প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

০১. তীর্থপথ

রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা

১. তীর্থপথ

আপনি যদি ভারতের রোদে-পোড়া সমতল-অধিবাসী হিন্দু হন, সকল সৎ হিন্দুর মত আপনারও যদি কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের অতি প্রাচীন দেবপীঠে তীর্থযাত্রার ইচ্ছা থাকে, তাহলে আপনাকে তীর্থযাত্রা শুরু করতে হবে হরিদ্বার থেকে। তীর্থযাত্রা সঠিক সম্পন্ন করলে যে পুণ্যফল হবার কথা তা সম্পূর্ণ পেতে হলে আপনি অবশ্যই হরিদ্বার থেকে কেদারনাথের পথের সবটুকু খালি পায়ে হেঁটে যাবেন। সেখান থেকে পাহাড়ী পথে হেঁটে যাবেন বদ্রীনাথ।

পবিত্র হর-কি-প্যারী কুন্ডে অবগাহন করে শুদ্ধশুচি হয়ে, হরিদ্বারের অসংখ্য দেবপীঠ ও মন্দির দর্শন করবেন আপনি, সেগুলির ভাণ্ডারে আপনার যথাসাধ্য দক্ষিণাও জমা হবে। পবিত্র কুণ্ডের উপরে তীর্থ-পথের সংকীর্ণতম অংশে সার দিয়ে যে কুষ্ঠীরা (কুষ্ঠরোগী) বসে আছে, তাদের কাছ-বরাবর একটি পয়সা ছুঁড়ে দিতে ভুলবেন না। ওই গলা-পচা নুলোগুলোর একদিন স্বাভাবিক হাতই ছিল। যদি এতে ত্রুটি করেন, তবে ওরা আপনাকে শাপশাপান্ত করবে। যে পর্বত-গুহা ওদের কাছে ‘ঘর’, সেখানে–অথবা বেচারাদের দুর্গন্ধ নোংরা ঝুলিতে যদি আপনার স্বপ্নাতীত ঐশ্বও লুকনো থাকে, তাতেই বা কি এসে যায়? অমন হতভাগ্যদের শাপশাপান্ত এড়িয়ে যেতে পারলেই সবচেয়ে ভাল। সামান্য কয়টা তামার পয়সা দিলেই তো অভিশাপ আপনাকে স্পর্শও করতে পারবে না।

প্ৰথা-ধর্ম অনুসারে একজন সৎ হিন্দুর যা যা করা দরকার, সবই আপনার করা হল এখন। এবার আপনি স্বচ্ছন্দে দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য তীর্থযাত্রা শুরু করতে পারেন।

হরিদ্বারের পর প্রথম যে দর্শনীয় জায়গায় পৌঁছবেন, তা হৃষীকেশ। এখানে আপনার সঙ্গে কালাকমলী-ওয়ালাদের প্রথম পরিচয় হবে। প্রতিষ্ঠাতা কাল কম্বল পরতেন বলে এঁদের এই নামে ডাকা হয়। তার শিষ্যদের অনেকে এখনো কাল কম্বলের পোশাক বা ঢিলে আলখাল্লা পরেন। কোমরে বাঁধা থাকে ছাগলের লোমে-বোনা দড়ি। পুণ্য কাজের জন্যে দেশ জুড়ে এঁদের খ্যাতি আছে।

তীর্থ-পথে অন্য যে-সব ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনার পরিচয় হবে, তাদের কোনোটি সে-খ্যাতি দাবি করার অধিকার রাখে কি না আমি জানি না। তবে কালাকমলী-ওয়ালারা যে সে-দাবি করতে পারেন তা আমি নিজে জানি। সে দাবি ন্যায্য। এঁদের প্রতিষ্ঠিত বহু দেবপীঠ ও মন্দিরে যে প্রণামী-দর্শনী পান, তা দিয়ে এঁরা হাসপাতাল, ঔষধ-বিতরণ কেন্দ্র, তীর্থযাত্রা-নিবাস, স্থাপনা ও পরিচালনা করেন। গরিব-দুঃখীকে খেতে দেন।

হৃষীকেশ পিছনে রইল। এবার আপনি পৌঁছবেন লছমনঝোলায়। এখানে তীর্থ-পথ, একটা ঝোলা-পুল বেয়ে গঙ্গার ডানদিক থেকে পেরিয়ে চলে গেল বাঁদিকে। ঝোলা-পুলের উপর বাঁদরদের জমায়েতকে খুব সাবধান! এরা হরিদ্বারের কুষ্ঠীদের চেয়েও নাছোড়বান্দা। মিঠাই অথবা ছোলাভাজা ভেট দিয়ে এদের তুষ্ট করতে ভুলে যান যদি তাহলে লম্বা, সরু পুলটা পেরনো কঠিন হবে, যন্ত্রণাও ভোগ করতে হবে শরীরে।

গঙ্গার বাঁ-তীর ধরে চড়াই-পথে তিনদিন হেঁটে আপনি গাড়োয়ালের প্রাচীন রাজধানী শ্রীনগরে পৌঁছে গেলেন। ইতিহাস, ধর্ম ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে জায়গাটির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা প্রশস্ত, উন্মুক্ত একটি অধিত্যকার কোলে অবস্থিত জায়গাটির সৌন্দর্যও অপরিসীম। দুটি বিশ্বযুদ্ধে যে গাড়োয়ালী সৈন্যরা অমন অসম-সাহসে লড়ে; তাদের পূর্বপুরুষরা এখানেই গুর্খা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে শেষবারের মত বিফল সংগ্রাম করেছিল।

১৮৯৪ সালে, গোহনা হ্রদের বাঁধ ভেঙে, গাড়োয়ালীদের প্রাচীন নগরী শ্রীনগর, সমস্ত রাজপ্রাসাদ-টাসাদসুদ্ধ নিশ্চিহ্ন করে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এটি গাড়োয়ালবাসীদের গভীর সন্তাপ। গঙ্গার এক উপনদী বিরেহি গঙ্গার উপত্যকায় এক ধস নামার ফলে বাঁধটির সৃষ্টি। বাঁধটির তলভূমি ১১,০০০ ফুট চওড়া, উপরিস্থিত ২, ০০০ ফুট চওড়া, গভীরতা ৯০০ ফুট। মাত্র ছ’ঘণ্টার মধ্যে এক লক্ষ কোটি ঘনফুট জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যায়। এমন সঠিক সময়মত বাঁধটি ভাঙে, যে হরিদ্বার অবধি গঙ্গার উপত্যকা বিধ্বস্ত করে, প্রতিটি সেতু ভাসিয়ে বন্যা বয়ে যায়, কিন্তু মৃত্যু হয় মাত্র একটি পরিবারের। বিপজ্জনক এলাকা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরও, ওরা ওখানেই ফিরে গিয়েছিল।

শ্রীনগর থেকে ছাতিখাল, চড়াই-পথটি অত্যন্ত খাড়াই। তবে গঙ্গা-উপত্যকা ও কেদারনাথের ওপরে চির তুষাররাজ্যের মহান সৌন্দর্য আপনাকে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।

ছাতিখাল থেকে একদিনের পথ। তারপরই সামনে দেখুন গোলাব্রাই। সার-সার ঘাসের ছাউনি-দেওয়া তীর্থযাত্রীদের থাকার ঘর, পাথরে তৈরি একটি এক-কামরা বাড়ি, পানীয় জলের একটি আধার। একটি ছোট্ট কাকচক্ষু পার্বত্য নদী এই বিশাল, প্রকাণ্ড জলাধারে জল যোগায়। পাইনগাছের চারা দিয়ে তৈরি সার-সার নালা বসিয়ে, পাহাড়ের গা দিয়ে, গ্রীষ্মে সন্তর্পণে নদী থেকে জলাধারে জল নামিয়ে আনা হয়। বছরের অন্যান্য ঋতুতে, শেওলা ও মেডেন হেয়ার ফার্নে ঢাকা পাথরের ওপর দিয়ে, উজ্জ্বল সবুজ জলজলতা ও আকাশ-নীল স্ট্রোবিলান্থ ফুলের ভিতর দিয়ে মহানন্দে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁধনহারা জল।

যাত্রীশালার একশো গজ পিছনে পথের ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে একটি আমগাছ।

এই গাছটি, এটির ওপরে গোলাই যাত্ৰীশালার মালিক পণ্ডিতদের দোতলা বাড়িটি স্মরণযোগ্য। আমাকে যে কাহিনী বলতে হবে, ওদের এক বিশেষ ভূমিকা আছে।

আরো দু-মাইল হাঁটুন সমতল পথে। এখন বহুদিনের মত এই আপনার সমতল পথে শেষ হাঁটা। এবার আপনি রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে গেলেন। আমার তীর্থযাত্রী বন্ধু, এখানেই আমাদের পরস্পরের কাছে বিদায় নিতে হবে। আপনার পথ চলে গেল অলকানন্দা পেরিয়ে মন্দাকিনীর বাঁ-তীর ধরে চড়াই-পথে কেদারনাথে। আমার পথ গেছে পাহাড়গুলির ওপারে নৈনিতালে, আমার বাড়িতে।

অত্যন্ত খাড়া-চড়াই, অবিশ্বাস্য বন্ধুর এক পথ আপনার সামনে। এ-পথে আপনার মত লক্ষ-লক্ষ তীর্থযাত্রী হেঁটেছে। সাগরাঙ্কের চেয়ে উঁচু কোনো জায়গার বাতাসে আপনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন নি? নিজের বাড়ির ছাতের চেয়ে উঁচু কোনো জায়গায় আপনি ওঠেন নি। নরম বালির চেয়ে শক্ত কোনো কিছু মাড়ায় নি আপনার পা। আপনি খুবই কষ্ট পাবেন।

এমন অনেক সময় আসবে যখন একটু নিঃশ্বাসের জন্যে হাঁপাতে-হাঁপাতে আপনি অত্যন্ত কষ্টে পাহাড়ের খাড়াই ভেঙে উঠবেন। বন্ধুর শিলা, তীক্ষ্ম ধার ফাটা-চটা মাটি, বরফজমাট পথ বেয়ে চলতে গিয়ে আপনার পা ফেটে রক্ত পড়বে। যে সম্ভাব্য লাভের সন্ধানে চলেছেন, তা এই যন্ত্রণার মূল্যের যোগ্য কি-না, এ প্রশ্ন আপনি নিজেই নিজেকে করবেন। তবু, সৎ হিন্দু বলে, আপনি কষ্ট করে হাঁটতেই থাকবেন। মনকে এই বলে বোঝাবেন, বিনাকষ্টে পুণ্যলাভ হয় না। ইহজীবনে যত বেশি কষ্ট করা যায়, পরকালে তত বেশি সুখ মেলে।

.

২. নরখাদক

হিন্দীতে “সঙ্গম”কে বলা হয় “প্রয়াগ”। কেদারনাথ থেকে নেমে এসেছে মন্দাকিনী, বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দা। রুদ্রপ্রয়াগে এসে দুটি নদী মিলেছে। এরপর থেকে দুটি নদীর মিলিত জলধারা সকল হিন্দুর কাছে “গঙ্গা মায়ী”, এবং পৃথিবীর অন্য সর্বত্র “দি গ্যাঞ্জেস” নামে পরিচিত।

চিতা বা বাঘ, যাই হক না কেন, যখন কোনো জানোয়ার নরখাদক হয়ে দাঁড়ায়, শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো জায়গার নামে তার নামকরণ করা হয়। একটি নরখাদককে ওই যে নাম দেওয়া হল, তার মানে কিন্তু সবসময়ে এই নয়, যে ওই বিশেষ জাগয়াটিতেই জন্তুটির নরখাদক-জীবন শুরু হয়েছে, অথবা ওর সব শিকারই ওই একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ। কেদারনাথ তীর্থের পথে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বার মাইল দূরে একটি ছোট গ্রামে যে চিতা নরখাদক-জীবন শুরু করে, বাকি জীবনটা যে ‘রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা’ নামেই তার পরিচয় থাকবে, এ খুবই স্বাভাবিক।

বাঘরা যে-কারণে নরখাদক হয়, চিতারা তা হয় না। আমাদের জঙ্গলের সকল জন্তুর মধ্যে চিতা সবচেয়ে সুন্দর, সাবলীল। জখম হলে, বা কোণঠাসা হলে সাহসে সে কারো চেয়ে কম যায় না। তবে এরা এমন মড়াখেকো, যে খিদের জ্বালায় জঙ্গলে যে মড়া পায়, তাই খায়। ঠিক আফ্রিকার জঙ্গলের সিংহদের মত। এ-সব কথা স্বীকার করতে আমার লজ্জাই করছে।

গাড়োয়ালের অধিবাসীরা হিন্দু, তাই তারা মৃতদেহ দাহ করে। দাহ অবশ্যই কোনো নদী বা ঝরনার ধারে হয়, যাতে ছাইগুলো ভেসে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে, অবশেষে সমুদ্রে। গ্রামগুলো বেশির ভাগই উঁচু পাহাড়ের ওপর, এবং নদী বা ঝরনা অনেক ক্ষেত্রেই থাকে বহু নিচে, উপত্যকার মধ্যে। কাজেই বোঝাই যায়, ছোট গ্রামে শবদাহের লোকজন যোগাড় করা বেশ কষ্টকর। কারণ শববাহক ছাড়াও জ্বালানী কাঠ যোগাড় করা ও বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেও লোক থাকা দরকার।

স্বাভাবিক সময়ে শবকৃত্যের কাজ নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু যখন রোগ মহামারীর আকারে পাহাড় ছারখার করে চলে যায়, যখন সৰ্গতির ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে অনেক কম সময়ে তাড়াতাড়ি মানুষ মরতে থাকে, তখন গ্রামে একটি অত্যন্ত সহজ উপায়ে শবকৃত্য করা হয়। মৃতের মুখে একটি জ্বলন্ত কাঠকয়লা গুঁজে দিয়ে, পাহাড়ের কিনারা অবধি বয়ে নিয়ে গিয়ে শবটি নিচের উপত্যকায় ফেলে দেওয়া হয়।

স্বীয় এলাকায় স্বাভাবিক শিকারে ঘাটতি পড়লে, এই মৃতদেহগুলি পেলে পরে একটি চিতা খুব তাড়াতাড়ি মানুষের মাংসের স্বাদে আসক্ত হয়ে পড়ে। মড়ক চলে গেলে আবার কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যখন খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল দেখে চিতাটি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মানুষ মারতে শুরু করে। ১৯১৮ সালে দেশ জুড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার মড়ক দেখা দেয়। ভারতে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা পড়ে। এ মড়কে কঠিন মূল্য দিতে হয় গাড়োয়ালকে। এ মহামারীর শেষেই গাড়োয়ালের নরখাদক আত্মপ্রকাশ করে।

১৯১৮ সালের ৯ই জুন, বৈঁজি গ্রামে রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক, চিতা প্রথম মানুষ মারে, নথিতে লেখা আছে। সর্বশেষ যে মৃত্যুর জন্য নরখাদকটি দায়ী, তা ১৯২৬ সাঁলের ১৪ই এপ্রিল ভৈঁসোয়ারা গ্রামে ঘটে। সরকারী নথিতে লেখা আছে। এই দুটি তারিখের অন্তর্বর্তী সময়ে একশো পঁচিশ জন মানুষ মারা পড়ে।

তখন গাড়োয়ালে যে সরকারী কর্মচারীরা কাজ করছিলেন, যে-অঞ্চলে নরখাদকটি মারছিল, সেখানে যে অধিবাসীরা ছিলেন, তাঁরা এই একশো পঁচিশ জন মৃতের সংখ্যা সঠিক বলে কতটা দাবি করেন তা আমি জানি না। তবে আমি নিজে জানি এ সংখ্যা সঠিক নয়। আমি যখন ওখানে ঘুরছি তখন কিছু কিছু মানুষ নিহত হয়। সরকারী নথিতে সে হিসাব দেখানো হয় নি।

যতগুলি মানুষের মৃত্যুর জন্য নরখাদকটি সত্যিই দায়ী, হিসাবে সে সংখ্যা কম দেখানোর জন্য, গাড়োয়ালের অধিবাসীরা দীর্ঘ আট বছর ধরে যে-যন্ত্রণা সহ্য করেছে, তাকে আমি খাটো করছি না। ওটি সর্বকালের সবচেয়ে খ্যাত নরখাদক চিতা বলে গাড়োয়ালের লোকরা দাবি জানায়, জানোয়ারটির সে খ্যাতিও আমি কিছুতেই হ্রাস করতে চাই না।

যাই হ’ক, নিহত মানুষের সংখ্যা যাই হয়ে থাকুক, গাড়োয়ালীরা এ দাবি করতে পারে যে এই চিতাটি চিরকালের সকল জীবিত প্রাণীর মধ্যে সর্বাধিক প্রচার-প্রখ্যাত প্রাণী। আমার জানা আছে, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ভারতের অধিকাংশ সাপ্তাহিক ও দৈনিক কাগজে চিতাটির কথা উল্লেখ করা হয়।

সংবাদপত্রে এই প্রচার ছাড়াও, যে ষাট হাজার তীর্থযাত্রী বছর-বছর কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের দেবপীঠ দর্শনে যায়, তারা এই নরখাদকের গল্প ভারতের সর্বত্র বয়ে নিয়ে যায়।

নরখাদক দ্বারা নিহত বলে কথিত যে-কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই একটি সরকারী নিয়ম আছে। নিহত হবার পর যত তাড়াতাড়ি হয়, নিহতের আত্মীয় বা বন্ধুরা গ্রাম পাটোয়ারীর কাছে গিয়ে রিপোর্ট দাখিল করবে। সেটি পেলেই পাটোয়ারী ঘটনাস্থলে যাবে। ও পৌঁছবার আগে নিহতের দেহ খুঁজে না পেয়ে থাকলে, ও নিজে তল্লাসীর লোকজন যোগাড় করবে। সেই দলের সহায়তায় পাটোয়ারী নিহতকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাবে।

ও পোঁছবার আগে যদি মড়া খুঁজে পাওয়া যায়, যদি তল্লাসী-দল মড়া খুঁজে পায় পাটোয়ারী তখনি সরেজমিন তদন্ত করবে। এটি খুনের কেস নয়, সত্যিই নরখাদকটি একে মেরেছে, এ বিষয়ে নিজে নিশ্চিত হবার পর, তবে নিহতের জাত-ধর্ম অনুযায়ী পাটোয়ারী, শব সকার বা সমাধিদানের অনুমতি দেবে আত্মীয়দের।

ও-অঞ্চলে নরখাদকটির কার্যকলাপ বিষয়ে ওর যে সরকারী-খাতা আছে, তাতে এই হত্যার ঘটনা যথাসময়ে নথিভুক্ত হবে। জেলার প্রশাসনিক মুখ্য ডেপুটি কমিশনারের কাছে ঘটনাটির একটি সম্পূর্ণ বিবরণী দাখিল করা হবে। তিনিও একটি রেজিস্টার রাখেন। তাতে নরখাদকটির প্রত্যেক নরহত্যার কথা নথিভুক্ত করা হয়।

শিকারকে বহু দূর বয়ে নিয়ে যাওয়া নরখাদকদের একটা বদ অভ্যাস। কাজেই মাঝে-মধ্যে এমনও হয়, যে মৃতদেহ, অথবা তার কোনো অংশই পাওয়া গেল না। সে ক্ষেত্রে কেসটি আরো তদন্ত-সাপেক্ষ থাকে। সংশ্লিষ্ট নরখাদকটিকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে ধরা হয় না। নরখাদক যখন মানুষ জখম করে, জখমের ফলে যদি লোকজন মারা পড়ে, তখনো সে মৃত্যুগুলির কারণ নরখাদকটি, তা দেখানো হয় না।

অতএব দেখা যাচ্ছে, নরখাদকগুলির নরহত্যার হিসাব নথিভুক্ত করার জন্য গৃহীত নিয়ম যথাসম্ভব ভালই। তবু, এই অস্বাভাবিক জানোয়ারগুলির মধ্যে কোন একটিকে, শেষ অবধি যতগুলি মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে ধরা হল-তার চেয়ে বেশি মানুষ সে মেরেছে, এও এভাবে সম্ভব। বিশেষ করে, বহু বছর ধরে যখন সে হাড় দিতে থাকে, তখন।

.

৩. সন্ত্রাস

“সন্ত্রাস” শব্দটা দৈনন্দিন তুচ্ছ ব্যাপারে অত্যন্ত সাধারণ ও সার্বিকভাবে ব্যবহার হয়। ফলে, প্রয়োজনের সময়ে এর প্রকৃত অর্থ প্রকাশে শব্দটি অক্ষম হলেও হতে পারে। তাই, নরখাদক যেখানে হানা দিয়ে ফিরছিল, গাড়োয়ালের সেই পাঁচশো বর্গ মাইলের পঞ্চাশ হাজার অধিবাসী এবং ১৯১৮ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর যে ষাট হাজার তীর্থযাত্রী ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেছিল, তাদের কাছে সন্ত্রাস প্রকৃত সন্ত্রাসের সংজ্ঞা কি, আমি আপনাদের তার সামান্য ধারণা দিতে চেষ্টা করব। কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়ে অধিবাসী ও তীর্থযাত্রীদের সন্ত্রাসের কারণটা বোঝাব।

রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা যা জারী করে, তার চেয়ে কঠোরতর কোনো সান্ধ্য-আইনকে কোনোদিন বলবৎ করা হয় নি, এমন অমোঘতায় মান্য করাও হয় নি।

দিনের আলোয় ওই এলাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবেই চলত। পুরুষরা দূরের বাজারে কেনাবেচার জন্যে, কিংবা কাছের গ্রামে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যেত। মেয়েরা পাহাড়ের গা থেকে ঘরের চাল ছাইবার, বা গরুর ঘাস কাটতে যেত। বাচ্চারা স্কুলে যেত। নইলে ছাগল চরাতে বা শুকনো কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে যেত। গ্রীষ্মে তীর্থযাত্রীরা হয় একা, নয় দল বেঁধে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের দেবপীঠে যাওয়া-আসা করত তীর্থপথে।

সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে পৌঁছত, ছায়া দীর্ঘ হতে থাকত, তখন এলাকাটির সকল মানুষের গতিবিধি ব্যবহারে একটি অতি আকস্মিক, লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিত।

যে পুরুষরা ধীরেসুস্থে বাজারে অথবা কাছের গ্রামে গিয়েছিল তারা দ্রুত ফিরে আসত ঘরে। ঘাসের মস্ত বোঝা পিঠে মেয়েরা পাহাড়ের খাড়াই-ঢাল বেয়ে হুড়মুড় করে নামতে থাকত। যে বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরার পথে, ছাগলের পাল, অথবা শুকনো কাঠ নিয়ে ফিরতে দেরি করছে, মা-রা গভীর উৎকণ্ঠায় তাদের ডাকাডাকি করত। পথে, শ্রান্ত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যে স্থানীয় বাসিন্দার দেখা হত, সেই তাদের তাড়াতাড়ি যাত্রীশালায় চলে যেতে বলত।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত এলাকায় থমথম করত এক অশুভ নৈঃশব্দ্য কোথাও কোনো গতিবিধি, কোনো আওয়াজ নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের সবাই বন্ধ দরজার পিছনে। বহু ক্ষেত্রে বাড়তি দরজা লাগিয়ে তারা অধিকতর নিরাপত্তা খুঁজত। বাড়ির ভিতরে ঠাই পাবার ভাগ্য যে তীর্থযাত্রীদের হয় নি, তারা যাত্রীশালায় গা ঘেঁষাঘেষি করে থাকত। কি বাড়ির ভিতরে, কি যাত্রীশালায়, সবাই সেই ভয়ঙ্কর নরখাদক সাড়া পাবার ভয়ে চুপ করে থাকত। দীর্ঘ আট বছর ধরে গাড়োয়ালের বাসিন্দা ও তীর্থযাত্রীদের কাছে সন্ত্রাস শব্দের সংজ্ঞা ছিল এই।

আমি এবার কয়েকটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেব। দেখাব এ সন্ত্রাসের কারণ কি!

.

একটি চোদ্দ বছরের অনাথ ছেলেকে চল্লিশটা ছাগলের তদারকীর চাকরি দেওয়া হয়। ছেলেটি অনুন্নত, অস্পৃশ্য শ্রেণির। প্রতি সন্ধ্যায় ও যখন ছাগল নিয়ে ফিরত, ওকে খেতে দেওয়া হত। তারপর ছাগলগুলোর সঙ্গে একটি ছোট ঘরে বন্ধ করে রাখাঁ হত। ঘরটা ছিল লম্বা সার-বাঁধা কয়েকটি দোতলা বাড়ির একতলায়, ছেলেটির মনি ছাগলগুলির মনিব যে-ঘরে থাকত, তার ঠিক নিচে। ঘুমের মধ্যে পাছে ছাগলগুলো ওর গায়ে এসে পড়ে, সেইজন্য ছেলেটি ঘরের ভিতরের বাঁ-কোণটি বেড়া বেঁধে ঘিরে নিয়েছিল।

এই ঘরে শুধু একটি দরজা, কোনো জানলা ছিল না। ছেলেটি আর ছাগলগুলি নিরাপদে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে ছেলেটির মনিব দরজা টেনে শেকল বন্ধ করত পাল্লার সঙ্গে আঁটা শেকলের মুখটা চৌকাঠে বসানো আংটায় গলিয়ে দিত। শেকলের মুখ যাতে না খোলে, সে-জন্যে আংটার ভিতর এক-টুকরো কাঠের গোঁজ ঢোকান হত। আরো নিরাপত্তার জন্য ছেলেটি ঘরের ভিতর দিকে একটা পাথর গড়িয়ে এনে দরজার গায়ে ঠেকিয়ে রাখত।

ছেলেটির মনিব বলে, যে-রাতে ছেলেটিকে ওর পূর্বপুরুষরা ডেকে নেয়, সে-রাতেও দরজা যথারীতিই বন্ধ ছিল। ওর কথার সত্যতাকে সন্দেহ করার কোন কারণ পাই নি আমি। দরজার গায়ে অনেকগুলি নখের গভীর আঁচড় ওর উক্তিকে সমর্থন করে। এও সম্ভব যে আঁচড়ে দরজা খোলার চেষ্টা করার সময়ে আংটার মুখের কাঠের গোঁজটা খুলে ফেলে চিতাটা। তারপর পাথরটা ঠেলে সরিয়ে ঘরে ঢোকা তার পক্ষে সহজ হবার কথা।

একটি ছোট ঘরে চল্লিশটা ছাগল গাদাগাদি করে ঠাসা। একটি কোণ বেড়া দিয়ে ঘেরা। এতে, নড়াচড়া করার বেশি জায়গা পাবার কথা নয় চিতাটার। দরজা থেকে ছেলেটি যেখানে, ঘরের সে-কোণ অবধি দুরত্বটুকু চিতাটা ছাগলগুলোর পিঠের ওপর দিয়ে গিয়েছিল, না পেটের তলা দিয়ে তা অনুমানসাপেক্ষ। কেন না, ও চলবার সময়ে ছাগলগুলোর প্রত্যেকটা নিশ্চয় দাঁড়িয়ে উঠেছিল।

জোরে দরজা ঠেলে খোলার চেষ্টায় চিতাটা যে শব্দ করে, চিতাটা ঘরে ঢোকার পর ছাগলগুলোও নিশ্চয় গোলমাল করে। এই সব গণ্ডগোলের মধ্যেও ছেলেটি নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল মনে করাই সবচেয়ে বাঞ্ছনীয়। সেই জন্যেই সে সাহায্যের জন্যে বৃথা চেঁচায় নি। যে আতঙ্ক তাকে সন্ত্রস্ত করেছিল, সে আতঙ্ক এবং ওর নিজের মধ্যে ব্যবধান তো একটি পাতলা তক্তা।

ছাগলগুলো রাতের আঁধারে পালিয়ে বাঁচে। বেড়া-ঘেরা কোণে ছেলেটিকে মেরে চিতাটা ওকে বয়ে শূন্য ঘর পেরিয়ে যায়। নেমে যায় পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে। তারপর কয়েকটা স্তর-কাটা খেত পেরিয়ে নেমে যায় পাহাড়ের পাথর-ছড়ানো গিরিখাতের বুকে। সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা বাদে ওখানেই ছেলেটির মনিব ওর চাকরের দেহের যতটুকু চিতাটার ভুক্তাবশেষ, তা খুঁজে পায়।

অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু চল্লিশটা ছাগলের একটার গায়েও এমন কি একটা আঁচড়ও লাগে নি।

.

এক প্রতিবেশী এসেছিল বন্ধুর বাড়িতে একটু ধীরেসুস্থে ধূমপান করতে। ঘরটির আকার ইংরেজি “L” (বড় হাতের ‘এল) বর্ণের মতো। যেখানে দুজন মেঝেয় বসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তামাক খাচ্ছিল, সেখান থেকে ঘরের একমাত্র দরজাটা চোখে পড়ে না। দরজাটা ভেজানো, কিন্তু আটকানো নয়। কারণ সে-রাত অবধি গ্রামের একটি মানুষও মারা পড়ে নি।

ঘর অন্ধকার। ঘরের মালিক সবে ওর বন্ধুর হাতে কোটা দিয়েছে, অমনি হুঁকোটা মাটিতে পড়ে গেল। ছিটিয়ে গেল এক পসলা জ্বলন্ত কাঠকয়লা আর তামাক। ও ওর বন্ধুকে আরো হুঁশিয়ার হতে বলল, নইলে যে কম্বলে ওরা বসে আছে তাতেই বন্ধু আগুন ধরিয়ে ফেলবে। এই বলে, জ্বলন্ত কাঠকয়লাগুলো কুড়োবার জন্যে ও সামনে ঝুঁকল। যেমন ঝুঁকেছে দরজাটা চোখে পড়ল। নতুন চাঁদ প্রায় ডুবুডুবু। চাঁদের পশ্চাৎপটের সিয়েটে লোকটি দেখল, একটা চিতা ওর বন্ধুকে বয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দরজা দিয়ে।

কয়েকদিন পরে এই ঘটনার বিবরণী আমাকে দিতে-দিতে লোকটি বলে, “যখন চিতাটা আমার বন্ধুকে মারছিল, যখন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি, আমার বন্ধুর কাছ থেকে এমন কি একটা শ্বাস টানার, বা অন্য কোনো শব্দই পাই নি। অথচ আমার এক হাতের মধ্যে ও বসেছিল। এ কথা যখন বলি, তখন সত্যি কথাই বলি সাহেব। বন্ধুর জন্য তো কিছুই করার ছিল না আমার। তাই চিতাটা চলে যাবার পর কিছুক্ষণ সবুর করে আমি হামাগুড়ি দিয়ে দরজা অবধি যাই। তারপর তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিই।”

.

এক গ্রামপ্রধানের স্ত্রী জ্বরে ভুগছিল। ওর শুশ্রূষার জন্যে ওর দুই বন্ধুকে ডাকা হয়।

বাড়িতে দুটি ঘর। বাইরের ঘরে দুটি দরজা। একটির মুখ একটা ছোট টালি পাথরে বাঁধানো উঠোনের দিকে। অন্যটি দিয়ে ভিতরের ঘরে যাওয়া যায়। বাইরের ঘরে, মেঝে থেকে প্রায় চার ফুট উঁচুতে সংকীর্ণ একফালি একটা জানলাও ছিল। জানলাটা খেলা। জানলার মুখে পিতলের একটা বড় ঘড়া। ঘড়ায় রোগিণীর জন্য খাবার জল।

বাইরের ঘরে যাবার একটি দরজা ছাড়া ভিতরের ঘরের চার দেওয়ালের একটিতেও একটা ছিদ্র নেই।

উঠোনে বেরোবার দরজাটা বন্ধ, শক্ত করে আঁটাসাঁটা। দু-কামরার মাঝের দরজাটা হাট করে খোলা।

ভিতরের ঘরে তিনটি মেয়েই মাটিতে শুয়েছিল। রোগিনী মাঝখানে, দু-পাশে দুই বন্ধু। বাইরের ঘরে, জানালাটির খুব কাছ বরাবর একটি খাটে শুয়েছিল মহিলার স্বামী। ওর খাটের পাশে মেঝের ওপর লন্ঠন, যাতে লণ্ঠনের আলো ভিতরের ঘরে গিয়ে পড়ে। তেল বাঁচাবার জন্য লণ্ঠনের পলতেটা নামানো।

মাঝরাত বরাবর, দু-ঘরের বাসিন্দারাই যখন ঘুমোচ্ছে, চিতাটা ওই সরু একফালি জানলা দিয়ে ঢোকে। পিতলের ঘড়াটা প্রায় জানলা জোড়া। কোনো অলৌকিক উপায়ে চিতাটা ঘড়া ফেলে-দেওয়াটা বাঁচায়। পুরুষটির নিচু খাটটি ঘুরে গিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে রোগিণীকে মারে। চিতাটা যখন ওর শিকার তুলে ধরে জানলা দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করে, তখন ভারি পিতলের ঘড়াটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে। একমাত্র তখনই নিদ্রিতেরা জেগে ওঠে।

লণ্ঠনের পলতে বাড়াবার পর দেখা যায় অসুস্থ মহিলাটি তালগোল পাকিয়ে জানলার নিচে পড়ে আছে। গলায় চারটে বড়-বড় দাঁতের দাগ।

সে-রাতে শুশ্রূষাকারিণীদের মধ্যে একজন হল এক প্রতিবেশীর স্ত্রী। আমাকে ঘটনার বিবৃতি দেওয়ার সময়ে প্রতিবেশীটি বলে, “মেয়েটা জ্বরে খুব ভুগছিল। ও হয়তো মারা যেতই। ভাগ্য ভাল যে চিতাটা ওকেই বেছে নেয়।”

.

দু’জন গুজার তাদের ত্রিশটা মোষের পাল নিয়ে চড়াই (চারণভূমি) থেকে আরেকটায় ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লোক দুটি সহোদর ভাই। বড় ভাইয়ের বার বছরের মেয়েটি ওদের সঙ্গে ছিল।

ওরা ও-অঞ্চলে নবাগত। হয় ওরা নরখাদকটির কথা শোনেই নি। কিংবা ওদের যতটা নিরাপদ-প্রহরা রাখা দরকার, মোষগুলোই তা করতে পারবে, এ রকমটা ভাবা আরো সম্ভব।

পথের কাছে, আট হাজার ফুট উচ্চতায় সরু একফালি সমভূমি। তার নিচে প্রায় পনের কাঠা চওড়া কাস্তে-আকৃতির স্তর-কাটা খেত। খেতটি বহুদিন অনাবাদে পড়ে আছে। লোক দুটি আস্তানার জন্য এই জায়গাটিই বেছে নিল। ওদের চারপাশ ঘেরা জঙ্গল। সেখান থেকে খোঁটা কেটে এনে খেতে শক্ত করে পুঁতে মোষগুলোকে লম্বা সারে বাঁধল।

 মেয়েটি রাঁধল। রাতের খাওয়া সেরে, রাস্তা আর মোষগুলোর সারির মাঝামাঝি সরু ফালি জমিটায় কম্বল বিছিয়ে তিনজনই ঘুমিয়ে পড়ল।

সে এক গাঢ় অন্ধকারের রাত। মোষের গলার ঘণ্টার ঢঙ-ঢঙানিতে, ভীত পশুগুলির ফোঁসফোসানিতে, ভোরের দিকে পুরুষ দুজনের ঘুম ভেঙে যায়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফলে ওরা জানত এই শব্দগুলি হচ্ছে কোনো মাংসাশী জানোয়ারের উপস্থিতির প্রমাণ। ওরা একটা লণ্ঠন জ্বালল। মোষগুলোকে শান্ত করতে গেল। দেখতে গেল যে একটি মোষও যেন খোঁটায় বাঁধা দড়ি না ছেড়ে।

ওরা গিয়েছিল মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। যখন শোয়ার জায়গায় ফিরে এসেছে, তখন দেখে মেয়েটি বেপাত্তা। ওরা যাওয়ার সময়ে মেয়েটি ঘুমোচ্ছিল। যে কম্বলে ও শুয়েছিল তাতে রক্তের বড়-বড় ছাপ।

আলো ফুটতে বাবা আর কাকা রক্তের দাগ অনুসরণ করে। রক্তের দাগ খোঁটায় বাঁধা মোষের সারি ঘুরে গিয়ে, সরু খেতটা পেরিয়ে পাহাড়ের খাড়াই ঢাল বেয়ে কয়েক গজ নিচে নেমে যায়। সেখানেই চিতাটা তার শিকার খেয়েছে।

“আমার দাদার জন্মটাই খারাপ লগ্নে সাহেব! কেননা ওর কোনো ছেলে নেই, এই একটি মাত্র মেয়ে ছিল। মেয়েটির শীগগিরি বিয়ে হবার কথা। ভরা বয়সে ওই মেয়েটিই ওকে উত্তরাধিকারী যোগাবে বলে দাদা আশা করেছিল। এখন এই চিতাটা এসে ওকেই খেল।”

আরো বলে চলতে পারি আমি। কেন না বহু লোক মারা পড়েছে। প্রত্যেক মৃত্যুরই নিজস্ব এক করুণ কাহিনি আছে। তবে আমার মনে হয়, রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতার বিষয়ে গাড়োয়ালের বাসিন্দাদের যে সন্ত্রস্ত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল, তা আপনাদের বোঝাবার পক্ষে আমিও যথেষ্টই বলেছি। বিশেষ করে মনে রাখা দরকার, গাড়োয়ালীরা অত্যন্ত কুসংস্কারগ্রস্ত। চিতাটার সঙ্গে শারীরিক সংস্পর্শে আসার ভয় তো ছিলই! তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অলৌকিকতা বিষয়ে গাড়োয়ালীদের দারুণতর ভয়। আমি তার একটা দৃষ্টান্ত আপনাদের দিচ্ছি।

এক সকালে, ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে আমি রুদ্রপ্রয়াগের ছোট, এক-কামরা ইন্সপেকশন বাংলো থেকে বেরোই। বারান্দা থেকে নেমেই মানুষের পায়ে-পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া জমির ধুলোয় নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখলাম।

ছাপগুলো একেবারে টাটকা। বোঝা গেল, আমার মাত্র কয়েক মিনিট আগে চিতাটা বারান্দা থেকে নেমে গেছে। থাবার ছাপ যে-দিক পানে গেছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলোয় আসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়াতে চিতাটা পঞ্চাশ গজ খানেক দূরে তীর্থ-পথের দিকে যাচ্ছে। জমির ওপরটা বেজায় শক্ত। তাই বাংলো আর তীর্থ-পথের মাঝামাঝি জায়গায় থাবার ছাপ অনুসরণ করা সম্ভব হল না। তবে গেটের কাছে পৌঁছতেই দেখি, থাবার ছাপ গোলাব্রাইয়ের দিকে যাচ্ছে। গত সন্ধ্যায় ওই পথে ভেড়া-ছাগলের এক বড় পাল গেছে। ওদের খুরে ওড়ানো ধুলোর ওপরেও চিতাটার থাবার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এত স্পষ্ট, যেন টাটকা-পড়া তুষারের ওপর থাবার ছাপ পড়েছে।

নরখাদকটার থাবার ছাপের সঙ্গে ততদিনে আমার দিব্যি পরিচয় হয়ে গিয়েছে। প্রায় অনায়াসে যে-কোনো একশো চিতার থাবার ছাপের মধ্যেও আমি ওর থাবার ছাপ আলাদা করে চিনে নিতে পারি।

মাংসাশী পশুর থাবার ছাপ থেকে অনেক কিছু জানা যায়। যেমন, প্রাণীটি মদ্দা না মাদী, তার বয়েস, তার শরীরের আয়তন। প্রথম যখন দেখি, তখনি নরখাদকটির থাবার ছাপ আমি খুব যত্ন করে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছিলাম। আমি জানতাম, ওটা একটা অতিকায় মদ্দা চিতা, ওর যৌবন পার করেছে বহুকাল আগে।

এই সকালে নরখাদকটার থাবার চিহ্নের পেছু-পেছু চলতে-চলতে দেখলাম, ও আমার চেয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ এগিয়ে আছে। চলছে মন্থর স্থির গতিতে।

এত কাকভোরে পথে কোনো লোক চলাচল নেই। পথটা এঁকেবেঁকে অসংখ্য ছোট গিরিকরে ঢুকেছে আর বেরিয়েছে। অতি সাবধানে আমি প্রতিটি মোড়ের বাঁক ঘুরছিলাম। কেননা ভোরের আলো ফোঁটার পর কখনো না-বেরুবার নীতি এবারটা ও না মানতেও পারে, সে সম্ভাবনা আছে। তারপর, মাইলখানেক গিয়ে দেখলাম, চিতাটা পথ ছেড়ে একটা জংলা পথ ধরে ঝোঁপ ঝাড় ও গাছের ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেছে।

চিতাটা যেখানে রাস্তা ছেড়েছে, সেখান থেকে একশো গজ দূরে একটা ছোট খেত। তার ঠিক মাঝখানে একটা কাঁটাঝোপে ঘেরা জায়গা। খেতের মালিক ওটি তৈরি করেছে। যাতে পশুচারকরা ওখানে আসতে উৎসাহ পায়, ওর জমিটাও সার পায়। গত সন্ধ্যায় তীর্থ-পথ ধরে যে ছাগল ভেড়ার পাল এসেছে, তা এই ঘেরা জায়গাতেই ছিল।’

পালের মালিক একটি বলিষ্ঠ পুরুষ। চেহারা দেখলে মনে হয় প্রায় আধ শতাব্দী ধরে ও ব্যবসার মাল নিয়ে তীর্থ-পথে যাওয়া-আসা করছে। আমি যখন এসে পৌঁছলাম তখন ও সবে ঘেরা জায়গায় ঢোকার মুখের কাঁটাঝোপের ঝাঁপটা সরাচ্ছিল। আমার প্রশ্নের জবাবে ও বলল, চিতাটার চিহ্নমাত্রও ও দেখে নি বটে, তবে সবে যখন ভোরের আলো ফুটছে, তখন ওর পালরক্ষী প্রহরী কুকুর দুটো ডেকে ওঠে। কয়েক মিনিট বাদে পথের উপরের জঙ্গলে একটি কাকার হরিণ ডাকে। আমি যখন বুড়ো মালবাহককে জিগ্যেস করলাম, ওর একটা ছাগল আমায় বেচবে কিনা, ও জিগ্যেস করলে কি উদ্দেশ্যে আমি ছাগল চাইছি। যখন বললাম, নরখাদকটার টোপ হিসেবে বেঁধে রাখবার জন্যে, ও বেড়া ছেড়ে বেরিয়ে এল। ঝাঁপ দিয়ে মুখটা বন্ধ করে আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট নিল। পথের ধারে একটা পাথরের ওপর বসল।

কিছুক্ষণ আমরা ধূমপান করলাম। আমার প্রশ্নের কোনো জবাব মিলল না। তারপর ও কথা বলতে শুরু করল। “আপনি নিশ্চয় সেই সাহেব! বদ্রীনাথের কাছে আমার, গ্রাম থেকে নামার সময়ে আমি আপনার কথা শুনেছি। আমার দুঃখ হচ্ছে, মিছেমিছি বাড়িঘর ছেড়ে এত দূরে এতটা পথ এলেন আপনি! এ অঞ্চলের প্রতিটি নরহত্যার জন্য দায়ী ও দুষ্ট আত্মাটা কোনো জানোয়ারই নয়। আপনি ভাবছেন ওটা জানোয়ার। গুলি-গোলা দিয়ে ওটাকে মারা যাবে। অথবা, আপনার আগে অন্যরা ওটাকে মারার যে-সব পন্থা ভেবেছে, আপনিও যা ভাবছেন, সে উপায়ে ওটাকে মারা যাবে। এই দ্বিতীয় সিগারেটটা টানতে-টানতে আমার কথার প্রমাণস্বরূপ আমি আপনাকে একটা গল্প বলছি। গল্পটা আমাকে বলেছিলেন আমার বাবা। সবাই জানে কেউ তাকে কখনো মিছে কথা বলতে শোনে নি।”

 “আমার বাবার তখন জোয়ান বয়স। অমি তখনো জন্মাই নি। এখন যেটা এ অঞ্চলে উপদ্রব করছে, ঠিক এই মত একটা দুষ্টু আত্মা আমাদের গ্রামে হানা দেয়। সবাই বলে, এ একটা চিতা। পুরুষ-ছেলেমেয়ে-বাচ্চা বাড়িতে বাড়িতে নিহত হতে থাকে। জানোয়ারটাকে মারার জন্যে, এখানে যেমন হচ্ছে, ওখানেও সব রকমেই চেষ্টা করা হয়। ফাঁদ পাতা হয়। বহুখ্যাত অব্যর্থ শিকারীরা কাছে বসে চিতাটাকে গুলি-গোলা মারে। ওটাকে মারার এই সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে পরে মানুষ ভীষণ আতঙ্কে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের মাঝামাঝি সময়ে কেউ ঘরের আশ্রয় ছেড়ে বেরোতে সাহত করত না।

“তারপর আমার বাবার গ্রাম, আর আশপাশের গ্রামের প্রধানরা সকলকে পঞ্চায়েতে হাজির হতে হুকুম দেয়। সবাই হাজির হলে পরে তারা সভাকে উদ্দেশ করে বলে, এই নরখাদক চিতার হাত থেকে রেহাই পাবার কোনো নতুন পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। একটি বুড়োর নাতি গত রাতে নিহত হয়। সদ্য-সদ্য সে শ্মশানঘাট থেকে ফিরেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ওর পাশে শুয়ে ওর নাতি ঘুমোচ্ছিল। বাড়িতে ঢুকে কোনো চিতা নাতিকে মারে নি। মেরেছে নিজেদের মধ্যেই কেউ। যখন মানুষের রক্ত-মাংসের লোভ জাগে, তখন সে চিতা রূপ ধরে। যে-সব চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে যে তাকে মারা যাবে না, তার প্রমাণ তো যথেষ্টই মিলল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে একমাত্র মারা যেতে পারে ওকে। বুড়ো বলে, ভাঙা মন্দিরের কাছের কুঁড়েঘরে যে মোটা সাধু থাকে, ওর তাকে সন্দেহ হচ্ছে।

“এ কথায় বেজায় হইহল্লা বেধে যায়। কেউ বলে, নাতি মরার শোকে বুড়ো পাগল হয়ে গিয়েছে। আবার অন্যেরা বুড়োকে সমর্থন করে। এদের পরে মনে পড়ে যখন থেকে নরহত্যা শুরু হয়, সেই সময়েই সাধুটা গ্রামে এসেছে বটে। সকলের আরো মনে পড়ে, একটা মানুষ মারা পড়ার পরদিন সাধুটা বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ে সারা দিন ধরে ঘুমোয়।

“সবাই শান্ত হলে ব্যাপারটা নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক চলে। অবশেষে পঞ্চায়েত স্থির করে, এখনি কিছু করা হবে না। তবে ভবিষ্যতে সাধুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা উচিত হবে। জমায়েতী লোকজনকে তিন দলে ভাগ করা হয়। যে-রাতে এবার নরহত্যা হতে পারে বলে অনুমান, সেই রাত থেকে প্রথম দল লক্ষ রাখতে শুরু করবে। মোটামুটি নিয়মবাঁধা সময় বাদে-বাদেই হত্যাগুলো ঘটছিল।

“প্রথম ও দ্বিতীয় দল যখন পাহারা দেয়, সে-সব রাতে সাধুটা ঘর ছেড়ে বেরোল না।

“আমার বাবা ছিলেন তৃতীয় দলের সঙ্গে। রাতে উনি নিশূপে নিজের জায়গায় দাঁড়ালেন। একটু বাদেই কুঁড়ের দরজা আস্তে খুলে গেল। সাধুটা বেরিয়ে এসে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা বাদে দূরে পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে এক কাঠকয়লা-জ্বালানীওয়ালার কুঁড়েঘরের দিক থেকে রাতের বাতাসে ভেসে নিচে এসে পৌঁছল একটি যন্ত্রণার্ত আর্ত চীৎকার। তারপর সব নিঃশব্দ।

“আমার বাবার দলের কেউ সে-রাতে দু-চোখের পাতা এক করে নি। পূর্ব আকাশে যখন নতুন দিনের আলো দেখা দিচ্ছে, ওরা দেখল সাধু বাড়ির দিকে ছুটছে। সাধুর হাত আর মুখ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।

“সাধু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে পাহারাদাররা এগিয়ে গেল। ঝুলন্ত শিকল চৌকাঠের আংটায় গলিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করল দরজাটা। তারপর প্রত্যেকে গিয়ে নিজের-নিজের খড়ের গাদা থেকে একটা করে বড় খড়ের আঁটি নিয়ে ফিরে এল। সকালে সূর্য যখন উঠল, তখন যেখানে কুঁডেটা ছিল, সেখানে জ্বলন্ত, ধূমন্ত ছাই ছাড়া কিছুই নেই। সেদিন থেকেই নরহত্যাও বন্ধ হল।

 “এ অঞ্চলের বহু সাধুর কারো ওপরই এ পর্যন্ত সন্দেহের নজর পড়ে নি। তবে যখন পড়বে, তখন আমার বাবার সময়ে যে পন্থায় কাজ হয়েছিল, আমার কালেও তাতেই কাজ হবে। সেদিন না-আসা পর্যন্ত গাড়োয়ালের লোকের দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।

“জিজ্ঞেস করছিলেন, আপনাকে একটা ছাগল বেচব কিনা। ছাগল আমি বেচব না সাহেব। বাড়তি ছাগল একটাও নেই আমার। যেটাকে আপনি নরখাদক চিতা ভাবছেন, আমার গল্প শোনার পরও যদি তার টোপের জন্যে কোনো পশু বেঁধে রাখতে চান, আমি আপনাকে একটা ভেড়া ধার দেব। যদি ভেড়াটা মারা পড়ে, আপনি আমাকে তার দাম দিয়ে দেবেন। যদি না পড়ে, তবে আমাতে-আপনাতে কোনো টাকা লেনদেন হবে না। আজকের দিনটা আর রাতটা আমি জিরোব এখানে। কাল ভুটিয়া তারা (শুকতারা) ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে।”

সূর্যাস্তের সম-সম কালে সন্ধ্যায় আমি সেই কাঁটাঝোপ-ঘেরা জায়গায় ফিরে গেলাম। আমার মালবাহী বন্ধু মহানন্দে ওর পাল থেকে একটা মোটা ভেড়া আমায় বেছে নিতে দিল। মনে হল ভেড়াটার ওজন যা, তাতে চিতাটার দু রাতের খোরাকি হয়ে যাবে। প্রায় বার ঘণ্টা আগে যে-পথে চিতাটা গেছে, তার কাছাকাছি ঝোপ-জঙ্গলে আমি ভেড়াটা বেঁধে রাখলাম।

পরদিন সকালে খুব ভোরে উঠলাম। বাংলো থেকে বেরোচ্ছি, আবার দেখি বারান্দা থেকে নরখাদকটা যেখানে নেমেছে, সেখানে তার থাবার ছাপ। গেটে পৌঁছে দেখি গোলাব্রাইয়ের দিক থেকে চিতটা এসেছিল, বাংলোয় দেখা দিয়ে রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দিকে গেছে।

সত্যি কথাটা হল, চিতাটা শিকার হিসাবে মানুষ খুঁজছিল। আমি ওর জন্যে যে ভেড়াটা রেখেছিলাম, তাতে যে কোনো আগ্রহই চিতাটা দেখায় নি, তাতে তাই প্রমাণ করে। আমি ভেড়াটাকে বাঁধার অল্প পরেই চিতাটা ওটাকে মারে। কিন্তু ভেড়াটার এতটুকুও ও খায় নি দেখে আমি অবাক হলাম না।

বুড়ো মালবাহক শিস দিয়ে ওর ছাগল-ভেড়ার পালকে ডাকল। হরিদ্বারে যাবার জন্যে উত্রাই পথে রওনা হল। যাবার কালে ও বলে গেল, “ঘরে ফিরে যাও সাহেব। পয়সা আর সময় বাঁচাও তোমার।”

কয়েক বছর আগে রুদ্রপ্রয়াগের কাছাকাছি অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল। তবে সুখের বিষয়, তার পরিণতি অত শোচনীয় নয়।

আত্মীয়-বন্ধুদের হত্যায় খেপে আগুন হয়ে রাগে খ্যাপাখ্যাপ্ত একদল লোক দশজুলাপট্টির কোঠগি গ্রামের এক হতভাগ্য সাধুকে ধরে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, কোনো মানুষই এই মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী। ফিলিপ মেসন তখন গাড়োয়ালের ডেপুটি কমিশনার। কাছাকাছি তবু ফেলেছিলেন মেসন। সাধুটির ওপর ওরা হিংস্র প্রতিশোধ নেবার আগেই উনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান।

মেসন অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। জনতার মেজাজের মাত্রা দেখে মেসন বললেন, প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়েছে, তাতে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। তবে ন্যায় বিচারের দাবিতে এই বলে যে, জনতা সাধুটিকে হত্যা করার আগে ওর অপরাধ সুপ্রমাণিত হ’ক। তাই তিনি প্রস্তাব করেন, সাধুটিকে গ্রেপ্তার করা হক, রাত-দিন কড়া পাহারায় থাকুক ও। এ প্রস্তাবে জনতা রাজী হয়। সাতদিন, সাত-রাত সাধুটিকে পুলিস সযত্নে পাহারা দেয়, জনতাও সমান মনোযোগে নজর রাখতে থাকে। আটদিনের দিন সকালে, যখন পাহারা আর নজরদার বদল হচ্ছে খবর আসে, কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে আগের রাতে এক বাড়িতে হানা পড়েছে এবং একটি লোককে নিয়ে গেছে।

সেদিন সাধুটিকে ছেড়ে দেওয়াতে জনতা কোনো আপত্তি করে নি। এবার না হয় ভুল লোককে ধরা হয়েছিল, পরের বার আর কোনো ভুল হবে না–এই বলে তারা নিজেদের মনকে বোঝায়।

গাড়োয়ালে নরখাদকদের সকল নরহত্যার জন্যই সাধুদের দোষী করা হয়। নৈনিতাল ও আলমোড়া জেলায় অনুরূপ প্রতি মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় বোখসারদের। পাহাড়ের পায়ের কাছে, অস্বাস্থ্যকর তৃণভূমি তরাইয়ে থাকে বোখসারেরা। ওদের জীবনধারণের প্রধান উপায় শিকার।

লোকবিশ্বাস, সাধুরা মানুষ মারে রক্ত-মাংসের লোভে। বোখসাররা মারে, যাকে মারছে তার গায়ের গহনা বা অন্য দামী জিনিসের লোভে। নৈনিতাল ও আলমোড়া জেলায় পুরুষের চেয়ে মেয়েরাই নরখাদকের হাতে মারা পড়েছে বেশি। যে কারণ এখনি দেখানো হল, তার চেয়ে ভাল কারণ অবশ্যই তার পিছনে আছে।

কল্পনাবিলাসী নই আমি, কেননা বড় দীর্ঘকাল আমি নীরব-নিভৃত সব জায়গায় থেকেছি। তবুও, শুধু বসে-বসে রুদ্রপ্রয়াগে রাতের পর রাত কাটিয়েছি, একবার তো একটানা আটাশ দিন কেটেছিল। সেতু অথবা তেরাস্তা-চৌরাস্তার মুখ অথবা গ্রামে ঢোকার পথ অথবা পশু বা মানুষ-মড়ির ওপর নজর রেখেছি বসে-বসে। তখন আমিও কল্পনায় ভাবতাম নরখাদকটার শরীরটা চিতার, মাথাটা পিশাচের। যখন প্রথমবার ওকে দেখি, দেখেছিলাম নরখাদকটা অতিকায়, গায়ের রং হাল্কা।

ও একটা পিশাচ। রাতের দীর্ঘ প্রহর ধরে আমার ওপর নজর রাখে। নজর রাখতে রাখতে, ওর ওপর টেক্কা মারার জন্য আমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে ও নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসিতে কাপে, মাটিতে গড়ায়। কখন মুহূর্তের জন্য আমি অসতর্ক হব, আমার গলায় দাঁত বসাবার প্রত্যাশিত সুযোগ ও পাবে, সেই সময়ের প্রত্যাশায় ও ঠোঁট চাটে।

.

রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক যখন গাড়োয়ালের অধিবাসীদের সন্ত্রস্ত করে বেড়াচ্ছে, তখন অত বছর ধরে সরকার কি করছিল সে প্রশ্ন করা যেতে পারে। সরকারের ধামা ধরছি না আমি। তবে ও অঞ্চলে দশ সপ্তাহ কাটাবার পর আমি জোর দিয়ে বলব অঞ্চলটি এ-সন্ত্রাস মুক্ত করার জন্য সাধ্যায়ত্ত সবকিছুই করেছে সরকার। ওই সময়কালের মধ্যে আমি বহু শত মাইল হেঁটেছি, উপত অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ গ্রামে গেছি।

পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, সে পুরস্কার হল দশ হাজার নগদ টাকা এবং দুটি গ্রাম। গাড়োয়ালের চার হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুকধারীর প্রত্যেককে নরখাদকটির সম্ভাব্য হত্যাকারী করে তোলার পক্ষে এ পুরস্কার উদ্যম যোগাতে যথেষ্ট। প্রচুর মাইনের বাছাই করা শিকারীদের নিয়োগ করা হয়। চেষ্টা সফল হলে তাদের বিশেষ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। চার হাজার বন্দুক তো ছিলই, তার ওপর তিনশোরও বেশি বিশেষ লাইসেন্স দেওয়া হয়।

ল্যান্সডাউনে গাড়োয়াল রেজিমেন্টের যে সৈন্যরা মোতায়েন ছিল, ছুটিতে বাড়ি। যাওয়ার সময়ে সঙ্গে নিজের রাইফেল নিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় তাদের। নইলে অফিসাররা সিপাহীদের শিকার-বন্দুক দেয়। প্রেসের মাধ্যমে, চিতাটিকে মারতে সহায়তা করার জন্য ভারতের সর্বত্র শিকারীদের কাছে আবেদন জানানো হয়। ঝপাং করে দরজা পড়ে যায়, এমনি অসংখ্য ফাঁদের ভিতর ছাগলের টোপ বেঁধে রেখে গ্রামে ঢোকার পথে, যে পথে নরখাদকটি বেশি চলে ফেরে সে-সব পথে ফঁদগুলি পেতে রাখা হয়। মানুষের মড়িতে বিষ মাখিয়ে রাখার জন্য পাটোয়ারী ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের বিষ সরবরাহ করা হয়। সরকারী কর্মচারীরা, প্রায়ই ভীষণ বিপদের ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়ে সরকারী কাজের বাইরে যতটুকু সময় পায়, সব সময়টা নরখাদকটার অনুসরণে ফেরে। এ কথা শেষে বললাম, কিন্তু কথাটি তুচ্ছ করার নয়।

এই সব নানা রকম এবং সংযুক্ত প্রচেষ্টার মোট পরিণতি দাঁড়ায়–একটা সামান্য বন্দুকের গুলির চোট। এর ফলে চিতাটার পিছনে বাঁ-পায়ের থাবায় ভাঁজ পড়ে, একটা আঙুলের সামান্য চামড়া উড়ে যায়। আর গাড়োয়ালের ডেপুটি কমিশনারের সরকারী নথিতে লেখা হয়, বিষক্রিয়ায় কোনো কষ্ট পাওয়া দূরে থাকুক, মানুষের মড়ি থেকে বিষ খেয়ে চিতাটা দিব্যি ভালো থাকছে, শরীরে শক্তিও পাচ্ছে।

তিনটে চমকপ্রদ ঘটনা একটি সরকারী বিবরণীতে নথিভুক্ত আছে। আমি সেগুলো সংক্ষেপে বলছি–

প্রথম : প্রেসের মাধ্যমে শিকারীদের আবেদন জানানোর ফলে ১৯২১ সালে দুই তরুণ ব্রিটিশ অফিসার রুদ্রপ্রয়াগে হাজির হয়। তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, নরখাদকটিকে মারবে। রুদ্রপ্রয়াগের ঝোলা-পুল দিয়ে চিতাটা অলকানন্দা নদীর এপার থেকে ওপারে যায়, ওদের এ কথা ভাবার কারণ কি, আমি জানি না। যাই হক, ওরা ঠিক করে এই পুলের ওপরই ওদের সকল প্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ রাখবে। রাতে যখন চিতাটা পুল পেরোবে, তখন ওকে মারবে। ঝুলন্ত তারের ভার ধরে রাখবার জন্য পুলটির দুদিকে দুটি টাওয়ার আছে। একটি তরুণ শিকারী নদীর বাঁ-দিকের টাওয়ারে বসে। ওর সঙ্গী বসে ডানদিকের টাওয়ারে।

দু’মাস টাওয়ারে বসে কাটাবার পর বাঁ-দিকের টাওয়ারে বসা শিকারীটি একদিন দেখে ঠিক ওর তলার খিলানের নিচ থেকে বেরিয়ে চিতাটি পুলে উঠল। পুলের বেশ খানিকটা অবধি চিতাটা যাওয়া অবধি অপেক্ষা করে ও গুলি ছোঁড়ে। চিতাটা যেমন ছুটে পুল পেরোয়, ডানদিকের টাওয়ার থেকে শিকারীটি ছ’ঘরা রিভলভারের সবকটি গুলি ছোঁড়ে চিতাটির দিকে। পরদিন সকালে পুলের উপর, যে পাহাড় বেয়ে চিতাটি উঠে গেছে, তাতে রক্ত দেখা যায়। সেহেতু মনে করা হয়, জখম, অথবা জখমগুলি প্রাণাস্তিক, বহুদিন ধরে তল্লাসী চলতে থাকে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জখম হবার পর ছমাস চিতাটি কোনো মানুষ মারে নি।

যারা সাতটি গুলির আওয়াজ শুনেছিল, জখম জানোয়ারটিকে খুঁজে বের করার কাজে সহায়তা করেছিল, তারাই আমাকে ঘটনাটির কথা বলে। আমাকে যারা বলে, তারা ঐ দুজন শিকারী, সবাই ভেবেছিল প্রথম গুলিটা চিতাটার পিঠে লাগে, হয়তো পরের গুলিগুলোর কয়েকটা ওর মাথায় লাগে। সেই জন্যেই দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে তল্লাসী চালানো হয়।

রক্তচিহ্নের বিশদ বর্ণনা শুনে আমার মনে হয় চিতাটার শরীরে ও মাথায় জখম করেছে, শিকারীদের এ ধারণা ভুল। রক্তচিহ্নের বর্ণনা আমি যেমনটি শুনি, তা একমাত্র পায়ে জখম হলেই সম্ভব। আমার অনুমান যে নির্ভুল পরে তা দেখে আমি খুবই সন্তুষ্ট হই। দেখি, বাঁ-দিকের টাওয়ারের শিকারীটির গুলির ফলে চিতাটার পিছনের বাঁ পায়ের থাবা কুঁচকে ভাঁজ পড়েছে মাত্র। গুলিতে একটা আঙুলের একাংশ শুধু উড়ে গেছে। ডান দিকের শিকারীটির সব গুলিই লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে।

দ্বিতীয়: ঝাঁপফেলা ফাঁদে বন্দী হয়ে প্রায় কুড়িটি চিতা মারা পড়ে। তারপর একটি চিতা একটা ফাঁদে ধরা পড়ে। সকলে ধরে নেয় ওটাই নরখাদক চিতা। হিন্দুরা ওটাকে মারতে চায় নি। ওদের ভয়, নরখাদক যাদের মেরেছে, তাদের আত্মা ওদের যন্ত্রণা দেবে। তাই এক ভারতীয় ক্রীশ্চানকে ডেকে পাঠানো হয়। ক্রীশ্চানটি থাকত প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে এক গ্রামে। সে ঘটনাস্থলে পৌঁছুবার আগেই চিতাটি ফাঁদ থেকে পালায়, ফাঁদ ছিঁড়ে-খুঁড়ে।

তৃতীয়: একটি মানুষকে মেরে মড়ি নিয়ে চিতাটি একটা ছোট নির্জন জঙ্গলে বসে থাকে। পরদিন সকালে, যখন নিহত ব্যক্তির তল্লাসী চলছে, দেখা যায় চিতাটি জঙ্গল ছেড়ে বেরোল। সামান্য তাড়া খাবার পর দেখা যায় ও একটা গুহায় ঢুকল। তখনি গুহার মুখ কাঁটাঝোপে বন্ধ করে বড় বড় পাথর এনে মুখে জমা করা হয়। প্রত্যেকদিন লোকজন জায়গাটা দেখতে যেতে থাকে। দিনে-দিনে ভিড়ও বাড়ে। পাঁচ দিনের দিন, প্রায় পাঁচশো লোক জমা হবার পর এক ভদ্রলোক আসেন। তাঁর নাম করা হয় নি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।” বিবৃতির ভাষায় বলতে গেলে, “তিনি ত্যাচ্ছিল্যে বলেন, গুহায় কোনো চিতা নেই। গুহামুখ থেকে তিনি কাঁটাঝোপ সরিয়ে দেন। যেই কাঁটাঝোপ তুলে ফেলেন, অমনি চিতাটা হঠাৎ গুহা থেকে ধেয়ে বেরিয়ে আসে। ওখানে যে পাঁচশো নোক জমায়েত হয়েছিল, তাদের ভিতর দিয়ে অবহেলায় পালিয়ে যায়।”

চিতাটি নরখাদক হবার অব্যবহিত পরেই এই ঘটনাগুলো ঘটে। চিতাটা যদি পুলে মারা পড়ত, ফাঁদের ভিতর গুলিতে মরত, গুহাতে চিরবন্দী থাকত, তাহলে বহু শত লোক মারা পড়ত না। বহু বছরব্যাপী দুর্ভোগের হাত থেকে গাড়োয়াল রেহাই পেত।

.

৪. রুদ্রপ্রয়াগে এলাম

১৯২৫ সালে নৈনিতালের শালে থিয়েটারে গিলবার্ট সালিভানের ‘দি ইয়েমেন অক্ দি গার্ড’ ছবিটার এক বিরতির সময় রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদকটা সম্বন্ধে আমি সর্বপ্রথম সঠিক খবর পাই।

মাঝে মাঝে শুনতাম যে গাড়োয়ালে একটা নরখাদক চিতা আছে এবং কাগজেও সেটার সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়েছিলাম। কিন্তু জানতাম গাড়োয়ালে চার হাজারের ওপর লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুকধারী আছে, তাছাড়া রুদ্রপ্রয়াগের মাত্র ৭০ মাইল দূরে ল্যান্সডাউনে রয়েছে বহুসংখ্যক উৎসাহী শিকারী। কাজেই অনুমান করতাম যে চিতাটা মারবার উৎসাহে এ-ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় নবাগত একজনকে কেউ পছন্দ করবে না।

কাজেই সে রাতে শালের বার’-এ এক বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু গলা ভিজিয়ে নেবার সময় আমি খুব বিস্মিত হয়েই শুনলাম তখনকার যুক্তপ্রদেশ সরকারের চীফ সেক্রেটারি এবং পরে আসামের গভর্নর মাইকেল কীন কয়েকজনকে নরখাদকটা সম্বন্ধে বলছেন ও ওটাকে মারার চেষ্টা করতে তাদের পেড়াপীড়ি করছেন। তার আবেদনে যে কোনো উৎসাহ জাগল না, তা ঐ দলের একজনের মন্তব্য ও আরেকজনের সমর্থন থেকেই বুঝলাম। মন্তব্যটা হল, “শতখানেক মানুষ মেরেছে এরকম মানুষখেকোর পিছনে যাওয়া? প্রাণ থাকতে নয়!”

পরদিন সকালে মাইকেল কীনের সঙ্গে দেখা করে যা-যা জানবার জানলাম। নরখাদকটা ঠিক কোন্ অঞ্চলে উপদ্রব করছে তা তিনি বলতে পারলেন না, তবে আমাকে রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে ইবটসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। বাড়ি ফিরে দেখি আমার টেবিলে ইবটসনের একটা চিঠি।

 ইবটসন–এখন স্যার উইলিয়াম ইবটসন, এবং যুক্তপ্রদেশের গভর্নরের ভূতপূর্ব উপদেষ্টা–খুব সম্প্রতি গাড়োয়ালের ডেপুটি কমিশনার হয়ে এসেছে, এবং তার অন্যতম প্রধান কাজ হয়েছে গাড়োয়াল জেলাকে নরখাদকটার উৎপাত থেকে মুক্ত করা। এই প্রসঙ্গে সে আমার কাছে চিঠিটা লিখেছে।

যাবার বন্দোবস্ত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। রাণীখেত, আদবদ্রী ও কর্ণপ্রয়াগ হয়ে দশ দিনের দিন সন্ধ্যায় একটা রোড ইনসপেকশন বাংলোয় পোঁছলাম আমি। এ বাংলোয় থাকতে হলে যে অনুমতি নিতে হয়, তা রওনা হবার সময় আমি পেতাম না। চৌকিদারের উপর হুকুম ছিল, অনুমতিপত্র না থাকলে কাউকে থাকবে দিবে না। যারা আমার মাল বইছিল, সেই ছ’জন গাড়োয়ালী, আমার চাকর এবং আমি রুদ্রপ্রয়াগের পথে আরো দু’ মাইল হেঁটে হয়রান হলাম। তারপর রাতের আস্তানার উপযোগী জায়গা পেলাম একটা।

গাড়োয়ালীরা জল ও জ্বালানী-কাঠ যোগাড়ে লেগে গেল। রাঁধবার উনোন তৈরি করার জন্য আমার ভৃত্য পাথর আনতে লাগল। একটা কুড়োল তুলে নিয়ে আমি গেলাম কাঁটাঝোপ কাটতে। কাঁটাঝোপ দিয়ে জায়গাটা ঘেরাও করে রাতে নিজেদের। রক্ষা করতে হবে। পথে আসতে দশ মাইল আগেই আমাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে, যে আমরা নরখাদকের রাজ্য সীমান্তে ঢুকে পড়েছি।

সান্ধ্য আহার রাঁধবার জুন্যে সবে, উনোন ধরানো হয়েছে! একটু বাদেই দূরে, পাহাড়ের উপরের এক গ্রাম থেকে আসা, একটা, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল আমার কাছে। জিগ্যেস করল, ওই খোলা প্রান্তরে কি করছি আমরা? সাবধান করে দিল, যেখানে আছি, সেখানেই থেকে যাই যদি, তবে আমাদের মধ্যে এক, কিংবা একাধিক জন অবশ্যই নরখাদকের হাতে মারা পড়ব।

পরোপকারী লোকটি সারধান করে দিল। কিন্তু তখন তো অন্ধকার। লোকটি সম্ভবত প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাছে এসে সতর্ক করে। মাধো সিংয়ের*[*”কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ” বই-এর “চৌগড়ের বাঘ” দেখুন।] সঙ্গে আপনাদের অন্যত্র পরিচয় হয়েছে। সে সকলের হয়ে বলল, “আমরা এখানেই থাকব সাহেব। লণ্ঠনে যথেষ্ট তো আছে, সারা রাত জ্বলবে। আর-আপনার রাইফেল তো, আছেই।”

সারা রাত জ্বলবার মত যথেষ্ট তেল লণ্ঠনে ছিল। কেননা সকালে যখন জাগি, তখনও ওটা জ্বলছে। আমার গুলি-ভরা রাইফেল, বিছানায় পড়ে আছে। তবে আঁটাঝোপের ঘেরাওটা নেহাত পলকা। দশ দিন পথ চলে আমরাও হত-ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে রাতে চিতাটা যদি সমোলাাত করতে আসত, অতি সহজে ও একটা শিকার পেতে পারত। পরদিন আমরা রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছলাম। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে ইটসন যাদের, পাঠিয়েছিল, তাদের ঝছে সাদর অভ্যর্থনা পেলাম।