প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

থাকের মানুষখাকী

থাকের মানুষখাকী

লাধিয়া উপত্যকায় বহু মাস ধরে শান্তি বিরাজ করছিল কিন্তু ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরে নৈনিতালে একটা সংবাদ এল যে কোটকিন্দ্রী গ্রামে একটি বার বছরের মেয়ে বাঘের হাতে মারা পড়েছে। যে খবরটি আমার কাছে বনবিভাগের ডোনাল্ড স্টুয়ার্ট মারফত এল তাতে বিস্তারিত কিছুই জানা গেল না। কয়েক সপ্তাহ বাদে সেই গ্রামটিতে যাওয়ার পরেই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানলাম। মনে হয় একদিন দুপুরবেলা মেয়েটি গ্রামটির কাছেই; আর গ্রাম থেকে পরিষ্কার দেখা যায় এমন একটা আম গাছের নিচে ঝড়ে-পড়া আম কুড়োচ্ছিল–এমন সময় হঠাৎ সেখানে একটা বাঘ এসে উপস্থিত হয়। যারা আশেপাশে কাজ করছিল তারা কোনো সাহায্যে আসার আগেই বাঘটা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যায়। বাঘটার পিছু নেওয়ার কোনো চেষ্টাই করা হয় নি। আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর বহু আগেই রক্তের এবং শিকার টেনে নিয়ে যাওয়ার সব দাগই মুছে গিয়েছিল ফলে বাঘটা যে মেয়েটিকে কোথায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল তা আমি খুঁজে পেলাম না।

কোটকিন্দ্ৰী, চুকার চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে আর থাক থেকে সোজ তিন মাইল পশ্চিমে। কোটকিন্ত্রী আর থাকের মধ্যের উপত্যকাতেই গত এপ্রিলে চুকার মানুষখেকোকে গুলি করা হয়েছিল। ৩৮ সালের গরমকালের মধ্যে বনবিভাগ থেকে এ অঞ্চলের সব গাছগুলি কাটার জন্যে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু একটা আশঙ্কা ছিল যে নভেম্বর নাগাদ যখন গাছ কাটা শুরু হওয়ার কথা তার মধ্যেই যদি মানুষখেকোটার কোনো ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে ঠিকাদাররা মজুর সংগ্রহ করতে পারবে না ফলে তাদের সব চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। এই সূত্রেই ডোনাল্ড স্টুয়ার্ট মেয়েটি মারা পড়ার অল্পদিনের মধ্যেই আমাকে লেখেন। আমি যখন তাঁর অনুরোধে কোটকিন্দ্রী যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই তখন স্বীকার করতেই হবে যে ঠিকাদারদের স্বার্থরক্ষার থেকেও স্থানীয় লোকদের উপকারে আসাই আমার কাছে বেশি জরুরী মনে হয়েছিল।

আমার পক্ষে কোটকিন্দ্রী যাওয়ার সবচেয়ে সোজা রাস্তা ছিল রেলে টনকপুরে যাওয়া, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কালধূঙ্গা আর চুকা হয়ে যাওয়া। এই পথে গেলে আমার একশো মাইল রাস্তা বাঁচবে বটে কিন্তু আমাকে যেতে হবে উত্তর ভারতের সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে। এই অঞ্চলটা এড়াবার জন্যে আমি স্থির করলাম পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে মৌরনৌলা পর্যন্ত যাব–সেখান থেকে পরিত্যক্ত রাস্তা শেরিং রোড দিয়ে সোজা চলে যাব যেখানে কোটকিন্দ্রীর ওপরে পাহাড়ি রাস্তাটি শেষ হয়েছে সেখান পর্যন্ত।

আমার এই দীর্ঘ পদযাত্রার প্রস্তুতি যখন চলছে, নৈনিতাল থেকে দ্বিতীয় সংবাদ এল যে লাধিয়া উপত্যকার বাঁ দিকে, চুকার থেকে আধ মাইল দুরে সেম নামে ছোট্ট একটি গ্রামে বাঘের হাতে আরেকজন প্রাণ হারিয়েছে।

এবারে বাঘের শিকার হয়েছে একজন বয়স্কা স্ত্রীলোক-সেম গ্রামেরই মোড়লের মা। এই হতভাগ্য স্ত্রীলোকটি মারা পড়ে দুটি থাক করা ধাপকাটা খেতের মধ্যেকার খাড়া পাড়ে ঝোঁপ কাটার সময়। সে ঝোঁপ কাটতে আরম্ভ করে পঞ্চাশ গজ লম্বা পাড়ের অন্য প্রান্ত থেকে। ঝোঁপ কাটতে কাটতে এগিয়ে সে যখন নিজের কুঁড়েঘরের গজখানেকের মধ্যে এসে পড়েছে তখন ওপরের মাঠ থেকে বাঘটা ওর ওপরে লাফ দেয়। আক্রমণটা এত আশাতীত আর এত অতর্কিতে হয়েছে যে বাঘটা ওকে মেরে ফেলার আগে স্ত্রীলোকটি শুধু একবার চিৎকার করার সময় পায়। বাঘটি ওকে নিয়ে বার ফুট উঁচু পাড়ে উঠে ওপরের মাঠটা পেরিয়ে দূরের গভীর জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওর ছেলে, প্রায় বছর কুড়ি বয়েস, সেই সময় কয়েক গজ মাত্র দূরে একটা ধান খেতে কাজ করছিল। সে পুরো ঘটনাটা দেখতে পায় কিন্ত সে এত ভয় পেয়েছিল যে কোনো সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে নি। ছেলেটির জরুরী আবেদনে দুদিন পরে সেম গ্রামে পাটোয়ারী এসে পৌঁছয়–তার সঙ্গে সংগ্রহ করা জনা আশি লোক। বাঘটা যেদিকে গিয়েছে সেই দিকটি অনুসরণ করে সে স্ত্রীলোকটির জামাকাপড় আর কয়েক টুকরো হাড় কুড়িয়ে পায়। এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বেলা দুটো নাগাদ ঘটনাটি ঘটে–আর বাঘটা তার শিকার খায় যে কুঁড়েঘরের কাছে স্ত্রীলোকটিকে মেরেছিল তার মাত্র ষাট গজের মধ্যেই।

এই দ্বিতীয় সংবাদটি পৌঁছনোর পর আলমোড়া, নৈনিতাল আর গাড়োয়াল এই তিনটে জেলার ডেপুটি কমিশনার ইবটসন আর আমি এক যুদ্ধকালীন পরামর্শ বৈঠকে বসলাম। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইবটসন তার তিব্বত সীমান্তে আসকটে একটা জমি-বিরোধের নিষ্পত্তি করতে যাওয়া স্থগিত রাখলেন। তিনি সেখানে বেরনোর জন্যে তৈরি হয়েছিলেন। ঠিক ছিল তিনি বাগাশ্বর হয়ে আসকটে যাবেন কিন্তু নতুন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক হল তিনি প্রথমে আমার সঙ্গে যাবেন সেম-এ সেখান থেকে আসকটে রওনা হবেন।

যাত্রার জন্যে যে পথটি আমি বেছে নিয়েছিলাম সেটা পাহাড়ের চড়াইয়ে ভরা তাই শেষে ঠিক হল আমরা নান্ধাউর উপত্যকা দিয়ে যাব, নাউর আর লাধিয়ার মধ্যের জলধারা অতিক্রম করে লাধিয়া নদীর ধার দিয়ে গিয়ে সেম গ্রামে পৌঁছব, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইবটসনরা নৈনিতাল ছাড়লেন ১২ই অক্টোবর, তারপর দিন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম চৌরগল্লিয়ায়।

নানধাউর নদীর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের পথচলা আর মাছধরা একই সঙ্গে চলতে থাকল। ট্রাউট মাছ ধরার হাল্কা ছিপে, যেদিন আমরা সবচেয়ে বেশি মাছ ধরি, সেদিন ধরেছিলাম একশো কুড়িটি মাছ। পঞ্চম দিনে আমরা পৌঁছলাম দুর্গা পেপল-এ। এখানে নদীর গতিপথ ছেড়ে আমরা একটা খুব খাড়া চড়াইয়ে উঠে রাত কাটালাম নদীটিরই ওপরে। পরদিন সকালে খুব ভোরে যাত্রা করে সে রাতে আমরা চালতি থেকে বার মাইল দূরে লাধিয়ার বাঁ পাড়ে তাবু খাটালাম।

সেবার আমাদের সৌভাগ্যক্রমে বর্ষা তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল কারণ পাহাড়ের পাথরে গাগুলো খাড়া উপত্যকায় নেমে যাওয়ার দরুন প্রায় প্রত্যেক সিকি মাইল অন্তর আমাদের নদীটা পেরোতে হচ্ছিল। এইরকমভাবে পার হতে গিয়ে আমাদের পাঁচক, যে জুতোসুদ্ধ পাঁচফুটের বেশি লম্বা হবে না একবার প্রায় ভেসে যাচ্ছিল। তার সলিল সমাধিই হত, যদি না আমাদের খাবারের ঝুড়ি যে লোকটি বহন করছিল সে তৎক্ষণাৎ সাহায্য করত।

চৌরগল্লিয়া ছাড়ার দশদিন পরে আমরা সেই গ্রামের এক নির্জন মাঠে তাবু ফেললাম। মাঠটি যে কুঁড়েঘরের কাছে স্ত্রীলোকটি মারা পড়েছিল তার থেকে দুশো গজ দূরে। লাধিয়া আর সারদা নদীর সঙ্গমস্থল থেকে মাঠটির দূরত্ব হবে একশো গজ মতন।

পুলিস বিভাগের গিল ওয়াভেল, যার সঙ্গে লাধিয়া দিয়ে আসার সময়ে আমাদের দেখা হয়েছিল, বেশ কয়েকদিন ধরে সেম-এ ক্যাম্প করেছিলেন। বনবিভাগের ম্যাকডোনাল্ড আমাদের অনুগ্রহ করে একটা মোষ দিয়েছিলেন। সেটা বেঁধে অপেক্ষা করেছিলেন গিল ওয়াভেল। ওয়াভেল থাকাকালীন বাঘটা বেশ কয়েকবার সেম্-এ এসেছিল কিন্তু মোষটা মারে নি।

সেম-এ পৌঁছনোর পরদিন ইবটসন যখন পাটোয়ারী, বনরক্ষী, আশপাশের গ্রামের গ্রাম-মোড়লদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শুরু করলেন আমি বেরোলাম বাঘের থাবার ছাপের খোঁজে। আমাদের ক্যাম্প আর নদীর সঙ্গমের মধ্যে, আর লাধিয়া নদীর দুই পাড়ে লম্বা লম্বা বালির চড়া। এই বালির ওপরে আমি একটা বাঘিনীর থাবার ছাপ দেখলাম–সেই সঙ্গে একটি কম বয়সী পুরুষ বাঘের ছাপও দেখা গেল। সম্ভবত এটা সেই বাচ্চাটার থাবার ছাপ যাকে আমি এপ্রিলে দেখেছিলাম। বাঘিনীটা লাধিয়া নদী বেশ কয়েকবার ওপার ওপার করেছে গত কয়েক দিনে আর গত রাতে আমাদের তাঁবুর সামনের এক ফালি বালির ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। গ্রামের লোকের ধারণা বাঘিনীটিই মানুষখেকো। গ্রামের সর্দারের মা মারা পড়ার পর বাঘিনীটা গ্রামে বারে বারে ফিরে এসেছে। সেইজন্যে তাদের সন্দেহ অমুলক নাও হতে পারে।

বাঘিনীটার থাবার ছাপ পরীক্ষা করে বোঝা গেল সে আকারে সাধারণ মাপের আর বয়সে যুবতী। কেন সে মানুষখেকো হল, তা পরে বের করা যাবে। কিন্তু গত বছর সঙ্গমের মরসুমে সে ছিল চুকা মানুষখেকোর সঙ্গে, তখন নিশ্চয়ই চুকা মানুষখেকোর শিকার খেতে ও তাকে সাহায্য করত। এইভাবে নরমাংসে ওর রুচি জন্মায় কিন্তু ওর কোনো সঙ্গী ছিল না যে ওর রসনা পরিতৃপ্ত করতে সাহায্য করতে পারে। কাজে কাজেই ওকে নিজেকেই মানুষখাকী হতে হয়েছে। এটা আমার ধারণা মাত্র এবং কিন্তু পরে এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।

নৈনিতাল ছাড়ার আগে আমি টনকপুরের তহশীলদারকে লিখেছিলাম আমার জন্যে চারটি বাচ্চা পুরুষ মোষ কিনে সেম-এ পাঠিয়ে দিতে; চারটি মোষের মধ্যে একটি পথেই মারা যায় অন্য তিনটি এসে পৌঁছয় ২৪শে। আমরা এই তিনটি মোষ আর ম্যাকডোনাল্ড যেটি আমাদের দিয়েছিলেন সব কটি একত্রে সেইদিনই সন্ধেবেলায় বাইরে বেঁধে দিয়েছিলাম। পরদিন সকালে যখন আমি জন্তুগুলিকে দেখতে গিয়েছি–দেখি চুকার অধিবাসীদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। গ্রামের আশপাশের জমিগুলিতে সদ্য লাঙল দেওয়া হয়েছে। তিনটি পরিবারের ওই চষা জমিতে তাদের গরু মোষের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। বাঘিনীটি গতরাতে তাদের খুব কাছ দিয়ে যাতায়াত করেছে। তাদের ভাগ্য ভাল কারণ প্রতিবারই গরু মোষগুলি বাঘিনীকে দেখতে পেয়ে ঘুমন্ত লোকজনদের সাবধান করে দিয়েছে। চষা জমি পেরিয়ে বাঘিনীটি কোটকিন্দ্রীর পথ ধরে চলে গিয়েছে। যাওয়ার পথে আমাদের দুটি মোষের খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে সে কিন্তু দুটির একটিকেও স্পর্শ করে নি।

আমরা সেম-এ পৌঁছনোর পরে পাটোয়ারী, বনরক্ষী এবং গ্রামবাসীরা আমাদের বুঝিয়েছিল যে মোষ বেঁধে রাখা শুধু সময়ের অপব্যয় হবে কারণ এদের দৃঢ় ধারণা মানুষখাকী ওগুলো মারবে না। কারণ হিসেবে ওরা বলেছিল এভাবে মানুষখাকীটিকে মারার চেষ্টা আগেও অনেকে করেছে কিন্তু কোনো ফল হয় নি–আর মানুষখাকীটা যদি-মোষই খেতে চায় তাহলে জঙ্গলে বহু মোষ চড়ে বেড়াচ্ছে, যে কোনো একটা বেছে নিলেই হল। ওদের উপদেশ সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মোষ বাঁধা বন্ধ করলাম না। এর পরের দু রাত বাঘিনীটা একটি বা একাধিক মোষের খুব কাছ দিয়ে যাতায়াত করেছে কিন্তু কাউকে স্পর্শ করে নি।

১৭ই সকালে আমরা যখন প্রাতরাশ সারছিলাম, থাকের মোড়লের ভাই তেওয়ারীর নেতৃত্বে একদল লোক ক্যাম্পে এসে পৌঁছল আর খবর দিল যে তাদের গ্রামের একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা বলল লোকটি গতকাল দুপুরে বেরিয়েছিল-যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বলে গিয়েছিল যে ওর গরু মোষ যাতে গ্রামের সীমানার বাইরে না চলে যায় তাই দেখতে যাচ্ছে ও। ওর না ফেরা দেখে মনে হচ্ছে মানুষখাকীর হাতে মারা পড়েছে লোকটি।

আমরা খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলাম এবং দশটা নাগাদ ইবটসনদের সঙ্গে আমি থাকের দিকে রওনা হলাম। আমাদের সঙ্গে রইল তেওয়ারী আর তার দলবল। দূরত্ব মাত্র দুমাইল হলে কি হবে চড়াইটা ভয়ানক খাড়া, আর আমরাও চেষ্টা করছিলাম কোনো সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে তাই আমরা যখন গ্রামের সীমানায় পৌঁছলাম তখন দলের সবাই হাঁপাচ্ছি, আমাদের গায়ে যেন ঘামের ফেনা ছুটছে।

আমরা যখন ঝোপে ঢাকা সমতল জমির টুকরোটার ওপর দিয়ে গ্রামের দিকে এগোচ্ছি তখন একটি স্ত্রীলোকের কান্না শুনতে পেলাম। এই সমতল ভূমিটির কথা যুক্তিসংগত কারণেই পরে আমি উল্লেখ করেছি। কোনো ভারতীয় স্ত্রীলোক যখন মৃতের শোকে চিৎকার করে কাঁদে তখন সে আওয়াজ ভুল করার উপায় নেই। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আমরা শোকার্ত স্ত্রীলোকটির কাছে এলাম। যে লোকটি নিখোঁজ হয়েছে তারই স্ত্রী মেয়েটি। চষা জমির পাড়ে আরও দশ পনেরজন লোক আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। এই লোকগুলি আমাদের জানাল যে ওপরে তাদের বাড়ি থেকে তারা সাদা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে, সেটা নিখোঁজ লোকটির কাপড় বলেই তাদের মনে হয়েছে। যেখানে তারা দেখতে পেয়েছে সে জায়গাটি আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে তিরিশ গজ দূরে, একটা ঘন ঝোপে ভরা জমিতে। ইবটসন, তেওয়ারী আর আমি সাদা জিনিসটার তল্লাসে বেরোলাম, মিসেস ইবটসন স্ত্রীলোকটিকে এবং অন্যান্য লোকজনদের নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হয়ে গেলেন।

মাঠটিতে কয়েক বছর চাষবাস হয় নি-মাঠটি এক জাতীয় ঘন ঝোপে ঢাকা, সে ঝোপের গাছগুলি অনেকটা চন্দ্রমল্লিকা গাছের মত। আমরা যখন সাদা জিনিসটার প্রায় ওপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তখন তেওয়ারী জিনিসটি নিখোঁজ মানুষটির ধুতি বলে চিনতে পারল। তার কাছেই পড়েছিল লোকটির টুপি। জায়গাটায় একটা লড়াই হয়ে গেছে বোঝা গেল কিন্তু কোথাও কোনো রক্তের চিহ্ন নেই। যেখানে প্রথম আক্রমণ হয়েছিল সেখানে আর যেখান দিয়ে লোকটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারও বেশ খানিকটা জায়গায় রক্তের দাগ না থাকার মানে বাঘটা লোকটিকে প্রথমে কামড়ে যে জায়গাটায় ধরেছিল সেখান থেকে দাঁত সরায় নি। কামড়ের জায়গা পরিবর্তন না করলে রক্ত পড়ার কথা নয়।

পাহাড়ে, আমাদের তিরিশ গজ ওপরে লতায় ঢাকা ঝোপের ভিড়। লোকটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন অনুসরণ করার আগে এই জায়গাটা ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে কারণ বাঘিনীটাকে আমাদের পেছনে রাখা কোনো কাজের কথা নয়। ঝোপের নিচে নরম মাটির ওপর আমরা বাঘিনীটার থাবার ছাপ দেখলাম। লোকটিকে আক্রমণ করার আগে এই জায়গাটিতেই বাঘিনীটা ওৎ পেতে ছিল।

আগেকার জায়গাটিতে ফিরে গিয়ে আমরা নিম্নলিখিত কার্যসূচী গ্রহণ করলাম। আমাদের প্রধান কাজ হল বাঘিনীটাকে অনুসরণ করে মড়ির ওপর থেকে গুলি করা। এর জন্যে আমাকে যেতে হবে চিহ্ন অনুসরণ করে আর একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে সামনের দিকে। তেওয়ারী, যার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না সে থাকবে আমার একগজ পেছনে আর তার কাজ হবে ডাইনে বাঁয়ে তীক্ষ্ণ লক্ষ রাখা। ইবটসন থাকবেন তেওয়ারীর একগজ পেছনেতার দায়িত্ব থাকবে পেছনের আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করার। আমি বা ইবটসন যদি বাঘিনীর একটা কেশাগ্রও কোথাও দেখতে পাই তাহলে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আমাদের গুলি ছুঁড়তে হবে।

এই জায়গাটায় গতকাল গরু চলেছিল ফলে জমির অবস্থা ভাল নয়। কোনো রক্তের দাগ ছিল না, বাঘটার যাওয়ার একমাত্র চিহ্ন ছিল কোথাও কোথাও উল্টে থাকা পাতার বা পায়ে মাড়ানো ঘাসে। তাই আমাদের অনুসরণের কাজটাও এগোচ্ছিল খুব ধীর গতিতে। লোকটিকে দুশো গজ মতন নিয়ে গিয়ে বাঘিনীটি তাকে মেরে ফেলে রেখে গিয়েছিল আবার কয়েক ঘণ্টা পরে এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই থাকের লোকেরা এইদিক থেকে কয়েকটি সম্বরের ডাক শুনতে পেয়েছিল। লোকটিকে মারার পরই না নিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে লোকটির গরু মোষগুলি এই আক্রমণ দেখেছিল। তারাই হয়তো বাঘিনীটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

লোকটি যেখানে পড়েছিল সে জায়গাটা রক্তে ভেসে গিয়েছিল। বাঘিনীটি আবার যখন লোকটিকে তুলে নিয়ে যায় তখন গলার জখম দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া বাঘিনীটি প্রথমে লোকটিকে ধরে গলায়, এবার ধরে ছিল পিঠে তাই অনুসরণের কাজটা আমাদের পক্ষে আরও শক্ত হয়ে উঠল। বাঘিনীটি পাহাড়ের ঢাল ছাড়ে নি–এখানে ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভিড়, দুএক গজের বেশি দূরে দেখাই যায় না তাই আমাদের গতিও ক্রমে মন্থর হয়ে এল। দুঘণ্টায় আমরা আধমাইল রাস্তা পেরিয়ে একটা ঢালের ওপর পৌঁছলাম। এই ঢালটির পরেই সেই উপত্যকাটি যেখানে ছ মাস আগে আমরা চুকার মানুষখেকো বাঘটার খোঁজ পেয়েছিলাম আর মেরেও ছিলাম। এই ঢালটির ওপরে একটা বিশাল ঊর্ধ্বমুখী পাথর অর্থাৎ আমরা যেদিক থেকে এসেছি পাথরটির মুখ তার বিপরীত দিকে। বাঘিনীটির থাবার ছাপ চলে গেছে পাথরটার ডান দিক ঘেঁষে–আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হল বাঘিনীটা পাথরের ঝুঁকে পড়া অংশটার নিচে অথবা তারই আশেপাশে লুকিয়ে আছে।

ইবটসন আর আমি দুজনেই হাল্কা রবার সোলের জুতো পরেছিলাম, তেওয়ারী ছিল খালি পায়ে–সেইজন্যে আমরা পাথরটার কাছে পৌঁছলাম নিঃশব্দে। ইসারায় আমার সঙ্গী দুজনকে দাঁড়িয়ে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে বলে আমি পাথরটার ওপর কোনোক্রমে একটা পা রেখে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে গেলাম। পাথরটার পরেই ছোট্ট কিছুটা সমতল জমি-জমিটা যতই আমার দৃষ্টির সামনে পরিস্ফুট হচ্ছে ততই আমার মনে হতে লাগল বাঘিনীটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আছে এ সন্দেহ আমার অমুলক নয়। আরো দু এক ফুট গেলে আমি জমিটার পুরোটা দেখতে পাব। এমন সময় আমার সামনে বাঁ দিকে একটা নড়াচড়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি সোনালী-ভঁটা গাছ চেপে রাখা হয়েছিল সেটা যেন হঠাৎ স্প্রিংয়ের মত সোজা হয়ে উঠল–তার এক মুহূর্তের মধ্যে দূরের ঝোপটা একটু নড়ে উঠল আর ঝোপগুলির ওধারে একটা গাছ থেকে একটা বাঁদর ডাকতে শুরু করল।

বাঘিনীটা তার খাওয়ার পর ঘুমনোর জায়গাটা বেছেছিল খুব সযত্নে কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সে ঘুমিয়ে পড়ে নি, পাথরের ওপর আমার মাথার ওপরটা দেখতে পেয়ে–টুপিটা আমি আগেই খুলে নিয়েছিলাম—ও উঠে দাঁড়ায় এবং একটু পাশে সরে গিয়ে একটা ব্ল্যাকবেরি ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। ও যদি অন্য কোথাও শুয়ে থাকত তাহলে ও যত তাড়াতাড়িই চলুক না কেন আমি গুলি করার আগে ও কিছুতেই সরে যেতে পারত না। আমাদের এত সযত্ন পরিকল্পিত অনুসরণ একেবারে শেষ মুহূর্তে ভেস্তে গেল। এখন মড়িটা খুঁজে বের করা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই আর দেখতে হবে আমাদের বসার মত মড়িটার যথেষ্ট অবশিষ্ট আছে কিনা। ব্ল্যাকবেরি ঝোপের মধ্যে ওকে অনুসরণ করা বৃথা আর তাতে ওকে পরে গুলি করার সুযোগও কমে যাবে।

বাঘিনীটা যেখানে শুয়েছিল তার কাছেই সে তার খাওয়া সেরেছে। জায়গাটা খোলা আকাশের নিচে শকুনদের নজরে আসার মত। সেইজন্যে সে তার মড়িটি সরিয়ে রেখেছে একটা নিরাপদ জায়গায় যেখানে আকাশ থেকে কিছু দেখা যাবে না। এখন অনুসরণ করা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে কারণ একটা রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এই চিহ্ন ধরে গিয়ে আমরা পেঁছলাম একটা বিরাট পাথরের ঢিবিতে। এই পাথরগুলির পঞ্চাশ গজ দূরেই আমরা মড়িটা দেখতে পেলাম।

ওই ছিন্নভিন্ন ক্ষতবিক্ষত রক্ত মাংসের তালের বর্ণনা দিয়ে আমি আপনাদের অনুভূতির ওপর অত্যাচার করতে চাই না। যে লোকটি কয়েক ঘণ্টা আগেই ছিল একজন মানুষ, দুই সন্তানের জনক, এই শোকার্ত স্ত্রীলোকটিকে, রোজগার করে খাওয়ানো পরানোর কর্তা তার শরীর সম্পূর্ণ নগ্ন, একটুকরো সুতো কোথাও নেই, মানুষের শরীরের সবটুকু মর্যাদা যেন তার শরীর থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। স্ত্রীলোকটিকে এখন মেনে চলতে হবে ভারতীয় বৈধব্যের কঠোর অনুশাসন, সারা জীবন এর থেকে আর মুক্তি নেই। আমি এরকম দৃশ্য, আমার বত্রিশ বছরের মানুষখেকো শিকারের জীবনে অনেক দেখেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে দুঃস্বপ্নের মত এই একতাল মাংসপিণ্ড দেখে সবাই কষ্ট পাওয়ার থেকে শিকার আর খাদককে এক জায়গায় ছেড়ে দিলেই ভাল হত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও খুনের বদলা খুন এই সহজাত প্রতিশোধ স্পৃহাই জয়ী হত, এছাড়াও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত আশপাশের গ্রামগুলিকে–যে সন্ত্রাসের থেকে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না এমন একটা সন্ত্রাস মুক্ত করার বাসনা। আর যতই উদ্ভট হক না কেন একটা আশা সব সময়েই থাকে যে কোনো অলৌকিক শক্তির জোরে বাঘের শিকার হয়তো এখনও বেঁচে আছে, হয়তো ওর শুশ্রূষার প্রয়োজন।

যে জানোয়ার সম্ভবত মড়ির ওপর জখম হয়ে মানুষখেকো হয়েছে তাকে মড়ির কাছে গুলি করার সুযোগ মেলে না বললেই চলে। তাকে মারার চেষ্টা যতই ব্যর্থ হয় সে যে ভাবেই হক না কেন, জানোয়ারটিও হয়ে ওঠে সেই পরিমাণে সতর্ক। এর পরে একটা সময় আসে যখন একবার খেয়েই জানোয়ারটি মড়ি ছেড়ে চলে যায় অথবা ছায়ার মত নিঃশব্দে ফিরে আসে। ফিরে আসার সময় প্রতিটি ডাল-পাতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে করতে আসে কারণ ও নিশ্চিত জানে যে তার হবু ঘাতক যতই সাবধানে লুকোক, যতই নিঃশব্দ, নিশ্চল হয়ে থাকুক ও তাকে খুঁজে বার করবেই, এরকম ক্ষেত্রে গুলি করার সুযোগ মেলে লাখে একটা কিন্তু সুযোগ এলে আমাদের মধ্যে কেউ ছাড়বে কি?

যে ঝোপটার মধ্যে বাঘিনীটা আশ্রয় নিয়েছিল সেটার আয়তন হবে প্রায় চল্লিশ বর্গ। গজ। বাঁদরটার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর পক্ষে এই ঝোঁপ পেরিয়ে যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। আর বাঁদরটা ওকে দেখলেই আমাদের হুশিয়ারী দেবে, সেইজন্যে আমরা পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসলাম ধূমপান করতে আর জঙ্গল আমাদের আরো কি শোনায় তা শোনার জন্যে। এর মধ্যেই আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমাদের পরবর্তী। কর্তব্য কি।

মাচা তৈরি করতে হলে আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে আর সেই ফাঁকে বাঘিনী নিশ্চয়ই মড়িটি তুলে নিয়ে যাবে। যখন সে পুরো মানুষটাকে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই তাকে অনুসরণ করা যথেষ্ট কঠিন ছিল আর এখন যখন ওর ভার অনেক কমে গেছে এবং ও বাধা পেয়েছে তখন ও হয়তো মাইলের পর মাইল চলে যাবে–আমরা হয়তো মড়িটা আর খুঁজেই পাব না। সেই জন্যেই আমাদের মধ্যে একজনকে মড়িটার কাছে থাকা দরকার, অন্য দুজন দড়ির খোঁজে গ্রামে যেতে পারে।

ইবটসন ওঁর স্বাভাবিক বেপরোয়া সাহসে গ্রামে যেতে চাইলেন। আমরা যে কঠিন রাস্তা দিয়ে সদ্য এসেছি সেটা এড়াবার জন্যে তিনি যখন তেওয়ারীর সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেলেন, আমি মড়ির কাছে একটা ছোট্ট গাছের ওপর চড়ে বসলাম। মাটির ওপর চারফুট মত উঠে গাছটা দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে তারই একটিতে হেলান দিয়ে, অন্যটিতে রেখে, কোনোক্রমে আমি বসলাম। আমার বসার জায়গাটির যা উচ্চতা তাতে বাঘিনী মড়ির দিকে এগোলে ওকে দেখা যাবে। আর ওর যদি আমাকে আক্রমণ করার কোনো মতলব থাকে তাহলে আক্রমণের দূরত্বে আসার আগেই আমি ওকে দেখতে পাব।’

ইবটসন যাওয়ার পর পনের কুড়ি মিনিট কেটেছে হঠাৎ আমি শুনলাম একটা পাথর সামনে-পেছনে টলে যাওয়ার শব্দ। বোঝাই যাচ্ছে পাথরটা খুব দুর্বল ভারসাম্য নিয়ে কোনো রকমে আটকে ছিল। বাঘিনী যখন ওটার ওপরে তার ভার দিয়েছে তখন পাথরটা সামনের দিকে টলে গেছে টের পেয়েই বাঘিনী পা সরিয়ে নিয়েছে আর পাথরটা আবার ফিরে এসেছে যথাস্থানে। আমার সামনে বাঁ দিকে প্রায় কুড়িগজ দূর থেকে, শব্দটা এসেছিল–আমার পক্ষে গাছ থেকে পড়ে না গিয়ে একমাত্র ওই একটা দিকেই গুলি করা সম্ভব।

সময় গড়িয়ে চলল–প্রতি মুহূর্তে আমার উচ্চ গ্রামে বাঁধা আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল। স্নায়ুর উত্তেজনা আর ভারি রাইফেলটার ভার যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, তখন হঠাৎ আমার কানে এল ঝোপের ওপর দিক থেকে একটা ডাল ভাঙার শব্দ। বাঘ কি ভাবে জঙ্গল দিয়ে চলতে পারে এটা তারই একটা উদাহরণ। আওয়াজটা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক কোথায় ও আছে, আমার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল সেই দিকে কিন্তু তা সত্ত্বেও ও এসেছে, আমায় দেখেছে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমায় লক্ষ করেছে তারপর চলে গেছে–অথচ একটি পাতা কিংবা একটা ঘাসের শীষ পর্যন্ত আমি নড়তে দেখি নি।

স্নায়ুর ওপর ভার যখন হঠাৎ কমে যায় তখন ব্যথায় আড়ষ্ট মাংসপেশীগুলি একটু আরাম চায়। এক্ষেত্রে তার মানে রাইফেলটা হাঁটুর ওপর নামিয়ে কাঁধের ও হাতের পেশীগুলিকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়া। যত সামান্যই হক না কেন এই একটু নড়াচড়াতেই আমার সারা শরীরটা যেন একটু আরাম পেল। বাঘিনীটার দিক থেকে আর কোনো আওয়াজ এল না, তার এক কি দুই ঘণ্টা পরে আমি শুনলাম ইবটসন ফিরে আসছেন।

আমি যতজনের সঙ্গে শিকারে গিয়েছি তার মধ্যে ইবটসনের মত সঙ্গী আর আমি কখনও পাই নি। ওঁর যে শুধু অসাধারণ সাহস তাই নয়, ওঁর প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি জিনিসের দিকে লক্ষ সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা শিকার করতে যান তাদের মধ্যে ইবটসনের মত স্বার্থ বোধহীন লোক বড় একটা দেখা যায় না। উনি গিয়েছিলেন শুধু দড়ি আনতে কিন্তু যখন ফিরে এলেন তখন ওর সঙ্গে কম্বল, কুশন, আমি যা খেতে পারি তার থেকেও ঢের বেশি চা আর প্রচুর পরিমাণে দুপুরের খাবার। আমি একটু চাঙ্গা হওয়ার জন্যে বসলাম মড়িটার যে দিক থেকে হাওয়া বইছে সেই দিকটায়। ইবটসন বাঘিনীর লক্ষ বিভ্রান্ত করার জন্যে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে একটা গাছের ওপর একজন লোক উঠিয়ে দিলেন আর নিজে উঠলেন মড়িটার ওপর একটা গাছে দড়ির মাচা তৈরি করতে।

মাচা তৈরি হয়ে গেলে ইবটসন মড়িটাকে কয়েক ফুট সরিয়ে নিলেন–কাজটা খুব আনন্দদায়ক হয় নি নিশ্চয়ই। তারপর একটা চারাগাছের গোড়ায় মড়িটাকে খুব শক্ত করে বেঁধে দিলেন যাতে বাঘিনীটা মড়ি নিয়ে না চলে যেতে পারে–কারণ চাঁদ ক্ষয়িষ্ণু, এই গাছে-ভরা জঙ্গলে জায়গাটা রাতের প্রথম ঘণ্টা দুয়েক সূচীভেদ্য অন্ধকারে ঢাকা থাকবে। শেষ সিগারেটটি খেয়ে আমি মাচায় উঠে বসলাম।

আমি একটু জুত করে বসার পরে ইবটসন–যে লোকটি বাঘিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্যে অন্য গাছে বসেছিল তাকে ডেকে নিলেন তারপর থাকের দিকে রওনা হয়ে গেলেন–সেখান থেকে মিসেস ইবটসনকে নিয়ে ওঁকে সেম-এ ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে।

বিদায়ী দলটি দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেও তাদের কণ্ঠস্বর তখনও মেলায় নি। এমন সময় আমি শুনলাম একটা ভারী শরীরের সঙ্গে পাতার ঘষটানির শব্দ–সেই মুহূর্তেই বাঁদরটা, যেটা এতক্ষণ চুপ করেছিল, সেটা ডাকতে আরম্ভ করল। আমি ব্ল্যাকবেরি ঝোপের ওপাশে গাছে বসা বাঁদরটাকে এখন দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার ভাগ্য আশাতীত রকম ভালবাঘিনীটার দৃষ্টি অন্যদিকে আকৃষ্ট করার জন্যে লোকটিকে অন্য গাছে বসিয়ে দেওয়ার কৌশল অন্য একবারের মত বেশ ভালই কাজ দিচ্ছে। একটা উদ্বেগ ভরা মিনিট কাটল তারপরে আরেকটা, হঠাৎ যে ঢিবিটার ওপর দিয়ে আমি বিশাল পাথরটার ওপর উঠেছিলাম সেদিক থেকে একটা কাকার আর্ত চিৎকার করতে করতে আমার দিকে দৌড়ে এল। তার মানে বাঘিনীটা মড়ির দিকে আসছে না, ইবটসনদের পিছু নিয়েছে। আমার উদ্বেগ তখন চরমে কারণ বোঝাই যাচ্ছে মড়ি ছেড়ে ও এখন একটা নতুন শিকার যোগাড় করার চেষ্টা করছে।

যাওয়ার আগে ইবটসন সবরকমভাবে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু ঢিবিটার এপারে আমার দিকে কাকারের ডাক শুনে ওঁর পক্ষে ভাবা স্বাভাবিক যে বাঘিনীটা মড়ির দিকেই এগোচ্ছে। এই ভেবে উনি যদি সতর্কতার বাঁধনে ঢিলে দেন তাহলেই বাঘিনীটা তার সুযোগ পেয়ে যাবে। এইভাবে অস্বাচ্ছন্দ্যে ভরা দশটি মিনিট কেটে গেল তারপর আমি শুনলাম থাকের দিক থেকে দ্বিতীয় কাকারের ডাক; বাঘিনীটা এখনও অনুসরণ করছে কিন্তু ওখানে জায়গাটা তুলনামুলকভাবে ফাঁকা হওয়ার দরুণ ওঁর দলটিকে আক্রমণের আশঙ্কা কম। ইবটসনদের বিপদের আশঙ্কা কিন্তু একেবারেই কমে নি কারণ ক্যাম্পে পৌঁছতে এখনও ওঁদের দু মাইল গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যেটা আমি আশঙ্কা করেছিলাম আর পরে সত্যিও প্রমাণিত হয়েছিল, ওঁরা যদি আমার গুলির আওয়াজ শোনার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকেন, তাহলে এখানে আসার পথে ওদের ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে। ভাগ্যক্রমে ইবটসন বিপদের গুরুত্ব বুঝেছিলেন এবং দলটিকে একজোটে রেখেছিলেন। পরদিন সকালে থাবার ছাপ দেখে বোঝা গেল বাঘিনীটা সারাটা পথ ওঁদের পিছু পিছু গিয়েছিল–কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁরা নিরাপদেই ক্যাম্পে পৌঁছেছিলেন।

কাকার আর সম্বরের ডাক থেকে আমি বাঘিনীটার গতিবিধি অনুমান করতে পারছিলাম। সূর্যাস্তের একঘণ্টা পরে সে দুমাইল দূরে উপত্যকাটার নিচে ছিল। এখনও তার সামনে সারাটা রাত পড়ে রয়েছে–তাই যদিও মড়ির কাছে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তবুও আমি কোনো একটা সুযোগ যদি আসে সেটার সদ্ব্যবহার করার জন্যে বদ্ধপরিকর রইলাম। সেটা ছিল প্রচণ্ড শীতের রাত, তাই ভাল করে কম্বল মুড়ি দিয়ে আমি বেশ জুত করে বসলাম। যাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নড়াচড়া না করলেও কোনো অসুবিধা না হয়।

আমি মাচায় বসেছিলাম বিকেল ৪টার সময়। রাত দশটা নাগাদ আমি শুনলাম দুটি জানোয়ার পাহাড় থেকে আমার দিকে নেমে আসছে। গাছের নিচের জমাট অন্ধকারে ওদের দেখা যাচ্ছে না। তবে ওরা যখন মড়িটার পায়ের দিকে এল তখন বুঝলাম ও দুটি শজারু। গায়ের কাঁটার শব্দ করে, গুরুগম্ভীর আওয়াজ করে–যা একমাত্র শজারুর পক্ষেই সম্ভব ওরা মড়িটার কাছে এগিয়ে বার কয়েক ঘুরে আবার নিজেদের পথ ধরল। আরো এক ঘণ্টা পরে চাঁদ তার বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠেছে। আমি নিচের উপত্যকা থেকে একটা জানোয়ারের ডাক শুনলাম। জানোয়ারটা যাচ্ছে পূব থেকে পশ্চিমদিকে। জানোয়ারটা মড়ির দিক থেকে যেদিকে হাওয়া নিচের দিকে বইছে সেদিকে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল–বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর খুব সাবধানে পাহাড় বেয়ে উঠে এল। জানোয়ারটা কিছুটা দূরে থাকতেই ওর বাতাসে গন্ধ শোঁকার শব্দ পেলাম। তখন বুঝলাম ওটা একটা ভাল্লুক। রক্তের গন্ধ ওকে আকর্ষণ করছে, কিন্তু রক্তের গন্ধের সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা মানুষের অবাঞ্ছিত গন্ধ-তাই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ও খুব সাবধানে মড়িটার খোঁজ করছিল। জঙ্গলে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তির অধিকারী এই জানোয়ারটি উপত্যকায় থাকতেই বুঝতে পেরেছিল যে মড়িটা কোনো বাঘের সম্পত্তি। অকুতোভয় হিমালয়ের ভাল্লুকের কাছে এটা কোনো একটা বাধাই নয় কারণ ও মড়ির কাছ থেকে বাঘকে তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমার আগের কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বলছি। ওকে যেটা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সেটা হল রক্ত আর বাঘের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের গায়ের গন্ধ।

সমতল জমিটাতে পৌঁছে ভাল্লুকটা মড়ির কয়েক গজ দূরে পেছন ভর দিয়ে বসল। যখন ওর বিশ্বাস হল যে ঘৃণ্য মানুষের গন্ধে ওর কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই ও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে একটা লম্বা, টানা, চিৎকার করল। ডাকটা সম্ভবত তার কোনো সঙ্গিনীকেই, প্রতিধ্বনি তুলে উপত্যকার নিচে চলে গেল। তারপর আর কোনো ইতস্তত না করে সে দৃঢ় পদক্ষেপে মড়িটার কাছে চলে গেল। ও যখন মড়িটার গন্ধ শুঁকছে তখন আমি রাইফেল তুলে ওর ওপর তাক করলাম। হিমালয়ের ভালুকের মানুষ খাওয়ার ঘটনা আমি একটাই জানি; সেটা ঘটেছিল, যখন একটি স্ত্রীলোক ঘাস কাটতে কাটতে পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে যায়। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীলোকটি মারা যায়। পরে একটা ভাল্লুক তার ঘঁাতলানো শরীরটা দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে। যে ভাল্লুকটির কাঁধের ওপর আমার বন্দুকের নিশানা ঠিক করা আছে তার অবশ্য নরমাংসে কোনো রুচি আছে বলে মনে হল না। মড়িটা দেখে গন্ধ খুঁকে ও আবার পশ্চিমমুখী যাত্রা শুরু করল। ওর চলে যাওয়ার শব্দ যখন দূরে মিলিয়ে গেল তখন জঙ্গলে আবার নেমে এল জমাট স্তব্ধতা। সে স্তব্ধতা ভাঙল সূর্যোদয়ের পরে, ইবটসন আসার পরে।

ইবটসনের সঙ্গে এসেছিল মৃত লোকটির ভাই এবং অন্যান্য আত্মীয়, ওরা মৃতের দেহাবশেষ খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে একটা পরিষ্কার সাদা কাপড়ে জড়িয়ে নিল, তারপর দুটো চারাগাছের সঙ্গে ইবটসনের দেওয়া দড়ি দিয়ে একটা দোলনা মতন বানিয়ে সারদা নদীর তীরে শ্মশান ঘাটের দিকে রওনা হল। যাওয়ার সময়ে তারা হিন্দু মন্ত্র ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’ আর তার আখর ‘সত্য বোল সত্ হ্যায়’ বলতে বলতে গেল।

চোদ্দ ঘণ্টা ঠান্ডায় বসে থাকা আমার পক্ষে খুব সুখপ্রদ হয় নি ঠিকই কিন্তু ইবটসনের আনা গরম পানীয় আর খাবার খাওয়ার পর রাতে পাহারা দেওয়ার সব কষ্ট আমি ভুলে গেলাম।

২৭শে সন্ধেবেলা ইবটসনদের চুকা পর্যন্ত অনুসরণ করার পর বাঘিনীটা রাতে কোনো এক সময়ে লাধিয়া পেরিয়ে আমাদের ক্যাম্পের পেছনে একটা আগাছার জঙ্গলে ঢুকেছিল। এই আগাছার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা পথ ছিল যেটা গ্রামবাসীরা মানুষখেকো আসার আগে পর্যন্ত নিয়মিত ব্যবহার করত। এরপরে পথটা বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। ২৮ তারিখে দুজন ডাকহরকরা, যারা ইবটসনের ডাক টনকপুরের পথের প্রথম পর্যায়টা নিয়ে যেতো, তারা ক্যাম্পে দেরি হয়ে যাওয়ায় সময় বাঁচানোর জন্যে ওই আগাছার জঙ্গলের রাস্তাটা দিয়ে শর্টকাট করার চেষ্টা করে অথবা সঠিকভাবে বলতে গেলে সবে শর্টকাটের পথ ধরেছিল। ওদের সৌভাগ্য যে সামনের লোকটি খুব সজাগ ছিল আর সে ওই বাঘিনীটাকে দেখতে পায় ঝোপের মধ্যে দিয়ে গুঁড়ি মেরে মেরে আসতে এবং তাদের সামনে রাস্তায় ওপর শুয়ে থাকতে।

যখন লোকদুটি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ক্যাম্পে গেল তখন আমি আর ইবটসন সবে থাক থেকে ফিরেছি, আমরা তাড়াতাড়ি রাইফেল নিয়ে খোঁজ নিতে ছুটলাম। যেখান থেকে বাঘিনীটা রাস্তায় বেরিয়ে লোকগুলিকে কিছুটা অনুসরণ করেছিল সেখানে তার থাবার ছাপ দেখলাম কিন্তু বাঘিনীটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। যদিও একটা জায়গায় যেখানে আগাছার ঝোঁপ খুব ঘন সেখানে একটা নড়াচড়া আর একটা জানোয়ারের চলে যাওয়া আমরা লক্ষ করেছিলাম।

২৯শে সকালে থাক ছেড়ে একদল লোক এসে খবর দিল যে তাদের একটা ষাঁড় গত রাত্রে গোয়ালে ফেরে নি; যেখানে ষাঁড়টাকে শেষ দেখা গিয়েছিল সেখানে অল্প একটু রক্তের ছাপ দেখা গেছে। বেলা দুটোর সময় আমি আর ইবটসনরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। এক পলক মাটির দিকে তাকিয়েই আমরা বুঝলাম যে কোনো বাঘই ষাঁড়টাকে মেরে টেনে নিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নভোজন শেষ করে আমি আর ইবটসন ষাঁড়টাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ ধরে অগ্রসর হলাম। আমাদের সঙ্গে দুজন লোক চলল মাচা তৈরির দড়ি বয়ে। দাগটা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে একশো গজ তারপর সোজা নেমে গেছে সেই খাদটার ভেতর যেখানে গত এপ্রিলে আমি বড় বাঘটাকে গুলি করেছিলাম কিন্তু আমার তাক ফসকে গিয়েছিল। এই খাদটার কয়েকশো গজ নিচে বিশালদেহী ষাঁড়টা দুটো পাথরের ফাঁকে ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলছে। ষাঁড়টাকে সরাতে না পেরে বাঘিনীটা ওর পেছন দিক থেকে কিছুটা খেয়ে বাকিটা ফেলে চলে গেছে।

একটা বিরাট ওজন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বলে বাঘিনীটার থাবার ছাপ ধেবড়ে গেছে সেইজন্য বলা মুশকিল ওটা সেই মানুষখেকোটাই কি না। কিন্তু এ অঞ্চলের কোনো বাঘই আমাদের সন্দেহের বাইরে নয়, কাজেই আমি মড়ির ওপর বসাই স্থির করলাম। মড়িটার ধারেকাছে শুধু একটাই নিঃসঙ্গ গাছ, লোকজনেরা যখন তার ওপরে মাচা তৈরি করতে উঠছে নিচের উপত্যকা থেকে বাঘের ডাক শুরু হল। খুব তাড়াতাড়ি দুটো ডালের মধ্যে কয়েকটা দড়ি পাক দিয়ে দেওয়া হল–ইবটসন রাইফেল হাতে পাহারায় রইলেন, আমি গাছে উঠে আমার জায়গায় বসলাম। আগামী চোদ্দ ঘণ্টার মধ্যে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে এরকম কষ্টদায়ক আর বিপজ্জনক মাচায় আমি আর কখনও বসি নি। গাছটা পাহাড়ের গা থেকে হেলে ছিল আর অসমানভাবে টানা যে তিনটি দড়ির ওপর আমি বসেছিলাম তার ঠিক নিচে একশো। গজ মত খাড়া খাদ গিয়ে পড়েছে একটা পাথরভর্তি নালায়।

আমি গাছে ওঠার সময় বাঘটা বেশ কয়েকবার ডেকেছিল–সন্ধে গম্ভীর হওয়া পর্যন্ত সে ডাক সমানেই চলল, শুধু ডাকের মধ্যে সময়ের ব্যবধানটা বেড়ে যাচ্ছিল। ওর শেষ ডাকটা শোনা গেল আধ মাইলটাক দূরের একটা ঢিবির ওপর থেকে। পরিষ্কার বোঝা গেল বাঘটা মড়ির কাছাকাছিই ছিল আর ও লোকজনদের গাছে ওঠা দেখতে পেয়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই ওঁ বুঝতে পেরেছিল এর মানে কি আর তাই গর্জন করে ও বাধা পাওয়ার প্রতিবাদ জানায়। বাঘটা নিশ্চয়ই তারপরে চলে গিয়েছিল কারণ পরদিন সকালে ইবটসন আসা পর্যন্ত আমি ঠায় ওই তিনটে দড়ির ওপর বসেছিলাম কিন্তু সারা রাতের মধ্যে আর কিছু দেখি নি, শুনিও নি।

খাদটা গভীর আর গাছে ঢাকাই শকুনদের পক্ষে মড়িটা দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়-ষাঁড়টাও আকারে এত বড় যে বাঘটার বেশ কয়েকবারের খাওয়া চলবে তাই আমরা মড়িটা যেখানে পড়ে আছে সেখানে আর না বসাই স্থির করলাম।

আমাদের আশা ছিল যে বাঘটা মড়িটাকে কোনো সুবিধাজনক জায়গায় টেনে নিয়ে যাবে যেখানে আমাদের পক্ষে গুলি চালানোও সহজ হবে, এ আশা অবশ্য আমাদের হতাশায় পর্যবসিত হয়েছিল কারণ বাঘটা আর মরি কাছে ফিরে আসে নি।

দু রাত পরে সেম-এ আমাদের ক্যাম্পের পেছনে যে মোষটা বেঁধে রাখা হয়েছিল সেটা মারা পড়ে আর আমরাই সামান্য একটু অমনোযোগিতার জন্যে বাঘটাকে মারার একটা সুবর্ণ সুযোগ আমরা হারাই।

যে লোকগুলি এই দুর্ঘটনার সংবাদ আনে তারা বলে, যে দড়িটা দিয়ে মোষটি বাঁধা ছিল সেটা ছিঁড়ে খাদের নিচ থেকে মোষটাকে ওপরে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা সেই খাদ যেখানে আমি আর ম্যাকডোনাল্ড গত এপ্রিলে একটা বাঘিনীর পিছু নিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু সেবার বাঘিনীটি তার মড়ি খাদের কিছুটা ওপরে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমি বোকার মত সিদ্ধান্ত করলাম এবারও বাঘিনীটি সেইরকমই কিছু করবে।

প্রাতরাশ সেরে আমি আর ইবটসন বেরোলাম মড়িটা দেখার জন্যে আর সন্ধেবেলা মড়িটার ওপর বসার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা যাচাই করার জন্যে। যে খাদের মধ্যে মোষটি মারা পড়েছে সেটা প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া আর নিচে গম্ভীর হয়ে মিশেছে পাহাড়ের পাদদেশের সঙ্গে।

খাদটা দুশো গজ মত সোজা চলে গেছে তারপর বেঁকে গেছে বাঁ দিকে। বাঁকটার পরেই বাঁদিকে একটা জায়গায় ঘন চারাগাছের ঠাস বুনোনি আর তারপরেই একটা একশো ফুট ঘাসে ঢাকা ঢিবি। খাদটার মধ্যে চারাগাছগুলোর কাছে একটা ছোট্ট পুকুরমত আছে। আমি এপ্রিল মাসে খাদটা বেয়ে বেশ কয়েকবার উঠেছি কিন্তু চারাগাছের জঙ্গলটি বাঘের লুকনোর সম্ভাব্য জায়গা বলে আমার কখনও মনে হয় নি–সেইজন্যেই মোড় নেওয়ার সময় আমার যত সতর্ক থাকা উচিত ছিল তা আমি ছিলাম না। ফলে পুকুরে জলপানরত বাঘিনীটাই আমাদের প্রথম দেখতে পায়। ওর পালাবার একটাই মাত্র নিরাপদ পথ ছিল, সেটাই ও ধরল। পথটা সোজা পাহাড়ের খাড়াই ধরে, ঢিবিটার ওপর দিয়ে দূরে শালবনে গিয়ে মিশেছে।

পাহাড়ে চড়ার পক্ষে খাড়াটাই অত্যন্ত বেশি তাই আমরা একটা সম্বরের চলার পথ ধরে খাদটার গা বেয়ে চললাম। এই পথটা অনুসরণ করেই আমরা এসে পৌঁছলাম ঢিবিটার ওপর। বাঘিনীটা এখন একটা ত্রিভুজাকৃতি জঙ্গলের মধ্যে তার একদিকে ঢিবিটা, একদিকে লাধিয়া আর অন্যদিকে একটা গিরিশিখর যার গা বেয়ে নামা কোনো জানোয়ারের পক্ষে সম্ভব নয়। জঙ্গলটার আয়তন বড় নয় আর এর মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটা হরিণ যেগুলো মধ্যে মধ্যে ডেকে বাঘের গতিবিধি সম্বন্ধে আমাদের ওয়াকিবহাল রাখছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, জমিটায় গভীর সরু সব বৃষ্টির জলের নালা–এগুলোর মধ্যেই শেষে আমরা বাঘিনীর থাবার ছাপ হারিয়ে ফেললাম।

আমরা তখনও মড়িটা দেখি নি তাই আমার সেই সম্বর চলার পথ ধরেই আবার খাদে ফিরে গেলাম আর মড়িটাকে পেলাম চারাগাছগুলির মধ্যে লুকনো অবস্থায়। এই চারাগাছগুলির গুঁড়ির ব্যাস ছ ইঞ্চি থেকে এক ফুটের মধ্যে। মাচা বাঁধার পক্ষে এগুলো যথেষ্ট মজবুত নয় তাই মাচা বাঁধার পরিকল্পনা আমাদের ত্যাগ করতে হল। একটা শাবল দিয়ে অরণ্য পাহাড়ের গা থেকে একটা পাথর তুলে দিয়ে বসার জায়গা করা যেত কিন্তু যেখানে মানুষখেকো নিয়ে কারবার সেখানে তা না করাই ভাল।

অথচ গুলি করার এরকম একটা সুযোগ ছেড়ে দিতেও আমাদের ঘোর অনিচ্ছে, তাই আমরা মড়ির কাছে ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকার কথা ভাবলাম কারণ আমাদের আশা ছিল বাঘিনীটা অন্ধকার নামার আগেই ফিরে আসবে আর ও আমাদের দেখার আগেই ওকে আমরা দেখতে পাব। কিন্তু এই পরিকল্পনার দুটো প্রধান অন্তরায় ছিল (ক) আমরা যদি গুলি চালাতে না পারি আর বাঘিনীটা যদি ওর মড়ির কাছে আমাদের দেখতে পায় তাহলে গত দুবারের মত এবারও হয়তো সে মড়িটা ছেড়ে চলে যাবে। (খ) মড়িটা আর ক্যাম্পের মধ্যের জায়গাটায় ঘন আগাছার জঙ্গল, আমরা অন্ধকারে এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাঘিনীটা ইচ্ছেমত আমাদের বিপদে ফেলতে পারে। সেইজন্য গভীর অনিচ্ছে সত্ত্বেও আমরা সে রাতের মত মড়িটা বাঘের কাছে রেখে যাওয়াই স্থির করলাম–সব পরিকল্পনা আমাদের তোলা রইল পরদিন সকালের জন্য।

পরদিন সকালে ফিরে এসে দেখি বাঘিনী মড়িটা তুলে নিয়ে গেছে। খাদের নিচ দিয়ে প্রায় তিনশো গজ মত সে গেছে পাথরের ওপর পা দিয়ে দিয়ে। মড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ কোথাও নেই। মড়িটা যেখান থেকে তোলা হয়েছে তার তিনশো গজ দূরে একটা জায়গায় আমরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। যদিও ভিজে জমির ওপর বেশ কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে কিন্তু এর কোনোটাই সে মড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে হয় নি। অবশেষে, কয়েকবার জায়গাটা চক্কর মেরে আমরা সেই জায়গাটি খুঁজে পেলাম যেখানে খাদ ছেড়ে বাঘিনীটি বাঁ দিকের পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে।

যে পাহাড়টার ওপর দিয়ে বাঘিনী তার মড়ি নিয়ে গেছে সেটা ফার্ন এবং সোনালী-আঁটা গাছে ভরতি তাই বাঘিনীটাকে অনুসরণ করা কঠিন নয়। কিন্তু ওপরে ওঠা কঠিন কারণ পাহাড়টার চড়াই খুব খাড়া আর মধ্যে মধ্যেই আমাদের পথ ছেড়ে ঘুরে অন্যদিকে গিয়ে চিহ্ন খুঁজে নিতে হচ্ছিল। এই দুরূহ পথ প্রায় হাজার ফুট ওঠার পর আমরা এসে পৌঁছলাম একটা সমতল ভূমিতে, তার বাঁ দিকে প্রায় এক মাইল চওড়া একটা পাহাড়। সমতল জমিটার পাহাড়ের দিকটি ফাটা এবড়ো খেবড়ো আর এই গর্তগুলির মধ্যে গজিয়ে উঠেছে নিবিড় শালবন–গাছগুলো দু ফুট থেকে ছ ফুট লম্বা। বাঘিনীটার মড়ি টেনে নিয়ে গেছে ওই নিবিড় শালবনের আশ্রয়ে। মড়িটার গায়ে পা-লাগা পর্যন্ত আমার বুঝতে পারি নি কোথায় আছে ওটা।

মোষটার যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু দেখার জন্য আমরা তাকিয়েছি এমন সময়ে আমাদের ডান দিকে একটা চাপা গর্জন শোনা গেল। রাইফেল তুলে আমরা মিনিটখানেক অপেক্ষা করলাম তারপর যেখান থেকে গর্জনটা এসেছে তার কিছু দূরে একটা ঝোপে নড়াচড়া দেখে আমরা চারাগাছগুলো ঠেলে দশ গজ মত এগিয়ে একটা ছোট পরিষ্কারমত জায়গায় এলাম। এখানেই বাঘিনীটা নরম ঘাসের ওপর ঘুমিয়েছিল। ১ ঘেসো জমিটার ওধারে পাহাড়টার আরো বিশ গজ মত ওপরে একটা সমতল জায়গা। যে আওয়াজটা আমরা শুনেছিলাম সেটা এসেছিল ওই ঢাল থেকেই। যত নিঃশব্দে সম্ভব ঢালটি বেয়ে উঠে আমরা সবে পঞ্চাশ গজ মত চওড়া সমতল জমিটাতে পৌঁছেছি এমন সময় বাঘিনীটা ঢালের ওদিক দিয়ে খাদের মধ্যে নেমে গেল কিছু কালিজ আর একটি কাকার দ্রুত চিৎকার করে উঠল। ওকে অনুসরণ করা বৃথা সেইজন্য আমরা মড়িটার কাছে ফিরে এলাম। মড়িটা এখনও খাওয়ার মত যথেষ্ট অবশিষ্ট আছে, তাই বসার মত দুটো গাছ ঠিক করে আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম।

তাড়াতাড়ি দুপরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা মড়ির কাছে ফিরে গেলাম। রাইফেল থাকাতে কিছুটা কষ্ট করেই আমরা আমাদের বাছাই করা গাছ দুটিতে উঠলাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বসে রইলাম আমরা, কিন্তু কিছুই দেখতে বা শুনতে পেলাম না। সন্ধেবেলা আমরা গাছ থেকে নেমে এলাম, তারপর ফাটা অসমতল জমির ওপর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে আমরা খাদটার কাছে পৌঁছলাম। তখন অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। আমাদের দুজনেরই একটা অদ্ভুত গা শিরশির করা অনুভূতি হচ্ছিল যে আমাদের পেছন থেকে কেউ যেন অনুসরণ করছে। কিন্তু দুজনে কাছাকাছি থেকে বিনা বিপত্তিতেই আমরা রাত নটা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরলাম।

ইবটসনরা যতদিন সম্ভব সেম-এ কাটালেন। এবার তাদের যাওয়ার পালা। পরদিন খুব সকালে আসকটে তাদের পূর্ব নির্ধারিত কাজের তাগিদে তারা তাঁদের বার দিনের পদযাত্রা আরম্ভ করলেন। যাওয়ার আগে ইবটসন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমি কোনো মড়ি একা অনুসরণ করব না বা সেম-এ আর দু একদিনের বেশি থেকে আরও বেশি করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করব না।

ইবটসন ও তাঁর পঞ্চাশজন লোকজন চলে যাওয়ার পরে ঘন আগাছার জঙ্গলে ঘেরা আমাদের ক্যাম্পটিতে রইলাম শুধু আমি আর আমার দুই ভৃত্য–আমার কুলিরা ছিল গ্রামের সর্দারের বাড়ির একটি ঘরে। তাই সারাদিন ধরে আমি তাদের লাগিয়ে দিলাম ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহের কাজে–এখানে এ কাঠ অজস্র পাওয়া যায়। এই কারণে আমি চেয়েছিলাম সারা রাত আগুন জ্বালিয়ে রাখতে। আগুন দেখে ভয় পেয়ে পালাবে না হয়তো বাঘিনীটা কিন্তু সে যদি আমাদের তাঁবুর আশেপাশে রাতে ঘোরাঘুরি করে, তাহলে আগুনের আলোয় তাকে দেখতে পাব আমরা। যাই হক রাতে বড় করে আগুন জ্বালিয়ে রাখার সপক্ষে প্রয়োজন হলে আমাদের যুক্তি আছে–কারণ রাতগুলো এখন বেশ ঠাণ্ডা।

সন্ধের দিকে আমার লোকেরা নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে এলে বাঘিনীটা নদী পেরিয়েছে কিনা দেখার জন্যে একটা রাইফেল নিয়ে আমি লাধিয়ার দিকে গেলাম। আমি বালির ওপর বেশ কিছু ছাপ দেখলাম কিন্তু তার মধ্যে কোনোটাই নতুন নয়। সন্ধেবেলা যখন আমি ফিরলাম তখন আমার ধারণা আরও দৃঢ় হল যে বাঘিনীটা এখনও নদী পেরোয় নি, আমাদের দিকেই আছে। প্রায় এক ঘণ্টা পরে, অন্ধকার তখন বেশ ঘনিয়ে এসেছে, হঠাৎ আমাদের তাবুর কাছে একটা কাকার ডাকতে শুরু করল, তার ডাক সমানে চলল প্রায় আধণ্টা ধরে।

মোষ বাঁধার কাজটি, যার দায়িত্ব আগে ছিল ইবটসনের লোকদের ওপর, তার ভার এখন আমার লোকরাই নিল। পরদিন সকালে তারা যখন মোষগুলোকে আনতে গেল তখন আমি তাদের সঙ্গে গেলাম। আমরা বেশ কয়েক মাইল হাঁটলাম কিন্তু বাঘিনীর কোনো চিহ্নআমার চোখে পড়ল না। প্রাতরাশ সেরে একটা ছিপ নিয়ে আমি দুটি নদী যেখানে মিলেছে সেখানে গেলাম। সেদিনটা আমার জীবনে সবচেয়ে ভাল একটা মাছ ধরার দিন। জায়গাটা বড় বড় মাছে ভর্তি। আমার হুইল বারে বারে ভেঙে গেলেও সেদিন মহাশোল মাছ যা মেরেছিলাম তা আমার ক্যাম্পকে খাওয়ানোর পক্ষে যথেষ্ট।

আগের সন্ধের মতই আজও আমি লাধিয়া পেরোলাম, উদ্দেশ্য একটাই পাথরের ওপর থেকে নদীর ডান পাড়ে খোলা জায়গাটার ওপর নজর রাখা–লক্ষ করা কখন বাঘিনীটা নদী পেরোয়। দুটি নদীর সঙ্গমের জলোচ্ছ্বাসের আওয়াজ থেকে সরে আসতেই শুনলাম আমার বাঁ দিকে পাহাড় থেকে একটা সম্বর আর একটা হরিণের ডাক, পাথরটার কাছে এগোতেই দেখলাম বাঘিনীটার সদ্য ফেলা থাবার ছাপ। সেই ছাপ অনুসরণ করে ফিরে এসে দেখি যেখানে বাঘিনীটা হেঁটে নদী পেরিয়েছে সেখানকার পাথরগুলি তখনও ভিজে। মাছ ধরার সুতো শুকোবার জন্যে কয়েক মিনিট দেরি, এক কাপ চায়ের প্রলোভনে কিছুটা সময় ব্যয়-এর মূল্য দিতে হবে একটি মানুষের জীবন দিয়ে, কয়েক হাজার লোকের সপ্তাহের পর সপ্তাহ উদ্বেগের আর আমার দীর্ঘ পরিশ্রমের বিনিময়ে। কারণ আমি যদিও সেম-এ আরো তিনদিন ছিলাম বাঘিনীটাকে গুলি করার আর কোনো সুযোগ আমি পাই নি।

৭ই সকালে টনকপুরে যাওয়ার কুড়ি মাইল হাঁটার প্রস্তুতি হিসেবে যখন আমি ক্যাম্প ভেঙে দিচ্ছিলাম তখন আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন ভিড় করে এল। তারা আমায় অনুরোধ করল আমি যেন তাদের মানুষখেকোর খেয়ালখুশির ওপর ফেলে দিয়ে না চলে যাই। ওদের মত অবস্থায় যারা পড়েছে তাহাদের যতটুকু উপদেশ দেওয়া যায় তা দিয়ে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিলাম তাদের।

পরদিন সকালে টনকপুর থেকে আমি ট্রেন ধরলাম এবং ৯ই নভেম্বর নৈনিতালে পৌঁছলাম। আমি ঠিক একমাস বাইরে ছিলাম।

আমি ৭ই নভেম্বর সে ছেড়েছি আর ১২ই থাকে, মানুষখেকোর হাতে একটি মানুষ মারা পড়েছে। খবরটা আমি পেলাম, হলদিঘাটের আঞ্চলিক বনবিভাগের অফিসারের মাধ্যমে-পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের শীতকালীন গৃহে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। জোর কদমে হেঁটে ২৪শে সকালে সূর্যোদয়ের কিছু পরেই আমি চুকায় পৌঁছলাম।

আমার ইচ্ছে ছিল চুকায় প্রাতরাশ সেরে থাকে চলে যাব আর থাক গ্রামটিকেই আমার প্রধান কর্মকেন্দ্র করব। কিন্তু থাকের মোড়ল, যাকে আমি পেলাম চুকায়, আমায় বলল যে ১২ই লোকটি মারা পড়ার পরই প্রতিটি নরনারী, শিশু থাক ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি যদি থাকে ক্যাম্প ফেলতে চাই তাহলে আমি হয়তো নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারব কিন্তু আমার সঙ্গের লোকজনদের জীবন রক্ষা আমি করতে পারব না। খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা। আমি লোকজন পৌঁছনোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই মোড়ল আমার ক্যাম্প করার একটা জায়গা বাছাই করতে সাহায্য করল। এমন একটা জায়গা নেওয়া হল যেখানে আমার লোকজন মোটামুটি নিরাপদ থাকবে। আমিও-জঙ্গল কাটতে যে হাজার হাজার লোকের ভিড় হচ্ছে তার বাইরে একটু নিরিবিলি থাকতে পারব।

মড়িটা সম্বন্ধে বিভাগের আঞ্চলিক অফিসারের তার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি টনকপুরের তহশীলদারকে তার যোগে চুকায় তিনটি কচি মোষ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমার অনুরোধ অনুযায়ী খুব তৎপরতার সঙ্গে কাজ করা হয়েছিল। আমি পৌঁছনোর আগের দিন সন্ধেবেলায় তিনটি জানোয়ার চুকায় পৌঁছে গিয়েছিল।

প্রাতরাশ সেরে, আমি একটি মোষ নিয়ে থাকের দিকে রওনা হয়ে গেলাম– উদ্দেশ্য ছিল ১২ই লোকটা যেখানে মারা পড়েছে মোষটা সেখানে বেঁধে দেওয়া। মোড়ল আমাকে সেদিনকার ঘটনার একটা নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিল কারণ সে নিজেই প্রায় মরতে বসেছিল বাঘিনীর হাতে। মনে হল সেদিন বিকেল নাগাদ ওর দশ বছর বয়সী নাতনীকে নিয়ে বাড়ি থেকে ষাট গজ দূরে একটা খেতে ও আদা তুলতে গিয়েছিল। এই খেতটা আয়তনে দেড় বিঘার মতন হবে আর তিন দিক জঙ্গলে ঘেরা। বেশ খাড়া একটা পাহাড়ের ঢালের ওপর অবস্থিত হওয়ায় খেতটা মোড়লের বাড়ি থেকে দেখা যায়। বৃদ্ধ এবং তার নাতনী বেশ কিছুক্ষণ কাজ করার পর ওর স্ত্রী, বাড়ির উঠোনে ধান কুটছিল, খুব উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে ওকে জিজ্ঞাসা করে ও কি কালা? ও কি শুনতে পাচ্ছে না ওর ওপরের জঙ্গলে ময়ূর এবং অন্যান্য পাখিরা কিচির-মিচির শুরু করেছে? সৌভাগ্যক্রমে ও খুব তৎপরতার সঙ্গেই কাজ করেছিল। কোদাল ফেলে, শিশুটির হাত ধরে ও বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। ওর স্ত্রীর চিৎকার সমানেই চলে, আর সে বলতে থাকে খেতের ওপর দিকটার ঝোপের মধ্যে ও লাল কোনো একটা জানোয়ার দেখতে পাচ্ছে। এর আধঘণ্টা পরে মোড়লের বাড়ি থেকে তিনশো গজ দূরে একটা মাঠে গাছের ডাল কাটতে কাটতেই লোকটি বাঘিনীটার হাতে মারা পড়ে।

মোড়লের বর্ণনা শোনার পর সেই গাছটা খুঁজে বার করতে আমার কোন অসুবিধে হল না। ওটা ছিল দুটো ধাপকাটা খেতের মধ্যেকার তিনফুট উঁচু আলের ওপর গজিয়ে ওঠা গাঁটওয়ালা ছোট্ট গাছ-বছরের পর বছর এর পাতা কেটে গরু মোষদের খাওয়ানো হয়। যে মানুষটি মারা পড়েছিল সে গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে একটা ডাল ধরে আরেকটা ডাল কাটছিল যখন, বাঘিনীটা পেছন দিকে থেকে আসে, ডাল থেকে ওর হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেয় তারপর ওকে মেরে ফেলে টেনে নিয়ে যায়। খেতের সীমানা বরাবর ঘন ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে।

থাক গ্রামটি বর্তমান জমিদারের পুর্বপুরুষদের উপহার দেন চাঁদ রাজারা যারা গুখা দখলের আগে বহু শত বছর ধরে কুমায়ুনে রাজত্ব করেন। এই উপহারটি দেওয়া হয় পূর্ণগিরির মন্দিরে তাঁদের কাজের বিনিময়ে। (চাঁদ রাজাদের প্রতিশ্রুতি যে থাক এবং অন্য দুটি গ্রামের সব জমি সর্বসময়ের জন্যে খাজনা মুক্ত থাকবে। তার সম্মান ইংরেজ সরকার একশো বছর ধরে রেখেছিল। কয়েকটা কুঁড়েঘরের সমষ্টি থেকে কালক্রমে গ্রামটি একটি বেশ সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখন এখানে বেশ টালিছাওয়া পাকা বাড়ি দেখা যায়। তার কারণ এখানকার জমিই শুধু উর্বর নয়, মন্দিরগুলি থেকে আয়ও এখানে যথেষ্ট।

কুমায়ুনের অন্যান্য গ্রামের মতই থাক তার একশো বছরের জীবনে অনেক ওঠা পড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এর দীর্ঘ ইতিহাসে গ্রাম এরকম কঁকা হয়ে যাওয়ার নজীর বোধহয় আর নেই। আমি এর আগে যে কয়েকবার এসেছি প্রতিবারেই গ্রামের কর্মব্যস্ত চেহারাই দেখেছি, কিন্তু আজ বিকেলে যখন আমি বাচ্চা মোষটি সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গেলাম তখন দেখলাম চারিদিক নিস্তব্ধ। গ্রামের একশোজন বা আরও কিছু বেশি অধিবাসী সবাই পালিয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের গৃহপালিত পশুগুলি-সারা গ্রামে আর একটি মাত্র জানোয়ারই দেখতে পেলাম, সেটা হচ্ছে বেড়াল। বেড়ালটা আমায় খুব আন্তরিক স্বাগতম জানাল। লোকজন এত তাড়াতাড়ি পালিয়েছে যে বহু বাড়ির দরজা হাট করে খোলা–তালা বন্ধ করার সময় পায়নি। গ্রামের প্রতিটি রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে, বাড়ির সামনে ধুলোয় আমি বাঘিনীটার থাবার ছাপ দেখলাম। খোলা দরজাগুলো বিপজ্জনক হতে পারে কারণ গ্রামের ঐকাবেঁকা পথটি গিয়েছে এই দরজাগুলো ঘেঁষেই, আর এর যে কোনো একটির মধ্যে বাঘিনীটার ওত পেতে থাকা অসম্ভব নয়।

গ্রামের তিরিশ গজ ওপরে পাহাড়টির গায়ে কয়েকটা গোয়াল। এই গোয়ালগুলোর কাছে আমি যে পরিমাণ কালিজ, জংলী মোরগ এবং সাদা ঝুঁটিওলা ছাতারে দেখেছিলাম আগে কোনো জায়গায় একসঙ্গে তা দেখি নি। যেরকম সহজ বিশ্বাসে পাখিগুলি আমাকে তাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে দিল তাতে মনে হল থাকের লোকজনের জীবহত্যা সম্বন্ধে কোনো ধর্মীয় সংস্কার আছে।

গরুর গোয়ালগুলির ওপরে ধাপকাটা খেত থেকে পুরো গ্রামটা পরিষ্কার দেখা যায় তাই মোড়লের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে যে গাছটিতে বাঘিনীটি তার শেষ শিকার ধরেছিল সে গাছটি খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল হল না। গাছটার নিচে নরম মাটিতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন আর কয়েক ফোঁটা জমা রক্ত দেখা গেল। এইখান থেকে বাঘিনীটি মড়িটাকে চষা খেতের ওপর দিয়ে প্রায় একশো গজ নিয়ে গেছে তারপর একটা বেড়ার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে দূরের ঘন ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে। গ্রাম থেকে আসা ও ফিরে যাওয়ার পদচিহ্ন দেখেই অনুমান করলাম সারা গ্রামটাই জড়ো হয়েছিল ওই দুর্ঘটনার জায়গায়। কিন্তু সেই গাছটি থেকে বেড়া পর্যন্ত, একটাই থাবার ছাপ-আর সেটা বাঘিনীরা লোকটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে এই থাবার ছাপ পড়ে। বাঘিনীটিকে অনুসরণ করে লোকটির শরীরটি উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই হয় নি।

গাছটার নিচ থেকে কিছুটা মাটি খুঁড়ে একটা শেকড় বার করে আমি মোষটাকে তার সঙ্গে বেঁধে দিলাম। কাছাকাছি একটা গাদা থেকে প্রচুর খড় এনে সামনে রেখে আমি তাকে শুইয়ে এলাম।

পাহাড়ের উত্তরদিকে গ্রামটা এখন ছায়ায় ঢাকা-যদি ক্যাম্পে ফিরতে হয় তাহলে আমার এখনই রওনা হওয়া উচিত–খোলা দরজাগুলোর বিপদ এড়াবার জন্যে গ্রামটা ঘুরে আমি বাড়িগুলির নিচের রাস্তাটি ধরলাম।

এই রাস্তাটি গ্রাম ছাড়ার পরে একটা বিশাল আমগাছের নিচ দিয়ে যায়-এর গোড়ায় একটা পরিষ্কার ঠাণ্ডা জলের উৎস। একটা বিরাট পাথরের খাত কেটে কিছুটা যাওয়ার পরে জলটা পড়েছে এবড়ো-খেবড়ো একটা পাথরের পাত্রের মত জায়গায়। সেখান থেকে জলটা ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের জমিতে–ফলে সেখানকার জমি নরম এবং কর্দমাক্ত। আমি ওপরে ওঠার সময় এই ঝরনার জল খেয়েছিলাম তাই কাদার ওপর আমার পায়ের ছাপ পড়েছিল। এবার দ্বিতীয়বার জল খাওয়ার জন্যে ঝরনাটার দিকে এগোতে দেখি আমার পায়ের দাগের ওপর বাঘিনীর থাবার ছাপ। তৃষ্ণা মেটার পর বাঘিনী রাস্তাটা এড়িয়ে নীল বাসক আর বিছুটির ঝোঁপ ভরা একটা খাড়া আলের ওপর দিয়ে গ্রামে পৌঁছেছে। সেখানে কোনো একটা বাড়ির নিচ্ছিদ্র আশ্রয় থেকে ও সম্ভবত আমার গাছে মোষ বাঁধা লক্ষ করেছে আর আশা করছে আমি যে পথ দিয়ে এসেছি সেই পথ দিয়েই ফিরে যাব। আমার নেহাতই ভাগ্য ভাল যে আমি ওই খোলা দরজাগুলো পেরোবার বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে ঘুর রাস্তাটাই বেছে নিয়েছিলাম।

চুকা ছাড়ার সময়ে সব রকম হঠাৎ আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্কতা নিয়ে আমি ভালই করেছিলাম কারণ থাবার ছাপ থেকে বুঝলাম ক্যাম্প ছাড়ার পর সারাটা পথ বাঘিনীটা আমায় অনুসরণ করেছে। পরদিন সকালে থাকে ফিরে গিয়ে দেখলাম আমি বাড়িগুলির নিচের রাস্তা ধরা থেকেই বাঘিনীটা আমায় অনুসরণ করতে আরম্ভ করেছে আর চুকার চষা ক্ষেত পর্যন্ত সে আমার পিছু ছাড়ে নি।

আমার সঙ্গে আলোর যা অবস্থা ছিল তাতে পড়াশুনা সম্ভব নয় সেইজন্যে সে রাতে খাওয়ার পরে আগুনের পাশে বসে আমি পুরো ব্যাপারটা মনে মনে পর্যালোচনা করলাম আর একটা উপায় ঠাওরাবার চেষ্টা করলাম কি করে বাঘিনীটাকে জব্দ করা যায়। সে রাতে আগুনে শুধু আরামদায়ক উত্তাপই ছিল না, ছিল একটা নিরাপত্তার আশ্বাসও।

২২শে বাড়ি ছাড়ার সময়ে আমি কথা দিয়ে এসেছিলাম যে আমি দশ দিনের মধ্যেই ফিরব আর এটাই হবে মানুষখেকো শিকারে আমার শেষ অভিযান। বছরের পর বছর রোদ জলে পোড়া, পরিশ্রম আর, দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকা এতে আমার শরীরের ওপর ধকলও যেমন যাচ্ছিল, আমার বাড়ির লোকদেরও অশান্তির শেষ ছিল না। চৌগড়ের বাঘিনী বা রুদ্রপ্রয়াগের চিতা মারার সময়ে তো বেশ কয়েক মাস আমায় বাইরে কাটাতে হয়েছিল। ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে যদি আমি মানুষখেকোটাকে মারতে পারি তাহলে এ দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে অন্য কাউকে খুঁজে বার করতে হবে।

আজ ২৪শে রাত–আমার সামনে ঠিক ছদিন সময় আছে। সেদিন সন্ধেবেলা বাঘিনীটার হালচাল দেখে মনে হল ও আরেকটা মানুষ শিকারের জন্যে যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেইজন্যে আমার হাতে যা সময় আছে তাতে ওর সঙ্গে দেখা করা কঠিন হবে না। দেখা করার অনেক রকম রাস্তা আছে, একে একে প্রতিটিই চেষ্টা করা হবে। পাহাড় অঞ্চলে বাঘকে গুলি করার সবচেয়ে ভাল সুযোগ মেলে মড়ির ওপর কোনো গাছে বসে থাকলে। সে রাতে বাঘিনীটা যদি থাকে আমার বাঁধা মোষটা না মারে তাহলে পরের এবং তারও পরের প্রতিরাতে আমি আমার বাছাই করা জায়গায় অন্য দুটি মোষও বেঁধে রাখব। মানুষ শিকার না পেলে বাঘিনীটা আমার একটা মোষ মারতেও পারে, যেমন এপ্রিলে আমি আর ইবটসন সেম-এ ক্যাম্প করার সময়ে মেরেছিল। আগুনটা সারারাত জ্বালিয়ে রাখার মত মোটা মোটা কাঠ দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম আর তাঁবুর পেছনের আগাছার জঙ্গল থেকে ভেসে আসা কাকারের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে প্রাতরাশ যখন তৈরি হচ্ছে তখন আমি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চুকা আর সেম-এর মাঝামাঝি জায়গায় নদীর ডান পাড়ে বালির চড়ার ওপর থাবার ছাপ দেখতে। পথটা চষা জমি ছাড়িয়ে কিছুটা যায় ঘন আগাছার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এইখানে আমি একটা বড় পুরুষ চিতার থাবার ছাপ দেখলাম–সম্ভবত এটাকে দেখেই কাকারটা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। একটা ছোট পুরুষ বাঘ গত সপ্তাহে লাধিয়া নদী বহুবার পারাপার করেছে–ঠিক সেই সময়টা বাঘিনীটা একবারই নদী পেরিয়েছে, সেম-এর দিক থেকে আসার সময়ে। একটা বিরাট ভাল্লুক আমি আসার কিছুক্ষণ আগেই বালির ওপর দিয়ে চলাফেরা করেছে। আমি ক্যাম্পে ফিরে আসার পরে কাঠের ঠিকাদাররা বলল যে তারা সকালে কাজ ভাগ করে দেওয়ার সময়ে একটা ভাল্লুক দেখেছিল- ভাল্লুকটার মনোভাব খুব হিংস্র ছিল। তাই মজুরেরা যে অঞ্চলে ভাল্লুকটা দেখা দিয়েছিল সেখানে আর কাজ করতে চাইছে না।

বেশ কয়েক হাজার লোক–ঠিকাদারদের হিসেব অনুযায়ী পাঁচ হাজার হবে, গাছ কেটে, করাত দিয়ে চিরে মোটর চলাচলের জন্যে যে রাস্তাটা তৈরি হচ্ছে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জড়ো হয়েছিল চুকায় আর কুমায়া চকে। মজুরদের এই বিরাট দলটি যখনই কাজ করত তখনই তারস্বরে চিৎকার করত সাহস রাখার জন্যে। উপত্যকায় কুড়োল করাতের শব্দ, খাড়া পাহাড়ের গায়ে বিরাট বিরাট গাছ পড়ার শব্দ, হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে পাথর ভাঙা আর তার সঙ্গে কয়েক হাজার লোকের চিৎকার–এই সব মিলিয়ে যে সম্মিলিত শব্দ তা বর্ণনা করা যায় না, অনুমান করে নিতে হয়। এই রকম ভয়ার্ত যেখানকার লোকজন সেখানে থেকে থেকে ভয় পাওয়াই তো স্বাভাবিক। আগামী কয়েকটা দিন নানা ধরনের গুজবের তদন্ত করতে গিয়ে আমার প্রচুর হাঁটাহাঁটি আর সময় নষ্ট হল। সব গুজবই বাঘিনীটার আক্রমণ আর তার মানুষ মারা নিয়ে। অবাক হবার কিছু নেই, কারণ বাঘিনীটার সম্বন্ধে সন্ত্রাস শুধু লাধিয়া উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ এমন নয়, সারদা পেরিয়ে কালধূঙ্গা হয়ে একেবারে গিরিখাত পর্যন্ত চলে গেছে। এই পুরো জায়গাটার আয়তন হবে প্রায় পঞ্চাশ বর্গমাইল যেখানে কাজ করছে অতিরিক্ত আরও দশ হাজার লোক।

একটা জানোয়ার যে এতবড় একদল মজুরকে সন্ত্রাসের মধ্যে রাখতে পারে তা কল্পনার অতীত। সন্ত্রাস শুধু মজুরদের মধ্যেই নয়, এছাড়াও আছে আশপাশের গ্রামবাসীরা, শয়ে শয়ে লোক যারা মজুরদের জন্যে খাবার নিয়ে আসে, অথবা যারা পাহাড়ের ফলমূল যেমন কমলালেবু (যা বার আনায় একশো কিনতে পাওয়া যায়), কাঠ বাদাম, লঙ্কা, এসব নিয়ে টনকপুরের বাজারে যায়–আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে তাদের মধ্যেও। পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য মনে হতো যদি না সাভোর মানুষখেকোর ঐতিহাসিক নজীর আমাদের সামনে থাকত–যেখানে দুটো সিংহ শুধু রাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে পুরো উগাণ্ডা রেলের কাজ দীর্ঘদিন থামিয়ে রেখেছিল।

আসল গল্পে ফিরে আসা যাক। ২৫শে সকালে প্রাতরাশ সেরে আমি দ্বিতীয় মোষটা নিয়ে থাকের দিকে রওনা হলাম। পথটা চুকার চষা খেত পেরিয়ে, পাহাড়ের নিচ দিয়ে ঘুরে আধমাইলটাক যাওয়ার পরে দুভাগ হয়ে গিয়েছে।

একটা পথ ঢালু জমির ওপর দিয়ে সোজা চলে গেছে থাকের দিকে, অন্য পথটা পাহাড়ের নিচ দিয়ে আরও আধমাইলটাক গিয়ে এঁকে বেঁকে কুমায়া চকের মধ্য দিয়ে কোটকিন্দ্রী পর্যন্ত গিয়েছে।

পথটি যেখানে বিভক্ত, সেখানে আমি বাঘিনীটার থাবার ছাপ দেখলাম। থাক পর্যন্ত সেই ছাপ অনুসরণ করে এলাম আমি। ও যে গত সন্ধেবেলা আমার পিছু পিছু পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল তাতেই প্রমাণ হয় যে মোষটা মারে নি। ঘটনাটা হতাশাজনক হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয় কেননা বাঘ, কোনো কোনো সময় গাছে বাঁধা কোনো জানোয়ারকে মারার আগে জানোয়ারটার কাছে রাতের পর রাত ফিরে যায়–খিদে না পেলে বাঘ কখনও হত্যা করে না।

দ্বিতীয় মোষটাকে একটা আম গাছের কাছে রেখে, সেখানে ঘাস প্রচুর–আমি বাড়িগুলি ঘুরে ফিরে দেখার সময় দেখলাম এক নম্বর মোষটা প্রচুর খড় খেয়ে, বিনিদ্র বাতের ধকল সামলে নেওয়ার জন্যে পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। থাবার ছাপ দেখে বুঝলাম বাঘিনীটা গ্রামের দিক থেকে এগিয়ে এসে মোষটার কয়েক ফুটের মধ্যে এসেছিল–তারপর যে পথে এসেছিল সেই পথেই সে ফিরে যায়। মোষটাকে নিয়ে ঝরনার কাছে গিয়ে ওটাকে এক ঘণ্টা কি দু ঘণ্টা চরে বেড়াতে দিলাম তারপর সেটাকে নিয়ে গিয়ে গতরাতের জায়গাতেই আবার বেঁধে রেখে দিলাম।

দ্বিতীয় মোষটাকে বাঁধলাম আমগাছটার থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটা জায়গায়। আমি আর ইবটসনরা যেদিন তদন্তে আসি সেদিন এই জায়গাটিতেই সেই শোকার্ত মহিলা আর গ্রামবাসীরা আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিল। এই পথের মধ্যে একটা নালা পড়ে, তার একদিকে একটা শুকনো গাছের গুঁড়ি আর অন্যদিকে একটা বাদাম গাছ। বাদাম গাছটার ওপর মাচা বাঁধা চলে। আমি দু নম্বর মোষটাকে গাছের গুঁড়িটার সঙ্গে বাঁধলাম আর ওর সামনে বেশ কয়েকদিন চলার মত প্রচুর খড় রেখে দিলাম। থাকে আর আমার বিশেষ কিছুই করার নেই সেইজন্য আমি ক্যাম্পে ফিরে এলাম এবং তৃতীয় মোষটা নিয়ে লাধিয়া পেরিয়ে সেম-এর পেছনে একটা নালায় ওকে বেঁধে রেখে এলাম। এ জায়গাটাতেই বাঘিনীটা গত এপ্রিলে আমাদের একটা মোষ মেরেছিল।

আমার অনুরোধে টনকপুরের তহশীলদার খুঁজে-পেতে তিনটে বেশ পুষ্ট বাচ্চা মোষ আমার জন্যে বেছেছিল। তিনটেকেই এখন বাঁধা হয়েছে বাঘিনীটা ঘোরাফেরা করার জায়গায়। ২৫শে সকালে যখন আমি মোষগুলিকে দেখতে বেরোলাম আমার খুব আশা ছিল যে বাঘিনীটা হয়তো একটা মোষ মারবে, সেই মড়ির ওপর বসে ওকে গুলি করার একটা সুযোগ অন্তত আমি পাব। লাধিয়ার ওপারে যেটা বাঁধা ছিল সেটাকে দিয়ে শুরু করে পালা করে সব কটি মোষ আমি দেখলাম-বাঘিনী একটাকেও স্পর্শ করে নি। আগের দিনের সকালের মতই আমি আবার ওর থাবার ছাপ দেখলাম থাকের দিকে যাওয়ার। আসার সময়ে এবং ফিরতি পথেও বাঘিনীটা রাস্তার ওপর দিয়েই যাতায়াত করেছে আর আমগাছের পঞ্চাশ গজ দূরে কাটা গুঁড়িতে বাঁধা,মোষটার কয়েক ফুটের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।

আমি চুকায় ফেরার পর থাক গ্রামবাসীদের একটা প্রতিনিধিদল মোড়লের নেতৃত্বে আমার তাবুতে এসে আমায় অনুরোধ করল ফুরিয়ে যাওয়া রসদের যোগান আনতে তারা যখন গ্রামে যাবে আমি যেন তাদের সঙ্গে যাই। ঠিক দুপুরবেলায় আমি থাকে পৌঁছলাম–আমার পেছনে মোড়ল আর তার প্রজারা এবং আমার খাবার ও মাচা তৈরির দড়িদড়া বহনকারী চারজন আমার লোক। থাকে পৌঁছে আমি পাহারা দিতে লাগলাম। সেই ফাঁকে গ্রামের লোকজন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার সংগ্রহ করে নিল।

মোষ দুটোকে খাবার জল খাইয়ে আমি দু নম্বর মোষটাকে গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দিলাম আর এক নম্বর মোষটাকে পাহাড়ের নিচে মাইল খানেক নিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে একটা চারা গাছে বেঁধে রাখলাম। তারপরে আমি গ্রামবাসীদের চুকা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, পাহাড়ের চড়াই বেয়ে কয়েকশো গজ ফিরে এসে, আমার লোকজন মাচা বাঁধতে বাঁধতে কোনোরকমে আমি খাওয়া সেরে নিলাম।

এখন এটা পরিষ্কার যে আমার মোটাসোটা মোযুগুলোর ওপর বাঘিনীটার কোনো লোভ নেই। থাক যাওয়ার পথে গত তিনদিনে আমি পাঁচবার বাঘিনীটার থাবার ছাপ দেখেছি। আমি স্থির করলাম ওই পথের ওপর বসেই বাঘিনীটাকে গুলি করার চেষ্টা করব। বাঘিনীটা আসার সময় আমায় সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে গলায় ঘন্টা বাঁধা একটা ছাগল আমি পথের ওপর বেঁধে রাখলাম। বিকেল চারটে নাগাদ আমি গাছে চড়ে বসলাম। আমার লোকজনদের পরদিন সকালে আটটার সময় ফিরে আসতে বলে আমি পাহারা দিতে শুরু করলাম।

সন্ধের দিকে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগল–কোটটা ভাল করে কাঁধের ওপর টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি এমন সময় মাচার একদিকের দড়ি খুলে গেল। ফলে বসা আরও কষ্টকর হয়ে উঠল। ঘণ্টাখানেক পরে ঝড় উঠল। বৃষ্টি যদিও খুব বেশি হয় নি কিন্তু আমি বেশ ভিজে গিয়েছিলাম, ফলে কষ্ট আরও বাড়ল। যে সোল ঘণ্টা আমি গাছে বসেছিলাম তার মধ্যে আমি কিছু দেখি নি বা শুনি নি। আমার লোকজন সকাল আটটায় ফিরে এল। আমি ক্যাম্পে ফিরে গরম জলে স্নান করে ভাল করে খাওয়া দাওয়া সেরে আমার ছয়জন লোককে নিয়ে থাকের দিকে রওনা হলাম।

রাতের বৃষ্টি পুরনো সব দাগগুলি ধুয়ে মুছে দিয়েছে। যে গাছটায় আমি বসেছিলাম তার দুশো গজ দূরে বাঘিনীটার নতুন থাবার ছাপ দেখলাম–ঠিক যে জায়গাটিতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ও থাকের পথে রওনা হয়েছিল সেইখানে। খুব সাবধানে আমি প্রথম মোষটির দিকে এগোলাম, দেখলাম ওটা পথের ওপর ঘুমিয়ে আছে। বাঘিনী ওর চারপাশ ঘুরে কয়েক গজ এগিয়ে আবার পথটি ধরেছে তারপর পাহাড় ধরে এগিয়ে গেছে। ওর থাবার ছাপ ধরে আমি দ্বিতীয় মোষটার দিকে এগোলাম, যেখানে মোষটাকে বাঁধা হয়েছিল সে জায়গাটার কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি দু’দুটো নীল হিমালয়ের ম্যাগপাই মাটির থেকে উঠে চিৎকার করতে করতে পাহাড়ের নিচে নেমে গেল।

এই পাখিগুলির উপস্থিতির মানে (ক) মোষটি মৃত (খ) মোষটিকে আংশিকভাবে খাওয়া হয়েছে তবে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নি এবং (গ) বাঘিনীটা খুব কাছাকাছি নেই। যে গুঁড়িটায় মোষটিকে বাঁধা হয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখি যে মোষটাকে পথ থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে শরীরের কিছুটা অংশ খাওয়া হয়েছে এবং মৃত জানোয়ারটিকে ভাল করে পরীক্ষা করে বুঝলাম যে ওটা বাঘিনীর হাতে মারা পড়ে নি, খুব সম্ভবত সাপের কামড়ে ওটার মৃত্যু হয়েছে। (আশপাশের জঙ্গলে অনেক শঙ্খচূড় সাপ আছে) এবং ওটাকে পথের ওপর মরে পড়ে থাকতে দেখে বাঘিনীটা কিছুটা খেয়ে ওটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। বাঘিনীটা যখন দেখেছে দড়িটা ছেঁড়া যাবে না তখন কিছু শুকনো পাতা আর কাঠকুটো দিয়ে মোষটাকে ঢেকে থাকের পথে রওনা হয়েছে।

বাঘেরা কখনও গলিত পচা মাংস খায় না কিন্তু কখনও কখনও অন্য জানোয়ারের মারা মাংস খায়। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি একবার একটা চিতার মৃতদেহ একটা ঘাস-পোড়া রাস্তার ওপর ফেলে রেখে এসেছিলাম। পরদিন সকালে যখন আমি একটা ফেলে আসা ছুরি উদ্ধার করতে সেখানে যাই তখন দেখি একটা বাঘ মৃতদেহটাকে প্রায় একশো গজ টেনে নিয়ে গিয়ে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ খেয়ে ফেলেছে।

চুকার থেকে উপরে ওঠার সময় আমি গত রাতে বসা মাচাটা ভেঙে দিয়ে এসেছিলাম। দুজন লোক বাদাম গাছটায় উঠল আমার মাচা তৈরির জন্যে। অবশ্য গাছটা মাচার পক্ষে যথেষ্ট বড় ছিল না। অন্য চারজন ঝরনার কাছে গেল চা তৈরির মত এক কেটলি জল আনার জন্যে। বিকেল চারটের মধ্যে আমি চা বিস্কুট দিয়ে হাল্কা খাবার খেয়ে নিলাম। এই খেয়েই আমায় থাকতে হবে পরদিন পর্যন্ত। আমার লোজন থাকেই কোনো একটা বাড়িতে থাকার জন্যে আমার অনুমতি চেয়েছিল কিন্তু সে অনুরোধে রাজী না হয়ে আমি ওদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। ক্যাম্পে ফেরার পথে ওদের বিপদের আশঙ্কা আছে কিন্তু থাকে কোনো বাড়িতে রাত কাটালে যে বিপদ হতে পারে এটা তার তুলনায় কিছুই নয়।

গাছে আমার বসার জায়গাটি দুটো সোজা ডালের সঙ্গে দড়ির কয়েকটা পাক দিয়ে তৈরি, নিচে আরো কয়েকটা দড়ি প্যাচানো যার ওপর আমি পা রাখতে পারি। আরাম করে বসার পর আমার আশপাশের কয়েকটা ডাল টেনে এনে একটা সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলাম–একটু ফাঁক রাখলাম যেখান দিয়ে লক্ষ করে আমি গুলি করতে পারি। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার ‘গুপ্তস্থানটির পরীক্ষা হয়ে গেল–কারণ আমার লোকজন চলে যাওয়ার পরেই ম্যাগপাই দুটি ফিরে এল। তারপর অন্যদের ডাকাডাকি করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নয়টি পাখি সন্ধ্যে পর্যন্ত মড়িটা ঠুকরে ঠুকরে খেল। পাখিগুলো থাকাতে আমি একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলাম কারণ বাঘিনী এদিকে এগোলে ওরা অমায় সাবধান করে দেবে। পাখিগুলি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল আমার রাতের পাহারা।

নেপাল পাহাড়ের পেছন থেকে চতুর্দশীর চাঁদ উঠে যখন চারিদিকের পর্বতশ্রেণি আলোয় ভাসিয়ে দিল তখনও কিন্তু গুলি করার মত যথেষ্ট দিনের আলো আছে। গতরাতের বৃষ্টিতে সব ধুলো, ধোঁয়া মুছে গিয়ে চারদিকে ঝকঝকে তকতকে হয়ে গিয়েছিল, এবং চাঁদ ওঠার কয়েক মিনিট পর আলো এত উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে আমি দেড়শো গজ দূরে একটা গম খেতে একটা সম্বর আর তার বাচ্চাকে পরিষ্কার খেতে দেখলাম।

মরা মোষটা আমার সামনে থেকে প্রায় কুড়ি গজ দূরে আর যে পথটা দিয়ে বাঘিনী আসবে বলে আমি আশা করছিলাম সেটার দূরত্ব দু তিন গজের কম। এই দূরত্ব থেকে গুলি করা খুব সহজ হবে, বাঘিনীটা আমর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই–কিন্তু সবই হবে বাঘিনীটা যদি আসে। ওর না আসার কিন্তু কোনো কারণ নেই।

চাঁদ ওঠার পর ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেছে, সম্বরটা আমার গাছের পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে গেছে এমন সময় গ্রামের ঠিক ওপরে পাহাড়টিতে একটা কাকার ডাকতে শুরু করল। কাকারটা কয়েক মিনিট ডেকেছে এমন সময় গ্রামের দিক থেকে টানা চিৎকার ভেসে এল। চিৎকারটার সঠিক বর্ণনা আমি করতে পারব না কিন্তু ‘আর-আর-আআর একটা আওয়াজ ক্রমেই দীর্ঘতর হলে যেমন হয়, আওয়াজটা অনেকটা সেইরকম। চিৎকারটা এত অপ্রত্যাশিত আর এত হঠাৎ হয়েছে যে আমি গাছ থেকে নেমে গ্রামের দিকে দৌড়বার জন্যে নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়িয়েছি–আমার মাথায় বিদ্যুতের মত খেলে গেল মানুষখেকোটা নিশ্চয় আমার কোনো লোককে মারছে। কিন্তু তার পরের মুহূর্তে এক ঝলকে আমার মনে পড়ে গেল ওরা যখন আমার গাছের নিচ দিয়ে যায় তখন একে একে আমি ওদের সবাইকে গুনে নিয়েছিলাম–ওরা আমার একত্রে থাকার নির্দেশ ঠিকমত মানছে কিনা দেখার জন্যে দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত ওদের ওপর নজর রেখেছিলাম।

চিৎকারটা কোনো বিপন্ন মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার কিন্তু যুক্তি দিয়ে আমি বুঝতে পারলাম না একটা জনমানবহীন গ্রাম থেকে কিভাবে এ ধরনের চিৎকার আসতে পারে। এটা আমার কল্পনা নয় কারণ কাকারটা চিৎকার শুনেই হঠাৎ ওর ডাক থামিয়ে দিয়েছিল, সম্বরটা বাচ্চা নিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। দুদিন আগে লোকজনদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার সময়ে আমি বলেছিলাম তাদের বিশ্বাস তো খুব বেশি–এরকম দরজা জানলা হাট করে খোলা বাড়িতে সব কিছু ফেলে রেখে যাওয়া তো সহজ নয়। এর উত্তরে মোড়ল বলেছিল তাদের গ্রামে বছরের পর বছর, যদি কোনো নোক না থাকে তাহলেও তাদের ধন সম্পত্তি নিরাপদেই থাকবে কারণ তারা পূর্ণগিরির পুরোহিত, তাদের ওপর চুরি ডাকাতি করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। সে আরও বলেছিল যদি রক্ষীর কোনো প্রয়োজন থাকে তাহলে বাঘিনীটা যতদিন বেঁচে আছে সেই ওদের সম্পত্তি একশোটা রক্ষীর থেকেও ভাল পাহারা দেবে, কারণ বাঘিনী থাকাতে আশপাশের গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনো কারণেই কেউ গ্রামের দিকে আসার সাহস পাবে না–অবশ্য ওদের যেমন পৌঁছে দিয়েছি তেমনি আমি যদি তাদের সঙ্গে থাকি সে আলাদা কথা।

চিৎকারটা আর ফিরে এল না। আমার আর কিছুই করার ছিল না তাই দড়ির ওপর আসনে আবার বসলাম। রাত দশটায় একটা কাকার, যে খেতের নিচের দিকে কচি গম খাচ্ছিল, হঠাৎ ডাকতে ডাকতে পালিয়ে গেল–ঠিক তার মিনিটখানেক পরেই দুবার বাঘিনীটার গর্জন শোনা গেল। ও এখন গ্রাম ছেড়ে চলতে শুরু করেছে। ওর যদি মোষটাকে আরেকবার খাওয়ার ইচ্ছে নাও থাকে, তাহলেও যে পথে গত কয়েক দিন–প্রতিদিন অন্তত দুবার করে যাতায়াত করেছে সেই পথ দিয়ে ও আসতেও পারে। ট্রিগারে আঙুল রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পথটির দিকে তাকিয়ে আমি দিনের আলো জ্যোৎস্না ডুবিয়ে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সূর্য ওঠার ঘণ্টা খানেক পরে আমার লোকজন ফিরে এল। আমার কথা ভেবেই ওরা একবোঝা জ্বালানী কাঠ নিয়ে এসেছিল–তাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি বসলাম হাতে ধূমায়িত এক কাপ চা নিয়ে।

বাঘিনীটা আমাদের আশপাশের ঝোপেও ওত পেতে থাকতে পারে আবার এমনও হতে পারে যে ও বহু মাইল দূরে চলে গেছে কারণ রাত দশটায় ওর গর্জন শোনার পর জঙ্গল ছিল নিস্তব্ধ।

ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি আমার তাবুর কাছে কয়েকজন লোক বসে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এসেছে গতরাতে ভাগ্যদেবী আমার ওপর কতটা সদয় ছিলেন দেখার জন্যে। অন্যরা আমাকে খবর দিতে এসেছে যে বাঘিনীটা পাহাড়ের পাদদেশে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের কিছু আগে পর্যন্ত সমানে গর্জন করেছে। জঙ্গলে এবং মাল পাঠানোর নতুন রাস্তায় কর্মরত মজুরেরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে কাজ বন্ধ করেছে। বাঘিনীটার সম্বন্ধে আমার লোকজন আগেই আমায় বলেছিল–কি ভাবে চুকার আশে পাশে ক্যাম্প করে থাকা হাজার হাজার লোকের সঙ্গে তারা সারারাত বসে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল।

আমার তাঁবুর কাছে যারা জড়ো হয়েছিল তার মধ্যে ছিল থাকের মোড়ল। সবাই চলে গেলে আমি তাকে মাসের ১২ তারিখে থাকে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। এই দুর্ঘটনায় মানুষখেকোর শিকার হতে হতে সে কোনোরকমে বেঁচে গেছে।

আরেকবার মোড়ল আমাকে সবিস্তারে বলল কিভাবে আদা খুঁড়তে ও নাতনীকে নিয়ে খেতে গিয়েছিল, কিভাবে স্ত্রীর চিৎকার শুনে ও নাতনীর হাত ধরে দৌড়ে বাড়ি চলে আসে–সেখানে কান খোলা না রেখে নিজের ও নাতনীর জীবন বিপন্ন করার জন্যে কিভাবে ওর স্ত্রী ওকে ভর্ৎসনা করে–ঠিক তার কয়েক মিনিট পরেই কিভাবে বাঘিনীটা তার বাড়ির ওপারের মাঠে গাছের পাতা কাটায় ব্যস্ত একটি লোককে মারে।

এ গল্পের সবটাই আমার আগে শোনা, তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম বাঘিনীর মানুষটাকে মারা কি ও নিজের চোখে দেখেছে? ও উত্তর দিল না, যেখানে ও দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে গাছটা দেখা যায় না। আমি-যখন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ও কি করে বুঝল মানুষটা সত্যিই মারা পড়েছে। ওর উত্তর হল ও আওয়াজ শুনে অনুমান করেছিল। আমার আরও প্রশ্নের জবাবে ও বলল নোকটা সাহায্যের জন্যে কাউকে ডাকে নি শুধু চিৎকার করে উঠেছিল। যখন প্রশ্ন করলাম লোকটি একবার চিৎকার করেছিল? ও বলল, না–লোকটা চিৎকার করেছিল তিনবার। এবার সে নিজেই গলার স্বর নকল করে দেখিয়ে দিল লোকটা কিভাবে চিৎকার করেছিল। আমি গতরাত্রে যে চিৎকার শুনেছিলাম এটা তারই এক অভ্যস্ত দুর্বল সংস্করণ।

আমি তখন মোড়লকে বললাম গতরাতে আমি কি শুনেছিলাম আর জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনাচক্রে কারো কি গ্রামে ফেরার কোনো সম্ভাবনা আছে? ও খুব জোর দিয়ে বলল না সে সম্ভাবনা নেই। যাওয়ার দুটো মাত্রই রাস্তা আছে–যে সব গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা দুটি গিয়েছে সেখানকার প্রতিটি নরনারী শিশু জানে যে থাক গ্রামে কোনো জনমানবের বাস নেই এবং তার কারণ কি তাও ওরা জানে। সারা জেলায় একথা কারো অজানা নয় যে থাকের কাছে যাওয়া দিনের আলোতেও বিপজ্জনক তাই গতরাতে আটটার সময় করো গ্রামে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।

যখন ওকে প্রশ্ন করা হল যে একটা পরিত্যক্ত গ্রাম থেকে এরকম একটা চিৎকার কি কারণে আসতে পারে–আর গ্রামে যে কোনো জনপ্রাণী নেই সেই ব্যাপারে ও নিশ্চিত-তখন ও বলল, এর কোনো সদুত্তর জানা নেই।

আমার অবস্থাও মোড়লের থেকে কোনো অংশে ভাল নয় তাই ধরেই নিতে হবে যে সেই বিপন্ন কণ্ঠের পরিষ্কার, আর্ত চিৎকার আমি, কাকারটা বা সম্বরটা শুনি নি।

মোড়ল শুন্ধু আমার সব অতিথিরা চলে যাওয়ার পর আমি যখন প্রাতরাশ সারছি তখন আমার ভৃত্য আমায় খবর দিল গতকাল সন্ধেবেলা সে গ্রামের মোড়ল আমার কাছে এসেছিল। সে আমার জন্যে খবর রেখে গেছে যে, যে কুঁড়েঘরের কাছে ওর মা মারা পড়ে তারই পাশে একটা মাঠে ঘাস কাটার সময় ওর স্ত্রী জমিতে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছে। ও আমার জন্যে সকালবেলা লাধিয়ার পারাপার করার জায়গায় অপেক্ষা করবে। সুতরাং প্রাতরাশ সেরেই আমি রক্তের দাগ সম্বন্ধে খোঁজখবর করার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম।

আমি যখন নদীটা হেঁটে পেরোচ্ছি, দেখলাম আমার লোকজন আমার দিকে দৌড়ে আসছে, শুকনো মাটিতে পৌঁছনো মাত্রই ওরা আমায় বলল যে ওরা যখন সেম-এর ওপরের পাহাড়টা থেকে নেমে আসছে তখন ওরা একটা বাঘের ডাক শুনতে পায়–ডাকটা আসছিল উপত্যকার ওদিকে চুকা আর থাকের মাঝামাঝি পাহাড়টা থেকে। জলের আওয়াজে আমি বাঘের ডাক শুনতে পাই নি। আমি বলোকজনদের বললাম আমি সেম-এ যাচ্ছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চুকায় ফিরব। তারপরে আমি রওনা হলাম।

মোড়ল ওর বাড়ির কাছে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল–ওর স্ত্রী আমাকে নিয়ে গেল যেখানে গতকাল রক্তের দাগ দেখেছিল সেই জায়গাটায়। দাগটা একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে কিছুটা গিয়ে কয়েকটা বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে গিয়েছে। একটা পাথরের ওপর আমি কিছু কাকারের নোম দেখলাম। আরো কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটা বড় পুরুষ চিতার থাবার ছাপ–যখন ছাপটা দেখছি তখনই কানে এল একটা বাঘের ডাক। আমার সঙ্গের লোকজনদের শান্ত হয়ে বসতে বলে কোন জায়গায় বাঘটা থাকতে পারে বোঝার জন্য কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। স্বল্পক্ষণের মধ্যেই ডাকটা আবার কানে এল, আবার, তারপর দুমিনিট বাদে বাদে ডাকটা চলতেই থাকল।

ডাকটা বাঘিনীটার। অনুমানে বুঝলাম বাঘিনীটা আছে থাকের পাঁচশ গজ নিচে গভীর নালাটার মধ্যে যে নালাটা আমগাছের নিচে ঝরনার কাছ থেকে শুরু হয়ে পথটার সমান্তরালভাবে চলে গেছে। পথটা যেখানে কুমায়া চকের পথের সঙ্গে মিলেছে সেখানে নালাটা পথের মাঝবরাবর গিয়েছে। মোড়লকে বললাম চিতাটা অন্য সময় সুবিধে মত মারা যাবে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্পের রাস্তা ধরলাম। নদীর পারঘাটে যে চারজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল তাদের চুকা যাওয়ার জন্যে সঙ্গে নিয়ে নিলাম।

ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি আমার তাঁবু ঘিরে এক জনতার ভিড়–তাদের মধ্যে অধিকাংশই দিল্লীর করাতী কিন্তু তাদের সঙ্গে আরও ছিল ছোট ঠিকাদার দালাল কেরানী ঘড়িবাবু, আর যে লোকটা লাধিয়া উপত্যকায় কাঠের ও রাস্তা তৈরির ঠিকাদারী নিয়ে যে টাকা লগ্নী করেছে তারই অধীনস্থ কুলি দলের সর্দার। তারা জানতে এসেছে চুকায় আমি আর কতদিন থাকব। তারা জানাল যে কাঠ বইতে আর রাস্তায় কাজ করতে এরকম বহু পাহাড়ী সেইদিনই সকালে বাড়ি চলে গেছে আর আমি যদি ১লা ডিসেম্বর চুকা ছেড়ে চলে যাই, ওরা শুনেছে আমার ইচ্ছে সেইরকমই, তাহলে পুরো মজুরের দল আর সেই সঙ্গে ওরা সেই দিনই চলে যাবে। এমনিতেই ভয়ে ওরা ভাল করে খেতে বা ঘুমোতে পারছেনা তার ওপর আমি যদি চলে যাই তাহলে আর একজনও এ উপত্যকায় থাকতে সাহস করবে না। সেদিন ছিল ২৯শে নভেম্বর। আমি ওদের বললাম আমার হাতে এখনও দুটো দিন আর দুটো রাত আছে। এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু কোনোমতেই ১লা সকালের বেশি থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ইতিমধ্যে বাঘিনীটা ডাক থামিয়েছিল। আমার চাকর আমায় কিছু খাবার দিলে, সেটা খেয়ে আমি থাকের পথে রওনা হলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল বাঘিনী আবার যদি ডাকে, আর আমি যদি বুঝতে পারি ও কোথায় আছে তাহলে খুব সাবধানে ওর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করব। যদি ও আর না ডাকে তাহলে মোষটার মড়ির ওপর বসব। আমি পথের ওপরেই, যেখান দিয়ে ও নালাটার মধ্যে ঢুকেছে সেখানে ওর থাবার ছাপ দেখলাম আর থাক যাওয়ার পথে যদিও আমি বারে বারে ওর ডাক শোনার জন্যে দাঁড়াচ্ছিলাম কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না। সুতরাং সূর্যাস্তের কিছু আগে আমি সঙ্গে আনা চা বিস্কুট খেয়ে নিয়ে বাদাম গাছটায় উঠলাম তারপর বসলাম কয়েক টুকরো দড়ি জড়ানো আমার সেই আসনে–এটা দিয়েই এখন আমার মাচার কাজ চালাতে হবে। এবারে ম্যাগপাইগুলো ছিল না তাই গত সন্ধের মত ওদের পর সব ছেড়ে দিয়ে দু এক ঘন্টার নিশ্চিন্ত ঘুম আমার আর হল না।

যদি কোনো বাঘ মড়ির কাছে প্রথম রাতে ফিরে না আসে তার মানেই এ নয় যে সে মড়িটা ফেলে রেখে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি বাঘকে দশম রাতে ফিরে এসে মাংস বলে চেনা যায় না এমন মড়ি খেতে দেখেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি কোনো মড়ির ওপর বসছি না, বসছি এমন একটা জানোয়ারের ওপর যেটাকে বাঘিনীটা মৃত অবস্থায় পেয়েছে আর কিছুটা খেয়েও গেছে। বাঘিনীটা যদি মানুষখেকো না হত তাহলে ওর দ্বিতীয় রাত্রে ফিরে আসার ওপর ভরসা করে সারা রাত একটা গাছে বসে থাকার কথা ভাবতামই না, বিশেষ করে যখন মোষের মড়িটা প্রথম রাতেই ওকে ফিরে আসার মত আকর্ষণ করতে পারে নি। সেইজন্যে গুলি চালানোর সুযোগের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়ে আমি গাছের ওপর সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে রইলাম। যদিও গতরাতের মত দীর্ঘ সময় আমাকে কাটাতে হয় নি তবু কষ্ট হয়েছিল অনেক বেশি কারণ যে দড়ির ওপর আমি বসেছিলাম সেগুলো যেন গায়ে কেটে বসে যাচ্ছিল। চাঁদ ওঠার অল্পক্ষণ পর থেকেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করল আর চলল সারা রাত ধরে আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে। এই দ্বিতীয় রাতে আমি জঙ্গলের বা অন্য কোনো আওয়াজ শুনি নি–সেই সম্বরটাও বাচ্চা নিয়ে আর মাঠে খেতে আসে নি। যখন চাঁদের আলো ছাপিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠছে তখন আমার মনে হল যেন দূর থেকে একটা বাঘের ডাক শুনলাম। কিন্তু আওয়াজটা কোন দিকে থেকে আসছে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারলাম না।

যখন ক্যাম্পে ফিরে গেলাম তখন আমার চাকর এক কাপ চা আর স্নানের জন্যে গরম জল নিয়ে তৈরি। কিন্তু স্নান করার আগেই এক উত্তেজিত জনতাকে আমায় বিদায় করতে হল কারণ আমার ৪০ পাউন্ডের তাবুর মধ্যে স্নান করা চলে না। তারা তাদের গত রাতের অভিজ্ঞতা আমায় বলার জন্যে ছটফট করছিল। ওদের কথাবার্তায় মনে হল চাঁদ ওঠার কিছুক্ষণ পরেই চুকার কাছ থেকে বাঘিনীটা ডাকতে আরম্ভ করে আর কিছুক্ষণ বিরতির পরে পরেই ঘণ্টা দুয়েক ডেকে কুমায়া চকের মজুর বস্তির দিকে চলে যায়। বস্তির লোজন ওর আসার আওয়াজ পেয়েই চিৎকার করে ওকে তাড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু তাড়ানো দূরে থাক, চিৎকারে বাঘিনীটা আরও খেপে যায় এবং যতক্ষণ না লোকগুলো ভয়ে চুপ করে যায় ততক্ষণ ক্যাম্পের সামনে গর্জন করতে থাকে। এই কাজটি সেরে বাঘিনীটা চুকা এবং মজুর বস্তির মাঝামাঝি জায়গায় বাকি রাতটা কাটায়-চিৎকার করে ওকে বিরক্ত করার সাহস কারো আছে কিনা দেখার জন্যেই হয়তো।

মানুষখেকো শিকারের এইটিই আমার শেষ দিন। তাই একটু বিশ্রাম এবং ঘুমের খুব প্রয়োজন থাকলেও আমি স্থির করলাম দিনের অবশিষ্ট সময়টুকু বাঘিনীর সঙ্গে মোলাকাতের একটা শেষ চেষ্টা করে কাটাতে হবে।

শুধু চুকা আর সেম-এর লোকই নয় আশেপাশের সমস্ত গ্রামের বিশেষ করে তল্লাদেশের লোকজনের বিশেষ ইচ্ছে যে আমি একটা জ্যান্ত ছাগলের ওপর বসে চেষ্টা করি। এই তল্লাদেশেই বছর দুয়েক আগে আমি তিনটে মানুষখেকো মারি। তাদের বক্তব্য–”সব পাহাড়ী বাঘই ছাগল খায় আর মোষ দিয়ে চেষ্টা করে যখন ভাগ্য ফেরাতে পারি নি তখন ছাগল দিয়ে একবার চেষ্টাই করে দেখুন না?” বাঘিনীটাকে গুলি করার কোনো আশাই আমার ছিল না কিন্তু নেহাতই ওদের মন রাখার জন্যে যে দুটি ছাগল এই উদ্দেশ্যে আমি কিনেছিলাম তাদের ওপর বসে এই শেষ দিনটি আমি কাটাতে রাজী হলাম।

আমার স্থির বিশ্বাস ছিল যে বাঘিনীটা রাতে যেখানেই ঘুরে বেড়াক না কেন, থাককে কেন্দ্র করেই ওর যত ঘোরাফেরা আর সেইজন্যে মধ্যাহ্নে দুটো ছাগল এবং আমার চারজন লোককে সঙ্গে নিয়ে থাকের দিকে রওনা হলাম।

চুকা থেকে থাকের পথ, যেমন আমি আগেও বলেছি, খুব খাড়া একটা ঢিবির ওপর দিয়ে। থাকের সিকি মাইল এদিকে পথটা টিবি ছেড়ে মোটামুটি একটা সমতল জমি পার হয়ে গিয়েছে, সমতল জমিটা আমগাছ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সমতল জমিটা জুড়ে পথটা গিয়েছে ঘন আগাছার ঝোপের মধ্যে দিয়ে এবং দুটো পুবমুখী নালা পথটা কেটে মূল নালাটির সঙ্গে মিলেছে। এ দুটো নালার মাঝামাঝি জায়গায়, যে গাছটায় বসে আমি গত দুরাত কাটিয়েছি সেই গাছটার থেকে একশো গজ দূরে একটা বিরাট বাদাম গাছ আছে। যখন আমি ক্যাম্প ছাড়ি তখন এই গাছটিই ছিল আমার লক্ষ। পথটা গিয়েছে গাছটার ঠিক নিচ দিয়েই এবং আমি ভাবলাম, আমি যদি গাছটার মাঝামাঝি উঠি তাহলে আমি শুধু ছাগল দুটোই নয় মৃত মোষটিকেও দেখতে পাবো। কারণ একটি ছাগল আমি বাঁধা ঠিক করেছিলাম মূল নালাটির ধারে অন্যটি ডান দিকে পাহাড়ের পাদদেশে। যেহেতু এই তিনটি বিন্দুর দূরত্বই গাছ থেকে বেশ কিছুটা সেইজন্যে আমি কোনো জরুরী অবস্থার জন্যে নেওয়া ৪৫০/৪০০ রাইফেলের ওপরেও একটা নির্ভুল ২৭৫ রাইফেল নিয়ে তৈরি হলাম।

চুকার থেকে ওঠার পথটা এই শেষ দিনে আমার বিশেষ কষ্টকর মনে হল এবং ঢাল ছেড়ে পথটা যেখানে সমতল জমির সঙ্গে মিশেছে সেই জায়গাটাতে পৌঁছেছি অমনি আমার বাঁ দিকে প্রায় দেড়শো গজ দূর থেকে বাঘিনীটা ডেকে উঠল। এখানে জমি ঘন আগাছায় ভর্তি, গাছগুলো লতাপাতায় জড়ানো, অসংখ্য সরু গভীর নালায় ক্ষতবিক্ষত আর চারিদিকে ছড়ানো বিশাল বিশাল পাথর মানুষখেকোর দিকে নিঃশব্দে এগনোর পক্ষে মোটেই উপযোগী নয়। আমি কি করব তা স্থির করার আগে আমার জানা দরকার বাঘিনীটা শুয়ে আছে অথবা চলে বেড়াচ্ছে। চলে বেড়ালে, কোন দিকে বেড়াচ্ছে। অবশ্য শুয়ে থাকাও অসম্ভব নয় কারণ এখন বেলা ১টা বেজে গেছে। তাই লোকজনকে আমার পেছনে বসতে বলে আমি উৎকর্ণ হয়ে রইলাম, অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার বাঘিনীর ডাক শোনা গেল; ও অন্তত পঞ্চাশ গজ সরে– গেছে, মনে হল মূল নালাটা ধরে ও থাকের দিকে যাচ্ছে।

এটা খুবই আশার কথা কারণ বসার জন্যে যে গাছটা আমি বেছে নিয়েছিলাম, নালাটার থেকে তার দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ। লোকজনকে চুপচাপ আমার পেছন পেছন অনুসরণ করতে বলে আমি পথটা ধরে খুব দ্রুত এগোলাম। আমরা প্রায় অর্ধেক পথ পৌঁছেছি, গাছটায় যেতে আর দুশো গজ মত বাকি–পথের এমন একটা জায়গায় এগোচ্ছি যেখানে পথের দুধারে ঘন আগাছার ঝোপঝাড়–এমন সময় একঝাক কালিজ ঝোঁপ থেকে উঠে চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পথটা কয়েক মিনিট লক্ষ করলাম কিন্তু কিছুই না ঘটায় আমরা সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম এবং কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই গাছটার কাছে পৌঁছলাম। যত তাড়াতাড়ি এবং নিঃশব্দে সম্ভব একটা ছাগল বেঁধে দেওয়া হল নালাটার ধারে, অন্যটাকে বাঁধা হল ডানদিকে, পাহাড়ের পাদদেশে, লোকজনকে চষা খেতের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে আমি তাদের নির্দেশ দিলাম আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত মোড়লের বাড়ির ওপরের বারান্দায় থাকতে, তারপর দৌড়ে চলে গেলাম গাছটার কাছে। গাছটায় চল্লিশ ফুটের মত উঠলাম তারপর একটা দড়ির সাহায্যে রাইফেলটা ওপরে টেনে তুললাম। আমার বসার জায়গা থেকে ছাগল দুটির দূরত্ব একটির সত্তর গজ অন্যটির ষাট গজ–আমি শুধু ছাগল দুটিই দেখতে পাচ্ছিলাম না মোষটিরও একাংশ এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমার ২৭৫ রাইফেলটি খুব নির্ভুল তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমার দৃষ্টির মধ্যের জমিটুকুর যে কোনো জায়গায় বাঘিনীটা দেখা দিলেই ওকে আমি মারতে পারব।

আমি গতবারে কেনার পর থেকেই ছাগলদুটো একসঙ্গে আছে তাই এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়াতে দুজনেই আকুলস্বরে দুজনকে ডাকাডাকি করতে লাগল। সাধারণভাবেই একটা ছাগলের ডাক শোনা যায় প্রায় চারশো গজ দূরত্ব থেকে কিন্তু এখানে অবস্থা খুব স্বাভাবিক ছিল না কারণ পাহাড়টার যে দিকে ছাগলগুলো বাঁধা হয়েছিল সেদিকে খুব জোর বাতাস নিচের দিকে বইছিল–আমি ডাক শোনার পর বাঘিনীটা যদি সরেও গিয়ে থাকে তাহলেও ওর পক্ষে ছাগলগুলোর ডাক না শোনা অসম্ভব। আর ও যদি ক্ষুধার্ত হয়–ও যে ক্ষুধার্ত একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। তাহলে সেটা হবে আমার গুলি চালানোর একটা খুব ভাল সুযোগ।

আমি গাছে মিনিট দশেক কাটানোর পর যেখান থেকে কালিজের ঝাঁকটা উড়েছিল সেখানে একটা কাকার ডেকে উঠল। দুএক মিনিটের জন্যে আমার আশা যেন আকাশ ছুঁয়েছিল কিন্তু তার পরেই সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল, কারণ কাকারটা ডাকল মাত্র তিনবার আর প্রতিবারই ওর ডাকটা শেষ হল একটা জিজ্ঞাসায়, যার অর্থ এই ঝোপের মধ্যে একটা সাপ আছে যেটাকে ও বা কালিজগুলো মোটেই পছন্দ করে নি।

আমার বসার আসনটা অসুবিধের নয় আর সূর্যের আলোও তখন বেশ আরামদায়কভাবে উষ্ণ তাই পরবর্তী তিনঘণ্টা গাছে বসে থাকতে আমি কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নি। বিকেল চারটের সময় থাকের ওপরের পর্বতশ্রেণীর পেছনে সূর্য অস্ত গেল আর তারপরেই বাতাস হয়ে এল অসহ্য ঠাণ্ডা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমি কষ্ট সহ্য করলাম তারপর হাল ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলাম, কারণ ঠাণ্ডায় আমার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল–এখন যদি বাঘিনীটা আসেও তাহলেও ওকে তাক করে মারা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি দড়ির ঢিল দিয়ে রাইফেলটা নামিয়ে দিলাম, নিজে নামলাম তারপর চষা জমির ধারে হেঁটে গেলাম আমার লোকজনকে ডাকতে।

আমার মনে হয় কোনো কাজ করতে গিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির পর ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়ার যে হতাশা–সে অভিজ্ঞতা হয় নি এমন লোক খুব কমই আছে। একটা শ্রমক্লান্ত দিনের শেষে ব্যাগ ভর্তি পাহাড়ী তিতির নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসা আর সেই একই রাস্তায় মাইলের পর হতাশা ক্লান্ত মাইল হাঁটা, ব্যাগ যখন খালি এই দুটি তুলনা করুন। একটি মাত্র দিনের শেষে এই ধরনের হতাশার শিকার আপনি যদি হয়ে থাকেন–আর আপনার অভিপ্রেত শিকার যদি শুধুমাত্র তিতির হয় তাহলে আপনি অনুমান করতে পারবেন সেদিন সন্ধেবেলা আমি যখন লোকজনদের ডেকে, ছাগলগুলিকে খুলে ক্যাম্পের দুমাইল পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যে রওনা হলাম আমার হতাশার গভীরতা, কারণ আমার তখন একটা দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শুধুমাত্র কয়েকটি পাখি মারাই আমার উদ্দেশ্য ছিল না আর আমার ব্যর্থতার ফলভোগ শুধু আমাকেই করতে হবে না আরো অনেকেরই ভাগ্য জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।

বাড়ি থেকে যাতায়াতের সময়টুকু বাদ দিলে আমি মানুষখেকোটার পিছু পিছু ঘুরছি এদিকে ২৩শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর, ওদিকে আবার ২০শে থেকে ২৮শে নভেম্বর পর্যন্ত এবং আপনাদের মধ্যে যাঁরা গলায় বাঘের দাঁত বসার ভয় নিয়ে হেঁটেছেন একমাত্র তারাই কিছুটা অনুমান করতে পারবেন এই ধরনের আশঙ্কার মধ্যে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটালে একজনের স্নায়ুর ওপর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

তার ওপরে আমার অভিপ্রেত শিকার ছিল একটা মানুষখেকো, যাকে গুলি করতে ব্যর্থ হওয়া মানেই অঞ্চলে যারা কাজ করছে বা বসবাস করে তাদের প্রত্যেকের জীবন সংশয়। জঙ্গলের কাজ আগেই থেমে গেছে এবং জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামটির অধিবাসীরা সবাই ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। অবস্থা এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ এবং নিঃসন্দেহে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে যদি মানুষখেকোটাকে মারা না হয় কারণ পুরো মজুরের দল অনির্দিষ্ট কালের জন্যে কাজ থামিয়ে থাকতে পারবে না আর আশপাশের গ্রামের অধিবাসীরাও বাড়িঘর খেতখামার ছেড়ে থাকতে পারবে না–যেমন পেরেছে থাকের তুলনামূলকভাবে সচ্ছল অধিবাসীরা। কয়েকটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, বাঘিনীটা বহুকাল আগেই মানুষ সম্বন্ধে তার স্বাভাবিক ভয় হারিয়েছে, যেমন– কর্মরত মানুষদের সামনেই আম কুড়োচ্ছিল এমন একটি স্ত্রীলোককে তুলে নিয়ে যাওয়া, একটি স্ত্রীলোককে তার বাড়ির দরজার সামনে মারা, গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে একজন লোককে গাছ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া এবং গতকাল রাতে কয়েক হাজার লোককে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা। এখানকার স্থায়ী এবং অস্থায়ী অধিবাসীদের কাছে পাহাড়ের পাদদেশের বাজারে, অথবা পূর্ণগিরির মন্দিরে যাওয়ার জন্যে যে সব লোকজন এই জেলার মধ্যে দিয়ে যায় তাদের কাছে একটা মানুষখেকোর উপস্থিতির তাৎপর্য কি তা আমার থেকে ভাল আর কে জানে? সেই আমি, লোকজনকে দেওয়া আমার প্রতিশ্রুতি মত মানুষখেকো মারার শেষ দিনটিতে মন্থর গতিতে ক্যাম্পে ফিরে চলেছি;মনের অন্তস্থল পর্যন্ত স্পর্শ করা গম্ভীর হতাশার এই যথেষ্ট কারণ নয় কি? আমার মনে হয়েছিল জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এ হতাশার গ্লানি আমার সঙ্গ ছাড়বে না। সেই মুহূর্তে আমি আনন্দের সঙ্গে বাঘিনীটাকে ধীর নিরুদ্বেগভাবে গুলি করার একটা সুযোগের জন্যে আমার বত্রিশ বছরের মানুষখেকো শিকার জীবনের সাফল্য বিনিময় করতে রাজী ছিলাম।

সাতদিন সাতরাত ধরে বাঘিনীটাকে গুলি করার একটি সুযোগের জন্যে আমার কয়েকটি প্রয়াসের কথাই আপনাদের জানিয়েছি কিন্তু আমার প্রচেষ্টা শুধু মাত্র সেগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমি জানতাম আমাকে লক্ষ এবং অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রতিবারই আমি যখন আমার ক্যাম্প আর থাকের মধ্যে দুমাইল জঙ্গলটির মধ্যে দিয়ে যেতাম, বাঘিনীটাকে বুদ্ধির লড়াইয়ে হারাবার জন্যে আমার বত্রিশ বছরের জঙ্গল জীবনে শেখা সব কৌশলই প্রয়োগ করতে হত আমাকে। আমার হতাশা যতই তিক্ত হ’ক না কেন আমি জানতাম আমার কোনো চেষ্টার ত্রুটি এ ব্যর্থতার জন্যে দায়ী নয় বা এমন কোনো কাজ আমি অসমাপ্ত রাখি নি যা থাকতে পারে এই ব্যর্থতার মূলে।

আমার লোকজন আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর আমায় জানাল কাকারটা ডাকার একঘন্টা পরে ওরা বাঘিনীটার ডাক শুনেছিল–ডাকটা আসছিল বহুদূর থেকে কিন্তু ঠিক কোনদিক থেকে ডাকটা আসছিল সে বিষয়ে ওরা নিশ্চিত নয়। বোঝাই যাচ্ছে বাঘিনীটার মোষের মতই ছাগলের ব্যাপারেও অনীহা কিন্তু তাহলেও দিনের ঠিক এই সময়টিতে একটি অতি পরিচিত অঞ্চল ছেড়ে ওর চলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক নয় অবশ্য এমন যদি না হয় যে ও কোনো আওয়াজে আকৃষ্ট হয়েছিল যা আমি বা আমার লোকজন শুনি নি। যাই হক, কারণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই একথা পরিষ্কার যে ও চলে গেছে এবং আমার আর কিছু করার না থাকায় আমি ক্লান্ত পদক্ষেপে ক্যাম্পের পথে পা বাড়ালাম।

পথটা, আমি আগেই বলেছি সেই ঢিবিটার সঙ্গে মিশেছে যেটা থাক থেকে সিকি মাইল দূরে চুকা পর্যন্ত গিয়েছে এবং আমি যখন এসব জায়গায় পৌঁছেছি যেখানে ঢিবিটা কয়েক ফুট মাত্র চওড়া আর যেখান থেকে দেখা যায় বিরাট গিরিবর্ত দুটি, যেগুলি মিশেছে লাধিয়া নদীর সঙ্গে, সেখানে উপত্যকার ওদিক থেকে আমি বাঘিনীর ডাক আরেকবার শুনলাম। বাঘিনীটা তখন কুমায়া চকের একটু ওপরে বাঁদিকে এবং কোটকিন্দ্রীর ঢিবিটা, যেটার ওপর ওই অঞ্চলে কর্মরত লোকেরা ঘাসের বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে তারই কয়েকশো গজ নিচে।

সাফল্যের আশা সুদূরপরাহত তবু এই একটা গুলি করার সুয়োগ; এইটিই আমার শেষ সুযোগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমার করা উচিত না অনুচিত।

আমি যখন গাছ থেকে নেমে আসি তখন অন্ধকার হওয়ার আগে ক্যাম্পে ফিরে যেতে আমার একঘণ্টা হাতে ছিল। লোকজনদের ডাকা, তাদের বক্তব্য শোনা, ছাগলগুলো সংগ্রহ করে ঢিবির দিকে হাঁটার সময় লেগে ছিল প্রায় তিরিশ মিনিট এখন নেপাল পর্বত শ্রেণীর মাথায় সিঁদুর রঙ লাগিয়ে অস্তগামী সূর্যের অবস্থান দেখে আমি হিসেব করে নিলাম আমার হাতে এখনও প্রায় একঘণ্টা দিনের আলো আছে। এই সময়ের হিসেব–আরও নির্ভুলভাবে বলতে গেলে আলোর হিসেব এখন সব থেকে বেশি জরুরী কারণ এখন আমার সামনের সুযোগটি যদি আমি গ্রহণ করতে পারি। তবে পাঁচটি লোকের জীবন বাঁচবে।

বাঘিনীটি, এক মাইল দূরে আছে–মধ্যের জমিটা জঙ্গল সমাকীর্ণ, বড় বড় পাথরে ভর্তি আর গভীর নালায় ক্ষত বিক্ষত হলেও ও ইচ্ছে করলে এই দূরত্বটা স্বচ্ছন্দে আধঘণ্টার মধ্যেই অতিক্রম করতে পারে। যে প্রশ্নটি সম্বন্ধে আমার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটা হচ্ছে আমি বাঘিনীটাকে ডেকে আনার চেষ্টা করব কিনা। যদি আমি ডাকি আর ও শুনতে পায় এবং দিনের আলো থাকতে থাকতেই এসে আমায় গুলি করার সুযোগ দেয় তাহলে সব ঠিক আছে; কিন্তু অন্যদিকে ও যদি আসে আর আমায় গুলি করার সুযোগ না দেয় আমাদের মধ্যে কয়েকজন আর ক্যাম্পে পৌঁছবে না কারণ এখনও আমাদের যেতে দুমাইল পথ বাকি–এই পথটা পুরোটাই গিয়েছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কোনো কোনো জায়গায় পথটার দুধারেই বিশাল বিশাল পাথর, আবার কোনো কোনো জায়গায় ঘন ঝোপঝাড়। সঙ্গের লোকজনদের সঙ্গে আলোচনা করা অর্থহীন কারণ তারা কেউই এর আগে কোন জঙ্গলে আসে নি সেজন্য সিদ্ধান্ত যাই হক সেটা নিতে হবে আমাকেই।

আমি বাঘিনীটাকে ডাকাই স্থির করলাম।

 রাইফেলটা একজনের হাতে দিয়ে আমি বাঘিনীটা আর একবার ডাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তারপর মুখের ওপর হাত জড়ো করে, ফুসফুসে যতটা সম্ভব নিঃশ্বাস ভরে নিয়ে উপত্যকার ওপর দিয়ে একটা উত্তরের ডাক পাঠিয়ে দিলাম। ওর উত্তর ফিরে এল, তারপর কয়েক মিনিট ধরে চলল ডাকের উত্তরে ডাক। আসবে–হয়তো ও রওনা হয়ে গেছে এতক্ষণ, যদি ও গুলি করার মত আলো থাকতে থাকতেই এসে পৌঁছয় সব সুবিধেই তাহলে থাকবে আমার দিকে, কারণ ওর মুখোমুখি হওয়ার মত সুবিধের জায়গা আমি নিজের ইচ্ছেমত বেছে নিতে পারব। নভেম্বর মাস বাঘদের সংগমের সময় আর বোঝা গেল ও গত আটচল্লিশ ঘণ্টা জঙ্গল তোলপাড় করে একজন সঙ্গী খুঁজে বেড়াচ্ছিল এবং এখন একটা বাঘ তার মিলিত হবার আবেদনে সাড়া দিচ্ছে ভেবে ও তার সঙ্গে যোগ দিতে কোনো সময় নষ্ট করবে না।

ঢিবিটার চারশো গজ নিচে পথটা প্রায় পঞ্চাশ গজ গিয়েছে একটা সমতল ভূমির ওপর দিয়ে। এই সমতল ভূমির দূরের ডানদিকে পথটা একটা বিরাট পাথরকে পাক খেয়ে খাড়া নেমে গেছে তারপর চুলের কাটার মত মোচড় খেতে খেতে পরবর্তী বাঁক পর্যন্ত গিয়েছে। এই পাথরের ওপরেই আমি বাঘিনীটার সম্মুখীন হওয়া স্থির করলাম এবং নিচে নামার পথে বেশ কয়েকবার ডাকলাম–উদ্দেশ্য আমার অবস্থান পরিবর্তনের কথা ওকে জানানো এবং ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।

আমি চাই জায়গাটির একটি পরিষ্কার ছবি আপনি মনে মনে এঁকে নিন যাতে পরবর্তী ঘটনাগুলি আপনি অনুধাবন করতে পারেন। চল্লিশ গজ চওড়া, আর আশি গজ লম্বা একটা চতুর্ভুজ জমির কথা ভাবুন যেটা গিয়ে শেষ হয়েছে মোটামুটি খাড়া একটা পাথরের গায়ে। থাক থেকে নেমে আসা পথটা এই জমিটার ওপর দিয়ে গেছে সরু বা দক্ষিণ দিকটায় তারপর জমিটার মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে পঁচিশ গজ গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেছে এবং চতুর্ভুজ জমিটা ছেড়েছে ওটার চওড়া অথবা পুব দিকে। যে জায়গাটায় পথটা সমতলভূমি ছেড়েছে সেখানে একটা প্রায় চার ফুট উঁচু পাথর আছে। যেখানে পথটা ডান দিকে মোড় নিয়েছে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে একটা তিন চার ফুট উঁচু পাথরের ঢিবি উঠে চলে গেছে চতুর্ভুজ জমিটার উত্তর দিক পর্যন্ত যেখানে জমিটা সোজা নেমে গেছে একটা খাড়া পাথরের গা বেয়ে। এই নিচু ঢিবিটার নিকটবর্তী অথবা পথের দিকে সারিবদ্ধ ঘন ঝোপঝাড়-চার ফুট উঁচু যে পাথরটার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি, তার দশ ফুটের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। চতুর্ভূজ জমিটার অন্যান্য জায়গা গাছ, ছড়ানো ঝোপঝাড় আর ছোট ঘাসে ভর্তি।

আমার ইচ্ছে ছিল পাথরটার দিকে পথের ওপর শুয়ে থাকা এবং বাঘিনীটা আমার দিকে এগনোর সময়ে গুলি করা কিন্তু এই অবস্থানটি পরখ করে দেখলাম যে ও আমার দু-তিন গজের মধ্যে আসার আগে ওকে আমি দেখতেই পাব না, আর তাছাড়া বাঘিনীটা পাথরটা ঘুরে অথবা আমার বাঁ দিকের ছড়ানো ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে আমায় ধরতে পারে একেবারে সম্পূর্ণ আমার দৃষ্টির বাইরে থেকে। পাথরটার যে দিক দিয়ে বাঘিনীটা আসবে আমি আশা করেছিলাম তার উল্টো দিকে একটা সরু আলসে মত বেরিয়ে আছে। তার ওপর বসে দেখলাম আমার পশ্চাদ্দেশের অল্প অংশই আলসেটার ওপর ধরল–বাঁ হাতে পাথরটার গোলাকৃতি ওপরটা ধরে আর ডান পা-টা টানটান করে যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে আঙুল দিয়ে মাটি স্পর্শ করে আমি কোনো মতে ওটার ওপর থাকতে পারলাম। লোকজন এবং ছাগলগুলিকে রাখলাম ঠিক আমার পেছনে, আমার থেকে দশ বারো ফুট নিচে।

বাঘিনীকে অভ্যর্থনা জানানোর সব প্রস্তুতিই এখন শেষ আর যার জন্যে এত, আয়োজন সে ততক্ষণে তিনশো গজের মধ্যে এগিয়ে এসেছে। দিক জানাবার জন্যে শেষবারের মত ওকে একবার ডেকে আমি পেছন ফিরে দেখলাম আমার লোকজন ঠিক আছে কিনা।

লোকজনকে যে অবস্থায় দেখলাম তা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে হাস্যকর মনে হত কিন্তু এখন দৃশ্যটি খুব করুণ মনে হল। খুব কাছ ঘেঁষে, হাঁটু মুড়ে মাথা কাছাকাছি এনে বৃত্তাকারে ওরা বসে আছে, ছাগলগুলো ওদের তলায় লুকানো–ওদের চিন্তাক্লিষ্ট মুখে সেই উৎকণ্ঠাভরা কৌতূহল যা দেখা যায় একটা বড় কামান ছুটে যাওয়ার আগে অপেক্ষমান দর্শকদের মুখে। ঢিবিটার ওপর থেকে আমরা প্রথম বাঘিনীর ডাক শোনার পরে লোকজন অথবা ছাগলগুলো একটা চাপা কাশির ওপরে একটি আওয়াজও করে নি। ওরা এতক্ষণে বোধ হয় ভয়ে হিম হয়ে গেছে– হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই–আর যদি হয়েও থাকে তাহলেও ওদের বাহাদুরী না দিয়ে উপায় নেই কারণ ওরা যে কাজ করার সাহস দেখিয়েছে তা আমি ওদের অবস্থায় থাকলে করার কথা স্বপ্নেও ভাবতাম না। এই ভয়াবহ জানোয়ারটি গত দুরাত ধরে ওদের জাগিয়ে রেখেছে, এর সম্বন্ধে গত সাতদিন ধরে ওরা নানারকম অতিরঞ্জিত এবং রক্ত জল করা গল্প শুনেছে আর এখন যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ওরা বিনা অস্ত্রে বসে আছে একটা জায়গায় যেখান থেকে ওরা কিছু দেখতে পাচ্ছে না শুধু শুনতে পাচ্ছে মানুষখেকোটা কাছে, আরো কাছে এগিয়ে আসছে; এর থকে বেশি সাহস বা বিশ্বাসের কথা কল্পনাও করা যায় না।

আমি যে আমার রাইফেলটা, একটা ডি. বি. ৪৫০/৪০০ বাঁ হাত দিয়ে ধরতে পারছিলাম না (এই হাত দিয়ে ধরে পাথরের আলসেটার ওপর কোনোরকমে আমি বসেছিলাম) তাতে আমার একটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছিল–কারণ পাথরটার গোলাকৃতির ওপরে রাইফেলটা পিছলে যেতে পারে-অবশ্য তা যাতে না হয় সেজন্যে আমি একটা রুমাল ভাঁজ করে রাইফেলটা তার ওপরে রেখেছিলাম কিন্তু আমার কোনো ধারণা ছিল না ঠিক এই অবস্থায় বসে একটা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রাইফেল ছুঁড়লে তার পিছন পানের ধাক্কার প্রতিক্রিয়া কি হবে। রাইফেলটার মুখ যে প্রথটার দিকে তার ওপরে কুঁজের মত একটা উঁচু জায়গা। আমার উদ্দেশ্য ছিল পাথরটার থেকে প্রায় কুড়ি ফুট দূরে এই কুঁজের মত উঁচু জায়গাটায় উপস্থিত হলেই বাঘিনীটার মুখ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ব।

বাঘিনীটা কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে এল না–এ রাস্তায় এলে কুঁজটার কিছু দূরে একটা পথের ওপর উঠত। ও একটা গভীর গিরিবর্ত পার হয়ে ও সোজা চলে এল যেখানে আমার শেষ ডাকটা ও শুনেছিল, সেখানে ঘড়ির কাঁটা একটা বাজার সময় যে ভাবে থাকে ও অনেকটা সেই ধরনের একটা কোণ সৃষ্টি করে এল। এই কৌশলের ফলে নিচু পাথরের ঢিবিটা আমাদের মধ্যে পড়ে গেল, ওপারটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। ও খুব নির্ভুলভাবে আমার শেষ ডাকের জায়গাটা বের করেছিল কিন্তু দূরত্বটা ঠিক আঁচ করতে পারে নি এবং সম্ভাব্য সঙ্গীকেও আশানুরূপ জায়গায় দেখতে না পেয়ে ওর রাগ ক্রমেই একটা প্রচণ্ড রূপ নিচ্ছিল। এই অবস্থায় একটা বাঘিনীর রাগ যে কি আকার ধারণ করতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার এর থেকে ধারণা হবে যে আমার বাড়ি থেকে কিছু মাইলের মধ্যে একটি বাঘিনী একবার জনসাধারণের রাস্তা প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ রেখেছিল, যা কিছুই যাওয়ার চেষ্টা করে তাই আক্রমণ করে ও এমনকি একটা উটের সারিও ওর হাত থেকে রেহাই পায় নি–এই চলে যতদিন না একজন সঙ্গীর সঙ্গে ওর মিলন হয়।

এমন কোনো আওয়াজ আমার জানা নেই যা খুব কাছাকাছি থেকে একটা অদৃশ্য বাঘের গর্জনের থেকে বেশি স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আমার লোকজনের ওপর এই ভয়ংকর আওয়াজের প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে তা ভাবতেও আমার ভয় হচ্ছিল এবং ওরা যদি আর্ত চিৎকার করতে করতে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করত তাহলেও আমি বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হতাম না কারণ যদিও একটা ভাল রাইফেলের পেছন দিক আমার কাঁধে, কুঁদো আমার গাল ছুঁয়ে আছে, তাহলেও আমার নিজেরই চিৎকার করে ওঠার বাসনা আমি বহু কষ্টে দমন করছিলাম।

কিন্তু এই গর্জনের থেকেও ভয়াবহ হচ্ছে ক্রম বিলিয়মান আলো। আর কয়েক সেকেন্ড, খুব বেশি হলে দশ থেকে পনের সেকেন্ডের মধ্যেই অন্ধকার এত ঘন হয়ে আসবে যে আমার রাইফেলের সাইটে কিছু দেখা যাবে না-তখন আমাদের জীবন নির্ভর করবে একটা মানুষখেকোর মর্জির ওপর–শুধু তাই নয়, সঙ্গীর সঙ্গলিঙ্গু এক বাঘিনীর ওপর। বেপরোয়াভাবে হত্যার হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হলে একটা কিছু করতেই হবে, আর খুব তাড়াতাড়ি–একমাত্র করণীয় যার কথা আমি এই মুহূর্তে ভাবতে পারি তা হচ্ছে ঢাকা।

বাঘিনীটা এখন আমার এত কাছে যে প্রতিবার ডাকার আগে ওর নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম–এর পরে ও যখন ফুসফুস ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিল, আমিও ঠিক তাই করলাম, তারপর দুজনে একসঙ্গে ডেকে উঠলাম। চমকে ওঠার মত দ্রুত এর প্রতিক্রিয়া হল। মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা না করে ও মরা পাতার ওপর দিয়ে, উঁচু। ঢিবিটা বেয়ে আমার সামনের ডান দিকের ঝোপে দ্রুত পদক্ষেপে চলে এল আর যখন ও আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি, ও থেমে গেল আর পরমুহূর্তে ওর গুরুগম্ভীর গলার গর্জন আছড়ে পড়ল আমার মুখের ওপর–আমার মাথায় টুপি পরা থাকলে সেটা গর্জনের মুখে উড়ে যেতো। মুহূর্তের বিরতি, তারপরেই আবার দ্রুত পদক্ষেপ, দুটো ঝোপের মধ্যে একঝলক দেখা দিয়ে ও একেবারে খোলা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াল এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়েই পাথরের মত নিশ্চল হয়ে গেল।

আমার ভাগ্য আশাতীত রকম ভাল হওয়ার দরুণই বাঘিনীটা সামনে ডানদিকে যে আধডজন পা ফেলেছিল তা ওকে নিয়ে গেল ঠিক সেই বিন্দুটিতে যেখানে আমার রাইফেলের লক্ষ্য স্থির করা আছে। শেষ ডাকটির আগে যে দিক দিয়ে আসছিল সেই দিকেই ও যদি এগিয়ে যেত তাহলে আমার গল্প কোনোদিন লেখা হত কি না। সন্দেহ–তার সমাপ্তিটা অন্যরকম হত কারণ গোলাকৃতি পাথরটার ওপরে রাইফেল ঘোরানো অসম্ভব ছিল আর তেমনই অসম্ভব ছিল একহাতে রাইফেল তুলে গুলি চালানো।

বাঘিনীটার নৈকট্য এবং ম্লান হয়ে আসা আলোর দরুন ওর মাথাটাই শুধু আমি দেখতে পেলাম। আমার প্রথম বুলেটটা লাগল গিয়ে ওর ডান চোখের নিচে আর দ্বিতীয়টা যেটি আমার সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে ছোঁড়া নয়, হঠাৎ ছুটে গিয়ে লাগল ওর গলায়–ও পাথরে নাকটা রেখে চির বিশ্রামের কোলে ঢলে পড়ল। ডানদিকের নলটার পেছনের ধাক্কায় পাথরটার ওপর আমার হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আমি ঠিকরে পড়লাম আলসেটার ওপর থেকে এবং আমি শুন্যে থাকা অবস্থায় রাইফেলটা আরেকবার ছুটে যাওয়ায় বাঁ দিকের নলের পেছনের ধাক্কায় রাইফেলটা প্রচণ্ড জোরে লাগল আমার চোয়ালে আর আমি মানুষ-ছাগলের ওপর ডিগবাজি খেয়ে পড়লাম। আবার ওই চারটি লোককে আমি বাহাদুরী জানাই যে পরমুহূর্তেই বাঘিনীটা ওদের ওপর ঝাঁপ দেবে কিনা তার কোনো স্থিরতা নেই তবুও আমায় পড়ন্ত অবস্থায় ওরা ধরে ফেলেছিল এবং এইভাবে আমাকে আঘাত থেকে আর আমার রাইফেলটি ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে ওরা বাঁচিয়েছিল।

মানুষ ও ছাগলের পায়ের জট থেকে নিজেকে উদ্ধার করে আমি যে লোকটি কাছে ছিল তার হাত থেকে আমার .২৭৫ রাইফেলটি নিয়ে ম্যাগাজিনের মধ্যে বেশ কয়েকটা গুলি পুরে দিলাম তারপর পাঁচটা গুলির একটা ঝাক ছেড়ে দিলাম, গুলিগুলো শিস দিয়ে চলে গেল উপত্যকার ওপর দিয়ে সারদা পেরিয়ে নেপালের মুখে।

উপত্যকা এবং আশপাশের গ্রামের লোক যারা উদগ্রীব হয়ে আছে আমার রাইফেলের আওয়াজ শোনার জন্যে, তাদের কাছে দুটো গুলির আওয়াজের যে কোনো মানে হতে পারে কিন্তু দুটো গুলির পরেই ঠিক পাঁচ সেকেন্ড বিরতির পরে পরে আরো পাঁচটি গুলির আওয়াজ ওদের কাছে একটাই শুভ সংবাদ পৌঁছে দেবে যে মানুষখেকোটি মারা পড়েছে।

পাহাড়ের ওপর বাঘিনীটার প্রথম ডাক শোনার পর থেকে আমি আমার লোকজনের সঙ্গে কথা বলি নি। আমি যখন ওদের বললাম যে বাঘিনীটা মারা গেছে এবং আর আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মনে হল ওরা আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না তাই আমি ওদের বললাম গিয়ে দেখতে আর আমি একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। খুব সতর্কভাবে ওরা পাথরটার ওপর উঠল কিন্তু তার বেশি এগোল না কারণ আমি আগেই বলেছি বাঘিনীর শরীর পাথরের ওদিকটা স্পর্শ করে ছিল। সে রাতে ক্যাম্পে, ক্যাম্প আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে ওরা যখন উদগ্রীব শ্রোতাদের কাছে ওদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিল–ওদের বিবরণী ঘুরে ফিরে এই একটি কথায় শেষ হচ্ছিল,-”তারপর বাঘটা, যার গর্জন শুনে আমাদের পিলে গলে জল হয়ে যাচ্ছিল, সাহেবকে মাথায় মেরে আমাদের ওপর উল্টে ফেলে দিল আর তোমরা যদি আমাদের বিশ্বাস না কর, গিয়ে ওর মুখ দেখ। আয়না, ক্যাম্পে একটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস আর আমার যদি একটা আয়না থাকত তাহলেও আমার চোয়ালের ফোলাটা, যার জন্যে আমাকে বেশ কিছুদিন শুধু দুধ খেয়ে থাকতে হয়েছিল, নিশ্চয়ই আমার যে রকম মনে হচ্ছিল যতখানি ফোলা এবং কষ্টকর দেখাত না।

একটা চারাগাছ কেটে বাঘিনীটাকে তার সঙ্গে বাঁধার সময়টুকুর মধ্যেই লাধিয়া উপত্যকায় এবং আশপাশের সমস্ত বস্তি এবং গ্রামে আলো দেখা যেতে লাগল। ওই চারজন লোক বাঘিনীটাকে ক্যাম্পে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্মানের জন্যে খুবই আগ্রহী ছিল কিন্তু কাজটা ছিল ওদের সাধ্যের বাইরে সেইজন্যে আমি ওদের রেখে সাহায্যের জন্যে এগোলাম।

গত আট মাসে আমার তিনবার চুকা যাত্রার দিনের বেলা বহুবার এ পথটা পেরিয়েছি এবং তখন সব সময় আমার হাতে ছিল গুলিভরা রাইফেল আর এখন নিরস্ত্র অবস্থায় অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে চলেছি, আমার একমাত্র চিন্তা কি করে পড়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। কোনো প্রচণ্ড ব্যথা হঠাৎ কমে যাওয়া যদি সব থেকে সুখের হয় তাহলে নিঃসন্দেহে তারপরেই স্থান নেবে কোনো ভয়াবহ আতঙ্কে হঠাৎ নির্মূল হয়ে যাওয়া। মাত্র একঘণ্টা আগেই ওই মানুষগুলোকে তাদের ক্যাম্পে, বাড়ি থেকে টেনে বার করতে খ্যাপা হাতির দলের দরকার হত, কিন্তু তারাই এখন গান করতে করতে, চিৎকার করতে করতে, এক বা সদলে চারিদিক থেকে জড়ো হচ্ছে থাক-মুখী রাস্তাটার ওপর। এই দ্রুত জমে ওঠা ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকটি লোক বাঘিনীটাকে বয়ে আনতে সাহায্যের জন্যে রাস্তার ওপর দিকে চলে গেল। অন্যরা আমার ক্যাম্পের পথের সঙ্গী হল এবং আমি সম্মতি দিলে ওরা সেদিন আমায় বয়ে নিয়ে যেত। আমাদের গতি খুব মন্থর ছিল কারণ নবাগতদের তাদের নিজেদের মতন ভাবে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ দেওয়ার জন্যে আমাদের থেকে থেকেই দাঁড়াতে হচ্ছিল। এর ফলে যে দলটি বাঘিনীটা বয়ে আনছিল তারা আমাদের ধরে ফেলার সময় পেল এবং আমরা এক সঙ্গেই গ্রামে প্রবেশ করলাম। সেদিন আমি এবং আমার লোকজন যে সংবর্ধনা পেয়েছিলাম বা চুকায় সে রাতে যে সব দৃশ্য দেখেছিলাম তা বর্ণনা করার চেষ্টা করব না কারণ জীবনের অধিকাংশ সময় জঙ্গলে জঙ্গলে কাটালেও, কথা দিয়ে ছবি আঁকার সামর্থ্য আমার নেই।

একটা খড়ের গাদা নামিয়ে বাঘিনীটাকে তার ওপর শোয়ানো হল আর দৃশ্যটি– আলোকোজ্জ্বল করার জন্যে, উষ্ণতার জন্যেও বটে, কারণ রাতটা অন্ধকার এবং ঠাণ্ডা আর একটা উত্তরে বাতাসও বইছিল তার আশপাশ থেকে জ্বালানী কাঠ কুড়িয়ে এক বিরাট বহূৎসব করা হল। মাঝরাত নাগাদ আমার চাকর, থাকের মোড়ল এবং য়ার বাড়ির কাছে আমি ক্যাম্প করেছিলাম সেই কুনোয়ার সিং-এর সাহায্যে জনতাকে তাদের নিজের নিজের গ্রাম ও মজুরদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে রাজী করাল–তাদের বলা হল পরদিন বাঘিনীটাকে চোখ ভরে দেখার সুযোগ তারা যথেষ্ট পাবে। নিজে চলে যাওয়ার আগে থাকের মোড়ল আমায় বলে গেল যে সকালে ও থাকের অধিবাসীদের গ্রামে ফিরে যেতে বলবে। ও কথা রেখেছিল এবং দুদিন পরে সব লোকজন তাদের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল আর তারপর থেকেই তারা সুখে স্বচ্ছন্দেই বসবাস করছে।

আমার মাঝরাতের খাওয়া শেষ করে আমি কুনোয়ার সিংকে ডেকে পাঠালাম এবং তাকে বললাম যে প্রতিশ্রুত দিনটিতে বাড়ি পৌঁছতে হলে আমায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রওনা হয়ে যেতে হবে এবং ওকে সকালে লোকজনকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন আমায় চলে যেতে হল। ও কথা দিল এ কাজটি ও করবে, তখন আমি গেলাম বাঘিনীটার ছাল ছাড়াতে। পকেট ছুরি দিয়ে একটা বাঘের ছাল ছাড়ানো অনেক সময়ের ব্যাপার কিন্তু এতে জানোয়ারটা ভালভাবে পরখ করে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় যা অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায় না। এবং মানুষখেকোদের ক্ষেত্রে মোটামুটি নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা যায় জানোয়ারটি মানুষখেকো হয়ে যাওয়ার কারণ কি।

বাঘিনীটি তুলনামূলকভাবে কম বয়েসী এবং সঙ্গমের মরসুমের আগে ঠিক যেমনটি আশা করা যায়, শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী, ওর গাঢ় রঙের শীতের চামড়াতে কোনো দাগ নেই এবং আমার দেওয়া খাদ্যসম্ভার বারে বারে প্রত্যাখ্যান করলেও ওর শরীর চর্বিতে ঢাকা। ওর শরীরে ছিল দুটি বন্দুকের গুলির ক্ষত কিন্তু কোনোটাই চামড়ার ওপর দেখা যায় না। একটা ওর বাঁ কাঁধে, ক্ষতটা হয়েছে কোনো ঘরে তৈরি গাদাবন্দুকের ছররায়–ক্ষতটা ক্ৰমে বিষাক্ত হয়ে যায় তারপর যখন শুকোতে আরম্ভ করে তখন বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে চামড়া, বেশ পাকাপাকিভাবে মাংসের সঙ্গে জুড়ে যায়। এই ক্ষতটা ওকে কতটা অক্ষম করে দিয়েছিল তা বলা কঠিন হত কিন্তু ওটা শুকোতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লেগেছে এবং ওর মানুষখেকো হওয়ার মূলে এ ক্ষতটি একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষতটি, যেটি ওর ডান কাঁধে, সেটিও হয়েছে গাদাবন্দুকের গুলিতেই তবে সেটা বিষাক্ত না হয়ে শুকিয়ে গেছে।

মানুষখেকো হওয়ার আগের দিনগুলিতে মড়ির ওপর পাওয়া এই চোট দুটিও ওর মানুষের মড়ি এবং অন্যান্য যে সব মড়ির ওপর আমি বসেছিলাম সেগুলিয় কাছে ফিরে না আসার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ। বাঘিনীটার ছাল ছাড়ানো হলে আমি স্নান করে পোশাক পরে নিলাম এবং যদিও আমার মুখে ফোলা ও ব্যথা দুইই ছিল আর সামনে ছিল কুড়ি মাইল দুর্গম রাস্তা, আমি যখন হেঁটে চুকা ছাড়লাম তখন আমি যেন বাতাসে উড়ছি। উপত্যকার এবং আশপাশে হাজার হাজার লোক তখন শান্ত ঘুমে মগ্ন।

যে জঙ্গলের গল্প আপনাদের শোনাতে শুরু করেছিলাম তা শেষ হল এবং আমিও আমার মানুষখেকো শিকার জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি।

একটা দীর্ঘমেয়াদী কাজের পালা শেষ হল এবং সেদিন যে আমি নিজের পায়ে হেঁটে বেরোতে পেরেছিলাম আর আমাকে যে থাকের সেই মানুষটির প্রদর্শিত প্রথা অনুসারে একটা দোলনায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নি। এতে নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করি।

জীবনের অনেক ক্ষেত্রে প্রাণটা ঝুলছে একটা সুতোর মুখে, কখনও রোদে জলে ঘোরা, পরিশ্রমের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ হয়ে উঠেছে কঠিন কিন্তু আমার শিকারের ফলে একটি মানুষের প্রাণও যদি বেঁচে থাকে তাহলে এসব কষ্ট স্বীকারের জন্যে নিজেকে যথেষ্ট পুরস্কৃত মনে করব।