৭.১ একই গন্তব্যের মুসাফির

কই গন্তব্যের মুসাফির

হালবের উত্তরে আজকের সিরিয়া ও লেবাননের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি শহর। নাম হেমস। যুদ্ধ এখনও গ্রাস করেনি বলে শহরটি শান্ত। খৃষ্টান সৈন্যরা মাঝে-মধ্যে তার আশপাশ দিয়ে অতিক্রম করছে। শহরটির কোল ঘেঁষে বয়ে চলছে ছোট্ট একটি নদী। সে কারণেই শহরটি সৈন্যদের বিচরণ থেকে নিরাপদ রয়েছে। অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এতো বেশি। ফলে এটি মুসলমানদের নগরী বলেই পরিচিত। অল্প কটি খৃষ্টান পরিবারও আছে। আছে কটি ইহুদী পরিবারও। তবে ব্যবসা বাণিজ্য ইহুদী-খৃস্টানদের দখলে। বাণিজ্যের সুবাদে তাদের দূর-দূরান্ত অঞ্চলে যাওয়া-আসা আছে। তারা বহিঃজগতের যে খবরাখবর নিয়ে আসে, হেসের মানুষ তা-ই সত্য বলে বিশ্বাস করে। তারা ক্রুসেডার ও ইসলামী বাহিনীর যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে আসে। তাতে মুসলমানদের পরাজয়ের উল্লেখই বেশি থাকে। খৃষ্টান বাহিনী সম্পর্কে তারা ভীতিকর কথাবার্তাই শুনিয়ে থাকে।

তাদের উদ্দেশ্য, মুসলমানদের উপর খৃস্টান বাহিনীর আতঙ্ক বিরাজিত থাকুক এবং অন্তত এই নগরীর কোন মুসলমান ইসলামী বাহিনীতে অংশগ্রহণ না করুক। কিন্তু তার ক্রিয়া হচ্ছে উল্টো। মুসলমানগণ ীত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আইন করে বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাদের এই সামরিক প্রস্তুতি রুখবার শক্তি কারো নেই। এখানে খৃস্টানদের শাসন চলে না।

হেমসের মুসলমানগণ অশ্বচালনা, বর্শা ছেঁড়া, তরবারীচালনা ও তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করছে। এই প্রশিক্ষণ মেয়েরাও গ্রহণ করছে। তাদের নেতা নগরীর বড় মসজিদের খতীব, যার সকল ইলম ও আমল জিহাদের জন্য নিবেদিত। তিনি প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাস শত্রুমুক্ত করার এবং খৃস্টানদেরকে আরব দুনিয়া থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে মুসলমানদের প্রস্তুত করছেন।  

আর এই যুদ্ধটা কেন লড়া হচ্ছে?- খতীব তাঁর ভাষণে ব্যাখ্যা প্রদান করছেন- খৃস্টানরা আরব দুনিয়ার উপর দখলদারিত্ব কায়েম করে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে আর আমরা পৃথিবীতে আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করার জন্য জান-মালের কুরবানী দিয়ে চলেছি। তারা আরব দুনিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করলো কেন তার একমাত্র কারণ, মহান আল্লাহর মহান পয়গাম আরবদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেই বার্তা আরবদের উপর কর্তব্য আরোপ করে দিয়েছে যে, হেরা গুহায় বসে প্রিয়নবীর প্রাপ্ত এই বার্তা আমরা সমগ্র মানবতার নিকট পৌঁছিয়ে দেবদ। তারিক ইবনে যিয়াদ রোম উপসাগরের মিসরীয় তীরে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহকে বলেছিলেন- তুমি যদি আমাকে সাহস ও দৃঢ়তা দান করে, তাহলে আমি তোমার নাম সমুদ্রের ওপারে নিয়ে যাবে। সে সময় তার বক্ষ থেকে ঈমানী চেতনার যে শিখা উত্থিত হয়েছিলো, তা-ই তাঁর ঘোড়াকে সমুদ্রে নামিয়ে দিয়েছিলো। নৌকায় করে তার বাহিনী ইউরোপের কূলে পৌঁছে যায়। যিয়াদপুত্র তারিক আদেশ দিলেন- নৌকাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দাও। আমরা ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি।

আর আজ খৃস্টানরা আল্লাহর ভূখণ্ডে এই প্রত্যয় নিয়ে এসেছে যে, তারা ফিরে যাবে না। এই ভূখণ্ডকে তারা করায়ত্ত্ব করার সিদ্ধান্ত নিলো কেন? তারা চাচ্ছে, আল্লাহ পাক যে ইসলামকে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করেছিলেন, তাকে এখানেই নিশ্চিহ্ন করে দেবে। মনে রেখো মুসলমান! ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যে পাথরকে মোমে পরিণত করে দেয়। আমাদের ধর্মের মূলনীতিগুলো সহজে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়। কারণ, এটি মানব স্বভাবের সম্পূর্ণ অনুকূল জীবনব্যবস্থা। হাক্কুল ইবাদ (মানবাধিকার) এমন একটি মৌল বিধান, মানবজাতিকে একমাত্র ইসলামই উপহার দিয়েছে। ইসলাম একটি ধর্মই নয়- এটি একটি মতবাদ। ইসলাম বিশ্ব মানবতার পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।

ক্রুশের ধ্বজাধারীরা জানে, ইসলাম যদি বিস্তার লাভের সুযোগ পেয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী নামক এই গ্রহটি ইসলামের ছায়াতলে চলে আসবে এবং ক্রুশের নাম-চিহ্ন মুছে যাবে। এ কারণেই ক্রুসেডাররা তাদের পূর্ণ সমর শক্তি নিয়ে এখানে এসেছে। তারা ইসলামের উৎসমুখ বন্ধ করে দিতে এসেছে। ইহুদীদের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে, বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করে তাদের হাতে তুলে দেবে, যাতে ইহুদীরা আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসাকে হাইকেলে সুলায়মানীতে পরিণত করতে পারে। এটি ইহুদীদের একটি প্রাচীন স্বপ্ন, যাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তারা অস্থির হয়ে আছে। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা তাদের রূপসী মেয়েদেরকে এবং তাদের ধন-সম্পদ খৃস্টানদের হাতে তুলে দিয়েছে। এই নারী আর অর্থই আমাদের সারিতে গাদ্দার জন্ম দিয়েছে।

আমি তোমাদেরকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম শোনাচ্ছি। তোমরা তাকে হৃদয়ে অঙ্কন করে নাও। ইসলামের সৈনিক সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁর ফৌজ ও জাতিকে বলে রেখেছেন, চলমান লড়াই দুটি বাহিনীর যুদ্ধ নয়, এটি প্রথম কেবলা ও হাইকেল সুলাইমানীর যুদ্ধ। আজ যদি আমরা বাতিলকে চিরতরে খতম করতে না পারি, তাহলে বাতিল একদিন আমাদের ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমাদের আত্মা দেখবে, ইতিহাস দেখবে, ফিলিস্তীন ইহুদীদের দখলে আর মসজিদে আকসা হাইকেলে সুলাইমানীতে পরিণত হচ্ছে।

হেমসের মুসলমানগণ! তোমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের সৈনিক নও বটে; তবে অবশ্যই আল্লাহর সৈনিক। তোমাদের উপর জিহাদ ফরজ করে দেয়া হয়েছে। কুরআন নির্দেশ দিয়েছে, নিজের মাতৃভূমি ও ধর্মের সুরক্ষার জন্য ঘোড়া ও অস্ত্র প্রস্তুত রাখো এবং জিহাদের প্রস্তুতিতে নিয়োজিত থাকো। তবে মনে রেখো, তোমাদের শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে শুধু রণাঙ্গনেই যুদ্ধ করে না। তাদের যুদ্ধক্ষেত্র আরো আছে। তারা অপপ্রচারের মাধ্যমে তোমাদের উপর তাদের বাহিনীর ভীতি ও ইসলামী ফৌজের বিরুদ্ধে কুধারণা সৃষ্টি করছে। তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে সুন্দরী মেয়ে আর সোনার চাকচিক্য দ্বারা নিজেদের অনুগত বানিয়ে নিচ্ছে। এই দুটি বস্তু মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই দুয়ের সঙ্গে যখন মদ যোগ হয়, তখন মুসলমান তার ঈমানকে ঈমানের শত্রুর পায়ের উপর অর্পণ করে। এমনটি অতীতে হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। খৃস্টানরী আমাদেরকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে আমাদের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। আমাদের কতক আমীর খৃস্টানদের কাছে ঈমান নীলাম করে সালতানাতে ইসলামিয়া ও মুসলিম উম্মাহর এই ক্ষতিটা করেছে। কিন্তু তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করেছে জাতি, দেশ ও সেনাবাহিনী। যারা অন্যের মাঝে গৃহযুদ্ধ বাধায়, তারা দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনীকে আবেগে ফেলে একদলকে অপর দলের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় এবং একদল দ্বারা অপর দলকে খুন করায়। আর নিজেরা প্রাসাদে বসে ফুর্তি করে। তোমরা স্মরণ রেখে, এই পাথরগুলো সব যদি সোনা হয়ে যায় আর সেগুলো তোমাদের দান করা হয়, তবুও জিহাদের প্রতিদান হবে না। জিহাদের পুরস্কার লাভ করে আত্মা। আত্মা ঘরা-জহরতে খুশি হয় না। জিহাদের পুরস্কার আল্লাহর হাতে। তোমরা যদি আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দাও, তবু জীবিত থাকবে। তোমরা দৈহিক সুখ-ভোগকে লক্ষ্য স্থির করো না। এই দৈহিক সুখ-ভোগকে যে-ই লক্ষ্য বানিয়েছে, সে-ই আপন ঈমানদার ভাইয়ের গলা কেটেছে, জাতির গলায় ছুরি চালিয়েছে। কুরআন তোমাদেরকে আত্মিক শান্তিতে ধন্য করতে চায়।

এভাবে খতীব হেমসের মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত করে রাখেন। তারই তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা মোতাবেক সামরিক প্রশিক্ষণ চলছে। তিনি স্বয়ং তরবারী ও খঞ্জর চালনায় অভিজ্ঞ। হেসে এই প্রশিক্ষণ পুরোদমে চলছে। সকলের হৃদয়ে একটিই সুর অনুরণিত হচ্ছে- জিহাদ জিহাদ জিহাদ চাই, জিহাদ করে বাঁচতে চাই।

হেমস নগরীতে তিনটি মসজিদ আছে। এই মসজিদগুলো জিহাদের আলোচনায় মুখরিত থাকে। কিন্তু এখানকার খৃস্টান ও ইহুদী অধিবাসীরা সহানুভূতিশীল সেজে দুঃসংবাদ শুনিয়ে শুনিয়ে মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ মুসলমানগণ মসজিদের খতীব ও ইমামদের নিকট এসব সংবাদের সত্যতা জিজ্ঞেস করছে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কুশ ও চাঁদ-তারার যুদ্ধের সঠিক ও বাস্তব চিত্র জেনে হেমসের মুসলমানদের কৌতূহল নিবারণের জন্য খতীব তাবরিজ নামক এক যুবককে দামেশক পাঠিয়ে দিয়েছে।

***

যুদ্ধের সঠিক চিত্র সংগ্রহ করে হেস ফিরে আসছে তাবরিজ। সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাকে দামেশক পর্যন্ত যেতে হয়নি। পথেই তার কাজ হয়ে গেছে। খৃস্টান বাহিনী হামাত থেকে বহু দূরে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলো। তাবরিজ তাদের দেখে ফেলে। দূর থেকে পতাকা দেখে চিনে ফেলে, ওরা খৃস্টান সৈন্য। তাবরিজ অগ্রসর হতে থাকে। পথে দুজন উজ্জ্বারোহীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। তারা মুসলমান। তাবরিজ তাদের থেকেও জানতে পারে, ওরা খৃষ্টান বাহিনী। উল্লারোহীরা আরো জানায়, এই বাহিনী মুসলমানদের হাতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এসেছে। তাবরিজ তারে বললো, আমি হেমস থেকে জানতে এসেছি, ফান বাহিনী কোন্ অবত এসে গেছে এবং আরবের রুটি খাল করছে।

ঐ যে পাহাড়গুলো দেখতে পাচ্ছে জোহরা একটি পার্বতময় এলাকার প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এই পথটিই তোমাকে পর্বতমালার অভ্যন্তরে নিয়ে যাবে। ওখানে গেলেই আমাদের ফৌজ দেখতে পাবে। দামেশৃক এখনো অনেক দূর। বাহিনীর যে কোন একজন সৈনিককে জিজ্ঞেস করলেই তুমি সবকিছু জানতে পারবে। আমরা শুধু এটুকু জানি, রামাল্লায় যে যুদ্ধ হয়েছিলো, তাতে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত ও পরাজিত হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেছে। তারপর খৃস্টানদের সঙ্গে হামাতের দুর্গের সন্নিকটে লড়াই হয়েছে, যাতে খৃষ্টানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পলায়ন করেছে। তুমি সম্মুখে চলে যাও। তবে কোন খৃষ্টান সৈন্যের কাছে ঘেঁষবে না। তারা যখনই টের পাবে তুমি মুসলমান, সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে হত্যা করে ফেলবে।

দিবসের শেষ বেলা। তাবরিজ হামাতের পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়েছে। ভেতরে সুপরিসর একটি উপত্যকা। সম্মুখ দিক থেকে জনাকয়েক অশ্বারোহী এগিয়ে আসে। তাবরিজ মাঝপথ দিয়েই হাঁটছে। এক আরোহী ছুটে এসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- পথছাড়ো মিয়া! প্রধান সেনাপতি আসছেন।

তাবরিজ সামান্য সরে দাঁড়ায়। আরোহী তাকে আরো দূরে সরে যেতে বলছে। প্রধান সেনাপতি ও তাঁর সহকর্মীরা দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন।

প্রধান সেনাপতি সুলতান আইউবীর ভ্রাতা আল-আদিল। এসে পৌঁছেই তিনি দেখতে পান তার এক ব্ৰক্ষীসেনা একজন পথিকের সঙ্গে ক্ষুব্ধ ভাষায় কথা বলছে। বোধ হয় পথিক পথ ছাড়ছিলো না। আল-আদিল নিকটে এসে দাঁড়িয়ে যান। তাবরিজকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে? রক্ষীর সঙ্গে বচসা করছো কেন? 

তাবরিজ জবাব দেয়, আমি হেমস থেকে জানতে এসেছি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী কী অবস্থায় আছে এবং খৃষ্টান বাহিনী কী পরিমাণ সাফল্য অর্জন করেছে। সে আল-আদিলকে জানায়, হেসের মুসলমানরা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে এবং সুলতান আইউবীর ফৌজের অপেক্ষা করছে। আমাদের বোনরাও যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রকুত শিশু-কিশোর-বৃদ্ধরাও।

আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আল-আদিলের সঙ্গে আছেন। তিনি তাবরিজকে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষা করছেন। তাবরিজ শত্রুপক্ষের চর হতে পারে। তবে তার সরলতা প্রমাণ করছে লোকটা গুপ্তচর নয়। তবু সন্দেহ করা আবশ্যক। গোয়েন্দারা এর চেয়েও বেশী সরলতা প্রকাশ করতে পারে।

তোমাদের খতীবের নাম কী? হাসান ইবনে আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করেন।

তাবরিজ খতীবের নাম বলে। তকালের অপ্রকাশিত লিপিতে খতীবের নামটা স্পষ্ট উল্লেখ নেই। প্রকাশিত কোন ইতিহাস গ্রন্থেও হেসের এই খতীবের নাম পাওয়া যায় না। তাই অগত্যা আমরা তাকে খতীব বলেই ডাকবো।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আল-আদিলকে বললেন, আমি নিশ্চিত হয়েছি লোকটি আমাদেরই। তার কথা-বার্তায় বুঝা যাচ্ছে, সে আন্তরিকতার সঙ্গেই নিজ দায়িত্ব পালন করছে।

আল-আদিলের নির্দেশে তাবরিজকে মেহমান হিসেবে তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ রাতে তাবরিজকে নিজ তাঁবুতে তলব কমে এবং খতীবের নামে একখানা পত্র লিখে দেন

পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্গীন। তবে এতোটা নয়, যতোটা আপনারা শুনেছেন। জনগণকে বলুন, তারা যেনো তা-ই বিশ্বাস করে, যা তারা নিজ চোখে দেখে এবং যা ইমামগণ মসজিদে মসজিদে বলে থাকেন। এদিক ওদিকের কথা-বার্তায় যেনো তারা কান না দেয়, সত্য বলে বিশ্বাস না। কমে। আপনারা একটি মহা-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন। এলাকার ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রতি দৃষ্টি রাখুন আর সতর্ক থাকুন, যেনো তারা আপনাদের তৎপরতা জানতে না পারে। আপনাদের তৎপরতা ও কর্মসূচী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখতে হবে।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ খতীবের নামে এমন একটি বার্তা প্রেরণ করেন, যা হেসের মুসলমানদের জন্য উদ্দীপক। কিন্তু তাতে তিনি উল্লেখ করেননি, সেসব কিরূপ তৎপরতা, যেগুলো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখতে হবে। ব্যাপার হলো, হেমসের মুসলমানদেরকে সুলতান আইউবীর নির্দেশ মোতাবেক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো, যখনই প্রয়োজন হবে, তারা খৃস্টান বাহিনীর উপর পেছন থেকে গেরিলা অপারেশন চালাবে। তবে উপরে উপরে খৃস্টানদের অনুগত থাকবে। এ লক্ষ্যে হেসে তিন-চারজন অভিজ্ঞ কমান্ডো প্রেরণ করে রাখা হয়েছে, যারা সেখানে পরিকল্পনা মোতাবেক প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। খতীব তাদের কমান্ডার।

পরদিন সকালে তাবরিজ হেমূসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

***

যুগটা কাফেলাবদ্ধ হয়ে সফর করার। আবার কেউ একাকীও সফর করে। একাকী সফরকারীরা পথে দুচারজন লোক দেখলে গন্তব্য এক হলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এভাবে এক একটি কাফেলার রূপ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে কাফেলার বহর বাড়তে থাকে।

তাবরিজ এসেছিলে একাকী। ফেরার সময় পথে ক্ষুদ্র একটি কাফেলা পেয়ে যায়, যার গন্তব্যও হেস নগরী। কাফেলায় ইহুদী ব্যবসায়ীও আছে। দুটি খৃস্টান পরিবার উটের উপর সওয়ার। কিছু লোক পায়ে হেঁটে চলছে।

তাবরিজ এই কাফেলায় যুক্ত হয়ে যায়। কাফেলা এগিয়ে চলছে। দীর্ঘ পথ। পথে দুরাত অবস্থান করতে হয়। তৃতীয়দিন সফরের শেষ দিন। মধ্যরাতের পর কাফেলার হেস পৌঁছে যাওয়ার কথা। সম্মুখে একটি নদী। নদীটি তেমন বড় নয়। গভীরতা বড়জোর এক কোমর। মানুষ তার মধ্যদিয়ে অনায়াসেই চলাচল করে থাকে।

সফরের শেষ দিন। সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। কাফেলা দেখতে পায়, দিগন্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। কাফেলা চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। তারা চেষ্টা করছে, বর্ষণ শুরু হওয়ার আগে আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। না পারলেও কোন পাহাড়ী এলাকায় ঢুকে লুকানোর স্থান খুঁজবে। আর যদি সম্ভব হয়, তাহলে ফুলে উঠার আগেই নদী পার হয়ে যাবে।

ভাবতে না ভাবতে গোটা আকাশ ঘোর কালো মেঘে ছেয়ে যায়। সঙ্গে দমকা বাতাস। এলাকাটা পাহাড়ী। তারা যখন নদীর কূলে গিয়ে পৌঁছে, ততক্ষণে মেঘ দুনিয়াটাকে ঘোর তমশাচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং এমন মুষলধারায় বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে যে, চোখ খুলে হাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কাফেলার এক বৃদ্ধ খৃষ্টান বললো, নদী ফুঁসছে। তবে এখনো অতিক্রম করা সম্ভব। তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাও।

বৃদ্ধের সঙ্গে উটের উপর বসা একটি সুন্দরী যুবতী। খৃস্টান মেয়ে। কাফেলা নদীর কিনারায় পৌঁছে গেছে। নদীর পানি ঘোেলা হয়ে গেছে। গতিতে উচ্ছ্বাসের জোশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। গভীরতা এখনো বাড়েনি। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সময়টা সকাল হলেও মেঘ প্রকৃতিতে সন্ধ্যার পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে। আকাশে সূর্য দেখা যাচ্ছে না। যেন দিবসের কর্তব্য পালন করে যথা সময়ে অস্তমিত হয়ে গেছে। একজন তার ঘোড়াটা নদীতে নামিয়ে দেয়। কয়েক পা এগুতেই চীৎকার করে বলে ওঠে- এসে পড়ো। পদাতিকরাও আসো। পালি গভীর নয়।

কেউ দেখলে না উজানের দিকে থেকে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে তীব্র ৩য় জলোস খেয়ে আসছে। পাহাড়ী অংশের জােল জব্র হয় থাকে। উপর থেকে এফন খলধারায় বৃষ্টি নামছে, যেনো আকাল চালনি হয়ে গেছে, পানি আটকে রাখতে পারছে না। কাফেলার উট-ঘোড়াগুলো বেহ এইই অনুভব করছিলো। এমন একটি নদী অতিক্রম করা যে প্রাণীগুলোর পক্ষে কোন ব্যাপার ছিলো না, তারা এখন নদীতে বেয়াড়ার ন্যাচরণ করছে। আর এতে যেনো তাদের মন সায় দেয় না। অথচ পানি এখনো গভীর নয়।

হঠাৎ নিতাই হঠাৎ নদীটি পানিতে ভরে যায়। পর্বতসম ও বিশাল কিশা তে এসে আঘাত হানতে শুরু করে। পানি গভীরতর হয়ে যায়। মণীর পাড় উলটে নি উপরে উঠে আসে- আরো উপরে। কাফেলার পদাতিক সদস্যরা সাঁতার কাটতে শুরু করে। উটগুলো চীৎকার জুড়ে দোকালো নদীতে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। নদীর অপর পার দূরে নয়। কি তীব্র স্রোত কাউকে আড়াআড়ি এগুতে দিচ্ছে না। কাফেলার সকল সদস্য আশআপন জীবন রক্ষার চেষ্টা করছে।

খৃষ্টান মেয়েটির চীৎকার শোনা গেলো। তাবরিজ নিকটেই কোথাও আছে। মেয়েটির চীৎকার তার কানে আসে। তাবরিজ দেখতে পায়, মেয়েটি যে উটের পিঠে সওয়ার ছিলো, সেটি স্রোতের মোকাবেলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পা উপড়ে গেছে এবং তীব্র স্রোত তাকে ফেলে দিয়েছে। তার পিঠের উপর বসা মেয়েটি নদীতে ছিটকে পড়ে যায়। পানির স্রোত-উচ্ছ্বাসের অবস্থা হলো, কখনো ঢেউ উপরে উঠে ঠায় দাঁড়িয়ে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে, আবার কখনো ঘূর্ণিপাকের রূপ ধারণ করছে। হৈ খুল্লোড়, আর্তচীৎকার এতো তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, কেউ কারো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। তাবরিজ যদি নিকটে না থাকতো, তাহলে মেয়েটির চীৎকারও কেউ শুনলে না। তাবরিজ ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। ঘোড়াটা স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না বটে, তবে স্রোত-ঢেউয়ের মোকাবেলা করে চলেছে। নিজ মেয়েটিকে পানিতে ছিটকে পড়তে দেখে নিজের ঘোড়াটা স্রোতের অনুকূলে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ঘোড় তেমন দ্রুত সাঁতার কাটতে পারছে না।

তাবরিজ খোঁড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে দ্রুতগতিতে সাঁতার কেটে মেয়েটির পেছনে চলে যায়। একটি ঢেউ মেয়েটিকে উপরে তুলে ফেললে তাবরিজ তাকে দেখে ফেলে। তাবরিজের তরুণ বাহুতে শক্তি আছে। সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে ফেলে। মেয়েটি এখনো তুবলি বটে; কিন্তু সেসাঁতরাতে পারছে না। তাকে সামলে রাখা তারিজের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।উত্তাল নদীতে নিম আর একটি মেয়েকে বানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করছে তাবরিজ। এরই মধ্যে সাত দেয়াকে অনেক দূর ভসিয়ে নিয়ে গেছে। তাবরিজ মেয়েটিকে নিজের পিঠের উপর গুলি নিয়ে কূলের দিকে সঁতরাতে শুরু করে। কিন্তু স্রাতের তোেড় মেয়েটি তাবর্নিজের পিঠ থেকে ছিটকে যায়। মেয়েটির এখন চৈতনা নেই। যদি মুসলিম যুবক তাবরিজের দেহে শক্তি আর হৃদয়ে মানবোধ না খাকত, তাহলে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে সে নিজের জীবন রক্ষারই চেষ্টা করলে।

কাফেলা যে স্থান থেকে নদীতে অবতরণ করেছিলো, তার থেকে অন্তত দুমাইল দুরে তাবরিজ মেয়েটিকে নিয়ে কূলে ভিড়ে। স্কুলে শিকৃত প্রস্তর। তাবরিজ মেয়েটিকে উপরে তুলে মাটিতে শুইয়ে দেয়। মেয়েটি জীবিত। অবে অচেতন। অচেতন মানুষের চৈতন্য ফিরিয়ে আনতে কী করতে হয়, তাবরিজ জানে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ মেয়েটি মুদিত চক্ষেই নড়ে ওঠে এবং আপনা-আপনি উপুড় হয়ে যায়। পৈটে সপ পড়লে মুখ দিয়ে নদীর ঘোলা পানি বের হতে শুরু করে। তাবরিজ মেয়েটির কটিতে হাত রেখে চাপ দেয়। এবার আরো খানি বেরিয়ে আসে। উদ্দীপ্ত তাবরিজ এবার আরো জোরে চাপ দেয়। মেয়েটর পেট পানিশূন্য হয়ে যায়।

আকাশ মেঘমুক্ত হতে শুরু করেছে। বৃষ্টির জোর কমে গেছে। মেঘের ফাঁক গলে কিছু আলোও পৃথিবীতে এসে পড়ছে। তাবরিজ মেয়েটিকে সোজা করে শোয়ায়। মেয়েটি পলকের জন্য সামান্য চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে। তাবরিজের শরীরটা অবশ হয়ে গেছে। নিজের ঘোড়াটা নদীতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এখন আর তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। ঘোড়ার পরিণতি কী ঘটেছে, তাবরিজ জানে না। হয়তো মরে গেছে, নয়তো পানিতে জীবিত ভাসছে।

তাবরিজের ক্লান্তি কমে এসেছে। শরীরটা এখন মোটামুটি চাঙ্গা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা অস্ত গেলো বলে। তার মনে পড়ে যায় রাত আসছে। এখন একটা আশ্রয় খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু আশা আছে, অঞ্চলটা যেহেতু পাহাড়ী, তাই কোথাও না কোথাও একটা গুহা পেয়ে যাবে। জীর্ঘ পথের পথিকরা মাটির টিলা এবং বালুকাময় প্রান্তরে গুহা তৈরি করে রাখে, যা অন্য পথিকদেরও কাজে আসে।

***

তাবরিজ মেয়েটিকে পিঠে তুলে নিয়ে দুটি টিলার মধ্যদিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলেও আশা আছে তার। যুবক মনে মনে আল্লাহর নিকট দুআ করতে করতে এগিয়ে চলে। বেশকিছু সময় হেঁটে ডান-বাম ঘুরে একটি প্রশস্ত স্থানে গিয়ে পৌঁছে। তাবরিজ দেখতে পায়, একটি টিলার কোল ঘেঁষে তিন-চারটি উট দাঁড়িয়ে আছে। উটগুলোর পিঠে যিন নেই। কাজেই এগুলো কোন মুসাফিরের বাহন নয়।

তাবরিজ উটগুলোর নিকটে পৌঁছে যায়। এবার সে মানুষের কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। শব্দটা যেদিক থেকে ভেসে আসে, তাবরিজ সেদিকে তাকায়। টিলার অভ্যন্তরে একটি উঁচু ও সুপরিসর গুহা দেখতে পায়। ভেতরে তের-চৌদ্দ বছর বয়সের দুটি বালক দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় ওরা বৃষ্টির ককুল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গুহায় ঢুকে আশ্রয় নিয়েছে।

তোমরা নদী থেকে বেরিয়ে এসেছে বুঝি?- এক ছেলে বললো এখানে এসে পড়ো, বেশ ভালো জায়গা।

জায়গাটা সত্যিই চমৎকার। প্রশস্ত কক্ষের ন্যায়। ভেতরটা একেবারে শুকনো-ঝরঝরে। কোন মুসাফির দল কিংবা ধারে-কাছের কোন রাখাল নিপুণভাবে কেটে কেটে কক্ষটি তৈরি করেছে। ছেলে দুটো ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। তাবরিজ মেয়েটিকে পিঠ থেকে নামিয়ে গুহার মেঝেতে শুইয়ে দেয়। মেয়েটির এখনো জ্ঞান ফেরেনি। গুহার একদিকে কতগুলো শুষ্ক ঘাস ও গাছের শুকনো ডালের স্তূপ পড়ে আছে।

তোমরা এখানে কী করছো? তাবরিজ ছেলে দুটোকে জিজ্ঞেস করে।

আমাদের বাড়ি নদীর ওপারে- এক ছেলে উত্তর দেয়- মাঝে-মধ্যে আমরা উট নিয়ে এখানে আসি। ঘাস ওখানেও প্রচুর আছে। কিন্তু এখানে খেলতে আসি আর চরাবার জন্য উটগুলোও সাথে নিয়ে আসি। এক জায়গায় নদীটা বেশ চওড়া। ওখানে পানি কম- এক হাঁটুর বেশি থাকে না। আমরা ওখান দিয়ে আসা-যাওয়া করি। আজো আসলাম আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আমরা এখানে আগুন জ্বালিয়ে খেলছি।

এখন বাড়ি যাবে কীভাবে?- তাবরিজ জিজ্ঞেস করে- নদী তো পানিতে ভরে গেছে। নদী এখন উত্তাল।

এই নদীর জোর বেশিক্ষণ থাকে না- এক ছেলে নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললো- আমরা যেখান দিয়ে আসা-যাওয়া করি, সেখানে নদী উত্তাল হয় না। পানি ছড়িয়ে যায় বলে বেশি স্রোত হয় না।

বৃষ্টি থেমে গেছে। সূর্য অস্ত্র যাচ্ছে। বালক দুটি উট নিয়ে চলে গেছে। তাবরিজ তাদের কোন সহায়তা কামনা করেনি। এও ভাবেনি, ওদেরকে বলে মেয়েটিকে নিয়ে ওদের গ্রামে চলে যাবে কিনা।

ছেলেদের চলে যাওয়ার পর তাবরিজ নিভু নিভু আগুনে শুকনো ডাল ছুঁড়ে দেয়। আগুন জ্বলে ওঠে। তাবরিজ গায়ের টাখনু পর্যন্ত লম্বা ভিজা কাপড়টা খুলে আগুনের উপর ধরে শুকাতে শুরু করে। মনে মনে শোকর আদায় করছে তাবরিজ। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তার জন্য আগুন জ্বালাতে আল্লাহ এই ছেলেগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ইত্যবসরে মেয়েটি চোখ মেলে তাকায়। তার চেহারায় ভীতির ছাপ। মেয়েটি এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে। তাবরিজকে দেখামাত্র মুখটা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাবরিজের ঊর্ধ্বাংশ নগ্ন। নদীর ঘোলা পানি তার মাথার চুল ও চোহরাকে ভয়ঙ্কর বানিয়ে রেখেছে।

ভয় পেও না- তাবরিজ মেয়েটিকে বললো আমাকে চেনো না? আমি তোমার সফর সঙ্গী ছিলাম।

কিন্তু তুমি মুসলমান- মেয়েটি উঠে বসে। তার সর্বাঙ্গে ভীতির ছাপ। বললো- তোমার উপর ভরসা রাখা আমার উচিত হবে না। আমাকে চলে যেতে দাও।

যাও- তাবরিজ বললো- পারলে চলে যাও।

মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। চলে যাওয়ার জন্য সম্মুখে পা বাড়ায়। গুহার বাইরে এক পা রেখে বাইরে রাতের ঘোর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। ভেতরে আলো জ্বলছে। মেয়েটি মোড় ঘুরিয়ে তাবরিজের দিকে তাকায়। শুকনো বৃক্ষ ডালের আগুনে তাবরিজকে একজন রহস্যময় মানুষ বলে মনে হলো। তাবরিজও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভেতর দিকে এক-দুপা এগিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ার মতো করে বসে পড়ে এবং অসহায়ের ন্যায় তাবরিজের মুখপানে তাকিয়ে থাকে।

তোমার চেয়ে সেই ঘোড়াটি আমার বেশি প্রিয় ছিলো, যাকে নদীতে ছেড়ে দিয়ে তোমাকে ডুবে মরা থেকে রক্ষা করেছি। ভাবরিজ বললো।

আমার দাম বিশ-পঞ্চাশটি ঘোড়ার চেয়েও বেশি- মেয়েটি অস্ফুট ও কম্পিত কণ্ঠে বললো- আমার বিশ্বাস, তুমি আমার ন্যায় রূপসী মেয়ে কখনো দেখোনি। তুমি আমার শ্লীলতা বিনষ্ট করে আমাকে বিক্রি করে ফেলবে। তোমার হাতে আমি অসহায়। তোমাকে ঠেকাবার কেউ নেই।

