০৬. দেবনদী গঙ্গা

দেবনদী গঙ্গা

গঙ্গার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন মত আছে। কোনও কোনও পুরাণে গঙ্গাকে হিমালয়ের দুহিতা বলা হয়েছে। গঙ্গা জ্যেষ্ঠা, উমা বা কালী কনিষ্ঠা। ব্রহ্মা স্বর্গীয় কার্যে হিমালয়ের কাছ থেকে গঙ্গাকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার কোনও কোনও পুরাণের মতে গঙ্গা বিষ্ণুর গলিত রূপ। ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট শিবের সঙ্গীতের মূর্ছনায় বিষ্ণু গলে যেতে থাকেন। ব্রহ্মা সেই গলিত বিষ্ণুকে কমণ্ডলুতে ধারণ করেন। সেই গলিত রূপই গঙ্গা।

প্রজারঞ্জক, সত্যবাদী এবং যথার্থ বিক্রমী ‘মহাভিষ’ নামে ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন। তিনি বহুতর অশ্বমেধ ও রাজসূয় যজ্ঞ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করেন। তারপর স্বর্গলাভ করেন। তারপর, কোনও এক সময়ে দেবগণ গিয়ে ব্রহ্মার উপাসনা করছিলেন। সেই সময়ে অন্যান্য রাজর্ষিরাও ছিলেন, সেই মহাভিষ রাজাও ছিলেন। তখন গঙ্গা গিয়ে ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হন। তখন বায়ু এসে গঙ্গার চন্দ্রকিরণতুল্য সূক্ষ্ম বস্ত্রখানিকে গুপ্ত অঙ্গ থেকে সরিয়ে দিলেন। তখন দেবগণ তৎক্ষণাৎ মুখ নিচু করে ফেললেন; কিন্তু মহাভিষ রাজা নিঃশঙ্ক হয়েই সেই অবস্থায় গঙ্গাকে দেখতে লাগলেন। ক্ষুব্ধ ভগবান ব্রহ্মা মহাভিষ রাজাকে অভিসম্পাত করেন, “তুমি মর্ত্যলোকে গিয়ে জন্মাবে। আবার স্বর্গে আসতে পারবে।” তখন মহাভিষ রাজা, মর্ত্যলোকবাসী সমস্ত রাজার চিন্তা করে, অত্যন্ত তেজস্বী প্রতীপ রাজাকেই পিতা স্বীকার করবার ইচ্ছা করলেন।

নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা সেই মহাভিষ রাজাকে ধৈর্যচ্যুত দেখে, তাঁকেই মনে মনে চিন্তা করতে থেকে ব্রহ্মলোক থেকে ফিরে চললেন। তিনি পথে যাবার সময়ে দেখলেন স্বর্গীয় বসুগণ মুর্ছিতপ্রায় হয়ে ভূতলে পড়ে আছেন। তাঁদের সেইভাবে পড়ে থাকতে দেখে গঙ্গা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা এমন হতশ্রী কেন? আপনারা তো দেবতা; আপনাদের মঙ্গল তো?” তখন বসুদেবতারা গঙ্গাকে বললেন, “গন্ধে, আমাদের ক্ষুদ্র অপরাধেই মহাত্মা বশিষ্ঠ ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের অভিসম্পাত করেছেন। ইতিপূর্বে মহর্ষি বশিষ্ঠ একটি নিভৃত স্থানে বসে সন্ধ্যা করছিলেন। আমরা অন্যমনস্কভাবে তাঁকে নমস্কার না করে পথ অতিক্রম করেছিলাম। ক্রুদ্ধ মহর্ষি আমাদের অভিসম্পাত করেন যে, ‘তোমরা গিয়ে মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ করো।’ সুতরাং বেদবাদী-বশিষ্ঠ যা বলেছেন, তা অতিক্রম করার সামর্থ্য আমাদের নেই। অতএব কল্যাণী, আপনি ভূতলে গিয়ে, মানুষী হয়ে, আমাদের পুত্ররূপে প্রসব করুন, আমরা মানুষীর উদরে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করি না।” বসু দেবতারা এই কথা বললে, “তাই হবে” বলে গঙ্গা পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠগণ, মর্ত্যলোকে কোন ব্যক্তি আপনাদের জনক হবেন?” বসুগণ বললেন, প্রতীপ রাজার পুত্র শান্তনু মনুষ্যলোকে জগদ্‌বিখ্যাত রাজা হবেন, তিনিই আমাদের পিতা হবেন।” গঙ্গা বললেন, “হে নিষ্পাপ দেবগণ, আপনারা যা বলছেন, আমারও তাই মত। আমি তাঁর প্রীতিকর কার্য করতে ইচ্ছা করি; আপনাদেরও তাই অভীষ্ট।”

বসুগণ বললেন, “গঙ্গে, আপনি সেই পুত্রগুলি জন্মমাত্রই তাদের জলে ফেলে দেবেন; যাতে অচিরকালের মধ্যে আমাদের নিষ্কৃতি হয়।” গঙ্গা বললেন, “আমি তাই করব; কিন্তু আপনারা সেই শান্তনু রাজার একটি পুত্র অবশিষ্ট রাখবার ব্যবস্থা করুন। যাতে পুত্রের জন্য আমার সেই শান্তনু রাজার সঙ্গম ব্যর্থ না হয়।” বসুগণ বললেন, আমাদের প্রত্যেকের তেজের এক-এক অষ্টমভাগ আমরা দান করব; সুতরাং সম্পূর্ণ একটি তেজেই শান্তনুর অভীষ্ট আপনার একটি পুত্র হবে। কিন্তু মনুষ্যলোকে আপনার সেই পুত্রের আর সন্তান হবে না। অতএব, আপনার সে পুত্র আর সন্তানের জন্ম দেবে না। আপনার সেই পুত্র অপুত্রক হবে বটে। কিন্তু সে অত্যন্ত বলবান হবে।

সেই বসুদেবতারা গঙ্গার সঙ্গে এই নিয়ম করে সন্তুষ্ট চিত্তে ইচ্ছানুসারে সেই স্থান থেকে চলে গেলেন।

প্রতীপ রাজা সেই সময়ে গঙ্গাতীরে গিয়ে, সমস্ত প্রাণীর হিতসাধনে রত হয়ে মন্ত্র-জপে প্রবৃত্ত থেকে বহু বৎসর অতিবাহিত করেছিলেন। এই সময়ে গঙ্গাদেবী তাঁর রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়ে, জল থেকে উঠে, জপপ্রবৃত্ত রাজার শালবৃক্ষসদৃশ দক্ষিণ উরুতে গিয়ে উপবেশন করলেন। তখন রাজা প্রতীপ গঙ্গাকে বললেন, “কল্যাণী, আমি তোমার কোন প্রিয় কার্য করব?” স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা বললেন, “মহারাজ, আমি আপনাকে প্রার্থনা করি। সুতরাং আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করুন। কামুকী রমণীকে পরিত্যাগ করা সাধুজন গর্হিত।” প্রতীপ বললেন— “সুন্দরী! আমি পরস্ত্রী গমন করি না, অসবর্ণা স্ত্রীও গমন করি না। এই আমার নিয়ম।” গঙ্গা বললেন, “মহারাজ, আমি দুর্লক্ষণা নই, অগম্যাও নই, এবং কোনও বিষয়ে নিন্দনীয়াও নই; কিন্তু আমি স্বর্গীয়া, উৎকৃষ্টা স্ত্রী এবং কুমারী, অথচ আপনার প্রতি অনুরক্তা। অতএব আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করুন।” প্রতীপ বললেন, “তুমি যে প্রীতিজনক কার্য করবার জন্য আমাকে প্রণোদিত করছ, তা আমার অতীত হয়ে গিয়েছে, এখন আমি অন্য পথে চলছি; সুতরাং ধর্মের ব্যাঘাত করলে, বিনষ্ট হতে হবে। সুন্দরী তুমি উপস্থিত হয়েই আমার দক্ষিণ ঊরু আশ্রয় করেছ; কিন্তু তা সন্তানদের ও পুত্রবধূর আসন বলে জানবে। বাম ঊরুই স্ত্রীর ভোগ্য; তুমি তা পরিত্যাগ করেছ; অতএব আমি তোমার সঙ্গে কাম ব্যবহার করব না। কল্যাণী, তুমি আমার পুত্রবধূ হও। পুত্রের জন্যই আমি তোমাকে বরণ করছি। কেন-না তুমি এসেই আমার পুত্রবধূর পক্ষ আশ্রয় করেছ।”

