ঘনশ্যামের অন্তর্ধান

ঘনশ্যামের অন্তর্ধান

 নেচার আবার আজ খুব হঠাৎ ফুঁসে উঠছিল। কেন জানেন? প্রাঙ্গণে কবরগুলির আনাচে-কানাচে জমে-ওঠা বৃষ্টির জল এড়িয়ে গিয়ে একটা পাথরের স্ল্যাবে দাঁড়ালেন ব্ৰজহরি এবং ঘনশ্যামের উদ্দেশে কথাটা বললেন।

ঘনশ্যাম নেমে গিয়ে একটা পাথরের কবরে দাঁড়িয়েছিলেন। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, মৃতরা জড় পদার্থমাত্র। তিনি এসব মানেন না। বললেন, কেন?

ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। খুনীকে ধরিয়ে দেবার জন্য। কী হারে বাজ পড়ছিল, বলুন! বাজের ভয়ে গলাকাটা কালু গাছ থেকে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে কি না? সারেন্ডার করতে হয়েছে কি না তাকে? তারপর দেখুন এখন আবার স্বাভাবিক, মেঘ সরেছে। রোদ্দুর ফুটছে। নেচার ইজ স্মাইলিং!

আস্তানাঘরের পেছনে গাছপালার ফাঁকে বিকেলের ঝলমলে রোদ্দুর পিচকিরির ধারায় উপচে আসছে। তাই দেখিয়ে ব্ৰজহরি ফের বললেন, নেচার ইজ বিশ্বমাতৃকা। মানুষ কিছু বুঝেও বোঝে না। দুরন্ত অবাধ্য শিশু। তাই মা তাকে কিল থাপ্পাড়টা মেরে থাকেন। এবার দেখুন, সব শান্ত হয়ে গেছে।

ঘনশ্যাম বাঁকা মুখে বললেন, কিন্তু রিলিফের নৌকো কোথায়? কটা বাজছে দেখুন তো ডাক্তারবাবু?

ঘড়ি দেখে ব্ৰজহরি বলেন, চারটে পাঁচ। তিন ঘণ্টা আগে– উঁহু, সম্ভবত ঘণ্টা চারেক আগে হেলিকপ্টারটা আমাদের দেখে গেছে। অথচ এখনও বোট পাঠাচ্ছে না কেন? সচরাচর এসব বড় ফ্লাডে আর্মি নামানো হয়। এবার হলটা কী?

ঘনশ্যাম বললেন, আমার ধারণা, ততবেশি নৌকো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মহকুমার অসংখ্য গ্রাম ডুবে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং গবাদি পশুর কথা ভাবুন! তাদের চেয়ে আমাদের উদ্ধার ওরা জরুরি মনে করছে না দিস মাচ আই ক্যান এক্সপ্লেন!

 ইউ আর রাইট। ব্ৰজহরি সমর্থন করলেন। ওরা খবর ঠিকই পেয়েছে। মিনিস্টারের মুখে। কিন্তু আগে যারা ভেসে যাচ্ছে, তাদের কথাই ভেবেছে। ইউ আর রাইট! বাট উই আর হাংগ্রি!…

বারান্দায় বসে ক্লারা কান করে শুনছিল। চাপাস্বরে প্রদোষকে বলল, আমার ধারণা, প্রদোষ ওই দুজন ভদ্রলোক পরস্পরের মধ্যে ইংলিশ বেশি পরিমাণে বলতে শুরু করেছেন। এটা খুব আশ্চর্যজনক।

কর্নেল শুনতে পেয়ে জার্মান ভাষায় বললেন, স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে, ক্লারা!। স্বাভাবিক অবস্থায় এদেশের শিক্ষিতেরা পরস্পর ইংরেজিতে বাক্যলাপে অভ্যস্ত।

 প্রদোষ জার্মান জানে না। শিখতে চেষ্টা করেছিল মাত্র। ক্লারা তাকে বুঝিয়ে দিল। তখন প্রদোষ বাংলায় বলল, কর্নেলসায়েব! আমার স্ত্রীকে আপনি উল্টো বোঝাচ্ছেন। বরং এদেশের শিক্ষিত লোক উত্তেজনা বা রাগ হলে ইংরেজি বলে। তার মানে যখন স্বাভাবিকতা থাকে না, তখন।

কর্নেল হাসলেন।…আমি ভেবেছিলাম প্রদোষবাবু বাংলা ভুলে গেছেন।

প্রদোষ এ মন্তব্যে ক্ষুণ্ণ হল। স্মার্ট ভঙ্গিতে বলল, ইংরেজি বলাটা আমার ক্ষেত্রে অভ্যাসের ব্যাপার। দুবছর আমি স্টেটসে ছিলাম।

হতে পারে। বংকুবিহারী মন্তব্য করলেন। তবে কর্নেল যা বলেছেন, ঠিক। আমরা উন্মাদ অবস্থায় ছিলাম। খুনী ধরা পড়ার পর আমরা স্বাভাবিক হতে পেরেছি। বোট এসে গেলে আমরা পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠব। দা সিচুয়েশন ইজ প্লাজুয়্যালি বিকামিং নর্মাল। দা কিলার ইজ অ্যাট আওয়ার হ্যান্ড অ্যান্ড ইউ আর নাও সেইফ। নো চান্স অফ অ্যানাদার মার্ডার! নো ফিয়ার! আইন রক্ষক সগৌরবে রিভলবার দোলাতে দোলাতে অনর্গল যথেষ্ট ইংরেজি বাক্য উচ্চারণ করতে থাকলেন। তার এবং চাক্কুর মাঝখানে বন্দী গলাকাটা কালু কুঁকড়ে বসে আছে। তবে ঠকঠক করে কাঁপছে। দরবেশ এখন ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ…

কর্নেল উঠে বর্ষাতিটা খুলে কালুর গায়ে জড়িয়ে দিলেন। বংকুবিহারী চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। কিন্তু বাধা দিলেন না। কর্নেল প্রাঙ্গণে নেমে গেলেন। তাঁকে আস্তানাঘরের পেছন দিকে যেতে দেখা গেল।

ব্ৰজহরি তার উদ্দেশে বললেন, নৌকো দেখলে খবর দেবেন কর্নেলসায়েব!

ঘনশ্যাম কান পেতে কী শুনছিলেন। বললেন, কী একটা গুরুগুরু শব্দ শুনছি যেন?

উত্তেজনায় ব্রজহরি চঞ্চল হয়ে বললেন, কই? কই? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না! মাই ইয়ার্স আর শার্প।

হু, গুরগুর শব্দ। বলে ঘনশ্যাম পূর্বদিকে যেদিকে ভাঙা দেউড়ি, পা বাড়ালেন। ব্ৰজহরি বললেন, যান, যান! দেখে আসুন! গো অ্যান্ড সি!

বংকুবিহারী আপন খেয়ালে ইংরেজিতে কথা বলছেন, লক্ষ্য একান্তভাবে মেমসায়েব ক্লারা। খুনী এবং চোর-ডাকাত ধরার যতরকম মারাত্মক অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন। ঘনশ্যামের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নেই। ব্ৰজহরি ডেকে তাকে বললেন, দারোগাবাবু! কোনও গুরগুর ভয়েজ শুনতে পাচ্ছেন কি? ওই শুনুন! ব্ৰজহরি লাফিয়ে উঠলেন। ইয়েস! দে আর কামিং! হিয়ার, হিয়ার!

ক্লারা ও প্রদোষ উঠে প্রাঙ্গণে এল। ক্লারা কান করে বলল, হ্যাঁ তারা আসছেন! আসছেন!

বংকুবিহারীও শুনতে পেলেন। কিন্তু উত্তেজিত হলেন না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললেন, ডাক্তারবাবু! আপনারা যান! গো অ্যান্ড টেল দেম আই অ্যাম হিয়ার– উইথ থ্রি ডেডবডিজ অ্যান্ড দেয়ার কিলার। গো গো টেল দেম!

ব্ৰজহরি বললেন, ঘনশ্যামবাবু হ্যাঁজ অলরেডি গন! আই অ্যাম টায়ার্ড অ্যান্ড হাংগ্রি।

হোয়াট? বংকুবিহারী নড়ে উঠলেন। পরমুহূর্তে ফ্যাচ করে হাসলেন। …যাক না। একা তো ওকে নিয়ে যাবে না। এতগুলো লোক দেখেছেন মিনিস্টার আকাশ থেকে। হি হ্যাঁজ সিন আস। অ্যান্ড অলসো কিল আ ম্যান ইন দা পোলিস ইউনিফর্ম! ডাক্তারবাবু, অলসো টেল দেম অ্যাবাউট এ পলিটিক্যাল প্রিজনার।

ক্লারা প্রদোষকে টানতে টানতে নিয়ে গেল দক্ষিণে। শব্দটা সেদিক থেকেই শোনা যাচ্ছিল। শব্দটা বাড়ছিল। ব্ৰজহরি দাঁড়িয়েই রইলেন। তখন বংকুবিহারী হেঁড়ে গলায় চেঁচালেন, ম্যাডাম ক্লারা! টেল দেম, উই হ্যাড টু ডেঞ্জারাস প্রিজনার্স হেয়ার, অ্যান্ড থ্রি ডেডবডিজ– থ্রি! থ্রি-ই-ই-ই!

ব্ৰজহরি বারান্দায় গিয়ে তার ডাক্তারি ব্যাগ এবং বর্ষাতিটা ঊরুর ওপর রেখে বসে রইলেন। প্রচণ্ড উত্তেজনার পর প্রচণ্ড ক্লান্তি তাঁকে পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে উঃ ওঃ শব্দ করতে থাকলেন।…

প্রদোষ বটগাছটার দিকে তাকিয়ে চমকানো স্বরে বলল, হরিবল্! ভালচার্স!

ক্লারা তার কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিল! চোখে রেখে বলল, একটা সামরিক মোটরচালিত ক্ষুদ্র নৌকা একটি বৃহৎ নৌকাকে টেনে আনছে। সামরিক এবং অসামরিক কয়েকজন লোক আছেন।

প্রদোষ তার হাত থেকে বাইনোকুলার নিল। চোখে রেখে দেখতে দেখতে বলল, হোয়াট ডু য়ু থিংক বেবি? আই অ্যাম ড্যাম সিওর দ্যাট মাই আঙ্ক হ্যাঁজ সেন্ট দেম! ইউ নো, মাই ড্যাডি হ্যাড অলরেডি গিভ হিম আ ট্রাঙ্ককল মেসেজ দ্যাট উই হ্যাড স্টার্টেড ফ্রম ক্যালকাটা। দা ট্রাংককল ডিড দা ম্যাজিক, ইউ নো!

তুমি একটা ক্লারা হেসে উঠল। সে ফাঁকা জায়গায় একটা উঁচু চাঙড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকল। সে যেন নাচতে সুরু করেছে।

প্রদোষ তার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। বলল, তুমি একটা–

মিলিটারি স্পিডবোটের শব্দ ঢিবির পূর্বদিকে এসে থেমে গেল। বংকুবিহারী উঠে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হলেন। কিন্তু রিভলবারটি হাতে। কারণ এ একটা চরম মুহূর্ত। বললেন, চাক্কু! ওকে ধরে থাক। আমি রিসিভ করব ওঁদের।

চাক্কু বলল, যাবে কোথায় শালা? ঘেঁটি ধরে আছি। আপনি যেখানে যাবেন, যান না সার!

বংকুবিহারী প্রাঙ্গণে নেমে বললেন, যাব কোথায়? এখানেই ওয়েট করব। বলে রিভলবারটা সরকারি শালীনতাবশে কোষবদ্ধ করে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।

চাক্কু চাপা গলায় গলাকাটা কালুকে বলল, এই শালা! আমার ড্যাগারখানা কোথায়?

কালু হিপিয়ে উঠল।..বিশ্বেস কর– খোদার কসম, পিরবাবারর কসম। আমি খুন করিনি!

চাক্কু ওর পাঁজরে গুঁতো মারল।…বল্ শালা, কোথায় আমার ড্যাগার?

 কালু আবার ককিয়ে বলল, বিশ্বেস কর—

 ব্ৰজহরি বিরক্ত হয়ে বললেন, অ্যাই চাক্কু! হচ্ছেটা কী? পুলিশের কাজ পুলিশ করবে।

এই শালা পুঁতিকে কেটেছে! চাক্কু ফুঁসে উঠল। এমন অবস্থা না হলে একে আমি এতক্ষণ গলা কেটে পুঁতে ফেলতাম। আমার নাম চাক্কু! আম্মো কম যাই নে। বল্ কালু, আমার ড্যাগার কোথায়? এখনও বল্ বলছি!…

কর্নেল স্পিডবোট এবং নৌকোটি বাইনোকুলারে দেখছিলেন। বাঁদিকে গাছপালার আড়ালে তা অদৃশ্য হলে ঘুরে পা বাড়ালেন। আস্তানাঘরের পেছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ধ্বংসাবশেষ, ঝোপঝাড় এবং উঁচু গাছপালা। একসময়ে পেছন দিকটাতেও কয়েকখানা ঘর ছিল বোঝা যায়। এদিকটা ঢিবির পশ্চিম অংশ। ঝলমলে বিকেলের সূর্য প্রচুর রোদ্দুর ছড়াচ্ছে। বন্যার জল বাড়বে ভেবেছিলেন, বাড়েনি। বরং এতক্ষণ বৃষ্টিসত্ত্বেও অন্তত একমিটার, নেমে গেছে।

পা বাড়াতে গিয়ে পূর্বমুখী হয়েছেন, ডানদিকের গাছে ঝটপট শব্দে কী একটা বসল। দেখলেন, একটা শকুন। ঘুরে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। আবার একটা শকুন এসে বসল। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে গাছটা শকুনে ভরে গেল। তারপর গাছটার নিচের দিকে তাকাতেই চোখে ছটা লাগল কিসের। চোখ ধাঁধানো ছটা। কাচের টুকরো কি? রোদ্দুরে কী একটা ঝকঝক করছে ইটের চাঙড়ের নিচে। চাঙড়টার আধখানা জলে ডুবে গিয়েছিল। এখন জল নেমে গেছে। জিনিসটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ছ-সাত ইঞ্চি লম্বা ফলা– একটা ছুরি। স্প্রিংয়ের ছুরি!

দ্রুত কুড়িয়ে নিয়ে স্পিংয়ে চাপ দিলেন। ফলাটা বাঁটে ঢুকে গেল। রক্তের চিহ্ন থাকা সম্ভব নয়। বন্যার জলে ধুয়ে গেছে। গলাকাটা কালু ছুরিটা এখানেই ছুঁড়ে ফেলেছিল তাহলে? ছুঁড়ে ফেলেছিল, কারণ তার আর কাউকে হত্যার প্রয়োজন ছিল না। কুকুরটা তাকে বিরক্ত করছিল। তাই কুকুরটাকে সে জবাই করেছিল, শাওনি তাকে চিনতে পেরেছিল। হয়তো অভ্যাসবশে শাওনি তাকে দারোগাবাবুর হাতে ধরিয়ে দেবে বলে ব্ল্যাকমেল করেছিল, কিংবা না করলেও সে ভেবেছিল, শাওনির তাকে ধরিয়ে দেবার সম্ভাবনা আছে। তাই শাওনিকে সে জবাই করেছিল। কিন্তু পুঁতি? পুঁতির সামনে সে দৈবাৎ পড়ে গিয়েছিল, অথবা যেভাবেই হোক পুঁতি তাকে চিনতে পেরেছিল। তাই সে ঝুঁকি নেয়নি। পুঁতিকেও আচমকা একা পেয়ে জবাই করেছে। হরিপদ? হরিপদও কি তাকে চিনতে পেরেছিল? — তাছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? হরিপদর গানগুলোতে কী যেন আভাস ছিল। নিশ্চয় ছিল। কিন্তু হরিপদ পুঁতির মতোই ভয়ে অথবা ঝুটঝামেলা এড়ানোর জন্য কথাটা খুলে দারোগাবাবু কিংবা অন্য কাউকে বলেনি। এদিকে হরিপদ একটা দারুণ ঝুঁকি খুনীর কাছে। কারণ দু-দুটো খুন কে করেছে, হরিপদ নিশ্চয় টের পেয়েছে। তাই পুঁতির মতো আচমকা পেছন থেকে ধরে ফেলে হরিপদকেও জবাই করেছে। হরিপদর গানই হয়তো তার নিজের মৃত্যুর কারণ! হুঁ, খুব সরল অথচ অভ্যস্ত পদ্ধতিতে হত্যা। আচমকা পেছন থেকে একটা হাত বাড়িয়ে চিবুক খামচে ধরে মাটিতে শুইয়ে একলাফে বুকে বসে গলায় জোরালো একটা প্যাঁচ। চাক্কুর ছুরিটা বিদেশী ক্ষুরের মতো ধারালো। গতরাতে অন্ধকারে হত্যাকারী বারান্দায় ভিড়ে মিশে গিয়েছিল। চাক্কুর ছুরিটা তখনই চুরি করে থাকবে সে। তবে এও ঠিক, সে জানত চাক্কুর ব্যাগে একটা ছুরি আছে। নিশ্চয় সে দেখেছিল ছুরিটা ঝোপের আড়াল থেকে। চাক্কু বলেছে, তার একটা ড্যাগার ছিল। কিন্তু তার আগে কি চাক্কু কোনো কারণে ড্যাগারটা বের করেছিল? নিশ্চয় করেছিল।

আবার ঝুপঝাঁপ শব্দে শকুন এসে বসছে। ব্ৰজহরি কর্নেলের উত্তেজিতভাবে ডাকছিলেন। কর্নেল ঢাল বেয়ে দ্রুত আস্তানা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আবার কিছু ঘটল কি?

কিন্তু গিয়ে দেখলেন, জনাতিনেক সৈনিক এবং জনাচার স্বেচ্ছাসেবী যুবক তিনটি মৃতদেহ প্রাঙ্গণে নামিয়েছে। বংকুবিহারী গলা টা কালুর পায়ের বাঁধন খুলে তার ঘাড় ধরে নামিয়ে আনলেন। বললেন, বডি ওঠান আপনারা। নৌকোয় নিয়ে যান একে-একে।

স্বেচ্ছাসেবীদের বুকে ব্যাজ। লেখা আছে : তরুণ সংঘ, কাঁদরা। ব্ৰজহরিকে একজন বলল, আপনিও যে এখানে আটকে আছেন, জানতাম না ডাক্তারবাবু! আমরা ভেবেছিলাম–

বংকুবিহারী তাড়া দিলেন, মেক্ হেস্ট ভলান্টিয়ার্স! পরে সব কথা হবে।

 স্বেচ্ছাসেবীদের একজন পুঁতির মুখের কাপড় তুলেই ঢেকে দিল। আঁতকে ওটা স্বরে বলল, বাপস্!

মেক হেস্ট! মেক হে প্লিজ! বংকুবিহারী ফের তাড়া দিলেন।

চারজন স্বচ্ছাসেবী পুঁতির মড়াটা ওঠাল– দুজন বুকের কাছে ধরল, দুজন পা দুটো ধরল। চাক্কু ডুকরে কেঁদে কোমরের তলাটা ধরল।

 পুঁতিকে নিয়ে গেলে সৈনিক তিনজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর একজন মাথার দিকে, একজন কোমরের তলা, তৃতীয়জন পায়ের দিকটা ধরে অনায়াসভঙ্গিতে নিয়ে গেল একটা মৃতদেহ। বংকুবিহারী তারিফ করে বললেন, কেমন ট্রেন্ড হ্যান্ড দেখছেন কর্নেল? সরি, ইউ আর অলসো এ মিলিটারিম্যান!

কর্নেল একুটু হাসলেন।…ছিলাম!

বংকুবিহারী কান করলেন না। তৃতীয় লাশটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু! দেখুন তো এটা কে?

ব্ৰজহরি পা বাড়িয়ে বললেন, আপনি দেখুন। আমি আর ওতে নেই!

হন্তদন্ত চলে গেলেন ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু। বংকুবিহারী গুম হয়ে বললেন, নেই বললে চলবে না। এক নম্বর উইটনেস ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!

কর্নেল কাপড় একটু তুলে দেখে বললেন, হরিপদ। তারপর ঢেকে দিলেন।

বংকুবিহারী বললেন, মেমসায়েবকে তো এম এল এর ভাগ্নে টানতে টানতে নিয়ে গেল। যাক্ গে, হরিপদকে নিয়ে গেলে আমাদের ছুটি! এই ভয়ঙ্কর জায়গা ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি!

কর্নেল বললেন, ঘনশ্যামবাবু নৌকোয় গিয়ে বসেছেন বুঝি?

নড়ে উঠলেন আইনরক্ষক।…মাই গুডনেস! তা তো জানি না। দেখেছ কাণ্ড? বলে পূবদিকে কড়া চোখে তাকালেন। সেইসময় স্বেচ্ছাসেবীরা দরগার কাছে এসে পৌঁছুলে গলা চড়িয়ে বললেন, নৌকোয় লম্বা নাক, রোগামতো এক ভদ্রলোক আছেন দেখলেন? ধুতি-পাঞ্জাবি পরা– আই মিন, পলিটিকাল লিডার ঘনশ্যাম রুদ্র! একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, ঘনশ্যাম রুদ্র? বলেন কী দারোগাবাবু? তিনি তো শুনেছি আন্ডার গ্রাউন্ডে আছেন। মলোচ্ছাই! বংকুবিহরী খাপ্পা হয়ে বললেন। নৌকোয় তাকে দেখলেন কি না জিগ্যেস করছি! অপর একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, তাকে আমরা দেখিনি। তবে নাম শুনেছি। সে না কি সাংঘাতিক লোক।

অপর একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, ধুস! যত গর্জায়, তত বর্ষায় না। কত লিডার দেখলাম লাইফে। আয়, হাত লাগা!

চতুর্থ স্বেচ্ছাসেবী হাসলেন। …ওয়েট! জওয়ানরা আসুক। ওদের ডেকে এসেছি। কী হেভি ডেডবডি মাইরি!-আড়াইমণ ওজন যেন।

বংকুবিহারী বললেন, কর্নেল! ওরা বডি আনুক। আসুন, আমরা নৌকোয় গিয়ে দেখি দু নম্বর অসামি আছে না কি! এরা মনে হচ্ছে, খেয়াল করে দেখেনি। চলে আসুন!

কর্নেল বললেন, আপনি চলুন দারোগাবাবু! আমি যাচ্ছি।

ইউ আর স্টিল ম্যাড। বলে ক্রুদ্ধ আইনরক্ষক গলাকাটা কালুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললেন। সৈনিকদের আসতে দেখা গেল ভাঙা দেউড়ির ওখানে। তারা এগিয়ে এলে স্বেচ্ছাসেবী চার যুবক এক গলায় বলে উঠল, কাম অন ব্রাদার্স! কাম অন! সৈনিকরা হাসল। একজন বলল, মুর্দা হোনে সে আদমি বহৎ হেভি হো যাতা!

অন্য একজন কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, উও ডাগদারবাবু কর্নিলসাবকা বাত বোলা। আপ কোন হ্যায়? আপকো তো কর্নিল-ঊর্মিল নেহি মালুম হোতা। কঁহা হ্যায় উও কর্নিলসাব?

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড বের করে তার সামনে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সে এবং তার দুই সঙ্গী খটাখট শব্দ তুলে স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো স্যালুট দিল। স্বেচ্ছাসেবী যুবকরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল বললেন, আপলোগোঁকা মদত্ চাক্তা হোড়া।

ইয়েস স্যার! হমলোগ রেডি। একজন সৈনিক বলল। বোলিয়ে, ক্যা করনে পড়ে গা?

কর্নেল স্বেচ্ছাসেবীদের দিকে ঘুরে বললেন, আপনারা নৌকো বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না?

একজন স্বেচ্ছাসেবী দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, পারব হয়তো তবে জলে টান ধরেছে। বড্ড স্রোত।

কর্নেল একটু ভেবে বললেন, ঠিক আছে। সোলজার্স! আপলোগ সবকো পঁহুছা, দে কর তুরন্ত চলা আইয়ে। ইন্তেজার করুঙ্গা ময়! কিতনা টাইম লাগে গা?

একজন সৈনিক বলল, আধা ঘণ্টা, স্যার! বহৎ কারেন্ট হ্যায়! নেহি তো জলদি আ যাতা।

দ্বিতীয় সৈনিক বলল, আভি যানেকা টাইম উও নাওকে নিয়ে জাস্তি টাইম লাগেগা। স্পিডবোট হ্যায়, স্যার! একেলা আনেসে দশ মিনিট–ব্যস!

ঠিক হ্যায়! কর্নেল গলা চড়িয়ে বললেন। ওর শুনিয়ে যাকে দারোগাবাবু কো বোলিয়ে, উনকা পলিটিকাল প্রিজনারকো পড়নে চাহতা তো আপকা সাথ ফিরভি আনা পড়ে গা। উনকো সমঝ দিজিয়ে ইয়ে বাত।

পলিটিক্যাল প্রিজনার! সৈনিকেরা পরস্পরের দিকে তাকাল।

 কর্নেল বললেন, হাঁ বহৎ খতরনাক আদমি! ঘনশ্যাম রুদ্র!

একজন সৈনিক বলল, তো কুছ আর্মস ভি ক্যাম্পসে লানা পড়ে গা, স্যার?

নেহি। আর্মসকা কৈ জরুরত নেহি! জলদি কিজিয়ে।

সৈনিকরা আবার কর্নেলকে স্যালুট ঠুকে মৃতদেহে হাত লাগাল। স্বেচ্ছাসেবীরাও হাত লাগানোর ভঙ্গি করল। হরিপদর মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর নির্জন হয়ে উঠলে খোঁড়া পিরের দরগা। বিকেলের রোদ্দুর ক্রমে লালচে হয়ে উঠেছে। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে চারদিকে ঘুরে-ঘুরে গাছপালাগুলো দেখতে থাকলেন। কী একটা পাখি ডাকছে, যার ডাক সব পাখির ডাকের ভেতর আলাদা– শ্রুতিপারের ধ্বনি যেন ওই ডাকে। কী পাখি ওটা? শেষবেলায় পাখিরা তুমুল হল্লা করছে গাছে-গাছে। খুঁজে বের করা কঠিন বটে।

কর্নেল উত্তর-পূর্ব কোণের ছাতিম গাছটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ওখানে হরিপদ খুন হয়েছিল। গিয়েই চমকে উঠলেন। একবুক জলে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যাম রুদ্র কী একটা টানাটানি করছেন।

কর্নেল হেসে ফেললেন। ঘনশ্যামবাবু!

ঘনশ্যাম হকচকিয়ে ঘুরে কর্নেলকে দেখতে পেলেন এবং করুণ হেসে বললেন, ডোঙাটা

হ্যাঁ, ডোঙাটা। কর্নেল বললেন। আপনি কী ভাবে টের পেলেন?

ঘনশ্যাম বললেন, জল কমে গেছে তো! কালো রেখার মতো দেখা যাচ্ছিল। একটা ডাল ভেঙে হাঁটুজলে নেমে গিয়ে ডালটা দিয়ে পরখ করে বুঝলাম, তালডোঙাটাই বটে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। উল্টেট গেল তো গেল। কিছুতেই চিত করাতে পারছি না! পারলে তো এতক্ষণ কেটে পড়তাম। বৈঠারও দরকার হত না। হাতদুটোই যথেষ্ট ছিল।

আপনি ওটা ডুবিয়েই রাখুন। উঠে আসুন! দারোগাবাবু চলে গেছেন আসামী নিয়ে।

ঘনশ্যাম দুঃখিতমুখে বললেন, কিন্তু আমি যে আটকে গেছি। প্রচণ্ড ক্ষিদেও পেয়েছে। উঠে আসুন।

দেরি করবেন না। শিগগির!

ঘনশ্যাম আন্ডারপ্যান্ট পরে জলে নেমেছিলেন। বিমর্ষভাবে উঠে এলেন। ঝোপের ভেতর লুকোনো ব্যাগে ধুতি-জামা-গেঞ্জি ছিল। একটা গামছাও। কর্নেলের তাড়ায় ঝটপট গা মুছে ধুতি-গেঞ্জি-পাঞ্জাবি পরে নিলেন আগের মতো। স্যান্ডেল গতকাল খুইয়েছেন বন্যার জলে। খালি পা। ফিসফিস করে বললেন, তা আপনি একা রয়ে গেলেন যে? এক নৌকোয় জায়গা হল না বুঝি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনাকে ফেলে যাই কী করে? চুল্লুর পাল্লায় পড়ে

ওসব আমি বিশ্বাস করি না! অশরীরী আত্মা-টাত্মা স্রেফ বাজে কথা। ঘনশ্যাম ফুঁসে উঠলেন।…তার চেয়ে বলুন, আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য আপনি থেকে গেছেন। আমি তো বুঝতেই পেরেছি, আপনি একজন গোয়েন্দা।

কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি জোর বেঁচে গেছেন ঘনশ্যামবাবু! চুল্লু এতক্ষণ আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনাকে ডুবিয়ে মারত। না– গলা কাটত না। কারণ চাক্কর ড্যাগারটা এখন আমার হাতে। এই দেখুন!

স্প্রিংয়ের ছুরটা দেখেই আঁতকে উঠলেন ঘনশ্যাম।…সর্বনাশ! কোথায় পেলেন?

দেখাচ্ছি। আসুন আমার সঙ্গে। চাপা স্বরে কথাটা বলে কর্নেল ঘনশ্যামকে অবাক করে তার পাঞ্জাবিটা গলার কাছে খামচে ধরে টানলেন। প্রাঙ্গণের কবরখানায় পৈৗছে দেখা গেল, অন্ধ দরবেশ পিরের দরগার সামনে ভিজে চত্বরে দাঁড়িয়ে বিকেলের নমাজ পড়ছেন। কর্নেল জোরে হাঁটছিলেন। ঘনশ্যামকে, বিব্রত ও ভীত দেখাচ্ছিল। আস্তানাঘরের পেছনে গিয়ে দেখা গেল, একদঙ্গল শকুন জলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, কিছু। বুঝতে পারছেন ঘনশ্যামবাবু?

ঘনশ্যাম রাগী মুখে বললেন, না তো। কিছু বুঝতে পারছি না। কেনই বা আমাকে আপনি এমন করে টানাটানি করছেন?

কর্নেল তেমনি ফিসফিস করে বললেন, ওখানে একটি লাশ পোঁতা আছে। শকুনগুলো গন্ধ পেয়েছে। কিন্তু জল নামতে দেরি আছে। আসুন। আস্তানাঘরে যাই।

কর্নেল ঘনশ্যামের জামা ছেড়ে হাত ধরে টেনে আনার ভঙ্গিতে হন্তদন্ত ঢাল বেয়ে উঠে এলেন। অন্ধ দরবেশ দরগার কাছে দাঁড়িয়ে এবার বুকে চিমটে ঠুকছেন। কর্নেল হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলেন, ঘনশ্যামবাবু! আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পালানোর চেষ্টা করবেন না। চুপ করে বারান্দায় বসুন। যা বসুন বলছি।

ঘনশ্যাম সত্যিকার রাগে পাল্টটা গলা চড়িয়ে বললেন, যান, যান! আমাকে জাঁক দেখাবেন না! কী সব উদ্ভুট্টে কাজকারবার! তক্ষুণি ভদ্রলোকের মতো কথাবার্তা, আবার তক্ষুণি অপমানজনক ব্যবহার! অদ্ভুত লোক তো মশাই আপনি!

বলে টপাস করে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আপনি বলছিলেন আমি পুলিশের গোয়েন্দা। কাজেই ঘনশ্যামবাবু, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সাধ্য আপনার নেই। পালাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?

ঘনশ্যাম আর কোনো কথা বললেন না। আঙুল খুঁটতে থাকলেন মুখ নামিয়ে। দরবেশের প্রার্থনা শেষ। চিমটে বাড়িয়ে মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসছিলেন। বারান্দায় উঠে হাঁক ছাড়লেন, চুল্লু! তারপর তালা খুলতে দরবেশ যখন দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, তখন কর্নেল বললেন, দরবেশ সায়েব! আপনার ওপর আর আমরা জুলুম করব না। এখনই বোট এসে যাবে। এই আসামীকে নিয়ে আমরা চলে যাব। তবে দয়া করে যদি একটু চা খাওয়ান, ভাল হয়। দশটা টাকাই না হয় নেবেন।

দরবেশ আস্তে বললেন, দুধ নাই বাবাসকল মা সকল! খালি চা আর একটুখানি চিনি আছে।

কর্নেল উঠে গিয়ে পায়ের কাছে একটা দশ টাকার নোট রাখলেন। বললেন, টাকাটা নিন!!

অন্ধ দরবেশ টাকাটা চিমটে দিয়ে ঠিকই খুঁজে পেলেন এবং চিমটেতে আটকে তুলে নিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে তক্তপোশের তলা থেক কেরোসিন কুকার বের করে বললেন, নিন বাবাসকল, মা সকল! জালায় পানি আছে। বারান্দার তাকে কেটলি আছে। ভাড় আছে। চা-চিনি দিচ্ছি।

কর্নেল কেরোসিন কুকার ধরানোর সময় স্পিডবোটের শব্দ শুনতে পেলেন। দরবেশ কাগজের পুরিয়ায় চা ও চিনি নিয়ে ডাকলেন, বাবা সকল, মা সকল! চা-চিনি!

চা-চিনি পুরিয়া নিয়ে কর্নেল বললেন, আপনিও খাবেন তো দরবেশসায়েব?

আপনাদের ইচ্ছা বাবাসকল, মা সকল!

 তাহলে বসে পড়ুন এখানে। কই, আপনার আসন নিয়ে আসুন!

 দরবেশ ঘর থেকে জীর্ণ গালিচাটি বের করে বিছিয়ে বসলেন। বুকে চিমটে ঠুকে বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, চুল্ল! চুল্ল চুল্লু! মোটরবোটের আওয়াজ বাড়ছিল ক্রমশ বাড়তে বাড়তে একসময় থেমে গেল আওয়াজটা। কর্নেল জালা থেকে জলতুলে কেটলি ভরছিলেন। হঠাৎ ঘুরে দেখলেন, বারান্দায় ঘনশ্যাম নেই। প্রাঙ্গণের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে এক পলকের জন্য তাঁকে ধ্বংসস্কৃপের ফাঁকে দেখা গেল। কর্নেলের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু কিছু বললেন না। কেটলি চাপিয়ে দিলেন কেরোসিন কুকুারে।…

.

চুল্লু! চুল্লু!

 সৈনিকেরা ফিরে এসেছে। একজন সশস্ত্র। কাদরা থানার ওসি বংকুবিহারী ধাড়া আসেননি। পাঠিয়েছেন থানার সেকেন্ড অফিসার ধরণীধর সমাদ্দারকে। ইনি ঢ্যাঙা, ফো, টানটান গড়নের মধ্যবয়সী মানুষ। সঙ্গে দুজন তাগড়াই কনস্টেবল, হাতে মাস্কেট। সৈনিকদের স্যালুট ঠোকা দেখে তারাও জৰ্বর স্যালুট ঠুকল। ধরণীধরকে।

বড়বাবু বংকুবিহারী ততকিছু বলেননি। তাই নেহাতই নমস্কার করে ফেলেছিলেন। কর্নেলকে। সৈনিকদের এবং কনস্টেবলদ্বয়ের স্যালুট ঠোকা তাঁকে বিব্রত করায় তিনিও একখানা স্যালুট ঠুকে বসলেন। কর্নেল মিটিমিটি হেসে পাল্টটা স্যালুট ঠুকে বললেন, আপনারা বসুন আগে। একটু চা খান। বৈঠ যাইয়ে সব।

ধরণীধর বললেন, কর্নেলসায়েব! কিছু যদি মনে করেন, একটা কথা বলি?

হবে। কথা হবে। একটু বসুন। কর্নেল হাসলেন। র চায়ে আপত্তি নেই আশা করি। সোলজার্স?

সশস্ত্র সৈনিকটি মুচকি হেসে বলল, জরুর পিয়েঙ্গে, স্যার! হমলোগ বহৎ টায়ার্ড! চায় পিনে কা মওকা মিলা নেহি অভিত।

ছোট্ট মাটির ভাঁড়ে একটুখানি করে চিনি মেশানো লিকার ঢেলে বিলি করলেন কর্নেল। দরবেশকে পুরো ভাঁড়ই দিলেন। দরবেশ চিমটে ঠোকা বন্ধ। করে ভাড় নিয়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে হাঁকলেন, চুল্লু!

ধরণীধর একটু অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, চুল্লু এ দরগার পাহারাদার– অশরীরী আত্মা! সেই তো গলাকাটা কালুকে ভর করেছিল। তাই তিন-তিনটে মানুষের প্রাণ গেছে, বুঝলেন তো?

 শুনে ধরণীধর হাসলেন।…কালুর নামটাই গলাকাটা। এর আগে সে অনেকের গলা কেটেছে। ইদানিং সে ইসমাইল ডাকুর দলে ভিড়েছে বলে খবর ছিল আমাদের হাতে। যাই হোক, এতদিনে তাকে বড়বাবু হাতেনাতে ধরেছেন। প্রমোশন হয়ে যাবে বড়বাবুর।

সৈনিক আর কনস্টেবলরা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে দু চুমুকেই চা শেষ করেছে। ভাড়গুলো ছুঁড়ে ফেলায় কিছু আওয়াজ হল। দরগার বনভূমির তলায় আবছায়া, মাথায় ফিকে গোলাপী রোদ্দুর। পাখিদের হট্টগোল তুমুল বেড়েছে। কর্নেল চটুকু শেষ করে বললেন, হ্যাঁ- কালু বা হরমুজ আলি এর আগেও গলা কেটেছে শুনেছি। কিন্তু এভাবে তিন-তিনটে মানুষ এবং একটা কুকুরের গলা চব্বিশঘণ্টার মধ্যে কখনও কি সে কেটেছে?

ধরণীধর স্বীকার করলেন, না– তা কাটেনি।

তাহলে? কর্নেল গলার ভেতর বললেন, চুল্ল! চুল্লু তাকে ভর করেছিল। দরবেশসায়েব কী বলেন?

দরবেশও ভরাটগলায় বললেন, চুল্লু!

ধরণীধর কালো আলখেল্লা ও কালো পাগড়িপরা দরবেশকে দেখতে দেখতে বললেন, এই দরবেশসায়েবের কথা শুনেছি। ইনি এক সাধক পুরুষ, তাও শুনেছি। তা উনি নাকি কথা বলেন না কারুর সঙ্গে?

কর্নেল বললেন, একেবারে বলেন না, তা নয়। তবে খুব দরকার হলে বলেন। উনি খুব জ্ঞানী মানুষ। গতকাল ওঁর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতে গিয়েই বুঝেছিলাম, উনি যা কিছু বলেন, সবই সিম্বলিক। যেমন, ওই চুল্ল! চুল্লু হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এভিলের মানে, সবকিছু মন্দের উৎস। তার মানে, যা কিছু মন্দ জিনিস, চুল্লু থেকেই বেরিয়ে আসছে।

ধরণীধর একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন, প্লিজ কর্নেলসায়েব! ঘনশ্যাম রুদ্র

হুঁ, বেলা পড়ে এসেছে। এবার অপারেশন শুরু করা দরকার। কর্নেল উঠে প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ফের, ঘনশ্যামবাবুর পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। চারদিকের বিশাল মাঠের মাঝখানে এই উঁচু ঢিবি। কাজেই উনি এখানেই লুকিয়ে আছেন– থাকতে বাধ্য। বাই দা বাই, বন্যার জলের গভীরতা কতটা বলতে পারেন?

ধরণীধর বলার আগে একজন সৈনিক বলে দিল, কমসে কম বিশ ফুট হোগা, স্যার!

ধরণীধর সায় দিলেন। তা হবে। হোল এরিয়া একেবারে ফ্ল্যাট ল্যান্ড সমতলই বটে। কাজেই সর্বত্র জলের ডেস্থ একইরকম।

কর্নেল বললেন, আপনারা টর্চ এনেছেন। কাজেই অসুবিধা নেই। তবে একটা কথা। দল বেঁধে খুঁজতে হবে। কারণ, একা-একা কম্বিং অপারেশন চালানো বিপজ্জনক।

ধরণীধর একটু বিরক্ত হয়ে বললনে, তাতে কি লাভ হবে? আমরা চক্কর দেবে, ঘনশ্যামবাবুও চক্কর দিতে থাকবেন। তার চাইতে তিন দলে ভাগ হয়ে তিনদিক থেকে–

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, না, না! সাবধান, সাবধান! চুল্লু সত্যি ভয়ঙ্কর। সে যে-কোনও মুহূর্তে হামলা করবে। আসুন, আমরা প্রথমে ঢিবির পশ্চিম দিক থেকে শুরু করি।

বিরক্তমুখে ধরণীধর কর্নেলকে অনুসরণ করলেন। দিগন্তে সূর্য লালরঙের চাকা হয়ে সবে রঙবেরঙের মেঘের ভেতর লুকিয়ে গেল। বিস্তীর্ণ উত্তরঙ্গে বন্যার জলে একটু লালচে ছটা খেলছে। বাঁদিকে শকুনের দঙ্গল জলের ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ধরণীধর বললেন, মড়াটড়ার আশায় বসে আছে। বন্যা হলে অনেক জন্তু মারা পড়ে। ভেসে এসে ঢিবিতে আটকে যেতে পারে।

কর্নেল আস্তে বললেন, ধরণীবাবু, ওখানে একটা লাশ পোঁতা আছে।

ধরণীধর চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু কর্নেল দ্রুত চুপ বলায় থমকে দাঁড়ালেন। চাপাস্বরে শুধু বললেন, সে কী!

কর্নেল গলা চড়িয়ে বললেন, চলুন ধরণীবাবু, এখান থেকে দক্ষিণদিক হয়ে সার্চ করা যাক।

শকুনগুলোকে এড়িয়ে গাছপালা, ঝোপঝাড়ে, ধ্বংসস্তূপের ভেতর সাতজন লোক কম্বিং অপারেশন শুরু করল। সবার আগে ধরণীধর। একহাতে টর্চ, অন্যহাতে রিভলবার। গাছপালার ভেতর এখনই অন্ধকার জমেছে। টর্চ জ্বেলে। গাছের ওপর, ডালপালার ভেতর, ঝোপের আড়াল, ধ্বংস্তূপ তন্নতন্ন খোঁজা হচ্ছে। দক্ষিণে বটতলায় গিয়ে কর্নেল বাঁদিকে ঘুরে দেখলেন দরবেশ দরগার কাছে নামাজ পড়ছেন। দলটা ঘুরে পূর্বে পৌঁছুল। নিচে দুটি সাদা মোটরবোট দেখা গেল আবছায়ার ভেতর। ধরণীধর বুদ্ধিমান। একজন সশস্ত্র কনস্টেবলকে একটা বোটে বসিয়ে রখেছেন। কর্নেল বললেন, ধরণীবাবু! আপনার প্রশংসা করা উচিত।

ধরণীধর মনে-মনে অসন্তুষ্ট। বিরক্ত। কারণ, এভাবে কম্বিং অপারেশন অর্থহীন। কিন্তু কথাটা শুনে অগত্যা একটু হাসলেন। কেন বলুন তো কর্নেলসায়েব?

আমাদের পলিটিক্যাল প্রিজনার যাতে ওই বোটে করে পালাতে না পারে, আপনি তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন, দেখছি। বলে কর্নেল হঠাৎ হন্তদন্ত সোজা হাঁটতে শুরু করলেন উত্তর দিকে। একজন সৈনিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ইয়ে ক্যা হো রাহা?

ধরণীধর চাপা স্বরে বললেন, এর একটা বোঝাপড়া করা দরকার। কোনো মানে হয়?

একজন কনস্টেবল্ বলল, স্যার! বড়বাবু বোলা না, কর্নিসাব পাগলা আদমি!

হুঁ, বোলা। ধরণীধর শক্ত মুখে বললেন। ছোড় দো উনকো। এক কাম করো। তেওয়ারি, তুম ইয়ে তিন জওয়ানলোগোঁকা সাথ সিধা দরবেশবাবাকা ডেরাকি পিছেসে স্টার্ট করো। সাউথসাইড দেখ লিয়া। ওয়েস্টসে স্টার্ট কারকে ইস্টমে সার্চ করো। হমলোগ ইধারসে নর্থবরাবর ওয়েস্টমে সার্চ করতা। গো! জলদি!

তেওয়ারিজি তিনজন সৈনিককে নিয়ে ভাঙা দেউড়ি দিয়ে সোজা আস্তানার দিকে চলে গেল। ধরণীধর দ্বিতীয় কনস্টেবলকে বললেন, ধনেশ্বর! আও মেরা সাথ…।

উত্তর-পূর্ব কোণে ছাতিমতলায় কর্নেল দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে লম্বা একটা ডাল। উরু পর্যন্ত ভিজে গেছে পাতলুন। ধরণীধর এসেই বললেন, কী ব্যাপার?

সাপ।

 ধরণীধর চমকে গেলেন। কই সাপ? কোথায় সাপ?

কর্নেল ডালটা জলে ফেলে দিয়ে বললেন, পলিয়ে গেল। যাই হোক, এই ঢিবিতে কিন্তু প্রচুর সাপ এসে জুটেছে। সাবধান ধরণীবাবু!

ধরণীধর বিরক্ত মুখে বললেন, জানি। দেখেশুনেই পা ফেলছি।

বলে ছাতিম গাছটাতে টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে থাকলেন পলিটিক্যাল প্রিজনার ঘনশ্যাম রুদ্রকে। কনস্টেবল ধনেশ্বর সামনের জঙ্গলে আলো ফেলল। কর্নেল বললেন, আর খুঁজে লাভ নেই। ধরণীবাবু! আপনাদের দ্বিতীয় আসামী পালিয়ে গেছে।

অসম্ভব। ধরণীধর শক্তমুখে বললেন। সাঁতার কেটে পালানোর মতো ক্ষমতা ঘনশ্যাম রুদ্রের নেই। আমাদের রেকর্ডে আছে ওঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা কী। আই অ্যাম সরি, কর্নেল সায়েব! ইউ হ্যাভ মিসলেড আস।

বলেন কী। কর্নেল হাসলেন।

 এগেন– সরি। ধরণীধর পা বাড়ালেন। প্লিজ লেট মি ডু মাই ডিউটি।

 দুজনে আলো ফেলতে ফেলতে বুটের শব্দ তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলেন ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। কর্নেল আপনমনে হাসছিলেন। ঘনশ্যামবাবুকে ইচ্ছে করেই যথেষ্ট সময় দিয়েছেন পালানোর জন্য। ভোঙাটি উদ্ধার করে পালাতে পেরেছেন, কারণ ভোঙাটি যথাস্থানে নেই। খুঁজে পাননি কর্নেল।

প্রাঙ্গণের কবরখানায় গিয়ে দেখলেন দরবেশ নমাজ সেরে বারান্দায় গিয়ে বসেছেন। যথারীতি বুকে চিমটে ঠুকছেন। কর্নেল বারান্দায় উঠলে দরবেশ হাঁকলেন, চুল্লু!

কর্নেল তার কিটব্যাগ ও বর্ষাতি বারান্দার ধারে নিয়ে এলেন। পা ঝুলিয়ে বসে কিটব্যাগ খুলে চুরুটের কৌটো বের করলেন। একটি চুরুট জ্বেলে টানতে থাকলেন। একটু পরে ধরণীধরদের দেখা গেল। প্রাঙ্গণে এসে ধরণীধরবাবু নিচু গলায় কী নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনসময় কর্নেল ডাকলেন, ধরণীবাবু! এখানে আসুন! জরুরি কথা আছে। শিগগির! ঘনশ্যামবাবু।

ঘনশামবাবু শুনেই ধরণীধর সদলবলে প্রায় দৌড়ে এলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, কই? কই? বাট প্লিজ, ডোন্ট মিসলিড এগেন! হোয়্যার ইজ দ্যাট ম্যান?

আপনি শান্তভাবে বসুন। বলছি।

আঃ! আবার

 ধরণীধর, সত্যিই ঘনশ্যামবাবু পালিয়ে গেছেন। বিশ্বাস করুন আমরা কথা।

কিন্তু পালালেন কীভাবে? দেখেছেন আপনি তাকে পালাতে?

দেখেছি বলতে পারেন। নিশ্চয় পারেন।

ধরণীধর খাপ্পা হয়ে বললেন, আশ্চর্য! দেখেছেন, কিন্তু আমাদের বলেননি!

 ঘনশ্যামবাবু

আগে আমার কথার জবাব দিন। আমাদের সেটা এতক্ষণ বলেননি কেন?

কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন, ঘনশ্যামবাবু একটা তালডোঙায় চেপে পালিয়ে গেছেন।

তালডোঙা? ধরণীবাবু ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নড়ে উঠলেন মাই গুডনেস! বড়বাবু গলাকাটা কালুর তালডোঙাটার কথা বলেছিলেন মনে পুড়ছে!

কর্নেল শান্তভাবে বললেন, তালডোঙাটা প্রথমে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু চুল্লু আড়াল থেকে দেখে সেটা দড়ি ছিঁড়ে জলের তলা থেকে উদ্ধার করেছিল। তারপর আজ কোনো এক সময়ে চুল্লু ওটা ছাতিমতলায় জলে ডুবিয়ে রেখেছিল। জল কমে এলে ঘনশ্যামবাবুর সেটা চোখে পড়ে। চুল্লু তাকে মেরে ফেলত। গলা কেটে নয়, গলা টিপে জলে ডুবিয়ে। দৈবাৎ আমি গিয়ে পড়ায়। উনি বেঁচে যান। চুল্লু কেটে পড়ে।

কী খালি চুল্লু-চুল্লু করছেন আপনি! ওসব আমি বিশ্বাস করি না!

 চুল্লুকে বিশ্বাস করেন না? নাকি আমার কথা?

তেতোমুখে সিগারেট জ্বেলে ধরণীধর বললেন, দুটোই।

কিন্তু দুটোই নিখাদ সত্যি! চুল্লু সত্যিই আছে!

হ্যাণ্ডেরি! ধরণীধর তার বড়বাবুর ভঙ্গিতে বললেন। আপনার মাথার ঠিক নেই। জলবন্দী অবস্থায় থেকে ক্ষিদের চোটে আপনার সেন্স অফ রিজনিং লোপ পেয়েছে। খালি চুল্লু-চুল্লু করছেন।

অন্ধ দরবেশ হাঁক দিলেন, চুল্লু! তারপর উঠে দাঁড়ালেন। দরজার তালা খুলতে চাবি বের করলেন আলখেল্লার ভেতর থেকে।

কর্নেল বললেন, দরবেশসায়েব! এঁরা চুল্লুর কথা বিশ্বাস করছেন না। .. দয়াকরে এঁদের বলুন, চুল্লু কে? চুল্লু কে ছিল? কত বছর আগে চুল্লু খাঁ নামে এর জায়গিরদার এই এলাকার মালিক ছিল?, দরবেশসায়েব! বলুন তো এঁদের সেই সাংঘাতিক গল্পগুলো! কত খুন খারাপি করেছিল চুল্লু খাঁ, সেইসব কথা বলুন।

দরবেশ সবে তালা খুলেছেন, কর্নেল এক লাফে উঠে গিয়ে পেছন থেকে দুহাতে তাকে জাপটে ধরে এক প্যাঁচে বারান্দায় ধরাশায়ী করলেন..ধরণীবাবু! হেল্প মি! চুল্লুকে ধরে ফেলেছি।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিয়ে গেছে। ততক্ষণে কর্নেল দরবেশের বুকে চেপে বসেছেন, চিমটেটি তার তলায় লম্বালম্বি হয়ে আছে। বারান্দায় আবছা অন্ধকারে কয়েকটা টর্চের আলোয় দৃশ্যটা চোখে পড়ল। ধরণীধর বললেন, ব্যাপার কী? কর্নেল! কর্নেল! ও কী করছেন?

কর্নেল দরবেশের চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর হ্যাঁচকা টানে পাগড়ি উপড়ে ফেললেন। পাগড়ির সঙ্গে পরচুলা ও দাড়িও হাতে উঠে এল। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ধরণীবাবু! ডাকু ইসমাইলকে কখনও দেখেছেন?

মাই গড! ধরণীবাৰু এতক্ষণে লাফ দিলেন। কনস্টেবল দুজন একগলায় চেঁচিয়ে উঠল, ইসমাইল ডাকু! ওহি তো ইসমাইল ডাকু!

কর্নেল চিমটেটি কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরবেশবেশী ঈসমাইল শুয়েই রইল। তেওয়ারি ও ধনেশ্বর তাকে টেনে ওঠাল। ধরণীধর তার বুকে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে বললেন, ধনেশ্বর! হ্যান্ডকাপ হ্যায় তুমহারা পাস। লাগা দো!

দুই কনস্টেবল ইসমাইলের দুটো হত পিঠের দিকে টেনে হ্যান্ডকাপ পরাল। ইসমাইল চুপ। সৈনিকত্রয় বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। ব্যাপারটা তাদের এখনও তত বোধগম্য নয়। কর্নেল ঘরের ভেতর ঢুকে তক্তাপোসের তলায় নিজের টর্চটি জ্বেলে বললেন, ধরণীবাবু! দেখে যান।

 ধরণীবাবু দরজার কাছে গুঁড়ি মেরে তক্তাপোসের তলা দিয়ে টর্চের আলো ফেললেন। বললেন, কী কাণ্ড! একটা ফোকর দেখছি!

হু, চিমটে দিয়ে এই সুড়ঙ্গটা খুঁড়েছিল ইসমাইল। ভেতর থেকে যখন-তখন দরজা বন্ধ করার এই হল রহস্য। কর্নেল টর্চের আলোয় ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে বললেন। দরজা বন্ধ করে ইসমাইল এই ফোকর দিয়ে বাইরে বেরুত। আমাদের অলক্ষ্যে সকলের গতিবিধির ওপর নজর রাখত। গলাকাটা কালু ওর সাগরেদ। একটা তালডোঙা এনেছিল ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু হঠাৎ শাওনি, তারপর আমাকে এবং দরগায় এতগুলো লোকজন, এমন কী স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখে কালু ঝটপট গাছের ডালে লুকিয়ে পড়েছিল। আমি তালডোঙাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম– নেহাত একটা খটকা বেধেছিল বলেই। কিন্তু ইসমাইল মহা ধূর্ত। যেভাবে হোক, ব্যাপারটা দেখেছিল। তারপর কোনো এক সময়, নিশ্চয় গতরাতেই ওটা উদ্ধার করে ছাতিমতলার নিচে লুকিয়ে রেখে এসেছিল।

ধরণীধর বললেন, কিন্তু তখনই পালিয়ে যেতে পারতো। কেন পালায়নি?

কর্নেল হাসলেন। পালায়নি, তার কারণ অন্ধ দরবেশের জমানো টাকাকড়ি খুঁজে পাচ্ছিল না। ওই দেখুন, সিন্দুকের ভেতরটা ওলটপালট হয়ে আছে। আর এই দেখুন, এখানে খোঁড়াখুঁড়ির চেষ্টা। আমরা আসার আগেই অন্ধ দরবেশকে সম্ভবত গলা টিপে মেরে–

সর্বনাশ! বলেন কী? ধরণীধর অবাক হয়ে বললেন। তাহলে কি শকুনগুলো যেখানে বসে আছে, ওখানেই অন্ধ দরবেশের ডেডবডি পোঁতা আছে?

আছে। গতকাল এখানে এসে ঘোরাঘুরি করতে করতে জায়গাটা আমার চোখে পড়েছিল। ঘাসের আর কাদামাটির চাবড়া চাপানো দেখে সন্দেহ হয়েছিল আমার। সদ্য কেউ যেন কিছু পুঁতেছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্যই আসলে দরগায় থেকে গেলাম। তারপর হঠাৎ নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যা এসে পড়ল। জায়গাটা ডুবে গেল। ওখানেই ইসমাইল আসল দরবেশকে মেরে পুঁতেছে।

ধরণীধর বারান্দা থেকে পরচুলা আর চিমটেটা কুড়িয়ে নিলেন। বললেন, ইসমাইল ডাকুর ছদ্মবেশ ধরার কথা পুরনো পুলিশ রেকর্ডে আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। অথছ দেখছি, ব্যাপারটা সত্যি। একবার নাকি নবাবগঞ্জ বাজারে ফকির সেজে হাত পেতে বসে থাকত। পুলিশের নাকের ডগায়! ধরণীধর হাসতে লাগলেন।

ধনেশ্বর বলল, স্যার! আর কেতনা দের হোগা?

ধরণীধর কিছু বলার আগে কর্নেল বেরিয়ে এসে বললেন, উসকো লে যাইয়ে! বোটমে যাকে বৈঠিয়ে। সোলজার্স! গো উইথ দেম!

ধরণীধর বললেন, আমাদের আর এখানে থাকার দরকার আছে কি কর্নেলসায়েব?

দরকার আছে, ধরণীধরবাবু! কর্নেল বললেন। আমার ধারণা, এই ঘরে অন্ধ দরবেশের জমানো টাকাকড়ি তো আছেই, আগের আমলের আরও দামী কিছু থাকা সম্ভব। এই দরগায় যুগ যুগ ধরে লোকেরা মানত দিয়েছে। বহু দামী জিনিসপত্রও দিয়ে থাকবে।

গুপ্তধন? ধরণীধর মুচকি হেসে বললেন।

অসম্ভব নয়। এটি একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক জায়গা। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি বারান্দার কোণ থেকে উদ্ধার করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। বললেন তার চেয়ে বড় কথা দরবেশের ডেডবডিটা শকুনের মুখে এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না। আপনি বরং এক কাজ করুন। একটা বোটে ওরা আসামী নিয়ে চলে যাক। বাই দা বাই, আপনাদের বোটে যদি কিছু ফুড থাকে নিয়ে আসুন। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত!

রিলিফের জন্য কিছু ফুডপ্যাকেট দেখেছি জওয়ানদের বোটে! নিয়ে আসছি। বলে ধরণীধর সদব্বলে চলে গেলেন।

কর্নেল ঘর থেকে খুঁজে দরবেশের লণ্ঠনটি নিয়ে এলেন বারান্দায়। জ্বালতে গিয়ে কয়েকমুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। প্রকৃতই এক অন্ধ দরবেশ এই নির্জন দরগায় এই লণ্ঠনটি জ্বেলে রাত কাটাতেন। হয়তো নিজেকেই সাহস দিতে মাঝে মাঝে হাঁক দিতেন, চুল্লু! চুল্লু! ডাকু ইসমাইল চমৎকার নকল করেছিল এই ডাকটি।

বারান্দার ধারে জ্বলন্ত লণ্ঠনটি রেখে প্রাঙ্গণের কবরখানায় নামলেন কর্নেল। চারপাশে গা ছমছমকরা অন্ধকার বনভূমি ঘিরে আবছা ছলছল বন্যাজলের শব্দের সঙ্গে পোকামাকড়ের ডাক মিশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিভীষিকা একাকার হয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একটা বাতাস এল শনশনিয়ে। যেন ফিসফিস করে উঠলেন অন্ধ দরবেশ, চুল্লু! চুল্ল! চুল্ল!

কর্নেল শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। হু, শকুনগুলো ওত পেতে আছে। বন্যার জল আলগা করে বসানো ঘাসের চাবড়া টেনে নামিয়ে নিয়ে গেলে মাটি গলে দরবেশের লাশ বেরিয়ে পড়বে সারারাত সেই প্রতীক্ষা শকুনদের। ভোরবেলা তারা বাঁকা ধারালো ঠোঁট বাগিয়ে পা বাড়াবে।

তাই এরাতটাও দরগায় কাটাতে হবে। কর্নেল সিন্ধান্ত করলেন। ধরণীধরকে বলবেন কথাটা, যদি ধরণীধর থাকতে রাজি না হন, একাই থাকবেন কর্নেল। শকুনের মুখ থেকে হতভাগ্য অন্ধ মানুষটির মৃতদেহ রক্ষা করা তার কর্তব্য। কর্নেলের মনে হল, চারপাশ থেকে মৃত মানুষটির অসহায় আর্তনাদ বাতাসে স্পন্দিত হচ্ছে, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু!…

.

বংকুবিহারীর পুনরাবির্ভাব

 বন্দী ইসমাইল ডাকুকে একটি মোটরবোটে পাঠিয়ে দিয়ে ধরণীধর কয়েকটা ফুডপ্যাকেট বগলদাবা করে এনেছিলেন। তিনিও ক্ষুধার্ত। খাওয়া সেরে আস্তানাঘর খুঁজে চা ও চিনির কৌটো পাওয়া গেছে। দুধ সত্যি নেই। কর্নেল চা করেছেন কুকার জ্বেলে। চা খেতে খেতে ধরণীধর বলছিলেন, এমন ভয়ংকর বন্যা নাকি মহকুমায় গত একশোবছরে দেখা যায়নি। আর্মি না নামালে একাধিক মানুষ মারা পড়ত। তবে গৃহপালিত জীবজন্তু বন্যা ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে। আসার পথে প্রচুর ডেডবডি দেখলাম। হরিব!

সেইসময় আবার মোটরবোটের শব্দ। দুজনেই কান পাতলেন। শব্দটা দরগার ঢিবির পশ্চিমে শোনা যাচ্ছিল। আওয়াজ বাড়তে বাড়তে কাছে এসে থেমে গেল। আলোর ঝলকানি দেখা গেল। দুজনে প্রাঙ্গণে নেমে গেলেন। তাদের ওপর আলো পড়ল। তারপর বংকুবিহারীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কণ্ঠস্বর বলা ভুল, গর্জন মিশ্রিত আর্তনাদ যেন, কর্নেল! ধরণীবাবু! ওকে পালাতে দেবেন না। অ্যারেস্ট দ্য ম্যান, দ্যাট দরবেশ।

দুজনে মুচকি হাসলেন শুধু। বংকুবিহারী সদলবলে মাটি কাঁপিয়ে প্রাঙ্গণে এসে বারান্দায় টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, আস্তানাঘরের দরজা খোলা। এক লাফে বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠলেন, হোয়ার ইজ দ্যাট বাস্টার্ড? পালিয়ে গেছে? তাকেও পালাতে দিলেন আপনারা? ধরণীধর কিছু বলার আগে কর্নেল বললেন, গলাকাটা কালু নিশ্চয়ই কবুল করেছে কিছু?

হ্যাঁ। বংকুবিহারী হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন। কিন্ত কোথায় সে? কীভাবে পালিয়ে গেল?

কর্নেল হাসলেন।…পালাতে পারেনি। দরবেশরূপী ইসমাইলকে নিয়ে কনেস্টেবলরা এতক্ষণ থানায় পৌঁছে গেছে। আপনি পশ্চিমদিক ঘুরে এসেছেন, সম্ভবত তাই মোটরবোটটি দেখতে পাননি।

তাই? বলে ধপাস করে বারান্দায় বসে পড়লেন বংকুবিহারী। তারপর ফাঁচ করে হাসলেন। আপনি মশাই, সত্যি বড় অদ্ভুত মানুষ! খুলে বলুন তো সব, শুনি।

কর্নেল বললেন, কালু কী কবুল করেছে বলুন আগে।

বংকুবিহারী শ্বাস ছেড়ে বললেন, কালু আর ইসমাইল কালীতলা গ্রামে এক সাগরেদের বাড়ি লুকিয়েছিল। আমার হানা দেবার খবর চরের মুখে পেয়ে মাঝরাত্তিরেই কেটে পড়েছিল। দুজনে এই দরগায় গা ঢাকা দিতে এসেছিল। কিন্তু দুবৃত্তদের স্বভাব এবং লোভ! দরবেশের কাছে লোকেরা টাকাকড়ি সোনাদানাও মানত দেয়। সেগুলোর লোভে দুই ডাকু নিলে বেচারা অন্ধ দরবেশেকে গলা টিপে মারে। তারপর ওঁর চিমটেখানি তো দেখেছেন? বেশ, মজবুত আর সূচলল।

কর্নেল বললেন, সাধুদের যেমন ত্রিশূল, ফকির-দরবেশদের তেমনি চিমটে থাকে। আসলে আত্মরক্ষার অস্ত্র।

বংকুবিহারী বললেন, ওই চিমটে দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একখানা লাশ গুম করে দুজনে। তারপর এই ঘরে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। দেয়াল, মেঝে সবখানে খোঁড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। দৈবাৎ কোনো লোক মানত দিতে এসে পড়তেও পারে। তাই কালুকে পুবের দেউড়ির ওখানে পাহারা দিতে পাঠায় ইসমাইল। এমন সময় একজন সাদা দাড়িওলা বুড়ো সায়েব মানে আপনি!

খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলেন বংকুবিহারী। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ আমি এসে পড়ায় ওদের কাজে বাধা পড়া স্বাভাবিক।

বংকুবিহারী ফের সিরিয়াস হয়ে বললেন, কালু দৌড়ে এসে খবর দেয়। ইসমাইল বলে, তুই পালিয়ে যা এখান থেকে। কালু কেটে পড়ে। আর ইসমাইল দরবেশের আলখেল্লা পরে বুঝলেন তো? কালু একটা গ্রামে ছিল। একটা তালডোঙা চুরি করে ওস্তাদকে উদ্ধার করতে আসে। কালু তখন আমাদের যা-যা বলেছিল, সবই শুনেছেন। শুধু একটা কথা চেপে রেখেছিল সে। সেটা হল- দরবেশই ইসমাইল ডাকু!

হাঃ! বংকুবিহারী শ্বাসের সঙ্গে বললেন। কিন্তু আপনি মশাই অদ্ভুত! সব জেনেও চুপচাপ ছিলেন! কেন?

কর্নেল হাসলেন। আসলে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। পরিস্থিতিটা বড্ড জট পাকিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেককেই সন্দেহ করা চলে, এমন একটা অবস্থা। অবশেষে চাক্কুর ড্যাগারটা কুড়িয়ে পেয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম। তাই বাই দা বাই, আপনার পলিটিক্যাল প্রিজনার ঘনশ্যামবাবু

লাফিয়ে উঠলেন বংকুবিহারী। মাই গুডনেস! ওর কথা তো ভুলেই গেছি! তাকে খোঁজা দরকার।

কালুর তালডোঙা উদ্ধার করে ঘনশ্যামবাবু পালিয়ে গেছেন।

বংকুবিহারী হঠাৎ নিস্তেজ ভঙ্গিতে বললেন, মরুক গে। বিপ্লবী না হাতি! পাতি-বিপ্লবী। ওকে নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। ডাকু ইসমাইল ধরা পড়েছে, এতই হইচই পড়ে যাবে। তাছাড়া আমি বড্ড টায়ার্ড।

বলে হাই তুললেন। চলুন, থানায় গিয়ে আপনার বক্তব্য শুনব ডিটেই শুনব।

কর্নেল বললেন, কিন্তু এখানে লোক থাকা দরকার। দরবেশের ডেডবডিটা পোঁতা আছে। একদঙ্গল শকুন ওত পেতে রয়েছে। ভোরে ওরা হানা দেবে।

ধরণীবাবু থাকুন। কনস্টেবলরা রইল। বংকুবিহারী বললেন। ধরণীবাবু! বি কেয়ারফুল।

ধরণীবাবু বললেন, ঠিক আছে স্যার, মার্নিং-এ শকুনিবধ পর্ব শুরু হবে। ভাববেন না। কর্নেল বংকুবিহারীকে অনুসরণ করলেন। যেতে যেতে ঘুরে অন্ধকার নিঝুম দরগার দিকে একবার তাকালেন। আবার একটা বাতাস এসেছে। বনভুমি জুড়ে অন্ধ অসহায় এক দরবেশের আত্মা ফিসফিসিয়ে ডাকছে, চুল্লু! চুল্লু! ….