৫.১ পাপের প্রায়শ্চিত্ত

পাপের প্রায়শ্চিত্ত

হালবের বাইরে অনুষ্ঠিত তিন মুসলিম আমীরের বৈঠক সমাপ্ত হয়েছে। তারা সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছেন। খৃস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শ বেশী গ্রহণ করা হয়েছে। বাহিনীত্রয়ের বিন্যাস কিরূপ হবে, তারা তা-ও ঠিক করে নিয়েছে। গোমস্তগীনের বাহিনী অগ্রে থাকবে। তার উভয় পার্শ্বের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব হালবের বাহিনীর। প্রথম হামলার পর দ্বিতীয় হামলার দায়িত্ব- যা সুলতান আইউবীর জবাবী হামলাকে প্রতিহত করার জন্য পরিচালিত হবে সাইফুদ্দীনের উপর ন্যাস্ত করা হয়েছে। সাইফুদ্দীন তার বাহিনীর একটি অংশকে তার ভাই ইজুদ্দীনের কমান্ডে রেখে এসেছেন। এটি সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে তার প্রতারণা। সম্মিলিত বাহিনীকে তিনি বুঝ দিয়েছেন যে, আমি তাদেরকে রিজার্ভ রেখে এসেছি এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদেরকে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু তিনি ভাইকে বলে গেছেন, তুমি হাররানের বাহিনীর অবস্থা বুঝে সম্মুখে অগ্রসর হবে। যুদ্ধের পরিস্থিতি যদি আমাদের প্রতিকূল হয়ে যায়, তাহলে রিজার্ভ বাহিনীকে মসুলের প্রতিরক্ষায় ব্যবহার করা হবে। আর যদি জবাবী আক্রমণে অংশগ্রহণ করতেই হয়, তাহলে এই অংশগ্রহণ এমনভাবে করতে হবে যে, আমরা মসুল ও নিজেদের স্বার্থের প্রতি বেশী লক্ষ্য রাখবো।

রমযান মাস শুরু হয়ে গেছে। তিন বাহিনীর মাঝে থোষণা করে দেয়া হয়েছে, যুদ্ধের সময় রোযা রাখা ফরজ নয়। তিন-চারদিন পর বাহিনীগুলো আপন আপন শহর ত্যাগ করে রওনা হয়ে যায়। কথা আছে, তারা হামাতের নিকট এসে একত্রিত হবে এবং আক্রমণের বিন্যাসে প্রস্তুত হয়ে যাবে।

এই তিন বাহিনীর রওনা হওয়ার দুদিন আগের ঘটনা। সুলতান আইউবী তার মোর্চা পর্যবেক্ষণ করছেন। ইত্যবসরে তিনি সংবাদ পান, হাররান থেকে দুজন সালার পালিয়ে চলে এসেছেন এবং তাদের সঙ্গে একটি লাশ আছে।

সুলতান আইউবী ঘোড়া হাঁকান। গন্তব্যে গিয়ে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে অবরতণ করেন এবং সালারদ্বয়কে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর সিপাহীদ্বয়ের সঙ্গেও আলিঙ্গনাবদ্ধ হন। এরা দুজন তার নামকরা গেরিলা গোয়েন্দা ছিলো। কমান্ডারও তার গুপ্তচর ছিলো, যিনি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গোমস্তগীনের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সুলতান আইউব লাশটির গালে চুমো খান এবং লাশটি দামেস্ক পৌঁছে দেয়ার এবং শহীদদের কবরস্তানে দাফন করার নির্দেশ প্রদান করেন।

আপনি এখানে বসে কী ভাবছেন? সালার শামসুদ্দীন নিজের কাহিনী শুনানোর আগেই যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দেন।

আমি রিজার্ভ বাহিনীর এসে পৌঁছার অপেক্ষা করছি- সুলতান আইউবী বললেন- গত রাতে সংবাদ পেয়েছি, বাহিনী আজ রাতে পৌঁছে যাবে। তারা কায়রো থেকে আসবে। সে কারণেই এতোদিন লেগে গেছে।

সুলতান আইউবী তার সেনাসংখ্যা কত এবং তাদেরকে কিভাবে বিন্যস্ত করে রেখেছেন দুভাইকে তার বিবরণ দেন।

সুলতান তখনই তার সকল ইউনিটের কমান্ডারদের ডেকে পাঠান এবং শামসুদ্দীন ও শাদবখত-এর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। পুরাতন অফিসারগণ তাদেরকে চেনেন।

সুলতান আইউবী বললেন—

যে শত্রুবাহিনী আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছে, তাদের সামরিক অভিজ্ঞতা কিরূপ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা কেমন আমার কমান্ডারদের তার বিবরণ দিন। তারা বললেন

সৈন্য সর্বাবস্থায় সৈন্যই হয়ে থাকে। দুশমনকে আনাড়ি ও দুর্বল মনে করা একটি সামরিক পদস্খলন হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ওরা মুসলিম ফৌজ, যার সেনারা শত্রুকে পিঠ দেখাতে অভ্যস্ত নয়। সৈন্যদের মাঝে একটি সামরিক আত্মা বিরাজ করে থাকে। তারা পূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে লড়াই করবে। তাদের মস্তিষ্কে এই বুঝ দেয়া হয়েছে, আপনারা হিংস্র, জংলী ও নারীলোলুপ এবং সুলতান আইউবী এসেছেন তার সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য। খৃস্টানরা তাদের অন্তরে আপনার বিরুদ্ধে ঘৃণা ভরে রেখেছে। তবে তাদের নেতৃত্ব প্রশংসাযোগ্য নয়। তাঁদের একজনও সুলতান আইউবী নয়। সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীন যার যার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য যুদ্ধ করতে আসছেন। তার আপন আপন হেরেম ও মদের পিপ-পেয়ালা সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। আমাদের স্থলে গোমস্তগীন স্বয়ং তার বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন। তবে এই নেতৃত্ব বাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে লড়াতে পারবে না। কিন্তু তারপরও আপনাকে সাবধানতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। তারা আপনাকে পর্বতমালার অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ করে ফেলতে চাচ্ছে। বাহিনীত্রয়ের কমান্ড থাকবে যৌথ; কিন্তু মনের দিক থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ নয়।

সুলতান আইউবী সালার শামসুদ্দীন, শাদবখত ও অন্যান্য সালার কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় খতীব ইবনুল মাখদূম, সায়েকা, কারা কর্মকর্তা ও এক গুপ্তচর এসে উপস্থিত। তারা পথ ভুলে গিয়েছিলেন, তাই বিলম্ব হয়ে গেছে। সুলতান আইউবীর জানা আছে, খতীব তার সমর্থক এবং মসুলে তার গোয়েন্দাদের নেতৃত্ব প্রদান ও তত্ত্বাবধান করতেন। সুলতান তাকেও বৈঠকে যুক্ত করে নেন এবং বললেন, আপনি মসুলের ফৌজ সম্পর্কে কিছু বলুন।

সেই নেতা কিভাবে যুদ্ধ করবে, যিনি মদ-নারীতে আসক্ত এবং কুরআন থেকে ফাল বের করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন?- খতীব বললেন- যার বক্ষে ঈমান নেই, সে যুদ্ধের ময়দানে বেশী সময় টিকতে পারে না। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কুরআন থেকে ফাল বের করে বলুন, আইউবীবিরোধী যুদ্ধে আমি জিতলো না হারবো। আমি তাকে বললাম, যেহেতু তার এই পদক্ষেপ কুরআনী বিধানের পরিপন্থী, তাই এই যুদ্ধে তার পরাজয় হবে। তিনি আমাকে কারাগারে বন্দী করলেন। তিনি কুরআনকে জাদুর বই মনে করে থাকেন। আমি আপনাকে কুরআনের কারামতের কথা শোনাতে চাই। কুরআনের বদৌলতেই আমার পালিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। সাইফুদ্দীন আমার কন্যাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। আমি আপনাকে সুসংবাদ শোনাতে চাই যে, আপনি যদি কুরআনের অনুসারী হয়ে থাকেন এবং যুদ্ধটা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে করে থাকেন, তাহলে জয় আপনারই হবে। এই হলো যুদ্ধের ধর্মীয় দিক। আর কৌশলগত দিক সম্পর্কে আমি আপনাকে পরামর্শ দেবো, আপনি গেরিলা বাহিনীকে অধিকতর ব্যবহার করুন। এই মুসলমান ভাইদের বিরুদ্ধে এ পদ্ধতিটা বেশী প্রয়োগ করুন। রাতেও যেন তারা শান্তিতে থাকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করুন।

যে জেল কর্মকর্তা খতীবকে পলায়নে সাহায্য করেছিলেন, তিনিও সঙ্গে আছেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে বাহিনীতে যুক্ত করে নেয়া হয়েছে। খতীবকে তার কন্যাসহ দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখতকে নিজের সঙ্গে রাখেন সুলতান আইউবী।

***

হালব, হাররান ও মসুলের বাহিনী এগিয়ে আসছে। এদিকে মিশর থেকে সুলতান আইউবীর জন্য যে রিজার্ভ বাহিনী রওনা হয়েছিলো, তারাও নিকটে চলে এসেছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, সুলতান আইউবী পর্যন্ত দুমশনের ফৌজ আগে পৌঁছে, নাকি তাঁর রিজার্ভ বাহিনী। সুলতানের মনে অস্থিরতা। অবরোধকে ভয় পাচ্ছেন তিনি। রিজার্ভ বাহিনীর সাহায্য ব্যতীত অবরোধ ভাঙ্গাও সহজ নয়। যদি তিনি অবরোধের মধ্যে পড়েই যান, তাহলে এই সামান্য সৈন্য দ্বারা কিভাবে তিনি অবরোধ ভাঙ্গবেন? তার সবটুকু মেধা তিনি। এ সমস্যার সমাধানে ব্যয় করে ফেলেন। তিনি এতোই অস্থির হয়ে পড়েন যে, ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের নিকট পর্যন্ত তাঁর এই উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করে ফেলেন। তিনি বললেন

কমান্ডো ইউনিটগুলোকে পরিপূর্ণরূপে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ও দৃষ্টিতে রাখবে। রিজার্ভ বাহিনীর এখনো কোনো পাত্তা নেই। অবরোধের আশংকা আছে। অবরোধ কেবল গেরিলারাই ভাঙ্গতে পারবে।

আল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন, তা বাস্তবায়িত হবেই- এক সালার বললেন এটা দুর্গ নয় যে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে আমরা লড়াই করতে পারবো না। এই পার্বত্য এলাকায় আমরা ঘুরেফিরে লড়াই করবো।

এ রাতেও সুলতান আইউবী ভালোভাবে ঘুমাতে পারেননি। তাঁর তাঁবুতে সারারাত প্রদীপ জ্বালানো থাকে। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার যে নকশা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন, সেটি নিরীক্ষণ করতে থাকেন এবং তার উপর দাগ দিতে থাকেন। সেই সময়ে কোন বেসামরিক লোক দেখলে সে নির্ঘাত মনে করতো, সুলতান শতরঞ্জ খেলার অনুশীলন করছেন।

 সাহরীর সময় যখন নাকাড়া বেজে উঠে এবং সৈনিকরা সজাগ হয়ে যায়, তখন সুলতান আইউবীরও চোখ খুলে যায়। জাগ্রত হয়েই সুলতান একসঙ্গে দুটি সংবাদ পান। এক. রিজার্ভ বাহিনী পৌঁছে গেছে। দুই. শক্র বাহিনী আট থেকে দশ মাইল দূরত্বের মধ্যে এসে পড়েছে এবং সম্ভবত আগামীকালের মধ্যে আমাদের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। সংবাদদাতা কোন এক তত্ত্বাবধায়ক গ্রুপের কমান্ডার। তিনি জানান, দুশমনের অগ্রযাত্রা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এক অংশ সম্মুখে, অপর অংশ পেছনে, তৃতীয় অংশ তারও পেছনে।

সুলতান আইউবীর যেসব তথ্য নেয়া আবশ্যক ছিলো, নিয়ে নিয়েছেন। সংবাদদাতা কমান্ডারকে বিদায় করে দিয়ে তিনি দারোয়ানকে বললেন, তুমি এক্ষুণি গেরিলা ও রিজার্ভ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের ডেকে আনন। তাদেরকে বলো, তারা যেনো সাহরী আমার সঙ্গে খায়। সুলতান চট জলদি ওজু করে নেন। রিজার্ভ বাহিনী এসে পৌঁছায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বল নামায আদায় করেন এবং আল্লাহর সমীপে বিজয়ের জন্য দুআ করেন।

অল্পক্ষণের মধ্যেই গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার এসে উপস্থিত হন এবং পরক্ষণই রিজার্ভ বাহিনীরও চারজন কমান্ডার এসে হাজির হন। সাহরীর খাবারও এসে পড়ে। রিজার্ভ সৈন্য সুলতান আইউবীর আশার তুলনায় কম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এ-ই যথেষ্ট। আল-আদেল যে পরিমাণ অস্ত্র প্রেরণ করেছেন, তাতে সুলতান আইউবী নিশ্চিন্ত। অস্ত্রগুলোর মধ্যে ছোট-বড় মিনজানিক বেশী। দাহ্য পদার্থও প্রচুর। সেনা সংখ্যার দিক থেকে সাহায্যটা সামান্য হলেও বাহিনীটা যেহেতু অভিজ্ঞ, তাই হতাশার কিছু নেই। তবে সমস্যা হলো, এই ফৌজ আর অশ্বপাল পাহাড়ী যুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়।

ইতিমধ্যে ইন্টেলিজেন্স প্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহও এসে পড়েন। তিনি জানান, হাব থেকে আমার এক গোয়েন্দা সংবাদ নিয়ে এসেছে যে, খৃস্টানরা এই যৌথ বাহিনীকে বিপুল পরিমাণ তীর-ধনুক, মটকা ভর্তি দাহ্য পদার্থ এবং পাঁচশত ঘোড়া প্রেরণ করেছে। গোয়েন্দা আরো জানায়, সে তাদের রওনা হওয়ার পর এসেছে। এই কাফেলাটি বাহিনীর সঙ্গে মিশে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সঙ্গে মিনজানিকও রয়েছে। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে, দুশমন মিনজানীকের সাহায্যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করবে এবং সলিতাওয়ালা তীর ছুঁড়বে।

সুলতান আইউবী গেরিলা বাহিনীর প্রধানকে বললেন, তোমাকে সবকিছুই অবগত করা হয়েছে। তোমার দায়িত্ব কী, তা তোমার জানা। এবার পরিকল্পনায় এটাও যোগ করে নাও যে, দুশমন আক্রমণ না করা পর্যন্ত কোথাও তাদের উপর গেরিলা হামলা করা হবে না। প্রাপ্ত সংবাদ মোতাবেক শক্র বাহিনী সোজা হামাত-এর দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের উপর গেরিলা। ক্রিমণ চালানো হলে তাদের অগ্রযাত্রার গতি শ্লথ হয়ে যাবে। আর তোমার তো জানা আছে, তাদের আক্রমণের পর আমি জবাবী আক্রমণ করবো না। দুশমন আমার আক্রমণের আশংকা করে থাকবে, যা আমি সম্মুখ থেকে নয়, পেছন দিক থেকে পরিচালনা করবো। তোমার কাজ তখন থেকে শুরু হবে, নি পেছনের আক্রমণে ভীত হয়ে দুশমন এদিক-ওদিক পালাবার চেষ্টা শুরু করবে। এই পার্বত্য এলাকা থেকে একজন শত্রুসেনাও যেনো বেরিয়ে যেতে না পারে। যতো সম্ভব বেশী বেশী শক্র বন্দী করো। তারা মুসলমান সৈনিক। সমাদের হাতে বন্দী হলে পরে তাদের সত্য-মিথ্যার বুঝ এসে যাবে। লক্ষ্যও এই। তবে আমাদের মোকাবেলায় এসে আমাদের তীর-তরবারীর আঘাতে যারা মৃত্যুবরণ করে, আমি তাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারি না।

আমাদের নিকট তথ্য আছে, দুশমন মটকায় ভরে দাহ্য পদার্থ নিয়ে আসছে। এগুলে আমাদের হস্তগত হলে ভালো হতো। কিন্তু তা সম্ভব হবে না বলেই ধরে নেয়া যায়। তার চেয়ে বরং তুমি একটা কাজ করো, তোমার কোনো একটি ইউনিটের দশ-বারজন গেরিলাকে দায়িত্ব দাও, তারা আক্রমণের সময় অতর্কিত গেরিলা হামলা চালিয়ে মটকাগুলো ভেঙ্গে ফেলুক এবং দাহ্য পদার্থগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিক। দিনের বেলা দেখে নিতে হবে, মটকা বহনকারী কাফেলার অবস্থান কোথায়। সবচেয়ে জরুরী কথা হলো, দুশমন এখনো নদী পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তোমরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাও এবং মশকে পানি ভরে নাও। মওসুম ঠাণ্ডা। এটা মরুভূমি নয়। পিপাসায় কেউ মরবে না। তারপরও এটা যুদ্ধ। পিপাসা তোমাদেরকে অস্থির তো করবেই।

গেরিলা বাহিনীর কমান্ডারকে বিদায় দিয়ে সুলতান আইউবী রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ডারদের বললেন

একটা বিষয় তোমরা সবসময় মাথায় রাখবে যে, এটা মিশরের মরু এলাকা নয়। এটা পাহাড়ী এলাকা এবং শীতল। খরতাপের মধ্যে ছুটাছুটি করলে শীত দূর হয়ে যাবে। এখানে আঘাত করো আর একদিকে পালিয়ে যাও- এর সুযোগ অবশ্যই পাবে। তোমাদেরকে এর প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তোমাদের স্মরণ রাখতে হবে, এখানকার মাটি তোমাদের জন্য বিস্তৃত নয়। ভোলা ময়দানে তো কয়েক ক্রোশ পথ ঘুরে আবার দুশমনের উপর চড়াও হতে পারো এবং যুদ্ধের কৌশল প্রয়োগ করার জন্য অসীম ভূমি খুঁজে পাও। কিন্তু এখানে আমি দুশমনকে যে স্থানটিতে টেনে আনার বন্দোবস্ত করেছি, সেটি ময়দান বটে, তবে সীমিত। তোমাদেরকে টিলা-পর্বতের সঙ্গে পরিচিত করানোর মতো সময় হাতে নেই। তাই জ্ঞান খরচ করে কাজ করতে হবে। তীরন্দাজদেরকে পর্বতের উপর রাখবে। ঘোড়া:নিয়ে পাথুরে এলাকায় ঢুকবে না। তবে ঘোড়া অল্পতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমাদের ঘোড়াগুলো তো কিছুটা হলেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

মিশর থেকে আসা সাহায্যকারী বাহিনীকে সুলতান আইউবী রিজার্ভ রেখে দেন এবং কমান্ডারদেরকে তাদের উধর্বতন সালারদের হাতে তুলে দেন। সালারদেরকে যুদ্ধের পরিকল্পনা পূর্বেই দিয়ে রাখা হয়েছে।

***

ফজরের আযান হয়ে গেছে। সুলতান আইউবী গোসল করেন। খাপ থেকে বের করে তরবারীটা হাতে নেন। তরবারীর ঝলক ও ধার পরখ করেন। তারপর অকস্মাৎ তার আবেগ উথলে ওঠে। তিনি তরবারীটা উভয় হাতের উপর রেখে কেবলার দিকে মুখ করে হস্তদ্বয় উপরে তুলে ধরেন। তারপর চক্ষু বন্ধু করে দুআ করতে শুরু করেন

মহান আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টি যদি এতে নিহিত থাকে যে, তুমি আমাকে পরাজিত করবে, তাহলে আমি এই লাঞ্ছনা মাথা পেতে বরণ করে নিতে প্রস্তুত আছি। আর যদি তুমি আমাকে বিজয় দান করো, তাহলে আমি তোমার কৃতজ্ঞতা আদায় করবো। আজ আমি তোমার রাসূলের নাম উচ্চরণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তুমি আমাকে ইঙ্গিত দাও, আমি নিজের তরবারীটা আমার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে দেই। আমি সেই কিশোরীদের ডাকে সাড়া দিতে এসেছি, যাদের সম্ভ্রম শুধু এই জন্য লুণ্টিত হয়েছে যে, তারা তোমার রাসূলের উম্মত। আমি তোমার সেই অসহায় বান্দাদের আহ্বানে এসেছি, যারা একমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে কাফিরদের নির্মম অত্যাচারের শিকার। আমি তোমার মহান ধর্মের মর্যাদা সংরক্ষণ করার জন্য পাহাড়-পর্বত, জঙ্গল-মরু ভূমিতে ঘুরে ফিরছি। আমি তোমার রাসূলের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে দখলমুক্ত করার জন্য রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু তোমার রাসূলের একদল উম্মত আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তুমি আমাকে ইশারা দাও, তাদের রক্ত ঝরানো আমার জন্য হালাল না হারাম। আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাইনি তো? আমাকে তুমি তোমার নূরের চমক দেখাও। আমি যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি, তাহলে তুমি আমাকে সাহস ও দৃঢ়তা দান করো।

সুলতান আইউবী মাথাটা অবনত করে ফেলেন। এই অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর হঠাৎ তরবারীটা কোষবদ্ধ করে বাইরে বেরিয়ে নামাযের স্থানে চলে যান।

জামাত দাঁড়িয়ে গেছে। সুলতান পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে যান। একদিকে বাবুর্চি, অপরদিকে তার এক কমান্ডারের আদালী দণ্ডায়মান।

***

নামায আদায় করে সুলতান আইউবী হামাতের দিকে রওনা হয়ে যান। পথে পরপর চারজন দূতের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তারা তাঁকে মৌখিকভাবে রিপোর্ট প্রদান করে। এরা তথ্যানুসন্ধানকারী দলের দূত, যারা হাররান, হাব ও মসুলের সম্মিলিত বাহিনীর গতিবিধি ও তৎপরতার সংবাদ নিয়ে এসেছিলো।

এই ধারা দিন-রাত চলতে থাকে। সুলতান আইউবী দূতদেরকে বিদায় করে দেন। সালার শামসুদ্দীন তার সঙ্গে আছেন। শামসুদ্দীনের ভাই শাদবখতকে তিনি অন্য এক স্থানে মোতায়েন করে রেখেছেন।

শক্র সম্পর্কে যেসব খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?- শামসুদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন- এই সামান্য ফৌজ দিয়ে আমরা এতো বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করতে পারবো কি?

দুশমন কতজন সৈন্য নিয়ে এসেছে আর আমার কজন সৈন্য আছে, আমার কাছে এটা কোনো বিষয় নয়- সুলতান আইউবী বললেন- আমি অস্থির এই জন্য যে, দুশমন আক্রমণ করছে না কেন? আমার সেই মুসলমান ভাইদের নিকট খৃষ্টান গোয়েন্দা আছে, তারা কি এতই আনাড়ি হয়ে গেলো যে, তারা জানতেই পারলো না, মিশর থেকে আমার সাহায্য আসছে এবং আমি সাহায্য ছাড়া লড়াই করতে পারবো না! দুশমন যদি তৎপর হতো, তাহলে আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। দুশমনের এ পর্যন্ত এসে থেমে যাওয়া এবং আমাকে এতোটুকু সময় দেয়া যে, সাহায্য পেয়ে যাবো, তাদেরকে বিন্যস্ত করে ফেলবো, সকল সৈন্যের সবগুলো ঘোড়াকে পানি পান করাবো এবং পানি রিজার্ভ করে নেবো; আমার জন্য অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার আশংকা হচ্ছে, দুশমন এমন কোনো কৌশল প্রয়োগ করবে, যা কখনো আমার মাথায় আসেনি। তো তামাশা করতে আসেনি।

আমি তাদেরকে যতোটুকু জানি- শামসুদ্দীন বললেন- তাদের হাতে এমন কোনো কৌশল নেই। আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে। আল্লাহ তাদের বিবেকের উপর মোহর মেরে দিয়েছেন। কেননা, তারা বাতিলের পরিকল্পনা ও সাহায্য নিয়ে সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছে। তাদের চোখের উপর পটি বেঁধে দেয়া হয়েছে। আমি গভীর কোনো কৌশল-ষড়যন্ত্রের আশংকা করছি না।

শামসুদ্দীন ভাই!- সুলতান, আইউবী বললেন- আমারও আল্লাহর উপর ভরসা আছে। তবে আমি আবেগ ও তত্ত্বের চেয়ে বাস্তবকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বাতিল হকের উপর একাধিকবার জয়লাভ করেছে। তখন সত্যের অনুসারীরা আল্লাহ ভরসা বলে হাত গুটিয়ে বসেছিলো। সত্য খুন ও কুরবানীর দাবি করে। আমরা যদি সেই কুরবানী দিতে প্রস্তুত থাকি, তাহলেই সত্যের জয় হবে। বাতিলের মধ্যে যে শক্তি আছে, আমাদেরকে তার মোকাবেলা ময়দানে করতে হবে। আমাদেরকে বাস্তবতার উপর চোখ রাখতে হবে। নিজের পূর্ণ যোগ্যতা ও সর্বশক্তি কাজে লাগাতে হবে। তারপর ফলাফল আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের আত্ম প্রবঞ্চনায় লিপ্ত হওয়া চলবে না।

সুলতান আইউবী ঘোড়র পিঠ থেকে অবতরণ করেন। সালার শামসুদ্দীনের দুউপদেষ্টা এবং রক্ষীসেনারাও ঘোড়া থেকে নেমে যান। সুলতান আইউবী শামসুদ্দীন এবং উপদেষ্টাদ্বয়কে একটি উঁচু টিলার উপর নিয়ে যান। তাদের সম্মুখে পর্বতবেষ্টিত বিশাল এক মাঠ, যেটি শিং-এর ন্যায় টিলাগুলো অতিক্রম করে বিস্তৃত হয়ে সামনের দিকে চলে গেছে। সুলতান আইউবী যে দিকটায় দাঁড়িয়ে আছেন, সেদিকে দুটি টিলা একটির পেছনে অপরটি দণ্ডায়মান। সেই টিলা দুটোর মধ্যদিয়ে একটি গলি ময়দানের দিকে এগিয়ে গেছে। মাঠে পর্বতগুলোর কোল ঘেঁষে ছোট-বড় শত শত তবু দাঁড়িয়ে আছে। একধারে তাঁবুতে অবস্থানরত সৈনিকদের ঘোড়াগুলো ধী। সৈন্যরা এদিক-সেদিক ঘুরাফেরা করছে। কিছু সৈন্যকে রোদের মধ্যে হয়ে এবং ঘুমিয়ে থাকতেও দেখা গেলো। তাদের ভাব-গতি দেখে মনে হলো, বিশাল এক শত্রুবাহিনী আক্রমণ করার জন্য তাদের মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে, তা তারা জানেই না। তারা যদি যুদ্ধ করার জন্য প্রভুক্ত থাকতো, তাহলে তাদের তাঁবুগুলো পঁড়িয়ে থাকতো না এবং তাদের ঘোড়াগুলোর পিঠে জিন কষা থাকতো।

আমার ইউনিটগুলোর সালার ও কমান্ডারদেরকে আমি যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছি, তা তোমরাও একবার শুনে নাও- সুলতান আইউবী বললেন হতে পারে, আমি তোমাদের আগে মৃত্যুবরণ করবো এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্রই মারা যাবো। আমার পরে রণাঙ্গনের দায়িত্ব তোমাদেরকেই পালন করতে হবে। আমি তাদেরকে বলেছি, তাঁবুগুলো খাটানো অবস্থায় থাকতে দাও। ঘোড়াগুলোকে জিন ছাড়া বেঁধে রাখো। ভাবনাহীন ভাব প্রদর্শন করে ঘোরাফেরা করো এবং এদিক-ওদিক বসে ও শুয়ে থাকে। তবে তাঁবুতে তাঁবুতে অস্ত্র ও জিন প্রস্তুত রাখো। দুশমনের গোয়েন্দারা তোমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদেরকে এই ধারণী দাও যে, দুশমন সম্পর্কে তোমাদের কোনই খবর নেই। দুশমনের বাহিনী এসে পড়লে নিজেদেরকে ভীত বলে প্রকাশ করবে এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেবে। কিন্তু তারপরও তাঁবুগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকবে দেবে। সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মোকাবেলা করবে না। দুশমন উপরে উঠে এলে লড়াই করতে করতে এতোটুকু দ্রুত পেছনে সরে যাবে, যেনো দুশমনের আক্রমণকারী বাহিনী তোমাদেরই সঙ্গে এই পার্বত্য এলাকায় তোমাদের বেষ্টনীতে এসে পড়ে। দুশমনকে বুঝাবে, তোমরা পিছপা হয়ে যাচ্ছ।

সুলতান আইউবী দুই টিলার মধ্যবর্তী গলিটির প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন—

 আমি এই বাহিনীগুলোকে বলে দিয়েছি, তোমরা এই গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। তারপর তাদেরকে কোথায় গিয়ে একত্রিত হতে হবে, তাও তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে।

সুলতান তাঁর বন্ধুদেরকে জায়গাটার কথা উল্লেখ করে বললেন –

এই বাহিনীগুলোকে দুমশনের পেছনে চলে যেতে হবে। এই পার্বত্য অঞ্চলটিতে আমি দুশমনকে স্বাগত জানোনোর যে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তা তোমাদের জানা আছে। স্মরণ রেখো আমার বন্ধুগণ! আমরা এখানে কোনো অঞ্চল বা কোনো দুর্গ জয় করবো না। আমাদের কাজ হলো দুশমনকে অসহায় ও নিষ্ক্রিয় করে তোলা, যাতে তারা আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। আমার মুসলমান ভাইদেরকে দুশমন বলতে আমার লজ্জা হয় কিন্তু কী করবো, পরিস্থিতি আমাকে তা বলতে বাধ্য করছে। আমি তাদেরকে ধ্বংস করতে চাই না। আমি নির্দেশ জারি করে দিয়েছি, যতো বেশী সম্ভব শত্রুসেনাদের জীবিত গ্রেফতার করো আর যুদ্ধবন্দী বানাও। আমি তাদেরকে তরবারী দ্বারা পদানত করে চরিত্র দ্বারা বুঝাবো যে, তোমরা মুসলিম সৈনিক এবং তোমাদের রাজা তোমাদের ধর্মের শত্রুদের হাতে খেলছে।

কোনো জাতিকে যদি হত্যা করতে হয়, তাহলে তাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দাও- সালার শামসুদ্দীন বললেন- খৃস্টানরা সাফল্যের সঙ্গে এই অস্ত্রটা ব্যবহার করেছে।

মুসলিম জাতির দৃষ্টান্ত বারুদের ন্যায়- সুলতান আইউবী বললেন বারুদের এই স্কুপের উপর যদি কোনো দিক থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার এসে পতিত হয়, তাহলে সেটি বিস্ফোরণে ফেটে যায়। জাতির এই দুর্বলতা যদি শিকড় গেড়ে বসে, তাহলে আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। দুশমন তাদেরকে দলে দলে বিভক্ত করে পরস্পরে যুদ্ধ করায় এবং জাতির কর্ণধারণ ক্ষমতার লোভে পরস্পর লড়াই করতে থাকে। এই যে তিনটি গোষ্ঠী স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে, তাদের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একে অপরের শত্রু। তারা প্রত্যেকে একে অপরকে ধোঁকা দিয়ে সালতানাতে ইসলামিয়ার রাজা হতে চায়। আমি তাঁদের দেমাগ থেকে রাজত্বের পোকা বের করে জাতিকে সঠিক পথে তুলে আনার চেষ্টা করছি। আমার লক্ষ্য ইসলামের সুরক্ষা ও প্রসার।

***

হামাত থেকে সামান্য দূরে হাররানের দুর্গপতি গোমস্তগীন- যিনি স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা দিয়েছিলেন- নিজ সালার ও ছোট-বড় কমান্ডারদেরকে একত্রিত করে বলছিলেন–

সালাহুদ্দীন আইউবী খৃস্টানদেরকে পরাজিত করতে পারে। কিন্তু যখন সে তোমাদের সামনে আসবে, সব কৌশল ভুলে যাবে। সে আমাদের গোষ্ঠীভুক্ত নয়- সে কুর্দি। তোমরা পাক্কা মুসলমান, দ্বীনদার ও পরহেজগার। আর সে শুধু নামের মুসলমান। সালাহুদ্দীন প্রতারক ও বদকার মানুষ। এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সে তার রাজা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আমি তোমাদেরকে তার সামরিক অবস্থাও জানিয়ে দিচ্ছি। তার সৈন্যসংখ্যা অনেক কম এবং সে পাহাড়বেষ্টিত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে বসে আছে। এই একটু আগে গোয়েন্দারা আমাকে সংবাদ দিয়ে গেলো যে, সালাহুদ্দীনের ফৌজ তাঁবুর অভ্যন্তরে আরামে সময় কাটাচ্ছে এবং তার ঘোড়াও অলস দাঁড়িয়ে আছে। তার কারণ দুটি হতে পারে। প্রথমত, সে নিশ্চিত, আমরা তাকে পরাজিত করতে পারবো না। দ্বিতীয়ত, সে এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত থাকবে পারে যে, আমরা তার উপর হামলা করবো না। এমনও হতে পারে, সে সন্ধির জন্য আমাদের নিকট দূত পাঠাবে। কিন্তু এখন আর আমরা তার সঙ্গে কোনো সন্ধি বা সমঝোতা করবো না। সে এখন আমাদের কয়েদী। যদি সে জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে ধরা না দেয়, তাহলে আমি তোমাদেরকে তার লাশ দেখাবো। তোমরা তোমাদের সৈনিকদেরকে বলে দাও, সালাহুদ্দীন আইউবী মাহদী বা নবী-রাসূল নয় এবং তার সৈন্যদের মাঝেও কোনো জিন-ভূত নেই। আমরা তার বাহিনীকে তাদের অজ্ঞাতেই ঝাঁপটে ধরবো।

শ্রোতাদেরকে উত্তেজিত করে এবং তাদের সাহস বৃদ্ধি করে গোমস্তগীন তাদেরকে বিদায় করে দিয়ে নিজে তাঁবুতে চলে যান। তাঁবু তো নয় যেন জঙ্গলের মঙ্গল। বিশাল এক তাঁবু, যার ভেতরে জাজিম ও মূল্যবান পালঙ্ক সাজানো। আছে মদের সোরাহী ও কারুকার্য খচিত মদের পেয়ালা। ভেতর থেকে তাবুটাকে প্রাসাদের সুসজ্জিত কক্ষ বলে মনে হয়। তার আশপাশে আরো কতগুলো তাঁবু খাটানো, যেগুলো সামরিক তাঁবুগুলো থেকে ভিন্ন ধরনের ও আকর্ষণীয়। এ তাঁবুগুলোতে বাস করছে হেরেমের মেয়েরা এবং গায়িকা নর্তকীরা। তাঁবুগুলো থেকে দূরে দূরে পাহারাদাররা দাঁড়িয়ে আছে। গোমস্তগীনের তাঁবুর বাইরে এক ব্যক্তি তার অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। তাদের দেখেই গোমস্তগীন দ্রুত হাঁটা দেন এবং নিকটে গিয়ে তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে বলেন। তারা ভেতরে প্রবেশ করামাত্র একদল মেয়ে তশতরি হাতে তাবুতে ঢুকে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যে খাবার এসে হাজির হয়। এসে পড়ে মদের সোরাহীও। গোমস্তগীন এই নয় ব্যক্তির সঙ্গে আহারে যোগ দেন।

নয় ব্যক্তি খাবারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা ভুনা গোশতের বড় বড় টুকরো হাতে নিয়ে রাক্ষসের মতো গিলতে শুরু করে। পাশাপাশি মদপান করছে পানির মতো। তাদের চোখগুলো রক্তজবার ন্যায় টকটকে লাল, যেনো তারা জংলী ও রক্তখোর হায়েনা। তিন-চারটি সুন্দরী মেয়ে তাদের পেয়ালায় মদ ভরে দিয়ে চলেছে আর তারা মেয়েগুলোর সঙ্গে অশ্লীল অচিরণ করছে। কখনো কোনো মেয়ের এলো চুলে বিলি কাটছে। কখনো বা বিবস্ত্র বাহু ধরে কাছে টেনে এনে সোহাগ করছে। এক কথায় গোমস্তগীনের তাঁবুতে একসঙ্গে ভুঁড়িভোজন, মদপান আর নারীভোগ করে চলেছে নয় অতিথি। গোমস্তগীন তাদের আচার-আচরণ ও খাওয়ার ধরন দেখে মুচকি হাসছেন। কিন্তু তার হাসিই প্রমাণ করছে, তিনি হাসছেন জোরপূর্বক। এই লোকগুলো তার বিলকুল অপছন্দ।

আহার শেষ হলে গোমস্তগীন মেয়েগুলোকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মেহমানদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ গল্প-গুজব করার পর গোমস্তগীন বললেন- তোমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর উদ্দেশ্যে বিদায় করে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। এবারকার আক্রমণ যেনো ব্যর্থ না হয়।

আপনি যদি আমাদেরকে থামিয়ে না রাখতেন, তাহলে এতোক্ষণে সুসংবাদ পেয়ে যেতেন যে, অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে সালাহুদ্দীন আইউবী খুন হয়েছেন। এক ব্যক্তি বললো।

এরা হাসান ইবনে সাব্বাহর নয় ফেদায়ী, যাদেরকে শেখ সান্নান সুলতান আইউবীকে হত্যা করার জন্য ত্রিপোলী থেকে প্রেরণ করেছিলো। আকার গঠনে মানুষ হলেও এরা চরিত্রে হায়েনা। তারা নিজ নিজ ডান হাতে মধ্যমা আঙ্গুল থেকে দশ দশ ফোঁটা করে রক্ত বের করে পাত্রে রাখে। তার মধ্যে মদ ও হাশীশ মিশিয়ে শরবত তৈরি করে প্রত্যেকে এক এক চুমুক পান করে বিশেষ শব্দে শপথ নিয়েছিলো যে, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করবোই। শেখ সান্নান তাদেরকে দুনিয়াত্যাগী সুফীর পোশক পরিয়ে হাতে তাসবীহ ও গলায় কুরআন ঝুলিয়ে এই নির্দেশনা দিয়ে প্রেরণ করেছিলো, তোমরা সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে যাও এবং তার সম্মুখে আলোচনা উত্থাপন করো যে, মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই না করা উচিত। তারপর বলবে, আমরা মধ্যস্থতা করে এই আত্মকলহ মিটিয়ে দিতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা অন্যান্য মুসলিম আমীরদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আপনার নিকট আসলাম। এভাবে সুযোগ মতো তোমরা সুলতান আইউবীকে হত্যা করে ফেলবে।

শেখ সান্নান কৌশলটা ঠিক করেছে ভালোই। সুলতান আইউবী আলিম উলামা ও ধর্মীয় নেতাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কাছে বসাতেন এবং মনোযোগ সহকারে তাদের বক্তব্য শুনতেন। তার আরো একটি দুর্বলতা এই ছিলো যে, তিনি চাচ্ছিলেন, কেউ মাঝে পড়ে বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে তাকে একটা সমঝোতা করিয়ে দিতে, যাতে মুসলমানে-মুসলমানে খুনাখুনি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যথায় খৃস্টানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার এবং হামলা করে সাফল্য অর্জনের সুযোগ পেয়ে যাবে। তিনি হাব প্রভৃতি এলাকায় দূতও প্রেরণ করেছিলেন, যারা অপমানজনক উত্তর নিয়ে ফিরে এসেছে। এবার তাঁর সেই দুর্বলতাকে পুঁজি করে তাকে খুন করার পরিকল্পনা নিয়ে আসছে সূফীবেশী নয় সদস্যের একদল ঘাতক। তার সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ করার নামে চোগার ভেতরে খঞ্জর আর তরবারী লুকিয়ে আছে তারা। এটা সুলতান আইউবীকে হত্যা করার এক সহজ পন্থা। তারা ত্রিপোলী থেকে রওনা হয়ে হাররান এসে পৌঁছেছিলো। খৃস্টান উপদেষ্টারা গোমস্তগীনকে বলেছিলো, এরা সুলতান আইউবীকে হত্যা করতে যাচ্ছে। তিনি তাদের নিকট হত্যা প্রক্রিয়ার কথা শুনে তা প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদা দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন এবং খৃস্টান উপদেষ্টাদের বলে দেন, আমি সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছি। আপনাদের এই নয় ঘাতককে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবে এবং সুযোগ মতো অন্য কোনো পন্থায় সুলতান আইউবীকে খুন করাবো। সে মতে গোমস্তগীন তাদেরকে সঙ্গে করে ময়দানে নিয়ে এসেছেন।

রণাঙ্গনে গোমস্তগীন তাদের জন্য সুযোগও সৃষ্টি করে নিয়েছেন, এবং তাদের ছদ্মবেশও প্রস্তুত করে ফেলেছেন। আহার শেষে তিনি তাদেরকে বললেন এবার আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার কী পন্থা আমি ঠিক করে রেখেছি। তোমরা যে সুফীবেশ ধারণ কব্লেছো, তা সন্দেহ জন্ম দিতে পারে। আইউবীর দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও গভীর। তার উপর ইতিপূর্বে চারবার সংহারী আক্রমণ হয়েছিলো। ফলে তিনি অধিক সতর্ক হয়ে গেছেন। তার উচ্চ পর্যায়ের অভিজ্ঞ দুজন গোয়েন্দাও আছে। একজন আলী বিন সুফিয়ান, অপরজন হাসান বিন আবদুল্লাহ। তারা এক দৃষ্টিতেই মানুষকে আন্দাজ করে ফেলতে পারে। আমাদের গোয়েন্দাদের সংবাদ মোতাবেক এ সময় হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে আছে। আর আলী বিন সুফিয়ান আছে কায়রো। কোনো অপরিচিত লোক সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলে দুতিনজন সালার এবং হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করে নেয়। সন্দেহ হলে তল্লাশিও নিয়ে থাকে। আইউবী কিংবা হাসান ইবনে আবদুল্লাহ প্রশ্ন করতে পারেন যে, এই সংঘাত আত্মকলহ তো কয়েক মাস ধরেই চলে আসছে। তা তোমাদের সন্ধি সমঝোতার চিন্তাটা আজ আসলো কিভাবে? আইউবী এ-ও জিজ্ঞেস করতে পারেন, তোমরা কোথাকার ধর্মীয় নেতা? কিংবা তিনি এমন কোনো প্রশ্ন করতে পারেন, তোমরা যার উত্তর দিতে পারবে না অথবা এমন উত্তর দেবে, যার ফলে তোমাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে। তিনি নিজে আলিম। ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান রয়েছে। তাছাড়া তোমাদের চেহারায় দাড়ি ব্যতীত সুফীদের আর কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। তোমাদের চারজনের দাড়ি এখনো ছোট, যা প্রমাণ করছে, মাসখানেক ধরে তোমরা দাড়ি রেখেছো। তোমাদের চোখে হাশীশ ও মদের ক্রিয়া পরিস্ফুট। এই চেহারাগুলোতে পবিত্রতার লেশও চোখে পড়ছে না।

নয়জনের একজনও গোমস্তগীনের বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হলো না। তার বক্তব্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে বরং একমত পোষণ করলো। দলনেতা বললো- আমি আপনার প্রতিটি কথার সঙ্গে একমত। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি আমাদেরকে সুফী কিংবা ইমাম মনে করে সম্মানের সাথে তার তাঁবুতে বসতে দেন আর আমাদের আপ্যায়নের জন্য খাবারের আয়োজন করেন, তাহলে আমার এই বন্ধুরা খাদ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। একজন ইমাম ও খতীব কিভাবে আহার করেন, আমরা একজনও তা জানি না। আপনি কী বুদ্ধি ঠিক করেছেন?

অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ-গোমস্তগীন বললেন- আমি তোমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর স্বেচ্ছাসেবী রক্ষীসেনা দলে ঢুকিয়ে দেব। তবে তার জন্য খুব যাচাই-বাছাই করে রক্ষী নির্বাচন করা হয়ে থাকে। তাদের পরিবার পরিজনেরও খবরাখবর নেয় হয়। তাই যাওয়া মাত্রই তোমরা তার রক্ষী বাহিনীতে ঢুকে যেতে পারবে, এমনটা সম্ভব নয়। আমি যে পন্থাটা ভেবে রেখেছি, আশা করি তোমরা তাতে সফল হবে। তাহলো, গোয়েন্দারা জানিয়েছে, দামেস্কের লোকদের মাঝে আমাদের বিরুদ্ধে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষে এতো বেশী আবেগ ও উদ্দীপনা বিরাজ করছে যে, তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রণাঙ্গনে ছুটে আসছে। আমি জানতে পেরেছি, আইউবী তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনীতেও ভর্তি করে নিচ্ছেন এবং অন্য কাজেও ব্যবহার করছেন। এই পরিস্থিতি থেকে আমি ফায়দা হাসিল করতে চাই।

গোমস্তগীন আলাদাভাবে রাখা একটি কাঠের বাক্স টেনে হাতে নেন। তিনি বাক্সটা খুলেন। তার ভেতরে কতগুলো পোশাক। তিনি ঘাতকদের উদ্দেশ করে বললেন–

তোমরা প্রত্যেকে এই পোশাক পরিধান করে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট যাবে। এটা তার রক্ষী সেনাদের ইউনিফর্ম। তোমাদের একজনের হাতে আইউবীর ঝাণ্ডা থাকবে। অবশিষ্ট আটজনের বর্শার আগায় আইউবীর সৈন্যদের পতাকা থাকবে। তোমরা সোজা আইউবীর নিকট চলে যাবে। এক স্থানে তোমাদেরকে থামিয়ে দেয়া হবে। তোমাদেরকে আইউবীর নিকট যেতে দেয়া হবে না। তোমরা আপুত কণ্ঠে বলবে, আমরা স্বেচ্ছাসেবী। আমরা দামেস্ক থেকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হেফাজতের জন্য এসেছি। আরো বলবে, আমরা অত্যন্ত মমতার সঙ্গে রক্ষী বাহিনীর পোশাক প্রস্তুত করে এনেছি এবং অন্তরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভক্তি নিয়ে এসেছি। আমাদেরকে সুলতানের আশপাশে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত করুন কিংবা কোনো জানবাজ বাহিনীতে যুক্ত করে দিন। আমরা ফেরত যাবো না।

গোমস্তগীন বললেন- তোমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট যেতে দেয়া হবে না। তোমরা জিদ ধরবে এবং বলবে, আমরা বহুদূর থেকে ভক্তি ও আবেগ নিয়ে এসেছি। সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে আমরা যাবো না। আমি তোমাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আইউবী জযবার খুব মূল্যায়ন করে থাকেন। তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে সাক্ষাৎ দেবেন। বর্শাগুলো তোমাদের হাতে থাকবে। যদি তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন, তাহলে তোমরা ঘোড়া থেকে নামবে না। নিকটে গিয়েই ঘোড়া হাঁকাবে আর তার দেহটা বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করবে। তোমরা প্রত্যেকে জীবনের বাজি লাগানোর শপথ করেছে। তবে আমার আশা, তোমরা প্রত্যেকে নিরাপদে পালিয়ে আসতে সক্ষম হবে। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, সুলতানকে আহত অবস্থায় দেখামাত্র রক্ষীদের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যাবে। ঘটনাটা কী ঘটলো বুঝবার আগেই তোমরা তাদের তীরের আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আমি তোমাদেরকে আরবের এমন উন্নত জাতের ঘোড়া প্রদান করবো, বাতাসও যাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠে না।

পন্থাটা অত্যন্ত ভালো- ফেদায়ী ঘাতকচক্রের প্রধান বললো আমাদের সেই সহকর্মীরা আনাড়ি ও কাপুরুষ ছিলো, যারা আইউবীকে ঘুমন্ত অবস্থায়ও হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং উল্টো তার হাতে প্রাণ হারিয়েছে ও জীবন্ত গ্রেফতার হয়েছে। এবার আমরা যাচ্ছি। আমরা যদি আইউবীর মাথাটা কেটে নাও আসতে পারি, আপনি এ সংবাদ অবশ্যই শুনতে পাবেন যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিহত হয়েছেন।

আর যদি আমরা তাকে হত্যা করে ফিরে আসতে পারি, তাহলে? এক ফেদায়ী হেরেমের মেয়েদের তাঁবুগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে এবং শয়তানী হাসি হাসে।

গোমস্তগীন শয়তানী হাসির সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত। তিনিও ঠোঁটে অনুরূপ হাসি টেনে বললেন- তোমাদের যারা জীবিত ফিরে আসবে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করে আসবে, তাদেরকে আমি এক একটি তাঁবুতে প্রবেশ করিয়ে দেবো। খৃস্টানরা তোমাদেরকে যে পুরস্কার প্রদান করবে, তার চেয়ে আমি তোমাদেরকে এতো বেশী সোনা-দানা প্রদান করবো, যা তোমরা কখনো স্বপ্নেও দেখোনি। আর যে ব্যক্তি সালাহুদ্দীন আইউবীর মাথা কেটে নিয়ে আসবে, তাকে তার পছন্দ অনুসারে দুটি মেয়ে আজীবনের জন্য দিয়ে দেবো।

ফেদায়ীরা পশুর ন্যায় চিৎকার করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। গোমস্তগীন বড় কষ্টে তাদেরকে থামিয়ে বললেন- এসো, আমি তোমাদেরকে হামাতের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি। তবে সাবধান! পথে যদি কেউ তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কারা এবং কোথা থেকে এসেছে, তাহলে শুধু এটুকু বলবে যে, আমরা দাশে থেকে এসেছি এবং রণাঙ্গনে যাচ্ছি। পথে সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা ও গেরিলা সৈন্যদের সঙ্গে তোমাদের সাক্ষাৎ হবে। আজ রাতই তোমাদের রওনা হতে হবে।

আজ রাতেই?- এক ফেদায়ী বললো- আগামীকাল দিনে গেলে হয় না?

অতো সময় নেই- গোমস্তগীন বললেন- তোমাদের পথ অনেক দীর্ঘ। গন্তব্যে পৌঁছতে দুদিন সময় লাগবে। ঘোড়াগুলোকে আরাম দিতে দিতে যাবে। দ্রুত চলার দরুন ঘোড়া পথেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে পরে গন্তব্যে পৌঁছা কঠিন হবে।

গোমস্তগীন বাক্স থেকে পোশাকগুলো বের করে তাদের হাতে দিয়ে বললেন- এগুলো এখানেই পরে নাও। তিনি দারোয়ানকে বললেন, সেই নয়টি ঘোড়া নিয়ে আসো, যেগুলো আমি আলাদা করে রেখেছিলাম।

মধ্যরাতের পর। নয়জন অশ্বারোহী গোমস্তগীনের তাঁবু ত্যাগ করে হামাতের দিকে রওনা হয়ে যায়। সর্বসম্মুখের অশ্বারোহীর হাতে সুলতান আইউবীর ঝাণ্ডা। অপর আটজনের বর্শার আগায় বাঁধা ছোট ছোট পতাকা।

***

সেদিনের যে সময়টিতে গোমস্তগীন তার সালার ও কমান্ডারদেরকে জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে উৎসাহিত-উদ্দীপ্ত করছিলেন, সেদিন একই সময়ে সাইফুদ্দীন এবং হালবের সৈন্যরাও অনুরূপ উত্তেজনাকর ভাষণ শুনছিলো। হালবের এক সালার নিজ ঘোড়ার পিঠে চড়া অবস্থায় তার সৈনিকদেরকে বলছিলো

ইনি সেই সালাহুদ্দীন, যিনি হাল অবরোধ করেছিলেন। তোমরা সালাহুদ্দীনকেই এবং তার এই ফৌজকেই হাল্ব থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আমি কাবার প্রভুর শপথ করে বলছি, সালাহুদ্দীন কোনো দুর্গ বা শহর অবরোধ করলে তাকে জয় না করে ক্ষান্ত হন না, এ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা। তিনি হালবের অবরোধে কেন সফল হননি? তিনি কেন অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন? শুধু এ কারণে যে, তোমরা হলে সিংহ। তোমরা জানবাজ মুজাহিদ। তোমরা শহর থেকে বের হয়ে তার উপর যে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলে, তিনি তা সামাল দিতে পারেননি। জয় তারই ভাগ্যে জুটে, যার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন। মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট। সালাহউদ্দীন আইউবীর উপর আল্লাহ কেনো খুশী হবেন? তিনি তো লুটেরা। তিনি দামেস্ক দখল করেছেন। পদানত করার পর সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তিনি কিরূপ আচরণ করেছেন, সেখানে গিয়ে দেখে আসো। সেখানকার একজন নারীর ইজ্জতও অক্ষত নেই। আমরা দামেস্ক ত্যাগ করে হাল্ব চলে এসেছি। কিন্তু আমাদের দামেস্ক ফিরে যেতে হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী থেকে আমাদেরকে প্রতিশোধ নিতে হবে। আল্লাহর সৈনিকগণ! তোমরা একথা চিন্তা করো না যে, মুসলমান হয়ে তোমরা মুসলমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। সেই মুসলমান কাফিরের চেয়েও নিকৃষ্ট, যে মুসলমানদের শহর-নগর দখল করে বেড়ায়। এমন মুসলমানকে হত্যা করা তোমাদের উপর আল্লাহ ফব্রজ করে দিয়েছেন।

খেলাফতের মোহাফেজগণ! তোমাদের শত্রু খৃস্টানরা নয়- সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার বাহিনী। তিনিই খৃস্টানদেরকে আমাদের শত্রুতে পরিণত করেছেন। নূরুদ্দীন জঙ্গী জাতির উপর সবচেয়ে বড় অবিচার এই করেছেন যে, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে মিশরের শাসন ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। অন্যথায় লোকটা ক্ষুদ্র একটি সেনাদলের কমান্ড করারও যোগ্য ছিলেন না। আমি তো তাকে আমার বাহিনীতে সাধারণ সৈনিক হিসেবেও নিয়োগ দেবো না। এবার মৃত্যু তাকে এই পার্বত্য এলাকায় টেনে নিয়ে এসেছে। এখন তার সম্মুখে থাকবে তোমাদের তরবারী, বর্শা আর ঘোড়া। পেছনে থাকবে টিলা আর পাহাড়। তোমরা তাকে ও তার সৈনিকদেরকে পিষে মেরে ফেলতে পারবে। হালবের অপমান আর ধ্বংসের প্রতিশোধ তোমাদের নিতেই হবে। তোমরা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীকে এখানে এই পার্বত্য অঞ্চলে খতম করতে না পারো, তাহলে তিনি সোজা হালব চলে আসবেন। তার দৃষ্টি হালবের উপর নিবিষ্ট। তিনি তোমাদেরকে তার গোলাম বানাতে চাচ্ছেন। তোমাদের বোন কন্যারা তার সালারদের হেরেমের সেভায় পরিণত হবে। আমি মিথ্যুক হতে পারি, নূরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র মিথ্যুক নন। গোমস্তগীন তত মিথ্যা বলছেন না। এতোগুলো আমীর যদি মিথ্যুক না হয়ে থাকেন, তাহলে এক সালাহুদ্দীন অবশ্যই মিথ্যুক। আর এ কারণেই ইসলামের তিনটি বাহিনী তাকে পিষে মারতে এসেছে। তোমরা সকলে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তোমরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান। আজ প্রমাণ করতে হবে, ইসলাম ও আত্মমর্যাদার খাতিরে তোমরা আপন ভাইয়েরও রক্ত ঝরাতে পারো।

বাহিনী বাহ্যত নীরবে সালারের বক্তব্য শুনছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা চরমভাবে উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত। সালার সূত্য ও বাস্তবকে মাটিচাপা দিয়ে ফৌজের চেতনাকে উত্তেজিত করে তুলেছে। সৈন্যরা ধ্বনি দিতে শুরু করে- আমরা কারো গোলামী বরণ করে নেবো না, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে বেঁচে থাকতে দেবো না। তারা স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে।

সাইফুদ্দীনের ক্যাম্পের অবস্থাও উত্তেজনাকর। তিনিও তার বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন। তিনি তার সৈনিকদের জন্য একটি সুযোগ এই করে দেন যে, তিনি দুজন আলিম থেকে ফতোয়া নিয়ে এসেছেন, যুদ্ধের ময়দানে রোযা রাখা ফরজ নয়। এ ঘোষণায় তার সৈন্যরা সবাই খুশী। সাইফুদ্দীন বললেন, আমরা তখন আক্রমণ করবো, যখন আইউবীর রোযাদার সৈনিকদের দম নাকের আগায় এসে যাবে। তারপর আমাদের গন্তব্য হবে দামেস্ক। দামেস্কের অঢেল সম্পদ হবে তোমাদের।

***

সুলতান আইউবী তার সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেননি। তাঁর দৃতি সেই ভূখণ্ডটির উপর নিবদ্ধ, যেখানে তাঁকে লড়াই করতে হবে। এই যুদ্ধে কিভাবে অধিকতর সামরিক স্বার্থ উদ্ধার করা যায়, তা-ই তার ভাবনা। তিনি কথাবার্তা যা বলেছেন, বলেছেন সিনিয়র ও জুনিয়র কমান্ডারদের সঙ্গে। তাও বাস্তবভিত্তিক কোনো উত্তেজনাকর বক্তৃতা নয়। একটা বিষয় মনে পড়লেই কেবল মাঝে-মধ্যে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন যে, মুসলমান বন্ধুরাই তার ফিলিস্তিনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে আর মুসলমানরা মুসলমানের হাতে খুন হচ্ছে। তার কাছে এর কোনো প্রতিকারও ছিলো না। সন্ধি ও শান্তির জন্য প্রতিপক্ষের নিকট দূত প্রেরণ করে তিনি নিজেকেই। অপমানিত করেছেন। এখন সংঘাত-সংঘর্ষে তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি মিশর থেকে আসা বাহিনীকে পরিকল্পনা মোতাবেক বিভক্ত করে দিয়ে এখন দুশমনের অপেক্ষায় অস্থিরচিত্তে সময় অতিবাহিত করছেন। তিনি তার উপদেষ্টাদের নিকট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সম্ভবত শক্র বাহিনী চাচ্ছে, আমরা পাহাড়ি এলাকা থেকে বের হয়ে তাদের উপর আক্রমণ করি। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত, তিনি এ স্থান ত্যাগ করবেন না। তিনি দুশমনকে বিভ্রান্ত করার ফন্দি এঁটে বসে আছেন। তিনি ইচ্ছা করলে কমান্ডো সেনাদের দ্বারা দুশমনের ক্যাম্পে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা-ও করলেন না। তিনি দুশমনের চাল-কৌশল পর্যবেক্ষণ করছেন।

দামেস্কে নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের বিধবা স্ত্রী অপর এক রণাঙ্গন চালু করে রেখেছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন দামেস্ক ত্যাগ করে চলে যান, তখন থেকেই এই মহিয়সী নারী মেয়েদের একটি স্বেচ্ছাসেবক ফৌজ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। মেয়েদেরকে যুদ্ধাহত সৈনিকদেরকে রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে আনা, ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ প্রদান করার নিয়ম প্রচলিত ছিলো। কিন্তু নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী তার বাহিনীর মেয়েদেরকে তরবারী চালনা, বোমাবাজি এবং তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণও প্রদান করছেন। এ কাজের জন্য তিনি কয়েকজন অভিজ্ঞ পুরুষকেও দলে রেখেছেন। তিনি জানতেন, সুলতান আইউবী যুদ্ধক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি পছন্দ করেন না। এমতাবস্থায় তিনি মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করবেন, সে কথা তো ভাবাই যায় না। তথাপি তিনি মেয়েদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। তাছাড়া তখনকার পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো যে, মানুষ নিজ নিজ মেয়েদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করাকে গর্বের বিষয় মনে করতো। দশ বার বছরের কিশোরীরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কাঠের তরবারী তৈরি করে তরবারী চালনার অনুশীলন করতো।

সম্প্রতি জঙ্গীর স্ত্রীর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা চারজন বৃদ্ধি পেয়েছে। তন্মধ্যে একজন হলো ফাতেমা, যাকে সুলতান আইউবীর এক গুপ্তচর গোমস্তগীনের হেরেম থেকে বের করে এনেছে। একজন মসুলের খতীব ইবনুল মাখদূমের কন্যা মানসূরা। অপর দুজন সেই দুই মেয়ে, যাদেরকে হাল থেকে গোমস্তগীনের নিকট উপহারস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছিলো এবং সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত হাররানের কাজীকে হত্যা করে সেখান থেকে উদ্ধার করে এনেছিলো। তারা হলো হুমায়রা এবং সাহার। এরা সুলতান আইউবীর নিকট রণাঙ্গনে গিয়েছিলো। সেখান থেকে সুলতান তাদেরকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেন। এ ধরনের অসহায় মেয়েদেরকে নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রীর হাতে সোপর্দ করা হতো। এই চারজন মেয়েও তার নিকট পৌঁছার পর তিনি তাদেরকে সামরিক . প্রশিক্ষণে ভর্তি করে দেন। তাদের স্বপ্নও এটিই ছিলো, যা পূরণ হয়েছে।

তারা জঙ্গীর স্ত্রীকে নিজ নিজ কাহিনী শোনায়। তিনি তাদেরকে তার সংগঠনের মেয়েদের নিকট নিয়ে যান এবং বলেন, তোমরা এদেরকে পুখানুপুঙ্খরূপে তোমাদের কাহিনী শোনাও, চার মেয়ে নিজ নিজ কাহিনী শোনায়। খতীব কন্যা মানসূরা অত্যন্ত জ্ঞানী ও সচেতন। সে মেয়েদের উদ্দেশ করে বললো- 

নারী হলো জাতির ইজ্জত। দুশমন যখন কোনো জনবসতি দখল করে, তখন তাদের সৈন্যরা সর্বপ্রথম নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তোমরা এই মেয়ে দুটোর মুখ থেকে শুনেছ যে, খৃস্টান কবলিত এলাকাগুলোতে খৃস্টানরা মুসলমানদের সঙ্গে কত ভয়ংকর ও নির্মম আচরণ করে চলেছে। সেখানে একটি মুসলিম মেয়েরও ইজ্জত অক্ষত নেই। আল্লাহ না করুন, দামেস্কও যদি তাদের দখলে চলে যায়, তাহলে তোমাদেরকেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। আমরা যদি রক্তের কুরবানী দিতে অসম্মত হই, তাহলে খৃস্টানরা আমাদের প্রভুতে পরিণত হবে। তারা আমাদের বহু আমীরকে ক্রয় করে নিয়েছে। এখন খৃস্টানরাও আমাদের শত্রু, মুসলিম আমীরগণও আমাদের শত্রু। আমরা যদি বিজয় অর্জন করতে চাই, তাহলে প্রতিশোধের স্পৃহা জীবিত ও শাণিত রাখতে হবে। আমার আব্বাজান বলে থাকেন, যে জাতি কাফিরদের বর্বরতার শিকার ভাইদের কথা ভুলে যায়, সে জাতি বেশিদিন টিকে থাকে না।

আমার বোনেরা! আমি মোহতারাম সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভক্ত। আমি আইউবীর নামে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাঁর একটা নীতি আমি পছন্দ করি না, তিনি নারীকে রণাঙ্গনে যেতে দেন না। তিনি যা চিন্তা করেছেন, হয়ত ঠিকই করেছেন। যুবতী ও সুন্দরী মেয়েদেরকে হেরেমের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। আমাদেরকে পুরুষের বিনোদনের উপকরণ বানানো হয়েছে। এভাবে জাতির অর্ধেক শক্তি বেকারই রয়ে গেছে। দুশমন সৈন্য নিয়ে আসে। তার মোকাবেলায় আমাদের সৈন্যসংখ্যা তাদের অর্ধেকও হয় না। তাই আমরা নারীদের পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করে সৈন্যের অভাব পূরণ করবো। আমি মসুলে গোয়েন্দা দলে ছিলাম। এই ময়দানে আমি লড়াই করে এসেছি। আমার পিতার ভুলটা ছিলো, তিনি আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর মনের কথা বলে ফেলেছেন। ধরা না খেলে সেখানে আমাদের পরিকল্পনা অন্যকিছু ছিলো। আমরা সেখানে ধ্বংসলীলা চালাতে পারিনি এবং সেখান থেকে আমাদের পালিয়ে আসতে হলো।

চার মেয়ের জ্বালাময়ী বক্তব্য নূরুদ্দীন জঙ্গীর বাহিনীর মেয়েদের স্পৃহাকে আরো শাণিত করে তুলেছে। এখন তারা পূর্বের তুলনায় অনেক উজ্জীবিত। তাদের চারশত মেয়ে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে প্রস্তুত হয়ে আছে। জঙ্গীর স্ত্রী তাদেরকে রণাঙ্গনে প্রেরণ করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তারা রওনা হবে বলে। নবাগত চার মেয়েও কয়েকদিনের মধ্যে কিছু প্রশিক্ষণ অর্জন করে ফেলেছে। কিন্তু এখনও পূর্ণ দক্ষ হয়ে ওঠেনি বলে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হলো না। কিন্তু তাদের হৃদয়ে প্রতিশোধস্পৃহা এতোই বেশি যে, তারা এই বাহিনীর সঙ্গে ময়দানে যেতে জিদ ধরে। ফাতেমা, হুমায়রা তো রীতিমতো কেঁদে ফেলে। অগত্যা জঙ্গীর স্ত্রী তাদেরকেও বাহিনীতে যুক্ত করে নেন। একশত পুরুষ যোদ্ধাও তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। তাদের কমান্ডার হলেন হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস।।

নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাসকে একটি লিখিত বার্তা দিয়ে বললেন, এটি সালাহুদ্দীন আইউবীকে দেবে। আমার যা বলার সব লিখে দিয়েছি। তাকে বলবে, এই মেয়েগুলোকে আহতদের সেবা-শশ্রুষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তুমি ভালোভাবে শুনে নাও, এই মেয়েগুলোকে এবং স্বেচ্ছাসেবী মোহাফেজদেরকে তোমার সঙ্গে রাখবে। এরা প্রত্যেকে গেরিলা হামলার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মেয়েরাও যুদ্ধ করতে জানে। আহতদের সেবার বাহানা দেখিয়ে তোমরা লড়াই করবে। সুযোগ পেলেই দুশমনকে দুর্বল করে ফেলবে। আমি মেয়েদেরকে বলে দিয়েছি, তারা যেন দুশমনের হাতে ধরা না পড়ে। তারা নিজেরাই বলছে, ধরা পড়ার আশংকা দেখা দিলে নিজের তরবারী দ্বারাই নিজেকে শেষ করে ফেলবে।

চারশত মেয়ে ও একশত স্বেচ্ছাসেবী পুরুষ যোদ্ধার এই বাহিনীটি ঘোড়ায় আরোহন করে যখন রওনা হয়, তখন সমগ্র শহর যেনো হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে। জনতা ইসলামের এই সৈনিকদেরকে ফুল ছিটিয়ে স্বাগত জানায়। নারায়ে তাকবীর-আল্লাহ আকবার, ইসলাম জিন্দাবাদ, সালাহুদ্দীন আইউবী জিন্দাবাদ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। জনতা তাদেরকে এই বলে উৎসাহিত করে যে, তোমরা ফিরে এসো না, সম্মুখপানে এগিয়ে যাও। সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবে, দামেস্কের সকল নারী আসবে। আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়, দান করুন। ইসলামের একজন শত্রুও বেঁচে থাকতে পারবে না। শহরের বহু মানুষ উট-ঘোড়ায় আরোহন করে বহু দূর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গিয়ে বিদায় জানায়।

***

রমযান মাস। পথে এক রাত অবস্থান করতে হবে। ইফতারের খানিক আগে কাফেলা এক স্থানে যাত্রাবিরতি দেয়। মেয়েরা খাবার প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতে শীত পড়ছে। কাফেলায় ঘোড়ার পাশাপাশি উটও আছে। উটগুলোর পিঠে তাঁবু বোঝাই করা। তাঁবুগুলোর ভেতরে লুকিয়ে রাখা আছে বর্শা, তরবারী ও তীর-ধনুক। সূর্যাস্তের আগ মুহূর্তে কোথা থেকে যেন আটজন অশ্বারোহী এসে হাজির হয়। এরা সুলতান আইউবীর গেরিলা সৈনিক দামেস্ক থেকে রণাঙ্গনগামী পথের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা কাফেলা দেখে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য এসেছে।

অশ্বারোহীদেরকে কাফেলার দিকে আসতে দেখে কমান্ডার হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস এগিয়ে যান। গেরিলাদের কমান্ডার হলেন আনতান। তিনি আবু ওয়াক্কাসকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কারা এবং কোথায় যাচ্ছেন? আবু ওয়াক্কাস তাকে ঘটনাটা বিস্তারিত অবহিত করেন। আনতানুন নিশ্চিত হয়ে যান।

গেরিলাদের দেখে অনেকগুলো মেয়ে ছুটে এসে তাদের চারপাশে জড়ো হয়। সকলের একই প্রশ্ন, ময়দানের খবর কী? আনতন্ন তাকে জানান, যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি এবং কখন শুরু হবে তাও বলা যায় না।

আনতানূন বলতে বলতে থেমে যান। তার দৃষ্টি একটি মেয়ের উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। এক সময় বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ফাতেমা! তুমি কিভাবে এসেছো?

ফাতেমা অস্থিরচিত্তে এগিয়ে এসে আনতানূনের ডান হাতটা ধরে ফেলে। আনতানূন ফাতেমাকে গোমস্তগীনের হেরেম থেকে বের করে এনেছিলো। আবু ওয়াক্কাস আনতানূনকে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে ইফতার করবেন এবং খানা খাবেন।

সবাই যার যার কাজে চলে যায়। ফাতেমা আনতানূনকে জয় করে ফেলে। আনতান্ন তাকে রাতে একত্র হওয়ার জন্য একটা জায়গা ঠিক করে দেয়।

দামেস্ক থেকে দূরবর্তী এই বিজন অঞ্চলে মাগরিবের আযানের সুললিত সুর ভেসে ওঠে। সবাই ইফতার করে নামায আদায় করে। পরে আহারপর্ব সমাপ্ত করে। সারাদিনের ক্লান্ত সবাই। অনেকে শুয়ে পড়ে। আনতানূন ডিউটি করার নাম বলে সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে একদিকে চলে যায়।

মেয়েদের ভেতর থেকে ফাতেমা চুপি চুপি বের হয়ে আসে। তাঁবু এলাকা থেকে দূরে এক স্থানে দাঁড়িয়ে আনতানূনের অপেক্ষা করছে সে। আনতানূন এসে গেছেন। ফাতেমার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল হাররানে। সে সময় আনতানূন সুলতান আইউবীর গুপ্তচর ছিলেন। হাররানের শাসনকর্তা ও সুলতান আইউবীর দুশমন গোমস্তগীনের হেরেমের মেয়ে বলে তাকে হাত করেছিলো আনতানূন। তাকে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটনাক্রমে ফাতেমা এক খৃস্টান উপদেষ্টাকে খুন করে ফেলে এবং আনতান্ন গ্রেফতার হয়ে পরে ফাতেমাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন। সুলতান আইউবী ফাতেমাকে দামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং আনতানূন তার আবেদন মোতাবেক গেরিলা বাহিনীতে ভর্তি করে নেন। দীর্ঘদিন পর আজ অনাকাঙ্খিতভাবে ফাতেমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়ে গেলে তার মনে তীব্র অনুভূতি জাগে যে, ফাতেমাকে ছাড়া তার জীবন অচল এবং মেয়েটা তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। অপরদিকে ফাতেমার অবস্থাও অনুরূপ।

ফাতেমা ও আনতানূন দুজনই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। কেউই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কিন্তু এক সময় নিজেকে সামলে নিয়ে আনতামূন ললো- ফাতেমা! আমাদের কর্তব্য এখনো পালিত হয়নি। আমি হাররানে আমার দায়িত্ব শেষ করে আসতে পারিনি। তোমাকে সেখান থেকে বের করে আনা আমার কোনো কৃতিত্ব ছিলো না। এটা আমার কর্তব্যও ছিলো না। আমি সুলতান আইউবীর সম্মুখে লজ্জিত। জাতির কাছেও আমার মুখ দেখানোর সুযোগ নেই। দায়িত্ব পালন করতে না পারার কাফফারা স্বরূপ আমি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছি। সুলতান আইউবী এই সাতজন কমান্ডোর নেতৃত্ব আমার উপর সোপর্দ করেছেন। তোমাকে আমি অনুরোধ করি, তুমি এরপর পুনরায় আমার গতিরোধ করো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে কর্তব্য পালনের সুযোগ দাও।

আমিও কর্তব্য পালন করতে এসেছি- ফাতেমা বললো- আমি গোমস্তগীনকে হত্যা করতে এসেছি।

অসম্ভব- আনতামূন বললেন- মহামান্য সুলতান নারীদেরকে রণাঙ্গন থেকে অনেক দূরে রাখেন। তিনি সম্ভবত তোমাদের প্রত্যেককে ফিরিয়ে দেবেন।

আমি ফিরে যাবো না- ফাতেমা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- আমি প্রমাণ করবো, নারী হেরেমের জন্য নয়- জিহাদের জন্য জন্মেছে। আনতান! আমাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমার আকাঙ্খটা তুমি পূর্ণ করো। আমাকে পুরুষের পোশাক পরিয়ে দাও।

এ হতে পারে না- আনতানূন বললেন- আমি যদি তোমাকে সঙ্গে রাখি, তাহলে আমার মনোযোগ তোমার উপর আটকে থাকবে। আমি কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হবে। আর যদি ধরা খেয়ে যাই, তাহলে একটি মেয়েকে সঙ্গে রাখার অপরাধে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। আমাদের উদ্দেশ্য যতোই পবিত্র ও সৎ হোক না কেন, এই অন্যায় সামান্য নয়। ফাতেমা! যুদ্ধ আবেগ দ্বারা লড়া যায় না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। তুমি যেদিকে যাওয়ার জন্য এসেছে, চলে যাও। হতে পারে, সুলতান তোমাদেরকে জখমীদের ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত করবেন।

তারপর আবার কবে কোথায় দেখা হবে? ফাতেমা জিজ্ঞেস করে।

 যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে হতে পারে; জীবিত কিংবা মৃত আনতান জবাব দেয়- একজন গেরিলা সৈনিক আগাম বলতে পারে না কখন কোথায় থাকবে এবং তার লাশ কোথা থেকে উদ্ধার করা হবে। তাছাড়া গেরিলাদের লাশ পাওয়া যায় না। তারা দুশমনের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তারপরও যদি আমি বেঁচে থাকি, সোজা তোমার নিকট এসে যাবো।

 এমনও তো হতে পারে যে, তুমি যুদ্ধে আহত হবে আর আমি তোমার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করবো। ফাতেমা বললো।

গেরিলা সৈনিকদের ব্যান্ডেজ-চিকিৎসা করে শত্রুরা- আনতানূন জবাব দেয়- তুমি আবেগপ্রবণ হয়ে না ফাতেমা! আমাদেরকে আবেগ ত্যাগ করতে হবে, ত্যাগ করতে হবে ভালবাসাও। তুমি যদি এই কামনা করো, যে, তুমি কোনো মুসলমানের হেরেমেও যাবে না, দুশমনের হিংস্রতা থেকেও বেঁচে থাকবে, তাহলে আমার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলল। যুদ্ধের ময়দানে তোমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, তা-ই শুধু পালন করবে। আর তুমি গোমস্তগীনকে হত্যা করতে পারবে না। এই ভাবনাটাও মাথা থেকে ফেলে দাও।

আনতানের কোনো কথাই ফাতেমাকে প্রভাবিত করলো না। না তার অন্তর থেকে গোমস্তগীন হত্যার চিন্তা দূর হলো, না আনতানূনের ভালবাসা।

***

সুলতান আইউবীর তৎপরতা দুটি। হয় তিনি রণাঙ্গনের মানচিত্র দেখে তাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন, নয়তো ঘোড়ার পিঠে চড়ে নিজ বাহিনীর মোর্চাগুলো পরিদর্শন করবেন। তিনি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আসল যুদ্ধটা তিনি হামাতের অভ্যন্তরে লড়তে চাচ্ছেন, যার পরিকল্পনা তার ঠিক করা আছে। কিন্তু একটা সমস্যা হলো, ডান পার্শ্বে টিলার সংখ্যা বেশি নয়। তার পিছনে খোলা মাঠ। দুশমন সেই পথে বেরিয়ে যেতে কিংবা সেদিক থেকে এসে ক্ষতিসাধন করতে পারে। আর তাতে সুলতান আইউবীর সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশংকা বিদ্যমান। তার কাছে এতে সৈনিকও নেই যে, তিনি এই ময়দানে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর দেয়াল তৈরি করে ফেলতে পারবেন। পার্শ্ববর্তী টিলার উপর তিনি তীরন্দাজ বসিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এতোটুকু আয়োজন যথেষ্ট নয়। ময়দানের জন্য তিনি দুই ইউনিট আরোহী ও পদাতিক বাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছেন। কিন্তু তাদেরকে এখনো লুকিয়ে রেখেছেন। এই ময়দানই সুলতান আইউবীকে বেশি অস্থির করে তুলছে। তাছাড়া আরো একটা বিশেষ বাহিনী তিনি তৈরি করে নিজের কাছে রেখেছেন।

সুলতান আইউবী একটা টিলার উপর দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক পর্যবেক্ষণ করছেন। এমন সময় দূরদিগন্তে তিনি ধূলি উড়তে দেখতে পান। একজন সৈনিক এই ধূলির তাৎপর্য ভালোভাবেই বুঝে। সুলতান বুঝে ফেললেন, কোনো অশ্বারোহী বাহিনী এগিয়ে আসছে। ধূলির বিস্তৃতিদেখে বুঝা যাচ্ছে ঘোড়াগুলো এক সারিতে নয়- চার কিংবা ছয় সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে সুবিন্যস্তরূপে অগ্রসর হচ্ছে। এই বাহিনী দুশমন ছাড়া আর কারো হতে পারে না। সুলতান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- এই পথে কি আমাদের একজন লোকও ছিলো না। প্রস্তুতির নির্দেশ দাও।

 প্রস্তুতির ঘণ্টা বেজে ওঠে। প্রতিরক্ষার জন্য যে পদ্ধতিতে প্রস্তুত হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো, তারা সে পদ্ধতিতেই প্রস্তুত হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর ঘোড়া চোখে পড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের চলন শত্ৰু কিংবা আক্রমণকারীসুলভ নয়। সুলতান আদেশ করেন, দু-চারজন অশ্বারোহী এগিয়ে গিয়ে জেনে আস, তারা কারা? কয়েকজন অশ্বারোহী ছুটে যায়। ফিরে এসে তারা দূর থেকেই চিৎকার করে বলতে শুরু করে- দামেস্ক থেকে স্বেচ্ছাসেবী এসেছে। সঙ্গে নারী ফৌজও আছে।

নারী ফৌজ?- কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে যায় সুলতান আইউবীর। কণ্ঠে বিস্ময়- নারী ফৌজ! কিছুক্ষণ নীরব থেকে স্তস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন- এই বাহিনী আমার বিধবা বোনটি গঠন করে পাঠিয়ে থাকবেন। জঙ্গী মরহুমের বিধবাই এ কাজ করতে পারেন।

সুলতান আইউবী হাসতে শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, সুলতান অতীতে কখনো এতো হাসেননি। হাসতে হাসতে তিনি আবেগাপুত হয়ে পড়েন। তিনি উফুল্লচিত্তে পার্শ্বে দণ্ডায়মান সালারদের বলতে শুরু করলেন আমার জাতির মেয়েরা তোমাদেরকে সফলকাম না করে নিঃশ্বাস ফেলবে না। এই কিশোরীগুলোর ইজ্জতের জন্য আমরা কেননা জীবন বিলিয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু… কিন্তু আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেবো। একটি মেয়েও যদি শক্রর হাতে। চলে যায়, তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

টিলার উপর থেকে নেমে সুলতান আইউবী সামনের দিকে এগিয়ে যান। নারীফৌজ ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীদের কাফেলাটি নিকটে চলে আসে। কমান্ডার আবু ওয়াক্কাস ঘোড়া থেকে নেমে সুলতান আইউবীর নিকট চলে যান। তিনি সালাম দিয়ে নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর পত্রখানা সুলতানের হাতে তুলে দেন। সুলতান পত্র পাঠ করতে শুরু করেন

আমার ভাই! আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। আমার স্বামী জীবিত থাকলে আজ আপনাকে এতোগুলো দুশমনের সম্মুখে একা থাকতে হতো। আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারছি না। যা সব ছিলো, আপনার সখীপে পেশ করলাম। এই মেয়েগুলোকে আমি আহতদের ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছি। বিপুল পরিমাণ ঔষধপত্রও পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে একশত পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী প্রেরণ করলাম। প্রবীণ যোদ্ধারা এদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। প্রত্যেককে কমান্ডো আক্রমণের অনুশীলনও প্রদান করেছে। সবাই উদ্দীপ্ত-উজ্জীবিত। আমি জানি, আমার মেয়েগুলোকে ময়দানে প্রেরণ করা আপনি পছন্দ করবেন না। আমি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত আছি। কিন্তু আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, যদি আপনি এদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেন, তাহলে দামেস্কবাসীর মন ভেঙ্গে যাবে। এই নগরীর লোকদের মাঝে কিরূপ চেতনা বিরাজ করছে, আপনি তা জনেন না। পুরুষরা ময়দানে যেতে প্রস্তুত। নারীরা আপনার নেতৃত্বে লড়াই করতে অস্থির। এই বাহিনীকে সকল নপরবাসী পরম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসার সঙ্গে বিদায় করেছে। এখানকার শিশু-কিশোররাও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। আপনার সৈন্যের অভাব থাকবে না।  

সুলতান আইউবী পত্রখানা পাঠ করেন। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি মেয়েগুলোর প্রতি চোখ তুলে তাকান। ওরা মেয়ে বটে; কিন্তু ঘোড়ার পিঠে তাদেরকে সৈনিক বলেই মনে হচ্ছে। সুলতান আইউবী তাদের সবাইকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে নিজের সম্মুখে দাঁড় করান। তিনি বললেন

আমি তোমাদের প্রত্যেককে যুদ্ধের ময়দানে স্বাগত জানাচ্ছি। তোমাদের জযবার মূল্য আমি পরিশোধ করতে পারবো না। আল্লাহ তোমাদেরকে উপযুক্ত বিনিময় দান করবেন। মেয়েদের যুদ্ধের ময়দানে ডেকে আনবো আমি কখনো ভাবিনি। আমার ভয় হচ্ছে, ইতিহাস বলবে, সালাহুদ্দীন আইউবী নারীদের দিয়ে যুদ্ধ করিয়েছেন। তবে আমি তোমাদের চেতনাকে বিক্ষতও করতে পারি না। তোমাদের মধ্যে যদি কোনো মেয়ে এমন থাকে যে স্বেচ্ছায় আসেনি, সে আলাদা সরে দাঁড়াও। আর তারাও আলাদা হয়ে যাও, যাদের অন্তরে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ কিংবা ভীতি আছে?

কিন্তু মেয়েদের কেউই সরে দাঁড়ালো না।

সুলতান আইউবী বললেন–

আমি তোমাদেরকে নিরাপদ স্থানে রাখবো। যুদ্ধের সময় আমি তোমাদেরকে সামনে যেতে দেবো না। তারপরও ভূখণ্ডটা এমন যে, তোমরা দুশমনের নাগালে এসে যেতে পারো। কেউ বর্শার আঘাতে মারাও যেতে পারো। এমনও হতে পারে, তোমাদের কেউ দুশমনের হাতে ধরা পড়ে যাবে। এ কথাও শুনে রাখো যে, তীর-তরবারী ও বর্শার জখম খুবই শহর ও গুরুতর হয়ে থাকে।

এক মেয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো- আপনি ইতিহাসকে ভয় করছেন আর আমরাও ইতিহাসকে ভয় করছি। আমরা যদি ফিরে চলে যাই, তাহলে ইতিহাস বলবে, জাতির মেয়েরা সুলতান আইউবীকে একাকী ময়দানে ফেলে ঘরে বসেছিলো।

অপর এক মেয়ে বললো, আল্লাহ সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারীতে আরো শক্তি দান করুন। আমরা হেরেমের জন্য জন্মাইনি।

আরেক মেয়ে বললো- তিন চাঁদ আগে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। আপনি যদি আমাকে ফেরত দেন, তাহলে আমি আমার স্বামীকে নিজের জন্য হারাম মনে করবো।

তোমার স্বামী নিজে কেন আসেনি? সুলতান জিজ্ঞাসা করলেন- সে, তার স্ত্রীকে কেনো পাঠিয়ে দিয়েছে?

তিনি আপনার ফৌজেই আছেন। মেয়েটি জবাব দেয়। 

এবার সবগুলো মেয়ে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তারা তাদের জোশ ও জযবার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। হৈ-চৈ কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসলে এক মেয়ে বলে উঠলো- মহামান্য সুলতান! আপনি আমাদেরকে যুদ্ধ করার সুযোগ দিন; আমরা আপনাকে নিরাশ করবো না।

আমি তোমাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেবো, এ কথা তোমরা ভুলে যাও- সুলতান আইউবী বললেন- আমি তোমাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করবো

  সুলতান আইউবী সেদিনই মেয়েদেরকে চার-চারজনের দলে বিভক্ত করে দেন। প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে স্বেচ্চাসেবী নিয়োজিত করেন। স্বেচ্চাসেবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সুলতান আইউবী তাদের সেবা-শশ্রুষার কাজে নিয়োজিত করেন। কেননা, তারা নিয়মিত সৈনিক নয়। ফৌজের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। সুলতান আইউবী তাদেরকে সেই সৈনিকদের হাতে তুলে দেন, যারা শহীদদের লাশ ও আহত সৈনিকদের তুলে আনা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা মেয়ে এবং স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেয়।

***

ফাতেমা, মানসূরা, হুমাইরা ও সাহার পড়ে একদলে। তাদের একদলে একত্রিক হওয়া একটি অলৌকিক ব্যাপার। কেননা, তারা দামেস্কও। এসেছিলো একসঙ্গে। হৃদয়ের বাসনা, জ্বলন এবং চেতনাও তাদের অভিন্ন। তাদের দলের স্বেচ্ছাসেবীর নাম আযর ইবনে আব্বাস। আযরের ক্ষুদ্র তবুটি আলাদা। তার সন্নিকটেই স্থাপন করা হয়েছে চার মেয়ের বড় তাবু। এই চার মেয়ের মধ্যে খতীবের কন্যা অন্যদের তুলনায় সর্বল, বুদ্ধিমতি ও চতুর। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মানসূরা দেখতে পেলো, আর একটি টিলার উপর উঠে এদিকে-ওদিক তাকাতে শুরু করেছে। দেখে সেও উপরে চলে যায় এবং ইতিউতি তাকায়। উপত্যকা ও পাহাড়ের ঢালুতে সৈনিক দেখা যাচ্ছে। আর মানসূরাকে বললো, এসো আমরা আরো একটু সম্মুখে যাই। মানসূরা আযরের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এবং পাহাড়ী এলাকার প্রশংসা করতে শুরু করে।

আযর সুদর্শন যুবক। কথাবার্তা বেশ আকর্ষণীয়। মানসূরার সঙ্গে সালাপ করতে শুরু করে সে। মানসূরাও তাতে স্বাদ নিতে আরম্ভ করে। তারা সূর্যাস্তের আগে আগেই ফিরে আসে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে আর মানসূরার অন্তরে বাসা বেঁধে ফেলে।

ইফতারের পর মেয়েরা তাদের তাঁবুতে বসে আহার করছে। ফৌজের এক কমান্ডার তাঁবুর ভেতর উঁকি দিয়ে তাকায় এবং মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করে- কোন অসুবিধা নেই তো? মেয়েরা জানায়- না, আমাদের কোন সমস্যা নেই। কমান্ডার ফিরে যায়।

সে সময় আযর বাইরে দাঁড়ানো ছিলো। সে কমান্ডারের সাথে কথা বলতে থাকে। মানসূরা তাদের কথোপকথন শুনছিলো। আর কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করে, এই সামান্য ফৌজ দ্বারা সুলতান তিনটি বাহিনীর মোকাবেলা কিভাবে করবেন?

দুশমনের জন্য ফাঁদ বসানো আছে। যুদ্ধ সেই ময়দানে হবে না, যে ময়দানে হবে বলে দুশমন মনে করছে। আমরা তাদেরকে টেনে সেই জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে তাদের জন্য আমরা ফাঁদ প্রস্তুত করে রেখেছি। কমান্ডার আযরের আবেগে প্রভাবিত হয়ে বলে দেয়, সুলতান আইউবী তার ফৌজকে কোথায় কিভাবে বণ্টন করেছেন এবং তিনি কী করবেন। মিশরের রিজার্ভ বাহিনীর কথাও বলে ফেলে কমান্ডার।

সে রাতের ঘটনা। মধ্যরাতে মানসূরার চোখ খুলে যায়। আর ইবনে আব্বাসের তাঁবু থেকে কথার শব্দ শুনতে পায়- তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও। কিছু বিষয় তোমরা নিজেরা জেনে নিয়েছে। বাকি তথ্য আমি তোমাদেরকে বলে দিয়েছি। আমার পক্ষে এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব ছিলো না। ভালোই হলো যে, তোমরা এসে গেছে। এবার রাস্তা চিনে নাও।

আযর পথের বিবরণ দিয়ে বললো- তুমি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। ফাঁদ প্রস্তুত। পাহাড়ের অভ্যন্তরে ঢোকা যাবে না।

মানসূরা এক ব্যক্তির পায়ের শব্দ শুনতে পায়। লোকটি চলে গেছে। মেয়েটি তাঁবুর দরজা সামান্য ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকায়। আর তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে একদিকে চলে যায়। মানসূরা তার তাবুর কাউকে না জাগিয়েই সামান থেকে খঞ্জরটা বের করে বেরিয়ে পড়ে।

আকাশে হালকা মেঘ। ফলে জোৎস্না রাত হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। আযরকে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছে মানসূরা। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আড়ালে আড়ালে আয়রকে অনুসরণ করছে সে। আর একটি টিলার কোল ধরে সম্মুখপানে হাঁটতে শুরু করে। মানসূরাও একই পথ ধরে এগুতে থাকে। পথে কোনো সান্ত্রী কিংবা অন্য কোনো সৈনিক চোখে পড়ছে না। তাতে মানসূরা বুঝে ফেলে, নারী সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবীদের তাঁবু সম্মুখের মোর্চাগুলো থেকে অনেক পেছনে স্থাপন করা হয়েছে এবং তার পেছনে আর কোনো ফৌজ নেই। কিন্তু সেখানে কয়েকটি স্থানে যে ফৌজ বিদ্যমান, মানসূরার তা অজানা। কিন্তু আর আগন্তুককে এমন পথ বলে দিয়েছে, যে পথে কোনো ফৌজ তাকে দেখতে পাবে না। আযর দুটি টিলার মধ্যকার সরু একটি গলির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। মানসূরা প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সেও তাতে প্রবেশ করে।

সম্মুখে গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ সমতল ভূমি। আর কোনো একটি গাছের আড়ালে গিয়ে থেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার হাঁটছে। মানসূরাও একই ধারায় অগ্রসর হচ্ছে।

বেশকিছু পথ অতিক্রম করার পর এখন আবার পাহাড়ের পাদদেশ। আযর এগিয়ে চলছে। মানসূরাও তাকে অনুসরণ করছে। পাহাড়টির অভ্যন্তরে একটি গিরিপথ। আর তাতে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে মানসূরাও।

গিরিপথে ঢোকামাত্র হিমশীতল বাতাসের ঝাঁপটায় মানসূরার পা উপড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তার দেহ নির্জীব হতে শুরু করে। আযরের মনে কী যেন সংশয় জাগে। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পেছন দিকে ফিরে তাকায়। তৎক্ষণাৎ মানসূরা বিশাল একটি পাথরের আড়ালে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আর আবার সম্মুখপানে এগুতে শুরু করে। মানসূরা উঠে দাঁড়ায় এবং পাহাড়ের ছায়াটা যেদিকে গিয়ে পড়েছে, মানসূরা সেদিকে এগিয়ে যায়।

গিরিপথ থেকে বের হওয়ার পর এখন খোলা মাঠ। আর দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। মানসূরাও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সে তো মহিলা। তদুপরি এততক্ষণ বহু পথ অতিক্রম করেছে সে। একদিকে প্রচণ্ড শীত, অপরদিকে পায়ের তলে কংকর। মানসূরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

এটা একটা আবেগ, যা মানসূরাকে আযরের পশ্চাতে হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছে। এবার তার মনে ভাবনা জাগে, এই পশ্চাদ্ধাবনের ফল কী দাঁড়াবে। আর যদি দৌড় দেয়, তাহলে মানসূরা তার সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু আযরের প্রতি মানসূরার সন্দেহ বাস্তব। আর দুশমনের দিকেই যাচ্ছে। মানসূরা তাকে ধাওয়া করছে ঠিক; কিন্তু তাকে কিভাবে ধরবে বা ধরাবে, ভেবে দেখেনি। এখন তো আর হাঁটছে খুব দ্রুত। এই পরিস্থিতিতে তাকে ধরতে গেলে মুখোমুখি মোকাবেলা করতে হবে। মানসূরার কাছে খঞ্জর আছে। আছে খঞ্জর ব্যবহারের প্রশিক্ষণও। কিন্তু দুশমনের মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা তার নেই। এই দুশমন স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী। মানসূরা কি পারবে পরাস্ত করে তাকে ধরে ফেলতে!

মানসূরা ভাবছে আর দ্রুত হাঁটছে। হঠাৎ আযর থেমে যায়। সে পেছনে ফিরে তাকায়। মানসূরার নিকটে একটি গাছ ছিলো। সে দ্রুত গাছটির আড়ালে চলে যায়। গাছের স্থানটা সামান্য উঁচু। আশপাশটা পাথরে পরিপূর্ণ। মানসূরা পাথরের পেছনে নেমে পড়ে। রাতের নীরবতায় পাথরের শব্দ কানে আসে আযরের। আর পেছন দিকে ফিরে আসে। মানসূরা তার আগমন দেখে ফেলে। সে উঠে না দাঁড়িয়ে গাছটির পিছনে শক্ত করে ধারণ করে। আর গাছটির একেবারে নিকটে চলে আসে। মানসূরা দেখতে পায় তার হাতে খাপখোলা তরবারী। গাছটি অতিক্রম করে আযর সামান্য এগিয়ে গেলে মানসূরা পেছন দিকে থেকে খপ করে তার দুপায়ের গোড়ালী ধরে ফেলে পূর্ণ শক্তিতে পেছন দিকে ঝটকা টান দেয়। আর উপুড় হয়ে সম্মুখ দিকে পড়ে যায়। পরক্ষণেই মানসূরা তার পিঠের উপর দুই চাপা দিয়ে ডান হাতে খঞ্জরের আগাটা তার ঘাড়ে স্থাপন করে। ঘটনাটা দু থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়।

কনুই আর দেহের সমস্ত ওজন দিয়েও তাগড়া একটা যুবককে কাবু করা একটা মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কিন্তু ঘাড়ের উপর খঞ্জরের আগা আযরকে নিক্রিয় করে ফেলে। তার তরবারীটা হাত থেকে ছুটে পড়ে যায়।

তুমি কে? উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অসহায় অবস্থায় নিজ্ঞেস করে আযর।

যার হাত থেকে তুমি বাঁচতে পারবে না। মানসূরা বললো।

তুমি কি নারী?

হ্যাঁ- মানসূরা জবাব দেয়- আমি নারী, তোমার পরিচিত এক নারী। আমার নাম মানসূরা।

উহ্, পাগলী মেয়ে!–আযর হেসে বললো- তুমি ঠাট্টা করছো? আমি তে ভয় পেয়ে গেছি। ঘাড় থেকে খঞ্জর সরাও। ওটা চামড়ায় ঢুকে যাচ্ছে।

এটা ঠাট্টা নয় আযর। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?

আল্লাহর কসম! আমি অন্য কোনো মেয়ের পেছনে যাচ্ছিলাম না- আযৰু বন্ধুসুলভ কণ্ঠে জবাব দেয়- তোমার চেয়ে ভালো মেয়ে আছে বলে আমি মনে করি না। আমি তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছি না।

আমাকে নয়, তুমি আমার জাতিকে ধোঁকা দিচ্ছো- মানসূরা বললো তুমি আমাকে সবচেয়ে ভালো মেয়ে মনে করছে। আর আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালো পুরুষ মনে করতাম। কিন্তু এখন না তুমি আমার কাছে ভালো, না আমি তোমার কাছে ভালো। কর্তব্যের কাছে আবেগ পরাজিত হয়েছে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালনে যাচ্ছে আর আমি আমার কর্তব্য পালন করছি। তুমি যদি আমার স্বামী, আমার দেহ ও আত্মার মালিক কিংবা আমার সন্তানদের পিতা হতে, তবুও আমার খঞ্জর তোমার ঘাড় স্পর্শ করতো।

আচ্ছা, তুমি আমাকে কী মনে করে ফেলে দিয়েছ? আযর জিজ্ঞেস করে।

নামের মুসলমান আর খৃস্টানদের চর মনে করে- মানসূরা জবাব দেয় তুমি খৃস্টান বন্ধুদের বলতে যাচ্ছে যে, সাবধানে আক্রমণ চালাবে এবং পবর্তমালার অভ্যন্তরে ঢুকবে না।

তুমি আসলে জানোই না চর কাকে বলে- আযর বললো- আমি দুশমনকে পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছিলাম।

আমি জানি, গুপ্তচর কেমন হয়ে থাকে- মানসূরা বললো- আমি অনেক বড় এক গোয়েন্দার কন্যা। ইবনুল মাখদুম কাকরূরীর নাম কখনো শুনেছো? তিনি মসুলের খতীব ছিলেন। আমি তারই দলের গোয়েন্দা। আমি আমার পিতাকে মসুলের কারাগারের পাতাল কক্ষ থেকে বের করে এনেছি এবং নিজে তাঁর সঙ্গে মসুল থেকে পালিয়ে এসেছি। তুমি আনাড়ী গুপ্তচর। অভিজ্ঞ গুপ্তচররা দূরে গিয়ে কথা বলে। কারো তাবুর নিকট দাঁড়িয়ে গোপন কথা বলে না। তুমি স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এসেছিলে। এখন এখানে কী করছো?

আমার উপর থেকে সরে যাও- আযর বললো- খঞ্জর সরাও। আমি একটি জরুরী কথা বলতে চাই।

তোমার যবান মুক্ত- মানসূরা বললো- বলো, জরুরী কথা বলো। আমি শুনছি।

আর চুপ হয়ে যায়। তার দেহটা নির্জীব হয়ে গেছে। নিজের মাথাটা মাটির সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। মানসূরার সম্মুখে এখন প্রশ্ন- তাকে বাঁধবে কিভাবে এবং কিভাবেই এখান থেকে তাকে নিয়ে যাবে। আয়রকে হত্যা করার ইচ্ছা থাকলে তা কঠিন ছিলো না। কিন্তু মানসূরা তাকে জীবিত সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে যেতে চায়। গুপ্তচরদের জীবিত গ্রেফতার করাই নিয়ম মানসূরার তা জানা আছে। হঠাৎ তার মাথায় ভাবনা আসে যে, আশপাশে কোথাও তাদের সৈনিক থাকতে পারে। তাই মানসূরা সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চস্বরে একটা চিৎকার দেয়- কেউ থাকলে এদিকে আসো। আসো, আসো, আসো।

নির্জীব পড়ে থাকা আর হঠাৎ এতো জোরে নড়ে উঠে যে, তার পিঠের উপর কনুই চাপা দিয়ে বসে থাকা মানসূরা একদিকে পড়ে যায়। আর তরবারীর প্রতি হাত বাড়ায়। মানসূরা বিদ্যুাতিতে উঠে পেছন দিক থেকে আয়রকে এমনভাবে ধাক্কা দেয় যে, সে সামনের দিকে পড়ে যায়। মানসূরা তারবারীটা তুলে নেয়। আযর উঠে দৌড় দেয়। তার পক্ষে এই পরিস্থিতিতে মোকাবেলা করার চেয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া বেশী আবশ্যক। মানসূরা চিৎকার করতে করতে তার পেছনে দৌড়াতে শুরু করে। তার পায়ে বিড়ালের শক্তি এসে গেছে। দূরে কোথাও পেট্টোল সেনারা টহল দিচ্ছিলো। তারা মানসূরার চিৎকার শুনতে পেয়ে ছুটে আসে।

সামনে নদী। আযরকে থেমে যেতে হলো। মানসূরা পৌঁছে যায়। দুজন সান্ত্রীও এসে পড়ে। আর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানসূরা চিৎকার করে ওঠে ওকে যেতে দিও না, গুপ্তচর। জীবিত ধরে ফেলল।

সান্ত্রীরাও নদীতে ঝাঁপ দেয়। তারা আরকে ধরে ফেলে। কিন্তু একটি মেয়েকে দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা ভাবে এটা অন্য কোন ব্যাপার হবে। তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে মানসূরা নিজের পরিচয় প্রদান করে এবং লাঙ্গনে কিভাবে এসেছে তার বিবরণ দেয়। মানসূরা জানায়, এই লোকটি বেসেবী হয়ে এসেছিলো। কিন্তু লোকটি সন্দেহভাজন। একে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট নিয়ে চলো।

শোনো বন্ধুগণ!- আযর সান্ত্রীদের বললো- এখানে তোমরা কী পাও? কটা টাকা আর দুবেলার রুটির জন্য এখানে তোমরা মরতে এসেছে। আমার

সে চলল, তোমাদেরকে রাজপুত্র বানিয়ে দেব। এর মতো মেয়েদের সঙ্গে। মি দেবো। সম্পদ দ্বারা লাল করে দেবো।

যাবো- এক সান্ত্রী বললো- তবে তার আগে তুমি আমাদের সঙ্গে চলো। তুমিও চলো মেয়ে! ওখানে নিয়ে দেখবো, এই লোক গোয়েন্দা, নাকি তুমি। নাকি দুজন এখানে ফস্টিনস্টি করতে এসেছিলে।

***

সুলতান আইউবীর তাবুর সামান্য দূরে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর তাঁবু। সান্ত্রীরা আযর ও মানসূরাকে তাদের কমান্ডারের নিকট নিয়ে যায়। কমান্ডার তাদেরকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর নিকট নিয়ে যান। হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে ঘুম থেকে তুলে আযরকে তার হাতে তুলে দেয়া হয়। মানসূরা হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে সমস্ত কাহিনী শোনায়। পশ্চাদ্ধাবনের ঘটনাও সবিস্তারে বিবৃত করে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ মানসূরাকে নিরীক্ষার সাথে, দেখে বললেন- তোমার চেহারাটা আমার কাছে অপরিচিত নয়। তুমি সম্ভবত মসুল থেকে পালিয়ে এসেছিলে। তোমার সঙ্গে মসুলের খতীব ইবনুল মাখদূমও ছিলেন?

আমি তার মেয়ে। মানসূরা বললো।

তুমি আমার বিস্ময় দূর করে দিয়েছ- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন আমাদের মেয়েরা তোমার চেয়ে সাহসী হতে পারে; কিন্তু এরকম বুদ্ধিমত্তা কমই পাওয়া যায়, যার প্রমাণ তুমি দিয়েছে।

 আমাকে আমার আব্বাজান প্রশিক্ষণ দিয়েছেন- মানসূরা বললো– আমার কানে মাত্র দুটি বাক্য প্রবেশ করে আর আমি বুঝে ফেলি ব্যাপারটা কী ঘটছে।

আযরের পোশাক তল্লাশি করা হয়। ভেতর থেকে এক খণ্ড কাগজ বেরিয়ে আসে, যাতে এই যুদ্ধে সুলতান আইউবীর বাহিনীর বিন্যাস-পজিশনের নকশা অংকিত আছে। আঁকা-বাঁকা দাগ টেনে হামাত শিং-এর চিত্র আঁকা আছে এই কাগজে। অস্পষ্ট বুঝা গেলো। সুলতান আইউবীর পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা দুশমনের কাছে যাচ্ছিলো।

আযর ভাই!- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আরকে কাগজগুলো দেখাতে দেখাতে বললেন। এরপরও যদি সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে, তাহলে বলল, আমি তোমাকে মুক্ত করে দেবো। তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাকো, তবে বলল, আমাকে নিশ্চয়তা দাও। আচ্ছা, তুমি কি মুসলমান?

মহান আল্লাহর কসম।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আযরের মুখের উপর সজোরে একটা ঘুষি মারেন। আযর কয়েক পা পেছনে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ধীর অথচ রোষ কষায়িত কণ্ঠে বললেন- চরবৃত্তি করছে কাফেরদের, আর কসম করছে আমাদের মহান আল্লাহর নামে। আমি তোমাকে একথা জিজ্ঞেস করছি যে, তুমি গুপ্তচর কিনা। আমি জানতে চাচ্ছি, এখানে তোমার সহকর্মী কারা। তাদের নাম বলল, আস্তানার ঠিকানা বলল।

আমি মুসলমান- আযর অনুনয়ের স্বরে বললো- আমি আপনাকে সবদি; বলে দেবো। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবো।

তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- এ মুহূর্তে আমার উপর কোনো শর্ত আরোপ করার অধিকার তোমার নেই।

আমি একা, এখানে আমার কোন সহকর্মী নেই। আর হঠকারী উত্তর দেয়।

এই মেয়েটি তোমার তাঁবুতে যে লোকটিকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিলো, সে কে? হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করে।

আমি তাকে চিনতে পারিনি- আযর জবাব দেয়- সে অন্ধকারে এসে অন্ধকারেই ফিরে গিয়েছিলো।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর দুজন লোককে ডেকে বললেন- একে নিয়ে যাও। এর সহকর্মী কারা, তারা কোথায় অবস্থান করছে জিজ্ঞেস করো। মানসূরাকে বললেন- তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ে। ফজরের পর তোমাকে তলব করবো।

***

ফজর নামাযের পর সুলতান আইউবী এসে উপস্থিত হন। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে। হাসান সুলতানকে জানান, খতীব ইবনুল খামদূমের কন্যা রাতে একজন গুপ্তচর ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি পুরো ঘটনা বিবৃত করলে সুলতান বললেন- ইসলামের কন্যাদের কাজ এমনই হয়ে থাকে। আমরা যদি আমাদের কালেমাপড়া দুশমনকে রক্তে লেখা পাঠ না পড়াই, তাহলে তারা জাতির কন্যাদের প্রতিভা নিঃশেষ করে দেবে। আচ্ছা, গুপ্তচর কোথায়?

আপনি এখনই তাকে দেখতে পাবেন না- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- তার কক্ষটা শূন্য করার পর আমি তাকে আপনার নিকট নিয়ে আসবো। সুদর্শন এক যুবক। দামেস্কের অধিবাসী বলে দাবি করছে। এখানে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এসেছিলো।

আযর একটি বৃক্ষের সঙ্গে ঝুলে আছে। মাথাটা নীচের দিকে আর পা দুটো উপর দিকে। মাটি থেকে মাথা এক-দেড় গজ উপরে। নীচে অঙ্গার জ্বলছে। এক সৈনিক কিছুক্ষণ পরপর আগুনের মধ্যে কি যেন নিক্ষেপ করছে, যার ধোয়ায় আর ছটফট করছে ও কাশছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনেন। চোখ দুটো ফুলে গেছে। শরীরের সমস্ত রক্ত মুখমণ্ডলে নেমে এসেছে। বাধন খুলে দেয়ার পর আযর দাঁড়াতে পারলো না। কিছুক্ষণ অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে রইলো। মুখে পানির ছিটা দেয়া হলো। খানিক পর চোখ খুললে হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- মাত্র শুরু। না বলো যদি, তাহলে এক এক করে দেহের প্রতিটি জোড়া আলাদা করে ফেলবো।

আযর পানি প্রার্থনা করে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- পানি নয়, দুধ পান করাবো। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এক সৈনিককে বললেন এক গ্লাস দুধ আর একটি ঘোড়া ও একখানা রশি নিয়ে আসো। রশির এক মাথা তার পায়ের সঙ্গে, অপর মাথা ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধো।

আযর দুব্যক্তির নাম বলে। দুজনই স্বেচ্ছাসেবী। এর মধ্যে রাতের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট লোকটিও আছে। সে দামেস্কের আস্তানার ঠিকানাও বলে দেয়। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তৎক্ষণাৎ উভয় স্বেচ্ছাসেবীকে ধরে আনার নির্দেশ দেন এবং আয়রকে সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে যান।

বাড়ী কোথায়?

 দামেস্ক।

কার ছেলে?

আর এক জাগিরদারের নাম বলে।

আমি সম্ভবত তাকে চিনি? সুলতান আইউবী বললেন- তিনি কি দামেস্কে আছেন?

আল-মালিকুস সালিহ যখন দামেস্ক থেকে পলায়ন করেন, তখন তিনিও হাব চলে গেছেন। আযর জবাব দেয়।

আর তোমাকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য রেখে গেছেন। সুলতান আইউবী বললেন।

না, আমি নিজেই দামেস্ক থেকে গেছি- আযর বললো- পরে আব্বাজান হাল্ব থেকে এক লোকের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করেন, আমি যেন গুপ্তচরবৃত্তি করি। আমি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা এবং দিক-নির্দেশনাও পেয়েছিলাম। হাতজোড় করে আযর সুলতান আইউবীকে অনুনয়ের সঙ্গে বললো- আমি মুসলমান। আমার পিতা আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন। এখন আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে রাখুন। আমি এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।

আল্লাহ তোমার অপরাধ ক্ষমা করুন- সুলতান আইউবী বললেন- আমি আল্লাহর বিধানে হাত দিতে পারি না। আমি শুধু এটুকু দেখতে চেয়েছিলাম, সেই লোকটা কেমন মুসলমান, একটি নারী যার হাত থেকে ছিনিয়ে তরবারী নিয়ে তাকে ধরে ফেললো। আচ্ছা, তুমি এখানে কী কী দেখেছো?

এখানে আমি বহু কিছু দেখেছি- আযর জবাব দেয়- অবশিষ্ট তথ্য আমার সেই দুই সঙ্গী দিয়েছে, যারা পূর্ব থেকেই এখানে অবস্থান করছিলো। আমাকে মিনজানীক এবং তীরন্দাজদের অবস্থান জানবার জন্য বলা হয়েছিলো। আমি তা দেখে নিয়েছি।

তোমার আগে তোমার কোনো সঙ্গী কি এখান থেকে তথ্য নিয়ে গেছে? সুলতান আইউবী জিজ্ঞাসা করেন।

না- আযর জবাব দেয়। আমরা তিনজন ছাড়া এখানে আমাদের আর কোনো সঙ্গী নেই।

তোমার কি জানা আছে, তুমি কত সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী? সুলতান আইউবী জিজ্ঞাসা করেন- আর তুমি কি জানো, মেয়ে হয়েও কিভাবে ও তোমাকে ফেলে দিয়েছিলো?

সে যদি পেছন দিক থেকে আমার উভয় পায়ের গোড়ালি ধরে না ফেলতো, তাহলে আমি পড়তাম না। আযর জবাব দেয়।

তারপরও তুমি পড়ে যেতে- সুলতান আইউবী বললেন- যাদের ঈমান বিক্রি হয়ে যায়, তারা অনায়াসেই পড়ে যায়। আর তারা তোমার মতো উপুড় হয়েই পড়ে থাকে। তুমি যদি সত্য ও ঈমানওয়ালাদের সঙ্গে থাকতে, তাহলে দশজন কাফির মিলেও তোমাকে ফেলতে পারতো না। আসল শক্তি বাহু আর তরবারীর নয়; আসল শক্তি ঈমানের।

আপনি আমাকে একটিবার সুযোগ দিন। আযর বললো।

সেই সিদ্ধান্ত দামেস্কের বিচারপতি নেবেন- সুলতান আইউবী বললেন আমি তোমার সঙ্গে এসব কথা এ জন্য বলছি যে, তুমি মুসলমান। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তুমি ওদিকে চলে গেছে। আমি জানি, দামেস্কের দু-চারটা মেয়ে তোমার ভালোভাসায় বিভোর। চেহারা-শরীরে তুমি এর উপযুক্ত যে, মেয়েরা তোমাকে ভালোবাসবে। কিন্তু এখন সেসব মেয়ে তোমার মুখে থু থু নিক্ষেপ করবে। আল্লাহও তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। দামেস্কের কাজী তোমাকে কী শাস্তি দেবেন, আমি তা বলতে পারবো না। তিনি যদি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন, তাহলে সে পর্যন্ত যে কদিন বেঁচে থাকবে, আল্লাহর নিকট পাপের জন্য প্রার্থনা করতে থাকো। অন্ততপক্ষে মৃত্যুর আগে মুসলমান হয়ে যাও।

আমার পিতাকে শাস্তি দেবেন? আযর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- এই পাপের উৎসাহ তো আমাকে তিনিই দিয়েছিলেন। তিনিই আমার অন্তরে প্রলোন ঢুকিয়েছেন। তিনিই আমার হৃদয় থেকে ঈমান বের করে ফেলেছিলেন।

আল্লাহর বিধান তাকে ক্ষমা করবে না- সুলতান আইউবী বললেন দৌলতের নেশা অস্থায়ী হয়ে থাকে। ঈমানের শক্তি মৃত্যুর পরও নিঃশেষ হয় না।

আমার পিতা সম্পদশালী লোক ছিলেন না- আযর বললো- তিনি সম্পদের পুজারী ছিলেন। আমার দুটি বোন ছিলো। যৌবনে উপনীত হওয়ার পর তিনি তাদেরকে দুজন আমীরের হাতে তুলে দিয়ে দরবারে স্থান করে নেন। তিনি তার কন্যাদের বিপুল মূল্য উসুল করেন। তারপর চরবৃত্তি করতে শুরু করেন। আমাকেও তিনি এ কাজে লাগিয়ে দেন এবং আমার অন্তরে সম্পদের মোহ সৃষ্টি করে দেন। নূরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পর তিনি দরবারে আরো উচ্চ মর্যাদা পেয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি একজন বিজ্ঞ কুচক্রী ও ভাঙ্গা-গড়ার সুদক্ষ কারিগরে পরিণত হন। এক পর্যায়ে তিনি বিপুল পরিমাণ জায়গীরের মালিক হয়ে যান। আপনার বাহিনী এসে পড়ার পর যখন আল মালিকুস সালিহ, তার দরবারী আমীর ও জাগিরদারগণ দামেস্ক থেকে পালিয়ে যায়, তখন তাদের সঙ্গে আমার পিতাও ছিলেন। আমি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই দামেস্ক থেকে যাই। কিছুদিন পর হাল্ব থেকে এক ব্যক্তি দামেস্ক আসে। সে আমার পিতার একটি বার্তা নিয়ে আসে, আমি যেন গুপ্তচরবৃত্তির কাজ শুরু করে দেই। সেই লোকটিই আমাকে সেই আস্তানায় নিয়ে যায়, আমি যার ঠিকানা আপনাদেরকে দিয়েছি। সেখানে আমাকে প্রচুর অর্থ দেয়া হয় এবং দু তিন দিনের মধ্যেই আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো আমাকে কী করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে। আমি তাদের দলে ঢুকে পড়ি। একদিন আমাদের দলনেতা বললেন, স্বেচ্ছাসেবীরা রণাঙ্গনে যাচ্ছে। তোমরা তিন থেকে চারজন লোক তাদের দলে ঢুকে পড়ে। আমরা তিনজন ঢুকে পড়লাম। দুজন আগেই এখানে এসে পৌঁছেছে। আমিও গেলাম। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়, যেনো আমিও এখানে চলে আসি এবং আপনার বাহিনীর পূর্ণ অবস্থা জেনে সকল তথ্য যৌথ বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিকট পৌঁছিয়ে দেই। আমি এসে পড়লাম। আমার সঙ্গীরা এখানকার নকশা প্রস্তুত করে রেখেছিলো। তারা এও জেনে নিয়েছিলো যে, আপনি শত্রু বাহিনীকে সেই স্থানটিতে নিয়ে এসে লড়াতে চাচ্ছেন, যা চারদিকের পর্বত ও টিলা-বেষ্টিত। আমি টিলার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার তীরন্দাজ এবং মিনজানীকের অবস্থান দেখে নিয়েছিলাম।

আযরের চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে শুরু করে। সে বললো- ধরা পড়ার পর এখন আমি অনুভব করছি, আমি অপরাধ করছিলাম। আপনার বক্তব্য আমার ভেতরে ঈমানের উত্তাপ জাগ্রত করে দিয়েছে। আমার পিতা যদি তার কন্যাদের বিক্রি করে সম্পদশালী না হতেন, তাহলে আমার ঈমান অটুটই থাকতো। অপরাধ আমার পিতার। মহামান্য সুলতান! আপনার মর্যাদা বুলন্দ হোক। আপনি দয়া করে আমাকে এই পাপের কাফফারা আদায় করার সুযোগ দিন।

সুলতান আইউবী হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে ইঙ্গিত করেন। হাসান আয়রকে তাবুর বাইরে নিয়ে যান।

***

সেদিনই আয়রকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার সঙ্গে দুজন মোহাফেজ দেয়া হয়। তিনজনই অশ্বারোহী। আযরের হাত রশি দ্বারা বাঁধা। সূর্যাস্তের খানিক আগে তারা অর্ধেক পথ অতিক্রম করে ফেলে। রাতে কোথাও যাত্রাবিরতি দিতে হবে। পথে মোহাফেজগণ আযরের অপরাধের বিবরণ শুনতে থাকে। আযর আবেগপ্রবণ কথা বলে বলে তাদেরকে প্রভাবিত করে ফেলে। সন্ধ্যার সময় সে মোহাফেজদের বললো, সামান্য সময়ের জন্য তোমরা আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও। মোহাফেজরা এই ভেবে তার হাত খুলে দেয় যে, নিরস্ত্র পালিয়ে যাবে কোথায়। তারা তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে দেয়। বাঁধনমুক্ত হয়ে আযর মাটিতে বসে পড়ে। মোহাফেজরা তাকে নিয়ে খেতে শুরু করে।

আযর পূর্ব থেকেই ফন্দি এঁটে রাখে। আহাররত অবস্থায় হঠাৎ সে উঠে দেীড়ে গিয়ে দ্রুত ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। মোহাফেজরা উঠে ঘোড়ার পিঠে চড়তে চড়তে আযর বেশ দূরে চলে যায়। তারা পলায়নপর আয়রকে ধাওয়া করে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সন্ধ্যা গাঢ় হতে শুরু করে। উঁচু-নীচু ভূমি। মাঝে-মধ্যে টিলা এবং বড় বড় এর আছে। মোহাফেজরা তাকে বহুদূর পর্যন্ত ধাওয়া করে। কিন্তু আযর চলে আসছে দৃষ্টিসীমার বাইরে।

পরদিন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মোহাফেজদ্বয় পরাজিতের ন্যায় অবনত মস্তকে সন ইবনে আবদুল্লাহর নিকট এসে হাজির হয়। একজন বললো- আমাদের তার করুন; বন্দী পালিয়ে গেছে। তারা জানালো, বন্দীর দাবিতে তারা তার হাতের বন্ধন খুলে দিয়েছিলো। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাদেরকে হেফাজতে নিয়ে নেন। কিন্তু ভয়ে-শংকায় তার ঘাম বেরিয়ে আসে। কেননা, আযর সাধারণ কোন বন্দী ছিলো না। সে সুলতান আইউবীর সমস্ত পরিকল্পনা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো। জয়-পরাজয় ঐ পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল ছিলো। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ সুলতান আইউবীকে জানাতে চাচ্ছিলেন না যে, ধৃত গোয়েন্দা হাতছাড়া হয়ে গেছে এবং আপনার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গেছে। তবে সুলতানকে বিষয়টা না জানিয়েও উপায় নেই।

সংবাদটা শোনার পর সুলতানের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। তিনি বসা থেকে উঠে তাঁবুর ভেতরে পায়চারি করতে শুরু করলেন। তৎকালের ঐতিহাসিক আসাদুল আসাদী লিখেছেন- সালাহুদ্দীন আইউবী চরম বিপদের সময়ও বিচলিত হতেন না। কিন্তু গুপ্তচরের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ শোনার পর তার চেহারার রক্ত উধাও হয়ে যায় এবং চোখ জ্যোতিহীন হয়ে পড়ে। তিনি তাঁবুর ভেতরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে যান এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন- মহান আল্লাহ! এটা কি ইঙ্গিত যে, আমি এখান থেকে ফিরে যাবো? আপনার মহান সত্ত্বা কি আমার পাপ ক্ষমা করেনি? আমি তো কখনো অস্ত্র ত্যাগ করিনি। আমি কখনো পিছপা হইনি।

তারপর তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। সম্ভবত তিনি অদৃশ্যের কোনো ইশারা লাভ করতেন, যা সেদিন এই পরিস্থিতিতেও পেয়েছিলেন। তিনি হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে বললেন- ঐ মোহাফেজদ্বয়কে বেশী শাস্তি দিও না। শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা পালাতে পারতো। কিন্তু তারা আমাদের নিকট চলে এসেছে। তাদেরকে শুধু ভুলের শাস্তি দেবে। সত্য বলা এবং সরলতার পুরস্কারও প্রদান করবে। সালারদেরকে ডাকো। তার চেহারায় রওনক এবং চোখে চমক ফিরে আসে।

তিন সালার এসে হাজির হন। সুলতান আইউবী তাদেরকে বললেন সেই গুপ্তচর পালিয়ে গেছে, যার কাছে আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ছিলো। সে যে মানচিত্রটা প্রস্তুত করেছিলো, সেটি আমাদের নিকট রয়ে গেছে বটে; কিন্তু সে বহু কিছু চোখে দেখে গেছে এবং আমরা দুশমনকে কোথায় নিয়ে লড়াতে চাই, সেই তথ্যও সে জেনে গেছে। ফলে দুশমনের জন্য আমরা যে ফাঁদ প্রস্তুত করেছিলাম, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তারা এখন পর্বতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না। হয়তো তারা আমাদেরকে অবরোধ করে ফেলবে এবং আমাদের রসদের পথ বন্ধ করে দেবে। আপনারা পরামর্শ দিন এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী। আমরা কি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলবো, নাকি বহাল রাখবো।

তিন সালার ভিন্ন ভিন্ন অভিমত ব্যক্তি করেন। তারা সকলে একটি ব্যাপারে একমত পোষণ করেন যে, পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলা হোক। সুলতান আইউবী তাদের সঙ্গে একমত হলেন। তিনি বললেন- পরিকল্পনা পরিবর্তন করার জন্য সময় দরকার। আমাদের হাতে সময় নেই। আশংকা থাকে, এই রদবদলের মধ্যে যদি দুশমন হামলা করে বসে, তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। মুক্ত মাঠে মুখোমুখি লড়াই করার জন্য সৈন্যও অপ্রতুল।

সিদ্ধান্ত হলো, পরিকল্পনা অপরিবর্তিত থাকবে। গেরিলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হলো, যেন তারা ব্যাপকহারে অতর্কিত হামলা চালায় এবং দুশমনের সম্মিলিত কমান্ড ও তিন বাহিনীর কেন্দ্রের উপর গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করে। রসদের পথকে আরো বেশি নিরাপদ করা হবে। তিনি গেরিলা বাহিনীর সালারকে বললেন, আপনি সেই দলটিকে ফিরিয়ে আনুন, যাদেরকে মটকা অঙ্গার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো।

নতুন আদেশ নিয়ে সালার চলে যান। সুলতান আইউবী এই সিদ্ধান্ত— আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রদান করেন বটে; কিন্তু মনটা তার অস্থির। তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত, পালিয়ে যাওয়া গোয়েন্দা তার সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে। এখন জানা নেই, কী হবে?

কিছুক্ষণ পর বারোজন গেরিলার একটি বাহিনী সুলতানের সামনে হাজির ২লা। খৃস্টানরা হাবের বাহিনীকে দাহ্য পদার্থ ভর্তি যে মটকাগুলো প্রেরণ করেছিলো, সেগুলো রণাঙ্গনে নিয়ে আসা হয়েছে। সুলতান আইউবীর চররা সেগুলোর অবস্থান জেনে নিয়েছে। সুলতান আগে নির্দেশ দিয়েছিলেন, দুশমন যখন হামলা করবে, তখন মটকাগুলো ধ্বংস করে দেবে। এর জন্য বারোজন জানবাজ এবং উন্মাদ প্রকৃতির কমান্ডো নির্বাচন করা ছিলো। এখন তাদেরকেই সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত করা হলো। তান তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। এক গেরিলাকে দেখে তিনি মুচকি স বললেন- আনতান! তুমি এই বাহিনীতে এসে পড়েছো?

আমাকে এই বাহিনীতেই আসা প্রয়োজন ছিলো- আনতামূন বললো আপনাকে বলেছিলাম, আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।

আমার প্রিয় বন্ধুগণ!- সুলতান আইউবী গেরিলাদের উদ্দেশে বললেন –তোমরা এ যাবত বহু কুরবানী দিয়েছে। কিন্তু এখন দ্বীন ও জাতির ইজ্জত তোমাদের থেকে আরো বেশী ত্যাগ দাবি করছে। তোমরা যুদ্ধের গতি পাল্টে দিতে পারো। তোমাদেরকে টার্গেট বলে দেয়া হয়েছে। তোমরা যদি এগুলো ধ্বংস করে দিতে পারো, তাহলে অনাগত প্রজন্ম তোমাদেরকে স্মরণ করবে। তোমরা জানো, আমাদের সেনাসংখ্যা কম। দুশমনের বাহিনী তিনটি। তাদের থেকে নিজেদের বাহিনীকে তোমরা রক্ষা করতে পারো।

আমরা দ্বীন ও জাতিকে নিরাশ করবো না। গেরিলাদের কমান্ডার বললো।

সুলতান আইউবী আরো কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে বিদায় জানালেন।

পরদিন ভোর বেলা। এক ব্যক্তি ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে এসে উপস্থিত হয়। সুলতান আইউবী এখনো তাঁবুতে অবস্থান করছেন। অশ্বারোহী সংবাদ দেয়, শত্রুবাহিনী এগিয়ে আসছে। এখন তারা এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। তাদের গতি হামাতের দিকে। ইত্যবসরে আরো এক আরোহী এসে পৌঁছে। তার সংবাদ হলো, ডানদিক থেকেও দুশমন আসছে। এই বাহিনীর গতি থেকে সুলতান আইউবী অনুমান করলেন, এরা ডান পার্শ্ব অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। এই দিকটা নিয়ে সুলতানের পেরেশানী ছিলো। এবার তিনি আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন। এই বাহিনীর সম্মুখ ভাগে অবস্থান করছে আযর, যে কিনা এখান থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে পালিয়েছিলো। সুলতান আইউবী বললেন আর গত রাতেই পৌঁছে গিয়েছিলো এবং তার অখ্য মোতাবেক দুশমন হামলা করে বসেছে।

সুলতান আইউবী প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। তাঁর দূত চারদিকে ছুটে চলে। হামাতের মধ্যস্থানে তাঁবু খাটানো আছে। সৈন্যরা তাঁবুতে অবস্থান করছে কিংবা এদিকে-ওদিক ঘোরাফেরা করছে, যেন দুশমন মনে করে, তারা প্রস্তুত নয়। তীরন্দাজ সৈনিকরা টিলার উপর প্রস্তুত হয়ে যায়।

তীব্ৰগতিতে এগিয়ে আসছে শত্রুবাহিনী। তাদের অগ্রগামী বাহিনী দেখতে, পেলো, সুলতান আইউবীর তাঁবুগুলো এখনো পঁড়িয়ে আছে। তারা এই ভেবে দ্রুত এগিয়ে আসার জন্য পেছনে সংবাদ পাঠায় যে, তারা সুলতান আইউবীর বাহিনীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে গেছে।

সুলতান আইউবী একটি উঁচু টিলার উপর উঠে যান, যেখান থেকে চারদিকের সমস্ত দৃশ্য দেখা যায়। তিনি দেখলেন, গোমর্ন্তগীনের বাহিনী সোজা শিং-এর দিকে এগিয়ে আসছে। সুলতান বিস্মিত হন। তিনি তার সৈনিকদেরকে সেই সময় ঘোড়ায় জিন বাঁধার নির্দেশ দেন, যখন দুশমন একেবারে নিকটে এসে পড়েছে। দুশমনের পদাতিক বাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কয়েকটি তীর নিক্ষেপ করে। ওদিক থেকে ডাক-চিৎকার ভেসে আসে- পিষে ফেলো, একজনকেও জীবিত ছেড়ে দিও না, সালাহুদ্দীন আইউবীকে জীবিত ধরে ফেলল। তার মাথাটা কেটে ফেলো।

সুলতান আইউবীর অশ্বারোহী বাহিনী কিছুটা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে আবার পিছনে সরে আসে। পদাতিক ও আরোহী বাহিনী শত্রুবাহিনীর সম্মুখভাগের আক্রমণের মোকাবেলা করতে করতে পিছন দিকে সরে আসতে থাকে। এভাবে আক্রমণকারী প্রত্যেকে হামাতের সেই ফাঁদের ভেতরে এসে পড়ে, যেখানে সুলতান আইউবী তাদেরকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।

টিলা-পর্বতবেষ্টিত এই ময়দানটা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে দেড় মাইলের মতো। দুমশন যেইমাত্র তার ভেতরে প্রবেশ করলো, অমনি উভয় দিকের টিলার উপর থেকে তাদের উপর তীর বর্ষিত হতে শুরু করলো। দুশমনের ঘোড়াগুলো তীর বিদ্ধ হয়ে নিজেদেরই লোকদেরকে পিষতে পিষতে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। শত্রু বাহিনীর কমান্ডার বুঝতেই পারলো না, এখানে তাঁবুগুলোর মধ্যে যে সৈনিকরা ছিলো, তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো। সামনের টিলাগুলোর ভেতরে দিয়ে একটা পথ, যা উপত্যকার দিকে বেরিয়ে গেছে এবং সুলতান আইউবীর সৈন্যরা সেই পথেই লাপাত্তা হয়ে গেছে, তা তাদের জানা ছিলো না। ময়দানে তাঁবু খাটানো ছিলো, যার রশিগুলো শত্রু বাহিনীর জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলো।

কিছুক্ষণ পর সলিতাওয়ালা অগ্নিতীর আসতে শুরু করে। এই তীর ভাবুগুলোকে জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। তারা তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রণাঙ্গন থেকে অগ্নিশিখা উঠতে শুরু করে। দুশমনের কমান্ডারদের জন্য বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাদের দলবদ্ধতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ঘোড়াগুলোর হেষারব, আহতদের আর্ত-চিৎকার এবং আন্ডারদের হাঁক-ডাক এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যেনো এখানে প্রলয় ঘটে গেছে।

প্রায় দুঘন্টা ধরে দুশমনের কমান্ডাররা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে তাদের সৈনিকদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু তারা সুলতান আইউবীর তীরন্দাজদের হাতে হতাহত হতেই থাকে। কিন্তু তারা তা মুসলমান সৈনিক। সামরিক চেতনা তাদেরকে পিছপা হতে দিচ্ছে না। দের কয়েকজন সৈনিক যে পাহাড়টির উপর থেকে তীর আসছিলো, তাতে আরোহনের চেষ্টা করে। কিন্তু এটা ছিলো নিছক তাদের সাহসিকতা প্রদর্শন। কিন্তু উপর থেকে ধেয়ে আসা তীর তাদেরকে পাথরের ন্যায় গড়িয়ে নীচে ফেলে দেয়।

অবশেষে শক্র কমান্ডাররা তাদের সৈনিকদেরকে পেছনে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু খানিকটা পিছু হটার পর তারা টের পেলো, পেছনে সুলতান আইউবীর ফৌজ দাঁড়িয়ে আছে। ঘোষণা শুরু করলো- অন্ত্র ফেলে দাও। তোমরা আমাদের ভাই। আমরা তোমাদেরকে হত্যা করবো না।

ঘোষণার তালে তালে আইউবী বাহিনীর সেনারা সম্মুখে অগ্রসর হতে এবং চারদিক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ গোমস্তগীন বাহিনীর এখন আর লড়াই করার সাধ্য নেই। তাদের অর্ধেকই হতাহত হয়েছে। যারা জীবিত আছে, তারাও চরম ভীতসন্ত্রস্ত। তারা এসেছিলো অন্য আশা নিয়ে। তাদের বলা হয়েছিলো, এই জয় অতি সহজে হবে। কিন্তু রণাঙ্গন তাদের জন্য জাহান্নামে পরিণত হলো।

তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করে।

***

সুলতান আইউবীর এই কৌশল সফল হয়েছে বটে; কিন্তু অপরদিকে দুশমন তাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তা হলো ডান পার্শ্বের সেই : ময়দান, যার ব্যাপারে পূর্ব থেকেই তিনি চিন্তিত ছিলেন। ওদিক থেকে শত্রুবাহিনী মরুঝড়ের ন্যায় এগিয়ে আসছে। তার মোকাবেলায় সুলতান আইউবীর ক্ষুদ্র দুটি ইউনিট। আক্রমণকারীদের পতাকা নজরে পড়তে শুরু করে। এটি হাবের ফৌজ। সুলতান আইউব হাব অবরোধ করে এই বাহিনীর পরাকাষ্ঠা দেখেছিলেন। তাঁর জানা আছে, এই বাহিনী গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের বাহিনী থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। সামরিক যোগ্যতা ও বীরত্বের দিক থেকে এই ফৌজ সত্যিই প্রশংসাহ্য। সুলতান আইউবী কখনো আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হন না। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেন, তাঁর বাহিনী এই বাহিনীকে প্রতিহত করতে পারবে না। আবার রিজার্ভ বাহিনীকেও তিনি ব্যবহার করতে চাচ্ছেন না। ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে কাছে দণ্ডায়মান সালারকে নির্দেশনা প্রদান করে পাঠিয়ে দেন।

সুলতান আইউবী রিজার্ভ বাহিনী ছাড়াও বাছাইকরা একটি বাহিনীকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি ওদিককার পাহাড়ের উপর মোতায়েন তীরন্দাজদের কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেন, তোমার শিং এলাকা থেকে সরে পেছনদিকে মুখ ফিরাও এবং ঐ পজিশনেই নতুন আক্রমণকারীদেরকে টার্গেট করো। তিনি তাঁর বিশেষ অশ্বারোহী বাহিনীর কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেন, তোমার বাহিনীকে ময়দানে নিয়ে আসো; আমি নিজে তাদের কমান্ড করবো। স্বল্প সময়ের মধ্যে সুলতান আইউবী পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নেমে আসেন। তাঁর বাহিনী প্রস্তুত দণ্ডায়মান। তিনিও ময়দানে অবতীর্ণ হোন।

সুলতান আইউবী যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পতাকা উড়ালেন না, যেন দুশমন বুঝতে না পারে তিনি কোথায় আছেন। কিন্তু আজ তিনি সেই নিয়মে ব্যত্যয় ঘটালেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দেন, আমার পতাকা উঁচু করে রাখে।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন– এই যুদ্ধে পতাকা উড়িয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার বাহিনীকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, সুলতান স্বয়ং তাদের কমান্ড করছেন। পাশাপাশি হাবের আক্রমণকারী শত্রুসেনাদেরকে জানান দিতে চেয়েছিলেন, তাদের মোকাবেলায় সুলতান আইউবী স্বয়ং ময়দানে।

সুলতান আইউবী অতিদ্রুত অশ্বারোহী সৈন্যদের এভাবে বিন্যস্ত করে ফেলেন যে, দুটি ঘোড়া সম্মুখে, চারটি পিছনে। তার পিছনে ছয়টি। তারপর আটটি। অবশিষ্ট সকল সৈন্য আট আটজন করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে চলন্ত অবস্থায় সম্পন্ন করেছেন। সম্মুখ থেকে দুশমন সারিবদ্ধভাবে বিস্তৃত হয়ে এগিয়ে আসছে। নিকটে গিয়ে সুলতান আইউবীর অশ্বারোহী নারাও বিন্যস্ত হয়ে যায়। মোকাবেলাটা এরূপ হয় যে, সুলতান আইউবীর অশ্বারোহীরা একটি পেরেকের ন্যায় দুশমনের অভ্যন্তরে ঢুকে ড়। সুলতান আইউবী হলেন এই বিন্যাসের মধ্যখানে। দুশমনের রোহীরা ডান-বাম থেকে সম্মুখ দিকে এগিয়ে যায়। পথে যাকেই লো আঘাতে আহত করতে থাকে।

শত্রুবাহিনী আরোহী সেনাদের পেছনে পতাদিক বাহিনী। সুলতান ইউবী সম্মুখে বেশ দূরে এবং সঙ্গে সঙ্গে সারির অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে তিক ইউনিটের উপর হামলা করে বসেন। পদাতিক শত্রুসেনার। যথাসাধ্য মোকাবেলা করে। কিন্তু আইউবী বাহিনীর ঘোড়া এবং আরোহী এরা তাদের পিষে মারতে মারতে ও তারবারীর আঘাত হানতে, হানতে মনের দিকে এগিয়ে যায়। সুলতান আইউবীর পদাতিক বাহিনীটি ছিলো সম্মুখে। তারাও দুশমনের অশ্বারোহী বাহিনীর মোকাবেলা করে। পিছন দিক থেকে সুলতান আইউবী হঠাৎ আক্রমণ করে বসেন। নিকটস্থ পাহাড়গুলোর উপর থেকে তীরন্দাজরা তীরবর্ষণ করতে শুরু করে। কিন্তু এতোকিছুর পরও হাবের সৈন্যদের মনোবল অটুট থাকে। সুলতান আইউবী তাঁর কমান্ড বিক্ষিপ্ত হতে দিলেন না। লড়াই অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী এবং তীব্র আকার ধারণ করলো।

সকল ঐতিহাসিক লিখেছেন, সুলতান আইউবী যদি এই যুদ্ধের কমান্ড নিজে করতেন, তাহলে এই বাহিনীর দ্বারাই তার সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যেতো।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ ইতিহাসবিদদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর রোজনামচা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই আক্রমণকারী বাহিনীটি হাবের নয়- মসুলের ফৌজ ছিলো এবং সালার মুজাফফর উদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন তার সেনাপতিত্ব করছিলো। তার ভাষ্য মতে, এই কমান্ড এভো নিপুণ ছিলো যে, মুজাফফর উদ্দীন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এই বাহিনীটিকে উপড়ে ফেলে দিয়েছিলো। নেতৃত্বের বিচক্ষণতার কারণ এই বর্ণনা করেছেন যে, মুজাফফর উদ্দীন একসময় সুলতান সালাউদ্দীন আইউবীর সালার ছিলো এবং এই বিদ্যা সে সুলতান আইউবীর নিকট থেকে শিক্ষালাভ করেছিলো। সৈন্য সংখ্যার আধিক্যের পাশাপাশি তার অতিরিক্ত সুবিধা এই ছিলো যে, সে সুলতান আইউবীর কৌশল ভালভাবেই বুঝতো।

সুলতান আইউবী দূতদের সঙ্গে রাখতেন এবং তাদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তিনি এমন কৌশল প্রয়োগ করেন যে, শত্রু বাহিনীকে তিনি সেই পর্বতের নিকট নিয়ে যান, যার উপর তার তীরন্দাজরা প্রস্তুত ছিলো। জীরান্দাজ সংখ্যায় কম হলেও কাজ অনেক আঞ্জাম দেয়। সুলতান তার সেনাসংখ্যার স্বল্পতায় এতো। অনুভূতি ছিলো যে, তাকে তার প্রথম পরিকল্পনাটি পাল্টে ফেলতে হয়। তিনি রিজার্ভ বাহিনীকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ঠিক এমন মুহূর্তে এক দূত তাকে সংবাদ জানায় যে, একদিক থেকে, আপনার চার-পাঁচশত অশ্বারোহী আসছে। সুলন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, তারা কোন্ বাহিনীর এবং কেন? আসছে। তিনি যুদ্ধের ময়দানে শৃখলার অত্যন্ত পাবন্দ ছিলেন। অথচ এই ময়দানে তাঁর সাহায্যের তীব্র প্রয়োজন। কিন্তু তার অনুমতি ও নির্দেশনাবিহীন একটি পদক্ষেপ তার পছন্দ হয়নি। তিনি দূতকে বললেন- এক্ষুণি যাও। জিজ্ঞেস করে আসো, তোমরা কারা?

দূতের নিয়ে আসা সংবাদ শুনে সুলতান আইউবী হতভম্ভ হয়ে পড়েন। এরা চারশত মেয়ে এবং একশত স্বেচ্ছাসেবীর বাহিনী। হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা সালার শামসুদ্দীনের অনুমতিক্রমে এসেছে। এ হলো সংবাদ।

সুলতান আইউবী তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এই পাঁচশত অশ্বারোহী যে ধারায় অগ্রসর হয়েছে, তাতে সুলতান বুঝে ফেলেন, কমান্ড সালার শামসুদ্দীন নিজেই করছেন। এই বাহিনীটি শত্রুকে পাহাড়ের দিকে ঠেলে নিয়ে আসছিলো। তারা দুশমনের অগ্রযাত্রা ব্যহত করে দিয়েছে।

মুসলমান মুসলমানের হাতে মারা যাচ্ছে। আল্লাহু আকবর তাকবীর ধ্বনি আল্লাহ আকবর ধ্বনির সঙ্গে সংঘর্ষিত হচ্ছে। জমিন কাঁপছে। আকাশ নীরব দর্শকের ন্যায় তাকিয়ে আছে। খৃস্টানরা তামাশা দেখছে। ইতিহাস নির্বিকার হয়ে আছে। মেয়েরা ভাইয়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। রক্তের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। জাতির মর্যাদা অশ্বখুরের নীচে পদদলিত হচ্ছে। আল্লাহ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।

সারাদিনকার যুদ্ধের পরিণতি এই দাঁড়ালো যে, দুশমনের মনোবল নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং তারা অস্ত্র ত্যাগ করতে শুরু করেছে। তারা এখন আঁধা অবরোধে অবরুদ্ধ। তাদের সেনাপতি বেরিয়ে গেছে। আহতদের আর্ত-চিৎকারে রাতের নীরব পরিবেশ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। সারাদিনের যুদ্ধক্লান্ত নারী সৈনিকরা আহতদের তুলে আনতে থাকে। রাত পোহাবার পর ময়দানের এক ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়লো। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত লাশের পর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অসংখ্য মৃত ঘোড়া এদিক-ওদিক পড়ে আছে। যুদ্ধবন্দীদেরকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লাশগুলোর মধ্যে নারী সৈনিকদের লাশও আছে। তাদেরকেও তুলে আনা হলো।

রাজত্বের নেশা মানুষকে এমন এক স্তরে নামিয়ে নিয়ে আসে, সেখানে একজন মানুষ তার জাতিকে দুটি দেহে বিভক্ত করে তাদেরকে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়– সুলতান আইউবী ময়দানের দৃশ্য দেখে বললেন ভাই তার বোনের সন্ত্র হরণ করছে। আমরা যদি রাজত্বের মোহ থেকে মুক্ত হতে না পারি, তাহলে কাফেররা এই জাতিকে আপসে যুদ্ধ করিয়ে জাতিরই কর্ণধারদের হাতে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।  

হামাত শিং ও তার পার্শ্ব এলাকার যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অন্যত্র এখানে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের রাতে বারো কমান্ডো হাব বাহিনীর সেই স্থানটিতে পৌঁছে যায়, যেখানে দাহ্য পদার্থের মটকাগুলো রাখা আছে।

হালবের একটি বাহিনী এখনো রিজার্ভ অবস্থায় আছে। তারা সংবাদ পেয়ে গেছে, তাদের দুই বাহিনীর হামলা ব্যর্থ হয়ে গেছে। আক্রমণে সাফল্য অর্জনের জন্য আগুন নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

সুলতান আইউবীর বারো কমান্ডো তাদের টার্গেট ঠিক করে নিয়েছে। তাদের চার-পাঁচজনের নিকট ধনুক এবং সলিতাওয়ালা তীর আছে। তারা ঘোড়া থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সলিতায় আগুন ধরিয়ে তীর নিক্ষেপ করে। আগুন লাগানো সলিতা গিয়ে মটকার ডিপোতে নিক্ষিপ্ত হয়। মটকাগুলোতে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ ছেয়ে যায়। শত্রু শিবিরে হৈ-হুঁল্লোড় পড়ে যায়।

কমান্ডোদের জানানো হয়েছিলো, মটকার সংখ্যা অনেক। সেখানে স্থলস্থূল শুরু হয়ে গেলে কমান্ডোরা পুনরায় আঘাত হানে। আগুনের শিখায় স্থানটি আলোকিত হয়ে যায়। কমান্ডোরা নিরাপদ মটকাগুলোর অবস্থান দেখতে পায়। তারা আগেই বর্শার সঙ্গে হাতুড়ীর ন্যায় লোহার টুকরো বেঁধে রেখেছিলো। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসেই তারা মটকাগুলো পিটিয়ে ভাঙ্গতে শুরু করে। শত্রু সেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বারোজন জানবাজ সেনা হাজার হাজার শত্রুসেনার নাগালের মধ্যে যুদ্ধ করছে। আগুনের শিখা সবদিক ছড়িয়ে পড়ে। শিবিরময় ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। উট-ঘোড়াগুলো রশি ছিঁড়ে ছিঁড়ে পালাতে শুরু করে।

সুলতান আইউবীর ফৌজের অবস্থান এলাকায় পাহাড়ের উপর দন্ডায়মান এক ব্যক্তি চিৎকার করছে- আকাশ জ্বলছে। খোদার গজব নাযিল হচ্ছে।

সংবাদ পেয়ে সুলতান আইউবী দৌড়ে একটি টিলার উপরে উঠে যান। দুশমনের শিবিরের দিককার আকাশ লালে লাল দেখে তিনি নিজের অজ্ঞাতে, বলে ওঠেন- শাবাশ! শাবাশ! আল্লাহ তোমাদেরকে বিনিময় দান করুন।

এখনই পাল্টা হামলা চালাবে সেই শক্তি মসুলের বাহিনীর শেষ হয়ে গেছে। সুলতান আইউবীর কমান্ডো সেনারা তৎপর হয়ে ওঠেছে। তারা তিন রাত গোমস্তগীন, সাইফুদ্দীন ও আল-মালিকুস সালিহর শিবিরগুলোতে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালায় যে, তাদের কেন্দ্র পর্যন্ত হেলে ওঠেছে। অবশেষে তারা অন্য কোন দিক থেকে আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করে। ঠিক সে সময় তারা জানতে পারে, পেছনে সুলতান আইউবীর ফৌজ এসে পড়েছে।

এদিকে সুলতান আইউবী তার বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে দুশমনকে বেহাল করে দেন। তিনি হত্যাও করছেন না, ছেড়ে দিচ্ছেন না। এই যুদ্ধ আঘাত করো আর পালাও নীতি অনুযায়ী লড়া হচ্ছিলো। শত্রু বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে এবং অস্ত্র ত্যাগ করতে শুরু করে। সুলতান আইউবীর লক্ষ্যও ছিলো এই।

৫৭০ হিজরীর রমযান মোতাবেক ১৯৭৫ সালের ১৩ এপ্রিল। সাহরী খাওয়ার পর সুলতান আইউবী তার পরিকল্পনার শেষ অংশটি কার্যকর করেন, যার দিক-নির্দেশনা তিনি একদিন আগেই দিয়ে রেখেছেন। তিনি খোলাখুলি আক্রমণ করে বসেন। উল্লেখযোগ্য সংঘাত হলো না। তিনি গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের তাঁবু এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু তারা দুজনই উধাও। তারা এমন কাপুষের ন্যায় পালিয়ে গেছে যে, তাদের জঙ্গলের মঙ্গল তাঁবুগুলো যেমনটা তেমন পড়ে আছে। হেরেমের নারী, গায়ক-গায়িকা এবং তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো যথাস্থানে রয়েছে। সুলতান আইউবীর ফৌজ দেখে তারা আতঙ্কিত মনে এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করে। তাদেরকে ধরে সুলতান আইউবীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সুলতান তাদের প্রত্যেককে মুক্তি দিয়ে দামেস্ক পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। মসুলের গবর্নর সাইফুদ্দীনের তাঁবুটা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মেয়েদের ছাড়া সেখানে সুন্দর সুন্দর পিঞ্জিরাও ছিলো, যেগুলোতে রং বেরংয়ের পাখি বাঁধা ছিলো।

সে রাতে আরো একটি মেয়েকে সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত না হয়, যে কিনা শত্রু বাহিনীর সেই শিবিরটিতে লাশ শনাক্ত করে ফিরছিলো, যার উপর সুলতান আইউবীর কমান্ডো সেনারা রাতে অতর্কিত হামলা করে দাহ্য পদার্থের মটকা ধ্বংস করেছিলো। সুলতান আইউবী মেয়েটিকে চিনে ফেললেন এবং বললেন- তুমি আমার গোয়েন্দা আনতানূনের সঙ্গে হাররান থেকে এসেছিলো

জি হ্যাঁ- মেয়েটি বললো- আমার নাম ফাতেমা। আমি নারী ফৌজের সঙ্গে দামেস্কে থেকে এসেছি। মেয়েটি আহত। সে বলতে লাগলো- আমি নতে পেরেছি আননূন এখানে গেরিলা হামলায় অংশ নিয়েছিলো। মি তার লাশ অনুসন্ধান করছিলাম।

লাভ নেই। সুলতান আইউবী বললেন।

 সে-ও বলতো, গেরিলা সৈন্যের লাশ পাওয়া যায় না- ফাতেমা উদাস কণ্ঠে বললো- সে আমাকে বলেছিলো, আসো, আমরা নিজ নিজ কর্তব্যে কুরবান হয়ে যাই। আমার খুশি লাগছে এ জন্য যে, আনতানূন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করেছে। কিন্তু আমার কর্তব্য এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে। আমি গোমস্তগীনকে হত্যা করতে এসেছিলাম।

মেয়েটির আবেগময় অবস্থা দেখার পর কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না। সুলতান আইউবী বললেন- দামেস্ক থেকে যে মেয়েগুলো এসেছিলো, তাদেরকে পাঠিয়ে দাও। তারা দুশমনকে পরাজিত করার কাজে আমাকে সাহায্য করেছে। এ সময় সাহায্যের কতো প্রয়োজন ছিলো, আমিই তা জানি। এই মেয়েগুলো যেন অদৃশ্য থেকে এসেছিলো; কিন্তু আমি তাদেরকে সঙ্গে রাখতে পারি না।

***

মেয়েদের প্রতিবাদ এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সুলতান আইউবী এখন আর কোথাও থামতে চাচ্ছেন না। তিনি দুশমনকে যে পরাজয় দান করেছেন, তা থেকে তিনি পুরোপুরি ফায়দা তুলতে চাচ্ছেন। তিনি নির্দেশ দেন, সমস্ত ফৌজকে হাল্ব অভিমুখে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করো। তিনি সালারদেরকে পরবর্তী পরিকল্পনা। সম্পর্কে অবহিত করছেন।

এমন সময় হঠাৎ দেখা গেলো, এক অশ্বারোহী এদিকে ছুটে আসছে। তার হাতে বর্শা। বর্শার আগায় কি একটি বস্তু গাঁথী। লোকটি নিকটে চলে আসলে সুলতান আইউবীর দেহরক্ষীরা তাকে থামিয়ে দেয়। সুলতান দেখলেন, তার বর্শার আগায় গেঁথে রাখা বস্তুটা মানুষের মাথা। তিনি তাকে সম্মুখে আসার অনুমতি প্রদান করেন।

লোকটি আযর ইবনে আব্বাস। সেই গুপ্তচর, যাকে দামেস্ক নিয়ে যাওয়ার পথে যে রক্ষীদের হেফাজত থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সে বর্শা থেকে মাথাটা খুলে সুলতান আইউবীর পায়ে নিক্ষেপ করে বললো- আমি আপনার পলাতক কয়েদী। আমি নিবেদন করেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন; আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করবো। কিন্তু আপনি আমার আবেদন মঞ্জুর করেননি। আমি পথে চিন্তা করলাম, আমাকে ইসলামের বিপক্ষে পথে নামিয়েছেন আমার পিতা। তিনিই আমার অন্তরে সম্পদের মোহ সৃষ্টি করেছেন। আমি শুধু এই কাজের জন্য পালিয়েছিলাম। আমি হাল্ব গেলাম। পিতাকে হত্যা করলাম। তার মাথা কেটে এনে আপনার পায়ে অর্পন করলাম। এবার বলুন, আমার পাপের কাফফারা আদায় হলো কিনা। না হলে আপনি আমাকে আবারো বন্দী করুন এবং এভাবে আমার মাথাটাও কেটে ছুঁড়ে ফেলুন।

সুলতান আইউবী আয়রকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়ে বললেন- এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। লোকটি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলেছে। আমি ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না, দুশমনের গুপ্তচর পূর্ণ তথ্য নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা আমাদের ফাঁদে এসে পা দিলো কেন! এবার বুঝলাম, আযর পালিয়ে সংবাদ জানাতে যায়নি- গিয়েছিলো পিতাকে খুন করতে!

পরদিন। সুলতান আইউবী তাঁবুতে ঘুমিয়ে আছেন। বাইরে অনেকগুলো লোকের কথোপকথনে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সুলতান দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- বাইরে কী হচ্ছে? দারোয়ান বললো- আপনার মোহাফেজদের উর্দি পরে এবং আপনার ঝাণ্ডা উঁচিয়ে নয়জন লোক এসেছে। বলছে, তারা দামেস্ক থেকে এসেছে। তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আপনার রক্ষী বাহিনীতে কাজ করতে চায়। বাধা দেয়া হলে তারা বললো, তারা বহুদূর থেকে পরম ভক্তি ও জযবা নিয়ে এসেছে। তারা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়।

এরা শেখ সান্নান ও গোমস্তগীনের প্রেরিত সেই ঘাতকচক্র। কৌশল তাদের সফল। সুলতান আইউবী দারোয়ানকে বললেন- তাদেরকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।

তাদের হাতের বর্শাগুলো বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। তারা সুলতান আইউবীর তাবুতে প্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে যার যার খঞ্জুর ও তরবারী বের করে হাতে নেয়। সুলতান আইউবীর দুজন রক্ষীও তাদের সঙ্গে প্রবেশ করে। এক ঘাতক সুলতান আইউবীর উপর হামলা করে বসে। সুলতান দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করে আক্রমণ প্রতিহত করেন। তিনি নিজের তরবারীটা হাতে তুলে নেন। প্রথম আঘাতেই আক্রমণকারী দুবৃত্তের পেট চিড়ে ফেলেন। তাঁবুর ভেতরের স্থানটা সংকীর্ণ। অন্যান্য ঘাতকরাও সুলতানের উপর আক্রমণ করে। রক্ষীদ্বয় শক্ত হাতে তাদের মোকাবেলা করে। বাহির থেকে অন্যান্য রক্ষীরাও এসে পড়ে।

সুলতান আইউবীর তাবুতে তরবারী ও খঞ্জরের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।  দেহরক্ষীরা ঘাতকদেরকে নিজেদের সঙ্গে ব্যস্ত করে ফেলে। লড়াই করতে করতে তারা তাঁবুর বাইরে চলে আসে। সুলতান আইউবীর লম্বা তরবারী কাউকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। পাঁচ-ছয়জন ঘাতক প্রাণ হারায়। অন্যরা টিকতে না পেরে পালাতে উদ্যত হয়। তাদেরকে জীবিত ধরে ফেলা হলো।

ইত্যবসরে তাঁবুর ভেতর থেকে এক ঘাতক সদস্য বেরিয়ে আসে। তার পোশাক রক্তরঞ্জিত। সুলতান আইউবীর পিঠটা ছিলো তার দিকে। সুযোগ বুঝে সে সুলতানের উপর পিছন থেকে আঘাত হানতে উদ্যত হয়। এক দেহরক্ষী যথাসময়ে ঘটনাটা দেখে ফেলে। সে চিৎকার করে ওঠে নীচে সুলতান! বলেই সে আক্রমণকারীর দিকে ছুটে যায়। সুলতান আইউবী সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়েন। ঘাতকের তরবারী বাতাসে আঘাত হেনে সুলতানের উপর আক্রমণ করে। দেহরক্ষী ঘাতক সদস্যের পাজরে বর্শী সেঁধিয়ে দেয়। লোকটা পূর্ব থেকেই আহত ছিলো। এবার আঘাত খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ও মারা যায়।

সুলতান আইউবী এই আক্রমণ থেকেও প্রাণে রক্ষা পেয়ে যান।

শেখ সান্নান ও গোমস্তগীন প্রেরিত এই নয় ঘাতক সদস্য শপথ করে এসেছিলো, হয়তো তারা সুলতান আইউবীকে হত্যা করবে, অন্যথায় জীবন নিয়ে ফিরবে না। তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্য করতে পারেনি। তবে জীবিতও ফেরত যেতে পারেনি। যাঁরা আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলো, সুলতান আইউবী তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *