১. সেন্ট জন্স নদীর ধারে

হ্যাভ এ নাইস-নাইট

০১.

জ্যাকসনভিলের সেন্ট জন্স নদীর ধারে স্বল্পালোলাকিত একটা ঘিঞ্জী বারে দুজন লোক একটা টেবিলে বসে খুব নীচু স্বরে কথা বলছিল। মোটামতন বারম্যান ছাড়া আশেপাশে কেউ ছিল না।

ডানদিকে বসা লোকটার নাম এড হ্যাডন–শিল্পদ্রব্য চোরাকারবারীদের রাজা। লোকটা একজন প্রথম শ্রেণীর পরিকল্পনাকারী। হাবেভাবে চলা ফেরায় যেন এক অবসরপ্রাপ্তধনীব্যবসায়ী। ভদ্রলোকের মতন নিয়মিত ট্যাক্স দেয়। আজ প্যারিসের ফ্ল্যাটে থাকছে তো কাল থাকছে লন্ডনে কিংবা দক্ষিণ ফ্রান্সের কোন অভিজাত এলাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে। তার নেতৃত্বে অত্যন্ত সুসংহত ভাবে কাজ করে চলেছে চোরদের একটা বিরাট দল। প্রতিটি চুরির পিছনেই কাণ্ড করছে তার চমৎকার পরিকল্পনা। আর প্রত্যেকটা কাজ থেকেই সে লুটছে বিরাট-মুনাফা।

হ্যাডনকে দেখে কোন সেনেটর বা সেক্রেটারী অফ স্টেটস্ ভাবাটা ভুল নয়। লম্বা শক্ত সমর্থ চেহারা। মাথা ভর্তি ধূসর রঙের চুল। সুন্দর মুখে সবসময়েই একটা বিনয়ী হাসি লেগে রয়েছে। তার এই আপাত সুন্দর চেহারার পেছনে রয়েছে অত্যন্ত ক্ষুরধারসম্পন্ন এবং ধূর্ত এক মাথা। তার ডানদিকের পাশে বসা লোকটির নাম লু ব্রাডে। অন্ধকার জগতে তার নাম এক নম্বর শিল্প-চোর হিসেবে। পঁয়ত্রিশ বছরের ছিপছিপে চেহারা। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। পিঙ্গ ল বর্ণের চঞ্চল চোখ দুটি। যে কোন ধরনের তালা খোলার দক্ষতা ছাড়াও তার আর একটা গুণ রয়েছে। সে হচ্ছে ছদ্মবেশ ধারণ করা। তার মুখের চামড়া রবারের মতন। মুখের ভেতরে কয়েকটা প্যাড ঢোকালেই তার চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। নিজেই সে পরচুলা বানিয়ে নেয়। গোঁফ লাগালে মনেই হয় না সেটা আসল না নকল। প্যাড লাগানো জামাকাপড় পরলে তাকে মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা তোক মনে হয়। তার ছদ্মবেশ ধারণ করার এই অপূর্ব দক্ষতার জন্য আজ পর্যন্ত তার নাম পুলিশ রেকর্ডে নেই। যদিও পুলিশ তাকে ধরবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে।

এই দুটি লোক একসঙ্গে অনেক অন্ধকার জগতের কাজ করেছে এবং এই মুহূর্তে তারা তাদের ঠিক আগের কাজটার সমালোচনা করছে। কাজটা ছিল ওয়াশিংটন মিউজিয়াম থেকে ক্যাথারিন দি গ্রেটের আইকম চুরি করা। সামান্য কিছু ভুলের জন্য তারা কাজটায় ব্যর্থ হয়েছিল।

হ্যাডন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আমার অনেক টাকার লোকসান হয়ে গেছে ঐ কাজটায়, লু। অবশ্য সে জন্য আমি কেয়ার করি না। একবার হার তো পরের বার জিত তো আছেই। তখন লোকসানটা পুষিয়ে নিলেই হল। ঠিক বলছি কিনা?

ব্রাডে মাথা নাড়ল।তোমার মাথায় কোন ফন্দি এসেছে বলে মনে হচ্ছে?

আমি একদম বাধ্য না হলে চুপচাপ বসে থাকিনা। এবারের কাজটা বিরাট। অবশ্য তার জন্য ঠিকমতন প্রস্তুতি নেওয়াদরকার।আমাদের প্রথমকাজ একটাভাল দল তৈরীকরা এইকাজটার জন্য। সেই তালিকার প্রথমেই তোমার নাম আছে। আগামী তিন সপ্তাহের জন্যে তুমি কি খালি আছ?

ব্রাডে ধূর্তের হাসি হেসে বলল, তুমি যখনই আমাকে চাইবে তখনই পাবে, এড।

হা। মাথা নাড়ল এড হ্যাডন। তা ঠিক। কারণ, তুমি জান যে আমি যখন কোন কাজ নিই, তা হল প্রচুর অর্থে থাবা বসান। আমি যখন আইকম চুরির পরিকল্পনা করেছিলাম–সেই সময় আমি প্যারাডাইজ সিটির বে হোটেলেছিলাম। প্রচুর খরচা হয়েছিল অবশ্য। এখন এই হোটেলটার একটা বিশেষত্ব আছে। এটা বলতে গেলে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দামী ডিলুক্স হোটেল। শুধুমাত্র অপরিমেয় অর্থের মালিকরাই এই হোটেলে থাকতে পারে। আর সত্যি কথা বলতে কি সেরকম অর্থবান লোক অনেক আছে বলে এই হোটেলটায় সবসময়েই ভীড় লেগে থাকে।

ব্রাডে ভ্রূ কুঁচকিয়ে বলল, তুমি ওখানে ছিলে?

–নিশ্চয়। আমি বড়লোকদের সাথে ওঠানামা করি আর সেইখান থেকেই আমার পরিকল্পনা গড়ে ওঠে। খরচা হয় বটে। তবে তার দাম উঠে আসে। এই হোটেলটা থেকেও আমি একটা মগজের ধোরাক পেয়েছি। হ্যাডন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছাইটা ঝেড়ে আবার বলল, জন ডুল্যাক নামে এক ফরাসী ভদ্রলোক ঐ হোটেলটার মালিক। লোকটা জানে ব্যবসা করতে। তাকে দেখতে সুন্দর, সম্ভ্রান্ত এবং খদ্দেররাও তাকে পছন্দ করে। সে বেছে বেছে কর্মচারী রাখে এবং সেরা জিনিস পছন্দ করে। আমি হোটেলে কোন স্যুট জোগাড় করতে না পেরে একতলায় কিছু দুকামরার ঘর রয়েছে, সেখানে ছিলাম। অবশ্য সেগুলোও ডিলুক্স।আমি সারা হোটেলটায়মানে লাউঞ্জে, তিনট রেস্তোরাঁয় আর সুইমিং পুলে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেয়েছিলাম।তারপর একটু থেমে হ্যাডন ব্রাডেকে লক্ষ করে গম্ভীরভাবে বলল, সত্যিই হোটেলটা ভয়ানক ধরণের পয়সাওলা লোকে ঠাসা।

ব্রাডে মন দিয়ে সব শুনছিল।

তোমার আর বলার দরকার হবেনা, পুরুষরা যখন ধনী হয় তখন তাদের স্ত্রীরা একে অন্যের সঙ্গে দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এই প্রতিযোগীতায় দামী জামাকাপড় ছাড়াও থাকে অলংকারের প্রদর্শন। এইসব নির্বোধ মেয়েমানুষগুলো যারা নিজেদের জীবনে এক ডলারও রোজগার করেনি তারাই তাদের স্বামীর কাছে লক্ষ লক্ষ ডলারের গয়না দাবী করে এবং পেয়েও থাকে। হোটেলের সবচাইতে দামী রেস্টুরেন্টে ডিনারের সময়টা একটা দেখার মতম দৃশ্য। মেয়েরা হীরে, মণি, মুক্তো দিয়ে নিজেদের মুড়ে ডিনার খেতে আসে। আমি জীবনে একটা ঘরের মধ্যে অত মণি মুক্তোর সমারোহ আর দেখিনি। এক এক জন মহিলা প্রায় ষাট, সত্তর লক্ষ ডলারের গয়না পরে আসে।

ব্রাডে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অতীব চমৎকার। তারপর?

হ্যাডন সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, তাই আমার মনে হয়েছে হোটেলে যদি একটা দাও বসাতে পারি, তাহলে লাভের অঙ্কটা বিরাট হয়।

যাট লক্ষ ডলার? ব্রাডে প্রশ্ন করল।

আরও বেশী হতে পারে, তবু ষাটই বলা ভাল।

ব্যাপারটা আকর্ষণীয়।তারপর মাথা চুলকে বলল, কিন্তু হোটেলে কিভাবেদাও মারবে,এড। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবে?

খুব স্বাভাবিক, চট করে তুমি বুঝতে পারবে না, লু। কারণ, তুমি স্মার্ট চালাক চতুর ঠিকই। কিন্তু মগজটা আমার। তুমি কাজ কর আর বুদ্ধি যোগাই আমি। তাই তো তোমার আমার জোটটা এত ভাল।

বেশ কাজের কথায় এস। ষাট যদি হয়, তবে আমার ভাগে কত আসবে?

কুড়ি। অন্যান্য খরচা সব আমার। ঠিক আছে?

বেশ। কিন্তু মালগুলো যখন সরাব, সেগুলো কে সামলাবে?

বিরাট হৈ চৈ হবে ঠিকই। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ শুরু হয়ে যাবে। তাই ভাবছি ঠিক তক্ষুণি মালগুলো শহরে থেকে না সরিয়ে কেনড্রিকের কাছে জমা রাখব। কেনড্রিক আমাদের একনম্বরের বিশ্বাসী লোক। দেখি ওর সাথে কথা বলি।

ব্রাডে মুখ কুঁচকিয়ে বলল ঐ মোটা লোকটাকে আমি ঘেন্না করি।

ওসবে কিছু যায় আসে না।

বেশ! কিন্তু কাজটা করবে কী ভাবে? প্ল্যানটা বল।

হ্যাডন বারম্যানকে আরও দুপেগ মদ দিয়ে যাবার জন্য বলল। বারম্যান চলে যাবার পরে সে বলল, লু, তবে শোন–ঐ হোটেলের সিকিউরিটিটা দারুণ। প্রত্যেক হোটেল বাসিন্দাকে একটা স্ক্যামলারতালাওলা বাক্স দেওয়া হয়। রাতে বোর্ডাররা তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র এবং অলংকার ঐ বাক্সে রেখে দেয়। স্ক্যামলার তালার নম্বর শুধুমাত্র ঐ বোর্ডারই জানে। এরপর দুজন সিকিউরিটি গার্ড এসে সব বাক্স জড়ো করে হোেটলের সিন্দুকে নিয়ে রাখে। বুঝতে পারছ?

মাথা নাড়ল ব্রাডে। স্ক্যামলার তালা? ই, হেসে বলল, আমার কাছে ওসব জলভাত।

সুতরাং, বুঝতে পারছ ঐসব ধনী অলস লোকগুলো যখন শুতে যায়, হোটেলের সিন্দুক ভর্তি থাকে অমূল্য সম্পদে।

হোটেলের সিন্দুকটা কিরকম দেখতে? কোথায় রাখা আছে?

–সেটা দেখে নিতে হবে।

–ঠিক আছে, এখন সিকিউরিটির ব্যবস্থাটা বল।

হোটেলে দুজন ডিটেকটিভ আছে। তারা পালা করে হোটেলের তদারকি করে।এবং দেখে মনে হয় যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। রাত নটার সময় অস্ত্রধারী দুজন সিকিউরিটি গার্ড আসে এবং তারা রাত দুটো পর্যন্ত পাহারা দেয়। দুজনেই যুবক এবং শক্ত ধরনের। হোটেলের কলরব স্তব্ধ হয়ে আসে রাত প্রায় তিনটের সময়। কিন্তু কখনও কখনও রাত চারটেয় বোর্ডার আসে। আমার মনে হয় সিন্দুক খোলার আদর্শ সময় হবে রাত তিনটের সময়। আমি এখন আর বিশদভাবে কিছু বলতে পারব না। বাকিটুকু তোমায় দেখে এবং বুঝে নিতে হবে।

-তার মানে আমাকে হোটেলে থাকতে হবে?

এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আমি তোমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই একজন ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে ঐ হোটেলের এক তলার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। মোটা টাকাও জমা দিয়েছি। তুমি আগামী সপ্তায় কর্নেলিয়াম ভান্স নাম নিয়ে ঐ হোটেলে গিয়ে উঠবে। তুমি যে ধনী তার প্রমাণ স্বরূপ একটা রোলস রয়েলসের ব্যবস্থা করেছি। তুমি ছদ্মবেশ নেবে একজন ধনীবৃদ্ধ অশক্ত লোকের যে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে। সঙ্গে থাকবে একজন পুরুষ নার্স। কারোর সাথে মেলামেশা করবেনা এবং হোটেল কতৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে তুমি একান্তে থাকতে চাও। তোমার হোটেল বাবদ আমার খরচ খরচা পড়বে পনের হাজার ডলার। ঘরের ভাড়াই দিনে আটশো ডলার। মদ খেতে পারবে না। সাধারণ খাবার খাবে। না হলে বিল আকাশ ছোঁয়া হবে। কি রাজী?

ব্রাডে মাথা নাড়ল।

-তোমার কাজটা হবে সিন্দুকটা খুঁজে বার করে খোলা। তোমার একজন সাহায্যকারী থাকবে যে রোলসটা চালাবে আর লোকজনদের সাথে মিলে মিশে খবর জোগাড় করবে। সেও তোমায় সাহায্য করবে সিন্দুকটা খুঁজে বার করতে এবং অপারেশনের সময় বাক্সগুলো সরাতে এই হচ্ছে মোটামুটি প্ল্যান। এবার বাকিটা তুমি ঠিক করে নেবে।

–তুমি বলছ যে রাতে একজন ডিটেকটিভ পাহারাতে থাকে?

–হ্যাঁ।

দুজন অস্ত্রসমেত প্রহরীও থাকে?

–ওদের নিয়ে তুমি চিন্তা কোর না। কারণ, আমি জানি যে প্রথমেই এই ডিটেকটিভ আর প্রহরী দুজনের ব্যবস্থা করা দরকার। সে ব্যবস্থাও আমি করেছি।

–তাই যদি করে থাক, তাহলে ভাল। এবার পুরুষ নার্সের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। এসব ব্যাপারে একজন সুন্দরী যুবতী নার্স বেশী কাজে লাগবে–হোটেলের যত্রতত্র সে ঘুরে বেড়াতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় খবরও জোগাড় করতে পারবে।

–তুমি তোমার গার্লফ্রেণ্ডের কথা নিশ্চয়ই বলছ। সে তুমি ঠিক কর। তুমি পাবে মোট কুড়ি। তার থেকে যদি ভাগ দিতে চাও দেবে।

কিন্তু ঐ ডিটেকটিভ আর গার্ড দুজনের ব্যবস্থা কি ভাবে করছ?

হ্যাডন বলল, ঘুম পাড়ানী গুলি দিয়ে। এই দ্যাখ, বলে হ্যাডন তার পায়ের কাছে রাখা ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে তার থেকে একটা এয়ার পিস্তলের মতন যন্ত্র বার করল–দ্যাখ, এতে ছটা গুলি ভরা আছে। তোমাকে শুধু লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টিপতে হবে। ছঘন্টার মতন লোকটা ঘুমিয়ে থাকবে।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, ব্রাডে বলল। হ্যাডন হাসল। দেখতেই পাবে, তুমি তো পিস্তল চালাতে পার।

–না, আমি ওসব মোটে পছন্দ করি না।

–তাহলে অভ্রান্ত টিপ আছে এরকম একজন লোক আমাকে জোগাড় করতে হবে। সেই লোকই তোমার গাড়ি চালাবে, গার্ডগুলোর ব্যবস্থা করবে আর বাক্স সরাবার সময় তোমায় সাহায্য করবে। এবার পিস্তলের ব্যাপারটা আমি তোমায় দেখাব।

হ্যাডন বারম্যানকে ডাকল,বারম্যান এসে বিলের টাকাপয়সা নিয়ে পেছন ফিরতেই, হ্যাডন পিস্তলটা তুলে ট্রিগার টিপল। অস্পষ্ট ববকরে একটা শব্দ হল। বারম্যান দুহাতে তার ঘাড় চেপে হ্যাডনের দিকে বহু কষ্টে একবার তাকাবার চেষ্টা করল।হ্যাউন কিন্তু তখন তার ব্রিফকেস গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে বারম্যানটির হাঁটু দুটো মুড়ে এল এবং সে আস্তে আস্তে মেঝের উপর এলিয়ে পড়ল।

-দেখলে? বিশ্বাস হল? কত তাড়াতাড়ি কাজ করে দেখলে?

চোখ বড় বড় করে ব্রাডে অচৈতন্য বারম্যানটির দিকে তাকিয়ে রইল।

চোদ্দ বছর বয়েস থেকেই ম্যাগী শ্লজ পুরুষদের কাছে এক আতংকস্বরূপ হয়ে উঠেছিল। এখন তেইশ বছর বয়সে সে পুরুষদের কাছে নিউট্রন বোমার মতই ভয়ংকর। সত্যিই সব দিক থেকে সে অপূর্ব সুন্দরী। পর্ণমুভি ব্যবসায়ীরা তাকে ব্যবহার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। বেশ্যাগিরিতে সে ধাপে ধাপে উপরে উঠে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে সে এখন তার মনের মানুষকে নিজেই বেছে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার সঙ্গে লুব্রাডের দেখা এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম।

ব্রাডে মনস্থির করে নিয়েছে যে ম্যাগীকে সে চোখের জলে পটিয়ে নেবে। ম্যাগীর চেয়ে লাস্যময়ী নার্সের কথা সে চিন্তাই করতে পারে না।

*

 ব্রাডের সাড়া পেয়ে দরজা খুলে দিল ম্যাগী। আর প্রায় বাঘিনীর মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্রাডের ওপর।

আধঘণ্টা পরে বিধ্বস্ত ব্রাডে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল ম্যাগীর অসাধারণ ক্ষমতার কথা।

একটু ড্রিংক করলে কেমন হয়, ডার্লিং? ব্রাডে বলল।

নিশ্চয়। ম্যাগী বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল। ব্রাডে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করল ম্যাগীকে তার চলাফেরা সবকিছু। নাহ ম্যাগীই এই কাজে আদর্শ হবে।

ম্যাগী ফিরে আসলে ব্রাডে বলল, প্যারাডাইস সিটিতে সপ্তাহ খানেক কাটালে কেমন হয়?

ম্যাগী চোখ বড় বড় করে বলল, যেখানে সব কোটিপতিরা বাস করে?

–হ্যাঁ।

–তুমি যেতে চাও?

যাব না মানে? ওখানে কী দামী দামী হোটেল সমুদ্রতীরে- এসবের লোভ ছাড়া যায়?

-আস্তে ম্যাগী আস্তে। আমি ওখানে একটা কাজ করতে যাচ্ছি। তুমি যদি আসতে চাও আমাকে সাহায্য করতে হবে।

নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করব। যে কোন কাজ করতে রাজি তোমার জন্য। আমি তোমাকে পাগলের মতন ভালবাসি।

–ম্যাগী। তাহলে একটা সত্যি কথা শোন আমি কখনই এ্যান্টিক ব্যবসায়ী ছিলাম না।

 খক খক করে হেসে উঠল ম্যাগী, সে আমি জানি আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা না।

বাঃ, তুমি তো বেশ চালাক মেয়ে হে। আসলে আমি একজন পেশাদার চোর, কথাটা বলে ব্রাডে ম্যাগীর দিকে তাকাল প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

–তার মানে তুমি রবিন হুডের মতন। ধনীদের থেকে চুরি করে গরীবদের বিলিয়ে দাও।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রাডে বলল, না। আমি চুরি করে নিজের পকেট ভর্তি করি।

তাই নাকি? আমিও অনেকবার ভেবেছি রবিন হুডের মাথাটা দেখান দরকার। আমি ধনী বুড়োদের ব্যাগ থেকে অনেক টাকা হাতিয়েছি তাঁরা ঘুমিয়ে পড়লে। এটাও তো চুরি–তাই না?

ব্রাডে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাধা অতিক্রম করা গেছে। এখন দরকার ম্যাগীকে তৈরী করে নেওয়া।

ব্রাডে ম্যাগীকে পরিকল্পনাটা খুলে বলল, তোমার কাজ হবে সিন্দুকটা খুঁজে বার করা। কর্মচারীদের আর ডিটেকটিভকে ভোলানো।

ম্যাগী হাততালি দিয়ে বলল, কোন অসুবিধে হবে না। আমি সব ম্যানেজ করে নেব।

ব্রাডে ম্যাগীর দিকে তাকিয়ে ভাবল প্রয়োজন হলে ম্যাগী কবরে শোয়া লোককেও তাতিয়ে তুলতে পারে।

-তাহলে?

–তাহলে? ঠিক থাকল সব ম্যাগী ব্রান্ডের সাথে হাত মেলাল।

.

জীবনের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কুড়িবার জেলে কাটিয়ে এসে আর্ট ব্যানিয়েন এমন উপলব্ধি করেছে যে অপরাধের শাস্তি অপরিহার্য।

জেলে বিভিন্ন দাগী এবং সেরা অপরাধীদের সাথে মিশে এখন ব্যানিয়েন নতুন ধান্ধার কথা চিন্তা করছে। এতে দুপক্ষেরই লাভ হবে।

বৌয়ের সহযোগিতায় সে অন্ধকার জগতে একটি বিশেষ এজেন্সিখুলে বসেছে। সে দেখেছে যে হলিউডেরও ঐরকম একটা এজেন্সি আছে যারা নানান লোকজন ও আর্টিস্টের যোগান দেয়। পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটিত করতে অন্ধকার জগতেও যোগান দিতে হয় সঠিক মেয়ে বা ছেলে। ব্যানিয়েনের তালিকায় এরকমঅজস্র অপরাধীর নাম রয়েছে, যারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কাজ করার দক্ষতা রাখে। চাহিদা মাফিক লোকের যোগান দেওয়া বা যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়াই ব্যানিয়েনের কাজ। টেলিফোনে এই কাজ চলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে টেলিফোনের আওয়াজের জন্য। তার বৌ বেথ পাশের ঘরে বসে উল বোনে। যখনই একটা কল আসে সে তক্ষুনি তাদের খাতা থেকে উপযুক্ত লোকটির নাম ঠিকানা হাজির করে তার স্বামীর কাছে। লোকটির যা পারিশ্রমিক তার দশ ভাগ পাবে ব্যানিয়েন। ওতে এই কবছরে সে ভালই রোজগার করেছে। পুলিশের নজর এড়াবার জন্য অফিস ঘরের দরজায় লাগানো রয়েছে দি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বাইবেল রিডিং সোসাইটি।

ব্যানিয়েনের বাবা-মা ছিল ছোট ধরনের চাষী। কিন্তু ব্যানিয়েন চাইত টাকা। সতের বছর বয়সে সে নিউইয়র্ক চলে যায়। সেখানেবছর দুয়েক অর্ধাহারে থাকার পর ব্যাঙ্কের সিন্দুক ভাঙ্গার অপরাধে দুজন লোকের সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দুবছর জেল হয়। তার বাপ-মার মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই মাইক সৈন্যবিভাগে যোগ দেয়। ব্যানিয়েনের মতে ওটা জানোয়ারের জীবন। কিন্তু ভাইকে সে ভালবাসত। মাইক তার সাথে জেলখানায় দেখা করত–কোনদিন তাকে সমালোচনা করেনি বা শোধরাবার চেষ্টা করেনি। দুভাইয়ের মধ্যে অটুট একটা বন্ধন ছিল। ব্যানিয়েন মনে মনে ছোট ভাইকে প্রশংসা করত আর এখন ব্যানিয়েন যখন উপলব্ধি করল ক্রাইম ডাজ নট পে, সে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করল। চল্লিশ বছরের এক মহিলাকে বিয়ে করল। নাম বেথ। বাবা হত্যার দায়ে জেল খাটছে, মা নিউগলিঙ্গে একটা বেশ্যালয় চালায়।

অফিসে বসে নানান কথা ভাবতে ভাবতে ভাইয়ের কথা মনে পড়ল বানিয়েনের। মাইকের সত্যিই খুব দুঃসময় চলেছে–এমন দুঃসময় যেন কোন শত্রুরও না হয়। মাইক সার্জেন্টের পদে প্রমোশন পাবার পরেই বিয়ে করে এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় বদলী হয়ে যায়। বছর দুয়েক দুজনের কোন দেখাসাক্ষাত নেই। চিঠি টিঠি লেখা তাঁর পোয় না।

দু-সপ্তাহ আগে হঠাৎ মাইকের ফোন আসে। সে ব্যানিয়েনের সাথে দেখা করতে চায়, একা।

-ঠিক আছে, বেথকে কোথাও পাঠিয়ে দেব।

তাহলে রাত আটটার মধ্যে দেখা করব।ব্যানিয়েনের দুশ্চিন্তা হয়।

সেই দিনের সাক্ষাৎকারের কথা ভাবলেই ব্যানিয়েন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে সে তার ভাইকে চিনতেই পারেনি। আগে ভাইয়ের চেহারা দেখে তার হিংসে হত। আজকের মাইকের চেহারা সেদিনের মাইকের প্রেতাত্মা যেন। রোগা, গাল তুবড়িয়ে গেছে। চোখ বসে গেছে। মুখে একটা হতাশার ছাপ।

মাইক তার জীবনের বিগত দুবছরের কাহিনী শুনিয়েছিল।

বিয়ের এক বছরের মধ্যে তাদের এক কন্যা-সন্তানের জন্ম হয়। মাইকের স্ত্রী মেয়েকে দেখা শোনার জন্য কাজ ছেড়ে দেয়। তার একার রোজগারে কোনরকমে দিন চলছিল।

কন্যাটি জড়ভরত। কোনদিন লিখতে-পড়তে পারবে না–অনেক কষ্টে কথা বলতে পারবে। যা হোক, সন্তান যখন আমাদের তার ভার আমাদেরই বইতে হবে। সে জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম–মাইক বলে, কিন্তু

–কিন্তু কি?

–তিন সপ্তাহ আগে মেরী গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছে।

ব্যানিয়েন চমকে উঠে বসল।

এসব কথা আমাকে আগে জানাওনি কেন?

–কি লাভ? এখন মেরী না থাকাতে আমি আমার মেয়েকে আমার ব্যারাকের কাছে একটা বোর্ডিং হাউসে রেখেছি। এতদিন পর্যন্ত এইভাবেই চলছিল, কিন্তু আর পারছি না।

–তোমার কি টাকার দরকার মাইক? আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি। কয়েকশ ডলার দিতে পারি।

না, আমার কম করে পঞ্চাশ হাজার ডলার চাই।

ব্যানিয়েন অবাক হয়ে মাইকের দিকে তাকাল, অত টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?

–টাকাটা ক্রীসের চিকিৎসার জন্য। ক্রীসের হার্টে একটা গোলমাল আছে। ডাক্তার বলছে পনের বছরের বেশী বাঁচবে না। ক্ৰীসকে বাঁচাতে গেলে ঐ অঙ্কের টাকাটা চাই।

মাইক, তুমি তো রোজগার করছ। মাসে মাসে টাকাটা দিলেও তো হয়।

-কিন্তু আমিও পাঁচ-ছ মাসের বেশী বাঁচব না।

আর্ট ব্যানিয়েন চমকে উঠল।

মারা যাবে, কি যা তা বলছ, মাইক ব্যানিয়েনের দিকে তাকিয়ে বলল, তার টারমিনাল। ক্যানসার হয়েছে। খানিকক্ষণ চুপ করে মাইক বলল, বছর দুই আগে আমার একটা যন্ত্রণা হত–আবার ভাল হয়ে যেত। কিন্তু মেরী মারা যাবার পর সাংঘাতিক যন্ত্রণা শুরু হয়। বাধ্য হয়ে ডাক্তার দেখাই। দিন দুয়েক হল রিপোর্টটা পেয়েছি। আমার আয়ু আর পাঁচ কি ছয় মাস।

-হে ভগবান, তুমি অন্য ডাক্তার দেখাও।

-কোন লাভ নেই। যাক গিয়ে, কাজের কথা শোন। তুমি তো নানান কাজের জন্য লোক নাও। আমায় এমন কাজ দিতে পার যাতে আমি পঞ্চাশ হাজার ডলার পেতে পারি। খুন করতেও আমি পারি। আর কটা মাসই বা বাঁচব। ক্রিসের জন্য আমি সব করতে পারি।

রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছেআর্টবলল, এত দামের কাজ তোআমার কাছে নেই।তাছাড়া তুমি নতুন লোক। তোমার ক্রিমিনাল রেকর্ডও নেই। তোমার মতন অনভিজ্ঞকে এত বড় কাজ কে দেবে?

আমি তোমার ওপর নির্ভর করে আছি। আমি মাস খানেকের ছুটি নিয়ে এসেছি। তুমি একটা উপায় করে দাও মাইক ব্যানিয়েনের হাত চেপে ধরল।

–বেশ আমি দেখব। কিন্তু কথা দিতে পারছি না, আর্ট বিমোহিতের মত বলল।

 যাবার সময় মাইক আবার মিনতি করল।

আর্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেউই মাইকের মতন একজন অপেশাদারকে কাজ দিতে রাজি নয়।

আজ সকালে বসে আর্ট ভাবছিল কি করা যায়। সে কি তার শেয়ারের কাগজগুলো বিক্রী করে মাইককে টাকাটা দেবে। কিন্তু বেথ রাজি হবে না।

একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। আর্ট মাইকের জন্য কিছুই করে উঠতে পারেনি। কিন্তু ভাইয়ের অসহায় চোখদুটো তাঁর সামনে সবসময়ই ভেসে উঠছে। কিছু একটা করতেই হবে।

আর্টের চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল। বেথ ঘরে ঢুকে বলল–এড হ্যাডন তোমাকে ডাকছে।

আর্ট সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠল। হ্যাডম তার এক নম্বরের খদ্দের। টাকা পয়সার ব্যাপারেও তার হাত খুব দরাজ।

রিসিভার তুলে ব্যানিয়েন বলল, হ্যালো মিঃ হ্যাডন, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?

-শোন আর্ট। আমার এমন একজন লোক দরকার যে দেখতে ভাল। অব্যর্থ লক্ষ্য। রোলস চালাতে পারে এবং সোফারের অভিনয় করতে পারে।

এটা কোন ব্যাপারই নয় মিঃ হ্যাডন। লোক আমার রেডি আছে, কাজটা কি বলবেন?

বেশ বড় ব্যাপার। আমি ষাট হাজার দেব।

উত্তেজনায় আর্ট চোখ বন্ধ করে ফেলল।

–কোন ব্যাপারই নয় মিঃ হ্যাডন।

–লোকটার নাম কি?

–আমার ভাই। গুলিতে তার অব্যর্থ লক্ষ্য এবং তার টাকার দরকারও আছে। তার উপর আপনি সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারেন।

–তার পুলিশ রেকর্ড?

–কোন রেকর্ড নেই। বর্তমানে সে আর্মিতে একজন বন্দুক প্রশিক্ষক। তাকে দেখতে সুন্দর, কথাবার্তাও চমৎকার। আমি তার হয়ে গ্যারান্টি দিচ্ছি, চোখ বুজে আর্ট বলে ফেলল। যদিও সে জানে কাজে গড়বড় হলে হ্যাডনের মতন খদ্দেরকে তাকে হারাতে হবে।

হ্যাডন বলল, তুমি যদি গ্যারান্টি দাও, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তাকে বলবে, তেইশ তারিখেরবিবার সকাল দশটায় সে যেন বে হোটেলেমিঃ কর্নেলিয়াস ভান্সের কাছে রিপোর্ট করে।

বন্দুকের ব্যাপারটা?

–ভান্স তাকে সেটা দেবে। তবে খুনোখুনির ব্যাপার নেই এতে।

টাকা কখন পাওয়া যাবে?

-কাজ শেষ হলে। দুএকমাস লাগবে। বড় ব্যাপার। মুখ বন্ধ রাখবে। না হলে ব্যবসার জগত থেকে তোমাকে সরতে হবে।

 হ্যাডন ফোন রেখে দিল।

এসময় বেথ ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে–লিস্টে তো কত লোকের নাম রয়েছে

আর্ট চেঁচিয়ে বলল, চুপ কর। ও আমার ভাই। আমায় ওকে সাহায্য করতেই হবে।

আর্ট-মিরাডোর হোটেলে মাইককে খবরটা দিল।

মাইক শুনে খুশী হয়ে বলল, আমি জানতাম আমি তোমার ওপর ভরসা করতে পারি। তুমি চিন্তা কোরনা, তোমার সম্মান আমি রাখবই। আমি ঠিক সময়ে হোটেলে পৌঁছে যাব। কিন্তু টাকা?

–তুমি ভেবনা, তোমার হোটেলে আমি এখনই তিন হাজার ডলার পাঠিয়ে দিচ্ছি। সোফারের পোশাকটা উঁচু দরের হওয়া চাই। আমার খদ্দের খুব দামী।

কিছুক্ষণ চুপ করে মাইক বলল, তাহলে খুনের ব্যাপার নেই এর মধ্যে।

–তাই তো বলল।

–ঠিক আছে আর্ট। ধন্যবাদ। আমার উপর ভরসা রাখতে পার, মাইক ফোন রেখে দিল।

আর্ট ভাবল, সে তো ভগবান নয়। কিন্তু ভাইকে সাহায্য তো সে করতে পারছে, এতেই সে খুশী।