১১. চতুর্থ দিনের যুদ্ধ

জিজ্ঞাসিল জন্মেজয় কহ মুনিবর।
যুধিষ্ঠির ধর্ম্মপুত্র কুরু-নরবর।।
কি কর্ম্ম করিল কহ শুনি মহামতি।
কি করিল পুত্র দুর্য্যোধন মূঢ়মতি।।
মহামহারথিগণ সংগ্রামে দুর্জ্জয়।
বাণেতে পীড়িল পার্থ কুন্তীর তনয়।।
অর্জ্জুনের হাতে সব পরাভব হৈয়া।
কি কর্ম্ম করিল ভীষ্ম শিবিরে আসিয়া।।
সঞ্জয় বলেন, রাজা কর অবগতি।
শিবিরে প্রবেশ কৈল কৌরব নৃপতি।।
সিংহাসন ছাড়ি রাজা ভূমেতে বসিল।
দূত পাঠাইয়া ভীষ্ম দ্রোণেরে আনিল।।
রাজার আদেশে দোঁহে আইল সত্বরে।
প্রণমিয়া দোঁহারে বলয়ে নরবরে।।
যে প্রতিজ্ঞা কৈলে দোঁহে হইল অন্যথা।
সবাকার পরাজিত পার্থ মহারথা।।
পাণ্ডবের স্নেহ করি নাহি মার বাণ।
রণমধ্যে আমার হইল অপমান।।
পশু যেন খেদিয়া মারয়ে পশুপতি।
বহুসৈন্য নিপাতিল ভীম মহামতি।।
নির্ভয়ে করয়ে যুদ্ধ পাণ্ডুর কুমার।
দিনে দিনে সৈন্য মোর মারিল অপার।।
অগ্রযুদ্ধে তোমরা হইলে সেনাপতি।
তোমার সাক্ষাতে মোর এতেক দুর্গতি।।
আপনি প্রতিজ্ঞা কৈলে সভা বিদ্যমান।
যুদ্ধ হেতু কর্ণেরে করিলে নিবারণ।।
অগ্রযুদ্ধে কর্ণেরে করিলে সেনাপতি।
দৃষ্টিমাত্রে পাণ্ডবে মারিত মহামতি।।
ভুব্নবিজয়ী কর্ণ রণেতে নির্ভয়।
কোন্ বা পতঙ্গ হয় পাণ্ডুর তনয়।।
পরশুরামের শিষ্য সর্ব্বগুণযুত।
পরাপর নাহি জ্ঞান সমরে অজিত।।
তাহারে ত্যজিয়া তোমা কৈনু সেনাপতি।
স্নেহেতে পাণ্ডবে নাহি মার মহামতি।।
এত শুনি ভীষ্ম বীর করিল উত্তর।
না কর শোচন, স্থির হও নরবর।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি শুন দুর্য্যোধন।
দাবানলে বন যেন করয়ে দাহন।।
সেইরূপ দহিব পাণ্ডব সৈন্যগণ।
এই কহিলাম আমি নিশ্চয় বচন।।
এত শুনি দুর্য্যোধন আনন্দিত মন।
ক্রোধে দ্রোণ প্রতিজ্ঞা করিল ততক্ষণ।।
কালিকার সংগ্রামে দেখিবে বিদ্যমান।
পাঞ্চাল-বংশেতে যত আছে বীরগণ।।
কালি রণে সবারে পাঠাব যমালয়।
আমার প্রতিজ্ঞা কভু নাহিক সংশয়।।
এতেক প্রতিজ্ঞা শুনি কৌরব-নৃপতি।
সাহসে পূর্ণিত তনু হৈল মহামতি।।
সোমদত্ত জয়দ্রথ গুরুর নন্দন।
শীঘ্রগতি ডাকিয়া আনিল তিন জন।।
আজ্ঞামাত্র চরে ডাকি আনে ততক্ষণ।
তবে দুর্য্যোধন রাজা বলিল বচন।।
শুন অশ্বত্থামা জয়দ্রথ মহামতি।
সোমদত্ত মহাভাগ শুন মহামতি।।
মহাপাপী দুরাশয় শিখণ্ডী দুর্জ্জয়।
শিখণ্ডীরে দেখিলে ভীষ্মের বীর্য্যক্ষয়।।
তেকারণে তিন জনে শুন সাবধানে।
তিন জন মিলি তারে সংহারহ রণে।।
এত শুনি প্রতিজ্ঞা করিল তিন জন।
বিদ্যামন কালি মোর দেখিবে তরণ।।
কালি যুদ্ধে শিখণ্ডীরে করিব সংহার।
ক্ষুদ্র মৃগে সিংহ যেন করয়ে প্রহার।।
এত বলি তিন জন হইল বিদায়।
চরমুখে এসব শুনিল ধর্ম্মরায়।।
ভীমসেন ধনঞ্জয় সাত্যকি দুর্জ্জয়।
তিন জনে ডাকিয়া কহিল মহাশয়।।
প্রতিজ্ঞা করিল আজি দ্রোনের তনয়।
জয়দ্রথ সোমদত্ত বাহ্লীক-তনয়।।
শিখণ্ডী-বধের হেতু করিল নিশ্চয়।
অবশ্য শিখণ্ডী কালি করিবে সংশয়।।
রাজা বিদ্যমানেতে কহিল তিন জনে।
কালি যুদ্ধে শিখণ্ডীরে মারিবেক রণে।।
সাবধান হৈয়া কালি করিবেক রণ।
প্রাণপণে শিখণ্ডিকে করিবে রক্ষণ।।
রাজার বচনে তবে কৈল অঙ্গীকার।
কৃষ্ণার্জ্জুনে বলে তবে ধর্ম্মের কুমার।।
সাবধান হয়ে কালি করিবে সমর।
প্রতিজ্ঞা করিল ভীষ্ম দ্রোন বীরবর।।
চর আসি আমাকে কহিল সমাচার।
দুর্য্যোধন-আগে গুরু কৈল অঙ্গীকার।।
পাঞ্চাল-বংশেতে যত আছে বীরগণ।
কালি সমরেতে সবে করিব নিধন।।
তেকারণে শুন পার্থ নবঘনশ্যাম।
সাবধান হৈয়া সবে করিবে সংগ্রাম।।
এতেক বলিল যদি ধর্ম্মের কুমার।
শুনি কৃষ্ণার্জ্জুন দোঁহে কৈলা অঙ্গীকার।।
পাঞ্চাল-বংশেতে যত আছে বীরগণ।
হইল আমার ভার করিব রক্ষণ।।
সঞ্জয় বলেন শুন অম্বিকা-সম্ভব।
এইরূপে যুক্তি কৈল কৌরব-পাণ্ডব।।
রাত্রি অবশেষে তবে প্রকাশে অরুণ।
যুদ্ধ হেতু দুই দলে করিল সাজন।।
নানাবিধ বাদ্য বাজে সাজে বীরগণ।
রথী মহারথী সাজে না যায় লিখন।।
ভেরী ঝাঝরি বাজে অসংখ্য কাহাল।
লক্ষ লক্ষ শঙ্খবাজে কাংস্য করতাল।।
মৃদঙ্গ দুন্দুভি বাজে, বাজে বাদ্যগণ।
বাজয়ে অনেক বাদ্য না যায় লিখন।।
লক্ষ লক্ষ এককালে ধনুক টঙ্কার।
শব্দেতে পূরিল ক্ষিতি শবদ-সঞ্চার।।
মহাবল ভীষ্ম বীর শান্তনু সম্ভব।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া কৈল শ্ঙ্খবর।।
এক শব্দে যেন শত বজ্রের নিঃস্বন।
মহাশব্দে মোহিত হইল সৈন্যগণ।।
তবে পার্থ মহাবীর ইন্দ্রের কুমার।
আকর্ণ পূরিয়া কৈল ধনুক টঙ্কার।।
মহাশব্দে ত্রাসিত হইল কুরুগণ।
পাঞ্চজন্য শঙ্খ তবে পূরে নারায়ণ।।
লক্ষ লক্ষ শঙ্খ বাজে পাণ্ডবের দলে।
প্রলয়কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।
তবে ধনঞ্জয় বীর সংগ্রামে নিপুণ।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ না হয় বর্ণন।।
ব্যূহমুখে নিয়োজিল মহাযোধগণ।
ততোধিক ব্যূহ কৈল গঙ্গার নন্দন।।
ব্যূহঅগ্রে নিয়োজিল মহা মহাবীর।
দুই দলে যুদ্ধ করে রণে বড় স্থির।।
অন্যে অন্যে দুইজনে বরিষয়ে শর।
রথী মহারথী যুঝে পদাতি বিস্তর।।
মল্লে মল্লে মহাযুদ্ধ ধানুকী ধানুকী।
আসোয়ার আসোয়ার তবকি তবকি।।
দুই দলে বহুসৈন্য হইল নিধন।
চতুর্থ দিবস যুদ্ধ না হয় বর্ণন।।
রথী মহারথিগণ পড়িল অনেক।
লিখনে না যায় পত্তি পড়িল যতেক।।
গজ বাজী রথ ধ্বজ মল্ল অগণন।
অলঙ্কারে রণস্থল হইল শোভন।।
বীরগণ মস্তকে ছাইল রণস্থলী।
পড়িল অনেক সৈন্য আথালি পাথালি।।
ছত্র-ধ্বজ-পতাকায় পৃথিবী ছাইল।
বিচিত্র কানন যেন বসন্তে ফুটিল।।
রক্তে নদী বহে ঠাট রক্তেতে সাতাঁর।
অনেক কবন্ধ উঠে হাতে ধনুঃশর।।
রক্তমাংসাহারীগণ ছাইল অম্বরে।
শৃগাল-কুক্কুরগণ রক্তেতে সাতাঁরে।।
মহাবল ধৃষ্টদ্যুন্ন সংগ্রামে প্রচণ্ড।
কৌরবের ব্যূহ কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।
রথী মহারথিগণ মারিল অপার।
দ্রোণের সাক্ষাতে সৈন্য করয়ে সংহার।।
মহাক্রোধ হয়ে আইল দ্রোন মহামতি।
নানা অস্ত্র ধৃষ্টদ্যুম্নে বিন্ধে শীঘ্রগতি।।
অস্ত্রে অস্ত্রে ধৃষ্টদ্যুম্ন করে নিবারণ।
ডাক দিয়া আচার্য্যে বলয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন।।
আমার প্রতিজ্ঞা এই জানয়ে সংসারে।
সেই কাল হৈল আজি কহিনু তোমারে।।
মোর হাতে আজি তব হইবে সংহার।
খণ্ডিবারে পারে ইহা শকতি কাহার।।
এত বলি পঞ্চ বাণ পূরিল সন্ধান।
বাণে বাণ হানি দ্রোণ কৈল খান খান।।
তবে দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নে বলয়ে বচন।
শুন রে আমার বাক্য পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।।
আমার হস্তেতে রক্ষা নাহিক তোমার।
সবংশেতে যাবি আজি যমের দুয়ার।।
এত বলি দিব্য এক তোমর লইল।
আকর্ণ পূরিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নেরে মারিল।।
ভৃগুপতিদত্ত অস্ত্র অব্যর্থ সংসার।
নিবারিতে না পারিল ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।।
কবচ কাটিয়া অস্ত্র অঙ্গে প্রবেশিল।
সেই ঘায়ে ধৃষ্টদ্যুম্নে অচেতন হৈল।।
রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।
অবসর পাই যুঝে দ্রোণ মহামতি।।
নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে পাঞ্চাল উপর।
বরিষাকালেতে যেন বর্ষে জলধর।।
কাহারো কাটিল হাত কারো কাটে মুণ্ড।
কারো কাটে মধ্যস্থল কারো কাটে দণ্ড।।
সহিতে না পারি ভাঙ্গে পাঞ্চাল-বাহিনী।
দ্রোণের বাহিনী করে জয় জয় ধ্বনি।।
শত শত রথী দ্রোণ করিল নিধন।
কতক্ষণে ধৃষ্টদ্যুম্ন পাইল চেতন।।
সারথিরে নিন্দি বহু করিল ভৎসনা।
পুনরপি দ্রোণসৈন্যে আসি দিল হানা।।
আকর্ণ পূরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।
দিব্য দিব্য অস্ত্র বীর করে অবতার।।
শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।
নিরন্তর বর্ষে দ্রোণসৈন্যের উপর।।
মহাবীর ধৃষ্টদ্যুন্ন পূরিল সন্ধান।
রথধ্বজ দ্রোণের করিল খান খান।।
ধ্বজ কাটা গেল দ্রোণ ক্রোধ কৈল মনে।
সহস্র সহস্র তোমর বিন্ধে ততক্ষণে।।
আকর্ণ পূরিয়া অস্ত্র এড়িল সত্বরে।
দশদিক অন্ধকার হইল অম্বরে।।
দেখ নাহি যায় বীর আবরিল বাণে।
অর্জ্জুন দেখিয়া তাবে রক্ষা কৈল প্রাণে।।
অশ্বত্থামা মহাবীর দ্রোনের নন্দন।
শিখণ্ডী উপরে করে বাণ বরিষণ।।
ক্রোধ হৈল মহাবীর সংগ্রামে প্রচণ্ড।
অশ্বত্থামা বীরের কাটিল ধ্বজদণ্ড।।
ধ্বজ কাটা গেল বীর ক্রোধ হৈল মনে।
শক্তি ফেলি শিখণ্ডীরে হানে ততক্ষণে।।
দুই বাণে শক্তি বীর কৈল খান খান।
অশ্বত্থামা বীরে পুনঃ মারে পাঁচ বাণ।।
বাণে বাণ হানি অশ্বত্থামা মহামতি।
পুনরপি দুই অস্ত্র মারে শীঘ্রগতি।।
শরজালে অন্ধকার করিল গগন।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন বর্ষে ঘোর ঘন।।
দিব্যাস্ত্র শিখণ্ডী তবে পূরিল সন্ধান।
দৃষ্টিমাত্র শরজাল কৈল খান খান।।
বায়ু যেন খণ্ড খণ্ড করে মেঘমালা।
তাপ খণ্ডি উদয় হইল শশিকলা।।
হাসিয়া শিখণ্ডী বীর পূরিল সন্ধান।
মহাক্রোধে এড়ে তবে আট গোটা বাণ।।
আকাশে উঠিল অস্ত্র তারা যেন খসে।
জ্যোতির্ম্ময় হয়ে অস্ত্র অন্তরীক্ষে আসে।।
দিব্য অস্ত্র দ্রোণপুত্র এড়ে ততক্ষণ।
অর্দ্ধপথে অস্ত্র কাটি কৈল শতখান।।
তবে অশ্বত্থামা পুনঃ এড়ে দিব্য বাণ।
কালান্তক সম হয় বাণের গর্জ্জন।।
মহাশব্দে আইসে বাণ গগনমণ্ডলে।
শরৎ কালেতে যেন হংসপতি চলে।।
বাণে বাণে হানিল শিখণ্ডী মহামতি।
ভল্লবাণে দ্রৌণিরে বিন্ধিল শীঘ্রগতি।।
কবচ ভেদিয়া অস্ত্র ফুটিল শরীরে।
তথাপি ভ্রূক্ষেপ কিছু নাহি মহাবীরে।।
দিব্য অস্ত্রে পুনরপি পূরিয়া সন্ধান।
রথধ্বজ শিখণ্ডীর কৈল খান খান।।
চারি বাণে চারি অশ্ব মারিল ত্বরিতে।
সারথির মাথা কাটি পাড়িল ভূমিতে।।
গদা হাতে করি বীর ভূমিতে পড়িল।
খড়্গ চর্ম্ম লয়ে বীর হানিতে লাগিল।।
হেনকালে বৃকোদর বরিষয়ে বাণ।
আগু হয়ে রক্ষা কৈল শিখণ্ডীর প্রাণ।।
তবে সোমদ্ত্ত বীর হাতে শরাসন।
ভীমের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
শেল শূল শক্তি জাঠা মুষল মুদগর।
পরিঘ নারাচ আদি ভৈরব তোমর।।
মহাবীর বৃকোদরে সমরে প্রচণ্ড।
অস্ত্রে অস্ত্র কাটিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।
শীঘ্রহস্তে মহাবীর পবন-কুমার।
অশ্বত্থামা উপরে মারিল পঞ্চ শর।।
দুই বাণে জয়দ্রথে কৈল অচেতন।
চারি বাণে সোমদত্তে বিন্ধে ততক্ষণ।।
দুই বাণে সোমদত্ত কৈল খণ্ড খণ্ড।
অষ্ট গোটা নারাচ ভীমে বিন্ধিল প্রচণ্ড।।
কবচ ভেদিয়া অঙ্গে বাণ প্রবেশিল।
তথাপিহ ভীমসেন সম্ভ্রম না কৈল।।
মহাবীর বৃকোদর পবন-নন্দন।
পবন প্রতাপ বীর গতিতে শমন।।
দিব্য অস্ত্র ধনুকেতে পূরিল সন্ধান।
অস্ত্রমুখে অগ্নিবৃষ্টি হয় ক্ষণে ক্ষণে।।
জ্যোতির্ম্ময় হয়ে অস্ত আইসে অম্বরে।
নানা শক্তি করে বীর নিবারিতে নারে।।
কৃপার সাগর দ্রৌণি হৈল কৃপাবান।
অর্দ্ধপথে অস্ত্র কাটি কৈল খান খান।।
আকাশেতে প্রশংসা করয়ে দেবগন।
সাধু অশ্বত্থামা বীর দ্রোণের নন্দন।।
তবে সোমদত্ত বীর হাতে লৈল ধনু।
অষ্ট বাণে বিন্ধিলেক বৃকোদর-তনু।।
ক্রোধ করি ভীম পুনঃ হাতে নিল শর।
দশ বাণে সোমদত্তে বিন্ধিল সত্বর।।
এক বাণে ধ্বজ ছত্র ভূমিতে পাড়িল।
চারি বাণে চারি অশ্ব সত্বর কাটিল।।
দুই বাণে সারথির মাথা কাটা গেল।
গদা হাতে করি তবে ভূমিতে পড়িল।।
গদা হাতে করি যায় ভীমে মারিবারে।
সিংহ যেন ক্রোধে ধায় মৃগের উপরে।।
চারি অশ্ব মারিল মারিয়া গদাবাড়ি।
সারথির চুলে ধরি ভূমিতলে পাড়ি।।
দগা হাতে করি ভূমে নামে বীর ভীম।
দুইজনে গদাযুদ্ধ হইল অসীম।।
মহাবীর নকুল তবে সমরে দুর্ব্বার।
বাণে হানি কুরুসৈন্যে কৈল মহামার।।
নকুলের বেগ সৈন্য সহিতে না পারে।
ভঙ্গ দিল সৈন্যগণ বাণের প্রহারে।।
সুদক্ষিণ নামে রাজা কুরু-সেনাপতি।
তার ভাই দেবাপি সংগ্রামে মহামতি।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখি তার ক্রোধ হৈল মনে।
গজে চড়ি আইল নকুল বিদ্যমানে।।
ঐরাবত স্কন্ধে যথা দেব ইন্দ্ররায়।
প্রভাতের রবি যেন নিকটে উদয়।।
বিচিত্র কবচ অঙ্গে যেন প্রভা ভানু।
নানা অলঙ্কারে তার বিভূষিত তনু।।
বিচিত্র মুকুট মাথ শোভা অতিশয়।
কাঞ্চন পর্ব্বতে যেন রবির উদয়।।
বিচিত্র ধনুক হাতে দিব্য তূণচয়।
শক্রধনু আকাশে যেমন প্রকাশয়।।
ক্রোধেতে ডাকিয়া বলে নকুলেরে বোল।
আমার সংগ্রামে তোরে যমে দিল কোল।।
এত বলি বিদ্য অস্ত্র পূরিল সন্ধান।
নকুলেরে প্রহার করিল পঞ্চ বাণ।।
বাণে বাণ কাটি পাড়ে নকুল দুর্দ্ধর।
ডাক দিয়া দেবাপিরে বলিল উত্তর।।
শুনরে পাপিষ্ঠ পশু অধম বর্ব্বর।
মোর হাতে আজি তুই যাবি যমঘর।।
এই ইন্দ্র দিব অস্ত্র অব্যর্থ সংসারে।
পূর্ব্বে গুরু দ্রোণাচার্য্য দিলেন আমারে।।
এত বলি নকুল আকর্ণ টানে বাণ।
মহাক্রোধে এড়ে বাণ সূর্য্যের সমান।।
নানা শক্তি করে বীর নিবারিতে নারে।
বুকেতে লাগিয়া অস্ত্র পড়ে ভূমি পরে।।
রথ হৈতে পড়ে বীর পূর্ব্বমুখ হৈয়া।
মধ্যাহ্নের ভানু যেন পড়িল খসিয়া।।
হাহাকার শব্দ হৈল কৌরবের দলে।
ভ্রাতৃশোকে সুদক্ষিণ মহাকোপে জ্বলে।।
অনেক কান্দিয়া শোক কৈল নিবারণ।
নকুল উপরে করে বাণ বরিষণ।।
শেল শূল শক্তি জাঠা পরশু তোমর।
নারাচ ভূষণ্ডী গদা মুষল মুদগর।।
নিরন্তর বৃষ্টি করে নকুল উপরে।
বরিষার কালে যেন বর্ষে জলধরে।।
ক্রুদ্ধ হইল নকুল সমরে প্রচণ্ড।
বাণে বাণ কাটিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।
তবে সুদক্ষিণ এড়ে অর্দ্ধচন্দ্র বাণ।
ভল্লবাণে নকুল করিল খান খান।।
বাণ ব্যর্থ গেল বীর ক্রোধ হৈল মনে।
শক্তি ফেলি নকুলে বিন্ধিল ততক্ষণে।।
সেই ঘায়ে মোহ গেল নকুল দুর্জ্জয়।
অবসর পেয়ে সুদক্ষিণ দুরাশয়।।
নানা অস্ত্রবৃষ্টি করে সৈন্যের উপর।
আষাঢ় শ্রাবণে মেঘ বর্ষে নিরন্তর।।
মোহ ভাঙ্গি কতক্ষণে উঠিল নকুল।
সারথিরে নিন্দা করি বলিল বহুল।।
মহা অপমান মোর হৈল তোমা হৈতে।
কেন রথ বাহুড়িলা সংগ্রাম মুখেতে।।
সারথি বলিল আমি নিন্দ অকারণ।
বাহুড়িনু রথ তোমা দেখি অচেতন।।
ক্রোধ সম্বরিয়া বীর বলে পুনর্ব্বার।
শীঘ্র আগু লহ রথ সূতের কুমার।।
যথা আছে সুদক্ষিণ পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।
আজ্ঞামাত্র রথ চালাইল ততক্ষণ।।
তবে নানা অস্ত্র দোঁহে দোঁহাকারে এড়ে।
অন্ধকার করিয়া দোঁহের গায়ে পড়ে।।
শরজালে গগন ছাইল দুই জনে।
ক্রোধেতে নকুল অস্ত্র এড়ে ততক্ষণে।।
দুইবাণে রথধ্বজ কাটিয়া পাড়িল।
সারথিরে সাত বাণ ক্রোধেতে মারিল।।
ছয় বাণে সুদক্ষিণে কাটিয়া পাড়িল।
মস্তক কাটিয়া তারে দুই খণ্ড কৈল।।
রথ হৈতে সুদক্ষিণ ভূমেতে পড়িল।
আকাশের চন্দ্র যেন ভূমেতে খসিল।।
হাহাকার শব্দ হৈল কৌররেব দলে।
নানা অস্ত্র নকুল এড়িল কুতূহলে।।
সেনাপতি পড়িল ভাঙ্গিল সৈন্যগণ।
মহাক্রোধ হৈল তবে গঙ্গার নন্দন।।
রথ চালাইয়া দিল নকুল-গোচর।
দুই জন সমাগমে হইল সমর।।
তবে ত নকুল বীর পূরিল সন্ধান।
দশ বাণ মারিল পিতামহ বিদ্যমান।।
বাণে বাণ হানি ভীষ্ম এড়ে দিব্যশর।
দশবাণে বিন্ধিল নকুল-কলেবর।।
চারি বাণে চারি অশ্ব কাটিয়া পাড়িল।
দুই বাণে ধনু কাটি শরীর ভেদিল।।
শীঘ্রহস্ত মহাবীর গঙ্গার তনয়।
রুধিরে জর্জ্জর কৈল নকুল দুর্জ্জয়।।
সর্ব্বাঙ্গ বহিয়া পড়ে রুধিরের ধার।
তথাপি ভ্রূক্ষেপ নাহি মাদ্রীর কুমার।।
সিংহের সমান বীর নাহি পরাজয়।
গঙ্গাপুত্র মহাবীর সমরে দুর্জ্জয়।।
খড়্গ হাতে করি ভূমে দিল এক লাফ।
ধনু টঙ্কারিয়া বীর এড়িলেক চাপ।।
হেনকালে শীঘ্রগতি আইল অর্জ্জুন।
ভীষ্মার্জ্জুন সমাগমে হৈল মহারণ।।
মহাবীর গঙ্গাপুত্র সমরে প্রতাপ।
এক বাণে এড়িল সহস্র সংখ্য সাপ।।
গগনেতে আবরিল ঘোর অহিগণ।
অর্জ্জুন উপরে আইসে বিস্তার বদন।।
হাসিয়া গরুড় বাণ অর্জ্জুন এড়িল।
ধরিয়া সকল অহি ভক্ষণ করিল।।
শত শত খগবর উড়য়ে আকাশে।
দেখি সৈন্যগণ সব পলায় তরাসে।।
ঘোর শব্দে পক্ষিগণ বিস্তারি বদন।
ভীষ্মের সম্মুখে আসে করিয়া গর্জ্জন।।
অগ্নিবাণ এড়ি হাসি গঙ্গার কুমার।
পুড়িয়া পক্ষীর পাখা কৈল ছারখার।।
পর্ব্বতপ্রমাণ অগ্নি দেখি লাগে ভয়।
বরুণাস্ত্রে নিবারিল ইন্দ্রের তনয়।।
মহাবলবান্ দোঁহে সংগ্রামে নিপুণ।
সিংহের বিক্রম যেন প্রতাপে অরুণ।।
সঞ্জয় বলেন, শুন অন্ধ নৃপমণি।
দুই দলে বহুতর পড়িল বাহিনী।।
সন্ধ্যাকালে বহু সৈন্য পড়িল সমরে।
রক্তে নদী বহে, ঠাট রক্তেতে সাঁতারে।।
গজ গজী অশ্ব রথ রথী অগণন।
মল্ল পত্তি পদাতিক না হয় গণন।।
পড়িল বহুল সৈন্য আথালি পাথালি।
নানা অলঙ্কারেতে শোভিল রণস্থলী।।
মুকুট কুণ্ডল হার বলয় কঙ্কণ।
কবচ কিরীট আর ছত্র অগণন।।
বসন্ত কালেতে যন শোভয়ে কানন।
নানা অলঙ্কারে রণস্থলী সুশোভন।।
অসংখ্য কবন্ধ উঠে হাতে ধনুঃশর।
ভয়ঙ্কর রণস্থলী দেখি লাগে ডর।।
শ্মশান সদৃশ হৈল নাচে প্রেতগণ।
শকুনি গৃধিনীগণে ছাইল গগন।।
অস্ত গেল দিনমণি প্রবেশিল রাতি।
দুইদলে চলি গেল যে যার বসতি।।
মুনি বলে জন্মেজয় কর অবধান।
চতুর্থ-দিবস যুদ্ধ হৈল সমাধান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
একমনে শুনিলে লভয়ে দিব্যজ্ঞান।।
মস্তকে বন্দিয়া চন্দ্রচূড়-পদদ্বন্দ্ব।
কাশীরাম দাস কহে পয়ার প্রবন্ধ।।