জানবাজ
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিজয়ী কমান্ডারদের সম্মুখে দুশমনের অগনিত লাশ পড়ে আছে। দিশেহারা আহত উট-ঘোড়াগুলো হতাহতদের পিষে চলেছে। শত্রু শিবিরের যেসব সৈনিক পালাতে পারেনি, তারা অস্ত্র ত্যাগ করে একস্থানে জড়ো হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক ঢাল-তরবারী, ধনুক-বর্শা, তাঁবু ও অন্যান্য আসবাবপত্র দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, যেটি তাঁর শক্রজোটের প্রধান সেনানায়ক সাইফুদ্দীনের হেডকোয়ার্টার ও বিশ্রামাগার ছিলো। গাজী সাইফুদ্দীন তার বাহিনীর পরাজয় ও সুলতান আইউবীর জয় নিশ্চিত টের পেয়ে কাউকে কিছু না বলে কাপুরুষের ন্যায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। তার পলায়ন যেমন ছিলো গোপনীয়, তেমনি ছিলো লজ্জাজনক। হেরেমের বেশ কটি রূপসী মেয়ে তার সঙ্গে ছিলো, ছিল নর্তকী ও সোদানা। নিজ সৈন্যদের ভাতা প্রদান ও আইউবীর লোকদের ক্রয় করার জন্য তিনি এই স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। মহামূল্যবান মনোহরী কাপড়ের তাবু ও শামিয়ানার তৈরি বিশ্রামাগারটি যেন একটি রাজ প্রাসাদ। সে যুগের যুদ্ধবাজ শাসকবর্গ এরূপ মহল ও যতোসব বিলাস সামগ্রী সঙ্গে রাখতেন। গাজী সাইফুদ্দীন তেমনই এক শাসক ছিলেন। তিনি মদের পিপা এবং রং-বেরঙের পেয়ালা-মটকাও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
সুলতান আইউবী মন পাগলকরা এই প্রাসাদটির প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ সাইফুদ্দীনের পালংকটির উপর তার চোখ পড়ে। পালংকের উপর সাইফুদ্দীনের তরবারীটি পড়ে আছে। পালাবার সময় তিনি তারবারীটাও নিতে ভুলে গেছেন। সুলতান আইউবী ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তারবারীটা হাতে তুলে নেন। ধীরে খাপ থেকে তরবারীটা বের করেন। তারবারীটা ঝিকমিক করছে। সুলতান তারবারীটার প্রতি এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর মুখ ঘুরিয়ে পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সালারের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন- মুসলমানের তরবারীর উপর যখন নারী ও মদের ছায়া পড়ে, তখন সেটি লোহার অকেজো টুকরায় পরিণত হয়ে যায়। এই তরবারীর ফিলিস্তিন জয় করার কথা ছিলো। কিন্তু খৃস্টানরা একে তাদের পাপ পংকিলতায় চুবিয়ে কাঠের অকেজো লাঠিতে পরিণত করেছে। যে তরবারী মদ দ্বারা সিক্ত হয়, সেই তরবারী রক্ত থেকে বঞ্চিত থাকে।
সাইফুদ্দীনের বিশ্রামাগারের পার্শ্বেই আরেকটি প্রশস্ত মনোরম তাঁবু। তার মধ্যে কতগুলো অর্ধনগ্ন রূপসী মেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তারা তাদের অশুভ পরিণাম চিন্তায় বিভোর। তারা জানে, বিজয়ী বাহিনীর হাতে ধরা খেলে মেয়েদের কী দশা হয়! এমন চিত্তাকর্ষক মেয়েদের মুঠোয় পেলে কে না পশু হয়। কিন্তু সুলতান আইউবীর ঘোষণা শুনে তারা নির্বাক। আইউবী ঘোষণা দিলেন- তোমরা মুক্ত। তোমরা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। সসম্মানে ও নিরাপদে সেখানে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।
সুলতান আইউবীর এই অভাবিত ঘোষণায় তারা আরো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সুলতানের এই ঘোষণাকে উপহাস মনে করে তারা অধিকতর লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের ভয়ে মুষড়ে পড়ে। সুলতান মেয়েদেরকে নিজের হেফাজতে নিয়ে যান। যুদ্ধের ময়দানে নারীর উপস্থিতিকে সুলতান সহ্য করতেন না। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমরা কতজন ছিলে? তারা জানায়, এখন যে কজন আছি, আরো দুজন ছিলো। তারা এখন নিখোঁজ। তারা মুসলমান ছিলো না। তারা দুজন সাইফুদ্দীনকে কজা করে রাখতো। হয়তোবা তারাও সাইফুদ্দীনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
সেকালের যুদ্ধ-বিগ্রহে সাধারণত যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে বিজয়ী বাহিনীর সৈন্যরা পরাজিত শত্রু বাহিনীর ফেলে যাওয়া সম্পদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। পরাজিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতির বিশ্রামাগার তথা হেডকোয়ার্টারের উপর লুটিয়ে পড়তো অধিকাংশ সৈনিক। সেখানে থাকতো সম্পদের খাজানা, মদ আর নারী। এসবের দখল নিয়ে তাদের মাঝে বিবাদ সংঘাতও বেঁধে যেতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুলতান আইউবীর নীতি ছিলো খুবই কঠোর। কোন অফিসারের জন্যও তার পদমর্যাদা যতোই উঁচু হোক না কেন- মালে গনীমতে হাত লাগানোর অনুমতি ছিলো না। তিনি কোনো একটি ইউনিটকে মালে গনীমত কুড়িয়ে এক জায়গায় জমা করার দায়িত্ব প্রদান করতেন। তারপর নিজ হাতে তা বণ্টন করতেন। কিন্তু তুমানের যুদ্ধ শেষে সুলতান আইউবী মালে গনীমত সম্পর্কে কোনো নির্দেশ জারি করলেন না। তিনি নিজ বাহিনী এবং শত্রুপক্ষের আহতদের তুলে সেবা-চিকিৎসা এবং যুদ্ধবন্দীদের আলাদা করার নির্দেশ প্রদান করেন।
সুলতান আইউবী অত্যন্ত কঠোরভাবে রণাঙ্গনের শৃঙ্খলা বিধান করতেন। এই যুদ্ধে তার শত্রুপক্ষ অতিশয় বিশৃঙ্খলভাবে পলায়ন করেছিলো। তার কোনো কোনো ইউনিট পলায়নপর শত্রুসেনাদের ধাওয়াও করেছিলো। এই পশ্চাদ্ভাবনেও তারা শৃঙ্খলা বিনষ্ট করেনি। সুলতান আইউবী ধাওয়াকারীদের ফিরিয়ে আনেন এবং ডান ও বাম পার্শ্বকে ঠিক যুদ্ধ পূর্বের অবস্থার ন্যায় প্রস্তুত রাখেন। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পরও তিনি পার্শ্ব বাহিনীকে প্রত্যাহার করেননি। তাছাড়া তিনি তাঁর রিজার্ভ বাহিনীটিকে তলব করে নিজের কমান্ডে নিয়ে নেন।
দুশমনের মালপত্র এবং পশুপাল ইত্যাদির ব্যাপারে সুলতানের নির্দেশ কী?- এক সালার সুলতান আইউবীকে জিজ্ঞেস করেন- যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের জয়ী করেছেন।
না, আমি এখনো এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হইনি- সুলতান আইউবী বললেন- যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আমার পাঠ এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যেও না। সবে আমরা দুশমনের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করেছি মাত্র। আমাদের কোনো ইউনিট তাদের পার্শ্ব বাহিনীর উপর হামলা করেছে কি না, করেনি। আমার সন্দেহ, উভয়টি না হলেও তাদের এক পার্শ্ব নিরাপদ আছে। তারা তিনটি ফৌজের যৌথ বাহিনী ছিলো। তাদের সালার ঈমান বিক্রেতা হতে পারে; কিন্তু এমন আনাড়ী নয় যে, তার যেসব ইউনিট যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তাদেরকে জবাবী হামলার জন্য ব্যবহার করবে না। তার রিজার্ভ বাহিনীও অক্ষত এবং প্রস্তুত আছে।
তাদের কেন্দ্র খতম হয়ে গেছে মাননীয় সুলতান! সালার বললেন তাদেরকে নির্দেশ দেয়ার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই।
না থাকুক, খৃস্টানদের ভয় তো উড়িয়ে দেয়া যায় না- সুলতান বললেন যদিও আমার কাছে এই তথ্য নেই যে, খৃস্টানরা কাছে-ধারে কোথায় অবস্থান করছে। কিন্তু এই অঞ্চলটা পাহাড়ী। এখানে টিলাও আছে, বিস্তৃত সমতল ভূমিও আছে। কোথাও ঝোঁপ-জঙ্গলও আছে। কিছু এলাকা বালুকাময়। চোখে বেশী দূর পর্যন্ত দেখা যায় না। শত্রু আর সাপের উপর কখনো আস্থা রাখা উচিত নয়। ওরা মৃত্যুর সময়ও, ছোবল মেরে যায়। সাইফুদ্দীনের সালার মুজাফফর উদ্দীনের কোনো সংবাদ আমার জানা নেই। তোমরা জানো, মুজাফফর উদ্দীন সহজে পালাবার মতো মানুষ নয়। আমি তার অপেক্ষায় আছি। তোমরা চোখ খোলা রাখে। বাহিনীগুলোকে একত্রিত করো। মুজাফফর উদ্দীন যদি আমার প্রশিক্ষণ মা ভুলে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে সে আমার উপর পাল্টা আক্রমণ চালাবে।
***
সুলতান আইউবীর আশংকা ভিত্তিহীন ছিলো না। প্রিয় পাঠক! হামাত যুদ্ধে সাইফুদ্দীনের জনৈক সালার মুজাফফর উদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীনের আলোচনা পড়েছেন। মুজাফফর উদ্দীন এক সময় আইউবী বাহিনীর সালার ছিলেন এবং আইউবীর কেন্দ্রীয় পটভূমিকে সামনে রেখে সুলতান আইউবী যুদ্ধের পরিকল্পনা ঠিক করেন এবং কিভাবে রণাঙ্গনে তাতে রদবদল করেন। মুজাফফর উদ্দীন একে তো জন্মগত যোদ্ধা। অপরদিকে প্রশিক্ষণ অর্জন করেছেন সুলতান আইউবীর নিকট থেকে। সব মিলিয়ে তিনি রণাঙ্গন থেকে পিছপা হওয়ার মতো লোক নন।
মুজাফফর উদ্দীন ছিলেন সাইফুদ্দীনের নিকটাত্মীয় (খুব সম্ভব চাচাতো ভাই)। সুলতান আইউবী যখন মিশর থেকে দামেস্ক আগমন করেন এবং মুসলিম আমীরগণ তার বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান, তখন মুজাফফর উদ্দীন সুলতানকে কিছুই না বলে তার ফৌজ থেকে বের হয়ে শত্রু শিবিরে চলে যান।
তুর্কমানের এই যুদ্ধের আগে হামাত যুদ্ধে মুজাফফর উদ্দীন সুলতান আইউবীর পার্শ্বের উপর এমন তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, যার মোকাবেলার জন্য সুলতান আইউবী পার্শ্ব বাহিনীর নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের মতে, সেদিন যদি সুলতান আইউবী নিজে সেনাপতিত্ব না করতেন, তাহলে মুজাফফর উদ্দীন যুদ্ধের গতি পাল্টে দিতেন। সুলতান আইউবী মুজাফফর উদ্দীনকে যুদ্ধবিদ্যার ওস্তাদ বলে স্বীকার করতেন। এবার তুর্কমানের গুপ্তচররা তাকে সম্মিলিত শক্ৰবাহিনী সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রদান করেছে, তার মধ্যে একটি হলো, মুজাফফর উদ্দীনও এই বাহিনীতে আছেন। কিন্তু তিনি বাহিনীর কোন্ অংশের সঙ্গে আছেন, তা জানা যায়নি। সুলতান কয়েকজন যুদ্ধবন্দীকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু তারা মুজাফফর উদ্দীনকে বাহিনীতে উপস্থিত থাকার বিষয়টা সত্যায়ন করলেও কেউ বলতে পারেনি তিনি বাহিনীর কোন্ অংশে আছেন।
হতে পারে বন্দীরা জানা সত্ত্বেও বিষয়টা গোপন রেখেছে- সুলতান আইউবী তার সালারদের বললেন- মুজাফফর উদ্দীন যুদ্ধ না করে ফিরে যাবে আমি বিশ্বাস করি না। সে আমার শিষ্য। আমি তার যোগ্যতা জানি। জানি তার স্বভাব-চরিত্রও। সে হামলা করবে। পরাজয় নিশ্চিত জানলেও করবে। তবে আমি চাই সে হামলা করুক। অন্যথায় আমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে না।
সালাহুদ্দীন আইউবী যেনো বলতে না পারে, মুজাফফর উদ্দীনও পালিয়ে গেছে- সাইফুদ্দীনের সালার মুজাফফর উদ্দীনের কণ্ঠ। তুকমান থেকে দুআড়াই মাইল দূরে ধ্বনিত হচ্ছিলো- আমি যুদ্ধ না করে ফিরে যাবো না।
সুলতান আইউবী যে সময়টায় সাইফুদ্দীনের প্রাসাদোপম বিশ্রামাগারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঠিক সে সময় সাইফুদ্দীনের নিকট সংবাদ পৌঁছে সালাহুদ্দীন আইউবী কিভাবে যেনো আগেই জেনে ফেলেছেন, তার উপর হামলা আসছে। সে কারণেই আমরা তার ফাঁদে আটকা পড়েছি। এখন এখানে যুদ্ধ করা অনর্থক। ভালোয় ভালো আপনারাও ফিরে যান এবং কোনো একটি উপযুক্ত স্থানে যুদ্ধ করানোর জন্য বাহিনীগুলোকে পেছনে সরিয়ে নিন।
আপনার যে কোনো আদেশ-নিষেধ মান্য করতে আমাদের কোন আপত্তি নেই- মুজাফফর উদ্দীনের এক নায়েব সালার বললো- কিন্তু যেখানে আমাদের বিপুলসংখ্যক সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছে, অনেকে পালিয়ে গেছে, এমতাবস্থায় এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা পাল্টা আক্রমণ করা আমার নিকট যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না।
আমার কাছে এখনো যে পরিমাণ সৈন্য আছে, আমি তাদেরকে অপর্যাপ্ত মনে করি না- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- আমরা যে বাহিনী নিয়ে এসেছি, এরা তার চার ভাগের এক ভাগ। সুলতান আইউবী এর চেয়েও স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা যুদ্ধ করেন এবং সফল হয়ে থাকেন। আমি তার পার্শ্বের উপর হামলা করবো। এবার আমি তাকে সেই চাল চালতে দেবো না, যেটি তিনি হামাত-এ চেলেছিলেন। তোমরা সবাই আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকো।
মসুলের শাসনকর্তা মহামান্য গাজী সাইফুদ্দীন তিনটি ফৌজের এতো বিপুল সৈন্য সত্ত্বেও হেরে গেছেন- নায়েব সালার বললো- আমি আবারো বলবো, এই সামান্য সৈন্য দ্বারা আক্রমণ করা আর তাদেরকে মৃত্যুর হাতে তুলে দেয়া এক কথা।
যারা যুদ্ধের ময়দানে হেরেমের নারী আর মদের মটকা সঙ্গে রাখে, তাদের কাছে তিন নয়, দশটি বাহিনী থাকলেও সেই পরিণতিই বরণ করতে হবে, যা আমাদের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনের ভাগ্যে জুটেছে- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- আমি মদপান করি। কিন্তু এখানে যদি এক গ্লাস পানিও না জোটে, তবু পরোয়া করবো না। সুলতান আইউবী আমাকে ঈমান নীলামকারী ও বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করে থাকেন। আমি তাকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়বো না। আমার এই লড়াই হবে দুই সেনাপতির লড়াই। এই যুদ্ধ হবে দুই বীরের যুদ্ধ। এটি হবে দুই অসিবিদের সংঘাত। তোমরা তোমাদের নিজ নিজ বাহিনীকে প্রস্তুত করো। মনে রাখতে হবে, সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দারা মাটির তলেও দেখতে পায়। তোমাদের ইউনিটগুলোকে আজ রাতে আরো গোপনে নিয়ে যাবে এবং চারদিকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত গুপ্তচর ছড়িয়ে দেবে। তারা সন্দেহজনক অবস্থায় কাউকে পেলে ধরে নিয়ে আসবে।
মুজাফফর উদ্দীন তার সৈন্যদের লুকিয়ে রাখার জন্য একটি স্থান ঠিক করে নেন। আক্রমণের জন্য তিনি কোনো দিন বা সময় নির্ধারন করেননি। তিনি তার নায়েব সালারদের বললেন- সালাহুদ্দীন আইউবী শিয়ালের ন্যায় ধূর্ত এবং খরগোসের ন্যায় গতিশীল। আমি গুপ্তচর মারফত জানতে পেরেছি, তিনি এখনো মালে গনীমত সগ্রহ করেননি। তার অর্থ হলো, তিনি সম্মুখে অগ্রসর হবেন না এবং আমাদের জবাবী হামলার আংশকা করছেন। আমি তাকে ভালোভাবেই জানি যে, তিনি কোন্ ধারায় চিন্তা করে থাকেন। আমি তাকে ধোকা দেবো যে, আমরা সবাই পালিয়ে গেছি এবং এখন আর আক্রমণের কোনো ভয় নেই। এটি হবে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার লড়াই। আমি প্রমাণ করবো, কার বিচক্ষণতা বেশি- আইউবীর না আমার। আইউবী দুদিনের বেশি অপেক্ষা করবে না। তার মতো আমিও তার গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য আমার গুপ্তচরদের ব্যবহার করবো। যখনই তিনি গনীমত সগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং তার দৃষ্টি ডান-বাম থেকে সরে যাবে, আমরা তার পার্শ্বের উপর আক্রমণ চালাবো।
সুলতান আইউবী এই শংকাই অনুভব করছিলেন।
***
সুলতান আইউবী তাঁর কিছুসংখ্যক সৈন্যকে সাইফুদ্দীন বাহিনীর ডান-বাম থেকে সরিয়ে পেছনে প্রেরণ করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি কমান্ডোসেনাও রওনা করিয়েছিলেন। এরা তাঁর সেই কমান্ডো ফোর্স, যার প্রত্যেক কমান্ডার ও প্রত্যেক সৈনিক অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দুঃসাহসী। এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচরও। এই ফোর্স চার থেকে বারজন করে এক একটি দলে বিভক্ত হয়ে দুশমনের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছিলো। তন্মধ্যে একটি দলের সদস্য সংখ্যা ছিলো বারজন, যার মাত্র তিনজন সৈনিক আর তার কমান্ডার আন-নাসের জীবিত আছে।
আন-নাসর তার দলের সঙ্গে তুর্কর্মানের রণাঙ্গনে থেকেই সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত বাহিনীর পেছনে চলে গিয়েছিলেন। তার টার্গেট হতো সাধারণত দুশমনের রসদ। এবারও তিনি তার কমান্ডোদের ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যান। তার সঙ্গে আছে সলিতাওয়ালা তীর। সামান্য দাহ্য পদার্থ, বর্শা, তরবারী ও খঞ্জর। শত্রুর রসদ এখান থেকে অনেক দূরে। আন-নাসেরের জন্য একটি বিশেষ সুবিধা হলো, এই ভুখণ্ডটি না উন্মুক্ত ময়দান, না বালুকাময় প্রান্তর। বরং জায়গাটি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পার্বত্য ও টিলাময়, যার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সহজ। দিনের বেলা লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি ঘোড়া লুকিয়ে রাখা যায়। সম্মিলিত বাহিনীর রসদ- যাতে সৈন্যদের খাদ্যদ্রব্য ও পশুপালের জন্য শুকনা ঘাস, দানাদার খাদ্য ইত্যাদি রয়েছে- পিছনে আসছে। এই মালপত্রে তীর-ধনুক-বর্শাও আছে। আন-নাসের প্রথম রাতেই শত্রু বাহিনীর এই রসদের উপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিপুল পরিমাণ রসদ অগ্নিতীরে ভষ্ম হয়ে গেছে।
আন-নাসের কমান্ডোদেরসহ দিনের বেলা এক স্থানে লুকিয়ে থাকে। সে দেখতে পায়, শত্রুবাহিনী খানা-খন্দক ও টিলার আড়ালে তাদের অনুসন্ধান করছে। সে-তার কমান্ডোদেরকে এদিক-ওদিক উপযুক্ত উঁচু স্থানে বসিয়ে রাখে। তারা ধনুকে তীর সংযোজন করে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। শত্রুসেনারা দূর থেকেই ফেরত চলে যায়। সূর্যাস্তের পর সে চুপি চুপি রসদ বহরের উপর দৃষ্টি রাখে।
কাফেলা একস্থানে ছাউনি ফেলে। কিন্তু এ রাত আক্রমণ করা সহজ মনে হলো না। দুশমন চারদিকে কঠোর টহল প্রহরার ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই প্রহরায় পদাতিকও আছে, অশ্বারোহীও আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন-নাসের হামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। দুশমনের এখনো বহু রসদ অক্ষত আছে। কমান্ডো হামলার মাধ্যমে রসদ ধ্বংস একটি বিশেষ কৌশল। এ কাজের জন্য তিনি এমন বাহিনী গঠন করে রেখেছেন, যারা চেতনার দিক থেকে উন্মাদ ও উগ্র প্রকৃতির। তাদের বীরত্ব অস্বাভাবিক ও বুদ্ধিমত্ত্বা ঈর্ষণীয়। এই জানবাজদের সততা ও ঈমানী চেতনার অবস্থা হলো, তারা এতো দূরে গিয়েও দায়িত্ব পালনে জানবাজির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকে। যেখানে তাদের খোঁজ নেয়ার মতো কেউ থাকে না।
আন-নাসের দিনের বেলা যেখানে লুকিয়ে ছিলো, রাতে সেখানেই ঘোড়াগুলো বেঁধে রাখে। তারপর পায়ে হেঁটে দলের সদস্যদের নিয়ে এক স্থান দিয়ে দুশমনের রসদ বহরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। মালপত্রের স্তূপ দাহ্য পদার্থ ফেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দলের সদস্যদের এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দেয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। শত্রুসেনারা ছুটোছুটি করতে ও করে। আন-নাসেরের কমান্ডোরা ছুটন্ত ও পলায়নপর শত্রুসেনাদের উপর তীরবৃষ্টি শুরু করে দেয়। শত্রুসেনারা তাদের সন্ধান করতে শুরু করে। সফল অপারেশনের পর তাদের পক্ষে বেশি সময় লুকিয়ে হামলা করা সম্ভব হল না। তারা এক একজন করে ধরা পড়তে ও শহীদ হতে শুরু করে। যে তিনজন কমান্ডো আন-নাসেরের সঙ্গে ছিলো, শুধু তারাই বেঁচে থাকে। তা। ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে। রসদের সঙ্গে যেসব পাহারাদার ছিলো, তার তাদেরকে ঘেরাও করে ধরার চেষ্টা করে। আন-নাসের তার এই তিন সঙ্গীকে তার থেকে আলাদা হতে দেয়নি। তারা ধীরে ধীরে কৌশলে আলো থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে ঘোরাফেরা ও তাবুর আড়ালে লুকিয়ে শত্রুসেনাদে চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
আন-নাসের আকশের দিকে তাকায়। আকাশে কোনো তারকা নেই। কমান্ডোসেনাদের তারকা দেখে দিক নির্ণয় করার প্রশিক্ষণ থাকে। কিন্তু আজকের আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে। আন-নাসের শত্রু বাহিনীর রসদে অবস্থান থেকে অনেক দূর চলে এসেছে। তবে এখনো দুশমনের প্রজ্বলমান রসদ ও আসবাবপত্রের আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। তার অপর ৯ সৈনিক বেঁচে আছে নাকি শহীদ হয়েছে, তা সে জানে না। সে মনে মনে তাদের নিরাপত্তার জন্য দুআ করে তিন সঙ্গীকে নিয়ে যে জায়গায় দলের ঘোড়াগুলো বাঁধা আছে, অনুমান করে সেদিকে এগিয়ে চলে। তারা রাতভর হাঁটতে থাকে। দুশমনের রসদের অগ্নিশিখা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
পথ হারিয়ে ফেলেছে আন-নাসের। তারা যে পথে হাঁটছে, এটি তাদের গন্তব্যের পথ নয়। হাঁটছে দিক-নির্দেশনাহীন। এখন তারা যে মাটিতে হাঁটতে তার প্রকৃতি অন্য রকম। তারা যে পথে এসেছিলো, তাতে কোন গাছ-গাছা ছিলো না। পায়ের নীচে শক্ত মাটির পরিবর্তে বালি অনুভূত হচ্ছে। পানি। খাদ্যদ্রব্য তাদের ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা। আন-নাসের পিপাসা অনুভব করে। শরীর ক্লান্ত। তার সঙ্গীরাও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছে। চলার গতি বী হয়ে আসছে তাদের। আন-নাসের সেখানেই যাত্রাবিরতি দিয়ে বিশ্রাম নেয়। ইচ্ছা ব্যক্ত করে। তার সঙ্গীরা এই আশায় এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়, হয়তো সামনে কোথাও পানি পাওয়া যাবে। তারা আরো কিছুক্ষণ হাঁটে এ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে।
***
আন-নাসের চোখ খুলে দেখতে পায়, তার সঙ্গী তিন সৈনিক অচেতন ঘুমিয়ে আছে। সূর্যটা উদায়স্থল ত্যাগ করে উপরে উঠে এসেছে। সে চারদিকে তাকায়। অনুভব করে- সে বালির সমুদ্র মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভেঙ্গে পড়ে আন-নাসেরের। লোকটার লালন-পালন, বড় হওয়া, যুদ্ধ করা সবই মরু অঞ্চলে হয়েছে। বালির সমুদ্রকে ভয় পাওয়ার মতো লোক নয় সে। তার ভয় পাওয়ার কারণ হলো- তার ধারণা ছিলো না, এখানে মরুদ্যান আছে। আরো একটি কারণ হলো, যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় পানির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পিপাসায় কণ্ঠনালীতে জ্বালা অনুভব করছে, আন-নাসেরের। সঙ্গীদের অবস্থাও আন্দাজ হচ্ছে তার। এখান থেকে তুর্কমান কোন্দিক হতে পারে সূর্য দেখে তা ঠিক করে সেদিকে তাকায়। পর্বতমালার বাঁকা একটা রেখা দেখতে পায়। কিন্তু সোজা সেদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, পথে দুশমনের ফৌজ রয়েছে।
আন-নাসের তার সঙ্গীদের জাগায়। জাগ্রত হয়ে তারা উঠে বসে। চেহারায় ভীতির ছাপ।
প্রয়োজন হলে আমরা আরো দুদিন না খেয়ে থাকতে পারবো- আন নাসের তার সঙ্গীদের বললো- আর এই দুদিনে গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলেও পানি পর্যন্ত অবশ্যই পৌঁছে যাবো।
তিন সৈনিক যার যার অভিমত ব্যক্ত করে। কিন্তু তারা চলে এসেছে বহু দূর। সঙ্গে ঘোড়া থাকলে অনেকটা সহজ হতো। নিদ্রা তাদের পরিশ্রান্ত দেহকে কিছুটা সজীবতা দান করেছে।
সঙ্গীগণ- আন-নাসের বললো- মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করেছেন, তাকে মাথা পেতে বরণ করে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
এখানে বসে থাকা তো কোনো প্রতিকার নয়- এক সঙ্গী বললো- সূর্য মাথার উপর এসে পোড়াতে শুরু করার আগে আগেই রওনা হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদেরকে পথের দিশা দান করবেন।
স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে দিক নির্ণয় করে তারা হাঁটতে শুরু করে। সূর্য মাথার উপর উঠে আসছে। পায়ের নীচের বালি উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। সামান্য দূরের বালিগুলোকে মরিচিৎকার ন্যায় পানি বলে মনে হচ্ছে। আন-নাসেরও তার সঙ্গীরা মরুভূমির নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে অবহিত এবং অভ্যন্তও। তাদের মরিচিকাও চোখে পড়তে শুরু করে। কিন্তু মরুভূমির এই প্রতারণা সম্পর্কে অবগত থাকার সুবাদে তারা প্রতিটি মরিচিকাকে উপেক্ষা করে সম্মুখে এগিয়ে চলছে।
বন্ধুগণ!- আন-নাসের বললো- আমরা ডাকাত নই, আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দেবেন না। এই অবস্থায় যদি আমাদের মৃত্যু হয় তা হবে শাহাদাত। আল্লাহকে স্মরণ করে হাঁটতে থাকো।
যদি এমন কোন পথিক পেয়ে যাই, যার সঙ্গে পানি আছে, তাহলে ডাকাতি করতে পরোয়া করবো না। এক সৈনিক বললো।
সবাই হেসে ওঠে। তবে এই হাসির জন্য তাদেরকে শক্তি ব্যয় করতে হয়েছে।
সূর্য তাদের মাথার উপর উঠে এসেছে। উপর থেকে সূর্য আর নীচ থেকে উত্তপ্ত বালি তাদেরকে পোড়াতে শুরু করে। আন-নাসের গুন গুন করে একটি জিহাদী গান গাইতে শুরু করে। গান গাওয়া শেষ হলে সে ভিন্ন এক সুরেলা কণ্ঠে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদর রাসুলুল্লাহ জপতে শুরু করে। হাল্কা বেগে বাতাস বইছে। চিকচিকে বালিকণা তাদের পদচিহ্নগুলো মুছে দিচ্ছে।
এবার সূর্যটা পশ্চিমাকাশের দিকে নামতে শুরু করেছে। চারজন আদম সন্তানের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে চলছে। পা ভারি হয়ে যাচ্ছে। হাঁটার গতি কমে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। আদ্রতার অভাবে হা করা মুখ বন্ধ হচ্ছে না। একজনের জবান বন্ধ হয়ে গেছে; এখন আর সে কথা বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর আরো একজন নীরব হয়ে যায়। আন-নাসের ও তার তৃতীয় সঙ্গী এখনো অস্ফুট স্বরে আল্লাহর নাম জপ করছে। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তৃতীয় সঙ্গীর কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যায়।
সঙ্গীগণ!- আন-নাসের দেহের অবশিষ্ট শক্তি ব্যয় করে বললো- হিম্মত হারাবে না। আমরা ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান। ঈমানের শক্তিতেই আমরা বেঁচে থাকবো।
আন-নাসের একজন একজন করে সঙ্গীদের চেহারার প্রতি তাকায়। কারো চেহারায় যেনো রক্ত নেই। সকলের চোখ কোঠরে ঢুকে গেছে।
সূর্য ডুবে গেছে। আঁধারে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি। পদতলের উত্তপ্ত বালি ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আন-নাসের সঙ্গীদের থামতে দেয়নি। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পথ চলা সহজ হয়। সাধারণ পথচারী হলে লোকগুলো বহু আগেই হারিয়ে যেতো। এরা সৈনিক এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো। সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের দেহ বেশী কষ্ট-সহিষ্ণু। আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আন-নাসের সঙ্গীদের যাত্রা বিরতি দিয়ে শুয়ে পড়তে বললো।
***
আন-নাসের শেষ রাতে জাগ্রত হয়। আকাশ পরিষ্কার। তারকা দেখে অনুমান করে রাত পোহাতে আর কত দেরি। একটি তারকা দেখে দিক নির্ণয় করে সঙ্গীদের জাগিয়ে তোলে। তাদের নিয়ে রওনা হয়। তাদের হাঁটার গতি ভালো। তবে পিপাসার কারণে মুখ দিয়ে কথা সরছে না।
এই মরুভূমি এতো বেশি বিস্তীর্ণ নয়- আন-নাসের বড় কষ্টে বললো আজই শেষ হয়ে যাবে। আমরা আজই পানি পর্যন্ত পৌঁছে যাবো।
সম্মুখে পানি পাওয়া যাবে এই আশায় তারা এগুতে থাকে। রাত পোহায়ে ভোর হলো। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদিত হলো। মাইল দশেক দূরে কতগুলো খুটি ও মিনার চোখে পড়ে। এগুলো মাটির টিলা ও পর্বতের চূড়া। দূর থেকে খুঁটি আর মিনারের মতো দেখা যাচ্ছে। একটি গাছও চোখে পড়ছে না। পায়ের তলার মাটি এখন ফেটে চৌচির। মনে হচ্ছে, কয়েক শত বছর ধরে এই মাটি পানির ছোঁয়া পায়নি। শত শত বছরের পিপাসাকাতর মাটি মানুষের রক্ত পেলে পান করতে কুণ্ঠিত হবে না।
আন-নাসের তার সঙ্গীদের চেহারা পর্যবেক্ষণ করে। এক সঙ্গীর জিহ্বা কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। লক্ষণটা ভয়ানক। মরু সাহারা ট্যাক্স উসুল করতে শুরু করেছে। অপর দুই সঙ্গীর বাহ্যিক অবস্থা অতোটা সঙ্গীন না হলেও স্পষ্ট যে, দশ মাইল পথ অতিক্রম করে মিনারসদৃশ টিলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আন-নাসের দলের কমান্ডার। দায়িত্ববোধের কারণেই তার হুশ-জ্ঞান এখানো ঠিক আছে। তার শারিরিক অবস্থা সঙ্গীদের চেয়ে ভালো নয়। সে কথা দ্বারা সঙ্গীদের সাহস বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ধীরে ধীরে সূর্য উপরে উঠছে আর মাটির উত্তাপ বাড়ছে। আন-নাসের ও তার সঙ্গীগণ পা তুলে হাঁটতে পারছে না। তারা পা হেঁচড়িয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। যে সিপাহীর জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিলো, তার বর্শাটা হাত থেকে পড়ে যায়। তারপর সে কোমরবন্ধ থেকে তরবারীটাও খুলে ফেলে দেয়। নিজের অজ্ঞাতে এসব আচরণ করে সে। তার হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কাজ করে যাচ্ছে। এটি মরুভূমির একটি নির্দয় ক্রিয়া যে, মানুষ যেমন ঘুমের ঘোরে অজ্ঞাতে নানা আচরণ করে থাকে, তেমনি পথভোলা পিপাসার্ত পথিকও নিজের অজান্তে দেহের বোঝা ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করে। সে কোথাও থামে না। লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে আর এক এক করে নিজের সহায়-সম্বল ও পাথেয় ফেলে দিতে থাকে। মরু মুসাফিররা যখন স্থানে স্থানে এরূপ বস্তু পড়ে থাকতে দেখে, তখন তারা বুঝে ফেলে, আশ-পাশে কোথাও কোন হতভাগা আদম সন্তানের লাশ পড়ে আছে।
মরুভূমি আন-নাসেরের এক সঙ্গীকে এমনি এক অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। আন-নাসের তার বর্শা ও তারৰারীটা তুলে নিয়ে তাকে স্নেহমাখা কণ্ঠে বললো- এতো তাড়াতাড়ি পরাজয় মেনে নিও না বন্ধু। আল্লাহর সৈনিকরা জীবনদান করে, অন্ত্রত্যাগ করে না। তুমি তোমার মর্যাদাকে বালির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলো না।
সঙ্গী অসহায় দৃষ্টিতে আন-নাসেরের প্রতি তাকায়। আন-নাসের তার প্রতি তাকিয়ে থাকে। সিপাহী হঠাৎ খিল খিল করে হেসে ওঠে সামনের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে ইশারা করে। তারপর নিজের দেহের অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি ব্যয় করে চিৎকার করে ওঠে- পানি… ঐ দেখ… বাতাস… পানি পেয়ে গেছি। লোকটি সামনের দিকে দৌড় দেয়।
সেখানে পানি ছিলো না, না মরিচিকা। তুমি এমন যে, এরূপ ভূমিতে মরিচিকা দেখা যায় না। মরিচিকা সৃষ্টি হয় বালির চমক থেকে। লোকটির উপর সাহারার দ্বিতীয় নিষ্ঠুর আচরণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। সে দেখতে পায়, তার সম্মুখে পানির ঝিল, বাগ-বাগিচা ও অসংখ্য প্রাসাদ। আসলে কিছুই নেই। একজন অসহায় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিমর্ম উপহাস। সে আরো দেখতে পায়, মাইল দুয়েক দূরে একটি শহর। দলে দলে মানুষ চলাচল করছে। গায়িকা-নর্তকীরা গাইছে-নাচছে।
জনমানবহীন এই নিষ্ঠুর মরুভূমি আন-নাসেরের এই সঙ্গীকে ধোকা দিতে শুরু করে। মরু সাহারা লোকটির জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে। তবে এটা সাহারার দয়াও হতে পারে যে, একজন পথিকের জীবন হরণ করার আগে তাকে সুদর্শন ও চিত্তহারী কল্পনায় ব্যস্ত করে দেয়, যাতে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভূত না হয়।
আন-নাসেরের সঙ্গী দৌড় দেয়। যে লোকটি এততক্ষণ পা হেঁচড়ির পথ চলচিলো, সে কিনা সুস্থ-সবল মানুষের ন্যায় দৌড়াচ্ছে। কিন্তু এই দৌড় সেই প্রদীপের ন্যায়, যা নির্বাপিত হওয়ার আগে দপ করে ওঠে। আন-নাসের তার পেছন পেছন ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তার অপর দুই সঙ্গীর দম এখনো কিছুটা অবশিষ্ট আছে। তারাও দৌড়ে গিয়ে সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সিপাহী সঙ্গীদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করছে এবং চিৎকার করছে। আমাকে ঝিলের কাছে যেতে দাও। ঐ দেখ, কতো হরিণ ঝিল থেকে পানি পান করছে।
সঙ্গীরা তাকে ধরে রাখে। সে ধীরে ধীরে পা টেনে টেনে এগিয়ে চলে। আন-নাসের তার মুখমণ্ডলের উপর একখানা কাপড় রেখে দেয়, যেনো সে কিছু দেখতে না পায়।
***
সূর্যটা ঠিক মাথার উপর উঠে এসেছে। এবার আরো এক সিপাহী উচ্চস্বরে বলে ওঠে- বাগিচায় নর্তকীরা নাচছে। চলো, নাচ দেখি, রূপ দেখি। চলো, বন্ধুগণ! ওখানে পানি পাওয়া যাবে। মানুষ আহার করছে। আমি তাদেরকে চিনি। চলল… চলো…। বলেই সিপাহী দৌড়াতে শুরু করে।
যে সিপাহী প্রথমে অলীক দৃশ্য অবলোকন করেছিলো, সে বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত নীরব থাকে। সে কারণে সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিলে। এখন এক সঙ্গীকে দৌড়াতে দেখে সেও তার পেছন পেছন ছুটছে এবং চিৎকার করতে শুরু করে- নর্তকীটা অত্যন্ত রূপসী। আমি তাকে কায়রোতে দেখেছি। সেও আমাকে চিনে। আমি তার সঙ্গে খাবো। তার সঙ্গে শরবত পান করবো।
আন-নাসেরের মাথাটা হেলে পড়েছে। মরুভূমির কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি তার ছিলো। কিন্তু সঙ্গীদের এই পরিণতি ও দুর্দশা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা তার সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিজের শারীরিক অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। এখন তার একজন মাত্র সঙ্গীর মস্তিষ্ক ঠিক আছে। দৈহিক শক্তি তারও শেষ হয়ে গেছে।
যে দুসঙ্গী কল্পনার বাগিচা ও নাচ-গানের পেছনে ছুটে চলছিলো, কয়েক পা এগিয়ে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পড়ারই কথা। দেহে তাদের আছেই বা কী। আন-নাসের ও সঙ্গী তাদেরকে বসিয়ে ধরে রাখে এবং গায়ের উপর কাপড় দিয়ে ছায়া দান করে। তাদের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। মাথা হেলে পড়েছে।
তোমরা আল্লাহর সৈনিক- আন-নাসের ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে শুরু করে– তোমরা প্রথম কেবলা ও কাবা গৃহের প্রহরী। তোমরা ইসলামের দুশমনের কোমর ভেঙ্গেছে। কাফিররা তোমাদের ভয়ে ভীত ও কম্পিত। তোমরা মরণজয়ী মর্দে মুমিন। এই মরুভূমি, পিপাসা ও সূর্যের উত্তাপকে তোমরা কী মনে করছো? তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। জান্নাতের ফেরেশতারা তোমাদের পাহারা দিচ্ছে। তোমাদের দেহ পিপাসার্ত হলেও আত্মা পিপাসার্ত নয়। ঈমানদাররা পানির শীতলতায় নয়- ঈমানের শতীলতায় জীবিত থাকে।
উভয়ে এক সঙ্গে চোখ খুলে আন-নাসেরের প্রতি তাকায়। আন-নাসের হাসবার চেষ্টা করে। আবেগের আতিশয্যে সে যে বক্তব্য প্রদান করে, তা ক্রিয়া করে বসেছে। উভয় সিপাহী কল্পনার জগত থেকে বাস্তব জগতে ফিরে আসে। তারা উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে।
সকালে রওনা হওয়ার সময় তারা টিলা-পর্বতের যে খুঁটি ও মিনার দেখেছিলো, সেগুলো নিকটে এসে গেছে। এখন সেগুলো তখনকার তুলনায় অনেক বড় দেখাচ্ছে। ওখানে পানি থাকতে পারে আশা করা যায়। থাকতে পারে সমতল ভূমি ও খানা-খন্দক। আন-নাসের তার সঙ্গীদের বললো, আমরা পানির নিকটে এসে পড়েছি এবং আজ সন্ধ্যার আগেই পানি পেয়ে যাবো। তারা টিলা-পর্বতের আরো নিকটে পৌঁছে যায়। হঠাৎ এক সিপাহী চিৎকার করে ওঠে- আমি আমার গ্রামে এসে পড়েছি। আমি গিয়ে সকলের জন্য খাবার রান্না করি। আমার গ্রামের মেয়েরা কূপ থেকে পানি তুলছে। বলেই সে দৌড়াতে শুরু করে।
তার পেছনে অপর সিপাহীও দৌড়াতে শুরু করে। হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে মুঠি করে মাটি ও বালি তুলে মুখে পুরে।
আন-নাসের ও তার তৃতীয় সঙ্গী দৌড়ে গিয়ে তার মুখ থেকে মাটিগুলো বের করে ফেলে। মুখটা পরিস্কার করে তুলে দাঁড় করায়। কিন্তু তার হাঁটার শক্তি নেই। অপর সিপাহীও পড়ে যায় এবং উপুড় হয়ে পড়ে থেকে বলতে থাকেকূপ থেকে পানি পান করে নাও। আমি তোমাদের জন্য খাবার রান্না করবো।
আন-নাসের দুআর জন্য দুহাত একত্রিত করে আকাশপানে তুলে ধরে বলতে শুরু করে
মহান আল্লাহ! আমরা তোমার নামে লড়তে ও মরতে এসেছিলাম। আমর কোনো পাপ করিনি। আমরা দস্যু-তস্করও নই। কাফিরদের সঙ্গে লড়াই করা যদি পাপের কাজ হয়ে থাকে, তাহলে তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। হে মহান আল্লাহ! আমার জীবনটা তুমি নিয়ে নাও। আমার দেহের রক্তকে পানি বানিয়ে দাও। সে পানি পান করে আমার সঙ্গীরা বেঁচে থাকুক। তারা তো। রাসূলের প্রথম কেবলা জবর-দখলকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমার রক্তকে পানি বানিয়ে তুমি তাদের পান করাও।
আন-নাসেরের সঙ্গীরা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং অন্ধের ন্যায় হাত আগে বাড়িয়ে দিয়ে এমনভাবে হাঁটতে শুরু করে, যেনো তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আন-নাসের ও তার চেতনাসম্পন্ন সঙ্গীদের হাঁটতে দেখে তারাও উঠে পা টেনে টেনে এগুতে শুরু করে। হঠাৎ আন-নাসেরের চোখও ঝাপসা হয়ে আসে। অন্যদের ন্যায় সেও সবুজ-শ্যামলিমা দেখতে শুরু করে। আন নাসের বুঝে ফেলে, মরুভূমি তাকেও ধোঁকা দিতে শুরু করেছে।
***
আন-নাসের অনেকগুলো টিলার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। এই টিলাগুলো বেশ চওড়া। কোনটিই তেমন উঁচু নয়। কোথাও বালুকাময় প্রান্তরও চোখে পড়ছে।
আন-নাসের সামনে এবং তার সঙ্গী পেছনে পেছনে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে আন-নাসের হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। তারা দূর থেকে যে খুঁটি ও মিনার দেখেছিলো, সেগুলো এখন সরাসরি তার চোখের সামনে। এক স্থানে দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। তারই সন্নিকটে দুটি মেয়ে বসে আছে। তারা উঠে দাঁড়ায়। মেয়েগুলোর বর্ণ গৌর এবং দেহের রূপ-কাঠামো আকর্ষণীয়।
আন-নাসের খানিক দূরে দাঁড়িয়ে গিয়ে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করে- তোমরা কিদুটি ঘোড়া আর দুটি মেয়ে দেখতে পাচ্ছে?
তার যে দুই সঙ্গী অলীক কল্পনার শিকার হয়েছিলো, তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। একজন বললো- না, কিছু তো দেখা যাচ্ছে না।
আন-নাসেরের যে সঙ্গীর মানসিক অবস্থা এখনো ঠিক আছে, সে অস্কুট স্বরে ললো- হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি।
আল্লাহ আমাদের দয়া করুন- আন-নাসের বললো- আমাদের দুজনেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরাও অবাস্তব বস্তু দেখতে শুরু করেছি। জাহান্নামসম এই বিরানভূমিতে এমন রূপসী নারী আসতে পারে না।
তাদের পোশাক-আশাক যদি মরু যাযাবরদের ন্যায় হতো, তাহলে বুঝতাম, এটা কল্পনা নয়, বাস্তব- আন-নাসেরের সঙ্গী বললো- চলো, সামনে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে পড়ি। ওরা মেয়ে নয়। এটা আমাদের মানসিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু আমার হুশ-জ্ঞান ঠিক আছে- আন-নাসের বললো- আমি তোমাকে চিনতে পারছি। তুমি যা যা বলেছে, আমি বুঝে ফেলেছি। আমার মস্তিষ্ক এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে।
আমারও হুঁশ আছে- সঙ্গী বঁললো- আমরা কি সত্যিই মেয়ে দেখছি, নাকি ওরা জিন-পরী।
মেয়েগুলো একইভাবে মূর্তির ন্যায় তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। আম নাসের সাহসী মানুষ। সে ধীরে ধীরে মেয়েগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েরা অদৃশ্য হলো না। তারা এখন আন-নাসেরের হাত পাঁচেক দূরে। মেয়েদের একজন অপরজনের তুলনায় বয়সে বড়। এমন রূপসী মেয়ে আন-নাসের জীবনে আর দেখেনি। মাথার ওড়নার ফাঁক দিয়ে যে কটি চুল কাঁধের উপর পড়ে আছে, সেগুলো সরু রেশমের ন্যায় মনে হলো। উভয় মেয়ের চোখের রংও বেশ চিত্তাকর্ষক ও বিস্ময়কর। চোখগুলো মুক্তার ন্যায় ঝিকমিক করছে।
তোমরা সৈনিক- বড় মেয়েটি বললো- তোমরা কার সৈনিক।
সবই বলবো- আন-নাসের বললো- তার আগে বলো, তোমরা মরুভূমির ধা ধা নাকি জিন-পরী?
আমরা যাই হই না কেন, আগে বলো তোমরা কারা এবং এদিকে কী করতে এসেছে? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে- আমরা মরুভূমির ধা ধা নই। তোমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছো, আমরাও তোমাদের দেখছি।
আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর গেরিলা সৈনিক- আন-নাসের বললো পথ ভুলে এদিকে এসে পড়েছি। তোমরা যদি জিন-পরী না হয়ে থাকো, তাহলে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর দোহাই, আমার এই সঙ্গীদের পানি পান করাও এবং তার বিনিময়ে আমার জীবন নিয়ে নাও। এটা আমার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
অস্ত্রগুলো আমাদের সামনে রেখে দাও- মেয়েটি বললো- হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর নামে প্রার্থিত বস্তু আমরা না দিয়ে পারি না। তোমার সঙ্গীদের ছায়ায় নিয়ে আসো।
আন-নাসের তার অস্তিত্বে একটি ঢেউ খেলে গেছে বলে অনুভব করে, যেনো ঢেউটি মাথা দিয়ে প্রবেশ করে পা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সে মানুষের সঙ্গে যুদ্ধকারী জানবাজ। তার সকল গেরিলা আক্রমণ সঙ্গীদের অবাক করে তুলতো। কিন্তু এই মেয়ে দুটোর সামনে সে কাপুরুষ হয়ে গেছে। তার মনে এমন একটা ভীতি চেপে বসেছে, যা পূর্বে কখনো অনুভব করেনি। সে জিন পরীর গল্প শুনতো; কিন্তু কখনো জিনের মুখোমুখি হয়নি। প্রতি মুহূর্তেই তার আশংকা ছিলো, মেয়ে দুটো এবং ঘোড়গুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে কিংবা আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলবে। তখন সে কিছুই করতে পারবে না। আন-নাসের মেয়েগুলোর সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। সে তার সঙ্গীদের বললো- তোমরা ছায়ায় চলে আসে। তাদের একজন অচেতন পড়ে ছিলো। তাকে টেনে ছায়ায় নিয়ে আসা হলো।
বলল, তোমরা কী করতে এসেছো?–মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
পানি পান করাও- আন-নাসের অনুনয়ের সাথে বললো- শুনেছি, জিনরা যখন-তখন যে কোনো বস্তু উপস্থিত করতে পারে।
ঘোড়ার সঙ্গে মশক বাঁধা আছে- মেয়েটি বললো- একটি খুলে নাও।
আন-নাসের একটি ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা মশক খুলে হাতে নেয়। মশকটি পানিতে পরিপূর্ণ। সবার আগে তার অচেতন সঙ্গীর মুখে পানির ছিটা দেয়। পানির ছোঁয়া পেয়ে সে চোখ খোলে এবং ধীরে ধীরে উঠে বসে। আন নাসের মশকের মুখটা তার মুখের সঙ্গে লাগায়। সঙ্গীর সামান্য পানি পান করার পর মশক সরিয়ে নেয়। আন-নাসের তাকে বেশি পানি পান করতে দেয়নি। ভীষণ পিপাসার পর বেশি পানি পান করা ক্ষতিকর। তারপর একজন একজন করে প্রত্যেকে পানি পান করে। সবশেষে আন-নাসের নিজে পানি পান করে। তার মস্তিষ্ক পরিস্কার হয়ে গেছে। এবার তার ভাবনা হচ্ছে, এই মেয়েগুলো যদি বাস্তব না হয়ে তার কল্পনা হতো, তাহলে মস্তিষ্ক পরিস্কার হওয়ার পর এখন তারা অদৃশ্য হয়ে যেতো। কিন্তু তাতো হয়নি। মেয়েগুলো এখানো যথাস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, পরিস্কার হওয়ার আগে মেয়েগুলোর ন্যায় মশকভর্তি পানিও দেখেছিলো। সেই পানি তার সঙ্গীরা এবং সে নিজে পান করে চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে। বিষয়টা যদি অলীক অল্পনা হতো, তাহলে পানি পান করাই সম্ভব হতো না। সব মিলিয়ে আন নাসের নিশ্চিত যে, সে যা দেখছে, বাস্তব দেখছে। সে মেয়েগুলোর প্রতি তাকায় এবং গভীরভাবে নিরিক্ষা করে। এবার তাদেরকে পূর্বের তুলনায় আরো রূপসী মনে হলো, যেনো তারা মানুষ নয়।
আন-নাসেরের নিজের উপরই নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে অনুভব করছে, নিজের ইচ্ছায় কিছু ভাববার শক্তি তার নেই। তার সঙ্গীদের চেহারায় জীবন ফিরে এসেছে। এটা সেই যৎসামান্য পানির সুফল, যা তাদের দেহে অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু আন-নাসেরের ন্যায় তাদের উপরও ভীতি চেপে বসেছে। মেয়েগুলো চুপচাপ তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। বাইরের জগত আগুনে জ্বলছে। মাটি এমন অগ্নিশিখা উদগীরণ করছে, যা অনুভব করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা যে স্থানটিতে বসে আছে, সেটি এই উত্তাপ থেকে নিরাপদ।
বড় মেয়েটি আন-নাসেরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয়। মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলী দ্বারা ঘোড়ার প্রতি ইংগিত করে বললো- ঐ থলেটা খুলে এনে সঙ্গীদের দাও।
আন-নাসের ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা চামড়ার থলেটা এমনভাবে খুলে নিয়ে আসে, যেনো এই কাজটা সে কোনো জাদুর ক্রিয়ায় সম্পন্ন করেছে। থলেটি খুলে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। ভেতরে খেজুর ছাড়াও এমন সব খাবার রয়েছে, যা রাজা-বাদশারা খেয়ে থাকেন। আছে গোশতও। সে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে মেয়েদের প্রতি তাকায়। বড় মেয়েটি বললো- খাও।
আন-নাসের বস্তুগুলো তার সঙ্গীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়। সকলের পেট আর পিঠ, এক হয়ে ছিলো। তারা খেতে শুরু করে। মহামূল্যবান হলেও খাবার পরিমাণে কম, যা বড়জোর একজনের জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তারা চারজনই পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। তাদের দেহ-মনে সজীবতা ফিরে না আসে। এবার মেয়েগুলোর রূপ-সৌন্দর্য আগের তুলনায় আরো মনোহারী ও রহস্যময় হয়ে ওঠে।
তোমরা আমাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবে?- আন-নাসের বড় মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে- জিন মানুষের তো মোকাবেলা হয় না। তোমরা আগুন আর আমরা মাটি। আল্লাহ আমাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা। তোমাদেরই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি বিবেচনা করে আমাদের প্রতি দয়া করো। তোমরা আমাদেরকে তুর্কমানের রাস্তায় তুলে দাও। তোমরা ইচ্ছে করলে তো মুহূর্তের মধ্যে আমাদেরকে তুকমান পৌঁছিয়ে দিতে পারো।
তোমরা কোথাও গেরিলা আক্রমণ করতে গিয়েছিলে কী?- বড় মেয়েটি জিজ্ঞেস করে- সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডো সেনারাও জিন হয়ে থাকে। বলো কোথায় গিয়েছিলে? কী করে এসেছে?
