৪৫. বিরাট রাজার স্বগৃহে আগমন ও যুধিষ্ঠিরের সহিত পাশা-ক্রীড়া

হেথায় বিরাট রাজা ত্রিগর্ত্তে জিনিয়া।
বাদ্য কোলাহলে দেশে উত্তরিল গিয়া।।
অন্তঃপুরে প্রবেশিল বিরাট ভূপতি।
আগুসারি নিল আসি যতেক যুবতী।।
একে একে প্রণমিল যত কন্যাগণ।
উত্তর না দেখি রাজা বলিছে বচন।।
কি কারণে নাহি দেখি কুমার উত্তর।
রাণী বলে বার্ত্তা নাহি জান নরবর।।
তুমি গেলে ত্রিগর্ত্তের যুদ্ধেতে যখন।
উত্তরে কৌরব আসি বেড়িল গোধন।।
গোপেরা আসিয়া তবে দিল সমাচার।
শুনি যুদ্ধে চলি গেল উত্তর কুমার।।
দ্বিতীয় নাহিক রথী, সারথি না ছিল।
সারথি করিয়া বৃহন্নলা পুত্র গেল।।
ইহা শুনি নরপতি শিরে হানে ঘাত।
বিস্ময় মানিয়া চিন্তে মুখে দিয়া হাত।।
এমত কুবুদ্ধি কেন পুত্রের হইল।
কুরুসৈন্য মধ্যে পুত্র একা রণে গেল।।
যেই সৈন্যে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ দুর্য্যোধন।
ইন্দ্র জিনিবারে পারে এক এক জন।।
হেন সৈন্যমধ্যে যুদ্ধ করিবে একক।
তাহাতে সারথি বৃহন্নলা নপুংসক।।
এহেতু আমার চিত্তে হইতেছে ত্রাস।
বৃহন্নলা কৈল যাত্রা, লোকে উপহাস।।
যত যোদ্ধাগণ সবে যাহ শীঘ্রগতি।
হয় হস্তী রথী মম যতেক সারথি।।
এতক্ষণ জীয়ে, কি না জীয়ে, নাহি জানি।
শীঘ্র শুভবার্ত্তা মোরে পাঠাবেক শুনি।।
এতেক বচন রাজা বলে বার বার।
শুনিয়া উত্তর দিল ধর্ম্মের কুমার।।
চিন্তা ‍না করহ রাজা উত্তরের প্রতি।
মহাবুদ্ধি বৃহন্নলা আছয়ে সারথি।।
যদি সাথে আনে দেব ইন্দ্রাদি কৌরব।
বৃহন্নলা সারথির নাহি পরাভব।।
এইরূপে বিরাটেরে কহে ধর্ম্মসুত।
হেনকালে উপনীত উত্তরের দূত।।
প্রণমিয়া নৃপবরে বলে যোড় করে।
উত্তম কুমার রাজা পাঠাইল মোরে।।
কুরুসৈন্য জিনিয়া গোধন ছাড়াইল।
রণে ভঙ্গ দিয়া কুরুগণ পলাইল।।
আসিছে সারথি সহ কুমার উত্তর।
মোরে পাঠাইয়া দিল জয় সমাচার।।
শুনিয়া আনন্দে মোহে বিরাট নৃপতি।
ধর্ম্মপুত্র তবে কহিছেন তাঁর প্রতি।।
বড় ভাগ্যে নৃপ শুভ বৃত্তান্ত শুনিলে।
তব পুত্র কুরুসৈন্য জিনিলেক হেলে।।
পূর্ব্বে কহিয়াছি, বৃহন্নলা আছে যথা।
কৌরবে জিনিবে ইহা বিচিত্র কি কথা।।
তবে রাজা আজ্ঞা দিল মন্ত্রিগণ প্রতি।
দূতগণে পুরস্কার কর শীগ্রগতি।।
কুলের দীপক মম কুমার উত্তর।
কুরুসৈন্য যুদ্ধে আজি জিনে একেশ্বর।।
তার আসিবার পথ কর মনোহর।
উচ্চ নীচ কাটি সব কর সমসর।।
দিব্য দিব্য গন্ধ-বৃক্ষ রোপহ দুসারি।
মঙ্গল বাজনা কর নাচুক নরনারী।।
যতেক কুমার যাহ সুসজ্জ হইয়া।
আগুবাড়ি উত্তরেরে আন সবে গিয়া।।
উত্তরাদি কন্যা যত যাহ শীঘ্রতর।
বৃহন্নলে আন সবে করিয়া আদর।।
এতেক রাজার আজ্ঞা পেয়ে মন্ত্রিগণ।
নৃপ-আজ্ঞা মত কাজ করিল তখন।।
হৃষ্ট হয়ে বলে রাজা চাহি ধর্ম্মকারী।
খেলিব সম্প্রতি, শীঘ্র আন পাশা-সারি।।
ধর্ম্ম বলিলেন, রাজা নহে এ সময়।
হর্ষকালে পাশাতে যে চিত্ত স্থির নয়।।
বিশেষে দেবন ভাল নহে অনুক্ষণ।
সর্ব্বকার্য্য নষ্ট হয় পাশার কারণ।।
লক্ষ্মী ভ্রষ্ট, রাজ্য নষ্ট, শত্রু হয় বলী।
নানামত দুঃখ লোক পায় পামা খেলি।।
শুনিয়াছ তুমি পাণ্ডবের বিবরণ।
এই পাশা হেতু হারাইল রাজ্য ধন।।
বিরাট কহিল কঙ্ক, কহ না বুঝিয়া।
কোন্ শত্রু আছে মম বিরোধে আসিয়া।।
রাজচক্রবর্ত্তী কুরুরাজ দুর্য্যোধন।
হেন জনে জিনিলেক আমার নন্দন।।
ভুবন মণ্ডলে এই শব্দ প্রচারিল।
পৃথিবীর রাজা শুনি ভয়ে স্তব্ধ হৈল।।
আর কোন্ জন আছে পৃথিবী ভিতরে।
হইয়া আমার বৈরী যাবে যমঘরে।।
যুধিষ্ঠির বলে, রাজা উত্তম কহিলা।
কি ভয় কৌরবে, যার আছে বৃহন্নলা।।
এত শুনি রোষভরে বিরাট নৃপতি।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ কহে কঙ্ক প্রতি।।
কুলের তিলক মম কুমার উত্তর।
সংগ্রামে জিনিল সেই কুরু-নরবর।।
একবার তার তুই না কহিস্ গুণ।
বৃহন্নলা ক্লীবে বাখানিস্ পুনঃ পুনঃ।।
কোন্ ছার বৃহন্নলা বাখানিস্ তারে।
তার মত কত জন আছে মম পুরে।।
কেবল সহায় মাত্র হইল সংগ্রামে।
কোন্ গুণে ধন্যবাদ দিস্ নরাধমে।।
শ্রবণে শুনিতে যোগ্য যেই কথা নহে।
পুনঃ পুনঃ কহিছিস্ , কত দেহে সহে।।
মম কথা কঙ্ক নাহি শুন ভালমতে।
কিমতে এ ভাষা কহ আমার অগ্রেতে।।
কহিতে কহিতে রাজা হৈল ক্রোধমতি।
হাতেতে আছিল পাশা, মারে শীগ্রগতি।।
অক্ষপাটী প্রহারিল রাজার বদনে।
ফুটিয়া শোণিত বাহিরায় সেইক্ষণে।।
অক্রোধী অজাতশত্রু ধর্ম্মের নন্দন।
দুই হাতে নিজ রক্ত ধরেন তখন।।
নিকটে আছিলা কৃষ্ণা বুঝি অভিপ্রায়।
হেমপাত্র শীঘ্র লয়ে রাজারে যোগায়।।
সেই পাত্র করি রাজা ধরেন শোণিতে।
না দিলেন তাহা যত্নে ভূমিতে পড়িতে।।
হেনকালে দ্বারদেশে উত্তর আগত।
দ্বারীরে বলিল, নৃপে জানও ত্বরিত।।
উত্তরের আজ্ঞা পেয়ে দ্বারী শীঘ্রগতি।
করযোড়ে বার্ত্তা কহে মৎস্যরাজ প্রতি।।
অবধান নরপতি শুভ সমাচার।
বৃহন্নলা সহ এল উত্তর কুমার।।
তব আজ্ঞা হেতু রাজা আছয়ে দুয়ারে।
আজ্ঞা হৈলে ভেটিবেন আসিয়া তোমারে।।
বার্ত্তা পেয়ে নরপতি কহে হরষেতে।
বৃহন্নলা সহ পুত্রে আনহ ত্বরিতে।।
বিরাটের আজ্ঞা পেয়ে চলিল সারথি।
নিকটে ডাকিল তারে ধর্ম্ম নরপতি।।
নিঃশব্দে কহেন রাজা সারথির কাণে।
শীঘ্র গিয়া আন তুমি রাজার নন্দনে।।
বৃহন্নলা হেথায় না আন কদাচন।
সাবধানে কহিবে না হও বিস্মরণ।।
সারথি শুনিয়া তবে চলে সেইক্ষণে।
কুমারে বলিল, চল রাজ-সম্ভাষণে।।
বৃহন্নলা এবে যাক আপনার স্থানে।
একেশ্বর চল তুমি রাজ-সম্ভাষণে।।
বৃহন্নলা যাইবারে কঙ্কের বারণ।
শুনিয়া করেন পার্থ স্বস্থানে গমন।।
উত্তরে লইয়া দ্বারী গেল সেইক্ষণ।
বাপে নমস্করি চাহে ধর্ম্মের বদন।।
রক্তধারা বহে মুখে, দেখিয়া কুমার।
সম্ভ্রমে বাপেরে বলে হয়ে চমৎকার।।
কহ তাত কেন দেখি হেন বিপরীত।
ভূমিতে বসিয়া কঙ্ক কেন বিষাদিত।।
মুখে রক্তধারা বহিতেছে কি কারণ।
কিবা হেতু কহ তাত হইল এমন।।
মৎস্যরাজ বলে, পুত্র গুনহ কারণ।
তোমার প্রশংসা কঙ্ক করি অবহেলা।।
পুনঃ পুনঃ বলে ধন্য ক্লীব বৃহন্নলা।
এই হেতু চিত্তে ক্রোধ হৈল মম তাত।
অক্ষপাটী প্রহারিনু, হৈল রক্তপাত।।
উত্তর বলিল, তাত কুকর্ম্ম করিলে।
সামান্য ব্রাহ্মণ বলি কঙ্কেরে জানিলে।।
এক্ষণে ইহারে যদি শান্ত না করিবে।
নিশ্চিত জানিহ তাত সর্ব্বনাশ হবে।।
ইন্দ্র যম বৈরী হৈলে আছে প্রতিকার।
কঙ্ক ক্রোধ হৈলে রক্ষা নাহিক তাহার।।
শীঘ্র উঠ তাত, আগে প্রবোধ কঙ্কেরে।
যেমত চিত্তেতে ক্রোধ না জন্মে তোমারে।।
পুত্রের বচনে রাজা উঠি শীঘ্রগতি।
বিনয় পূর্ব্বক কহে ধর্ম্মরাজ প্রতি।।
অনেক স্তবন রাজা করিল কঙ্কেরে।
অত্যন্ত অজ্ঞান আমি ক্ষমহ আমারে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ব্যস্ত না হও রাজন।
তোমাতে আমার ক্রোধ নাহি কদাচন।।
আমার হইলে ক্রোধ পূর্ব্বেতে হইত।
এখন তোমাতে ক্রোধ নাহি কদাচিত।।
পূর্ব্বেতে তোমারে ক্ষমা করেছি রাজন।
অক্ষপাটী যেই কালে করিলে যাতন।।
আমার ললাটে যেই শোণিত বহিল।
যতন পূর্ব্বক রক্ত পাত্রে ধরা গেল।।
শোণিত যদ্যপি সেই পড়িত ভূতলে।
তবে রাজ্য সহ নাহি থাকিতে কুশলে।।
আমার শোণিত বিন্দু যেই স্থলে পড়ে।
সেই স্থলের রাজা প্রজা সকলেই মরে।।
উত্তর বলিল, তাত কঙ্ক দয়াবান।
কঙ্কের ক্ষমাতে হৈল সবার কল্যাণ।।
যখন সারথি মোরে আনিবারে গেল।
বৃহন্নলা আসিবারে কঙ্ক নিষেধিল।।
বৃহন্নলা আসি যদি শোণিত দেখিত।
তবে সে জনক বড় অনর্থ ঘটিত।।
মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণব।
যাহার প্রসাদে জীব তরে ভবার্ণব।।