৪. লাইট ইন দ্য ডার্কনেস

অধ্যায় চার – লাইট ইন দ্য ডার্কনেস

মানুষের মন-মেজাজ যত ভালোই হোক না কেন, হার্লক শোমস এমন একজন মানুষ, যাকে কখনো দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে, যাতে করে খুব সাহসী প্রতিযোগীও লড়াইয়ে নামার আগে নিজের দক্ষতাগুলো খতিয়ে দেখতে বাধ্য হয়।

“আমি আজকে একটু ছুটি নেবো,” বলল শোমস।

“আর আমি কী করব?” জিজ্ঞেস করল উইলসন।

“তুমি— বলছি দাঁড়াও! তুমি চাইলে আন্ডারওয়্যার কিনে আমাদের ওয়ারড্রোবটা ভর্তি করতে পারো। আর আমি এদিকে একটু ঘুমিয়ে নেই।”

“ঠিক আছে, শোমস। তুমি ঘুমাও, আর আমি না হয় তোমাকে পাহারা দেই।”

অটল প্রহরীর মতো গুরুত্ব দিয়ে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করল উইলসন। সব বিপদের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে যেন সে। পেশী টানটান হয়ে গেল তার, চোখ সরু করে নিজেদের বর্তমান আবাসস্থলটা ভালোমতো দেখতে লাগল সে।

“ঠিক আছে, উইলসন, পাহারা দাও তুমি। আমি এদিকে আমাদের শত্রুকে কীভাবে আক্রমণ করব, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করি গিয়ে। লুপাঁর কাছে বোকা বনার কারণ আছে অবশ্য। আমার মনে হচ্ছে, এই ব্যাপারটার একদম শুরু থেকে ঘাঁটতে হবে আমাদের।”

“পারলে তারও আগের ঘটনা জানতে হবে। কিন্তু হাতে কি অত সময় আছে আমাদের?”

“নয় দিন আছে, বৎস। চার দিনের কাজ এটা।”

পুরো বিকেলটা সিগারেট খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটালো শোমস। পরের দিনের আগে নিজের পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামালো না। এরপর বলল:

“উইলসন, আমি প্রস্তুত। শত্রুকে আক্রমণ করি চলো।”

“তো, পথ দেখাও সেনাপতি!” যুদ্ধংদেহী ভঙ্গীতে চেঁচিয়ে উঠল উইলসন। “আমি ফ্রন্ট র‍্যাংকে থেকে লড়তে চাই। আর ভয় কোরো না! নিজের দেশ এবং মহারাজাকে যথাযোগ্য সম্মানই দেবো আমি, একজন সত্যিকারের ইংলিশম্যানের মতো।”

প্রথমে তিনজনের সাথে তিনটা দীর্ঘ মিটিং-এ বসতে হবে শোমসকে। মঁসিয়ে দেতিনাঁর সাথে কথা বলে দেখতে হবে, তার ঘরগুলোর খুঁটিনাটি অবশ্য আগেই দেখা সারা তার। এরপর সে সুজান গার্বোইকে জিজ্ঞেস করবে স্বর্ণকেশী মহিলার ব্যাপারে। এরপর দেখা করবে সিস্টার অগাস্টের সাথে। ব্যারন ডি’হটরেকের মৃত্যুর পর থেকে কনভেন্টের দর্শনার্থী সামলানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।

প্রতিটা মিটিংয়েই একা একা গেল সে। উইলসন দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। বেরিয়ে আসার পর জিজ্ঞেস করল:

“সন্তুষ্ট?”

“মোটামুটি।”

“আমি নিশ্চিত আমরা সঠিক পথেই আছি।”

ব্যারন ডি’হটরেকের বাড়ির পাশের দুই বাড়িতে গেল তারা। এরপর গেল ক্য ক্ল্যাপেরনে। ২৫ নম্বর বাড়ির সামনের অংশ পরীক্ষা করার সময়ে শোমস বলল :

“এই বাড়িগুলোর মাঝে কোনো গোপন সুড়ঙ্গ আছে, কিন্তু আমি সেগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’

জীবনে প্রথমবারের মতো তার বিখ্যাত সহযোগীর অসীম ক্ষমতা নিয়ে একটু সন্দেহ হলো উইলসনের। এত কথা বলেও মাত্র এটুকু কাজ উদ্ধার করতে পারল ও?

“কেন?” উইলসনের মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “এই লোককে ধরতে গেলে ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। আর চিরাচরিত যে নিয়ম চলে এসেছে, তা না মেনে মাথাটা খাটিয়ে চলতে হবে। এরপর দেখতে হবে সেটা কেসের সাথে খাপ খায় কি না।”

“কিন্তু তাতে গোপন সুড়ঙ্গপথগুলো বেরোবে কীভাবে?”

“ওগুলো আছে তো অবশ্যই। কিন্তু ওগুলো বের করে খুব লাভ হবে কী? লুপাঁ কীভাবে উকিলের বাড়ি থেকে পালিয়েছে আর স্বর্ণকেশী মহিলা কীভাবে ব্যারনের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, সেটা জানতে পারব শুধু। কিন্তু তাতে আমার লাভ কী? এ জেনে ওকে আক্রমণ করা যাবে?”

“তাহলে চলো ওকে কীভাবে আক্রমণ করব, সেটা ভাবি আগে,” কথাগুলো বলে শেষ করার আগেই চেঁচিয়ে পিছে সরে যেতে বাধ্য হলো উইলসন। ওদের পায়ের কাছে কী যেন পড়েছে। একটা বালিভর্তি ব্যাগ। ওদের উপরে পড়লে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারত।

উপরে তাকালো শোমস। ছয়তলার ব্যালকনিতে লাগানো একটা বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে কাজ করছে কয়েকজন। সে বলল:

“আমাদের কপাল ভালো। আর কয়েক পা এদিক-সেদিক হলেই ভারি ব্যাগগুলো পড়ত আমাদের মাথায়। কে জানে—”

হঠাৎ কী মনে হওয়ায় দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকল সে। সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠে কলিং বেল চেপে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। তার তাড়াহুড়া দেখে অবাক হয়ে গেল গৃহকর্মী। জলদি ব্যালকনিতে গিয়ে শোমস দেখে, কেউ নেই সেখানে।

“এখানে একটু আগে যে মিস্ত্রীরা কাজ করছিল, ওরা কোথায়?” গৃহকর্মীকে জিজ্ঞেস করল সে।

“ওরা চলে গেছে।”

“কোনদিকে গেছে?”

“চাকরদের নামার সিঁড়িটা বেয়ে।”

জানালা দিয়ে নিচে তাকালো শোমস। দুজন লোক বাইসাইকেল হাতে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। ওগুলোয় চড়ে দ্রুত রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা।

“ওরা এই মাচায় কতদিন ধরে কাজ করছে?”

“ঐ লোকগুলো?…আজকে সকালেই প্রথম কাজে এসেছে ওরা। “

রাস্তায় নেমে এসে উইলসনের সাথে যোগ দিলো শোমস। অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে পেতে রাখা একটা বেঞ্চে বসে রইল দুজনে। খুবই বিরক্ত হলো উইলসন। যে বাড়িতে এসব ঘটেছে, সে বাড়ির দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে অসহ্য লাগছে তার।

“কী হবে এখন, শোমস? আর্সেন লুপাঁ বেরিয়ে আসবে ঐ বাড়ি থেকে?”

“না।”

“তাহলে কী? স্বর্ণকেশী মহিলা উদয় হবে?”

“না।”

“তাহলে কী?”

“কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় আছি আমি। ছোট্ট কোনো ঘটনা যাতে করে সামনে আগানোর একটা সূত্র পেতে পারি।”

“আর যদি তা না ঘটে?”

“তাহলে গোলাবারুদে আগুন ধরানোর কাজটা আমাকেই করতে হবে।” খুবই বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা-অঘটনই বলা চলে-ঐ বিকেলের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে নষ্ট করে দিলো।

অ্যাভিনিউ ধরে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল এক ভদ্রলোক। তার ঘোড়াটা আচমকা ঘুরে ধেয়ে এলো শোমসদের বেঞ্চের দিকে। এসে শোমসের কাঁধে জোরে একটা ধাক্কা দিলো।

“আরে!” চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “আরেকটু হলে কাঁধের হাড়টাই ভেঙে গিয়েছিল আমার!”

নিজের ঘোড়াটাকে সামলানোর চেষ্টা করল লোকটা। শোমসের হাতে রিভলভার বেরিয়ে এসেছে, লোকটার দিকে তাক করল সে। উইলসন এসে

তার হাত চেপে ধরে বলল:

“বোকার মতো কাজ করো না! কী করবে? খুন করবে লোকটাকে?”

“উইলসন, আমাকে ছেড়ে দাও বলছি!”

দুজনের মাঝে টানাটানি চলল কিছুক্ষণ। ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে ঘোড়সওয়ার।

“এখন চাইলে গুলি করোগে,” বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল উইলসন। বেশ দূরে চলে গেছে লোকটা

“উইলসন, তুমি একটা গাধা! বুঝছ না যে ঐটা লুপাঁর লোক?”

রাগে কাঁপছে শোমস। উইলসন কাতর কণ্ঠে বলল:

“কী…ঐটা…লুপার লোক?”

“হ্যাঁ, আমাদের ওপর বালির ব্যাগ ফেলা ঐ মিস্ত্রীগুলোর মতো।”

“সেটা তো সম্ভব না। “

“সম্ভব হোক বা না হোক, তা প্রমাণের একটাই উপায় ছিল।”

“ঐ লোককে খুন করে?”

“না, ঐ ঘোড়াটাকে খুন করে। আমার হাত চেপে না ধরলে লুপাঁর আরেক দোসরকে ধরতে পারতাম আমি। এখন বুঝছ কী ভুল করেছ?”

পুরো বিকেলজুড়ে মুখ ব্যাজার করে ঘুরে বেড়ালো দুজনে। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলল না। পাঁচটার সময়ে ক্য ক্ল্যাপেরনে গেল তারা। তবে বাড়িটা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখল। তিন তরুণ হাতে হাত রেখে গান গাইতে গাইতে রাস্তা পার হচ্ছিল। শোমস আর উইলসনের মুখোমুখি হয়ে রাস্তা আটকালো তারা। শোমসের এমনিতেই মেজাজ খারাপ, ওদের সাথে হাতাহাতি শুরু করে দিলো তাই। কিছুক্ষণ পরে মুষ্টিবদ্ধ হাতটা বসিয়ে দিলো একটা ছেলের বুকে। একইসাথে ভূপাতিত হলো তার দুই সহযোগীও। আর পারবে না বুঝে তারা তিনজন উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

“উফ! গা টা ঝরঝরে লাগছে এখন,” চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “ভালো একটা ব্যায়াম হয়ে গেল।”

কিন্তু দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল উইলসন। শোমস বলল :

“কী হয়েছে? তোমার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে।”

নিজের বাঁ হাতটা দেখালো উইলসন। কেমন জড়পদার্থের মতো ঝুলে রয়েছে সেটা।

“কী হয়েছে জানি না। হাতটা ব্যথা করছে।”

“বেশি ব্যথা করছে?”

“হ্যাঁ, অনেক।”

হাতটা তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। ওটাকে আস্তে করে টেনে দেখল শোমস। এরপর জোরে ঝাড়া দিয়ে দেখল, কতোটা আহত হয়েছে সেটা দেখার জন্য। বুঝল, উইলসন আসলেই বেশ আহত হয়েছে। তাকে কাছের একটা ফার্মেসিতে নিয়ে গেল সে। জানা গেল, হাতটা ভেঙে গেছে তার, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তার আগে ব্যথা কমানোর জন্য কিছু ওষুধ লাগিয়ে দিলো ফার্মেসির লোকেরা।

“আরে বন্ধু, চিন্তা কোরো না!” উইলসনের হাত ধরে বলল শোমস। “পাঁচ- ছয় সপ্তাহের মাঝেই আবার ঠিক হয়ে যাবে তুমি। কিন্তু হারামিগুলোর ওপর ঠিকই এর শোধ নেবো আমি! বিশেষ করে লুপাঁ…এসব ওরই বুদ্ধি। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। আমি কথা দিচ্ছি কখনো যদি -”

হঠাৎ করে থেমে উইলসনের হাতটা ছেড়ে দিলো সে। ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে যাবার দশা হলো তার। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই শোমসের। মাথায় টোকা মেরে সে বলল :

“উইলসন, একটা বুদ্ধি পেয়েছি। তুমি তো জানোই, মাঝে মাঝে হুট করেই দারুণ সব বুদ্ধি আসে আমার মাথায়। “

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। এরপর নিচু স্বরে কিন্তু স্পষ্টভাবে বলে উঠল:

“হ্যাঁ, এটাই হয়েছে…এটাই সবকিছুর ব্যাখ্যা… সূত্রগুলো সব আমার নখদর্পনেই ছিল…অথচ কিছুই দেখিনি আমি…আহহা! আমার এসব আগেই ভাবা উচিত ছিল…উইলসন, তোমার জন্য ভালো খবর আছে।”

বন্ধুকে রেখেই হঠাৎ রাস্তার মাঝে দৌড় দিলো শোমস। সোজা ২৫ নম্বর বাড়ির দিকে গেল। বামের একটা পাথরে লেখা আছে, ‘দেস্তাঁগে, আর্কিটেক্ট, ১৮৭৫।’

২৩ নম্বর বাড়ির সামনেও খোদাই করে লেখা আছে এই কথা।

অবশ্য এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউর বাড়িতে কী লেখা থাকার কথা?

একটা গাড়ি যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। সেটাকে থামিয়ে ড্রাইভারকে ১৩৪ নং অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে যেতে বলল সে। উত্তেজনায় গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে তার। “ভাই, তাড়াতাড়ি চালান,” বলতে বলতে গাড়ির মধ্যে সে দাঁড়িয়ে পড়ছিল প্রায়। ড্রাইভারকে বাড়তি বখশিশও সাধলো সেজন্য।

ক্য দ্য লা পম্পে থেকে ঘোরার সময়ে উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ডটা বেরিয়ে আসছিল প্রায়। অবশেষে কি সত্যের দেখা পেতে চলেছে সে?

প্রয়াত ব্যারনের বাড়ির একটা পাথরে ‘দেস্তাগে, আর্কিটেক্ট, ১৮৭৪’ কথাটা দেখেছিল সে। পাশের দুটো বাড়িতেও একই কথা লেখা আছে।

খুশিতে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির সিটে বসে রইল সে। অবশেষে এই ঘোর রহস্যের মাঝে একটু আলোর নিশানা মিলেছে! ঘন অন্ধকার বনের মাঝে অসংখ্য রাস্তা দুই পাশ থেকে এসে মিলেছে। তবে শত্রুকে অনুসরণ করার প্রথম ব্লুটা খুঁজে পেয়েছে সে।

একটা পোস্ট অফিসে গিয়ে শ্যাতো দ্য ক্রোজোনে ফোন করল সে। জবাব দিলেন কাউন্টেস।

“হ্যালো?…মাদাম বলছেন?”

“আপনি মঁসিয়ে শোমস, তাই না? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

“অনেকটা ভালো, তবে আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই আপনাকে … হ্যালো?”

“জি, শুনছি।”

“আচ্ছা, শ্যাতো দ্য ক্রোজোন কবে বানানো হয়েছে বলুন তো?”

“এটা তো আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। ত্রিশ বছর আগে আবার নতুন করে বানানো হয়েছে।”

“কে বানিয়েছিল? কত সালে?”

“বাড়ির সামনে একটা পাথরে খোদাই করে লেখা ছিল: ‘দেস্তাগে, আর্কিটেক্ট, ১৮৭৭।”

“অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদাম। এটুকুই জানার ছিল। বিদায়।”

“দ্যোগে…লুসিয়েন দেত্তাগে…নামটা চেনা চেনা লাগছে কেন যেন! “ আপনমনেই বিড়বিড় করতে করতে বলল শোমস।

একটা পাবলিক রিডিং রুম দেখে সেখানে ঢুকে পড়ল সে। সেখানে মডার্ন বায়োগ্রাফির একটা ডিকশনারি পাওয়া গেল। তাতে লেখা: ‘লুসিয়েন দেস্তাগে, ১৮৪০ সালে জন্ম, গ্রাঁ-প্রি দ্য রোম, লিজিওন অভ অনারপ্রাপ্ত অফিসার, স্থাপত্যের ওপর বেশ কিছু জ্ঞানগর্ভ বই লিখেছেন তিনি…. ‘

লেখাগুলো টুকে নিয়ে ফার্মেসিতে ফিরে গেল সে। জানল, উইলসনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখে, তার হাতে স্প্লিন্টার বসানো হয়েছে। প্রবল জ্বরে কাঁপছে উইলসন।

“উইলসন! জিতে গেছি আমি! সুতোর শেষ প্রান্ত পেয়ে গেছি!” চেঁচিয়ে উঠল শোমস।

“কীসের শেষ প্রান্ত?”

“যেটা বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে আমাকে। এখন পায়ের নিচে মাটি এসেছে আমার। সেখানে সূত্র কিংবা পায়ের ছাপ, সবই মিলে যাবে…”

“সিগারেটের ছাই?” ব্যথা ভুলে কৌতুহলী হয়ে উঠেছে উইলসন।

“আরো অনেক কিছুই পাবো। ভেবে দেখো, উইলসন, স্বর্ণকেশী মহিলা যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তার সবগুলোর মাঝে একটা সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি আমি। লুপাঁ ঠিক এই বাড়িগুলোতেই কেন চুরি করতে গেল?”

“কেন?”

“কারণ, ঐ বাড়িগুলো একই স্থপতির বানানো। সমাধানটা সোজাই, তাই না? কিন্তু কে ভাবতে পারবে এত কথা?”

“তুমি বাদে আর কেউই পারবে না।”

“আর আমি বাদে কে ভাবতে পারবে যে, এই স্থপতি একই ধাঁচে বাড়িগুলো বানানোয় এইগুলো থেকে ঢোকা আর বেরোবার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে? সাধারণ মানুষের চোখে এগুলো ভেলকিবাজি, কিন্তু এমনিতে কাজটা খুবই সোজা।”

“এটা নেহাতই তোমার সৌভাগ্য।”

“এই সৌভাগ্যটুকু আমার বকেয়া ছিল। একদম অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি। দেখো, আজকে এখানে আমাদের চতুর্থ দিন।”

“দশ দিনের মধ্যে।”

“ওহ! এর পরে –“

স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি খুশি খুশি দেখাচ্ছে শোমসকে।

“একবার ভাবো, হারামিগুলো হয়তো রাস্তায় আমাকে পেলে আমারও হাত ভেঙে দেবার চেষ্টা করত। তাই না, উইলসন?”

ঘটনাটার কথা ভেবে কেঁপে উঠল উইলসন। শোমস আবার বলল:

“এখান থেকে শিক্ষা নেবার আছে আমাদের। খোলা ময়দানে লুপাঁর সাথে যুদ্ধে নামা যাবে না। তাতে আক্রমণের ঝুঁকি আছে।”

“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, ভাঙা হাতের মাঝে টেরও পাচ্ছি,” জবাব দিলো উইলসন।

“একটাই সান্ত্বনা তোমার। আমি বেঁচে গেছি ওর হাত থেকে। এখন আমাকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। খোলা ময়দানে ও আমাকে হারিয়ে দিতে পারে। তাই অন্ধকারে গা ঢেকে কাজ করতে হবে আমাকে। ওর লোকেরা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, সেই সুযোগ আমার আছে।”

“গাঁইমার্দ হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবে। “

“কক্ষনো না! যেদিন আমি সত্যিকারেই বলতে পারব যে: আর্সেন লুপাঁ এখানে আছে; যেদিন ওকে ধরার পথটা বের করে ফেলতে পারব; কেবলমাত্র সেদিনই গাঁইমার্দের কাছে যাবো আমি। হয় রু পারগোলিজে ওর বাড়িতে যাবো, কিংবা প্লেস দ্যু শ্যালেতের সরাইখানায়। তার আগ পর্যন্ত একাই কাজ করব আমি।”

বিছানার দিকে এগিয়ে এসে উইলসনের আহত কাঁধে হাত রাখল সে। এরপর বলল:

“নিজের যত্ন নিও, বন্ধু। লুপাঁর দু’-তিনজন লোক বৃথাই এখানে চোখ রাখবে, আমি আসি কি না তা দেখার জন্য। তোমার কাজ হবে ওদের ব্যস্ত রাখা। এটা তোমার একটা গোপন মিশন, ঠিক আছে!”

“আচ্ছা। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তারমানে তুমি আর এখানে আসবে না?”

“কেন আসব?” জিজ্ঞেস করল শোমস।

“জানি না…আমি অবশ্য যত তাড়াতাড়ি পারি, সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু হার্লক, একটা উপকার করো, আমাকে একটা ড্রিংকস দিয়ে যাও।”

“ড্রিংকস?”

“হ্যাঁ, তেষ্টায় মারা যাচ্ছি আমি, আর জ্বরের কারণে-

“নিশ্চিত হতে চাচ্ছি আরকি- এভাবে সরাসরি-”

পানি আনার ভান করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল সে। এরপর পাইপ ধরিয়ে চট করে এমনভাবে সরে গেল, যেন বন্ধুর অনুরোধ কানেই যায়নি ওর। এদিকে অধরা পানির জন্য নিঃশব্দে প্রার্থনা করতে লাগল উইলসন।

“মঁসিয়ে দেস্তাগে!”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল কাজের লোকটা। বাড়িটা খুবই আলিশান। প্লেস ম্যালেশাবস আর ক্য মন্টচ্যানিনের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা। ধূসর চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে ঢিলেঢালা কালো কোট চাপানো শুষ্ক, শ্রীহীন লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিতৃষ্ণ বোধ করল আলিশান বাড়ির গৃহকর্মী। দায়সারাভাবে বলল:

“উনি বাসায় থাকতেও পারেন, নাও থাকতে পারেন। আপনার কোনো কার্ড আছে?”

মঁসিয়ের সাথে কোনো কার্ড নেই। তবে পরিচয় লেখা একটা চিঠি আছে। মঁসিয়ে দেস্তাগের কাছে সেটা নিয়ে গেল গৃহকর্মী। এরপর ভদ্রলোককে বাড়ির এক উইং-এ একটা বড় গোলাকার রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, এরকম ঘরকে রোতুন্ডা বলে। সেখানে গাদা গাদা বই আর আর্কিটেকচারাল ড্রয়িং। আগন্তুক ঘরে ঢোকার পরে স্থপতি তার দিকে তাকিয়ে বললেন:

“আপনি মঁসিয়ে স্টিকমান?”

“জি, মঁসিয়ে

“আমার সেক্রেটারি জানিয়েছে, সে অসুস্থ। আমার কথামতো বইয়ের ক্যাটালগ বানাচ্ছিল ও, সেই কাজ শেষ করার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছে এখন। বিশেষ করে জার্মান বইগুলোর জন্য। আপনি কি এ ধরনের কাজ আগে করেছেন?”

“জি, মঁসিয়ে, করেছি,” জবাব দিলো সে। কথায় কড়া জার্মান টান

অল্প কিছু শর্তের মাধ্যমে কিছুক্ষণ বাদেই চুক্তি হয়ে গেল দুজনের। নিজের নতুন সেক্রেটারির সাথে কাজ করা শুরু করলেন মঁসিয়ে দেস্তাগে।

এভাবেই এই বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করে ফেলল হার্লক শোমস। এই বাড়িটার মালিক লুসিয়েন দেস্তাগে এবং তার মেয়ে ক্লোটিল্ডে।

আর্সেন লুপাঁর কুনজর এড়ানোর জন্য আর দেস্তাগের বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করার জন্য বেশ কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বিখ্যাত গোয়েন্দা। ছদ্মনাম নিয়ে বেশ কিছু মানুষের সাথে খাতির করেছে সে, বেশ কয়েকজনের আস্থা অর্জন করেছে। আটচল্লিশ ঘন্টা ধরে বেশ জটিলভাবে জীবন যাপন করতে হয়েছে তাকে। এর মাঝে বেশ কিছু তথ্য জানতে পেরেছে সে: নিজের স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়ে পড়ায় অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন মঁসিয়ে দেস্তাগে। এতদিন স্থাপত্যের ব্যাপারে যেসকল বই সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো নিয়েই সময় কাটে তার। পুরোনো ধুলিমাখা বইগুলো হাতড়ে অনিন্দ্য সুখ অনুভব করেন তিনি।

তার মেয়ে ক্লোটিল্ডে অবশ্য বেশ অদ্ভুত ধরনের মানুষ। বাড়ির অন্য অংশে দিন কাটায় সে। কখনোই ঘর থেকে বেরোয় না।

“সেটাই,” নিজেকে নিজে বলে উঠল শোমস। মঁসিয়ে দেস্তাগের কথামতো বইয়ের নাম রেজিস্টারের কাজ করছে সে। “সবকিছুই ভাসা ভাসা আর অর্ধসমাপ্ত। কিন্তু এ কাজ করে অনেকটাই এগিয়ে গেলাম আমি। লুপাঁর সাথে তার সম্পর্ক আছে কি না, এখনো দুজনের দেখা হয় কিনা, একইরকম নকশার অন্য বাড়ি, যেগুলোতে লুপাঁ অচিরেই আঘাত হানতে পারে, সেগুলোর অবস্থান এই নথিপত্র থেকে আমি বের করতে পারব কি না- এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া অনেক সহজ এখন আমার জন্য।

“মসিয়ে দেস্তাগে তাহলে আর্সেন লুপাঁর একজন সহযোগী! এরকম পূজনীয় এক ব্যক্তিত্ব, লিজিওন অভ অনারপ্রাপ্ত অফিসার কিনা হাত মিলিয়েছে এক চোরের সাথে! এরকমটা ভাবাই তো অন্যায়! তাছাড়া, এরকম জটিল কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব যদি হয়েই থাকে, তাহলে ত্রিশ বছর আগে এই বাড়িগুলোর এমন নকশা করার কী ব্যাখ্যা? লুপাঁ তো তখন নেহাত শিশু ছিলো! “

তা যাই হোক না কেন! ব্রিটিশ গোয়েন্দা এখন অদম্য বোধ করছে। যে ক্ষুরধার ইন্দ্রিয় আর অনুমানশক্তি তাকে কোনোদিন ব্যর্থ হতে দেয়নি, সেই শক্তিই তাকে বলছে যে সে কোনো অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে চলে এসেছে। এই বাড়িতে ঢোকার পরমুহূর্ত থেকেই তার মনে হয়েছে এমনটা। তবে এই সন্দেহের কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি সে এখন পর্যন্ত।

দ্বিতীয় দিন সকাল পর্যন্ত বড় কিছু আবিষ্কার করতে পারল না সে। ঐদিন দুপুরে প্রথমবারের মতো ক্লোটিল্ডে দেস্তাগের সাথে দেখা হলো তার। এক বইয়ের খোঁজে লাইব্রেরিতে এসেছিল সে। মহিলার বয়স ত্রিশ হবে, মাথায় বাদামিরঙা চুল, ধীরেসুস্থে হাঁটে। যারা একাকী থাকতে পছন্দ করে, তাদের মুখের মধ্যে একটা নির্বিকার অভিব্যক্তি লেপ্টে থাকে। ইনার মধ্যেও আছে সেটা। নিজের বাবার সাথে কিছু কথা বলল সে, এরপর চলে গেল। শোমসের দিকে ফিরেও তাকালো না।

বিকেলটা কাটতে লাগল মন্থর গতিতে। পাঁচটার দিকে মঁসিয়ে দেস্তাগে ঘোষণা দিলেন, তিনি বাইরে যাবেন। শোমস একাই রয়ে গেল গোলাকার গ্যালারিটায়। রোতুন্ডার প্রায় ফুট দশেক উপরে বানানো হয়েছে সেটা। প্ৰায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো সে। তখনই একটা শব্দ এলো তার কানে, শব্দটা থামিয়ে দিলো তাকে। ঘরে অন্য কেউ আছে ওর সাথে! এরপরের কয়েক মিনিট কিছু দেখতে বা শুনতে পেল না শোমস। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে: অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি উদয় হয়েছে, ওর বেশ কাছেই। ব্যালকনির উপরে। কী অসম্ভব ব্যাপার! লোকটা কতক্ষণ ধরে আছে ওখানে? কখনই বা এলো?

সিঁড়ি বেয়ে নেমে একটা ওককাঠের কাবার্ডের কাছে গেল লোকটা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার নড়াচড়া লক্ষ্য করছে শোমস। কাবার্ডে থাকা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে সে। কী খুঁজছে কে জানে?

এরপর দরজাটা খুলে গেল হঠাৎ। ঘরে এসে ঢুকল মাদামোয়াজেল দেস্তাগে। তার পেছনে থাকা কারো দিকে তাকিয়ে বলল:

“তাহলে বাইরে যাবে না বাবা?…আলো জ্বালিয়ে দেই তাহলে… এক সেকেন্ড…নড়ো না…”

রহস্যময় লোকটা কাবার্ড লাগিয়ে বড় একটা জানালার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এরপর টেনে দিলো পর্দাটা। মাদামোয়াজেল দেস্তাগে কি দেখেনি তাকে? তার আওয়াজ শোনেনি? শান্তভাবে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলো। এরপর সাথে করে আনা বইটা পড়া শুরু করে দিলো 1 কয়েক মিনিট পরে বলল :

“তোমার সেক্রেটারি চলে গেছে।”

“সেটাই, দেখছি না ওকে।”

“তোমার শুরুতে ওকে যেমন পছন্দ ছিল, তেমন পছন্দ আছে এখনো?” সে জিজ্ঞেস করল। কী অদ্ভুত! সে যেন জানেই না যে আগের সেক্রেটারি অসুস্থ আর তার বদলে স্টিকমান নিয়োগ পেয়েছে।

“হ্যাঁ, একইরকম পছন্দ। “

একপাশ থেকে অন্যপাশে ঝুঁকে গেল মঁসিয়ে দেস্তাগের মাথাটা। ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। মেয়েটা পড়া শুরু করল আবার। কিছুক্ষণ পরে সরে গেল জানালার পর্দাটা। লোকটা বেরিয়ে এসে দেয়াল ধরে ধরে দরজার দিকে এগোতে লাগল। মঁসিয়ে দেস্তাগেকে পেরিয়ে গেলেও ক্লোটিল্ডের সামনে চলে এলো সে। কিছুটা আলো মুখে পড়ায় তার চেহারাটা ভালোমতো দেখতে পেল হার্লক।

আর্সেন লুপাঁ!

হার্লকের মনটা খুশি হয়ে গেল। ওর অনুমান মিলে গেছে। রহস্যের একদম গভীরে পৌছাতে পেরেছে সে। আর্সেন লুপাঁকেও পেয়ে গেছে সেখানে।

ক্লোটিল্ডে এখনো দেখতে পায়নি তাকে। অথচ এত নড়াচড়ার পরে কাউকে না খেয়াল করাটা খুবই অস্বাভাবিক। দরজার কাছে পৌঁছে নবে হাত দিয়ে ফেলেছিল প্রায় লুপাঁ, কিন্তু ওর কোট লেগে পড়ে গেল টেবিলের একটা জিনিস। ঝটকা দিয়ে জেগে গেলেন মঁসিয়ে দেস্তাগে। আর্সেন লুপাঁ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে তার সামনে, হাতে হ্যাট আর মুখে হাসি নিয়ে।

“ম্যাক্সিম বারমন্ড,” উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে দেস্তাগে। “এ দেখি আমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ! কী সৌভাগ্য তোমাকে টেনে নিয়ে এলো এখানে?”

“আপনাকে আর মাদামোয়াজেলকে দেখার ইচ্ছায় চলে এলাম!”

“তুমি ফিরলে কবে?”

“কালকে।”

“রাতের খাবার খেয়ে যাবে অবশ্যই।”

“ধন্যবাদ, তার প্রয়োজন নেই। আমি দুঃখিত। কয়েকজন বন্ধুর সাথে এক রেস্টুরেন্টে ডিনারের দাওয়াত আছে আমার।”

“কালকে এসো তাহলে। ক্লোটিল্ডে, কালকে ওকে আসতে বল, প্লিজ! তুমি চলে যাবার পরে তোমার কথা অনেকবার মনে হয়েছে আমার।”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ। আর ঐ কাবার্ডে আমার পুরোনো সকল কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি আমি। আমাদের অ্যাকাউন্টের শেষ স্টেটমেন্টও খুঁজে পেয়েছি।”

“কীসের অ্যাকাউন্ট?”

“অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউর সাথে সম্পর্কিত।

“আহ! এসব কাগজ রাখেন নাকি আপনি? কীসের জন্য?”

এই কথা বলতে বলতে তিনজনেই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। পাশের একটা পার্লারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল।

“এটা লুপাঁই ছিল তো?” নিজেকে প্রশ্ন করল শোমস। হঠাৎ করেই সন্দেহ জেগেছে তার মনে। দূর থেকে দেখে অবশ্য ওর মতোই লাগছিল। চেহারার ধরন, চুলের রঙ, ভাবভঙ্গি— সব একইরকম। পাশের ঘর থেকে লুপাঁর গলা কানে এলো তার। তার বলা কোনো গল্প শুনে জোরে জোরে হাসলেন মঁসিয়ে দেস্তাগে। বিষণ্ন ক্লোটিল্ডের মুখেও হাসি ফুটল। এতক্ষণ ধরে ওদেরকে হাসানোর চেষ্টাই করে যাচ্ছিল সে, অবশেষে সফল হলো। উৎসাহী হয়ে আরো কিছু বলল সে, তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্লোটিল্ডের মুখ, মনমরা ভাব একদমই চলে গেছে।

“ওরা একে অপরকে খুব পছন্দ করে,” ভাবল শোমস। “কিন্তু ক্লোটিল্ডে আর ম্যাক্সিমের মাঝে কী এমন মিল থাকতে পারে? সে কি আদৌ জানে যে এই লোক একটা বিখ্যাত চোর?”

সাতটা পর্যন্ত চিন্তিত মুখে ওদের সব কথা শুনতে লাগল শোমস। কোন কথা থেকে কী বের হয় কিছুই বলা যায় না। এরপর অতি সাবধানে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এলো সে। এমনভাবে দরজার দিকে এগোলো যাতে পাশের ঘরের লোক তাকে দেখতে না পায়।

রাস্তায় পৌঁছানোর পর সন্তুষ্ট হলো শোমস। আশেপাশে কোনো গাড়ি কিংবা ক্যাব দেখা যাচ্ছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বুলেভার্দ ম্যালশাবস ধরে হাঁটতে লাগল সে। চট করে পাশের এক রাস্তায় গিয়ে হাতে থাকা কোটটা গায়ে দিয়ে নিলো সে। নিজের হ্যাটের আকারটাও বদলে দিলো। টানটান হয়ে দাঁড়ালো। এখন তাকে দেখে আমূল ভিন্ন মানুষ মনে হচ্ছে। এখান থেকে মঁসিয়ে দেস্তাগের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে ভালোমতোই।

কয়েক মিনিট পরেই বেরিয়ে এলো আর্সেন লুপাঁ। র‍্য দ্য কনস্ট্যান্টিনোপল ধরে প্যারিসের কেন্দ্রের দিকে হাঁটতে লাগল সে। একশো কদম পিছে থেকে তাকে অনুসরণ করতে লাগল শোমস।

ব্রিটিশ ভদ্রলোক এখন দারুণ উত্তেজিত! নাক উঁচু করে শ্বাস নিলো সে, গন্ধ পাওয়া শিকারী কুকুরের মতো। নিজের প্রতিপক্ষকে অনুসরণ করতে পেরে

খুব ভালো লাগছে তার। এখন নজর রাখার পালা। তাও সে নজর রাখছে আর্সেন লুপাঁর মতো অতিমানবকে। গোটা দুনিয়ার চোখেই যে প্ৰায় অদৃশ্য, তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সে। তাদের মাঝে আর বাধা দিতে আসবে না কেউ। এই শিকার এখন ওর কবলে।

কিন্তু অচিরেই কয়েকজনকে সন্দেহজনকভাবে হাঁটাহাটি করতে দেখল সে। তার আর লুপাঁর মাঝে রয়েছে তারা, একই পথে যাচ্ছে। বিশেষ করে নামানো হ্যাট পরা দুই বলশালী লোককে দেখে বোঝাই যাচ্ছে, লুপাঁকে অনুসরণ করছে তারা। রাস্তার বামপাশ দিয়ে হাঁটছে তারা। আর রাস্তার ডানদিকে ক্যাপ পরা দুজন সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছে। এরা অবশ্য এমনিতেও যেতে পারে। কিন্তু লুপাঁ একটা সিগারেটের দোকানে ঢোকার পরেই তারা চারজন একত্র হয়ে গেল। এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না শোমসের। লুপাঁ বেরিয়ে আসার পরে আবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে হাঁটতে লাগল লোকগুলো।

“যত্তসব!” বিড়বিড় করে বলল শোমস। “ওর পিছে অন্য লোকও লেগেছে।”

লুপাঁকে অন্য কেউ অনুসরণ করছে, অন্য কেউ এসে তাকে সাফল্য বঞ্চিত করবে, ভেবে মনটা তেতো হয়ে গেল তার। খ্যাতির প্রতি লোভ নেই তার। কিন্তু নিজের সবচেয়ে কঠিন শত্রুকে ধরে ফেলার অনির্বচনীয় সুখটা সে হারাতে চায় না। আর এ লোকগুলোর ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই। লোকগুলো যতোই স্বাভাবিক আচরণ করুক, যতোই নির্বিকার মুখে চলুক, এতদিনের অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব না।

“এরা কি গাঁইমার্দের লোক?” বিড়বিড় করল শোমস। “ও কি কোনোভাবে আমাকে বোকা বানাচ্ছে?”

একটা লোকের সাথে কথা বলতে এগোলো সে। বলবে, সে-ও একই উদ্দেশ্যেই যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এগুতে এগুতে লোকের ভিড় বেড়ে গেল। এখন কথা বলতে গেলে লুপাঁ হারিয়ে যেতে পারে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো সে। বুলেভার্দের মোড় ঘুরে দেখে, ক্ন্য দ্য হেল্ডারের হাঙ্গেরিয়ান রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে লুপাঁ। রেস্টুরেন্টের দরজাটা খোলাই আছে। তাই বুলেভার্দের অপরপাশের এক বেঞ্চে বসেও লুপাঁকে দেখতে পেল শোমস। বেশ আলিশান, ফুল দিয়ে সাজানো একটা টেবিলে গিয়ে বসলো সে। আগে থেকেই তাতে তিনজন ভদ্রলোক আর দুজন ভদ্রমহিলা বসে আছে। দেখেশুনে সবাইকেই বেশ অভিজাত মনে হলো। লুপাঁকে দেখে অভিবাদন জানালো সবাই।

ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে লুপাঁকে অনুসরণ করা চারজনকে খুঁজল শোমস। পাশেই এক ক্যাফেতে কয়েকজন ভিড় করে জিপসি অর্কেস্ট্রা শুনছে। সেখানে পাওয়া গেল তাদেরকে। মজার ব্যাপার হলো, এখন লুপাঁর দিকে তাকাচ্ছেই না তারা। আশেপাশের লোকের সাথে ভাব পাতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। একজন একটা সিগারেট নিয়ে পাশের একজনকে সাধল। পাশের সেই লোক ফ্রক কোট আর সিল্কের হ্যাট পরা। সেই লোক আবার পাশের জনের কাছে আগুন চাইল। শোমসের মনে হলো, দরকারের তুলনায় একটু বেশিই সময় ধরে কথা বলছে তারা। অবশেষে লোকগুলো এগোলো হাঙ্গেরিয়ান রেস্টুরেন্টের দিকে। সেখানে ঢুকে আশেপাশে তাকালো তারা। লুপাঁকে দেখে তারা এগিয়ে গিয়ে কথা বলল কিছুক্ষণ। এরপর পাশের এক টেবিলে গিয়ে বসলো। লোকটাকে চিনতে পারল শোমস। অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে যে ঘোড়সওয়ারগুলো ওদেরকে আক্রমণ করতে এসেছিল, তাদের একজন সে।

আসলে কী হয়েছে, বুঝতে পারল শোমস। এরা আসলে লুপাঁর দলেরই লোক। ওর নিরাপত্তার জন্য পিছে পিছে যাচ্ছিল। এরা ওর বডিগার্ড, ওর স্যাটেলাইট, ওর জন্য বুক পেতে দেয়া অকুতোভয় সেনানী। যখনই লুপাঁ কোনো বিপদে পড়বে, তখনই এরা চলে আসবে ওকে রক্ষা করতে। এই চারজনই ওর সহযোগী। নিজের অবস্থা বুঝে চিন্তায় পড়ে গেল শোমস। ও কি আদৌ এদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে ধরতে পারবে ওকে? লুপাঁ এতোই ক্ষমতাধর যে এরকম একটা গ্যাং এর পরিচালক হয়ে বসে আছে?

নিজের নোটবুক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিলো সে। পেন্সিলে কয়েক লাইন লিখে খামে রেখে দিলো সেটা। ওর পাশে চৌদ্দ-পনেরো বছরের এক ছেলে বসে ছিল। তাকে বলল:

“শোনো, খোকা। একটা গাড়ি নিয়ে চলে যাবে প্লেস দ্যু শ্যালেতে। এরপর এই চিঠিটা সুইস ট্যাভার্নের ক্যাশিয়ারের কাছে দেবে। জলদি!”

ছেলেটার হাতে পাঁচ ফ্রাঁ ধরিয়ে দিলো সে। অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেল। ভিড় বাড়ছে আস্তে আস্তে। কিছুক্ষণ পরপর লুপাঁর সহযোগীগুলোকে দেখছে শোমস। হঠাৎ একজন এসে দাঁড়ালো তার কাছে। কানে কানে বলল:

“কী হয়েছে, মঁসিয়ে শোমস?”

“গাঁইমার্দ? আপনি নাকি?”

“জি, ট্যাভার্নে আপনার পাঠানো নোটটা পেলাম। কী হয়েছে?”

“ও ওখানে আছে।”

“কী বলতে চাইছেন?”

“ঐখানে..রেস্টুরেন্টের ভেতরে। ডানদিকে ঝুঁকুন..এখন দেখতে পাচ্ছেন?”

“না।”

“ঐ ভদ্রমহিলাকে এইমাত্র শ্যাম্পেন ঢেলে দিলো যে।”

“ওটা তো লুপাঁ না।”

“অবশ্যই ওটা লুপাঁ।”

“কিন্তু আমি বললাম তো…আহ! হতেও পারে, ওর সাথে চেহারার মিল আছে বটে,” কিছুটা বোকা হয়ে বলল গাঁইমার্দ। “আর সাথে ওগুলো কারা? ওর দোসর?”

“না; ওর পাশে বসে আছেন লেডি ক্লাইভডেন, অন্যজন হলেন ডাচেস ডে ক্লিথ। লুপাঁর বিপরীতে যিনি বসে আছেন তিনি হলেন লন্ডনে বহাল হওয়া স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত।”

এক পা এগিয়ে গেল গানিমার্দ। তাকে সামলালো শোমস।

“সাবধান হোন, আপনি একা।”

“লুপাও তো।”

“না, বুলেভার্দে বেশ কয়েকজন লোককে গার্ড হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ও। আর রেস্টুরেন্টের ভেতরে ওই ভদ্রলোক -”

“ওখানে গিয়ে আর্সেন লুপাঁর কলার চেপে ধরে ওর নামটা ঘোষণা করলে, পুরো রুম আমার পক্ষে চলে আসবে। ওয়েটারেরা সহ।”

“কয়েকজন পুলিশ নিয়ে গেলে ভালো হতো মনে হয়।”

“কিন্তু মঁসিয়ে শোমস, উপায় নেই আমাদের হাতে। সুযোগ পাওয়ামাত্র ধরতে হবে ওকে।“

গাঁইমার্দ ঠিকই বলেছে। শোমস নিজেও জানে সেকথা। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ওকে ধরার চেষ্টা করতে হবে এখনই। শোমস কেবল একটাই উপদেশ দিলো গাঁইমার্দকে:

“নিজের পরিচয় যথাসম্ভব গোপন রাখবেন।”

একটা পত্রিকার দোকানের আড়ালে সরে গেল শোমস। সেখান থেকে নজর রাখল লুপাঁর ওপরে। লেডি ক্লাইভডেনের দিকে ঝুঁকে কথা বলছে আর হাসছে সে।

দুই হাত পকেটে রেখে রাস্তা পেরিয়ে গেল গাঁইমার্দ। বুলেভার্দ দিয়ে নেমে যাচ্ছে যেন। রাস্তার ওপাশে গিয়েই দ্রুত ঘুরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে উঠতে লাগল সে। তীক্ষ্ণ একটা হুইসেলের শব্দ হলো। প্রধান ওয়েটারের সাথে ধাক্কা খেলো গাঁইমার্দ। ফট করেই যেন সে চলে এসেছে তার সামনে। রাগে তাকে পাল্টা ধাক্কা দিলো সে। গাঁইমার্দের মতো অভব্য লোককে রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই দেবে না যেন। অবাক হয়ে গেল গাঁইমার্দ। ঠিক সেই মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো ফ্ৰক কোট পরা লোকটা। গাঁইমার্দের পক্ষ নিয়ে ওয়েটারের সাথে তর্ক জুড়ে দিলো সে। একজন তাকে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আরেকজন বাইরের দিকে। বহু চেষ্টা এবং প্রতিবাদের পরেও দুর্ভাগা গোয়েন্দা কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে ফুটপাতে আবিষ্কার করল।

তাদের হাতাহাতি দেখে লোক জমে গেছে। দুই পুলিশও চলে এসেছে। ভিড়ের মাঝে এগোনোর চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু অদ্ভুত কোনো কিছুতে বাধা পেয়ে বারবার পিছিয়ে যেতে লাগল তারা। উত্তেজিত জনতা ঢোকারই সুযোগ দিলো না তাদের।

হঠাৎ করেই কোন জাদুবলে যেন ভাগ হয়ে গেল লোকেরা। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোবার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রধান ওয়েটার বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগল। ফ্রক কোট পরা লোক ডিটেকটিভের হয়ে তর্ক করা বাদ দিলো। ভিড় কমে গেল দ্রুতই। পুলিশেরাও সরে গেল। দ্রুত রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছয়জন বসা ঐ টেবিলের দিকে এগোলো গাঁইমার্দ। সেখানে তো এখন মাত্র পাঁচজন বসা! আশেপাশে তাকালো সে, দরজা বাদে বেরোনোর কোনো পথ নেই।

“যে লোক এখানে বসে ছিল, সে কোথায়?” অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা পাঁচজন অতিথির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে।

“মঁসিয়ে দেস্ত্রো?”

“না; আর্সেন লুপাঁ!”

একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে বলল:

“ঐ ভদ্রলোক তো উপরতলায় গেছেন।”

তাকে খুঁজে পাওয়ার আশায় দ্রুতপদে উপরে উঠতে লাগল গাঁইমার্দ। রেস্টুরেন্টের উপরতলায় প্রাইভেট ডাইনিং রুম আর নিজস্ব সিঁড়ি আছে। সেটা চলে গেছে বুলেভার্দের দিকে

“এখন আর ওকে খুঁজে কোনো লাভ নেই,” বিড়বিড় করে বলল গাঁইমার্দ। ও বহুদূরে চলে গেছে এতক্ষণে।”

ও কিন্তু বহুদূরে যায়নি- ২০০ ইয়ার্ড দূরে গেছে বড়জোড়। ম্যাডেলিন – বাস্টিল অমনিবাসে চড়ে বসেছে সে। সেটা ধীরেসুস্থে প্লেস দ্য লে’অপেরার তিনটা বাড়ি পেরিয়ে বুলেভার্দ দ্য ক্যাপুসিনার দিকে এগোচ্ছে। অমনিবাসের ছাদে সিঁড়ির কাছে এক বুড়ো ঝিমোচ্ছে। হার্লক শোমস।

মাথাটা একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে ঝুঁকে যাচ্ছে তার। নিজেকে নিজে বলল:

“উইলসন এখন আমাকে দেখলে বন্ধুগর্বে বুকটা ভরে যেত ওর। লোকটা হুইসেল দেবার সাথে সাথেই আমি বুঝেছি যে ও আর পারবে না। তাই তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের শত্রুকে পালাতে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। লুপাঁ আসলেই আমাদের জীবনকে টানটান উত্তেজনায় ভরে দিচ্ছে।”

বাস যখন টার্মিনালে পৌঁছে যাবে, তখন ঝুঁকে গেল হার্লক। দেখল, বাস থেকে নেমে যাচ্ছে লুপাঁ। বডিগার্ডগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময়ে শোমস তাকে বলতে শুনল: “অ লে’টয়েল।”

“অ লে’টয়েল, ঠিক তাই! দেখা করবে ওরা। আর আমিও থাকব সেখানে,” ভাবল সে। “এই দুজনের পিছু নিলেই হবে।”

একটা গাড়িতে চলে বসলো লুপাঁ। লোকগুলো অবশ্য পায়ে হেঁটেই চলল। শোমস অনুসরণ করল তাদের। একটা সরু বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল তারা। ৪০ নং কৱ্য চ্যালগ্রিন। কলিংবেল বাজালো তারা। দরজার আড়ালে দাঁড়ালো শোমস। নিচতলার একটা জানালা খুলে ফেলল এক লোক। এরপর শাটার টেনে দিলো। কিন্তু শাটারটা নিচ পর্যন্ত পৌঁছালো না। জায়গাটা খালি হয়ে রইলো।

দশ মিনিট পরে এক ভদ্রলোক এসে ঐ একই দরজায় কলিংবেল দিলো কয়েক মিনিট বাদেই এলো আরো একজন। কিছুক্ষণ পরে একটা গাড়ি এসে থামল বাড়িটার সামনে। দুজন যাত্রী এসে নামল: আর্সেন লুপাঁ আর ভারী পোশাক পরা, মুখের সামনে ভারি পর্দা টানা এক মহিলা।

“স্বর্ণকেশী মহিলা নিশ্চয়ই এটা,” নিজেকে বলল শোমস। চলে গেল গাড়িটা।

বাড়িটার দিকে এগোতে শুরু করল হার্লক। আঙুলের ওপর ভর দিয়ে জানালায় চড়ে বসলো। শাটারের ভেতর দিয়ে রুমের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে।

ম্যান্টেলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্সেন লুপাঁ। বিচিত্র ভঙ্গিমা করে কথা বলছে সে। অন্যরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। তাদের মাঝে ফ্রক কোট পরা লোকটাকে চিনতে পারল শোমস। আরেকজনকে দেখে রেস্টুরেন্টের প্রধান ওয়েটার বলে মনে হলো। স্বর্ণকেশী মহিলা একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে, জানালার দিকে পিঠ করে।

“ওরা আলোচনা সভা বসিয়েছে তাহলে,” ভাবল শোমস। “রেস্টুরেন্টের ঘটনাটায় চিন্তিত হয়ে বৈঠক বসিয়ে ফেলেছে। আহহা, এবারে এক দফায় ওদের সব কয়টাকে ধরে ফেলতে পারলে কী দারুণ একটা কাজ হতো!”

তাদের একজন দরজার দিকে এগোলো। মাটিতে লাফিয়ে পড়ল শোমস। ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ফ্রক কোট পরা লোক আর প্রধান ওয়েটার বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। মুহূর্ত পরেই দোতলার এক রুমের জানালায় আলো দেখা গেল। কিন্তু সাথে সাথেই বন্ধ করে দেয়া হলো শাটার। বাড়িটার উপরের অংশ এখন নিচের অংশের মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন।

“লুপা আর ঐ মহিলা এখন নিচতলায় আছে; আর ওর বাকি দুই দোসর আছে উপরে,” ভাবল শোমস।

রাতের বেশিরভাগ সময় ওখানেই কাটালো শোমস। চোখের আড়াল করলেই লুপাঁ যদি চলে যায়, এই ভয়ে।

ভোর চারটার সময়ে রাস্তার শেষ মাথায় দুই পুলিশকে দেখা গেল। তাদেরকে গিয়ে পরিস্থিতি সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলে বাড়িটা পাহারা দিতে বলে গেল সে। এরপর গাঁইমার্দের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল।

“ওকে পেয়ে গেছি,” জানালো শোমস।

“আর্সেন লুপাঁকে?”

“হ্যাঁ।”

“একটু আগেও তো ধরেই ফেলেছিলেন প্রায়। ওরকম অবস্থা হলে বাপু আমি আমার ঘুম নষ্ট করব না। তবে স্টেশন হাউজে যাওয়া যেতে পারে।

রু্য মেসনিলের পুলিশ স্টেশনে গেল তারা। সেখান থেকে গেল কমিসারি, মঁসিয়ে ডেকয়েত্রের বাড়িতে। এরপর গোটা ছয়েক পুলিশ নিয়ে ক্ন্য চ্যালগ্রিনের বাড়ির দিকে রওনা দিলো তারা।

“নতুন কিছু ঘটেছে?” পুলিশ দুজনকে জিজ্ঞেস করল শোমস।

“না।”

দিনের আলো মাত্র ফোটা শুরু করেছে তখন। ওদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে কলিংবেল বাজালেন কমিসারি। প্রহরীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। এরকম ভোরবেলা অতর্কিত জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে বেশ ভড়কে গেল মহিলা। কাঁপতে কাঁপতে জানালো, নিচতলায় কোনো ভাড়াটিয়া থাকে না।

“কী! ভাড়াটিয়া থাকে না?” চমকে গেল গাঁইমার্দ।

“না; দোতলায় দুজন লোক ছিল, লেরয় নামে। দেশের বাড়ির লোক আসবে বলে নিচতলায় কিছু আসবাবপত্র সাজাচ্ছিল তারা।”

“এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা।”

“হ্যাঁ।”

“কালকে রাতে এখানে এসেছে তারা।”

“হয়তো…কিন্তু আমি জানি না…আমি আসলে ঘুমাচ্ছিলাম। তবে আমার মনে হয় না, চাবি তো এখানেই আছে। ওরা তো এটা চায়নি।”

“চাবি দিয়ে নিচতলার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুললেন কমিসারি। মাত্র দুইটা রুম রয়েছে তাতে। রুমগুলোতে কেউ নেই।

“অসম্ভব!” চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “ওদের দুজনকেই এখানে দেখেছি আমি।”

“আপনার কথা বিশ্বাস করেছি আমি,” বললেন কমিসারি। “কিন্তু এখন তো ওরা নেই এখানে। “

“চলুন আগে দোতলায় যাই। বাকি দুজন নিশ্চয়ই ওখানেই আছে।”

“দোতলায় লেরয় নামে দুজন থাকে।”

“এই দুই মঁসিয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তাহলে।”

সিঁড়ির দিকে এগোলো সবাই। সবার আগে কমিসারি। কলিংবেল বাজালেন তিনি। দু’বার বেল বাজার পরে এক লোক দরজা খুলল। শার্ট পরে আছে সে। দেখামাত্রই তাকে চিনল শোমস। লুপাঁর বডিগার্ডদের একজন। লোকটা রাগত স্বরে বলল:

“এরকম ভোরবেলা এসে ভেজাল করছেন কেন…মানুষের ঘুম নষ্ট করছেন…”

তবে হঠাৎ করেই চমকে উঠে থেমে গেল সে।

“খোদা মাফ করুক! আমি তো আপনাদের চিনতেই পারিনি। মঁসিয়ে দেকয়েত্রে এসেছেন দেখি!…আর আপনি, মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, আপনাদের জন্য কী করতে পারি?”

জোরে হেসে ফেলল গাঁইমার্দ। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার, পিঠ বেঁকে গেছে হাসির তোড়ে।

“আরে! লেরয়! তুমি এখানে!” কোনোমতে বলল সে। “লেরয় তারমানে আর্সেন লুপাঁর সহযোগী? হায়রে, হাসতে হাসতে মরেই যাবো আমি! আর তোমার ভাইটা কোথায়?”

“এডমন্ড!” বলে ডাক দিলো লোকটা। “গাঁইমার্দ দেখা করতে এসেছেন আমাদের সাথে।”

আরেকজন লোক এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে হাসি আরো বাড়ল গাঁইমার্দের।

“আরে! এসব তো কল্পনাতেও ভাবিনি আমরা! বন্ধুরা, এবার ভালো গ্যাড়াকলে পড়ে গেলে। কে ভাবতে পেরেছিল এসব?”

শোমসের দিকে ফিরে গাঁইমার্দ পরিচয় করিয়ে দিলো তাকে:

“এ হলো ভিক্টর লেরয়, আমাদের অফিসের একজন গোয়েন্দা। আয়রন ব্রিগেডের সেরাদের একজন…আর এ এডমন্ড লেরয়, অ্যান্থোপোমেট্রিক সার্ভিসের চিফ ক্লার্ক।“