সূর্যাস্তের আগে একঘণ্টা

সূর্যাস্তের আগে একঘণ্টা

রোদ্দুর দেখে লোকগুলি ছত্রভঙ্গ হয়েছিল, শাওনি বাদে। শাওনি দরবেশের সামনে চুপচাপ বসে ছিল। ঘনশ্যাম রুদ্রের পরনে এখন ধুতি ও পাঞ্জাবি, খালি পা। বংকুবিহারী দারোগাকে দেখার পর থেকে তাঁর প্রচণ্ড উদ্বেগ, তবে বংকুবিহারী তাকে কখনও দেখেননি। তুব পুলিশের স্বভাব। নামধাম জিগ্যেস করায় বলেছেন, হর্ষনাথ নন্দী। বাড়ি কোনো এক কেশবপুরে নদীয়া জেলায়। পেশা শিক্ষকতা। বাসে চেপে নবাবগঞ্জ থেকে ফিরছিলেন। নবাবগঞ্জে তার এক পিসতুতো দাদা থাকেন। জনৈক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, নাম হর্ষনাথ বটু। বটু? এ আবার কেমন পদবি? এমন পদবির কথা তো শোনেননি বংকুবিহারী।

পশ্চিমের ঢালে রোদ্দুর পড়েছে, সেদিকে গিয়ে বংকুবিহারীকে ইউনিফর্ম শুকোতে দেখে ঘনশ্যাম হাত তিরিশেক তফাতে একটা ঝোপের আড়াল খুঁজে নিয়েছেন। ভিজে লুঙ্গি ও গেঞ্জি শুকোচ্ছেন।

ডাঃ ব্ৰজহরি কুণ্ডু রাগ করে সি ভিটামিন ট্যাবলেট দ্বিতীয়বার মুখে গুঁজে চুষতে চুষতে রোদ্র নিতে গিয়ে বাঁয়ে বংকুবিহারী এবং ডাইনে ঘনশ্যামকে দেখে মাঝামাঝি একটা জায়গা বেছে নিলেন, যেটা টিপি থেকে ঝরনার মতো জলস্রোত নেমে যাওয়ার রাস্তা, তার পাশে একটা চাঙড়। স্রোতরেখাঁটিতে নুড়ি ও ইটের গুঁড়ো। তার মনে হল, ঝরনার পাশে বসে আছেন। তার বর্ষাতি, টুপি ও ডাক্তারি পেটমোটা বাকসো অথবা ব্যাগটি দরবেশের ঘরের বারান্দায় আছে।

ঘনশ্যাম থেকে অনেকটা তফাতে পুঁতি ও চাক্কু একটা প্রকাণ্ড এবং কাত হয়ে পড়া হিজলগাছের ডালে পাশাপাশি বসল। চাক্কু পুঁতির কাঁধে হাত রাখলে পুঁতি ঝটপট এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিল। তারপর আস্তে বলল, কী হবে বলো তো?

প্রদোষ ক্লারার টানে বেরিয়ে এসে দরবেশের ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনেই চুপচাপ। তবে ক্লারা হাস্যমুখী।

কর্নেল সবাইকে সাপ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। তাই প্রত্যেকে মাঝেমাঝে পায়ের কাছে বা আশেপাশে তাকিয়ে নিচ্ছে, যদিও দরবেশ বলেছেন, বাবার দরগায় সাপ কখনও দংশ্যাবে না। কর্নেল আবার তিনদিকে চক্কর মেরে চতুর্থ দিক পশ্চিমের রোদ্দুরে পা বাড়ালে কুকরটি তাঁর সঙ্গ নিল। কুকুরটি রোগা ও নেড়ি, হাল্কা বাদামি রঙের। কর্নেল তাকে শিস দিয়ে কাছে ডাকলে সে লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে গেল। কর্নেল জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে দৈবাৎ কয়েকটা চকোলেট পেয়ে গেলেন। একটা চকোলেট মোড়ক খুলে মুখে গুঁজে দিতে গেলে কুকুরটা পিছিয়ে গেল। তখন সামনে ফেলে দিলেন। তখন কুকুরটা সেটা শুঁকে দেখে মুখে নিল এবং চিবুতে থাকল। কুকুরটি ক্ষুধার্ত।

এই সময় কোথায় পিড়িং পিড়িং শব্দে একতারা বেজে উঠল। কর্নেল শব্দের দিকে ঘুরে দেখলেন, হরিপদ বাউল বংকুবিহারীর কাছে মর্যাদাজনক দূরত্ব রেখে নিচু একটা চাঙড়ে বসে আছে। বংকুবিহারী সম্ভবত তাকে গান গাইতে বললেন। কারণ তারপর বাউলটি ঘুমঘুম স্বরে গান গাইতে থাকল।

কর্নেল! কর্নেল! ব্ৰজহরি ডাক্তার তাকে ডাকছিলেন চাপা স্বরে। তিনি কর্নেলের ঠিক নিচেই।

কর্নেল তার কাছে গেলেন। কুকুরটি দুঠ্যাঙ ভাঁজ করে এবং দুঠ্যাঙ সোজা রেখে চকাস চকাস শব্দে চকোলেট চুষছিল অথবা কামড়াচ্ছিল। কর্নেল ব্ৰজহরির কাছে গেলে ব্ৰজহরি ইশারায় তাকে বসতে বললেন। একটা মোটা শেকড় বেরিয়ে এসেছে ঢালু মাটি খুঁড়ে। মসৃণ ভিজে শেকড়। কর্নেল শেকড়টাতে বসলে ব্ৰজহরি চাপা স্বরে বললেন, একটা সিরিয়াস ব্যাপার ঘটেছে, জানেন?

কর্নেল একটু হাসলেন। কী?

আমাদের মধ্যে একজন প্রসটিটুট আছে।

 বলেন কী! কে?

ব্ৰজহরি আরও গোমড়ামুখে বললেন, যে মেয়েটা সবশেষে এল। মানত দিল।

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, শাওনির কথা বলছেন?

ব্ৰজহরি খুব অবাক এবং প্রায় মূৰ্ছিত হবার ভঙ্গিতে বললেন, চেনেন নাকি ওকে! কী অদ্ভুত কথা!

কর্নেল হাসলেন। …দারোগাবাবু সবাইকে নামধাম জিগ্যেস করছিলেন, তখন শুনেছি।

আমি মশাই শুনিনি! ব্ৰজহরি ভরাট গলায় বললেন। পুলিশের দিকে তাকাতেও আমার খারাপ লাগে।

তাহলে আপনি কীভাবে জানলেন শাওনি প্রসটিট্যুট?

ব্ৰজহরি ফিসফিস করে সাপের গজরানির মতো বললেন, ওই রিকশোওলা ছোকরাটা– ওকে চিনি, ওর রিকশোয় বহুবার চেপেছি, কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলেছে, ডাক্তারবাবু মেয়েটা বেশ্যা। বুঝলেন না? রিকশাওয়ালারা ওদের চেনে। চেনা স্বাভাবিক কি না বলুন?

কর্নেল স্বীকার করলেন। খুবই স্বাভাবিক! বলে আধপোড়া চুরুটুটি পকেট থেকে বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। কুকুরটা নেমে এসে তাঁর পায়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে দাঁড়িয়ে রইল। ব্ৰজহরি গুমোটমুখে মাথানিচু করে ঘাস কুচি করছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন, একটা কথা ভাবছি। ভীষণ খারাপ লাগছে ভাবতে।

কী কথা, ডাক্তারবাবু?

শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মাথা নিচু রেখে ব্ৰজহরি বললেন, রিলিফের নৌকো যদি বেরোয়, এ তল্লাটে আসবে না। কারণ এটা মাঠের মধ্যিখানে। এটা গ্রাম নয়, দরগা। দরগা ডোবার চান্স নেই যে দরবেশবাবাকে উদ্ধার করতে হবে। কাজেই একমাত্র ভরসা, যদি দরবেশবাবার কোনো ভক্ত তার খোঁজ নিতে আসে! কিন্তু প্রব্লেম হল, এ তল্লাটে তালডোঙারই রেওয়াজ। জেলেরাও তালডোঙা ব্যবহার। করে। কাজেই

ব্ৰজহরি থেমে গেলে কর্নেল বললেন, হুঁ বলুন!

তালডোঙ্গা বিপজ্জনক। মাত্র একবার চাপতে হয়েছিল রোগী দেখতে। গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! ব্ৰজহরি মাথা নিচু রেখে আরেকটা ঘাস ছিঁড়ে বললেন, কিন্তু তার চেয়ে ভয়াবহ একজন বেশ্যার সঙ্গে এখানে থাকা। দরগার মাটি পর্যন্ত দূষিত হয়ে গেছে, আমি টের পাচ্ছি! .একটু পরে ফের বললেন, আর ওই পুলিশ! সেও কম বিপজ্জনক নয়। বিশেষ করে কাঁদরা থানার ওই অফিসারটির সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা শুনেছি। ভীষণ দুর্নীতিপরায়ণ– ভীষণ! আপনি জানেন, আমার নামে কারা পিটিশন করেছিল হাসপাতালের ওষুধ নিয়ে চোরাকারবার করি বলে? তারপর ওই লোকটা এল। বলল, রফা করে নিন।

করলেন, নাকি করলেন না?

মুখ তুলে অদ্ভুত এবং নিঃশব্দ হাসলেন ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু। আমি রফা করব? গরিবের ডাক্তার বলে আমার প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা আছে– আমি কেন রফা করব? পাল্টটা পিটিশন গেল। উল্টেট দারোগাবাবুরই ট্রান্সফার হয়-হয় অবস্থা! এসে হাতে ধরে বলেই কুকুরটিকে দেখতে পেয়ে ব্ৰজহরি হ্যাঁৎ হ্যাঁৎ শব্দে হাত নাড়তে থাকলেন।

কুকুরটি দাঁত বের করে ধমকাল। ব্ৰজহরি রেগে গিয়ে এবং আতঙ্কে ঝরনারেখাঁটি ডিঙিয়ে চলে গেলেন এবং অনিবার্যভাবে পড়লেন বংকুবিহারীর কাছে। হরিপদ বাউল ঝুমঝুম সুরে গান গাইছিল। বংকুবিহারী সহাস্যে বললেন, বসুন ডাক্তারবাবু! বড় ভাল গায়-তাই না?….

ক্লারা পা বাড়ালে প্রদোষ ফুঁসে উঠল, ক্লারা! হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর গোয়িং টু ডু?

ক্লারা ঘুরে মিষ্টি হেসে বলল, তুমি ইংলিশ বোলো না! খারাপ লাগে। তাছাড়া আমার মাতৃভাষা কী তুমি জানো। একথা ঠিক, আমার পরিবার যুদ্ধের সময় জার্মানি ছেড়ে আ্যামেরিকা গিয়েছিল। আমার পরিবার সেজন্য ইংলিশ বলে। আমিও বলতাম। কিন্তু এখন আমি ভারতীয়। কারণ আমি তোমার স্ত্রী।

প্রদোয হাসবার চেষ্টা করে বলল, ভারতীয় বলে কিছু নেই!

ঠিক। আমি বাঙালি। বলে ক্লারা হাসতে হাসতে নেমে গেল ঢাল বেয়ে। সে একেবারে জলের ধারে গিয়ে একটুকরো পাথরের স্ল্যাবে বসল। পা দুটো জলে রাখল। জল নিয়ে খেলতে থাকল।

প্রদোষ একটু দাঁড়িয়ে থেকে পেছনের ভাঙাচোরা ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে প্রাঙ্গণে চলে গেল। একটা ভিজে কবরের ওপর বসে সিগারেট ধরাল। একটু পরে ঘুরে দেখল, মানত দিতে আসা কেমন-চেহারার মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রদোষ চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকল।

শাওনি এসে তার সামনের একটা কবরে নিঃসঙ্কোচে বসে একটু হাসল। …বাবু, আপনার মেমবউ কোথায়?

প্রদোষ তাকাল। কেন?

আমাকে একটা সিগারেট দেবেন?

 প্রদোষ ভুরু কুঁচকে তাকাল।

শাওনি হাত বাড়িয়ে বলল, দিন না বাবু একটা সিগারেট! তখন থেকে সিগারেটের গন্ধ শুঁকে মাথা খারাপ। দিন না!

প্রদোষ তাকে দেখতে দেখতে বলল, কোথায় থাকো তুমি?

নবাবগঞ্জেতে। আমার নাম শাওনি। শাওনি বারবধূর হাসি হেসে বলল। ভিজে কাপড় গায়ে শুকিয়ে গেল। ভেতরটা ঠাণ্ডা হিম। আহা, দিন না একটা– আচ্ছা, আপনার মুখেরটা দিন!

 প্রদোষ হাসল।…তুমি সিগারেট খাও?

খাই। বলে শাওনি দুহাত তুলে এলিয়েপড়া ভিজে চুল ঝাড়ার ভঙ্গি করার পর খোঁপা বাঁধতে থাকল। সে ইচ্ছে করেই বুক দেখাল। তারপর ব্লাউজে হাত রেখে বলল, এম্মা! এখনও ভিজে ন্যাতা হয়ে আছে। করছি কী। আমার যে নিমুনি হবে! সে প্রদোষের চোখের সামনে ব্লাউজটি খুলে ফেলল, শাড়িটা আড়াল করার ছলও করল, এবং বেশ্যারা যা করে থাকে!

প্রদোষ তাকে গিসারেট দিলে সে বলল, এম্মা! ধরিয়ে দিন! কী মানুষ আপনি! উঁহু খামোকা লাইটার জ্বেলে কী হবে? হাতেরটাতে ধরিয়ে দিন।

প্রদোষ এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল। শাওনি দুহাত চেপে ধরে ঝুঁক এল। প্রদোষ শিহরিত হল। নিজের ইচ্ছা ও সংস্কারের বিরুদ্ধে এ শিহরন জৈব। সিগারেট ধরিয়ে নেবার সময় বারবধূটির দুটি চোখ তার দিকে নিবদ্ধ, এতে প্রদোষের শরীর কেঁপে উঠল। আস্তে বলল, তুমি কে?

শাওনি হাত ছেড়ে দিয়ে সিগারেট টেনে ধোঁয়ার মধ্যে বলল, শাওনি।

ধোঁয়া প্রদোষের মুখের দিকে ছুঁড়েছিল। প্রদোষের শরীর ভারি হয়ে গেল। এবার সে মেয়েটিকে বুঝতে পারল। লজ্জিত ও বিব্রত হল। সে ঝটপট উঠে। দাঁড়াল। আচ্ছন্ন অবস্থায় ভাঙা দেউড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। ক্লারা আছে পশ্চিমে, যেখানে রোদ্দুর। প্রদোষ চলেছে পূর্বে তূপের ভেতর একফালি পায়েচলা রাস্তায়। একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় পৌঁছে সে ঘুরল। দেখল শাওনি তার দিকেই আসছে। কাছে এলে প্রদোষ শক্ত গলায় বলল, কী চাই?

সাওনি হাসল। বাবু, দশটা টাকা দিন না!

 প্রদোষ মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল, নেই।

আহা, দিন না! আপনার অনেক টাকা আছে, আমি জানি!

 তুমি কে, আমি বুঝতে পেরেছি।

সাওনির কোমরে ব্লাউজটা গোঁজা। একটা স্তন খোলা। বাঁকা হেসে প্রদোষের মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কৈ, দিন। বেশি না, দশটাকা।

প্রদোষ জৈবতাবশে ক্রুদ্ধ, কিন্তু সংস্কারবশে বিব্রত, শেষে হাত তুলে বলল, আর একটা কথা বললে থাপ্পড় খাবে!

তার আগেই আমি চাঁচাব। হাসতে লাগল শাওনি। চেঁচিয়ে লোকগুলোকে জড়ো করব। আপনার মেমবউ এসে শুনবে। সেটা কি ভাল হবে?

 প্রদোষের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। গলার ভেতর বলল, তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! এখানে একজন পুলিশ অফিসার আছেন।

শাওনি একটুও দমে গেল না…পুলিশটুলিশ দিয়ে কিছু হবে না। আপনার মেমবউ জেনে যাবে–

প্রদোষ গর্জনের চেষ্টা করল। …সে বিশ্বাস করবে না এসব কিছু! সে আমাকে জানে।

শাওনি আরও হাসল। মেম হোক আর যাই হোক, মেয়েমানুষ। আমিও মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ কী আমি জানি। কৈ, ছাড়ুন, দেরি করবেন না।

প্রদোষ শেষ চেষ্টার মতো বলল, দেব না।

 শাওনি ব্লাউজটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ঝটপট গায়ে ঢোকাল। কোমরের কাপড় ঢিলে করতে করতে বলল, তাহলে আমি চেঁচাই? তারপর মাটিতে পড়ার ভঙ্গি করল।

প্রদোষ দ্রুত প্যান্টের পেছনপকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দশটা টাকা ওর হাতে গুঁজে দিল। সে কাঁপছিল। জীবনে একবার এমন অবস্থায় পড়েছিল। সেটা সানফ্রানসিসকোতে মার্কেট স্ট্রিট নামে একটা রাস্তার গলিতে। মেয়েটি অবশ্য নিগ্রো ছিল। দশ ডলারের নোটটি নিয়ে বলেছিল, ম্যান! হোয়েন ইউ আর ইন দা মার্কেট স্ট্রিট এরিয়া, ইউ মাস্ট নো হোয়্যার আর ইউ গোয়িং! ঠিক সেইরকম হয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছ, আগে জেনেশুনে তবে যাও? নৈলে এরকম, অথবা আরও সাংঘাতিক কিছু। প্রদোষের কপালে ঘাম ফুটল।

টাকাটা কোমরের কাছে গুঁজে শাওনি মিষ্টি হাসল। চাপা স্বরে বলল, বেশি চাইতে পারতাম। চাইলাম না। আপনার মেমবউয়ের খাতিরে। তবে রেট পঁচিশ। রাত্তিরে ইচ্ছে হলে চোখ টিপে জানিয়ে দেবেন।

সে গাছটির কাণ্ডে ঘষে সিগারেট নেভাল। তারপর হাল্কা পায়ে আগাছার জল ভেঙে উত্তরের ঢালের দিকে চলে গেল। প্রদোষ শ্বাস ছেড়ে ভারি পা ফেলে দেউড়ির দিকে এগোল। ভাবছিল, কথাটা পুলিশ অফিসারটিকে জানানো উচিত কি না…।

ঘনশ্যাম রুদ্র আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন কর্নেলকে। সায়েবচেহারার ওই শাদা দাড়িওলা বৃদ্ধটির হাবভাব এবং অমায়িক কথাবার্তায় সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন সদাশিব চৌধুরি একজন কর্নেলের বন্ধু হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কিন্তু আটকে যাচ্ছে মাথার ভেতর। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর লোক নয় তো? রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসারদের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানো হয়।

এই যে হর্ষবাবু! কর্নেল নেমে এলেন কাছে।

ঘনশ্যাম হাসবার ভঙ্গি করলেন। … আসুন কর্নেলসায়েব! অবস্থা দেখুন। এই আমাদের দেশ!

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে কিছু দেখার পর একটু তপাতে একটা পাথরের স্ল্যাবে বসলেন।… আপনি ঠিকই বলেছেন। প্ল্যানিং-এর পর প্ল্যানিং। অথচ এই অবস্থা।

সায় পেয়ে ঘনশ্যাম সিরিয়াস হলেন। … সম্ভবত আমূল পরিবর্তন ছাড়া–

 বিপ্লব বলুন!

ঘনশ্যাম একটু হাসলেন।…বিপ্লব মানেই তো রক্তক্ষয়! রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকা চাই। কে দেবে? আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। গঠনমূলক পথেই আমাদের এগোতে হবে।

কর্নেল জলের দিক আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন গঠনমূলক পথের অবস্থা। জলের তলায়।

ঘনশ্যাম হাসতে লাগলেন। আপনি নিশ্চয় বাঁধটার কথা বলছেন? দোষ তো বাঁধের নয়, যারা বাঁধ বেঁধেছে, তাদের। তারা দুর্নীতিবাজ!

কুকুরটা মাটি শুঁকতে শুঁকতে ঘনশ্যামের খুব কাছে এসে পড়ল এবং তার কাছাকাছি আরেকটা চাঙড়ে একঠ্যাঙ তুলে হিসি করল। ঘনশ্যাম বললেন, এ কী! এটা আবার কোত্থেকে এল?

কর্নেল বললেন, আপনারা যেভাবে এসেছেন।

বেচারা! ঘনশ্যাম প্রণীটিকে দেখতে দেখতে বললেন। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের সঙ্গে এখন ওর প্রভেদ নেই, এটাই সান্ত্বনা। আপনি কলকাতার মানুষ। গ্রামের বন্যা হয়তো এই প্রথম দেখছেন। দেখার প্রয়োজন ছিল আপনার জীবনে। একটা অভিজ্ঞতা হল।

কর্নেল হাসলেন। কলকাতাতেও আজকাল বন্যা হয়।

হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি। …ঘনশ্যাম একটু ইতস্তত করে বললেন। …একটা কথা মাঝে মাঝে আমার মাথায় আসে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করি। সামান্য মাইনে পাই। ফলে আমার মধ্যে নানা ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। আপনি কথাটা দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না!

না, না। বলুন আপনি! কর্নেল কুকুরটিকে আরেকটি চকোলেট দিলেন। ঘনশ্যাম ব্যাপারটি দেখে মনেমনে রেগে গেলেন। কিন্তু মুখে হাসি এনে বললেন, আগে দেশে এত ঘন ঘন বন্যা হত না। সেইসঙ্গে ধরুন, এত দাঙ্গাহাঙ্গ মা, খুনোখুনি, এত বেশি নৈরাজ্য, দলাদলি ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, তত এসব বাড়ছে। আপনার কি মনে হয় না এসবের পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে?

থাকতেও পারে। হয়তো আছে।

নিশ্চয় আছে। ঘনশ্যাম জোর দিয়ে বললেন। আমি সামান্য শিক্ষক। আমার খালি মনে হয়, কোনো বৈদেশিক শক্তি অথবা একাধিক বৈদেশিক শক্তি দেশটাকে বিপর্যস্ত করে ফেলতে চাইছে।

আপনার ধারণা অস্বীকার করা যায় না।

ঘনশ্যাম চাপা স্বরে বললেন, দেশে ইদানিং সায়েব, বিশেষ করে মেমসায়েব এত বেশি সংখ্যায় আসছে কেন? মেমসায়েবরা বউ হয়েও আসছে! তাদের প্রকৃত পরিচয় কী, কে বলতে পারে? তারা সি আই এর চর কি না?

কর্নেল মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন, আপনি কি ক্লারা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন কিছু?

ঘনশ্যাম আস্তে বললেন, আমার ধারণা। মেমসায়েবের শাড়ি পরে থাকা, বারবার সবাইকে বলা : আমি হিন্দু, আমি ভারতীয়! কী মানে হয় এর, আমার মাথায় তো ঢুকছে না!

কর্নেল একই গাম্ভীর্যে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আমরা যদি ইউরোপীয় সেজে থাকতে পারি, ইওরোপীয়রা এদেশে এসে ভারতীয় সেজে থাকলে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো

বাধা দিয়ে ঘনশ্যাম বললেন, দুটোর মধ্যে তফাত আছে। আপনি যাই বলুন, মেমসায়েব বাঙালি বউ হয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরে পুজো দেখতে যাবে, এটা বাজে কৈফিয়ত। দারোগাবাবু লোকটি বদমেজাজি। নৈলে আমি তখনই– মানে, পাসপোর্ট-ভিসা দেখতে চাওয়ার সময় ওকে ইনসিস্ট করতাম। করলাম না। কারণ পুলিশও তো ধোয়া তুলসীপাতা নয়। যাই হোক, এ বিষয়ে আপনার একটা কর্তব্য আছে বলে মনে করি। কারণ আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। আপনি একজন প্রাক্তন সৈনিক। আপনি ইনসিস্ট করুন। দেখবেন, ওই ট্যাশ ছোকরারও প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। ওরা দুজনে মৌরীনদীর বাঁধে ডিনামাইট চার্জ করে বাঁধটাকে বুঝলেন তো?

কর্নেল শুধু বললেন, হুম! তারপর উঠে দাঁড়ালেন। কুকুরটিও পা বাড়াল।

 ঘনশ্যাম ডাকলেন, শুনুন! আরও একটা কথা আলোচনার ছিল।

 বলুন!

ঘনশ্যাম করুণ হাসলেন। … আমার ধারণা, প্রত্যেকেরই খিদে পেয়েছে বা পাবে। সে বিষয়ে কিছু করা যায় কি না, আপনিই লিড নিন।

কর্নেল এবার একটু হাসলেন। দরবেশের ঘরে প্রচুর চাল-ডালের স্টক, আছে। ভাববেন না। অবশ্য বেশি টাকা দিতে হবে। চাঁদা করে দেওয়া যাবে। রান্নার জন্য বড় পাত্রও আছে। ভাড়ায় পাওয়া যাবে। আমি কথা বলে রেখেছি। আর একটা কথা

ঘনশ্যাম দ্রুত বললেন, বলুন!

 ডাক্তারবাবুর কাছে শুনলাম, সব শেষে যে মেয়েটি এসেছে, সে একজন প্রস। আর ডাক্তারবাবু শুনেছেন রিকশাওয়ালা যুবকটির কাছে! এখন কথা হল, সেও আমাদের সঙ্গে খাবে। আশা করি, আপনার আপত্তি হবে না।

ঘনশ্যাম নির্মল হেসে বললেন, তাতে কী? এই দূষিত সমাজব্যবস্থায় দেহ বেচে যারা খায়, তাদের প্রতি ঘৃণা নেই আমার। বরং সিমপ্যাথি আছে।…

কর্নেল ওপরে উঠে গেলেন। তার একটু পরেই আচমকা শাওনি এসে পড়ল। সে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। ঘনশ্যামের পাশ দিয়ে নেমে জলের ধারে গেল। পরিব্যাপ্ত জলে শেষবেলার রোদ ঝিলমিল করছে। ঘনশ্যাম দুঃখিত চোখে তাকে দেখছিলেন। তারপর চাপা শ্বাস ফেললেন।

শাওনি ঘুরে বলল, বাবু, দেশলাই আছে?

 ঘনশ্যাম একটু অবাক হয়ে বললেন, না। কেন?

শাওনি আধপোড়া সিগারেটটা দেখাল। তারপর বলল, আপনি খান না সিগারেট?

ঘনশ্যাম মাথা দোলালেন। তার বিস্ময়টুকু, নিজেই টের পেলেন, বাবুজনোচিত সংস্কার। বহুবছর তার কেটেছে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষজনের সঙ্গে এবং তাদের স্ত্রীলোকেরা ধূমপান করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই যুবতীটিকে তিনি কোন বর্গে ঠাই দেবেন, বুঝতে পারছিলেন না। এর পরনের শাড়িটা, ব্লাউজটা এবং চোখেমুখে যে ঝলমলে ভাব– এমন একটা দুঃসময়েও, ঘনশ্যামের কাছে। বিসদৃশ ঠেকছিল। একমিনিট পরে তিনি নড়ে উঠলেন। মনে পড়ে গেল, এই মেয়েটিই সবার শেষে এসেছে। কর্নেল এর কথাই এইমাত্র বলে গেছেন। হু, এই তাহলে সেই দেহ-বেচে-বেঁচে-থাকা হতভাগিনীটি! ঘনশ্যাম ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

শাওনি বাঁকা হাসল। দাড়িওলা বুড়ো সায়েবকে চুরোট খেতে দেখেছি। আগুন চাইলাম। বলল কী, নিচের বাবুর কাছে যাও। বুড়ো-হাবড়ার কাছে আগুন থাকে? শাওনির বাঁকা হাসি অশালীনতায় ফেটে পড়ল। তা নিচের বাবু। তো এখনও তত বুড়ো হয়নি। সেও বলে, আগুন নেই!

ঘনশ্যাম একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, বাঁচালতা কোরো না! অন্য কারুর কাছে। দেখ গিয়ে।

শাওনি চোখে ঝিলিক এনে বলল, ঠিক আছে। তারপর জলের দিকে আদ্ধেকটা ঘুরে ব্লাউজের বোতাম খুলল। আনমনা ভঙ্গি করে বলল ফের, তুলোভরা বেসিয়ের খানা শুকুতে দিয়েছি আমি। কোন্ নিমেগে লম্পট সেটা জলে ফেলে দিয়েছে। ভাসতে ভাসতে চলে গেল। এখন থাকো খালি বুকে আর লম্পটদের নোলায় জল গড়াক।

এত অশালীনতা সহ্য হল না ঘনশ্যামের। গম্ভীর মুখে বললেন, দেখ মেয়ে, তুমি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ।

কে, করছে না? শাওনি পা দিয়ে জল ঠেলতে ঠেলতে বলল। দেউড়ির দিকে রাস্তার অবস্থা দেখতে গেলাম, তো ওই যে মেমওলা লোকটা, সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে এল!

ঘনশ্যাম ইচ্ছার বিরুদ্ধে হেসে ফেললেন, তবু হাসিটি ঘৃণার। বললেন, ওরা তো ওইরকম। ওদের শ্রেণীধরনই তাই। যাই হোক, তুনি চেঁচামেচি করলেই পারতে! এখানে দারোগাবাবু আছেন!

হুঁ, বড়বাবুও তো বাঘের মতো হাঁ করে আছে। কতবার ইশারা করল, চোখ ঠারল–বাব্বাঃ!

ঘনশ্যাম ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। জানি! ওরাও ওদের প্রভুর নকল করে। তা হ্যাঁ গো মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল? তুমি এ পথে এলে কেন? বলো, তোমার জীবনের কথা বলো, শুনি।

ঘনশ্যাম জাঁকিয়ে বসলেন। শাওনি জলের ধার থেকে কাছে এল। এত কাছে যে ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকল ঘনশ্যামের। তারপর বারবধূর স্বভাববশে, তাছাড়া এই লোকটিকে যথেষ্ট নিরীহ মনে হয়েছে, শাওনি খপ করে তাঁর পাঞ্জাবির বুকপকেটে হাত পুরে দিল। ঘনশ্যাম হাতটা চেপে ধরলেন এবং বিপথগামিনী এক হতভাগিনীর প্রতি দার্শনিক প্রক্রিয়ায় ছিঃ, করে না এইরকম স্নেহমাখা তিরস্কারের ভঙ্গিতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলেন। এর ফলে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হল। ঘনশ্যাম বাঁ হাতে তার গালে থাপ্পড় মারতে গেলেন। কিন্তু চতুরা মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় তার কানের দুলে থাপ্পড়টা পড়ল। দুলের ওপরদিকটা খাঁজকাটা হওয়ার দরুন ঘনশ্যামের হাতের আঙুল ও তালুর সন্ধিতে একটা জায়গা ছড়ে গেল।

এইসময় ওপরদিক থেকে নেমে আসছিলেন ডাঃ ব্রজহরি কুণ্ডু। শেষবেলায় আকাশ পরিষ্কার হয়েছে এবং ঝলমলে রোদ্দুর ফুটেছে। এর ফলে প্রত্যেকেই বিশাল ও প্রশস্ত ঢিবিটার চারদিকে ব্যাকুলতা ও প্রত্যাশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রত্যেকের অবস্থা খাঁচায় বন্দী বুনোপাখির মতো। এদিকে রোদ্দুর প্রত্যেককে শুকনো করেছে এবং নেতিয়ে পড়া জবুথবু অবস্থাটি শরীর থেকে ঘুচে গেছে।

প্রত্যেকেই স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে। উদ্ধারের জন্য ছটফট করছে। তাছাড়া বিষাক্ত সাপটার কথাও রটে গেছে, আর এই চুল্লুর প্রেতাত্মা রাতের অন্ধকারের জন্য যে বিভীষিকাটি ওত পেতে আছে।

হরিপদর গান শুনে ব্ৰজহরির অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ। তার মুখে প্রসন্নতার প্রগাঢ় ছাপ। তিনি এই স্কুলশিক্ষককেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। দার্শনিক আলোচনার উপযুক্ত দোসর হওয়ার সম্ভাবনা যাঁর। বলতে আসছিলেন, বাউল-টাউলের গানই ভাল। ওদের তত্ত্বকথায় মাথামুণ্ডু নেই। দরবেশসায়েবের ইসলামি সুফিতত্ত্বও এইরকম গোমমেলে। তার চেয়ে বড় কথা, বাউল-টাউল বলুন আর যাই বলুন। মশাই, ওদের ওই সাধনসঙ্গিনী– মানে মেয়েমানুষের ব্যাপারটা ভারি সন্দেহজনক। আপনি ভেবে দেখুন, ব্রহ্মচর্য মানুষকে পরমাত্মার কাছে সরাসরি পৌঁছে দেয়। এজন্যই নারী সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মনুর উক্তি হল—

ব্ৰজহরি মনে মনে ঠিক এই কথাগুলি হর্ষনাথ মাস্টারমশাইকে বলতে বলতে নেমে আসছিলেন, কর্নেল একটু আগে তার খোঁজ দিয়েছেন কিন্তু আচমকা চোখে অশালীন দৃশ্যটি ধাক্কা দিল। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর সম্বিৎ ফিরলে গর্জে উঠলেন, ধিক! ধিক! ধিক আপনাকে হর্ষবাবু!

শাওনি প্রায় চোখের পলকে পাশের ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘনশ্যাম রাগে কাঁপছিলেন। মুখ তুলে ভাঙা গলায় বললেন, আমার ফার্স্ট এইড দরকার। রক্ত পড়ছে। তিনি বাঁ হাতের তালুতে ডানহাতের বুড়ো আঙুল চেপে ধরলেন। বিমর্ষ ও বিপন্ন মুখে ফের বললেন, আপনার কাছে ডাক্তারি ব্যাগ আছে দেখছি! প্লিজ, একটু পট্টি-ফটি বেঁধে দিন।

ব্ৰজহরি বিকৃত মুখে বললেন, আছে। কিন্তু আপনার জন্য কিছুই করব না।

সে কী! ঘনশ্যাম রেগে গেলেন। মানুষের বিপদে-আপদে আপনি ডাক্তার, আপনি–

বাধা দিয়ে ব্রজহরি বাঁকা হেসে বললেন, আপনার লাম্পট্যের শাস্তি আমি এনজয় করতে চাই।

ঘনশ্যাম মুখ নিচু করে রক্তের ফোঁটা দেখতে দেখতে গলার ভেতর বললেন, ঠিক এজন্যই ডাক্তারদের খতম করার স্লোগান দেওয়া হত।

কথাটা না বুঝতে পেরে ব্রজহরি আরও বাঁকা হেসে বললেন, বেশ্যার সঙ্গে প্রেম করছিলেন। প্রেমদংশনে রক্তপাত ঘটেছে।

আপনি আপনি ভুল দেখেছেন! ঘনশ্যাম চড়া গলায় বললেন। মেয়েটা আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল!

আরও বাঁকা কথা বলার জন্য নেমে এলেন ব্ৰজহরি…সাহস পায় কোত্থেকে? কৈ আমার পকেটে তো হাত ঢোকাতে আসেনি!

ঘনশ্যাম বললেন, আসেনি আসবে। তখন কী করেন, দেখা যাবে। তাও তো আমি থাপ্পড় মেরেছি!

হা হা করে হাসলেন ব্রজহরি। আর আমি একটা বেশ্যাকে বুকে টেনে নেব! আপনার মতো!

ক্ষোভে দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলার ভঙ্গিতে ঘনশ্যাম বললেন, আমাকে আপনি কী ভেবেছেন? আমাকে আপনি জানেন না। তাই এই সব জঘন্য কথাবার্তা বলতে বাধছে না আমার সম্পর্কে।

জানি বলেই তো আপনার কীর্তি দেখে দুঃখ হচ্ছে!

জানেন? বলুন, কে আমি? চার্জ করলেন ঘনশ্যাম। বলুন, কী জানেন আমার সম্পর্কে?

ব্ৰজহরি নির্বিকার মুখে বললেন, আপনি স্কুল-টিচার বলে পরিচয় দিয়েছেন। আমার সন্দেহ হয়েছিল আপনার হাবভাব দেখে। চোরা চাউনি, জড়োসড়ো বসে থাকা, দূরে-দূরে চলাফেরা, আত্মগোপনের চেষ্টা। কথাটা একবার দারোগাবাবুর কাছে তুলেছিলাম। উনি আমাকে সাপোর্ট করলেন। বললেন, ওয়াচ করবখন।

ঘনশ্যাম ভেতর-ভেতর নেতিয়ে গেলেন। কঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, আপনি আমার পেছনে লেগেছেন বুঝতে পারছি। আপনি আমার ওপর নজর রেখেছেন তাহলে! কিন্তু আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছে, ভুল করবেন না। প্রয়োজনে আমি স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।

ঘনশ্যাম বানের জলে রক্ত ধুতে গেলেন। ব্রজহরি একটু দমে গিয়েছিলেন ওই সব কথাবার্তা শুনে। রক্ত ধুতে ধুতে ঘনশ্যাম ঘাড় ঘুড়িয়ে আরক্তিম চোখে তাকে দেখলেন। ওই চাউনি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন ব্রজহরি। এই পবিত্র ঢিবিতে ইতিমধ্যে একজন বেশ্যার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এবার একজন খুনে প্রকৃতির লোক, সম্ভবত লোকটি দাগী ক্রিমিন্যাল, আবিষ্কৃত হল। ভারি পা ফেলে ঢাল বেয়ে উঠতে হাঁপ ধরে গেল ডাক্তার ব্রজহরি কুন্ডুর।

একটা স্তূপের আড়ালে পৌঁছে কর্নেলকে সামনে পেলেন। কুকুরটির মুখের ওপর চকোলেট ধরে খেলা করছেন কর্নেল। নেড়ি কুকুরটি মুখ উঁচু করে সেঁতো হেসে দুঠ্যাং সামনে তুলে যেন নৃত্য করছে। কথাটি বলতেন ব্রজহরি। কুকুরটা দেখে রাগ ও ভয় হওয়ায় অন্য পাশে ঘুরে চলে গেলেন। দারোগাবাবুর উদ্দেশেই।…

উপড়ে পড়া হিজলের মোটা ডালটাতে বসে ঝগড়া করছিল পুঁতি চাক্কুর সঙ্গে। ওই বেশ্যা মাগীটার সঙ্গে তোমার চেনা আছে জানলে কক্ষনো তোমার সঙ্গে আসতাম না!

চাক্কু বলল, আহা! কথাটা কিছুতেই বুঝছ না তুমি। রিকশা চালায় যারা, তারা ওদের চিনবে না? সব রিকশোওলা চেনে। বাগানপাড়ার গলিতে রিকশো চাপিয়ে খদ্দের পৌঁছে দেয়। চিনবে না?

পুঁতি গাল ফুলিয়ে বলল, চালাকি কোরো না। আমি বুঝেছি।

চাক্কু রেগে গেল এতক্ষণে। …কলাটি বোঝো তুমি! বেশি রেট পেলে বাগান পাড়ার গলিতে কোন রিকশোওলা ঢুকবে না! আমিও ঢুকেছি। তাতে কী হয়েছে?

পুঁতি চোখ মুছে বলল, একটুও বিশ্বাস করি না। ভাব না থাকলে অমন করে সাবার সামনে চোখঠার দিয়ে হাসতে পারে কেউ! তারপর আমাকে পর্যন্ত চোখঠারে যেন কী বলল!

বাজে বোলো না। ওদের ওই স্বভাব। চাক্কু সিগারেট ধরাল। গুম হয়ে টানতে থাকল।

পুঁতি তবু থামল না।…আমি দুজনের চোখে-চোখে কথা দেখেই বুঝেছি আমার বরাতে কী আছে! আমি কিছুতেই যাব না তোমার সঙ্গে। সাঁতার কেটে গাঁয়ে ফিরে যাব।

চাক্কু খাপ্পা হয়ে বলল, পারিস তো তাই যা! কান পচিয়ে দিলে মাইরি; এত করে বলছি– পিরবাবার থান এটা, সিথেয় নিজের হাতে সিঁদুর পরিয়ে দিলাম, তবু সন্দ! অত যদি সন্দ, তবে চলে যা!

পুঁতি ডাল থেকে মাটিতে পা রাখল। সোজা দাঁড়িয়ে বলল, যাব। যাবার আগে ওই মাগীর রক্ত দেখে তবে যাব!

পুঁতি ঝোপঝাড় ভেঙে বেগে ওপরে উঠে গেল। চাক্কু ঘুরে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর একটু হাসল। তিনক্রোশ পথ পেরিয়ে পুঁতি গাঁয়ে। ফিরতে পারবে না। ফিরলেও দাঁড়াবে কোথায়! ডুবো গাঁ। হারামজাদি মাসি মেরে ভাসিয়ে দেবে বানের জলে। চাক্কু মুখ নামিয়ে নোখ খুঁটতে থাকল।

একটু পরে গায়ে ছায়া পড়লে সে মুখ তুলে দেখল, শাওনি। শাওনি মুখ টিপে হেসে বলল, কী রে চাক্কু? মেয়েটা অমন করে চলে গেল কেন?

চাক্কু দুঃখে হাসল।…তোকে খুন করতে। তুই মাইরি যা করিস– যাঃ!

শাওনি চাপা স্বরে এবং চোখ নাচিয়ে বলল, কোথায় যোগাড় করলি? সত্যিসত্যি বউ?

হুঁ। বউ ছাড়া কে?

শাওনি ওর হাত থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিয়ে টানতে টানতে বলল, সিঁথিয় টাটকা সিঁদুর! বৃষ্টিতে জলে সাঁতরে এসেছিল। আর সিঁথিয় টাটকা সিঁদুর! এই দেখ আমার সিঁদুরের অবস্থা! দেখতে পাচ্ছিস?

চাক্কু বলল, শাওনি! ছেনালিপনার জায়গা না এটা। পাছায় এমন লাথি মারব, জলে গিয়ে পড়বি। বাগানপাড়ায় গলিতে যা করার করিস। এখানে নয়।

শাওনি একপা পিছিয়ে ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, তোকে বিশ্বাস নেই। তাও পারিস! একটা কথা বলব, শুনবি?

চাক্কু তাকাল। কিন্তু চোখে মিটিমিটি হাসি।

শাওনি ফিস ফিস করে বলল, ছুঁড়িটা তোর বউ-টউ না। ভাল খদ্দের আছে, দিবি?

শাওনি! চাক্কু গর্জন করল।

পাঁচশো টাকা পাবি। শাওনি একই সুরে বলল। গাদাকে জিগ্যেস করিস। সে একটা ছুঁড়ি এনেছিল গাঁওয়াল থেকে। এটার চেয়ে পুরুষ্টু। শাওনি সেই মেয়েটির বুকের মাপ দেখাল। পুঁতির বুকের সঙ্গে যে উপমাটা দিল, তা অশ্লীল। তারপর ফিক করে হাসল।…যে খদ্দেরের কথা ভেবে নিয়ে যাচ্ছিস, তাকে আমি চিনি। গুলাই তো? আমার খদ্দের এক বাবু। খুব বড়লোক। একেবারে বোম্বাই চালান করে দেবে তোর গায়ে আঁচড়টিও লাগতে দেবে না।

চাক্কু তার ব্যাগে হাত ভরে একটা কী বের করল। সেটা থেকে বেরিয়ে এল চকচকে ইঞ্চি ছয়েক ফলা। কদর্য গাল দিয়ে বলল, মাগীর গলা কেটে ভাসিয়ে দেব বানের জলে ফের যদি একটা কথা বলেছিস!

শাওনি বাঁকা হেসে বলল, আচ্ছা! দেখা যাবে!

সে হাল্কা পায়ে ঢাল বেয়ে উঠে গেল। চাক্কু শ্বাস ফেলে স্প্রিংয়ের চাক্কুটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল! তারপর পুঁতিকে খুঁজতে গেল। তার ভাবনা হচ্ছিল, পুঁতি বিপন্ন।…

বাউল হরিপদ ভুলুণ্ঠিত দণ্ডবৎ করে বলল, দারোগাবাবু! এবার অনুগ্রু করে হরিপদকে ছুটি দিন।

বাউলগান শুনে বংকুবিহারীর মনে উড়ুউড়ু ভাব। মিঠে হেসে বললেন, ছুটি নিয়ে যাবি কোথায় বাবা? চতুর্দিকে তো অথৈ সমুদ্র– কূলকিনারাহীন!

হরিপদ হাসল।…এ সঙ্কটে গুরুই ভরসা দারোগাবাবু! গুরুই উদ্ধার করবেন।

সে একতারাটি পিড়িং পিড়িং করতে করতে উঠে গেল। সূর্য জলের ওপর ঝুঁকে এসেছে। অপার জলে লালচে ছটার ঝিলিমিলি। বংকুবিহারী এতক্ষণে ইউনিফর্ম পরলেন। রিভলবার, বেল্ট ইত্যাদিতে ফের আইনরক্ষকে রূপান্তরিত হলেন। ক্ষিদে পেয়েছে। দরবেশবাবার ঘরে চালডাল থাকা সম্ভব। দেখা যাক।

হঠাৎ খুব কাছ থেকে কেউ ডাকল, দারোগাবাবু, অমনি প্রচণ্ড চমকে অভ্যাসবশে রিভলবারের বাঁটে হাত চলে গেল বংকুবিহারীর। প্রেতাত্মায় তাঁর বিশ্বাস আছে। কেমন নাকিস্বরে ডাক, ভেবেছিলেন চুল্লু। কিন্তু দেখলেন, চুল্ল নয়, একটি মেয়েমানুষ। ভুরু কুঁচকে বংকুবিহারী বললেন, অ্যাই মাগী! লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছিস কেন?

শাওনি জিভ কেটে বলল, ওম্মা! সে কী কথা! একটা নালিশ করতে এসে গালমন্দ খেলাম!

ছেনালি রাখ। কী নালিশ তোর?

 শাওনি খুঁ খুঁ করে কান্নার ভঙ্গি করল।…হতে পারি বেশ্যা! পেটের দায়ে খাতায় নাম লিখিয়েছি। তাই বলে কি মানুষ নই? আপনি এর একটা বিহিত করুন, দারোগাবাবু!

বংকুবিহারী একটু শান্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?

শাওনি ফুঁপিয়ে উঠল…জামাকাপড় শুকোতে যেখানে যচ্ছি, একলা পেয়ে মিনসেরা আমাকে টানাটানি করছে।

হ্যা হ্যা করে হাসলেন বংকুবিহারী।…তুই কি সতীলক্ষ্মী? তোর হাত ধরে টানল তো কী হয়েছে? পয়সা চাইলেই পারতিস। নালিশের কী আছে এতে? আঁ?

শাওনি চোখ মুছে বলল, হুঁ, পয়সা! তার বেলা নেই কেউ।

 ভুরু নাচিয়ে বংকুবিহারী চাপা স্বরে বললেন, নাম বল্ শুনি!

 শাওনি বলল, ওই মেমওলা বাবু–তাপরে…

 দ্রুত আইনরক্ষক বললেন, বলিস কী!

 আপনার দিব্যি। এ পিরবাবার থান।

হ্যাঁ রে, ওর তো জার্মান তরুণী বউ। ওর তোকে পছন্দ হল?

শাওনি ঠোঁট বাঁকা করে বলল, জানেন না, ঘরে সুন্দর-সুন্দর বউ ফেলে লোকে আমাদের কাছে আসে? আসে না বলুন?

বংকুবিহারী ভেবে বললেন, হু। তা সত্যি। তবে ওই ছোকরার ব্যাপারে আমি নাচার। ওর মামা এম এল এ। এঁদে লোক। রাইটার্সে কথা তুললে আরও অখাদ্য জায়গায় বদলি করে দেবে। চেপে যা! আর কে বল্!

শাওনি বলল, ওই যে লম্বা নাক আধবুড়ো লোকটা..

বুঝেছি। স্কুলটিচার– কী যেন নামটা? বংকুবিহারী ফিক ফিক করে হাসতে লাগলেন।…এই বিপদেও মানুষের আদিরিপু মাথা চাড়া দেয়, ভাবা যায় না। মানুষ এক হারামজাদা জীব, বুঝলি? প্রত্যেকটা মনুষ বর্ন ক্রিমিনাল। কেউ পারে, কেউ পারে না এই আর কী! বুঝলি কিছু?

শাওনি বলল, আর ওই পেটমোটা ডাক্তারবাবু!

যাঃ! জিভ কেটে বংকুবিহারী বুটে পা ঢোকালেন এবং চাঙড়ে বসলেন। মোজা শুকোয়নি। তুই এটা একেবারে বানিয়ে বলছিস! ডাক্তার কুণ্ডুকে আমিই চিনি। ধার্মিক মানুষ। বিয়ে পর্যন্ত করেননি।

শাওনি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আপনি পুলিশের লোক। কিন্তু আমি বেশ্যা। আপনার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চিনি।

বংকুবিহারী মোজা দুটো কাঁধে রেখে হাসলেন।…ঠিক আছে। আর?

আর রিকশাওলা ছোঁড়া।

 ওর তো সঙ্গে বউ আছে!

বউ ঝগড়া করে দরবেশবাবার কাছে বসে আছে। শাওনি চাপা স্বরে বলল, আমার একটা সন্দেহ হয়েছে। ঘুড়িটাকে ভাগিয়ে নিয়ে বেচতে যাচ্ছে ছোঁড়াটা। জেরা করুন, গুঁতোর চোটে বেরিয়ে পড়বে।

কথাটা মনে ধরল বংকুবিহারীর। ভুরু যথেষ্ট কুঁচকে বললেন, দেখছি।

শাওনি দমআটকানো গলায় বলল, আমাকে ধরে টানাটানি করছিল। শেষে চাক্কু বের কল। ওর ব্যাগে ইপিরিং-এর চাক্কু আছে। এতটা বড়ো!

বংকুবিহারী সিরিয়াস হয়ে বললেন, তখন তুই ওর সঙ্গে শুয়ে পড়লি?

না। বিনি পয়সায় আমি কারুর সঙ্গে শুই না। দৌড়ে পালিয়ে এলাম। আপনাকে নালিশ করতে এলাম।…শাওনি ঠোঁট কামড়ে একটা ভঙ্গি করল, যেন সে ক্রুদ্ধ কিন্তু অসহায়।

বংকুবিহারী হঠাৎ ফিক করে হাসলেন।… হা রে, ওই কর্নেলবুড়ো কিছু বলেনি তো?

শাওনিও হাসল।..বুড়োসায়েবের শরীলে আর আগুন নেই। কুকুর নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে।

বংকুবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে বললেন, প্রব্লেম হল, তুই একজন বেশ্যা। ওরা তোর বিরুদ্ধে পাল্টটা চার্জ আনলেই মামলা কেঁচে যাবে। তবে ওই রিকশোওলা ছোঁড়াটার কাছে ড্যাগার আছে বললি। সেটা সিজ করে নিচ্ছি। আর শোন, তোর সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।

শাওনি কাছে গিয়ে বলল, বলুন!

আইনরক্ষক চাপাস্বরে বললেন, ওই মেমসায়েটার দিকে নজর রাখতে পারবি? ও কী করছে, কার সঙ্গে কী কথা বলছে-টলছে, কিছু আঁকছে-টাকছে কি না…

শাওনি নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলল, বুঝেছি।..

ক্লারা পাথরের স্ল্যাবে বসে জলে শাদা পা ছড়িয়ে সূর্যাস্তের প্রতীক্ষা করছিল। পায়ের শব্দে ঘুরে শাওনিকে দেখতে পেল। মিষ্টি হেসে ডাকল, এস তুমি। এখানে বসো। এস এস।

শাওনি একটু তফাতে বসে বলল, দিদি, আপনি আমাদের কথা বলতে পারেন?

কেন পারব না? ক্লারা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল। বলছি না? আচ্ছা, এবার বলো, তোমার নাম কী?

শাওনি।

শাওনি কথার মানে জানো তুমি?

হুউ। শ্রাবণ মাসে জন্মে তাই মা নাম রেখেছিল শাওনি।

তুমি খুব ভাল মেয়ে। ক্লারা হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত নিল।…তোমার হাতের সঙ্গে আমার হাতের পার্থক্য শুধু রঙের। কারণ আমি বিষুব রেখার বহু দূরে উত্তরে জন্মেছিলাম। তুমি বিষুব রেখার দিকে কর্কটক্রান্তিতে। ও! তুমি কতটা লেখাপড়া করেছ, শাওনি?

আমি লেখাপড়া জানি না। শাওনি মেমসায়েবকে খুঁটিয়ে দেখছিল। তার হাতটাতে অস্বস্তি। গা ঘিনঘিন করা সাদাটে হাত। যেন চামড়াছাড়ানো হাত।

ক্লারা বলল, তুমি কিছু কাজ করো কি? কী কাজ করো?

কিছু না।

ক্লারা হেসে ফেলল। ..বুঝলাম। তোমার স্বামী করে। সে কী করে?

শাওনি ফোঁস করে উঠল। অত কথায় কী কাজ?

ক্লারা হাসতে লাগল। …তুমি হঠাৎ রেগে গেলে কেন? আমি শুনেছি, ভারতের লোকেরা এসব প্রশ্ন শুনলে খুশি হয়। যাইহোক, দেখছি কথাটা ভুল। ঠিকই তো। অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ শিষ্টতা-বহির্ভূত আমি তোমাকে এসব প্রশ্ন আর করব না।

শাওনি হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। ক্লারা মজা পেয়ে গেল। বলল, তুমি আমাকে দিদি বলেছ। চলো, তোমাকে আমিই মিষ্টান্ন খাওয়াব- তার আগে ছাড়ব না। এবং তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্তও।

ক্লারা তাকে টেনে ওঠাল। শাওনি টের পাচ্ছিল মেমসায়েবের গায়ে জোর আছে। পা বাড়ালো শাওনি। আস্তে বলল, হাত ছাড়ুন যাচ্ছি।

ক্লারা বলল, কিছুতেই নয়। দরকার হলে আমার বোনকে তুলে নিয়ে যাব!

ক্লারা! ক্লারা!

ক্লারা মুখ তুলে দেখল প্রদোষ দাঁড়িয়ে আছে ওপরে। ক্লারা বলল, একজন বোন পেয়েছি।

প্রদোষ একলাফে নেমে এল। …হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর ডুয়িং? সি ইজ আ প্রসটিটিউট আ ব্ল্যাকমেলার।

ক্লারা হকচকিয়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগে শাওনি একঝটকায় ছাড়িয়ে নিল। নিজেকে। সে প্রস শব্দটার সঙ্গে পরিচিত। বাঁকা হেসে বলল, পস! তখন পস। কে ধরে টানাটানি করতে খুব মজা লাগছিল, তাই না? দশটা টাকা দিয়ে ভিজে মাটিতে শোওয়ার জন্য পায়ে ধরতে বাকি! বলব না ভেবেছিলাম, বলিয়ে ছাড়লে!

প্রদোষ হুংকার দিয়ে ঘুসি তুলে ঝাঁপ দিল বারবধূটির দিকে। কিন্তু ক্লারা তাকে ধরে ফেলল। শাওনি দৌড়ে ঝোপঝাড় ভেঙে পালিয়ে গেল।

প্রদোষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আই মাস্ট কিল দা ডার্টি বিচ!

 ক্লারা তাকে ছেড়ে দিল।

প্রদোষ দম নিয়ে বলল, সি ইজ আ ব্ল্যাকমেলার। আই শুড ন্যারেট দা। ইনসিডেন্ট লেটার অন। লেটস গো ব্যাক, বেবি!

ক্লারা তার চোখে চোখ রেখে নির্বিকার মুখে বলল, তোমাকে এই শেষবার বলছি, প্রদোষ। তুমি আমাকে ইংলিশ বলবে না। যদি জার্মানভাষা শিখতে পারো– বলবে, নতুবা বাংলা বলবে, যদিও আমি জানি, তুমি জার্মানভাষা শিখবে না। তুমি এমন মানুষ প্রদোষ, যে হাত বাড়িয়ে সবকিছু চায়, কষ্ট করে না। ভারত ইংলিশম্যানেদের উপনিবেশ ছিল। সুতরাং ইংলিশ শেখা তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি ভারতীয়। তুমি জানো না ইংলিশম্যানরা ভারতীয়দের ঘৃণা করে। আমেরিকাবাসীরা করে না।

ক্লারা হাল্কা পা ফেলে ঢাল বেয়ে দরগার দিকে উঠে গেল। প্রদোষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বেশ্যা-মেয়েটা সম্ভবত তাকে আবার ব্ল্যাকমেল করে গেল। একটা কিছু করা দরকার। তার চোয়াল আঁটো হয়ে গেল।…

.

একটি তালডোঙা

কুকুরটা খেলতে-খেলতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে ভেউ ভেউ করে উঠল। যেন কাউকে ধমক দিচ্ছে সে। কর্নেল হাসলেন।… চুল্লুকে দেখতে পাচ্ছিস নাকি রে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তুই লুল্লু। কী? নামটা পছন্দ হল তো? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কুকুরটা ঢিবির উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে কাকে ধমক দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে। কর্নেল শিস দিলেন। আ-তু-তু ডাকলেন দিশি প্রথায়। শেষে ধমক দিলেন, লুল্লু! ফিরে আয় বলছি! কুকুরটা– লুল্লু ফিরল না।

সূর্য ডুবে গেছে। খোঁড়া পিরের দরগার জঙ্গলে ফাঁকে-ফোকরে লালচে রোদ্দুরের ফালিগুলি মুছে দিয়েছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা। পোকামাকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে, চাপা, দুরবর্তী এবং বিস্তৃত। মাথার উপর গাছপালার ঘন ডাল ও পাতা। আকাশের অবস্থা বোঝা যায় না। কুকুরটা কোথায় চলেছে দেখার জন্য পা বাড়ালে সাপের কথা মনে পড়ল কর্নেলের। পাতলুনের পকেট থেকে ছোট্ট কিন্তু জোরালো টর্চটি বের করলেন। এখনও যথেষ্ট আলো আছে বলে জ্বাললেন না। একটু পরে জলের শব্দ শুনতে পেলেন। ঢিবিটা চারদিক থেকে ঘিরে জলের মারমুখী চেহারা এবং উত্থান। ঘণ্টা দুই আগে এইসব মাদারগাছের অনেক নিচে জল দেখেছিলেন। এখন ঢালু মাদারগাছের জটলার ভেতর জল। বন্যা বাড়ছে তবে ধীরে। কর্নেল ডাকলেন, লুল্লু!

লুল্লু মাদারগাছের পাশে উঁচু চাঙড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কাকে শাসাচ্ছিল। তার পাশে গিয়ে অবাক হলেন! একটা কালো তালডোঙা– তালগাছের গুঁড়ি কেটে বানিয়ে যাতে আলকাতরা মাখানো হয়, শেকড়ে বাঁধা। শেকড়টা নেমে গেছে একটা শিরীষগাছ থেকে। শেকড়ের পাশে ঘন ঘাস। ঘাসগুলোর পাতা চ্যাপ্টা, লম্বাটে ছিপছিপে গড়ন। সবে সোজা হচ্ছে।

কেউ ডোঙা বেয়ে এসেছে এবং দ্রুত সেটা বেঁধে রেখে দরগায় গেছে। ঘাসের ভেতর গামবুটে-ঢাকা একটা পা নামিয়ে বাঁদিকে মাদার-জঙ্গলের পেছনটা দেখতে উঁকি মারলেন কর্নেল। কারণ লুল্লু সেদিকে মুখ ঘুরিয়েছিল।

কাউকে দেখতে পেলেন না। ডোঙাটার ভেতর ফুট সাতেক লম্বা একটা বৈঠা পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে বৈঠাটা তুলে নিলেন কর্নেল। একটু ভাবলেন। তারপর শেকড় থেকে, দড়িটা খুলে ডোঙায় উঠলেন। ভীষণ টলমলে এই ধরনের জলযানে চাপার অভ্যাস তার আছে। ব্রাজিলের অববাহিকার দুর্গম জঙ্গলে হিংস্র উপজাতি নিভারো ইন্ডিয়ানরা ঠিক এইরকম ক্যানো ব্যবহার করে। ডোঙাটা বেয়ে ঢিবির পূর্ব দিকে পৌঁছুতে সেই স্মৃতি ফিরে এল এবং চলে গেল। একটু দূরে ডুবন্ত অথই পিচরাস্তার ওধারে বাঁকা বনটা কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের মতো। লুল্লু ঢিবির কিনারা ধরে তাকে অনুসরণ করছিল। দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘুরে ঢালু পাড়ে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে থাকা ঝোপের কাছে পৌঁছে আবার একটু ভাবলেন কর্নেল।

ডুবন্ত ঝোপের ভেতর ঢুকে বৈঠা দিয়ে জলের গভীরতা দেখে নিয়ে কর্নেল ডাঙার কাছে গেলেন। তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললেন। নেমে ডোঙাটা কাত করে ধরলেন। জল ঢুকতে ঢুকতে ডোঙাটা ডুবে গেল! সেটাকে জলের ভেতর ঝোপের তলায় ঠেলে দিলেন। ডোঙাটার কোনো চিহ্ন রইল না। বৈঠাটাও ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখে উঠে এলেন। দেখলেন, লুল্লু নেই।

লুল্লুর দেখা পাওয়া গেল বিধ্বস্ত দেউড়ির কাছে। সেখানে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে শাওনি। লুল্লু তার কাপড় শুকচ্ছে আর লেজ নাড়ছে। কর্নেলের পায়ের শব্দে শাওনি ঘুরল। মুহূর্তের জন্য কর্নেলের মনে হল সে ভীষণ চমকে উঠেছে। কিন্তু সেই সময় ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডুর ডাক শোনা গেল, কর্নেলসায়েব! কর্নেলসায়েব! সঙ্গে সঙ্গে শাওনি প্রাঙ্গণ পেরিয়ে হন্তদন্ত চলে গেল।

ব্ৰজহরির পাশ দিয়ে যাবার সময় সম্ভবত মেয়েটা কিছু রসিকতা করে গেল। কারণ ব্রজহরি হুংকার ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। থাপ্পড়ের ভঙ্গিতে ডানহাতটা উঠে ধীরে নেমে গেল। কর্নেল ডাকলেন ডাক্তারবাবু!

ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

বলুন!

চাপাস্বরে ব্রজহরি বললেন, ফকির-দরবেশ এমন গলাকাটা দোকানদারি করতে পারে, ভাবা যায় না। পঞ্চাশ টাকায় রফা হল। তাও চাল-ডালের যা পরিমাণ, এতগুলো লোকের আধপেটা হবে। কুমড়ো আছে শুনলাম। বলে, দেওয়া যাবে না। জ্বালানি কাঠের পাঁজা আছে ঘরভর্তি। খানকতক চেলা কাঠ দিয়ে বললে এতেই হয়ে যাবে। হরিপদ ওই ভাঙা ঘরটার ভেতর উনুন বানাচ্ছে। আমরা দুজনে রাঁধব। আর

বলুন!

ব্ৰজহরি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, মেমসায়েব পুরো টাকা দিতে যাচ্ছিল, তা কি উচিত? শেষ পর্যন্ত চাদা করে চল্লিশ উঠেছে– মানে, আমি পাঁচ, মেমসায়েব আর এম এল এর ভাগ্নে মিলে দশ, টিচার ভদ্রোলোক পাঁচ, রিকশোওলা আর তার বউ দশ– ওই মেয়েটাকেও দুমুঠো দেওয়া হবে, তবে ওঁর চাদা নেওয়া হবে না, এখন

কর্নেল দ্রুত পার্স বের করে একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিলেন ওঁর হাতে।

ব্ৰজহরি ফ্যাঁচ শব্দে হাসলেন।…ভগবানের আশীর্বাদে রাতটা ভালয়-ভালয় কাটলে আগামীকাল দেখবেন, ঠিকই রিলিফের নৌকো আসবে। বলে আবার গলা চাপলেন।…একটা কথা বলি! এভাবে ঘুরবেন না একা-একা। জায়গাটা ভাল না।

কর্নেল সিরিয়াস ভঙ্গিতেই বললেন, আপনি কি চুল্লুর কথা ভাবছেন?

আমি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি। ব্ৰজহরি ঝটপট বললেন। তা ছাড়া একটু আগে

উনি ভয়-পাওয়া মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে কর্নেল বললেন, কিছু কি দেখেছেন?

দেখেছি। ব্ৰজহরি ফিসফিস করে বললেন। এদিকে-সেদিকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ ওদিকে গাছপালার আড়ালে যেন কালো রঙের একটা কিছু যাই হোক, আসুন। টাকা না দিলে দরবেশ ব্যাটাচ্ছেলে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। লোকটা খাঁটি ফকির-দরবেশ নয়।…

.

 সূর্যাস্তের পর এক ঘন্টা

আবার ঝিরিঝিরে বৃষ্টি। বারান্দায় অন্ধ দরবেশ নমাজের পর ধ্যানে বসেছেন। বুকে চিমটে টুকছেন। ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। তার সামনে ঘরটা বন্ধ। তালা আঁটা। পাশের ঘরে ছেঁড়া সতরঞ্জি বিছিয়ে বসে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন লোক। এখন গম্ভীর, নিশ্চুপ ও বিমর্ষ। ক্লারা দরজার কাছে ঘনশ্যাম কোণে। পুঁতি-চাক্কু মাঝামাঝি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। বংকুবিহারী মাঝখানে হাঁটু দুমড়ে বসেছেন। শাওনি ক্লারার কাছে বসে অন্ধকারে বৃষ্টি পড়া দেখছে। পাশের ভাঙা ঘরটাতে ব্ৰজহরি ও হরিপদ খিচুড়ি রান্না করছেন। কর্নেল বারান্দায় বসে উনুনে ঝলসে-ওঠা দুটি মুখ দেখছিলেন। দুটি মুখই মাঝে-মাঝে হেলে-পড়া ছাদটির দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে। ঝুলন্ত কড়িকাঠের ওপর ছাদটা কোনোক্রমে আটকে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। ধোঁয়ায় নাক-মুখ কুঁচকে ব্ৰজহরি হাতা দিয়ে প্রকাণ্ড ডেকচির ফুটন্ত চাল-ডাল নাড়তে থাকলেন। হরিপদ গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। বৃষ্টির শব্দের ভেতর ফোঁপানির মতো সুরটা।

বৃষ্টি এসেই সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোণঠাসা করে ফেলেছে। বিকেলের রোদ্দুরটা খুব আশা যুগিয়েছিল। ফলে জোট ভেঙে লোকগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা এবং আবার বৃষ্টি তাদের একত্র করেছে। তা ছাড়া চুল্লু!

 কর্নেল লুল্লুকে খুঁজছিলেন। ব্ৰজহরির সঙ্গে এখানে আসার সময় কুকুরটার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর আর তার পাত্তা নেই। সম্ভবত বৃষ্টির শুরুতে সে কোনো ভাঙা ঘরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি দেখে সে-ও কি আতঙ্কে চুপ করে গেল?

বৃষ্টি বাড়ল। বাতাস উঠল। তখন দরবেশ আচ্ছন্ন স্বরে ডাকলেন, চুল্লু!

 বংকুবিহারীও অমনি চাপাস্বরে ডাক দিলেন, কর্নেল!

বলুন!

 বারান্দায় ছাঁট লাগছে না? এখানে আসুন।

কর্নেল টর্চ জ্বেলে পাশের ঘরে গেলেন। তখনও দরবেশ চাপা-গলায় বলছেন, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু! বংকুবিহারী হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমার টর্চটা সেপাইদের কাছে থেকে গেছে। জানি না বরাতে কী ঘটল! একেবারে ইন্টিরিয়ারে তো! প্রিমিটিভ অবস্থা যাকে বলে!

কর্নেল হাসলেন।..আপনার দাগী আসামির কথাও ভেবে দেখুন!

ওর কিছু হয়নি। বংকুবিহারী আস্তে বললেন। ও ব্যাটাকে চেনেন না। ওর নাকি অনেকগুলো প্রাণ। সহজে যাবার নয়।

চাক্কু বলল, কার কথা বলছেন সার?

বংকুবিহারী বললেন, হ্যাঁরে, চাক্কু না ফাল্লু, ইসমাইলকে চিনিস?

আজ্ঞে নাম শুনেছি। চোখে দেখিনি কখনও।

 চুপ ব্যাটা! তুই ইসমাইলের চেলা! তোকে দেখেই বুঝেছি।

চাক্কু হাসল। …বিপদের সময় এটা কী একটা কথা হল সার? সবাই জানে আমি রিকশো চালিয়ে খাই। ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করুন। তাপরে এই শাওনিকে জিগ্যেস করুন!

বংকুবিহারী হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন, কর্নেল! একবার টর্চ জ্বালুন তো! প্লিজ! আমি দেখাচ্ছি।

কর্নেল ক্ষুদে টর্চট জ্বাললেন। বংকুবিহারী হাত বাড়িয়ে খপ করে চাক্কুর ঝোলাটা টেনে নিলেন। চাক্কু ভড়কে গেল। বংকুবিহারী ঝোলাটা উপুড় করে ধরলেন। একটা হাফপ্যান্ট, লাল গেঞ্জি, চিরুনি, একটা মানিব্যাগ, আধ-শুকনো একটা লুঙ্গি ছড়িয়ে পড়ল। বংকুবিহারী চার্জ করলেন, ড্যাগারটা কোথায় লুকোলি? কাছে আয়। সার্চ করি।

চাক্কু বলল, করুন সার্চ। তবে ড্যাগার একটা ছিল। রাতবিরেতে বদমাশ পেসেঞ্জার

চুপ! কোথায় রেখেছিস ড্যাগার?

জানি না। আমারও তো অবাক লাগছে। ব্যাগেই ছিল।

বংকুবিহারী ওকে দাঁড় করিয়ে রীতিমতো সর্বাঙ্গ সার্চ করলেন। কর্নেল বললেন, টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে দারোগাবাবু! ক্ষমা করবেন। বলে টর্চ অফ করে দিলেন।

বংকুবিহারী বললেন, তোর বউকে চালান করেছিস! দেখি, ওর ব্যাগটা দে!

বারান্দার কোণে দরবেশের ঘরের দরজার পাশে রাখা মিটমিটে হেরিকেনের আলো টেরচা হয়ে এ-ঘরে ঢুকেছিল। পুঁতি হতবাক। তার ব্যাগেও ছোরাটা নেই। বংকুবিহারী বললেন, শাওনি! ওর বডি খুঁজে দ্যাখ তো!

শাওনি পুঁতির গায়ে হাত দিতে গেলে পুঁতি ধাক্কা দিল ওকে। ক্লারা বলে উঠল, এ কী হচ্ছে? কী করছেন আপনারা? এমন বিপদের মধ্যে আইনের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। কর্নেল, আপনি ওদের বলুন। বাধা দিন।

দরবেশ হাঁক দিলেন এইসময়, চুল্ল! তারপর বাইরে কী একটা ঘটল। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। ব্ৰজহরি ও হরিপদকে বারান্দায় দেখা গেল। ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, ছাদটা ধসে গেল। একচুলের জন্য বেঁচে গেছি।

হরিপদ বলল, হায় গুরু! এতগুলো লোকের মুখের আহার! হায় হায় গো!

ব্ৰজহরি গর্জন করলেন, এমন হবে জানতাম। সবই জানি, কেন এমন হচ্ছে। কেন আবার নেচার ক্ষেপে গেল, কেন মুখের খাদ্য ধ্বংস হল–ক্লারা বলল, কেন, আপনি বলুন। আমরা শুনি।

ব্ৰজহরি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, এবং ইংরেজিতে, যেহেতু ক্লারা মেমসায়েব। ইউ নো ম্যাডাম, দা ডেভিল! ইউ নো হিম ওয়েল। অলসো ইউ নো দা স্টোরি অফ দা বাইবেল– দা সেক্রেড বুক অফ ইওর রিলিজিয়ন, ম্যাডাম

আপনি বাংলায় বলুন! আমি জার্মান। ইংলিশ জানি না।

 ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু গ্রাহ্যই করলেন না। দা স্যাটান লেট লুজ! শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন। হেয়ার ইজ দা সিম্বল! এ প্রসটিস্যুট! দা ডেভিলস্ ডটার ইজ ইন দিস্ সেক্রেড প্লেস, ম্যাডাম! তারপর যুগপৎ কর্নেল ও বংকুবিহারীর উদ্দেশে বললেন, কর্নেলসায়েব! দারোগাবাবু! আপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, আমি করেছি। আমার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। যে মুহূর্তে ওই হারামজাদি মেয়েমানুষটা এ মাটিতে পা দিয়েছে, তখন থেকে একটার পর একটা বিপদ ঘটছে কি-না বলুন!

শাওনির হাসি শোনা গেল। …ওরে ড্যাকরা মিনসে! আমি বুঝি না কাকে ইংরিজি-মিংরিজি করে গাল দেওয়া হচ্ছে? আমি নেকি?

ব্ৰজহরি তীক্ষ্ণদৃষ্টে আবছা আঁধারে তাকে দেখার চেষ্টা করে বললেন, বেরো! বেরিয়ে যা বলছি!

শাওনি চ্যাঁচাল। …তুই বেরো! ডাক্তার না ফাঁকতার! জল বেচে টাকা খায়, তার আবার বড় বড় কথা? তুই জল বেচে খাস, আমি শরীল বেচে খাই। খাবো।

ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, আপনারা সহ্য করছেন? দারোগাবাবু! কর্নেল!

বংকুবিহারী বললেন, আহা! জানেন তো ওরা ওই রকমই। কেন ঘাঁটাতে গেলেন ওকে?

শাওনি দারোগাবাবুর সাহসে আবার চাঁচাল। ভেংচি কেটে বলল, স-ই-হ্য। করছেন! স-ই-হ্যওলা ডাক্তারবাবু রে আমার! তখন জলের ধারে একলা পেয়ে পিরীত করতে লজ্জা করেনি?

ব্ৰজহরি মুখে দু হাত চাপা দিয়ে হো হো করে কেঁদে ফেললেন। বসে পড়লেন ধপাস করে। বাউল হরিপদ ফোঁস করে নাক ঝেড়ে কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল, হা গুরু! জয় গুরু! এ কী হচ্ছে গো বাবার দরগায়!

ঢিবি জুড়ে গাছপালা দুলছে, টালমাটাল হচ্ছে, মেঘ গর্জে-গর্জে উঠছে, বিদ্যুতের ছটায় ছটায় ঝলসে উঠছে মুহূর্তকাল, আবার বৃষ্টিময় অন্ধকার মুঠোয় চেপে ধরছে সব কিছু, এবং দরবেশ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, চুল্লু! তখন ঘনশ্যামের কথা শোনা গেল, যা আরও ভয়ঙ্কর : এ ঘরখানা ধসে পড়বে না।

বংকুবিহারী ব্যস্তভাবে বললেন, কর্নেল! টর্চ জ্বালুন তো! মনে হল জল চোঁয়াচ্ছে ছাদ থেকে।

কর্নেল ছাদে টর্চের আলো ফেললেন। সত্যি জল চোঁয়াচ্ছে কয়েকটা জায়গায়। চাক্কু দেশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। প্রদোষ লাইটার জ্বেলে বলল, টর্চ আনতে ভুলে গেছি!

শিগগির সে লাইটার নিভিয়ে দিল। ক্লারা বলল, চলুন, আমরা বারান্দায় যাই।

তার বলার তর সয়নি কারুর, ভিড় করে চলে এল বারান্দায়। ধাক্কাধাক্কিও হল খানিকটা। কিন্তু দরবেশ হাত বাড়িয়ে লণ্ঠন নিভিয়ে দিলেন। বংকুবিহারী বললেন, আশ্চর্য! নেভালেন কেন?

অন্ধ দরবেশ বুকে চিমটে ঠুকতে ঠুকতে আওড়ালেন, চুল্লু! রাখুন মশাই আনপার চুল্লু! বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন। কর্নেল! টর্চ জ্বালুন। হেরিকেনটা জ্বালা দরকার।

কর্নেল টর্চ জ্বালালেন। বংকুবিহারী হিংস্রভাবে হেঁটে হেরিকেনটা আনতে যাচ্ছেন, দরবেশ এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। হেরিকেনটা তুলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে। বংকুবিহারী বললেন, আশ্চর্য!

আবার বিদ্যুতের ঝিলিক। মেঘের গর্জন। বংকুবিহারী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, সাধুসন্ত মানুষরা কেন পাগল হয়, বুঝি না!

ব্ৰজহরি সামলে নিয়েছেন। ফোঁস করে নাক ঝেড়ে বললেন, হয়। আসলে আমরা সাধারণ মানুষেরা মেটিরিয়্যালি বিচার করে সাধুসন্ত ফকির দরবেশদের পাগল বলি। কিন্তু স্পিরিচুয়ালি দেখলে, ওটাই স্যানিটি– সুস্থতা।

ঘনশ্যামের কণ্ঠস্বর শোনা গেল : আমরাও পাগল হয়ে যাব শিগগির, যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

সন্দেহজনক শব্দ খুটখাট। বংকুবিহারী বললেন, টর্চ! টর্চ!

কর্নেল ভারি গলায় বললেন, ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে। এমার্জেন্সির জন্য দরকার হবে। আপনি চুপচাপ বসুন তো দারোগাবাবু!

প্রদোষ লাইটার জ্বালল। কিন্তু কিছু দেখা গেল না।

বংকুবিহারী ফের বললেন, আশ্চর্য! দরবেশ নিশ্চয় ঘরে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া করছেন।

ঘনশ্যাম বলল, লোকটা স্বার্থপর। ভণ্ড। চুল্লু-টুলু বোগাস। সব কিছু বোগাস! রিলিজিয়ন ইজ দা ওপিয়াম অফ দা পিপল!

ধুর মশাই! বংকুবিহারী বললেন। আপনি দেখছি কমিউনিস্ট! আজকাল টিচারমাত্রেই কমিউনিস্ট। কেন কে জানে!

ঘনশ্যাম থেমে গেলেন। ব্রজহরি ভাঙা গলায় ডাকলেন, হরিপদ!

 হরিপদ তার পাশেই। বলল, বলুন গুরু!

ব্ৰজহরি বললেন, বৃষ্টি কমলে কর্নেলসায়েব, প্লিজ একবার ওকে নিয়ে গিয়ে দেখবেন– যদি খিচুড়িটা উদ্ধার করা যায়? ডেকচির মুখে ঢাকনা দেওয়া ছিল বলেই বলছি। ইটকাঠ সরিয়ে-টরিয়ে যদি–

ক্লারা বলল, আমাদের কাছে কিছু খাদ্য আছে। মিষ্টান্ন। আপনারা খেতে পারেন।

হরিপদ বলল, জয় গুরু! জয় গুরু!

বংকুবিহারী বললেন, দ্যাটস এ গুড নিউজ ম্যাডাম!

প্রদোষ বলল, নেই। ও ঘরে রেখে গিয়েছিলাম, তখন কেউ খেয়ে ফেলেছে। ক্লারা বলল, সে কী বিচিত্র কথা! এমন হওয়া উচিত ছিল না। তুমি কি সত্যই দেখেছ?

হ্যাঁ। তুমিও গিয়ে দেখতে পার।

বংকুবিহারী ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, চাবকাতে ইচ্ছে করে না? এমন বিপদ আপদের মধ্যেও চোর হতে পারে মানুষ! সে জন্যই তো বলছিলাম, মানুষ বর্ন-ক্রিমিন্যাল।

সায় দিলেন ব্রজহরি। …অনেকাংশে ঠিক। তবে কথাটা অন্যভাবেই বলা উচিত। মানুষ জন্মায় দু ঠেঙে জন্তু হয়ে। অনেক সাধনায় তাকে মানুষ হতে হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতিবোধ– এসব তো সঙ্গে করে কেউ জন্মায় না। তবে মেমসায়েবদের সন্দেশ-ইন্দেশ কে চুরি করে খেয়েছে, আমরা জানি। জেনেও মুখ খোলার উপায় নেই। দা স্যাটান লেট লুজ!

বংকুবিহারী হাঁকরালেন, শাওনি! এ তোর কাজ।

শাওনি বলল, বেশ করেছি। যা পারেন, করুন।

তোকে গুলি করে ভাসিয়ে দেব, হারামজাদি মেয়ে। বংকুবিহারী অভিমানেই বললেন। ক্ষিদেয় প্রত্যেকের নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। অন্তত একটা করে সন্দেশ খেয়ে জল খেলেও ওঃ!

 ঘনশ্যাম বললেন, কিন্তু জল? ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়্যার, বাট নট এ ড্রপ টু ড্রিংক!

আপনি হাসছেন মশাই? বংকুবিহারী তেড়ে গেলেন। একি হাসির সময়?

ব্ৰজহরি বললেন, আহা! ওই কোনায় পোঁতা জালায় জল আছে। খান না!

শাওনি বলল, আমি এঁটো করে রেখেছি। ধম্মপুতুরেরা খাক না বেশ্যার এঁটো জল। সে খি খি করে হাসতে লাগল।

ব্ৰজহরি নড়ে বসলেন। …কী বললি, কী বললি?

শাওনি বলল, শুধু এঁটো? খেয়েছি, খেয়ে হিসি করে দিয়েছি। ধম্মপুত্তুররা খাবে বলে!

এই অশ্লীলতার ধাক্কা প্রথমে লাগল ব্ৰজহরিকে, তারপর চাক্কুকে, তারপর ঘনশ্যামকে, শেষে প্রদোষকেও। ভয়াবহ এই অশ্লীলতা, কারণ ওঁরা ওই জল অ্যালুমিনিয়মের পাত্রে তুলে খেয়েছেন মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। চারজনে একসঙ্গে উঠে এল শাওনির উদ্দেশে। বিদ্যুতের ছটায় ওকে দেখামাত্র চারজনে চ্যাংদোলা করে তুলল। পুঁতি চেঁচাতে থাকল, বানের জলে! বানের জলে!

বাতাসের ঝাপটানি ও বৃষ্টির ভেতর, প্রাঙ্গণে বারবধূটিকে চারজন রাগী পুরুষ, প্রতিশোধবশেই নামিয়ে দিল এবং ঠেলে ফেলে দিয়ে ফিরে এল। ব্রজহরি বারন্দায় এসে বললেন, নজর রাখুন! সারবন্দি দাঁড়ান সবাই! এলেই ভাগিয়ে দেবেন!

শাওনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। দুবার দারোগাবাবুকে চিৎকার করে ডাকল। সাড়া না পেয়ে প্রাঙ্গণে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে চূড়ান্ত অশ্লীল গাল দিতে শুরু করল। ক্লারা হতবাক হয়ে বসেছিল। এতক্ষণে উঠে এসে চেরা গলায় বলল, এটা অমানবিক! আপনারা মানুষ না পশু?

ঘনশ্যাম গর্জন করলেন, শাট আপ ইউ, সি আই এ এজেন্ট!

এতে প্রদোষ চটে গেল। …আপনি মশাই বাড়াবাড়ি করছেন। আমার স্ত্রীকে আপনি

ঘনশ্যাম বাধা দিয়ে বললেন, আপনাদের দুজনকেই অ্যারেস্ট করা হবে। আপনারা কারা আমি জানি!

বংকুবিহারীর গলা শোনা গেল, চুপ করুন তো মশাই! কমিউনিস্টগিরি পরে ফলাবেন।

ক্লারা নেমে গিয়ে শাওনিকে বলল, এস বোন। আমরা পাশের ঘরে থাকব। ঘরের ছাদ ভেঙে পড়বে যখন, পড়বে। যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাব।

শাওনি ওর হাত ছাড়িয়ে হন হন করে চলে গেল। ক্লারা অবাক হয়ে ফিরে এল। কর্নেল ডাকলেন, শাওনি! শাওনি! যেও না- ওটা নেই। খুঁজে পাবে না।

শাওনির সাড়া এল না। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, কী খুঁজে পাবে না কর্নেল?

একটা তালডোঙা।

মাই গুডনেস! তালডোঙা- কোথায় তালভোঙা?

 কর্নেল শুধু বললেন, ছিল।

আহা, ব্যাপারটা খুলে বলুন না মশাই!

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, সকালের জন্য অপেক্ষা করুন। সকালে সব বোঝা যাবে। তারপর একটু হাসলেন। …চুল্লুর ব্যাপার আর কী!

ভ্যাট! আপনিও খালি– রাগে থেমে গেলেন আইনরক্ষক।…