রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান-সমাজ

রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান-সমাজ

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

আজকের দিন বাংলাদেশের পক্ষে যে এক দুর্দিন সে কথা অনেকেই বলে থাকেন। হয়ত মিথ্যা বলেন না। এমন একটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, অবিশ্বাস, এমন কি শক্রতা, আজ বাংলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এই পরিমণ্ডলে বাস করা ভদ্ৰব্যক্তিদের পক্ষে রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তবে আর একদিক দিয়ে দেখতে গেলে বর্তমানের এই অস্বস্তিকর অবস্থা মনে হয় ভালই। ফোঁড়া যখন পেকে ওঠে তখনকার যন্ত্রণা অসহ্য, কিন্তু সেই সঙ্গে সান্ত্বনাও পাওয়া যায় যে, বেদনার অবসান হতে দেরী হবে না।

এই দিনে কোনো কোনো শিক্ষিত মুসলমান বাঙালির মুখেও শুনতে পাওয়া গেছে এই প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ একজন অতি বড় কবি, মহামানব, বিশ্বপ্রেমিক, কিন্তু তার বাড়ির কাছের মুসলমানদের জন্য তিনি কি করেছেন?

এরূপ প্রশ্ন বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু একবার একজন শ্রদ্ধেয় মুসলিম সাহিত্যিক এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছিলেন তা মনে রাখবার মতো; তিনি বলেছিলেন : আকাশের সূর্য মুসলমানের জন্য বিশেষ কি করেছে? [‘আমাদের দুঃখ’ প্রণেতা আনোয়ারুল কাদীর]

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের সমালোচকদের উক্তির এইই হয়ত শ্রেষ্ঠ প্রত্যুত্তর। কবি আকাশের সূর্যের মতোই একজন সহজ মানব বন্ধু। অবশ্য যেহেতু কবি একজন মানুষ, এক বিশেষ পরিবেষ্টনের সৃষ্টি, সেজন্যে অত্যন্ত কাছে থেকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আলোকের উৎস সূর্যেও ধরা পড়ে কালো দাগ। যে গোলাপ সৌষ্ঠব আর গন্ধে অতুলনীয় তার স্পর্শ লোভাতুর লাভ করে হাতে কাটার আঘাত। কিন্তু কালো দাগ সত্ত্বেও সূর্য সূর্যই। কাঁটা সত্ত্বেও গোলাপ গোলাপই। এক বিশেষ পরিবেষ্টনে জন্ম সত্ত্বেও কবি চিরন্তন মানব– তাঁর পরিবেষ্টনের সমস্ত সীমারেখা অবলীলাক্রমের অতিক্রম করে তাতে উৎসারিত হয় মানুষের চিরন্তন সুখ, চিরন্তন দুঃখ, চিরন্তন প্রেম, চিরন্তন অভয়। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি, এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ, সেজন্যে মুসলমান তার আজকার বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু নন।

কিন্তু চিরন্তন যদি সত্য হয়, যা স্থানিক ও কালিক তাও তা মিথ্যা নয়। আজকের এই বিশেষ যুগে কবি-রবীন্দ্রনাথের মুসলিম দেশ-ভ্রাতাদের মনে এই অকরুণ প্রশ্ন জেগে থাকে যে তিনি তাঁদের কোন কাজে লেগেছেন, তবে সত্য জিজ্ঞাসুকে সে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের মুসলমান প্রতিবেশীর মনে জেগেছে প্রধানত দুটি কারণে, প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবি নন; বিশেষভাবে একজন ভারতীয় কবিও বটে। সেই ভারতীয়তার রূপ দান করতে গিয়ে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু মনোরম চিত্রও তিনি অঙ্কিত করেছেন, তাঁর সেই সব সৃষ্টি হিন্দুকে শুধু আনন্দিতই করেনি, গর্বিতও করেছে।

দ্বিতীয়ত, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিগত বিরূপতা না থাকলেও, এমন কি অল্পাধিক অনুরাগ সত্ত্বেও, সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তিনি প্রায় মৌনীই রয়েছেন তার সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে।

খুব সহজভাবে এই ব্যাপারের এই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, শিল্পীর তুলিকার অবলম্বন হয় যে-সমস্তের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় হয় সেই-সব। হয়ত তাঁর প্রতিদিনের পরিচিত মুখ তাঁর তুলিকায় ধরা পড়ে না, কিন্তু ক্ষণিকের দেখা এক আধ পরিচিত মুখ তার অন্তরে চাঞ্চল্য জাগায় দীর্ঘ দিন ও দীর্ঘ রাত্রি। শিল্পীর এই পক্ষপাতের তত্ত্ব দুরধিগম্য। কিন্তু হয়ত প্রশ্ন হবে, রবীন্দ্রনাথ তো শুধু শিল্পী নন, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ জীবন-সমালোচক। সে-ক্ষেত্রে তাঁর দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তাঁর প্রায় তুষ্ণীম্ভাব অদ্ভুত নয় কি?

এ প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথের একদল অনুরাগী এই কৈফিয়ৎ দিয়ে থাকেন, যে মুসলমান সাধারণত সমালোচক-অসহিষ্ণু। এরূপক্ষেত্রে আলোচনা বা সমালোচনার পক্ষে যে অবাঞ্ছিত কলহ অপরিহার্য রবীন্দ্রনাথের রুচি তাঁকে সে পথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করেছে। কিন্তু এই কৈফিয়ৎ বড় দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর সমালোচনাও কম করেননি, এবং সে-ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর কলহ তিনি যে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন ঠিক তা নয়। হয়ত তিনি এড়িয়ে যেতে চানও নি, চাইলে এই বাণী তার জন্য অসত্য হত।

যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য বলি’ উঠে বর খড়গ সম…..

বস্তুত তার দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তিনি যে কম আলোচনা করেছেন তা নয়, অন্তত, তিনি যে আলোচনা করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান ধর্মের প্রতি অথবা পরধর্মের প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘সতী’ নাটিকায় তা তুলনাহীন। ভারতের মুসলমান দোষ ও গুণ দুই-ই তাঁর আলোচনার বিষয় হয়েছে। [দ্রঃ আত্মশক্তি ও আধুনিক সাহিত্য।] বিশেষত ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমানের পার্থক্য কোথায় এবং ভারতীয় মুসলিম জীবনের সত্যকার পরিণতি কোন পথে সে-সম্বন্ধেও স্পষ্ট ভাষায় তিনি তার মতামত প্রকাশ করেছেন।[দ্রঃ আত্মপরিচয়ঃ পরিচয়।] তাঁর এই সব মত স্বীকার্য কি অস্বীকার্য তার চাইতেও বড় কথা এই যে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই তিনি এ-সব মতামত ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য মুসলমানের ধর্ম বা ধর্ম প্রবর্তক সম্বন্ধে কোন বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেন নি। তিনি যে কবি জগতের প্রাত্যহিক জীবনের সাহচর্য আর আত্ম অনুভূতি এই-ই যে তাঁর জীবনের রাজপথ– এ-বোধের সঞ্চার তাতে হয়েছিল তার প্রথম যৌবনে আর এই স্বধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হন নি কখনো। একজন ব্রাহ্মনেতার সন্তান হয়ে তিনি জন্মলাভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই পিতৃধর্মও তাঁর জন্য হয়েছিল এক প্রেরণার স্থল, পরিক্রমণের স্থল নয়। এ সম্বন্ধে তাঁর এই উক্তি স্মরণীয় :

……..ধর্ম সম্প্রদায় ব্যাপারটাকে আমরা কী চোখে দেখিব? তাহাকে এই বলিয়াই জানিতে হইবে যে, তাহা তৃষ্ণা মিটাইবার জল নহে, তাহা জল খাইবার পাত্র। সত্যকার তৃষ্ণা যাহার আছে, সে জলের জন্যই ব্যাকুল হইয়া ফিরে, সে উপযুক্ত সুযোগ পাইলে গভূষে করিয়াই পিপাসা নিবৃত্তি করে। কিন্তু যাহার পিপাসা নাই সে পাত্রটাকেই সবচেয়ে দামি বলিয়া জানে। সেই জন্যই জল কোথায় পড়িয়া থাকে, তাহার ঠিক ঠিকানা নাই, পাত্র লইয়া বিষম মারামারি বাধিয়া যায়। তখন যে-ধর্ম বিষয়বুদ্ধির ফাঁস আলগা করিবে বলিয়া আসিয়াছিল, তাহা জগতে একটা নূতনতর

বৈষয়িকতার সূক্ষ্মতার জাল সৃষ্টি করিয়া বসে, সে-জাল কাটানো শক্ত।[দ্রঃ চারিত্র পূজা] রবীন্দ্রনাথের নিজের ভিতরে সত্যের জন্য এই যে সহজাত তৃষ্ণা ছিল এই জন্যই হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সব সমাজেরই সত্যকার ধর্ম জিজ্ঞাসুদের তিনি পরম বন্ধু তা তিনি সেই সমস্ত ধর্মের বিশেষ আলোচনা ও অনুশীলন করুন আর নাই করুন। যে সমস্ত মুসলমান সমালোচক এই প্রশ্নের অবতারণা করেন রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের জন্য কি করেছেন, তাঁদের নিজেদের প্রথমে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত– মুসলমান কে, এবং কি সে চায়। যদি মুসলমানীর অর্থ এই হয় যে তা বিশেষ কতকগুলি অনড় মতবাদের সমষ্টি তবে সে মুসলমানীর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিছুই করেন নি। এই মুসলমানীর সমর্থন কোরআন, হজরত মোহাম্মদ, এবং যুগযুগান্তের মুসলিম শ্রেষ্ঠরাও করেন নি, বরং তার প্রতিবাদ করেছেন, যেমন মহামনীষী সাদী বলেছেন–

তরিকত ব-জূজ্‌ খেদমতে খালক নিস্‌ত
ব-তসবি ও সাজ্জাদা ও দল্‌ক নিস্‌ত।

সৃষ্টির সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়, তসবিহ জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নেই। অথবা যেমন কোরআনে বলা হয়েছে- আল্লাহ ভুল ধারণার জন্য মানুষ আল্লাহর রোষে পতিত হয় না, পতিত হয় দুষ্কৃতির জন্য (১১ঃ১১৭)।

কিন্তু মুসলমানীর অর্থ যদি হয় সত্যপ্রীতি, কাণ্ডজ্ঞান-প্রীতি, মানব-প্রীতি, জগৎপ্রীতি, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ, তবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় মুসলমান এ যুগে আর কেউ জন্মেছেন কি না সে কথা এই সব সমালোচকদের গভীর বিচার বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত।

দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় মুসলমান আজও ভুগছে একটি মানসিক বিকৃতি থেকে, ইংরেজিতে তাকে বলা হয় Inferiority complex. তারা সংখ্যায় অল্প, প্রভাবে খর্ব এই চেতনা তাদের অন্তরে সঞ্চারিত করেছে একটি মানসিক অস্বস্তি। এই মানসিক অস্বস্তির চশমার সাহায্যে জগৎকে যথাযথভাবে দেখা ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মানসিক অস্বস্তি যেদিন তার কেটে যাবে, তার পরিবর্তন তার অন্তরে সঞ্চারিত হবে অভয় ও আশা, সেদিন সহজেই সে বুঝবে দেশে দেশান্তরে মুসলমানদের মধ্যে অমুসলমানদের মধ্যে কোথায় তার পরম মিত্রেরা বাস করেছেন। সেদিনে আজকার একশ্রেণীর দুঃখী মুসলমানের এই যে প্রশ্ন– কবি ও বিশ্বপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য কি করেছেন, এটি তার অট্টহাসির সামগ্রী হবে।

১৩৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *