২. দ্য ব্লু ডায়মন্ড

অধ্যায় দুই – দ্য ব্লু ডায়মন্ড

২৭ শে মার্চ, সন্ধ্যা। নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে ছয় মাস আগে পাওয়া ১৩৪ নং অ্যাভিনিউ অঁরি-মার্টিনের বাড়িতে আছেন বুড়ো জেনারেল ব্যারন ডি’হটরেক। ফ্রান্সের সেকেন্ড এম্পায়ারের অধীনে বার্লিনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এখন একটা আরামকেদারায় শুয়ে আছেন তিনি, আর তার সেক্রেটারি পড়ে শোনাচ্ছে তাকে। সিস্টার অগাস্ট তার বিছানা তৈরি করছেন, নাইট-ল্যাম্প প্রস্তুত করছেন। রাত ১১টায় নিজের কনভেন্টে ফিরে যাবেন সিস্টার। তার আগে তিনি ব্যারনের সেক্রেটারিকে বললেন :

“মাদামোয়াজেল আঁতোয়ানেত, আমার কাজ শেষ। আমি চলে যাচ্ছি।”

“ঠিক আছে, সিস্টার।

“রাঁধুনি কিন্তু বাসায় নেই, মনে রাখবেন। আছেন শুধু আপনি আর আপনাদের ভৃত্য।”

“ব্যারনের জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না। পাশের ঘরেই শোবো আমি, আর দরজাটা খুলে রাখব।“

সিস্টার চলে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে গৃহকর্মী চার্লস এসে ঢুকল তার আদেশ শোনার জন্য। ব্যারন জেগে গেছেন এখন। নিজেই বলে উঠলেন:

“সবসময় যা করো, তাই করবে। তোমার ঘরে তো ইলেকট্রিক বেল বাজে। ঐটা বাজার সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে তুমি। আচ্ছা, মাদামোয়াজেল আঁতোয়ানেত, কতখানি পড়া হলো আমাদের?”

“মঁসিয়ে কি এখন ঘুমাতে যাবেন না?”

“না, না, পরে যাবো। তাছাড়া, আমার কাছে কাউকে থাকতে হবে না।”

বিশ মিনিট পরে উনি ঘুমিয়ে গেলেন আবার। পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আঁতোয়ানেত।

চার্লস সেসময়ে নিজের ঘরের পর্দা লাগাচ্ছিল। এরপর রান্নাঘর থেকে বাগানে বেরোনোর দরজাটায় তালা দিলো সে। আর বারান্দার দরজাটায় শুধু তালা নয়, শিকলটাও টেনে দিলো সে। এরপর চারতলায় নিজের ঘরে চলে গেল সে। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেল অচিরেই।

এক ঘন্টা পেরিয়েছে মনে হয়। হঠাৎ বেল বেজে ওঠায় লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। কমপক্ষে সাত-আট সেকেন্ড ধরে কোনো বিরতি ছাড়াই বেজে চলেছে বেলটা।

“ভালো,” বিড়বিড় করে বলল চার্লস। “রাতদুপুরে আবার মাথায় পোকা উঠেছে ব্যারনের।”

দ্রুত পোশাক পরে নিলো সে। এরপর সিঁড়ি বেয়ে এসে নামল দরজার কাছে। নিয়মমতো প্রথমে টোকা দিলো সে। কোনো জবাব না পেয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

“আরে! আলো নেই দেখছি,” বিড়বিড় করল সে। “এমনটা হলো কেন?”

এরপর নিচু স্বরে ডাক দিলো সে

“মাদামোয়াজেল?”

কোনো জবাব এলো না।

“মাদামোয়াজেল, আপনি কি আছেন? কী হয়েছে? মঁসিয়ে ব্যারন কি অসুস্থ বোধ করছেন?”

কোনো জবাব এলো না এবারেও। শুনশান নীরবতা চারিদিকে। মন কেমন করতে লাগল তার। দুই পা এগুতেই একটা চেয়ার পায়ে বাঁধল। হাত বাড়িয়ে চেয়ারটা ধরেই সে টের পেল, উল্টিয়ে দেয়া হয়েছে এটাকে। এরপর হাত দিয়ে মেঝেতে হাতড়ে আরো কিছু জিনিস পেলো সে— একটা ছোটো টেবিল, একটা স্ক্রিন। শঙ্কিত হয়ে দেয়ালের দিকে এগুতে লাগল সে। কোনোমতে হাতড়ে বাটন চেপে জ্বালিয়ে দিলো লাইট।

রুমের মাঝখানে, টেবিল আর ড্রেসিং টেবিলের মাঝে ভূপাতিত হয়ে আছে তার মনিব ব্যারন ডি’হটরেকের দেহ।

“কী?…এটা কীভাবে সম্ভব!” কোনোমতে বলল সে।

বিস্ফোরিত নেত্রে ঐদিকে তাকিয়ে আছে চার্লস। নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পুরো রুম তছনছ হয়ে আছে। চেয়ারগুলো উল্টে পড়ে আছে, বিশাল একটা কাচের ঝাড়বাতি পড়ে হাজার টুকরো হয়ে গেছে। ভয়ানক মারামারি হয়ে গেছে এখানে। লাশের অদূরে পড়ে থাকা একটা ছুরির ফলক ঝিলিক দিয়ে উঠল। ছুরিটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। রক্তে ভেজা একটা রুমাল পড়ে আছে বিছানার প্রান্তে।

ভয়ে শিউরে উঠে পিছিয়ে গেল চার্লস। ওর পায়ের কাছে পড়ে থাকা লাশটা টানটান হলো একবার। এরপর গুটিয়ে ছোটো হয়ে গেল। দু-তিনবার কেঁপে উঠেই নিথর হয়ে গেলেন ব্যারন।

লাশটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল সে। ঘাড়ে একটা স্পষ্ট ক্ষত, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে কার্পেটের উপর কালচে একটা রক্তের পুকুর তৈরি হয়েছে। লাশের চেহারায় স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ।

“কেউ খুন করেছে ওনাকে!” বিড়বিড় করে বলল সে। “কেউ এসে মেরে রেখে গেছে ওনাকে!”

হঠাৎই তার মনে পড়ল, আরেকটা ভয়ানক অপরাধ ঘটে যাবার সম্ভাবনা আছে এখানে। ব্যারনের সেক্রেটারি না পাশের ঘরেই শুয়েছিলেন! খুনি কি তাকেও মেরে ফেলল নাকি! ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে সে দেখে, রুমে কেউ নেই। চার্লস ভাবল, আঁতোয়ানেতকে নির্ঘাত খুনি তুলে নিয়ে গেছে। কিংবা সে হয়তো খুনের আগেই চলে গিয়েছে।

ব্যারনের চেম্বারে আবার ফিরে এলো সে। আঁতিপাঁতি করে মহিলাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার চোখ। সে দেখল, ফার্নিচারের আর্টিকেলটা এখনো অক্ষতই রয়ে গেছে। এরপর পাশের টেবিলটা দেখল সে। সেখানে প্রতিদিনই ঘুমানোর আগে চাবির গোছা আর নিজের মানিব্যাগ রেখে দেন ব্যারন। সেগুলোর পাশে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা পড়ে আছে। মানিব্যাগটা নিয়ে খুলে দেখল সে। ভেতরে কিছু টাকা আছে। গুনে দেখল, একশো ফ্রাঁ-এর তেরোটা নোট আছে সেখানে।

যন্ত্রের মতো টাকাগুলো নিজের পকেটে ভরে নিলো সে। এরপর দ্রুতবেগে নিচে নেমে তালা খুলে শিকল টেনে বেরিয়ে গেল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মাঝরাতেই পালিয়ে গেল রাস্তা দিয়ে।

কিন্তু চার্লস সৎ মানুষ। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই রাতের শীতল বাতাস আর বৃষ্টি থামিয়ে দিলো তাকে। কী করেছে, সেটা মাথায় ঢুকল অবশেষে। নিজের পরিণামের কথা ভেবে ভয়ে আঁতকে উঠল। পাশ দিয়েই একটা ক্যাব যাচ্ছিল, সম্বিত ফিরে পেয়ে সেটাকে থামালো সে। বলল:

“জলদি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে কমিসারিকে ডেকে আনুন। ঐ বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেছে!”

জলদি গাড়ি হাঁকালো ক্যাবওয়ালা। আবার বাড়িতে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা হলো চার্লসের, কিন্তু দরজায় তো তালা মারা। সে নিজেই লাগিয়েছে। কলিং বেল বাজিয়েও লাভ নেই, খোলার মতো কেউ নেই এই বাড়িতে।

পুলিশ আসলো প্রায় ঘন্টাখানেক পরে। তারা আসার পরে সব খুলে বলল চার্লস, টাকাগুলোও কমিসারির হাতে তুলে দিলো। একজন তালার মিস্ত্রীকে ডাকা হয়েছিল, সে এসে কষ্টেসৃষ্টে বাগানের দরজা আর বারান্দার দরজাটা খুলতে সমর্থ হলো। পুলিশের কমিসারি সবার আগে ঢুকলেন ঘরে।

ঢুকেই সাথে সাথে চার্লসের দিকে ফিরে বললেন: “আপনি তো বলেছিলেন পুরো ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।”

স্থানুর মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইল চার্লস। সব আসবাবপত্রই যথাযথ জায়গায় সাজানো রয়েছে এখন। দুটো জানালার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোটো টেবিলটা। চেয়ারগুলোও উল্টে পড়ে নেই আর। ঘড়িটা এখন ম্যান্টেলের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ঝাড়বাতির কাচের টুকরোগুলোর চিহ্নমাত্র নেই মেঝেতে।

“মঁসিয়ে… ব্যারন কোথায়?” তোতলাতে তোতলাতে বলল চার্লস। “সেটাই তো কথা!” চেঁচিয়ে উঠলেন অফিসার। “ভিক্টিম কোথায়?”

বিছানার কাছে গিয়ে বড় একটা চাদর সরালেন তিনি। তার তলায় পড়ে আছে ব্যারন ডি’হটরেকের দেহ। বার্লিনে কর্মরত ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের ওপরে তার মিলিটারি কোটটা সাজানো রয়েছে। তাতে অসংখ্য ক্রস অভ অনার। শান্ত ভঙ্গিতে চোখ মুদে শুয়ে রয়েছেন তিনি। আরামে ঘুমোচ্ছেন যেন।

“কেউ এসেছিল এখানে,” বলল চার্লস।

“ওরা এখানে ঢুকল কী করে?”

“আমি জানি না। কিন্তু আমি যখন ছিলাম না, তখন এখানে এসেছিল কেউ। মেঝেতে একটা ছুরি পড়েছিল— ঐখানে! আর রক্তমাখা একটা রুমালও ছিল বিছানায়। কিন্তু এখন আর এখানে নেই ওগুলো। কেউ সরিয়ে ফেলেছে। তারপর পুরো রুমটাকে গুছিয়ে রেখেছে।”

“কে এ কাজ করল?”

“গুপ্তহত্যাকারীই নিশ্চয়ই।“

“কিন্তু আমরা তো দেখলাম সব দরজায় তালা মারা রয়েছে।“

“নিশ্চয়ই ঘরেই ছিল ও।”

“তাহলে এখনো এখানেই আছে ও, আপনি তো বাড়ির সামনেই ছিলেন।”

একটু ভেবে দেখল চার্লস। এরপর ধীরে ধীরে বলল:

“হ্যাঁ… তা তো বটেই….. গেট থেকে বেশি দূরে যাইনি আমি।’

“ব্যারনের সাথে শেষ কাকে কথা বলতে দেখেছেন?”

“তার সেক্রেটারি…মাদামোয়াজেল আঁতোয়ানেতকে।”

“ওনার কী অবস্থা?”

“আমি জানি না। ওনার বিছানায় কেউ ছিল না। উনি মনে হয় বাইরে গিয়েছেন। এতে অবাক হইনি আমি, সুন্দরী তরুণীরা রাতে বিছানায় না থাকতেই পারে।”

“কিন্তু উনি বেরোলেন কোনদিক দিয়ে?’

“দরজা দিয়ে,” বলল চার্লস।

“কিন্তু আপনি তো ওটাতে তালা লাগিয়ে শিকল টেনে দিয়েছেন।”

“উনি নিশ্চয়ই তার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন।”

“আর উনি যাবার পরে খুনটা সংঘটিত হয়েছে?”

“সেটাই হবার কথা। “

বাড়ির সবখানে খোঁজাখুঁজি করা হলো। কিন্তু খুনিকে পাওয়া গেল না। কীভাবে পালালো সে? কখনই বা পালালো? পরবর্তীতে অকুস্থলে এসে যে সব গুছিয়ে রেখে গেছে, সে কি খুনির সহযোগী? নিজের পরিচয় চাপা দেয়ার জন্যই কি একাজ করেছে সে? এরকম বেশ কিছু প্রশ্ন এসে দাঁড়ালো পুলিশের সামনে।

করোনার এলেন সাতটার সময়ে। আটটার সময়ে এলেন গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মঁসিয়ে দুদো। তাদের সাথে সাথে এলেন প্রসিকিউটর অভ দ্য রিপাবলিক আর ইনভেস্টিগেটিং ম্যাজিস্ট্রেট। বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে আরো এলেন পুলিশ, গোয়েন্দা, রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার আর মরহুমের আত্মীয়-স্বজনেরা। বাড়ি মানুষে গিজগিজ করতে লাগল।

আঁতিপাঁতি করে খোঁজাখুঁজি করা হলো সবখানে। চার্লসের বক্তব্যের সাথে লাশের বর্তমান অবস্থানের তুলনা করে দেখল তারা। সিস্টার অগাস্ট আসামাত্র তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু নতুন কিছু জানতে পারল না পুলিশ। আঁতোয়ানেত ব্রেহাতের গায়েব হবার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। মাত্র বারো দিন আগে মেয়েটাকে কাজ দিয়েছিলেন তিনি। রাতের বেলা নিজের কাজ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাবে সে, একথা মানতে চাইলেন না কোনোভাবেই।

“কিন্তু দেখুন, উনি তো এখনো ফেরেননি,” বললেন ম্যাজিস্ট্রেট। “ওনার কী হয়েছে এ প্রশ্নের জবাব এখনো পাইনি আমরা।’

“আমার মনে হচ্ছে খুনি ওনাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে,” বলল চার্লস।

এরকমটা ঘটতেই পারে। যুক্তি আছে তার কথা। একমত পোষণ করে মঁসিয়ে দুদো বললেন:

“অপহৃত? ঠিকই বলেছেন! ব্যাপারটা একদম অসম্ভব নয়!”

“অসম্ভব না হলেও এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই,” বলে উঠল একটা কণ্ঠ। “বরং এর বিপরীতে অনেক যুক্তি দেয়া যায়। ওনাকে অপহরণ করা হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণই নেই এখানে।”

কণ্ঠটা খসখসে, তাতে কড়া ফরাসি টান। গাঁইমার্দকে দেখে অবাক হলো না কেউ। আর কেউ-ই এরকম উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলার সাহস করবে না।

“আরে! গাঁইমার্দ এসে গেছো দেখি!” চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে দুদো। “কখন আসলে? দেখিনি তো!”

“দুইটা থেকেই এখানে আছি আমি।”

“৫১৪ নম্বর টিকেট, ক্য ক্ল্যাপেরন, স্বর্ণকেশী মহিলা আর আর্সেন লুপাঁ বাদে অন্য কিছুতেও তোমার আগ্রহ আছে তাহলে?”

“হা-হা!” ব্যাঙ্গের হাসি হাসল পোড় খাওয়া গোয়েন্দা। “এই কেসের সাথে লুপাঁর কোনো সম্পর্ক নেই, এমনটা বলব না। তবে আপাতত লটারি টিকেটের কথা বাদ দিয়ে এই রহস্য সমাধান করি চলুন।”

গাঁইমার্দ ততটা নামকরা গোয়েন্দা নয়, যাদের কর্মপদ্ধতি স্কুলে শেখানো হয়, অথবা দেশের অপরাধের ইতিহাসেও যাদের নাম জ্বলজ্বলে অক্ষরে ফুটে আছে, তাদেরও অন্তর্ভুক্ত নয় সে। দুপা, লেকোক কিংবা হার্লক শোমসের মতো ক্ষুরধার মস্তিষ্ক নেই তার। কিন্তু তার পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা অসামান্য পর্যায়ের। সাথে বিচক্ষণতা, ধৈর্য আর সুচতুর অনুমানশক্তির ওপর ভর করে সে এগিয়ে আছে অনেকের থেকেই। তার মূল শক্তি তার স্বাধীনতায়। কেউ তার কাজে কোনো প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে না। তবে হ্যাঁ, আর্সেন লুপাঁ তার মাথা গরম করিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে বটে। তারপরেও, রাতদুপুরে মরহুম ব্যারন ডি’হটরেকের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নিঃসন্দেহে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের একটা প্রমাণ দিলো সে। আর এই কেসে সে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় অনেক কৃতজ্ঞও হয়েছেন ইনভেস্টিগেটিং ম্যাজিস্ট্রেট।

“সবার আগে মঁসিয়ে চার্লসকে কেবল একটা প্রশ্ন করব আমি,” বলল গাঁইমার্দ। “ওনার কথামতে, প্রথমবার ঘরে ঢুকে উনি রুমটাকে লণ্ডভণ্ড অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন। বেশ কিছু আসবাবপত্র উল্টে-পাল্টে ফেলে রাখা হয়েছিল ঘরজুড়ে। এখন, দ্বিতীয়বার রুমে ঢুকে আপনি দেখলেন, সবকিছু গোছানো অবস্থায় আছে। এগুলো কি আগে যে জায়গায় রাখা হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গাতেই চলে এসেছে?”

“জি, একদম যেটা যেখানে থাকার কথা, সেটা সেখানেই পেয়েছি।”

“তারমানে, যে লোক এগুলো গুছিয়েছে, সে আগে থেকেই জানত যে এগুলো কোথায় ছিল।”

গাঁইমার্দের কথায় অকাট্য যুক্তি আছে। তাই কেউ প্রতিবাদ করল না এ কথায়। আবার মুখ খুলল সে

“আরেকটা প্রশ্ন, মঁসিয়ে চার্লস। আপনি তো বেল বাজার শব্দে জেগে উঠেছিলেন। তো, ঐ বেলটা কে বাজিয়েছে বলে মনে হয়?”

“মঁসিয়ে ব্যারন বাজিয়েছেন অবশ্যই।”

“উনি কখন বাজালেন এটা?”

“ধ্বস্তাধ্বস্তির পরে… মারা যাচ্ছেন যখন, তখন নিশ্চয়ই।”

“অসম্ভব; কারণ ওনাকে বেল বাটন থেকে চার মিটার দূরে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন আপনি।”

“তাহলে উনি ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়ে বাজিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।”

“সেটাও অসম্ভব,” ঘোষণা করল গাঁইমার্দ। “আপনার কথামতে বেলটা কোনো বিরতি ছাড়াই সাত-আট সেকেন্ড ধরে বেজেছিল। আপনার কি ধারণা তার হত্যাকারী তাকে এতক্ষণ বেল বাজানোর সুযোগ দেবে?”

“তাহলে হয়তো আক্রমণের শিকার হবার আগেই উনি বাজিয়েছিলেন।”

“সেটাও অসম্ভব। কারণ, আপনার কথানুযায়ী, বেল বাজানোর মিনিট তিনেক পরেই এই রুমে এসে ঢুকেছেন আপনি। ব্যারন যদি আক্রমণের শিকার হবার আগে বেলটা বাজিয়ে থাকেন, তাহলে এই ধ্বস্তাধ্বস্তি, খুন এবং খুনির পালানো— সবকিছুই ঘটেছে তিন মিনিটের মধ্যে। তাই আমি আবারো বলছি: ব্যাপারটা অসম্ভব।”

“কিন্তু ঐ বেলটা যদি ব্যারন না বাজিয়ে থাকেন, তাহলে কে বাজালো?” জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

“খুনি নিজেই বাজিয়েছে।”

“কীসের জন্য?”

“সেটা এখনো জানি না। কিন্তু তার বেল বাজানোতে এটা প্রমাণিত হয় যে, চার্লসের ঘরে থাকা বেলটার ব্যাপারে সে জানে। আর সে বিষয়টা এ বাড়ির বাসিন্দা বাদে আর কে জানবে?”

জাল পেতে আস্তে আস্তে সেটাকে গুটিয়ে ছোটো করে আনছে গাঁইমার্দ। মাত্র কয়েকটা পরিষ্কার যুক্তি দিয়েই এই খুনের ব্যাপারে নিজের থিওরি উত্থাপন করে দিয়েছে সে। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাজিস্ট্রেট বলে উঠলেন:

“গাঁইমার্স, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আঁতোয়ানেত ব্রেহাত নামের মেয়েটাকে সন্দেহ করছেন আপনি।”

“আমি তাকে সন্দেহ করছি না; আমি তাকে দায়ী করছি।”

“আপনার মতে, সে এই খুনির সহযোগী ছিল?”

“আমার মতে, এই মেয়েই ব্যারন ডি’হটরেককে খুন করেছে।”

“কী অদ্ভুত কথা! এ ব্যাপারে কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

“ভিক্টিমের ডান হাতে এই চুল পেয়েছি আমি।”

একটা চুল দেখালো গাঁইমার্দ। সুন্দর সোনালি-রঙা চুল, স্বর্ণের মতো ঝিকিঝিক করছে। সেটার দিকে তাকিয়ে চার্লস বলল :

“এটা তো মাদামোয়াজেল আঁতোয়ানেতের চুল। কোনো সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে। আরেকটা কথা। আমি রুমে ঢুকে যে চুরিটা দেখেছিলাম, আমার মনে হয় ওটা ওনারই ছুরি। বইয়ের কাগজ কাটতেন উনি ওটা দিয়ে।”

থমথমে একটা নীরবতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। এমন ভয়ঙ্কর একটা খুন ঘটেছে এক নারীর হাত দিয়ে, ভাবতেই শিউরে উঠল সবাই। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন:

“তাহলে আর কিছু না জানা পর্যন্ত আমরা অনুমান করে নিচ্ছি যে, আঁতোয়ানেত ব্রেহাতই খুন করেছে ব্যারনকে। অপরাধের পরে সে কোথায় লুকিয়েছিল, চার্লস বেরিয়ে যাবার পরে সে কীভাবে ফিরে এসেছিল কিংবা পুলিশ আসার পরে সে কীভাবে পালিয়েছে, এসব প্রশ্নের জবাব এখনো জানি না আমরা। গাঁইমার্দ, এসব ব্যাপারে আপনার কোনো মতামত আছে?”

“জি না।”

“বেশ, এখন তাহলে কোন অবস্থায় আছি আমরা?”

কিছুটা লজ্জিত হলো গাঁইমার্দ। জোর করেই মুখ খুলে বলল:

“আমরা ৫১৪ নম্বর লটারি টিকেটের মতো একই ঘটনা ঘটতে দেখছি এই কেসেও। সেই একইরকম আশ্চর্য উপায়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা। যেরকম অদ্ভুত উপায়ে মঁসিয়ে দেতিনাঁর বাড়িতে ঢুকে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল লুপাঁ, ঠিক সেইভাবেই এই বাড়িতে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেছে আঁতোয়ানেত। লুপাঁর সাথে অবশ্য তার স্বর্ণকেশী বান্ধবী ছিল।”

“এতে কি কিছু বোঝা যাচ্ছে?”

“আমি বুঝতে পারছি অন্তত। এই দুটো অদ্ভুত ঘটনার মাঝে একটা সম্ভাব্য যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি আমি। আঁতোয়ানেত ব্রেহাতকে বারো দিন আগে নিয়োগ দিয়েছিলেন সিস্টার অগাস্ট। আমাদের নাগাল গলে লুপাঁ আর ওই স্বর্ণকেশী মহিলা বেরিয়ে যাবার পরের দিন সেটা। আর এখানে লাশের হাতে পাওয়া চুলটা অবিকল ঐ মহিলার চুলের মতো।

“তারমানে, আপনার মতে, আঁতোয়ানেত ব্ৰেহাতই-“

“ঐ স্বর্ণকেশী মহিলা।”

“আর দুই কেসের সাথেই সম্পর্ক আছে লুপাঁর!”

“জি, সেটাই আমার ধারণা।”

কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন কেউ। মঁসিয়ে দুদো।

“লুপা, লুপাঁ আর লুপাঁ! সবখানেই এই লুপাঁ! এর কব্জা থেকে আর বেরোনো গেল না!”

“হ্যাঁ, সব পরিস্থিতিতেই লুপাঁ এসে হাজির হচ্ছে,” জবাব দিলো গাঁইমার্দ মঁসিয়ে দুদো কেন তাকে নিয়ে হাসছেন, মাথায় ঢুকছে না তার।

“আমি যতদূর বুঝলাম, এই অপরাধের কোনো মোটিভ খুঁজে বের করতে পারোনি তুমি,” বললেন মঁসিয়ে দুদো। “ওনার ঘরে তালা ভেঙে ঢোকেনি কেউ, মানিব্যাগটাও নিয়ে যায়নি। এমনকি ওনার টেবিলে রাখা স্বর্ণমুদ্রাও তেমনি ছিল।”

“তা তো ছিলই, কিন্তু ঐ বিখ্যাত হীরাটা?” চেঁচিয়ে উঠল গাঁইমার্দ।

“কোন হীরা?”

“সেই বিখ্যাত নীল হীরা! ফ্রান্সের রাজমুকুটের অংশ হিসেবে বানানো হয়েছিল, ব্যাপক জনপ্রিয় এটা। ডিউক ডি’আমালের পক্ষ থেকে লিওনাইড লেব্রানকে দেয়া হয়েছিল এটা। লেব্রান মারা যাওয়ার পরে এটা কিনে নেন ব্যারন ডি’হটরেক। ঐ কমেডিয়ানের খুব ভক্ত ছিলেন তো, তার স্যুভেনির হিসেবে নিজের কাছে রেখে দেন একটা। আমার মতো পুরোনো দিনের কথা যে ফরাসিরা মনে রাখে, তাদের সবার মনে আছে এটা।”

“এটা ঠিক যে, যদি নীল হীরাটা পাওয়া না যায়, তবে এটাই হবে এই খুনের মোটিভ,” বললেন ম্যাজিস্ট্রেট। “কিন্তু আমরা এটা খুঁজব কোথায়?”

“ব্যারনের আঙুলে,” জবাব দিলো চার্লস। “সবসময় নিজের বাঁ হাতের আঙুলে নীল হীরার আংটিটা পরে থাকতেন তিনি।”

“ঐ হাতটা দেখেছি আমি, আঙুলে একটা সাধারণ সোনার আংটি ছিল, লাশের দিকে এগোতে এগোতে বলল গাঁইমার্দ।

“হাতের তালুটা দেখুন,” জবাব দিলো চার্লস

শক্ত হয়ে যাওয়া হাতটা খুলল গাঁইমার্দ। আংটিটা ঘুরে গিয়েছিল ভেতরের দিকে। আর তার কেন্দ্রে বসে আপন মহিমায় চকচক করছে নীল হীরকখণ্ডটা।

“আরে আজব!” বিড়বিড় করে বলল গাঁইমার্দ। মাথায় যেন বাজ পড়েছে ওর। “বুঝলাম না কিছুই!”

“লুপাকে অযথাই সন্দেহ করার জন্য ওর কাছে এখন মাফ চাও গিয়ে,” হাসতে হাসতে বললেন মঁসিয়ে দুদো।

এক মুহূর্ত থেমে চিন্তা করল গাঁইমার্দ, এরপর নিচুস্বরে বলল:

“আসলে, যখনই কোনো কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না, তখনই আমার আর্সেন লুপাঁকে সন্দেহ হয়।”

রহস্যময় অপরাধটি সংঘটিত হবার পর এ কয়টা ব্যাপারেই পরিষ্কার হতে পারল পুলিশ। খুনের কারণ এখনো ভাসা ভাসা, ছিন্ন সুতোর মতো। পরবর্তীতেও এমন কিছু বের হলো না যা দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। আঁতোয়ানেতের অন্তর্ধানও স্বর্ণকেশী মহিলার মতো রহস্যঘেরা হয়েই থাকল। স্বর্ণকেশী যে রহস্যময় মানুষটি ব্যারনকে খুন করে পালিয়েছে, তার আঙুল থেকে ফ্রান্সের রাজকীয় মুকুটে একসময় শোভাবর্ধনকারী হীরকখণ্ড সমৃদ্ধ আংটিটা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, তার কোনো চিহ্নই বের করতে পারল না পুলিশ।

এই খুনের কথা ছড়িয়ে গেল সবখানে, আর ব্যারন ডি’হটরেকের উত্তরাধিকারীরা সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল। বিভিন্ন আসবাবপত্র আর অন্যান্য জিনিস নিয়ে বাড়িতে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করল তারা। পরবর্তীতে সেগুলো ড্রাউওট অ্যান্ড কো.-তে নিলামে বেচা হবে। গতানুগতিক আঙ্গিকের আধুনিক আসবাবপত্র, শৈল্পিক মুল্যহীন নানা সামগ্রী ইত্যাদি দেখানো হলো সেখানে। আর রুমের কেন্দ্রে বেগুনি ভেলভেটের বাক্সে রাখা হলো সেই নীল হীরকখণ্ডটি। কাঁচের গ্লোব দিয়ে ঘিরে রাখা হলো সেটি, সামনে সদাসতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দুই অফিসার।

বিশাল বড় আর মোহনীয় এক হীরকখণ্ড এটা, অতুলনীয় বিশুদ্ধতার অধিকারী। এর নিঃসীম নীল রঙ দেখলে পানিতে ছায়া পড়া শরতের মেঘমুক্ত আকাশের কথা মনে পড়ে যায়। শুভ্র লিনেনের ওপর ধকধক করে জ্বলছে সেটা। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওটা, কেউ ওটার প্রশংসা করল, কেউ উচ্ছ্বসিত হলো…কেউ কেউ ভয়ে শিউরে উঠল ভিক্টিমের বেডরুম দেখে। লাশ পড়ে থাকার জায়গাটা দেখে, রক্তমাখা কার্পেট দেখে বুক কেঁপে উঠল তাদের। সেই সাথে তাদের অবাক করল এই রুমের দেয়ালগুলো, অনতিক্রম্য এই দেয়াল পেরিয়েই বেরিয়ে গেছে খুনি। হয়তো ঐ মার্বেলের ম্যান্টেলটা নড়ানো যায়। অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিলো এই ধারণাকে। অনেকে আবার কল্পনার ডানায় ভেসে ভেসে ভাবতে লাগল, ঐ ম্যান্টেল সরে বেরিয়ে এসেছে এক গোপন সুড়ঙ্গ, তার সাথে নিশ্চয়ই যোগসূত্র আছে কোনো ড্রেন বা নর্দমার, সেই পথ ধরে খুনি চলে গেছে গোরস্থানের দিকে –

ড্রাউওট অ্যান্ড কো.-তে নিলামে তোলা হলো নীল হীরকখণ্ডটা। লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে জায়গাটা। নিলাম ডাকার জায়গাটা একদম বিশৃঙ্খল হয়ে আছে হই-হট্টগোলের কারণে। এমনি যারা প্যারিসের নিলামগুলোতে যায়, যারা কেনে, কিংবা কেনার সামর্থ্য রাখে, তারা তো আছেই, সেই সাথে এখানে এসেছে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ: ব্যাংকার, দালাল, চিত্রকর, এমনকি নারীরাও বাদ যায়নি। সেই সাথে এসেছেন দুজন মন্ত্রী, একজন ইতালীয় গায়ক, একজন দেশচ্যুত রাজা যিনি মান বজায় রাখার জন্য গলা ফাটিয়ে দাম হেঁকে যাচ্ছেন। এক লক্ষ ফ্রাঁ! তিনি ভালোই জানেন, এই পর্যন্ত এগুনোটা নিরাপদ। ইতালীয় গায়ক আরেকটু ঝুঁকি নিয়ে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার হাঁকলেন। ফ্রান্সের কমেডি থিয়েটারের এক সদস্য হাঁকলেন এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার।

হীরকের দাম দুই লক্ষে উঠে যাবার পরে অনেকেই ঝরে গেলেন প্রতিযোগিতা থেকে। দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজারে যাবার পরে মাত্র দুজন টিকে রইলেন। তাদের একজন হলেন হার্শম্যান, নামকরা শিল্পপতি, বহু স্বর্ণখনির মালিক। দ্বিতীয়জন হলেন কাউন্টেস ডি ক্রোজোন, আমেরিকান কোটিপতি। বহুমূল্য রত্ন আর হীরকের সংগ্রহের কারণে তার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে।

“দুই লক্ষ ষাট হাজার… দুই লক্ষ সত্তর হাজার… পঁচাত্তর… আশি…” পাগলের মতো চিল্লিয়ে যাচ্ছে নিলামদার। পর্যায়ক্রমে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে সে। “মাদাম দুই লক্ষ আশি হাজার হেঁকেছেন…আরো বাড়াবেন নাকি?”

“তিন লক্ষ,” বলে উঠলেন হার্শম্যান।

কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেল সবাই। কাউন্টেসের মুখের হাসি মুছেনি এখনো, তবে উত্তেজনায় তাকে কিছুটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। সামনে রাখা চেয়ারটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উপস্থিত অন্য সবার সাথে সাথে তিনিও এই দ্বৈরথের ব্যাপারে আন্দাজ করেছিলেন। যুক্তি অনুযায়ী, অবধারিতভাবেই এই লড়াইয়ে জিতবেন শিল্পপতি। নিজের শখ মেটানোর জন্য মিলিয়ন ফ্রাঁ খরচ করা কোনো ব্যাপারই না তার কাছে।

তবে যাই হোক, আরো একবার দাম হাঁকলেন কাউন্টেস:

“তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।”

আবার স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। সবার নজর এখন শিল্পপতির দিকে। উনি নিশ্চয়ই আরো চড়া দাম হাঁকাবেন এখন। কিন্তু নিলামের দিকে আর মনোযোগ নেই হার্শম্যানের, নিজের ডান হাতে থাকা এক টুকরো কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, অন্য হাতে একটা ছেঁড়া খাম।

“তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার,” প্রতিধ্বনি করল নিলামদাতা। “এক!… দুই!… এই শেষ সুযোগ…. আর বাড়াবেন নাকি?… এক… দুই….. হাতছাড়া হয়ে গেল কিন্তু!…”

নড়লেন না হার্শম্যান।

“এবং তিন! শেষ! বিক্রি হয়ে গেল!” গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠে টেবিলে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিলো নিলামদাতা।

“চার লক্ষ,” চেঁচিয়ে উঠলেন হার্শম্যান। হাতুড়ির শব্দে যেন ঘোর কেটেছে তার।

কিন্তু এখন তো দেরি হয়ে গেছে। নিলামদারের সিদ্ধান্ত আর বদলানোর নয়।

হার্শম্যানের কয়েকজন পরিচিত লোক কাছে ঘেঁষে এলেন তার। হয়েছিল কী? আরো আগেই বললেন না কেন উনি? জবাবে হেসে ফেললেন তিনি।

বললেন:

“আরে! কিছুক্ষণের জন্য মনোযোগটা ঘুরে গিয়েছিল আমার, সেজন্যই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

“কী অদ্ভুত কথা।”

“আসলে একটা চিঠি পেয়েছি আমি।”

“আর সেই চিঠিটা আপনার-”

“মনোযোগ ঘুরানোর জন্য যথেষ্ট ছিল? হ্যাঁ, কিছুক্ষণের জন্য তো বটেই।”

গাঁইমার্দও ছিল ওখানে। আংটিটার নিলাম দেখতে এসেছিল সে। নিলামে আসা একজনকে থামালো সে। জিজ্ঞেস করল:

“আপনিই কি ঐ চিঠিটা মঁসিয়ে হার্শম্যানকে দিয়েছিলেন?”

“জি।”

“আপনাকে কে দিয়েছিল ওটা?”

“এক ভদ্রমহিলা।”

“উনি কোথায়?”

“উনি কোথায়?…এখানেই তো বসে ছিলেন…মুখের সামনে ভারি পর্দা টানা।”

“উনি চলে গেছেন?”

“এইমাত্রই গেছেন।“

তড়িঘড়ি দরজার দিকে গেল গাঁইমার্দ। ঐ মহিলাকে নেমে যেতে দেখল সিঁড়ি বেয়ে। তাকে ধাওয়া করল সে। কিন্তু রুমে ঢোকার মুখে গিজগিজ করতে থাকা মানুষ তার গতিকে শ্লথ করে দিলো। রাস্তায় বেরিয়ে দেখেন, ঐ মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। আবার নিলামখানায় ফিরে এসে হার্শম্যানকে খুঁজে বের করল সে। নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইল চিঠিটার কথা। হার্শম্যান চিঠিটা ধরিয়ে দিলেন তাকে। দায়সারাভাবে পেন্সিলে লেখা হয়েছে:

“এই নীল হীরকখণ্ড দুর্ভাগ্য বয়ে আনে।
ব্যারন ডি’হটরেকের কথা মনে করুন।”

লেখাটা কার, তা চিনতে পারেননি শিল্পপতি।

নীল হীরা নিয়ে গোলমালের পালা তাহলে তখনো শেষ হয়নি। ব্যারন ডি’হটরেকের খুন আর নিলামখানার ঘটনাটা দিয়েই ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল এটা। তবে মাস ছয়েক বাদে এটার খ্যাতি আরো বেড়ে গেল। যে জিনিসের জন্য এত কষ্ট আর অর্থ ব্যয় করলেন কাউন্টেস ডি ক্রোজোন, সে জিনিস চুরি হয়ে গেল তার কাছ থেকে।

অদ্ভুত ঘটনাটা বলছি আপনাদেরকে, দাঁড়ান। ব্যাপারটা এতোই চমকপ্ৰদ আর নাটকীয় যে শুনলে উত্তেজনায় গা গরম হয়ে যাবে। আর এখন ঘটনাটির ব্যাপারে আলোকপাত করছি আমি।

আগস্টের দশ তারিখে সন্ধ্যায় কাউন্ট এবং কাউন্টেস ডি ক্রোজোনের অতিথিরা এসে জড়ো হয়েছিলেন তাদের রাজকীয় অট্টালিকা, শ্যাঁতো দ্য ক্রোজোনের ড্রয়িং রুমে। সেখান থেকে সোম উপসাগরের মনোরম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বন্ধুদের আনন্দ দেয়ার জন্য পিয়ানো বাজাচ্ছেন কাউন্টেস। নিজের রত্নগুলো পিয়ানোর কাছের একটা ছোটো টেবিলে রেখেছেন তিনি। তার মধ্যে ব্যারন ডি’হটরেকের আংটিটাও রয়েছে।

ঘন্টাখানেক পরে কাউন্ট আর বেশিরভাগ অতিথিই বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। তাদের মাঝে তার দুই কাজিন এবং কাউন্টেসের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মাদাম ডি রিয়েলও আছেন। মাদাম অবশ্য ড্রয়িং রুমেই বসলেন। তার সাথে ছিলেন অস্ট্রিয়ান বাণিজ্যদূত হার ব্লেইকেন এবং তার স্ত্রী।

কিছুক্ষণ কথা বললেন তারা। এরপর রুমের মাঝখানে থাকা বিশাল ল্যাম্পটাকে নিভিয়ে দিলেন কাউন্টেস। ঠিক সেই মুহূর্তে পিয়ানোর সাথে থাকা দুটো ল্যাম্পও নিভিয়ে দিলেন হার ব্লেইকেন। কিছুক্ষণের জন্য ঘন অন্ধকার নেমে এলো ঘরজুড়ে। একটু পরেই মোমবাতি জ্বালালেন ব্লেইকেন। এরপর তিনজন চলে গেলেন যার যার ঘরে। কিন্তু নিজের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ামাত্র রত্নগুলোর কথা মনে পড়ল কাউন্টেসের। সাথে সাথে গৃহকর্মীকে ওগুলো নিয়ে আসতে পাঠালেন তিনি। মেয়েটা ওগুলো নিয়ে আসার পর ওগুলো না দেখেই ম্যান্টেলের ওপর রেখে দিলেন তিনি। পরের দিনে সকালে উঠে দেখেন, একটা আংটি নেই সেখানে। ব্যারনের নীল হীরকখণ্ড বসানো আংটিটা।

সাথে সাথেই নিজের স্বামীকে ব্যাপারটা জানালেন তিনি। কিছুক্ষণ কথা বলে দুজনেই একমত হলেন একটা বিষয়ে, কাজের মেয়েটার এ ব্যাপারে কোনো হাত নেই, আর কাজটা নিশ্চয়ই হার রেইকেনই করেছেন।

অ্যামিয়েন্সের পুলিশ কমিসারিকে ব্যাপারটা জানালেন কাউন্ট। সাথে সাথেই তদন্ত শুরু করলেন তারা। সেই সাথে অস্ট্রিয়ান বাণিজ্যদূতের ওপর কড়া নজর রাখা হলো, কোনোভাবেই যাতে আংটিটা কারো কাছে পাচার না করতে পারেন তিনি।

প্রাসাদোপম বাড়িটাকে দিনরাত ঘিরে রাখল গোয়েন্দার দল। দুই সপ্তাহ কেটে গেল কোনো ঘটনা ছাড়াই। এরপর হার ব্লেইকেন ফিরে যাবার ঘোষণা দিলেন। ঠিক সেইদিনেই তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করা হলো। পুলিশ আঁতিপাঁতি করে খুঁজল তার লাগেজ। সাথে একটা তালা দেয়া ছোট ব্যাগ রাখেন তিনি সবসময়। সেটার চাবি উনি বাদে আর কারো কাছে থাকে না। সেটার মাঝে টুথ পাউডারের একটা বোতল পাওয়া গেল। আর সেই বোতলের ভেতরে মিলল আংটিটা।

দেখে জ্ঞান হারালেন মাদাম ব্লেইকেন। তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হলো।

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য হার রেইকেন যে কথা বলেছিলেন, তা কেউই ভুলতে পারবে না। তিনি ঘোষণা দিলেন, আংটিটা স্বয়ং কাউন্টই রেখেছেন ওখানে, ওনার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য। তিনি বললেন:

“এই কাউন্ট খুবই নিষ্ঠুর। আর ওনার স্ত্রী খুবই অসুখী। আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন তিনি। আমি বলেছিলাম ডিভোর্স নিয়ে নেবার জন্য। কাউন্ট কোনোভাবে মনে হয় শুনে ফেলেছিলেন কথাটা। তাই আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য ওটা রেখে দিয়েছেন আমার ব্যাগে।”

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকলেন কাউন্ট এবং কাউন্টেস। তাদের দেয়া ব্যাখ্যা আর বাণিজ্যদূতের দেয়া ব্যাখ্যার মাঝে কোনটা সত্য, তা বোঝার উপায় ছিল না। মানুষ বলল, দুটোই সমসম্ভাব্য। ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার মতো আর কোনো তথ্য উঠে এলো না সামনে। তুমুল তদন্ত চলল, মানুষ রসিয়ে রসিয়ে গল্প বানাতে লাগল, অনেকে অনেক কিছু অনুমানও করল, কিন্তু আসলে কী হয়েছিল তা জানা গেল না।

এত উত্তেজনা আর কুখ্যাতি সহ্য হচ্ছিল না কাউন্ট আর কাউন্টেসের। বাণিজ্যদূতের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণও দেখাতে পারছিলেন না তারা। তাই রহস্যের জট ছাড়ানোর জন্য প্যারিস থেকে গোয়েন্দা নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। গাঁইমার্দকে নিয়ে এলেন তারা।

চারদিন ধরে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালো পোড় খাওয়া গোয়েন্দা, এক ফুটও বাদ দিলো না। গৃহকর্মী, শোফার, মালি, কাছের পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের সাথে কথা বলল দীর্ঘক্ষণ ধরে। অতিথিরা যে ঘরে ছিল, সেগুলো দেখল। তারপর এক সকালে কাউন্ট কিংবা কাউন্টেসকে কিছু না বলেই গায়েব হয়ে গেল সে। সপ্তাহখানেক বাদে একটা টেলিগ্রাম এলো তার:

ক্য বয়েজি ডি’অ্যাংলাসের জাপানিজ টি-রুমে চলে আসবেন, পিজ। কালকে শুক্রবার, বিকেল ৫টায়।

-গাঁইমার্দ।

শুক্রবার বিকেল ৫টায় তাদের গাড়ি এসে থামল ৯ নম্বর রু্য বয়েজি ডি’অ্যাংলাসে। সামনের ফুটপাতে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে গাঁইমার্দ। কোনো কথা না বলে তাদেরকে দোতলার জাপানিজ টি-রুমে নিয়ে গেল সে। একটা রুমে দুই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো তাদের। পরিচয় করিয়ে দিলো গাঁইমার্দ:

“ইনি হলেন মঁসিয়ে গার্বোই, ভার্সেই কলেজের প্রফেসর। তার কাছ থেকে আধা মিলিয়ন ফ্রাঁ চুরি করেছিল আর্সেন লুপাঁ, মনে আছে নিশ্চয়ই? আর ইনি হলেন মঁসিয়ে লিওঁস ডি’হটরেক, ব্যারন ডি’হটরেকের ভাগ্নে এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী।”

কয়েক মিনিট পরে এলেন আরেকজন। গোয়েন্দা সার্ভিসের প্রধান মঁসিয়ে দুদো। তার মেজাজ খুব তেতে আছে মনে হচ্ছে। সবার উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে বললেন:

“আবার কী ঝামেলা শুরু করলে, গাঁইমার্স! তোমার টেলিফোন মেসেজ পেয়ে তড়িঘড়ি এলাম এখানে। কোনো ভালো সূত্র পেয়েছ নাকি?”

“জি চীফ, খুবই জরুরি একটা বিষয়ে কথা বলতে ডেকেছি। এক ঘন্টার মধ্যে আমাকে দায়িত্ব দেয়া সর্বশেষ দুই কেসের সমাধান হয়ে যাবে এখানে। তাই মনে হলো, আপনাকে ডাকা উচিত।”

“সাথে ডিউজি আর ফলেনফাঁতকেও উপস্থিত থাকতে হবে বুঝি? ওদেরকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।”

“জি, চীফ।”

“কীসের জন্য? সবাইকে তাক লাগিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করবে নাকি তুমি? তাড়াতাড়ি বলো তো, তর সইছে না আমার।”

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল গাঁইমার্দ। এরপর তার স্বভাবসুলভ দরাজ গলায় সবাইকে শুনিয়ে বলল:

“প্রথমে একটা কথা পরিষ্কার করি। এই আংটি চুরির সাথে হার ব্লেকেনের কোনো সম্পর্ক নেই।”

“কী!” চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে দুদো। “এটা বলাটা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি রকমের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।”

“শুধু এটুকুই কি জানতে পেরেছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট ডি ক্রোজোন।

“মোটেই না। চুরি হবার এক দিন পরে আপনার তিনজন অতিথি গাড়ি করে ক্রেসি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তাদের দুজন ওখানকার বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্রটায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকার সময়ে তৃতীয় ব্যক্তিটি চট করে গিয়েছিলেন পোস্ট অফিসে। সেখান থেকে ছোট্ট একটা বাক্স মেইল করেন তিনি। নিয়মানুযায়ী ভালোমতো বন্ধ করে সিল মারা ছিল তাতে। ওখানে লেখা ছিল, ওটার দাম একশো ফ্রাঁ।”

“তাতে আমি সন্দেহজনক কিছু দেখছি না,” বললেন কাউন্ট।

“কিন্তু আমার পরের কথাটা শুনলে আপনারও সন্দেহ হবে। এই ব্যক্তি নিজের নামের বদলে জিনিসটা পোস্ট করেছিলেন ‘রুশো’ নামটা লিখে। আর জিনিসটা পাঠানো হয়েছিল প্যারিসের জনৈক মঁসিয়ে বেলোউ’র নামে। সে ব্যক্তি বাক্সটা পাওয়ার পরপরই দ্রুত বাসা পাল্টে ফেলেন। আর ঐ বাক্সেই ছিল আংটিটা।”

“আপনি কি আমার কাজিন ডি’আন্দেলকে ইঙ্গিত করছেন?”

“না,” জবাব দিলো গাঁইমার্দ।

“মাদাম ডি রিয়েল তাহলে?”

“জি।”

“আপনি আমার বান্ধবী মাদাম ডি রিয়েলকে অভিযুক্ত করছেন?” উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন কাউন্টেস।

“আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, মাদাম,” শান্তকণ্ঠে বলল গাঁইমার্দ। “আপনি আংটিটা কেনার সময়ে কি মাদাম ডি রিয়েল ছিলেন ওখানে?”

“জি, কিন্তু আমরা একসাথে ওখানে যাইনি।”

“উনিই কি আপনাকে আংটিটা কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন?”

একটু ভেবে দেখলেন কাউন্টেস, এরপর বললেন:

“হ্যাঁ, কথাটা মনে হয় ও-ই তুলেছিল—”

“ধন্যবাদ, মাদাম। আপনার কথায় এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মাদাম ডি রিয়েলই প্রথম আংটিটার কথা তুলেছিলেন। আর উনিই আপনাকে ওটা কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। “

“কিন্তু আমার মনে হয় না আমার বান্ধবী – “

“মাফ করবেন, কাউন্টেস। সোজাসুজি একটা কথা বলি। মাদাম ডি রিয়েল আপনার ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবী নন। ওনার সাথে আপনার মোটামুটি জানাশোনা আছে, এটুকুই। পত্রিকা থেকে জেনেছি এসব। গত শীতে প্রথম ওনার সাথে পরিচয় হয়েছিল আপনার। উনি নিজের সম্পর্কে, নিজের অতীত, নিজের আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে আপনাকে যা যা বলেছেন, তার সবই বানোয়াট। আমার কাছে প্রমাণ আছে এর। সত্যি বলতে, আপনার সাথে পরিচয় হবার আগে মাদাম ব্ল্যাঞ্চে ডি রিয়েলের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আর এখনো ওনার কোনো অস্তিত্ব নেই।”

“তো?”

“তো?” পাল্টা বলল গাঁইমার্দ।

“খুবই উদ্ভট একটা গল্প শোনালেন আপনি,” বললেন কাউন্টেস। “কিন্তু এ তথ্য তো আমাদের কেসে কোনো কাজে আসবে না। মাদাম ডি রিয়েল ওই আংটিটা নিয়ে গেলে ওটা হার রেইকেনের টুথ পাউডারের বোতলে পাওয়া গেল কীভাবে? এত ঝুঁকি নিয়ে ওটা চুরি করলে তো ওটা নিজের কাছেই রেখে দেয়ার কথা ওনার, তাই না? এ ব্যাপারে কী বলবেন?”

“আমি কিছুই বলব না- সত্যিকারের মাদাম ডি রিয়েলই জবাবটা দেবেন আপনাকে।”

“ওহ! ওনার অস্তিত্ব আছে তাহলে?”

“আছে, আবার নেই। অল্প কথায় বলছি। দিন তিনেক আগে একটা পত্রিকা পড়ার সময়ে ট্রাউভিলের হোটেলে কে কে এসেছেন, তার তালিকায় নজর বুলাচ্ছিলাম আমি। সেখানে পড়লাম: ‘হোটেল বিউরিভ্যাজ— মাদাম ডি রিয়েল, ইত্যাদি।’

“সাথে সাথে ট্রাউভিলে ছুটলাম আমি। হোটেলের মালিককে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তার কাছ থেকে শোনা বর্ণনা আর অন্যান্য তথ্য থেকে বুঝলাম, উনিই সেই মাদাম ডি রিয়েল, যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু উনি তখন ঐ হোটেল ছেড়ে দিয়েছেন। যাওয়ার আগে প্যারিসের একটা ঠিকানা দিয়ে গিয়েছেন। ঠিকানাটা হলো: ৩ নং ক্যু দ্য কলিসি। গত পরশু ঐ ঠিকানায় গিয়েছিলাম আমি। জানতে পারলাম, ওখানে মাদাম ডি রিয়েল নামে কেউ থাকেন না। তবে ঐ বাড়ির তিনতলায় জনৈক মাদাম রিয়েল থাকেন বটে। পেশায় ডায়মন্ড ব্রোকার, প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকেন। আগের দিন সন্ধ্যায়ই ফিরেছেন তিনি। গতকালকে তাকে ফোন করলাম আমি। একটা বানোয়াট নাম দিয়ে বললাম, মিডলম্যান হিসেবে আমার কিছু ধনী বন্ধুর কাছে ওনার হীরা বেচে দিতে পারব আমি। আজকে এখানে উনি আসবেন সেই ব্যাপারে কথা বলার জন্য।”

“কী! আপনার ধারণা এখানে আসবেন উনি?”

“জি, ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায়।”

“আপনি কি নিশ্চিত যে এটা উনিই?”

“শ্যাতো দ্য ক্রোজোনের মাদাম ডি রিয়েল কি না? হ্যাঁ, আমি শতভাগ নিশ্চিত কারণ এ বিষয়ে শক্ত প্রমাণ আছে আমার কাছে। কিন্তু… শুনুন!… ফলেনফাঁত সিগনাল দিয়েছে!”

বাইরে একটা হুইসেল বেজে উঠেছে। তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল গাঁইমার্দ।

“মঁসিয়ে এবং মাদাম ডি ক্রোজোন, হাতে সময় একদমই নেই। আপনারা একটু কষ্ট করে পাশের ঘরে যাবেন? মঁসিয়ে ডি’হটরেক আর মঁসিয়ে গাৰ্বোই, আপনারাও যান ওনাদের সাথে। এই দরজাটা খোলা থাকবে। আমি সিগনাল দেওয়ামাত্র বেরিয়ে আসবেন আপনারা। আর চীফ, আপনি এখানেই থাকুন।”

“আমাদের কাজেকর্মে অন্য মানুষেরা বিরক্ত হতে পারে,” বললেন মঁসিয়ে দুদো।

“না, এই দোকানটা নতুন হয়েছে, মালিক আমার বন্ধুমানুষ। এখানে এসে কেউ যাতে আমাদের বিরক্ত করতে না পারে, সে খেয়াল রাখবে ও। কেবল ঐ স্বর্ণকেশী মহিলা ছাড়া।”

“ঐ স্বর্ণকেশী মহিলা! কী বলতে চাইছ তুমি?”

“জি, চীফ, আমাদের অতিপরিচিত সেই স্বর্ণকেশী মহিলার কথাই বলছি। আর্সেন লুপাঁর বন্ধু এবং বিশ্বস্ত সহচরী। ঐ মহিলার বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ থাকায় এখনই ধরতে পারি তাকে। কিন্তু সে যাদের কাছ থেকে লুট করেছে, তাদেরকে নিয়ে তার মুখোমুখি হতে চাই আমি।”

জানালা দিয়ে তাকাল সে।

“ওকে দেখতে পাচ্ছি আমি। দরজা দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছে ও। কোনোভাবেই আর পালাতে পারবে না এবার! ফলেনফাঁত আর ডিউজি পাহারা দিচ্ছে দরজায়… অবশেষে সেই স্বর্ণকেশী মহিলাকে ধরতে পারলাম, চীফ!

মুহূর্তপরেই এক মহিলা প্রবেশ করল দরজা দিয়ে। লম্বা, দীর্ঘদেহী, ফ্যাকাশে চেহারা। মাথায় চকচকে সোনালি চুল। উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে উঠল গাঁইমার্দ। মুখ দিয়ে কথা সরছে না তার, নড়ার শক্তিও যেন হারিয়েছেন তিনি। ঐ মহিলা আসলেই চলে এসেছে তার সামনে, ধরা পড়তে যাচ্ছে অচিরেই! আর্সেন লুপাঁর বিরুদ্ধে কী দারুণ এক বিজয়! এতদিনের অনেক অপমানের প্রতিশোধও নেয়া হয়ে গেল এতে। কিন্তু এত সহজেই জিতে যেতে কি পারবেন তিনি? আর্সেন লুপাঁর মতো ধোঁকা দেখিয়ে স্বর্ণকেশী মহিলা হয়তো আরো একবার তার নাগাল গলে পালাবে। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে এখনো মহিলা, সবাই চুপ করে যাওয়াতে একটু অবাক হয়েছে। তার মুখে কোনো সন্দেহ কিংবা আতঙ্কের ছাপ নেই।

“ও নির্ঘাত পালাবে! গায়েব হয়ে যাবে আবার!” ভাবল গাঁইমার্দ।

চলে যাওয়ার জন্য ঘুরতে যাচ্ছিল মহিলা। ফট করে তার আর দরজার মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাঁইমার্দ।

“না, আপনাকে যেতে দেয়া যাবে না! কেন যাবেন?”

“দেখুন মঁসিয়ে, এসবের অর্থ কিছুই বুঝছি না আমি। আমাকে যেতে-”

“আপনি তো যেতে পারবেন না, মাদাম। বিশেষ কারণে আপনাকে এখানে থাকতেই হবে।’

“কিন্তু–”

“তর্ক করে কোনো লাভ নেই, মাদাম। আপনি যেতে পারবেন না।” কম্পিত ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল মহিলা। তোতলাতে তোতলাতে বলল :

“আপনি কী চান আসলে?”

যুদ্ধে জিতে গেছে গাঁইমার্দ। স্বর্ণকেশীও ধরা পড়েছে। তাই সব বলে দিতে আর বাধা থাকল না ওর। সে বলল:

“আমার বন্ধুটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। উনি কিছু হীরা কিনতে চাচ্ছেন। আপনাকে যে রত্নগুলো আনতে বলেছিলাম, সেগুলো এনেছেন তো?”

“না— না- আমি জানি না। আমার কিছু মনে পড়ছে না।”

“আহহা! নিজের মগজটাকে নাড়া দিন একটু। আপনার পরিচিত একজন আপনাকে একটা হীরা বসানো সোনার আংটি পাঠাতে চেয়েছিল… নীল হীরার মতো। আমার কথা শুনে আপনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ঠিক এই জিনিসটাই আছে।’ মনে পড়েছে?”

কোনো জবাব দিলো না মহিলা। একটা ছোটো ব্যাগ খসে পড়ল তার হাত থেকে। তাড়াতাড়ি তুলে নিলো সেটা সে। শক্ত করে ধরে রাখল হাতের মুঠোয়। হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে তার।

“মাদাম ডি রিয়েল,” গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল গাঁইমার্দ। “আমাদের ওপর আপনার কোনো ভরসাই নেই দেখছি। আমার কাছে কী আছে, দেখাচ্ছি। তাহলে হয়তো একটু বিশ্বাস আসবে আপনার।“

নিজের মানিব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল সে। সেটায় মোড়ানো রয়েছে কিছু সোনালি রঙের চুল।

“এই চুলগুলো আঁতোয়ানেত ব্রেহাতের মাথা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিলেন ব্যারন ডি’হটরেক। তার লাশের হাতে আটকে ছিল এগুলো। ওগুলো মাদামোয়াজেল গার্বোইকে দেখিয়েছি আমি। সে বলেছে, স্বর্ণকেশী মহিলার চুলের সাথে হুবহু মিলে যায় সেগুলো। তাছাড়া, ওগুলো তো আপনার চুলের সাথেও মিলে যায়।“

হতবিহ্বল হয়ে তার দিয়ে তাকিয়ে রইল মাদাম রিয়েল, তার কথা বুঝতে পারছে না যেন। আবার মুখ খুললেন গাঁইমার্দ:

“আর এখানে দুটো খালি পারফিউমের বোতল আছে। কোনো লেবেল লাগানো নেই সেগুলোতে। কিন্তু খালি হলেও সেগুলোতে একটু ঘ্রাণ রয়ে গেছে। আর সেই ঘ্রাণটুকু দিয়েই মাদামোয়াজেল গার্বোই শনাক্ত করে বলেছে, দুইদিন ধরে তার ভ্রমণসঙ্গী হওয়া ঐ নারী এই পারফিউমই ব্যবহার করত। এর একটা বোতল পাওয়া গেছে শ্যাতো দ্য ক্রোজোনের যে রুমে মাদাম ডি রিয়েল ছিলেন, সেই রুমে। আর অন্যটা মিলেছে হোটেল বিউরিভ্যাজের এক রুমে, সেই রুমেই ছিলেন আপনি।”

“কী বলছেন এসব?… স্বর্ণকেশী মহিলা… শ্যাতো দ্য ক্রোজোন …”

জবাব দিলো না গোয়েন্দা। নিজের পকেট থেকে চারটা কাগজ বের করে পাশাপাশি রাখল টেবিলে। এরপর বলল :

“এই চারটা কাগজে বিভিন্ন রকমের হাতের লেখা রয়েছে। প্রথম লেখাটা আঁতোয়ানেত ব্রেহাতের। দ্বিতীয়টা নিলামের দিনে ব্যারন হার্শম্যানকে চিঠি লেখা সেই মহিলার। তৃতীয়টা লিখেছেন মাদাম ডি রিয়েল, ডি ক্রোজোনদের বাড়িতে থাকাকালে। আর চার নম্বরটা… আপনার হাতের লেখা, মাদাম। হোটেল বিউরিভ্যাজের মালিককে ট্রাউভিলে নিজের ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন আপনি। এখন, চারটা হাতের লেখা মিলিয়ে দেখুন। হুবহু মিলে যাচ্ছে।’

“এ কী অদ্ভুত কথা? মঁসিয়ে, সত্যি করে বলুন তো, কী হচ্ছে এসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

পাশের রুমে চলে গেল গাঁইমার্দ, ফিরে এলো মঁসিয়ে গার্বোইকে নিয়ে। তাকে মাদাম রিয়েলের সামনে দাঁড়া করিয়ে বলল:

“মঁসিয়ে গার্বোই, এ-ই কি সেই মহিলা নয় যে আপনার মেয়েকে অপহরণ করেছিল, যাকে আপনি মঁসিয়ে দেতিনাঁর বাড়িতে দেখেছিলেন?”

“জি না।”

স্তম্ভিত হয়ে গেল গাঁইমার্দ। এক মুহূর্তের জন্য মুখ দিয়ে কথা সরলো না তার। অবশেষে কোনোমতে বলল: “না?… আপনার কোনো ভুল হচ্ছে নিশ্চয়ই…”

“আমার ভুল হচ্ছে না। এই মাদামের চুলের রঙ সোনালি ঠিকই। সে কারণেই ওনার সাথে চেহারায় মিলও আছে কিছুটা। কিন্তু আর সবদিক থেকেই ইনি ভিন্ন।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে আপনার।” অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদেরকে ডাকল গাঁইমার্দ

“মঁসিয়ে ডি’হটরেক,” সে বলল, “আপনি কি আঁতোয়ানেত ব্ৰেহাতকে চিনতে পারছেন?”

“না, এই মহিলাকে আমি আমার আঙ্কেলের বাড়িতে দেখিনি।”

“ইনি মাদাম ডি রিয়েল নন,” ঘোষণা করলেন কাউন্ট ডি ক্রোজোন।

ওনার কথাটাই ছিল কফিনের শেষ পেরেক। তার কথায় পুরোপুরি দমে গেল গাঁইমার্দ। এতদিন ধরে তিলে তিলে গড়া সূত্রগুলোর ধ্বংসস্তূপে যেন চাপা পড়ে গেল সে। তার গর্বে বড় একটা কালির আঁচড় লাগল। আত্মবিশ্বাসও ভেঙে পড়ল এই আকস্মিক আঘাতে।

উঠে দাঁড়ালেন মসিয়েঁ দুদো। বললেন:

“আপনাকে এভাবে বিব্রত করার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, মাদাম। দুর্ভাগ্যবশত একটা ভুল হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আপনাকে একটু সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। কিছু নিয়ে চিন্তায় আছেন আপনি। কী সেটা?”

“আসলে, মঁসিয়ে, আমি ভড়কে গিয়েছিলাম খুব। আমার এই ব্যাগে লাখ ফ্রাঁ সমমূল্যের হীরা আছে। আর আপনার বন্ধুটির আচার-আচরণ খুবই সন্দেহজনক।”

“আপনি তো প্রায়ই প্যারিসের বাইরে যান। এর ব্যাখ্যা কী?”

“নিজের ব্যবসার কাজে প্রায়ই অন্য শহরে যেতে হয় আমার, এটুকুই।” আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো খুঁজে পেলেন না মঁসিয়ে দুদো। নিজের অধীনস্থের দিকে ফিরে বললেন:

“তোমার এই তদন্তের মাঝে অনেক ফাঁক-ফোকর ছিল, গাঁইমার্দ। আর এই ভদ্রমহিলার সাথে খুবই রূঢ় আচরণ করেছ তুমি। কাল সকালেই আমার অফিসে এসে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে তোমাকে।”

সাক্ষাৎকারের পালা শেষ। মঁসিয়ে দুদো চলে যাবার সময়ে একটা বিরক্তিকর ঘটনা ঘটল। মাদাম রিয়েল গাঁইমার্দের দিকে ফিরে বলল:

“আপনার নাম তো মসিয়ে গাঁইমার্দ, তাই না?”

“জি।”

“তাহলে এই চিঠিটা নিশ্চয়ই আপনাকেই পাঠানো হয়েছে। আজ সকালে এটা পেয়েছি আমি। ঠিকানায় লেখা ছিল ‘মঁসিয়ে জাস্টিন গাঁইমার্দ, প্রযত্নে মাদাম রিয়েল।’ ভেবেছিলাম কেউ ফাজলামি করে পাঠিয়েছে বুঝি এটা। তখন তো আপনার নাম জানতাম না, তাই। মনে হচ্ছে, আপনার প্রতিপক্ষ জানতেন যে, আমরা এখানে দেখা করতে যাচ্ছি।”

চিঠিটা না পড়েই নিজের পকেটে রেখে দিতে যাচ্ছিল গাঁইমার্দ। কিন্তু নিজের বসের সামনে এ কাজ করার সাহস হলো না তার। খাম খুলে নিচুস্বরে পড়ল :

কোনো এক সময়ে, এক স্বর্ণকেশী মহিলা, এক লুপাঁ আর এক গাঁইমার্দ ছিল। সুন্দরী সেই স্বর্ণকেশী মহিলার জন্য দুষ্টুবুদ্ধি করেছিল শয়তান গাঁইমার্দ। লুপাঁ ছিল ভালোমানুষ, ঐ নারীর বন্ধু আর রক্ষাকর্তা সে। ঐ নারীকে কাউন্টেস ডি ক্রোজোনের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বলেছিল লুপাঁ। এক ডায়মন্ড ব্রোকার মাদাম ডি রিয়েলের নামে ছদ্মনাম নিতে বলেছিল তাকে। সেই নারীরও ছিল সোনালি চুল আর ফ্যাকাশে চেহারা। লুপাঁ মনে মনে ভাবল: দুষ্টু গাঁইমার্দ যদি কোনোভাবে স্বর্ণকেশী মহিলার সন্ধান পেয়ে যায়, তাহলে এই ব্যাপারটা কাজে লাগবে। সৎ ডায়মন্ড ব্রোকারের দিকে তার নজর সরিয়ে দেয়া যাবে তখন। এই আগাম সতর্কতাই দারুণভাবে কাজে লেগে গেল পরে। গাঁইমার্দ যে পত্রিকা পড়ে, তাতে একটা নোট পাঠিয়ে তার ঠিকানা ছাপানো হলো। আসন স্বর্ণকেশী মহিলা ইচ্ছা করে একটা পারফিউমের বোতল ফেলে রেখে গেল হোটেল বিউরিভ্যাজে। আসল স্বর্ণকেশী মহিলাই মাদাম রিয়েলের ঠিকানাটা লিখে দিয়ে আসলো হোটেলের রেজিস্টারে। গাঁইমার্দকে বোকা বানানোর সকল চেষ্টাই সম্পন্ন হলো। শুনতে কেমন লাগছে আপনার! এর পেছনের আসল ঘটনাটা অপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে আমার। জানি, এই গল্পটা শুনলে সবার আগে হো হো করে হেসে উঠবেন আপনিই। ব্যাপারটা আসলেই খুব মজার। আমি নিজে তো খুবই মজা পেয়েছি।

আমার শুভাশিষ নিবেন, প্রিয় বন্ধু। আমার যোগ্য প্রতিপক্ষ মঁসিয়ে দুদোকেও আমার শুভাশিষ জানাবেন।

-আর্সেন লুপাঁ।

“ও সবকিছু জানে,” বিড়বিড় করে বলল গাঁইমার্দ। লুপাঁর কথামতো হো হো করে হাসি এলো না তার। “ও এমন সব জিনিস জানে, যেগুলো আমি কক্ষনো কাউকে বলিনি। চীফ, আমি যে আপনাকে এখানে ডেকে আনব, সেটা ও জানল কী করে? আমি যে পারফিউমের বোতলগুলো খুঁজে পাবো, সেটাই বা জানল কী করে? এসব কীভাবে জানা সম্ভব?”

মেঝেতে পা ঠুকল সে, মাথার চুলগুলো টেনে ধরল। হতাশার চরম পর্যায়ে চলে গেছে সে। তার জন্য খারাপ লাগল মঁসিয়ে দুদোর। তিনি বললেন:

“এসো, গাঁইমার্দ, মন খারাপ কোরো না। এরপরের বার আরো সূক্ষ্ণভাবে কাজ করার চেষ্টা কোরো।

একটু পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মসিয়ে দুদো, তার সাথে বেরিয়ে গেল মাদাম ডি রিয়েল।

পরের দশ মিনিট ধরে বারবার আর্সেন লুপাঁর চিঠিটা পড়তে লাগল গাঁইমার্দ। মঁসিয়ে এবং মাদাম ডি ক্রোজোন, মঁসিয়ে ডি’হটরেক আর মঁসিয়ে গার্বোই মিলে রুমের কোণায় দাঁড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে আলোচনা করতে লাগলেন। অবশেষে গোয়েন্দার সামনে গিয়ে কাউন্ট বললেন:

“প্রিয় মঁসিয়ে, অনেক তো তদন্ত করলেন। কিন্তু আমরা শুরুতে যেখানে ছিলাম, এখনো ঠিক সেখানেই আছি।”

“মাফ করবেন, আমার তদন্তে একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার: ঐ স্বর্ণকেশী মহিলাই এসব কুকর্ম ঘটাচ্ছে। আর লুপাঁই তাকে দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে।”

“এটা জেনে তো রহস্যের সমাধান হচ্ছে না। সত্যি বলতে, ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে এসবের কারণে। নীল হীরাটা চুরি করার জন্য একটা খুন করেছে ঐ মহিলা। তারপরেও জিনিসটা চুরি করেনি সে। পরে জিনিসটা চুরি করেও গোপনে সেটা আরেকজনকে দিয়ে দিয়েছে সে। এসব অদ্ভুত ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?”

“এসবের ব্যাখ্যা দিতে পারব না আমি।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি। তবে অন্য কেউ হয়তো পারবেন।”

“কে?”

একটু দ্বিধা করলেন কাউন্ট। তার অবস্থা দেখে মুখ খুললেন কাউন্টেস:

“এ ব্যাপারে আপনার মতো দক্ষ গোয়েন্দা আর একজনই আছেন। তার পক্ষেই লুপাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে তাকে হারানো সম্ভব। আমরা যদি এই কেসে হার্লক শোমসের সাহায্য নেই, তাহলে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?”

তার কথায় ধন্ধে পড়ে গেল গাঁইমার্দ। কোনোমতে মুখ খুলে বলল :

“না…কিন্তু…আমি বুঝতে পারছি না—”

“আচ্ছা, আমি ব্যাখ্যা করছি। এসব রহস্য আমাকে খুবই অধৈর্য করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিষ্কার জানতে চাই আমি। মঁসিয়ে গার্বোই আর মঁসিয়ে ডি’হটরেকের একই ইচ্ছা। আমরা জনপ্রিয় এই ব্রিটিশ গোয়েন্দার সাহায্য নিতে চাই।”

“আপনি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, মাদাম,” জবাব দিলো গোয়েন্দা। এরকম ভদ্রতা দেখানোর জন্য তাকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। “বুড়ো গাঁইমার্দ হয়তো আর্সেন লুপাঁকে টেক্কা দিতে পারেনি, কিন্তু হার্লক শোমস কি পারবে? আশা করছি। ওনার কাজ তো খুব প্রশংসনীয়, তবে… লুপাঁকে ধরার গ্যারান্টি দেয়া যায় না।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে উনি সফল হবেন না?”

“আমার তো তাই ধারণা। হার্লক শোমস আর আর্সেন লুপাঁর মধ্যকার দ্বৈরথের ফলাফল দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমি। ঐ ব্রিটিশ ভদ্রলোক হেরে যাবেন তার কাছে।”

“কিন্তু তারপরেও, যাই হোক না কেন, এই কেসে আপনার সহযোগিতা কি আমরা আশা করতে পারি?”

“অবশ্যই, মাদাম, যেকোনো বিষয়ে মঁসিয়ে শোমসকে খুশিমনেই সাহায্য করব আমি।”

“আপনি কি ওনার ঠিকানা জানেন?”

“জি, ২১৯ পার্কার স্ট্রিট।”

সেই সন্ধ্যায় হার ব্লেইকেনের ওপর থেকে মামলা তুলে নিলেন মঁসিয়ে এবং মাদাম ডি ক্রোজোন। সেই সাথে যৌথ উদ্যোগে হার্লক শোমসকে একটা চিঠি পাঠানো হলো।