৮.৬ রানী সাবীলা

রানী সাবীলা

ক্রুসেড যুদ্ধ তুলে পৌঁছে গিয়েছিলো। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাইতুল মুকাদ্দাস জয় সমগ্র ইউরোপকে তীব্র এক ভূ-কম্পনের ন্যায় কাঁপিয়ে তোলে। সুলতান আইউবী জীবনের মিশন বাস্তবায়িত করে ফেলেছেন। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় ছিলো তার জীবনের পরম লক্ষ্য। তবে বাইতুল মুকাদ্দাসকে ক্রুসেডারদের দখল থেকে মুক্ত করাই যথেষ্ট ছিলো না। এই পবিত্র নগরীটির প্রতিরক্ষা মৃদুঢ় করাও আবশ্যক ছিলো। তার জন্য নগরীর চারদিকে শক্ত প্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আশপাশের অঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকাগুলো দখলে আনাও জরুরি। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে ফেলেছেন। অবশিষ্টগুলোর উপর সুলতানের বাহিনী আক্রমণ করছে আর দখল করে নিচ্ছে।

বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে খৃষ্টান নাগরিকরা পালিয়ে যাচ্ছে। যেসব অঞ্চলের উপর খৃস্টানদের দখল ছিলো, সেখানে তারা মুসলমানদের বেঁচে থাকাকে হারাম করে রেখেছিলেন। তাদের জন্য মুসলমানদের গণহত্যা দৈনন্দিন কর্মসূচি ও ধর্মীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার বিপরীতে সুলতান আইউবী যখন যে অঞ্চল জয় করতেন, সেখানকার খৃস্টান অধিবাসীদেরকে নিজ বাহিনীর নিরাপত্তায় বের করে দিতেন, যাতে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এখন ফিলিস্তীনেও তিনি একই নীতি অবলম্বন করেন। একজন খৃষ্টান নাগরিকও যাতে নিগ্রহের শিকার না হয়, সুলতান আইউবী তার নিশ্চয়তা বিধান করেন।

হেডকোয়ার্টার থেকে যতোই দূরে থাকুক না কেন, সুলতান আইউবী তাঁর প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছেন এবং তাদেরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাউকে কিছু করতে দিচ্ছেন না। গেরিলা বাহিনী শকুন ও ব্যাঘ্রের ন্যায় পাহাড়-পর্বত ও বন-বিয়াবানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানেই খৃস্টান বাহিনীর কোনো ইউনিট কিংবা রসদের বহর চোখে পড়ছে, অমনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কমান্ডো আক্রমণ করছে, হতাহত করছে ও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাদের ঘোড়া, অস্ত্র ও রসদ সরঞ্জামাদি তুলে আনছে।

এই গেরিলারা যেসব কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করেছে, ইসলামের ইতিহাসে সে এক বিস্ময়কর, ঈমানদীপ্ত ও অস্বাভাবিক বীরত্বের কাহিনী। তার প্রতিটি কাহিনী লিখতে গেলে এই সিরিজ শেষ হবে না। তারা ছিলো ফিলিস্তীনের মাটির প্রহরী। তারা একজন একজন দুজন দুজন ও চারজন চারজনের দলে বিভক্ত হয়ে শত শতজনের শত্রুসেনা দল ও ক্যাম্পের উপর আক্রমণ চালিয়ে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতো কিংবা নিজেদেরই রক্তে ডুবে যেতো। নিজেদের লাগানো আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হতো। শহীদ হওয়ার পর তাদের কপালে কাফন জোটেনি। কেউ তাদের জানাযা পড়েনি। কাউকে সসম্মানে কবরস্ত করা হয়নি।

তারা শত্রুর উপর গজবরূপে আবির্ভূত হতো। তাদেরই উপর নির্ভর করে বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর সুলতান আইউবী সমগ্র ফিলিস্তীনে সিংহের ন্যায় হুংকার দিয়ে চলছিলেন। সুলতান আইউবীর এই গেরিলা ও কমান্ডো বাহিনীগুলো সম্পর্কে প্রখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোল লিখেছেন–

এই বিধর্মীরা (মুসলমানরা) আমাদের নাইটদের ন্যায় ভারি বর্ম পরিধান করতো না। অথচ তারা আমাদের বর্মপরিহিত নাইটদেরকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দিতো। তাদের উপর আক্রমণ হলে তারা পালাতো না। তাদের ঘোড়াগুলো সমগ্র পৃথিবীতে সবচে দ্রুতগামী ঘোড়া বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তারা যখন দেখতে, খৃস্টানরা তাদের। পেছন থেকে সরে গেছে, তখন তারা পুনরায় ফিরে আসতো। এরা ছিলো সেই ক্লান্তিহীন মাছির ন্যায়, যাদেকে উড়িয়ে দিলে মুহূর্তের জন্য উড়ে আবার ফিরে এসে গায়ে বসে। সারাক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সরে থাকে। যখনই এই প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয়া হয়, অমনি কমান্ডো হামলা করে বসে। তারা পার্বত্য অঞ্চলের ঝড়-বৃষ্টির ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে এসে খৃস্টান বাহিনীর বিন্যাস চুরমার করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতো। তারা আমাদের নাইটদেরকে পায়ে পায়ে অস্থির এবং বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করে রাখতে।

***

বর্তমানে যে ভূখণ্ডটিকে ইসরাইল বলা হয়, এটিই সেই পবিত্র ভূমি, যাকে খৃষ্টানদের থেকে মুক্ত করার জন্য সুলতান আইউবীর আমলে আল্লাহর এক একজন সৈনিক সেখানে নিজ দেহের রক্তের নজরানা দিয়েছিলো। সুলতান আইউবী কয়েকটি বসতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। মাঝে-মধ্যে মনে হতো তার হৃদয়ে একবিন্দু মমতা নেই। কিন্তু তিনি মমতার এমন এক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন যে, খৃষ্টান ঐতিহাসিকরাও তার প্রশংসা করেছেন। তার নিকট দয়া ভিক্ষার জন্য খৃস্টানদের এক রানীও এসেছিলেন। এসেছিলো এক অসহায় গরীব খৃস্টান মহিলাও।

খৃস্টান রানীর নাম ছিলো সাবীলা। মহিলা প্রখ্যাত খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডের স্ত্রী ছিলেন। হিত্তীন যুদ্ধের সময় তিনি তাবরিয়ার দুর্গের রানী ছিলেন। রেমন্ড হিত্তীনের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তাবরিয়ার দুর্গ সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সুলতান আইউবী তাকে বন্দি করেননি। সেই যুদ্ধে বাইতুল মুকাদ্দাসের ম্রাট গাই অফ লুজিনান সুলতান আইউবীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন।

বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর সুলতান আইউবী আক্ৰায় ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছেন। তার নিকট সংবাদ আসে, রানী সাবীলা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন। সুলতান তাকে বারণ করেননি। বরং এগিয়ে গিয়ে রানীকে স্বাগত জানান।

সালাহুদ্দীন!- রানী সাবীলা বললেন- আপনি কি জানেন, কতো হাজার নাকি কতো লাখ খৃস্টান গৃহহীন হয়ে পড়েছে? তাদের উপর এই

অবিচার আপনার নির্দেশে হয়েছে।– আর আপনারা যে নিরপরাধ মুসলমানদের গণহত্যা করিয়েছেন এবং করিয়ে যাচ্ছেন, সেটা কার আদেশে হয়েছিলো?- সুলতান আইউবী তার উত্তরের অপেক্ষা না করে বললেন- আমি যদি রক্তের বদলা রক্ত দ্বারা গ্রহণ করি, তাহলে একজন খৃস্টানও রক্ষা পাবে না। তা আপনি কেন এসেছেন? আমার নিকট এই অভিযোগ দায়ের করতে?

না- রানী সাবীলা উত্তর দেন- আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। গাই অফ লুজিনান আপনার হাতে যুদ্ধবন্দি হয়ে আছেন। আমি তাকে মুক্ত করতে এসেছি।

আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না, তাকে কেনো মুক্ত করতে চাচ্ছেন- সুলতান আইউবী বললেন- তবে জানতে চাই, তাকে কোন শর্তে মুক্তি দেবো

আপনার পুত্র কিংবা ভাই যদি শক্রর হাতে বন্দি হয়, তাহলে কি আপনি তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করবেন না রানী সাবীলা পাল্টা প্রশ্ন করেন।

আপনাদের নিকট আমার যতো কমান্ডার ও সৈনিক বন্দি আছে, তারা সকলে আমার পুত্র-ভাই- সুলতান আইউবী বললেন- যদি স্বয়ং আমিও বন্দি হয়ে যাই, তবু আপনার নিকট আমি মুক্তি ভিক্ষা চাইবো না। আমার কোনো পুত্র কিংবা ভাই আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আপনার নিকট যাবে না।

সালাহুদ্দীন।- রানী সাবীলা বললেন- আপনি নিজে রাজা। নিশ্চয়ই বোঝেন, একজন রাজার কারাগারে পড়ে থাকা তার জন্য কতো বড় অপমান। তিনি তো জেরুজালেম এবং আশপাশের দূর-দূরান্ত অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন।

জেরুজালেম নয়- বায়তুল মুকাদ্দাস- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন- তোমাদের গাই এই ভূ-খণ্ডটির লুটেরা ছিলেন। আমরা কোনো লুটেরাকে ম্রাট বলি না। যদি বলতেন, তিনি ইসলামের মূলোৎপাটন করে এখানে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন, তাহলে আমি আপনাকেও শ্রদ্ধা করতাম এবং তাকেও। আমি সেই লোকদের মন-প্রাণ দিয়ে শ্রদ্ধা করি, যারা আপন ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হোক তার ধর্ম ভিত্তিহীন বা মিথ্যা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি না নিজেকে রাজা মনে করি, না কারো রাজত্ব স্বীকার করি। রাজত্ব শুধুই আল্লাহর। আমরা। তাঁর রাজত্বের পাহারাদার ও সংরক্ষক মাত্র। আমরা আল্লাহর সৈনিক।

আমরাও খোদার রাজ প্রতিষ্ঠার কাজ করছি। রানী সাৰীলা বললেন।– আমি যে খোদায় বিশ্বাসী, আপনিও যদি সেই একই খোদায় বিশ্বাসী হতেন, তাহলে রাজার নয়- রাজার সাধারণ সৈনিকদের মুক্তির আবেদন নিয়ে আসতেন- সুলতান আইউবী বললেন- আপনার অস্বীকার না করা উচিত, এই ভূখও আমাদের আপনাদের নয়। খৃষ্টানরা এখানে শান্তিপ্রিয় নাগরিকের ন্যায় থাকতে পারে- রাজী হয়ে নয়। আপনার দৃষ্টান বন্ধুদের বলে দিন, তারা মানুষের খুন ও লুটপাট থেকে ফিরে আসুক এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাক। আপনাদের প্রতিটি অস্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। আপনারা আপন নিষ্পাপ মেয়েদেরকে পাপের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন এবং তাদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিয়েছেন। আপনারা আমাদের ধর্মনেতাদের ছদ্মবেশে নাশকতাকারী সন্ত্রাসী প্রেরণ করে আমার জাতির বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। আপনারা হীরা-জহরত, মদ ও রূপসী মেয়েদের দ্বারা আমার জাতির মাঝে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বপন করেছেন এবং গৃহযুদ্ধ করিয়েছেন। আপনার হাশিশিদের দ্বারা আমাকে হত্যা করাবার একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। হ্যাঁ, ক্রুশের রানী। একটি কাজে আপনারা সফল হয়েছেন যে, আপনারা ইসলামী সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন এবং মুসলমানদের দ্বারা মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছেন।

আমার প্রিয় সুলতানা রানী সাবীলা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মানসে বললেন- আমি এতো দীর্ঘ ও জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। আপনি গাই অফ লুজিনানকে মুক্তি দিন।

আমি জানি, এরপর আপনি আর আমার কাছে আসবেন না সুলতান আইউবী বললেন- কেবল আমার এই তাবুতেই নয়- এরপর আপনাকে কোনোদিন এই ভূখণ্ডের কোথাও দেখা যাবে না। আমি আপনাকে আলোচনায় জড়িয়ে রাখতে চাই না। আপনাকে আমি একটি বার্তা দিচ্ছি। এই বার্তাটি আপনি আপনার ক্রুশের সকল পূজারীর কানে পৌঁছিয়ে দেবেন।…

কোথায় আপনাদের সেই বড় কুশ, যার উপর হাত রেখে আপনারা শপথ নিয়েছিলেন যে, আরব ভূমিকে পদানত করবেন, মসজিদে আকসা ও খানায়ে কাবাকে নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের উপাসনালয় বানাবেন সেই কুশ আমার কজায়। আর আপনাদের সেই প্রত্যয় এখন আমার অনুগ্রহ অনুকম্পার প্রত্যাশী। যে ভূখণ্ডটিকে আপনারা জেরুজালেম বলেন, সেটি এখন বাইতুল মুকাদ্দাস এবং চিরদিন বাইতুল মুকাদ্দাসই থাকবে।

আপনার বাহিনী উন্নত এবং সংখ্যায় বেশি রানী সাবীলা বললেন আমাদের বাহিনীর নেতৃত্ব ত্রুটিপূর্ণ।

বাস্তবকে লুকাবার চেষ্টা করবেন না রানী সাবীলা। সুলতান আইউবী বললেন নিজেকে ধোঁকা দেবেন না। আত্মপ্রতারণা পরাজয়ের লক্ষণ। আমার সেনাসংখ্যা কোনদিন খৃষ্টান বাহিনীর চেয়ে বেশি ছিলো না। উন্নতও নয়। আমার ফৌজের কপালে কখনো বর্ম জোটেনি। আপনাদের ঈমানদীপ্ত দান সালারদের তাঁবুতে যেরূপ রূপসী নারীরা শোভা পায়, আমার সালাররা সেরূপ নারী কখনো পায়নি। আমার সৈন্যদের অস্ত্র আপনাদের চেয়ে উন্নত নয়। তবে আমি আপনাকে আমাদের গোপন কথাটা বলে দিচ্ছি, আমার বাহিনীর কাছে একটি শক্তি আছে, আপনাদের বাহিনীর যার থেকে বঞ্চিত। আমরা তাকে ঈমান ও নবীপ্রেম বলি। আপনাদের বিশ্বাস যদি সঠিক হতো,তাহলে খোদা আপনাদের জাতির প্রিয়ভাজন হতেন। কিন্তু তারা তো অদ্বিতীয় এক খোদাকে এক পুত্রের জনক বানিয়ে রেখেছে। আপনারা খোদাকে মানুষের কাতারে নামিয়ে এনেছেন এবং তাঁর রাজত্বের কাছে নতি স্বীকারের পরিবর্তে নিজেদেরকে রাজার আসনে বসিয়েছেন।

আপনি কি আমাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিচ্ছেন? রানী সাবীলা জিজ্ঞেস করেন।

রানী সাবীলা!- সুলতান আইউবী রানী সাবীলার কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। আঁচ করে বললেন- আমার আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, আমি তাদেরকে বিবেক দিয়েছি, কিন্তু তারা চিন্তা করে না। আমি তাদেরকে চোখ দিয়েছি; কিন্তু তারা দেখে না। আমি তাদের কান দিয়েছি; কিন্তু তারা শোনে না। মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, আমি যখন তাদের জন্য শাস্তি অবধারিত করি, তখন তাদের মন-মস্তিষ্কের উপর মোহর এঁটে দেই। আপনি ইসলাম গ্রহণ না করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, বিজয় সে-ই লাভ করে, যার অন্তরে ঈমান থাকে। আমার জাতির কর্ণধারদের হৃদয় থেকে যখন আপনারা সম্পদ, নারী ও মদের মাধ্যমে ঈমান বের করে দিয়েছিলেন, তখন আমরা আপসে যুদ্ধ ও রক্তারক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ আমাদের শান্তিদান করেছেন। সমগ্র জাতি পাপে লিপ্ত হয় না। পাপ করে কর্ণধাররা। কিন্তু শাস্তি ভোগ করে দেশের প্রতিজন নিরীহ মানুষ। জাতি পাপ করে না তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়।

আমার আসল শক্তি হচ্ছে, আমি যখন পরাজিত হই, তখন তার দায়ভার নিজের মাথায় তুলে নেই। তখন জাতি পরাজয়কে জয়ে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়ে যায়। পরাজয়ের দায়ভার যদি একজন অপরজনের উপর চাপাতে চেষ্টা করে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে থাকে, তাহলে এক পরাজয়ের পর আরেক পরাজয় সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আমি যদি তা-ই করতাম, তাহলে দ্বিধাবিভক্ত সালতানাতে ইসলামিয়া বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তো। মুহতারামা! আমাদের গৃহযুদ্ধের জন্য দায়ী আস-সালিহ ছিলো কিংবা সাইফুদ্দীন, আপনি ছিলেন অথবা গোমস্তগীন। কিন্তু আমি আমার সালারদের বলে দিয়েছি, এ দায়-দায়িত্বও আমার। তার মোকাবেলায় আমি প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহার করেছি এবং আল্লাহর সৈনিকগণ রক্তের বিনিময়ে খণ্ডিত সাম্রাজ্যকে এক সুতোয় গেঁথে নিয়েছি। রক্তের আঁঠায় জোড়া লাগানো খণ্ড পরে কোনোদিন আলগা হয় না রানী সাবীলা! আপনি স্মরণ করুন, আপনাদের বাহিনী মদীনা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। অথচ আজ আপনি আমার নিকট আপনার একজন সম্রাটের মুক্তি ভিক্ষা চাচ্ছেন। এ কোন্ কাজের ফল? সে কাজটি হচ্ছে, মহান আল্লাহ আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমি জীবনের বাজি লাগিয়ে সে কর্তব্য পালন করেছি। আল্লাহ আমাকে তার জন্য পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।

রানী সাবীলা মনোযোগ সহকারে সুলতান আইউবীর বক্তব্য শুনছিলেন। কিন্তু যৌবনদীপ্ত চিন্তাকর্ষক রূপসী নারী সাবীলার রাঙা ঠোঁটে অবজ্ঞার মুচকি হাসি, যে হাসির মর্ম সুলতান আইউবী ভালোভাবেই বোঝেন।–

আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি না- সুলতান আইউবী বললেন- আপনার মুখের হাসি বলছে, এই তাবু থেকে বের না হয়েই আপনি আমার কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলবেন, যেভাবে হিত্তীন ও বাইতুল মুকাদ্দাসে আপনাদের বাহিনী অস্ত্র ত্যাগ করেছিলো। কথাগুলো আমি আপনাকে এ জন্য বলছি যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ আছে, যাদের চোখে আবরণ পড়ে গেছে, তাদের আবরণ খুলে দাও এবং তাদের হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝিয়ে দাও। ভেবে দেখুন সম্মানিতা রানী? আপনার স্বামী আমাকে হত্যা করার লক্ষ্যে চারবার সংহারী আক্ৰমণ করিয়েছিলো। একবার আমি গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিলাম। সে অবস্থায় তারা আমার উপর হামলা চালিয়েছিলো। কিন্তু হলো কী? তারা নিজেরাই খুন হলো। একবার আমি একাকি তাদের ঘেরাওয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি রক্ষা পেয়ে গেলাম আর তারা মারা গেলো। আপনার সেই স্বামী নিজেই শেষ পর্যন্ত সেই ফেদায়ীদের হাতে খুন হলো। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারলো না। বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন।

 মন দিয়ে শুনুন রানী! হিত্তীনের রণাঙ্গন থেকে আপনার স্বামী যুদ্ধ না করে পালিয়ে গিয়েছিলো। আপনিও বিনাযুদ্ধে তাবরিয়ার দুর্গ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আপনারা সকলে যে বড় কুশটির উপর হাত রেখে যুদ্ধ করার ও জীবন দেয়ার শপথ করেছিলেন, সেটি সেই রণাঙ্গনেই আপনাদের সেই পাদ্রীর রক্তে ডুবে গিয়েছিলো, যাকে আপনারা ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ বলে থাকেন। সেই কুশ এখন আমার দখলে। আর আপনি আমার নিকট গাই অফ লুজিনানের মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছেন।

এ বিষয়গুলো আপনি আমাকে স্মরণ করাচ্ছেন কেননা রানী সাবীলা ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন।

যাতে আপনি মহান আল্লাহর এই ইঙ্গিতগুলো বুঝতে পারেন-সুলতান আইউবী উত্তর দেন- আপনার চোখের উপর রাজত্বের পট্টি বাধা আছে। রাজত্ব ও ক্ষমতা আপনার জন্য বিরাট এক গৌরবের বিষয়। তাছাড়া আশা করি, আপনি এই সত্যটাকেও অস্বীকার করবেন না যে, একজন রূপসী নারী হওয়ার জন্য আপনি গর্বিত। আমি একথা বলে আপনাকে খুশি করতে পারি যে, বাস্তবিকই আপনি সুন্দরী। তবে এ কথা বলে নিরাশও করবো যে, আপনার রূপে প্রভাবিত হয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। আপনার অর্ধনগ্ন দেহ আমাকে সরল-সঠিক পথ থেকে সরাতে পারবে না।

রানী সাবীলা একজন সাধারণ মহিলার ন্যায় হেসে ওঠেন এবং বলেন আমাকে বলা হয়েছিলো আপনি পাথর।

সুলতান আইউবী মুচকি হেসে বললেন- আপনার জন্য আমি অবশ্যই পাথর। কিন্তু আসলে আমি এমন এক মোম, যা ঈমানের উত্তাপে গলে যায়– এবং মমতার জযবাও তাকে গলিয়ে দেয়। দৈহিক সুখভোগ ও বিলাসিতা মানুষকে অকর্মণ্য করে তোলে। এমন ব্যক্তি না নিজের কোনো কাজে আসে, না জাতির। খোদার দরবারেও তার কোনো স্থান থাকে না।

আমি আপনার হৃদয়ে মমতার জযবা সৃষ্টি করতেই এসেছিলাম- রানী সাবীলা বললেন- গাইকে মুক্তি দিন। আমি শুনেছি সাচ্চা মুসলমানের ঘরে যদি দুশমন ঢুকে পড়ে, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

এবার রানী সাবীল অনুনয়-বিনয়ের সুরেই কথা বলতে থাকেন। সুলতান আইউবী বললেন, গাইকে এক শর্তে মুক্তি দিতে পারি। সে আমাকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেবে, জীবনে কখনো আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না।

রানী সাবীলা বললেন, লিখিত শপথনামা দেয়া হবে। এ-ও লেখা হবে, যদি তিনি এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন এবং পরে কখনো গ্রেফতার হোন, তাহলে আপনি তাকে হত্যা করে ফেলবেন।

সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়। রানী সাবীলা চলে যান।

ঈমানদীপ্ত আত্মন ০২০৬

সুলতান আইউবী সেদিনই গাই অষ্ণ লুজিনানের মুক্তির আদেশনামা দিয়ে দামেশকে দূত পাঠিয়ে দেন। তিন-চারদিন পর গাইকে সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে আসা হলো। সুলতান বললেন, চুক্তিনামাটি তাকে তার ভাষায় শোনাও। যদি সে প্রয়োজন মনে করে, তাহলে তার ভাষায়ও লিখে স্বাক্ষর নিয়ে নাও।

আর তাকে বলে দাও, আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলবো না সুলতান আইউবী বললেন- তাকে বলে দাও, আমি জানি সে এই চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে। তাকে আরো বলে দাও, রানী সাবীলার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমি তাকে মুক্তি দেইনি। তাকে জানাতে চাই, আমি তার মতো অপরাধীকে ক্ষমা করতে জানি। আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছি। কারো নিকট থেকে আমি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চাই না। আর সে যেখানে যেতে চায়, নিরাপত্তা প্রহরায় পৌঁছিয়ে দাও।

গাই অফ লুজিনান- যিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের শাসনকর্তা ছিলেন এবং হিত্তীন যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন- শপথনামায় স্বাক্ষর করে সুলতান আইউবীর সম্মুখে এসে দাঁড়ান। সুলতান তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দেন। গাই আগ্রহের সঙ্গে সুলতানের সঙ্গে হাত মেলান এবং বললেন- আইউবী! তুমি মহান।

গাই অফ লুজিনান মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে সুলতান আইউবীর তাবু থেকে বেরিয়ে যান।

***

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ গাই অফ লুজিনানের মুক্তির ঘটনা উল্লেখ করে একে রানী সাবীলার কৃতিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন। তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী রানী সাবীলার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং গাইকে নিজের মতো একজন রাজা জ্ঞান করে মুক্তি দিয়েছিলেন। তারা এও বুঝনোর কসরত করেছেন যে, সাধারণ ও গরীব লোকদের প্রতি সুলতান আইউবীর কোনো সমবেদনা ছিলো না। অথচ তাদের এই মূল্যায়ন সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এক গরীব খৃষ্টান মহিলার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।

গাই অফ লুজিনানের মুক্তির পর যখন খৃষ্টানরা উপকূলীয় নগরী আক্রমণ অবরোধ করে দেখেছিলেন, সে সময়কার ঘটনা। খৃষ্টান বাহিনীর ক্যাম্পের সঙ্গেই সেই খৃষ্টান নাগরিকদের আশ্রয় শিবির ছিলো, যারা বাইতুল মুকাদ্দাস ও অন্যান্য স্থান হতে বেরিয়ে এখানে এসে সমবেত হয়েছিলো। অবরোধের বয়স দুবছর হয়ে গেছে। একদিকে সুলতান আইউবীর গেরিলা সৈনিকরা অবরোধকারী খৃস্টান সৈনিকদের কোনো না কোনো অংশের উপর গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে, উক্ত অঞ্চলের অসামরিক মুসলমানরাও তাদের নানাভাবে বিরক্ত ও অস্থির করে চলেছে। খৃস্টান নাগরিকরা সৈন্যদের সঙ্গে ছিলো বলে সৈন্যদের অনেক সাহায্য দিচ্ছে।

অসামরিক মুসলমানরা উক্ত অসামরিক খৃস্টানদেরও উত্যক্ত-পেরেশান করতে থাকে। তারা রাতে তাদের ক্যাম্পে ঢুকে যেতো এবং তাদের জিনিসপত্র তুলে নিয়ে আসতো। কখনো কখনো এক-দুজন খৃস্টানকেও তুলে নিয়ে আসতো এবং তাদেরকে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে ঢুকিয়ে দিতো। সাধারণ খৃস্টানরা নিজ বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানাতে থাকে যে, মুসলমান চোর-ডাকাতরা রাতে তাদের মালপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বাহিনী পাহারার ব্যবস্থা করে। তথাপি এই চুরি ও অপহরণের ধারা অব্যাহত থাকে।

এক রাতে এক ব্যক্তি খৃস্টানদের ক্যাম্প থেকে তিন মাস বয়সের একটি শিশুকন্যাকে তুলে নিয়ে আসে। মায়ের একমাত্র কন্যা এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু। মহিলা হাউমাউ শুরু করে দেয়। খৃস্টান কমান্ডারদের নিকট যায়। সে পাগলের মতো হয়ে গেছে। খৃস্টানদের সেনাপতি পর্যন্ত গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে। সেনাপতি তাকে পরামর্শ দেয়, সুলতান আইউবীর ক্যাম্প কাছেই আছে; তুমি গিয়ে বিষয়টা তাকে জানাও। সকলের দৃঢ় বিশ্বাস, শিশুটিকে কোনো মুসলমানই তুলে নিয়ে গেছে।

পাগলপারা মা জিজ্ঞেস করে করে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে এসে হাজির হয়। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, তিনি তখন সুলতান আইউবীর পার্শ্বে দাঁড়ানো ছিলেন এবং সুলতান কোথাও যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় চড়ে বসেছেন। এক ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে, এক গরীব খৃস্টান মহিলা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। সে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে। সুলতান আইউবী বললেন, তাকে এক্ষুনি নিয়ে আসো। নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষ থেকে তার উপর বাড়াবাড়ি হয়ে থাকবে।

মহিলা সুলতান আইউবীর সামনে এসে ঘোড়ার সন্নিকটে ধপাস করে বসে পড়ে এবং মাটিতে মাথা ঠুকে ঠুকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সুলতান বললেন, ওঠে বলো তোমার উপর কে জুলুম করেছে?

আমাদের বাহিনীর সেনাপতি বললেন, তুমি সুলতান আইউবীর নিকট চলে যাও, তিনি খুব দয়ালু মানুষ। তিনি তোমার ফরিয়াদ শুনবেন- মহিলা বললো- আপনার লোকেরা আমার একমাত্র দুগ্ধপোষ্য শিশু কন্যাটিকে তুলে এনেছে।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, মহিলার ফরিয়াদ-ক্রন্দনে সুলতান আইউবীর চোখে অশ্রু নেমে আসে। শিশুটি অপহৃতা হয়েছে সাত দিন হয়ে গেছে। সুলতান আইউবী ঘোড়র পিঠ থেকে নেমে আসেন। তিনি আদেশ করেন, এক্ষুনি খোঁজ নাও, শিশুটিকে কে এনেছে। তিনি মহিলাকে আহার করাতে বললেন এবং যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো পরিকল্পনা মুলতবি করে দেন।

যেসব সাধারণ মুসলমান খৃস্টান ক্যাম্প থেকে মালপত্র নিয়ে আসতো, তারা বাহিনীর সঙ্গেই থাকতো। তাদের যে লোকটি শিশুটিকে তুলে এনেছে, সে ক্যাম্পেই অবস্থান করছে। সংবাদ শুনে সে সুলতান আইউবীর নিকট ছুটে গিয়ে বললো, মহামান্য সুলতান! শিশুটিকে আমি এনেছি এবং বিক্রি করে ফেলেছি। সুলতান আইউবী আদেশ করেন, যাও, মূল্য ফেরত দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসো।

সুলতান আইউবী শিশুটির এসে না পৌঁছা পর্যন্ত নিজ তাঁবুতে অবস্থান করেন। শিশুটি বেশি দূরে যায়নি। ফলে পেতে তেমন সময় লাগেনি। তার মূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে। সুলতান নিজ হাতে শিশুটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে কলিজার টুকরোটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে এবং এমন আবেগের সাথে আদর করে যে, (শাদ্দাদের ভাষায়) আমাদের সকলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সুলতান আইউবী মহিলাকে একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে বিদায় করে দেন।– বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর মুসলমানদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং ফিলিস্তীনের প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে খৃস্টানরা উৎখাত হয়ে গেছে। খৃস্টান জগতে কম্পন ও হতাশা নেমে এসেছে। সে যুগে সামরিক দিক থেকে তিনটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী জ্ঞান করা হতো- ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ড। তাদের পোপ স্বয়ং প্রতিটি দেশের সম্রাটদের নিকট গিয়ে গিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে তার বক্তব্য ছিলো নিম্নরূপ–

তোমরা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে উঠে না দাঁড়াও, তাহলে সমগ্র ইউরোপ থেকে ক্রুশ উৎখাত হয়ে যাবে এবং সর্বত্র ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়ে যাবে। এই যুদ্ধ সালাহুদ্দীন আইউবীর ব্যক্তিগত যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ খৃষ্টবাদ ও ইসলামের যুদ্ধ। আমাদের বড় ক্রুশ মুসলমানদের দখলে। জেরুজালেমের উপর মুসলমানদের পতাকা উড়ছে। হাজার হাজার খৃষ্টান নারী মুসলমানদের কবলে চলে গেছে। তাদেরকে মুসলিম সৈন্যদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হচ্ছে। তোমরা কি ঘরে বসে ইসলামের ক্রমবর্ধমান এই ঝডুকে প্রতিহত করতে পারবে? তোমরা কী করে সহ্য করছো, যে ক্রুশের উপর হযরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো, সেটি মুসলমানদের হাতে চলে যাবে?

এ জাতীয় উত্তেজনাকর সত্য-মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে পোপ বড় বড় খৃস্টান কমান্ডারদের উত্তেজিত করে তোলেন। জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিক দুলাখ সৈন্য নিয়ে সকলের আগে চলে আসেন। তিনি কারো সঙ্গে জোট বাঁধবার প্রয়োজন মনে করেননি। সম্পূর্ণ নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন তিনি। সে অনুযায়ী তিনি দামেশকের উপর আক্রমণ চালান। তার জন্য দুর্ভাগ্য ছিলো যে, তিনি সুলতান আইউবীর রণকৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। দুলাখ সৈন্যের উপর ভরসা করে তিনি আরব ভূখণ্ডকে দখল করতে এসেছিলেন। তার দামেশক আক্রমণকে দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ বলা হয়। কিন্তু ফ্রেডারিক এই দুলাখ সৈন্য দ্বারা দামেশকের একটি ইটও খসাতে সক্ষম হননি। মুসলমান গেরিলারা তার রসদের উপর এমন দুঃসাহসী কমান্ডো আক্রমণ চালায় যে, তারা তার হাজার হাজার ঘোড়া ও ঘোড়াগাড়ি নিয়ে আসে। রসদগুলো তাদের বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।

ফ্রেডারিক শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। তার রসদের অভাব দেখা দেয়। বিপুলসংখ্যক সৈন্য প্রাণ হারায়। তিনি পেছনে সরে গিয়ে নতুন উদ্যমে দামেশক আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দেন। কিন্তু মুসলিম গেরিলারা তার বাহিনীকে স্থির হয়ে বসতে দেয়নি। পানির উৎসগুলোও মুসলমানরা দখল করে নেয়। ঘটনাটা ১১৯১ সালের ২০ জানুয়ারি মোতাবেক ৫৮৬ হিজরীর ২২ যিলহজ্বের। শোকাহত হয়ে জার্মানিরা তাদের ক্যাম্পে স্থানে স্থানে কাঠ সঞ্চয় করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যেনো ক্যাম্প জ্বলছে। এদিকে মুসলিম সৈন্যরাও নিজ ক্যাম্পে উল্লাসে মেতে ওঠে।

 ফ্রেডারিকের এক পুত্র জার্মানি বাহিনীর কমান্ড হাতে তুলে নেয়। তার জানা ছিলো, ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস ও ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ডও আসছেন। তারা রণতরী নিয়ে আসছেন। ফ্রেডারিকের পুত্র বাহিনীকে ফিলিস্তীনের উপকূলীয় নগরী আক্রার দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। সুলতান আইউবী তার সালারদেরকে পূর্বেই দিক-নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। সে মোতাবেক তারা খৃষ্টান বাহিনীর উপর আক্রমণ না করে যেতে দেয়। সালারদের জানা ছিলো, পথে তাদের কমান্ডো বাহিনী উপস্থিত রয়েছে। তাদের কৌশল ছিলো, তারা শত্রু বাহিনীর একেবারে পেছন অংশের উপর আক্রমণ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো। তারা সংখ্যায় ছিলো অনেক। রাতে জার্মানরা প্যারেড করার সময় কমান্ডোরা ছোট মিনজানিকের সাহায্যে তরল দাহ্য পদার্থ ভর্তি পাতিল এবং পরক্ষণেই জ্বলন্ত সলিতাওয়ালা তীর ছুঁড়ছিলো। তাতে ক্যাম্পে আগুন ধরে যেতো।

জার্মান বাহিনী যখন আক্রা পৌঁছে, তখন তাদের সেনাসংখ্যা কমে বিশ হাজারে নেমে এসেছিলো। অথচ এই বাহিনী যখন পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করে, তখন সংখ্যা ছিলো দুলাখ। তাদের কিছু দামেশক আক্রমণের সময় নিহত হয়েছে। কিছু রোগ ও ক্ষুৎপিপাসায় মারা গেছে। কিছু দামেশক থেকে আক্রা যাওয়ার সময় পথে মুসলিম গেরিলাদের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। সেই সৈনিকদের সংখ্যাও কম ছিলো না, যারা ফৌজ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। শেষমেষ যে বিশ হাজার রক্ষা পেয়েছিলো, তারা সম্পূর্ণরূপে মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলো। তাদের অন্তর থেকে ক্রুশের শ্রদ্ধা ও নিজেদের শপথ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।

ওদিক থেকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সম্রাটদ্বয় নদীপথে এগিয়ে আসছেন। ইংল্যান্ডের ফৌজ- যারা কাবরাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে- কীরূপ এবং সংখ্যা কতো, সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত সময়মতো জেনে ফেলেছেন। তারা ষাট হাজার। ফ্রান্সের বাহিনীর সংখ্যাও প্রায় অনুরূপ। আছে বিশ হাজার জার্মান ফৌজ। খৃস্টানদের আরো কিছু সৈন্য পূর্ব থেকেই পবিত্র ভূমিতে রয়েছে।

সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত সংবাদ পান, যে সম্রাট গাই অফ লুজিনান ভবিষ্যতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, কাউন্ট অফ কনডের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি বাহিনী গঠন করেছেন, যাতে সাতশ নাইট, নয় হাজার ফিরিঙ্গ সৈন্য এবং বারো হাজার ওলন্দাজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় অফিসার-সৈন্য রয়েছে। এভাবে শুধু তার বাহিনীরই সেনা সংখ্যা প্রায় বাইশ হাজার হয়ে গেছে। আনুমানিক হিসেবে খৃস্টান যৌথ বাহিনীর সেনাসংখ্যা ৬ লাখে দাঁড়িয়েছে, যারা অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামের দিক থেকে। ইসলামী ফৌজ থেকে উন্নত।

সুলতান আইউবীর সঙ্গে দশ হাজার মামলুক ছিলো। এটি তার একটি নির্বাচিত বিশেষ বাহিনী, যাদের উপর তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। আক্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটি বন্দর এলাকাও। প্রাকৃতিকভাবেই অঞ্চলটা এমন যে, নৌবাহিনীর এক বিশাল ও নিরাপদ ক্যাম্পরূপে গড়ে উঠতে পারে। আক্ৰা নগরীতে সুলতান আইউবীর সৈন্যসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সাহায্য নিতে পারছেন না। কেননা, এটিই সেই ভূখণ্ড, যার জন্য খৃষ্টানদের এই মহা-সমরের আয়োজন-প্রস্তুতি। এর প্রতিরক্ষা এতোটুকুও দুর্বল করা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডের নৌ-বহর অনেক শক্তিশালী ও ভয়ংকর। সুলতান আইউবী ভালোভাবেই জানেন, তার মিসরী নৌ-বহর ইংল্যান্ডের বহরের মোকাবেলা করতে পারবে না।

 সুলতান আইউবীর জন্য এ এক বিশাল ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ, যা তাকে বরণ করে নিতে হলো। কিন্তু তিনি এই ঝড়ের মোকাবেলা কীভাবে করবেন। তার বাহিনী চারটি বছর অবিরাম যুদ্ধ করছে। গেরিলা ও কমান্ডো সেনারা পাহাড়-জঙ্গলে যুদ্ধ করেছে আর জীবন বিলাচ্ছে। নিজেও অনুরূপ জীবন অতিবাহিত করছেন। কাজেই বাহ্যিক বিবেচনায় এখন তার এই বাহিনী যুদ্ধ করার উপযোগী নয়। কতো আর পারা যায়। শুধু ঈমানী চেতনার জোরে এই স্বল্প ও ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বাহিনীটির ৬ লাখ তরতাজা খৃস্টান বাহিনীর মোকাবেলা করা কীভাবে সম্ভব?

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, সুলতান আইউবীর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, তিনি রাতে ঘুমাতেন না। প্রতি মুহূর্ত গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতেন এবং মাথায় যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে থাকতেন। তার স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিলো। একবার অসুস্থও হয়ে পড়েন। তিন দিন বিছানায় পড়ে থেকে চতুর্থ দিন ওঠে বসেন। কিন্তু শরীরে পূর্বের শক্তি আর ফিরে আসেনি। তখন বয়স হয়েছিলো ৫৪ বছর। যৌবনে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং এখনো পাহাড়-বন-বিয়াবনে যুদ্ধ করছেন। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করবেন বলে কসম খেয়েছিলেন। সে কসম তিনি পূর্ণ করেছেন। তারপর প্রতিজ্ঞা নেন, যে কদিন বেঁচে থাকবেন বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ইসলামের পতাকা অপসারিত হতে দেবেন না। এই প্রতিজ্ঞাই তাঁর আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো।

***

আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও সমর বিশেষজ্ঞ এ্যান্থনি ওয়েস্ট হারল্ড ল্যাম্ব, লেনপোল, গিবন ও আরনল্ড প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের সূত্রে লিখেছেন- সুলতান আইউবী একদিন মসজিদে গিয়ে বসেন। সারাদিন আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দুআ করতে থাকেন, যেনো এই নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাকে ইসলামী বাহিনীকে সঠিক ও নির্ভুল নেতৃত্বদানের তাওফীক দান করেন। তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিলো। সন্ধ্যা হয়ে গেলে তিনি মসজিদ থেকে বের হন। তখন তাঁর চেহারায় স্থিরতা ও প্রশান্তি ছিলো।

এ কথা ঠিক যে, সুলতান আইউবী মসজিদে গিয়ে সিজদাবনত; হয়েছিলেন এবং কেঁদে কেঁদে মহান আল্লাহর দরবারে সাহায্য ও দিক নির্দেশনা প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ও কাহিনীকারগণ লিখেছেন, সুলতান দিনে নয়- রাতে মসজিদে আকসায়। গিয়েছিলেন। তিনি সারারাত নামায, দুআ, দরূদ ও অজীফা পাঠে অতিবাহিত করেন এবং ফজর নামায আদায় করে মসজিদ থেকে বের হন।

সে রাতে মসজিদে তিনি একা ছিলেন না। মসজিদের বারান্দায় এক কোণে এক ব্যক্তি গায়ে কম্বল জড়িয়ে বসে ছিলো। লোকটি কখনো সিজদা করছিলো, কখনো হাত তুলে দুআ করছিলো। লোকজন ঈশার নামায আদায় করে মসজিদ থেকে চলে যাওযার পর লোকটি মসজিদে এসে বসেছিলো। মুখটা তার কম্বলে ঢাকা ছিলো।

মুআজ্জিন যখন ফজরের আযান দেন, তখন সে নিজেকে কম্বলে ঢেকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়, এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করার সময় তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখতে থাকে। তারপর লোকটার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করে। কম্বলওয়ালা ব্যক্তি ঘুরে পেছন পানে এক নজর তাকিয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। তাকে অনুসরণকারী লোকটিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। সামনে একস্থানে অপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলো। কম্বলওয়ালা তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং কী যেনো বলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তৃতীয় ব্যক্তি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। অনুসরণকারী লোকটি তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, লোকটি কে ছিলো?

উহ্ তুমি- লোকটি বললো- তুমি ওকে অনুসরণ করছিলে?

 আমি তার পা দেখেছি- অনুসরণকারী লোকটি বললো- লোকটি পুরুষ নয়- নারী। তোমার আত্মীয়? তুমি তাকে চেনো?

এহতেশাম!- লোকটি বললো- আমি জানি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করছে। যে কারো উপর নজর রাখা তোমার কর্তব্যের অংশ। আমি তোমার থেকে কিছুই গোপন রাখবো না। কিন্তু একজন নারীর মসজিদে যাওয়া গুনাহ তো নয়।

তা ঠিক- এহতেশাম বললো- আমার সন্দেহটা হচ্ছে, সে নিজেকে কম্বলে মুড়িয়ে রেখেছে কেনো? শোনো আল-আস! রাতে আমরা তিনজন লোক মসজিদের চারদিকে পাহারার জন্য ঘোরাফেরা করতে থাকি। কারণ, সুলতান ভেতরে ছিলেন। তবে তিনি বিষয়টা জানতেন না। তিনি কাউকে কিছু না বলে মসজিদে এসেছিলেন। তিনি জানেন, তার পোশাকী রক্ষীদের ছাড়াও কেউ তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এটা হাসান ইবনে আবদুল্লাহর ব্যবস্থাপনা। তুমি স্বয়ং ফৌজের একজন কমান্ডার। আমাকে তুমি ভালোভাবেই জানো। সে কারণে কথাগুলো এতো খোলাখুলি বলছি।

বলল এহতেশাম!- আল-আস বললো- বাইতুল মুকাদ্দাসে এবং মসজিদে আকসার এত নিকটে দাঁড়িয়ে কোনো মুসলমান মিথ্যা বলতে পারে না। আমি তোমাকে বলে দেবো, মেয়েটা কে। তার আগে তুমি বলল, তার উপর কেননা তোমার সন্দেহ জেগেছে।

আমি রাতে তাকে বারান্দার কোণে দেখেছি- এহতেশাম উত্তর দেয় সুলতানের নিরাপত্তার খাতিরে তাকে ওখান থেকে তুলে দেয়া আবশ্যক ছিলো। ঈশার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। লোকটার চলে যাওয়া উচিত ছিলো। তখন সুলতান মিম্বরের সামনে ইবাদত ও অজীফায় মগ্ন ছিলেন। এই লোকটি কম্বলে ঢাকা ছিলো। সুলতানের উপর সংহারী আক্রমণ হতে পারতো। কিন্তু মসজিদ থেকে তো কাউকে বের করে দেয়া যায় না। আমি এ-ও দেখলাম, লোকটা অভিনব এক পন্থায় ইবাদত করছে। সিজদা করছে, উঠছে আর দুআর জন্য হাত উত্তোলন করছে। সে নিয়ম অনুযায়ী নামায পড়েনি। আমি আমার সঙ্গীদের বিষয়টা জানালাম। তারা একজন একজন করে ভেতরে গিয়ে এমনভাবে দেখে যে, সে টের পায়নি কেউ তাকে দেখছে। তারা বেরিয়ে এসে বললো, সন্দেহভাজন- নজর রাখতে হবে। কিন্তু তুলে দেয়া যাবে না। কারণ, আমি তার একেবারে পেছনে বসে তার হেঁচকি শুনেছি এবং কিছু শব্দও শুনেছি। যেন সে নিজ পাপের ক্ষমা এবং খৃস্টানদের পরাজয়ের দুআ করছিলো।…

আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এমনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রাত কেটে গেছে। ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়। আমরা সারারাত পালাক্রমে তার উপর নজর রাখি। আযানের পর বেরিয়ে আসবার সময় মসজিদের বাতির আলোতে কম্বলের ফাঁক দিয়ে আমি তার পা দেখেছি। হাতও দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে সে হাতখানা কম্বলে ঢেকে ফেলে। আমি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করি।

হ্যাঁ, বন্ধু!- আল-আস বললো- তুমি ঠিক দেখেছো। লোকটি পুরুষ নয়- নারী। আর খুবই রূপসী ও যুবতী। আমি তোমাকে আরো বলে দিচ্ছি, মেয়েটি একজন গুনাহগার নারী, যে কিনা বিগত দশ বছর আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করেছিলো।

খৃস্টান?

 খৃস্টান ছিলো- আল-আস উত্তর দেয়- এখন মুসলমান। আমি তাকে এক মুসলমানের ঘরে রেখেছি। তুমি তাকে দেওয়ানা বলতে পারো। দরবেশদের ন্যায় কথা বলে।

আর তুমি তার কথায় বিশ্বাস করেছে- এহতেশাম বললো- তুমি রণাঙ্গনের যোদ্ধা। এই নারীদের ছলনা বুঝবে না।

আমার সঙ্গে আসো- আল-আস বললো- তাকে দেখো, তার সঙ্গে কথা বলো। সন্দেহ দূর করো। এটা তোমারই কাজ। বিষয়টা তুমিই ভালো বুঝবে। এটা সত্য যে, আমি তার কথায় বিশ্বাস করেছি। তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা আমিই করেছি। তুমি আমার সঙ্গে আসো।

এহতেশাম আল-আসের সঙ্গে চলে যায়।

***

সেটি এক বুযুর্গের ঘর, যিনি দীর্ঘদিন যাবত বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করছেন। এহতেশাম ও আল-আস তাঁর দেউড়িতে গিয়ে বসে। বুযুর্গ নামায পড়তে মসজিদে গেছেন। এহতেশাম আল-আসকে বললো, আচ্ছা, উনি আসুন। এই ফাঁকে বলো তো, মেয়েটি কোথা থেকে কীভাবে এসেছে। তার ব্যাপারে আরো যা জানো বলো।

গত গ্রীষ্মের ঘটনা- আল-আস বলতে শুরু করে। আমি মিসরের সীমান্ত থেকে সামান্য দূরে গেরিলাদের একটি ইউনিটে ছিলাম। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় হয়ে গেছে। টিলা-পাথর ও মরুভূমিতে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। ওখানে আমাদের কোনো কাজ ছিলো না। একসময় আমাদেরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। আমার হাতে একটি সেনাদলের কমান্ড অর্পণ করা হয়। সঙ্গে খোলজন গেরিলা ছিলো। প্রতিটি দল নিজ নিজ গতিতে ফিরে আসছিলো। একস্থানে অনেকগুলো টিলা স্তম্ভের ন্যায় দণ্ডায়মান ছিলো। কোনো কোনোটি অতিশয় ভয়ঙ্কর ও বিস্ময়কর লাগছিলো। আমার এক গেরিলা রসিকতা করে বললো, এগুলো জিন-পরীদের প্রাসাদ। এখানে রূপসী ও দুশ্চরিত্র নারীর প্রেতাত্মাও থাকতে পারে। শুনে আমাদের হাসি পায়। আমরা টিলাগুলোর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ি।

সেগুলোর চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর স্থানেও আমরা রাত যাপন করেছি। এমন এমন জায়গায়ও বহু রাত ঘুমিয়েছি, যেখানে মানব কংকাল, মাথার খুলি ইত্যাদি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এই টিলাগুলোর ভেতরে ঢোকামাত্র ভয়ে আমাদের সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে ওঠে। আমরা দাঁড়িয়ে যাই। আমি জীবনে এই প্রথমবার ভয় কী জিনিস অনুভব করি। আমার গোটা বাহিনী দাঁড়িয়ে গিয়ে দুআ-দরুদ পড়তে শুরু করে। সামনে এক টিলার ছায়ায় এক মহিলা বসে আছে। মহিলার সর্বাঙ্গ বিবস্ত্র- একদম জন্মকালীন পোশাক পরিহিত। তার সম্মুখে আরেক নারী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে- সেও উলঙ্গ। উপবিষ্ট মহিলাকে যুবতী বলে মনে হলো। তার গায়ের রং গৌর। ওষ্ঠাধর মরুভূমির বালির ন্যায় শুষ্ক ও ফাটা ফাটা। মুখটা খোলা। মাথার চুলগুলো বিক্ষিপ্ত। উলঙ্গ দেহের হাড়গোড় দেখা যাচ্ছে। তবে এই অবস্থায়ও বুঝা যাচ্ছে, মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী।….

মনে প্রশ্ন জাগে- এরা মানুষ না অন্যকিছু। মাথায় উত্তর আসে না, মানুষ হতে পারে না। এটা তো চলাচলের পথ নয় যে, এখান দিয়ে মানুষ গমনাগমন করছে আর দস্যু-তস্করা তাদের লুটে নিয়ে গেছে এবং এরা রক্ষা পেয়ে এখানে এসে লুকিয়ে রয়েছে। আমি আমার সৈনিকদেরকে ভয় দেখাতে চাইলাম না। কিন্তু তারা নিজেরাই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। আমার হৃদয়েও প্রত্যয় জন্মে গেছে, এরা পাপিষ্ঠ নারীর প্রেতাত্মা বৈ নয়। আমি এই আশায় দূরেই দাঁড়িয়ে থাকি যে, ওরা: অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু উপবিষ্টজন বসেই থাকলো আর শায়িতজন শুয়েই রইলো। উপবিষ্টজন পিট পিট চোখে আমাদের দেখতে থাকে। আমার এক সঙ্গী আমাকে কানে কানে বললো, চলুন পেছনে ফিরে যাই। পাশের থেকে একজন বললো, হ্যাঁ চলে যাওয়াই ভালো হবে। তবে এদের দিকে পিঠ দেয়া যাবে না। ভয়ে সকলের গা ছম ছম করছে।

তাদের ও আমাদের মাঝে ব্যবধান বড়জোর পনের পা। আমরা সকলে খুব ধীরে একপা-একুপা করে পেছনে সরে যেতে থাকি। এবার বসা মেয়েটি মাথায় ইঙ্গিত করে, যেনো আমাদের ডাকছে। আমি পেছন পানে আরো একপা তুললে সে আবারো মাথা দ্বারা ইশারা করে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই, তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। আমি বাস্তবিক কোনো শব্দ শুনেছিলাম, নাকি মনে কল্পনা এসেছিলো ঠিক বলতে পারবো না। আমার কানে শব্দ আসে- পলায়ন করো না আল-আস! ওরা মানুষ বৈ নয়। হঠাৎ আমার ডান হাতটা কোমরে চলে যায়। তরবারীটা খুলে এনে কোষমুক্ত করে ফেলি। আমার পা আপনা-আপনি সামনের দিকে এগুতে শুরু করে। আমি সঙ্গীদের কথা শুনতে পাই। তারা আমাকে সম্মুখে যেতে বারণ করছে। আমি আয়াতুল কুরসী পাঠ করতে শুরু করি।

আমি মেয়েটি থেকে তিন-চার পা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। সে ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর আমার দিকে পা বাড়ায়। তার মাথাটা দুলছে। একপা এগিয়ে আরেক পা তুলতে উদ্যত হয়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ এমনভাবে পড়ে যায় যে, তার মাথাটা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে এবং মাথার চুলগুলো আমার পায়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে। আমি উলঙ্গ নারীর গায়ে হাত লাগাতে ইতস্তত করছিলাম। তাছাড়া ভয় তো আছেই। আমার দেখবার ছিলো, মেয়েটি মানুষ না অন্যকিছু। আমি বসে তার শিরায় হাত রাখি। শিরা চলছে। মনে ধারণা জন্মে, জিন-পরীদের হয়তো শিরা থাকে না। এবার তার থেকে সরে আমি শুয়ে থাকা মেয়েটির শিরা দেখি। কাঠফাটা গরম সত্ত্বেও তার দেহটা রাতের মরুভূমির বালির ন্যায় অস্বাভাবিক শীতল। তার শিরায় প্রাণ নেই। মুখটা খোলা। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে। শরীরটা সাদা। আমি তার মধ্যে মৃত্যুর সব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করি।…

আর বসা থেকে ওঠে এসে যে মেয়েটি আমার পায়ের কাছে পড়ে গিয়েছিলো, তার দেহ গরম। এ প্রেতাত্মা কিংবা পরী হতে পারে না। আল্লাহ আমাকে বিবেক ও সাহস দান করেছেন। আমি আমার বাহিনীকে ডাক দেই। আমাদের সঙ্গে খাবার-পানি সবই ছিলো। সঙ্গীদের বললাম, তাড়াতাড়ি দুটি চাদর আর কিছু পানি নিয়ে আসো। তারা চাদর ও পানি নিয়ে আসে। সূর্য এখনো মাথার উপর আসেনি। এখানে উঁচু টিলার ছায়া ছিলো। আমি একখানা চাদর টিলার পাদদেশে ছায়ায় বিছিয়ে তার উপর সংজ্ঞাহীন মেয়েটিকে শুইয়ে দেই এবং অপর চাদর দ্বারা ভালোভাবে ঢেকে রাখি। তার মুখে পানির ছিটা দেই। মুখটা খোলা ছিলো। তাতে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঢেলে দেই। পানি তার কণ্ঠনালী গড়িয়ে ভেতরে চলে যায়।…

সঙ্গীরা আমাকে বারণ করছে, অহেতুক বিপদ ডেকে এনো না। কিন্তু এখন আর আমার কোনো ভয় লাগছে না। সঙ্গীদের কথাও কোনো ক্রিয়া করছে না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে। ঠোঁট দুটো একত্র হয়ে আবার খুলে যায়। আমি আবারো তার মুখে পানি দেই। তারপর আটি বের করে একটি খেজুর তার মুখে রাখি। সে খেতে শুরু করে। এবার মেয়েটি উঠে বসবার চেষ্টা করে। আমি তাকে ধরে তুলে বসিয়ে দেই।

আল-আস এহতেশামকে কাহিনী শোনাচ্ছে—

 আমি তাকে খাবার খেতে দেই। খাবার খেয়ে সে পানি পান করে। আরো খেতে চাইলে খালি পেটে অতো খাওয়া ঠিক হবে না বলে বারণ করি। সে ক্ষীণকণ্ঠে বললো, আমি তোমার ভাষা বুঝি ও বলতে পারি। ঐ মেয়েটি মারা গেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কারা? বললাম, আমরা ইসলামী ফৌজের কমান্ডো সেনা। বাইতুল মুকাদ্দাস যাচ্ছি। সে বললো, তাহলে তো তোমাদের থেকে কোনো করুণা আশা করতে পারি না। আমি বললাম, তুমি বোধ হয় মুসলমান নও। সে বললো, আমি মিথ্যা, বলবো না। তবে সত্য বললেও তুমি আক্ষেপ করবে, কেননা বাঁচিয়ে রাখলাম। আমি বললাম, তুমি শুধু এটুকু নিশ্চিত করো, তুমি মানুষ। শুনে মেয়েটি ফিক করে হেসে ওঠে। আস্তে আস্তে তার চেহারার রং বদলে যেতে শুরু করে। দেহে রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়ে গেছে।…

সহসা মেয়েটির দুচোখের পাতা বুজে আসে। তার ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎই সে অবোধ শিশুর ন্যায় একদিকে কাৎ হয়ে পড়ে গিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

আমরা অনেক খুন ও লুণ্ঠন করেছি। বহু কমান্ডো আক্রমণ চালিয়েছি। কয়েকজন সঙ্গী আমাদের চোখের সামনে শহীদ হয়েছে। মরা আর মারা আমাদের জন্য ছিলো শিশুর খেলার ন্যায়। কিন্তু একজন নারীর উপর হাত তোলা- হোক সে আমাদের শত্রু- আমরা মহাপাপ মনে করেছি। আমি সঙ্গীদের বললাম, সূর্য মাথার উপর উঠে আসছে। একটু পর এখানে ছায়া থাকবে না। আশপাশে ছায়া খুঁজে বের করে বিশ্রাম নাও। মেয়েটি জাগ্রত হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হবো।..

আমার এক-দুজন সঙ্গী বললো, মেয়েটি গুপ্তচর মনে হচ্ছে। অন্যরা ভিন্নমত পোষণ করে বললো, এখানে নারী গুপ্তচরের কী কাজ থাকতে পারে? এরা গুপ্তচরও নয়- মানুষও নয়। আমি বললাম, আমরা গেরিলা সৈনিক। মিসর ও ফিলিস্তীনের সীমান্ত অঞ্চলে তৎপর ছিলাম। আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এদেরকে এখানে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পরক্ষণে নিজের মধ্যেই সন্দেহ জাগে, তা-ই যদি হতো, তাহলে কমপক্ষে এক-দুজন পুরুষও তো থাকতো।

সূর্যাস্তের খানিক আগে মেয়েটির ঘুম ভেঙে যায় এবং উঠে বসে। আমি তার নিকটে গিয়ে বসি। সে পানি পান করে আরো কিছু খেতে চায়। আমি তাকে খাবার দেই। এবার সে ভালোভাবে কথা বলতে পারছে। মৃত মহিলার প্রতি ইঙ্গিত করে বললো, ওকে দাফন করে ফেলল। আমার। সৈনিকরা ধার্মিক ছিলো। একজন নিজের চাদরটা দিয়ে দেয়। আমরা একটা কবর খনন করে চাদরে পেঁচিয়ে লাশটা দাফন করে রাখি।

আল-আস এহতেশামকে জানায়–

মেয়েটি তারা কারা, কোথা থেকে আসলো, কোথায় যাচ্ছে- এসব বলরি পরিবর্তে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি কখনো খোদাকে দেখেছো? উত্তরে আমার যা বুঝে আসলো বললাম। সে বললো, আমি তোমার খোদাকে দেখেছি। এই এইমাত্র দেখেছি। বলবে, তুমি স্বপ্ন দেখেছে। খোদা আমাকে বলেছেন, আমি তোমাকে চোখ দিয়েছি। অন্ধকারেও তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তিনি আরো বলেছেন, তুমি পাপ করেছে। এরপর যদি কখনো পাপের চিন্তা করো, তাহলে তোমার নিজ হাতেরই খঞ্জর দ্বারা তোমার চোখ দুটো তুলে ফেলবো। খোদা আমাকে এ কথাও বলেছেন, আমি তোমাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখান থেকে আমি আমার প্রিয় রাসূলকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছিলাম।…।

মেয়েটি এমন অনেক কথা বলে, যাদ্বারা প্রমাণিত হয়, মরুভূমির কষ্টকর সফর আর নানাবিধ বিপদাপদ তার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে। যেমন, সে বললো, তোমরা আমার দেহটা ঢেকে দিয়েছো কেন? তাকে উলঙ্গই থাকতে দিলে কী হতো? আমি এখন শরীর নই- আত্মা। আত্মা যদি পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে দেহের পাপরাশি মুছে যায় ইত্যাদি। সে বেশিরভাগ এ জাতীয় কথা-বার্তাই বলতে থাকে। তাতে আমি নিশ্চিত হই, মেয়েটি অন্যকিছু নয়- মানুষই। আর তার বলা ছাড়াই আমার জানা হয়ে গেছে, এরা সেই খৃস্টান মেয়েদের দলভুক্ত, যাদেকে আমাদের আমীর উজির ও সালারদেরকে গাদ্দার বানানোর লক্ষ্যে আমাদের দেশে প্রেরণ করা হয়। আমার মনে সন্দেহ জাগে, মেয়েটি আমাদেরকে বোকা ঠাওরানোর চেষ্টা করছে। তার মাথাটা আসলে সম্পূর্ণ ঠিক আছে।…

আমি তাকে বললাম, ঠিক ঠিক বলে দাও, তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে? সত্য বের করার জন্য আমি তাকে হুমকি-ধমকিও দেই। কিন্তু তার বলার ধরণ ও দেওয়ানা জাতীয় কথা-বার্তায় কোনো পরিবর্তন আসলো না। সূর্যাস্তের পর আমি তাকে আমাদের মালবাহী ঘোড়ার উপর বসিয়ে গন্তব্যপানে রওনা হই।…।

আমার বাহিনী সামনের দিকে এগুতে থাকে। আমি মেয়েটির ঘোড়ার সঙ্গে অনেক পেছনে পড়ে যাই। এখন সে নিজেকে সামলাতে পারছে। কিন্তু কথা-বার্তা ঐ দরবেশদের ন্যায় বলছে। মধ্যরাতের পর আমরা যাত্রা বিরতি দেই। আমি মেয়েটিকে সকলের থেকে আলাদা রাখি এবং নিজে তার সঙ্গে থাকি। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়– যেতে চাও? সে বললো, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো। বললাম, আমি তোমাকে কয়েদখানায় নিয়ে যাচ্ছি। সে বললো, অসুবিধা নেই। শুনেছি খোদা কয়েদখানায়ও থাকেন। তারপর আমি অন্য পন্থা অবলম্বন করি। আমি তার বেশ আপন ও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই। ভাবলাম, হয়তো সে আমার সঙ্গে সওদাবাজি শুরু করবে এবং প্রলোভন দেখিয়ে বলবে, আমাকে খৃস্টানদের কোনো এক অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দাও। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না। এসবের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপই করলো না। পরবর্তী রাতে সে নিজের আসল পরিচয় প্রদান করে।…

মেয়েটি বললো, সে দেড় বছর কায়রোতে ছিলো। সেখানে তার পরিচয় ছিলো, সে বড় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কন্যা। এক মুসলিম শাসকের গণিকা ছিলো। মিসর সরকারের দুজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে তার শত্রুতে পরিণত করে। তারপর তিনজনকে আপসে দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে। কায়রোর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। দুজন খৃস্টান গোয়েন্দাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করায়। একজন বিপজ্জনক খৃস্টান গোয়েন্দা ও নাশকতাকারীকে- যার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা ছিলো সেই মুসলিম কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ফেরার করায়। অবশেষে মিসরের গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো।…

সেই মুহূর্তে সে হিত্তীন যুদ্ধের ফলাফলের কথা জানতে পারে। এ-ও অবহিত হয় যে, তাদের বড় ক্রুশ সুলতান আইউবীর হাতে চলে গেছে আর সেই ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয়েছেন। মেয়েটি এ সংবাদও পায় যে, কয়েকজন খৃস্টান সম্রাট মারা গেছেন। কতিপয় যুদ্ধবন্দি : হয়েছেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের শাসনকর্তা গাই অফ লুজিনানও বন্দি হয়েছেন। এ সংবাদগুলো তার মাথায় হাতুড়ির ন্যায় আঘাত করতে থাকে। তারপর সে আরো দুটি সংবাদ পায়, তাদের চরবৃত্তি ও নাশকতার শুরু হারমান বন্দি হয়েছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে চলে গেছে। এসব সংবাদ তার মাথাটা উলোট-পালট করে দিয়েছে। তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং প্রস্তুত করে কায়রো পাঠানো হয়েছিলো। পাপের প্রশিক্ষণটা শৈশবেই হয়েছিলো। তার ভেতরে চেতনার স্থলে ধোকা ও প্রতারণা ভরে দেয়া হয়েছিলো। তাকে জানানো হয়েছিলো, তোমাকে বড় কুশ এবং যীশুখৃস্টের সন্তুষ্টির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পর আক্রার বড় গীর্জায় ক্রুশের প্রধান পাদ্রী তাকে আশির্বাদ করেছিলেন।…

বিদায়ের প্রাক্কালে পাদ্রী তাকে বলেছিলেন, ক্রুশের রাজত্ব অজেয় এবং তার কেন্দ্র জেরুজালেম, যার সন্নিকটে হযরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো। তাকে আরো বলা হয়েছিলো, ইসলাম কোনো ধর্ম নয় এবং মুসলমানদেরকে খৃস্টধর্মে দিক্ষিত করা কিংবা তাদের হত্যা করে পৃথিবীকে মুসলমানমুক্ত করা পুণ্যের কাজ। আর এই যে মেয়েরা ক্রুশের নামে সম্ভ্রম বিসর্জন দিচ্ছে, তাদেরকে পরজগতে স্বর্গের হুর বানানো হবে। এভাবে পাপকে পুণ্যরূপে উপস্থাপন করে মেয়েটিকে প্রস্তুত করা হয়েছিলো।…

পরে যখন সে জানতে পারলো বড় কুশও তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন তার বিশ্বাস লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সে দেখতে পায়, কায়রোতে তার যে পুরুষ সহকর্মীরা ছিলো, তারা, ওখান থেকে পালাতে শুরু করেছে। একদিন এক সঙ্গীর সন্ধানে গিয়ে জানতে পারে, সে উধাও হয়ে গেছে। অপর এক সঙ্গী তাকে বললো, এখন আমাদেরকে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো কেউ নেই। ভালো হবে, মুসলমান হয়ে কোনো একজন মুসলমানকে বিয়ে করে নাও। নতুবা এখান থেকে পালিয়ে যাও।…

মেয়েটি পাগলের মতো হয়ে যায়। সে তার এক বান্ধবীকে সঙ্গে নেয়। এক মুসলমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার প্রেমিক ছিলো। ফাঁকি দিয়ে তার থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে সন্ধ্যার সময় দুজন বেরিয়ে পড়ে। অন্ধকার গাঢ় হলে নগরী থেকে বেরিয়ে আসে। তারা খাবার-পানির কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। কিন্তু মরুভূমির সফর সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। কোথায় যাবে, তাও তারা জানতো না। আশা ছিলো, পথে কোথাও খৃস্টান সেনাদল পেয়ে যাবে। কিন্তু তাদের নির্বুদ্ধিতা ছিলো, পথঘাট সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা না নিয়েই রওনা হয়েছিলো।…

রাতটা কেটে গেছে। তারা ঘোড়া দ্রুত হাঁকিয়েছিলো। পরদিন সূর্যটা মাথার উপর উঠে এসে যখন মরুভূমিকে ঝলসে দিতে শুরু করে, তখন ঘোড়া ক্লান্তি ও পিপাসায় বেহাল হয়ে যেতে শুরু করে। তাদের অবস্থা। শোচনীয় হয়ে ওঠে। তারা মরুভূমিতে পানি ও শ্যামলিমা দেখতে শুরু করে। সেগুলোর পেছনে পেছনে তারা ঘোড়া হাঁকিয়ে চলতে থাকে। সেদিনটি ঘোড়া কিছুটা সঙ্গ দেয় বটে; কিন্তু পরদিনও যখন পানাহারের জন্য কিছু জোটেনি, তখন ঘোড়া দুটো প্রথমে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর লুটিয়ে পড়ে। অতপর আর ওঠে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।…

তারপর মেয়ে দুটোর যে সফর শুরু হয়েছিলো, এহতেশাম ভাই! তুমি তা ভালোভাবেই জানেনা। নির্দয় মরুভূমি এ ধরনের পথিকদের কোন্ পরিণতিতে নিয়ে পৌঁছায়, তোমার তা জানা আছে। মেয়েটি আমাকে বলেছে, আমরা মানুষকে যেসব ধোঁকা দিয়েছিলাম, মরুভূমি আমাদেরকে তার চেয়েও বেশি নির্মম ধোঁকা দিয়েছে। আমি মরুভূমিতে নদী প্রবাহিত হতে দেখলাম। নিকটে গেলাম, তো নদী দূরে সরে গেলো। আমরা তাদের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি। আমি হাত উপরে তুলে নাড়াতাম, চীৎকার করতাম ও তাদের পেছনে পেছনে দৌড়াতাম। বহু জায়গায় আমরা পানি পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আসলে সেগুলো পানি ছিলে না।…।

মেয়েটি আমাকে বলেছে, তার যে অস্তিত্ব কায়রোর সরকারি কর্মকর্তাদের উপর যাদু প্রয়োগ করেছিলো, মরুভূমিতে সেই অস্তিত্ব মরে গেছে। তার হৃদয়ে আমাদের খোদার ভাবনা এসে গেছে এবং তার মধ্যে এই অনুভূতি কাটার ন্যায় বিদ্ধ হতে শুরু করেছে যে, ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ তাকে ধোকা দিয়েছেন আর এখন সে অন্যদের পাপের শাস্তি ভোগ করছে। তার মধ্যে বুঝ আসে, নিজের সম্ভ্রম উপস্থাপন করে কাউকে ধোকা দেয়া পুণ্যের কাজ নয়। মনে এই ভাবনাও জাগে যে, মুসলমানরা তাদের মেয়েদেরকে এভাবে ব্যবহার করে না। একদিন মরুভূমিতে তার এই অনুভূতিও জাগে, যেনো সে ও চার বান্ধবী মরে গেছে এবং নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে কিংবা প্রেতাত্মায় পরিণত হয়ে গেছে এবং নরকের ন্যায় প্রজ্বলমান প্রান্তরে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে ফিরছে।…

এক রাতে সে তার বান্ধবীকে বললো, আজীবনের লালিত বিশ্বাস থেকে আমার মন উঠে গেছে এবং এখন থেকে আমি মুসলমানের খোদাকে ডাকবো। উভয়ের ঠোঁট ও জিহ্বা কাঠের ন্যায় শুকিয়ে গিয়েছিলো। কণ্ঠনালীতে কাঁটা বিদ্ধ হচ্ছিলো। কথা বলতে তাদের কষ্ট হচ্ছিলো। আপন বিশ্বাস থেকে সরে আসা এবং শত্রুর বিশ্বাস ধারণ করার বিষয়টি তার বান্ধবী ভালো চোখে দেখেনি। তাই সে তার মতে সায় দেয়নি। একসময় বান্ধবী শুয়ে পড়লে সে দূরে এক স্থানে চলে যায়। সে সিজদা করে ও হাত তুলে মহান আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। মেয়েটি সমগ্র রাত ক্রন্দন করে কাটায়। সিজদা ছাড়া ইবাদতের আর কোনো পন্থা তার জানা ছিলো না।…

তার ভাষ্য মতে, সে রাতেই হঠাৎ ধোয়ার ন্যায় শশ্রুমণ্ডিত এক ব্যক্তি তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। সে বললো, তুমি যদি অন্তর থেকে তাওবা করে থাকো, তাহলে তুমি যে খোদার সমীপে প্রার্থনা করেছে, তিনি এই মরুভূমি থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নেবেন।… ..

আমরা দশ-বারো দিন পর বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছি। এতোদিনে তার স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গেছে। দেহের রূপ-লাবণ্য ফিরে এসেছে। কিন্তু কথা-বার্তা সেই দেওয়ানার ন্যায়ই বলতে থাকে। সেরূপ কথা যদি তোমার সঙ্গেও বলতো, তুমি প্রভাবিত হয়ে যেতে। সে বহুবার বলেছে, বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আর কোনদিন খৃস্টানদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। খোদা তাদেরকে পথেই ডুবিয়ে মারবেন। মেয়েটি এরূপ অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকে। রাতে তার ইবাদত শুরু হতো। পন্থা একটাই- সিজদা করা, ক্রন্দন করা ও প্রার্থনা করা।…

মেয়েটি এখন এই যার ঘরে থাকছে, আমি বহুদিন যাবত তাকে জানি। অনেক বড় আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি। আমি তাঁর ভক্ত। আমি মেয়েটিকে তার হাতে তুলে দেই।…

***

বুযুর্গ নামায পড়ে ফিরে এসেছেন। তিনি এহতেশামকে উদ্দেশ করে বললেন- যার কাছে ইলম আছে, আল্লাহ এই ফজীলত তাকেই দান করবেন এটা জরুরি নয়। জানিনা কখন কোন্ ফরিয়াদ মেয়েটির মুখ থেকে বের হয়েছিলো, আল্লাহ যা কবুল করে নিয়েছেন এবং মেয়েটিকে এই মর্যাদা দান করেছেন। মেয়েটি পাগল নয়, কাউকে ধোকাও দিচ্ছে না। নিজের ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি তাকে নামায পড়াতে ও শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার ইবাদতের সেই একই পদ্ধতি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য করছে আর যখন কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে গায়েব থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়েছে।

ও কি মসজিদে আকসায় সবসময়ই যাওয়া-আসা করে? এহতেশাম জিজ্ঞেস করে।

না- বুযুর্গ বললেন- রাতে এই প্রথমবার মসজিদে গেলো। আল আস সকালে এসে জিজ্ঞেস করলো, বললাম ও মসজিদে গেছে। আল-আস তার পেছনে চলে যায়। সম্ভবত সে পথেই তাকে পেয়ে যায়।

সন্দেহটা এখান থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে যে, যে রাতে সুলতান আইউবী মসজিদে উপস্থিত ছিলেন, কেবল সেই রাতে কেন ও মসজিদে গেলো?

আমি তার উত্তর দিতে পারবো না। বুযুর্গ বললেন।

এহতেশাম বললো, আমি মেয়েটিকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর নিকট নিয়ে যাবো। এটা আমার কর্তব্য। তারপর যা করার তিনি করবেন।

মেয়েটিকে যখন জানানো হলো, তোমাকে এহতেশামের সঙ্গে যেতে হবে, সে চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আল-আসও সঙ্গে যায়। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ এহতেশাম ও আল-আস থেকে বৃত্তান্ত শোনে মেয়েটিকেও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মেয়েটি উত্তর দেয়- এখন সমুদ্র থেকে আসা নৌবহর তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমাকে কেন ভয় করছো? আমাকে তোমাদের সুলতানের নিকট নিয়ে চলো। তিনি রাতে যে দুআ করেছেন, খোদা সব কবুল করে নিয়েছেন।

অনেক চেষ্টার পরও তার থেকে কোনো কথা বের করা গেলো না। সুলতান আইউবীকে অবহিত করা হলো। সেদিনই সুলতানের আক্রা যাওয়ার কথা ছিলো। তিনি বললেন, মেয়েটাকে নিয়ে আসো। মেয়েটি সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সুলতানের ডান হাতটা চুম্বন করে। তারপর মাথা তুলে এগিয়ে উঁকি দিয়ে সুলতানের চোখে কী যেনো দেখে। তারপর স্বগতোক্তি করার মতো করে বললো, এই চোখগুলো থেকে রাতে সিজদার মধ্যে অশ্রু বের হয়েছিলো। তোমাদের শক্রর রণতরীগুলো এই অশ্রুতে ডুবে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রাচীরের কাছেও কেউ ঘেঁষতে পারবে না। রক্তের নদী বয়ে যাবে। তারা পথেই মারা যাবে। তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। যে অশ্রু আল্লাহর সমীপে প্রবাহিত হয়, ফেরেশতারা মুক্তা জ্ঞান করে সেগুলো তুলে নেয়। খোদা সেই মুক্তাগুলোকে বিনষ্ট করেন না। নিয়ত পরিষ্কার হলে পথও পরিষ্কার হয়ে যায়।

মেয়েটিকে আসলরূপে ফিরিয়ে আনার বহু চেষ্টা করা হলো। কিন্তু সে এমন ধারায় কথা বলতে থাকে, যেনো অনাগত দিনগুলো দেখতে পাচ্ছে। অবশেষে দেওয়ানা সাব্যস্ত করেই মেয়েটিকে বুযুর্গের হাওয়ালা করে দেয়া হলো এবং বুযুর্গকে তার প্রতি নজর রাখতে বলা হলো।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মসজিদে আকসায় আল্লাহর সমীপে যে অশ্রু প্রবাহিত করেছিলেন, ফেরেশতারা মুক্তা মনে সেগুলো তুলে নিয়ে যায়। তিনি সর্বপ্রথম সংবাদ পান, সম্রাট ফ্রেডারিক মারা গেছেন। তার দিন কয়েক পর অপর এক খৃস্টান সম্রাট কাউন্ট হেনরির মৃত্যুর সংবাদ আসে। ইনিও খৃস্টানদের যৌথ বাহিনীর এক শরীক ছিলেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুসলমানদের দখল থেকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় লিখেছেন, খৃস্টানরা কাউন্ট হেনরির মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ পেতে দেয়নি। সুলতান সংবাদটা জানতে পেরেছেন অন্যভাবে।

সুলতান আইউবীর নৌ-কমান্ডোরা খৃস্টানদের দুটি জঙ্গী নৌকা পাকড়াও করেছিলো, যেগুলো ফিলিস্তীনের তীর থেকে সামান্য দূর দিয়ে অতিক্রম করছিলো। তাতে পঞ্চাশজন খৃস্টান নৌ-সেনা ছিলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো।

পরদিন খৃষ্টানদের আরো একটি নৌকা ধরা পড়ে। তাতে একটি কোট ছিলো, যার গায়ে মনি-মুক্তা খচিত ছিলো। এটি কোনো এক সম্রাট ছাড়া কারো কোট হতে পারে না। জিজ্ঞাসাবাদে খৃস্টান সৈন্যরা বললো, এটি কাউন্ট হেনরির কোট এবং তিনি মারা গেছেন। এই নৌকায় নৌবাহিনীর কমান্ডার গোছের এক ব্যক্তি ছিলো। জানা গেলো, লোকটি কাউন্ট হেনরির ভাতিজা। তাদের সকলকে বন্দি করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হলো।

সম্রাট কাউন্ট হেনরি কীভাবে মারা গেলেন? কেউ বলেন, তিনি নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, তিনি মাত্র তিন ফুট গভীর পানিতে পড়ে মারা গেছেন। এক বর্ণনা মতে, নদীতে গোসল করতে নামবার পর তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মারা যান।

সুলতান আইউবী যার ব্যাপারে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তিনি হলেন ইংল্যান্ডের যুদ্ধবাজ সম্রাট রিচার্ড, যিনি ব্ল্যাক প্রিন্স নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাকে সিংহ-হৃদয় রিচার্ডও বলা হতো। লোকটি অভিজ্ঞ ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। উচ্চতায় যেমন দীর্ঘ ছিলেন, তেমনি তার বাহুও ছিলো লম্বা। তাতে তার তরবারী দুশমন পর্যন্ত পৌঁছে যেতো; কিন্তু দুশমনের তরবারী তাকে স্পর্শ করতে কষ্ট হতো। খৃস্টজগতে সকলের দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ ছিলো। তার সামরিক শক্তিও ছিলো বেশি। তার নৌ-শক্তি ছিলো তৎকালীন পৃথিবীর সবচে বেশি শক্তিশালী। এ ব্যাপারটিই এখন সুলতান আইউবীর ভয়ের কারণ।

সুলতান আইউবীর এক নৌ-কর্মকর্তার নাম হুসামুদ্দীন লুলু। নৌ বাহিনী প্রধান আবদুল মুহসিন। সুলতান আইউবী যখন সংবাদ পেলেন, রিচার্ড তার নৌ-বহর নিয়ে আসছে, তখন আবদুল মুহসিনকে আদেশ প্রেরণ করেন, যেনো তিনি রিচার্ডের বহরের মুখোমুখি না হন এবং নিজের রণতরীগুলো ছড়িয়ে রাখেন। সুলতান আইউবী হুসামুদ্দীন লুলুকে কয়েকটি জাহাজ ও নৌকাসহ আসকালান তলব করেন। তাকে নির্দেশনা প্রদান করেন, দুশমনের জাহাজগুলোর উপর দৃষ্টি রাখবে। তবে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িত হবে না। তদস্থলে নৌ-গেরিলাদেরকে দুশমনের বিচ্ছিন্ন জাহাজগুলোকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করবে।

সুলতান আইউবী দেখতে পাচ্ছেন, সমুদ্রেও তাকে গেরিলা যুদ্ধ লড়তে হবে। সময়টা ছিলো সুলতান আইউবীর জন্য খুবই কষ্টকর। রাতে ঘুমাতেন না। তিনি মজলিশে শূরায় বলেছিলেন, আমাদেরকে একটি উপকূলীয় নগরী কুরবান করতে হবে। হতে পারে সেটি আক্রাঁ। আমি দুশমনকে বুঝাতে চাই, আমাদের যা কিছু আছে সব আক্ৰায় এবং আক্রা হাতছাড়া হয়ে গেলে মুসলমানদের কোমর ভেঙে যাবে। তারপর বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুসলমানদের দখলমুক্ত করা সহজ হবে। সুলতান আইউবী মজলিশে শূরাকে জানালেন, আমরা যদি দুশমনকে আক্রা টেনে আনতে সক্ষম হই, তাহলে দুশমন আক্রার প্রাচীরের সঙ্গেই মাথা ঠুকতে থাকবে। মজলিসে শূরা অনুমোদন প্রদান করে, আপনি যা ভালো মনে করেন, করুন।

***

এখন বাইতুল মুকাদ্দাস ও পবিত্র ভূমিকে সুলতান আইউবীর সেই অই রক্ষা করতে পারে, যা তিনি মসজিদে আকসায় ঝরিয়েছিলেন। পারে সেই দুআ, যা সুলতান আইউবী মসজিদে আকসায় সিজাবনত হয়ে করেছিলেন। উক্ত মেয়েটিও মসজিদে আকসায় দুআ করেছিলো। পরে সে সুলতান আইউবীর চোখে উঁকি দিয়ে বলেছিলো- তোমার দুশমনের জাহাজ তোমার চোখের অশ্রুতে নিমজ্জিত হতে দেখতে পাচ্ছি।

কোনো ঐতিহাসিক বলতে পারছেন না, সে রাতে সুলতান আইউবী কী দুআ করেছিলেন। তবে সব ঐতিহাসিকই বর্ণনা করেছেন, সুলতান আইউবীর ন্যায় মর্দে-মুজাহিদ রিচার্ডের যে নৌ-বহরে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন, ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে নোম উপসাগরে প্রবেশ করামাত্র সেই বহর। ভয়াবহ এক ঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিলো। সবগুলো জাহাজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক পরিসংখ্যান মোতাবেক সেই বহুরে ৫২০টি ছোট জাহাজ ছিলো। বড় জাহাজ ছিলো একাধিক। বহরটি সৈন্য, ঘোড়া, রসদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিতে বোঝাই ছিলো।

ঝড়ের কবলে পড়ে বহরটি এমনভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে, রিচার্ডের নিজের জীবনই বিপন্ন হয়ে যায়। ঝড় থামার পর কয়েক দিনে যখন জাহাজগুলোকে একত্রিত করা হলো, তখন জানা গেলো, পঁচিশটি বড় জাহাজ ডুবে গেছে। দুটি বিশাল মালবাহী জাহাজও পানিতে তলিয়ে গেছে। সেগুলোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ছিলো। রিচার্ডকে সবচে বেশি ক্ষতিটির শিকার হতে হলো, সে হলো বিপুল নগদ অর্থ, যেগুলো তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসছিলেন, সেই বিশাল অর্থ ভাণ্ডারটি তার রোম উপসাগরের অঞ্চলে হারিয়ে গেলো।

কারবাসের দ্বীপে এসে নোঙ্গর ফেলে রিচার্ড জানতে পারেন, ঝড় তার বহরের তিন-চারটি জাহাজকে কারবাসের কূলে এনে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তার একটিতে তার যুবতী বোন জুয়ানা এবং বোনের হবু স্বামী বেরঙ্গারিয়াও রয়েছে। এ দুজনের ব্যাপারে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তারা ডুবে মারা গেছে। এখন জানতে পারলেন তারা জীবিত ও নিরাপদ আছে। কিন্তু কাবরাসের সম্রাট আইজেক জাহাজগুলোর সমুদয় মালামাল বের করে নিয়ে গেছেন এবং বোন ও বোনের হবু স্বামীকেসহ সকলকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। রিচার্ডকে আইজেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলো। পরাজিত করে তিনি আইজেককে একটি তাঁবুতে আটকে রাখেন। কিন্তু আইজেক রাতে বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যান। রিচার্ড পনের-বিশ দিন পর্যন্ত তাকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে তাকে পাওয়া গেলো। রিচার্ড তার ঘোড়াটা নিয়ে নেন। সে এক অস্বাভাবিক দ্রুতগামী ঘোড়া। রিচার্ড যখন পবিত্র ভূমিতে যুদ্ধ করতে আসেন, তখন এই ঘোড়াটি তার সঙ্গে ছিলো।

রিচার্ড যখন পবিত্র ভূমির কূলে এসে ভিড়েন, ততোক্ষণে তার জোটভুক্ত খৃস্টানরা আক্রা অবরোধ করে ফেলেছে। সর্বপ্রথম যার বাহিনী অবরোধে অংশগ্রহণ করে, তিনি হচ্ছেন গাই অফ লুজিনান, যাকে রানী সাবীলা এই শর্তে মুক্ত করিয়েছিলেন যে, তিনি সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। তার সঙ্গে ফিলিপ অগাস্টাসের বাহিনী এসে যুক্ত হয় এবং অবরোধ শক্ত হয়ে যায়। শহরের ভেতরে মুসলিম বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। রসদ-পাতি যা ছিলো, তা এক বছরের জন্য যথেষ্ট ছিলো। অবরোধ ১১৮৯ সালের ১৩ আগস্ট শুরু হয়। আক্রা নগরীর অবস্থান হচ্ছে, তার একদিকে এল আকৃতির প্রাচীর। তিনদিকে নদী। নদীতে খৃস্টানদের নৌ-বহর বর্তমান। জাহাজগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাচীর থেকে দূরে খৃস্টান বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এভাবে স্থলের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সুলতান আইউবী নগরীতে নেই। তিনি বাইরে কোথাও অবস্থান করছেন। তিনি তার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এবং ভাবগতি দেখিয়ে দুশমনকে আক্ৰায় টেনে এনেছেন। খৃস্টানরা যখন অবরোধ শুরু করে, তখন তাদের জানানো হয়েছিলো, আইউবী ভেতরে আছেন। কিন্তু অবরোধ সম্পন্ন হওয়ার পর যখন তাদের একটি অংশের উপর পেছন থেকে আক্রমণ হলো, তখন তাদের খবর হয়, আইউবী ভেতরে নয়- বাইরে আছেন এবং তিনি খৃস্টানদের আক্রা অবরোধকারী বাহিনীকে অবরোধ করে রেখেছেন।

সুলতান আইউবীর সমস্যা হচ্ছে, তার সৈন্য কম। তথাপি আশা করছেন, তিনি অবরোধ ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তার কামনা, অবরোধ বেশিদিন স্থায়ী হোক, যাতে খৃস্টানদের শক্তি এখানেই ব্যয় হতে থাকে। ১১৮৯ খৃস্টাব্দের ৪ অক্টোবর তিনি খৃস্টানদের উপর জোরদার আক্রমণ চালান। খৃস্টানরা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিলো। ভয়াবহ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৯ হাজার খৃস্টানসেনা মারা যায়। কিন্তু তাদের ছিলো দুলাখ সৈন্য। ৯ হাজারের মৃত্যুতে তাদের কোনো ক্ষতি হলো না। কীভাবে শহর জয় করবে, তার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে তারা। তাদের বাহিনী প্রাচীরের কাছে ঘেঁষতে ভয় পাচ্ছে। কারণ, প্রাচীরের উপর থেকে মুসলমানরা তাদের উপর তীর ছাড়াও অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছে।

খৃস্টানরা প্রাচীরের নিকটে পৌঁছে যায়। নগরীর অভ্যন্তরে পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষেপ ও প্রাচীর অতিক্রমের জন্য কাঠ দ্বারা চাকাওয়ালা উঁচু মাচান তৈরি করে নিয়েছে। এতো বিশাল মাচান যে, তাতে কয়েকশ সৈনিক দাঁড়াতে পারে। তাকে মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত দাহ্য পদার্থ ও গোলা থেকে রক্ষা করার জন্য তার ফ্রেমগুলোতে তামার পাত চড়ানো হয়েছে। তারা যখন মাচানটি প্রাচীরের সন্নিকটে নিয়ে যায়, তখন মুসলমানরা প্রাচীরের উপর থেকে তার উপর দাহ্য পদার্থের পাতিল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পদার্থগুলো মাচানের উপর গিয়ে পতিত হয় এবং অবস্থানকারী সৈনিকদের গায়েও গিয়ে পড়ে। পরপর কয়েকটি পাতিল এসে পতিত হওয়ার পর যখন মাচানটি ভিজে যায়, এবার এক এক করে প্রজ্বলমান কাঠ ছুটে আসতে শুরু করে। আগুনধরা, কাঠগুলো তেলভেজা মাচানে এসে পতিত হওয়ামাত্র মাচানে আগুন ধরে যায়। মাচান জ্বলে যায় এবং তাতে অবস্থানকারী সৈন্যরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়।

প্রাচীরের বাইরে একটি পরিখা ছিলো, যেটি পার হওয়া খৃস্টানদের জন্য দুঃসাধ্য ছিলো। তারা মাটি দ্বারা পরিখাঁটি ভরাট করতে শুরু করে। কিন্তু নগরীর ভেতরের সৈনিকরা এতোই দুঃসাহসী যে, তাদের একটি অংশ বাইরে বেরিয়ে এসে খৃস্টানদের উপর আক্রমণ করে করে ফিরে যাচ্ছে। পরিখা ভরাট করার জন্য খৃস্টানরা একটি পন্থা অবলম্বন করে যে, তারা তাদের মৃত সৈনিকদের লাশগুলো তাতে ছুঁড়ে মারছে। তখন থেকে তাদের যত সৈনিক প্রাণ হারায়, সকলের মরদেহ উক্ত পরিখায় নিক্ষেপ করা হয়। পেছন থেকে সুলতান আইউবী তাদের উপর অনবরত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু খৃস্টানদের অবরোধ দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে আরো দৃঢ় হতে থাকে।

নগরীর সঙ্গে সুলতান আইউবী বার্তাবাহী কবুতরের মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখেন। অপর মাধ্যমটি ছিলো এক ব্যক্তি, যার নাম ঈসা আল আমওয়াম। লোকটি চামড়ার গায়ে বার্তা লিখে কোমরের সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রে সাঁতার কেটে সংবাদ আদান-প্রদান করতো। কাজটা সে রাতে করতো। দুশমনের নোঙ্গরকরা জাহাজের তলে দিয়ে যাওয়া-আসা করতো। এক রাতে সে এভাবেই আসে। নগরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলে এবং লিখিত বার্তা দেয়া হয়েছিলো। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন- লোকটি যখন নিরাপদে নগরীতে গিয়ে পৌঁছতো, তখন একটি কবুতর উড়িয়ে দেয়া হতো। কবুতরটি আমাদের নিকট উড়ে আসতো। তাতে আমরা বুঝে নিতাম, ঈসা নিরাপদে পৌঁছে গেছে। আমরা কবুতরটি ফেরত উড়িয়ে দিতাম। যে রাতে সে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে গেলো, তার পরদিন কবুতর আসলো না। আমরা বুঝে ফেললাম, ঈসা ধরা পড়েছে। কয়েকদিন পর আমাদের নিকট সংবাদ আসে, ঈসার লাশ আক্রার কূলে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। সোনাভর্তি থলেটি তার দেহের সঙ্গে বাধা ছিলো। লোকটি সোনার ওজন বহন করে সাঁতার কাটতে না পেরে ডুবে গিয়েছিলো।

মীর কারাকুশ ছিলেন আক্রার শাসনকর্তা। প্রধান সেনাপতি আলী ইবনে আহমাদ আল-মাশতুব। তারা বারংবার সুলতান আইউবীকে পয়গাম প্রেরণ করতে থাকেন, আমরা অস্ত্র ত্যাগ করবো না। আপনারা বাইরে থেকে খৃস্টানদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখুন এবং যে কোনো প্রকারে হোক নগরীতে ফৌজ, অস্ত্র ও রসদ পৌঁছাতে থাকুন।

কিন্তু সুলতান আইউবী নগরীতে সাহায্য পৌঁছাবেন কীভাবে? জ্বরে তার। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। লাগাতার রাত জাগা, মানসিক অস্থিরতা আর চারদিকে পঁচা-গলা লাশের দুর্গন্ধ এসব সুলতান আইউবীর শারীরিক অবস্থা আরো শোচনীয় করে তুলেছে। তিন-চারদিন পর্যন্ত তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, আক্ৰা তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *