১৮. কৃষ্ণ-ভগিনী সুভদ্রা

কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা

অর্জুনের একক বনবাসের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি মণিপুর রাজ্যে গমন করেন এবং সেইখানে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তাঁর প্রণয়-পরিণয় ঘটে। পুত্র বভ্রুবাহনের জন্মের পর অর্জুন চিত্রাঙ্গদার নিকট প্রস্থান অনুমতি প্রার্থনা করেন। অর্জুন তিন বৎসরকাল মণিপুরে অবস্থান করেছিলেন।

অর্জুন মণিপুর ত্যাগ করে সখা কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দ্বারকায় উপস্থিত হন। সহস্র সহস্র দ্বারকাবাসী অর্জুনকে দেখার জন্য রাজপথে উপস্থিত হন। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় সকলেই অর্জুনের বিশেষ সম্মান করলেন। কুমারগণ অত্যন্ত আদরের সঙ্গে অর্জুনকে আপন আপন ভবনে নিয়ে যাবার জন্য আগ্রহ করতে লাগল; তখন অর্জুন সেই বৃষ্ণি কুমারগণকে বারবার আলিঙ্গন করে, বহু রত্ন ও খাদ্যসম্পন্ন মনোহর কৃষ্ণভবনে গিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে সেখানে অনেকদিন বাস করলেন। তারপরে কয়েকদিন অতীত হলে, বৈষ্ণব পর্বতে বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়গণের বার্ষিক উৎসব আরম্ভ হল। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় বীরগণ রৈবতকের সেই উৎসবে সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণকে নানাবিধ বস্তু দান করতে লাগলেন। রৈবতক পর্বতের সকল দিকেই রত্নবিচিত্রীকৃত বহুতর অট্টালিকা এবং কৃত্রিম কল্পবৃক্ষ দ্বারা সে-স্থানটি শোভিত হয়েছিল। বাদ্যকারেরা বাদ্য বাজাচ্ছিল, নর্তকেরা নৃত্য করছিল এবং গায়কেরা গান করছিল। বৃষ্ণিবংশীয় কুমারেরা অলংকৃত হয়ে স্বর্ণময় যানে আরোহণ করে সকলদিকে বারবার বিচরণ করতে লাগল। আর শত শত এবং সহস্র সহস্র পুরবাসীরা ভার্যা ও অনুচরবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাদচারে ও নানাবিধ যানে আরোহণ করে ভ্রমণ করতে থাকল। তারপরে বলরাম মদ্যপানে মত্ত হয়ে, রেবতীকে সঙ্গে নিয়ে বিচরণ করতে লাগলেন, গর্ন্ধবেরাও তাঁর সঙ্গে বেড়াতে থাকল। প্রতাপশালী বৃষ্ণিরাজ উগ্রসেন বহুতর স্ত্রী সঙ্গে করে ভ্রমণ করতে লাগলেন। তার পিছনে গন্ধর্বেরাও বিচরণ করতে লাগল। যুদ্ধদুর্ধর্ষ প্রদ্যুম্ন ও শাম্ব মদ্যপানে মত্ত হয়ে দিব্য মাল্য ও বস্ত্রপরিধান করে দুটি দেবতার ন্যায় বিচরণ করতে থাকলেন। অঙ্কুর, সারণ, গদ, বভ্রু, বিদূরথ, নিশঠ, চারুদেষ্ণ, পৃথু, বিপৃথু, সত্যক, সাত্যকি, ভঙ্গবার, মহারব, হার্দিক্য ও উদ্ভব— এরা এবং অন্যান্য অনেক লোক স্ত্রীগণ ও গর্ন্ধবগণে পরিবেষ্টিত হয়ে পৃথক পৃথকভাবে রৈবতক পর্বতে সেই উৎসবটিকে শোভিত করলেন।

সেই অত্যন্ত আশ্চর্য উৎসব চলতে থাকলে এবং তার মধ্যে নানাবিধ কৌতুক ব্যাপার হতে থাকলে কৃষ্ণ ও অর্জুন মিলিত হয়ে সকল দিকে বিচরণ করতে লাগলেন। তারা সেখানে বিচরণ করতে থেকে সুলক্ষণা ও অলংকৃতা বসুদেব কন্যা সুভদ্রাকে দেখতে পেলেন। সুভদ্রাকে দেখেই অর্জুনের কাম আবির্ভূত হল, তাই তিনি তাকে একাগ্রচিত্তে চিন্তা করতে লাগলেন, কৃষ্ণ তা লক্ষ করলেন। লক্ষ করেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “বনবাসীর মন কামে আলোড়িত হচ্ছে কেন? ইনি আমার ভগিনী, সারণের সহোদরা এবং আমার পিতার প্রিয়তমা কন্যা, এঁর নাম ‘সুভদ্রা’। ইনি তোমার পক্ষে মঙ্গলময়ীই হবেন। সুতরাং তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে আমি নিজেই পিতৃদেবকে বলব।” অর্জুন বললেন, “বসুদেবের কন্যা, বাসুদেবের ভগিনী, অথচ রূপবতী, সুতরাং ইনি কোন পুরুষকে না মোহিত করেন। অতএব কৃষ্ণ, তোমার এই ভগিনীটি যদি আমার ভার্যা হন, তবে নিশ্চয়ই আমার সর্বপ্রকার মঙ্গল হবে। কিন্তু একে পাবার উপায় কী, তা বলো। সে উপায় যদি মানুষের শক্তিসাধ্য হয়, তবে তা আমি অবলম্বন করব।” কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন, ক্ষত্রিয়ের স্বয়ংবর বিবাহ আছে বটে, তবে তা তোমার পক্ষে সন্দিগ্ধ। কেন-না, স্ত্রীলোকের স্বভাব অনিয়ত, হয়তো সুভদ্রা স্বয়ংবরে অন্য পুরুষকেও বরণ করে ফেলতে পারেন। তারপর, বিবাহের জন্য বীর ক্ষত্রিয়গণের বলপূর্বক কন্যাহরণও প্রশস্ত, ধর্মজ্ঞেরা তাই বলে থাকেন। অতএব অর্জুন, তুমি বলপূর্বক আমার ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করো। কারণ সে স্বয়ংবরে কাকে বরণ করবে তা কে জানে।”

তারপর অর্জুন ও কৃষ্ণ সুভদ্রাকে হরণ করবার বিষয়ে ইতিকর্তব্যতা স্থির করে, সে-বিষয়ে অনুমতি নেবার জন্য ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রুতগামী কয়েকটি লোক পাঠিয়ে দিলেন; যুধিষ্ঠির তাদের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনেই সে-বিষয়ে অনুমতি দিলেন। অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করার বিষয়ে কৃষ্ণের সম্মতি ও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি পেয়ে সুভদ্রা রৈবতক পর্বতে গিয়েছেন জেনে, তাঁকে হরণ করার ইতিকর্তব্যতার বিষয়ে কৃষ্ণের কাছে বলে, তারও অনুমতি পেয়ে আবারও তাঁর মত নিয়ে যাত্রা করলেন। সারথি কৃষ্ণেরই অনুমতিক্রমে একটি স্বর্ণময় রথ প্রস্তুত করে এনেছিল। তাতে শৈব্য ও সুগ্রীব নামে দুটি ঘোড়া সংযোজিত ছিল এবং কিঙ্কিণির মালা দুলছিল, আর ভিতরে সর্বপ্রকার অস্ত্র ছিল এবং সে-রথখানি প্রজ্বলিত অগ্নির মতো প্রকাশিত হচ্ছিল, মেঘের মতো গম্ভীর শব্দ করছিল এবং শত্রুপক্ষের আনন্দ নষ্ট করছিল। অর্জুন এহেন রথে আরোহণ করে, কবচ, খড়্গ, তল ও অঙ্গুলিত্র ধারণপূর্বক যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হয়ে সুভদ্রাকে হরণ করবার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলেন।

