১৪. মহাভারতের নায়িকা দ্রৌপদী

মহাভারতের নায়িকা দ্রৌপদী

চন্দ্রভাগা দ্রৌপদী। যজ্ঞবেদি সমদ্ভূতা দ্রৌপদী। অযোনিসম্ভূতা দ্রৌপদী। নাথবৎ অনাথবতী দ্রৌপদী। কৃষ্ণসখী দ্রৌপদী। পঞ্চপাণ্ডবের পট্টমহিষী দ্রৌপদী। কৃষ্ণা দ্রৌপদী, পাঞ্চালী— নাম আর বিশেষণ লিখতে লিখতে পাতা ফুরিয়ে যাবে কিন্তু দ্রৌপদীর বর্ণনা ফুরোবে না। মহাভারত মহাকাব্যের নায়িকা দ্রৌপদী।

পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীর নাম প্রথম শোনেন একচক্রাপুরীতে অতিথি আগন্তুক ব্রাহ্মণের মুখে। সেই আগন্তুক ব্রাহ্মণ পাণ্ডবদের ও কুন্তীর কাছে অনেক দেশ, তীর্থ, নদী, নানাবিধ আশ্চর্য চরিত্রসম্পন্ন রাজা, তাঁদের রাজ্য ও রাজধানীর বিষয় বলতে লাগলেন। বহু উপাখ্যানের মধ্যে ব্রাহ্মণ পাঞ্চালদেশে দ্রৌপদীর অদ্ভুত স্বয়ংবর বৃত্তান্ত বললেন। আর তিনি দ্রুপদরাজের মহাযজ্ঞে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর উৎপত্তি ও দ্রৌপদীর অযযানি জন্মের কথাও বললেন। পাণ্ডবগণ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সেই বর্ণনা শুনছিলেন। পাণ্ডবেরা প্রশ্ন করলেন, দ্রুপদরাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন যজ্ঞাগ্নি থেকে এবং দ্রৌপদীর যজ্ঞবেদি থেকে কী প্রকারে সেই অদ্ভুত উৎপত্তি হয়েছিল? ধৃষ্টদ্যুম্ন কী প্রকারে মহাধনুর্ধর দ্রোণের নিকট অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন? কী প্রকারেই বা পরস্পরের বন্ধু এবং কোন দোষেই বা পরস্পরের শত্রু হয়েছিলেন?

তখন ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণের জন্ম, পৃষৎ রাজার পুত্র দ্রুপদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব, দ্রুপদের শপথ এবং রাজা হবার পর দ্রুপদের দ্রোণকে প্রত্যাখ্যানের কাহিনি বললেন। প্রত্যাখ্যাত দ্রোণ কর্তৃক কুরুপাণ্ডবের গুরুত্ব বরণ ও শিক্ষান্তে গুরুদক্ষিণা হিসাবে দ্রুপদকে বন্দি করে আনার ঘটনাও জানালেন। পরাজিত বন্দি দ্রুপদ অপুত্রক ছিলেন। তিনি পুত্রলাভের জন্য যাজ ও উপযাজ নামক দুই বিখ্যাত ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হলেন। যাজ তাঁর প্রার্থনা স্বীকার করে পুত্রযাগ যজ্ঞ করতে সম্মত হলেন। তখন দ্রুপদরাজা, দ্রোণহন্তা পুত্র লাভ করার ইচ্ছায় এবং তার সিদ্ধির জন্য যাজ ও উপজের উপদেশক্রমে সেই পুত্ৰযাগ সম্পন্ন করলেন। যাগ হয়ে গেলে তখন যাজ দ্রুপদের মহিষীকে বললেন, “রাজ্ঞী! পৃষতি! আপনি আসুন, আপনার দুটি সন্তান উপস্থিত হয়েছে।” রানি বললেন, “ব্রাহ্মণ! আমি এখনও মুখ প্রক্ষালন করিনি এবং স্নান না করায় এখনও অঙ্গে তৈলের সুন্দর সৌরভ রয়েছে, অতএব যাজ, একটু অপেক্ষা করুন, পুত্র আমার প্রিয় হলেও আমি এখন তা গ্রহণ করতে পারি না।” যাজ বললেন, “যাজ পাক করেছেন, উপযাজ অভিমন্ত্রিত করেছেন, সুতরাং এই হবি কেন অভীষ্ট ফল জন্মাবে না? অতএব রানি! আপনি আসুন বা থাকুন, আপনার সন্তান জন্মাবেই।”

যাজ এই বলে অভিমন্ত্রিত হবি অগ্নিতে নিক্ষেপ করলে, তৎক্ষণাৎ অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বলবর্ণ, ভয়ংকরাকৃতি এবং কিরীট, উত্তম বর্ণ, তরকারি, বাণ ও কার্মুকধারী দেবতার তুল্য একটি কুমার গর্জন করতে করতে সেই অগ্নি থেকে উঠে এল এবং তখনই সেই কুমার উৎকৃষ্ট রথে আরোহণ করে গমন করল। তাতে পাঞ্চালগণ আনন্দিত হয়ে ‘সাধু সাধু’ বলে কোলাহল করল। তখন এই পৃথিবী হর্ষাবিষ্ট পাঞ্চালগণকে ধারণ করতে অসমর্থ হয়ে উঠলেন। আর সেই সময়ে গগনচর অদৃশ্য এক মহাপ্রাণী এই কথা বলল যে, “দ্রোণবধের জন্য উৎপন্ন এই রাজপুত্র পাঞ্চালগণের ভয় দূর করবে এবং যশ জন্মাবে, আবার রাজারও শোক নষ্ট করবে।”

আর যজ্ঞবেদির মধ্য থেকে একটি কন্যা উদ্ভূত হল—

কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা।

সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী স্বসিতায়তলোচনা ॥

শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিত মূৰ্দ্ধজা।

তাম্র-তুঙ্গী-নখী সুশ্রূশ্চারু পীন পয়োধরা ॥

মানুষং বিগ্রহং কৃত্বা সাক্ষাদমর বর্ণিনী।

নীলোৎপল সমো গন্ধে যস্যাঃ ক্রোশা প্রধাবিত ॥ আদি : ১৬৮ : ৪৪-৪৬ ॥

“সেই কুমারীর নাম ‘পাঞ্চালী’। দেহের কান্তি মনোহর, সকল অঙ্গ সুদৃশ্য, নয়নযুগল সুন্দর, কৃষ্ণবর্ণ এবং সুদীর্ঘ, শরীরের বর্ণ শ্যাম। নয়নযুগল পদ্মপত্রের ন্যায়, কেশকলাপ কুঞ্চিত ও কৃষ্ণবর্ণ, নখসমূহ তাম্রবর্ণ ও উন্নত, ভ্রূযুগল মনোহর আর স্তন দুটি সুন্দর ও স্থূল; সুতরাং কোনও দেবী যেন মানুষের আকৃতি ধারণ করে এসেছিলেন; আর তার অঙ্গের নীলোৎপলতুল্য গন্ধ এক ক্রোশের উপরেও ছড়িয়ে যাচ্ছিল।”

আর যে মনোহর রূপ ধারণ করেছিল জগতে তার কোনও উপমা ছিল না, সুতরাং সে দেবরূপিণী কন্যাটি জন্মালে পরও দৈববাণী হয়েছিল যে, “এই কন্যাটির নাম ‘কৃষ্ণা’। এ সকল স্ত্রীলোকের শ্রেষ্ঠা আর এ ক্ষত্রিয়দের ধ্বংসের কারণ হবে। এই সুন্দরী যথাকালে দেবকার্য সম্পাদন করবে, আর এর জন্যই কুরুবংশের গুরুতর ভয় আসবে।” সেই দৈববাণী শুনে পাঞ্চালগণ সিংহসমূহের ন্যায় কোলাহল করতে লাগল। তখন এই পৃথিবী সেই আনন্দপূর্ণ পাঞ্চালগণকে ধরে রাখতে পারছিল না। এদিকে দ্রুপদরাজের মহিষী সেই কুমার ও কুমারীকে দেখে, তাঁদের পুত্র ও কন্যা করবার ইচ্ছায় যাজের কাছে গিয়ে বললেন, “এরা যেন আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে জননী বলে না জানে।” যাজও রাজার সন্তোষ জন্মাবার ইচ্ছায় মহিষীকে বললেন, “তাই হবে।” তখন পূর্ণমনোরথ ব্রাহ্মণগণ তাদের নামকরণ করলেন।

“অত্যন্ত প্রগল্‌ভ হয়েছে বলে এবং মূল্যবান কবচ ও কুণ্ডলের সঙ্গে উৎপন্ন হয়েছে বলে দ্রুপদরাজার এই পুত্রটির নাম হোক—ধৃষ্টদ্যুম্ন।” আর দৈববাণী এই শ্যামাঙ্গীকে “কৃষ্ণা” বলেছে বলে এবং এর বর্ণও শ্যামাই হওয়ায় এর নাম হোক “কৃষ্ণা”। দ্রুপদরাজার মহাযজ্ঞে সেই কুমার ও কুমারী জন্মলাভ করেছিল। তারপর প্রতাপশালী দ্রোণ দ্রুপদনন্দন ধৃষ্টদ্যুম্নকে আপন ভবনে এনে অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে তার উপকার করেছিলেন। কারণ অনিবার্য দৈব অবশ্যই হবে এই ভেবেই মহামতি দ্রোণ আপনার যশ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে শিক্ষা দিয়েছিলেন।”

ব্রাহ্মণের মুখে এই বর্ণনা শুনে পাণ্ডবরা পাঞ্চাল দেশ এবং দ্ৰৌপদী সম্পর্কে অত্যন্ত আকৃষ্ট হন। কুন্তীদেবী ছেলেদের মনের ভাব খুব ভাল বুঝতেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রস্তাব দিলেন যে, একস্থানে দীর্ঘদিন থাকা ভাল নয়—অতএব পাঞ্চাল নগরে যাবার প্রস্তাব দিলেন। পাণ্ডবরাও মাতার প্রস্তাবে সম্পূর্ণভাবে মত দিলেন। ইতিমধ্যে একদিন ব্যাসদেব সেই ব্রাহ্মণের গৃহে পাণ্ডবদের দেখা দিলেন। ধর্ম ও অর্থ প্রসঙ্গে বহু উপদেশ দেবার পর তিনি পাণ্ডবদের এক অদ্ভুত উপাখ্যান শোনালেন। এক তপোবনে এক মহর্ষির একটি কন্যা ছিল, তার কটিদেশ পিপীলিকার ন্যায় কৃশ এবং নিতম্বযুগল ও জ্বযুগল সুন্দর ছিল। আর তাতে সমস্ত গুণ ছিল। সে আপন কর্মের ফলে দুর্ভাগা হয়েছিল। কেন-না সে সুন্দরী হয়েও উপযুক্ত পতি পাচ্ছিল না। তারপরে সেই দুঃখিনী কন্যাটি উপযুক্ত পতি লাভ করবার জন্য তপস্যা করতে আরম্ভ করল এবং ভয়ংকর তপস্যা দ্বারা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করল। সন্তুষ্ট মহাদেব তাঁকে বললেন, “তোমাকে অভীষ্ট বর দেব! অভীষ্ট বর প্রার্থনা করো।” তারপর “সর্বগুণসম্পন্ন পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি” এই আপন হিতকর বাক্যটি পাঁচবার মহাদেবের কাছে সেই কন্যাটি বলল। তখন মহাদেব তাঁকে বললেন, “ভদ্রে, তোমার ভরতবংশীয় পাঁচটি পতি হবে।” মহাদেব একথা বললে, সেই কন্যাটি বরদাতা মহাদেবকে বলল, “দেব! প্রভো! আপনার অনুগ্রহে আমি একটি পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি।” তখন মহাদেব পুনরায় এই উত্তম কথা বললেন যে, “পতি দান করুন” এই কথাটি তুমি আমাকে পাঁচবার বলেছ, সুতরাং জন্মান্তরে তোমার পাঁচটি পতিই হবে।” সেই দেবরূপিণী কন্যাটি দ্রুপদের বংশে জন্মেছে, সুতরাং পৃষতপৌত্রী অনিন্দ্যসুন্দরী সেই কৃষ্ণানাম্নী কন্যাটিকেই মহাদেব তোমাদের পত্নী বলে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। অতএব বীরগণ, তোমরা পাঞ্চাল নগরীতে গিয়েই বাস করো, পরে সেই কন্যাটিকে লাভ করে সুখী হতে পারবে। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

বেদব্যাস চলে গেলে, পুরুষশ্রেষ্ঠ ও শত্রুদমনকারী পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্ত হয়ে গৃহস্বামী ব্রাহ্মণকে অভিবাদন জানিয়ে, তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুন্তীকে সামনে রেখে উত্তরমুখ সরল পথে পাঞ্চালদেশে যাত্রা করলেন। পথে গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্গারপর্ণের উপদেশ অনুসারে তাঁরা ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ ধৌম্যকে আপনাদের পুরোহিত পদে বরণ করে নিলেন।

স্বয়ংবরসভা

বেদপাঠী, পবিত্রচিত্ত, মনোহরাকৃতি এবং প্রিয়বাদী পাণ্ডবগণ ক্রমে পাঞ্চাল দেশে উপস্থিত হলেন। তাঁরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং রাজধানী এবং সেনানিবাস সকল দেখলেন। তাঁরা ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করে ভিক্ষান্ন দ্বারা জীবিকানির্বাহ করতে লাগলেন। দ্রুপদরাজার সর্বদাই ইচ্ছা ছিল যে, ‘পাণ্ডুনন্দন অর্জুনের হস্তে দ্রৌপদীকে দান করব।’ সেই অব্যক্ত ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তিনি এমন একখানি ধনু নির্মাণ করালেন যে, অর্জুন ভিন্ন কেউই তা নোয়াতে পারবে না। আর তিনি আকাশে একটি কৃত্রিম যন্ত্র নির্মাণ করালেন এবং তার উপরভাগে সেটি সংলগ্নভাবে একটি লক্ষ্যও নির্মাণ করালেন। তারপর দ্রুপদ বললেন, “যিনি এই ধনুতে গুণারোপণ করে এই বাণ ক’টি দ্বারা যন্ত্র অতিক্রম করে এই লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তিনি আমার কন্যা লাভ করবেন।”

দ্রুপদরাজা এইভাবে স্বয়ংবরে কন্যাপ্রার্থীদের কর্তব্য ঘোষণা করলেন। তা শুনে অন্যান্য রাজারা, কর্ণর সঙ্গে দুর্যোধন প্রভৃতি কুরুবংশীয়েরা এবং স্বয়ংবর দর্শনার্থী ঋষিরা সেখানে আসলেন।

নানাদেশ থেকে ব্রাহ্মণেরাও দেখতে আসলেন। তারপর দ্রুপদরাজা অন্নপানাদি দ্বারা আগন্তুক রাজাদের সংবর্ধনা করলেন। তখন পুরবাসী জনগণ স্বয়ংবর দেখার ইচ্ছায় সমুদ্রের ন্যায় কোলাহল করতে থেকে মঞ্চের উপর কাছে কাছে উপবেশন করল। রাজধানীর পূর্বোত্তর কোণে সমতল ও সুন্দর স্থানে সেই রাজারা নক্ষত্রসমূহাত্মক নারায়ণের মস্তকের দিকে উপবেশন করলেন। বিশাল সভামণ্ডপ সকল দিকেই সুসজ্জিত ছিল।

সেখানে নানাবিধ সপ্ততল অট্টালিকাতে রাজারা অলংকৃত হয়ে পরস্পর স্পর্ধা করতে থেকে অবস্থান করতে লাগলেন। নগরবাসী ও দেশবাসী লোকেরা দ্রৌপদীকে দেখবার জন্য সকল দিকে উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট মঞ্চের উপরে উপবেশন করল। আর পাণ্ডবরা দ্রুপদরাজার সেই অসাধারণ সম্পদ দেখতে থেকে ব্রাহ্মণদের সঙ্গেই উপবেশন করলেন। তারপর অনেকদিন ধরে সেই লোকসমাজ বৃদ্ধি পেল, প্রচুর ধনরত্ন দান চলতে লাগল এবং নট ও নর্তকগণ অভিনয় ও নৃত্য করতে থাকল। এই সমাজ সন্নিবিষ্ট হলে, ষোলো দিনের দিন দ্রৌপদী স্নান ও সুন্দর বস্ত্র পরিধান করে সমস্ত অলংকারে অলংকৃত হয়ে এবং মণিখচিত সুবর্ণমালা ধারণ করে রঙ্গস্থানে উপস্থিত হলেন।

তখন মন্ত্রজ্ঞ ও পবিত্র সোমক বংশীয়দের পুরোহিত অগ্নি স্থাপন করে তাতে ঘৃত দ্বারা যথাবিধানে হোম করলেন। তিনি হোম করে এবং ব্রাহ্মণগণ দ্বারা স্বস্তিবচন পাঠ করিয়ে সকলদিকের সকল বাদ্য নিবারণ করলেন। সেই রঙ্গস্থানটি নীরব হলে, মেঘ ও দুন্দুভির ন্যায় কণ্ঠধ্বনি সম্পন্ন ধৃষ্টদ্যুম্ন যথানিয়মে দ্রৌপদীকে নিয়ে সেই রঙ্গমঞ্চে গিয়ে মেঘের তুল্য গম্ভীরভাবে উচ্চৈঃস্বরে কোমল এবং মনোহর এই কথাগুলি বললেন, “সমবেত রাজগণ আমার কথা শ্রবণ করুন—এই ধনু, এই বাণ এবং ওই লক্ষ্য—আপনারা এই সুধার পাঁচটি বাণ দ্বারা ওই যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ওই লক্ষ্যটাকে বিদ্ধ করুন। উচ্চবংশ মনোহর রূপ এবং অসাধারণ বলশালী যে রাজপুত্র এই গুরুতর কার্য সম্পন্ন করতে পারবেন, আমার ভগিনী এই দ্রৌপদী আজ তাঁরই ভার্যা হবেন।”

ধৃষ্টদ্যুম্ন রাজাগণকে এই কথা বলে নাম, গোত্র ও কার্য দ্বারা উপস্থিত রাজগণের পরিচয় দেবার জন্য ভগিনী দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী! দুর্যোধন, দুর্বিষহ, দুর্মুখ, দুষ্প্রধর্ষণ, বিবিংশতি, বিকর্ণ সহ দুঃশাসন, যুযুৎসু, বায়ুবেগ, ভীমবেগ, উগ্ৰায়ুধ, বলাকী, কনকায়ু, বিরোচন, কুম্ভজ, চিত্রসেন, সুবৰ্চা, কনকধ্বজ, নন্দক, বাহুশালী, তুহুণ্ড এবং বিকট—এই সকল ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র এবং বলবান অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররাও কর্ণর সঙ্গে তোমার জন্য এসেছেন। উদারচেতা ও ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অন্যান্য অসংখ্য রাজাও এসেছেন। শকুনি, সৌবল, বৃষক এবং বৃহদ্বল—এই চারজন গান্ধার রাজার পুত্রও এসেছেন। তারপর অস্ত্রজ্ঞ শ্রেষ্ঠ অশ্বত্থামা এবং ভোজবান—এরা দু’জনও অলংকৃত হয়ে তোমার জন্য সমবেত হয়েছেন। বৃহন্ত, মণিমান এবং দণ্ডধার রাজাও এসেছেন। বার্ধক্ষেমি, জয়ৎসেন, মগধরাজ মেঘসন্ধি এবং শঙ্খ ও উত্তর নামক দুই পুত্রের সঙ্গে বিরাটরাজাও এসেছেন। কেনাবিন্দু, সুনামা, সুবৰ্চার সঙ্গে সুকেতুরাজ এসেছেন। সুচিত্র, সুকুমার, বৃক, সত্যধৃতি, সূর্যধ্বজ, রোচমান, নীল এবং চিত্রায়ুধ রাজা এসে সমবেত হয়েছেন। অংশুমান, চেকিতান, মহাবল শ্রেণিমান এবং সমুদ্রসেনের পুত্র প্রতাপশালী চন্দ্রসেন উপস্থিত হয়েছেন। বিদণ্ড এবং দণ্ড নামক পুত্রের সঙ্গে জলসন্ধ, পৌন্ড্রিক বাসুদেব এবং বলবান ভগদত্ত এসেছেন। কলিঙ্গের রাজা, তাম্রলিপ্তের রাজা, পত্তনের রাজা, পুত্রের সঙ্গে মদ্রদেশের রাজা মহারথ শল্য এসে সমবেত হয়েছেন। রুক্মাঙ্গদ ও রুক্ষরথের সঙ্গে কুরুদেশীয় সোমদত্ত এবং তাঁর মহারথ পুত্রগণ এসেছেন। মহাবীর ভূরি, ভূরিশ্রবা এবং শল—এঁরা তিনজন, আর কম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ এবং পুরুবংশীয় দৃঢ়ধ্বন্বা এসে সমবেত হয়েছেন। বৃহদ্বল, সুষেণ, উশীনরপুত্র শিবি এবং চৌরহন্তা বংশের রাজা এসেছেন। বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্নের পুত্র, গদ, অক্রূর, সাত্যকি, উদ্ভব, কৃতবর্মা, হার্দিক্য, পৃথু, বিপৃথু, বিদূরথ, কঙ্ক, শঙ্খ, গবেষণ, আশাবহ, অনিরুদ্ধ, সমীক, সারিমেজয়, বাস্পতি, ঝিল্লী, পিণ্ডারক এবং উশীনর—এই সকল বৃষ্ণিবংশীয়রা এসেছেন। ভগীরথ, বৃহৎক্ষত্র, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, বৃহদ্রথ, বাহ্রিক এবং মহারথ শতায়ু এসেছেন। উলুক, কৈতব, চিত্রাঙ্গদ, শুভাঙ্গদ, বৎসরাজ, কোশলরাজ বিক্রমশালী শিশুপাল এবং জরাসন্ধ এসেছেন। ভদ্রে! এঁরা এবং নানাদেশের অধীশ্বর অন্যান্য অনেক রাজা, আর জগৎপ্রসিদ্ধ বহুতর ক্ষত্রিয় তোমার জন্য এখানে এসেছেন। এই বিক্রমশালী রাজারা তোমার জন্য লক্ষ্যভেদ করতে প্রবৃত্ত হবেন। এঁদের মধ্যে যিনি এই লক্ষ্য ভেদ করতে পারবেন, তুমি আজ তাঁকেই বরণ করবে।”

কুণ্ডল প্রভৃতি সমস্ত অলংকারে অলংকৃত যুবক রাজগণ অস্ত্রশিক্ষা ও দৈহিক বল নিজেদের আছে মনে করে, পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা করতে থেকে, অস্ত্র উত্তোলন করে লক্ষ্যভেদের জন্য গাত্রোত্থান করলেন। কুলশীল, রূপ, যৌবন, বল ও বিত্ত থাকায় হিমালয়বাসী মদমত্ত শ্রেষ্ঠ হস্তীগণের মতো তাঁদের দর্প প্রকাশ পেতে লাগল। তাঁরা পরস্পরের প্রতি স্পর্ধাপূর্বক দ্রৌপদীর দিকে দৃষ্টিপাত করে, কামার্ত হয়ে “দ্রৌপদী আমারই হবেন” এইরূপ বলতে থেকে তৎক্ষণাৎ রাজাসন থেকে উঠলেন। পূর্বকালে হিমালয়কন্যা উমাকে লাভ করবার জন্য সমবেত দেবগণ যেমন শোভা পেয়েছিলেন, সেই দ্রুপদনন্দিনীকে লাভ করবার জন্য সমবেত সেই রাজগণও রঙ্গস্থানে এসে শোভা পেতে লাগলেন। তাঁদের চিত্ত দ্রৌপদীর উপরে নিবিষ্ট হয়েছিল বলে তাঁরা কামবাণে পীড়িত হতে থেকে রঙ্গস্থানে গিয়ে পরস্পরের বন্ধু হয়েও দ্রৌপদীর জন্য পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ করতে লাগলেন।

তখন একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, অশ্বিনীকুমারদ্বয় সমস্ত সাধ্যগণ, মরুদগণ এবং যমকে অগ্রবর্তী করে কুবের বিমানে আরোহণ করে আসলেন। দৈত্যগণ, গরুড়বংশীয় নাগগণ, দেবর্ষিগণ, গুহ্যকগণ, চারণগণ, বিশ্বাবসু, নারদমুনি, পর্বতমুনি এবং অপ্সরাদের সঙ্গে প্রধান গন্ধর্বগণও আসলেন। তখন বলরাম, কৃষ্ণ, বৃষ্ণিবংশীয়গণ, অন্ধকবংশীয়গণ এবং প্রধান প্রধান যদুবংশীয়গণ কৃষ্ণের মতানুসারে, দেবগণ এবং ঋষিগণের মতো কেবল দেখতেই লাগলেন। এই সময়ে মত্ত হস্তীর মতো সবল দেহ, ভস্মাবৃত অগ্নির মতো নিগূঢ় মুর্তি এবং একটি পদ্মকে লক্ষ্য করে অবস্থিত পাঁচটি হস্তীর মতো পাণ্ডবগণকে দেখেই কৃষ্ণ চিনতে পারলেন। তিনি বলরামের কাছে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের বিষয় বললেন। তখন বলরাম ধীরে ধীরে পাণ্ডবদের দেখে আনন্দিত চিত্তে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। কিন্তু দ্রৌপদীর দিকে মন ও নয়ন গিয়েছিল বলে অন্যান্য রাজা, রাজপুত্র বা রাজপৌত্রগণ হাই তুলতে থাকলেন এবং পাণ্ডবগণকে দেখতে পেলেন না, কেবল আরক্তনয়ন হয়ে ওষ্ঠদংশন করতে থাকলেন। সেইরূপই লম্বিতবাহু যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এঁরাও দ্রৌপদীকে দেখে সকলেই কামবাণে পীড়িত হতে লাগলেন। এই সময়ে দেবগণ, ঋষিগণ ও সিদ্ধগণ আকাশে এসে উপস্থিত হলেন। স্বর্গীয় সৌরভ ছুটতে থাকল, স্বর্গীয় পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল, বিশাল দুন্দুভিধ্বনি হতে থেকে আকাশ ব্যাপ্ত করল; বেণু, বীণা ও পণবের বাজনা হতে লাগল এবং বিমানে আকাশ ব্যাপ্ত হয়ে গেল।

তারপর কর্ণ, দুর্যোধন, শাল্ব, শল্য, দ্রৌণায়নি, ক্ৰাথ, সুনীথ এবং বক্র—এরা দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য ক্রমশ বিক্রম প্রকাশ করতে লাগলেন। আর কলিঙ্গ, বঙ্গ, পাণ্ড্য এবং পৌন্ড্রদেশের রাজা, বিদেহের রাজা, যবনদেশের রাজা এবং কিরীট, হার ও কেয়ূর ও বলয় প্রভৃতির অলংকারে অলংকৃত পদ্মনয়ন, দীর্ঘবাহু, বিক্রম ও অধ্যবসায়শালী অন্যান্য রাজারা, রাজপুত্ররা ও রাজপৌত্ররা ক্রমশ বল ও দর্পবশত গর্জন করতে লাগলেন কিন্তু বিশালাকৃতি ধনুতে গুণারোপণ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারলেন না; তবুও তাঁরা সেই ধনুর সামনে গিয়ে গুণারোপণ করার চেষ্টায় ধনুর আঘাতে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের তেজ নষ্ট হয়ে গেল এবং কিরীট, হার প্রভৃতি অলংকার ছড়িয়ে পড়ল; এই অবস্থায় তাঁরা নিশ্বাস ত্যাগ করে দ্রৌপদী লাভের আশা ত্যাগ করতে থাকলেন।

তখন ধনুর্ধর-প্রধান কর্ণ প্রায় সকল রাজার সেই অবস্থা দেখে ধনুর কাছে গেলেন এবং সত্বর সেই ধেনু উত্তোলন করে তাতে গুণারোপণ ও বাণ সংযোগ করলেন। পাণ্ডবগণ কর্ণকে দেখে মনে করলেন যে, পৃথিবীর মধ্যে এই কর্ণই লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে পেয়েছেন। আর অন্যান্য ধনুর্ধরেরা মনে করলেন যে, কর্ণ দ্রৌপদীর প্রতি অনুরাগবশত লক্ষ্যভেদ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছেন; সুতরাং তিনি আপন তেজে অগ্নি, সূর্য ও চন্দ্রকেও অতিক্রম করেছেন। কর্ণকে লক্ষ্যভেদ করতে উদ্যত দেখে দ্রৌপদী উচ্চৈঃস্বরে বললেন যে, “আমি সূতকে বরণ করব না (নাহং বরয়ামি সূতম)।” তখন কর্ণ ক্রোধ ও হাস্যর সঙ্গে সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে সেই স্পন্দিত ধনুখানা পরিত্যাগ করলেন।

এইভাবে সেই ক্ষত্রিয়রা সকল দিক থেকে নিবৃত্তি পেলে, চেদিরাজা যমের তুল্য বীর ও সাহসী, ধীরপ্রকৃতি ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান দমঘোষ পুত্র শিশুপাল সেই ধনুতে গুণ আরোহণ করতে প্রবৃত্ত হয়ে তারই আঘাতে হাঁটু পেতে ভূতলে বসে পড়লেন। তারপর মহাবীর ও মহাসাহসিক জরাসন্ধরাজা ধনুর কাছে গিয়ে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে একটু দাঁড়ালেন। তারপর তিনি সেই ধনুতে গুণারোপণ করতে প্রবৃত্ত হলেন, অমনি তার আঘাতে হাঁটু পেতে ভূতলে বসে পড়লেন। তখন তিনি উঠে নিজের রাজ্যে চলে গেলেন। তারপর মহাবীর ও মহাসাহসিক মদ্ররাজা শল্যও সেই ধনুতে গুণ পরাতে গিয়ে তার আঘাতে শিশুপালের দশাই প্রাপ্ত হলেন। তখন সমস্ত লোকই বিস্ময়ে চকিত হল; রাজারা লক্ষ্যভেদের চিন্তা পর্যন্ত পরিত্যাগ করলেন। এই সময়ে কুন্তীপুত্র মহাবীর অর্জুন সেই ধনুতে গুণারোপণ করে শরসংযোগ করার ইচ্ছা করলেন।

এই সময়ে ইন্দ্ৰধ্বজের মতো দীর্ঘাকৃতি অর্জুন অগ্রসর হচ্ছেন দেখে প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণগণ মৃগচর্ম আন্দোলিত করে “নিবৃত্ত হও, নিবৃত্ত হও” বলে কোলাহল করে উঠলেন। কতগুলি লোক উদ্বিগ্ন হল, কতগুলি লোক আনন্দিত হল, আর বুদ্ধিমান কতগুলি লোক এইসব বলতে লাগল, “হে ব্রাহ্মণগণ, লোকবিখ্যাত বলরাম ও ধনুর্বেদ নিরত শল্য প্রভৃতি ক্ষত্রিয়েরা যে কার্য সম্পন্ন করতে পারলেন না, অস্ত্রে অশিক্ষিত ও অত্যন্ত দুর্বল শরীর একটি ব্রাহ্মণ সেই গুণারোপণ করে-ধনুতে লক্ষ্যভেদ কীভাবে করবেন? এই ব্যক্তি পূর্বে লক্ষ্যভেদ পরীক্ষা করে দেখেনি, অথচ এখন চাঞ্চল্যবশত ওই কার্য যদি সম্পন্ন করতে না পারে, তবে সমস্ত রাজার কাছে ব্রাহ্মণরা হাস্যাস্পদ হবেন। এ ব্যক্তি গর্ব, হর্ষ বা ব্রাহ্মণ্যচাপল্যবশত যদি ধনু নোয়াবার জন্য প্রস্থান করে থাকে, তবে ওকে ভাল করে বারণ করুন; ও যেন না যায়।” ব্রাহ্মণরা বললেন, “আমরা জগতে উপহাস্যও হব না, কিংবা রাজাদের বিদ্বেষের পাত্রও হব না।” কতগুলি লোক বললেন, “এই ব্যক্তি যুবা, সুশ্রী, ঐরাবতের শুঁড়ের মতো দীর্ঘ এবং ধৈর্যে হিমালয়ের তুল্য; এর স্কন্ধযুগল, উরুযুগল ও বাহুযুগল স্থূল; সিংহের মতো সলীল গতি, বলিষ্ঠ দেহ এবং মত্ত হস্তীর মতো বিক্রম রয়েছে। সুতরাং এ লক্ষ্যভেদ করতে পারবে বলেই মনে হয় এবং উৎসাহ দেখেও তাই মনে হয়। এর দেহে শক্তি ও মনে প্রচুর উৎসাহ রয়েছে, এ সমর্থ না হলে নিজে যেত না। প্রাকৃত মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণদের অসাধ্য কোনও কাজ নেই। কেন-না ব্রাহ্মণরা কেবল জল, বায়ু ও ফল আহার করে সুদৃঢ়ভাবে যোগ অভ্যাস করে থাকেন; সুতরাং তাঁরা দেহে দুর্বল হলেও যোগপ্রভাবে অত্যন্ত বলবান। তার দৃষ্টান্ত— পরশুরাম একাকী যুদ্ধে সমস্ত ক্ষত্রিয়কে জয় করেছেন। সুতরাং সুখজনক বা দুঃখজনক, বিশাল বা ক্ষুদ্র এবং সৎ বা অসৎ যে-কোনও কার্য ব্রাহ্মণ করুন না কেন, তাঁকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ব্রাহ্মণ যে অসাধ্যসাধন করতে পারেন তার আরও একটি দৃষ্টান্ত—অগস্ত্য আপন ব্ৰহ্মতেজে অগাধ সমুদ্র পান করেছিলেন, আপনারা সকলেই বলুন যে, এ ব্যক্তি ক্ষুদ্র হলেও ব্ৰহ্মতেজে মহান, সুতরাং ইনি সত্বরই ধনুতে গুণারোপণ করতে পারবেন।” ব্রাহ্মণরা তাই বললেন। ব্রাহ্মণগণের মধ্যে এই ধরনের নানাবিধ আলোচনা চলতে লাগল।

তখন অর্জুন ধনুর কাছে গিয়ে কিছুকাল পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে থাকলেন, তারপর তিনি ভ্রমণ করে সেই ধনুখানাকে প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর অর্জুন মাথা নিচু করে ঈশ্বর, বরদাতা ও জগতের নিয়ন্তা কৃষ্ণকে প্রণাম ও মনে মনে ধ্যান করে ধনুর্ধারণ করলেন। পূর্বে রুক্মী, সুনীথ, বক্র, রাধেয়, দুর্যোধন, শল্য এবং শাল্ব প্রভৃতি প্রধান প্রধান রাজা বিশেষ যত্ন করে যে ধনুতে গুণারোপণ করতে পারেননি, দর্পশালী এবং বিষ্ণুর তুল্য প্রভাবযুক্ত ইন্দ্রপুত্র অর্জুন বীরগণের সামনেই নিমেষমধ্যে সেই ধনুতে গুণারোপণ করে সেই পাঁচটি বাণ হাতে নিলেন। পরে সেই লক্ষ্য বিদ্ধ করলেন, তৎক্ষণাৎ সেই লক্ষ্য যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত বিদ্ধ হয়ে ভূতলে পতিত হল। তখন আকাশে দেবগণের এবং সমাজমধ্যে সভ্যগণের বিশাল কোলাহল উত্থিত হল এবং দেবতারা অর্জুনের মাথায় স্বর্গীয় পুষ্প বর্ষণ করলেন।

তখন সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ উত্তরীয় বস্ত্র আন্দোলিত করতে থাকলেন এবং রাজারা লজ্জিত হয়ে সকল দিকেই হাহাকার করতে লাগলেন। আকাশের সকল দিক থেকেই পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল, বাদ্যকরেরা শতাঙ্গ ও তুর্য বাজাতে লাগল এবং সৃত ও মাগধগণ স্তুতিপাঠ করতে লাগল। আর শক্ৰহন্তা দ্রুপদরাজা অর্জুনকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং সৈন্যগণ নিয়ে তাঁর সাহায্য করবার ইচ্ছা করলেন। সেই বিশাল শব্দ ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে লাগল, ধার্মিকশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে সত্বরই বাসস্থানে চলে গেলেন।

বিদ্ধন্তু লক্ষ্যং প্রসমীক্ষ্য কৃষ্ণা পার্থঞ্চ শত্ৰুপ্রতিমং নিরীক্ষ্য।

স্বভ্যস্ত রূপাপি নবেব নিত্যং বিনাপি হাসং হসতীব কন্যা ॥

মদাদৃতেহপি স্খলিতীব ভাবৈর্বাচা বিনা ব্যাহরতীব দৃষ্ট্য।

আদায় শুক্লম্ বরমাল্যদাম জগাম কুন্তীসুতমুৎস্মবন্তী ॥ আদি : ১৮২ : ২৬-২৭ ॥

আর লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখে এবং বিদ্ধকারী অর্জুনের শৌর্য ও সৌন্দর্য ইন্দ্রের তুল্য নিরীক্ষণ করে দ্রৌপদী বহুদৃষ্ট হয়েও লোকের চোখে নূতন বলেই যেন প্রতীত হতে লাগলেন এবং হাস্য না করেও যেন হাসতে লাগলেন। দ্রৌপদী মত্ত না হয়েও যেন পড়ে যেতে লাগলেন এবং বাক্য ব্যতীত দৃষ্টি দ্বারাই যেন কিছু বলতে থাকলেন; এইভাবে তিনি শুভ্রবর্ণ বরমাল্য নিয়ে মনোহর মৃদু হাস্য করতে করতে অর্জুনের কাছে গমন করলেন।”

তারপর দ্রৌপদী শুভদৃষ্টি করে, নিঃশঙ্কচিত্তে রাজগণ ও ব্রাহ্মণগণের মধ্যে বরণের জন্য অর্জুনের বক্ষে সেই বরণমাল্য সমর্পণ করে তাঁকেই বরণ করলেন। পূর্বকালে শচী যেমন দেবরাজকে, স্বাহা যেমন অগ্নিকে, লক্ষ্মী যেমন নারায়ণকে, ঊষা যেমন সূর্যকে, রতি যেমন কামদেবকে এবং পার্বতী যেমন মহাদেবকে বরণ করেছিলেন, তখন ব্রাহ্মণেরা সেই রঙ্গবিজয়ী অচিন্ত্যকর্মা অর্জুনের বিশেষ গৌরব করতে থাকলে, তিনি দ্রৌপদীকে নিয়ে রঙ্গস্থান থেকে নির্গত হলেন, আর দ্রৌপদী তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন।

তখন দ্রুপদরাজা ব্রাহ্মণরূপী অর্জুনকে কন্যা দান করতে ইচ্ছা করলে, নিকটবর্তী রাজারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, “আমরা সম্মিলিত হয়েছি, এই অবস্থায় দ্রুপদ আমাদের তৃণের মতো অগ্রাহ্য করে স্ত্রীরত্ন দ্রৌপদীকে একটা ব্রাহ্মণের হাতে দিতে ইচ্ছা করছে। বৃক্ষরোপণ করে ফল জন্মাবার সময়ে সেটাকে নষ্ট করছে। সুতরাং যে আমাদের গ্রাহ্য করছে না, সেই দুরাত্মাকে আমরা বধ করব। এ গুণের কারণে সম্মান কিংবা বৃদ্ধের গৌরব পেতে পারে না, সুতরাং পুত্রের সঙ্গেই এই দুরাচারী রাজদ্বেষী দ্রুপদকে বধ করব। এই দুরাচার সমস্ত রাজাকে ডেকে এনে, উৎকৃষ্ট অন্ন ভোজন করিয়ে, তারপর আর গ্রাহ্য করছে না। দেবগণের মতো সমবেত রাজাদের মধ্যে এ একজনও রাজাকে উপযুক্ত মনে করল না। তারপর কন্যা বরণ করা বিষয়ে ব্রাহ্মণেরও অধিকার নেই। কেননা, ‘স্বয়ংবর ক্ষত্রিয়দের’ এই কিংবদন্তি জগতে প্রসিদ্ধ আছে। পক্ষান্তরে এই কন্যাটি যদি কোনও রাজাকেই বরণ করতে না চায়, তবে আমরা ওটাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করে আপন আপন রাজ্যে চলে যাব।

কিন্তু যদিও এই ব্রাহ্মণ চাঞ্চল্যবশত বা লোভবশত রাজগণের এই অপ্রিয় কার্য করেছে, তথাপি কোনও প্রকারেই একে বধ করা উচিত নয়। কেন-না, আমাদের জীবন, রাজ্য-ধন-পুত্র-পৌত্রাদি এবং অন্য যা-কিছু দ্রব্য আছে, সে সমস্তই ব্রাহ্মণের জন্য। তবে, আমরা অপমানের ভয় এবং স্বধর্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অবশ্যই দ্রুপদকে বধ করব, যাতে অন্যান্য স্বয়ংবরেও এই ধরনের না ঘটে।” এই কথা বলে পরিঘতুল্য বাহুশালী রাজারা অস্ত্রধারণ করে হৃষ্টচিত্তে দ্রুপদকে বধ করবার জন্য ধাবিত হলেন। তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে অঙ্গুলিত্র ধারণ করে আসছেন দেখে বিবাদ নিবৃত্তির জন্য দ্রুপদরাজা ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলেন।

মদস্রাবী হস্তীগণের মতো সেই রাজারা বেগে আসতে লাগলে, শত্রুহন্তা ভীম ও অর্জুন তাঁদের সম্মুখীন হলেন। তখন রাজারা ভীম ও অর্জুনকে বধ করবার জন্য অগ্রসর হলেন। তখন অদ্বিতীয় বীর, বজ্রের মতো দৃঢ় শরীর, অত্যন্ত বলবান এবং অদ্ভুত ভয়ংকর কার্যকারী ভীম বাহুযুগল দ্বারা একটি বৃক্ষ উপড়ে নিয়ে হস্তীর মতো সেটাকে পত্রশূন্য করলেন এবং দণ্ডধারী যমের মতো অর্জুনের পাশে দাঁড়ালেন। অমানুষ বুদ্ধি এবং অচিন্তনীয়কৰ্মা অর্জুনও ভ্রাতার সেই কাজ দেখে ভয় পরিত্যাগ করে বিস্ময়াপন্ন হলেন এবং ধনু ধারণ করে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং অচিন্তনীয়কৰ্মা কৃষ্ণ ভীমের সঙ্গে অর্জুনের সেই কার্য দেখে ভয়ংকর বলশালী ভ্রাতা বলরামকে বললেন, “আর্য! সংকর্ষণ। সিংহ ও বৃষের ন্যায় সলীলগামী এই যে ব্যক্তি তালপ্রমাণ বিশাল ধনু আকর্ষণ করছে, এ ব্যক্তি অর্জুন; আমি যদি বাসুদেব হই, তবে এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই যিনি বলপূর্বক বিশাল বৃক্ষ উপড়ে ফেলে তৎক্ষণাৎ রাজাগণকে পরাভূত করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, ইনি ভীমসেন। কেন-না, ভীমসেন ছাড়া পৃথিবীর মধ্যে অন্য কোনও ব্যক্তিই যুদ্ধে এরূপ কার্য করতে পারেন না। আর ওই যিনি এখান থেকে পূর্বে চলে গিয়েছেন, যাঁর নয়নযুগল পদ্মপত্রের মতো দীর্ঘ, শরীরটি বিশাল, সিংহের মতো গমন, স্বভাবটি বিনীত, শরীরের কান্তি গৌরবর্ণ এবং নাসিকাটি লম্বিত, উন্নত ও মনোহর, তিনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। তারপর দুটি কার্তিকের মতো যে দুই কুমার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে গিয়েছেন, তাঁরাই নকুল ও সহদেব। কারণ, আমি শুনেছিলাম যে, কুন্তীদেবী ও পাণ্ডবগণ সেই জতুগৃহ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন।” জলশূন্য মেঘের মতো শুভ্রবর্ণ বলরাম আনন্দিত হয়ে কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ! বড় আনন্দিত হলাম যে, আমাদের পিসি কুন্তীদেবী কৌরবপ্রধান যুধিষ্ঠির প্রভৃতির সঙ্গে ভাগ্যবশত মুক্তিলাভ করেছেন।”

ব্রাহ্মণরা মৃগচর্ম ও কমণ্ডলু আন্দোলিত করে অর্জুনকে বললেন, “তুমি ভীত হয়ো না, আমরা শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।” অর্জুন তাদের কথা শুনে বললেন, “আপনারা দর্শক হয়ে এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকুন। মন্ত্র দ্বারা যেমন সর্পগণকে বারণ করে, তেমনই আমি সরলমুখ শত শত বাণ দ্বারা এই ক্রুদ্ধ রাজাদের বারণ করব।” এই কথা বলে মহাবল অর্জুন পণলব্ধ ধনুখানাকে আয়ত করে ভীমের সঙ্গে পর্বতের মতো অচল হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর দুটি হস্তী যেমন বিপক্ষ হস্তীদের প্রতি ধাবিত হয়, তেমনি ভীম ও অর্জুন যুদ্ধবিশারদ কর্ণ প্রভৃতি ক্ষত্রিয়গণকে দেখে নির্ভয় হয়ে তাদের প্রতি ধাবিত হলেন। তখন সেই যুদ্ধার্থী রাজারা এই নিষ্ঠুর কথা বললেন, “ওহে! যুদ্ধার্থী ব্রাহ্মণেরও কিন্তু যুদ্ধে বধ দেখতে পাওয়া যায়।’ এই কথা বলে রাজারা তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণগণের প্রতি ধাবিত হলেন, আর মহাবল কর্ণ অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। হস্তিনীর জন্য একটি হস্তী যেমন অপর হস্তীর প্রতি ধাবিত হয়, তেমনি বলবান মদ্ররাজ শল্য ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। আর দুর্যোধন প্রভৃতি অন্যান্য রাজারা সেই যুদ্ধে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মিলিত হয়ে অযত্নের সঙ্গে কোমলভাবে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

তারপর মনোহর মূর্তি অর্জুন সুদৃঢ় ধনু আকর্ষণ করে সুধার বাণ দ্বারা সম্মুখগত কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। নিশিত, তীক্ষ্ণ্ণ বাণগুলির বেগ দেখে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ কর্ণ যত্ন নিয়ে অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। তখন বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ ও অর্জুন দু’জনেই ক্রুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে জয় করার ইচ্ছা করে এমনি লঘুহস্ততা দেখিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন যে, তাঁদের তারতম্য বোঝা গেল না। “তোমার কার্যের অনুরূপ কার্য দেখো, আমার বাহুবল দেখো,” এই ধরনের বীরত্বব্যঞ্জক বাক্য দ্বারা তাঁরা একে অপরকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। তারপর সূর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের বাহুবল জগতে অতুলনীয় বুঝে, ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি তখন অর্জুন নিক্ষিপ্ত বেগশালী সেই সকল বাণ প্রতিহত করে উচ্চ স্বরে সিংহনাদ করলেন। সৈন্যরা সে ঘটনার প্রশংসা করলেন। তখন কর্ণ বললেন, “ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, যুদ্ধে তোমার বাহুবল, অনবসন্নতা এবং আমার এই অস্ত্র ও শস্ত্র নিবারণ দেখে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি কি সাক্ষাৎ ধনুর্বেদ, না পরশুরাম, না ইন্দ্র, সাক্ষাৎ বিষ্ণু। আত্মগোপনের জন্য এই ব্রাহ্মণরূপ ধারণ করে বাহুবল অবলম্বনপূর্বক আমার সঙ্গে যুদ্ধ করলে? কারণ আমি যুদ্ধে ক্রুদ্ধ হলে, সাক্ষাৎ রাম কিংবা পাণ্ডব অর্জুন ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষ আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয় না।” কর্ণ এ-কথা বললে, অর্জুন প্রত্যুত্তরে বললেন, “কর্ণ! আমি ধনুর্বেদও নই। প্রতাপশালী পরশুরামও নই। যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ, আমি সমগ্র অস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন ব্রাহ্মণ; গুরুর উপদেশে ব্রাহ্ম ও ইন্দ্র অস্ত্রে শিক্ষিত হয়েছি। বীর আজ তোমাকে জয় করবার জন্য যুদ্ধে অবস্থান করছি। তুমি স্থির হও। অথবা বলো যে পরাজিত হয়েছি। পরে ইচ্ছানুযায়ী চলে যাও।” এই বলে অর্জুন কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। তারপর কর্ণ অন্য ধনু নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য বাণ সন্ধান করলেন। অর্জুন বাণ দ্বারা সে ধনুও ছেদন করে যুদ্ধে কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। ধনু ছিন্ন ও অঙ্গ অত্যন্ত বিদ্ধ হলে, মহাবল কর্ণ পলায়ন করলেন। মুহূর্তকালের মধ্যে তিনি অন্য ধনু ও বাণ নিয়ে পুনরায় যুদ্ধে আসলেন এবং অর্জুনের প্রতি বাণ বৃষ্টি করতে লাগলেন। তখন অর্জুন বাণ দ্বারা কর্ণের সেই সকল বাণ প্রতিহত করলেন। সেই সময় কর্ণ নিজের সকল বাণ প্রতিহত হয়েছে দেখে ব্রাহ্মতেজকে অজেয় মনে করে তৎক্ষণাৎ বাইরে চলে গেলেন।

সমরাঙ্গণের অন্য স্থানে মহাবীর শল্য ও ভীম পরস্পর আহ্বান এবং মুষ্টি ও জানু দ্বারা পরস্পর আঘাত করতে থেকে দুটি মত্ত হস্তীর মতো যুদ্ধ করতে লাগলেন। তাঁরা সম্মুখে দূরে প্রেরণ, কাছে টেনে আনা, দক্ষিণ পার্শ্বে ঠেলে দেওয়া ও বামপার্শ্বে পাঠানো এইরূপ পরম্পর কর্ষণ করতে লাগলেন এবং মুষ্টিদ্বারা আঘাত করতে লাগলেন, তা থেকে ‘চট চট’ শব্দ হতে থাকল। তাঁরা কিছুকাল পাষাণপাততুল্য চপেটাঘাত দ্বারা পরস্পরকে প্রহার করলেন, তারপরে পরস্পর আকর্ষণ করতে লাগলেন। তারপর ভীম দুই হস্তে শল্যকে মাথার উপরে তুলে মাটিতে ফেলে দিলেন, তখন ব্রাহ্মণেরা হেসে উঠলেন। তখন বলবান ভীম সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার করলেন যে, শল্যকে মাটিতে ফেলেও বধ করলেন না। ভীম শল্যকে ফেলে দিলে এবং কর্ণও আশঙ্কিত হলে সকল রাজাই আশঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করবার জন্য ভীমকে পরিবেষ্টন করে দাঁড়ালেন। সকলে মিলে তখন বললেন, “এই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ দু’জন বিশেষ প্রশংসার কার্য করেছেন; এখন আমরা জানতে চাই যে, এঁদের কোথায় জন্ম এবং কোথায়ই বা নিবাস? পরশুরাম, দ্রোণাচার্য, কৃষ্ণ, কৃপাচার্য এবং অর্জুন ছাড়া কোন ব্যক্তি কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে এবং কোন ব্যক্তিই বা দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয়? এবং মহাবীর বলরাম, পাণ্ডব ভীমসেন ও মহাবীর দুর্যোধন ব্যতীত কোন ব্যক্তি বীরশ্রেষ্ঠ মদ্ররাজ শল্যকে যুদ্ধে ভূপাতিত করতে পারে? অতএব ব্রাহ্মণের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে বিরত হোন। কারণ, ব্রাহ্মণেরা অপরাধ করলেও তাদের রক্ষা করা আমাদের সর্বদা কর্তব্য। তারপর এঁদের পরিচয় জেনে আনন্দিত হয়ে পুনরায় আমরা যুদ্ধ করব।”

কৃষ্ণ ভীমসেনের সেই কার্য দেখে, তাঁদের কুন্তীপুত্র মনে করে, সেই সকল রাজাকে এই বলে অনুনয় করে বারণ করলেন যে, “ইনি ধর্ম অনুসারেই দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন।” এইভাবে যুদ্ধবিশারদ সেই সকল রাজা বিস্মিত হয়ে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি পেয়ে যথাস্থানে চলে গেলেন। আর অন্য যে সকল লোক সেখানে এসেছিল, তারাও বলতে বলতে চলে গেল যে, “ব্রাহ্মণপ্রধান স্বয়ংবর সম্পন্ন হল, দ্রৌপদীকেও ব্রাহ্মণরাই পেলেন।” মৃগচর্মধারী ব্রাহ্মণে পরিবেষ্টিত ভীম ও অর্জুন তাদের মধ্য থেকে কষ্টেই বার হয়ে এলেন।

দ্রৌপদীর প্রথম পাণ্ডবগৃহে গমন

শত্রুগণ কর্তৃক অপরিক্ষতদেহ মনুষ্যবীর ভীম এবং অর্জুন দ্রৌপদীর সঙ্গে সেই জনসংঘ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণিমা তিথিতে মেঘমুক্ত চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় শোভা পেতে লাগলেন। এদিকে পুত্ররা ফিরে এল না, ভিক্ষা করার সময়ও চলে গেল, এই দেখে কুন্তীদেবী নানাবিধ অনিষ্টের আশঙ্কা করতে লাগলেন। ভাবলেন, “ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা চিনতে পেরে পাণ্ডবগণকে বিনষ্ট করেনি তো? কিংবা মায়াবী, ভয়ংকর ও অক্ষুণ্ণ বৈরী রাক্ষসেরা মেরে ফেলেনি তো? হায়, মহাত্মা বেদব্যাসের উক্তিগুলিও কি বিপরীত হল?” পুত্র স্নেহাকুল কুন্তীদেবী এইরকম নানাধরনের চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর মানুষ যখন নিদ্রিতের মতো নিষ্ক্রিয় থাকে, সেইরকম মেঘাচ্ছন্ন দুর্দিনের অপরাহ্বশেষে অর্জুন ব্রাহ্মণগণে পরিবেষ্টিত হয়ে, মেঘাবৃত সূর্যের মতো সেই কুম্ভকারের গৃহে প্রবেশ করলেন। মহাপ্রভাবশালী মনুষ্যশ্রেষ্ঠ ভীম ও অর্জুন সেই কুম্ভকারের কর্মশালায় গিয়ে কুন্তীকে লক্ষ্য করে, আনন্দিত চিত্তে দ্রৌপদীর বিষয় জানালেন যে, “মা! ভিক্ষা এনেছি।”

কিন্তু কুন্তী ঘরের ভিতরে ছিলেন বলে ভীমার্জুনকে না দেখেই বলে ফেললেন যে, “তোমার সকলে মিলে তা ভোগ করো।” পরে তিনি দ্রৌপদীকে দেখে বললেন যে, “হায়! আমি বড়ই কষ্টের কথা বলে ফেলেছি।” তারপর কুন্তী দ্রৌপদীর অধর্মের ভয়ে ভীত হয়ে, চিন্তা করতে থেকে দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, “পুত্র! তোমার কনিষ্ঠ সহোদর ভীম ও অর্জুন এই দ্রুপদরাজার কন্যাটিকে আমার কাছে ভিক্ষা বলে দিতে চেয়েছিল; তখন আমিও না জেনে ভিক্ষা মনে করেই উপযুক্ত কথাই বলে ফেলেছি যে, ‘তোমরা সকলে মিলে ভোগ করো।’ আমার এই কথা কী প্রকারে সত্য হতে পারে, এ-বিষয়ে যা সংগত হয়, যাতে এঁর পাপ না হয় এবং সেই পাপে উনি নরকে না যান, সেই উপায় বলো।

কুন্তী এই কথা বললে, বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির একটু কাল চিন্তা করে এবং কুন্তীকে আশ্বস্ত করে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন, তুমি দ্রৌপদীকে জয় করেছ সুতরাং এই রাজকন্যা তোমাকেই শোভা পাবেন। অতএব তুমি অগ্নি প্রজ্বলিত করো এবং যথাবিধানে তুমিই এর পাণিগ্রহণ করো।” অর্জুন বললেন, “মহারাজ! আপনি আমাকে অধর্মভোগী করবেন না, আপনি যা আদেশ করছেন, তা আমার পক্ষে ধর্মবিরুদ্ধ হবে, এই ব্যবহার অশিষ্টজনেই দেখা যায়। প্রথমে আপনি বিবাহ করবেন, তারপরে ভীম বিবাহ করবেন। তারপর আমি, তারপর নকুল, সহদেব বিবাহ করবেন। আমরা সকলে এবং এই কন্যা আপনার আজ্ঞাবহ। এ-কথা ঠিক হলে, এ-বিষয়ে যা ধর্মসংগত ও যশের কারণ বলে কর্তব্য হয়, আপনি চিন্তা করে তাই করুন আর যা পাঞ্চালরাজের হিত হয়, সে বিষয়ে উপদেশ দিন, আমরা সকলেই আপনার বশে আছি।”

তখন পাণ্ডবগণ অর্জুনের কথাগুলি ভক্তি ও স্নেহযুক্ত বুঝে দ্রৌপদীর উপর দৃষ্টিপাত করলেন। তখন দ্রৌপদী সমস্ত পাণ্ডবকেই দেখছিলেন, তাঁর দৃষ্টি দেখে সকল পাণ্ডবই দ্রৌপদীকে হৃদয়ে ধারণ করলেন। তাঁদের সকলেরই ইন্দ্রিয়সমূহ জয় করে প্রবল কামবেগ উপস্থিত হল। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি দ্রৌপদী অন্য নারী অপেক্ষা স্পৃহণীয় ছিল, সকলের মনোহর ছিল। মনুষ্যশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, ভীম প্রভৃতির ভঙ্গি ও অভিপ্রায় বুঝে বেদব্যাসের উক্তি স্মরণ করলেন। তারপর তিনি পরস্পর ভেদের ভয়ে ভ্রাতৃগণকে বললেন, “কল্যাণী দ্রৌপদী আমাদের সকলের ভার্যা হবেন।”

ঠিক এই আলোচনার সময়েই কৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে সেই কুম্ভকারের গৃহে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণর থেকে বয়সে দু’ বছরের বড় ছিলেন, বলরামের থেকে এক বছরের। সেই কারণেই কৃষ্ণ-বলরাম চরণধারণ করে যুধিষ্ঠির ও কুন্তীকে প্রণাম করলেন। মহাভারত পাঠকেরা স্মরণ রাখবেন যে, ব্যাসদেবের বর্ণনা অনুযায়ী এই প্রথম কৃষ্ণের সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের সাক্ষাৎ ঘটল। কুশলবিনিময় করে কৃষ্ণ-বলরাম পঞ্চপাণ্ডবের পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

ভীম ও অর্জুন যুদ্ধে জয়লাভ করে যখন সেই কুম্ভকারের গৃহে ফিরছিলেন, তখন দ্রুপদরাজার নির্দেশানুযায়ী ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন। ভগিনী কোন ঘরে কেমন পাত্রের হাতে পড়ল তা জানার কৌতূহল ধৃষ্টদ্যুম্নের ছিল। সন্ধ্যাবেলা ভিক্ষা করে এসে ভীমার্জুন ও নকুল সহদেব তা যুধিষ্ঠিরের কাছে সমর্পণ করলেন। তখন উদারস্বভাবা কুন্তীদেবী সেই ভিক্ষান্ন পাক করে দ্রৌপদীকে বললেন, “ভদ্রে, তুমি এই অন্নের অগ্রভাগ নিয়ে দেবতাদের উপহার এবং ব্রাহ্মণদের ভিক্ষা দাও। আর যে সকল লোক সকল দিকে ভোজনার্থী হয়ে আছে, তাঁদেরও দাও। তারপর যা থাকবে, এই দু’ভাগ করো। তার এই ভাগকে আবার চার ভাইয়ের জন্য চার ভাগ, আর এক ভাগ তোমার নিজের এক ভাগ আমার এরূপ ছ’ভাগ করো। তারপর এই যিনি শ্রেষ্ঠ হস্তীর ন্যায় বলিষ্ঠাকৃতি, গৌরবর্ণ ও যুবক এবং বিশাল দেহ, এই ভীমকে সেই অর্ধ ভাগ দাও। কেন-না, ইনি মহাবীর কিনা, তাই সর্বদাই অধিক ভোজন করে থাকেন।” সচ্চরিত্রা দ্রৌপদী কুন্তীদেবীর কথাগুলিকে ভাল বলেই মনে করলেন, তাই তিনি রাজকন্যা হয়েও আনন্দিত হয়ে কুন্তীর আদেশ অনুযায়ী কার্য করলেন, তখন পাণ্ডবরা সেই অন্ন ভোজন করলেন।

তারপর সহদেব ভূতলে কুশময় শয্যা রচনা করলেন। পরে পাণ্ডবরা সকলে তার উপর আপন আপন মৃগচর্ম আস্তৃত করে তার উপর ভূতলেই শয়ন করলেন। পাণ্ডবগণের মস্তক দক্ষিণ দিকে থাকলে, কুন্তী তাঁদের মাথার উপর এবং দ্ৰৌপদী তাঁদের চরণের নিম্নে শয়ন করলেন। দ্রৌপদী সেইভাবে শয়ন করলে, পাণ্ডবরা যেন তাঁকে পা-বালিশ করলেন। তাতেও দ্রৌপদীর শরীরে বা মনে কোনও দুঃখ হল না এবং তিনি পাণ্ডবগণকে কোনও অবজ্ঞা করলেন না। পাণ্ডবেরা সেইভাবে শয়ন করে সৈন্যবিষয়ে নানাবিধ কথোপকথন করতে লাগলেন এবং দিব্য অস্ত্র, রথ, হস্তী, তরবারি, বাণ ও পরশু সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের সমস্ত কথাই শুনলেন এবং তিনি ও তাঁর সঙ্গের লোকেরা দ্রৌপদীকে সেই অবস্থায় থাকতে দেখলেন।

রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবগণের সমস্ত বৃত্তান্ত এবং কথোপকথন রাত্রির মধ্যেই দ্রুপদরাজাকে জানাবেন বলে সত্বর চলে গেলেন। এদিকে দ্রুপদরাজা পাণ্ডবগণকে চিনতে না পেরে বিষণ্ণ হয়েছিলেন। তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন উপস্থিত হওয়া মাত্র তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “দ্রৌপদী কোথায় গেল? কে তাঁকে নিয়ে গেল? করদাতা কোনও হীনজাতি, কোনও শূদ্র বা বৈশ্য দ্রৌপদীকে নিয়ে যায়নি তো? কেউ আমার মাথায় কাদা মাখায়নি তো? কিংবা ফুলের মালা শ্মশানে পড়ে যায়নি তো? যে দ্রৌপদীকে নিয়ে গেছে, সে কোনও প্রধান ক্ষত্রিয় তো? কিংবা কোনও ব্রাহ্মণ তো? পুত্র! আজ কোনও হীন লোক দ্রৌপদীকে স্পর্শ করে আমার মস্তকে বামচরণ বিন্যস্ত করেনি তো? আমি অনুতপ্ত হব না তো? নরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীকে সম্মিলিত করে বিশেষ সন্তুষ্ট হব তো? ধৃষ্টদ্যুম্ন! যথার্থ বলল, কোন ব্যক্তি আজ আমার কন্যাটিকে জয় করে নিয়ে গেল? বিচিত্রবীর্যের পুত্র কুরুবংশপ্রধান পাণ্ডুর পুত্রগণ জীবিত আছেন তো? কুন্তীদেবীর কনিষ্ঠপুত্র অর্জুন আজ ধনুর্ধারণ করে লক্ষ্যভেদ করেছেন তো?”

দ্রুপদের প্রশ্নের উত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, “যে যুবকের নয়নযুগল সুদীর্ঘ ও রক্তবর্ণ, যিনি কৃষ্ণমৃগের চর্ম ধারণ করেছিলেন, যাঁর রূপ দেবতার তুল্য, যিনি সেই বিশাল ধনুতে গুণারোপণ করেছিলেন এবং লক্ষ্যভেদ করে ভূতলে পতিত করেছিলেন, আর যে বলবান যুবক ব্রাহ্মণগণে পরিবেষ্টিত ও আদৃত হয়ে দেবগণ ও ঋষিগণ সেবিত দেবরাজ যেমন অসুরগণের মধ্যে প্রবেশ করতেন, সেইরকম একাকী শত্রুগণের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, তখন অসহিষ্ণু রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করতে আসতে থাকলেও, হস্তিনী যেমন হস্তীর অনুসরণ করে, সেইরূপ দ্রৌপদী যার মৃগচর্ম ধারণ করে তাঁর অনুসরণ করেছিলেন; তারপর অন্য কোনও বীর বিশাল একটি বৃক্ষ ভগ্ন করে যম যেমন প্রাণীগণকে মর্দন করেন, তেমনই রাজাগণকে মর্দন করতে থেকে সেই যুবকেরই অনুসরণ করেছিলেন। সেই মহাবীর দু’জনেই রাজগণের সমক্ষে দ্রৌপদীকে নিয়ে চন্দ্র ও সূর্যের মতো দীপ্তি পেতে থেকে, নগরের বাইরে ভার্গব নামক কোনও কুম্ভকারের কর্মশালায় গিয়েছেন। সেখানে অগ্নিশিখার ন্যায় একটি মহিলা বসেছিলেন, তিনি তাদের জননী হবেন বলেই আমার ধারণা। কারণ, সেই যুদ্ধবিজয়ী বীর দুটির মতো আরও তিনটি অগ্নিশিখা তুল্য তেজস্বী বীর সেই মহিলাটিকে বেষ্টন করে ছিলেন।

তারপর যুদ্ধবিজয়ী সেই যুবক দু’জন গিয়ে সেই মহিলার চরণে নমস্কার করে দ্রৌপদীকে বললেন, “তুমিও নমস্কার করো।” তখন দ্রৌপদী নমস্কার করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলে, তাঁর বিষয় জানিয়ে তাঁদের মধ্য থেকে চারজন ভিক্ষা করতে গেলেন। তাঁরা ভিক্ষা করে আনলেন, বৃদ্ধা তা পাক করলেন, তখন দ্রৌপদী সেই অন্ন নিয়ে প্রথমে দেবতা ও ব্রাহ্মণকে দিয়ে পরে সেই বৃদ্ধাকে ও সেই বীর ক’টিকে পরিবেশন করে দিয়ে নিজেও খেলেন। তারপর তাঁরা সকলেই শয়ন করলেন, আর দ্রৌপদী তাঁদের পা-বালিশের মতো রইলেন। তাঁদের শয্যা ভূতলেই নির্মিত হয়েছিল, প্রথমে কুশ পেতে তার উপর মৃগচর্ম আস্তৃত করা হয়েছিল। তখন তাঁরা সজল মেঘের ন্যায় গম্ভীর স্বরে নানাবিধ কথোপকথন করতে লাগলেন। কিন্তু সে বীরগণ ব্রাহ্মণ, বৈশ্য বা শূদ্রের উপযোগী কথোপকথন করেননি। তাঁরা যেরকম যুদ্ধবিষয়ে কথোপকথন করলেন, তাতে বোধহয় তাঁরা নিশ্চয়ই ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ। তা হলে আমাদের আশা নিশ্চয়ই পূর্ণ হয়েছে। কারণ আমরা শুনেছি যে পাণ্ডবরা অগ্নিদাহ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। তারপর সেই যুবক যেরূপ বলপূর্বক ধনুতে গুণারোপণ করেছেন, লক্ষ্যভেদ করেছেন আর যেরূপ যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, তাতে বোধহয় তিনি এবং অন্যরা পাণ্ডব—গোপনে বিচরণ করছেন।” তখন দ্রুপদ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁদের নিকট পুরোহিতকে এই বলে পাঠালেন যে, “আপনি গিয়ে বলবেন, আপনাদের পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি, আপনারা কি মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্র?” রাজার আদেশ পেয়ে পুরোহিত সেখানে গিয়ে, তাঁদের গুণকীর্তন করে রাজার উপদেশ অনুসারে তাঁদের সমস্ত কথাই বললেন, “মহাশয়গণ!, লোকের অভিলাষপূরক পাঞ্চালরাজ আপনাদের পরিচয় জানতে ইচ্ছা করেন; কেন-না, লক্ষ্যভেদকারী এই যুবকটিকে দেখে তিনি আনন্দের অন্ত পাচ্ছেন না। আপনারা আপনাদের জ্ঞাতি ও বংশের আনুপূর্বিক বিবরণ বলুন। শত্রুর মস্তকে চরণ সমর্পণ করুন এবং আমার ও সানুচর পাঞ্চালরাজের হৃদয় আনন্দিত করুন। পাণ্ডুরাজা দ্রুপদরাজা অভিন্ন হৃদয় প্রিয়সখা ছিলেন; সুতরাং দ্রুপদরাজার এই ইচ্ছা যে আমার কন্যাটি পাণ্ডুরাজার পুত্রবধূ হোক। হে সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষগণ! দ্রুপদরাজার মনে সর্বদাই এই অভিলাষ রয়েছে যে, স্থূল ও দীর্ঘবাজু অর্জুন ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে আমার এই কন্যাটি লাভ, করবেন। আমি যদি তাঁকে এই কন্যাটি দান করতে পারি, তবে বড়ই ভাল কাজ করা হবে এবং তাতে আমার যশ, পুণ্য ও মঙ্গল হবে।”

এই কথা বলে পুরোহিত বিরত হলে, তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে যুধিষ্ঠির নিকটবর্তী ভীমকে বিনীতভাবে আদেশ করলেন, “ভীম একে পাদ্য ও অর্ঘ্য দান করো। কারণ দ্রুপদরাজার পুরোহিত আমাদের বিশেষ পূজনীয়; সুতরাং এঁকে বিশেষভাবে পূজা করাই আমাদের উচিত।” তারপরে ভীমসেন সেইভাবে পূজা করলেন, তখন সেই পুরোহিত সেই পূজা গ্রহণ করে আনন্দে সুখে উপবেশন করলে, যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, “মহাশয়! দ্রুপদরাজা আপন ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারেই কন্যাদান করতে ইচ্ছা করেছিলেন। কেবল ইচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই নয়, তাই তিনি যে পণ নির্দেশ করেছিলেন, সেই বীর সেই পণেরই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু দ্রুপদরাজা সে-বিষয়ে জাতি, কুল, শীল বা বংশ— এর কোনওটিই বলতে ইচ্ছা করেননি। কেবল ধনুতে গুণারোপণ করা এবং লক্ষ্যভেদ করা— এই মাত্র পণ রেখেই কন্যাদান করার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন। এই মহাত্মা, রাজাদের মধ্যে সেইভাবেই এই দ্রৌপদীকে জয় করেছেন। এমন অবস্থায় দ্রুপদরাজা আমাদেরও দুঃখ জন্মাবার জন্য অনুতাপ করতে পারেন না। দ্রুপদরাজার অভিলাষ, তাও সম্পন্ন হবে এবং এই রাজকন্যাটি সর্বথা তাঁর প্রাপ্য পাবেন এই আমি মনে করি। কারণ সেই ধনুতে গুণারোপণ করা দুর্বলের অসাধ্য এবং সেই লক্ষ্যভেদ করে পাতিত করা অশিক্ষিত বা হীন জাতির পক্ষে অসাধ্য। অতএব কন্যার জন্য দ্রুপদরাজা অনুতাপ করতে পারেন না। কেন-না, এই জগতে ইনি ভিন্ন অন্য লোক সেই লক্ষ্যভেদ করে পতিত করতে পারে না।”

যুধিষ্ঠির যখন এই কথা বলছিলেন, এমন সময়ে দ্রুপদরাজার কাছ থেকে আর-একটি লোক ‘অন্ন প্রস্তুত হয়েছে’ এই কথা জানাবার জন্য সেখানে উপস্থিত হল। দূত বলল, “মহাশয়গণ, দ্রুপদরাজা নিজ কন্যার বিবাহ সম্পন্ন করবার জন্য বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের ভোজনের নিমিত্ত অন্ন প্রস্তুত করিয়েছেন। সুতরাং আপনারা প্রাত্যঃকৃত্যাদি সম্পন্ন করে ভোজনের জন্য সেখানে চলুন। স্বর্ণপদ্মখচিত রাজোচিত এই রথগুলি আপনাদের বহন করে নিয়ে যাবে।” তারপর পুরোহিতকে আগে পাঠিয়ে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি সকলেই সেই উৎকৃষ্ট রথে আরোহণ করে প্রস্থান করলেন; কুন্তী ও দ্রৌপদী এক রথে গেলেন।

যুধিষ্ঠির যে-কথা বলেছিলেন, তা পুরোহিতের মুখে শুনে দ্রুপদরাজা তাদের চেনার উদ্দেশ্যে নানাবিধ উপহার দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাগে রাখলেন। একদিকে ফল ও মালা, অপরদিকে চর্ম, বর্ম, বাহন এবং অন্যদিকে কৃষিকার্যের জন্য গোরু, দড়ি ও নানাবিধ বীজ রাখলেন। সেই সময় অন্য শিল্পকার্যে যে-সকল খেলার উপকরণ ব্যবহৃত হত, সে সমস্তই উপহার দেবার জন্য দ্রুপদরাজা সেখানে রাখলেন। উজ্জ্বল চর্ম ও বর্ম, বিশাল তরবারি, নানাবিধ অশ্ব ও রথ, উৎকৃষ্ট ধনু, উত্তম বাণ এবং স্বর্ণভূষণে ভূষিত শক্তি ও ঋষ্টি সে-স্থানে স্থাপিত করলেন। আর কুন্ত, ভূশণ্ডি ও পরশু সর্বপ্রকার যুদ্ধের উপকরণ, শয্যা, আসন এবং নানাবিধ অস্ত্র সেখানে সাজিয়ে রাখলেন।

এদিকে কুন্তী দ্রৌপদীকে নিয়ে দ্রুপদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন, তখন সেই স্থানের স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে তাঁর পরিচর্যা করতে লাগল। এদিকে পাণ্ডবগণের গমন সিংহের ন্যায় বিক্ৰমসূচক, নয়নযুগল মহাবৃষের ন্যায় বিশাল, মৃগচর্ম উত্তরীয়, সেই উত্তরীয়ে আবৃত স্কন্ধযুগল সুন্দর এবং বাহুযুগল বৃহৎ সৰ্পশরীরের ন্যায় দীর্ঘ। এই সমস্ত দেখে দ্রুপদরাজা, তাঁর মন্ত্রীগণ, পুত্রগণ, বন্ধুগণ ও অনুচরগণ এঁরা সকলেই সর্বপ্রকারে অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। মহাবীর ও মনুষ্যশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ তখন নিঃশঙ্কচিত্তে জ্যেষ্ঠানুক্রমে গিয়ে পাদপীঠযুক্ত মহামূল্য উৎকৃষ্ট আসনে উপবেশন করলেন, কিন্তু সেগুলি দেখে বিস্মিত হলেন না। তারপর পরিস্কৃতবেশধারী দাস-দাসী ও পাচকগণ সুর্বণ নির্মিত ও রৌপ্যনির্মিত পাত্রে করে রাজভোগ্য নানাবিধ খাদ্য পরিবেশন করল। তাঁরা আপন আপন ইচ্ছানুসারে সেই সকল বস্তু ভোজন করে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত হলেন এবং অন্যান্য দ্রব্য পরিত্যাগ করে তাঁরা যুদ্ধের উপকরণযুক্ত গৃহে প্রবেশ করলেন। তা দেখে দ্রুপদরাজার পুত্রগণ এবং প্রধান প্রধান মন্ত্রীগণের সঙ্গে স্বয়ং দ্রুপদরাজাও অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে নিকটে গিয়ে তাঁদের কুন্তীর ও পাণ্ডুর পুত্র বলে ধারণা করলেন।

তারপর দ্রুপদরাজা যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণের যোগ্য ব্যবহার দেখিয়ে প্রসন্নচিত্তে তাঁর কাছে প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কি ব্রাহ্মণ? না ক্ষত্রিয়? না গুণবান বৈশ্য বা শূদ্র? অথবা ব্রাহ্মণই বটেন, তবে মায়া অবলম্বন করে সকল দিকে বিচরণ করছেন? অথবা আপনারা দেবতা, দ্রৌপদীকে দেখার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন? আপনি আমাদের কাছে সত্য বলুন; কেননা এ-বিষয়ে আমাদের মধ্যে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। আপনি দয়া করে এ-বিষয়টি সত্য বলুন, কেন-না, রাজসভায় সত্যই শোভা পায়। তারপর যাগ প্রভৃতি হোক বা কূপনিৰ্মাণাদি হোক, কোনও বিষয়েই মিথ্যা বলতে নেই। হে দেবতাতুল্য! আপনার কথা শোনার পর আমি যথাবিধানে বিবাহকার্য সম্পাদন করব।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “মহারাজ, আপনি বিষণ্ণ হবেন না, আপনার আনন্দই হোক। কেন-না আপনার চিরকালের অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে। কারণ আমরা ক্ষত্রিয় এবং মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্র, তন্মধ্যে আমি কুন্তীদেবীর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং এঁরা ভীম ও অর্জুন। এরা দু’জনেই রাজসভায় আপনার কন্যাকে জয় করেছেন। আর প্রথমাবধি কুন্তী এবং পরে দ্রৌপদী গিয়ে যেখানে ছিলেন, সেইখানে নকুল ও সহদেব ছিলেন। নরশ্রেষ্ঠ! আপনার মনের দুঃখ দূর হোক, আমরা ক্ষত্রিয়। পদ্মিনী যেমন এক হ্রদ থেকে অপর হ্রদে যায়, আপনার এই কন্যাটিও তেমন এক রাজার কাছ থেকে অপর রাজার কাছে গিয়েছেন। এ সমস্তই আমি আপনার কাছে সত্য বলছি; কারণ আপনি আমাদের গুরু এবং পরম আশ্রয়।”

তখন দ্রুপদরাজার নয়নযুগল আনন্দে বিস্ফারিত হল। তিনি তখন যুধিষ্ঠিরকে যোগ্য উত্তর দিতে পারলেন না। পরে তিনি যত্নপূর্বক সেই আনন্দের বেগ রুদ্ধ করে যুধিষ্ঠিরের কাছে উপযুক্ত উত্তর করলেন। পাণ্ডবগণ যেভাবে জতুগৃহ থেকে চলে গিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রুপদ জিজ্ঞাসা করলেন, যুধিষ্ঠির আনুপূর্বিক সেই সমস্ত ঘটনা দ্রুপদের কাছে বললেন। তখন দ্রুপদরাজা সেইসব কথা শুনে রাজা ধৃতরাষ্ট্রর গুরুতর নিন্দা করলেন এবং বাগ্মীশ্রেষ্ঠ দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করলেন, আর তাঁর রাজ্য তাঁকে দেবেন বলে প্রতিজ্ঞাও করলেন। তারপর কুন্তী, দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দ্রুপদরাজার নির্দেশক্রমে বিশাল এক অট্টালিকায় গিয়ে প্রবেশ করলেন।

দ্রৌপদীর বিবাহ-বিভ্রাট

পাণ্ডবগণ দ্রুপদ কর্তৃক সম্মানিত হয়ে দ্রুপদ প্রদত্ত অট্টালিকাতে বাস করতে থাকলেন। তারপর কিছুদিন পরে দ্রুপদরাজা পুত্রগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আশ্বস্ত চিত্তে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আজ বিবাহের প্রশস্ত দিন, সুতরাং আজই মহাবাহু অর্জুন যথাবিধানে কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন এবং আমাদের নির্দিষ্ট লগ্নও আপনি অনুমোদন করুন।” তখন যুধিষ্ঠির দ্রুপদরাজাকে বললেন, “মহারাজ, আমারও তো বিবাহ করতে হবে।” দ্রুপদ বললেন, ‘বীর, তা হলে আপনিই যথাবিধানে আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন অথবা আপনি যাঁর পাণিগ্রহণের কথা ইচ্ছা করেন, তাঁর কথা বলুন।” যুধিষ্ঠির বললেন, “মহারাজ, দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই মহিষী হবেন, এই কথা আমার মা পূর্বেই বলেছেন। আমি ও ভীম এখনও বিবাহ করিনি, অথচ অর্জুন আপনার রত্নসদৃশী কন্যাটিকে জয় করেছেন। তাতে আমাদের সকলের এই নিয়ম আছে যে, আমরা সকলে মিলে রত্ন ভোগ করব; আমরা সে-নিয়ম ত্যাগ করতে চাই না। সুতরাং দ্রৌপদী আমাদের সকলের মহিষী হবেন; অতএব ইনি অগ্নির নিকটে জ্যেষ্ঠানুক্রমে আমাদের সকলের পাণিগ্রহণ করুন।” দ্রুপদ বললেন, “বাবা যুধিষ্ঠির, বেদে একপুরুষের অনেক স্ত্রী বিহিত আছে বটে, কিন্তু একটি স্ত্রীর অনেক পতি কোথাও শোনা যায় না। অতএব হে কুদ্দীনন্দন! আপনি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্র হয়ে, লোকবিরুদ্ধ এবং বেদবিরুদ্ধ অধর্মের কাজ করতে পারেন না; সুতরাং আপনার এরূপ বুদ্ধি হল কেন?” যুধিষ্ঠির বললেন, “মহারাজ! ধর্ম অতি সূক্ষ্ম পদার্থ; সুতরাং আমরা তার গতি বুঝতে পারি না, তাই প্রাচীনেরা যে-পথে গিয়েছেন, আমরাও সেই পথ অনুসরণ করে থাকি। তারপর আমার বাক্যও কখনও মিথ্যা কথা বলে না এবং মনও অধর্মের দিকে যায় না এবং মাতৃদেবীও এইকথা বলেছেন, আমার অভিপ্রায়ও তাই। অতএব মহারাজ, এ নিশ্চয়ই ধর্ম; সুতরাং আপনি বিচার না করে এই করুন, আপনার যেন এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ না হয়।

দ্রুপদ বললেন, “যুধিষ্ঠির, আপনি, কুন্তীদেবী এবং আমার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, আপনারা এ-বিষয়ে কর্তব্য স্থির করুন, যা স্থির হয় তা পরে করা যাবে।” তখন তাঁরা মিলিত হয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। এই সময়ে ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে বেদব্যাস সেখানে আগমন করলেন। তখন পাণ্ডবরা সকলে এবং দ্রুপদরাজা গাত্রোত্থান করে বেদব্যাসকে নমস্কার করলেন। বেদব্যাসও তাঁদের সকলকে সমাদরপূর্বক মঙ্গল প্রশ্ন করে নির্মল সুবর্ণাসনে উপবেশন করলেন। এবং দ্রুপদ প্রভৃতি অন্য সকলেও বেদব্যাসের অনুমতিক্রমে মহামূল্য আসনে উপবেশন করলেন। তারপর দ্রুপদরাজা মধুর বাক্যে বেদব্যাসের কাছে দ্রৌপদীর বিবাহের বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। “একটি স্ত্রী বহু পুরুষের পত্নী হবে, অথচ তাতে ধর্ম মিশ্রিত পাপ কেন হবে না, এই বিষয়টি আপনি আমার কাছে যথাযথভাবে বলুন।” বেদব্যাস বললেন, “লোকবিরুদ্ধ এবং বেদবিরুদ্ধ বলে যে আচারকে পাপ বলে ধারণা হয়, তাতে যাঁর যে যে মত হয়েছে, তা আমি আগে শুনতে ইচ্ছা করি।” দ্রুপদ বললেন, “এটা পাপ, কেন-না এ লোকবিরুদ্ধ ও বেদবিরুদ্ধ, সুতরাং একটি পুরুষের বহু স্ত্রী হলেও, একটি স্ত্রীর বহুপরুষ স্বামী হতে পারে না। এই আমার মত। আর প্রাচীন মহাত্মারাও এরূপ আচরণ করেননি, এ-কথা জেনেশুনে মানুষের কোনও প্রকারেই এই পাপ করা উচিত নয়। এইজন্যই আমি বিবাহ-সম্পাদন করবার বিষয়ে কোনও চেষ্টাই করছি না। কারণ, এটা ধর্ম কি অধর্ম এরূপ সন্দেহ আমার সর্বদাই হচ্ছে।” ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, “তপোধন! সদাচারী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কী করে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভার্যাতে উপগত হবেন। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলে ধর্মের গতি আমরা কোনও প্রকারেই বুঝতে পারছি না। তাই এটা কি ধর্ম না অধর্ম, এই সন্দেহ হতে থাকলে আমাদের মতো লোকেরা কোনও চেষ্টাই করতে পারে না, সুতরাং দ্রৌপদী পাঁচটি পুরুষের পত্নী হবেন, এমন বিষয়ে আমরা কোনও চেষ্টাই করছি না।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “আমার বাক্য কখনও মিথ্যা বলে না, মনও অধর্মে যায় না। অথচ এ-বিষয়ে আমার মন গিয়েছে, সুতরাং এটা কোনও প্রকারেই অধর্ম হতে পারে না। পুরাণেই শুনতে পাই, জটিলা নামে গৌতমবংশীয়া ধার্মিক শ্রেষ্ঠা রমণী সাতজন মুনিকে পতিরূপে আশ্রয় করেছিলেন। এবং বাক্ষী নামে কোনও মুনিকন্যা তপস্যায় বিশুদ্ধচিত্ত প্রচেতা নামধারী দশ ভ্রাতার সঙ্গে পত্নীরূপে মিলিত হয়েছিলেন। তারপর মহর্ষিরা গুরুবাক্যকে ধর্মপ্রযোজক বলে থাকেন, অথচ মাতা সকল গুরুর মধ্যে প্রধান গুরু। সেই মাতৃদেবীও এই কথা বলেছেন যে, ‘ভিক্ষালব্ধ অন্নের মতো তোমরা সকলেই ভোগ করো, সুতরাং আমি এটাকে প্রধান ধর্ম বলেই মনে করি।’ কুন্তী বললেন, “ধার্মিক যুধিষ্ঠির যা বলল, তাই সত্য। সুতরাং মিথ্যা থেকে আমার অত্যন্ত ভয় হচ্ছে, আমি কী করে মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব।”

বেদব্যাস বললেন, “ভদ্রে! তুমি মিথ্যা থেকে মুক্তি পাবে। কেননা, এ সনাতন ধর্ম, তবে তা সকলের পক্ষে নয়। দ্রুপদরাজা, আপনি নিজের মুখে শুনুন। যখন এ ধর্ম বলে বিহিত আছে, যখন এ সনাতন এবং যখন একে যুধিষ্ঠিরও ধর্ম বলেই বললেন, তখন এ অবশ্য ধর্ম।” তারপর ভগবন বেদব্যাস গাত্রোত্থান করে দ্রুপদরাজার হস্ত ধারণপূর্বক অন্য নির্জন গৃহে প্রবেশ করলেন। আর পাণ্ডবগণ, কুন্তী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন যেখানে বসে ছিলেন, সেখানে থেকেই তাঁদের দুজনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। তারপর বেদব্যাস মহাত্মা দ্রুপদের কাছে বহু পুরুষের এক পত্নী হওয়া যে ধর্ম তা বলতে লাগলেন।

বেদব্যাস বললেন, “মহারাজ, পূর্বকালে নৈমিষারণ্যে দেবতারা এক যজ্ঞ করেন, সেই যজ্ঞে যম পুরোহিত হয়ে যজ্ঞ সম্পাদন করতে থাকেন। যজ্ঞ সম্পাদনে প্রবৃত্ত যম কোনও মানুষকেই মারতেন না। মৃত্যুহীন মনুষ্যেরা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে লাগল। তখন ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, কুবের, সাধ্যগণ, রুদ্রগণ, বসুগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতারা সেখানে এলেন। সুখাৰ্থী সমবেত দেবগণ মনুষ্যবৃদ্ধিবশত অত্যন্ত ভীত ও অস্থিরচিত্ত হয়ে ব্রহ্মাকে বললেন, “আমরা সকলেই আপনার শরণাপন্ন হলাম।” ব্রহ্মা বললেন, “তোমাদের মানুষের কাছ থেকে ভয় কীসের? তোমরা সকলেই অমর। অতএব মানুষের কাছ থেকে তোমাদের ভয় হতে পারে না।” দেবতারা বললেন, “মনুষ্যরাও এখন অমর হয়েছে। সুতরাং মনুষ্য ও দেবতাদের কোনও পার্থক্য নেই। সেই পার্থক্য না থাকাতেই আমরা ভীত হয়ে আপনার কাছে এসেছি।” ব্রহ্মা বললেন, “যম যজ্ঞ সম্পাদনে ব্রতী আছেন, তাই মনুষ্যরা মরছে না। কিন্তু যম যজ্ঞ সম্পাদন করে মনোনিবেশ করলেই মনুষ্যের মৃত্যুকাল উপস্থিত হবে। যমের শরীরেই তোমাদের প্রভাবে আবার সকলে বিভিন্ন প্রকার হবে। সেই শরীরই মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে, সেই অন্তিমকালে মানুষেরাও আর বাঁচবার শক্তি পাবে না।”

তখন দেবতারা ব্রহ্মার কথা শুনে যজ্ঞস্থানে যাবার জন্য যাত্রা করলেন। পথে তাঁরা সমবেত হয়ে গঙ্গাতীরে বসেছিলেন, এমন সময়ে দেখলেন, একটি স্বর্ণপদ্ম গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছে। তা দেখে তাঁরা বিস্মিত হলেন। তখন তাঁদের মধ্যে বলবান ইন্দ্র সেই পদ্মটির কাছে গেলেন, গিয়ে যেখানে গঙ্গার জল গভীর সেখানে অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বলাকৃতি একটি রমণীকে দেখতে পেলেন। সেই রমণী জলার্থিনী হয়ে গঙ্গায় নেমে রোদন করছিল। তার যে সকল অশ্রুবিন্দু জলে পড়ছিল, সেইগুলিই সেখানে স্বর্ণপদ্ম হচ্ছিল। সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে ইন্দ্র তখনই তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভদ্রে! তুমি কে? কী জন্যই বা রোদন করছ? সত্য বলো, আমি শুনতে ইচ্ছা করি।” রমণী বলল, “ইন্দ্র, আমি কে এবং যে জন্য রোদন করছি, তা আপনি জানতে পারবেন। আসুন, সম্মুখের দিকে চলুন। দেখবেন— আমি যে জন্য রোদন করছি।” তখন রমণীটি চলতে লাগল, ইন্দ্রও তার পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন—নিকটে হিমালয়ের উপরে সুন্দর একটি যুবক ব্যাঘ্রচর্মের উপর উপবেশন করে অন্য একটি যুবতীর সঙ্গে পাশা খেলছে। কিন্তু সে যুবক পাশাখেলায় এমনই মত্ত হয়ে ছিল যে, ইন্দ্রকে দেখেও গাত্রোখান করল না বা অভ্যর্থনা করল না। এই কারণে ক্রুদ্ধ ইন্দ্র বললেন, “ওহে! এই সমস্ত জগৎসংসার আমার অধীনে আছে, আমিই এর অধীশ্বর।”

ইন্দ্রকে দেখে সেই যুবক হাস্য করল এবং ইন্দ্রের প্রতি ধীরে ধীরে দৃষ্টিপাত করল। তৎক্ষণাৎ ইন্দ্র স্তব্ধশরীর হয়ে স্থাণুর মতো অবস্থান করতে লাগলেন। তারপর তার পাশাখেলা সমাপ্ত হলে সেই যুবক রোদনকারিণী সেই যুবতীকে বলল, “আমার কাছে ওকে নিয়ে এসো, ওর যাতে আর দর্প উপস্থিত না হয়, তা করে দিচ্ছি।” তখন সেই রমণী গিয়ে ইন্দ্রকে স্পর্শ করা মাত্র তাঁর সমস্ত অঙ্গ শিথিল হয়ে গেল, তিনি ভূতলে পড়ে গেলেন। তখন যুবকরূপী উগ্রতেজা মহাদেব ইন্দ্রকে বললেন, “ইন্দ্র! তুমি আর এরূপ দর্প কখনও কোরো না। তোমার অতুলনীয় বল ও প্রভাব আছে, সুতরাং তুমি এই মহাপর্বত প্রমাণ পাথরটাকে সরিয়ে ফেলো এবং এই গর্তের মধ্যে প্রবেশ করো। সেখানে সূর্যের মতো তেজস্বী তোমারই মতো আরও কয়েকটি পুরুষ আছে।” তখন ইন্দ্র হিমালয়ের সেই গর্ত আবিষ্কার করে নিজের তুল্য তেজস্বী আরও চারটি পুরুষ দেখতে পেলেন। তাঁদের দেখে দুঃখিত হলেন এবং ভাবলেন, “আমিও এদের মতো হব না তো?” তারপর মহাদেব কূপিত হয়ে নয়নযুগল বিস্ফারিত করে ইন্দ্রকে বললেন, “ইন্দ্র তুমি এই গুহায় প্রবেশ করো, যেহেতু মূর্খতাবশত তুমি আমাকে পূর্বে অবজ্ঞা করেছ।”

মহাদেব এই কথা বললে, ইন্দ্র যাতনায় পীড়িত হয়ে বায়ুচালিত অশ্বপত্রের মতো সেই হিমালয়ের উপরে শিথিল অঙ্গে কম্পিত হতে লাগলেন। মহাদেব সহসা ওইরূপ বললে, দেবরাজ কাঁপতে থেকে কৃতাঞ্জলি হয়ে বহুমূর্তি মহাদেবকে বললেন, “সমস্ত জগতের মধ্যে আজ আপনিই আমার প্রতি প্রথম অনুগ্রহ করুন।” তখন উগ্রতেজা মহাদেব হাস্য করে ইন্দ্রকে বললেন, “অহংকারীরা অনুগ্রহ লাভ করে না। এরাও পূর্বে অহংকার করেছিল বলে এই গুহাতে আছে, সুতরাং তুমিও এই গুহায় প্রবেশ করে অবস্থান করো। তোমরা মর্ত্যলোকে গিয়ে মানুষ হয়ে থাকবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং তোমরা সকলে গিয়ে মনুষ্যযোনিতে প্রবিষ্ট হও। সেখানে তোমরা শত্রুর অসহ্য কাজ করে এবং বহু শত্রুকে বিনাশ করে, আপন আপন কর্ম অনুসারে পুনরায় ইন্দ্রলোকে আসবে। আমি বললাম বলে এ সমস্তই হবে এবং অন্য নানাবিধ কার্যও তোমরা করবে।” পূর্ববর্তী ইন্দ্রেরা বললেন, “আমরা দেবলোক থেকে মনুষ্যলোকে যাব, যেখানে মুক্তি দুর্লভ। তবে ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়—এই পাঁচজন দেবতা আমাদের জননীর গর্ভে উৎপাদন করবেন।”

নূতন ইন্দ্র পূর্ববর্তী ইন্দ্রগণের কথা শুনে পুনরায় মহাদেবকে বললেন, “আমি দেবগণের কার্য সম্পাদন করবার জন্য আপন বীর্য দ্বারা উৎপাদিত মৎপুত্রকেই এঁদের পঞ্চম ইন্দ্র করে পাঠাতে ইচ্ছা করি।” সেই পাঁচজন ইন্দ্রের মধ্যে প্রথমের নাম বিশ্বভৃক, দ্বিতীয়ের নাম ভূতধামা, তৃতীয়ের নাম শিবি, চতুর্থের নাম শান্তি এবং পঞ্চমের নাম তেজস্বী ছিল। ভগবান মহাদেব নিজের সদ্‌স্বভাববশত তাঁদের সেই অভিলাষ পূর্ণ করবার অঙ্গীকার করলেন এবং এঁদের ভোগ্য স্বর্গবাসীর লোভনীয় স্বর্গলক্ষ্মীকে মনুষ্যলোকে তাঁদের ভার্যা হবার জন্য আদেশ দিলেন। তারপরে যাঁর মহিমার ইয়ত্তা করা যায় না, যিনি অনন্ত, অস্পষ্ট, জন্মহীন, সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সনাতন, বিশ্বব্যাপক এবং অনন্তমূর্তি—সেই নারায়ণের কাছে সেই পাঁচজন ইন্দ্রের সঙ্গে মহাদেব গমন করলেন।

নারায়ণও সেই সমস্ত বিষয়ের অনুমোদন করলেন; তখন পঞ্চ ইন্দ্র এবং স্বর্গলোকলক্ষ্মী পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলেন। এই সময়ে নারায়ণ নিজের একটি শুক্লকেশ ও একটি কৃষ্ণবর্ণ কেশ উৎপাটন করলেন। সেই কেশ দুটি গিয়ে যদুবংশে দেবকী ও রোহিণীর গর্ভে প্রবেশ করল। তার মধ্যে শুক্লবর্ণ কেশটি বলরাম হল এবং কৃষ্ণবর্ণ কেশটি কেশব অর্থাৎ কৃষ্ণ হল। হিমালয়ের সেই গুহার ভিতরে পূর্বে যে সেই ইন্দ্ররূপী চারটি পুরুষ আবদ্ধ ছিলেন, তাঁরা চারজনেই এই মর্ত্যলোকে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেব, আর অর্জুন হলেন সেই নূতন ইন্দ্রের অংশ। পূর্বে যে পাঁচজন ইন্দ্র ছিলেন, তাঁরাই এভাবে পঞ্চপাণ্ডব হয়েছেন, আর মহাদেব পূর্বে যে স্বর্গলক্ষ্মীকে এঁদের ভার্যা হবার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি এই মনোহর দ্রৌপদী হয়েছেন। এরূপ দৈবযোগ ব্যতীত যজ্ঞাবসানে কী করে একটি স্ত্রী ভূতল থেকে উঠতে পারে? যাঁর রূপ চন্দ্রের এবং সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল এবং দেহের সৌরভ এক ক্রোশ দূরে ছড়িয়ে পড়ে। মহারাজ দ্রুপদ, আমি আপনাকে বরস্বরূপ দিব্যদৃষ্টি দিচ্ছি, আপনি পুণ্যবশত ভূতপূর্ব ইন্দ্রদেহধারী পাণ্ডবদের দর্শন করুন।”

মহর্ষি কন্যাকে মহাদেবের আশীর্বাদ

তারপর অদ্ভুতকর্মা শুদ্ধচিত্ত বেদব্যাস তপস্যার প্রভাবে দ্রুপদরাজাকে দিব্যচক্ষু দান করলেন। তখন দ্রুপদরাজা গবাক্ষরন্ধ্র দ্বারা সকল পাণ্ডবকেই ভূতপূর্ব ইন্দ্রদেহধারীদের দেখলেন। তিনি দেখলেন, পাণ্ডবগণের স্বর্গীয় মূর্তি, দেহে ছায়া বা নয়নে নিমেষ নেই। সুবর্ণের মুকুট ও মালা, ইন্দ্রের ন্যায় আকৃতি, অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল বর্ণ, মস্তকে স্বর্গীয় পুষ্পের মালা, মনোহর মূর্তি, যৌবন বয়স, বিশাল বক্ষ, সুদীর্ঘ দেহ, ধূলিশূন্য স্বর্গীয় বস্ত্র এবং সুগন্ধি উৎকৃষ্ট মালা রয়েছে, তাতে সাক্ষাৎ শিব, বসুগণ, রুদ্রগণ ও আদিত্যগণের মতো দেবযোগ্য সর্বগুণসম্পন্ন দেখা যাচ্ছে। মনোহর মূর্তি যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবকে পূর্ব ইন্দ্রমূর্তি দেখে এবং অর্জুনকে নূতন ইন্দ্রমূর্তি দেখে আর তাঁদের শক্তিকে অলৌকিক ও অনির্বচনীয় পর্যবেক্ষণ করে দ্রুপদরাজা আনন্দিত ও বিস্মিত হলেন। আর সাক্ষাৎ চন্দ্র ও অগ্নির মতো উজ্জ্বলকান্তি, স্বর্গীয়মূর্তি, অতিসুন্দরী দ্রৌপদীকে রূপ, তেজ ও যশে তাঁদেরই উপযুক্ত পত্নী স্বর্ণলক্ষ্মী মনে করে দ্রুপদরাজা আনন্দে অধীর হলেন। দ্রুপদরাজা সেই গুরুতর আশ্চর্য ঘটনা দেখে বেদব্যাসের চরণযুগল ধারণ করলেন, বেদব্যাস প্রসন্ন হয়ে দ্রুপদরাজাকে বললেন, “কোনও তপোবনে একটি মহর্ষির কন্যা ছিল। সে কন্যাটি সুন্দরী হয়েও উপযুক্ত পতি পাচ্ছিল না। তারপর সেই কন্যাটি ভয়ংকর তপস্যা করে মহাদেবকে সন্তষ্ট করে মহাদেবের সাক্ষাৎ লাভ করল। মহাদেব সেই কন্যাটিকে বলেন, “তোমার অভীষ্ট বিষয় প্রার্থনা করো।” মহাদেব এই আদেশ করলে, “আমি সর্বগুণসম্পন্ন পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি” এই কথাটি সে পাঁচবার মহাদেবকে বলেছিল। তখন মহাদেব সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকে সেই বর দিলেন এবং বললেন, “ভদ্রে! তোমার পাঁচটি পতি হবে।” তখন কন্যাটি মহাদেবকে প্রসন্ন করে পুনরায় সেই কথা বলল যে, “শংকর আমি আপনার কাছে গুণবান একটি পতি প্রার্থনা করি।” তখন সন্তুষ্টচিত্ত মহাদেব পুনরায় তাঁকে বললেন, “ভদ্রে! তুমি ‘পতি’ দিন এই কথাটি পাঁচবার আমাকে বলেছ। সুতরাং সে বাক্য সেইরূপই হবে, তোমার মঙ্গল হোক, জন্মান্তরেই তোমার পঞ্চপতি হবে।” দ্রুপদ রাজা, দেবরূপিণী সেই ঋষিকন্যাই আপনার কন্যা দ্রৌপদী হয়ে জন্মেছেন এবং এই অনিন্দ্যসুন্দরী পৃষতপৌত্রী দ্রৌপদীকে বিধাতা পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী বিধান করেছেন। সেই স্বর্গলক্ষ্মী মধ্যে ঋষিকন্যা হয়ে, ঘোরতর তপস্যা করে পাণ্ডবগণের জন্য মহাযজ্ঞে উৎপন্ন হয়ে, এখন আপনার কন্যা হয়েছেন। দ্রুপদরাজা, পরমসুন্দরী দেবসেবিতা সেই দেবী স্বর্গলক্ষ্মীকেই তাঁর কর্ম অনুসারে পঞ্চপাণ্ডবের একমাত্র পত্নীরূপে স্বয়ং বিধাতা সৃষ্টি করেছেন, এ-কথা শুনে আপনার যা ইচ্ছা, তাই করতে পারেন।”

দ্রুপদ বললেন, “মহাত্মন! আপনার এই সত্যবাক্য শ্রবণ করে আমার মোহ দূর হয়েছে। ঈশ্বরবিহিত বিষয়ের নিবৃত্তি করা মানুষের শক্তিসাধ্য নয়। অতএব দ্রৌপদীকে পঞ্চপাণ্ডবের হাতে দান করাই সংগত। দৈবের ঘটনা অত্যন্ত দৃঢ়; সুতরাং মানুষ তার নিবৃত্তি করতে পারে না, অতএব জগতে মানুষ নিজের চেষ্টায় কিছুই করতে পারে না। কারণ, আমি একটি বরের জন্য যে লক্ষ্যভেদ পণ করেছিলাম, তাই এখন বহু বরের পণে দাঁড়াল।”

