মৃতেরা কথা বলে না – ৮

০৮.

কর্নেল ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। হোটেল কন্টিনেন্টাল থেকে সোজা গিয়েছিলেন ভিডিওজোন-এর ঠিকানায়। দরজায় তালা দেওয়া ছিল। অন্যপাশে কয়েকটা ছোট কোম্পানির অফিস। খোঁজ নিয়েছিলেন। কেউ জানে না ওই ঘরটা কার, তবে মাঝে মাঝে কেউ-কেউ আসে। পুরুষ এবং মহিলা। ওটা ছবি তোলার ঘর, নাকি ক্যাসেটে গান রেকর্ডিংয়ের, সে-বিষয়ে নানা মত। শুধু একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, বেশির ভাগ সময় ঘরটা বন্ধই থাকে। বাড়ির মালিক থাকেন। বোম্বেতে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তার নামে ভাড়া জমা দেয় ভাড়াটেরা।

কর্নেল ফিরে এসে একবার পাঁচটা পনেরোতে এবং একবার প্রায় সাতটা নাগাদ ফোন করেছিলেন। রিং হচ্ছিল। কেউ ধরেনি। তারপর লালাবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর নরেশ ধরকে ঠিকানা দিয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেছেন।

এখন নরেশবাবু কী খবর দেন, তার প্রতীক্ষা। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। চন্দ্রনাথ দেববর্মন ছাড়া পেয়ে হঠাৎ কোথায় গেলেন? কেন? প্রাণভয়ে গা ঢাকা দিলেন কি– আততায়ী তার চেনা লোক বলেই?

টেলিফোন বাজল।

কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর নরেশবাবুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।…আমি ধর কইতাছি স্যার!

বলুন নরেশবাবু।

ভিডিওজোন থেক্যা কইতাছি। আইয়া দেখি, ডোর ইজ ওপেন। কিন্তু মানুষ নাই। হাঃ হাঃ হাঃ

আচ্ছা!

তিনখান পাও লইয়া স্ট্যান্ড খাড়াইয়া আছে। ক্যামেরা নাই। হাঃ হাঃ হাঃ!

 বলেন কী! তারপর?

ফ্যান ঘুরতাছে! হাওয়া খাওনের মানুষ নাই। হাঃ হাঃ হাঃ!

 হু। আর?

 ট্যার পাইয়া কাটছে আর কি! হা– একখান গ্লাস কাত হইয়া আছে কার্পেটে। এইটুকু খানি তরল পদার্থ আছে গ্লাসে। অ্যাঁ? হোয়াট ইজ দিস? লেডিস জুতা? দুইখান জুতা!

নরেশবাবু! শুনুন প্লিজ।

কন স্যার!

গ্লাসটা দরকার। গ্লাসের তরল পদার্থ ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাতে হবে। দিস ইজ ভেরি ইমপর্ট্যান্ট! বুঝলেন?

হঃ! আর জুতা?

 জুতা জোড়াও নিয়ে যান। ওটাও ইমপর্ট্যান্ট।

ভেরি ইমপর্ট্যান্ট! অ কাশেম মিয়া! জুতাজোড়া প্যাকেটে বান্ধো! ওই তো কত পেপার।

নরেশবাবু! দরজা সিল করে দেবেন যেন!

হ্যান্ডকাফ পরাইয়া দিমু। হাঃ হাঃ হাঃ!

ডি সি ডি ডি সায়েবকে এখনই গিয়ে রিপোর্ট দেবেন। ছাড়ছি।…

ফোন রেখে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী? আর এক কাপ কফি দিয়ে যা বাবা।

সাদা দাড়ি আঁকড়ে ধরলেন কর্নেল। একটু ভুল হয়ে গেছে। হোটেলের ঘরে রঞ্জন রায়ের কার্ড পেয়েই পুলিশকে ওই ঠিকানায় নজর রাখতে বলা উচিত ছিল।

হঠাৎ মনে হলো শুভ্রাংশু সোম অভিনয় করে। ফিল্মের লোকেদের সঙ্গে তার চেনাজানা থাকা সম্ভব। তাকে জিজ্ঞেস করা যায় রঞ্জন রায় এবং ভিডিওজোন সম্পর্কে খবর রাখে কি না।

ষষ্ঠী কফি এনে দেওয়ার পর কর্নেল শুভ্রাংশুর কার্ড দেখে টেলিফোন করলেন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর মহিলাকণ্ঠে সাড়া এল, হ্যালো!

শুভ্রাংশু সোম আছেন কি?

 দাদা নেই। বাইরে গেছে। আপনি কে বলছেন?

চিনবেন না। আপনি কি শুভ্রাংশুবাবুর বোন?

হ্যাঁ। আপনার নাম বললে দাদা ফিরে আসার পর জানাব। দাদার বলা আছে কেউ ফোন করলে

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

এক মিনিট। লিখে নিই।…হ্যাঁ, বলুন!

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আপনার তোমার নাম কী ভাই?

সুস্মিতা সোম।

বাহ্। আচ্ছা, তোমার দাদা কখন বাইরে গেছেন?

 দাদাকে তো প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

 আজ কখন গেছেন?

 দুপুরে অফিস থেকে ফোন করে বলল, বাইরে যাচ্ছে। আজ না-ও ফিরতে পারে।

কোথায় যাবেন বলেননি?

 নাহ্। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের যখন তখন বাইরে যেতে হয়। ছাড়ছি।…

কর্নেলের অনুমান, শুভ্রাংশুর বোন কিশোরী। কফিতে চুমুক দিয়ে ভিডিওজোন-এর কথা ভাবতে থাকলেন। মেঝেয় গড়িয়ে পড়া গ্লাস, একটা ডিভান, দু পাটি লেডিজ জুতো, খালি ক্যামেরাস্ট্যান্ড এবং শিলিং ফ্যানটা ঘুরছিল।

শুভ্রাংশুর কথাগুলো মনে ভেসে এল এবার। মউ তাকে টেলিফোনে জানিয়েছিল, হংকংয়ের এক ব্যবসায়ী মউকে ব্ল্যাকমেল করে। আর একটা ভিডিও ক্যাসেট তার ব্ল্যাকমেলের অস্ত্র! হুঁ, ব্লু ফিল্ম। শুভ্রাংশুর দৃঢ় বিশ্বাস, মউকে নিয়ে সেই ব্লু ফিল্ম তোলা হয়েছিল।

শুভ্রাংশু একরকম ড্রাগের কথা বলছিল! কেউ সেই ড্রাগের ঘোরে থাকলে বোঝা যায় না সে কী করছ বা তাকে দিয়ে কী করানো হচ্ছে। শুভ্রাংশু এই কথাটা বলেছিল, এ বিষয়ে আমি কিছু পড়াশোনা করেছি। কেন সে পড়াশোনা করেছে এ বিষয়ে? জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে সে চাকরি করে। এই কোম্পানি কি গোপনে সেই ড্রাগ তৈরি করে এবং শুভ্রাংশু তা জানতে পেরেছিল?

কর্নেল কফি শেষ করার পর টেলিফোন তুললেন ফের। ডায়াল করলেন। সাড়া এল।

মিঃ দাশগুপ্ত?

 কে বলছেন?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আপনাকে একটু বিরক্ত করছি।

 একটু পরে শান্তশীল বলল, হ্যাঁ, বলুন!

 রঞ্জন রায় নামটা কি আপনার পরিচিত?

 হু ইজ দ্যাট গাই?

 ফিল্মমেকার।

চিনি না।

নামটা কি কখনও আপনার স্ত্রী কাছে শুনেছেন? প্লিজ, একটু স্মরণ করুন।

 নাহ। শুনিনি।

 ভিডিওজোন শব্দটা?

হোয়াটস্ দ্যাট?

 কখনও শুনেছেন কি না কথাটা?

 শুনিনি।

 সিওর?

ড্যাম ইট!..সরি! আমি ওরকম কোনও শব্দ শুনিনি কারও কাছে।

মিঃ দাশগুপ্ত, একটা অনুরোধ! আপনার স্ত্রীর কাজিপত্রের মধ্যে কোথাও যদি রঞ্জন রায়ের নেমকার্ড বা ভিডিওজোন মার্কা কোনও কাগজ খুঁজে পান, অনুগ্রহ করে আমাকে জানাবেন।

জানাবো।

আর একটা কথা মিঃ দাশগুপ্ত! আপনি একটা নামী ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা। মেডিসিন, তার মানে, যে-কোনোরকম ড্রাগ সম্পর্কে আপনার জ্ঞান থাকার কথা। কী উপাদানের কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, এ বিষয়েও মোটামুটি ধারণা থাকা উচিত।

সো হোয়াট?

এমন ড্রাগ থাকা খুবই সম্ভব, যা কেউ খেলে টের পাবে না সে কী করছে বা তাকে দিয়ে কী করানে হচ্ছে।

ওটা নার্কোটিক্স। নিষিদ্ধ ড্রাগ। উই ডু নট সেল দোজ ডার্টি থিংস।

বলছি না। আমি জাস্ট আপনার কাছে জানতে চাইছি, অমন ড্রাগ থাকা সম্ভব। কি না?

খুবই সম্ভব। এল এস ডি-জাতীয় ড্রাগ তো এখন আউট অব ডেট হয়ে গেছে।

মিঃ দাশগুপ্ত! শুনেছি, বহু নিষিদ্ধ ড্রাগ আজকাল ছদ্মনামের আড়ালে বিক্রি হয় তাই না?

হতেই পারে। হয়। বাট ইউ ডু নট প্রোডিউস অর সেল দেম। জেনিথের রেকর্ড ক্লিন। ইউ হ্যাভ পোলিস-কন্ট্যাক্ট কর্নেল সরকার। ইউ মে আস্ক দেম। বাট হোয়াই

প্লিজ মিঃ দাশগুপ্ত! অফেন্স নেবেন না। আমি আপনার সহযোগিতা চাইছি শুধু।

ওরকম কোনও ড্রাগের ব্যাপারে আমার সহযোগিতা আশা করবেন না।

কর্নেল হাসলেন। না, না মিঃ দাশগুপ্ত! আমি আপনার স্ত্রীর খুনীকে খুঁজে বের করার জন্য আপনার সহযোগিতা চাইছি।

মউয়ের মার্ডারের সঙ্গে নার্কোটিকসের কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারছি না।

আছে। বাই দা বাই, আপনার কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ শুভ্রাংশু সোম

তাকে চেনেন নাকি?

চিনি। আজ সকালে সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আমাকে বলেছে। সে-ও চাইছে আপনার স্ত্রীর খুনি ধরা পড়ুক।

একটু পরে শান্তশীল শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আই ডু নট লাইক হিম।

আজ শুভ্রাংশুকে বাইরে কোথায় পাঠানো হয়েছে জানেন?

ওটা আমার জানার কথা নয়। কেন?

ওকে একটু দরকার ছিল। ওর বাড়িতে শুনলাম বাইরে গেছে হঠাৎ।

 সেটা স্বাভাবিক।…ও কে! আমি একটু ব্যস্ত কর্নেল সরকার!

সরি! রাখছি। ধন্যবাদ।….

কর্নেল টেলিফোন রেখে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। শুভ্রাংশুকে খুবই দরকার ছিল এ মুহূর্তে। সে নিশ্চয় ওরকম কোনও ড্রাগের খবর রাখে। তার কাছে এটা জানা গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যাবে। হংকংবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী যে সত্যিই ব্লু ফিল্মের কারবারি, তাতে সন্দেহের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সে খুন হয়ে গেছে। শুভ্রাংশুর কথামতো সে মধুমিতার ব্ল্যাকমেলার ছিল। কিন্তু নিছক ব্লু ফিল্মের কারবারি ব্ল্যাকমেল করবে কেন? তাহলে তো তার কারবারই বন্ধ হবে যাবে।

একটু চঞ্চল হলেন কর্নেল। রঞ্জন রায়ের সাহায্যে রঙ্গনাথন ব্লু ফিল্ম তৈরি করতেন তা স্পষ্ট। রঞ্জন কি সেই ফিল্মের কপি হাতিয়ে বিত্তবান এবং বিশিষ্ট লোকেদের ব্ল্যাকমেল করে এসেছে? এ সব ঘটনা গোপনে ঘটে থাকে। স্ক্যান্ডালের ভয়ে কেউ পুলিশকে জানাতে চায় না। সম্ভবত রঞ্জন এবার এমন কাউকে ব্ল্যাকমেল করছিল, যার সঙ্গে কোনও সুত্রে রঙ্গনাথনের ঘনিষ্ঠতা আছে। রঙ্গনাথন রঞ্জনের কুকীর্তি টের পেয়ে বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো খুন হয়ে গেলেন। আর একটা পয়েন্ট। ১২৭ নং সুইটে কোনও ফিল্মের ক্যাসেট পাওয়া যায়নি। তবে রঙ্গনাথনকে হত্যার এই মোটিভটা যুক্তিযুক্ত বলা চলে।

টেলিফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিলেন।

 কর্নেল সরকার! দাশগুপ্ত বলছি। শান্তশীল দাশগুপ্ত।

 বলুন? আপনার স্ত্রীর কাগজপত্রের মধ্যে তাহলে

না কর্নেল সরকার! আপনার সঙ্গে একটু আগে কথা বলার পর হঠাৎ আমার মনে হলো, আপনার সঙ্গে বসা দরকার। অনেক কথা বলা দরকার। কাল মর্নিংয়ে আপনার সময় হবে কি? আমি যেতে চাই আপনার কাছে।

আমিই বরং আপনার কাছে যাব। দ্যাটস দা বেস্ট ল্পেস টু টক। অন দা স্পট।

বাট কর্নেল সরকার, ডেডস ডু নট স্পিক, ইউ নো!

কী বললেন?

 মৃতেরা কথা বলে না।

কর্নেল হাসলেন। আসাধারণ উক্তি মিঃ দাশগুপ্ত। কিন্তু আমার কাজটাই হলো মৃতদের কথা বলানো। ডেডস স্পিক টু মি।

ও কে! আপনি আসুন। আমি অপেক্ষা করব। শুধু সময়টা জানিয়ে দিলে ভাল হয়।

সকাল নটা।

 দ্যাটস ও কে। ছাড়ছি।…

ফোন রেখে কর্নেল বুকশেলফের কাছে গেলেন। নার্কোটিকস্ সংক্রান্ত একটা বই তাঁর সংগ্রহে আছে। তবে সেটা নার্কোটিকস্ স্মাগলিংয়ের রেকর্ড। বলা চলে, অপরাধবৃত্তান্ত। তবে ওতে নানা ধরনের নিষিদ্ধ ড্রাগ এবং তার গুণাগুণেরও উল্লেখ আছে।

বইটা এনে ইজিচেয়ারে বসলেন। টেবিলবাতি জ্বেলে দিলেন। কিছুদিন থেকে রিডিং গ্লাস ব্যবহার শুরু করেছেন। চোখের দোষ নেই। বয়স থেমে থাকে না।

পাতা ওল্টটাতে গিয়ে শান্তশীলের কথাটা মাথায় ভেসে এল, মৃতেরা কথা বলে না। হু, এটা সব হত্যাকারীই ধরে নেয়। কিন্তু মৃতেরা কথা বলে। চুপিচুপি কথা বলে। অরণ্যে মর্মরধ্বনির মতো কণ্ঠস্বর …

.