১৪. ভদ্রশীল ও ধনুধ্বজের উপাখ্যান

ভীষ্মদেব বলিলেন শুন কুন্তীসুত।
যমের দক্ষিণ দ্বার বড়ই অদ্ভূত।।
পূর্ব্বে যাহা শুনিলাম দেবলের মুখে।
অবহিত হ’য়ে আমি বলিব তোমাকে।।
ভদ্রশীল নামে ঋষি অযোধ্যায় স্থিতি।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ গুণে মহামতি।।
যজন যাজন বেদ করি অধ্যয়ন।
নানামতে অর্জ্জিত নানারূপ ধন।।
ধনুধ্বজ রক্ষণ হেতু রাখিল তাহারে।
গোধন রক্ষণ হেতু রাখিল তাহারে।।
পূর্ব্বেতে অবন্তী নামে ব্রাক্ষণ সে ছিল।
ভ্রাতৃশাপে চণ্ডালের কুলেতে জন্মিল।।

এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
দ্বিজ হয়ে চণ্ডাল হইল কি কারণ।।
ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।
ইক্ষাকু বংশের গুরু শান্তি তপোধন।।
সুবন্তী অবন্তী তাঁর দুইটি নন্দন।
স্বধর্ম্ম অধর্ম্ম তারা করে দুইজন।।
মহাধর্ম্মশীল হৈল সুবন্তী কুমার।
দুরাত্মা অবন্তী হৈল মহা পাপাচার।।
নিজ ধর্ম্ম ছাড়িয়া করিল কদাচার।
চুরি হিংসা পাপ করে, হরে পরদার।।
বহুমতে সুবন্তী করিল নিবারণ।
না শুনিল ভ্রাতৃবাক্য পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।।
ক্রুদ্ধ হয়ে সুবন্তী শাপিল সেই ক্ষণ।
না শুনিলে মম বাক্য করিলে হেলন।।
এই পাপে জন্মান্তরে চণ্ডাল হইবে।
অনন্তরে যমদূত হইয়া জন্মিবে।।
ব্রাহ্মণ হইতে পুনঃ হইবে মোচন।
এত শুনি অবন্তী হইল ক্রুদ্ধমন।।
দণ্ডক কাননে প্রবেশিল সেইক্ষণ।
তপস্যা করিল তবে শান্তির নন্দন।।
অনাহারে আপনি ত্যাজিল কলেবর।
সেইত অবন্তী হৈল শ্বপচকুমার।।
ভদ্রশীল ব্রাহ্মণের হইল রাখাল।
যতন পূর্ব্বক রাখে গোধনের পাল।।
তাহার পালনে গাভী ব্যাধি নাহি জানে।
ভদ্রশীল ব্রাহ্মণে তুষিল নিজগুণে।।
কতদিনে সর্পের দংশনে সে মরিল।
শুনি ভদ্রশীল দ্বিজ শোকার্ত্ত হইল।।
পুত্রশোকে পিতা যেন করয়ে রোদন।
সেইরূপ দ্বিজ বহু করিল শোচন।।
খণ্ডন না যায় কভু মুনির উত্তর।
সেই ধনুধ্বজ হৈল যমের কিঙ্কর।।

একদিন ধনুধ্বজ যমের আজ্ঞায়।
সুশীল নামেতে বৈশ্য আনিবারে যায়।।
পথে ভদ্রশীল সহ হৈল দরশন।
দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত হৈল তপোধন।।
জিজ্ঞাসিল কহ তুমি আছিলা কোথায়।
মরিয়া কিরূপে পুনঃ আইলা ধরায়।।
মরিলে না জীয়ে লোক ব্রহ্মার সৃজন।
মরিয়া কিরূপে পুনঃ পাইলে জীবন।।
সেই হস্ত সেই পদ সেই কলেবর।
আকৃতি প্রকৃতি সেই পরম সুন্দর।।
এত শুনি প্রণমিয়া বলেন বচন।
সেই ধনুধ্বজ আমি শ্বপচনন্দন।।
নিজ কর্ম্মফলে হই যমের কিঙ্কর।
পূর্ব্বে তুমি আমারে পালিলে বহুতর।।
নমো জগৎগুরু ব্রহ্ম প্রণতপালন।
নমস্তে ব্রাহ্মণমূর্ত্তি পতিত তারণ।।
কৃপা করি দিলা মম গোধন রক্ষণে।
পুনর্জ্জন্ম খণ্ডন না হল সে কারণে।।

এত শুনি বিস্ময় মানিল তপোধন।
জিজ্ঞাসিল কহ শুনি যমের কথন।।
কিরূপেতে জন্মে জীব মায়ের উদরে।
কিরূপেতে তনু ত্যাগ করে আরবারে।।
জন্মেতে যতেক ধর্ম্ম অধর্ম্ম আচার।
কিরূপেতে কর্ম্মভোগ করায় তাহার।।
দূত বলে সেই কথা কহিতে বিস্তার।
সংক্ষেপে কহিব কিছু শুন সারোদ্ধার।।
মায়ের উদরে জীব শৃঙ্গার পরশে।
ঋতুর সংযোগে জন্ম জনক ঔরসে।।
পঞ্চ রাত্রি গতে হয় বদ্বুদ প্রমাণ।
পক্ষান্তরে হয় জীব বদরী সমান।।
মাসেক অন্তরে হয় অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ।
হস্ত পদ নাহি মাংসপিণ্ডের সমান।।
দ্বিতীয় মাসেতে হয় মস্তক উৎপত্তি।
তৃতীয় মাসেতে হয় হস্ত পদাকৃতি।।
চতুর্থ মাসেতে কেশ লোমের জনম।
পঞ্চম মাসেতে তনু বাড়ে ক্রমে ক্রম।।
ষষ্ঠ মাসে ভ্রমে জীব মায়ের উদরে।
চতুর্দ্দিকে ঘোর অগ্নি দহে কলেবরে।।
সপ্তম মাসেতে জীব নানা ক্লেশে রয়।
ক্ষণেক চৈতন্য পেয়ে উদরে ভ্রময়।।
মায়ের ভোজন রসে বাড়ে দিনে দিনে।
অষ্টমাসে দিব্যজ্ঞান আপনারে জানে।।
জন্ম জন্মান্তরে যত করেছিল পাপ।
তাহার স্মরণে হয় জ্ঞানের প্রতাপ।।
স্মরিয়া সে সব পাপ করয়ে ক্রন্দন।
আপনারে নিন্দা করি বলয়ে বচন।।
অধম পাপিষ্ঠ আমি বড় দুরাচার।
কেন না ভজিনু কৃষ্ণ সংসারের সার।।
এইবার জন্মি প্রভু ভজিব তোমারে।
জ্ঞানদাতা জ্ঞান নাহি হরিও আমারে।।
এইরূপ দশমাস অবধি নির্ণয়।
জন্মমাত্রে মহামায়া জ্ঞান হরি লয়।।
জ্ঞানহত হবা মাত্রে করয়ে রোদন।
জননীর স্তনপানে বাড়ে অনুক্ষণ।।
যুগধর্ম্মে যথা আয়ু বিধির নির্ণয়।
তাহাতে অধর্ম্ম হৈল আয়ু যায় ক্ষয়।।
অধর্ম্মের ফলে লোক মরে বাল্যকালে।
যৌবনে মরয়ে কেহ অধর্ম্মের ফলে।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম ফলে মরে অর্দ্ধেক বয়সে।
বৃদ্ধকালে মরে লোক অদৃষ্টের বশে।।
সর্ব্বকালে আছে মৃত্যু নাহিক এড়ান।
ছোট বড় সর্ব্ব জীব একই সমান।।
চুরি হিংসা মিথ্যা কহি পোষে সুত দার।
মৃত্যুকালে বেড়িয়া কান্দয়ে পরিবার।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম জানিয়া তাহার আচরণ।
বিচারিয়া ধর্ম্মরাজ করয়ে তাড়ন।।
যাহা করে তাহা ভোগ নাহিক এড়ান।
সংক্ষেপে কহিনু জীব কর্ম্মের বাখান।।

এত শুনি হাসিয়া বলয়ে দ্বিজবর।
এক সত্য কর তুমি আমার গোচর।।
কেমন যমের পুরী দেখাবে আমারে।
এত শুনি ভাবি দূত কহিছে তাহারে।।
যমের বিষম পুরী বিপুল বিস্তার।
দেখিবারে ইচ্ছা যদি হইল তোমার।।
যত পিতৃ পিতামহ ঋণে বদ্ধ আছ।
আপনি যতেক ঋণ লোকেরে দিয়াছ।।
ক্রমে ক্রমে সব ঋণ করহ শোধন।
তবে সে লইতে পারি যমের সদন।।
ঋণগ্রস্ত জনের না হয় তথা গতি।
যদি বা তথায় যায় ভুঞ্জয়ে দুর্গতি।।

এত শুনি ভাবি দ্বিজ বলয়ে বচন।
আজি আমি সর্ব্বঋণ করিব শোধন।।
অঋণী হইব আমি তোমার বচনে।
পুনরপি তোমাকে পাইব কোন স্থানে।।
দূত বলে দ্বিজ তুমি হইলে অঋণী।
খট্বাতে গৃহের মধ্যে শুইবে আপনি।।
দুয়ারেতে খিল দিয়া করিয়া শয়ন।
সুত দারা সবাকে করিবে নিবারণ।।
পুনঃ পুনঃ সবাকে কহিবে এই বাণী।
তিন দিন গত হলে ঘুচাবে খিলনি।।
ইতিমধ্যে যদি কেহ ঘুচায় দুয়ার।
নিশ্চয় হইবে তবে আমার সংহার।।
এইরূপে সবাকারে কহিবে বচন।
সত্য কহি দেখাইব যমের সদন।।

এত বলি অন্তর্দ্ধান হৈল সেইক্ষণ।
আনন্দেতে দ্বিজ গৃহে করিল গমন।।
পিতা পিতামহ হৈতে যত ঋণ ছিল।
ক্রমে ক্রমে ভদ্রশীল সকল শুধিল।।
আপনিও যত ঋণ দিয়াছিল লোকে।
সর্ব্বলোকে বলিলেক পরম কৌতুকে।।
যার ধারি লহ ঋণ যেবা ধার দেহ।
এই ভিক্ষা মাগি আমি কর অনুগ্রহ।।
এইরূপ সর্ব্বলোকে কহিয়া বচন।
ক্রমে ক্রমে যত ঋণ করিল শোধন।।
অঋণী হইল দ্বিজ আনন্দিত মন।
দারাসুত সবাকারে কহিল বচন।।
তিন দিবসের মত শুইব গৃহেতে।
কদাচিত কেহ মোরে না যাবে তুলিতে।।
যদ্যপি আমার বাক্য করহ অন্যথা।
তবেত আমার মৃত্যু না হয় সর্ব্বথা।।
এতেক বচন দ্বিজ কহি সুত দারে।
আনন্দেতে নিদ্রা গেল ঘরের ভিতরে।।
দ্বিজে সত্য করি দূত সুস্থ নাহি মনে।
বৈশ্যেরে লইয়া গেল যমের সদনে।।

এত বলি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কিরূপেতে যম তারে করিল তাড়ন।।
আচন্বিতে মৃত্যু তার হৈল কিরূপেতে।
ইহার বিধানে দেব কহিবে আমাতে।।
শুনিয়া কহেন হাসি ভীষ্ম মহাশয়।
কীর্ত্তিমন্ত নামে এক বৈশ্যের তনয়।।
সুশীল তাহার পুত্র বিখ্যাত জগতে।
তার সম ধনে বৈশ্য নাহি পৃথিবীতে।।
তড়াগ পুকুর বিল দিল শত শত।
লিখনে না যায় দ্বিজ দান দিল যত।।
ক্রোধের সমান রিপু নাহি সংসারেতে।
দানকালে এক দ্বিজে চাহিল ক্রোধেতে।।
জগতের গুরু দ্বিজ চিনিয়া না চিনে।
ধনে মত্ত হয়ে চাহে সক্রোধ নয়নে।।
ক্রোধে দ্বিজ তার দান কিছু না লইল।
ক্রোধে দ্বিজ তারে শাপ সেইক্ষণে দিল।।
দান দিয়া ক্রোধ মোরে কর পুনর্ব্বার।
এই পাপে অপমৃত্যু হইবে তোমার।।
এত বলি নিজ স্থানে গেল তপোধন।
বিরস বদন হৈল বৈশ্যের নন্দন।।
একদিন নিত্যকৃত্য হেতু সন্ধ্যাকালে।
গোষ্ঠ দিয়া যায় বৈশ্য রেবা নদীকূলে।।
দৈবযোগে ষণ্ড এক বিক্রম করিয়া।
বৈশ্যের হরিল প্রাণ শৃঙ্গেতে চিরিয়া।।
যমের আজ্ঞায় তবে যমের কিঙ্কর।
বৈশ্যেরে লইয়া গেল যমের গোচর।।
কপট করিয়া যম জিজ্ঞাসিল তারে।
তোমা হেন পুণ্য কেহ না করে সংসারে।।
তুমি পুণ্যবান, দান করিলে বিস্তর।
তড়াগ পুষ্কর্ণি কূপ দিলে বহুতর।।
দেবঋণে পিতৃঋণে হইলে মোচন।
নানা যজ্ঞ করি আরাধিলে পদ্মাসন।।
কিছুমাত্র তব পাপ আছে হৃদিমাঝে।
ক্রোধদৃষ্টে তুমি চাহি ছিলা এক দ্বিজে।।
যাহা অর্জ্জি তাহা ভুঞ্জি বেদের বচন।
পাপ পুণ্য দুই ভোগ নাহিক মোচন।।

এত শুনি বৈশ্য বলে বিনয় বচন।
অল্প আছে যদি পাপ করিব ভুঞ্জন।।
যম বলিলেন পড় হ্রদের ভিতরে।
চিরকাল থাক তথা কুম্ভীর শরীরে।।
দেবল ঋষির সঙ্গে হৈলে দরশন।
তবে পাপভোগ তব হইবে খণ্ডন।।
এত শুনি হ্রদমধ্যে পড়ে সেই ক্ষণে।
গ্রাহরূপী হইয়া রহিল কতদিনে।।
রামহ্রদ নামে সেই পুণ্য তীর্থবর।
কুম্ভীর শরীর তাহে হৈল ভয়ঙ্কর।।
নর নারী পশু পক্ষী আদি যত জন।
সলিল স্পর্শন মাত্র করয়ে ভক্ষণ।।
তার ভয়ে কেহ নাহি হ্রদ পরশয়।
কত দিনে আইল দেবল মহাশয়।।
ম্নান করি হ্রদে তপ করে তপোধন।
হেনকালে গ্রাহ আসি ধরিল চরণ।।
মুনির পরশ মাত্র দিব্যমূর্ত্তি চরণ।
দেব পূজ্যমান হয়ে স্বর্গেতে চলিল।।

এত শুনি আনন্দিত হৈল নৃপমণি।
পুনরপি জিজ্ঞাসেন করি যোড়পাণি।।
অতঃপর কহ দেব দ্বিজের কথন।
কিরূপে যমের সভা করিল দর্শন।।
ভীষ্ম কন শুন কহি ধর্ম্মের নন্দন।
যতেক দেখিল তাহা না হয় বর্ণন।।
দক্ষিণ দুয়ারে লয়ে গেল দ্বিজবরে।
দেখিয়া যমের পুরী বিস্ময় অন্তরে।।
পুরীষের হ্রদ কোথা দেখে শত শত।
লিখনে না যায় পাণী তাহে আছে যত।।
কোন স্থানে উষ্ণজল বহে জলধর।
তপ্ত তৈল বৃষ্টি কোথা হয় নিরন্তর।।
কোন স্থানে স্নিগ্ধজল আছে থরে থর।
তাহাতে পড়িয়া পাপী কান্দয়ে বিস্তর।।
কৃমি হ্রদ কোন স্থানে দেখি ভয়ঙ্কর।
ক্ষারজল বৃষ্টি কোথা হয় নিরন্তর।।
কোন স্থানে বৃষ্টি শীতে কাঁপে কলেবর।
কোন স্থানে অগ্নিবৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর।।
কোন স্থানে দূতগণ ভয়ঙ্কর কায়।
যতেক দুর্গতি করে লিখন না যায়।।
হাতে পায়ে বান্ধিয়া আনয়ে কোনজনে।
প্রহারে পীড়িত তনু কাতর রোদনে।।
এইরূপে শত শত অসংখ্য যাতনা।
ভুঞ্জায়েন ধর্ম্মরাজ না হয় বর্ণনা।।
দেখি সবিস্ময় হইলেন তপোধন।
পুরীর দুয়ারে তবে করিল গমন।।
দ্বার পার হয়ে চলিলেন তপোধন।
মনে করে যমেরে করিব দরশন।।
কোন মুর্ত্তি ধরে যম কেমন বরণ।
হেনকালে ডোমনীর সঙ্গে দরশন।।
কেশিনী তাহার নাম জন্মান্তরে ছিল।
যমের কিঙ্করী আসি মরিয়া হইল।।
দশ গণ্ডা কড়িতে বিক্রীত কুলাখানি।
হাটে তার ঠাঁই লয়েছিল দ্বিজমণি।।
পাঁচ গণ্ডা কড়ি দিয়া কুলা লয়েছিল।
বাকী পাঁচ গণ্ডা ধার শুধিতে নারিল।।
দুইবার তিনবার দ্বিজস্থানে গেল।
ধারিয়া না দিল তারে মনে পাসরিল।।
দৈবযোগে দেখা তার ডোমনী পাইল।
ধাইয়া সত্বরে আসি বসনে ধরিল।।
ক্রোধেতে ব্রাহ্মাণে চাহি বলয়ে বচন।
সেই ভদ্রশীল তুই ‍পাপীষ্ঠ দুর্জ্জন।।
পাঁচ গণ্ডা কড়ি মম ধারিয়া না দিলে।
তাহার উচিত ফল পাবে এই কালে।।
ভাল চাহ যদি তবে যাহ কড়ি দিয়া।
নতুবা তোমার আত্মা লইব কাড়িয়া।।

দ্বিজ বলে হেথা আমি কড়ি কোথা পাব।
ছাড়ি দেহ, কড়ি ঘর হৈতে আনি দিব।।
ভাবিয়া ডোমনী বলে নাহিক এড়ান।
কড়ি দেহ, নহে তোমা লইব পরাণ।।
এতেক শুনিয়া দ্বিজ হইল ফাঁপর।
ক্রোধে ধনুধ্বজ দূত করিল উত্তর।।
সেইকালে দ্বিজবর কহিনু তোমারে।
যে কালে আসিতে তুমি ইচ্ছিলা এথারে।।
পাঁচ গণ্ডা ধার যদি ধারহ কাহার।
তবে সে প্রমাদ দ্বিজ হইবে তোমার।।
অঙ্গীকার করি তুমি বলিলে তখন।
যত ধার আছে তাহা করিব শোধন।।
ব্রাহ্মণ জগৎগুরু পুরাণে বাখানে।
এমত তোমার আছে জানিব কেমনে।।
নাহিক এড়ান তব হইল প্রলয়।
ব্রহ্মহত্যা পাপ মোরে ফলিল নিশ্চয়।।

এতেক শুনিয়া দ্বিজ বলয়ে করুণে।
পাসরিয়া ছিনু এত জানিব কেমনে।।
তবে ধনুধ্বজ দূত ভাবে মনে মন।
ডোমনীরে চাহি বলে বিনয় বচন।।
না করিহ বধ, ছাড়ি দেহ গো ব্রাহ্মণে।
দ্বিজবধ মাহপাপ সর্ব্বশাস্ত্রে ভণে।।
দূতের বচনে হাসি বলয়ে ডোমনী।
তবে সে ছাড়িয়া আমি দিব দ্বিজমণি।।
কুলার প্রমাণ বক্ষচর্ম্ম কাটি ক্ষূরে।
এইক্ষণে দ্বিজবর দিউক আমারে।।
নহে আপনার অঙ্গ করিয়া ছেদন।
দেহ মোরে কুলার প্রমাণ এইক্ষণ।।
নহে বা দ্বিজের ধার ধারে যেই জন।
তাহারে আনিতে পার আমার সদন।।
তবে এই ধার আমি লই তার স্থান।
ইহা ভিন্ন দ্বিজ আর নাহিক এড়ান।।

এতেক শুনিয়া দ্বিজ হইল সত্বর।
দূতের সহিত তথা ভ্রমিল বিস্তর।।
আপনার ধারগ্রস্ত না দেখি কাহারে।
চিত্তেতে আকুল হয়ে চিন্তিল অন্তরে।।
নেত্র মুদি দিব্যজ্ঞান করিলেক ধ্যান।
জনার্দ্দন বিনা ইথে নাহি পরিত্রাণ।।
বিধিমতে নানা স্তুতি করিল বিস্তারে।
ত্রাণ কর জগন্নাথ রাখহ আমারে।।
নমস্তে বামনরূপ নমস্তে মুরারী।
নমঃ হয়গ্রীব রূপ নমঃ মধুহারী।।
নমঃ কূম্ম অবতার পৃথিবী ধারণ।
নমস্তে মোহিনীরূপ অসুরমোহন।।
নমো রঘুকুলবর রাম অবতার।
এক অংশে চারি রূপ দেব নরাকার।।
ক্ষন্ড্র কুলান্তক নমো নমো ভূগুপতি।
নমো রামকৃষ্ণ নমো নমো জগৎপতি।।
সর্ব্বত্র ব্যাপিত রূপ সর্ব্ব দেহে স্থিতি।
অভক্তের শাস্তিদাতা ভক্তকুলগতি।।
তুমি ব্রহ্মা তব মুখে ব্রাহ্মণ উৎপত্তি।
বাহুযুগে ক্ষন্ত্র উরে হৈল বৈশ্যজাতি।।
পদযুগে তোমার উৎপন্ন শূদ্রগণ।
তোমার সৃজন যত চরাচর জন।।
না জানিয়া পাপ করিলাম অকারণ।
এ মহা বিপদে প্রভু করহ তারণ।।

এইরূপে স্তুতি কৈল করি যোড়হাত।
বৈকুণ্ঠে অস্থির তথা বৈকুণ্ঠের নাথ।।
ভক্তের অধীন সদা দেব নারায়ণ।
প্রত্যক্ষ হইয়া দ্বিজে দিলেন দর্শন।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম কিরীট ভূষণ।
পীতবাস পরিধান শ্রীবৎসলাঞ্ছন।।
ত্রিভঙ্গ ললিত রূপ দেব সনাতন।
দেখি ভদ্রশীল হৈল সবিস্ময় মন।।
আনন্দে অশ্রুর জলে ভাসে কলেবর।
দণ্ডবৎ প্রণমি পড়িল পদপর।।
করে ধরি বিপ্রেরে তুলিল নারায়ণ।
আলিঙ্গন দিয়া হাসি বলিল বচন।।
ব্রাহ্মণ আমাতে কিছু নাহি ভেদ লেশ।
সে কারণ নাম আমি ধরি হৃষীকেশ।।
ভক্তের অধীন আমি শুনহ বচন।
ভক্তের মানস পূর্ণ করি সর্ব্বক্ষণ।।
বর মাগ দ্বিজবর যেই প্রয়োজন।
এত শুনি প্রণমিয়া বলয়ে বচন।।
বরেতে আমার কিছু নাহি প্রয়োজন।
বর দিয়া ভাণ্ড তুমি ভকতের মন।।
যদি বর দিবা প্রভু দেহত আমায়।
জন্মে জন্মে ভক্তি যেন থাকয়ে তোমায়।।
কীট পতঙ্গাদি যত যোনিতে জনম।
ইতিমধ্যে প্রভু যেন না হয় সম্ভ্রম।।
কর্ম্মাদোষে যথা তথা জন্মি পুনর্ব্বার।
অচলা তোমাতে ভক্তি রহুক আমার।।
আর এক বর মোরে দেহ নারায়ণ।
এই ধনুধ্বজ দূতে করহ তারণ।।
কেশিনী ডোমনী দেব বড়ই পাপিনী।
তার ঠাই রক্ষা মোরে কর চক্রপাণি।।

এত শুনি হাসি প্রভু করেন উত্তর।
ভক্তের অধীন দ্বিজ মম কলেবর।।
ভক্তে যাহা মাগে নারি অন্য করিবারে।
আপনার অঙ্গ কাটি দিবত তাহারে।।
তবে রক্ষা পাবে দ্বিজ তোমার পরাণী।
এত বলি দ্বিজরূপ ধরে চক্রপাণি।।
ভদ্রশীল যেইরূপ সে রূপ ধরেন।
ধনুধ্বজ দূতে চাহি তবে কহিলেন।।
যাও শীঘ্র লয়ে দ্বিজে রাখ নিজ স্থানে।
ডোমনীর বোধ আমি করিব এক্ষণে।।
এত শুনি ধনুধ্বজ চলিল সত্বরে।
শীঘ্রগতি লইয়া আইল দ্বিজবরে।।
ধনুধ্বজ সহ তবে দেব নারায়ণ।
ডোমনীর স্থানেতে করিলেন গমন।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কেবা খণ্ডাইতে পারে।
আপনার অঙ্গ কাটি দিব ত তোমারে।।
এত বলি বক্ষচর্ম্ম কাটিয়া সত্বরে।
কুলার প্রমাণ প্রভু দিলেন তাহারে।।
নিজ মূর্ত্তি ধরি প্রভু চলেন সত্বর।
দেখিয়া কেশিনী হৈল বিস্ময় অন্তর।।
স্তুতি করে ডোমনী করিয়া যোড়কর।
কি হেতু করিলে হেন কর্ম্ম গদাধর।।
ব্রাহ্মণ কারণ প্রভু নিজ ধর্ম্ম দিলে।
ইহার বৃত্তান্ত মোরে কিছু না কহিলে।।
কেশিনীর প্রতি প্রভু বলেন বচন।
ইহার বৃত্তান্ত কহি শুন দিয়া মন।।
ব্রাহ্মণ অশ্বত্থবৃক্ষ করিয়া রোপণ।
বিধিমতে প্রতিষ্ঠা করিল সেইক্ষণ।।
বৃক্ষেতে অশ্বত্থ আমি জান সারোদ্ধার।
সে কারণে আপদে করিলাম উদ্ধার।।
ইহা শুনি বহু স্তুতি ডোমিনী করিল।
হেনকালে শূণ্য হৈতে বিমান আইল।।
দোঁহাকারে রথে তুলি নিল সেইক্ষণ।
ব্রাহ্মণ প্রসাদে হৈল বৈকুণ্ঠে গমন।।

তিন দিন বাদে তথা দ্বিজ ভদ্রশীল।
নিদ্রাভঙ্গ হয়ে দ্বারে ঘুচাইল খিল।।
ভৃঙ্গার হাতেতে করি বহির্দ্দেশে যায়।
হেনকালে অশ্বত্থ বৃক্ষেতে দৃষ্টিহয়।।
কুলার প্রমাণ ছাল ছেদিতে দেখিয়া।
নাকে হাত দিয়া রহে নিঃশব্দ হইয়া।।
জানিল অশ্বত্থবৃক্ষ দেব নারায়ণ।
শীঘ্রগতি পঙ্কে তাহা করিল পূরণ।।
মাহভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে পরলোকে তরি।।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।
একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।।
তাহারে পাপের বাধা নাহি কোনকালে।
যতেক সৌভাগ্য তার হয় কর্ম্মফলে।।
পুত্রার্থী লভয়ে পুত্র ধনার্থীকে ধন।
নাহিক সংশয় ইথে ব্যাসের বচন।।
মস্তকে করিয়া চন্দ্রচূড় পদধূলি।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পাঁচালী।।