১. দ্য জুইশ ল্যাম্প

অধ্যায় এক – দ্য জুইশ ল্যাম্প

জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসের সামনে আরামকেদারায় বসে আছে হার্লক শোমস আর উইলসন, পা জোড়া মেলে দেয়া কয়লার আগুনের আরামদায়ক উষ্ণতার দিকে।

রুপালি ব্যান্ডঅলা শোমসের খাটো ব্রায়ার পাইপটা নিভে গেছে। পাইপের ছাই ঝেড়ে আবার ও ভরে নিল ওটা, তারপর আগুন জ্বেলে হাঁটুর উপর তুলে নিল পরনের ড্রেসিং গাউনের প্রান্ত। রিঙের আকারে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে লাগল ছাদের উদ্দেশে।

এমনভাবে ওর দিকে চাইল উইলসন, ঠিক যেভাবে আগুনের সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কুকুর আশাহীন ড্যাবডেবে চোখে তাকায় তার প্রভুর দিকে। মালিকের ইঙ্গিত মেনে চলা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা থাকে না যে চোখের দৃষ্টিতে। শোমস কি নীরবতা ভাঙবে? উইলসনের কাছে প্রকাশ করবে ওর ভাবালুতার বিষয় সম্পর্কে? নিজের জাদুময় চিন্তার জগতে কি স্বাগত জানাবে ওর নিত্য সঙ্গীকে?

কিন্তু আরও কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় রাখল শোমস। সেজন্য উইলসনকেই শুরু করতে হলো।

“সব কিছুই শান্ত-স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এখন। কোনো মামলার ঝামেলা ব্যাঘাত ঘটাতে আসছে না আমাদের বিশ্রামের সময়টাতে।”

জবাব দিলো না শোমস। উদ্‌গীরিত ধোঁয়াগুলোর আকৃতি বরং আরও নিখুঁত হলো। লক্ষ করল উইলসন, ওর কথাটা পরম তৃপ্তির ছায়া ফেলেছে সঙ্গীর অভিব্যক্তিতে— যার মানে হলো, সিরিয়াস কোনো ভাবনায় আচ্ছন্ন নয় সে এ মুহূর্তে।

কিঞ্চিৎ হতাশার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল উইলসন। চলে গেল জানালার কাছে। নোংরা-মলিন বাড়িগুলোর অন্ধকার ফ্যাসাডের মাঝ দিয়ে বিস্তার পেয়েছে ফাঁকা রাস্তাটা। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে অস্বাভাবিক রকমের আঁধার হয়ে আছে এই সক্কালবেলাতেও। একটা গাড়ি চলে গেল নিচ দিয়ে, এর পর আরেকটা। নাম্বারগুলো নোটবইয়ে টুকে রাখল ও। কখন কী কাজে লেগে যায়, বলা যায়! “আহ!” বিস্ময়ধ্বনি শোনা গেল উইলসনের কণ্ঠে। “ডাকপিয়ন এসেছে!”

ভৃত্যের সঙ্গে এসে হাজির হলো লোকটা।

“রেজিস্ট্রি করা দুটো চিঠি আছে, স্যার… দয়া করে যদি স‍ই করে দিতেন…”

রসিদে স্বাক্ষর করে, পোস্টম্যানকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো শোমস। ফিরে আসতে আসতে খুলে ফেলল খাম দুটোর একটা।

“মন ভালো করে দেয়ার মতো কিছু বলে মনে হচ্ছে,” এক মুহূর্তের নীরবতার পর মন্তব্য করল উইলসন।

“হ্যাঁ, খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রস্তাব রয়েছে চিঠিটায়। কেস নেই— বলছিলে না? পড়ো এটা।

পড়ল উইলসন।

মঁসিয়ে,

সাহায্য কামনা করছি আপনার। সাংঘাতিক এক চুরির শিকার হয়েছি আমি। তদন্ত এগোয়নি এখন পর্যন্ত। কয়েকটা খবরের কাগজ পাঠাচ্ছি, যা থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে পারবেন আপনি। কেসটার দায়িত্ব নেন যদি, অধমের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাকে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খরচাপাতির অঙ্ক বসিয়ে নেবেন আমার সই করা চেকটায়।

টেলিগ্রাম মারফত দয়া করে মতামত জানাবেন আপনার। যথাবিহিত সম্মানের সঙ্গে,

বিনীত,

ব্যারন ভিকটর ডি’ইমভালে
১৮ ক্যু মুরিয়ো, প্যারিস।

“দারুণ শোনাচ্ছে না?” গলা বাড়াল শোমস। “ছোট্ট একটা সফর প্যারিসের উদ্দেশে— কী বলো, উইলসন? আর্সেন লুপাঁর সঙ্গে সাড়া জাগানো ওই টক্করটার পর থেকে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি ওখানে পদধূলি দেয়ার। এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতেও দুনিয়ার ওই রাজধানী দেখতে ইচ্ছুক আমি।”

চেকটা ছিঁড়ে চার টুকরো করল শোমস। আর উইলসন কটুবাক্য বর্ষণ করল প্যারিস আর প্যারিসবাসীদের প্রতি। ওর হাত এখনও আগের শক্তি ফিরে পায়নি।

দ্বিতীয় চিঠিটা খুলল এবার শোমস।

সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তি ফুটল ওর চেহারায়। পড়তে পড়তে ভাঁজ পড়ল কপালে। কাগজটা দলা পাকিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলল ও মেঝেতে।

“কী হলো আবার?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল উইলসন।

দলামোচা পাকানো কাগজটা তুলে নিয়ে খুলল ও। পড়তে পড়তে বাড়তে লাগল বিস্ময়।

সুপ্রিয় মঁসিয়ে,

আপনার আর আপনার খ্যাতির প্রতি এই অধমের মুগ্ধতা ও আগ্রহের বিষয়ে তো ভালো মতোই অবগত আপনি। যাই হোক… সাবধান করছি আপনাকে। এই মাত্র যে-কেসটা হাতে পেলেন, সেটার ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলুন দয়া করে। আপনি নাক গলালে আরও খারাপ হবে পরিস্থিতি। আপনার হস্তক্ষেপ মানেই ফলাফল মারাত্মক— জনসমক্ষে ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে আপনাকে।

এহেন অপমান থেকে আপনাকে রেহাই দেয়ার আন্তরিক ইচ্ছায়, আমাদের পুরানো সম্পর্কের খাতিরে অনুনয় করছি— চুপচাপ বিশ্ৰাম নিন আগুনের ধারে বসে।

আপনার আর মঁসিয়ে উইলসনের জন্য শুভকামনা রইল।

যথাযথ সম্মানের সঙ্গে,
আপনার গুণমুগ্ধ,
আর্সেন লুগাঁ।

“লুপা!” উচ্চারণ করল স্তম্ভিত উইলসন।

টেবিলে কিল বসাল শোমস। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, “উফ! এরই মধ্যে জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে আহাম্মকটা! এমনভাবে উপহাস করছে আমাকে নিয়ে, আমি যেন স্কুলের ছাত্র! সর্বসমক্ষে হার স্বীকার করব! ও কি ভুলে গেছে যে, নীল হিরেটা কীভাবে হাতছাড়া করতে বাধ্য করেছিলাম ওকে?”

“ভয় পেয়েছে বোধহয়,” বাতলাল উইলসন।

“ননসেন্স! আর্সেন লুপাঁ যে ভীতু নয়, খোঁচা মেরে লেখা চিঠিটাই এর প্ৰমাণ।”

“কিন্তু ও জানল কীভাবে যে, ব্যারন ডি’ইমভালে চিঠি লিখেছে তোমাকে?”

“আমি তার কী জানি? বোকার মতো হয়ে গেল না প্রশ্নটা?”

“ভেবেছিলাম… না, মানে…”

“কী? অলোকদ্রষ্টা, নাকি জাদুকর আমি?”

“না, তা নয়। তবে অবিশ্বাস্য কাণ্ডকীর্তি করতে তো কম দেখিনি তোমাকে…”

“কারোরই সাধ্য নেই ‘অবিশ্বাস্য’ কিছু ঘটানোর। তোমার চেয়ে পড়াশোনায় খানিকটা এগিয়ে আমি, এই যা। তা-ই দিয়ে ভাবি, অনুমান করি, উপসংহারে পৌছাই আমি- ব্যস, এ-ই। ঐশ্বরিক কিছু তো নয় এটা। বোকারাই শুধু ভাবতে পারে এমনটা।”

উইলসন উপলব্ধি করল, চাবুক খাওয়া কুকুরের দশা হয়েছে ওর বন্ধুর। শোমসের উপর দৈবত্ব আরোপের চেষ্টাটা যে আসলেই বোকামি হয়ে গেছে, বুঝতে পারল ও।

অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করেছে শোমস। কিন্তু বেল বাজিয়ে যখন সুটকেস নিয়ে আসার নির্দেশ দিলো ভৃত্যকে, উইলসনের মনে হলো, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ওর সহকর্মী।

“শোমস, তাহলে কি প্যারিস যাচ্ছ তুমি?” জিজ্ঞেস না করে পারল না ও।

“সম্ভবত।”

“লুপার ঔদ্ধত্যই প্ররোচিত করছে তোমাকে, তাই না?”

“সম্ভবত।”

“আমিও যাব তোমার সাথে!”

“আহ! আহ! এই না হলে বন্ধু!” পায়চারি থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শোমস। “বাম হাতের মতো তোমার ডান হাতটারও একই দুরবস্থা হতে পারে ভেবে ভয় লাগছে না একটুও?”

“কী আর হবে? তুমি তো থাকছই।”

“এই তো চাই, উইলসন! ধুরন্ধর ওই ফরাসিকে বুঝিয়ে দেব আমরা, চরম ভুল করেছে ও আমাদের মুখের উপর দস্তানা ছুঁড়ে মেরে। …জলদি করো, উইলসন, প্রথম ট্রেনটাই ধরতে হবে আমাদের।”

“ব্যারনের পাঠানো কাগজগুলোর জন্য অপেক্ষা করবে না?”

“ওতে আর কী উপকারটা হবে?”

“ঠিক আছে, ওঁকে টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি আমি।”

“দরকার নেই। তাহলে আমাদের আগমনের খবরটা আর গোপন থাকবে না আর্সেন লুপাঁর কাছে। ওটা এড়াতে চাই আমি। ছদ্মপরিচয়ে লড়াই করব এবার আমরা, উইলসন!”

.

সেই বিকেলেই ডোভার থেকে জাহাজে উঠল দুই বন্ধু।

আনন্দদায়ক ছিল যাত্রাটা। ক্যালে থেকে প্যারিসের পথে ট্রেনে ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে নিল শোমস। ওই সময়টায় কমপার্টমেন্টের দরজায় পাহারায় রইল উইলসন।

চনমনে মন নিয়ে জেগে উঠল ওর বন্ধু। লুপাঁর সঙ্গে আরেকটা দ্বৈরথের সম্ভাবনায় খুশি মনে হচ্ছে এখন ওকে। চমৎকার এক অবকাশ যাপনের প্রত্যাশায় সন্তুষ্টিতে ডলছে হাত জোড়া।

“অবশেষে আবার কাজে ফিরছি আমরা!” গলা চড়ে গেল উইলসনের। সে-ও অনুকরণ করছে শোমসের অঙ্গভঙ্গি।

ট্রেন থেকে নেমে পোটলা-পুটলি নিয়ে এগিয়ে চলা বন্ধুর পিছু নিল উইলসন। সুটকেস বইছে ও। টিকেট দেখিয়ে দ্রুত পা চালাল ওরা।

“দারুণ আবহাওয়া, উইলসন!” মুগ্ধতা ঝরল শোমসের কন্ঠ থেকে। “নীল আকাশ আর সূর্যালোক! রাজকীয় অভ্যর্থনা পেলাম আমরা প্যারিসের কাছ থেকে!”

“হ্যাঁ… কিন্তু ভিড় দেখেছ?”

“ভালোই হলো, কারও নজরে পড়ার সম্ভাবনা রইল না। এই ভিড়ের মধ্যে কেউ-ই চিনতে পারবে না আমাদের।”

“মঁসিয়ে শোমস?”

থমকে গেল শোমস। কোন হতচ্ছাড়া ডাকল ওর নাম ধরে?

পাশেই এক তরুণী দাঁড়িয়ে। সাদাসিধে পোশাকে ছিপছিপে গড়নটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। সুন্দর মুখটায় দুঃখ আর উদ্বেগের অভিব্যক্তি আবার করল সে প্রশ্নটা: “মঁসিয়ে শোমস আপনি?”

বিভ্রান্তির কারণে শোমস নীরব রইলে, তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, “মঁসিয়ে শোমসের সঙ্গে কথা বলছি আমি?”

“কী চান আপনি?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইল শোমস, বাজিয়ে দেখতে চাইছে মেয়েটাকে।

“আমার কথাগুলো শুনতেই হবে আপনাকে, মঁসিয়ে শোমস! গুরুতর বিষয় এটা। জানি, ক্য মুরিয়োর উদ্দেশে চলেছেন আপনারা।”

“কী বললেন?”

“হ্যাঁ, সবই জানি আমি… ক্য মুরিয়ো… আঠারো নম্বর বাড়ি। কিন্তু ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না আপনাদের! একদমই উচিত হবে না। আমি বলছি, গেলে পস্তাতে হবে আপনাদের! ভাবছেন, আমার এত মাথাব্যথা কেন? কর্তব্য বলেই সাবধান করছি আপনাকে। আমার বিবেকই করতে বলছে কাজটা!”

পালাই-পালাই করছে শোমস। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল মেয়েটা।

“ওহ! পায়ে পড়ি আপনার, হেলায় উড়িয়ে দেবেন না পরামর্শটা! উহ… কীভাবে যে বোঝাই আপনাকে! তাকান আমার চোখের দিকে! তাকিয়ে দেখুন… কোনো ছলনা পাবেন না চোখ দুটোতে!”

সরাসরি শোমসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা- নির্ভীক, নিষ্পাপ দৃষ্টিতে। স্বচ্ছ, সুন্দর চোখ জোড়ায় নিখুঁত প্রতিফলন ঘটেছে অন্তরের, ঘোষণা করছে পরিস্থিতির গুরুত্ব।

মাথা নাড়ল উইলসন। “সত্যি কথাই বলছেন বলে মনে হচ্ছে মাদমোয়াজেল।”

“হ্যাঁ,” কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল মেয়েটি। “আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস—”

“হুম, আপনাকে বিশ্বাস করছি আমি, মাদমোয়াজেল,” জবাব দিলো উইলসন।

“ওহ, অনেক খুশি হলাম শুনে! আপনার বন্ধুটিও করছেন নিশ্চয়ই! হ্যাঁ, অন্তরে অনুভব করছি আমি। কী যে আনন্দ লাগছে এখন! সব কিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে তাহলে! ভাগ্যিস, দেখা করার বুদ্ধিটা এসেছিল মাথায়! … বিশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন আসবে ক্যালের। ওতে চেপে ফিরে যেতে পারবেন আপনারা। জলদি আসুন আমার সঙ্গে… এই যে, এদিক দিয়ে… দেরি হয়ে যাবে নইলে!”

টেনে-হিঁচড়ে ওদেরকে সরিয়ে নেয়ার উপক্রম করল মেয়েটি।

তরুণীর বাহু পাকড়াল শোমস। যতটা সম্ভব, ভদ্রভাবে বলল, “মাফ করবেন, মাদমোয়াজেল। আপনার অনুরোধটা রাখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একবার কোনো কাজে হাত দিলে শেষ না দেখে ছাড়ি না আমি।”

“দোহাই আপনার! হাত জোড় করছি আপনাদের কাছে! হায়, এর গুরুত্বটা যদি বোঝাতে পারতাম আপনাদের!”

প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে, দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল শোমস।

“ভয় পাবেন না,” মেয়েটিকে বলল উইলসন। “দেখুনই না, কী হয় শেষ পর্যন্ত! আজ পর্যন্ত কখনোই ব্যর্থ হয়নি ও।“

দৌড় দিলো ও শোমসের নাগাল ধরার জন্য।

হার্লক শোমস-আর্সেন লুপাঁ

রেলস্টেশন ত্যাগ করতেই বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা নাম দুটো নজর কাড়ল ওদের। ক’জন স্যান্ডউইচ-বিক্রেতা প্যারেড করছে রাস্তায়, একজনের পিছনে আরেকজন, লোহার টুপিঅলা ভারি বেত ওদের হাতে, তালে তালে আঘাত করছে পেভমেন্টে। বড়সড় পোস্টার শোভা পাচ্ছে লোকগুলোর পিঠে, যাতে লেখা:

হার্লক শোমস বনাম আর্সেন লুপাঁ!
প্যারিসে এসে হাজির হয়েছেন ইংরেজ চ্যাম্পিয়ন!
রু্য মুরিয়োর রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন বিখ্যাত গোয়েন্দা!
বিস্তারিত পাওয়া যাবে একো দ্য ফ্রান্স-এ।

“দেখো, দেখো, শোমস!” মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল উইলসন। “আর আমরা কিনা ভাবছিলাম, কেউ-ই চিনতে পারবে না আমাদের! টোস্ট আর শ্যাম্পেইন নিয়ে যদি রিপাবলিকান গার্ডেরা আমাদের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় থেকে থাকে ক্য মুরিয়োতে, সেক্ষেত্রে মোটেই অবাক হব না আমি।”

“উইলসন!” চাপা স্বরে গর্জে উঠল শোমস। “মাঝেমধ্যে এমন সব হাস্যকর কথাবার্তা বলো না তুমি! “

বলেই এক স্যান্ডউইচ-ম্যানের দিকে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা। মনে হলো, শক্ত হাতে লোকটাকে পাকড়াও করে মাথাটা ওরই যাচ্ছেতাই সাইনবোর্ডে ঠুকে দিতে চাইছে ও।

ভিড় জমে উঠেছে লোকগুলোকে ঘিরে, হাস্য-কৌতুকে মেতেছে ওরা নোটিশটা নিয়ে।

“কখন ভাড়া করা হলো তোমাদের?” রাগ চেপে জানতে চাইল শোমস স্যান্ডউইচ-ব্যবসায়ীর কাছে।

“আজ সকালে, মঁসিয়ে।”

“কতক্ষণ যাবৎ প্যারেড করছ তোমরা?”

“এক ঘণ্টা ধরে…”

“কিন্তু বোর্ডগুলো তো আরও আগেই তৈরি করা হয়েছে?’

“তা তো বটেই। সকালে এজেন্সিতে গিয়েই তৈরি পেয়েছি এগুলো।” অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে: শোমস যে চ্যালেঞ্জটা নেবে, টের পেয়েছিল লুপাঁ। লোকটার চিঠি থেকে এটাও পরিষ্কার, পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়ায় আগ্রহী ও, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আরও একবার সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিতে তৈরি। কী কারণে? মোটিভটা কী?

মুহূর্তকাল ইতস্তত করল শোমস। নিজের সাফল্যের ব্যাপারে নির্ঘাত অতি আত্মবিশ্বাসী লুপাঁ, যে কারণে এতখানি আস্পর্ধা দেখাচ্ছে। সাহায্যের আহ্বান শুনে, তড়িঘড়ি করে ফ্রান্সে হাজির হয়ে কি লোকটার ফাঁদে পা দিচ্ছে না ও?

গাড়ি ডাকল শোমস।

“চলে এসো, উইলসন!” চেঁচিয়ে উঠল স্বভাবজাত উদ্যমে। “ড্রাইভার, আঠারো নম্বর ক্যু মুরিয়ো!”

বক্সিঙে নামতে চলেছে যেন, এমনিভাবে উত্তেজিত ধমনি আর মুষ্টিবদ্ধ হাতে উঠে পড়ল ও ক্যারিজে।

বিশাল সব ব্যক্তিগত বাসভবনের সমাহার ক্য মুরিয়োর দু’পাশে, তবে সব কিছু ছাড়িয়ে চোখে পড়ে দূরের পার্ক মনশে। এই দালানগুলোর মধ্যে নিজেকে সদম্ভে জাহির করছে ব্যারন ডি’ইমভালের আঠারো নম্বর বাড়িটি।

ভদ্রলোক নিজের সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী সাজিয়েছেন বিলাসবহুল বাসস্থানটি। সামনে আঙিনা, আর বাড়ির দূরে রয়েছে বৃক্ষশোভিত উদ্যান। সেসব গাছের ডালপালাগুলো মিতালি পাতিয়েছে পার্কেরগুলোর সঙ্গে।

বেল বাজানোর পর, ভেতরে ঢোকানো হলো দুই ইংরেজকে। প্রাঙ্গণ পেরিয়ে, ফুটম্যানের সাদর সম্ভাষণ পেল ওরা সদর দরজায় এসে। বাড়িটার গভীরে, বাগানের দিকে মুখ করা ছোটো এক পার্লারে নিয়ে এল সে অতিথিদেরকে।

আসন গ্রহণ করে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল দুজনে, চট করে দেখে নিল ঘর ভর্তি মূল্যবান জিনিসগুলো।

“রুচির প্রশংসা করতে হয় ভদ্রলোকের,” বিড়বিড় করল উইলসন। “রীতিমতো যাচাই-বাছাই করে কেনা হয়েছে এগুলো। অনুমান করা কষ্টের নয় যে, কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর তো হবেই এগুলোর সংগ্রাহকের বয়স।”

খুলে গেল দরজা। স্ত্রীর সঙ্গে পার্লারে প্রবেশ করলেন ব্যারন ডি’ইমভালে।

ব্যর্থ হয়েছে উইলসনের অনুমান। একেবারেই কম বয়স দুজনের। হাবভাবে ঠিকরে বেরোচ্ছে আভিজাত্য। কথাবার্তায় প্রাণবন্ত; আর মুখের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ওঁদের।

“এসেছেন বলে অশেষ ধন্যবাদ আপনাদের।” বিনয়ের অবতার যেন ব্যারন। “আন্তরিক দুঃখিত আপনাদের কষ্ট দেয়ার জন্য। চুরিটার মনে হচ্ছে এবার একটা সুরাহা হয়েই যাবে, যেহেতু তদন্তের দায়িত্ব নিচ্ছেন আপনারা।”

“ফরাসিদের সৌজন্যবোধ অতুলনীয়!” ভাবল উইলসন।

“সময়ের দাম আছে, মঁসিয়ে,” কথাটায় জোর দিলেন ব্যারন। “বিশেষ করে, আপনার সময়ের। আসল কথায় চলে আসছি সেজন্য। কী ভাবছেন আপনারা? পারবেন এর কিনারা করতে?”

“সব কিছু না শুনে জবাব দিই কীভাবে?” ব্যারনকেই পাল্টা বলল শোমস।

“ভেবেছিলাম, সব জানেন আপনি।”

“না। আপনাদের কাছেই জানতে চাইছি বিস্তারিত। কিছুই বাদ দেবেন না, সেটা যত নগণ্যই হোক না কেন। সবার আগে জানতে চাই: ঠিক কোন জাতের কেস এটা?”

“কেন, চুরির কেস!”

“কখন হয়েছে চুরিটা?”

“গত শনিবার,” জানালেন ব্যারন। “শনিবার রাতের কোনো এক সময়ে; নয়তো বলা যায়, রোববার ভোরে।”

“ছয় দিন আগের ঘটনা। এবার খুলে বলুন পুরোটা।”

“শুরুতেই যেটা বলতে হয়, মঁসিয়ে… আমাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে, খুব কমই বাড়ির বাইরে বেরোই আমি আর আমার সহধর্মিণী 1 বাচ্চাকাচ্চাদের পড়াশোনা, অতিথিসেবা, গৃহসজ্জা আর তদারকির কাজগুলো ছাড়া বেশির ভাগ সন্ধ্যাই কাটে এই ছোট্ট কামরায়। ওর খাস কামরা এটি। শৈল্পিক কিছু জিনিস রেখেছি এখানে। গেল শনিবার এগারোটার দিকে, বৈদ্যুতিক বাতিগুলো বন্ধ করে দিয়ে রোজকার মতো নিজেদের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়ি আমরা।”

“কোথায় সে কামরাটা?”

“এ ঘরের পাশেই। এই যে… দুই ঘরের কমন দরজা। পরদিন- মানে, রোববার সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি আমি। সুজান ঘুমাচ্ছিল তখনও।” স্ত্রীর দিকে তাকালেন ব্যারন। “ওকে না জাগিয়ে সন্তর্পণে ঢুকে পড়ি এখানে। হতভম্ব হয়ে খোলা অবস্থায় আবিষ্কার করি জানালাটা, যেটা আগের সন্ধ্যায় বন্ধ করা হয়েছিল বলে দিব্যি মনে আছে আমার। “

“ভৃত্যরা কি?”

“বেল না বাজালে সকালে কেউ-ই ঢোকে না এখানে। তাছাড়া, সাবধানতার খাতিরে অ্যান্টি-চেম্বারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী দ্বিতীয় দরজাটার বল্টু লাগিয়ে রাখি সব সময়। তার উপর, প্রমাণও ছিল হাতে- ডান দিক থেকে দ্বিতীয় কাচের শার্সিটা— ছিটকিনির কাছাকাছি যেটা, কাটা ছিল ওটা।’

“কী দেখা যায় জানালা দিয়ে?”

“নিজেরাই দেখুন না! পাথরের রেলিং ঘেরা ছোটো এক ব্যালকনিতে খোলে এটা। দোতলায় রয়েছি আমরা। বাড়ির পিছনের বাগান আর পার্ক থেকে ওটাকে আলাদা করা লোহার বেড়াটা তো দেখতেই পাচ্ছেন আপনারা। একদম নিশ্চিত যে, পার্ক হয়েই এখানে এসেছে চোরবাবাজি, মইয়ের সাহায্যে বেড়া টপকে চলে এসেছে জানালার নিচের প্রাঙ্গণে।”

“একদম নিশ্চিত, বলছেন?”

“বেশ… বেড়ার দু’দিকের নরম মাটিতেই মইয়ের তলা থেকে সৃষ্ট এক জোড়া গর্ত পাওয়া গেছে। একই ধরনের গর্ত পাওয়া গেছে জানালার নিচে। এ ছাড়া ব্যালকনির পাথরের রেলিংয়ে পাওয়া গেছে আঁচড়ের জোড়া-দাগ, নিঃসন্দেহে যেগুলো মইয়ের ঘষায় হয়েছে।”

“রাতে কি বন্ধ থাকে পার্কটা?”

“না। তবে থাকলেও, চৌদ্দ নম্বর বাড়ির ইমারতের দিকে একটা রাস্তা আছে; যে কেউ-ই ঢুকতে পারে ওদিক দিয়ে।

কয়েক মিনিট ভাবল শোমস, তারপর বলল, “চুরির বিষয়ে আসা যাক। এই কামরাতেই হয়েছে নিশ্চয়ই চুরিটা?”

“জি হ্যাঁ। বারো শতকের ভার্জিন আর রুপোর একখানা আসনের মাঝে ছোটো একটা জুইশ ল্যাম্প ছিল— খোয়া গেছে ওটা।”

“স্রেফ এটাই?”

“হুম।”

“তা, এই জুইশ ল্যাম্পটা কী জিনিস?”

“প্রাচীন ইহুদিদের ব্যবহার করা তামার লণ্ঠন, যাতে একখানা খুঁটি সাপোর্ট দিচ্ছে একটা তেল ভরা বাটিকে। ওই বাটি থেকে কয়েকটা বার্নার বেরিয়ে এসেছে পলতের জন্য।”

“শুনে তো মনে হচ্ছে, খুব একটা মূল্য নেই ওটার!”

“তা নেই ঠিকই, তবে বিশেষ এই লণ্ঠনটিতে একটা গোপন কুঠুরি রয়েছে, যেটির মধ্যে চুনি আর পান্না বসানো সোনার একখানা দুর্দান্ত কাইমেরা রেখেছিলাম আমরা— অমূল্য জিনিস সেটা।”

“কেন রেখেছিলেন, বলবেন?”

“বিশেষ কোনো কারণে নয়, মঁসিয়ে। ওরকম গোপন একটা জায়গাকে কাজে লাগানোর লোভ সামলাতে পারিনি আসলে।”

“কেউ কি জানত এটা?”

“নাহ।“

“শুধু চোরটা ছাড়া,” মন্তব্য করল শোমস। “নয়তো এই লণ্ঠন চুরির ঝামেলায় যেত না সে।”

“তা তো বটেই। কিন্তু কীভাবে জানবে সে? আমরাই তো দৈবক্রমে জেনেছি লণ্ঠনটার গোপন কারিকুরি সম্বন্ধে।

“একইভাবে রহস্যটা ফাঁস হয়ে যেতে পারে অন্য কারও কাছেও… কোনো ভৃত্য কিংবা চেনাশোনা কারো কাছে। পুলিশ এসে ঘুরে গেছে নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ। নিজের তদন্ত সম্পন্ন করেছেন এক্সামিনিং ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের তদন্তকাজও সারা। কিন্তু যেমনটা লিখেছি আমি: রহস্যটার মনে হয় সমাধান হবে না কোনোদিন। “

উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল শোমস। পরীক্ষা করল গরাদবিহীন জানালা, ব্যালকনি, নিচের আঙিনা। আতশি কাচ দিয়ে জরিপ করল রেলিংয়ে পড়া আঁচড়গুলো। এরপর এরপর বাগান দেখানোর অনুরোধ করল মঁসিয়ে ডি’ইমভালেকে।

বাইরে একখানা বেতের চেয়ারে বসে স্বপ্নালু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও বাড়িটার ছাদের দিকে। কিছুক্ষণ পর এগিয়ে গেল ছোট্ট দুটো কাঠের বাক্স অভিমুখে, যেগুলো দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে মইয়ের গর্ত দুটো, ওগুলো অক্ষত রাখার জন্য নিশ্চয়ই।

বাক্সগুলো সরিয়ে মাটিতে হাঁটু গাড়ল শোমস। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গর্ত পরীক্ষা করে মাপজোক করল কিছু। এরপর বেড়ার ধারের গর্তগুলোতেও একই রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ব্যারনের সঙ্গে ফিরে এল ওঁর স্ত্রীর খাস কামরায়, ওখানে ওদের অপেক্ষায় ছিলেন মাদাম ডি’ইমভালে।

সংক্ষিপ্ত নীরবতার পর মুখ খুলল গোয়েন্দাপ্রবর।

“আপনার দেয়া বিবরণ যারপরনাই বিস্মিত করেছে আমাকে, মঁসিয়ে। বিস্ময় চোরটা এত সহজ পন্থা বেছে নিয়েছে বলে। মই খাটানো, শার্সি কাটা, এরপর দামি একটা জিনিস নিয়ে পগার পার হওয়া। এভাবে আসলে হয় না এসব। এতই সহজে, এতই সাদামাটাভাবে!”

“সেক্ষেত্রে কী হতে পারে বলে মনে হচ্ছে আপনার?”

“এই চুরির পিছনে হাত রয়েছে আর্সেন লুপাঁর

“আর্সেন লুপাঁ!” চমকে উঠলেন ব্যারন।

“হ্যাঁ। কিন্তু ও নিজে করেনি এটা, কেউ-ই যেহেতু বাইরে থেকে বাড়িতে ঢোকেনি। বোধহয় জলস্তম্ভের সাহায্যে উপরতলা থেকে নেমে এসেছিল কোনো ভৃত্য। বাগানে থাকা অবস্থায় নজরে এসেছে সম্ভাবনাটা।”

“কেন মনে হচ্ছে এমনটা?”

“লুপা নিজে হলে খালি হাতে ফেরত যেত না ও।”

“খালি হাতে ফেরত যেত না? কিন্তু ও তো নিয়ে গেছে লণ্ঠনটা!“

“কিন্তু হিরে বসানো ওই নস্যির বাক্সটা তো নিয়ে যায়নি, কিংবা নেয়নি উপলের কণ্ঠহারটাও। না নেয়ার মানে হলো, সাধ্য হয়নি চোরটার।”

“কিন্তু বাইরের ওই মইয়ের চিহ্নগুলো?”

“বানোয়াট ওগুলো। তদন্ত ভুল পথে চালিত করার জন্য।”

“আর রেলিংয়ের ওই আঁচড়ের দাগ?”

“ওগুলোও জালিয়াতি। সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে করা হয়েছে ওগুলো। এই দেখুন, বাগানে পেয়েছি কাগজের টুকরোগুলো।”

“মইয়ের তলা থেকে যে-গর্তগুলো হয়েছে, সেগুলোকে নকল বলছেন কেন?”

“জানালার নিচের চারকোনা গর্ত আর বেড়ার কাছের গর্ত দুটো একই ধরনের হলেও মাপ নিয়ে দেখেছি, বাড়ির কাছেরগুলো বেড়ারগুলোর চেয়ে পরস্পরের কাছাকাছি কিছুটা। মানেটা কী দাঁড়াল? কাঠের কোনো টুকরো দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে ওগুলো।”

“টুকরোটা পাওয়া গেলে হালে পানি পেত সম্ভাবনাটা।”

“এই যে, এটা।” দেখাল শোমস। “বাগানে লরেল কাঠের একটা বাক্সের নিচে পাওয়া গেছে টুকরোটা।”

ওর দক্ষতার পরিচয় পেয়ে সসম্মানে বাউ করলেন ব্যারন। ইংরেজ ভদ্রলোক এ বাড়িতে পা রাখার পর চল্লিশ মিনিট পেরিয়েছে মাত্র, অথচ এরই মধ্যে আগের থিওরিগুলো উড়িয়ে দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চিত এবং অনস্বীকার্য সত্যের উপর ভিত্তি করে নিজের থিওরি পেশ করেছেন তিনি।

“আমার গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন আপনি, অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ সেটা,” বললেন ব্যারনেস। “বহু বছরের পুরোনো কাজের লোক এরা, বিশ্বাস ভঙ্গ করার মতো নয় এদের কেউ-ই।”

“না হলে আপনাদের চিঠি যেদিন যে মেইলে এসেছে, একই দিন একই মেইলে এই চিঠি কীভাবে এল আমার কাছে?” লুপাঁর কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটা ব্যারনেসের হাতে তুলে দিলো শোমস।

“আর্সেন লুপাঁ!” আওড়ালেন বিস্মিত মহিলা। “কীভাবে জানল লোকটা?”

“কাউকে বলেছিলেন নাকি, চিঠি দিচ্ছেন আমাকে?”

“নাহ, কাউকেই না,” জবাব ব্যারনের। “চিঠি দেয়ার বুদ্ধিটা এসেছে ডিনার-টেবিলে আলাপ করার সময়।”

“চাকরবাকরদের সামনে?”

“না, শুধু বাচ্চারা ছিল ওখানে। ওহ, না… সোফি আর হেনরিয়েট তো উঠে পড়েছিল টেবিল ছেড়ে, তাই না, সুজান?”

“হ্যাঁ,” এক মুহূর্ত চিন্তা করে জবাব দিলেন মাদাম ডিইমভালে। “মাদমোয়াজেলের কাছে চলে গিয়েছিল ওরা।”

“মাদমোয়াজেল?” শোমসের প্রশ্ন।

“মাদমোয়াজেল অ্যালিস ডিমান। গভর্নেস ও।”

“আপনাদের সঙ্গেই খান নাকি তিনি?”

“না, ওনার ঘরেই পাঠিয়ে দেয়া হয় খাবারটা।”

এ সময় মাথায় একটা ভাবনা এল উইলসনের।

“আমার বন্ধু হার্লককে লেখা চিঠিটা কি ডাক মারফত পাঠানো হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল ও।

“আলবত।”

“কে ফেলেছে ডাকে?”

“ডমিনিক,” জবাব ব্যারনের। “বিশ বছরের পুরোনো খানসামা আমার। ওর ব্যাপারে তদন্ত করলে সময়ই নষ্ট হবে শুধু।”

“তদন্তে কখনও নষ্ট হয় না সময়,” দার্শনিকের মতো জবাব দিলো উইলসন।

প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশন শেষ আপাতত। বিরতি চাইল শোমস।

এক ঘণ্টা পর সোফি আর হেনরিয়েটের সঙ্গে ডিনারে দেখা হলো ওর। একজনের বয়স ছয়, অন্যজনের আট।

অল্পই বাতচিত হলো খাবার-টেবিলে। মেজবানদের বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপের বিপরীতে এমনই চাঁছাছোলা ভঙ্গিতে সাড়া দিলো শোমস যে, অপর পক্ষ নীরব হয়ে পড়ল একটু পরেই। কফি এলে পরে, নিজেরটুকু শেষ করে নিয়ে বিদায় নেয়ার জন্য উঠে পড়ল শোমস।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওর কাছে আসা এক টেলিফোন-বার্তা নিয়ে হাজির হলো এক ভৃত্য।

লিখে নেয়া মেসেজটা পড়ল শোমস।

আমার সশ্রদ্ধ প্রশংসা গ্রহণ করুন, মসিয়ে। এত অল্প সময়ে যে-ভেলকি দেখিয়েছেন আপনি, তা সত্যিই বিস্ময়কর। ভয়ই ধরে গেছে আমার।
-আর্সেন লুপাঁ

ক্ষুব্ধ চেহারায় ব্যারনের হাতে তুলে দিলো ও মেসেজটা। “এবার কী বলবেন, মঁসিয়ে? আপনার বাড়ির দেয়ালে কি চোখকান আছে নাকি?”

“বুঝতে পারছি না কিছু!” হতচকিত ব্যারন।

“আমিও না। তবে এটা বুঝতে পারছি যে, এ বাড়ির সমস্ত কিছুই লুপাঁর নখদর্পণে… প্রতিটি গতিবিধি, উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ। কোনোই সন্দেহ নেই এতে। কিন্তু পাচ্ছে সে কীভাবে তথ্যগুলো? এই রহস্যটাই ভেদ করতে হবে প্রথমে। এটা বোধগম্য হলেই বাকি সব জলবৎ তরলং।”

.

সারা দিন অনেক দৌড়ঝাঁপ হয়েছে, হতক্লান্ত হয়ে সে রাতে শুতে গেল উইলসন। চটজলদি ঘুম নেমে এল ওর দু’চোখে, ভাসতে লাগল সুখস্বপ্নের সাগরে। স্বপ্নে দেখল, একাই তাড়া করে পাকড়াও করে ফেলেছে লুপাঁকে। স্বপ্নের মধ্যেই এতখানি উত্তেজিত হয়ে উঠল যে, ভেঙে গেল ঘুমটা।

কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর বিছানার পাশে!

“নড়বে না, লুপাঁ!” রিভলভার হাতে হুমকি দিয়ে উঠল উইলসন। “নইলে গুলি চালাতে বাধ্য হব আমি।”

“কী, হে, শয়তান, কী বলছ এসব?”

“শোমস, তুমি! তুমি কী করছ এখানে?”

“একটা জিনিস দেখাতে চাই তোমাকে। উঠে পড়ো, বন্ধু।

জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে শোমস। “দেখো! বেড়ার অন্য পাশটায়…”

“পার্কের দিকে?”

“হ্যাঁ। কী দেখছ?”

“কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না আমি!”

“আলবত দেখছ।”

“ওহ, হ্যাঁ, একটা… না-না, দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে!”

ঝটপট সিঁড়ি বেয়ে নেমে, বাগানের দিকে খোলে, সেই রুমটাতে চলে এল ওরা। কাচের দরজা ভেদ করে একই জায়গায় দেখতে পেল জোড়া- ছায়ামূর্তিকে।

“আজব তো!” বলে উঠল শোমস। “মনে হচ্ছে, বাড়ির ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ পাচ্ছি যেন! “

“বাড়ির ভেতরে? অসম্ভব! সবাই তো ঘুমে এখন।”

“ভালো করে শোনো, বন্ধু”

কথা শেষ হলো না, তার আগেই নিচু শিসের শব্দ ভেসে এল বেড়ার অন্য পাশ থেকে। আবছা আলোর আভাস ধরা পড়ল ওদের চোখে, যেটা মনে হচ্ছে বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে।

“ব্যারন নিশ্চয়ই বাতি জ্বেলেছেন ওনার কামরার,” অনুমান করল শোমস। “আমাদের ঠিক উপরেই কামরাটা।”

“আর সেজন্যই বোধহয় আওয়াজ হচ্ছে উপরে,” উইলসনের অনুমান। “ওনারাও বোধহয় তাকিয়ে আছেন বেড়ার দিকে।”

আবার শোনা গেল আরেকটা শিসের আওয়াজ। এটা আগেরটার চাইতে মোলায়েম।

“বুঝলাম না… একদমই মাথায় ধরছে না ব্যাপারটা!” ত্যক্ত স্বরে বলল শোমস।

“আমিও না,” স্বীকার করল উইলসন।

দরজার চাবি ঘোরাল শোমস। হুড়কো টেনে নিঃশব্দে খুলে ফেলল পাল্লাটা।

আরেকবার শব্দ হলো শিসের। এবার আগের চাইতে জোরালো, এবং অন্য ধরনের।

মাথার উপরের আওয়াজগুলো স্পষ্ট হলো আরও।

“ব্যারনেসের জানালার বাইরের ব্যালকনি থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে,” ধারণা করল শোমস।

আধখোলা দরজা দিয়ে মাথা বের করল ও, কিন্তু তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে এল আবার, দম আটকে ফেলেছে।

এবার উইলসনও তাকাল।

ওদের খুব কাছেই মই দেখা যাচ্ছে একটা, যেটার উপরের প্রান্তটা ঠেকে আছে ব্যালকনির গায়ে।

“কেউ রয়েছে ব্যারনেসের কামরায়!” বলল শোমস চাপা স্বরে। “এজন্যই আওয়াজ পাচ্ছি আমরা। এসো, সরিয়ে ফেলি মইটা।”

কিন্তু তক্ষুণি এক লোক নেমে এল মই বেয়ে।

ছুট দিলো সে মইটা কাঁধে তুলে নিয়ে, বেড়ার বাইরে যেখানে ওর সঙ্গীরা অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

মইটা বেড়ার গায়ে ঠেকানোর আগেই শোমস আর উইলসন ধাওয়া করে পৌঁছে গেল লোকটার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে পর পর দু’বার গুলির আওয়াজ উঠল বেড়ার ওপাশ থেকে।

“লেগেছে নাকি?” চেঁচিয়ে জানতে চাইল শোমস।

“না,” উত্তর দিলো উইলসন।

লোকটাকে জাপটে ধরল ও, চেষ্টা করছে আটকে রাখার; পারল না, ঘুরে দাঁড়িয়েই উইলসনের বুকে ছুরি গেঁথে দিলো দুর্বৃত্ত।

গুঙিয়ে উঠল শোমসের সহকারী। টলে উঠে, লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

শাপশাপান্ত করে উঠল শোমস। উইলসনকে ঘাসের উপর ফেলে রেখেই দৌড় দিলো ও বেড়ার গায়ে ঠেকানো মইয়ের দিকে।

দেরি হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে বেড়া ডিঙিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে লোকটা। মুহূর্তে চম্পট দিলো ওরা ঝোপঝাড় তছনছ করে।

“উইলসন! উইলসন!” ডাকতে ডাকতে ফিরে এল শোমস। “সিরিয়াস কিছু হয়নি তো, বন্ধু? নাহ… মনে হয়, সামান্য আঁচড় লেগেছে!”

এমন সময় খুলে গেল বাড়ির দরজা। আবির্ভূত হলেন মঁসিয়ে ডি’ইমভালে। পিছনে মোমবাতি হাতে চাকর-ভৃত্যরা।

“হয়েছে কী?” জানতে চাইলেন ব্যারন। “মঁসিয়ে উইলসন কি আহত নাকি?”

“আরে, নাহ, কিচ্ছু হয়নি! সামান্য আঁচড় লেগেছে শুধু!” নিজেকে বুঝ দেয়ার জন্যই পুনরাবৃত্তি করল যেন শোমস।

প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মড়ার মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে উইলসনের চেহারা। বিশ মিনিট পর ডাক্তারসাহেব নিশ্চিত করলেন যে, মাত্র আধ ইঞ্চির জন্য ছুরির ফলা থেকে রক্ষা পেয়েছে হৃৎপিণ্ডটা।

“বেঁচে গেল বন্ধু!” কেমন ঈর্ষার সুরে মন্তব্য করল শোমস।

“একেই বলে কপাল!” বিড়বিড় করলেন ডাক্তার।

“তা তো অবশ্যই। শিগগিরই ঘোড়ার মতো দৌড়াবে বন্ধু আমার।”

“উহুঁ। অন্তত ছয় সপ্তাহ বিছানায় থাকতে হবে ওনাকে। সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করতে করতে আরও অন্তত দুটো মাস।

“এর বেশি নয়?”

“যদি না কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়।”

“হুম!” গম্ভীর হয়ে গেল শোমস।

উইলসনের ব্যাপারে আপাতত নিশ্চিত হয়ে ব্যারনের সঙ্গে ওর অর্ধাঙ্গিনীর খাস কামরায় যোগ দিলো ও।

আগের মতো আর সংযম দেখাতে পারেনি রহস্যময় চোরটা। হীরের নস্যির বাক্স, উপলের কণ্ঠহার সহ যা কিছুর জায়গা হয়েছে লোভীটার পকেটে, নির্দ্বিধায় করায়ত্ত করেছে সেগুলো।

জানালাটা খোলা এখনও, নিপুণভাবে কাটা হয়েছে একখানা শার্সি।

সকালের সংক্ষিপ্ত তদন্তে বেরিয়ে এল, মইটা এ বাড়িরই, ব্যবহার করা হয় কনস্ট্রাকশনের কাজে।

“দেখতেই পাচ্ছেন,” কেমন এক গলায় বললেন মঁসিয়ে ডি’ইমভালে। “জুইশ ল্যাম্পের মতোই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো!”

“হুম, যদি পুলিশের দেয়া প্রথম থিওরি মেনে নিই আমরা।“

“মানতে পারেননি এখনও? কেন, দ্বিতীয় চুরিটা কি নিজের থিওরি থেকে সরে আসতে বাধ্য করছে না আপনাকে?”

“না, বরং আরও পাকাপোক্ত হয়েছে থিওরিটা।”

“বলেন কী, মঁসিয়ে! বাইরের লোকেরা করেছে গত রাতের চুরিটা – এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, বাড়ির লোকই সরিয়েছে জুইশ ল্যাম্পটা- নিজের এই যুক্তিতেই অটল আপনি?”

“হ্যাঁ, তাই।”

“কিন্তু ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে?”

“কোনো কিছু ব্যাখ্যা করি না আমি, মঁসিয়ে। দুটো সত্য উপস্থাপন করেছি আমি আপনার সামনে; আপাতদৃষ্টিতে এ দুটোর মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলেই মনে হচ্ছে যদিও। সম্পর্ক বের করার জন্য অধরা সূত্র খুঁজে চলেছি এখনও।”

শোমসের কথাগুলো এতটাই আন্তরিক শোনাল যে, প্রভাবিত হলেন ব্যারন। “খুব ভালো। পুলিশকে জানাতে হচ্ছে তাহলে-”

“একদমই নয়!” তড়িঘড়ি করে বলে উঠল শোমস। “একদমই করবেন না ওটা! লাগলে ওদের সাহায্য নেব আমি- কিন্তু এখনই নয় সেটা।”

“কিন্তু আপনার বন্ধুর উপরে যে হামলা হলো! “

“তাতে কী হয়েছে? স্রেফ তো আহত হয়েছে ও। ভালো ডাক্তারের হাতে পড়েছে নিশ্চয়ই। আমিই দেখছি এর আইনগত দিকটা।”

.

দুটো দিন কেটে গেল কোনো ঘটনা ছাড়া। তবে একটা মিনিটও নষ্ট না করে নিজের তদন্তকার্য চালিয়ে গেল শোমস। ঘটনাস্থলে হাজির থাকা সত্ত্বেও, ওর নাকের ডগা দিয়ে যে এরকম দুঃসাহসিক চুরি হয়ে গেল, আর সেটা যে ও ঠেকাতে পারেনি, এতে ভীষণ আহত হয়েছে ওর আত্মগর্ব।

বাড়ি আর বাগানে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চালাল ও, জেরা করল ভৃত্যদের, দীর্ঘক্ষণ সময় কাটাল কিচেন আর আস্তাবলে। এত সব প্রচেষ্টার ফল না এলেও, হতাশ হলো না শোমস।

“সফল আমি হবই,” বলল ও নিজেকে। “সমাধান নিশ্চয়ই এ বাড়ির মধ্যেই রয়েছে। স্বর্ণকেশী মহিলার কেস থেকে একেবারেই আলাদা এটা। সেখানে আমাকে কাজ করতে হয়েছিল অচেনা, অন্ধকার ময়দানে। আর এখানে আমি নিজেই নেমে গেছি যুদ্ধক্ষেত্রে। দুশমন এখানে অদৃশ্য, ঐন্দ্রজালিক লুপাঁ নয়; ওর রক্তমাংসের সহযোগী, যার আনাগোনা এ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। সামান্য সূত্র পেলেই নিজের করে নিতে পারব খেলাটা।”

আর সূত্র ও পেয়েও গেল ঘটনাক্রমে।

তৃতীয় দিন বিকেলে যখন ব্যারনেসের খাস কামরার উপরের ঘরটায় ঢু মারল ও— যেটি কিনা বাচ্চাদের পড়াশোনার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়— ওখানে সে পেয়ে গেল দুই বোনের মধ্যে ছোটোজন, হেনরিয়েটকে। কাঁচি খুঁজতে এসেছিল বাচ্চাটা।

“জানো,” বলল ও শোমসকে। “ওই দিন সন্ধ্যায় যে কাগজ পেয়েছিলে তুমি, আমিও কিন্তু কাগজ বানাই ওরকম।”

“কোন দিনের কথা বলছ?”

“ওই যে… খাওয়া শেষে ছাপঅলা একটা কাগজ পেলে না… টেলিগ্রাম আরকি… আমিও তৈরি করি ওরকম।”

কথাটা বলেই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা।

অন্য কারও কাছে বাচ্চাদের অর্থহীন বোল বলেই মনে হবে ওগুলো; শোমসও পড়ে গেছে বিভ্রান্তির চক্করে। ঝটিতি হেনরিয়েটের পিছু নিল ও, সিঁড়ির মাথায় ধরে ফেলল ওকে। জিজ্ঞেস করল, “তার মানে কি, কাগজে ডাকটিকেট সাঁটিয়ে ঠিকানা লেখো তুমি?”

গর্বভরে জবাব দিলো শিশুটি, “হ্যাঁ… ডাকটিকেট ছিঁড়ে খামে লাগাই আমি।”

“কে শিখিয়েছে এটা?”

“মাদমোয়াজেল… আমার গভর্নেসের কথা বলছি… প্রায়ই ওকে করতে দেখি এরকম। খবরের কাগজ থেকে অক্ষর কেটে কেটে কাগজে লাগায়…”

“কী বানান তিনি ওগুলো দিয়ে?”

“টেলিগ্রাম আর চিঠি। তারপর পাঠিয়ে দেয় ওগুলো।”

স্টাডিতে ফিরে এল শোমস। বিহ্বল করে তুলেছে ওকে তথ্যগুলো। খবরের কাগজের গাদা ছিল ম্যান্টেলের উপরে। ওগুলো খুলে আবিষ্কার করল- অনেক শব্দ; কোথাও কোথাও আস্ত একটা লাইনই কেটে নেয়া হয়েছে পত্রিকা থেকে। আগে-পিছের শব্দগুলো পড়ে বোঝা যাচ্ছে, বাছবিচার ছাড়াই কাটা হয়েছে ওগুলো। খুব সম্ভব বাচ্চাটারই কাজ। সম্ভাবনা রয়েছে যে, কোনো একটা কাগজ মাদমোয়াজেলের কাটা। কিন্তু কীভাবে নিশ্চিত হবে ওই ব্যাপারে?

যন্ত্রের মতো টেবিলে রাখা স্কুলের বইগুলোর দিকে ঘুরে গেল শোমস, এরপর বইয়ের তাকে রাখা অন্য বইগুলোর দিকে। আচমকা উল্লাসধ্বনি বেরোল ওর মুখ দিয়ে।

বুকশেলফের কোনায়, এক্সারসাইজ-বইয়ের পুরোনো স্তূপটার নিচে, বাচ্চাদের একটা বর্ণমালার বইয়ের হদিস পেয়েছে ও। ছবি দিয়ে অলঙ্করণ করা এর অক্ষরগুলো। তবে একটা শব্দ গায়েব হয়ে গেছে একটা পাতা থেকে।

কাটা জায়গাটা পরীক্ষা করল শোমস। সপ্তাহের দিনগুলোর তালিকা রয়েছে পাতাটায়। সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, ইত্যাদি। কিন্তু পাত্তা নেই শনিবারের। আর শনিবার রাতেই চুরি হয়েছিল লণ্ঠনটা।

অন্তরের ছটফটানি আগেই ওকে স্পষ্ট করে দিয়েছিল: সঠিক রাস্তাতেই চলেছে ও। এ মুহূর্তে বিজয়ের বার্তা শুনতে পাচ্ছে কানে। সত্যের ওই আলো, নিশ্চয়তার সেই অনুভূতিগুলো কখনোই প্রতারণা করেনি ওর সাথে।

অস্থির হাতে বাকি পৃষ্ঠাগুলো পরীক্ষা করল শোমস। কিছুক্ষণ পরই আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করল ও। বড় হাতের অক্ষরের একটা পাতা ওটা, যাতে রয়েছে এক সারি সংখ্যাও। নয়টা অক্ষর আর তিনটে সংখ্যা সুচারুভাবে কেটে নেয়া হয়েছে ওখান থেকে।

ক্রম অনুসরণ করে উধাও হওয়া অক্ষর আর সংখ্যার তালিকা করল শোমস ওর নোটবইয়ে। পাওয়া গেল এটা:

CDEHNOPEZ-237

“হুম! প্রথম দেখায় মনে হয় দুর্বোধ্য ধাঁধা,” বিড়বিড় করল শোমস। “কিন্তু সবগুলো অক্ষর ওলটপালট ও ব্যবহার করে একটা, দুটো বা পূর্ণাঙ্গ তিনটে শব্দ দাঁড় করানো সম্ভব বোধহয়।“

চেষ্টা করল ও। কিন্তু কোনো কাজ হলো না তাতে।

একটামাত্র সমাধানেই পৌছুনো সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। যেদিক থেকেই নাড়াচাড়া করা হোক না কেন অক্ষরগুলো, বার বারই সামনে আসছে সমাধানটা। কাজেই, ওটাকেই সত্যিকার সমাধান হিসাবে ধরে নিল শোমস। ওটাকেই সমর্থন করছে যুক্তি আর পরিস্থিতি।

পাতাটায় যেহেতু কোনো দ্বৈত অক্ষর নেই, খুব সম্ভব- আদতে নিশ্চিত করেই বলা যায়- যে-শব্দই বানাতে যাক না কেন এসব অক্ষর দিয়ে, সম্পূর্ণ হবে না সেগুলো। অন্য পাতা থেকে অক্ষর নিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে মূল শব্দগুলো। ভুলত্রুটি আর বর্জনকে গ্রাহ্যের মধ্যে নিলে যে-সমাধান পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে:

REPOND Z-CH-237

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে প্রথম শব্দটা: réspondez বা reply। শব্দটায় দু’বার E রয়েছে বলে একটা E মিসিং এখানে, যেহেতু একটা অক্ষর একবারই রয়েছে পাতাটায়।

এর পর ২৩৭ সংখ্যাটা নিয়ে দ্বিতীয় যে-অপূর্ণাঙ্গ শব্দটা তৈরি হয়েছে, কোনোই সন্দেহ নেই, একটা ঠিকানা ওটা, যেখানে পাঠানো হয়েছে চিঠিটা সময় হিসাবে শনিবারকে বেছে নিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে CH. 237 নম্বর ঠিকানায় জবাব পাঠানোর জন্য।

আবার এমনও হতে পারে, CH. 237 হচ্ছে পোস্ট অফিসে চিঠিপত্রের ‘সাধারণ ডেলিভারি’ দেয়ার ঠিকানা। অথবা, কোনো শব্দের অপূর্ণাঙ্গ অংশও হতে পারে ওটা।

আবার ঘাঁটল শোমস বইটা। কিন্তু আর কোনো অক্ষর সরানো হয়েছে, এমন কোনো আলামত পেল না সে ওতে। অতএব, নতুন কোনো সূত্র হাতে না আসা পর্যন্ত এ-ই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে ওকে।

হেনরিয়েট এসে খেয়াল করল শোমসের কাজটা।

“মজার না?” সাক্ষী মানল ওকে বাচ্চাটা।

“হুম, মজার।” মাথা দোলাল শোমস। “আর কোনো কাগজ আছে তোমাদের? কিংবা এরই মধ্যে কাটা কোনো অক্ষর, যেগুলো সাদা কাগজে সাঁটাতে পারি আমি?”

“কাগজ? …না… মাদমোয়াজেল পছন্দ করবে না ওটা।”

“পছন্দ করবে না?”

“হ্যাঁ, এরই মধ্যে বকুনি শুনতে হয়েছে আমাকে। “

“কেন?”

“তোমাকে কিছু কথা বলে দিয়েছি যে! ও বলেছে, পছন্দের কাজের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা ঠিক নয়।”

“ঠিকই বলেছেন।”

খুশি হয়ে উঠল হেনরিয়েট। এতটাই যে, জামার সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো একটা সিল্কের ছোটো ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাপড়ের টুকরো, তিনখানা বোতাম, দুটো চিনির কিউব আর সব শেষে এক টুকরো কাগজ বের করল। কাগজটা তুলে দিলো ও শোমসের হাতে। “এই দেখো, এটাও আগেরটার মতো।”

একটা ক্যাবের নাম্বার লেখা ওতে— ৮২৭৯।

“কোথায় পেলে এটা?” শোমসের জিজ্ঞাসা।

“মাদমোয়াজেলের পকেট থেকে পড়ে গেছে।”

“কখন?”

“রবিবারের প্রার্থনায় যখন ও চাঁদা তুলছিল।”

“আচ্ছা। এবার তোমাকে বলি, কীভাবে ওনার বকুনি থেকে বাঁচবে। আমার সঙ্গে যে দেখা হয়েছে, এটা বোলো না ওনাকে- ব্যস।”

শোমস এবার মঁসিয়ে ডিইমভালের কাছে গিয়ে মাদমোয়াজেলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল ওনাকে।

“অ্যালিস ডিমান!” বিরক্ত হলেন ব্যারন। “কী করে ভাবলেন এটা? এ তো একেবারেই অসম্ভব!”

“কতদিন ধরে আপনার এখানে কাজ করছেন উনি?”

“মাত্র এক বছর। কিন্তু এ বাড়িতে ওর চেয়ে বেশি ভরসা রাখতে পারি না আমি অন্য কারও উপরে।”

“এখনও ওনাকে দেখিনি কেন আমি?”

“ক’দিনের জন্য বাড়ির বাইরে ছিল মেয়েটা।”

“কিন্তু এখন তো আছেন এখানে!”

“হ্যাঁ। আসার পর থেকে দেখাশোনা করছে আপনার অসুস্থ বন্ধুর। নার্সের সমস্ত গুণ রয়েছে ওর মধ্যে… অমায়িক, সংবেদনশীল… মঁসিয়ে উইলসনের ভালো লাগবে নিশ্চয়ই।”

“আহ!” বন্ধুকে পুরোপুরি উপেক্ষা করল শোমস। মুহূর্ত খানেক চিন্তার পর বলল, “রোববার সকালে বাইরে বেরিয়েছিলেন তিনি?”

“চুরির পরদিন?”

“হ্যাঁ।”

স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ব্যারন।

“এগারোটার দিকে বাচ্চাদের নিয়ে গির্জায় গিয়েছিল ও, বরাবরের মতোই,” বললেন মহিলা।

“তার আগে?”

“তার আগে? দাঁড়ান, ভেবে দেখি। চুরির ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই আপসেট ছিলাম যে… হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন… আগের দিন সন্ধ্যায় অনুমতি চাইতে এসেছিল ও রোববার সকালে বাইরে যাওয়ার জন্য। প্যারিস হয়ে যাচ্ছে, এমন এক কাজিনের সঙ্গে দেখা করবে বলেছিল বোধহয়। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই সন্দেহ করছেন না ওকে?”

“না, অবশ্যই না। তবে দেখা করতে চাইছি ওনার সঙ্গে।”

উইলসনের কামরায় গেল শোমস।

হাসপাতালের সেবিকার মতো ধূসর পোশাক পরিহিত এক মহিলা ঝুঁকে রয়েছে ওর বন্ধুর উপরে। মুখ ঘোরাতেই চিনতে পারল ওকে শোমস, রেলস্টেশনে দেখা সেই তরুণী!

মিষ্টি করে হাসল অ্যালিস ডিমান। বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত ভাব নেই ওর ব্যক্তিত্বপূর্ণ, সারল্য মাখা চোখ দুটোতে।

কিছু বলার চেষ্টা করল শোমস, থেমে গেল অস্ফুট ক’টা শব্দ উচ্চারণ করে।

আবার কাজে প্রবৃত্ত হলো মেয়েটা, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করছে শোমসের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে। বোতলগুলো সরিয়ে রেখে নতুন করে ব্যান্ডেজ জড়াল উইলসনের ক্ষতে। এবং আবারও অপাপবিদ্ধ হাসি দিলো শোমসের উদ্দেশে।

ঘুরে দাঁড়াল শোমস, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। কোর্টইয়ার্ডে মঁসিয়ে ডি’ইমভালের অটোমোবাইল দাঁড়ানো দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসল ওতে।

হেনরিয়েটের কাছ থেকে পাওয়া কাগজটায় একটা ঠিকানাও ছিল নাম্বারের সঙ্গে। সেই ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছুল ও লেভালুয়া-য় এক ক্যাব কোম্পানির অফিসে।

রোববার সকালে যে লোক ৮২৭৯ নম্বরের গাড়ি চালিয়েছিল, সে তখন ছিল না ওখানে।

অটোমোবাইলটা ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল শোমস।

ড্রাইভার ফিরে এসে জানাল, পার্ক মনশের কাছ থেকে কালো পোশাক পরা এক মহিলাকে তুলেছিল লোকটা। ভারি নেকাব ছিল মহিলার মুখে, আর স্পষ্টতই অস্থির দেখাচ্ছিল তাকে।

“কোনো প্যাকেট-ট্যাকেট কি ছিল মহিলার সঙ্গে?”

“হ্যাঁ, বেশ লম্বা একটা প্যাকেট ছিল বৈকি।“

“কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে তাকে?”

“অ্যাভিনিউ দ্য টারনিসে। প্লেস সেইন্ট-ফার্দিনান্দের কোনায় ওটা। দশটা মিনিট ছিল ওখানে মহিলা, এর পর আবার ফিরে আসে পার্কে।”

“চিনতে পারবে দ্য টারনিসের বাড়িটা?”

“সহজেই। নিয়ে যাব আপনাকে?”

“এক্ষুণি। তবে ছত্রিশ নম্বর কে দ্য অরফেভরেসে নিয়ে চলো আগে।”

পুলিশ অফিসে ডিটেক্টিভ গাঁইমার্দের সঙ্গে দেখা হলো শোমসের।

“মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, কোনো কাজ আছে আপনার হাতে?” জিজ্ঞেস করল ও। “লুপার কোনো ব্যাপার হলে— আছে।”

“হ্যাঁ, লুপাঁরই ব্যাপার।

“সেক্ষেত্রে যাচ্ছি না আমি।”

“কী! হাল ছেড়ে দিয়েছেন আপনি?”

“হ্যাঁ, প্রাপ্য সম্মান দিয়েছি অনিবার্য পরিণতিকে। অসম প্রতিযোগিতায় হারতে হারতে ক্লান্ত আমি। এবারও যে পরাজয় বরণ করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার চাইতে শক্তিশালী লুপাঁ, আমাদের দুজনের চাইতেই শক্তিশালী ও। সুতরাং, হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।”

“না, আমি অন্তত হাল ছাড়ছি না।”

“বাধ্য হবেন ছাড়তে, আর সবার ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে।”

“আর হাত-পা গুটিয়ে তা-ই দেখবেন আপনি, গাঁইমার্দ?”

“এ ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে আমার!” অসহায় কণ্ঠে বলল ডিটেক্টিভ। “তবে আপনি যেহেতু হাল ছাড়ছেন না, অতএব আমিও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।”

গাড়িতে উঠে বসল ওরা। চলে এল অ্যাভিনিউ দ্য টারনিসে। শোমসের নির্দেশে বাড়িটা থেকে কিছু দূরে, রাস্তার অন্য পাশে থেমে দাঁড়াল গাড়িটা, ছোটো একটা ক্যাফের সামনে। ক্যাফেটার প্রাঙ্গণে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আসন নিল দুজনে। আঁধার হতে শুরু করেছে সবে।

“ওয়েটার,” ডাকল শোমস। “লেখার কিছু জিনিস লাগবে আমার।”

একটা নোট লিখে ফের ডাকল ও লোকটাকে। চিঠিটা দিয়ে ওর নির্দেশ করা বাড়ির দারোয়ানকে দিতে বলল ওটা।

ক’মিনিট পর দারোয়ান লোকটা এসে দাঁড়াল ওর সামনে। শোমস জিজ্ঞেস করল ওকে, রোববার সকালে কৃষ্ণবসনা কোনো তরুণীকে দেখেছে কি না।

“কালো কাপড় পরা? হ্যাঁ, নয়টার সময়। তিন তলায় গিয়েছিলেন তিনি।“

“প্রায়ই দেখেন নাকি তাকে?”

“না, মাঝে মাঝে। আ… গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই দেখছি।”

“রোববারের পর কি দেখেছেন আর?”

“কেবল একবার, আর সেটা আজই। “কী! আজ এসেছিল মহিলা?”

“জি। এখনও আছেন ওখানে।”

“বলেন কী!”

“হ্যাঁ, দশ মিনিট আগে এসেছেন। বরাবরের মতো প্লেস সেইন্ট- ফার্দিনান্দে অপেক্ষা করছে ওনার গাড়িটা। দরজায় দেখা হয়েছে মহিলার সাথে।”

“কারা থাকে তিন তলায়?”

“দুজন। একজন এক ড্রেসমেকার, মাদমোয়াজেল লাঁজে; আর ব্রেসন নাম নিয়ে মাস খানেক আগে দু’খানা সুসজ্জিত কামরা ভাড়া নিয়েছেন এক ভদ্রলোক।”

“ব্রেসন নাম নিয়ে মানে?”

“নামটা বানানো মনে হয়েছে আমার কাছে। আমার স্ত্রী দেখভাল করছে কামরাটার… ইয়ে, একই আদ্যক্ষরঅলা এক জোড়া শার্ট পর্যন্ত পাওয়া যায়নি ওখানে।”

“লোকটা কি অনেকক্ষণ সময় কাটায় ঘরটায়?”

“না, বাইরে বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। তিন দিন ধরে পাত্তা নেই তাঁর।”

“শনিবার রাতে কি ছিল ওখানে?”

“শনিবার রাতে? দাঁড়ান, ভাবি একটু।…হ্যাঁ, শনিবার রাতে এসে কামরায় ছিলেন সারাটা রাত।”

“কী ধরনের মানুষ লোকটা?”

“বলা খুব মুশকিল। ঘন ঘন ভোল পাল্টান কিনা! কখনও লম্বা, কখনও খাটো, কখনও মোটা, কখনও পাতলা, কখনও ফরসা, কখনও শ্যামলা। সব সময় চিনতেও পারি না ওনাকে।”

দৃষ্টি বিনিময় করল শোমস আর গাঁইমার্দ।

“ও-ই সে,” মন্তব্য করল গাঁইমার্দ।

“ওই যে মহিলা!” বলে উঠল দারোয়ান।

এই মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মেয়েটি। হেঁটে চলেছে অপেক্ষমাণ গাড়িটার উদ্দেশে।

“আর ওই যে মঁসিয়ে ব্রেসন! “

“ব্রেসন? কোনজন?”

“পার্সেল রয়েছে যাঁর বগলের তলায়।”

“কিন্তু মেয়েটার দিকে তো মনোযোগ নেই ওর। একাই গাড়িতে উঠছে মেয়েটা।”

“হ্যাঁ, কখনোই একসঙ্গে দেখিনি আমি ওঁদেরকে।”

উঠে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা। স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় আর্সেন লুপাঁর অবয়ব চিনতে কষ্ট হচ্ছে না ওদের। মেয়েটার উল্টো দিকে হাঁটা ধরেছে সে।

“কাকে ফলো করবেন আপনি?” জিজ্ঞেস করল গাঁইমার্দ।

“লুপাঁকে তো বটেই। ও-ই তো পালের গোদা।”

“সেক্ষেত্রে মেয়েটার পিছু নিচ্ছি আমি।”

“না, না,” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শোমস। মেয়েটার পরিচয় ফাঁস করতে চায় না গাঁইমার্দের কাছে। “আমি জানি, কোথায় পাওয়া যাবে ওকে। আসুন আমার সঙ্গে।”

নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে লুপাঁকে অনুসরণ করতে লাগল ওরা; যতটা সম্ভব, চলমান ভিড় আর কাগজের দোকানের আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে। অনুসরণ করাটা সহজই মনে হচ্ছে ওদের কাছে, তার কারণ: ডানে-বাঁয়ে মোড় না নিয়ে সোজা হাঁটছে লুপাঁ। তবে সামান্য খোঁড়াচ্ছে ডান পায়ে। এতটাই সামান্য যে, জহুরির চোখ চাই ধরতে হলে। গাঁইমার্দ ব্যাপারটা খেয়াল করে বলে উঠল, “খোঁড়ার অভিনয় করছে লোকটা। আহ… সাথে যদি দু-তিনজন পুলিশ থাকত আমাদের, ধরাশায়ী করতে পারতাম ব্যাটাকে।”

কিন্তু পোর্টে দ্য টারনিসে পৌঁছুনোর আগ পর্যন্ত কোনো পুলিশম্যানের সাক্ষাৎ পেল না ওরা। দুর্গ পেরিয়েও সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখল না।

“রাস্তায় লোক যেহেতু খুবই কম,” মুখ খুলল শোমস। “আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো হবে আমাদের।”

বুলেভার্দ ভিক্টর-হুগোতে রয়েছে এখন ওরা। রাস্তার দু’পাশ ধরে হাঁটছে দুজনে, গাছের ছায়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে।

এভাবে মিনিট কুড়ি এগোনোর পর বাঁয়ে বাঁক নিল লুপাঁ, এগিয়ে চলল সিন নদীর পাড় ধরে। শিগগিরই দেখা গেল তাকে নদীর পাড় বেয়ে নিচে নামতে।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড অবস্থান করল ও ওখানে। তবে লুপাঁর কার্যকলাপ আর দেখতে পাচ্ছিল না গোয়েন্দারা। কুখ্যাত চোর আবার উপরে উঠে আসতেই এক প্রবেশপথের ছায়ায় লুকাল ওর অনুসরণকারীরা।

ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল লুপাঁ। পার্সেলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে বগলের নিচ থেকে। ও যখন ফিরে চলেছে, এক বাড়ি থেকে আরেকজন বেরিয়ে এসে গাছের আড়ালে আড়ালে চলল লুপাঁর পিছন পিছন।

“এ-লোক তো মনে হয় ফলো করছে ওকে,” বলল শোমস নিচু স্বরে।

অনুসরণের কাজটা আবারও শুরু হলেও এবার ওরা অস্বস্তি বোধ করছে তৃতীয় ব্যক্তিটির উপস্থিতিতে।

একই পথ ধরে ফিরে চলল লুপাঁ, পোর্টে দ্য টারনিস পেরিয়ে ঢুকে পড়ল আবার অ্যাভিনিউ দ্য টারনিসের বাড়িটায়।

ওরা যখন উপস্থিত হলো ওখানে, দারোয়ান তখন দুয়ার আঁটছিল রাতের জন্য।

“দেখেছেন লোকটাকে?” জানতে চাইল গাঁইমার্দ।

“হ্যাঁ,” জবাব দিলো দারোয়ান। “আমি যখন ল্যান্ডিংয়ের গ্যাস নেভাচ্ছি, তিনি তখন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছেন।

“কেউ কি রয়েছে ওর সঙ্গে?”

“না, কোনো ভৃত্য নেই লোকটার। এমনকি খায়ও না এখানে।“

“চাকরবাকরদের ওঠানামার জন্য সিঁড়ি আছে কোনো?”

“না, নেই।”

“আমি বরং কামরার দরজায় গিয়ে দাঁড়াই,” শোমসকে বলল গাঁইমার্দ। “এই ফাঁকে ক্যু ডিমুরে গিয়ে ঘুরে আসুন কমিসারি অভ পুলিশের কাছ থেকে।”

“এর মধ্যে পালিয়ে যায় যদি?”

“তো, আমি আছি কী করতে?”

“একজনের বিরুদ্ধে একজন, তাও আবার প্রতিপক্ষ যেখানে লুপাঁ, সেখানে আপনার কোনো আশা দেখছি না।”

“হুম। দরজার উপরে জোর খাটানোর ক্ষমতা নেই আমার। বিশেষ করে, রাতের বেলায়।”

শ্রাগ করল শোমস। “লুপাকে গ্রেফতার করলে, কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না, কেন ওকে গ্রেফতার করেছেন। যাইহোক… দরজার বেল বাজিয়ে দেখি, কী ঘটে।”

তিন তলায় উঠে এল ওরা। ল্যান্ডিংয়ের বাঁ দিকে একটা জোড়া-দরজা রয়েছে।

বেল চাপল গাঁইমার্দ। জবাব নেই।

আবারও বেল বাজাল সে। তাও কোনো উত্তর নেই।

“ভেতরে ঢুকতে হবে,” জরুরি তাগিদ শোমসের কণ্ঠে।

“ঠিক আছে,” প্রত্যুত্তরে বলল গাঁইমার্দ।

বলল বটে, কিন্তু তাও নড়ছে না ওরা। গুরুতর পরিস্থিতিতে তৎপরতা দেখানোর সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া মানুষের দশা হয়েছে যেন ওদের। ভেতরেই রয়েছে লুপাঁ, নাজুক দরজাটার ঠিক অন্য পাশে, এক ধাক্কায় ভেঙে ফেলা সম্ভব যেটা। তারপরও অসম্ভব মনে হচ্ছে কাজটা। কারণ, ওদের ধারণা, লুপাঁও ফাঁদ পেতেছে ওদের জন্য।

না, না, না− হাজার বারের মতো ভাবল দুজনে- সম্ভবত ভেতরেই নেই ও এখন। লাগোয়া ঘরবাড়ি, ছাদগুলো আর সুবিধাজনকভাবে তৈরি করা নির্গমনপথ ব্যবহার করে ভেগেছে বোধহয় লোকটা। এখন আর লুপাঁর ছায়াটিও পাবে না ওরা ভেতরে।

দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসতেই কেঁপে উঠল দুজনে। প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল তখন, ভেতরেই রয়েছে লোকটা, ভঙ্গুর কাঠের দরজাটা তাকে আড়াল করে রেখেছে। এটাও বুঝল, ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছে ও, শোনাটা অসম্ভব নয় মোটেই কী করা এখন! অবস্থা তো সঙ্গিন!

গোয়েন্দা হিসাবে প্রচুর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, এতটাই অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ওরা, মনে হচ্ছে, ওদের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি শুনে ফেলবে লুপাঁ।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে শোমসের দিকে তাকাল গাঁইমার্দ। পরক্ষণেই প্ৰচণ্ড জোরে ধাক্কা মেরে বসল দরজায়।

সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল ওপাশে। নিজের উপস্থিতি গোপন করার কোনো চেষ্টাই নেই পায়ের মালিকের।

আবার ধাক্কা দিলো গাঁইমার্দ। এরপর ও আর শোমস মিলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজার উপরে। পরমুহূর্তে থমকে দাঁড়াল ওরা হতবাক হয়ে

একটা গুলির আওয়াজ হয়েছে লাগোয়া কামরায়।

আরও একটা গুলি, আর দেহপতনের শব্দ।

পাশের কামরায় ঢুকে দেখা গেল, মার্বেলের ম্যান্টেলের দিকে মুখ করে ফ্লোরে পড়ে আছে লোকটা। হাত থেকে ছুটে গেছে রিভলভার।

উবু হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে দিলো গাঁইমার্দ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হতভাগ্যের চেহারা। এক জোড়া ক্ষত এই রক্তের উৎস। একটা গালে, আর আরেকটা হয়েছে কপালের পাশে।

“রক্তের কারণে চেনা যাচ্ছে না মুখটা।”

“তাতে কিছু যায়-আসে না, গাঁইমার্দ।” মাথা নাড়ল শোমস। “লুপা নয় এটা।”

“কীভাবে বুঝলেন? আপনি তো এমনকি ওর চেহারাও দেখেননি।”

“আপনার কি ধারণা, আর্সেন লুপাঁ আত্মহত্যা করার মানুষ?” শুধাল শোমস উপহাসের সঙ্গে।

“কিন্তু আমরা তো ভেবেছিলাম, বাইরে ওকে চিনেছি আমরা।”

“ভেবেছিলাম, কারণ সেটাই চেয়েছিল পাজিটা। ধোঁকা দিয়েছে ও আমাদের!”

“সেক্ষেত্রে এ লোক নিশ্চয়ই ওর কোনো সাগরেদ হবে!”

“আর্সেন লুপাঁর সাগরেদরাও আত্মহত্যা করে না।”

“তাহলে কে এই লোক?”

লাশটা সার্চ করল ওরা। ওটার এক পকেটে শোমস পেল খালি এক পকেটবুক, আর অন্য পকেট থেকে ক’টা লুই বের করল গাঁইমার্দ। পরিচয়ের কোনো প্রমাণই পাওয়া গেল না লোকটার কাছ থেকে। ট্রাঙ্ক আর দুটো সুটকেস থেকে কাপড়চোপড় ছাড়া আর কিছুই পেল না ওরা। ম্যান্টেলে পাওয়া গেল খবরের কাগজের গাদা। ওগুলো খুলল গাঁইমার্দ। প্রত্যেকটা কাগজেই জুইশ ল্যাম্প চুরির উপর প্রতিবেদন রয়েছে।

এক ঘণ্টা পর, ও আর শোমস যখন বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসছে, ওদের অসময়ের আগমনে সুইসাইড করতে বাধ্য হওয়া লোকটির ব্যাপারে একটিও তথ্যও নেই তখন ওদের হাতে।

কে ওই লোক? কেনই বা শেষ করে দিলো নিজেকে? জুইশ ল্যাম্পের সঙ্গে কী সম্পর্ক লোকটার? নদী থেকে ফেরার সময় কে ওকে অনুসরণ করছিল?

অনেক প্রশ্ন, অনেক রহস্য এসে ভিড় করেছে ওদের সামনে…

তিতিবিরক্ত হয়ে বিছানায় গেল শোমস।

পরদিন সকাল-সকাল একখানা টেলিফোন-বার্তা পেল ও:

মঁসিয়ে ব্রেসনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটা আপনাকে জানাতে পেরে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছে লুপাঁ। ২৫ জুন, বৃহস্পতিবার মরহুমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আপনার সদয় উপস্থিতি কামনা করছি।