৪.৫ ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

কাজী ইবনুল খাশিবের খুন এবং উপহার স্বরূপ আসা মেয়ে দুটোকে পালাবার সুযোগ করে দেয়ার অপরাধে যে সময় সালার শামসুদ্দীন ও শাদ বখৃতকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, ঠিক তখন অপর এক দূত মসুলে গাজী সাইফুদ্দীনের নিকট গিয়ে পৌঁছে। গাজী সাইফুদ্দীন খেলাফতের অধীনে মসুল ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার গবর্নর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে মসুলের স্বাধীন শাসক হিসেবে দাবি করে বসেন। তিনি চরিত্র ও চিন্তা-চেতনার দিক থেকে ছিলেন আইউবীর বিপরীত। মসুল ছিল ইসলামী সালতানাতের অঙ্গ। কিন্তু সাইফুদ্দীন তথাকার স্বাধীন শাসকে পরিণত হয়ে বসেন এবং সুলতান আইউবীর শত্রু পক্ষের সঙ্গে যোগ দেন। তার ভাই ইজুদ্দীন একজন অভিজ্ঞ সেনা অধিনায়ক ছিলেন। সেনা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কমান্ড ছিল তার হাতে। সাইফুদ্দীন যেহেতু নিজেকে রাজা মনে করতেন, তাই তার চাল-চলনও ছিল রাজকীয়। তিনি দেশ বিদেশের সুন্দরী নারী ও নর্তকী দ্বারা তার হেরেম পরিপূর্ণ করে রেখেছিলেন। নারী-নর্তকীর পর তার দ্বিতীয় সখের বস্তু ছিল পাখি। তার হেরেমে যেমন একটি অপেক্ষা অপরটি সুন্দরী নারী শোভা পেত, তেমনি তার ঘরে শোভা পেত খাঁচাভর্তি রং-বেরংয়ের পাখি। নারী আর পাখি নিয়েই ছিল তার জীবন।

ভাই ইজুদ্দীনের সামরিক যোগ্যতার উপর পূর্ণ আস্থা ছিল সাইফুদ্দীনের। তার আশা ছিল, ইজুদ্দীন সুলতান আইউবীকে পরাজিত করে তার জন্য স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন। এ লক্ষ্যে তিনি হাররানের দুর্গপতি গোমস্তগীনের এবং কথিত শাসক আল-মালিকুস সালিহ-এর ন্যায় নিজের জন্য খৃষ্টান উপদেষ্টা নিয়োগ করে রেখেছিলেন, যারা তাকে আশা দিয়ে রেখেছিল, সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে খৃষ্টানরা তাকে সাহায্য করবে। এভাবে মুসলমানদের তিনটি বাহিনী সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। একটি হালবে, একটি হাররানে এবং একটি মসুলে। তারা ছিল বড় বড় মুসলিম শাসক ও আমীর। ছোট ছোট শেখ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রদেশের নবাবগণ- যাদের সংখ্যা বহু- তারা এই তিন বৃহৎ শাসকের সমর্থক ও সহযোগি ছিল। তারা এই তিন শাসনকর্তাকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিল এবং দিচ্ছিলও। তাদেরকে বুঝানো হল, সুলতান আইউবী যদি জয়লাভ করে বসেন, তাহলে যেভাবে তিনি মিশর ও সিরিয়াকে একীভূত করে একটি সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন, তেমনি প্রতিটি মুসলিম প্রদেশকে তাঁর সালতানাতে সংযুক্ত করে প্রত্যেককে তাঁর নিজের গোলামে পরিণত করে ফেলবেন।

তারা বাহ্যত ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু ভিতর থেকে ছিল চরম অনৈক্য। আমি অন্যের তুলনায় দুর্বল থাকি এমনটা তাদের কেউ কামনা করত না। তাদের অবস্থা ছিল ছোট ও বড় মাছের মত। প্রতিটি ছোট মাছ বড় মাছকে ভয় করে চলে এবং কামনা করে, আমিও বড় মাছ হয়ে যাই।. সুলতান আইউবী গোয়েন্দাসূত্রে ভালভাবেই অবহিত ছিলেন যে, তার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে কপটতা বিদ্যমান। তথাপি তিনি কোন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তিনি সবসময় এই বাস্তবতাকে সামনে রাখতেন যে, তিনটি বৃহৎ বাহিনী তার মুখোমুখি দন্ডায়মান। ফৌজ যেমনই হোক, ফৌজ-ই- তারা ভেড়া-বকরীর পাল নয়। তাঁর এই অনুভূতিও ছিল, এই ত্রিপক্ষের কমান্ডার ও জওয়ানরা মুসলমান এবং আল্লাহ পাক যে পরিমাণ সামরিক যোগ্যতা ও বীরত্ব মুসলমানদেরকে দান করেছেন, অন্য জাতিকে তা দান করেননি। ইতিহাস সাক্ষী, খৃষ্টানরা চার পাঁচগুণ বেশী শক্তিধর বাহিনী নিয়ে হামলা করা সত্ত্বেও স্বল্পসংখ্যক নিরস্ত্রপ্রায় মুসলিম সৈনিক তাদেরকে পরাজিত করেছে।

সুলতান আইউবী হাল অবরোধ করে পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। একদল মুসলিম বাহিনী আরেকদল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। হাবের মুসলিম সৈনিকরা এবং সেখানকার মুসলিম জনসাধারণ যেরূপ উদ্দীপনা ও বীরত্বের সঙ্গে হাব রক্ষা করল, তাতে সুলতান আইউবীর পা ফসকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি এই লড়াইয়ের কথা ভুলতে পারছিলেন না।

সুলতান আইউবীর উপর অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল যে, তিনি মুসলমানদের উপর সেনা অভিযান পরিচালনা করছেন। এই দুর্নাম রটনাকারীদের প্রধান লোকটি ছিলেন আব্বাসী খেলাফতের সমর্থক, যাকে সুলতান আইউবী মিশরে পদচ্যুৎ করেছিলেন। এক কথায় এই মুসলিম শাসক ও আমীরগণ সুলতান আইউবীর ফিলিস্তীন স্বাধীন করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রথম কেবলা কাফেরদের দখলে এই বাস্তবতা সুলতানকে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হতে দিচ্ছিল না। তিনি ইহুদীদের প্রত্যয়-পরিকল্পনা সম্পর্কেও বে-খবর ছিলেন না। তিনি জানতেন, ইহুদীরা দাবি করে ফিরছে, ফিলিস্তীন তাদের জন্মভূমি এবং প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের নয়- ইহুদীদের উপাসনালয়। ইহুদীরা স্বসৈন্য সামনে আসছে না বটে; কিন্তু তারা খৃষ্টানদেরকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে যাচ্ছে। তারা খৃষ্টানদেরকে সবচে ভয়াবহ যে-সহযোগিতাটা দিয়ে রেখেছিল, তা ছিল, অসাধারণ রূপসী যুবতী, অতিশয় বিচক্ষণ ও চতুর নারীর আকারে। সেসব মেয়েকে গুপ্তচরবৃত্তি এবং মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হত।

সুলতান আইউবীকে আরো একটি বাস্তবতা বেশী অস্থির করে রেখেছিল যে, খৃষ্টান সৈন্যরাও তার বিরুদ্ধে সোচ্ছার, যাদের ঊর্ধ্বতন কমান্ডার ও ম্রাটগণ তার বিরুদ্ধবাদী মুসলদানদেরকে উষ্কানী দিয়ে যাচ্ছিল।

এমত পরিস্থিতিতে সুলতান আইউবী অতিশয় সাবধানতার সঙ্গে পা বাড়াচ্ছিলেন। তিনি তার বাহিনীকে অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে বিন্যস্ত করে নেন এবং তাঁর গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনাকে দুশমনদের এলাকায় প্রেরণ করে রাখেন। তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনার মধ্যে বেশী ভরসা ছিল কমান্ডো বাহিনী ও গুপ্তচরদের উপর।

***

হালবের দূত পৌঁছে গেছে মসুলেও। আল-মালিকুস সালিহ ও তার আমীরগণ মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনের জন্য প্রেরিত পয়গামের সঙ্গে উপহার প্রেরণ করেছিলেন। তাতে তেমনি দুটি মেয়েও ছিল, যেমনটি প্রেরণ করা হয়েছিল হাররানের দুর্গপতি গোমস্তগীনের নিকট। হাররানে তো দুজন ভারতীয় সেনাপতি শামসুদ্দীন ও শাদবখত মেয়ে দুটোকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং সে সূত্রে কাজী ইবনুল খাশিবকে হত্যা করে নিজেরা কয়েদখানায় বন্দী হয়েছিলেন। কিন্তু মসুলে প্রেরিত মেয়ে দুটো সাইফুদ্দীনের হাতে পৌঁছে যায় এবং সাইফুদ্দীন তাদেরকে সাদরে বরণ করে নেন। এই দুটো মেয়ে তার হেরেমের শোভা আরো বাড়িয়ে তোলে। দূত সাইফুদ্দীনকেও সে একই পয়গাম পৌঁছায়, যা পৌঁছিয়েছিল আরেক দূত গোমস্তগীনকে। তাহল, খৃষ্টানরা হাল্ববাসীকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে প্রতারণা করেছে। সে কারণে তাদের উপর বেশী আস্থা রাখা যাবে না। তবে তাদের বন্ধুত্ব থেকেও হাত গুটানো ঠিক হবে না। তাদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করার উত্তম পন্থা হল, আমরা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুলতান আইউবীর উপর হামলা করব। তিনি আলরিস্তানের পর্বতমালায় হামাতের শিং নামক স্থানে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় যদি আমরা তার উপর হামলা করি, তাহলে খৃষ্টানরা পিছন দিক থেকে তাদের উপর হামলা করবে।

বার্তার সঙ্গে একটি পরিকল্পনাও ছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আলরিস্তানের বরফ গলছে। গোয়েন্দাদের সংবাদ মোতাবেক বরফের প্রবাহমান পানির তোড়ে সুলতান আইউবীর মোর্চাসমূহ তছনছ হয়ে গেছে। আমরা তিনটি বাহিনী একত্রিত হয়ে তাকে সেই উপত্যকায় অবরুদ্ধ করে অনায়াসে পরাজিত করতে পারি। বার্তায় আরো উল্লেখ করা হয়েছিল, গোমস্তগীনকেও পয়গাম প্রেরণ করা হয়েছে। আশা করছি, তিনি আমাদের সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করবেন। আপনিও সময় নষ্ট না করে জোটে এসে যোগ দিন। তবেই সালাহুদ্দীন আইউবীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা সম্ভব হবে।

বার্তাটা পেয়েই সাইফুদ্দীন তার ভাই ইজুদ্দীন, দুজন সিনিয়ন সেনা অধিনায়ক ও মসুলের স্বনামধন্য খতীব ইবনুল মাখদুম কাকবুরীকে নিয়ে বৈঠকে বসেন।

তিনি সকলকে দূতের বার্তাটা শুনিয়ে বললেন

আপনারা আমার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ভালভাবে অবগত আছেন যে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর আনুগত্য মেনে নেব না। তার শিরায় যে খুন প্রবাহিত, আমার শিরায়ও সেই একই খুন বিদ্যমান। আপনারা আমাকে শুধু এই পরামর্শ দিন যে, আমরা জোটে যোগ দেব কি-না। আমার ইচ্ছা হল, আমাদের বাহিনী প্রকাশ্যে সম্মিলিত বাহিনীর অধীনে থাকবে। কিন্তু আপনারা লড়াই করবেন আলাদাভাবে। যাতে আমাদের বাহিনী যে যে এলাকা জয় করবে, তার অধিকর্তা আমি ছাড়া কেউ না হতে পারে।

আপনি যে সিদ্ধান্ত স্থির করেছেন, তার চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না। আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এক সালার বললেন।

সালাহুদ্দীন আইউবী খৃষ্টান ও সুদানীদেরকে পরাজিত করতে পারেন আমাদেরকে নয়। আরেক সালার বললেন- আপনি আপনার বাহিনীকে সম্মিলিত বাহিনীতে যুক্ত করে নিন। কিন্তু কমান্ড রাখুন নিজের হাতে। আমরা আমাদের সৈন্যদের দ্বারা এমনভাবে যুদ্ধ করাব যে, আমাদের বিজয় হাল্ব ও হাররানের বাহিনী থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা দেখা যাবে।

আমরা আপনার আদেশের সামনে নিজেদেরকে কোরবান করে দেব মাননীয় সম্রাট- প্রথম সালার বললেন- আমরা আপনাকে সেই সালাতানাতে ইসলামিয়ার রাজা বানাব, সালাহুদ্দীন আইউবী যার স্বপ্ন দেখছেন।

সালাহুদ্দীন আইউবীর মাথা কেটে আমরা আপনার পায়ে রাখব- দ্বিতীয় সালার বললেন- তার ফৌজ আলরিস্তানের উপত্যকা থেকে জীবিত বের হতে পারবে না। আপনি এখনি রওনা হওয়ার নির্দেশ দিন। বাহিনী প্রস্তুত।

উভয় সালার একজন অপরজনের চেয়ে নিজের অফাদারী প্রকাশে ব্যাকুল। ইজুদ্দীন চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছেন কখন তার পালা আসবে। খতীব ইবনুল মাখদুম কখনো সালারদ্বয়ের প্রতি, কখনো সাইফুদ্দীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন। আবার কখনো মাথা নত করে বসে থাকছেন।

ইজুদ্দীন! তোমার মতামত কী বল। ভাইকে উদ্দেশ করে সাইফুদ্দীন বললেন।

আমি আপনার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত যে, আমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে- ইজুদ্দীন বললেন- কিন্তু আমাদের সালারদের এজাতীয় আবেগময় বক্তব্য আমি সমর্থন করি না। আইউবী খৃষ্টান ও সুদানীদের পরাজিত করতে পারেন আমাদেরকে নয় শুধু এ ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লেই আইউবীকে পরাজিত করা যাবে না। আমি বরং বলব, যার স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিজেদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী খৃষ্টান সেনাকে পরাজিত করতে পেরেছে, সেই তিনি আপনাকেও পরাজিত করতে পারবেন। যিনি মরুভূমির সৈন্যদের দ্বারা তুষারাবৃত এলাকায় যুদ্ধ করিয়ে চার চারটি দুর্গ জয় করলেন এবং রেমন্ডের বাহিনীকে পিছনে সরে যেতে বাধ্য করলেন, তিনি বরফ গলে যাওয়ার পর আরো ভালভাবে যুদ্ধ করতে পারবেন। আমাদের কোন প্রকার আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না। শত্রুকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই। কিরূপ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এবং কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করতে হবে, তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

ইজুদ্দীন সুলতান আইউবীর সৈনিকদের বৈশিষ্ট্যের বিবরণ প্রদান করেন। তারপর আইউবীর লড়াই করার পদ্ধতি বিবৃত করেন এবং সামনের যুদ্ধটা যে ময়দানে সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার উপর আলোকপাত করে বললেন- বরফ গলতে শুরু করেছে। এ বছর বর্ষা শুরু হয়েছে বিলম্বে। সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ তাঁবুতে অবস্থান করছে। কিন্তু উট-ঘোড়া তো আর তাবুতে রাখা যায় না। এ সময়ে তার ফৌজের উট-ঘোড়াগুলো গাছের তলে কিংবা গুহায় বাস করছে। উট-ঘোড়া এভাবে সুস্থ্য-সবল থাকতে পারে না। তাছাড়া এই আশাও রাখা যায় যে, আইউবীর সৈনিকরা পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থান করে করে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আমাদেরকে এ বিষয়টাও নজরে রাখতে হবে যে, আমরা যদি আমাদের বাহিনীকে হাল্ব ও হাররানের বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করে যুদ্ধ করি, তাহলে আইউবীকে ঘিরে ফেলা সহজ হবে। কিন্তু আমাদেরকে একথা ভুলে গেলে চলবে না, মুসলমান সৈনিক যখন মুসলমান সৈনিকের মুখোমুখি হবে, তখন ইসলামের চিরন্তর আত্মীয়তা তাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে পারে। যে তরবারী পরস্পর যুদ্ধ করতে কোষমুক্ত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হবে, তা অবনমিতও হয়ে যেতে পারে এবং রক্ত না ঝরিয়ে-ই কোষে ফিরে যেতে পারে।

ইজুদ্দীন!–ইজুদ্দীনকে থামিয়ে দিয়ে সাইফুদ্দীন বললেন- তুমি একজন সৈনিক মাত্র। তুমি রক্ত, তরবারী আর তরবারীর কোষের কথা ভাবতে পার শুধু। মুসলমান সৈনিককে মুসলমান সৈনিকের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াতে হয়, সেই কৌশল তোমাকে আমার নিকট থেকে শিখতে হবে। আগামী পরশু রমযান শুরু হচ্ছে। সালাহুদ্দীন আইউবী নিজে নামায-রোযার যতটুকু পাবন্দ, ততটুকু পাবন্দী তার সৈন্যদের দ্বারাও করিয়ে থাকেন। যুদ্ধটা যখন শুরু হবে, তখন তার সব সৈন্য রোযাদার থাকবে। আমরা আমাদের সৈন্যদেরকে বলে দেব, যুদ্ধের সময় রোযা রাখার পাবন্দী নেই। মাননীয় খতীব সাহেব তোমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। আমি তার পক্ষ থেকে ঘোষণা করিয়ে দেব যে, যুদ্ধের সময় রোযা মাফ। আমরা হামলা করব দুপুরের পর। সকাল বেলা হামলা করলে তখন আইউবীর সৈন্যরা তরতাজা থাকবে। দুপুরের পর আমাদের সৈন্যদের পেটে খাবার থাকবে আর আইউবীর সৈন্যরা থাকবে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। আমি শুধু এটুকু জানতে চাই যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর বিপক্ষে লড়াই করার সিদ্ধান্তটা সঠিক কিনা।

আপনার এই সিদ্ধান্ত যথার্থ। এক সালার বললেন।

 আমরা আপনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করে প্রমাণ দেব, এই সিদ্ধান্ত সর্বদিক থেকেই সঠিক। আরেক সালার বললেন।

আমি আপনার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কোন কথা বলিনি- ইজুদ্দীন বললেন আপনাকে আমি আরো একটি পরামর্শ দেব। আপনি আমাকে রিজার্ভ রেখে দিন। যদি প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমি পরে সময়মত হামলা করব। প্রথম সংঘর্ষের কমান্ড আপনি নিজের হাতে রাখুন।

তা-ই হবে- সাইফুদ্দীন বললেন- বাহিনীকে দুভাগে ভাগ করে নাও এবং দ্রুত প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দাও। রিজার্ভ বাহিনীটিকে তোমার কাছে রাখ।

***

খতীব ইবনুল মাখদুম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সাইফুদ্দীন তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে মুচকি হেসে বললেন- মহামান্য খতীব! আপনি একাধিকবার কুরআন থেকে ফাল বের করে আমাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। আপনি মহান আল্লাহর দরবারে আমার নিরাপত্তা ও বিজয়ের জন্য দুআও করেছিলেন। আপনি জানেন, আমি আপনার অপেক্ষা আর কাউকে বড় বুজুর্গ মনে করি না। মানুষের যদি কোন মানুষকে সেজদা করার অনুমতি থাকত, তাহলে আমি আপনাকে সেজদা করতাম। এ মুহূর্তে আমি এমন এক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছি, যার সফলতার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমি একটি শক্তিশালী দুশমনের মোকাবেলায় যাচ্ছি। যুদ্ধে জয় হয়, নয় পরাজয়। আপনি কোরআন থেকে ফাল বের করে আমাকে বলুন, এ যুদ্ধে আমার ভাগ্যে বিজয় লেখা আছে, পরাজয়।

 আমীরে মোহতারাম!–খতীব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন- একথা সঠিক যে, আপনি আমার দ্বারা কয়েকবার কুরআন থেকে ফাল বের করিয়েছিলেন। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের জীবদ্দশায় আপনি একবার একদল ডাকাতকে ধাওয়া করেছিলেন। তখন আমি কুরআন থেকে ফাল বের করে আপনাকে সাফল্যের সুসংবাদ শুনিয়েছিলাম এবং আপনি সফল হয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। আপনি যখন খৃষ্টানদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, আমি কুরআন থেকে ফাল বের করে আপনাকে বিপদ সম্পর্কে সাবধান করেছিলাম ও কামিয়াবির সুসংবাদ প্রদান করেছিলাম। আল্লাহর শোকর, আমার বের করা প্রতিটি ফাল সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু…।

খতীব প্রথমে ইজুদ্দীনের প্রতি, তারপর সালারদ্বয়ের প্রতি তাকিয়ে বললেন

কিন্তু, মসুলের শাসনকর্তা! এবার ফাল বের না করেই আমি আপনাকে বলে দিতে পারব, আপনি যে অভিযানে বের হচ্ছেন, তাতে আপনি জয়লাভ করবেন, নাকি পরাজয়।

শীঘ্র বলুন মাননীয় শায়খ! অস্থির হয়ে সাইফুদ্দিন বললেন।

 আপনি এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করবেন যে, যদি সময়মত পলায়ন না করেন, তাহলে আপনি নিঃশেষ হয়ে যাবেন–খতীব বললেন- আমার পরামর্শ, এ অভিযানে না আপনি নিজে যাবেন, না ভাইকে প্রেরণ করবেন, না আপনার ফৌজ পাঠাবেন।

সাইফুদ্দীনের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায়। ইজুদ্দীন এবং সালারদ্বয়ের মুখও বন্ধ হয়ে যায়। খতীব সাইফুদ্দীনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে থাকেন।

আপনি তো কুরআন খুললেনই না- সাইফুদ্দীন বললেন- কুরআন ছাড়া আপনি ফাল বের করলেন কিভাবে? আমি কিভাবে মেনে নেব যে, আপনি যে দুঃসংবাদ শোনালেন, তা সঠিক?

শুনুন মসুলের শাসক!–খতীব ইবনুল মাখদুম বললেন- আমি এতকাল কুবআন থেকে যেসব ফাল বের করে আপনাকে সুসংবাদ শুনিয়ে আসছিলাম, কুরআনের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। কুরআন কোন জাদুমন্ত্রের বই নয়। কুরআন ঘোষণা করছে যে, এই কুরআনের যেসব বিধিবিধান রয়েছে, যে ব্যক্তি তা মান্য করবে, সে সফল হবে। আর যে তা অমান্য করবে, সে ব্যর্থ ও পরাজিত হবে। এর আগে আপনি ক্রুশের পূজরীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েছিলেন। তখন আমি বলেছিলাম, আপনি কামিয়াব হবেন। তারপর আপনি যখনই যে অভিযানে গিয়েছিলেন, আমি আপনাকে সাফল্যের সুসংবাদ শুনিয়েছি এবং বলেছি, এটা কুরআনের ফাল। প্রতিটি ফালই শুভ ছিল। তার কারণ একটি-ই ছিল যে, আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ ও কর্মকান্ড আল্লাহর বিধানের অনুকূলে ছিল। কিন্তু এখন আপনি যে অভিযানে বের হচ্ছেন, তা আল্লাহর বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন ও বিরোধিতা। আপনি কাফেরদের হাতকে শক্তিশালী করছেন। তাদের সহযোগিতা নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য নিবেদিত ঈমানদান লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছেন।

আপনি কিসের ভিত্তিতে বলছেন, সালাহুদ্দীন আইউবী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য নিবেদিত হয়ে এখানে এসেছেন?- উত্তেজিত কণ্ঠে সাইফুদ্দীন বললেন- আমি তো বলছি, তিনি একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্যের রাজা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন। আমরা তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হতে দেব না। তাকে এখানে যমে টেনে এনেছে। আমরা প্রথমে তাকে যমের হাতে তুলে দিয়ে তারপর ক্রুশের পূজারীদের খতম করব।

অন্তসারশূন্য শব্দমালা দ্বারা আপনি আমাকে ধোকা দিতে পারেন আল্লাহকে নয়- খতীব বললেন- আমাদের কার অন্তরে কী আছে, আল্লাহ পাকের সবই জানা আছে। বিজয় তার কপালেই জুটবে, যে নিজের নফসের উপর জয়ী হতে পেরেছে। এ মুহূর্তে আমি আপনাকে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ভবিষ্যদ্বানী করছি, পরাজয় আপনার কপালের লিখন হয়ে আছে। আপনি যদি ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নেন এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য দাঁড়ান, তবেই শুধু আপনার ললাটের লিখন টলতে পারে।

মোহতারাম খতীব!–ইজুদ্দীন বলে উঠলেন- আপনি আপনার ধর্ম আর মসজিদ নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। সামরিক বিষয়াবলী ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড আপনি বুঝবেন না। আমি আপনাকে আমাদের মনোবল নষ্ট করার চেষ্টা না করার পরামর্শ দেব। যুদ্ধজয়ের সব উপকরণই আমাদের আছে, আপনার হয়ত তা জানা নেই।

আপনি যদি যুদ্ধকে ধর্ম ও মসজিদ থেকে আলাদা করে লড়াই করেন, তাহলে না হৃদয় আপনার সঙ্গ দেবে, না জযবা- খতীব বললেন- আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আমি সামরিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ। কিন্তু আমি এ কথাটা জানি যে, যুদ্ধ শুধু অস্ত্র আর ঘোড়া দ্বারা জয় করা যায় না এবং সেই সামরিক যোগ্যতার বলেও জয় করা যায় না, আপনি যার জন্য গর্বিত এবং যার উপর নির্ভর করে আপনি কুরআনের বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত হচ্ছেন। আরো একটি বিষয় এমন রয়েছে, যা জয়কে পরাজয়ে পরিণত করে দেয়।

সবাই চকিত নয়নে তাঁর প্রতি তাকিয়ে থাকে। তিনি বললেন—

 যে শাসক চাটুকারিতা পছন্দ করে সে নিজের সঙ্গে দেশ ও জাতিকে নিয়ে একসঙ্গে ডুবে মরে। সে শাসক রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডকে চাটুকার ও দাস মানসিকতাসম্পন্ন লোকদের হাতে তুলে দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিকে অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও দাসানুদাস প্রজায় পরিণত করে ছাড়ে। আর এই শাসক যখন ফৌজের কমান্ড চাটুকার সালারদের হাতে তুলে দেয়, তখন দুশমন দেশটাকে হজম করে ফেলে। চাটুকার সেনা অধিনায়ক তার অধীনদের দ্বারা চাটুকারিতা আদায় করে। তারপর দেশ ও জাতির জন্য লড়াই করার পরিবর্তে শাসকের সন্তুষ্টি অর্জন তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়। আমি এই দরবারেই দেখলাম যে, উপস্থিত দুসালারই আপনার হা-এর সঙ্গে হ্যাঁ মিলার কসরত করেছে এবং এমন আবেগময় কথা-বার্তা বলেছে, যা একজন যোদ্ধ বলে না। তারা উভয়ে আপনার সিদ্ধান্ত ও প্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করেছে বটে; কিন্তু আপনাকে সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করেনি। তারা আপনাকে এইকথা জানায়নি যে, খৃষ্টানরা আমাদের সকলকে ঘিরে রেখেছে। আল-আক্সা কাফেরদের দখলে। এমতাবস্থায় ভাল হবে, আপনি গোমস্তগীন ও হাবের আমীর প্রমুখ সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট গিয়ে যোগ দিন এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর দুশমন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করুন। আর যদি আপনি ই সত্য পথের অনুসারী হয়ে থাকেন, তাহলে আইউবীকে মিথ্যুক ও ক্ষমতালোভী প্রমাণ করুন।

কিন্তু আপনার সালারগণ আপনাকে এরূপ কোন পরামর্শ দেয়নি। তারা আপনাকে একথাও বলেনি যে, সালাহুদ্দীন আইউবী আলরিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলকে ঘাটি বানিয়ে তার বাহিনীকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত এমনভাবে ছড়িয়ে রেখেছেন যে, আপনি তাকে অবরোধ করার কল্পনাও করতে পারবেন না। তার গেরিলা সেনাদের সম্পর্কে তো আপনি ভালভাবে অবহিত। কিন্তু আপনার সালারগণ আপনার চোখে পট্টি বেঁধে এ বিষয়টাকে আপনার দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে রেখেছে যে, আইউবীর গুপ্তচর ও কমান্ডো সেনারা আপনার অন্তর থেকে তথ্য বের করে নিয়ে যেতে পারে এবং আপনার চোখে ধূলি দিয়ে আপনার হেরেমের মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন। আপনার ফৌজ এখান থেকে রওনা হওয়া মাত্র আইউবী তাদের গতিবিধি, সংখ্যা ও গন্তব্য জেনে ফেলবেন।

মহামান্য সুলতান!- এক সালার ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন- আমরা কি এভাবেই আপনার অপমান সহ্য করে যাব? মসজিদে বসে রাত-দিন আল্লাহ আল্লাহ জিকিরকারী দরবেশ আমাদের গুরু হওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে! ইনি আমাদের সামনে আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করে আপনাকে অপমান করছেন। আমরা এটা সহ্য করতে পারিনা।

আমাকে শুনতে দাও- সাইফুদ্দীন বললেন- আমি আমার মোহতারাম খতীবকে এখনো সম্মানের চোখেই দেখছি।

বলুন মুহতারাম খতীব!- অবজ্ঞার সুরে ইজুদ্দীন বললেন- শেষ পর্যন্ত আপনাকে একথাও বলতে হবে, আপনার আনুগত্য কার প্রতি। আমাদের প্রতি, নাকি সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি।

আমার আনুগত্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেল প্রতি- ইৰ্জ্জুদ্দীনকে উদ্দেশ করে খতীব বললেন- আমি আপনার প্রশংসা করব যে, আপনি আপনার ভাইকে দু চারটা সত্য কথা শুনিয়েছেন। বাদবাকী কথা আপনিও চোখ-দেমাগ বন্ধ করে বলেছেন। ইমামুদ্দীনও তো আপনার ভাই। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সুহৃদ কেন এবং কেন আপনার সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন না?

আপনি আমাদের পারিবারিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না- ইজুদ্দীন বললেন- আপনি আসলে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে, সালাহুদ্দীন আইউবী খোদার পয়গাম্বর এবং আমাদের সকলকে তাকে সেজদা করতে হবে। আপনাকে শুধু বলা হয়েছিল, কুরআন থেকে ফাল বের করে বলুন আমাদের এই অভিযান সফল হবে না ব্যর্থ।

কুরআন তার বিধি-বিধান স্পষ্টভাবেই বর্ণনা করেছে- জোরালো কণ্ঠে খতীব বললেন- আমি আপনাদের সম্মুখে বাস্তব সত্যটা খোলাখুলি ব্যক্ত করেছি। সালাহুদ্দীন আইউবী খোদার প্রেরিত পয়গাম্বর নন। তিনি একটি ঝড়, একটি স্রোত, যা কুফরকে শুষ্ক তৃণলতার ন্যায় ভাসিয়ে নেয়ার জন্য দামেস্ক থেকে উঠে এসেছে। আপনারা সবাই বৃক্ষের ভেঙ্গে পড়া ডাল, যার পাতাগুলো একে একে ঝরে পড়ছে আর সেই স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। আইউবী আপনাদের উপর চড়াও হননি- আপনারাই-ই বরং তাঁর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। আপনাদের পরিণতি তা-ই হবে, যা স্রোতের মুখে পড়া পত্র-পল্লবের হয়ে থাকে।

খতীব!- সাইফুদ্দীন গর্জে উঠে বললেন- অনুগ্রহপূর্বক আমার অন্তর থেকে আপনার মর্যাদাবোধ বের করে ফেলবেন না।

তুমি… সাইফুদ্দীন!- গম্ভীর কণ্ঠে খতীব বললেন- তুমি পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডটির রাজা। ভয় কর সেই সত্ত্বাকে, যিনি উভয় জগতের বাদশাহ। আমাকে তোমার শ্রদ্ধা করার প্রয়োজন নেই। তুমি আমার মুখে থু থু নিক্ষেপ কর; তবু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ থেকে সরে যেও না। তোমার উপর রাজত্বের নেশা চেপে বসেছে। এই আত্মমর্যাদাহীন সালার এবং তোমার প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ তোমাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য তোমাকে রাজা বানিয়েছে। তুমি বুঝছ না যে, এটা নিছক চাটুকারিতা এবং তুমি রাজা নও। তুমি জান না, এই চাটুকার লোকগুলো তোমার শত্রু, জাতি ও দেশের দুশমন। যখন তোমার পতন ঘনিয়ে আসবে, তখন এরা তোমাকে চিনতেও অস্বীকার করবে এবং সেই ব্যক্তির পাপোষ চাটবে, যে তোমার সিংহাসনে বসবে। আমার প্রতি ক্রুদ্ধ চোখে দৃষ্টিপাত কর না সাইফুদ্দীন! জাহান্নামে ঠিকানা নিও না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। এই গোলাম মানসিকতার লোকগুলো বহু প্রতাপাম্বিত রাজা-বাদশাহকে ভিখারীতে পরিণত করেছে। ইতিহাস বলছে, এমনটি অতীতেও হয়েছে এবং হতে থাকবে। দুঃখ হল, রাসূলের উম্মতও এই ধ্বংসের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

লোকটাকে এখান থেকে নিয়ে যাও- ক্ষোভ-কম্পিত কণ্ঠে গর্জে উঠলেন সাইফুদ্দীন- একে এমন জায়গায় আবদ্ধ করে রাখ, যেখান থেকে এর কণ্ঠ আমার কানে এসে না পৌঁছে।

এক সালারের ডাকে দুজন দেহরক্ষী ভিতরে প্রবেশ করে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হল, খতীবকে কয়েদখানায় নিয়ে যাও।

খতীব ইবনুল মাখদুমকে যখন দুবাহুতে ধরে কয়েদখানা অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সাইফুদ্দীন তার কণ্ঠ শুনতে পান

রাজত্বের মোহ মানুষকে দ্বীন থেকে সম্পর্কহীন করে তোলে। তোষামদপ্রিয় শাসক জাতিকে বিক্রি করে খায়। কাফেরের বন্ধুত্ব শত্রুতা অপেক্ষা বেশী ক্ষতিকর। ফিলিস্তীন আমাদের। ফিলিস্তীন আমার রাসূলের। কাফেররা তোমাদেরকে পরস্পর এজন্য যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে, যাতে ফিলিস্তীনের উপর তাদের দখল অটুট থাকে। তোমরা যদি আপসে লড়াই করতে থাক, তাহলে প্রথম কেবলা তোমাদেরকে অভিশম্পাৎ করতেই থাকবে।

খতীব ইবনুল মাখদুমকে টেনে-হেঁচড়ে কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর তিনি চিৎকার করে এ কথা বলছেন। বহু সৈনিক বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের ন্যায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, খতীব ইবনুল মাখদুম পাগল হয়ে গেছেন এবং তাকে কয়েদখানায় আটকে রাখা হয়েছে।

সংবাদটা শহরময় ঘুরেফিরে খতীবের বাসগৃহের দরজায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। ঘরে আছে খতীবের ষোড়শী এক কন্যা। ঘরে পিতা-কন্যা দুজনই বাস করতেন। মেয়েটা খতীবের একমাত্র সন্তান। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তিনি পরে আর বিয়ে করেননি। এভাবেই বাকী জীবন কাটিয়ে দেবেন বলে তিনি মনস্থির করেছিলেন।

আশ-পাশের বহু মহিলা খতীবের ঘরে এসে ভীড় জমায়। পরিবারটা সকলের শ্রদ্ধাভাজন। মহিলারা খতীবের কন্যার নিকট জানতে চায়, তোমার পিতার হঠাৎ করে কী হয়ে গেল? তিনি কি সত্যই পাগল হয়ে গেছেন?

এমন হওয়ারই কথা ছিল- মেয়ে বলল- এমনটা হওয়ারই কথা ছিল। তার কণ্ঠে গাম্ভীর্য। ভয়-ভীতির লেশ মাত্র নেই। যত মহিলা তার ঘরে এসেছে, প্রত্যেককে সে একই জবাব দিয়েছে- এমনটা হওয়ারই কথা ছিল।

***

মসুলে খতীবকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। হাররানে দুসেনা অধিনায়ক শামসুদ্দীন ও শাদবখতকে গোমস্তগীন বন্দী করে রেখেছেন। গোমস্তগীন এই প্রথমবার জানতে পারলেন যে, তার এই দুসালার মূলত সালাহুদ্দীন আইউবীর লোক এবং গোয়েন্দা। দুজন আটক হওয়ার পর গোমস্তগীন রাতে কয়েদখানায় যান এবং তাদেরকে ওখান থেকে বের করে সে কক্ষে নিয়ে যান, যেখানে আসামীদের মুখ থেকে তথ্য বের করার সব ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। ওখানে দুজন লোককে এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে যে, তাদের উভয় বাহু রশি দ্বারা ছাদের সঙ্গে বাঁধা, পা দুটো মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে এবং পায়ের গোড়ালীর সঙ্গে অন্তত দশ সের ওজনের লোহা ঝুলানো। প্রচন্ড শীতের মধ্যেও তাদের সমস্ত শরীর ঘামে জবজবে হয়ে আছে। তাদের বাহু ছিঁড়ে কাঁধ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে যেন। জায়গাটায় রক্ত ও পঁচা-গলা লাশের দুর্গন্ধে এক অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছে।

এদেরকে দেখে নাও- গোমস্তগীন দুভাইকে উদ্দেশ করে বললেন- এই বন্দীশালায় আসার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা আমার সেনাবাহিনীর মালিক ছিলে। এখন কর্মদোষে এখানে এসে স্থান নিয়েছ। তোমরা গাদ্দার। তোমরা আমার আস্তিনের তলে সাপ হয়ে পালিত হয়েছিলে। তবে আমি তোমাদেরকে এখনো ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত আছি। তোমরা আমাকে শুধু বলে দাও, যে দুটো মেয়েকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছ এবং তাদের সঙ্গে আরো যে দুজন পুরুষ গিয়েছে, তারা কোথায় গেছে এবং এখান থেকে কি কি তথ্য নিয়ে গেছে। জবাবে শামসুদ্দীন ও শাদবখত মুচকি হাসি দিয়ে চুপ করে থাকেন। গোমস্তগীন বললেন- তারা সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট গেছে। কী, মিথ্যা বললাম? শামসুদ্দীন ও শাদবখত কান দিলেন না। গোমস্তগীন বললেন- এই দুজনকে দেখে নাও। এরা যুবক বলে এখনো সহ্য করতে পারছে। তোমাদেরকে যদি এভাবে ঝুলিয়ে পায়ে বিশ সের ওজন বেঁধে দেই, তাহলে অল্পক্ষণের মধ্যেই বক্ষ উন্মুক্ত করে আমার সামনে রেখে দেবে। কিন্তু আমার পরামর্শ, এসব বাদেই তুমি আমাকে সব বলে দাও।

তারা কোন তথ্য নিয়ে যায়নি- শামসুদ্দীন বললেন- এখানে কোন তথ্য নেই। তোমার ব্যাপারে সালাহুদ্দীন আইউবী ভাল করেই জানেন যে, তুমি খৃষ্টানদের সহযোগিতা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছ। আইউবী পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই তোমাদেরকে পরাজিত করতে এসেছেন। এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার মত কোন তথ্য নেই। তথ্য শুধু এতটুকু ফাঁস হয়েছে যে, আমরা দুভাই তোমার ফৌজের সালার ছিলাম। তুমি আমাদেরকে বিশ্বস্ত মনে করতে। অথচ আমরা আসলে আইউবীর লোক।

অপর তথ্যটিও আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি- শামসুদ্দীনের ভাই শাদবখত বললেন- দুটি মুসলিম মেয়ে উপহার স্বরূপ তোমার কাছে এসেছিল। ঘটনাক্রমে আমরা জানতে পারলাম, তারা মজলুম এবং মুসলমান। তোমার কাজী ইবনুল খাশিব তোমার আগেই তাদেরকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমরা তাদেরকে নিজ কন্যা মনে করে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছি এবং কাজী ইবনুল খাশিব আমাদের জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন যে, তাকে খুন করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। তুমি ঘটনাটা জেনে ফেলেছ এবং আমাদেরকে গ্রেফতার করে বন্দী করে ফেলেছ। আমরা যদি ধরা না পড়তাম, তাহলে আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যখন তুমি আমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করতে, আমরা গোটা বাহিনীটিকে সুলতান আইউবীর বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে যেতাম এবং তাঁর হাতে আত্মসমর্পণ করে তোমাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতাম। দুঃখ, আমাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না।

তারপরও আমরা সফল- শামসুদ্দীন বললেন- তুমি আমাদেরকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দাও। আমাদেরকে ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে আমাদের পায়ের সঙ্গে বিশ বিশ সের ওজনের পাথর বেঁধে দাও। আমাদের বাহু কাঁধ থেকে আলাদা করে ফেল। আমরা কষ্ট অনুভব করব না। আল্লাহর পথের পথিকদের জন্য তীর ফুলে পরিণত হয়ে যায়। তাদের দেহ নিঃশেষ হয়ে যায়; আত্মা মরে না। আল্লাহর পথের পথিকের আত্মা আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় বস্তু।

আমি তোমাদের ওয়াজ শুনতে আসিনি- গোমস্তগীন বললেন- ওহে বিশ্বাসঘাতকরা! তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট কী গোপন তথ্য প্রেরণ করেছ বল।

তুমি আমাদেরকে বিশ্বাসঘাতক বলছ- শামসুদ্দীন বললেন- এটাই আসল তথ্য, যা তুমি গোপন করতে চাচ্ছ যে, গাদ্দার কে? অনাগত বংশধরদের নিকট থেকে তুমি এ তথ্য গোপন করতে পারবে না যে, তুমি গাদ্দার। ইতিহাস চীৎকার করে করে বলবে, সালাহুদ্দীন আইউবী ফিলিস্তীনকে খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছিলেন; কিন্তু গোমস্তগীন নামক একজন মুসলিম দুর্গপতি তাঁর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।

তোমরা যদি এতই পাকা মুসলমান হতে, তাহলে হিন্দুস্তানকে হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়ে নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট পালিয়ে আসতে না- গোমস্তগীন অবজ্ঞার সুরে বললেন- তোমরা গোলাম দেশ থেকে এসেছ।

হিন্দুস্তানকে হিন্দুদের হাতে আমরা তুলে দেইনি- শাদবখত বললেন ওখানেও তোমাদের মত কিছু মুসলমান ছিল, যারা হিন্দুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পেতেছিল এবং তোমাদের-ই ন্যায় রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। রাজত্বের নেশা তাদেরকে পেয়ে বসেছিল। সে সুযোগে হিন্দুরা মুসলমানদের পরাজিত করে হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। দেশের ভাগ্য যদি সেনা অধিনায়কদের হাতে থাকত, তাহলে আজ হিন্দুস্তান আরবের ভূখন্ডের সঙ্গে মিলিত থাকত। কিন্তু সেখানে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রনায়করা নিজেদের গোলাম বানিয়ে নিয়েছিল।

ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমি তোমাদেরকে আরো দুদিন সময় দিলাম- গোমস্তগীন বললেন- আমার প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব যদি পেয়ে যাই, তাহলে এই নরক থেকে বের করে আমি তোমাদেরকে তোমাদের ঘরে নজরবন্দী করে রাখব। তবে যদি আমাকে নিরাশ কর, তাহলে তোমাদেরকে আমি মৃত্যুদন্ড দেব। তোমরা এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পঁচে-গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তোমরা ভেবে দেখ।

***

গোমস্তগীন তার দুর্গে খৃষ্টান উপদেষ্টা নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাদেরকে জানালেন, তাদের যে বন্ধু খুন হয়েছে, সে কারো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়নি। বরং সে হেরেমের একটি মেয়ের হাতে খুন হয়েছে। গোমস্তগীন তাকে অবহিত করেন, আমি কাজী ইবনুল খাশিবের খুন ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে আমার দুজন সালারকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেছি। তিনি উপদেষ্টার নিকট থেকে পরামর্শ কামনা করেন, সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে এখনই অভিযান পরিচালনা করব কিনা।

আমি জানি না সালারদ্বয় কি কি তথ্য সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট সরবরাহ করেছে- গোমস্তগীন বললেন- প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক প্রস্তুতি নেয়ার আগেই আমাদের হামলা করা উচিত। এ পরিস্থিতিতে আমাকে আপনাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।

খৃষ্টান উপদেষ্টাগণ গোমস্তগীনকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে বলল, আজ রাত-ই আমরা খৃষ্টান ক্যাম্পে লোক পাঠাব।

সে রাতেই এক খৃষ্টান দূত রওনা হয়ে যায়।

মসুলে খতীব ইবনুল মাখদুম কয়েদখানার একটি প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ। তার যুবতী কন্যা- যার নাম সায়েকা- ঘরে একাকী পড়ে আছে। মহিলারা দিনভর তার নিকট আসা-যাওয়া করছে আর সে সবাইকে বলছে- এমনটা হওয়ার-ই কথা। কিন্তু কথাটার অর্থ কী, মহিলারা গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেনি। তবে দুটি যুবতী মেয়ে বিষয়টা লক্ষ্য করে। তাদের মনে সন্দেহ জাগে।

রাতের বেলা। সায়েকার ঘরে আর কেউ নেই। মেয়ে দুটো ঘরে প্রবেশ করে। সায়েকা তাদেরকে ভালভাবে চিনে না।

আচ্ছা, সারাক্ষণ তুমি একথা কী বলছ যে, এমনটা হওয়ারই কথা? এক মেয়ে বলল।

আল্লাহর সিদ্ধান্ত এমনই ছিল- সায়েকা জবাব দেয়- আমি এ ছাড়া আর কী বলতে পারি?

কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে। শেষে অপর মেয়ে বলল- তুমি কথাটার মর্ম বুঝিয়ে বল, দেখি, আমরা তোমার কোন উপকার করতে পারি কিনা।

আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ আমার সাহায্য করতে পারবে না- সায়েকা বলল- আব্বাজান কোন অন্যায় করেননি। তিনি সব সময় সত্য কথা বলে থাকেন। সম্ভবত তিনি মসুলের শাসনকর্তাকে কোন কড়া কথা শুনিয়েছেন। সেজন্যই আমি বলছি, এমনটা হওয়ারই কথা। কেননা, তিনি তোষামোদ করবার মত মানুষ নন।

তিনি আসলে কী বলেছেন বা কী করেছেন, আল্লাহ-ই ভাল জানেন- অপর মেয়ে বলল- আমার মনে হচ্ছে, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষে কথা বলেছেন। তবে তিনি আসলে কার সমর্থক, তুমি-ই ভাল জান।

তোমরা যাকে সত্য মনে কর, তিনি তার সমর্থক- সায়েকা মুচকি হেসে বলল এবং জিজ্ঞেস করল- তোমরা কাকে সমর্থন কর?

সালাহুদ্দীন আইউবীর! উভয় মেয়ে বলল।

আব্বাজানও আইউবীর সমর্থক- সায়েকা স্পষ্ট বলে দিল- বিষয়টা সম্ভবত সাইফুদ্দীন জেনে ফেলেছেন।

তিনি কি আইউবীকে শুধু মৌখিকভাবে সমর্থন করেছেন, নাকি কাজেও এক মেয়ে জিজ্ঞেস করে।

আচ্ছা, তোমরা কি গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ?- সায়েকা হঠাৎ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে- মসুলের তরুণ প্রাণগুলোকে কি কাফেরদের পক্ষে চলে গেল?

হ্যাঁ- এক মেয়ে জবাব দেয়- আমরা দুজনে গুপ্তচরবৃত্তি করতে এবং তোমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে এসেছি যে, মসুলের যুবকরা কাফেরদের সমর্থক নয়। তারা কাফেরদের পদতল থেকে আরবের মাটিকে উদ্ধার করার জন্য অস্থির। তারা তাদের মিশনে সফল হতে বদ্ধপরিকর। তুমি যে বলতে, এমনটা হওয়ারই কথা ছিল- একথার অর্থ আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারেনি। এথেকেই তুমি আমাদেরকে আন্দাজ করে নিতে পার। আমরা তোমার কথা থেকেই বুঝে ফেলেছি, তোমার পিতা সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক ছিলেন এবং সাইফুদ্দীন বিষয়টা জেনে ফেলেছেন।

দীর্ঘ আলাপ ও মতবিনিময়ের পর সায়েকা নিশ্চিত হয়, মেয়ে দুটো তাকে ধোঁকা দিচ্ছে না। সে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে, আমি কী করতে পারি এবং তোমরা আমার কী সহযোগিতা করবে?

প্রথমে জানতে হবে, মোহতারাম খতীবকে কয়েদখানায় কষ্ট দেয়া হচ্ছে কিনা- এক মেয়ে বলল- যদি তিনি নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।

কয়েদখানায় তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করা হচ্ছে, তা জানব কী করে? সায়েকা জিজ্ঞেস করে।

আমরা চেষ্টা করব- অপর মেয়ে বলল- তুমি মসুলের শাসনকর্তার নিকট গিয়ে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আবেদন জানাও। তিনি যদি অনুমতি না দেন, তাহলে অন্য ব্যবস্থা নেব।

আমি কাল সকালেই যাব- সায়েকা বলল- আমি তাকে একথাও জিজ্ঞেস করব, আমার পিতার অপরাধ কী?

মেয়েরা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ তাদের মনে পড়ে যায়, সায়েকা ঘরে একা। তারা সায়েকাকে বলল, রাতে তুমি আমাদের সঙ্গে থাক। কিন্তু সায়েকার মনে কোন ভয় নেই। তবু মেয়েরা নিজ নিজ পরিবারের নিকট বলে সায়েকার ঘরে ঘুমাতে আসে।

শীতকাল। তিনজন এক কক্ষে শুয়ে পড়ে। মধ্যরাতের পর এক মেয়ে বাথরুমে যাওয়ার জন্য বাইরে বের হয়। সে দেখতে পায়, ঘরের বাইরে কালোমত একটি ছায়া নড়াচড়া করতে করতে কোন দিকে যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। মেয়েটির গা ছমছম করে ওঠে। সে দ্রুত ঘরে ফিরে গিয়ে বান্ধবীকে জাগিয়ে তোলে এবং ঘটনাটা জানায়। তাদের দুজনেরই কাছে খঞ্জর ছিল। তারা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে এদিক-ওদিক তাকায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। 

তারা সায়েকাকে জাগায়নি। কিন্তু সায়েকার চোখ খুলে গেছে। বিছানা থেকে উঠে বান্ধবীদেরকে কক্ষে না পেয়ে বারান্দায়, গিয়ে ডাক দেয়। তারা এগিয়ে এসে বলে, এই, বাইরে কালোমত একটি ছায়া নড়াচড়া করছে! মানুষ টানুষ কিনা কে জানে।

ধুত্তুরি, আস তো শুয়ে থাকি- সায়েকা বলল- ওসব কিছু না। তুমি যখনই বের হবে, এরকম কিছু নড়াচড়া করতে দেখবে। দৌড়ে গিয়ে ছায়াকে খঞ্জর দ্বারা আঘাত কর না আবার।

ছায়া বলছ কেন?- এক মেয়ে বলল- ওটা তো মানুষ। আমি দেখেছি।

যা হয় হোক, ওসব আমি ভয় করিনা- সায়েকা বলল- তোমরাও ভয় করনা।

সায়েকার এসব কথায় মেয়ে দুটোর গা ছমছম করে ওঠে। গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যায়। তারা মানুষকে ভয় করে না। সায়েকার কথা অনুযায়ী যদি ওটা মানুষ না হয়, তাহলে জিন-ভূত তো নিশ্চয়। সায়েকা বলল- এটা আমার আব্বাজানের ছায়া। তোমরা তাদেরকে জিন-ই মনে কর। আমি কখনো তাদের কাছে যাইনি। আমার বিশ্বাস, তারা আমার নিরাপত্তার জন্য ঘরের চারপাশে ঘোরা-ফেরা করছে।

খতীব সাহেব বড় বুজুর্গ মানুষ- এক মেয়ে বলল- জিনদের মধ্যেও তার ভক্ত আছে।

ব্যাপারটা এমনই- সায়েকা বলল- ওদেরকে ভয়ও করনা, ওদের কাছেও যেও না।

***

সেই রাত। খতীব ইবনুল মাখদুম সাইফুদ্দীনের বন্দীশালায় আবদ্ধ। তিনি এখনো জানে না, তাঁর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করা হবে। এক সান্ত্রী তাঁর কক্ষের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করে। খতীব তাকে থামিয়ে বললেন- আমার এক কপি কুরআন প্রয়োজন। জেলখানায় কুরআন শরীফ আছে নিশ্চয়।

এখানে? …কুরআন?- সান্ত্রী বিস্ময় ও অবজ্ঞার সুরে বলল- কুরআন পাঠকারীরা এখানে আসে না। এটা জাহান্নাম। এখানে আসে পাপিষ্ঠরা। আপনি ঘুমিয়ে থাকুন।

সান্ত্রী হেঁটে সামনের দিকে চলে যায়।

খতীব কুরআনের হাফেজ ছিলেন না। তবে অনেক সূরা ও আয়াত মুখস্ত ছিল। তিনি উচ্চস্বরে সূরা আর-রাহমান তেলাওয়াত শুরু করলেন। খতীবের সুললিত কণ্ঠ গোটা কয়েদখানাকে মাতিয়ে তোলে। তেলাওয়াত শেষ করার পর তিনি দেখলেন, উর্দি পরিহিত এক জেল কর্মকর্তা বিমুগ্ধ মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।

তুমি কে?- কর্মকর্তা খতীবকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি ছয় বছর যাবত এই জেলখানায় চাকরি করছি। কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত এবং এই সুর এই প্রথমবার শুনলাম, যা আমার হৃদয়ে গেঁধে গেছে। আমি কুরআন পড়া জানি না। অথচ, এটি আমার মাতৃভাষায় লেখা গ্রন্থ।

আমি মসুলের খতীব। খতীব জবাব দেন।

আপনার অপরাধ? কর্মকর্তা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন।

 আমার অপরাধ হল, আমি কুরআনের ভাষায় কথা বলি- খতীব জবাব দেন- আমার অপরাধ, আমি আমার রাজার আদেশ অমান্য করেছি এবং কুরআনের বিধানকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।

আবার পড়ুন- কর্মকর্তা অনুরোধের সুরে বললেন- আমার ভিতরে কিছু বিষ আছে, কুরআনের ভাষা ও আপনার সুর যাকে বের করতে শুরু করেছে।

খতীব পূর্বের চেয়ে অধিক হৃদয়কাড়া সুরে আবারো সূরা আর-রাহমান তেলাওয়াত শুরু করেন। কর্মকর্তা কক্ষের জানালার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তেলাওয়াত শেষে খতীব থামলে কর্মমর্তা চক্ষু বন্ধ করে ভাঙ্গা গলায় ক্ষীণ কণ্ঠে সূরা আর-রহমানের দুএকটি আয়াত আবৃত্তি করতে শুরু করেন।

আপনার কণ্ঠে যখন এত যাদু, তো আপনার ভক্তদের মধ্যে জিনও আছে নিশ্চয়- কর্মকর্তা বললেন- আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আমি শুনেছি, কুরআন থেকে নাকি ফাল বের করা যায়। বিশেষ পন্থা অবলম্বন করে প্রশ্ন করলে নাকি জিনরা কুরআনের ভাষায় জবাব দেয়?

কিন্তু প্রশ্ন হল, তোমার প্রশ্নটা কী?- খতীব বললেন- কুরআন শুধু ঈমানদারদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে থাকে।

আর যার ঈমান পাকা নয়? কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন।

তার বক্ষে ঈমানের প্রদীপকে আলোকিত করে- খতীব বললেন- তোমার প্রশ্নটা বল।

আমার একটি আকাংখা আছে- কর্মকর্তা বললেন আমার বুকে আগুন জ্বলছে। জানি না, এটা ঈমানের দীপশিখা, নাকি প্রতিশোধের আগুন। যে ফৌজ জেরুজালেম উদ্ধার করতে মাঠে নেমেছে, আমি সে ফৌজে যোগ দিতে চাই। আমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে।

জেরুজালেম জয় করাকে যদি তুমি ঈমান মনে করে থাক, তাহলে শীঘ্রই তুমি সেখানে পৌঁছে যাবে- খতীব বললেন- প্রতিশোধ ব্যক্তিগত কাজ। ঈমান আল্লাহর নির্দেশ। আচ্ছা, তুমি কিসের প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলছ? আর জেরুজালেম বলছ কেন?- বাইতুল মুকাদ্দাস বল।

আমি এর আগে কখনো কোন কয়েদীর সঙ্গে এরূপ কথা-বার্তা বলিনি জেল কর্মকর্তা বললেন- আপনি খতীব। আমি আমার হৃদয়টা খুলে আপনার সম্মুখে রাখতে চাই। আমার আত্মার প্রশান্তি প্রয়োজন। আমি বাইতুল মোকাদ্দাসের বাসিন্দা। ওখানে খৃষ্টানদের শাসন চলছে। ওখানে মুসলমানদের সঙ্গে বকরী-ভেড্রা ও পশুর ন্যায় আচরণ করা হয়। খৃষ্টানরা যে মুসলমানকে ইচ্ছা খুন করে, যাকে খুশি কারাগারে নিক্ষেপ করে। বেগার খাটানোর প্রচলন তো ব্যাপক। যে পরিবারে যুবতী মেয়ে আছে, সে পরিবারের মুখ সব সময় ও থাকে। ওখানকার মুসলমানরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পথপানে তাকিয়ে আছে। সাত বছর আগের ঘটনা। একদিন এক খৃষ্টান আমাকে ধরে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কিছু মালপত্র মাথায় করে তার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে বলে। কিন্তু আমি অস্বীকার করি। সে আমার মুখের উপর প্রচন্ড একটা চপেটাঘাত করে বলল, হারামজাদা! মুসলমান হয়ে আমার আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছিস! আমি রাগের মাথায় তার মুখে একটা ঘুষি মারি। লোকটা মাটিতে পড়ে যায়। আমি তার মাথার চুলগুলো মুঠি করে ধরে টেনে দাঁড় করাই এবং আরেকটি ঘুষি মেরে আবারো ফেলে দেই।

এমন সময়ে পিছন থেকে কে যেন আমাকে ঝাঁপটে ধরে। পরক্ষণেই চারদিকে খৃষ্টানরা এসে ভীড় জমায়। সংবাদ পেয়ে পুলিশও ধেয়ে আসে এবং আমাকে বেগার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমি সেখানে তিনদিন অতিবাহিত করি। তৃতীয় রাতে আমি এক সান্ত্রীকে পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরে খঞ্জরের আঘাতে তাকে কাবু করে পালিয়ে যাই। পরিকল্পনা ছিল, ঘরে পৌঁছে রাতেই পরিবারের সকলকে নিয়ে বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে পালিয়ে যাব। অন্যথায় ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা প্রবল। কিন্তু ততক্ষণে আমার বাড়ীটা ধ্বংসস্তূপ। সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে আছে। আমি এক মুসলিম পরিবারের দরজায় করাঘাত করি। গৃহকর্তা ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার পরিবারের লোকজন কোথায়? আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে তিনি আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন- তোমার পরিবারের পুরুষদেরকে খৃষ্টানরা ধরে নিয়ে গেছে। তোমার দুকুমারী বোনকে খৃষ্টান সেনারা নিয়ে গেছে। শেষে তারা আগুন দিয়ে ঘরটাকে জ্বলিয়ে দিয়ে গেছে।

তখন আমার মানসিক অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল, আপনি তা আন্দাজ করতে পারবেন। আমি জানতাম, আমি আমার বোনদেরকে ফিরে পাব না এবং এখানে বেশী সময় অবস্থান করলে আমি ধরা পড়ে যাব এবং খৃষ্টানরা আমাকে মেরে ফেলবে বা কয়েদখানায় আটক করে রেখে আজীবন নির্যাতন চালাতে থাকবে। কোন মুসলিম পরিবারের ঘরে লুকাবার মত ভুলও আমি করতে পারছিলাম না। কেননা, তার পরিণতিতে সেই পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যেত। তাই আমি রাতেই বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে বেরিয়ে আসি। আমার জখম থেকে রক্ষক্ষরণ হচ্ছিল। কিন্তু আমি নিরুপায়। ভোর বেলা পথে এক অশ্বারোহী খৃষ্টানের সঙ্গে দেখা। লোকটা সাধারণ নাগরিক। আমি তার পথ আগলে দাঁড়াই এবং কথার ফাঁদে ফেলে তাকে ঘোড়র পিঠ থেকে নীচে নামাই। তার এক পা ঘোড়ার রেকাবে, অপর পা মাটিতে- এমন অবস্থায় আমি পেছন দিক থেকে তার ঘাড়টা দুবাহু দ্বারা ঝাঁপটে ধরি। তার কোমরে ছোট আকারের একটি তরবারী বাঁধা ছিল। সেটি কেড়ে নিয়ে আমি তাকে খুন করি এবং তার ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করি।

এ নিয়ে আমি দুজন খৃষ্টানকে হত্যা করলাম। তার আগে কয়েদখানায় সান্ত্রীকে হত্যা করে এসেছি। কিন্তু আমার মন শান্ত হল না। আমি সকল খৃষ্টানকে হত্যা করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এ অবস্থায় আমি কত সময় পথ চললাম এবং কোথায় কোথায় ঘুরে ফিরলাম, তা আমার স্মরণ নেই। এত দীর্ঘ সময়ে না আমার পেটে ক্ষুধা লাগল, না পিপাসা। একটু পরপর আমার বোনদের কথা মনে পড়ত আর আমি তারবারীটা হাতে নিয়ে বাইতুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকতাম। আমার গা কাঁপতে শুরু করত। আমি বেশ কবার আল্লাহকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাকে কোন্ পাপের শাস্তি দিচ্ছ? যদি আমি গুনাহগার হয়ে থাকি, তাহলে শাস্তি তো শুধু আমার পাওয়া দরকার। বোন এবং অবুঝ ভাইটির তো কোন পাপ ছিল না। কিন্তু আল্লাহ আমাকে কোন উত্তর দিলেন না। আমি সেজদাবনত হয়ে আল্লাহকে ডেকেছি এবং নিরাশ হয়েছি। আমি আল্লাহর সমীপে এ ফরিয়াদও করেছি যে, তুমি আমাকে শান্ত করে দাও এবং আমার অন্তরের প্রতিশোধের আগুন নিভিয়ে দাও। আমার অনুভূতি মরে যাক।

আমি মসুলের এমন একটি জায়গায় এসে পৌঁছে গেলাম, যেখানে আর খৃষ্টানদের হাতে ধরা পড়ার আশংকা রইল না। কিন্তু একটি নির্দয় হাত আমার হৃদয়টাকে এমনভাবে চেপে ধরে রাখল যে, আমি প্রতি মুহূর্ত অস্থিরতার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করতে বাধ্য হই। আমি মসজিদে চলে গেলাম। ইমাম সাহেবকে বললাম, খোদা কোথায় আমাকে দেখিয়ে দিন। বলুন, আমার অন্তর কোথায় শান্তি পাবে। কিন্তু তিনি আমার কোন সাহায্য করলেন না। সেখান থেকে আমি অন্য এক গ্রামে চলে গেলাম। তারপর সেখান থেকেও চলে গেলাম। তারপর এক এক করে ইমামদের নিকট আমার প্রশান্তি ভিক্ষা করতে থাকি। কিন্তু কেউই আমাকে সাহায্য করল না। কেউ আমাকে আল্লাহর সন্ধান দিল না। কেউ এমন কোন বুদ্ধি আমাকে বলল না, যার বলে আমি আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারি এবং তার নিকট শান্তি প্রার্থনা করতে পারি। আমি অধিকাংশ রাতে বোনদেরকে স্বপ্নে দেখতাম। দেখতাম, তারা কাঁদছে। জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের ফোঁপানি ও হিচকি শুনতে পেতাম। আমার মনে অনুভূতি জাগে যে, বোনরা আমাকে অভিশম্পাত করছে।

এক ব্যক্তি আমাকে বলল, যদি খৃস্টানদের থেকে প্রতিশোধ নিতে হয়, তাহলে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে যাও। সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী ফিলিস্তীনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে লড়াই করছেন। মুসলমান ও খৃস্টানদের মাঝে যে যুদ্ধ চলছে, তা আমার জানা ছিল। কোন্ যুদ্ধে কারা পরাজিত হচ্ছে, বাইতুল মোকাদ্দেসে বসেই আমি খবর পেতাম। বাইতুল মোকাদ্দাসে যখন খৃস্টানরা সেখানকার মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দিত, তখনই আমরা বুঝে ফেলতাম, কোন এক ময়দানে খৃস্টানরা পরাজিত হয়েছে, যার প্রতিশোধ তারা এখানকার নিরস্ত্র-নিরীহ মুসলমানদের থেকে গ্রহণ করছে। ওখানে বসে আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর নাম শুনতাম। এ নামটা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, সেখানকার খৃস্টান আদিবাসীরা এ নামে আতংকিত হয়ে উঠে এবং তাকে ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। আমরা এও শুনেছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবী বানের ন্যায় ধেয়ে আসছেন। কিন্তু তিনি আসলেন না। তার পরিবর্তে উল্টো আমিই বুকে গভীর একটা জখম নিয়ে এখানে চলে এসেছি। আমি সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু যুদ্ধের জন্য ময়দানে না পাঠিয়ে আমাকে এই জেলখানার দায়িত্ব দেয়া হয়। ইতোমধ্যে আমি প্রমোশনও পেয়েছি।

এখানে আমি মানুষের উপর জুলুম দেখেছি। জুলুম দেখে দেখে আমি কেঁপে উঠি। এখানে মানুষের হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেলা হয়। বাইতুল মোকাদ্দাসে খৃস্টানরা মুসলমানদের উপর অত্যাচার করে থাকে। এখানে আমি মুসলমানদেরকে মুসলমানের উপর জুলুম করতে দেখেছি। আমি জানতে পেরেছি, এখানে নির্দোষ লোকদেরও আনা হয় এবং অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। তাদের অপরাধও তা, যা আপনার অপরাধ। আপনাকে এখানে এনে কেন আটক রাখা হল, আমি বুঝে ফেলেছি। এ কাজটা আমাকেও করতে হয়েছে। আমি মানুষকে এমন এমন কষ্ট দিয়েছি, যার বিবরণ দিলে আপনি বেশ হয়ে যাবেন। আমার সঙ্গীরা পুরোপুরি হিংস্র হায়েনায় পরিণত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে মানবতা শুধু এটুকু অবশিষ্ট আছে যে, তারা মানুষের ন্যায় চলাফেরা করে ও মানুষের মত কথা বলে। তাদের থেকে আমার পার্থক্য হল, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েদীদের সঙ্গে সমবেদনার দুচারটা কথা বলি, তাদের দুঃখ বুঝবার চেষ্টা করি। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, তোমাদের অপরাধ কী? কিন্তু সমবেদনার এই জযবা আমার হৃদয়ের বোঝা হাল্কা করার পরিবর্তে আরো ভারী করে তুলছে। আমি এক মুহূর্তের জন্যও মনে শান্তি পাই না। আমি আল্লাহকে দেখি না। আমার চোখের সামনে থেকে আমার বোনরা সরছে না। মনে হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি খৃস্টানদের থেকে প্রতিশোধ না নেব, ততক্ষণ এভাবে আমাকে অস্থিরতার মধ্যেই কাটাতে হবে।

আজ আমি আপনার কণ্ঠে কুরআনের ঘোষণা শুনেছি

পাপিষ্ঠদেরকে তাদের চেহারা দেখেই চিনে নেয়া হবে। তারপর পা ও মাথার খুঁটি ধরে তাদের পাকড়াও করা হবে। তোমরা তোমাদের রবের কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? এটাই সেই জাহান্নাম, পাপিষ্ঠরা যাকে অবিশ্বাস করত। তারা জাহান্নামের অগ্নি ও টগবগে গরম পানির মাঝে ছুটাছুটি করবে।

আপনার কণ্ঠে জীবনে এই প্রথমবার কুরআনের অমোঘ ঘোষণা শুনে আমার মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আমার মনে হতে লাগল, আমি যে সত্যের সন্ধানে ঘুরে ফিরছি, তা এই কটি শব্দের মধ্যেই লুকায়িত আছে।

জেল কর্মকর্তা জানালার ফাঁক দিয়ে একটা হাত ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে খতীব ইবনুল মাখদুমের পরনের চোগা ধরে ফেলে এবং অস্থির চিত্তে বলে ওঠে বলুন, এ আপনি আমাকে কী শোনালেন। বলুন, আমার মস্তিষ্কে কি খুন চেপেছে? তা-ই যদি হয়, বলুন, আমি কিভাবে প্রতিশোধ নেব? আমি পাগল হয়ে যাব না তো? আল্লাহ যদি সত্যিই থাকেন, তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করে আমাকে বলুন, আমার প্রশ্নগুলোর জবাব কী?

তোমার মস্তিষ্কে খুন চেপেছে- খতীব বললেন- তুমি আল্লাহর আওয়াজ শুনে ফেলেছ। আমার কণ্ঠে আল্লাহই কথা বলছিলেন। তুমি প্রতিশোধ নিতে অস্থির হয়ে পড়েছ। কিন্তু এখানে তোমাকে এভাবে বেহাল ও বেচাইন হয়েই থাকতে হবে। তুমি যে ফৌজের কর্মকর্তা, তারা কখনো বাইতুল মোকাদ্দাস যাবে না।

কেন?

কারণ, এ ফৌজ প্রথমে সুলতান আইউবীকে পরাজিত করবে- খতীব জবাব দেন। তারপর তাকে হত্যা করবে। তারপর খৃষ্টানদের ক্রীড়নকে পরিণত হবে।

জেল কর্মকর্তার চোখ খুলতে শুরু করেছে। খতীব তাকে বললেন- মুসলিম শাসকরা কী করছে, তা কি তুমি জান?

কর্মকর্তা বললেন- আমি বেশ কদিন ধরেই এ জাতীয় কথাবার্তা শুনছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। জাতির যে মেয়েগুলো খৃস্টানদের বর্বরতার শিকার হয়েছে, আমাদের শাসকরা তাদের কথা ভুলে যাবে, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

তারা ভুলে গেছে- খতীব বললেন- তারা এ কথাও ভুলে গেছে, সেই অপহৃত মুসলিম মেয়েদেরকেই যে তাদেরকে উপহার দেয়া হয় এবং তাদেরকে নিজেদের হেরেমের শোভা বানায়। তারা এ কারণেই সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমনে পরিণত হয়েছে। কারণ, তিনি কুরআনের বিধান অনুসরণ করে চলেন এবং জাতির মর্যাদা রক্ষা করতে চান। তার কোন বাড়ি-ঘর আছে কিনা, তাও তিনি ভুলে গেছেন। জীবনটা কাটছে তার পাহাড়-জঙ্গল আর মরুভূমি ও উপত্যকায়- জিহাদের ময়দানে। আমার অপরাধও এটাই যে, আমি মসুলের শাসনকর্তাকে কুরআনের বিধান স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিলাম, একজন মর্দে মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তুমি পরাজিত হবে। কুরআনের যে পবিত্র বাক্যগুলো একটু আগে তোমাকে জাদুর ন্যায় প্রভাবিত করেছে, সাইফুদ্দীনকে আমি তা-ই স্মরণ করিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার ন্যায় পাপিষ্ঠদের চেহারা দেখে চিহ্নিত করা হবে এবং মাথার ঝুঁটি ও পায়ে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাকে আমি কুরআনের বিধানও শুনিয়েছি যে, তুমি যদি মস্তিষ্ক থেকে রাজত্বের নেশা দূর না কর, তাহলে তুমি জাহান্নামের অগ্নি ও টগবগে ফুটন্ত পানির মাঝে ছুটাছুটি করবে। কিন্তু সে আল্লাহর বিধান মান্য করতে অস্বীকার করে প্রবৃত্তির কথা মান্য করল এবং সত্য বলার অপরাধে আমাকে গ্রেফতার করে বন্দী করে রাখল।

এখানে আপনাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হবে- কর্মকর্তা বললেন তবে আমি আপনার যতটুকু সম্ভব সেবা ও সহযোগিতা করব।

এই জাগতিক ও দৈহিক নির্যাতন আমাকে কোন কষ্ট দিতে পারবে না খতীব বললেন- তুমি আমার কণ্ঠে যে জ্বলন ও প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছ, তা ছিল আমার আত্মার কণ্ঠ। দুনিয়ার জাহান্নামে আমি নিশ্চিন্ত। আমার আওয়াজ আল্লাহর আওয়াজ। আমার কোন কষ্ট নেই। তবে আমার একটি চিন্তা আছে, যা আমাকে পেরেশান করছে। আমার একটা যুবতী মেয়ে আছে। মেয়েটা আমার একমাত্র সন্তান। স্ত্রী মারা গেছে বহু বছর আগে। এই মেয়েটির স্বার্থে আমি আর বিয়ে করিনি। আমরা একজন অপরজনের জন্য বেঁচে আছি। মেয়েটা ঘরে একা।

আমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। কর্মকর্তা বললেন।

প্রত্যেকেরই হেফাজতকারী আল্লাহ– খতীব বললেন- আমি তোমাকে আমার ঘরের ঠিকানা দিচ্ছি। কন্যা সায়েকাকে বলবে, যেন সে অটল থাকে এবং আমার ব্যাপারে কোন চিন্তা না করে। এখানে যদি কুরআন পাঠ করার অনুমতি থাকে, তাহলে তার নিকট থেকে আমার কুরআনটা নিয়ে আসবে।

জেল কর্মকর্তা ভোরেই খতীবের বাড়ি চলে যান এবং তার কন্যাকে সান্ত্বনা দেন যে, পিতার ব্যাপারে কোন চিন্তা করবে না, তিনি ভাল আছেন। কর্মকর্তা সায়েকাকে জানায়, আমি আপনার পিতার দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়েছি। যতটুকু সম্ভব আমি তাকে সাহায্য করব। তবে আমি উপরের আদেশের পরিপন্থী কিছু করতে পারব না। আমি কয়েদখানার একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা। সে সায়েকাকে বলল, মোহতারাম খতীব আপনাকে তাঁর কুরআন শরীফখানা দিতে বলেছেন। সায়েকা কুরআন দেয়ার আগে তার সঙ্গে নানা কথা বলে নিশ্চিত হয় যে, লোকটা আসলেই অন্তর থেকে তার পিতার সহেযাগিতা করতে চাচ্ছে। সায়েকার নিকট লোকটাকে আবেগপ্রবণ বলে মনে হল। কর্মকর্তা যখন বলল, আমি আপনার ও আপনার পিতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুতি আছি, তখন সায়েকা তাকে বলল, আপনি কি জানেন, আব্বাজানকে কি অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে? আমার মনে হচ্ছে, তথ্য বের করার জন্য সাইফুদ্দীন তার উপর নির্যাতন চালাবে। আপনি কী সহযোগিতা দিয়ে তাকে কয়েকখানা থেকে পালাবার সুযোগ করে দিতে পারেন না? আমরা দুজন মসুল ছেড়ে চলে যাব।– কর্মকর্তা মুচকি হেসে বললেন, আল্লাহর যা ইচ্ছা। আমি আপনার পিতার কণ্ঠে আল্লাহর কণ্ঠ শুনেছি এবং তার চোখে ঈমানের নূর দেখেছি। আল্লাহর আওয়াজ ও ঈমানের নূরকে কোন মানুষ কয়েদখানায় আবদ্ধ করে রাখতে পারে না। সম্ভবত এই আওয়াজ ও নূরকে মুক্ত করার শুভ কর্মটি আল্লাহ পাক আমার জন্য লিখে রেখেছেন এবং তার বিনিময়ে আমার মনের আগুন নির্বাপিত হবে। আমি আপনাকে বলতে পারব না যে, আমি কী করব। বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয়।

আপনি বসুন, আমি আব্বাজানের জন্য কুরআন নিয়ে আসছি- বলেই সায়েকা ভেতরে চলে যায় এবং দীর্ঘ সময় পর ফিরে আসে। তার হাতে এক কপি কুরআন। কুরআন শরীফখানা কর্মকর্তার হাতে দিয়ে সায়েকা বলল আব্বাজানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নেয়ার জন্য আমি মসুলের শাসনকর্তার নিকট যাচ্ছি।

আচ্ছা যান, আমিও যাচ্ছি। বলে জেল কর্মকর্তা খতীবের ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

***

সায়েকা প্রস্তুত হয়ে সাইফুদ্দীনের দরবারে চলে যায়। তাকে ফটকের বাইরে থামিয়ে দেয়া হল। সাইফুদ্দীন সালাহুদ্দীন আইউবী নন যে, তার সঙ্গে যে কারো সাক্ষাৎ করার অনুমতি থাকবে। সাইফুদ্দীন রাজা। তার রীতি-নীতিও রাজকীয়। তাকে মদপান করতে হয়। হেরেমের জন্য সময় বের করতে হয়, বাইজি নাচের আসর বসাতে হয় এবং এসব করে যেটুকু সময় বাঁচে তা সুলতান আইউবী থেকে রাজত্বকে বাঁচানোর পরিকল্পনা প্রস্তুতির কাজে ব্যয় করেন। জনসাধারণের কোন খোঁজ-খবর তিনি রাখেন না। ক্ষমতালোভীরা জনগণকে ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে শুধু। জনগণের ভাল-মন্দ ও সুখ-দুঃখে তাদের কিছু যায় আসে না। যতটুকু খাবার খেয়ে প্রজারা বেঁচে থেকে তাদের সামনে সেজদাবনত হয়ে থাকবে, ততটুকুর বেশি সুযোগ-সুবিধা তাদের দেয়া হয় না।

সায়েকা সেই প্রজাদেরই একটি মেয়ে। দারোয়ান তাকে জিজ্ঞেস করল- আপনি কে? সায়েকা বলল- আমি মসুলের খতীব ইনবুল মাখদুম কাকবুরীর কন্যা।

অন্যদের ন্যায় দারোয়ানও শুনেছে, খতীব ইবনুল মাখদুম হঠাৎ পাগল হয়ে গেছেন এবং তাকে জেলখানায় আটক করে রাখা হয়েছে। মসুলের সব মানুষই খতীবকে শ্রদ্ধা করে থাকে। তার পাগল হয়ে যাওয়ার কারণে সকলেই মর্মাহত ও অনুতপ্ত। দারোয়ান দরবারের এক কর্মকর্তাকে বলে সায়েকাকে সাইফুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নিয়ে দেয়।

সায়েকা সাইফুদ্দীনের নিকট গিয়ে উপস্থিত হয়। মেয়েটির রূপ-যৌবন দেখে সাইফুদ্দীন চমকে ওঠেন। সাইফুদ্দীন নারী-শিকার পুরুষ। তিনি সায়েকাকে স্বস্নেহে নিজের পার্শ্বে বসতে দেন। তিনি বুঝে ফেলেন, মেয়েটা তার পিতার মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছে।

শোন মেয়ে- সাইফুদ্দীন সায়েকার বক্তব্য না শুনেই বললেন- আমি জানি, তুমি কেন এসেছ। কিন্তু আমি বেজায় বাধ্য হয়েই তোমার পিতাকে বন্দী করেছি। দু-একদিন পর ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা হলে আমি তাকে গ্রেফতারই করতাম না। আমি তাকে মুক্তি দিতে পারব না।

তার অপরাধ কী? সায়েকা জিজ্ঞেস করে।

বিশ্বাসঘাতকতা। সাইফুদ্দীন জবাব দেন।

তিনি কি আপনার বিরুদ্ধে খৃস্টানদের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? সায়েকা জিজ্ঞেস করে।

রাষ্ট্রের শত্রু খৃস্টান হোক কিংবা মুসলমান- সাইফুদ্দীন জবাব দেন- তাকে সঙ্গে রেখে রাষ্ট্রের ক্ষতি করা অন্যায়। তোমার পিতা কি সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক ছিলেন না?

আমার জানা নেই- সায়েকা জবাব দেয় তবে আমার বিশ্বাস, সালাহুদ্দীন আইউবীকে সমর্থন করা অন্যায় নয়।

এ বিষয়টা তোমার পিতাও বুঝতে পারেননি- সাইফুদ্দীন বললেন- আমি ভেবে অবাক হই, বহু মানুষ সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফেরেশতা মনে করে থাকে। অথচ তিনি নারীর ক্ষেত্রে হায়েনা। তিনি দামেস্ক এবং কায়রোয় তার হেরেমকে তোমার ন্যায় শত শত রূপসী মেয়ে দ্বারা পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। তিনি তার হেরেমের মেয়েদেরকে তিন-চার মাস পর তার সালারদের হাতে তুলে দেন। তার বাহিনী যেখানেই হামলা করে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে অসদাচরণ করে। তারা যে কোন বাড়ি-ঘর লুট করে এবং যে কোন মেয়েকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তোমার ন্যায় সুন্দরী মেয়েরা তার থেকে কখনো রক্ষা পায় না। তোমার ইজ্জতের হেফাজত করা আমার কর্তব্য- তোমাকে আমার ঘরে রেখে হলেও। .

আমাকে আল্লাহই রক্ষা করবেন- সায়েকা বলল- আপনার নিকট আমার আবেদন এটুকু যে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাকে আব্বাজানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন।

বিচারক তার শাস্তি ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত অনুমতি দেয়া যাবে না।

শাস্তি কী হবে?

মৃত্যুদণ্ড।

সায়েকার দুচোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। সাইফুদ্দীন মেয়েটাকে আরো আতংকিত করার জন্য বললেন- তবে এই মৃত্যুদণ্ড অত সহজ হবে না যে, তরবারী দ্বারা তার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। তাকে ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে মারা হবে। প্রথমে তার চোখ দুটো তুলে ফেলা হবে। তারপর সাড়াশি দ্বারা টেনে টেনে একটা একটা করে দাঁত তুলে ফেলা হবে। তারপর তার হাত ও পায়ের আঙ্গুলগুলো এক এক করে কাটা হবে। তারপরও যদি তিনি না মরেন, তাহলে গায়ের চামড়া তুলে ফেলা হবে।

মেয়েটির গা কাঁপতে শুরু করে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। চেহারার রং পিতবর্ণ ধারণ করে। সায়েকা কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- আপনি কি তার প্রতি এতটুকু দয়া করতে পারেন না যে, তরবারী দ্বারা এক কোপে মাথাটা কেটে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করবেন? তাকে মৃত্যুদণ্ডই যদি দিতে হয়, স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেললেই তো হয়।

তুমি যদি তোমার মূল্যবান যৌবনের প্রতি সদয় হতে পার, তাহলে আমি তোমার পিতার উপর রহম করতে পারি।

সায়েকা সাইফুদ্দীনের প্রতি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে সাইফুদ্দীন বললেন- পিতার মৃত্যর পর তোমাকে একটা অসহায় ও নিরাশ্রয় মেয়ে হিসেবে জীবনযাপন করতে হবে। তার চেয়ে বরং ভাল, তুমি আমার স্ত্রী হয়ে যাও। তাতে তোমার পিতারও উপকার হবে, তুমিও মসুলের রাণীর মর্যাদা লাভ করবে।

আব্বাজান যদি আমাকে আত্মমর্যাদা শিক্ষা না দিতেন, তাহলে আপনার স্ত্রীত্ব বরণ করে মসুলের রাণী হওয়া একটা বিষয় ছিল। তখন আমি আপনার সঙ্গে একটি রাত অতিবাহিত করে গৌরববোধ করতাম- সায়েকা বলল কিন্তু আমার ইজ্জত রক্ষায় আব্বাজান নিজের জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হওয়ার মতো লোক নন। এ সওদা আপনি আব্বাজানের সাথে করুন। আপনি তাকেই জিজ্ঞেস করুন, জল্লাদের হাতে সোপর্দ হওয়া এবং কন্যাকে আমার হাতে তুলে দেয়া এ দুটি বিষয়ের কোটি তোমার পছন্দ? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, জবাবে আব্বাজান বলবেন, আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দাও। আমি আপনার সমীপে শুধু এই আবেদন নিয়ে এসেছিলাম যে, অল্প সময়ের জন্য হলেও আমাকে আব্বাজানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিন। এবার আমি আমার আবেদনের সঙ্গে নতুনভাবে এ কথাটা সংযোগ করছি যে, আপনার এ সওদা আমি প্রত্যাখ্যান করলাম।

তুমি আমার ঘরে আসবে না, এই কি তোমার সিদ্ধান্ত? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।

এ আমার অটল সিদ্ধান্ত- সায়েকা জবাব দেয়- আপনি মসুলের অধিপতি। বল প্রযোগ করেই তো আপনি আমাকে আপনার হেরেমে ঢুকিয়ে ফেলতে পারেন।

এমন অন্যায় আমি কখনো করিনি। সাইফুদ্দীন জবাব দেন।

সায়েকা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়- তার আসল উদ্দেশ্য ছিল, কয়েকখানায় তার পিতার সঙ্গে কিরূপ আচরণ হচ্ছে, তা জানা। আর তা সে জেল কর্মকর্তার নিকট থেকে জানতে পেরেছে। তার আশা ছিল, এই কর্মকর্তা তার পিতার পলায়নে সাহায্য করবে। সায়েকা সাইফুদ্দীনকে সালাম করে হাঁটা দেয়। সাইফুদ্দীন তাকে চলে যেতে দেখে বললেন- দাঁড়াও, আমি তোমাকে এ কথা বলতে দেব না যে, মসুলের শাসনকর্তা একটি মেয়ের মনোবসনা পূরণ করেননি। তুমি আজ রাতেই তোমার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবে। এক লোক তোমার ঘরে যাবে। সে তোমাকে সঙ্গে করে কয়েদখানায় নিয়ে যাবে। তুমি যত দীর্ঘ সময় ইচ্ছা পিতার সঙ্গে কথা বলতে পারবে।

সায়েকা সাইফুদ্দীনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বিদায় নেয়। সাইফুদ্দীনের পেছনে একজন বডিগার্ড দাঁড়িয়ে ছিল। সায়েকা বেরিয়ে গেলে তিনি তাকে বললেন- এই সুদর্শনা পাখিটা পিঞ্জিরায় আসা উচিত। আমি তাকে সন্ত্রস্ত করার জন্য বলেছিলাম, তার পিতাকে কিরূপ নির্যাতন দিয়ে হত্যা করার হবে। কিন্তু মেয়েটা বড় শক্ত ধাতুর মানুষ। আমি তাকে বলেছি, এক ব্যক্তি তোমার ঘরে যাবে। সে তোমাকে কয়েদখানায় নিয়ে যাবে। তুমি কি বিষয়টা বুঝতে পেরেছ?

কি যে বলেন? আপনার ইশারা বুঝতে কি আমার এখনো বাকী আছে? বডিগার্ড ঠোঁটে শয়তানি হাসি টেনে বলল- সেই ব্যক্তিটি আমিই হব। আজ সন্ধ্যার পরই আমি কয়েকখানায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাকে জায়গা মতো নিয়ে আসব।

জান তো, কোথায় নিতে হবে?- সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন- খবরদার! মেয়েটার মনে যেন সন্দেহ না জাগে যে, আমি তাকে অপহরণ করিয়েছি?

আমি সবই বুঝি- বডিগার্ড জবাব দেয়- এ কাজ আমি এই প্রথমবার তো আর করছি না। আমি তাকে আঁকা-বাঁকা পথ ঘুরিয়ে এমন অবস্থায় আপনার নিকট নিয়ে আসব যে, সে মনে করবে একমাত্র আপনিই তার হিতাকাঙ্খী ও আপনজন। তারপর এরূপ পক্ষীদের পিঞ্জিরায় কিভাবে আবদ্ধ করতে হয়, তা আপনিই ভাল জানেন।

সাইফুদ্দীন তার বডিগার্ডের কানে কানে কী যেন বললেন। বডিগার্ডের চোখের তারায় শয়তান পিট পিট হাসতে শুরু করে।

***

 রাতের বেলা। কয়েদখানার যে কর্মকর্তা সায়েকার ঘরে গিয়েছিল এবং তাকে সান্ত্বনা দিয়ে খতীবের জন্য কুরআন নিয়ে ফিরে গিয়েছিল, সে ডিউটি করছে। লোকটা সন্ধ্যার পর কারাগারে প্রবেশ করে দিনের দায়িত্বশীলকে বিদায় করে দেয় এবং খতীব ইবনুল মাখদুমের কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক দেখে সে কুরআনখানা খতীবের হাতে দিয়ে বলল- আপনি আপনার মেয়ের ব্যাপারে কোন চিন্তা করবেন না; সে সব দিক থেকেই ভাল এবং নিরাপদ আছে। সে আমার নিকট একটা আবদার রেখেছে; আপনি দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে মেয়েটার আবদার পূরণে তাওফীক দান করেন।

কী আবদার করেছে ও? খতীব কৌতূহলী মনে জিজ্ঞেস করেন।

কর্মকর্তা এদিক-ওদিক তাকিয়ে জানালার সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বলল পলায়ন, আপনার কি সাহস হয়? আমি আপনাকে সাহায্য করব।

যে কাজের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি জড়িত, তার জন্য আল্লাহ সাহসও দিয়ে দেন- খতীব বললেন- কিন্তু আমি তো তোমার সাহায্য নিয়ে পালাব না। তার পরিবর্তে আমি এখানে মৃত্যুবরণ করাকেই বরণ করব।

কেন?- জেল কর্মকর্তা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন- আপনি কি আমাকে পাপী মনে করে আমার সাহায্য নিতে অস্বীকার করছেন?

না- খতীব বললেন- বরং আমি তোমার সাহায্য এ কারণে নিতে চাচ্ছি না যে, তুমি নির্দোষ। আমি তো তোমার সহযোগিতায় এখান থেকে পালিয়ে যাব। কিন্তু তুমি পেছনে থেকে যাবে এবং ধরা পড়বে। আমার অপরাধের শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে, যা আমার পক্ষে মারাত্মক অন্যায় হবে।

আমিও আপনার সঙ্গে যাব- জেল কর্মকর্তা বললেন- আপনার গত রাতের বক্তব্যে এখান থেকে আমার মন উঠে গেছে। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজে গিয়ে যোগ দেব। আর যেহেতু আমি কয়েদী নই, সেহেতু আমি সহজেই পালাতে পারব। কিন্তু আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। এই জগতে আমার কেউ নেই। হৃদয়টা জুড়ে আছে শুধু আগুন। এই আগুন আমাকে নেভাতেই হবে।

হ্যাঁ- খতীব বললেন- এভাবে হলে আমি তোমার সাহায্য নিতে পারি।

আপনার মেয়ে আমাকে বলেছিল, সে নাকি মসুলের শাসনকর্তার নিকট যাবে- কর্মকর্তা বললেন তার নিকট সে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভের আবেদন জানাবে।

না- খতীব শংকিত হয়ে বললেন- তার সাইফুদ্দীনের মতো শয়তান চরিত্রের লোকটির নিকট যাওয়া উচিত হবে না। তুমি আবার গিয়ে তাকে বলে আস, সে যেন সাইফুদ্দীনের নিকট না যায়।

আমি তো সকাল ছাড়া যেতে পারব না- কর্মকর্তা বললেন।

 জেল কর্মকর্তা খতীবের নিকট থেকে চলে যান। খতীব কুরআন শরীফখানায় চুম্বন করেন। তারপর বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মনে মনে বললেন এখন আর আমি কারা প্রকোষ্ঠে একা নই। তিনি গেলাফটা খুলে প্রদীপের আলোতে বসে কুরআন খুললেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ এক টুকরো কাগজ বেরিয়ে আসে। সায়েকার লেখা একখানা চিরকুট- আল্লাহ সঙ্গে আছেন- জিনরা আছে- পয়গম্বর সত্য- তার বার্তা শুনুন- ঈমান তাজা আছে।

খতীবের বিমর্ষ মুখে মুচকি হাসির আভা ফুটে ওঠে। তিনি চিরকুটখানা প্রদীপের আগুনে পুড়ে ফেললেন। চিঠির মর্ম তিনি বুঝে ফেলেছেন। পয়গম্বর সত্য দ্বারা উদ্দেশ্য, লোকটা যা বলছে, সত্য বলে মনে হচ্ছে; আপনি তার পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করুন। জিনরা আছে দ্বারা উদ্দেশ্য সায়েকার নিরাপত্তা দানের জন্য লোক আছে। তারা তাকে পাহারা দিচ্ছে।

যে সময়ে খতীব সায়েকার পত্রখানা পুড়ে ফেলার জন্য আগুনে ধরেন, ঠিক সে সময় সায়েকার ঘরে করাঘাত পড়ে। সায়েকা দরজা খুলে দেয়। তার হাতে প্রদীপ। বাইরে দণ্ডায়মান লোকটাকে সে চিনে ফেলে- সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষী। সে সাইফুদ্দীনের সঙ্গে সায়েকার সাক্ষাতের সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। সে সায়েকাকে বলল- আমি আপনাকে আপনার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কয়েদখানায় নিয়ে যেতে এসেছি। সাক্ষাতের পর আবার আপনাকে আপনার ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।

সায়েকা প্রস্তুত ছিল। সে বিলম্ব না করে বের হয়ে আসে এবং হাঁটতে শুরু করে। দেহরক্ষী তাকে বলল- পিতার সঙ্গে শুধু কুশল বিনিময় আর ঘরের খোঁজ-খবর বলার অনুমতি থাকবে। আপনাকে কারা প্রকোষ্ঠের জানালা থেকে তিন পা দূরে রাখা হবে। এমন কোন কথা বলবেন না, যা মসুলের শাসনকর্তা গাজী সাইফুদ্দীনের মর্যাদায় আঘাত হানবে।

***

বডিগার্ড সামনে সামনে হাঁটছে। সায়েকা তার দু-তিন পা পেছনে। দুজনই চুপচাপ হাঁটছে। অন্ধকার রাত। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তারা গলির পর গলি অতিক্রম করছে। একটি গলিতে মোড় নিতেই বডিগার্ড হঠাৎ থেমে যায়। সে পেছন দিকে তাকায়। সায়েকা জিজ্ঞেস করে- কী ব্যাপার?

তুমি কি পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুননি? বডিগার্ড জিজ্ঞেস করে।

না- সায়েকা জবাব দেয়- আমিই তো তোমার পেছনে পেছনে হাঁটছি। সম্ভবত তুমি আমার আওয়াজই শুনতে পাচ্ছ।

না, আমি অন্য একটি শব্দ শুনেছি। বডিগার্ড ফিস ফিস করে বলল এবং সামনের দিকে হাঁটা দিল।

এত ভয় পাচ্ছ কেন?- সায়েকা বলল- পেছনে পেছনে কেউ যদি এসেই থাকে, আসুক না।

বডিগার্ড কোন উত্তর দেয় না। এই গলি শেষ হয়ে গেছে। সম্মুখে কোন জনবসতি নেই। মাটি উঁচু-নীচু। খানা-খন্দকও আছে। জেলখানাটা ওদিকেই, বসতির পেছনে কিছু দূরে। দুজনই পা টিপে টিপে সাবধানতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে। এখন চারদিকে ঝোঁপ-ঝাড় ও গাছপালা। বডিগার্ড আবারো থমকে দাঁড়িয়ে চকিত নয়নে পেছন দিকে তাকায়। সে কারো হাঁটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তরবারীটা বের করে হাতে নেয় সে। পেছনের দিকে চলে যায়। দুতিনটি ঝোঁপের চারপাশে ঘুরে-ফিরে দেখে। কিন্তু কিছুই নেই।

এবারও নিশ্চয়ই পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনেছ?- বডিগার্ড সায়েকাকে বলল- এবারের শব্দটা আমি স্পষ্ট শুনেছি।

সায়েকা শব্দটা শুনেছে। কিন্তু সে মিথ্যা বলে- ওটা আসলে তোমার মনের ভয়। আর যদি কোন শব্দ শুনেই থাক, তাহলে তা খরগোশ কিংবা অন্য কোন জন্তু-জানোয়ার হবে। তুমি ওসব শব্দকে ভয় করছ কেন?

আমার ভয় করার কারণ হল- সাইফুদ্দীনের বডিগার্ড বলল- তুমি অতিশয় রূপসী ও যুবতী মেয়ে। তোমার মূল্য সম্ভবত তুমি জান না। কেউ যদি তোমাকে অপহরণ করে কোন আমীর বা শাসনকর্তার নিকট বিক্রি করে, তাহলে সে লাল হয়ে যাবে। এখন তুমি আমার দায়িত্বে। আমার হাত থেকে যদি কেউ তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে মহারাজা আমার মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলবেন। তুমি আমার পাশাপাশি হাঁট।

সায়েকা বডিগার্ডের পাশে চলে আসে। দুজন হাঁটতে শুরু করে। একটু সামনে থেকে সরু গলিপথের শুরু। তারা সে পর্যন্ত চলে যায় এবং সরু পথে হাঁটতে শুরু করে। একটু সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পর গলির মাথা থেকে অন্য একটি পথ বেরিয়ে আরেক দিকে চলে গেছে। বডিগার্ড সায়েকাকে নিয়ে সে পথে এগুতে শুরু করে। কয়েক পা অগ্রসর হওয়ামাত্র তারা কারো ধাবমান পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়, যা পরক্ষণেই হঠাৎ করে থেমে যায়। পেছন দিক থেকে কে যেন ছুটে আসে এবং ডানদিকে চলে যায়। বডিগার্ড একটি গাছের পেছনে একটি ছায়া অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে ফেলে। সে তরবারী উঁচু করে গাছটার দিকে ছুটে যায়। অমনি পেছন থেকে সায়েকার ক্ষীণ একটা চীৎকার কানে আসে তার। কে যেন সায়েকার গায়ের উপর একটা বস্তা ছুঁড়ে মেরে ঝাঁপটে ধরে। তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয় আগেই। বডিগার্ড অন্ধকারের মধ্যে শুধু এটুকু দেখতে পায়, যে জায়গাটায় সায়েকা একাকী ছিল, এখন সেখানে দুটি ছায়া ধস্তাধস্তি করছে।

বডিগার্ড সেদিকে ছুটে যেতে উদ্যত হয়। এমন সময় পেছন দিক থেকে কে একজন তাকে ঝাঁপটে ধরে। তার মুখেও কাপড় গুঁজে দেয়া হয় এবং চাটাইয়ের ন্যায় মোটা একটা কাপড় দ্বারা তাকে পেঁচিয়ে ফেলা হয়। বডিগার্ড স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী যোদ্ধা। কিন্তু তারা সংখ্যায় অধিক এবং একেকজন শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ।

সায়েকাকে বস্তায় ভরে বস্তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে বডিগার্ডও বস্তাবন্দী। লোকগুলো তাদেরকে তুলে নিয়ে রওনা হয়ে পড়ে।

কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বস্তা দুটি পিঠে তুলে নেয়া হল। অন্ধকারের মধ্যে পাশ দিয়ে অতিক্রমকারীদেরও বুঝবার উপায় নেই যে, দুজন মানুষকে অপহরণ করে বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা একটি অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ে এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে।

ঘরে ঢুকে তারা সায়েকাকে এক কক্ষে এবং বডিগার্ডকে আরেক কক্ষে নিয়ে যায়। আলাদা আলাদা কক্ষে বস্তার মুখ খুলে দেয়া হয়। সায়েকা বস্তা থেকে বেরিয়ে এলে তার মুখের কাপড় বের করে ফেলা হয়। কক্ষে প্রদীপ জ্বলছিল। সায়েকা সামনে দুব্যক্তিকে দেখে চমকে উঠে কম্পিত কণ্ঠে বলল- তোমরা এ পন্থাটা কেন অবলম্বন করেছ?

নিরাপদ পন্থা এটাই ছিল- একজন জবাব দেয়- অন্যথায় কেউ পথে তোমাকে আমাদের সঙ্গে চলতে দেখে ফেলত। তাই তোমাকে লুকিয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল।

তাহলে আগে আমাকে বিষয়টা বললে না কেন?- সায়েকা জিজ্ঞেস করে আমি তো মনে করেছিলাম, লোকগুলো তোমরা নও, দস্যু এবং আমাকে সত্যি সত্যিই বুঝি অপহরণ করা হচ্ছে।

আমাদের কাজের পন্থা-পদ্ধতি অনেকটা এরূপই হয়ে থাকে। অপর ব্যক্তি বলল।

তোমরা কি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলে যে, লোকটা আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে? সায়েকা জিজ্ঞেস করে।

তুমি যখন তার সঙ্গে ঘর থেকে বের হও, তখনই আমরা নিশ্চিত হই যে, সাইফুদ্দীনের লোক তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে- একজন বলল- তোমাকে কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়াই যদি তার উদ্দেশ্য হত, তাহলে তার জন্য সোজা ও সংক্ষিপ্ত পথ ছিল।

লোকটা কয়েকবার তোমাদের পায়ের শব্দ শুনেছিল- সায়েকা বলল এমন অসাবধান হওয়া ঠিক নয়।

ব্যাপার তা নয়। আসলে অন্ধকারে আমরা তোমাদের দূরত্বের ব্যবধান আন্দাজ করতে পারিনি। তাছাড়া দূর থেকে তোমাদেরকে দেখা যাচ্ছিল না। ফলে অনুসরণ করার জন্য কাছাকাছি থাকতে হয়েছে। তারা বলল।

সায়েকার চেহারায় প্রশান্তির আভা। মেয়েটা সাইফুদ্দীনের বডিগার্ডের হাতে অপহরণ ও লাঞ্ছিত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে।

অপর কক্ষে বডিগার্ডকে বস্তা থেকে বের করে তার মুখ থেকে কাপড় বের করা হয়। তার সামনে তিনজন মুখোশধারী দাঁড়িয়ে আছে। তার তরবারীটা মুখোশধারীদের হাতে।

তোমরা কারা?- মুখে প্রভাব ও গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বডিগার্ড মুখোশধারীদের জিজ্ঞেস করে- আমি মসুলের শাসনকর্তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করব।

মসুলের শাসনকর্তার হেফাজত এখন আল্লাহ করলে করতে পারেন- এক মুখোশধারী বলল- তুমি তোমার নিজের জীবন বাঁচানোর চিন্তা কর। মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?

কয়েদখানায় তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর জন্য বডিগার্ড জবাব দেয়- মনে রেখ, তোমরা যে মেয়েটাকে অপহরণ করেছ, তাকে তোমরা গিলতে পারবে না। এ খতীব ইবনুল মাখদুমের কন্যা এবং মসুলের শাসনকর্তা তার হেফাজতের জন্য নিজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে প্রেরণ করেছেন। এ থেকেই অনুমান করতে পার যে, তোমরা কোথায় হাত দিয়েছ। মসুলের শাসনকর্তা মেয়েটার সন্ধানে শহরের প্রতিটি ঘর অনুসন্ধান করবেন। তোমরা শহর থেকে বের হতে পারবে না। সাইফুদ্দীন এক্ষুণি সংবাদ পেয়ে যাবেন যে, তার এক দেহরক্ষী এবং খতীবের মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে শহর সীল করে দেয়া হবে। আচ্ছা, মেয়েটিকে তোমরা কোথায় রেখেছ?

শোন বন্ধু!- এক মুখোশধারী বলল- মেয়েটা এখানেই আছে। তাকে অপহরণ করা হয়নি, বরং তাকে অপহরণের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। আমরা জানি, মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনের জন্য এই মেয়েটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সন্ধানে তিনি তার গোটা বাহিনীকে মাঠে নামাবেন। তার কারণ, মেয়েটা অতিশয় রূপসী ও যুবতী এবং তার পিতা কয়েকখানায় বন্দী। মেয়েটা সাইফুদ্দীনের পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তাকে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি প্রদান করেছেন। আমরা জানি, সাক্ষাতের এই অনুমতিদান একটি প্রতারণা। সাক্ষাতের নামে দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি সময়টা রাতে নির্ধারণ করেছেন। আচ্ছা, তুমি বল তো, খতীবের সঙ্গে তার মেয়ের সাক্ষাৎ দিনে করানো হয়নি কেন? ঘর থেকে বের করেই তুমি তাকে ভুল পথে নিয়ে এসেছ। তখনই আমরা তোমাদের পিছু নিয়েছি। তোমরা দু-তিনবার থেমে পেছন দিকে তাকিয়েছিলে। তোমরা যাদের উপস্থিতি আন্দাজ করেছিলে, তারা আমরাই। যাদেরকে তুমি ঝোঁপের মধ্যে সন্ধান করতে গিয়েছিলে, তারাও আমরা। কিন্তু তুমি আমাদেরকে দেখনি। দেখবে কিভাবে? আমাদেরকে দিনের আলোতেও কেউ দেখতে পায় না।

তোমরা এই মেয়েটার উপর জুলুম করেছ- বডিগার্ড বলল- আমি তাকে তার পিতার নিকট নিয়ে যাচ্ছিলাম।

তুমি মেয়েটাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলে- এক মুখোশধারী তরবারীর আগাটা তার ধমনির উপর রেখে চাপা কণ্ঠে বলল- তুমি তাকে সাইফুদ্দীনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলে। তোমাদের শাসনকর্তা কত দয়ালু মানুষ, তা আমাদের জানা আছে যে, তিনি খতীব ইনবুল মাখদুমের ন্যায় শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে জেলে পুরতে কুণ্ঠাবোধ করলেন না। আর এখন তার কন্যাকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি প্রদান করলেন! তুমি শুধু এতটুকুই জান, খতীব অপরাধী। কিন্তু তোমার একথা জানা নেই যে, এই মহামান্য আলেমে দ্বীন মসুলে নিঃসঙ্গ নন এবং তিনি যখন কয়েকখানায় আবদ্ধ, তখন তার কন্যাও ঘরে একাকী নয়। আমরা সাইফুদ্দীনের সিংহাসন উল্টে দেব। দিন তার শেষ হয়ে এসেছে। আমরা তাকে যে কোন সময় খুন করতে পারি। কিন্তু হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতকদের ন্যায় কাউকে খুন করতে সুলতান আইউবী আমাদের নিষেধ করে দিয়েছেন। আমরা ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে যুদ্ধ করে শত্রুকে নিধন করি।

তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর লোক? বডিগার্ড জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ- এক মুখোশধারী জবাব দেয়- আমরা আইউবীর কমান্ডো বাহিনীর সদস্য।

মুখোশধারী বডিগার্ডের ধ্বমনিতে স্থাপন করা তরবারীটায় একটু চাপ দেয়। বডিগার্ডের পিঠ দেয়ারের সঙ্গে গিয়ে ঠেকে। মুখোশধারী বলল- তুমি সাইফুদ্দীনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং সবসময় তার সঙ্গে থাক। তার সব গোপন তথ্য তোমার জানা আছে। তুমি তাকে মেয়ে অপহরণ করে নিয়ে দাও। বল, একদম খোলাখুলিভাবে বল, সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে তার পরিকল্পনা কী? যদি বলতে অস্বীকার কর কিংবা যদি বল আমি কিছু জানি না, তাহলে তোমারও সেই দশাই হবে, যা সাইফুদ্দীন বন্দীশালায় তার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে ঘটিয়ে থাকে।

তোমরা যদি সৈনিকই হয়ে থাক, তাহলে ভালভাবেই জান যে, শাসক ও রাজা-বাদশার সামনে একজন দেহরক্ষীর কোন মূল্য থাকে না বডিগার্ড জবাব দেয়- মসুলের শাসনকর্তার পরিকল্পনা কী, তা আমি কিভাবে বলব বলল।

এক মুখোশধারী তার মাথাটা উদোম করে চুলগুলো মুঠি করে ধরে একটা মোচড় দেয় এবং ঝটকা টান দিয়ে একদিকে নত করে ফেলে। অন্য একজন পা ধরে টান দিয়ে তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেলে দেয়। একজন তার পিঠের উপর দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়ানো অবস্থায় কয়েকবার চাপ দিলে বডিগার্ডের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তারপর তাকে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের একটু একটু স্বাদ উপভোগ করানো হয় এবং তাকে বলা হয়, এখান থেকে তুমি জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে না।

আমাকে উঠতে দাও। কোঁকাতে কোকাতে বডিগার্ড বলল।

তাকে তুলে বসানো হল। সে বলল- সাইফুদ্দীন সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান।

এটা কোন তথ্য নয়- এক মুখোশধারী বলল- বল, তিনি কখন এবং কিভাবে যুদ্ধ করতে চান? তিনি কি তার বাহিনীকে হাব ও হাররানের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে লড়তে চান, নাকি আলাদা লড়বেন?

তার বাহিনী অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে- বডিগার্ড জবাব দেয় কিন্তু তিনি এমন কৌশল অবলম্বন করবেন যে, তার বিজয় সম্পূর্ণ আলাদা দেখা যাবে। হাব ও হাররানের লোকদেরকে তিনি বিশ্বাস করেন না।

সালারদের প্রতি তার নির্দেশনা কী?- মুখোশধারী জিজ্ঞেস করে।

তার পরিকল্পনা হল, সালাহুদ্দীন আইউবীকে পাহাড়ী এলাকায় ঘিরে ফেলা হবে। বডিগার্ড জবাব দেয়।

বাহিনী কোন্ পথে যাবে?

 হামাত শিং-এর পথে।

খৃস্টানরা কী পরিমাণ সাহায্য করছে?

খৃস্টানরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে- বডিগার্ড জবাব দেয়। কিন্তু সাইফুদ্দীন তাদেরকেও ধোকা দেবেন। খৃস্টান বাহিনীর কয়েকজন কমান্ডার মসুলের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

এই দুমুখোশধারী এবং অপর কক্ষে সায়েকার কক্ষে উপবিষ্ট দুব্যক্তি সুলতান আইউবীর কমান্ডো গুপ্তচর। খতীব ইবনুল মাখদুমের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল। বরং বলা যায়, খতীব তাদের পৃষ্ঠপোষক ও নেতা ছিলেন। এই দলটি সুলতান আইউবীর জন্য চোখ ও কানের কাজ দিত। মসুলে থেকে যখনই যে তথ্য সংগ্রহ করতে পারত, তা সুলতান আইউবীর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছিয়ে দিত। তারা মসুলে চাকুরি-ব্যবসা ইত্যাদি কাজ নিয়ে অবস্থান করত। খতীব ইবনুল মাখদুম গ্রেফতার হওয়ার পর তারা রাতে পালাক্রমে তার বাসভবন পাহারা দিত। সায়েকার সঙ্গ দেয়ার জন্য দুটো মেয়ে রাতে ঘুমাতে এসে যে ছায়া দেখে ভয়ে পেয়েছিল, এরাই সেই ছায়া। সায়েকা তাদেরকে বলেনি যে, ছায়াগুলো মানুষ। বরং সে ধারণা দিয়েছিল, এগুলো জিন। লোকগুলোর জানা ছিল, সায়েকা সাইফুদ্দীনের নিকট পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি আনতে গেছে। ফিরে এসে মেয়েটা এদের একজনকে অবহিত করেছিল যে, রাতে এক লোক এসে তাকে কয়েদখানায় নিয়ে যাবে। সে এও বলেছিল যে, সাইফুদ্দীন তার সঙ্গে আপত্তিকর কথা বলেছেন এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। লোকটি তার দলের সকলকে বিষয়টি অবহিত করে। তারা সবাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তাদের মনে সন্দেহ জাগে, কয়েকখানায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে সায়েকাকে অন্য কোন স্থানে উধাও করে ফেলা হতে পারে। তাই সূর্য ডোবার পর পাঁচজন লোক সায়েকার ঘরে ঢুকে লুকিয়ে থাকে। সায়েকা বডিগার্ডের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে তারাও তাদের পিছু নেয়। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তাদের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়। তারা সাফল্যজনকভাবে সায়েকাকে রক্ষা করে এবং সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষীকে ধরে ফেলে। তারা তার মুখ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য বের করে। তন্মধ্যে এ তথ্য, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, সাইফুদ্দীনের ভাই ইজুদ্দীন বাহিনীকে দুভাগে বিভক্ত করে এক অংশকে নিজের কমান্ডে রেখে দিয়েছেন। এই অংশটা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ তাদেরকে পরে প্রয়োজন অনুপাতে প্রেরণ করা হবে। প্রথম হামলার নেতৃত্ব দেবেন সাইফুদ্দীন নিজেই। দ্বিতীয়ত, যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পাওয়া গেছে, তাহল, হাব থেকে গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের নিকট দূত এসেছে। বার্তা হল, তিনটি বাহিনীকে যৌথ কমান্ডে রাখা হবে এবং খৃস্টানদের সাহায্যের উপর বেশি ভরসা রাখা যাবে না। প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্যও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

এসব তথ্য প্রদান করে বডিগার্ড দাবি জানায়, এবার আমাকে মুক্তি দাও।

মুখোশধারীরা দেব দেব করে কাল ক্ষেপণ করে। সায়েকাকে সে কক্ষেই থাকতে দেয়া হল। তাকে নিজ ঘরে নিয়ে রাখা নিরাপদ নয়। বডিগার্ডকে ভবনটির একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হল।

***

হাররান ও হাল্ব থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে খৃস্টান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। এখানকার অধিকাংশ তৎপরতা গোয়েন্দা বিষয়ক। এখানে যে কজন খৃস্টান সম্রাট ও কমান্ডার অবস্থান করছেন, তারা সরাসরি নিজেরা সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করার পরিবর্তে তার মুসলিম বিরুদ্ধবাদীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আগেই বলে এসেছি যে, খৃস্টানরা বড় বড় মুসলিম আমীরদেরকে খৃস্টান সামরিক উপদেষ্টা দিয়ে রেখেছিল। তারা তাদেরকে সামরিক পরামর্শ প্রদান ছাড়াও সৈন্যদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করত। নিজেদের আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখার জন্য তারা মুসলিম আমীরদেরকে বিলাসিতার উপকরণ সরবরাহ করত। তাদের গুপ্তচররাও এই আমীরদের দরবারে অবস্থান করত এবং তাদের হেডকোয়ার্টারে খবরাখবর প্রেরণ করত।

হাররান থেকে গোমস্তগীনের এক খৃস্টান উপদেষ্টা তাদের এই হেডকোয়ার্টারে এসে পৌঁছে। তখন খৃস্টানদের দুজন বিখ্যাত যুদ্ধবাজ সম্রাট রেমন্ড ও রেজিনাল্ট হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলেন। রেমন্ড সেই সম্রাট, যাকে সুলতান আইউবী এই অল্প কদিন আগে যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর রেজিনাল্ট হলেন সেই বিখ্যাত খৃস্টান রাজা, যাকে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী এক যুদ্ধে বন্দী করেছিলেন। তাকে এবং অন্যান্য খৃস্টান কয়েদীদের হাররানে গোমস্তগীনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। সে সময় গোমস্তগীন বাগদাদের খেলাফতের একজন দুর্গপতি ছিলেন। জঙ্গীর ওফাতের পর গোমস্তগীন কেন্দ্রীয় খেলাফতের সঙ্গে বিদ্রোহ করে স্বাধীন শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় করার লক্ষ্যে রেজিনাল্টের ন্যায় মূল্যবান বন্দীকে অন্য সকল খৃস্টান কয়েদীর সঙ্গে মুক্ত করে দেন। নূরুদ্দীন জঙ্গী ঘোষণা দিয়েছিলেন, রেজিনাল্টের বিনিময়ে তিনি খৃস্টানদের থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করে নেবেন। কিন্তু জঙ্গী মৃত্যুবরণ করার পর আমীরগণ বিলাসিতা ও ক্ষমতার নেশায় পড়ে তার সকল পরিকল্পনা উলট পালট করে দেয় এবং খৃস্টানরা সালতানাতে ইসলামিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে।

হাররান থেকে এক খৃস্টান উপদেষ্টা- প্রকৃতপক্ষে সে একজন গোয়েন্দা রেমন্ড ও রেজিনাল্টের নিকট এসে পৌঁছে এবং হাররানের তাজা ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে। সে বলল- হাল্ব থেকে আল-মালিকুস সালিহ গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের নিকট উপহারসহ বার্তা প্রেরণ করেছেন, অরা যেন তাদের সেনাবাহিনীকে তার বাহিনীর সঙ্গে যৌথ কমান্ডে দিয়ে দেন। সেখানে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে যে, গোমস্তগীনের দুজন সালার হাররানের কাজীকে হত্যা করে ফেলেছে এবং হাল্ব থেকে আল-মালিকুস সালিহ বার্তার সঙ্গে উপহার হিসেবে যে দুটি সুন্দরী মেয়ে প্রেরণ করেছিলেন, সালারদ্বয় তাদেরকে পালাবার সুযোগ করে দেয়। তারপর তারা স্বীকার করে, তারা সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক এবং তারই জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। এ দুসালার পরস্পর আপন ভাই। গোমস্তগীন তাদেরকে কয়েদখানায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। তার মাত্র একদিন আগে আমাদের এক সঙ্গী উপদেষ্টা গোমস্তগীনের বাসভবনে নিমন্ত্রণে গিয়ে রহস্যজনকভাবে খুন হয়। পরদিন তথ্য পাওয়া গেল, গোমস্তগীনের হেরেমের এক মেয়ে ও একজন দেহরক্ষী নিখোঁজ রয়েছে।, খৃস্টানদের এই বৈঠকে অট্টহাসির ধুম পড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে এই হাসাহাসির ধারা। অবশেষে হাসি থামিয়ে রেমন্ড বললেন- এই মুসলিম জাতিটা এতই যৌনবিলাসী হয়ে উঠেছে যে, তার শাসক ও আমীর উজীরগণ যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও যৌনতায় প্রভাবিত অবস্থায় নিয়ে থাকে। একটু ভেবে দেখুন, গোমস্তগীনের ন্যায় একজন প্রতাপান্বিত ও যুদ্ধবাজ দুর্গপতির সেনাবাহিনীর কমান্ড যে দুজন সালারের হাতে ছিল, তারা তার শত্রু সালাহুদ্দীন আইউবীর সেনা অধিনায়ক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা উপহার হিসেবে আসা মেয়ে দুটোর খাতিরে কাজীকে খুন করেছে এবং মেয়েগুলোকে সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা ধরা পড়ে গেছে। গোমস্তগীনের হেরেমের যে মেয়েটি নিখোঁজ হয়, তাকে সেই রক্ষীসেনা-ই ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে আমাদের লোকটা কোন্ চক্করে পড়ে খুন হল, তা অবশ্য বলতে পারব না। মুসলমান আমীর, শাসক ও দুর্গপতিদের হেরেমের অবরুদ্ধ জগত অত্যন্ত রহস্যময়। আমি আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, এই জাতি ভোগ-বিলাস ও নারীপূজার কারণেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি দুটি কথা বলতে চাই- খৃস্টান সামরিক বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স প্রধান অপর এক খৃস্টানকে বলল- প্রথম কথা হল, আপনি বলেছেন, উপহারস্বরূপ আসা মেয়ে দুটোকে হাররান থেকে ভাগিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনার এ ধারণা সঠিক নয়। আমি গুপ্তচরবৃত্তিতে অভিজ্ঞ। দুশমনের সামরিক তথ্য সগ্রহ করা ছাড়া সামরিক নেতৃবর্গ-কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদস্ত কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত চরিত্র ও রণকৌশল সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করাও আমার বিভাগের দায়িত্ব। আমি আপনাকে পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলছি, নারী ও মদের ব্যাপারে সালাহুদ্দীন আইউবী শক্ত একটা পাথর। এই একটা কারণেই আপনি তাঁকে না পারবেন বিষ খাইয়ে খুন করতে, না পারবেন কোন রূপসী নারীর জালে আবদ্ধ করে ঘাতকদের দ্বারা হত্যা করাতে। প্রকৃতির অমোঘ বিধান হল, যে লোক মানসিক বিলাসিতায় অভ্যস্ত নয়, তার প্রত্যয় দৃঢ় ও শক্ত হয়ে থাকে। এমন মানুষ যখন যে পরিকল্পনা হাতে নেয়, তা বাস্তবায়ন করেই তবে নিঃশ্বাস ফেলে। আপনার শত্রু সালাহুদ্দীন আইউবীর মধ্যে এই গুণ বিদ্যমান। এ কারণেই তার মাথা পুরোপুরি কাজ করে থাকে এবং তিনি এমন এমন কৌশল প্রয়োগ করেন, যা আপনার কল্পনায়ও আসে না। যার ফলে আপনার পা উপড়ে যায়। আমি আইউবী সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে অনুমিত হচ্ছে, তিনি অনৈতিক চাহিদা ও বিলাসিতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। নিজ সেনাবাহিনীর মধ্যেও তিনি এই গুণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। তা না হলে খোলা ময়দানের লড়াইয়ে অভ্যস্ত সৈন্যরা বরফাবৃত উপত্যকা ও পার্বত্য এলাকায় এই তীব্র শীতের মওসুমে যুদ্ধ করতে পারত না। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মধ্যে এই গুণ সৃষ্টি করতে না পারবেন, ততক্ষণ আপনি সালাহুদ্দীন আইউবী নামক আপনার এই শত্রুকে পরাজিত করতে পারবেন না।

আমার দ্বিতীয় কথা হল, অন্যান্য মুসলিম আমীর, উজীর ও শাসনকর্তাদের মধ্যে যে নারীপূজা শুরু হয়ে গেছে, তা আমার বিভাগেরই কৃতিত্ব। ইহুদী পণ্ডিতগণ এক শতকেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানদের চরিত্র বিনষ্টের অভিযান পরিচালিত করে আসছেন। এটা মূলত তাদেরই সাফল্য যে, আমরা নারী, সোনা-দানা ও মনি-মাণিক্যের মাধ্যমে মুসলিম নেতৃবর্গের চরিত্র ধ্বংস করে দিয়েছি। আমরা চারিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য রূপসী ও বিচক্ষণ মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক উপহারের নামে তাদের নিকট প্রেরণ করে থাকি। এখন তারাও একজন আরেকজনকে নারী উপহার দেয়া শুরু করেছে। তাদের জাতীয় চরিত্র নিঃশেষ হয়ে গেছে। এটা আমাদের সাফল্য যে, আমরা তাদের মাঝে বিভেদ ও রাজত্বের মোহ সৃষ্টি করে দিয়েছি।

এই জাতিটাকে আমরা শেষ করে দেব- রেজিনাল্ট বললেন- চরিত্র বিনষ্ট করার মাধ্যমেই তাদের সর্বনাশ ঘটাতে হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী এই ভেবে উফুল্ল হয়ে থাকবেন যে, তিনি ভাই রেমন্ডকে পিছু হটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি জানেন না, রেমন্ড যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছপা হয়েছেন ঠিক; কিন্তু তার জাতির বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়েছেন। ময়দানে অবতীর্ণ হয়েই লড়াই করব, এটা জরুরী নয়। আমরা অন্য অঙ্গনেও লড়তে পারি।

এই অভিযানকে আরো তীব্রতর করে তোলা প্রয়োজন- হাররান থেকে আগত উপদেষ্টা বলল- আমি আপনাদেরদেরকে গোমস্তগীনের ঘরের ঘটনাবলী শুনিয়েছি। তাতে প্রমাণিত হচ্ছে, ওখানে সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর ও নাশকতা কর্মী শুধু অবস্থানই করছে না; গোমস্তগীনের বাসভবন এবং তার সেনাবাহিনীর উচ্চতর পদেও পুরোপুরি তৎপর। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

আমাদের কী ঠেকাটা পড়েছে যে, আমরা সাইফুদ্দীন, আল-মালিকুস সালিহ ও তাদের যৌথ বাহিনীর অপরাপর আমীর প্রমুখকে সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতা থেকে রক্ষা করব?- এক খৃস্টান কমান্ডার বলল আমরা তো তাদের ধ্বংসের গতিকে আরো তীব্রতর ও ত্বরান্বিত করব। হোক তা আমাদের হাতে কিংবা তাদেরই জাতি ভাইয়ের হাতে। এই যেসব মুসলমান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, আপনি কি সত্য মনে তাদেরকে আমাদের বন্ধু মনে করে বসেছেন? তা-ই যদি হয়, তাহলে তার অর্থ হবে, আপনি খাঁটি খৃস্টান নন। আপনি বুঝতে পারেননি যে, আমাদের শত্রুতা না ছিল নূরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে, না আছে সালাহুদ্দীন আউইবীর সঙ্গে। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি কখনো আমার সম্মুখে এসে পড়েন, তাহলে আমি তাকে শ্রদ্ধা করব। তিনি একজন যোদ্ধা, রণাঙ্গনের রাজা। আমাদের শত্রুতা হচ্ছে সেই ধর্মের সঙ্গে, যার নাম ইসলাম। যারা এই ধর্মের সুরক্ষা ও এর প্রচার-প্রসারে কাজ করবে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। আমাদের এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর মৃত্যুর পরও এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। সে লক্ষ্যে আমরা মুসলমানদের মধ্যে এমন কু-চরিত্র সৃষ্টি করছি, যা তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরের মধ্যেও বিস্তার লাভ করতে থাকবে। আমরা এমন পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করছি যে, মুসলমান তাদের নিজস্ব রীতি-নীতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে আমাদের সৃষ্টি করা ও শেখানো চরিত্র-সভ্যতা লালন করবে।

আমাদেরকে তাদের আসল ধর্ম ও কালচার বিকৃত করতে হবে- রেমন্ড বললেন- আমাদের এই অভিযান যখন পূর্ণতা লাভ করবে, সে সময়ে আমরা বেঁচে থাকব না। এই অভিযানের ফল আমরা দেখতে পাব না। আমি পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি যে, আমরা যদি এই অভিযান অব্যাহত রাখি, তাহলে এমন একটা সময় আসবে, যখন ইসলাম যদিও বেঁচে থাকে, তা হবে ইসলামের বিকৃত রূপ, যা পালনে মানুষ শুধুই বিভ্রান্ত হবে। মুসলমান হবে নামের মুসলমান। তাদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র কোন রাজ্য থাকেও যদি, সেটি হবে পাপের আড্ডাখানা। ইহুদী ও খৃস্টান পন্ডিতগণ এই জাতিটার মধ্যে পাপের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, তারা এখন আমাদের সাহায্যের অপেক্ষায় বসে আছেন খৃস্টান উপদেষ্টা বলল- গোমস্তগীন আমাকে সে উদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছেন।

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে মতবিনিময় চলে। শেষে সিদ্ধান্ত হয়, সৈন্য পাঠিয়ে তার কোন সাহায্য করা হবে না। দেই দিচ্ছি বলে কালক্ষেপণ করতে হবে। তাকে এই বলে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করে তাকে আলরিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ করতে বাধ্য কর। আমরা তারই কোন একটা স্পর্শকাতর স্থানে সেনা অভিযান চালিয়ে তাকে এমন বেকায়দায় ফেলে দেব যে, তিনি আলরিস্তান ত্যাগ করে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হল, হাল্ব, হাররান ও মসুলের সৈন্যদের জন্য এই উপদেষ্টার সঙ্গে তীর-ধনুক ও দাহ্য পদার্থ পাঠিয়ে দেয়া হবে। তাছাড়া পাঁচশত ঘোড়াও প্রেরণ করা হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, অধিকাংশ ঘোড়াই যেন এমন হয়, যেগুলো আমাদের সৈন্যদের কাজে আসে না, কিন্তু বাহ্যিকভাবে সুস্থ ও সবল।

আর ভবিষ্যতে সেই আমীর প্রমুখকে অল্প অল্প করে অস্ত্র সরবরাহ করা হবে- রেজিনাল্ট বললেন- সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে তাদেরকে বিলাসিতার দিকে টেনে আনতে হবে। তাদেরকে বুঝ দিয়ে রাখতে হবে যে, যখনই তাদের অস্ত্র কিংবা ঘোড়ার প্রয়োজন পড়বে, তা সরবরাহ করা হবে। এভাবে তারা নিজেরা নিজেদের ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন হয়ে পড়বে এবং আমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। এসব সাহায্য-সহযোগিতা এবং আমাদের উপদেষ্টাদের মধ্যস্থতায় আমরা তাদের মন-মস্তিষ্কের উপর জয়লাভ করে ফেলব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা কিন্তু বলা হয়নি- এক কমান্ডার বলল- শেখ সান্নানের পাঠানো নয় সদস্যের ঘাতক দল রওনা হয়ে গেছে। আশা করছি, এবার তারা সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা না করে ফিরবে না। তারা যে শপথ নিয়ে গেছে, তাতে তারা এ কথাও বলেছে যে, জীবন বাজি রেখে তারা আইউবীকে হত্যা করবে। অন্যথায় তারা জীবিত ফিরে আসবে না।

সেদিনই পাঁচশত ঘোড়া, কয়েক হাজার ধনুক, লক্ষাধিক তীর ও দাহ্য পদার্থ ভর্তি কয়েকটি মটকা হাবের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সঙ্গে একখানা বার্তাও দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল- এই সাহায্যের ধারা চলতে থাকবে। আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর এক্ষুণি আক্রমণ করুন।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার হেডকোয়ার্টারে বসে আছেন। তাঁর নিকট সর্বপ্রথম আনতানুন ও সাদিয়া গিয়ে পৌঁছে। সাদিয়া গোমস্তগীনের হেরেমের সেই মেয়ে, যে একজন খৃস্টান উপদেষ্টাকে খুন করে আনতানুন নামক রক্ষী সেনার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। আনতানুন সুলতান আইউবীর এমন এক গোয়েন্দা, যে আবেগের বশবর্তী হয়ে সীমালংঘন করে ফেলেছিল। যার ফলে সে, গ্রেফতার হয়েছিল। সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত কৌশল করে তাকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স প্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আনতানুন ও সাদিয়াকে সুলতানের নিকট নিয়ে যান। আনতানুন সুলতানকে তার ইতিবৃত্ত অবিকৃতরূপে শোনায়। আনতানুনের এই কর্মনীতি সুলতানের পছন্দ না হলেও তিনি তাকে এই বলে ক্ষমা করে দেন যে, যেরূপ সাফল্যের সঙ্গে তুমি গোমস্তগীনের রক্ষী বাহিনীতে ঢুকে পড়েছিলে, তা তোমার বিরাট কৃতিত্ব। সাদিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে হেরেম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াও তার আরেক কৃতিত্ব। সুলতান আইউবী আনতানুনের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেন, একে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়ে দাও। কারণ, গুপ্তচরবৃত্তির নাজুক কাজের জন্য এর আবেগ নিয়ন্ত্রিত নয়। আর সাদিয়াকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেয়ার আদেশ দেন।

আমি আনতানুনকে বিয়ে করতে চাই- সাদিয়া বলল।

তা-ই হবে- সুলতান আইউবী বললেন- কিন্তু বিয়েটা হবে দামেস্কে। যুদ্ধের ময়দান শহীদ হওয়ার স্থান- বিয়ের জায়গা নয়।

মহামান্য সুলতান!- আনতানুন বলল- আমি আপনাকে অসন্তুষ্ট করেছি। তার শাস্তিস্বরূপ যতক্ষণ না আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারি, ততক্ষণ বিয়ে করব না। সে সাদিয়াকে উদ্দেশ করে বলল- তুমি সুলতানের আদেশ মোতাবেক দামেস্ক চলে যাও। সেখানে তোমার বসবাসের ভাল ব্যবস্থা হবে। আমার সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। সে আবার সুলতান আইউবীকে বলল- আমি কোন একটা কমান্ডো বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে কাজ করতে চাই; আপনি আমার এই আবেদনটুকু মঞ্জুর করুন। আমি গেরিলা হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

আনতানুনকে একটি কমান্ডো দলে পাঠিয়ে দেয়া হল। বৈঠক থেকে বিদায় নেয়ার সময় সাদিয়ার প্রতি এক নজর তাকালও না সে।

পরদিন যখন সাদিয়ার দামেস্ক রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন সেই মেয়েগুলো এসে পৌঁছে, যাদেরকে আল-মালিকুস সালিহ গোমস্তগীনের নিকট উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখতের প্রেরিত দুব্যক্তি। হাররানে কী সব ঘটনা ঘটছে, তারা সুলতান আইউবীকে তার কাহিনী শোনায়।

ফিলিস্তিনের মুসলমানরা যে আপনার পথ পানে তাকিয়ে আছে, তা কি আপনি জানেন? এক মেয়ে বলল- সেখানকার মেয়েরা আপনার নামে গান গায়। মসজিদে মসজিদে আপনার বিজয়ের জন্য দুআ হয়।

অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে খৃস্টানরা কিভাবে মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং পৃথিবীটাকে তাদের জন্য জাহান্নামে পরিণত করেছে, মেয়েটা তার বিবরণ প্রদান করে।

সেখানে শুধু আমাদের মেয়েদের নয়; জাতীয় মর্যাদারও শ্লীলতাহানি চলছে- অপর এক মেয়ে বলল- আমি বরং বলব, জাতির শ্লীলতাহানি আমাদের শাসকরাই করছে। আমাদেরকে গোমস্তগীনের নিকট উপহারস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছিল। আমরা তাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলেছি, আমরা আপনাদেরই কন্যা। কিন্তু তারা আমাদের কোনই আবেদন-আর্তি শোনেননি, তারা আমাদেরকে একজন অপরজনের নিকট উপহার হিসেবে দান করা শুরু করেছেন।

ফিলিস্তীনের পথের প্রতিবন্ধকও তারাই- সুলতান আইউবী বললেন আমি ফিলিস্তীনের উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাইয়েরা আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেছে। যা হোক, এখন তোমরা নিরাপদ। তোমাদের আগে আরো একটি মেয়ে এখানে এসেছিল। তাকে দামেস্ক পাঠানো হচ্ছে। তোমরাও তার সঙ্গে চলে যাও।

আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই- এক মেয়ে বলল- আমাদেরকে এখানেই রেখে দিন এবং কাজ দিন। আমরা এখন আর কোন হেরেম কিংবা কোন গৃহে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাই না।

আমি এখনো জীবিত আছি- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা দামেস্কে চলে যাও। সেখানে তোমাদেরকে কেউ আবদ্ধ করে রাখবে না। সেখানে আরো কয়েকটি মেয়ে বিভিন্ন উপায়ে আমাদের সাহায্য করছে। সেখানে তোমাদেরকেও কোন একটা দায়িত্ব দেয়া হবে।

মেয়েগুলোকে বিদায় দিয়ে সুলতান আইউবী অস্থির মনে এদিক-ওদিক পায়চারি করতে শুরু করেন। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তার সঙ্গে আছেন। তিনি বললেন- মিশর থেকে রিজার্ভ ফোর্স এখনো এসে পৌঁছেনি। তিনটি বাহিনী যদি আমাদের উপর আক্রমণ করতে এসে পড়ে, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব। মনে হচ্ছে, আমাদের সৈন্য যে কম এবং আমি সাহায্যের অপেক্ষায় আছি, তা দুশমন জানে না। তাদের স্থলে যদি আমি হতাম, তাহলে এক্ষুণি আক্রমণ করে বসতাম এবং রসদের পথ বন্ধ করে দিতাম।

মিশর থেকে সাহায্য আসবে, তাতে সন্দেহ নেই- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- মোহতারাম আল-আদেল এমন লোক তো নন যে, তিনি সময় নষ্ট করবেন। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, দুশমন আমাদের সরবরাহ পথ বন্ধ করেনি।

সকল ঐতিহাসিক লিখেছেন, সে সময়টা ছিল সুলতান আইউবীর জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিপদসংকুল। তিনি মিশর থেকে বিশেষ সাহায্যের অপেক্ষা করছিলেন। সে মুহূর্তে যদি আল-মালিকুস সালিহ, সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীনের সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইউবীর উপর হামলা করে বসত, তাহলে তাকে সহজেই পরাজিত করতে পারত। কারণ, তার সৈন্য ছিল খুবই কম। তিনি পাহাড়ী অঞ্চলে মরু এলাকার কৌশল প্রয়োগ করতে পারতেন না। কিন্তু তার শত্রুপক্ষ কী ভাবছিল, তা কে জানে। খৃস্টানরা তার উপর আক্রমণ করার পরিবর্তে মুসলিম আমীরদেরকে তার বিরুদ্ধে লড়াতে চাচ্ছিল। তারাও দেখল না যে, সুলতান আইউবী এক অসহায় অবস্থায় বসে বসে আল্লাহর নিকট দুআ করছেন- ইয়া আল্লাহ! এই অসহায় পরিস্থিতিতে দুশমন যেন আমার উপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে; তুমি আমাকে রক্ষা কর।

যুদ্ধ বেঁধে গেলে ফৌজের ঘোড় ও উটগুলাকে যে নদী থেকে পানি পান করাতে হবে, সেটির দখল বজায় রাখার শক্তিও তার ছিল না। খৃস্টান কিংবা তার মুসলিম শত্রুপক্ষ যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করত, তাহলে গেরিলাদের দ্বারা তারা আইউবীর রিজার্ভ বাহিনীর আগমন ও রসদের পথটা বন্ধ কিংবা নতুন বাহিনীর আগমনের গতি শ্লথ করে দিতে পারত। সুলতান আইউবী টহল কমান্ডোদের দ্বারা সে পথটা নিরাপদ করে রেখেছিলেন।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ- যিনি সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার বিশ্লেষক- তার রোজনামচায় সুলতান ইউসুফ (সালাহুদ্দীন আইউবী)-এর উপর কি বিভীষিকা নেমে এসেছিল শিরোনামে লিখেছেন–

আল্লাহ যদি তাদেরকে (শত্রুপক্ষকে) বিজয় দান করতে ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা তখনই সুলতান আইউবীর উপর হামলা করে বসত। কিন্তু আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করতে চান, সে লাঞ্ছিতই থাকে। তারা সুলতান আইউবীকে এতটুকু সময় ও সুযোগ দিয়ে দেয় যে, মিশর থেকে নতুন ফোর্স এসে পৌঁছে যায়। সুলতান তাদেরকে তার বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করে নতুন বিন্যাস তৈরি করে নেন। তিনি হামলার আগে সবকটি ঘোড়াকে পানি পান করিয়ে নেন এবং প্রচুর পানি রিজার্ভ করে রাখেন।

সুলতান আইউবীর ব্যাকুলতার অবস্থা এই ছিল যে, তিনি রাতে ঘুমাতেন না। তিনি যেখানে যেখানে সেনা স্থাপন করেছেন, সব কটি পয়েন্টে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন, ভাবতেন এবং এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা দুশমনের হামলা প্রতিহত করার পরিকল্পনাটা ঝালাই করে নিতেন। হামাত শিংয়ে যে স্থানে একটি পাহাড় শিং-এর ন্যায় দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, তিনি সেটিকে দুশমনের জন্য ফাঁদ হিসেবে প্রস্তুত করে রাখেন। কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে, এত স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা তিনি কেবল প্রতিরোধ যুদ্ধই লড়তে পারতেন। যুদ্ধের পটভূমি পাল্টে দেয়ার জন্য যে জবাবী আক্রমণের প্রয়োজন, তার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। তার গোয়েন্দারা তাকে তথ্য প্রদান করেছিল যে, খৃস্টানরা মুসলিম আমীরদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে এমনভাবে লড়াবার চেষ্টা করবে, যাতে যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, যেন সুলতান আইউবী পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হতে না পারেন এবং অবরুদ্ধ থেকে প্রতিরোধ লড়াই করতে করতে শেষ হয়ে যান।

কিন্তু সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারা তাকে এ তথ্য জানাতে পারেনি যে, নয় সদস্যের একটি ঘাতক দল তাকে হত্যা করতে আসছে। অপরদিকে সুলতানের দৃষ্টিও নিজের জীবনের প্রতি নয়, রণাঙ্গনের উপর নিবদ্ধ। তিনি পর্যবেক্ষণের জন্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত সৈন্য ছড়িয়ে রেখেছেন।

এর পরদিনই হাররান থেকে সুলতান আইউবীর এক দূত এসে পৌঁছে। সে সংবাদ নিয়ে আসে, সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত কারাগারে আটক রয়েছেন। তারা কাজী ইবনুল খাশিবকে খুন করেছেন। গোয়েন্দা এই হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে পারেনি। সংবাদটা শোনামাত্র সুলতান আইউবীর চেহারার রং বদলে যায়। এই দুসহোদরের সঙ্গে তিনি অনেক আশা-ভরসা যুক্ত করে রেখেছিলেন। তাদের জানা ছিল, গোমস্তগীনের ফৌজের কমান্ড এই দুভাইয়ের হাতে থাকবে এবং তাদের বাহিনী লড়াই না করে স্বেচ্ছায় তার হাতে আত্মসমর্পণ করবে। গোয়েন্দা এ তথ্যও প্রদান করে যে, এখন গোমস্তগীন নিজে ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে ফৌজের কমান্ড করবেন। গোয়েন্দা আরো জানায়, গোমস্তগীন তার বাহিনীকে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে লড়াই করবেন।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ!- সুলতান আইউবী বললেন- শামসুদ্দিন ও শাদবখতকে যেন বেশিদিন গোমস্তগীনের কারাগারে থাকতে না হয়। এর নিকট থেকে জেনে নাও, হাররানে আমাদের কতজন লোক আছে এবং তারা তাদেরকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে আনতে পারবে কিনা। আমার আশংকা হচ্ছে, গোমস্তগীন তাদেরকে হত্যা করে ফেলবে। এরা যে আমার গোয়েন্দা, গোমস্তগীন তা জেনে ফেলেছে। আমি হাররান গিয়ে অবরোধ করে দুর্গ জয় করে তাদেরকে মুক্ত করব, এতটুকু সময় অপেক্ষা করতে পারব না। গোমস্তগীন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই তুমি তাদেরকে কয়েকখানা থেকে মুক্ত করে আন। আমি আমার এই দুই সালারের জন্য দুইশ কমান্ডোর জীবন খোয়াতেও প্রস্তুত আছি। হাররানে পর্যাপ্ত লোক না থাকলে এখান থেকে কমান্ডো পাঠাও।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন; আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন।

***

হাল্ব এখন সুলতান আইউবীর বিরোধী পক্ষের কেন্দ্র। সাহায্য হিসেবে খৃস্টানদের প্রেরিত তীর-ধনুক ও দাহ্য পদার্থের মটকা ও ঘোড়াগুলো হাল্ব পৌঁছে গেছে। খৃস্টানরা হাবের লোকদের মধ্যে একটি গুণ এই প্রত্যক্ষ করেছিল যে, তারা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে সুলতান আইউবীর অবরোধের মোকাবেলা করেছিল। সালতানাতের রাজধানীও এখন হাল্ব। খৃস্টান উপদেষ্টাগণ মসুলে সাইফুদ্দীনকে এবং হাররানে গোমস্তগীনকে সংবাদ পাঠায় যে, আপনাদের সম্মিলিত বাহিনীর জন্য সাহায্য এসে গেছে, আপনারা বিলম্ব না করে চলে আসুন। ঐতিহাসিকদের বিবরণ মোতাবেক হাল্ব নগরীর বাইরে একস্থানে এই তিন মুসলিম শাসকের সাক্ষাৎ ঘটে এবং সেখানে বসে তাদের মাঝে একটি অলিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি কি ধরনের হবে, তা ঠিক করে খৃস্টান উপদেষ্টাগণ।

সেই রাতের ঘটনা। মসুলের কারাগারে বসে খতীব ইবনুল মাখদুম প্রদীপের আলোতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তার কন্যা সায়েকা সেই ভবনটির একটি কক্ষে অবস্থান করছে, বস্তাবন্দী হয়ে যে ভবনে এসে সে পৌঁছেছিল, তার সঙ্গে যে রক্ষী সেনাকে ধরে আনা হয়েছে, সে অন্য কক্ষে। ভবনটিতে তারা ব্যতীত আরো দুজন লোক আছে, যারা তাদেরকে তুলে এনেছিল। তাদের অবশিষ্ট সঙ্গীরা কয়েদখানার বাইরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালের উপরিভাগ দুর্গের দেয়ালের মত, যার উপর মোর্চার মত তৈরি করা আছে। উপরে কয়েকজন সান্ত্রী ঘোরাফেরা করছে। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। যে জেল কর্মকর্তা খতীবকে পালাবার সুযোগ করে দেয়ার ওয়াদা দিয়েছিলেন, তিনি সান্ত্রীদের প্রতি দৃষ্টি রেখে ঘোরাফেরা করছেন। যে দেয়ালের নীচে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, তিনি তার উপরের সান্ত্রীকে ডেকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।

জেল কর্মকর্তা কি যেন একটা ইঙ্গিত করেন। নীচে লুকিয়ে থাকা লোকগুলো উপর দিকে একটি রশি ছুঁড়ে দেয়। রশির এক মাথা একটি লাঠির মধ্যখানে বাঁধা। লাঠিটা কাপড় পেঁচানো, যাতে দেয়ালের উপরে নিক্ষিপ্ত হয়ে শব্দ না করে। লাঠিটা উপরে গিয়ে আটকে যায়। একে তো অন্ধকার, তদুপরি কর্মকর্তা সান্ত্রীকে নিয়ে দূরে চলে গেছেন। চারজন লোক রশি বেয়ে উপরে উঠে যায়। তারা এই রশিটাই টেনে তুলে নিয়ে দেয়ালের অপরদিকে ছেড়ে দেয়। চারজন খঞ্জর বের করে নিজ নিজ মুখে চেপে ধরে রশি বেয়ে নীচে নেমে যায়। জেল কর্মকর্তা তাদেরকে ভেতরের মানচিত্র বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভেতরে কিছুটা আলো আছে। স্থানে স্থানে প্রদীপ জ্বলছে। জেল কক্ষের সারিতে মাথায় এক স্থানে একটুখানি বারান্দা। এই সান্ত্রী ওখানে পায়চারি করছে। চার ব্যক্তি লুকিয়ে যায়। সান্ত্রী তাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলে একজন বলল, এদিকে একটু আসুন তো ভাই। সান্ত্রী দ্রুতগতিতে তাদের নিকট গিয়ে পৌঁছে। অমনি দুব্যক্তি তাকে ঝাঁপটে ধরে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে খঞ্জর মেরে কাজ সমাধা করে দেয়।

চার ব্যক্তি চুপি চুপি সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একজন একটু বেশি এগিয়ে যায়। অপর তিনজন বিক্ষিপ্তভাবে চুপিসারে তাকে অনুসরণ করে এগুতে থাকে। সামনের লোকটি কয়েদখানার গোলাকার একটা জায়গায় পৌঁছে যায়। খতীবের প্রকোষ্ঠটা এখানেই। লোকটা খতীবের কুঠুরী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। খতীব দরজার দিকে তাকান। তিনি কুরআনখানি বন্ধ করে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে আসেন। লোকটার হাতে বড় একটা চাবি। জেল কর্মকর্তা এক কর্মকার দিয়ে চাবিটা তৈরি করে দিয়েছেন। কয়েকখানার চাবি সম্পর্কে সে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল। লোকটি চাবিটা তালায় ঢুকায়। তালা খুলে যায়। খতীব এখন কক্ষের বাইরে। তালাটা খুলে দিয়েই কমান্ডো ফেরত রওনা হয়ে যায়।

পিছন দিকে কতটুকু সরে আসার পর কমান্ডো কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। সেই সঙ্গে কণ্ঠস্বর- কে? দাঁড়াও। এদিক থেকে জবাব দেয়া হয়- কাছে আস দোস্ত! লোকটি কমান্ডোর নিকটে এগিয়ে আসামাত্র একটি খঞ্জর তার হৃদপিণ্ডে গেঁথে যায়। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লে পেছন দিক থেকে আরেকটি খঞ্জর তাকে আঘাত হানে। লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কমান্ডো খতীবকে নিয়ে রশির নিকট চলে যায়।

সর্বপ্রথম এক কমান্ডো দেয়ালের উপরে ওঠে। তারপর উঠেন খতীব। জেল কর্মকর্তা সান্ত্রীকে এখনো দূরে কোথাও আলাপে মাতিয়ে রেখেছেন। খতীবসহ একে একে সব কমান্ডো দেয়ালের উপর উঠে যায়। তারপর রশিটা টেনে তুলে বাইরের দিকে ছেড়ে দেয় এবং সকলে নীচে নেমে আসে। জেল কর্মকর্তা কয়েদখানার বাইরের দিক থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাকের ন্যায় শব্দ শুনতে পায়। সে সান্ত্রীকে আরেক দিকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সেই জায়গায় চলে আসে, যেখানে রশি ঝুলানো হয়েছিল। সে দ্রুত রশিটা সরিয়ে ফেলে।

সায়েকা ও বডিগার্ড যে গৃহে অবস্থান করছে, এরা সকলে সেখানে চলে যায়। পিতাকে দেখে সায়েকা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

যখন ভোর হল, তখন মসুল থেকে কয়েক মাইল দূরে চারটি ঘোড়া ছুটে চলছিল। একটির আরোহী খতীব। একটিতে সায়েকা। একটিতে সাইফুদ্দীনের কারা কর্মকর্তা এবং চতুর্থটিতে অপর এক ব্যক্তি। এ লোকটি সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। যে দলটি সাইফুদ্দীনের বডিগার্ডকে ধরে এনেছিল, লোকটি তাদের একজন। এ লোকটিই বডিগার্ড থেকে কড় মূল্যবান তথ্য বের করেছিল। তারা যখন মসুল থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল, ততক্ষণে বডিগার্ড সমাধিস্থ হয়ে গেছে। রাতে এ দলটি মসুল ত্যাগ করার সময় বডিগার্ডকে খুন করে গিয়েছিল।

সাইফুদ্দীনের কয়েদখানার অবস্থা শোচনীয়। ভেতরে দুজন সান্ত্রীর লাশ পড়ে আছে। খতীব উধাও। কর্মকর্তার পাত্তা নেই। বডিগার্ড খতীব কন্যা সায়েকাকে নিয়ে যথাসময়ে না পৌঁছায় সাইফুদ্দীন ধরে নিয়েছিলেন, বডিগার্ড গাদ্দারী করেছে। তার ধারণা, মেয়েটার রূপ-সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে লোকটার মাথা বিগড়ে গেছে। তাই সে মেয়েটাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু তার কল্পনায়ও আসেনি যে, তার দেহরক্ষী সায়েকাসহ আইউবীর কমান্ডোদের হাতে ধরা পড়েছে।

***

 সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত গোমস্তগীনের কারাগারে বন্দী। সুলতান আইউবী নির্দেশ প্রদান করেছেন, তাদেরকে ওখান থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা কর। কিন্তু তারা হাররানে যেসব লোক তৈরি করে রেখেছেন, তারা সে ব্যবস্থা আগেই করেছে। এই দুই সালার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে এক একজন ও দু-দুজন করে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে রেখেছেন। তবে তাদের পলায়নে বড় সমস্যা হল, তারা যেখানে বন্দী রয়েছেন, সেটা কয়েদখানার পাতাল কক্ষ। সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য বিশেষ কোন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেছেন। সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখতের মুক্তির পথ বেরিয়ে এসেছে। হাব থেকে গোমস্তগীনের তলব এসেছে। তিনি তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, উপদেষ্টা ও রক্ষীদের নিয়ে হাবের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। শামসুদ্দীন ও শাদবখতের বন্দী হওয়ার সংবাদ গোমস্তগীনের একান্ত ঘনিষ্ঠ লোকজন ব্যতীত কেউ জানত না। কাজী ইবনুল খাশিবের হত্যাকাণ্ডের খবরও গোপন রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী পর্যন্ত এখনো জানে না, তাদের ঊর্ধ্বতন দুজন সালারকে কয়েকখানায় নিক্ষেপ করা হয়েছে।

গোমস্তগীনের রওনা হয়ে যাওয়ার একদিন পর জেলার দেখতে পান যে, তিনজন অশ্বারোহী কারাগারের দিকে ছুটে আসছে। ঘোড়াগুলো আরো নিকটে আসার পর দেখা গেল, তাদের সঙ্গে আরো দুটি শূন্য ঘোড়া রয়েছে। ঘোড়াগুলো কয়েদখানার গেটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এক আরোহী হাররানের সামরিক পতাকা উঁচিয়ে রেখেছে। এই পতাকাটা যুদ্ধের ময়দানে প্রধান সেনাপতির হাতে থাকে। অশ্বারোহীদের মধ্যে একজন কমান্ডার। অপর দুজন সাধারণ সৈনিক। সম্ভবত তারা রক্ষীবাহিনীর সদস্য। জেলার প্রধান ফটকের ফাঁক দিয়ে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি কমান্ডারকে চিনেন। ফটক খুলে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন। কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করেন কেন এসেছ?

রাজা-বাদশাদের আদেশ-নিষেধের কোন তাল থাকে না- কমান্ডার বলল আমাদের শাসনকর্তা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এমন দুজন সালারকে জেলে পুরে রেখেছেন, যাদের ছাড়া ফৌজ এক পা-ও চলতে পারে না। এখন আবার আদেশ করলেন, তাদেরকে জেল থেকে বের করে আন।

তার মানে আপনারা সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখকে নিতে এসেছেন? জেলার জিজ্ঞেস করেন।

 হা- কমান্ডার বলল- তাদেরকে জলদি নিয়ে যেতে হবে।

দুর্গপতি গোমস্তগীনের লিখিত কোন নির্দেশনামা নিয়ে এসেছেন?- জেলার জিজ্ঞেস করেন। তিনি তো বাইরে কোথায় যেন চলে গেছেন?

আমি তার নিকট থেকেই এসেছি- কমান্ডার বলল- আমি রাতেই এসে পড়েছি। তখন তার এতটুকু হুঁশ ছিল না যে, নির্দেশনামা লিখে দেবেন। আমাদের ফৌজ হাল্ব ও মসুলের ফৌজের সঙ্গে মিলে সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে। সময় নষ্ট করলে আইউবীই উল্টো আমাদের উপর হামলা করে বসবেন। বিপদ বেড়ে গেছে। গোমস্তগীন এ ব্যাপারেই হাল্ব গেছেন। মাথার উপর বিপদ দেখার পর এখন তার হুশ ফিরে এসেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এ দুসালার ব্যতীত তিনি লড়াই করতে পারবেন না। তাই আমাকে হাবের রাস্তা থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। পতাকাটা দিয়ে বলেছেন, তাদেরকে এই পতাকা উড়িয়ে পূর্ণ মর্যাদার সাথে নিয়ে আস। আপনি জলদি করুন।

জেলার কমান্ডারকে ভেতরে নিয়ে যান। সৈনিকদ্বয়ও তাদের সঙ্গে চলে যায়। তারা পাতাল কক্ষে ঢুকে পড়ে। শামসুদ্দীন ও শাদবখত আলাদা আলাদা দুটি কক্ষে আবদ্ধ। প্রথমে একজনকে বের করে আনা হল। কমান্ডার তাকে সামরিক কায়দায় সালাম করে বলল- হাররানের আমীর গোমস্তগীন আপনার মুক্তির নির্দেশ পাঠিয়েছেন। আপনার ঘোড়া ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষী আমাদের সঙ্গে আছে। আপনার জন্য নির্দেশ হল, প্রস্তুতি নিয়ে এক্ষুণি হাল্ব পৌঁছে যাবেন।

মনে হয়, মদের নেশা কেটে গেছে। সালার বললেন।

আমি এমন কেউ নই যে, আপনার অভিমত সমর্থন কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারি- কমান্ডার বলল- আমার কাজ নির্দেশ পৌঁছানো আর আপনার সঙ্গে যাওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

জেলার মনোযোগ সহকারে তাদের কথাবার্তা শ্রবণ করেন। তিনি নিশ্চিত হন যে, বিষয়টা সঠিক। কিন্তু অপর সালারকে বের করে আনতে গিয়েই জেলারের মনে সন্দেহ জাগে। এই সালার কমান্ডারকে দেখামাত্র আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন- তোমরা এসে পড়েছ? সব ঠিক আছে তো? তিনি জেলারের উপস্থিতি অনুধাবন করে সে অনুপাতে কথা বলতে ব্যর্থ হন। জেলার আনাড়ী লোক নন। তার কর্মজীবনটা পুরোটাই কাটে কারাগারে। তিনি কক্ষের তালা খুলে দিয়েছিলেন। মনে সন্দেহ জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তালাটা লাগিয়ে দেন এবং বললেন- লিখিত নির্দেশনামা ব্যতীত আমি এদেরকে মুক্তি দিতে পারব না।

কমান্ডার থাবা দিয়ে তার হাত থেকে চাবিটা ছিনিয়ে নেয়। সালারদের দেহরক্ষী হিসেবে আসা সৈনিকদ্বয় জেলারের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তারা খঞ্জর বের করে খঞ্জরের আগা জেলারের পিঠের উপর ঠেকিয়ে রাখে। কমান্ডার তাকে কানে কানে বলল- এ মুহূর্তে তুমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডোর কজায় আটক রয়েছ। তুমি তো জান, আইউবীর কমান্ডোরা কী করতে পারে। আর একটা শব্দও যেন মুখ থেকে বের না হয়।

কমান্ডার তালা খুলে কক্ষের দরজা খুলে ফেলে। জেলারকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে আশপাশ থেকে কেউ বুঝতে না পারে যে, এখানে কোন অপরাধ হচ্ছে। ভেতরে ঢুকিয়ে তাকে ছিদ্রওয়ালা দরজার নিকট থেকে সরিয়ে আড়ালে নিয়ে যায়। এক সৈনিক দ্রুত এক টুকরো রশি দ্বারা, যা বড়জোর পৌনে এক গজ লম্বা হবে- তার গলাটা পেঁচিয়ে ধরে রশিটাকে একটা মোড় দেয় এবং দু-তিনটি ঝটকা টান মারে। জেলারের চোখ দুটো কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। লোকটি শীতল হয়ে যায়।

নিথর-নিস্তব্ধ জেলারকে পাথরের মেঝেতে ফেলে রাখা হল। লাশের উপর একখানা কম্বল ছড়িয়ে দেয়া হল। সালার আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে এই সমস্যাটা সৃষ্টি করে দিলেন।

শামসুদ্দীন ও শাদবখতকে নিয়ে বের হয়ে কমান্ডার দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং চাবিটা নিয়ে নেয়। বাইরের দরজাগুলোর চাবিও জেলারের নিকট ছিল। কমান্ডার সেগুলোও নিয়ে নেয়। এই দলটি সেখান থেকে রওনা হয়। তারা পাতাল কক্ষ থেকে উপরে উঠে আসলে পাতালের সান্ত্ৰী নীচে গিয়ে শূন্য প্রকোষ্ঠগুলো পর্যবেক্ষণ করে। সে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিল, জেলার দুজন কয়েদীকে মুক্তি দিচ্ছেন। কয়েদী দুসালারকে সে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে। কিন্তু নীচে গিয়ে দেখতে পায়, এক প্রকোষ্টে কে একজন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। লোকটা কে, চিনতে পারল না সে। অপর কক্ষটি শূন্য। সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা লোকটাকে ডাক দেয়। কিন্তু তার কোন সাড়া নেই। দরজা তালাবদ্ধ। সান্ত্রী দেয়ালের ছিদ্রপথে হাতের বর্শাটা ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। বর্শার আগা লোকটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বর্শার আগা দ্বারা লোকটাকে খোঁচা মারে। তারপরও সে উঠল না। বর্শা দ্বারা গায়ের কম্বলটা সরিয়ে লোকটার মুখমণ্ডল উদাম করে। সহসা চমকে উঠে সান্ত্রী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাটা দিয়ে উঠে তার। ইনি যে কারাগারের জেলার! চোখ ও মুখমণ্ডলে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, লোকটা মৃত।

সান্ত্রী সেখান থেকেই চিৎকার শুরু করে দেয়- সাবধান! সাবধান! আসামী পালিয়ে গেছে। সে দৌড়ে উপরে উঠে আসে। তার ডাক-চিৎকারের সূত্রে নাকাড়া বাজতে শুরু করে। ততক্ষণে পলায়নরত দলটি প্রধান ফটকে পৌঁছে গেছে। সান্ত্রীরা ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রধান ফটকের চাবিগুলো কমান্ডারের নিকট। তারা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় এবং ভেতরের তালায় চাবি ঢুকায়। সান্ত্রী দূর থেকে চিৎকার করে বলল- ওদেরকে ধরে ফেল? ওরা আমাদের জেলারকে খুন করে পালাচ্ছে।

নাকাড়ার আওয়াজে কয়েদখানার সকল সান্ত্রী যার যার ডিউটিতে পৌঁছে গেছে। বাইরের রক্ষীরাও ছুটে এসেছে। ফটক খুলে গেছে। যে নাকাড়া বাজানো হয়েছে, তা হচ্ছে বিপদ সংকেত। তাই বাইরে থেকে ছুটে আসা রক্ষীসেনারা তাদের প্রশিক্ষণ মোতাবেক দ্রুততার সাথে ফটকে ঢুকে পড়ে। তাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় বিপদ এই হতে পারে যে, হয়ত কয়েদীরা বিদ্রোহ করে বসেছে কিংবা কারাগারের কোথাও আগুন লেগে গেছে। যে সান্ত্ৰী ডাক চিৎকার করে ফিরছিল, সে বাইরে থেকে আগত সান্ত্রীদের ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। এই হুলস্থূল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পলায়নপর লোকগুলো ফটক অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়। বাইরে ঘোড়া দণ্ডায়মান। তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে।

ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে একজন পেছন দিকে থেকে চিৎকার দেয়- থাম, অন্যথায় মারা যাবে। তারা ক্ষিপ্রগতিতে ঘোড়া হাঁকায়। পেছন থেকে একসঙ্গে এক ঝাঁক তীর ধেয়ে আসে। দুটি তীর কমান্ডারের পিঠে গেঁথে যায় এবং একটি এক সালারের ঘোড়ার পেছন অংশে আঘাত হানে। কমান্ডার দেহে দুটি তীর নিয়েও আত্মনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। সালার শামসুদ্দীনের ঘোড়া তীর খেয়ে লাফিয়ে ওঠে। শামসুদ্দীন ঘোড়াটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন এবং তাকে কমান্ডারের ঘোড়ার পাশে নিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে তার ঘোড়ায় চড়ে বসেন। কমান্ডারের হাত শিথিল হয়ে আসে। শামসুদ্দীন তার হাত থেকে ঘোড়ার লাগামটা নিয়ে নেন। পেছন থেকে আরো তীর আসে। কিন্তু ঘোড়ার গতি দ্রুত থাকায় নিশানা ব্যর্থ হয়।

তারা পেছন দিকে তাকায়। সাইফুদ্দীনের কয়েদখানা এখন তাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু দশ-বারজন অশ্বারোহী তাদেরকে ধাওয়া করছে। সামনে উন্মুক্ত মাঠ। পলায়নকারীরা তীব্রগতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলছে। তাদের অস্ত্রের অভাব। উভয় সালার নিরস্ত্র। কমান্ডার ধীরে ধীরে নিথর হয়ে আসছে। মোকাবেলা করার মত শক্তি তার নেই। সামনে টিলা ও পার্বত্য এলাকা। এক সালার বললেন- তোমরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাও। একাকী হয়ে যাও।

ধাওয়াকারীরা এখনো অনেক দূরে। তারা দেখল, পলায়নকারীরা পরস্পর আলাদা হয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে হারিয়ে গেছে। তাদের গতি শ্লথ হয়ে যায়। পলায়নকারীরা তাদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।

[চতুর্থ খণ্ড সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *