০৪৭. যযাতির প্রতি শুক্রের অভিশাপ দান

হেনমতে কতদিনে যযাতি নৃপতি।
বিহারে চলিল দেবযানীর সংহতি।।
নানা বৃক্ষে সুশোভিত অশোকের বন।
ফলে-ফুলে সুগন্ধি, সুনাদে পক্ষিগণ।।
দেবযানী সহ ক্রীড়া করে নৃপবর।
শর্ম্মিষ্ঠা আইল সেই বনের ভিতর।।
শর্ম্মিষ্ঠার তিন পুত্র পিতারে দেখিয়া।
রাজার নিকটে সবে যাইল ধাইয়া।।
সুন্দর কুমার তিন দেখি দেবযানী।
জিজ্ঞাসিল, কার পুত্র কহ ‍নৃপমণি।।
মৌনেতে রহিল রাজা, না দিল উত্তর।
কুমারগণেরে তবে পুছিল সত্বর।।
কি নাম তোমরা ধর, কাহার নন্দন।
সত্য কহ, হেথায় আইলা কি কারণ।।
দেবযানী বলে যদি এতেক বচন।
প্রত্যেকে আপন নাম কহে তিন জন।।
শর্ম্মিষ্ঠা নামেতে আমা সবাকার মাতা।
রাজারে দেখায়ে বলে এই মোর পিতা।।
এত বলি গেল তিনে রাজার নিকটে।
প্রণিপাত করি দাঁড়াইল করপুটে।।
দেবযানী-ভয়ে রাজা কিছু না বলিল।
বিরস-বদনে তিন শিশু বাহুড়িল।।
এত শুনি দেবযানী অরুণ-লোচন।
শর্ম্মিষ্ঠাকে ডাকি তবে বলেন বচন।।
পূর্ব্বে যে কহিলি তুই আমার গোচরে।
ঋষি এক পুত্রদান দিলেক আমারে।।
এক্ষণে তোমার কথা হইল বিদিত।
শর্ম্মিষ্ঠা শুনিয়া তাহা হইল বিস্মিত।।
করযোড়ে করিয়া শর্ম্মিষ্ঠা কহে বাণী।
ধর্ম্মে নাহি ঘাটি আমি, শুন ঠাকুরাণি।।
তুমি মোর ঈশ্বরী, তোমার রাজা পতি।
সে কারণে মোর ভর্ত্তা হৈলা নরপতি।।
সেবিকার পুত্রগণ তোমার সেবক।
ক্রোধ পরিহর মোর দেখিয়া বালক।।
দেবযানী বলে, তুমি সেবিকা হইয়া।
মোর স্বামী ভোগ কর ভয় না চিন্তিয়া।।
ক্রোধে দেবযানী তবে রাজা প্রতি বলে।
শুক্র বাক্য লঙ্ঘন করিলে অবহেলে।।
গুরুবাক্য লঙ্ঘি কর সেবিকা-গমন।
জানিলাম মহাপাপী তুমি হে রাজন।।
আর না রহিব আমি তোমার সদন।
এত বলি দেবযানী করেন ক্রন্দন।।
কাঁদিতে কাঁদিতে যান জনকের ঘর।
বিনয় করিয়া রাজ্য বুঝান বিস্তর।।
রাজার বিনয়- বাক্য না শুনিল কানে।
দেখিয়া নৃপতি বড় ভয় পায় মনে।।
পাছে নাহি চাহে ক্রোধে, যায় শীঘ্রগতি।
পাছে পাছে নরপতি চলিল সংহতি।।
শুক্রের সম্মুখে গিয়া হৈল উপনীত।
প্রণাম করিয়া কহে রাজার চরিত।।
অবধান কর পিতা মোর নিবেদন।
অধর্ম্মে প্রবৃত্ত হৈল যযাতি রাজন।।
তোমার নিয়ম-বাক্য হেলন করিয়া।
বৃষপর্ব্ব-কন্যারে গোপনে কৈল বিয়া।।
তিনপুত্র জন্মাইল তাহার উদরে।
দুর্ভাগা করিল মোরে রাজা অবিচারে।।
কন্যার বচন শুনি ভৃগুর নন্দন।
ক্রোধ করি রাজারে বলিল ততক্ষণ।।
সর্ব্বধর্ম্ম জ্ঞাত তুমি পরম পণ্ডিত।
মম বাক্য লঙ্ঘ রাজা, এ কোন বিহিত।।
গুরু-বাক্য নাহি মান করি অহঙ্কার।
এই পাপে অঙ্গে জরা হইবে তোমার।।
শুনিয়া শুক্রের শাপ, কম্পিত হৃদয়ে।
করযোড় করি রাজা বলিল বিনয়ে।।
মোর কোন্ শক্তি প্রভু তোমারে লঙ্ঘিতে।
সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম মুনি গোচর তোমাতে।।
সত্য কহি তব পাশে, শুন তপোধন।
কামভাবে শর্ম্মিষ্ঠারে না করি বরণ।।
ঋতুধান শর্ম্মিষ্ঠা যাচিল বারম্বার।
সে কারণে ঋতু রক্ষা করিলাম তার।।
ঋতুরক্ষা তরে নারী হইলে প্রার্থিত।
না পূরালে মহাপাপে হয় নিপতিত।।
নুপংসক হৈয়া জন্ম লভে ক্ষিতিতলে।
নরকের মধ্যে গিয়া পড়ে অন্তকালে।।
ঋতুদান করিলাম করি ধর্ম্ম ভয়।
আর মোর অঙ্গীকার জান মহাশয়।।
যেই যাহা মাগে তাহা না করিব আন।
সে কারণে দিনু যে মাগিল ঋতুদান।।
শুক্র বলে, ধর্ম্ম ভয় করিলা বিচার।
মোর বাক্যে ভয় নাহি এত অহঙ্কার।।
এতেক বলিবা মাত্র ভৃগুর নন্দন।
রাজার শরীরে জরা হইল তখন।।
অশক্ত হইল রাজা, শুক্ল হৈল কেশ।
মুখেতে না সরে বাক্য হৈল বৃদ্ধবেশ।।
আপনার অঙ্গ দেখি নৃপতি বিস্ময়।
যোড়হাতে কহে পুনঃ করিয়া বিনয়।।
নাহি হয় তৃপ্তি নাহি পূরে যে কামনা।
তব কন্যা দেবযানী প্রথম-যৌবনা।।
হইলাম বঞ্চিত এ সংসারের সুখে।
কৃপায় শাপান্ত প্রভু আজ্ঞা কর মোকে।।
শুক্র বলে, মম বাক্য না যায় খণ্ডন।
ভোগ করিবারে রাজা আছে যদি মন।।
আপনার জরাবস্থা দিয়া অন্য জনে।
সাংসারিক সুখভোগ করহ আপনে।।
রাজা বলে, আছে মোর পঞ্চ যে কুমার।
যেই জরা লবে, তারে দিব রাজ্যভার।।
শুক্র বলে, জরাভার লবে যেই জন।
দীর্ঘ আয়ু হবে সেই রাজ্যের ভাজন।।
বংশবৃদ্ধি হবে, আর রাজ্যে হবে রাজা।
পরম পণ্ডিত হবে, বলে মহাতেজা।।
শুক্রের পাইয়া আজ্ঞা যযাতি রাজন।
দেবযানী সহ দেশে করিল গমন।।
যযাতি-চরিত কথা শ্রবণে অমৃত।
পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচিত।।