এদিকে সুভদ্রা সমস্ত দেবতার ও রৈবতকের পূজা সমাপ্ত করে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা স্বস্তিবাচন করিয়ে এবং রৈবতক পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে দ্বারকার দিকে গমন করতে লাগলেন, এমন সময়ে অর্জুন কামবাণে প্রপীড়িত হয়ে হঠাৎ গিয়ে সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রাকে বলপূর্বক রথে তুলে নিলেন। তারপর তিনি স্বর্ণখচিত রথে সেই মধুরহাসিনী সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে প্রস্থান করলেন।

অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে সেখানকার সৈন্যেরা কোলাহল করতে করতে দ্বারকানগরীর দিকে ধাবিত হল। তারা মিলিত হয়ে সুধর্মাসভায় গিয়ে, সভাপালের চারদিকে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে অর্জুনের বিক্রম সম্বন্ধে সমস্ত বৃত্তান্ত বলল। সভাপাল তাদের মুখে সেই বৃত্তান্ত শুনে, স্বর্ণখচিত বিশালাকৃতি যুদ্ধসজ্জাসূচক মহাভেরি বাজাতে লাগলেন। তখন সেই শব্দে উদ্বেলিত হয়ে ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় ভোজন ও পান পরিত্যাগ করে সকল দিক থেকেই আসতে লাগলেন। তারা সেখানে এসে মন্ত্রণা করবার জন্য স্বর্ণখচিত গদি ও আস্তরণযুক্ত, মণি ও প্রবালশোভিত এবং অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বলবর্ণ শত শত সিংহাসনে উপবেশন করলেন। তখন তাদের নিজ কিরণে উজ্জ্বল অগ্নির ন্যায় দেখা যেতে লাগল।

দেবগণের মতো তাঁরা সভায় উপবিষ্ট হলে, সভাপাল অনুচরবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের কাছে অর্জুনের ব্যবহারের কথা বললেন। তা শুনে বৃষ্ণিবংশীয় সেই বীরগণ ক্রোধে আরক্তনয়ন হয়ে, গর্ব প্রকাশ করতে থেকে, অর্জুনের ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে গাত্রোত্থান করলেন এবং অনেকে আদেশ করলেন যে, “সত্বর রথ প্রস্তুত করো এবং কুন্ত, ধনু, মহামূল্য কবচ আনয়ন করো।” কেউ কেউ উচ্চৈঃস্বরে সারথিগণকে ডাকতে লাগলেন, কেউ কেউ রথ প্রস্তুত করতে বললেন এবং কেউ কেউ নিজেরাই স্বর্ণভূষিত অশ্ব আনয়ন করে রথে যুক্ত করতে লাগলেন। অপরদিকে রথ, কবচ ও ধ্বজ প্রভৃতি আনয়ন করলে এবং মহা কোলাহল চলতে থাকলে, বীরগণ ছুটোছুটি করতে লাগলেন। তখন বনমালাধারী, মদ্যপানমত্ত, কৈলাসপর্বতের ন্যায় উন্নতদেহ এবং মদগর্বিত বলরাম বললেন, “হে মূঢ়গণ, কৃষ্ণ এখনও নীরব রয়েছেন, এ-অবস্থায় তাঁর অভিপ্রায় না জেনে ক্রুদ্ধ হয়ে বৃথা গর্জন করতে থেকে এটা কী করছ? প্রথমে মহামতি কৃষ্ণ নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করুন; তারপর তাঁর অভিপ্রেত অনুযায়ী তোমরা উদযোগী হয়ে কর্ম করো।” বীরগণ বলরামের মুখে সেই উপাদেয় বাক্য শুনে “সাধু সাধু” বলে নীরব হলেন। তখন বলরাম কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি বীরগণের অবস্থা দেখেও নীরবে বসে আছ কেন? কৃষ্ণ, তোমার সন্তোষের জন্যই আমরা সকলেই অর্জুনের সম্মান করেছি; কিন্তু কুলদূষক সে দুর্বুদ্ধি সে সম্মান পাবার যোগ্য নয়। যে ব্যক্তি আপনাকে সৎকুলজাত মনে করে, যে পাত্রে অন্ন ভোজন করে সেই পাত্রখানিকেই ভেঙে ফেলতে পারে? এবং কোন ব্যক্তি পূর্ব সম্বন্ধের গৌরব রেখে, নূতন সম্বন্ধ করবার ইচ্ছা করে, অথচ কোনও বস্তুর প্রার্থী হয়ে সাহসের কার্য করে? অর্জুন আমাদের অবজ্ঞা করে এবং তোমাকে অগ্রাহ্য করে আজ নিজের মৃত্যুস্বরূপা সুভদ্রাকে বলপূর্বক হরণ করেছে। সুতরাং অর্জুন আমার মস্তকের মধ্যস্থানে পদার্পণ করেছে, অতএব কৃষ্ণ, সর্পের ন্যায় আমি সেই পদার্পণ কী করে সহ্য করব? অতএব আমি একাকীই পৃথিবীকে কৌরবশূন্য করব। কারণ, অর্জুনের এই অত্যাচার সহ্য করার যোগ্য নহে।”

বলরাম মেঘ ও দুন্দুভির ন্যায় গম্ভীর স্বরে গর্জন করতে লাগলে ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়েরা সকলেই তাঁর কথার অনুমোদন করলেন। তখন কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন এই বংশের অপমান করেননি, বরং তিনি এটা অধিক সম্মানের কার্যই করেছেন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তারপর অর্জুন আপনাদের ধনলুব্ধ মনে করেন না বা স্বয়ংবর ব্যাপারটিও তিনি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না। আর কোন ক্ষত্রিয় বীর কন্যাদানের অনুমোদন করে থাকে? এবং জগতে কোন পুরুষই বা সন্তান বিক্রয় করে? অর্জুন মনে মনে এই সমস্ত দোযের পর্যালোচনা করেছিলেন বলেই আমার ধারণা এবং এইজন্যই তিনি ক্ষত্রিয়ের নিয়ম অনুসারে বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করেছেন। তারপর এ সম্বন্ধও উচিত, সুভদ্রাও সৌন্দর্যের কারণে যশস্বিনী এবং এই রূপই অর্জুন বলপূর্বক হরণ করেছেন। আর অর্জুন যশস্বী ভরত ও শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছেন। সুতরাং কোন ব্যক্তি অর্জুনকে পাত্ররূপে লাভ করতে ইচ্ছা না করে? তারপর আর্য, আমি ইন্দ্রলোক ও রুদ্রলোক প্রভৃতি সমস্ত লোকের মধ্যেও সেরূপ ব্যক্তিকে দেখি না, যিনি যুদ্ধে বলপূর্বক অর্জুনকে জয় করতে পারেন। কারণ, সেই প্রকার রথ, আমার সেই ঘোড়াগুলি এবং যোদ্ধা লঘুহস্ত অর্জুন। অতএব অপর কোন ব্যক্তি অর্জুনের তুল্য হতে পারেন? অতএব আপনারা আনন্দিত হয়ে দ্রুত গিয়ে অতি মধুর বাক্যে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনুন; এই সম্পূর্ণ মত আপনাদের কাছে প্রকাশ করলাম। কেন-না, অর্জুন বলপূর্বক আপনাদের জয় করে যদি নিজের ইন্দ্রপ্রস্থে যেতে পারেন, তবে সঙ্গে সঙ্গেই আপনাদের যশোনাশ হবে। কিন্তু মধুরবাক্যে ফিরিয়ে আনলে আপনাদের পরাজয় হবে না। তারপর, তিনি আমাদের পিসতুতো ভাই হয়ে শত্রুর মতো ব্যবহার করতে পারবেন না।” কৃষ্ণের সেই কথা শুনে যাদবেরা সেইরূপ কার্যই করলেন।

তখন অর্জুন দ্বারকায় ফিরে এসে সুভদ্রাকে বিবাহ করলেন এবং এক বৎসরের অধিকদিন দ্বারকায় থেকে, ইচ্ছানুসারে বিহার করে, যাদবগণ কর্তৃক সম্মানিত হয়ে, বারো বৎসরের অবশিষ্ট কাল পুষ্করতীর্থে অতিবাহিত করলেন। তারপর বারো বৎসর পূর্ণ হলে, অর্জুন বনবাস নিয়মে সংযত থেকেই নিজেদের ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে যুধিষ্ঠির ও ব্রাহ্মণদের পূজা করে দ্রৌপদীর কাছে গেলেন। তখন দ্রৌপদী প্রণয়বশতই তাঁকে বললেন, “পার্থ, যেখানে সুভদ্রা আছেন, আপনি সেখানে যান। কারণ কোনও বস্তু দ্বিতীয়বার বন্ধন করলে, পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।” দ্রৌপদী নানাপ্রকার বিলাপ করতে থাকলে অর্জুন তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন এবং বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারপর অর্জুন দ্রুত গিয়ে রক্তকৌষেয়বসনা সুভদ্রাকে গোপবধূর বেশ ধরিয়ে কুন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন বিশালরক্তনয়না বীরপত্নী উত্তম রমণী যশস্বিনী সুভদ্রা সেই বেশে অত্যন্ত শোভিত হতে থেকে, প্রধান ভবনে গিয়ে কুন্তীদেবীকে নমস্কার করলেন; তখন কুন্তীদেবী সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রার মস্তকাঘ্রাণ করলেন। এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অসাধারণ আশীর্বাদ করলেন। তারপর পূর্ণচন্দ্রমুখী সুভদ্রা দ্রুত গিয়ে দ্রৌপদীকে নমস্কার করলেন এবং বললেন, “আমি আপনার দাসী।”তখন দ্রৌপদী উঠে কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে আলিঙ্গন করে প্রীতি সহকারে বললেন, “তোমার পতি শত্রুশূন্য হোন।” সুভদ্রাও আনন্দিত হয়ে বললেন, “তাই হোক।” তারপর মহারথ পাণ্ডবগণ আনন্দিত হলেন এবং কুন্তীদেবীও প্রীত হলেন।

এদিকে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন নিজ রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে এসেছেন শুনে, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় প্রধান প্রধান লোক, বীরগণ, মহারথগণ, ভ্রাতৃগণ, কুমারগণ ও যোদ্ধৃগণে পরিবেষ্টিত হয়ে এবং বিশাল সৈন্যগণে রক্ষিত থেকে, শত্ৰুসন্তাপী বলরামের সঙ্গে সে-স্থানে আগমন করলেন। দানবীর, বুদ্ধিমান, যশস্বী, বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণের সেনাপতি ও শ্রক্রহন্তা অক্রুর সেখানে এলেন। এবং তেজস্বী অনাধৃষ্টি, সাক্ষাৎ বৃহস্পতির শিষ্য, বুদ্ধিমান, উদারচেতা ও যশস্বী উদ্ধব, সত্যক, সাত্যকি, কৃতবর্মা, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, নিশঠ, শঙ্কু, বিক্রমশালী চারুদেষ্ণ, ঝিল্লী, বিপৃথু, মহাবাহু সারণ এবং জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ গদ—এঁরা এবং অন্যান্য বহুতর বৃষ্ণিবংশীয় ভোজবংশীয় ও অন্ধকবংশীয়েরা প্রচুর যৌতুকধন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে আগমন করলেন।

তারপর রাজা যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ এসেছেন শুনে তাঁকে আদরপূর্বক আনবার জন্য তখনই নকুল ও সহদেবকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা গিয়ে আদরপূর্বক প্রবেশের আগ্রহ জানালে মহাসমৃদ্ধিশালী যাদবগণ পতাকাধ্বজশোভিত ইন্দ্রপ্রস্থে এসে প্রবেশ করলেন এবং বলরামের সঙ্গে কৃষ্ণও এসে প্রবেশ করলেন। তাঁরা আসার আগেই ইন্দ্রপ্রস্থের সমস্ত পথগুলিকে পরিষ্কার করে ধুয়ে রাখা হয়েছিল, নানাবিধ ফুল ছড়ানো হয়েছিল এবং স্থানে স্থানে সুগন্ধি অগুরু দগ্ধ করা হচ্ছিল এবং সে-নগরটি হৃষ্টপুষ্ট লোক পরিপূর্ণ এবং বণিকসমূহে পরিশোভিত ছিল। কৃষ্ণ এসে প্রবেশ করলে, সহস্র সহস্র পুরবাসী ও ব্রাহ্মণ তাঁর সম্মান করতে লাগলেন; এই অবস্থায় তিনি ইন্দ্রভবনতুল্য যুধিষ্ঠিরভবনে গিয়ে প্রবেশ করলেন।

যুধিষ্ঠির আশীর্বাদ করে বলরামকে আলিঙ্গন করলেন এবং কৃষ্ণের মস্তকাঘ্রাণ করে বাহুযুগল দ্বারা তাঁকেও আলিঙ্গন করলেন। কৃষ্ণও আনন্দিতচিত্তে বিনয়পূর্বক যুধিষ্ঠির ও পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীমসেনকে যথানিয়মে প্রণাম করলেন। তারপর যুধিষ্ঠির প্রাচীনদের কাছে যেমন শুনেছিলেন, সেইভাবে যথানিয়মে বৃষ্ণিবংশীয় ও অন্ধকবংশীয় প্রধান প্রধান লোকদের আদর করে গ্রহণ করলেন। সম্পর্কে এবং বয়সে জ্যেষ্ঠ কতগুলি লোককে গুরুর ন্যায় পূজা করলেন। সমবয়স্কদের বয়স্যর ন্যায় আলিঙ্গন করলেন, আর কেবল বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিবাদন করলেন। তখন কেউ কেউ তাঁকেও প্রণয়বশত অভিবাদন করল। তারপর যশস্বী কৃষ্ণ বরপক্ষীয়দের জন্য তাঁদের হাতে উৎকৃষ্ট ধন উপহার দিলেন এবং সুভদ্রাকেও জ্ঞাতিগণের দেয় যৌতুক দান করলেন। আর, তিনি স্বর্ণখচিত, কিঙ্কিণিমালা সম্পন্ন, চারটি অশ্বযুক্ত এবং সুশিক্ষিত সারথিচালিত সহস্র রথ উপহার দিলেন এবং মথুরাদেশ জাত, পরমসুন্দর, প্রচুর দুগ্ধশালী ও পবিত্রমূর্তি দশ সহস্র গোদান করলেন। কৃষ্ণ প্রণয়ের সঙ্গে নির্মল চন্দ্রের ন্যায় শুভ্রবর্ণ এবং স্বর্ণালংকারে অলংকৃত এক সহস্র অশ্বী দান করলেন। মস্তকে কৃষ্ণবর্ণ কেশযুক্তা, গাত্রে শ্বেতবর্ণা, বায়র ন্যায় বেগবতী ও সুশিক্ষিতা এক সহস্র অশ্বতরী দান করলেন। আর এক সহস্র গৌরবর্ণা যুবতী স্ত্রী দান করলেন; তারা পূর্বে স্নানে, পানে ও উৎসবে নিযুক্ত হত; এবং তাদের বেশ ও লাবণ্য সুন্দর ছিল, কণ্ঠদেশে নানাবিধ স্বর্ণালংকার ছিল। অঙ্গে লোম ছিল না; আর তারা অন্যকে সাজিয়ে দিতে নিপুণ ও পরিচর্যায় দক্ষ ছিল। এ ছাড়াও কৃষ্ণ বাহ্লিকদেশীয় অতি দ্রুতগামী এক লক্ষ উৎকৃষ্ট অশ্ব যৌতুক দিলেন। আর দশজন মানুষ বহন করতে পারে এই পরিমাণে সোনার তৈয়ারি জিনিস এবং আদত সোনা যৌতুক দিলেন। বলরামও অর্জুনকে এক হাজার হাতি যৌতুক দিলেন; সেই পর্বতশৃঙ্গ তুল্য হাতিগুলি যুদ্ধে ফিরত না, গণ্ডযুগল ও গুহ্যদেশ থেকে মদস্রাব করত এবং স্বর্ণমালায় ভূষিত, শিক্ষিত ও দেখতে সুন্দর ছিল, সেগুলির গলদেশে ঘণ্টা ছিল এবং সঙ্গে মাহুত ছিল।

সেই যৌতুকরূপ মহানদ গিয়ে পাণ্ডবরূপ সাগরে প্রবেশ করল; ধনরাশি ছিল তার রত্নসমূহ, বস্ত্র ও কম্বল ছিল তার ফেনা, বিশাল হস্তীগণ ছিল জলজন্তুসমূহ এবং শ্যাওলা ছিল তার পতাকা। এহেন মহাহ্রদ সেই পূর্ণ সমুদ্রকে অধিকপূর্ণ করে পাণ্ডব শত্রুদের উদ্বেগ জন্মাচ্ছিল। ধর্মরাজ-যুধিষ্ঠির সে সমস্ত যৌতুকধন গ্রহণ করলেন এবং সম্ভাষণ ও সদ্ব্যবহার দ্বারা সেই বৃষ্ণিবংশীয় এবং অন্ধকবংশীয়দের সম্মানিত করলেন। তারপরে সেই কুরু, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় মহাত্মারা মিলিত হয়ে, পুণ্যবান লোকেরা যেমন স্বর্গলোকে বিহার করেন, তেমনই বিহার করতে লাগলেন। তাঁরা উত্তম উত্তম যানে আরোহণ করে সুবিধা অনুসারে এবং আমোদ সহকারে বিহার করতে লাগলেন; তাঁদের যানভ্রমণের সময়ে সুন্দর চক্ৰশব্দ হত। বলবান যাদবগণ এইভাবে অনেকদিন আমোদ করে, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি কর্তৃক সম্মানিত হয়ে পুনরায় দ্বারকানগরে গমন করলেন।

সুভদ্রার পুত্রজন্ম

কৃষ্ণ দ্বারকার অন্য বরযাত্রীর সঙ্গে দ্বারকায় ফিরলেন না। তিনি অর্জুনের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থেই থেকে গেলেন। তিনি মৃগয়া করার জন্য যমুনাতীরে গমন করতেন এবং অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে হরিণ ও শূকর বিদ্ধ করে আনন্দিত হতেন। তারপরে, শচীদেবী যেমন যশস্বী জয়ন্তকে প্রসব করেছিলেন সেইরকম কৃষ্ণের প্রিয়তমা ভগিনী সুভদ্রা অভিমন্যুকে প্রসব করলেন। ক্রমে, সেই অভিমুন্য দীর্ঘবাহু, বিশালবক্ষা, বৃষতুল্য নয়ন, শত্রুহন্তা, মহাবীর ও নরশ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ সেই অভিমন্যুর ভয় ছিল না এবং ক্রোধ ছিল বলে সকলেই তাঁকে অভিমন্যু বলত। যজ্ঞ মন্থন করায় শমীবৃক্ষের ভিতর থেকে অগ্নির ন্যায়, সেই অতিরথ অভিমন্যু অর্জুন থেকে সুভদ্রার গর্ভে জন্মেছিলেন। অভিমন্যুর জন্মের পর যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে দশ হাজার গোরু এবং স্বর্ণালংকার দান করেছিলেন। চন্দ্র যেমন লোকের প্রিয়, সেইরকম অভিমন্যু বাল্যকাল থেকে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির প্রভৃতির প্রিয় হয়েছিলেন। এইজন্যই কৃষ্ণ অভিমন্যুর জন্ম থেকে তাঁর সমস্ত শুভকার্য করেছিলেন এবং অভিমন্যুও শুক্লপক্ষীয় চন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পেয়েছিলেন।

শত্রুবিজয়ী অভিমন্যু বেদ এবং সমস্ত ধনুর্বিদ্যা অর্জুনের কাছে শিক্ষা করেছিলেন; যে ধনুর্বেদের চারটি পাদ ও দশটি অবস্থা আছে এবং যা স্বর্গে ও মর্ত্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্জুন অভিমন্যুকে অস্ত্রজ্ঞানে ও অস্ত্রপ্রয়োগে নিজের তুল্য করে গড়ে তুলেছিলেন এবং তিনি অভিমন্যুকে দেখে আনন্দলাভ করতেন। কেন-না, অভিমন্যু শত্ৰুবিজয়ের সমস্ত কৌশল জানতেন। সর্বপ্রকার সুলক্ষণে লক্ষিত ছিলেন এবং বিবৃতমুখ সর্পের মতো দুর্ধর্ষ ও মহাধনুর্ধর ছিলেন; আর তার বুষের ন্যায় স্কন্ধ, সিংহের ন্যায় দর্প, মত্ত হস্তীর ন্যায় বিক্রম, মেঘ ও দুন্দুভির ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠস্বর ও পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সুন্দর মুখ ছিল। পূর্বে ইন্দ্র যেমন অর্জুনকে কৃষ্ণের তুল্য দেখেছিলেন। তেমন অর্জুনও অভিমন্যুকে শৌর্য, বীর্য, সৌন্দর্য ও আকৃতিতে কৃষ্ণেরই তুল্য দেখতেন।

অভিমন্যুর বাল্যজীবন কেটেছিল দ্বারকায়। অর্জুনের শেখানো বিদ্যা, তিনি সাত্যকির কাছে অভ্যাস করতেন। মাতুল কৃষ্ণ তাঁকে চতুর্বেদ ও পুরাণকাহিনি শোনাতেন। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হলে কৃতজ্ঞ বিরাটরাজ আপন কন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহের প্রস্তাব দেন। বেদবিদ ও ধার্মিক অর্জুন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, তিনি এক বৎসর কাল উত্তরাকে নৃত্যশিক্ষা দিয়েছেন। উত্তরা তাঁর কন্যা তুল্যা, লোকে এ-বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করবে। তিনি যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে উত্তরার সঙ্গে আপন পুত্র অভিমন্যুর বিবাহের প্রস্তাব করেন। এ-প্রস্তাব সকলের অনুমোদন পায়। অভিমন্যু উত্তরার বিবাহ হয়ে যায়। অভিমন্যুর বয়স তখন মাত্র ষোলো।

অভিমন্যুর মৃত্যু

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে কৌরব সেনাপতি দ্রোণ, যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য চক্রব্যুহ রচনা করেন। ব্যূহমুখ রক্ষা করেন রাজা জয়দ্ৰথ, যিনি ভীম অর্জুনের নিকট পরাস্ত ও চূড়ান্ত লাঞ্ছনা লাভ করার পর উমাপতি মহেশ্বরের তপস্যা করে বরলাভ করেন যে, তিনি অর্জুন ব্যতীত অন্য পাণ্ডব ভ্রাতাদের একদিনের জন্য পরাস্ত করতে পারবেন। ওদিকে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে ধরার জন্য দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ রচনা করে অগ্রসর হচ্ছেন। সংশপ্তক বাহিনী অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছে। উপায়ান্তর না-দেখে যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে চক্রব্যূহের দ্বার খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালেন। অভিমন্যু বললেন যে, পিতা অর্জুনের কাছ থেকে তিনি চক্রব্যূহের দ্বার খোলার পথ জেনেছেন, কিন্তু চক্রব্যূহ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ শেখেননি। ভীমসেন প্রমুখ পাণ্ডববীরেরা বললেন যে, অভিমন্যু দ্বার খুলে দিন, অভিমন্যুর পিছনে পিছনে তাঁরাও সেই পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকবেন। অভিমন্যু অনায়াসে চক্রব্যূহের দ্বার খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু জয়দ্রথ, যুধিষ্ঠির ভীম ইত্যাদিদের আটকে দিলেন। সমস্ত প্রচেষ্টা করেও ভীমসেন সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন জয়দ্রথকে পরাজিত করে চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে পারলেন না। একাকী অভিমন্যু চক্রব্যূহের মধ্যে এককভাবে দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, দুঃশাসন, ভূরিশ্রবা প্রত্যেককে পরাজিত করলেন—কেউ এঁর সামনেই দাঁড়াতে পারলেন না। শেষে দ্রোণাচার্যের পরামর্শে সপ্তরথী একত্রে চতুর্দিক বেষ্টন করে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। পিছন থেকে কর্ণ অস্ত্রাঘাতে তাঁর কবচ ছিন্ন করলেন, রথ বিনষ্ট করলেন, অন্য রথীরা ক্রমাগত অস্ত্রাঘাত করতে থাকলেন। দুঃশাসনপুত্রের এর সঙ্গে অভিমন্যুর গদাযুদ্ধ হতে লাগল। আঘাতে জর্জরিত হয়ে দুজনেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। দুঃশাসনপুত্রের চেতনা আগে ফিরল। তিনি অচেতন অভিমন্যুর মস্তকে তীব্র গদার আঘাত করলেন। সেই আঘাতে অভিমন্যুর মৃত্যু ঘটল।

সন্ধ্যাবেলা সংশপ্তকদের নিহত করে অর্জুন পাণ্ডবশিবিরে ফিরে ভয়ংকর মৃত্যুসংবাদ শুনলেন। তীব্র ক্ষোভে ক্রোধে তিনি ভ্রাতাদের ধিক্কার দিলেন এবং যখন শুনলেন মহাদেবের বরে সেদিন জয়দ্রথ অজেয় ছিলেন, তখন অর্জুন ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন যে, আগামীকাল সন্ধ্যার পূর্বে তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন। এই ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করে অর্জুন কৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন যে, তিনি অভিমন্যু-মাতা সুভদ্রা ও পত্নী উত্তরাকে শান্ত করুন।

তখন অতিদুঃখিতচিত্ত কৃষ্ণ অর্জুনের গৃহে গমন করে পুত্রশোকার্তা ও দুঃখিতা সুভদ্রাকে আশ্বস্ত করতে লাগলেন। কৃষ্ণ বললেন, “বৃষ্ণিবংশ-নন্দিনী, উত্তরার সঙ্গে তুমি কুমারের জন্য শোক কোরো না; ভীরু, সমস্ত প্রাণীরই কালকৃত এইরূপ বিনাশ হয়ে থাকে। বিশেষত সদ্‌বংশজাত বীর ক্ষত্রিয়ের এরূপ মরণই উপযুক্ত। সুতরাং তোমার পুত্র সম্পর্কে শোক কোরো না। মহারথ ও পিতার তুল্য পরাক্রমশালী বীর অভিমন্যু ক্ষত্রিয় নিয়ম অনুসারে বীরাভিলষিত গতিই লাভ করেছে। অভিমন্যু বহুতর শত্রু জয় করে এবং তাদের যমলোকে প্রেরণ করে পুণ্যবান লোকেদের প্রাপ্য সর্বাভীষ্টপূরক অক্ষয়লোকে গমন করেছে। সাধুলোকেরা তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, বেদাধ্যয়ন ও তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা যে লোক লাভ করার ইচ্ছা করেন, তোমার পুত্র সেই স্থান লাভ করেছে। ভদ্রে, তুমি বীরপ্রসূ, বীরপত্নী, বীরতনয়া এবং বীরবান্ধবা। অতএব পুত্রের জন্য শোক কোরো না; সে উত্তম স্থান লাভ করেছে। বালঘাতক ও পাপাত্মা জয়দ্রথ সুহৃদ ও বন্ধুগণের সঙ্গে এই গর্বের ফল পাবে। রাত্রি প্রভাত হলে সেই পাপকর্মকারী জয়দ্রথ অমরাবতী নগরীতে প্রবেশ করেও অর্জুনের হাত থেকে মুক্তিলাভ করবে না। তুমি কালই শুনতে পাবে যে, যুদ্ধে সেই জয়দ্রথের মাথা কাটা গিয়েছে এবং সেই মাথা সমস্তপঞ্চকের বাইরে পড়েছে। সুতরাং তুমি শোক কোরো না, আর কেঁদো না, আমরা যে-গতি লাভ করব এবং অন্য যে সকল অস্ত্রজীবী আছেন, তাঁরাও যে-গতি লাভ করবেন, বীর অভিমন্যু ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারে সেই সজ্জনের গতি লাভ করেছে। দৃঢ় বিশালবক্ষা, মহাবাহু, অপলায়নকারী ও বিপক্ষরথ বিজয়ী তোমার পুত্র স্বর্গে গমন করেছে। অতএব শোকসন্তাপ পরিত্যাগ করো। বলবান, বীর ও মহারথ অভিমন্যু পিতৃপক্ষ ও মাতৃপক্ষের অনুকরণ করতে থেকে সহস্র সহস্র শত্ৰুসংহার করে নিহত হয়েছে। তুমি তোমার পুত্রবধূকে আশ্বস্ত করো, ক্ষত্রিয়ে, তুমি গুরুতর শোক কোরো না। তুমি কাল বিশেষ প্রিয় সংবাদ শুনবে বলে শোকবিহীন হও। অর্জুন যা প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা ঘটবে, তার অন্যথা হবে না। কারণ তোমার স্বামী যা করবার ইচ্ছা করেন, তা কখনও মিথ্যা হয় না। যদি দেব-দানব, পক্ষী, রাক্ষস, পিশাচ, নাগ ও মনুষ্যেরা সমরস্থিত জয়দ্রথকে সর্বতোভাবে রক্ষা করেন, তবুও সে প্রভাতকালে তাঁদের সঙ্গে থেকেও বেঁচে থাকবে না।”

মহাত্মা কৃষ্ণের এই সকল কথা শুনে সুভদ্রা পুত্রশোকার্তা ও অত্যন্ত দুঃখিতা হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন, “হা পুত্র! হা বৎস অভিমন্যু! তুমি মন্দভাগ্যা আমার উদরে এসে ক্রমে পিতার তুল্য পরাক্রমশালী হয়ে কেন যুদ্ধে নিধনপ্রাপ্ত হলে?

কথমিন্ধীবর শ্যামং সুদংষ্ট্রং চারুলোচনম।

মুখং তে দৃশ্যতে বৎস! গুণ্ঠিতং রণরেণুনা ॥ দ্রোণ : ৬৯ : ৩ ॥

“বৎস! নীলোৎপলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, সুন্দরদন্তযুক্ত, মনোহর নয়ন সমন্বিত এবং রণভূমির ধূলিজালে আবৃত তোমার মুখখানি কী করে সকলে দেখছে?”

“বৎস! তুমি বীর ছিলে; যুদ্ধ থেকে পলায়ন করতে না; তোমার মাথা, গলা, দুই হাত এবং দুই কাঁধ সুন্দর, বক্ষঃস্থল দৃঢ় ও বিশাল, উদরদেশ কৃশ, এই অবস্থায় তুমি পড়ে আছ আর সকলে তোমাকে দেখছে। আর সমস্ত অঙ্গ মনোহর ও পুষ্ট এবং ইন্দ্রিয়গুলি মনোরম ছিল; এহেন তুমি অস্ত্রে ক্ষত ও ব্যাপ্তদেহ হয়ে রয়েছ; সেই অবস্থায় প্রাণীরা সকলে তোমাকে নূতন চন্দ্রের ন্যায় দেখছে। তুমি সুখভোগে অভ্যস্ত ছিলে; পূর্বে তুমি দুগ্ধফেনতুল্য আস্তরণে আবৃত শয্যায় শয়নে অভ্যস্ত ছিলে, আজ কী করে বাণিবিদ্ধদেহে ভূতলে শয়ন করে আছ? হায়! পূর্বে উত্তম নারীগণ যে মহাবাহু বীরের সেবা করত, আজ কেন শৃগালেরা সেই বীরের সেবা করছে? পূর্বে সূত, মাগধ, বন্দিগণ আনন্দিত হয়ে যাঁর স্তব করত, আজ ভয়ংকর মাংসভোজী জন্তুগণ রব করতে করতে তাঁর সেবা করছে। প্রভাবশালী অভিমন্যু! বীর পাণ্ডবগণ, বৃষ্ণিগণ ও পাঞ্চালগণ রক্ষক থাকতে তুমি কেন অনাথের ন্যায় নিহত হলে?

“নিস্পাপ পুত্র! তোমার দর্শনে আমার পুত্র দর্শনাকাঙক্ষা তৃপ্ত হয়নি। সুতরাং মন্দভাগ্যা আমি নিশ্চয়ই আজ যমালয়ে যাব। পুত্র, বিশালনয়ন, সুন্দরকেশপ্রান্ত, মনোহরবাক্য ও সৌরভযুক্ত তোমার অক্ষত মুখখানি আবার কবে দেখতে পাব। ভীম, অর্জুন, অন্যান্য ধনুর্ধরগণ, বৃষ্ণিবীরগণ ও পাঞ্চাল বীরগণের বলকে ধিক এবং কেকয়, চেদি, মৎস্য ও সৃঞ্জয়গণকে ধিক, যাঁরা যুদ্ধমধ্যে তোমাকে সহায়তা করতে পারলেন না। আজ আমি অভিমন্যুকে দেখতে না পেয়ে শোকাকুলচিত্ত হয়ে সমগ্র পৃথিবীটাকেই যেন শূন্য এবং বিশ্রী দেখছি। বৎস, কৃষ্ণের ভাগিনেয়, অর্জুনের পুত্র অতিরথ ও বীর তোমাকে আজ কী করে ভূপাতিত অবস্থায় দেখব। তুমি স্বপ্নের ধনের ন্যায় আমার দৃষ্টিগোচর হয়েই তিরোহিত হয়ে গেলে! মনুষ্যত্ব অনিত্য, এমনকী জলবুদ্‌বুদের ন্যায় চঞ্চল। বৎস অভিমন্যু, তোমার এই যুবতী ভার্যাটি তোমার শোকে আকুল হয়ে পড়েছে। এ-অবস্থায় বৎসহীন ধেনুর ন্যায় কী করে একে বাঁচাব। তুমি পুত্ৰদর্শনাভিলাষিণী সুভদ্রাকে ফল দেখাবার সময়ে পরিত্যাগ করে অকালে প্রস্থান করলে! নিশ্চয়ই দৈবের গতি জ্ঞানীগণেরও অতি দুর্জ্ঞেয়। যেহেতু স্বয়ং কৃষ্ণ রক্ষক থাকতেও, তুমি যুদ্ধে অনাথের ন্যায় নিহত হয়েছ। যজ্ঞকারী, দানশীল, পবিত্রচিত্ত, ব্রহ্মচারী, পুণ্যতীর্থস্নায়ী, কৃষ্ণ, উদারচেতা, গুরুপরিচর্যানিরত ও সহস্র দক্ষিণাদাতা ব্রাহ্মণগণের যে গতি হয়, তুমি সেই গতি লাভ করো। বীরেরা যুদ্ধে শত্ৰুসংহার করে অপরাঙ্মুখভাবে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হলে, তাঁদের যে-গতি হয়, তুমি সেই গতি লাভ করো। যাঁরা সহস্র গোদান করেন, কিংবা যজ্ঞানুষ্ঠান করেন, তাঁদের যে গতি হয়, অথবা যাঁরা অভিমত গৃহনির্মাণ উপযোগী দ্রব্য দান করেন, তাঁদের যে গতি হয়, কিংবা যাঁরা শরণার্থী ব্রাহ্মণের জন্য নিধি স্থাপন করেন, অথবা যাঁরা অভিমান ত্যাগ করেন, তাঁদের যেমন গতি হয়, পুত্র তুমি তেমন গতি লাভ করো। দৃঢ়ব্রতপরায়ণ মুনিরা ব্রহ্মচর্য দ্বারা যে গতি লাভ করেন, কিংবা একমাত্র পত্নীশালী পুরুষেরা যে গতি পেয়ে থাকেন, পুত্র! তুমি সেই গতি লাভ করো। সদাচার এবং পবিত্র চতুরাশ্রমীদের পুণ্যে সুরক্ষিত করায় রাজাদের যে সনাতনী গতি হয়ে থাকে। কিংবা দীনজনের প্রতি দয়াকারীদের, উৎকৃষ্ট দ্রব্য বণ্টন করে পরিজনদের দানকারীগণের এবং খলতাশূন্য লোকেদের যেরূপ গতি হয়, পুত্র! তুমি সেই গতি লাভ করো। কষ্ট, বিপদ, শোকাগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ধৈর্যশালী লোকেদের যে-গতি লাভ হয়ে থাকে, পুত্র তুমি সেই গতি লাভ করো।

“যারা সর্বদা পিতা ও মাতার শুশ্রূষা করেন এবং যাঁরা স্বদারমাত্রে নিরত থাকেন, তাঁদের যে গতি হয় পুত্র তুমি সেই গতি লাভ করো। পরস্ত্রী পরাঙ্মুখ এবং ঋতুকালে নিজপত্নীগামী মনস্বীদের যে-গতি হয়ে থাকে, পুত্র, তুমি সেই গতি লাভ করো। যাঁরা পরবিদ্বেষহীন হয়ে প্রিয়ভাবে সমস্ত প্রাণীকে দেখেন, সেই অমর্মপীড়ক ক্ষমাশীল লোকেদের গতি তুমি প্রাপ্ত হও। মদ্য, মাংস, মত্ততা, অহংকার, মিথ্যা, পরসন্তাপকতাশূন্য মহাত্মাদের যেরূপ গতি হয়, পুত্র! তুমি সেই গতি লাভ করো।

শোকার্তা ও অবসন্না সুভদ্রা উত্তরার সঙ্গে এরূপ বিলাপ করছিলেন, এমন সময়ে দ্রৌপদী সেখানে আগমন করলেন। তখন তাঁরা উন্মত্তের মতো যথেষ্ট রোদন ও বিলাপ করে অচৈতন্য হয়ে ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন পদ্মনয়ন কৃষ্ণ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে অন্য পরিচর্যার সঙ্গে অতি জলসেকে অতিদুঃখিতা দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও উত্তরাকে আশ্বস্ত করে সেই সেই হিতবাক্য বলে অচেতনপ্রায়া, রোদনপরায়ণা, মর্মপীড়িতা ও কম্পমানা ভগিনী সুভদ্রাকে এই কথা বললেন, “সুভদ্রা, তুমি শোক কোরো না, তুমি উত্তরাকে আশ্বস্ত করো। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অভিমন্যু প্রসিদ্ধ গতি লাভ করেছে। আমাদের বংশে অন্য যেসব পুরুষ আছেন, সেই মনস্বীরা যেন অভিমন্যুর গতি লাভ করেন। অভিমন্যু একা যে কার্য করেছেন, আমরাও যেন সেইরকম কাজ করতে পারি।” এই কথা বলে কৃষ্ণ অর্জুনের কাছে চলে গেলেন।

সুভদ্রার পৌত্রলাভ

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চারমাস পরে বিজয়ী হস্তিনাপুরের রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের অন্তঃপুরে অভিমন্যু-পত্নী উত্তরা একটি নিশ্চেষ্ট শবশিশু প্রসব করলেন। দ্রৌপদীর সুপ্তিমগ্ন পঞ্চপুত্র, শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিদ্রিত অবস্থায় বধ করেন অশ্বত্থামা। প্রায়োপবেশনে বসে জীবনের বিনিময়ে দ্রৌপদী, অশ্বত্থামার মাথার মণি দাবি করলেন। সহদেবকে দ্রৌপদীর পরিচর্যায় রেখে চারভ্রাতা অশ্বত্থামাকে ধরতে চললেন। পাণ্ডবদের আসতে দেখেই ভীত অশ্বত্থামা নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। অর্জুন সেই ভয়ংকর অস্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য সেই নারায়ণাস্ত্রই প্রয়োগ করলেন। দুই অস্ত্রের মধ্যপথে দাঁড়িয়ে নারদ প্রমুখ ঋষিরা উভয়কে অস্ত্রসংবরণ করতে বললেন। সংযমী ব্রহ্মবিদ অর্জুন তাঁর অস্ত্রের উপশম ঘটালেন। কিন্তু আত্মসংযমে অসমর্থ অশ্বত্থামা অস্ত্র সংবরণ করতে পারলেন না। উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে সেই অস্ত্র আঘাত করল। ভীমসেন অশ্বত্থামার মাথার মণি ছিনিয়ে আনলে দ্রৌপদী প্রায়োপবেশন ত্যাগ করলেন। কৃষ্ণের অভিশাপে অশ্বত্থামা তিন সহস্র বৎসর পূতিগন্ধযুক্ত পূঁজ দূষিত রক্তের দেশে নির্বাসিত হলেন। কৃষ্ণ শপথ করলেন, অশ্বত্থামার অস্ত্রে উত্তরার গর্ভস্থ শিশু মৃত অবস্থায় জন্ম নিলে, তিনি তাকে জীবিত করে তুলবেন।

যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধযজ্ঞে অংশ গ্রহণের জন্য কৃষ্ণ বলরাম হস্তিনায় উপস্থিত হলে কয়েক দিন পরে উত্তরার মৃত শিশুর জন্ম হল। পুরবাসীগণের হর্ষধ্বনি উথ্থিত হয়েই নিবৃত্ত হল। কৃষ্ণ ব্যথিত হয়ে সাত্যকির সঙ্গে অন্তঃপুরে গেলেন, কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা ও অন্যান্য কুরুনারীগণ সরোদনে তাকে বেষ্টন করলেন। কুন্তী বললেন, বাসুদেব, তুমিই আমাদের একমাত্র গতি, এই কুরুকুল তোমারই আশ্রিত। তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র অশ্বত্থামার অস্ত্র প্রভাবে মৃত হয়ে জন্মেছে। তুমি তাকে জীবিত করে উত্তরা সুভদ্রা দ্রৌপদী ও আমাকে রক্ষা করো। এই বালক পাণ্ডবগণের প্রাণস্বরূপ, এবং আমার পতি, শ্বশুর ও অভিমন্যুর পিণ্ডদাতা। তুমি পূর্বে বলেছিলে যে, একে পুনর্জীবিত করবে এখন সেই প্রতিজ্ঞা পালন করো। অভিমন্যু উত্তরাকে বলেছিল, তোমার পুত্র আমার মাতুলগৃহে ধনুর্বেদ ও নীতিশাস্ত্র শিখবে। মধুসূদন আমরা বিনীত হয়ে প্রার্থনা করছি, তুমি কুরুকুলের কল্যাণ করো।

সুভদ্রা আর্তকণ্ঠে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, এই দেখো, পার্থের পৌত্র ও অন্যান্য কুরুবংশীয়দের ন্যায় গতাসু হয়েছে। পাণ্ডবগণ ধন সংগ্রহ করতে গেছেন, তাঁরা ফিরে এসে এই সংবাদ শুনে কী বলবেন? তুমি থাকতে এই বালক যদি জীবিত না হয় তবে তোমাকে দিয়ে আমাদের কোন উপকার হবে? তুমি ধর্মাত্মা, সত্যবাদী সত্যবিক্রম, তোমার শক্তি আমি জানি। মেঘ যেমন জল বর্ষণ করে শস্যকে সঞ্জীবিত করে সেইরূপ তুমি অভিমন্যুর মৃত পুত্রকে জীবিত করো। আমি তোমার ভগিনী, পুত্রহীনা ও শরণাপন্ন হয়ে বলছি, দয়া করো।

সুভদ্রা প্রভৃতিকে আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণ সূতিকাগৃহে প্রবেশ করলেন। সূতিকাগৃহের পরিচ্ছন্নতায় কৃষ্ণ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। উত্তরা কৃষ্ণকে দেখে অশ্রু সংবরণ ও দেহ আচ্ছাদন করে বললেন, “পুণ্ডরীকাক্ষ, দেখুন, আমি পুত্রহীনা হয়েছি, অভিমন্যুর ন্যায় আমিও নিহত হয়েছি। গোবিন্দ, আমি নতশিরে প্রার্থনা করছি, এই বালককে সঞ্জীবিত করুন, নতুবা আমি প্রাণত্যাগ করব। দ্রোণপুত্র আমার সকল মনোরথ নষ্ট করেছে, আমার জীবনে আর কী প্রয়োজন? আমার আশা ছিল পুত্রকে কোলে নিয়ে আপনাকে প্রণাম করব, তা বিফল হল। আমার চঞ্চলনয়ন স্বামী আপনার প্রিয় ছিলেন, তাঁর মৃত পুত্রকে আপনি দেখুন। এর পিতা যেমন কৃতঘ্ন ও নিষ্ঠুর এও সেইরূপ, তাই পাণ্ডবগণের সম্পদ ত্যাগ করে যমসদনে। গেছে।”

কৃষ্ণ বললেন, “উত্তরা আমার কথা মিথ্যা হবে না। দেখো, সকলের সমক্ষেই আমি এই বালককে পুনর্জীবিত করব। যদি আমি কখনও মিথ্যা না বলে থাকি, যুদ্ধে বিমুখ না হয়ে থাকি, যদি ধর্ম ও ব্রাহ্মণগণ আমার প্রিয় হন, তবে অভিমন্যুর এই পুত্র পুনর্জীবন লাভ করুক। যদি অর্জুনের সঙ্গে কদাচ আমার বিরোধ না হয়ে থাকে, যদি সত্য ও ধর্ম নিত্য আমাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, যদি কংস ও কেশীকে আমি ধর্মানুসারে বধ করে থাকি, তবে এই বালক জীবিত হোক।” বাসুদেব এইরূপ বললে শিশু ধীরে ধীরে চেতনা পেয়ে স্পন্দিত হতে লাগল। অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র কৃষ্ণ কর্তৃক নিবর্তিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে চলে গেল। রাক্ষসেরা পালিয়ে গেল। আকাশ থেকে দৈববাণী হল— সাধু ‘কেশব সাধু। বালকের অঙ্গসঞ্চালন দেখে কুরুকুলের নারীগণ হৃষ্ট হলেন। উত্তরা পুত্রকে কোলে নিয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। ভরতবংশ পরিক্ষীণ হলে অভিমন্যুর পুত্রের জন্ম হল বলে কৃষ্ণ এর নাম রাখলেন—পরিক্ষিৎ। পাণ্ডবগণ ফিরে এসে সমস্ত সংবাদ শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।

পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে ছত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞে কৃষ্ণ শেষ হস্তিনাপুরে এসেছিলেন। দীর্ঘকাল যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কৃষ্ণের সাক্ষাৎও ঘটেনি। রাজত্বের শেষ বৎসরে যুধিষ্ঠির চারপাশে নানা দুর্লক্ষণ দেখতে পেলেন। ইতিমধ্যে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন যুধিষ্ঠির, বিদুরের তিরোধানের সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। চারপাশের দুর্লক্ষণে উৎকণ্ঠিত যুধিষ্ঠির অর্জুন-সুভদ্রাকে পাঠালেন কৃষ্ণের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। অর্জুন উপস্থিত হয়ে শুনলেন সেই কঠোরতম সত্য ভাষণ। যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে অর্জুনের প্রিয় শিষ্য সাত্যকি ও প্রদ্যুম্নের প্রত্যক্ষ দায়িত্বে। বলরাম ও কৃষ্ণ মানবলীলা সংবরণ করেছেন। অর্জুনকে কৃষ্ণের শেষ ইচ্ছা জানিয়ে, হস্তিনাপুরীতে যাদব নারীদের নিয়ে যাবার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন কৃষ্ণ, বসুদেবও দেহত্যাগ করলেন।

শ্রাদ্ধাদি কার্য সমাপ্ত করে সুভদ্রাকে এবং অন্য যাদব নারীদের নিয়ে অর্জুন দ্বারকা ত্যাগ করলেন। অর্জুন যত এগোতে লাগলেন, পিছনের ততটা পথ সমুদ্র গ্রাস করতে লাগল। কিন্তু অর্জুন যাদব নারীদের নিয়ে হস্তিনায় পৌঁছোতে পারলেন না। পথিমধ্যে আভির পল্লির দস্যু গোয়ালারা কৃষ্ণের অন্তঃপুরিকাদের অর্জুনের সামনেই হরণ করলেন। অর্জুন গাণ্ডিব কোনওমতে উত্তোলন করলেন কিন্তু একটিও উপযুক্ত অস্ত্র তাঁর স্মরণে এল না। কৃষ্ণরমণীরা আভির পল্লির দস্যুদের হাতে অপহৃত হল। ফিরে এসে অর্জুন অশ্রুসজল কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরকে জানালেন যে, কৃষ্ণ আর নেই, তিনি দেহলীলা সংবরণ করেছেন। যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ রাজ্য পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

কালঃ পচতি ভূতানি সর্বাণ্যেব মহামতে!।

কালপাশমহং মন্যে ত্বমপি দ্রষ্টুমহসি ॥ মহাপ্রস্থান : ১: ৩ ॥

“মহামতি! কালই সকল প্রাণীকে পাক করছে এবং আমি কালকেই বন্ধনরজ্জু বলে মনে করি, তুমিও (অর্জুন) এ পর্যালোচনা করে দেখতে পারো।”

তারপর যুধিষ্ঠির ধর্মকামনায় বহির্গত হবেন বলে বৈশ্যপুত্র যুযুৎসুকে সমগ্র রাজ্য পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপ্রদান করলেন এবং পরিক্ষিৎকে রাজ ও রাজ্যে অভিষিক্ত করে, দুঃখার্ত হয়ে সুভদ্রাকে বললেন, “সুভদ্রে! তোমার এই পুত্রের পুত্র পরিক্ষিৎ কুরুদেশের রাজা হবেন। আর যদুবংশের অবশিষ্ট বজ্রকেও ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা করা হয়েছে। তুমি এই দু’জনকেই রক্ষা করবে; কিন্তু অধর্মের দিকে মন দিয়ো না।” সুভদ্রার প্রতি যুধিষ্ঠিরের এই শেষ বাণী।

এরপর পঞ্চপাণ্ডব, ভার্যা দ্রৌপদীর সঙ্গে মহাপ্রস্থানের পথে অগ্রসর হলেন। উলূপী পাতালে নাগলোকে চলে গেলেন। চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে পুত্র বভ্রুবাহনের কাছে গেলেন। সুভদ্রা পৌত্র পরিক্ষিৎকে নিয়ে হস্তিনাপুরেই পাণ্ডবদের অন্য স্ত্রীদের নিয়ে অবশিষ্ট জীবনযাপন করলেন!

মহাভারতে সুভদ্রার কাহিনি এই পর্যন্তই। তাঁর প্রথম যৌবন, বিবাহ, পুত্রজন্ম, পুত্রের মৃত্যু, পৌত্রের জন্ম ও অবশিষ্ট জীবন বৈধব্যের সঙ্গে কাটানোর ধারাবাহিক বৃত্তান্ত ব্যাসদেব এইভাবেই দিয়েছেন। পঞ্চপাণ্ডবের মহাপ্রস্থান যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে কাহিনিতে সুভদ্রা-বর্ণনার প্রয়োজনও শেষ হয়েছে। বীর ক্ষত্রিয়রমণীর সমগ্র জীবনকথা ব্যাসদেব তাঁর অনুপম বর্ণনায় পাঠককে উপহার দিয়ে গেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *