২. দ্য শিপর‍্যাক

অধ্যায় দুই – দ্য শিপর‍্যাক

“এটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না, উইলসন!” ক্ষোভ ঝাড়ল শোমস। “এই ব্যাপারটাই রীতিমতো উত্তেজিত করে তুলেছে আমাকে। বারবার মনে হচ্ছে, কৌতুকে ভরা এক জোড়া ধূর্ত চোখ সর্বত্র অনুসরণ করে চলেছে হার্লক শোমসকে। সবই দেখছে ও, সবই ওর জানা; আমার সমস্ত ভাবনাচিন্তাও যেন পড়ে নিচ্ছে লোকটা। এমনকি আগে থেকে আন্দাজ করে ফেলছে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার খুঁটিনাটিও। আহ… অসাধারণ ওর অনুমানশক্তি! এমনকি স্বয়ং হার্লক শোমসের চাইতেও এগিয়ে ও এই একটা ব্যাপারে। কিছুই এড়ায় না ওর খপ্পর থেকে। আমি যেন কোনো মঞ্চাভিনেতা, যার প্রতিটি পদক্ষেপ পরিচালিত হচ্ছে স্টেজ-ম্যানেজারের দ্বারা। সে-ই ঠিক করে দিচ্ছে, কী করতে হবে আমাকে। বাধ্য ছেলের মতো আমাকে যেন পালন করতে হচ্ছে ঊর্ধ্বতনের নির্দেশগুলো। এই হচ্ছে অবস্থা! বুঝতে পারছ তো, উইলসন?”

উইলসন বুঝত ঠিকই, গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন লোকেদের মতো যদি ওর চলচ্ছক্তিহীন শরীরটার তাপমাত্রা একশ’ থেকে একশত তিন ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা না করত। তবে ও শুনুক বা না শুনুক, তাতে কিছুই আসে-যায় না শোমসের।

“কাজের অগ্রগতির জন্য সমস্ত শক্তি আর রিসোর্স নিয়ে সক্রিয় হতে হবে আমাকে,” বলে চলল ও। “সুখের কথা হলো, খোঁচা মেরে উল্টো জাগিয়েই দিয়েছে ওরা আমাকে। ক্ষতের যন্ত্রণা মিলিয়ে যেতেই, আত্মগরিমায় লাগা ধাক্কাটা সয়ে আসতেই, নিজেকে বলেছি আমি: ‘রোসো, বন্ধু! সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।’ আজ হোক, কাল হোক, নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়বে ওরা। কারণটা তো জানোই, উইলসন, ছোট্ট হেনরিয়েটের মাধ্যমে লুপাঁর সঙ্গে অ্যালিস ডিমানের সম্পর্কের গুমর ফাঁস হয়ে গেছে আমার কাছে। শুনছ তো, উইলসন?”

কিন্তু উইলসন তখন ঘুমিয়ে কাদা।

“এখনও অন্তত লেজেগোবরে হয়ে পড়েনি অবস্থা,” পায়চারি করতে করতে মুখ চালু রাখল শোমস। “খানিকটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়তো। তবে আলোর অস্তিত্বও টের পাচ্ছি আমি।”

“সবার আগে মঁসিয়ে ব্রেসন সম্বন্ধে জানতে হবে আমাকে। গাঁইমার্দকে নিয়ে যাব আবার নদীর পারে, যেখানে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিয়েছিল ব্রেসন। ভদ্রলোকের বিশেষ ভূমিকাটা হয়তো পরিষ্কার হবে এবার আমার কাছে। পরের খেলা অ্যালিস ডিমান আর আমার মধ্যে। দুর্বল প্রতিপক্ষ- কী বলো, উইলসন? তোমার কি মনে হয় না যে, বর্ণমালার বই থেকে কেটে নেয়া অক্ষরগুলো দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে, খুব শিগগিরই জানতে পারব সেটা? কিংবা জানব বিচ্ছিন্ন অক্ষর C আর H-এর মানে?”

কামরায় প্রবেশ করল মাদমোয়াজেল। শোমসকে বকবক করতে দেখে গলায় মধু ঢেলে বলল ও, “আমার পেশেন্টকে জাগিয়ে দিলে কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না আপনাকে, মঁসিয়ে। ওনাকে বিরক্ত করাটা উচিত হচ্ছে না আপনার। ডাক্তারসাহেব ওনাকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়েছেন।“

মেয়েটাকে নীরবে দেখল শোমস। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মেয়েটার এই আত্মনিয়ন্ত্রণ দেখে।

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন, মঁসিয়ে? মনে হচ্ছে, আমার মন পড়ার চেষ্টা করছেন আপনি! কী, ঠিক বলেছি না?”

এমনভাবে কথা বলছে মেয়েটা, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। সুন্দর চেহারা আর স্বচ্ছ নীল চোখে নিষ্কলুষ অভিব্যক্তি। মুখে খেলা করছে মৃদু হাসি।

এরকম নির্বিকার ভাবভঙ্গি দেখে ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভাঙার উপক্রম হলো ইংরেজ গোয়েন্দার। মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে ও অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, “কাল রাতে আত্মহত্যা করেছে ব্রেসন।”

তরুণীর ভাব দেখে মনে হলো, বুঝতে পারেনি শোমসের কথাটা। কাজেই আবারও বলতে হলো ওকে: “গতকাল রাতে আত্মহত্যা করেছে ব্রেসন।”

সামান্যতম আবেগ প্রকাশ পেল না অ্যালিসের মধ্যে। এমন আচরণ করছে, তথ্যটা যেন কোনো ধরনের আগ্রহ কিংবা দুশ্চিন্তা জাগাতে পারেনি ওর মধ্যে।

“জানিয়ে রাখলাম আরকি আপনাকে!” বিরক্তি ঢাকার কোনো চেষ্টাই করল না শোমস। “না হলে হয়তো চমকে যেতেন শুনে। অবশ্য আমার ধারণার চাইতেও শক্ত ধাতের আপনি। তবে আমার কাছ থেকে কোনোকিছু লুকিয়ে কী লাভ আপনার, বলুন তো!”

প্রশস্ত টেবিলে রাখা বর্ণমালার বইটা তুলে নিল শোমস। কাটা পাতাটা খুলে বলল, “জুইশ ল্যাম্পটা চুরি যাওয়ার চার দিন আগে ব্রেসনকে যে বার্তাটা পাঠিয়েছিলেন আপনি, সেটা তৈরি করার জন্য অক্ষরগুলো কোন ক্রমে সাজিয়েছিলেন, বলবেন কি?”

“ক্রম? ব্রেসন? জুইশ ল্যাম্প চুরি?”

এমনভাবে থেমে থেমে উচ্চারণ করল শব্দগুলো, যেন ওগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা।

“হ্যাঁ, এখান থেকে নেয়া হয়েছে অক্ষরগুলো, এই পাতাটা থেকে। কী লিখেছিলেন আপনি সেনকে?”

“অক্ষর নেয়া হয়েছে? কী বলছেন এসব?”

অকস্মাৎ হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা। “হাহ… এই তাহলে ব্যাপার! বোঝা গেল অবশেষে! ওই অপরাধের অপরাধী ভাবছেন তবে আমাকে! কোনো এক মঁসিয়ে ব্রেসন চুরি করেছিল ল্যাম্পটা, এখন সে আত্মহত্যা করেছে। আর আপনি তার সঙ্গী মনে করছেন আমাকে! ওহ, কী নির্বোধ আপনি! “

“কাল রাতে অ্যাভিনিউ দ্য টারনিসের এক বাড়ির তিন তলায় কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি?”

“আমার ড্রেসমেকার মাদমোয়াজেল লাজেঁর সঙ্গে। বলতে চাইছেন, তিনি আর মঁসিয়ে ব্রেসন একই ব্যক্তি?”

সব কিছু জানা থাকা সত্ত্বেও সন্দেহে পড়ে গেল শোমস। যে কেউ-ই পারে ভয়, আনন্দ, উদ্বেগ; আদতে সব ধরনের আবেগই দমিয়ে রাখতে; কিন্তু পারে না এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন থেকে, চটুল, বেপরোয়া হাসি দিয়ে সেটা উড়িয়ে দিতে।

“কেন ওই দিন নর্দার্ন রেলওয়ে স্টেশনে অনুরোধ করেছিলেন আপনি আমাকে? কেন বলেছিলেন চুরির তদন্ত না করে অবিলম্বে বাড়ি ফিরে যেতে?”

“বড়ই অনুসন্ধিৎসু মন আপনার, মঁসিয়ে!” এখনও একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসছে মেয়েটা। “শাস্তি দেয়ার জন্য কিছুই বলব না আপনাকে। জরুরি প্রয়োজনে ফার্মেসিতে যেতে হচ্ছে এখন। ততক্ষণ খেয়াল রাখুন রোগীর প্রতি। বিদায়।”

চলে গেল মেয়েটা।

“একটা মেয়ে আমাকে ঘোল খাইয়ে দিলো এভাবে!” বিড়বিড় করতে লাগল শোমস। “ওর কাছ থেকে কিছু যে বের করতে পারিনি, শুধু তা-ই নয়; আমি যে সন্দেহ করছি ওকে, সেটাও বুঝিয়ে দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছি মেয়েটাকে।”

নীল হীরের ঘটনাটা মনে পড়ল ওর। মনে পড়ল ক্লোটিল্ডা দেস্তাগের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। স্বর্ণকেশী ওই মহিলাও কি একই রকম নির্বিকার প্রশান্তির সঙ্গে মোকাবেলা করেনি ওর প্রশ্নগুলোর? আরও একবার কি এমনই একজনের মুখোমুখি হয়নি ও, লুপাঁর ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মাথা একদম ঠাণ্ডা রেখেছে যে ভয়ানক বিপদের মাঝেও?

“শোমস… শোমস…”

ডাকটা উইলসনের।

বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল শোমস। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, উইলসন? ব্যথা করছে নাকি?”

ঠোঁট নড়ে উঠল উইলসনের, কিন্তু কোনো কথা বেরোল না। অনেক কসরতের পর বলতে পারল শেষমেশ, “ন্-না, শোমস… ও নয়… এটা অসম্ভব…’

“কী জানো তুমি, উইলসন? আমি বলছি, ও-ই সে। এই প্রথম লুপাঁর এমন এক সহচরের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে আমার, যাকে দেখে মাথা-টাথা গরম করে ফেলে গর্দভের মতো কাজ করে বসেছি। বাজি ধরতে পারো, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আমাদের সাক্ষাতের সমস্ত কিছুই জেনে যাবে লুপাঁ। আরে, কীসের এক ঘণ্টা? কী বলছি এসব? এরই মধ্যে জেনে গেছে নির্ঘাত! ফার্মেসিতে যাওয়া… জরুরি প্রয়োজন… সবই ভুয়া কথা! গেছে আসলে লুপাঁকে টেলিফোন করতে!”

কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়ল শোমস। চলে এল অ্যাভিনিউ দ্য মেসিনে-য়। সময়মতোই পৌঁছুতে পেরেছে ও, সেজন্যই ফার্মেসিতে ঢুকতে দেখল মাদমোয়াজেলকে।

দশ মিনিট পর ছোটো ছোটো কয়েকটা প্যাকেট আর সাদা কাগজে মোড়ানো একটা বোতল নিয়ে বেরিয়ে এল মেয়েটা। বেশি দূর এগোতে পারেনি, তার আগেই হ্যাট হাতে একজন থামাল ওকে। মতিগতি পরিষ্কার নয় লোকটার; মনে হলো, সাহায্য চাইছে।

লোকটাকে কিছু দিলো মেয়েটা, এরপর পা চালাল আবার নিজের পথে।

“লোকটার সঙ্গে কথা বলেছে অ্যালিস,” শোমস নিজেকে বলল।

কী ভেবে কৌশল পরিবর্তন করল ও। মেয়েটাকে ছেড়ে এবার ও পিছু নিল সন্দেহভাজন ভিক্ষুকটির।

অ্যাভিনিউ দ্য টারনিসের দিকে মন্থর পায়ে হাঁটছে লোকটা। অনেকক্ষণ ঘুরঘুর করল বাড়িটার আশপাশে, একদা যেখানে ব্রেসন থাকত। বার কয়েক চোখ তুলে তাকাল সে তিন তলার জানালাগুলোর দিকে। লক্ষ করল ও বাড়িতে প্রবেশ করা মানুষগুলোকে।

ঘণ্টা খানেক পর নিইলির দিকে যাত্রা করা এক ট্রামকারের উপরতলায় চড়ে বসল সন্দেহভাজন। পিছু নিয়ে শোমস গিয়ে বসল তার পিছনের সিটে।

ওর পাশে যে ভদ্রলোকটি বসেছে, খবরের কাগজ দিয়ে চেহারা আড়াল করা তার। দুর্গের কাছে এসে কাগজটা নামালে গাঁইমার্দকে চিনতে পারল শোমস।

“গত রাতে এই লোকই ফলো করেছিল ব্রেসনকে,” সামনের জনের দিকে ইঙ্গিত করে ফিসফিসিয়ে বলল পুলিশ ডিটেক্টিভ। “এক ঘণ্টা ধরে ওর বাড়ির উপর নজর রেখেছে ব্যাটা।”

“ব্রেসনের ব্যাপারে নতুন কিছু জানতে পারলেন?” জিজ্ঞেস করল শোমস।

“হ্যাঁ, সকালে একটা চিঠি এসেছে ওর ঠিকানায়।”

“আজ সকালে? তাহলে তো মনে হয় ব্রেসনের মৃত্যুর ব্যাপারে অবহিত হওয়ার আগেই চিঠি পোস্ট করেছিল প্রেরক।”

“ঠিক তাই। এক্সামিনিং ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে এখন চিঠিটা। তবে ওটা পড়েছি আমি। ওতে লেখা: ‘কোনো ধরনের আপস কাম্য নয় ওর। সবই চাইছে লোকটা— প্রথমটা তো বটেই, দ্বিতীয় বারেরগুলোও। অন্যথায়, হাসিল করবে নিজের পরিকল্পনা।”

“কোনো স্বাক্ষর নেই চিঠিতে,” যোগ করল গাঁইমার্দ। “এ ক’টি বাক্য থেকে কোনো ধরনের সাহায্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। “

“আমি এতে একমত নই, গাঁইমার্দ। আমার কাছে তো খুবই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হচ্ছে বাক্যগুলো।”

“কী কারণে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি।”

“না পারার কারণ, ওটা আমার ডিপার্টমেন্ট,” মক্কেলদের সঙ্গে যে ভঙ্গিতে কথা বলে, অনেকটা ওরকম করেই বলল শোমস।

ক দ্য শ্যাতোতে থামল ট্রামকারটা। এর পর আর যায় না গাড়ি। ট্রাম থেকে নেমে চুপচাপ হাঁটতে লাগল লোকটা।

খুব কাছ থেকে শোমসকে অনুসরণ করতে দেখে আপত্তি তুলল গাঁইমার্দ। “ঘুরে তাকালে সন্দেহ করে বসতে পারে আমাদের।”

“ঘুরবে না।”

“কীভাবে জানছেন সেটা?”

“লুপার সাগরেদ ও। হাঁটার ধরন থেকেই বোঝা যাচ্ছে সেটা। পকেটে যেভাবে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি: ওকে যে অনুসরণ করা হচ্ছে, জানে লোকটা। আর দ্বিতীয়ত, ভীত নয় সে।”

“তাও আমার মনে হচ্ছে, অনুসরণ করার জন্য খুব কাছে হয়ে গেছে দূরত্বটা।

“এতখানি কাছে নয় যে, আমাদের হাত গলে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারব। নিজেও সে জানে এটা।”

“আহ, ওই দেখুন! ওই ক্যাফেটার সামনে বাইসাইকেলঅলা দুজন পুলিশ দেখতে পাচ্ছি। সাহায্যের জন্য ডাক দিলে, কীভাবে পালাবে লোকটা?”

“ভালো কথা। তবে আমার বন্ধুটির কিন্তু এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টো, নিজেই ও লোকগুলোর সাহায্য চাইবে বলে মনে হচ্ছে।”

“হা, ঈশ্বর!” চেঁচিয়ে উঠল গাঁইমার্দ। “স্নায়ুর জোর আছে বটে বদমায়েশটার!”

লোকটা যখন পুলিশ দুজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ওরা তখন বাইসাইকেলে চেপেছে। দু-চার আলাপের পর ক্যাফের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা তৃতীয় আরেকটা সাইকেলে উঠে পড়ল ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে থাকা লোকটা। তারপর দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল দুই পুলিশম্যানের সঙ্গে।

“আরে, এ কী! এক, দুই, তিন… হাওয়া!” গরগর করে উঠল শোমস। “কাদের সহায়তায়, গাঁইমার্স? আপনারই দুই সহকর্মীর! তাক লাগিয়ে দিচ্ছে লুপাঁর এই দলটা! বাইসাইকেল পুলিশকেও কাজে লাগাচ্ছে এরা! বলেছিলাম না, সামনের লোকটা খুব শান্ত আর নিশ্চিত ছিল নিজের ব্যাপারে?” করুণ হাসল ও।

“তাহলে?” যারপরনাই বিরক্ত গাঁইমার্দ। “কী করা এখন? হাসা তো খুবই সহজ। যে-কেউ-ই করতে পারে সেটা।’

“দাঁড়ান! দাঁড়ান! মাথা গরম করবেন না, গাঁইমার্দ! শোধ আমরাও নেব। তবে এ মুহূর্তে রি-ইনফোর্সমেন্ট প্রয়োজন আমাদের।”

“অ্যাভিনিউ দ্য নিইলির শেষ মাথায় আমার অপেক্ষায় রয়েছে ফলেনফাত।”

“ঠিক আছে। ওকে নিয়ে এসে যোগ দিন আবার আমার সঙ্গে। আমি পিছু নিচ্ছি পলাতকের।”

বাইসাইকেলের ট্র্যাক অনুসরণ শুরু করল শোমস। সাইকেলের চাকার স্পষ্ট ছাপ পড়েছে ধুলোর উপরে। অল্পক্ষণেই নিশ্চিত হলো ও, ট্র্যাকগুলো ওকে নিয়ে চলেছে সিন নদীর দিকে। আগের সন্ধ্যায় যেদিক গিয়েছিল ব্রেসন, সেদিকেই চলেছে তিনজনে।

চলতে চলতে এসে পৌঁছুল ও এক প্রবেশপথে, আগের দিন যেখানে গা ঢাকা দিয়েছিল গাঁইমার্দের সঙ্গে। একটু পরে সাইকেলের ট্র্যাকগুলোর জগাখিচুড়ি আবিষ্কার করল এক জায়গায়। বুঝতে পারল, ওখানে এসে থেমেছে লোকগুলো। ঠিক এর বিপরীত দিকে এক টুকরো জমিন উন্মুক্ত হয়েছে নদীর দিকে। পুরোনো একটা নৌকা বাঁধা পাড়ে। এখানেই প্যাকেটটা ছুঁড়ে কিংবা ফেলে দিয়েছিল ব্রেসন।

পাড় ধরে নেমে চলল শোমস। ঢাল বেশি খাড়া আর পানি বেশি গভীর না হওয়ায় প্যাকেট তুলে নেয়াটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। দেখা গেল, আগেই তিনজনে তুলে নিয়ে যায়নি ওটা।

“সম্ভবত বেশি সময় পায়নি বলে,” ভাবল ও। “পনেরো মিনিট এগিয়ে ছিল ওরা বড়জোর। তারপরও এদিকে এল কেন?”

এক জেলে বসে ছিল নৌকাটায়। শোমস গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “ক’মিনিট আগে সাইকেলে চেপে তিন লোককে আসতে দেখেছেন এখানে?”

না-সূচক মাথা নাড়ল লোকটা।

“পাড়ের ঠিক কিনারে এসে থেমেছিল ওরা…”

বড়শিটা বগলে আটকে পকেট থেকে একখানা নোটবই বের করল জেলে। একটা পাতায় কিছু একটা লিখে পাতাটা ছিঁড়ে দিলো শোমসের হাতে।

হকচকিয়ে গেছে ইংরেজ গোয়েন্দা। হাতে ধরা কাগজটার মাঝে বর্ণমালার বই থেকে কাটা অক্ষর আর সংখ্যাগুলো সঠিক ক্রমে সাজানো:

CDEHNOPRZEO-237

আবার মাছ ধরা শুরু করল লোকটা। রোদ থেকে বাঁচতে বড়সড় একখানা স্ট্র হ্যাট চাপিয়েছে মাথায়। পাশেই রাখা কোট আর ভেস্টটা। এক মনে তাকিয়ে রয়েছে সে সুতোয় বাঁধা ফাতনার দিকে। জলের উপরিতলে ভাসছে ওটা।

এক মুহূর্তের অস্বস্তিকর নীরবতা।

“এ-ই কি সে-ই?” নিদারুণ উদ্বেগ ভর করেছে শোমসের মধ্যে। পরমুহূর্তেই সত্যটা উদ্ভাসিত হলো ওর কাছে।

হ্যাঁ, এ-ই সে! এ-ই সে! আর কারও পক্ষে এতখানি শান্ত থাকা সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই, নেই অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র শঙ্কা! তাছাড়া আর কে-ই বা জানবে রহস্যময় চিঠির ব্যাপারটা? দূত মারফত সাবধান করে দিয়েছে ওকে অ্যালিস!

সহসা অনুভব করল শোমস, নিজের অজান্তেই হাত চেপে বসেছে রিভলভারের হাতলে। লোকটার পিছনে দৃষ্টি নিবদ্ধ ওর, ঘাড়ের সামান্য নিচের দিকে। একটু নড়াচড়া- ব্যস, খেল খতম! করুণ পরিণতি ঘটবে দুঃসাহসী চোরের।

কিন্তু না, নড়ছে না জেলে।

অস্থির হাতে রিভলভারটা নাড়াচাড়া করছে শোমস। হাত নিশপিশ করছে গুলি করে দিয়ে সমস্ত কিছুর অবসান ঘটাতে। কিন্তু এমন কিছু করাটা তো ধাতে নেই ওর। তা ছাড়া লুপাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তো ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে রহস্যটা।

“উঠে দাঁড়িয়ে বাধা দিক লোকটা,” ভাবল ও। “নইলে খারাপি আছে ব্যাটার কপালে। আর এক সেকেন্ড দেখব… তারপর…”

কিন্তু পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘোরাতে বাধ্য হলো ও। দুজন সহকারীকে নিয়ে ফিরে এসেছে গাঁইমার্দ।

মুহূর্তেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে, নৌকায় উঠে পড়ল শোমস। অকস্মাৎ দুলে ওঠায় ঘাট থেকে সরে গেল নৌকা। লোকটার উপর চড়াও হয়ে জাপটে ধরল ওকে ইংরেজ গোয়েন্দা। দুজনে একসাথে গড়াতে শুরু করল নৌকার তলার দিকে।

“কী মানে এসবের!” চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ, প্রাণপণে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে নিজেকে। “যে-ই জিতুক না কেন, ফায়দাটা কী হচ্ছে তাতে? আপনিও বুঝবেন না, কী করবেন আমাকে নিয়ে; আমিও না। দুজনের জন্যই আহাম্মকি হয়ে যাচ্ছে সেটা!”

পিছলে দাঁড় দুটো পড়ে গেল পানিতে।

“হায়, খোদা, এ কী অনর্থ ঘটাচ্ছেন আপনি! আপনার বয়সী একজনের তো এর চেয়ে ভালো কিছু করা উচিত ছিল! বাচ্চাদের মতো আচরণ করছেন আপনি, মঁসিয়ে শোমস!”

ডিটেক্টিভের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে লুপাঁ। বেদম হাঁপাচ্ছে গোয়েন্দা। শত্রুকে নিকেশ করার অভিপ্রায়ে দাঁতের ফাঁকে শপথ উচ্চারণ করতে করতে হাত ঢোকাল পকেটে। আর তক্ষুণি খেয়াল হলো, লুপাঁ কেড়ে নিয়েছে ওর রিভলভারটা।

হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে যাওয়া দাঁড় দুটোর একটা তোলার চেষ্টা করল শোমস তীরে ভেড়ার জন্য। অন্যদিকে লুপাঁ চেষ্টা করছে অন্য দাঁড়টা ওঠানোর, নদীর গভীরে নৌকা নিয়ে যেতে চায়।

“ধুর, গেছে!” খেদ ঝাড়ল লুপাঁ। “নাগাল পাচ্ছি না দাঁড়টার! তবে ওতেও কিছু যায়-আসে না। আপনি যদি তুলতে পারেন দাঁড়টা, আমি বাধা দেব আপনাকে। আপনিও হয়তো তা-ই করতেন। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, উদ্দেশ্য কিংবা নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এসব করছি আমরা। বৃথাই খরচ করছি নিজেদের শক্তি। নিয়তিই যেন ঠিক করে দিয়েছে এগুলো। তো, বুঝতে পারছেন না কেন, নিয়তি ওর পরম বন্ধু আর্সেন লুপাঁর পক্ষেই রয়েছে। এই খেলা একান্তই আমার। স্রোত পুরোপুরি আমার অনুকূলে।”

মন্থর গতিতে নদীর দিকে ভেসে চলেছে নৌকা

“দেখুন, দেখুন! তাকিয়ে দেখুন!” হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ।

কেউ একজন রিভলভার তাক করেছে তীর থেকে।

থমকে গেছে লুপাঁ।

গুলি হলো একটা। নৌকার পিছনে ছলকে উঠল নদীর পানি। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কুখ্যাত চোর।

“ঈশ্বর করুণাময়!” চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ। “আমার বন্ধু গাঁইমার্দ ওটা! কিন্তু বিরাট ভুল করে ফেলেছে বন্ধু! আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া তো গুলি করার অধিকার নেই ওর। লুপাঁ কি ওকে এতটাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে যে, বিস্মৃত হয়েছিল এটা? তবে নিজেকে এবার সংবরণ করো, দোস্ত! গুলি কোরো না আর। তাতে আহত হতে পারেন আপনার এই ইংরেজ বন্ধুটি।”

শোমসের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল লুপাঁ, এরপর গাঁইমার্দকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাল আবার, “গাঁইমার্স! তৈরি আমি! সই করুন ওনার হৃৎপিণ্ড বরাবর। আরও উপরে তুলতে হবে পিস্তলটা… আরেকটু বাঁ দিকে… হ্যাঁ! প্রথমবার তো মিস করেছিলেন। তাক খারাপ আপনার। চেষ্টা করুন আরেকবার। হবে না, হাত কাঁপছে আপনার! এক… দুই… তিন… ফায়ার! আহ-হা, আবারও মিস! ঈশ্বর! কর্তৃপক্ষ কি খেলনা-পিস্তল দিয়েছে আপনাকে?”

লম্বা একটা রিভলভার বের করে লক্ষ্যস্থির না করেই গুলি চালাল লুপাঁ।

হ্যাটে হাত চলে গেল গাঁইমার্দের। গুলিটা ছ্যাঁদা করে দিয়েছে ওর টুপি।

“কী মনে হচ্ছে, অ্যা?” মৌজে রয়েছে লুপাঁ। “সত্যিকারের রিভলভার আমারটা, খাঁটি ইংলিশ বুলডগ। আমার বন্ধু হার্লক শোমসের জিনিস।

হেসে উঠে তীরের দিকে ছুঁড়ে দিলো ও পিস্তলটা। গাঁইমার্দের পায়ের কাছে পড়ল ওটা।

তারিফের হাসি না হেসে পারল না শোমস। প্রাণশক্তির কী অবাধ স্ফুরণ লোকটার! মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা উপভোগই করছে লুপাঁ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা যেন শারীরিক সুখই দিচ্ছে ওকে। অনন্যসাধারণ চোরের জীবনে যেন বিপদ এড়ানোর বদলে বিপদকে আপন করে নেয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। কীসের জন্য? নিজের বিনোদনের জন্য!

প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে এখন নদীপারে। মন্থর স্রোতে এগিয়ে চলা নৌকাটাকে অনুসরণ করছে গাঁইমার্দ আর ওর সঙ্গীরা। লুপাঁর ধরা পড়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ঘুরল লোকটা শোমসের দিকে। “খুবই সহজ একটা প্রশ্ন করছি আপনাকে- উত্তরটাও চাই এক কথায়- হ্যাঁ কিংবা না দিয়ে। এভাবেই কি চাইছেন আপনি? যে-ক্ষতিটা করলেন আপনি, এ মুহূর্তে সেটা আমার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তবে এরপর কিন্তু সাধ্যের বাইরে চলে যাবে সব কিছু…”

“হ্যাঁ, এভাবেই চাইছি আমি…”

বিরক্তিতে ছেয়ে গেল লুপাঁর চেহারা। “আবারও জিজ্ঞেস করছি আপনাকে! আমার নিজের চাইতে আপনারই ভালো বেশি এতে। কারণ, আমি নিশ্চিত, আপনিই পস্তাবেন প্রথমে আপনার এই বাড়াবাড়ির জন্য। শেষবারের মতো জানতে চাইছি— হ্যাঁ, নাকি না?”

“হ্যাঁ।”

নিচু হয়ে নৌকার একখানা পাটাতন সরাল লুপাঁ। পরের কয়েকটা মিনিট কী কাজে মগ্ন রইল, ও-ই জানে। সিধে হয়ে ইংরেজ গোয়েন্দার পাশে বসে বলল, “আমার বিশ্বাস, মঁসিয়ে, একই উদ্দেশ্য নিয়ে নদীতে এসেছি আমরা, ব্রেসনের ফেলে যাওয়া জিনিসটা উদ্ধার করতে। আমার কথা বলি। ক’জন বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এখানে। নিজে উদ্যোগী হয়েছিলাম নদীর আশপাশে খোঁজাখুঁজি করতে। একটা পর্যায়ে বন্ধুরা আপনার আগমনবার্তা ঘোষণা করে। স্বীকার করছি যে, খবরটায় বিস্মিত হইনি আমি, যেহেতু নজর ছিল আপনার তদন্তকর্মের খুঁটিনাটির দিকে। খুবই সহজ কাজ এটা। আগ্রহ জাগানোর মতো যা-কিছুই ঘটুক না কেন ক্য মুরিয়োতে, একটা ফোন করে দিলেই জেনে যাই আমি।”

থামল লুপাঁ। যে পাটাতনটা খুলে ফেলেছে ও, পানিতে ভাসতে ভাসতে সেটা এখন উঠে আসছে উপরে।

“পোড়া কপাল আমার!” অদৃষ্টকে গাল দিয়ে উঠল লুপাঁ। “জানি না, কীভাবে ঠিক করব এটা। মনে হচ্ছে, লিক হয়েছে নৌকাটায়। ভয় করছে না আপনার, মঁসিয়ে?”

কাঁধ ঝাঁকাল শোমস।

“আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা,” বলে চলল লুপাঁ। “এ ধরনের পরিস্থিতিতে, আমি যদি লড়াই এড়াতে চাইতাম, উল্টো আপনিই বেশি করে জড়াতে চাইতেন লড়াইয়ে। আপনিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এখন ব্যাপারটা? না, খারাপ লাগছে না এরকম একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, ফলাফল যেহেতু জানাই আছে, সবগুলো ট্রাম্প কার্ড যেহেতু আমারই হাতে। ভেবে দেখলাম, বহুল প্রচার হওয়া উচিত আমাদের এই দ্বৈরথটার, সবাই যাতে অবগত হয় আপনার পরাজয় সম্বন্ধে। তাতে আর কোনো কাউন্টেস দ্য ক্রোজোন কিংবা ব্যারন ডি’ইমভালে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে না আপনাকে। তা ছাড়া, মাই ডিয়ার মঁসিয়ে-”

আবার থেমে গেল লুপাঁ। আধখোলা হাত দুটো দুরবিন হিসাবে ব্যবহার করে নদীর তীর জরিপ করল সে।

“হে, ঈশ্বর! ফাটাফাটি একটা নৌকা চার্টার করেছে ওরা। সত্যিকারের যুদ্ধযান যাকে বলে। কীভাবে বৈঠা মারছে, দেখেছেন? পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের পাশে চলে আসবে ওরা, হার স্বীকার করতে হবে আমাকে। একটা পরামর্শ দিই, মঁসিয়ে, ধরেবেঁধে আইনের লোকেদের হাতে সোপর্দ করুন আমাকে। কেমন লাগছে আইডিয়াটা? না হয় খানিক বাদেই ডুবে মরব আমরা। কিছুই করার থাকবে না তখন আমাদের। কী বলবেন, মঁসিয়ে?”

চোখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা। লুপাঁর সুবিধাটা এখন উপলব্ধি করতে পারছে শোমস। নৌকার তলা ফুটো করে দিয়েছে লোকটা। পানি উঠছে হু-হু করে। জুতোর তলা ছুঁয়ে ফেলেছে পানি। পরক্ষণেই ডুবে গেল পায়ের পাতা

নড়ল না দুজনের কেউ। দেখতে দেখতে হাঁটুর নিচের অর্ধেকটা পর্যন্ত উঠে এল পানি।

পকেট থেকে তামাক বের করে সিগারেট রোল করল শোমস, তারপর জ্বালিয়ে নিল ওটা।

“মনে করবেন না যে, প্রস্তাবটা আমার দুর্বলতা থেকে দেয়া,” বলে চলেছে লুপাঁ। “যে যুদ্ধে আপনার কাছে হার মেনে নিয়েছি, সেই যুদ্ধক্ষেত্র নিজে তৈরি করিনি আমি। নয়তো আমার জয় ছিল অবধারিত। হৃদয়ঙ্গম করছি, আপনিই আমার একমাত্র শত্রু, যাকে ভয় করে এই বান্দা। আশঙ্কা হচ্ছে, আমার পথ থেকে হটবেন না আপনি। ভাগ্য আপনার সাথে আলাপের সুযোগটা দিয়েছে বলে বলছি কথাগুলো। একটাই আফসোস- এমন সময় হচ্ছে আলাপটা, যখন কিনা ফুটবাথ নিচ্ছি আমরা। স্বীকার করতেই হবে যে… অ্যা, কী বললাম? ফুটবাথ? অবস্থা তো এর চেয়েও খারাপ দেখছি!”

যেখানটায় বসে ছিল ওরা, সেপর্যন্ত চলে এসেছে এখন নদীর পানি। ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে নৌকাটা!

ধূমপানরত শোমসকে দেখে মনে হচ্ছে, শান্ত ভঙ্গিতে ঘটনার মজা নিচ্ছে ও। বিপদাপন্ন কোনো মানুষ যদি— লোকজন যাকে ঘিরে ফেলেছে— পিছু নিয়েছে এক দঙ্গল পুলিশ- রঙ্গতামাশা করতে পারে এভাবে; ও-ই বা কীভাবে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্নায়ুদৈর্বল্য দেখায়?

দুজনকেই দেখে মনে হচ্ছে, বলে উঠবে ওরা: “কেমন লাগে এভাবে উৎপাত করলে? রোজই কি মানুষ ডুবে মরছে না নদীতে? এটা কি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা যে, বিশেষভাবে নজর দিতে হবে?” একজন বকবক করছে, আরেকজন নিজের চিন্তায় মগ্ন; কিন্তু দুজনেই আসলে বিকারহীনতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের আহত আত্মাভিমান।

আর এক মিনিট! তারপরই পুরোপুরি তলিয়ে যাবে নৌকাটা।

“আইনের ধ্বজাধারীরা পৌছুনোর আগে হোক বা পরে, ডুববই আমরা,” বলল লুপাঁ। “গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটাই। নৌকাডুবির সঙ্গেই শেষ হচ্ছে সব কিছু। সময় এখন নিজেদের উইল তৈরি করার। আমার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছি আমি ইংল্যান্ডের নাগরিক হার্লক শোমসকে। নিজের সুবিধা ও প্রয়োজনে এসব ব্যবহার করবেন তিনি। কিন্তু, ঈশ্বর, কত দ্রুতই না এগিয়ে আসছে লোকগুলো! বড়ই সাহসী ওরা, আহা! এদেরকে চাক্ষুষ করাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার। দাঁড়গুলো কী রকম, দেখেছেন? আহ! ওটা কি তুমি নাকি, ব্রিগেডিয়ার ফলেনফাত? সাবাস! তারিফ করতে হয় যুদ্ধযান নিয়ে আসার। পদক চাও এর জন্য? তোমার ঊর্ধ্বতনদের কাছে সুপারিশ করব তবে তোমার নামে। আর তোমার সহযোদ্ধা ডিউজি? কোথায় সে? আহ, হ্যাঁ! মনে হলো, নদীর বাম তীরে যেন দেখলাম ওকে। স্থানীয় লোকেদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার মানে, নৌকাডুবি থেকে যদি বেঁচেও যাই, ধরা পড়ব ডিউজি আর ওর লোকেদের হাতে। এদিকে নিইলির বাসিন্দাদের নিয়ে ডান দিকে রয়েছে গাঁইমার্দ। উভয়সঙ্কট দেখি!“

পানির একটা ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আটকে গেল নৌকাটা। দাঁড় আটকানোর ফাঁকটা ধরে সামলাল শোমস নিজেকে।

“মঁসিয়ে, কোটটা খুলে ফেলা উচিত আপনার। কোট ছাড়া সহজ হবে সাঁতরানো। না? প্রত্যাখ্যান করছেন প্রস্তাবটা? তাহলে আমিও পরে নিচ্ছি আমারটা।”

কোট পরল লুপাঁ। শোমসের মতোই আঁটো করে বোতাম লাগাল।

“কী জঘন্য লোক আপনি! এরকম পরিস্থিতিতেও গোয়ার্তুমি করছেন! যদিও আপনার শক্তিরই পরিচয় দিচ্ছে এটা। কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে আদৌ? সত্যিই, নিজের পায়ে কুড়াল মারছেন আপনি!”

“মঁসিয়ে লুপাঁ,” নীরবতা ভাঙল শোমস। “বেশি কথা বলেন আপনি। অধিক আত্মবিশ্বাস আর ছেলেমানুষির কারণে বকবক করে কানের পোকা নাড়িয়ে দেন।”

“কী, এত বড় অপমান!

“আর এভাবেই, নিজের অজান্তেই, যা জানতে চাই, সেই তথ্য দিয়ে দিয়েছেন আমাকে খানিকক্ষণ আগেই।”

“কী! তথ্য চাইছিলেন, বলবেন না সেটা?”

“বলার প্রয়োজন পড়েনি, নিজেই যখন ফাঁস করে দিচ্ছেন। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই রহস্যটা পরিষ্কার করে দেব আমি মঁসিয়ে ডি’ইমভালের কাছে। এটাই একমাত্র জবাব–“

বাক্যটা শেষ হলো না শোমসের। আচমকা ডুবে গেল নৌকা। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য উল্টে গিয়ে তলাটা ভেসে উঠল আবার।

উৎকণ্ঠায় ভরা ক’মুহূর্তের নীরবতার পর নদীর দুই তীরই ভরে উঠল শোরগোলের আওয়াজে। সেটা আরও তীব্র হলো দুজনের একজন জলসমতলে ভেসে উঠলে।

মানুষটা আর কেউ নয়, শোমস। তুখোড় সাঁতারু ও। প্রবল বেগে সাঁতরে চলল ফলেনফাতের নৌকা লক্ষ্য করে।

“এই তো, হয়ে গেছে, মঁসিয়ে শোমস,” চিৎকার ছাড়ল ফলেনফাত। “এখানেই আছি আমরা। চালিয়ে যান! চালিয়ে যান, স্যার। এক্ষুণি আমরা তুলে নিচ্ছি আপনাকে। আরেকটু… আরেকটু, মঁসিয়ে… হ্যাঁ, এবার ধরে ফেলুন দড়িটা।”

ওর দিকে ছুঁড়ে দেয়া রশিটা ধরে ফেলল শোমস। ওরা যখন নৌকায় তুলছে ওকে, একটা কণ্ঠ শুনতে পেল সে পিছনে।

“রহস্যের চাবিকাঠি… হ্যাঁ, মঁসিয়ে, আপনি পেয়ে যাবেন ওটা। অবাক হচ্ছি এখনও পাননি দেখে। তবে পাবেন যখন, তখন আর কী উপকার হচ্ছে ও-থেকে? ততক্ষণে তো হেরেই যাচ্ছেন খেলাটায়…’

ওল্টানো নৌকার দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসে শান্ত কণ্ঠে নিজের বক্তব্য দিয়ে চলল লুপাঁ, প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করানোর প্রয়াস চালাচ্ছে যেন।

“আপনার বোঝা উচিত, প্রিয় শোমস, করার কিছুই নেই আপনার এ মুহূর্তে, একদম কিচ্ছু নেই। শোচনীয় অবস্থা এখন আপনার।”

“সারেন্ডার, লুপাঁ!” হাঁক ছাড়ল ব্রিগেডিয়ার।

“তুমি একটা অসভ্য, ফলেনফাঁত, কথার মাঝখানে বাধা দিচ্ছ! বলছিলাম-”

“আত্মসমর্পণ করো, লুপাঁ!”

“ওহ, ঈশ্বর! মানুষ শুধু বিপদে পড়লেই আত্মসমর্পণ করে, ব্রিগেডিয়ার। নিশ্চয়ই বলতে চাইছ না, বিপদে রয়েছি আমি!”

“শেষবারের মতো বলছি তোমাকে, সারেন্ডার করো, লুপাঁ!”

“আমাকে খুন করার ইচ্ছে নেই তোমার, ফলেনফাত। পালিয়ে যেতে পারি, এই ভয়ে আহত করতে পারো যদিও। অবশ্য দৈবক্রমে যদি মারাত্মক হয় ক্ষতটা, তবেই পারবে পাকড়াও করতে। তবে এর জন্য কি একটুও অনুশোচনায় ভুগবে না তুমি? এটা কি তিক্ত করে তুলবে না তোমার বুড়ো বয়সটা?”

গুলির আওয়াজ হলো।

টলে উঠল লুপাঁ। এক মুহূর্তের জন্য ধরে রইল ও নৌকার তলিটা। পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে গেল জলের তলায়।

.

ঠিক তিনটের সময় সূচনা হলো পরবর্তী অধ্যায়ের।

ছ’টার সময় নিইলির এক সরাইমালিকের কাছ থেকে ধার নেয়া ট্রাউজার আর কোটের সঙ্গে মাথায় টুপি আর গায়ে ফ্ল্যানেলের শার্ট চড়িয়ে মাদাম ডি’ইমভালের খাস কামরায় প্রবেশ করল শোমস। কোট, পাজামা- দুটোই মাপে অনেক ছোটো হয়েছে ওর গায়ে। মঁসিয়ে ও মাদাম ডি’ইমভালেকে খবর পাঠিয়েছিল, একটা জিজ্ঞাসাবাদের আসর বসাতে চাইছে এখানে।

কামরায় এসে ওনারা পায়চারি করতে দেখলেন ওকে। বিচিত্র বেশভূষায় শোমসকে এমনই হাস্যকর দেখাচ্ছিল যে, হাসি চাপতে কষ্ট হলো স্বামী-স্ত্রীর ধ্যানমগ্ন চেহারায়, কাঁধ জোড়া সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে যন্ত্রের মতো একবার জানালা থেকে দরজা, আবার দরজা থেকে জানালা করছিল বিখ্যাত গোয়েন্দা। প্রতিবারই সমান সংখ্যক কদম ফেলছে ও, প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে একই ভঙ্গিমায়।

এক পর্যায়ে থেমে দাঁড়াল শোমস। ছোট্ট একটা গয়না তুলে নিয়ে যন্ত্রবৎ পরীক্ষা করল ওটা। তারপর আবারও শুরু করল হাঁটা। শেষমেশ অবশ্য ব্যারন আর ব্যারনেসের সামনে এসে জানতে চাইল, “মাদমোয়াজেল আছেন এখানে?”

“হ্যাঁ, বাচ্চাদের সঙ্গে বাগানে রয়েছে ও।”

“এই ঘরে চাইছি আমি ওনাকে।”

“এর কি কোনো—” বলতে যাচ্ছিলেন ব্যারন।

“একটু ধৈর্য ধরুন, মঁসিয়ে। যে সত্য উন্মোচন করতে চলেছি আমি আপনাদের সামনে, শুনলেই বুঝতে পারবেন ওনার এখানে থাকার প্রয়োজনীয়তা।”

“আচ্ছা, আচ্ছা… সুজান, ডাকবে ওকে?”

উঠে দাঁড়ালেন মাদাম ডি’ইমভালে। বেরিয়ে গিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন আবার অ্যালিস ডিমানকে নিয়ে।

স্বাভাবিকের চাইতে কিঞ্চিৎ পাণ্ডুর দেখাচ্ছে মাদমোয়াজেলকে, দাঁড়িয়ে রইল একটা টেবিলে হেলান দিয়ে। জিজ্ঞেসও করল না, কী জন্য ডাকা হয়েছে ওকে।

মেয়েটার দিকে তাকাল না শোমস। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল ও মঁসিয়ে ডি’ইমভালের দিকে।

“গত ক’দিনের তদন্ত শেষে,” বলতে লাগল ও নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। “আবারও বলতে হচ্ছে আমাকে, বাড়ির লোকই চুরি করেছে লণ্ঠনটা।”

“নাম কী তার?”

“বলছি।”

“প্রমাণ?”

“সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্টই রয়েছে তা আমার হাতে।”

“কিন্তু শুধু প্রমাণ থাকলেই তো হবে না, হারানো জিনিস ফেরতও তো পাওয়া চাই।”

“জুইশ ল্যাম্প? ওটা এখন আমার কাছে।”

“উপলের নেকলেস? নস্যির বাক্স?”

“দ্বিতীয়বার যা যা চুরি হয়েছে, ওগুলোও।”

নাটকীয় সংলাপগুলো আউড়ে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে শোমস। অদ্ভুত এক সন্তুষ্টি বোধ করছে কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে নিজের বিজয় ঘোষণা করে।

বিস্ময় ধরছে না ব্যারন ও তাঁর স্ত্রীর। নিঃশব্দ কৌতূহলে তাকিয়ে রয়েছেন ওঁরা শোমসের দিকে। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে শ্রদ্ধা।

গত তিনটে দিন যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল শোমস। বর্ণমালার বই আবিষ্কার, হারানো অক্ষরগুলো দিয়ে কাগজে বাক্য তৈরি, ব্রেসনের নদী- অভিযান, আত্মহত্যা, সব শেষে লুপাঁর সঙ্গে সংঘাত, নৌকাডুবি, তস্করের মৃত্যু- কিচ্ছু বাদ দিলো না ও। যখন শেষ হলো বক্তব্য, নিচু কণ্ঠে বলে উঠলেন ব্যারন, “সবই তো বললেন, মঁসিয়ে, কেবল দোষীর নামটা ছাড়া। কাকে সন্দেহ করছেন আপনি?”

“বর্ণমালার বই থেকে অক্ষর কেটে যে লুপাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাকেই সন্দেহ করছি আমি।’

“কীভাবে বুঝলেন, এসব চিঠিপত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে লুপাঁর?”

“স্বয়ং লুপাঁর কাছ থেকে পেয়েছি এই তথ্য।”

ভেজা, দোমড়ানো কাগজটা বের করল শোমস। এটাই নিজের নোটবই থেকে ছিঁড়ে নিয়ে লিখে দিয়েছিল ওতে লুপাঁ।

“খেয়াল করুন,” বলল ও পরম সন্তুষ্টির সঙ্গে। “কাগজটা দিতে বাধ্য ছিল না লুপাঁ। তাতে করে তো নিজের পরিচয়ই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অথচ ওর এই শিশুতোষ আচরণই কাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলো দিয়ে দিয়েছে আমাকে।”

“কী সেই তথ্য?” ব্যারনের জিজ্ঞাসা। “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

একটা পেনসিল নিয়ে অক্ষর আর সংখ্যাগুলো নতুন করে লিখল আবার শোমস।

CDEHNOPRZEO-237

“তো?” ব্যারনের চেহারায় প্রশ্নচিহ্ন। “এটা কি কোনো ফর্মুলা নাকি?”

“না। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারা উচিত ছিল আপনার, প্রথমটার মতো নয় এটা।”

“তা, কোন দিক দিয়ে আলাদা হলো?”

“দুটো অক্ষর বেশি আছে এখানে— একটা E, আর একটা O।”

“ও, তা-ই তো! খেয়াল করিনি আমি।“

“অক্ষর দুটো C আর H-এর সঙ্গে যোগ করুন- যেগুলো বাকি রয়েছে গিয়েছিল réspondez শব্দটা বানানোর পরে- আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, একমাত্র শব্দটি বানানো যাচ্ছে, তা হচ্ছে- ECHO।”

“মানে কী এর?”

“Echo de France। লুপাঁর খবরের কাগজ ওটা, ওর আনুষ্ঠানিক প্রত্যঙ্গ। ওই পত্রিকার মাধ্যমেই যোগাযোগ রক্ষা করে ও একো দ্য ফ্রান্স-এর বিজ্ঞাপন বিভাগে, ২৩৭ সংখ্যাটি ব্যবহার করে। রহস্যের চাবিকাঠি এটাই। লুপাঁ নিজেই আমাকে জানিয়েছে এটা। গিয়েছিলাম আমি পত্রিকা অফিসে।”

“কী পেলেন সেখানে?”

“আর্সেন লুপাঁ ও তার সহযোগীর মধ্যে সম্পর্কের পুরো কাহিনী।”

সাতটা খবরের কাগজ বের করল শোমস। সবগুলোর চতুর্থ পাতায় একটা লাইনের প্রতি ইঙ্গিত করল:

১. আর্স. লুপাঁ। সুরক্ষা চাইছেন ভদ্রমহিলা। ৫৪০।

২. ৫৪০। অপেক্ষা করছি বিস্তারিত জানার জন্য। এ. এল.

৩. এ. এল.। নজরবন্দি। শত্রু। পরাজয়।

৪. ৫৪০। ঠিকানা লিখুন। তদন্ত করব।

৫. এ. এল.। মুরিয়ো।

৬. ৫৪০। পার্ক থ্রি ও’ক্লক। ভায়োলেট।

৭. ২৩৭। বুঝেছি। শনি হবে রবি। সকাল। পার্ক।

“এই আপনার পুরো কাহিনী?” বিস্মিত ব্যারন।

“হ্যাঁ, আপনি যদি কয়েকটা মিনিট শোনেন আমার কথা। প্রথমত, ৫৪০ নামধারী এক ভদ্রমহিলা সাহায্য প্রার্থনা করছে লুপাঁর কাছে। জবাবে হুঁপা তাকে জানাতে বলছে বিস্তারিত। মহিলা জানায়, শত্রুর নজর রয়েছে ওর উপরে। সন্দেহ নেই, এই শত্রুটি হচ্ছে ব্রেসন। আরও বলছে মহিলা, সাহায্য না পেলে অশনিসঙ্কেত নেমে আসবে ওর উপরে। সন্দিহান চোর মহাশয় তখনও সাক্ষাৎ করেনি মহিলার সঙ্গে। বরঞ্চ ঠিকানা চেয়েছে তদন্তের জন্য। পরের চার দিন দ্বিধায় ছিল মেয়েটা— তারিখটা দেখুন— শেষমেশ পরিস্থিতির চাপে এবং বেসনের হুমকির কারণে জায়গার নামটা বলে দেয় সে- মুরিয়ো। লুপাঁ জানায়, পরদিন তিনটের সময় পার্ক মনশেতে থাকবে ও, চেনার জন্য ভায়োলেট ফুলের তোড়া নিয়ে আসতে বলে অচেনা সংবাদদাতাকে। এর পর আট দিনের একটা গ্যাপ দেখা যাচ্ছে। কারণটা হলো, খবরের কাগজের মাধ্যমে যোগাযোগের আর প্রয়োজন ছিল না ওদের, সরাসরি দেখা করে কিংবা চিঠি লিখে যেহেতু যোগাযোগ করতে পারছে। এদিকে ব্রেসনের দাবি অনুযায়ী জুইশ ল্যাম্প সরাতে রাজি হতে হলো মেয়েটিকে। কোন দিন সরাবে, তখনও ঠিক হয়নি সেটা। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে, বইয়ের পাতা থেকে অক্ষর কেটে লুপাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়েটা। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শনিবার করবে চুরিটা। একো ২৩৭-এ জবাব দিতে বলে সে হুঁপাকে। লুপাঁ জানায়, চিঠির বক্তব্য বুঝতে পেরেছে, এবং রোববার সকালে পার্কে উপস্থিত থাকবে ও। রোববার ভোরেই হয়েছিল চুরিটা।”

“খুঁটিনাটি সমস্ত প্রমাণ এনে হাজির করেছেন, দেখছি!” না বলে পারলেন না ব্যারন। “প্রতিটা ফাঁকই এখন যথাযথভাবে পূরণ হয়ে গেছে।”

“চুরি তো হলো,” বক্তব্য শেষ হয়নি শোমসের। “রোববার বাইরে গিয়ে লুপাঁকে জানাল মেয়েটা চুরির কাহিনী, জুইশ ল্যাম্পটা দিয়ে দিলো ব্রেসনকে। পরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে লুপাঁর দেয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী। আইনের লোক, খোলা জানালার মাধ্যমে ধোঁকা দেয়া, মাটিতে পড়া চারটে চিহ্ন, ব্যালকনির রেলিংয়ে এক জোড়া আঁচড়ের দাগ এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে যে,

ডাকাতি হয়েছে এ বাড়িতে। সেফ সাইডে চলে যায় মেয়েটা। বুঝতেই পারছেন, সবই এগুলো লুপাঁর তেলেসমাতি।”

“হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে যে, যৌক্তিক শোনাচ্ছে এখন কথাগুলো।” মাথা নাড়লেন ব্যারন। “কিন্তু দ্বিতীয় চুরিটা—”

“দ্বিতীয় চুরিটা হয়েছে প্রথমটার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে। জুইশ ল্যাম্প চুরির ব্যাপারে সংবাদপত্রের রিপোর্ট পড়ে কেউ একজন আইডিয়াটা কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করে; এবং বাকি যা ছিল, চুরি করে নিয়ে যায়। এবারের চুরিটা বানোয়াট ছিল না, ছিল সত্যিকারের চুরি-”

“লুপা নিশ্চয়ই?”

“না, অত আহাম্মক নয় লুপাঁ। তুচ্ছ কারণে লোকজনের উপর গুলি চালায় না সে।”

“কে তাহলে?”

“নিঃসন্দেহে ব্রেসন আর ওই মেয়েটা, যাকে বশ করেছে লোকটা। ব্রেসনই ঢুকেছিল এ বাড়িতে। ব্রেসনকেই ধাওয়া দিয়েছিলাম আমি। ব্রেসনই আহত করেছে বেচারি উইলসনকে।”

“নিশ্চিত আপনি?”

“তবে আর বলছি কী! ব্রেসনের এক সাগরেদ গতকাল চিঠি পাঠিয়েছিল ওকে, আত্মহত্যার আগে আর কী; চিঠিটা প্রমাণ করে, আপনার বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া জিনিসগুলোর পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সেই লোক আর লুপাঁর দর কষাকষি বাকি তখনও। সবই দাবি করছিল লুপাঁ, জুইশ ল্যাম্প সহ সব কিছুই। তার উপর একটা চোখ রেখেছিল ব্রেসনের উপরে। লোকটা যখন নদীর ধার থেকে ফিরছিল গতকাল রাতে, আমাদের মতোই লুপাঁর এক সহকর্মী অনুসরণ করে তাকে। “

“নদীর ধারে কী করছিল ব্রেসন?”

“আমাদের তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে সাবধান করা হচ্ছিল ওকে।”

“সাবধান করা হচ্ছিল? কে সাবধান করছিল?”

“ওই মেয়েটাই, যে ভয় পাচ্ছিল, জুইশ ল্যাম্প পাওয়া গেলে ওর নিজের অপরাধ আর চাপা থাকবে না। সাবধানবাণী শুনে জিনিসগুলো একটা প্যাকেটের মধ্যে ভরে ফেলল ব্রেসন; এমন এক জায়গায় ফেলে দিলো ওটা, যাতে বিপদ কেটে গেলে সেখান থেকে তুলে আনতে পারে। ফেরার সময় আমি আর গাঁইমার্দ ওকে অনুসরণ করছি টের পেয়ে, সন্দেহ নেই, ধরা পড়ার ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় লোকটার, করে বসে আত্মহত্যা।”

“প্যাকেটের মধ্যে- “

“যা বললাম আপনাকে … জুইশ ল্যাম্প আর অন্য জিনিসগুলো ছিল।”

“সেগুলো আবার আপনার কাছে এল কীভাবে? তখন কি জানতেন, কী ছিল প্যাকেটে?”

“না। আসলে, লুপাঁর বাধ্য করা গোসল থেকে উপকৃত হয়েছিলাম আমি। লোকটা অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, চলে যাই আমি ব্রেসনের বেছে নেয়া জায়গাটায়। ওখান থেকেই চুরি যাওয়া জিনিসগুলো উদ্ধার করি মাটি মাখা লিনিনে মোড়ানো অবস্থায়। ওই যে… টেবিলে রাখা আছে ওগুলো।”

কোনো কথা না বলে রশি কাটলেন ব্যারন, ছিঁড়ে ফেললেন ভেজা লিনিন। এরপর ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে নিচের দিকের স্ক্রুটা ঘোরালেন তিনি। সমান দু’ভাগে লণ্ঠনের বাটিটা ভাগ হয়ে যেতেই বেরিয়ে পড়ল চুনি আর পান্না বসানো সোনালি কাইমেরা।

একদম আস্তই রয়েছে ওটা।

.

শোমসের বলা সমস্ত কথাই গেছে মাদমোয়াজেলের বিপক্ষে। কিন্তু টু-শব্দটি করল না অ্যালিস ডিমান।

ইংরেজ গোয়েন্দা যখন একের পর এক অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করছে মেয়েটির দিকে, মুখের একটি পেশিও কাঁপেনি ওর; এক বিন্দু ভয় কিংবা প্রতিবাদের ছায়া খেলেনি শান্ত, নির্মল চোখ দুটোতে। কী ভাবছিল অ্যালিস; বিশেষ করে, কী বলবে ও, সবাই যখন উন্মুক্ত হয়ে চেয়ে রয়েছে জবাবের প্রত্যাশায়? কী বলে সে অস্বীকার করবে হার্লক শোমসের উত্থাপন করা প্রমাণগুলো?

কিন্তু কিছু না বলে নীরব রইল মেয়েটা।

“কথা বলো! কথা বলো, মাদমোয়াজেল!” চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে ডিইমভালে।

তাও কোনো কথা বলল না মেয়েটা।

“স্রেফ একটা কথা, মাদমোয়াজেল,” জোর করলেন ব্যারন। “তাহলেই মুক্ত হয়ে যাবে তুমি। অস্বীকার করো সব কিছু, আমি বিশ্বাস করব তোমাকে।”

কিন্তু কথাটা আর উচ্চারণ করল না অ্যালিস।

উত্তেজনায় পায়চারি শুরু হলো ব্যারনের।

“না, মঁসিয়ে, বিশ্বাস করতে পারছি না আমি!” বললেন তিনি শোমসকে উদ্দেশ্য করে। “অসম্ভব অপরাধ এটা! যা জানতাম আমি, এতগুলো বছরে যা কিছু দেখেছি আমি, সম্পূর্ণ এর বিপরীত এটা। না ভাই, আমি অন্তত বিশ্বাস করি না এটা।” শোমসের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি নরম স্বরে, “সত্যিই নিশ্চিত তো আপনি?”

দোটানায় পড়ে গেছে শোমস। অন্যায্য দাবি করা হয়েছে যেন ওর কাছে। সে কারণে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব জোগাচ্ছে না মুখে। শেষমেশ মৃদু হেসে বলল ও, “এ বাড়িতে অবস্থানের কারণে একমাত্র ওনার পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল, মহামূল্য এক রত্ন রয়েছে ল্যাম্পটার মধ্যে।”

“বিশ্বাস করি না আমি,” ব্যারনের ওই এক কথা।

“জিজ্ঞেস করুন ওনাকে!”

মেয়েটার আত্মবিশ্বাস দেখে এতক্ষণ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি শোমস, কিন্তু এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। হেঁটে গিয়ে চোখ রাখল অ্যালিস ডিমানের চোখে।

“কাজটা কি আপনার, মাদমোয়াজেল?” জানতে চাইল ও। “আপনিই কি সরিয়েছিলেন রত্নটা? আপনিই কি লুপাঁর সঙ্গে আঁতাত করে চৌর্যবৃত্তিতে জড়ান?”

“হ্যাঁ, আমিই,” স্বীকার করল মেয়েটা।

না, মাথা নিচু হলো না তরুণীর। লজ্জা কিংবা ভয়ের চিহ্ন মাত্র নেই চেহারায়।

“এটা কি সম্ভব?” বিড়বিড়িয়ে বললেন মঁসিয়ে ডি’ইমভালে। “কখনোই বিশ্বাস করব না এটা। সন্দেহ করার মতো কেউ থেকে থাকলে, তোমাকেই সবার শেষে সন্দেহ করতাম আমি। কীভাবে তুমি করতে পারলে এমনটা?”

“মঁসিয়ে শোমস যেটা বললেন, সেভাবেই করেছি আমি চুরিটা। শনিবার রাতে এ ঘরে এসে ল্যাম্পটা তুলে নিই আমি, সকালে পৌঁছে দিই ওই লোকের কাছে।”

“না!” চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যারন। “অসম্ভব! অসম্ভব এটা!”

“অসম্ভব কেন?”

“কারণ, সকালে এ ঘরের দরজা বন্ধ পেয়েছি আমি।“

লাল হলো মেয়েটা। পরামর্শের আশায় তাকাল যেন শোমসের দিকে।

মেয়েটার বিব্রত ভঙ্গি দেখে বিস্মিত হলো শোমস। কিছুই কি বলার নেই ওর? এই স্বীকারোক্তি কি তাহলে মিথ্যে কোনোকিছুকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য? ওদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্যই কি মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে মেয়েটা?

“বন্ধ ছিল দরজাটা,” থামলেন না ব্যারন। “রাতে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই পেয়েছি ওটা। তুমি যদি ওই দরজা দিয়ে ঢুকে থাকো— যেমনটা বলছ তুমি- কেউ নিশ্চয়ই ভেতর থেকে খুলে দিয়েছে ওটা, কিংবা আমাদের চেম্বার থেকে। কিন্তু কেউ-ই তো ছিল না এই দুই ঘরে… কেবল আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া।”

মাথা নিচু করল শোমস। অনুভূতি ঢাকতে হাত চাপা দিলো মুখে। সহসা একটা আলো প্রবেশ করেছে ওর অন্তরে। এতটাই চমকে উঠল যে, বেজায় অস্বস্তি লেগে উঠল। সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে। সকালের দৃশ্যপট থেকে কুয়াশা সরে গেছে যেন।

বিরক্তির সঙ্গে লজ্জাও অনুভব করছে এখন শোমস। লজ্জা ওর অনুমান ব্যর্থ হয়েছে বলে। অর্থহীনে পর্যবসিত হয়েছে গোটা থিওরি।

অ্যালিস ডিমান নির্দোষ!

অ্যালিস ডিমান নিষ্কলঙ্ক!

শুরু থেকেই যখন মেয়েটির বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলছিল, সেসময় এমন উসখুস লাগছিল কেন, ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে এখন। এবার ও দেখতে পাচ্ছে সত্যটা, এবার ও জেনে গেছে সব কিছু!

কয়েক সেকেন্ড পর মাথা তুলল শোমস, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকাল মাদাম ডি’ইমভালের দিকে

পাংশু হয়ে গেছেন ভদ্রমহিলা। জীবনে অচিন্তনীয় মুহূর্ত এসে উপস্থিত হলে যে রং ধারণ করে মানুষের চেহারা। কাঁপুনি উঠেছে লুকাতে চাওয়া হাত দুটোয়। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছেন যেন

“আর এক মিনিট,” ভাবল শোমস। “তারপরই নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসবেন ব্যারনেস।”

স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে এসে দাঁড়াল ও। ব্যারনকে দেখে মনে হচ্ছে, কেঁপে উঠেছে ওনার অন্তরাত্মা। শোমসের মতোই একই চিন্তা খেলা করছে ভদ্রলোকের মধ্যেও। তিনিও বুঝে গেছেন সত্যটা।

“ঠিকই বলেছেন, মঁসিয়ে। ভুল হয়েছে আমার,” নিদারুণ হতাশায় অমোঘ সত্যটার বিপরীতে অবস্থান নিল অ্যালিস। “দরজা দিয়ে ঢুকিনি আমি। আমি এসেছি বাগান আর বারান্দা হয়ে… মইয়ের সাহায্যে…”

সত্যিকার আনুগত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন যাকে বলে। কিন্তু অর্থহীন ওর এ প্রচেষ্টা! মোটেই বিশ্বাসযোগ্য শোনাচ্ছে না কথাগুলো। স্বচ্ছ, ভয়ডরহীন দৃষ্টি আর নেই বেচারির চোখ জোড়ায়। লোপ পেয়েছে পাপহীন, স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। মাথা নত হয়ে এল বিধ্বস্ত মেয়েটার।

অত্যন্ত পীড়াদায়ক এই নীরবতা। স্বামীর পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছেন মাদাম ডি’ইমভালে। ভয় আর উদ্বেগে অস্থির।

ভয়ানক সন্দেহের দোলাচলে দুলছেন ব্যারন। ব্যক্তিগত সুখশান্তির জলাঞ্জলি হতে চলেছে, মানতে পারছেন না যেন। শেষমেশ বললেন স্ত্রীকে, “বলো, সুজান! জবাব দাও!”

“বলার কিছু নেই,” নিচু কণ্ঠে জবাব দিলেন মহিলা। ভীষণ সন্তাপে মুষড়ে পড়েছে চেহারা।

“তাহলে… মাদমোয়াজেল…”

“মাদমোয়াজেল বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে… ওর মহৎ হৃদয়ের মমতা দিয়ে… সব দোষ তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে…”

“বাঁচিয়ে দিয়েছে বলতে? কার কাছ থেকে?”

“ওই লোকটা…”

“ব্রেসন?”

“হ্যাঁ। ওর হুমকিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে লোকটার সঙ্গে পরিচয়। মাথামোটার পরিচয় দিয়েছি ব্রেসনের কথা শুনতে গিয়ে। ওহ, ক্ষমা চাওয়ার মুখ পর্যন্ত নেই এখন আমার! তবে দু’খানা চিঠি লিখেছিলাম লোকটাকে…” বললেন তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে। “দেখাব তোমাকে চিঠিগুলো… আমাকেই আবার কিনতে হতো ওসব… বুঝতেই তো পারছ, কীভাবে! হায়, কী ভোগাটাই না ভুগেছি আমি!”

“তুমি, সুজান, তুমি!”

স্ত্রীকে আঘাত করার জন্য মুঠোবদ্ধ হাত তুললেন ব্যারন। খুন চেপে গেছে ওনার মাথায়। কিন্তু ঝপ করেই আবার পড়ে গেল হাত জোড়া। বিড়বিড় করতে করতে দোষারোপ করতে লাগলেন তিনি অদৃষ্টদেবীকে।

ছোটো ছোটো বাক্যে হৃদয়বিদারক ঘটনাটা শোনালেন ব্যারনেস। ব্রেসনের কুখ্যাতি সম্বন্ধে জানতে পারার পর পরিস্থিতির ব্যাপারে টনক নড়া, ভয়, অনুশোচনা, অ্যালিসের মহানুভবতা, মনিবানির মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়, লুপাঁকে লেখা, ব্রেসনের খপ্পর থেকে মহিলাকে বাঁচাতে নিজেই চৌর্যকর্মে জড়ানো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

“সুজান, তুমি!” লজ্জায়, দুঃখে বুকের সঙ্গে লেগে গেছে মঁসিয়ে ডি’ইমভালের থুতনি। “কীভাবে তুমি করতে পারলে এটা?”

***

ওই দিনই সন্ধ্যায়, ক্যালে আর ডোভারের মাঝে যাতায়াত করা ‘সিটি অভ লন্ডন’ নামের স্টিমারটি মসৃণ গতিতে ভেসে চলেছিল সাগরের বুকে। মসিকৃষ্ণ রাত। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। যাত্রীদের বেশির ভাগই যার যার কেবিনে রয়েছে এ মুহূর্তে। তবে নির্ভীক কিছু যাত্রীকে দেখা যাচ্ছে ডেকে হাঁটাচলা করতে, কিংবা রকিং চেয়ারে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে। এখানে-ওখানে চোখে পড়ছে চুরুটের আগুন। বাতাসের মৃদু ফিসফিসানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চাপা কণ্ঠস্বর রাতের শান্ত নীরবতায় কিছু মাত্র ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না সেসব আওয়াজ।

ডেকে পায়চারি করা যাত্রীদের একজন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়াল বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা আরেক যাত্রীর সামনে। খুঁটিয়ে পরখ করল তাকে। মেয়েটি নড়ে উঠলে বলে উঠল সে, “ভেবেছিলাম, ঘুমাচ্ছেন আপনি, মাদমোয়াজেল।”

“না, মঁসিয়ে শোমস, ঘুমাইনি। ভাবছিলাম আমি।”

“কী নিয়ে? অনধিকার চর্চা করছি না তো?”

“নাহ। মাদাম ডিইমভালের কথা ভাবছিলাম আমি। মহিলা নিশ্চয়ই খুব কষ্টে আছেন। শেষ হয়ে গেছে ওনার জীবনটা।”

“আরেহ, না, না!” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শোমস। “ভুলটা ওনার গুরুতর নয়। মঁসিয়ে ডি’ইমভালে ব্যাপারটা ভুলে তো যাবেনই, ক্ষমাও করে দেবেন স্ত্রীকে। দেবেন বলি কেন, আমরা রওনা হওয়ার আগেই লক্ষ করেছি, স্ত্রীর প্রতি নরম হয়ে এসেছে ওনার আচরণ।”

“হয়তো। তবে সহজে ভুলতে পারবেন না এটা। আর ভদ্রমহিলার কষ্টও দূর হবে না সহজে।”

“আপনি ভালোবাসেন ওনাকে?”

“খুবই। যখন ভয়ে কাঁপতাম আমি, এই ভালোবাসাই শক্তি দিত আমাকে; সাহস পেতাম তখন আপনার চোখের দিকে তাকাতে।”

“ওনাকে ছেড়ে আসার জন্য কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”

“খুব, খুব, খুবই। কোনো বন্ধু কিংবা আত্মীয় স্বজন ছিল না আমার- একমাত্র উনি ছাড়া।”

“বন্ধু পেয়ে যাবেন আপনি।” মেয়েটির ব্যথায় ব্যথিত শোমসও। “কথা দিচ্ছি আপনাকে। আত্মীয় স্বজন আর কিছু চেনাজানা লোকজন রয়েছে আমার। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য পস্তাতে হবে না আপনাকে। “

“হয়তো, মঁসিয়ে। কিন্তু মাদাম ডি’ইমভালে তো থাকছেন না ওখানে।“

ভ্রমণসঙ্গীর পাশে আসন নিল শোমস। পাইপটায় তামাক ভরে চার-চারটে কাঠি খরচ করল ওটাকে জ্বালানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে। আর কোনো ম্যাচের কাঠি নেই শোমসের কাছে।

উঠে দাঁড়াল ও। কাছেই বসা এক ভদ্রলোকের কাছে দেশলাই কাঠি হবে কি না, জানতে চাইল।

দেশলাই বাক্স খুলে একটা কাঠি জ্বালল লোকটা। আগুনের আভায় চেহারাটা আলোকিত হতেই চিনতে পারল শোমস— আর্সেন লুপাঁ!

আবেগের উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ খাটিয়ে, সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রবর। “কেমন আছেন, মঁসিয়ে লুপাঁ?”

“সাবাস!” নিজের অজান্তেই গলা চড়ে গেল লুপাঁর।

“সাবাস কেন?”

“কেন আবার? ইংরেজদের মতো বুক ভরা গর্বের সঙ্গে সিন নদীতে ডুবে যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভূতের মতো হাজির হয়েছি আবার আপনার সামনে, অথচ তিল পরিমাণ বিস্ময়ের ছোঁয়া নেই আপনার মাঝে! একদম স্বাভাবিকভাবে সম্ভাষণ জানালেন আমাকে। আহ! আবারও বলছি: তুলনা নেই আপনার, মঁসিয়ে।”

“এমন কিছু তো করিনি আমি! যেভাবে বোট থেকে পড়ে গিয়েছিলেন আপনি, খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম, কাজটা পরিকল্পিত। বুলেট স্পর্শ করতে পারেনি আপনাকে।”

“তারপরও তো চলে গিয়েছিলেন আপনি, আমার কী হলো-না-হলো, না জেনেই?”

“নাহ, জানতাম আমি। আধমাইলের মধ্যে অন্তত পাঁচ শ’ লোক ছিল নদীর দুই পারে। মৃত্যুকে এড়াতে পারলে ধরা পড়াটা নিশ্চিতই ছিল আপনার জন্য।”

“কিন্তু তারপরও তো এখানে আমি!”

“মঁসিয়ে লুপাঁ, দুনিয়ায় দুজনের ব্যাপারে কখনোই অবাক হই না আমি একজন হচ্ছি আমি; আর আরেকজন, আর্সেন লুপাঁ, আপনি।”

এভাবেই মৈত্রী স্থাপিত হলো দুই বিস্ময়পুরুষের মধ্যে।

সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাপ্তিটা অত সুন্দর হয়নি হয়তো, যেহেতু জুইশ ল্যাম্প উদ্ধারের পরও মুখে কুলুপাঁ এঁটে ছিল শোমস; একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি লুপাঁর ব্যাপারে। কিন্তু দুই সিংহপুরুষের তুলনা যদি করি- হার্লক শোমস বনাম আর্সেন লুপাঁ— গোয়েন্দা বনাম তস্কর— কেউ-ই সেখানে বিজয়ী কিংবা পরাজিত হয়নি। অথবা দুজনকেই বিজয়ী ধরা যায় যার যার জায়গা থেকে।

সম্ভ্রমের সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে দুজনে।

শোমসের অনুরোধে ওর পলায়নপর্বের বিচিত্র কাহিনী বলতে লাগল লুপাঁ।

“এটাকে যদি পলায়ন বলি,” বলল ও। “খুব সহজেই সম্ভব হয়েছে সেটা। বন্ধুরা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। জুইশ ল্যাম্প উদ্ধারের জন্য আমিই বলেছিলাম ওদেরকে যোগাযোগ করতে। ওল্টানো নৌকার নিচে স্বচ্ছন্দে আধঘণ্টা কাটিয়ে দেয়ার পর, লোকজন নিয়ে ফলেনফাত যখন আমার মৃতদেহ খুঁজছে নদীর তীর বরাবর, এ সুযোগে নৌকার তলার উপরে উঠে বসি আবার। বন্ধুরা তখন সহজেই মোটরবোটে করে এসে তুলে নেয় আমাকে। গাঁইমার্দ আর ফলেনফাত সহ আরও অনেকের থতমত খাওয়া দৃষ্টির সামনে দিয়ে টা-টা জানিয়ে সটকে পড়ি আমরা।”

“চমৎকার!” শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে শোমস। “একদম নিখুঁত কাজ হয়েছে। তা, এখন নিশ্চয়ই ইংল্যান্ডে কাজ আছে আপনার?”

“তা আছে… কিন্তু… ভুলেই গিয়েছিলাম… মঁসিয়ে ডি’ইমভালের কী খবর?”

“সব জেনে গেছেন তিনি।”

“আহ, শোমস, কী বলেছিলাম আপনাকে? ক্ষতিটা এখন অপূরণীয়। ব্যাপারটা আমার নিজস্ব পদ্ধতিতেই সামলাতে দিলে ভালো হতো না সেটা? দুয়েক দিনের মধ্যেই তাহলে চুরির মাল উদ্ধার করে ফেলতাম ব্রেসনের কাছ থেকে। তারপর সেগুলো ফেরত দিয়ে আসতাম যথাস্থানে। সৎ, সম্মানিত ডি’ইমভালে দম্পতি তখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন বরাবরের মতো। তার বদলে…”

“তার বদলে,” কথা কেড়ে নিল শোমস। “তাসগুলো এলোমেলো করে দিয়েছি আমি। আপনার দায়িত্বে থাকা পরিবারটার আত্ম-অহমিকায় বুনে দিয়েছি সন্দেহের বীজ।’

“খোদা! অবশ্যই ওদেরকে নজরে রাখছি আমি। চুরি, ধোঁকাবাজি, ভুলই কি করে কেউ সব সময়?”

“ও, আপনিও তাহলে ভালো কাজ করেন?”

“হ্যাঁ, সময় থাকলে। তাছাড়া কাজটা করে মজা লেগেছে আমার। তো, আমাদের শেষ এই কেসটায় মনে হলো, আগাগোড়া উল্টে যাওয়া উচিত দুজনের ভূমিকা। নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দুর্ভাগা মানুষগুলোকে সাহায্য করব আমি, অন্যদিকে আপনার সঙ্গী হবে কেবল অশ্রু আর হতাশা।”

“অশ্ৰু! হতাশা!” আপত্তি তুলল শোমস।

“তা নয় তো, কী! কী দুর্দশা দেখুন ডি’ইমভালে পরিবারটার! কাঁদতে হয়েছে অ্যালিস ডিমানকে।”

“ওখানে থাকাটা আর সম্ভব ছিল না ওনার পক্ষে। যেকোনো দিনই ওনার নাগাল পেয়ে যেত গাঁইমার্দ, এবং ওনার মাধ্যমে পৌঁছে যেত মাদাম ডিইমভালের কাছে।”

“তা তো ঠিকই, মঁসিয়ে। কিন্তু কার দোষ এটা?”

দুই ভদ্রলোক চলে গেলেন ওদের সামনে দিয়ে।

“চেনেন আপনি এই দুজনকে?” বন্ধুত্বপূর্ণ সুরে জানতে চাইল শোমস।

“একজন মনে হয় এই স্টিমারের ক্যাপ্টেন।”

“আর অন্যজন?”

“বলতে পারছি না।”

“ওনার নাম অস্টিন জিলেট। প্যারিসে মঁসিয়ে দুদোর যে অবস্থান, লন্ডনে ওনারও তা-ই।”

“আহ, কী সৌভাগ্য! পরিচয় করিয়ে দেবেন না আমাকে? মঁসিয়ে দুদো অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার। মঁসিয়ে জিলেটেরও সেরকম সুহৃদ হতে পারলে আনন্দিত হতাম।”

আবার পাশ কাটালেন দুজনে।

“সত্যিই যেতে চাইছেন ওনাদের কাছে?” উঠে দাঁড়িয়ে লৌহমুষ্টিতে হুঁপার কবজি আঁকড়ে ধরল শোমস।

“এত জোরে হাত ধরলেন কেন, মঁসিয়ে?” অবাক হয়েছে লুপাঁ। “আপনার সঙ্গে যেতে তো কোনো আপত্তি নেই আমার।” একটুও বাধা না দিয়ে এগিয়ে চলল ও।

দুই ভদ্রলোক অদৃশ্য হয়ে গেছেন দৃষ্টিসীমা থেকে। চলার গতি দ্রুত করল শোমস। লুপাঁর কবজিতে নখ বসে গেছে ওর।

“আসুন! আসুন! তাড়াতাড়ি আসুন!” তাড়া দিতে লাগল বিকারগ্রস্তের মতন।

কিন্তু সহসা থমকে দাঁড়াতে হলো ওকে। অ্যালিস ডিমান অনুসরণ করছে ওদেরকে।

“কী করছেন, মাদমোয়াজেল? আপনার তো দরকার নেই আসার। দয়া করে আসবেন না আপনি।”

জবাবটা লুপাঁই দিলো।

“খেয়াল করেননি, মঁসিয়ে। নিজের ইচ্ছায় আসছেন না তিনি। আপনার মতোই ওনার হাতটা বজ্রমুষ্টিতে ধরে রেখেছি আমি।”

“কেন?”

“কারণ, ওনাকেও ওনাদের সামনে পেশ করতে চাইছি আমি। জুইশ ল্যাম্পের ঘটনায় আমার চাইতে ওনার ভূমিকাটাই গুরুত্বপূর্ণ বেশি। আর্সেন লুপাঁর সহযোগী হিসেবে, ব্রেসনের সহযোগী হিসেবে, অধিকার রয়েছে ওনার মাদাম ডি’ইমভালের সঙ্গে যে আপস হয়েছিল, সেই কাহিনী বলার। আইনের লোক হিসেবে অত্যন্ত আগ্রহী করে তুলবে তা মঁসিয়ে জিলেটকে। আর ওনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আপনার সুখ্যাতিও বাড়বে, মঁসিয়ে।”

বন্দির হাত ছেড়ে দিলো গোয়েন্দা। লুপাঁ ছাড়ল মাদমোয়াজেলের হাত পরের কয়েক সেকেন্ড পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। নিশ্চল। নির্বাক।

আবার বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল শোমস। ওকে অনুসরণ করল লুপাঁ আর মেয়েটা।

“দেখলেন, মঁসিয়ে?” দীর্ঘ নীরবতার পর মুখ খুলল লুপাঁ। “যা-ই করুন না কেন আপনি, কখনোই এক হবে না আমাদের দুজনের পথ। বেড়ার একদিকে আপনি, আরেক দিকে আমি। হাত মেলাতে পারি আমরা, পারি কুশল বিনিময় করতে, কিন্তু বেড়াটা থাকছেই। আপনি যেমন রয়ে যাবেন ডিটেক্টিভ হার্লক শোমস হিসেবে, আমিও তেমনি থেকে যাব তস্কর আর্সেন লুপাঁ হয়ে। গোয়েন্দা হিসেবে শোমস যেমন চলবেন কমবেশি নিজের ইন্দ্রিয়গুলোর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী- তাতে তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় থাকুক কিংবা না-ই থাকুক— লুপাঁও তেমনি ওর তস্করসুলভ ইন্দ্রিয়ের বাধ্য। শোমসের চেষ্টা যেখানে আমার মতো মানুষগুলোকে গারদে পোরার, আমার চেষ্টা তেমনি আপনাদের নাগাল এড়ানোর, সম্ভব হলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর; যেমনটা করেছি আমি এ যাত্রায়… হা-হা-হা!” ধূর্ত, নিষ্ঠুর, শয়তানি হাসিতে ফেটে পড়ল লুপাঁ।

পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে পড়ল লোকটা। অ্যালিস ডিমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “নিশ্চিত থাকতে পারেন, মাদমোয়াজেল, কোনো অবস্থাতেই আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব না আমি। কারও সঙ্গেই এ কাজ করে না লুপাঁ- বিশেষ করে, যাদের সে ভালোবাসে, আর যাদের তারিফ করে। হ্যাঁ, বলতেই হচ্ছে যে, অকুণ্ঠ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য আপনার সাহস আর যোগ্যতা।”

পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করল লুপাঁ। কার্ডটা দু’টুকরো করে ছিঁড়ে একটা টুকরো বাড়িয়ে দিলো ও মেয়েটির দিকে। আবেগভরা কম্পিত কণ্ঠে বলল, “আপনাকে নিয়ে মঁসিয়ে শোমসের পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয় কোনো কারণে, সোজা চলে যাবেন লেডি স্ট্রংবারোর কাছে— সহজেই খুঁজে পাবেন ওনার ঠিকানা- আধখানা কার্ডটা দেখিয়ে উচ্চারণ করবেন ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ কথাটা; ব্যস, আপন বোনের মতোই সমাদর পাবেন আপনি ভদ্রমহিলার কাছে।”

“ধন্যবাদ,” বলল মেয়েটা। “আগামীকালই দেখা করব ওনার সঙ্গে।”

“এখন, মঁসিয়ে,” ভদ্রলোকের মতো নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পেরে যারপরনাই সন্তুষ্ট শোনাচ্ছে লুপাঁকে। “শুভরাত্রি জানাচ্ছি আপনাকে। ঘণ্টা খানেকের আগে ডাঙায় ভিড়ছি না আমরা। সুতরাং, ততক্ষণ পর্যন্ত একটু গড়িয়ে নিতে চাইছি।”

বেঞ্চে শুয়ে পড়ল সে মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইংলিশ উপকূলের উঁচু, খাড়া পাহাড়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে এল ওরা নতুন দিনের ক্রম-উদ্ভাসিত সকালে। কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে ডেকে ভিড় করতে শুরু করেছে যাত্রীরা, কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আগুয়ান তীরের দিকে।

দুজন লোককে নিয়ে পাশ কাটালেন জিলেট, যাদেরকে শোমস চিনতে পারল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গুপ্তচর হিসাবে

তখনও অকাতরে ঘুমাচ্ছে লুপাঁ বেঞ্চির উপরে।

(সমাপ্ত)