১. লটারি টিকেট নং ৫১৪

অধ্যায় এক – লটারি টিকেট নং ৫১৪

গত ডিসেম্বরের আট তারিখ। কলেজ অভ ভার্সেই এর গণিতের প্রফেসর, মঁসিয়ে গার্বোই, একটা পুরোনো কিউরিওসিটি শপে দুর্লভ জিনিসপত্র দেখছিলেন। হঠাৎ মেহগনির একটা ছোটো ডেস্ক দেখলেন তিনি। অসংখ্য ড্রয়ার থাকার কারণে রাইটিং ডেস্কটা ভারি মনে ধরে গেল তার।

“সুজানের জন্মদিনের উপহার হিসেবে দারুণ হবে এটা,” ভাবলেন তিনি নিজের পরিমিত উপার্জন দিয়ে মেয়েকে সবসময়ই সাদাসিধে অথচ কাজের, এমন জিনিস দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। জিনিসটার দাম দেখলেন তিনি। এরপর হালকা দামাদামি করে পঁয়ষট্টি ফ্রাঁ দিয়ে কিনে নিলেন সেটা। কেনার পরে যখন নিজের ঠিকানাটা দোকানদারের কাছে দিচ্ছিলেন তিনি, ঠিক তখনই এক সুবেশী তরুণ এসে প্রবেশ করলেন সেখানে। বিভিন্ন অ্যান্টিক জিনিস দেখতে দেখতে তার চোখ পড়ল ঐ রাইটিং ডেস্কটার ওপরে। সাথে সাথেই সেটার দাম জানতে চাইলেন তিনি।

“এটা বিক্রি হয়ে গেছে,” জবাব দিলো দোকানদার।

“আহ! এই ভদ্রলোকের কাছে নাকি?”

মাথা নুইয়ে হ্যাঁ বললেন মঁসিয়ে গার্বোই, এরপর বেরিয়ে গেলেন দোকান থেকে। এরকম অভিজাত এক ভদ্রলোকের পছন্দ হওয়া জিনিসের মালিক হয়েছেন তিনি, ভাবতেই খুশি লাগছে। কিন্তু ডজনখানেক কদম এগুনোর আগেই ঐ তরুণ এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। মাথা থেকে হ্যাট খুলে খুবই ভদ্রভাবে তাকে বললেন:

“মাফ করবেন, মঁসিয়ে; আপনাকে বেহায়ার মতো একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি। কথা হলো, এই রাইটিং ডেস্কটা কেনার সময় কি অন্য কোনো বিশেষ জিনিসের প্রতি চোখ পড়েছিল আপনার?”

“জি না। ভাগ্যক্রমেই এটা চোখে পড়েছে আমার, আর পছন্দ হয়ে গেছে সাথে সাথেই।”

“কিন্তু এমনিতে এটা আপনার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই না?”

“মানে, এটা আমি রেখে দেবো, এটুকুই!”

“এটা অ্যান্টিক জিনিস বলেই কি রেখে দিতে চাচ্ছেন?”

“জি না, জিনিসটা খুবই কাজের,” ঘোষণা করলেন মঁসিয়ে গাৰ্বোই। “সেক্ষেত্রে ঐটার বদলে আরেকটা ডেস্ক নিতে রাজি হবেন কি? সেটাও এরকমই ড্রয়ারওয়ালা, আরো মজবুত আছে এটার চেয়ে।”

“কিন্তু এটাও তো বেশ মজবুত। তাই অদল-বদলের কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”

“কিন্তু–”

ভদ্র আচরণ করলেও মঁসিয়ে গার্বোই এমনিতে খিটখিটে মেজাজ আর অধৈর্য স্বভাবের লোক। তাই জোর দিয়ে বললেন তিনি:

“মাফ করবেন মঁসিয়ে, আর জোরাজুরি করবেন না এ নিয়ে।”

কিন্তু তরুণ ভদ্রলোক তো নাছোড়বান্দা।

“আমি জানি না আপনি ওটা কত দিয়ে কিনেছেন। কিন্তু আমি এর দ্বিগুণ দিতে রাজি আছি।”

“জি না।”

“তিনগুণ দেবো।”

“ওহ! তাতে কাজ হবে ভেবেছেন?” অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। “এটা বেচার কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।”

তরুণ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তার দৃষ্টি কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দিলো মঁসিয়ে গার্বোইকে। এরপর ঘুরে দ্রুতবেগে চলে গেলেন তরুণটি।

ঘন্টাখানেক বাদে ডেস্কটা ভিরোফ্লে রোডে প্রফেসরের বাসায় ডেলিভারি দেয়া হলো। তিনি নিজের মেয়েকে ডেকে জানালেন:

“তোর জন্য এটা নিলাম, সুজান। আশা করি, তোর পছন্দ হবে। “

সুজান একজন হাসিখুশি, সুন্দরী তরুণী। দুই হাতে বাবার ঘাড় জড়িয়ে ধরে তাকে সস্নেহে অনেকগুলো চুমু খেলো সে। তার কাছে এই ডেস্কটা রাজকীয় উপহার বৈ অন্য কিছু নয়। ঐ রাতে গৃহকর্মী হরটেন্সের সহায়তায় ডেস্কটাকে নিজের রুমে নিয়ে এলো সে। এরপর ধুলো ঝাড়লো, ড্রয়ার আর খোপগুলো পরিষ্কার করে নিলো ভালোমতো। সেখানে গুছিয়ে রাখল নিজের কাগজপত্র, লেখার সরঞ্জামাদি, চিঠিপত্র, পোস্ট কার্ডের কালেকশন, আর তার কাজিন ফিলিপের গোপনীয় কিছু স্যুভেনির।

পরেরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় কলেজে গেলেন মঁসিয়ে গাবোই। দশটার দিকে নিত্যকার অভ্যাসবশত তার সাথে দেখা করতে গেল সুজান। তন্বী তরুণী মেয়েটিকে মুখে শিশুসুলভ হাসি ঝুলিয়ে কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মন ভরে গেল ওনার। একসাথে বাড়ি ফিরলেন দুজনে।

“আর তোর রাইটিং ডেস্কটার কী অবস্থা?”

“খুব সুন্দর ওটা! হরটেন্স আর আমি মিলে পেতলের খাঁজগুলো পলিশ করে নিয়েছি। এখন স্বর্ণের মতো চকচক করছে সেগুলো।”

“এটা পেয়ে খুশি হয়েছিস তো?”

“খুশি মানে! এতদিন যে এরকম একটা জিনিস ছাড়া কী করে চলেছি, তাই তো ভেবে পাচ্ছি না এখন।”

বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মঁসিয়ে গার্বোই বললেন:

“নাশতা খাওয়ার আগে ওটাকে আরেকবার গিয়ে দেখে আসবো নাকি?” বাবার আগে আগেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। কিন্তু নিজের রুমে ঢোকামাত্র তার গলা চিরে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এলো। সেই চিৎকারে বিস্ময় আর হাহাকার মেশানো।

“কী হয়েছে?” থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন মঁসিয়ে গার্বোই।

“রাইটিং ডেস্কটা চুরি হয়ে গেছে!”

পুলিশকে ডাকার পরে তারা চোরের সরল-সোজা পরিকল্পনা দেখে আকাশ থেকে পড়ল। সুজান গিয়েছিল বাইরে, তাদের গৃহকর্মীও গিয়েছিল বাজার করতে। ঠিক সেসময়ে ব্যাজধারী এক ড্রেম্যান আসে তাদের বাড়িতে, বিয়ার দেয়ার জন্য। তাদের বেশ কিছু প্রতিবেশিও দেখেছে তাকে। লোকটা নিজের কার্ট বাড়ির সামনে দাঁড়া করিয়ে দু’বার বেল বাজায়। হরটেন্স যে বাড়িতে নেই, সেটা ঐ প্রতিবেশিদের জানা ছিল না। তাদের মনে কোনো সন্দেহও জাগেনি তাই। এদিকে চোর বাবাজি আরামসেই তার কাজ সেরে নিয়েছেন।

ডেস্কটা বাদে বাড়ির একটা জিনিসেও হাত দেয়া হয়নি। এমনকি রাইটিং ডেস্কের ওপরে নিজের পার্সটা ফেলে গিয়েছিল সুজান, সেটাকেও পাশের একটা টেবিলে গুছিয়ে রেখে যাওয়া হয়েছে। ভেতরের কোনোকিছু খোয়াও যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, চোরটা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই এ বাড়িতে এসেছিল। এতে করে রহস্যটা আরো ঘোরালো হয়ে গেল। এরকম তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্য চোরটা এত বড় ঝুঁকি নিতে গেল কেন?

এর পেছনে একটা ব্লু-ই আছে প্রফেসরের হাতে, আগের রাতে ঘটা সেই অদ্ভুত ঘটনাটা। তিনি বললেন:

“ঐ তরুণ আমার প্রত্যাখ্যানে বেশ আহত হয়েছিল। আর তার চলে যাবার সময়ে যেন প্রচ্ছন্ন হুমকির ছাপ ছিল।”

কিন্তু এরকম ভাসা ভাসা ক্লু দিয়ে তো আর তদন্ত এগুনো যায় না। দোকানদারও এ ব্যাপারে বেশি কিছু আলোকপাত করতে পারল না। দুই ভদ্রলোকের কাউকেই তেমন চেনে না সে। ডেস্কটা সে চল্লিশ ফ্রাঁ দিয়ে শেভরিউজের এক নিলাম থেকে কিনেছিল। তার মতে, ন্যায্য দামেই সে বেচেছে এটাকে। পুলিশি তদন্তে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।

কিন্তু মঁসিয়ে গার্বোই’র বারবার মনে হতে লাগল যে, তিনি অমূল্য কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। ডেস্কের কোনো গোপন ড্রয়ারে নিশ্চয়ই কোনো গুপ্তধন লুকানো ছিল, আর তার কারণেই ঐ তরুণ চুরির পথ বেছে নিয়েছে।

“আহা বাবা! মন খারাপ কোরো না! ঐ গুপ্তধন দিয়ে কী-ই বা করতাম আমরা?” জিজ্ঞেস করল সুজান।

“খুকিরে! ঐটা দিয়ে তোকে ধুমধাম করে কোনো বড়লোকের সাথে বিয়ে দিতে পারতাম।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সুজান। কাজিন ফিলিপকে পেলেই তার চলবে। কিন্তু তার অবস্থাও যে শোচনীয়। আর ভার্সেইতে তাদের জীবন তো ইয়ো-র মতো সুখে-সমৃদ্ধিতে ভরপুর নয়।

দুই মাস পেরিয়ে গেল। এরপর বেশ কয়েকটা পিলে চমকিয়ে দেয়া ঘটনা ঘটে গেল। সেগুলোতে সৌভাগ্যের ছোঁয়ার পাশাপাশি নিদারুণ দুর্ভাগ্যের রেশও মিশে আছে।

ফেব্রুয়ারির এক তারিখে বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময়ে নিজের বাড়িতে এসে ঢুকলেন মঁসিয়ে গার্বোই। হাতে সান্ধ্য পত্রিকা। একটা চেয়ারে বসে সেটা পড়া শুরু করলেন তিনি। রাজনীতি তাকে তেমন একটা টানে না বলে সরাসরি ভেতরের পাতায় চলে গেলেন। সাথে সাথেই একটা খবর তার মনোযোগ আকর্ষণ করল:

প্রেস অ্যাসোসিয়েশন লটারির তৃতীয় ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছে
২৩ নং সিরিজের ৫১৪ নং লটারি ১ মিলিয়ন ফ্রাঁ জিতেছে।

হাত থেকে পত্রিকাটা খসে পড়ে গেল তার। ঘরের দেয়ালগুলো দুলে উঠল যেন। তার মনে হলো, হৃৎপিন্ডটা বুঝি চলা বন্ধ করে দেবে এখনই। ২৩ নম্বর সিরিজের ৫১৪ নং লটারিটার মালিক তিনি। এক বন্ধুর অনুরোধে লটারিটা কিনেছিলেন তিনি কোনো আশা ছাড়াই। অথচ সেটাই তাকে মিলিয়ন ফ্রাঁ-এর মালিক করে দিচ্ছে!

দ্রুত নিজের মেমোরান্ডাম বুকটা খুলে বসলেন তিনি। হ্যাঁ, ঠিকই তো, লটারির নম্বর মিলে যাচ্ছে ওখানকার লেখার সাথেও। কিন্তু টিকেটটা কোথায়?

দ্রুত নিজের ডেস্কে গিয়ে খামের বাক্স খুলে বসলেন তিনি। তার অতি মূল্যবান টিকেটটা তো এখানেই থাকার কথা। কিন্তু বাক্সটা নেই সেখানে! হঠাৎ মনে হলো, বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই ওটাকে ওখানে দেখেননি তিনি I

বাড়ির সামনে থাকা নুড়িপথের রাস্তায় কারো পায়ের আওয়াজ পেলেন তিনি। হাঁক দিয়ে বললেন:

“সুজান! সুজান!”

বিকেলবেলায় হাঁটতে বেরিয়েছিল সুজান। এইমাত্র ফিরল। বাবার ডাকে তড়িঘড়ি ঘরে এসে ঢুকল সে। তার দিকে তাকিয়ে মঁসিয়ে গার্বোই কোনোমতে উচ্চারণ করলেন:

“সুজান…বাক্সটা….খাম রাখার বাক্সটা?”

“কোন বাক্সটা?”

“এক শনিবারে ল্যুভরে কিনেছিলাম যেটা…টেবিলের শেষ মাথায় ছিল।”

“বাবা, সব ভুলে বসে আছো? আমরা না সব জিনিস একসাথে সরিয়ে রাখলাম?”

“কবে?”

“ওই সন্ধ্যায়… যে সন্ধ্যায়…”

“কিন্তু কোথায়?…জলদি বল, কোথায় রেখেছিস ওটা?”

“আমার রাইটিং ডেস্কে রেখেছিলাম।”

“চুরি হয়ে গেল যেটা?”

“হ্যাঁ।”

“হায় খোদা! চুরি হয়ে যাওয়া ডেস্কেই রাখতে হলো ওটা!”

অস্ফুট স্বরে শেষ কথাটা বললেন তিনি। গলা ধরে এসেছে তার। এরপর খপ করে সুজানের হাত ধরে নিচুস্বরেই বলে উঠলেন

“মা রে, ঐ টিকেট এক মিলিয়ন ফ্রাঁ জিতেছে।

“হায় হায়! বাবা, আগে বলোনি কেন আমাকে?” অবুঝের মতো হাহাকার করে উঠল সুজান।

“এক মিলিয়ন!” আবার বললেন তিনি। “ঐ বাক্সে থাকা টিকেটটা প্রেস লটারির সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা জিতেছে।”

এরকম বড় বিপর্যয়ে আগে কখনো পড়েনি তারা। দীর্ঘক্ষণ তাই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল দুজনে। অবশেষে সুজান বলল:

“কিন্তু বাবা, ওরা হয়তো টাকাটা দেবে তোমাকে।”

“কীভাবে? কীসের ভিত্তিতে?”

“প্রমাণ কি থাকতেই হবে?”

“তা তো লাগবেই। “

“আর কোনো প্রমাণই নেই তোমার কাছে?”

“প্রমাণ তো ছিল ঐ বাক্সের মধ্যে।”

“সে বাক্স তো গায়েব হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, আর এখন ঐ চোরটা সব টাকার মালিক হবে। “

“বাবা! এ ঘটনা ঠেকাতে হবে তোমাকে! যে করেই হোক!”

এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলেন তিনি। এরপর এতক্ষণ চেপে রাখা সব ক্ষোভ আর হতাশা যেন ঝেড়ে ফেললেন মেঝেতে একটা লাথি দিয়ে। উচ্চস্বরে বলে উঠলেন:

“ঐ চোরকে আমি কোনোমতেই ঐ টাকার মালিক হতে দেবো না। ও কেন পাবে ওটা? আহ! খুব চালাক ভেবেছে নিজেকে? কিছুই পাবে না সে। ও যখনই ঐ টাকা দাবি করতে যাবে, তখনই ওকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হবে। এরপর দেখব চোর বাবাজি নিজেকে বাঁচায় কী করে!”

“তুমি কী করবে, বাবা?”

“আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করব, যাই হোক না কেন! আর আমরা সফল হবোই। ঐ মিলিয়ন ফ্রাঁ-এর আসল মালিক আমি। আর তাই ওটা আদায় করেই ছাড়ব।”

কয়েক মিনিট পরে একটা টেলিগ্রাম লিখলেন তিনি:

বরাবর,

ক্রেডিট ফুঁসিয়েরের গভর্নর,

ক্য ক্যাপসিনা, প্যারিস।

২৩ নং সিরিজের ৫১৪ নং টিকেটের আসল মালিক আমি। অন্য কেউ

এটা দাবি করতে আসলে আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য অনুরোধ করা

হলো। -গার্বোই।

প্রায় একই সময়ে ক্রেডিট ফঁসিয়ের আরো একটা টেলিগ্রাম পেল:

২৩ নং সিরিজের ৫১৪ নং টিকেট আমার কাছে আছে।

– আর্সেন লুপাঁ

যতবারই আমি আর্সেন লুপাঁর জীবনকে স্মরণীয় করে রাখা অভিযানগুলোর সাথে নিজেকে মেলাতে চাই, ততবারই লজ্জায় পড়তে হয়। শুধু মনে হয়, এই অভিযানগুলোর বেশিরভাগই আমার পাঠকদের জানা। সত্যি বলতে, আমাদের এই ‘জাতীয় তস্কর’-এর এমন কোনো কাজ নেই, যেটা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি। এমন কোনো ভাঁওতাবাজি নেই, যেটাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়নি। আর তার এমন কোনো অভিযান নেই, যেটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে তাকে প্রায় হিরো বানিয়ে দেয়া হয়নি।

যেমন ধরুন, ‘দ্য ব্লন্ড লেডি’ (স্বর্ণকেশী মহিলা) কেসের ঐ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটার কথা জানেন না, এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। পত্রিকায় বড় বড় কালো অক্ষরে নানা রকম আকর্ষণীয় শিরোনাম দেয়া হচ্ছিল: “৫১৪ নম্বর লটারি টিকেট!”…”অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে ডাকাতি!”…”নীল হীরার কেচ্ছা!”

জনপ্রিয় ব্রিটিশ গোয়েন্দা হার্লক শোমস এই কেসের দায়িত্ব নেয়ায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সবাই। দুই বিখ্যাত শিল্পীর টক্করের সাক্ষী হয়ে সবার সেই উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল আরো বহুগুণে। আর যেদিন পত্রিকাওয়ালা ছেলেগুলো “আর্সেন লুপী গ্রেপ্তার!” খবর লেখা পত্রিকা বেচতে এসেছিল, সেদিন তো বুলেভার্দে হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল!

এই গল্পগুলোর কথা আবার বলার পেছনে একটা কারণ আছে আমার। এই রহস্যটার চাবি আসলে আমারই হাতে। এর আগের ঘটনাগুলো সবসময়ই একটা পর্যায় পর্যন্ত ধোঁয়াশায় ঘেরা থাকত। সেটা এখন সরিয়ে দেবো আমি। পুরোনো খবরের কাগজ বের করলাম আমি, পুরোনো দিনের সাক্ষাৎকারগুলো পড়লাম, বহুযুগ আগের চিঠিগুলো বের করলাম। এরপর সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে আসল তথ্যটা বের করলাম। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং আর্সেন লুপাঁই সাহায্য করল, আরো ছিল হার্লক শোমসের বিশ্বস্ত বন্ধু উইলসন।

এ দুটো টেলিগ্রাম (ক্রেডিট ফঁসিয়েরের কাছে লেখা গার্বোর্হ ও লুপাঁর টেলিগ্রাম) পত্রিকায় ছাপা হবার পরে সবাই যে কী পরিমাণে মজা পেয়েছিল, তা ভুলার নয়। শুধু ‘আর্সেন লুপাঁ’ নামটাই যে কারো আগ্রহ জাগানোর জন্য যথেষ্ট। গ্যালারির সবার আলোচনার বিষয় হয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে সে। আর এখানে গ্যালারি বলতে আমি গোটা দুনিয়াকে বোঝাচ্ছি।

সাথে সাথেই ক্রেডিট ফুঁসিয়ের এসব তদন্ত করার জন্য একটা দল গঠন করল। এতে করে এ ব্যাপারটা নিশ্চিত হলো: ২৩ নং সিরিজের ৫১৪ নং টিকেটটা লটারির ভার্সেই শাখার অফিস থেকে বেসি নামের এক আর্টিলারি অফিসারের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। কিছুদিন বাদে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর তার বন্ধুরা একটা চিঠির সূত্রে জানতে পারে, টিকেটটা তিনি তার এক বন্ধুকে দিয়ে গেছেন।

“আর আমি হলাম সেই বন্ধু,” দৃঢ়কণ্ঠে বললেন মঁসিয়ে গাৰ্বোই।

“সেটার প্রমাণ দিন,” জবাবে বললেন ক্রেডিট ফঁসিয়েরের গভর্নর।

“সেটা প্রমাণ করা কোনো ব্যাপারই না। কমপক্ষে বিশজন মানুষ বলবে যে, আমি মঁসিয়ে বেসির খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। ক্যাফে দ্য লা প্লেস- ডি’আরমেসে নিয়মিত কফি খেতে যেতাম আমরা। ওখানেই একদিন বিশ ফাঁ দিয়ে ঐ টিকেটটা কিনে নেই আমি, ওরই অনুরোধ রক্ষা করার জন্য।”

“আপনাকে ঐ টিকেটটা কিনতে দেখেছিল কেউ?”

“জি না।”

“তাহলে আপনি সেটা প্রমাণ করবেন কীভাবে?”

“ও আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল, সেটা দিয়ে “কীসের চিঠি?”

“টিকেটটার সাথে পিন দিয়ে গেঁথে রাখা ছিল সেটা।”

“তাহলে সেটা দেখান।”

“ওটা তো টিকেটের সাথেই চুরি হয়ে গেছে।

“তাহলে আপনাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”

দ্রুত জানা গেল যে, ওই চিঠিটা আর্সেন লুপাঁর কাছেই আছে। একো দ্য ফ্রান্স পত্রিকায় একটা ছোটো অনুচ্ছেদ ছাপা হলো কিছুদিন পরে। ঐ অংশটা বলা যায় লুপাঁর জন্যই বরাদ্দ। গুজব রয়েছে, ঐ পত্রিকার অন্যতম শেয়ারহোল্ডার সে। সেই অনুচ্ছেদের লেখা অনুযায়ী, আর্সেন লুপাঁ তার অ্যাডভোকেট এবং আইনি উপদেষ্টা মঁসিয়ে দেতিনাঁর কাছে ঐ চিঠিটা গচ্ছিত রেখেছেন। আর ঐ চিঠিটা নাকি মঁসিয়ে বেসি তাকে উদ্দেশ্য করেই লিখে গিয়েছেন।

এই ঘোষণায় সবাই আরেকচোট হেসে গড়াগড়ি খেল। আর্সেন লুপাঁ কি না এক উকিলের শরনাপন্ন হয়েছে! যে লোক আধুনিক সমাজের কোনো আইন- কানুনের তোয়াক্কা করে না, সে কি না প্যারিসের বার কাউন্সিলের এক সম্মানিত সদস্যকে নিজের আইনি প্রতিনিধি বানিয়েছে!

আর্সেন লুপাঁর সাথে অবশ্য মঁসিয়ে দেতিনাঁর কখনো সরাসরি সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়নি। এ ব্যাপারে বড় আক্ষেপ আছে তার। তবে এই রহস্যময় ভদ্রলোক তাকে নিজের আইনি প্রতিনিধি হবার ভার দেয়ায় খুবই সম্মানিত বোধ করেন তিনি। নিজের মক্কেলের দাবি-দাওয়া আদায়ে সদাপ্রস্তুত থাকেন তাই। মঁসিয়ে বেসির চিঠিটা খুশিমনে এবং কিছুটা গর্ব সহকারে তিনি প্রদর্শন করলেন সবার কাছে। সেই চিঠিতে টিকেট বেচার কথা লেখা থাকলেও, যার কাছে বেচা হয়েছে তার নামটা লেখা নেই। শুধু লেখা- ‘আমার প্রিয় বন্ধু।’

“আমার প্রিয় বন্ধু! এটা বলতে তো উনি আমাকেই বুঝিয়েছেন,” মঁসিয়ে বেসির চিঠির সাথে সংযুক্ত এক নোটে লিখে দিয়েছে আর্সেন লুপাঁ। “আর তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, চিঠিটা আমার কাছে থাকা।”

সাথে সাথে রিপোর্টারেরা এসে ঝেঁকে ধরল মঁসিয়ে গার্বোইকে। তিনি কোনোমতে বললেন:

“আমার প্রিয় বন্ধু বলতে উনি আমাকে বুঝিয়েছেন!… কিন্তু আর্সেন লুপাঁ ঐ টিকেটের সাথে সাথে চিঠিটাও চুরি করে নিয়ে গেছে।”

“ওনাকে তা প্রমাণ করতে বলুন!” রিপোর্টারদের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গভরে জানালো লুপাঁ।

“ও ছাড়া আর কার কাজ হবে এটা? রাইটিং ডেস্কটার সাথে সাথে চিঠিটাও চুরি করে নিয়ে গেছে সে!” একই রিপোর্টারদের সামনে চিৎকার করে উঠলেন মঁসিয়ে গার্বোই।

“ওনাকে তা প্রমাণ করতে বলুন!” আবারও জবাব দিলো লুপাঁ।

৫১৪ নং টিকেট নিয়ে এভাবেই দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গেল এর দুই দাবিদারের। আর্সেন লুপাঁ তো শান্তভাবে সামলাচ্ছিল সবকিছু, এদিকে মঁসিয়ে গার্বোই বেচারা কোনোভাবেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছিলেন না। পত্রিকা ভরতি হয়ে যাচ্ছিল এই চরম অসুখী লোকটার আক্ষেপ দিয়ে। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা অকপটে সবার কাছে ঝেড়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

“আপনারা একবার ভেবে দেখুন! বদমাশটা সুজানের বিয়ের টাকা চুরি করেছে। এমনিতে ও টাকার প্রতি আমার একবিন্দু লোভ নেই…কিন্তু সুজানের কথা ভাবলে বুকটা ভেঙে যায়। পুরো এক মিলিয়ন! ভাবা যায়! এক লক্ষ ফ্রাঁ- এর দশগুণ। আহহা! আগেই মনে হয়েছিল ঐ ডেস্কে একটা গুপ্তধন আছে!”

কয়েকজন তাকে ধীরে ধীরে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, ডেস্কটা চুরির সময়ে ওতে থাকা লটারির টিকেটের যে পরে এত দাম হবে, চোর সেটা জানত না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! একথা বললেই তিনি জবাব দিতেন:

“কী ভুয়া কথা! অবশ্যই জানতো ও। নইলে একটা সাদাসিধে টেবিলকে চুরি করার জন্য এত ঝুঁকি নিতে যাবে কেন?”

“হয়তো কোনো অজ্ঞাত কারণে ও এটা চুরি করেছিল। কিন্তু মাত্র বিশ ফাঁ দামের এক টুকরো কাগজের জন্য করেনি, এটা নিশ্চিত!”

“এক মিলিয়ন ফ্রাঁ জিতেছে ঐ কাগজের টুকরোটা! অবশ্যই জানতো ও ও সবকিছু জানে! ও হলো বিশ্বের নম্বর ওয়ান ধাপ্পাবাজ! আপনারা আমার কষ্ট বুঝবেন কী করে? ও তো আপনাদের এক মিলিয়ন ফ্রাঁ চুরি করেনি!”

এই বিতর্ক হয়তো আরো অনেকদিন ধরেই চলত। কিন্তু বারোতম দিনে আর্সেন লুপাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি এলো মঁসিয়ে গার্বোইর কাছে। খামের উপর লেখা ‘গোপনীয়’। চিঠিতে লেখা:

মঁসিয়ে,

আমাদের কাজকর্ম দেখে লোকে হাসছে। আপনার কি মনে হয় না যে এবার আমাদের ব্যাপারটা একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত? আমি এমন একটা টিকেট পেয়েছি, যেটা আইনত আমার নয়। এদিকে আপনি আইনত যে টিকেটের মালিক, সেটা আপনার কাছে নেই। আমরা কেউই কোনোদিকে এগুতে পারছি না। আপনিও টিকেটের দাবি ছাড়বেন না, আমিও টিকেটটা আপনার কাছে দেবো না। এখন কী করার আছে? এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা উপায়ই কেবল জানা আছে আমার। চলুন, আমরা পুরস্কারের টাকাটা ভাগাভাগি করে নেই। আধা মিলিয়ন নেবেন আপনি, আধা মিলিয়ন আমি। সেটাই কি ন্যায্য হবে না? আমার মতে, এটাই এই সমস্যার একমাত্র ন্যায়সঙ্গত সমাধান। আর খুব দ্রুতই আমাদের এ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ প্রস্তাব নিয়ে ভেবে দেখার জন্য তিনদিন সময় দিলাম আপনাকে

বৃহস্পতিবার সকালে একো দ্য ফ্রান্স পত্রিকার ব্যক্তিগত কলামে এম.আর্স.প. এর উদ্দেশ্যে একটা গোপন মেসেজ পাওয়ার আশায় থাকব আমি। সেখানে সাংকেতিক ভাষায় জানিয়ে দেবেন যে, আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। এ কাজ করলে খুব দ্রুতই ঐ টিকেটটা হাতে পেয়ে যাবেন আপনি। এক মিলিয়ন ফ্রাঁ সংগ্রহ করে নেবেন। এরপর আমি যে উপায়ে বলব, সে উপায়ে আমাকে তার অর্ধেক পাঠিয়ে দেবেন।

আপনি যদি এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে থাকেন, তাহলে অন্য উপায় অবলম্বন করব আমি। তাতে লাভও হবে আমার। কিন্তু আপনার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। একে তো আপনার একগুঁয়েমির কারণে আমার অপছন্দের মানুষদের একজন হিসেবে বিবেচিত হবেন আপনি, তার ওপর এসব ঝামেলা করার জন্য পঁচিশ হাজার ফ্রাঁ আক্কেল সেলামি দিতে হবে আপনার।

বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে, আমি আজীবন আপনার অনুগত ভৃত্য থাকব।

– আর্সেন লুপাঁ

উত্তেজিত অবস্থায় মঁসিয়ে গার্বোই-র মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। সেকারণেই চিঠিটা প্রকাশ করার মতো বড় একটা ভুল করে বসলেন তিনি। সাংবাদিকেরা এর একটা কপিও নিয়ে গেল। এসব যে গোপন রাখার মতো বিষয়, তীব্র ক্ষোভের কারণে সে বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার।

“কক্ষনো না! ওকে এক পয়সাও দেবো না আমি!” এক ঝাঁক রিপোর্টারের সামনে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। “আমার সম্পত্তির ভাগ দেবো ওকে! জীবনেও না! চাইলে ও টিকেট ছিঁড়ে ফেলুক ও!”

“কিন্তু পাঁচ লাখ ফ্রাঁ তো কিছু না পাওয়ার চেয়ে ভালো।”

“এ কথা তো হচ্ছে না। এটা আমার ন্যায্য অধিকারের প্রশ্ন। আর সেই অধিকার আমি কোর্টে গিয়েই আদায় করে নেবো।”

“কী! আর্সেন লুপাঁর বিরুদ্ধে লড়বেন? দেখার মতো ঘটনা হবে তাহলে।”

“জি না, কিন্তু ক্রেডিট ফঁসিয়েরের বিরুদ্ধে লড়ব। আমাকে এক মিলিয়ন ফ্রাঁ দিতে হবে ওদের।

“টিকেট ছাড়া কিংবা ওটা কেনার প্রমাণ ছাড়া কীভাবে দাবি করবেন?”

“তার প্রমাণ তো আছেই। ঐ ডেস্ক চুরি করার কথা তো স্বীকারই করেছে আর্সেন লুপাঁ। “

“কিন্তু লুপাঁর কথাকে কি কোর্টে প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করা যাবে?”

“তাতে কিছু যায় আসে না। আমি নিজেই লড়ব।”

তার কথা শুনে সমবেত জনতা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। লুপাঁর পক্ষে আর বিপক্ষে বাজি ধরাও শুরু হয়ে গেল। পরের বৃহস্পতিবারের একো দ্য ফ্রান্স-এর ব্যক্তিগত কলামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। কিন্তু সেখানে এম.আর্স.লুপ. কে উদ্দেশ্য করে কোনো কিছু পাওয়া গেল না। আর্সেন লুপাঁর চিঠির জবাব দেননি মঁসিয়ে গার্বোই। যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল এভাবে।

ঐদিন সন্ধ্যায় মাদামোয়াজেল সুজান গার্বোই-র অপহরণের খবর ছাপা হলো পত্রিকায়।

আর্সেন লুপাঁকে ঘিরে হওয়া এসব নাটকের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনোদন পাওয়া যায় প্যরিসের পুলিশদের হাস্যকর আচার-আচরণ দেখলে। আর্সেন লুপাঁ দিব্যি কথা বলে, লেখে, পরিকল্পনা করে, আদেশ দেয়, হুমকি দেয়, সব কাজ সমাধা করে ফেলে এমনভাবে যেন প্যারিসে কোনো পুলিশবাহিনীর অস্তিত্বই নেই। এদেরকে গোনায় না ধরেই সব পরিকল্পনা সফল হয় তার।

অথচ পুলিশেরা কিন্তু জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে তাকে ধরার। কিন্তু যে শত্রু তাদেরকে গোনায়-ই ধরে না, সেই শত্রুকে ধরার সাধ্য কি আছে তাদের?

গৃহকর্মীর মতে, সকাল দশটা বাজার বিশ মিনিট আগে ঘর থেকে বেরিয়েছিল সুজান। তার বাবা কলেজ থেকে বেরিয়েছেন দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে। মেয়ের যেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে এসে তাকে পাননি তিনি। তারমানে, বাড়ি থেকে কলেজে আসার পথেই কিছু হয়েছে সুজানের সাথে। বাড়ি থেকে তিনশো ইয়ার্ড দূরে দুই প্রতিবেশির সাথে দেখা হয়েছিল তার। আরেক ভদ্রমহিলা তার মতো এক তরুণীকে দেখেছেন অ্যাভিনিউ ধরে যেতে। আর কেউ দেখেনি তাকে।

চারপাশে খোঁজ পড়ে গেল, সবাইকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করা শুরু হলো। রেলওয়ে আর গাড়ির লাইনের কর্মচারীরাও বাদ গেল না। কিন্তু কেউই নিখোঁজ মেয়েটার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। তবে ভিলে ডি’অ্যাভ্রেতে এক দোকানদারকে খুঁজে পেল পুলিশ। অপহরণের দিন প্যারিস থেকে আসা এক গাড়িতে গ্যাসোলিন ভরেছিল সে। সেই গাড়ির মালকিন ছিলেন এক স্বর্ণকেশী মহিলা। লোকটা বলল, স্বর্ণের মতো চকচকে সোনালি চুল ছিল তার। ঘন্টাখানেক পরে ঐ গাড়িটা আবার ভিলে ডি’অ্যাভ্রে পেরিয়ে যায়। ভার্সেই থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল তখন সেটা। দোকানদারের দাবি, ঐ গাড়িতে তখন আরো একজন নারী ছিল। তার মুখ ঢাকা ছিল নেকাব দিয়ে। তারমানে ওটা সুজান গার্বোই ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।

অপহরণের ঘটনাটা নিশ্চয়ই শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্য দিবালোকেই ঘটেছে। কিন্তু কীভাবে? আর কোথা থেকে? কোনো চেঁচামেচি শোনেনি কেউ, কোনো সন্দেহজনক কাজ করতে দেখেনি। দোকানদারের মতে গাড়িটা ছিল টুয়েন্টি ফোর হর্সপাওয়ারের একটা রয়্যাল ব্লু রঙের লিমোজিন। পিউজিওন অ্যান্ড কো. ফার্মের গাড়ি। মাদাম বব ওয়ালথারের বড় গ্যারেজের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। গাড়ি দিয়ে অপহরণের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ তিনি। জানা গেল, ঐদিন এক স্বর্ণকেশী মহিলাকে একটা পিউজিওনের লিমোজিন ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। মহিলাকে আগে কখনো দেখেননি তিনি।

“গাড়ির শোফার কে ছিল?’

“আর্নেস্ট নামের এক তরুণ। একদিন আগেই তাকে কাজ দিয়েছিলাম আমি। ভালো রিকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছিল সে।”

“সে কি এখানে আছে এখন?”

“না। ও গাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তারপর আর ওকে দেখিনি।” মাদাম বব ওয়ালথার বললেন।

“ওকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?”

“যারা ওকে রিকমেন্ডেশন দিয়েছে, তাদের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। এইযে তাদের নাম।”

জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তাদের কেউই আর্নেস্ট নামে কাউকে চেনে না। ঐ রিকমেন্ডেশনগুলো সবই বানোয়াট।

পুলিশের বের করা বাকি কুগুলোও তাদেরকে কানাগলিতেই নিয়ে গেল। তাই রহস্যটা অমীমাংসিতই রয়ে গেল।

এরকম অসম লড়াইয়ে লড়ার শক্তি কিংবা সাহস কোনোটাই ছিল না মঁসিয়ে গার্বোই-র। নিজের মেয়ের অন্তর্ধানের ব্যাপারটা তাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিল। প্রতিপক্ষের কাছে অচিরেই হার মেনে নিলেন তিনি। কিছুদিন পরেই একো দ্য ফ্রান্সে তার নিঃশর্তে হার মেনে নেবার খবর বেরোলো।

দু’দিন পরে ক্রেডিট ফঁসিয়েরের অফিসে গেলেন মঁসিয়ে গার্বোই। এরপর ২৩ নং সিরিজের ৫১৪ নং লটারিটা গভর্নরের হাতে তুলে দিলেন তিনি। তিনি চমকে উঠে বললেন:

“আরে! ও আপনার কাছে ওটা ফিরিয়ে দিয়েছে দেখছি!”

“ওটা ভুল জায়গায় রাখা ছিল আসলে,” জবাব দিয়ে বললেন মঁসিয়ে গাৰ্বোই।

“কিন্তু আপনি তো ওটা হারিয়ে গেছে বলেছিলেন।“

“প্রথমে তাই ভেবেছিলাম… পরে খুঁজে পেয়েছি।“

“টিকেটটা যে আপনারই, সেটার কিছু প্রমাণ লাগবে আমাদের।”

“প্রমাণ হিসেবে মঁসিয়ে বেসির চিঠিটা দেখালে চলবে?”

“জি, তাতেই চলবে।“

“এইযে নিন,” চিঠিটা দিয়ে বললেন মঁসিয়ে গার্বো ই।

“খুব ভালো। এই কাগজগুলো আমাদের কাছে রেখে যান। লটারি কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী আপনার দাবির ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য পনেরো দিন সময় পাবো আমরা। টাকা পাওয়ার জন্য কবে ফোন করতে হবে, সেটা জানিয়ে দেবো আপনাকে। আশা করছি আমার মতো আপনিও আর কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই ব্যাপারটা সেরে ফেলতে চাচ্ছেন।”

“একদম ঠিক ধরেছেন।”

যেই কথা সেই কাজ। মঁসিয়ে গার্বোই এবং গভর্নর হেন্সফোর্থ— দুজনেই এ ব্যাপারে মুখে কুলুপাঁ এঁটে থাকলেন এরপর থেকে। কিন্তু লুপাঁ যে মঁসিয়ে গার্বোইকে টিকেটটা ফিরিয়ে দিয়েছে, এই কথাটা কীভাবে যেন ফাঁস হয়ে গেল। খবরটা পেয়ে সবাই যেমন অবাক হলো, তেমনি লুপাঁর প্রশংসাও করতে লাগল। লোকটার বুকের পাটা আছে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা টিকেট নইলে সে হাতছাড়া করে কী করে? এমন তো না যে তার হাতে আর ট্রাম্পকার্ড ছিল না। কিন্তু ঐ মেয়েটা যদি তার কাছ থেকে পালিয়ে যায়? যদি জিম্মি মেয়েটাকে কোনোভাবে উদ্ধার করে ফেলে পুলিশ?

পুলিশ ভেবেছিল, তারা শত্রুপক্ষের দুর্বল দিকটা খুঁজে পেয়েছে। সেজন্য নিজেদের চেষ্টা জোরদার করল তারা। নিজের চালে নিজেই ফেঁসেছে আর্সেন লুপাঁ, নিজের গাড়ির চাকায় নিজেই পিষ্ট হয়েছে। কথা রাখতে গিয়ে এক মিলিয়ন ফ্রাঁ মূল্যের টিকেটখানি হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়েছে। অতঃপর সবার নজর ঘুরে গেল তার প্রতিপক্ষের দিকে।

কিন্তু সুজানকে খুঁজে বের করা তো খুবই জরুরি। আর তারা তাকে খুঁজে পায়নি, সে-ও পালাতে পারেনি। সুতরাং বলতেই হচ্ছে, প্রথম দফায় জয় হয়েছে আর্সেন লুপাঁরই। তবে খেলার ফলাফল এখনো নির্ধারিত হয়নি। সবচেয়ে জটিল অংশই এখনো বাকি। পঞ্চাশ লাখ ফ্রাঁ হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তো সে মাদামোয়াজেল গার্বোইকে ছাড়বে না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিনিময়টি কোথায় ঘটানো সম্ভব? তাদের দেখা করার সময়ে যে প্রফেসর কোনো পুলিশকে নিয়ে আসবেন না, তা কী করে নিশ্চিত করবে লুপাঁ? প্রফেসরই বা নিজের টাকা বাঁচিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করবেন কীভাবে?

প্রফেসরের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য তড়িঘড়ি করে ছুটল রিপোর্টারেরা। কিন্তু তিনি এতোই সাবধানী হয়ে গেছেন যে, তেমন কিছুই জানা গেল না।

“আমার কিছুই বলার নেই।”

“আর মাদামোয়াজেল গার্বোই?”

“এখনো খোঁজাখুঁজি চলছে।”

“কিন্তু আর্সেন লুপাঁ কি চিঠি লিখেছে আপনাকে?”

“না।”

“বুকে হাত দিয়ে বলছেন একথা?”

“না।”

“তাহলে চিঠি ঠিকই লিখেছে সে। কী করতে বলেছে?”

“আমার কিছুই বলার নেই। “

রিপোর্টারেরা এরপর গেল মঁসিয়ে দেতিনাঁর কাছে। তার কাছ থেকেও কোনো তথ্য উদ্ধার গেল না।

“মঁসিয়ে লুপাঁ আমার মক্কেল। তার কোনো বিষয়ে আলোচনা করার এখতিয়ার নেই আমার।” গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন তিনি।

এই রহস্যগুলো জনসাধারণকে ভারি বিরক্ত করে তুলল। দু’পক্ষের মধ্যে ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলছে নিশ্চয়ই। আর্সেন লুপাঁ নিশ্চয়ই ঘন নিরাপত্তার জালে বেষ্টিত করে রেখেছে নিজেকে। এদিকে পুলিশও নিশ্চয়ই দিন-রাত কড়া নজর রাখছে প্রফেসরের ওপরে। নাটকের তৃতীয় অঙ্কে ঘটার মতো ঘটনা আছে দুটোই— লুপাঁর গ্রেপ্তার ও পুলিশবাহিনীর বিজয় কিংবা আরেকদফা লুপাঁর কাছে পুলিশের ঘোল খেয়ে যাওয়া। এ নিয়ে জোর আলোচনা চললেও জনগণের তৃপ্তি পুরোপুরি মিটল না। আসলে কী ঘটল, তা জানানোর জন্য সামনের পৃষ্ঠাগুলো বরাদ্দ আছে।

১২ই মার্চ, সোমবারে, মঁসিয়ে গার্বোই ক্রেডিট ফঁসিয়েরের কাছ থেকে একটা নোটিশ পেলেন। বুধবার দুপুর একটার ট্রেন ধরে প্যারিসে গেলেন তিনি। দুটোর সময়ে এক হাজার ফ্রাঁ-র এক হাজারটা নোট দেয়া হলো তাকে। কিছুটা শঙ্কিত প্রফেসর কাঁপা হাতে এক এক করে গুনতে লাগলেন সেগুলো। সুজানের মুক্তিপণের টাকা বলে কথা। সেসময়ে দুজন লোক একটা গাড়ি নিয়ে ব্যাংক থেকে একটু দূরে এসে থামল। তাদের একজনের চুল ধূসর হয়ে এসেছে। বুদ্ধিদীপ্ত হাবভাবের সাথে তার বিধ্বস্ত চেহারা একেবারেই খাপ খাচ্ছে না। দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবে যে এটা মেক-আপ। ভদ্রলোক হলেন ডিটেকটিভ গাঁইমার্দ, আর্সেন লুপাঁর চির-প্রতিদ্বন্ধী। নিজের সঙ্গী ফলেনফাঁতের দিকে তাকাল গাঁইমার্দ:

“পাঁচ মিনিটের মাঝে আমাদের ধুরন্ধর বন্ধু লুপাঁর দেখা পাবো আমরা। সব ঠিকঠাক আছে তো?”

“জি।”

“আমরা কতজন আছি সব মিলিয়ে?”

“আটজন— তাদের মধ্যে দুজন বাইসাইকেলে।”

“যথেষ্ট, তবে খুব বেশি নয়। কোনোভাবেই গার্বোই আমাদের কাছ থেকে পালাতে পারবে না। পালালেই সব শেষ। নির্ধারিত জায়গায় লুপাঁকে গিয়ে অর্ধেক টাকা দিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনবে সে তখন, আমরা কোনো সুযোগই পাবো না লুপাঁকে ধরার

“কিন্তু গার্বোই আমাদের সাথে কাজ করছেন না কেন? তাহলেই কি সুবিধা হতো না ওনার? আর সব টাকাও বেচে যেত ওনার।”

“হ্যাঁ, কিন্তু ওনার ভয় যে, ওকে বোকা বানালে উনি আর ওনার মেয়েকে ফিরে পাবেন না।”

“কাকে?”

“লুপাকে।’

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে নিচু হয়ে এলো গাঁইমার্দের কণ্ঠ। মনে হচ্ছে যেন কোনো অতিপ্রাকৃত জন্তুর নাম নিচ্ছে, যার থাবার স্বাদ আগেই পেয়েছে সে।

“ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত,” বিজ্ঞের মতো বলে উঠল ফলেনফাঁত। “এই লোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপকার করার চেষ্টা করছি আমরা।”

“হ্যাঁ, কিন্তু লুপাঁ তো সবসময়ই দাবার বোর্ড উল্টিয়ে দেয়,” আক্ষেপের সুরে বলল গাঁইমার্দ

মুহূর্তপরেই আবির্ভূত হলেন মঁসিয়ে গার্বোই। রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। ক্যু দ্য ক্যাপুসিনা পেরিয়ে গিয়ে উঠলেন বুলেভার্দে। ধীরে ধীরে হাঁটছেন এখন, প্রায়ই থেমে দোকানের জানালাগুলো দেখছেন।

“উনি অস্বাভাবিক রকম শান্ত,” বলে উঠল গাঁইমার্দ। “পকেটে এক মিলিয়ন ফ্রাঁ নিয়ে ঘোরা লোকের পক্ষে এরকম মাথা ঠাণ্ডা রাখা সম্ভব না।”

“কী করছেন উনি?”

“তেমন কিছু করছেন বলে তো মনে হচ্ছে না…তবে আমার ধারণা যে লুপাঁ ইতিমধ্যেই এসে গেছে- হ্যাঁ এসে গেছে!”

একটা পত্রিকার দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে পত্রিকা কিনলেন মঁসিয়ে গার্বোই। তারপর সেটা পড়ার ভান করতে করতে হাঁটতে লাগলেন। মুহূর্তপরেই ব্যারিকেডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে গেলেন তিনি। গাড়িটা নিশ্চয়ই তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দ্রুতগতিতে টান দিয়ে ম্যাডেলিনের মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা।

“হায় খোদা!” চেঁচিয়ে উঠল গাঁইমার্দ। “এ তো ওর অতি পরিচিত ধোঁকাবাজিগুলোর একটা!”

তড়িঘড়ি নিজের গাড়িটাকে টান দিয়ে ম্যাডেলিনের ওপাশে গেল গাঁইমার্দ। গিয়েই হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল সে। বুলেভার্দ ম্যালশার্বসের দরজায় ঐ গাড়িটা থেমে নামিয়ে দিচ্ছে মসিয়ে গার্বোইকে।

“ফনেলফাঁত, জলদি যাও, ঐ শোফারকে ধরো! এ-ই হয়তো সেই আর্নেস্ট ছোকরাটা!”

শোফারকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল ফলেনফাঁত। তার নাম গ্যাস্টন। অটোমোবাইল ক্যাব কোম্পানির একজন কর্মচারী সে। মিনিট দশেক আগে এক ভদ্রলোক তাকে ভাড়া করে বলেছে, পেপার স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে তুলে নিতে।

“আর ঐ ভদ্রলোক কোন ঠিকানায় যেতে বলেছিল?” জিজ্ঞেস করল ফলেনফাঁত।

“কোনো ঠিকানা দেয়নি। বুলেভার্দ ম্যালশার্বস…অ্যাভিনিউ দ্য মেসাইন। এটুকুই। দ্বিগুণ টাকা দিয়েছে আমাকে।”

ইতোমধ্যে ওখান দিয়ে যাওয়া একটা গাড়িতে চড়ে বসেছেন মঁসিয়ে গাৰ্বোই।

“মেট্রোপলিটনের কনকর্ড স্টেশনে যাবেন,” ড্রাইভারকে বললেন উনি।

প্লেস দ্যু প্যালা-রয়্যালে গিয়ে নেমে পড়লেন তিনি। উঠে আসলেন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে। এরপর আরেকটা গাড়িতে উঠে বললেন, প্লেস দ্য লা বুর্সে যেতে। আরেকদফা আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে অ্যাভিনিউ দ্য ভিলিয়ার্সে গেলেন তিনি। এরপর আরেকটা গাড়ি ধরে গেলেন ২৫ নম্বর ক্যু ক্ল্যাপেরনে।

বুলেভার্দ দ্য বাতিগনোল থেকে একটা বাড়ি দ্বারা আলাদা হয়ে আছে ২৫ নম্বর ক্যু ক্ল্যাপেরনে। ঐ বাড়ির দোতলায় উঠে বেল বাজালেন তিনি। এক ভদ্রলোক খুলে দিলেন দরজাটা।

“মঁসিয়ে দেতিনাঁ কি এখানে থাকেন?”

“জি, আমিই দেতিনাঁ। আপনি কি মঁসিয়ে গার্বোই?”

“জি।”

“আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আসুন।”

গার্বোই উকিলের অফিসে ঢুকতে ঢুকতে তিনটা বাজল ঘড়িতে। উনি বললেন:

“আমি তো একদম সময়মতো এসে গেছি। উনি কি এসেছেন?”

“এখনো না।”

একটা সিটে বসে কপালের ঘাম মুছলেন মঁসিয়ে গার্বোই। আরেকবার নিজের ঘড়ির দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন সময়টা জানা নেই তার। এরপর উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন:

“উনি কি আসবেন? “

“দেখুন মঁসিয়ে, সেটা তো আমি ঠিক জানি না,” যথাসম্ভব ভদ্র কণ্ঠে জবাব দিলেন উকিল। “আপনার মতোই উদ্বিগ্ন আর অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছি আমি। উনি আসলে ভীষণ বিপদে পড়বেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখা হচ্ছে এ বাড়ির ওপরে। পুলিশ আমাকে একবিন্দু বিশ্বাস করে না। “

“ওরা আমাকেও সন্দেহ করছে। তবে গোয়েন্দাদেরকে খসাতে পেরেছি কি না জানি না।

“কিন্তু আপনি তো- “

“এতে আমার কিছু করার ছিল না,” সাথে সাথেই কঁকিয়ে উঠলেন প্রফেসর। “আপনারা আমাকে কোনো দোষ দিতে পারবেন না। আমি ওনার কথামতো চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আর চিঠিটার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। ঠিক যে সময়ে টাকা তোলার কথা, সেসময়ে ওটা তুলেছি। যেভাবে এখানে আসতে বলেছে, ঠিক সেভাবে এসেছি। আমার দিক থেকে তো সৎ আছি আমি, এখন ওনাকে ওনার কাজটুকু করতে বলুন!”

একটু থেমে শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি:

“উনি তো আমার মেয়েকে নিয়ে আসবেন, তাই না?”

“আশা করছি।”

“কিন্তু…আপনি কি ওনাকে দেখেছেন?”

“আমি? জি না, ওনাকে দেখার ভাগ্য এখনো হয়নি আমার। উনি চিঠি লিখে অ্যাপয়েনমেন্ট করেছেন। বলেছেন, আপনি আর উনি দুজনেই এখানে থাকবেন। আমাকে বলেছেন, তিনটার আগে সব চাকর-বাকর বিদেয় করে দিতে আর ঘরে কাউকে ঢুকতে না দিতে। আর, তার কথায় রাজি না হলে একো দ্য ফ্রান্সে চিঠি লিখে জানাতে। কিন্তু মঁসিয়ে লুপাঁর কাজ করে দেয়াই তো আমার দায়িত্ব, তাই রাজি হয়ে গেছি আমি।”

“উফ! এসবের শেষ কোথায়?” গুঙিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে গার্বোই।

টাকার নোটগুলো নিজের পকেট থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি। দুটো সমান ভাগে ভাগ করলেন। এরপর দুজনে বসে রইলেন চুপ করে। মাঝে মাঝে কান পেতে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলেন মঁসিয়ে গার্বোই। “কেউ কি বেল বাজালো?…সময় যাবার সাথে সাথে তার উদ্বিগ্নতাও বাড়তে লাগল। মঁসিয়ে দেতিনাঁও বেশ চিন্তিত মুখে বসে রইলেন। অবশেষে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল তার। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন:

“উনি আসবেন না… এটা আসলে আশা করা উচিত হয়নি আমাদের। এখানে আসাটা খুবই বোকামি হয়ে যায়। আসলে ভীষণ ঝুঁকিতে পড়বেন উনি।”

টাকার ওপর হাত দিয়ে বসে থাকা মঁসিয়ে গার্বোই হতাশায় তোতলাতে লাগলেন:

“হে ঈশ্বর! উনি না আসলে কী হবে! নিজের মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য চাইলে পুরো টাকা দিয়ে দিতে রাজি আছি।”

ঠিক সেসময় খুলে গেল দরজাটা।

“অর্ধেক দিলেই চলবে, মঁসিয়ে গার্বোই।”

কথাগুলো বেরিয়েছে এক সুবেশী তরুণের মুখ থেকে। তাকে দেখামাত্র চিনে ফেললেন মঁসিয়ে গার্বোই। এই লোকই তার কাছ থেকে ডেস্কটা কিনতে চেয়েছিল ভার্সেইতে। দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

“আমার মেয়ে কোথায়? আমার সুজান কোথায়?”

দরজাটা সাবধানে লাগিয়ে দিলো আর্সেন লুপাঁ। ধীরে ধীরে নিজের গ্লাভস খুলে উকিলকে বলল:

“আমার অতি প্রিয় সহকর্মী, আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন আপনি। আপনার এ উপকার কোনোদিন ভুলব না।”

“কিন্তু আপনি তো বেল বাজাননি, আমি তো দরজাটা খোলার-” বিড়বিড় করে বলতে গেলেন মঁসিয়ে দেতিনাঁ

“দরজা আর কলিং বেল এমন জিনিস যেগুলোর শব্দ ছাড়াই কাজ করা উচিত। আমি এসে গেছি এটাই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না?”

“আমার মেয়ে! সুজান! কোথায় ও?” আবার বললেন প্রফেসর।

“আহা, মঁসিয়ে, এত তাড়া কীসের?” শান্ত স্বরে বলল লুপাঁ। “আপনার মেয়ে একটু পরেই চলে আসবে এখানে।”

কিছুক্ষণ ইতস্তত পায়চারি করে ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গিতে লুপাঁ বলল:

“মঁসিয়ে গার্বোই, খুবই বুদ্ধিমানের মতো এখানে এসেছেন আপনি। একটা অভিনন্দন আপনার প্রাপ্য। “

এরপর নোটের তাড়ার দিকে নজর গেল তার

“আরে! মিলিয়ন ফ্রাঁ চলে এসেছে দেখছি! একটুও সময় নষ্ট হবে না আমাদের। দেখি একটু।”

“এক সেকেন্ড,” টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন উকিল, “মাদামোয়াজেল গার্বোই তো এখনো এসে পৌঁছাননি।”

“তো?”

“ওনার উপস্থিত থাকার কথা ছিল না?”

“বুঝেছি! বুঝেছি! আর্সেন লুপাঁর ওপর ভরসা করতে পারে না মানুষেরা। যদি সে অর্ধেক টাকা পকেটে পুরে জিম্মিকে ফেরত না দেয়? আহা! মঁসিয়ে, মানুষ কখনোই আমাকে পুরোপুরি বুঝতে পারল না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে, পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিছু কাজ একটু অন্যভাবে সমাধা করেছি বলে নিজের নামটাই খারাপ হয়ে গেছে। অথচ আমি সবসময়ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করি চুক্তিভঙ্গ না করার জন্য। তাছাড়া, প্রিয় মঁসিয়ে, আপনার বেশি ভয় লাগলে জানালা খুলে ডাক দিন না। রাস্তায় অন্তত ডজনখানেক গোয়েন্দা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।”

“আপনার কি তাই মনে হয়?”

পর্দাটা তুলে ধরল লুপাঁ।

“আমার মনে হয় মঁসিয়ে গার্বোই আসলে গাঁইমার্দকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। দেখুন, আমার কথাই ঠিক। ঐ যে উনি।”

“এটা কীভাবে সম্ভব!” চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। “কিন্তু আমি শপথ করে বলছি-”

“যে আপনি আমার সাথে বেইমানি করেননি?…আপনার কথা বিশ্বাস করছি আমি। কিন্তু এই লোকগুলো মাঝে মাঝে ভালো রকম চালাকি করে বসে। আরে! ফলেনফাঁত, গ্রিউম আর ডিউজিকে দেখা যাচ্ছে— এরা সবাই আমার অতি প্রিয় বন্ধু!”

মঁসিয়ে দেতিনাঁ অবাক হয়ে লুপাঁর দিকে তাকালেন। কী নির্ভার লোকটা! খুশিতে এমনভাবে লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে মজার কোনো খেলায় নেমেছে সে। তার সামনে যে ঘোর বিপদ, কে বলবে তাকে দেখে! গোয়েন্দাদের উপস্থিতির চেয়ে লুপাঁর নিরুদ্বিগ্ন হাব-ভাবই যেন বেশি আশ্বস্ত করল উকিলকে। টাকা সাজিয়ে রাখা টেবিলটা থেকে দূরে সরিয়ে এলেন তিনি। দুটো স্তূপ থেকে একটা করে বান্ডিল তুলে নিলো লুপাঁ। একেকটা বান্ডিলে পঁচিশটা করে নোট আছে। সেটা মঁসিয়ে দেতিনাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।

“মঁসিয়ে গার্বোই এবং আর্সেন লুপাঁর হয়ে কাজ করার জন্য এই পুরস্কার আপনার প্রাপ্য।”

“আমাকে কিছু দিতে হবে না,” বললেন উকিল।

“কী? আপনার এত ঝামেলা করলাম যে আমরা?”

“আরে, যে মজা দেখিয়েছেন, তাতে আমারই উল্টো টাকা দেয়া উচিত আপনাকে।”

“তার মানে, আপনি আর্সেন লুপাঁর কাছ থেকে কিছু নিতে চাচ্ছেন না। প্রিয় মঁসিয়ে, দেখেছেন, নামের সাথে কাদা লেপ্টে গেলে কী হয়?”

এরপর মঁসিয়ে গার্বোইর দিকে ৫০ হাজার ফ্রাঁ বাড়িয়ে দিলো সে। বলল: “মঁসিয়ে, আমাদের এই মধুর সাক্ষাতের স্মৃতিস্বরূপ মাদামোয়াজেল গার্বোইর বিয়ের উপহার হিসেবে এটা গ্রহণ করুন।”

মঁসিয়ে গার্বোই টাকাটা নিলেন ঠিকই, এরপর বললেন :

“আমার মেয়ে বিয়ে করবে না।”

“আপনি মত না দিলে বিয়ে করবে না। কিন্তু ও বিয়ে করতে চায় ঠিকই।”

“আপনি এ ব্যাপারে কী জানেন?”

“আমি জানি যে, তরুণীরা অনেক সময়ই এমন কিছু স্বপ্ন দেখে, যেটা তাদের বাবা-মায়ের অজানা। ভাগ্য ভালো যে, তাদের সাহায্য করতে মাঝে মাঝে উদিত হয় আর্সেন লুপাঁ নামের ইচ্ছাপূরণ জিনেরা, যারা তাদের রাইটিং ডেস্কের ড্রয়ারে থাকা গোপন লেখাগুলো পড়ে ফেলতে পারে।“

“আর কিছু খুঁজে পেয়েছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলেন উকিল। “ঐ ডেস্কটা নেবার জন্য কেন এত ঝামেলা করলেন, সেটা জানার লোভ সামলাতে পারছি না।”

“এটার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে। তবে মঁসিয়ে গার্বোই অবশ্য ভুল ভেবেছিলেন। ডেস্কটাতে লটারির টিকেট বাদে মূল্যবান আর কিছু ছিল না। আর টিকেটটার কথা তো আমি জানতামই না। আসলে এই ডেস্কটা বহুদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমি। ইউ আর মেহগনি কাঠ দিয়ে বানানো এই রাইটিং ডেস্কটা একটা ছোটো বাড়িতে আবিষ্কৃত হয়। বোলোনের সেই বাড়িতে ম্যারি ওয়ালেউস্কা থাকতেন একসময়। একটা ড্রয়ারে খোদাই করে লেখা আছে: ‘ফরাসি সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তার বাধ্যগত গৃহকর্মী ম্যানসনের পক্ষ থেকে।’ তার ওপরে ছুরির মাথা দিয়ে কেটে লেখা হয়েছে ‘তোমার জন্য, ম্যারি।’ পরে সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের জন্য এরকম একটা ডেস্ক বানিয়ে নিয়েছিলেন নেপোলিয়ন। তবে ওটা কিন্তু গুপ্তস্থানে থাকা বহুল প্রশংসিত ডেস্কটার একটা ত্রুটিপূর্ণ কপি বাদে আর কিছু না। আর এজন্যই এটাকে সংগ্রহে রাখতে চাই আমি।”

“আহহা! দোকানে থাকতে এই কথা জানলে আপনাকে খুশিমনেই দিয়ে দিতাম এইটা,” বললেন প্রফেসর।

“তাহলে আপনার লটারি টিকেটটাও আপনার কাছেই থাকত,” মুচকি হেসে বলল লুপাঁ।

“আর আমার মেয়েকে অপহরণ করার দরকার হতো না আপনার।“

“আপনার মেয়েকে অপহরণ?”

“জি।”

“প্রিয় মঁসিয়ে, আপনার ভুল হচ্ছে। মাদামোয়াজেল গার্বোইকে অপহরণ করা হয়নি।”

“করা হয়নি?”

“অবশ্যই না। অপহরণ মানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি যে, ও নিজের ইচ্ছাতেই জিম্মি হতে রাজি হয়েছে।”

“নিজের ইচ্ছায়!” আকাশ থেকে পড়লেন মঁসিয়ে গাৰ্বোই।

“সত্যি বলতে, ও নিজেই বলেছে ওকে তুলে নিয়ে যেতে। মাদামোয়াজেল গার্বোইর মতো একজন বুদ্ধিমতী তরুণী, যে কি না ইতিমধ্যে একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে, সে কেন নিজের বিয়ের খরচের টাকা উদ্ধার করতে এটুকু কাজ করবে না? আপনার জেদ ভাঙার জন্য আর কোনো উপায় ছিল না। আর একথা ওকে বোঝাতে একটুও কষ্ট হয়নি আমার।”

খুবই মজা পেলেন মঁসিয়ে দেতিনাঁ। লুপাঁকে বললেন:

“কিন্তু ওর সাথে কথা বলার সুযোগ পেতে ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়ই? ওর কাছে গেলেন কী করে?”

“ওহ! আমি নিজে যাইনি ওর কাছে। তার সাথে পরিচিতি থাকার সৌভাগ্য নেই আমার। আমার এক নারী বন্ধু আমার হয়ে কাজটা করে দিয়েছেন।”

“নিঃসন্দেহে গাড়ির সেই স্বর্ণকেশী মহিলা।”

“ঠিক ধরেছেন। কলেজের কাছে প্রথমবার দেখা হবার সময়ই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপর থেকে মাদামোয়াজেল গার্বোই আর তার নতুন বান্ধবী মিলে বেলজিয়াম আর হল্যান্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তরুণ বয়সে এমন মজাদার আর শিক্ষামূলক ভ্রমণের সুযোগ সহজে জোটে না। ও নিজেই সব খুলে বলবে আপনাকে—”

সদর দরজার কলিংবেল বেজে উঠল। পরপর তিনবার। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বাজলো আরো দু’বার।

“ও এসে গেছে,” বলল লুপাঁ। “মঁসিয়ে দেতিনাঁ, কষ্ট করে যদি—”

দরজার দিকে দ্রুতবেগে গেলেন উকিল।

দুই তরুণী এসে প্রবেশ করল। তাদের একজন এসে জড়িয়ে ধরল মঁসিয়ে গার্বোইকে। অন্যজন এগোলো লুপাঁর দিকে। বেশ দীর্ঘাঙ্গী সে, সুগঠিত দেহ। সাথে ফ্যাকাশে চামড়া আর সোনালি চুল। সেগুলো কপালের কাছে সিঁথি কেটে ঢেউ খেলানো রয়েছে। অস্তমিত সূর্যের ন্যায় চকচক করছে চুলগুলো। গায়ে কোনো অলংকার নেই তার। কিন্তু হাবেভাবেই বোঝা যাচ্ছে বেশ সম্ভ্রান্ত বংশের রুচিশীল নারী সে। তার সাথে কিছু কথা বলল আর্সেন লুপাঁ। এরপর মাদামোয়াজেল গার্বোইর উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে বলল:

“এত কষ্ট দেয়ার জন্য মাফ চাইছি, মাদামোয়াজেল। আশা করি, বেশি রাগ করেননি-

“রাগ! আরে না! খুবই খুশি হবার কথা আমার। শুধু আমার বেচারা বাবাকে ছেড়ে যেতে হলো বলে হতে পারছি না।”

“তাহলে যা হবার ভালোর জন্যই হয়েছে। ওনাকে চুমু খেয়ে নিন আবার। আর এখনই সুবর্ণ সুযোগ-আপনার কাজিনের ব্যাপারে প্রস্তাবটা দিয়ে ফেলার।’

“আমার কাজিন? কী বলতে চাইছেন? কিছুই বুঝলাম না।”

“বেশ বুঝতে পারছেন। আপনার কাজিন ফিলিপ। যার লেখা চিঠি সযত্নে রেখে দিয়েছেন আপনি।”

লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে। তবে লুপাঁর উপদেশ মানল ঠিকই। আবারো বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তাদের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে রইল লুপাঁ।

“আহা! পুণ্যকাজের কী দারুণ উপহার! কী সুন্দর দৃশ্য! একজন সুখী বাবা আর তার সুখী মেয়ে! আর তাদের জীবনে এই সুখটুকু এনে দিয়েছি আমি লুপাঁ! এতে করে এই মানুষেরা আমাকে আশীর্বাদ করবে, তাদের বংশধরদের কাছে আমার নাম ছড়িয়ে দেবে। হয়তো চার প্রজন্ম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে আমার নাম। একটা ভালো কাজের জন্য কী দারুণ উপহার পেয়ে গেলাম!”

জানালার দিকে হেঁটে গেল সে।

“আমার প্রিয়বন্ধু গাঁইমার্দ কি এখনো অপেক্ষা করছে?…এই মনোমুগ্ধকর পারিবারিক দৃশ্যটা দেখতে পারলে খুশিই হতেন উনি।… আরে! ওনি নেই দেখছি! ওদের কেউই আর নেই এখানে!.. কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। কপালে খারাবি আছে! পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে! আমি নিশ্চিত ওরা বাড়ির সামনে থাকা প্রহরীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিয়েছে। কিংবা, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে!”

চট করে একটা কাজ করলেন মঁসিয়ে গার্বোই। মেয়ে ফিরে আসায় পুরো ঘটনাকে এখন ভিন্ন চোখে দেখছেন তিনি। তার কাছে, তার প্রতিপক্ষের ধরা পড়া মানে অর্ধ মিলিয়ন ফ্রাঁ লাভ করা। কী ভেবে এক পা আগে বাড়লেন তিনি। তার সামনে এসে দাঁড়াল লুপাঁ।

“কোথায় যাচ্ছেন, মঁসিয়ে গার্বোই! ওদের কাছে আমার হয়ে কথা বলতে? আপনার অসীম দয়া, কিন্তু তার দরকার হবে না। ওরা এখন আমার চেয়ে বেশি চিন্তায় আছে।”

কথা শেষ করেনি সে, শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল:

“কিন্তু আসলেই বা কী জানে ওরা? জানে যে, আপনি এখানে আছেন, হয়তো মাদামোয়াজেল গার্বোইও এখানে আছে- তারা হয়তো ওকে এখানে একজন অপরিচিত মহিলার সাথে আসতে দেখেছে। কিন্তু আমি যে এখানে আছি, সেটা তো ওরা জীবনেও ভাববে না। আজ সকালেই যে বাড়ির আগাগোড়া তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তারা, সে বাড়িতে আমার আসাটা তো অসম্ভব! ওরা হয়তো ভাববে, ঐ অপরিচিত নারীকে দিয়ে অদল-বদল করা হচ্ছে। আর প্রস্তুত থাকবে বের হওয়ামাত্র ওকে গ্রেপ্তার করার জন্য- “

ঠিক ওই মুহূর্তে বেল বেজে উঠল। দ্রুতচালে মঁসিয়ে গার্বোইকে আটকালো লুপাঁ। তারপর কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলল:

“একদম নড়বেন না! নিজের মেয়ের কথা ভেবে বুদ্ধি রেখে কাজ করুন! নইলে— আর মঁসিয়ে দেতিনাঁ, আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছেনই।”

জায়গায় জমে গেলেন মঁসিয়ে গার্বোই। নড়লেন না উকিলও। বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো না করে নিজের হ্যাট তুলে নিলো লুপাঁ, হাতা দিয়ে ময়লা মুছে নিলো হালকা করে।

“প্রিয় মঁসিয়ে দেতিনাঁ, কখনো কোনো কাজে আসতে পারলে বলবেন— শুভাশিষ রইল, মাদামোয়াজেল সুজান। মঁসিয়ে ফিলিপের জন্যও শুভকামনা।”

পকেট থেকে একটা ভারি স্বর্ণের ঘড়ি বের করল সে।

“মঁসিয়ে গার্বোই, এখন তিনটা বিয়াল্লিশ বাজে। তিনটা বেজে ছেচল্লিশ মিনিটে এই ঘর থেকে বের হবেন আপনি। তার এক মিনিট আগেও নয়।”

“কিন্তু ওরা তো জোর করে ঢুকে যাবে,” বললেন মঁসিয়ে দেতিনাঁ।

“আপনি আইন ভুলে যাচ্ছেন, প্রিয় মঁসিয়ে! গাঁইমার্দ কখনোই একজন ফরাসি নাগরিকের ব্যক্তি নিরাপত্তা লঙ্ঘন করবে না। মাফ করবেন, সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। আর আপনারা সবাই হালকা ভড়কে গেছেন।“

ঘড়িটা টেবিলে রাখল সে। দরজা খুলে স্বর্ণকেশী মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল:

“প্রস্তুত, প্রিয় বন্ধু?”

পিছিয়ে মহিলাকে যাবার সুযোগ করে দিলো সে। সম্মান জানিয়ে মাথা নোয়ালো সুজানের উদ্দেশ্যে, এরপর বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। এরপর বারান্দায় তার কণ্ঠ শুনতে পেল সবাই। চেঁচিয়ে বলল লুপাঁ: “গাঁইমার্দ, কী অবস্থা? কেমন যাচ্ছে দিনকাল? মাদাম গাঁইমার্দকে বলবেন আমার কথা। একদিন উনাকে নাশতায় দাওয়াত দেবো। বিদায়, গাঁইৰ্মাদ।”

পাগলের মতো বাজতে লাগল কলিংবেলটা। সেইসাথে বাইরে লোকজনের শোরগোলে কান ফেটে যেতে লাগল।

“পঁয়তাল্লিশ মিনিট,” বিড়বিড় করে বললেন মঁসিয়ে গার্বোই।

কয়েক সেকেন্ড বাদে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি

আর্সেন লুপাঁ আর স্বর্ণকেশী মহিলা নেই ওখানে।

“বাবা!… এ কাজ কোরো না! দাঁড়াও!” চেঁচিয়ে উঠল সুজান।

“আরে! বোকা নাকি তুই?…ঐ হতচ্ছাড়াকে আমি আধা মিলিয়ন তো দূরের কথা, একটা পয়সাও দেবো না!”

সদর দরজা খুলে দিলেন তিনি। হুড়মুড় করে এসে ঢুকল গাঁইমার্দ। “ঐ মহিলা কোথায়? আর লুপাঁ?”

“ও তো এখানেই ছিল…এখানেই ছিল।”

গাঁইমার্দের গলা চিড়ে বিজয়োল্লাস বেরিয়ে এলো।

“ওকে তাহলে ধরে ফেলেছি আমরা, পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে।”

“কিন্তু গৃহকর্মীদের চলার জন্য যে সিঁড়িটা?”

“ওটা কোর্টের দিকে গেছে,” বলল গাঁইমার্দ। “ওখান দিয়ে বেরোবার মুখ কেবল একটাই- রাস্তার দিকে। দশজন পাহারা দিচ্ছে সেখানে।”

“কিন্তু উনি তো রাস্তার দরজাটা দিয়ে আর্সেননি। আর ওদিক দিয়ে যাবেনও না।”

“কোথা দিয়ে যাবে তাহলে?” জিজ্ঞেস করল গাঁইমার্দ। “উড়ে যাবে নাকি?”

একটা পর্দা টেনে সরালো সে। লম্বা একটা করিডর চলে গেছে রান্নাঘরের দিকে। ওখান দিয়ে গিয়ে গৃহকর্মীদের সিঁড়িতে যাবার দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সে। জানালা দিয়ে একজন সহকারীকে বলল:

“কাউকে দেখেছ?”

“না।”

“তাহলে ওরা এখনো এই বাড়িতে আছে!” চেঁচিয়ে উঠল সে। “কোনো একটা রুমে লুকিয়ে আছে ওরা! ওরা কোনোমতেই পালাতে পারবে না! আহা! লুপাঁ, বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘুঘু তোমার বধিবো পরাণ!”

সন্ধ্যা সাতটা বাজে। কোনো খবর না পেয়ে নিজেই চলে এসেছেন গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মঁসিয়ে দুদো। বাড়ি ঘিরে রাখা গোয়েন্দাদের নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এরপর মসিয়ে দেতিনাঁর অ্যাপার্টমেন্টে এলেন। উকিল তাকে নিয়ে এলেন নিজের রুমে। সেখানে দুটো পা ঝুলে আছে চিমনির কাছে, বাকি দেহটা চিমনির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

“অ্যাই!…অ্যাই!” চাপাস্বরে বলল একটা কণ্ঠ। উপরে দূরে কোথাও থেকে আরেকটা কণ্ঠ জবাব দিলো: “অ্যাই!…অ্যাই!”

হো হো করে হেসে উঠলেন মঁসিয়ে দুদো। এরপর চিল্লিয়ে বললেন: “হেই, গাঁইমার্দ! চিমনি পরিষ্কারের ঝাড়ু হয়ে গেছ নাকি?”

চিমনির ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো ডিটেকটিভ। কালিঝুলি মাখা মুখ আর জামা-কাপড়, রক্তলাল চোখে তাকে চেনা যাচ্ছে না।

“ওকে খুঁজছি আমি,” গর্জে উঠল সে।

“কাকে?”

“আর্সেন লুপাঁ…আর তার বন্ধুকে।”

“কী ভেবেছ? চিমনির ভেতরে লুকিয়ে আছে ওরা?”

উঠে দাঁড়াল গাঁইমার্দ। এরপর নিজের কালিমাখা হাতটা বসের কোটে রেখে রাগী কণ্ঠে বলল:

“আপনার কী মনে হয়, চীফ? কোথায় আছে ওরা? কোথাও না কোথাও তো থাকতে হবে! ওরা তো আপনার আমার মতো রক্ত-মাংসেরই মানুষ। ধোঁয়ার মতো গায়েব তো আর হয়ে যেতে পারবে না।”

“পারবে না, কিন্তু সেভাবেই গায়েব হয়ে গেছে।”

“কিন্তু কীভাবে? বাড়ি তো আমাদের লোকেরা ঘিরে রেখেছে, ছাদ পর্যন্ত।”

“পাশের বাড়ি দিয়ে গেছে হয়তো?”

“ওটাতে যাবার কোনো উপায় নেই।”

“আর অন্য তলার অ্যাপার্টমেন্টে?”

“সব ভাড়াটিয়াকে চিনি আমি। ওরা দেখেনি কাউকে।”

“তুমি সবাইকে চেনো? নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ, দারোয়ান ওদের সবার পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া, সাবধানতাবশত প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টে একজন করে লোক বসিয়ে রেখেছিলাম আমি। ওরা কোনোভাবেই পালাতে পারবে না। ওদেরকে আজকে রাতে খুঁজে বের করতে না পারলে কালকে বের করব। আজকে আমি এখানেই ঘুমাবো।”

ঐ রাতে ওখানেই ঘুমাল সে। তার পরের দুই রাতেও। তিন-দিন তিন- রাত পেরিয়ে যাবার পরেও অপ্রতিরোধ্য লুপাঁ কিংবা তার নারী সঙ্গীর টিকিটির খোঁজও পাওয়া গেল না। তাদের পালানোর কী ব্যাখ্যা দেবে, তার কিছুই খুঁজে পেল না গাঁইমার্দ। সেজন্য নিজের প্রথম সিদ্ধান্তেই অটল থাকল সে।

“ওদের পালানোর কোনো চিহ্ন নেই; তারমানে ওরা এখানেই আছে।” মুখে একথা বললেও মনের গভীরে কথাটা আর বিশ্বাস করতে পারছে না গাঁইমার্দ। তবে সেটা সে স্বীকার করবে না। হাজার বললেও না! দুজন নারী- পুরুষ এভাবে রূপকথার প্রেতাত্মার মতো গায়েব হয়ে যেতে পারে না। সাহস না হারিয়ে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে গেল সে। আশা করছে, দুই পলাতক আসামিকে কোণঠাসা অবস্থায় আবিষ্কার করবে সে। কিংবা পালাতে না পেরে বাড়ির পাথুরে দেয়ালের পেছনে জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে ওদের।