নীলাঞ্জনছায়া

নীলাঞ্জনছায়া

সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছিল, দুপুর হতে-না-হতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। পাঁচতলার ওপরে বাতাসের জোরটা বেশি, সজল হাওয়ায় পর্দাগুলো মেঝের সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল হয়ে উড়তে লাগল। বীথি খাওয়া শেষ করে, টেবিল তুলে, মৌরি মুখে দিয়ে বসবার ঘরে এসে ওঁর প্রিয় রকিং চেয়ারটায় বসলেন। এসময় টিভি দেখতে ইচ্ছে করছিল না, তাই পাশে টেবিলের ওপর রাখা ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দিলেন। শুনলেন কে যেন গাইছে— নীলাঞ্জনছায়া…। মনে মনে ভাবলেন, আজ রাত্রেই তো গৌতম টুর থেকে ফিরছে, কাজেই কান্তবিরহকান্তারে আর বেশিক্ষণ থাকতে হবে না।

গানটা ভালো করে শোনবার জন্য চোখ বুজে শরীরটা এলিয়ে দিলেন বীথি। শুনতে শুনতে ওঁর সমস্ত দেহমনে এক তৃপ্ত প্রশান্ত মধুর অনুভূতি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পাঁচতলার ওপরে ভিজে মাটির গন্ধ আসে না, তবু যেন কল্পনায় তাঁর ছেলেবেলাকার সেই অতিপরিচিত সুবাস— বেল, জুঁই আর কেয়াফুলের গন্ধে মিশে তাঁর সমস্ত সত্তাকে অধিকার করে নিতে আরম্ভ করল। যেমন হত হরিমোহনপুরের সোমারভিল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের স্টাফ-কোয়ার্টার্সে তাঁর ছেলেবেলায়। ভাবা যায় না যে, তাঁর ছেলেমেয়েরা প্রফুল্ল কদম্ববন যে কী বস্তু তা জানেই না। ঘন মেঘের ছায়ায় জামের বনে যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে, বাগান থেকে ভেসে আসে আশ্চর্য সুগন্ধ, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তাঁর মনে হতে লাগল যেন তাঁর জীবন থেকে সেই বেঁচে থাকার তীব্রতাটা কখনোই সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়নি। কলকাতার ধুলোধোঁয়া, ট্রামবাসের ঘড়ঘড়ানি আর অসংখ্য মানুষের ঠেলাঠেলি তাঁর অস্তিত্বের সেই অংশটাকে কোনোদিনই মুছে ফেলতে পারেনি।

এই চিন্তার মধ্যেই রাজার মতো প্রচণ্ড বজ্রপাতের ডংকা বাজিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। বীথির মনে হল, এক্ষুনি যেন রান্নাঘরের টিনের চালের ওপরে বৃষ্টির জলতরঙ্গের আওয়াজ ভেদ করে ভেসে আসা মা-র গলা শুনবেন, ‘ওরে জানলাগুলো বন্ধ কর। ঢিপসি হয়ে বসে না-থেকে বাইরের কাপড়গুলো তুলে আনতে পারছিস না? তোর বাবা তো একটা ছাতা নিয়েও যায়নি। ভিজে ঢোল হয়ে ফিরবে।’

হঠাৎ দরজার কর্কশ ঘণ্টির শব্দ বীথিকে একটা নিষ্ঠুর নাড়ায় হরিমোহনপুর থেকে উপড়ে এনে ফেলে দিল রাধামাধব দত্ত রোডের পাঁচতলার ফ্ল্যাটে। এ সময় কে আসতে পারে? গৌতম তো রাত্রে আসছে। তবে আবার কে এল?

চেয়ার থেকে উঠে দরজার আইহোলে চোখ লাগিয়ে বীথি দেখলেন বাইরে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর পরনে নীল রঙের শার্ট, ছাইরঙের প্যান্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে কাঁচা-পাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। এঁকে কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে হল না।

একটু বিরক্ত হয়েই বীথি বললেন, ‘কে?’

বাইরের থেকে প্রশ্ন করা হল, ‘এটা কি মি গৌতম চক্রবর্তীর বাড়ি?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু তিনি তো বাড়িতে নেই, কলকাতার বাইরে গেছেন, আজ রাত্রে ফিরবেন। আপনি কাল আসবেন।’

প্রশ্নকর্তা হাসলেন। বললেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আমার দরকার তাঁর স্ত্রী বীথির সঙ্গে। তিনি বাড়িতে আছেন কি?’

‘আপনি কে?’

‘আমি শশাঙ্ক, হরিমোহনপুরের শশাঙ্কশেখর মিত্র।’

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো থরথর করে কেঁপে উঠলেন বীথি। কোনো কিছু চিন্তা করবার আগেই তাঁর ডানহাতটা যেন উড়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল। চেঁচিয়ে বললেন, ‘আরে, শশাঙ্কদা, তুমি! তুমি কোত্থেকে? এসো, এসো ভেতরে এসো। একী, দাড়ি রেখেছ কেন? চুলগুলো সব পেকে গেল কী করে? নিজের গলার তীব্রতাটা তাঁর নিজের কানেই কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনাল।’

ভিজে জুতো পচপচ করতে করতে, এক হাতে একটা ব্রাউন রঙের চামড়ার ব্যাগ আর অন্য হাতে একটা ভিজে ছাতার জল ঝরাতে ঝরাতে ঘরে ঢুকলেন শশাঙ্ক। দরজার পাশে টেলিফোনের টেবিলের ওপর ব্যাগটা রেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার অনেক প্রশ্ন করবার আছে তো? আমি জানি। সব জবাব পাবে। আগে বলো, এই ভিজে জুতো আর ছাতা রাখব কোথায়?’

বীথি সামান্য বিস্ফারিত চোখে শশাঙ্ককে দেখছিলেন। তেতাল্লিশ বছর বয়েস অথচ এর মধ্যেই চুলদাড়ি বেশ পেকে গেছে, চোখে চশমা উঠেছে। তবে, সেই অসাধারণ স্বাস্থ্যটি অটুট রয়েছে, টোল খায়নি একেবারেই। হরিমোহনপুরের দিগন্তবিস্তৃত ধান খেতের আলের ওপর দিয়ে হো হো করে দৌড়োনো, ক্যানালের জলে সাঁতার কাটা, আম গাছে উঠে ঘুড়ি পাড়া আর বড়ো দরগার রুক্ষ মাঠে সারাবছর ফুটবল খেলা যে স্বাস্থ্য তৈরি করে দেয়, তাকে নষ্ট করা সহজ ব্যাপার নয়।

শশাঙ্কের প্রশ্ন শুনে বীথি বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি।’ বলে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হল ছেলেমানুষের মতো দৌড়ে যেতে কিন্তু পারলেন না, দেখলেন পায়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে। বাথরুম থেকে একটা লাল প্লাস্টিকের বালতি এনে শশাঙ্কের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভিজে জুতোজোড়া আর ছাতাটা এর মধ্যে রাখো।’

শশাঙ্কের ঠোঁটের কোণে একটা তীক্ষ্ন ছুরির মতো বাঁকা হাসি খেলে গেল। বললেন, ‘আমার প্যান্টটাও কিন্তু ভিজে গেছে।’

বীথির বুকের ভেতরে একটা আকাশ-ফাটানো বাজ পড়ল। ওঁর কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ভিজুক গিয়ে। ফ্যানের নীচে বসো, এক্ষুনি শুকিয়ে যাবে।’

জুতো আর ছাতা বালতিতে রেখে শশাঙ্ক হাসতে হাসতে একটা সোফায় গিয়ে বসলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। কত বছর বাদে দেখা হল বলো তো? বিশ বছর হবে। এখনও কিন্তু আমাকে বকুনি দেবার তোমার অভ্যেসটি পালটায়নি।’

বীথি ততক্ষণে ফিরেগেছন তাঁর রকিং চেয়ারে। বললেন, ‘বকুনি দেব না তো কী করব? তোমারও তো বাজে কথা বলার অভ্যেস পালটায়নি দেখছি।’

শশাঙ্ক সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে, ভালো করে হেলান দিয়ে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এবার তোমার কী কী প্রশ্ন করবার আছে করে ফ্যালো। তারপরে, আমি আমার প্রশ্নমালা বের করব।’

বীথি বললেন, ‘আমার আর কী প্রশ্ন! কোথায় আছ, কী করছ, ছেলেপুলে ক-টি, কী করে তারা— এই তো।’

‘বেশ। তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, আছি গৌরদাস লাহা রোডে হিমশিখর অ্যাপার্টমেন্টে। এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। একটা ফ্ল্যাট কিনেছি সেখানে। বছর খানেক হল। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, রুগি মারছি আর পয়সা কামাচ্ছি। হিমশিখরের একতলাতেই আমার চেম্বার। তৃতীয় উত্তর, ছেলেপুলে নেই, কারণ বিয়ে করিনি।’

‘বিয়ে করনি? কেন?’

‘এ প্রশ্নের উত্তর তো তোমার না জানার কথা নয়, বীথি। হরিমোহনপুরকে যদি ভুলে গিয়ে থাকো, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।’

‘হরিমোহনপুরকে ভুলিনি শশাঙ্কদা, ভোলা সম্ভবও নয়। কিন্তু তার জন্যে—’

বাধা দিয়ে শশাঙ্ক বললেন, ‘এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই বীথি। যা হবার নয়, তা হয়নি। ক-টা বছরই বা ছিলুম বিলেতে! তিনবছর, তার বেশি তো নয়। সেই তিনবছরের প্রত্যেকটা দিন আমি বেঁচে থাকতে পেরেছি কেবল হরিমোহনপুরের স্মৃতিটাকে বুকের ভেতর আঁকড়ে রেখে। প্রচণ্ড শীতে সেই আমাকে জুগিয়েছে উত্তাপ, নিঃসঙ্গতায় প্রাণ-ভরানো গান, ক্লান্তিতে নতুন করে লড়াই করার উদ্যম। যখন ফিরে এলুম, দেখলুম আমার সেই স্মৃতির হরিমোহনপুর ছিন্নভিন্ন হয়ে কোথায় মিলেয়ে গেছে, তার আর চিহ্নমাত্র নেই। জানো, তোমার যে বিয়ে হয়ে গেছে সে খবরটা পর্যন্ত আমাকে কেউ দেয়নি।’

বীথির গলার কাছে কী যেন একটা কঠিন জিনিস আটকে আছে, গলা দিয়ে স্বর বেরুতে অসুবিধে হচ্ছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোরকমে ঢোঁক গিলে সেটাকে একটু নীচে নামিয়ে বললেন, ‘ওঁরা কেউ জানতেন না শশাঙ্কদা। মা কাউকে জানায়নি। তুমি বিলেত যাবার দশদিনের মধ্যে বাবা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন আর সেই আঘাতে মা কীরকম যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। আমিও ভাবতে পারিনি যে তার একমাসের মধ্যে সমস্ত টাকাপয়সা বুঝিয়ে দিয়ে সোমারভিল কেমিক্যাল আমাদের ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমরা তখন অকূল-পাথারে। আর একটা মাস থাকবার অনুমতির জন্যে হেন লোক নেই যার কাছে আমরা দরবার করিনি। কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। কেউ এগিয়ে এসে একজন সামান্য সুপারভাইজারের স্ত্রী আর মেয়েকে সাহায্যের হাত বাড়ানো প্রয়োজন মনে করেনি, এমনকী কিছু বাড়তি মালপত্র কয়েক দিনের জন্য রাখার দায়িত্ব পর্যন্ত কেউ নিতে চায়নি। ফলে, মালপত্র নিয়ে আমরা যখন হাওড়া স্টেশনে এসে নামলুম, তখনও জানি না কোথায় গিয়ে উঠব। সেই রাগে মা হরিমোহনপুরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল।’

শশাঙ্ক বললেন, ‘আমি এরকমই কিছু অনুমান করেছিলুম। কিন্তু তোমার যখন বিয়ে ঠিক হল, তখন তুমি একবার হরিমোহনপুরে আমার বাবা-মার কাছে গেলে না কেন?’

‘গিয়েছিলুম শশাঙ্কদা, সব লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে গিয়েছিলুম। ওঁরা আমার সঙ্গে খুবই সস্নেহ ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তোমার ঠিকানা দেননি। বলেছিলেন, হারিয়ে গেছে। এরপর, আমার আর কিছু করবার ছিল না। যদিও আজ বলা নিরর্থক, তবু তার কারণটা তোমাকে বলছি। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে, আমরা জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলুম আশ্রয়ের সন্ধানে। জ্যাঠাইমা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, ওখানে আমাদের স্থান হবে না। সেখান থেকে মা-র বড়োমামার কাছে। সেখানে থাকতে পেলুম। সেটা যে কত বড়ো পাওয়া, যাদের সামনে একমাত্র বিকল্প ফুটপাথ— তারা ছাড়া আর কেউ তা বুঝতে পারবে না। তাই, আমার মামাতো ভাই শম্ভুদার স্ত্রী নন্দাবউদি যখন তার মাসতুতো ভাই গৌতমের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব আনল, তখন সেটা অস্বীকার করবার মতো ক্ষমতা আমাদের ছিল না। সদ্য বিএ পাশ করা কুড়িবছর বয়েসের একটি মেয়ের পক্ষে বিদ্রোহ করা তখন আত্মহত্যারই নামান্তর হত। পায়ের তলায় যেটুকু সামান্য মাটি সেটা যেকোনো মূল্যে আঁকড়ে থাকাই তখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমার মা-র কথা ভেবে আমাকে রাজি হতে হয়েছিল।’

শশাঙ্ক ফিকে হাসলেন। বললেন, ‘হয়তো ভালোই করেছিলে যে, আমার কথাটা আর ভাবোনি। আমি আজ সেইজন্যে আর কিছু না-হোক, মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে থাকতে পারছি। কিন্তু মুক্তি আমি চাইনি বীথি, আমি বন্ধনই চেয়েছিলুম। সেই সোনার খাঁচাটার সন্ধানে বিলেত থেকে ফিরে পাগলের মতো কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কত লোকের কাছে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনেছি, কত জায়গায় মার খেতে খেতে বেঁচে গেছি। তবু, সেই খোঁজা তো আজও বন্ধ হল না। কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলে থমকে দাঁড়াই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার মুখে আর একটা মুখ খুঁজি। লোকে ভাবে আমি দুশ্চরিত্র বদমাশ। আমি কেয়ার করিনে।’

‘কাকে তুমি খুঁজছ, শশাঙ্কদা? সেই বীথি তো আর নেই। হরিমোহনপুরের মতো সেও তো আজ কেবল একটা স্মৃতি।’

‘না, হরিমোহনপুর আমার কাছে কেবল একটা স্মৃতি নয়, বীথি। আমার বেঁচে থাকার জন্য দরকারি অন্যান্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মতোই তা বাস্তব। আমি তাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারি। বিশেষ করে যবে থেকে রাজলক্ষ্মী কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একটি দু-বিনুনি করা শান্তশিষ্ট মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা, তবে থেকে আমার জীবনের সঙ্গে সে তো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তাকে কেবল একটা স্মৃতি বলে এড়িয়ে যাব, তার কি উপায় আছে?’

বীথির মনে হল, যেন তাঁর ঘরের সুস্থ, মসৃণ আর কঠিন দেওয়ালগুলো আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। তাদের আটকানো দরকার, কিন্তু আটকাবেন কী করে? তাদের ভিতগুলো যে কবে নড়বড়ে হয়ে গেছে, টেরই পাননি। কীসের যেন একটা ঘুণপোকা তাঁর অজান্তে তাদের কুরেকুরে খেয়ে ফেলেছে। অথচ, দেওয়ালগুলো না থাকলে অনভ্যস্ত আকাশের নীচে বাঁচতে পারবেন কি? তাই বীথি নিজেকে দিয়ে বলালেন, ‘ওসব কথা থাক, শশাঙ্কদা। তার চেয়ে বলো, আমার ঠিকানা পেলে কোত্থেকে।’

শশাঙ্ক হাসলেন। বললেন, ‘চেষ্টায় কী না হয়, কী না হয় শেষটায়! তোমাদের এই বাড়িতে আমার এক রুগিনী আছেন। দিন দশেক আগে তাঁকে দেখতে এসে, তোমাকে দেখলুম গাড়ি থেকে নামতে। তোমাকে চিনতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি, জানো? রবীন্দ্রনাথের ক্ষ্যাপা পরশপাথর চিনতে পারেনি, এই ক্ষ্যাপা কিন্তু পারল। শুধু একটু মোটা হয়েছ, এই যা। তোমার সব খবর আমার সেই রুগিনীই দিলেন। তোমার গৃহকর্তার বদলির চাকরি, এতদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে বছর খানেক আগে এসেছেন কলকাতার হেড অফিসে। তাঁর রিটায়ারমেন্টের আগে এটাই বোধ হয় শেষ পোস্টিং। মাসছয়েক আগে এই ফ্ল্যাটটা কিনে এখানে এসেছেন। তোমাদের ভারতবর্ষের অনেক শহরেই ঘুরতে হয়েছে। তোমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে পুনায়, মেয়ে পড়ছে দিল্লির মিরান্দা হাউসে। পরিপূর্ণ সংসার।’

গলার মধ্যে শব্দ করে হাসলেন বীথি। বললেন, ‘হ্যাঁ, পরিপূর্ণ সংসারই বটে। ছেলে-মেয়ে দুটো সারাজীবনই কাটাল হস্টেলে, হাজব্যান্ড মাসের মধ্যে পনেরো দিন টুরে। আমি উৎকণ্ঠ হয়ে এই পরিপূর্ণ সংসার সাজিয়ে বসে থাকি কে কবে কখন এসে আমাকে ধন্য করবে সেই আশায়। আজ আমার সব ভালোবাসা, স্নেহ, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা আটকে রয়েছে এ বাড়ির কতগুলো ফোটো-অ্যালবামের হলদে হয়ে আসা ছবির ভেতরে।’

শশাঙ্ক গম্ভীর হয়ে গেলেন। চশমাটা খুলে মুখের ওপর হাত বুলিয়ে বললেন, ‘জানো বীথি, আমি চিরকাল ভাবতুম, এখনও ভাবি, যে তোমার আর যাই কিছু প্রাপ্য হোক না কেন, সেটা নিঃসঙ্গতা নয়। অনেকে হয়তো তোমাকে জানে সুন্দর, শান্ত, গম্ভীর আর অন্তর্মুখী বলে। কিন্তু আমি জানি, তোমার মধ্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছে একটা পাগলা ঘোড়া। বেড়া ভেঙে মুক্ত মাঠের ওপর বেরিয়ে এলে তার উদ্দাম উল্লাস আর হৃষ্ট হ্রেষা আমি যে আজও শুনতে পাই।’

বীথির সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। অতীতের তীর থেকে ভেসে আসা ঝরাফুলের কান্নায় তাঁর দু-চোখ জলে ভরে এল, আপ্রাণ চেষ্টা করেও তা ঠেকাতে পারলেন না। একটু সামলে নিয়ে কোনোরকমে বললেন, ‘যা হারিয়ে যায়, তাকে আগলে বসে থেকে কী লাভ, শশাঙ্কদা? আজ তুমিও কি নিঃসঙ্গ নও? আমিও তো জানি যে তোমার ওই শিক্ষিত, সভ্য, ভদ্র, পরিচ্ছন্ন ওপরের খোলসটার ভেতরে একটা আদিম বন্য হিংস্র মানুষ লুকিয়ে রয়েছে, যে সবকিছু নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নেয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাঁধভাঙা বন্যার মতো। আজ তো সে সবই পুরোনো কথা। যে লতার গোড়াটাই কাটা গেছে, তাতে কি আর ফুল ফুটতে পারে?’

‘আমার নিঃসঙ্গতার কথা বাদ দাও। সেটা ভেতরের, তাকে ছোঁওয়া যায় না। আমার তো কাজ আছে, বাইরের পৃথিবীটা আছে। অথচ তোমার একাকিত্বটা যেন তোমাকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। তোমার ভেতরের পাগলা ঘোড়াটাকে সে তো কিছুতেই বাইরে আসতে দেবে না। জানো বীথি, ওই বুনো লোকটা যদি সেই ঘোড়াটাকে পেত, তবে সে হুংকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলত, সবাই সাবধান, ঘূর্ণিঝড়ের মতো আমরা আসছি, তোমরা আমাদের অভ্যর্থনা না করতে পারো— অগ্রাহ্য করতে পারবে না।’

শশাঙ্ক সেন্টার টেবিল থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বীথির কাছে এগিয়ে এসে ওঁর আর্দ্র মুখটা দু-হাতে উঁচু করে তুলে ধরে ঠোঁটের ওপরে একটা অসাধারণ চুমু খেলেন। কোনো বাধা দিতে পারলেন না বীথি; অথবা দিলেন না। ব্যাপারটা আকস্মিক হলেও তাঁর মনের অনেকটা গভীরে বোধ হয় অপ্রত্যাশিত ছিল না।

কিছুক্ষণ বাদে বীথির মুখের ওপর থেকে মুখ সরিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন শশাঙ্ক। যেন বৃষ্টির দৃশ্য দেখতে দেখতে বললেন, ‘তোমার ঠাকুমার শোবার ঘরটা মনে পড়ে, বীথি? উনি মারা যাবার পর ওই ঘরেই আমাদের প্রথম প্রকৃত ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।’

বীথির সমস্ত দেহ তখন শিথিল, থরথর করে কাঁপছে। অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘মনে পড়ে, শশাঙ্কদা।’

‘ওই যে তুমি প্রশ্ন করলে না যে, যে লতার গোড়াটাই কাটা গেছে, তাতে কি আর ফুল ফুটতে পারে, তার উত্তর হল পারে। সেটা মনের ব্যাপার, বাগানের নয়। আসল কথা কি জানো, আমাদের মনটা ওই শোবার ঘরের মতো। সেখানে সব অসম্ভবই সম্ভব হয়। আমরা বন্ধ দরজার বাইরে একরকম, ভেতরে বোধ হয় একেবারেই অন্যরকম। যে ভীরু কিশোরীটি সবার কাছ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সবসময় নিজেকে আঁচল দিয়ে ঘিরে রাখে, সে-ই শোবার ঘরের ভেতরে অক্লেশে উলঙ্গ হয়, নিজেকে নির্ভয়ে নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে চায়। একটা নার্ভাস আনাড়ি ছেলে তার নিজের মধ্যে খুঁজে পায় তার অন্তর্গত দুর্দমনীয় পৌরুষকে। এর মধ্যে কোনটা যে কার আসল রূপ, তা আমি জানি না। বোধ হয়, দুটো মিলেই আমাদের বেঁচে থাকা। তবে, একটা ব্যাপার বড়ো অদ্ভুত। শোবার ঘরের বাইরে, বিশাল পৃথিবীতে আমাদের আনাগোনা একটা নিতান্ত ছোট্ট গণ্ডির ভেতরে। অথচ দ্যাখো, ওই চার দেওয়ালের মধ্যে আমরা সীমাহীন আকাশটাকে টেনে নামিয়ে আনতে পারি, আনতে পারি সমুদ্রের উচ্ছ্বাস, বসন্তের সুগন্ধ অথবা মৃত্যুর প্রশান্তি। পারি না?’

‘আমি আর পারি না, শশাঙ্কদা। তোমার পাগলা ঘোড়া ছ্যাকড়াগাড়ি টেনে টেনে আজ বুড়ো হয়ে গেছে, তার শোবার ঘর শুধু সারাদিনের শেষে ঘুমিয়ে পড়বার জায়গা। আকাশ, সমুদ্র, বসন্ত— এসব আর নেই। যা আছে সেটা শুধুই ক্লান্তি।’

‘এটা ঠিক নয়, বীথি। আমিও এতদিন এরকম কথাই ভাবতুম। মনে হত, সব বুঝি শেষ হয়ে মিলিয়ে গেছে। আবার তোমাকে দেখে পর্যন্ত মনে হচ্ছে, এই ক্লান্তিটা মিথ্যে। তাদের বয়েস যাই হোক না কেন, দুটো তারার সংঘর্ষে সারা আকাশ জুড়ে আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়বেই, দু-টুকরো কাঠের ঘষায় দাবানল জ্বলে উঠবেই। এসো বীথি, এই প্রাণহীন, হৃদয়হীন, দিনগত পাপক্ষয়ের মধ্যে আবার আমরা হরিমোহনপুরের একটা বর্ষণমুখর দিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’

বীথি শুনেছিলেন যে রেললাইনের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো লোক যখন একটা ইঞ্জিনকে তার দিকে ছুটে আসতে দ্যাখে, তখন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সে অসহায়ভাবে অনড় হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে— পালাতে চাইলেও পালাতে পারে না। তাঁর মনে হতে লাগল যেন, ঠিক সেইরকম কোনো সুদূর দিগন্তে বিলীন হয়ে যাওয়া রেললাইন দিয়ে অনেক কষ্টে তৈরি করা নিরাপদ অন্ধকার ভেদ করে তাঁর প্রথম যৌবনের এক তীব্র জ্বালা, চোখধাঁধানো আলো জ্বেলে ভয়ংকর গতিতে তাঁর দিকে ছুটে আসছে। তিনি জানেন, ওই আলোর মধ্যে তিনি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন, তবু পালাতে পারছেন না তো! তিনি কি পালাতে চান, অস্বীকার করতে চান ওই চোখ অন্ধ করে দেওয়া আলোটাকে? সে বিচারে যাওয়ার আগে তাঁর রক্তের ভেতরে মিশে থাকা হাজার বছরের সংস্কার তাঁকে দিয়ে বলাল, ‘তা হয় না, শশাঙ্কদা। এটা অন্যায়, অনুচিত। আমরা যে পালটে গেছি— সেটা তো অস্বীকার করা চলে না।’

‘ন্যায়-অন্যায় বা উচিত-অনুচিতের কথা আমাকে বোলো না, বীথি। আমরা যেদিন ঘনিষ্ঠ হয়েছিলুম, সেদিন ওসব কথা বিবেচনা করিনি, আজ কেন তা করতে যাব! পালটে গেছি আমরা? আমার ডান কাঁধে পাঁচটা সেলাই-এর দাগ আছে, তোমার মনে পড়ে? কই, সেটা তো পালটায়নি! তোমার নাভির ঠিক পাশে একটা লাল তিল ছিল। সেটা কি পালটেছে? আমাদের বুকের ভেতরে ভালোবাসা, সাহচর্য আর সুখের জন্যে যে উজ্জ্বল বাসনাটা ছিল, সেটা পালটেছে? আর, সমাজের প্রতি কর্তব্য? যা সত্যি, যা একান্ত অবশ্যম্ভাবী, তাকে অস্বীকার করাটা মূর্খতা, কর্তব্যপালন নয়। এসো, বীথি, চলো, আমরা শোবার ঘরে যাই। আমি দরজাটা খুলে রাখব, তোমাকে আসতে হবে— আসতেই হবে।’

শশাঙ্ক দীর্ঘ এবং দৃঢ় পদক্ষেপে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, দরজাটা খুলে দিলেন হাট করে। বীথি নিজেকে আটকে না-রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় চোখ বুজে তাঁর কম্পিত শরীর আর মনকে আয়ত্তে আনার চেষ্টায় নিজেকে ব্যাপৃত করলেন।

হঠাৎ আবার একটা দীর্ঘ কর্কশ ঘণ্টির শব্দে চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বীথি। তাঁর বুকের ভেতরে একটা ভয়ংকর আতঙ্ক ধড়ফড় করে উঠল। এবার নিশ্চয়ই গৌতম। কিন্তু দরজার বাইরে যেন অনেকগুলো মেয়েলি গলায় উত্তেজিত কোলাহল শুনলেন। চট করে শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার দরজা বন্ধ রয়েছে। ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজার একপাশে টেলিফোন টেবিলের ওপর কোনো ব্যাগের চিহ্নমাত্র নেই, অন্যপাশে লাল প্লাস্টিকের বালতিও নেই। তবে কি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন? কী অদ্ভুত জীবন্ত স্বপ্ন! এখনও যেন তাঁর মুখের ওপর আর একটা সুগন্ধী মুখের স্পর্শ লেগে রয়েছে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দরজা খুললেন বীথি।

করিডরে পাঁচতলার যাবতীয় ফ্ল্যাটের মহিলাদের উত্তেজিত জটলা। পুনরায় বেল বাজানোর জন্য উদ্যত পাঁচ-শো তিনের দীপ্তি ঘোষ বললেন, ‘এই যে! ঘুমুচ্ছিলি, না? চোখ মুখ ফোলাফোলা দেখছি। কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি। এদিকে এ বাড়িতে যে কত ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তার খোঁজ রাখিস?’

বীথি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘ভয়ংকর ঘটনা! কী হয়েছে?’

‘একটা মারাত্মক খুনি এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। একগাদা পুলিশ সারা বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে। এখন প্রত্যেক ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঢুকে তল্লাশি চালাচ্ছে।’

পাঁচ-শো ছয়ের আলপনা মৈত্র চোখ গোল গোল করে বলল, ‘হ্যাঁ বীথিদি, লোকটা নাকি সাইকোপ্যাথিক মার্ডারার। আমার ননদ একটু আগে কলেজ থেকে ফিরেছে। নীচের থেকে শুনে এসেছে।’

এই কথার মধ্যে ভিজে ছাতা ঝাড়তে ঝাড়তে লিফট থেকে বেরুলেন পাঁচ-শো আটের রণদেব হাজরা। বছর-দুয়েক হল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বেরিয়েই ভিড় দেখে বললেন, ‘একী, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? যান, যে যার ফ্ল্যাটে চলে যান। এক্ষুনি পুলিশ এসে পড়বে।’

আলপনা বলল, ‘যাচ্ছি মেশোমশাই। তবে, আগে শুনি আপনি নীচের থেকে কী শুনে এলেন। তিস্তা বলল, লোকটা নাকি সাইকোপ্যাথিক মার্ডারার।’

রণদেব বললেন, ‘আমি নীচে ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের দু-জন অফিসারের কাছে যা শুনে এসেছি, বলছি—’

ভিড়টা রণদেবের চারদিকে ঘন হয়ে এল। রণদেব বললেন, ‘আমিও তাই শুনলুম। লোকটা ডাক্তার, বিলিতি ডিগ্রি আছে, হার্ট স্পেশালিস্ট আর সাক্ষাৎ শয়তান। রুগিদের বাঁচানোর চেয়ে মারার দিকেই তার ঝোঁকটা বেশি। অন্তত দু-জন রুগি আর ছ-জন রুগিনি, যাঁরা সঙ্গে কাউকে না-নিয়ে একা তার হিমশিখর অ্যাপার্টমেন্টের চেম্বারে গিয়েছিলেন, তাঁরা নিখোঁজ। এঁদের সকলেরই জীবনের ইতিহাস আবার এমনই যে, ডাক্তার দিব্যি তার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গেছে। সে নাকি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলায় মহা ওস্তাদ। এঁদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে যখন চেম্বারে কেউ নেই সেইসময় নিয়ে এসে খুন করেছে। পরে তাঁদের কয়েক জনের মৃতদেহ কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ আবিষ্কার করে। এর প্রথম স্ত্রীও নিখোঁজ। ডাক্তার বলে, সে নাকি তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে। তবে পুলিশের ধারণা অন্যরকম। দু-নম্বর স্ত্রী আর তার মা-কে তো একেবারে গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া যায় নৈহাটি স্টেশনে রেললাইনের ধারে। কিন্তু ডাক্তার এমন অকাট্য অ্যালিবাই তৈরি করে যে পুলিশ তাকে ছুঁতেই পারে না। তিন নম্বরটা শুনলুম এখনও টিকে আছে। আজ সকালেও ব্যাটা একজন রুগিনীকে চেম্বারে নিয়ে এসে তাঁকে ধর্ষণ করেছিল। পরে অবশ্যই তাঁকেও হারিয়ে যেতে হত। তা, সেইসময় একজন ইলেকট্রিশিয়ান ঘটনাটা দেখে ফেলে। সে গিয়ে সেই কমপ্লেক্সের সবাইকে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।’

দীপ্তি বললেন, ‘তা ওখান থেকে সবাই মিলে আমাদের এখানে চলে এল কী করে? যত ঝামেলা!’

‘আগে শুনুন তো। ডাক্তার বিপদ আঁচ করে ফেলে। পুলিশ তো অনেকদিনই তক্কে তক্কে ছিল। তারা হুড়মুড় করে এসে পড়ে দেখে যে, সে গাড়ি নিয়ে পালাচ্ছে। তারাও তখন তার পেছনে ছোটে। লোকটা তখন উপায়ান্ত না-দেখে এখানে ঢুকে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। পুলিশও সঙ্গেসঙ্গে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে তার সব পালাবার রাস্তা বন্ধ করে দেয়। অতএব, এমন ইঁদুরকলে পড়ে লোকটা এখনও যে এ বাড়িতেই আছে তাতে সন্দেহ নেই। কাজেই, আপনাদের কর্তব্য হল, নিজের নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে পুলিশের অপেক্ষা করা আর যতক্ষণ তারা না আসছে ততক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখা।’

ঠিক এইসময় সিঁড়িতে অনেকগুলো ভারী জুতোর দুপদাপ আওয়াজ পাওয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যে করিডর ফাঁকা হয়ে গেল, কেবল তাঁর ফ্ল্যাটের খোলা দরজার সামনে স্তম্ভিত বীথি প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

উদ্যত রিভলবার হাতে একজন পুলিশ অফিসার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন, সঙ্গে তিনজন রাইফেলধারী কনস্টেবল। সামনেই বীথিকে দেখে তড়বড় করে বলে গেলেন, ‘ম্যাডাম, আপনার ফ্ল্যাটে কি ব্লু শার্ট আর গ্রে ট্রাউজার্স পরা, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে সেইরকম ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে চশমা, ডাক্তারের ব্যাগ হাতে, শশাঙ্কশেখর মিত্র বলে কোনো লোক একটু অগে এসে ঢুকেছে?’

নিঃশব্দে ভাবলেশহীন মুখে যন্ত্রচালিতের মতো হাত তুলে শোবার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন বীথি।

1 Comment
Collapse Comments

কেউ কি আসলে ঘটনাটি কী ব্যাখ্যা করতে পারেন? বীথি কি স্বপ্ন দেখছিল পুরোটাই? যদি স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে বীথি শশাঙ্ক এর ব্যাপারে, তার পোশাক-পরিচ্ছদ এর ব্যাপারে কীভাবে জানলো? আর যদি সত্যি হয় তাহলে দড়জা কেনো বন্ধ ছিল? বা বালতি,ব্যাগ ই বা কোথায় গেলো? প্রতিবেশীরা কেনো ঘুমের কথা বললো? অনুগ্রহ করে কেউ ব্যাখ্যা করলে উপকৃত হতাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *