সত্য পথের পথিক
নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র আল-মালিকুস সালিহ, গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীন গাজী- এই তিন মুসলিম শাসক সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মোকাবেলায় এসেছেন। ক্রুসেডাররা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তারা তাদেরকে উট ঘোড়া, মটকা ভর্তি তরল দাহ্য পদার্থ ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা সুলতান আইউবীকে যুদ্ধের ময়দানেই পরাজিত করা আবশ্যক মনে করে না। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য, যে কোন প্রকারে হোক আইউবীকে পরাভূত করা এবং আরব ভূখণ্ড কজা করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা।
ফিলিস্তিন খৃস্টানদের দখলে। খৃস্টানরা মুসলমানদের তিনটি দুর্বলতা আঁচ করে নিয়েছে। তাহলো- ক্ষমতার মোহ, সম্পদের লোভ ও নারীর প্রতি আসক্তি। খৃস্টানরা ইউরোপ থেকে এই আশা নিয়ে এসেছিলো যে, তারা তাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য, অস্ত্র ও নৌ-শক্তির বিনিময়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে মুসলমানদের খতম করে প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাস ও খানায়ে কাবা দখল করে নিবে এবং পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলবে।
ধর্ম এমন কোনো বৃক্ষ নয়, যাকে গোড়া থেকে কেটে দিলে তা শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ধর্ম একটি গ্রন্থ কিংবা কতগুলো গ্রন্থের স্থূপের নামও নয়, যাকে আগুনে ভষ্মিভূত করে দেয়া যায়। ধর্ম হলো বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ে সংরক্ষিত থাকে এবং মানুষকে নিজের অনুগত করে রাখে। একজন মানুষকে খুন করে ফেললে বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিলুপ্তি ঘটে না। একটি ধর্মকে বিলুপ্ত করে দেয়ার উপায় হলো, মন-মস্তিষ্কে বিলাসিতা ও ক্ষমতার মোহ ঢুকিয়ে দেয়া। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির বাঁধন যতো ঢিল হয়, মানুষ তত স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের জন্য এ জালই বিছিয়ে রেখেছে। আরব ভূখণ্ড ও মিশরে এই জাল বিছিয়ে দিয়ে মুসলিম শাসকদের তাতে আটকাতে শুরু করে। মিল্লাতে ইসলামিয়ার দুর্ভাগ্য যে, মুসলমানরা ক্ষমতা ও নারীর লোভে ঈমান বিসর্জন দিয়ে থাকে।
নুরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহুদ্দীন আইউবীর আমলে এই মধুমাখা বিষ মুসলিম, শাসক ও আমীরদের শিরায় ঢুকে পড়েছিলো এবং খৃস্টানরা ফিলিস্তিন দখল করে নিয়েছিলো। কয়েকটি মুসলিম প্রজাতন্ত্র এমন ছিলো যে, সেগুলোর উপর খৃস্টানদের দখল ছিলো না বটে; কিন্তু সেগুলোর শাসকদের হৃদয়ের উপর তাদের কজা ছিলো। খৃস্টান ও ইহুদীরা মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংস করার কাজে এতো সাফল্য অর্জন করেছিলো যে, একজন মুসলিম সালার সম্পর্কেও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব ছিলো না, ইনি সালতানাতে ইসলামিয়ার অফাদার। জঙ্গী ও আইউবীর জন্য এই গাদ্দাররা একটি মহা-সমস্যার রূপ ধারণ করেছিলো। ১১৭৪ ও ১৯৭৫ সালে সুলতান আইউবীও ফিলিস্তিনের মাঝে কালেমাগো ভাইয়েরাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। খৃস্টনরা দূরে বসে তামাশা দেখছিলো। সুলতান আইউবী প্রতিটি রণাঙ্গনে খৃস্টানদেরকে পরাজয়ের পর পরাজয় উপহার দিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু তারা মুসলিম আমীরদেরকেই আইউবীর মোকাবেলায় দাঁড় করিয়ে দেয়। তার সবচেয়ে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা হলো স্বয়ং নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র আল-মালিকুস সালিহ তার ওফাতের পর সুলতান আইউবীর বিরোধী শিবিরে চলে যায়।
১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। আল-মালিকুস সালিহরই এক মিত্র সাইফুদ্দীন গাজী সুলতান আইউবীর হাতে পরাস্ত হয়ে জনৈক ব্যক্তির এক ঝুপড়িতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাঁর অপর এক মিত্র হলো গোমস্তগীন। সুলতান আইউবী এই তিন রাষ্ট্রনায়কের জোট বাহিনীকে এমন লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করেন যে, তারা তাদের হেডকোয়ার্টারের সমুদয় মালামাল ফেলে পালিয়ে যায়। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা তাদের যেসব সৈন্যকে বন্দী করেছিলো, মুসলমান মনে করে সুলতান তাদেরকে– ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই উদারতার মাসুল সুলতানকে কড়ায়-গণ্ডায় শুনতে হয়েছে। এই বন্দীরা ফিরে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে পুনরায় সংগঠিত হয়ে যায়।
যুদ্ধের ময়দান থেকে আল-মালিকুস সালিহ, সাইফুদ্দীন গাজী ও মেস্তগীনের পলায়ন ছিলো একটি বিস্ময়কর ঘটনা। তাদের একজনের কাছে অপরজনের খবর ছিলো না। গোমস্তগীন ছিলো হাররানের দুর্গপতি, যা ছিলো বাগদাদের খেলাফতের অধীন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেয়। রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে সে হাররানের পরিবর্তে আল-মালিকুস সালিহর রাজধানী হাবে চলে গিয়েছিলো। সুলতান আইউবী ধাওয়া করে ধরে ফেলতে পারেন, এই ভয়ে সে নিজ এলাকা হাররান যাওয়ার সাহস পেলো না।
সাইফুদ্দীন অপর এক শহর মসুল ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের সম্রাট ছিলেন। শুধু ম্রাটই নন, তিনি একজন সেনা অধিনায়কও ছিলেন। রণাঙ্গনের কূটকৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন তিনি। ছিলেন লড়াকু সৈনিক। কিন্তু তিনি নিজের ঈমান বিক্রি করে ফেলেছিলেন, যা কিনা মুমিনের ঢাল-তরবারী। যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত তিনি হেরেমের বাছা বাছা মেয়ে ও নর্তকীদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। মদের মটকা ছাড়াও তার সঙ্গে থাকতো সুন্দর সুন্দর পাখি। এই সকল বিলাস সামগ্রী তিনি রণাঙ্গনে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পলায়নকারীদের মধ্যে তার নায়েব সালার এবং একজন কমান্ডার ছিলো। যাবেন মসুল। কিন্তু সুলতান আইউবীর গেরিলারা দুশমনের পেছন থেকে ধাওয়া করছিলো। তারা দুশমনের ছত্রভঙ্গ সৈন্যের জন্য পিছু হটাও অসম্ভব করে তুলেছিলো।
সুলতান আইউবীর গেরিলারা সাইফুদ্দীন ও তার সঙ্গীদেরকে সম্ভবত দেখে ফেলেছিলো। তাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তারা মসুলের পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরেছিলো। অঞ্চলটা কোথাও বালুকাময়, কোথাও পার্বত্য, কোথাও সবুজ-শ্যামল। ফলে লুকাবার জায়গা বিস্তর।
সাইফুদ্দীন এখন মসুল থেকে সামান্য দূরে। গভীর রাত। চাঁদের আলোতে তিনি কয়েকটি ঘর দেখতে পান। তিনি প্রথম গৃহটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজায় করাঘাত করেন। সাদা শশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন। তার সম্মুখে তিনজন অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে। লোকগুলো হাঁপাচ্ছে। বৃদ্ধ বললেন সম্ভবত তোমরাও মসুলের ফৌজের সৈনিক এবং পালিয়ে এসেছে। দুদিন যাবত আমি সৈনিকদের এই পথে যেতে দেখছি। তারা এখানে এসে পানি পান করার জন্য দাঁড়ায়। তারপর মসুল চলে যায়।
মসুল এখান থেকে কত দূরে? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।
তোমাদের ঘোড়ার দেহে যদি দম থাকে, তাহলে রাতের শেষ প্রহর নাগাদ পৌঁছে যাবে-বৃদ্ধ বললেন-এ গ্রামটা মসুলেরই অংশ।
আমরা কি রাতটা আপনার এখানে কাটাতে পারি জায়গা হবে? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।
অন্তর প্রশস্ত হলে জায়গার অভাব হয় না- বৃদ্ধ বললেন- ঘোড়া থেকে নেমে এসো, ভেতরে চলো।
***
তিন আগন্তুক একটি কক্ষে গিয়ে বসে। কক্ষে বাতি জ্বলছে। বৃদ্ধ তাদের পোশাক নিরিক্ষা করে দেখেন।
আমাদেরকে চেনার চেষ্টা করছেন? সাইফুদ্দীন মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেন।
আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমরা সিপাহী নও- বৃদ্ধ বললেন- তোমাদের পদমর্যাদা সালারের নীচে হবে না।
ইনি মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীন গাজী- নায়েব সালার বললেন আপনি যেনতেন লোককে আশ্রয় দেননি। আপনি এর পুরস্কার পাবেন। আমি নায়েব সালার আর ইনি কমান্ডার।
আমরা হয়তো আপনার গৃহে অনেকদিন থাকবো- সাইফুদ্দীন বললেন আমরা দিনের বেলা বাইরে বের হবে না, যাতে কেউ জানতে না পারে আমরা এখানে আছি। যদি কেউ জেনে ফেলে, তার শাস্তি আপনাকে ভোগ করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি আপনি গোপনীয়তা রক্ষা করেন, তাহলে পুরস্কার পাবেন- যা চাইবেন তা-ই দেবো।
মসুলের শাসনকর্তাকে আমি আমার আশ্রিত ভাবতে পারি না- বৃদ্ধ বললেন- আপনি বিপদে পড়ে, পথ ভুলে গরীবালয়ে এসে পৌঁছেছেন। যতোদিন ইচ্ছা থাকবেন, আমি আপনার সাধ্যমতো সেবা করবো। আমার এক পুত্র আপনার ফৌজের সৈনিক। আপনাকে আমি অবহেলা করতে পারি না।
আমরা তাকে পদোন্নতি দেবো। নায়েব সালার বললেন।
আপনি যদি তাকে বাহিনী থেকে অব্যাহতি দান করেন, তবে আমার জন্য তা-ই হবে বড় পুরস্কার। বৃদ্ধ বললেন।
ঠিক আছে- সাইফুদ্দীন বললেন- আমরা আপনার পুত্রকে অব্যাহতি দিয়ে দেবো। সব পিতাই কামনা করে তার পুত্র বেঁচে থাকুক।
না- বৃদ্ধ বললেন- তার শুধু বেঁচে থাকা আমার কাম্য নয়। ফৌজে ভর্তি করিয়ে আমি তাকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করেছিলাম। আমিও সৈনিক ছিলাম। আমি যখন ফৌজে ভর্তি হই, আপনার তখন জন্ম হয়নি। আল্লাহ আপনার পিতা কুতুবুদ্দীনকে জান্নাত দান করুন। আমি তাঁর আমলে সৈনিক ছিলাম। আমরা কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু আমার ছেলেটাকে আপনি ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ করেছেন। আমি তার শাহাদাঁতের পিয়াসী ছিলাম- অপমৃত্যুর নয়।
সালাহুদ্দীন আইউবী নামের মুসলমান- সাইফুদ্দীন বললেন- তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েযই নয়, ফরযও বটে।
জনাব!- নায়েব সালার বললেন- বিষয়টা আপনি বুঝবেন না। আমরা ভালোভাবেই জানি কে মুসলমান, আর কে কাফের।
বৎস!- বৃদ্ধ বললেন- বয়সে আপনারা আমার পুত্রের সমান। অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। আমার বয়স পঁচাত্তর বছর। আমার পিতা নব্বই বছর বয়সে মারা গেছেন। দাদা পঞ্চাশ বছর বয়সে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। দাদাজান আমার পিতাকে তার আমলের কাহিনী, শোনাতেন। পিতার নিকট থেকে আমি সেসব শুনেছি। এই সূত্রে আমি দাবি করতে পারি, আমি যতোটুকু জানি, আপনারা ততোটুকু জানেন না। রাজত্বের মোহ যাকেই পেয়েছে, যে ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে যুদ্ধে লিপ্ত করিয়েছে, সে-ই একদিন না একদিন কোনো না কোনো গরীবের ঝুপড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। আপনাদের আগে যারা অতীত হয়েছে, তাদেরও এই একই পরিণতি ঘটেছিলো। আপনাদের তিন তিনটি বাহিনীকে সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি মাত্র বাহিনী পরাজিত করেছে। আর তাও এমন শোচনীয়ভাবে যে, আমি তা দুদিন যাবত অবলোকন করছি। আপনাদের যদি দশটি বাহিনীও থাকতো, তবুও এভাবেই আপনাদের পালাতে হতো। যারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তারাই জয়লাভ করে। কখনো পরাজিত হলে তারা লেজ তুলে পালায় না। তাদের লাশ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নেয়া হয়; তারা আত্মগোপন করে না।
তোমাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক মনে হচ্ছে- সাইফুদ্দীন কিছুটা ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বললেন- তোমার উপর তো আমাদের আস্থা রাখা চলে না।
আমি আপনার সমর্থক- বৃদ্ধ বললেন- আমি ইসলামের সহযোগী। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি যে, আপনি আপন ভাইদের শত্রুকে বন্ধু ভেবে বসেছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না, তারা আপনার ধর্মের শত্রু। আপনার পরাজয়ের কারণ এটাই। আপনি নিশ্চিন্তে আমার উপর আস্থা রাখুন সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ যদি আকস্মিকভাবে এখানে এসে পড়ে, আমি আপনাকে লুকিয়ে– রাখবো, ধোকা দেখো না।
ইত্যাবসরে একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। তার পেছনে তদপেক্ষা খানিক বেশি বয়সের আরেক যুবতী সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি প্রথম মেয়েটির উপর নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা খাবার রেখে চলে গেলে তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেন- এরা কারা?
ছোটটা আমার কন্যা- বৃদ্ধ জবাব দেন- আর বড়টা পুত্রবধূ- আমার সেই ছেলের স্ত্রী, যে আপনার ফৌজে কাজ করছে। আমার মনে হচ্ছে, বউটা আমার বিধবা হয়ে গেছে।
আপনার পুত্র যদি মারা যায়, তাহলে আমি আপনাদের বিপুল অর্থ দান করবো- সাইফুদ্দীন বললেন- আর মেয়ের ব্যাপারে কোন চিন্তা করবেন না। এই মেয়ে কোনো সৈনিকের স্ত্রী হয়ে কোনো ঝুঁপড়িতে যাবে না। আমি তাঁকে আমার স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করে ফেলেছি।
আমি না আমার পুত্রকে বিক্রি করেছি, না কন্যাকে বিক্রি করবো-বৃদ্ধ বললেন- কুঁড়েঘরে লালিত একটি মেয়েকে একজন সৈনিকের কুঁড়ে ঘরেই ভালো মানায়। আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, আমাকে প্রলোভন দেখাবেন না। আপনি আমার মেহমান। আমাকে আতিথেয়তার দায়িত্ব পালন করতে দিন।
আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনার উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমি এই জন্য আনন্দিত যে, আমার রাজ্যে আপনার ন্যায় স্পষ্টবাদী ও নীতিবান লোক আছে। সাইফুদ্দীন বললেন।
বৃদ্ধ চলে যান। সাইফুদ্দীন তার সঙ্গীদের বললেন- এ ধরনের মানুষ ধোঁকা দেয় না। আচ্ছা, তোমরা কেউ মেয়েটাকে অলোভাবে দেখেছিলে?
চমৎকার এক মুক্তা। নায়েব সালার বললেন।
পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হোক, এই মুক্তা আমার হেরেমে যাবে। সাইফুদ্দীন ক্রুর হাসি হেসে বললেন। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নায়েব সালারকে উদ্দেশ করে বললেন- তোমরা মসুলের সংবাদ নাও। বাহিনীকে একাট্টা করো। সালাহুদ্দীন আইউবীর তৎপরতা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করো এবং আমাকে তাড়াতাড়ি জানাও, আমি এখনই মসুল চলে আসবো, নাকি আরো অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে। তারপর কমান্ডারকে উদ্দেশ করে বললেন- আমি কোথায় আছি, হালববাসীকে জানিয়ে দাও। নিজে যাও কিংবা কাউকে পাঠাও।
নায়েব সালার ও কমান্ডার রওনা হয়ে যায়। সাইফুদ্দীন- যিনি মদমত্ত হয়ে রূপসী নারী নিয়ে প্রাসাদে ঘুমাতে অভ্যস্ত- বৃদ্ধের কুঁড়েঘরের এক কক্ষের মেঝেতে শুয়ে পড়েন।
***
তার একদিন আগের ঘটনা। এক সৈনিক রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে মসুল যাচ্ছিলো। লোকটি কখনো দ্রুতবেগে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে, কখনো ধীরে ধীরে চলছে, আবার কখনো বা দাঁড়িয়ে থাকছে। মাঝে-মধ্যে ঘোড়া থামিয়ে সন্ত্রস্ত মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সাধারণ রাস্তা ত্যাগ করে অন্য পথে চলছে সে। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, লোকটি ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নিজের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। এক স্থানে ঘোড়া থামিয়ে নেমে কেবলামুখী হয়ে লোকটি নামায পড়তে শুরু করে। নামায শেষে দুআর জন্য হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দুআ শেষে সেখান থেকে না ওঠে মাথানত করে বসে থাকে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে পরাজয়বরণ করে বাহিনীগুলো যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পিছু হটে যায়, তখন সুলতান আইউবীর কয়েকজন গুপ্তচর তাদের সঙ্গে মিশে যায়। সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের নিয়মই ছিলো, দুশমন যখন পিছপা হতো, তখন কিছু গুপ্তচর পলায়নপর সৈনিক কিংবা যুদ্ধকবলিত গ্রামগুলোর মুহাজিরদের বেশ ধারণ করে দুশমনের অঞ্চলে চলে যেতো এবং শত্রুপক্ষের পুনর্বিন্যাস, সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এসে তথ্য সরবরাহ করতো।
আল-মালিকুস সালিহ যখন তার দলবলসহ দামেস্ক থেকে পলায়ন করেছিলেন, তখনও বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা ফৌজ ও পলায়নপর মাগরিকদের সঙ্গে চলে গিয়েছিলো। এভাবে সুলতান আইউবী অর্ধেক যুদ্ধ গোয়েন্দা ব্যবস্থার মাধ্যমেই জয় করে নিতেন। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য যে লোকদের নির্বাচন করা হতো, তারা অস্বাভাবিক বিচক্ষণ, স্থির ও শান্ত মেজাজের অধিকারী হতো। তারা হতোউপস্থিত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গম ও আত্মবিশ্বাসী লড়াকু সৈনিক।
১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন সুলতান আইউবী তাঁর মুসলমান শত্রুদের বাহিনীকে পরাস্ত করেন, তখন তাঁর ইন্টেলিজেন্স প্রধান হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ তাঁর সুপ্রশিক্ষিত গোয়েন্দাদেরকে দুশমনের ছত্রভঙ্গ বাহিনীতে লুকিয়ে দিয়ে হাল্ব, মসুল ও হারান গিয়ে দুশমনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্যাদি সগ্রহ করার জন্য পাঠিয়ে দেন। তাদের কেউ ছিলো শত্রুসেনার পোশাকে, কেউ সাধারণ পল্লীবাসীর লেবাসে। তাদের এই যাওয়া ছিলো নেহায়েতই জরুরী। কেননা, দুশমন পুনঃ সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ করবে, এই আশংকা প্রতি মুহূর্তেই বিরাজমান। সুলতান আইউবী দুশমনের যে পরিমাণ ক্ষতিসাধন করেছিলেন, তাতে তাঁর ধারণা ছিলো, পুনর্গঠনে দুশমনের বেশ সময় লেগে যাবে।
দুশমনের বাহিনী তিনটি। প্রতি বাহিনীর আকাংখা ছিলো, সুলতান আইউবীকে পরাজিত করে সে সালতানাতে ইসলামিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ও রাজা হয়ে যাবে। তারা পরস্পর বৈরি ভাবাপন্নও ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা প্রত্যেকে সুলতান আইউবীকে সকলের শত্রু বিবেচনা করছে। সে কারণে তারা পুনর্গঠিত হয়ে তিনটি বাহিনীকে এক বাহিনীর রূপ দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
সুলতান আইউবী জানতেন, বিলাস-পাগল মানুষ যুদ্ধের ময়দানে টিকতে পারে না। কিন্তু পাশাপাশি তাঁর এও জানা ছিলো যে, তার শত্রুরা ক্রুসেডারদের সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করছে এবং তাদের কাছে খৃস্টান উপদেষ্টাও রয়েছে। তাছাড়া মুসলিম সালারদের মধ্যে দু-তিনজন এমন ছিলেন, যারা নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখতো। তন্মধ্যে মুজাফফর উদ্দিন ইবনে যাইনুদ্দীন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সুলতান আইউবীর ফৌজের সালার ছিলেন। সেই সূত্রে সুলতান আইউবীর কলাকৌশল তার জানা ছিলো। খৃস্টান উপদেষ্টাবৃন্দ ও মুজাফফর উদ্দীনের ন্যায় সালারগণ সুলতান আইউবীকে অত্যন্ত চৌকান্না করে দিয়েছিলো।
সুলতান আইউবীর ফৌজের অবস্থা সন্তোষজনক হলেও এই মুহূর্তে পুনরায় যুদ্ধ করার অবস্থা তাদের নেই। তারা দুশমনকে পরাজিত করেছিলো বটে; কিন্তু তার জন্য অল্পবিস্তর মূল্যও তাদের পরিশোধ করতে হয়েছিলো। এসব কারণে সুলতান আইউবীর মনে খানিকটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। তার একটি সমস্যা এই ছিলো যে, এখন তার কার্যক্রম মূল ঠিকানা থেকে অনেক দূরে। সঙ্গে রসদ আছে ঠিক; কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘ হলে সংকটও দেখা দিতে পারে। সুলতান পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে সেনাভর্তি শুরু করে দিয়েছিলেন। মানুষ। সোসাহে ভর্তি হচ্ছিলো। তাদের অধিকাংশ লোক তরবারী চালনী, তীরন্দাজী ও অশ্বারোহনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কিন্তু নিয়মিত সেনা হিসেবে যুদ্ধ করানোর জন্য তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিলো।
প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি সুলতান আইউবী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন, যাতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো দখলে চলে আসে। কিছু কিছু অঞ্চলে প্রতিরোধ ছাড়াই তার হস্তগত হয়। তিনি এমন একস্থানে পৌঁছে যান, যেখানে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত সবুজ-শ্যামলিমা আর পানির প্রাচুর্য বিরাজমান। তাঁর ফৌজ ও পশুপাল পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। এখন তার হালে পানি এসে গেছে।
সুলতান আইউবী সেখানেই তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। পর্যবেক্ষক ইউনিটগুলো বিভিন্ন উপযুক্ত স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গোয়েন্দারা চলে গেছে আগেই। সুলতান আইউবীর নির্দেশ ছাড়াই সব কাজ সম্পাদিত হয়ে যায়। ব্যবস্থাপনা তার এততাই সুশৃংখল যে, মিশন তার মেশিনের ন্যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই যে স্থানটিতে সুলতান আইউবী অবস্থান গ্রহণ করছেন, সেটি তুকমান নামে খ্যাত। পুরো নাম হুবাবুত তুর্কমান বা তুর্কমানের কূপ।
ভর্তি আরো জোরদার করো- সুলতান আইউবী তাঁর কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রথম কনফারেন্সে বললেন- সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দাও। আল্লাহ তোমাদের উপর করুণা করেছেন যে, তোমাদেরকে তিনি অতিশয় বোকা শত্রুর মুখোমুখি করেছেন। তাদের যদি ন্যূনতম বুঝ-বুদ্ধিটুকুও থাকতো, তাহলে তারা পিছপা হয়ে এখানে সমবেত হতো। যুদ্ধের পশু ও সৈনিকদের জন্য এ স্থানটি জান্নাত অপেক্ষা কম নয়। এখানে তোমাদের পশুগুলো এতে ঘাস খেতে পারবে যে, দশদিন পর্যন্ত আর খাওয়া ছাড়া লড়াই করতে পারবে। আমার বন্ধুগণ! শত্রুকে তুচ্ছ মনে করো না। বাহিনীকে বিশ্রামের সুযোগ দাও। কিন্তু সর্বদা প্রস্তুত অবস্থায় রাখতে হবে। ডাক্তারদের বলে দাও, যেনো তারা রাতে না ঘুমায়। আহতদের খুব দ্রুত সুস্থ করে তুলতে হবে এবং রুগ্নদের দিন-রাত তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। আর স্মরণ রেখো, আমাদের উদ্দেশ্য আপন ভাইদের হত্যা কিংবা তাদের ধিক্কার সমালোচনা করা নয়। আমাদের গন্তব্য ফিলিস্তিন। আমরা যদি নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধে ব্যস্ত থাকি, তাহলে খৃষ্টানরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়ে যাবে। দৃষ্টি ফিলিস্তিনের উপর নিবদ্ধ রাখো এবং পথের প্রতিটি বাঁধা পদদলিত করে এগিয়ে যাও।
ঠিক এ সময়ই সুলতান আইউবীর নিকট আল-মালিকুস সালিহর উক্ত পয়গামটি এসে পৌঁছায়। সুলতান শর্ত সাপেক্ষে সন্ধি প্রস্তাব মেনে নেন। তাতে তিনি নিশ্চিত হন যে, তাঁর দুশমন অস্ত্র সমর্পণ করেছে। তিনি উদারতা প্রদর্শন করে বন্দি সেনাদেরকে সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিয়ে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কেননা, তাঁর মতে তাঁর মুসলিম ভাইয়েরা তার শত্রু নয়। আল-মালিকুস সালিহর সন্ধিপত্রে সীল-স্বাক্ষর করার সময়ও সুলতান আইউবী কঠিন কোনো শর্ত আরোপ করেননি। তিনি তার মুসলিম ভাইদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন, তোমাদের শত্রু আমি নই- খৃস্টানরা।
কিন্তু উক্ত বার্তাটি তাকে যে স্বস্তি দান করেছিলো, তা দু-তিন দিনের বেশী স্থায়ী হয়নি। আল-মালিকুস সালিহর অপর এক বার্তা তাকে পুনরায় পেরেশান করে তোলে। তাঁর নামে আসা পত্রখানি খুলে দেখতে পান, সেটি তাঁকে নয়- সাইফুদ্দীন গাজীকে লেখা। দূত ভুলবশত সেটি সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে আসে। পত্রটি প্রমাণ করে, সাইফুদ্দীন আল-মালিকুস সালিহকে লিখেছিলেন, আপনি আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করে ভুল করেছেন এবং তা জোটের অংশীদার শক্তির সঙ্গে প্রতারণার শামিল। তার জবাবে আল-মালিকুস সালিহ লিখেছেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে সন্ধির নামে ধোকা দিয়েছি, যাতে তিনি অপ্রস্তুত অবস্থায় পুনরায় আমাদের উপর আক্রমণ না করে বসেন। আমি জানি, সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টি হাবের উপর। তার বাহিনীও এখনই আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। আমি কালক্ষেপণের জন্য সন্ধির ফাঁদ পেতেছি। আপনারা নিজ নিজ বাহিনীকে সংগঠিত করে ফেলুন। খৃস্টান উপদেষ্টাগণ আমার বাহিনীকে সংগঠিত ও প্রস্তুত করছে। আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, আমরা এখনই যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত নই।
আল-মালিকুস সালিহ নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র। তার বয়স মাত্র তের বছর। নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর প্রশাসন ও ফৌজের স্বার্থপর পদস্থ কর্মকর্তাগণ আল-মালিকুস সালিহকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্থলাভিষিক্ত করে তাকে সুলতান অভিধায় ভূষিত করে। তারপর তাকে তাদের ক্রীড়নকে পরিণত করে। সালতানাতে ইসলামিয়া ভেঙ্গে খান খান হতে শুরু করে। সুলতান আইউবী মিশর থেকে দামেস্ক চলে গেছেন। আল-মালিকুস সালিহ ও তার সাঙ্গরা দামেস্ক শহরটিকে দারুস সালতানাত ঘোষণা করে। সাঙ্গপাঙ্গরা আল-মালিকুস। সালিহকে ব্যবহার করে চলে। তারা তাদের খৃস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শেই সুলতান আইউবীকে সন্ধির ধোঁকা দিয়েছিলো। কিন্তু বার্তাটি সাইফুদ্দীনের পরিবর্তে সুলতান আইউবীর হাতে এসে পড়ে। এটি সে যুগের ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, দূত ভুলবশত বার্তাটি সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকগণ- সিরাজুদ্দীন যাদের অন্যতম- দৃঢ়তার সঙ্গে লিখেছেন, এই দূত সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ছিলো।
বার্তাটি সুলতান আইউবীকে পেরেশান করে তোলে। কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ রওনা ও হামলা করার নির্দেশ দেননি। দুশমনের ন্যায় তাঁকে তাঁর ফৌজকে সুসংগঠিত করার প্রয়োজন ছিলো। তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ বিষয় হলো, শত্রুবাহিনীর অবস্থান তাদের মূল ঠিকানার কাছে। আর তিনি তার ঠিকানা থেকে অনেক দূরে। তাঁর রসদ সরবরাহের পথ অনেক দীর্ঘ ও অনিরাপদ। তাছাড়া তিনি এলোপাতাড়ি অগ্রযাত্রার পক্ষপাতী নন। গোয়েন্দাদের নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট ছাড়া তিনি সম্মুখে অগ্রসর হন না। তদস্থলে তিনি দুশমনকে সম্মুখে এগিয়ে আসবার সুযোগ দিয়ে থাকেন। তাই তিনি হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে বললেন, তুমি আরো কিছু গোয়েন্দা দুমশনের এলাকায় পাঠিয়ে দাও। তারা অতি দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসুক। এসব ছাড়াও তিনি আরো কিছু আবশ্যকীয় ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তিনি তার কেন্দ্রীয় কমান্ডকে জানিয়ে দিলেন, তিনি হামলা করবেন না। বরং তিনি দুশমনের আক্রমণ করার সুযোগ দেবেন, যাতে তারা তাদের আস্তানা থেকে বেরিয়ে দূরে চলে আসে। এসব নির্দেশনার পর তিনি নীরিক্ষা করতে শুরু করেন, দুশমনকে কোন্ স্থানে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা যায়।
***
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে মসুলের দিকে যাচ্ছিলো সৈনিকটি। সে সাইফুদ্দীন গাজীর ফৌজের সৈনিক। এই বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক একত্রে পিছপা হয়েছিলো। ক্ষুদ্র দলের সৈনিকরা বিক্ষিপ্ত হয়ে একা একা পলায়ন করছিলো। এই সৈনিকও একাকী পলায়নকারীদের একজন। লোকটি অতিশয় পেরেশান। সে একস্থানে ঘোড়া থামিয়ে নামায পড়ে। তারপর দুআ করতে করতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শেষ পর্যন্ত দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুজিয়ে বসে থাকে। এভাবে কিছু সময় কেটে যায়। হঠাৎ এক অশ্বারোহী তার সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। সৈনিক কল্পনার জগতে এভোই বিভোর যে, একটি ধাবমান ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি তাকে সজাগ করতে পারেনি। আরোহী ঘোড়া থেকে অবতরণ করে ধীর পায়ে আরো এগিয়ে এসে সিপাহীর মাথায় হাত রাখে। এবার সৈনিক চকিত হয়ে মাথা তুলে উপর দিকে তাকায়।
আমি জানি, তুমি রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে এসেছে- আরোহী তার পাশে বসতে বসতে বললো- কিন্তু তুমি এভাবে বসে আছো কেন? আহত হলে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
আমার দেহে কোন জখম নেই- সিপাহী জবাব দেয় এবং নিজের বুকের উপর হাত রেখে বললো- তবে হৃদয়টা আমার ক্ষত-বিক্ষত।
আগন্তুক অশ্বারোহী সুলতান আইউবীর সেই গোয়েন্দাদের একজন, যাদেরকে দুশমনের পিছপা হওয়ার সুযোগে শক্ত এলাকায় প্রেরণ করা হয়েছিলো। লোকটার নাম দাউদ। প্রশিক্ষণ অনুযায়ী সে সৈনিককে গভীরভাবে নীরিক্ষা করতে শুরু করে। বিচক্ষণ গোয়েন্দা বুঝে ফেলে, এই সৈনিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং এটা পরাজয়ভীতির প্রতিক্রিয়া। সে সিপাহীর সঙ্গে এমন সব কথা বলে যে, সিপাহী হৃদয়ের সব বাস্তব কথা খুলে বলতে শুরু করে।
সৈনিকগিরি আমার বংশের পেশা- সিপাহী বললো- আমার পিতা সৈনিক ছিলেন। দাদাও সৈনিক ছিলেন। এই পেশা আমার উপার্জনের মাধ্যম এবং আত্মার খোরাক। আমি আল্লাহর সৈনিক। আমি নিজ ধর্ম ও জাতির জন্য লড়াই করি। আমি জানতাম, খৃস্টানরা আমাদের ধর্মের ঘৃণ্যতম শত্রু। আমি এও জানি যে, আমাদের প্রথম কেবলা খৃস্টানদের কজায়। আমার পিতা আমাকে বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ইতিহাস শুনিয়েছেন। আমি ইসলামী চেতনা নিয়ে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে শুনতে শুরু করলাম, সুলতান আইউবী ইসলামের শত্রু, খৃস্টানদের বন্ধু এবং পাপিষ্টমানুষ। অথচ তার আগে আমরা শুনতাম, সুলতান সালাহুদ্দীন: আইউবী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, খৃস্টানরা তাকে ভয় করে এবং তিনি প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাসকে খৃস্টানদের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করছেন।, আমি আমাদের রাজ্যের শাসক সাইফুদ্দীন গাজীকে সত্য ভেবে আসছিলাম। একদিন আমাদের ফৌজ অভিযানে রওনা হওয়ার নির্দেশ লাভ করে। আমরা এখানে আসলাম। যুদ্ধ হলো। যুদ্ধ চলাকালে জানতে পারলাম, আমরা মুসলমান ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করছি এবং আমাদের প্রতিপক্ষ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ। সে ফৌজের সৈনিকরা আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে বলছিলো- তোমরা মুসলমান! তোমরা সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করো না। তোমাদের শত্রু আমরা নই। শত্রু তোমাদের খৃস্টানরা। তোমরা পক্ষ ত্যাগ করে আমাদের সঙ্গে চলে আসো। প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করো। তোমরা বিলাসী শাসকগোষ্টির জন্য যুদ্ধ করো না।
আমি সেই ফৌজের সৈনিকদের হাতে কালেমা খচিত পতাকা দেখেছি। আমি সেই সৈনিকদের যেভাবে যুদ্ধ করতে দেখেছি, তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন- অগ্নিশিখা কোথা থেকে উত্থিত হচ্ছিলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
মৃত্যুর নয়- আল্লাহর ভয়ে আমি এমনভাবে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম যে, আমার বাহুদ্বয় শক্তিহীন হয়ে পড়লো। আমি তরবারীর ওজনটাও বহন করতে পারছিলাম না। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কয়েকটি টিলা দেখতে পেলাম। আমি ঘোড়াসহ টিলাগুলোর অভ্যন্তরে ঢুকে লুকিয়ে গেলাম। আমি কাপুরুষ নই। কিন্তু তখন আমার সমস্ত শরীর কাঁপছিলো। বাইরে দুপক্ষের তরবারীর সংঘাত চলছিলো। ঘোড়ার ডাক- চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো। আমি আহ্বান শুনতে পাচ্ছিলাম- রমযান মাসে নিজ ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করো না। আমার মনে পড়ে গেলো, আমাদেরকে বলা হয়েছিলো, যুদ্ধের সময় রোযা রাখতে হয় না। আমরা রোযাদার ছিলাম না। আমি বুঝতে পারলাম, সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিকরা রোযাদার। ততক্ষণে আমি তাদের তিনজন সৈনিককে হত্যা করে ফেলেছি। তাদের রক্ত আমার তরবারীতে জমাট হয়ে আছে। সৈনিকরা নিজ তরবারীতে রক্ত দেখে আনন্দিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমি আমার তরবারীর প্রতি তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ, আমার তরবারীতে আমার ভাইয়ের খুন লেগে আছে।
আমার মধ্যে ওখান থেকে বের হওয়ার ও যুদ্ধ করার সাহস ছিলো না। আমি সেখানেই জড়সড় হয়ে লুকিয়ে থাকি। সালাহুদ্দীন আইউবীর এক অশ্বারোহী সৈনিক আমাকে দেখে ফেলে। সে আমাকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁক দেয়। সে আমার প্রতি বর্শা তাক করে। আমি রক্তমাখা তরবারীটা ঘোড়ার পায়ের উপর ফেলে দিয়ে বললাম- আমি তোমাদের মুসলমান ভাই। আমি যুদ্ধ করবো না। ঘোরতর যুদ্ধটা সেখান থেকে খানিক দূরে চলছিলো। এই আরোহী সম্ভবত কমান্ডোসেনা ছিলো এবং লুকিয়ে থাকা শত্রুসেনাদের সন্ধান করছিলো। সে এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো- সত্যিই কি তুমি বুঝতে পেরেছো, তুমি প্রকৃত মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই করছো? আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে বললাম- এই অপরাধ আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে। সে আমার বর্শাটা নিয়ে নেয়। তরবারী আগেই ফেলে দিয়েছিলাম। সে একদিকে ইঙ্গিত করে বললো আল্লাহর নিকট সাপের ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং ওদিকে পালিয়ে যাও। পেছন দিকে তাকাবে না। আমি তোমাকে জীবন দান করলাম।
আমার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় কান্না এসে পড়েছিলো। যুদ্ধের ময়দানে দুশমন জীবন দান করে না। আমি ঘোড়া হাঁকাই এবং তিনি যে পথ দেখিয়েছিলেন, সে পথে ছুটে চলি। পথটা নিরাপদ ছিলো। আমি রণাঙ্গন থেকে অনেক অনেক দূরে চলে আসি। রাতে এক স্থানে অবতরণ করে শুয়ে পড়ি। যে তিন সেনাকে হত্যা করেছিলাম, তাদের স্বপ্নে দেখি। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। তারা আমার চার পার্শ্বে ঘোরাফেরা করতে থাকে। তাদের সঙ্গে অস্ত্র ছিলো না। তারা আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। ভয়ে আমার গা ছমছম করে ওঠে। আমার জীবনটা বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমি শিশুর ন্যায় চিৎকার করতে শুরু করলাম। তারপরই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রচণ্ড শীতের রাতে আমার দেহ থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করে। আমি ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। কম্পিত দেহে উঠে ওজু করে নামায পড়তে শুরু করলাম। আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে।
আজ তিন-চার দিন যাবত আমি দিগ্বিদিগ ঘুরে ফিরছি। রাতে ঘুমাতে পারি না। দিনে কোথাও শান্তি পাই না। বহু কষ্টে দুচোখের পাতা বন্ধ করলেই সুলতান আইউবীর সেই তিন সৈনিককে দেখতে পাই, যারা আমার তরবারীর আঘাতে নিহত হয়েছিলো। দিনের বেলা মনে হয় এই বিজন এলাকায় তারা। আমার চারপার্শ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে অশ্বারোহী আমাকে টিলার অভ্যন্তরে লুকায়িত অবস্থায় দেখেছিলো, সে যদি আমাকে হত্যা করে ফেলতো, তাহলে ভালো হতো। লোকটা প্রাণভিক্ষা দিয়ে আমার উপর বড় জুলুম করেছে। সঙ্গে তরবারী থাকলে আমি নিজেই নিজেকে খুন করে ফেলতাম। আমি আমার রাসূলের তিনজন মুজাহিদকে হত্যা করেছি।
তুমি বেঁচে থাকবে- দাউদ বললো- আল্লাহর মর্জিতে তুমি মরবে না। যুদ্ধের ময়দান থেকে তুমি জীবিত বেরিয়ে এসেছে। তোমার সঙ্গে আত্মহত্যা করার কোন অস্ত্র নেই। এতেই প্রমাণিত হয় আল্লাহ তোমার দ্বারা ভালো কোন কাজ নেয়ার জন্য তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ তোমাকে পাপের কাফফারা আদায় করার সুযোগ দিয়েছেন।
তুমি বলো, সালাহুদ্দীন আইউবী সম্পর্কে আমাকে যেসব মন্দ কথা শোনানো হয়েছিলো, সেসব সত্য না মিথ্যা? সিপাহী জিজ্ঞাসা করলো।
সম্পূর্ণ মিথ্যা- দাউদ জবাব দেয়- সালাহুদ্দীন আইউবী খৃস্টানদের বিতাড়িত করে এই ভূখণ্ডে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন আর সাইফুদ্দীন ও তার দোসররা নিজ নিজ রাজত্ব ধরে রাখার জন্য যুদ্ধ করছে। তারা খৃস্টানদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে নিয়েছে এবং তাদের মদদে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে।
সালাহুদ্দীন আইউবী কেমন মানুষ এবং কী তার রক্ষ্য, দাউদ বিস্তারিতভাবে সিপাহীকে অবহিত করে। সে মসুলের শাসক সাইফুদ্দীন সম্পর্কে সিপাহীকে জানালো, লোকটা এতো বিলাসী যে, যুদ্ধের ময়দানে পর্যন্ত তিনি বিলাস সামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন।
বলো, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর সেই তিন মুজাহিদের রক্তের মূল্য কিভাবে পরিশোধ করবো?- সিপাহী দাউদকে জিজ্ঞেস করে- হৃদয় থেকে এই বোঝা সরাতে না পারলে আমি শান্তি পাবো না। আমি শান্তিতে মরতে পারবো না। তুমি সম্মতি দিলে আমি মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনকে হত্যা করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করবো।
এতো বড় ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন নেই- দাউদ বললো- তুমি বললে আমি তোমার সঙ্গী হয়ে যাবো।
তুমি কে? সিপাহী জিজ্ঞেস করে- তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাচ্ছে, কিছুই তো জানা হয়নি।
আমার নাম হারিছ। আমার গন্তব্য মসুল- দাউদ অসত্য বললো সেখানেই আমার বাড়ি। যুদ্ধের কারণে অন্য পথে যাচ্ছি। তোমার বাড়িটা যদি পথে পড়ে, তাহলে সেখানে বেড়াবো।
আমার গ্রাম বেশী দূরে নয়- সিপাহী বললো- জোর করে হলেও আমি তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো। তুমি আমার বিক্ষত আত্মাকে শান্তি দিয়েছে। এমন ভালো কথা আমি কখনো শুনিনি। আমি বাড়িতেই চলে যাবো। আর কখনো মসুলের ফৌজে যোগ দেব না। আমি আশা করি, তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে।
***
বৃদ্ধের কুঁড়ে ঘরের মেঝেতে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীন। একটানা কয়েক রাত জাগ্রত থাকার পর তিনি এখন এতো গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছেন যে, গৃহের বাইরের দরজার করাঘাতেও তার চোখ খোলেনি। রাতের অর্ধেকটা কেটে গেছে। বৃদ্ধ গৃহকর্তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তার কন্যা এবং পুত্রবধূও জেগে ওঠেছে। বৃদ্ধ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন- মনে হচ্ছে, সালাহুদ্দীন আইউবীর তাড়া খেয়ে মসুলের আরো কোনো কমান্ডার কিংবা সিপাহী এসেছে। রাস্তার পাশে বাড়ি না হওয়াই ভালো।
বৃদ্ধ দরজা খুললেন। বাইরে দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। আরোহীগণ আগেই নেমে গেছে। হারিছ সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলে বৃদ্ধ তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- বাবা! আমি এই জন্য আনন্দিত যে, তুমি হারাম মৃত্যু থেকে বেঁচে এসেছো। অন্যথায় আমাকে জীবনভর শুনতে হতো, তোমার পুত্র ইসলামী ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো। বৃদ্ধ পুত্রের সঙ্গী দাউদের সঙ্গে মুসাফাহা করে কুশল জিজ্ঞাসা করেন।
দাউদ কথা বলতে উদ্যত হলে বৃদ্ধ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে তাকে থামিয়ে দেন। পরে তার কানের কাছে গিয়ে বললেন- তোমাদের রাজা ও প্রধান সেনাপতি সাইফুদ্দীন ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তোমরা ঘোড়াগুলোকে একদিকে নিয়ে বেঁধে রেখে ভেতরে চলে এসো। কোনো শব্দ হয় না যেন।
সাইফুদ্দীন?- হারিছ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে তিনি এখানে কীভাবে আসলেন?
পরাজয়বরণ করে- বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন- তোমরা ভেতরে চলো।
ঘোড়াগুলোকে এদিকে সরিয়ে নিয়ে আড়ালে বেঁধে রাখা হলো। বৃদ্ধ দাউদ ও হারিছকে ভেতরে নিয়ে যান। হারিছ-ই তার সেই পুত্র, যার কথা তিনি সাইফুদ্দীনকে বলেছিলেন। হারিছ পিতার নিকট দাউদকে পরিচয় করিয়ে দেয়- এর নাম দাউদ। এমন অন্তরঙ্গ বন্ধু দ্বিতীয়জন হতে পারে না।
তোমরাও কি পালিয়ে এসেছো? বৃদ্ধ দাউদকে জিজ্ঞেস করেন।
আমি সৈনিক নই- দাউদ জবাব দেয়- আমি মসুল যাচ্ছি। যুদ্ধ আমাকে আমার পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। পথে হারিছকে পেয়ে তার সঙ্গ নিলাম।
বলুন, মসুলের শাসনকর্তা আমাদের ঘরে কীভাবে আসলেন? হারিছ পিতাকে জিজ্ঞেস করে।
আজ রাতে এসেছে- বৃদ্ধ জবাব দেয়। তার সঙ্গে এক নায়েবু সালার ও একজন কমান্ডার ছিলো। তাদেরকে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার কানে যে শব্দগুলো এসেছে, তাহলো, বাহিনীকে একত্রিত করো, তারপর আমাকে জানাও, আমি মসুল আসবো নাকি কিছুদিন লুকিয়ে থাকবো। আমি সেসময় কক্ষের দরজার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তাদের কথাবার্তা থেকে কি আপনি এই বুঝেছেন যে, মসুলের ফৌজকে একত্রিত করে তিনি এখনই পুনরায় যুদ্ধ করতে চান? দাউদ জিজ্ঞেস করে।
লোকটা এখানে এতোই সন্ত্রস্ত যে, আমাকে বলছিলেন, কেউ যেনে টের না পায়, আমি এখানে আছি- বৃদ্ধ জবাব দেন- আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা তার অবশ্যই আছে। কমান্ডারকে তিনি মসুলের স্থলে অন্য একদিকে প্রেরণ করেছেন।
আমি তাকে খুন করে ফেলবো- হারিছ বললো- লোকটা মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত করেছে। তারই চক্রান্তে এক আল্লাহু আকবার ধ্বনি দানকারী অপর আল্লাহু আকবার ধ্বনি দানকারীর রক্ত ঝরিয়েছেন। লোকটা আমাকে পাগল বানিয়েছে।
হারিছ ক্ষোভে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দেয়ালের সঙ্গে তার পিতার তরবারীটা ঝুলছিলো। ঝট করে সেটা হাতে নিয়ে নেয়।
পেছন থেকে বৃদ্ধ ছেলেকে ঝাঁপটে ধরে। দাউদ তার বাহু ধরে ফেলে। হারিছ আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ পিতা তাকে বললো- আগে আমার কথা শোেননা। তারপর যা খুশী করো। দাউদও তাকে থামিয়ে বললো, এ জাতীয় কাজ করার আগে ভেবে নিলে ভালো হয়। আমরা তাকে খুন করেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো। কিন্তু তার আগে নিজেরা যুক্তি-পরামর্শ করে পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে।
পিতা ও বন্ধু দাউদের কথায় হারিছ আপাতত নিবৃত্ত হয়েছে বটে; কিন্তু তার তর্জন থামেনি। ক্ষোভের আতিশয্যে তার চোখ দুটো রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে ওঠেছে।
তাকে হত্যা করা কঠিন কাজ নয়- বৃদ্ধ তার ক্ষুব্ধ পুত্রকে বসিয়ে বললেন তিনি গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। এখন আমার এই শক্তিহীন বাহুও তাকে হত্যা করতে পারবে। তার লাশটাও লুকিয়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু তার যে দুজন সঙ্গী চলে গেছে, তারা আমাদেরকে ছেড়ে দেবে না। তারা সন্দেহভাজন হিসেবে আমাদেরকে গ্রেফতার করবে। তোমার যুবতী স্ত্রী ও তরুণী বোনের সঙ্গে অসদাচরণ করবে। আমরা যদি বলি, তিনি মসুল চলে গেছেন, তারা। বিশ্বাস করবে না। কারণ, তিনি তাদেরকে এখানে আসতে বলেছেন।
মনে হচ্ছে, আপনি সাইফুদ্দীনকে সত্য বলে বিশ্বাস করছেন- হারিছ বললো আপনি মুসলমানের বিরুদ্ধে মুসলমানের লড়াইকে বৈধ মনে করছেন।
এখানে এসে ওঠার পর আমি তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমি তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি না- বৃদ্ধ বললেন- নিজের ঘরে তাকে হত্যা না করার এও একটি কারণ। তিনি আমাকে বলেছেন, তোমাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক বলে মনে হচ্ছে। তিনি আমাকে এই প্রলোভনও দিয়েছেন যে, তোমার পুত্র যদি যুদ্ধে নিহত হয়, বিনিময়ে আমাকে প্রচুর অর্থ দান করবেন। আমি তাকে বলেছি, আমি পুত্রের শাহাদাত কামনা করি- অন্যায় পথে মৃত্যু কিংবা অর্থ নয়। সাইফুদ্দীন আমার মনোভাব বুঝে ফেলেছেন। এখন যদি আমরা তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলি, তবু তার নায়েব এসে নির্দ্বিধায় আমাকে ধরে ফেলবে এবং বলবে, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক বলে মসুলের শাসনকর্তাকে হত্যা করেছে।
দাউদ ভাই!- হারিছ দাউদকে উদ্দেশ করে বললো- তুমিই বলে দাও, আমি কী করবো। তুমি আমার আবেগময় অবস্থাটা দেখেছো। তুমি বলেছিলে, আল্লাহ আমাকে আমার গুনাহের কাফফারা আদায় করার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। সেই শাসনকর্তাকে খুন করা, যিনি হাজার হাজার মুসলমানকে মুসলমানদের হাতে খুন করিয়েছেন। আমি তোমাকে বুদ্ধিমান লোক মনে করি। ভেবে-চিন্তে তুমি আমাকে সঠিক পরামর্শ দাও।
এই একজন মানুষকে হত্যা করলে কিছু অর্জিত হবে না- দাউদ বললো তার সাঙ্গপাঙ্গরা আছে, তারা হাবেও আছে, হাররানেও আছে। তাদের অনেক সালার আছে। আছে তাদের তিন-তিনটি ফৌজ। কাজেই সাইফুদ্দীন খুন হলেই তারা সালাহুদ্দীন আইউবীর সম্মুখে অস্ত্র সমর্পণ করবে না। অস্ত্র সমর্পণ করার জন্য পন্থাও আছে। তা হলো, এদেরকে যুদ্ধের ময়দানে এমনভাবে অসহায় করে ফেলতে হবে, যেননা তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর শর্ত সম্পূর্ণ মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এ কাজটা সালাহুদ্দীন আইউবী ছাড়া আর কে করতে পারেন- হারিছ বললো- আমার হৃদয়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, তা কিভাবে নিভবে ইসলামের তিনজন মুজাহিদের রক্তের প্রায়শ্চিত্ত্ব আমি কীভাবে আদায় করবো
মসুলের শাসনকর্তাকে এখানে পেয়ে গেছে বলে দাউদ বেজায় খুশি। হারিছ ও তার পিতাকে নিজের গোয়েন্দা পরিচয়টা দিতে ইতস্তত করছে সে। আবেগতাড়িত হয়ে গোয়েন্দারা নিজের পরিচয় ফাস করে না। কিন্তু এ মুহূর্তে পরিচয় গোপন রেখে তার কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। তার সিদ্ধান্ত, সাইফুদ্দীন যেখানে যাবে, সে তার পিছু নেবে এবং তার তৎপরতা ও গতিবি পর্যবেক্ষণ করবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত হারিছের ঘরে অবস্থান করাও সব মনে হচ্ছে না। তার পিতা-পুত্রের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই পরিকল্পনা ঠিক করে সে মোতাবেক কথাবার্তা বলতে শুরু করে দাউদ।
আচ্ছা, আমি যদি আপনাকে এমন একটা পন্থা বলে দেই, যার ফ সাইফুদ্দীন ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়াবার শক্তি হারিয়ে ফেলবে, তাহলে কি আপনি আমার সঙ্গ দেবেন? দাউদ হারিহের পিতাকে জিজ্ঞেস করে।
তুমি যদি আমার পুত্রের ন্যায় আবেগজড়িত হয়ে না ভাবো, তাহলে কি তোমার সঙ্গে আছি। হারিছের পিতা বললেন।
আমি কিন্তু খুন ছাড়া আর কোন পরিকল্পনার কথা শুনতে প্রস্তুত নই। হারিছ বললো।
আপনারা যদি নিজেদের বিবেক ও আবেগের লাগাম আমার হাতে তুলে দেন, তাহলে আপনাদের হাতে আমি এমন কাজ করাব, যা আপনাদের আত্মাকে শান্তিতে ভরে দেবে। দাউদ গম্ভীর দৃষ্টিতে পিতা-পুত্রের প্রতি তাকায়। হারিছের স্ত্রী ও বোন খানিক দূরে বসে তাদের কথোপকথন শুনছিলো। দাউদ তাদের প্রতিও গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে বললো- আমাকে একখানা কুরআন দিন।
হারিছের বোন উঠে গিয়ে একখানা কুরআন হাতে নিয়ে তাতে চোখ লাগিয়ে চুমো খেয়ে এনে দাউদের দিকে এগিয়ে দেয়। দাউদ কুরআনখানা হাতে নিয়ে তাতে চুম্বন করে। তারপর কুরআন খুলে একস্থানে আঙ্গুল রেখে পড়তে শুরু করে, যার মর্মার্থ হলো :
শয়তান তাদেরকে তাদের কজায় নিয়ে নিয়েছে এবং আল্লাহর স্মরণ তাদের মস্তিষ্ক থেকে উদাও হয়ে গেছে। ওরা শয়তানের দল। তোমরা শুনে, রাখো, শয়তানের দলের ক্ষতি অবধারিত। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তারা লাঞ্ছিত হবে।
কুরআন খোলামাত্র সূরা হাশরের এই আঠার ও ঊনিশতম আয়াত দুটি বেরিয়ে আসে। দাউদ বললো- এটি আল্লাহ পাকের বাণী। আমি নিজের মর্জিতে এই পাতাটা খুলিনি। এই আয়াতগুলো আপনা আপনি আমার সামনে : এসে পড়েছে। এটি আল্লাহ পাকের ঘোষণা ও তার সুসংবাদ। কুরআন আমাদেরকে বলে দিয়েছে, এরা শয়তানের সৈনিক। কুরআন ঘোষণা করেছে, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তারা লাঞ্ছিত হবে। কিন্তু তারা ততোক্ষণ পর্যন্ত লাঞ্ছিত হবে না, যতক্ষণ না আমরা চেষ্টা চালিয়ে তাদের অপমানের পথ সৃষ্টি করবে। তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করা আমাদের কর্তব্য।
দাউদ কুরআনখানা দুহাতের তালুতে রেখে সম্মুখে এগিয়ে ধরে বললো আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ডান হাতখানা এই কুরআনের উপর রেখে বলুন, আমরা আমাদের গোপনীয়তা ফাঁস করবে না এবং দুশমনকে পরাজিত করতে নিজের জীবন কুরবান করে দেবো।
সকলেই- যাদের মধ্যে দুজন মহিলাও রয়েছে- কুরআনের উপর হাত রেখে শপথ করে। কুরআন তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা তাদের চেহারায় ভেসে ওঠে। কক্ষে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ছাড়া আর কোন সাড়া নেই। দাউদ প্রতিক্রিয়াটা গভীরভাবে লক্ষ্য করে।
আপনারা কুরআনে হাত রেখে শপথ করেছেন- দাউদ বললো- আল্লাহ তাআলা কুরআনকে আপনাদের ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। এই পবিত্র গ্রন্থটির প্রতিটি শব্দ আপনারা বুঝেন। কৃত অঙ্গীকার থেকে যদি আপনারা সরে যান, তাহলে তার শাস্তিও কুরআনে লেখা আছে। তখন আপনারা সেই লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হবেন, যা শয়তানের বাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
তুমি কে? বৃদ্ধ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- তোমাকে তো বড় আলেম বলে মনে হচ্ছে।
আমার মধ্যে কোন ইলম নেই- দাউদ বললো- আমার নিকট আছে আমল। আমি কুরআনের নির্দেশে জীবন হাতে নিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। এই পাঠ আমাকে কোনো আলিম নয়, সালাহুদ্দীন আইউবী শিক্ষা দিয়েছেন। মসুলের নয়, আমি দামেস্কের বাসিন্দা। আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রেরিত গোয়েন্দা। এই সেই গোপন তথ্য, যা ফাঁস করবেন না বলে আপনারা শপথ করেছেন। আমাকে আপনাদের প্রত্যেকের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাকে নিশ্চয়তা দিন, আমি যা বলবো, আপনারা বিনা বাক্য ব্যয়ে তা পালন করবেন।
আমরা শপথ করেছি-বৃদ্ধ কললেন- তুমি তোমার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ব্যক্ত করো।
আল্লাহ আমার প্রতি মুখ তুলে তাকিয়েছেন- দাউদ বললো- যার পক্ষ থেকে তথ্য বের করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পৌঁছানোর কথা, তিনি এখন সেই ছাদের তলে শায়িত, যে ছাদের নীচে আমি বা আছি। মহান আল্লাহ ফেরেস্তাদের মাধ্যমে এখানে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আমাকে জানতে হবে, সাইফুদ্দীন ও তার বন্ধুদের পরিকল্পনা কী? তা। যদি পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই কিংবা প্রস্তুতি গ্রহণ অবস্থায় ধ্বংস করে দিতে হবে। সময়ের আগেই তাদের পরিকল্পনা জানতে হবে। হতে পারে, সুলতান আইউবী প্রস্তুত থাকবেন না আর এরা হঠাৎ আক্রমণ করে বসবে আপনারা জানেন, এমনটি হলে পরিণতি কী হবে।– যারা প্রতারণার মাধ্যমে নিজেদের্ন বাহিনীকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমি তাদেরকে হত্যা করার অনুমতি পেতে পারি কী? হারিছ জিজ্ঞেস করে।
শোন বন্ধু! দাউদ বললো- কোনো কোনো পরিস্থিতিতে হাতের কাছে পেয়েও শত্রুকে বধ না করা কল্যাণকর হয়ে থাকে। প্রতিটি কদম তোমাকে বুঝে-শুনে ঠাণ্ডা মাথায় ফেলতে হবে। সাইফুদ্দীনের প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তাকে ধাওয়া করতে হবে। ইনি এখানে এসে যেভাবে আত্মগোপন করেছেন, তেমনি আমি ও হারিছ লুকিয়ে থাকবে এবং দেখবো লোকটা কী করে।
***
উক্ত গৃহের এক কক্ষে গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছেন সাইফুদ্দীন। ভোর হলো। বৃদ্ধ উঁকি দিয়ে তাকান। সাইফুদ্দীন এখনো শুয়ে আছেন। সূর্যটা বেশ উপরে উঠে আসার পর তার চোখ খোলে। হারিছের বোন ও স্ত্রী তার সম্মুখে নাস্তা এনে হাজির করে। তিনি হারিছের বোনের প্রতি কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন- তোমরা আমাদের যে সেবা করেছে, আমরা তার এমন প্রতিদান দেবো, যা তোমরা কল্পনাও করোনি। আমরা তোমাদেরকে অট্টালিকায় রাখবো।
আমরা যদি আপনাকে এই ঝুপড়িতেই রেখে দেই, তাহলে কি আপনি খুশি হবেন না? মেয়েটি হেসে জিজ্ঞেস করে।
আমরা বনে-জঙ্গলেও থাকতে পারি- সাইফুদ্দীন বললেন- কিন্তু তোমরা তো ফুল দ্বারা সাজিয়ে রাখার মতো বস্তু।
আপনি কি নিশ্চিত যে, আপনার কপালে পুনরায় মহলে যাওয়া লেখা আছে? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
এমনটা বলছো কেন? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করে।
আপনার অবস্থা দেখে মেয়েটি বললো- রাজার ঝুপড়িতে আত্মগোপন করা প্রমাণ করে তার রাজত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তার বাহিনী তাকে ত্যাগ করেছে।
ফৌজ আমার সঙ্গ ত্যাগ করেনি- সাইফুদ্দীন বললেন- আমি একটুখানি বিশ্রাম নেয়ার জন্য এখানে যাত্রাবিরতি দিয়েছি। মহল শুধু আমার নসীবেই নয়, তোমাদেরও ভাগ্যে লেখা আছে। যাবে না আমার সঙ্গে?
হারিছের স্ত্রী কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। বোন সাইফুদ্দীনের কাছে বসে কথা বলতে শুরু করে। আপনার স্থলে যদি আমি হতাম, তাহলে সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত না করে মহলের নামও উচ্চারণ করতাম না। আপনি যদি আমাকে পছন্দ করেই থাকেন, তাহলে আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আপনার এই পলায়ন ও আত্মগোপন করা আমার মোটেই পছন্দ নয়। যুদ্ধকুশলী রাজার ন্যায় বেরিয়ে পড়ুন। বাহিনীকে একত্রিত করুন এবং সুলতান আইউবীর উপর হামলা করুন।
মেয়েটি সরল প্রকৃতির মানুষ। তবে তার সরলতায় সৌন্দর্য আছে। সাইফুদ্দীন বিমোহিত নয়নে তার প্রতি তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। সেই হাসিতে যেমন আছে ভালোবাসা, তেমনি কু-পরিকল্পনাও।
আমি রাজকন্যা নই- মেয়েটি বললো- এই পার্বত্য এলাকায় জন্ম এবং এখানেই বড় হওয়া। আমি সৈনিকের কন্যা, সৈনিকের বোন। আপনার সঙ্গে আমি প্রাসাদে নয়, যুদ্ধের ময়দানে যাবো। আপনি কি আমার সঙ্গে তরবারী চালনার প্রতিযোগিতা করবেন? পাহাড়ের নীচ থেকে উপরে, উপর থেকে নীচে আমার সঙ্গে ঘোড়া দৌড়াবেন?
তুমি শুধু রূপসীই নও, যোদ্ধাও- সাইফুদ্দীন মেয়েটির মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন- এমন মায়াবী চুল আমি এই প্রথম দেখলাম।
মেয়েটি সাইফুদ্দীনের বেয়াড়া হাতটা সযত্নে সরিয়ে দিয়ে বললো- চুল নয়, বাহু। এই মুহূর্তে আপনাকে চুলের নয়, আমার বাহুর প্রয়োজন। আমাকে বলুন, আপনার ইচ্ছে কী?
তোমার পিতা একজন ভয়ংকর মানুষ- সাইফুদ্দীন বললেন- তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক এবং সম্ভবত আমাকে পছন্দ করেন না। আমার আশংকা, তিনি আমাকে ধোঁকা দেবেন।
আব্বাজান বৃদ্ধ মানুষ- মেয়েটি মুখে হাসি টেনে বললো- আপনার সঙ্গে তিনি কী কথা বলেছেন, তা অবশ্য আমার জানা নেই। আমাদের সামনে তো আপনার ভূয়সী প্রশংসাই করলেন। তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর নামটাই শুনেছেন। তার সম্পর্কে আর কিছু জানেন না। আপনার তাকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। একজন দুর্বল বৃদ্ধ মানুষ আপনার কিইবা ক্ষতি করতে পারবে। আপনি আমাকে পরীক্ষা করে দেখুন।
সাইফুদ্দীন মেয়েটির প্রতি হাত বাড়ায়। মেয়েটি পেছনে সরে গিয়ে বলতে শুরু করে আপনাকে আমি আমার দেহ থেকে বঞ্চিত করবো না। নিজেকে আপনার হাতে তুলে দেবো। কিন্তু তখন দেবো, যখন আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করে ফিরে আসবেন। এ মুহূর্তে আপনি বিপদগ্রস্ত। আপাতত আমার থেকে দূরে থাকুন। বলুন, আপনার পরিকল্পনা কী?
সাইফুদ্দীন বিলাসী ও নারীপূজারী পুরুষ। রূপসী নারী তার জন্য অভিনব কিছু নয়। কিন্তু এই মেয়েটির মধ্যে বিস্ময়কর যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করলেন, তাহলে মেয়েটি তার সম্মুখে অবনত হচ্ছে না। এর আগে তো যে কোনো মেয়ে প্রশিক্ষিত জন্তুর ন্যায় তার আঙ্গুলের ইশারায় নেচে বেড়াতো। কিন্তু এই মেয়েটি তার উপর এমনভাবে আঘাত হানলো যে, তার আত্মমর্যাদা জেগে ওঠেছে।
শোন রূপসী- সাইফুদ্দীন বললো- তুমি আমার পৌরুষের পরীক্ষা নিতে চেয়েছে। শপথ নিলাম, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার গায়ে হাত দেবো না, যতক্ষণ না সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারী আমার হাতে চলে আসবে এবং আমি তার ঘোড়ায় সওয়ার হবো। আমাকে ওয়াদা দাও, তুমি আমার কাছে চলে আসবে।
আমাকে আপনার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে চলুন। মেয়েটি বললো।
না–সাইফুদ্দীন বললেন- আমাকে এখনো বাহিনী প্রস্তুত করতে হবে। আমি এক ব্যক্তিকে মসুল পাঠিয়ে দিয়েছি। তাকে বলে পাঠিয়েছি, তোমরা ফৌজকে একত্রিত করো এবং অবিলম্বে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করো, যাতে তিনি আমাদের শহর অবরোধ করতে আসতে না পারেন। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার প্রেরিত উভয় ব্যক্তি ফিরে আসার কথা। তখন জানা যাবে, হাল্ব ও হাররানের ফৌজ কী অবস্থায় আছে। আমরা পরাজয় মেনে নেবো, না। পাল্টা আক্রমণ করবো এবং অবিলম্বে করবো।
সাইফুদ্দীন এখন ব্যক্তিত্বহারা মানুষ। নারীপূজা ও ঈমান বিক্রি তার চরিত্রকে এমনই ফোকলা করে দিয়েছে যে, সহজ-সরল একটি মেয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের গোপন তথ্য ফাঁস করতে শুরু করেছে। মেয়েটি তার হাতে চুমো খেয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
***
সাইফুদ্দীনের সঙ্গে যে লোকটি এসেছিলো, তাদের একজনকে তিনি মসুল পাঠিয়ে দিয়েছেন, অপ্রজনকে হাব- হারিসের বোন পিতা, ভাই ও দাউদকে বললো- তার পরিকল্পনা হচ্ছে, তিনটি বাহিনীকে একত্রিত করে অবিলম্বে সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করা, যাতে তিনি অগ্রসর হয়ে শহর অবরোধ করতে না পারেন। যে দুব্যক্তিকে তিনি প্রেরণ করেছেন, তারা এসে জানাবে, ফৌজ যুদ্ধ করার অবস্থায় আছে কিনা।
সাইফুদ্দীন হারিছের বোনকে যা যা বলেছেন, মেয়েটি তার পিঞ্জ, ভাই হারিছ ও দাউদকে সব শোনায়।
মেয়েটির নাম ফাওজিয়া। গায়ের সরজ-সরল মেয়ে। আল্লাহ তাকে দিয়ানত ও জযবা দান করেছেন। দাউদ তাকে সাইফুদ্দীনের বক্ষ থেকে তথ্য বের করার দায়িত্ব অর্পন করেছিলো। কৌশলও বুঝিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটিকে। বলেছিলো, লোকটা বিলাসী ও অসৎ। তাই তার ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ফাওজিয়া অত্যন্ত চমৎকারভাবে কর্তব্য পালন করে। সে সাইফুদ্দীনের হৃদয় থেকে যেসব তথ্য বের করে এনেছে, তাতে দাউদ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, সাইফুদ্দীনের পিছু নেয়া আবশ্যক।
মধ্যরাতের খানিক আগে বৃদ্ধের চোখ খুলে যায়। তিনি দরজায় করাঘাতের শব্দ ও ঘোড়ার হোধ্বনি শুনতে পান। শয্যা ত্যাগ করে উঠে দরজা খোলেন। বাইরে সাইফুদ্দীনের নায়েব সালার দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধ তার ঘোড়াটা একদিকে সরিয়ে নিয়ে যান। নায়েব সালার ভেতরে চলে যায়। বৃদ্ধ ঘরে প্রবেশ করে নায়েব সালারের খাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। নায়েব সালার প্রযোজন নেই বলে জবাব দেয়। বৃদ্ধ তার সঙ্গে ভৃত্যের ন্যায় আচরণ করেন। সাইফুদ্দীন বললেন, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। বৃদ্ধ প্রজার ন্যায় আদবের সাথে বেরিয়ে যান। তিনি দাউদকে জাগিয়ে তোলেন এবং দুজনে দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যান।
গোমস্তগীন সম্পর্কে জানতে পেরেছি, তিনি হাবে আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে আছেন- নায়েব সালার বললো- মসুলে যে পরিস্থিতি দেখেছি, তা এতো খারাপ নয় যে, আমরা যুদ্ধ করতেই পারবো না। সালাহুদ্দীন আইউবী তুমানে থেমে গেছেন। খৃস্টান গোয়েন্দারা জানিয়েছে, আইউবী আল-জাযিরা, দিয়ার, বকর ও আশপাশের অঞ্চলগুলো থেকে লোকদেরকে ফৌজে ভর্তি করছেন। মনে হচ্ছে, তিনি এক্ষুণি সম্মুখে অগ্রসর হবেন না। তবে তিনি অগ্রসর হবেন অবশ্যই, যা হবে ঝড়ের ন্যায়। তার ফৌজের তাবু বলছে, তিনি সেই স্থানে অনেক দিন অবস্থান করবেন। সম্ভবত তিনি এই আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত যে, আমরা যুদ্ধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের যে ফৌজ মসুল গিয়ে পৌঁছেছে, তাদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের অনেক কম। অন্যরা মৃত্যুবরণ করেছে। অনেকে নিখোঁজ রয়েছে।
তাহলে কি এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।
শুধু আমাদের ফৌজ হামলার জন্য যথেষ্ট নয়- নায়েব সালার জবাব দেয়- আল মালিকুস সালিহ ও গোমস্তগীনকে সঙ্গে নিতে হবে। আমাদের উপদেষ্টাগণ (খৃস্টানরা) এ পরামর্শই প্রদান করেছে।
তুমি কি তাদেরকে বলেছে, আমি কোথায় আছি? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।
না, আমি এ জায়গার কথা বলিনি- নায়েব সালার জবাব দেয়- আমি তাদেরকে বলেছি, আপনি তুর্কমানের উপকণ্ঠে ঘোরাফেরা করছেন এবং নিজ চোখে সালাহুদ্দীন আইউবীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। আমার পরামর্শ, তিন-চার দিন পর আপনাকে মসুল চলে যাওয়া উচিত।
তার আগে হাবের খবরাখবর জানতে হবে- সাইফুদ্দীন বললেন কমান্ডার কাল সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবে। তুমি তো জানো, গোমস্তগীন শয়তান চরিত্রের মানুষ। তাকে তার দুর্গে (হাররানে) চলে যাওয়া উচিত ছিলো। লোকটা হাবে কী করছে? আমি মসুল যাওয়ার আগে হাব যাবো। গোমস্তগীন আমার জোট সদস্য বটে; কিন্তু আমি তাকে বন্ধু ভাবতে পারি না। আল-মালিকুস সালিহর সালারদেরকে মতে আনতে হবে, সালাহুদ্দীন আইউবীর এ গড়িমসিকে কাজে লাগাতে হবে এবং সময় নষ্ট না করে হামলা করতে হবে। এখন আমি এ পরামর্শও দেবো যে, তিনটি ফৌজ একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে পরিচালিত হওয়া উচিত এবং তার একজন প্রধান সেনাপতি থাকা আবশ্যক। আমরা শুধু এ জন্য পরাজয়বরণ করেছি যে, আমাদের বাহিনীগুলোর কমান্ড পৃথক পৃথক ছিলো। এক বাহিনীর অপর বাহিনীর পরিকল্পনা ও কৌশল জানা ছিলো না। অন্যথায় মুজাফফর উদ্দীন সালাহুদ্দীন আইউবীর পার্শ্বর উপর যে হামলা করেছিলো, তা ব্যর্থ হওয়ার কথা ছিলো না।
তখন কেন্দ্রীয় কমান্ড আপনার হাতে থাকতে হবে। নায়েব সালার বললো।
আর আমাদেরকে বন্ধুদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে- সাইফুদ্দীন বললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, খৃস্টানরা কি আমাদেরকে সাহায্য করবে?
তারা সৈন্য তো দেবে না- নায়েব সালার জবাব দেয়- উট-ঘোড়া ও অস্ত্র ইত্যাদি সরবরাহ করবে। আচ্ছা, এখানে আপনি কোনো সমস্যা অনুভব করছেন কি?
না- সাইফুদ্দীন বললেন- বৃদ্ধকে নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে। তার মেয়ে আমার ফাঁদে এসে গেছে। কিন্তু মেয়েটি আবেগপ্রবণ। বলছে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করে তার তরবারী নিয়ে নাও। তারপর তার ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে আসো। আমি তোমার সঙ্গে চলে যাবো।
নায়েব সালার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হারিছ, তার পিতা ও দাউদ দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে তাদের কথোপকথন শুনছে। সাইফুদ্দীন ও তার নায়েব সালারের ফেরেস্তারাও জানে না, এ গৃহে একজন বৃদ্ধ ও দুটি মেয়ে ছাড়া দুজন যুবক মুজাহিদও আছে, যারা যে কোন উপযুক্ত সময়ে তাদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে। সাইফুদ্দীনের মনে সন্দেহের লেশমাত্র নেই যে, তিনি ফাওজিয়াকে ফাঁদে ফেলেননি, বরং তিনিই ফাওজিয়ার জালে আটকা পড়েছেন।
***
দাউদ ও হারিছ ঘরে অবস্থান করছে। সাইফুদ্দীন ও তার নায়েব সালার দেউড়ি সংলগ্ন কক্ষে লুকিয়ে আছে। দিনের বেলা ফাওজিয়া তিন-চারবার উক্ত কক্ষে যাওয়া-আসা করছে। মেয়েটি যেহেতু সাইফুদ্দীনের কাছে গেলেও দুহাত দূরে থাকছে, সে কারণে তার প্রতি সাইফুদ্দীনের আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি ফাওজিয়াকে বললেন- তোমার ভাই আমার ফৌজের সৈনিক। আমি তাকে বাহিনীর কমান্ডার বানিয়ে দেবো।
তিনি জীবিত আছেন নাকি মারা গেছেন, আমরা তাও তো জানি না ফাওজিয়া বললো- যদি মারাই গিয়ে থাকেন, তাহলে আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়বো।
তাই যদি হয়, তাহলে আমি তোমার পিতা এবং ভাবীকেও সঙ্গে নিয়ে যাবো সাইফুদ্দীন বললেন।
ফাওজিয়ার পিতাও সাইফুদ্দীনের নিকট আসা-যাওয়া করছেন। তিনি কাজে-আচরণে সাইফুদ্দীনকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি তার অফাদার।
রাতে পুনরায় দরজায় করাঘাত পড়ে। বৃদ্ধ দরজা খোলেন। বাইরে সাইফুদ্দীনের সেই কমান্ডার দাঁড়িয়ে, যাকে তিনি হাল্ব পাঠিয়েছিলেন। বৃদ্ধ তাকে সাইফুদ্দীনের কক্ষে পাঠিয়ে দেন। তার ঘোড়াও অন্য ঘোড়াগুলোর সঙ্গে বেঁধে রেখে ঘরে গিয়ে কমান্ডারের খাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চান। কমান্ডার অনেক দ্রুত এসেছে। পথে কোথাও দাঁড়ায়নি। ফলে পথে খাওয়া সম্ভব হয়নি। বৃদ্ধ খাবার আনার জন্য ভেতরে গেলে ফাওজিয়া বললো আপনার যেতে হবে না, আমি নিয়ে যাচ্ছি। তার উদ্দেশ্য, এই সুযোগে কমান্ডারের নিয়ে আসা তথ্যও সে সগ্রহ করবে।
ফাওজিয়া খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। বক্তব্যরত কমান্ডার তাকে দেখেই থেমে যায়। সাইফুদ্দীন বললেন- অসুবিধা নেই, বলো, ও আমাদেরই মেয়ে। ফাওজিয়া কমান্ডারের সামনে খাবার রেখে সাইফুদ্দীনের পাশে বসে পড়ে। এই প্রথমবার মেয়েটি সাইফুদ্দীনের এত কাছে গিয়ে বসলো। সাইফুদ্দীন তার একটি হাত নিজের মুঠোয় নেয়। ফাওজিয়া হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেনি। অন্যথায় খৃস্টানদের এই বন্ধু তার হাতছাড়া হয়ে যেতো। এই লম্পট শাসককে মুঠোয় রাখার এ এক মোক্ষম অস্ত্র।
হালবের বাহিনীর জযবা প্রশংসার দাবীদার- কমান্ডার বলা শুরু করে। ফাওজিয়া সাইফুদ্দীনের আঙ্গুলে পরিহিত একটি আংটিতে হাত রেখে নাড়াচাড়া করছে এবং হিরার এই আংটিটার প্রতি শিশুসুলভ আকর্ষণ নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেনো কমান্ডারের বক্তব্যের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু কান দুটো তার সেদিকেই খাড়া আছে। কমান্ডার বললো- আল মালিকুস সালিহ সালাহুদ্দীন আইউবীকে সন্ধির প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন।
সন্ধির প্রস্তাব? সাইফুদ্দীন চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করেন।
জ্বি হ্যাঁ, সন্ধির প্রস্তাব।- কমান্ডার বললো- কিন্তু আমি তথ্য পেয়েছি, তিনি আইউবীকে ধোঁকা দিয়েছেন। তার খৃস্টান বন্ধুরা তার ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে দিচ্ছে এবং তাকে উস্কানি দিচ্ছে, যেনো তিনি মসুল ও হাররানের বাহিনীকে একক কমান্ডে নিয়ে এসে অবিলম্বে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করেন। আইউবী যদি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায় এবং নতুন ভর্তি দিয়ে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করে, তাহলে তাকে প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। গুপ্তচর সংবাদ নিয়ে এসেছে, সালাহুদ্দীন আইউবী তুর্কমানের সবুজ-শ্যামল অঞ্চলে দীর্ঘ সময়ের জন্য ছাউনী ফেলেছেন এবং সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি অতি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করছেন। আল-মালিকুস সালিহর সালারেরও একই অভিমত যে, তুকমান এলাকায়ই সালাহুদ্দীনের উপর এখনই হামলা করা উচিত।
আমি হা্লবের বাহিনীর এক খৃস্টান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে নিয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, আমরা এখনই সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করাতে সক্ষম নই। তিনি বললেন, এটা তোমাদের বিরাট সামরিক ক্রটি বলে বিবেচিত হবে। সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করার উদ্দেশ্য, তাকে এখনই পরাজিত করা নয়। উদ্দেশ্য হলো, তাকে সুযোগ দেয়া যাবে না। তাকে তুর্কমানের এলাকাতেই অস্থির করে রাখতে হবে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ ধরে রাখতে হবে। এই যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে আইউবীরই ধারায় আঘাত করো, পালিয়ে যাও, গেরিলা হামলা করো ধরনের। চেষ্টা করতে হবে, তুকমানেরযেখানেই পানি আছে, আইউবীকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে, যাতে খানা-পানির অভাবে সে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
বড় ভালো বুদ্ধি তো- সাইফুদ্দীন বললেন- এমন যুদ্ধ আমার, সিপাহসালার মুজাফফর উদ্দীন লড়তে পারে। দীর্ঘদিন যাবত সে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে থেকে এসেছে। তিন ফৌজের একক কমান্ড যাতে আমার হাতে চলে আসে। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে মরু শিয়ালের ন্যায় ধোকা দিয়ে মারবো।
ফাওজিয়া সাইফুদ্দীনের তরবারীটা কোষ থেকে বের করে হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করে। মেয়েটা একেবারে অবুঝ শিশুর মতো বসে আছে।
আমি আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছি- কমান্ডার বললো- কিন্তু সালার ও কর্মকর্তারা তাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, তা সম্ভব হলো না। এসব তথ্য আমি তার সালারদের থেকে সগ্রহ করেছি।
তোমাকে আজ পুনরায় হাল্ব যেতে হবে- সাইফুদ্দীন বললেন- আল মালিকুস সালিহকে বার্তা দিয়ে আসবে, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছো। তুমি আইউবীর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। তার হাত শক্ত করে দিয়েছে। সে আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবে না। তুমি এখনো বালক। তুমি ভয় পেয়ে গেছে কিংবা তোমার সালারগণ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তোমাকে এই পরামর্শ দিয়েছে।
সাইফুদ্দীন এতদ্বিষয়ে দীর্ঘ বার্তা দিয়ে কমান্ডারকে বললেন- তুমি রাত পাহাবার আগেই আলো-আঁধারীতে রওনা হয়ে যাবে। দিনের বেলা যেনো এ এলাকায় কেউ তোমাকে দেখতে না পায়।
কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর কমান্ডার রওনা হয়ে যায়।
ফাওজিয়া যা কিছু শুনলো, দাউদকে বলে দিলো। এসব তথ্যও কাজের। হারিছ ও তার পিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। দাউদ কি এক কাজে ঘর থেকে বের হয়। ফাওজিয়াও পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে। দাউদ তার ঘোড়ার নিকট গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ফাওজিয়াও সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
আমাকে এর চেয়ে আরো বড় কাজ করতে দিন- ফাওজিয়া বললো আপনার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।
আমার জন্য নয়, নিজ জাতি ও ধর্মের জন্য জীবন দিতে হবে- দাউদ বললো- তুমি যে কাজটা করেছে, এটা অনেক বড় কাজ। আমরা যারা গোয়ে, আমরা এ কাজেই নিজেদের জীবন বিলিয়ে থাকি। তোমার দ্বারা যে কাজ করাচ্ছি, তা মূলত আমার কাজ। আমি তোমাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলাম।
কেমন ঝুঁকি?
তুমি এতোটা চতুর নও- দাউদ বললো- সাইফুদ্দীন রাজা। এ কুঁড়েঘরেও রাজা।
তা রাজা আমাকে খেয়ে ফেলবে নাকি?- ফাউজিয়া বললো- আমি চালাক না হতে পারি, সোজাও নই।
রাজত্বের চমক দেখলে তোমার চোখ বুজে আসবে- দাউদ বললো এই মানুষগুলো সেই চমকেই অন্ধ হয়ে ঈমান বিক্রি করেছে এবং ইসলামের মূলোৎপাটন করছে। আমার ভয় হচ্ছে, পাছে তুমিও সেই ফাঁদে আটকা পড়ে যাও কিনা।
আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার কোনো ঠিকানা নেই- দাউদ বললো- আমি গুপ্তচর ও গেরিলা। যেখানে দুশমনের হাতে পড়বো, সেখানেই মারা যাবো। আর যেখানে মারা যাবো, সেটাই হবে আমার মাতৃভূমি। শহীদের রক্ত যে ভূখণ্ডে পতিত হয়, সেই ভূখণ্ড সালতানাতে ইসলামিয়ার হয়ে যায়। সেই ভূখণ্ডকে কুফর থেকে পবিত্র করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয হয়ে যায়। আমাদের মা ও বোনেরা আমাদেরকে প্রতিপালন করে আল্লাহর হাতে তুলে দিয়েছেন। তারা নিজেদের অন্তরে পাথর বেঁধে রেখেছেন এবং আমরা পুনরায় তাদের কোলে ফিরে যাবো।
আপনার অন্তরে বাড়ি যাওয়ার, মাকে দেখার এবং ভাই-বোনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্খ জাগে নিশ্চয়ই। ফাওজিয়া আপুত কণ্ঠে বললো।
মানুষ যখন কামনার গোলাম হয়ে যায়, তখন কর্তব্য অসম্পাদিত থেকে যায়- দাউদ বললো- ইসলামের একজন সৈনিককে জীবন কুরবান করার আগে আবেগ কুরবান করতে হয়। এই কুরবানী তোমাকেও দিতে হবে।
ফাওজিয়া দাউদের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বললো- আপনি কি আমাকে আপনার সঙ্গে রাখবেন?
না। দাউদের সুস্পষ্ট জবাব।
দিন কয়েক আমার কাছে থাকতে পারবেন? ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করে।
আমার কর্তব্য যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে পিরবো- দাউদ জবাব দেয়- তা আমাকে কাছে রেখে কী করবে?
আপনাকে আমার ভালো লাগে- ফাওজিয়া বললো- আপনার মুখ থেকে এমন আবেগমাখা মূল্যবান কথা শুনেছি, যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। আমার মন চায় আপনার সঙ্গে থাকি আর…।
আমার পায়ে শিকল বেঁধো না ফাওজিয়া- দাউদ বললো- নিজেকেও আবেগের শিকল থেকে মুক্ত রাখো। আমাদের সামনে বড় কঠিন পথ। পরস্পর হাতে হাত ধরে একসঙ্গে চলতে হবে বটে, একজন অপরজনের বন্দী হবো না। দাউদ খানিক চিন্তা করে বললো- ফাওজিয়া! তুমি বেশী দূর আমার সঙ্গ দিতে পারবে না। আমার কাছে তোমার ইজ্জতটা বেশী মূল্যবান। পুরুষদের কাজ পুরুষরাই করবে। তার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।
সহসা ফাওজিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দাউদকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক নজর দেখে নিয়ে কোন কথা না বলে মোড় ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়। দাউদ ফাওজিয়ার বাহুতে হাত রাখে এবং তাকে কাছে টেনে চোখে চোখ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ফাওজিয়া তার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায় এবং আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বলে- যে কাজ পুরুষদের, তা নারীরাও করতে পারে। আমার সম্ভ্রম তো কাঁচ নয় যে, সামান্য আঘাতে ভেঙ্গে যাবে। আমি তোমাকে আমার সম্ভ্রম পেশ করছি না। তোমাকে আমার ভালো লাগে। তোমার কথাগুলো ভালো লাগে। আমাকে তুমি যে পথ দেখিয়েছে, তাও আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি তোমার গা ঘেঁষে এ জন্য দাঁড়িয়েছি, যাতে আমার ছোঁয়ায় তুমি তোমার মা কিংবা বোনের ঘ্রাণ লাভ করতে পারো। তুমি বড্ড ক্লান্ত দাউদ ভাই। আমার ভাবী আমাকে অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পুরুষরা যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে, তখন নারী ছাড়া কেউ তাদের ক্লান্তি দূর করতে পারে না। নারী না থাকলে পুরুষের আত্মা নির্জীব হয়ে যায়। আমার ভয় হচ্ছে, আপনার আত্মা যদি নির্জীব হয়ে যায়, তাহলে…।
দাউদ হেসে ওঠে এবং ফাওজিয়ার গালে আলতো হাত বুলিয়ে বললো তোমার এই সরল-সহজ কথাগুলো আমার আত্মাটাকে সজীব করে তুলেছে।
আমার কোনো কথা আপনার অপছন্দ হয়নি তো- ফাওজিয়া বললো ভাইয়াকে বলবেন না কিন্তু।
না, বলবো না- দাউদ বললো- তোমার ভাইকে এ ব্যাপারে কিছুই বলবো না। আর তোমার কোনো কথায় আমি কষ্ট পাইনি।
আপনার-আমার গন্তব্য একই- ফাওজিয়া বললো- মনের কথা কিভাবে বলতে হয়, আমার জানা নেই।
তুমি তোমার মনের কথাই বলে দিয়েছো ফাওজিয়া- দাউদ বললো আর আমিও বুঝে ফেলেছি, তুমি ঠিকই বলেছো, আমাদের গন্তব্য এক। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, পথে রক্তের নদী আছে, যার উপর কোনো পুল নেই। তুমি যদি চিরদিনের জন্য আমাকে পেতে চাও, তাহলে আমাদের বিয়ে হবে রক্তাক্ত প্রান্তরে। তারপর যদি আমাদের লাশ দুটো একটি অপরটি থেকে দূরে থাকে, তবু আমরা একত্রিত হবো। সত্য পথের পথিকদের বিয়ে পৃথিবীতে নয়, আকাশে হয়ে থাকে। তাদের বরযাত্রী পথ অতিক্রম করে ছায়াপথে। তাদের বিয়ের উৎসবে সমস্ত আকাশকে তারকা দ্বারা সজ্জিত করা হয়ে থাকে।
দাউদের সঙ্গে কথোপকথনের শেষে ফাওজিয়া যখন ফিরে যেতে উদ্যত হয়, তখন তার ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা যায়, যে হাসিতে আনন্দের তুলনায় প্রত্যয়ের প্রতিক্রিয়া অধিক বেশী পরিস্ফুট।
***
আল-মালিকুস সালিহর নামে সাইফুদ্দীনের বার্তা নিয়ে যাওয়া কমান্ডার দুদিন পর ফিরে আসে। আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। ফলে বার্তা পৌঁছিয়ে তার লিখিত জবাব পাঠিয়ে দিতে বলে আসে সে। সাইফুদ্দীন কোথায় আছেন এবং যে গৃহে অবস্থান করছেন, সেখানে কিভাবে আসতে হবে, বলে এসেছে কমান্ডার। সাইফুদ্দীন তার পত্রের জবাবের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। কিন্তু জবাব আসছে না। তার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। চারদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি অত্যন্ত পেরেশেন হয়ে পড়েন।
নাকি আমি নিজেই হাব যাবো- সাইফুদ্দীন তার নায়েব সালারকে বললেন- হাবের বাহিনী যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সমঝোতা করেই ফেলে, তাহলে নিজেদের ব্যাপারে ভাবতে হবে। গোমস্তগীনের উপর কোন ভরসা রাখা যায় না। আমরা একা তে লড়াই করতে পারবো না। তখন খৃস্টানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য কোনো পরিকল্পনা করতে হবে।
আচ্ছা, আল-মালিকুস সালিহ সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে যে সন্ধি করেছেন, তা থেকে কি তিনি ফিরে আসতে পারবেন? নায়েব সালার জিজ্ঞেস করেন।
তা পারবেন- কমান্ডার বললো- আমি তাদের যে কজন সালার ও কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলেছে, আল মালিকুস সালিহ সালাহুদ্দীন আইউবীকে ধোঁকা দিয়েছেন। যদি ধোকা নাও দিয়ে থাকেন, তবু অধিকাংশ সালার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এই সন্ধিকে সমর্থন করে না। খৃস্টান উপদেষ্টারা তো এক্ষুণি আক্রমণ করার পক্ষপাতী।
আপনাকে হালব চলে যাওয়া উচিত- নায়েব সালার বললেন- আমি মসুল চলে যাই।
তুমি পুনরায় হাল্ব চলে যাও- সাইফুদ্দীন কমান্ডারকে বললেন- গিয়ে আল-মালিকুস সালিহকে বলো, আমি আসছি। তুমি আজই রওনা হয়ে যাও। কাল রাতে আমিও রওনা হবো। তিনি হয়তো আমাকে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হবেন না। নগরীর বাইরে আল-মাবারিক নামক স্থানে যে কূপটি আছে, আমি সেখানে অবস্থান করবো। আল-মালিকুস সালিহকে বলবে, তিনি যেনো আমার সঙ্গে সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। যদি তিনি সাক্ষাৎ করতে সম্মত না হন, তাহলে সেখানে এসে তুমি আমাকে অবহিত করবে।
আপনার একা যাওয়া কি ঠিক হবে? নায়েব সালার জিজ্ঞেস করেন।
এসব এলাকায় কোনো ভয় নেই- সাইফুদ্দীন বললেন- আমি রাতে রওনা হবো। কেউ জানবে না যে, মসুলের শাসনকর্তা যাচ্ছেন।
সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা ও গেরিলাদের ফাঁদে পড়ার আশংকা আছে- নায়েব সালার বললেন- আমাদের এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও তাদের থেকে নিরাপদ নয়।
আমাকে যেতেই হবে- সাইফুদ্দীন বললেন- ঝুঁকি নিতেই হবে। তুমি আজই মসুল রওনা হয়ে যাও। আমি আগামী রাতে হাবের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।
যে সময় সাইফুদ্দীন ও তার সঙ্গীদের মাঝে এসব কথোপকথন চলছিলো, তখন দাউদ ও হারিছের কান দরজার সঙ্গে লাগা ছিলো। এবার তারা সেখান থেকে সরে নিজ কক্ষে চলে আসে। দাউদ চিন্তায় পড়ে যায়। তাকে সাইফুদ্দীনের পিছু নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? দীর্ঘ ভাবনার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।
আমরা সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষী সেজে তার সঙ্গে হাল্ব চলে যাবো- দাউদ হারিছকে বললো- আমরা আকস্মিকভাবে তার সামনে গিয়ে হাজির হবো এবং বলবো, আমরা আপনার ফৌজের সিপাহী।
তিনি যদি বলে ফেলেন, তোমরা মসুল চলে যাও, তাহলে কি করবো? হারিছ জিজ্ঞেস করে।
আমি আমার জাদু চালানোর চেষ্টা করবো। দাউদ জবাব দেয়।
এই কৌশলও যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে? হারিছ প্রশ্ন করে।
তারপরও আমরা হাল যাবো না- দাউদ বললো- আল-মালিকুস সালিহ যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করেই থাকে, তাহলে সাইফুদ্দীন সেই সন্ধিকে বাতিল করানোর জন্য হাল্ব যেতে পারবে না। দাউদ হারিছকে বুঝিয়ে দেয় তাকে কী করতে হবে।
সেই রাত। সাইফুদ্দীন রুদ্ধ কক্ষে তার নায়েব সালার ও কমান্ডারের নিকট বসে তাদেরকে শেষবারের মতো নির্দেশনা প্রদান করছেন। রাতের প্রথম প্রহর। সর্বপ্রথম কমান্ডার সেখান থেকে বের হয়। হারিছের পিতা তার ঘোড়ার বাঁধন খুলে দেয়। কিছুক্ষণ পর নায়েব সালারও বেরিয়ে যায়। সাইফুদ্দীন এখন একা। তিনি শুয়ে পড়েন। হঠাৎ কক্ষের দরজাটা প্রবলবেগে খুলে যায়। তিনি ভয় পেয়ে উঠে বসেন। বিস্ফারিত নয়নে তাকান। ফাওজিয়া আপাদমস্তক উল্লসিত হয়ে ঢুকেই সাইফুদ্দীনের পাশে বসে এবং তার হস্তদ্বয় ঝাঁপটে ধরে।
ভাইয়া এসে পড়েছেন- ফাওজিয়া আনন্দে পাগলপারা হয়ে বললো সঙ্গে তার এক বন্ধু এসেছেন।
তুমি কি তাদেরকে বলেছো, আমি এখানে আছিঃ সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।
হ্যাঁ- ফাওজিয়া বললো- আমি বলে দিয়েছি। শুনে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। তারা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
নিয়ে আসো। সাইফুদ্দীন বললেন।
***
দাউদ ও হারিছ সাইফুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করে তাকে সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। সাইফুদ্দীন ইঙ্গিতে তাদেরকে তার পাশে বসতে বলেন। তারা বসে পড়ে দাউদ ও হারিছ পোশাক ও মুখমণ্ডলে ধূলি মেখে এসেছে। তারা এমনভাবে শ্বাস ফেলছে, যেনো দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার দরুন ক্লান্ত। সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন- তোমরা কোন্ ইউনিটের সদস্য ছিলে?
হারিছ যেহেতু তারই ফৌজের সৈনিক, তাই সে-ই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। দাউদ চুপচাপ বসে থাকে। তার তো কিছুই জানা নেই।
তোমরা এতোদিন কোথায় ছিলে? সাইফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন
আমাদের ফৌজ কিভাবে পিছপা হয়েছে, বলতে লজ্জা লাগছে- দাউদ মুখ খুলে আমাদের পিছপা হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু একে সঙ্গে নিয়ে আমি একটি পাথর খণ্ডের পেছনে লুকিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। আমরা লক্ষ্য রাখি, আইউবীর বাহিনী আমাদের ধাওয়া করতে আসছে, নাকি কোথাও ছাউনী ফেলছে। আমি গোয়েন্দাগিরি করতে শুরু করি। আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে, খৃস্টান উপদেষ্টাদের দ্বারা আপনি গেরিলা বাহিনী গঠন করেছিলেন। আমিও এক বাহিনীতে ছিলাম। আমি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় এই প্রশিক্ষণ বেশ কাজে আসে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আমি আমার এই যোগ্যতাকে কাজে লাগাই। ভাবলাম, পালাতেই যদি হয়, তাহলে আপন ফৌজের জন্য দুশমনের কিছু তথ্যও নিয়ে যাবো। ইতিমধ্যে হারিছ ভাইকে পেয়ে গেলাম। তাকে সঙ্গে রেখে দিলাম। সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ অগ্রসর হতে থাকে আর আমরা তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। সে সময় যদি আমাদের সঙ্গে জনাদশেক সৈন্যও থাকতো, তাহলে কমান্ডো হামলা চালিয়ে আমরা তাদের অনেক ক্ষতি করতে পারতাম।
আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীকে তুকমান অঞ্চলে ছাউনী ফেলতে দেখেছি। তারা যেভাবে তাঁবু স্থাপন করেছে, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেখানে তারা দীর্ঘ সময় অবস্থান করবে। আমার আফসোস লাগছে যে, আমাদের বাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে এসেছে। আপনি একে জিজ্ঞেস করুন, আমরা শত্রু বাহিনীর যে লাশ দেখেছি, তার সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। আর আহতদের তো কোনো হিসেবই নেই। আমরা রাতে তাদের ছাউনীর নিকটে গিয়ে দেখেছি। আল্লাহু আকবার! জখমীদের আর্তনাদ সহ্য করার মতো নয়। আমাদের মনে হলো, তাদের অর্ধেক সৈন্যই যেনো আহত।
আমীরে মোহতারাম! আল্লাহ আপনার মর্যাদা বুলন্দ করুন। এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী- আপনিই ভালো জানেন। আমরা আপনার দাসানুদাস যা আদেশ করবেন, তাই পালন করবো। আমার বিশ্বাস, সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী এ মুহূর্তে পুনরায় যুদ্ধ করতে সক্ষম নয়। আপনি যদি এক্ষুণি আপনার বাহিনীকে একত্রিত করে হামলা করেন, তাহলে আইউবীকে দামেস্ক তাড়িয়ে নিতে সক্ষম হবেন।
সাইফুদ্দীন মনোযোগ সহকারে দাউদের রিপোর্ট শ্রবণ করেন। পরাজিত বিধায় তিনি এমন সব সান্ত্বনাদায়ক কথাবার্তা শুনতে উদগ্রীব ছিলেন যে, তিনি আসলে পরাজিত হননি কিংবা পলায়ন করেননি। দাউদ তার সেই চাহিদাটাই পূরণ করছে। সাইফুদ্দীনের দুর্বলতাই বলতে হবে যে, দাউদের বক্তব্যে তার হৃদয়ে স্বস্তি ও শান্তি ফিরে আসে।
আমরা মসুল যাচ্ছিলাম- দাউদ বললো- হারিছের গ্রামটা পথে বিধায়, ক্ষণিকের জন্য বাড়িতে ঢুকে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যাবো। কিন্তু এখানে এসেই শুনতে পেলাম আপনি এখানে আছেন। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। বিষয়টা এতোই অবিশ্বাস্য যে, আপনাকে দেখার পর এখনও যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনি এখানে। রিপোর্ট আপনাকে অবহিত করা প্রয়োজন ছিলো। ভাগ্য ভালো যে, আপনাকে এখানেই পেয়ে গেলাম।
তোমাদের বক্তব্য শুনে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি- সাইফুদ্দীন রাজকীয় ভঙ্গীতে বললেন- এই বীরত্বের জন্য তোমাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।
আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে যে, আমরা আপনার পাশাপাশি বসে আপনার সঙ্গে কথা বলছি- হারিছ বললো আপনার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারলেই আমরা ধন্য হবো।
জানতে পারলাম, এখানে আপনার সঙ্গে আরো লোক আছে। দাউদ বললো।
তারা চলে গেছে- সাইফুদ্দীন জবাব দেন- আমিও চলে যাবো।
বেআদবী মাফ করলে জিজ্ঞেস করবো, আপনি এখানে কতদিন থাকবেন- হারিছ বললো- এবং কোথায় যাবেন? আমি লজ্জিত যে, আমার স্বজনরা আপনাকে এই ভাঙ্গা কক্ষে থাকতে দিয়েছেন এবং মেঝেতে বসিয়ে রেখেছেন।
এটাই আমার কামনা ছিলো- সাইফুদ্দীন বললেন- এখানে আমি আরো দিন কয়েক কাটাতে চাই। তোমরা কিন্তু কাউকে বলবে না, আমি এখানে আছি।
আপনি কোথায় যাবেন? দাউদ জিজ্ঞেস করে।
আমি হালব যাবো- সাইফুদ্দীন জবাব দেন- সেখান থেকে মসুল চলে যাবো।
কিন্তু আপনি যে একা- দাউদ বললো- আপনার তো দেহরক্ষী প্রয়োজন।
এই অঞ্চলে কোনো আশংকা নেই- সাইফুদ্দীন বললেন- একা একাই যেতে পারবো।
গোস্তাখী মাফ করবেন- দাউদ বললো- এই অঞ্চলকেও আপনি শত্রুমুক্ত ভাববেন না। আমি যা জানি, আপনি তা জানেন না। সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডোরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কেউ যদি আপনাকে চিনে ফেলে, তাহলে আমাদের দুজনকে আজীবন আক্ষেপ করতে হবে, কেননা আমরা আপনার সঙ্গে গেলাম না। আমরা এখানে ঘটনাক্রমে এসে পড়েছি। আমাদের সঙ্গে ঘোড়া আছে, অস্ত্রও আছে। আপনি বললে আমরা আপনার সঙ্গ দিতে পারি। তাছাড়া একজন শাসকের একাকী সফর করা বেমানানও বটে।
সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষীর প্রয়োজন আছে বটে। মুখে যাই বলুন, অন্তরটা তার ভয়ে কাঁপছে। দাউদ তাকে আরো ভীত করে তোলে। তিনি বললেন ঠিক আছে, তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও। আমরা আগামী রাতে রওনা হবো।
দাউদ ও হারিছ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। সাইফুদ্দীন ফাওজিয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন। কিন্তু আজ আর ফাওজিয়া তার কক্ষে এলো না। দিনে দাউদ ও হারিছ তাকে খাবার খাওয়ায়। দিন শেষে রাত আসে।
***
আল-মালিকুস সালিহ, সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীন যে স্থানে বসে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সেখান থেকে খানিক দূরে খৃস্টান কমান্ডার ও সম্রাটদের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। তারা আল-মালিকুস সালিহ, সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীনের সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয় নিয়ে পর্যালোচনা করছে। এদের প্রায় সকলেই সুলতান আইউবীর মোকাবেলায় পরাজিত সৈনিক।
এই তিনটি মুসলিম ফৌজের পরাজয় মূলত আমাদেরই পরাজয় রেমন্ড বললেন- আমি যতটুকু জানি, সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীতে সৈন্য বেশী ছিলো না।
আপনার মতের সঙ্গে আমি একমত নই- ফরাসী সম্রাট রেজিনাল্ট বললেন- আমাদের উদ্দেশ্য কখনো এটা নয় যে, মুসলমানরা যখন পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হবে, তখন তাদের কোনো পক্ষ জয়ী কিংবা পরাজিত হবে। বরং আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমান পরস্পর লড়তে থাকবে এবং তাদের একটি পক্ষ আমাদের হাতে খেলতে থাকবে। আমাদের ঘৃণ্য ও ভয়ংকর শত্রু হলেন সালাহুদ্দীন আইউবী। আমরা চাই তার মুসলমান ভাইয়েরা তার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকুক এবং তার শক্তি বিনষ্ট করতে থাকুক। তার মুসলমান প্রতিপক্ষের শক্তিও যদি নষ্ট হয়, হতে থাকুক। এমনও হতে পারে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাস্ত করে তার প্রতিপক্ষ মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে।
আমি আপনাদের মুসলিম অঞ্চলসমূহ ও শাসকদের পূর্ণ বিবরণ শোনাতে চাই, যা আমাদের উপদেষ্টাগণ প্রেরণ করেছেন- এক কমান্ডার বললো- সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতিপক্ষ তিনটি বাহিনীর অবস্থা হলো, সৈন্যদের মাঝে যুদ্ধ করার স্পৃহা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। তাদের ব্যাপক দৈহিক ক্ষতি হয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও মালপত্র খোয়া গেছে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে পুনরায় যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলো না। আমরা তাদেরকে যে উপদেষ্টা দিয়ে রেখেছি, তারা বড় কষ্টে মুসলিম শাসকদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছেন। সালাহুদ্দীন আইউবী হুবাবুত তুর্কমানের একটি মনোরম জায়গায় ছাউনী ফেলে সেখানে অবস্থান করছেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অগ্রযাত্রা স্থগিত রেখেছেন। আমাদের খৃস্টান উপদেষ্টা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, হাল্ব, হররান ও মসুলের বাহিনী যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, কাল বিলম্ব না করে পুনরায় আক্রমণ করুক। আমি আশাবাদী, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে অসতর্ক অবস্থায় ঘায়েল করে ফেলতে সক্ষম হবেন। আইউবীকে হত্যা করার এ মুহূর্তে এটাই উপযুক্ত পন্থা।
আর এই পন্থা সম্ভবত সফল হবে না- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন কেননা, আইউবী কখনো বেখবর বসে থাকে না। তার গোয়েন্দা বিভাগ সর্বক্ষণ সজাগ ও তৎপর থাকে। যে ঘটনা বা যে হামলা দুদিন পরে সংঘটিত হবে, তার সংবাদ তিনি দুদিন আগেই পেয়ে থাকেন। আমাদের যেসব উপদেষ্টা মুসলমানদের সঙ্গে আছেন, তাদেরকে জোরালোভাবে বলে দেয়া প্রয়োজন, যেনো তারা তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা তীব্রতর করে। গোয়েন্দাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তাদেরকে দায়িত্ব অর্পণ করুন, যেনো তারা সমগ্র অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় এবং আইউবীর গোয়েন্দাদের ধরে ফেলে। মুসলমান সৈন্যরা যখন হামলার জন্য যাত্রা করবে, তখন যেন আমাদের গুপ্তচর ও গেরিলা সৈন্যরা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে যেনো ধরে ফেলে। পথচারীদেরকে ধরে ফেলতে হবে। উদ্দেশ্য থাকবে, আইউবী যেনো হামলার সংবাদ তখন পায়, যখন তার মুসলমান ভাইয়ের ঘোড়া তার ছাউনী এলাকায় ঢুকে তার সৈন্যদের যমের হাতে তুলে দিতে শুরু করবে।
এ সংবাদও এসেছে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী তার অধিকৃত এলাকাগুলো থেকে সেনাভর্তি নিচ্ছেন। মানুষ দলে দলে তার বাহিনীতে ভর্তি হচ্ছে- অপর এক কমান্ডার বললো- এই ধারা প্রতিহত করতে হবে। তার একটি পন্থা হলো, যা আমরা পূর্ব থেকেই প্রয়োগ করে আসছি যে, কালবিলম্ব না করে তার উপর হামলা চালাতে হবে, যাতে তিনি প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ না পান। দ্বিতীয় পন্থা হলো, ঐসব এলাকায় চরিত্র বিধ্বংসী সেই অভিযান পরিচালনা করতে হবে, যা আমরা মিশরে পরিচালনা করেছিলাম। এটা সত্য যে, এ ধরনের অভিযানে আমাদের বহু পুরুষ ও কয়েকটি মূল্যবান মেয়ে ধরা পড়েছিলো এবং মারা গিয়েছিলো। কিন্তু এই কুরবানী তো দিতেই হবে। আমরাও তো মারা যাচ্ছি। ক্রুশের খাতিরে প্রয়োজন হলে আমাদেরকে জীবন দিতে হবে এবং আমাদের সন্তানদেরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামাতে হবে। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে হোক, মুসলমানদের চেতনার উপর আঘাত হানতেই হবে। আমি স্বীকার করছি, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে এই ভূখণ্ড থেকে বেদখল করতে পারবো না। লোকটা মিশরেও বেঁকে বসেছে এবং এই ভূখণ্ডেও এসে পৌঁছেছে। তার সাফল্যের এক কারণ তো এই যে, তিনি রণাঙ্গনের শাহসাওয়ার। দ্বিতীয় কারণ, তিনি বিচক্ষণ ও দক্ষ সেনানায়ক। তৃতীয় মৌলিক কারণটি হলো, তিনি তার সৈনিকদের মাঝে জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে রেখেছেন। আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে তারা পবিত্র ধর্মীয় কাজ মনে করে। সে কারণেই তার কমান্ডো সেনারা আমাদের বাহিনীর উপর সিংহের ন্যায় আঁপিয়ে পড়ে। তাদের এই বিশ্বাস ও উন্মাদনাকে ধ্বংস করতে হবে।
আমরা বরাবরই মানুষের সেই দুর্বলতা থেকে উপকৃত হয়েছি, যাকে পলায়নপরতা ও বিলাসপ্রিয়তা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- যেসব মুসলমানের কাছে বিত্ত আছে, তারা শাসক হতে চায়। আমরা তাদের এই দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়েছি। আমাদের নতুন কোনো পন্থা আবিষ্কার করার প্রয়োজন নেই। তবে আমাদেরকে আরো একটি অভিযান শুরু করতে হবে। তাহলো, আইউবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির অভিযান। যতোসব অবমাননাকর দুর্নাম আছে, তার নামে প্রচার করতে হবে। কিন্তু এ কাজটা তোমরা করবে না; মুসলমানদের দ্বারা করতে হবে। প্রতিপক্ষ এবং শত্রুপক্ষের দুর্নাম করতে হলে নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করা চলবে না। সবসময় নিজেদের স্বার্থকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমার শক্ত মর্যাদা ও খ্যাতির দিক থেকে যত উঁচু মানের, তার বিরুদ্ধে ততো নিচ ও হীন অপবাদ আরোপ করতে হবে। শতজনের মধ্য থেকে কমপক্ষে পাঁচজন তোমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে।
এই ফাঁকে তোমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি অব্যাহত রাখো- এক কমান্ডার বললো আমরা প্রচুর সময় পেয়ে গেছি। আপনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে মুসলমানদের মাঝে ক্ষমতাপূজার ব্যাধি সৃষ্টি করে তাদেরকে পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত করিয়ে দিয়েছেন। আমরা যদি মুসলমানদের মাঝে আমাদের বন্ধু তৈরী না করতাম, তাহলে আজ সালাহুদ্দীন আইউবী ফিলিস্তিনে অবস্থান করতেন। আমরা তারই স্বজাতিকে তার পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি।
আমি বিস্মিত- রেমন্ড বললেন- যে, এই মুসলমানরাই আবার আইউবীর বাহিনীর সৈনিক। তারা এক একজন আমাদের দশজন সৈনিকের মোকাবেলায়ও শক্তিশালী। আবার এই মুসলমানরাই আইউবীর প্রতিপক্ষ বাহিনীতে যোগ দিয়ে এমন কাপুরুষে পরিণত হয়ে যায় যে, শোচনীয় পরাজয়বরণ করে তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়। বিষয়টা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়কর।
এটা বিশ্বাস ও চেতনার কারসাজি, যাকে মুসলমানরা ঈমান বলে থাকে রেজিনান্ট বললেন- যে সৈনিক বা সেনাপতি নিজের ঈমান নিলাম করে দেয়, তার যুদ্ধ করার স্পৃহা নিঃশেষ হয়ে যায়। জীবন আর সম্পদই তার অধিকতর প্রিয় হয়ে থাকে। এ কারণেই আমরা মুসলমানদের চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করাকে বেশী আবশ্যক মনে করি। তাদের মধ্যে যৌনতা ও নেশার অভ্যাস সৃষ্টি করে দাও। দেখবে, তোমাদের সব কেল্লা জয় হয়ে যাবে।
এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তিনটি মুসলিম বাহিনীকে হালবে একত্রিত করে একক কমান্ডে রাখা হবে। তবে কৌশলে তাদের মাঝে পরস্পর বিরোধও জিইয়ে রাখা হবে। তাদেরকে আবশ্যক পরিমাণ সাহায্য সরবরাহ করা হবে।
***
রাতের দ্বিতীয় প্রহর। হারিছের গ্রামের সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তার ঘর থেকে তিনটি ছোঁড়া বের হয়। একটির আরোহী সাইফুদ্দীন, একটিতে হারিছ ও অপরটিকে দাউদ। হারিছ ও দাউদের হাতে বর্শা। তাদের বিদায় জানানোর জন্য হারিছের পিতা, বোন ও স্ত্রী ঘরের দরজায় দণ্ডায়মান। সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি ফাওজিয়ার উপর নিবদ্ধ। কিন্তু ফাওজিয়ার দৃষ্টি দাউদের প্রতি। সাইফুদ্দীন ও নিজ ভাইয়ের উপস্থিতি উপেক্ষা করে দাউদের প্রতি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফাওজিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যে উভয় দিক থেকে আল্লাহ হাফেজ, আল্লাহ হাফেজ শব্দ ভেসে আসে। তিনটি ঘোড়া সম্মুখপানে চলতে শুরু করে।
ঘোড়াগুলো অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফাওজিয়া তাদের পায়ের শব্দ শুনতে থাকে। ধীরে অশ্বক্ষুরধ্বনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। পাশাপাশি ফাওজিয়ার কানে দাউদের কণ্ঠ উঁচু হতে শুরু করে- সত্য পথের পথিকদের বিবাহ আকাশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে…।
ফাওজিয়া দরজা বন্ধ করে নিজ কক্ষে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার আশপাশে দাউদের কণ্ঠ গুঞ্জরিত হয়েই চলেছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগে আচ্ছা, আমি কি সত্যিই দাউদকে বিয়ে করতে চাই? লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ে ফাওজিয়ার। নিজের প্রতি রাগ আসে তার। দাউদের বক্তব্য মনে পড়ে যায়- পথে রক্তের নদীও আছে, যার উপর কোনো সেতু নেই। ফাওজিয়ার হৃদয় সাগরে রক্তের ঢেউ শুরু হয়ে যায়। বিয়ে-কল্পনা একটা অর্থহীন ভাবনায় পরিণত হয়ে মাথা থেকে উবে যায়।
সাইফুদ্দীন ও তার দেহরক্ষীরা রাতটা সফরে অতিবাহিত করে। এখন ভোর। সাইফুদ্দীন আগে আগে চলছেন। দাউদ ও হারিছ এতোটুকু পেছনে যে, তাদের কথাবার্তা সাইফুদ্দীনের কানে পৌঁছছে না।
জানি না, তুমি আমাকে কেননা বারণ করছো?- হারিছ ঝাঝালো কণ্ঠে বললো- এখানে যদি আমরা তাকে খুন করে লাশটা কোথাও পুঁতে রাখি, কেউ টেরও পাবে না।
তাকে জীবিত রেখে আমরা তার গোটা বাহিনীকে হত্যা করতে পারবো দাউদ বললো- ইনি মারা গেলে এর বাহিনীর কমান্ড অন্য কেউ হাতে তুলে নেবে। আমাকে তথ্য জানতে হবে। তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখো।
বেলা দ্বি-প্রহর। হালবের মিনার দেখা যাচ্ছে। খানিক দূরে প্রাকৃতিক কূপসমৃদ্ধ আল-মাবারিকের সবুজ-শ্যামল এলাকা। কাফেলা সে স্থানে পৌঁছে যায়। সাইফুদ্দীন তার যে কমান্ডারকে আল-মালিকুস সালিহর নিকট প্রেরণ করেছিলেন, সে ছুটে এসে জানালো, আল-মালিকুস সালিহ আপনার অপেক্ষা করছেন। আল-মাবারিকের শ্যামলিমায় প্রবেশ করামাত্র সাইফুদ্দীনকে স্বাগত জানানোর জন্য পূর্ব থেকে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সালার এগিয়ে এসে তাকে অভিবাদন জানায়। সাইফুদ্দীন আশংকা ব্যক্ত করেন, আমার তাবুটা কূপের পাড়ে স্থাপন করা হোক। আমি এখানেই অবস্থান করবো। তিনি আল-মালিকুস সালিহর মহলে যেতে কেনো অনীহ ছিলেন, ইতিহাসে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। দাউদ ও হারিছকে তিনি নিজের সঙ্গে রাখেন। তার জন্য অত্যন্ত মনোরম ও প্রশস্ত তাঁবু স্থাপন করা হলো। চাকর-বাকরও এসে পড়েছে। প্রাসাদের চিত্র ফুটে ওঠে তার তাঁবুতে। আল-মালিকুস সালিহ তাকে নৈশভোজের জন্য কেল্লায় নিমন্ত্রণ জানান এবং সেখানেই দুজনের সাক্ষাৎ স্থির হয়।
***
সন্ধ্যার পর সাইফুদ্দীন ও আল-মালিকুস সালিহর সাক্ষাৎ ঘটে। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এই সাক্ষাতের বিবরণ এভাবে উল্লেখ করেছেন
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, আল-মালিকুস সালিহ ও সাইফুদ্দীনের সাক্ষাৎ হবে। সাক্ষাৎ হলো দুর্গে। আল-মালিকুস সালিহ সাইফুদ্দীনকে স্বাগত জানান। সাইফুদ্দীন বালক রাজী আল-মালিকুস সালিহকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন। সাক্ষাতের পর সাইফুদ্দীন আল-মাবারিকের কূপের পাড়ে নির্মিত তাঁর তাঁবুতে চলে যান। সেখানে তিনি অনেক দিন অবস্থান করেন।
দুজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, সাইফুদ্দীন আল-মালিকুস সালিহকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমার পত্রের জবাব দিলেন না কেননা? কিন্তু প্রশ্ন শুনে আল মালিকুস সালিহ বিস্মিত হন, না তো, আমি তো পরদিনই আপনার পত্রের লিখিত জবাব পাঠিয়ে দিয়েছি! তাতে আমি লিখেছি, আপনি চিন্তা করবেন না। এই সন্ধিচুক্তি স্রেফ প্রতারণা। সময় নেয়ার জন্য আমি আইউবীর সঙ্গে এই প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করেছি।
আমি আপনার কোনো পত্র পাইনি- সাইফুদ্দীন বললেন- আমি তো এই ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম যে, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করে ভুল করেছেন এবং আমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছেন।
আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে তার দুজন সালারও ছিলো। যার মাধ্যমে বার্তাটি প্রেরণ করা হয়েছিলো, তারা তৎক্ষণাৎ তাকে ডেকে পাঠায়। সে এসে কোন্ দূত পত্র নিয়েছিলো, তার নাম জানায়। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো, সে যেদিন বার্তা নিয়ে গিয়েছিলো, সেদিনের পর থেকে আর তাকে দেখা যায়নি। তুমুল দৌড়-ঝাঁপ ও ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু দূতের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। লোকটির বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। এখানে যে জায়গায় থাকতো, সেখানে তার বিছানাপত্র পড়ে আছে। কিন্তু নিজে নেই। সে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে পৌঁছিয়ে দিতে পারে, এমন কল্পনাও কারো মনে ছিলো না।
বিষয়টি আল-মালিকুস সালিহর খৃস্টান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হলো। তারা অভিমত ব্যক্ত করে- দূত হয়তো সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর ছিলো কিংবা সাইফুদ্দীনের নিকট যাওয়ার পথে সে আইউবীর গেরিলাদের হাতে ধরা পড়ে গেছে এবং তারা তাকে হত্যা করে ফেলেছে। তবে ঘটনা যাই হোক, এটা নিশ্চিত যে, এই ঘটনার পর সালাহুদ্দীন আইউবী তার যুদ্ধ প্রস্তুতি নিশ্চয় তীব্র করে তুলেছেন। এমনও হতে পারে, এখন তিনিই আগে হামলা করে বসবেন। এর মোকাবেলায় আমাদের সবকটি বাহিনীর যতো দ্রুত সম্ভব একত্রিত করে আইউবীর উপর আক্রমণ চালাতে হবে।
খৃস্টানদের এটাই কামনা যে, মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। একই দিনে মসুল ও হাররানে বার্তা প্রেরণ করা হলো যে, বাহিনী যে অবস্থায় থাকুক না কেননা, এক্ষুণি হাল্ব পাঠিয়ে দেয়া হোক। হাররানের শাসনকর্তা গোমস্তগীন কিছুটা ইতস্তত করলেও বৈঠকে বসে সকলের মঝে প্রকাশ্য বিরোধিতা করলেন না। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে, সবকটি বাহিনী এক হাই কমান্ডের অধীনে কাজ করবে এবং সুপ্রিম কমান্ডার থাকবেন সাইফুদ্দীন। গোমস্তগীন তার বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলেন বটে; কিন্তু নিজে হালবে বসে থাকাই ভালো মনে করলেন। তিনি সাইফুদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারলেন না।
দু-তিন দিনে বাহিনীত্রয় হাব এসে একত্রিত হয়ে যায়। খৃস্টানরা অস্ত্র ও অন্যান্য সামানপত্র পাঠিয়ে দেয়। তারা প্রয়োজন অনুপাতে আরো সাহায্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাহিনী রওনা করিয়ে দেয়। তাড়াহুড়ো করে আক্রমণের পরিকল্পনা ঠিক করা হয়। এই অভিযানের সংবাদ গোপন রাখার জন্য রাতে পথচলা এবং দিনে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাছাড়া বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য বিপুলসংখ্যক কমাভোসেনা পথের ডানে-বাঁয়ে এই বলে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, কোনো পথিকও যদি চোখে পড়ে, ধরে হাব পাঠিয়ে দেবে। যাতে অভিযানের সংবাদ গোপন থাকে।
রওনা হওয়ার প্রাক্কালে সাইফুদ্দীন, দাউদ ও হারিছকে ডেকে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন- তোমরা বিপদের সময় আমার সঙ্গ দিয়েছে। যুদ্ধের পর তোমাদের পদোন্নতি দেয়া হবে এবং পুরস্কারও পারে। তিনি হারিছকে বললেন- আমার মাথার উপর তোমার বোনের একটি কর্তব্য আছে। আমি তার সম্মুখে তখন যাবো, যখন আমি এই কর্তব্য আদায় করার যোগ্য হবো। হারিছকে বিস্মিত হতে দেখে তিনি বললেন- ফাওজিয়া বলেছিলো, আপনি যদি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারী নিয়ে এবং তার ঘোড়র পিঠে সওয়ার হয়ে আসতে পারেন, তখন আমি আপনার সঙ্গে চলে যাবো…। হারিছ! আমি যদি জয়ী হয়ে ফিরে আসতে পারি, তাহলে তোমার বোন মসুলের রাণী হবে।
ইনশাআল্লাহ-হারিছ বললো- আমরা আপনাকে বিজয়ী বেশেই ফিরিয়ে আনবো। আচ্ছা, তিন বাহিনী কি একত্রে যাচ্ছে।
হা- সাইফুদ্দীন জবাব দেন- আর আমি এই সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতি থাকবো।
জিন্দাবাদ–দাউদ স্লোগান দিয়ে ওঠে- এবার পালাবার পালা আইউবীর।
দাউদ ও হারিছ ভৃত্যসুলভ কথাবার্তা বলে। সাইফুদ্দীনকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এবং বারবার ফাওজিয়ার নাম উল্লেখ করে তার থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও গতিবিধি জেনে নেয়।
তোমরা তোমাদের বাহিনীতে চলে যাও- সাইফুদ্দীন বললেন- আমার রক্ষী বাহিনী এসে গেছে। আমি তোমাদেরকে আজীবন স্মরণ রাখবো।
***
রাতের একটা উপযুক্ত সময়ে রওনা হয় তিন বাহিনী। দাউদ ও হারিছ মসুলের একটি ইউনিটে গিয়ে যোগ দেয়। হারিছ অনেকেরই পরিচিত। আগে সে এ বাহিনীতেই কাজ করেছে। দাউদকে কেউ চেনে না। হারিছ তাকে মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনের প্রেরিত লোক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। ব্যস্ততার কারণে কেউ দাউদকে যাচাই করে দেখার সুযোগ পায়নি।
তিন সারিতে সম্মুখপানে এগিয়ে চলছে তিন বাহিনী। মধ্যরাত পর্যন্ত চলার পর বাহিনী একটি পার্বত্য এলাকায় এসে উপনীত হয়। ফলে সৈন্যদের সারি বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দাউদ হারিছকে বললো- এটাই মোক্ষম সুযোগ। চলো, পালাই।
রাতের অন্ধকারকে পুঁজি করে দুজন ধীরে ধীরে নিজ নিজ ঘোড়া একদিকে সরিয়ে নিতে এবং বাহিনী থেকে আলাদা হতে থাকে। দাউদের পরিকল্পনা হলো, দূরে গিয়ে তীব্র গতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে যাবে। দিনে বাহিনীগুলো ছাউনী ফেলে অবস্থান গ্রহণ করবে আর তারা তুর্কমান পৌঁছে সালাহুদ্দীন আইউবীকে আক্রমণের সংবাদ জানাবে। এভাবে সুলতান সংবাদটা একদিন আগেই পেয়ে যাবেন এবং দুশমনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন করে ফেলবেন। দাউদের পূর্ণ বিশ্বাস, এই পরিকল্পনা তার সফল হবে। কিন্তু তার জানা ছিলো না, এতদঞ্চলের চারদিকে শত্রুপক্ষের গেরিলা গুপ্তচর ছড়িয়ে রয়েছে।
তারা ডানদিকে অনেক দূরে সরে যায়। এখন আর কোনো সমস্যা নেই মনে করে এবার তারা তুকমান অভিমুখে রওনা হয়। এখনও ঘোড়া হাঁকায়নি। গতি কিছুটা তীব্র করেছে মাত্র। দীর্ঘ পথ চলার পর ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সামনের বাকি পথ অতিক্রম করতে হবে অবিরাম গতিতে। তাই ঘোড়াগুলোকে কিছুক্ষণ আরাম দেয়া আবশ্যক।
রাতের শেষ প্রহর। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দাউদ ঘোড়া থেকে নেমে একটি টিলায় চড়ে সাইফুদ্দীনের বাহিনী যে পথে অগ্রসর হওয়ার কথা, সেদিকে তাকায়। কিন্তু দূরে ধূলি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দাউদ নিশ্চিন্ত হয় যে, তারা বাহিনী থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। এখন তারা নিরাপদ। কিন্তু এই ধারণাটা তার সঠিক নয়। কেউ তাকে দেখছে। তাকে অনুসরণ করছে। তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।
দাউদ নিশ্চিন্ত মনে নীচে নেমে আসে। ঘোড়ায় চড়ে উভয়ে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। এলাকটা টিলায় ঘেরা ও বালুকাময়। দাউদ ও হারিছ দুটি টিলার মাঝখান দিয়ে পথ চলছে। সামনে মোড়। মোড়ে পৌঁছামাত্র অকস্মাৎ সম্মুখ থেকে চারটি ঘোড়া ছুটে এসে তাদের প্রতি বর্শা তাক করে দাঁড়িয়ে যায়।
ঘোড়া থেকে নেমে এসো। এক আরোহী হুংকার দিয়ে বললো।
আমরা মুসাফির। দাউদ বললো।
মুসাফির হলে মসুলের বাহিনী থেকে দূরে থাকতে না- অশ্বারোহী বললো- পথচারীদের সঙ্গে এসব অস্ত্র থাকে না, যেগুলো তোমাদের সাথে আছে। তোমরা যারাই হয়ে থাকো, আমাদের সঙ্গে মসুল যেতেই হবে। আমরা তোমাদের ছাড়তে পারবো না। ঘোড়া ঘুরাও।
লোকগুলো হালবের গেরিলা সেনা, যাদেরকে সন্দেহভাজন লোকদেরকে ধরে হাল্ব নিয়ে যাওয়ার জন্য সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা দাউদ ও হারিছকে ঘিরে ফেলে। দাউদ হারিছকে কানে কানে বলুনো- সময় এসে গেছে ভাই। হারিছ তার ঘোড়ার লাগাম নাড়া দেয়। ছুটে চলার জন্য তার ঘোড়া সামনের দুপা উপরে তোলে। ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে হারিছ তার সামনের অশ্বারোহীর বুকে বর্শা বিদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ততক্ষণে তার বাঁ-দিকের অশ্বারোহীর বর্শা তার কাঁধে এসে গেঁথে যায়। দাউদ অভিজ্ঞ গেরিলা সৈনিক। সে ঘোড়া হাঁকিয়ে মোড় ঘুরিয়ে একটা চক্কর কেটে এক অশ্বারোহীকে ঘায়েল করে ফেলে।
তারা চারজন। আর এরা দুজন। জায়গাটা ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করার উপযোগী নয়। উভয় দিকে টিলা। কিছুক্ষণ ঘোড়াগুলো লম্ফঝম্ফ করতে থাকে। পরস্পর টক্কর খেতে থাকে বেশকটি বর্শা। হারিছ ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে। দাউদও আহত হয়ে পড়েছে। দেহের দুতিন স্থানে তার গভীর ক্ষত। কিন্তু তার চৈতন্য ঠিক আছে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। চার অশ্বারোহীর কেউ নিহত, কেউ গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছে। দাউদও গুরুতর আহত।
দাউদ উঠে দাঁড়ায়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে হারিছের গ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। হারিছের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। দাউদ নিশ্চিত, হারিছ মারা গেছে। নিজেও শেষ পর্যন্ত বাঁচবে না বলে তার ধারণা। তার দেহঝরা রক্তে ঘোড়ার জিন ও পিঠ লাল হয়ে গেছে। তার জানা মতে এখান থেকে তুর্কমান অপেক্ষা হারিছদের বাড়ি নিকটে। হারিছের পিতাই এখন তার ভরসা। তার আশা, হারিছদের বাড়ি পর্যন্ত জীবিত পৌঁছতে পারলে বৃদ্ধকে বলবে- শহীদ পুত্রের আত্মার শান্তির জন্য এক্ষুণি তুর্কমান চলে যান এবং সুলতান আইউবীকে সতর্ক করুন।
দাউদ ঘোড়া হাঁকায়। কিন্তু ঘোড়া যততবেশী নড়াচড়া করছে, তার ক্ষতস্থানগুলো থেকে তততবেশী রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পিপাসায় তার কণ্ঠনালীটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। দাউদ দোআ-কালাম পড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পর আকাশপানে মাথা তুলে উচ্চস্বরে বলছে- জমিন ও আসমানের মালিক! তোমার রাসূলের উসিলা করে বলছি, আমাকে আর অল্প কিছু সময়ের জন্য জীবন দান করো।
এখন আর দাউদ ঘোড়া হাঁকাচ্ছে না, বরং ঘোড়া তাকে নিয়ে এগিয়ে চলছে। এবার দাউদের মনে হচ্ছে, তার দেহের জোড়াগুলো যেনো আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একবার মাথাটা একদিকে হেলে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। দাউদ নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে।
***
আবারো ঘোঁড়া থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় দাউদ। নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু পারলো না। দাউদ তার পায়ের নীচে মাটির অস্তিত্ব অনুভব করে। তার চোখের সম্মুখে শুধুই অন্ধকার।
একসময় যখন খানিক চৈতন্য ফিরে আসে, তখন দাউদ উপলব্ধি করে এখন রাত এবং তাকে কে একজন আগলে রেখেছে। লোকটাকে শক্র মনে করে তার থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করে। তার কানে এক নারীকণ্ঠ প্রবেশ করে- দাউদ! তুমি ঘরে আছো, ভয় পেও না। দাউদ কণ্ঠটা চিনে ফেলে ফাওজিয়ার কণ্ঠ। চেতনাহীন অবস্থায় নিজে নিজেই সে হারিছের বাড়ি এসে পৌঁছেছিলো। আল্লাহ তাকে পথ দেখিয়ে গন্তব্যে নিয়ে এসেছেন।
বাপজান কোথায়? জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দাউদের প্রথম উক্তি।
তিনি বাইরে চলে গেছেন- ফাওজিয়া জবাব দেয়- আগামীকাল কিংবা পরশু আসবেন।
ফাওজিয়া ও তার ভাবী দাউদের ক্ষতস্থান মুছতে শুরু করে। এ সময়ে দাউদ পানি তলব করে। ফাউজিয়া পানি এনে দিলে দাউদ তা পান করে বললো- ফাওজিয়া! তুমি বলেছিলে পুরুষের কাজ নারীরাও করতে পারে। আমার ক্ষতস্থান ধুয়ে লাভ নেই। ভেতরে রক্ত নেই। আমি সুস্থ থাকলে যতো প্রয়োজনই হোক, তোমাদেরকে ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি দিতাম না। কিন্তু বিষয়টা আমার-তোমার ব্যক্তিগত নয়। তুমি সাহস করলে এবং জীবন ও সম্ভ্রমের ঝুঁকি নিলে একটি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পেতে পারে। অবর্ণনীয় এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারে ইসলামী দুনিয়া।
দাউদ ফাওজিয়াকে কিভাবে তুকমান যেতে হবে বুঝিয়ে দেয়। তারপর হালব, হাররান ও মসুলের বাহিনীসমূহ যৌথ কমান্ডের অধীনে কিভাবে আসছে, কোন্ দিক থেকে আসছে এবং তাদের পরিকল্পনা কী, ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বললো- তোমার ভাই এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে শাহাদাতবরণ করেছে।
ফাওজিয়া প্রস্তুত হয়ে যায়। তার সঙ্গে প্রস্তুতি গ্রহণ করে হারিছের স্ত্রীও। একটি ঘোড়া নিজেদের সংরক্ষণে আছে। আর একটি আছে দাউদের। ফাওজিয়া ও তার ভাবী দাউদকে এই অবস্থায় ঘরে রেখে কিভাবে যাবে ভাবছে।
ফাওজিয়া- দাউদ ক্ষীণ কণ্ঠে বললো- আমার কাছে এসো।
ফাওজিয়া দাউদের নিকট আসে। দাউদ তার ডান হাতটা মুঠো করে ধরে বহু কষ্টে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে বললো- সত্যের পথের পথিকদের বিবাহ আকাশে সম্পাদিত হয়ে থাকে। তাদের বরযাত্রা গন্তব্যে পৌঁছে কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে। আমাদের বিয়ের উৎসবে আকাশে তারকার বাতি প্রজ্বলিত করা হবে।
দাউদের মাথাটা একদিকে কাত হয়ে ঢলে পড়ে। ফাওজিয়া চিৎকার দেয় দাউদ। ততক্ষণে দাউদের আত্মা ইহজগত ত্যাগ করে চলে গেছে অনন্ত শান্তিময় জান্নাতে। ফাওজিয়ার ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ফাওজিয়াকে সবকিছু বলে-বুঝিয়ে দাউদ শাহাদাত বরণ করে। ঘরটা আল্লাহর হেফাজতে তুলে দিয়ে ফাওজিয়া ও তার ভাবী বেরিয়ে পড়ে। পিঠে জিন কষে এক ঘোড়ায় ফাওজিয়া এবং অপর ঘোড়ায় হারিছের স্ত্রী চড়ে বসে। দাউদের ঘোড়ার পিঠে চপচপে রক্তের দাগ। ঘোড়া দুটো গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়ে দুটো আল্লাহর উপর ভরসা করে গন্তব্যপানে এগিয়ে চলে। পথ তাদের অজানা। দাউদ ফাওজিয়াকে একটি তারকার কথা বলেছিলো। সেই তারকার অনুসরণে তারা এগিয়ে যেতে থাকে।
তিন বাহিনী দিনভর অবস্থান করার পর রাতে আবার রওনা হয়। তুকমান এখন আর বেশি দূরে নয়। সুলতান আইউবী তুর্কমান অভিমুখে ধেয়ে আসা ঝড় সম্পর্কে বেখবর। তিনি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন বটে; কিন্তু এবার তার শত্রুরা ভালো আয়োজন করে রেখেছে। ইতিহাসবেত্তাগণ লিখেছেন- সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষে এই সাইমুমের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া বাহ্যত সম্ভব ছিলো না। তার সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে পড়া নিশ্চিত ছিলো। তিনি তার সালারদের সম্মুখে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, হাব, হাররান ও মসুলের যযাদ্ধারা এতো দ্রুত আক্রমণ করতে সক্ষম হবে না। অথচ সাইফুদ্দীনের প্রতি আল মালিকুস সালিহর পত্র তার হাতে এসে পৌঁছেছিলো।
ফাওজিয়া ও তার ভাবী ভুলেই গেছে যে, তারা নারী। পথে তারা কী কী সমস্যায় পড়তে পারে, সেই চিন্তা তাদের মাথায় নেই। ভাবনা শুধু একটাই কখন তুর্কমান পৌঁছে সুলতান আইউবীকে সংবাদ পৌঁছাবেন, আপনার শত্রুরা ধেয়ে আসছে; আপনি প্রস্তুত থাকুন।
তারা রাতটা ঘোড়ার পিঠে কাটিয়ে দেয়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তারা টিলা ও বালুকাময় এলাকার কোল ঘেঁষে অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ ফাওজিয়া দেখতে পায়, একটি পাথরের সঙ্গে হেলান দিয়ে এক লোক উদাস মনে বসে আছে। লোকটার পরিধানের কাপড় রক্তে লাল হয়ে আছে। ফাওজিয়া তার ভাবীকে ডেকে বললো- দেখ ভাবী! একজন লোক বসে আছে; জখমী মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের থামা যাবে না। কে বলবে, কে না কে তবে লোকটার পাশ দিয়েই তাদের যেতে হবে। তারা দেখতে পায়, লোকটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
ঘোড়া লোকটার নিকটে এসে পৌঁছলে ফাওজিয়া চিৎকার করে ওঠে হারিছ? ভাবী! বেঁচে আছে। তার দেহে অনেকগুলো ক্ষত।
ফাওজিয়াদের সঙ্গে পানি আছে। তারা হারিছকে পানি পান করায়। কিছুটা চৈতন্য আসলে হারিছ জিজ্ঞেস করে- আমি কি ঘরে? দাউদ কোথায়?
ফাওজিয়া ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনায়। দাউদের শাহাদাঁতের সংবাদ জানায় এবং তারা কী কাজে কোথায় যাচ্ছে, হারিছকে অবহিত করে। হারিছ বললো- আমাকেও ঘোড়ায় তুলে নাও এবং সময় নষ্ট না করে তুকমান অভিমুখে ঘোড়া হাঁকাও।
ফাওজিয়া ও তার ভাবী হারিছকে পাজাকোলা করে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেয়। ফাওজিয়া তার পেছনে বসে। হারিছের দেহে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। লোকটা বেঁচে আছে শুধু আত্মার শক্তিতে। কর্তব্য এখানো শেষ হয়নি বলেই তার এই বেঁচে থাকা। ফাওজিয়া তার পিঠটা নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নিয়ে। তাকে এক বাহু দ্বারা আগলে রাখে। হারিছ অস্ফুট স্বরে ডান-বাম বলে বোনকে পথনির্দেশ করছে।
সাইফুদ্দীনের কমান্ডে আইউবীর শত্রু বাহিনী তুর্কমানের কাছাকাছি পৌঁছতে আর বেশি বাকি নেই। এদিকে ফাওজিয়া, হারিছ ও হারিছের স্ত্রী এক নিরাপদ পথে তুর্কমানের দিকে এগিয়ে চলছে। ধীরে ধীরে দিগন্ত থেকে আকাশ বাদামী বর্ণ ধারণ করছে এবং এই রংটা উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। ফাওজিয়ার ভাবীর দিগন্তপানে চোখ পড়া মাত্র আঁৎকে ওঠে এবং চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে- ফাওজিয়া, ওদিকে চেয়ে দেখ।. হারিছ ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- কী ফাওজিয়া!
ধূলিঝড়। ফাওজিয়া বললো। তার অন্তরে ভয় ঢুকে গেলো।
হারিছ এই ভূখণ্ডের এসব ধূলিঝড় সম্পর্কে অবহিত। এলাকাটা পাথুরে বটে; কিন্তু কিছু বালুকাময় অঞ্চলও আছে। ধূলিঝড় শুরু হলে টিলা ও পাথর খণ্ডগুলো বালিতে সমাধিস্ত হয়ে যায়। মানুষ এবং অন্যান্য জীব-জন্তুর জন্য তা কেয়ামতের রূপ ধারণ করে। কিন্তু এইমাত্র ফাওজিয়া ও তার ভাবী যে ঝড় দেখতে পেলো, তা অত্র অঞ্চলের আরো পাঁচ-দশটি ভয়ংকর ঝড়ের একটি, যেটি ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। মেজর জেনারেল আকবর খান তার ইংরেজি গ্রন্থ গেরিলা ওয়ার ফেয়ার-এ কয়েকজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ও মুসলিম কাহিনীকারের সূত্রে লিখেছেন- যেদিন আল-মালিকুস সালিহ, গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত বাহিনী সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন, ঠিক সেসময় এমন এক ধূলিঝড় উঠেছিলো যে, নিজের নাকের আধা হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। সুলতান আইউবীর জানা ছিলো না যে, এই ঝড়ের মাঝে আরো একটি ঝড় ধেয়ে আসছে তার দিকে।
ইতিহাসে একথাও লিখা আছে। এই পরিস্থিতিতে সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণে বিলম্ব করে, যা ছিলো মূলত প্রধান সেনানায়কের ভুল সিদ্ধান্ত। সত্যের পথের পথিকদের সাহায্য করা আল্লাহর ওয়াদা। বলা যেতে পারে, এই প্রক্রিয়ায় মহান আল্লাহ দুটি বীরাঙ্গনা মুসলিম নারীর ঈমানী চেতনার লাজ রক্ষা করেছেন। এক বোন তার আহত মুজাহিদ ভাইকে আগলে ধরে মুজাহিদীনে ইসলামকে কাফিরদের আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য ছুটে চলছিলো। মনে তার নিজের কিংবা ভাইয়ের কোনো ভাবনা নেই। ভাবনা তার একটাই- ইসলাম ও সালতানাতে ইসলামিয়া।
ঝড় এতো দ্রুত ধেয়ে আসে যে, কেউ আত্মসংবরণ করার সুযোগ পায়নি। সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে বড় বড় পাথরের আড়ালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের উট-ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। কমান্ডারদের দৃঢ় বিশ্বাস, অল্প সময়ের মধ্যে ঝড় থেমে যাবে এবং তারা বাহিনীকে সংগঠিত করে নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু ঝড় উত্তরোত্তর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলছে।
***
সুলতান আইউবীর ছাউনি এলাকার অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। তাঁবুগুলো উড়ছে। রশিবাধা উট-ঘোড়াগুলো প্রলয় সৃষ্টি করে ফিরছে। বালি তো আছেই, পাশাপাশি নুড়ি-কংকরও উড়ে এসে গায়ে বিদ্ধ হচ্ছে। চারদিকের আর্ত চিৎকার এমন রূপ ধারণ করেছে, যেনো প্রেতাত্মারা চিৎকার করছে। সূর্য এখনো উদিত হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে, মরুঝড় আকাশের সূর্যটাকেও উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কমান্ডারগণ চিৎকার করে ফিরছেন। সৈন্যরা উড়ন্ত তাঁবুগুলোকে সামলাতে গিয়ে নিজেরাই বেসামাল হয়ে পড়ছে।
তিন-চারজন সৈনিক একটি পাথরের আড়ালে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ধীর-পদবিক্ষেপে অগ্রসরমান একটি ঘোড়া এসে তাদের উপর উঠে পড়ার উপক্রম হয়। সৈন্যরা এদিক-ওদিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিৎকার করে ওঠে। ঘোড়াটাকে থামাও। হতভাগা! কোথাও আড়াল হয়ে যাও।
ঘোড়া থেমে যায়। এক সৈনিক তার সঙ্গীদের বললো- কিছু বল না, মহিলা। অন্য একজন বললো- দুজন।
তারা ফাওজিয়া ও তার ভাবী। ঝড়ের কবলে পড়ে পথ ভুলে এদিকে এসে পড়েছে মনে করে সৈনিকরা তাদের ঘোড়ার বাগ ধরে ফেলে এবং একটি পাথরের আড়ালে নিয়ে যায়।
আমাদেরকে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছিয়ে দিন- চারদিকের হট্টগোলের মধ্যে চিৎকার করে ফাওজিয়া বললো- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কোথায়? আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম নিয়ে এসেছি। আমাদের তাড়াতাড়ি সুলতানের নিকট নিয়ে যান। অন্যথায় সকলে মারা পড়বেন।
সৈনিকরা ঘোড়ার উপর একজন রক্তাক্ত জখমীও দেখতে পায়। তারা লাগাম ধরে বড় কষ্টে ঘোড়াটাকে সুলতান আইউবীর তাবুর নিকট নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে তাঁবু নেই। উড়ে গেছে। সুলতান কোথায় আছেন, জেনে নিয়ে কমান্ডার মেয়েগুলোকে তাঁর নিকট নিয়ে যায়। সুলতান বৃহদাকার একটি পাথরের আড়ালে বসে আছেন। দুটি মেয়েকে দেখেই সুলতান দ্রুত দাঁড়িয়ে যান।
সর্বাগ্রে হারিছকে ঘোড়া থেকে নামানো হলো। এখনো সে জীবিত। ফাওজিয়া ও তার ভাবী দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে কথা বলতে শুরু করে। ফাওজিয়া সুলতান আইউবীকে জানায়, সম্মিলিত বাহিনী আক্রমণের জন্য এসে পড়েছে। হারিছ অস্ফুট স্বরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রদান করে এবং কথা বলতে বলতেই চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর ঝড় প্রশমিত হতে শুরু করে। সুলতান আইউবী তার সালারদেরকে তলব করে নির্দেশ দেন, তাঁবু টানোর প্রয়োজন নেই। সৈনিকদেরকে ইউনিটে ইউনিটে একত্রিত করো। কমান্ডো দলটিকে এক্ষুণি ডেকে আনো। কী ঘটতে যাচ্ছে, সুলতান সালারদের তা অবহিত করেন এবং রাতারাতি কী কী মহড়া দিতে হবে ও কী কী কাজ করতে হবে বলে দেন।
ঝড়ের তীব্রতা অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু রাতের ঘোর আঁধারে ছেয়ে আছে প্রকৃতি। সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্যরা নিজেদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক সৈনিক শুয়ে পড়েছে। এই বিশৃঙ্খলার কারণে রাতের আক্রমণ মুলতবী করা হয়েছে। পশুগুলোও এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে।
মধ্য রাতের পর। সাইফুদ্দীনের সৈন্যরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু সুলতান আইউবীর ক্যাম্প সম্পূর্ণ সজাগ ও কর্মতৎপর। আইউবী সাইফুদ্দীনকে স্বাগত জানানোর জন্য কী কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন, সাইফুদ্দীদের তা অজানা।
***
ভোর হয়েছে। সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত বাহিনীর মাঝে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। রসদ উড়ে গেছে। দিশেহারা উট-ঘোড়াগুলো সৈন্যদের পিষে মেরেছে। সবকিছু গুছিয়ে সৈন্যদের সংগঠিত করতে দিনের অর্ধেকটা কেটে গেলো। সাইফুদ্দীন সম্মুখ দিক থেকে প্রকাশ্যে সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করার জন্য তার সালারদের নির্দেশ দেন। তিনি জানেন, সুলতান আইউবী তার এই অভিযান সম্পর্কে বে-খবর।
বিকাল বেলা। সাইফুদ্দীনের বাহিনী আইউবী বাহিনীর উপর আক্রমণ করলো। ডানে-বাঁয়ে টিলা আর বড় বড় পাথর। মুহূর্তের মধ্যে অপ্রস্তুত আইউবী বাহিনী নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সাইফুদ্দীনের কামনাও তা ই। কিন্তু একী! টিলা আর পাথরের আড়াল থেকে উল্টো হামলাকারীদের উপরই তীরবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু করে। সম্মুখ দিক থেকে ধেয়ে আসতে শুরু করে আগুনের গোলা। দাহ্য পদার্থ ভর্তি পাতিল এসে সৈন্যদের মাঝে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে আর ভেতরের তরল পদার্থগুলো ছিটিয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর মিনজানীক দ্বারা নিক্ষিপ্ত অগ্নিগোলা এসে পড়ছে আর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠছে।
সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ থেমে গেছে। সাইফুদ্দীন তার বাহিনীকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে যান এবং আক্রমণের বিন্যাস ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলেন। কিন্তু তার সৈন্যরা পেছনে সরে যাওয়ামাত্র পেছন দিক থেকেও তাদের উপর এমন তীব্র আক্রমণ আসে যে, তাদের পরিকল্পনা ও মনোবল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
এমনি আক্রমণ হলো বাহিনীর উভয় পার্শ্বের উপরও। সাইফুদ্দীনের কেন্দ্রীয় কমান্ড শেষ হয়ে গেছে। রাতে আক্রমণ অব্যাহত থাকে। সাইফুদ্দীন আরো পেছনে সরে আসেন। এবার শুরু হলো তীরবৃষ্টি। সুলতান আইউবীর বাহিনী সারারাত তৎপর থাকে। শেষ রাতের আলো-আঁধারিতে সুলতান একটি টিলার উপর উঠে রণাঙ্গনের পরিস্থিতি অবলোকন করেন। তার সম্মুখে এখন যুদ্ধের শেষ পর্ব। তিনি দূত মারফত তার রিজার্ভ বাহিনীর নিকট নির্দেশ প্রেরণ করেন। অল্পক্ষণের মধ্যে ধাবমান অশ্বের ক্ষুরধ্বনিতে মাটি কেঁপে ওঠে। পদাতিক বাহিনী ডান-বাম থেকে বেরিয়ে আসে। আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাশ মুখরিত হয়ে ওঠে।
এই আক্রমণের ধকল সালমানোর সাধ্য সাইফুদ্দীনের নেই। তারা এখন সম্পূর্ণরূপে আইউবী বাহিনীর বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ। সম্মুখ থেকে তীব্র আক্রমণ এসে পড়ে। শুধু সাইফুদ্দীনের সৈনিকদেরই নয়, স্বয়ং তারও মনোবল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। উট-গোড়াগুলো আহত সৈনিকদের পিষে মারছে। অবশেষে তারা যার যার মতো অস্ত্রসমর্পণ করতে শুরু করে।
সুলতান আইউবীর যে বাহিনী সাইফুদ্দীনের পেছনে ছিলো, তারা এগিয়ে আসছে। ডান ও বামদিক থেকে কমান্ডো সেনারা মার মার কাট কাট রবে আঘাতের পর আঘাত হানছে। সাইফুদ্দীনের বাহিনী আইউবীর পিঞ্জিরায় আবদ্ধ হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবীর সৈন্যরা সাইফুদ্দীনের কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। সেখানে মদের পিপা-পেয়ালা ছাড়া আর কিছুই নেই। সেখান থেকে যাদেরকে গ্রেফতার করা হলো, তারা বললো- আমাদের প্রধান সেনা অধিনায়ককে শেষবারের মতো একটি পাথরের আড়ালে দেখেছিলাম। তারপর থেকে আর তার কোন পাত্তা নেই।
সুলতান আইউবী তাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলেন। অনেক অনুসন্ধান করা হলো। কিন্তু পাওয়া গেলো না। তিন বাহিনীর প্রধান সেনা অধিনায়ক তার সৈনিকদেরকে সুলতান আইউবীর দয়ার উপর ফেলে রেখে পালিয়ে গেছেন।
রাতের বেলা। ফাওজিয়া তুর্কমানের সবুজ-শ্যামলিমায় স্থাপিত একটি তাবুতে ভাইয়ের লাশের কাছে বসে স্বগতোক্তি করছে- আমি রক্তের নদী পার হয়ে এসেছি, যার উপর কোনো পুল ছিলো না। হারিছ। আমি তোমার কর্তব্য পালন করেছি।
সুলতান আইউবী এসে তাঁবুতে প্রবেশ করেন। ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করে খবর কী সুলতান! আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি তো?
আল্লাহ দুশমনকে পরাজয় দান করেছেন। তুমি জয়ী। তোমার জীবন স্বার্থক। তুমি…।
সুলতান আইউবীর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে।