৬. সেকেন্ড অ্যারেস্ট অভ আর্সেন লুপাঁ

অধ্যায় ছয় – সেকেন্ড অ্যারেস্ট অভ আর্সেন লুপাঁ

আটটা থেকে কম করে হলেও ডজনখানেক চলন্ত ভ্যান এসে ঢুকেছে ক্য ক্রেভুতে। দ্যু বই-দ্য-বোলোনিয়া আর বুজিউ অ্যাভিনিউর মাঝের জায়গা সেটা। মঁসিয়ে ফেলিক্স ড্যাভি নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিচ্ছিলেন। পাঁচ তলার আট নম্বর ফ্লাটে থাকতেন তিনি। এদিকে মঁসিয়ে ডুব্রয় একই বাড়ির ছয় তলায় থাকেন। দুই পাশের দুই ছয়তলাকে নিয়ে একসাথে বানানো এই ফ্ল্যাটটা। ঠিক আজকেই এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। ব্যাপারটা পুরোই কাকতালীয়, কারণ, তারা একে অপরকে চেনেন না। আসবাবপত্রের বিশাল সংগ্রহ থাকার কারণে প্রতিদিন বহু বিদেশী এজেন্ট আসে তার কাছে।

এই ঘটনা দৃষ্টি আকর্ষণ করল কয়েকজন প্রতিবেশির। তবে এ নিয়ে কথা উঠল পরে। তার আগ পর্যন্ত বারোটা ভ্যান আর তাতে চড়া লোকেরা ঘোরাঘুরি করতে লাগল আশেপাশের ওয়াইন শপে। ভ্যানগুলোর কোনোটাতেই তাদের মালিকদের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল না। লোকগুলো এত দায়িত্ববান যে সব আসবাবপত্র বেরিয়ে গেল এগারোটার মাঝেই। বাসা পাল্টানোর পরে রুমের মাঝে কিছু কাগজের টুকরো আর বস্তা পড়ে থাকে না? ঐসব বাদে আর কিছুই রইল না রুমগুলোতে।

মসিয়ে ফেলিক্স ড্যাভি একজন অভিজাত তরুণ। হালফ্যাশনের পোশাক পরনে তার। হাতে একটা ওজনদার ওয়াকিং স্টিক। বাইসেপে জোর আছে তার, বোঝাই যায়। শান্ত ভঙ্গীতে দ্যু বয়-দ্য-বোলোনিয়ার এক বেঞ্চে বসলেন ফেলিক্স। ক্ন্য পারগোলিজের দিকে মুখ করে আছেন তিনি। তার কাছেই বসে পত্রিকা পড়ছে এক মহিলা। পরনে কমদামি কিন্তু পরিপাটি পোশাক। তার কাছে একটা বাচ্চা বালি কুপিয়ে কুপিয়ে খেলছে।

কিছুক্ষণ পরে মাথা না ঘুরিয়েই মহিলাকে বললেন ফেলিক্স ড্যাভি:

“গাঁইমার্দ!”

“সকাল নয়টায় বেরিয়ে গেছে।”

“কোথায়?”

“পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।”

“একা?”

“হ্যাঁ।”

“রাতে কোনো টেলিগ্রাম আসেনি?”

“না।”

“বাসায় তোমাকে সন্দেহ করেছে?”

“না; আমি মাদাম গাঁইমার্দের জন্য কিছু কাজ করে দিয়েছি। তাতেই ওনার স্বামী যা যা করেন, সব বলে দিয়েছেন আমাকে। সারা সকাল ছিলাম ওনার সাথে।”

“খুব ভালো। আর কোনো নির্দেশ না আসা পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল এগারোটায় এখানে চলে আসবে।”

উঠে ডাফিন গেটের দিকে হেঁটে গেলেন তিনি। এরপর চাইনিজ প্যাভিলিয়নের কাছে থামলেন। সেখানে দুটো ডিম, ফল আর সবজি দিয়ে নাশতা সেরে নিলেন। এরপর ক্য ক্রেভুতে ফিরে দারোয়ানকে বললেন:

“আমি রুমগুলো এক নজর দেখে নিয়েই চাবিটা দিয়ে দেবো।”

লাইব্রেরি হিসেবে যে রুমটাকে ব্যবহার করতেন, সেটা দেখা শেষ করলেন তিনি। এরপর একটা গ্যাস পাইপের শেষ অংশটা ধরলেন। চিমনির পাশে ঝুলে আছে সেটা। পাইপটা বেঁকে মাঝ বরাবর ফেটে গেছে। সেই ছিদ্রে একটা ছোটো যন্ত্র ভরে দিলেন তিনি। জিনিসটা অনেকটা হেয়ারিং এইডের মতো। সেখান থেকে হালকা শিসের শব্দ আসলো। জিনিসটা মুখের কাছে ধরে তিনি বললেন,

“ডুব্রয়, আশেপাশে কেউ আছে?”

“না।”

“আমি কি উপরে আসতে পারি?”

“আসুন।”

পাইপটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নিজেকে বললেন তিনি :

“আমরা তো দারুণ উন্নতি করেছি! আমাদের এই শতকের ছোটো ছোটো আবিষ্কারগুলো আমাদের জীবনকে একদম ছবির মতো সুন্দর বানিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে দারুণ উপভোগ্যও, বিশেষ করে আমার মতো জীবনকে উপভোগ করতে পারা মানুষদের জন্য।’

ম্যান্টেলের একটা মার্বেলের নকশাকে ঘোরালো সে। তাতে করে ম্যান্টেলের অর্ধেকটাই ঘুরে গেল। উপরের আয়নাটা পড়ে গেল অদৃশ্য কোনো খাঁজে। চিমনির গায়ে থাকা একটা সিঁড়ির মুখ আর নিচের ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে এখন। সিঁড়িটার কাজ শেষ হয়েছে অবশেষে, চকচকে করছে সেটা পলিশ করা ধাতু আর সাদা টাইলসের দেয়াল দিয়ে বানানো হয়েছে এটা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন তিনি। ছয়তলার চিমনির কাছে এরকম আরেকটা মুখ দেখা যাচ্ছে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছেন মঁসিয়ে ডুব্ৰয়।

“আপনার ঘরের কাজ শেষ হয়েছে?”

“জি।”

“সবকিছু বের করা হয়েছে?”

“জি।”

“আর লোকগুলো?”

“তিনজন গার্ড দিচ্ছে শুধু।”

“খুব ভালো; আসুন।”

একই পথে উপরতলায় গেল তারা। সেখানে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।

“নতুন কিছু চোখে পড়ল?”

“জি না, গভর্নর।”

“রাস্তাঘাট সব শান্ত?”

“জি।”

“আর দশ মিনিটের মাঝে আমি চলে যাবো। তোমরাও যাবে। এর মাঝে কোনোকিছু দেখে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়, সাথে সাথে জানাবে আমাকে। “

“অ্যালার্ম-বেলের ওপর হাত দিয়েই আছি আমি।”

“ডুব্রয়, বেলের তারে হাত দিতে মিস্ত্রীদের না করে দিয়েছেন তো?”

“অবশ্যই, ওটা ঠিকভাবেই কাজ করছে।”

“এটুকুই জানার ছিল।”

দুই ভদ্রলোক এরপর ফেলিক্স ড্যাভির অ্যাপার্টমেন্টের দিকে নামতে লাগলেন। ডুব্রয়ের অ্যাপার্টমেন্টে নেমে মার্বেলের ম্যান্টেলটা ঠিক করে ফেলিক্স খুশিমনে বললেন:

“ডুব্রয়, যে লোকের উর্বর মস্তিস্ক থেকে এই যন্ত্রগুলো আবিষ্কারের বুদ্ধি বেরিয়েছে, তার সাথে দেখা করতে চাই আমি। ওয়ার্নিং বেল, ইলেকট্রিক তারের নেটওয়ার্ক, অ্যাকুস্টিক টিউব, অদৃশ্য পথ, লুকানো সিঁড়ি, সরানো যায় এমন মেঝে— সব মিলিয়ে তো রূপকথার রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে!”

“আর্সেন লুপাঁ তো বিখ্যাত হয়ে গেল!”

“একে ঠিক খ্যাতি বলা যাবে না। এরকম সুচারুভাবে বানানো একটা জায়গা ছেড়ে নতুন কোথাও আস্তানা গাড়তে হবে তাকে, ভাবলে বরং করুণা হয় তার প্রতি। তাও সেটা নতুন মডেলে বানাতে হবে নিশ্চয়ই…এই মডেলের অনুকরণ করা তো অসম্ভব। যত দোষ ঐ হার্লক শোমসের!”

“সে কি প্যারিসে ফিরেছে?”

“কীভাবে ফিরবে? সাউদাম্পটন থেকে আসার মতো জাহাজ আছে কেবল একটা। সেটা সেখান থেকে মাঝরাতে ছাড়ে। এদিকে হাভ্রে থেকে একটা ট্রেন আছে, সেটা আজ সকাল আটটায় রওনা দিয়েছে। এগারোটা পনেরোতে প্যারিসে পৌঁছানোর কথা। সে তো সাউদাম্পটনে মাঝরাতের জাহাজে উঠতে পারেনি। আর ঐ ক্যাপ্টেনকে বারবার করে বলে দেয়া হয়েছে, আজ সন্ধ্যার আগে যেন সে ফ্রান্সে পৌঁছাতে না পারে।’

“আপনার কি মনে হয় সে ফিরে আসবে?”

“হ্যাঁ, ও কখনোই হাল ছাড়ে না। সে প্যারিসে ফিরে আসবে ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।”

“আর মাদামোয়াজেল দেস্তাগে?”

“তার সাথে ঘন্টাখানেকের মাঝেই দেখা হবে আমার।”

“তার বাড়িতে?”

“আরে না! সে সেখানে যাবে না কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু ডুয়, আপনাকে তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। আমাদের মালামাল ভরতে অনেক সময় লাগবে। ওসব দেখাশোনা করতে হবে আপনাকে।

“আপনি কি নিশ্চিত যে আমাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে না?”

“কে রাখবে? শোমস বাদে কাউকে ভয় করি না আমি।”

চলে গেলেন ডুব্রয়। অ্যাপার্টমেন্টটাকে শেষবারের মতো ঘুরে দেখলেন ফেলিক্স ড্যাভি। দুই-তিনটা ছেঁড়া চিঠি তুলে নিলেন। এরপর এক টুকরো চক দেখে সেটা দিয়ে ড্রয়িং রুমের কালো কাগজে একটা বড় ফিগার এঁকে ফেললেন তিনি। এরপর লিখলেন :

আর্সেন লুপাঁ, জেন্টলম্যান-বার্গলার, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পাঁচ বছর ছিল এখানে।

এই ছোট্ট কাজটাই মনটা আরো ভালো করে দিলো তার। এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠলেন তিনি। এরপর নিজেকে বলল:

“ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাসবিদের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেললাম। এখন আমি চলে যাবো। জলদি করো, হার্লক শোমস। আর মিনিট তিনেকের মধ্যেই নিজের বর্তমান আবাস ছেড়ে দেবো আমি। আর তোমার হারটা একদম নিশ্চিত হয়ে যাবে…আর মাত্র দুই মিনিট! অপেক্ষা করি কিছুক্ষণ তোমার জন্য…আর এক মিনিট! তুমি কি আসবে না? বেশ তাহলে, তোমার পতন আর আমার উত্থান ঘোষণা করে দিলাম তাহলে। এখন আমি পালিয়ে যাচ্ছি। বিদায়, আর্সেন লুপাঁর সাম্রাজ্য! আর কখনো দেখা হবে না তোমাদের সাথে। ছয় অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চান্নটা রুম ধরে এতদিন শাসন চালিয়ে এসেছি আমি। বিদায়, আমার অতি নিজস্ব রাজকীয় বেডরুমকে!”

তার উচ্ছ্বাসে বাধা দিলো তীক্ষ্ণ শব্দ। দু’বার বেজে থেমে গেল ওটা। আরেকবার হলো। তারপর থেমে গেল একেবারেই। অ্যালার্ম বেলের শব্দ।

কী হলো আবার? কোন অভাবিত বিপদ ঘনিয়ে এলো? গাঁইমার্দ নাকি? নাহ, সেটা তো সম্ভব না।

লাইব্রেরিতে ফিরে পালানোর জন্য প্রস্তুত হলো ও। তবে প্রথমে এগোলো জানালার দিকে। রাস্তায় তো নেই কেউ-ই। শত্রু কি ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে গেছে নাকি? কান পেতে শুনল ও। আলাদা কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না বোঝার চেষ্টা করল। আর দ্বিধা না করে লাইব্রেরির দিকে দৌড়ে গেল ও। ভেতরে পা রাখামাত্র নিচের দরজার তালায় চাবি ঢোকানোর শব্দ এলো কানে।

“কী আশ্চর্য!” বিড়বিড় করে বলল সে। “একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। বাড়িটা মনে হয় ঘিরে ফেলা হয়েছে। চাকরদের সিঁড়ি দিয়ে- নাহ, অসম্ভব! ভাগ্য ভালো যে চিমনিটা আছে।”

মার্বেলের নকশাটায় চাপ দিলো সে; নড়ল না ওটা। আরো জোরে চাপ দিয়ে দেখল, কিছুই করা যাচ্ছে না ওটাকে। এদিকে নিচের দরজাটা খুলে ফেলা হয়েছে মনে হচ্ছে। পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ও।

“হায়রে! এই ঘোড়ার ডিমের মেকানিজমটা কাজ না করলে আমি শেষ!” চেঁচিয়ে উঠল সে।

সর্বশক্তি দিয়ে আরেকবার চেষ্টা করল সে। একচুলও নড়ল না ওটা। কোনো অভাবনীয় দুর্ঘটনায়, কিংবা দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে কয়েক মিনিট আগে কাজ করা মেকানিজমটাও অচল হয়ে গেছে।

রাগে চোখে সর্ষে চুল দেখতে লাগল ও। মুখ খারাপ করে সে অভিশাপ দিলো মার্কেলটাকে। এই সামান্য বাধার কারণে ধরা পড়ে যাবে সে? পাগলের মতো ওটাতে আঘাত করতে লাগল সে হাতুড়ি দিয়ে। সব চেষ্টাই বৃথা।

“আহা! কী হয়েছে, মঁসিয়ে লুপাঁ? কোনো কিছু নিয়ে রেগে আছেন মনে হয়?”

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল লুপাঁ। হার্লক শোমস দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে! ব্রিটিশ ভদ্রলোকটির কথায় ভদ্রতার সাথে গা জ্বালানো রসিকতার ছাপ ঠিক একই সুরে তার সাথে আগে কথা বলেছিল লুপাঁ। চোখ সরু করে তার দিকে তাকিয়ে রইল সে। ভুল দেখছে না তো! হার্লক শোমস প্যারিসে আসে কী করে? ইংল্যান্ডগামী জাহাজে যাকে সে তুলে দিয়ে এসেছে আগের দিন, সে এমন বিজয়ীর ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকে কী করে! এরকম অলৌকিক কাজ করা কী করে সম্ভব? এ তো প্রকৃতির সব নিয়মকে ভেঙে দিচ্ছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক কোনো উপায়ে তার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে গোয়েন্দা।

“মঁসিয়ে লুপাঁ, প্রথমেই আপনাকে একটা কথা বলে নেই। ব্যারন ডি’হটরেকের বাড়িতে আমাকে শোচনীয় অবস্থায় রাত কাটাতে বাধ্য করা, আমার বন্ধু উইলসনকে আহত করা, আমাকে অপহরণ করা কিংবা সমুদ্রপথে ভ্রমণ করতে বাধ্য করা, অস্বস্তিকর অবস্থায় একটা কাউচের সাথে বেঁধে রাখা- এসবকিছু আমি মন থেকে মুছে ফেললাম এখানের এই অভিজ্ঞতাটুকু দিয়ে এখন আমি যে আনন্দ পেয়েছি তাতে সব তিক্ত স্মৃতিই প্রশমিত হয়ে গেছে। সবকিছু মাফ করে দিয়েছি আমি। সবকিছু ভুলে গিয়েছি। আমার ঋণ শোধ হয়ে গেছে একদম সুদে আসলে।

কোনো জবাব দিলো না লুপাঁ। হার্লক বলল :

“আপনার নিজেরও কি তাই মনে হয় না?”

লুপার কাছ থেকে যেন মৌন সম্মতির প্রতিক্ষায় আছে সে। ঋণ মিটে যাবার পরে রিসিপ্ট নেয়ার মতো।

কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। ব্রিটিশ গোয়েন্দার মনে হলো, তার মনের একদম গহীন পর্যন্ত দেখে নিয়েছে লুপাঁ। এরপর সে ঘোষণা করল :

“তো মঁসিয়ে, ধরে নিচ্ছি যে, আপনি যা বলছেন, একদম মন থেকেই বলছেন।”

“অবশ্যই, খুব গুরুত্বের সাথে বলছি এসব।”

“আপনি যে আমার ক্যাপ্টেন আর ক্রু এর কাছ থেকে পালিয়েছেন, সেটা তো আমাদের লড়াইয়ের ছোটো একটা অংশ ছিল। কিন্তু আপনি যে এখানে একা আর্সেন লুপাঁর মুখোমুখি চলে এসেছেন, এতে করে আশা করি আপনার প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়েছে?”

“এর চেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হওয়া আর সম্ভব ছিল না।”

“এই বাড়ি?”

“ঘিরে ফেলা হয়েছে।”

“দু’পাশের দুই বাড়ি?”

“ঘিরে ফেলা হয়েছে।”

“এর উপরের অ্যাপার্টমেন্টটা?”

“ছয় তলার যে তিনটা অ্যাপার্টমেন্টে মঁসিয়ে ডুব্রয় ছিলেন এতদিন, সেটাও ঘিরে ফেলা হয়েছে।”

“তারমানে—”

“তারমানে আপনি ধরা পড়ে গেছেন, মঁসিয়ে লুপাঁ – পালানোর কোনো পথ নেই আপনার সামনে। “

গাড়িতে করে যাবার সময়ে শোমসের যেমন অনুভূত হয়েছিল, ঠিক তেমনটাই অনুভূত হচ্ছে এখন লুপাঁর। সেই একইরকম জমাটবদ্ধ রাগ, আর সব ভেঙে বেরিয়ে যাবার আকাঙ্খা। আর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার দুর্নিবার সাহস, সামনে জয়-পরাজয় যাই আসুক না কেন।

“আমরা দুজনেই এখন সমানে সমান, মঁসিয়ে।” সোজাসুজি বলল লুপাঁ। তার অকপট স্বীকারোক্তিতে খুশি হলো হার্লক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুলল লুপাঁ। কণ্ঠে চিরাচরিত কর্তৃত্ব ফিরে এসেছে আবার

“তবে আমার এতে কোনো দুঃখ নেই। সবসময়ে জিততে বরং একঘেয়ে লাগছিল আমার। কালকের কথাই ধরুন। আমার হাতের ইশারায় আপনি হেরে গেলেন। আজকে আবার আমি আপনার কবলে পড়ে গেছি। বল এখন আপনার কোর্টে,” আন্তরিক হাসি দিয়ে বলল লুপাঁ। “অবশেষে গোটা পৃথিবী এখন আনন্দিত হবে। লুপাঁ জেলে বন্দি! কী করে পালাবে সে এখন?… কী একখান রোমাঞ্চকর ব্যাপার!… আহা! শোমস! জীবন একের পর এক চমক দিয়েই যাচ্ছে!”

দুই হাত কপালে চেপে ধরল সে। ভেতর থেকে উঠে আসা উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারছে না যেন। অবশেষে আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিলো সে। এরপর গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এসে বলল:

“এখন কীসের অপেক্ষা করছেন আপনি?”

“কীসের অপেক্ষা করছি মানে?”

“গাঁইমার্দ তো তার দলবল নিয়ে চলে এসেছে— ওরা ঢুকছে না কেন?”

“আমি ওনাদেরকে আসতে মানা করেছি।”

“আর উনি রাজি হলেন?”

“আমি ওনার সাথে কাজ করতে রাজি হয়েছিলাম এক শর্তে। কিছু করতে গেলে আমার কথামতো চলতে হবে। তাছাড়া, ওনার ধারণা, ফেলিক্স ড্যাভি হলো আর্সেন লুপাঁর কোনো সাগরেদমাত্র।”

“তাহলে আমার প্রশ্নটা অন্যভাবে করি। আপনি একা আসলেন কেন?”

‘কারণ, আপনার সাথে একা কথা বলার ইচ্ছা ছিল আমার। “ “আচ্ছা! তারমানে আমাকে কিছু বলতে চান আপনি!”

ব্যাপারটা লুপাঁর ভারি পছন্দ হলো মনে হয়। মাঝে মাঝে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে, যাতে কাজের চেয়ে কথা বেশি চলে।

“মঁসিয়ে শোমস, আপনাকে ইজি চেয়ারে বসাতে পারছি না বলে দুঃখিত। ভাঙা বাক্সটা পছন্দ হয়? কিংবা জানালার ধারেও বসতে পারেন। আমি নিশ্চিত এক গ্লাস বিয়ার পেলে ভালো লাগবে আপনার- লাইট নেবেন? নাকি ডার্ক?…আচ্ছা যাই হোক, আগে বসুন, প্লিজ।”

“অনেক ধন্যবাদ— আমরা দাঁড়িয়েই কথা বলতে পারব।”

“বেশ তো— বলুন।”

“সংক্ষেপে বলছি। আপনাকে গ্রেপ্তার করতে ফ্রান্সে আসিনি আমি। আপনাকে ধাওয়া করতে বাধ্য হয়েছি অন্য এক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।”

“সেটা কী?”

“নীল হীরা উদ্ধার করা।”

“নীল হীরা!”

“হ্যাঁ। কারণ, হার রেইকেনের টুথ পাউডারের বোতলে পাওয়া হীরাটা নকল।”

“তা ঠিকই বলেছেন। আসল হীরাটা তো স্বর্ণকেশী মহিলা নিয়ে গেছে। তারপর ওটার একটা হুবহু কপি বানিয়েছি আমি। কাউন্টেসের গহনার নকশা তো ছিলই আমার কাছে। হার ব্লেইকেনকে তো এমনিতেই সন্দেহ করা হচ্ছিল, তাই নিজের ওপর থেকে সন্দেহ এড়ানোর জন্য স্বর্ণকেশী মহিলা ওটা রেখে দেয় বাণিজ্যদূতের লাগেজে।’

“আর আসলটা আপনি নিজের কাছে রেখে দেন?”

“তা তো রাখবোই।”

“ওই হীরাটা লাগবে আমার।“

“আমি খুবই দুঃখিত— ওটা দেয়া সম্ভব নয়। ‘

“কাউন্টেস ডি ক্রোজোনকে কথা দিয়েছি আমি। ওটা আমার লাগবেই।”

“ওটা তো আমার কাছে, কী করে নেবেন আপনি?”

“আপনার কাছে বলেই তো এত কথা!”

“ওহ! মানে আমি দিয়ে দেবো আপনাকে?”

“জি।”

“কোনো জোর-জবরদস্তি ছাড়াই?”

“আমি নাহয় কিনে নেবো ওটা।”

“আরে!” আবারো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল লুপাঁ। “আপনি দেখে ঝানু ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করছেন। আসলেই খাসা এক ইংলিশম্যান আপনি।“

“এটা তো আমার কাছে ব্যবসাই।”

“বেশ! তো বিনিময়ে কী দেবেন আমাকে?”

“মাদামোয়াজেল দেস্তাগের মুক্তি।”

“ওকে কীভাবে মুক্তি দেবেন? ও তো গ্রেপ্তার হয়নি জানতাম।”

“মঁসিয়ে গাঁইমার্দকে দরকারমতো তথ্য দিয়ে দেবো আমি। রক্ষা করার জন্য আপনি থাকছেন না যেহেতু, ওনাকে সহজেই ধরে ফেলা যাবে।”

আবার হাসলো লুপাঁ। বলল:

“প্রিয় মঁসিয়ে, আপনি আমাকে এমন এক জিনিস সাধছেন যেটা আপনার হাতে নেই। মাদামোয়াজেল দেস্তাগে নিরাপদ এক জায়গায় আছে। তার ভয়ের কোনোই কারণ নেই। আমাকে অন্য কোনো প্রস্তাব দিতে হবে আপনার।”

একটু দ্বিধা করল ব্রিটিশ গোয়েন্দা। মুখে স্পষ্ট বিরক্তি আর লজ্জার ছাপ। কিছুক্ষণ পর প্রতিপক্ষের কাঁধে হাত রেখে সে বলল:

“আর আমি যদি আপনাকে– “

“আমাকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দেন?”

“না…তবে রুম ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য গাঁইমার্দের সাথে কথা বলতে যাবো আমি।”

“আর আমাকে একা রেখে যাবেন?”

“হ্যাঁ।”

“আরে ধুর! তাতে কী লাভ হবে? ঘোড়ার ডিমের মেকানিজমটা তো কাজই করছে না,” বলল লুপাঁ। গায়ের জোরে আরেকবার ম্যান্টেলটাকে ঠেলা দিলো সে। এইবার তাকে চমকে দিয়ে সরে গেল ওটা। মুখ দিয়ে হালকা চিৎকার বেরিয়ে এলো তার। শুধুমাত্র এটাই ওকে পালানোর আশা দেখাতে পারে। তাহলে শোমসের শর্ত মানবে কেন সে? রুমের মাঝে পায়চারি করে লাগল সে, নিজের জবাবটা খতিয়ে দেখছে যেন। এরপর সে-ও একইভাবে প্রতিপক্ষের কাঁধে হাত রাখল। বলল:

“মঁসিয়ে শোমস, ভেবে দেখলাম, আমি আসলে আমার নিয়মে চলতেই পছন্দ করি।”

“কিন্তু-”

“কারো সাহায্যের দরকার নেই আমার।”

“গাঁইমার্দ আপনাকে ধরে ফেললে কিন্তু সব শেষ। ওদের হাত থেকে আর পালাতে পারবেন না।”

“কে বলতে পারে সেটা?”

“বোকার মতো কথা বলছেন কেন? প্রতিটা জানালা আর দরজায় পুলিশের লোক দাঁড়ানো।”

“একটা বাদে।”

“কোনটা?”

“যেটা আমি বেছে নেবো।”

“ফাঁপা বুলি! আপনি অচিরেই ধরা পড়বেন।”

“মোটেই না!”

“তাহলে?”

“নীল হীরাটা আমার কাছেই থাকবে।”

নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো শোমস:

“তিনটা বাজতে আরো দশ মিনিট বাকি। ঠিক তিনটায় গানিমার্দকে ডাকব আমি।”

“বেশ তাহলে, কথা বলার জন্য আরো দশ মিনিট আছে আমাদের হাতে। নিজের কৌতুহলটা মিটিয়ে নেই তাহলে। আচ্ছা, আপনি আমার নাম যে ফেলিক্স ড্যাভি আর এটাই যে আমার ঠিকানা, তা জানলেন কী করে?”

লুঁপার নির্ভার কথাবার্তা শুনে একটু অস্বস্তি লাগছিল শোমসের। তারপরেও প্রশ্নটার জবাব দেবার সিদ্ধান্ত নিলো সে। আর এতে তার বুদ্ধির কেরামতির কৃতিত্বটাও নেয়া যাবে। সে বলল:

“আপনার ঠিকানা? এটা স্বর্ণকেশী মহিলা দিয়েছেন আমাকে।”

“ক্লোটিল্ডে!”

“উনি স্বয়ং ফাঁস করে দিয়েছেন। কালকে সকালে ওনাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে উনি নিজের দর্জিকে ফোন করেছিলেন, মনে আছে?”

“তাতে কী হয়েছে?”

“আমি পরে বুঝলাম যে, দর্জির কথা বলে আপনাকেই ফোন করেছিলেন উনি। গত রাতে জাহাজের মধ্যে নিজের মগজের ধূসর কোষগুলোকে একটু নাড়াচাড়া করলাম আমি। নিজের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি নিয়ে যুক্তিসঙ্গত কারণেই বেশ বড়াই করি আমি। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আপনার টেলিফোন নম্বরের শেষের দুটো সংখ্যা মনে করতে পারলাম-৭৩। এরপর আপনার সংস্কার করা বাড়িগুলোর তালিকায় চোখ বোলালাম। কাজটা বেশ সহজই ছিল। আজ সকাল এগারোটায় প্যারিসে পৌঁছে টেলিফোন ডিরেক্টরি দেখে ফেলিক্স ড্যাভির নাম আর ঠিকানা বের করে ফেললাম। ঐ তথ্য জানার পরে মঁসিয়ে গাঁইমার্দের সাহায্য চাইলাম।”

“বাহ দারুণ!” প্রশংসার সুরে বলল লুপাঁ। “কিন্তু হাভ্রে থেকে আটটার ট্রেন কীভাবে ধরলেন আপনি? ‘দ্য সোয়ালো’ থেকে কীভাবে পালালেন?”

“পালাইনি তো।”

“কিন্তু–”

“আপনি ক্যাপ্টেনকে রাত একটার আগে সাউদাম্পটনে পৌঁছাতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু উনি আমাকে মাঝরাতেই নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেকারণেই হাভ্রের উদ্দেশ্যে ছাড়া বারোটার জাহাজ ধরতে পেরেছি আমি।”

“ক্যাপ্টেন আমার সাথে বেইমানি করল? বিশ্বাস করতে পারছি না!”

“না, উনি বেইমানি করেননি।”

“তাহলে কী?”

“ওনার ঘড়িটা বেইমানি করেছে।”

“ওনার ঘড়ি?”

“হ্যাঁ, ওটাকে এক ঘণ্টা এগিয়ে দিয়েছিলাম আমি।”

“কীভাবে?”

“স্বাভাবিকভাবেই, ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলছিলাম, ওনাকে বেশ কিছু মজার গল্প শোনালাম আমি…অন্যমনস্ক হয়ে আমার কাজটা খেয়াল করেননি তিনি।”

“সাব্বাস! দারুণ চালাকি করেছেন। আমি কখনোই এটা ভুলব না। কিন্তু কেবিনের দেয়ালেও তো একটা ঘড়ি ঝুলছিল। ওটা?”

“ঐ ঘড়ির সময় বদলাতে একটু বেগ পেতে হয়েছে, পা বাঁধা ছিল তো। কিন্তু ক্যাপ্টেনের অনুপস্থিতিতে যে নাবিক আমাকে পাহারা দিচ্ছিল, সে আমার হয়ে কাজটা করে দিয়েছে।”

“কী অদ্ভুত! ওর তো এ কাজ করার কথা না!”

“ও আসলে নিজের কাজের গুরুত্ব ধরতে পারেনি। আমি ওকে বলেছিলাম, লন্ডনগামী প্রথম ট্রেনটা যেকোনো মূল্যে ধরতে হবে আমার। একটু পটাতেই রাজি হয়ে গেল।”

“কী দিয়ে পটালেন?”

“সামান্য একটা উপহার দিয়ে। আপনার একান্ত অনুগত সহযোগী যেটা পাঠাতে চেয়েছিলেন আপনাকে।”

“কী সেটা?”

“তুচ্ছ একটা জিনিস।

“সেই তুচ্ছ জিনিসটাই বা কী?”

“নীল হীরা।

“নীল হীরা!”

“জি, কাউন্টেসের হীরার বদলে যেটা রেখে দিয়েছিলেন। উনি ওটা দিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। “

হো হো করে হেসে ফেলল লুপাঁ। চোখে পানি এসে গেছে তার।

“বলেন কি! খুব মজা পেলাম শুনে! আমার নকল হীরা দিয়ে আমারই গোবেচারা নাবিকটাকে বোকা বানালেন! আর এভাবে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেনকেও বোকা বানিয়ে দিলেন।”

শোমসের মনে হচ্ছে, তাদের দুজনের মাঝে উত্তেজনা আরো বাড়ছে।

নিজের ইন্দ্রিয় সতর্ক করল তাকে। সে জানে, এভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার আড়ালে আসলে পালানোর পাঁয়তারা করছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আস্তে আস্তে ব্রিটিশ গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এলো লুপাঁ। নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলো শোমস। মনের অজান্তেই হাতটা চলে গেল ঘড়ির পকেটে।

“তিনটা বেজে গেছে, মঁসিয়ে।”

“এত তাড়াতাড়ি! আফসোস! আপনার সাথে কথা বলে খুব মজা পাচ্ছিলাম।”

“আপনার জবাবের জন্য কিন্তু এখনো অপেক্ষা করছি আমি।”

“আমার জবাব? হায়রে! মঁসিয়ে দেখি সহজে ছাড়বেন না! শেষ কার্ড দেখানোর পালা এখন। বাজিমাত করলেই কেবল পাবেন আমাকে।”

“কিংবা নীল হীরাটাকে।“

“আচ্ছা, লাগাম তো আপনারই হাতে। তো কী করবেন এখন?”

“আমি রাজা চাললাম,” বলে পিস্তল বের করে উপরের দিকে গুলি করল শোমস।

“আর আমি চাললাম টেক্কা,” বলে শোমসের পেটে ঘুষি মারল লুপাঁ।

গাঁইমার্দকে সংকেত দেবার জন্য গুলিটা চালিয়েছিল শোমস। লুপাঁর বেমক্কা ঘুষিতে বাঁকা হয়ে গেল সে। দ্রুত ফায়ারপ্লেসের দিকে এগিয়ে মার্বেলে চাপড় দিলো লুপাঁ…কিন্তু দেরি হয়ে গেছে অনেক! ইতিমধ্যেই খুলে গেছে ঘরের দরজাটা।

“লুপাঁ! আত্মসমর্পণ করো, নইলে গুলি করব!”

লুপা ভেবেছিল, গাঁইমার্দ আরেকটু দূরে আছে বুঝি। এত তাড়াতাড়ি রিভলভার হাতে এসে পড়বে ভাবেনি। সে একা নয়, সাথে আছে আরো জনাবিশেক পুলিশ। বলশালী, নিষ্ঠুর চেহারা তাদের। কথার সামান্যতম অবাধ্যতা করলে তারা পিটিয়ে তক্তা বানাবে তাকে।

“পিস্তল নামান! আমি আত্মসমর্পণ করছি!” শান্ত কণ্ঠে বলল লুপাঁ। এরপর দুই হাত আড়াআড়িভাবে রাখল নিজের বুকের ওপরে।

রুমের সবাই অভিভূত হয়ে পড়ল। আসবাবপত্রহীন রিক্ত রুমটায় প্রতিধ্বনিত হলো লুপাঁর বলা কথাটা…”আমি আত্মসমর্পণ করছি!”… মনে হচ্ছে, এটা বাস্তব কোনো দৃশ্য নয়। সে এখন চট করে গায়েব হয়ে গেলে কিংবা দেয়ালের মাঝে দিয়ে পালালেও কেউ অবাক হতো না। মনে করত, এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ কোনো জারিজুরি না দেখিয়ে সোজা হার মেনে নিলো সে!

এগিয়ে এলো গাঁইমার্দ। কিছুটা শঙ্কিত হয়ে আছে সে। তারপরেও পরিস্থিতির সাথে তাল দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে লুপাঁর কাঁধে হাত রেখে বলল:

“আর্সেন লুপাঁ, তোমাকে গ্রেপ্তার করলাম আমি।”

“আরে! আপনার কথায় তো কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে আমার, গাঁইমার্দ। কী গম্ভীর মুখ করে আছেন! কোনো প্রিয়বন্ধুর শেষকৃত্যে বক্তব্য দেবার সময়ে এরকম চেহারা করে লোকে। ঈশ্বরের দোহাই লাগে, এরকম মনমরা করে ফেলবেন না পরিবেশটাকে।”

“তোমাকে গ্রেপ্তার করলাম আমি।”

“এ নিয়ে ভাববেন না! আইনের যোগ্য এক স্তম্ভ আপনি। গাঁইমার্দ নামের এই বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ গোয়েন্দা অবশেষে ধরে ফেলল চতুর আর্সেন লুপাঁকে। ঐতিহাসিক এক ঘটনা। এটার গুরুত্ব ভালোই জানেন আপনি। তার ওপর এ নিয়ে দু’বার হলো এমনকিছু। সাবাস, গাঁইমার্স! আসলেই নিজের বেছে নেয়া পেশায় বড় একটা ধাপ এগিয়ে গেলেন আপনি।”

দুই হাত বাড়িয়ে দিলো সে হাতকড়া পরানোর জন্য। গম্ভীর মুখে সেটা পরিয়ে দিলো গাঁইমার্দ। উপস্থিত পুলিশদের সবারই তিক্ত অনুভূতি লুপাঁকে ঘিরে। অপরাধীকে ধরার দৃশ্য দেখে তারা অভ্যস্ত। তারপরেও এই রহস্যময়, অধরা প্রাণীটিকে বন্দি অবস্থায় দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল তারা।

“বেচারা লুপাঁ,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল গাঁইমার্দ। “তোমার অভিজাত বন্ধুরা তোমার এই দুর্দশা দেখলে কী বলত?”

সর্বশক্তি দিয়ে দুই হাত আলাদা করে ফেলল লুপাঁ। কপালের রগগুলো ফুলে গেছে তার। দুই হাতে হাতকড়া কেটে বসেছে। তবে একটু চেষ্টাতেই শিকল খুলে পড়ে গেল নিচে

“আরেকটা দিন, কমরেড। এটা ভেঙে গেছে।”

এ দফায় দুটো হাতকড়া পরানো হলো তাকে।

“ঠিক আছে।” বলল সে। “সাবধানের মার নেই।”

এরপর গোয়েন্দা আর পুলিশদেরকে গুনে বলল:

“আপনারা কয়জন আছেন এখানে? পঁচিশ? তিরিশ? এতজনের সাথে পেরে উঠব না আমি! জনা পনেরো হলে পারতাম!”

লুপার একটা আকর্ষণীয় দিক আছে। কোনো কোনো অভিনেতা যেমন নিজের সবটুকু সত্ত্বাকে ঢেলে দিয়ে নিজের চরিত্রটাকে ধারণা করেন, অনায়াসে সেটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন, লুপাঁও তেমনি। শোমসের তো তাকে নিখুঁত রং আর দক্ষতায় আঁকা একটা শিল্পকর্ম মনে হয়। সে ভেবেছিল, অস্ত্র থাকতেই কী হয়েছে, ত্রিশ জন লোকের সাথেও দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেবে হাতকড়া পরা নিরস্ত্র মানুষটা।

“তো, গুরু, এসবই আপনার বদান্যতা,” শোমসকে বলল লুপাঁ। “আপনার কল্যাণে লুপাঁ এখন স্যাঁতস্যাঁতে কোনো অন্ধকূপে পচে মরবে। নিজের বিবেক কি আপনাকে একটু হলেও দংশন করেছে না? একটুও কি আক্ষেপ লাগছে না? স্বীকার করে ফেলুন। “

শ্রাগ করল শোমস। যেন বলল:

“নিজের দোষেই আপনার আজ এই অবস্থা।”

“কক্ষনো না!” চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ। “ভেবেছেন, ঐ নীল হীরাটা এত সহজে দিয়ে দেবো? ওটার জন্য বহু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাকে! ওটা রেখে দেবো আমি। আপনাদের লন্ডনে প্রথমবারের মতো যাচ্ছি আমি- সামনের মাসেই হয়তো। তখন আপনাকে সব কারণ ভেঙে বলব। কিন্তু আপনি কি সামনের মাসে লন্ডনে থাকবেন? নাকি ভিয়েনা বেশ পছন্দ আপনার? অথবা সেইন্ট পিটার্সবার্গ?”

এরপর একটা চমক পেল লুপাঁ। একটা বেল বেজে উঠল হঠাৎ। এটা অ্যালার্ম বেল নয়। টেলিফোনের রিং এর শব্দ। রুমের দুই জানালার মাঝে রাখা আছে ওটা, এখনো নিয়ে যাওয়া হয়নি।

টেলিফোনটা! কে ফোন করতে পারে এখন? কোন অভাগা এখন পুলিশের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? বজ্জাত যন্ত্রটাকে ভেঙে শত টুকরো করতে ইচ্ছা হলো লুপাঁর। রহস্যময় যে কণ্ঠ তাকে ফোন করেছে, তার নাম-নিশানা মুছে দিতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু রিসিভারটা ইতিমধ্যেই তুলে নিয়েছে গাঁইমার্স:

“হ্যালো!…হ্যালো!…নম্বর ৬৪৮…৭৩…জি, এটাই সেই নম্বর।

এরপর এগিয়ে গেল শোমস। কর্তৃত্বপরায়ণ ভঙ্গিতে গাঁইমার্দকে সরিয়ে দিলো একপাশে। এরপর রিসিভারটা তুলে রুমাল দিয়ে ট্রান্সমিটারটা ঢেকে দিলো। ওর কণ্ঠ এখন আর বুঝতে পারবে না অপরপক্ষ। সেই মুহূর্তে লুপাঁর দিকে তাকালো সে। চোখাচোখি হলো। দুজনের মনে এখন একই ভাবনা চলছে। সেটা সত্যি কি না তা জানা যাবে এক্ষুণি। তারা ভাবছে, নিশ্চয়ই স্বর্ণকেশী মহিলা ফোন করেছে। ফেলিক্স ড্যাভি ওরফে ম্যাক্সিম বারমন্ডের সাথে কথা বলতে চায় সে। কিন্তু শোমস বাদে আর কারো সাথে কথা হবে না তার। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বলল :

“হ্যালো…হ্যালো!”

এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল:

“হ্যাঁ, আমি ম্যাক্সিম বলছি।”

নাটক এখন ট্র্যাজেডির দিকে এগোচ্ছে। সদা নির্বিকার, অদম্য লুপাঁ নিজের উদ্বিগ্নতাকে ঢেকে রাখার কোনো চেষ্টা করল না। সর্বশক্তি দিয়ে ফোনের অপরপাশের কণ্ঠটা শুনতে চাচ্ছে সে, এই ফোনকলের উদ্দেশ্য ভেস্তে দিতে চাচ্ছে। মেকি কণ্ঠে কথা চালিয়ে গেল শোমস:

“হ্যালো!…হ্যালো!…হ্যাঁ, সবকিছু সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি এখনই যাচ্ছি। যেখানে দেখা হবার কথা, সেখানে দেখা হচ্ছে তাহলে…কোথায় সেটা?…তুমি এখন কোথায়?…..উনি মনে হয় এখনো আর্সেননি এখানে! …

থেমে গেল শোমস। কথা হাতড়াতে লাগল। নিজের সাথে বেইমানি না করে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাচ্ছে সে। এটা পরিষ্কার যে মেয়েটার অবস্থান জানা নেই তার। তাছাড়া, গাঁইমার্দের উপস্থিতিও কিছুটা লজ্জার মাঝে ফেলে দিয়েছে তাকে। কোনো অত্যাশ্চর্য উপায়ে এই অভিশপ্ত লাইনটা যদি কেটে যেত, ভাবল লুপাঁ। কায়মনে এই প্রার্থনা করতে লাগল সে। শরীরের সব কয়টা স্নায়ু টানটান হয়ে আছে তার। দীর্ঘ এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে শোমস বলল:

“হ্যালো!…হ্যালো!…শুনতে পাচ্ছ তুমি?…আমি ভালো করে শুনতে পাচ্ছি

না তোমার কথা…ভালোমতো বুঝতে পারছি না…তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? আমার মনে হয় তোমার ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত…এখন আর কোনো বিপদ নেই…কিন্তু উনি তো ইংল্যান্ডে ফিরে গেছেন! সাউদাম্পটন থেকে টেলিগ্রামে ওনার পৌছানোর খবর পেয়েছি আমি।”

নিয়তির পরিহাসে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করল লুপাঁর। কী অবলীলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে শোমস! সাথে যোগ করল:

“খুব ভালো। দেরি কোরো না। তোমার কাছে আসছি আমি।” রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে।

“মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, তিনজন লোক দিতে পারবেন আমাকে?”

“স্বর্ণকেশী মহিলার জন্য?”

“জি।”

“সে কে, কোথায় আছে, তা জানেন আপনি?”

“জি।”

“বাহ! তাহলে মঁসিয়ে লুপাঁকে সামলে…ফলেনফাঁত, দুজন লোক নিয়ে মসিয়ে শোমসের সাথে যাও।“

খেলা শেষ। স্বর্ণকেশী মহিলা এখন ধরা পড়ে যাবে ব্রিটিশ গোয়েন্দার হাতে। দীর্ঘ চেষ্টার পর এবং কিছুটা কপালের জোরে এই খেলায় জিতে গেছে সে। আর গো-হারা হেরেছে লুপাঁ। সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তার

“মঁসিয়ে শোমস!”

থেমে গেল ইংলিশম্যান।

“মঁসিয়ে লুপাঁ?”

শেষ দাগা খাওয়ার পরে আসলেই বেশ ভেঙে পড়েছে লুপাঁ। কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে তার। মুখে তীব্র হতাশার ছাপ স্পষ্ট। তারপরেও নিজেকে সামলে নিলো সে। নিজের হার সত্ত্বেও খুশি খুশি কণ্ঠে বলল:

“ভাগ্য যে আমার বিপক্ষে, সেটা মানতেই হবে আপনাকে। কয়েক মিনিট আগে চিমনি দিয়ে আমার পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আর এখন ঐ টেলিফোনের জন্য স্বর্ণকেশী মহিলাকে পেয়ে গেলেন আপনি। আমি তাই নতুন একটা প্রস্তাব দিতে চাচ্ছি।

“কী বলতে চাচ্ছেন?”

“আমি আপনার সাথে চুক্তিটা করতে আগ্রহী এখন।”

গানিমার্দকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে লুপাঁর কথা শোনার প্রস্তাব দিলো শোমস। তার কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার জন্য নয়, কেবল বলার জন্য বলা। এরপর কিছুটা শঙ্কিত আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে লুপাঁকে বলল:

“কী চান আপনি?”

“মাদামোয়াজেল দেস্তাগের মুক্তি।”

“এর জন্য কী দিতে হবে, তা জানা আছে আপনার।”

“জি।”

“সেটা দিতে রাজি আপনি?”

“জি, আপনার সব শর্ত মেনে নিচ্ছি।”

“কিন্তু আপনি তো মানতে চাচ্ছিলেন না নিজের জন্য,” চেঁচিয়ে উঠল শোমস।

“দেখুন, নিজের দেখভাল আমি নিজেই করতে পারি, মঁসিয়ে শোমস। কিন্তু এখন এক তরুণী জড়িয়ে গেছেন এসবের সাথে। আমার ভালোবাসার মানুষ সে। আমরা ফরাসিরা এসব ব্যাপারে কখনো দ্বিধা করি না। আমি নিজেও ভালোবাসাকেই সবার আগে রাখি।”

একদম অকপটে কথাটা বলে দিলো লুপাঁ। মাথা সামান্য কাত করল শোমস, এরপর বিড়বিড় করে বলল:

“বেশ, নীল হীরাটা দিয়ে দিন তাহলে।”

“আমার হাঁটার ছড়িটা দিন, ম্যান্টেলের শেষ মাথায় আছে ওটা। এক হাত দিয়ে ওটার মাথায় টোকা দিন, আর আরেক হাত দিয়ে তলার লোহার রিংটা ঘুরিয়ে দিন।’

ছড়িটা নিয়ে যা বলা হয়েছে তাই করল শোমস। সাথে সাথেই ছড়ির মাথাটা দুই ভাগ হয়ে একটা গর্ত দেখা গেল। তাতে ছোটো একটা মোমের বল। সেটার মধ্যে একটা হীরা রাখা। নেড়েচেড়ে দেখল সে। এটাই সেই নীল হীরা।

“মঁসিয়ে লুপাঁ, মাদামোয়াজেল দেস্তাগে এখন মুক্ত।”

“তার ভবিষ্যৎও কি নিশ্চিন্ত? আপনার পক্ষ থেকে আর কিছু করা হবে না তো তাকে?”

“আমার কিংবা কারো পক্ষ থেকেই কিছু করা হবে না।”

“সেটা কীভাবে নিশ্চিত করবেন?”

“খুব সহজেই। ওনার নাম আর ঠিকানা ভুলে যাবো আমি।”

“ধন্যবাদ, আর বিদায়। আপনার সাথে আবার দেখা হবে তো, মঁসিয়ে শোমস?”

“এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার।”

এরপর শোমস আর গাঁইমার্দের মাঝে কিছু উত্তেজিত বাক্য বিনিময় হলো। কথাটা হঠাৎ করেই থামিয়ে দিলো শোমস। বলল:

“আমি খুবই দুঃখিত, মঁসিয়ে গাঁইমার্দ। এই ব্যাপারে আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। আপনাকে রাজি করানোর মতো সময়ও নেই আমার। এক ঘন্টার মাঝেই ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে আমাকে।”

“কিন্তু…স্বর্ণকেশী মহিলা?”

“এরকম কাউকে চিনি না আমি।”

“কিন্তু কয়েক সেকেন্ড আগেও তো—”

“যেভাবে যা ঘটছে, তাই মেনে নিতে হবে আপনাকে। আপনার হাতে আর্সেন লুপাঁকে তুলে দিয়েছি আমি। এই হলো নীল হীরা। কাউন্টেস ডি ক্রোজোনের হাতে ওটা ফিরিয়ে দেবার সৌভাগ্য হবে আপনার। আর কী চান?”

“স্বর্ণকেশী মহিলাকে। “

“ওনাকে খুঁজে বের করুন তাহলে।”

কপালের ওপর হ্যাট টেনে দিয়ে দ্রুতপদে হাঁটা শুরু করল শোমস। কোনো কাজ শেষ হবার সাথে সাথে এভাবেই চলে যাওয়ার অভ্যাস তার।

“যাত্রা শুভ হোক, মঁসিয়ে,” চেঁচিয়ে বলল লুপাঁ। “যেরকম বন্ধুবৎসল ভঙ্গিতে আমাদের মধ্যে লেনদেন হলো, তা কখনো ভুলব না আমি। মঁসিয়ে উইলসনকে আমার শুভাশিস জানাবেন।“

কোনো জবাব না পেয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে লুপাঁ যোগ করল:

“এটাকেই বলে ‘ব্রিটিশ ভঙ্গীতে চলে যাওয়া।’ জাতিগত গর্বের কারণে ওদের বেশ কিছু আচরণ অভব্য লাগে। এদিক দিয়ে আমরা ফরাসিরা একদম আলাদা। গাঁইমার্দ, একটু ভাবুন, এরকম পরিস্থিতিতে কোনো ফরাসি চলে যাবার আগে কতোটা ভদ্রতা দেখিয়ে যেত। এমন তো না যে ভদ্রতা দেখালে তার সাফল্য চাপা পড়ে যাবে!…আচ্ছা যাইহোক, গাঁইমার্দ, কী করছেন আপনি? খুঁজছেন? কী লাভ এতে? কিচ্ছু নেই এখানে, এক টুকরো কাগজও না। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমার পুরো আর্কাইভ এখন নিরাপদ কোনো জায়গায়।”

“আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই,” জবাব দিলো গানিমার্দ। “ভালোভাবে সবকিছু খুঁজে দেখতে হবে আমাকে।”

হাল ছেড়ে তার কাজ দেখতে লাগল লুপাঁ। দুজন গোয়েন্দা ধরে রেখেছে তাকে, বাকিরা ঘিরে রয়েছে চারপাশে। ধৈর্য ধরে বিশ মিনিট অপেক্ষা করল সে। এরপর বলল :

“গাঁইমার্দ, জলদি শেষ করেন!

“তোমার মনে হয় খুব তাড়া!”

“অবশ্যই। জরুরি একটা অ্যাপয়েনমেন্ট আছে আমার।”

“পুলিশ স্টেশনে?”

“না; শহরে।”

“তাই নাকি? কয়টার সময়ে?”

“দুটোয়। “

“কিন্তু এখন তো তিনটা বাজে।”

“কী আর করা, দেরি করে যাবো।”

“আচ্ছা, পাঁচটা মিনিট সময় দাও।”

“আর এক সেকেন্ডও না,” বলল লুপাঁ।

“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি-”

“আহহা! এত কথা বলবেন না তো…এখনো কাবার্ডে খুঁজে বেড়াচ্ছেন? ওটা তো খালি।”

“এখানে কিছু চিঠি আছে।”

“পুরোনো ইনভয়েস মনে হয়!”

“না; একটা প্যাকেটে, ফিতা দিয়ে বাঁধা।

“লাল ফিতা? গাঁইমার্দ, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, খুলবেন না ওটা!”

“কোনো মেয়ের পাঠানো নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“এই পৃথিবীর কোনো নারী?”

“সেরা নারী বলা যায়।“

“তার নাম?”

“মাদাম গাঁইমার্দ।”

“হাহা! হাসতে হাসতে মরে গেলাম!” কপট হেসে বলল গোয়েন্দা।

অন্য রুমে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল, তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। লুপাঁ হেসে বলল:

“আপনি কি আমার ভিজিটিং লিস্ট কিংবা জার্মানির সম্রাটের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তির কাগজ খুঁজে পাবেন ভেবেছিলেন নাকি? কী নিয়ে তদন্ত করা উচিত আপনার, বলে দেই: এই অ্যাপার্টমেন্টে অনেক ছোটো ছোটো রহস্য আছে। যেমন, ওই গ্যাসের পাইপটা দিয়ে কথা বলা যায়। চিমনির মাঝে একটা সিঁড়ি আছে। দেয়ালটা ফাঁপা। বেলের সিস্টেমটাও ভারি চমকপ্রদ। আরে গাঁইমার্দ! বাটনটা চেপেই দেখেন না।”

কথা শুনল গাঁইমার্দ।

“কিছু শুনলেন?” জিজ্ঞেস করল লুপাঁ।

“না।”

“আমিও না। তবে এর মাধ্যমেই আপনি আমার বেলুনওয়ালাকে সংকেত দিয়ে দিয়েছেন। বেলুনে করে সে মেঘের রাজ্যে নিয়ে চলে যাবে আমাকে।”

“এসো,” বলল গাঁইমার্চ। খোঁজাখুঁজি শেষ তার। “আর আলতু-ফালতু বকতে হবে না। চলো যাই।”

নিজের লোকদের নিয়ে হাঁটা দিলো সে। নড়ল না লুপাঁ। গোয়েন্দারা তাকে ঠেলে নড়াতে পারল না।

“কী? যেতে চাচ্ছ না নাকি?” জিজ্ঞেস করল গাঁইমার্দ।

“না, তবে ব্যাপারটা একটা জিনিসের ওপর নির্ভর করছে।”

“কীসের ওপর?”

“আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, তার ওপর।”

“স্টেশন হাউজে নিয়ে যেতে চাই।“

“তাহলে আমি যাবো না। ওখানে আমার কোনো কাজ নেই।“

“তুমি কি পাগল নাকি?”

“বললাম না, জরুরি একটা অ্যাপয়নমেন্ট আছে আমার?”

“লুপা!”

“গাঁইমার্দ, স্বর্ণকেশী মহিলার সাথে একটা অ্যাপয়নমেন্ট আছে আমার। তাকে চিন্তায় ফেলব, এরকম অভদ্র মানুষ আমাকে ভাবলে কী করে? সেটা তো খুবই অভব্য কাজ হবে।”

“শোনো, লুপাঁ,” অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল গোয়েন্দা। “এতক্ষণ অনেক ধৈর্য ধরে তোমার কথা শুনেছি। আর সহ্য করব না। এখন হাঁটো।”

“অসম্ভব। এক জায়গায় যাবার কথা আমার, আর সেই কথা রাখতে চাই আমি।”

“শেষবারের মতো বলছি— হাঁটো!”

“অসম্ভব!”

গাঁইমার্দের ইশারায় দু’পাশ থেকে লুপাঁকে চেপে ধরল দুজন; কিন্তু সাথে সাথেই ব্যথায় চিৎকার করে ছেড়ে দিলো তাকে। তাদের শরীরে দুটো সুঁই ঢুকিয়ে দিয়েছে লুপাঁ। রাগে গজরাতে গজরাতে অন্যরা ধেয়ে এলো লুপাঁর দিকে। সহকর্মীদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে, গায়ের ঝাল মেটাতে মনের সুখে পেটাতে লাগল তাকে। মাথায় জোরে একটা আঘাতের পরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল লুপাঁ।

“ওকে আঘাত করলে কিন্তু আমার কাছে জবাব দিতে হবে,” গর্জে উঠল গাঁইমার্দ।

লুপার ওপর ঝুঁকে তার অবস্থা দেখতে লাগল সে। সে দম নিচ্ছে এটা নিশ্চিত হবার পরে তাকে মাথা আর পা ধরে ঝুলিয়ে নিতে আদেশ দিলো পুলিশদেরকে। নিজে ধরল ওর দেহটা।

“আস্তে করে!…আহহা, ঝাঁকিও না ওকে! বর্বরগুলো আরেকটু হলে তো মেরেই ফেলত ওকে…লুপা, কী অবস্থা?”

“বেশি সুবিধার নয়, গাঁইমার্স…আপনার লোকেরা তো আমাকে মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেছিল।”

“তোমার নিজের দোষেই এই অবস্থা হয়েছে; এত অবাধ্য তুমি,” জবাব দিলো গাঁইমার্দ। “আশা করি ওরা তোমাকে বেশি ব্যথা দেয়নি।”

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোলো সবাই। লুপাঁ গুঙিয়ে উঠে জড়িত কণ্ঠে বলল :

“গাঁইমার্দ…এলিভেটরে করে…ওরা আমার হাড়গোড় ভেঙে ফেলছে।”

“দারুণ বুদ্ধি, অসাধারণ বুদ্ধি,” বলল গাঁইমার্দ। “তাছাড়া, সিঁড়িটা বড্ড সরু।”

এলিভেটরের বাটনে চাপ দিলো সে। লুপাঁকে যত্ন করে সিটে বসিয়ে দিলো তারা। তার পাশে বসলো গাঁইমার্দ। নিজের লোকেদের দিকে তাকিয়ে বলল:

“সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, বুঝেছ?”

এলিভেটরের দরজা লাগিয়ে দিলো গাঁইমার্দ। সুতা ছিঁড়ে যাওয়া বেলুনের মতো উপরে চলে গেল ওটা। বিদ্রুপাত্মক হাসিতে ফেটে পড়ল লুপাঁ।

“হায় খোদা!” চেঁচিয়ে উঠল গাঁইমার্দ। অন্ধকারে বাটন হাতড়ে বেড়াতে লাগল সে। ওটা খুঁজে পেয়ে বলল:

“ছয় তলা! ছয়তলার দরজাটা দেখো!”

পুলিশেরা হইহই করে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। একেকবারে দু-তিন ধাপ করে উঠতে লাগল তারা। কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। এলিভেটরটা যেন সর্বশেষ তলার ছাদ ফুঁড়ে চলে গেছে কোথাও। আশেপাশে কোথাও তাকিয়ে সেটাকে দেখতে পেল না গাঁইমার্দের সহকারীরা। তারপর ধাম করেই সবার উপরের তলায় এলো ওটা। গৃহকর্মীদের ঘর এই তলায়। তিনজন অপেক্ষা করছে সেখানে। দরজা খুলে দুজন ধরল গাঁইমার্দকে, আকস্মিক আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে সে। কাউকে কোনো বাধা দিলো না তাই। তৃতীয়জন বের করে আনল লুপাঁকে।

“গাঁইমার্দ, আপনাকে বেলুনটার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলাম। এরপরের বারে এত কোমল হৃদয়ের পরিচয় দেবার দরকার নেই। আর মনে রাখবেন, যথাযথ কারণ ছাড়া কাউকে নিজের গায়ে হাত তুলতে দেয় না আর্সেন লুপাঁ।’

গাঁইমার্দকে ভেতরে রেখে এলিভেটরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। নিচে নামা শুরু করল মেশিনটা। নিজের সহকারীদের সাথেই নিচতলায় চলে এলো সে। কোনো কথা না বলে চাকরদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল তারা। লুপাঁ যেখান দিয়ে পালিয়েছে, সেখানে এই সিঁড়ি ছাড়া যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

একটা লম্বা করিডরের বেশ কিছু বাঁক এবং রুম পেরিয়ে তালাবিহীন একটা দরজার দেখা মিলল। ঐ দরজার অন্যপ্রান্তে আরেকটা বাড়ি। সেখানেও ঠিক একইরকম বাঁক আর রুমওয়ালা একটা করিডর আছে। সেটার শেষে চাকরদের নামার সিঁড়ি। সেটা বেয়ে নামতে লাগল গাঁইমার্দ। একটা কোর্ট আর চত্বর পেরিয়ে নিজেকে র্য পিকোটে আবিষ্কার করল। এরপর বুঝল কী হয়েছে। পুরো জমি নিয়েই বানানো হয়েছে বাড়িটা। দুটো বাড়ির নিচতলা একত্রে। কিন্তু বাড়ি দুটোর সামনের দিক সমান্তরাল দুই রাস্তায়। রাস্তা দুটোর মাঝে ষাট মিটার ফারাক। তাই কেউই বুঝবে না যে এটা একই বাড়ির অংশ।

দারোয়ানের কাছে গিয়ে নিজের কার্ড দেখাল সে। জিজ্ঞেস করল:

“এখান দিয়ে কি চারটা লোক গেছে এইমাত্র?”

“জি; চারতলা আর পাঁচতলার দুই গৃহকর্মী আর তাদের দুই বন্ধু।”

“চারতলা আর পাঁচতলায় কে থাকে?”

“দুই লোক: ফভেল আর তার কাজিন, নাম প্রোভোস্ট। আজকেই এসেছে তারা, দুজন চাকর রেখে বাইরে গেছে। তারাও এইমাত্র চলে গেল।”

“আহহা!” ভাবল গাঁইমার্দ। “কী সুবর্ণ সুযোগ হারালাম! দলের সবাই মিলে এই বাড়িগুলোতে থাকত ওরা।”

এরপর হতাশ হয়ে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে।

.

চল্লিশ মিনিট পরে নর্দার্ন রেলওয়ে ধরে যাচ্ছে দুই ভদ্রলোক। লক্ষ্য: ক্যালে এক্সপ্রেস। পেছন পেছন তাদের মালপত্র বয়ে আনছে একজন কুলি। একজনের একটা হাত প্লিং এ ঝোলানো। পাংশু মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ অসুস্থ। অন্য মানুষটার মেজাজ বেশ ফুরফুরে।

“উইলসন, জলদি করো, নইলে ট্রেন চলে যাবে….জানো, এই দশটা দিনের কথা কোনোদিন ভুলব না আমি।”

“আমিও না।”

“দারুণ এক লড়াই হলো দুই পক্ষের মধ্যে! “

“অসাধারণ লড়াই!”

“মাঝেমধ্যে কিছু হোঁচট খেয়েছি অবশ্য-”

“সেটার প্রভাব পড়েনি ফলাফলে।”

“আর শেষে গিয়ে জয় আমাদেরই হয়েছে। লুপাঁ গ্রেপ্তার হয়েছে! নীল হীরা উদ্ধার হয়েছে!”

“আমার হাত ভেঙেছে!”

“ভাঙা হাতকে বিজয়ের অংশ ধরব কেন?”

“আমার হাত বলে।”

“তবে একটা কথা মনে আছে? তুমি যখন ফার্মেসিতে বসে বীরের মতো কষ্ট সহ্য করছিলে, তখন আমি এই রহস্যের সবচেয়ে মূল্যবান সূত্রটা আবিষ্কার করেছিলাম।”

“কী সৌভাগ্যের বিষয়!”

ট্রেনের দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে।

“জলদি করুন সবাই!”

একটা খালি কম্পার্টমেন্টে চড়ে বসলো কুলি। তাদের মালপত্র তুলে দিলো র‍্যাকে। বেচারা উইলসনকে উঠতে সাহায্য করল শোমস।

“কী হয়েছে, উইলসন? আসলেই এত খারাপ লাগছে? আরে, স্নায়ুর জোর বাড়াও তো।”

“আমার স্নায়ু ঠিকই আছে।”

“কী হয়েছে তাহলে?”

“একটা হাত নড়াতে পারছি না।”

“আরে তাতেই কী?” চেঁচিয়ে উঠলেন শোমস। “মানুষের হাত ভাঙে না নাকি? মন ভালো করো তো।”

কুলির হাতে পঞ্চাশ পেনি ধরিয়ে দিলো শোমস।

“ধন্যবাদ, মসিয়ে শোমস,” বলে উঠল কুলি।

তার মুখের দিকে তাকালো ব্রিটিশ গোয়েন্দা। কুলিটা আর কেউ নয়, স্বয়ং আর্সেন লুপাঁ।

“আপনি!…আপনি!” তোতলাতে লাগল সে। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

নিজের ভালো হাতটা তুলে উইলসন বলল:

“কিন্তু আপনাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গাঁইমার্দ আর ত্রিশজন লোকের কাছে আপনাকে দিয়ে এসেছিল শোমস।”

দুই হাত ভাঁজ করে কিছুটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে লুপাঁ বলল:

“কী করে ভাবলেন, বিদায় না জানিয়ে আপনাকে চলে যেতে দেবো? আমাদের মাঝে এরকম দারুণ সম্পর্ক হবার পরে এ ঘটনা ঘটতে দেই কীভাবে? অভদ্র আর অকৃতজ্ঞের মতো কাজ হবে না সেটা?”

ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। লুপাঁ আবার বলল:

“আচ্ছা, প্রয়োজনীয় সবকিছু আপনার কাছে আছে তো? টোব্যাকো, দেয়াশলাই…আর…সন্ধ্যার পত্রিকা? ওগুলোর মাঝে আমার গ্রেপ্তারের খবর পাবেন আপনি- আপনার সর্বশেষ অভিযান। আপাতত, বিদায়। আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুব ভালো লাগল। কখনো কোনো কাজে আসতে পারলে জানাবেন, খুব খুশি হবো…” প্লাটফর্মে লাফিয়ে নেমে দরজা লাগিয়ে দিলো সে।

“বিদায়,” আবার বলল সে। রুমাল নাড়তে লাগল। “আপনার কাছে চিঠি লিখব আমি…আপনিও লিখবেন কিন্তু। আর আপনার হাত ভেঙে যাবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত, উইলসন। আপনাদের দুজনের কাছ থেকেই চিঠি পাওয়ার আশায় থাকব। কিংবা মাঝেমাঝে পোস্টাল কার্ড। ঠিকানার জায়গায় কেবল ‘লুপা, প্যারিস’ লিখে দিলেই হবে। সেটুকুই যথেষ্ট…বিদায়…শীঘ্রই দেখা হবে।