স্ত্রীরূপিণী গঙ্গা বললেন, “মহারাজ বরং তাই হোক। আমি আপনার পুত্রের সঙ্গেই মিলিত হব। আপনার প্রতি ভক্তিবশতই ভরতকুলের আশ্রয় নেব। পৃথিবীতে যত রাজা আছেন, আপনারাই তাঁদের মধ্যে প্রধান, আপনাদের গুণ আমি শত বৎসরেও বলে শেষ করতে পারব না। আপনাদের বংশে যে সকল রাজা জন্মেছেন, তাঁদের সাধুতাও সর্বোৎকৃষ্ট ছিল। মহারাজ আমি শপথ করেছি বলে, যা করব, আপনার পুত্র কোনও সময়েই তা বিচার করতে পারবেন না। এইভাবেই আমি আপনার পুত্রের সঙ্গে বাস করে তাঁর প্রীতি-বর্ধন করব। তিনিও পুত্রলাভ এবং পবিত্র ও প্রীতিকর আচরণ দ্বারা স্বর্গলাভ করবেন।” প্রতীপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললেন, “তাই হবে।” স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলেন। রাজা প্রতীপ আপন ভার্যার সঙ্গে মিলিত হয়ে পুত্রের জন্য তপস্যা করতে লাগলেন।

তারপর, সেই মহাভিষ রাজা এসে, বৃদ্ধ রাজা ও রানির পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। শমগুণান্বিত রাজার পুত্র হয়েছিলেন, তাঁর নাম হয়েছিল— “শান্তনু।” পুরুষশ্রেষ্ঠ শান্তনু আপন কর্মলব্ধ অক্ষয়লোক স্মরণ করতে থেকে সর্বদা পুণ্যই করতেন। পুত্র শান্তনু যৌবনে পদার্পণ করলে, প্রতীপ রাজা তাঁকে বললেন, “শান্তনু তোমার জন্য একটি স্ত্রী পূর্বেই আমার কাছে এসেছিল। পরমাসুন্দরী সেই বরবৰ্ণিনী কামার্ত হয়ে পুত্রকামনা করে যদি নির্জনে তোমার কাছে উপস্থিত হয়, তবে তুমি তার কাছে কোনও প্রশ্ন করবে না। সে যে কাজ করবে সে বিষয়েও তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। আমার আদেশে সেই অনুরক্তা রমণীর ইচ্ছা পূর্ণ করবে।”

পুত্র শান্তনুকে নির্দেশ দিয়ে, তাঁকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে প্রতীপ রাজা তপোবনে চলে গেলেন। এদিকে ইন্দ্রের ন্যায় প্রভাবশালী বুদ্ধিমান রাজা শান্তনু সর্বদাই বনে বনে ভ্রমণ করে মৃগয়া করে বেড়াতে লাগলেন। রাজশ্রেষ্ঠ শান্তনু হরিণ, মহিষ প্রভৃতি পশু বধ করে, সিদ্ধচারণ প্রভৃতি সেবিত গঙ্গার তীর দিয়ে একাকী বিচরণ করতেন।

শান্তনু কোনও সময়ে গঙ্গাতীরে দেখলেন— পরমসুন্দরী একটি স্ত্রী উপস্থিত হল, শরীরের কান্তিতে সে যেন জ্বলছিল; সে যেন দ্বিতীয় লক্ষ্মীর মতো শোভা পাচ্ছিল। তার সমস্ত অঙ্গই অনিন্দনীয়। দাঁতগুলি অত্যন্ত সুন্দর। সকল অঙ্গ স্বর্গীয় অলংকারে অলংকৃত। পরিধানে সূক্ষ্ম বস্ত্র এবং শরীরের কান্তি পদ্মকোষের ন্যায় গৌরবর্ণ ছিল। সে নারীকে দেখে তার সৌন্দর্যে শান্তনু বিস্ময়াপন্ন হলেন। তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হল এবং তিনি নয়নযুগল দ্বারা তাকে পান করেও তৃপ্তিলাভ করছিলেন না।

আবার পরমসুন্দর রাজাকে বিচরণ করতে দেখামাত্রই সে রমণীরও অনুরাগে প্রণয় এসে উপস্থিত হল; সুতরাং সে রমণীও তৃপ্তিলাভ করল না। তারপর রাজা কোমল বাক্যে সেই রমণীকে সন্তুষ্ট করে বললেন, “সুন্দরী, আপনি দেবী না দানবী? না গন্ধর্বী? না অপ্সরা? অথবা আপনি যক্ষী? না সর্পী? না মানুষী? দেববালিকাতুল্যে, আপনি যে-ই হোন না কেন, আমার ভার্যা হোন।”

গঙ্গা রাজার এই সহাস্য, মৃদু ও মধুর বাক্য শুনে এবং পূর্বে বসু দেবতাগণের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা স্মরণ করে, রাজার কাছে আসলেন এবং বাক্য দ্বারা রাজার চিত্ত আনন্দিত করে তাঁকে বললেন, “মহারাজ আমি আপনার বশবর্তিনী মহিষী হব। কিন্তু মহারাজ, আমি শুভ বা অশুভ যে যে কার্যই করব, তাতে আপনি বারণ করতে পারবেন না, কিংবা কটুকথা বলতে পারবেন না। মহারাজ আপনি এই নিয়ম স্বীকার করলেই আমি আপনার সঙ্গে বাস করব। আর, আপনি আমাকে বারণ করলে কিংবা কটুকথা বললে নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ত্যাগ করব।” “তাই হবে” এই কথা বলে শান্তনু গঙ্গাকে লাভ করলেন এবং অতুল আনন্দলাভ করলেন।

জিতেন্দ্রিয় শান্তনুও গঙ্গাকে লাভ করে ইচ্ছানুসারে ভোগ করতে লাগলেন এবং গঙ্গাকে কোনও বিষয়েই জিজ্ঞাসা করা যাবে না এই মনে করে কোনও বিষয়ই তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন না। শান্তনু গঙ্গার স্বভাব, ব্যবহার, রূপ, উদারতা এবং নির্জনে পরিচর্যায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হতে থাকলেন। গঙ্গা স্বর্গীয় দেবী হয়েও, নদীশ্রেষ্ঠা হয়েও, মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে রাজার বাস্তবিক ভার্যার মতোই সর্বদা রাজার সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন এবং দেবরাজতুল্য প্রভাবশালী রাজশ্রেষ্ঠ শান্তনুরও সৌভাগ্যবশত দেবীর সঙ্গে কামব্যবহার চলতে লাগল।

শান্তনু যাতে গঙ্গার সঙ্গেই রমণ করেন, তেমনভাবেই শৃঙ্গার-ব্যবহার, কোমল-নৃত্য, সম্ভোগ, অনুরাগ এবং রমণ ব্যাপারে নৈপুণ্য দেখিয়ে রাজাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন। শান্তনু উত্তম রমণী গঙ্গার গুণে আকৃষ্ট থেকে, তাঁর সঙ্গে রমণে আসক্ত ছিলেন বলে, বহুতর বৎসর ঋতু ও মাস যে চলে গিয়েছিল, তা বুঝতেও পারেননি। শান্তনু ইচ্ছানুসারে গঙ্গার সঙ্গে রমণ করে, তাঁর গর্ভে দেববালকতুল্য আটটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। কিন্তু যখনই পুত্রের জন্ম হত, তখনই গঙ্গা ‘আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করছি’ এই বলে সেই সেই পুত্রকে প্রথমে জলে নিক্ষেপ করতেন, পরে স্রোতের ভিতর ডুবিয়ে দিতেন।

গঙ্গার সেই কার্য শান্তনুরাজার অত্যন্ত অপ্রীতিকর হত; অথচ গঙ্গা তাঁকে ত্যাগ করে যাবেন—এই ভয়ে তিনি গঙ্গাকে কিছুই বলতেন না।

অথ তামষ্টমে জাতে পুত্রে প্রহসতীমিব।

উবাচ রাজা দুঃখার্ত পরীস্ত্রন পুত্রমাত্মনঃ ।। আদি : ৯২ : ৫৬ ।।

তারপর অষ্টম পুত্র জন্মালে, গঙ্গা যেন আনন্দে হাস্য করে উঠলেন, তখন শান্তনু সেই আপন পুত্রটিকে রক্ষা করার ইচ্ছায় দুঃখিত হয়ে গঙ্গাকে বললেন।

“পুত্রবধ কোরো না! তুমি কে? কার স্ত্রী? কেনই বা পুত্রগুলিকে বধ করছ? পুত্রহত্যাকারিণী, তোমার যে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ ও পাপ এসে পড়ল!”

স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা বললেন, “হে পুত্রীশ্রেষ্ঠ, তুমি পুত্র কামনা করছ; সুতরাং তোমার আর পুত্রবধ করব না। তবে তোমার সঙ্গে থাকা আমার এখানেই শেষ হোক; কেন-না আমাদের নিয়ম মনে করে দেখো। আমি জহ্নুমুনির কন্যা গঙ্গা। মহর্ষিগণ আমার সেবা করে থাকেন। আমি দেবকার্যের জন্যই আপনার সঙ্গে বাস করছিলাম। মহাভাগ্যবান ও মহাতেজস্বী যে আটজন বসু দেবতা আছেন, তাঁরাই বশিষ্ঠের অভিশাপে মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন; মর্ত্যলোকে আপনি ভিন্ন আর কেউই তাঁদের জনক হতে পারেন না; আবার এই মর্ত্যলোকে আমার মতো গর্ভধারিণী কোনও মনুষ্যরমণী নেই। সুতরাং আমি বসুদেবতাগণের জননী হবার জন্য মানুষী হয়েছি আর আপনি আমার গর্ভে সেই অষ্টবসুকে উৎপাদন করে অক্ষয়-স্বর্গ আয়ত্ত করেছেন। বসুদেবতাগণের প্রার্থনায় আমি অঙ্গীকার করেছিলাম, জন্মমাত্রই আমি তাদের মনুষ্যজন্ম থেকে মুক্তি দেব।

সেই বসুদেবতারা আজ মহাত্মা বশিষ্ঠের অভিসম্পাত থেকে মুক্ত হলেন। আপনার মঙ্গল হোক। আমি এখন যাব। আপনি এই ভাবী মহানিয়মী পুত্রটিকে পালন করুন। বসুগণের অংশক্রমে উৎপন্ন এই পুত্রটিকে আমি আপনার নিকট রাখলাম। আপনিও এই পুত্রটিকে গঙ্গার গর্ভজাত ও গঙ্গার প্রদত্ত বলে জানবেন।”

শান্তনু বললেন, “আপব নামে ইনি কে? বসুগণই বা কী অপরাধ করেছিলেন যে আপবের অভিসম্পাতে সেই বসুগণ এসে মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন? তোমার প্রদত্ত এই বালকটিই বা কোন দুষ্কার্য করেছেন? যা করার জন্য এই বালকটি মানুষের মধ্যে বাস করবেন। সমস্ত লোকের অধীশ্বর হয়ে সেই বসুগণই বা কেন মনুষ্যের মধ্যে জন্মেছিলেন? গঙ্গে, তুমি সেই সমস্ত বৃত্তান্ত আমার নিকট বলো।”

তখন গঙ্গা পুরুষশ্রেষ্ঠ শান্তনু রাজাকে বলতে লাগলেন, “হে ভরতবংশ শ্রেষ্ঠ, পূর্বকালে বরুণদেব যে পুত্র লাভ করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল ‘বশিষ্ঠ’ এবং ‘আপব’ নামেও তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। পর্বতশ্রেষ্ঠ সুমেরুর পার্শ্বে তাঁর পবিত্র আশ্রম ছিল; তাতে নানাবিধ পশুপক্ষী বিচরণ করে বেড়াত এবং সকল ঋতুতেই ফুল ফুটত। আর সেই আশ্রমের ফল, মূল ও জল সুস্বাদু ছিল। সেই আশ্রমে থেকে বরুণনন্দন বশিষ্ঠ তপস্যা করতেন।

দক্ষ প্রজাপতির সুরভি নামে যে কন্যা ছিলেন তিনি জগতের মঙ্গলের জন্য কশ্যপ প্রজাপতি থেকে নন্দিনীনাম্নী গোরূপা একটি কন্যা প্রসব করেন। সেই নন্দিনী সমস্ত অভীষ্ট দান করতে পারতেন এবং গোসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ধর্মাত্মা বশিষ্ঠ সেই নন্দিনীকে হোমধেনুরূপে লাভ করেছিলেন। সেই নন্দিনী, পবিত্র ও মনোহর সেই তপোবনে থেকে নির্ভয়ে বিচরণ করতেন। আর তখন মুনিরা তাঁর সেবা করতেন।

তারপর, কোনও সময়ে পৃথু প্রভৃতি বসুগণ, দেবতা ও দেবর্ষিসেবিত সেই তপোবনে আগমন করলেন। তাঁরা আপন আপন ভার্যার সঙ্গে সেই তপোবনের সর্বত্র বিচরণ করে মনোহর পর্বতে এবং বনে বিহার করেন। সেই বসুগণের মধ্যে কোনও বসুর ভার্যা সেই বনের মধ্যে বিচরণ করতে করতে সমস্ত অভীষ্ট দাতৃগণের মধ্যে প্রধানা নন্দিনীকে দর্শন করেন এবং তার স্বভাব ও অলংকারসমৃদ্ধি দেখে বিস্ময়াপন্ন হন। সেই নন্দিনীর মুখ, লাঙুল এবং পালান দুটি বিশেষ সুন্দর ছিল এবং উৎকৃষ্ট স্বভাব ও সমস্ত গুণ ছিল, আর সে প্রচুর পরিমাণে দুধ দিত। ‘দ্যু’ নামক বসুর ভার্যা দ্যুকে এইভাবে নন্দিনীর রূপ দেখিয়ে দিলেন। তখন দ্যু বসু সেই নন্দিনীকে দেখেই তার রূপ ও গুণের বর্ণনা করতে আপন প্রিয়তমাকে বললেন, “দেবী, যাঁর এই সুন্দর তপোবন দেখছ, সেই মহর্ষি বশিষ্ঠেরই এই নীলনয়না উৎকৃষ্টা গোরুটি। যে মানুষ এই গোরুটির সুস্বাদু দুগ্ধ পান করবে সে মানুষ স্থিরযৌবন হয়ে দশ সহস্র বৎসর জীবিত থাকবে।”

সর্বাঙ্গসুন্দরী বসুভার্যা এই কথা শুনে, উজ্জ্বল মূর্তি নিজ ভর্তাকে বললেন, “মনুষ্যলোকে জিতবতী-নাম্নী রাজকন্যা আমার সখী আছেন। আমার সেই সখী— সত্যপ্রতিজ্ঞ বুদ্ধিমান এবং রাজর্ষি উশীনরের কন্যা। তিনি নিজের সৌন্দর্যের জন্য মনুষ্যলোকে বিখ্যাত হয়েছেন। হে দেবশ্রেষ্ঠ, আপনি আমার সেই সখীর জন্য এই গোরুটিকে বৎসের সঙ্গে সত্বর আনয়ন করুন। এর দুগ্ধ পান করে আমার সখী একাই জরা-রোগবিহীন হবেন। মহাশয় আমার এই কার্যটি আপনাকে অবশ্য করতে হবে। কারণ এর থেকে অধিক প্রিয় কার্য আমার আর নেই।” এই কথা শুনে দ্যু বসু প্রিয়তমার প্রিয় কার্য করবার ইচ্ছায় পৃথু প্রভৃতি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে তখন সেই গোরুটিকে অপহরণ করলেন।

তখন দ্যু-বসু মহর্ষি বশিষ্ঠের তপস্যার তীব্র তেজের প্রতি দৃষ্টিপাতও করতে পারছিলেন না। তথাপি তিনি পদ্মনয়না ভার্যার আগ্রহে সে গোরুটিকে অপহরণ করলেন। কিন্তু তাতে তাঁর যে নিজের পতন হতে পারে তা একবার মনেও করলেন না। তারপর বশিষ্ঠ ফল নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তপোবনের কোথাও বাছুরসহ সেই গোরুটিকে দেখতে পেলেন না। বশিষ্ঠ অনেক অন্বেষণ করলেন, কিন্তু কোথাও গোরুটিকে পেলেন না। তখন বশিষ্ঠ ধ্যানে সমস্ত বিষয় অবগত হলেন। বশিষ্ঠ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বসুগণকে অভিসম্পাত করলেন। বশিষ্ঠমুনি বসুগণকে অভিসম্পাত করে পুনরায় তপস্যাতেই মনোনিবেশ করলেন। তখন সেই বসুগণ বশিষ্ঠকে প্রসন্ন করে অভিশাপমুক্তির প্রচেষ্টা করলেন। কিন্তু বশিষ্ঠ শাপমুক্তির অনুগ্রহ দান করলেন না। তখন ধর্মাত্মা বললেন, “ধর প্রভৃতি তোমাদের আমি অভিসম্পাত করেছি, কিন্তু এক বৎসর পরে তোমরা সকলেই মুক্তিলাভ করবে। কিন্তু যার জন্য আমি তোমাদের অভিসম্পাত করেছি সেই দ্যু-বসু আপন কর্মের ফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে থাকবে। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে তোমাদের যা বলেছি, তা মিথ্যা হবে না। তবে, এর মতো মহাত্মা মনুষ্যলোকে আর জন্মগ্রহণ করবে না। এই দ্যু-বসু ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রে নিপুণ এবং পিতার প্রিয় ও হিতসাধনে নিরত থাকবে এবং স্ত্রীসম্ভোগ পরিত্যাগ করবে।”

মহর্ষি এই বলে পুনরায় তপস্যায় চলে গেলেন। তখন বসুগণ গঙ্গার কাছে গিয়ে বর চাইলেন, “গঙ্গাদেবী, আমরা যখন যখন জন্মগ্রহণ করব, তখন তখনই আপনি নিজে আমাদের জলে নিক্ষেপ করবেন।” গঙ্গা শান্তনুকে বললেন, “মহারাজ, সেই বসুগণকে মুক্ত করার জন্যই আমি জন্মমাত্র পুত্রদের জলে বিসর্জিত করেছি। হে রাজশ্রেষ্ঠ, আপনার এই পুত্ররূপী একমাত্র সেই দ্যু-বসু অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পুনরায় স্বর্গে যাবেন। আর আমিও আপনি ডাকামাত্র আপনার কাছে উপস্থিত হব।” এই বলে গঙ্গা সেই বালকটিকে নিয়ে, তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলেন এবং অভীষ্ট স্থানে চলে গেলেন। শান্তনুর সেই পুত্র দুই নামে—দেবব্রত ও গাঙ্গেয় নামে খ্যাত হয়েছিল এবং যথাকালে শান্তনুর থেকেও অধিক গুণবান হয়েছিল।

শান্তনু এরপরে ছত্রিশ বছর স্ত্রীসংসর্গ সম্পূর্ণ বর্জন করে পিতার ন্যায় প্রজাপালন করতে থাকেন। একদিন শান্তনু মৃগয়ায় একটি হরিণকে বিদ্ধ করে তার অনুসরণক্রমে গঙ্গাতীরে পৌঁছে দেখলেন— গঙ্গার জল অল্প। গঙ্গার জল এত অল্প হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তিনি দেখলেন দেবতাপুত্রের তুল্য মনোহরাকৃতি ও দীর্ঘ শরীর একটি বালক দেবরাজের ন্যায় দিব্য অস্ত্র প্রয়োগ করছে এবং তীক্ষ্ণ বাণে সমস্ত গঙ্গাকে আবৃত করে তার তীরে অবস্থান করছে। গঙ্গার অষ্টম পুত্র জন্মগ্রহণের পর শান্তনু এক মুহূর্ত মাত্র তাকে দেখেছিলেন। তখন তিনি বালকটিকে চিনতে পারলেন না। বালকটি শান্তনুকে দেখে মায়া দ্বারা তাকে মুগ্ধ করে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে অন্তর্হিত হল।

রাজা তখন সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে, সেই বালকটিকে আপন পুত্র মনে করে গঙ্গাকে বললেন, “গঙ্গা পুত্রটিকে দেখাও।” তখন গঙ্গা উত্তমরূপ ধারণ করে দক্ষিণ হস্ত ধারণপূর্বক সেই সুন্দর বালকটিকে এনে রাজাকে দেখালেন। তখন গঙ্গা সমস্ত অলংকারে অলংকৃত ছিলেন এবং শুভ্র বস্ত্র পরিধান করেছিলেন। রাজা তাঁকে পূর্বে দেখেছিলেন বটে, তবুও তখন তিনি তাকে চিনতে পারছিলেন না।

তখন গঙ্গা বললেন, “মহারাজ, আপনি পূর্বে আমার গর্ভে যে অষ্টম পুত্রটি লাভ করেছিলেন, এটি সেই পুত্র; এখন অস্ত্রাভিজ্ঞদের মধ্যে সর্বপ্রধান হয়েছে। মহারাজ, আমি একে সংবর্ধিত করেছি। আপনি এখন গ্রহণ করুন এবং একে নিয়ে আপন ভবনে রাখুন। এ এখন বলবান হয়েছে। বশিষ্ঠের নিকট স অঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছে। সমস্ত অস্ত্রে শিক্ষিত হয়েছে। মহাধনুর্বর হয়েছে এবং যুদ্ধে ইন্দ্রের তুল্য হয়েছে। মহারাজ আপনার এই পুত্রটি সর্বদাই দেবগণ ও অসুরগণের প্রীতির পাত্র; আর শুক্রাচার্য যত শাস্ত্র জানেন সে সমস্তই এ জানে। এবং দেবগণ ও অসুরগণের সম্মানভাজন বৃহস্পতি যত শাস্ত্র জানেন, ষড়ঙ্গ উপাঙ্গ সে সমস্ত শাস্ত্রই আপনার এই পুত্রে বিদ্যমান আছে। অতএব মহারাজ, মহাধনুর্ধর এবং রাজধৰ্ম অভিজ্ঞ মৎ প্রদত্ত নিজের এই বীর সন্তানটিকে আপনি নিজের গৃহে নিয়ে যান।” এই কথা বলে গঙ্গা সেই স্থানেই অন্তর্হিত হলেন।

গঙ্গার কাহিনি মহাভারতে এখানেই শেষ। এরপর একটিবার মাত্র তাঁকে আমরা দেখতে পাই। ভীষ্ম অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দেবার পর শাল্ব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। অম্বার দুরবস্থা দেখে গুরু পরশুরাম এসে ভীষ্মকে অম্বাকে গ্রহণ করতে আদেশ করেন। ভীষ্ম সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ক্রুদ্ধ পরশুরাম ভীষ্মকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। ভীষ্ম যুদ্ধ স্বীকার করেন। তেইশ দিন ভয়ংকর যুদ্ধ করেও পরশুরাম ভীষ্মকে পরাজিত করতে পারেননি। তেইশ দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র প্রয়োগে উদ্যত হলে সপ্ত বসু ভীষ্মের কাছে এসে তাঁকে নিবারণ করেন। গঙ্গাও নদীরূপে ভীষ্ম ও পরশুরামের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকেন। ভীষ্ম-পরশুরামের যুদ্ধ সাঙ্গ হয়। গঙ্গাও পূর্বের গতিপথ ধরে ফিরে যান।

ভীষ্মের মৃত্যুর পর গঙ্গা শরশয্যার কাছে এসেছিলেন। তারপর তিনি চলে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *