ধকারের স্তূপ। সামনে একটা বেশ বড়ো পাঁচিলঘেরা বাগান। যদিও পাঁচিলের অতি সামান্যই আজ অবশিষ্ট আর বাগানে কয়েকটা ঝাউগাছ ছাড়া বাকি সবই আগাছা। সেই অন্ধকার, কাঁটাঝোপ আর ভাঙা ইট-পাথরের স্তূপ এড়িয়ে অজয় কাশীনাথ অবলীলাক্রমে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। একটা বাঁশের মই বেয়ে আমরা দোতলায় উঠলুম। চওড়া টানা বারান্দা, একপ্রান্তে একটা ছোট্ট ঘর আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। দেখলুম, ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা আছে। দুটো ক্যাম্পখাট, একটা টেবিল, গোটা দুই চেয়ার, কিছু বইপত্র, জলের কুঁজো ইত্যাদি সযত্নে সাজানো আছে। ঘরের পুব দিকে দুটো প্রকাণ্ড জানলার ফোকর। তার মধ্য দিয়ে দেখলুম, চাঁদের আলোয় ময়ূরাক্ষীর রুপোলি শরীর আর তার দু-পাশে বিশাল বালিয়াড়ি। সমস্ত ব্যাপারটা আমার ভারি পছন্দ হল। কেবল বাঁশের মইটা ছাড়া।

অজয় বললেন, ‘এ ছাড়া উপায় নেই। ওরিজিন্যাল সিঁড়ি ছিল কাঠের। আজ তার চিহ্নমাত্র নেই। আর অসুবিধেই বা কী আছে? আমরা চলে গেলে মইটা ওপরে উঠিয়ে নেবেন। কোনো জন্তুজানোয়ার অন্তত ওপরে আসতে পারবে না।’

আমি বললুম, ‘না, না, অসুবিধে কিছু নেই। কিন্তু আমরা আসায় এত গোলমাল বাধল কীসের, এবার সেটা যদি বলেন।’

অজয় বললেন, ‘দেখুন স্কন্দগুপ্তের কিছু লেখা যে আমলকী গ্রামে ডাকে দেওয়া হয়েছিল, পুলিশ সে খবর জানে। এতদিন স্পাইদের মাধ্যমে গোপনে তদন্ত চলছিল। এখন, এ-গ্রামে হঠাৎ দু-জন আগন্তুক এসে পড়েছে, পুলিশ অবশ্যই তাদের দিকে বেশি নজর দেবে। আর চন্দ্রনাথবাবুর ডেসক্রিপশনও তারা পেয়েছে। আমার ধারণা, সেটুকুই ওঁকে চিনিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’

চাঁদু এতক্ষণ ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াছিল। হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা অজয়বাবু, যদি কিছু মনে না-করেন তো একটা কথা জিগ্যেস করি।’

‘করুন।’

‘এ ঘর গুছোনোর পেছনে যেন নারীহস্তের স্পর্শ রয়েছে মনে হচ্ছে? এমন চমৎকার করে কোনো পুরুষমানুষের পক্ষে সাজানো কঠিন।’

অজয় ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘আপনার সন্দেহ ঠিক। একটি মেয়ে রোজ এসে আমাদের এই ঘর গুছিয়ে দিয়ে যায়। কালও সে আসবে, তখন তাকে দেখতেই পাবেন। মেয়েটি একটু রহস্যময়।’

‘কীরকম?’

অজয় একটু চিন্তা করে বললেন, ‘অনেকগুলো কারণে। প্রথমত, মেয়েটি বেশ সুন্দরী, বয়স ত্রিশের একটু ওপরে হবে। স্থানীয় আদিবাসী লোকেদের মতো চেহারা নয়। দ্বিতীয়ত, সে যে কোথায় থাকে, সেটা আজও বের করতে পারিনি। তাকে জিগ্যেস করে লাভ নেই, কারণ সে বোবা। আমরা এখানে যখন প্রথম আসি, তখন সে এসেছিল একটা ছেঁড়া কানি দিয়ে কোনোরকমে লজ্জা-নিবারণ করে। অঙ্গভঙ্গি করে বুঝিয়েছিল যে সে কাজ করতে চায়। আমরা তাকে কাজ করতে বলি, কিন্তু টাকা দিলে সে নেয় না। শাড়ি দিয়েছি— খুশি হয়েছে। বড়ো একটিন মুড়ি দিয়েছি— তাতে আরও খুশি। কিন্তু এ-বাড়িতে সে থাকে না। সকালে একটু বেলায় আসে, ঘণ্টাদুয়েক বাদে চলে যায়। আমলকী গ্রামের মেয়ে সে নয়, কাছেপিঠে অন্য কোনো গ্রামও নেই। কাউকে জিগ্যেস করতে পারিনে, পাছে আমাদের গোপন আস্তানাটার কথা জানাজানি হয়ে যায়।’

‘আমলকী ছাড়া সবচেয়ে কাছের গ্রাম কতদূরে।’

‘বহু দূরে। হেঁটে আসা অসম্ভব। কোনো রাস্তাও তেমন নেই। তেঁতুলতলির মাঠ পেরিয়ে যে রাস্তায় আপনারা এসেছেন, সেটা আমলকীতেই শেষ। তার পরে আর নেই। আর থাকবেই বা কোত্থেকে? এ-জমির ওপর দিয়ে তো মানুষ হাঁটে না। বলে, হাঁটলে নাকি মরণদশায় ধরে।’

‘কেন?’

অজয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেখুন, এ জায়গাটা এককালে খুবই বর্ধিষ্ণু ছিল, অনেকগুলো গ্রাম ছিল, চাষবাস হত। তারপর এল নীলদানব। শুরু হল নৃশংস অত্যাচার। অতঃপর নীল বিদ্রোহ। এই কুঠির কুঠিয়াল সাহেব আর তার অ্যাসিস্টেন্ট কলকাতা থেকে কিছু সেপাই আর গোরা পল্টন নিয়ে এল। তখন শুরু হল তাণ্ডব। সেই নারকীয় ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। কিছু কিছু পুরোনো গান আমার কালেকশনে আছে, সেখান থেকে কিছুটা আন্দাজ পাবেন। ঝড় যখন থামল তখন দেখা গেল, এই সমস্ত অঞ্চল শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কাল সকালে বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পাবেন সামনে আর পাশে কিছু কিছু ধ্বংসস্তূপ। কেবল আমাদের আমলকী গ্রামটা বেঁচে গিয়েছিল, কারণ সে-সময়কার জমিদার ক্ষেত্রমোহন মজুমদার কলকাতায় মুৎসুদ্দিগিরি করার সুবাদে এই কুঠির সাহেবদের সঙ্গে যথেষ্ট খাতির বজায় রেখেছিল। কাজেই আজও লোকে মনে করে যে এই জায়গাটা অভিশপ্ত।’

কাশীনাথ বললেন, ‘মেয়েটি সম্পর্কে আমার একটা থিয়োরি আছে। আমার ধারণা, সে ভদ্রঘরেরই মেয়ে। সে যে বোবা, এটা লুকিয়ে তার বাবা-মা তার বিয়ে দেয়। শ্বশুরবাড়িতে ধরা পড়ামাত্র সে বিতাড়িত হয়। তার মতো সুন্দরী মেয়ে পথে নামলে অবধারিতভাবে অকথ্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তাই সে আজ লোকালয়ে থাকে না, কোনো পোড়ো ভিটেয় লুকিয়ে থাকে। বনের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করে। আমাদের নেহাতই নিরীহ দেখতে বলে আমাদের কাছে কাজ চাইতে এসেছিল বা হয়তো তার ইন্সটিংক্ট তাকে বলে দিয়েছে যে আমাদের কাছ থেকে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই।’

অজয় আবার ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘হয়তো তোর কথাই ঠিক। কিন্তু তাতে সেই রহস্যটা সমাধান হয় না। আমি জানি, তুই বলবি ওটা কাকতালীয় ব্যাপার। হয়তো তাই, কিন্তু না-হতেও তো পারে?’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘কোন রহস্যের কথা বলছেন?’

‘সেটা আজ বলব না। আপনারা যেদিন যাবেন, সেদিন বলব।’

চাঁদু মাথা চুলকে বলল, ‘মেয়েটা ভূতটুত নয়তো?’

অজয় এবার সশব্দে হেসে উঠলেন, ‘না, না, ভূত কখনো প্রশস্ত দিবালোকে কারোর বাড়ির ঝিগিরি করতে আসে, শুনেছেন কখনো? তা ছাড়া, আমরা দেখেছি তার বেশ স্পষ্ট একটা ছায়া পড়ে, তার উলটোবাগে পা নয়, মই না-নামালে ওপরে উঠতে পারে না, পা-গুলো তালগাছের মতো লম্বা করার ক্ষমতা বোধ হয় তার নেই। আসলে যে রহস্যের কথা আমরা বলছি, সেটা অন্য ব্যাপার। তাতে আপনাদের বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে কেন যে আজ সে সম্বন্ধে কিছু বলছি না, সেটাও যেদিন আপনারা যাবেন সেদিনই বলব।’

কাশীনাথ বললেন, ‘চলো দাদা, এবার আমাদের রওনা হওয়ার সময় হল। আমাদের একজন কাল মাঝরাতে আসবে খাবার আর জল নিয়ে। দিনের খাওয়াটা মুড়ি আর গুড় দিয়েই সারতে হবে আপনাদের। একটু কষ্ট হবে, তা আর কী করা যাবে। আর ভালো কথা, জানলাটার সামনে যত কম সম্ভব যাবেন, রাত্রি বেলা নদীতে স্নান করে আসবেন, একতলার পেছনের ঢাকা বারান্দায় কাপড় শুকোবেন, দোতলার খোলা বারান্দায় বা পেছনের ছাদে পারতপক্ষে যাবেন না। এইসব উপদেশ দেওয়ার কারণ একটিই— নদীর এপারে কোনো লোক চলাচল নেই ঠিকই, কিন্তু নদীর ওপারে মাঝে মাঝে দু-একজন হাটুরে যাতায়াত করে থাকে। দেখবেন, যেন তাদের কোনোরকম সন্দেহের উদ্রেক করে বসবেন না।’

চাঁদু অত্যন্ত বিমর্ষ মুখে বলল, ‘ও বাবা! এর চেয়ে যে ইংরেজের জেল ছিল ভালো।’

পরদিন বেলা দশটা নাগাদ মেয়েটি এল। চাঁদু অবশ্য তখনও পরমানন্দে সশব্দে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছিল, আর আমি সামনের বারান্দায় একটা মোটা থামের আড়ালে যথাসাধ্য আত্মগোপন করে বসে একটা বই পড়বার চেষ্টা করছিলুম। নীচের বাগানে মচমচ শব্দ শুনে গলা বাড়িয়ে তাকে দেখতে পেলুম।

একটু বাদে মই বেয়ে যে উঠে এল, তাকে দেখে একটু আশ্চর্যই হলুম। মেয়েটির একমাথা লালচে চুল চুড়ো করে মাথার ওপরে বাঁধা। পরনে একটা কালোপাড় ধুতি। খুব লম্বা-চওড়া নয়, তবে বেশ স্বাস্থ্যবতী। গায়ের রং দুধে-আলতায় না-হলেও, ফর্সা অবশ্যই বলা চলে। আর আশ্চর্য তার মুখ। আজও ভুলতে পারিনি। বাঁশির মতো নাক, পদ্মপলাশ দুই চোখ, খোদাই করা দুটি ঠোঁট— আপনারা আজকাল যেরকম মা দুর্গার পটের ছবি দেওয়ালে সাজিয়ে রাখেন, ঠিক সেইরকম। আর মুখে একটা প্রবল ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্য। আমার দেখে মনে হল যেন স্বয়ং মা ভবানী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন।

মেয়েটিও আমাকে দেখে কিছু কম আশ্চর্য হয়নি। আমি তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললুম। সেসব কথা মন দিয়ে শুনল, কী বুঝল কে জানে, তারপর আমাদের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

এইখানে একটা অদ্ভুত দৃশ্য আমার নজরে পড়ল। মেয়েটি ঘরে ঢুকে চাঁদুকে দেখেই প্রথমে থমকে দাঁড়াল। তার দুই চোখ এক লহমার জন্য বিস্ফারিত হয়ে ধ্বক-ধ্বক করে জ্বলে উঠল, তার পর-মুহূর্তেই, বোধ হয় চাঁদুর গলায় পৈতেটা নজরে পড়ার ফলে চোখ নামিয়ে হাতজোড় করে তার উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম করে সে নিজের কাজে মন দিল। আমি পরে চাঁদুকে আমার এই অভিজ্ঞতার কথা বললুম, কিন্তু সে বিশেষ পাত্তা দিল না। বলল, ‘হয়তো কোনো পুরোনো শত্রুর সঙ্গে আমার চেহারার মিল খুঁজে পেয়েছিল। পরে ভুল বুঝতে পেরেছে।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু সে তোর মুখ দেখতে পায়নি।’

‘তাতে কী হয়েছে? আমার ফিগার আর গায়ের রঙে মিল থাকতে পারে। তবে একটা বাঁচোয়া— যেই তার শত্রু হোক-না কেন, সে ব্রাহ্মণ-সন্তান নয়।’ তারপর আমাকে ঠাট্টা করে বলল, ‘তোমার এই বেকারত্ব আর চোখে দেখা যায় না চিত্তদা। এইসব আজেবাজে প্রবলেম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তোমাকে এখন চিত্তবিনোদন করতে হচ্ছে?’

সত্যি, কিছুদিনের মধ্যেই কর্মহীন দিনগুলো অসহ্য হয়ে উঠল। কাঁহাতক আর বই পড়া যায়? বোবা মেয়েটির সঙ্গে আলাপাচারী করার চেষ্টা বৃথা, তাতে কেবল হাত-পা ব্যাথাই বাড়ল। নীলকুঠি এক্সপ্লোরেশন— তাও একদিন শেষ হয়ে গেল। দেখা গেল, বাড়িটার তিন-চতুর্থাংশ একেবারে ধসে গেছে। বাকি যেটুকু আছে, তার মধ্যে ওপরে-নীচে মিলিয়ে গোটা ছয়েক ঘর। সব ক-টাই সাপ আর বিছের রাজত্ব। কোনোটাতেই দরজা-জানলার বালাই নেই। কেবল একটাই কৌতূহলোদ্দীপক জিনিস নজরে পড়ল। সেটা একটা শ্বেত পাথরের প্লাক, দোতলার একটা ঘরের জানলার বাইরে দেওয়ালে গাঁথা। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, আমার প্রিয়া পত্নী আগাথা এই ঘরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন— জেমস কার্টার।

আমাদের একমাত্র আনন্দের সময় ছিল শেষরাত্রি, যখন অজয় অথবা কাশীনাথ আসতেন। গল্পগুজব হত, বাইরের জগতের খবরাখবর পাওয়া যেত। অনেক কষ্ট করেছিলেন দু-জন আমাদের জন্যে।

প্রায় দিনদশেক এরকম চলবার পর হঠাৎ একদিন অজয় বললেন, ‘কাল রাত্রে আপনাদের এখান থেকে পালাতে হবে। কোথায় যাবেন স্থির করিনি এখনও। কাশীকে পাঠিয়েছি নদীর ওপারে আমার মামার বাড়িতে। যদি সেখানে কোনো অসুবিধে না-থাকে, তাহলে কাল মাঝরাত্রিতে রওনা হলে ঘণ্টাতিনেক সাইকেল চালালে পৌঁছে যাওয়া যাবে।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘কেন, কোনো গণ্ডগোল বেধেছে?’

