১৫. উত্তর গো-গৃহে কুরুসৈন্য কর্ত্তৃক গো-হরণ

হেথায় উত্তরভাগে রাজা দুর্য্যোধন।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ গুরুর নন্দন।।
দুর্ম্মুখ দুঃসহ দুঃশাসন মহাবল।
রথ রথী গজ বাজী চতুরঙ্গ দল।।
বেড়িল আসিয়া মৎস্যরাজের গোধন।
যুদ্ধ করি মারি লইলেক গোপগণ।।
পলাইল গোপগণ গোধন ছাড়িয়া।
ষষ্টি লক্ষ গোধনেরে দিল চালাইয়া।।
শীঘ্রগতি গোপগণ রথ আরোহণে।
জানাইতে গেল মৎস্যরাজার ভবনে।।
উত্তর নামেতে পুত্র বিরাট রাজার।
প্রণাম করিয়া দূত কহে সমাচার।।
অবধান মহাশয় বিরাট-নন্দন।
গোধন তোমার সব নিল কুরুগণ।।
যতেক রক্ষক গোপগণেরে মারিয়া।
গোধন তোমার সবে যেতেছে লইয়া।।
শীঘ্রগতি উঠি রথে করি আরোহণ।
কুরুগণে জিনি নিজ রাখহ গোধন।।
নানা অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা, লোকে তুমি খ্যাত।
জানি দেশ রক্ষা হেতু রাখিলেক তাত।।
তোমার সংগ্রামে স্থির হবে কোন্ জনা।
তৃণসম মুহূর্ত্তেকে নাশ কুরুসেনা।।
উঠ শীঘ্র, বসিলে না হবে কোন কার্য্য।
গোধন লইয়া তারা যাবে নিজ রাজ্য।।
দৈত্য জিনি ইন্দ্র যথা রাখে সুরপুর।
সেইমত রক্ষা কর মৎস্যের ঠাকুর।।
স্ত্রীবৃন্দের মধ্যে গোপ এতেক কহিল।
শুনিয়া বিরাট পুত্র উত্তর করিল।।
কি কহিব গোপগণ কহনে না যায়।
রাজ্যরক্ষা হেতু তাত রাখিল আমায়।।
এক গুটি সঙ্গে নাহি আমার সারথি।
সারথি থাকুক দূরে, নাহিক পদাতি।।
মম পরাক্রম মত পাইলে সারথি।
মুহূর্ত্তেকে জিনিবারে পারি কুরুপতি।।
মৃগগণে একা যথা মারয়ে কেশরী।
দৈত্যগণে দলে যথা একা বজ্রধারী।।
সেইমত দলি আমি কুরুসৈন্যগণ।
এইক্ষনে ফিরাতাম আপন গোধন।।
রাজ্য মম বীর শূন্য জানিলেক মনে।
দ্বিতীয় শমন আছে বলিয়া না জানে।।
জনৈক সারথি যদি মম যোগ্য হয়।
এক রথে করিব সে কুরু পরাজয়।।
ধনঞ্জয় বীর যথা দলি দেবগণ।
একেশ্বর করিলেক খাণ্ডব দাহন।।
পার্থসম বীরকর্ম্ম আজি সে করিব।
একেশ্বর সর্ব্বসৈন্য নিমিষে মারিব।।
স্ত্রীগণের মধ্যে যদি এতেক কহিল।
পার্থপ্রিয়া যাজ্ঞসেনী তথায় আছিল।।
রাখিব বিরাট লক্ষ্মী বিচারিলা মনে।
শীঘ্রগতি উঠি গেলা অর্জ্জুনের স্থানে।।
নৃত্যশালে পার্থ সহ সব কন্যাগণ।
সঙ্কেতে দ্রৌপদী তাঁরে বলেন বচন।।
বিরাটের রাজ্য ভাঙ্গি যতেক গোধন।
বলেতে লইয়া যায় কুরু-সৈন্যগণ।।
ইহার উপায় তুমি চিন্তহ আপনি।
রাখহ বিরাট গবী কুরুগণে জিনি।।
অর্জ্জুন বলেন, দেবি কিমতে এ হয়।
যত দিন ধর্ম্মরাজ, অনুমতি নয়।।
কুরুসৈন্য মধ্যে গেলে হইবেক খ্যাত।
না জানি কি কহিবেন পাণ্ডুকুলনাথ।।
দ্রৌপদী কহিল, গবী কুরুগণে নিলে।
অধর্ম্মী হইবে তুমি বসিয়া দেখিলে।।
বিরাট নৃপতি হন বহু উপকারী।
উপকারী জনে আমি হইলাম বৈরী।।
সহায় বলিষ্ঠ তাঁর কীচক মরিল।
তোমা সবে দিয়া স্থান বিপাকে মজিল।।
এত শুনি ধনঞ্জয় করে অঙ্গীকার।
রাখিব বিরাট ধেনু বাক্যেতে তোমার।।
প্রকাশ করিয়া গিয়া জানাহ উত্তরে।
সারথি করিয়া মোরে যুদ্ধে যেন বরে।।
এত শুনি হৃষ্ট হয়ে গেলা যাজ্ঞসেনী।
সব কহি পাঠাইলা উত্তরা ভগিনী।।
ভ্রাতৃস্থানে কহে গিয়া বিরাট-নন্দিনী।
শুন ভাই কহিল সৈরন্ধ্রী সুবদনী।।
সারথির হেতু তুমি হয়েছ চিন্তিত।
সে কারণে হেথা মোরে পাঠায় ত্বরিত।।
নর্ত্তকী যে বৃহন্নলা আছয়ে আমার।
সৈরন্ধ্রী কহিল সব পরাক্রম তার।।
খাণ্ডব দহিয়া পার্থ তুষিল অনলে।
বৃহন্নলা সারথি যে ছিল সেই কালে।।
সৈরন্ধ্রী পাণ্ডবগৃহে আছিল যখন।
বৃহন্নলা পরাক্রম দেখেছে তখন।।
বৃহন্নলা সহায়েতে ধনঞ্জয় বীর।
এক রথে শাসিলেন নৃপ পৃথিবীর।।
আজ্ঞা যদি হয় ভাই, লয় তব মন।
সারথি করিয়া বৃহন্নলা কর রণ।।
উত্তর বলিল, তুমি আনহ তাহারে।
সারথি হইল যোগ্য যাইব সমরে।।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃ-বচনেতে চলে নৃপসুতা।
কাঞ্চনের মালা গলে বিচিত্র মুকতা।।
রূপেতে কমলা সমা কমলগামিনী।
আনন্দিতা সিংহমধ্যা মরালগামিনী।।
জিজ্ঞাসিল পার্থ কেন গতি শীঘ্রতর।
শুনিয়া বিরাটপুত্রী করিল উত্তর।।
মোর ‍পিতৃ-গোধনেরে হরে কুরুগণে।
জানিয়া রক্ষার্থে মোর ভাই যাবে রণে।।
সারথির হেতু চিন্তা হয়েছে তাঁহার।
সৈরন্ধ্রী কহিল গুণ সকল তোমার।।
অবশ্য তথায় তুমি করিবে গমন।
আনহ গোধন তুমি জিনি কুরুগণ।।
না গেলে তোমার আগে ত্যজিব জীবন।
শুনিয়া উঠিয়া পার্থ করেন গমন।।
উত্তরা সহিত যান যথায় উত্তর।
বৃহন্নলায় উত্তর করিল সত্বর।।
পূর্ব্বে তুমি অর্জ্জুনের আছিলে সারথি।
তোমার সাহায্যে জিনিলেক সুরপতি।।
সারথি যতেক খ্যাত আছে ত্রিভুবনে।
ইন্দ্রের সারথি শ্রেষ্ঠ সর্ব্বলোকে জানে।।
বিষ্ণুর দারুক আর সূর্য্যের অরুণ।
দশরথ নৃপতির সুমন্ত্র নিপুণ।।
সকল সারথি হৈতে তোমা বাখানিল।
তোমা সম কেহ নহে সৈরন্ধ্রী কহিল।।
এ হেতু তোমারে আমি আনিনু ডাকায়ে।
চল শীঘ্র, গবী আনি কৌরবে জিনিয়ে।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি এ সব না জানি।
নৃত্যগীত জানি আর তাল বাদ্যধ্বনি।।
কভু আমি নাহি দেখি সমর কেমন।
শুনিয়া বলিল তবে বিরাট নন্দন।।
নর্ত্তনে গায়নে তুমি সর্ব্বত্র বিখ্যাত।
সৈরন্ধ্রীর মুখে তব গুণ হৈল খ্যাত।।
সৈরন্ধ্রীর বাক্য মিথ্যা নহে কদাচন।
উঠ শ্রীঘ্র মোর রথে কর আরোহণ।।
অর্জ্জুন বলেন, মানি তোমার বচন।
সারথি নহি যে, তবু করিব গমন।।
কেবল আমার এক আছয়ে নিয়ম।
যথা যাই শত্রু যদি হয় যম সম।।
না জিনিয়া বাহুড়ি না আসে মম রথ।
সর্ব্বথা প্রতিজ্ঞা মম জানিবে এমত।।
স্ত্রীগণের আগে তুমি যা কিছু বলিলে।
রথ না বাহুড়ে মম, তাহা না কহিলে।।
যথায় কহিবে, রথ তথাকারে লব।
রথসজ্জা দেহ, রথ সাজন করিব।।
এত শুনি উত্তরের আনন্দিত মন।
মোর মনোমত যোগ্য তুমি বিচক্ষণ।।
এত বলি গলা হৈতে দিল রত্নমালা।
বড় ভাগ্যবশে তোমা পাই বৃহন্নলা।।
রাজপুত্র প্রসাদ না নিলে অনুচিত।
প্রসাদ লইতে পার্থ হৈলেন লজ্জিত।।
রথের সাজন করিলেন ধনঞ্জয়।
দেখিয়া উত্তর মনে মানিল বিস্ময়।।
বীরবেশে বীরসজ্জা করি রাজসুত।
রথে আরোহণ করে অশ্বগণযুত।।
চতুর্দ্দিকে নারীগণ করয়ে মঙ্গল।
হেনকালে উত্তরাদি বালিকা সকল।।
বৃহন্নলা প্রতি চাহি বলে ততক্ষণ।
শুনহ বৃহন্নলা আমাদের বচন।।
ভীষ্ম দ্রোণ আদি করি জিনি বীরগণ।
সবাকার অঙ্গ হৈতে আনিবে বসন।।
পুত্তলী খেলিব মোরা যত কন্যাগণ।
মোদের এ বাক্য তুমি রাখিও স্মরণ।।
কহেন ঈষৎ হাসি ‍পার্থ ধনুর্দ্ধর।
সংগ্রাম জিনিবে যবে তব সহোদর।।
আনিব বসন রত্ন তোমার বাঞ্ছিত।
এত বলি রথমধ্যে বসেন ত্বরিত।।
হেনকালে অন্তঃপুরে যত নারীগণ।
অর্জ্জুনে চাহিয়া বলে করুণ বচন।।
খাণ্ডব দাহনে যথা জিনি পুরন্দরে।
সহায় ইয়া জয় দিলে পার্থ বীরে।।
সেমত ত্বরায় জিনি যত কুরুগণে।
উত্তর কুমারে লয়ে আসিবে কল্যাণে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।