আন-নাসের তার পুরো কার্যক্রমের বিবরণ প্রদান করে। তার বাহিনী যে বীরত্বপূর্ণ গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে এসেছে এবং শত্রু পক্ষের কী কী ক্ষতিসাধন করেছে, সব বলে দেয়। তারপর ফেরত পথে কিভাবে পথ ভুলে উভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, তারও বিবরণ প্রদান করে।
তোমাদেরকে তোমাদের বাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক বলে মনে হচ্ছে- বড় মেয়েটি বললো- তোমাদের বাহিনীর সব সৈনিকই কি এ কাজ করতে পারে, যা তোমরা করেছো?
না–আন-নাসের জবাব দেয়- আমাদেরকে তোমরা মানুষ মনে করে। আমাদের ওস্তাদগণ আমাদেরকে যে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন, তা যে কোনো সৈনিক সহ্য করতে পারে না। আমরা বনের হরিণের ন্যায় দৌড়াতে পারি। আমাদের চোখ বাজপাখির ন্যায় বহুদূর পর্যন্ত দেখতে সক্ষম এবং আমরা চিতার ন্যায় আক্রমণ করতে পারঙ্গম। আমরা কেউ চিতা দেখিনি। চিতা কী এবং কিভাবে আক্রমণ করে, ওস্তাদগণ আমাদের সেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এই শারীরিক পারঙ্গমতা ছাড়াও আমাদের মস্তিষ্কও অন্যান্য সৈনিকের তুলনায় বেশী উন্নত ভাবনা ভাবতে পারে। শত্রুর দেশে গিয়ে কিভাবে তাদের সামরিক গোপন তথ্য বের করে আনা যায়, আমাদের ওস্তাদগণ আমাদেরকে সে বিদ্যাও শিক্ষাদান করেছেন। আমরা বেশ বদল করে ফেলি, কণ্ঠ পরিবর্তন করে ফেলি এবং অন্ধ হতে পারি। প্রয়োজন হলে আমরা চোখের অশ্রু ঝরাতে পারি এবং ধরা পড়ার আশংকা দেখা দিলে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করি এবং বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। আমরা বন্দী হই না- শহীদ হই।
আমরা যদি পরী না হতাম, তাহলে তোমরা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করতে?–মেয়েটি প্রশ্ন করে।
তোমরা বিশ্বাস করবে না- অনি-নাসের বললো- আমরা সেই পাথর, নারীর রূপ যাকে ভাঙ্গতে পারে না। আমি যদি নিশ্চিত হতে পারি যে, তোমরা মানুষ আর জানতে পারি, তোমরা পথ ভুলে এসেছে, তাহলে তোমাদের দুজনকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেবো। আমার ঈমানের ন্যায় তোমাদের মূল্যবান বিবেচনা করবো। কিন্তু তোমরা তো মানুষ নও। তোমাদের অবস্থাই বলছে, তোমরা মানুষ নও। তোমাদের ন্যায় মেয়ে এই ধরায় আসতে পারে না। তোমাদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, আমাদেরকে আশ্রয় দাও।
আমরা মানুষ নই- বড় মেয়েটি বললো- আমরা তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। আমাদের জানা ছিলো, তোমরা পথ হারিয়ে ফেলেছো। তোমরা যদি গুনাহগার হতে, তাহলে যে বিজন মরু এলাকা অতিক্রম করে এসেছে, সেটি তোমাদের রক্ত চুষে নিতে এবং তোমাদের দেহের গোশতকে বালিতে পরিণত করে তোেমাদের কংকর বানিয়ে ছাড়তো। এই মরুদ্যান কখনো পথভোলা পাপিষ্ঠকে ক্ষমা করেনি। আমরা দুজন তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম। তেমাদেরকে যেসব কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তা এই জন্য করতে হয়েছে, যাতে তোমরা খোদাকে ভুলে না যাও এবং তোমার অন্তর থেকে পাপের কল্পনাটুকুও বের হয়ে যায়। আমাদের ধারণা ছিলো, আমাদের ন্যায় রূপসী মেয়েদের দেখে তোমরা ক্ষুৎপিপাসার কথা ভুলে যাবে এবং শয়তানের কজায় চলে যাবে।
তোমরা আমাদের সঙ্গ দিলে কেন? আন-নাসের জিজ্ঞেস করে।
আমাদেরকে তিনি প্রেরণ করেছেন, যিনি মরুভূমিতে পথভোলা নেক বান্দাদের পথের দিশা প্রদান করেন- বড় মেয়েটি বললো- খোদা তোমাদের উপর যে রহমত বর্ষণ করেছেন, তোমরা তার হিসাব করতে পারবে না। তিনি আমাদের বলেছেন, মানুষ মৃত্যুর সময়ও শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। শয়তানের এই অপবিত্র কজা থেকে মুক্ত করার জন্য খোদা তোমাদের শাস্তিদান করেছেন। তারপর আমাদের আদেশ করেছেন, এদের সম্মুখে এসে পড়ো এবং এদেরকে আশ্রয় দান করো। আমরা জানতাম, তোমরা দুশমনকে কিভাবে এবং কী পরিমাণ ক্ষতিসাধন করেছে।
তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করলে কেন? আন-নাসের বললো।
এটা দেখার জন্য যে, তুমি কতটা মিথ্যা বলো, আর কতটা সত্য– মেয়েটি বললো- তুমি সত্যবাদী।
আমরা মিথ্যা বলি না- আন-নাসের বললো- গেরিলা সৈনিকরা আল্লাহকে সাক্ষী বানিয়ে থাকে। আমরা নিজ বাহিনী ও সালারদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গিয়েও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে থাকি, আল্লাহ আমাদের দেখছেন। আমরা আল্লাহকে ধোকা দিতে পারি না। আন-নার্সের নীরব হয়ে যায় এবং পরক্ষণেই বলে ওঠে- আচ্ছা, আমি যে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের সঙ্গে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে, তার তত উত্তর দিলে না।
আমরা যে নির্দেশ লাভ করেছি, তার বিপরীত করতে পারি না- মেয়েটি জবাব দেয়- তোমাদের সঙ্গে আমাদের আচরণ মন্দ হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তোমাদের চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে ঠিক; কিন্তু মনের ভয় তোমাদেরকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। অন্তর থেকে সব ভীতি দূর করে ফেলে এবং ঘুমিয়ে পড়ো।
তারপর কী হবে? আন-নাসের জিজ্ঞেস করে।
খোদা যা নির্দেশ করেন- মেয়েটি জবাব দেয়। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যদি পালাবার চেষ্টা করো, তাহলে এই খুঁটিগুলোর ন্যায় খুঁটিতে পরিণত হয়ে যাবে। তোমরা দূর থেকে এই খুঁটিগুলো দেখে থাকবে। এগুলোর উপরে কোন ছাদ নেই। দেখতে এগুলো মিনারের ন্যায়। কিন্তু আসলে এগুলো মানুষ মানুষ ছিলো। যদি তোমাদেরকে আসল ব্যাপারটা দেখাবার অনুমতি থাকতো, তাহলে বলতাম, এর কোনো একটি মিনারের গায়ে তরবারীর আঘাত হানো, দেখতে তার দেহ থেকে ফিকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।
ভয়ে আন-নাসের ও তার সঙ্গীদের চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এটা হলো পৃথিবীর জাহান্নাম- মেয়েটি বললো- এদিকে সে আসে, যে পথ ভুলে যায় আর আগমন ঘটে তার, যে পথভোলা পথিককে পথ দেখায়। অন্য কাউকে এ পথে দেখা যায় না। তারা হরিণের ন্যায় সুদর্শন প্রাণী কিংবা আমাদের ন্যায় সুন্দরী মেয়ের রূপে এসে পথহারা পথিকের পথের সন্ধান দিয়ে থাকে এবং এই জাহান্নামের কষ্ট থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু মানুষ এতোই অসৎ যে, তীর ছুঁড়ে হরিণকে মেরে ফেলে তার গোশত ভক্ষণ করে আর আমাদের মতো নারীদেরকে অসহায় মনে করে ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করার চেষ্টা করে। সে ভুলে যায়, তার জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এখন আর তার কোনো অন্যায় করা উচিত নয়। সে মেয়েদের প্রলোভন দেখায়, আমার সঙ্গে আসো; আমি তোমাকে বিয়ে করবো আর তুমি আমার হেরেমের রাণী হবে। এই মিনার আর খুঁটিগুলো এমনই মানুষ ছিলো। তবে তোমাদেরকে তাদের পরিণতি বরণ করতে হবে না। তোমরা শুয়ে পড়ে। আমাদের দেখে যদি তোমাদের মনে পাপ প্রবণতা জেগে উঠে, তাহলে সেই কামনাকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখো। অন্যথায় তোমাদেরও সেই পরিণতি বরণ করতে হবে, যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো। মানুষের একটা দুর্বলতা যে, তারা পিতা-মাতার যে আনন্দের মাধ্যমে জন্মলাভ করে, তারই মোহে মোহাবিষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের এই দুর্বলতা বহু সম্প্রদায়ের নাম-চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিয়েছে।
মেয়েটির বলার ভঙ্গিতে যাদুর ক্রিয়া। তাকে এই জগতের মেয়ে বলে মনেই হচ্ছে না। তার বুকে আছে এক পবিত্র বার্তা। আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা অভিভূত হয়ে পড়ে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেয়েটির বক্তব্য শুনতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা ঝিমুতে শুরু করে এবং একজন একজন করে মাটিতে শুয়ে পড়ে।
আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটির প্রতি তাকায়। দুজনই মুচকি হাসতে থাকে। তারা প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
***
আন-নাসের যেভাবে তার মিশনে সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনি তার বাহিনীও তাদের অভিযানে এক আক্রমণেই সফল হয়েছে। কিন্তু সেই সংবাদ আন-নাসেরের জানা নেই। সুলতান আইউবী সম্মিলিত বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিলেন। বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সাইফুদ্দীন রণাঙ্গন থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। সুলতান আইউবী এখন তার এক সালার মুজাফফর উদ্দীনের অপেক্ষা করছেন। তাঁর আংশকা মুজাফফর উদ্দীন যদি রণাঙ্গনে থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই সে হামলা চালাবে। বাহিনীর এক-চতুর্থাংশ তার সঙ্গে রয়েছে। সম্মিলিত বাহিনীর এই অংশটি যুদ্ধে অংশ নেয়ার সুযোগই পায়নি। এরা পরাজিত বাহিনীর অক্ষত রিজার্ভ বাহিনী। সুলতান আইউবী তাদের উপস্থিতির সংবাদ নিশ্চিতভাবে জানতেন না। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার আলোকে অনুভব করছিলেন, এখনো সমস্যা রয়েছে। তিনি তার গোয়েন্দাদেরকে রণাঙ্গনের চারদিকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাতে কোথাও কোনো ফৌজের সন্ধান পেলে যেনো সঙ্গে সঙ্গে তাকে অবহিত করা হয়।
রণাঙ্গন থেকে দু-আড়াই মাইল দূরে বন ও টিলা পরিবেষ্টিত সমতল ভূমি। সেখানকার তাঁবুতে বসে মুজাফফর উদ্দীন সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করছেন। বেশ কর্মব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন তিনি। ইত্যবসরে নায়েব সালার এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তাবুতে প্রবেশ করে।
নতুন কোনো খবর আছে? মুজাফফর উদ্দীন জিজ্ঞেস করে।
সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীতে কোন পরিবর্তন আসেনি- নায়েব সালার বললো- বিস্তারিত এর থেকে শুনুন। এ সবকিছু দেখে এসেছে।
গুপ্তচর বললো- সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী এখনো আমাদের পালিয়ে যাওয়া বাহিনীর পরিত্যক্ত সামানপত্র আহরণ করেনি। শুধু তাদের নিহত ও আহতদের তুলে নিয়েছে। তাদের লাশের সঙ্গে আমাদের লাশগুলোও ভিন্ন ভিন্ন কবরে দাফন করছে।
মৃতদের নয়- জীবিতদের সংবাদ বলো- মুজাফফর উদ্দীন বললেন আইউবী কি তার বাহিনীতে কোনো রদবদল করেছেন। তার ডান বাহু সেখানেই আছে, নাকি এদিক-ওদিক হয়ে গেছে?
মহামান্য সালার!- গুপ্তচর বললো- আমি সাধারণ সৈনিক নই। আমি আপনাকে যে রিপোর্ট প্রদান করছি, তা কিছু একটা বুঝে-শুনেই দিচ্ছি। আপনাকে সন্তুষ্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি আপনার অসন্তোষকেও ভয় করি না। আমার উদ্দেশ্য ঠিক আপনারই ন্যায় যে, সুলতান আইউবীর বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করতে হবে। আপনি খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে আছেন বলে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়িই করতে হবে। তবে আপাতত অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকুন। আমি যা বলছি, বলতে দিন। আমি জানি, আপনার দৃষ্টি সুলতান আইউবীর ডান পার্শ্বের উপর নিবদ্ধ। আপনার এই টার্গেট সঠিক। কিন্তু এই ডান পার্শ্বের উপর হামলা চালালে আইউবী তার অন্যান্য অংশগুলোকে কিভাবে কাজে লাগাবে, আমি তাও পর্যবেক্ষণ করে দেখে এসেছি।
তিনি আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবেন- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- ঘেরাও বিস্তৃত রাখবেন। আমাদেরকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরে ধীরে ধীরে ঘেরাও ছোট করে ফেলবেন। আমি তার কৌশল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি।
সালাহুদ্দীন আইউবী যে ইউনিটগুলো দ্বারা আমাদের কাবের উপর আক্রমণ করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাদেরকে গুটিয়ে নিয়ে সম্মুখের বাহিনীর এক ক্রোশ দূরে প্রস্তুত রেখেছেন। আপনি ঠিকই ধরেছেন যে, আইউবী আমাদের আক্রমণকারী বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবেন। সুলতান আইউবীর ডান বাহু যে স্থানটিতে অবস্থিত, তার থেকে এক-দেড় ক্রোশ পেছনে আমাদের ও আইউবীর সৈন্যদের জন্য কবর খনন করা হয়েছে। তার সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার হবে- দেড় হাজার গর্ত। আপনি তো জানেন, কবরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা কতটুকু হয়ে থাকে। আপনি এমন একদিক থেকে হামলা করবেন, যাতে আইউবীর বাহিনী পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। আপনি তাদেরকে কবরগুলোর নিকটে নিয়ে যাবেন। হাতাহাতি লড়াই করার পরিবর্তে কবরের নিকট চলে যেতে বাধ্য করবেন। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, ঘোড়া উন্মুক্ত করে কিভাবে নিক্ষিপ্ত হবে।
আইউবীর ডান বাহুর শক্তি কতটুকু এবং কী প্রকৃতির? মুজাফফর উদ্দীন জিজ্ঞেস করে।
অন্তত এক হাজার অশ্বারোহী এবং দেড় হাজার পদাতিক- গুপ্তচর কমান্ডার উত্তর দেয়- এই বাহিনী প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। আপনি তাদেরকে তাদের অজান্তে হামলা করতে পারবেন না। সে মুজাফফর উদ্দীনের সম্মুখস্থ নকশাটির এক স্থানে আঙ্গুল রেখে বললো- এই হলো দুশমনের (আইউবীর) ডান বাহু। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তাহলে এর বিস্তৃতি আটশ কদম। তার সম্মুখের জমি খানাখন্দকে পরিপূর্ণ। ডানের এলাকা সমতল ও পরিচ্ছন্ন আক্রমণের জন্য এই পথটি উপযুক্ত মনে হয়। কিন্তু হামলা করতে হবে সন্ধু থেকে। তাহলে দুশমন পেছনে সরে যেতে বাধ্য হবে।
আমার আক্রমণ সামনের পরিত্যক্ত রাস্তা থেকেও হবে, ডানদিকে থেকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা থেকেও- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- আমি কবরের গর্ত এক মাটির স্তূপকেই কাজে লাগাবো। তিনি তার নায়েব সালারদের বললেন- বে কোনো স্থানে কাউকে পেলে ধরে নিয়ে আসবে। এই অঞ্চল এখন যুদ্ধকবলিত। এদিক থেকে কোনো পথিক পথ অতিক্রম করবে না। এই পথে সে-ই পা রাখবে, যে কোনো না কোনো পক্ষের গুপ্তচর।
দু-জন পথিক। বোধ হয় তারা জানে না, এই অঞ্চলটা এখন যুদ্ধকবলিত। একজন উটের পিঠে সাওয়ার পাকা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ। উটের উপর কিছু মালপত্রও বোঝাই করা। অপরজনের হাতে উটের লাগাম। দুজনেরই পরনে সাদাসিধে পোশাক। তারা সেই পথে অতিক্রম করছে, যেখান থেকে মুজাফফর উদ্দীনের লুকিয়ে থাকা সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে। এক সিপাহী তাদের ডাক দেয়। তারা থামেনি। তাদের গতি আরো তীব্র হতে থাকে। মুজাফফর বাহিনীর এক অশ্বারোহী তাদের পিছু নিলে তারা দাঁড়িয়ে যায়। অশ্বারোহী তাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বলে।
আমরা পথিক- যুবক বলল- আপনাদের তো আমরা কোনো ক্ষতি করছি না। আমাদের যেতে দিন।
এই পথে যেই যাবে, তাকেই ধরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আছে। অশ্বারোহী বললো এবং তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো।
ধৃতদের একটি তাঁবুর সম্মুখে দাঁড় করিয়ে তাঁবুতে সংবাদ দেয়া হলো। এক কমান্ডার বেরিয়ে এসে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে- তোমরা কোথা থেকে এসেছো? তাদের উত্তরে কমান্ডার নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের বলা হলো, তোমাদেরকে সম্মুখে যেতে দেয়া হবে না। তোমাদেরকে বন্দী করব না, সম্মানের সঙ্গে রাখা হবে। তবে কতদিন পর্যন্ত এখানে রাখা হবে। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো না।
এরাই প্রথম পথচারী, যাদেরকে মুজাফফর উদ্দীনের নির্দেশে আটক কর হলো। তাদেরকে দুজন সিপাহীর হাতে তুলে দেয়া হলো। তারা তাদের তাঁবুতে অবস্থান করবে।
মধ্যরাত। ধৃত পথিকদের পাহারাদার সিপাহীদ্বয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সাদ দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ জেগে আছে। তাঁবুতে কোন আলো নেই। বৃদ্ধ নাক ডাকা শব্দ পেয়ে বুঝে ফেলে সিপাহী ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তার সঙ্গীকে চিমটি মারে। দুজন শুয়ে শুয়েই দরজার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দরজার নিকট পৌঁছেই তারা দাঁড়িয়ে যায় এবং বেরিয়ে পড়ে। বাইরে পিনপতন নীরবতা। তারা পালাতে শুরু করে। তাঁবু থেকে খানিক দূরে পৌঁছে বৃদ্ধ তার সঙ্গীকে বললো- তুমি আমার থেকে আলাদা হয়ে যাও এবং অন্য এক দিক দিয়ে ছাউনি এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও।
দুজন আলাদা হয়ে যায়। তাদের ধারণা ছিলো, সমগ্র ক্যাম্পই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। প্রহরী জেগে আছে। এক প্রহরী অন্ধকারে ছায়ার নড়াচড়া দেখে কিছু না বলে ছায়ার পিছু ছুটতে শুরু করে।
লোকটি বৃদ্ধ পথিক। প্রহরীকে দেখে সে একস্থানে লুকিয়ে যায়। প্রহরী এগিয়ে এসে তাকে খুঁজতে শুরু করে। সেই জায়গায় কিছু মালামাল ছিলো। বৃদ্ধ তারই আড়ালে লুকিয়ে থাকে। পরে অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ে।
তেমনি অপর এক প্রহরী বৃদ্ধের সঙ্গীকে দেখে ফেলে। গোয়েন্দাদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখার এবং গ্রেফতার করার কঠোর নির্দেশ মুজাফফর উদ্দীনের। তিনি জানেন, সুলতান আইউবীর গুপ্তচররা অত্যন্ত চৌকস ও তীব্র গতিসম্পন্ন। তাই মুজাফফর উদ্দীনের এই প্রহরীদ্বয় কর্তব্য পালনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। উভয়ে চুপচাপ আপন আপন শিকার ধরার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বৃদ্ধের সঙ্গীও চুপ হয়ে আছে। এদিকে বৃদ্ধ এক প্রহরীর সঙ্গে কানামাছি খেলে বেড়াচ্ছে। খানিক পর বৃদ্ধ অপর এক জায়গায় লুকিয়ে যায়। প্রহরী তার পেছন পেছন আসছে। বোকা প্রহরী তার বৃদ্ধ শিকারকে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। বৃদ্ধ খঞ্জর হাতে নেয়। নিজের মুক্তির জন্য খঞ্জরাঘাতে প্রহরীকে খতম করার পরিকল্পনা করে। সে উঠে দাঁড়ায়। আঘাত হেনে পালাবে কোন্ পথে ভাবছে মাত্র। ঠিক এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি তার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। মুহূর্ত বিলম্ব না করে বৃদ্ধ খঞ্জরটা তারই হৃদপিণ্ডে সেঁধে দেয়। পরক্ষণেই দ্বিতীয় আঘাত হানে। লোকটি ক্ষীণ একটি শব্দ করেই নীরব হয়ে লুটিয়ে পড়ে।
বৃদ্ধ সেখান থেকে পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু অকস্মাৎ কে একজন পেছন থেকে তাকে ঝাঁপটে ধরে। বৃদ্ধ নিজেকে ছাড়াবার জন্য সজোরে এমন ঝটকা টান মারে যে, লোকটি পড়ে যায়। নিজে দ্রুত পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে কি একটা বস্তুর সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। বৃদ্ধ যাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে এসেছে, সে উঠে দাঁড়ায়। সে দ্রুত ছুটে এসে আবারো বৃদ্ধকে ঝাঁপটে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক-চিৎকার শুরু করে দেয়। সাথে সাথে কয়েকটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে। তিন-চারজন প্রহরী ছুটে আসে। তারা প্রদীপের আলোতে দেখতে পায়, তাদের শিকার একজন শশ্রুমণ্ডিত বয়োঃবৃদ্ধ। কিন্তু তাদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লোকটি এমন শক্তি প্রদর্শন করছে, যা এই বয়সে তার মধ্যে থাকার কথা নয়। প্রহরীদের কবল থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হয়নি। ধস্তাধস্তির ফলে তার মুখে সাদা দাড়ি উপড়ে যায়। সকলে দেখতে পায় তার মুখমণ্ডলে খোঁচা খোঁচা কালো দাড়ি। লোকটি বলিষ্ঠ নওজোয়ান। সাদা দাড়ি কৃত্রিম। শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ এখন টগবগে যুবক।
এই যুবক যে স্থানে খঞ্জরের আঘাতে এক প্রহরীকে হত্যা করে এসেছে, ধরে তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রদীপের আলোতে সবাই দেখলো, নিহত লোকটি মুজাফফর উদ্দীনের প্রহরী নয়- হত্যাকারী যুবকেরই সঙ্গী। মুখোশধারী বৃদ্ধ প্রহরী মনে করে তারই সঙ্গীকে খুন করে ফেলেছে। তারা দুজন আলাদা আলাদাভাবে ক্যাম্প থেকে পালাবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু প্রহরীরা তাদেরকে দেখে ফেলেছে। প্রহরীদের ধাওয়া থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশায় ঘটনাক্রমে একত্র হয়ে গিয়েছিলো। বৃদ্ধ তারই সঙ্গীকে প্রহরী মনে করে খঞ্জর দ্বারা আঘাত হানে। পরপর দুটি আঘাতে যুবক প্রাণ হারায়।
লাশের অনুসন্ধান নেয়া হলো। তার পোশাকের ভেতর থেকে খঞ্জর বেরিয়ে আসে। তাদের উটের পিঠে যে বোঝাটি ছিলো, সেটি খোলা হলো। তাতে কোন মালপত্র নেই। বস্তার ভেতরে ঘাস ভরে রাখা আছে।
ধৃত ব্যক্তিকে এক নায়েব সালারের তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। নায়েব সালার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তিনি লোকটিকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তার মুখের কৃত্রিম সাদা দাড়িগুলো নায়েব সালারকে দেখানো হলো। এ ব্যাপারেও সে কোনো মন্তব্য করলো না। কিন্তু এটা তো একটা জ্বলন্ত প্রমাণ, যা সে অস্বীকার করতে পারে না। তাকে বলা হলো, তুমি স্বীকার করো- তুমি এবং তোমার সঙ্গী সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। কিন্তু এই অভিযোগ স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায় সে। তাকে বেদম প্রহার করা হলো। তাকে অস্থির করে তোলা হলো। তারপরও সে স্বীকার করলো না সে গুপ্তচর। রাত কেটে যায়। সকালে তাকে মুজাফফর উদ্দীনের নিকট নিয়ে যাওয়া হলো এবং তাকে রাতের ঘটনা শোনানো হলো। তার কৃত্রিম দাড়ি এবং সামানপত্রও মুজাফফর উদ্দীনের সম্মুখে রাখা হলো।
কার শিষ্য?- মুজাফফর উদ্দীন জিজ্ঞেস করেন- আলী বিন সুফিয়ানের, নাকি হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর?
আমি এদের একজনকেও চিনি না। ধৃত ব্যক্তি জবাব দেয়।
আমি দুজনকেই জানি- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর শিষ্য। ওস্তাদ তার শিষ্যকে ধোকা দিতে পারে না।
আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকেও চিনি না, আপনি কে তাও জানি না। ধৃত ব্যক্তি জবাব দেয়।
শোনো হতভাগ্য বন্ধু!- মুজাফফর উদ্দীন তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করবো না। আমি এ কথাও বলবো না, তুমি অযোগ্য বা অকর্ম। তুমি বেশ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। ধরা পড়া কোনো দোষের নয়। তোমার জন্য দুর্ভাগ্য যে, তোমার সঙ্গী তোমারই হাতে খুন হলো। তুমি আমাকে শুধু এটুকু বলল, এ পথে তোমার আর কোনো সঙ্গী ছিলো কিনা এবং সালাহুদ্দীন আইউবীকে সংবাদ দিয়েছে কিনা যে, এখানে ফৌজ আছে? আর বলল, তোমাদের ফৌজের বিন্যাস কিরূপ এবং বাহিনী কোথায় কোথায় আছো তুমি আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। আমি তোমাদের কুরআনের নামে ওয়াদা দিচ্ছি, যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র তোমাকে মুক্তি দেবো। আর সে পর্যন্ত তোমাকে সম্মানের সাথে রাখবো।
আপনার শপথে আমার কোনো আস্থা নেই- ধৃত ব্যক্তি জবাব দেয় কারণ, আপনি কুরআন থেকে সরে এসেছেন।
কেন, আমি কি মুসলমান নই মুজাফফর উদ্দীন ধৈর্যের সাথে জিজ্ঞেস করেন।
আপনি মুসলমান নিশ্চয়ই- ধৃত ব্যক্তি জবাব দেয়- তবে আপনি কুরআনের নয়, ক্রশের অফাদার।
তুমি আমাকে অপমান করছো- মুজাফফর উদ্দীন বললেন- কিন্তু একটি শর্তে আমি এই অপমান সয়ে নেবো যে, আমি যা জানতে চেয়েছি, বলে দাও। তোমার জীবন এখন আমার হাতে।
আল্লাহর হাত থেকে আপনি আমার জীবন ছিনিয়ে নিতে পারবেন না ধৃত ব্যক্তি বললো- আপনি তো জানেন, আমাদের প্রত্যেক সৈন্য নিজেদের জীবন আল্লাহর হাতে তুলে দিয়ে যুদ্ধ করে। আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর এবং আমার সঙ্গীও গুপ্তচর ছিলো। আপনার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। আমি জীবিত আছি। আপনি আমার গায়ের চামড়া তুলে ফেলুন। তারপরও আমার মুখ থেকে আপনার কাঙ্খিত প্রশ্নগুলোর উত্তর বের হবে না। আমি আপনাকে এও বলে রাখছি, পরাজয় আপনারই কপালে লিবিদ্ধ হয়ে আছে।
লোকটার পায়ের সঙ্গে রশি বেঁধে ঐ গাছটার সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখো। মুজাফফর উদ্দীন একটি গাছের দিকে ইশারা করে নির্দেশ দিয়ে আপন তাঁবুতে ফিরে যান।
***
তারা দু-জন তো এখনো আসলো না- হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলছিলেন- ওদের তো ধরা পড়ার কোন আশংকা ছিলো না। এখানে আমাদের গুপ্তচরদের ধরার মতো কারা আছে। তাদের বেশি দূরেও তো যাওয়ার কথা ছিলো না।
হয়তো বা তারা ধরা পড়ে গেছে- সুলতান আইউবী বললেন- যখন তারা সকালে গিয়ে সন্ধ্যার পরও এসে পৌঁছলো না, তো তারা ধরাই পড়ে গেছে। তাদের না আসাই প্রমাণ করে, এখানে ধরার মতো লোফ আছে। রাতে আরো কিছু লোক পাঠিয়ে দাও। তারা আরো খানিক দূরে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসুক।
সুলতান আইউবী ও হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ সেই দুই গুপ্তচরের কথাই বলছিলেন। আইউবী সবসময় তার গোয়েন্দা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেছেন এবং এই ব্যবস্থারই দিক-নির্দেশনায় দুশমনকে নাকাকি-চুবানি খাইয়েছেন। কিন্তু এবার তার সেই ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে চলেছে। কারণ হচ্ছে, এখানকার যুদ্ধে তার প্রতিপক্ষ তারই শিষ্য মুজাফফর উদ্দীন। গত রাতে তুৰ্কৰ্মনের কিছু দূরে এক বিজন এলাকায় আইউবীর এক গোয়েন্দার লাশ পাওয়া গেছে। তার পাজরে তীর গাঁথা ছিলো। মুজাফফর উদ্দীন তার নায়েব সালারদের বলেছিলেন- তোমরা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারো, তাহলে তিনি অন্ধ ও বধির হয়ে যাবেন। তারপর তোমরা তাকে পরাজিত করার কথা ভাবতে পারবে।
এখন আবার তার দুজন গোয়েন্দা নিখোঁজ হয়ে গেলো। এ দুটি ঘটনাকে সুলতান অবহেলা করতে পারেন না। তার নির্দেশে হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ ছয়জন কমান্ডো গোয়েন্দা রওনা করিয়ে দেন।
রাতের শেষ প্রহর। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আযানের প্রথম ধ্বনি আল্লাহু আকবার ধ্বনিত হওয়ামাত্র সুলতান আইউবীর চোখ খুলে যায়। তিনি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসেন। খাদেম প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁর তাঁবুর সম্মুখে রেখে দেয়। ওদিক থেকে এক আরোহী ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে আসে। লোকটি সুলতানের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে ঘোড়া থেকে অবতরণ করে বললো সুলতানের মর্যাদা বুলন্দ থোক। আপনার বাহিনীর ডান পার্শ্ব যে স্থানে অবস্থান করছে, তার সম্মুখে অন্য কোনো বাহিনীর পদচারণা লক্ষ্য করা গেছে। খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য দুজন লোক এগিয়ে গিয়েছিলো। তারা তথ্য নিয়ে এসেছে যে, বাহিনী আসছে।
সুলতান আইউবী তার কেন্দ্রীয় কমান্ডের সালারদের নাম উল্লেখ করে বললেন, ওদেরকে ডেকে আনো। তিনি তায়াম্মুম করেন। তার কাছে অজু করার মতো সময় নেই। তারপর জায়নামায বিছানোনা ছাড়াই কেবলামুখী হয়ে সেখানেই নামায আদায় করেন। শেষে সংক্ষিপ্ত দুআ করে ঘোড়া তলব করেন।
এই বাহিনী মুজাফফর উদ্দীন ছাড়া আর কারো হতে পারে না সুলতান আইউবী তার সালারদের বললেন- এরা খৃস্টান হতে পারে না। এই তথ্য যদি সত্য না হয় যে, দুশমন আমাদের ডান পার্শ্বের বাহিনীর সমুখ দিক থেকে আসছে, তাহলে হামলাটা হবে দুতরফা। আমাদের কোনো ইউনিটকে পিছু হটতে দেয়া যাবে না। পেছনে দেড় হাজার কবরের গর্ত। এখানো সব লাশ দাফন করা হয়নি। অন্যথায় এইসব গর্ত আমাদের অশ্বারোহীদের কবরে পরিণত হবে।
সুলতান আইউবী ঘোড়ায় আরোহন করেন। তার রক্ষী বাহিনীর বারজন সেনা তার পেছনে রওনা দেয়। তারাও অশ্বারোহী। তিনি আধা ডজন দ্রুতগামী অশ্বারোহী দূতও সঙ্গে নিয়ে নেন। সাথে আছে দুজন সালারও। ঘোড়া হাঁকিয়ে তিনি এমন একটি টিলার উপর আরোহন করেন, যেখান থেকে তার বাহিনীর ডান পার্শ্বের সম্মুখের এলাকা ও তার বাহিনীকে দেখা যায়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে তিনি টিলার উপর থেকে অবতরণ করে ডান পার্শ্বের বাহিনীগুলোর কমান্ডারদের নির্দেশ দেন। আরোহীদেরকে ঘোড়ায় আরোহন করাও। পদাতিকদের মধ্যে যারা তীরন্দাজ, তাদেরকে সম্মুখস্থ অঞ্চলের খানা-খন্দকে ও উঁচু পাথরের আড়ালে গিয়ে মোর্চা তৈরি করতে বলো।
এখন থেকে ডান পার্শ্বের সবকটা ইউনিটের সর্বোচ্চ কমান্ড আমার হাতে থাকবে- সুলতান আইউবী তার কমান্ডার ও নায়েব সালারদের বললেন –যার যার দূতকে সঙ্গে রাখো এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।
মুজাফফর উদ্দীনের বাহিনী এখানো এতো নিকটে এসে পৌঁছায়নি যে, তারা সুলতান আইউবীর বাহিনীর তৎপরতা দেখতে পাবে।
***
মুজাফফর উদ্দীনের অশ্বারোহী বাহিনী আক্রমণ করে। কিন্তু যেইমাত্র তার প্রথম অশ্বারোহী ইউনিটটি সুলতান আইউবীর বাহিনীর সম্মুখস্থ এলাকায় এসে পৌঁছে, সঙ্গে সঙ্গে তার সেনানিবাস লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এলাকাটা অসংখ্য খাদ আর স্তূপের ন্যায় পাথর খণ্ডে পরিপূর্ণ। এসব খানা-খন্দকেই সুলতান আইউবীর তীরন্দাজরা বসে আছে। মুজাফফর উদ্দীনের বাহিনী এসে পৌঁছামাত্র উপর দিয়ে অতিক্রমকারী ধাবমান ঘোড়র উপর তীর ছুঁড়তে শুরু করে। তীরের আঘাত খেয়ে আরোহীরা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতে আরম্ভ করে। যখনই যে ঘোড়র গায়ে তীর বিদ্ধ হচ্ছে, সেটি বেশামাল হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করে। সাধারণত এমনটি যে কোনো যুদ্ধেই হয়ে থাকে। মুজাফফর উদ্দীনের জন্য এই পরিস্থিতি বিস্ময়কর কোনো ঘটনা নয়। তার অস্থিরতার কারণ হচ্ছে, তার আশা ছিলো, তিনি সুলতান আইউবীর অজান্তে ও অলক্ষ্যে হামলা করবেন। কিন্তু তার সেই আকাঙ্খর বিপরীতে আইউবীর ডান বাহুর সৈন্যরা সচেতন এবং মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। এই সংঘাতে সুলতান আইউবীর অসংখ্য তীরন্দাজ ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। সৈন্যদের এই ত্যাগের বিনিময়ে সুলতান আইউবীর উপকার এই হলো যে, মুজাফফর উদ্দীনের আক্রমণের তীব্রতা শেষ হয়ে গেছে। এরপর তিনি স্থির হয়ে লড়াই করতে পারবেন। মুজাফফর উদ্দীন যে আশা নিয়ে ময়দানে এসেছিলো, তা পূর্ণ হবে না। তার আশা ছিলো তিনি সুলতান আইউবীর উপর অতর্কিত হামলা চালাবেন এবং আইউবীকে তার কৌশলের ফাঁদে ফেলে পরাস্ত করবেন। কিন্তু তিনি যতোই কুশলী হোন, আইউবী তাঁর ওস্তাদ। ওস্তাদের বিদ্যার কাছে ছাত্রের বিদ্যা হার মানতে বাধ্য। সুলতান আইউবীর নিকট আসার পর মুজাফফর উদ্দীনের বিদ্যা ও কৌশল প্রথমবারের মতো হার মানতে বাধ্য হয়।
সুলতান আইউবীর কিছুসংখ্যক তীরন্দাজ মুজাফফর উদ্দীনের ঘোড়ার পদতলে পড়ে জীবন কুরবান করে দেয়। তাদের এই কুরবানীতে সুলতান আইউবী লাভবান হন। মুজাফফর উদ্দীনের আক্রমণকারী বাহিনী কিছুসংখ্যক ঘোড়া ও তাদের আরোহীদের নিহত ফেলে সম্মুখে এগিয়ে যায়। সম্মুখে সুলতান আইউবী স্বয়ং। আক্রমণকারীদের বিস্তার দেখে সে অনুপাতে নিজ সৈন্যদের নির্দেশ প্রদান করেন। আক্রমণকারী বাহিনী নিকটে এসে পৌঁছলে সুলতান আইউবীর বাম বাহুর অশ্বারোহী সৈন্যরা তাদের ঘোড়াগুলোকে বামদিকে ঘুরিয়ে ছুটতে শুরু করে। ডান বাহুর অশ্বারোহী সৈন্যরাও তা-ই করে। এখন আক্রমণকারীদের সম্মুখে কোনো প্রতিপক্ষ নেই। তাদের প্রতিপক্ষ ডান ও বামদিকে পালিয়ে গেছে।
আক্রমণকারীদের কিছু ঘোড়া ডানদিকে মোড় নেয়। কিছু বামদিকে। অধিকাংশ সৈন্য নাক বরাবর চলে আসে। এখন আক্রমণকারী বাহিনীর পার্শ্বে আইউবীর সৈন্যদের সম্মুখে তারা প্রবলবেগে ঘোড়া হাঁকায় এবং উভয় দিক থেকে ক্ষীপ্র গতিতে হামলা করে বসে। আক্রমণটা এতোই,তীব্র ও কার্যকর প্রমাণিত হয় যে, তাদের একটি বর্শার আঘাতও ব্যর্থ হয়নি। আক্রমণকারীরা তো সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। পার্শ্ব বাহিনীকে হেফাজত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সামনের দিকে চলে যেতে পারলেই তারা নিষ্কৃতি পায়। সামনে দেড় হাজার কবরের গর্ত। আক্রমণকারীদের পেছনে পেছনে সুলতান আইউবীর অশ্বারোহী বাহিনী ধেয়ে আসছে। পেছনের ধাওয়া খেয়ে আক্রমণকারীদের ঘোড়া উন্মুক্ত কবরগুলোর উপর দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে।
মুজাফফর উদ্দীন ভয় পাওয়ার মতো সেনাপতি নন। প্রথম আক্রমণটা স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা করিয়ে তিনি রণাঙ্গনের ভাবটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। পরিস্থিতিটা বুঝে এবার তিনি সৈন্যের স্রোত ছেড়ে দেন। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা খোঁড়া কবরগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। তারা সুলতান আইউবীর দ্বিতীয় নির্দেশ বাস্তবায়ন শুরু করলো বলে, অমনি মুজাফফর উদ্দীনের দ্বিতীয় ইউনিটটি তাদের মাথার উপর এসে পড়ে। তারা আত্মসংবরণ করতেই শত্রু বাহিনীর পেছন দিক থেকে প্রবল বেগে হামলা করে বসে। এই আক্রমণে সুলতান আইউবীর সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। কয়েকজন অশ্বারোহী সামনের দিকে পালিয়ে যায় এবং তাদের ঘোড়াগুলো কবরের গর্তে পড়ে যায়। পরক্ষণেই মুজাফফর উদ্দীন ডানদিক থেকেও আক্রমণ করে বসে।
এই পরিস্থিতি সুলতান আইউবীকে পেরেশান করে তোলে। তিনি এই নির্দেশসহ দূত পাঠিয়ে দেন যে, রিজার্ভ বাহিনী যেনো পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। ডান বাহুর বিন্যাস বেকার হয়ে পড়ে। মুজাফফর উদ্দীন লড়াই করছে আইউবীরই শেখানো কৌশল অনুপাতে। তবে তার দুর্বলতা হলো, পেছন থেকে তার সাহায্যের কোন ব্যবস্থা নেই। সুলতান আইউবী দূতদের মাধ্যমে তার কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদেরকে ডান ও বাম দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। যখন তার রিজার্ভ বাহিনী পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে, মুজাফফর উদ্দীন বেকায়দায় পড়ে যান। এবার তার হেডকোয়ার্টারই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু তারপরও তিনি পালাবার চিন্তা করেননি।
ঐতিহাসিকদের মতে, বিকাল পর্যন্ত উভয় বাহিনীর যে লড়াই অব্যাহত থাকে, তা ছিলো অত্যন্ত তীব্র ও অতিশয় রক্তক্ষয়ী। কমান্ড সুলতান আইউবীর হাতে ছিলো। অন্যথায় ফলাফল ভিন্ন রকম হতো। এই যুদ্ধে মুজাফফর উদ্দীন যে দক্ষতা ও সাহসিকতার প্রমাণ দেন, তাতে সুলতান আইউবী তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তবে গুরুর কাছে শিষ্য হার মানতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সুলতান আইউবী তার একটি বিশেষ অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা আক্রমণ করান। তাতে মুজাফফর উদ্দীনের অবস্থান অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। টিকতে না পেরে তিনি পেছনে সরে যান। তার বহু সৈন্য সুলতান আইউবীর হাতে বন্দী হয়। মুজাফফর উদ্দীনের সামরিক উপদেষ্টা ফখরুদ্দীনও বন্দী হয়।
ফখরুদ্দীন সাধারণ কোনো লোক নয়। সাইফুদ্দীনের মন্ত্রী ছিলো। তুমানের যুদ্ধে সাইফুদ্দীন পালিয়ে গেলে ফখরুদ্দীন মুজাফফর উদ্দীনের নিকট চলে যায় এবং সুলতান আইউবীর উপর হামলা করার জন্য তাকে প্ররোচিত করে।
ঘটনাটা ৫৭১ হিজরী মোতাবেক ১১৭৪ সালের। এই যুদ্ধে মুজাফফর উদ্দীন পরাজয়বরণ করেন এবং সুলতান আইউবী তার মুসলমান দুশমনদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুলতান আইউবীরও এতো বেশি ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো যে, পরবর্তী দুই মাস পর্যন্ত তিনি তুকমান থেকে নড়ার শক্তি পাননি। তাঁর ডান বাহু নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো, যেনো তাঁর নিজের বাহু অবশ হয়ে গেছে। তার নিকট নতুন ভর্তি আসছিলো। কিন্তু এখনই তাদের নিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিলো না। তিনি সেদিনই দামেস্ক ও মিশর দূত প্রেরণ করে নতুন সৈন্য তলব করেন। ক্ষতিটা যদি এতো বেশি না হতো, তাহলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে হাব, মসুল ও হাররানের উপর আক্রমণ করে তাঁর যেসব মুসলমান দুশমন ফিলিস্তিনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছিলো, তাদেরকে হয়তো সুপথে ফিরিয়ে আনতেন, নতুবা খতম করে দিতেন।
এটা আমার বিজয় নয়- যুদ্ধের পর সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের উদ্দেশে বললেন- এটা খৃস্টানদের বিজয়। তারা আমাকে দুর্বল করতে চাচ্ছিলো। এই লক্ষ্যে তারা সফল হয়েছে। তারা আমাদের অগ্রযাত্রার গতি শ্লথ করে ফিলিস্তিনের উপর তাদের কজা আরো দীর্ঘতর করে নিলো। আমাদের এই মুসলমান ভাইয়েরা কবে বুঝবে যে, কাফেররা তাদের বন্ধু হতে পারে না এবং তাদের বন্ধুত্বের আড়ালেও শত্রুতা লুকায়িত থাকে। ইতিহাস লেখকরা আমাদের অনাগত বংশধরদের আমাদের এই পারস্পারিক সংঘাতকে কোন্ ভাষায় বুঝাবে, তা আমার জানা নেই।
***
আসিয়াত ও তুর্কমানের মধ্যবর্তী সেই নরকসম এলাকায়, যেখানে সুলতান আইউবীর চারজন কমান্ডো সেনা পথ ভুলে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিলো, সেখানে এখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কমান্ডার আন-নাসের চোখ খোলে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে। মেয়ে দুটো জেগে আছে। এবার আন-নাসের-এর মনে ভয় ধরে যায়। মেয়েরা তাকে অভয়বাণী শুনিয়েছিলো। আর সে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
ওদেরকে জাগাও- বড় মেয়েটি বললো- আমাদেরকে বহু দূর যেতে হবে।
আমাদেরকে পথে তুলে দিয়ে যাবে তো? আন-নাসের জিজ্ঞেস করে।
তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে যাবে- মেয়েটি জবাব দেয়- আমাদের ছাড়া তোমরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না।
আন-নাসের তার সঙ্গীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে কি যেন বললো। সে উঠে অপর একটি ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা থলে থেকে কি যেনো বের করে। তারপর পানির মশক খুলে আনে। মশকের মুখ খুলে থলের বস্তুগুলো মশকের মধ্যে ফেলে দেয়। তারপর নাড়া দিয়ে মশকটি আন-নাসেরের হাতে দিয়ে বললো- পানি পান করে নাও; গন্তব্যে পৌঁছার আগে পানি না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা পানি পান করে। বড় মেয়েটি তাদের প্রত্যেককে কিছু খাবার খেতে দেয়। পরে মেয়েরা থলে থেকে মশকটিকে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বেঁধে রাখে। সূর্য নীচের দিকে নামতে থাকে।
তোমরা এই স্থানটিকে জাহান্নাম বলেছিলে- আন-নাসের উচ্চস্বরে বলে ওঠে- আমি তো এখানে সবুজ-শ্যামলিমা দেখতে পাচ্ছি। তোমরা এতো তাড়াতাড়ি আমাদেরকে এখানে কিভাবে পৌঁছিয়ে দিলে?
আন-নাসেরের তিন সঙ্গী বিস্মিত নয়নে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করছে।
তোমরাও কি সবুজ-শ্যামলিমা দেখতে পাচ্ছ? বড় মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
আমরা সবুজের মাঝে বসে আছি- একজন বললো।
তোমরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে না তো? তোমরা তো পরী! অপর একজন বললো।
না- মেয়েটি মুচকি হেসে বললো- আমরা তোমাদেরকে এর চেয়েও সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।
বড় মেয়েটি আন-নাসের ও তার সঙ্গীদের তার সম্মুখে পাশাপাশি বসিয়ে দুহাত দুজনের কাঁধের উপর রেখে বললো- আমার চোখে দৃষ্টিপাত করো।
ছোট মেয়েটিও আন-নাসেরের অপর সঙ্গীদেরকে অনরূপ সামনাসামনি বসিয়ে নিজের হাত দুটো তাদের কাঁধে রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বললো। সুলতান আইউবীর চার কমান্ডের কানে বড় মেয়েটির সুরেলা কণ্ঠ প্রবেশ করতে শুরু করে- এটি তোমাদের জান্নাত। এই ফুলগুলোর রং দেখো। এর সৌরভ শুঁকে দেখো। ফুলের মাঝে উড়ন্ত পাখিগুলোকে দেখো। তোমাদের পায়ের নীচে মখমলের ন্যায় ঘাস। কূপ দেখো। কূপগুলোর স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পানি দেখো।
মেয়েটির কণ্ঠ চার কমান্ডোর বিবেক, চোখ ও সমস্ত অনুভূতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। আন-নাসের পরে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা প্রধান হাসান ইব্নে আব্দুল্লার নিকট ঘটনার যে বিবরণ প্রদান করেছিলো, তাতে সে বলেছিলো, মেয়ে দুটোর চোখগুলোকে পানির স্বচ্ছ কূপ মনে হতে লাগলো। সঙ্গে তাদের কাঁধের উপর ছড়ানো রেশমকোমল চুলগুলো চিত্তাকর্ষক ফুলের পাপড়িতে পরিণত হয়ে যায়। আমাদের মনে হচ্ছিলো, আমরা এমন একটি বাগিচায় বসে আছি, যার সৌন্দর্য ও ফুলের রঙের বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। সেখানে বালি ও মাটির লম্বা লম্বা টিলা ছিলো না। ছিলো না মরু অঞ্চল। সর্বত্র গাছ-গাছালি আর সবুজের সমারোহ। পায়ের নীচে মখমলসম ঘাসের ফরাশ আর রং-বেরঙের পাখ-পাখালির কিচির-মিচির শব্দ।
***
আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা মখমলসম যে ঘাসের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছিলো, সেগুলো ছিলো মূলত বালি। কোথাও কোথাও শক্ত মাটি। তারা সব কজন গুন গুন করে একটি গান গেয়ে চলছে। মেয়ে দুটো তাদের কয়েক পা দূরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের গতি তুর্কমান নয়, যেখানে সুলতান আইউবীর ফৌজ অবস্থান করছে এবং সেটি আন নাসের ও তার সঙ্গীদের গন্তব্য। তাদের গতি আসিয়াতের সেই দুর্গ, যেখানে হাশিশিদের নেতা শেখ সান্নান অবস্থান করছে। আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা জানে না, তারা কোনদিকে যাচ্ছে। বরং পথ চলছে কিনা, তাদের সেই অনুভূতিটাই ভোতা হয়ে গেছে। তাদের পেছনে পেছনে সেই মেয়ে দুটো আপসে কথা বলছে। সেই কথার শব্দ কমান্ডোদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। সূর্য ডুবে গেছে।
তুমি বলছো, রাতে কোথাও অবস্থান করবে না- ছোট মেয়েটি বড় মেয়েকে বললো- লোকগুলো কি সারারাত হাঁটতে পারবে?
তুমি পানিতে মিশিয়ে তাদেরকে যে পরিমাণ হাশিশ পান করিয়েছে, তার ক্রিয়া আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে- বড় মেয়েটি বললো- আর আমি তাদেরকে যা খাইয়েছি, তা তুমি দেখেছো। এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আশা করি, সূর্যোদয়ের আগে আগেই আমরা আসিয়ান পৌঁছে যাবো।
আমি তো ওদেরকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম- ছোট মেয়েটি বললো তোমার কৃতিত্ব যে, তুমি তাদেরকে আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে এবং তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে, আমরা পরী। মুসলমানরা জিন-পরী বিশ্বাস করে।
এটা ছিলো বুদ্ধির খেলা- বড় মেয়েটি বললো- আমি তাদের মানসিক অবস্থাটা আয়ত্ত্ব করে ফেলেছিলাম। তাদের চেহারা ও চালচলন দেখে আমি বুঝে ফেলেছিলাম, ওরা সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিক এবং পথ ভুলে গেছে। আমি এও বুঝে ফেলেছিলাম যে, আমাদেরকে দেখে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি আমরা ভয় পেয়ে যেতাম এবং নারীর ন্যায় কাপুরুষতা প্রদর্শন করতাম, তাহলে উল্টো তারা আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে, যা আমরা জীবনেও ভুলতে পারতাম না। এই বিজন অঞ্চলে কোনো পুরুষ যদি আমাদের ন্যায় মেয়েদের হাতে পেয়ে যায়, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে বোন-কন্যার চোখে দেখবে, এমন আশা করা যায় না। আমি তাদের দৈহিক অবস্থা দেখেছি। তারপরও কৌশল ঠিক করেছি, মুসলমানদের মধ্যে তো এই দুর্বলতা আছে যে, জিনের ব্যাপারে তারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তাই আমি বুদ্ধি করে জিন সেজেছি। এই নরকে আমাদের ন্যায় রূপসী মেয়েদের উপস্থিতিকে তাদের বিবেক মেনে নিতে পারে না। তারা আমাদেরকে হয়তো কাল্পনিক বলে মনে করছে, নয়তো জিন-পরী ভাবছে। আমি তাদের সঙ্গে যে ধারায় কথা বলেছি, তাতে তারা নিশ্চিতভাবে বুঝে নিয়েছে। আমরা পরী। মুসলমান আবেগপ্রবণ জাতি। এটা তাদের দুর্বলতা। বিষয়টা আমার জানা ছিলো। তোমাকে এখনো অনেক কিছু শেখাতে হবে। তাড়াতাড়ি শিখে ফেলল। আমি সাইফুদ্দীনের ন্যায় সুচতুর লোকটাকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়ে ছেড়েছি। এরা তো সৈনিক।
জানি না আমি কেন এই বিদ্যায় সফল হতে পারছি না- ছোেট মেয়েটি বললো- আমার অন্তর আমাকে সঙ্গ দেয় না। তোমার মতো কৃতিত্ব প্রদর্শনের চেষ্টা তো কম করছি না। কিন্তু হৃদয় থেকে আওয়াজ আসে, এটা প্রতারণা।
তাহলে তুমি পুরুষদের হাতের খেলনা-ই হয়ে থাকবে- বড় মেয়েটি বললো- তুমি এই প্রথমবার বাইরে বের হয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি সফল হচ্ছে না। এমন হলে তোমাকে পুরুষদের গণিকা হয়েই থাকতে হবে। এভাবে তুমি ক্রুশের কোন সেবা করতে পারবে না। নিজের শরীরটাকে তুমি সময়ের অনেক আগে বৃদ্ধ বানিয়ে ফেলবে আর এই পুরুষরা তোমাকে বাইরে ছুঁড়ে মারবে। আমাদের উদ্দেশ্য এই নয় যে, আমরা মুসলিম আমীর ও শাসকদের বিনোদনের উপকরণ হয়ে থাকবে। একদিন না একদিন আমাদেরকে জাদু হয়ে তাদের বিবেকের উপর জয়ী হতেই হবে। এই চার সৈনিকের মাঝে তুমি যে কুসংস্কার দেখেছে, তা আমাদের খৃস্টান গুরু এবং ইহুদীরা তাদের মাঝে জন্ম দিয়েছে। তুমি দেখেছো, আমি কতো তাড়াতাড়ি তাদেরকে আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছি। আমি তাদেরকে একটি কথা বলছিলাম। কথাটা আমাকে আমার ওস্তাদ শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলে মানুষ একটি আনন্দের সৃষ্টি। আর সবসময় তারা সেই আনন্দ ভোগ করার প্রত্যাশী থাকে। আবার তারা এই কামনাকে দমন করারও চেষ্টা করে থাকে। আমাদের মিশন হলো মুসলমানদের মাঝে এই ভোগলিপ্সা জাগিয়ে তোলা। এটাই মানুষের সেই দুর্বলতা, তাকে ধ্বংসের দুয়ারে পৌঁছিয়ে দেয়। তোমার কি সেই রাতের কথা মনে নেই, যে রাতে সাইফুদ্দীন আমাদের উপস্থিতিতে তার এক সালারকে বলেছিলেন- আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করা যায় কিনা ভাবছি। আমি সেই রাতেই তার মস্তিষ্ক থেকে এই ভাবনা বের করে দিয়েছিলাম।
আসিয়াত পৌঁছে আমাকেও এই ওস্তাদী শিখিয়ে দিও- ছোট মেয়েটি বললো- এই কাজগুলো করতে আমার কেমন যেনো অনীহা লাগছে। আমি মুসলমান শাসকদের খেলনা হয়ে আছি। তুমি তো চালাকি করে আঁচল বাঁচিয়ে রাখছে; কিন্তু আমি পারছি না। অনেক সময় মনে চিন্তা আসে, পালিয়ে কোথাও চলে যাই। কোন পথও পাই না, আমার কোন আশ্রয়ও নেই।
সবই শিখতে পারবে- বড় মেয়েটি বললো- তোমাকে আমার সঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমি তোমার দুর্বলতাগুলো বুঝতে পেরেছি। এসব দূর হয়ে যাবে।
আন-নাসের তার সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে চলছে। মেয়েরা ঘোড়া নিয়ে তাদের সামনে চলে যায়, যাতে তারা পথ হারিয়ে না ফেলে। তারা সমকণ্ঠে গান গেয়ে চলছে। বালি, মাটি ও পাথর তাদের জন্য ঘাস হয়ে আছে।
ওদেরকে অন্য কোন পথে তুলে দেয়া প্রয়োজন ছিলো- ছোট মেয়েটি বললো- ওদেরকে অসিয়াত নিয়ে কী করবে?
আমাদের গুরু শেখ সান্নানের জন্য এর চেয়ে উত্তম উপহার আর কিছু হতে পারে না- বড় মেয়েটি জবাব দেয়- এরা সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডোসেনা এবং গুপ্তচর। আইউবীর একজন গুপ্তচর ধরে তার মস্তিষ্ক ধোলাই করতে পারলে বুঝতে হবে, তুমি তার বাহিনীর এক হাজার সৈনিককে বেকার করে দিয়েছে। আইউবীর একজন গুপ্তচর গেরিলা সৈন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন একজন সেনা অফিসারের সমান, বরং তার চেয়েও মূল্যবান। তারা দৈহিক দিকে থেকে অস্বাভাবিক শক্তিশালী ও সহনশীল। আবার মানসিক দিক থেকেও পাহাড়ের ন্যায় অটল। নিজের কর্তব্যকে তারা জীবনের চেয়েও মূল্যবান মনে করে থাকে। এই চার সৈনিক অভিযান পরিচালনা এবং ক্লান্তির পরও মরু অঞ্চলে যে বিপদ ও ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করেছে, তা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সৈন্যদের মাঝে এই চেতনা ও ক্ষমতা নেই। সুলতান আইউবীর এই চার সৈনিককে আমি শেখ সান্নানের হাতে তুলে দেবো। তুমি সম্ভবত, জানো না, সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। কিন্তু একটি অভিযানও সফল হয়নি। এই চার ব্যক্তিকে হাশিশ ও ওস্তাদীর মাধ্যমে আইউবীকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এরা আইউবীর নিজস্ব কমান্ডো। এরা সহজে আইউবী পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবে।
আচ্ছা, আমরা সাইফুদ্দীন, গোমস্তগীন ও অন্যান্যদেরকে যেভাবে কাবু করেছি, সালাহুদ্দীন আইউবীকে কি সেই প্রক্রিয়ায় কাবু করা যায় না? ছোট মেয়েটি প্রশ্ন করে।
না–বড় মেয়েটি জবাব দেয়- যে ব্যক্তি জগতের সুখ-ভোগ ত্যাগ করে একটি পবিত্র লক্ষ্য অর্জনে আত্মনিয়োগ করেছে, আমাদের ন্যায় রূপসী মেয়ে আর সোনার স্তূপ কোনকিছুই তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। আইউবী এক স্ত্রীর প্রবক্তা। নুরুদ্দীন জঙ্গীর এই একটি সমস্যা ছিলো যে, রাজা হয়েও তিনি ঘরে একজন মাত্র স্ত্রী রেখেছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তারই অনুরক্ত ছিলেন। এই সমস্যাটা সালাহুদ্দীন আইউবীর মধ্যেও বিদ্যমান। বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু এই পাথরটাকে গলানো যায়নি। অথচ আইউবীকে হত্যা না করে আমাদের ফিলিস্তিনে দখল বজায় রাখা সম্ভব নয়।
সেই পুরুষই আমার কাছে ভালো লাগে, যে এক স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ছোট মেয়েটি বললো- আমি ক্রুশের পুজারী। ক্রুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জানা থাকা সত্ত্বেও আমি মাঝে-মধ্যে ভাবি, আমি এমন একজন পুরুষের হৃদয়ে স্থান করে নেই, যে আমার দেহ-মন ও আত্মার অংশ হয়ে থাকবে।
আবেগ ত্যাগ করো- বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বললো ক্রুশের মহান মিশন বাস্তবায়নে নিবেদিত হয়ে কাজ করো। ক্রুশ হাতে নিয়ে যে শপথ করে এসেছে, সে কথা স্মরণ করো। আমি জানি, তুমি টগবগে এক তরুণী। এই বয়সে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ। কিন্তু ক্রুশ আমাদের থেকে এই কুরবানীই কামনা করছে।
রহস্যময় এই কাফেলাটি এগিয়ে চলছে। আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা মেয়েদের ঘোড়ার পেছন পেছন হাঁটছে। তারা কখনো সমস্বরে গান গাইছে, কখনো গুন গুন করছে। আবার কখনোবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। রাত যতো গম্ভীর হচ্ছে, তাদের গন্তব্যও কাছে চলে আসছে।
***
এরা সেই গোত্রের মেয়ে, যাদের একাধিক কাহিনী আপনারা পেছনে পাঠ করে এসেছেন। ইহুদী-খৃস্টানরা সুন্দরী কিশোরী-তরুণীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা বিনষ্ট, চরিত্র ধ্বংস এবং শত্রুকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করার কলাকৌশল শিক্ষা দিতো। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে শত্রুর চিন্তা-চেতনার উপর কিভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে হবে, সেই প্রশিক্ষণ তাদের কৈশোরেই প্রদান করা হতো। তাদের মাঝে চঞ্চলতা ও বেহায়াপনা সৃষ্টি করা হতো। তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে নীতি নৈতিকতা ও লাজ-শরম কিছুই অবশিষ্ট রাখা হতো না। ইহুদীরা যেহেতু মুসলমানদেরকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করতো, সে জন্যে তারা তাদের কন্যাদেরকে এ কাজের জন্য খৃস্টানদের হাতে তুলে দিতো। খৃষ্টানরা নিজেদের কন্যাদেরকে ব্যবহার করতো। তারা তাদের শাসিত অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের কাফেলার উপর আক্রমণ করতো এবং কোন রূপসী-কিশোরী কন্যা পেলে তাকে তুলে নিয়ে আসতো এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মিশনের জন্য প্রস্তুত করতো।
এই মেয়ে দুজনকে খৃস্টানরা কিছুদিন আগে মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনের নিকট উপহার স্বরূপ প্রেরণ করেছিলো। সাইফুদ্দীন সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন। খৃস্টানরা এ মেয়ে দুজনকে তিনটি মিশন দিয়ে প্রেরণ করে। প্রথমত, তারা খৃস্টানদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করবে। দ্বিতীয়ত, সাইফুদ্দীন যাতে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করার ভাবনা ভাবতে না পারে, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখবে। তৃতীয় মিশন ছিলো, যেসব মুসলিম আমীর সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গিয়েছিলো, তাদের মাঝে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা। এ কাজগুলো শুধু এ দুটো মেয়ের উপরই ন্যাস্ত করা হয়নি, সেখানকার গোটা খৃস্টান মিশনারীই এ কাজে নিয়োজিত ছিলো। তারা বেশ কজন মুসলমানের ঈমান ক্রয় করে ফেলেছে। এখন সেসব মুসলমান তাদেরই হয়ে কাজ করছে।
সাইফুদ্দীন যখন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে তুর্কমানে সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করতে গিয়েছিলেন, তখন রাজা বাদশাদের রীতি অনুযায়ী তিনি তার হেরেমের বাছা বাছা মেয়ে এবং গায়িকা নর্তকীদের রণাঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই রূপসী মেয়ে দুজনও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সাইফুদ্দীন এদেরকে নিষ্পাপ মনে করতেন। কিন্তু বড় মেয়েটি প্রেতাত্মার ন্যায় সাইফুদ্দীনের শিরায় শিরায় মিশে গিয়েছিলো। হেরেমের অন্যান্য মেয়েদেরকে সে তার দাসী বানিয়ে রেখেছিলো।
সাইফুদ্দীন জঙ্গলকে মঙ্গলে পরিণত করে নিয়েছিলো। এক সময় সেখানে মরুঝড় হয়, যার বিবরণ আপনারা উপরে পাঠ করে এসেছেন। এই ঝড়ের মধ্যে ফাওজিয়া নাম্মী এক মেয়ে আপন ভাইয়ের মৃতদেহ ঘোড়ার পিঠে করে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে দিয়েছিলো এবং সংবাদ প্রদান করেছিলো যে, তিনটি বাহিনী একজোট হয়ে তার উপর আক্রমণ করতে এসে পড়েছে।
সুলতান আইউবী দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং সাইফুদ্দীনের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসেন। অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে সাইফুদ্দীনের বহু সৈন্য প্রাণ হারায়। এই একতরফা লড়াইয়ে রণাঙ্গন ছিলো সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে। সাইফুদ্দীন তার সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ড সামলাতে ব্যর্থ হন। যখন তার ময়দান ছেড়ে পালাবার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন এই মেয়ে দুটো তার সঙ্গে ছিলো। খৃস্টানদের কয়েকজন মুসলমান এজেন্ট সাইফুদ্দীনের ফৌজের উচ্চপদে সমাসীন ছিলো। এই মেয়ে দুটোর সঙ্গে তাদের ভালো যোগাযোগ ছিলো। মেয়েরা তাদেরকে খবরাখবর জানাতো আর তারা সেসব সংবাদ খৃস্টানদের নিকট পৌঁছে দিতো।
তারা যখন দেখলো, যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন এক রূপ ধারণ করেছে যে, সম্মিলিত বাহিনীকে পিছপা হওয়া ব্যতীত কোন উপায় নেই, তখনই তারা মেয়ে দুটোকে ওখান থেকে নিয়ে কেটে পড়ার পরিকল্পনা আঁটে। খৃস্টানদের এই মেয়ে দুজন খুবই মূল্যবান। সাইফুদ্দীন যুদ্ধের ময়দানে ছুটে বেড়াচ্ছেন। হেরেমের মেয়েরা তার বিশ্রামাগারের একটি তাঁবুতে এসে জড়ো হয়। এই খৃস্টান মেয়ে দুটো এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের লোকেরা এসে পড়েছে। তাদেরকে দুটি ঘোড়া দেয়া হলো। ঘোড়ার জিনের সঙ্গে পানির চারটি মশক ও খাবারের দুতিনটি থলে বেঁধে দেয়া হলো। খঞ্জরও দেয়া হলো। কিন্তু তাদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে হাশিশ আর অনুরূপ এমন একটি নেশাকর দ্রব্য, যার কোনো স্বাদ নেই। এই বস্তুটা কাউকে তার অজান্তে পান করানো বলে সে টেরই পায় না যে, পানি বা শরবতের সঙ্গে তাকে অন্য কিছু পান করানো হয়েছে। এই নেশাকর পদার্থ দুটো তাদের সঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, তাদেরকে কোনো পুরুষের সঙ্গ ছাড়া সফর করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত যদি পথে কারো হাতে পড়ে যায়, তাহলে অজান্তে এসব পান করিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে।
রাতের বেলা। রণাঙ্গনে ঘোরতর যুদ্ধ চলছে। দুব্যক্তি মেয়ে দুটোকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে ছুটতে শুরু করে। তুর্কন পেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত লোকগুলো তাদের সঙ্গে যায়। তারপর মেয়েদেরকে পথ বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। মেয়েদের গন্তব্য অসিয়ানের দুর্গ। বড় মেয়েটি অত্যন্ত বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ও সাহসী। ছোট মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সে যাত্রা শুরু করে। তোর নাগাদ তারা সবুজ-শ্যামল অঞ্চল ত্যাগ করে বেশ দূরে চলে যায় এবং উক্ত অঞ্চলের নরক বলে পরিচিত ভূখণ্ডে এসে পৌঁছে। মেয়েদের জানা আছে, এ স্থানে পৌঁছে তরুলতাহীন পাথুরে পথ অতিক্রম করতে হবে। অঞ্চলটা ভীতিকর এবং উত্তপ্ত চুলোর ন্যায় গরম। সূর্য মাথার উপর উঠে এলে তারা পাবর্ত্য এলাকায় এসে পৌঁছে। তারা একটি টিলার আড়ালে অবস্থান নিয়ে পানাহার করে বিশ্রাম করতে থাকে। ঐ সময় তারা আন-নাসেরকে তার তিন সঙ্গীসহ আসতে দেখে।
তাদেরকে দেখেই বড় মেয়েটি বুঝে ফেলে, তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন। মেয়েটির তার বিদ্যার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে শুরু করে, যার ফলে আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা তাদেরকে কাল্পনিক বস্তু কিংবা পরী বলে বিশ্বাস করে ফেলে। মেয়েটির প্রতিটি পদক্ষেপই শতভাগ সফল হয়। প্রথমে সে লোকগুলোকে পানি ও কাবাব খাওয়ায়। তারপর হাশিশ এবং অন্য নেশাকর দ্রব্যটি পান করায়। লোকগুলোকে নেশা পান করিয়ে তারা ফুল, সবুজ-শ্যামলিমা, পাখ-পাখালি ও মখমলসম ঘাসের উল্লেখ করেছিলো, তা লোকগুলোর মস্তিষ্কে জান্নাতের কল্পনা জাগ্রত করে দেয়। হাশিশ পান করিয়ে মানুষের মন-মস্তিষ্কে সুদর্শন কল্পনা সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা হাসান ইবনে সাব্বাহর আবিষ্কৃত পদ্ধতি। শত বছর পরে শেখ সান্নান এখন তার স্থলাভিষিক্ত। এই চক্রটিকে এখন হাশিশি কিংবা ফেদায়ী বলা হয়। বড় মেয়েটির এ বিদ্যার প্রশিক্ষণ আছে।
মেয়েটি আন-নাসের ও তার সঙ্গীদেরকে আয়ত্ত্বে নিয়ে একটি লক্ষ্য তো এই অর্জন করতে চাচ্ছিলো যে, লোকগুলো তাদের প্রতি হাত বাড়াবে না কিংবা অপহরণ করে নিয়ে যাবে না। দ্বিতীয়ত, যদি প্রমাণিত হয় যে, এরা সুলতান আইউবীর গুপ্তচর কিংবা কমান্ডো সেনা, তাহলে কৌশলে তাদেরকে নিয়ে শেখ সান্নানের হাতে তুলে দেবে। এদের দ্বারা তার কোনো না কোনো উপকার আসতে পারে। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে হাররানের স্বাধীন শাসক গোমস্তগীন আসিয়ান দুর্গে শেখ সান্নানের সঙ্গে সাক্ষাতও করে গেছেন।
***
তুর্কমানে মুজাফফর উদ্দীনের আক্রমণ ব্যর্থ করে দিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁর সালারদের বললেন- এবার যুদ্ধ শেষ হলো। তিনি মালে গনীমত সংগ্রহ করার নির্দেশ প্রদান করেন। শত্রু বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ। সাইফুদ্দীনের ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হলো বিপুল সোনা ও নগদ অর্থ। শত্রু বাহিনীর সৈন্যদের লাশের দেহ থেকেও নগদ অর্থ, সোনার আংটি ইত্যাদি সম্পদ পাওয়া যায়। অন্যান্য মালপত্র ও অস্ত্রশস্ত্রের কোনো হিসাব ছিলো না। সালাহুদ্দীন আইউবী যুদ্ধের কাজে আসতে পারে এমন সব মালপত্র সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন। একাংশ মালামাল দামেস্ক এবং সেসব এলাকায় গরীবদের মাঝে বণ্টন করে দেয়ার আদেশ প্রদান করেন, যেগুলো মিশর ও সিরিয়ার সাম্রাজ্যের আওতায় এসে গেছে। অপর এক অংশ মাদ্রাসা নিজামুল মুলককে প্রদান করেন। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ লিন পোলের বর্ণনা মতে- সালাহুদ্দীন আইউবী উক্ত মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ইতিহাসে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সালাহুদ্দীন আইউবী তুর্কমানের গনীমত থেকে নিজে কোনো ভাগ নেননি।
এবার বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। বন্দীরা সকলেই মুসলমান। সালাহুদ্দীন আইউবী তাদেরকে একত্রিত করে বললেন- তোমরা মুসলমান এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিলে। তোমাদের পরাজয়ের কারণ হচ্ছে, তোমাদের শাসনকর্তা তোমাদের ধর্মের ঘৃণ্যতম শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তার হাত শক্ত করছে। তোমাদের দুনিয়াও নষ্ট হলো, আখেরাতও বরবাদ হলো। এখন তোমাদের সামনে পাপ স্খলনের একমাত্র পথ হচ্ছে, তোমরা ইসলামের সৈনিক হয়ে যাও এবং নিজেদের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করো।
সালাহুদ্দীন আইউবীর এই ভাষণটি ছিলো অত্যন্ত তেজস্বী ও আবেগপ্রবণ। বন্দীদের সমাবেশের মধ্য থেকে শত কণ্ঠে আকাশ কাঁপানো নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারিত হতে শুরু করে। তারা সমস্বরে সালাহুদ্দীন আইউবীর আনুগত্যের ঘোষণা দিতে আরম্ভ করে। এভাবে আইউবীর বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও কমান্ডারের সংখ্যা বেড়ে গেলো। তথাপি সুলতান অগ্রযাত্রা মুলতবি রাখেন। বাহিনীর নববিন্যাস আবশ্যক। তিনি দামেস্ক ও. কায়রো থেকেও সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। সেখানেই আহতদের চিকিৎসা সেবা চলছে। যুদ্ধে জয়ী হলেও মুজাফফর উদ্দীনের এই আক্রমণ সালাহুদ্দীন আইউবীকে বেশ বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
আসিয়াত দুর্গ ছিলো বর্তমানকার লেবাননের সীমান্ত এলাকায়। মিশরী ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ফরীদ আবু হাদীদের বর্ণনা মোতাবেক আসিয়াত দুর্গ ছিলো হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক চক্র হাশিশিদের কেন্দ্র ও আস্তানা। সেখানে হাসান ইবৃনে সাব্বাহর স্থলাভিষিক্ত শেখ সান্নানের রাজত্ব ছিলো। দুর্গে তার একটি বাহিনীও রাখা ছিলো। দুৰ্গটা ছিলো বেশ বড়সড়। তার থেকে দূরে দূরে ছোট আরো তিন-চারটি দুর্গ ছিলো। এই দুর্গগুলোও ছিলো শেখ সান্নানের হাশিশীদের দখলে। খৃস্টানরা তাদেরকে এই দুর্গগুলো দিয়ে রেখেছিলো। খৃস্টানরা এই হাশিশীদের মুসলিম নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা এবং মুসলিম জাতির চরিত্র ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করতো। কিন্তু তাদেরই একটি দল শেষ পর্যন্ত ভাড়াটিয়া খুনী চক্রে পরিণত হয়ে যায়। তারা কতিপয় খৃস্টান নেতৃবর্গকেও হত্যা করেছিলো। বিনিময় পেলেই তারা যে কাউকে খুন করতে প্রস্তুত হয়ে যেতো। সালাহুদ্দীন আইউবীর আমলে খৃস্টানরা তাদেরকে এতো বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে যে, কতগুলো দুর্গ পর্যন্ত তাদেরকে দিয়ে দেয়। তাদের মাধ্যমে, খৃস্টানরা সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহুদ্দীন আইউবীকে খুন করাবার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যু সম্পর্কে মেজর জেনারেল আকবর খান কোনো কোনো ঐতিহাসিকের সূত্রে লিখেছেন- এটি ছিলো হাশিশীদের কর্ম। হাশিশীরা তাকে গোপনে কি যেনো খাইয়েছিলো, যার ক্রিয়ায় দিন কয়েক পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারা এখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে। হাশিশীরা খৃস্টানদের হাতে খেলছে।
সকাল বেলা। সূর্য এখনো উদিত হয়নি। আন-নাসের ও তার তিন সঙ্গী খৃস্টান মেয়ে দুটির সঙ্গে আসিয়াত দুর্গের ফটকের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। বড় মেয়েটি একটি সাংকেতিক শব্দ উচ্চারণ করে। ক্ষণিক পর দুর্গের দরজা খুলে যায়। শেখ সান্নান সব বিচারেই রাজা। একজন রাজার সব ক্ষমতাই তার আছে। তার চলন-বলন, ভাবগতি ও শান-শওকত রাজকীয়। লোকটার এই অনুভূতিটুকুও নেই যে, সে বৃদ্ধ হয়ে গেছে। বড় মেয়েটি যখন তাকে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলো এবং সাইফুদ্দীনের শোচনীয় পরাজয়ের বিস্তারিত শোনাচ্ছিলো, তখনো তার লোলুপ দৃষ্টি ছোট মেয়েটির উপর নিবদ্ধ ছিলো।
এদিকে আসো- শেখ সান্নান বড় মেয়েটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে ছোট মেয়েটিকে কাছে ডেকে বললো- তুমি প্রয়োজন অপেক্ষা বেশি রূপসী। তুমি আমার কাছে এসে বসো। শেখ সান্নান মেয়েটির বাহু ধরে টেনে এনে নিজের গা-ঘেঁষে বসায় এবং তার মাথায় হাত দিয়ে আঙ্গুল দ্বারা চুলে বিলি কাটতে শুরু করে। বললো- তুমি অনেক ক্লান্ত। আজ আমার কাছে বিশ্রাম করবে।
মেয়েটি শেখ সান্নানকে এই প্রথমবারের মতো দেখলো। সে লোকটাকে ঘুরে-ফিরে দেখতে থাকে। একবার তার প্রতি, আবার তার সঙ্গী মেয়েটির প্রতি তাকাতে থাকে। মুখে তার বিরক্তির ছাপ। যেনো বৃদ্ধের এই আচরণ তার ভালো লাগছে না। মেয়েটি লাফ দিয়ে বৃদ্ধের নিকট থেকে সরে যায়। শেখ সান্নান আবারো মেয়েটির বাহু ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে, যেনো সরে গিয়ে সে তাকে অপমান করেছে। সে বড় মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বললো মেয়েটিকে বোধ হয় আমাদের রীতি শিক্ষা দেয়া হয়নি। আমাদের অপমান করা কতো বড় অপরাধ!
আমি আপনার দাসী নই- ছোট মেয়েটি উত্তেজিত কণ্ঠে বললো- এটা আমার কর্তব্য নয় যে, কেউ আমাকে নিয়ে টানা-হেঁছড়া করতে চাইলেই আমি নিজেকে সপে দেবো। মেয়েটির উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো- আমি ক্রুশের গোলাম, আমি হাশিশীদের কেনা দাসী নয়।
বড় মেয়েটি তাকে ধমক দিয়ে চুপ হতে বললো। কিন্তু মেয়েটি চুপ হলো না। বলতে লাগলো- এই লোকটি আমাকে মুসলমানদের হেরেমে দেখেনি। আমি দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি করিনি। আমি তোমার সঙ্গে থেকে সাইফুদ্দীন ও তার পরামর্শকদের বিবেক-বুদ্ধির উপর পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছি। তাই বলে এটা আমার দায়িত্ব নয় যে, আমি এই বুড়োর সাথে রাত কাটাবো।
তুমি যদি এতো রূপসী না হতে, তাহলে আমি তোমার এই গোস্তাখি ক্ষমা করতাম না- শেখ সান্নান বললো এবং বড় মেয়েটিকে উপদেশের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো- একে নিয়ে গিয়ে আসিয়াত দুর্গের আদব কায়দা শিখিয়ে দাও।
বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে বাইরে বের করে রেখে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করে শেখ সান্নানকে বললো- আপনার অসন্তুষ্টি যথার্থ। কিন্তু আমরা বসদের অনুমতি ব্যতীত যে কারো আদেশ পালন করতে পারি না। আমি যেহেতু আপনাকে জানি এবং এই দুর্গে আগেও এসেছি, সেজন্য আপনার কাজে আসতে পারে এমন চার ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছি। আপনাকে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। মেয়েটি শেখ সান্নানকে আন-নাসের ও তার সঙ্গীদের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে।
আমি এদের দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করবো- শেখ সান্নান বললো- কিন্তু ঐ মেয়েটাকে আমি অবশ্যই আমার কক্ষে রাখবো।
এ বিষয়টা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন- বড় মেয়েটি বললো- ওতে আর পালাতে পারবে না। আমি তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আপনার কাছে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
***
শেখ সান্নানের দুজন সহযোগী আন-নাসের ও তার সঙ্গীদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। লোকগুলো নেশা অবস্থায় ছিলো বটে; কিন্তু সারাটা রাত পায়ে হেঁটে এখানে এসে পৌঁছেছে। তাদেরকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। টলটলায়মান পরিশ্রান্ত লোকগুলো ধপাস করে খাটের উপর পড়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ওদিকে মেয়ে দুটোও রাতে এক মুহূর্ত ঘুমোতে পারেনি। তারাও একটি কক্ষে শুয়ে পড়ে।
দুপুরের পর আন-নাসেরের চোখ খোলে। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে তার সঙ্গীরা এখানো ঘুমিয়ে আছে। সে আশ-পাশটা চেনার চেষ্টা করে। এটি একটি কক্ষ। কক্ষে পালংক আছে। আন-নাসেরের তিন সঙ্গী পালংকের উপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সবুজ-শ্যামলিমা, রং-বেরঙের ফুল, পাখ-পাখালি ও মখমলসম সবুজ ঘাসের কথা মনে পড়ে তার। মেয়েদের কথা স্মরণে আসে। বিষয়গুলো তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। মরুভূমির সফরের কথা তার বাস্তবের ন্যায় স্মরণ আছে। কিন্তু দুটো মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী তার কাছে স্বপ্ন কিংবা কল্পনা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন সে কোথায়? এই প্রশ্ন তাকে বিব্রত ও বিচলিত করতে শুরু করে।
আন-নাসের তার সঙ্গীদের জাগালো না। নিজে বসা থেকে উঠে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। এটি একটি দুর্গ। সৈনিকরা চলাফেরা করছে দেখতে পায়। এটা কোন্ বাহিনীর দুর্গ? আন-নাসের বিষয়টা কাউকে জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে করলো না। দুৰ্গটা দুশমনেরও হতে পারে। তাহলে কি আমি সঙ্গীদেরসহ বন্দী হয়েছি? কিন্তু এই কক্ষটা তো কয়েদখানার প্রকোষ্ঠ নয়। আন-নাসের গুপ্তচর ও গেরিলা সৈনিক। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সে বিষয়টার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে সে আশংকা অনুভব করতে লাগলো। এবার দরজা থেকে সরে পালংকের উপর গিয়ে বসলো। বাইরে কারো পায়ের শব্দ শোনা গেলো। সাথে সাথে সে ঘুমের ভান করে নাক ডাকতে শুরু করলো।
দুব্যক্তি কক্ষে প্রবেশ করে।
এখনো ঘুমিয়ে আছে। একজন অপরজনকে বললো।
ঘুমিয়েই থাকতে দাও- দ্বিতীয়জন বললো- মনে হচ্ছে, একটু বেশি খাওয়ানো হয়েছে। আচ্ছা, এদের ব্যাপারে কি কিছু বলা হয়েছে?
খৃস্টান মেয়ে দুটি ফাঁদে ফেলে এদেরকে নিয়ে এসেছে- প্রথমজন উত্তর দেয়- এরা সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডো গুপ্তচর। অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। এদেরকে প্রস্তুত করতে হবে।
তারা চলে যায়।
আন-নাসের বুঝে ফেলে, তারা প্রতারণার শিকার এবং শত্রুর হাতে বন্দী। এবার তাকে জানতে হবে, এটি কোন্ দুর্গ, কোন অঞ্চলে অবস্থিত এবং কী উদ্দেশ্যে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছে। তার জানা আছে, কোনো দুর্গ থেকে পলায়ন করা শুধু কঠিনই নয়- অসম্ভব।
ছোট মেয়েটি কিছুক্ষণ ঘুমিয়েই জেগে ওঠে। কক্ষের জানালাটা খুলে জানালার কাছে বসে বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি সফরের সময় বড় মেয়েটির কাছে তার আবেগের কথা প্রকাশ করেছিলো। সবে তরুণী। এখনো পরিপক্ক হয়নি। সমবয়সী অন্য পাঁচটি মেয়ের ন্যায় এখনো সে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই প্রথমবারের মতো সে ময়দানে এসেছে। সঙ্গের বড় মেয়েটি অভিজ্ঞ। সে অনুভব করছে, ছোট মেয়েটি সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। পুরুষদেরকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচানোর যোগ্যতা-মানসিকতা কোনটিই এখনো তার আয়ত্ত্ব হয়নি। বাঘা বাঘা সালার ও সাইফুদ্দীন তাকে খেলনা বানিয়ে রেখেছিলো। এখন সে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে কঠিন ও কষ্টদায়ক সফর করে এসে এখানে পৌঁছেছে। সারা রাত সফর করেছে; অথচ এসে পৌঁছামাত্র শেখ সান্নানের মতো বৃদ্ধের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে এবং তিনি যা বলবেন শুনতে হবে!
একথা সত্য যে, মেয়েটিকে শৈশব থেকেই এই নোংরা জীবনধারার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু যৌবনে পদার্পন করার পর যখন তার চোখ ফোটে এবং নিজের চোখে দেখতে ও নিজের মাথায় ভাবতে শিখে, তখন দীর্ঘ প্রশিক্ষণের ক্রিয়া এলোমেলো হয়ে যায়। যে মানুষগুলোকে ফাঁসিয়ে রাখতে এবং খৃস্টানদের জালে আটকে রাখতে তাকে প্রস্তুত করা হয়েছিলো, তাদের প্রতি তার মনে ঘৃণার সৃষ্টি হয় এবং নিজের এই পেশাটিকে হীন ভাবতে শুরু করেছে। জানালার কাছে বসে মেয়েটি নানা তিক্ত কল্পনায় ডুবে আছে। তার চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসে। কিন্তু সে চোখের সামনে না কোনো আশ্রয় দেখতে পাচ্ছে, না পালাবার পথ পাচ্ছে।
বড় মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলে দেখতে পায়, তার সঙ্গী হেট মেয়েটি জানালার কাছে বসে আছে। সেও উঠে তার পাশে গিয়ে বসে। চোখে অশ্রু দেখে বললো- প্রথম প্রথম এমনটা হয়ে থাকে। আমরা যা কিছু করছি বিলাসিতার জন্য করছি না, করছি ক্রুশের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলে ক্রুশের রাজত্ব কায়েম করা। আমাদের সৈনিকরা তাদের অঙ্গনে লড়াই করছে। আমাদেরকে আমাদের অঙ্গনে লড়তে হবে। মনটাকে বড় বানাও। দেহের চিন্তা বাদ দাও, আত্মাটা পবিত্র থাকলেই হলো। তোমার আত্মা পবিত্র।
আচ্ছা, আমাদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়, মুসলিম মেয়েদেরকে সেভাবে ব্যবহার করা হয় না কেন?- ছোট মেয়েটি জিজ্ঞেস করে- আমাদের বাদশাহ এবং তাদের সৈন্যরা মুসলমানদের ন্যায় লড়াই করে না কেনো? মুসলমানদেরকে তারা চোরের ন্যায় খুন করে কেননা? খৃস্টান বাহিনী সালাহুদ্দীন আইউবীর এই চার কমান্ডোর ন্যায় কমান্ডো তৈরি করে না কেননা? তার কারণ একটাই- আমাদের জাতি কাপুরুষ। যারা চুপি চুপি আক্রমণ করে, তারা কাপুরুষ না তো কী?
ছোট মেয়েটির বক্তব্য ও প্রশ্নবাণে বড় মেয়েটি চমকে ওঠে বললো- এমন কথা অন্য কারো সামনে বলবে না। অন্যথায় খুন হয়ে যাবে। এ মুহূর্তে আমরা শেখ সান্নানের কাছে রয়েছি। তার দ্বারা আমাদের অনেক কাজ নিতে হবে। তাকে নারাজ করা যাবে না।
লোকটার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে- ছোট মেয়েটি বললো- ইনি . তো কোন রাষ্ট্রের সম্রাট নন, ভাড়াটিয়া খুনীদের লিডার মাত্র। আমি তাকে আমার দেহ স্পর্শ করার যোগ্য মনে করি না।
বড় মেয়েটি দীর্ঘ কথোপকথনের পর বড় কষ্টে ছোট মেয়েটিকে সম্মত করতে সক্ষম হয় যে- সে শেখ সান্নানের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলবে ও সদ্ব্যবহার করবে।
সে মেয়েটিকে পরামর্শ দেয়- তুমি তাকে প্রলোভন দেখিয়ে সময় পার করে দেবে। তুমি তো আমার কৌশল দেখেছো। আমি মুসলিম রাজাদেরকে মুঠোয় নিয়ে তাদের গোমরা করতে জানি। শেখ সান্নানকে আমি কোন ব্যক্তিত্বই মনে করি না। . তুমি কি আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারো? ছোট মেয়েটি বললো।
চেষ্টা করবো- বড় মেয়েটি বললো- আগে আমাদের সংবাদ পৌঁছাতে হবে যে, আমরা এখানে আছি।
এমন সময় দুজন লোক কক্ষে প্রবেশ করে। তারা মেয়েদেরকে তাদের নিয়ে আসা লোকগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। লোকগুলো কারা, কোথা থেকে কিভাবে এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে? বড় মেয়েটি তার বিবরণ দেয়।
তারা কী অবস্থায় আছে? বড় মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
এখনো ঘুমিয়ে আছে। একজন জবাব দেয়।
তাদেরকে কি কারাগারে আটকে রাখবে? ছোট মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
কারাগারে নিক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন নেই- লোকটি জবাব দেয় এখান থেকে পালিয়ে যাবে কোথায়?
আমরা কি তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারি? ছোট মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
অবশ্যই পারবে- লোকটি জবাব দেয়। তারা তোমাদের শিকার। যাও, দেখা করো। তোমরা তাদের কাছে যাও, তাদেরকে তোমাদের জালে আটকে রাখো।
কিছুক্ষণ পর ছোট মেয়েটি বড় মেয়েটির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আন-নাসের ও তার সঙ্গীরা যে কক্ষে ঘুমিয়ে আছে, সেখানে চলে যায়। আন-নাসের মূলত সজাগ। মেয়েটিকে দেখে সে উঠে বসে এবং জিজ্ঞেস করে- আমাদেরকে কোথায় নিয়ে এসেছো? বলো, তোমরা কারা? তোমাদের মিশন কি? এটা কোন্ জায়গা?
মেয়েটি গভীর দৃষ্টিতে আন-নাসেরের প্রতি তাকায়। মনটা তার আবেগাপ্লুত। আন-নাসেরকে কানে কানে জিজ্ঞেস করে- পালাতে চাও?
তোমাকে বলবো না আমি কী করতে চাই- আন-নাসের জবাব দেয় আমার যা করণীয় করে দেখাবো।
মেয়েটি আন-নাসেরের আরো কাছে এসে বললো- আমি জিন নই, মানুষ। তুমি আমার উপর আস্থা রাখতে পারো।
আন-নাসের রোষ কষায়িত লোচনে মেয়েটির প্রতি তাকায়। মেয়েটি তার পার্শ্বে পালংকের উপর বসে পড়ে।
[পঞ্চম খণ্ড সমাপ্ত]