প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

৪. চুকার মানুষখেকো

৪. চুকার মানুষখেকো

০১.

লাচিয়া উপত্যকার মানুষখেকো বাঘকে যে জায়গাটি নিজের নামটি ধার দিয়েছিল সে চুকা হল লাচিয়া ও সারদা নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে সারদা-নদীর ডান পাড়ে আন্দাজ দশ-লাঙলী একটি ছোট গ্রাম। গ্রামটির উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে একটি পথ দুভাগে ভাগ হয়ে যাবার আগে সিকি মাইল গেছে জঙ্গল-জ্বলে সাফ হয়ে তৈরি একটি পথ। ধরে; একটি পথ এক শৈলশিরায় সিদে উঠে গিয়ে থাক গ্রামে গেছে, অন্যটি তির্যক রেখায় পাহাড়গুলিতে উঠে ও সেগুলি পেরিয়ে গেছে চুকার লোকদের মালিকানাভুক্ত গ্রাম কোটকিরিতে।

১৯৩৬ সালের শীতকালে পরের পথটিতে একটি লোক দুটি বলদ নিয়ে যাচ্ছিল এবং যখন সে চুকার কাছে এসেছে, একটি বাঘ সহসা দেখা দিল জঙ্গল-জ্বলে সাফ হয়ে তৈরি পথটিতে। অতি প্রশংসনীয় সাহসে লোকটি বাঘটি ও বলদগুলির মধ্যে এসে দাঁড়াল, এবং লাঠি তুলে ও চেঁচিয়ে বাঘটিকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। তাদের অনুকূলে এই গণ্ডগোল সৃষ্টি হবার সুবিধা গ্রহণ করে বলদগুলি তৎক্ষণাৎ ছুটে গ্রামে পালাল, এবং শিকার থেকে বঞ্চিত হওয়াতে বাঘটি এবার মনোযোগ দিল লোকটির ওপর। বাঘটির মারমুখো ভাব দেখে শঙ্কিত হয়ে লোকটি দৌড়বে বলে ঘুরে দাঁড়াল এবং যখন সে ঘুরছে, বাঘটি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটির কাঁধে ছিল কাঠের ভারি লাঙল এবং চুকায় থাকার জন্য তার যে রসদ প্রয়োজন তার থলি ছিল ওর পিঠে। বাঘটি যখন লাঙল ও থলির ওপর নখ-দাঁতের ধার পরীক্ষা করছিল, লোকটি ভারমুক্ত হয়ে গ্রামের দিকে দৌড় লাগাল ও ছুটতে ছুটতে সাহায্যের জন্য চেঁচাতে লাগল। চীৎকার শুনে ওর আত্মীয় ও বন্ধুরা ওর সাহায্যে এগিয়ে এল এবং আর নতুন কোনো ঘটনা ব্যতীতই ও গ্রামে পৌঁছল। বাঘের একটা থাবায় তার ডান হাতটা কাঁধের কাছ থেকে কজী পর্যন্ত চিরে গিয়ে একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।

কয়েক সপ্তাহ বাদে টনকপুরের হাট থেকে ফিরতি পথে দুটি লোক কোটকিরি যাবার খাড়াই পথে উঠেছিল, তখন ওদের থেকে পঞ্চাশ গজ সামনে একটি বাঘ রাস্তাটি পার হয়। পথের কাছ থেকে সরে যাবার জন্যে বাঘটিকে সময় দিতে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে লোকগুলি ওদের পথে এগোল এবং চলতে চলতে চেঁচাতে থাকল। বাঘটি কিন্তু সরে যায় নি, এবং সামনের লোকটি একে ছাড়িয়ে এগোতেই ও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই লোকটি বইছিল এক বস্তা গুড়, বস্তার অর্ধেকটা ছিল মাথায় আর অর্ধেকটা ঝুলছিল পিঠে। বাঘটির দাঁত বসল বস্তাটায় এবং লোকগুলির কোনো ক্ষতি না করে ও বস্তাটি নিয়ে পাহাড়ের গা ধরে নেমে গেল। এ পর্যন্ত ও যা যা পেল, একটি লাঙল এবং এক বস্তা গুড়, সে বিষয়ে বাঘটির মনোভাব যে কি, তার রেকর্ড নেই কোনো; তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ও যে যে শিকার পেল তাতে সন্তুষ্ট হয় নি কেন না এখন থেকে ও সেই সব মানুষদের বেছে নিতে থাকল যারা লাঙল অথবা বস্তায় ভারাক্রান্ত নয়।

চুকা থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চে অবস্থিত থাক্‌-এ পার্বত্যগ্রাম অনুপাতে বেশ বৃহৎ জনসংখ্যা আছে। গুর্খাদের আবির্ভাবের আগে যে চাঁদ রাজারা কুমায়ুন শাসন করতেন, তারা বর্তমান মালিকদের পূর্বপুরুষদের ভরণপোষণের জন্যে থাকে জমি দেন এবং পূর্ণগিরি মন্দিরসমূহের বংশানুক্রমিক তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন তাঁদের। সুফলা জমি ও মন্দিরগুলি থেকে রীতিমত রোজগার, থাকের জনসাধারণকে ভাল, শক্তসমর্থ বাড়ি তৈরিতে এবং গৃহপালিত পশুর বড় বড় পাল খরিদে সহায়তা করেছে।

১৯৩৭ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে এক দিন থাকের দুশো গজ পশ্চিমে সাতটি পুরুষ ও দুটি বালক গ্রামের পশুপাল চরাচ্ছিল। সকাল ১০টায় দেখা গেল যে কিছু পশু ফাঁকা জায়গা ছেড়ে জঙ্গলের দিকে ছটকে পড়তে শুরু করেছে এবং দুটি ছেলের একটিকে, বয়স তার চোদ্দ, তাদের ফিরিয়ে আনতে পাঠানো হল। পুরুষরা দিনের তাতের সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিল; যে জঙ্গলে তখন সব পশুই ঢুকে পড়েছে, সে জঙ্গলটি ঘিরে আছে ফাঁকা জমি। জঙ্গলে একটি কাকারের ডাক শুনে পুরুষদের ঘুম ভাঙল এবং দ্বিতীয় ছেলেটি, তারও বয়স চোদ্দ, তাকে পাঠানো হল পশুগুলি তাড়িয়ে বের করে আনার জন্যে। সে জঙ্গলে ঢোকার অল্প পরেই পশুগুলি এস্তে পালায় এবং ওরা যখন গ্রামের পথে একটি উন্মুক্ত খাত পেরোচ্ছে, একটি গরুর ওপর লাফিয়ে পড়ল একটি বাঘ এবং সাতটি পুরুষের একেবারে সামনে সেটিকে মেরে ফেলল। পশুগুলির ডাক এবং লোকদের হইহল্লায় গ্রামের লোকজনের হুঁস হল এবং খাতটির মুখোমুখি উঁচু জমিতে শীঘ্রই এক ভিড় জমল। এই লোকজনের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় ছেলেটির মা, এক বিধবা, আর পুরুষরা ওর ছেলেকে ডাকছে শুনে কি ঘটেছে তা জানতে ও ওদের দিকে ছুটে গেল। পশুগুলি তাড়িয়ে বের করতে ওর ছেলে জঙ্গলে ঢুকেছে, আর ফিরে আসে নি জেনে ও তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। এই মুহূর্তে প্রথম ছেলেটির বাবা-মা এসে হাজির হল ঘটনার জায়গায় এবং ওরা যখন জিজ্ঞেস করল ওদের ছেলে কোথায়, এক মাত্র তখনি সাতটি পুরুষের মনে পড়ল তাকে ওরা সকাল ১০টার পর দেখে নি।

খাতের ধারে নিহত গরুটির কাছে যে বিশাল মানুষের জমায়েত হয়েছিল, তারা অনুসরণ করল এবং সেই উদ্ৰান্ত জননী জঙ্গলে গিয়ে যেখানে বাঘ ওর ছেলেকে মেরে ফেলে রেখে গেছে তা দেখল; এবং প্রথম ছেলেটির বাবা-মা কাছের এক ঝোপের নিচে পেল তাদের নিহত, খানিকটা খাওয়া ছেলেকে। এই ছেলেটির কাছেই ছিল একটি নিহত বাছুর। সে দিনের শোচনীয় ঘটনাবলীর যে বিবরণী পরে গ্রামবাসীরা আমাকে দেয়, আমার বিশ্বাস, যে জমিতে পশুগুলি চরছিল তার মুখোমুখি জঙ্গলে ওঁত পেতে ছিল বাঘটি; এবং পুরুষদের অগোচরে বাছুরটি যখন জঙ্গলে ঢোকে, বাঘটি তাকে মারে এবং ওটাকে সে নিয়ে যেতে পারার আগেই প্রথম ছেলেটি হয় অসাবধানে নয় কৌতূহলের বশে বাছুরটির কাছে যায় এবং সেও নিহত হয়, ঝোপের নিচে তাকে টেনে নিয়ে খানিকটা খায়। এর পর স্পষ্টতই বাঘটি বিকেল ৪টে অব্দি তার দুই মড়ি আগলে বসেছিল; তখন ফাঁকা জায়গার কিনারের জলাশয়ে জল খেতে যাবার পথে একটি কাকার হয় মড়ি দেখে অথবা গন্ধ পেয়ে ডাকতে থাকে। এতে, পশুগুলি ছটকে জঙ্গলে গেছে বলে পুরুষদের হুঁশ হয় এবং দ্বিতীয় ছেলেটিকে পশুগুলি খেদিয়ে আনতে পাঠানো হয়, তার দুর্ভাগ্য, সে সিধে যায় সেই জায়গায় যেখানে বাঘটা তার মড়িগুলো আগলে বসে আছে।

দ্বিতীয় ছেলেটি মারা পড়ার সময়ে স্পষ্টতই পশুগুলি সাক্ষী ছিল, তারা তার উদ্ধারে সমবেত হয়–গরু ও মোষ, উভয়কেই আমি এ কাজ করতে দেখেছি–এবং ছেলেটির কাছ থেকে বাঘটিকে তাড়িয়ে দেবার পর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোটে। মড়িগুলো থেকে হটে যেতে বাধ্য হয়ে বাঘটি রেগে গিয়েছিল, এবং সম্ভবত সে সময়ে যে গুঁতোটা সে খায় সেজন্যেও, বাঘটি পলায়নকারী পশুদলের পিছু নেয় এবং প্রথম যেটিকে ধরতে পারে তারই ওপর মেটায় প্রতিহিংসা। পশুপালটি সিধে গ্রামে ছুটে না গেলে ও হয়তো ওকে যারা আক্রমণ করেছিল তাদের একটিকে মেরেই সন্তুষ্ট থাকত না। এমনি এক উদ্ধার প্রচেষ্টার বেলা আমি একবার এক ক্রুদ্ধ বাঘের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধে পাঁচটি মোষের পুরো দলকে প্রাণ হারাতে দেখেছিলাম। বাঘটি যে দলের একটিকে মেরেছিল এবং আর চারটি বীর-হৃদয় পশু তাকে আক্রমণ করে এবং তাদের শেষটি মারা না-পড়া অব্দি লড়াই চালায়। সে লড়াইয়ে বাঘটি স্পষ্টতই দারুণ জখম হয় কেন না যখন রণক্ষেত্র ছেড়ে যায় তখন সে রক্তের নিশানা রেখে গিয়েছিল।

একই দিনে সেই দুটি মানুষ ও দুটি পশু নিধন বাইরে থেকে যা অনাবশ্যক মনে হবে, তা প্রথম মড়ির বেলা বাঘটিকে বিরক্ত করার পরিণতি বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস–এতে নৈনিতাল ও আলমোড়া জেলায় বিরাট হইচই পড়ে যায় এবং বাঘটিকে মারবার জন্যে সব রকম চেষ্টা চালানো হয়। মড়ি সামনে রেখে মাচায় বহুবার বসেন জেলা-আধিকারিকরা, দুর্ভাগ্যক্রমে শুধু ছররাগুলিতে যদিও দুবার বাঘটি আহত হয়–তবু সে মানুষ শিকার করে চলতেই থাকে এবং দুর্ভাগ্য থাক গ্রাম থেকে আরো দুটি মানুষ প্রাণ হারায়।

থাকের দুশো গজ ওপরে আছে একটি গমের খেত। এ খেতের ফসল কাটা হয়ে গিয়েছিল এবং দুটি ছেলে কয়েকটি পশু চরাচ্ছিল কাটা গমের খেতে। ছেলে দুটির বয়স দশ ও বার, তারা অনাথ, সহোদর। নিরাপত্তার কারণে তারা বসেছিল খেতের মধ্যিখানে। গ্রাম থেকে খেতের দূরতর প্রান্তটিতে একটি পাতলা ঝোঁপঝাড়ের বেড়া। গ্রাম থেকে পাহাড়টি সিঁদে খাড়াইয়ে উঠে গেছে হাজার ফুট এবং পাহাড়ের যে কোনো জায়গা থেকে ফাঁকায় বসে থাকা ছেলেদুটি চোখে পড়বার কথা। বিকেলের দিকে একটি গরু ছট্‌কে চলে যায় ঝোঁপগুলির দিকে এবং ছেলে দুটি একসঙ্গে থেকে গরুটিকে তাড়িয়ে খেতে ফিরিয়ে আনবার জন্যে রওনা হল। বড় ছেলেটি সামনে ছিল এবং সে যেমন একটি ঝোঁপ পেরিয়েছে, বাঘটি অপেক্ষায় ওত পেতেই ছিল, ছেলেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও নিয়ে চলে যায়। ছোট ছেলেটি গ্রামে পালায় ও একদল পুরুষের কাছে ছুটে গিয়ে কেঁদে তাদের পায়ে পড়ে। যখন ছেলেটি গুছিয়ে কথা বলতে সক্ষম হয়, ও তখন পুরুষদের বলে, একটা বড় লাল জানোয়ার ওর ভাইকে নিয়ে গেছে–বাঘ ও জীবনে এই প্রথম দেখল। দ্রুত একটি তল্লাসী দল গঠিত হয় এবং অতি প্রশংসনীয় সাহসে মাইল খানেক ধরে গ্রামটির পূবে নিবিড় বনাচ্ছাদিত সুওয়ারগড় গিরিখাত অবধি রক্তের নিশানা অনুসরণ করা হয়। তখন রাত ঘনিয়ে আসছে, তাই দলটি থাকে ফিরে আসে। পরদিন, কাছাকাছি গ্রামগুলির পুরুষদের সহযোগিতায় দিনভোর তল্লাসী চালানো হয় কিন্তু ছেলেটি বলতে পাওযা যায় শুধু তার লাল টুপি আর ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা জামাকাপড়। এই হল চুকার মানুষখেকোর শেষ নিহত মানুষ।

যে বিপদের কারণে সাহসের উৎপত্তি সম্ভব হয়েছে, সে বিপদের অভিজ্ঞতা না হওয়া অব্দি সাহসের সমঝদারী করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। যে অঞ্চলে এক মানুষখেকো কার্যকলাপ চালাচ্ছে, সেখানে যারা কখনো বাস করেনি, তারা এ ভাবতে পারে, এক জননীর তার পুত্রকে খুঁজতে যাওয়া; দুটি ছেলের পশু চরানো; একদল লোকের একটি নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে যাওয়া; এর মধ্যে সাহসের কিছু নেই। কিন্তু যে তেমন জায়গায় থেকেছে তার কাছে, যে নিবিড় অরণ্যভূমে এক ক্রুদ্ধ বাঘ আছে বলে জানে সেখানে এক মায়ের প্রবেশ; দুটি ছোট ছেলের আত্মরক্ষার জন্য কাছ ঘেঁষে বসা; এক মানুষখেকোর রেখে যাওয়া রক্তের নিশানা অনুসরণে একদল নিরস্ত্র লোকের যাত্রা; এগুলি এমন উচ্চ মানের সাহসের কাজ, যা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশংসার যোগ্য।

.

০২.

চুকার মানুষখেকো এখন লাচিয়া উপত্যকার সকলের জীবন বিপর্যস্ত করছিল, এবং নৈনিতাল, আলমোড়া ও গাড়োয়াল, ইবটসন এই তিনটি জেলার ডেপুটি কমিশনার-ইনচার্জ নিযুক্ত হবার পর ওর ডিভিশনকে এই উপদ্রব মুক্ত করার জন্য আমরা হাতে হাত মেলালাম।

১৯৩৭ সালের এপ্রিলের এক দুরন্ত গরম দিনে বিকেলের গোড়ার দিকে ইবি, ওর স্ত্রী জীন এবং আমি বরমদেয়ের উপর অবস্থিত বুম্-এ নামলাম মোটরবাস থেকে। অতি প্রত্যূষে আমরা নৈনিতাল থেকে রওনা হয়েছিলাম এবং হলদোয়ানি ও টনকপুর হয়ে মাথা থেকে পা অব্দি ধুলো ভরিয়ে, অদেখা, কোমল সব জায়গায় বহু ব্যথার চিহ্ন বয়ে বুম-এ পৌঁছলাম দিনের তপ্ততম সময়ে। সারদা নদীর তীরের নরম বালিতে বসে এক কাপ চা পান আমাদের মেজাজ শরিফ করতে সহায়তা করল; এবং নদী তীরের সোজা পথ ধরে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা হলাম ধূলিগড়ে, সেখানে আগেভাগে পাঠিয়ে দেওয়া আমাদের তাঁবুটি ফেলা হয়েছিল।

পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর রওনা হয়ে আমরা গেলাম কালাধূঙ্গায়। সারদা গিরিখাতের পথে ধূলিগড় ও কালাধূঙ্গার মধ্যবর্তী দূরত্ব আট মাইল এবং পূর্ণগিরির পথে চোদ্দ মাইল। এই গিরিখাতটি চার মাইল লম্বা এবং এক সময়ে এটির বুক দিয়ে গিয়েছিল একটি ট্রামওয়ে লাইন (আসলে এটি রেলপথ কিন্তু কাঠ চালানীর রেলপথকে তখন ট্রামওয়ে লাইন বলাই নিয়ম ছিল); প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ধন্যবাদ জানাবার স্মারক উপহার হিসেবে নেপাল দরবার ভারত সরকারকে যে দশলক্ষ কিউবিক ফুট শাল কাঠ উপহার দেন, তাই সংগ্রহের কারণে জে. ডি. কলিয়ার দুরারোহ পাহাড়ের গা ডাইনামাইটে ফাটিয়ে লাইনটি বসান। ট্রামওয়ে লাইনটি বহুদিন আগে পাহাড়ের ধস ও বন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং এই চার মাইল উঠতে হলে ভাল রকম পাহাড়ে ওঠার জ্ঞান থাকা দরকার। সেখানে একটি ভুল পদক্ষেপ বা একবার ধরার জায়গা থেকে হাত পিছলে যাওয়া মানে ছিটকে শীতল নদীবক্ষে পড়া একেবারে সুনিশ্চিত। বিনা দুর্ঘটনায় আমরা গিরিখাতটি পেরোলাম এবং উপরের মুখে, যেখানে কলিয়ারের ট্রাম-লাইন জঙ্গলে ঢুকেছিল সেখানে, যেখানে বাড়ির আয়তনের এক পাথর নদীর ভেতরে ঢুকে এসেছে, সেখানে আটকে যাওয়া স্রোতে দুটি মাছ ধরলাম।

কালাধূঙ্গাতে আমাদের সঙ্গে দেখা করে মানুষখেকোটির সব চেয়ে টাটকা খবর জানাবার জন্যে আগেই পাটোয়ারীদের এবং ও অঞ্চলে কর্মনিরত বনরক্ষীদের খবর দেওয়া হয়েছিল। আমাদের আগমনের জন্যে অপেক্ষমান চারটি লোককে পেলাম আমার বাংলোয় এবং তারা যে খবর দিল তা বেশ উৎসাহজনক। গত কয়েক দিনে কোনো মানুষ মারা পড়ে নি, তিন দিন আগে থাক গ্রামে বাঘটি একটি বাছুর মেরেছে এবং গ্রামের কাছাকাছিই সে আছে বলে জানা গেছে।

কালাধূঙ্গা হল ধীরে উঁচু হয়ে-যাওয়া লম্বা-কোণাটে এক উপদ্বীপ; মোটামুটি চার মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া; তিনদিকে সারদা নদীতে বেষ্টিত; চতুর্থদিকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু এক শৈলশিরার প্রাচীর। তিন কামরা ও একটি চওড়া বারান্দা সংবলিত বাংলোটি পুবমুখো এবং উপদ্বীপটির উত্তর অথবা উচ্চতর সীমান্তে ওটি অবস্থিত। দূরের পর্বতমালার উপর দিয়ে যখন সূর্য ওঠে ও কুয়াশা মেলাতে থাকে তখন বারান্দা থেকে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়, কল্পনার মনকে আনন্দ দেবার মত যে সব দৃশ্যের কথা ভাবা সম্ভব, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক দৃশ্য। সিধে সামনে, সারদা নদীর ওপারে এক প্রশস্ত উন্মুক্ত উপত্যকা নেপালের অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে। তার দুদিকের পাহাড় নিবিড় অরণ্যে ঢাকা, এবং মরকত-সবুজ শরঘাস দু-তীরে নিয়ে নদীটি এঁকে বেঁকে চলে গেছে উপত্যকা দিয়ে। যতদূর চোখ চলে, কোনো জনবসতি চোখে পড়ে; এবং বাংলো থেকে বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীদের যে ডাক শোনা যায়, তা থেকে অনুমানে মনে হয় উপত্যকাটিতে প্রচুর বন্যপ্রাণী আছে। এই উপত্যকা থেকেই কলিয়ার দশলক্ষ কিউবিক ফুট শালকাঠ সংগ্রহ করেছিলেন।

কালাধূঙ্গায় আমরা একদিন রইলাম এবং আমাদের লোকজন যখন তাঁবু ফেলতে ও ক্যাম্পের ব্যবস্থা করতে চুকা রওনা হয়ে গেল, আমরা মাছ ধরলাম; অথবা, সঠিক বলতে হলে, ইবটসনরা মাছ ধরল এবং আমি পাড়ে বসে দেখলাম; আগের রাতে আমি ম্যালেরিয়ায় পড়েছিলাম বিছানায়। ইবটসনরা মাছধরা সুতো ছুঁড়ে দিয়ে মাছ ধরতে ওস্তাদ; বাংলোর নিচের বিক্ষুব্ধ জলরাশি থেকে উপদ্বীপের কোণবিন্দু অবধি প্রায় পাঁচশো গজের জলবিস্তার ওরা এক-ইঞ্চি ম্পূন দিয়ে আঁতিপাঁতি খুঁজে একটিও মাছের হদিশ পেল না। উপদ্বীপের কোণবিন্দুর উলটো মুখে নেপাল-উপত্যকা দিয়ে ভেসে আসা ছোট্ট নদীটি সারদা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এখানে সারদা নদী চওড়া ও অগম্ভীর হয়ে যায় এবং একটি বড় জলাশয়ে প্রবেশ করার আগে দুশো গজ ধরে বয়ে যায়। এই প্রবাহের গোড়ার দিকের মুখে, নদীর বেশ মাঝখানে ইবি ওর প্রথম মাছটি গাঁথল-একটি আট পাউন্ড ওজনের মাছক্ৰমে তীরের কাছে খেলিয়ে এনে পাড়ে তোলার আগে এই সরু সুতোয় ওটাকে যত্ন করে কায়দা করা দরকার হয়ে পড়েছিল।

সকল উৎসাহী মেছুঁড়েরা অন্য মেছুঁড়েদের, সকল আউটডোর স্পোর্টের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই মাছ ধরায় রত হতে দেখে আনন্দ পায়। আমার কথা বলতে পারি, আমি নিজে মাছ ধরলেও যা, অন্য একজনকে মাছ ধরতে দেখলেও তেমনই আনন্দ পাব; বিশেষ যখন মাছ গেঁথেছে এবং পা রাখবার জায়গাটি হড়হড়ে, এবং নদী খরস্রোতা, সারদায় যা সর্বদাই হয়ে থাকে। ইবি ওর মাছটি মারবার অব্যবহিত পরেই জীন একটি মাছ গাঁথল; ও মাছ ধরছিল তার থেকে ত্রিশ গজ ভেতরে, বিক্ষুব্ধ জলে। ওর রীলে ছিল মাত্র একশো গজ সুতো এবং মাছটি আবদ্ধ জলের দিকে ছুটবে, সুতোটা ছিঁড়ে দেবে, এই ভয়ে মাছটিকে খেলাতে ও পিছন পানে হাঁটতে চেষ্টা করল, করতে গিয়ে পা হড়কাল এবং একটি দীর্ঘায়িত মিনিট সময়কাল ধরে এক পায়ের আঙুল এবং ছিপের ডগাটুকুই ওর দেখা গেল। আপনি স্বভাবতই ধরে নিচ্ছেন যে সাম্প্রতিক ম্যালেরিয়ার আক্রমণ ভুলে গিয়ে আমি ওর উদ্ধারে ছুটে গেলাম। ঘটনা হল, আমি তেমন কিছুই করলাম না। পাড়ে বসে বসে হাসলাম শুধু, কেননা জল-সমাধি থেকে ইবটসনদের একজনকেও উদ্ধারের চেষ্টা, একটি জলভোদড়কে জলে ডোবা থেকে বাঁচাবার চেষ্টার মতই নিরর্থক হত। দীর্ঘ এক প্রবল ধস্তাধস্তির পর জীন সোজা উঠে দাঁড়াল, পাড়ে পৌঁছে ওর মাছটিকে মারল, সেটির ওজন ছয় পাউন্ড। ও সেটি মারতে না মারতেই ইবি দূরে সুতো ছুঁড়তে গিয়ে যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ছিল তা থেকে পিছলে পড়ে গেল এবং ছিপ-টিপ সবসুদু জলের নিচে তলিয়ে গেল।

প্রবাহের তলের জলাশয়ের তল-সীমা থেকে নদীটি ডান দিকে মোড় নিয়েছে। নদীর এই বাঁকের যেদিকে নেপাল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় শিমূল গাছ; একজোড়া উৎক্রোশ পাখি বহু বছর ধরে সেখনে বাসা বেঁধে আছে। পাখিদের পক্ষে এ গাছটি এক আদর্শ বাসা বাঁধার জায়গা; কেননা এটি শুধু নদীর বিস্তারিত দৃশ্যের মুখোমুখি আছে তাই নয়, এর গুঁড়ির সঙ্গে সমকোণে যে বড় বড় ডাল বেরিয়েছে, উৎক্রোশদের পিছিল শিকার রাখবার ও খাবার টেবিল বিশেষ সেগুলো। গত বছর বর্ষার বন্যা পাড় ধসিয়ে প্রাচীন গাছটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এবং নদী থেকে একশো গজ দূরে জঙ্গলের কিনারায় দণ্ডায়মান একটি দীর্ঘ শিশম্ গাছে উৎক্রোশরা বেঁধেছে। নতুন বাসা।

প্রবাহটি স্পষ্টতই উৎক্রোশদের প্রিয় মাছ শিকারের জায়গা, এবং মাদীটি যখন বাসায় বসে ছিল মদ্দাটি ইবটসনদের মাথার উপর দিয়ে সামনে ও পিছনে উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে এই বেফায়দা-ব্যায়ামে ক্লান্ত হয়ে ও নদীর আরো আগে এগোল, সেখানে কয়েকটি খানিক ডুবে থাকা পাথর জলের উপর মাথা জাগিয়ে এক ছোট প্রবাহ রচনা করেছে। এখান দিয়ে যে মাছ যাচ্ছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, এক ডজন বার ঝুঁকি নিল উৎক্রোশটি, ডানা মুড়ে ভারি কোনো পদার্থের মত পড়ল নিচে এবং জল ছোঁয়ার আগে ডানা ছড়িয়ে, লেজ দিয়ে নিজেকে সামলে নিল, ডানা ঝাঁপটে উপরে উঠল আবার ঝাঁপ দেবে বলে। অবশেষে তার অধ্যবসায়ের পুরস্কার মিলল। ওর ঠিক নিচে জলের ওপর উঠে এসেছিল এক অসতর্ক মাছ এবং এক মুহূর্ত না থেমে ও সমান-উড়াল থেকে বাতাসে একশো ফুট বিদ্যুতিতে ঝাঁপ দিল এবং বিক্ষুব্ধ জলরাশির গভীরে ডুব দিল। ওর সূচের মত তীক্ষ্ণ, ইস্পাতের মত কঠিন নখে শিকার পাকড়াল ঠিকই, কিন্তু ও যেমনটি ভেবেছিল তার চেয়ে শিকারটি স্পষ্টতই আরো ভারি। বার বার এলোপাথাড়ি ডানা ঝাঁপটে ও বাতাসে ভেসে উঠতে চেষ্টা করল, আবার নিচে নেমে জল ছুঁল বুকের পালকে। সেই সংকটের মুহূর্তে নদী খেপিয়ে একটা ঝাঁপটা বাতাস উঠে ওর সহায়তায় বয়ে না এলে ওকে মাছটা ছেড়ে দিতে হত বলেই আমার বিশ্বাস। বাতাসটা ওকে ছুঁতেই ও নদীর ভাটির দিকে গেল, এক শেষ ও মরিয়া চেষ্টায় মাছটি তুলে ফেলল জল থেকে। ও যেদিকে চলেছে এখন, বাসা তার উলটো দিকে, কিন্তু এখন ফেরা অসম্ভব, তাই নামবার মত এক বিশাল পাথরের চাই পাড়ের ওপর দেখে নিয়ে সেদিকে সিধে উড়ে চলল।

আমি একাই উৎক্রোশটিকে লক্ষ করছিলাম এমন নয়, কেননা ও সে পাথরে নামতে না নামতেই, নদীর যে পাশে নেপাল, সেদিকে যে মেয়েটি কাপড় কাঁচছিল সে উত্তেজিত হয়ে চেঁচাল এবং তার মাথার ওপরাকর উঁচু পাড়ে এসে দেখা দিল একটি ছেলে। যেখানে মেয়েটি কাপড় কাঁচছে, চড়া উত্রাইয়ে, সেখানে নেমে এসে ছেলেটি যা শুনবার, শুনে নিল এবং বড় বড় আলগা পাথর ছড়ানো পাড় ধরে এমন জোরে ছুটল যে প্রতি পদে ওর ঘাড় আর হাত-পা এই ভাঙে তো সেই ভাঙে। উৎক্রোশটি তার শিকার নিয়ে যাবার কোনো চেষ্টাই করল না এবং ছেলেটি সে পাথরে পৌঁছতেই ও বাতাসে উঠে পড়ল, পাক দিতে থাকল তার মাথার কাছে; ছেলেটা তখন মাছটা তুলে ধরেছে মেয়েটিকে দেখবার জন্যে–দেখে মনে হল মাছটার ওজন হবে চার পাউন্ড।

তারপর কিছুক্ষণ আমি উৎক্রোশটিকে আর দেখি নি; আবার যখন তাকে দেখলাম তখন আমরা লাঞ্চ শেষ করেছি। ছেলেটি যে মাছটা ওকে নিতে দিল না, সেটি ও যেখানে ধরে, সেই জলপ্রবাহের ওপরে চক্কর দিয়ে উড়েছিল ও। সদাই একই উচ্চতায় থেকে সামনে ও পেছনে উড়তে থাকল ও, তারপর ঝুঁকি নিল, পড়ল পঞ্চাশ ফুট, আবার ঝুঁকি নিল, পড়ল সিধে জলের মধ্যে। এবার ও যে মাছটি ধরল সেটি আগের চেয়ে হাল্কা, একটি কালবাউশ, আন্দাজ দু পাউন্ড ওজনের। অনায়াসে পাখিটি তুলে ফেললে জল থেকে এবং বায়ুচাপ যাতে কম লাগে তাই সেটাকে টর্পেডোর মত সিধে করে ধরে উড়ে চলল ওর বাসার দিকে। ওর কপাল সেদিন মন্দ, কেননা যতটা পথ যেতে হবে তার সবে অর্ধেকটা গেছে ও, এমন সময়ে আকারে ও ওজনে ওর দ্বিগুণ একটি মাছ-মারা উড়ে এল পেছন থেকে, দ্রুত ধরে ফেলল ওকে। উৎক্রোশটি ওকে আসতে দেখল এবং যেতে যেতে ডানদিকে একটুখানি হেলে উড়ে চলল জঙ্গলের দিকে। গাছের ডালপালার মধ্যে ওর পশ্চাদ্ধাবনকারীকে এড়াবে বলে। এ কলাকৌশলের উদ্দেশ্য বুঝে মাছ মারাটি এক সক্রোধ চিৎকার দিল এবং ওড়ার বেগ বাড়িয়ে দিল। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে আর মোটে বিশগজ বাকি কিন্তু এ বড় দারুণ ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যায়, এবং একেবারে যথা সময়ে উৎক্রোশটি কালবাউশটি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিল বাতাসে। মাছটা এক গজও পড়েনি, তার আগেই মাছ-মারাটি সেটি ধরে নিল এবং অপূর্ব লীলাময় ছন্দে ঘুরে গিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল, নদীর সেই উজানের দিকে চলে গেল। যেমনটি ভেবেছিল, লুঠের মাল নিয়ে পালানো ওর পক্ষে তত সোজা হল না কেন না ফিরতি পথে ও অল্প দূরেই গেছে, তখন উৎক্রোশটির উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচত যে কাক জোড়া তারা ওকে তাক করে ছুটল, বাধ্য হল জঙ্গলে ছুটতে, তা কাকদের এড়াবার জন্যেও বটে। জঙ্গলের কিনারে যেতে কাক দুটো পিছু ফিরল এবং মাছ-মারাটি সবে সকলের চোখের আড়াল হয়েছে, তখনি শূন্য থেকে এসে পড়ল দুটি খয়েরি ঈগল, মাছ-মারাটি যে-পথে গেছে ঠিক সেই পথে ছুটে চলল অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। আমার খুবই দুঃখ যে আমি এ পেছু-নেওয়ার শেষটা দেখি নি; আমি যতক্ষণ দেখি কোনো পাখিটাই জঙ্গল ছেড়ে উপরে উঠে গিয়ে ওড়ে নি, তাই সন্দেহ হয় মাছ-মারাটি হয় তো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময়কাল ধরে রেখেছিল মাছটিকে। মাত্র একবার আমি এর চেয়েও চিত্তাকর্ষক এক পেছু নেওয়া দেখেছি। সেবার আমি ঘাসের ভিতর দিয়ে আঠারটি ইতির এক সার নিয়ে যাচ্ছিলাম কৃষ্ণ তিতির শিকারে, দশজনের ছিল বন্দুক আর পাঁচজন বসেছিলেন হাতির পিঠে; তখন দেখেছিলাম এক চড়ুইবাজের হাত থেকে, একবারও মাটি না ছুঁয়ে একটি পিন্ডা পাখিকে পালাতে; প্রথমটি ওটাকে আমাদের হাতির লাইনের ঠিক সুমুখে মারে–প্রথমে মরা পাখিটা কেড়ে নেয় এক লালশির বাজ; তারপর এক মধুবাজ, অবশেষে একটি বাজ ছোট্ট পাখিটাকে আস্ত গিলে ফেলে। ফেব্রুআরির সেই সকালে আমার সঙ্গে যে বন্দুকধারী ও দর্শকরা ছিলেন, তাঁদের কেউ এ অধ্যায়টি পড়লে ঘটনাটি মনে করতে পারবেন, এটি ঘটেছিল রুদ্রপুর ময়দানে।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে আরামে পাঁচ মাইল হেঁটে আমরা চলে গেলাম কালাধূঙ্গা থেকে চুকা। দিনটি ছিল মাছশিকারীদের স্মৃতিতে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার মত এক ঝলমলে দিন। রোদটি মিঠে কড়া; উত্তরদিক থেকে বইছে শীতল বাতাস; একপাল মাছের পোনা চলেছে স্রোত উজিয়ে; নদীতে বড় বড় মাছ বোঝাই, শুধু ধরার অপেক্ষা। হালকা ছিপে মাছ ধরতে গিয়ে আমরা অনেক রোমাঞ্চকর লড়াই করেছিলাম, সবগুলো আমরা জিতি নি। তবে সারা দিনে আমরা যা মাছ ধরেছিলাম তা আমাদের ক্যাম্পের ত্রিশজন লোকের পক্ষে যথেষ্ট।

.

০৩.

মানুষখেকোটির বিরুদ্ধে অভিযানে আমাদের সহায়তা করতে এবং আরো মানুষের প্রাণ বিনাশ বন্ধ করার চেষ্টায়, বাঘের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে আগেই টনকপুর থেকে ছয়টি তরুণ মদ্দা মোষ পাঠানো হয়েছিল আমাদের। আমরা চুকায় পৌঁছবার পর আমাদের বলা হল যে মোষগুলিকে তিন রাত ধরে বেঁধে রাখা হচ্ছে বাইরে, এবং যদিও কয়েকটির কাছে এক বাঘের থাবার ছাপ দেখা গেছে, কিন্তু একটিও মারা পড়ে নি। পরের চারদিন ধরে আমরা ভোরবেলা মোষগুলি দেখতে, গেলাম; দিনে চেষ্টা করলাম বাঘটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে; মোষগুলি বাইরে বাঁধছিল যে লোকরা, তাদের সঙ্গে গেলাম সন্ধ্যায়। পঞ্চম দিনে আমরা দেখলাম, থা-এ যে জঙ্গলে দুটি ছেলে প্রাণ হারিয়েছিল, তার কিনারায় যে মোষটিকে আমার বেঁধেছিলাম সেটি এক বাঘের হাতে মারা পড়েছে ও তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা যেমনটি ভেবেছিলাম, তেমনটি মড়িটিকে ঘন বনে নিয়ে না গিয়ে বাঘটি ওটাকে নিয়ে গেছে একটি ফাঁকা জমি পেরিয়ে একটা পাথুরে গোল টিলার ওপর। এই হয়তো এটা করেছে মাচানের কাছ দিয়ে যাবার পথটা এড়াবার জন্যে। এই মাচান থেকে আগে দুবার তাকে গুলি করা হয়েছে, সম্ভবত সে তাতে আহতও হয়েছে। সামান্য পথ মোষটিকে টেনে নেবার পর, ওর শিং দুটো, দুটো পাথরের মাঝে আটকে যায়; এবং তা ছাড়াতে না পেরে মড়ির পিছন দিক থেকে সামান্য কয় পাউন্ড মাংস খেয়ে বাঘটা ওটাকে ফেলে রেখে গেছে। কোন পথে বাঘটা গেছে তা ঘুরে দেখতে গিয়ে, মড়ি এবং জঙ্গলের মাঝামাঝি এক মহিষ-ডোবায় আমরা ওর থাবার ছাপ পেলাম। থাবার ছাপ দেখে বুঝলাম একটি বড় মদ্দা বাঘ হল মোষটির হত্যাকারী।

জেলা কর্তৃপক্ষরা মনে করেছিলেন, জানি না কোন বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছিলেন কিনা– মানুষখেকোটি এক বাঘিনী। গ্রামবাসীদের মহিষ-ডোবার ছাপগুলো দেখাবার পর ওরা আমাদের বলল, ওরা বিভিন্ন বাঘের থাবার ছাপে পার্থক্য করতে পারে না এবং ওরা জানে না মানুষখেকোটি মদ্দা না মাদী, তবে ওরা জানে তার একটি দাঁত ভাঙা। ওদের গ্রামের কাছে মানুষে-পশুতে যতটি মারা পড়েছে, সব ক্ষেত্রে ওরা দেখেছে বাঘটির একটি দাঁত চামড়া আলতো ছুঁয়ে গেছে, চামড়া ভেদ করে নি। এ থেকে ওরা সিদ্ধান্ত করেছে বাঘটির একটি কুকুর-দাঁত ভাঙা।

মড়িটি থেকে বিশগজ দূরে একটি আমগাছ। পাথর দুটির মাঝখান থেকে মড়িটি টেনে বের করবার পর; গাছের যে একমাত্র ডালে বসা সম্ভব তা থেকে মড়িটিকে দেখার পথে যে কয়টি সরু ডাল ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো ভেঙে ফেলার জন্যে একটি লোককে গাছে চড়ালাম আমরা। গোল পাথরটির ওপর এই নিঃসঙ্গ গাছটি, আশপাশের জঙ্গল থেকে পুরোই চোখে পড়ে এবং যদিও লোকটি পরম সতর্কে গাছে চড়ে ডালগুলি ভাঙে, তবুও আমার ধারণা যে বাঘ ওকে দেখেছিল।

তখন সকাল ১১টা, তাই দুপুরের আহারের জন্যে আমাদের লোকজনদের গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে আমি এবং ইবি, রোদ থেকে আড়াল পাবার মত একটি ঝোঁপ বেছে নিলাম এবং দিনের তাতের সময়টা কথা কয়ে কাটালাম আর ঝিমোলাম। আড়াইটের সময়ে আমরা তখন পিকনিক-লাঞ্চ খাচ্ছি, যেখানে মোষটি নিহত হয়, জঙ্গলের সেই কিনারে কিছু কালিজ পাখি বিচলিতভাবে কিচিরমিচির জুড়ল এবং তাদের ডাক শুনে আমাদের লোকজন গ্রাম থেকে ফিরে এল। বাঘের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ইবি এবং ওর সাহসী সঙ্গী শ্যাম সিং যখন জঙ্গলের সেই জায়গাটিতে গেল, যেখানে কালিজগুলো ডাকছিল, তখন আমি নিপে জাম গাছে উঠে পড়লাম। আমাকে গুছিয়ে বসার জন্যে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে ইবি ও শ্যাম সিং জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল এবং চুকায় আমাদের ক্যাম্পে ফিরে গেল, আমার দুজন লোক রয়ে গেল থাক-এ।

ইবি চলে যাবার অব্যবহিত পরেই কালিজগুলি আবার ডাকতে শুরু করে এবং একটু বাদে ডাকতে থাকে একটি কাকার। বাঘটা নিশ্চয় এখন চলছে, কিন্তু সূর্য না ডুবলে, গ্রামটি রাতের মত নিশ্চুপ না হলে এই ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে ওর মড়ির কাছে আসার আশা ক্ষীণ। প্রায় পনের মিনিট ধরে বা তারও বেশিক্ষণ ডাকল কাকারটি তারপর থেমে গেল একদম, আর তখন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাঘের কথা বলতে গেলে, অজস্র পাখির স্বভাব-কাকলি ব্যতিরেকে জঙ্গল ছিল নীরব।

 সারদা নদীর সুদূরবর্তী পার্শ্বে নেপাল গিরিমালা থেকে অস্ত্যমান সূর্যের রত্নাভা মিলিয়ে গেল; গ্রামের কোলাহল থেমে গেল; তখন মহিষ-ডোবার দিকে একটি কাকার ডাকল; মড়ি ছেড়ে যাবার সময়ে যে পথে গিয়েছিল, সেই পথেই ফিরছে বাঘ।

আমার সামনে একটা সুবিধেমত ডালের ওপর আমার রাইফেলটা রাখা ছিল, বাঘটা যখন আসবে তখন একটা মাত্র কাজ আমায় করতে হবে, তা হচ্ছে ঝুঁকে পড়ে রাইফেলের বাঁটটা চেপে ধরা। মিনিটের পর মিনিট কাটল, আমার বয়সের সঙ্গে যুক্ত হল একশো মিনিট, তখন পাহাড়ের ঢালে দুশো গজ উঁচুতে একটি কাকার ডাকল এবং একটি গুলি ছুঁড়বার মত সুযোগ যা দশের মধ্যে একবার মিলবে ভেবেছিলাম, তা কমে গিয়ে হাজারে একবারে দাঁড়াল। এখন পরিস্কার বোঝা গেল যে বাঘটি আমার লোকটিকে গাছের ডাল ভাঙতে দেখেছে; সূর্যাস্ত এবং এই শেষ কাকারটি ডাকার মাঝামাঝি সময়ে সে গাছটি ঠাহর করে দেখে গেছে এবং আমি যে গাছের ওপর আছি, সে দেখে চলে গেছে। তখন থেকে কিছুক্ষণ বাদে বাদে কাকার ও সম্বর ডাকতে থাকল, প্রতি ডাক আগেরটির চেয়ে কিছু দূরে। মাঝরাতে এই হুশিয়ারি ডাকগুলি থেমে গেল নিঃশেষে; অরণ্যে নামল সেই শান্তি ও বিশ্রামের নৈশ সময়, যখন বৈরিতা থেমে যায় এবং আরণ্যপ্রাণী ঘুমোতে পারে শান্তিতে। অন্য যাঁরা ভারতের অরণ্যে রাত কাটিয়েছেন তারাও এই বিশ্রাম-প্রহর লক্ষ্য করে থাকবেন; বৎসরের ঋতু এবং চন্দ্রের কলা অনুযায়ী এতে সামান্য তারতম্য হয় এবং প্রকৃতির নিয়মে এর সময় হল মধ্য রাত থেকে ভোর চারটে। এই ঘণ্টাগুলির মধ্যকালে ঘাতকরা নিদ্রা যায় এবং যারা তাদের ভয়ে ফেরে তারা থাকে শান্তিতে। মধ্যরাত থেকে ভোর চারটে অবধি ঘুমনো হয়তো মাংসাশী প্রাণীর স্বভাবধর্ম; তবে প্রকৃতি এই কয় ঘণ্টাকে পৃথক করে রেখেছেন যাতে যাঁরা প্রাণভয়ে ফেরে, তারা স্বস্তি পায় ও শান্তিতে থাকে, এরকমটা ভাবতেই আমি বেশি ভালবাসি।

 দিনের বয়স তখন কয়মিনিট মাত্র হয়েছে, গাঁটে গাঁটে খিল ধরিয়ে আমি গাছ, থেকে নেমে এলাম এবং য়ে থার্মোফ্লাস্কটি ইবি অতীব বিবেচনায় এক ঝোপের নিচে পুঁতে রেখেছিল সেটি খুঁড়ে তুলে এক পেয়ালা চা খেতে থাকলাম, তার খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। অচিরে আমার দুই লোক পৌঁছে গেল এবং আমরা যখন ওটিকে শকুনের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে ডালপালা দিয়ে মুড়িটি ঢাকছি তখন আধ মাইল দূরে একটি পাহাড়ের ওপর বাঘটি তিনবার ডাকল। ক্যাম্প-ফিরতি আমি যখন থাক দিয়ে চলেছি, গ্রামের বুড়োরা আমার সঙ্গে দেখা করল এবং রাতের বিফলতার জন্যে আমাকে ভেঙে পড়তে বারণ করল; কেননা, ওরা বলল, ওরা গণনা করিয়েছে, প্রার্থনা জানিয়েছে, যদি আজ বাঘটা না মরে পরদিন, নয় তো তার পরদিন নির্ঘাত মরবে।

গরম জলে স্নান এবং ভরপেট আহার আমাকে তাজা করে তুলল এবং বেলা একটার সময়ে আমি আবার থাক্‌এ যেতে খাড়াই পাহাড়ে চললাম এবং সেখানে পৌঁছে জানলাম, গ্রামের ওপরে একটি পাহাড়ে একটি সম্বর বহুবার ডেকেছে। একটি জ্যান্ত মোষের টোপ ফেলে বসব বলে সেই উদ্দেশ্যে ক্যাম্প থেকে রওনা হয়েছিলাম এবং আমি যখন বাঘটির জন্য এক জায়গায় অপেক্ষা করছি, ও যেন তখন অন্য জায়গায় না যায়, সে বিষয়টি সুনিশ্চিত করবার জন্যে গত রাত্রে যে মড়ি নিয়ে বসেছিলাম তার কাছে অনেক খবরের কাগজ পেতে দিয়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটি বহু-ব্যবহৃত গো-পথ আছে, গ্রামবাসীরা বলল সেখানেই সম্বরটি ডেকেছে। এই পথের পাশের একটি গাছে আমি একটি দড়ির আসন ঝুলিয়ে দিলাম এবং গো-পথের উপর একটি শেকড়ে বাঁধলাম মোষটিকে। বেলা তিনটেয় আমি গাছে চড়লাম এবং এক ঘণ্টা বাদে উপত্যকার সুদূর পার্শ্বাঞ্চলে, হাজার গজ দূরে প্রথমে একটি কাকার ও পরে একটি বাঘ ডাকল। মোষটিকে প্রচুর তাজা ঘাসের খোরাক দেওয়া হয়েছিল এবং ওর গলায় আমি যে ঘণ্টা বেঁধে দিই, সারারাত ও সেটি বাজাতে থাকল কিন্তু তা বাঘকে টেনে আনতে পারল না। সকালে আমার লোকজন আমার জন্যে এল এবং ওরা আমাকে বলল, যে গভীর গিরিখাতে ছেলেটির লাল টুপি ও ছেঁড়া জামাকাপড় পাওয়া যায়, যার নিচের কিনারে গ্রামবাসীদের অনুরোধে আমার একটি মোষ বেঁধে দিই, রাতে সেখানে কাকার ও সম্বর ডেকেছে।

যখন চুকাতে ফিরলাম, দেখলাম ভোরের আগে ইবি ক্যাম্প থেকে চলে গেছে। আগের সন্ধ্যায় দেরি করে খবর এসেছে যে, লাটিয়া উপত্যকায়, আধ মাইল দূরে একটি বাঘ একটি বলদ মেরেছে। বাঘের দর্শনমাত্র না পেয়ে ও মড়ি নিয়ে সারা রাত বসে থাকে এবং পরের সন্ধ্যায় শেষের দিকে ফিরে আসে ক্যাম্পে।

.

০৪.

জ্যান্ত মোষটি নিয়ে আমি গাছে রাত কাটাবার পর জীন ও আমি প্রাতরাশ খাচ্ছিলাম, তখন আমাদের বাকি পাঁচটি মোষ বাইরে বাঁধতে নিযুক্ত লোকগুলি খবর পেশ করতে এল, আগের রাতে আমার লোকজন যে গিরিখাতে সম্বর ও কাকারকে ডাকতে শুনেছিল, তার নিচের কিনারে বেঁধে রাখা মোষটি নিখোঁজ। আমাদের যখন এই খবর দেওয়া হচ্ছে, তখন ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার ম্যাকডোনাল্ড এলেন; তিনি সেদিন কালাধূঙ্গা থেকে চুকায় ক্যাম্প সরাচ্ছেন; বললেন যেখানে আমাদের মোষগুলির একটি বেঁধে রাখা হয়েছে বলে তিনি ধরে নিয়েছেন, তেমন একটি গিরিখাতের নিচের কিনারে তিনি একটি বাঘের থাবার ছাপ দেখেছেন। ম্যাক বললে, এর আগে একবার যখন থাক্‌-এ ও যে থাবার ছাপ দেখেছিল, এ ছাপগুলো ঠিক তারই মতন।

ব্রেকফাস্টের পর জীন ও ম্যাক গেল নদীতে মাছ ধরতে আর নিখোঁজ মোষটির কি হয়েছে দেখতে চেষ্টা করব বলে আমি গেলাম শ্যাম সিং-এর সঙ্গে। ছেঁড়া দড়ি এবং বাঘটির থাবার ছাপ ব্যতীত মোষটি যে নিহত হয়েছে তার কোনো চিহ্ন নেই দেখার মত। যাই হক, চারপাশে চেয়ে আমি দেখতে পেলাম যেখানে মোষের একটি শিং মাটিতে ঘষেছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে এক সুস্পষ্ট রক্তের নিশানা। মোষটিকে মারার পর বাঘটি দিশা হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, না ওর খোঁজ-নিশানা লুকোতে চেষ্টা করেছিল আমি জানি না, কেননা বহু মাইল পথ মড়িটিকে অতি দুর্গম জায়গা দিয়ে নিয়ে যাবার পর ও সেটিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সেই একই গিরিখাতে। যেখান থেকে যেতে শুরু করেছিল তার দুশো গজ দূরে। এই বিন্দুতে পৌঁছে গিরিখাতটি সংকীর্ণ হয়ে প্রায় দশ ফুট চওড়া এক বোতলের গলার আকারে পর্যবসিত হয়েছে। বাঘটি হয়তো ওই সরু গলা-আকারের জায়গাটির সুদূর পাশ্বাঞ্চলে মড়ি নিয়ে বসে আছে; এবং যেহেতু এর জন্যে পুরো রাত বসে থাকা আমার উদ্দেশ্য, বসার আগে যারা মাছ ধরছিল তাদের কাছে চলে গিয়ে ওদের লাঞ্চে ভাগ বসানো স্থির করলাম।

পেটের খিদে মিটিয়ে, শ্যাম সিং এবং মাছ ধরার দল থেকে ধার নেওয়া তিনটি লোক সহ আমি ফিরে এলাম; কেননা যদি মড়িটি খুঁজে পাই এবং ওটার সামনে বসি, ক্যাম্পে একা ফিরে যাওয়া শ্যাম সিং-এর পক্ষে নিরাপদ হবে না। চারটি লোককে পেছনে ফেলে যথেষ্ট এগিয়ে হেঁটে আমি দ্বিতীয়বার সেই বোতলের গলা সদৃশ স্থানে পৌঁছলাম, আর যেই পৌঁছেছি, বাঘটি গরগর করতে শুরু করল। এখানে গিরিখাতটি খাড়াই এবং আলগা পাথরে বোঝাই এবং বাঘটি গর্জাচ্ছে ঝোপের আড়াল থেকে–আমার সমুখে প্রায় সিধেসিধি বিশ গজ দূর থেকে। যে বাঘকে দেখা যাচ্ছে না খুব কাছ থেকে তার গরগরানি হল জঙ্গলের সবচেয়ে ভয়-জাগানো আওয়াজ এবং তা অনাধিকার প্রবেশকারীদের প্রতি আর কাছে না এগোবার অতি সুস্পষ্ট নির্দেশ। ওই আবদ্ধ জায়গায়, বাঘটি যখন সব দেখতে পাচ্ছে, আর এগনো হত মূর্খতা। তাই লোকজনকে ফিরে যেতে ইশারা করে এবং তা করার জন্য তাদের ক মিনিট সময় নিয়ে আমি অতি ধীরে পেছনপানে হাঁটতে শুরু করলাম–কোনো জানোয়ারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে যখন কেউ আগ্রহী হন, তার কাছ থেকে সরে যাবার একমাত্র নিরাপদ পন্থা এটি। যেই সেই ফঁড়ার জায়গাটি পেরিয়েছি অমনি আমি ফিরে দাঁড়ালাম এবং শিস দিয়ে লোকজনকে আসতে বলে গিরিখাতের ভাটিতে আরো একশো গজ এগিয়ে ওদের সঙ্গে মিলিত হলাম। কোথায় বাঘ আছে আমি এখন সঠিক জানি, বেশ বিশ্বাস হল তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে আমি সক্ষম তাই লোকজনের কাছে ফিরে গিয়ে আমি ওদের বললাম আমাকে রেখে ফিরে গিয়ে মাছ ধরিয়েদের দলে ভিড়তে। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই তারা এ-কাজ করতে খুব ভয় পেল। আমি যেমন, তারাও তেমনি বিশ্বাস করছিল, যে বাঘের গররগানি এইমাত্র শুনেছে সেইই মানুষখেকো, এবং তারা আমার রাইফেলের ভরসা পেতে চেয়েছিল। আমি নিজে ওদের নিয়ে গেলে আমার দু’ঘণ্টা নষ্ট হয় এবং যেহেতু আমরা ছিলাম এক শাল বনে আর চড়ার মত একটি গাছও দৃষ্টিসীমায় ছিল না, তাই বাধ্য হয়েই ওদেরকে আমার সঙ্গেই রাখতে হল।

খাড়াই বাঁ পাড় বেয়ে উঠে আমরা গিরিখাতটি থেকে সোজা দুশো গজ দূরে চলে গেলাম। এখানে আমরা বাঁয়ে ঘুরলাম এবং দুশো গজ এসেছি বোঝার পর আমরা আবার বাঁয়ে ঘুরলাম এবং যেখানে বাঘটিকে গরগর করতে শুনেছি তা থেকে একশো গজ ওপরে গিরিখাতেই ফিরে এলাম। অবস্থা ঘুরে গেছে এখন, অবস্থিতির সুবিধা এখন আমাদের হাতে। আমি জানতাম বাঘটা গিরিখাত ধরে নিচে নামবে না কেননা। মাত্র ক মিনিট আগে ওদিকপানে ও লোকজন দেখেছে এবং ও গিরিখাত ধরে ওপরেও উঠবে না কেননা তা করতে হলে আমাদের পেরিয়ে যেতে হয়। আমাদের দিকে পাড়টি ত্রিশ ফুট উঁচু এবং তলাটা ঝোপঝাড়শূন্য ফাঁকা; তাই আমরা কৌশল করে বাঘটাকে যে বহে আটকিয়েছি তা থেকে ওকে বেরোতে হলে ওর একমাত্র পথ হল উল্টোদিকের পাহাড়ের গা দিয়ে ওঠা। দশ মিনিট কাল আমরা গিরিখাতের কিনারে বসে থাকলাম, সামনের প্রতি ফুট জমি খুটিয়ে দেখলাম। তারপর, ক পা পিছিয়ে আমরা বাঁয়ে ত্রিশ গজ গেলাম এবং আবার বসলাম কিনারে আর যখন বসলাম, আমার পাশে যে লোকটি বসে ছিল সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শের এবং গিরিখাতের ওপারে দেখাল। আমি কিছুই দেখতে পেলাম না, আর বাঘটার কতটুকু ও দেখতে পাচ্ছে লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল কান নড়তে দেখেছে, কয়েকটি শুকনো পাতার কাছে। পঞ্চাশ গজ দূর পাল্লায় বাঘের কান কিছু সুস্পষ্ট বস্তু নয় এবং যেহেতু শুকনো পাতায় মাটি ঢেকে আছে, ওর বর্ণনায় বাঘকে হদিশ করায় আমাকে কিছু সহায়তা করল না। আমার পেছনের লোকজনের নিশ্বাসে পরিস্কার টের পাওয়া গেল উত্তেজনা চড়া পর্দায় উঠে যাচ্ছে। ভাল করে দেখতে পাবার কারণে অচিরে একজন উঠে দাঁড়ল; আমাদের দিকে মুখ করে আর একটি ঝোপের পেছন থেকে ওর মাথা বেরিয়ে আসতেই আমি গুলি করলাম। পরে দেখেছিলাম আমার বুলেটটি ওর ঘাড়ের লোম ভেদ করে ছুটে গিয়ে একটি পাথরে লাগে। পাথরটি টুকরো হয়ে ফিরে এসেছিল; ফলে ও লাফিয়ে ছিটকে বাতাসে উঠে যায় এবং মাটিতে পড়ার সময়ে ও বেধে যায় একটি বড় লতাগাছে; তা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ওকে বেগ পেতে হয়। যখন ওকে মাটিতে ঝটাপটি করতে দেখলাম, আমরা ভাবলাম ও চিরতরে কুপোকাৎ হল, কিন্তু যখন পায়ে ভর করে উঠে ও ছুটে পালাল, শ্যাম সিং মত প্রকাশ করল ও বেগর-জখম, আমিও ওর মতকে সমর্থন করলাম। লোকদের ফেলে রেখে আমি গিরিখাতটি পেরোলাম এবং মাটি খুঁজে বুলেটটি যে লম্বা লোমগুলো উড়িয়েছে তা পেলাম; পেলাম টুকরো হওয়া পাথর এবং ছেঁড়া ও কামড়ে টুকরো করা লতাটি; কিন্তু কোনো রক্ত পেলাম না।

কোনো জানোয়ারকে বিধলে সবসময়ে তখনি রক্ত বয় না এবং বুলেটটি যে ভাবে লেগেছে বলে আমি ভাবছি তা ভুল হয়ে থাকতে পারে; তাই মড়িটি খুঁজে বের করা দরকার কেননা সেটিই আগামীকাল বলে দেবে বাঘটি জখম হয়েছে কি হয় নি। এতে আমাদের কিছু হয়রানি হল এবং দুবার জমিটি খোঁজার আগে আমরা মড়িটি পাই নি; অবশেষে মড়িটি পেলাম চার ফুট গভীর এক জলাশয়ে, ধরে নেওয়া যায় ভিমরুল। এবং নীল মাছির হাত থেকে বাঁচাতে ও ওখানে মড়িটিকে রেখেছিল। যাদের আমি ধার নিয়েছিলাম সে তিনজনকে মাছধরা দলের কাছে ফেরত পাঠিয়ে এখন তা করা নিরাপদ–জঙ্গলের শব্দ-টব্দ শোনার জন্যে আমি আর শ্যাম শিং মড়ির কাছে এক ঘণ্টা লুকিয়ে থাকলাম; তারপর, কিছুই না শুনতে পেয়ে ক্যাম্পে ফিরলাম। পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে আমি ও ম্যাক ফিরে এলাম গিরিখাতে এবং দেখলাম, জলাশয় থেকে মড়িটি সরিয়েছে বাঘ; অল্প দূরে বয়ে নিয়ে গেছে সেটাকে; এবং মাথা ও খুর বাদে সবই খেয়ে ফেলেছে। খাওয়ার সময়ে যে জমিতে শুয়েছিল তাতে রক্ত নেই এবং এতেই প্রমাণ হল যে, বাঘটি জখম হয় নি ও ভয় কাটিয়ে উঠেছে।

যখন আমরা তাঁবুতে ফিরলাম, আমাদের খবর দেওয়া হল, লাটিয়া নদীর সুদূর পাশ্বাঞ্চলে এক প্রশস্ত উন্মুক্ত গিরিখাতে একটি গরু নিহত হয়েছে এবং যারা সেটি খুঁজে পেয়েছে তারা সেটি ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। লাচিয়ার আট মাইল উজানের গ্রামটি থেকে ইবি তখনো ফেরে নি এবং লাঞ্চের পর ম্যাক ও আমি গরুটি দেখতে গেলাম। মধ্যাহ্নে ওটিকে ঢাকা হয় আর একটু পরেই বাঘটি ফিরে আসে ও হেঁচড়ে নেবার কোনো নিশানা না রেখেই ওদিকে বয়ে নিয়ে যায়। এখানে জঙ্গল সৃষ্ট হয়েছে বড় বড় শাল গাছে, নিচের জমিতে কোনো ঘাস লতা নেই এবং শুকনো পাতার এক সুবিশাল স্কুপের নিচে যেখানে বাঘ মড়ি লুকিয়ে রেখেছে তা খুঁজে পেতে আমাদের এক ঘণ্টা লেগে গেল। সেখানে ছায়াতে তাপমাত্রা প্রায় একশো দশ ডিগ্রী-একটি কাছের গাছে ম্যাক অসীম শৌর্যে একটি মাচা তৈরি করে দিল আমাকে, আমি ধূমপান ও ওর জলের বোতল খালি করতে থাকলাম এবং আমাকে গাছে উঠতে দেখে ও ক্যাম্পে ফিরে গেল। এক ঘণ্টা বাদে গিরিখাতে সুদূর পার্শ্বের খাড়াই পাহাড় দিয়ে গড়ানো একটি ছোট্ট পাথর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং অচিরে দৃশ্যপথে এল একটি বাঘিনী, তার অনুসরণে দুটি ছোট বাচ্চা। এ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে এই প্রথমবার ওদের জীবনে বাচ্চা দুটিকে এক মড়ির কাছে আনা হয়েছে। এ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত বিপদের গুরুত্ব; যে প্রবল সাবধানতা নিয়ে চলা উচিত; তা বাচ্চাদের বোঝানোর জন্যে মা যে প্রবল চেষ্টা করছিল তা দেখা খুবই চিত্তাকর্ষক। বাচ্চাগুলোর আচরণ মার মতই মনোগ্রাহী। পায়ে পায়ে ওরা ওর ছাপ ধরে এগোল; কখনো এ-ওকে কিংবা মাকে পাশ কাটাতে চেষ্টা করল না; মা যে বাধা এড়িয়ে চলছে তা যত তুচ্ছই হক, ওরাও তা এড়াল এবং কয়েক গজ বাদে বাদে মা যখন কান পাততে থামল, ওরাও সম্পূর্ণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জমিতে বড় বড় শাল পাতার গালচে; তা শোলার মত শুকনো; তার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে চলা অসম্ভব; তবু প্রতিটি থাবা ফেলা হল খুব আলতো করে, তেমনি আলতো করেই তা তোলা হল, যত কম সম্ভব আওয়াজ করা হল।

গিরিখাতটি পেরিয়ে, বাচ্চাদুটির ঘনিষ্ঠ অনুসরণে আমার দিকে এল বাঘিনীটি, আমার গাছের পেছন পেরিয়ে মড়ির মুখোমুখি, তা থেকে ত্রিশ গজ দূরে এক সমতল ভূ-খণ্ডে গুঁড়ি মেরে বসল। স্পষ্টতই ওর গুঁড়ি মেরে বসার উদ্দেশ্য হল যেদিক পানে ওর নাক উঁচিয়ে আছে সেদিকে ছানাদের এগিয়ে যাবার এক ইশারা, এবং এখন তারা তাই করতে থাকল। এখানে যে আহার আছে, কি উপায়ে মা সে সংবাদ শাবকদের জানাল তা আমি জানি না, তবে সে যে ওদের এ খবর পৌঁছে দিয়েছিল তাতে কোনো প্রশ্ন নেই। মা গুঁড়ি মেরে বসার পর তাকে পেরিয়ে গেল ওরা। মার পেছনে পেছনে আসার সময় মা ওদের যে রকম সাবধানে চলতে বাধ্য করেছিল, ঠিক তেমনি সাবধানে এগোল। ছানারা যখন রওনা হল তখন ওদের মধ্যে এই ভাবভঙ্গী ফুটে উঠল যে ওরা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে চলেছে। আমি বারবার বলেছি বাঘদের কোনো ঘ্রাণ বোধ নেই এবং বাচ্চারা সে বলার সপক্ষে প্রচুর প্রমাণ যোগাচ্ছিল আমাকে। যদিও যে সকালে মড়িটার খবর আমাদের পৌঁছনো হয়, আসলে গরুটি নিহত হয়েছিল আগের দিন, এবং ওটাকে শুকনো পাতার পাঁজার নিচে লুকিয়ে রাখার আগে বাঘিনীটি ওর বেশির ভাগ খেয়ে ফেলেছিল। আমি যেমন বলেছি, আবহাওয়া ছিল অতি গরম এবং ওই দুর্গন্ধই ক্রমে ম্যাক ও আমাকে মড়ি খুঁজে পেতে সহায়তা করে। আর এখানে এখন দুটি ক্ষুধার্ত শাবক, মড়িটির এক গজের ভেতর দিয়ে ওপর থেকে নিচে, সামনে থেকে পেছনে, এক ডজন বার ওটাকে বারবার পার হয়ে চলে যাচ্ছে তবু ওটাকে খুঁজে পাচ্ছে না। নীল মাছিগুলো মড়িটা কোথায় আছে প্রকাশ করে দিল এবং অনেকক্ষণ বাদে ওটা খুঁজে পেতে ওদের সহায়তা করল। ওটাকে পাতার তলা থেকে টেনে বের করে বাচ্চারা একসঙ্গে খানা খেতে বসল। আমি যেমন, বাঘিনীও শাবকদের তেমনি একাগ্রে লক্ষ করছিল এবং একবার মাত্র ও ওদের বকেছিল, যখন মরা মড়ির খোঁজ করতে বড় দূরে চলে গিয়েছিল। যেই মড়িটি মিলল, সেই মা চিত হয়ে ঠ্যাং শূন্যে তুলে ঘুমোতে গেল।

শাবকদের যখন খেতে দেখছিলাম, কয়েক বছর আগে ত্রিশূলের পাদদেশে যে একটি দৃশ্য দেখেছিলাম তা আমার মনে পড়ল। সকল হিমালয়ী ছাগ প্রজাতির মধ্যে সব চেয়ে অটল পা ফেলে থর। সেই থর-এর আশায় এক শৈলশিরায় শুয়ে ফিল্ড-গ্লাস দিয়ে আমার উলটো দিকের এক পর্বত চূড়া আঁতিপাঁতি করে দেখছিলাম আমি। চূড়াটির চড়াই দিকে আধাপথে এক কার্নিসে একটি থর ও তার ছানা শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। চটপট থরটি উঠে দাঁড়াল, আড়মোড়া ভাঙল, এবং তৎক্ষণাৎ ছানাটি ওকে গুতিয়ে দুধ খেতে শুরু করল। আন্দাজ এক মিনিট বাদে মা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল, কার্নিস ধরে কয়েক পা গেল, এবং ওর বার থেকে পনের ফুট নিচে আরেকটি আরো সরু কার্নিসে লাফিয়ে নামল। যেই ওকে একা ছেড়ে আসা হল, অমনি ছানাটি সামনে ও পেছনে দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল। মাঝে মাঝে নিচে মার দিকে উঁকি মারবে বলে দৌড় থামায়, কিন্তু নিচে লাফ মেরে মার কাছে যাবার সাহস আর সঞ্চয় করে উঠতে পারে না। কেননা সেই সামান্য ক ইঞ্চি সরু কার্নিসের নিচে পড়ে যায় যদি পড়তে হবে একেবারে হাজার ফুট। মা তার ছানাকে সাহস দিচ্ছিল কি না শোনার পক্ষে আমি বড়ই দূরে ছিলাম, কিন্তু যেভাবে মায়ের মাথা ঘোরানো ছিল, আমার বিশ্বাস, তা দিচ্ছিল ও। ছানাটি এখন ক্রমেই বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছিল এবং সে কোনো মূর্খ করে বসে যদি সম্ভবত সেই ভয়ে মা যেখানে গেল, তা চোখে দেখাল পাহাড়ের খাড়া গায়ে সামান্য এক ফাটলের মত; তা বেয়ে উঠে মা শাবকের সঙ্গে পুনর্মিলিত হল। এ কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই মা শুয়ে পড়ল, বোঝাই গেল ছানাটিকে দুধখাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্যেই। অল্পক্ষণ বাদে ও আবার উঠে দাঁড়াল, ছানাকে এক মিনিট দুধ খেতে দিল, কিনারে দাঁড়াল সন্তর্পণে, লাফিয়ে নামল নিচে; তখন ওর ওপরে ছানাটি আবার সামনে পেছনে দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল। পরবর্তী আধ ঘন্টার মধ্যে সাত বার এই আচরণটি করা হল; অবশেষে নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে ছানাটি লাফ দিল, মার পাশে নিরাপদে অবতরণ করল, আশমিটিয়ে দুধ খেতে পেল, এই ভাবে হল পুরস্কারপ্রাপ্তি ওর। ও যে পথ দেখাচ্ছে তা অনুসরণ করা নিরাপদ, থরটির শাবককে সে শিক্ষাদানের সমাপ্তি হল সে দিনের মত। সহজাতপ্রবৃত্তি নিশ্চয়ই সহায়তা করে; কিন্তু বন্যজগতে সকল প্রাণীর শাবকদের বড় হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে মায়ের এই অসীম ধৈৰ্য্য এবং সন্তানের বিনাপ্রশ্নে বাধ্যতা। আমার দুঃখ হয়, যখন সুযোগ ছিল, আমি যে সব বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের তাদের শাবকদের প্রশিক্ষণ দিতে দেখেছি তার সিনেমাটোগ্রাফি রেকর্ড করার সাধ্য আমার ছিল না। তখন; কেননা জঙ্গলে তার চেয়ে চিত্তাকর্ষী দেখবার আর কিছু নেই।

শাবকদের খাওয়া হয়ে গেলে ওরা ওদের মার কাছে ফিরে গেল এবং মা ওদের গড়িয়ে গড়িয়ে, খাবার সময়ে ওরা যে রক্ত লাগিয়েছিল গায়ে, তা চেটে চেটে ওদের সাফ করতে লেগে গেল। ওর মনোমত ভাবে.এ কাজটি সমাপন হলে ও রওনা হল লাচিয়াতে এক অগভীর পারঘাটার দিকে এবং ছানারা চলল ওর পেছনে, কেননা মড়িটিতেও আর অবশেষ নেই কিছু এবং নদীর এপারে ওর ছানাদের আড়াল রাখার মত নেই কিছু।

আমি জানতাম না, এবং জানলেও এসে যেত না কিছু যে, সেদিন যে বাঘিনীটিকে অমন সাগ্রহে নিরীক্ষণ করেছিলাম, সে পরে গুলিজনিত জখমের কারণে মানুষখেকোতে পর্যবসিত হবে এবং লাচিয়া উপত্যকা ও আশপাশের গ্রামগুলিতে যারা সব বাস ও কাজকর্ম করে সকলের ত্রাসের কারণ হয়ে উঠবে।

থাক্‌-এ যে মড়িটি নিয়ে আমি প্রথম রাত বসেছিলাম, শকুনরা খেয়ে শেষ করে দিক বলে সেটি খুলে বের করে দেওয়া হয় এবং আরেকটি মোষ বাঁধা হয় উপত্যকার মুখে, গ্রামের পশ্চিমে পুরনো মড়ির আন্দাজ দুশো গজ দূরে। চতুর্থ দিনে থাক্‌-এর গ্রামমোড়ল আমাদের খবর পাঠাল যে এই মোষটি একটি বাঘের হাতে মারা পড়েছে, এবং বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে।

আমাদের তোরজোড় হয়ে গেল তড়িঘড়ি এবং বেদম গরমে চড়াই ভেঙে আমি ও ইবি দুপুর নাগাদ হত্যার জায়গায় পৌঁছলাম। মোষটিকে মারবার ও একটি বেজায় শক্ত রশি ছেঁড়ার পর বাঘটি মড়িটি তুলে নিয়েছে ও সিধে নেমে গেছে উপত্যকায়। আমাদের লাঞ্চ বইতে যে দুজন লোককে এনেছিলাম তাদের আমাদের খুব কাছাকাছি পেছনে থাকতে বলে আমরা হেঁচড়ানোর দাগ অনুসরণে রওনা দিলাম। শীঘ্রই বোঝ গেল বাঘটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো জায়গায় গেছে, কেননা সে আমাদের নিবিড় জমি-ঝোপ, খাড়া পাড়ের উত্রাই বিছুটি ও র‍্যাপবেরি ফলের ঝোঁপ; পড়ে থাকা গাছের ওপর ও তলা দিয়ে; সুবিশাল শিলাস্তূপের ওপর দিয়ে দু মাইল হাঁটাল। অবশেষে দেখা গেল খোলা ছাতার মত দেখতে একটি বক্স গাছের তলার এক ছোট নাবালে ও মড়িটি সুরক্ষিত করে আগলে রেখেছে। মোষটি মারা পড়েছে আগের রাতে এবং একবারটিও না খেয়ে বাঘটি ওটা ফেলে রেখে গেছে এ ঘটনাটি মনে অশান্তি জাগাবার মত। যাই হক মড়িটি এ জায়গায় আনতে ও যে কষ্ট স্বীকার করেছে তাতে এ কষ্টের অনেকটা ক্ষতিপূরণ হয়ে গেল এবং সব যদি ঠিকঠাক চলে তবে এ আশা করার সম্পূর্ণ কারণ আছে যে ও ওর মড়ির কাছে ফিরবেই; কেননা মোষটির ঘাড়ের দাঁতের দাগ থেকে আমরা বুঝেছিলাম ও শুধু এক সামান্য বাঘ নয়, আমরা যাকে খুঁজছি সেই নরখাদক।

থাক্‌-এ গরম গরম হেঁটে ওঠা এবং তারপর দুর্গম সব জায়গা দিয়ে নিবিড় বনে ঢাকা পাহাড়ের গা দিয়ে উৎরাই নামা, এর ফলে আমরা ঘেমে নেয়ে উঠেছিলাম; আর আমরা যতক্ষণ সে নাবালে বিশ্রাম করতে করতে লাঞ্চ এবং প্রচুর চা খেলাম, আমি চারদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে থাকলাম। যার ওপর বসব, দরকার হলে রাতও কাটাব, তেমনি একটি সুবিধামত গাছের খোঁজ করতে থাকলাম। জঙ্গলে কোনো একটি বিশাল গাছ এক সময়ে জীর্ণ হয়ে যায়। তারই এক পচধরা অংশে ফিকাস্ গাছটি জন্মায়। যে গাছটি ওকে জন্ম দিল তার চারপাশে দিয়ে ঝুরি নামিয়ে জাল বুনে দিয়ে নতুন গাছটি তাকে মেরে ফেলল। এখন ঝুরিগুলো ঠাস বুনোট হয়ে পরগাছা গাছটির গুঁড়ি তৈরি করছে। ঝুরিগুলো নামতে নামতে থেমে গেছে। সেখানে মাটি আর ঝুরিগুলোর মধ্যে দশ ফুট ফঁক আর সেই ফাঁকের মধ্যে পচাধরা প্রথম গাছটি পড়ে আছে। সেখানে আরামে বসার জায়গা হবে বলে মনে হল আর সেখানেই বসব.. বলে ঠিক করলাম।

লাঞ্চ এবং একটি সিগারেট খাওয়া হতে ইবি আমাদের দুটি লোককে ষাট গজ। ডাইনে নিয়ে গেল এবং বাঘ যদি কাছে ওঁত পেতে থেকে থাকে, আমাদের দেখে থাকে, তাহলে তার মনোযোগ অন্যপথে নেবার জন্যে-ডাল ঝাঁকিয়ে তার মাচা তৈরি করছে ভান করবার জন্যে লোক দুটিকে তুলে দিল গাছে–আমি ওদিকে যত নিঃশব্দে সম্ভব, উঠে পড়লাম ফিকাস্ গাছে। যে আসন বেছেছি আমি তা ঝুলে নেমেছে সমুখপানে; পচা কাঠ ও মরা পাতায় তাতে গদী বিছানো; যদি সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দিই তবে সে শব্দ ও নড়াচড়া বাঘ ধরে ফেলতে পারে এই ভয়ে সেগুলো যেমনটি ছিল তেমন রেখে দিলাম আর বসলাম সেগুলোর ওপরে।-কায়মনে আশা করলাম আমার তলের ফঁপা গুঁড়িতে যেন কোনো সাপ না থাকে, মরা পাতার ভেতর না থাকে কোনো বিছে। পিছনে বা সামনে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে আমার পা কুরির একটি ফাঁকে রেখে এ অবস্থায় যতটা সম্ভব ততটা গুছিয়ে বসলাম আরামে এবং যখন আমি বসে পড়লাম, ইবি লোকগুলিকে গাছ থেকে ডেকে নামাল এবং হেঁকে কথা কইতে কইতে চলে গেল।

বসব বলে যে গাছটি নির্বাচন করেছি সেটি বাইরের দিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রীর এক কোণ সৃষ্টি করেছে তা আগেই বলেছি; এবং আমার ঠিক দশ ফুট নিচে একখণ্ড সমতল জমি, প্রায় দশ ফুট চওড়া ও বিশ ফুট লম্বা। এই সমতল ভূখণ্ড থেকে পাহাড়টি খাড়াই নেমে গেছে ক্রমে এবং লম্বা ঘাস ও নিবিড় আগাছার জঙ্গলে তা আচ্ছাদিত; তার ওপারে আমি একটি নদীকে বইতে শুনছিলাম। বাঘের ঘাপটি মেরে থাকার এক আদর্শ জায়গা।

ইবি ও লোক দুটি চলে যাবার পর আন্দাজ পনের মিনিট কেটেছে তখন উপত্যকার সুদূর পার্শ্বে জঙ্গলের প্রাণীদের বাঘের উপস্থিতি সম্পর্কে হুশিয়ার করার জন্যে একটি লাল বাঁদর ডাকতে শুরু করল। হেঁচড়ানির দাগের অনুসরণে আমরা যখন পাহাড়ের উত্রাই নামছিলাম তখন এ বাঁদরটি ডাকে নি এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল যে আমাদের আগমনে বাঘটি সরে যায় নি। এখন, বাঘরা যা করে থাকে, ওর মড়ির কাছাকাছি ও যে সব শব্দ শুনেছে তার তদন্ত করতে আসছে। বাঁদররা অসামান্য ভাল দৃষ্টিশক্তির আশীর্বাদধন্য এবং যেটি ডাকছে সেটি যদিও সিকি মাইল দূরে আছে; এ খুবই সম্ভব যে বাঘকে দেখে ও ডাকছে সে বাঘ আমার কাছেই আছে। আমি বসে আছি পাহাড়ের মুখোমুখি, মড়িটি আমার সম্মুখে বাঁ দিকে। বাঁদরটি সবে মাত্র আটবার ডেকেছে, তখন আমার পেছনের পাহাড়ের খাড়াই ঢালে একটি শুকনো কাঠ ভাঙতে শুনলাম। ডাইনে মাথা ঘুরিয়ে, ঝুরির ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখলাম এপাশে ঝুরির জাল আমার মাথার একটু উঁচু অব্দি ছড়ানো; দেখলাম প্রায় চল্লিশ গজ দূর থেকে বাঘটি দাঁড়িয়ে আমার গাছের দিকে চেয়ে আছে। বেশ কয় মিনিট ধরে ও একবার আমার দিকে, আরেকবার যে গাছে লোকদুটি চড়েছিল সেদিকে চেয়ে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর অবশেষে আমার দিকপানে আসা স্থির করে ও পাহাড়ের খাড়াই ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। হাত ব্যবহার না করে, প্রচুর শব্দ না করে, কোনো মানুষের পক্ষে ওই খাড়াই দুর্গম পথ পেরনো সম্ভব হত না, কিন্তু বাঘটি সে কাজ নিঃশব্দে সারল। সমতল জমিটির যত কাছে এল ও ততই সতর্ক হয়ে উঠল ও এবং পেটটা মাটির তত কাছে ঘেঁষিয়ে রাখল। যখন পাড়ের মাথার কাছে পৌঁছে গেছে তখন অতি ধীরে ও মাথা তুলল। যে গাছে লোকগুলি চড়েছিল সে দিকে বহুক্ষণ চেয়ে দেখে নিল এবং ওতে মানুষ নেই জেনে লাফিয়ে চলে এল সমতল জমিতে এবং আমার তলে এসে আমার নজরের আড়ালে চলে গেল। আমি আশা করছিলাম ও আমার বাঁ ধারে আবার দেখা দেবে এবং মড়ির দিকে যাবে এবং তা করবে বলে আমি যখন অপেক্ষা করছি, শুনলাম গাছের তলের শুকনো পাতাগুলো দলেমচে যাচ্ছে। বাঘটা শুকনো পাতার ওপর শুচ্ছে।

পরের সিকি ঘণ্টা আমি একেবারে অসাড় বসে রইলাম এবং বাঘের দিক থেকে আমার দিকে আর কোনো শব্দ এল না বলে আমি ডাইনে মাথা ঘোরালাম ও ঝুরির এক ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে বাঘটির মাথা দেখলাম। আমার চোখ টিপে এক ফোঁটা চোখের জল বের করতে যদি পারতাম এবং সেই ফাঁক দিয়ে তা ফেলতে পারতাম, তবে আমার বিশ্বাস, তা সিধে ওর নাকের ওপরে পড়ত। ওর চিবুক মাটিতে, চোখ বোজা। অচিরে চোখ খুলল ও, মাছি তাড়াতে চোখ পিটপিট করল, আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল। আগেকার অবস্থায় ফিরে এসে আমি এখন বাঁয়ে মাথা ঘোরালাম। এদিকে কোনো ঝুরি নেই, যার গায়ে ভর দিয়ে নিজেকে সামলাই। এমন কোনো ডালও নেই, আর বেসামাল হয়ে পড়ে না গিয়ে যতদূর পারি, ততদূর ঘাড় ঘুরিয়ে নিচে চাইলাম। দেখলাম বাঘটির লেজের প্রায় সবটা এবং পিছনের একটি পায়ের এক অংশ দেখতে পাচ্ছি।

পরিস্থিতিটি বিবেচনাসাপেক্ষ। গাছের যে গুঁড়িতে আমি পিঠ ঠেস দিয়েছি তা মোটামুটি তিন ফুট মোটা এবং আড়াল দিচ্ছে চমৎকার। অতএব বাঘ আমাকে দেখে ফেলবার সম্ভাবনা নেই। বিরক্ত না করলে ও মড়ির কাছে যাবে তা সুনিশ্চিত তবে প্রশ্ন হচ্ছে যাবে কখন? বিকেলটি বেজায় তপ্ত, কিন্তু ও যে শোয়ার জায়গা বেছে নিয়েছে তা আমার গাছের ঘন ছায়ায়। এবং আরো কি, উপত্যকা থেকে বইছে শীতল বাতাস। এই সন্তোষজনক অবস্থায় ও ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাতে পারে এবং দিবালোক সাঙ্গ না হওয়া অবধি মড়ির কাছে না যেতেও পারে, আমার একটি গুলি ছোঁড়ার সুযোগ নষ্ট করে দিতে পারে। তাহলে বাঘের খেয়ালখুশির জন্যে সবুর করার ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে না; কেননা যে সব কারণ দর্শিয়েছি তা ব্যতীতও আমাদের হাতের সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়; এবং বাঘকে মারার এই হয়তো শেষ সুযোগ পাচ্ছি আমি, আর সে সুযোগের ওপর বহু মানুষের জীবন নির্ভর করতে পারে। গুলি ছোঁড়ার জন্যে অপেক্ষা করা সুপরামর্শের কাজ নয়, তাহলে রইল একটি, সম্ভাবনা–বাঘ যেখানে শুয়ে আছে সেখানেই ওর সঙ্গে মোকাবিলা করা। আমার ডানদিকে ঝুরির জালে অনেক ফঁক, তা দিয়ে আমি রাইফেলের নল ঢোকাতে পারি; কিন্তু তা করলে পরে মাছিদুটো বাঘটার মাথা বরাবর তাক করার পক্ষে নলের মাথা যথেষ্ট নামানো যাবে না। কিন্তু খানিকটা আওয়াজ না করে তা করা সম্ভব নয়; কেননা আমার শরীরের চাপটা সরে গেলে যে শুকনো পাতার ওপর আমি বসে আছি তা মচমচ শব্দ করবে এবং আমার দশ ফুটের মধ্যে আছে জঙ্গলে যে কারো চেয়ে তীক্ষ্ণ শ্রুতিসম্পন্ন একটি জানোয়ার। বাঘের মাথার দিকে গুলি মারা সম্ভবপর নয়। রইল লেজের দিকটি।

যখন রাইফেলে ছিল দুটি হাত এবং আমি ঘাড় ঘুরিয়েছিলাম বাঁয়ে, বাঘের লেজের প্রায় সবটুকু এবং একটি পিছনের পায়ের একাংশ দেখতে সক্ষম হয়েছিলাম। রাইফেল থেকে ডান হাত সরিয়ে নিয়ে ঝুরিটি আঁকড়ে ধরে দেখলাম বাঘটির এক-তৃতীয়াংশ দেখতে পাব এতটা বাইরে ঝুঁকতে পারছি। হাত সরাবার পরেও যদি ওইভাবে থেকে যেতে পারি তবে ওকে পঙ্গু করে দেওয়া সম্ভব। একটি প্রাণীকে পঙ্গু করে ফেলা–বিশেষ, এক ঘুমন্ত জানোয়ারকে–শুধু এই কারণে, যে সে মাঝেসাঝে মুখ বদলাতে পছন্দ করে–সে একেবারে ঘৃণ্য। তবে বিষয়টি যখন এক নরখাদক, তখন ভাবপ্রবণতার ঠাই এ নয়। আরে, মানব, প্রাণহানি বন্ধের জন্য আমি এ বাঘটিকে মারতে চেষ্টা করছি বেশ কিছু দিন যাবৎ, এবং এখন যখন তার এক সুযোগ পেয়েছি, তখন ওকে মারার আগে ওর পিঠ ভেঙে দিতে হবে সেজন্যে এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়া ন্যায়সংগত হয় না। তাই পন্থাটি যতই অপ্রীতিকর হক না কেন, মারতে আমাকে হবেই, এবং তা যত তাড়াতাড়ি সারা যায় ততই ভাল, কেননা মড়িটি এখানে আনতে গিয়ে বাঘটি এক দু-মাইল ব্যাপী রক্তের নিশানা রেখে এসেছে এবং এক ক্ষুধার্ত ভাল্লুক সে নিশানা খুঁজে পেলে পরে যে কোনো মুহূর্তে আমার হাত থেকে সিদ্ধান্তের ভার ছিনিয়ে নিতে পারে। শরীর সম্পূর্ণ অনড় কঠিন রেখে আমি ক্রমে ঝুরি থেকে হাত সরালাম, দুহাত রাখলাম রাইফেলে এবং একটি গুলি ছুঁড়লাম পিছনে, আমার নিচে, আরেকবার তেমন গুলি ছোঁড়বার কোনো বাসনা নেই আমার। ৪৫০/৫০০ হাই ভেলোসিটি রাইফেলের ঘোড়া যখন টিপি, বাঘটা ছিল আকাশপানে তাক করে এবং আমি মাছিগুলির নিচ দিয়ে দেখছিলাম। ওপর দিয়ে নয়। পিছু ধাক্কায় আমার আঙুলগুলো ও কবজি জখম হল বটে তবে আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, তা হল না, ভাঙল না, এবং বাঘটি যেমন তা শরীরের উপরাংশ উলটে দিয়ে চিত অবস্থায় পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকল, আসনে ঘুরে গিয়ে বসে আমি দ্বিতীয় নলটি দিয়ে ওর বুকে গুলি ছুঁড়লাম। আমার প্রথম গুলিতে বাঘটা যদি গর্জাত ও খেপে যেত, নিজেকে কম খুনী খুনী মনে হত আমার; কিন্তু ও যে রকম দরাজ কলিজা জানোয়ার, মুখটি খুলল না ও, এবং একটি শব্দও না করে আমার দ্বিতীয় গুলিতে মরল।

চারদিন আগে যে মোষ মারা পড়ে, এবং কোনো অযাচিত কারণে শকুনরা যাকে খায় নি, সেটাকে সমানে রেখে সেই গাছে বসার উদ্দেশ্যে ইবি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। ও ভেবেছিল, বাঘটি যদি আমাকে ফিকাস্ গাছে উঠতে দেখে থাকে, যে মড়ি রেখে আমি বসেছি সেটা ফেলে চলে যেতে পারে ও, ফিরে যেতে পারে থাক-এ, ওর পুরনো মড়ির কাছে এবং ইবিকে একটিগুলি ছোঁড়ার সুযোগ দিতে পারে। আমার দুটি গুলি শুনে, ওর সাহায্য আমার দরকার কি না তা দেখতে দ্রুত ফিরে এল ও, এবং ফিকা গাছ থেকে আধ মাইল দূরে ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আমার। দুজনে ফিরে এলাম হত্যাস্থলে, বাঘটি নিরীক্ষণ করব বলে। চমৎকার বিশাল এক লম্বা বাঘ, যৌবনের শিখরে, চমৎকার শরীরাবস্থা এবং মাপ নেবার কিছু আমাদের থাকলে পরে ওর মাপ হত নাকের ডগা থেকে লেজের শেষ অবধি কাঠির মাপে ন ফুট, ছ ইঞ্চি এবং গায়ের মাপে ন ফুট, দশ ইঞ্চি। তলার চোয়ালের ডান দিকে স্ব-দন্তটি ভাঙা ছিল ওর। পরে ওর শরীরের বিভিন্নাংশে গ্রথিত কিছু ছররাগুলি পেয়েছিলাম আমি।

আমাদের চারজনের ক্যাম্পে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ও বেজায় ভারি, তাই ঘাস, ডালপালা, শুকনো কাঠের ওপর চাপানো হল বড় বড় পাথর, এইসব দিয়ে ওকে ঢেকে রেখে এলাম যেখানে পড়েছিল সেখানেই–ভালুকের হাত থেকে বাঁচাবার কারণে। সে রাতে কথা ছড়িয়ে পড়ল যে মানুষখেকো বাঘটি নিহত হয়েছে এবং পরদিন সকালে যখন ওর চামড়া ছাড়াতে সেই ফিকাস গাছের গোড়ায় ওকে বয়ে আনলাম, একসোজনেরও বেশি পুরুষ ও বালক ভিড় জমাল ওকে দেখতে। বালকদের মধ্যে ছিল চুকার মানুষখেকোর শেষ নিহত মানুষের দশ বছরের ভাইটি।