৫. অ্যান অ্যাবডাকশন

অধ্যায় পাঁচ – অ্যান অ্যাবডাকশন

একটা কথাও বলল না হার্লক শোমস। কী বলবে? লোক দুজনকে অভিযুক্ত করবে? তা করে তো কোনো লাভ হবে না। হাতে কোনো প্রমাণ নেই ওর। এটুকু সময়ে সেটা সংগ্রহ করার সুযোগও পায়নি। সুতরাং কেউ-ই বিশ্বাস করবে না ওকে। তার ওপর রাগে পাথর হয়ে গেছে সে। তবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা গাঁইমার্দের সামনে সেটা প্রকাশ করল না সে। সমাজসেবক লেরয় ভ্রাতৃদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ালো একবার, এরপর চলে গেল।

বারান্দায় গিয়ে নিচু একটা দরজা ঘোরালো সে। সেলারে যাবার পথ মনে হচ্ছে। সেখান থেকে একটা ছোটো পাথর তুলে নিলো সে। গার্নেটের মতো দেখতে। রাস্তায় পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল সে। এরপর বাড়ির সামনের লেখাটা পড়ল ‘ লুসিয়েন দেস্তাগে, আর্কিটেক্ট, ১৮৭৭।’

পাশের বাড়িটা ৪২ নম্বর। তাতেও একই কথা খোদাই করা।

“সবসময় ভেতর দিয়ে যাবার পথ থাকে- ৪০ নং আর ৪২ নং এর মাঝেও যাবার পথ আছে তাহলে। আমি একথা আগে ভাবিনি কেন? ঐ পুলিশগুলোর সাথে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত ছিল আমার।”

কোণায় দাঁড়ানো পুলিশ দুজনকে গিয়ে বলল সে :

“আমি যখন ছিলাম না, তখন ৪২ নম্বর বাসা থেকে দুজন বেরিয়েছে, তাই না?”

“জি। এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা।”

এগিয়ে এলো গাঁইমার্দ। তার হাত ধরল শোমস। দুজনে একসাথে রাস্তায় হাঁটতে লাগল। শোমস বলল:

“মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, খুব তো হাসির উপকরণ পেয়ে গেলেন। আপনাকে এত ঝামেলায় ফেলার জন্য আমাকে কখনো মাফ করবেন না মনে হয়।”

“আরে, অতো সমস্যা নেই। কৌতুকটা মজার ছিল।”

“সেটা আমিও স্বীকার করছি। কিন্তু ভালো কৌতুকগুলোর আয়ু বেশিদিন হয় না। এটাও বেশিদিন টিকবে না। “

“আমার তা মনে হয় না।”

“আজকে আমার এখানে আসার সপ্তম দিন। আর মাত্র তিনদিন থাকতে পারব আমি। এরপরেই লন্ডনে ফিরে যেতে হবে।”

“ওহ!”

“আপনি একটু প্রস্তুত থাকবেন। আপনাকে মঙ্গল বা বুধবার যেকোনো সময়ে ডাকতে পারি আমি।”

“আজকে রাতের মতো অভিযানে যাবার জন্য?”

‘জি, মঁসিয়ে, একইরকম অভিযান।”

“তাতে লাভ কী?”

“আর্সেন লুপাঁকে ধরা যাবে,” জবাব দিলো শোমস।

“আপনার তাই মনে হয়?”

“আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, মঁসিয়ে।”

গাঁইমার্দকে বিদায় জানালো শার্লক। এরপর কাছের এক হোটেলে গিয়ে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলো। বেশ ঝরঝরে বোধ করছে এখন সে, হারানো আত্মবিশ্বাসটাও কিছুটা ফিরে এসেছে।

আবার ক্য চ্যালগ্রিনে ফিরল সে। দারোয়ানের হাতে দুই ফ্রাঁ দিয়ে জানল, বেরিয়ে গেছে লেরয় ভাইয়েরা। আরো জানল, বাড়িটা মঁসিয়ে হারমিঞ্জিয়েট নামে এক লোকের। একটা মোমবাতি নিয়ে নিচু দরজাটা সেলারে নেমে পড়ল সে। সিঁড়ির নিচে আগের মতো আরেকটা গার্নেট পাথর পড়ে আছে।

“আমার ভুল হয়নি,” ভাবল সে। “এটাই তাহলে ওদের যোগাযোগের মাধ্যম। দেখি আমার স্কেলিটন-কি দিয়ে নিচতলার বাসিন্দার জন্য বরাদ্দ সেলারের দরজা খোলে কি না। হুম খুলে গেছে। এখন এই ওয়াইনের কেসগুলো দেখব আমি…কিছু কিছু জায়গা থেকে ময়লা সরে যেতে দেখা যাচ্ছে। মাটিতে কিছু পায়ের ছাপও আছে…”

একটা ক্ষীণ শব্দ ওকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে বাধ্য করল। জলদি দরজাটা ঠেলে মোমবাতি নিভিয়ে দিলো সে। একগাদা ওয়াইনে কেসের পেছনে লুকালো। কয়েক মুহূর্ত পরে দেয়ালের একটা অংশ ঘুরে গেল। সেলারের

দেয়ালে একটা লণ্ঠনের আলো পড়ল। প্রথমে একটা হাত এসে ঢুকল, এরপর পুরো শরীরটা।

মেঝেতে ঝুঁকে কী যেন খুঁজতে লাগল লোকটা। ধুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে দেখল। তার বামহাতে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স। তাতে কী যেন তুলে রাখছে সে। এরপর নিজের পায়ের ছাপ মুছে ফেলল সে। লুপাঁ আর স্বর্ণকেশী মহিলার পায়ের ছাপও মুছে দিলো। যে পথে ঢুকেছে, সেই পথেই বেরিয়ে যাচ্ছিল সে। ঠিক সে সময়ে একটা আর্তনাদ করে মেঝেতে পড়ে গেল হঠাৎ। মুহূর্তের মধ্যে শোমস ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপরে। অনায়াসে তাকে মেঝেতে আটকে ফেলল শোমস। হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। এরপর তার দিকে ঝুঁকে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বলল:

“কিছু বলার আছে তোমার?…যা জানো সেটা বলতে চাও?”

লোকটার মুখে ব্যঙ্গের হাসি ফুটল। শোমস বুঝল, এর পেটে বোম মেরেও লাভ নেই। লোকটার পকেটে হাত দিয়ে দেখল সে। কিছু চাবি, রুমাল আর কার্ডবোর্ডের বাক্স বাদে কিছু পাওয়া গেল না। বাক্সে আরো ডজনখানেক গার্নেট রয়েছে।

এখন এই লোককে কী করবে সে? ওর বন্ধুরা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে আর তারপর সবাইকে একসাথে পুলিশের হাতে তুলে দেবে? তাতে কী লাভ হবে ওর? লুপাঁকে ধরতে সুবিধা হবে এতে?

একটু দ্বিধায় পড়ে গেল ও। কিন্তু বাক্সটা একবার পরীক্ষা করেই সংশয় দূর হয়ে গেল ওর। বাক্সের গায়ে লেখা: ‘লিওনার্দ, গহনাকার, ক্য দ্য লা পেই।’

লোকটাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলো সে। এরপর সেলার আটকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পোস্ট অফিসে গিয়ে একটা টেলিগ্রাম দিলো মঁসিয়ে দেস্তাগেকে। জানালো, ঐদিন কাজে আসতে পারবে না সে। এরপর গেল গহনাকারের কাছে, তাকে গার্নেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল:

“মাদাম আমাকে এই পাথরগুলোসহ পাঠিয়েছেন। ওগুলো আবার বসাতে চান তিনি।”

আসল জায়গাতেই নাড়া দিয়েছে শোমস। গহনাকার জবাব দিলো : “নিশ্চয়ই। ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন আমাকে। বলেছেন, উনি আজকে আসবেন এখানে।

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মহিলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল শোমস। পাঁচটার সময়ে মুখের সামনে পর্দা টানা এক মহিলা এসে ঢুকল দোকানে। জানালা দিয়ে তাকালো শোমস। গার্নেট পাথর বসানো একটা অ্যান্টিক গহনা বের করে কাউন্টারে রাখল মহিলা।

প্রায় সাথে সাথেই চলে গেল মহিলাটি। দ্রুতপদে হাঁটছে সে, একের পর এক রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। হার্লকের কাছে এ রাস্তাগুলো অচেনা। প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে এখন। মহিলার থেকে একটু দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চলেছে সে। অবশেষে তার পিছে পিছে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং-এ ঢুকল সে। প্রতিটা ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট। সবগুলোতেই ভাড়াটিয়া আছে। তিনতলায় ঢুকে গেল মহিলা। ক্যু চ্যালগ্রিনে ধরা লোকটার কাছ থেকে পাওয়া চাবি দিয়ে দরজার তালা খোলার চেষ্টা করল হার্লক। চার নম্বর চাবিটা মিলে গেল।

রুমের অন্ধকার চোখে সয়ে আসার পর সে দেখল, রুমে কিছু নেই এখানে যেন কেউ থাকেইনি কখনো। রুমের দরজাগুলো খোলা থাকায় পুরো অ্যাপার্টমেন্টটাই চোখে পড়ছে তার। করিডরের শেষে একটা আলোর রেখা চোখে পড়ল তার। পা টিপে টিপে গিয়ে কাচের দরজার ওপাশে তাকালো সে। মহিলা তার পর্দা বসানো হ্যাট খুলে ফেলেছে। এখন তার পরনে একটা ভেলভেটের ড্রেসিং গাউন। ছেড়ে রাখা পোশাকগুলো রুমের একমাত্র চেয়ারে ফেলে রাখা। ম্যান্টেলের ওপরে একটা ল্যাম্প জ্বলছে।

ফায়ারপ্লেসের দিকে এগোলো মহিলা। সেখানে একটা ইলেকট্রিক বেলের বাটন রয়েছে সম্ভবত। ওতে চাপ দেয়ার সাথে সাথে সরে গেল ফায়ারপ্রেসটা। আস্তে করে চলে গেল পাশের প্যানেলের পেছনে। মাঝের জায়গাটা ফাঁক হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে অনায়াসেই একটা মানুষ যেতে পারবে এখন। ল্যাম্প হাতে মহিলাটা ঢুকে পড়ল সেখান দিয়ে।

শোমসের কাজ এখন খুবই সহজ। মহিলার পিছু নিলো সে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সেখানে। মুখে নরম কী যেন লাগল তার। একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে দেখে, খুবই ছোটো একটা রুমে এসে ঢুকেছে সে। তাতে আলখাল্লা আর পোশাক ঝুলছে হ্যাঙ্গারে। সামনে এগুতে লাগল সে। অবশেষে একটা দরজা পাওয়া গেল। সেটা পর্দা দিয়ে ঢাকা। উঁকি দিয়ে দেখল সে। স্বর্ণকেশী আছে সেখানে। চাইলে ওকে ছুঁতে পারবে এখন হার্লক।

ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো মহিলা। এই প্রথমবারের মতো তার মুখটাকে ভালো করে দেখতে পারল শোমস। যে মহিলার জন্য এত ঝামেলা করেছে, এত ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিয়েছে, সে আর কেউই নয়, ক্লোটিল্ডে দেস্তাগে

সে-ই তারমানে ব্যারন ডি’হটরেকের হত্যাকারী! নীল হীরা চুরিও তারই কাজ। আর্সেন লুপাঁর রহস্যময়ী বান্ধবী, সেই কুখ্যাত স্বর্ণকেশী মহিলা তারমানে ক্লোটিল্ডে দেস্তাগে!

“আমি আসলেই একটা গাধা,” ভাবল হার্লক। “লুপার বান্ধবীর চুল সোনালী আর ক্লোটিল্ডের চুল বাদামি বলে দুজনে যে একই মানুষ, এটা মাথাতেই আসেনি আমার। কিন্তু ব্যারনকে খুন করে তার হীরা চুরি করার পরেও ও চুলের রঙ বদলায়নি কেন?”

রুমের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছে শোমস। আলিশান একটা বেডরুম। রুচিশীল জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। একটা মেহগনির কাউচ দেখা গেল, সিল্ক দিয়ে সাজানো। শোমস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বিপরীতে রাখা আছে ওটা। সেই কাউচেই বসে আছে ক্লোটিল্ডে। নড়ছে না। দুই হাতে মুখ ঢেকে আছে সে। শোমসের মনে হলো, কাঁদছে মহিলা। তার ফ্যাকাশে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে ভেলভেটের পোশাকে পরল। টপটপ করে পড়ছে পানি, থামাতে পারছে না সে।

তার পেছনের একটা দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। ঘরে এসে ঢুকল লুপাঁ। নিজের উপস্থিতির জানান না দিয়ে মহিলার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। এরপর ওর কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলো। দুই হাতে ক্লোটিল্ডেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। নিখাদ ভালোবাসা আর দরদ প্রকাশ পাচ্ছে তাতে। কিছুক্ষণের জন্য কোনো কথা বলল না কেউই। তবে মহিলার কান্নার তোড় একটু কমলো।

“তোমাকে খুশি করার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি,” বিড়বিড় করে বলল সে।

“আমি তো খুশি।”

“না, তুমি কাঁদছ… ক্লোটিল্ডে, তোমার চোখের পানি দেখলে আমার বুকটা ভেঙে যায়।”

ওর নরম কণ্ঠে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেল ক্লোটিল্ডে। ও এমনভাবে লুপাঁর দিকে তাকালো যেন ও-ই একমাত্র ওকে আশা দিতে পারে, সুখ দিতে পারে। মুখে হালকা হাসি ফুটল ওর। সেই হাসিতেও চরম দুঃখের ছাপ! কোমল কণ্ঠে কথা চালিয়ে গেল লুপাঁ

“তুমি মন খারাপ কোরো না, ক্লোটিল্ডে। মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই তো।”

নিজের দীর্ঘ হাতগুলো তুলে ক্লোটিল্ডে বিমর্ষ কণ্ঠে বলল:

“ম্যাক্সিম, এই হাতগুলো যতদিন দেখব, ততদিন আমার মন খারাপ থাকবে।”

“কেন?”

“ওগুলো রক্তে মাখামাখি।”

“চুপ! একথা ভেবো না!” চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ। “যা হবার তা হয়ে গেছে। মৃত এই অতীতকে আর জাগিয়ে তুলো না।”

ওর দীর্ঘ, নরম হাতে আপ্লুত হয়ে চুমু খেল সে। মহিলার মুখে হাসি ফুটল। এক একটা চুম্বনে যেন ঐ ভয়াল স্মৃতি সরে যাচ্ছে তার কাছ থেকে।

“ম্যাক্সিম, আমাকে ভালোবাসতে হবে তোমার- কারণ, আমার মতো ভালোবাসা তুমি আর কারো কাছে পাবে না। তোমার জন্য অনেক কিছু করেছি আমি। তোমার আদেশ বা অনুরোধ হিসেবে নয়, সেগুলো মেনেছি তোমার গোপন ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য। আমি এমন কিছু কাজ করেছি যাতে বিবেক বাঁধ সেধেছে। কিন্তু কোনো এক অজানা ক্ষমতা আমাকে ওই কাজগুলো করিয়ে ছেড়েছে। তোমাকে সাহায্য করার জন্য, তোমাকে খুশি করার জন্য, অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেসব করেছি। তুমি চাইলে কালকেও এ কাজ করব আমি আজীবন করে যাবো। “

“আহারে, ক্লোটিল্ডে, কেন যে তোমাকে এই টানাপোড়েনের জীবনে জড়ালাম!” তিক্ত কণ্ঠে বলল লুপাঁ। “পাঁচ বছর আগে যে ম্যাক্সিম বারমন্ডকে ভালোবেসেছিলে, সেই লোকটি হয়ে থাকলেই ভালো হতো। আমার এই নতুন রূপ তোমাকে দেখানো উচিত হয়নি।”

নিচু স্বরে জবাব দিলো ক্লোটিল্ডে:

“এই মানুষটিকেও ভালোবাসি আমি। এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

“অবশ্যই আছে। আগের সুখী, স্বাধীন জীবনের কথা ভেবে আক্ষেপ করো তুমি।”

“তুমি এখানে থাকলে ওসব আক্ষেপের লেশমাত্র থাকে না আমার মধ্যে, “ আবেগপ্রবণভাবে বলল সে। “সব অপরাধ অদৃশ্য হয়ে যায় তোমাকে দেখলে। কিন্তু যখন তুমি থাকো না, তখন কষ্ট পাই আমি। যা করেছি তা ভেবে খুব কান্না আসে তখন। কিন্তু তুমি ফিরে এলে আর এসব কিছু মনে থাকে না। তোমার ভালোবাসা এর সবকিছুই মুছে দেয়। আর আমি আবার সুখী হয়ে যাই…কিন্তু আমাকে ভালোবাসতে হবে তোমার!”

“ক্লোটিল্ডে, তোমাকে তো বাধ্য হয়ে ভালোবাসি না আমি। তোমাকে ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসি।”

“তুমি ঠিক জানো?”

“আমি তোমার ভালোবাসা যেমন ঠিক বুঝি, আমার ভালোবাসাও তেমনি বুঝি। আমার জীবনটা খুব উত্তেজনায় ঘেরা বলেই কেবল তোমার সাথে সময় কাটাতে পারি না- এখনকার মতো।”

‘কী হয়েছে? নতুন কোনো বিপদে পড়েছ? বলো আমাকে!”

“আরে, তেমন কিছু না। শুধু…”

“শুধু কী?” জিজ্ঞেস করল সে।

“ও আমাদের আস্তানা পেয়ে গেছে।”

“কে? হার্লক শোমস?”

“হ্যাঁ। ওই হাঙ্গেরিয়ান রেস্টুরেন্টে গাঁইমার্দকে পাঠিয়েছিল। ক্য চ্যালগ্রিনের বাড়িতে দুই পুলিশকে পাঠানোও ওরই কাজ। আমার কাছে এর প্রমাণ আছে। গাঁইমার্দ পুরো বাড়ি খুঁজেছে আজকে। শোমস ওর সাথে ছিল। তাছাড়া—”

“তাছাড়া কী?”

“আমাদের এক লোককে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“কে?”

“জিনিউ।”

“বাড়ির দারোয়ানটা?”

“হ্যাঁ।”

“ওকে তো ক্যু চ্যালগ্রিনে পাঠিয়েছিলাম আমি। আমার ব্রুচ থেকে কিছু গার্নেট খসে গিয়েছিল, ওগুলো কুড়িয়ে আনার জন্য।”

“আমি নিশ্চিত শোমস ধরে ফেলেছে ওকে।”

“না, ওই পাথরগুলো ক্যু দ্য লা পেই এর গহনাকারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।”

“তাহলে ও কোথায় গেল?”

“ম্যাক্সিম! খুব ভয় করছে আমার!”

“আরে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু সত্যি বলছি, পরিস্থিতি খুবই ঘোরালো হয়ে উঠেছে। ও কী জানে? ও কেন লুকালো নিজেকে? নিজেকে লুকিয়েই বেশি এগিয়ে গেছে ও। ওর কাছে পৌঁছাতে পারছি না আমি।”

“কী করবে তুমি?”

“খুবই সাবধানে এগুতে হবে আমাকে। কিছুক্ষণ আগে ঠিক করেছি, নিরাপদ কোথাও থাকা শুরু করব আমি। শোমস যেহেতু ঐ বাড়ি চিনে ফেলেছে, নতুন জায়গায় এখনই যেতে হবে আমার। এরকম লোক পিছে লাগলে সবসময়ে বিপদের চিন্তা মাথায় রাখতে হয়। আমি আমার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামী পরশু, মানে বুধবার, সরে পড়ব আমি। দুপুর নাগাদ সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। দুইটার সময় ঐ বাড়ি ছাড়ব আমি, আর আমাদের শেষ চিহ্নটুকুও ঐ বাড়ি থেকে মুছে ফেলব। এসবই ছোটো কাজ। তার আগ পর্যন্ত-

“কী?”

‘আমাদের দেখা করা উচিত হবে না। ক্লোটিল্ডে, আপাতত বাইরে বেরিও না। নিজেকে নিয়ে ভয় নেই আমার, কিন্তু তোমার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাব।”

“ঐ ব্রিটিশ ভদ্রলোক আমাকে খুঁজে পাবে না।“

“সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ও খুবই বিপজ্জনক লোক। কালকে এখানে কাবার্ডের মধ্যে মঁসিয়ে দেস্তাগের কাগজপত্র আর রেকর্ড খুঁজতে এসেছিলাম আমি। তখন বিপদের ঝুঁকি ছিল। সবখানে বিপদের ঝুঁকি আছে। আমার মনে হচ্ছে ও আমাকে দেখছে আড়াল থেকে- আস্তে আস্তে নিজের পাতা জালটাকে ছোটো করে আনছে আমাদের চারপাশে। আমার এই ইন্দ্রিয় কখনো ভুল করে না।”

“সেক্ষেত্রে তুমি যাও, ম্যাক্সিম। আমার চোখের পানির কথা ভেবো না। আমি বুক বেঁধে অপেক্ষা করব তোমার জন্য। বিপদ কাটলে তবেই তুমি এসো।”

বিদায় জানিয়ে বহুক্ষণ একে অপরকে আলিঙ্গন করে রইল তারা। অবশেষে ক্লোটিল্ডেই তাকে সরিয়ে দিলো আস্তে করে। দূর থেকে তাদের কণ্ঠ কানে আসছে শোমসের।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে উৎসাহী হলো শোমস। নিজের তদন্তে সমাপ্তি টানার এখনই সুযোগ। যে বাড়িতে সে এসে ঢুকেছে, সে বাড়িটাকে একটু ভালোমতো দেখল সে। ক্লোটিল্ডের বেডরুম পেরিয়ে এসে ঢুকল একটা করিডরে। সেটার শেষ মাথা দিয়ে একটা সিঁড়ি চলে গেছে নিচতলায়। ঐ সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে, এরকম সময়ে নিচ থেকে কণ্ঠ এলো তার কানে। জলদি পথ বদলে ফেলল ও। এরপর গোলাকার করিডোর ধরে এগোলো। মঁসিয়ে দেস্তাগের লাইব্রেরিতে এসে ঢুকেছে সে।

“আরে চমৎকার!” উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল শোমস। “এখন সবকিছু বুঝতে পেরেছি আমি। মাদামোয়াজেল ক্লোটিল্ডের বেডরুম-স্বর্ণকেশী মহিলা— পাশের বাড়ির একটা রুমের মধ্যে গিয়ে যোগাযোগ করে ওর সাথে। আর ঐ বাড়ির মুখ প্লেস মারশার্বসে নয়, পাশের অন্য আরেক রাস্তায়। ক্য মন্টচ্যানিন নাম এটার সম্ভবত। এভাবেই ক্লোটিল্ডে দেস্তাগে দেখা করত তার প্রেমিকের সাথে। আর সবাই ভাবত সে বুঝি বাসা থেকেই বেরোয় না। আর্সেন লুপাঁও এই রহস্যময় উপায়েই গ্যালারিতে ঢুকেছিল কালকে রাতে। তারমানে ঐ লাইব্রেরি আর পাশের রুমের মাঝে আরো কোনো গোপন পথ আছে। আরেকটা অন্ধকার বাড়িতে গিয়ে পড়েছে গোপন পথগুলো। সেই বাড়ির স্থপতিও নিশ্চয়ই লুসিয়েন দেস্তাগেই! এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে আমার। কাবার্ডে কী আছে, তা দেখতে হবে। সেই সাথে মঁসিয়ে দেত্তাগের বানানো অন্য যে বাড়িগুলোর মাঝে গোপন পথ আছে, সেগুলোকেও বের করতে হবে।”

গ্যালারির দিকে সন্তর্পণে এগোলো শোমস। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখল নিজেকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত রইলো সেখানেই। অবশেষে এক চাকর এসে সব বাতি নিভিয়ে দিলো। ঘন্টাখানেক বাদে ব্রিটিশ ভদ্রলোক নিজের লণ্ঠনের আলো ধরে এগোলো কাবার্ডের দিকে। সে যেমনটা ভেবেছিল, আর্কিটেক্টের সকল পুরোনো নথিপত্র, ড্রয়িং, প্ল্যান আর নানা বইয়ের কথা লেখা কাগজ রয়েছে সেখানে। সিরিজ ধরে রেজিস্টারে লেখা আছে সেগুলো, তারিখ অনুযায়ী সাজানো রয়েছে সুন্দর করে। সবচেয়ে নতুন তারিখগুলো দেখল শোমস। সূচীপত্রের মাঝে ‘হার্মিনগিট’ নামটা খুঁজল। রেজিস্টারের ৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় রেফারেন্সসহ সে খুঁজে পেল সেটা। সেখানে লেখা:

‘হার্মিনগিট, ৪০ ক্যু চ্যালগ্রিন।’

সেটাতে ওই বাড়িতে একটা ফার্নেস বসানো সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। আর বইয়ের মার্জিনে কেউ লিখে রেখেছে: ‘অ্যাকাউন্ট অভ এম.বি. দেখুন।’

“আহ! সেটাই ভেবেছিলাম,” বলে উঠল শোমস। “অ্যাকাউন্ট অভ এম.বি.-ই তো চাই আমি। সেখান থেকেই মঁসিয়ে লুপাঁর আসল অবস্থান জানা যাবে।”

আগেরদিন সকালে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাউন্টটার ব্যাপারে জানতে পেরেছে সে। সেটা ষোলো পৃষ্ঠা সম্বলিত। ক্য চ্যালগ্রিনের মঁসিয়ে হার্মিনগিটের জন্য যে কাজ করা হয়েছে, তার বর্ণনা লেখা কাগজের একটা কপিও আছে এতে। আরেকটা কাগজে মঁসিয়ে ভ্যাটিনেলের জন্য করা কাজের বর্ণনা রয়েছে। তার বাড়ির ঠিকানা ২৫ র‍্য ক্ল্যাপেরন। আরেকটা কাগজ বরাদ্দ রয়েছে ব্যারন ডি’হটরেকের জন্য। ঠিকানা ১৩৪ অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউ। আরেকটা পৃষ্ঠায় শ্যাতো দ্য ক্রোজোনের কথা পাওয়া গেল। বাকি এগারোটা পৃষ্ঠাতেও প্যারিসজুড়ে অবস্থিত বিভিন্ন বাড়ির কথা লেখা।

দ্রুত এগারোটা বাড়ির নাম-ঠিকানার তালিকা করে ফেলল শোমস। বইগুলোকে তাদের জায়গায় রেখে দিলো। এরপর জানালা খুলে শূন্য রাস্তায় লাফিয়ে নেমে শাটারটা বন্ধ করে দিলো।

হোটেলের রুমে পৌঁছে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে নিজের পাইপ ধরালো সে। ধোঁয়ার মধ্যে অ্যাকাউন্ট অভ এম.বি. থেকে যা জেনেছে, তা থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যায়, তা ভাবতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে এটা ম্যাক্সিম বারমন্ড তথা আর্সেন লুপাঁর অ্যাকাউন্ট।

রাত আটটার সময়ে নিচের বার্তাটা গাঁইমার্দকে পাঠালো সে:

আজকে দুপুরে ক্যু পারগোলিজ পেরিয়ে যাবো আমি। এমন একজনের কথা জানাবো, যাকে গ্রেপ্তার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো অবস্থাতে আজকে রাত থেকে কাল দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকবেন এবং অন্তত ত্ৰিশ জন লোককে প্রস্তুত রাখবেন।

এরপর সামনের বুলেভার্দের স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটা গাড়ি পছন্দ করল সে। শোফার দেখে পছন্দ করল মূলত— লোকটা ভদ্র কিন্তু বোকা টাইপের। তাকে প্লেস ম্যালশার্বসে যেতে বলল সে। মঁসিয়ে দেস্তাগের বাড়ির একশো ফুট আগেই নেমে পড়ল সে।

“খোকা, গাড়িটা বন্ধ করে রাখো,” শোফারের দিকে তাকিয়ে বলল সে। “কোটের কলার তুলে দাও, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আর একটু দাঁড়াও। দেড় ঘন্টা পরে গাড়ি গরম করবে। আমি ফেরার পর ক্যু পারগোলিজে নিয়ে যাবে আমাকে।”

বাড়িটার দরজার দিকে সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে একটা সন্দেহ খেলল তার মনে। যেখানে আর্সেন লুপাঁ আবার গা ঢাকা দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, সেখানে স্বর্ণকেশী মহিলাকে নিয়ে সময় নষ্ট করাটা কি ভুল হচ্ছে তার? ওর কি তালিকার বাকি এগারোটা বাড়িতে গিয়ে ওর প্রতিপক্ষের আস্তানা খোঁজা উচিত না?

“নাহ,” নিজেকে বলল সে। “স্বর্ণকেশী মহিলাকে ধরতে পারলে পুরো পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

এরপর বেল বাজালো সে।

মঁসিয়ে দেস্তাগে লাইব্রেরিতে চলে গেছেন ইতিমধ্যেই। মাত্র কয়েক মিনিট তার সাথে কাজ করার পরেই ঘরে এসে ঢুকল ক্লোটিল্ডে। তার বাবাকে সুপ্রভাত জানিয়ে পাশের পার্লারে ঢুকে পড়ল সে। সেখানে বসে লেখা শুরু করল। নিজের জায়গা থেকে শোমস দেখল, টেবিলের ওপর ঝুঁকে লিখছে সে। আর মাঝে মাঝে কী যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ পরে একটা বই তুলে নিয়ে সে মঁসিয়ে দেস্তাগেকে বলল :

“এই বইটা মাদামোয়াজেল দেস্তাগে খুঁজে দিতে বলেছিলেন আমাকে।”

ছোটো পার্লারটাতে ঢুকে পড়ল সে। ক্লোটিল্ডের সামনে এমনভাবে দাঁড়ালো যাতে তার বাবা তাকে দেখতে না পায়।

“আমি মঁসিয়ে স্টিকমান, আপনার বাবার নতুন সেক্রেটারি।”

“আচ্ছা,” না নড়েই বলল ক্লোটিল্ডে, “আমার বাবা যে সেক্রেটারি বদলিয়েছে, জানতামই না সেটা।”

“জি, মাদামোয়াজেল। আর আপনার সাথে কিছু কথা আছে আমার।”

“দয়া করে বসুন, মঁসিয়ে। আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।”

নিজের চিঠিতে আরো কিছু কথা যোগ করল সে। এরপর তাতে সাইন করে খামে ভরে মুখ বন্ধ করল। নিজের লেখার সরঞ্জাম সরিয়ে টেলিফোন করল তার দর্জিকে। ভ্রমণের জন্য একটা পোশাক বানাচ্ছে সে, সেটা আরো দ্রুত বানানোর জন্য তাড়া দিলো। বলল, খুব জলদিই সেটা লাগবে তার। এরপর শোমসের দিকে ফিরে বলল :

“বলুন কী বলবেন, মঁসিয়ে। কিন্তু আগে আমার বাবার সাথে কথা বললে ভালো হতো না?”

“জি না, মাদামোয়াজেল। আর আপনাকে অনুনয় করে বলছি, দয়া করে গলা উঁচিয়ে কথা বলবেন না। মঁসিয়ে দেস্তাগের কানে আমাদের কথাগুলো না গেলেই ভালো হয়। “

“কার জন্য ভালো হবে সেটা?”

“আপনার জন্য, মাদামোয়াজেল।”

“আমার বাবা শুনবে না, এমন কোনো কথা আপনার সাথে বলতে রাজি নই আমি।”

“কিন্তু আপনাকে যে রাজি হতেই হবে। এ ছাড়া আর উপায় নেই।

চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। মহিলা বলল:

“বলুন, মঁসিয়ে।”

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শোমস বলল:

“ছোটোখাটো কোনো বিষয়ে আমার ভুল হলে মাফ করবেন। তবে আমার সব কথা মোটামুটি ঠিক থাকবে, এই গ্যারান্টি দিচ্ছি।”

“এইসব নিয়মনীতি বাদ দিয়ে সোজা কথায় চলে গেলে হয় না? নাকি এগুলো বলাও জরুরি?”

শোমস বুঝল, মহিলা একদম সতর্ক হয়ে আছে। তাই সে বলল:

“বেশ। সোজা কাজের কথায় আসছি তাহলে। পাঁচ বছর আগে জনৈক ম্যাক্সিম বারমন্ড নামে এক লোকের সাথে পরিচয় হয় আপনার বাবার। সে সম্ভবত নিজেকে কোনো কন্ট্রাকটর কিংবা আর্কিটেক্ট হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। মঁসিয়ে দেস্তাগে তাকে খুব পছন্দ করে ফেলেন। এদিকে নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তিনি অবসর নিতে বাধ্য হন। ফলে তার পুরোনো কাস্টমারদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু কাজ সম্পন্ন করার জন্য বারমন্ডকে দায়িত্ব দেন তিনি। মঁসিয়ে বারমন্ডের সামর্থ্যের মধ্যেই ছিল সেগুলো।”

থেমে গেল হার্লক শোমস। মহিলার ফ্যাকাশে মুখ আরো সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু পরের কথাটা বলার সময়ে তার গলা কাঁপল না একবিন্দুও:

“আপনি যে ঘটনার কথা বলছেন, তার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি, মঁসিয়ে। কীভাবে এটা আমার সাথে সম্পর্কিত, সেটাও বুঝছি না।”

“কারণ মাদামোয়াজেল, আমার সাথে সাথে আপনিও জানেন যে, এই ম্যাক্সিম বারমন্ডই বিশ্বজুড়ে আর্সেন লুপাঁ নামে পরিচিত।

হেসে ফেলল মহিলা।

“আর্সেন লুপাঁ? হাস্যকর কথাবার্তা! ম্যাক্সিম বারমন্ড কী করে আর্সেন লুপাঁ হয়? আরে না! এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়!”

“আপনাকে এই তথ্যটা জানাতে পেরে খুবই সম্মানিত বোধ করছি আমি। আর আমার কথার অর্থ যেহেতু বুঝতেই চাচ্ছেন না, সেহেতু এটাও বলি যে, আর্সেন লুপাঁ এই বাড়িতে তার প্রিয় এক বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য তাকে বন্ধু বললে ভুল হবে, সহযোগী বলা যায়। তার প্রতি অনুরক্ত, তার অন্ধভক্ত এক সহযোগী।”

“আপনার অভিযোগটা কী, তা আপনি বুঝতে পারছি না, মঁসিয়ে। তবে এই মুহূর্তে আপনাকে আর কোনো কথা না বলে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে আদেশ দিচ্ছি।”

কোনো আবেগ প্রকাশ পেল না মহিলার গলায়। অবাক হলো শোমস।

“আপনার এ বাড়িতে জোর করে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই আমার,” ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিলো শোমস। “তবে এই বাড়ি একা ছাড়ব না আমি।”

“কে থাকবেন আপনার সাথে?”

“আপনি।”

“আমি?”

“জি হ্যাঁ, মাদাময়জেল। এই বাড়ি থেকে একসাথেই বেরোবো আমরা। আর কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই আমার পিছে পিছে আসবেন আপনি। “

এই অদ্ভুত সাক্ষাৎকারে দুই পক্ষেরই নিরাবেগ, অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। এরকম শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারার কথা না। কিন্তু তাদের আচরণ আর কথার ধরনে পাশ দিয়ে কেউ গেলে ধরতেও পারবে না যে তাদের মাঝে কী ধরনের বাক্যালাপ চলছে। ভাববে, হালকা তর্ক হচ্ছে বুঝি।

হার্লক শোমসের শেষ কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের সিটে বসে রইল ক্লোটিল্ডে। হালকা কাঁধ ঝাঁকালো শুধু। শোমস নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল:

“এখন সাড়ে দশটা বাজে। আর পাঁচ মিনিট পরে বেরোবো আমরা।”

“হয়তো।”

“না হলে মঁসিয়ে দেত্তাগেকে গিয়ে বলে দেবো আমি।”

“কী বলবেন?”

“ম্যাক্সিম বারমন্ডের ভয়ানক জীবনের সকল কথা ফাঁস করে দেবো। তার সহযোগীর দ্বৈত জীবনের কথাও বলব।”

“তার সহযোগীর?”

“হ্যাঁ, স্বর্ণকেশী মহিলা নামে পরিচিত সে।”

“তাকে কী প্রমাণ দিতে পারবেন আপনি?”

“তাকে ক্য চ্যালগ্রিনে নিয়ে যাবো আমি। এরপর দেখাবো, আর্সেন লুপাঁর লোকেরা কীভাবে গোপন পথ বানিয়েছে সেখানে। ৪০ আর ৪২ নম্বর বাড়ির মাঝে কীভাবে পথ বানিয়েছে সে। যে পথ দু’দিন আগে ব্যবহার করেছেন আপনি আর ও।”

“তাতে কী?”

“এরপর ওনাকে মসিয়েঁ দেতিনাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবো আমি। গৃহকর্মীদের সিঁড়িটা বেয়ে নেমে দেখাবো। গাঁইমার্দের কাছ থেকে ঐ পথ দিয়েই পালিয়েছেন আপনি আর লুপাঁ। এরপর একসাথে পাশের বাড়িগুলো খুঁজব আমরা, যেটার মুখ বাতিগনোলে, ক্য ক্যাপেরনে নয়।”

“তো?”

“এরপর মঁসিয়ে দেস্তাগেকে শ্যাতো দ্য ক্রোজোনে নিয়ে যাবো আমি। কাজটা সোজাই হবে তার জন্য। শ্যাঁতোতে লুপাঁ যে রিস্টোরেশনের কাজ করেছে, তা কে না জানে। সেখানকার গোপন পথটা আবিষ্কার করব আমরা। এতে করে পরিষ্কার হবে যে, গভীর রাতে কাউন্টেসের ঘরে এসে ঢুকেছিল স্বর্ণকেশী মহিলা। ম্যান্টেল থেকে নীল হীরাটা এভাবেই নিয়ে গেছে সে। আর দুই সপ্তাহ পরে, একইভাবে, হার রেইকেনের ঘরে ঢুকে নকল হীরাটা তার টুথ-পাউডারের বোতলে রেখে দিয়েছে সে। অদ্ভুত কাজ করেছে এটা, মানছি প্রতিশোধবশত সম্ভবত। জানি না, জানার প্রয়োজনও বোধ করছি না।”

“তাতেই বা কী?”

“এরপর,” গম্ভীর হয়ে এসেছে হার্লকের কণ্ঠ। “মঁসিয়ে দেস্তাগেকে ১৩৪ অঁরি-মার্টিন অ্যাভিনিউতে নিয়ে যাবো আমি। আমরা জানব কীভাবে ব্যারন ডি’হটরেক-”

“না, না, চুপ করুন,” কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল মহিলা। হঠাৎ করেই যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সে। “খবরদার একথা বলবেন না!….আপনার এত বড় সাহস…..আপনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন?…”

“ব্যারন ডিইটরেককে হত্যার অভিযোগ তোলা হলো আপনার বিরুদ্ধে।”

“না, না, এসব মিথ্যা কথা।”

“আপনিই ওনাকে খুন করেছেন, মাদামোয়াজেল। আঁতোয়ানেত ব্ৰেহাত নাম দিয়ে ওনার বাড়িতে ঢুকেছেন।”

“চুপ করুন, মঁসিয়ে,” তাকে অনুনয় করে বলল মহিলা। “এতকিছু জানলে নিশ্চয়ই এটাও জানেন যে, আমি ব্যারনকে খুন করিনি।”

“আপনিই ওনাকে খুন করেছেন, তা তো বলিনি। ব্যারন ডি’হটরেক বরাবরই বাতিকগ্রস্থ ছিলেন। একমাত্র সিস্টার অগাস্টই তাকে সামলাতে পারতেন। উনি নিজেই বলেছেন আমাকে একথা। তার অনুপস্থিতিতে উনি নিশ্চয়ই আক্রমণ করেছিলেন আপনাকে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যই ওনার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে বাধ্য হন আপনি। জানের দায়ে বাড়ি মেরে বসেন তাকে। পরিস্থিতি ভয়ানক দেখে বেল বাজিয়ে নীল হীরাটা ভিক্টিমের আঙুল থেকে না নিয়েই চলে যান আপনি। কয়েক মিনিট পরে ফিরে আর্সেন লুপাঁর এক সহযোগীকে নিয়ে। পাশের বাসায় কাজ করত সে। ঘরে ঢুকে সবকিছু গুছিয়ে দেন আপনি, ব্যারনকেও খাটে তুলে দেন। কিন্তু নীল হীরাটা চুরি করতে ভয় পেয়েছিলেন আপনি। এখন আমি বলি, কী ঘটেছিল ঐদিন রাতে। আবার বলছি, আপনি ব্যারনকে খুন করেননি। কিন্তু আপনার হাত দিয়েই আঘাতটা করা হয়েছিল।”

দুই হাত কপালে চেপে ধরল ক্লোটিল্ডে। দীর্ঘ ফর্সা আঙুলওয়ালা সেই হাত। এভাবে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর আঙুল আলগা করে এক বুক আক্ষেপ নিয়ে বলল:

“আর এসবকিছু আমার বাবাকে বলে দেবেন আপনি?”

“জি। সাক্ষী হিসেবে কারা কারা আছেন সেটাও বলব- মাদামোয়াজেল গার্বোই, স্বর্ণকেশী মহিলাকে চিনবে সে; সিস্টার অগাস্ট, আঁতোয়ানেত ব্রেহাতকে চিনবেন তিনি; আর কাউন্টেস ডি ক্রোজোন, মাদাম ডি রিয়েলকে চিনবে সে। এইসব কথা তাকে বলব আমি।”

“খবরদার ভুলেও একথা বলবেন না,” আসন্ন বিপদের মুখে পড়ে রেগে গেছে যেন।

উঠে দাঁড়াল শোমস। লাইব্রেরির দিকে এগোলো এক পা। ক্লোটিল্ডে থামাল তাকে:

“এক সেকেন্ড, মঁসিয়ে।”

একটু থেমে এক মুহূর্ত চিন্তা করল সে। এরপর শান্ত কণ্ঠে বলল:

“আপনি হার্লক শোমস?”

“জি।”

“আমার কাছে কী চান আপনি?”

“আমি কী চাই? আর্সেন লুপাঁর সাথে এক দ্বৈরথে লড়ছি আমি। আর আমাকে এতে জিততেই হবে। এই প্রতিযোগিতা এখন ক্লাইম্যাক্সের পর্যায়ে। আর আপনার মতো মূল্যবান এক জিম্মিকে হাতে পেলে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে যাবো আমি। তাই আমার সাথে আসবেন আপনি। আপনাকে আমার এক বন্ধুর হাতে তুলে দেবো আমি। দ্বৈরথ শেষ হবার সাথে সাথে আবার এই লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো আপনাকে।”

“এটুকুই?”

“এটুকুই। আমি এই দেশের পুলিশের সাথে যুক্ত নই। তাই আপনাকে গ্রেপ্তার করার অধিকার আমার আছে বলে মনে হয় না।”

মহিলা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল প্রায়- তারপরেই থমকে গেল হঠাৎ চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগে ভাবার চেষ্টা করল সে। অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো শোমস। মহিলার মুখে শান্তিপূর্ণ একটা ভাব নেমে এসেছে- আসন্ন বিপদের জন্য কোনো শঙ্কার লেশমাত্র নেই সেখানে। ও কি জানে যে ও বিপদে আছে? মনে হয় না। লুপাঁর ওপর অগাধ বিশ্বাস ওর। নিশ্চয়ই ভাবছে, লুপাঁ তার অসীম ক্ষমতা দিয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে তাকে।

“মাদামোয়াজেল, পাঁচ মিনিটের মাঝে বেরিয়ে যাবার কথা ছিল আমাদের। সেই সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।”

“আমাকে আমার ঘরে যেতে দেবেন? কিছু জরুরি জিনিস নেবার দরকার ছিল।”

“অবশ্যই, মাদামোয়াজেল। আর আপনার জন্য ক্য মন্টচ্যানিনে অপেক্ষা করব আমি। জিনিউ আমার একজন বন্ধুমানুষ।“

“ওহ! আপনি জানেন…” চিন্তার ছাপ পড়ল মহিলার মুখে।

“অনেক কিছুই জানি আমি।”

“খুব ভালো। গৃহকর্মীকে ডাকছি আমি।”

কাজের মেয়ে এসে তার হ্যাট আর জ্যাকেট দিয়ে গেল তাকে। এরপর শোমস বলল:

“আমাদের যাবার কারণ হিসেবে কিছু বলে যান মঁসিয়ে দেস্তাগেকে। সম্ভব হলে এমন কোনো কারণ দেখাবেন যাতে কয়েকদিনের অনুপস্থিতিতেও উনি সন্দেহ না করেন। “

“তার দরকার হবে না। খুব দ্রুতই ফিরব আমি।”

একে অপরের দিকে দিকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল দুজন। মুখে ব্যঙ্গের হাসি।

“কী নিখাঁদ বিশ্বাস আপনার ওর ওপরে!”

“অসীম বিশ্বাস।”

“ও সবকিছু ভালোভাবেই করে, তাই না? যে কাজ করে, তাতেই সফল হয়। আর সবসময়ে আপনার কাছ থেকে সহযোগিতা আর প্রশংসা অর্জন করে।“

“আমি ওকে ভালোবাসি,” বলতে গিয়ে আবেগে গলা কেঁপে গেল ক্লোটিল্ডের।

“আর আপনার ধারণা, ও এসে বাঁচাবে আপনাকে?”

কাঁধ ঝাঁকালো মহিলা। বাবার দিকে এগিয়ে বলল :

“মঁসিয়ে স্টিকমানকে নিয়ে গেলাম, বাবা। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাচ্ছি আমরা।”

“দুপুরে খাবার জন্য ফিরবি তো?”

“হয়তো…না-ও ফিরতে পারি…কিন্তু চিন্তা কোরো না।”

এরপর শোমসের দিকে ফিরল সে। দৃঢ়কণ্ঠে বলল:

“কী করবেন, করুন, মঁসিয়ে।”

“যা ইচ্ছা তাই করব?”

“নিশ্চয়ই।”

“আপনাকে সাবধান করে একটা কথা বলি। কোনোভাবে পালানোর চেষ্টা করলে আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবো আমি। ভুলে যাবেন না যে আপনাকে খুঁজছে পুলিশ।”

“পালানোর চেষ্টা করব না আমি, কথা দিচ্ছি।”

“বিশ্বাস করলাম। এখন চলুন।”

একসাথে বাড়ি থেকে বেরোলো দুজনে। শোমসের কথামতো।

গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে জায়গামতোই। ওটার দিকে এগিয়ে মোটরের গর্জন শুনতে পেল শোমস। দরজা খুলে ক্লোটিল্ডেকে উঠতে বলল। এরপর তার পাশে গিয়ে বসলো। গাড়ি চালু হয়ে গেল সাথে সাথেই। বুলেভার্দ থেকে বেরিয়ে হচ অ্যাভিনিউ আর ডে লা গ্রান্দে-আর্মি অ্যাভিনিউ ধরে ছুটতে লাগল। নিজের পরিকল্পনাটা খতিয়ে দেখল শোমস। ভাবল:

“গাঁইমার্দ তো এখন বাসায়। মেয়েটাকে তার কাছে রেখে যাবো নাহয়। কিন্তু ওকে কি মেয়েটার পরিচয় দেয়া ঠিক হবে? না, তাহলে মেয়েটাকে জেলে ভরবে ও। এতে নষ্ট হবে সবকিছু। একা হয়ে নাহয় এম.বি. অ্যাকাউন্টের বাড়িগুলো দেখব আমি। আজকে রাতে, কিংবা কালকে সকালে গাঁইমার্দের কাছে গিয়ে আর্সেন লুপাঁ আর তার দলবলকে ধরিয়ে দেবো আমি, যেমনটা কথা ছিল।”

খুশিতে দুই হাত ঘষল সে। লুপাঁর সাথে ওর লড়াই প্রায় শেষের পথে। সাফল্যের পথে আর কোনো বাধা দেখতে পাচ্ছে না সে। কিছুটা দায়িত্বজ্ঞানশূন্যভাবেই নিজের আবেগটা প্রকাশ করে ফেলল সে। কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে বলল:

“আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে কিছু মনে করবেন না, মাদামোয়াজেল। খুবই দুরূহ এক লড়াই ছিল এটা। সফল হয়ে তাই একটু বেশিই ভালো লাগছে।”

“আসলেই দারুণ সাফল্য এটা, মঁসিয়ে। এজন্য তো গর্বিত হওয়াই উচিত আপনার।”

“ধন্যবাদ, কিছু কোথায় যাচ্ছি আমরা? শোফার মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারেনি।

সে মুহূর্তে তারা প্যারিস ছেড়ে গেট দ্য নেউইর দিকে আগাচ্ছে। কী অদ্ভুত। ক্যু পারগোলিজ তো প্যারিসের বাইরে না। গাড়ির কাচ নামালো শোমস। বলল :

“শোফার, ভুল হচ্ছে আপনার… পারগোলিজে চলুন।”

কোনো জবাব দিলো না লোকটা। শোমস আবার গলা উঁচিয়ে বলল:

“আপনাকে তো ক্যু পারগোলিজে যেতে বলেছিলাম আমি।”

এরপরেও জবাব দিলো না লোকটা।

“ও আচ্ছা! আপনি মনে হয় কানে শোনেন না! নাকি উনি ইচ্ছা করেই করছেন এ কাজ? আমরা পথ ভুল করে ফেলেছি…রু পারগোলিজে যেতে হবে!…গাড়ি এক্ষুণি ঘুরান…ক্য পারগোলিজ!”

এবারেও শোফার কথাটা শুনল বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ ভদ্রলোক এবার অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ক্লোটিল্ডের দিকে তাকালো সে। অদ্ভুত হাসি ফুটেছে তার মুখে।

“আপনি হাসছেন কেন?” বলল সে। “হাস্যকর একটা ভুল হয়েছে বটে, কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না আপনার। “

“তা তো ঠিকই,” জবাব দিলো মহিলা।

এরপর শোমসের মাথায় একটা চিন্তা আসল। উঠে ভালোমতো শোফারকে নিরীখ করল সে। এই লোকের কাঁধ অতোটা চওড়া নয়, হাবভাবও অতোটা নির্বিকার নয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো শোমসের। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল ভয়ে। সে মোটামুটি নিশ্চিত যে এই শোফার আর্সেন লুপাঁ বাদে কেউ নয়। “তো মঁসিয়ে শোমস, আমাদের এই ছোট্ট ভ্রমণটা কেমন লাগল আপনার?”

“খুব আনন্দ পেলাম, মঁসিয়ে, বলাই বাহুল্য।”

গলার কাঁপুনি ঢেকে কথা বলার জন্য, কিংবা নিজের মনের ভাব ঢেকে রাখার জন্য কখনো এতোটা কষ্ট করতে হয়নি শোমসকে। তবে দ্রুতই সব বাঁধ ভেঙে একগাদা রোষ আর ঘৃণা তার আত্ম-নিয়ন্ত্রণকে গ্রাস করে নিলো। সোজা পিস্তল বের করে মাদাময়জেল দেস্তাগের কপালে ধরল সে।

“লুপা, গাড়ি থামাও এক্ষুণি। নইলে কিন্তু আমি মাদামোয়াজেলকে গুলি করব।”

“কপালে গুলি লাগাতে চাইলে গালে তাক করার পরামর্শ রইল,” মাথা না ঘুরিয়েই জবাব দিলো লুপাঁ।

“ম্যাক্সিম, একটু আস্তে চালাও,” বলল ক্লোটিল্ডে। “রাস্তা একদম পিচ্ছিল হয়ে আছে, আমার একটু ভয় ভয় করছে।”

মুখে হাসি ফুটেছে তার। চোখগুলো নিবদ্ধ হয়ে আছে রাস্তার দিকে। সেখান দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে গাড়ি।

“ওকে থামান! থামান বলছি!” তার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি! আমি কিন্তু এখন মরিয়া!”

রিভলবারের ব্যারেলটা ছুঁয়ে গেল তার ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে। সে শান্ত কণ্ঠে বলল:

“ম্যাক্সিমের খুব মাথা গরম। এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে ও, অ্যাক্সিডেন্ট না হয়ে যায়।”

পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে দরজার হাতল ধরে টান দিলো শোমস। এমন ভাব যে এতেই খুলে যাবে ওটা। এমন হাস্যকর কাজ সত্ত্বেও ক্লোটিল্ডে ওর দিকে তাকিয়ে বলল:

“সাবধান, মঁসিয়ে। আমাদের পিছে একটা গাড়ি আসছে।”

ঝুঁকে তাকালো শোমস। অল্প দূরত্ব রেখে একটা গাড়ি অনুসরণ করছে তাকে। রক্তলাল রঙের বিশাল এক গাড়ি, আগাটা ধারালো। তাতে ফারের কোট পরা চারজন বসে আছে।

“বাহ, ভালোই পাহারাদার জুটেছে আমার। একটু ধৈর্য ধরি তাহলে।”

দুই হাত ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখল সে। নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়েছে যেন। ভাগ্য বিপক্ষে গেলে এমনই করে গল্প-উপন্যাসের হিরোরা। সিন নদী পেরিয়ে সুরেইন, রুয়েইল আর শ্যাঁতো দিয়ে যাবার সময়ে নিজেকে সামলে চিন্তা করতে লাগল শোমস। কোন আশ্চর্য উপায়ে লুপাঁ এখানে চলে এলো, তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করল সান্ত্বনাস্বরূপ। আজ সকালে ও যে ভোলাভালা গোছের শোফারটাকে জোগাড় করেছিল, সে লুপাঁর দলের কেউ বলে মনে হয় না। তারপরেও কোনোভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল লুপাঁ। ক্লোটিল্ডের কাছে শোমস যখন গিয়েছে, তার পরেই সম্ভবত এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে সে। কারণ এর আগে ওর প্রজেক্টের কথা ঘুণাক্ষরেও কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। তারপর থেকে তো কখনোই ক্লোটিল্ডেকে চোখের আড়াল করেনি শোমস।

এরপর একটা কথা মাথায় এলো ওর: ক্লোটিল্ডে একবার তার দর্জিকে ফোন করেছিল বটে। এবার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। মেয়েটার সাথে মঁসিয়ে দেস্তাগের সেক্রেটারি সেজে কথা বলার সময়েই বিপদ আঁচ করে ফেলেছিল সে। তার উদ্দেশ্য টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিত্যদিনের প্রাত্যাহিক একটা কাজ করার ভান করে সে খবর দিয়ে দিয়েছে আর্সেন লুপাঁকে। এরকম সাংকেতিক ভাষায় কথা বলার ব্যাপারটাও নিশ্চয়ই আগে থেকেই ঠিক করা।

আর্সেন লুপাঁ কীভাবে শোফারের জায়গা নিলো, সেটা অবশ্য খুবই তুচ্ছ বিষয়। এই মুহূর্তে শোমসের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এই সাধারণ ভদ্রমহিলার কথা ভেবে। আপাতদৃষ্টিতে মিষ্টভাষী এই মহিলা কীভাবে তার স্নায়ুকে শক্ত রেখে, চোখের দৃষ্টিকে আড়াল করে হার্লক শোমসের মতো চতুর গোয়েন্দাকে বোকা বানিয়ে দিলো, সেটা ভাবতে গিয়ে উল্টো সব রাগ দমে যাচ্ছে তার। এরকম একজন প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করা তো আসলেই দুঃসাধ্য। প্রচুর লোককে সে নিজের পক্ষে নিয়েছে, আর একজন ভদ্রমহিলাকে এরকম স্নায়ুক্ষয়ী মুহূর্তেও তীব্র সাহসের পরিচয় দিতে অনুপ্রাণিত করেছে।

সিন নদী পেরিয়ে সেইন্ট-জার্মেইনের পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল তারা। শহর পেরিয়ে পাঁচশো মিটার যাবার পরে গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এলো। অন্য গাড়িটা পেরিয়ে গেল এটাকে। একটু পরে পাশাপাশি থেমে গেল দুটো গাড়ি। আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

“মঁসিয়ে শোমস, দয়া করে ঐ গাড়িতে উঠে পড়ুন,” বলল লুপাঁ। “আমাদের গাড়ির গতি অনেক কম।”

“বেশ!” শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো শোমস। জানে, ওর হাতে অন্য কোনো উপায় নেই।

“আপনাকে একটা ফারের কোট নিতে অনুরোধ করছি। গাড়িটা অনেক জোরে চলবে, ঠাণ্ডা বাতাসে কষ্ট হবে। আর কিছু স্যান্ডউইচ খেয়ে নিন, রাতের খাবার কখন খাওয়া হবে, তা আপাতত বলা যাচ্ছে না।”

“অন্য গাড়ি থেকে নেমে পড়ল চারজন লোক। তাদের একজন এগিয়ে এসে গগলস খুলল। তাকে দেখামাত্র চিনল শোমস। এই লোকই ফ্রক কোট পরে গিয়েছিল হাঙ্গেরিয়ান রেস্টুরেন্টে। লুপাঁ তাকে বলল:

“যে শোফারের কাছ থেকে এটা ভাড়া নিয়েছি, তাকে এটা ফিরিয়ে দেবে তুমি। ক্য লিজেন্দ্রে দিয়ে ওঠার পথে প্রথম ওয়াইন শপে আছে সে। তাকে হাজার ফ্রাঁ দেবার কথা আছে…আর দয়া করে তোমার গগলসটা মঁসিয়ে শোমসকে দাও।”

মাদামোয়াজেল দেস্তাগের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল সে। এরপর গাড়ি

চালানো শুরু করল। শোমসকে বসালো তার পাশে। আর তার একজন লোক বসলো পেছনে। ‘গাড়ি জোরে চলবে’ বলে অত্যুক্তি করেনি লুপাঁ। শুরু থেকেই তুফানের গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো সে। কোনো রহস্যময় শক্তির জোরে দিগন্ত যেন ছুটে চলে আসলো তার চোখের সামনে। এরপর তাদেরকে গিলে নিলো অতল গহ্ববরের মধ্যে। বাড়ি-ঘর, মাঠ, বন, প্রান্তর পেরিয়ে তারা ছুটে চলল প্রবল ঢেউয়ের গতিতে, এখনই কোনো জলপ্রপাতে গিয়ে মিশবে যেন।

শোমস আর লুপাঁর মধ্যে একটা কথাও হলো না। তাদের মাথার ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই করে পেরিয়ে যাওয়া গাছের পাতাগুলোর শনশন শব্দ শুনে উত্তাল সাগরের ধ্বনির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গাছগুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে রয়েছে বলে শব্দটায় একটা নির্দিষ্ট তাল রয়েছে যেন। একের পর এক শহর পেরিয়ে যেতে লাগল তারা: মাতেও, ভার্নন, গেইলন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ছুটে চলল— বন সেকুউ, ক্যান্টালু, রুয়া। এই গ্রাম দিয়ে যাচ্ছে, এই বন্দর, তারপরেই মাইলের পর মাইল নদীর ঘাট। রুয়াঁকে দেখে কোনো গ্রামের পথভ্রষ্ট রাস্তা বলে মনে হলো। তারপর আছে ডুক্লেয়ার, কদেবেক,

কু কাউন্টি তীরের বেগে সবকিছু পেরিয়ে চলল তারা। এরপর এলো লিলেবোঁ, কিলিবাফ। হঠাৎ করে নিজেদেরকে সিন নদীর এক ঘাটের একদম প্রান্তে আবিষ্কার করল তারা। সেখানে একটা জলরোধী ইয়ট দাঁড়িয়ে রয়েছে, এখনই সমুদ্রে নামতে প্রস্তুত। সেটার ফানেল থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

থেমে গেল গাড়িটা। দুই ঘন্টায় মনে হয় একশো বিশ মাইল পার করে ফেলেছে তারা।

নীল ইউনিফর্ম আর সোনালি লেস দেয়া ক্যাপ পরা এক লোক এগিয়ে এসে স্যালুট দিলো। লুপাঁ তাকে বলল :

“সব প্রস্তুত, ক্যাপ্টেন? আমার টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন?”

“জি, পেয়েছি।”

“দ্য সোয়ালো কি প্রস্তুত আছে?”

“জি, মঁসিয়ে।”

“আসুন, মঁসিয়ে শোমস।”

আশেপাশে তাকালো শোমস। ক্যাফের সামনের বারান্দায় একদল লোককে দেখা যাচ্ছে। একটু দ্বিধা করল সে। এরপর বুঝল, কোনো সাহায্য পাওয়ার আগেই তাকে ধরে ইয়টের ভেতরে ভরে ফেলা হবে। গ্যাং-প্ল্যাঙ্ক পেরিয়ে লুপাঁর পিছে পিছে ক্যাপ্টেনের কেবিনে ঢুকল সে। রুমটা বেশ বড়, ঝকঝকে পরিষ্কার। বার্নিশ করা কাঠের কাজ আর পলিশ করা পেতল দেখে উৎসব উৎসব লাগছে। দরজা লাগিয়ে শোমসের দিকে চেয়ে কঠিনস্বরে লুপাঁ বলল:

“তো, কী কী জানেন আপনি?”

“সবকিছু জানি।”

“সবকিছু? প্লিজ, নির্দিষ্ট করে বলুন।”

তার কথাবার্তা থেকে আগের সেই ভদ্র, কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ভাবটা চলে গেছে পুরোপুরি। এখন তার কথা শুনে মনে হবে, একজন মনিব তার চাকরের সাথে কথা বলছে। এমনকি হার্লক শোমস হলেও তার কথা মানতে হবে তাকে। একে অপরের মুখভঙ্গি পড়ার চেষ্টা করল দুজনে। এখন তারা শত্রু- এসব আর রাখঢাকের কোনো প্রয়োজন নেই। লুপাঁই মুখ খুলল প্রথমে। কিছুটা নরম সুরে বলল:

“আপনার তাড়া খেতে খেতে আমি ক্লান্ত। আপনার পাতা ফাঁদগুলো এড়ানোর পেছনে আর কোনো সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। আপনাকে সাবধান করে বলি, এখন যা জবাব দেবেন, তার ওপর ভিত্তি করে আমি আপনার ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো। এখন বলুন, আপনি কী জানেন?”

“আমি সবকিছুই জানি, মঁসিয়ে।

নিজের রাগ দমন করল লুপাঁ। এরপর শ্রাগ করে বলল:

“আমি বলছি কী কী জানেন আপনি। আপনি জানেন যে, ম্যাক্সিম বারমন্ড নাম নিয়ে আমি পনেরো বাড়ি সংস্কার করেছি, যেগুলোর কাজ মঁসিয়ে দেস্তাগের করার কথা ছিল।”

“হ্যাঁ।”

“সেই পনেরোটা বাড়ির মধ্যে চারটা বাড়ি দেখা হয়েছে আপনার।

“ঠিক বলেছেন।”

“সন্দেহ নেই, সেই লিস্টটা আপনি পেয়েছেন মঁসিয়ে দেস্তাঁগের বাড়িতে।”

“হ্যাঁ।”

“আর বাকি এগারোটা বাড়িরও তালিকা আছে আপনার কাছে।

“ঠিক।”

“আপনার কি কোনো ধারণা আছে যে, এই এগারোটা বাড়ির মধ্যে একটা বাড়ি আমি আমার এবং আমার বন্ধুদের জন্য রেখেছিলাম। আর আপনি গাঁইমার্দকে আমার সেই গোপন আস্তানায় পাঠিয়েছেন।”

“না।”

“এতে কী প্রমাণিত হয়?”

“এতে প্রমাণিত হয় যে আমি একা কাজ করতে পছন্দ করি। ওর সাহায্য চাই না।”

“তাহলে আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি তো আমার হাতের মুঠোয় চলেই এসেছেন।”

“আমি যতক্ষণ আপনার হাতে থাকব, ততক্ষণ আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। “

“তারমানে বলতে চাচ্ছেন যে, আপনি আমার হাতের মুঠোয় থাকবেন না?”

“না, থাকব না।”

ব্রিটিশ ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেল লুপাঁ। তার কাঁধে হাত রেখে বলল :

“শুনুন, মঁসিয়ে। আপনার সাথে তর্ক করার মতো মেজাজ নেই এখন আমার। আর দুর্ভাগ্যবশত, আপনারও এখন বেছে নেয়ার সুযোগ নেই। তাই আগে আমাদের কাজ শেষ করতে দিন।”

“বেশ।”

“আপনি আমাকে কথা দিন যে, ইংল্যান্ডের জলসীমায় পৌঁছানোর আগে আপনি এই জাহাজ থেকে পালানোর চেষ্টা করবেন না।”

“আমি কথা দিচ্ছি যে, সুযোগ পাওয়ামাত্র আমি জাহাজ থেকে পালানোর চেষ্টা করব,” উদ্ধত ভঙ্গিতে জবাব দিলো হার্লক।

“হায়রে খোদা! আপনি খুব ভালোমতোই জানেন যে, আমার মুখের একটা কথাতেই আপনাকে একটা মমি বানিয়ে ফেলা হবে। এই লোকেরা আমাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। আমার হাতের একটা ইশারাতেই আপনাকে শিকল পরাবে ওরা—”

“শিকল তো ভাঙা যায়।”

‘তারপর আপনাকে তীর থেকে দশ মাইল দূরের পানিতে ফেলে দেবে।”

“আমি তো সাঁতরাতে পারি।”

“তাই নাকি? আমি তো ভাবিইনি একথা,” হেসে বলল লুপাঁ। “মাফ করবেন…আগে কথাটা শেষ করে নেই। পুরোটা শুনলে বুঝবেন যে, নিজেকে এবং নিজের বন্ধুদের রক্ষা করার জন্য লৌহকঠিন ব্যবস্থা নিতে পারি আমি।”

“বেশ, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোনো লাভ হবে না।”

“তারপরেও আপনি এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে চাইবেন না নিশ্চয়ই।”

“আমাকে আটকানো তো আপনার দায়িত্ব। কিছু করার নেই।”

“বেশ তাহলে।“

দরজা খুলে ক্যাপ্টেন আর দুই নাবিককে ডাকল লুপাঁ। নাবিক দুজন এসে চেপে ধরল হার্লককে। এরপর তার হাত-পা বেঁধে ফেলে তাকে ক্যাপ্টেনের বাংকের সাথে আটকে দিলো।

“এতেই চলবে। আপনার একগুঁয়েমি আর ঘোরালো পরিস্থিতির কারণেই আপনার সাথে এরকম অপমানজনক আচরণ করতে হচ্ছে আমাদেরকে।

চলে গেল নাবিক দুজন। ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরল লুপাঁ:

“একজন ক্রুকে মঁসিয়ে শোমসের দেখাশোনার জন্য রাখুন এখানে। আপনিও চাইলে ওনাকে যতক্ষণ খুশি সঙ্গ দিতে পারেন। ওনাকে যথাযোগ্য সম্মান এবং গুরুত্ব দেবেন। মনে রাখবেন, উনি আমাদের বন্দী নন, অতিথি। কয়টা বাজে, ক্যাপ্টেন?”

“দুইটা পাঁচ।”

“নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো লুপাঁ, এরপর কেবিনের দেয়ালে আটকানো ঘড়িটার দিকে তাকালো।

“ঠিকই আছে। সাউদাম্পটনে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে আপনার?”

“সব ঠিক থাকলে নয় ঘন্টা লাগবে।”

“এগারো ঘন্টা লাগিয়ে যাবেন আপনি। মাঝরাতের জাহাজটা চলে গেলে তবেই নোঙর ফেলবেন ওখানে। আজকে সকাল আটটায় হাভ্রেতে পৌঁছেছে সেটা। বুঝেছেন, ক্যাপ্টেন? আবার বলছি: মঁসিয়ে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসতে পারে ঐ জাহাজে চড়ে। এ ঝুঁকি নিতে পারব না আমরা। রাত একটার আগে ভুলেও সাউদাম্পটনে পৌঁছাবেন না আপনি।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“বিদায়, মাস্টার; দেখা হবে আগামী বছর, এই দুনিয়ায় কিংবা অন্য কোনো দুনিয়ায়।”

“কালকে দেখা হবে,” জবাব দিলো শোমস।

কয়েক মিনিট পরে গাড়িটা চলে যাবার শব্দ পেলো শোমস। ঠিক একই সময়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এলো ‘দ্য সোয়ালো’র নিচ থেকে। ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে জাহাজ। ঠিক তিনটা বাজে নদী পেরিয়ে সাগরের বুকে গিয়ে নামল জাহাজটা। সেসময় ক্যাপ্টেনের বাংকে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল শোমস।

পরের দিন সকাল। শোমস আর লুপাঁর দ্বৈরথের দশম ও শেষ দিন। একো দ্য ফ্রান্স -এ একটা মজার সংবাদ ছাপা হলো:

বিখ্যাত ব্রিটিশ গোয়েন্দা হার্লক শোমসের সাথে আর্সেন লুপাঁর কেস থেকে একজনকে বিচারের মাধ্যমে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। দুপুরবেলা সাক্ষর করা হলেও বিচারটা সমাধা হয়েছে ওদিনই। আজকে রাত ১টায় শোমস গিয়ে সাউদাম্পটনে নামবেন।