‘হ্যাঁ। আমলকীতে একটা গুজব রটেছে যে নীলকুঠিতে নাকি কুঠিয়াল সাহেবের ভূত দেখা গেছে। এরকম গুজব এর আগেও দু-একবার ঘটেছে, কিন্তু এবারের গুজবটা সত্যি না-হয়ে যায় না। কারণ কালেক্টরেটের চৌকিদার লালতাপ্রসাদ ভরদুপুর বেলা স্বচক্ষে তাকে দেখেছে। সেই সাহেব-ভূত নাকি আবার তাকে দেখেই তালগাছের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে তাড়া করে এসেছিল। সে যদি তখন নদীর ওপারে না-থাকত আর বুদ্ধি করে ঠিক সময়ে তার টাট্টু ঘোড়া ছুটিয়ে না-দিত, তাহলে যে কী হত তা আর না-বলাই ভালো। আসলে সে দেখেছে, ঠিকই, তবে যা দেখেছে তা সাহেব-ভূত নয়, চন্দ্রকান্ত গাঙ্গুলির কিছু অংশ। গাঙ্গুলিমশাই, আপনি নিশ্চয়ই কয়েক দিন আগে খালি গায়ে ওই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে দুপুর বেলার দৃশ্য উপভোগ করছিলেন? মানে, কাশী ঠিক যে কাজটা করতে বারণ করেছিল।’

চন্দ্রনাথ লজ্জিত মুখে মাথা নেড়ে বলল, ‘ইয়ে মানে, হ্যাঁ, তা হতে পারে।’

‘যাহোক, যা হওয়ার তা তো হয়েছে। গুজবটা আবার রটেছে দিন কয়েক আগে, যদিও আমাদের কানে এসেছে আজ। আশা করি, এখনও বেশি দেরি হয়ে যায়নি। তবে নীলকুঠিতে আর নয়। আমার মামাবাড়িতে যদি না-ও হয়, তা হলেও অন্য কোথাও ব্যবস্থা করা যাবে। কাল রাতের জন্য আপনারা প্রস্তুত থাকবেন।’

সেই প্রস্তুতির আর দরকার হল না। পরদিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙল ঘরের মধ্যে অনেকগুলো লোকের কথাবার্তায়। চোখ খুলে দেখি, আমাদের খাটের চারপাশে আট-দশজন সেপাই, জানলার কাছে একজন বেঁটেখাটো ইংরেজ পুলিশ অফিসার আর চাঁদুর মাথার কাছে দণ্ডায়মান আর-একজন পর্বতাকার ইংরেজ পুলিশ অফিসার। ইউনিফর্ম দেখে বুঝলুম, প্রথমজন জুনিয়ার আর দ্বিতীয়জন সিনিয়ার।

আমাদের চোখ খুলতে দেখে পর্বতাকার মধুর গলায় আমাদের সাদর সম্ভাষণ করে বলল, ‘সুপ্রভাত, সুপ্রভাত। এইসময়ে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি অতিশয় দুঃখিত, কিন্তু কী করব বলুন, চাকরি বজায় রাখতে গেলে এ হেন খারাপ কাজ আমাদের করতেই হয়। তা মিস্টার গাঙ্গুলি, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে পালিয়ে এসে আপনি এই জায়গায় থাকাটাই পছন্দ করলেন? এ জায়গাটায় কি আপনার কোনো বিশেষ আকর্ষণ আছে?’

চন্দ্রনাথ এ প্রশ্নের কোনো জবাবই দিল না। বিকৃত মুখে চুপ করে বসে রইল। পবর্ত তখন চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘মিস্টার গাঙ্গুলি, জেমস কার্টার যখন কোনো প্রশ্ন করে, তখন তার উত্তর না-দিয়ে চুপ করে থাকাটা কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’

নামটা শুনে আমরা দু-জনেই চমকে উঠলুম এবং প্রায় একইসঙ্গে দু-জনে বলে উঠলুম, ‘জেমস কার্টার!’

আমাদের চমকানো দেখে পর্বত একটু আশ্চর্য হল। বলল, ‘কেন আমার নামটা কি তোমাদের চেনা-চেনা লাগছে?’

চাঁদু বলল, ‘তা একটু লাগছে বই কী! আচ্ছা, তোমার কোনো পূর্বপুরুষ কি ভারতবর্ষে নীলের চাষ করতেন?’