বিবাহ

বেদব্যাসের সঙ্গে নিভৃতে আলোচনার পর রাজা দ্রুপদ পুত্রগণের সঙ্গে কুন্তী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন যেখানে ছিলেন, সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “যুধিষ্ঠির, আজ শুভদিন, কেন-না আজ চন্দ্র পুত্রোৎপাদক যোগে রয়েছেন, সুতরাং তুমি আজ প্রথমে দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করো।” যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে তিনি ভীম প্রভৃতিকে বললেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠগণ, তোমরা ক্রমশ আপন আপন পাণি দ্বারা দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করো।”

তখন দ্রুপদরাজা ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে মিলিত হয়ে বর ও কন্যার জন্য নির্বাচিত সেইসব উৎকৃষ্ট বস্ত্র ও দ্রব্যাদি আনয়ন করলেন এবং দ্ৰৌপদীকে স্নান করিয়ে ও নানাবিধ অলংকারে রত্নালংকৃত করে সুসজ্জিত করলেন। তারপর দ্রুপদরাজার বন্ধুগণ, মন্ত্রীগণ, ব্রাহ্মণগণ ও পুরবাসীগণ সম্মিলিত হয়ে প্রধান প্রধান ব্যক্তিকে অগ্রবর্তী করে আনন্দিত চিত্তে বিবাহ দেখবার জন্য উপস্থিত হলেন। পূর্বেই ভৃত্যরা পদ্ম ও উৎপল ছড়িয়ে উঠানগুলিকে ভূষিত করেছিল, সৈন্যগণ উজ্জ্বলবেশে নানাস্থানে অবস্থান করছিল এবং বহুস্থানে উজ্জ্বল রত্নসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছিল, আর সেই সময়ে প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা এসে উজ্জ্বল বেশ পরিধান করে সভার শোভা বৃদ্ধি করেছিলেন; সুতরাং বিরাট ভবনখানি তখন দ্রুপদরাজার জয় ঘোষণা করে নির্মল নক্ষত্রযুক্ত আকাশের মতো শোভা পাচ্ছিল।

তখন যুধিষ্ঠির প্রভৃতি রাজপুত্রগণ স্নান ও মাঙ্গলিক কার্য সম্পাদন করে কুণ্ডল প্রভৃতি অলংকারে অলংকৃত হয়ে আকাশের মতো সূক্ষ্ম মহামূল্যবান বস্ত্র পরিধান করে এবং চন্দন তিলকে সজ্জিত হয়ে গুরুজনদের নমস্কার করতে করতে মহাবৃষেরা যেমন গোষ্ঠে প্রবেশ করে সেইরূপ অগ্নির তুল্য তেজস্বী ধৌম্য পুরোহিতের সঙ্গে ক্রমশ বিবাহসভায় প্রবেশ করলেন। তখন বেদপারদর্শী ও মন্ত্রজ্ঞ ধৌম্য পুরোহিত প্রজ্বলিত অগ্নি স্থাপন করে মন্ত্রপাঠপূর্বক হোম করলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে সম্মিলিত করলেন। তখন, দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠির পরস্পর হস্ত ধারণ করলে, ধৌম্য পুরোহিত তাঁদেরকে অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করালেন, যুধিষ্ঠিরই প্রথম ধন, গোরু ও নানাবিধ রত্নধারণ করে ব্রাহ্মণকে দিতে লাগলেন। ব্রাহ্মণরা সন্তুষ্ট হলে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করলেন এবং ধৌম্য পুরোহিত অগ্নিকল্প ঋষিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে হোম সম্পন্ন করলেন।

তারপর আকাশ হতে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল এবং সৌরভযুক্ত বাতাস বইতে লাগল। তখন রাজপুরোহিত মহাত্মা ধৌম্য যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে ব্রাহ্মণগণ, দ্রুপদরাজার বন্ধুগণ এবং দ্রুপদরাজার কাছে গিয়ে পুনরায় তাঁদের প্রশ্ন করলেন, “অপর রাজপুত্রেরা এখন যথাবিধানে রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করুন।” তখন রাজা দ্রুপদ তাঁর প্রশংসা করে বললেন, “তাই করুন।” তখন ভীম প্রভৃতি উত্তম বেশধারী রাজপুত্ররা পর পর দিনে দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করলেন। যুধিষ্ঠিরের বিবাহ হয়ে গেলে, প্রত্যহ প্রাতঃকালে ব্রহ্মর্ষি ব্যাসদেব অদ্ভুত, অলৌকিক ও উত্তম এই বাক্য দ্রৌপদীকে বলতেন যে,

মহানুভবা কিল সা সুমধ্যমা বভুব কন্যৈব গতে গতেহহনি ॥ আদি : ১৯১: ২২ ॥

“—তুমি আবার কন্যা হও।” তাতেই সেই দ্রৌপদী, মহাপ্রভাবশালিনী নারী, সেই বিবাহের দিন অতীত হলেই কন্যা হয়ে যেতেন।

পতিশ্বশুরতা জ্যেষ্ঠে পতি দেবরাহনুজে।

মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যাস্ত্রিতয়ং ত্ৰিতয়ং ত্ৰিষু ॥ আদি : ১৯১: ২৩ ॥

“যুধিষ্ঠির কেবল দ্রৌপদীর পতি ও কেবল ভাশুর হলেন এবং সহদেব তাঁর পতি ও কেবল দেবর হলেন, আর ভীম, অর্জুন ও নকুল— এঁরা প্রত্যেকেই তাঁর পতি, ভাশুর ও দেবর হলেন।”

বিবাহ হয়ে গেলে, দ্রুপদরাজা পাণ্ডবদের নানাবিধ উৎকৃষ্ট ধন এবং একশত রথ যৌতুক দিলেন, তাঁদের প্রত্যেক রথে সোনার ঝালর ও সোনার লাগাম যুক্ত চারটে করে অশ্ব ছিল। স্বর্ণময় শৃঙ্গযুক্ত একশত পর্বতের ন্যায় স্বর্ণপদ্মভূষিত একশত হস্তী এবং মহামূল্য বেশ, আভরণ, রত্ন ও মাল্যযুক্ত পূর্ণযুবতী একশত দাসী দান করলেন। আর মহাত্মা দ্রুপদরাজা অগ্নিকে সাক্ষী করে পাণ্ডবগণের প্রত্যেককেই পৃথক পৃথকভাবে সুনয়না অনেক দাসী, প্রচুর ধন, মহামূল্য বস্ত্র ও অলংকার দান করলেন। বিবাহ হয়ে গেলে ইন্দ্রতুল্য বলবান পাণ্ডবরা প্রচুর রত্নালংকারে অলংকৃতা স্বর্গলক্ষ্মীরূপা সেই দ্রৌপদীকে নিয়ে দ্রুপদের পুরে বিহার করতে লাগলেন। দ্রুপদরাজা পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছিলেন বলে তাঁর দেবগণ থেকেও কোনও ভয় ছিল না।

মহাত্মা দ্রুপদরাজার মহিষীরা কুন্তীর কাছে গিয়ে আপন আপন নাম উচ্চারণ করে তাঁকে প্রণাম করে তাঁর মস্তকে কুন্তীর চরণধূলি গ্রহণ করলেন। দ্রৌপদী পট্টবস্ত্র পরে মাঙ্গলিক কার্য সম্পাদন করে, শাশুড়ি কুন্তীর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে তাঁর সম্মুখে অবনতা ও কৃতাঞ্জলি হয়ে দাড়াতেন। কুন্তীও বাৎসল্যবশত সুরূপা, সুলক্ষণা, সৎস্বভাবা ও সদাচারী পুত্রবধু দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করে বলতেন, “শচী যেমন ইন্দ্রের, স্বাহা যেমন অগ্নির, রোহিণী যেমন চন্দ্রের, দময়ন্তী যেমন নলের, ভদ্রা যেমন কুবেরের, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠের এবং লক্ষ্মী যেমন নারায়ণের আদরের পাত্রী, তুমিও তেমনই ভর্তাদের আদরের পাত্রী হও। ভদ্রে! তুমি চিরজীবী ও মহাবীর পুত্র প্রসব করো, বহুবিধ সুখলাভ করো, গুণবতী ও ভাগ্যবতী হও, নানাবিধ ভোগ করো এবং পতিদের যজ্ঞপত্নী ও পতিব্রতা হও। অতিথি, অভ্যাগত, সাধু, বালক, বৃদ্ধ ও গুরুজনদের যথানিয়মে সেবা করতে থাকা অবস্থায় যেন তোমার চিরদিন চলে যায়। কুরুজাঙ্গল দেশের রাজ্য ও যেসকল নগর আছে, তাতে তুমি ধর্মানুরক্ত হয়ে রাজার সঙ্গে অভিষিক্ত হও। মহাবীর স্বামীরা বিক্রম প্রকাশ করে যে সকল রাজ্য জয় করবেন, সে সমস্তই তুমি অশ্বমেধ যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের দান কোরো। পৃথিবীতে যে-সকল উৎকৃষ্ট রত্ন আছে, সে সমস্তই তুমি লাভ করো। তুমি সুখে থেকে শত বৎসর জীবিত থাকো। আজ যেমন পট্টবস্ত্র পরিহিতা তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তেমন পুত্র জন্মালে ভাগ্যবতী অবস্থাতেও তোমাকে আশীর্বাদ করব।”

পাণ্ডবরা বিবাহ করেছেন শুনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের জন্য মুক্তা ও বৈদূর্যমণি খচিত নানাবিধ অলংকার, মহামূল্য বস্ত্র, সুখস্পর্শ কম্বল, সুলক্ষণ রত্ন, বৃহৎ বৃহৎ শয্যা এবং আরও অনেক বস্তু উপহার স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন।

হস্তিনায় দ্রৌপদী—ইন্দ্রপ্রস্থে পট্টমহিষী ও সন্তান জন্ম

গুপ্তচরের মুখে স্বয়ংবরসভার বৃত্তান্ত শুনে ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে, পুত্র দুর্যোধনই লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। পরে বিদুরের মুখে তিনি প্রকৃত সংবাদ শুনলেন। ধৃতরাষ্ট্র আপাতসন্তোষ বজায় রাখলেও দুর্যোধন ও কর্ণের প্ররোচনায় পাণ্ডবদের ক্ষতি করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু প্রাথমিক আলোচনায় পাণ্ডবদের ক্ষতি করা সম্ভব নয় বলেই তাঁদের বোধ হল। তখন এ-বিষয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুরের মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

ভীষ্ম বললেন, যে-কোনও প্রকারে পাণ্ডবদের মধ্যে ভেদ প্রচেষ্টা করা তাঁর অভিপ্রেত নয়। তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করে, তাঁদের অর্ধরাজ্য দান করার প্রস্তাব দিলেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এই রাজ্য পাণ্ডবদের পিতামহের, বিশেষত পিতার ছিল। কেন-না, দুর্যোধন যতটা এ রাজ্য পৈতৃক বলে বোধ করেন, পাণ্ডবরাও ততটাই এ রাজ্য পৈতৃক বোধ করার অধিকারী। দুর্যোধন অধর্ম অনুসারে রাজ্য হাতে পেয়েছেন। বাস্তবিক পক্ষে এ রাজ্যের যথার্থ অধিকারী পাণ্ডবরা। সুতরাং তিনি দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে সন্ধি করার পক্ষে মত দিলেন। আচার্য দ্রোণ, ভীষ্মের বক্তব্য সর্বাংশে করণীয় উচিত বলে তার সপক্ষে মত দিলেন। কর্ণের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতের বিপরীত হল। বিদুর, ভীষ্ম ও দ্রোণের বক্তব্য সম্পূর্ণ অনুমোদন করলেন, তিনি পাণ্ডবদের বলবীর্যের কথা স্মরণ করলেন। আরও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, বলরাম ও সাত্যকি সম্পূর্ণভাবে পাণ্ডবদের সহায়তা করবেন, কৃষ্ণ তাঁদের মন্ত্রী, দ্রুপদ রাজা শ্বশুর এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি মহাবীর তাঁদের শ্যালক—সুতরাং পাণ্ডবরা গুরুতর শক্তিলাভ করেছেন।

বিশদ আলোচনার পর সভায় পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে দ্রৌপদী, পাণ্ডবগণ ও দ্রুপদ প্রভৃতির জন্য নানাবিধ ধন ও রত্ন নিয়ে দ্রুপদ ও পাণ্ডবদের কাছে উপস্থিত হলেন। দ্রুপদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়ায় অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করে বিদুর পাণ্ডবদের হস্তিনায় যাবার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ জানালেন। দ্রুপদ ও কৃষ্ণ পাণ্ডবদের হস্তিনায় যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করলে দ্রুপদরাজার অনুমতিক্রমে পাণ্ডবগণ দ্রৌপদী ও কুন্তীকে নিয়ে হস্তিনা রাজধানীর দিকে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবরা রাজধানীতে এসে পৌঁছেছেন শুনে বিকর্ণ, চিত্রসেন, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে প্রত্যুদ্‌ৰ্গমনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। পাণ্ডবরা ধীরে ধীরে হস্তিনানগরে প্রবেশ করলেন। পাণ্ডবরা এসেছেন শুনে নগরবাসী হস্তিনাকে সুসজ্জিত করে তুলল, নানাবিধ মনোহর কথা বলতে লাগল। রাজসভায় প্রবেশ করে পাণ্ডবগণ ভীষ্মের, ধৃতরাষ্ট্রের ও অন্যান্য পূজনীয় ব্যক্তিদের চরণে নমস্কার করলেন। তারপর তারা ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে রাজান্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। তখন দুর্যোধনের মহিষী কাশীরাজ সুতা ধৃতরাষ্ট্রের অন্য পুত্রবধূগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, দ্বিতীয় লক্ষ্মীর ন্যায় দ্রৌপদীকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং আগতা শচীদেবীর ন্যায় মাননীয়া দ্রৌপদীর সম্মান করলেন। সেই সময়ে কুন্তীদেবী দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে গান্ধারীকে নমস্কার করলেন, গান্ধারীও আশীর্বাদ করে দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে এইরূপ মনে করলেন যে, এই দ্রৌপদীই আমার পুত্রগণের মৃত্যুর কারণ হবেন।

তারপর তিনি চিন্তা করে ন্যায় অনুসরণ করে বিদুরকে বললেন, “বিদুর, যদি আপনার ইচ্ছা হয়, তা হলে কারণ, লগ্ন ও নক্ষত্রের যোগবশত শুভজনক তিথিতে সমস্ত উপকরণ (আসবাব) ও দ্রৌপদীর সঙ্গে কুন্তীকে নিয়ে পাণ্ডুর গৃহে সংস্থাপিত করুন। সেই আপন গৃহে যাতে সুখ হয়, তেমনভাবে কুন্তী পুত্রগণের সঙ্গে অবস্থান করবেন।” “তাই হোক” বলে বিদুর তাই করলেন।

কিছুকাল পরে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম এবং অন্যান্য গুরুজনদের উপস্থিতিতে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আমাদের মধ্যে আবার বিবাদ না হয়, এইজন্যে তোমরা ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে বাস করো। তোমরা সেখানে গিয়ে বাস করলে, দেবরাজ যেমন দেবগণকে রক্ষা করেন, তেমনই অর্জুন তোমাদের রক্ষা করবে। সুতরাং কেউই উৎপীড়ন করতে পারবে না। তোমরা রাজ্যের অর্ধাংশ লাভ করেই ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে প্রবেশ করো।” পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের কথা স্বীকার করে, ভয়ংকর বনপথ দিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রস্থান করলেন এবং অর্ধরাজ্যের অধীশ্বর হয়েই সেখানে গিয়ে প্রবেশ করলেন।

পাণ্ডবদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইন্দ্রপ্রস্থ একটি বিশাল নগরে পরিণত হল। তাঁরা সমুদ্রের ন্যায় বিশাল পরিখা দ্বারা এবং জলশূন্য মেঘ ও চন্দ্রের তুল্য শুভ্রবর্ণ অত্যুচ্চ প্রাচীর দ্বারা সেই নগরটিকে অলংকৃত করলেন। নগরটি বহুসংখ্যক অট্টালিকা দ্বারা শোভিত হল এবং মন্দার পর্বতের ন্যায় বিশাল দ্বার আর গরুড়ের পক্ষদ্বয়ের ন্যায় বিশাল কপাট দ্বারা রক্ষিত হল। ক্রমে সেই ইন্দ্রপ্রস্থ ধনে পরিপূর্ণ হয়ে কুবেরের অলকাপুরীর ন্যায় শোভা পেতে লাগল। তখন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরা সেখানে আসতে লাগলেন, সর্বপ্রকার ভাষাভিজ্ঞ লোকেরা সেখানে বাস করবার ইচ্ছা করল, শিল্পীরা আগমন করতে থাকল এবং সকল দিকেই মনোহর উপবনসমূহ নির্মিত হল। তেজস্বী ও সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলে ধর্ম অনুসারে রাজ্য পালন করতে থাকলেন।

একদিন মহাত্মা পাণ্ডবরা উপবিষ্ট রয়েছেন, এমন সময়ে দেবর্ষি নারদ আপন ইচ্ছাক্রমে সেখানে উপস্থিত হলেন। নারদ উপবেশন করলে যুধিষ্ঠির তাঁকে অর্ঘ্যদান করলেন এবং আপন রাজ্য দান করতে চাইলেন। পূজা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হয়ে, আশীর্বাদ করে নারদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “তুমি উপবেশন করো।” তারপর যুধিষ্ঠির উপবেশন করে অন্তঃপুর থেকে দ্রৌপদীর কাছে সংবাদ পাঠালেন। পবিত্র ও ভক্তিযুক্ত হয়ে ধর্মপরায়ণা দ্রৌপদী দেবর্ষির চরণযুগলে নমস্কার করে কৃতাঞ্জলি হয়ে অবগুণ্ঠিত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন ধর্মাত্মা ও সত্যবাদী নারদ দ্রৌপদীকে নানাবিধ আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি যেতে পারো।” দ্রৌপদী চলে গেলে নারদ সকল পাণ্ডবকে সম্মুখে বসিয়ে বললেন, “যুধিষ্ঠির, একমাত্র দ্রৌপদীই তোমাদের ধর্মপত্নী। সুতরাং তাঁকে নিয়ে যাতে তোমাদের পরস্পর বিবাদ হয়, তেমন নিয়ম করো। কারণ পূর্বকালে ত্রিভুবন বিখ্যাত সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভ্রাতা ছিল। তারা দু’জনেই সম্মিলিত থাকত এবং অন্যের অবধ্য ছিল। তাদের এক রাজ্য, এক গৃহ, এক শয্যা, একত্রে অবস্থান ও ভোজন ছিল, কিন্তু তারাও এক তিলোত্তমার জন্যই পরস্পরকে বধ করেছিল।”

পঞ্চপাণ্ডব নারদের মুখে বিস্তারিতভাবে সুন্দ উপসুন্দ ও তিলোত্তমার কাহিনি শুনলেন। সেই কাহিনি শুনে পরস্পর পরস্পরের অধীন মহাত্মা পাণ্ডবগণ সেই দেবর্ষি নারদের সমক্ষেই একটি নিয়ম করলেন যে, “পাপশূন্যা দ্রৌপদী আমাদের এক-একজনের ঘরে এক-এক বৎসর করে বাস করবেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে-কেউ দ্রৌপদীর সঙ্গে বাস করবার সময়ে অন্য যে-কেউ এসে পরস্পর দেখা করবেন, তিনি ব্রহ্মচারী থেকে বারো বৎসর পর্যন্ত বনে বাস করবেন।” ধার্মিক পাণ্ডবগণ সেই নিয়ম করলে, মহামুনি নারদও সন্তুষ্ট হয়ে অভীষ্ট স্থানে চলে গেলেন।

কিন্তু নিয়মবন্ধনের প্রথম বৎসরেই অর্জুন এই নিয়ম লঙ্ঘন করতে বাধ্য হন। এক ব্রাহ্মণের গোধন দস্যুরা হরণ করলে, ব্রাহ্মণ অর্জুনের শরণাপন্ন হন। দস্যুদের তাড়িয়ে দিতে অর্জুনের অস্ত্রের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রাগারে তখন যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী ছিলেন। অর্জুন বাধ্য হন সেই অস্ত্রাগারে প্রবেশ করতে। দস্যুরা তাড়িত হয়। অর্জুন নিয়মলঙ্ঘনের অপরাধে বনবাসে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টা করেও অর্জুনকে থামাতে পারেননি। “জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠ প্রবেশ করলে অপরাধ হয় না।” যুধিষ্ঠিরের এই উক্তির প্রতিবাদে অর্জুন বলেন, “আপনার কাছেই শিখেছি যে, ছল করেও ধর্মাচরণ করবে না।” অতএব অর্জুন চলে গেলেন। বনবাসে অর্জুন প্রথমে নাগকন্যা উলূপী, পরে মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে মিলিত হন। তাঁদের গর্ভে অর্জুনের সন্তানও জন্মগ্রহণ করে। বনবাসের শেষ তিন বছর অর্জুন দ্বারকায় বাস করেন। শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রার প্রতি আসক্ত হয়ে তিনি সুভদ্রাকে হরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের অনুমতিতে, শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় অর্জুন-সুভদ্রার পরিণয় ঘটে। অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে হস্তিনায় প্রত্যাগমন করেন। যথাসময়ে অর্জুন সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুর জন্ম হয়।

এদিকে শুভলক্ষণা দ্রৌপদীও পঞ্চপতির থেকে পঞ্চপর্বতের ন্যায় পাঁচটি বীর পুত্র লাভ করেছিলেন। অদিতি যেমন দেবগণকে প্রসব করেছিলেন, দ্রৌপদীও তেমনই যুধিষ্ঠির থেকে প্রতিবিন্ধ্যকে, ভীম থেকে সূতসোমকে, অর্জুন থেকে শ্রুতকর্মাকে, নকুল থেকে শতানীককে এবং সহদেব থেকে শ্রুতসেনকে প্রসব করেছিলেন। “এই যুধিষ্ঠির পুত্র অন্যের প্রহার বোঝার বিষয়ে বিন্ধ্যপর্বতের তুল্য হোক” এই কথা বলে ব্যাকরণ অনুসারে সেই যুধিষ্ঠির পুত্রকে ‘প্রতিবিন্ধ্য’ বলতেন। বহুতর সোমযাগ করার পর দ্রৌপদী ভীমসেন থেকে চন্দ্র ও সূর্যের তুল্য তেজস্বী পুত্র প্রসব করেছিলেন বলে তার নাম হয়েছিল ‘সূতসোম’। অর্জুন লোকবিশ্রুত মহৎ কর্ম (তীর্থ পর্যটন) করে ফিরে এসে উৎপাদন করেছিলেন বলে, তাঁর পুত্রের নাম হয়েছিল ‘শ্রুতকর্মা’। কুরুবংশে শতানীক নামে এক মহাত্মা রাজর্ষি ছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে নকুল কীর্তিবর্ধক নিজ পুত্রটির নাম দিয়েছিলেন ‘শতানীক’। তারপর দ্রৌপদী কৃত্তিকানক্ষত্রে সহদেবসম্ভূত একটি পুত্র প্রসব করেন, তাতেই তার নাম হয়েছিল ‘শ্রুতসেন’। এই দ্রৌপদীর পুত্রগণ এক-এক বৎসরের কনিষ্ঠ ছিল এবং তারা যথাসময়ে যশস্বী ও পরস্পরহিতৈষী হয়েছিল। ধৌম্যপুরোহিত জ্যেষ্ঠানুক্রমে এবং যথাবিধানে তাদের জাতকর্ম প্রভৃতি সংস্কার এবং চূড়া ও উপনয়ন সংস্কার করেছিলেন। তারপর তারা যথানিয়মে ব্রহ্মচর্য পালন করতে থেকে এবং বেদ অধ্যয়ন করে অর্জুনের কাছে সর্বপ্রকার দেবাস্ত্র ও মনুষ্যাস্ত্র শিক্ষা করেছিল। পাণ্ডবদের বনবাসকালে এরা দ্বারকায় কৃষ্ণের স্নেহে, যদুবংশের আদরে বর্ধিত হয়ে উঠছিল।

দ্যুতক্রীড়ায় দ্রৌপদী লাঞ্ছনা

খাণ্ডবদাহনে কৃষ্ণার্জুন অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট করলেন। তাঁর ব্যাধির উপশম ঘটল, অর্জুনের কৃপাতে জীবিত রইলেন—ময়, অসুর দানবের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। প্রত্যুপকার করতে চাইলে কৃষ্ণ বললেন যে, যুধিষ্ঠিরের উপযুক্ত হয়, এমন একটি সভাকক্ষ নির্মাণ করে দাও। ময় এক অদ্ভুত, অত্যাশ্চর্য, অলৌকিক সভাগৃহ নির্মাণ করল। সে-সভা ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, দৈত্য দানব সকল শ্রেষ্ঠ সভার থেকে সুশোভিত, সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হলে দুর্যোধন সেই সভাগৃহ পরিদর্শন করতে গিয়ে অশেষ ভ্রমে পড়লেন। স্ফটিকময় পাষাণে গঠিত দেওয়ালকে দরজা ভ্রমে সরাতে গিয়ে তিনি হ্রদে পড়লেন। জল ভ্রমে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় সরিয়ে যেতে গিয়ে ভূতলে আছড়ে পড়লেন। স্থলভ্রমে জলে পতিত হয়ে অশেষ বিড়ম্বনায় পতিত হলেন। ঈর্ষায়, বিদ্বেষে জর্জরিত দুর্যোধন হস্তিনায় ফিরলেন। দিন দিন তিনি কৃশতর হতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি স্থির করলেন, পাণ্ডবদের সকল সম্পদ তিনি গ্রাস করবেন। কপট দ্যুতক্রীড়ায় তিনি যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করবেন এবং অক্ষধূর্ত শকুনি তাঁর হয়ে পাশার চাল দেবেন। ধৃতরাষ্ট্রকে দিয়ে এই কুমতলব অনুমোদন করিয়ে, যুধিষ্ঠিরকে পাঠানো হল দ্যুতক্রীড়ার আমন্ত্রণ। আমন্ত্রণ করতে গেলেন মহামন্ত্রী বিদুর স্বয়ং। যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলায় আগ্রহ ছিল না— কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। সুতরাং তিনি মাতা, ভার্যা ও ভ্রাতাদের নিয়ে হস্তিনাপুর যাত্রা করলেন।

পঞ্চপাণ্ডব রাজসভায় উপস্থিত হলে ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে অক্ষক্রীড়া আরম্ভ হল। শকুনির ধূর্ত অক্ষক্ষেপণে যুধিষ্ঠির একটির পর একটি চালে হারতে আরম্ভ করলেন। রাজ্যসম্পদ সব হারিয়ে তিনি আপনার এবং ভ্রাতাদের সকল অলংকার কুণ্ডল ও কণ্ঠভূষণ পণ ধরে ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হলেন। শকুনি সে-সবও জিতে নিলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, “শ্যামবর্ণ, যুবক, রক্তনয়ন, সিংহস্কন্ধ ও মহাবাহু নকুলই আমার একটি পণ, বর্তমান সময়ে এটিকেই আমার দ্যূতক্রীড়ার ধন জানবেন।” শকুনি বললেন, “রাজা যুধিষ্ঠির, তোমার প্রিয় এবং রাজপুত্র নকুল যদি জয় করার জন্য আমাদের অধীন হয়, তবে তুমি অন্য কোন বস্তু দ্বারা ক্রীড়া করবে?” এই কথা বলে শকুনি গুটি ধরলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই জিতলাম। যুধিষ্ঠির বললেন, “এই সহদেব ধর্মের উপদেশ দিয়ে থাকেন। এই জন্যই ইনি পণ্ডিত নাম লাভ করেছেন। অতএব ইনি পণের যোগ্য নন, অথচ আমার প্রিয়! তবুও আমি অপ্রিয় বস্তুর মতো এর দ্বারা খেলা করব।” শুনে শকুনি খেলায় প্রবৃত্ত হলেন এবং শঠতাপূর্বক জয় করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এই জিতলাম।” শকুনি বললেন, “রাজা, তোমার প্রিয় নকুল ও সহদেবকে তো আমি জিতলাম। কিন্তু আমি মনে করি, ভীম ও অর্জুন তোমার অধিক প্রিয়!” যুধিষ্ঠির বললেন, “মূর্খ! তুমি আমাদের পরস্পর সৌহার্দ্য দেখছ না এবং পরস্পর প্রণয় সমান থাকায় আমাদের হৃদয় প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও তুমি আমাদের মধ্যে ভেদ জন্মানোর চেষ্টা করছ; সুতরাং, তুমি নিশ্চয়ই পাপ করছ।” শকুনি বললেন, “হে ভারতশ্রেষ্ঠ! মত্ত লোক গর্তে পতিত হয় এবং অধিক মত্ত লোক বৃথা কথা বলেন। সে যাই হোক, তুমি রাজা এবং আমা অপেক্ষা বয়সে জ্যেষ্ঠ ও গুণে শ্রেষ্ঠ। অতএব আমি তোমার নিকট অবনত হচ্ছি। দেখো যুধিষ্ঠির, দ্যূতকারেরা খেলায় মত্ত হয়ে যে-সকল উৎকট বিষয় বলে, তা কোনও লোকই স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় দেখে না। যুধিষ্ঠির বললেন, “শকুনি, যিনি যুদ্ধে নৌকার মতো আমাদের পারাপার করেন, যিনি শত্রুদের জয় করেন এবং যিনি মহাবীর, পণের অযোগ্য রাজপুত্র সেই অর্জুনকে পণ ধরে আমি খেলা করব।” এই শুনে শকুনি শঠতাপূর্বক জয় করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এই জিতলাম।” যুধিষ্ঠির বললেন, “অসুর শত্রু ইন্দ্রের মতো যিনি আমাদের একমাত্র নায়ক, যিনি যুদ্ধে আমাদের পরিচালক, যিনি বক্রভাবে দৃষ্টিপাত করে থাকেন, যার ভ্রূযুগল অবনত এবং সিংহের ন্যায় স্কন্ধযুগল, যিনি উদারচেতা ও সর্বদাই কোপনস্বভাব, যার তুল্য বলবান পুরুষ পৃথিবীতে আর নেই, যিনি গদাধারীদের মধ্যে প্রধান ও শত্রুমর্দনকারী, পণের অযোগ্য সেই রাজপুত্র ভীমসেন দ্বারা আমি খেলা করব।” শুনে শকুনি খেলায় প্রবৃত্ত হলেন এবং শঠতাপূর্বক জয় করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এই জিতলাম।”

শকুনি পুনরায় বললেন, “যুধিষ্ঠির, তুমি বহুতর ধন এবং হস্তী, অশ্বের সঙ্গে ভ্রাতৃগণকে হেরেছ। এখন যদি তোমার কোনও ধন অপরাজিত থাকে তবে তার কথা বলল।” যুধিষ্ঠির বললেন, “আমি সমস্ত ভ্রাতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তাঁদের প্রিয়। আমি বিজিত হলে নিজেই বিজেতার দাসত্ব করব— এই ভেবে আমার আত্মাকেই পণ করলাম।” শুনে শকুনি খেলায় প্রবৃত্ত হলেন এবং শঠতাপূর্বক যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এই জিতলাম।” পুনরায় শকুনি বললেন, “রাজা! অবশিষ্ট ধন থাকতে তুমি যে আপনাকে হারলে, এটা পাপের কাজ করা হল, কারণ আত্মপরাজয় পাপ। রাজা, তোমার প্রিয়তমারূপ একটি পণ এখনও অপরাজিত রয়েছে। অতএব সেই পাঞ্চালনন্দিনী দ্রৌপদীকে পণ ধরো এবং তাঁর দ্বারাই আপনাকে মুক্ত করো।” যুধিষ্ঠির বললেন,

নৈব হ্রস্বা ন মহতী নাতিকৃষ্ণা ন রোহিণী।

নীল কুঞ্চিত কেশী চ ত্বয়া দীব্যাম্যহং দ্বয়া ॥ সভা: ৬২: ৯ ॥

—“যিনি খর্ব নন, দীর্ঘও নন এবং অত্যন্ত কৃষ্ণবর্ণা নন, রক্তবর্ণাও নন, আর যাঁর কেশকলাপ কৃষ্ণবর্ণ এবং বক্র, সেই দ্রৌপদী দ্বারাই আমি আপনার সঙ্গে খেলা করব।”

যুধিষ্ঠির এই কথা বললে, বৃদ্ধ সভ্যগণের মুখ থেকে “ধিক ধিক” এই বাক্য উত্থিত হল। তখন সেই সভাটাই বিচলিত হয়ে উঠল, রাজাদের শোক উপস্থিত হল এবং ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতির ঘর্ম নির্গত হতে লাগল। আর, বিদুর মস্তক ধারণ করে প্রাণহীনের ন্যায় হয়ে পড়লেন এবং সর্পের ন্যায় নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে অধোবদন হয়ে রইলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত হয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে, “কী জয় করলে? কী জয় করলে?” এবং তিনি আকার গোপন করতে পারলেন না। কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন, আর অন্যান্য সভ্যগণের নয়ন থেকে জল পড়তে লাগল। তখন জয়োৎফুল্ল ও মদমত্ত শকুনি আগের মতোই “এই জিতলাম” বলে পুনরায় সেই গুটিগুলি ধরলেন।

দুর্যোধন বললেন, “বিদুর! এ দিকে এসো, তুমি গিয়ে পাণ্ডবগণের মনোনীতা প্রিয়তমা ভার্যা দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এসো, সেই পাপশীলা গৃহ সম্মার্জন করবে। সুতরাং, সে সত্বর এখানে আসুক, অন্তঃপুরে গিয়ে পরে অন্য দাসীদের সঙ্গে মিলিত হোক।” বিদুর বললেন, “মূর্খ! তোমার মতো লোকই অভাবনীয় বিষয় বলতে পারে। তুমি দৈবকর্তৃক পাপবদ্ধ হয়ে কিছুই বুঝতে পারছ না, তুমি উঁচুস্থানে ঝুলছ এবং তুমি হরিণ হয়ে ব্যাঘ্রদের অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করছ। হে অতিমূৰ্খ! তোমার মস্তকে পূর্ণকোপ মহাবিষ সর্পগণ অবস্থান করছে, তুমি তাদের আর কুপিত কোরো না, যমালয়ে যেয়ো না। দ্রৌপদী দাসী হতে পারেন না। কারণ, যুধিষ্ঠির দ্যূতে হেরে নিজে অস্বামী হয়েই তাঁকে পণ ধরেছিলেন, এই আমার ধারণা। হায়, বাঁশ যেমন নিজের মৃত্যুর জন্য ফল ধারণ করে, এই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রও নিজের মৃত্যুর জন্য দ্যূতক্রীড়ায় জয়লাভ করে ধনলাভ করেছে। কারণ, দ্যূতক্রীড়াটা মহাভয়জনক শত্রুতার জন্যই হয়ে থাকে, এই মত্ত নির্বোধ মৃত্যুকালে তা বুঝতে পারছে না। কারও মর্মে বেদনা দেবে না, কাউকেও নিষ্ঠুর বাক্য বলবে না, নিকৃষ্ট উপায়ে অন্যকে বশীভূত করবে না এবং যে বাক্যে অন্যের উদ্বেগ হয়, তেমন অমঙ্গল ও পাপজনক বাক্য বলবে না। দুর্জনের মুখ থেকে মর্যাদাহানিকর বাক্য নির্গত হয়ে থাকে, যে বাক্যবাণে আহত হয়ে অন্য লোক রাত্রিদিন দুঃখ অনুভব করে, দুর্জনেরা পরের মর্মস্থান ভিন্ন অন্যস্থানে পতিত হয় না, সুতরাং জ্ঞানী লোক অন্যের সংসর্গ করতে হলে সেরূপ দুর্জনের সংসর্গ করবেন না। একটা ছাগল ভূতলে স্থাপিত একখানি ছুরি গিলে ফেলেছিল, তারপর সেই ছুরির আগায় তার গলা কেটে গিয়েছিল, অতএব দুর্যোধন! তুমি সেই ছাগলের মতো পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা কোরো না। বনচর, গৃহস্থ, দরিদ্র কিংবা বিদ্বান—কারও প্রতি পাণ্ডবরা এই ধরনের কোনও কথা বলেন না। হায়! কুকুরের মতো মানুষরাই সর্বদা এই জাতীয় কথা বলে থাকে। দ্যূতক্রীড়াটি যে ভয়ংকর ও বক্র নরকের দ্বার, তা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বুঝতে পারছে না। যদি লাউ ডুবে যায়, পাথর ভাসে, সর্বদাই নৌকা জলে মগ্ন থাকে, তথাপি মূর্খ দুর্যোধন আমার কথা শুনবে না। অতএব নিশ্চয়ই কুরুবংশের সর্বনাশ হবে। যেহেতু সুহৃদের কাছে শুক্রাচার্যের উপদেশ শুনছে না; কেবল ওদের লোভই বেড়ে যাচ্ছে।”

বিদুরকে ধিক এই কথা বলে দর্পমত্ত দুর্যোধন প্রাতিকামীর দিকে তাকালেন, সভাস্থ সভ্যগণের মধ্যে প্রাতিকামীকে বললেন, “প্রাতিকামী! তুমি দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো, পাণ্ডবদের থেকে তোমার কোনও ভয় নেই। এই দাসীপুত্র বিদুর ভীত হয়ে কেবল বিবাদ করে আর সর্বদাই আমাদের অবনতি কামনা করে।” সূতবংশীয় প্রাতিকামী দুর্যোধনের আদেশ শুনে দ্রুত প্রস্থান করল এবং কুকুর যেমন সিংহের বাসস্থানে প্রবেশ করে, সেইরূপ সে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দ্রৌপদীর কাছে গেল। তারপর প্রতিকামী বলল, “দ্রুপদনন্দিনী! রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতমদে মত্ত হয়ে আপনাকে দ্যূতে পণ ধরেছিলেন, তাতে দুর্যোধন আপনাকে জয় করেছেন, অতএব আপনি রাজসভায় আসুন, আপনার কর্তব্য কার্য জানিয়ে দেবার জন্য আমি আপনাকে নিয়ে যাব।” দ্রৌপদী বললেন, “প্রাতিকামী! তুমি কেন এ-কথা বলছ? কোনও রাজপুত্র আপন ভার্যা দ্বারা খেলা করেন? রাজা দ্যূতমদে মত্ত হয়ে কি একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন? তাঁর কি পণ ধরবার যোগ্য কোনও বস্তুই ছিল না?” প্রাতিকামী বলল, “রাজনন্দিনী! যখন তাঁর পণ রাখবার যোগ্য অন্য কোনও বস্তুই ছিল না, তখনও তিনি খেলা করছিলেন, তাতেই তিনি প্রথমে ভ্রাতৃগণকে, পরে নিজেকে এবং তারপর আপনাকে পণ রেখেছিলেন।” দ্রৌপদী বললেন, “সূতপুত্র! তুমি সভায় যাও, গিয়ে সেই দ্যূতকারকে জিজ্ঞাসা করো যে, আপনি কি প্রথমে নিজেকে হারিয়েছেন না, আমাকে? সূতপুত্র! এই প্রশ্নের উত্তর তুমি জেনে এসো, তারপর আমাকে নিয়ে যেয়ো। আমি সেই রাজার অভিপ্রেত বিষয় বুঝে, তারপর দুঃখিত মনে যাব।”

প্রাতিকামী সভায় গিয়ে রাজমধ্যস্থিত যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রৌপদীর কথাগুলি এইভাবে বললেন, “মহারাজ! দ্রৌপদী আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, আপনি কোনও বস্তুর প্রভু থেকে কি আমাকে হেরেছেন? আর আপনি নিজেকে প্রথমে হেরেছেন না আমাকে?” তখন যুধিষ্ঠির অচৈতন্য এবং প্রাণহীনের ন্যায় হয়ে থাকলেন, কিন্তু ভাল বা মন্দ কোনও কথাই প্রাতিকামীকে বললেন না। তখন দুর্যোধন বললেন, “দ্রৌপদী এখানে এসে এই প্রশ্ন করুক এবং তার ও দ্রৌপদীর যে-কথা থাকে, তা এখানে বসেই সকলে শ্রবণ করুন।” দুর্যোধনের বশবর্তী প্রাতিকামী দুঃখিত হয়ে পুনরায় রাজভবনে গিয়ে দ্রৌপদীকে বলল, “রাজনন্দিনী! সভ্যগণ আপনাকে আহ্বান করছেন। আমি মনে করি, কৌরবগণের বিনাশ উপস্থিত হয়েছে। কারণ, ক্ষুদ্র লোক প্রধান লোকের সম্মান রাখছে না! যেহেতু আপনাকে সভায় নিয়ে যাবে।”

দ্রৌপদী বললেন, “নিশ্চয় বিধাতা এইরূপ বিধান করেছেন যে, পণ্ডিত ও মূর্খ দুই প্রকার লোকই ধর্ম ও অধর্মকে স্পর্শ করে থাকে, তার মধ্যে ধর্ম ও অধর্মকেই জ্ঞানীরা প্রধান বলে থাকেন, সুতরাং আমরা সেই ধর্মকে রক্ষা করতে পারলে, তিনিই আমাদের মঙ্গল করবেন। সেই ধর্ম যেন কৌরবগণকে পরিত্যাগ করেন না, সুতরাং তুমি গিয়ে সভ্যগণের কাছে আমার এই ধর্মসংগত বাক্য জিজ্ঞাসা করো। সেই ধর্মাত্মা, নীতিজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠসভ্যগণ আমাকে যা বলবেন, আমি নিশ্চয়ই তা করব।”

প্রাতিকামী দ্রৌপদীর সেই কথা শুনে সভায় গিয়ে তা বলল। তখন সেই সভ্যরা দুর্যোধনের অত্যন্ত আগ্রহ হয়েছে বুঝে মাথা নিচু করে বসে রইলেন, কেউ কিছু বললেন না। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের অভিপ্রায় বুঝে একটি বিশ্বস্ত দূতকে এই বলে দ্রৌপদীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন যে, “দ্রুপদনন্দিনী! তুমি রজস্বলা, সুতরাং, একখানি বস্ত্রমাত্রই তোমার পরিধানে আছে, এই অবস্থাতেই তুমি রোদন করতে করতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।” তখন সেই বুদ্ধিমান দূত সত্বর দ্রৌপদীর গৃহে গিয়ে তাঁর কাছে যুধিষ্ঠিরের মত নিশ্চিতভাবে জানাল। এদিকে মহাত্মা পাণ্ডবরা বিষণ্ণ, দুঃখিত এবং সত্যনিরুদ্ধ হয়ে অধোবদনে রইলেন, কোনও দিকে তাকাতে পারলেন না।

দুর্যোধন পাণ্ডবদের সেই অধোবদনে থাকা দেখে আনন্দিত হয়ে সূতকে বললেন, “প্রাতিকামী! তুমি দ্রৌপদীকে এইখানে নিয়ে এসো। তার সাক্ষাতেই কৌরবগণ বলুন যে, তাঁকে আমি জিতেছি কি না!” প্রাতিকামী কিন্তু যেমন দুর্যোধনের বশবর্তী ছিল, তেমনই দ্রৌপদীর ক্রোধেরও ভয় করছিল, তাই সে আত্মসম্মান ত্যাগ করে আবারও সভ্যগণের কাছে জিজ্ঞাসা করল যে, “আমি দ্রৌপদীকে কী বলব?” দুর্যোধন বললেন, “দুঃশাসন! আমার এই দুর্বলচিত্ত সূতপুত্রটি ভীমের ভয় পাচ্ছে, অতএব তুমি নিজে গিয়ে দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো। পরাধীন শত্রুগণ তোমার কী করবে?”

তখন, দুঃশাসন ভ্রাতার আদেশ শুনে, আরক্তনয়নে উঠে গিয়ে পাণ্ডবদের গৃহে প্রবেশ করে দ্রৌপদীকে বলল, “পাঞ্চালনন্দিনী! এসো এসো, কৃষ্ণে! তুমি দ্যূতক্রীড়ায় বিজিত হয়েছ, অতএব লজ্জা পরিত্যাগ করে দুর্যোধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করো। হে সুদীর্ঘপদ্মনয়নে তুমি কৌরবদের ভজনা করো, তুমি ধর্মানুসারেই লব্ধ হয়েছ, অতএব সভায় চলে এসো।” তারপর অত্যন্ত দুঃখিতা দ্রৌপদী গাত্রোত্থান করে হস্ত দ্বারা মলিন মুখ মুছে, আকুল হয়ে, যেখানে গান্ধারী ভিন্ন ধৃতরাষ্ট্রের অন্য ভার্যারা ছিলেন, সেখানে দৌড়ে গেলেন। সেখানে কুন্তীদেবীও অবস্থান করছিলেন।

দুঃশাসনও রোষবশত অত্যন্ত ভর্ৎসনা করতে করতে রেগে গিয়ে দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হল এর তাঁর দীর্ঘ, নীল ও কুঞ্চিত কেশকলাপ ধারণ করল। যে কেশকলাপ রাজসূয় মহাযজ্ঞে মন্ত্রপূত জল দ্বারা সিক্ত হয়েছিল, দুঃশাসন পাণ্ডবগণের বলকে অবজ্ঞা করে বলপূর্বক সেই কেশকলাপ ধারণ করল। দ্রৌপদীর স্বামীরা সেখানে বিদ্যমান ছিলেন, তবুও তিনি স্বামীহীনার মতো হয়ে পড়েছিলেন। তাই দুঃশাসন তাঁকে আকর্ষণ করে সভার মধ্যে নিয়ে বায়ু যেমন কদলীবৃক্ষকে আকর্ষণ করে, সেইভাবে সকলের দৃষ্টির সম্মুখে নিয়ে যাবার জন্য আকর্ষণ করতে থাকলেন। দুঃশাসনের আকর্ষণে দ্রৌপদীর দেহটি অবনত হয়ে পড়েছিল, সেই অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “মন্দবুদ্ধি! আমি রজস্বলা, সুতরাং, আমার পরিধানে একখানি মাত্র বস্ত্র, অতএব দুর্জন! এ-অবস্থায় তুমি আমাকে সভার মধ্যে নিয়ে যেতে পারো না।” দুঃশাসন বলপূর্বক কেশাকর্ষণ করেই দ্রৌপদীকে বলতে লাগল; দ্রৌপদীও রক্ষা পাবার জন্য মনে মনে সর্বদুঃখহন্তা নররূপী নারায়ণ কৃষ্ণকে ডাকতে লাগলেন। দুঃশাসন বলল, “দ্রৌপদী! তুমি রজস্বলাই হও কিংবা একবস্ত্রাই হও, অথবা বিবস্ত্রাই হও, তোমাকে দ্যূতক্রীড়ায় জয় করে দাসী করেছি, সুতরাং এখন যথাসুখে আমাদের ভজন করো।”

দুঃশাসনের আকর্ষণে কেশকলাপ এলিয়ে গিয়েছিল, পরিধানের বস্ত্র অর্ধ-পতিত হয়েছিল, তাতে তিনি ক্রোধে দগ্ধ হচ্ছিলেন এবং লজ্জিত হচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “শাস্ত্রজ্ঞ, সৎক্রিয়াসম্পন্ন এবং ইন্দ্রতুল্য এই সকল লোক সভায় আছেন, আর গুরুস্থানীয়েরা ও গুরুজনেরাও সভায় বিদ্যমান আছেন, তাঁদের সম্মুখে আমি এইভাবে থাকতে পারি না। নৃশংস! দুর্জন! দুঃশাসন! তুই আমাকে বিবস্ত্রা করিস না, কিংবা আর সভার মধ্যে আকর্ষণ করিস না। কারণ ইন্দ্রের সঙ্গে দেবগণও যদি তোর সহায় হন, তথাপি এই রাজপুত্ররা তোকে ক্ষমা করবেন না। মহাত্মা ধর্মপুত্র ধর্মের দিকেই চেয়ে আছেন, সে ধর্মও অত্যন্ত সূক্ষ্ম। সুতরাং, তা নিপুণভাবেই জানতে হয়, অতএব আমি সেই ধার্মিক পতির গুণ পরিত্যাগ করে অণুমাত্র দোষ বাক্য দ্বারা প্রকাশ করতে পারি না। দুঃশাসন! আমি রজস্বলা, তথাপি তুই আমাকে কুরুবংশীয় বীরগণের মধ্যে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছিস, এটা গুরুতর অকার্য হচ্ছে। হায়! এই সভায় কোনও ব্যক্তি পর্যন্ত এর নিন্দা করছেন না। নিশ্চয়ই এরা দুঃশাসনের মতেরই অনুমোদন করছেন। ধিক, ভরতবংশের ধর্ম পর্যন্ত লোপ পেয়েছে। ক্ষত্রিয় ধর্মজ্ঞদের চরিত্রও নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ, যে সভায় কৌরবগণ সকলেই কৌরবধর্মের মর্যাদা লঙঘন অবাধে প্রত্যক্ষ করছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, এই মহামতি বিদুর এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের যেন প্রাণ নেই বলে মনে হচ্ছে কারণ, এই কৌরবশ্রেষ্ঠ বৃদ্ধগণ যেন এই ভয়ংকর অকার্যের কার্য লক্ষই করছেন না!” দ্রৌপদী করুণস্বরে এইরূপ বলতে থেকে বক্রনয়নে পতিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং সেই বক্রদৃষ্টি দ্বারা পাণ্ডবগণের যেরূপ দুঃখ হল, রাজ্য, ধন এবং উৎকৃষ্ট রত্ন সকল হরণ করায়ও সেরূপ দুঃখ হয়নি। দ্রৌপদী কাতরভাবে সেই দীন পতিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন দেখে দুঃশাসনও অচেতনপ্রায় দ্রৌপদীকে বেগে ধাক্কা দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল, “দাসী!” তখন কর্ণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অট্টহাস্য করে দুঃশাসনের সেই কথার প্রশংসা করলেন এবং শকুনিও দুঃশাসনের প্রশংসা করলেন।

দুর্যোধন, কর্ণ ও শকুনি ছাড়া অন্য যে-সকল সভ্য সেই সভায় ছিলেন, তাঁরা সকলেই দ্রৌপদীকে সভার মধ্যে আকর্ষণ করতে দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তখন ভীষ্ম বললেন, “ভাগ্যবতী! যাঁর যে বস্তুতে স্বত্ব থাকে না, তিনি সেই বস্তু পণ করতে পারেন না, আবার স্ত্রীলোকের উপর পতির স্বত্ব আছে, এই দুই দিক পর্যালোচনা করে এবং ন্যায়-এর সূক্ষ্মতার কারণে আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। যুধিষ্ঠির সমৃদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত রাজ্যও পরিত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু সত্য পরিত্যাগ করতে পারেন না, সেই যুধিষ্ঠির জানিয়েছেন যে, ‘আমি পরাজিত হয়েছি’। সুতরাং আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় মনুষ্যমধ্যে অদ্বিতীয়, তিনি দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা জন্মিয়ে দিয়েছেন। তারপর যুধিষ্ঠির এই খেলাটাকে শঠতাপূর্বক খেলা বলে মনে করছেন না, সুতরাং আমি তোমার এ-প্রশ্নের উত্তর করতে পারলাম না।”

দ্রৌপদী বললেন, “দ্যূতনিপুণ, দ্যূতপ্রিয়, দুষ্টচিত্ত, অসভ্য ও শঠতাপরায়ণ লোকেরা রাজসভায় আহ্বান জানিয়েছেন, তখন রাজা দ্যূতক্রীড়ায় বিশেষ ইচ্ছা করেননি, সুতরাং কী করে দ্যূতক্রীড়ায় তাঁর ইচ্ছা জন্মেছিল? নির্মল স্বভাব রাজা প্রথমে বিপক্ষের শঠতা বুঝতে পারেননি, তারপর সকলে মিলে এঁকে জয় করেছে, পরে উনি শঠতা বুঝেছেন। সে যাই হোক, পুত্র ও পুত্রবধূগণের নিয়ন্তা কুরুবংশীয়গণ এই সভায় বিদ্যমান আছেন, তাঁরা সকলে মিলে আমার বাক্য পর্যালোচনা করে যথাযথভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর করুন যে, ‘আমি জিত হয়েছি কি না।’ দ্রৌপদী এই কথা বলতে বলতে রোদন করছিলেন এবং বার বার স্বামীগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করছিলেন, এই অবস্থায় দুঃশাসন তাঁকে নিষ্ঠুর, কু ও অপ্রিয় কথা বলতে লাগল। দ্রৌপদী রজস্বলা বস্ত্র পরে গিয়েছিলেন, তিনি সে অবস্থার যোগ্য ছিলেন না, তবুও ভীম তাঁকে সেইরূপ অবস্থায় দেখে, যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ক্রোধ করলেন।

ভীম বললেন, “মহারাজ! যুধিষ্ঠির! দূতকারদের বেশ্যা থাকে, তারা তো তাদের দ্বারাও খেলা করে না। কারণ, তাদের উপরও তাদের দয়া থাকে। তারপর, কাশীর রাজা যে ধন এবং অন্যান্য যে সকল উত্তম দ্রব্য উপহার দিয়েছিলেন, আর অন্যান্য যে সমস্ত রাজা রত্ন, বাহন, ধন কবচ ও অস্ত্র দিয়েছিলেন, সেই সকল ও অস্ত্র, রাজ্য, আত্মা, আমরা—এ সমস্তই শত্রুরা ছলপূর্বক হরণ করেছে। তাতেও আমার ক্রোধ হয়নি, কারণ, আপনি আমাদের এবং সমস্ত বস্তুরই স্বামী; কিন্তু দ্রৌপদীকে আপনার পণ ধরা আমি গুরুতর অন্যায় বলেই বোধ করি। এই দ্রৌপদী পাণ্ডবদের পেয়ে এরূপ কষ্ট পাবার যোগ্য নন, তথাপি ক্ষুদ্রস্বভাব, নৃশংসপ্রকৃতি ও অশিক্ষিত কৌরবেরা আপনার জন্যই তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। অতএব রাজা! দ্রৌপদীর জন্যই আপনার উপর এই ক্রোধের ফল আরোপ করব। আপনার হস্তযুগল দগ্ধ করব। সহদেব, অগ্নি আনয়ন করো।” অর্জুন বললেন, “আর্য ভীমসেন! আপনি পূর্বে কখনও এইরূপ বাক্য ব্যবহার করেননি, সুতরাং নিশ্চয় নৃশংস শত্রুরা আপনার ধর্মগৌরবও নষ্ট করে দিয়েছে। আপনি শত্রুদের অভিলাষ পূর্ণ করবেন না। উত্তম ধর্মচারণই করুন, ধার্মিক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অপমান করবেন না।

আহতো হি পরৈ রাজা ক্ষাত্রং ধর্মমনুস্মরণ!

দীব্যতে পরকামেন তন্ন কীর্তিকরং মহৎ ॥ সভা : ৬৫ : ৯।।

“অন্য লোক আহ্বান করলে রাজা যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ধর্ম স্মরণ করে নিষ্কামভাবে খেলা করে থাকেন, তা আমাদের মহা কীৰ্তিজনক!” ভীম বললেন, “অর্জুন! তোমার কথায় আমি যদি শাস্ত্রীয় নিয়ম স্মরণ না করতাম তবে নিশ্চয়ই আমি বলপূর্বক প্রজ্বলিত অগ্নিতে রাজার বাহুযুগল দগ্ধ করে ফেলতাম।”

পাণ্ডবগণকে সেইরূপ দুঃখিত দেখে এবং দ্ৰৌপদীকে আকর্ষণ করতে দেখে ধৃতরাষ্ট্রর পুত্র বিকর্ণ এই কথা বলল, “রাজগণ! দ্রৌপদী যা বললেন, আপনারা তার স্পষ্ট উত্তর দিন। এ-বাক্য সম্বন্ধে বিবেচনা না করলে আমাদের সদ্যই নরক হবে। কুরুবংশের মধ্যে অধিক বৃদ্ধ ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র কোনও কথাই বলছেন না এবং মহামতি বিদুরও চুপ করেই আছেন। সকলের আচার্য দ্রোণ বা কৃপ, এই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ দু’জনই বা কেন দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। অন্য যে সকল রাজা সকল দিক থেকে এসেছেন, তাঁরা কাম ও ক্রোধ পরিত্যাগ করে আপন আপন বুদ্ধি অনুসারেই বলুন। কল্যাণী দ্রৌপদী বার বার এই যে কথা বললেন, তার মধ্যে কার কোন পক্ষ অভিপ্রেত হয়, তা বিবেচনা করে আপনারা বলুন।” বিকর্ণ এইভাবে সেই সমস্ত সভ্যকে বহুবার বলল, তবুও তাঁরা ভাল বা মন্দ কোনও কথাই বিকর্ণকে বললেন না, তখন বিকর্ণ সকল সভ্যকেই সেইভাবে আবার বার বার বলে হাতের উপর হাত ঘষতে ঘষতে, নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল, “হে রাজগণ! হে কৌরবগণ! আপনারা দ্রৌপদীর কথার উত্তর করুন বা না করুন, আমি এ-সম্পর্কে যা ন্যায়সংগত মনে করছি, তা বলব। মৃগয়া, মদ্যপান, অক্ষক্রীড়া ও স্ত্রী-সংসর্গে অত্যন্ত আসক্তি— এই চারটিকেও মুনিরা রাজাদের ব্যসন বলে থাকেন। মানুষ এই ব্যসনে আসক্ত হয়ে ধর্ম পরিত্যাগ করে চলে থাকে এবং ব্যসনাসক্ত হয়ে যা-কিছু কার্য করে, তা লোকে অকৃত বলেই মনে করে। অতএব, যুধিষ্ঠির ধূর্তগণ কর্তৃক আহূত হয়ে দ্যূতক্রীড়ায় অত্যন্ত আসক্ত থেকেই এই দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন। তারপর অনিন্দিতা দ্রৌপদীর উপরে সকল পাণ্ডবেরই সমান শর্ত রয়েছে, আর যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজে পরাজিত হয়ে পরে দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন। আর শকুনি যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে পণ ধরাবার জন্যই তাঁর কাছে এই দ্রৌপদীর উল্লেখ করেছিলেন। এইসকল দিক বিবেচনা করে, আমি মনে করি দ্রৌপদী দুর্যোধন কর্তৃক বিজিত হননি।” এই কথা শুনে সভ্যগণের মধ্যে বহু লোক বিকর্ণের প্রশংসা করতে লাগলেন এবং অনেকে শকুনির নিন্দা করতে থাকলেন। তাতে সভায় গুরুতর কোলাহল দেখা দিল। কোলাহল থামলে, রাধানন্দন কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার বিশাল বাহু মর্দন করে এই কথা বললেন, “বিকর্ণে বহুতর বিকার দেখা যাচ্ছে, অরণি কাষ্ঠজাত আগুন যেমন নিজের বিনাশের জন্যই জন্মে থাকে, তেমনই এই বিকর্ণজাত বিকারগুলিও তার বিনাশের জন্যই জন্মেছে। দ্রৌপদী নিজের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই সভ্যগণের কাছে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এঁরা কোনও কথা বলছেন না। কারণ এঁরা দ্রৌপদীকে ধর্ম অনুসারেই বিজিত বলে মনে করছেন। কিন্তু বিকর্ণ! তোমার বালকত্বই তোমাকে নষ্ট করেছে। যেহেতু তুমি বালক হয়ে সভার মধ্যে বৃদ্ধের ন্যায় কথা বলছ। অথচ তুমি যথাযথভাবে ধর্ম জানো না। হে দুর্যোধন কনিষ্ঠ! তুমি নির্বোধ! যেহেতু তুমি জিত দ্রৌপদীকে অজিত বলে প্রকাশ করছ! বিকর্ণ! তুমি কী প্রকারে দ্রৌপদীকে অবিজিত বলে মনে করছ। কারণ যুধিষ্ঠির সভার মধ্যে তাঁর সর্বস্ব পণ রেখেছিলেন। দ্রৌপদী সেই সর্বস্থের অন্তর্গত। সেই কারণে দ্রৌপদী ধর্ম অনুসারেই বিজিত হয়েছেন, সুতরাং তুমি কী করে দ্রৌপদীকে অজিতা মনে করছ? তারপর, যুধিষ্ঠির স্পষ্ট বাক্য দ্বারাই এঁকে পণ ধরেছিলেন তাতে অন্যান্য পাণ্ডবরাও অনুমোদন করেছিলেন; সুতরাং বিকর্ণ, তোমার মতে কোন কারণে ইনি অবিজিতা হবেন? অথবা তুমি যদি মনে করো যে, একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে অধর্ম অনুসারে সভায় নিয়ে আসা হয়েছে, এ-বিষয়েও আমার উৎকৃষ্ট বাক্য শ্রবণ করো। স্ত্রীলোকের একটি মাত্র ভর্তাই বেদে বিহিত আছে, কিন্তু দ্রৌপদী অনেক ভর্তার অধীন, সুতরাং তাকে ‘বেশ্যা’ বলেই গ্রহণ করা চলে। অতএব একবস্ত্রা হোক কিংবা বিবস্ত্রাই হোক, তাকে সভায় আনা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়, এই আমার ধারণা। তারপর পাণ্ডবদের যা-কিছু ধন, যে দ্রৌপদী অথবা যে-সব পাণ্ডব আছেন, সে সমস্ত শকুনি ধর্ম অনুসারেই জয় করেছেন। দুঃশাসন! এই পণ্ডিতাভিমানী বিকীর্ণ অত্যন্ত বালক, অতএব তুমি পাণ্ডবগণের ও দ্রৌপদীর বস্ত্রগুলি হরণ করো তো।”

কর্ণের কথা শুনে পাণ্ডবরা সকলে আপন আপন উত্তরীয় বস্ত্র ত্যাগ করে সভামধ্যে উপবেশন করলেন। তারপর দুঃশাসন বলপূর্বক দ্রৌপদীর বস্ত্র ধারণ করে সভার মধ্যেই আকর্ষণ করে নেবার চেষ্টা করল। তখন দ্রৌপদী চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললেন,

* আকৃষ্যমানে বসনে দ্রৌপদ্যা চিন্তিত হরিঃ।

গোবিন্দ! দ্বারকাবাসন! কৃষ্ণ গোপীজন প্রিয়! ॥১॥

কৌরবেঃ পরাভূতা, মাং কিং ন জানসি কেশব!

হে নাথ! হে রমানাথ! ব্রজনার্তিনাশন ॥ ২॥

কৌরবার্ণবমগ্নাং মামুদ্ধরস্ব জনার্দন।

কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! মহাযোগিন! বিশ্বাত্মন! বিশ্বভাবন।

প্রপন্নাং পাহি গোবিন্দ! কুরুমধ্যেহবসীদতীম ॥ ৩ ॥

ইত্যনুস্মৃত্য কৃষ্ণং সা হরি ত্রিভুবনেশ্বরম।

দুঃখিতা রাজন! মুখমাচ্ছাদ্য ভামিনী ॥ ৪ ॥

যাজ্ঞসেন্যা বচঃ শ্রুত্বা কৃষ্ণো গহ্বরিতোহভ্রবৎ।

ত্যক্ত্বা শয্যাসনং পদ্ভ্যাং কৃপালু কৃপয়াহভ্যগাৎ ॥ ৫॥

তখন দ্রৌপদী লজ্জা নিবারণের জন্য সর্বদুঃখহন্তা নরমূর্তিধারী কৃষ্ণ নামক বিষ্ণুকে মনে মনে ডাকতে লাগলেন। তখন মহাত্মা ধর্ম এসে বস্ত্ররূপ ধারণ করে নানাবিধ বস্ত্রসমূহ দ্বারা দ্রৌপদীকে আবৃত করলেন। তখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করতে থাকলে, সেইরূপ অন্য অনেক বস্ত্র আবির্ভূত হতে লাগল। ধর্ম এসে লজ্জারক্ষা করতে থাকায় নানাবিধ বিরাগ-রাগযুক্ত শত শত বস্ত্র প্রাদুর্ভূত হতে থাকল। তখন সেই সভায় ভয়ংকর শব্দে হলাহলধ্বনি উঠল। রাজারা সকলে সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে দ্রৌপদীর প্রশংসা ও দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন।

তখন ভীমসেন হাতে হাত ঘষতে ঘষতে রাজগণের মধ্যে বিশাল শব্দে, প্রচণ্ড ক্রোধে, স্পন্দিত ওষ্ঠযুগল থেকে ভয়ংকর শপথ করলেন, “হে জগদ্‌বাসী ক্ষত্রিয়গণ! আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আমার এই শপথ পূর্বে কেউ করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। আমি যুদ্ধে বলপূর্বক এই পাপাত্মা, দুর্বুদ্ধি ও ভরতকুলকলঙ্ক দুঃশাসনের বক্ষ বিদারণ করে যদি রক্ত পান না করি এবং রাজগণ, এই প্রতিজ্ঞা করে যদি তা সম্পন্ন না করি তবে যেন আমি পিতৃপুরুষগণের গতি লাভ না করি।”

রাজারা ভীমসেনের সেই ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা শুনে দুঃশাসনের নিন্দা ও ভীমসেনের বহুতর প্রশংসা করতে থাকলেন। যখন দ্রৌপদীর বস্ত্ৰসমূহ সভার মধ্যে রাশিকৃত হল, তখন দুঃশাসন পরিশ্রান্ত ও লজ্জিত হয়ে বসে পড়ল। কুরুবংশীয়গণ দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর করছেন না দেখে সভাস্থ সজ্জনগণ ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করে আক্রোশ করতে লাগলেন। তারপর সর্বধর্মজ্ঞ বিদুর বাহুযুগল উত্তোলন করে সভ্যগণকে কোলাহল করতে নিষেধ করে বললেন, “সভ্যগণ! দ্রৌপদী এইরূপ প্রশ্ন করে অনাথার মতো অনবরত রোদন করছেন, অথচ আপনারা সে-প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। এতে ধর্মের হানি হচ্ছে। কারণ, প্রজ্বলিত অগ্নির মতো দুঃখসন্তপ্ত লোক বিচারার্থী হয়ে সভায় উপস্থিত হয়ে থাকে, তখন সভ্যগণ সত্যধর্ম অনুসারে তাকে শান্ত করে থাকেন। অতএব সাধুলোক সত্য অনুসারে ধর্ম প্রশ্নের উত্তর করবেন এবং কাম, ক্রোধ ও বলের অপেক্ষা না করে নিরপেক্ষভাবে সেই প্রশ্ন উত্তর করবেন। রাজগণ! বিকর্ণ আপন বুদ্ধি অনুসারে প্রশ্নের উত্তর করেছে, আপনারাও আপন আপন বুদ্ধি অনুসারে সেই প্রশ্নের উত্তর করুন। যে ধর্ম সভ্য প্রশ্নের উত্তর না করেন, তিনি মিথ্যা ব্যবহারের অর্ধফল ভোগ করেন। আবার যে ধর্মজ্ঞ সভ্য মিথ্যা বলেন, তিনিও নিশ্চয়ই মিথ্যা কথার সমগ্র ফল ভোগ করেন।”

রাজারা বিদুরের কথা শুনে কিছুই বললেন না। এই সময়ে কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন, “দাসী দ্রৌপদীকে ঘরে নিয়ে যাও।” তখন লজ্জিতা ও দীনা দ্রৌপদী সভার প্রান্তে থেকে কাঁপছিলেন এবং পাণ্ডবগণকে লক্ষ্য করে বিলাপ করছিলেন। আর দুঃশাসন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। দ্রৌপদী বললেন, “পূর্বে স্বয়ংবর সভায় সমাগত রাজারা যাঁকে দেখেছিলেন, অন্য কোনও স্থানেই দেখেননি, হায়! সেই আমি আজ সভায় এসেছি। পূর্বে রাজভবনের বায়ু এসে যাঁকে স্পর্শ করলেও পাণ্ডবরা সহ্য করতে পারতেন না; হায়! আজ দুরাত্মা দুঃশাসন তাঁকেই স্পর্শ করছে, তবুও পাণ্ডবরা সহ্য করছেন। আমি কারও কারও পুত্রবধূ স্থানীয়া, আবার কারও কারও কন্যা স্থানীয়া এবং এই কষ্ট পাওয়ার যোগ্য নই, তবুও দুঃশাসন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, অথচ এই কুরুবংশীয়েরা তা সহ্য করছেন, সুতরাং আমি মনে করি—কালের পরিবর্তন হয়েছে। এর থেকে দৈন্যের আর কী বিষয় হতে পারে যে, আমি শুভলক্ষণা সতী স্ত্রী হয়েও আজ সভার মধ্যে বিচরণ করছি। রাজাদের ধর্ম কোথায় গেল। পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মনিষ্ঠা নারীকে সভায় নিতেন না— এ আমরা শুনেছি। হায়! আমার ভাগ্যে সেই সনাতন কুরুবংশে পূর্বধর্ম নষ্ট হয়ে গেল। সভ্যগণ! আমি পাণ্ডবগণের ভার্যা, দ্রুপদরাজের কন্যা এবং কৃষ্ণের সখী হয়ে কী করে রাজসভায় যেতে পারি? আমি ধর্মরাজের সবর্ণা ভার্যা, আপনারা আমাকে দাসী বা অদাসী যা বলবেন আমি সেই অনুযায়ী কার্য করব। কুরুবংশের যশোনাশক এই ক্ষুদ্র দুঃশাসনটা আমাকে বড়ই কষ্ট দিচ্ছে, আমি এ কষ্ট দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারব না। রাজগণ! কৌরবগণ! আপনারা আমাকে জিতা বা অজিতা যা বলবেন, আমি সেই অনুযায়ী উত্তর দেব এবং কাজ করব।”

ভীষ্ম বললেন, “কল্যাণী! আমি পূর্বেই তো বলেছি যে, জগতে বিজ্ঞ ধর্মাত্মারাও ধর্মের সূক্ষ্ম গতি বোঝেন না। তারপর, জগতে প্রবল লোক যেটাকে ধর্ম বলে, ধর্ম বিচারের সময়ে সেইটাই ধর্ম হয়, কিন্তু দুর্বল লোক যা বলে, তা প্রতিহত হয়ে যায়। সূক্ষ্ম, অত্যন্ত দুর্বোধ এবং এই কার্যের গুরুত্ববশত আমি বিবেচনা করেও তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। হায়! অধিককালের মধ্যেই এই বংশের ধ্বংস হবে। কারণ, কুরুবংশীয়েরা সকলেই লোভ পরায়ণ ও মোহ পরায়ণ হয়ে পড়েছে। হে কল্যাণী! তুমি যাঁদের কুলবধূ তাঁদের কুলোৎপন্ন ব্যক্তিগণ অত্যন্ত ব্যসনাসক্ত হয়েও তোমার গুণে ধর্মপথ থেকে ভ্রষ্ট হচ্ছেন না। পাঞ্চালী! তোমার আচরণ সংগত। তুমি বিপদে পড়েও ধর্মের অনুসরণ করছ। হায়! এই দ্ৰোণ প্রভৃতি ধর্মজ্ঞ বৃদ্ধ লোকেরাও গতাসু হয়েই যেন অবনত বদনে এবং শূন্য শরীরে অবস্থান করছেন। আমার ধারণা এই যে, তোমার এই প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরের কথাই গ্রাহ্য, সুতরাং তিনি নিজে বলুন যে তুমি জিতা না অজিতা।”

তখন দ্রৌপদী দুঃখিত হয়ে কুররী পক্ষিণীর ন্যায় সেইভাবে বারবার বিলাপ করতে লাগলেন, তথাপি রাজারা দুর্যোধনের ভয়ে ভাল বা মন্দ কোনও কথাই বললেন না। তখন দুর্যোধন সেই রাজপুত্রগণ ও রাজপৌত্রগণকে নীরব দেখে হাসতে হাসতেই দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী! তোমার এই প্রশ্ন তোমারই পতি মহাবল ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের উপরেই থাক। তাঁরাই তোমার বাক্যের উত্তর বলুন। পাঞ্চালনন্দিনী! ভীম প্রভৃতি সকলে এই সভ্যগণের মধ্যে তোমার জন্য যুধিষ্ঠিরকে তোমার অস্বামী বলুন এবং তাঁকে মিথ্যাবাদী করুন। তারপরে তুমি দাস্যভাব থেকে মুক্তি পাবে। অথবা ধার্মিক, মহাত্মা এবং ইন্দ্রতুল্য যুধিষ্ঠির নিজেই বলুন যে, উনি তোমার প্রভু বা অপ্রভু। তারপর তুমি সত্বর একদিক অবলম্বন করো। এই কৌরবেরা সকলেই তোমার দুঃখসাগরে মগ্ন হয়েছেন এবং তোমার মন্দভাগ্য পতিদের দেখে তোমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারছেন না।”

তারপর সভ্যগণ দুর্যোধনের কথা শুনে উচ্চৈঃস্বরে তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন এবং স্তুতিবাদ করতে থেকে বস্ত্রাঞ্চল কম্পিত করতে লাগলেন। অন্য দিকে ‘হা হা’ ইত্যাকার আর্তনাদও হতে লাগল। ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠির কী বলবেন সেই কথা ভেবে সেই সকল রাজা সকলেই উদ্‌গ্রীব হয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। যুদ্ধবিজয়ী অর্জুন কী বলবেন এবং ভীম, নকুল ও সহদেবই বা কী বলবেন, এ-কথা ভেবে সকলেই অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। সেই প্রশংসার কোলাহল থামলে, ভীমসেন চন্দনচর্চিত ও বিশাল ও গোলাকার বাহু উত্তোলন করে বললেন, “আমাদের গুরু ও মহামান্য এই ধর্মরাজ যদি আমাদের সকলের প্রভু না হতেন, তবে আমরা কখনওই ক্ষমা করতাম না। আমাদের পুণ্য, তপস্যা এমনকী প্রাণ পর্যন্তের অধীশ্বর যুধিষ্ঠির যদি আপনাকে জিত বলে মনে করেন, তবে আমরাও জিত হয়েছি। না হলে, ভূচরে কোনও প্রাণীই দ্রৌপদীর এই কেশ আকর্ষণ করে জীবিত অবস্থায় আমার কাছ থেকে মুক্তিলাভ করত না। আপনারা পরিঘ অস্ত্রের মতো আমার এই দীর্ঘ ও গোল বাহুযুগল দর্শন করুন, এর মধ্যে এসে ইন্দ্রও মুক্তি পেতে পারেন না। কিন্তু আমি ধর্মপাশে বদ্ধ। যুধিষ্ঠিরের গৌরবে নিরুদ্ধ এবং অর্জুনের নিবারণে নিবর্তিত, তাই এই কষ্ট ভোগ করছি। কিন্তু ধর্মরাজ যদি আমাকে বিদায় দেন, তবে আমি—সিংহ যেমন ক্ষুদ্র মৃগসমূহকে সংহার করে, সেইরূপ চপেটাঘাত করেই এই পাপাত্মা ধার্তরাষ্ট্রদের সংহার করতে পারি।” তখন ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর বললেন, “ভীম! তুমি ক্ষমা করো, তোমার সে ক্ষমতা আছে।

কর্ণ বললেন, “ভদ্রে! ক্রীতদাস, পুত্র এবং ভার্যা— এই তিনজনের আপন লব্ধ ধনেও স্বত্বহীন হয়ে থাকে, সুতরাং আপন ভার্যার উপর ক্রীতদাসের স্বত্ব থাকে না এবং তার অন্য সকল ধনেও তার স্বত্ব থাকে না। এখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররাই তোমার প্রভু, কিন্তু পাণ্ডবরা নয়। কামিনী! তুমি এখন অন্য পতি বরণ করো, উদ্যমহীন ক্ষুদ্র পাণ্ডবদের দ্বারা আর তোমার কী হবে? পতিদের সঙ্গে কামব্যবহার করা নিন্দনীয় নয়, দাস্যবৃত্তি করার সময়ে একথা যেন সর্বদাই তোমার স্মরণে থাকে। দ্রৌপদী! যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব— এরা সকলেই পরাজিত হয়েছে। তুমিও দাসী হয়েছ, সুতরাং আর পাণ্ডবেরা তোমার পতি নয়। যুধিষ্ঠির! এখন আর জন্মগ্রহণ করাতেই বা কী প্রয়োজন আছে এবং পরাজয় ও পুরুষকারের বা কী আছে মনে করো। যেহেতু তুমি দ্যূতক্রীড়ায় এই পাঞ্চাল রাজনন্দিনীকে পণ ধরেছিলে।”

যুধিষ্ঠিরের অনুগত এবং ধর্মপাশে আবদ্ধ ভীমসেন কর্ণের সেই কথা শুনে, অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, আরক্তনয়ন অথচ দুঃখিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে দগ্ধ করতে যেন নিশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। তারপর ভীম বললেন, “রাজা! আমি কর্ণের উপর ক্রুদ্ধ হইনি। কেন-না, কর্ণ এই দাসধর্ম সত্যই বলেছে, অতএব রাজা, আপনি যদি দ্রৌপদীকে নিয়ে খেলা না করতেন, তবে শত্রুরা কি আমাদের এ-কথা বলতে পারত?” সেই সময়ে যুধিষ্ঠির যেন অচৈতন্য হয়ে নীরবে অবস্থান করছিলেন। তাই ভীমের কথা শুনে দুর্যোধন বললেন, “রাজা! ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব— এরা সকলেই আপনার আদেশের অধীন, অতএব আপনিই দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর করুন এবং আপনি যদি দ্রৌপদীকে অজিতা বোধ করেন, তাও বলুন।” ঐশ্বর্যমদমত্ত দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে, বাম ঊরুর বস্ত্র সরিয়ে হাসতে হাসতে দ্রৌপদীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং তিনি কর্ণের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে ভীমসেনকে নির্যাতন করবার জন্যই যেন দ্রৌপদীর দিকে তাকাতে থেকে আপন কদলীস্তম্ভের মতো ও হস্তীশুণ্ডের মতো, বজ্রের মতো দৃঢ় এবং সর্বলক্ষণপ্রশস্ত আপন বাম ঊরু দ্রৌপদীকে দেখালেন। ভীমসেন তা দেখে আরক্ত নয়নযুগল বিস্ফারিত করে, সভ্যগণকে শোনাতে থেকে, রাজাদের মধ্যেই দুর্যোধনকে বললেন, “দুর্যোধন, আমি যদি মহাযুদ্ধে তোমার এই ঊরুভঙ্গ না করি, তবে যেন আমি পিতৃপুরুষদের সঙ্গে একলোকে বাস না করি।” জ্বলন্ত বৃক্ষকোটর থেকে যেমন আগুন বের হয়, তেমনই ভীমসেনের সমস্ত রোমকূপ থেকে আগুনের শিখা বের হতে লাগল।

বিদুর বললেন, “হে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ! তোমরা ধরে নাও যে মহাভয় উপস্থিত হয়েছে এবং তা ভীম থেকেই উপস্থিত হয়েছে জেনে রাখো। নিশ্চয়ই দেবতারা এরপর থেকেই অত্যাচারের কারণে ভরতবংশে মহাবিপদ উপস্থিত করেছেন। তোমরা দ্যূতক্রীড়ার নিয়ম লঙঘন করে স্ত্রীলোককে সভায় এনে বিবাদ করেছ। তোমাদের সকল মঙ্গল নষ্ট হয়েছে, বিশেষত তোমরা দুষ্ট মন্ত্রণা করছ। কৌরবগণ! তোমরা জেনে রাখো ন্যায়পরায়ণতা নষ্ট হলে সভাটাই দূষিত হয়ে পড়ে। যুধিষ্ঠির যদি আগে দ্রৌপদীকে পণ ধরতেন, তবে উনি তার প্রভু থাকতেন, কারণ, তখনও তিনি নিজেকে হারেননি। অতএব আমি মনে করি এই দ্রৌপদীকে জয় করাটা স্বপ্নে ধন জয় করার মতোই হচ্ছে। কারণ, যুধিষ্ঠির আপন পরাজয়বশত অস্বামী হয়েই দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন। তোমরা শকুনির মতের অনুগামী হয়ে ধর্ম নষ্ট কোরো না।

দুর্যোধন বললেন, “দ্রৌপদী! আমি—ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের বাক্যের অধীন হয়ে রয়েছি, তারা যদি যুধিষ্ঠিরকে তোমার অস্বামী বলেন, তবে তুমি দাস্যভাব থেকে মুক্ত পাবে।” অর্জুন বললেন, “রাজা যুধিষ্ঠির আগে আমাদের প্রভু ছিলেন, কিন্তু নিজেকে হেরে তিনি কোনও বস্তুর প্রভু থাকতে পারেন না, কৌরব সকলেই তা জেনে রাখো।” রাজা ধৃতরাষ্ট্রের হোমগৃহে উচ্চৈঃস্বরে শৃগাল ডেকে উঠল এবং শব্দ লক্ষ্য রেখে গর্দভ ও ভয়ংকর পক্ষীসকল চারদিকে ডাকতে আরম্ভ করল। তখন তত্ত্বদর্শী বিদুর, গান্ধারী, জ্ঞানী ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ সেই শব্দ শুনতে পেলেন, সুতরাং তারা সকলেই ‘স্বস্তি স্বস্তি” বলে উঠলেন। তারপর জ্ঞানী বিদুর ও গান্ধারী সেই ভয়ংকর উৎপাত লক্ষ করে পীড়িতের মতো হয়ে তখনই তা রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন, তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন! তুই শেষ হয়ে গিয়েছিস। রে দুর্বিনীত! তুই কৌরবশ্রেষ্ঠগণের সভার মধ্যে স্ত্রীলোকের সঙ্গে, বিশেষত পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গে আলাপ করছিস।”

শাস্ত্রজ্ঞ ও তত্ত্ববুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র এই বলে বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা করে বিশেষ উপায় অবলম্বন করে মধুরবাক্যে পাঞ্চালীকে এই কথা বললেন, “পাঞ্চালী! তুমি আমার কাছে যা ইচ্ছা করে, সেইরূপ বর গ্রহণ করো। কারণ তুমি আমার পুত্রবধূগণের মধ্যে প্রধানা এবং ধর্মপরায়ণা ও সতী।” দ্রৌপদী বললেন, “হে ভরতশ্রেষ্ঠ! আপনি যদি আমাকে বর দেন, তবে আমি এই বর গ্রহণ করছি যে, সর্বধর্মানুসারী শ্ৰীমান যুধিষ্ঠির দাসত্ব থেকে মুক্ত হোন। অতএব আমার পুত্র প্রশস্ত হৃদয় প্রতিবিন্ধ্য উপস্থিত থেকে, “দাসপুত্র! এসো” এইরূপ যেন অন্য কুমারেরা বলে না। আর, অন্য পুরুষ যেমন পূর্বে রাজপুত্র হয়ে কখনও দাসপুত্র না হয়, তেমনই আমার এই সম্মানিত পুত্রটিও যেন দাসপুত্র হয় না। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “কল্যাণী! তুমি যা বললে, তাই হবে। ভদ্রে! আমি তোমাকে দ্বিতীয় বর দিচ্ছি গ্রহণ করো। আমার মন বলছে যে, তুমি একটি মাত্র বর গ্রহণ করবার যোগ্য নও।” দ্রৌপদী বললেন, “মহারাজ! রথ ও ধন প্রভৃতির সঙ্গে ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব মুক্তিলাভ করুন। আমি এই দ্বিতীয় বর গ্রহণ করলাম।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বৎসে! তুমি যা ইচ্ছা করছ, তা হোক। মহাভাগে! তুমি কেবল দুটি বর দ্বারা উপযুক্তভাবে সম্মানিত হলে না, অতএব, তুমি আমার কাছ থেকে তৃতীয় বর গ্রহণ করো। কেন-না, তুমি আমার সকল পুত্রবধূদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং ধর্মচারিণী।” দ্রৌপদী বললেন, “হে মাহাত্ম্যশালী রাজশ্রেষ্ঠ! লোভ ধর্মনাশের জন্যই হয়ে থাকে, সুতরাং আমি আর বর নিতে পারি না, বিশেষত আমি তৃতীয় বর নিতে অযোগ্যা। কারণ, বৈশ্য একটি বর, ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী দুটি বর, ক্ষত্রিয় তিনটি বর এবং ব্রাহ্মণ একশত বর গ্রহণ করতে পারেন, মুনিরা এ-কথা বলে থাকেন। তারপর, আমার এই ভর্তারা দাস হয়ে আবার তা থেকে মুক্তিলাভ করেছেন, এখন আপন আপন পুণ্যবলেই মঙ্গল লাভ করতে পারবেন।”

কর্ণ বললেন, “আমরা মানুষের মধ্যে যত সুন্দরী স্ত্রীর কথা শুনেছি, তাদের মধ্যে কোনও স্ত্রীর এইরূপ কার্য শুনতে পাইনি। কারণ, পাণ্ডবগণ ও ধার্তরাষ্ট্রগণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলে, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাই পাণ্ডবগণের শান্তিবিধান করল। আর, পাণ্ডবগণ দুঃখসাগরে মগ্ন হয়েছিল এবং আশ্রয়হীন অপবাদসমুদ্রে মগ্ন হচ্ছিল, এই অবস্থায় এই দ্রৌপদীই তাদের পারগামিনী নৌকা হল।” “স্ত্রীই পাণ্ডবগণের গতি” এইরূপ কর্ণের উক্তি শুনে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও দুঃখিত হয়ে কৌরবগণের মধ্যে বললেন, “মহর্ষি দেবল বলেছেন যে, বিধাতা যে অবধি প্রজা সৃষ্টি করেছেন, সেই অবধি তিনটি পুরুষের তিনটি তেজ সৃষ্টি করেছেন। সে তিনটি তেজ— সন্তান, কর্ম ও জ্ঞান। প্রাণহীন, চৈতন্যশূন্য ও অপবিত্র দেহটাকে পরিত্যাগ করলে, এই তিনটি তেজ মানুষের প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে। কিন্তু অর্জুন! আমাদের পত্নীকে অপমানিত করায় আমাদের সেই অপত্য নামক তেজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ, অপমানিত পত্নীজাত সন্তান দূষিতই হয়ে গিয়েছে। অপমানিত পত্নীজাত সন্তান দূষিত হয়ে থাকে।”

অর্জুন বললেন, “হে ভরতনন্দন! নীচলোকেরা নিষ্ঠুর কথা বলুক, তাতে সজ্জনরা কোনও প্রতিবাদ করেন না। যাঁরা আপন ক্ষমতার বলে সম্মান লাভ করেন, সেই সকল সজ্জন পরকৃত উপকারই স্মরণ করে থাকেন, কিন্তু প্রতিকারের উপায় জেনেও পরকৃত শত্রুতা করেন না।” ভীম বললেন, “হে ভরতনন্দন মহারাজ! আমি এখন এই সমবেত সকল শত্রু বিনাশ করব, এদের সকলকে সংহার করব। এখন আমাদের বিবাদে বা কথা বলায় প্রয়োজন কী? আমি আজ এখানেই এদের নাশ করছি, আপনি পৃথিবী শাসন করুন।” ভীমসেন এই কথা বলে কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলে মৃগসমূহের মধ্যে সিংহের মতো বারবার শত্রুদের দিকে তাকাতে থাকলেন। তখন অনায়াস কার্যকারী অর্জুন সান্ত্বনা দিতে থাকলেও, বলবান ও মহাবাহু ভীমসেন দৃষ্টিপাত করতে থেকে অন্তর্দাহে ঘর্মাক্তকলেবর হতে লাগলেন। তখন প্রলয়কাল উপস্থিত হলে মূর্তিমান যমের মতো ভীমসেনের মুখমণ্ডল ভ্রূকুটি করায় দৃষ্টিপাত করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। সেই সময় যুধিষ্ঠির বাহুযুগল দ্বারা ভীমসেনকে ধারণপূর্বক বললেন, “ভীম! এ রকম কোরো না, নীরব হয়ে উপবেশন করো।” ক্রোধবশত আরক্তনয়ন মহাবাহু ভীমকে নিবারণ করে যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলি হয়ে জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে উপস্থিত হলেন।

তখন ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের মঙ্গল কামনা করে, তাঁকে বারবার অজাতশত্রু বলে, তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনার জন্য মার্জনা চেয়ে; তাঁর সাধুপ্রকৃতির অসংখ্য প্রশংসা করে—তাঁকে ইন্দ্রপ্রস্থে যাওয়ার অনুমতি দিলেন এবং তাঁর ভ্রাতাদের সৌহার্দ্য প্রার্থনা করলেন। দ্যূতক্রীড়া শেষ হলে যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে যাত্রা করলেন।

*হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ সংস্করণে এই পাঁচটি শ্লোক নেই। মহাভারতের অন্য সংস্করণে আছে। শ্লোকগুলি সুন্দর। তাই উদ্ধৃতির লোভ সামলানো গেল না। কিন্তু কৃষ্ণ দ্রৌপদীর আহ্বানে আসেননি। এসেছিলেন ধর্মদেব। বনপর্বে স্বয়ং কৃষ্ণ জানিয়েছেন, তিনি অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় অক্ষক্রীড়া সংবাদ বিষয়ে কিছুই জানতেন না, জানলে তিনি সভামধ্যেই কৌরবদের বিনাশ করতেন।

দ্রৌপদীর বনবাস

পট্টমহিষী দৌপদীর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে ফেরা সম্ভব হল না। অনেকটা পথ আসার পর হস্তিনা থেকে প্রতিকামী এসে ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ জানাল যে, পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করতে হবে। যুধিষ্ঠির বললেন—

ধাতুর্নিয়োগাদ্‌ভূতানি প্রাপ্নবন্তি শুভাশুভম্‌।

ন নিবৃত্তিস্তয়োরস্তি দৈবিতব্যম্‌ পুনর্যদি ॥ সভা : ৭৩ : ৩ ॥

“প্রাণীরা বিধাতার নিয়োগ অনুসারে মঙ্গল ও অমঙ্গল পেয়ে থাকে, সুতরাং সে মঙ্গল ও অমঙ্গলের নিবৃত্তি হয় না। অতএব আমি মনে করি, আবারও আমাদের খেলা করতে হবে।”

যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের ও দ্রৌপদীকে নিয়ে আবার সভায় ফিরলেন। শকুনি বললেন, “হে ভারতশ্রেষ্ঠ! বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তোমাদের যে ধন ফিরিয়ে দিয়েছেন আমরা তার প্রশংসা করছি। এখন একটি মহামূল্য পণের বিষয় আমার কাছে শোনো। দ্যূতক্রীড়ায় তোমরা আমাদের জয় করতে পারলে আমরা মৃগচর্ম পরিধান করে মহাবনে প্রবেশ করে বারো বৎসর বাস করব। আর আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতভাবে এক বৎসর যে-কোনও স্থানে বাস করব। তখন যদি আত্মীয়স্বজন আমাদের সংবাদ জানতে পারে, তবে আবার অপর বারো বৎসর বনবাস করব। তোমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। আমরা তোমাদের জয় করতে পারলে, তোমরাও মৃগচর্ম ধারণ করে দ্রৌপদীর সঙ্গে বনে গিয়ে বারো বৎসর বাস করবে।”

পাঠক লক্ষ করবেন যে, দ্রৌপদীর প্রতি কৌরবদের বিদ্বেষ কত গভীর। পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী ছাড়াও অন্য বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু কৌরবদের কেবল দ্রৌপদীকেই প্রয়োজন। সে যাই হোক, ধূর্ত শকুনি কপট অক্ষ ক্ষেপণ করলেন এবং বললেন, “এই জিতেছি।” পঞ্চপাণ্ডব রাজবেশ ত্যাগ করে মৃগচর্ম ধারণ করে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হলেন। দ্রৌপদীও স্বামীদের অনুগামিনী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। দুঃশাসন গভীর পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলতে লাগল, “আজ মহাত্মা দুর্যোধন রাজার সাম্রাজ্য আরম্ভ হল আর পাণ্ডবেরা পরাজিত হয়ে মহাবিপদে পড়ল। সোমকবংশ সদ্ভূত মহাপ্রাজ্ঞ দ্রুপদ পাণ্ডবদের হাতে দ্রৌপদীকে দান করে সুবিবেচনার কাজ করেননি। যেহেতু দ্রৌপদীর পতিগুলি নপুংসক। দ্রৌপদী, তোমার যে পতিগুলি পূর্বে সূক্ষ্ম উত্তরীয় বসন ধারণ করত, তারাই এখন চর্মময় উত্তরীয় ধারণ করছে এবং সর্বস্বহীন ও নিরাশ্রয় হয়েছে। তুমি এদের দেখে কী আনন্দ লাভ করবে। সুতরাং তুমি এখন যাকে ইচ্ছা করো, তাকে পতি বরণ করো। দ্রৌপদী! ক্ষমাশীল, শত্রুদমনকারী ও অত্যন্ত ধনাঢ্য এই কুরুবংশীয়েরা সকলেই এখানে উপস্থিত আছেন, অতএব তুমি এঁদের মধ্যে কোনও একজনকে পতিত্বে বরণ করো। তোমাকে যেন এই কালবিপর্যয় এসে আক্রমণ না করে। অঙ্কুর জননশক্তি তিল, চর্মময় হরিণ ও তণ্ডুলহীন যব যেমন নিষ্ফল, তেমনই পাণ্ডবরা এখন নিষ্ফল। অতএব দ্রৌপদী! তুমি এখন এই দুঃখসাগরমগ্ন পাণ্ডবগণের সেবা করবে কেন? অঙ্কুরজনন শক্তিহীন তিলের তুল্য পাণ্ডবগণের সেবা করায় তোমার পরিশ্রমই ব্যর্থ হবে।”

ভীমসেন পুনরায় ভয়ংকর শপথ করে দুঃশাসনের বক্ষোবিদারণের ঘোষণা করলেন। দুঃশাসন ভীমসেনকে ব্যঙ্গ করে “ওরে গোরুটা! ওরে গোরুটা” বলে নাচতে লাগল। দুর্যোধন ভীমের গমন অনুকরণ করে দেখালেন। ভীম তাঁকেও শেষ করার শপথ করলেন। তখন যুধিষ্ঠির ভিন্ন অপর চার পাণ্ডব শপথ করলেন যে, ভীম দুর্যোধনকে বধ করবেন। অর্জুন কর্ণকে বধ করবেন এবং সহদেব অক্ষ-ধূর্ত শকুনিকে বধ করবেন আর নকুল ধৃতরাষ্ট্রীয় পক্ষীয় বীরদের যমালয়ে পাঠাবেন। যুধিষ্ঠির শুধু বললেন, “সকলের অনুমতি নিয়ে আমি বনে যাচ্ছি; আবার এসে আপনাদের আমি দেখব।”

বিদুর যাত্রাকালীন মঙ্গল আশীর্বাদ করলেন। জানালেন যে, চিরকাল সুখভোগ অভ্যস্তা কুন্তীদেবী তাঁর গৃহেই বাস করবেন। বিদুর আরও বললেন যে, পাণ্ডবদের মঙ্গল হবে, কারণ তাঁরা ধর্মপরায়ণ। তিনি তাঁদের প্রত্যেকের শারীরিক সুস্থতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য কামনা করলেন। যুধিষ্ঠির ভীম, দ্রোণ ও বিদুরকে নমস্কার করে যাত্রা করলেন।

তারপর দ্রৌপদী যাত্রা করার সময় কুন্তীদেবীর কাছে এবং অন্য যে-সকল স্ত্রীলোক ছিলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বনগমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন এবং তিনি যথাযোগ্য নমস্কার ও আলিঙ্গন করে গমন করবার ইচ্ছা করলেন। তখন পাণ্ডবগণের অন্তঃপুরে বিশাল আর্তনাদ হতে লাগল। কুন্তী দ্রৌপদীকে গমন করতে দেখে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে, শোকাকুলকণ্ঠে অতিকষ্টে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, “বৎসে! তুমি এই গুরুতর বিপদে পড়ে শোক কোরো না। তুমি স্ত্রীলোকের সমস্ত ধর্মই জানো এবং সৎস্বভাবশালিনী ও সদাচারসম্পন্না। মৃদুহাসিনী, তোমার ভর্তাদের বিষয়ে তোমার কী করতে হবে, তা আমার বলে দেবার প্রয়োজন নেই। কারণ তুমি সমস্ত গুণ দ্বারা পিতৃ-মাতৃ—উভয় কুলকেই অলংকৃত করেছ। এই কৌরবেরা ভাগ্যবান, যাদের তুমি দৃষ্টি দ্বারা দগ্ধ করোনি। সে যাই হোক, আমার মঙ্গল চিন্তায় রক্ষিত হয়ে তুমি নির্বিঘ্নে পথ গমন করো। অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে স্ত্রীদের বিহ্বলতা সংগত নয়। তুমি অসাধারণ ধর্ম কর্তৃক রক্ষিত থেকে শীঘ্রই মঙ্গল লাভ করবে। বনবাসের সময় আমার পুত্র সহদেবকে তুমি সর্বদা লক্ষ্য রেখো। যাতে এই মহামতি সহদেব এই বিপদে পড়ে অবসন্ন হয়ে না পড়ে।”

পরিধানে একখানি মাত্র বসন ছিল, তাও রক্তাক্ত এবং চুলগুলি খোলা ছিল, এই অবস্থায় দ্রৌপদী “তাই হবে” এই কথা বলে নির্গত হলেন, তখন নয়নজল পতিত হতে থেকে তাঁর গণ্ডযুগলকে প্লাবিত করতে লাগল। এইভাবে দ্রৌপদী উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে করতে গমন করতে লাগলেন, কুন্তীও তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন, তারপর কুন্তী পুত্রগণকে দেখতে পেলেন, তখন তাঁদের বস্ত্র ও অলংকার হরণ করে নিয়েছিল, সমস্ত অঙ্গ মৃগচর্মে আবৃত ছিল, তাঁরা লজ্জায় মাথা নিচু করে হাঁটছিলেন। শত্রুরা আনন্দিত হয়ে তাঁদের ঘিরে যাচ্ছিল এবং বন্ধুরা শোক করছিল। কুন্তী সেই অবস্থাতে প্রত্যেক পুত্রকে আলিঙ্গন করতে থেকে, শোকবশত বারবার বিলাপ করছিলেন।

পাণ্ডবদের এইভাবে বনে পাঠিয়েও ধৃতরাষ্ট্রও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বিদুরকে ডেকে পাণ্ডবদের যাত্রাকালীন বিভিন্ন ভঙ্গির কথা জানতে চাইলেন। দ্রৌপদীর প্রসঙ্গে বিদুর বললেন যে, দীর্ঘনয়না পরমসুন্দরী দ্রৌপদী কেশকলাপ দ্বারা মুখমণ্ডল আবৃত করে রোদন করতে করতে রাজা যুধিষ্ঠিরের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন। এই ভঙ্গির তাৎপর্য প্রশ্ন করলে দ্রৌপদী সম্পর্কে বিদুর বললেন যে, দ্রৌপদী রোদন করতে করতে যেন মনে মনে বলছেন, “যারা আমার এই অবস্থা করল, তাদের রজস্বলা ভার্যারাও যেন আজ থেকে চোদ্দো বৎসরের সময়ে পতি, পুত্র, বন্ধু ও প্রিয়জন নিহত হলে রক্তাক্ত কলেবরা ও মুক্তকেশী অবস্থায় তর্পণ করে এইভাবেই হস্তিনায় প্রবেশ করে।”

অভিমানিনী দ্রৌপদী

পাণ্ডবরা কপট দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে কাম্যকবনে বাস করছেন শুনে ভোজ, বৃষ্ণি, অন্ধকবংশীয়রা তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। পাণ্ডবরা বনে আগমনের সময়ে সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ তাঁদের অনুগমন করেছিলেন। এত ব্রাহ্মণের ক্ষুধার অন্ন কীভাবে জোগাবেন, ভেবে যুধিষ্ঠির অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। ধৌম্য পুরোহিতের উপদেশে যুধিষ্ঠির সূর্যদেবের পূজায় ব্রতী হলেন। সন্তুষ্ট সূর্যদেব একটি তাম্ৰস্থালী প্রদান করে আশীর্বাদ করলেন, দ্রৌপদীর আহার পর্যন্ত স্থালীর অন্ন অফুরন্ত থাকবে। যুধিষ্ঠিরের সমস্যা মিটল। দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল ভয়ংকর রাক্ষস কির্মীর ভ্রাতা বক ও ভ্রাতা হিড়িম্বের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য পাণ্ডবদের আক্রমণ করল। অমিত বিক্ৰমে ভীম কির্মীর রাক্ষসকে বধ করলেন। ঠিক এই সময়ে সাত্যকির মুখে সমস্ত সংবাদ শুনে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। দুর্যোধন প্রভৃতি পাণ্ডবগণের দুরবস্থা করায়, কৃষ্ণ তাঁদের প্রতি এতদূর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি যেন সমস্ত লোককেই দগ্ধ করবার ইচ্ছা করছিলেন, তখন অর্জুন বহু স্তুতিতে তাঁকে শান্ত করলেন। অর্জুনের ন্যায়সংগত বচন শুনে কৃষ্ণের সঙ্গে আগত রাজারা দুর্যোধন ইত্যাদির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরভ্রাতৃগণের মধ্যে পরিবেষ্টিতা শরণার্থিনী দ্রৌপদী উপবিষ্ট শরণাগতরক্ষক কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বলতে লাগলেন, “বাসুদেব! হৃষীকেশ! বামন! অচ্যুত! বেদব্যাস বলেছেন যে, তুমি দেবতাদেরও দেবতা। অসিত দেবল বলেছেন, সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তুমিই সৰ্বলোকস্রষ্টা প্রজাপতি ছিলে। দুর্ধর্ষ। মধুসূদন! পরশুরাম বলেছেন যে, তুমি বিষ্ণু, তুমি যজ্ঞ, তুমি যাজক এবং তুমিই যাজনীয়। পুরুষোত্তম! ঋষিরা তোমাকে ক্ষমা ও সত্য বলে থাকেন এবং কশ্যপ বলেছেন যে, তুমি সত্য থেকে যজ্ঞরূপে আবির্ভূত হয়েছ। হে ভূতভাবন! হে ভূতনাথ! নারদ বলেছেন যে, তুমি সাধ্যগণ, দেবগণ ও রুদ্রগণেরও দেবতা। বালক যেমন খেলার বস্তু নিয়ে খেলা করে থাকেন, তুমিও তেমনই ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগণ দ্বারা খেলা করছ। প্রভু! তোমার মস্তক দ্বারা আকাশ এবং চরণযুগল দ্বারা পৃথিবী ব্যাপ্ত হয়ে আছে, এই প্রাণীগণ তোমার উদর, সুতরাং, তুমি সনাতন বিরাট পুরুষ। নারায়ণ! বিদ্যার্জনের কষ্ট ও তপস্যার কষ্টে সন্তুষ্ট, সন্তপ্ত, তপস্যার দ্বারা শোধিতচিত্ত এবং ব্রহ্মসাক্ষাৎকার নিবন্ধন পরিতৃপ্ত ঋষিগণের মধ্যে তুমিই প্রধান। পুরুষশ্রেষ্ঠ! পুণ্যবান। যুদ্ধে অপলায়িত এবং সর্বগুণসম্পন্ন রাজর্ষিগণের তুমিই গতি, আর তুমি প্রভু, তুমি ব্যাপক, তুমি জীব এবং তুমিই কার্য করে থাকো। ইন্দ্র প্রভৃতি দিকপাল, ত্রিভুবন, নক্ষত্র, দশ দিক, আকাশ, চন্দ্র ও সূর্য— এ-সমস্ত তোমাতে রয়েছে। মহাবাহু! প্রাণীগণের মরণশীলত্ব এবং দেবগণের অমরত্ব—এ দুটি ধর্মই তোমাতে আছে। মধুসূদন! প্রাণীগণের মধ্যে যারা স্বর্গীয় এবং যারা মর্ত্যীয়, তাদের সকলের ঈশ্বর তুমি, সুতরাং প্রণয়বশত তোমার কাছে আমার দুঃখের কথা বলব।

“কৃষ্ণ! প্রভু! পাণ্ডবগণের ভার্যা, তোমার সখী এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী আমার মতো নারীকে কী করে সভায় আকর্ষণ করে নিয়ে যেতে পারে। আমি লজ্জিতা, কম্পিতা, রজস্বলা ও একবস্ত্রা— এই অবস্থায় আমাকে কৌরবসভায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মধুসূদন! পাণ্ডবগণ, পাঞ্চালগণ এবং বৃষ্ণিবংশীয়গণ জীবিত থাকতে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রেরা আমাকে দাসীভাবে ভোগ করবার ইচ্ছা করেছিল। কৃষ্ণ! আমি ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র দু’জনেরই ধর্ম অনুসারে কুলবধূ হই, সেই আমাকেই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা বলপূর্বক দাসী করবার চেষ্টা করেছিল। এ ক্ষেত্রে মহাযোদ্ধা ও মহাবল পাণ্ডবগণকেই আমি নিন্দা করি। যেহেতু তাঁদের যশস্বিনী পত্নীকে এবং ধর্মপত্নীকে কেউ উৎপীড়িত করছিল, তা তাঁরা অবাধে দেখছিলেন। অতএব জনার্দন! ভীমের বাহুবলকে ধিক, অর্জুনের গাণ্ডিবকেও ধিক, যাঁরা ক্ষুদ্র কর্তৃক আমার উৎপীড়ন অবাধে সহ্য করেছিলেন। সর্বদা সজ্জনাচরিত এই ধর্মপথ চিরকাল চলে আসছে যে, স্বামীরা দুর্বল হলেও ভার্যাদের রক্ষা করে থাকেন। কারণ, ভার্যা রক্ষিত হলে সন্তান রক্ষিত হয় এবং সন্তান রক্ষিত হলে নিজেও রক্ষিত হয়। তারপর যেহেতু ভর্তা নিজে ভার্যার উদরে জন্মে থাকেন, সেই হেতু ভার্যার নাম হয়েছে জায়া। আবার ভর্তা কী করে ভার্যার উদরে জন্মাবেন এই ভেবে ভার্যাও ভর্তাকে রক্ষা করবেন। কৃষ্ণ! এঁরা কখনও শরণাগত লোককে পরিত্যাগ করেন না; অথচ আমি তখন শরণাগত ছিলাম। তাতেও এঁরা আমাকে রক্ষা করেননি।

“পাঁচ পতির ঔরসে আমার উদরে পাঁচটি মহাবল পুত্র জন্মেছে, সুতরাং এদের পর্যবেক্ষণের জন্যও আমাকে রক্ষা করা তাঁদের উচিত ছিল। যুধিষ্ঠির থেকে প্রতিবিন্ধ্য, ভীম থেকে সূতসোম, অর্জুন থেকে শ্রুতকীর্তি, নকুল থেকে শতানীক এবং সহদেব থেকে শ্রুতকর্মা জন্মেছেন। এরা সকলেই মহারথ, প্রদ্যুম্নের মতো মহাপরাক্রমশালী। এবং ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ ও শত্রুগণের অজেয় হয়েছে। তথাপি তারাই বা কেন অতিদুর্বল ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের অত্যাচার সহ্য করেছিল, মধুসূদন! তুমি ও অর্জুন ভিন্ন অন্য কোনও লোকই যে-ধনুতে গুণ আরোপণও করতে পারে না, সেই গাণ্ডিবধনু ও ভীমের বলকে এবং অর্জুনের পুরুষকারকেও ধিক। কারণ যেগুলি থাকতেও দুর্যোধন মুহূর্তকাল জীবিত রয়েছে। মধুসূদন, যে দুর্যোধন পূর্বে বেদপাঠী, ব্রহ্মচারী, বালক ও অহিংসক এই পাণ্ডবদের মাতার সঙ্গে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করেছিল, যে পাপাত্মা পূর্বসঞ্চিত, নূতন ও তীক্ষ্ণ্ণ লোমহর্ষণ কালকূট বিষ ভীমসেনকে অন্নে মিশিয়ে দিয়েছিল। ভীমসেনের আয়ু অবশিষ্ট ছিল বলে কোনও বিকার না জন্মেই সে বিষ অন্নের সঙ্গে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

“ভীমসেন প্রমাণকোটিতে নিরুদ্বেগে নিদ্রিত ছিলেন। এই অবস্থায় সেই পাপাত্মা তাঁকে বন্ধন করে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে নগরের ভিতরে চলে গিয়েছিল। তারপর, মহাবাহু ও মহাবল ভীমসেন যখন জাগরিত হলেন, তখন সেই বন্ধন ছিন্ন করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর আবার কোনও সময়ে ভীমসেন নিদ্রিত হলে, তাঁর সমস্ত অঙ্গে তীক্ষ্ণ্ণবিষ সর্প দ্বারা দংশন করিয়েছিল। কিন্তু ওই শত্রুহন্তা তাতেও মৃত্যুমুখে পতিত হননি। বরং তিনি জাগ্রত হয়ে সমস্ত সর্পকে ভূতলে প্রোথিত করেছিলেন এবং দুর্যোধনের সেই প্রিয়কার্যকারী সারথিকেও বামহস্ত দ্বারা বধ করেছিলেন। আবার বালক পাণ্ডবরা মায়ের সঙ্গে শায়িত ও নিদ্রিত হয়েছিলেন, এই অবস্থায় দুর্যোধন তাঁদের দগ্ধ করার উপক্রম করেছিলেন, কিন্তু ভীম ভিন্ন অন্য কে সেই কার্য ব্যর্থ করতে পারে। মাতা কুন্তীদেবী ভীত হয়ে পাণ্ডবদের বলেছিলেন যে, অগ্নি কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে গুরুতর বিপদাপন্ন হলাম। হায়! আমি মরলাম, কী করে এই অগ্নি সন্তাপের নিবৃত্তি হবে। অনাথা আমি আজ বালক পুত্রদের সঙ্গে বিনষ্ট হব।” তখন বায়ুর ন্যায় বেগ ও পরাক্রমশালী মহাবাহু ভীম মাতা ও ভ্রাতৃগণকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, “পক্ষীশ্রেষ্ঠ গরুড়ের মতো আমি আপনাদের নিয়ে চলে যাব। আপনাদের কোনও ভয় নেই।” বল ও উৎসাহশালী ভীমসেন বামক্রোড়ে কুন্তীকে, দক্ষিণ ক্রোড়ে যুধিষ্ঠিরকে, কাঁধে নকুল ও সহদেবকে নিয়ে, পিঠে অর্জুনকে স্থাপন করে, এইভাবে সকলকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ অগ্নিলঙঘন করে ভ্রাতৃগণ ও মাতাকে অগ্নি থেকে মুক্ত করেছিলেন।

“যশস্বী পাণ্ডবরা সকলে মাতার সঙ্গে সেখান থেকে প্রস্থান করে, ক্রমশ নিকটবর্তী হিড়িম্বনামক বনে প্রবেশ করলেন। পরিশ্রান্ত ও অত্যন্ত দুঃখিত পাণ্ডবরা মাতার সঙ্গে সেই ঘন বনের মধ্যেই নিদ্রিত হলেন। তখন হিড়িম্বারাক্ষসী তাদের কাছে আসল। সেই হিড়িম্বা রাক্ষসী মাতার সঙ্গে ভূতলে নিদ্রিত পাণ্ডবগণকে দেখে কামার্তা হয়ে সুলক্ষণা নারীর রূপ ধরে, নিজের কোলে ভীমসেনের চরণ তুলে নিয়ে, আনন্দিত চিত্তে মর্দন করতে লাগল। তখন অসাধারণ ধৈর্যশীল, বলবান ও যথার্থবিক্রম ভীমসেন তাঁকে বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলেন, “সুন্দরী! তুমি আমার কাছে কী চাও?” ভীমসেন এই কথা বললে, কামরূপিণী ও অনিন্দ্যসুন্দরী সেই রাক্ষসী ভীমসেনকে বলল, “তোমরা এখনই এ-স্থান থেকে পলায়ন করো, কারণ, আমার বলবান ভ্রাতা তোমাদের বধ করতে আসবে। অতএব যাও, বিলম্ব কোরো না।” তখন ভীম গর্বের সঙ্গে তাকে বললেন, “আমি তোমার ভ্রাতা থেকে ভীত নই, সে আসলে আমি তাকে বধ করব।” তাদের আলাপ শুনে ভীমাকৃতি ও ভীমদর্শন সেই রাক্ষসাধম বিশাল গর্জন করতে করতে সেখানে উপস্থিত হল। রাক্ষস বলল, “হিড়িম্বা! তুই কার সঙ্গে আলাপ করছিস, ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়, আমি ওকে ভক্ষণ করব, বিলম্ব করিস না। “তখন নরমাংসভোজী সেই রাক্ষস গর্জন করতে করতে বেগে ভীমসেনের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল এবং বাম হস্ত দিয়ে ভীমের হস্ত ধারণ করে তৎক্ষণাৎ দক্ষিণহস্তে বজ্রের মতো মুষ্টিবন্ধন করে ভীমকে প্রহার করল। ভীম সেই স্পর্শটাকে বজ্রের মতো মনে করলেন, মহাবাহু ভীম সহ্য করলেন না এবং ক্রুদ্ধ হলেন। তখন সর্বাস্ত্রনিপুণ ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের ন্যায় ভীম ও হিড়িম্ব রাক্ষসের ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। তারপর বলবান ও উৎসাহী ভীমসেন দীর্ঘকাল রাক্ষসের সঙ্গে খেলা করে সেই দুর্বল রাক্ষসকে বধ করলেন। ভীম হিড়িম্বকে বধ করে, ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিড়িম্বাকে সামনে রেখে এগিয়ে গেলেন, যে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচ জন্মেছিল।

“তারপর, শত্ৰুবিজয়ী পাণ্ডবরা সকলে ব্রাহ্মণগণে পরিবেষ্টিত হয়ে মাতা কুন্তীর সঙ্গে একচক্রানগরে প্রস্থান করলেন। প্রস্থান করার সময়ে বেদব্যাস এঁদের মন্ত্রী, প্রিয় কার্যকারী ও হিতৈষী হয়েছিলেন। তারপর পাণ্ডবরা ব্রহ্মচারী হয়ে একচক্রাপুরে গমন করলেন। সেখানেও তাঁরা হিড়িম্বা-রাক্ষসের মতো ভয়ংকর ও মহাবল বক নামক রাক্ষসের উপদ্রব ভোগ করেছিলেন। বীরবর ভীমসেন সেই ভয়ংকর বকরাক্ষসকে বধ করে, ভ্রাতাদের সঙ্গে দ্রুপদরাজের রাজধানীতে গমন করলেন। কৃষ্ণ, তুমি যেমন রুক্মিণীকে জয় করেছ, সেইরূপ অর্জুন সেখানে থেকেই আমাকে লাভ করেন। অর্জুন মহাযুদ্ধে অন্যের দুষ্কর কার্য করে আমাকে লাভ করেন। কৃষ্ণ, এইরূপ বহুতর ক্লেশে ক্লিষ্ট হয়ে কুন্তীদেবীকে ছেড়ে ধৌম্যকে অগ্রবর্তী করে এখানে বাস করছি। সিংহের ন্যায় বিক্রমী এবং অন্য অপেক্ষা অধিক বলশালী এই সেই পাণ্ডবরা নিকৃষ্ট কর্তৃক পরিক্লিষ্ট আমাকে কেন উপেক্ষা করছেন? পাণ্ডবদের থেকে দুর্বল, পাপাত্মা দুর্যোধন কর্তৃক আমি এই কষ্ট সহ্য করে দীর্ঘকাল যাবৎ সন্তাপ ভোগ করছি। অলৌকিক বিধানে উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি পাণ্ডবগণের প্রিয়তমা ভার্যা এবং মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ। কৃষ্ণ! মধুসূদন! তবুও আমি শ্রেষ্ঠা ও পতিব্রতা হয়ে, পঞ্চপাণ্ডবের দৃষ্টিগোচর থেকে কেশাকর্ষণের লাঞ্ছনা পেলাম।” এই কথা বলে মৃদুভাষিণী দ্রৌপদী পদ্মকোষতুল্য সুন্দর ও কোমল পাণিদ্বারা মুখমণ্ডল আবৃত করে রোদন করতে লাগলেন এবং তিনি উন্নত, সুগোল ও সুলক্ষণ স্তনদুটিকে দুঃখজাত অশ্রুবিন্দু দ্বারা সিক্ত করতে লাগলেন। তিনি নয়নযুগল মার্জনা করে এবং বারবার নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে, ক্রুদ্ধ হয়ে বাষ্পপূর্ণ কণ্ঠে এই কথা বললেন,

নৈব মে পতয়ঃ সন্তি ন পুত্ৰা ন চ বান্ধবাঃ।

ন ভ্রাতরো ন চ পিতা নৈব ত্বং মধুসূদন।। বন : ১১: ১২৬ ॥

“মধুসূদন! আমার পতিরা নেই, পুত্ররা নেই, বান্ধবরা নেই, ভ্রাতারা নেই, পিতা নেই এবং তুমিও নেই।”

“ক্ষুদ্রেরা আমাকে নির্যাতিত করল, অথচ তোমরা আমাকে সুস্থার মতোই উপেক্ষা করছ। তারপর কর্ণ তখন আমাকে যে উপহাস করেছিল, তোমরাও আমার সে দুঃখের শান্তি করছ না। কৃষ্ণ! কেশব! গুরুত্ব, সম্পর্ক, সখিত্ব ও প্রভুত্ব—এই চারটি কারণে সর্বদা আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।” তখন, কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সেই সকল কথা শুনে ক্রুদ্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে সেই বীরসমাজের মধ্যে দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী! তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ তারা অর্জুনের শরজালে আবৃতদেহ ও নিহত হয়ে, রক্তাক্ত কলেবর হয়ে ভূতলে শয়ন করবে— এই দেখে তাদের ভার্যারাও এইরূপ রোদন করবে এবং পাণ্ডবগণ দ্বারা যতদূর সম্ভব, তা আমি করব। তুমি রোদন কোরো না দ্রৌপদী! আমি তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি— তুমি রাজাদের রানি হবে, যদি স্বর্গ পড়ে যায়, হিমালয় বিশীর্ণ হয়, পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় এবং সমুদ্র শুষ্ক হয়, তবুও আমার বাক্য ব্যর্থ হবে না।” তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণের সেই কথা শুনে আর কোনও কথা বললেন না। কিন্তু তিনি বক্রভাবে অর্জুনের দিকে তাকালেন। তখন অর্জুন দ্রৌপদীকে বললেন, “দেবী! সুনয়নে! বরবর্ণিনী! তুমি রোদন কোরো না, কৃষ্ণ যা বললেন, আমি তা করব।” ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, “আমি দ্রোণকে বধ করব, শিখণ্ডী ভীষ্মকে বধ করবে, ভীম দুর্যোধনকে নিহত করবেন আর অর্জুন কর্ণকে বধ করবেন। ভগিনী! আমরা রাম ও কৃষ্ণকে অবলম্বন করে ইন্দ্রর সঙ্গে যুদ্ধেও অজেয় হব, সুতরাং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের কথা আর কী বলব।” অর্জুন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন এ কথা বললে, উপস্থিত বীরগণ কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। দ্রৌপদীর ক্ষোভ সাময়িকভাবে নিবৃত্ত হল।

প্রতিবাদিনী দ্রৌপদী

কাম্যকবন ত্যাগ করে পাণ্ডবরা দ্বৈতবনে চলে গেলেন। এক সন্ধ্যায় তাঁরা পরস্পর আলাপ করছেন, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, সেই পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের আমাদের বিষয়ে নিশ্চয় কোনও দুঃখ নেই। যে দুরাত্মা ও দুর্মতি দুর্যোধন আপনাকে মৃগচর্ম পরিয়ে আমার সঙ্গে বনে পাঠিয়েও কোনও অনুতাপ করেনি। আপনি জ্যেষ্ঠ এবং ধর্মপরায়ণ, তবুও সেই লৌহহৃদয় নির্মিত দুরাত্মা আপনাকে কটূবাক্য বলেছিল। আপনি সুখভোগেই অভ্যস্ত, দুঃখভোগে অভ্যস্ত নন, তবুও পাপিষ্ঠ ও দুরাত্মা দুর্যোধন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে, আপনাকে দুঃখভোগে ঠেলে দিয়ে আমোদ করছে। আপনি মৃগচর্ম পরে বনবাসের জন্য বার হয়ে এলে চারটে পাপিষ্ঠের অশ্রুপাত হয়নি— দুর্যোধন, তার দুষ্ট ভ্রাতা উগ্ৰস্বভাব দুঃশাসন এবং দুরাত্মা কর্ণ ও শকুনির। কিন্তু দুঃখিতচিত্ত অন্য সকল কুরুবংশীয়ের চোখ থেকে তখন জল পড়ছিল। আপনার এই শয্যা দেখে এবং পূর্বে আপনার যে-শয্যা ছিল, তা স্মরণ করে আমারই আপনার জন্য শোক হচ্ছে। কারণ আপনি তো দুঃখভোগের যোগ্য নন, বিশেষ সুখভোগেই অভ্যস্ত।

“সভার মধ্যে হস্তীদন্তনির্মিত এবং নানারত্নবিভুষিত আপনার যে-আসন ছিল, তা স্মরণ করে এবং আপনার এই কুশময় আসন দেখে আমি শোকে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছি। আমি আপনাকে সভার মধ্যে রাজগণে পরিবৃত অবস্থায় দেখেছি, বর্তমান সময়ে তা দেখছি না, কাজেই আমার মনে শান্তি নেই। আমি আপনাকে চন্দনলিপ্ত ও সূর্যতুল্য তেজস্বী দেখেছি, সেই আপনাকে ধূলিলিপ্ত দেখে মোহিত হয়ে যাচ্ছি। আমি পূর্বে আপনাকে শুভ্রবর্ণ পট্টবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় দেখেছি, সেই আমিই এখন আপনাকে কৌপীনধারী দেখছি। পরিজনেরা আপনার গৃহ থেকে সহস্র ব্রাহ্মণের, স্বর্ণপাত্রে করে সুপক্ক ও সকলের অভীষ্ট সেই অন্ন নিয়ে যেত। আর ব্রহ্মচারী, ভিক্ষু ও গৃহস্থদের সে অতি উত্তম খাদ্য দেওয়া হত এবং পূর্বে আপনার গৃহে সর্বপ্রকার অভীষ্ট বস্তু দান করে সহস্র সহস্র দরিদ্রকে সম্মানিত করা হত এবং সুনির্মিত ও সকলের বাঞ্ছনীয় বস্তু দান করে ব্রাহ্মণদের পূজা করা হত। বর্তমানে তা আর দেখছি না বলে আমার মনে কোনও শান্তিই আসছে না।

“মনুষ্যশ্রেষ্ঠ, পরিকৃত কুণ্ডলধারী যুবক পাচকেরা বিশেষ যত্নে প্রস্তুত মিষ্টান্ন দ্বারা আপনার যে ভ্রাতৃগণকে ভোজন করাত, আপনার সেই সকল ভ্রাতাই আজ বন্য ফলমূল দ্বারা জীবনধারণ করছেন। এঁরা তো দুঃখভোগের যোগ্য নন, সুতরাং আমার মন শান্তি পাচ্ছে না। বনবাসী দুঃখিত এই ভীমসেনের বিষয় চিন্তা করে আপনার বর্তমান সময়েও ক্রোধবৃদ্ধি পায় না? ধর্মপথ থেকে অবিচলিত এবং সুখভোগের যোগ্য নিজেই ফলমূল নিয়ে আসছেন, এই দেখেও আপনার ক্রোধ বৃদ্ধি পায় না? যিনি নানাবিধ যান, নানাবিধ বস্ত্র দ্বারা আদৃত হতেন, সেই ভীমকে বনবাসী দেখেও কেন আপনার ক্রোধ বৃদ্ধি পায় না? সমরবিজয়ী এই ভীমসেন একাকীই যুদ্ধে সকল কৌরবকে বিনাশ করতে পারেন, তবুও তিনি আপনার প্রতিজ্ঞার প্রতীক্ষা করে এই কষ্ট সহ্য করছেন।

“তারপর যে অর্জুন দ্বিবাহু হয়েও সত্বর বাণক্ষেপ করতে পারেন বলে সহস্রবাহু কার্তবীর্যার্জুনের তুল্য এবং শত্রুপক্ষের কালান্তক যমের তুল্য, সমস্ত রাজাই যাঁর অস্ত্রের প্রতাপে অবনত হয়ে আপনার রাজসূয় যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণের সেবা করেছিলেন, দেব-দানব সম্মানিত সেই অর্জুনকে নিজের দুর্ভাগ্য চিন্তা করতে দেখেও আপনি কেন শত্রুপক্ষের প্রতি ক্রুদ্ধ হচ্ছেন না। অর্জুন দুঃখভোগের যোগ্য নন, সুখভোগেই অভ্যস্ত। তবুও তাঁকে বনবাসী দেখেও আপনার যে ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তাতেই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। যিনি একরথে দেবতা, মনুষ্য ও নাগগণকে জয় করেছিলেন, সেই অর্জুনকে দেখে আপনার ক্রোধ বৃদ্ধি পায় না? পরাজিত রাজারা হস্তী, অশ্ব, আশ্চর্য রথ উপহার দিয়ে যে অর্জুনকে সম্মানিত করেছিলেন এবং যে পরন্তপ অর্জুন বলপূর্বক রাজাদের কাছ থেকে ধন নিয়ে এসেছিলেন, যে অর্জুন একবারেই পাঁচশো বাণ নিক্ষেপ করতে পারেন, সেই অর্জুনকে বনবাসী দেখেও কেন আপনার ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না?

“শ্যামবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, যুবা এবং যুদ্ধে চর্মধারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নকুলকে বনবাসী দেখে কেন আপনার ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না? সুন্দরমূর্তি ও বীর মাদ্রীপুত্র সহদেবকে দেখে ও তাঁর বনবাসকালীন কষ্ট দেখেও আপনি শত্রুদের ক্ষমা করছেন? তারপর, আমি দ্রুপদের বংশে জন্মেছি, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, বীরগণের পত্নী এবং তাঁদের অনুকূলা, এ-অবস্থায় আমাকে বনবাসিনী দেখেও আপনি ক্ষমা করছেন? নিশ্চয়ই আপনার ক্রোধ বলে বস্তুই নেই। ভ্রাতৃগণ ও আমাকে এই অবস্থায় দেখেও আপনার মন ব্যথিত হয় না? ক্রোধ ছাড়া ক্ষত্রিয় হয় না বলে জগতে প্রসিদ্ধি আছে, তা আজ আপনার ক্ষেত্রে বিপরীত দেখছি। যে ক্ষেত্রে সময় উপস্থিত হলেও ক্ষত্রিয় তেজ প্রদর্শন না করেন, তাঁকে সকল লোকই অবজ্ঞা করে চলেন। অতএব, শত্রুদের প্রতি কোনও প্রকারেই আপনার ক্ষমা করা উচিত নয়। কারণ তেজ দ্বারাই আপনি শত্রুদের সংহার করতে পারবেন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আবার যে ক্ষত্রিয় ক্ষমার সময়ে ক্ষমা না করেন, তিনি সকল লোকের অপ্রিয় হয়ে ইহলোক ও পরলোকে বিনষ্ট হন। এ-বিষয়ে মনস্বীরা প্রহ্লাদ ও বিরোচনপুত্র বলির ইতিহাস উল্লেখ করে থাকেন।

“অসুরশ্রেষ্ঠ, মহাপ্রাজ্ঞ ও ধর্মশাস্ত্রবিৎ পিতামহ প্রহ্লাদের কাছে একদিন বলি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পিতামহ! ক্ষমাকে ভাল বলা হয় না তেজকে? আমার এই সংশয়ের যথাযথ উত্তর বলুন।” বলি এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে প্রাজ্ঞ ও সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞ প্রহ্লাদ বলিকে বলেছিলেন, ‘বৎস, তুমি নিশ্চয় জেনে রাখো, সর্বদা তেজ প্রকাশ করাও ভাল নয়, আবার সর্বদা ক্ষমা করাও ভাল নয়। যে ব্যক্তি সর্বদা ক্ষমা করে, সে ব্যক্তি নানাপ্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভৃত্য, শত্রু ও নিরপেক্ষ লোক তাকে অবজ্ঞা করে এবং কখনও তার কাছে লোক অবনত হয় না; অতএব বৎস, জ্ঞানী লোকেরা সর্বদা ক্ষমা করার নিন্দাই করেছেন। ক্ষুদ্ৰহৃদয় ভৃত্যেরা অবজ্ঞাপূর্বক ওই ক্ষমাকারীর হিত না করে অহিতই করে এবং আরও সম্পত্তি নেওয়ার চেষ্টা করে এবং হৃদয়বিহীন ভৃত্যেরা ওই ক্ষমাকারীর যান, বস্ত্র, অলংকার, শয্যা, আসন, খাদ্য, পেয় এবং সমস্ত উপকরণ ইচ্ছানুসারে গ্রহণ করে। প্রভুর আদেশ অনুসারে নির্দিষ্ট বস্তুও দেয় না এবং সেই ভৃত্যরা প্রভুযোগ্য সম্মান দ্বারাও কোনও প্রকারেই সম্মানিত করে না; সুতরাং, এ-জগতে অবজ্ঞাটা মরণ অপেক্ষাও গর্হিত।

“কর্মচারী, পুত্র, ভৃত্য এবং নিরপেক্ষ লোকরা সর্বদা ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে কটূবাক্যও বলে থাকে। এমনকী, তাকে অবজ্ঞা করে সেই ক্ষমাশীল লোকের ভার্যাকেও লাভ করার ইচ্ছা করে এবং তাঁর হৃদয়হীন ভাৰ্যাও ইচ্ছানুসারে চলতে থাকে। স্বামীর নিকট যদি অনুমাত্র দণ্ডও না পায় তবে সেই ভার্যা সর্বদা আমোদে মগ্ন হয়ে দূষিত হয় এবং দূষিত হয়ে শেষে অপকার পর্যন্ত করে থাকে।

‘আবার সর্বদা অক্ষমাশীল লোকেদের দোষ শোনো। রজোগুণান্বিত লোক ক্রুদ্ধ হয়ে আপন তেজে স্থানে বা অস্থানে সর্বদাই যদি দণ্ডবিধান করতে আরম্ভ করে, তবে সে লোক বন্ধুদের সঙ্গেও বিরোধ ঘটায় ও সাধারণ লোক ও আত্মীয়স্বজনের বিদ্বেষভাজন হয়। স্থান ও অস্থান সর্বত্রই দণ্ডকারী লোক পরের অপমান করায় অর্থহানি, নিন্দা, অনাদর, সন্তাপ ও বিদ্বেষপ্রাপ্ত হয় এবং বহুলোকই তার শত্রু হয়। মানুষ ক্রোধবশত মানুষের প্রতি নানাপ্রকার দণ্ড বিধান করে এবং সত্বরই সম্পদ, বন্ধুজন এবং প্রাণ থেকে বিচ্যুত হয়। যে ব্যক্তি, উপকারী ও অপকারী উভয়ের প্রতি সমানভাবে দণ্ডপ্রয়োগ করে, গৃহস্থিত সর্পের মতো সেই ব্যক্তি থেকে সকল লোকই উদ্বিগ্ন হয়। যে ব্যক্তি থেকে সকল লোক উদ্বিগ্ন হয়, কী করে তাঁর মঙ্গল হতে পারে? তার ছিদ্র দেখে লোক বিকৃত হয়ে পড়ে। অতএব সর্বদা তেজও প্রকাশ করবে না এবং সর্বদা মৃদুও হবে না। যথাকালে মৃদু হবে এবং যথাকালে তীক্ষ্ণ্ণ হবে। যে লোক কালে মৃদু হয় এবং কালে তীক্ষ্ণ্ণ হয়, সে তোক ইহকালে এবং পরকালে সুখলাভ করে। যে ক্ষমাকালগুলি তোমার অপরিহার্য এবং যাঁর কথা জ্ঞানীরা বলেছেন, সে ক্ষমাকালগুলি বিস্তরক্ৰমে তোমার কাছে বলব। যে লোক পূর্বে তোমার উপকার করেছিল, সে যদি এখন অপরাধী হয় এবং সে-অপরাধ যদি গুরুতরও হয় তবু সেই পূর্ব-উপকার স্মরণ করে তার সম্বন্ধে ক্ষমা করা উচিত। যারা না বুঝে অপরাধ করে, তাদের সম্বন্ধেও ক্ষমা করা উচিত। মানুষের সমস্ত বিষয় জানা সম্ভব, তবে যারা জেনেশুনে বলে যে, না জেনে অপরাধ করেছি, সেই পাপিষ্ঠ কুটিল প্রকৃতির লোকদের অল্প অপরাধেও দণ্ড দেবে। সকল লোকের, প্রথম অপরাধ ক্ষমা করবে, কিন্তু দ্বিতীয় অপরাধ হলে অল্প দণ্ড দেবে। যদি কোনও লোক না-জেনে কোনও অপরাধ করে, তবে তুমি প্রমাণ দ্বারা বিশেষ পরীক্ষা করে ক্ষমাই করবে। কোমল ব্যবহারে তীক্ষ্ণ্ণ লোককে বশ করা যায় এবং কোমল লোককেও বশ করা যায়, অতএব কোমল ব্যবহারকারী লোকই অতি তীক্ষ্ণ্ণ। দেশ, কাল এবং নিজের সরলতা ও দুর্বলতার পর্যবেক্ষণ করেই এবং অপরাধের কারণ অনুসন্ধান করে তেজ বা ক্ষমা করবে। দেশ ও কাল না হলে কিছুই হয় না; অতএব তুমি দেশ ও কালের প্রতীক্ষা করবে। আর-এক কথা, লোকনিন্দার ভয়েও করবে। এইগুলি ছাড়া অন্য সময়ে তেজ প্রকাশের কাল।’ অতএব মহারাজ! সর্বদা অপকারী ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের প্রতি আপনার তেজপ্রকাশের কাল এসেছে। যে রাজা উপযুক্ত সময়েও তেজ প্রকাশ না করেন, তিনি বাস্তবিক রাজা নন।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “দ্রৌপদী! তুমি মহাপ্রজ্ঞাবতী। জেনে রাখো যে ক্রোধ থেকে শুভাশুভ দুই ঘটে। ক্রোধ সহ্য করতে পারলে মঙ্গল হয়। ক্রুদ্ধ লোক পাপ করে গুরুহত্যাও করে থাকে। তাদের অকার্য কিছুই নেই, তারা অবধ্যকে বধ করে, বধ্যকে পূজা করে। এই কারণেই আমার ক্রোধ বৃদ্ধি হচ্ছে না। অপরের ক্রোধ দেখলেও যে ক্রুদ্ধ হয় না, সে নিজেকে এবং অপরকে মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। ক্রোধ উৎপন্ন হলে, যিনি প্রজ্ঞার দ্বারা তা জয় করতে পারেন, পণ্ডিতরা তাঁকে তেজস্বী বলে গ্রহণ করেন। মূর্খেরা সর্বদাই ক্রোধকে তেজ মনে করে, মানুষের বিনাশের জন্যই রজোগুণজাত ক্রোধের উৎপত্তি। ভীষ্ম কৃষ্ণ দ্রোণ বিদুর কৃপ সঞ্জয় পিতামহ ব্যাসদেব সর্বদাই শমগুণের প্রশংসা করেন। এঁরা ধৃতরাষ্ট্রকে শান্তির উপদেশ দিলে তিনি অবশ্যই আমাকে রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন। যদি লোভের বশে না দেন, তবে বিনষ্ট হবেন।”

দ্রৌপদী বললেন, “ব্রহ্মা ও দৈবকে আমি নমস্কার করি, যাঁরা আপনার মোহ জন্মিয়ে দিয়েছেন। না হলে, কোথায় আপনি পৈতৃক ভার বহন করবেন, আর কোথায় এখন অন্য প্রকার বুদ্ধি হয়ে পড়েছে। প্রাণীরা কর্মানুসারে জন্মে জন্মে বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে, অতএব ভোগ ব্যতীত কর্মের ক্ষয় হয় না, সুতরাং ভ্রমবশতই মানুষ কর্মফল থেকে মুক্তি লাভ করতে ইচ্ছা করে। এ জগতে ধর্ম, কোমলতা, ক্ষমা, সরলতা কিংবা দয়া দ্বারা কেউ কখনও সম্পদ লাভ করতে পারে না। আপনি বা আপনার মহাবল ভ্রাতারা যে বিপদ ভোগ করবার যোগ্য নন, আপনার সেই দুঃসহ বিপদ উপস্থিত হয়েছে। আপনার ভ্রাতারা তখন বা এখন বা অন্য কোনও সময়েই ধর্ম অপেক্ষা কোনও বস্তুকেই প্রিয়তর বলে জানেন না, জীবন অপেক্ষাও ধর্মকেই প্রিয়তর বলে জানেন। আপনারও ধর্মার্থই রাজ্য, এবং ধর্মার্থই জীবন, এ-কথা ব্রাহ্মণরা, গুরুজনেরা এবং দেবতারাও জানেন।

ভীমসেনার্জুনৌ চেমৌ মাদ্রেয়ৌ চ ময়া সহ।

ত্যজেস্ত্বমিতি মে বুদ্ধিৰ্ন তু ধর্মং পরিত্যজে ॥ বন : ২৬ : ৭॥

“আমার এই ধারণা যে, আমার সঙ্গে ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেবকেও আপনি ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ধর্মকে ত্যাগ করতে পারেন না।”

“আমি গুরুজনদের কাছে শুনেছি যে রাজা ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্মও রাজাকে রক্ষা করেন, কিন্তু সে ধর্ম আপনাকে রক্ষা করছেন না— এ-কথা আমি মনে করি। নিজের ছায়া যেমন নিজের অনুসরণ করে, সেইরকম আপনার বুদ্ধিও অন্য বিষয়ে যায় না, নিত্য সর্বদাই ধর্মের অনুসরণ করে। আপনি সমস্ত পৃথিবী লাভ করেও সমান বা নিকৃষ্ট লোকের অবমাননা করেননি, তাতে উৎকৃষ্ট লোকের অবমাননা করবেন কেন? কারণ, সমস্ত পৃথিবীলাভেও আপনার প্রভুত্বের অভিমান বাড়েনি।

“আপনি যজ্ঞ দ্বারা দেবগণের, শ্রাদ্ধ দ্বারা পিতৃগণের এবং পূজা দ্বারা ব্রাহ্মণদের সর্বদা সেবা করে থাকেন। আপনি সর্বদা সর্বপ্রকার অভীষ্ট বস্তু দ্বারা ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্ট করতেন এবং আপনার গৃহে ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ এবং গৃহস্থেরা স্বর্ণপাত্র করে ভোজ করতেন, যেখানে আমি পরিচারিকা থাকতাম। আপনি বনবাসীদের তৈজসপত্র দান করে থাকেন, আপনার গৃহে ব্রাহ্মণকে অদেয় কোনও বস্তুই নেই। রাজা, আপনি শান্তির জন্য এই যে বৈশ্বদেব করেন এবং অতিথি ও প্রাণীগণকে দিয়ে তার অবশিষ্ট ভক্ষণ করে জীবনধারণ করেন। আর সাধারণ যাগ, পশুযাগ, কাম্যযাগ, নৈমিত্তিক যাগ, পাকযাগ এবং নিত্যযাগ হচ্ছে। সুতরাং, আপনি রাজ্য থেকে বার হয়ে এই নির্জন ও দস্যুসেবিত মহারণ্যে বাস করবার সময়েও আপনার ধর্মকর্ম হ্রাস পাচ্ছে না। তারপর, আপনি প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত অশ্বমেধ, রাজসূয়, পুণ্ডরীক এবং গোসব— এই সব মহাযজ্ঞও করেছেন। তারপর, আপনি ভ্রান্তিবশত সেই দারুণ দ্যূত পরাজয়ের সময়ে রাজ্য, ধন, অস্ত্র, ভ্রাতৃগণ এবং আমাকে পর্যন্ত হেরেছেন। আপনি সরল, কোমল, দাতা, লজ্জাশীল এবং সত্যবাদী, তবুও কেন আপনার দ্যুতব্যসনে বুদ্ধি উপস্থিত হয়েছিল, আপনার এই দুঃখ এবং ঈদৃশ বিপদ দেখে আমার মন অত্যন্ত মুগ্ধ এবং দুঃখাভিভূত হচ্ছে। মনস্বীরা পুরাতন ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন, “মানুষ ঈশ্বরের অধীনে থাকে, কিন্তু নিজের অধীনে থাকে না। বিধাতাই প্রাণীগণের পূর্বজন্মের কর্ম অনুসারে তাদের সুখ-দুঃখ, প্রিয় অপ্রিয়, এমনকী সমস্ত অবস্থারই বিধান করেন। নর্তক চালিত কাঠের পুতুল যেমন অঙ্গসঞ্চালন করে, সেইরূপ জগতের সকল প্রাণীই ঈশ্বর চালিত হয়ে অঙ্গ সঞ্চালন করে। ঈশ্বর আকাশের মতো সমস্ত প্রাণীকে অবলম্বন করে তাদের মঙ্গল ও অমঙ্গল বিধান করেন। সূত্রবদ্ধ পক্ষীর ন্যায় কর্মবদ্ধ প্রাণীরা অস্বাধীনভাবে ঈশ্বরের অধীনে থাকে, পরের বা নিজের পরিচালনে সমর্থ হয় না। জগতে সকল প্রাণীই ঈশ্বরময় এবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করে আছে। সুতরাং সূত্রগ্রথিত মণির মতো, নাসিকাবদ্ধ বৃষের মতো এবং তিরচ্যুত ও স্রোতের মধ্যে পতিত বৃক্ষের মতো প্রাণীগণ বিধাতার আদেশেরই অনুসরণ করে, স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। ঈশ্বর প্রেরিত হয়েই মানুষ স্বর্গে বা নরকে যায়। ছিন্ন তৃণসকল যেমন বলবান বায়ুর বশীভূত হয়ে চলে, সেই মতো সমস্ত প্রাণীই ঈশ্বরের বশীভূত হয়ে চলে। ঈশ্বর সর্বভূতে অধিষ্ঠান করে, পুণ্যে বা পাপে প্রবৃত্ত হয়ে বিচরণ করছেন, কিন্তু তিনি যে বিচরণ করছেন, জীব তা লক্ষ করতে পারে না। কার্যের হেতুমাত্র এই ঈশ্বরের প্রকাশিত হবার স্থান, যা দ্বারা তিনি জীবকে শুভাশুভ কর্ম করাচ্ছেন। ঈশ্বর নিজের মায়ায় মোহিত করে প্রাণীগণকে বধ করাচ্ছেন। জ্ঞানী মুনিরা বস্তুকে একভাবে দেখেন, অজ্ঞানীরা অন্যভাবে দেখেন। জীব বস্তুকে একভাবে দেখে, আবার ঈশ্বর সেগুলিকে অন্যরূপ করেছেন।

“মহারাজ, মাতা ও পিতা যেমন দয়া করে পুত্র প্রভৃতির সঙ্গে ব্যবহার করেন, ঈশ্বরও তেমন দয়া সহকারে প্রাণীগণের সঙ্গে ব্যবহার করেন না, কিন্তু ঈশ্বর ইতরলোকের মতো ক্রোধ সহকারেই যেন প্রাণীগণের সঙ্গে ব্যবহার করেন। সচ্চরিত্র ও লজ্জাশীল সজ্জনদের দুঃখিত দেখে এবং অসজ্জনদের সুখী দেখে আমি চিন্তায় যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছি। আপনার এই বিপদ ও দুর্যোধনের সম্পদ দেখে আমি বিধাতাকেই নিন্দা করছি। কারণ, তিনি বিপরীতভাবে পর্যালোচনা করছেন। দুর্যোধন ধর্মশাস্ত্র অতিক্রম করে ধর্ম নষ্ট করেছে এবং সে ক্রূর স্বভাব ও লুব্ধ প্রকৃতির, তবুও বিধাতা তাকে সম্পত্তি দান করে কী ফল পাচ্ছেন! যদি প্রাক্তন কর্ম কর্তারই অনুসরণ করে, অন্যের অনুসরণ করে না, তবে নিশ্চয়ই ঈশ্বরও সেই পাপকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। যদি এ-কথা বলা হয় যে, প্রাক্তন কর্ম কর্তার অনুসরণ করে না, তার কারণ একমাত্র বল। তা হলে দুর্বল লোকদের জন্যই আমার শোক হচ্ছে।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “যাজ্ঞসেনী, তোমার কথা সুন্দর, আশ্চর্য ও মনোহর, কিন্তু নাস্তিকের যোগ্য। আমি ধর্মের ফল অন্বেষণ করি না, দাতব্য বলেই দান করি। যজ্ঞ করা উচিত বলেই যজ্ঞ করি। ফলের আকাঙক্ষা না করেই আমি যথাশক্তি গৃহাশ্রমবাসীর কর্তব্য পালন করি। যে লোকে ধর্মকে দোহন করে ফল পেতে চায় এবং নাস্তিক বুদ্ধিতে যে লোক ফললাভ হবে কি না-হবে এই আশঙ্কা করে, সে ধর্মের ফল পায় না। দ্রৌপদী, তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে তর্ক করছ। ধর্মের প্রতি সন্দেহ কোরো না, তাতে তির্যক গতি লাভ হয়। কল্যাণী, তুমি মূঢ় বুদ্ধির বশে বিধাতার নিন্দা কোরো না, সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী যাঁর কথা বলেছেন, শিষ্টগণ যাঁর আচরণ করছেন, সেই ধর্মের সম্পর্কে সংশয়াপন্ন হোয়য়া না।”

দ্রৌপদী বললেন, “পার্থ, আমি কোনও প্রকারেই ধর্মকে অবজ্ঞা বা নিন্দা করিনি এবং কেনই বা লোকনিয়ন্তা ঈশ্বরের প্রতি অবজ্ঞা করব। আমি দুঃখিত হয়েই এই কথাগুলি বলেছি। আমি আরও বিলাপ করব, আপনি প্রসন্নমনে শ্রবণ করুন। শত্ৰুসূদন, এ-জগতে প্রাণীগণকে অবশ্যই কর্ম করতে হয়, কর্ম ব্যতীত স্থাবরগণ জীবনধারণ করতে পারে, জঙ্গম প্রাণীরা পারে না। জঙ্গম প্রাণীদের মধ্যে মনুষ্যেরাই বিশেষ কর্ম দ্বারা পরলোকে এবং ইহলোকে স্থিতিলাভ করবার ইচ্ছা করে। জগতের সকল প্রাণীই কর্মের উদ্যম করতে জানে এবং আপন প্রত্যক্ষ ও লোকপ্রত্যক্ষ সেই কর্মের ফল ভোগ করে। অতএব, আপনি কর্ম করুন, অবসন্ন হবেন না। কর্ম করতে জানা লোক সহস্রের মধ্যে একটিও কি না সন্দেহ আছে। অর্থের বৃদ্ধি ও রক্ষার জন্যও কর্ম প্রয়োজন হয়। নূতন সংগ্রহ না করে কেবলমাত্র ভোগ করলে হিমালয়ও ক্ষয় হয়ে যায়। কর্ম না করলে প্রাণীরা উৎসন্নে যেত, কর্ম নিষ্ফলা হলে প্রাণীরা বৃদ্ধি পেত না। নিষ্ফল কর্মে জীবিকালাভ হয় না। কেবলমাত্র দৈবকে আশ্রয় করলে, অথবা অতর্কিতেই পাওয়া যাবে—এই উভয় চিন্তাই অধম। কেবলমাত্র দৈব অবলম্বন করে শায়িত লোক ঘটে স্থাপিত অপক্ক ঘটের মতো বিলীন হয়ে যায়। কর্ম সামর্থ্য ব্যতীত আয়ুও দীর্ঘকালীন হয় না। যত্নসিদ্ধ কর্ম ব্যতীত লব্ধ বস্তু হটলব্ধ বস্তু। দেবতার আরাধনা করে কর্মকেই দৈব বলা হয় এবং তাই ধর্ম। জনসাধারণে প্রত্যক্ষে আপন কর্মের ফলই পৌরুষ। মানুষ কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে বিনা উদ্দেশ্যে স্বভাবতই যা লাভ করে, তাই স্বাভাবিক ফল। এইভাবে দৈব, পৌরুষ ও স্বভাব দ্বারা যা পাওয়া যায়, তাও পূর্ব কর্মেরই ফল। মানুষের সব শুভাশুভ কাৰ্য, ঈশ্বর পূর্বকৃত কর্মের ফলরূপে বিধান করে থাকেন। ঈশ্বরের ফলদান কার্যে মানুষের দেহ নিমিত্ত কারণমাত্র; সুতরাং, ঈশ্বর যেভাবে দেহটিকে, নিযুক্ত করেন, পরাধীন দেহ তাই করে।

“প্রাণীগণ প্রথমে মনে মনে কর্তব্য বিষয় নিশ্চয় করে, পরে চেষ্টা দ্বারা বুদ্ধিপূর্বক সেই কার্য আরম্ভ করে, সুতরাং তাদের দেহ নিমিত্ত কারণ। কর্ম অসংখ্য। গৃহ নগর প্রভৃতি সমস্ত কার্যসিদ্ধির প্রতি পুরুষের দেহ-হেতু। বুদ্ধিমান লোক প্রথমে তিলের ভিতরে তেল, গোরুর ভিতরে দুধ এবং কাঠের ভিতরে আগুন আছে বলে বুদ্ধি দিয়ে জানে, পরে ওই সকল করার উপায় স্থির করে। তারপর ওই সকল লাভ করার উপায়ে প্রবৃত্ত হয়, এইভাবে প্রাণী কর্ম-অনুসারে সিদ্ধিলাভ করে। মানুষ যদি কর্মফলের প্রতি কারণ না হত, তবে কেহই যাগ ও কূপ নির্মাণ প্রভৃতি কর্মের ফল পেত না এবং কেউ কারও শিষ্য বা গুরু হত না। নাস্তিকেরা বলে, ‘সকল কার্যই স্বভাবত সিদ্ধ হয়’ আস্তিকেরা বলেন, ‘সকল কার্যই দৈববশত সিদ্ধ হয়’ এবং প্রাকৃত লোকেরা বলেন, “সকল কার্যই মানুষের চেষ্টায় সিদ্ধ হয়। এইভাবে ত্রিবিধ লোক, ত্রিবিধ কারণ নিরূপণ করে। আর একদল বলে, ‘মানুষের চেষ্টায় কোনও কার্য হয় না, কিন্তু অদৃশ্য দৈব এবং দৃশ্য স্বভাব— এই দুটিই সমস্ত কার্যের কারণ। কেন-না, দেখা যায় যে, স্বভাব ও দৈব থেকেই ধারাবাহিক ভাবে কার্য হচ্ছে। তত্ত্বজ্ঞেরা বলেন, “মানুষ কোনও ফল দৈব থেকে, কোনও ফল অতর্কিতভাবে, কোনও ফল স্বভাব থেকে প্রাপ্ত হয়’। সুতরাং ফলের প্রতি এই তিনটিই কারণ, চতুর্থ কারণ নেই।

“কিন্তু আমরা বলি, ঈশ্বর যদি প্রাণীগণের ইষ্ট ও অনিষ্ট ফল না দিতেন, তবে প্রাণীগণের মধ্যে কেউই দীনভাবাপন্ন থাকত না। এবং যদি প্রারব্ধ কর্ম না থাকত, তবে মানুষ যে যে বিষয় লাভ করবার ইচ্ছা করত, তার সেই বিষয়ের সমস্ত কার্যই সফল হত। ফল হবে কি না, এই সন্দেহ করে যারা দৈব বা পুরুষকার করে, তাদের ফলসিদ্ধি হয় না। আর, যে সকল বুদ্ধিমান লোক নিঃসংশয় হয়ে দৈব বা পুরুষকারে ব্যাপৃত হন, তাদের নিশ্চয়ই ফল সিদ্ধি হয়। বর্তমান সময়ে আমরা গুরুতর বিপদের সম্মুখীন কিন্তু আপনি পুরুষকারে প্রবৃত্ত হলে নিশ্চয় বিপদ চলে যাবে। এমনকী আপনি যদি ফললাভ করেন, ভীমসেন, অর্জুন, নকুল সহদেবের পক্ষে তা সর্বপ্রকার সম্মানের হবে।

“অতএব মহারাজ, কার্যের সিদ্ধি হোক বা না-হোক, তা সন্দেহ করে আপনার যেন পুরুষকারে অপ্রবৃত্তি না জন্মে। কারণ, বহুতর কারণের সম্মেলন হলেই কার্যসিদ্ধ হয়। কার্য আরম্ভ হলে, তার অঙ্গহানি হলে, অল্প ফলও হয়, একেবারে ফল না-ও হয়। কিন্তু কার্য আরম্ভ না করলে, কোথাও ফল বা কর্তার উৎকর্ষ দেখা যায় না। সাবধান হয়ে নিজের পরাক্রম অনুসারে কার্য করবেন। পুরুষকার আরম্ভ করে পরাক্রম প্রকাশ করলে প্রায়ই কার্যসিদ্ধি ঘটে থাকে।

“বুদ্ধিমান লোক যে ক্ষেত্রে শত্রুকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ দেখবেন, সেই ক্ষেত্রে সাম্য দ্বারাই তার নিকট থেকে কার্যলাভ করবার ইচ্ছা করবেন এবং তাঁর কাছে উপযুক্ত কার্য চালাতে থাকবেন। বুদ্ধিমান লোক শত্রুর বিপদ এবং প্রবাসের প্রতীক্ষা করে থাকবেন। এমনকী সমুদ্র বা পর্বতের বিষয়েও এই কথা, মানুষের বিষয় আর কী বলব। সর্বদা বিপক্ষের ছিদ্রান্বেষণকারী মানুষের পরিজনবর্গের কাছে কোনও ঋণ থাকে না। পুরুষ কখনও নিজের প্রতি নিজে অবজ্ঞা করবে না, কারণ সেই ধরনের লোকের ভাল সম্পত্তি হয় না। ভরতনন্দন, আমি এই নিয়মে লোকের কার্যসিদ্ধির কথা এবং দেশ ও অবস্থার বিভাগ অনুসারে কার্যসিদ্ধির উপায়ের কথা বললাম।”

বনবাসে দ্রৌপদী-সত্যভামার মিলন

বনবাসে দ্রৌপদীর দিনগুলি সুখে-দুঃখে অতিবাহিত হচ্ছিল। রাজ সুখভোগে অভ্যস্তা দ্রৌপদীর চীরবাসিনী জীবনযাত্রা দুঃখেরই ছিল। আবার জটাসুরের মতো রাক্ষস হরণ করতে এসে বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলত। কিন্তু ভীমসেন থাকতে কোনও ব্যক্তি দ্রৌপদীর অঙ্গস্পর্শ করে জীবিত থাকত না, জটাসুরও থাকেনি। এই বিপর্যয়কালের মধ্যেও সুখ ছিল। বন প্রকৃতির মধ্যেই স্বামীদের দ্রৌপদী কাছের থেকে পেয়েছেন। অভ্যাসবশতই অর্জুনকে দিব্যাস্ত্র লাভ করতে স্বর্গে যেতে হয়েছে। যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদী ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, ভীমসেন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কার্য করতে সর্বদাই তৎপর ছিলেন, নকুল ও সহদেবও তন্নিষ্ঠ সেবায় দ্রৌপদীকে সন্তুষ্ট রাখতেন।

যুধিষ্ঠিরের কাছে মাঝেমধ্যেই মুনিঋষিরা আসতেন। তাঁদের কাছ থেকে দ্রৌপদী পেতেন দুঃখের দিনযাপনের মনের জোর। আর আসতেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, মহিষী সত্যভামাকে নিয়ে। কৃষ্ণের প্রধানা চার মহিষীর মধ্যে মহাভারতে সত্যভামাকে আমরা বারবার পাই। দ্রৌপদী সত্যভামার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। একদিন সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের দেখতে বনে এলেন। সেখানে মার্কণ্ডেয় ঋষি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। দুই সখী, দ্রৌপদী ও সত্যভামা একপ্রান্তে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন।

সত্রাজিৎ রাজার কন্যা সত্যভামা দ্রৌপদীকে নির্জনে পেয়ে প্রশ্ন করলেন, “দ্রৌপদী, দিকপালতুল্য মহাবীর, যুবক এবং পরম লোকপ্রিয় পাণ্ডবদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করো। কল্যাণী কীভাবে তাঁরা তোমার বশীভূত হয়ে আছেন? কেন এঁরা তোমার প্রতি কুপিত হন না। দ্রৌপদী! পাণ্ডবেরা সর্বদাই তোমার বশীভূত হয়ে আছেন এবং তারা সকলেই তোমার মুখাপেক্ষী হয়ে আছেন। এর কারণ তুমি আমার কাছে সত্য বলো। ব্রত, তপস্যা, স্নান, শাস্ত্রোক্ত ঔষধ, নিজের দক্ষতার প্রয়োগ, কোনও জড়িবুটি, বৃক্ষমূল ধারণের প্রভাব, জপ, হোম এবং শাস্ত্রে অনুক্ত কোনও ঔষধ— এর সব ক’টি অথবা কোনটি প্রয়োগ করে তুমি এই সকল দিকপাল স্বামীকে বশ করে রেখেছ? তুমি যেমন তোমার স্বামীদের বশ করে রেখেছ, আমিও কৃষ্ণকে সর্বদা আমার অনুরক্ত ও বশীভূত করে রাখতে চাই। তুমি আমাকে উপায় বলো।” এই বলে যশস্বিনী সত্যভামা বিরতা হলেন।

তখন পতিব্রতা ও চন্দ্রভাগা দ্রৌপদী তাঁকে বললেন, “সত্যভামা, তুমি অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহারের বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছ, তাঁদের ব্যবহারও অসৎ হয়। অসৎ ব্যপারের আলোচনা করা সংগত নয়। এই ধরনের প্রশ্ন করা অথবা আমি ভর্তাদের বশীভূত করার জন্য কোনও উপায় অবলম্বন করি কি না— এ-ধরনের কোনও সন্দেহ করাই তোমার উচিত নয়। কারণ, তুমি বুদ্ধিমতী এবং কৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী। ভর্তা যখন জানতে পারেন যে তাঁকে বশীভূত করার জন্য স্ত্রী কোনও মন্ত্রপ্রয়োগ বা ঔষধ প্রয়োগ ব্যাপৃত আছেন, তখন গৃহে সর্প প্রবেশ করলে গৃহস্থের মন যেমন উদ্বিগ্ন হয়, ভর্তার মনও তেমনই উদ্বিগ্ন হয়। মন উদ্বিগ্ন হলে গৃহে অশান্তি আসে, আর অশান্ত গৃহে সুখ থাকতে পারে না। তা ছাড়া ভর্তা কখনও মন্ত্রাদি প্রয়োগে ভার্যার বশীভূত হন না। বরং এই জাতীয় ঘটনায় ভর্তার দেহে অতিদারুণ রোগ হয়ে দেখা দেয়। কারণ জিঘাংসু লোকেরা মূল বলে বিষ দিয়ে থাকে। পুরুষ জিহ্বা অথবা চর্ম দ্বারা যে সকল ঔষধ গ্রহণ করে, তাতে প্রদত্ত বিষচূর্ণ পুরুষকে নষ্ট করে। সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ কোরো না।

“সত্যভামা, আমি জানি যে বহু স্ত্রীলোক আপন আপন পতিকে বশ করার জন্য ঔষধ প্রদান করে তাদের পতিকে জলোদর রোগী, শ্বিত্ররোগী, জরাজীর্ণ, নপুংসক, জড়, অন্ধ বা বধির করে ফেলেছে। পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কথা অনুসারে এই পাপিষ্ঠা নারীরা তাদের ভর্তাদের দেহ-মনে নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে থাকে, অতএব স্ত্রীলোক কোনও প্রকারেই ভর্তার অনভিপ্রেত অথবা অপ্রিয় কোনও কাজ করবে না।

“সত্যভামা, আমি মহাত্মা পাণ্ডবদের সঙ্গে যে আচরণ করে থাকি, তা তোমাকে বলছি। আমি সর্বদাই অহংকার, কাম ও ক্রোধ পরিত্যাগ করে, অন্য পাণ্ডবপত্নীদের সঙ্গে পাণ্ডবগণের পরিচর্যা করে থাকি। আমি মানশূন্য হয়ে, নিজের উপরেই নিজের ভার রেখে, অহংকার পরিত্যাগ করে, পতিদের চিত্ত রক্ষা করে, তাদের সেবা করে থাকি। ভর্তাদের কটুবাক্য, ক্রোধসূচক দৃষ্টি, কষ্টে শয়ন, কষ্টে উপবেশন, কষ্টে গমন, মন্দ অভিপ্রায়—এইগুলি বর্জন করে আমি অগ্নি ও সূর্যের তুল্য তেজস্বী চন্দ্রের তুল্য কোমল, ভীষণ বল ও প্রতাপশালী এবং দর্শন দ্বারাই শত্ৰু সংহারকারী পাণ্ডবদের সেবা করে থাকি।

দেবো মনুষ্যো গন্ধর্ব যুবা চ পি স্বলস্কৃত।

দ্রব্যবনভিরূপো বা ন মেহন্যঃ পুরুষো মতঃ ॥ বন : ১৯৬: ২২ ॥

“দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ, যুবক, ধনী, সম্যক অলংকৃত কিংবা সুন্দরাকৃতি হলেও অন্য পুরুষ আমার অভিমত হয় না।”

“আমি সর্বদাই গৃহকার্য করি এবং ভর্তা স্নান না করলে আমি স্নান করি না। ভর্তা ভোজন না করলে আমি ভোজন করি না এবং ভর্তা শয়ন না করলে আমি শয়ন করি না। ভর্তা— ক্ষেত্র, বন বা অন্য গ্রাম থেকে ফিরে আসলে আমি উঠে আসন ও জলদান করে তাঁর সংবর্ধনা করি। খাবার বাসন পরিষ্কার করি, খাদ্যবস্তু পরিষ্কার রাখি, বুভুক্ষুকে যথা সময়ে খাদ্য দিই, সংযত হয়ে থাকি, কাউকে তিরস্কার করি না, মন্দ স্ত্রীলোকের সংসর্গ করি না। সর্বদাই পরিজনবর্গের অনুকূল থাকি এবং কখনও অলস হই না।

“পরিহাস ব্যতীত হাসি না, গৃহে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি না এবং গোপন কোনও স্থানে বা গৃহের উদ্যানে দীর্ঘকাল থাকি না। আর অত্যন্ত হাস্য, অত্যন্ত ক্রোধ ও ক্রোধের বিষয় পরিত্যাগ করি। আমি সর্বদাই পতিসেবায় নিরত থাকি। ভর্তার কোনও প্রকার অহিতই আমার কোনও প্রকার অভীষ্ট হয় না। ভর্তা যখন পারিবারিক কোনও কার্যে অন্যত্র যান, তখন আমি পুষ্পমাল্য ও অনুলেপন ত্যাগ করি। ভর্তা যা পান করেন না, ভর্তা যা ব্যবহার করেন না, আমি সে সমস্তই বর্জন করি। আমি ভর্তার উপদেশ অনুসারে ও গৃহিণীর নিয়মে চলি এবং অলংকৃতা, অত্যন্ত পবিত্রা, ভর্তার প্রিয়কার্যে ও হিতে রত থাকি। আমার শাশুড়ি দেবী আমার জন্য পরিজনবর্গ সম্পর্কে যে আচরণের কথা বলে দিয়েছেন এবং ভিক্ষা, উপহার, শ্রাদ্ধ, পর্বকালে রন্ধন, মান্য লোকের সম্মান ও আদর এবং অন্য যে, সকল নিয়ম আমার জানা আছে, আমি আলস্যবিহীন হয়ে দিবারাত্রই সেই সমস্তের অনুসরণ করি, আর সর্বদা সর্বপ্রযত্নে বিনয় ও গৃহিণীদের নিয়ম পালন করে চলি।

“কারণ আমার মতে— পতিসেবা ধর্মই স্ত্রীলোকের সনাতন ধর্ম। স্ত্রীলোকের পক্ষে পতি দেবতা এবং পতিই গতি। কোনও স্ত্রীলোকের পতির অপ্রিয় আচরণ করা উচিত নয়। আমি কোনও বিষয়ে আমার পতিদের অতিক্রম করি না, তাঁদের আহারের পূর্বে আহার করি না। কখনও শাশুড়ির নিন্দা করি না এবং গৃহকার্যে সর্বদা নিয়োজিত থাকি। আমার গৃহকার্যের প্রতি একাগ্রতা ও সর্বদা উদ্‌যোগ এবং গুরুশুশ্রষার গুণেই ভর্তারা আমার বশীভূত হয়ে আছেন। আমি নিজেই সর্বদা কুন্তীদেবীর পান, ভোজন ও বসনাদি বহন করে তাঁর কাছে যাই এবং তাঁর পরিচর্যা করি। কুন্তীদেবী আমার কাছে পৃথিবীর তুল্যা মাননীয়া।

“পূর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের গৃহে প্রত্যহ প্রথমে আট হাজার ব্রাহ্মণ স্বর্ণপাত্রে ভোজন করতেন। অষ্টাআশি হাজার নিত্যস্নায়ী গৃহস্থ ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁদের আবার ত্রিশটি করে দাসী ছিল। দশ হাজার জন ব্রহ্মচারী ছিলেন। খাদ্য, পেয়, বস্ত্রের অগ্রভাগ তুলে বেদবাদী ব্রাহ্মণের খাদ্য আমিই পরিবেশন পাত্রে তুলে দিতাম। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের এক লক্ষ দাসী ছিল, তাদের হাতে শঙ্খবলয়, কেয়ূর ও কণ্ঠে স্বর্ণহার ছিল। মহামূল্য মালা, অলংকার, মণি ও স্বর্ণভূষিতা ক্ষত্রিয় জাতীয় মহিলা ছিলেন। তাঁরা নৃত্যগীত পারদর্শী ছিলেন। আমি এঁদের প্রত্যেককে চিনতাম, নাম ধাম ও পরিচয় জানতাম। ধীমান যুধিষ্ঠিরের এক লক্ষ দাসী খাদ্যবস্তুর পাত্র হাতে দিবারাত্র অতিথিদের ভোজন করাত। মহারাজ যুধিষ্ঠির যখন ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করতেন, তখন তাঁর বিহার যাত্রার সময়েও এক লক্ষ অশ্ব ও লক্ষ হস্তী অনুগমন করত এদের সংখ্যা গণনা আমি করতাম এবং কর্তব্য নির্দেশ করতাম। গোরক্ষক, মেষরক্ষক ও অন্তঃপুরগামী সকল ভৃত্যের সংবাদ আমিই রাখতাম। রাজার সমস্ত আয় ও ব্যয়ের বিষয় একমাত্র আমিই জানতাম। ভরতশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবরা পোষ্যবর্গের ভার আমার উপর রেখে সম্মিলিতভাবে ধর্মোপাসনা করতেন। সমস্ত সুখভোগ ত্যাগ করে আমি দিবারাত্র সকলভার বহন করতাম। আমি চিরদিনই সকলের আগে জাগরিত হই ও শেষে শয়ন করি। সত্যভামা আমি এইসব গুরুতর বশীকরণ করতে জানি, কিন্তু অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহার জানি না এবং শুনতেও চাই না।”

তখন সত্যভামা দ্রৌপদীর সেই ধর্মসংগত বাক্য শুনে ধৰ্মচারিণী দ্রৌপদীকে বিশেষ আদর করে বললেন, “পাঞ্চালনন্দিনী দ্রৌপদী, আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম। কারণ, সখীদের পরস্পর আলোচনায় হাসিঠাট্টা-উপহাস ইত্যাদি জড়িত থাকে।”

দ্রৌপদী বললেন, “সখী, স্বামীর মন আকর্ষণ করার জন্য তোমার কাছে এই নির্দোষ পথের কথা বলছি। তুমি যথানিয়মে থেকে আপন বলের দ্বারাই সপত্নীদের হাত থেকে স্বামীকে টেনে নিজের কাছে আনতে পারবে। পতির মতো দেবতা ত্রিভুবনে নেই। কারণ, তিনি অনুগ্রহ করলে জগতের সমস্ত অভীষ্ট লাভ করা যায়, তিনি কুপিত হলে হত্যাও করতে পারেন। পতি থেকে সন্তান, নানাবিধ ভোগ্যবস্তু, শয্যা, আসন, উত্তম বস্তু দর্শন, বস্ত্র, মাল্য, গন্ধ— স্বর্গ এবং ইহলোকের প্রচুর কীর্তি লাভ করা যায়। এ-জগতে কেবল সুখ দ্বারা সুখ লাভ করা যায় না। এই জন্যই সাধ্বী স্ত্রী দুঃখ দ্বারাই সুখ লাভ করেন। তুমি সর্বদাই স্নেহ ও অনুরাগ দিয়ে যথাযথ বেশভূষা পরিধান করে কৃষ্ণের সেবা করো। মনোহর খাদ্য, উত্তম মাল্য ও নানাবিধ গন্ধদ্রব্য দ্বারা ভর্তাকে তৃপ্ত করো এবং উদারতার সঙ্গে চলতে থাকো। কৃষ্ণ যাতে সর্বদা মনে করেন—‘এই নারীর আমি যথার্থ প্রিয়’ — এই কথা মনে করে যাতে তিনি মনে ধারণ করেন, তুমি সর্বদাই তাই করবে। দ্বারে আগত কৃষ্ণের কণ্ঠস্বর শুনলেই গৃহে প্রবেশ করবে। তাঁর হাত-পা ধোওয়ার জল দেবে, দাসী উপস্থিত না থাকলে নিজেই সবকিছু করবে। এতে কৃষ্ণ মনে করবেন—‘এই নারী সর্বদা আমার সেবা করছেন’।

“তোমার পতি তোমাকে যা বলবেন, তা গোপনীয় হলেও গোপন রাখবে। না হলে, অন্য সপত্নীরা তা যদি কৃষ্ণকে বলে দেয়, তাতে কৃষ্ণ তোমার প্রতি বিরক্ত হতে পারেন। স্বামীর অনুরক্ত, বিশ্বাসভাজন ও হিতকারী ব্যক্তিদের ভালভাবে আহার করাবে। আর পতির বিদ্বেষের পাত্র, অহিতকারী এবং প্রতারক ব্যক্তিদের কাছ থেকে সর্বদাই দূরে থাকবে। পুরুষদের সামনে মত্ততা, অনবধানতা পরিত্যাগ করে মনের ভাব গোপন করবে, আর নির্জনে কখনও পুত্র প্রদ্যুম্ন বা শাম্বেরও সেবা করবে না। সৎকুলজাতা, পাপবিহীনা, সতী স্ত্রীদের সঙ্গেই সখিত্ব করবে। আর কোপনস্বভাবা, মত্তা, অধিকভোজিনী, চৌরা, দুষ্টা ও চঞ্চলা স্ত্রীদের বর্জন করবে। এই কার্যগুলি যশ, সৌভাগ্য ও স্বার্থ সম্পাদন করে এবং শত্রুকে পরাভূত করে। অতএব, তুমি মহামূল্য মালা, অলংকার ও অঙ্গরাগ ধারণ করে এবং পবিত্র গন্ধযুক্ত হয়ে পতির পরিচর্যা করতে থাকো।”

ওদিকে কৃষ্ণ, মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ ও পাণ্ডবদের সঙ্গে কিছুকাল অনুকূল ও প্রীতিকর আলোচনার পর, সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করে রথে ওঠবার ইচ্ছায় সভ্যভামাকে ডেকে পাঠালেন। তখন সত্যভামা দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে তাঁর ইচ্ছা অনুরূপ মনোহর ও সংগত বাক্য বললেন। “দ্রৌপদী, রাজ্য হারিয়েছ বলে তোমার যেন উৎকণ্ঠা, মনোবেদনা ও রাত্রি জাগরণ না হয়। কারণ, তুমি দেবতুল্য পতিগণ কর্তৃক বিজিত রাজ্য পুনরায় পাবে। নীলনয়নে, যে কষ্ট তুমি সহ্য করেছ, তোমার মতো চরিত্রসম্পন্না এবং প্রশস্ত লক্ষণা নারীরা চিরকাল তা ভোগ করেন না। আমি ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের মুখে শুনেছি যে, অবশ্যই তুমি ভর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্কণ্টক ও নিরুপদ্রব এই পৃথিবী পুনরায় ভোগ করবে। দ্রৌপদী, তুমি অবশ্যই দেখতে পাবে যে, যুধিষ্ঠির সমস্ত শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়ে, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে পৃথিবী হস্তগত করেছেন। বনে আসার সময়ে দর্পমোহিতা যে-সব কৌরব নারী তোমাকে উপহাস করেছিল, অতি অল্পকালের মধ্যেই সেইসব কৌরব স্ত্রীকে তুমি হতভাগ্য নৈরাশ্যপূর্ণ দেখতে পাবে। তুমি দুঃখসাগরে নিমগ্ন হলে, যারা তোমার অপ্রিয় আচরণ করেছিল, তুমি সুনিশ্চিত ধারণা করতে পারো যে, তারা সকলেই যমালয়ে গিয়েছে।

তোমার পুত্র যুধিষ্ঠিরজাত প্রতিবিন্ধ্য, ভীমজাত সূতসোম, অর্জুনজাত শ্রুতকর্মা, নকুলজাত শতানীক ও সহদেবজাত শ্রুতসেন, এরা সকলেই ভাল আছে। অস্ত্রশিক্ষা করে বীর হয়েছে এবং দ্বারকানগরীতে অভিমন্যুর মতোই অত্যন্ত আনন্দিত ও প্রীতি সহকারে বাস করছে। আর, সুভদ্রাও তোমার মতো প্রীতি সহকারে ও সর্বপ্রযত্নে তোমার পঞ্চপুত্রকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তোমার প্রতি সুভদ্রার মনে কোনও বৈরী মনোভাব নেই, বরং বিশেষ প্রীতিই আছে। তোমার পুত্রদের বিষয়ে সুভদ্রার মনে কোনও সন্তাপ নেই। আপন পুত্র অভিমন্যু ও তোমার পুত্রদের মধ্যে সুভদ্রা কোনও পার্থক্য করেন না। তাই সুভদ্রা তোমার পুত্রদের দুঃখেই দুঃখী এবং সুখেই সুখ অনুভব করে থাকেন। রুক্মিণীদেবী সর্বপ্রযত্নে প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির পরিচর্যা করেন, আর কৃষ্ণ ও ভানুর থেকেও তাদের বেশি আদর করেন। আমার শ্বশুর তাদের খাওয়াপরা বিষয়ে সর্বদা বিশেষ পর্যবেক্ষণ করেন এবং বলরাম প্রভৃতি অন্ধকবংশীয়গণ ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ সকলে তাদের আদর করেন। কারণ, প্রদ্যুম্ন ও প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির উপর তাদের সমান স্নেহ আছে।”

এইরূপ প্রিয়, সত্য, অভীষ্ট ও মনের অনুকূল অনেক কথা বলে সত্যভামা কৃষ্ণের রথের দিকে যাবার জন্য দ্রৌপদীর অনুমতি চাইলেন। তারপর কৃষ্ণমহিষী সত্যভামা দ্রৌপদীকে প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর তিনি কৃষ্ণের রথে আরোহণ করলেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর দিকে মৃদু হেসে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, পাণ্ডবরা তাঁর রথের সঙ্গে মাটিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কৃষ্ণ তাদের প্রতিনিবৃত্ত করলেন এবং আপন দ্রুতগামী রথ ছুটিয়ে দ্বারকানগরে প্রস্থান করলেন।

দুই অসামান্য নারীর সম্মিলন দেখা গেল। দু’জনের মধ্যে সাদৃশ্যও আছে, বৈসাদৃশ্যও আছে। দু’জনেই রাজকুলের সন্তান—রাজার প্রিয়তমা মহিষী। এঁদের স্বামীরা দিকপাল, ভুবনবিখ্যাত বীরপুরুষ। নারীদের একজন ভুবন বিখ্যাত স্যমন্তক মণির অধিকারী রাজা, অন্যজন অযোনিজা যজ্ঞবেদিজাত নারী। এই অযোনিজা নারীটির ললাটে যত লাঞ্ছনা ঘটেছে, বিশ্বের আর কোনও নারীর তা ঘটেনি। গ্রিক মহাকাব্যের নায়ক ওডিসিয়াসের পত্নীও পুরুষের লালসার শিকার হয়েছিলেন, কিন্তু তা স্বামীর অনুপস্থিতিতে। কিন্তু পঞ্চ-ভুবন বিখ্যাত বীরস্বামীর উপস্থিতিতে দ্রৌপদীকে যে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে, তা কোনও নারীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। কৌরব দুষ্ট চতুষ্টয়, জটাসুর, জয়দ্রথ, কীচক বারবার দ্রৌপদীকে হরণ ও ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। সীতার ক্ষেত্রেও রাবণ ব্যর্থ হয়েছিলেন, কারণ, তাঁর অভিশাপের ভয় ছিল। কিন্তু দ্রৌপদী অত্যন্ত তেজস্বিনী নারী। আর এই তেজ তাঁর মধ্যে এসেছিল নারীধর্ম পালনের, কর্তব্য বোধ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার জন্যই।

ইন্দ্রপ্রস্থে দ্রৌপদীর জীবনযাপন কেমন ছিল, এর পরিচয় ব্যাসদেব দিয়েছেন সত্যভামা সংবাদে। সত্যভামাকেও কৃষ্ণের মতো পুরুষোত্তম ব্যক্তির ঘর করতে হয়েছে। গুণবতী বলেই তিনি কৃষ্ণের প্রিয়তমা। কিন্তু দ্রৌপদীর কাজ আরও কঠিন ছিল। বিখ্যাত পঞ্চ- পাণ্ডবের পট্টমহিষী তিনি। পাঁচ স্বামীকেই তাঁকে তুষ্ট রাখতে হয়, অনুরক্ত রাখতে হয়— কেউ যেন অবহেলিত, অনাদৃত বোধ না করেন, সে-বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়।

দ্রৌপদীর সমস্ত বক্তব্য অনুধাবন করলে বোঝা যায়, নারীধর্ম বলতে তিনি কী বোঝেন। রাজপ্রাসাদেই হোক আর নির্জন বনমধ্যেই হোক, সে ধর্ম তিনি পালন করে গিয়েছেন। অসৎ স্ত্রীদের মতো প্রশ্ন করায় সত্যভামাকে তিনি তিরস্কার করতে ছাড়েননি। করণীয় সম্পর্কে আপন মত প্রকাশ করেছেন। দ্রৌপদীর বক্তব্য শিক্ষণীয় বলেই সত্যভামা তাঁর আদর করেছেন, কৌতূহলী মাতৃহৃদয়ের কাছে পুত্রদের মঙ্গল সংবাদ দিয়েছেন, তাঁর দুর্ভাগ্যের দিনে যথার্থ সান্ত্বনা দিয়েছেন কেন ভারতীয় ঋষিরা দ্রৌপদীকে প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তাঁর গোটা ব্যক্তিত্ব তা পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছে।

দ্রৌপদী-হরণ

একদিন পঞ্চপাণ্ডব মহর্ষি ধৌমের অনুমতি নিয়ে দ্রৌপদীকে আশ্রমে রেখে বিভিন্ন দিকে মৃগয়া করতে গেলেন। সেই সময়ে সিন্ধুদেশের রাজা মহাযশা জয়দ্রথ বিবাহ করার ইচ্ছায় শাল্বদেশে যাচ্ছিলেন। বহুতর রাজার সঙ্গে তিনি দ্বৈতবনে উপস্থিত হলেন এবং দেখলেন— পাণ্ডবগণের প্রিয়তমা ভার্যা, যশস্বিনী, শোভায় শারীরিক দীপ্তিমতী ও পরম সুন্দরী দ্রৌপদী তখন সেই নির্জন বনমধ্যে আশ্রমদ্বারে অবস্থান করছেন এবং বিদ্যুৎ যেমন নীলমেঘকে উজ্জ্বল করে সেইরকম বনপ্রদেশকে উজ্জ্বল করছেন। ইনি কি অপ্সরা না দেবকন্যা, না দৈবী মায়া এইরূপ নানা কল্পনা করে তাঁরা কৃতাঞ্জলি হয়ে সেই অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদীকে দেখতে লাগলেন। বিস্মিত সিন্ধুদেশের রাজা বৃদ্ধক্ষত্ৰ-নন্দন দুরাত্মা জয়দ্রথ বয়স্য রাজা কোটিকাস্যকে বললেন, “এই অনিন্দ্যসুন্দরী কার? আমার মনে হয়— ইনি মানুষী নন। এই পরমসুন্দরীকে লাভ করায় আমার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, কারণ আমি এঁকে নিয়েই আপন ভবনে চলে যাব।” অতএব সৌম্য কৌটিকাস্য, তুমি এঁর কাছে যাও, জেনে এসো এই সুন্দরী কার? কী জন্যেই বা এই ঘন কণ্টকপূর্ণ বনে বাস করছেন? সুরনিতম্বা, ভুবনসুন্দরী, আয়তনয়না, মনোহর দন্তশালিনী ও ক্ষীণমধ্যা এই রমণী আজ আমাকে ভজনা করবেন কি?”

কুণ্ডলধারী কৌটিকাস্য এই কথা শুনে রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে, শৃগাল যেমন ব্যাঘ্রবধূর নিকট জিজ্ঞাসা করে, তেমনই দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, “সুন্দরী, রাত্রিতে বায়ুকম্পিত দেদীপ্যমানা অগ্নিশিখার মতো শোভা পেতে থেকে, কদম্ববৃক্ষের একটি শাখাকে নুইয়ে ধরে আশ্রমদ্বারে একাকিনী দণ্ডায়মানা তুমি কে? তুমি পরমরূপবতী অথচ বনের মধ্যে নির্ভয়ে আছ। তুমি কি কোনও দৈবী মায়া, যক্ষী না দানবী কিংবা প্রধান অপ্সরা অথবা প্রধান কোনও দানবরাজার পত্নী? অথবা তুমি নাগরাজের কন্যা, মানুষের মূর্তি ধারণ করে এসেছ? তুমি কি রাক্ষস-পত্নী? অথবা রাজা বরুণ, যম, চন্দ্র কিংবা কুবেরের পত্নী? ভদ্রে, আমাকে তোমার পরিচয় দাও, আমি সুরথ রাজার পুত্র কৌটিকাস্য। স্বর্ণময় রথে অবস্থিত ত্রিগর্তদেশের রাজা পদ্মনয়ন ও বীর ক্ষেমঙ্কর। বারোজন সৌবীর রাজপুত্র, অঙ্গারক, কুঞ্জর, গুপ্তক। শত্ৰুঞ্জয়, সৃঞ্জয়, সুপ্রবৃদ্ধ, প্রভঙ্কর, ভ্রমর, রবি, শূর, প্রতাপ ও কুহন— এঁদের মধ্যে মণিশ্রেষ্ঠের মতো দাঁড়িয়ে আছেন— সৌবীররাজ জয়দ্রথ।”

শিবিবংশপ্রধান কৌটিকাস্য এই প্রশ্ন করলে দ্রৌপদী কদম্বশাখা পরিত্যাগ করে অল্প দৃষ্টিপাত করে বললেন, “রাজপুত্র, আমি বনমধ্যস্থিতা একাকিনী নারী, সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই। অতএব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমি দ্রুপদরাজার সন্তান, নাম কৃষ্ণা, যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল সহদেব এই পঞ্চস্বামী দ্বারা রক্ষিত। আমার স্বামীরা আমাকে আশ্রমে রেখে মৃগয়ার জন্য চারদিকে গিয়েছেন। তাঁদের আসার সময়ও হয়ে গেছে। সুতরাং আপনারা সামান্য সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন, আমার স্বামীরা ফিরলে আপনারা যথাযথ সম্মানিত হয়ে ফিরতে পারবেন।” এই বলে দ্রৌপদী প্রশস্ত পর্ণশালায় প্রবেশ করলেন।

কৌটিকাস্য ফিরে গিয়ে জয়দ্রথকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। সমস্ত শুনে দুষ্টস্বভাব জয়দ্রথ বললেন, “দ্রৌপদীকে দেখব।” ক্ষুদ্র ব্যাঘ্র যেমন সিংহের আবাসে প্রবেশ করে জয়দ্ৰথও তেমনই ছ’জন সহচরকে নিয়ে সেই পবিত্র আশ্রমে প্রবেশ করে দ্রৌপদীকে বললেন, “বরবৰ্ণিনী, তোমার মঙ্গল তো? তোমার ভর্তারা সুস্থ আছেন তো? এবং তুমি যাঁদের মঙ্গল কামনা করো, তাঁরাও ভাল আছেন তো?”

দ্রৌপদী বললেন, “কুরুবংশজাত কুন্তীনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির, আমি ও তাঁরা ভ্রাতারা সকলেই কুশলে আছি এবং আপনি অন্য যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরাও কুশলে আছেন। আপনার রাজপদ, রাজ্য, কোষ ও সৈন্যগণের মঙ্গল তো? আপনি আপনার অধীনস্থ দেশগুলি ধর্ম অনুসারে পালন করছেন তো? আপনি এই পাদ্য ও আসন গ্রহণ করুন। আমি আপনাকে প্রাতঃকালীন খাদ্যরূপে পঞ্চাশটি হরিণ দেব। আর মহারাজ যুধিষ্ঠির এসে নিজে আপনাকে বহুতর ঐণেয়, পৃষত, ন্যঙ্কু, হরিণ, শরভ, শশ, ভল্লুক, রুরু, শম্বর, গবয়, মৃগ, বরাহ, মহিষ এবং অন্য যত প্রকার মৃগ আছে, সে সমস্ত দান করবেন।”

জয়দ্রথ বললেন, “আমার ও আমার রাজ্যপ্রভৃতির মঙ্গল। তুমি আমাকে সর্বপ্রকার প্রাতঃকালীন আহার দিতে চেয়েছ, তা এখন থাক। তুমি এখন হৃতরাজ্য, সমৃদ্ধিশূন্য। সমৃদ্ধিবিহীন ভর্তার সেবা বুদ্ধিমতী নারী করেন না। অতএব তুমি ওঠো। আমার রথে এসে বসে, আমার ভার্যা হও, পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করে, অনবরত সুখভোগ করতে থাকো।” দ্রৌপদী জয়দ্রথের কথা শুনে দ্রুত সে স্থান থেকে সরে গেলেন। মনে মনে জয়দ্রথের অবজ্ঞা ও নিন্দা করে তাঁকে বললেন, “এই জাতীয় কথা আর বলবেন না। আপনার কি লজ্জা হয় না।” তারপর দ্রৌপদীর মুখখানি ক্রোধে রক্তবর্ণ ও বিকৃত হল, নয়নযুগল রক্তবর্ণ ধারণ করল এবং ভ্রুযুগল অবনত ও উন্নত হতে লাগল। তিনি মুখ দ্বারা জয়দ্রথকে আক্রমণ করে পুনরায় বলতে লাগলেন— “মূর্খ যাঁরা যশস্বী, তীক্ষ্ণ বিষের ন্যায় ক্রোধশালী, মহারথ, ইন্দ্রতুল্য, স্বকর্মনিরত এবং যক্ষ রাক্ষসগণের যুদ্ধে অচল, সেই পাণ্ডবগণকে তুমি নিন্দা করতে থেকে কেন লজ্জা বোধ করছ না। বাঁশ, কদলীবৃক্ষ ও নল যেমন নিজের মৃত্যুর জন্য ফল ধারণ করে, কর্কটকী যেমন নিজের মৃত্যুর জন্য গর্ভধারণ করে, তুমি তেমনই পাণ্ডবরক্ষিত আমাকে গ্রহণ করবে।”

দ্রৌপদী পুনরায় জয়দ্রথকে বললেন, “মূর্খ! যাঁরা যশস্বী, তীক্ষ্ণ্ণবিষের ন্যায় ক্রোধশালী, মহারথ, ইন্দ্রতুল্য, স্বকর্মনিরত এবং যক্ষ রাক্ষসগণের সঙ্গেও যুদ্ধে অবিচল, সেই পাণ্ডবদের নিন্দা করেও তুমি লজ্জাহীন অবস্থায় আছ।”

দ্রৌপদী বুঝেছিলেন জয়দ্রথকে সম্ভ্রমের যোগ্য পাত্র নন। তাই সম্বোধনের রীতিও পরিবর্তিত করলেন। বললেন, “প্রশংসার যোগ্য লোক বনবাসী অথবা গৃহস্থ যাই হোক না কেন, সাধুব্যক্তি তাঁদের অসম্মান করেন না। কিন্তু কুকুরের তুল্য মানুষেরাই পূর্ণবিদ্যাশালী তপস্বীকে এই ধরনের তিরস্কার করতে পারেন। পর্বতের মতো বিরাট ও শক্তিশালী হস্তী যেমন হিমালয় সন্নিহিত স্থানে মদমত্ত বিচরণ করে, তখন কোন মহামূর্খ শুঁড় ধরে টানতে যায়? তোমার সেই দশাই ঘটবে, কারণ তুমি ধর্মরাজকে জয় করবার ইচ্ছা করেছ।”

দ্রৌপদী জয়দ্রথকে আরও বললেন, “তুমি মূর্খ বলেই পদাঘাত করে নিদ্রিত মহাবল সিংহর মুখ থেকে লোম ছিঁড়তে চাইছ। কারণ তুমি পালাতে গেলেই ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে দেখতে পাবে। তুমি ক্রুদ্ধ ও ভীষণমূর্তি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছ। তুমি বুঝতে পারছ না— তুমি পর্বতগুহা জাত, কালক্রমে বুদ্ধিপ্রাপ্ত, মহাবল এবং ভীষণাকৃতি ও ভীষণ প্রকৃতি নিদ্রিত সিংহকে চরণাগ্র দিয়ে আঘাত করতে চাইছ! তুমি নির্বোধ, তাই তুমি তীক্ষ্ণ্ণবিষ ও জিহাদ্বয়শালী কৃষ্ণসর্পদ্বয়কে— নকুল ও সহদেবকে পুচ্ছদেশে আক্রমণ করতে চাইছ।”

জয়দ্রথ বলল, “দ্রৌপদী, আমি তোমার কথার অর্থ বুঝেছি। পাণ্ডবরা কেমন তাও বুঝেছি। কিন্তু তুমি আমাকে ভয় দেখিয়ে ভীত করতে পারবে না। আমি অকালমৃত্যুশূন্য উচ্চবংশে জন্মেছি। দুটি গুণই আমার মধ্যে অধিক পরিমাণে আছে। অতএব আমি পাণ্ডবদের আমার থেকে নিকৃষ্ট বিবেচনা করি। তুমি কেবল বাক্য দ্বারা আমাকে নিবারিত করতে পারবে না। অনুনয় করলে দয়া করে তোমাকে ছেড়ে দিতেও পারি। তুমি রথে কিংবা হস্তীতে আরোহণ করো, আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”

দ্রৌপদী উপহাস করে বললেন, “আমি মহাবলা নারী। সৌবীররাজের বোধহয় ধারণা হয়েছে আমি অবলা। আমি আপন শক্তিতে বিশ্বাস করি। সুতরাং আক্রমণের ভয়ে আমি সৌবীররাজের কাছে কাতরোক্তি করব না। কারণ কৃষ্ণ আর অর্জুন একরথে আরোহণ করে যাঁর পিছনে যাবেন, তাঁকে দেবরাজ ইন্দ্রও অপহরণ করতে পারবেন না। গ্রীষ্মকালীন তৃণরাশি দাহকারী অগ্নির মতো আমার জন্য অর্জুন তোমার সেনামধ্যে প্রবেশ করবেন। অন্ধক, বৃষ্ণি, কেকয় বংশীয় বীরগণ আমায় তোমার হাত থেকে কৃষ্ণের সঙ্গে অনুসরণ করে উদ্ধার করবেন। তুমি গাণ্ডিবের ধ্বনি আর নিক্ষিপ্ত বাণে তোমার সৈন্যদলের মৃত্যু দেখতে দেখতে আক্ষেপ করবে। অর্জুননিক্ষিপ্ত শরে জর্জরিত হয়ে তুমি গদাধারী ভীমকে দেখতে পাবে, নকুল-সহদেবের ক্ষমাহীন শরাঘাতে তুমি দীর্ঘকাল যন্ত্রণায় ছটফট করবে। অতএব জয়দ্ৰথ, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে গেলেও আমি ভীত হব না। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি আমার স্বামীদের সঙ্গে এই আশ্রমে ফিরে আসব।”

তখন জয়দ্রথ ও তাঁর ছয় অনুচর দ্রৌপদীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলে ক্রুদ্ধা দ্রৌপদী তাদের ভর্ৎসনা করে বললেন, “আমাকে স্পর্শ করিস না।” এই বলে দ্রৌপদী পুরোহিত ধৌম্যকে ডাকলেন। জয়দ্রথ দ্রৌপদীর শাড়ির আঁচল ধরে টান দিতেই, দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিলেন। পাপাত্মা জয়দ্ৰথ, ছিন্নমূল তরুর মতো পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ মহাবেগে উঠে গিয়ে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে ধরে টানতে লাগল। তখন রাজনন্দিনী দ্রৌপদী ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে এবং ধৌম্য পুরোহিতের চরণে প্রণাম করে অগত্যা জয়দ্রথের রথে আরোহণ করলেন।

ধৌম্য বললেন, “জয়দ্ৰথ, প্রাচীন ক্ষত্রিয় রীতি স্মরণ করো। পাণ্ডবদের জয় না করে, তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পারো না। এই ক্ষুদ্রজনোচিত কাজ করে তুমি যুধিষ্ঠির প্রভৃতি মহাবীর পাণ্ডবগণের কাছে অত্যন্ত মন্দ ফল লাভ করবে। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” এই বলে পুরোহিত ধৌম্য জয়দ্রথের রথের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন।

ওদিকে পাঁচ পাণ্ডবভ্রাতা চারদিকে মৃগ, বরাহ, মহিষ বধ করে একস্থানে সম্মিলিত হলেন। কাম্যকবনের মধ্যে পক্ষীগণ ব্যস্ত হয়ে চিৎকার করছে শুনে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের বললেন, “পূর্বদিকে গিয়ে পশু ও পক্ষীগণ ভয়ংকর বেদনার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছে। ভ্রাতৃগণ, তোমরা নিবৃত্ত হও। আমার মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। গরুড় সর্পকে হরণ করলে যেমন হয় সরোবরে, শত্রুরা সমৃদ্ধি হরণ করলে অরাজক রাজ্যের অবস্থা যেমন হয়, সুরাপায়ীদের সমস্ত সুরা পান করলে সুরাকুম্ভের যে অবস্থা হয়, তেমনই কাম্যকবন আমার কাছে সর্বশূন্য বোধ হচ্ছে।”

পাণ্ডবগণ সত্বর রথে চড়ে আশ্রমাভিমুখী হলেন। এই সময়ে উচ্চরাবী শৃগালগণ পাণ্ডবদের বামপার্শ্বে গিয়ে ডাকতে লাগল। যুধিষ্ঠির সেই অবস্থা দেখে ভীম ও অর্জুনকে বললেন, “এই নিকৃষ্ট পশু আমাদের বামপার্শ্বে গিয়ে ডাকছে। আমার বোধ হচ্ছে, পাপাত্মা কৌরবগণ আমাদের অবজ্ঞা করে আশ্রমে উৎপীড়ন করছে।”

আশ্রমের কাছে প্রবেশ করা মাত্র তাঁরা দেখতে পেলেন দ্রৌপদীর দাসভার্যা বালিকা ধাত্রীতনয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করছে। যুধিষ্ঠিরের সারথি ইন্দ্রসেন রথ থেকে লাফিয়ে দ্রুত সেই ধাত্রীর কাছে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি ভূতলে পড়ে রোদন করছ কেন? তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে কেন? অতিনৃশসংকর্মা পাপাত্মারা— অচিন্ত্যনীয় সৌন্দর্যশালিনী, বিশাল নয়না এবং পাণ্ডবগণের দেহতুল্যা রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর কোনও ক্ষতি করেনি তো? দ্রৌপদী যদি পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করে থাকেন, স্বর্গে গিয়েও থাকেন, অথবা সমুদ্রে মগ্ন হয়েও থাকেন, তথাপি পাণ্ডবরা তাঁর কাছে উপস্থিত হবেন, কারণ স্বয়ং ধর্মপুত্র সন্তপ্ত হয়েছেন।

শত্রুমর্দনকারী, কষ্টসহিষ্ণু, সর্বত্র অপরাজিত এই মহাবীরগণের প্রাণতুল্যা প্রিয়তমা, সর্বোত্তম রত্নসদৃশী, দ্রৌপদীকে কোন মহামূর্খ হরণ করবার ইচ্ছা করবে? সে কি জানে না, দ্রৌপদী আজ এখানেও সনাথা এবং পাণ্ডবগণের বহিশ্চরহৃদয়ের স্বরূপা। তীক্ষ্ণ ও ভয়ংকর শর আজ কার দেহ বিদীর্ণ করে ভূমির ভিতরে প্রবেশ করবে?”

ধাত্রেয়িকা নিজের সুন্দর মুখ মুছে সারথি ইন্দ্রসেনকে বলল, “জয়দ্রথ, পঞ্চপাণ্ডবকে অবজ্ঞা করে উৎপীড়নপূর্বক দ্রৌপদীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। অপহরণকালে তারা গাছ ভাঙতে ভাঙতে নূতন পথ তৈরি করেছে। গাছের ভাঙা ডাল এখনও মলিন হয়নি। এখনও তারা দূরে যেতে পারেনি— তোমরা অবিলম্বে তার অনুসরণ করো। ব্রাহ্মণগণ অসতর্ক থাকলে কুকুর যেমন যজ্ঞের সোমরস পান করে, তুষের আগুন যেমন ঘূতের আহুতি দেয়, তেমনি কোনও অযোগ্য পুরুষও দ্রৌপদীকে ভোগ করতে পারে। কুকুর যেমন যজ্ঞের পুরোডাশ স্পর্শ করে, তেমনই অকার্যকারী পুরুষ যেন না আপনাদের প্রিয়তমার সুন্দর নাসিকা ও মুখখানি স্পর্শ করে।” যুধিষ্ঠির বললেন, “ভদ্রে তুমি সরে যাও, বাক্য সংবরণ করো, আমাদের সামনে এরূপ কুৎসিত কথা আর বোলো না।” তারপর পাণ্ডবেরা সেই পথ অনুসরণ করলেন।

কিছুদূর অগ্রসর হয়ে পাণ্ডবরা বিপক্ষ সৈন্যদের পদাঘাতে ধূলি উপরে উঠতে দেখলেন আর পদাতিসৈন্যদের মধ্যে ধৌম্য পুরোহিতের ভীম, এইদিকে এগিয়ে এসে চিৎকার শুনতে পেলেন। পাণ্ডবরা ধৌম্য পুরোহিতকে আশ্বস্ত করে রথে তুলে নিলেন। মাংসলোলুপ শ্যেনপক্ষীর মতো পাণ্ডবরা সৈন্যদের মধ্যে ছুটে চললেন। জয়দ্রথ এবং তার রথে দ্রৌপদীকে দেখে পাণ্ডবদের ক্রোধানল জ্বলে উঠল। পাণ্ডবরা জয়দ্রথ এবং তাঁর সৈন্যদের যুদ্ধে আহ্বান করলেন। সেই আহ্বান শুনে সৈন্যদের দিগ্‌ভ্রম শুরু হল। পাণ্ডবদের রথের ধ্বজা দেখেই দুরাত্মা জয়দ্রথের তেজ নষ্ট হতে আরম্ভ হল। তিনি রথস্থিত দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী, এই পাঁচখানি বিশাল রথ আসছে। আমি মনে করি, এরাই তোমার পতি। কিন্তু আমি এঁদের চিনি না, অতএব তুমি আমার কাছে এদের পরিচয় দাও।”

দ্রৌপদী বললেন, “মূর্খ! তুমি মৃত্যুজনক অতি ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছ। এখন এই মহাধনুর্ধরদের পরিচয় জেনে কী হবে? আমার বীরপতিগণ উপস্থিত হয়েছেন। এই যুদ্ধে তোমাদের কেউ আর অবশিষ্ট থাকবে না। তুমি মুমূর্ষ, মুমূর্ষর প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই ধর্ম। আর আমি অনুজদের সঙ্গে ধর্মরাজকে দেখতে পেয়েছি, সুতরাং আমার কোনও কষ্ট বা তোমা থেকে ভয় আর নেই। পরস্পর সংযুক্ত ও মধউরকারী ‘নন্দ’ ও ‘উপনন্দ’ নামে দুটি মৃদঙ্গ যাঁর ধ্বজের উপরে থেকে শব্দ করছে, ক্ষত্রিয়দের ধর্ম ও অর্থ অতি সূক্ষ্মভাবে নিরূপণ করতে পারেন বলে সকলেই যাঁর সেবা করেন, যিনি স্বর্ণের ন্যায় নির্মলবর্ণ, দীর্ঘদেই ও বিশাল নয়ন, যাঁর নাসিকা উন্নত— সেই কৌরব শ্রেষ্ঠকেই লোকেরা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলে জানে, ইনি আমার পতি। এই ধর্মপরায়ণ মনুষ্যবীর শরণাগত শত্রুরও প্রাণদান করে থাকেন। সুতরাং মূর্খ! তুমি নিজের মঙ্গলের জন্য, অস্ত্র পরিত্যাগ করে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, সত্বর এর শরণাগত হও।

“আর, শালবৃক্ষের মতো উন্নত, মহাবাহু, ওষ্ঠদংশনকারী ও ভ্রূকুটি করায় সংযুক্ত ভ্রূযুগল এই যে বীরকে রথে দেখছ, এর নাম ভীমসেন— ইনিও আমার পতি। সুশিক্ষিত, উৎসাহী, মহাবল অশ্বগণ এই বীরকে বহন করছে, এঁর সকল কর্মই অলৌকিক, পৃথিবীতে ইনি ভীম নামে প্রসিদ্ধ। অপরাধীরা এঁর কাছে অবশিষ্ট থাকেন না, ইনি কখনও শত্রুতা ভুলে যান না। অন্য লোক শত্রুতার অবসান করে শান্তি লাভ করে কিন্তু ইনি সম্পূর্ণরূপে শত্রুতার অবসান করেও শান্তি লাভ করেন না।

“আর ইনি— ধনুর্ধর শ্রেষ্ঠ, ধৈর্যশীল, যশস্বী, জিতেন্দ্রিয়, বৃদ্ধসেবী, মনুষ্যমধ্যে বীর যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতা ও শিষ্য অর্জুন— ইনিও আমার পতি—

ধনুর্ধরাগ্র্যো ধৃতিমান যশস্বী জিতেন্দ্রিয়ো বৃদ্ধসেবী নৃবীরঃ।

ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য ধনঞ্জয়ো নাম পতিৰ্মমেষঃ ॥ বন : ২২৪ : ১২॥

“যিনি ইচ্ছা ভয় বা ক্রোধবশত ধর্ম পরিত্যাগ বা নৃশংস কার্য করেন না এবং যিনি অগ্নির তুল্য তেজস্বী, শত্ৰুকষর্ণক্ষম ও শত্রুদমনকারী, ইনি সেই তৃতীয় কুন্তীনন্দন অর্জুন।

“আর যিনি, সমস্ত ধর্ম ও অর্থের নিরূপণ করতে সমর্থ, ভয়ার্তগণের ভয়হর্তা ও বুদ্ধিমান, পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপবান পুরুষ, প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তম এবং অনুকূল পাণ্ডবরা যাঁকে রক্ষা করে থাকেন— আমার পতি এই বীরের নাম নকুল।

“আর যিনি খড়গযোদ্ধা ও যুদ্ধের সময়ে যাঁর হাতখানি দ্রুতবেগে ও বিচিত্রভাবে ভ্রমণ করে থাকে এবং যিনি উদারচেতা ও বুদ্ধিমান দ্বিতীয় সহদেব রাজার তুল্য; মূঢ়বুদ্ধি জয়দ্রথ! যুদ্ধে দৈত্যসৈন্যদের মধ্যে ইন্দ্রের মতো কার্য করতে আজ তুমি যাঁকে দেখবে এবং যিনি বীর, অস্ত্রে সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান, প্রশস্তচেতা, ধর্মরাজের প্রিয় কার্যকারী, চন্দ্র ও সূর্যের তুল্য তেজস্বী এবং পাণ্ডবগণের প্রিয় ও কনিষ্ঠ, বুদ্ধিতে যাঁর তুল্য মানুষ আর পৃথিবীতে নেই, যিনি পণ্ডিতদের মধ্যে বক্তা, কার্যনিরূপণে নিপুণ, বীর, সর্বদা অসহিষ্ণু, বুদ্ধিমান ও বিদ্বান—ইনি সেই সহদেব, ইনিও আমার পতি। কুন্তীদেবীর প্রাণের তুল্য প্রিয়তম প্রশস্তচিত্ত ও সর্বদা ক্ষত্রিয়ধর্মে নিরত এই মনুষ্যবীর বরং প্রাণ পরিত্যাগ করতে পারেন এবং অগ্নিতেও প্রবেশ করতে পারেন— কিন্তু ধর্মবহির্ভূত বাক্য বলতে পারেন না। এই তোমাকে আমার পঞ্চপতির বর্ণনা দিলাম। তুমি যদি এদের হাত থেকে অক্ষত শরীরে মুক্তি লাভ করতে পারো, তবে জীবিত থেকে পুনর্জন্ম লাভ করবে।”

তখন জয়দ্রথ সেই রাজপুত্রদের যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করতে লাগলেন। বাঘের মতো বলমত্ত পাণ্ডবদের দেখে জয়দ্রথের সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি দেখা দিল। গদা হাতে ভীমসেন জয়দ্রথের দিকে অগ্রসর হলেন। কৌটিকাস্য ভীম ও জয়দ্রথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভীমকে লক্ষ্য করে বহুতর শক্তি, তোমর, নারাচ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভীমসেন অবিচলিত চিত্তে গদা দ্বারা চোদ্দোজন পদাতিককে ও আরোহীর সঙ্গে একটি হাতিকেও সংহার করলেন। অর্জুন জয়দ্রথের সৈন্যের সম্মুখভাগের পাঁচশত পার্বত্য মহারথবীরকে বধ করলেন। রাজা যুধিষ্ঠির নিমেষমধ্যে সৌবীরপ্রধান একশত যোদ্ধাকে নিহত করলেন। নকুল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে খগাঘাতে চক্ররক্ষী সৈন্যগণের মস্তক সকল মুহুর্মুহু নিপাতিত করলেন। আর সহদেব নারাচ দ্বারা গজারোহীদের নিপাতিত করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠিরের অর্ধচন্দ্রবাণে ত্রিগর্তরাজের হৃদয় বিদীর্ণ হল। মৃত্যুর পূর্বে নিক্ষিপ্ত ত্রিগর্তরাজের গদার আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথের চারটি অশ্বই নিহত হল। যুধিষ্ঠির সহদেবের রথে গিয়ে উঠলেন। ক্ষেম, কর ও মহামুখ নামে বীরেরা নকুলকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন নকুল দুটি বিপাঠ অস্ত্রপ্রয়োগ করে দুই বীরকে সংহার করলেন। সুরথ নামক অপর এক ত্রিগর্তরাজের হাতি নকুলের অশ্ব ধরে টান দিল। নকুল অসি হাতে রথ থেকে নেমে শুঁড় সমেত সেই হাতির দাঁত কেটে ফেললেন। নকুল ভীমসেনের রথে গিয়ে উঠলেন। ভীম ক্ষুরদ্বারা কৌটিকাস্যের সারথির মাথা কেটে ফেললেন। একটি মুষ্টিযুক্ত প্রাস দ্বারা ভীমসেন কৌটিকাস্যকে বধ করলেন।

এদিকে অর্জুন সৌবীরদেশীয় বারোজন বীরকেই বধ করলেন। তারপর অর্জুন শিবি আর ইক্ষ্বাকু বীরদের সংহার করলেন। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তখন অত্যন্ত ভীত হয়ে রথ থেকে দ্রৌপদীকে নামিয়ে দিয়ে পালাতে লাগলেন। ভীম নির্বিচারে সৈন্য বধ করছিলেন, অর্জুন তাঁকে বারণ করলেন। ভীম নিবৃত্ত হয়েও যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আপনি, নকুল-সহদেবকে ও দ্রৌপদীকে নিয়ে আশ্রমে যান, জয়দ্রথ পাতালে গেলেও আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না।” যুধিষ্ঠির বললেন, “ভীম, ভগিনী দুঃশলা ও মাতা গান্ধারীর কথা চিন্তা করে জয়দ্রথকে প্রাণে বধ কোরো না।” ক্রুদ্ধা ও লজ্জিতা দ্রৌপদী ভীমার্জুনকে বললেন, “আমার প্রিয়কার্য যদি আপনাদের কর্তব্য হয়, এই নরাধম, পাপাত্মা, কুলদূষক নিকৃষ্ট সিন্ধুরাজকে বধই করবেন।” ভীমার্জুন জয়দ্রথের পিছনে চললেন। যুধিষ্ঠির, ধৌম্য পুরোহিত ও অন্যদের নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন। ভীমার্জুন শুনতে পেলেন জয়দ্রথ এক ক্রোশ পথ দূরে গেছে। অর্জুন সেখান থেকেই বাণক্ষেপ করে জয়দ্রথের সমস্ত অশ্বকে মেরে ফেললেন। ভীত জয়দ্রথ যে পথ দিয়ে এসেছিলেন, সেই পথেই পালাতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে ভীমার্জুন জয়দ্রথকে ধরে ফেললেন। অর্জুন পিছন থেকে বললেন, “রাজপুত্র! তুমি এই বল নিয়ে পরস্ত্রী হরণ করতে এসেছিলে?” জয়দ্রথ পালাবার চেষ্টা করায় ভীমসেন দ্রুত ছুটে গিয়ে জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরলেন। জয়দ্রথকে মাথার উপর তুলে একটি আছাড় মেরে মাটিতে ফেললেন, তাঁর মাথা ধরে প্রচণ্ড নাড়া দিলেন। জয়দ্রথ ওঠবার চেষ্টা করতেই ভীম তাঁর মস্তকে পদাঘাত করলেন। তারপর তাঁকে নিজের জানুর উপর রেখে হাতের কনুই দ্বারা তাঁর বুকে আঘাত করলেন। তখন অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আদেশ স্মরণ করে তাঁকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন। ক্ষুব্ধ ভীম বললেন, “এই পাপাচারী দ্রৌপদীর অসম্মান করেছে, কাজেই এ আমার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না। কিন্তু আমি কী করব? রাজা সর্বদাই দয়ালু আর তুমি মূর্খবুদ্ধি।” এই বলে ভীমসেন অর্ধচন্দ্র বাণ দ্বারা জয়দ্রথের মাথার চুল মধ্যে মধ্যে মুণ্ডন করে তার মাথায় পাঁচটি জটা করে দিলেন। তারপর জয়দ্রথের দেহবন্ধন করে রথে তুলে নিয়ে চললেন। ভীম জয়দ্রথকে বললেন, “তুমি যদি বাঁচতে চাও, তা হলে সর্বদা বলবে, আমি পাণ্ডবদের দাস।” জয়দ্রথ স্বীকার করে বললেন, “তাই হবে।”

ভীমার্জুন জয়দ্রথকে নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন। যুধিষ্ঠির সেই বদ্ধ এবং মস্তকের অবস্থায় জয়দ্রথকে দেখে মনে মনে হাসলেন। ভীমকে বললেন, “এবার একে ছেড়ে দাও।” ভীম উত্তরে বললেন, “আপনি এই কথা দ্রৌপদীকে বলুন। এই পাপাত্মা পাণ্ডবের দাস।” যুধিষ্ঠির সস্নেহে ভীমকে বললেন, “আমার কথা যদি তোমার গ্রাহ্য হয়, এই নিকৃষ্টচারীকে ছেড়ে দাও।” দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে ভীমকে বললেন, “আপনি এঁর মাথায় পাঁচ জটা করে দিয়েছেন এবং ইনি রাজার দাস হয়েছেন, এখন আপনি একে মুক্ত করে দিন।”ভীমসেন মুক্ত করে দিলে জয়দ্রথ রাজা যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে, সেখানকার মুনিদেরও নমস্কার করলেন। অর্জুন জয়দ্রথের হাত ধরলেন, দয়ালু ও ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির জয়দ্রথকে বললেন, “পুরুষাধম। তুমি দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলে, সুতরাং অদাস হয়েই চলে যাও। আর কখনও এ-কাজ কোরো না। তুমি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রসহায়শালী এবং পরস্ত্রীকামুক। সুতরাং তোমাকে ধিক। কারণ, তুমি ছাড়া আর কোনও ব্যক্তি এই কাজ করে না।”

‘দ্রৌপদী হরণ’ জয়দ্রথের পক্ষে সম্ভব হল না। কিন্তু এর ফল হল গুরুতর। মৃতপ্রায়, লজ্জিত, দুঃখিত, অবনতমুখ জয়দ্রথ গঙ্গাতীরের দিকে চলে গেলেন, সেখানে তিনি দীর্ঘকাল বিরূপাক্ষ ও উমাপতি মহাদেবের প্রসন্নতা লাভের জন্য গুরুতর তপস্যা করলেন। মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলে জয়দ্রথ প্রার্থনা করলেন, “আমি যেন যুদ্ধে রথারোহী পঞ্চপাণ্ডবকে জয় করতে পারি।” মহাদেব বললেন, “না, অর্জুন পূর্বজন্মে নর-ঋষি ছিলেন, নারায়ণ তাঁর সখা ও সহায়। অর্জুন আমার কাছে পাশুপত অস্ত্র লাভ করেছে। নারায়ণ তাঁর রথের সারথি হবেন। এই নারায়ণ দশ অবতার রূপে বার বার পৃথিবীকে উদ্ধার করেছেন। অতএব জয়দ্রথ তুমি এক অর্জুন ব্যতীত যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সৈন্যকে এবং অপর চারজন পাণ্ডবকে মাত্র একদিন জয় করতে পারবে।” কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য দ্রোণ চক্রব্যুহ রচনা করলেন। পিতৃদত্ত শিক্ষার বলে অর্জুন-পুত্র অভিমন্যু সে ব্যূহভেদ করলেন। জয়দ্রথ অন্য সমস্ত পাণ্ডবের পথ আটকে দিলেন। একাকী সমস্ত দিনের যুদ্ধের শেষে অভিমন্যু সপ্তরথী কর্তৃক বেষ্টিত অবস্থায় নিহত হলেন। জয়দ্রথ মহাদেবের কাছে যে প্রার্থনা করেছেন, তাঁর মূল্য দিতে হল আত্মরূপ অর্জুন-পুত্রকে। তার পরদিবসেই অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেন।

অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীর অসম্মান—কীচক বধ।

তখন অজ্ঞাতবাসের দশ মাস কাল অতিবাহিত হয়েছে। দ্রৌপদী, যিনি রানি সুদেষ্ণার শুশ্রূষা পাবার যোগ্যা, তিনি ভাগ্যের পরিহাসে সুদেষ্ণার সেবা করে দিন অতিবাহিত করছেন। একদিন বিরাটরাজার সেনাপতি কীচক, রানি সুদেষ্ণার গৃহে পরিচারিকারূপে দ্রৌপদীকে দেখল। দেবকন্যার ন্যায় রূপবতী, দেবকন্যার ন্যায় বিচরণকারিণী দ্রৌপদীকে দেখে কীচক তৎক্ষণাৎ কামার্ত হয়ে পড়ল। কামাগ্নি সন্তপ্ত কীচক আপন ভগ্নী সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বলল, “এই বিরাটরাজার গৃহে এমন সুলক্ষণা রমণী আমি পূর্বে কখনও দেখিনি। সুন্দর সুরা যেমন গন্ধ দ্বারা মাতাল করে, তেমনই এই সুন্দর ভঙ্গিশালিনী রমণী রূপ দ্বারা আমাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। দেবতার তুল্য রূপবতী, শুভলক্ষণা ও চিত্তাকর্ষিণী এই সুন্দরী কে? কারই বা স্ত্রী? কোথা থেকে এসেছে? এ আমার চিত্ত মথিত করে আমাকে বশীভূত করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গম ছাড়া আমার স্বাস্থ্যলাভের অন্য কোনও ঔষধ নেই বলেই আমার মনে হচ্ছে।

“সুদেষ্ণা, তোমার এই সুন্দরী পরিচারিকাটি নূতন এসেছে বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু এ যে তোমার পরিচারিকার কাজ করছে, এটা আমার সংগত বোধ হচ্ছে না। সুতরাং আমি বা আমার যা-কিছু বস্তু আছে সে সমস্তের উপর এই নারী আধিপত্য করুক। আমার বিশাল ভবন, মনোহর ও সমৃদ্ধিযুক্ত। তাতে আবার বহুতর হস্তী, অশ্ব, রথ, পাত্র, খাদ্য, পেয় ও আশ্চর্য স্বর্ণভূষণ সকল রয়েছে। এই নারী সে ভবনকে শোভিত করুক।”

তারপর কীচক সুদেষ্ণার কাছে গোপনে এই কথা বলে, বনের ভিতর শৃগাল যেমন সিংহের কন্যার কাছে যায়, তেমনই রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “সুন্দরী! তোমার এই সৌন্দর্য, এই প্রথম বয়স কেবল ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কারণ কোনও পুরুষ ধারণ না করায় উত্তমা ও সুলক্ষণা মালার মতো সুন্দরী হয়েও তুমি শোভা পাচ্ছ না। ভাবিনী! আমার যে সকল পূর্ববর্তী স্ত্রী আছে, তাদের আমি ত্যাগ করব। তারা তোমার দাসী হবে।” তখন দ্রৌপদী বললেন, “সূতপুত্র! আমি হীনবর্ণা কেশ সংস্কারকারিণী নিন্দিতা সৈরিন্ধ্রী, সুতরাং আমি আপনার অপ্রাপনীয়া। তথাপি আপনি আমাকে প্রার্থনীয়া বলে মনে করছেন। বিশেষত আমি পরের ভার্যা। আমি আমার স্বামীগণের প্রিয়তমা। সুতরাং আমাকে এমন কথা বলা আপনার উচিত নয়। আপনি ধর্মের বিষয়ে চিন্তা করুন। আপনার মঙ্গল হবে। আপনি কখনও পরস্ত্রীর প্রতি ইচ্ছা করবেন না।”

“সৎপুরুষেরা কখনও অকার্য করেন না। মুগ্ধ ও পাপাত্মা ব্যক্তিরাই অনর্থক অন্যায় অভিলাষ করে ভয়ংকর নিন্দা ও ভয়ের পাত্র হয়ে থাকেন। সূতপুত্র, আমি বীরগণ দ্বারা সর্বতোভাবে রক্ষিত, সুতরাং আপনার অলভ্যা। আপনি আমাকে লভ্যা বলে মনে করলে আপনার জীবনসংশয় হবে। আমি আপনার বা অন্য কারুরই লভ্যা নই। সুতরাং আপনি সে চেষ্টা করলে আমার গন্ধর্ব স্বামীরা ক্রোধে আপনাকে বধ করবেন। নিজেকে নিজে বিনষ্ট করবেন না। যে পথে মানুষ যেতে পারেন না, আপনি সেই পথে যাবার চেষ্টা করছেন। নির্বোধ বালক যেমন নদীর এক তীর থেকে কোনও যান ছাড়াই অন্য তীরে যেতে ইচ্ছা করে, অল্পবুদ্ধি আপনিও তেমনই অপ্রাপ্য পেতে ইচ্ছা করছেন। কীচক, তুমি যদি ভূগর্ভে প্রবেশ করো, কিংবা আকাশে উড়ে যাও, তবুও আমার ভর্তাদের হাত থেকে মুক্তিলাভ করবে না। কারণ, আমার স্বামীরা দেবতার পুত্র, সর্বপ্রকার শত্রুদমনে সমর্থ। রোগী যেমন মৃত্যু প্রার্থনা করে, তুমি আমাকে তেমনভাবে প্রার্থনা করছ। শিশু যেমন মাতার ক্রোড়ে শুয়ে আকাশের চাঁদকে পেতে চায়, তুমিও আমাকে তেমন করেই পেতে চাইছ।”

ভয়ংকর কামে জর্জরিত কীচক দ্রৌপদী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বলল, “সুদেষ্ণা, সৈরিন্ধ্রীকে আমার কাছে পাঠাবার চেষ্টা করো। যদি আমাকে জীবিত দেখতে চাও, তবে গজগামিনী সৈরিন্ধ্রী যাতে আমাকে ভজনা করে তার ব্যবস্থা করো।” ভ্রাতা কীচকের বারবার এই বিলাপ শুনে সুদেষ্ণার মনে দয়া জাগ্রত হল। সুদেষ্ণা বললেন, “কীচক, কোনও উপলক্ষে আমাকে খাওয়ানোর জন্য তুমি বাড়িতে নিমন্ত্রণ করো। গৃহে উত্তম সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করাও। তারপর আমি সেই সুরা আনয়নের জন্য সৈরিন্ধ্রীকে তোমার গৃহে পাঠাব। তুমি তাকে নির্জন স্থানে এমন তোষামোদ করবে, যাতে সে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়।”

“সুদেষ্ণা এই কথা বললে, কীচক নিজগৃহে রাজকীয় সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করাল। ছাগ, শূকর ও অন্য পশুমাংস, সুশোভন অন্ন ও পানীয় প্রস্তুত করাল। তখন সুদেষ্ণা সৈরিন্ধ্রীকে কীচকের গৃহে পাঠাবার ইচ্ছা করলেন। সুদেষ্ণা বললেন, “সৈরিঞ্জী, কীচকের গৃহ থেকে আমার জন্য মদ নিয়ে এসো। কারণ উত্তম সুরার পিপাসা আমাকে কাতর করেছে।” কিন্তু সৈরিন্ধ্রী নির্লজ্জ কীচকের গৃহে যেতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, “অনিন্দ্যসুন্দরী! আমি আপনার গৃহে এসে পতিগণের নিকট ব্যভিচারিণী হয়ে কাম ব্যাপারে প্রবৃত্ত হব না। প্রশস্তস্বভাব দেবী, আপনার গৃহে প্রবেশের সময়ে আমি যে নিয়ম করেছিলাম তা আপনি জানেন। মূঢ় ও কামমত্ত কীচক আমাকে দেখেই অপমানিত করবে। রাজনন্দিনী আপনার অনেক দাসী আছে। সুতরাং অন্য কোনও দাসীকে সেখানে পাঠান। আমার কথা শুনুন, আপনার মঙ্গল হবে।”

সুদেষ্ণা বললেন, “আমি এখান থেকে তোমাকে পাঠাচ্ছি। সুতরাং কীচক তোমাকে অপমান করবে না”। এই কথা বলে রানি সুদেষ্ণা সৈরিন্ধ্রীর হাতে আবরণ যুক্ত স্বর্ণময় পানপাত্র প্রদান করলেন। সৈরিন্ধ্রী আশঙ্কার সঙ্গে রোদন করতে লাগলেন। তিনি সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা জানালেন, “আমি পাণ্ডবগণ ব্যতীত অন্য পুরুষকে জানি না, সেই সত্যধর্মহেতু কীচক যেন আমাকে বশীভূত করতে না পারে।” সূর্যদেব দ্রৌপদীর সেই স্তবের কারণ বুঝে দ্রৌপদীকে রক্ষা করার জন্য এক অদৃশ্য রাক্ষসকে নিযুক্ত করলেন। সেই রাক্ষসও ছায়ার মতো দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকতে লাগল।

সৈরিন্ধ্রী-রূপিণী দ্রৌপদী মদ আনবার জন্য কীচকের গৃহে উপস্থিত হলেন। পাড়ে নৌকা পেলে পাড়গামী ব্যক্তি যেমন উঠে দাঁড়ায়, তেমনই হরিণীর মতো ত্ৰস্তা দ্রৌপদীকে আসতে দেখে কীচক আনন্দে উঠে দাঁড়াল। কীচক বলল, “তোমার আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো? তুমি আমার সর্বম্বের অধীশ্বরী। আজ আমার সুপ্রভাত হয়েছে, কারণ তুমি আমার কাছে এসেছ। এখন তুমি আমার প্রিয় কার্য করো। সোনার মালা, শাঁখা, দুটি কুণ্ডল, নানা রত্নখচিত নির্মল দুটি কেয়ূর, সুন্দর মণি ও রত্ন এবং নানাবিধ পট্টবস্ত্র ভৃত্যেরা তোমার জন্য এনে দেবে। আমি তোমার সঙ্গে কল্পিত এক শয্যা রচনা করে রেখেছি, সেইখানে চলো, আমার সঙ্গে মিলে পুষ্পমদ্য পান করো।”

দ্রৌপদী বললেন, “সুদেষ্ণাদেবী সুরা নিয়ে যাবার জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি অত্যন্ত পিপাসার্তা। আমাকে সত্বর সুরা নিয়ে যেতে বলেছেন।” “অন্য দাসীরা সুদেষ্ণার জন্য সুরা নিয়ে যাবে।” এই বলে কীচক দ্রৌপদীর ডান হাত ধরে বিশালনয়না দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করতে চাইল, তখন দ্রৌপদী তাকে তিরস্কার করে উঠলেন। কীচক দ্রুত এসে আবার দ্রৌপদীকে ধরল। তখন সুলক্ষণা দ্রৌপদী ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে কীচককে তীব্র ধাক্কা মারলেন। পাপাত্মা কীচক ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো ভূমিতে পতিত হল। কীচককে ভূতলে নিক্ষেপ করে দ্রৌপদী দ্রুতবেগে রাজার কাছে যাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় কীচক তাঁর কেশাকর্ষণ করে বিরাটরাজার সামনেই তাঁকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করল। তখন সূর্যদেব দ্রৌপদীর রক্ষার জন্য যে রাক্ষসটিকে নিযুক্ত করেছিলেন, সেই রাক্ষস বায়ুবেগে গিয়ে কীচককে এক ধাক্কা দিল। রাক্ষসের আঘাতে আহত কীচক নিশ্চেষ্টভাবে মাটিতে পড়ে রইল। ওদিকে সেখানে উপবিষ্ট ভীম ও যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর উপর কীচকের পদাঘাত সহ্য করতে না পেরে, দুঃখ ও রোষের সঙ্গে দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন। মহাবল ভীমসেন সেই কীচককে বধ করবার জন্য দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করতে লাগলেন।

এই সময়ে লোকে বুঝে ফেলবে এই ভয়ে রাজা যুধিষ্ঠির আপন চরণাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ভীমের চরণাঙ্গুষ্ঠ মর্দন করে ভীমকে নিষেধ করলেন। ধর্মচারিণী, সুদেহিনী দ্রৌপদী তখন যুধিষ্ঠিরের অজ্ঞাতবাস-প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য কীচক বধের ইঙ্গিত না করে, সভার মধ্যে গিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একবার যুধিষ্ঠির ও ভীমের দিকে তাকালেন। তারপর প্রচণ্ড ক্রোধে বিরাটরাজাকে যেন দগ্ধ করতে করতে তাঁকে বললেন, যাঁদের শত্রু তাদের দেশ থেকে যষ্ঠদেশ দূরে থেকেও ভয়ে নিদ্রা যায় না আমি তাঁদের মানিনী ভার্যা। এই সূতপুত্র আমাকে পদাঘাত করল। ব্রাহ্মণ-হিতৈষী ও সত্যবাদী যে বীরেরা কেবল দানই করেন, কখনও প্রার্থনা করেন না, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা; আমাকে সূতপুত্র পদাঘাত করল।

যেষাং দুন্দুভিনির্ঘোষে জ্যাঘোষঃ শ্ৰয়তে মহান।

তেষাং মাং মানিনীং ভার্যাং সূতপুত্রঃ পদাহবধীৎ ॥ বিরাট : ১৫ : ১৯ ॥

“যে বীরগণের ধনুর্গুণাস্ফালনের শব্দ দুন্দুভির ন্যায় বৃহৎ শব্দ, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা, আর আমাকেই সূতপুত্র পদাঘাত করল। যাঁরা তেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, বলবান ও অভিমানী, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা, আর আমাকেই সূতপুত্র পদাঘাত করল। অনায়াসে যাঁরা জগৎ ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু বর্তমানে ধর্মপাশে আবদ্ধ হয়ে আছেন, আমি তাদেরই মানিনী ভার্যা, সেই আমাকে সূতপুত্র পদাঘাত করল।

“শরণার্থীদের চিরকাল যাঁরা রক্ষা করে থাকেন, যাঁরা গুপ্তভাবে সমাজে বিচরণ করছেন, সেই মহারথগণ এখন কোথায়? সতী ও প্রিয়তমা পত্নীকে সূতপুত্র পদাঘাত করল, এ দেখেও যাঁরা তাকে রক্ষা করছেন না, তাঁদের ক্রোধ ও বীর্য কোথায় গেল? আমি নিরপরাধা, তবুও কীচক আমাকে পদাঘাত করল; এ দেখেও যে বিরাটরাজা কীচককে ক্ষমা করছেন, সেই বিরাটরাজা যদি ধর্মদুষ্ট হন, তবে আমি অবলা নারী কীচকের আর কী করতে পারি? রাজা! আপনি কীচকের প্রতি রাজোচিত ব্যবহার করছেন না, সুতরাং আপনার রাজসভা ধর্ম দ্বারা রক্ষিত নয়, দস্যু দ্বারা পীড়িত। সুতরাং আপনার রাজ্যে আমার আর বাস করা সংগত হচ্ছে না। সভাসদগণও এই কীচকের অত্যাচার দেখুন। কীচক তো ধর্মাচারী, নয়ই, মৎস্যরাজাও ধর্মাচারী নন, যে সভ্যগণ এই অধর্মাচারী রাজার সেবা করছেন তাঁরাও ধর্মাচারী নন।

দ্রৌপদীর তীক্ষ্ণ তীব্র ভর্ৎসনা শুনে বিরাটরাজা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, আমার অগোচরে তোমাদের মধ্যে যে বিবাদ হয়েছে, তা আমি জানি না। সুতরাং তোমার এই অপমানের যথার্থ কারণ না জেনে, আমি কী বিচার করতে পারি?” দ্রৌপদী সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং কীচক বিশেষভাবে দোষী, সভাসদগণ এই ঘটনা জেনে দ্রৌপদীর প্রশংসা ও কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন। সভাসদগণ বললেন, “এই সর্বাঙ্গসুন্দরী দীর্ঘনয়না যাঁর ভার্যা, তিনি যথার্থই ভাগ্যবান এবং সেই ব্যক্তি কখনই শোক পাবেন না। এই নারীর মতো সর্বাঙ্গসুন্দরী নারী মনুষ্যসমাজে দুর্লভা। সুতরাং আমাদের ধারণা ইনি কোনও দেবী হবেন।”

সভাসদগণ এইভাবে দ্রৌপদীকে প্রশংসা করছেন দেখে ক্রোধে যুধিষ্ঠিরের কপালে ঘাম ঝরতে লাগল। তিনি তাঁর প্রিয়তমা মহিষী দ্রৌপদীকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, তুমি এখানে থেকো না, রানি সুদেষ্ণার কাছে যাও। দেখো, বীরপত্নীরা ভর্তাদের অনুসরণ করতে থেকে কষ্টও পান, কিন্তু ভর্তাদের সেবা করেই পতিলোক জয় করেন। তোমার ভর্তারা এখনও সময় হয়েছে বলে বোধ প্রকাশ করছেন না, তাই তাঁদের ক্রোধেরও প্রকাশ ঘটছে না। তুমি প্রতিকারের সময় বোঝে না— সেই কারণেই সূর্যতুল্য গন্ধর্বগণ প্রতিকার করার জন্য তোমার কাছে আসছেন না। নটীর মতো রোদন করে তুমি রাজসভায় ক্রীড়াকারী মৎস্যদেশীয়গণের ক্রীড়ায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছ! অতএব সৈরিন্ধ্রী তুমি যাও, তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা তোমার প্রিয়কার্য করবেন। যে লোক তোমার প্রতি অপ্রিয় আচরণ করেছে, তাকে সুনিশ্চিতভাবে দণ্ড দিয়ে তোমার দুঃখ দূর করবেন।”

দ্রৌপদী বললেন, “যাঁদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত, সেই মহাদয়ালুদের জন্যই আমি ভোগের সময়েও ধর্মাচারিণী হয়েছি। তা না হলে সেই দুর্জনদের তাঁরা তখনই বধ করতেন।” ক্রোধে আরক্তা দ্রৌপদী এই কথা বলে কেশকলাপ মুক্ত রেখেই দ্রুত সুদেষ্ণার ভবনে চলে গেলেন।

তখন দ্রৌপদী জল দ্বারা বস্ত্রযুগল প্রক্ষালন করলেন। কারণ কীচকের পদাঘাতে ভূতলে পতিত হওয়ায় এবং রোদনের জন্য বস্ত্রযুগল অপরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি দুঃখ পরিশোধের উপায় চিন্তা করতে লাগলেন এবং “ভীম ছাড়া অন্য কেউই আমার মনের প্রিয় কাজ করতে পারবে না” এই চিন্তা করে মনে মনে ভীমকেই স্মরণ করতে লাগলেন। গভীর রাতে দ্রৌপদী আশ্রয় লাভের জন্য আপন পতি ভীমসেনের নিকট যাওয়ার জন্য শয্যাত্যাগ করলেন। রন্ধনশালায় উপস্থিত হয়ে দ্রৌপদী নিদ্রিত ভীমসেনকে দেখতে পেলেন। ধেনু যেমন মহাবৃষের কাছে গমন করে, তেমনই দ্রৌপদী ভীমসেনের কাছে গিয়ে, দুর্গম বনে সিংহী যেমন সিংহকে আলিঙ্গন করে, নিদ্রিত পাণ্ডুনন্দন ভীমসেনকে আলিঙ্গন করে বললেন, “ভীমসেন! ওঠো ওঠো, মৃতব্যক্তির মতো কেমন করে শায়িত আছ? কারণ, পাপিষ্ঠ লোকেরা জীবিত ব্যক্তির ভার্যাকে স্পর্শ করে কখনও জীবিত থাকে না। পাপিষ্ঠ কীচক আমাকে পদাঘাত করে এখনও জীবিত আছে। এ-অবস্থায় তুমি নিদ্রিত থাকো কেমন করে?”

দ্রৌপদী এইভাবে জাগিয়ে তুললে ভীমসেন নিদ্রা ত্যাগ করে শয্যায় উঠে বসলেন এবং প্রিয়তমা মহিষী দ্রৌপদীকে বললেন, “তুমি কী প্রয়োজনে এত ব্যস্ত হয়ে আমার কাছে এসেছ। তোমাকে কৃশ দেখাচ্ছে, তোমার গাত্রবর্ণও স্বাভাবিক নয়। সমস্ত ঘটনা আমাকে বলো, যাতে আমি সব জানতে পারি। সুখ, দুঃখ, প্রিয়, অপ্রিয়, সমস্ত ঘটনা আমাকে বলো— তোমার বক্তব্য শুনে আমি আমার কর্তব্য নির্ধারণ করব। কৃষ্ণা, তুমি সকল অবস্থায় আমাকে বিশ্বাস কোরো, আমি তোমাকে বারবার বিপদ থেকে উদ্ধার করব। আর তোমার বক্তব্য বলে দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করো, অন্যে জানতে পারে তা আমি চাই না।”

দ্রৌপদী বললেন, “যুধিষ্ঠির যার স্বামী, তার কপালে দুঃখ থাকবে না কেন? কিন্তু তুমি সমস্ত জেনেও আমাকে আবার তা বলতে বলছ কেন? দ্যূতক্রীড়ার সময়ে দুর্যোধন আমাকে ‘দাসী, দাসী’ বলেছিল এবং বলপূর্বক অভিজাত বিদ্বান পুরুষমণ্ডলীর মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তা স্মরণ করলে আমি দগ্ধ হতে থাকি। আমি ভিন্ন অন্য কোনও রাজকন্যা এত দুঃখ সহ্য করেছেন? তারপর দ্বৈতবনে জয়দ্রথ দ্বিতীয়বার আমার কেশাকর্ষণ করেছিল। অন্য কোন নারী তা সহ্য করতে পারে? আজ সেই দ্যূতক্রীড়া প্রবৃত্ত মৎস্যরাজের সম্মুখেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে। ভীমসেন! যে দুঃখ সহ্য করে আমি বেঁচে আছি, তা কি তোমার অজানা? কিন্তু আমার বেঁচে থাকার ফল কী? বিরাটরাজার শ্যালক ও সেনাপতি দুরাত্মা কীচক সৈরিন্ধ্রী থাকার সময়ে রাজভবনে সর্বদাই আমাকে বলে, “তুমি আমার ভার্যা হও।’ কীচক যখন এ-কথা বলে তখন পাকা ফলের মতো আমার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়। তুমি তোমার দ্যূতক্রীড়াকারী জ্যেষ্ঠভ্রাতার নিন্দা করো। তাঁর জন্যই আমি এই অনন্ত দুঃখ ভোগ করছি। যুধিষ্ঠির ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি নিজের শরীর, রাজ্য ও সর্বস্ব ত্যাগ করে বনবাসের জন্য দ্যূতক্রীড়া করেন? তিনি যদি দশ হাজার মোহর, অন্য মূল্যবান ধন, রূপা, সোনা, বস্ত্র, যানবাহন, ছাগল, মেষ, অশ্ব ও অশ্বেতর— একটার পর একটা পণ ধরে যদি বহু বছর ধরে ক্রীড়া করতেন, তা হলেও তাঁর কোষ কখনও ক্ষয় হত না। সেই যুধিষ্ঠির অনবধানতাবশত ঐশ্বর্যভ্রষ্ট হয়ে, আপন কৃতকার্যের কথা চিন্তা করতে করতে বিকল চিত্তে বসে আছেন। কোথাও যেতে গেলে, দশসহস্র সাধারণ হস্তী এবং বহু সহস্র স্বর্ণমাল্যধারণকারী মহাহস্তী যার পিছনে পিছনে যেত, তিনি আজ পাশা খেলে লব্ধ ধনদ্বারা জীবিকানির্বাহ করছেন। সহস্র সহস্র রাজা এসে ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের স্তব করতেন। শতসহস্র দাসী পাত্র হাতে করে দিবারাত্র যুধিষ্ঠিরের অতিথিদের ভোজন করাত, প্রত্যহ সহস্র সহস্র স্বর্ণমুদ্রাদাতা, দাতৃশ্রেষ্ঠ সেই যুধিষ্ঠির পাশা খেলার ফলে গুরুতর বিপদপ্রাপ্ত হয়েছেন। মধুর স্বরসম্পন্ন সুপরিস্কৃত মাল্যধারী বহুতর বন্দি ও চারণ সন্ধ্যাকালে ও প্রভাতে এই যুধিষ্ঠিরের উপাসনা করত। তপস্বী ও শাস্ত্রজ্ঞ ঋষিরা তাঁর কাছে আসতেন। যুধিষ্ঠির অকাতরে অন্ধ, বৃদ্ধ ও বালকদের ভরণ-পোষণ করতেন। সেই যুধিষ্ঠির আজ ‘কঙ্ক’ নাম নিয়ে বিরাটরাজার সঙ্গে আলাপ করেন। যিনি উপহার দিয়ে প্রার্থীদের প্রার্থনা পূর্ণ করতেন, তিনি অন্য লোকের কাছে সম্পদলাভ করতে রত আছেন। পৃথিবীপালক রাজা যুধিষ্ঠির পরের অধীনে বিবশ অবস্থায় বাস করছেন। যিনি সমগ্র পৃথিবীকে সন্তপ্ত করতেন, তিনি আজ পরের সভাসদ হয়ে বাস করছেন। পরের উপাসনার অযোগ্য, মহাপ্রাজ্ঞ ও ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির জীবিকানির্বাহ করার জন্য অন্যের আশ্রয় নিয়েছেন দেখে কার না দুঃখ হয়? মধ্যম পাণ্ডব! তুমি কি আমার এই দুঃখ অনুভব করতে পারছ না?

‘কুন্তীনন্দন! আমার অসহ্য দুঃখ অনুভব করো। আমি তোমাদের কাউকে দোষারোপ করছি না। আমি গভীর দুঃখেই আমার অন্তরের কথা বলছি। অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং আপনার পক্ষে অযোগ্য কারুকার্য করার সময়ে তুমি যে ‘বল্লব’ নামে নিজের পরিচয় দাও, তাতে আমার মন শুকিয়ে যায়। পাকগৃহে পাককার্য শেষ হয়ে গেলে তুমি বিরাটরাজার সভায় গিয়ে তাঁর উপাসনা করো, তাতে দুঃখে বেদনায় আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। রানি সুদেষ্ণার সামনে তুমি যখন পশুশালা থেকে আগত বাঘ, সিংহ ও বন্য বরাহদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, তখন বিপদাশঙ্কায় আমার মোহ উপস্থিত হয়। আমি উদ্বিগ্ন এবং মূৰ্ছিতপ্রায় দেখে, রানি সুদেষ্ণা যখন বলেন, “এই নির্মল মৃদুহাসিনী সৈরিন্ধ্রী একত্রে বাস করার ফলেই স্নেহবশত এই বল্লবের বিষয়ে শোক করে। সৈরিন্ধ্রী সুন্দরী, বল্লবও অত্যন্ত সুন্দর। এদের রূপ পরস্পরের যোগ্য আর স্ত্রীলোকের মন বোঝা অতি দুষ্কর। এরা দুজনেই প্রায় এক সময়েই রাজবাড়িতে এসে বাস করছে। সৈরিন্ধ্রী সকল সময়েই বল্লবের সঙ্গে অতি সহৃদয়ভাবে বাক্যালাপ করে, সুদেষ্ণার এই বাক্যে আমার মনে খেদ জন্মায়। আমাকে ক্রুদ্ধ দেখে, সুদেষ্ণা আরও মনে করেন যে আমি তোমার প্রতি অনুরাগিণী। তাঁর কথা শুনে আমার মনে গভীর দুঃখ হয়। যুধিষ্ঠির কৃত এই শোকসাগরে মগ্ন হয়ে আমি আর জীবনধারণ করতে পারছি না।

“একই রথে যিনি দেবতা মানুষ দেবলোককে জয় করেছিলেন, সেই যুবক অর্জুনও এখন বিরাটরাজার কন্যার নৃত্যশিক্ষকের কাজ করছেন। যে অর্জুন খাণ্ডবদাহনে অগ্নিদেবকে পরিতৃপ্ত করেছিলেন, তিনি এখন অন্তঃপুরে কৃপে গুপ্ত অগ্নির মতো বাস করছেন। যাঁর জ্যা নির্ঘোষ শুনলে শত্রুরা কম্পিত হত, তিনি এখন গীতবাদ্যাদির দ্বারা স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জন করছেন। যাঁর পরিঘতুল্য বাহুযুগল ধনুর গুণবর্ষণে কঠিন, তিনি হাতে শাঁখাবালা পরে আছেন। যাঁর মাথায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল কিরীট শোভা পেত, সেই অর্জুন মাথার কেশকে বেণিদ্বারা বেঁধে রাখেন। বেণিকৃতবেশ ও কন্যা পরিবেষ্টিত অর্জুনকে দেখে আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। যে মহাত্মার কাছে সমস্ত স্বর্গীয় অস্ত্র আছে, সেই অর্জুন স্ত্রীধার্য কুণ্ডল কাঁধে বেঁধেছেন। সহস্র সহস্র রাজাও যাঁর সম্মুখবর্তী হতে চান না, সেই অর্জুন নপুংসকের বেশে কন্যাগণের পরিচারক হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পর্বত, বন ও দ্বীপের সঙ্গে স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণীগণ ও সমগ্র পৃথিবী যাঁর রথের শব্দে কম্পিত হত, যাঁর জন্মের পর কুন্তীর সব দুঃখ নষ্ট হয়েছিল, তোমার কনিষ্ঠভ্রাতা সেই অর্জুন আজ আমার শোক জন্মাচ্ছেন। অলংকারে অলংকৃত, শঙ্খবলয়ে আবৃত হস্ত, কনক ও কেয়ূরে সজ্জিত অর্জুনকে দেখলে আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। অতুলনীয় ধনুর্ধর অর্জুন কন্যাগণে পরিবৃত হয়ে গান গাইছেন। ধর্মপরায়ণ, সত্যাশ্রয়ী অর্জুন আজ স্ত্রীবেশে বিকৃত হয়ে আছেন। হস্তিনাপুরে মদস্রাবী হস্তীর মতো অৰ্জুন ধনপতি মৎস্যরাজার উপাসনা করছেন, আমার চোখ যেন অন্ধ হয়ে যায়। অর্জুনের স্ত্রীবেশে জীবনযাপনের কষ্ট তুমি বুঝতে পার না?

“কুন্তীনন্দন! তোমাদের সর্বকনিষ্ঠভ্রাতা, সুবক্তা সহদেব যখন গোপবেশে পথে বিচরণ করেন, তখন লজ্জায় কুণ্ঠায় আমি বিবর্ণ হয়ে যাই। সকলের প্রিয়, সকলের কনিষ্ঠ পাণ্ডুনন্দন সহদেব বিরাটরাজার গোপগৃহে গো-পরীক্ষা ও গোপালন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছেন, এর দুঃখের আগুনে আমি দগ্ধ হতে থাকি। গোরক্ষণাদি কার্য সম্পন্ন করে সহদেব অন্য গোপগণের অগ্রে থেকে যখন বিরাটরাজাকে অভিবাদন করতে যান, তখন আমার যেন জ্বর আসে। আমার শ্বশ্রূ আর্যা কুন্তীদেবী সর্বদাই বীর সহদেবের প্রশংসা করেন। “যাজ্ঞসেনী সহদেব কৌলীন্য অভিমানী, সচ্চরিত্র, সদাচারী, লজ্জাশীল, মধুরভাষী, ধার্মিক কোমল, বীর এবং যুধিষ্ঠিরের অনুগত। তুমি বনমধ্যে রাত্রিতেও সহদেবের ভার বহন কোরো। নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিয়ো। বনে আসার সময় আমাকে আলিঙ্গন করে কুন্তীদেবী এই কথা বলেছিলেন। সেই সহদেব গোরক্ষণে ব্যাপৃত এবং রাত্রিতে গোবৎসগণের সঙ্গে শায়িত থাকে দেখেও আমাকে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

“ভীমসেন তুমি কালের অদ্ভুত বিপর্যয় লক্ষ করো। যিনি সর্বদাই রূপ, অস্ত্রবিদ্যা, বুদ্ধি— এই তিনগুণ সম্পন্ন, সেই নকুল বিরাটরাজার অশ্বরক্ষক হয়েছেন। বন্ধনরজ্জু দিয়ে নকুল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অশ্বদের যখন শিক্ষা দিতে দিতে বিরাটরাজার উপাসনা করতে থাকেন, তখন আমি গভীর দুঃখ অনুভব করি। স্বামী কুন্তীনন্দন, যুধিষ্ঠিরের জন্য আমাকে এত দুঃখ সহ্য করতে হচ্ছে। তোমরা বর্তমান থাকতেও আমি বিশুষ্ক দেহ ও বিবর্ণ হয়ে দুঃখ-জর্জরিত আছি। সৈরিন্ধ্রীবেশে বিরাট রাজভবনে থেকে আমি সুদেষ্ণার শৌচ সম্পাদন করছি। আমি রাজপুত্রী, আমি কালের প্রতীক্ষা করছি। ভর্তাদের সম্পদলাভের জন্য অপেক্ষা করে আছি। মানুষ সম্পন্ন অবস্থায় দান করে আবার দরিদ্র অবস্থায় প্রার্থনা করে। সবল অবস্থায় নিহত করে, আবার দুর্বল অবস্থায় নিহত হয়। যোগ্যতার দ্বারা অন্যকে নিপাতিত করে। অযোগ্যতার সময়ে অন্য কর্তৃক নিপাতিত হয়। তারপর যে ঘটনা মানুষের জয়ের কারণ হয়, সেই ঘটনাতেই তার পরাজয় ঘটে। কালের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই। দৈবকে অতিক্রম করা যায় না, দৈবের দুষ্করও কিছু নেই। আমি পুনরায় সুদৈবের প্রতীক্ষা করছি। দৈব সুসম্পাদিত বিষয়কেও নষ্ট করে, তাই বিজ্ঞ লোক সুদৈবকে আনার চেষ্টা করেন। আমি পাণ্ডবগণের মহিষী এবং দ্রুপদরাজের কন্যা হয়েও এই দুরবস্থা ভোগ করছি, এতে আমি ছাড়া কোন রমণীর জীবিত থাকতে ইচ্ছা করে।

“পাণ্ডুনন্দন, আমার এই কষ্ট প্রত্যক্ষভাবে তোমাদের আশ্রয় করে আছে, ক্রমে কৌরব ও পাণ্ডবদেরও পরিভৃত করবে। বহুতর ভ্রাতা, শ্বশুর ও পুত্র কর্তৃক পরিবেষ্টিতা এবং সম্পত্তিশালিনী অন্য কোন রমণী এমন দুঃখভোগ করে! আমি বাল্যকালে বিধাতার কোন অপ্রিয় কার্য করেছিলাম যে, এতদূর কষ্টভোগ করছি। বনবাসের বারো বছরেও আমার শরীর এতদূর বিবর্ণ হয়নি, এখন যেমন হয়েছে। আমার ইন্দ্রপ্রস্থের জীবন তুমি জানো— সেই আমি এখন পরের দাসী ও অধীন হয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আমি জানি যে আমার এই দুঃখও দৈবকৃত। কারণ, যে দুঃখে, ভয়ংকর ধনুর্ধর ও মহাবাহু পৃথানন্দন অর্জুনও তেজোবিহীন হয়ে সুপ্ত অগ্নির মতো আছেন। আমি এও জানি যে, তোমাদের এই মহাদুঃখ অতিরিক্তই ছিল এবং অতর্কিত ছিল। ইন্দ্রতুল্য তোমরা সর্বদাই যার মুখাপেক্ষী ছিলে, সেই আমি, শ্রেষ্ঠ হয়েও নিকৃষ্ট নারীদের মতো পরের মুখাপেক্ষিণী হয়ে আছি। তোমরা পঞ্চভ্রাতা জীবিত থাকতে, আমার যে অবস্থা ভোগ করার কথা নয় সেই অবস্থা সহ্য করতে হচ্ছে। সসাগরা ধরণী যার বশবর্তিনী ছিল, সেই আমি, রানি সুদেষ্ণার অনুবর্তিনী হয়ে আছি। ভৃত্যেরা যার আগে ও পিছে চলত, সেই আমি রানি সুদেষ্ণার সামনে ও পিছনে চলতে বাধ্য হচ্ছি। যে আমি দেবী কুন্তী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির জন্য, এমনকী নিজের জন্যও গায়ে মাথায় চন্দন পেষণ করিনি, সেই আমাকে অন্যের জন্য গাত্রানুলেপন, পেষণ করতে হচ্ছে। তুমি আমার হাত দেখো, আমার হাতে কড়া পড়ে গেছে। যে আমি কখনও কুন্তীদেবী বা তোমাদের সামনে ভীত হইনি, সেই আমাকে বিরাটরাজার সম্মুখে ভীত হয়ে চলতে হয়। অন্যের ঘষা চন্দন রাজার ভাল লাগে না। এই জন্যই বিরাটরাজার মন্তব্যের জন্য আমি ভীত হয়ে থাকি।”

ভীমের প্রতি অনুরক্তা দ্রৌপদী তাঁর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে রোদন করতে লাগলেন। তারপর নিশ্বাস ত্যাগ করে গদগদ কণ্ঠে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন! আমি কোনওদিন দেবগণের অপ্রিয় কার্যে জড়িত থাকিনি। যে-কারণে অবধারিত মৃত্যু সত্ত্বেও আমি ভাগ্যহীন হয়ে বেঁচে আছি।” তখন বিপক্ষবীরহস্তা ভীমসেন দ্রৌপদীর কড়া-পড়া হাত চোখের সামনে তুলে এনে অনেক চোখের জল ফেললেন। সেই অবস্থায় আবেগে বশীভূত ভীমসেন অশ্রু ত্যাগ করে দ্রৌপদীকে বললেন, “যাজ্ঞসেনী আমার বাহুবল ও অর্জুনের গাণ্ডিবকে ধিক, কারণ তোমার স্বাভাবিক রক্তবর্ণ করতলে কড়া পড়েছে। আমি বিরাটরাজার সভায় কীচককে গুরুতর শাস্তি দিতাম। কিন্তু যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাস সমাপ্তির প্রতীক্ষা করছেন, তাই আমি কিছু করতে পারিনি। তা না হলে আমি খেলার যোগ্য সে মহাহস্তী কীচককে বধ করার জন্য একটি মাত্র পদাঘাত করতাম। যখন তোমাকে কীচক পদাঘাত করল, আমার সমস্ত মৎস্যদেশকে পীড়নের ইচ্ছা হয়েছিল।

“কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন আমাকে কটাক্ষ দ্বারা নিবারণ করলেন। আমি সেই কটাক্ষ বুঝতে পেরেই নিবৃত হলাম।

“তারপর, কৌরবদের সামনেই আমাদের যে রাজ্য ছেড়ে বনবাসে যেতে হয়েছিল এবং পাপাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ, সুবলপুত্র শকুনি ও দুঃশাসনের মস্তক আমি যে দেহচ্যুত করতে পারিনি, তা হৃদয়ে প্রবিষ্ট শল্যের মতো প্রতি মুহূর্তে আমাকে দগ্ধ করছে। তথাপি হে সুনিতম্বে! তুমি ধর্ম নষ্ট কোরো না। তুমি বুদ্ধিমতী নারী। ক্রোধ পরিত্যাগ করো। কারণ, যদি রাজা যুধিষ্ঠির তোমার মুখে এই তিরস্কার শোনেন, তিনি নিশ্চয়ই জীবন ত্যাগ করবেন। তা হলে, অর্জুন, নকুল ও সহদেবও জীবন ত্যাগ করবে এবং এঁরা চলে গেলে আমিও জীবিত থাকতে পারব না। তুমি জানো, পুরাকালে ভৃগুপুত্র চ্যবনমুনি তপস্যা করতে করতে উইপোকার স্থূপে ডুবে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি শান্ত থেকেই বনে গমন করেছিলেন এবং তার ভার্যা সুকন্যাদেবীও স্বামীর অনুসরণ করেছিলেন। তুমি শুনে থাকবে যে, পূর্বকালে নারায়ণমুনির কন্যা রূপবতী চন্দ্রসেনা সহস্র বৎসর ধরে বৃদ্ধপতি মুদ্‌গলমুনির সেবা করেছিলেন। তুমি জাননা যে, জনকরাজার কন্যা বৈদেহী সীতাও মহারণ্যবাসী স্বামী রামচন্দ্রের অনুসরণ করেছিলেন। রামচন্দ্রের প্রিয়তমা সেই সীতাদেবী রাবণ কর্তৃক নিগৃহীতা হয়েও কষ্ট পেতে থেকেই রামের অনুসরণ করেছিলেন। বয়স ও রূপগুণ সমন্বিতা লোপামুদ্রা পিতৃগৃহের সমস্ত মনোহর কাম্যবস্তু ত্যাগ করে মুনিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্যের অনুগমন করেছিলেন। এই সমস্ত নারী যেমন রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন, তুমিও তেমনই সমস্ত গুণসম্পন্না। অতএব পাঞ্চালী, তুমি এই অল্পদিন— অর্থাৎ মাত্র আর পনেরোটি দিন দুঃখ সহ্য করো। তারপর ত্রয়োদশ বৎসর পূর্ণ হলে, তুমি রাজ্ঞীশ্রেষ্ঠা হবে।”

দ্রৌপদী বললেন, “মধ্যমপাণ্ডব! আমি দুঃখে কাতর হয়েই অশ্রুমোচন করেছি, কিন্তু রাজাকে তিরস্কার করছি না। অতীত আলোচনায় এখন আর কোনও ফল নেই। বর্তমানে যে কার্যসম্পাদনের প্রয়োজন তা সম্পন্ন করুন। রাজমহিষী সুদেষ্ণা সর্বদা ভীত হয়ে আছেন যে তাঁর স্বামী বিরাটরাজা আমার রূপে অভিভূত হয়ে না পড়েন। সেই সুযোগে এবং আমাকে রক্ষকহীন দেখে দুরাত্মা কীচক সর্বদাই আমাকে প্রার্থনা করছে। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেও, ক্রোধ সংবরণ করে কামসংমূঢ় কীচককে বলেছিলাম, ‘কীচক! তুমি নিজের জীবন রক্ষা করো। আমি পাঁচজন গন্ধর্বের প্রিয়তমা ভার্যা, তুমি যে সাহস করেছ, তার পরিণতিতে তোমার মৃত্যু ঘটবে’। কীচক স্পর্ধাভরে বলেছিল, ‘সৈরিন্ধ্রী! আমি গন্ধর্বদের ভয় করি না। কারণ শত বা সহস্র গন্ধর্ব যুদ্ধে আসলে, আমি তাদের বধ করতে পারব। তুমি আমার রমণের সময় নির্দিষ্ট করো।’ আমি তখন সেই কামাতুর কীচককে বলেছিলাম, ‘কীচক, বলে তুমি আমার গন্ধর্ব স্বামীদের সমকক্ষ নও। কীচক আমি সর্বদাই ধর্মে রয়েছি এবং কুলশীল সমন্বিতা। সেইজন্য কেউ কাউকে বধ করুক, এ আমি চাই না, তাই তুমি জীবিত আছ’। আমি এ-কথা বললে সেই দুরাত্মা কীচক অট্টহাস্য করে উঠল, কারণ সে সৎপথে থাকে না, ধর্মেও তার মতি নেই। পাপিষ্ঠ, পাপকর্মা, কামবশীভূত, অবিনীত ও দুরাত্মা কীচককে বারবার আমি প্রত্যাখ্যান করব। সে-ও দেখা হলেই আমাকে প্রহার করবে, যাতে আমি জীবন ত্যাগই করব; তা হলে তোমরা ধৰ্মার্জনে যত্নশীল থেকেই তোমাদের সর্বধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে। যদি তোমরা অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকো, তবে তোমাদের ভার্যা থাকবে না। ভার্যাকে রক্ষা করলে, সন্তানও রক্ষিত হয়। সন্তান রক্ষিত হলে, নিজেরও রক্ষা হয়ে থাকে, কারণ প্রাণী নিজে সন্তানরূপে ভার্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। এইজন্যেই পণ্ডিতেরা ভার্যাকে ‘জায়া’ বলে থাকেন। আবার ভর্তা কী ভাবে আমার উদরে জন্মাবেন, তা ভেবে ভার্যাও ভর্তাকে রক্ষা করবেন। আমি ব্রাহ্মণদের কাছে এই ধর্ম শুনেছি।

“ক্ষত্রিয়দের ধর্ম হল সর্বদা শত্ৰু নির্যাতন করা। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও আপনার উপস্থিতিতেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে। আপনি ভয়ংকর জটাসুরকে বধ করে আমাকে তার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। অন্য ভ্রাতাদের সঙ্গে নিয়ে আপনি জয়দ্রথকে পরাজিত ও বন্দি করে আমাকে স্পর্শ করার শাস্তি দিয়েছিলেন। এখন এই কীচক, আমাকে ক্রমাগত অপমানিত করছে, আপনি সেই কীচককেও সংহার করুন। ভীমসেন রাজার শ্যালক ও প্রিয় বলেই কীচক আমার উপর অত্যাচার করতে সাহসী হচ্ছে। মাটির কলসিকে যেমন পাথরের উপর আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়, কাম অসংযত কীচককে বধ করুন। যে কীচক আমার বহুতর দুঃখের কারণ, সেই কীচক জীবিত থাকতে যদি কাল প্রভাতে সূর্যোদয় ঘটে, তবে আলোড়িত বিষ পান করব, কিন্তু কিছুতেই কীচকের কাছে ধরা দেব না।” এই বলে দ্রৌপদী শেষ শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘তোমার সম্মুখেই আমার মৃত্যু ভাল’। এ-কথা উচ্চারণ করেই দ্রৌপদী ভীমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও রোদন করতে লাগলেন। ভীম তাঁকে আলিঙ্গন করে, বারংবার সান্ত্বনা দিতে দিতে ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করতে থেকে কীচককে স্মরণ করতে লাগলেন। তারপর ভীমসেন দ্রৌপদীকে বললেন—

তথা ভদ্রে! করিষ্যামি যথা ত্বং ভীরু! ভাষসে!

অদ্য তং সুদয়িষ্যামি কীচকং সহবান্ধবম ॥ বিরাট : ২০ : ১ ॥

“ভদ্রে! ভীরু! তুমি যেমন বললে, আমি তাই করব। অদ্যই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেই কীচককে বধ করব।

“দ্রুপদরাজনন্দিনী, তুমি দুঃখ ও শোক পরিত্যাগ করে আগামীকাল সূর্যাস্তের পর প্রদোষকালে সংকেতালাপের জন্য কীচকের সঙ্গে দেখা করো। মৎস্যরাজের এই রাজ্যে একটি সুন্দর নৃত্যশালা আছে। দিনের বেলায় কন্যারা সেখানে নাচ শেখে এবং রাত্রিতে চলে যায়। সেই নৃত্যশালার ভিতরে একটি লৌহনির্মিত খাট পাতা আছে, তার উপর সুন্দর শয্যা পাতা আছে। আমি সেখানেই থেকে কীচককে বধ করে, তার মৃত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাব। কীচকের সঙ্গে তোমার আলাপের সময় কেউ যেন তোমাকে না দেখে, এবং কীচক যাতে অবশ্যই নৃত্যশালায় আসে তার ব্যবস্থা কোরো।”

দুঃখিতা দ্রৌপদী ও ভীমসেন এই আলোচনা করে, উভয়েই চোখের জল মুছে প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। পরদিন রাত্রি প্রভাত হলেই শয্যাত্যাগ করে কীচক রাজভবনে গিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, সভার মধ্যে রাজার সামনে তোমাকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করেছিলাম। কিন্তু আমি প্রবল বলে তোমাকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ, এই বিরাট কেবল কথা ও নামে মাত্রই মৎস্যদেশের রাজা, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সেনাপতি বলে আমিই রাজা। তুমি অনায়াসে আমাকে লাভ করো এবং আমি তোমার দাস হই। আমি এখনই তোমাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা দান করছি। এ ছাড়াও আমি তোমাকে একশো দাসী, একশো দাস, অশ্বতরী যুক্ত একটি রথ দেব! আমাদের সঙ্গম হোক!”

দ্রৌপদী বললেন, “কীচক, তুমি আমার কাছে শপথ করো যে, তোমার বন্ধুরা বা ভ্রাতারা কেউ আমার সঙ্গে তোমার সঙ্গম জানতে পারবে না। কারণ যশস্বী গন্ধর্ব স্বামীদের আমি ভীষণ ভয় করি। সতরাং আগে তূমি গোপনীয়তা বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করো, তারপর আমি তোমার বশবর্তিনী হব।

কীচক বলল, “ভীরু! তুমি যেমন বললে তেমনই আমি করব। তোমার কদলী সদৃশ উরু! আমি কামমুগ্ধ। সুতরাং তোমার সঙ্গে সঙ্গমের জন্য আমি একাকীই তোমার শূন্যগৃহে যাব, সূর্যতুল্য তেজস্বী গন্ধর্ব স্বামীরা জানতেও পারবেন না।”

দ্রৌপদী বললেন, “বিরাটরাজার নৃত্যশালায় কন্যারা দিনের বেলায় নৃত্য করে এবং রাত্রিতে আপন গৃহে চলে যায়। তুমি অন্ধকারে এ-গৃহে যাবে; গন্ধর্বরা তা জানতেও পারবেন না। তা হলেই দোষ কেটে যাবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

কীচকের সঙ্গে এই আলাপের পর দ্রৌপদীর পক্ষে দিনের অবশিষ্ট অর্ধাংশ যেন এক মাসের তুল্য দীর্ঘ বলে বোধ হতে লাগল। মূঢ় কীচক গৃহে ফিরে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আকুল হয়ে পড়ল; মৃত্যুরূপিণী সৈরিন্ধ্রীর আহ্বান সে বুঝতে পারল না। কামমুগ্ধ কীচক সমস্ত দিন গন্ধ, মাল্য, অলংকারে আপনাকে সুসজ্জিত করতে লাগল। কীচকেরও যেন দিনের অবশিষ্ট অংশ দীর্ঘকালের মতো বোধ হতে লাগল। নেভার আগে প্রদীপের সলতের মতো তার আগুন অনেক বেশি কান্তিমান হয়ে উঠল। কামমুগ্ধ কীচক দ্রৌপদীর কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এবং দ্রৌপদীর সঙ্গে তার সঙ্গমের চিন্তা করতে করতে তার যে দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাও বুঝতে পারল না।

দ্রৌপদী কীচকের সঙ্গে আলাপের পর স্বামী ভীমসেনের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং জানালেন যে, ভীমসেনের নির্দেশ মতোই নৃত্যশালায় কীচকের সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন। দ্রৌপদী ভীমসেনের কাছে প্রার্থনা জানালেন যে, ভীমসেন একাকী শূন্য নৃত্যশালায় আগত কীচককে সেইদিনই বধ করেন। দ্রৌপদী বললেন, ওই কীচক দর্পবশত আমার গন্ধর্ব স্বামীদের অবজ্ঞা করেন। অতএব বীরশ্রেষ্ঠ, হস্তী যেমন শস্যের মূল উৎপাটিত করে, আপনিও কীচকের দেহ থেকে প্রাণ উৎপাটিত করুন। নিজের ও নিজের বংশের নাম রাখুন। আপনার মঙ্গল হোক।”

ভীম বললেন, “তুমি সুখে এসেছ তো? তুমি আমাকে জানালে, সেই বিষয়ে আমি অন্য কোনও ব্যক্তির সহায়তা চাই না। হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করে আমার যে আনন্দ হয়েছিল আজ কীচকের সঙ্গে সম্মিলনে সেই আনন্দই হবে। সত্য, ধর্ম ও ভ্রাতৃগণকে সম্মুখে রেখে তোমাকে বলছি যে, ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, আজ কীচককে আমি বধ করব। তারপর সমস্ত মৎস্যদেশীয় যোদ্ধারা এলেও তাদের বধ করব। তারপর দুর্যোধনকে বধ করে রাজ্যলাভ করব। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির ইচ্ছানুসারে বিরাটরাজের উপাসনা করুন।”

দ্রৌপদী বললেন, “স্বামী, বীর, আমার জন্য তুমি সত্য পরিত্যাগ কোরো না। গুপ্ত অবস্থাতে থেকেই পাপাত্মা কীচককে বধ করো।”

ভীম বললেন, “অনিন্দিতে! ভীরু! তুমি যেমন বললে, তেমনই হবে। আজ রাত্রে আমি গুপ্ত অবস্থাতে থেকেই কীচককে বধ করব। তুমি কীচকের পক্ষে অলভ্যা, তবুও দুরাত্মা কীচক তোমাকে লাভ করার ইচ্ছা করছে। অতএব হস্তী যেমন বেলফল চূর্ণ করে, কীচকের মস্তকও তেমনই চূর্ণ করব।”

সেদিন রাত্রিতে, ভীম গুপ্তভাবে নৃত্যশালায় গিয়ে, সিংহ যেমন গুপ্ত থেকে হরিণের অপেক্ষা করে, তেমন কীচকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দ্রৌপদীর অসম্মানে ভীম ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং কীচকের মৃত্যুরূপে নৃত্যশালায় শুয়েছিলেন। এই অবস্থায় কীচক গিয়ে তাঁকে স্পর্শ করলেন এবং কামমুগ্ধ ও আনন্দে অস্থিরচিত্তে কাছে গিয়ে অল্প হাস্য করতে করতে কীচক বললেন, “সুন্দরী তোমার জন্য বহু রত্ন বহু দাসদাসী ও মূল্যবান বস্ত্র ও অপরিমিত দ্রব্য তোমার গৃহে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। আমার পুরস্ত্রীরা সকলে আমাকে প্রশংসা করেছে যে, তোমার মতো সুবসন ও সুদৃশ্য অন্য কোনও পুরুষ মানুষ নেই।” :

ভীম বললেন, “কীচক! তুমি আমার ভাগ্যে সুদৃশ্য হয়েছ এবং আমার ভাগ্যেই আত্মপ্রশংসা করেছ।” এই কথা বলে মহাবাহু ও অত্যন্ত পরাক্রমশালী কুন্তীনন্দন তখনই উঠে দাঁড়িয়ে কীচককে বললেন, “পাপিষ্ঠ! সিংহ যেমন পর্বতপ্রমাণ মহাহস্তীকে ভূতলে ফেলে টান মারে তোকে আজ আমি তেমনই ভূতলে ফেলে টান মারতে মারতে বধ করব এবং এই অবস্থায় তোর ভগ্নী তোকে দেখবে। তারপর আমি তোকে বধ করলে সৈরিন্ধ্রী নিরুপদ্রবে বিচরণ করবে এবং সৈরিন্ধ্রীর স্বামীরা নিশ্চিন্ত সুখে বিচরণ করবেন।”

তারপর মহাবল ভীমসেন কীচকের মাল্যভূষিত কেশপাশ ধারণ করলেন, তখন বলবান কীচকও বলপূর্বক আপন কেশপাশ ছাড়িয়ে নিয়ে ভীমের বাহুযুগল ধারণ করলেন। বসন্তকালে হস্তিনীর জন্য বলবান হস্তীদ্বয়ের মতো ভীম ও কীচকের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হল। পূর্বকালে বালী ও সুগ্রীবের মধ্যে যেমন সংগ্রাম হয়েছিল, ভীম ও কীচকের মধ্যে তেমনই ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হল। বিষতুল্য ক্রোধে উন্মত্ত ভীম ও কীচক পঞ্চমস্তক সর্পের মতো বাহুদ্বয় উত্তোলন করে, তীক্ষ্ণ দন্তের ন্যায় নখ দ্বারা পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। বলবান কীচক ভীমকে বেগে আঘাত করলেও ভীম স্থিরদেহে সে আঘাত সহ্য করলেন, এক পদও নড়লেন না। তখন দু’জনেই পরস্পরকে আঘাত করে, পরস্পরকে আকর্ষণ করে, দুটি ক্রুদ্ধ বৃষের ন্যায় প্রকাশ পেতে লাগলেন। নখ ও দন্তরূপ দুই অস্ত্রের সহায়তায় দুটি ব্যাঘ্রের মতো গর্বিত ভীম ও কীচকের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। তারপর একটা হস্তী যেমন শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে অন্য মদস্রাবী হস্তীকে আকর্ষণ করে, ক্রুদ্ধ কীচক রেগে গিয়ে ভীমসেনকে তেমন করে ধারণ করলেন। বলবান ভীমসেনও কীচককে ধারণ করলেন। তখন কীচক প্রচণ্ড বেগে ভীমসেনকে ধাক্কা মারল। তখন বলবান ভীম ও কীচক দুজনের বাহুর সংঘর্ষে যুদ্ধস্থানে বাঁশ ফাটার মতো ভয়ংকর শব্দ হতে লাগল। তারপর ভীমসেন সবলে কীচককে একটা ধাক্কা দিয়ে, ঘূর্ণিবায়ু যেমন বৃক্ষকে ধরে, কীচককে তেমনই ধরে গৃহমধ্যে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণিত করতে লাগলেন। কীচক ক্রমশ দুর্বল হতে থেকে, সমস্ত শক্তি দিয়ে ভীমসেনকে আকর্ষণ করতে লাগল এবং ভীমসেনের হাত থেকে অল্প নির্গত হয়ে কীচক জানু দ্বারা ভীমসেনকে আঘাত করে ভূতলে ফেলে দিল। মুহুর্তমধ্যে দণ্ডপাণি যমের মতো ভীম উঠে দাঁড়ালেন এবং সেই নির্জন রাত্রে পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করতে লাগলেন। নৃত্যশালা প্রকম্পিত হতে লাগল; ভীম ও কীচক দু’জনেই গর্জন করতে থাকলেন। ভীমসেন দু’হাতে কীচকের বক্ষে আঘাত করলেন কিন্তু কীচক অবিচলিতই রইল। যদিও কীচক মুহূর্তমাত্র কাল ভূতলে থেকে ক্রমশ দুর্বল হতে লাগল। মহাবল ভীমসেন কীচককে বলহীন বুঝতে পেরে, তাকে অচেতনপ্রায় অবস্থায় বক্ষে ধারণ করে প্রচণ্ড পেষণ করতে লাগলেন। যুদ্ধবিজয়ী ভীম ক্রোধাবিষ্ট হয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে আবার দৃঢ়ভাবে কীচকের কেশ আকর্ষণ করতে লাগলেন। মাংসভোজন অভিলাষী ব্যাঘ্ৰ মহামৃগ ধারণ করে যে গর্জন করে, ভীম সেই প্রচণ্ড গর্জন করতে লাগলেন। মানুষ যেমন গলায় দড়ি বেঁধে পশুকে টানতে টানতে নিয়ে যায়, ভীমসেন কীচককে পরিশ্রান্ত বুঝে তাকে বাহু দ্বারা বেঁধে ফেললেন। কীচক তখন ছটফট করতে করতে অচেতন হয়ে পড়ল এবং বিদীর্ণ ভেরির মতো গুরুতর শব্দ করতে লাগল। সেই অবস্থায় ভীমসেন তাতে বহুবার ঘোরাতে লাগলেন। পরে ভীমসেন দ্রৌপদীর ক্রোধ নিবারণের জন্য বাহুযুগল দ্বারা ধারণ করে কীচকের গলায় পীড়ন করতে লাগলেন এবং পশুর মতো তাকে বধ করলেন। তারপর ভীমসেন গর্জন করে বললেন, “ভার্যার উপর পদাঘাতকারী এবং সৈরিন্ধ্রী-রূপিণী সেই ভার্যার শত্রুকে বধ করে আজ আমি ভ্রাতাদের কাছে ঋণী না থেকে পরম শান্তি লাভ করব।” এই বলে ক্রোধে আরক্তনয়ন ভীম কীচককে পরিত্যাগ করলেন। কীচকের বস্ত্র ও অলংকার খুলে গিয়েছিল। নয়ন ঘুরতে ঘুরতে প্রাণ বার হয়ে গেল। তারপর মানসিক ও কায়িক বলিশ্রেষ্ঠ ক্রুদ্ধ ভীমসেন দুই ঠোঁট চেপে হাতে হাত ঘষে পুনরায় কীচককে আক্রমণ করলেন। পূর্বকালে মহাদেব যেমন করেছিলেন, তেমনই কীচকের পদদ্বয়, হস্তদ্বয়, মস্তক ও গ্রীবা তার শরীরের ভিতর সমস্তটাই প্রবেশ করিয়ে দিলেন।

তারপর মহাবল ভীমসেন দ্রৌপদীকে ডেকে মথিত সর্বাঙ্গ ও মাংসপিণ্ডের ন্যায় কৃত সেই কীচকটাকে দেখালেন। তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, “পাঞ্চালী এসো, আমি কামুকটাকে কেমন করেছি তা দেখো।” এই বলে ভীমসেন পাকগৃহে চলে গেলেন। নারীশ্রেষ্ঠ দ্রৌপদী কীচককে বধ করিয়ে আনন্দিত ও নির্ভয় হয়ে সভারক্ষকদের গিয়ে বললেন, “সভারক্ষকগণ পরস্ত্রীকামুক কীচক আমার পতি গন্ধর্বগণ কর্তৃক নিহত হয়ে পড়ে আছে। তোমরা যাও, গিয়ে দেখে এসো।”

দ্রৌপদীর কথা শুনে নৃত্যশালার রক্ষক তৎক্ষণাৎ অনেকগুলি মশাল জ্বালিয়ে নৃত্যশালার ভিতরে ভূতলে গিয়ে ভূতলে পতিত, রক্তাক্ত ও প্রাণহীন অবস্থায় কীচককে দর্শন করল। এর গলা, পা দুটি কোথায়, হাত দুটি কোথায়, এবং মাথাই বা কোথায়? এই বলে তারা গন্ধর্ব-নিহত কীচককে অনুসন্ধান করতে লাগল।

এই সময়ে কীচকের সমস্ত বন্ধুবান্ধব সেই স্থানে এসে কীচককে সেই অবস্থায় দেখে রোদন করতে লাগল। কীচকের সমস্ত অঙ্গ শরীরের ভিতরে প্রবিষ্ট ছিল। তাঁকে একটা কচ্ছপের মতো দেখাচ্ছিল। তখন ইন্দ্র দ্বারা চূর্ণিত মহাদানবের মতো ভীম কর্তৃক চূর্ণিত কীচকের মাংসপিণ্ড দেখার জন্য ও দাহ করার জন্য তার বন্ধুরা বাইরে নিয়ে এসে দেখল যে, অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদী একটি স্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। উপকীচকরা সেই অবস্থায় দ্রৌপদীকে দেখে বলল, “যার জন্য কীচক নিহত হয়েছেন, সেই অসতীটাকে শীঘ্র দাহ করো। কামী কীচকের সঙ্গে একে দাহ করে হত্যা করা হবে। কারণ তাতে মৃত কীচকের অত্যন্ত প্রিয়কার্য করা হবে।”

তখন সেই উপকীচকরা বিরাটরাজাকে গিয়ে বলল, “মহারাজ! এই নারীর জন্যই কীচক নিহত হয়েছেন। সুতরাং এর সঙ্গে কীচককে দাহ করা হোক। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” বিরাটরাজা উপকীচকদের পরাক্রম স্মরণ করে সৈরিন্ধ্রীকে দাহ করায় অনুমোদন দিলেন। কীচকরা তখনই গিয়ে ভীতা, অত্যন্ত মোহিতা, কমলনয়না দ্রৌপদীকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করলেন, তারপর তারা সকলে সুনিতম্বা দ্রৌপদীকে বেঁধে তুলে নিয়ে শ্মশানের দিকে চলল। উপকীচকরা ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে থাকলে অনিন্দিতা দ্রৌপদী পতিশালিনী হয়েও রক্ষক লাভের আশায় চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, “জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন ও জয়দ্বল— যে যেখানে আছ, তাঁরা আমার বাক্য শ্রবণ করো— উপকীচকরা আমাকে দগ্ধ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। মহাযুদ্ধে বলবান ও তেজস্বী যে গন্ধর্বগণের বজ্ৰশব্দতুল্য ধনুষ্টংকার, ভীষণ সিংহনাদ ও গুরুতর রথের ধ্বনি শোনা যেত, সেই গন্ধর্বরা আমার কথা শোনো— উপকীচকরা আমাকে দগ্ধ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।” ভীমসেন চিৎকার করে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, তোমার কথা শুনেছি। তোমার উপকীচকদের কাছ থেকে কোনও ভয় নেই।” জিঘাংসায় জ্বলতে জ্বলতে ভীমসেন পাচকের বেশ পরিত্যাগ করে, দীর্ঘবস্ত্র পরে, অদ্বার দিয়ে লাফিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ দ্রুত গিয়ে প্রাচীরের উপর উঠে, যেদিকে উপকীচকরা গিয়েছিল, সেই শ্মশানের দিকে যাবার ইচ্ছা করলেন এবং লাফিয়ে অতি দ্রুত গিয়ে সেই কীচকদের সামনে উপস্থিত হলেন। চিতার কাছে গিয়ে ভীমসেন দেখলেন সেখানে তালগাছের মতো একটি বড় গাছ আছে। তার গুড়ি বিশাল এবং উপরিভাগ শুষ্ক হয়ে গেছে। হস্তীর ন্যায় বাহুযুগল দ্বারা জড়িয়ে ধরে সেই গাছটাকে ভীমসেন উপড়ে নিজের কাঁধে ফেললেন। যমের মতো সেই বৃহৎ বৃক্ষ নিয়ে উপকীচকদের দিকে ছুটে গেলেন। সিংহের মতো ক্রুদ্ধ সেই গন্ধর্বরূপী ভীমকে দেখে উপকীচকরা বিপদে ও ভয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। “বলবান গন্ধর্ব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বৃক্ষ উত্তোলন করে আসছে। অতএব সত্বর সৈরিন্ধ্রীকে ছেড়ে দাও।” ভীমসেন তখন মাথার উপর বৃক্ষ ঘোরাচ্ছেন দেখে উপকীচকরা রাজধানীর দিকে পালাতে লাগল। ইন্দ্র যেমন দানবদের বধ করেছিলেন, তেমনই ভীমসেন সেই একশো পাঁচজন উপকীচককে যমালয়ে পাঠালেন। দ্রৌপদীকে মুক্ত করে, আশ্বস্ত করে বললেন, “যারা বিনা অপরাধে তোমাকে হিংসা করে, আমি তাদের এইভাবেই বধ করে থাকি। তুমি রাজধানীতে ফিরে যাও, কোনও ভয় নেই, আমিও অন্য পথে বিরাটরাজার পাকস্থানে যাব।” ভীম কর্তৃক নিহত সেই একশো পাঁচজন উপকীচক, ছিন্ন পতিতবৃক্ষ মহাবলের মতো সেইখানে পড়ে রইল। কীচক ও উপকীচক মিলিয়ে মোট একশো ছ’জন ভীম কর্তৃক নিহত হল।

পরদিন নরনারীগণ নিহত কীচকদের দেখে বিরাটরাজার কাছে গিয়ে বলল, “মহারাজ! গন্ধর্বরা সকল কীচককেই বধ করেছে। নিহত কীচকদের মস্তক বজ্র দ্বারা বিদীর্ণ পর্বতের বিশাল মস্তকের মতো ইতস্তত ছড়ানো আছে। আর সৈরিন্ধ্রীও মুক্ত হয়ে আপনার গৃহে ফিরে এসেছে। অতএব মহারাজ, আপনার সমগ্র রাজধানীই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কারণ, সৈরিন্ধ্রী পরমাসুন্দরী, আর গন্ধর্বরাও পরম শক্তিশালী। আবার ভোগ্যবস্তু মৈথুনের জন্যই পুরুষদের অভীষ্ট। সুতরাং সৈরিন্ধ্রীর জন্য আপনার রাজধানীর সম্পূর্ণ বিনাশের সম্ভাবনা আছে। দ্রুত এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”

বিরাটরাজা সেই সেনাপতি কীচক ও তার ভ্রাতাদের সর্বপ্রকার রত্ন ও গন্ধদ্রব্য সংযুক্ত অবস্থায় এক প্রজ্বলিত অগ্নিতে দাহ করবার আদেশ করলেন। তারপর বিরাটরাজা ভীত হয়ে মহিষী সুদেষ্ণাকে বললেন, “মহিষী আমার ইচ্ছা অনুসারে সৈরিন্ধ্রী রাজবাটীতে ফিরে এলে তুমি তাকে বলবে যে, সৈরিন্ধ্রী যেন এই রাজবাটী ছেড়ে চলে যায়। কারণ, সুনিতম্বে, রাজা গন্ধর্বদের বিষয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছেন। ভীত রাজা তোমাকে এ-কথা বলার সাহস করছেন না। তবে স্ত্রীলোক এ-কথা বলায় দোষ হয় না। অতএব আমিই তোমায় বলতে বাধ্য হচ্ছি।”

ওদিকে ভীমসেন কীচক ও তার ভ্রাতাদের বধ করলে, দ্রৌপদী নির্ভয়ে জলে সমস্ত অঙ্গ ও বক্ষযুগল ধুয়ে, আগে ব্যাঘ্রের ভয়ে ভীতা কিন্তু পরে একান্ত নির্ভয়ে বালিকার ন্যায় দ্রুতপদে রাজধানীর দিকে যেতে লাগলেন। তাঁকে দেখে লোক চোখ বন্ধ করে রাস্তায় চলতে লাগল। পাকগৃহের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী ভীমসেনকে দেখে ঈষৎ হাস্যের সঙ্গে সংকেতে বললেন, “যিনি আমাকে মুক্ত করে দিয়েছেন, সেই গন্ধর্ব রাজাকে নমস্কার করি।” উত্তরে ভীম তাঁকে বললেন, “তোমার বশবর্তী পুরুষেরা এই নগরে দুঃখের সঙ্গে বাস করলেও আজ তাঁরা ঋণশোধের পর সুখে বাস করছেন।”

তখন দ্রৌপদী দেখলেন, মহাবাহু অর্জুন নৃত্যশালার ভিতরে বিরাটরাজার কন্যাদের নৃত্যশিক্ষা দিচ্ছেন। সেই কন্যারা অর্জুনের সঙ্গে নৃত্যশালার বাইরে এসে বিনা অপরাধে ক্লিষ্টা দ্রৌপদীকে আসতে দেখলেন। তখন সেই কন্যারা বলল, “সৈরিন্ধ্রী, ভাগ্যবশত তুমি মুক্ত হয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছ এবং বিনা অপরাধে যারা তোমার অনিষ্ট করতে চেয়েছিল, তাদের মৃত্যু ঘটেছে।” বৃহন্নলা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, তুমি কীভাবে মুক্ত হলে, কীভাবে সেই পাপী কীচকরা নিহত হল, আমাকে সমস্ত খুলে বলো।”

দ্রৌপদী বললেন, “কল্যাণী বৃহন্নলে! তুমি এখন সৈরিন্ধ্রীর কী উপকার করবে। তুমি সর্বদাই কন্যাপুরে সুখে বাস করছ, সৈরিন্ধ্রীর অশেষ দুঃখ তুমি বুঝতেই পারবে না। তুমি তো সুখেই আছ।” বৃহন্নলা বললেন, “কল্যাণী, বৃহন্নলাও গুরুতর দুঃখ ভোগ করছে। সে পশুর মতন জীবনযাপন করছে, তুমি তা বুঝতে পারছ না। আমি সমস্ত সময়ে তোমার সঙ্গে বাস করছি। নির্দোষ তুমি দুঃখ পেতে থাকলে, কে-না দুঃখ ভোগ করবে। অপরের মনের কথা মানুষ বুঝতে পারে না, তুমিও আমার মনের কথা বোঝো না।”

তখন দ্রৌপদী সেই কন্যাদের সঙ্গেই রানি সুদেষ্ণার কাছে পৌঁছোলেন। সুদেষ্ণা বিরাটরাজার আদেশ অনুসারে তাঁকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী তুমি যেখানে তোমার ইচ্ছা চলে যাও। রাজা তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের ভয় পাচ্ছেন। তুমি যুবতী এবং অতুলনীয়া রূপবতী। তোমার মঙ্গল হোক, তুমি চলে যাও।” সৈরিন্ধ্রী বললেন, “ক্রুদ্ধা রানি, রাজা আর মাত্র তেরোটি দিন আমাকে ক্ষমা করুন। তাতেই আমার স্বামীরা কৃতকার্য হবেন। তারপর তাঁরা আমাকে নিয়ে যাবেন, আপনার প্রিয়কার্য করে নিশ্চয়ই রাজাকে মঙ্গলযুক্ত করবেন।”

সন্ধি বিরোধী-দ্রৌপদী

অজ্ঞাতবাসের ত্রয়োদশ বৎসর শেষ হতে চলল। দুর্যোধনের গুপ্তচরেরা কোথাও পাণ্ডবদের খোঁজ পেল না। ইতিমধ্যে দুর্যোধনের সভায় সংবাদ এসে পৌঁছোল, গন্ধর্ব কতৃক বিরাটরাজার সেনাপতি মহাবলী কীচকের মৃত্যু ঘটেছে। কীচকের চিরশত্রু সুশৰ্মা এই সংবাদে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। স্থির হল যে, কৌরবপক্ষ বিরাটরাজার লক্ষ লক্ষ গোধন হরণ করবেন। দুই দলে বিভক্ত হয়ে কৌরববাহিনী মৎস্যদেশের দিকে যাত্রা করলেন। এক দিকে থাকলেন ভীষ্মের নেতৃত্বে সমস্ত কৌরবপক্ষীয় প্রধান বীরগণ— অন্যদিকে সুশর্মার নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যেরা বিরাট রাজ্য আক্রমণ করল। ভীম এবং যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধ ক্ষমতায় বিরাটরাজা যুদ্ধে সুশর্মাকে পরাজিত করলেন। অন্য দিকে ভীষ্মের নেতৃত্বে কৌরবেরা মৎস্যরাজ্যের গোধন হরণ করলেন। রাজধানী রক্ষার জন্য তখন বিরাটরাজপুত্র উত্তর ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। উপযুক্ত সারথি নেই, এই অজুহাতে উত্তর যুদ্ধযাত্রার চেষ্টাই করলেন না। তখন সৈরিন্ধ্রীরূপিণী দ্রৌপদী নৃত্যশালায় এসে অর্জুনকে ভাববক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দিলেন, অজ্ঞাতবাসের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, এইবার আত্মপ্রকাশের পালা। নানা কৌতুককর কর্ম করে, উলটো বর্ম পরে অর্জুন উত্তরের সারথি হয়ে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে রাজপুত্র উত্তর অর্জুনের আসল পরিচয় জানতে পারলেন, শমীবৃক্ষে লুকোনো পাণ্ডবদের অস্ত্রশস্ত্র দেখলেন। অভিভূত হয়ে সারথ্যভার নিজের হাতে তুলে নিলেন এবং অর্জুনের নির্দেশিত পথে রথ চালিয়ে দিলেন। একা অর্জুন সমস্ত কৌরবপক্ষকে পরাজিত করে, রাজকুমারী উত্তরার অভিলাষ অনুযায়ী ভীষ্ম ব্যতীত সকল বীরের উষ্ণীষ উত্তরার খেলার জন্য নিয়ে যুদ্ধজয়ী হয়ে ফিরে এলেন। এর তিন দিন পরে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাস শেষ করে আত্মপ্রকাশ করলেন। কৃতজ্ঞ, আনন্দে আপ্লুত বিরাটরাজা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ দিতে চাইলেন। অর্জুন উত্তরার স্বামী হিসাবে আপন পুত্র অভিমন্যুকে নির্বাচিত করলেন। মহাসমারোহে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ বলরামেরা আসলেন। পাণ্ডবদের হৃতরাজ্য ফিরে পাবার জন্য সভা হল। বিরাটরাজার পুরোহিত সেই প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনায় গেলেন, কিন্তু দুর্যোধন প্রত্যাখ্যান করলেন। হস্তিনাপুর থেকে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে পাঠালেন শান্তির প্রস্তাব দিয়ে, কিন্তু রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা বললেন না। স্থির হল যে, কৃষ্ণ স্বয়ং সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনায় যাবেন, তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলে যুদ্ধ অনিবার্য হবে। যে-সভায় এই প্রস্তাব নেওয়া হল, সে-সভায় পাণ্ডবপক্ষীয় প্রধান বীরেরা তো বটেই, এমনকী ভীমসেনও যুদ্ধ অপেক্ষা শান্তি ভাল— এই প্রস্তাব করলেন। অন্য সকলের প্রস্তাব শোনার পর দ্রৌপদী রুখে দাঁড়ালেন।

অশ্রুপূর্ণ নয়নে দ্রৌপদী বললেন, “মধুসূদন, তুমি জানো যে দুর্যোধন শঠতা করে পাণ্ডবগণকে রাজ্যচ্যুত করেছে। ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায়ও সঞ্জয়ের মুখে শুনেছ। যুধিষ্ঠির পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন, দুর্যোধন সে-অনুরোধও গ্রাহ্য করেনি। রাজ্য না দিয়ে সে যদি সন্ধি করতে চায়, তবে তুমি সম্মত হোয়ো না, পাণ্ডবগণ তাঁদের মিত্রদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুর্যোধনের সৈন্য বধ করতে পারবেন। তুমি কৃপা কোরো না, সাম বা দান নীতিতে যে শত্রু শান্ত হয় না, তার উপর দণ্ডপ্রয়োগই বিধেয়। এই কার্য পাণ্ডবদের কর্তব্য, তোমার পক্ষে যশস্কর, ক্ষত্রিয়দেরও সুখকর। ধর্মজ্ঞেরা জানেন, অবধ্যকে বধ করলে যে দোষ হয়, বধ্যকে বধ না করলে সেই দোষ হয়। জনার্দন যজ্ঞবেদি থেকে আমার উৎপত্তি, আমি দ্রুপদরাজার কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, তোমার প্রিয়সখী, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধু, পঞ্চ ইন্দ্রতুল্য পঞ্চপাণ্ডবের মহিষী, আমার মহারথ পঞ্চপুত্র তোমার কাছে অভিমন্যুর সমান। কেশব তোমরা জীবিত থাকতে আমি দূত্যসভায় পাণ্ডবদের সমক্ষেই নিগৃহীত হয়েছি। এঁদের নিশ্চেষ্ট দেখে আমি ‘গোবিন্দ রক্ষা করো’ বলে তোমাকে স্মরণ করেছি। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের বরে এঁরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে বনবাসে যাত্রা করেন। ধিক অর্জুনের ধনুর্ধারণ, ধিক ভীমসেনের বল, দুর্যোধন মুহূর্তকালও জীবিত আছে।”

এই কথা বলে অসিতনয়না কৃষ্ণা তাঁর কোমল কৃষ্ণবর্ম কুঞ্চিতাগ্র সুন্দর সর্বলক্ষণযুক্তা সর্বগন্ধাধিবাসিত মহাভুজগসদৃশ বেণি বাম হস্তে ধরে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বললেন, “পুণ্ডরীকাক্ষ, তুমি যখন শত্রুদের সঙ্গে সন্ধির কথা বলবে, তখন যদি দীনভাবে সন্ধি-কামনা করেন তা হলেও তুমি সর্বদা এই বেণি স্মরণ কোরো, যা দুঃশাসন হাত দিয়ে টেনেছিল। ভীমার্জুন কৌরবদের সঙ্গে সন্ধি চাইছেন—

পঞ্চচৈব মহাবীৰ্যাঃ পুত্রা মে মধুসূদন।

অভিমন্যুং পুরস্কৃত্য যোৎসন্তে কুরুভি সহ || উদ্‌যোগ : ৭৬ : ৩৮ ||

“আমার বৃদ্ধ পিতা ও তার মহারথ পুত্রগণ কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন।

“অভিমন্যুকে অগ্রবর্তী করে আমার পাঁচ বীর পুত্রও যুদ্ধ করবে। দুঃশাসনের শ্যামবর্ণ বাহু যদি ছিন্ন ও ধূলিলুণ্ঠিত না দেখি তা হলে আমার হৃদয় শান্ত হবে কী করে? প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় ক্রোধ নিরুদ্ধ রেখে তেরো বৎসর কাটিয়েছি। এখন ভীমের বাক্‌শল্যে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। এই মহাবাহু আজ ধর্মপথে চলেছেন।”

এই বলে দ্রৌপদী অশ্রুধারায় বক্ষ সিক্ত করে কম্পিত দেহে গদগদ কণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ বললেন, “ভাবিনী, যাদের উপর তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ সেই কৌরবগণ সসৈন্যে সবান্ধবে নিহত হবে, তাদের ভার্যারা রোদন করবে। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ যদি আমার কথা না শোনে, তবে তারা ভূমিতে পড়ে কুকুর-শৃগালের খাদ্য হবে। হিমালয় যদি বিচলিত হয়, মেদিনী যদি শতধাবিদীর্ণ হয়, নক্ষত্রসমেত আকাশ যদি পতিত হয়, তথাপি আমার কথা ব্যর্থ হবে না। কৃষ্ণা অশ্রুসংবরণ করো, তুমি রাজশ্রী লাভ করবে।”

সুপ্তিমগ্ন পুত্রদের মৃত্যু— দ্রৌপদীর প্রায়োপবেশন

অষ্টাদশ দিনে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হল। কৌরবপক্ষ পরাজিত হল। দ্বৈপায়ন হ্রদে আত্মগোপন করে থাকা দুর্যোধনকে জলের উপর উঠে আসতে বাধ্য করলেন যুধিষ্ঠির। ভীমের সঙ্গে গদাযুদ্ধে ভগ্ন ঊরু দুর্যোধন রক্তাক্ত অবস্থায় ভূতলে পড়ে রইলেন। সেই অবস্থায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন তিন কৌরব মহাবীর। ভগ্নঊরু ও রক্তাক্ত অবস্থায় রাজা দুর্যোধনকে দেখে গুরুপুত্র ও বাল্যসখা অশ্বত্থামা আর্তনাদ করে উঠলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন সেই রাত্রিতেই পাণ্ডবদের বিনাশ করবেন। মুমূর্ষ দুর্যোধন কৃতবর্মা ও কৃপাচার্যের উপস্থিতিতে অশ্বত্থামাকে শেষ সেনাপতি হিসাবে অভিষিক্ত করলেন। অশ্বত্থামা স্থির করলেন নিদ্রিত পাণ্ডবদের সুপ্তিমগ্ন অবস্থায় হত্যা করবেন। কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা আপত্তি করেছিলেন। অশ্বত্থামা সংকল্পে অবিচল থেকে কৃপাচার্য, কৃতবর্মাকে পাণ্ডব শিবিরের বাইরে রেখে অন্তরে প্রবেশ করলেন।

ওদিকে, কৃষ্ণের উপদেশ শিবিরে সেদিন পঞ্চপাণ্ডব রাত্রিবাস করেননি। শিবিরে ছিলেন দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী। অশ্বত্থামা কৃতান্তের মতো ধৃষ্টদ্যুম্নের শিবিরে প্রবেশ করে পিতৃহত্যার জন্য তাঁকে বধ করলেন। এরপর তিনি নির্বিচারে খড়গের আঘাতে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে বধ করলেন। তারপর তিনি শিখণ্ডী, উত্তমৌজা ও যুধামন্যুকেও হত্যা করলেন।

পরদিন প্রভাতে সারথির মুখে যুধিষ্ঠির অশ্বত্থামার নৃশংস কার্য শুনলেন। যুধিষ্ঠির দুরন্ত শোকে নকুলকে আদেশ দিলেন মন্দভাগ্যা দ্রৌপদীকে মাতৃগণের সঙ্গে সেখানে নিয়ে আসার। নকুল উপপ্লব্য নগর থেকে দ্রৌপদীকে নিয়ে এলেন। দ্রৌপদী বাতাহত কদলীর মতো কাঁপতে কাঁপতে ভূমিতে পড়ে গেলেন। ভীম তাঁকে উঠিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। দ্রৌপদী সরোদনে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজা, তুমি ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে পুত্রদের যমকে দান করেছ, এখন রাজ্য ভোগ করো। ভাগ্যক্রমে তুমি সমগ্র পৃথিবী লাভ করেছ, এখন আর মত্তমাতঙ্গগামী অভিমন্যুকে তোমার স্মরণ হবে না। আর তুমি যদি পাপী দ্রোণপুত্রকে বধ না করো, তবে আমি এখানেই প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করব।” যুধিষ্ঠির বললেন, “অশ্বত্থামা বহু দূরে পলাতক হয়েছেন, তাঁর মৃত্যু দ্রৌপদী কীভাবে দেখবেন?” দ্রৌপদী বললেন, “অশ্বত্থামার মাথায় একটি সহজাত মণি আছে। তুমি সেই পাপীকে বধ করে সেই মণি মস্তকে ধারণ করে নিয়ে এসো, তবেই আমি জীবন ত্যাগে বিরত হব।” পাণ্ডবরা অশ্বত্থামাকে ধরার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। কৃষ্ণ সঙ্গে গেলেন, অশ্বত্থামাকে ব্যাসদেবের আশ্রমে খুঁজে বার করে, উভয়পক্ষের ব্রহ্মশির প্রয়োগের পর ভীমসেন অশ্বত্থামার মাথার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে মণি তুলে নিলেন। অশ্বত্থামার ‘ব্রহ্মশির’ উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানকে আঘাত করল। কৃষ্ণ অভিশাপে অশ্বত্থামাকে তিন সহস্র বৎসর ব্যাধিগ্রস্ত ও পূতিগন্ধময় দেশে নির্বাসিত করলেন। দ্রৌপদী প্রায়োপবেশন ভঙ্গ করলেন।

মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী

তখন অশ্বমেধযজ্ঞ শেষ হয়ে গেছে। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে দ্বারকায় ফিরে গেছেন। ছ’মাস কাল অতিক্রান্ত হল। কৃষ্ণের কোনও সংবাদ না পেয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুন সুভদ্রাকে পাঠালেন দ্বারকায়। একপক্ষ কাল পরে নিঃশেষিত শক্তি, অশ্রুমগ্ন অর্জুন ফিরে এলেন। যুধিষ্ঠির শুনলেন সেই চরমতম দুঃসংবাদ— কৃষ্ণলীলা শেষ হয়েছে। তিনি ত্যাগ করেছেন তাঁর নরদেহ। যুধিষ্ঠির সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভ্রাতাদের জানালেন তাঁর সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত। বারো দিনের মধ্যে যাবতীয় পার্থিব কার্য শেষ করে চারিভ্রাতা ও দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির উত্তর দিকে চলতে শুরু করলেন। একটি কুকুর পথে তাঁদের অনুসরণ করে চললেন।

হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে তাঁরা মরুভূমি দর্শন করলেন। তারপর পর্বতশ্রেষ্ঠ মহাপর্বত সুমেরু দেখতে পেলেন। তাঁরা সকলেই একাগ্র হয়ে দ্রুত গমন করছিলেন, সেই অবস্থায় তাঁদের মধ্যে দ্রৌপদী একাগ্রতাভ্রষ্ট হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তখন মহাবল ভীমসেন দ্রৌপদীকে পতিত দেখে এবং তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন,

“নাধর্মশ্চরিতঃ কশ্চিদরাজপুত্র্যা পরন্তপ।

কারণং কিং নু তদ্‌ব্রুহি যৎ কৃষ্ণা পতিতা ভূবি ॥ মহাপ্রস্থান : ২: ৫ ॥

“শত্রু সন্তাপক! রাজপুত্রী কৃষ্ণা কোনও অধর্ম করেননি; তথাপি তিনি যে পতিত হলেন, তার কারণ কী বলুন। দেবতা, ব্রাহ্মণ ও গুরুজনবর্গের পূজা ও পরিচর্যায় নিরতা এবং সর্বদা দানব্রতপরায়ণা দ্রৌপদী কেন পতিত হলেন।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ, অর্জুনের প্রতি বিশেষভাবে দ্রৌপদীর গুরুতর পক্ষপাত ছিল; আজ ইনি তারই ফল ভোগ করছেন।” এই বলে জ্ঞানী, ধর্মাত্মা ও পুরুষশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর প্রতি দৃষ্টিপাতও না-করে ঈশ্বরে মনোনিবেশ করে চলতে লাগলেন।

দ্রৌপদী— সাধারণ আলোচনা

দ্রৌপদী মহাভারতের নায়িকা। দ্রুপদের সংকল্পে যজ্ঞে চারপাশের অগ্নির মধ্যে যজ্ঞবেদি উদ্ভূতা দ্রৌপদী। চতুঃষষ্টি কলানিপুণা অনবদ্যাঙ্গী নারী। তেজস্বিতায়, মননে, চিন্তায় যার তুল্য নারী পৃথিবীর কোনও মহাকাব্যেই রচিত হয়নি। রামায়ণের নায়িকাও অযোনিসস্তৃতা, মহাভারতের নায়িকাও তাই। পুরুষের কামাগ্নিতে পুড়ে সীতাহরণ, আগুন পুড়িয়েই সীতাদেবীর স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু দ্রৌপদীকে অগ্নি সারাজীবন বইতে হয়েছে। হেলেন, পেনিলোপি, সীতাদেবী অনন্য-সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু দ্রৌপদীর সৌন্দর্য সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত। ইন্দ্রের পত্নী শচীদেবী দ্রৌপদী রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শচীকে পাবার লালসায় পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ নহুষ স্বর্গ পরিত্যক্ত হয়ে সর্পরূপ ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন— দ্রৌপদীকে অসম্মান করে কীচক সবংশে ধ্বংস হলেন, কৌরবরা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হলেন।

জন্মমুহূর্তে আকাশবাণী দ্রৌপদীর নামকরণ করেছিলেন কৃষ্ণা। কৃষ্ণা বৈদূর্যমণিসন্নিভ, শ্যামাঙ্গী, শ্রীময়ী। দ্রৌপদীকে মহাভারত পাঠক কথা বলতে শোনে স্বয়ংবরসভায়। সূতপুত্রকে বিবাহ করতে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে তিনি বললেন, “নাহং বরয়ামি সূতম।” সুতকে বিবাহ করব না। অনেকে প্রশ্ন করেন যে, দ্রৌপদী কীভাবে জানলেন, কর্ণ সূতপুত্র। দ্রৌপদীর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডী দ্রোণাচার্যের শিষ্য ছিলেন। তারা অস্ত্রপরীক্ষার দিন রঙ্গক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। সমস্ত ঘটনা তারা নিজের চোখেই দেখেছেন। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলে বিধি অনুসারে ভুবনবিখ্যাত পঞ্চবীর স্বামীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে দ্রৌপদী হস্তিনায় এসেছিলেন পাণ্ডবদের পট্টমহিষী হিসাবে, রাজ-রাজে মুর্তিতে। বনবাসে গেলেন চুড়ান্ত অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা আর অসম্মান নিয়ে ভিখারিনি মূর্তিতে। পুরুষের কামনার কদর্যরূপ তিনি দেখলেন হস্তিনাপুরের রাজসভায়। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, কৌরববংশ ধ্বংস করবেন, দুর্যোধনের মৃত্যু ঘটবে—দুঃশাসনের শ্যাম বাহু, যা তাঁর অভিষিক্ত কেশ আকর্ষণ করে সভায় নিয়ে গিয়েছিল, তা ছিন্ন হবে। হয়েছিলও তাই। দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করে মৃত্যু ঘটেছিল কীচকের। তাঁকে পদাঘাত করার জন্য কীচকের পদদ্বয় ভীম তার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন।

দ্রৌপদী তেজস্বিনী, বাগ্মীশ্রেষ্ঠা, বিদুষী এবং সবলা নারী। সীতাদেবীর মতো তিনি কখনও বলেন না— মা ধরণী, দ্বিধাবিভক্ত হও, আমি তোমাতে প্রবেশ করি। জয়দ্রথকে ধাক্কা দিয়ে তিনি ফেলে দিয়েছিলেন। ধাক্কা দিয়েছিলেন কীচককেও। জয়দ্রথের রথে তিনি উঠেছিলেন নিতান্ত অনুকম্পা ভরে। জানতেন যে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্বামীরা তাঁকে মুক্ত করবেন।

দ্রৌপদী অসাধারণ বাগ্মী। পঞ্চ ইন্দ্রের মতো পাঁচ স্বামী ছিল তাঁর। কিন্তু যখন প্রয়োজন, তিনি তখনই ব্যঙ্গ করেছেন অন্তত স্বামীকে। অন্যরা নিরুত্তর ছিলেন, কেবলমাত্র যুধিষ্ঠির দু’বার তাঁকে ভৎসনা করেছিলেন। স্বামীদের প্রত্যেকের গুণ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। যখনই পরিচয় দিতে চেয়েছেন, তখন প্রত্যেকের গুণাবলি ভিন্ন ভিন্নভাবে উচ্চারণ করেছিলেন।

দ্রৌপদী অনন্তযৌবনা নারী ছিলেন। জয়দ্রথ যখন তাঁকে হরণ করতে আসেন, তখন দ্রৌপদীর বয়স প্রায় ষাট বৎসর। স্বামীরা অন্য নারী বিবাহ করেছিলেন, দ্রৌপদী বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করেননি। শুধু অর্জুন সুভদ্রাকে বিবাহ করলে তিনি অভিমানে অর্জুনকে ব্যঙ্গ করেছেন। মহাভারতে দ্রৌপদীই কেবলমাত্র কৃষ্ণকে কৃষ্ণ নামে সম্বোধন করেছেন। তার কারণ সম্ভবত নিজ নামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি যে কৃষ্ণের সহচরী প্রিয়সখী, তা ঘোষণা করা।

শুধুমাত্র পাণ্ডবরা নয়— কৌরবেরাও দ্রৌপদীর অনন্যতা বিষয়ে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তাই দূতক্রীড়ায় তাঁরা পাণ্ডবদের অন্য স্ত্রীদের উল্লেখ করেননি, দ্রৌপদীর বিষয়ে যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দ্বিতীয় দূতক্রীড়ারও শর্ত ছিল পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর দ্বাদশ বর্ষ বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস।

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আটাত্তর বৎসর পঞ্চপাণ্ডবের গৃহিণী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর নিপুণ গৃহিণীপনায় পাণ্ডবদের গার্হস্থ্যজীবন সম্পর্কে কখনও ভাবতে হয়নি। ভুবনবিজয়ী পাঁচ স্বামীকে দ্রৌপদী কোনও অসতী নারীর মতো জটিকা-বুটিকা মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে বশ করেননি— বশ করেছিলেন তাঁর সদাসর্বদা সতর্ক পরিচর্যা ও গৃহিণীপনায়। দ্রৌপদী নিজেই বলেছেন, যুধিষ্ঠিরের সব আয়ব্যয়ের সংবাদ কেবলমাত্র তিনিই জানতেন। দাসদাসী, অতিথি-অভ্যাগত, স্নাতক, ব্রাহ্মণ সকলের সংবাদ রাখতেন তিনি।

এই আটাত্তর বৎসরের গৃহিণী জীবনের মধ্যেই লুকানো আছে মহাভারতের নায়ক-সমস্যার সমাধান। আটাত্তর বৎসর তিনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী ছিলেন। যেখানে যুধিষ্ঠির আছেন, সেখানে দ্রৌপদীও আছেন। অন্য স্বামীদের সন্তান জন্ম দেবার সময় ব্যতীত দ্রৌপদী নায়ক যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সর্বদা থেকেছেন।

মননশীলতা, বিচক্ষণতা, বুদ্ধি, যে-কোনও বিপদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস, স্বামীগর্বে গর্বিতা দ্রৌপদী তাই মুনিঋষিদের চোখেও মহাভারতের প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্তর্গত। পুরুষপ্রধান সমাজে এই নারীটি তাই চিরশ্রদ্ধেয়া। ব্যাসদেবের সঙ্গে আমাদেরও বড় প্রিয় নায়িকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *