৩. হার্লক শোমস ওপেনস হোস্টাইলিটিস

অধ্যায় তিন – হার্লক শোমস ওপেনস হোস্টাইলিটিস

“মঁসিয়ে কী চান?”

“যেকোনো কিছু হলেই চলবে,” জবাব দিলো আর্সেন লুপাঁ। খাবার নিয়ে যেন কোনো চিন্তাই নেই তার। “আপনার যা ইচ্ছা দিন, মাংস আর মদ ছাড়া।”

কিছুটা রেগে চলে গেল ওয়েটার।

“এখনো ভেজিটেরিয়ান নাকি তুমি?” অবাক হয়ে বললাম আমি।

“আগের চেয়ে আরো বেশি নিয়ম মেনে চলছি এখন,” বলল লুপাঁ।

“স্বাদের কারণে, বিশ্বাসের কারণে, নাকি অভ্যাসের কারণে?”

“পরিচ্ছন্নতা মেনে চলি, তাই।”

“কখনো হাত ফস্কে দু’-এক টুকরো খেয়ে ফেলো না?”

“তা মানুষের সাথে মাঝে মাঝে তো খেতে হয়-ই…নইলে তো আমাকে আজব লোক ভেবে বসবে।”

নর্দার্ন রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটা ছোট রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলাম আমরা। লুপাঁই দাওয়াত দিয়েছে আমাকে। মাঝেমধ্যেই আমাকে টেলিগ্রাম করে অচেনা সব রেস্টুরেন্টে দাওয়াত দেয় সে। সেখানে বসে শান্তিমতো ডিনার সারি আমরা। তবে একঘেয়ে লাগে না। ওর কোনো নাটকীয় অভিযানের কথা বলে সবসময়ই আসর জমিয়ে দেয় সে।

ঐদিন সন্ধ্যায় ওর মন স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই ফুরফুরে ছিল। কথায় কথায় হাসছিল সে, কৌতুক বলছিল। আর সব কথাতেই সূক্ষ্ণ ব্যাঙ্গের ছায়া তো ওর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। রাগ কিংবা হিংসার বশে নয়, স্রেফ মজা করেই স্বতস্ফূর্তভাবে কথায় কথায় টিপ্পনি কাটে সে। ওকে খুশি খুশি দেখে ভালোই লাগছিল আমার। ওকে সে কথাটা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

“তা ঠিকই ধরেছ,” উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল সে। “কোনো কোনো দিনকে আমার কাছে বসন্তের সকালের মতোই উজ্জ্বল আর সুন্দর। কিন্তু জীবন তো অনন্ত গুপ্তধনের উৎস, বিনোদনের অভাব কখনোই হবে না আমার। আর আমি তো উড়াধুরা জীবনই কাটাই।”

“একটু বেশিই উড়াধুরা বলতে হবে।”

“তা ঠিক! কিন্তু গুপ্তধন কিন্তু অনন্ত। দুই হাতে সেটা খরচ করতে পারব আমি। আমার যৌবন আর শক্তিকে স্বর্গের ফোর উইন্ডের হাতে তুলে দিয়ে সেটার বদলে আরো বেশি শক্তি আর তারুণ্য লাভ করতে পারব আমি। তাছাড়া, আমার জীবনটা এত সুন্দর!…চাইলে, আমি হয়তো, কী বলব?… একজন বক্তা, একজন কারিগর কিংবা একজন রাজনীতিবিদও হতে পারি। কিন্তু তোমাকে নিশ্চিত করে বলছি, আমার এসব হবার কোনো ইচ্ছাই নেই। আমি হলাম আর্সেন লুপাঁ; আজীবন আর্সেন লুপাঁই থাকব। আমার সাথে তুলনা করা করা যায়, এমন ক্যারিয়ারের খোঁজ করেছিলাম ইতিহাসে। এর চেয়েও বেশি উত্তেজনা ছিল যার জীবনে…নেপোলিয়ন? তা বলা যায় হয়তো।…কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে নেপোলিয়ন পুরো ইউরোপ দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তখন প্রতিটা যুদ্ধের আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করত সে, এটাই কি তার লড়া শেষ যুদ্ধ কি না।”

ও কি মজা করছে? নাকি গুরুত্ব দিয়ে বলছে এসব? কথাগুলো বলতে বলতে আরো অস্থির হয়ে উঠল সে:

“তুমি কি বুঝতে পারছ? চিরন্তন বিপদের আশঙ্কা থাকাটাই তো জীবনে সব! পদে পদে নিঃশ্বাসে বিপদের গন্ধ পাবে, প্রতিটা অস্বাভাবিক শব্দেই চমকে উঠবে…আর ভয়ানক নাটকের মাঝখানে নিজের মাথাটা ঠান্ডা রাখবে…ভেঙে পড়া চলবে না! অন্যথায় হেরে যাবে তুমি। এরকম অনুভূতি কেবল আর একটা পেশাতেই পাওয়া যায়। রেসিং। কিন্তু রেসকারের ড্রাইভারের জন্য এই অনুভূতি বজায় থাকে কয়েক ঘন্টা, আর আমার জন্য এই অনুভূতি বজায় থাকবে সারাটা জীবন।”

“কী সব স্বপ্ন!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “এরকম টানটান উত্তেজনাময় জীবন বেছে নেবার পেছনে তোমার নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই, এটা মেনে নিতে বলো আমাকে?”

“তুমি তো তুখোড় একজন সাইকোলজিস্ট,” মুচকি হেসে বলল সে। “নিজেই ভেবে বের করো।”

নিজের জন্য গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো সে। ওটা খেয়ে সে বলল:

“আজকের লে টেম্পস পত্রিকা পড়েছ?”

“না।”

“হার্লক শোমস আজ বিকালে চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে। ছয়টা নাগাদ প্যারিসে চলে এসেছে সে।”

“হে ঈশ্বর! সে আসছে কী করতে?”

“কাউন্ট আর কাউন্টেস ডি ক্রোজোন, মঁসিয়ে গার্বোই আর ব্যারন ডি’হটরেকের ভাগ্নের অনুরোধে এখানে বেড়াতে আসছে সে। নর্দার্ন রেলওয়ে স্টেশনে তাদের সাথে মিলিত হবে সে। এরপর তাকে নিয়ে যাবে গাঁইমার্দের কাছে। এ মুহূর্তে ওরা ছয়জন মিলে আলোচনা করছে।”

প্রবল ইচ্ছে থাকলেও লুপাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনো আমি প্ৰশ্ন করিনি তাকে। ও নিজেই বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলেছে বিভিন্ন সময়ে। ঐ মুহূর্ত পর্যন্ত নীল হীরক রহস্যের সাথে ওর নাম জড়ানো হয়নি, অন্তত অফিসিয়ালিভাবে। সেকারণেই ধৈর্য ধরে নিজের কৌতুহলকে চাপা দিলাম আমি। ও বলতে লাগল:

“লে টেম্পস পত্রিকায় আমার পুরোনো বন্ধু গাঁইমার্দের একটা সাক্ষাৎকারও আছে। তার কথামতে, জনৈক স্বর্ণকেশী মহিলা, যে নাকি আবার আমার বন্ধু, খুন করেছে ব্যারন ডি’হটরেককে। সে-ই নাকি বিখ্যাত আংটিটা চুরি করার চেষ্টা করেছিল কাউন্টেসের কাছ থেকে। তোমার কী মনে হয়? এসব অপরাধ ঘটানোর জন্য ও দায়ী করছে আমাকে।

নিজের ভেতর থেকে উঠে আসা কাঁপুনিটা চাপা দিতে পারলাম না আমি কথাটা কি আসলেই সত্যি? চৌর্যবৃত্তির ওপর ভর করে গড়ে তোলা এই ক্যারিয়ার, কার্যপদ্ধতি, এরকম জীবন বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য- সবকিছু থেকে দূরে সরে কি খুনের মতো গুরুতর অপরাধের পথে হাঁটা শুরু করেছে সে? ওর দিকে তাকালাম আমি। শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সে, চোখগুলো চকচক করছে আন্তরিকতায়। ওর হাতগুলো দেখলাম। দীর্ঘ, মোলায়েম, শিল্পীর হাতের মতো। এই হাত দিয়ে কারো ক্ষতি করা সম্ভব না…

“গাঁইমার্দ দিবা-স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে,” বললাম আমি।

“না, না!” প্রতিবাদ করল লুপাঁ। “গাঁইমার্দের বুদ্ধি আছে। মাঝে মাঝে উনি অনুপ্রাণিতও করেন আমাকে।”

“অনুপ্রাণিত করেন!”

“হ্যাঁ, যেমন সাক্ষাৎকারটা দিয়ে মারাত্মক ভালো একটা কাজ করেছে ও। প্রথমেই নিজের ব্রিটিশ প্রতিদ্বন্দ্বীর এখানে আসার কথা জানিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে আমাকে। ওর কাজটা আরো কঠিন হয়ে গেল এখন। দ্বিতীয়ত, এই রহস্য সমাধানের কোন পর্যায়ে ও আছে, সেটাও বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছে। এতে করে ওর করে যাওয়া কাজের জন্য কৃতিত্ব নিতে পারবে না শোমস। ভালোই চাল চালছে ও।”

“সে যাই হোক, এখন দু’-দুজন মহারথীকে সামলাতে হবে তোমার!”

“আরে! ওদের একজনকে তো আমি গোনার মধ্যেই ধরছি না।

“আর অপরজনকে?”

“শোমস? হ্যাঁ, এ লোক আমার যোগ্য প্রতিপক্ষই। এজন্যই আমার মেজাজ আজ এত ভালো। প্রথম কথা, ও আসায় আমার আত্মমর্যাদা অনেক বেড়েছে। এরকম ক্ষুরধার মস্তিষ্কের একজন ব্রিটিশ গোয়েন্দার প্রতিপক্ষ হিসেবে ওরা যোগ্য মনে করছে আমাকে, এতেই খুশি আমি। আর আমার মনের কথা একবার ভাবো। হার্লক শোমসের সাথে দ্বৈরথে জড়াবো, একথা ভাবতেই তো খুশিতে বিগলিত হয়ে যাচ্ছি আমি। তবে ওকে টেক্কা দিতে গেলে মগজের প্রতিটা কোষকেই খেলাতে হবে; লোকটা ভারি চতুর, এক বিন্দুও ছাড় দেবে না সে।”

“তারমানে ওকে খুব শক্ত একজন প্রতিপক্ষ ভাবছ তুমি?”

“তা ভাবছি। আমার মতে, একজন গোয়েন্দা হিসেবে ও নিজের যোগ্য প্রতিপক্ষ পায়নি কখনোই। তবে একটা সুবিধা পাবো আমি। ও বারবার আঘাত হানবে, আর আমি বারবার ঠেকিয়ে যাবো। তাই আমার কাজটা সহজ। তাছাড়া, ওর কর্মপদ্ধতি আমার জানা। কিন্তু ও আমার কিছুই জানে না। ওকে এমন কিছু ধোঁকাবাজির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যাতে করে ও আরেকটু ভাবতে বাধ্য হয়।”

টেবিলে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজালো সে। এরপর আনন্দিত ভঙ্গিতে বলল: “আর্সেন লুপাঁ বনাম হার্লক শোমস…ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ড… ট্রাফালগারের প্রতিশোধ নেয়া হবে অবশেষে। আরে! ঐ হতচ্ছাড়া নিশ্চয়ই জানেই না যে আমি আগে থেকেই সতর্ক হয়ে বসে আছি…আর সতর্ক হয়ে থাকা লুপাঁ তো-”

হঠাৎ থেমে গেল সে। দমক দিয়ে কাশি উঠে গেল ওর। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল এমনভাবে, যেন গলায় কিছু আটকিয়েছে।

“রুটি আটকালো নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। “পানি খাও।”

“না, সেরকম কিছু না,” জড়িত গলায় বলল সে।

“তাহলে কী হয়েছে?”

“দম নিতে পারছি না। “

“জানালা খুলে দেবো আমি?”

“নাহ, বাইরে যাব আমি। আমাকে আমার হ্যাট আর ওভারকোটটা দাও তো! আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।”

“কী হয়েছে?”

“এইমাত্র যে দুই ভদ্রলোক ঢুকল… লম্বা ব্যক্তিটাকে দেখো… আমরা যখন বেরোবো, তখন আমার বামে থাকবে তুমি, যাতে করে লোকটা আমাকে দেখতে না পারে।”

“তোমার পেছনে বসে আছে যে, তার কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, বাইরে চলো, খুলে বলছি।”

“কে এই লোক?”

“হার্লক শোমস।”

মরিয়া হয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সে, নিজের আবেগ নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছে যেন। ন্যাপকিন সরিয়ে এক গ্লাস পানি খেলো সে, অনেকটা সামলে উঠেছে। এরপর আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল:

“কিছু কিছু ব্যাপার এমন চমকে দেয় আমাকে, অদ্ভুত লাগে। কিন্তু ওকে এখানে দেখব ভাবিনি তো—”

“তোমার ভয় পাবার কী আছে? তুমি তো বহুরূপী, কেউই চিনবে না তোমাকে। তোমাকে যতবার দেখি, ততোবারই মনে হয় তোমার চেহারা বদলে গেছে, কী যেন আর আগের মতো নেই। আমি জানি না কেন। “

“কিন্তু ও তো আমাকে চিনে ফেলবে,” বলল লুপাঁ। “আমাকে মাত্র একবার দেখেছে ও, কিন্তু সেসময়ে মনে মনে আমার একটা ছবি তুলে রেখেছে সে। বাইরের চেহারাটার না, ভেতরের আত্মাটার। আমি দেখতে কীরকম সেটা না জানলেও আমি আসলে কীরকম- সেটা ঠিকই জানে ও। বুঝতে পেরেছ? আর তারপর…ওকে এখানে দেখব ভাবিনি আমি। কী অদ্ভুতভাবে দেখা হয়ে গেল! ছোট্ট এই রেস্টুরেন্টে…”

“আমাদের কি বেরিয়ে যাওয়া উচিত?”

“এখনই না,” বলল লুপাঁ।

“তুমি এখন কী করবে?”

“এখন স্বাভাবিক আচরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে…ওর ওপর ভরসা রাখতে হবে- ওকে বিশ্বাস করতে হবে…”

“তুমি কথা বলবে না ওর সাথে?”

“কেন বলব না? এতে আমার সুবিধাই হবে। আর ও কী জানে, ও কী ভাবছে, সেটা জানা যাবে। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমার ঘাড়ের দিকে নজর ওর। আমাকে আগে কোথায় দেখেছে, সেটা মনে করার চেষ্টা করছে মনে হয়।’

এক মুহূর্ত ভাবল সে। ওর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল। এরপর নিজের তাড়নার কাছে হেরে গিয়েই যেন দাঁড়িয়ে গেল সে। এই পরিস্থিতিতে যে এটা করা উচিত হবে না, সেটা আর মাথায় রাখল না। ঘুরে মাথা নুইয়ে খুশি খুশি ভঙ্গিতে বলল:

“আরে, কী সৌভাগ্য? আপনাকে এখানে দেখে খুবই খুশি হলাম! আমার এক বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাকে।”

এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল ব্রিটিশ ভদ্রলোক। এরপর এমনভাবে হাত চালালো যেন এখনই সে পাকড়াও করবে আর্সেন লুপাঁকে। লুপাঁ অবশ্য মাথা ঝুঁকালো। বলল :

“এটা তো ঠিক হবে না। তাছাড়া এভাবে হাত চালিয়ে… তেমন একটা কাজ হবে না, দেখতে অদ্ভুতই লাগবে শুধু।’

আশেপাশে তাকালো ব্রিটিশ ভদ্রলোক, কারো সাহায্য চাইবে কি না ভাবছে বোধহয়।

“কোনো লাভ নেই,” বলল লুপাঁ। “তাছাড়া, আপনি কি নিশ্চিত যে আমার গায়ে হাত দিতে পারবেন আপনি? অন্তত নিজের ব্রিটিশ ভদ্রতার একটু পরিচয় তো দিন, সর্বোপরি, একজন ভালোমানুষের পরিচয় দিন।”

তার উপদেশ সম্ভবত মনে ধরল ডিটেকটিভের। হালকা করে উঠে পেশাদার ভঙ্গিতে বলল:

“মঁসিয়ে উইলসন, আমার প্রিয় বন্ধু এবং সহকারী- ইনি হলেন মঁসিয়ে আর্সেন লুপাঁ।”

উইলসনের বিস্মিত মুখ দেখে হেসে ফেলল সবাই। বিস্ফোরিত চোখ আর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে সে, কিছু বুঝে উঠতে পারছে না যেন। হার্লক শোমস হেসে বলল:

“ওহে উইলসন, এ তো খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এতে এত আকাশ থেকে পড়ার কিছু নেই। “

“ওকে তুমি গ্রেপ্তার করছ না কেন?” কোনোমতে বলল উইলসন।

“উইলসন, দেখো, এই ভদ্রলোক তো আমার আর দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কড়ে আঙুল তোলার আগেই সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।”

“আমি আপনার কাজে কোনো বাধা দিতে চাই না,” বলল লুপাঁ। টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে এসে এমন এক চেয়ারে বসল সে, যাতে ওর আর দরজার মাঝে পড়ে হার্লক। এতে ওর পালানোটা খুবই কঠিন হয়ে গেল।

শোমসের দিকে তাকালো উইলসন। এরকম সংজ্ঞাহীন সাহসের উদাহরণকে সাধুবাদ দেবে কি না, সেটা নীরবে জিজ্ঞেস করল যেন। ব্রিটিশ ভদ্রলোকের পাথুরে অভিব্যক্তি দেখে অবশ্য কিছু বোঝা গেল না। এক মুহূর্ত পরেই সে ডাক দিলো:

“ওয়েটার!”

ওয়েটার আসার পরে সোডা, বিয়ার আর হুইস্কির অর্ডার দিলো সে। শান্তিচুক্তি সাক্ষর হয়ে গেছে— পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত। কয়েক মুহূর্ত পরেই চার ভদ্রলোককে বন্ধুর মতো আড্ডা দিতে দেখা গেল।

হার্লক শোমস দেখতে এমন, যার সাথে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রতিদিনই দেখা হওয়া সম্ভব। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কোঠায়, দেখে মনে হচ্ছে, পুরো জীবনটাই যেন অফিসে কাটিয়েছে সে- প্রতিদিন নীরস সব হিসাব করেছে, ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের বিবৃতি লিখেছে। চেহারা দিয়ে লন্ডনের আর দশজন সাধারণ নাগরিক থেকে তাকে আলাদা করার উপায় নেই। তবে তার দুই চোখ— সেগুলোর ধারালো দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় যে, মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে এগুলোর।

আর সে তো হার্লক শোমস— অন্তর্দৃষ্টি, পর্যবেক্ষণশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতার এক অসাধারণ সমন্বয়। এমনকি ভবিষ্যৎ বলারও ক্ষমতা রাখে সে। কারো মনে হতে পারে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্ট দুই ক্ষুরধার গোয়েন্দা- এডগার অ্যালান পো-র দুপা আর এমিল গ্যাবোরিয়াও-এর লেকোককে যেন তুলে নিয়েছে প্রকৃতি, আর তাদের একসাথে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছে হার্লক শোমসকে। সে কারণেই সে তাদের চেয়েও অসাধারণ, তাদের চেয়েও অতিমানবিক। আর এই অতিমানবের কর্মপদ্ধতি ফাঁস হলে বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। আচ্ছা, হার্লক শোমস নিজেই কোনো পৌরাণিক চরিত্র নয় তো। হয়তো কোনান ডয়েলের মতো কোনো মহান ঔপন্যাসিকের মগজ থেকে বেরিয়েছে এই চরিত্র।

যখন আর্সেন লুপাঁ তার কাছে জানতে চাইল যে সে ফ্রান্সে কতদিন অবস্থান করবে, তখন সে তাদের আলাপচারিতাকে আগের পথে পরিচালিত করে বলল :

“সেটা তো আপনার ওপর নির্ভর করছে, মঁসিয়ে।”

“ওহ!” হেসে ফেলল লুপাঁ। “এটা আমার ওপর নির্ভর করলে তো আপনি আজকে রাতেই ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে পারবেন।”

“সেটা একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তবে আট-নয়দিনের মধ্যে ফিরে যাবার ইচ্ছা আছে আমার- বড়জোর দশ।”

“আপনার কি অনেক তাড়া আছে?”

“হাতে অনেক কেস আমার। অ্যাংলো-চাইনিজ ব্যাংকের ডাকাতি, লেডি একলেস্টনের অপহরণ… মঁসিয়ে লুপাঁ, আপনার কি মনে হয় না যে আমি এক সপ্তাহের মাঝে প্যারিসে আমার কাজ শেষ করে ফেলতে পারব?”

“নীল হীরক রহস্যের সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই পারবেন। এই সময়টুকু নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে আমার। ঐ রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে আমাকে ধরার ব্যাপারে কোনো সুবিধা পেয়ে যেতে পারেন আপনি।”

“কিন্তু আমি পুরো কাজটাই আট থেকে দশ দিনে শেষ করতে চাই।”

“আর এগারোতম দিনে আমাকে গ্রেপ্তার করবেন বোধহয়?”

“না, দশ দিনের বেশি থাকব না।”

ধীর গতিতে মাথা নাড়ল লুপাঁ। এরপর বলল :

“সেটা খুবই কঠিন হয়ে যাবে।”

“কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়, তারমানে নিশ্চিত-”

“পুরোপুরি নিশ্চিত,” বলল উইলসন। সহযোগীর সাথে কোন কোন ধাপ পেরিয়ে এই কেসের আকাঙ্খিত ফলাফল পাবে, তার সবকিছুই যেন ভেবে ফেলেছে সে।

“অবশ্যই। কিন্তু আমার হাতে সব তুরুপের তাস নেই,” বলল হার্লক শোমস। “এই কেসগুলো ইতিমধ্যেই অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। যে তথ্য আর সূত্রের ওপর ভিত্তি করে এগুবো, তার অনেকগুলো ইতিমধ্যেই নেই হয়ে গেছে।”

“পায়ের ছাপ, সিগারেটের ছাই- এসব,” গম্ভীর ভঙ্গীতে বলল উইলসন। “মঁসিয়ে গাঁইমার্দ বেশ কিছু সমাধান টেনেছেন, এ ব্যাপারে সকল আর্টিকেল পড়েছি আমি, নিজেও কিছু সিদ্ধান্তে এসেছি।”

“বিভিন্ন অনুমান বা বিশ্লেষণ থেকে এসব সিদ্ধান্তে এসেছি আমরা,” বুঝিয়ে দিলো উইলসন।

“আমি কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করতে চাই,” শ্রদ্ধাবনত ভঙ্গিতে বলল আর্সেন লুপাঁ। এই ভঙ্গিতেই হার্লক শোমসের সাথে কথা বলে যাচ্ছে সে। “এই কেসের ব্যাপারে আপনি কি সিদ্ধান্তে এসেছেন, এটা আমার জিজ্ঞেস করাটা কি অযাচিত নাক গলানোর পর্যায়ে পড়ে?”

এই দুই চরিত্রকে মুখোমুখি বসে আন্তরিকভাবে আলোচনা করতে দেখাটা আসলেই সাংঘাতিক একটা বিষয়। এমন ভাব যেন দুর্বোধ্য কোনো সমস্যার সমাধান করছে দুজনে বসে। কিংবা কোনো বিতর্কিত ব্যাপারে একমত হয়েছে। উইলসনকে দেখে তো মনে হচ্ছে, খুশিতে সে সপ্তম-স্বর্গে পৌঁছে গেছে। নিজের পাইপ ধীরে ধীরে ভরতি করল হার্লক শোমস, তারপর সেটায় আগুন জ্বালিয়ে বলল:

“প্রথম দেখায় জটিল মনে হলেও এই রহস্যটা আসলে বেশ সরল।”

“বেশ সরল,” তার কথার পুনরাবৃত্তি করল উইলসন।

“আমার মতে এখানে রহস্য কেবল একটাই,” বলল শোমস। “ব্যারন ডি’হটরেকের হত্যাকাণ্ড, আংটিটার ইতিহাস, আর ৫১৪ নং লটারি টিকেটটার কথা ভুললেও চলবে না— এই তিন ধাপকে একত্রে ‘স্বর্ণকেশী মহিলার রহস্য’ নাম দেয়া যেতে পারে। এখন, আমি যা বুঝছি, এই তিন ধাপের মধ্যে সম্পর্কটা বের করতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। তিনটা বিষয়ই যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা যে তথ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে, সেটা বের করতে হবে। গাঁইমার্দের তদন্তে কমতি আছে। তিন ক্ষেত্রেই ঐ মহিলার অন্তর্ধানের ব্যাপারকে মূল চাবিকাঠি ধরেছে সে। কীভাবে চুপিসারে সে গায়েব হয়েছে, এই নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কিন্তু এই থিওরি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।”

“তো, আপনার কী ধারণা?” জিজ্ঞেস করল লুপাঁ।

“আমার মতে, এই তিন ধাপের এরকম একই বৈশিষ্ট্য আপনারই বুদ্ধি করা। এভাবে ঘটনাকে নিজের বেছে নেয়া অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত করেছেন আপনি। এই জিনিসটা আপনার কাছে পরিকল্পনার চেয়েও বেশি কিছু। সাফল্যের জন্য এক অপরিহার্য শর্ত এটা।”

“আপনি কি এই থিওরিতে বিস্তারিত আর কিছু বলতে পারবেন?”

“নিশ্চয়ই। প্রথমেই আপনার টক্কর লেগেছে মঁসিয়ে গার্বোইর সাথে। মঁসিয়ে দেতিনাঁর বাড়ি, যেখানে সবার মোলাকাত হলো, সে জায়গাটা যে আপনারই বেছে নেয়া, এটা তো পরিষ্কার? আপনার মতে, এই জায়গাটাই সব থেকে নিরাপদ। সেখানে সবার দেখা করার ব্যবস্থা করলেন আপনি। মোটামুটি জনসমক্ষেই দেখা দিলেন স্বর্ণকেশী মহিলা আর মাদামোয়াজেল গাৰ্বোই।’

“প্রফেসরের মেয়ে,” যোগ করল উইলসন। “এখন নীল হীরার কেসটা ভেবে দেখুন। এটা যখন ব্যারন ডি’হটরেকের কাছে ছিল, তখন কি এটা বগলদাবা করার চেষ্টা করেছিলেন আপনি? না। কিন্তু ব্যারন তার ভাইয়ের বাড়ি নিয়ে নিয়েছিলেন। ছয়মাস পরে আঁতোয়ানেত ব্রেহাতের হস্তক্ষেপ এবং ওটা চুরির প্রথম চেষ্টা সংঘটিত হয়। হীরাটা আপনার হাত গলে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ওটা নিলামের ব্যবস্থা করা হয় ড্রাউওটের এক নিলামখানায়। ব্যাপক প্রচারণা চলে এ নিয়ে। ঐ নিলামখানায় কি যে কারোরই ঢোকার অনুমতি ছিল? কোনো আনাড়ি চোর কি গ্যাঞ্জামের মাঝে ওটাকে চুরি করতে পেরেছে? না। মঁসিয়ে হার্শম্যান যখন আংটিটা কেনা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন, তখনই এক নারী চিঠি লিখে সতর্ক করে তাকে। সেই একই নারী যে কাউন্টেস ডি ক্রোজোনকে প্রভাবিত করে তাকে দিয়ে ঐ জিনিসটা কেনায়। তারপরেই কি চুরি হয়েছিল আংটিটা? না; আপনি সেই সুযোগ পাননি। তাই আপনাকে আরো অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে কাউন্টেস তার শ্যাঁতোতে গেলেন। সেই অপেক্ষাতেই ছিলেন আপনি। গায়েব হয়ে গেল আংটিটা।”

“কিছুক্ষণ পরেই ওটাকে আবার পাওয়া গেল হার রেইকেনের টুথ পাউডারের বোতলে।”

“উফ! কী আজগুবি কথা!” চেঁচিয়ে উঠে টেবিলে মুষ্টি দিয়ে ঘুষি মারল শোমস। “আমাকে এসব রূপকথার গল্প শোনাবেন না। ভুল পথ দেখে অন্য দিকে যাওয়ার বয়স অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি আমি।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?”

“কী বলতে চাইছি আমি?” এক মুহূর্ত থেমে নিজেকে ধাতস্থ করল শোমস। তারপর বলল:

“টুথ পাউডারের বোতলে পাওয়া ঐ আংটিটা আসল না। সত্যিকারের আংটিটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন আপনি।”

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল লুপাঁ। এরপর স্থির দৃষ্টিতে ব্রিটিশ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল:

“মঁসিয়ে, আপনি বড়ই উদ্ধত।”“

“উদ্ধতই বটে,” প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো উইলসন।

“হ্যাঁ, তবে আপনাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। খুবই রহস্যময় একটা বিষয়ে আলো দেখিয়েছেন আপনি। কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা এই কেসের পিছনে ছোটা কোনো রিপোর্টারই এই সত্যের কাছাকাছি আসতে পারেনি। অন্তর্দৃষ্টি আর যুক্তির এক অসামান্য প্রদর্শনী এটা।”

“আহ! একজন ব্যক্তি যে কি না নিজের মগজকে ব্যবহার করে।” দক্ষ অপরাধীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে বিড়বিড় করল হার্লক শোমস।

“আর খুব কম লোকেরই ব্যবহার করার মতো মগজ আছে।” লুপাঁ বলল। “আর এখন, অনুমানশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রও দিনদিন কমে আসছে। আর এ বাজে পরিস্থিতি এটাই পরিষ্কার করে যে—”

“যাইহোক, এখন আমার কাজ ২৫ নং র্য ক্ল্যাপেরন, ১৩৪ নং অ্যাভিনিউ অঁরি-মার্টিন আর শ্যাতো দ্য ক্রোজোনের চার দেয়ালের মাঝে ঘটা তিনটা ঘটনার পেছনের কারণ বের করা। তাহলেই আমার কাজ শেষ। সেটা তো বাচ্চাছেলের কাজ, তাই না?”

“তা ঠিকই বলেছেন আপনি।”

“তাহলে মঁসিয়ে লুপাঁ, দশ দিনে কাজ শেষ করার কথা বলে কি কিছু ভুল করেছি আমি?”

“দশ দিনের মাঝে আপনি পুরো সত্যটাই জেনে যাবেন।”

“আর আপনাকে গ্রেপ্তারও করা হবে। “

“না।”

“না?”

“আমাকে গ্রেপ্তার করতে হলে অনেকগুলো অসম্ভব এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে দিতে হবে। এরকম কোনো ঘটনা ঘটার আশ্বাস দিতে পারছি না আমি।”

“ইংল্যান্ডে একটা কথা প্রচলিত আছে, অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।”

দুজন একে অপরের দিকে শান্ত এবং নির্ভীক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অপ্রীতিকর কিছু করার চেষ্টা করল না কেউ। বুদ্ধি আর দক্ষতার দিক দিয়ে দুজনেই এখন সমানে সমান। আর দুজনের এই সাক্ষাতকে তলোয়ার লড়াইয়ের আগে দুই প্রতিপক্ষের তলোয়ারের ঠোকাঠুকি বলা চলে।

“উফ!” হুঁপা বলল। “অবশেষে নিজের খ্যাতির সমকক্ষ একজন প্রতিপক্ষ পেলাম আমি— তাকে হারানোটাই আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বিত অর্জন হবে।”

“আপনার কি ভয় লাগছে না?” জিজ্ঞেস করল উইলসন।

“তা একটু লাগছে, মঁসিয়ে উইলসন,” স্বীকার করল লুপাঁ। নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আর তার প্রমাণস্বরূপ এখনই দ্রুতবেগে প্রস্থান করব আমি। তাহলে, দশ দিনের কথাই রইল, মঁসিয়ে শোমস?”

“জি, দশ দিন। আজকে তো রবিবার, সামনের বুধবার রাত আটটার মাঝে সব সমাধা হয়ে যাবে।”

“আর আমি জেলে চলে যাব?”

“সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”

“আহা! আমার মতো একজন আমুদে মানুষের জন্য এরকম ভবিষ্যত খুব সুখকর নয়। চিন্তাহীন জীবন কাটাই আমি। পৃথিবীর সবকিছু নিয়েই আমার তুমুল আগ্রহ। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশকে ঘৃণার চোখে দেখি। বেশ কিছু বন্ধু আর ভক্তের প্রতি দরদ আছে আমার। অথচ এখন তার সবকিছুই বদলে যেতে যাচ্ছে! মেডালের উল্টোপিঠটা যেন দেখব এবার আমি। ঝকঝকে রোদের পরেই বৃষ্টি আসে কি না। এখন আর এটা হাসির বিষয় নয়। তাই বিদায়!”

“জলদি করুন,” উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে উঠল উইলসন। হার্লক শোমস যার ওপর এত প্রভাব ফেলেছে, তার প্রতি সমব্যথী হয়ে পড়েছে সে। “এক মিনিটও নষ্ট করা যাবে না।”

“এক মিনিটও নেবো না, মসিয়ে উইলসন। তবে আপনার সাথে দেখা করে যে ভালো লাগল, সেটা প্রকাশ করতে চাই আমি। আপনাকে বলতে চাই, এমন একজন যোগ্য সহকারী পেয়েছেন যিনি, তাকে বড় হিংসা হয় আমার।”

একে অপরের উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ালো তারা। লড়াইয়ের পূর্বে প্রতিপক্ষরা যেমনটা করে থাকে। একে অপরের প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই তাদের। কিন্তু পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এ কাজ করতে হচ্ছে। আমার হাতটা খপ করে টেনে ধরে আমাকে বাইরে নিয়ে এলো লুপাঁ।

“কী মনে হয়, ভাই? আমাকে নিয়ে মনে মনে যে জীবনী লিখছো, তাতে আজকে সন্ধ্যার এই আশ্চর্য ঘটনাটা দারুণ একটা সংযোজন হবে নিশ্চয়ই?”

রেস্টুরেন্টের দরজাটা লাগিয়ে দিলো সে। কয়েক পা এগিয়ে থেমে বলল: “তুমি কি সিগারেট খাও?”

“না। তুমিও তো খাও না, যতদুর জানি।”

“ঠিকই ধরেছ, আমিও খাই না।”

একটা ওয়াক্স-ম্যাচ দিয়ে সিগারেট ধরালো সে। ওটা নেভানোর জন্য ঝাঁকালো বেশ কয়েকবার। একটু পরেই ফেলে দিলো সিগারেটটা। সাথে সাথেই রাস্তার অপরপাশে ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দুই লোকের সাথে মিলিত হলো সে। এটা সিগনাল ছিল মনে হয়। অপরপাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল সে। এরপর আবার ফিরে এলো আমার কাছে।

“কিছু মনে কোরো না। ঐ হতচ্ছাড়া শোমস মনে হয় বেশ বড় ঝামেলাই বাঁধাবে। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি। ও এখনো আর্সেন লুপাঁর রহস্য সমাধান করতে পারেনি। এবার ও জানবে নিজের রক্ত গরম করতে কি করি আমি! আর এখন- বিদায়। উইলসন ভদ্রলোক ঠিকই বলেছে। একটা মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না।“

দ্রুতবেগে দূরে চলে গেল সে।

এমনি করেই টানটান উত্তেজনাময় সন্ধ্যার ঘটনাপ্রবাহে ইতি ঘটল। অন্তত আমি যে অংশে ছিলাম, সেই অংশের আরকি। সন্ধ্যার এই ঘটনাগুলো ঘটার সময়ে আরো কিছু সাড়া ফেলে দেয়া ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। এই অনন্য ডিনার পার্টির অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে আমি পরে জানতে পেরেছি সেটা।

লুপা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় হার্লক শোমস উঠে দাঁড়াল টেবিল থেকে। নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল:

“নয়টা বাজতে বিশ মিনিট বাকি। ঠিক নয়টার সময়ে রেলওয়ে স্টেশনে কাউন্ট আর কাউন্টেসের সাথে দেখা করার কথা আমার।”

“তাহলে তো দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের!” হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল উইলসন। রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এলো তারা।

“উইলসন, পিছনে তাকিও না। সম্ভবত আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এমন ভাব দেখাতে হবে যেন, তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আচ্ছা, একটা কথা বলো তো, লুপাঁ ঐ রেস্টুরেন্টে কী করছিল?”

“কিছু খেতে গিয়েছিল হয়তো,” চটজলদি জবাব দিলো উইলসন।

“উইলসন, এরকম নির্ভুল অনুমানের জন্য একটা প্রশংসা তোমার প্রাপ্য। আমি নিজেও এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারতাম না।

প্রশংসায় একটু লাল হলো উইলসন। শোমস বলতে লাগল:

“কিছু খাওয়ার জন্য গিয়েছিল, ঠিক আছে। তারপরে হয়তো বুঝতে চেয়েছিল আমি ডি ক্রোজোনদের বাড়িতে যাবো কি না। গাঁইমার্দ তো ওর সাক্ষাৎকারে এটাই প্রচার করেছে। ও যাতে হতাশ না হয় সেজন্য সেখানেই যেতে হবে আমার। কিন্তু সময় বাঁচাতে চাইলে ওখানে যাওয়া উচিত হবে না। “

“আহহা!” বিভ্রান্ত হয়ে বলল উইলসন।

“শোনো, বন্ধু, এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে তুমি। সাথে একটা বা দুটো স্যুটকেস নিয়ে নাও না হয়। আমরা স্টেশনে যে ব্যাগগুলো ফেলে এসেছি, সেগুলো পরে এসে নিও। ইলিসি-প্যালেসে চলে যাবে।”

“ইলিসি-প্যালেসে গিয়ে?”

“একটা রুম ভাড়া করবে। তারপর ঘুমিয়ে পড়বে। আমি না বলা পর্যন্ত কিছু করবে না।”

নিজের ওপর বর্তানো গুরুদায়িত্ব নিয়ে খুশিমনে হোটেলে চলে গেল উইলসন। হার্লক শোমস গেল রেলওয়ে স্টেশনে। একটা টিকেট কেটে উঠে পড়ল অ্যামিয়েন’স এক্সপ্রেসে। কাউন্ট আর কাউন্টেস ডি ক্রোজোন আগে থেকেই আছেন সেখানে। তাদের উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে নিজের পাইপটা ধরালো সে। এরপর করিডরে চুপচাপ কিছুক্ষণ ধূমপান করল। ট্রেন চলা শুরু করে দিলো কিছুক্ষণ পরেই। মিনিট দশেক বাদে সে কাউন্টেসের পাশে বসে বলল:

“মাদাম, আংটিটা কি সাথে আছে আপনার?”

“জি।”

“আমাকে একটু দেখতে দেবেন দয়া করে?”

ওটা নিয়ে ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখল সে।

“ঠিক যা সন্দেহ করেছিলাম। এটা কারখানায় বানানো হীরা। “

“কারখানায় বানানো হীরা?”

“জি। হীরার গুঁড়াকে প্রচণ্ড তাপ দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয় প্রথমে, এরপর সেটাকে ঢালাই করে পাথরে পরিণত করা হয়।”

“কিন্তু আমার হীরা তো আসল।”

“হ্যাঁ, আপনার হীরাটা আসল, কিন্তু এটা আপনার হীরা নয়।”

“আমার হীরা কোথায়?”

“ওটা আর্সেন লুপাঁর কাছে আছে।”

“আর এই পাথরটা?”

“আপনারটার বদলে রেখে যাওয়া হয়েছে। হার রেইকেনের টুথ পাউডারের বোতলে লুকিয়ে রেখে দেয়া হয়েছিল এটা।”

“তাহলে, আপনার ধারণা, এটা নকল?”

“অবশ্যই।”

বিস্ময় আর শোক গ্রাস করে ফেলল কাউন্টেসকে। এদিকে তার স্বামী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন হীরাটাকে। মুখে অবিশ্বাসের ছাপ। অবশেষে তোতলাতে তোতলাতে কাউন্টেস বললেন:

“এটা কি সম্ভব? আর ওরা ওটার বদলে এটা রেখে ভেজাল করল কেন? আর ওটাকে চুরিই বা করল কীভাবে?”

“ঠিক সেটাই বের করব আমি।”

“আমাদের বাড়িতে গিয়ে?”

“জি না, ক্রেইলে গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ব আমি। এরপর প্যারিসে ফিরে যাবো। সেখানেই আমার আর আর্সেন লুপাঁর লড়াইটা হবে। সত্যি বলতে, লড়াইটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। লুপাঁ ভাবছে, আমি আপনাদের বাড়িতে যাবো বুঝি।”

“কিন্তু-”

“এতে আপনার কী আসে যায়, মাদাম? আপনার হীরাটা পেলেই তো হলো, তাই না?”

“জি।”

“আচ্ছা, চিন্তা করবেন না। এরচেয়েও বহু কঠিন কাজ সামলেছি আমি। আপনাকে কথা দিচ্ছি, দশ দিনের মাঝেই আমি আসল হীরাটা ফিরিয়ে দেবো।”

ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে এলো। নকল হীরাটা পকেটে রেখে দরজা খুলল সে। কাউন্ট চেঁচিয়ে বললেন:

“এটা ট্রেনের উল্টো দিক। আপনি তো ট্র্যাকে নেমে পড়ছেন। ‘

“সেটাই তো আমার উদ্দেশ্য। লুপাঁ আমার পিছে কাউকে লাগিয়ে রাখলে সে এখনই আমাকে হারিয়ে ফেলবে। বিদায়।”

ট্রেনের এক কর্মচারীর প্রতিবাদেও কোনো কাজ হলো না। ট্রেন থেকে নামার পরে ব্রিটিশ ভদ্রলোক গেল স্টেশন-মাস্টারের অফিসে। চল্লিশ মিনিট পরে আরেকটা ট্রেনে উঠে পড়ল সে। মাঝরাতের একটু আগেই তাকে প্যারিসে নামিয়ে দিলো সেটা। প্ল্যাটফর্মজুড়ে খোঁজাখুঁজি করে লাঞ্চরুমটা খুঁজে পেল সে। এরপর আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা ক্যাবে উঠে পড়ল।

“ড্রাইভার, ক্য ক্যাপেরনে চলো।”

কেউ অনুসরণ করছে না এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে রাস্তার শেষে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। মঁসিয়ে দেতিনাঁ এবং তার পাশের দুই বাড়িতে ভালোমতো খোঁজাখুঁজি করতে গেল এরপরে। বিভিন্ন দূরত্ব মাপজোক করে নোটবুকে টুকে নিলো সে।

“ড্রাইভার, অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে চলো।”

অ্যাভিনিউ-এর কোণায়, রু দ্য লা পম্পেতে, গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। এরপর ১৩৪ নম্বর স্ট্রিটের দিকে গিয়েও একই কাজ করল। ব্যারন ডি’হটরেকের বাড়ি এবং তার দুই পাশের দুই বাড়ি দেখে কিছু জিনিসের দৈর্ঘ্য- প্রস্থ মেপে নিলো। সেগুলোর সামনে থাকা বাগানের আকারটাও মেপে নিলো।

অ্যাভিনিউটা এখন জনহীন। চার সারি গাছের কারণে ঘুটঘুটে অন্ধকার সেখানে। গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়ানো গ্যাস ল্যাম্পগুলো চেষ্টা সত্ত্বেও অন্ধকার কাটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের একটার মলিন আলো এসে পড়েছে বাড়িটার একপাশে। সেটা দিয়ে গেটে লাগানো টু-লেট সাইনটা নজরে এলো শোমসের। লনের আশেপাশের পথটা ধুলোময়। বিশাল জানালাগুলোও খালি খালি লাগছে।

“ব্যারনের মৃত্যুর পর থেকে বাড়িটায় মনে হয় কেউ থাকে না,” আপনমনে বলল সে। “অকুস্থলে ঢুকে দেখতে পারতাম যদি!”

ব্যাপারটা মাথায় আসার সাথে সাথেই বাড়িতে ঢোকার বন্দোবস্ত শুরু করে দিলো সে। কিন্তু এ কাজ করবে কীভাবে? এত উঁচু গেট টপকিয়ে তো আর উঠতে পারবে না। নিজের পকেট থেকে একটা ইলেকট্রিক লণ্ঠন আর একটা স্কেলিটন কি বের করল সে। পকেটে এগুলো সবসময়েই থাকে তার। অবাক হয়ে দেখল, গেটে কোনো তালা লাগানো নেই। বাগানে ঢুকে সাবধানে গেটটাকে আগের মতো ভেজিয়ে দিলো সে – হালকা খুলে রেখে। গেট থেকে কয়েক পা এগিয়েই থেমে গেল হঠাৎ। তিন তলার একটা জানালা দিয়ে আলো সরতে দেখেছে সে।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আরেকটা জানালা দিয়েও আলোর ঝলকানি চোখে পড়ল তার। অনেক চেষ্টা করে রুমগুলোর দেয়ালে একটা মানুষের ছায়া দেখল সে। আলোটা নিচতলার দিকে আসতে লাগল। তার আগে বেশ কিছুক্ষণ ওটা এঘরে ওঘরে ঘুরল।

“রাত একটার সময়ে এই বাড়ির মাঝে হাঁটছে কে এইভাবে? তাও আবার ব্যারন খুন হয়েছেন যে বাড়িতে, সেখানে?” গভীর আগ্রহ নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল শোমস।

এটা জানার একটাই উপায়- নিজেই এই বাড়িতে ঢুকে পড়া। কিন্তু রাস্তার লাইটের সামনে দিয়ে এগোবার সময়ে লোকটা মনে হয়ে দেখে ফেলল তাকে। কারণ, তার পরেই বাড়ির ভেতরের আলোটা নিভে গেল। ওটাকে আর জ্বলতে দেখল না সে। আস্তে করে দরজাটা নেড়ে দেখল সে। খোলা। ভেতরে কোনো শব্দ না পেয়ে হলওয়েতে ঢুকে পড়ল সে। সিঁড়ি বেয়ে সেটা বেয়ে দোতলায় উঠে পড়ল। সেখানেও একই রকম শুনশান নীরবতা আর অন্ধকার।

একটা রুমে ঢুকে জানালার কাছে গেল সে। বাইরে থেকে মলিন আলো এসেছে সেখানে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে যেতে দেখল সে। নির্ঘাত অন্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সে। ঝোপঝাড়ে ঘেরা দেয়ালের পাশ দিয়ে এগোচ্ছে লোকটা, এই দেয়াল দিয়েই পৃথক করা হয়েছে দুই বাগানকে।

“এই লোক তো পালিয়ে যাচ্ছে,’ আঁতকে উঠল শোমস।

লোকটার পালানো ঠেকানোর লক্ষ্যে সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল সে। কিন্তু নিচে নেমে কাউকে চোখে পড়ল না। অন্ধকারের কারণে ঝোপের পাশে থাকা মানুষটাকে আলাদা করতেই বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল তার। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে আসতে একটা কথা ভাবল সে। এই লোক সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও এতক্ষণ পালায়নি কেন? তাকে তার কাজে বাধা দিয়েছে যে, তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নাকি?”

“তবে যত যাই হোক, এটা লুপাঁ নয়।” সিদ্ধান্তে উপনীত হলো শোমস। “ওর কাজ-কারবার আরো কৌশলী। এটা হয়তো ওর কোনো সহচর হবে।”

কয়েক মিনিট নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। তার চোখ নিবদ্ধ রয়েছে লোকটার ওপর। লোকটাও সম্ভবত তাকিয়ে আছে এদিকেই। তবে লোকটা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকলেও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই ব্রিটিশ ভদ্রলোকের। নিজের রিভলভারটা বের করে দেখল সে, ঠিকমতো কাজ করে কি না। খোলস থেকে নিজের ছুরিটাও বের করে নিলো সে। বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া স্বভাবের জন্য খ্যাতি আছে তার। সেই স্বভাবের বশেই দুর্ধর্ষ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সে।

ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। প্রতিপক্ষও রিভলভার হাতে নিয়েছে তাহলে। তীব্রবেগে ঝোপের কাছে গিয়ে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরল সে। বেশ কিছুক্ষণ মরিয়া হয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করল দুজনে। একপর্যায়ে শোমস টের পেল, ছুরি বের করতে যাচ্ছে লোকটা। কিন্তু দুর্ধর্ষ আর্সেন লুপাঁর এই সহচরকে সেই সুযোগ দেবে কেন সে। খেলার প্রথম রাউন্ড জেতার জন্য গায়ে অমানবিক জোর চলে আসলো তার। দৃঢ়সংকল্প হয়ে লড়তে লড়তে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে দিলো সে। এরপর তার ওপর চেপে বসলো। এক হাতে লোকটার গলা চেপে ধরে আরেক হাতে ইলেকট্রিক লণ্ঠনটা হাতড়াতে লাগল সে। ওটার বাটন চেপে বন্দীর মুখে আলো ফেলতেই চমকে উঠল সে:

“উইলসন!”

“হার্লক শোমস!” দুর্বল কণ্ঠে জবাব এলো।

বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা হলো না দুজনের মধ্যে। এভাবেও বোকা বনে কেউ! একটা গাড়ির আওয়াজ রাতের বাতাসকে বিদীর্ণ করে দিলো। ঝিরিঝিরি বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিলো পাতাগুলোকে। হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পেল শোমস। নিজের বন্ধুর কাঁধ ধরে ভয়ানকভাবে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল:

“তুমি এখানে কী করছ? হ্যাঁ? তোমাকে কি… ঝোপের মাঝে লুকিয়ে আমার ওপর নজর রাখতে বলেছিলাম আমি?”

“তোমার ওপর নজর রাখতে?” বিড়বিড় করে বলল উইলসন। “আমি তো জানতামই না যে এটা তুমি।”

“কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো বিছানায় থাকার কথা।”

“আমি তো বিছানাতেই ছিলাম।“

“তোমার তো ঘুমানোর কথা।”

“আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম ঠিকই।“

“তাহলে এখানে তোমাকে নিয়ে এলো কীসে?”

“তোমার চিঠি।”

“আমার চিঠি? কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“হ্যাঁ, হোটেলে এক বার্তাবাহক এসে দিয়ে গেল আমাকে।”

“আমার চিঠি? পাগল হয়েছ তুমি?”

“সত্যি বলছি।

“চিঠিটা কোথায়?”

তাকে একটা কাগজ দিলো উইলসন। ইলেকট্রিক লণ্ঠনের আলোয় সেটা পড়তে লাগল সে। তাতে লেখা:

উইলসন-

অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে চলে এসো। বাড়িটা এখন খালি আছে। পুরো বাড়িটা ভালোমতো দেখে ঠিকঠাক একটা প্ল্যান করতে হবে। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে আসবো।

-হার্লক শোমস

“আমি রুমের ভেতরে মাপজোখ করছিলাম,” বলল উইলসন। “সেসময় বাগানে একটা ছায়া দেখতে পেলাম। কী করব ভাবতে গিয়ে একটা বুদ্ধি এলো মাথায়—”

“ছায়াটাকে আক্রমণ করা…বুদ্ধিটা ভালোই ছিল…কিন্তু উইলসন, একটা কথা মনে রাখবে, আমার কাছ থেকে চিঠি পেলে আগে পরীক্ষা করে নেবে, সেটা কি আসল নাকি নকল।”

“ওহ!” চেঁচিয়ে উঠল উইলসন। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকেছে তার। “তারমানে এই চিঠি তুমি লেখোনি?”

“না।”

“এটা কে পাঠিয়েছিল তাহলে?”

“আর্সেন লুপাঁ।”

“এ কাজ কেন করল ও?”

“জানি না। সেটাই চিন্তায় ফেলছে আমাকে। তোমাকে বিরক্ত করার মতো ঝামেলাটা ও কেন করতে গেল, বুঝতে পারছি না। ও আমাকে বোকা বানিয়ে কোথাও পাঠালে অবাক হতাম না। কিন্তু তোমাকে বিরক্ত করে কী ফায়দা উদ্ধার করল?”

“আমাকে এক্ষুণি হোটেলে ফিরে যেতে হবে।”

“আমাকেও যেতে হবে, উইলসন।”

গেটের দিকে এগোলো দুজনে। উইলসন সামনে থাকায় সেই টান দিলো দরজাটাকে। খুলল না সেটা।

“তুমি কি এটা বন্ধ করে দিয়েছিলে?” জিজ্ঞেস করল সে।

“না, আমি তো ওটা একটু খুলে রেখেছিলাম।”

শোমসও টেনে দেখল দরজাটাকে। এরপর শঙ্কিত হয়ে তালাটা দেখে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল:

“হে ঈশ্বর! এটা তো আটকে দিয়েছে! চাবি দিয়ে আটকে দিয়েছে এটা!” সর্বশক্তি দিয়ে গেটটাকে ঝাঁকাতে লাগল সে। নিজের শক্তিতে এটা কুলাবে না বুঝে হাল ছেড়ে দিলো একটু পরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল:

“আমি দিব্যি বুঝতে পারছি, এসব লুপাঁরই কাজ। আমি যে ক্রেইলে নেমে পড়ব, সেটা আগেই আন্দাজ করেছিল সে। আমি এখানে তদন্ত করব এটা আঁচ করে আমার জন্য ছোট্ট এই ফাঁদটা পেতে রেখেছিল। তবে মনটা নরম ওর, একাকী যাতে না লাগে সেজন্য একটা সঙ্গীও পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে আমার একটা দিন নষ্ট করল সে, আর নিজের চরকায় তেল দেয়ার শিক্ষা দিলো।”

“তারমানে আমরা এখন এখানে বন্দি?”

“হ্যাঁ। হার্লক শোমস আর উইলসনকে বন্দি করে ফেলেছে আর্সেন লুপাঁ। শুরুটা খুবই বাজে হলো আমাদের। কিন্তু শেষ হাসি যার হবে, সেই জিতবে।’

শোমসের হাত খামচে ধরে উইলসন বলল:

“দেখো! ঐ যে উপরে! একটা আলো!”

দোতলার জানালা দিয়ে একটা আলো দেখা গেল। দুজনেই দৌড়ে গেল বাড়িটার দিকে। যে যেই সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে, সেই সিঁড়ির দিকে এগোলো। এরপর যে ঘরে আলো দেখা গেছে, সেই ঘরে মিলিত হলো দুজনে। একটা ছোটো হয়ে আসা মোমবাতি জ্বলছে সেই ঘরের মাঝখানে। সেটার পাশে একটা ঝুড়িতে একটা বোতল, একটা আস্ত মুরগির রোস্ট আর একটা আস্ত রুটি রাখা।

মজা পেয়ে হো হো করে হাসতে লাগল শোমস।

“দারুণ! আমাদেরকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়ে এনেছে এখানে। জায়গাটাকে আসলেই রূপকথার এক জাদুকরী রাজ্য বলে মনে হচ্ছে। আরে উইলসন! মন ভালো করো! কারো শেষকৃত্য হচ্ছে না এখানে, পুরো ব্যাপারটাই অনেক মজার।”

“তোমার কাছে কি আসলেই এটা হাসির ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে?”

“আমার কাছে মনে হচ্ছে কি না?” অস্বাভাবিক রকমের খুশি খুশি গলায় বলে উঠল শোমস। “সত্যি বলতে, এমন মজার জিনিস আমি জন্মেও দেখিনি। এই আর্সেন লুপাঁ তো ব্যঙ্গ করতে ওস্তাদ দেখি! চতুরতার সাথে তোমাকে বোকা বানিয়েছে সে। এখন ব্যাংক অভ ইংল্যান্ডের সব টাকা দিলেও এই ডিনার মিস করব না আমি। তোমাকে দেখে তো মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। একটু নরম হও, দুর্ভাগ্য মানুষের জীবনে আসতেই পারে। তোমারও অভিযোগ করার কোনো কারণ দেখছি না আমি।”

কিছুক্ষণ ঠাট্টা-তামাশা করার পরে উইলসনের মন ভালো করতে সমর্থ হলো সে। একটুখানি মুরগি আর এক গ্লাস ওয়াইনও খাওয়াতে পারল। মোমবাতি নিভে যাবার পরে ওখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো তারা। খালি মেঝেকেই তোশক বানাতে হবে, আর শক্ত দেয়ালকে বালিশ। কী পরিমাণ নির্মম এবং হাস্যকর পরিস্থিতিতে এসে পড়েছে, সেটাও বুঝতে পারল আরেকদফা। এই নির্দিষ্ট ঘটনাটা বিখ্যাত গোয়েন্দার জীবনীতে একটা তিক্ত অধ্যায় হিসেবে থাকবে।

পরেরদিন সকালে উঠে পড়ল উইলসন। ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে গেছে শরীর হালকা একটা শব্দে পাশে তাকিয়ে দেখে: মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে কী যেন করছে হার্লক। সেখানকার বালির দানা, প্রায় মুছে আসা চকের দাগ থেকে কিছু নির্দিষ্ট আকার ও সংখ্যা তৈরি হয়েছে। সেগুলো নিজের নোটবুকে তুলে নিয়েছে সে।

তার কাজে সবসময়ই অসীম আগ্রহ উইলসনের। দুজনে মিলে সবগুলো ঘর পরীক্ষা করে ফেলল। আরো দুটো অ্যাপার্টমেন্টে এরকম চকের দাগ পাওয়া গেল। ওককাঠের প্যানেলে দুটো বৃত্ত, একটা তক্তায় একটা তীরচিহ্ন আর সিঁড়ির চারটা ধাপে চারটা সংখ্যাও চোখে পড়ল।

“সংখ্যাগুলো তো ঠিক, তাই না?” ঘন্টাখানেক পরে জিজ্ঞেস করল উইলসন। “জানি না, কিন্তু যেকোনো অবস্থাতেই ওগুলোর কোনো অর্থ থাকার কথা, জবাব দিলো শোমস। নতুন আবিষ্কারের খুশিতে আগের রাতের কষ্ট ভুলে গেছে।

“বোঝাই যাচ্ছে যে এই সংখ্যাগুলো দিয়ে মেঝের খণ্ড বুঝিয়েছে,” বলল উইলসন।

“আহ!”

“ঐ বৃত্তগুলো দিয়ে বুঝিয়েছে প্যানেলগুলো নকল, বুঝেছ নিশ্চয়ই। আর তীর চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়েছে প্যানেলগুলো কোনদিকে সরানো যাবে।”

বিস্মিত মুখে উইলসনের দিকে তাকালো হার্লক।

“বন্ধু! এতকিছু কী করে বুঝে ফেললে? তোমার অনুমানশক্তি তো আমাকে হার মানিয়ে দিচ্ছে।”

“আরে! এ তো তেমন কিছু না,” গর্বিত ভঙ্গিতে বলল উইলসন। “এই মার্কগুলো কালকে রাতেই দেখেছিলাম আমি, তোমার কথামতো, আসলে আর্সেন লুপাঁর কথামতো। চিঠিটা ও-ই লিখেছিল কি না।”

এই কথাটা বলে নিজেকে বড় একটা ঝুঁকিতে ফেলল উইলসন। কালকে বাগানের মধ্যে যেভাবে ওর গলা মুচড়ে ধরেছিল হার্লক, তার চেয়েও জোরে এখন ওর গলা চেপে ধরতে ইচ্ছা করছে তার! তবে নিজেকে সামলে নিলো শোমস। এমন মুখ করল যেন চিরতা গিলেছে। এরপর বলল:

“ঠিকই ধরেছ, উইলসন। আর তোমার কাজে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। আচ্ছা, পর্যবেক্ষণশক্তি কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাটাকে শান দিচ্ছ তো তুমি? তোমার অনুমানশক্তি প্রখর হলে অনেক লাভ হবে আমার।”

“ওহ! না, আর কিছু করিনি।”

“সেটা দুঃখজনক। শুরুটা তো দারুণ করেছিলে। আর কিছু ধরতে পারোনি যেহেতু, এখন আমাদের যেতে হবে।”

“কিন্তু আমরা বেরোবো কীভাবে?”

“যেভাবে সকল সৎ মানুষ বেরোয়, গেট দিয়ে।”

“কিন্তু তাতে তো তালা মারা।”

“ওটা খোলা হবে।”

“কে খুলবে?”

“এই অ্যাভিনিউর মাঝে টহল দেয়া পুলিশ দুজনকে ডাকো প্লিজ।”

“কিন্তু-”

“কিন্তু কী?”

“আর্সেন লুপাঁ এভাবে আমাদের আটকেছে, সেটা জানাজানি হয়ে যাবে যে তাহলে? ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক হয়ে যাবে না?”

“তা তো হবেই। আমি নিশ্চিত ওরা হেসে লুটোপুটি খাবে,” শুষ্ক কণ্ঠে বলল শোমস। “কিন্তু এই বাড়িটাকে আর কতক্ষণ পাহারা দেবো আমরা?”

“আর তুমি বেরোবার কোনো পথও খুঁজবে না?”

“না।”

“আচ্ছা, যে লোক বাক্সভর্তি খাবার রেখে গেছে, সে তো বাগান পেরিয়ে আসেনি। কিংবা যায়ও নি। এখান থেকে বেরোনোর অন্য কোনো পথ আছে নিশ্চয়ই। চলো খুঁজে দেখি আমরা। আর পুলিশকে ডাকার দরকার নেই।”

“তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, গোটা প্যারিসের সব গোয়েন্দারা মিলে এই পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে ছয় মাস ধরে। তাছাড়া, তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে, তখন আমি নিজেও বাড়িটার আগাগোড়া খুঁজে দেখেছি। আসলে উইলসন, আমরা লুপাঁর ধূর্ততার সাথে মানিয়ে নিতে পারিনি এখনো। ও আসলে কোনো সূত্রই ফেলে যায় না।”

সকাল এগারোটার সময়ে বের করা হলো হার্লক শোমস আর উইলসনকে। নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের। সেখানে কমিসারি ভালোমতো পরীক্ষা করে তাদেরকে ছেড়ে দিলেন। সাথে সান্ত্বনাবাণীও শোনালেন কিছু, যেগুলো শুনে পিত্তি জ্বলে গেল তাদের।

“এরকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটার কারণে আমি খুবই দুঃখিত মঁসিয়ে। এমনিতে আমরা ফরাসিরা খুবই অতিথিপরায়ণ জাতি। রাতটা কাটাতে খুব কষ্ট হয়েছে বুঝি? বদমাশ লুপাঁটা মানুষজনকে সম্মান করতে জানে না।”

একটা গাড়ি ধরে নিজেদের হোটেলে ফিরল তারা। অফিসে গিয়ে নিজের ঘরের চাবি চাইল উইলসন।

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে ক্লার্ক অবাক কণ্ঠে জবাব দিলো

“কিন্তু মঁসিয়ে, আপনি তো ঘর ছেড়ে দিয়েছেন।”

“ছেড়ে দিয়েছি? কখন?”

“আজকে সকালে, আপনার বন্ধু নিয়ে এসেছিলেন আপনার চিঠিটা।”

“কোন বন্ধু?”

“যে ভদ্রলোক আপনাদের চিঠিটা নিয়ে এসেছিলেন…দাঁড়ান, আপনাদের কার্ড এখনো লাগানো রয়েছে চিঠিটার সাথে। এই যে।”

কার্ডটা দেখল উইলসন। এ যে তারই কার্ড, এতে কোনো ভুল নেই। আর চিঠির হাতের লেখাটাও হুবহু তার মতোই।

“হায় খোদা!” বিড়বিড় করে বলল সে। “আরেকবার ভাঁওতাবাজি করেছে ও।” এরপর চেঁচিয়ে উঠে বলল, “আমার লাগেজ কোথায়?”

“আপনার বন্ধু নিয়ে গেছেন ওটা।”

“আহহা! আপনি দিয়ে দিলেন ওকে?”

“হ্যাঁ, আপনার চিঠি আর কার্ডকে প্রমাণ ধরে দিয়ে দিয়েছিলাম।”

“সেটাই… সেটাই।“

হোটেল থেকে বেরিয়ে চ্যাম্পস-ইলিসির রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল তারা। দুজনেরই মাথায়-ই চিন্তার ঝড়। শরতের উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে রাস্তাটা। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে সাথে। ভারি মনোরম দৃশ্য।

রোন্ড-পয়েন্টে গিয়ে নিজের পাইপটা ধরালো হার্লক শোমস। এরপর উইলসন বলল:

“তোমার হাবভাব বুঝতে পারছি না, শোমস। এত শান্ত আর নির্বিকার আছ কী করে তুমি? বিড়াল যেভাবে ইঁদুরকে বোকা বানায়, ঠিক সেভাবে তোমাকে বোকা বানাচ্ছে লুপাঁ। তারপরেও কিছুই বলছ না তুমি।”

শোমস থেমে গিয়ে জবাব দিলো:

“উইলসন, আমি তোমার কার্ডের কথা ভাবছিলাম।“

“কী ভাবছিলে?”

“কথা হলো, আমাদের প্রতিপক্ষের কাছে আমাদের হাতের লেখার নমুনা আর তোমার এক বা একাধিক কার্ড চলে গেছে। এই কাজটা করতে ও কী পরিমাণ ধূর্ততার পরিচয় দিয়েছে, ভাবতে পেরেছ?”

“তা দিয়েছে!”

“আগে থেকে এরকম দশ ধাপ এগিয়ে থেকে পরিকল্পনা করা শত্রুর বিরুদ্ধে জেতার জন্য হার্লক শোমসের মতো ক্ষুরধার মেধা লাগে। আর এই শত্রু এতোই তুখোড় যে আমিও হেরে গেলাম প্রথম দফায়।”

ছ’টার সময়ে একো দ্য ফ্রান্স সান্ধ্য পত্রিকায় নিচের আর্টিকেলটা ছাপালো :

আজকে সকালে সিক্সটিন্থ ডিস্ট্রিক্টের পুলিশ কমিসারি, মঁসিয়ে থেনার্ড, হার্লক শোমস আর তার বন্ধু উইলসনকে ছাড়িয়ে এনেছেন। তারা দুজনেই প্রয়াত ব্যারন ডা,হটরেকের বাড়িতে আটকে পড়েছিলেন। সেখানে রাতটা অবশ্য ভালোই কেটেছে তাদের, সেই ব্যবস্থা সুন্দরমতোই করে দিয়েছিল আর্সেন লুপাঁ।

অন্য ঝামেলার পাশাপাশি নিজেদের ট্র্যাভেল ব্যাগও খুইয়েছেন তারা। সেকারণে লুপাঁর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ দায়ের করেছেন থানায়। তাদেরকে এই শিক্ষাটুকু দিয়ে বেশ সন্তুষ্ট লুপাঁ। তার আশা, তাকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবেন না এই দুই ভদ্রলোক।

“বাহ!” চেঁচিয়ে উঠল হার্লক শোমস। হাতের পত্রিকাটা মুচড়ে ফেলল সে। “আর্সেন লুপাঁকে খাটো করে একটা কথাই বলেছিলাম আমি: ‘এটা তো বাচ্চাছেলের কাজ’। জবাবে গ্যালারিতে ছক্কা হাঁকিয়ে দিলো সে। ও আসলেই একটা দরবেশ জাতীয় কিছু।”

“শোমস! তুমি অসাধারণ একজন মানুষ। নিজের মেজাজের ওপর ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারো। কোনোকিছুই না তোমার মাথা গরম করাতে পারে না?”

“না, কোনোকিছুই আমার মাথা গরম করতে পারে না,” জবাব দিলো সে। রাগে গলা কাঁপছে তার। “তাছাড়া, মেজাজ হারিয়ে আর লাভ কী? ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়েই ভাবছি আমি। আর শেষ কথাটা আমার মুখ দিয়েই বেরোবে।”