‘হ্যাঁ, করতেন। আমার ঠাকুরদার বাবা। তোমরা কী করে জানলে?’

চাঁদু এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিল না। তবে বলল, ‘কী আশ্চর্য যোগাযোগ! তুমি জানো না যে এই বাড়িটা তোমার সেই পূর্বপুরুষের। তাঁর নাম ছিল জেমস। তাঁর স্ত্রী এখানেই মারা যান। তোমার গ্রেট গ্র্যান্ড মাদার।’

পর্বত মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তিনি অন্য মহিলা। আমার বাবার ঠাকুমাকে তিনি দেশে ফিরে বিবাহ করেন। কিন্তু এ খবরটা তোমরা পেলে কোত্থেকে?’

‘এই ঘরের পাশের ঘরের দরজার বাইরে একটা প্লাক আছে।’

‘তাই নাকি?’ বলে বেঁটে অফিসারকে সম্বোধন করে পর্বত বলল, ‘জানো পল, আমি সত্যিই আশ্চর্য হচ্ছি। অবিশ্বাস্য যোগাযোগ, তাই না? সেই বুড়োর কিছু কিছু চিঠিপত্র এখনও আমাদের বাড়িতে আছে, সেখানে আমি তাঁর ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতার কথা পড়েছি। সে প্রায় পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে। খুব ফূর্তি লুটেছিল তখন। শুধু যে দেদার নেটিভ মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল তাই নয়, পুরুষদের ওপর যা অত্যাচার করেছিল, তা আর কী বলব! একেবারে ডিলাইটফুল। তার ওপর গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছিল।’

বেঁটে সাহেব মহাপুলকিত হয়ে বলল, ‘তোমার পূর্বপুরুষটি বেশ মহাপুরুষ ব্যক্তি ছিলেন দেখছি।’

পর্বত দন্তবিকাশ করে বলল, ‘নিশ্চয়ই। চলো প্লাকটা দেখে আসি।’

বেঁটে মাথা নেড়ে বলল, ‘চলো।’ তারপর একজন সেপাইকে সম্বোধন করে বলল, ‘বদ্রি, এদের বাইরে নিয়ে এসো। হাতকড়ি লাগিয়ে একপাশে বসাও। আমরা বাড়িটা দেখে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হব।’

বদ্রি এবং আর একজন সেপাই আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে বলল, ‘চলো, বাহর নিকলো!’

আমরা খাট থেকে গড়িমসি করে উঠতে-না-উঠতেই বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। তখন তাড়াতাড়ি উঠে দরজার বাইরে পা দিতেই দেখি, দু-জন সেপাই আমাদের মা ভবনীকে ধরে নিয়ে আসছে। তারা দু-জনে তার দু-হাত ধরে রেখেছে।

গোলমাল শুনে পাশের একটা ঘরের ভেতর থেকে সাহেব দু-জনও বেরিয়ে এল। অভিনব বন্দিটিকে দেখে তারা এগিয়ে এসে তার আপাদমস্তক ভালো করে দেখল। বেঁটে সাহেব বাঁকা হাসি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘বেশ, বেশ, মিস্টার গাঙ্গুলি, এইবার বুঝতে পারছি, তোমার এই জায়গাটা এত পছন্দ হয়েছিল কেন। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য তার অতিথিশালায় তোমাকে এইরকম মজাদার মাল সরবরাহ করতে পারবে না। এখানে এরকম খাসা জিনিসটি জোটালে কোত্থেকে?’

চাঁদুর মুখটা ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠল, কিন্তু কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই বেঁটে সাহেবের পছন্দসই জিনিসটি অবলীলাক্রমে দুই সেপাইয়ের হাত ছাড়িয়ে বেঁটের ওপরওলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে হঠাৎ পরিষ্কার গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি জেমস কার্টার না?’

পর্বত অত্যন্ত খুশি হয়ে একটু সামনে ঝুঁকে মধুর হাস্যবিকাশ করে বলল, ‘হাঁ, হামি জেমস কার্টার আছি। তুমি হামাকে চিনো নাকি?’

‘আমি তোমাকে চিনি না, শয়তান? এত বছর আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি জানতুম তুমি ফিরে আসবে। এইবার আমার পালা!’

বলেই কেউ কিছু বোঝবার আগেই মেয়েটি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে এক হাতে কার্টারের বুকের কাছে ইউনিফর্মটা আর অন্য হাতে পেটের ওপর বেল্টটা খিমচে ধরে সেই অতিকায় শরীরটা অনায়াসে মাথার ওপর তুলে মারল প্রচণ্ড এক আছাড়! তারপরই বাঘিনীর মতো এক লাফ দিয়ে গিয়ে সেই ধরাশায়ী দেহটার ওপর চেপে বসল। এই আক্রমণের আকস্মিতায়, যন্ত্রণায় আর বিস্ময়ে কার্টার তখন অনড়।

বেঁটে সাহেবও কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরেই যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে, দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে খুব কাছ থেকে মেয়েটির মাথায় পরপর তিনটে গুলি করল।

আমরা স্পষ্ট দেখলুম তিনটে গুলিই মাথা ফুটো করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু সেই ক্ষত থেকে কোনো রক্ত বেরোল না। গুলি খেয়েই মেয়েটি ফিরে তাকিয়ে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে খপ করে স্তম্ভিত বেঁটে সাহেবের পা-টা ধরে ফেলল। তারপর তাকে হিড়হিড় করে কাছে টেনে এনে তার গলাটা টিপে ধরল। বেঁটে সাহেব কয়েক মুহূর্ত ছটফট করেই নেতিয়ে পড়ল।

সেই প্রাণহীন দেহটা ঘৃণাভরে একপাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েটি এবার একহাতে কার্টারের চুলের মুঠি আর অন্যহাতে গলাটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘শয়তান, তুই আমার স্বামীকে গুলি করে মেরেছিস, আমাকে বরবাদ করেছিস, আমার তিন বছরের ছেলেটাকে গাছের গায়ে আছড়ে-আছড়ে মেরেছিস! তুই ভেবেছিলি আমি মরে গেছি, না? কিন্তু আমি মরিনি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেঁচে থেকেছি— জোর করে বেঁচে থেকেছি। আর দেখেছি তোর পশুর মতো ব্যবহার। সারা গাঁ-টা জ্বালিয়ে শ্মশান করেছিস, তোর নোংরা হাত থেকে কেউ বাঁচেনি!’

এরই মধ্যে শুনি কার্টার গোঙাতে-গোঙাতে বলছে, ‘কী বলছে মেয়েটি… কী বলছে? কেউ কি আমাকে বুঝিয়ে দেবে?’

আমার পাশ থেকে চাঁদু চিৎকার করে বলল, ‘তোমার ঠাকুরদার বাবার যে সব কীর্তিকলাপে তুমি অহংকৃত বোধ করতে, মেয়েটি তারই বর্ণনা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেভাবেই হোক মেয়েটি সেইসব কীর্তিকলাপের শিকার হয়েছিল আর তার ধারণা যে তুমিই সেই জেমস কার্টার সিনিয়ার। শুনেছি থার্ড জেনারেশনে চেহারা নাকি ফিরে আসে। তোমারও এসেছে। সন্দেহ নেই।

কার্টার কাতরে উঠে বলল, ‘ওকে একটু বুঝিয়ে বলো! দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলো!’

চাঁদুর মুখ দেখে মনে হল না যে তার বুঝিয়ে বলার কিছুমাত্র বাসনা আছে। আর তার দরকারও হল না। কারণ তার পরেই দেখি মেয়েটি একহাতে কার্টারের ঘাড় আর অন্যহাতে তার থুতনিটা ধরে আস্তে আস্তে টেনে মুণ্ডুটা ধড় থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলল। আর যতক্ষণ ধরে এই অমানুষিক কাণ্ডটা ঘটল, ততক্ষণ ধরে কার্টারের গলা থেকে একটা বীভৎস নারকীয় আর্তনাদ বেরিয়ে এসে সমস্ত নীলকুঠিটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।

যখন সেই আর্তনাদ থামল, তখন দেখি রক্তমাখা হাতে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশে কেউ নেই। সেপাইরা কেউ বোকা নয়, তারা ব্যাপারটা একটু আঁচ করেই যথাসময়ে ভাগলবা। আমি হাতজোড় করে মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লুম। বললুম, ‘কে মা তুমি?’

ভাবলেশহীন গলায় মেয়েটি বলল, ‘আমার নাম সালমা। আমার স্বামী মোবারকের বড়ি ছিল ওই দূরে কতগুলো তালগাছ দেখছ, ওইখানে। তিনি চাষি ছিলেন। আমরা ছিলুম গরিব, কিন্তু ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে আমার কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু কীসের থেকে যে কী হয়ে গেল। নীলকুঠি হল, জোর করে নীলের চাষ করা হল। আমার স্বামী বদরাগি মানুষ ছিলেন, আপত্তি জানাতে গিয়ে কয়েক বার চাবুক খেলেন, কয়েদ হল কিছুদিনের। তারপর হঠাৎ একদিন এই শয়তানটা, একদল গোরা সেপাই নিয়ে আমাদের গ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজনও বাঁচেনি, জানো? বাচ্চা, বুড়ো কেউ নয়। কত কাঁদল সবাই, কিন্তু কাউকে রেয়াত করল না। সে কী অত্যাচার! আমিও বোধ হয় মরে গিয়েছিলুম। কিন্তু কী করে বেঁচে উঠলুম, জানি না। সেই মরার আগে সাহেবকে বলেছিলুম, আমি তোমাকে ছাড়ব না শয়তান, মরে গেলেও তোমার মুণ্ডু আমি নিজের হাতে ছিঁড়ব— তবেই আমার শান্তি। হয়তো সেই জন্যেই বেঁচে উঠেছিলুম। তারপর, কতদিন কেটে গেছে। শেয়াল কুকুরের মতো পোড়ো ভিটের মধ্যে লুকিয়ে থেকেছি কেবল এই দিনটির আশায়। আজ আমার সব কাজ শেষ।’

এই পর্যন্ত বলে মেয়েটি যেন একতলায় নামার মইটির দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে তার দিকে এগোতে যাচ্ছিলুম, চাঁদু পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলল। বলল, ‘দাঁড়ান, যাবেন না।’

আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই একটা বিকট পচা গন্ধে সমস্ত জায়গাটা ভরে রইল। তাকিয়ে দেখি, মেয়েটির সমস্ত শরীরটা পচে গলে যাচ্ছে। সে কী ভয়ংকর দৃশ্য! ধীরে ধীরে দেহটা কঙ্কালে পরিণত হল, তারপর সেটাও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে এক স্তূপ ধুলোয় পর্যবসিত হল। তারপর হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে সেই ধুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল, হয়তো চারদিকের ধ্বংসস্তূপগুলোর ওপর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে।

আর ভয়াবহ আতঙ্কে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলুম।

সোমেশ বলল, ‘আচ্ছা রায়সাহেব, অজয়বাবু যে রহস্যের কথা বলেছিলেন, সেটা কী তা কি জানতে পেরেছিলেন?’

চিত্তপ্রসাদ বললেন, ‘হ্যাঁ, পেরেছিলুম। অজয়বাবুর জ্যাঠামশাই যৌবনকালে কিছুদিন তন্ত্রসাধনা করেছিলেন। সেইসময় তিনি কয়েক বার নীলকুঠিতে গিয়েছিলেন নির্জনতার খোঁজে। সেখানে তিনি এই মেয়েটিকে দেখেছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে যা বর্ণনা দেওয়া ছিল, তাতে অজয়ের ধারণা হয়েছিল এই দু-জন অভিন্ন, কিন্তু কাশীনাথ সেকথা বিশ্বাস করেননি। কী করেই বা করবেন? এই দুই ঘটনার মধ্যে যে প্রায় বাহান্ন বছরের তফাত।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *