বেড়ালের চোখ

বেড়ালের চোখ

কর্নেলের জার্নাল থেকে

 এপ্রিলের সেই বিকেলে একটা ক্যাকটাসের প্রতীক্ষায় ছিলুম। তিনটে নাগাদ সেটা পৌঁছুনোর কথা। এদিকে চারটে বাজতে চলল।

এ ধরনের প্রতীক্ষা আমার কাছে অসহ্য। পারিজাত নার্শারিতে ফোন করার জন্য রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়েছি, ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। দ্রুত সাড়া দিলুম। তারপর কোনো মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বলছি।

শুনুন। পরিতোষদাদু মানে পরিতোষ দত্ত আপনাকে এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। খুব জরুরি দরকার।

অবাক হয়ে বললুম, পরিতোষ দত্ত? এ নামে তো কাকেও চিনি না।

 নিশ্চয় চেনেন। আপনার নেমকার্ড দিয়ে তিনি আমাকে বাইরে কোথাও থেকে চুপিচুপি ফোন করতে বললেন। শুনুন! আমাকে পরিতোষদাদু বলেছেন, কর্নেলসাহেব এখানকার ঠিকানা জানেন না। আমি যেন জানিয়ে দিই। বরানগরে গঙ্গার ধারে বাড়িটার নাম বিপ্লবী নিকেতন। ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে সেন্ট্রাল সেরামিক রিসার্চ সেন্টারের পাশের গলি। কাকেও জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দেবে। ছাড়ছি।

এক মিনিট, আপনি কে?

বিপ্লবী নিকেতনে চাকরি করি।

নাম বলুন প্লিজ।

ঝর্ণা দাশ। আপনি কিন্তু শিগগির চলে আসুন।..

লাইন কেটে গেল। ঝর্ণা দাশের কথার মধ্যে আবছা কোলাহল আর গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছিল। বোঝা যায়, বাজার এলাকা থেকে ফোন করছেন। হয়তো কোনো দোকান কিংবা পাবলিক বুথ থেকে।

কিন্তু এ এক উটকো উৎপাত। কিছুতেই পরিতোষ দত্তকে আমার মনে পড়ল না, যাকে আমি নেমকার্ড দিয়েছিলুম এবং যিনি থাকেন বিপ্লবী নিকেতন নামে একটি বাড়িতে।

বাড়ির নাম শুনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আবাসন মনে হলো। মোটামুটি বড় আবাসন তো বটেই। কারণ ঝর্ণা দাশ নামে এক মহিলা সেখানে চাকরি করেন। সমবায় আবাসন হতেও পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, কোনো এক পরিতোষ দত্ত আমাকে ফোন করতে বলেছেন বাইরে কোথাও থেকে চুপিচুপি। তার মানে, আবাসন অফিস থেকে ফোন করলে দ্বিতীয় পক্ষ জেনে যেতে পারে।

দ্বিতীয় পক্ষ?

নিজের সিদ্ধান্ত নিজের কাছেই অদ্ভুত মনে হলো। চুরুট ধরিয়ে ভাবতে থাকলুম কী করা উচিত। একটু পরে মনে হলো, এটা কোনো ফাঁদ নয় তো? আমার জীবনে যত বন্ধু, তত শত্রু।

টেলিফোন গাইড তুলে নিলুম। বিপ্লবী নিকেতন খুঁজে বের করা যাবে কিনা জানি না। হয়তো ফোন আছে অন্য কোনো নামে। তবু চেষ্টা করা যাক।

এইসময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠীচরণ এসে সহাস্যে ঘোষণা করল, বাবামশাইয়ের ক্যাকটাস এসে গেছে।

পারিজাত নার্সারির মালিক স্বয়ং চণ্ডীচরণ পাঠক থলে হাতে ঘরে ঢুকে বললেন, সারা পথ জ্যাম সার! বেরিয়েছি আড়াইটেতে। পৌঁছলুম সাড়ে চারটেতে। আপনার শূন্যোদ্যানে গিয়ে কনেবউয়ের ঘোমটা খুলব। বড় লাজুক। বুঝলেন তো?

সুরসিক পাঠকমশাইয়ের সঙ্গে তখনই ছাদের বাগানে চলে গেলুম। তারপর ভুলে গেলুম পরিতোষ দত্তের কথা!…

রাতে এবং পরদিন সকালে ছাদের বাগান-পরিচর্যার সময় পরিতোষ দত্তের ব্যাপারটা নিয়ে একটু-আধটু মাথা ঘামাইনি, তা নয়। কিন্তু কেন যেন উৎসাহ পাচ্ছিলুম না। কত লোকের সঙ্গে কত জায়গায় পরিচয় হয়েছে এবং নেমকার্ড দিয়েছি। এ ভদ্রলোক তাদেরই একজন। দেখা যাক। গরজ থাকলে আবার ঝর্ণা দাশকে দিয়ে তিনি যোগাযোগ করবেন। বোঝাই তো যাচ্ছে, তিনি অতিশয় বৃদ্ধ– আমার চেয়ে সম্ভবত অনেক বেশি। ঝর্ণা তাকে দাদু বলেন। তাছাড়া তিনি নিজে ফোন করতে পারেননি, কাজেই সম্ভবত শয্যাশায়ী কিংবা তত চলাফেরা করতে পারেন না।

বেলা দশটায় খবরের কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে আবার একটা চুরুট ধরিয়েছি, টেলিফোন বাজল। সাড়া দিতেই লালবাজার থেকে ডি সি ডি ডি-ওয়ান, আমার স্নেহভাজন অরিজিৎ লাহিড়ীর সম্ভাষণ শুনতে পেলুম। মর্নিং বস্। একটু বিরক্ত করছি।

বললুম, ডার্লিং! তুমি বিরক্ত করলে বিপন্ন বোধ করি।

আপনি অলরেডি বিপন্ন কর্নেল! আপনাকে পুলিশ ফাসাবে। নরেশ ভদ্র যাচ্ছেন। সঙ্গে একজন এস আই থাকছেন। বরানগর থানার রাধানাথ পালিত।

বরানগর! উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলুম। অরিজিৎ! খুনখারাপি নাকি?

হ্যাঁ। ছাড়ছি বস্। উইশ ইউ গুড লাক।…।

রিসিভার রেখে আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম। কে খুন হয়েছে না জেনেও অপরাধবোধ আমাকে বিব্রত করছিল। ক্যাকটাসটা এসে না পড়লে হয়তো অভ্যাসবশে শেষাবধি বরানগর ছুটে যেতুম। ক্যাকটাসটা দেখছি বড্ড অলক্ষুণে।

আধঘণ্টার মধ্যে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর নরেশ ভদ্র এবং সেই রাধানাথ পালিত এসে গেলেন। রাধানাথ বয়সে তরুণ। পরনে পুলিশের উর্দি। নরেশবাবু প্রৌঢ়। প্লেন ড্রেস। তিনি মাঝে মাঝে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলেন। তবে হালদারমশাইয়ের মতো নাটুকে নন। গম্ভীরও নন। সবসময় হাসিখুশি মানুষ।

নরেশ ভদ্র বললেন, আমি চুপচাপ কফি খামু। যা কইবার, আমার এই ভাইটি কইবে। নতুন চাকরিতে ঢুকছে। ঢুইক্যাই মার্ডার কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। বলে তিনি রাধানাথ পালিতের দিকে তাকালেন। স্টার্ট!

এস আই রাধানাথ পালিত যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই : যে সব স্বাধীনতা সংগ্রামী বৃদ্ধ বয়সে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় একা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, সরকার তাদের জন্য নানা জায়গায় জমি এবং বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। বরানগরে এক একর জমিতে নয়জনের জন্য নয়টি একতলা বাড়ি করা হয়েছিল। লটারি করে এবং কম দামে নয়জন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে এই আবাসন প্রকল্পটি দেওয়া হয়। সমবায় সমিতির ভিত্তিতে দেওয়া এই আবাসন প্রকল্পের নাম বিপ্লবী নিকেতন।

প্রতি বাড়িই স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর এবং ল্যাট্রিন। আশ্রমের মতো পরিবেশ। নয়জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর মধ্যে একজনের নাম পরিতোষ দত্ত। ভোরবেলায় প্রতিদিন তিনি গঙ্গাস্নান করে এসে গীতাপাঠ করতেন। আজ তাকে কেউ বেরুতে দেখেননি বা তার গীতাপাঠও শুনতে পাননি। তাই আবাসন সমিতির চেয়ারম্যান গঙ্গাপ্রসাদ ভাদুড়ি তার খোঁজ নিতে যান। বসার ঘরের দরজা খোলা ছিল। গঙ্গাপ্রসাদবাবু ভেতরে উঁকি দিয়ে চমকে ওঠেন। শোবার ঘরের দরজার কাছে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন পরিতোষবাবু। মাথার পেছনটা রক্তাক্ত। হাঁকডাক শুনে সবাই ছুটে আসেন। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। খুনী সব ঘর তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজেছে। জিনিসপত্র ওলটপালট হয়ে আছে। পুলিশ আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যায়। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরিতোষ দত্তের লাশ মর্গে পাঠায়। কিন্তু রাধানাথ পালিত হঠাৎ লক্ষ্য করেন, আমার নেমকার্ড পরিতোষবাবুর হাতের মুঠোয় ধরা আছে। কার্ডটা ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি দেখতে পান, উল্টোপিঠে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা আছে কাঠমাণ্ডু।

যাই হোক, একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে খুন করা হয়েছে, এই খবর পেয়েই এলাকার এক রাজনৈতিক নেতা সরাসরি লালবাজার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অরিজিৎ লাহিড়ী তখনই আই ও রাধানাথবাবুকে কেসফাইল নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।..

ষষ্ঠী ততক্ষণে কফি এনে দিয়েছিল। নরেশ ভদ্র কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, এবারে কর্নেলসায়েব কী কন শুনি।

বললাম, আমার নেমকার্ডটা কি সঙ্গে এনেছেন রাধানাথবাবু?

নরেশবাবু বললেন, এখন কেস আমাগো হাতে। বলে তিনি বুকপকেট থেকে নেমকার্ডটা বের করে আমাকে দিলেন।

কার্ডটা বিবর্ণ এবং কিনারা ক্ষয়ে বা ফেটে গেছে। অনুমান করলুম অন্তত দশ-বারো কিংবা পনের বছর আগের কার্ড। তারপর উল্টোপিঠের লেখাটা দেখতে দেখতে বললুম, কাঠমাণ্ডু নয়। মনে হচ্ছে কাঠমান্টু।

নরেশ ভদ্র বললেন, অ্যাঁ? কাঠমান্ডু? মান্টু ক্যান?

সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মৃতির অন্ধকার অংশে আলো পড়ল। মনে পড়ে গেল। পরিতোষ দত্তের কথা। হা– বছর পনের আগে ওড়িশার জঙ্গলে আলাপ হয়েছিল তার সঙ্গে। তখন পরিতোষবাবু কাঠের কারবার করতেন। গঞ্জাম জেলার বহরমপুর শহরে কাঠের বাজারকে বলা হতো কাঠমান্টু। সম্ভবত ঝর্ণা দাশকে তিনি এই কথাটিও বলতে বলেছিলেন আমাকে, যাতে আমি তাকে চিনতে পারি। বহরমপুরের কাঠমান্ডুতে তাঁর কাঠগোলা ছিল।

কিন্তু তিনি যে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, সে কথা আমাকে বলেননি।

নরেশবাবু হাসলেন। কর্নেলসায়েবের মুখ বলতাছে, দা মিস্ট্রি ইজ সলভড়।

বললুম, নরেশবাবু! মিস্ট্রি সলভড হয়নি। বরং প্যাচালো হয়ে গেল। কাঠমান্ডু ওড়িয়া শব্দ। আসলে হিন্দি মাণ্ডি শব্দের মানে বাজার। শব্দটা নেপালে গিয়ে হয়েছে মাণ্ডু। কাঠমাণ্ডু। আর ওড়িয়া ভাষায় ওটা দাঁড়িয়েছে মান্টু। কাঠমান্ডু মানে কাঠের বাজার।

নরেশবাবু বললেন, বুঝলাম। কিন্তু আপনার নেমকার্ডের উল্টোপিঠে ভিকটিম কাঠের বাজার বসাইলেন ক্যান?

সেটা বুঝতে হলে আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। বলে উঠে দাঁড়ালুম।

নরেশ ভদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওঠ হে রাধানাথ! যা কইছিলাম, মিলল তো?

.

 বিপ্লবী নিকেতনে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। সারাপথ আমি চুপচাপ বসে পনের বছর আগে পরিতোষ দত্ত নামক এক কাঠব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপের স্মৃতিচর্চায় মগ্ন ছিলুম। কিন্তু তার চেহারা আবছা থেকে যাচ্ছিল। শুধু একটা ব্যাপার স্মৃতিতে ভেসে আসছিল। তিনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তবে তা নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করিনি। এখন বুঝতে পারছি, ব্রিটিশ পুলিশ তার পায়ে গুলি করেছিল।

গেটের কাছে যথারীতি একটা পুলিশভ্যান্ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে একজন পুলিশ অফিসার আর জনা দুই কনস্টেবলকে দেখতে পেলুম। আমাদের দেখতে পেয়ে পুলিশ অফিসারটি এগিয়ে এলেন। নরেশ ভদ্র বললেন, এই যে কাশিমসায়েব! আপনি এখানে ট্রান্সফার হইলেন কবে?

কাশিমসায়েব বললেন, প্রায় একমাস হয়ে গেল সার?

ভাল। কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড তাহলে আপনার কাছে আশা করতে পারি!

না সার! এঁরা সব জেনুইন ফ্রিডম ফাইটার। সত্তর থেকে পঁচাশির মধ্যে বয়স। এ পর্যন্ত কোনো গোলমেলে বা সন্দেহজনক কাজকর্মের খবর আমাদের রেকর্ডে নেই। হা– বাইরে এঁদের অনেককেই সভা-টভায় বিভিন্ন ক্লাব ডেকে নিয়ে যেত। সেটা স্বাভাবিক। বাইরের অনেক লোক মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ করতে আসত। কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা এ যাবৎ ঘটেনি।

রাধানাথ পালিত বললেন, আটজন আবাসিকের স্টেটমেন্ট আমি সকালেই নিয়েছি। কারো কথায় সন্দেহযোগ্য কিছু পাইনি।

কাশিমসায়েব বললেন, সমস্যা হলো, এঁরা কোনো দারোয়ান বা সিকিউরিটির লোক রাখেননি। রাত দশটায় গেটে ভেতর থেকে তালা এঁটে দেন চেয়ারম্যান মিঃ ভাদুড়ি। কোঅপারেটিভ হাউসিং। তাই নামেই একটা অফিস আছে। ওই ছোট্ট ঘরটাতে। একজন মাত্র ক্লার্ক-কাম-টাইপিস্ট। ঝর্ণা দাশ নামে একটি মেয়ে। সে সকাল দশটায় আসে। পাঁচটায় চলে যায়। সেক্রেটারির নাম ভোলানাথ রায়। তিনিও ফ্রিডম ফাইটার এবং আবাসিক। ওই বাড়িটাতে থাকেন। ক্যাশিয়ার গোবিন্দবাবুও তা-ই। তিনি থাকেন ওই শেষদিকের বাড়িতে। খাতাপত্র এবং অডিট রিপোর্ট চেক করেছি। সব অলরাইট।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ঝর্ণা দাশ আজ আসেননি?

কাশিমসায়েব আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। এতক্ষণে নরেশ ভদ্র আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। কাশিমসায়েব অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনিই কর্নেলসায়েব? নমস্কার সার! আপনার কথা আমি শুনেছি। পরিতোষবাবুকে তো আপনি চিনতেন?

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলুম, ঝর্ণা দাশ কোথায়?

এসেছিলেন। কান্নাকাটি করছিলেন। চেয়ারম্যান তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

আপনারা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?

রাধানাথ পালিত বললেন, করেছিলুম। কন্নার চোটে অস্থির। জোরে মাথা নেড়ে বলছিল, সে কিছুই জানে না। কাল বিকেলে পরিতোষবাবু তাকে ওষুধ আনতে পাঠিয়েছিলেন। ওষুধ এনে দিয়ে সে বাড়ি চলে গিয়েছিল।

তার ঠিকানাটা আমাকে দেবেন।

নরেশবাবু বললেন, কেসফাইল আমার হাতে। সব ঠিকানা নেওয়া হয়েছে। মানে, আগে এই ভদ্রলোকেরা কে কোথায় ছিলেন, সে-সব ঠিকানাও রাধানাথ যোগাড় করেছে। আপনি পেয়ে যাবেন। এখন চলুন। ভিকটিমের ঘরে যাওয়া যাক। কাশিমসায়েব! দরজা লক করা থাকলে খুলে দেবেন, চলুন।

পরিতোষবাবুর বাড়িটা পশ্চিমদিকে শেষ প্রান্তে। বাড়ির সামনে তরুণ গাছপালা আর ফুলের বাগান। ভদ্রলোকের প্রকৃতিপ্রেম ছিল। মনে পড়ে গেল। শুধু এটাই অদ্ভুত, একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ওড়িশায় কাঠের কারবার করতেন!

দরজায় হ্যান্ডকাফ আঁটা ছিল। কাশিমসায়েব খুলে দিলেন। বসার ঘরে ঢুকে দেখতে পেলুম, একটা বইয়ের র‍্যাক থেকে বই গুলো তছনছ করা হয়েছে। জানালাগুলো বন্ধ। শোবার ঘরের দরজার ওধারে মেঝেয় খানিকটা রক্তের ছাপ। বিছানা ওলটানো। বালিশ নিচে পড়ে আছে। ঘরে কোনো আলমারি নেই। একটা পুরনো তোরঙ্গের তালা ভেঙে জামাকাপড় আর কিছু কাগজপত্র বের করে খুনী তল্লাশ চালিয়েছে। কগজপত্রগুলো বেশিরভাগই নানা। সংঘের দেওয়া মানপত্র। তার সঙ্গে কিছু চিঠি। চিঠিগুলোতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলুম। বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের লেখা নিছক কুশল বিনিময়। দেয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙানো আছে। সেগুলো ঠিকঠাক আছে। গান্ধীজি, নেহরু, নেতাজি এবং রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রন্নাঘর, স্নানঘর এবং ল্যাট্রিনেও খুনীর তল্লাশের চিহ্ন স্পষ্ট। বেরিয়ে গিয়ে চোখে পড়ল গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে যাওয়ার জন্য একটা দরজা পরিতোষবাবুর বাড়ির পেছনেই আছে। সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে রাধানাথবাবু বললেন, চেয়ারম্যান এবং আরও কজন আবাসিক বলেছেন, দরজাটা ভেজানো ছিল। তার মানে খুনী ওই পথেই পালিয়েছে।

নরেশবাবু বললেন, কিন্তু ঢুকছিল কী ভাবে? কম্পাউন্ড ওয়ালের ওপর তো দেখি কাঁটাতারের বেড়া।

কাশিমসায়েব আঙুল তুলে গঙ্গার দিকে পাঁচিলের বাইরে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন, ওই গাছের একটা ডাল থেকে পা বাড়ালে কাঁটাতারের বেড়া পেরুনো যায়। আমি দেখেছি। পাঁচিলের ওপর একটা ঘষটানো দাগ আছে।

রাধানাথ পলিত সায় দিলেন। নরেশ ভদ্র বললেন, কর্নেলসায়েব দেখবেন নাকি?

বললুম, নাহ। আমাকে এবার ঝর্ণার ঠিকানাটা দিন।

ওনাগো কিছু জিগাইবেন না?

আপনারা স্টেটমেন্ট নিয়েছেন, সেই যথেষ্ট।…

.

ঝর্ণার বাড়ি বাগবাজার এলাকায়। নরেশ ভদ্রের সঙ্গে তাঁর জিপে চেপে ঠিকানাটা খুঁজে বের করলুম। কিন্তু ঝর্ণা বাড়িতে ছিল না। তার মা বললেন, ঝর্ণা কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছে।

অগত্যা বাড়ি ফিরতে হলো। নরেশবাবু আমাকে ইলিয়ট রোডে আমার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। তাঁকে পরিতোষবাবুর লাশ সম্পর্কে মর্গের ফাইনাল রিপোর্টে কী থাকে তা ফোনে জানাতে বললুম।

প্রায় তিনটে বাজে। তিনতলায় আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে দিয়ে ষষ্ঠীচরণ আস্তে বলল, একটা মেয়েছেলে এসে বসে আছে। এত করে বললুম, কথা শুনল না। জোর করে ঢুকে পড়ল। খুব কন্নাকাটি করেছে মনে হলো।

ড্রয়িংরুমের সোফায় মাত্র সরে-আঠারো বছর বয়সী একটি মেয়ে বসে ছিল। আমাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি কি কর্নেলসায়েব? আমার নাম ঝর্ণা। কাল বিকেলে–

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, একটু বসো। আমি ঝটপট খাওয়া সেরে নিই। খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে বলে অভ্যাসমতো সামান্যই খেলুম। তারপর ষষ্ঠীকে কফি পাঠাতে বলে ড্রয়িংরুমে গেলুম।

ঝর্ণা রুমালে চোখ মুছে বলল, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।

কাঠমান্টু?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে সে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সামলে নিল। তারপর বলল, কাল বিকেলে আপনাকে ফোন করে গিয়ে পরিতোষদাদুকে বললুম। উনি আমাকে একখানা বই দিয়ে বললেন, যদি আমার বরাতে কিছু ঘটে, তুমি এই বইখানা কর্নেলসায়েবকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

চটি বইটার নাম জনৈক বিপ্লবীর আত্মচরিত। লেখকের নাম পরিতোষ দত্ত। বইটা গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত। পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি, এক টুকরো কাগজ ভেতরের পাতা থেকে মাথা উঁচিয়ে আছে। সেই পাতা উল্টে দেখলুম, ডটপেনে লেখা আছে :

১৯৪২ সালের আগস্ট বিপ্লবের সময় সত্যকাম রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। কাথিতে ঝড়বৃষ্টির রাত্রে ট্রেজারি লুণ্ঠনের সময় সে আমার সঙ্গে ছিল। তার চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু সম্প্রতি বিপ্লবী নিকেতনে যাকে সত্যকাম রায় নামে দেখলাম, সে কখনও সেই সত্যকাম নয়। অথচ সরকারি তাম্রফলক দেখেছি তার ঘরে। আমি তাকে চার্জ করেছিলাম। সে বলল, একই নামে কি দুজন বিপ্লবী থাকতে পারে না? এদিকে গঙ্গাপ্রসাদ ভাদুড়ি একদিন কথায়-কথায় বলছিলেন, সত্যকামবাবু কাঁথি ট্রেজারি লুণ্ঠনের মূল নায়ক। আমি মুখ বুজে থাকলাম। তাম্রপত্রে এই ঘটনার ঈষৎ উল্লেখ আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই লোকটি জাল সত্যকাম। নিশ্চয় সে সত্যকামের তাম্রফলক চুরি করেছিল। আমার এই আত্মজীবনীর একটি কপি এনে বাকি কপিগুলি প্রকাশক আমার দূরসম্পর্কের নাতি অজয়প্রকাশের কাছে গোপনে রেখে দিয়েছি। আমার মৃত্যুর পর তাকে বইটি বাজারে ছাড়তে বলেছি।

এই পাতায় ছাপা হরফে কাথি ট্রেজারি লুঠের বিস্তারিত বিবরণ আছে। কিন্তু এই টুকরো কাগজে পরিতোষবাবুর আঁকাবাঁকা হরফে লেখা ওই কথাগুলোই আমার পক্ষে যথেষ্ট।

যথেষ্ট। কিন্তু শুধু এই কারণেই কি জাল সত্যকাম তাকে খুন করে ফেলবে? নাহ্। খটকা থেকে যাচ্ছে।

ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করলুম, তুমি বইটা কি পড়েছ?

সে বলল, কাল রাত্রে পড়েছি।

এই কাগজটা?

পড়েছি। সত্যকাম রায় বিপ্লবী নিকেতনে আছেন। বদমেজাজি লোক। কারও সঙ্গে তত মেলামেশা করেন না।

কিন্তু তুমি পুলিশকে আজ এসব কথা জানাওনি কেন?

ভয় পেয়েছিলুম। আমি মোটে সাড়ে সাতশো টাকা মাইনে পাই। আমরা খুব গরিব। মাধ্যমিক পাশ করতে পারিনি। এম এল এ বাবুকে ধরে এই চাকরিটা পেয়েছি।

তুমি আবার অফিস যাচ্ছ কবে থেকে?

সেক্রেটারি দাদু কাল থেকে যেতে বলেছেন।

 ঠিক আছে। তুমি কাল থেকে যথারীতি অফিসে যাবে। ঘুণাক্ষরে এ সব কথা কাকেও বলবে না। আর শোনো! দরকার হলে আমাকে ফোন করবে। তোমাকে নেমকার্ড দিচ্ছি না। নাম্বারটা লিখে দিচ্ছি।..

ঝর্ণা চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পরে নরেশ ভদ্র টেলিফোনে জানালেন, মর্গের ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভোতা কিন্তু একটু সূচালো জিনিস দিয়ে পরপর দুবার পরিতোষবাবুর মাথার পেছনে আঘাত করার ফলে মৃত্যু হয়েছে।

ভোঁতা। কিন্তু একটু সূচলো জিনিস! সেটা কী হতে পারে? নরেশবাবুকে আমি কাল সকাল দশটায় আসতে বললুম। তারপর কফি খেয়ে সত্যকাম রায়ের আগের ঠিকানা টালিগঞ্জ এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লুম।

একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে দোতলা বাড়ি। নিচের তলার ভাড়াটে অধীর গাঙ্গুলি বললেন, সত্যকামবাবুকে আমি পাশের একটা ঘর সাবলেট করেছিলুম। কমাস আগে উনি ঘর ছেড়ে দিয়ে কোথায় গেছেন জানি না।

অনেক কথাবার্তা বলেও নতুন কোনো তথ্য জানা গেল না। অধীরবাবু তাকে ফ্রিডম ফাইটার বলে জানতেন। দেয়ালে তাম্রফলক দেখেছিলেন। সরকার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পেনসন পেতেন।

বাড়ি ফিরে পরিতোষবাবুর আত্মজীবনী পড়তে বসলুম। কঁথি ট্রেজারি লুঠের বিবরণ পড়তে পড়তে একখানে থমকে যেতে হলো। পরিতোষবাবু লিখেছেন, ট্রেজারি লুণ্ঠনে নগদ টাকা ছাড়াও অনেকগুলি স্বর্ণপিণ্ড হস্তগত হয়েছিল। সেগুলি পরে আমাদের কেন্দ্রীয় কোষাগারে গোপনে রাখা হয়। কিন্তু নভেম্বর মাসে পুলিশ অতর্কিতে হানা দিয়ে স্বর্ণপিণ্ডগুলি উদ্ধার করে। আমরা তখন নানা অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলাম। তবে সত্যের খাতিরে বলছি, একটি কৌটায় একখণ্ড বহুমূল্য রত্ন ছিল। সেটি আমি কৌতূহলবশত নিজের কাছে। লুকিয়ে রেখেছিলাম। রাত্রে কৌটা খুলে দেখতাম, রত্ন থেকে নীল আভা ঠিকরে পড়ছে। সম্ভবত এটি বৈদূর্যমণি। আমার কোষ্ঠি অনুসারে বৈদূর্যমণি আমার জীবনে হিতকারী রত্ন। সত্যই তাই। পাঁচ বৎসর পরে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলো। আমি ওড়িশার বহরমপুরে কাষ্ঠব্যবসায়ী নিত্যানন্দ জেনার বাড়িতে ছিলাম। তিনিই আমাকে সারাণ্ডা অরণ্যে ঠিকাদারের কাজে সঙ্গী করেছিলেন। ক্রমে আর্থিক সচ্ছলতা আসার পর আমি স্বাবলম্বী হলাম। বৈদূর্যমণিটি কিন্তু আমি বিক্রয় করিনি। গোপনে এমনভাবে তা রেখেছিলাম, কারও সাধ্য ছিল না তা খুঁজে বের করতে পারে। রত্নটি অদ্যাবধি আমার কাছে আছে। তারই গুণে লটারিতে আমার নাম উঠেছিল এবং বিপ্লবী নিকেতনে বাকি জীবনের জন্য ধর্মকর্মে মন দিয়ে শান্তিতে কাটানোর সুযোগ পেয়েছি।

এ পর্যন্ত পড়েই বইটা বন্ধ করলুম। প্রথমেই সন্দেহ হলো, ঝর্ণা দাশ জাল সত্যকামের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেনি তো? মুখ আর হাবভাব দেখে মানুষের কিছু বোঝা যায় না।

ঘড়ি দেখলুম, রাত নটা বাজে! অরিজিৎকে টেলিফোন করলুম তার বাড়িতে। সাড়া দিয়ে সে বলল, বলুন বস্!

অরিজিৎ! আজ রাতেই দুটি বাড়িতে হানা দিয়ে তল্লাশ করা দরকার।

কী ব্যাপার?

একটা বৈদূর্যমণি পরিতোষবাবুকে খুনের কারণ।

 বলেন কী? কিন্তু কোথায় হানা দিতে বলছেন?

একই সঙ্গে ঝর্ণা দাশের বাড়ি এবং বিপ্লবী নিকেতনে সত্যকাম রায়ের বাড়িতে। জিনিসটা না পেলেও দুজনকে জেরা করার জন্য আটক করা দরকার। দিস ইজ আর্জেন্ট।

ও কে বস। কিন্তু দেখবেন একজন ফ্রিডম ফাইটারকে ধরে টানাটানি করে ফেঁসে না যাই।

নাহ অরিজিৎ! ভদ্রলোক জাল সত্যকাম রায়।

অ্যাঁ? এত সব ব্যাপার?

দেরি নয় কিন্তু। রত্নটা না পাওয়া গেলেও জাল সত্যকাম রায় একটা বড় কেস হবে।

ঠিক আছে।…

সকালে ফোন এল অরিজিৎ লহিড়ীর। রত্নটত্ন কিছু পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক চাপে ঝর্ণাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জেরা করে ঝর্ণার কাছে কিছু জানা যায়নি। ভীষণ কান্নাকাটি করেছে শুধু। তবে সত্যকামের পরিচয় জানা গেছে দাগী ফেরারিদের তালিকা এবং ছবি থেকে। তার নাম ভানু মহন্ত। বাড়ি মেদিনীপুরে। ব্রিটিশ আমলে পুলিশের চর ছিল। আগস্ট বিপ্লবের সময় পুলিশকে সাহায্য করেছিল। জাল বিপ্লবী সেজে সে বিপ্লবীদের দলে ভিড়েছিল কিছুকাল।

বুঝলুম, তা হলে তার পক্ষে পরিতোষবাবুর হাতানো রত্নের খবর জানার একটা সুযোগ ছিল।

কিছুক্ষণ পরে নরেশ ভদ্র এলেন। কী যে করেন কর্নেলসায়েব! খামোকা মাইয়াডারে লইয়া টানাটানি। খালি কান্দে আর কান্দে।

হাসতে হাসতে বললুম, তাহলে ঝর্ণার কান্নায় রত্ন ঝরল না?

নাহ্। তবে ভানু মহন্তরে এতদিনে খুঁইজা পাইলাম। আপনার ক্রেডিট।

 চলুন। শেষ চেষ্টা করা যাক।

 যাবেন কই?

বিপ্লবী নিকেতনে।…

সেখানে গিয়ে দেখি সাতজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর জরুরি বৈঠক চলেছে অফিসঘরে। আমাদের দেখে ওঁরা খুব ঘটা করে অভ্যর্থনা জানালেন। চেয়ারম্যান উত্তেজিতভাবে বললেন, সত্যকামের ওপর আমার বরাবর একটু সন্দেহ ছিল। তাকে আমি শেষবার দেখেছিলুম বারাসতে একটা সভায়। সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। তারপর দেখলুম এখানে। অন্যরকম চেহারা। আসল সত্যকাম ছিল রোগা বেঁটে। আর এই জাল সত্যকাম বেঁটে হলেও রোগা নয়। চুলও তত সাদা নয়। এ কী করে হয়?

এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে ফাইল ঘাঁটছিলেন। ফ্যানের হাওয়ায় কাগজপত্র উড়ে যাচ্ছে দেখে তিনি পেপারওয়েট খুঁজতে থাকলেন। বললেন, মলোচ্ছাই! সেই নতুন পেপারওয়েটটা গেল কোথায়?

অমনি আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, মোটা এবং মাথার দিকটা একটু সূচালো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে উনি আমার দিকে তাকালেন।

বললুম, ওটা সম্ভবত গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। কারণ ওটাই ছিল মার্ডার উইপন।

সবাই নড়ে উঠলেন। তারপর চেয়ারম্যান গঙ্গাপ্রসাদবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, তিনটে ভারী পেপারওয়েট ছিল। সেগুলো গোল আর চ্যাপ্টা। কদিন আগে একটা পেপারওয়েট কেনা হয়েছিল। ডিমালো গড়নের এবং বেশ ভারী। নেই সেটা?

সেই ভদ্রলোক বললেন, নাহ। ঝর্ণা চারটে পেপারওয়েট এই ড্রয়ারেই রাখত দেখেছি।

নরেশবাবুকে ডেকে নিয়ে বাইরে গেলুম। বললুম, চলুন। পরিতোষবাবুর ঘরটা আবার দেখে যাই। দৈবাৎ বেড়ালের চোখ না দেখতে পাই, লেজের ডগাটুকুই যথেষ্ট। বৈদূর্যমণিকে ইংরেজিতে বলে ক্যাটস আই।

দরজার কড়ায় যথারীতি হাতকড়া আঁটা ছিল। নরেশবাবু খুলে দিয়ে বললেন, রত্ন-উত্ন আর থাকার কথা নয়। মহন্ত মহা ধড়িবাজ ঘুঘু। আর বেড়ালের চোখ কইলেন। মহন্ত কিন্তু নিজেই বেড়ালচোখো।

পরিতোষবাবুর ঘর তেমনি লণ্ডভণ্ড অবস্থায় থেকে গেছে। দেয়ালে লটকানো বরেণ্য দেশনেতাদের ছবি। গান্ধীজি, নেহরু, নেতাজি এবং রবীন্দ্রনাথ। ভানু মহন্ত কেন কে জানে ছবিগুলোর দিকে নজর দেয়নি। গান্ধীজি এবং নেহরুর ছবি খুলে নেতাজির ছবি ভোলার চেষ্টা করলুম। খোলা যাচ্ছিল না। নিচের দিকটা শক্ত হয়ে আটকানো আছে। জোরে টান দিতেই ছবিটা প্রায় উপড়ে এল। নিচের ফ্রেমটা দেয়ালে আটকে থাকল। কিন্তু তখনই চৌকো একটা গর্তে একটুকরো ইট ঢোকানো আছে দেখা গেল। ইটটা টেনে বের করলুম। তারপর ভেতর থেকে খুদে একটা কৌটো বেরুলো। খবরের কাগজে মোড়া সেটা। মোড়ক খুলে দেখি, লাল ভেলভেটে মোড়া পিসবার্ডের কৌটো। তার ভেতর একটুকরো উজ্জ্বল ধাতু। নীল ছটা ঠিকরে পড়ছিল।

নরেশবাবু বললেন, আপনি জানতেন? কী কাণ্ড!

বললুম, নাহ্। তবে আগস্ট বিপ্লব এবং নেতাজি এই দুটো কথা যেন একই কথার দুই পিঠ। তাই চান্সটা ছিল। গতকাল কে জানে কেন, নেতাজির ছবিটা আমার বেশি করে চোখে পড়েছিল।

নরেশ ভদ্র হেসে উঠলেন। এরেই কয় পিওর ম্যাথ। বিশুদ্ধ গণিত।..