আছে- তাবরিজ উত্তর দেয়- তোমার থেকে আমাকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য আল্লাহ আছেন। এ যাবত তিনিই ঠেকিয়ে রেখেছেন। অন্যথায় তোমার ন্যায় একটি সুন্দরী যুবতীকে এভাবে হাতে পেয়ে কোন পুরুষ ঠিক থাকতে পারে না। আমি পারলাম কীভাবে? আমি তোমাকে সেই উত্তাল নদীর গ্রাস থেকে রক্ষা করেছি, যাতে শক্তিশালী প্রাণী উট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। তারপর এখানে মাথার উপর ছাদ আর জ্বলন্ত আগুন পেয়ে গেলাম। এসব অলৌকিক ব্যাপার নয় কি? আমি আল্লাহর সমীপে দুআ করেছি। আল্লাহ কেবল সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করেন, যার নিয়ত স্বচ্ছ। দুটি বালক এই আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। ওরা ফেরেশতা ছিলো। আমি আমার ধর্মের আলোকে কথা বলছি। তুমি এ কারণে ভয় পাচ্ছে যে, তোমার ধর্ম মিথ্যা। আর এই জন্য যে, তোমার দৃষ্টি তোমার দেহের উপর নিবদ্ধ, যা অতিশয় আকর্ষণীয়। আর তোমার চোখে আছে শুধুই তোমার মুখাবয়ব, যেটি অত্যন্ত সুন্দর। বিপরীতে আমার দৃষ্টি হচ্ছে আমার আত্মার প্রতি, যা তোমার দেহ অপেক্ষা বেশী আকর্ষণীয় এবং তোমার চেহারার চেয়ে অধিক সুন্দর। আমি জানি, কিছুক্ষণ পর তুমি আমাকে তোমার দেহটা সপে দিয়ে বলবে, বিনিময়ে আমাকে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দাও। কান খুলে শুনে নাও সুন্দরী! আমি আমার আত্মাকে নাপাক হতে দেবো না। তুমি বলেছে, আমি তোমার ন্যায় রূপসী মেয়ে আর দেখিনি। এ কথা বলে তুমি আমার যৌনতাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করো না।

তাবরিজের বক্তব্যের এতোই ক্রিয়া যে, মেয়েটির মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সে অবাক ও বিহ্বল দৃষ্টিতে তাবরিজের প্রতি তাকিয়ে থাকে। তাবরিজের বক্তব্যে মেয়েটি পরিষ্কার নিষ্ঠা ও প্রত্যয় আঁচ করছে।

আগুনের কাছে চলে আসো- তাবরিজ আগুনের উপর ধরে জামাটা শুকাতে শুকাতে বললো। মেয়েটি উঠে এমন ধারায় আগুনের কাছে এসে বসে, যেনো তার মধ্যে আদেশ অমান্য করার কোনই সাহস নেই। তাবরিজ জামার এক কোণটা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-ধরো, আগুনের উপর ধরে রাখো। নিজে অপর প্রান্তটা ধরে জামাটা আগুনের উপর নাড়াতে লাগলো। মেয়েটির জামাও ভেজা। তাবরিজ বললো শুকানোর পর এটি পরিধান করে তোমারটা এভাবে শুকিয়ে নিও।

না- মেয়েটি সন্ত্রস্ত হয়ে বললো- আমি গায়ের পোশাক খুলবো না।

 গায়ের চামড়াটাও খুলে আগুনে রাখবে- তাবরিজ বললো- আমার কর্তব্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো না মেয়ে। আমি তোমাকে প্রমাণ দেব, মুসলমানরা জংলী, নাকি খৃস্টানরা। আমি জানি, তুমি কতটুকু পবিত্র। এখন তুমি আমার আশ্রয়ে রয়েছে। আমি তোমাকে কোন শক্ত কথা বলতে পারি না। তুমি নারী। অসহায় নারীর প্রতি হাত না বাড়ানো আমার ধর্মের নির্দেশ।

আচ্ছা, আমাকে তুমি ঢেউয়ের মধ্য থেকে কীভাবে তুলে এনেছো? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে- অন্যরা কি নদী পার হতে পেরেছে।

তাবরিজ মেয়েটিকে ঘটনার বিস্তারিত শুনিয়ে বললো, অন্যদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

এতোক্ষণে মেয়েটির ভয় সম্পূর্ণ দূর না হলেও কিছুটা কমেছে। শারীরিক অবস্থাও ভালো হতে চলেছে। তাবরিজের প্রশ্নের জবাবে সে বললো আমি আমার বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে হেস যাচ্ছিলাম। যে এলাকায় আমাদের বাড়ি, সেটি মুসলিম শাসিত। মুসলমানদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা হেমূল চলে যাচ্ছি। ওখানে আমাদের প্রভাবশালী আত্মীয় আছে।

মেয়েটি তার পিতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে।

***

কাফেলার সব কজন সদস্য নদীর গ্রাস থেকে বেরিয়ে গেছে। একেকজন একেক স্থানে গিয়ে কূলে ভিড়েছে। তারা পরস্পর ডাকাডাকি করে একত্রিত হতে শুরু করেছে।

এখন তারা সবাই একত্র। নেই শুধু তাবরিজ আর খৃস্টান মেয়েটি। ময়েটি যে উটের পিঠে আরোহী ছিলো, সেটির কোন সন্ধান পানা যায়নি। তারিজের ঘোড়া কূলে এসে ঠেকেছে। ঘোড়টি দূরে এক স্থানে পঁড়িয়ে আছে। কাফেলার এক সদস্য ঘোড়াটা ধরে নিয়ে আসে। সকলে নিশ্চিত হয়ে যায়, হেসের সুদর্শন ও তাগড়া যুবক ঘোড়া থেকে পড়ে ভুলে গেছে।

তাবরিজ উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ। তদুপরি মুসলমান। তার জন্য কারো দুঃখ নেই। দুঃখ মেয়েটির জন্য। মেয়েটির বৃদ্ধ পিতা, দুজন খৃষ্টান ও এক ইহুদী মেয়েটির জন্য মুষড়ে পড়েছে। তারা সম্মুখপানে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে নদীর কূলে কূলে অনুসন্ধান করার কথা ভাবছে। অন্যরা অভিমত ব্যক্ত করে, প্রয়োজন নেই। মেয়েটি ডুবেই গেছে। তবু চারজন ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে নদীর কূল ঘেঁষে চলতে শুরু করে। সে সময়ে তাবরিজ মেয়েটিকে নদী থেকে তুলে উপরে এনে পেটের পানি বের করছিলো। ওখানে নদীর বাঁক ছিলো। ছিলো টিলাও। সে কারণে মেয়েটির অনুসন্ধানকারীরা তাবরিজ ও মেয়েটিকে দেখতে পায়নি। বাঁক ঘুরে যখন তারা ওখানে পৌঁছে, ততক্ষণে তাবরিজ মেয়েটিকে পিঠে করে গুহায় পৌঁছে গেছে। অনুসন্ধানকারীরা সম্মুখে চলে যায়। তারপর সূর্য অস্ত্র গেলে তারা মেয়েটির আশা ত্যাগ করে ব্যথিত মনে হেসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

এমন মূল্যবান একটা মেয়েকে হারিয়ে ফেলার দায়ে যদি তারা আমাদেরকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়, তাহলে মনে করবো, তারা অনেক দয়ালু হয়ে গেছে- বৃদ্ধ বললো- মেয়েটি কীভাবে ডুবলো জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবো?

বলবো, আমরা প্রবল তরঙ্গের মধ্যে নিপতিত হলে মেয়েটি খামখেয়ালী করেছে- ইহুদী বললো- আমাদের কথা অমান্য করতে গিয়ে তার এই পরিণতি ঘটেছে। জিদ ধরে বললো, আমি আলাদা উটে চড়ে একাকী নদী পার হবো। হঠাৎ একটি ঢেউ এসে তাকে আমাদের থেকে দূরে নিয়ে গেছে। তারই হঠকারিতার কারণে আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি।

যা খুশি বলো- এক খৃস্টান বললো- আমাদের এ বিচ্যুতি যদি ক্ষমাও করে দেয়া হয়, তবুও কি অনুতাপের কথা নয় যে, এমন একটা দক্ষ ও কর্মঠ মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে? অন্য মেয়ে এনে তার স্থান পূরণ করতে এক মাসেরও বেশী সময় লেগে যাবে।

আমি কতবার পরামর্শ দিয়েছিলো, এ কাজে আমাদের দুটি মেয়ের প্রয়োজন- বৃদ্ধ বললো- হেমসের মুসলমানরা উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই, তারা যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে, তা সাময়িক কিংবা আবেগতাড়িত নয়। আমি গভীরভাবে তাদের প্রশিক্ষণ লক্ষ্য করেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এটা গেরিলা অপারেশন ও কমান্ডো হামলার নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ। আমি তাদের চারজন প্রশিক্ষক দেখেছি। তাদের কায়রো কিংবা দামেশক থেকে পাঠানো হয়েছে। লোকগুলোকে কমান্ডো মনে হচ্ছে।

তারা যদি আমাদের শাসনাধীন হতো, তাহলে আমরা দেখে নিতাম কীভাবে তারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এক খৃষ্টান বললো।

তুমি কি মনে করো এখানে তারা প্রশিক্ষণ পরিপূর্ণ করতে পারবে? ইহুদী বললো- আমরা তাদের মাঝে আপসে সংঘাত বাঁধিয়ে দেবো।

এ লক্ষ্যেই তো আমি মেয়েটিকে দামেশক থেকে এনেছিলাম- বৃদ্ধ বললো- হেসে অরাজকতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আমি এই মেয়েটির কথা বললাম। তারা বললো, তুমি মেয়েটির পিতা হয়ে যাও এবং তাকে নিয়ে হেমস চলে যাও। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, বসতি স্থানান্তর করছি।

লোকগুলো রাতের অন্ধকারে পথ চলছে আর নিজেদের গোপন মিশন সম্পর্কে কথা বলছে। বৃদ্ধ খৃষ্টানদের অভিজ্ঞ গুপ্তচর এবং ঈমান ও চেতনা বিধ্বংসের ওস্তাদ। সে তার সঙ্গীদের বললো- মুসলমান সর্বত্র সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। দামেশকে নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী মেয়েদেরকে যথারীতি সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। আমি সবখানে মুসলমানদের মাঝে এই জোশ দেখতে পেয়েছি। তবে হেল্স ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলো আমাদের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব অঞ্চলে মুসলিম গেরিলাদের ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ না পাওয়া উচিত। আমি জানতে পেরেছি, এটি সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি গোপন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা সফল না হওয়া দরকার।

হেমস সীমান্তবর্তী শহর- ইহুদী বললো- যদি মুসলমানরা এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে, তাহলে আমাদের জন্য বিপজ্জনক হবে। এখানকার মুসলমাদেরকে বরং সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে তাদেরকে দলে ভিড়িয়ে নেয়া প্রয়োজন।

এটা সম্ভব নয়- বৃদ্ধ বললো- আমাকে অবহিত করা হয়েছে, আমাদের লোকেরা নাকি অনেক গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা তাতে কান দিচ্ছে না। আমাকে এও বলা হয়েছে, তাদের খতীব নাকি বেশ প্রভাবশালী মানুষ এবং মুসলমানদের সামরিক প্রশিক্ষণ তারই নির্দেশনা ও পরিকল্পনা মোতাবেক চলছে। মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর এখন আমার হেমস না যাওয়াই উচিত ছিলো। কিন্তু তারপরও এই জন্য যাবো যে, দেখতে হবে খতীব লোকটি কে এবং সে আলেম নাকি কোন সেনা কমান্ডার। আমাদেরকে হেসের খৃস্টান ও ইহুদী পরিবারগুলো থেকে দু একটি মেয়ে সংগ্রহ করতে হবে, যারা এই মিশনে আমাদের সাহায্য করবে। মেয়েদের কাজ কী, তা তোমাদের জানা আছে।

আমি তোমাদেরকে দামেশকেও বলেছিলাম, এখানকার মুসলমানরা পাকা ঈমানদার- এক খৃস্টান বললো- এ পর্যন্ত আমরা তাদের একজনকেও ক্রয় করতে পারিনি।

আমি সারা জীবন সেই নদীটির উপর অভিশম্পাত করবো, যে আমাদের দিরাকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে।

***

আমার নাম দিরা- তবিরিজের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি বললো আমরা গরীব মানুষ। মুসলমানরা দামেশকে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে দিয়েছে। খোদা যেনো গরীবের মেয়েকে রূপ না দেন। বড় বড় আমীরগণ আমাকে ক্রয় করার চেষ্টা করেছে। একজন আমাকে অপহরণ করতে চেয়েছিলো। আমার পিতা আমাকে কাজীর নিকট নিয়ে যান। তিনি আমার ফরিয়াদ শুনেন এবং আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেখানকার শাসন মুসলমানদের হাতে। আমাদের ভয় দূর হয়নি। আমার পিতা দামেশক থেকে বের হয়ে যাওয়াই শ্রেয় ভাবলেন। হেসে আমাদের আত্মীয় আছে। এখন আমরা তাদের নিকট যাচ্ছিলাম। জানি না আব্বা বেঁচে আছেন কিনা। আচ্ছা, তুমি কি একটি অসহায় নিরাশ্রয় নারীর উপর দয়া করবে না?

রাত অতিক্রান্ত হতে থাকে। বৃদ্ধ খৃষ্টান- দি যাকে পিতা বলে দাবি করছে- সঙ্গীদেরসহ বহুদূর এগিয়ে গেছে।

আমার জামা শুকিয়ে গেছে- তাবরিজ জামাটা দিরার প্রতি ছুঁড়ে দিয়ে বললো- আমি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছি। ওঠো, গায়ের ভেজা জামাটা খুলে এটা পরে নাও। লম্বা আছে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে যাবে। পরে নিজেরটা শুকিয়ে বদলে ফেলল।

তোমার হাতে আমি অসহায়- দিরা ক্ষীণ কণ্ঠে বললো- শিকার মারার আগে তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তুমি আমার সঙ্গে সেই পশুসুলভ আচরণ করো না।

বলছি, ভেজা পোশাকটা খুলে ফেলল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেই তাবরিজ বাইরে বেরিয়ে যায়।

তাবরিজ আড়ালে চলে গেছে। সেখান থেকে দিরাকে দেখা যায় না। দিরা সামান্য এগিয়ে গিয়ে তাকায়। তাবরিজ গুহার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুহার অভ্যন্তরে প্রজ্বলমান আগুন এতো বেশী জ্বলছে যে, আলোটা তাবরিজের পিঠে গিয়ে পড়েছে।

দিরা বুকের ভেতর হাত ঢুকায়। ভেতরে কোমরের সঙ্গে কাপড় বাঁধা আছে। সেই বস্ত্রের মধ্যে খঞ্জর লুকানো। খঞ্জরটা বের করে দিরা পা টিপে টিপে সম্মুখে এগিয়ে যায়। তাবরিজ সম্পূর্ণ অসতর্ক দাঁড়িয়ে আছে। দিরা তার থেকে মাত্র এক পা দূরে। মেয়েটি খঞ্জরটা ডানদিকে নিয়ে তাবরিজের ডান পাজরে সেঁধিয়ে দেয়ার লক্ষে আঘাত হানে। তাবরিজ বিদ্যুতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিদার ডান হাতটা ধরে ফেলে এতো জোরে মোচড় দেয় যে, দিরা ঘুরে যায় এবং তার হাত থেকে খঞ্জরটা পড়ে যায়।

তাবরিজ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার কয়েক পা সামনেই আরেকটি টিলা। আগুন তাবরিজের পেছনে। তাবরিজ সম্মুখের টিলার গায়ে নিজের ছায়া দেখতে পায়। মেয়েটি আঘাত হানতে উদ্যত হলে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ছায়ার ডান বাহু ডানে বিস্তৃত হয়ে যাওয়া মাত্র তাবরিজ খঞ্জরের ছায়াটা স্পষ্ট দেখে ফেলে। দিরা তাবরিজের পাজরে আঘাত হেনে তার পেটটা ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলো। ছায়ার নড়াচড়া দেখে তাবরিজ পেছন দিকে ঘুরে গিয়ে মেয়েটির হাতের কব্জি ধরে ফেলে। মেয়েটির হাত থেকে খঞ্জরটি তুলে নেয়। তাবরিজ খঞ্জরের আগাটা মেয়েটির দিকে তাক করে ধরলে মেয়েটি হাঁটু গেড়ে তার সম্মুখে বসে পড়ে এবং হাতজোড় করে অনুনয় করতে শুরু করে যা বলবে শুনবো; আমাকে খুন করো না।

অন্য কোন কথা নেই। বলছি গায়ের ভেজা পোশাকটা খুলে আমার জামাটা পরে নাও- তাবরিজ আদেশের ভঙ্গিতে বললো- দেখেছে তো, আমাকে খুন করার সাধ্য তোমার নেই। আমার চোখ তো সামনেই আছে, পেছনে নয়। তাহলে তোমার আক্রমণটা দেখলাম কীভাবে? আত্মার চোখে দেখেছি। ইচ্ছা করলে কি আমি আমার সামনে তোমাকে পোশাক খোলাতে পারি না। কিন্তু আমি তোমাকে উলঙ্গ দেখতে চাই না। নাও, কাপড়টা বদলে নাও।

তাবরিজ পুনরায় বেরিয়ে গিয়ে পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। দিরা গুহার এক কোণে চলে যায়। তাড়াতাড়ি করে গায়ের ফ্রকটা খুলে। তারপর সেমিজটাও খুলে ফেলে তাবরিজের জামাটা পরিধান করে। দিরার সর্বাঙ্গ ঢেকে যায়। এবার তাবরিজকে ডাক দিয়ে বললো- কই এসে পড়ো।

তাবরিজ ভেতরে প্রবেশ করে। দিরার ফ্রকটা আগুনের উপর ধরে শুকাতে শুরু করে। দিরা লুকিয়ে লুকিয়ে তাবরিজকে দেখতে থাকে। তাবরিজ কোন কথা বলছে না। তার নীরবতা দিরাকে অস্থির করে তুলছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই তাগড়া সুদর্শন যুবকটা তাকে ক্ষমা করবে। এখন তো খঞ্জর তার হাতে।

তাবরিজ চুপচাপ দিরার পোশাক শুকাতে থাকে। শুকিয়ে গেলে ফ্রকটা মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, পরে নাও। বলেই তাবরিজ গুহা থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটি আবারও সভয়ে পোশাক পরিবর্তন করে তাবরিজকে ভেতরে ডেকে আনে।

তোমার কাছেই রাখো- তাবরিজ খঞ্জরটা দির দিকে ছুঁড়ে মেরে বললো- ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে রওনা হবো।

তুমি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছো- দিরা বললো- নাকি তুমি অনুভূতিহীন ও মৃত মানুষ?

আমি অনুভূতিহীন মৃত কিনা প্রমাণ করবো তোমার বাহিনীর সামনে তাবরিজ উত্তর দেয়- আমার অন্তরে তোমার বিরুদ্ধে কোন শত্রুতা নেই। আমি তোমাদের সেই সম্রাটদের শত্রু, যারা আমার মাতৃভূমি দখল করতে এসেছে এবং যারা আমাদের প্রথম কেবলা দখল করে আছে।

তোমাদের ভুল তথ্য দিয়ে উত্তেজিত করা হচ্ছে- দিরা বললো- তুমি অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষ। যাকে তুমি প্রথম কেবলা বলছে, ওটা ইহুদীদের উপাসনালয়। ওটা হাইকেলে সুলায়মানী। সালাহুদ্দীন আইউবী তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে চাচ্ছেন। তিনি তোমাদের ন্যায় সহজ-সরল যুবকদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে বলে বেড়াচ্ছেন- ওটা প্রথম কেবলা, ওটা মসজিদ।

আমরা আমাদের খতীব ছাড়া আর কারো কথা শুনে না- তাবরিজ বললো- তুমি শুয়ে পড়ো। আমি তোমার কোন কথা শুনবো না।

আমার ঘুম আসছে না- দিরা বললো- তোমাকে আমার ভয় লাগছে। আচ্ছা, তোমাদের খতীব হেমসেরই লোক, নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছেন?

তিনি হেমসেরই নাগরিক- তাবরিজ উত্তর দেয় এবং জামাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

দিরার গুপ্তচরবৃত্তি এবং চরিত্র ধ্বংসের প্রশিক্ষণ আছে। দামেশকে তাকে এ লক্ষ্যেই পাঠানো হয়েছিলো। আর এখনো একই উদ্দেশ্যে হেমস যাচ্ছিলো। মেয়েটি হেমসের খতীব এবং সেখানকার মুসলমানদের তথ্য নেয়ার জন্য অনেক প্রশ্ন করছে। কিন্তু তাতে তাবরিজের কোন আগ্রহ নেই। এসব আলাপচারিতায় অনীহা প্রকাশ করে চলেছে সে। মেয়েটি চেষ্টা করছে, যাতে চোখে ঘুম না আসে। কিন্তু এক সময় তার দুচোখের পাতা বুজে আসে। দিরা ঘুমিয়ে পড়ে।

***

সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দিরা চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে ধড়মড় করে উঠে বসে। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দিরা অর্ধ মুদিত ফ্যাল ফ্যাল চোখে এদিক-ওদিক তাকায়। দেখে, তাবরিজ বিশেষ এক ভঙ্গিতে নিজ মাথাটা মাটিতে ঠেকিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বসে। আবার মাথা মাটিতে ঠেকায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যায়।

তাবরিজ ফজর নামায আদায় করছে। তাবরিজের নামায পড়ার দৃশ্যটাই দেখে ফেলেছে খৃস্টান মেয়ে দিরা।

দিরা পরিধানের পোশাকটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নেয়। রাতে না ঘুমানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিদ্রা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ঘুম ভাঙ্গার পর সর্বপ্রথম তাবরিজের কথা মনে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে গাটা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু মেয়েটি বুঝতে পারে, যে অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেই অবস্থায়ই জেগেছে। সব ঠিক আছে তার।

মেয়েটি তাবরিজকে মহান আল্লাহর দরবারে সেজদাবনত দেখতে পায়। পরিস্থিতিটা আগাগোড়া স্বপ্ন বলে মনে হলো তার কাছে। দিরা জানতো, মুসলমান জংলী জাতি। কিন্তু তাবরিজের মতো একজন সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকের তার মতো এক রূপসী যুবতীর প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপই নেই! এ কেমন জংলীপনা! তাবরিজকে স্বপ্ন জগতের মানুষই মনে হচ্ছে তার।

দিরা পবিত্র মেয়ে নয়। শৈশব থেকেই তাকে চরিত্রহীনতা ও শয়তানি কর্মের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। রূপ এবং দেহের আকর্ষণকে জাদুর ন্যায় ক্রিয়াশীল বানানোর বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। যৌবনে পদার্পন করা পর্যন্ত যৌনতা আর অসচ্চরিত্রতা স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু মানব স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন মানুষের সৃষ্টিগত মৌলিকত্ব ধ্বংস করা যায় না। মানুষ অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার যতোই গভীরে নিমজ্জিত হোক, কোন দিন সুযোগ পেলে তার আসল রূপটা ভেসে ওঠে। মানুষ সুপথে ফিরে আসে। দিরা যেভাবে মৃত্যুর মুখে চলে গিয়েছিলো, সেখান থেকে উদ্ধার লাভের পর এখন তার মন-মস্তিষ্কে নতুন ভাবনা জাগতে শুরু করেছে। মেয়েটি জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে নিরাপদে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু ভয় এখনো কাটেনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তাবরিজ ভীতি। এই মুসলমান যুবকটির ব্যাপারে তার অন্য কোন ভয় নেই। একটিই ভয়, লোকটি যদি যাযাবর কিংবা বেদুইন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে কারো নিকট বিক্রি করে দেবে। মেয়েটি বিক্রি হওয়ার পরের কষ্টদায়ক জীবনের ভয় করছে।

রাত কেটে গেছে। তাবরিজ মেয়েটির এই মনোহারী দেহটার প্রতি কামনার দৃষ্টিতে একবারের জন্যও তাকায়নি। মেয়েটি অবচেতনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তারপরও তাবরিজ তার থেকে দূরে থেকেছে। সকালে যখন পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হয়, ততোক্ষণে মেয়েটির সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। বিদূরিত হয়েছে তাবরিজের ভয়ও। রাত, নাগাদ মেয়েটি তাবরিজকে বেরসিক, অনুভূতিহীন ও মৃতপ্রাণ কাপুরুষ মনে করছিলো। কিন্তু লোকটাকে তার গভীর দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে হলো। তাবরিজের ঠোঁট দুটি নড়ছে। দিরার মনে হচ্ছে, লোকটা সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছে। তার তাবরিজের একটি উক্তি মনে পড়ে যায় আল্লাহ কেবল তাদেরকে সাহায্য করেন, যাদের নিয়ত ও আত্মা পবিত্র।

তৎক্ষণাৎ দিরার মনে পড়ে যায়, তার নিয়ত তো পবিত্র নয়। তারিজের জাতির জন্য সে আপাদমস্তক একটি প্রতারণা। মেয়েটি রাতে এই সিদ্ধান্ত ঠিক করে রেখেছিলো, নিজেকে তাবরিজের হাতে তুলে দিয়ে বলবে, তুমি যা খুশি করো, বিনিময়ে আমাকে হেস পৌঁছিয়ে দাও।

আর আত্মা? দিরা জীবনে এই প্রথমবার অনুভব করলো, তার দেহ আত্মা থেকে বঞ্চিত। আর থেকেও যদি থাকে, তা অপরাধ-অশ্লীলতার আবর্জনায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু মরে যায়নি। দিরার উপর দিয়ে যে ঝড় অতিক্রান্ত হয়েছে, তাতে তার আত্মা জেগে ওঠেছে, যা এখন তাকে লজ্জিত করে চলছে। তাবরিজের দেহাবয়বটা এখন তার কাছে অন্য রকম মনে হচ্ছে। তাবরিজকে ফেরেশতা বলে মন হচ্ছে। ফেরেশতা না হলে খোদার সঙ্গে কথা বলতে পারে নাকি। দিরার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। অশ্রু যতোই ঝরছে, মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বটা তাবরিজের অস্তিত্বের মধ্যে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

তাবরিজ দুআর জন্য হাত উত্তোলন করে। বোধ হয় সে ভুলে গেছে, গুহায় আরো একজন মানুষ আছে। তাবরিজ কণ্ঠ ছেড়ে দিয়ে দুআ করছে —

মহান আল্লাহ! তুমি আমাকে সব রকম পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকার হিম্মত দান করো। আমাকে তুমি এমন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্র দান করো, যেনো তোমার এই সুন্দর আমানতটা কোন প্রকার খেয়ানত ব্যতীত গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দিতে পারি। তোমার এই বান্দা দুর্বল, অসহায়। তুমি আমাকে শয়তানের মোকাবেলা করার সাহস দান করো।

তাবরিজ আকাশের ফেরেশতা নয়- মাটির মানুষ, রক্ত-মাংসের মানুষ। লোকটি আল্লাহর নিকট মানবীয় দুর্বলতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। দুআ শেষ করে মুখে হাত বুলিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়। দিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির গণ্ড বেয়ে অশ্রু ঝরছে। তাবরিজ কিছুক্ষণ মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিও মূর্তির ন্যায় তার প্রতি তাকিয়ে আছে।

বাইরে যাও- তাবরিজ দিরাকে বললো- ওদিকে পরিস্কার পানির ঝরনা আছে। হাত-মুখ ধুয়ে এসো। তাবরিজ নিজের মাথায় জড়ানো মোটা কাপড়ের হাত দুয়েক লম্বা রোমালটা নামিয়ে দিরাকে দিতে দিতে বললো- ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে মাথার চুলগুলোও ঝেড়ে-মুছে নাও। জলোচ্ছাসে নিপতিত হওয়ার আগে তুমি যে অবস্থায় ছিলে, আমি ঠিক সেইরূপ তেমাকে তোমার স্বজনদের হাতে পৌঁছিয়ে দিতে চাই।

দিরা তাৰরিজের হাত থেকে রোমালটা নিয়ে এমনভাবে বেরিয়ে যায়, যেনো একজন বোবা ও বধির শিশু কারো ইঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করেছে। তাবরিজের সঙ্গে যে খাদ্য-পানীয় ছিলো, তা ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা ছিলো। এখন তার কাছে খাওয়ার কিছুই নেই।

তাবরিজ দিরার অপেক্ষায় বসে আছে।

***

দিরা হাত-মুখ ধুয়ে আসে। দেখে তাবরিজ হঠাৎ চমকে ওঠে, যেনো নতুন কাউকে দেখছে। এতোক্ষণ দিরার মাথার চুলগুলো মাটিমাখা ও এলোমেলো ছিলো। আপন রূপটা তার চাপা ছিলো। ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হওয়ার পর এখন মেয়েটির আসল রূপ ফুটে উঠেছে। এখন তাবরিজ তাকে চিনতেই পারছে না। এমন যাদুকরী চুল মাথায় নিয়ে ফিরছে দিরা, যা তাবরিজ কল্পনাও করেনি। এমন রূপ অতীতে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি তাবরিজ। দিরার সুদর্শন মুখাবয়ব এবং মনোহরী আখিযুগল তাবরিজকে হতবাক করে দেয়। তাবরিজ সেই তাবৱিজের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে, যে খানিক আগে আল্লাহর দরবারে দণ্ডায়মান ছিলো। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে বললো- খাওয়ার কিছু নেই। আমাদের উপোস করেই সফর করতে হবে। চলো রওনা হই। বলেই তাবরিজ দাঁড়াতে উদ্যত হয়।

দিরা তার কাঁধে হাত রেখে বললো- একটু বসো, আমি তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, কিছু জানতে চাই।

সারাটা রাত তাবরিজ মেয়েটির জন্য মহা এক আতঙ্ক হয়ে ছিলো। কিন্তু এখন তার মানসিক অবস্থা এমন, যেনো মেয়েটি তার উপর জয়ী হয়ে গেছে। তাবরিজ কিছু না বলে উঠতে উঠতে বসে পড়ে।

আচ্ছা, তুমি যখন খোদার সঙ্গে কথা বলছিলে, তখন কি তুমি খোদাকে দেখতে পাচ্ছিলে? দিরার প্রথম প্রশ্ন।

আমি আল্লাহকে দেখি না- তাবরিজ উত্তর দেয়- আমি আলেম নই, তাই বলতে পারবো না দেখা না দিয়েই আল্লাহ কীভাবে নিজের অস্তিত্বের অনুভূতি দান করে থাকেন। আমি শুধু এটুকু জানি, আল্লাহ আমার কথা ও দুআ শোনেন।

তুমি কি নিশ্চিত, যিনি আমাকে উত্তাল নদীর নিমজ্জন থেকে রক্ষা করেছেন, তিনি খোদা-ই ছিলেন? দিরা জিজ্ঞেস করে।

খতীব আমাদেরকে বলেছেন, আত্মা যদি পবিত্র হয়, তাহলে আল্লাহ যে কোন বিপদে-সমস্যায় সাহায্য করে থাকেন- তাবরিজ উত্তর দেয়- আমি যদি এই নিয়তে তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম যে, তুমি অতিশয় রূপসী মেয়ে। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে ডুবে মরতাম।

কিন্তু আমার আত্মা তো পবিত্র নয়- দিরা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো আল্লাহ আমাকে কেন সাহায্য করেছেন? তিনি আমাকে কেন নিমজ্জন থেকে রক্ষা করেছেন?

হেমস গিয়ে খতীবকে জিজ্ঞেস করবো- তাবরিজ উত্তর দেয়- আমার অতো জ্ঞান নেই।

আচ্ছা, তুমি আমার দেহটাকে এভাবে উপেক্ষা করলে কেন? দিরা জিজ্ঞেস করে।

একজন নারী হিসেবে তুমি আমার যে আচরণের ভয়ে শঙ্কিত ছিলে, আমি যদি তা-ই করতাম, তাহলে আমি তোমার খঞ্জর থেকে রক্ষা পেতাম না– তাবরিজ উত্তর দেয়- আমার হাতে তুমি আল্লাহর আমানত। আর… তাবরিজ চুপ হয়ে যায়। খানিক পর অলক্ষ্যে বলে ওঠে- তুমি অতিশয় সুন্দর এক আমানত। চলে রওনা হই।

তাবরিজ অস্থির মনে উঠে দাঁড়াতে উদ্যত হয়। দিরা তাকে ধরে রাখে। তাবরিজ বললো- আমাকে নিজের কাছে বসিয়ে রেখো না দিরা। এমন কঠিন পরীক্ষায় আমাকে ফেলো না বোন! তুমি আমাকে মহান আল্লাহর সমীপে অবনত থাকতে দাও।

তোমার আল্লাহর কসম- দিরা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললো- আমাকেও তোমার আল্লাহর সম্মুখে অবনতমস্তক হওয়ার যোগ্য বানিয়ে দাও। তুমি অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। তুমি খোদার দূত।

দিরার চোখে অশ্রু এসে যায়।

তুমি কাঁদছো কেন? তাবরিজ জিজ্ঞেস করে।

আমি একটি পাপী মেয়ে- দিরা উত্তর দেয়- খোদা আমার প্রতি রুষ্ঠ। আমার উট যখন আমাকেই স্রোতের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো, তখনও আমার খোদার কথা মনে আসেনি। আমি মনে করতাম, দেহটাই সব। এই দেহটা আমাকে রক্ষা করতে হবে। পরে নদীর গ্রাস থেকে রক্ষা করে তুমি যখন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলে, তখনও আমার একই ভাবনা ছিলো, তোমার থেকে আমার দেহটা রক্ষা করতে হবে। নিজের শরীরটা রক্ষা করার লক্ষ্যেই আমি তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। আমি নদীর তরঙ্গ থেকেও বেঁচে গেলাম, তোমারু থেকেও রক্ষা পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোমার ইবাদত আর দুআ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমাকে রক্ষাকারী শক্তি অন্য কিছু ছিলো। বলল, সেই শক্তিটা কী? কোথায়?

এটি আল্লাহর শক্তি- তাবরিজ উত্তর দেয়- এটি আত্মার পবিত্রতার সুফল।

আমার গোটা জীবন একটি পাপ।

স্পষ্ট বুঝিয়ে বলো- তাবরিজ বললো- তুমি কি নর্তকি? আমীর উজিদের কাছে থাকো? আমি শুনেছি, এ ধরনের মেয়েরা খুবই সুন্দরী হয়ে থাকে। তোমার মতো রূপসী মেয়ে আমি কখনো দেখিনি।

দিরার মুখে কথা নেই। চোখে অশ্রু নেমে এসেছে। হঠাৎ জায়গা থেকে সরে তাবরিজের ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। কিন্তু তাবরিজ দূরে সরে বসে। দিরা বললো- আমাকে ভয় পাচ্ছো? ঝড়-জুলোচ্ছাসের ভীতি এখনো আমাকে তাড়া করে ফিরছে। তুমি আমাকে তোমার কাছে রাখ।

না- তাবরিজ এক বিস্ময়কর হাসি হেসে বললো- তুমি আমার এতো কাছে এসো না। আমি বিচ্যুৎ হয়ে যাবো।

দেখছে তো আমি কতো বড় গুনাহগার- দিরা বললো- তুমি এ কারণে আমার থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছে যে, তুমি বিচ্যুৎ হয়ে যাবে। আমি বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছি।

দিরা বুঝে ফেলে তাবরিজের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা আছে; কিন্তু ভাবনায় গভীরতা নেই। ইচ্ছে করলে নতুন যে কোন ছছে তাকে গড়ে নেয়া সম্ভব। দিরা তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে শুরু করে। বললো- আমি যদি বলি, আসো আমরা সারা জীবনের সফরে একত্রে থাকি, তাহলে তুমি কী উত্তর দেবে?

তাবরিজ মেয়েটির মুখ পানে তাকায়। মুচকি একটা হাসি দিয়ে খানিকটা উজ্জীবিতের ন্যায় বললো- চলো, রওনা হই। সূর্য উঠে গেছে। দেরি করলে সমস্যায় পড়বে।

দিরা নিজের অস্তিত্বে একটি বিপ্লব অনুভব করে, যার তাৎপর্য সে অলোভাবে বুঝতে পারছে না। উঠে তাবরিজের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আয় দৃষ্টি যতোটা না পথের দিকে, তার চেয়ে বেশি তাবরিজের প্রতি। গত রাতে তাবরিজকে খুন করে হেস পালিয়ে যাওয়ার চিন্তায় বিভোর ছিলো। কিন্তু এখন তারত পথ চলতে ভালো লাগছে না। যতো দীর্ঘ সময় সম্ভব ভাবরিজের সঙ্গে থাকার বাসনা বিরাজ করছে তার মনে। চলতে চলতে একবার ভাবরিজের হাত চেপে ধরে দি বললো- আস্তে হাঁটো।

না, আমাদের দ্রুত হাঁটা উচিত- তাবরিজ বললো- অন্যথায় আরো একটি রাত এসে পড়বে।

আসতে দাও- দিরা বললো- আমি দ্রুত হাঁটতে পারছি না।

এখন তাড়াতাড়ি হাঁটো- তাবরিজ বললো-পরে হাঁটতে না পারলে পিঠে করে নেবো।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই আল-আদিল খৃস্টান সম্রাট বউইনকে হামাতের বাইরে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেছিলেন, যার ফলে কাউইনের বাহিনী দিশা হারিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পেছনে সরে গিয়েছিলো। সেই যুদ্ধের কাহিনী আপনারা পাঠ করেছেন। বন্ডইন অনেক করে তার বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে একত্রিত করেছিলেন। খুঁজে-পেতে জীবিত সৈন্যদের একত্রিত করার পর সম্রাট বুঝতে পারেন, তার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এখন বেঁচে আছে অর্ধেকের সামান্য বেশি সৈন্য। তিনি দামেশক দখল করতে এসেছিলেন। তার বিপুলসংখ্যক সৈন্য আল-আদিলের কমান্ডো আক্রমণে মারা গেছে। পিছপা হয়ে পালাবার পর অনেকে বিভিন্ন উপত্যকা ও বিজন অঞ্চলে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের কতিপয়কে মুসলমান রাখাল, যাযাবর ও গ্রামবাসীরা মেরে ফেলেছে এবং তাদের অস্ত্র-শস্ত্র ও ঘোড়াগুলো কেড়ে নিয়েছে।

বল্ডউইন যখন তার অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে হামাত থেকে দূরে এক স্থানে একত্রিত করেন, তখন তাকে অবহিত করা হলো, আপনার ফৌজের যেসব সৈন্য ও কমান্ডার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো, তারা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। পরাজয়ের কারণে বল্ডউইনের অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। বল্ডউইন বেজায় ক্ষুব্ধ। এই সংবাদে তার ক্ষোভ আরো বেড়ে গেছে। তিনি নির্দেশ প্রদান করেন, যেখানেই মুসলমানদের কোন বসতি চোখে পড়বে, লুট করো, যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে আসে এবং কাজ সমাধা করে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দাও।

নির্দেশমতো বল্ডউইনের বাহিনী পুনঃপ্রস্তুতি গ্রহণ করার লক্ষ্যে পিছপা হতে গিয়ে পথের মুসলিম বসতিগুলো একের পর এক ধ্বংস করে ফেলে।

এই বাহিনীটি এখন হেমস থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে! বল্ডউইন চেষ্টা করছেন, কোন খৃষ্টান ম্রাট তার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন, যাতে তিনি আল-আদিল থেকে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারেন এবং নিজের শাসন ক্ষমতাকে যাকে তিনি ক্রুশের শাসন বলে দাবি করতেন- দামেশক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় বায়িত করতে পারেন। এ সুবাদেই তিনি অপর এক খৃষ্টান সম্রাট রেজিনান্ট অফ শাইতুনের নিকট গিয়েছিলেন।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর দিরার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে বৃদ্ধ খৃষ্টান ও তার সঙ্গীরা রাতভর পথ চলতে থাকে এবং সকাল বেলা হেমস গিয়ে পৌঁছে। কাফেলার অন্যান্য লোকেরাও পৌঁছে গেছে। তাদের একজনও হেমসের অধিবাসী নয়। তাদের গন্তব্য আরো সম্মুখে। তাবরিজের শোস্তাদের সঙ্গে। তারা ঘোড়াটা এক মসজিদের ইমামের হাতে তুলে দিয়ে বললো, এটির মালিক হেমসের এক ব্যক্তি। লোকটি জলস্রোতে ঘোড়া থেকে পড়ে ডুবে গেছে এবং ঘোড়াটা তীরে উঠে এসেছে। ইমাম সাহেব ঘোড়াটা বুঝে নেন। কিছুক্ষণ পরই জানা গেলো ঘোড়াটা কার। ঘোড়া তাবরিজের ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়া হলে ঘরে মাতম শুরু হয়ে যায়।

হেসে এক ইহুদী ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিলো। অত্যন্ত ধনশালী মানুষ। যে লোকটি নিজেকে দিরার পিতা বলে দাবি করতো, সে সঙ্গীদেরসহ এই ইহুদীর ঘরে উপবিষ্ট। সে সংবাদ জানায়, দিরা পানিতে ডুবে মারা গেছে।

শুনে সকলে আক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু আক্ষেপে তো আর তাদের সমস্যার সমাধান হবে না। বৃদ্ধ ইহুদী মেজবানকে জিজ্ঞেস করে, হেমসের মুসলমানদের তৎপরতা ও পরিকল্পনা কী?

খুবই ভয়ঙ্কর- মেজবান উত্তর দেয় তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এই নগরী সুলতান আইউবীর কমান্ডো সেনাদের আস্তানায় পরিণত হতে যাচ্ছে। মুসলমানদের বড় মসজিদের খতীব শুধু খতীবই নয়, ফৌজের কমান্ডার এবং প্রশিক্ষক মনে হচ্ছে।

আচ্ছা, নোকটাকে খুন করে ফেললে কী লাভ হবে? বৃদ্ধ খৃস্টান জিজ্ঞেস করে।

কোন লাভ হবে না-ইহুদী উত্তর দেয়- বরং ক্ষতি হবে। আমাদের উপর মুসলমানদের সন্দেহ সৃষ্টি হবে এবং তারা আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেবে। জানেন তো, এই নগরী মুসলমানদের শাসনাধীন এলাকা।

এখানকার ইহুদী-খৃষ্টান পরিবারগুলোর মেয়েরা কি কিছু করতে পারে না? বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে।

আপনি জানেন, এ কাজের জন্য কী পরিমাণ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়ে থাকে- মেজবান উত্তর দেয়- আমাদের কোন মেয়েই এতোটা চতুর নয়।

সে যাই হোক, এখানকার মুসলমানরা সামরিক প্রশিক্ষণ না গ্রহণ করুক, এটা জরুরী বলে স্বীকার করেন তো? বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে।

আপনি কী নির্দেশ নিয়ে এসেছেন? মেজবান জিজ্ঞেস করে। নির্দেশ খুবই স্পষ্ট- বৃদ্ধ জবাব দেয়- রামাল্লায় সালাহুদ্দীন আইউবীর পরাজয় হয়েছে। কিন্তু এই পরাজয় তার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। ইতিমধ্যে তিনি সব সামলে নিয়েছেন। তিনি ফৌজ প্রস্তুত করে ফেলেছেন। আমাদের গোয়েন্দারা কায়রো থেকে যে খবরাখবর প্রেরণ করছে, তা সুখকর নয়। সালাহুদ্দীন আইউবী কায়রো ত্যাগ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো জানা যায়নি তিনি কোন্ দিকে রওনা হবেন এবং কোথায় আক্রমণ চালাবেন। এদিকে তার ভাই আল-আদিল দামেশক থেকে সাহায্য পেয়ে গেছেন। তিনি সম্রাট বল্ডউইনকে এমনভাবে পরাজিত করেছেন যে, এতো সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি পুনর্গঠিত হতে পারেননি। আপনি তো জানেন, সালাহুদ্দীন আইউবী গেরিলা ও কমান্ডো যুদ্ধ লড়ে থাকেন। আমাদের ফৌজের রসদ তার থেকে নিরাপদ থাকে না। হেমসের মুসলমানরা যদি তার গেরিলাদের জন্য আস্তানা করে দেয়, তাহলে এরা রসদ ও অগ্রসরমান সেনাদলের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

এমনি পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের দ্বারা মুসলমানদের মাঝে ফাটল ধরানো এবং তাদের চরিত্র ধ্বংসের কৌশল ব্যর্থ প্রমাণিত হবে। এসব কাজের জন্য স্থান-কাল স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। সব ক্ষেত্রে সকল কৌশল কার্যকরী হয় না। আমি আমাদের সেই অফিসারদের জন্য বিস্ময় প্রকাশ করছি, যারা এখানে একটি মেয়েকে প্রেরণ করেছিলেন।

তাহলে কী করা যায়?

একদম ভিনিস- মেজবান তার ডান হাতটা তরবারীর ন্যায় ডানে-বাঁয়ে দুলিয়ে বললো- পুরো নগরটাকে মানুষজনসহ একদম নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তখন আমরাও এখানে থাকতে পারবো না। আমরা প্রথমে আমাদের স্ত্রী সন্তান ও সহায়-সম্পদ এখান থেকে সরিয়ে ফেললো। আমি আশা করি, খৃষ্টান ম্রাট আমাদেরকে অন্যত্র পুনর্বাসিত হওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন এবং আমাদের আর্থিক ক্ষতি পূরণ করে দেবেন। আমি ইহুদী। হাইকেলে সুলাইমানীর জন্য আমি আমার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত আছি।

কিন্তু নগরী ধ্বংসের ব্যবস্থা কী হবে?-বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে- এ কাজের জন্য তো সেনাবাহিনীর প্রয়োজন।

ফৌজ আছে- ইহুদী বললো- সম্রাট বউইনের ফৌজের অবস্থান এখান থেকে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাইল দূরে। আপনি সম্ভবত জানেন না, এই ফৌজ পিছপা হওয়ার পথের সমস্ত মুসলিম বসতি ধ্বংশ করে দিয়েছে। তাদের দ্বারা হেস ধ্বংস করানো যাবে। আমি আই রওনা হয়ে যায় এবং সম্রাট বুউইনকে বলবো, আমাদের এই নগরীটি তার বাহিনীর জন্য কতটুকু বিপজ্জনক।

নগরী ধ্বংস করা তো উদ্দেশ্য নয়- বৃদ্ধ লো- আমাদের উদ্দেশ্য তো হচ্ছে এখানকার একজন মুসলমানকেও বেঁচে থাকতে দেয়া যাবে না।

আর মেয়েদেরকে ফৌজ তুলে নিয়ে যাবে।

সকলে একমত হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, মেজবান ইহুদী আজ রাতেই সম্রাট জ্বল্টইনে ছাউনীর উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

ইহুদী রওনা হয়ে যাওয়ান্ন সময় এক অশ্বারোহীকে নগরীতে প্রবেশ করতে দেখে। লোকটি অপরিচিত। খতীবের বাড়িটি দেখা যাচ্ছে। আরোহী খতীবে বাড়ির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সে ঘোড়র পিঠ থেকে নেমে খতীবের গৃহের দরজায় করাঘাত করে। খতীব বেরিয়ে এসে লোকটির সঙ্গে হাত মেলান এবং তাকে ভেতরে নিয়ে যান।

লোকটি কায়রোর দূত। ইহুদী বললো।

ঈশার নামাযের পর। মুন্সল্পীরা চলে গেছে। পাঁচ-ছয়জন লোক খতীবের কাছে বসে আছে। তাদের মধ্যে অশ্বারোহী আগন্তুকও আছে। খতীব একজনকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করতে বললেন।

আমার বন্ধুগণ!- খতীব বললেন- আমাদের এই বন্ধু আল-আদিলের তফ থেকে সংবাদ নিয়ে এসেছে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অতি তাড়াতাড়ি কায়রো থেকে রওনা হবেন। আপনারা সবাই সৈনিক এবং গেরিলা অপারেশনে দক্ষ। আপনাদের করণীয় কী বলা প্রয়োজন মনে করি না। প্রশিক্ষণ ও মহড়া জোরদার করুন। আল-আদিল এ সংবাদও প্রেরণ করেছেন যে, খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইনের যে বাহিনী হামাত থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো, তারা আমাদের কাছাকাছি কোথাও ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে। তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তাদের গতিবিধির সংবাদ আল-আদিলকে পৌঁছাতে হবে। তিনি নির্দেশ প্রদান করেছেন, আমরা খৃস্টামদের এই বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালাবো এবং কমান্ডো অভিযান অব্যাহত রাখবো, যাতে তারা স্থির হয়ে বসতে না পারে। সেই সঙ্গে আল-আদিল এ-ও বলেছেন, এই বাহিনী মুসলমানদের বহু জনপদ ধ্বংস করে দিয়েছে। সৈন্য স্বল্পতার কারণে তিনি তাদের ধাওয়া করতে পারেননি। তিনি আরো বলেছেন, বন্ডউইনের বাহিনী যদি পেছনে নিজ অঞ্চলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাদের খাটাবে না। আমি আশঙ্কা করছি, লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে হেমস নগরীকে ধ্বংস করে দেবে। তিনি আমাদেরকে প্রশিক্ষণ ও মহড়া জোরদার করার আদেশ প্রদান করেছেন। হতে পারে, সুলতান আইউবী কোনদিকে আক্রমণ চালালে বল্ডউইন তাদের উপর পেছন কিংবা পার্শ্ব থেকে আক্রমণ করবেন। তখন আমাদেরকে বল্ডউইনের পেছন অংশের উপর গেরিলা হামলা চালাতে হবে এবং তাকে এখানেই আটকে রাখতে হবে।

খতীব এক ব্যক্তিকে বল্ডউইনের ফৌজের অবস্থান ও গতিবিধি দেখে আসার জন্য প্রেরণ করেছেন। এ সময় তাবরিজ ও দিরা নগরীতে প্রবেশ করে। তাবরিজ দিরাকে পিঠে করে নিয়ে এসেছে। পথে পানি পাওয়া গিয়েছিলো বটে, কিন্তু খাবার জোটেনি। দিরা খৃস্টানদের রাজকন্যা। পায়ে হেঁটে সফর করায় অভ্যস্ত নয়। তাবরিজ রাতের জন্য কোথাও বিরতি দিতে চাচ্ছিলো না। তাই দিরাকে পিঠে তুলে নিয়ে অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করে এসেছে। নিজ গৃহের সম্মুখে এসে তাবরিজ দিরাকে পিঠ থেকে নামিয়ে তাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের লোকদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাবরিজ জীবিত আছে। তার ঘোড়াটা আগেই ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাবরিজ পরিজনকে ঘটনার বিস্তারিত শোনায়।

দিরার জানা আছে, তার গন্তব্য ইহুদী ব্যবসায়ীর ঘর। মেয়েটি এখনই সেখানে পৌঁছে যেতে চাচ্ছে। পিতার চিন্তায় উদগ্রীব সে। তার আশা, পিতা হয়তো জীবনে রক্ষা পেয়ে পৌঁছে গেছেন। তাবরিজের ইহুদীর ঘর জানা ছিলো। সে মেয়েটিকে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য রওনা হয়।

দুজনে পথ চলছে। অন্ধকার পথ। এক স্থানে দিরা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় এবং তাবরিজকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটি তাবরিজের প্রতি হৃদতা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করে।

আমাদের গন্তব্য আলাদা- তোমার এক আমার আরেক- দিরা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো- কিন্তু কোন এক দোরাস্তায় আমরা আবার মিলিত হবো। আমি আমার আত্মার সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিলাম। এখন তা পেয়ে গেছি। ভালোবাসা কী বস্তু আমি জানতাম না। তুমি আমাকে তা দিয়েছে। আমি হৃদয়ে তোমার স্মরণ নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি আমাকে ভুলে যাবে।

না দিরা!-তাবরিজের মানসিক অবস্থা দিরার চেয়েও বেশি নড়বড়ে। বলতে শুরু করে- আমি তোমাকে ভুলতে পারবো না। তুমি এতোদিন যাবত একটি মিথ্যা ধর্মের অনুসরণ করে এসেছে। অবশিষ্ট জীবন ইসলামের ছায়াতলে কাটিয়ে দাও। আমি তোমার অপেক্ষা করবো। আমার হৃদয়ে এখন অন্য কোন নারী স্থান পাবে না। এখন তো তুমি এই নগরীতেই অবস্থান করবে। সময়-সুযোগ মতো সাক্ষাৎ হবে। তবে সাবধান থাকতে হবে কেউ যেনো না দেখে ফেলে।

তাবরিজ আমানতের খেয়ানত করেনি। সফরকালেই মেয়েটি তার অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিলো। পরে সে তাবরিজের হৃদয়কে জয় করে নিয়েছিলো। এখন তাবরিজ মেয়েটিকে ইহুদী ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।

তাবরিজ দিরাকে নিয়ে ইহুদীর গৃহে পৌঁছে যায়। দিরার পিতা দাবিদার বৃদ্ধ খৃস্টান ইহুদীর ঘরে বসা। দিরাকে দেখে লোকটি আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ উঠে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ইহুদী ব্যবসায়ী ঘরে ছিলো না। সিদ্ধান্ত অনুসারে সে সম্রাট বল্ডউইনের সেনা ছাউনির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। বৃদ্ধের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তাবরিজ দিরাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে আর বিলম্ব করেনি। সেখান থেকেই মসজিদে চলে আসে। মসজিদের দরজা বন্ধ ছিলো। তাবরিজ বিশেষ পদ্ধতিতে দরজায় করাঘাত করে। দরজা খুলে গেলে তাবরিজ ভেতরে ঢুকে পড়ে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এক বছরের মধ্যে বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেন। তিনি বেশি অপেক্ষা করলেন না। যে রাতে, হেসের ইহুদী ব্যবসায়ী সেনা অভিযান পরিচালনা করে হেসের মুসলমানদের ধ্বংস করার আবেদন নিয়ে সম্রাট বল্ডউইনের নিকট রওনা হয়ে গিয়েছিলো, সে রাতেই সুলতান আইউবীর ফৌজ কায়রো ত্যাগ করে। তার গন্তব্য দামেশক। বাহিনী দ্রুত এগিয়ে চলছে। সুলতান আইউবী সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। তৎকালের ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান আইউবী দামে অবস্থান করে সেখানকার পরিস্থিতি, বিশ্বাসঘাতক ও কুচক্রীদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে এবং তাদের প্রতিহত করে আল-আদিলের সঙ্গে মিলিত হতে চাচ্ছেন। তারপর সেখান থেকে সামরিক অভিযান শুরু করবেন। কিন্তু পথেই তিনি রাস্তা পরিবর্তন করে ফেলেন।

পথে ইযযুদ্দীনের এক দূতের সঙ্গে আইউবীর সাক্ষাৎ ঘটে। দূত আইউবীর নামে কায়রোতে বার্তা নিয়ে যাচ্ছিলো। সুলতান যে কায়রো থেকে রওনা হয়ে এসেছেন, সে জানে না। মধ্যপথে সে একটি বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে। পতাকা দেখে বুঝে ফেলে এটি সুলতান আইউবীর ফৌজ। দূত বাহিনীর সম্মুখে চলে যায়। সুলতান আইউবী বাহিনীর সমুখ অংশে অবস্থান করছেন।

দূত ইযযুদ্দীনের পত্রখানা সুলতান আইউবীর হাতে দেয়। ইযযুদ্দীন নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের উপদেষ্টাদের একজন। পদমর্যাদায় একজন আমীরের সমান। লোকটি নিষ্ঠাবান ঈমানদার লোক। তাই তার প্রতি জঙ্গীর, বিশেষ দৃষ্টি ছিলো। জঙ্গী তাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করতেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে সুলতান জঙ্গী তাকে হাব প্রদেশে কারাহেসার নামক একটি দুর্গ দান করে তার অধিপতি নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন। বেশকিছু অঞ্চল এই দুর্গের অধীনে ছিলো। ইবনে লাউনের প্রদেশটিও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যিনি খৃষ্টানদের সঙ্গে খৃস্টান আর মুসলমানদের সঙ্গে মুসলমান হয়ে যেতেন। খৃস্টানদের মদদে তিনি ইযযুদ্দীনের অঞ্চলে সীমান্তের উপর হানা দিতে শুরু করেন। ইযযুদ্দীন একাকী তার মোকাবেলায় পেরে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু হাল্ব ও মসুল থেকেও তিনি সাহায্য নিতে চাচ্ছিলেন না। কারণ, হাল্ব ও মসুলের শাসনকর্তা আল-মালিকুস সালিহ ও সাইফুদ্দীন প্রমুখ যখনই সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখন থেকেই তিনি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।

ইযযুদ্দীন সুলতান আইউবীর নিকট যে বার্তা প্রেরণ করেন, তার বিবরণ নিম্নরূপ

মহামান্য সুলতান! আপনার এবং সালতানাতে ইসলামিয়ার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার অফাদারী সম্পর্কে আপনার কোন সংশয় নেই বলেই আমার বিশ্বাস। আমি তালখালেদের দিক থেকে খৃস্টানদের পথ বন্ধ করে রেখেছি। সমস্ত অঞ্চল এবং অগ্রযাত্রার রাস্তা আমার কমান্ডো সেনাদের দৃষ্টিতে থাকছে। খৃস্টানরা আমাকে রাস্তা থেকে হঠানোর জন্য ইবনে লাউনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। আপনি জানেন, আমার সীমান্ত সেই অঞ্চলের সঙ্গে লাগোয়া, যেটি মূলত আর্মেনিয়ার এলাকা। আর্মেনীয়রা আমার সীমান্ত চৌকিগুলোর উপর আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমার সৈন্য কম। খৃস্টান ও আর্মেনীয়রা দুবার মূল্যবান উপঢৌকনসহ আমার নিকট দূত প্রেরণ করেছে। তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেন আমি তাদের জোটে যোগদান করি এবং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলে তারা আমাকে হামলার হুমকি দিয়েছে। আমার স্থলে অন্য কেউ হলে নিজের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে নিতো। জায়গাটা এতই দূরে যে, প্রয়োজন হলে কারো সাহায্য নিয়ে সময় মতো পৌঁছানো সম্ভব নয়। তথাপি আমি তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়ার পরিবর্তে তাদের হুমকিকে বরণ করে নিয়েছি। এই পদক্ষেপ আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে নিয়েছি। আমি আমার দুর্গ, অঞ্চল এবং সেই সঙ্গে নিজের জীবনটাও কুরবান করে দিতে প্রস্তুত আছি। তবু আমি খৃস্টানদের সঙ্গে জোট বাঁধবো না, কাফিরদের সঙ্গে হাত মেলাবো না। আমাকে নূরুদ্দীন জঙ্গীর আত্মার নিকট জবাবদিহি করতে হবে। আমাকে সেই লাখো শহীদের সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে, যারা প্রথম কেবলার জন্য জীবনদান করেছে। আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে আমার জানা নেই। আমি কেবল এটুকু জানি, রামাল্লার দুর্ঘটনার পর আপনি পুনর্গঠন ও অন্যান্য আয়োজন-প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আছেন। আমি এও জানি, মুহতারাম আল-মালিকুল আদিল আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না। আমি আপনাকে আমার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা আবশ্যক মনে করছি। আপনি যদি আদেশ করেন, তাহলে আমি আমার অঞ্চল ও কারাহের দুর্গের দখল ত্যাগ করে বাহিনীসহ আপনার নিকট চলে আসবে। অন্যথায় বলুন, আমি কী করবো। কোন মূল্যেই আমি ক্রুসেডার ও আর্মেনীয়দের সঙ্গে সমঝোতা করবো না।

সুলতান আইউবী বার্তাটি পাঠ করেন। তৎক্ষণাৎ সালার ও উপদেষ্টাদের তলব করেন। বার্তাটি পড়ে তাদের শোনান এবং নির্দেশ প্রদান করে সকলকে বিস্মিত করে দেন যে, রাস্তা পরিবর্তন করো। আমরা ইবনে লাউনের অঞ্চলে আক্রমণ করবো।

একনায়কের ন্যায় আদেশ করা সুলতানআইউবীর নীতি নয়। তিনি আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে কোন সামরিক অভিযান পরিচালনা করতেন না। কিন্তু এবারকার আদেশের পেছনে সমর কৌশলের পাশাপাশি আবেগও কার্যকর ছিলো।

কারাহেসার মুহতারাম ওস্তাদ নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্মৃতি- সুলতান আইউবী বললেন- আর ইযযুদ্দীনের ভাষায় আমি জঙ্গী মরহুমের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। আমি সেই লোকটিকে নিঃসঙ্গ ফেলে রাখতে পারি না, যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে একমত, যে আমাদের একই পথের অভিযাত্রী।

মহামান্য সুলতান!- এক সালার বললেন- আমরা যদি বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করি, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো।

বাস্তবতা হলো, আমাদেরকে সর্বাগ্রে দামেশক পৌঁছে সেখানকার পরিস্থিতি অনুধাবন করা আবশ্যক ছিলো- সুলতান আইউবী বললেন কিন্তু এখন যদি আমরা দামেশক চলে যাই, তাহলে ইবনে লাউন তালখালেদের উপর আক্রমণ করে বসবে এবং ইযযুদ্দীন তার হাতে পরাজয় বরণ করবে। সম্মুখে হাব। তোমরা আল-মালিকুস সালিহ এবং তার উপদেষ্টাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জালা। আমাদের সঙ্গে তারা যে চুক্তি করেছে, তা এখনো বহাল আছে কই; কিন্তু চুক্তি লোহা প্রীর নয় যে, ভাঙ্গা যাবে না। খৃস্টানদের সঙ্গে সমঝোতা করে দেয় পুরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া বিচিত্র নয়। আমি খৃস্টানদেরকে হার দখল করতে দেবো না, আমি ইযযুদ্দীনকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে রাখতে পারবো না।

কিছুক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, বাহিনী তালখালেদ অভিমুখেই এগিয়ে যাবে। সুলতান আইউৰী ইযযুদ্দীনের দূতকে মৌখিক বার্তা প্রদান করেন, ইষষুদ্দীমকে বলবে, তিনি যেনো ইবনে লাউনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের ফাঁদ পাতেন। বলবে, আপনি বন্ধুত্বের টোপ দিয়ে আলাপ-আলোচনার শীর্মে কালক্ষেপণ করুন। তাকে এই আশ্বাসও দিন যে, আমার বাহিনীকে আপনার হাতে তুলে দেবো। আমি আমার বাহিনীকে তালখালেদ অভিমুখে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।

দূত বিদায় নিয়ে চলে যায়।

***

খৃস্টান গুপ্তচররা সুলতান আইউবীর গতিবিধির প্রতি নজর রাখছে এবং খৃস্টানদের নিকট সংবাদ পৌঁছাচ্ছে। তারা রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের দুর্গ ও অঞ্চলগুলোর প্রতিরক্ষা সংহত করছে। তারা জানে, সুলতান আইউবীজ পদক্ষেপ-পরিকল্পনা সম্পর্কে আগাম কিছু বলা যায় না। খৃস্টাম হেডকোয়ার্টার যখন গোয়েন্দা মারফত সংবাদ পায়, সুলতান আইউবীর ফৌজ দামেশকের পথ ত্যাগ করে অন্যদিকে যাচ্ছে, তখন তাদের সেনাপতিরা বললো, আইউবী তার পরীক্ষিত ময়দানে যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন।

হেমসের ইহুদী ব্যবসায়ীযে হেমন্সকে ধ্বল করার জন্য সম্রাট বল্ডউইনের নিকট নিয়েছিলো। ফিরে এসেছে। বল্ডউইনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি তার খৃস্টান বন্ধুদের নিকট সাহায্যের আবেদন করতে গিয়েছেন। তার সেনাপতিরা ইহুদীকে বললো, আমরা সম্রাটের নির্দেশ ব্যতীত কিছু করতে পারি না। তবে কাজ হবে।

ইহুদী ফিরে আসার পর তাকে জানানো হলো, দিরা জীবিত ফিরে এসেছে এবং তাবরিজ নামক এক মুসলমান তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। খৃস্টান ও ইহুদীরা তাবরিজকে নগদ পুরস্কার পেশ করে। কিন্তু তাবরিজ এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, জামি আমার ব্য পালন করেছি।

ইহুদী ব্যবসায়ী দিরাকে অকর্মণ্য মনে করছে। কারণ, নগরী ধ্বংস করার আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, দিরাকে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দিরা চতুর মেয়ে। বললো, আমি খতীবকে ঘায়েল করবো এবং যেসব মুসলমান সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে, তাদের মাঝে ফাটল ধরাবো। সে আরো বললো, এখানকার মুসলমানদের পরিকল্পনা জ্ঞাত হওয়ার জন্য আমাকে প্রয়োজন।

দিরাকে হেসেই রেখে দেয়া হলো। কিন্তু কেউ জানে না, তার এই থাকার আগ্রহ একমাত্র তাবরিজের জন্য।

দিরা তাবরিজের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকে। রাতে নগরী থেকে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে এবং দীর্ঘসময় বসে থাকছে। দিরা উঁচু স্তরের একটি সুন্দরী খৃষ্টান মেয়ে। তার মোকাবেলায় তাবরিজের কোন মর্যাদাই নেই। দিরা আমীর-উজীর ও রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে বসবাস করার মতো মেয়ে। দামেশকে প্রশাসনের দুজন পদস্থ কর্মকর্তাকে সে তার অনুগত বানিয়ে ফেলেছিলো এবং তাদের দ্বারা এমন সব ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিলো, যার জন্য সুলতান আইউবীকে দামেশকের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়েছিলো। কিন্তু জলেসের ভীতি আর তাবরিজের চরিত্র তাকে এমন এক ধাক্কা দিয়েছে যে, মেয়েটির ব্যক্তি সত্ত্বায় আত্মা ও আবেগ জেগে ওঠেছে। দিরা তাবরিজের পূজা করতে শুরু করে দিয়েছে এবং তাবরিজ তার ভালবাসার জালে আটকা পড়েছে।

একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তাবরিজ- দিরা বলল- খতীব এবং অন্যান্য যারা তোমাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, তারা কোথা থেকে এসেছেন?

তাবরিজ উত্তর দিতে শুরু করলে দিরা বলে ওঠে- রাখো, ওসব বাদ দাও তাবরিজ! তাতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। যার যা খুশি করুক। এমন সুন্দর রাতটাকে আমি বুদ্ধের আলোচনা দ্বারা কলঙ্কিত করবো কেন!

দিরা দুমুখো চরিত্রের মেয়েতে পরিণত হয়ে যায়। যখন তাবরিজের সঙ্গে থাকে, তখন নিষ্পাপ ও পবিত্র মেয়ের রূপ ধারণ করে। তখন তার মনেই থাকে না সে গুপ্তচর। গুপ্তচরবৃত্তির মানসে তাবরিজকে খতীব ও তার সহযোগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেও শেষ পর্যন্ত তাবরিজকে জবাব দিতে বারণ করে দেয়। আবার এই দিরাই যখন ইহুদী ব্যবসায়ীর ঘরে গিয়ে বসে, তখন সে মুসলমানদের ধ্বংস সাধন বিষয়ে কথা বলে।

***

দেড়-দুই মাস সময় চলে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় দিরা তাবরিজের ঘরে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। কথার ফাঁকে দিরা তাবরিজকে বিশেষ ভঙ্গিতে ইশারা করে, যার মর্ম তাবরিজ বুঝে ফেলে। তাবরিজ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাঁঝের আঁধার গম্ভীর হওয়া মাত্র তাবরিজ তাদের সাক্ষাতের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যায়। দিরাও এসে পৌঁছে। দিরা তাবরিজকে নগরী থেকে দূরে নিয়ে যায়। মেয়েটি কেমন যেনো আতঙ্কিত। তাবরিজ তার ভীতির কারণ জানতে চায়। কিন্তু দিরা কোন উত্তর দেয় না। হঠাৎ একটি শব্দ তাদের কানে ভেসে আসে। কে যেন দিরাকে ডাকছে। তাবরিজ জিজ্ঞেস করে, কে. ডাকছে? দিরা সন্ত্রস্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, আমার লোকেরা আমাকে খুঁজছে। চলো, আরো দূরে চলে যাই। বলেই তাবরিজকে টেনে দ্রুতপায়ে আরো দূরে চলে যায়। দিরাকে কে যেন এখনও ডাকছে।

এসব ডাকাডাকিতে কান দিও না তো তাবরিজ!- দিরা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো- আমি যখন তোমার সঙ্গে থাকি, তখন অন্য কারো আওয়াজ শুনতে চাই না।

সম্মুখে ছোট-বড় অনেকগুলো টিলা। তাবরিজ খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে দিরার সঙ্গে হাঁটতে থাকে। দিরা এক স্থানে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে কারো শব্দ এসে পৌঁছাচ্ছে না। হঠাৎ তাবরিজ চমকে উঠে কান খাড়া করে বললো- কেমন একটা শোরগোলের মতো শোনা যাচ্ছে! তুমিও শুনতে চেষ্টা করো। মনে হচ্ছে, অনেক লোকজন একসাথে চীৎকার করছে আর ঘোড়া ছুটাছুটি করছে।

কিছু না, তোমার কান বাজছে- দিরা অট্রহাসি হেসে বললো বাতাসের তীব্র ঝাপ্টা টিলার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অতিক্রম করছে। এটা সেই বাতাসের শব্দ।

নিজের সুকোমল বাহু আর রেশমী চুলের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিরা তাবরিজের চোখ, কান ও বিবেক কজা করে নেয়। তাবরিজ দিরার ব্যাখ্যা মেনে নেয়, এই শব্দ বাতাসের, যা দূর থেকে আসা শোরগোলের ন্যায় শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তার জানা নেই, এই হৈ-হুঁল্লোড় তার অঞ্চলের মানুষদের এবং সেখানে সেই প্রলয় ঘটে গেছে, যা ইহুদী ব্যবসায়ী ঘটাতে চেয়েছিলো। ঘটনাটা দিরা জানে। এই প্রলয়ের শব্দ তাবরিজের কানে পৌঁছুক, দিরার তা কাম্য নয়।

প্রথমবার ফিরে আসার পর ইহুদী ব্যবসায়ী আবারো বল্ডউইনের নিকট গিয়েছিলো। হেমসের মুসলমানরা কী করছে এবং কিভাবে খৃস্টান বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, ইহুদী বল্ডউইনকে তা অবহিত করে আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করে। মুসলমান বল্ডউইনের প্রিয় শিকার। তিনি ইহুদীর প্ররোচনা ও প্রস্তাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তিনি ইহুদীকে দিনক্ষণ জানিয়ে দেন। তিনি বলে দেন, সে রাতে হেসের ইহুদী ও খৃস্টানরা যেন আগে-ভাগে এলাকা থেকে সরে যায়। কাজটা করবে তারা রাতে। দিনে এলাকা ত্যাগ করতে গেলে মুসলমানরা সন্দেহ করে ফেলবে, কিছু একটা সমস্যা আছে। ইহুদী ফিরে এসে যখন তার লোকদেরকে পরিকল্পনা জানালো, তখন দিরা বললো, আমি তাবরিজ এবং তার পরিবারকে রক্ষা করতে চাই।

আমরা একে ক্রুশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করবো।বৃদ্ধ খৃস্টান বললো।

সাপের বাচ্চাকে রক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইহুদী বললো।

এখানে মুসলমানদের দুটি পরিবার আছে, যাদের সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে- হেমসের এক খৃস্টান অধিবাসী বললো- কিন্তু আমি তাদেরকে রক্ষা করার কথা ভাবি না। আমি মুসলমানদের রক্ত চাই। কোন মুসলমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তারপরও সে আমার ধর্মের শত্রু।

যে লোকটি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে এনেছে, আমি তাকে বাঁচাতে চাই। দিরা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো।

আমরা তাকে এতো পরিমাণ পুরস্কার পেশ করেছিলাম, যা সে কখনো স্বপ্নেও দেখেনি- ইহুদী বললো- কিন্তু সে বললো, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। আমরা পুরস্কার পেশ করে আমাদের দায়িত্ব আদায় করেছি। এখন সে আমাদের শত্রু, আমরাও তার শত্রু।

আমি তাকে শত্রু মনে করি না- দিরা ঝাঝালো কণ্ঠে বললো- আমি এই একজন পুরুষ পেয়েছি, যে আমার দেহের প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হয়নি। তোমরা সকলে পাপী। তোমাদের মধ্যে একজন লোকও এমন আছে কি, আমার ব্যাপারে যার নিয়ত পরিচ্ছন্ন? আমার চোখে নিজের চেহারাটা দেখে জবাব দাও।

আচ্ছা, তুমি শুধু তাবরিজকে রক্ষা করো- ইহুদী বললো- কিন্তু বাঁচাবে কী করে? কী ঘটতে যাচ্ছে, যদি তুমি তাকে বলে দাও, তাহলে সে সকলকে বলে দেবে না? তুমি যদি তার পরিবারকে নগরী থেকে বেরিয়ে যেতে বলল, তাহলে কি তারা এর কারণ জিজ্ঞেস করবে না? তখন তুমি কী উত্তর দেবে? একজন মুসলমানকে উপকারের প্রতিদান দিতে গিয়ে তুমি সেই সকল মুসলমানকে সতর্ক করে দেবে, যারা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাকে আনাড়ি মনে করো না- দিরা বললো- আমি ক্রুশকে ধোঁকা দেবে না।

আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় দিরা তাবরিজের ঘরে গিয়ে তাকে বাইরে নিয়ে আসে। দিরা রাতে প্রায়ই কোথায় চলে যায়, তার লোকেরা জানে। তারা জানে, প্রেমের ধোঁকা দিয়ে দিরা তাবুরিজ থেকে তথ্য সগ্রহ করছে।

দিরা তাবরিজকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে নগরীর ইহুদী ও খৃস্টানরা পা টিপে টিপে বের হতে শুরু করে। তারা দিরার সন্ধানে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করে, যে তাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু দিরা তাবরিজকে নিয়ে দূরান্তে চলে যেতে থাকে। মেয়েটি তাবরিজকে এতোটুকু দূরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, যেখান থেকে নগরীর হৈহুল্লোড় শোনা যাবে না। দিরার অনুসন্ধানে বের হওয়া লোকটি নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সমগ্র নগরী। খৃস্টান বাহিনীর পদাতিক সৈন্যরা পা টিপে টিপে নগরীর একেবারে নিকটে এসে পৌঁছুলে পেছন থেকে অশ্বারোহীরাও এসে পড়ে। নগরীর মুসলমানরা গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। খৃস্টান বাহিনী হঠাৎ ঝড়ের ন্যায় আক্রমণ করে বসে। খৃস্টান সৈন্যদের হাতে মশাল। অধিক আলোর জন্য তারা দুতিনটি ঝুপড়িতে অগ্নি সংযোগ করে দেয়। খৃস্টান সৈন্যরা প্রাচীর টপকে মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে। অধিকাংশ মুসলমান সজাগ হওয়ার আগেই মারা যায়। যারা সময় মতো জাগ্রত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে সক্ষম হয়, তারা মোকারেলা করে। অনেক মেয়ে খৃস্টানদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করে। খৃস্টান অশ্বারোহীরা নগরীটি ঘেরাও করে রেখেছিলো। তারা কাউকে পালাতে দেখামাত্র বর্শা কিংবা তরবারীর শিকারে পরিণত করে।

এই সেই হট্টগোল ও ডাক-চীৎকার, যা তাবরিজ টিলার অভ্যন্তরে বসে এনেছিলো। তার গৃহটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ম্রাট বল্ডউইন মুসলমানদের এই বসতিটি অধিবাসীদেরসহ ধ্বংস করে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।

আজ তুমি আমাকে এতো দূর নিয়ে এসেছো কেন?- তাবরিজ দিরাকে জিজ্ঞেস করে- আজ তুমি কথা বলছো না কেন? তুমি সন্ত্রস্ত কেন?

কারণ, তুমি আমার সঙ্গ দেবে না- সুচতুর মেয়ে দিরা বললো- আমি তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল ফিরে আসবো।

কোথায়?

কেন, আমার উপর কি তোমার আস্থা নেই? দিরা তাবরিজকে উভয় বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে মুখটা তাবরিজের এতো নিকটে নিয়ে যায় যে, তার বিক্ষিপ্ত রেশমী চুলগুলো তাবরিজের গণ্ডদেশ ছুঁয়ে যায়। এই সেই চুল, গুহায় থাকাবস্থায় যাকে দেখে তাবরিজ যুগপৎ রোমাঞ্চ ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলো। এখন তো মেয়েটির ভালোবাসা তার হৃদয় জুড়ে বাসা বেঁধে বসেছে- আমরা আর কতোদিন চোরের ন্যায় এভাবে মিলিত হবো? এখন আর আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছি না। তোমার হৃদয়ে যদি আমার ভালোবাসা থাকে, তাহলে জিজ্ঞেস করো না আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। মনে করো, সেখানে গিয়ে উপনীত হবো, যেখানে আমাদের মাঝে ধর্মের দেয়াল অন্তরায় হবে না। তুমি পুরুষ। আমাকে দেখো, আমি অবলা নারী হয়ে তোমার ভালবাসার খাতিরে কত বড় ঝুঁকি বরণ করে নিচ্ছি।

দুর্বল মূলত তাবরিজ। দিরা তার বিবেকের উপর জয়ী হয়েছে। এখন তার প্রচেষ্টা তাবরিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে না যাক। দিরা জানে, ফিরে গিয়ে তাবরিজ তার ভিটায় ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষ আর স্বজনদের অগ্নিদগ্ধ লাশ ছাড়া আর কিছুই পাবে না। তখন লোকটা পাগল হয়ে যাবে। হয়তো সন্দেহের বশবর্তী হয়ে দিরাকে খুন করে ফেলবে। তাবরিজ দিরাকে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে স্বসম্মানে হেমস এনে পৌঁছানোর বিনিময়ে এবং ভালবাসার খাতিরে তাবরিজকে খৃস্টানদের হাতে নিহত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। এবার তাকে নিজ গৃহ এবং স্বজনদের ধ্বংস ও করুণ পরিণতি দেখার যন্ত্রণা থেকেও বাঁচাতে চায়।

মেয়েটি তাবরিজকে নিয়ে একদিকে হাঁটা দেয়। তাবরিজ তার সঙ্গে কথা বলে চলেছে, যেনো দিরা তাকে যাদু করেছে।

রাত পোহায়ে ভোর হলো। গোটা হেস নগরী একটি ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই নয়। এখানকার একজন মুসলমানও জীবিত নেই। বড় মসজিদের মিনারটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খতীব ও সঙ্গীরা কোন প্রকার মোকাবেলা ছাড়াই শহীদ হয়ে গেছেন। এতক্ষণে দিরা তাবরিজকে নিয়ে খৃস্টান বাহিনীর সেনা ছাউনির নিকট পৌঁছে গেছে। এবার তাবরিজের মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠেছে। দিরাকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো? দিরা চাপার জোরে তাবরিজকে বুঝ দিয়ে দেয়। তাবরিজকে একধারে দাঁড় করিয়ে দিরা এক কমান্ডারের সাথে কথা বলে। কমান্ডার তাকে একটি পথের নির্দেশনা প্রদান করে। দিরা তাবরিজকে নিয়ে সেদিকে চলে যায়।

দিরা সম্রাট বল্ডউইনের প্রাসাদোপম তাঁবুর নিকট গিয়ে পৌঁছে। রক্ষীরা অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে তাকে বল্ডউইনের তাঁবুতে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করে। তাবরিজকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে দিরা তাঁবুতে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর তাবরিজকেও তাবুতে ডেকে নেয়া হয়।

বল্ডউইন তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন- এই মেয়েটি তোমাকে সঙ্গে রাখতে চাচ্ছে। আমরা তার আবদার উপেক্ষা করতে পারি না। তোমার ভয় কিংবা সন্দেহ পোষণ করার কোন কারণ নেই।

আমি আমার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবো না। তাবরিজ বললো।

ধর্ম পরিবর্তন করতে তোমাকে কে বলেছে দিরা বললো।

তারপর কী হবে?- তাবরিজ জিজ্ঞেস করে- এখানে অবস্থান করে আমি কী করবো? আমাকে ফিরে যেতে দাও।

তাবরিজ!- দিরা নিজের প্রতি তাবরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার চোখে চোখ রেখে বললো- আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমিও সেখানে যাবো, যেখানে তোমাকে যেতে হবে।

তাবরিজ কিছুই বুঝতে পারলো না।

***

ইযুদ্দীনের দূত সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জবাব নিয়ে ইযযুদ্দীনের নিকট পৌঁছে গেছে। সুলতান আইউবীর নির্দেশনা মোতাবেক ইম্যুদ্দীন ইবনে লাউনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে এবং সালাহ বিন্দ আইউবীকে ধোকা দেবো। তিলি ইবনে লাউনকে এমন এক সবুজ বাগিচা প্রদর্শন করেন, যেনো ইবনে লাউন তার ফাঁদে পড়ে যায়। পরক্ষণেই ইবনে লাউন ইযযুদ্দীনের সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে করাহের এসে হাজির হয়। কারাহের একটি উচ্চ ও সবুজ-শ্যামল অঞ্চল, যার দর্শনে ইবনে লাউনের চেহারায় আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।

দিন কয়েক পর সুলতান আইউবী বাহিনী নিয়ে কারাহেসারের সন্নিকটে এসে ছাউনি ফেলেন। বাহিনী, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কিন্তু তিনি বিশ্রাম নিয়ে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। এই আশঙ্কাও ছিলো যে, আক্রমণে বিলম্ব করলে ইবনে লাউন বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে যাবে। সুলতান আইউবীর ধারণা, ইবনে লাউনের সঙ্গে তাঁর কঠিন মোকাবেলা হবে। এই আশঙ্কার ভিত্তিতেই তিনি হাবের বাহিনীকেও ডেকে এনেছেন। এরূপ পরিস্থিতিতে সহযোগিতা করবেন বলে সুলতান আইউবীর সঙ্গে আল মালিকুস সালিহের চুক্তি ছিলো।

মধ্য রাতের খানিক পর সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে আক্রমণের জন্য রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। আর্মেনীয়দের চৌকিগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত এবং কোন্ চৌকিতে কতোজন করে সৈন্য আছে, সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত সেসব তথ্য জেনে নিয়েছেন। সেনাসংখ্যা যতোই হোক না কেন তারা সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়ে আছে। ইযয়ুদ্দীনের পক্ষ থেকে আক্রমণের কোন আশঙ্কাই তাদের ছিলো না এবং সুলতান আইউবীর এতো নীরবে সেখানে পৌঁছে যাওয়া ছিলো তাদের কল্পনার অতীত।

আইউবীর এই আক্রমণ ছিলো তিনতরফা। হামলাকারী প্রতিটি গ্রুপের সঙ্গে ইযযুদ্দীনের গঠন করা গাইড ছিলো। যে গ্রুপটি কৃষ্ণসাগরের দিক থেকে আক্রমণ করেছিলো, সুলতান আইউবী ছিলেন তাদের সঙ্গে।

কৃষ্ণসাগর ইবনে লাউনের রাজ্যের সীমান্ত। ইবনে লাউন তার উপর নৌকার পুল তৈরি করে রেখেছেন। নদীর কূলে আর্মেনীয়দের দুর্গ মুখাযাতুল আহ্যানের অবস্থান। ইবনে লাউন সেই দুর্গেই অবস্থান করছেন। এই দুর্গটি জয় করতে পারলে সমগ্র এলাকার জয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। সে কারণেই সুলতান আইউবী নিজের বাহিনীর এই গ্রুপের সঙ্গে থাকেন। এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুলতান আইউবীর ভ্রাতুস্পুত্র ফররুখ শাহ, ফিনি বীরযোহ্মা ও যুদ্ধাভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। অপর দুটি গ্রুপ চৌকিগুলোর উপর আক্রমণ করে দুশমনের সৈন্যদেরকে হতাহত ও বন্দী করে ফেলে এবং চৌকিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য কয়েকটি জনতিতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সুলতান আইউবীর জানবীজ সৈন্যরা যখন দড়ি বেয়ে দুর্গের প্রাচীরের উপর উঠে যায় এবং মিজানিকের সাহায্যে ভারি ভারি পাথর নিক্ষেপ করে দুর্গের দরজা ভেঙ্গে ফেলে, তখন ইবনে লাউনের চোখ খোলে। দুর্গে বাহিনী ঘুমিয়ে ছিলো। টের পেয়ে জাগ্রত হয়ে ইবনে লাউন দেীড়ে দুর্গের একটি মিনারের উপর উঠে যান। তিনি দূরে আগুনের শিখা দেখতে পান। কী ঘটছে এবং তার করণীয় কী, ভাবতে না ভাবতে সুলতান আইউবীর একদল জানবাজ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার রক্ষীরা যথাসাধ্য মোকাবেলা করে অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আইউবীর সৈন্যরা ইবনে লাউনকে বন্দী করে ফেলে।

ভোরে সূর্যোদয়ের আগে ইবনে লাউনকে সুলতান আইউবীর সম্মুখে দাঁড় করানো হয়। সুলতান দুর্গটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার আদেশ প্রদান করেন। এ কাজের জন্য তার এই বাহিনী যথেষ্ট ছিলো না। ইযযুদ্দীনও সুলতানের সঙ্গে আছেন। সুলতান আইউবীর পরামর্শ মোতাবেক ইবনে লাউন চতুর্দিকে এই নির্দেশসহ দূত প্রেরণ করেন, যেনো সকল সৈন্য অস্ত্র সমর্পণ করে দুর্গের নিকটে এসে জড়ো হয়। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী ইবনে লাউনের সঙ্গে সন্ধির শর্তাবলী ঠিক করে নেন। একটি শর্ত হলো, ইবনে লাউন তার অর্ধেক বাহিনীকে সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দেবেন। আরেকটি হলো, ইবনে লাউন সুলতান আইউবীকে বাৎসরিক কর প্রদান করবেন। এরূপ আরো কতিপয় শর্তের ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়, যা ইবনে লাউনকে একজন অথর্ব শাসকে পরিণত করে।

ইবনে লাউনের বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে দুর্গের নিকট এসে সমবেত হয়। সুলতান আইউবী তাদের আদেশ করেন, দুৰ্গটা এমনভাবে ধ্বংস করে দাও, যেনো এখানে দুর্গের কোন চিহ্ন না থাকে। পরাজিত বাহিনীটি সঙ্গে সঙ্গে দুর্গ ধ্বংসের কাজ শুরু করে দেয় এবং সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে মাসাফা নামক একটি পল্লীর নিকট নিয়ে যান। তিনি হাবের বাহিনীকে ফেরত পাঠিয়ে দেন এবং নিজ বাহিনীকে বিশ্রামের জন্য দীর্ঘ সময় প্রদান করেন। ইবনে লাউনের যে অর্ধেক বাহিনীকে নিয়েছিলেন, তাকে তিনি ইযুদ্দীনকে দিয়ে দেন। কিন্তু সুলতান আইউবীর জানা ছিলো না, তার বাহিনীর ছাউনি যে পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত, তার ভেতরে, ও চূড়ায় বল্ডউইনের বাহিনী এসে পৌঁছেছে এবং তার উপর ব্যাঘ্রের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। সুলতান ইিউবী সেই এলাকাটিতে খোঁজ-খবর নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। সেখানে কোন শত্রু বাহিনীর আগমন ঘটতে পারে, তা তাঁর ধারণা ছিলো না।

প্রায় সকল ঐতিহাসিক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, সুলতান আইউবী ইযুদ্দীনের পয়গামের ভিত্তিতে কেন নিজের এতো বিশাল পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ইবনে লাউনের ন্যায় একজন অগুরুত্বপূর্ণ শাসকের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করলেন! সে যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছেন বটে; কিন্তু যে পরিমাণ সময় ও সৈন্য নষ্ট হয়েছে, তার মূল্যও অনেক ছিলো। আরনল নামক এক ঐতিহাসিক লিখেছেন, সুলতান আইউবী আশপাশের সমস্যাগুলোকে দূর করতে চাচ্ছিলেন। তৎকালের ইতিহাসবেত্তাগণ যাদের মধ্যে আসাদুল আসাদী উল্লেখ্যযোগ্য লিখেছেন, ইযযুদ্দীনের বার্তা পাঠ করে সুলতান আইউবী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।

মোটকথা, সমর বিশেষজ্ঞরা সুলতান আইউবীর এই অভিযানকে যৌক্তিক বলে মেনে নেননি। তারা লিখেছেন, সুলতান আইউবী জানতেন, নিকটেই কোথাও ম্রাট বল্ডউইনের ফৌজ অবস্থান করছে, যারা তার উপর অতর্কিত আক্রমণ করে বসতে পারে। সুলতান আইউবীর ফৌজ যখন পর্বতমালার পাদদেশে ছাউনি স্থাপন করছিলো, ঠিক তখন বল্ডউইন তার বাহিনীকে যুদ্ধ বিন্যাসে পাহাড়ের অভ্যন্তরে ও উপরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ এর জন্যও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, বল্ডউইন সময়মতো আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু কোন ঐতিহাসিকই বলতে পারেননি, এটা তার রাজকীয় নির্বুদ্ধিতা নাকি অপারগতা ছিলো। তিনি যদি তখনই আক্রমণ করতেন, তাহলে সুলতান আইউবীর সেই পরিণতিই ঘটতো, যা রামাল্লায় ঘটেছিলো- পরাজয় আর পিছুহটা।

***

এখানে ছাউনি স্থাপনের পরও সুলতান আইউবী জানতে পারলেন না, ম্রাট বল্ডউইন তার মাথার উপর বসে পঁাঁতে ধার দিচ্ছেন। উপর থেকে বল্ডউইনের পর্যবেক্ষকরা সুলতান আইউবীর তাবুর প্রতি নজর রাখছে এবং বল্ডউইনকে আইউবী বাহিনীর গতিবিধির সংবাদ অবহিত করছে। সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ব্যবস্থার দুর্বলতার এটিই বোধ হয় প্রথম ঘটনা।

তাবরিজও আইউবীর এই বাহিনীর সঙ্গে আছে। দিরা এখনো বলেনি তাকে সঙ্গে করে কেন নিয়ে এসেছে। মেয়েটি সম্ভবত তাকে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে গুপ্তচর বানাতে চাচ্ছে। তার মধ্যে দুটি চরিত্র সমানভাবে কাজ করছে- এক. কুশের অফাদারি। দুই. তাবরিজের ভালবাসা। তাবরিজকে নিয়ে বল্ডউইনের কোন ভাবনা না থাকলেও দিরার প্রতি তার দুর্বলতা রয়েছে। দিরা অতিশয় রূপসী মেয়ে। একদিন দিরা বল্ডউইনকে বললো, আমাকে সম্মুখের ছাউনিতে পাঠিয়ে দিন। কিন্তু বল্ডউইন তাকে ধরে রাখেন।

একদিন বল্ডউইনের গোয়েন্দারা সংবাদ প্রদান করে, সুলতান আইউবীর ফৌজ তালখালেদ অভিমুখে রওনা হয়েছে। বল্ডউইনের কল্পনায় ছিলো না, সুলতান আইউবী ইবনে লাইনের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বাহিনীকে মাসাফার পার্বত্য অঞ্চল অভিমুখে রওনা হওয়ার আদেশ প্রদান করেন। তার পরিকল্পনা হলো, তিনি সুলতান আইউবীকে এই পার্বত্য অঞ্চলে টেনে এনে লড়াবেন। এই পরিকল্পনা অনুসারেই তিনি তার সৈন্যদের পাহাড়ের উপযুক্ত এলাকা এবং গোপন স্থানে ছড়িয়ে দেন। আউইবীর জন্য বিশাল এক ফাঁদ পাতেন বল্ডউইন।

বল্ডউইনের এই আদেশ শুনে দিরা বললো, আমি আপনার নিকট আশ্রয় নিতে এসেছিলাম। তাবরিজের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিরা অবহিত করেছিলো, কেন সে তাবরিজকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। এখন যখন বল্ডউইন যুদ্ধ করার জন্য যাচ্ছেন, তো দিরার তার সঙ্গে থাকায় কোন লাভ নেই। কিন্তু বল্ডউইন দিরাকে ছাড়তে নারাজ।

আমার কাছে মেয়ের অভাব নেই- বল্ডউইন বললেন- কিন্তু তুমিই প্রথম নারী, যে আমার হৃদয়টাকে জয় করে নিয়েছে। তুমি কাছে থাকলে আমার আত্মা শান্তি পায়। তুমি আরো কদিন আমার কাছে থাকো।

দিরা তার সম্রাটদের ভালভাবেই জানে। বল্ডউইনের উদ্দেশ্য বুঝা তার পক্ষে কঠিন নয়। সে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়, বিষয়টা যদি আত্মার শান্তি হয়ে থাকে, তাহলে আমি তা সেই মুসলিম যুবকের নিকট থেকেই লাভ করছি, যার গোটা পরিবারকে হত্যা করিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ফিরছি। জানি না তার পরিজনকে হত্যা করিয়ে এবং সেই সংবাদ তার থেকে গোপন রেখে আমি যে পাপ করেছি, আমার হৃদয় আমার থেকে তার প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে আদায় করবে।

তোমারও আত্মা আছে?- বল্ডউইন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন তোমার মন আছে? মুসলিম আমীরদের সঙ্গে রাত্রি যাপনকারী নারী পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করারও ভাবনা ভাবতে পারে?

আপনার সম্মুখে আমি শুধু একটি দেহ- একটি মনোহরী শরীর- দিরা বললো- আর যখন আমি তাবরিজের সম্মুখে থাকি, তখন আমি আত্মা হয়ে যাই- প্রেমপিয়াসী আত্মা।

বল্ডউইন রাজা। তিনি রাজাদের ন্যায় আদেশ করলেন- তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে। দারোয়ানকে ডেকে বললেন- আমাদের তাঁবুতে যে মুসলমানটা থাকে, তার পায়ে শিকল পরিয়ে দাও।

বল্ডউইন যখন মাসাফার পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে, তখন তাবরিজ শিকলপরা কয়েদী। আর দিরা বন্দী শিকল ছাড়া। রক্ষীদের নজরে দুজনই বন্দী।

বল্ডউইন বাহিনীর বিন্যাসে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অবসর হয়ে তিনি দিরাকে মানসিকভাবে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেন। তাবরিজকে উপস্থিত করিয়ে তিনি দিরাকে তার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে তাবরিজকে বেত্রাঘাত করতে আদেশ করেন। তাবরিজের পিঠে হান্টারের আঘাত পড়লে চীৎকার বের হচ্ছে দিরার মুখ থেকে। বল্ডউইন দিরাকে বললেন- তুমি আমার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। আমি তোমাকে আমার মুখের উপর কথা বলার শাস্তি দিচ্ছি।

তাবরিজ বোবা ও বধির হয়ে গেছে যেনো। তার কিছুই বুঝে আসছে না, এসব কী ঘটছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই শাস্তি তাকে দিরা দেয়াচ্ছে। দিরার চীৎকার-আহাজারিতে সে বুঝে ফেলেছে, মেয়েটিও মজলুম।

তাবরিজ অত্যাচার সহ্য করতে থাকে।

 কিন্তু একদিন দিরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মেয়েটি বল্ডউইনের নিকট গিয়ে তার পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললো- আপনি যতোদিন বলবেন এবং যেভাবে বলবেন, আমি আপনার সঙ্গে থাকবো। আমি তাবরিজকে ত্যাগ করেছি।

বল্ডউইনের নির্দেশে তাবরিজের হাত-পায়ের শিকল খুলে দেয়া হলো এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। দিরা সম্রাট বল্ডউইনের একাকীত্বের রওনকে পরিণত হয়ে যায়।

দিন কয়েক পর এক রাতে বল্ডউইন মদ ও দিরার রূপে মত্ত হয়ে দিরাকে বললো- আমি যদি সালাহুদ্দীন আইউবীকে তাবরিজের ন্যায় শিকল পরিয়ে তোমার সম্মুখে এনে দাঁড় করাই, তবে কি স্বীকার করবে না আমি এতো বৃদ্ধ নই, যতোটা তুমি মনে করছো?

আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবো, আমি রাজা বল্ডউইনের রাণী দিরা বললো- তোমার তরবারীটা আমার পায়ে রেখে দাও।

দুটা দিন অপেক্ষা করো। আমি কাজটা করে দেখাবো। বল্ডউইন বললেন।

মনে হয় পারবেন না। দিরা বললো।

তুমি দেখোনি, সালাহুদ্দীন আইউবী আমার পায়ের উপর ছাউনি ফেলে রেখেছে- বল্ডউইন বললেন- পরশু ভোরের আঁধারে আমরা তার উপর আক্রমণ চালাবো। কী ঘটছে, তা জানতে না জানতেই তিনি আমার কয়েদী হয়ে যাবেন। এখানে আমার উপস্থিতির কথা তার জানা নেই।

***

তাবরিজ এখন মুক্ত। বল্ডউইন তার ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেননি। এখন সে রাজ অতিথি। সকালে দিরা তার তাঁবুতে প্রবেশ করে। তাবরিজ হঠাৎ চমকে ওঠে কথা বলতে শুরু করে।

কথা বলার সময় নেই- দিরা বললো- আজ আমি তোমার উপকারের প্রতিদান এবং তোমার ভালোবাসার উত্তর দিতে চাই। আমি যা বলি, তা ই করবে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি অনেক পাপ করেছি। তোমার হেস ধ্বংস হয়ে গেছে। তুমি ওখানে যাবে না। তোমার জন্মভূমিটা এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। তোমার পরিবারের লোকদের হাড়ি ছাড়া আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই।

দিরা তাবরিজকে এই ধ্বংসযজ্ঞের এবং তাকে রক্ষা করার বৃত্তান্ত শুনিয়ে বললো- তোমাদেরকে বল্ডউইনের বাহিনী থেকে প্রতিশোধ নিতে হবে। আজ এই পাহাড়ী অঞ্চল থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাও, যেনো কেউ দেখতে না পায়। সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট যাও এবং তাঁকে বলো, খৃস্টান বাহিনী তার মাথার উপর বসে আছে এবং পরশু তারা আক্রমণ করবে।

দিরা তাবরিজকে বল্ডউইনের আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যক্ত করে বললো এখন আর আমার দিকে দৃষ্টিপাত করো না। অন্যথায় এখান থেকে নড়তে পারবে না। আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমাদের গন্তব্য আলাদা। আজ আমরা উভয়ে আপন আপন গন্তব্য পেয়ে গেছি।

দিরা যদি হেমসের ধ্বংসলীলা এবং গণহত্যার কাহিনী না শোনাতো, তাহলে তাবরিজ ওখান থেকে এতো তাড়াতাড়ি উঠতো না। তাবরিজ চোখে অশ্রু নিয়ে দিরা থেকে আলাদা হয়ে যায়।

রাতের আঁধার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাবরিজ চুপি চুপি হাঁটতে শুরু করে এবং সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে পার্বত্য এলাকা থেকে বেরিয়ে যায়।

তাবরিজ সুলতান আইউবীর বাহিনীর ছাউনিতে এসে বললো, আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

তাবরিজকে সুলতানের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হলো। সুলতান আইউবী ধৈর্যের সাথে তার কাহিনী শোনেন এবং তার থেকে বল্ডউইনের ফৌজ ও তার পরিকল্পনার তথ্য জ্ঞাত হন। তিনি তৎক্ষণাৎ তার সালারদের তলব করে তাদেরকে জরুরী নির্দেশনা প্রদান করেন।

সম্রাট বল্ডউইন তৃতীয় রাতে সুলতান আইউবীর ছাউনি এলাকায় আক্রমণ করেন। কিন্তু সেখানে তাঁবুর সারি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তাঁবুতে সৈন্য নেই। হঠাৎ আকাশে সলিতাওয়ালা তীরের স্ফুলিঙ্গ উড়তে এবং তাঁবুগুলোর উপর এসে পড়তে শুরু করে। তাঁবুগুলোতে শুকনো ঘাস ভরে তাতে তরল দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। নিক্ষিপ্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলো এসে নিক্ষিপ্ত হওয়ামাত্র ভয়ানক অগ্নিশিখায় পরিণত হয়ে যায়।

এই অবস্থা দেখে বল্ডউইন আক্রমণের জন্য আরো সৈন্য প্রেরণ করেন। তাদের উপর ডান ও বাঁ-দিক থেকে তীর এসে আঘাত হানতে শুরু করে। রাত পোহাতে না পোহাতে বল্ডউইনের উপত্যকায় লুকিয়ে থাকা সৈন্যদের উপর আক্রমণ হয়ে যায়। এবার বল্ডউইন বুঝতে পারে, সে সুলতান আইউবীর উপর অসতর্ক অবস্থায় আক্রমণ চালাতে পারেনি। বরং সে নিজেই আইউবীর ফাঁদে এসে পড়েছে।

বল্ডউইন একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে নিজ বাহিনীর পরিণতি দেখতে শুরু করেন। পেছন থেকে শাঁ করে তার প্রতি একটা তীর ধেয়ে আসে। কিন্তু তীরটি তার দুজন দেহরক্ষীর গায়ে বিদ্ধ হয়। তিনি পালিয়ে নীচে নেমে এলে সম্মুখ থেকে সুলতান আইউবীর সৈনিকরা ছুটে আসে।

বল্ডউইন একটি সরু পথে পালিয়ে যায়। ১১৭৯ সালের অক্টোবর মাসের এই যুদ্ধে বল্ডউইন বন্দী হওয়া থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে যান। সুলতান আইউবী রামাল্লার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়ে নেন। তার বাহিনীর মনোবল ও আত্মবিশ্বাস চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর তাবরিজ ও দিরা ইতিহাসের আঁধারে হারিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *