আল–ফারেস
হিত্তীনে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে বিজয় অর্জন করেছেন, তা কোনো সাধারণ বিজয় ছিলো না। সাত সাতজন খৃস্টান সম্রাট ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুলতান আইউবীর সামরিক শক্তিকে চিরতরে খতম করতে এবং তারপরে পবিত্র মক্কা-মদীনা দখল করতে এসেছিলেন। কিন্তু ফল ফলেছে উল্টো। মরুর টিলা যেমন ঝড়ের কবলে পড়ে বালিকণার ন্যায় মরুভূমিতে মিশে যায়, তেমনি তাদের নিজেদের সামরিক শক্তিই বরং নিঃশেষ হয়ে গেছে। চারজন বিখ্যাত ও শক্তিমান ম্রাট আইউবীর হাতে বন্দি হয়েছেন, যাদের মধ্যে জেরুজালেমের (বাইতুল মুকাদ্দাস) শাসনকর্তা গাই অফ লুজিনান অন্যতম। খৃস্টান বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছে এবং আইউবী বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। তবে গেরিলা অপারেশন এখনো চলছে। আইউবীর গেরিলারা পলায়নপর খৃস্টান সৈন্যদের পাকড়াও করছে। ক্রুসেডারদের মনোবল এমনভাবে ভেঙে গেছে যে, কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ভাষায়- এক ব্যক্তি যার সম্পর্কে আমার বিশ্বাস আছে, লোকটা সত্য বলে- আমাকে বলেছে, সে নিজ চোখে দেখেছে, মুসলিম বাহিনীর এক সৈনিক ত্রিশজন খৃস্টান সৈন্যকে এক রশিতে বেঁধে নিয়ে আসছিলো। এমন তো একাধিক দৃশ্য দেখা গিয়েছিলো, এক একজন মুসলিম সৈনিক কয়েকজন করে খৃস্টান সৈন্যকে নিরস্ত্র করে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে। কোনো কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ক্রুসেডারদের পরাজয়ের এরূপ একাধিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সামরিক যোগ্যতার প্রশংসা করেছেন।
হিত্তীন এবং তার আশপাশে এবং আরো দূরে যেখানে যেখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেই মাইলের পর মাইল বিস্তৃত অঞ্চলে ক্রুসেডারদের লাশ পড়ে আছে। গুরুতর আহতরা ছটফট করে করে প্রাণ হারিয়েছে। সাধারণ আহতরাও মারা গেছে। তার কারণ জখম নয়- পিপাসা। লোহা পরিহিত নাইটদের নিরাপত্তা বর্মগুলো উত্তপ্ত চুলায় পরিণত হয়ে তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ কালের এক ঐতিহাসিক এ্যান্থনি ওয়েস্ট সেকালের ঐতিহাসিকদের সূত্রে লিখেছেন, হিত্তীনের রণাঙ্গনে লাশের সংখ্যা ছিলো ত্রিশ হাজারেরও অধিক। লাশগুলো তুলে আনার কোনো ব্যবস্থা করা হলো না। তাদের যেসসব সহকর্মী জীবিত ছিলো, তারা হয়তো বন্দি হয়ে গিয়েছিলো, নতুবা ছিন্নভিন্ন হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। অ্যান্থনি ওয়েস্ট লিখেছেন, তাদের লাশগুলো চিল-শকুন ও শিয়াল-কুকুররা খেয়ে ফেলেছিলো। দিন কয়েকের মধ্যেই লাশগুলো হাড়ের কংকালে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। যারা উপর থেকে দৃষ্টিপাত করেছেন, তারা দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত ভূখণ্ডটাকে হাড়ের কারণে সাদা দেখেছেন। সেই কংকালগুলোর মাঝে হাজার হাজার ছোট ছোট ক্রুশ ছড়িয়ে পড়েছিলো, যেনো পাকা ফসল থেকে ফলগুলো ছিঁড়ে পড়ে শুকিয়ে গেছে।
সুলতান আইউবী লাশগুলো সরিয়ে অঞ্চলটাকে পরিষ্কার করার গরজ বোধ করেননি। কারণ, তিনি সেখানে অবস্থান করবেন না। তার গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস। কিন্তু তিনি আলোচনা করছেন আক্রার। আক্রার বড় কুশটা সুলতানের তাবুর বাইরে পড়ে আছে। তার মহান মোহাফেজ পাদ্রী মৃত্যুবরণ করেছেন। ক্রুসেডারদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।
***
আমাদেরকে এখন সোজা আক্ৰায় আক্রমণ চালাতে হবে- সুলতান আইউবী তার সালার ও নায়েবদের উদ্দেশে বললেন- আমি মহান আল্লাহর শোকর আদায় করছি যে, আমার রিজার্ভ বাহিনীটা গোটাই অক্ষত রয়ে গেছে- ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি। তিনি সকলের উপর চোখ বুলিয়ে মুচকি হেসে বললেন- মনে করো না আমার নিজের ও কদের ক্লান্তির অনুভূতি নেই। তোমাদেরকে এর বিনিময় আল্লাহ দান করবেন। তোমাদের বিশ্রাম হবে মসজিদে আকসায়। আমরা যদি এখানে বিশ্রামের জন্য বসে পড়ি, তাহলে ক্রুসেডাররা জড়ো হয়ে সতেজ ও প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমি তাদেরকে জখম পরিষ্কার করারও সুযোগ দিতে চাই না।
সালারগণ খানিকটা বিস্মিত হন। তাদের আশা ছিলো, এবার সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রযাত্রার আদেশ দেবেন। অথচ, তিনি কিনা আক্ৰা আক্রমণের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন। খৃস্টানদের বড় ক্রুশটা তার পেছনে রাখা আছে। তিনি কুশটার প্রতি তাকান এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। উপস্থিত লোকজন চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ তিনি দ্রুত সালারদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে বলে ওঠেন- আমার বন্ধুগণ! এটা দুটি বিশ্বাসের যুদ্ধ। এটা হক ও বাতিলের সংঘাত। এই ক্রুশটার উপর জমাট হয়ে থাকা রক্ত দেখো। এই রক্ত হযরত ঈসার নয়। এই রক্ত সেই পাদ্রীরও নয়, যাকে খৃস্টান জগত এই ক্রুশের মোহাফেজ বলে বিশ্বাস করে। এই রক্ত সেই পাদ্রীদেরও নয়, যারা এতো বড় ক্রুশটাকে যুদ্ধের ময়দানে এনে রেখেছিলো। এরা সকলে আল্লাহর সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু এই রক্ত তাদের একজনেরও নয়। এই রক্ত অসত্যের রক্ত। এই রক্ত ভিত্তিহীন বিশ্বাস ও মানুষের গড়া চিন্তা-চেতনার রক্ত।
সুলতান আইউবীর কণ্ঠে আবেগের জোশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। তিনি বললেন- আমি প্রতিটি যুদ্ধাভিযান জুমার দিন শুরু করে থাকি। অগ্রযাত্রা জুমার দিন করি। জুমা বরকতময় দিবস। আমি প্রতিটি অভিযান জুমার খুতবার সময় শুরু করি। কারণ, এই সময়টা দুআ কবুলের সময়। তোমরা যখন দুশমনের সঙ্গে লড়াইরত থাকো, তোমাদের উপর তীরবৃষ্টি হতে থাকে, দুশমনের মিনজানিকগুলো তোমাদের উপর আগুন ও পাথর বর্ষণ করতে থাকে, সে সময় জাতির প্রতিজন মানুষের হাত মহান আল্লাহর দরবারে তোমাদের নিরাপত্তা ও বিজয়ের জন্য উত্তোলিত থাকে। তোমরা কি দেখোনি, আমি এই যুদ্ধের জন্যও রওনা জুমার দিন করেছিলাম এবং জুমার দিন যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এখন তোমরা বিজয়ী। তোমাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি আছে। এটা আমাদের সুমহান বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনার জয়। এই যুদ্ধ ছিলো চাঁদ-তারা বনাম ক্রুশের যুদ্ধ। চাঁদ-তারা জয়লাভ করেছে। আমি তোমাদেরকে কথাগুলো কেনো বলছি? এই জন্য বলছি যে, তোমাদের কারো মধ্যে যদি বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো শোবা-সন্দেহ থাকে, তাহলে দূর হয়ে যাবে। তোমরা আল্লাহর রশিকে আরো শক্তভাবে ধারণ করো।
তোমাদের বোধ হয় অবাক লাগছে, আমি আক্ৰা আক্রমণের সিদ্ধান্ত কেননা নিয়েছি। আবেগের কথা বলতে হলে তার কারণ, ক্রুসেডাররা একবার আমাদের পবিত্র মক্কা ও মদীনা অভিমুখে অগ্রযাত্রা করেছিলো। প্রিন্স অর্নাত মক্কা থেকে মাত্র দুক্রোশ দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। আমি অর্নাত থেকে পবিত্র মক্কার প্রতি কুনজরে তাকাবার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছি। এবার অন্যান্য সম্রাট ও নাইটদের থেকে প্রতিশোধ নেবো। আক্রা তাদের মক্কা। আমি নগরীটা পদানত করবো। মসজিদের আকসার যে অবমাননা চলছে, তার প্রতিশোধ নেবো। আর সামরিক বিচারে বাইতুল মুকাদ্দাসের আগে আক্রা জয় করা এ কারণেও জরুরি যে, তাতে ক্রুসেডারদের মনোবল ভেঙে যাবে।
সুলতান আইউবী বিশাল একটা নকশা- যেটি তিনি নিজ হাতে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন- খুলে সকলের সামনে মেলে ধরেন এবং হিত্তীনের উপর আঙুল রেখে বললেন- এখন তোমরা এখানে। তিনি আঙুলটা এমনভাবে দ্রুত আক্রার দিকে নিয়ে যান, যেনো কিছু কর্তন করার জন্য খঞ্জরের আগা চালালেন। বললেন- ক্রুসেডারদের শাসনক্ষমতাকে দুভাগে বিভক্ত করে আমি তার মধ্যখানে এসে পড়বো। আক্ৰায় দখল প্রতিষ্ঠিত করে টায়ের, বৈরুত, হীফা, আসকালান এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সকল উপকূলীয় নগর ও পল্লীকে ধ্বংস করে দেবো। সামরিক-বেসামরিক কোনো খৃস্টানকে সেসব অঞ্চলে থাকতে দেবো না। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর দখল এ কারণেও জরুরি যে, ইউরোপের আরো কতিপয় সম্রাট তাদের খৃস্টান ভাইদের সাহায্যার্থে সৈন্য, অর্থ ও সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ করবে। উপকূল তোমাদের দখলে থাকলে দুশমনের কোনো রণতরী কূলে ভিড়তে পারবে না। এখান থেকে আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে রওনা হবো। আমাদেরকে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে।
ফিলিস্তীন ও লেবাননের মানচিত্র দেখলে আপনি গ্যালিলি ঝিলের পাড়ে হিত্তীন এবং তার বিপরীত দিকে সমুদ্রের কূলে আক্রা দেখতে পাবেন। দক্ষিণে বাইতুল মুকাদ্দাস। হিত্তীন থেকে আক্রার দূরত্ব পঁচিশ মাইল আর বাইতুল মুকাদ্দাস সত্তর মাইল। আজকের লেবানন ও ফিলিস্তীনের উপর সেদিন খৃস্টানদের দখল ছিলো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী পরিকল্পনা ঠিক করেছিলেন, তিনি হিত্তীন থেকে আক্রা পর্যন্ত এমনভাবে অগ্রযাত্রা করবেন যে, পথে পড়া প্রতিটি অঞ্চল দখল করতে থাকবেন এবং সেসব অঞ্চল থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত করে শুধু মুসলমানদের থাকতে দেবেন। সামরিক বিশেষজ্ঞগণ একে অতিশয় উত্তম এক পরিকল্পনা বলে অভিহিত করেছেন। সুলতান আইউবী এই পরিকল্পনা ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তিকে দুভাগে বিভক্ত করার লক্ষ্যে প্রস্তুত করেছিলেন। ক্রুসেডারদের মোকাবেলায় তাঁর বাহিনী ক্রুসেডারদের এভো বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও কম ছিলো। কিন্তু তার যুদ্ধ-কৌশলগুলো ক্রুসেডারদের অপেক্ষা উন্নত এবং চলাচলের গতি অত্যন্ত তীব্র ছিলো।
***
আক্রার প্রতিরক্ষা অনেক শক্ত- সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের উদ্দেশে বললেন- আমাদের গোয়েন্দারা জানিয়েছে, ওখানে শক্ত-সামর্থ যুবক মুসলমানরা কারাগারে আটক রয়েছে। নারী-শিশুরাও বন্দি অবস্থায় রয়েছে। ওখানকার খৃস্টান নাগরিকরা নগরীর প্রতিরক্ষায় জীবনের বাজি লাগিয়ে যুদ্ধ করবে। মুসলিম যুবকরা যেহেতু বন্দি, তাই ভেতর থেকে তারা আমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। আমি দীর্ঘ অবরোধ করতে চাই না। তোমাদের আক্রমণ ঝড়গতির হওয়া চাই। আক্রা পর্যন্ত আমাদের অগ্রযাত্রার নিরাপত্তা বিধান করবে আমাদের কমান্ডোরা। অগ্রযাত্রা হবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পথে কোন লোকালয় অক্ষত থাকবে না। তবে সৈনিকগণ গনীমত কুড়ানোর জন্য থামবে না। এ কাজের জন্য আলাদা বাহিনী নিযুক্ত করা হয়েছে।
আক্ৰায় মুসলমানদের অবস্থা হচ্ছে, দু-চারজন বৃদ্ধ ও পঙ্গু ছাড়া সবাই মানবতের ও আতঙ্কের জীবন-যাপন করছে। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। কারাগারে আটক মুসলমানদের সংখ্যা চার হাজারের অধিক লিখেছেন। সে যুদ্ধের অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ পাঁচ থেকে ছয় হাজারের মধ্যে লিখেছেন। মোটকথা, আক্ৰা মুসলমানদের জন্য কারাগারে পরিণত হয়েছিলো। কোনো মুসলমানের বোন-কন্যা নিরাপদ ছিলো না। ক্রুসেডারদের উদ্দেশ্য ছিলো, মুসলমানরা চলমান লাশে পরিণত হয়ে যাক এবং তাদের শিশুদের মধ্যে ধর্ম ও জাতীয়তার অনুভূতিই জাগ্রত না হোক। সেখানকার মসজিদগুলো বিরান হয়ে গিয়েছিলো।
১১৮৭ সালের ৪ জুলাইয়ের পর ক্রুসেডাররা সেখানকার মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এতোদিন যেসব মুসলমান নিজ ঘরে অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছিলো, তাদেরও ধরে ধরে উন্মুক্ত কারাগারে নিক্ষেপ্ত করা হলো। সে ছিলো এক ধরূনের বেগার ক্যাম্প। ওখানে মুসলমানদের দ্বারা পশুর ন্যায় কাজ করানো হতো। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাইয়ের পর আর তাদের বের হতে দেয়া হয়নি। তাদের কঠোর পাহারা বসিয়ে দেয়া হলো। তা থেকেই হতভাগ্যরা অনুমান করে নিয়েছিলো, খৃস্টানদের কোথাও পরাজয় ঘটেছে কিংবা ইসলামী ফৌজ তাদের নগরী অবরোধ করেছে। মহিলারা আল্লাহর দরবারে মিনতি করতে শুরু করলো। কারাগারের বাসিন্দাদের মধ্যে নতুন মাত্রায় বেদনার ছায়া নেমে হলো। মায়েরা দুআর জন্য অবুঝ সন্তানদের হাত উচ্চে তুলে ধরে বলতে শুরু করে- বেটা! বলল, হে আল্লাহ! আপনি ইসলামকে বিজয় দান করুন। বলল, হে আমার আল্লাহ! আপনি বাইরের মুসলমানদেরকে হিম্মত দান করুন, যেন তারা আমাদেরকে জালেমদের এই লোকালয় থেকে বের করে নিতে পারেন।
হাজার হাজার শিশু হাজার হাজার নারী আল্লাহর সমীপে হাত তুলে দুআ করছে, আকুল ফরিয়াদ জানাচ্ছে। শিশুরা তাদের মায়েদের কান্না দেখে তারাও কাঁদতে শুরু করে। তবে অবলা নারী আর অবুঝ শিশুদের এই ক্রন্দনরোলের সঙ্গে হান্টারের শব্দও ভেসে আসছে। তারা তাকিয়ে দেখে, বিপুলসংখ্যক নতুন কয়েদি নিয়ে আসা হচ্ছে। এরা নগরীর সেইসব মুসলিম বাসিন্দা, যারা এতোদিন আপন আপন বাড়িঘরে বসবাস করছিলো। তাদের নারী এবং শিশুদেরকেও নিয়ে আসা হয়েছে। তাদেরই উপর হান্টারের আঘাত হানা হচ্ছে।
ছয় কি সাত জুলাই মধ্যরাতের পর হঠাৎ নগরীতে হট্টগোল শুরু হয়ে যায় এবং কোনো কোনো স্থান থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হতে শুরু করে। শা শা করে তীর এসে এই মুক্ত কারাগার পর্যন্ত আঘাত হানতে শুরু করে। এই কারাগারের চারদিকে শুষ্ক কাটা এবং রশির জালের বেড়া দেয়া। রাতে চারদিকে স্থানে স্থানে বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বন্দিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। এক বন্দি বাইরে থেকে আসা একটি তীর তুলে হাতে নিয়ে বাতির আলোতে নিরিক্ষা করে দেখেই চীঙ্কার দিয়ে ওঠে- আমি এই তীর চিনি। এটি ইসলামী ফৌজের তীর।
এমন সময় বেড়ার জালের ফাঁক গলিয়ে শা করে অপর একটি তীর ধেয়ে এসে লোকটার বুকে গেঁথে যায়। কোন এক খৃস্টান সান্ত্রী বন্দিকে চুপ করানোর জন্য তীরটা ছুঁড়েছে। শহর জেগে ওঠেছে। নগরী ও দুর্গের পাচিলের উপর দৌড়-ঝাঁপ, হট্টগোল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধনুক থেকে তীর বের হওয়ার শব্দও বেড়ে চলেছে। বাইরে আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। একটু পরপর ভ্রাম ভ্রাম শব্দ কানে ভেসে আসছে। এগুলো বড় বড় পাথর পতনের শব্দ, যা কিনা সুলতান আইউবীর সৈন্যরা মিনজানিকের সাহায্যে পাঁচিলের উপর নিক্ষেপ করছে।
***
এটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অবরোধ। তবে অবরোধের চেয়ে আক্রমণটাই বেশি। শহরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপক মিনজানিক ছাড়াও ফটক ও পাঁচিলের উপর ভারি পাথর নিক্ষেপকারী বড় মিনজানিকও ব্যবহার করা হচ্ছে। উঁচু উঁচু মাচান সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। এক একটি মাচানের দশ থেকে বিশজন করে সৈনিক দাঁড়াতে পারে। সেগুলোর নীচে চাকা লাগানো। উট এবং ঘোড়া এগুলো টেনে এনেছে। এই চলমান মাচানগুলো দেয়াল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু খৃষ্টানরা নগরীর প্রতিরক্ষায় প্রাণান্ত যুদ্ধ লড়ছে। সাধারণ জনগণও সৈনিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। তারা সুলতান আইউবীর চলন্ত মাচানগুলোর উপর বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মুসলিম সৈনিকদের খতম করে চলেছে। যে মাচানগুলো পাঁচিলের সন্নিকটে পৌঁছে গেছে, খৃস্টান সৈনিকরা সেগুলোর উপর জ্বলন্ত প্রদীপ এবং তরল দাহ্য পদার্থের পাতিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের ভস্ম করে দিচ্ছে।
ভেতরে বন্দিশালায় হাজার হাজার কয়েদি সমকণ্ঠে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির করছে। মহিলারা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে আকুতি করছে। হঠাৎ একজন অতি উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারীব। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটে। সঙ্গে সকল নারী, শিশু ও পুরুষের কণ্ঠ এক কণ্ঠে পরিণত হয়ে যায়, যা যুদ্ধের হট্টগোল থেকে অধিক উচ্চ হয়ে দেখা দেয় এবং বিকট শব্দের রূপ ধারণ করে শহরময় ছড়িয়ে পড়ে।
দু-তিনজন সান্ত্রী ভেতরে প্রবেশ করে বন্দিদের চুপ করানোর চেষ্টা করতে শুরু করে। তিন-চারজন উত্তেজিত কয়েদি উঠে সান্ত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফটক খোলা ছিলো। অবশিষ্ট কয়েদিরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তীর বৃষ্টি সামনের লোকগুলোকে মাটিতে ফেলে দেয়। পরক্ষণে অনেকগুলো ঘোড়া ছুটে আসে। আরোহীদের হাতে বর্শা ছিলো। পলায়নপর কয়েদিরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। যারা পেছনে রয়ে যায়, তারা আরোহীদের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যায়। বন্দিদের পলায়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নারী ও শিশুরা আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারপর সমস্বরে কালেমা তায়্যেবার জিকির করতে শুরু করে।
রাতভর সুলতান আইউবীর জানবাজ সৈন্যরা পাচিল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার এবং পাঁচিলে ছিদ্র করার কিংবা সুড়ঙ্গ খনন করার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে আর উপর থেকে খৃস্টানরা তাদের উপর তীর, পাথর ও আগুন নিক্ষেপ করতে থাকে। সুলতান আইউবী অনুপম কুরবানী দিয়ে যাচ্ছেন। নগরীর পাঁচিলের এক স্থানে বড় মিনজানিকের সাহায্যে ভারি ভারি পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। রাত পোহাবার পর দেখা গেলো, পাঁচিলের উপর সবখানে সবদিকে আক্রার সাধারণ মানুষ ও সৈনিকরা মাছির ন্যায় ছেয়ে আছে। তারা তীর বর্ষণ করছে। আরো দেখা গেলো, প্রাচীরের এক স্থানে ফাটল ধরেছে। সুলতান আইউবী ঘোড়ার পিঠে চড়ে সামান্য পেছনে একস্থানে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছেন। তিনি আদেশ করেন, যেখান থেকে দেয়াল ফাটছে, তার উপর ও ডান-বাম থেকে দুশমনের উপর তীর বর্ষণ করো। তিনি অপর দিককার তীরন্দাজদেরও তলব করে উক্ত স্থানে নিয়োজিত করেন। সুড়ঙ্গ খননকারী বাহিনীকে বললেন, তোমরা দৌড়ে পাচিলের কাছে পৌঁছে যাও।
জানবাজরা পৌঁছে গেছে। প্রাচীরের উপর এতো অধিক ও এতো তীব্র গতিতে তীর বর্ষিত হচ্ছে যে, উপরের লোকদের পক্ষে মাথা ভোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। জানবাজরা প্রাচীরে এতোটুকু ছিদ্র করে ফেলেছে যে, সেই ছিদ্র পথে দুজন লোক এক সঙ্গে অতিক্রম করতে পারবে। মুসলিম সৈনিকরা এতো আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছে যে, তারা কোনো আদেশ ছাড়াই ছুটে একজন একজন করে ভেতরে ঢুকে যেতে শুরু করেছে। খৃস্টানরা প্রাচীরের উপর থেকে নীচে নেমে আসতে এতোটুকু সময় ব্যয় করে ফেলে যে, ইতিমধ্যে বহু মুসলমান সৈন্য ভেতরে ঢুকে পড়েছে। খৃস্টানরা প্রাণপণ মোকাবেলা করে। কিন্তু আক্রার নির্যাতিত মুসলিম নারী-শিশুদের ফরিয়াদ আরশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সুলতান আইউবীর শক্তি মূলত এটিই ছিলো।
***
নগরীর ভেতরে হুলস্থূল শুরু হয়ে গেছে। খৃস্টানদের বড় ক্রুশ মুসলমানদের কজায় চলে গেছে এবং তার প্রধান মোহাফেজ মারা গেছেন এ সংবাদ সেখানে আগেই পৌঁছে গিয়ছিলো। হিত্তীনের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া খৃস্টান সৈন্যও এই নগরীতে এসে পৌঁছেছে। কিছু জখমীও এসেছে। তারা নিজেদের পরাজয় এবং পিছুহটার ঘটনাকে যৌক্তিক প্রমাণিত করার জন্য অত্যন্ত ভীতিকর গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। সুলতান আইউবীর জানবাজরা যখন নগরীর প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং অপ্রতিরোধ্য বানের ন্যায় ভেতরে ঢুকতে শুরু করে, তখন সেই গুজবের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সৈন্যরা মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়েছে বটে; কিন্তু জনসাধারণের মাঝে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেছে। তারা নগরী ছেড়ে পালানোর জন্য ফটকগুলোর উপর আছড়ে পড়ে এবং সৈনিকদের বাধা সত্ত্বেও দু তিনটি দরজা খুলে ফেলে।
মুসলিম আরোহী সেনারা কমান্ডারদের আদেশে দ্রুতগতিতে ঘোড়া হাঁকায়। দলে দলে, ফটক অতিক্রমকারী জনসাধারণকে পিষে পিষে ঘোড়াগুলো ভেতরে ঢুকে পড়ে। এবার মুজাহিদদের স্রোত কেউ ঠেকাতে পারলো না। নগরীর প্রতিটি দ্বার খুলে গেছে। ক্রুসেডাররা অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করেছে। এখনো সূর্য অস্ত যায়নি। আক্রার শাসনকর্তা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সম্মুখে দণ্ডায়মান। তিনি খৃস্টান বাহিনীর সেনাপতি কমান্ডারদের এক স্থানে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে সেই জায়গাটিতে চলে যান, যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মুসলমান বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। প্রহরীরা পালিয়ে গেছে। বন্দিরা ফটক ও দড়ির জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সুলতান আইউবী তাদের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে যান। ওগুলো মানুষ তো নয়- মানুষের লাশ। নারী ও শিশুদের দেখে তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
যাও, রশিগুলো কেটে দাও। ওদেরকে মুক্ত করে দাও- সুলতান আইউবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আর তাদেরকে বলো না, আমি শহরে আছি। আমি তাদেরকে মুখ দেখাতে পারবো না।
সুলতানের আদেশ পেয়ে কয়েকজন অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে ছুটে যায়। তারা কারাগারের কাঠের বেড়া ভেঙে ফেলে। কয়েক স্থানে রশির জাল কেটে পেছনের ঝোঁপ-কাঁটা সরিয়ে দেয়। কয়েদিরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ওটা যেনো এক মুহূর্তও থাকার জায়গা নয়। আরোহীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য চীৎকার করে করে বলছে- ধীরে সুস্থে বের হও। এখন আর তোমাদেরকে কেউ ধরতে আসবে না। ঐ দেখো, দুর্গের উপর তোমাদের পতাকা উড়ছে।
তারা আমাদেরই পাপের শাস্তি ভোগ করছে- সুলতান আইউবীর কাছে দণ্ডায়মান এক সালারকে বললেন- এ ছিলো বিশ্বাসঘাতকদের পাপ, যার শাস্তি এই নিরপরাধ মানুষগুলো ভোগ করলো। যারা আপন দীনের শক্রদেরকে বন্ধু হিসেবে বরণ করলো, তারা একটুও ভাবলো না, তাদের জনগণের পরিণতি কী হবে। ক্ষমতালোভী গাদ্দাররা যদি আমার পথ আগলে না দাঁড়াতো, তাহলে আমাদের এই হাজার হাজার শিশু ও কন্যার এমনি দশা ঘটতো না। হযরত ঈসা (আ.) প্রেম-ভালোবাসা ও শান্তির পাঠ শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুশের পূজারীদের হৃদয়-মন মুসলমানদের বিরুদ্ধে এতো ঘৃণায় পরিপূর্ণ যে, তারা আপন পয়গম্বরের নীতি আদর্শেরও পরোয়া করছে না। পৃথিবীতে দুটি মাত্র ধর্ম টিকে থাকবে। ইসলাম ও খৃস্টবাদ। আমরা যদি হৃদয় থেকে ক্ষমতার লোভ ও ভোগ বিলাসিতার মোহ দূর করতে না পারি, এই দুর্বলতার সুযোগে খৃস্টবাদ ইসলামের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে।
খৃস্টান সেনাপতি ও কমান্ডারদের যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, সুলতান আইউবী সেখানে যান। তিনি বললেন- এদের সকলকে নদী তীরে নিয়ে যাও এবং প্রত্যেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দাও। অন্যান্য যুদ্ধবন্দিদের বাছাই করো। যাদেরকে জীবিত রাখা আবশ্যক মনে হবে, তাদের দামেশক পাঠিয়ে দাও আর বাকিদের খতম করে দাও। কোনো নিরস্ত্র নাগরিকের গায়ে হাত তুলবে না। তাদের যারা নগরী ত্যাগ করে চলে যেতে চায়, তাদের যেতে দাও। যারা এখানে থাকতে চাইবে তাদেরকে সসম্মানে থাকতে দাও।
১১৮৭ সালের ৮ জুলাই আক্রার দখল সম্পন্ন হয়ে যায়।
রাতে যখন সুলতান আইউবী আহার থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তখন তাকে সংবাদ দেয়া হলো, অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একজন কয়েদিকে আপনার সামনে হাজির করা হচ্ছে।
সে কে?- সুলতান আইউবী খানিক বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন।
হারমান- ক্রুসেডারদের আলী বিন সুফিয়ান।
হারমান খৃস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান। আলী বিন সুফিয়ানের ন্যায় অত্যন্ত বিচক্ষণ গোয়েন্দা এবং মানুষের চরিত্র ধ্বংসে অভিজ্ঞ। যেসব খৃস্টান ও ইহুদী মেয়েকে মুসলিম অঞ্চলে গুপ্তচরবৃত্তি ও চরিত্র ধ্বংসের জন্য প্রেরিত করা হতো, তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন এই হারমান। মিশনের বেশকটি মেয়েসহ তিনি আক্ৰায় অবস্থান করছিলেন এবং ধরা পড়ে গেলেন। তিনি নগরী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আইউবীর এক গোয়েন্দা পিছু নিয়ে তাকে ধরে ফেলে। ছদ্মবেশ সত্ত্বেও গোয়েন্দা তাকে চিনে ফেলে। সঙ্গের মেয়েগুলোকে কৃষাণীর পোশাক পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। গোয়েন্দা এক কমান্ডারকে বিষয়টা অবহিত করে।
কমান্ডার দুতিনজন সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে হারমানের কাফেলাটি ঘিরে ফেলে। হারমান মেয়েদের ছাড়া সঙ্গে সোনা-দানাও নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মেয়েগুলোকে কমান্ডারের ও সৈন্যদের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেন এবং সোনাগুলোও তার সামনে রেখে দিয়ে বললেন- যার যে মেয়েকে পছন্দ হয় নিয়ে নাও। আর এই সোনাগুলোও ভাগ করে নাও।
আমার সব কটা মেয়েই পছন্দ হয়- কমান্ডার বললো- আর সোনাগুলোও সব নিয়ে নেবো। তুমিও আমার সঙ্গে চলো।
কমান্ডার সকলকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। সোনাসহ সব কজনকে সুলতান আইউবীর ব্যক্তিগত আমলার হাতে তুলে দেয়। হারমান সুলতান আইউবীর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কয়েদি। তাকে সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত করা হয়।
তুমি আমার ভাষা জানো- সুলতান আইউবী হারমানকে উদ্দেশ করে বললেন- তাই আমার ভাষায় কথা বলল। আমি তোমার বিদ্যা ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি প্রদান করছি। আমি তোমার যতোটুকু কদর করতে পারবো, ততোটুকু তোমার ম্রাটরা পারেনি। আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
আপনি যদি আমার সঙ্গে কোনো কথা বলা ছাড়া আমার হত্যার আদেশ প্রদান করেন, তবেই ভালো হবে- হারমান বললেন- আমাকে যদি আক্রার সেনাপতি-কমান্ডারদের ন্যায় খুনই হতে হয় এবং আমার মৃতদেহটা মাছের আহারে পরিণত হতেই হয়, তাহলে কথা বলে লাভ কী?
তোমাকে হত্যা করা হবে না হারমান!- সুলতান আইউবী বললেন আমি যাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তার সঙ্গে কথা বলি না।
সুলতান আইউবী দারোয়ানকে ডেকে হারমানকে শরবত পান করাতে বললেন। হারমানের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আরবের রীতি সম্পর্কে অবহিত আছেন যে, আরবী মেজবান যদি দুশমনকে পানি বা শরবত পান করতে দেয়, তো তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি অন্তর থেকে শত্রুতা দূর করে ফেলেছেন এবং তার জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন। দারোয়ার শরবত এনে দিলে হারমান তা পান করেন।
আপনি বোধ হয় জানতে চাইবেন, আমাদের কোন্ কোন্ অঞ্চলে কী পরিমাণ সৈন্য আছে- হারমান বললেন- আপনি এ-ও জানতে চাইবেন, তাদের লড়াই করার যোগ্যতা কীরূপ?
না- সুলতান আইউবী বললেন- এ তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো, তোমাদের কোন্ অঞ্চলে কী পরিমাণ সৈন্য আছে। আমার গোয়েন্দারা তোমাদের বুকের উপর বসে থাকে। তাছাড়া তোমাদের কোন অঞ্চলে কতো সৈন্য আছে, তা আমার জানবার গরজও নেই। হিত্তীনে তোমাদের সৈন্য কম ছিলো না। কম ছিলো আমার। এখন আরো কমে গেছে। কোনো বাহিনীই এখন আমাকে পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারবে না। তুমি সংবাদ শুনবে, সালাহুদ্দীন আইউবী মারা গেছেন- পিছপা হননি।
যে কমান্ডার আমাকে ধরে এনেছে, আপনার সকল কমান্ডারের চরিত্র যদি তার মতো হয়, তাহলে আমি আপনাকে নিশ্চয়তার সঙ্গে বলবো, যতো বৃহই হোক কোনো শক্তিই আপনাকে এখান থেকে তাড়াতে পারবে না হারমান বললেন- আমি তাকে যে মেয়েদের পেশ করেছিলাম, তারা আপনার পাথরসম সালার ও দুর্গপতিদের মোমে পরিণত করেছে এবং তাদেরকে ক্রুসেডারদের ছাঁচে ঢেলে তৈরি করেছে। আর সোনা এমন এক বস্তু, যার চমক চক্ষুকে নয়- বিবেককেও অন্ধ ক তোলে। আমি সোনাকে শয়তানের সৃষ্টি বলে থাকি। অথচ আপনার কমান্ডার সোনাগুলোর প্রতি চোখ তুলে তাকালো না। আমার দৃষ্টি সব সময় মানবীয় স্বভাবের দুর্বলতাগুলোর উপর নিবদ্ধ থাকে। ভোগ-বিলাসিতা ঈমানকে খেয়ে ফেলে। আপনার বিরুদ্ধে আমি এই অস্ত্রটাই ব্যবহার করেছিলাম। কোনো সেনা অধিনায়কের মধ্যে যখন এসব দুর্বলতা সৃষ্টি হয়ে যায় কিংবা সৃষ্টি করে দেয়া হয়, তখন পরাজয় তার কপালের লিখন হয়ে যায়। আমি আপনার বলয়ে যে কজন গাদ্দার জন্ম দিয়েছি, তাদের মধ্যে প্রথমে এই দুর্বলতাগুলোই সৃষ্টি করেছি। ক্ষমতার নেশা মানুষকেসহ ডুবে মরে থাকে।
আমার বাহিনীর চরিত্র সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।
আপনার বাহিনীর চরিত্র যদি তেমন হতো, যেমনটি আমি তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম, তাহলে আপনার বাহিনী আজ এখানে থাকতো না হারমান বললেন- আপনি যদি দুশ্চরিত্র আমীর, সালার, শাসক ও উজিরদের উৎখাত না করতেন, তাহলে তারা সেই কবে আপনাকে আমাদের কারাগারে নিক্ষেপ করতো। আমি আপনার প্রশংসা করছি যে, আপনি অন্তরে ক্ষমতার মোহ স্থান দেননি।
হারমান!- সুলতান আইউবী বললেন- আমি তোমাকে জীবনদান করেছি। তোমাকে আমার বন্ধুরূপে বরণ করে নিয়েছি। বলো, আমার বাহিনীর চরিত্রকে আমি কীভাবে অটুট ও উচ্চ রাখতে পারি। আর আমার মৃত্যুর পর এই চরিত্র কীভাবে অটুট থাকতে পারে।
মহামান্য সুলতান!- আমরা এই যে যুদ্ধ লড়ছি, এটা আমার-আপনার কিংবা আমাদের সম্রাটদের আর আপনার যুদ্ধ নয়। এটা কালিমা ও কাবার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আমাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকবে। আমরা রণাঙ্গনে লড়বো না। আমরা কোন দেশ জয় করবো না। আমরা মুসলমানদের মন ও মস্তিষ্ক জয় করবো। আমরা মুসলমানদের কোনো ভূখণ্ড অবরোধ করবো না– অবরোধ করবো মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা। আমাদের এই মেয়েরা, আমাদের ধন-ঐশ্বর্য ও আমাদের সভ্যতার আকর্ষণআপনি যাকে বেহায়াপনা বলেন- ইসলামের প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দেবে। তারপর মুসলমানরা আপন সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ঘৃণা করবে আর ইউরোপের রীতি নীতিকে ভালোবাসবে। সেই সময়টা আপনি দেখবেন না। আমিও দেখবো না। আমাদের আত্মারা দেখবে।
সুলতান আইউবী জার্মান বংশোদ্ভূত খৃস্টান গোয়েন্দা প্রধান হারমানের বক্তব্য গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছেন। হারমান বলছেন
আমরা পারস্য, আফগানিস্তান ও হিন্দুস্তানের উপর কেনো দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করিনি। কেন আমরা আরবকে যুদ্ধক্ষেত্র বানালাম? একমাত্র কারণ, সমগ্র পৃথবীর মুসলমান এই ভূখণ্ডটার প্রতি মুখ করে ইবাদত করে এবং এখানে মুসলমানদের কাবা অবস্থিত। আমরা মুসলমানদের এই কেন্দ্রটা ধ্বংস করছি। আপনার বিশ্বাস, আপনার রাসূল মসজিদে আকসা থেকে আকাশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। আমরা তার মিনারের উপর ক্রুশ স্থাপন করেছি এবং সেখানকার মুসলমানদের বুঝাচ্ছি, তোমাদের বিশ্বাস ভুল যে, তোমাদের রাসূল কখনো এখানে এসেছিলেন এবং এখান থেকে মেরাজে গিয়েছিলেন।
হারমান!- সুলতান আইউবী বললেন- আমি তোমার দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রত্যয়-পরিকল্পনার প্রশংসা করছি। নিজ ধর্মের প্রতি এমনই অনুগত ও নিষ্ঠাবান হওয়া উচিত, যেমন তুমি হয়েছে। সে জাতিই জীবিত থাকে, যারা আপন ধর্ম ও সভ্যতা লালন ও সংরক্ষণ করে এবং তার আশপাশে এমন দুর্ভেদ্য প্রাচীর স্থাপন করে রাখে, যাতে কোনো মিথ্যা ধর্ম-কালচার তার কোনো ক্ষতিসাধন করতে না পারে। আমি জানি, ইহুদীরা আমাদের এখানে আমাদের চরিত্র-চেতনা ধ্বংসের মিশন নিয়ে কাজ করছে এবং তোমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। আমি বাইতুল মুকাদ্দাস যাচ্ছি- সেই লক্ষ্যে যাচ্ছি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তোমরা এখানে এসেছিলে। এটা আমাদের বিশ্বাসের কেন্দ্রভূমি। আমার রাসূলকে আল্লাহ পাক এখান থেকে মেরাজের সৌভাগ্য দান করেছিলেন। আমি তাকে ক্রুশের দখল থেকে মুক্ত করবো।
তারপর কী হবে?- হারমান বললেন- তারপর আপনি এই জগত থেকে চলে যাবেন। মসজিদে আকসা পুনরায় আমাদের উপাসনালয়ে পরিণত হবে। আমি যে ভবিষ্যদ্বাণী করছি, আপনার জাতির স্বভাব চরিত্রকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই করছি। আমরা আপনার জাতিকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভক্ত করে তাদেরকে একে অপরের শত্রু বানিয়ে দেবো। তারপর ফিলিস্তীনের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলবো। ইহুদীরা আপনার জাতির যুবক-যুবতীদের মধ্যে যৌন পূজার বীজ বপণ করতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে এখন আর কোনো নুরুদ্দীন জঙ্গী, সালাহুদ্দীন আইউবী জন্ম নেবে না।
সুলতান আইউবী মুচকি হাসি হেসে হারমানের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন- তোমার কথাগুলো অনেক মূল্যবান। আমি তোমাকে দামেশক পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানে তোমাকে সম্মানের সঙ্গে রাখা হবে।
আর আমার সঙ্গের মেয়েগুলো?
সুলতান আইউবী গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বললেন আমি নারীদের যুদ্ধবন্দি বানাই না। তোমার মেয়েগুলোকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিতে পারি।
মহামান্য সুলতান!- হারমান বললেন- এরা অত্যন্ত রূপসী মেয়ে। এক নজর দেখলে আপনি তাদেরকে হত্যা করতে পারবেন না, বন্দিশালায়ও নিক্ষেপ করতে পারবেন না। আপনার ধর্মে দাসীকে বিয়ে করার অনুমতি আছে। দাসীদেরকে হেরেমে রাখা যায়।
আমার ধর্ম এই বিলাসিতার অনুমতি দেয় না- সুলতান আইউবী বললেন- আমি নিজের ঘরে কিংবা কোনো মুসলমানের ঘরে সাপ পুষতে পারি না।
কিন্তু তাদের তো কোনো অপরাধ নেই- হারমান বললেন- এ কাজের জন্য তাদেরকে শৈশব থেকেই প্রস্তুত করে নেয়া হয়েছিলো।
এ কারণেই আমি তাদের হত্যার নির্দেশ দিচ্ছি না- সুলতান আইউবী বললেন- আমি তাদেরকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। আমি তোমার এই ভাবনার প্রশংসা করছি যে, তুমি এই মধুর বিষ আমার জাতির মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমার ন্যায় ভাবনা ভাবতে পারি না। ওদের বলে দাও, আক্রা থেকে বেরিয়ে যাক। আমার আওতার ভেতরে কোথাও তাদের কাউকে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে।
***
সুলতান আইউবী দু-তিন দিনের মধ্যে আক্ৰায় তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। মসজিদগুলোকে পাক-পরিষ্কার করিয়ে নামাযের উপযোগী করে তোলেন। গনীমতের সম্পদ যা হাতে এসেছে, তার সিংহভাগ সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এতোদিন যারা খৃস্টানদের কারাগারে আবদ্ধ ছিলো, একটা অংশ তাদেরকে দান করেন। কিন্তু সুলতানের সব ভাবনা-চিন্তা ফিলিস্তীনের মানচিত্রটার উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। তার অঙুলি লেবানন ও ইসরাইলের কূল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে চলছে। তার মন-মস্তিষ্কের উপর বাইতুল মুকাদ্দাস চেপে বসে আছে। এদিক-ওদিককার কোনো খবর তাঁর নেই। বাহিনীর কোন্ ইউনিট কোথায় অবস্থান করছে, তার জানা আছে। কমান্ডো সেনাদের বণ্টন-বিন্যাস বেশ উন্নত ও যুৎসই ছিলো। প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে তার যথারীতি যোগাযোগ আছে।
সুলতানে আলী মাকাম! সুলতান আইউবী হাসান ইবনে আবদুল্লাহর কণ্ঠ শুনতে পান।
হাসান!- মানচিত্র থেকে চোখ না সরিয়েই সুলতান আইউবী বললেন- যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমার হাতে সময় নেই যে, প্রতিটি কথা রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করে শুনবো, বলবো। আর আমার মাকাম সেদিন। উচ্চ হবে, যেদিন আমি বিজয়ী বেশে বাইতুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করবো।
ত্রিপোলী থেকে খবর এসেছে, রেমন্ড মারা গেছে। আহত ছিলো?
না সুলতান!- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ উত্তর দেন- লোকটা অক্ষত এবং সুস্থই ত্ৰিপোলী পৌঁছে গিয়েছিলো। পরদিন নিজ কক্ষে তার লাশ পাওয়া গেছে। বোধ হয় আত্মহত্যা করেছে।
লোকটা অতেটা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিলো না- সুলতান আইউবী। বললেন- আগেও কয়েকবার পরাজয়বরণ করে ময়দান থেকে পালিয়েছিলো। যাক গে, আমি তার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করছি। লোকটা আমাকে হত্যা করার জন্য হাশিশিদের দ্বারা তিনবার আক্রমণ করিয়েছিলো।
ঐতিহাসিকগণ রেমন্ড অব ত্রিপোলীর মৃত্যুর নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। কাজী বাহউদ্দীন শাদ্দাদ ফুসফুসের ব্যাধি লিখেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন, হাশিশিরা তাকে বিষ খাইয়েছিলো। রেমন্ড অসচ্চরিত্র এবং কুটিল মনের খৃস্টান শাসক ছিলেন। মুসলমানদেরকে গৃহযুদ্ধে জড়ানোর হীন কারসাজিতে তারও হাত ছিলো। খৃস্টান শাসকদের মাঝেও পরস্পর বিরোধ সৃষ্টি করতে কুণ্ঠিত হতেন না। তার সখ্য ছিলো হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের সঙ্গে। সুলতান আইউবীর উপর একাধিক সংহারী আক্রমণ করিয়েছিলেন। এক-দুজন খৃস্টান সম্রাটকেও ফেদায়ীদের দ্বারা হত্যা করাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। সে যুগের কাহিনীকারদের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, রেমন্ড জোটের শরীক সম্রাটদের সঙ্গে বড় ক্রুশে হাত রেখে শপথ করে পরে হিত্তীনের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ত্রিপোলী পৌঁছার পরদিনই তাকে তার কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। জীবনের শেষ রাতে হাশিশিদের নেতা শেখ সান্নান তার নিকট গিয়েছিলো।
তার আগে অপর খ্যাতিমান খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইন মৃত্যুবরণ করেন। এই লোকটি ফিরিঙ্গিদের যুদ্ধবাজ সম্রাট ছিলেন। বাইতুল মুকাদ্দাসের তত্ত্বাবধান তার দায়িত্বে ছিলো। বল্ডউইন যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি জানতেন, সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে চাচ্ছেন। তাই বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করার জন্য তিনি তার বাহিনীকে নিয়ে মুসলিম অঞ্চলগুলোতে ঘুরে-ফিরে যুদ্ধ করতে থাকেন। এটা তার যোগ্যতার প্রমাণ যে, তিনি ইযযুদ্দীন, সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীনকে ঐক্যবদ্ধ করে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজের এই রণময়দানকে যুদ্ধ সরঞ্জাম, মদ, সোনা-মাণিক্য ও সুন্দরী মেয়েদের দ্বারা সুসংগঠিত করতে থাকেন। বয়সে বৃদ্ধ ছিলেন। হিত্তীন যুদ্ধের দিন কয়েক আগে মারা যান। তার স্থলে গাই অফ লুজিনান বাইতুল মুকাদ্দাসের ক্ষমতা হাতে নেন।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিকরা যে ধরনের গেরিলা ও কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করেছিলো, ইতিহাস আজও তার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারেনি। গেরিলারা শত্রু অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালাতে পারে; কিন্তু কোনো ভূ-খণ্ড দখল করতে পারে না। ভূখণ্ড দখল করে সেনাবাহিনী। সুলতান আইউবী তার গেরিলা ও ফৌজকে যে পরিকল্পনা প্রদান করেছিলেন, তা হচ্ছে, বাইতুল মুকাদ্দাসের আশপাশে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত অঞ্চল থেকে খৃস্টান বাহিনীকে উৎখাত ও ধ্বংস করা, উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের দুর্গগুলো জয় করা এবং দুশমনের যেসব অস্ত্র ও রসদ হস্তগত হবে, সেগুলো নিরাপদ স্থানে এনে জমা করা।
সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দিয়ে রেখেছিলেন। এটাই ছিলো তার আসল শক্তি। সুলতান তাঁর সালারদের বলে রেখেছেন, যখন যে নগরী কিংবা পল্লী জয় করবে, সৈনিকদেরকে সেখানকার নির্যাতিত মুসলমানদের করুণ চিত্র দেখাবে। তাদেরকে সেইসব মসজিদ দেখাবে, যেগুলোকে খৃস্টানরা বিরান ও অবমাননা করেছে। তাদেরকে সেই মুসলিম নারীদের দেখাবে, খৃস্টানদের হাতে যাদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছিলো, তাদেরকে ভালোভাবে দেখাও, আমাদের শত্রু কীরূপ এবং তাদের পরিকল্পনা কী।
এ কারণেই সুলতান আইউবীর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর সেনাদল বৃহৎ থেকে বৃহত্তর শত্রু সেনাদলের উপর গজব হয়ে আপতিত হতো। সুলতান আইউবী যা যা দেখাতে চেয়েছিলেন, সৈনিকরা সব দেখে নিয়েছিলো। সে ছিলো এক উন্মাদনা। এখন সুলতান প্রতিনিয়ত একটিই শব্দ শুনতে পাচ্ছেন- অমুক অঞ্চল দখল হয়ে গেছে। অমুক ক্যাম্প থেকে খৃস্টানরা পিছু হটে গেছে ইত্যাদি। আইউবীর বাহিনীর অবিশ্রাম ও অবিরাম যুদ্ধ করছে আর সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একদিনের এক ঘটনায় সুলতান আইউবীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
সুলতান কক্ষে বসে মানচিত্রের উপর ঝুঁকে বসে হাইকমান্ডের সালার ও উপদেষ্টাদের দ্বারা পরবর্তী পরিকল্পনা প্রস্তুব করাচ্ছেন। হঠাৎ বাইরে শোর ওঠে- আমি তোমাদের সুলতানকে হত্যা করবো, তোমরা ক্রুসেডারদের তাবেদার… আমাকে ছেড়ে দাও। নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার। কণ্ঠটা একই ব্যক্তির। সেই সঙ্গে আরো কিছু মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে –ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও… সুলতান রুষ্ট হবেন… মেরে ফেলো বেটাকে… মুখে পানি ছিটাও… পাগল হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবী দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তার ধারণা ছিলো, কোনো খৃস্টান সৈনিক হবে হয়তো। কিন্তু এসে দেখেন তারই ফৌজের এক কমান্ডার, যার হাত দুটো রক্তে লাল হয়ে গেছে। গায়ের কাপড়-চোপড়ও রক্তে ভেজা। চোখ দুটোও রক্তের ন্যায় লাল। ঠোঁটের দুকোণ থেকে ফেনা বেরুচ্ছে। চারজন লোক তাকে ঝাঁপটে ধরে আছে। তারপরও আটকে রাখতে পারছে না।
এই ওকে ছেড়ে দাও। সুলতান আইউবী গর্জে ওঠে বললেন।
সুলতান!- কমান্ডার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- এখানে এসে তোমার সকল সৈন্য আত্মমর্যাদাহীন হয়ে পড়েছে। কাফেররা কেনো জীবিত বেরিয়ে যাচ্ছে? তুমি আমাদের সুলতান সেজে বসে আছো! যেসব মুসলিম নারী ও শিশু কারাগারে পড়ে ছিলো, তুমি কি তাদেরকে দেখেছো?
সুলতান আইউবীর রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার ছুটে গিয়ে উক্ত কমান্ডারের মুখে হাত চেপে ধরে। সে কমান্ডারের বাহু ধরে এতো জোরে ধাক্কা মারে যে, লোকটা তার কাঁধের উপর হয়ে সুলতান আইউবীর সম্মুখে গিয়ে পড়ে।
বাধা দিও না- ওকে বলতে দাও- সুলতান আইউবী পুনরায় গর্জে ওঠে বললেন- এদিকে আসো বন্ধু! আমাকে বলল, তারা তোমাকে কেননা ধরে রেখেছে?
তথ্য বের হয়, লোকটা এক বাহিনীর কমান্ডার ছিলো। তাকে সদ্য কারামুক্ত মুসলিম পরিবারগুলোতে খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি রিলিফ পৌঁছানোর এবং রুগ্নদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো। এ কাজের জন্য একশত সৈনিকের দুটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিলো। এই কমান্ডার মজলুম মুসলমানদের ঘরে ঘরে যেতে থাকে। সেই সূত্রে খৃস্টানরা মুসলমানদের উপর কীরূপ নির্যাতন করেছিলো, তার বিবরণ জানতে পারে। অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও লজ্জাকর কাহিনী। কমান্ডার তার বাহিনীর সৈনিকদেরকে কার্কের মসজিদগুলো পরিষ্কার করতে দেখে। এক মসজিদ থেকে দুজন নারীর বিবস্ত্র গলিত লাশ উদ্ধার হয়। এই কমান্ডার তা-ও নিজ চোখে দেখতে পায়।
সৈনিকরা লাশ দুটো মসজিদ থেকে বের করে আনে। তাদের চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে শুরু করে। একজন বললো- ওরা আমাদের বোন কন্যাদের সঙ্গে এরূপ অমানুষিক আচরণ করলো আর আমাদের সুলতান কিনা তাদেরকে পরিবার-পরিজনসহ এখান থেকে নিরাপদে চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন!
কমান্ডারের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কিছুদূর সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পর সে পনের-বিশটি মেয়েকে যেতে দেখে। তার এক সহকর্মী কমান্ডার কয়েকজন সৈনিকসহ তাদেরকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কমান্ডার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে- এরা কারা, তোমরা এদের সঙ্গে হাঁটছো কেন?
এরা সেই মেয়ে, যারা মিসর ও সিরিয়ায় গাদ্দার তৈরি করেছিলো সঙ্গী উত্তর দেয়- এদের নেতা হারমান ধরা পড়েছে। সবাই খৃস্টান। সুলতান এদের নেতাকে কারাগারে আটক করে এদের ব্যাপারে আদেশ করেছেন, নগরী থেকে বের করে দূরে কোথাও সেই খৃস্টানদের হাতে তুলে দিতে, যারা আক্রা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
আর তোমরা এদেরকে জীবিত রেখে আসবে? কমান্ডার জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, আদেশ তো এমনই পেয়েছি।
এরা কি আমাদের সেই বোনদের চেয়েও বেশি পবিত্র, যাদের উলঙ্গ লাশ মসজিদ থেকে উদ্ধার হচ্ছে এবং যাদেরকে কারাগারে আটক রেখে নিগৃহীত করা হয়েছিলো?
সঙ্গী কমান্ডার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- আমি তো হুকুমের পাবন্দ।
কমান্ডার দাঁড়িয়ে যায় এবং কাফেলার গমন দেখতে থাকে। হঠাৎ তরবারী বের করে তাদের দিকে ছুটে যায়। সে চীৎকার করে বলে ওঠে আমি কারো অনুগত নই। সে এতো তীব্রগতিতে তরবারী চালায় যে, মুহূর্ত মধ্যে তিন-চারটি মেয়ের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রক্ষী কমান্ডার তাকে ধরার জন্য ছুটে যায়। মেয়েরা চীৎকার করে করে এদিক ওদিক পালাতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ধাওয়া করে করে কমান্ডার আরো তিন-চারটি মেয়েকে হত্যা করে ফেলে। এক সৈনিক তাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলে বর্শার ন্যায় তরবারীটা তার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর আর কেউ তার কাছে ঘেঁষতে পারেনি।
এই মানসিক অবস্থা নিয়েই কমান্ডার নগরী থেকে বেরিয়ে যায়। সে কয়েকজন খৃষ্টানকে শহর ত্যাগ করে চলে যেতে দেখে তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। সামনে যাকে পেলে হত্যা করে ফেললো এবং তাকবীর ধ্বনি দিতে থাকে- আমি আত্মমর্যাদাহীন নই- আল্লাহু আকবার।
কমান্ডারের ডাক-চীৎকার শুনে কয়েকজন সৈনিক এগিয়ে আসে। তারা সকলে মিলে ঘেরাও করে কমান্ডারকে ধরে ফেলে। তাকে টেনে-হেঁচড়ে সুলতান আইউবী যে ভবনে অবস্থান করছিলেন, তার নিকট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। একজন বললো, একে সুলতানের আমলাদের হাতে তুলে দাও। ব্যবস্থা যা নেয়ার তারাই নেবেন। অপরাধ গুরুতর- সুলতানের আদেশ লংঘন। সুলতান নিরস্ত্র নাগরিকের উপর হাত তুলতে বারণ করে দিয়েছিলেন। কমান্ডার চীৎকার করতে থাকে। তার চীৎকার শুনে সুলতান আইউবী বাইরে বেরিয়ে আসেন।
সুলতান ঘটনাটা বিস্তারিত শোনেন। বিক্ষুব্ধ কমান্ডারের অভিযোগ অনুযোগও ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করেন। সকলে আশঙ্কা করেছিলো, সুলতান তাকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু না, সুলতান লোকটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে যান। তাকে শরবত পান করান এবং বুঝিয়ে দেন, আমাদের উদ্দেশ্য খৃষ্টানদের হত্যা করা নয়। আমাদের লক্ষ্য প্রথম কেবলাকে মুক্ত করে এই পুণ্যভূমি থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করা।
কমান্ডারের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। সুলতান তাকে ডাক্তারের হাতে অর্পণ করেন।
সৈনিকদের এতো আবেগপ্রবণ হওয়া উচিত নয়- সুলতান আইউবী। তাঁর সালার ও উপদেষ্টাদের বললেন- কিন্তু ঈমান উন্মাদনার পরিসীমা পর্যন্ত পোক্ত হওয়া দরকার। আমাদের এই কমান্ডার হুশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মুসলমান যদি আপন দীনের শত্রুদের দেখে উন্মাদ হয়ে যায়, তাহলে ইসলামের পতাকা সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, যেখানে গিয়ে এই ভূখণ্ডের পরিসীমা সমাপ্ত হয়েছে।
হারমানের যে মেয়েরা এই কমান্ডারের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো, তাদের দুজন সমুদ্রের কূলে পৌঁছে যায়। সমুদ্র দূরে ছিলো না। তারা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। তারা আশ্রয় সন্ধান করছে। তারা। এক স্থানে চুপচাপ বসে পড়ে। খানিক পর একখানা, নৌকা কূলে এসে ভিড়ে। মাল্লা দুজন। তৃতীয়জন অফিসার গোছের লোক। ইনি সুলতান আইউবীর নৌ-বাহিনীর অফিসার আল-ফারেস বায়দারীন। নৌ-বাহিনীর প্রধান হলেন আবদুল মুহসিন। তার পরবর্তী পদের আমীর হলেন হুসামুদ্দীন লুলু।
সুলতান আইউবীর আদেশে নৌবহর- যার হেডকোয়ার্টার আলেকজান্দ্রিয়ায়- রোম উপসাগরে টহল দিচ্ছিলো, ইউরোপের খৃস্টানদের জন্য যদি সেনা সাহায্য, রসদ-সরঞ্জাম ইত্যাদি আসে, তাহলে তাদের জাহাজগুলোকে পথেই যেনো প্রতিহত করা হয়।
হুসামুদ্দীন লুলু ভারত মহাসাগরে অবস্থান করছিলেন। সুলতান আইউবী যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলগুলো দখল করতে চাচ্ছিলেন, তাই মিসরী নৌ বহরকে নির্দেশ প্রেরণ করেন, যেনো ছয়টি সামুদ্রিক জাহাজ কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এগুলো যুদ্ধজাহাজ, যাতে মিনজানিক ছাড়াও অভিজ্ঞ তীরন্দাজ এবং লড়াকু সৈনিক ছিলো।
নৌবাহিনী প্রধান আবদুল মহসিন আল-ফারেসকে কমান্ডার নিযুক্ত করে ছয়টি জাহাজ প্রেরণ করেন। আল-ফারেস তারই একটি জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় করে কূলে চলে আসেন। তিনি নির্দেশনা গ্রহণের জন্য সুলতান আইউবীর নিকট যাচ্ছিলেন। কূলে অবতরণ করে তিনি কৃষাণীর পোশাক পরিহিত দুটি মেয়েকে দেখতে পান। আল-ফারেস তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কারা? এখানে কী করছো? তারা উত্তয় দেয়, আমরা যাযাবর গোত্রের মেয়ে, যুদ্ধের কবলে পড়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি। আমাদের বহু পুরুষ মারা গেছে। অন্যরা এদকি-ওদিক পালিয়ে গেছে।
আর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি- এক মেয়ে বললো খৃস্টানদের এই জন্য ভয় করি, তারা আমাদের মুসলমান মনে করে আর মুসলমানরা মনে করে খৃস্টান। আমরা এখন নিরুপায়-নিরাশ্রয়।
তোমরা মুসলমান না খৃস্টান?
আমাদের যিনি মালিক হবেন, তার ধর্ম যা, আমাদের ধর্মও তা-ই হবে- অপর মেয়ে বললো- আমাদেরকে কারো না কারো হাতে বিক্রি হতেই হবে।
আল-ফারেস নৌযুদ্ধে অভিজ্ঞ এবং অস্বাভাবিক সাহসী কমান্ডার। তদুপরি তিনি খোশ মেজাজের প্রাণবন্ত পুরুষ। এসব গুণের কারণে তিনি সকলের প্রিয়ভাজন। সেকালে তার মতো একজন পুরুষ একসঙ্গে দুতিনটি করে স্ত্রী রাখতো। কিন্তু তিনি এখনো বিয়েই করেননি। সময়টা ছিলো যুদ্ধ বিগ্রহের। আল-ফারেসকে মাসের পর মাস সমুদ্রে কাটাতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত স্থল চোখে দেখাই কপালে জুটছে না। প্রতিটি নৌ-জাহাজের কাপ্তান স্ত্রীকে সঙ্গে রাখছে।
মেয়েগুলোর রূপ-যৌবন আল-ফারেসকে এততটা প্রভাবিত ও বিমোহিত করে তোলে যে, তার ভেতরে অনুভূতি জাগ্রত হয়ে যায়, তিনি আজ তিনটি মাসেরও বেশি সময় সমুদ্রে ঘুরে ফিরছেন। তিনি মেয়েদের বললেন, তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে জাহাজে রাখতে পারি।
আমরা অসহায় অবলা নারী। আশা রাখি, আমরা প্রতারণার শিকার হবো না।
আমি তোমাদেরকে বিক্রি করবো না- আল-ফারেস বললেন- মিসর নিয়ে যাবে এবং দুজনকেই বিয়ে করে নেবো।
মেয়েরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। চোখে চোখে কথা বলে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তারা আল-ফারেসের আশ্রয় গ্রহণ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
আল-ফারেস মেয়ে দুটোকে নৌকার মাল্লাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন- এদেরকে আমার জাহাজে নিয়ে আমার কক্ষে খাবার খাওয়ায়। পরে এদের ওখানেই রেখে ফিরে এসে আমার অপেক্ষা করো।
মেয়ে দুটোকে নৌকায় তুলে দিয়ে আল-ফারেস প্রেমের গান গাইতে গাইতে আক্ৰা অভিমুখে রওনা হয়ে যান।
***
আল-ফারেস!- সুলতান আইউবী আর-ফারেসকে বললেন- আমি তোমার নাম জানি। তোমার দু-তিনটি সামুদ্রিক অভিযানের কীর্তির কথাও শুনেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আগে তুমি একাকি ছোট-খাট অভিযান পরিচালনা করতে। এখন বড় মাপের বৃহৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা বিরাজ করছে। আমি বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে এসেছি। কিন্তু তার আগে সকল বড় বড় বন্দর এলাকা দখল করতে হবে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোকে দখলে নিতে হবে। এই উপকূলীয় শহরগুলোর মধ্যে টায়ের ও আসকালান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ দূতদের মাধ্যমে হবে। তোমার দু-তিনটি নৌকা সবসময় কূলে ভেড়ানো থাকতে হবে। আমি স্থলপথে যেখানেই যাবো, তোমাকে অবহিত রাখবে। তোমার জাহাজ সমুদ্রে টহল দিতে থাকবে। তোমার জাহাজগুলোতে অস্ত্র ও রসদের ঘাটতি নেই তো?
আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। আল-ফারেস উত্তর দেন।
বৃহৎ যুদ্ধেরও সম্ভাবনা আছে- সুলতান আইউবী বললেন ক্রুসেডাররা হিত্তীনে যে পরাজয় বরণ করেছে এবং যেরূপ শোচনীয়ভাবে পলায়ন করেছে, তা খৃষ্টজগতের জন্য এক অসাধারণ ঘটনা। তাদের চার চারজন সম্রাট আমার হাতে বন্দি। একজনকে আমি হত্যা করেছি। রেমন্ড মরে গেছে। তাদের অতিশয় যোগ্য ও দুঃসাহসী সম্রাট বল্ডউইনও মারা গেছে। তার ফিরিঙ্গিরা বিশাল এক শক্তি। কায়রো থেকে আলী বিন সুফিয়ান সংবাদ প্রেরণ করেছে, ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ড এবং জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক ফিলিস্তীনে ক্রুশের রাজত্ব অটুট রাখার লক্ষ্যে নিজ নিজ বাহিনী ও নৌ-বহরসহ আগমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তারা আসলে পরে সিদ্ধান্ত নেবো, তাদেরকে ডাঙ্গায় আসতে দেবো, নাকি নদীতেই প্রতিহত করার চেষ্টা করবো। শুনেছি, ইংল্যান্ডের নৌ-বাহিনী নাকি অনেক শক্তিশালী। সংবাদ পেয়েছি, তারা বারুদ প্রস্তুত করে এমন খোলসে ভরে নিয়েছে, যেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলে উড়ে এসে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি এ জাতীয় খোলস সংগ্রহ করে এরূপ অস্ত্র তৈরি করে নেয়ার চেষ্টা করবো। যা হোক, তুমি তোমার জাহাজগুলোকে কূলের কাছাকাছি রাখবে। নৌ-বাহিনী প্রধান আবদুল মুহসিন সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে।
আল-ফারেস প্রয়োজনীয় সব দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করে বিদায় নিয়ে চলে যান। রেখে আসা নৌকা তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের জাহাজে পৌঁছে অন্যান্য জাহাজের কাপ্তানদের তলব করেন। তাদেরকে জরুরি নির্দেশনা প্রদান করে বিদায় করে দেন। নিজে আপন কেবিনে চলে যান, যেখানে আশ্রিতা মেয়ে দুটো তার অপেক্ষায় বসে আছে। অত্যন্ত সরল-সোজা সেজেছে মেয়েগুলো। কিছুই জানে না ভান ধরে জিজ্ঞেস করে, আপনারা সমুদ্রে কী করেন? আল-ফারেস অনেক দিন যাবত সমুদ্রে নিরানন্দ জীবন-যাপন করছেন। আজ একটু হাসি-আনন্দের পরিবেশ পেয়েছেন। পুরুষদেরকে আঙুলের ইশারায় নাচানোর দীক্ষা মেয়ে দুটোর আছে।
১১৮৭ সালের ২০ জুলাই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আক্ৰা ত্যাগ করেন। তাঁর গেরিলা সৈনিকরা তার জন্য পথ পরিষ্কার করে রেখেছে। সমুদ্রের কূলবর্তী কয়েকটি দুর্গ ও জনপদ তিনি জয় করে ফেলেছেন। ৩০ জুলাই তিনি বৈরুত অবরোধ করেন। খৃস্টানরা তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ নগরীটা রক্ষা করার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু সুলতান আইউবী পরম ত্যাগের বিনিময়ে নগরীটা দখল করে ফেলেন। আক্রার মুসলমানদের ন্যায় : করুণ অবস্থা এখানকার মুসলমানদেরও।
২৯ জুলাই নাগাদ বৈরুতের শাসনক্ষমতা সুসংহত করে সুলতান আইউবী আরেক বিখ্যাত উপকূলীয় শহর টায়ের অভিমুখে যাত্রা করেন। সুলতান গোয়েন্দা রিপোর্ট ব্যতীত অগ্রযাত্রা করতেন না। তাকে অবহিত করা হলো, আপনার ফৌজ অনেক বেশি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এদিক-ওদিক পলায়নকরা খৃস্টান সৈন্যরা টায়েরে একত্রিত হয়ে সংগঠিত হচ্ছে। সকল ফিরিঙ্গিও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পিছপা হয়ে টায়ের চলে গেছে। সুলতান আইউবী টায়ের আক্রমণ মুলতবী করে দেন। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের জন্য সৈন্যদের বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন।
এ সময়ে আল-ফারেস বায়দারীনের নৌ-জাহাজটি কূল থেকে দূরে দূরে টহল প্রদান করতে থাকে। মেয়ে দুটোও তার জাহাজে অবস্থান করছে। ইতিমধ্যে তারা আল-ফারেসের হৃদয়ে জেঁকে বসতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আল-ফারেস কর্তব্যে অবহেলা করছেন না। একটা নিয়ম আছে, যখনই কোনো রণতরী কূলে এসে নোঙ্গর ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট অনেক নৌকা তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। এগুলো গরীব পল্লীবাসীদের নৌকা। তারা নৌকায় করে এসে নানা রকম ফল-মূল, ডিম, মাখন ইত্যাদি মাল্লা ও সৈনিকদের নিকট বিক্রি করে থাকে। জাহাজের কাপ্তানরা তাদের কাউকে কাউকে রশির সিঁড়ি ফেলে জাহাজে তুলে নিয়ে তাদের থেকে স্থল জগতের খবরাখবর সংগ্রহ করেন।
একদিন আল-ফারেসের জাহাজ কূলে এসে ভিড়ে। স্থল বাহিনীর কোনো এক কমান্ডারের সঙ্গে তার কথা বলার প্রয়োজন। মেয়ে দুটো ছাদের উপর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট তিনটি নৌকা এগিয়ে আসে। সেগুলোতে ফল ইত্যাদি পণ্য দেখা যাচ্ছে। তাদের থেকে কিছু ক্রয় করার জন্য তারা জাহাজের লোকদের নিকট অনুনয় করতে শুরু করে। এক নৌকায় মাঝবয়সী এক বৃদ্ধ ছিলো। লোকটির গায়ে গেঞ্জি ছাড়া আর কিছু নেই। নিতান্ত গরীব মনে হচ্ছে। সে দুটো মেয়েকে দণ্ডায়মান দেখে নৌকা জাহাজের একেবারে নিকটে নিয়ে আসে।
কিছু নিন না শাহজাদী!- লোকটি বিনয়ের সুরে বললো- আমরা নিতান্ত গরীব মানুষ। আপনাদের মতো লোকদের দয়ায়ই তো আমরা বাঁচি।
মেয়েরা তার দিকে গভীর চোখে তাকালে সে বাঁ চোখে হাল্কা একটু ইঙ্গিত করে। উভয় মেয়ে খানিক বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। লোকটি এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে একটি আঙুল বুকের উপর উপর-নীচ ও ডান-বাম করে ক্রুশের চিত্র আঁকে। এক মেয়ে নিজের ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের তর্জনীর উপর আড়াআড়ি রেখে ক্রুশ তৈরি করে। বৃদ্ধ মুচকি হাসে। এক মেয়ে জাহাজের মাল্লাদের বললো, ঐ লোকটাকে উপরে তুলে আনো।
মাল্লাদের জানা আছে, এই মেয়ে দুটোর মালিক জাহাজের কাপ্তান, যিনি সবকটি জাহাজের কমান্ডার। তারা সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি ফেলে। বৃদ্ধ টুকরিতে বিভিন্ন পণ্য ভরে উপরে নিয়ে আসে এবং টুকরিটা মেয়েদের সম্মুখে রাখে। মেয়েরা নেড়ে-চেড়ে পণ্য দেখতে শুরু করে। অন্য কারো তাদের কাছে ঘেঁষবার সাহস নেই।
তোমরা এখানে আসলে কীভাবে? মাঝি জিজ্ঞেস করে।
দৈবক্রমে- এক মেয়ে উত্তর দেয়- হারমান ধরা পড়েছেন। মেয়েটি লোকটাকে পূর্ণ ঘটনা শোনায় এবং আল-ফারেস সম্পর্কে জানায়, তিনি আমাদেরকে যাযাবর মনে করে আশ্রয় দিয়েছেন।
কিছু ভেবেছো, কী করবে?- মাঝি জিজ্ঞেস করে- যাবে কোথায়?
আপাতত জান বাঁচানোর ব্যবস্থা করেছি- মেয়েটি উত্তর দেয়- আমরা কমান্ডার আল-ফারেসের মন-মস্তিষ্ক কজা করে ফেলেছি। সুযোগ পেলেই পালাবার চেষ্টা করবো। তবে তুমি দিক-নির্দেশনা দিলে এখানে থেকেই অন্য কিছু করতে পারি।
গরীববেশী এই ব্যবসায়ী মাঝিটা ক্রুসেডারদের গুপ্তচর এবং মেয়েদেরকে ভালো করে জানে। মেয়েরাও তাকে বেশ চিনে। সে বললো, কূলে অবতরণ করে পালাবার চেষ্টা করো না। অন্যথায় শোচনীয় মৃত্যুর সম্মুখীন হবে। বৈরুত পর্যন্ত মুসলমানদের দখল প্রতিষ্ঠি হয়ে গেছে। আমাদের খৃস্টান সৈনিরা প্রতিটি স্থান থেকে পিছু হটে যাচ্ছে। একটিমাত্র অঞ্চল টায়ের অবশিষ্ট আছে, যেখানে আমাদের আশ্রয় মিলতে পারে। এখনো এই জাহাজেই থাকো। আমি তোমাদের খোঁজ-খবর নেবো। পরিস্থিতি আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেছে। সর্বত্র মুসলিম সৈনিকরা গিজ গিজ করছে।
তুমি এখানে কী করছো?
ক্রুশের গায়ে হাত রেখে যে শপথ নিয়েছিলাম, তা পূর্ণ করার চেষ্টা করছি- মাঝি উত্তর দেয়- এই ছয়টি রণতরীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছি। এগুলো ধ্বংস করার ব্যবস্থা করবো।
নিজেদের তরী কোথায়?
টায়েরের নিকটে- মাঝি উত্তর দেয়- এই বহর যদি সেদিকে রওনা হয়, তাহলে আগে-ভাগে সংবাদ বলে দেবো। ভাগ্যক্রমে তোমরা এখানে এসে পৌঁছে গেছে। এ কাজে তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আমিও তোমাদেরকে এখান থেকে বের করে টায়ের পৌঁছিয়ে দিতে পিরবো। আচ্ছা, এবার আমাকে যেতে হবে। সংকেত ঠিক করে নাও। আমি এই জাহাজগুলোর সঙ্গে ছায়ার ন্যায় লাগা আছি। এই জাহজ যেখানেই নোঙ্গর ফেলবে, আমি এই বেশে সেখানে হাজির হয়ে যাবো।
তারা সংকেত ঠিক করে নেয়। মেয়েরা লোকটির টুকরি থেকে কিছু জিনিস নিয়ে দাম দিয়ে দেয়। লোকটি টুকরি মাথায় করে সিঁড়ি বেয়ে, ডিঙ্গিতে নেমে পড়ে।
***
১১৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুলতান আইউবী আরো একটি বিখ্যাত উপকূলীয় শহর আসকালান অবরোধ করেন। এখানেও ভারি পাথর নিক্ষেপকারী মিনজানিক ব্যবহার করা হয়। সুরঙ্গ খননকারী বাহিনী রাতে প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। নিকটেই একটি উঁচু জায়গা ছিলো। সেখান থেকে মিনজানিকের সাহায্যে শহরের ভেতরে পাথর ও অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করা হয়। দ্বিতীয় দিনই অবরুদ্ধরা নগরীর ফটক খুলে দেয় এবং অস্ত্র সমর্পণ করে।
১১৫৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ফ্রিং এই নগরীটা দখল করেছিলেন। পুরো চৌত্রিশ বছর পর শহরটি আবার স্বাধীন হলো।
আসকাল থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস চল্লিশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। দূরত্বটা সুলতান আইউবীর দ্রুতগামী বাহিনী জন্য দুদিনের পথ। তাঁর কোনো কোনো ইউনিট ও গেরিলা বাহিনী আগেই বাইতুল মুকাদ্দাসের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলো। তারা ক্রুসেডারদের বাইরের চৌকিগুলো ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে দিয়েছে। জীবনে রক্ষাপাওয়া অবশিষ্ট খৃস্টান সৈন্যরা বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছাচ্ছে। সুলতান আইউবী তাঁর বিক্ষিপ্ত বাহিনীগুলোকে আসকালানে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাস আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
সুলতান আইউবীর অব্যাহত জয় এবং ঝড়গতির অগ্রযাত্রার সংবাদ দামেক, বাগদাদ, হাব, মসুল এবং ওদিকে কায়রো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ- যিনি এসব আক্রমণ অভিযানে সুলতান আইউবীর সঙ্গে ছিলেন তার রোজনামচায় লিখেছেন, লাগাতার জয়ের ফলে সুলতান আইউবীর বাহিনী ক্লান্তির কথা ভুলেই গিয়েছিলো। তারা একের পর এক অঞ্চল জয় করছিলো আর বিজিত অঞ্চলের মুসলমানদের করুণ অবস্থা দেখে দেখে বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে অধিক থেকে, অধিকতর উদগ্রীব হয়ে উঠছিলো। এ-ই তো ছিলো সুলতান আইউবীর সামরিক শক্তি। কাজী বাহাউদ্দীন আরো লিখেছেন, আসকালানে সুলতান আইউবীর নিকট রূহানী শক্তিও পৌঁছুতে শুরু করেছিলো। তারা হলেন দামেশক, বাগদাদ ও অন্যন্য বড় বড় শহরের আলেম, দরবেশ ও সুফীগণ। তারা সুলতান আইউবীর সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করতে– এসেছিলেন। তারা এসে সুলতান আইউবীকে দুআ দেন এবং তার বাহিনীকে বাইতুল মুকাদ্দাসের গুরুত্ব ও পবিত্রতা অবহিত করেন। মুসলিম বাহিনীকে উত্তেজিত করে তোলেন। সুলতান আইউবী আলেম-দরবেশদের বেশ শ্রদ্ধা করতেন। এবার তাদেরকে সঙ্গে পেয়ে তার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন- এবার পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে পরাজিত করতে পারবে না।
আসকালান থেকে রওনা হওয়ার চার দিন আগে সুলতান আইউবীর নিকট হাব থেকে একজন মেহমান আসেন, যাকে দেখে সুলতান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মেহমান নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা রোজি খাতুন। রোজি খাতুন ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে গিয়ে সুলতান আইউবীকে জড়িয়ে ধরেন। দুজনেরই আবেগ উথলে ওঠে। দুজনই ভারাক্রান্ত হয়ে যান।
খানিক পর অনেকগুলো উটের দীর্ঘ এক সারি এসে দাঁড়িয়ে যায়। আরোহীরা শ দুয়েক মেয়ে।
এ কী? সুলতান আইউবী পরম বিস্ময়ের সাথে রোজি খাতুনকে জিজ্ঞেস করেন।
আহতদের সেবা-চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকটি মেয়ে- রোজি খাতুন উত্তর দেন- আমি এদেরকে যুদ্ধেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছি। তীরন্দাজির বেশ অনুশীলন আছে। আমি জানি, তুমি মেয়েদেরকে যুদ্ধের ময়দানে দেখতে চাও না। কিন্তু আমার ও এদের জযবা বিনষ্ট করার চেষ্টা করে না। তুমি জানো না, সিরিয়ায় তরুণীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কতো কষ্টকর হয়ে ওঠেছে। যে কোনো মেয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির উদগ্রীব। তুমি অনুমতি দিলে আমি এক হাজার মেয়েকে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেবো। তারা পুরুষ সৈনিকদের ন্যায় লড়াই করবে। এখানে যারা যুদ্ধ করছে, তাদের মায়েরা তাদের নিরাপত্তা নয়- জয়ের সংবাদ শুনতে অপেক্ষা করছে। লোকালয়ে একই কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে- সংবাদ কী? বলল সালাহুদ্দীন কতো মেয়ে পাঠাবো?
আমি এদেরকে আমার সঙ্গে রেখে দেবো- সুলতান আইউবী বললেন- আর কাউকে পাঠাবেন না।
উটের পিঠে করে আমি একটি মিম্বর এনেছি- রোজি খাতুন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে অশ্রু নেমে আসে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন- তোমার বোধ হয় মনে নেই, আমার মরহুম স্বামী নুরুদ্দীন জঙ্গী এই শপথ নিয়ে মিম্বরটি তৈরি করিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন যে, বাইতুল মুকাদ্দাসকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করে এটি মসজিদে আকসায় স্থাপন করবেন। অনেক সুন্দর মিম্বর। দামেশকে রাখা ছিল। আমি বহন করে এনেছি। আল্লাহ তোমাকে বিজয় দান করুন সালাহুদ্দীন। আমি দেখার অপেক্ষায় আছি, তুমি এই মিম্বরকে মসজিদে আকসায় স্থাপন করে আমার মরহুম স্বামীর শপথ পূরণ করেছে।
সুলতান আইউবী আপ্লুত হয়ে ওঠেন। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন- আল্লাহ যেনো এই শপথ আমার দ্বারা পূর্ণ করান।
এক যুবতী মেয়ে সুলতানের সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে সুলতানকে সালাম করে। রোজি খাতুন বললেন- চেনোনি? আমার কন্যা শামসুন্নিসা। সুলতান আইউবী মেয়েটাকে যখন দেখছিলেন, তখন ও অনেক ছোট ছিলো।
শামসুন্নিসা তোমার সঙ্গে ময়দানে থাকবে- রোজি খাতুন বললেন মেয়ে সৈনিকরা তার কমান্ডে কাজ করবে। আমাকে ফিরে যেতে হবে।
***
সুলতান আইউবীর নিকট যে আলেম-দরবেশগণ এসেছিলেন, তারা ইবাদত-বন্দেগী, তাসবীহ-তাহলীল, জিকির-অযীফা ও দুআ-দরূদে নিমগ্ন। মাঝে-মধ্যে সৈনিকদের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন এবং তাদের জিহাদী চেতনাকে শাণিত করার চেষ্টা করছেন। আসকালানের বাইরে যেখানে সৈনিকরা ডিউটি করছে, তারা সে পর্যন্তও ঘুরে এসেছেন। তাদের। ভাষণ-বক্তৃতার সারমর্ম মোটামুটি এরূপ
নব্বই বছর যাবত কাফেররা তোমাদের প্রথম কেবলা দখল করে আছে। কুরআন অধ্যয়ন করলে বুঝতে পারবে, প্রথম কেবলাকে কাফেরদের নাপাক কজা থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত কোনো মুসলমানের ঘুম আসার কথা নয়। যে মসজিদে আকসা থেকে আমাদের প্রিয়নবী আল্লাহর আমন্ত্রণে মিরাজে গমন করেছিলেন, সেটি এখন কাফেরদের উপাসনালয়ে পরিণত। রাসূলে মকবুল (সা.)-এর পবিত্র আত্মা আমাদেরকে অভিশম্পাত করছে। আহার-নিদ্রা, স্ত্রী সব আমাদের জন্য হারাম হয়ে যাওয়া দরকার ছিলো। কিন্তু নব্বইটি বছর যাবত আমরা গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছি এবং ভোগ-বিলাসিতায় লিপ্ত রয়েছি।
আল্লাহর সৈনিকগণ! ইহুদী-খৃস্টাদের সুদর্শন চক্রান্তজালে ফেঁসে আমাদের শাসকগণ তাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো, যারা প্রথম কেবলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন। বাইতুল মুকাদ্দাস সেই পবিত্র ভূমি, যেখানে আমাদের প্রিয়নবীর মুবারক পা পড়েছিলো এবং তাঁর পবিত্র কপাল সিজদা করেছিলো। হযরত ইরবাহীম ও হযরত সুলায়মানসহ (আ.) না জানি কতত নবী-রাসূল এখানে ইবাদত করেছিলেন। কিন্তু নব্বইটি বছর যাবত এখানকার মুসলমানদের উপর যে বিভীষিকা চলছে, সেই চিত্র তোমরা নগরীতে প্রবেশ করে দেখে নিও। মসজিদে আকসার উপর ক্রুশ দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদগুলা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়ে আছে। মুসলমানদের এমন গণহত্যা হয়েছে যে, নগরীর অলি-গলিতে রক্তের নদী বইয়ে গেছে। মুসলমানরা বন্দিত্বের জীবন-যাপন করছে এবং মেয়েরা কাফেরদের দাসীতে পরিণত হয়ে আছে।
হে ইসলামের জানবাজ সৈনিকগণ! আল্লাহ তোমাদের বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত ও পবিত্র করার সৌভাগ্য দান করেছেন। তোমাদের ভাগ্য প্রসন্ন যে, তোমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর আমলে জন্ম নিয়েছে। তোমরা যদি ব্যর্থ হও, তাহলে সেখান থেকে তোমাদের লাশ তুলে আনা হবে। আর তোমরা শুনে বিস্মিত হবে, যে বাইতুল মুকাদ্দাসে হযরত ঈসা (আ.) প্রেমের পাঠ শিখিয়েছিলেন, সেখানে ক্রুসেডাররা জঘন্যতম নিষ্ঠুরতার মহড়া দিচ্ছে। শুনলে তোমাদের কান্না পাবে, আবেগ উথলে উঠবে, কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করলে খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাসে উত্সবের আয়োজন করে থাকে। সেই উৎসবে তারা আমাদের যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে বিবস্ত্র করে নাচায় এবং সুঠাম সুদেহী মুসলিম যুবকদের জবাই করে তাদের গোশত রান্না করে খায়। আজ তোমাদেরকে প্রতিজন নিরপরাধ মজলুম মুসলমানের প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নিতে হবে। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মসজিদে আকসায় স্থাপন করার জন্য একটি মিম্বর তৈরি করিয়ে রেখেছিলেন। এখন তাঁর বিধবা সেটি এখানে এনে দিয়ে গেছেন। এই বিদূষী বীর মহিলা দুশ মেয়ে নিয়ে বহুদূর থেকে এসেছেন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে পূরণ করতেই হবে।
সুলতান আইউবী গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট মোতাবেক বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধের পরিকল্পনা প্রণয়নে আত্মনিয়োগ করেন।