২২. দুই সতীনে ঝগড়া

কৃষ্ণা বলে, নহে দূর খলের প্রকৃতি।
আপনি প্রকাশ পায়, যার যেই রীতি।।
কি আহার, কি আচার, কোথায় শয়ন।
কোথায় থাকিস, তোর না জানি কারণ।।
পূবের্ব শুনিয়াছি আমি তোর বিবরণ।
তোর সহোদরে ভীম করিল নিধন।।
ভ্রাতৃবৈরী জনে কেহ না দেখে নয়নে।
তুই ত ভজিলি সেই ভ্রাতৃহন্তা জনে।।
সতত ভ্রমিস্ তুই যথা লয় মন।
একে কুপ্রবৃত্তি, তায় নাহিক বারণ।।
সন্ধ্যানিয়া বেড়াস্ ভ্রমরী যেন মধু।
সভামধ্যে বসিলি হইয়া কুলবধূ।।
মর্য্যাদা থাকিতে কেন না যাস্ উঠিয়া।
আপন সদৃশ স্থানে তুমি বৈস গিয়া।।
কুপিল হিড়িম্বা দ্রৌপদীর বাক্য-জালে।
দুষ্ট চক্ষু রক্তবর্ণ কৃষ্ণা প্রতি বলে।।
অকারণে পাঞ্চালী করিস্ অহঙ্কার।
পরে নিন্দ, নাহি দেখ ছিদ্র আপনার।।
কুরূপ কুৎসিত লোকে নিন্দে ততক্ষণ।
যতক্ষণ দর্পণেতে না দেখে বদন।।
তোমার জনকে পূর্ব্বে, জানে সর্ব্বজনা।
বান্ধিয়া আনিয়া পার্থ করিল লাঞ্ছনা।।
যেই জন করিলেক এত অপমান।
কোন্ লাজে হেন জনে দিল কন্যাদান।।
আমি যে ভজিনু ভীমে দৈবের নির্ব্বন্ধ।
পশ্চাৎ আমার ভাই করিলেক দ্বন্দ্ব।।
সহিতে না পারি মৈল করিয়া সংগ্রাম।
বীরধর্ম্ম করিল লোকেতে অনুপাম।।
শত্রুরে যে ভজে, তারে বলি ক্লীব জন্ম।
সংসারে বিখ্যাত তোর জনকের কর্ম্ম।।
আমার সপত্নী তুমি, আমি না তোমার।
তব বিবাহের আগে বিভা হৈল মোর।।
একা রাজ্যভোগ কর হয়ে পাটরাণী।
দিনেক দেখিয়া মোরে হৈলে অভিমানী।।
পঞ্চজন কুন্তী ঠাকুরাণীর নন্দন।
পঞ্চ পুত্রে আছি মোরা বধূ নয় জন।।
ঐশ্বর্য্য ভুঞ্জহ অর্দ্ধ তুমি স্বতন্তরা।
অষ্ট জনেতে অর্দ্ধ নাহি দেখি মোরা।।
তথাপি আমারে দেখি অঙ্গ হৈল জরা।
কি হেতু নিন্দহ মোরে বলি স্বতন্তরা।।
পুত্র ঘটোৎকচ মোর বনের ঈশ্বর।
পুত্র-গৃহ-বাসে কভু নহি স্বতন্তর।।
বাল্যকালে কন্যা রক্ষা করয়ে জনকে।
নারীকে যৌবনকালে স্বামী সদা রাখে।।
শেষকালে পুত্র রাখে, আছে হেন রীত।
বিশেষে আমার পুত্র পৃথিবী-পূজিত।।
মাতুলের রাজ্যমধ্যে হইয়া ঈশ্বর।
বাহুবলে শাসিল যতেক নিশাচর।।
সুমেরু অবধি বৈসে যতেক রাক্ষস।
একেশ্বর মোর পুত্র সবে কৈল বশ।।
রাজসূয়-যজ্ঞবার্ত্তা লোকমুখে শুনি।
যতেক রাক্ষসগণ করে কাণাকাণি।।
রাক্ষসের বৈরী যত পাণ্ডু-পুত্রগণ
চল সবে যজ্ঞ নষ্ট করিব এখন।।
বকের অপত্য ভ্রাতা আছে যত জন।
মোর সহোদর হিড়িম্বের বন্ধুগণ।।
এইত বিচার তার অনুক্ষণ করে।
এ সকল বার্ত্তা আসে পুত্রের গোচরে।।
চরমুখে জানিল কুচক্রী যত জন।
যুদ্ধ করি সবাকারে করিল বন্ধন।।
লৌহপাশে বন্দী করি রাখে কারাগারে।
যাবৎ সারিয়া যজ্ঞ না আইসে ঘরে।।
আর যত পৃথিবীতে বৈসে নিশাচর।
সবারে জিনিয়া বলে আনিলেক কর।।
সাক্ষাতে দেখহ কৃষ্ণা মোর পুত্র-প্রভা।
মোর পুত্রে শোভিতেছে পাণ্ডবের সভা।।
এতেক হিড়িম্বা যদি বলে কটূত্তর।
কহিতে লাগিল কৃষ্ণা কুপিত অন্তর।।
পুনঃ পুনঃ যতেক কহিস্ পুত্র কথা।
পুত্রের করিস্ গর্ব্ব, খাও পুত্রমাথা।।
কর্ণের একাঘ্নী অস্ত্র বজ্রের সমান।
তার ঘাতে তোর পুত্র ত্যজিবে পরাণ।।
পুত্রের শুনিয়া শাপ হিড়িম্বা কুপিল।
ক্রুদ্ধা হয়ে হিড়িম্বা কৃষ্ণারে শাপ দিল।।
আমার নির্দ্দোষ পুত্রে দিলে তুমি শাপ।
তুমিও পুত্রের শোকে পাবে বড় তাপ।।
যুদ্ধ করি মরে ক্ষত্র, যায় স্বর্গবাস।
বিনা যুদ্ধে তোর পঞ্চপুত্র হৈবে নাশ।।
এত বলি ক্রোধ করি হিড়িম্বা চলিল।
আপনি উঠিয়া কুন্তী দোঁহে সান্ত্বাইল।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধু-প্রায়।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস গায়।।