হাবীবুল কুদ্দুস
বিজয় অর্জন করে কে না আনন্দিত হয়? সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কোনো যুদ্ধ কিংবা অবরোধে জয়ী হলে তারও চেহারায় আনন্দের দ্যুতি ভেসে ওঠতো। তার বাহিনী উল্লাস করতো, উট-বকরি-দুম্বা জবাই করে ভালো খাবারের আয়োজন করতো এবং আরামে একটা ঘুম দিতো। কিন্তু ১১৮৩ সালের এই দিনগুলোতে তার চেহারায় আনন্দের কোনো ছাপ ছিলো না। তার সৈন্যদেরও উল্লাস করতে দেখা যায়নি। অথচ এক বছর সময়ে তিনি বেশকটি দুর্গ জয় করে নেন এবং আর্মেনীয় সম্রাটের ন্যায় শক্তিশালী শাসক থেকে পরাজয়ের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে কঠিন থেকে কঠিনতর শর্ত মান্য করতে বাধ্য করেন।
ঐতিহাসিকগণ এ সময়টাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিজয়ের কাল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু তার মানসিক অবস্থাটা ছিলো, যেনো প্রতিটি জয়ের পর তার চেহারায় একটা করে রেখা জন্ম নিচ্ছে বার্ধক্য ও হতাশার বলিরেখা। এর একটি বিজয়েও তিনি আনন্দিত নন। তার গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক সারেম মিসরী বিজয়ীর ঢংয়ে একের পর এক রিপোর্ট দিচ্ছেন, গত রাতে আমার বাহিনী অমুক স্থানে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে দুশমনের এ পরিমাণ ক্ষতি করেছে, অমুক সময় আমরা এই সাফল্য অর্জন করেছি ইত্যাদি। কিন্তু রিপোর্ট শুনে সুলতান আইউবী শুধু মাথা দুলিয়ে তাকে সাধুবাদ জানিয়েই মাথাটা নত করে ফেলছেন, যেনো তার হৃদয়ের ওপর এমন এক বোঝা এসে চেপেছে, যা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।
আমাকে মোবারকবাদ সেদিন জানাবে; যেদিন তোমরা ক্রুসেডারদের পরাজিত করে বিজয়ী বেশে ফিরে আসবে। একদিন সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের বললেন। তারা দিয়ারে বকরের বিজয়ের পর সুলতানকে মোবারকবাদ জানাতে এসেছিলো। শুনে তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে ওঠে, যেনো তিনি উদাত অশ্রুধারা প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন- তোমরা হয়তো ভুলে গেছো, আমরা ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করতে এবং তাদেরকে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করতে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। কর গণনা করে বললো, তোমরা ক বছর যাবত আপন ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছো? হিসাব করো, আমরা একে অপরের কী পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছি। একে কি তোমরা বিজয় বলবে? এই গৃহযুদ্ধে আমি যে বিজয় অর্জন করছি, তা আমার-তোমার বিজয় নয়- সেসব ক্রুসেডারদেরই বিজয়। দুভাই যখন আপসে লড়াই করে, তখন তাদের উভয়ের শত্ৰু সফল হয়। আমরা আপন ভাইদের উপর যে বিজয় অর্জন করেছি, আমি তাকে বিজয় বলতে প্রস্তুত নই।
ক্রুসেডাররা দমে গেলো কেনো?- এক সালার বললেন- আমরা আপনাকে তাদের উপরও বিজয় অর্জন করে দেখাবো।
তারা যেখানে থমকে বসে রয়েছে, সেখান থেকে তাদের বের হওয়ার এবং যুদ্ধ করার প্রয়োজন কী?- সুলতান আইউবী বললেন যুদ্ধের প্রথম নীতি কী? শত্রুর সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করা। খৃস্টানরা আমাদের সামরিক শক্তিকে আমাদের ভাইদের হাতে ধ্বংস করানোর সকল ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমরা আপসে যুদ্ধ করে করে দুর্বল হয়ে চলেছি আর ক্রুসেডাররা সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। ফিলিস্তিনীদের উপর তাদের কজা শক্ত হয়ে চলছে। শাসন-রাজত্ব মূলত আল্লাহর। মানুষের উপর যখন রাজত্বের নেশা চেপে বসে, তখন ধর্ম ও জাতির মর্যাদা মূল্য হারিয়ে ফেলে। ক্ষমতালি মানুষ আপন কন্যাদেরকে উলঙ্গ নাচাতে শুরু করে। মিথ্যা ও প্রতারণাকে বৈধ ও জরুরি মনে করে। ক্রুসেডাররা উম্মতে রাসূলকে রাজ্যে রাজ্যে বিভক্ত করে চলেছে আর আল্লাহর সৈনিকদেরকে এই রাজ্যে রাজ্যে ভাগ করে ইসলামের সামরিক শক্তিকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
আমরা এসব অঞ্চল থেকে ফৌজের জন্য অনেক ভর্তি পাচ্ছি- এক সালার বললেন- ভালো ভালো সৈনিক ও অশ্বারোহী সৈন্য ভর্তি হচ্ছে।
কিন্তু আমি এতে আনন্দিত নই- সুলতান আইউবী সকলকে চমকে দিয়ে বললেন- এরা আমাদের বাহিনীতে শুধু এই জন্য ভর্তি হচ্ছে যে, তারা জানে, আমরা যে শহর জয় করি, আমাদের বাহিনী সেখানে লুট করে বেড়ায় এবং সেখানকার রূপসী মেয়েরা তাদের হয়ে যায়।
আমরা তো আমাদের বাহিনীকে এমন লুটতরাজ ও নারীর শ্লীলতাহানির অনুমতি কখনো দেইনি! অপর এক সালার বললেন।
কিন্তু আমাদের শত্রুরা আমাদের ফৌজের বিরুদ্ধে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, সালাহুদ্দীন আইউবী তার বাহিনীকে লুটতরাজ ও বিজিত অঞ্চলের যুবতী মেয়েদের তুলে এনে উপভোগ করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। আমাদের ফৌজের বিরুদ্ধে তাদের এই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাতে স্বয়ং মুসলমানদেরই অন্তরে ইসলামী ফৌজের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং আমরা কোথাও থেকে জনগণের সাহায্য না পাই। বরং কোনো নগরী অবরোধ করলে সেখানকার মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও যেনো আমাদের বাহিনীর মোকাবেলা করে। মনে রেখো আমার বন্ধুরা! সেনাবাহিনী ব্যতীত জনগণ আর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ব্যতীত সেনাবাহিনী দুশমনের জন্য সহজ হয়ে যায়। তোমরা আপন শত্রুর পরিচয় লাভ করো। তোমাদের শত্রু বুদ্ধিমান। তারা আমাদের জাতি ও ফৌজের মাঝে বৈরিতা সৃষ্টি করার উত্তম ব্যবস্থা করে রেখেছে। কুরআন সীসাঢালা প্রাচীরের রূপ ধারণ করার আদেশ শুধু জনগণকে কিংবা শুধু সেনাবাহিনীকে প্রদান করেনি। সীসাঢালা প্রাচীর জনগণ ও সেনাবাহিনী মিলেই কেবল গড়তে পারে। এই প্রাচীরে ফাটল ধরানোর সকল পন্থা হচ্ছে সেনাবাহিনীকে অযোগ্য, কাপুরুষ ও দস্যুতে পরিণত করা, যাতে তারা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে।
দিয়ারে বকরের মানুষদের উপর তো এমন কোনো ক্রিয়া দেখা যায়নি- সারেম মিসরী বললেন- তারা যখনই জানতে পারলো, অবরোধকারী আমরা এবং তাদের শাসকরা তাদের বাহিনীকে ইসলামী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ তারা আমাদের জন্য নগরীর ফটক খুলে দিয়েছে।
সেখানে আমাদের অনেক গোয়েন্দা ছিলো- সুলতান আইউবী বললেন- সেখানকার সবকটি বড় মসজিদের ইমাম আমাদের লোক ছিলেন। তারা সেখানকার মানুষদেরকে শুধু নামায-রোযা-হজ্ব যাকাতের ওয়াজই শোনননি। সেই সঙ্গে তাদেরকে ক্রসেডারদের প্রত্যয়-পরিকল্পনা এবং নিজেদের ঈমান নিলামকারী আমীর-শাসকদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করেছেন। তারা জনসাধারণকে এই ধারণা প্রদান করেছেন যে, কোনো মুসলমান যখন অপর মুসলমানের রক্ত ঝরায়, তখন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে এবং আল্লাহ সেই লোকালয়টির উপর গজব নাযিল করেন। তোমরা বোধ হয় জানো না, দিয়ারে বকরে দরবেশ, সুফী ও আলেমের বেশে ক্রুসেডারদের গোয়েন্দারা অবস্থান করছিলো এবং মুসলমানদের চেতনা ধ্বংসের জন্য কাজ করছিলো। কিন্তু আমাদের লোকেরা তাদের কতিপয়কে গোপনে অপহরণ করে হত্যা করেছে এবং তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা এখন যে ভূখণ্ডে অবস্থান করছি, এখানে ক্রুসেডারদের। নাশকতা-অরাজকতা সফল হয়ে চলছে।
এই যেসব সৈনিক লুটতরাজের লোভে ভর্তি হচ্ছে, এরা কি গোটা বাহিনীকে নষ্ট করবে না? সালার জিজ্ঞেস করেন।
তুমি কি দেখোনি তাদেরকে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সুলতান আইউবী বললেন- আমি তোমাদেরকে প্রশিক্ষণে সামরিক মহড়ার যে নতুন পদ্ধতি শিখিয়েছি, তা-ই তাদেরকে সঠিক চিন্তা চেতনার উপর নিয়ে আসবে। আমি বাহিনীতে তাদেরকে এমনভাবে বণ্টন করছি যে, তারা বাহিনীর উপর নয় বরং বাহিনী তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। আমি অনতিবিলম্বে এই মর্মে লিখিত আদেশ জারি করতে যাচ্ছি যে, আমাদের কোনো সৈনিককে লুটতরাজ কিংবা কোনো নারীর প্রতি হাত বাড়াতে দেখলে তাকে ঘটনাস্থলেই শায়েস্তা করে ফেলবে। দুশমনের অভিযোগসমূহকে ভুল ও মিথ্যা প্রমাণের একটা পন্থা হলো, ফৌজ আপন চরিত্র বলে বিজিত লোকদের উপর এবং স্বজাতিরও মন জয় করে নেবে। আমাদেরকে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে, ইহুদী-খৃষ্টানরা সর্বকালে ইসলামের সৈনিক ও জনগণের মাঝে বৈরিতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে থাকবে। তারা যেমন আমাদের জনসাধারণের চরিত্র ধ্বংসের চেষ্টা করবে, তেমনি সেনাবাহিনীরও। এভাবে উভয় পক্ষের ঈমান ও জাতীয় চেতনা বিনষ্ট করে একে অপরের শত্রুতে পরিণত করে রাখবে। কাজটা তারা মুসলমানদের হাতে করাবে।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ফোরাত নদীর তীরে তাবুতে অবস্থান করছেন। ইতিমধ্যে তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি মুসলিম প্রজাতন্ত্রের শাসকদেরকে অনুগত বানিয়ে নিয়েছেন এবং বেশকটি দুর্গও জয় করে ফেলেছেন। এরা সেসব মুসলিম শাসক, যারা গোপনে গোপনে ক্রুসেডারদের বন্ধু এবং সুলতান আইউবীর বিরোধী ছিলেন। সুলতান আইউবীর গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস, যাকে খৃস্টানরা দখল করে জেরুজালেম নাম রেখেছে। কিন্তু আপন মুসলিম শাসক ও আমীরগণ তার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফৌজকে দিন কয়েকের বিশ্রাম দেয়ার লক্ষ্যে সুলতান ফোরাতের তীরে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এখানে বসে বসে তিনি ঘোড়া, খচ্চর, উট ও রসদের অভাব পূরণ করে নিচ্ছেন।
অল্প পরেই সূর্যটা অস্ত যাবে। সুলতান আইউবী ফোরাতের তীরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর সালার এবং গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক সারেম মিসরী উপস্থিত আছেন। তাদের থেকে সামান্য দূরে সাদা জুব্বা পরিহিত এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান। লোকটি দুআর জন্য হাত উত্তোলন করে রেখেছেন। সুলতান আইউবী ওদিকে এগিয়ে যান। নিকটে পৌঁছে দেখেন, সেখানে চারটি কবর বিদ্যমান। একটি কবরের শিয়রে একটি লাঠি প্রোথিত আছে। তার সঙ্গে একখানা তক্তা বাঁধা। তক্তায় লাল বর্ণে আরবীতে লেখা আছে
ওমর আল-মামলুক!
আল্লাহ তোমার শাহাদাত কবুল করুন।
–নাসরুল্ল মামলুক
তার পার্শ্বের কবরের উপর তেমনি অপর এক তক্তায় অনুরূপ লাল হরফে লেখা আছে
নাসরুল মামলুক!
আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন।
সুলতান আইউবী লেখা দুটি পড়ে কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যে লোকটি ফাতিহা পাঠ করছিলেন, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। পোশাকে-ধরনে লোকটাকে বিজ্ঞ আলেম মনে হলো। সুলতান তার প্রতি তাকালে তিনি সামান্য অবনত হয়ে বললেন- আমি এ মহল্লার মসজিদের ইমাম। যখনই জানতে পাই অমুক স্থানে শহীদের কবর আছে, সেখানে ছুটে গিয়ে ফাতিহা পাঠ করি। আমার বিশ্বাস, যে স্থানে শহীদের রক্ত ঝরে, সে জায়গা মসজিদের ন্যায় পবিত্র হয়ে যায়। আমি মানুষকে বলে থাকি, মুজাহিদ এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর ঘোড়ার ক্ষুরের উড়ানো ধূলিকে আল্লাহও সম্মান করেন। মহান আল্লাহ তার পথে জিহাদকে সর্বোত্তম ইবাদত আখ্যা দিয়েছেন।
কিন্তু যারা আল্লাহর পথে জীবন কুরআন করে শাহাদাতবরণ করে থাকে, তাদের কেউ চেনে না। ইতিহাসে তাদের নয়- আমার নাম আসবে। অথচ যাদের মাধ্যমে আমি মর্যাদা লাভ করেছি, তারা হচ্ছে এরা, আপনি যাদের কবরে ফাতিহা পাঠ করছেন। সুলতান তাঁর সালারদের প্রতি তাকান এবং কবরের ফলক দুটোতে হাত বুলিয়ে বললেন- এই শব্দগুলো লাল রঙে আঙুল চুবিয়ে লেখা হয়েছে। উভয় ফলকের লেখক একই ব্যক্তি মনে হচ্ছে।
লাল রং নয়, সুলতানে মুহতারাম!- গেরিলা বাহিনীর সালার সারেম মিসরী বললেন- এ রক্ত। ওমর আল-মামলুকের ফলকের লেখাটা নাসরুল মামলুক নিজ দেহের রক্ত দ্বারা লিখেছেন। আর নিজ কবরের ফলকও নিজের রক্তে লিখে শাহাদাতবরণ করেছেন। ষোল সতের দিন আগে আমরা নদী থেকে বড় একটা নৌকা পাকড়াও করেছিলাম। তাতে দুশমনের গেরিলাদের জন্য রসদ বহন করা হচ্ছিলো। সে তথ্য আপনি জানেন। নৌকাটা আমাদের আটজন গেরিলা পাকড়াও করেছিলো। তাদের এ চারজন শহীদ হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা প্রথমে সংবাদ পাই, রাতে নদীপথে বড় একটি নৌকা অতিক্রম করবে, তাতে দুশমনের রসদ ও অস্ত্র থাকবে। আমি আমার আটজন সৈনিক প্রেরণ করি। তারা ছোট্ট একটি নৌকায় করে অভিযান পরিচালনা করে।
মধ্যরাতের দিকে নদীর অপর তীর ঘেঁষে ঘেঁষে নৌকাটা যাচ্ছিলো। আমাদের কাছে তথ্য ছিলো, তাতে চার-পাঁচজন লোক থাকবে। কিন্তু আমাদের গেরিলাদের নৌকা তার কাছে গিয়ে পৌঁছুলে দেখা গেলো, তারা অন্তত বিশজন। আমাদের গেরিলারা দুশমনের নৌকায় আঁপিয়ে পড়ার আগেই দুশমনের তরবারীধারী সৈনিকরা আমাদের নৌকায় লাফিয়ে এসে পড়ে। আমাদের গেরিলাদের নৌ-যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো। তারা নৌকা থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে দুশমনের নৌকায় উঠে গিয়ে তার পালের রশি কেটে দেয়। উভয় নৌকায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। আমাদের গেরিলারা দুশমনের বড় নৌকা থেকে আমাদের নৌকায় অবস্থানরত দুশমনের প্রতি তীর ছোঁড়ে। মোটকথা, আমাদের সৈনিকরা বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে যুদ্ধ করে উভয় নৌকা নিয়ে ফিরে আসে। দুশমনের প্রাণে রক্ষা পাওয়া সৈন্যরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে পৌঁছে যায়।
নৌকা দুটি কূলে এসে ভিড়ে। সংবাদ পেয়ে আমি তাদের দেখতে যাই। সূর্য উদিত হচ্ছিলো। এক নৌকায় ওমর আল-মামলুক এবং তার দুসঙ্গীর লাশ। অন্যরা সকলে আহত। নাসরুল মামলুক বেশি আহত। তার গায়ে দুটি গভীর জখম বর্শার আর দুটি তরবারীর। তার সংজ্ঞা ছিলো। ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার পর বললেন, আমাকে একখানা তক্তা এনে। দিন। আমি তাকে তক্তা এনে দিলাম। এ সময় তিনি আর তার চিকিৎসা করতে দেননি। তক্তা পেয়ে তাতে তিনি নিজের রক্তে শাহাদাত অঙুলি ডুবিয়ে ডুবিয়ে ওমর আল-মামলুকের নাম ও এই লেখাগুলো লিখেন। তারপর তক্তাটা আমাকে দিয়ে বললেন, এটি ওমর আল-মামলুকের কবরের উপর স্থাপন করে দেবেন। আমি তক্তাখানা একটি লাঠির মাথায় বেঁধে ওমর আল-মামলুকের শিয়রে গেড়ে রাখি।
নাসরুল মামলুকের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বেরুতেই থাকে। কোনোক্রমেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিলো না। তৃতীয় দিন তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আমি তাকে দেখতে আসলে ডাক্তার নিরাশা প্রকাশ করেন। স্বয়ং নাসরুল মামলুক অনুভব করতে শুরু করেছেন, তিনি বাঁচবেন না। তিনি অনুরূপ আরেকখানা তক্তা দিতে বললেন। তক্তার ব্যবস্থা করে দিলে তিনি তক্তাখানা নিজের কাছে রেখে দেন। রাতে সংবাদ পাই, নাসরুল মামলুক শহীদ হয়ে গেছেন। আমি গেলাম। তার এক আহত সঙ্গী তক্তাখানা আমাকে দিয়ে বললো, নাসর নিজের এক জখম থেকে পট্টি খুলে ফেললে ক্ষতস্থান থেকে দর দর করে রক্ত বের হচ্ছিলো। তিনি নিজ রক্তে আঙুল ডুবিয়ে ডুবিয়ে এই লেখাটা লিখেছেন–নাসরুল মামলুক! আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন। সঙ্গী জানায়, নাসরুল মামলুক বলেছিলেন, তাকে যেনো তার বন্ধু ওমর আল-মামলুকের পার্শ্বে দাফন করা হয়। এভাবে এই দুটি ফলক একই শহীদের রক্তে লেখা হয়েছে।
এরা দুজন মামলুক ছিলো মহামান্য ইমাম- সুলতান আইউবী ইমামকে উদ্দেশ করে বললেন- আপনি জানেন, মামলুক কোন্ বংশের মানুষ। এরা সেই গোলাম বংশের মানুষ, যাদেরকে মুক্ত করা হয়েছিলল। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) দাস প্রথা নিষিদ্ধ করে বলেছেন, মানুষ মানুষের গোলাম হতে পারে না। দেখছেন না, এই গোলামরা কিরূপ কীর্তি দেখালো। এরা আটজন ছিলো। কিন্তু বিশজন সৈনিকের হাত থেকে,এতো বড় নৌকাটা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। আমার ফৌজে মামলুক আর তুর্কিদের প্রতি আমার যতোটুকু আস্থা আছে, অন্যদের প্রতি তো নেই।
এখন মানুষ পুনরায় মানুষের গোলামে পরিণত হতে যাচ্ছে- ইমাম বললেন- সিংহাসনের মালিক হওয়ার কসরত এ জন্যই করা হচ্ছে যে, মানুষকে গোলাম বানানো হবে। কিন্তু মানুষ বোঝে না, সিংহাসন কোনদিন কারো সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেনি। ফেরাউনও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আল্লাহ সেই সকল মানুষকে শিক্ষামূলক শাস্তি দান করেছেন, যারা সিংহাসনে আসীন হয়ে মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে।
সুলতান আইউবীর রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার এক ব্যক্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। লোকটির অবস্থা বলছে, সে দীর্ঘ সফর করে এসেছে। কমান্ডার নিকটে এসে বললো- কায়রো থেকে দূত এসেছে।
কী সংবাদ নিয়ে এসেছো? সুলতান আইউবী দূতকে জিজ্ঞেস করেন।
সংবাদ ভালো নয়। বলেই দূত কটিবন্ধ থেকে ভাজকরা একখানা কাগজ বের করে সুলতান আইউবীর হাতে দেয়। সুলতান নিজ তাঁবুতে চলে যান।
***
তাঁবুতে বসে সুলতান কাগজের ভাঁজ খোলেন। গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানের লেখা চিঠি আলী লিখেছেন
আমাদের সর্বাপেক্ষা বেশি দীনদার ও দুঃসাহসী নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুস দশদিন যাবত নিখোঁজ। ক্রুসেডারদের নাশকতা ও অপতৎপরতা দিন দিন বেড়ে চলছে। এখানে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড যুদ্ধ লড়ছি। ঈমান বিক্রেতাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে এ সমস্যায় আপনাকে পেরেশান হওয়ার আবশ্যক নেই। আমরা দুশমনকে সফল হতে দেবো না। পেরেশানী সৃষ্টি করেছেন হাবীবুল কুদ্দুস। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তার শুধু নিখোঁজ হওয়াই অস্থিরতার কারণ, নয়। আমরা আরো একটি আশঙ্কা অনুভব করছি। আপনি জানেন, হাবীবুল কুদ্দুসের অধীনে যে কটি সেনা ইউনিট রয়েছে, প্রতিজন সৈনিক তার এতোই অনুরক্ত যে, তারা তার ইঙ্গিতে জীবন কুরবান করে দিতে প্রস্তুত থাকে। আশঙ্কা হচ্ছে, যদি তিনি নিজ থেকে দুশমনের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়ে থাকেন, তাহলে অধীন সৈন্যদেরকে তিনি সালতানাতের-বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কে দিতে পারেন। আমি তার অনুসন্ধানে এখনো নিরাশ হইনি। আপনার নিকট আমি অনুমতি প্রার্থনা করছি, অনুসন্ধানকালে যদি তিনি সামনে এসে পড়েন আর আমার তাকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যা করবো কিনা। আপনার স্থলাভিষিক্ত আমীরে মেসের আমাকে এর অনুমতি দেননি। তিনি এই অনুমতি সরাসরি আপনার থেকে নিতে বলেছেন। আমি যদি তাকে খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে আপনি আমার নিকট জবাব চাইবেন। আর যদি তিনি আমার হাতে খুন হন, তা-ও হয়তো আপনি পছন্দ করবেন না। এই নায়েব সালারের দুশমনের কাছে থাকা আমাদের জন্য বড় বিপজ্জনক।
সুলতান আইউবী তৎক্ষণাৎ কাতেব ডেকে পত্রের উত্তর লেখাতে শুরু করেন—
প্রিয় আলী বিন সুফিয়ান!
তোমার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। হাবীবুল কুন্দুসের উপর আমার যতোটুকু আস্থা ছিলো, ততোটুকু আছে তোমারও উপর। যে লোক নিজের ঈমান বিক্রি করতে সম্মত হয়ে যায়, সে আল্লাহকে ভয় করে না। এমতাবস্থায় সে আমার ন্যায় একজন সামান্য মানুষকে ভয় করবে কেনো? হাবীবুল কুন্দুসের মতো মানুষও ধোকা দিতে পারে, এর জন্য তোমাদেরকে বিস্মিত না হওয়া উচিত। ঈমান একটা শক্তি, একটা সম্পদ। কিন্তু এই শক্তি-সম্পদ হীরা-জহরতের ন্যায় চিক চিক করে না। এর মধ্যে নারীর রূপের আকর্ষণ নেই। তাছাড়া ঈমান ক্ষমতার মসনদও নয়। মানুষের মধ্যে যখন দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা ও হীরা-জহরতের লোভ সৃষ্টি হয়ে যায়, তখন তার ঈমান পরিত্যাগ করতে সময় লাগে না। হাবীবুল কুদ্দুসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। প্রয়োজন মনে করলে আমি তাকে হত্যা করে ফেলার অনুমতি দিলাম। তবে জানবার চেষ্টা করো, তাকে অপহরণ করা হয়েছে কিনা। পরিস্থিতি তুমি ভালো জানো। যা ভালো মনে হয় করো। সালতানাতের স্বার্থ আর, ধর্ম অগ্রগণ্য। যেখানে হাজার হাজার সৈনিক শক্রর হাতে জীবন দিচ্ছে, সেখানে একজন মানুষের জীবন-মৃত্যু বড় কোনো বিষয় নয়। হাবীবুল কুদ্দুস গাদ্দার প্রমাণিত হলে তার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করো না। সময় অনেক মূল্যবান। আল্লাহর নিকট গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকো। আমরা সকলে গুনাহগার। একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সত্ত্বাই পবিত্র। তোমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে থাকবেন।
সুলতান আইউবী পত্রের নীচে সীল-মোহর এঁটে দূতের হাতে দিয়ে বললেন, রাতটা বিশ্রাম করে সকাল সকাল রওনা হয়ে যাও।
সময়টা ছিলো ইসলামের ইতিহাসের এক সংকটময় কাল। এদিকে। আরব ভূখণ্ড মুসলমানদের রক্তে লাল হয়ে চলেছে। খৃস্টান ও ইহুদীরা মুসলমানদের মাঝে গাদ্দার ও কুচক্রী সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে গৃহযুদ্ধে উস্কে দিয়েছে। ওদিকে মিসরে এই কাফেররাই মুসলিম কর্মকর্তাদের মাঝে গাদ্দার জন্মদানে ব্যস্ত রয়েছে। জনসাধারণের মাঝে সুলতান আইউবীর শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করছে এবং আইউবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত লজ্জাজনক সব অপবাদ প্রচার করে বেড়াচ্ছে। তারা এসব তৎপরতা চালাচ্ছে গোপনে- অতি সন্তর্পণে। আলী বিন সুফিয়ান এবং কায়রোর কোতওয়াল গিয়াস বিলবীস এসব অভিযান অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়া দূর এবং অপরাধীদের পাকড়াও করার কাজে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।
একজন নায়েব সালারের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সাধারণ ঘটনা নয়। কিন্তু তার কোনই সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। হাবীবুল কুদ্দুস বিশ্বাসঘাতকের দলে যোগ দিতে পারেন, কেউ ভাবতেই পারছেন না। কিন্তু সময়টাও এমন যে, গাদ্দারী একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। হাবীবুল কুদ্দুস নিখোঁজ হওয়ার পর অনেকে মন্তব্য করেন, কেননা, তিনি ফেরেশতা তো আর নন। তার তিনজন স্ত্রী আছে। এটা কোনো দোষের বিষয় ছিলো না। তার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ঘরে চার-চারজন করে স্ত্রী আছে। হাবীবুল কুদ্দুস জীবনে কোনদিন মদ ছুঁয়ে দেখেননি। নামায-রোযার পাবন্দ মানুষ। যুদ্ধের ময়দানে দুশমনের জন্য আতঙ্ক হয়ে আবির্ভূত হওয়ার মতো দুঃসাহসী ও সমর বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।
তার সবচে বড় গুণটি হচ্ছে, বাহিনীর প্রতিজন সৈন্যের তিনি প্রিয় মানুষ। তার অধীন কমান্ডার ও সৈনিকরা এমন ধারায় লড়াই করে, যেনো তার নির্দেশে নয়- ভক্তি-শ্রদ্ধার বলে যুদ্ধ করছে। অনেক সময় মনে হতো, এই বাহিনী তার নিজস্ব ফৌজ এবং তারা সুলতান আইউবীর নয়- হাবীবুল কুদ্দুসের ইঙ্গিতে লড়াই করছে। তার ইউনিটে তিন হাজার পদাতিক ও দুহাজার অশ্বারোহী সৈনিক আছে। তারা তীরন্দাজিতে এতো দক্ষ যে, অন্ধকারে শব্দ লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লে তীর ব্যক্তির গায়ে গিয়ে আঘাত হানে।
আলী বিন সুফিয়ান অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। গিয়াস বিলবীস পুলিশ প্রধান এবং সিভিল ইন্টেলিজেন্সে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এই দুজনেরই অভিমত হচ্ছে, দুশমন হাবীবুল কুদ্দুসকে জালে আটকে ফেলেছে। উদ্দেশ্য হতে পারে, তার মাধ্যমে তারা আমাদের পাঁচ হাজার সৈন্যকে বিদ্রোহী বানাতে চাচ্ছে। পাঁচ হাজার সৈন্য কম কথা নয়। হাবীবুল কুদ্সের নিখোঁজ হওয়ার পর এই সৈনিকদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলার প্রস্তাব করা হয়েছিলো। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস এই বলে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন যে, এটা করা হলে তারা বিদ্রোহ করার না হলেও বিদ্রোহী হয়ে যাবে। তদস্থলে তাদের মাঝে নানা বেশে গোয়েন্দা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা ব্যারাকে সৈনিকদের সঙ্গে মিশে গপশপ শুনতে থাকে। কমান্ডারদের প্রতিও নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়।
গভীর নজরদারি রাখা হয়েছে হাবীবুল কুন্দুসের ঘরের উপর। তার তিন স্ত্রীর একজনের বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। দুজন চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সী। জিজ্ঞাসাবাদে তারা শুধু এটুকু বললো যে, একদিন সন্ধ্যায় তার নিকট দুজন লোক এসেছিলো। তিনি তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যান; পরে আর ফিরে আসেননি। চাকর-বাকরদের কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। তাদের থেকেও কোন তথ্য পাওয়া গেলো না। গোপনে স্ত্রীদের সম্পর্কে তথ্য নেয়া হলো। তাদের একজনও সন্দেহভাজন প্রমাণিত হলো না। শুধু এটুকু তথ্য পাওয়া গেলো যে, কম বয়সী দুজনের একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশি ছিলো। তার নাম: যোহরা। মেয়েটি এক আরোহী প্লাটুন কমান্ডারের কন্যা।
কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করা হলো, নিজের সম্মান বয়সী একজন পুরুষের কাছে যুবতী মেয়েকে বিয়ে দিলে কেন? হাবীবুল কুদ্দুস কি তোমাকে বাধ্য করেছিলো?
না- কমান্ডার উত্তর দেয়- নায়েব সালার হাবীকুল কুদুল ইসলাম ও জিহাদের অতোটুকু অনুরক্ত, যতোটুকু আমি। আমি তার সঙ্গে অনেক যুদ্ধে লড়েছি। তিনি বলতেন, মুমিনের তরবারী খাপ থেকে বের হওয়ার পর দুশমনের সর্বশেষ সৈনিকটিকে শেষ না করা পর্যন্ত খাপে ফিরে না আসা উচিত। তিনি আরো বলতেন, কুফরের ফেতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত থাকে। তিনি গাদ্দারদের এতো ঘৃণা করতেন যে, এক সীমান্ত লড়াইয়ে সুদানীরা আকস্মিকভাবে হামলা করলে আমাদের দুজন অশ্বারোহী সেনা পালাতে উদ্যত হয়। নায়েব সালার ঘটনাটা দেখে ফেলেন। তিনি তাদেরকে ধরে আনতে আদেশ করেন। তাদেরকে ধরে আনা হলো। নায়েব সালার তাদের কিছু জিজ্ঞেস করা বা কিছু বলা ব্যতিরেকেই তাদেরকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে পিঠে একজনকে বসিয়ে ঘোড়া হাঁকাতে নির্দেশ দেন। ঘোড়া যখন তাদের নিয়ে ফিরে আসে, তখন ঘোড়ার দেহ থেকে অঝোরে ঘাম ঝরছিলো এবং তাদের নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। পেছনে বাধা সৈনিকদের অবস্থা এই ছিলো যে, তাদের পরনে কাপড় ছিলো না এবং গায়ের চামড়া ছিলে ছিলে গোশত পর্যন্ত খসে পড়েছে। যখন যুদ্ধ শেষ হয়, ততোক্ষণে সুদানীদের অধিকাংশ সৈনিক মারা গেছে। কিছু ধরা পড়েছে এবং বাদ বাকিরা পালিয়ে গেছে। হাবীবুল কুদ্দুস বাহিনীর সকল সৈন্যকে একত্রিত করে নিজের সৈনিক দুজনের লাশ দেখিয়ে বললেন, আল্লাহর পথে লড়াই করা থেকে পলায়নকারীদের এই শাস্তি ইহকালীন। পরকালে তাদের দেহ অক্ষত হয়ে যাবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আমরা সকলে জিহাদ ও শাহাদাঁতের জযবায় উদ্দীপ্ত। একদিন আমার এই মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিলো। আমার পিতা আমাকে যে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন, আমিও মেয়েকে সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছি। আমার এক পুত্র এই মুহূর্তে সুলতান আইউবীর ফৌজের সঙ্গে সিরিয়ায় অবস্থান করছে। আমি মেয়েকে বলতাম, আমাদের নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুস সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় এক মর্দে মুজাহিদ। সেদিন নায়েব সালার আমার মেয়েটাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, এ কে? বললাম, আমার মেয়ে এবং মুজাহিদা। অনেক দিন পর তিনি আমাকে বললেন, আমি তোমার সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই। আমি মেয়ের মায়ের সঙ্গে আলাপ করি। সে বললো, মেয়ে তো আগে থেকেই লছে, সে ইসলামের একজন সৈনিকের স্ত্রী হতে ইচ্ছুক। এভাবে আমি খুশি মনে আমার এই মেয়েকে নায়েব সালারের নিকট বিয়ে দিই। এখন শুনেছি, তার নাকি কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আপনাকে নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি, এই দুর্ঘটনায় কেউ যদি অন্তর থেকে ব্যথা পেয়ে থাকে, তো সে শুধু আমার কন্যা। তার অপর দুই স্ত্রী বলছে, মরে গেলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবো।
***
আমি এখন নিশ্চিত, তার মস্তিষ্ক আমাদের কজায় এসে পড়েছে এই কণ্ঠ কায়রো থেকে বহু দূরে সেসব ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে উত্থিত হলো, যেখানে কোনো এক ফেরাউন তার আমলে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলো। সে যুগে জায়গাটা অত্যন্ত সুন্দর, মনোরম ও সবুজ-শ্যামল ছিলো। অঞ্চলটা পাহাড়ি এবং নীল নদের কূলে অবস্থিত। পর্বতমালা গাছ-গাছালি ও সবুজ-শ্যামলে ঢাকা। নদীটা খানিক পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে। এখন এলাকাটা এক ভীতিময় জায়গা। প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের গায়ে শেওলার আস্তর জমে আছে। চিলের ন্যায় বড় বড় চামচিকারা দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। ধ্বংসাবশেষের অলিন্দ ও কক্ষগুলোতে মানুষের অসংখ্য হাড়-খুলি পড়ে আছে। সেকালের নানা রকম অস্ত্রও এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। এখন কেউ সেদিকে মুখ করে না। জনশ্রুতি আছে, জায়গাটায় এখন জিন-পরী ও ভূতেরা বাস করে, যারা জীবিত মানুষদেরকে শিকার করে বেড়ায়।
সেই ভয়ংকর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বসে এক ব্যক্তি বলছে- আমি নিশ্চিত, তার মস্তিষ্ক আমাদের কজায় এসে পড়েছে। তবে না-ই যদি আসে, তাহলে এখান থেকে জীবিত যেতে দেবো না।
আমরা লোকটাকে হত্যা করতে এখানে আনিনি- অন্য একজন বললো- হত্যা করাই যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে ঘর থেকে বের করে এখানে তুলে আনার প্রয়োজন ছিলো না। আমরা তাকে বিশেষ এক কাজের জন্য এনেছি। সে কাজের জন্য তাকে প্রস্তুত করতে হবে।
হাশিশ ক্রিয়া করছে।
হাশিশ দ্বারা তোমরা কারো ঈমান ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে পারবে না। এই লোকটি পাঁচ হাজার সৈনিকের সামরিক শক্তির মালিক। শুধু তাকে নয়- আমাদেরকে তার গোটা বাহিনীকে হাতে আনতে হবে এবং তাদেরকে মিসরের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতে হবে। তারপর মিসর আমাদের হয়ে যাবে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর অবস্থা সেই সিংহের ন্যায় হয়ে যাবে, যে বহু শিকারের বেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকে গর্জন করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তার ভাগ্যে মৃত্যু অবধারিত হয়ে আছে। সালাহুদ্দীন আইউবীর এই নায়েব সালার যদি তার বাহিনীকে একটু ইশারা করে, তো কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তারা তার আদেশ মান্য করবে।
হাবীবুল কুদ্দুস উক্ত ধ্বংসাবশেষের এক কক্ষে উপবিষ্ট। নীচে নরম গালিচা বিছানো, পেছনে গোল তাকিয়া। আয়েশের সকল উপকরণই সেখানে বর্তমান। এক ব্যক্তি সম্মুখে বসে তার চোখে চোখ রেখে আছে এবং বলছে- মিসর আমার রাজ্য। সালাহুদ্দীন আইউবী ইরাকী কুর্দি। তিনি আমার রাজ্য দখল করে আছেন। আইউবী আমার রাজ্যের রূপসী মেয়েদের দ্বারা নিজ হেরেম পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। আমার পাঁচ হাজার জানবাজ সৈন্য সমগ্র মিসর দখল করে নেবে।
হাবীবুল কুদ্দুসের ঠোঁটে মুচকি হাসি। চেহারায় খুশির আভা। তিনি বিড় বিড় করে ওঠেন- আমার তরবারী কোথায়? আমার ঘোড়া প্রস্তুত করো। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করবো। আমার পাঁচ হাজার জানবাজ সৈন্য একদিনে মিসরের বাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করে ফেলবে।
ক্রুসেডাররা আমার বন্ধু- লোকটি তার চোখে চোখ রেখে বললো- তারা আমাকে সাহায্য করবে। বন্ধু তো সে, যে বিপদের সময় সাহায্য করে।
আমার তরবারী কোথায়?- হাবীবুল কুদ্দুস খানিক স্পষ্ট কণ্ঠে বলতে শুরু করেন- মিসর অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। মিসরের মেয়েরা অত্যন্ত রূপসী হয়ে গেছে। মিসর আমার, মিসর আমার।
একটি মেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। মেয়েটার পরিধানের পোশাক এমন, যেনো উলঙ্গ। মাথার রেশম-কোমল চুলগুলো খোলা। হাল্কা গোলাপী বর্ণের সুঢৌল দেহ। মেয়েটা হাবীবুল কুদ্দুসের গা-ঘেঁষে বসে পড়ে। একটা বাহু হাবীবুল কুদ্দুসের কাঁধের উপর আলগোছে রেখে দেয়। তার রেশমী চুলগুলো হাবীবুল কুদ্দুসের গণ্ডদেশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিনি আচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন- মিসর অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।
মেয়েটি এক ধারে সরে গিয়ে বললো- কিন্তু আমাকে সুলতান আইউবী দখল করে আছেন।
হাবীবুল কুদ্দুস অকস্মাৎ মেয়েটিকে টেনে কাছে এনে বাহুতে জড়িয়ে ধরে বললেন- তোমাকে কেউ দখল করতে পারবে না। তুমি আমার। মিসর আমার।
যে যাবত সালাহুদ্দীন আইউবী জীবিত আছেন কিংবা যতোক্ষণ পর্যন্ত মিসরের উপর তার রাজত্ব আছে, সে যাবত না আমি তোমার, মিসর তোমার।
আমি তাকে খুন করে ফেলবো- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আমি আইউবীকে হত্যা করবো।
থামো- কক্ষে একটি ক্ষুব্ধ কণ্ঠ গর্জে ওঠে। লোকটা খৃস্টান। মিসরী ভাষায় কথা বলছে- তোমরা হাসান ইবনে সাব্বাহর অনুসারীরা হাশিশ আর গুপ্তহত্যা ব্যতীত কিছুই জানো না। মেয়েটাকে তার কাছে থাকতে দাও। তুমি আমার সঙ্গে আসো।
লোকটি তাকে সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে বললো- এখন আর ওকে হাশিশ দিও না। তার নেশা কেটে যেতে দাও। তার হাতে সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করাতে হবে। তার মাধ্যমে তার বাহিনীকে বিদ্রোহে উস্কে দিতে হবে। আমার এসে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অন্যথায় আমি তার এই অবস্থা হতে দিতাম না। সংজ্ঞা ঠিক রেখে তাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর শত্রু বানাতে হবে। তোমরা লোকটাকে যেরূপ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে অপহরণ করে এনেছো, আমি অন্তর থেকে তার জন্য তোমাদের প্রশংসা করি। এর বিনিময়ে তোমাদেরকে এতো পরিমাণ পুরস্কার দেয়া হবে, যা তোমরা অতীতে কখনো পাওনি। কিন্তু হাশিশ প্রয়োগ করে তোমরা আমাদের কাজ কঠিন করে দিলে। এখন তার নেশা দূর করার ব্যবস্থা নাও।
ক্রুসেডারদের গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা এবং মুসলিম যুবকদের চরিত্র ধ্বংসের পন্থা-পদ্ধতি অত্যন্ত পরিপক্ক। তাদের এই বিদ্যার বিশেষজ্ঞগণ মানবীয় স্বভাবের দুর্বলতা ও চাহিদা সম্পর্কে সম্যক অবগত। তাদের দৃষ্টি সুলতান আইউবীর ফৌজ ও প্রশাসনের প্রতিজন অফিসার-কর্মকর্তার উপর নিবদ্ধ। অপরদিকে আরবের আমীর-উজির এবং বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের মুসলিম শাসকদের দুর্বলতা সম্পর্কেও তারা অবহিত। তাদের প্রচেষ্টা, অধিক থেকে অধিকতর শাসক ও কর্মকর্তা তাদের অধীন হয়ে যাক এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াক। ইহুদীরা সম্পদ ও নারী দিয়ে তাদের পুরোপুরি সাহায্য করে যাচ্ছে। কাফেরদের বিশেষজ্ঞগণ মুসলিম শাসক প্রমুখদেরকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে রেখেছে।
একদল সুন্দরী নারী, মদ আর হীরা-জহরতের বিনিময়ে নিজেদের ঈমান বিক্রি করে ফেলেছে। একটি দল তাদের, যারা স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তার স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তৃতীয় দলে আছে তারা, যারা দেশ ও জাতির অফাদার এবং পরিপক্ক মুসলমান। এই তৃতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হাত করা ক্রুসেডারদের স্বতন্ত্র একটি মিশন। সুলতান আইউবীর গোপন পলিসি-পরিকল্পনা সময়ের আগে অবগত হওয়া এবং তাঁর সৈন্যদের দ্বারা তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করানো ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে তারা এই মিশন পরিচালনা করছে। এই পরিপক্ক দীনদার ও নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের হাত করার জন্য তাদের নিকট কয়েকটি পন্থা আছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে অপহরণ করে দলে ভেড়ানো। একটি হচ্ছে হত্যা করা। প্রয়োজন হলে হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতকদের ভাড়া নেয়া হতো।
নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুস এমন একজন কর্মকর্তা, যাকে হত্যা করায় ক্রুসেডারদের কোনো লাভ নেই। বরং তাকে হাত করে তার বাহিনীকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে উস্কে দিতে হবে। ক্রুসেডাদের মুসলিম এজেন্টরা তাদের অবহিত করেছে, হাবীবুল কুদ্দুস ঈমান নয় জীবন দেয়ার মতো মানুষ এবং তার মধ্যে এমন জযবা ও অস্বাভাবিক যোগ্যতা আছে, যদি তাকে তার বাহিনীসহ এক লাখ শত্রুসেনার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়, তাহলে মাত্র পাঁচ হাজার সৈন্য দ্বারা এই বিশাল শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।
ক্রুসেডাররা বিষয়টা যাচাই করে দেখেছে। কখনো করেছে অস্বাভাবিক রূপসী যুবতীকে নিরাশ্রয় এতীম নির্যাতিতার বেশে সাহায্যের জন্য কিংবা কোনো মেয়েকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রেরণ করে। কখনো বা ভোজসভা কিংবা খেলাধুলার অনুষ্ঠানে কোনো সুন্দরী মেয়েকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়ে। কিন্তু হাবীবুল কুদ্দুস কখনোই তাদের জালে আটকা পড়েননি, যেন তিনি পাথর।
মিসরে বিদ্রোহ করানো ক্রুসেডারদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা, সালাহুদ্দীন আইউবী সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের অঞ্চলগুলোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মুসলিম আমীদেরকে যুক্তি-প্রমাণ কিংবা তরবারীর মাধ্যমে নিজের অনুগত বানিয়ে চলেছেন। এরপরই তিনি ফিলিস্তীন অভিমুখে যাত্রা করবেন। ফিলিস্তীন থেকে তার মনোযোগ সরানোর একটা পন্থা এই হতে পারে যে, মিসরে তাঁর যে ফৌজ আছে, তাদেরকে বিদ্রোহের জন্য উস্কে দেয়া হবে।
ইতিপূর্বে ক্রুসেডাররা সুদানীদেরকে মিসরী ফৌজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলো। সুদানী বাহিনী হামলাও করেছিলো। কিন্তু সুদানী বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক ছিলো হাবশী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। দ্বিতীয়ত তারা ছিলো হুজুগে মাতাল। এই একযোগে লড়াই করে তো এই একসঙ্গে পালিয়ে যায়। ক্রুসেডাররা তাদেরকে মিসরের বিরুদ্ধে উস্কে রাখে; কিন্তু যুদ্ধ করাবার কথা ভাবেনি। এখন তারা মিসরী বাহিনীরই দ্বারা বিদ্রোহ করানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তাদের বিবেচনায় হাবীবুল কুদ্দুসই এ কাজের জন্য যথোপযুক্ত ব্যক্তি। তাই খৃস্টান গোয়েন্দা ও বিশেষজ্ঞগণ তাকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের দ্বারা কর্মটা করিয়ে ফেলে।
এক সন্ধ্যায় দুজন লোক হাবীবুল কুদ্দুসের ঘরে যায়। তারা একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে বললো, ওখানকার একটি মসজিদের ছাদ ধসে গেছে। এখন পুরো মসজিদটিই নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এলাকাবাসী আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে কাজটা করে ফেলতে প্রস্তুত। এখন আমাদের একজন মুরুব্বীর প্রয়োজন। আপনি এলে কাজটা সহজে হয়ে যাবে। এ মর্মে তারা বেশকিছু আবেগময় কথা বলে হাবীবুল কুন্দুসের হৃদয়টা গলিয়ে ফেলে। তিনি তাদের সঙ্গে রওনা হয়ে যান। নগরী থেকে বেরিয়ে গেলে আরো চার ব্যক্তি তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়। হঠাৎ ছয়জন মিলে তাকে ঝাঁপটে ধরে ফেলে উল্লিখিত স্থানে নিয়ে যায়। ওখানে পৌঁছেই তার অজান্তে তারা তাকে হাশিশ খাইয়ে দেয়।
***
কায়রোতে মিসরী গোয়েন্দারা হাবীবুল কুন্দুসের অনুসন্ধানে গলদঘর্ম সময় অতিবাহিত করছে। সকলেরই ধারণা, তিনি সুদানী কিংবা ক্রুসেডারদের নিকট চলে গেছেন। নিজ বাহিনীর উপর হাবীবুল কুদ্দুসের কী পরিমাণ প্রভাব বিদ্যমান, আলী বিন সুফিয়ানের তা জানা আছে। সে কারণে তিনি মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের অনুমতিক্রমে বিষয়টা সুলতান আইউবীকে অবহিত করে রেখেছেন। ধারণা ছিলো, তিনি তার নির্ভরযোগ্য কমান্ডারদের নিকট কোন বার্তা প্রেরণ করবেন। গোয়েন্দারা চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে রাখে। কিন্তু কারো প্রতি তার কোনো বার্তা আগমনের কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। তার বাহিনীর কোনো কমান্ডার উধাও হয়ে যায় কিনা সেদিকেও কড়া নজর রাখা হচ্ছিলো। কিন্তু এতোদিনে একজন কমান্ডারও উধাও হয়নি।
খৃস্টান লোকটি গোটা রাত হাবীবুল কুদ্দুসের নেশার ক্রিয়া দূর হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। পরদিন সে হাবীবুল কুদ্দুসের পাশে গিয়ে বসে। হাবীবুল কুদ্দুস এখনো ঘুম থেকে জাগ্রত হননি। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তিনি এদিক-ওদিক তাকান। খৃস্টান লোকটির উপর চোখ পড়ামাত্র তিনি উঠে বসেন এবং গভীর দৃষ্টিতে তার প্রতি তাকিয়ে থাকেন।
আমি দুঃখিত যে, লোকগুলো আপনার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছে- খৃস্টান বললো- আপনি এতো বিস্মিত ও অস্থির হবেন না। অভাগারা আপনাকে হাশিশ পান করিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলো। আপনি হাশিশ আর ফেদায়ীদের পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত আছেন। তারা আপনাকে অপমান করেছে। এর জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি আপনাকে কোনো স্বপ্ন দেখাবো না। আমি আপনার সম্মুখে অত্যন্ত সুদর্শন এক বাস্তবতা উপস্থাপন করবো। আপনি নিজেকে কয়েদি ভাববেন না। আমি আপনার মর্যাদা উঁচু করে দেবো। আপনার একবিন্দু অপমান হতে দেবো না।
এরা প্রতারণার মাধ্যমে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- পরে বোধ হয় অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারদিকে তাকান এবং বিস্মিত কণ্ঠে বললেন- সেটা অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম জায়গা ছিলো। আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
আপনি নিজেকে জাগ্রত করুন- খৃস্টান বললো- এসব হাশিশের ক্রিয়া। আপনি প্রথম দিন থেকেই এখানে আছেন।
আমাকে অপহরণ করা হয়েছে?- হাবীবুল কুদ্দুস বাস্তবতায় ফিরে আসতে শুরু করেছেন। খানিক ভয়জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- তুমি কে?
আমি আপনার এক মুসলমান ভাই- খৃস্টান বললো- আমার আপনার থেকে নেয়ার মতো কিছু নেই। আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই।
আমি যদি এই লেনদেন অস্বীকার করি, তাহলে?
তাহলে আপনি জীবিত ফেরত যেতে পারবেন না- খৃস্টান বললো আপনি কায়রো থেকে এতো দূরে আছেন যে, আমরা আপনাকে মুক্ত করে দিলেও আপনি মরে যাবেন।
সেই মৃত্যুকেই আমি বরণ করে নেবো- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন আমি শত্রুর কয়েদখানায় মৃত্যুবরণ করতে চাই না।
আপনি না আটক আছেন, না আপনি আমাদের শত্রু- খৃস্টান বললো- অপদার্থগুলো আপনার সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করে আপনার মধ্যে কুধারণা সৃষ্টি করে দিয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
কথাগুলো বলার জন্য অপহরণ করে আমাকে এতো দূরে নিয়ে আসার কী প্রয়োজন ছিলো?
আমি যদি কায়রোতে বসে আপনার সঙ্গে কথা বলতাম, তাহলে আমরা উভয়ে এতোদিনে কয়েদখানার পাতাল প্রকোষ্ঠে চলে যেতাম খৃস্টান বললো- ওখানে আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস পায়ে পায়ে গোয়েন্দা দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
হাবীবুল কুদ্দুসের মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেমাগ তার ভাববার যোগ্য হয়ে গেছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন, তিনি খৃস্টান নাশকতাকারীদের কবলে এসে পড়েছেন। জিজ্ঞেস করেন- তুমি ক্রুসেডারদের লোক, নাকি সুদানীদের?
আমি মিসরের লোক- খৃস্টান জবাব দেয়- আপনিও মিসরী। আপনি বাগদাদী, শামী কিংবা আরবী নন। মিসর মিসরীদের। এ দেশটা নুরুদ্দীন জঙ্গী-সালাহুদ্দীন আইউবীর পৈতৃক জমিদারি নয়। এটা ইসলামী রাষ্ট্র। এখানে আল্লাহর রাজত্ব চলবে। এবার শাসন করবে মিসরী মুসলমানরা। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেননি, যারা আমাদের উপর রাজত্ব করছেন, তারা বাগদাদ ও দামেশক থেকে এসেছেন এবং মিসরকে সিরিয়ার সঙ্গে একীভূত করে এক রাজ্য গঠন করেছেন?
তুমি কি আমাকে মিসরকে সালাহুদ্দীন আইউবী থেকে মুক্ত করার জন্য উস্কানি দিচ্ছো?
আমি জানি, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে পয়গম্বর না হলেও পীর-মুরশিদ অবশ্যই মনে করেন- খৃস্টান বললো- আমি তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবো না। আইউবীর মধ্যে অনেক গুণ আছে। আপনি তাকে যতোটুকু পছন্দ করেন, আমি তার চেয়ে কম করি না। কিন্তু আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে, লোকটা আর কতোদিন বেঁচে থাকবেন। তারপর মিসর তার যে ভাই কিংবা পুত্রের হাতে আসবে, তার মধ্যে তো আর আইউবীর গুণাবলী থাকবে না। তখন মিসর আরেক ফেরাউনের কজায় চলে যাবে।
আমার দ্বারা তুমি কী কাজ করাতে চাও?
আপনি যদি আমার বক্তব্য বুঝে থাকেন, তাহলে আমি বলতে পারি, আপনি কী কাজ করতে পারেন- খৃস্টান উত্তর দেয়- আপনার মনে যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আগে সন্দেহ দূর করুন। আমি আপনাকে চিন্তা করার সুযোগ দিলাম। আপনি এইমাত্র ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েছেন। হতভাগ্যদের দেয়া হাশিশের ক্রিয়া এখনো, দূর হয়নি। আমি আপনার জন্য নাস্তা পাঠাচ্ছি। এতোদিনে লোকগুলো আপনাকে গোসল করার সুযোগটা পর্যন্ত দেয়নি। আমি আপনাকে একটি কূপে নিয়ে যাবো।
খৃস্টান লোকটি উঠে বাইরে বেরিয়ে যায়। সামান্য পরে অপর এক ব্যক্তি এসে বললো- আমার সঙ্গে চলুন। নাস্তার আগে গোসলটা সেরে নিন।
জীর্ণ ভবন থেকে হাবীবুল কুদ্দুসকে অন্য এক পথে বের করে নেয়া হয়। পথটি পার্বত্য অঞ্চলের ভেতরের দিকে চলে গেছে। খানিক দূরে একটি ঝরনা, যার স্ফটিকস্বচ্ছ পানি ক্ষুদ্র একটি প্রাকৃতিক পুষ্করিনীতে গিয়ে সঞ্চিত হচ্ছে। হাবীবুল কুদ্দুস কয়েকটি পর্বত ঘুরে ঘুরে ঝরনার নিজট গিয়ে পৌঁছুলে দেখতে পান, দুটি মেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করছে আর একে অপরের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। হাবীবুল কুদ্দুস অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। মেয়ে দুটো হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এই বিজন ভূমিতে মেয়ে দুটোকে জিন-পরী বলে মনে হলো। হাবীবুল কুদ্দুস এদিক ওদিক তাকান। সবদিকেই পাহাড়। তিনি পেছন দিকে দৃষ্টপাত করেন। তার সঙ্গে আসা লোকটি তার সামনে সামনে হাঁটছে।
হাবীবুল কুদ্দুস হঠাৎ ছোঁ মারার মতো করে এক বাহু দ্বারা লোকটার ঘাড় ঝাঁপটে সাধ্য পরিমাণ চেপে ধরে অপর হাত দ্বারা পূর্ণ শক্তিতে তার পেটে তিন-চারটি ঘুষি মারেন। লোকটি দম আটকে মরে যায়। হাবীবুল কুদ্দুস লাশটা টেনে-হেঁচড়ে একটি ঘন ঝোঁপের পেছনে ফেলে দিয়ে নিজে পালাতে উদ্যত হন। এক পাহাড়ের মধ্যকার পথটা আগেই দেখে নিয়েছেন। সেখানে পৌঁছে দেখতে পান, এক ব্যক্তি বর্শা তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি শুধু বললো- ফেরত। হাবীবুল কুদ্দুস নিরস্ত্র। অগত্যা মাথানত করে পেছন পানে মোড় ঘোরান। কয়েক পা অগ্রসর হয়েছেন মাত্র। হঠাৎ উক্ত খৃস্টান লোকটি তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটি মিটি মিটি হাসছে।
আমি আপনাকে বুদ্ধিমান মনে করি- খৃস্টান বললো- আপনি এই অঞ্চল থেকে বের হতে পারবেন না। অযথা বোকা সাজবেন না। গোসল করে আমার সঙ্গে আসুন।
হাবীবুল কুদ্দুস সুবোধ বালকটির ন্যায় পুকুরে নেমে গোসল করে কাপড় পরিধান করেন। খৃস্টান লোকটি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। পথে তিনি খৃস্টানকে জিজ্ঞেস করেন- এই মেয়েগুলো কি তোমাদের সঙ্গে থাকে?
হ্যাঁ, এমনি বিজন অঞ্চলে এমন চাকচিক্য সঙ্গে রাখতে হয়- খৃস্টান বললো- আপনারও তো ওখানে তিনটি বউ ছিলো। এখন প্রয়োজন হলে আপনিও এদের যাকে পছন্দ হয়, সঙ্গে রাখতে পারেন।
এমন সময় এক মেয়ে নাস্তা নিয়ে আসে। হাবীবুল কুদ্দুস তার প্রতি তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটি তার পাশে বসে পড়ে। খৃস্টান লোকটি বেরিয়ে যায়। মেয়েটি কথা ও আচরণে হাবীবুল কুদ্দুসকে পাগল করে তোলে। অনেক পরে যখন খৃস্টান ফিরে আসে, তখন মেয়েটি চলে যায়। তখন হাবীবুল কদুসের মনে আক্ষেপ জাগে।
আপনি স্বাধীন মিসরের প্রধান সেনাপতি হবেন- খৃস্টান বললো আপনার বাহিনীতে যে তিন হাজার পদাতিক এবং দুহাজার অশ্বারোহী আছে, তারা প্রত্যেকে আপনার অনুগত ও অনুরক্ত। আপনি তাদেরই সাহায্যে মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিতে পারেন।
সালাহুদ্দীন আইউবী যদি আক্রমণ করেন, তাহলে কি আমি এই বাহিনী দ্বারা মিসরকে তার থেকে রক্ষা করতে পারবো?
মিসরের বাহিনীতে যেসব সুদানী মুসলমান রয়েছে, তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে- খৃস্টান বললো- আইউবীর বাহিনীতে যেসব মিসরী আছে, আমরা তাদের নিকট সংবাদ পৌঁছিয়ে দেবো, এটা গৃহযুদ্ধ নয়- মিসরীয়দের মিসরকে মুক্ত করার লড়াই। আপনি আপনার বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ করাবেন। আপনাকে সামরিক শক্তি সরবরাহ করার দায়িত্ব আমাদের।
খৃস্টান লোকটি স্ববিস্তার হাবীবুল কুদ্দুসকে তাদের পরিকল্পনা ব্যক্ত, করে। হাবীবুল কুদ্দুস এখন আর আপত্তি করছেন না। বরং এমনভাবে প্রশ্ন করছেন, যেন তিনি সম্মত হয়ে গেছেন।
আমি কায়রো ফিরে না গেলে বিদ্রোহ কীভাবে করাবো? হাবীবুল কুদ্দুস জিজ্ঞেস করেন।
আপনাকে কায়রো যেতে হবে না- খৃস্টান বললো- আপনি এখান থেকেই আপনার নির্ভরযোগ্য সঙ্গীদেরকে বার্তা প্রেরণ করবেন। বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমরা করবো। আপনি আমাদের একজন মূল্যবান লোককে হত্যা করে ফেলেছেন। সেই অপরাধে আমরা আপনাকে মেরে ফেলতে পারি। আমাদের বাহু এতো লম্বা যে, আপনার বংশের প্রতিজন সদস্যকে আমরা খুন করতে পারি। আপনি যদি আমাদেরকে ধোকা দেন, তাহলে আমরা তা-ই করে দেখাবো।
তার মানে, এখানে আমাকে বহুদিন থাকতে হবে। হাবীবুল কুদ্দুস বললেন।
কিছুদিন তো থাকতেই হবে। খৃস্টান উত্তর দেয়।
আমার একটি প্রয়োজন পূরণ করে দাও- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন তুমি আমাকে দুটি মেয়ে পেশ করেছে। আমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাই। এমনও হতে পারে, এরূপ রূপসী মেয়েদের জালে আটকা পড়ে আমি নিজের আসল উদ্দেশ্য ভুলে যাবো। তার চেয়ে বরং আমার ছোট স্ত্রীকে এখানে এনে দাও। তার নাম যোহরা। আমি তাকে বার্তা আদান-প্রদানেও ব্যবহার করতে পারবো।
তাহলে তো তাকে অপহরণ করতে হবে- খৃষ্টান বললো- আমরা যদি বলি, আপনি তাকে আসতে বলেছেন, তাহলে তিনি বিশ্বাস করবেন না। তাছাড়া তিনি আমাদেরকে ধরিয়েও দিতে পারেন। বরং আমি আপনাকে যে উত্তম বিকল্প পেশ করেছি, আপনি তাই বরণ করে নিন। সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য অন্য কারো ঠিকানা দেন।
তাহলে তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আমাকে কায়রো পৌঁছিয়ে দাও। আমি এক মাসের মধ্যে বিদ্রোহ করিয়ে দেবো।
এ হতে পারে না- খৃস্টান বললো- আমরা যা কিছু করছি মুহতারাম! মিসরের স্বার্থেই করছি। আর তাতে আপনারও স্বার্থ আছে। আমি কিংবা আমার সংগঠনের কোন সদস্য মিসরের শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখি না। আপনি বুঝবার চেষ্টা করুন।
আমি বুঝে ফেলেছি- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আর আমি বুঝে শুনেই কথা বলছি। তোমরা আমার স্ত্রী যোহরাকে আমার নিকট চলে আসতে সংবাদ পাঠাও। সে যে কাজ করতে পারবে, অন্য কেউ তা পারবে না। তার চলে আসার পর দেখবে, আমি কীভাবে পরিকল্পনা সফল করে তুলি।
***
যে মহিলা যোহরার পথ আগলে দাঁড়ালো, সে এক ভিখারিনী। মহিলা দুতিন দিন যাবতই দেখে আসছে, প্রতি দিন দুপুরের পর যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসের ঘর থেকে বের হয়ে পিতার ঘরে যাচ্ছে। ভিখারিনী : তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো- নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুস আপনাকে যেতে বলেছেন। এই নিন তার নিজ হাতে লেখা চিঠি।
যোহরা কাগজখানা হাতে নিয়ে ভাজ খুলে পড়ে। তার স্বামীরই হাতের লেখা। ভিখারিনী বললো- তিনি যেখানেই আছেন নিজে গেছেন। এতো বড়ো ব্যক্তিত্বটাকে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে না। তিনি কেবলই আপনাকে কামনা করছেন এবং বলছেন, আমি যোহরাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমি আপনাকে এও বলে দিচ্ছি, যদি আপনি আমাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন কিংবা পুলিশে খবর দেন, তাহলে দুজনকেই হত্যা করা হবে। আপনার হাবীবুল কুদ্দুসের নিকট যাওয়া খুবই জরুরি।
আমি তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করবো? যোহরা জিজ্ঞেস করে।
আমি ভিখারিনী নই- মহিলা জবাব দেয়- এটা আমার ছদ্মবেশ। আমিও আপনার ন্যায় রাজকন্যা। আমাদের উদ্দেশ মহৎ ও পবিত্র। আপনি মনে কোনো সংশয় রাখবেন না।
মহিলা আরো এমন অনেক কথা বলে, যদ্বারা যোহরা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে মহিলার কথা মতো রাতে একস্থানে চুপি চুপি উপস্থিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সে এই ভয়ে কাউকে কিছু বলেনি যে, মহিলা বলেছিলো বিষয়টা আপনার ও আপনার স্বামীর জীবন-মরণের এবং মিসরের স্বাধীনতা ও গোলামীর সাথে সম্পৃক্ত।
রাতে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যোহরাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ভিখারিনীর সঙ্গে দুজন পুরুষ এসে হাজির হয়। অন্ধকারে যোহরা লোক দুজনকে চিনতে পারেনি। ভিখারিনীকে চিনেছে তার কণ্ঠে। কিন্তু এখন তার ভিখারিনীর বেশ নেই- এক রূপসী তরুণী। সে যোহরাকে বললো- আল্লাহর উপর ভরসা করে এদের সঙ্গে চলে যান। অন্তরে কোনো ভয় রাখবেন না।
যোহরাকে একটি ঘোড়ায় তুলে বসানো হয়। তারাও ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। যোহরা এমন এক সফরে রওনা হয়, যার গন্তব্য তার জানা নেই। মহিলা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। শহর থেকে দূরে এক স্থানে পৌঁছে আরোহীরা যোহরাকে বললো, তোমার চোখে পট্টি বাঁধতে হবে। যোহরা একা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শক্তি তার নেই। তার চোখে পট্টি বেঁধে দেয়া হলো।
দুদিন পরে খবর হলো, নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুসের ছোট স্ত্রীও নিখোঁজ হয়ে গেছে। প্রাথমিক তদন্ত করা হলো। গোয়েন্দারা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় তাকে অপহরণ করা হয়েছে। হাবীবুল কুদ্দুস। সম্পর্কেও সকলের ধারণা, তিনি ক্রুসেডার কিংবা সুদানীদের নিকট চলে গেছেন। এখন মানুষ বলছে, তার স্ত্রীও তার কাছে চলে গেছে। কেউ জানে না, মহিলা কখন কীভাবে গেছে।
এতোক্ষণে যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসের নিকট পৌঁছে গেছে। সেই কক্ষে তার চোখ খোেলা হলো, যেখানে তার স্বামী তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। মেয়েটা এই গোটা রাত এবং আগের আধা দিন সফরে ছিলো। পথে খাওয়া-দাওয়ার সময় শুধু তার চোখ খুলে দেয়া হয়েছে। অপহরণকারীরা তার সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলেনি। তারা তাকে অভয় দিয়ে দিয়ে নিয়ে আসে।
হাবীবুল কুদ্দুসকে দেখার পর যোহরার দেহে প্রাণ ফিরে আসে। খৃস্টান লোকটা সঙ্গে আছে। হাবীবুল কুদ্দুস যোহরাকে বললো- ইনি আমাদের বন্ধু। আমরা এখানে কারো কয়েদি নই। তুমি অনেক ক্লান্ত। আজ রাতটা বিশ্রাম নাও। কাল সকালে বলবো, তোমাকে কী করতে হবে। তুমি অনেক সময় বলতে, তোমার পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জিহাদ করতে ইচ্ছে হয়। আমার এই বন্ধু তোমার জন্য বেশ ভালো সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
খৃস্টান দুজনকে একাকি রেখে বাইরে বেরিয়ে যায়।
যোহরা এখনো তরুণী। রূপে আকর্ষণ আছে। ছেলেবেলার চাঞ্চল্য, দুরন্তপনা এখনো পুরোপুরি বিদ্যমান। হাবীবুল কুদ্দুস যে দুটি মেয়েকে পুকুরে গোসল করতে দেখেছিলেন, সন্ধ্যার খানিক আগে তারা যোহরার কক্ষে এসে পড়ে। এসেই এমনভাবে আলাপ জমিয়ে ফেলে, যেনো যোহরা তাদের বহুদিনের চেনা। তারা যোহরাকে অন্তরঙ্গ বান্ধবীর ন্যায় সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এলাকাটা ভয়ংকর এক ধ্বংসাবশেষ বটে, কিন্তু মেয়েগুলো যেখানে থাকে, সেটি এখন সাজানো-গোছানো কক্ষ। রঙিন ঝাড়বাতি জ্বলছে। এই কক্ষে প্রবেশ করলে ধ্বংসাবশেষের কল্পনাও মনে আসে না। যোহরা অল্প সময়ে তাদের সঙ্গে মিশে যায়। এক মেয়ে যোহরাকে বললো- তোমার বাবা-মা কতো নিষ্ঠুর, তারা তোমার ন্যায় ফুটন্ত কলিটাকে এই বৃদ্ধের পায়ে নিক্ষেপ করেছে। লোকটা তোমাকে ক্রয় করেনি তো?
হ্যাঁ- যোহরা বেদনামাখা কণ্ঠে বললো- তিনি আমাকে ক্রয় করেছেন। আমি পালিয়েও কোথাও যেতে পারছি না। আমার অন্য কোন আশ্রয়ও নেই।
আশ্রয় পেলে পালিয়ে যাবে?
সেই আশ্রয় যদি আমার বর্তমান জীবন থেকে উন্নত হয়, তাহলে অবশ্যই পালাবো- যোহরা বললো এবং জিজ্ঞেস করলো- তিনি আমাকে এখানে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন? তোমরা কারা? তিনি আমাকে বিক্রি করছেন নাকি?
তুমি যদি আমাদের নিকট এসে পড়ো, তাহলে রাজকন্যা হয়ে থাকবে- এক মেয়ে বললো- তোমাকে বলে দেবো, আমরা কারা। তবে তার আগে দেখতে হবে তুমি আমাদের সঙ্গে থাকার যোগ্য কিনা। তুমি কি আমাদের সঙ্গে বাইরে গিয়ে আমাদের ন্যায় উলঙ্গ হয়ে পুকুরে গোসল করতে পারবে?
ঐ পশুটা থেকে আমাকে মুক্ত করে দাও, তো যা বলবে তা-ই করবো। যোহরা উত্তর দেয়।
এক ব্যক্তি যোহরাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে। বললো, নায়েব সালার খাবার সামনে নিয়ে আপনার অপেক্ষা করছেন।
যোহরা চলে গেলে যে খৃস্টান লোকটি হাবীবুল কুদ্দুসের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলো, সে কক্ষে প্রবেশ করে। মেয়েরা আনন্দ প্রকাশ করে বললো- মেয়েটা আমাদের কাজের এবং বৃদ্ধ স্বামীর প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা। তুমি অনুমতি দিলে আমরা তাকে নিজেদের রঙে রঙিন করে নিতে পারি। দেখেছো তো, কতো রূপসী। চঞ্চলতা, দুরন্তপনা আছে। দেহ কঠোরতা সহ্য করতে পারবে। প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
কিন্তু আমি ভাবছি লোকটা বলতো, এই স্ত্রীর উপর তার আস্থা আছে। বার্তা আদান-প্রদান করতে পারবে- খৃস্টান বললো- মেয়েটা সত্যিই যদি লোকটাকে ঘৃণা করে থাকে, তাহলে তো সে তাকে ধোঁকা দেবে এবং আমাদের প্রত্যেককে ধরিয়ে দেবে। তার অর্থ হচ্ছে, এ কাজে আমাদেরকে তাড়াহুড়া করা যাবে না। লোকটা আমাদের জালে এসে পড়েছে। আমাকে সে মিসরী মুসলমান ও দেশপ্রেমিক বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে। সে আমাদের হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মেয়েটা যদি তাকে ধোকা দিতে রাজি হয়, তাহলে আমরা তাকে ব্যবহার করতে পারি। আমি তাকে যাচাই করে দেখবো। তোমরা রাতে অল্প সময়ের জন্য তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। আমার কাছে রেখে কোনো এক বাহানায় তোমরা বেরিয়ে যাবে।
আহারের কিছুক্ষণ পর মেয়েরা পুনরায় গল্প করার নাম করে যোহরাকে নিয়ে আসে। তারা তাকে পূর্বের চেয়ে বেশি ফ্রি বরং বলা চলে অনেকটা বেহায়া বানিয়ে ফেলেছে। খৃস্টান এসে উপস্থিত হলে যোহরাকে রেখে মেয়ে দুটো বেরিয়ে যায়। মেয়েরা যোহরার সঙ্গে যে ধারায় কথা বলেছিলো, পুরুষটিও একই ধারায় কথা বলে। খৃস্টান তাকে যাচাই যা করার করে এক পর্যায়ে বাহুতে আকড়ে ধরে কাছে টানতে শুরু করে। যোহরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো- আমি এমন সস্তা নই যে, একটু ইঙ্গিত করলেই কারো কোলে লুটিয়ে পড়বো।
উত্তরটা খৃস্টান লোকটার ভালো লাগে। যে কারো হাতে আসবার মতো মেয়ে নয়। তাদের গোয়েন্দা ও নাশকতাকারী মেয়েদের যেসব। গুণ থাকে, এর মধ্যেও সেসব বিদ্যমান। সামান্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। যোহরা তাকেও বলেছে, স্বামীটার প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা। কিন্তু যেহেতু সে বাধ্য এবং ঘৃণার কথা প্রকাশ করতে পারে না, তাই তিনি মনে করেন, আমি তাকে ভালোবাসি।
এখনো ঘৃণা প্রকাশ করবে না- খৃস্টান বললো- আমি তোমাকে তার থেকে মুক্ত করিয়ে দেবো। তুমি রাজকন্যাদের ন্যায় জীবন-যাপন করবে। তুমি এখানেই বসে থাকো। আমি তোমার বান্ধবীদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
খৃস্টান কক্ষ থেকে বেরিয়ে মেয়েদের নিকট চলে যায়। বললো মেয়েটা কাজের। নিজেদের ছায়ায় নিয়ে নাও। হাবীবুল কুদ্দুস মেয়েটাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে। আমরা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে নিয়ে সংবাদ আদান-প্রদানে কাজে লাগাবো। তাকে জালে আটকানো তোমাদের কাজ। রাজকীয় জীবনের মুলা দেখাও। আর তাকে কী উদ্দেশ্যে কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে, তোমরা জানো।
যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসের সঙ্গে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা প্রকাশ করতে থাকে, এবং খৃস্টান পুরুষ ও মেয়ে দুটোকে বলতে থাকে, স্বামীর প্রতি আমার অন্তহীন ঘৃণা। মেয়ে দুটো তাকে সঙ্গে রাখতে এবং বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঝরনার পুকুরে নিয়ে গেলে যোহরা অবলীলায় পরিধানের সমুদয় কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পুকুরে নেমে মেয়ে দুটোর সঙ্গে খেলতে শুরু করে। তারপর এটা তার নিত্যদিনের কর্মসূচিতে পরিণত হয়ে যায়। যোহরা রাত কাটাচ্ছে স্বামীর সঙ্গে। আর দিবস অতিবাহিত করছে মেয়ে দুটোর সাথে। মাঝে-মধ্যে দিনের বেলা খৃষ্টান পুরুষও তার সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ কথাবার্তা বলছে। চার-পাঁচ দিনেই যোহরা সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে মেয়ে দুটোর রঙে রঙিন হয়ে যায়। তার চাঞ্চল্য ও দুরন্তপনা বেহায়াপনার রং ধারণ করতে শুরু করেছে। মেয়েরা ধীরে ধীরে তাকে তাদের রহস্যময় জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে খৃস্টান লোকটি হাবীবুল কুদ্দুসের সঙ্গে বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে ফেলেছে। পরিকল্পনা প্রণয়নে হাবীবুল কুদ্দুস তাকে বেশ সাহায্য করেছেন। হাবীবুল কুদ্দুস এখন তার পূর্ণ আস্থাভাজন ব্যক্তি। সে হাবীবুল কুদ্দুসকে মিসরী ফৌজের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ দুজন অফিসারের নাম বলে, যারা গোপনে গোপনে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরোধিতা করছে এবং বিদ্রোহের কথা চিন্তা করছে। হাবীবুল কুদ্দুসকে হাত করার চিন্তা প্রথমে তাদেরই মাথায় আসে। এই খৃস্টান লোকটি নিজেকে দেশপ্রেমিক মিসরী মুসলমান পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তার দায়িত্ব মিসরে সেনা বিদ্রোহ ঘটানো।
যোহরা মেয়ে দুটোর সঙ্গে এমনভাবে একাকার হয়ে যায় যে, এখন বলার উপায় নেই, মেয়েটা কোনো সম্ভ্রান্ত পিতা-মাতার কন্যা এবং একজন মুসলিম নায়েব সালারের স্ত্রী। হাবীবুল কুদ্দুস তাকে নিজের অনুগত স্ত্রী মনে করতেন।
একদিন যোহরা মেয়েদের বললো, এই জীর্ণ ভবন আর পর্বতবেষ্টিত জগতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছি। মেয়েরা বললো, ঠিক আছে, আমরা তোমাকে এই বাইরের জগত দেখানো ব্যবস্থা করবো। তারা এক পার্বত্য পথে তাকে একটি ঝিলের কিনারায় নিয়ে যায়। কূল বেয়ে বেয়ে আরো অগ্রসর হলে সে নীলনদ দেখতে পায়। এই নীল নদেরই পানি পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকে ঝিলের সৃষ্টি হয়েছে। এক স্থানে এক পাহাড়ের আড়ালে একটি নৌকা বাঁধা আছে। তাতে, বৈঠা ও দুটি দাঁড় আছে। জায়গাটা খুবই সুদৃশ্য ও মনোরম। যোহরা মেয়েদের সঙ্গে সেখানে হাসি-তামাশা করতে থাকে।
এখানে ফেরাউনদের রাজকন্যারা খেলা করতো। এক মেয়ে বললো।
আর তোমরা দুজন তাদের প্রেতাত্মা। যোহরা রসিকতা করে।
তোমার তুলনায় আমরা প্রেতাত্মা-ই। অপর মেয়ে বললো।
শোনো, যোহরা!- এক মেয়ে বললো- তুমি কি বুঝতে পেরেছো, তোমার এই বৃদ্ধ স্বামী এখানে কেন লুকিয়ে বসে আছে এবং তোমাকে কেননা ডেকে এনেছে।
সে তো প্রথম দিনই আমাকে বলে দিয়েছেন- যোহরা বললো- আমি কাজটা করে দেবো। কিন্তু তিনি কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলছেন।
আর তুমি কি জানো, আমরা স্বাধীন মিসরের রাজকন্যা হবো?
আমাকে যদি এই স্বামী থেকে মুক্ত করিয়ে দিতে পারো, তাহলে আমি তোমাদেরকে রাজকন্যা মনে করবো। যোহরা বললো।
সে পরিকল্পনা ঠিক হয়ে আছে- এক মেয়ে বললল- কিন্তু তোমার স্বামী বিষয়টা জানে না। এ ক্ষেত্রে তোমাকে যে কাজটা করতে হবে তুমি কি তার জন্য প্রস্তুত আছো?
সময় আসলেই দেখবে- যোহরা বললো- আমার যদি এ কাজটা করতে না হতো, তাহলে স্বামীকে এখানেই খুন করে ফেলতাম। ভালোই সুযোগ ছিলো।
***
যোহরা পরদিনও মেয়েদের সঙ্গে নদীর কূলে চলে যায়। মেয়েরা তাকে যে পথে নদী পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে, একা গেলে এ পর্যন্ত যোহরা পথ খুঁজে পেতো না। পথটা প্রাকৃতিক এবং গোপন। যোহরা আবদার জানায়, চলো আমরা নৌকায় চড়ে নদীতে বেড়িয়ে আসি। কিন্তু মেয়েরা তাতে অসম্মতি জানায়।
হাবীবুল কুদ্দুসের উপরও এখন আগের মতো পাবন্দি নেই। তিনি নিশ্চিত করেছেন, তিনি স্বাধীন মিসরের সমর্থক এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর মসনদ না উল্টিয়ে ক্ষান্ত হবেন না। এখন তিনি আগ বাড়িয়ে কথা বলছেন। এক অভাবিতপূর্ব বিপ্লব এসে গেছে তার মধ্যে।
এক-দুদিন পর ভগ্ন প্রাসাদে আরো দুজন লোক আসে। একজন সুদানী, অপরজন মিসরী। তাদেরকে হাবীবুল কুদ্দুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হলো। তিনি তাদেরকে চেনেন না। তাদের সঙ্গে সুদান, মিসর ও আরবের মানচিত্র আছে। আছে কিছু কাগজপত্রও।
তারা হাবীবুল কুদ্দুসের সঙ্গে বিদ্রোহের বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করে। হাবীবুল কুদ্দুস শুধু আন্তরিকতাই প্রকাশ করেননি। বরং তাদেরকে এমন সব পরামর্শ প্রদান করেন, যা ইতিপূর্বে তাদের মাথায় আসেনি। তারা হাবীবুল কুদ্দুসকে আরো কয়েক ব্যক্তির নাম জানায়, যারা মিসরের ফৌজ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং গোপনে গোপনে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে পরিবেশ সৃষ্টি করছে। লোক দুজন আরো জানায়, মিসরের সীমান্ত এলাকায় মিসরী ফৌজের যে বাহিনীটি কর্তব্য পালন করছে, তাদেরকে ভুল নির্দেশ দিয়ে, সীমান্ত প্রতিরক্ষায় এমন একটা ফাটল ধরাতে হবে, যার সুযোগে সুদানের কিছু সৈন্য ভেতরে অনুপ্রবেশ করে বিদ্রোহে সহযোগিতা দিতে পারে।
বিদ্রোহ সফল হলে মিসরের আমীর কে হবেন? হাবীবুল কুদ্দুস জিজ্ঞেস করেন।
সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, স্বাধীন সেনাপতি আপনি হবেন। সেই সুবাদে আমীরও হবেন আপনিই। মিসরী বললো- সালাহুদ্দীন আইউবী আক্রমণ করবেন, তাতে সন্দেহ নেই এবং যুদ্ধ দীর্ঘরূপ লাভ করতে পারে। সে কারণে স্বাধীন মিসরের প্রথম আমীর প্রধান সেনাপতিই হওয়া যুক্তিযুক্ত। কেননা, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অসামরিক লোককে ক্ষমতার গদিতে বসানো ঠিক হবে না। আর আপনার মধ্যে যে গুণাবলী আছে, অন্য কোন সালারের মধ্যে তা নেই।
হাবীবুল কুদ্দুসের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায়। বুকটা ফুলে যায়। ঘাড়টা মোটা হয়ে যায়। মিসরের আমীর হওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা খৃস্টানদের থেকেও সাহায্য নেয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছি। আশা করি, এতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবে না। সুদানী বললো।
তাদেরকে বিনিময়টা কীভাবে দেবেন? হাবীবুল কুদ্দুস জিজ্ঞেস করেন।
তাদের জন্য বিনিময় এটুকুই যথেষ্ট যে, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং মিসরকে তার থেকে মুক্ত করবো–মিসরী বললে তারা মিসর চায় না। তারা ফিলিস্তীনকে আইউবীর হাত থেকে রক্ষা করার কাজে ব্যস্ত। মিসর হাতছাড়া হয়ে গেলে আইউবী মিসরের সেনাবাহিনী, এখানকার রসদ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বেন। তিনি মিসরের উপর আক্রমণ চালালে তার সঙ্গে যেসব মিসরী সৈন্য আছে, তারা তাদের মিসরী ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। খৃস্টানদের জন্য এ এক বিরাট পাওয়া।
হাবীবুল কুদ্দুস তাদেরকে চমৎকার চমৎকার সব বুদ্ধি শিখিয়ে দেন এবং তাদের নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, আমার অধীনে যে পাঁচ হাজার সৈন্য আছে, তারা আমার এক ইঙ্গিতে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাদেরকে বিদ্রোহের জন্য রাজি করানোর পন্থা কী হবে।
এক হতে পারে, আমি ফেরত চলে যাবো– হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- এটিই উত্তম পন্থা। তবে আমার ফেরত না যাওয়াই উচিত। কারণ, গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোথায় ছিলাম। যোহরা আমাকে বলেছে, আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস বলছেন, আমি আপন মর্জিতে শত্রুর নিকট চলে এসেছি। ফিরে গেলে এই সন্দেহের ভিত্তিতে তারা আমাকে হেফাজতে নিয়ে নেবেন। তারপর শুরু হওয়ার আগেই আমাদের খেল খতম হয়ে যাবে। আমি আসলে স্ত্রীকে এখানে ডেকে এনে ভুল করেছি। যদি তাকেও ফেরত পাঠিয়ে দেই, তার সঙ্গেও অসদাচরণ করা হবে। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। আপনারা আমাকে ভাববার সুযোগ দিন, আমি কোন্ কোন্ কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করবো।
হাবীবুল কুদ্দুসের অফাদারিতে আর কোনো সন্দেহ থাকলো না।
***
হাবের অবরোধ তামাশা হবে না- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ফোরাতের তীরে বসে তার সালারদের বলছেন- তোমাদের প্রত্যেকের স্মরণ থাকবে, পূর্বেও একবার আমরা এই নগরীটা অবরোধ করেছিলাম। কিন্তু হাবের মানুষ এমন প্রাণপণ লড়াই করে যে, আমরা অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে ছিলো হাল্ববাসীদের বীরত্ব, যা আমাদেরকে ফিরে আসতে বাধ্য করেছিলো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। তথাপি আমাদেরকে প্রতিটি আশঙ্কার মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এখান থেকে ফৌজে যে ভর্তি নেয়া হয়েছে, তাদের উপর এখনো ভরসা করা যাবে না। মিসর থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠানোর প্রয়োজন হতে পারে। আমি নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুসের বাহিনীটাকে নিয়ে আসবো। বলেই সুলতান নীরব হয়ে যান। তার চেহারার রং বদলে যায়। তিনি চাপা চাপা কণ্ঠে বললেন- আমি মানতে পারছি না, হাবীবুল কুদ্দুস আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। লোক্টা গেলো কোথায়? আমি যখন মিসর থেকে রওনা হই, তখন সে আমাকে বলেছিলো, আপনি মিসুরের চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিন। ক্রুসেডার কিংবা সুদানীদের যদি আপনার অনুপস্থিতিতে মিসরের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে আমার তিন হাজার পদাতিক আর দুই হাজার অশ্বারোহী তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে দেবে। আর যদি মিসরের ভেতর থেকে কেউ মাথা জাগায়, তাহলে তার মাথা ধড়ের সঙ্গে থাকতে পারবে না। আমরা আল্লাহর সৈনিক। কিন্তু হাবীবুল কুদ্দুস তো আল্লাহর সিংহ ছিলো।
মনে হয় তার এসব গুণাবলী দেখেই দুশমন তাকে গুম করে ফেলেছে- এক সালার বললেন- আমাদের অর্ধেক ফৌজের উপর তার গভীর প্রভাব রয়েছে। এদিক থেকে তিনি স্বয়ং একটি শক্তি। দুশমন আমাদেরকে সেই শক্তি থেকে বঞ্চিত করে দিলো।
তাকে যদি খুঁজে না-ই পাওয়া গেলো, তাহলে তার বাহিনীকে এখানে নিয়ে আসবো- সুলতান আইউবী বললেন- তবে এতো তাড়াতাড়ি ডাকবো না। মিসরের প্রতিরক্ষা বেশি জরুরি। আশঙ্কার ব্যপার হচ্ছে, মিসরের বাইরে থেকে অতোটুকু সমস্যা নেই, যতোটুকু ভেতর থেকে আছে। ঈমান বিক্রেতারা আমাদের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা ফিলিস্তীনকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পরম বিশ্বস্ত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন নায়েব সালার কায়রো থেকে দূরে পাহাড়বেষ্টিত এক ভীতিকর জীর্ণ প্রাসাদে বসে মিসরে বিদ্রোহ করার সকল আয়োজন-পরিকল্পনা সম্পন্ন করে ফেলেছেন। এখন রাত। জীর্ণ প্রাসাদে উৎসব চলছে। বাইরে থেকে কোনো লোক এখানে এলে ভয়ে পালিয়ে যেতো। এই গোটাকতক পুরুষ আর রূপসী মেয়েদের দেখলে জিন-পরী মনে করতো।
এরা আট-দশজন পুরুষ। হাবীবুল কুদ্দুস প্রথম দিন থেকে পরিচিত খৃষ্টান লোকটা আর পরে আসা মিসরী ও সুদানী লোক দুজনকে ছাড়া আর কাউকে চেনেন না। অন্যদেরকে এই আজই প্রথমবার দেখলেন। তারা সকলে এই প্রাসাদে হাবীবুল, কুন্দুসের আগমনের পূর্ব থেকেই অবস্থান করছে। কিন্তু তারা পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে লুকিয়ে পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। হাবীবুল কুদ্দুস পালাতে গিয়ে যে লোকটাকে হত্যা করেছিলেন, এরা তারই সহকর্মী। এখন আর পাহারার প্রয়োজন নেই। হাবীবুল কুদ্দুস তাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেছেন। তারা গোপনে গোপনে তাকে পরীক্ষাও করে দেখেছে।
আজ রাত পুরো দলটি উৎসবে উপস্থিত। কোনো রাজপ্রাসাদে যেরূপ নিমন্ত্রণের আয়োজন করা হয়, আজ এখানেও অনুরূপ আয়োজন করা হয়েছে। একের পর এক মদের সোরাহি শূন্য হচ্ছে। মেয়ে দুটো নাচ দেখিয়েছে। হাবীবুল কুদ্দুস অনুষ্ঠানে শরীক ছিলেন। কিন্তু তিনি মদপান করতে অস্বীকার করেন। তাকে বাধ্য করা হলো না। যোহরা অন্য মেয়েদের ন্যায় মদ পরিবেশন করে। কিন্তু নিজে পান করেনি। খৃস্টান লোকটি সুদানী ও মিসরীয়কে যোহরা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলে দিয়েছে। অন্যথায় হাবীবুল কুদ্দুস বিগড়ে যেতে পারে। যোহরা অনুষ্ঠানের আনন্দ-উল্লাসে অংশগ্রহণ করলেও অন্য মেয়েদের ন্যায় অশ্লীলতা প্রদর্শন করেনি।
মধ্যরাত নাগাদ সকলে মদে মাতাল হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। মিসরী ও সুদানী লোকটি মেয়ে দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসকে চোখে ইশারা করে। হাবীবুল কুদ্দুস উঠে যান। মিসরী ও সুদানী মেয়ে দুটোকে নিয়ে যে কক্ষে গিয়েছিলো, যোহরা সেই কক্ষে উঁকি দিয়ে তাকায়। চারজনই বিবস্ত্র পড়ে আছে। একজনেরও সংজ্ঞা নেই। ওদের অস্ত্র কোথায় থাকে, যোহরার জানা আছে। সে একটা বর্শা, একটা তরবারী, দুটো ধনুক ও তীর ভর্তি দুটিকে তৃনীর তুলে নেয়। হাবীবুল কুদ্দুস তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। যোহরা এলে তিনি তার হাত থেকে তরবারীটা নিয়ে নেন। একটা ধনুক ও একটা নীর কাঁধে ঝুলিয়ে নেন। আরেকটা তৃনীর ও বর্শা যোহরার কাছেই থেকে যায়।
এদের সব কজনকেই হত্যা, করবো? যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসকে জিজ্ঞেস করে।
আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়া আবশ্যক- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আমাকে নদী পর্যন্ত নিয়ে চলো।
যোহরা পথটা দেখে রেখেছে। আগে না দেখলে এ পথে বের হওয়ার সাধ্য তাদের ছিলো না। যোহরা আগে আগে হাঁটতে শুরু করে। তারা পা টিপে টিপে হাঁটছে। কান চারটা একদম খাড়া। যোহরা বর্শা আর হাবীবুল কুদ্দুস তরবারী তাক করে রেখেছে।
যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসকে নৌকার কাছে নিয়ে যায়। এটি খৃস্টানদের লুকিয়ে রাখা নৌকা। দুজনে বাঁধন খুলে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসে। হাবীবুল কুদ্দুস আস্তে আস্তে দাঁড় বাইতে শুরু করে, যাতে শব্দ না হয়। প্রতি মুহূর্তে এবং প্রতি পদে ভয়, কোনো না কোনো দিক থেকে কেউ বেরিয়ে আসে কিনা কিংবা কোনো দিক থেকে তীর ছুটে আসে কিনা। কিন্তু কিছুই হলো না। নৌকা পর্বতমালার সরু পথে বেরিয়ে যায়। নদীর শোর কানে আসতে শুরু করে।
আল্লাহর নাম নাও যোহরা?- হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আর একটা দাঁড় তুমিও হাতে নাও। তুমি জিহাদে অংশ নেয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছিলে। আল্লাহ তোমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। আমরা এখনো বিপদ থেকে বের হইনি। নৌকাটা নদীর মাঝে নিয়ে চলল।
দুজনে দাঁড় বাইতে শুরু করে। নৌকা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। পর্বতমালার কালো দৈত্যগুলো পেছনে সরে যেতে এবং ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করেছে।
***
পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ নীলনদ। সময়টা নদ-নদীর ভর যৌবনের। কূল ঘেঁষে ঘেঁষে স্রোতের গতিতে চলা নিরাপদ। মাঝে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা একটির উপর একটি আছড়ে পড়ছে। কাজেই, মাঝ নদী অনিরাপদ। কিন্তু কূল ঘেঁষে চলায় অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ। শত্রুর তীর এসে ইহলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে দুজনের। অগত্যা কূল ত্যাগ করে মাঝ পথেই যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন হাবীবুল কুদ্দুস।
নৌকার গতি ঘুরিয়ে দিলেন মাঝের দিকে। শত্রুর কবল থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে হঠাৎ অনুভব করলেন, কোনো একটা শক্তি তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। শক্তিমান ঢেউ মাথায় করে নৌকাটা উপরে তুলছে, আবার আছড়ে ফেলে দিচ্ছে। স্রোতের গতিতে নৌকা এগিয়ে চলছে তর তর করে। হাবীবুল কুদ্দুস যোহরাকে বললেন ভয় পেও না। আমরা ডুববো না। আমি দিকটা একটু নির্ণয় করে নিই।
আপনি আমার চিন্তা করবেন না- যোহরা বললো- ডুবে যদি যাই তো কী হবে? কাফেরদের কবল থেকে তো বেরিয়ে এসেছি।
হাবীবুল কুদ্দুস চোখ তুলে পর্বতমালার দিকে তাকান। উঁচু উঁচু পর্বতগুলো এখন মাটির টিপির ন্যায় মনে হচ্ছে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন- আমি এ জায়গাটা চিনি। এই অঞ্চলেরই এক স্থানে আমি আমার বাহিনীকে পাহাড়ি যুদ্ধের মহড়া করিয়েছিলাম। এদিকে নদীর দিকটা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। আমরা সোজা কায়রোই যাচ্ছি। নীলনদ আমাদেরকে অতি দ্রুততার সাথে কায়রো নিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর শোকর আদায় করো যোহরা। এটা আল্লাহর সাহায্য। আল্লাহ মানুষের নিয়ত বোঝেন। তবে আমাদেরকে কায়রোর আগে অন্য এক স্থানে থামতে হবে। কিছুদূর আগে নদীর বাঁক আছে। তারই সন্নিকটে আমাদের ফৌজের চৌকি। সামুদ্রিক টহলের জন্য তাদের কাছে অনেক নৌকা আছে। এ চৌকির সৈন্যদের দ্বারাই আমরা ওদের সকলকে পাকড়াও করাতে পারবো। কিন্তু তারা সজাগ হয়ে যাবে।
আমি আশা করি, কাল দুপুর পর্যন্ত তাদের একজনেরও ঘুম ভাঙবে না- যোহরা বললো- তারা আমার হাতে মদ খানিকটা বেশিই পান করেছে। আমি ভরা সোরাহী থেকে তাদেরকে যে এক এক পেয়ালা করে পান করিয়েছিলাম, তাতে খাকি বর্ণের সামান্য পাউডার মিশিয়ে দিয়েছি।
ওটা কী জিনিস?
মেয়ে দুটোর হৃদয়ে আমি কী পরিমাণ আস্থা অর্জন করে নিয়েছিলাম, তাতে আমি প্রতি রাতে আপনাকে অবহিত করেছি যোহরা বললো- গতকালের ঘটনা। তারা আমাকে হাশিশ দেখিয়ে তার ব্যবহার প্রণালী বুঝিয়ে দিয়েছে। পড়ে একটি ডিবা খুলে আমাকে এই পাউডারগুলো দেখিয়ে বললো, কোনো কোনো লোককে অনেক সময় অজ্ঞান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এখান থেকে সামান্য পাউডার শরবত পানি কিংবা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দিলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর তাকে যেখানে খুশি তুলে নিয়ে যাও। আজ রাত যখন আমি মটকা থেকে সোরাহী ভরতে গেলাম, তখন ওখান থেকে অর্ধেক পাউডার তাতে মিশিয়ে নিয়েছিলাম। বস্তুটার ক্রিয়া যদি সেরূপই হয়, যেরূপ মেয়েরা বলেছে, তাহলে কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সংজ্ঞা ফিরে আসবার কথা নয়।
হাবীবুল কুদ্দুসের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করে। এ অশ্রু আনন্দের। এ অশ্রু আবেগের। এ অশ্রু যোহরার কৃতিত্ব ও সাহসিকতার প্রশংসার। তিনি রুদ্ধকণ্ঠে বললেন- আমি তোমাকে অনেক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছিলাম যোহরা। তোমাকে আমি যে জগতের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলাম, সে হচ্ছে পাপের, নোংরা অথচ অত্যন্ত সুদৃশ্য জগত। আমার জন্য তুমি অনেক কুরবানী দিয়েছে।
আপনার জন্য নয়। ইসলামের জন্য যোহরা বললো- আমি আপনার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যে, আপনি আমাকে এই পবিত্র কর্তব্য পালনের সুযোগ দিয়েছেন। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি পাপের সেই চিত্তাকর্ষক জগতে গিয়েও নিজের আঁচলকে পাপ থেকে পবিত্র রেখেছি। ভালোই হলো যে, এখানে নিয়ে আসার পর তারা আমাকে আপনার সঙ্গে নির্জনে থাকতে দিয়েছে। অন্যথায় আপনি আমাকে জানাতে পারতেন না, তারা আপনাকে বিদ্রোহ করার জন্য অপহরণ করেছে। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে এ কাজের জন্যই ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
না- হাবীবুল কুদ্দুস উত্তর দেন- এ পন্থাটা তোমার আসার পরে আপনা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমি অন্য কিছু চিন্তা করেছিলাম। তোমাকে আমার মুক্তির জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিলো। ইচ্ছা ছিলো, তোমাকে বার্তাবাহক বানাবো। কিন্তু এখানে এসে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার পর আমার মাথায় এ বুদ্ধিটা আসে। তোমার বুদ্ধিমত্তা ও সাফল্যে এখন আমরা মুক্ত। আমরা বাড়াবাড়ি না করে লোকগুলোর প্রতি আস্থা ও সমর্থন জ্ঞাপন করি। আমি জানতাম, ওরা অস্বাভাবিক চালাক হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা যদি ঈমান ও হুশ-জ্ঞান অটুট রাখি, তাহলে ওরা নির্বোধ। আমার সঙ্গে তুমি যে লোকটাকে দেখেছিলে, সে নিজেকে মিসরী মুসলমান দাবি করতো। আমি প্রথম দিনই বুঝে ফেলেছি, লোকটা খৃস্টান এবং আমি খৃস্টানদের জালে এসে পড়েছি।
***
পাহাড়ি অঞ্চল থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছেন হাবীবুল কুদ্দুস ও যোহরা। মাঝ নদীটা এখন পূর্বের চেয়ে বেশি উত্তাল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নৌকাটা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নীলের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে। দাঁড় বৈঠা কোনো কাজ করছে না। নদীর উতলার তীব্রতায় বোঝা যাচ্ছে, এ স্থানটায় এসে নদী সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এই সেই বাঁক, যার সম্মুখে মিসরের সামরিক চৌকির অবস্থান। হঠাৎ নৌকা দাঁড়িয়ে গিয়ে চক্কর কেটে ঘুরে যায়। হাবীবুল কুদ্দুস বৈঠাটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন। নদীর শোর আরো বেড়ে গেছে। নৌকা ঘূর্ণিপাকে পড়ে গেছে। হাবীবুল কুদ্দুস নৌকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হলেন না। দুই আরোহীসহ নৌকা নীলের অতলে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
যোহরা- হাবীবুল কুদ্দুস চীৎকার করে বললেন- আমার পিঠে চড়ে বস।
যোহরা হাবীবুল কুদ্দুসের পিঠে সওয়ার হয়ে উভয় বাহু দ্বারা শক্তভাবে গলায় জড়িয়ে ধরে রাখে। হাবীবুল কুদ্দুস বললেন- আরো শক্ত করে ধরো। আমার থেকে আলাদা হয়ো না। বলেই পাকের উপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে নৌকা থেকে এমনভাবে লাফিয়ে পড়েন, যেনো ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।
হাবীবুল কুদ্দুস যোহরাকে নিয়ে পানির ভেতর চলে যান এবং দেহের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করে আবার ভেসে ওঠেন। তিনি ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু জায়গাটা বাঁক। উভয় দিকে চড়া। ফলে তরঙ্গ অত্যন্ত উঁচু এবং বিক্ষুব্ধ। যোহরা সাঁতার জানে না। সে আল্লাহর নিকট দুআ করতে শুরু করে। হাবীবুল কুদ্দুস তাকে পিঠে বহন করে তরঙ্গমালার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তার ও যোহরার মুখ যাতে পানির বাইরে থাকে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ঢেউ বারংবার তাকে ডুবিয়ে উপর দিয়ে অতিক্রম করছে।
ঊর্মিমালা হাবীবুল কুদ্দুসকে নদীর বাঁক থেকে বের করে নিয়ে যায়। এবার নদীটা চওড়া হয়ে গেছে। হাবীবুল কুন্দুসের বাহু ও পা অবশ হয়ে গেছে। তিনি শক্তির শেষ বিন্দুটুকু একত্রিত করে এই স্রোত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জোর চেষ্টা চালাতে শুরু করেন। তিনি অনুভব করেন, সোহরাব বন্ধন ঢিলা হয়ে গেছে। হাবীবুল কুদ্দুস বুঝে ফেলেন, যোহরার সুখ ও নাকের পথে পানি ঢুকে গেছে। তাকে রক্ষা করা ও নিজে সাঁতার কাটা দু হয়ে পড়েছে। তিনি এক হাতে যোহরাকে ধরে সর্বশক্তি ব্যয় করে সাঁতার কেটে খরস্রোত থেকে বেরিয়ে যান। কূল এখনো অনেক দূরে। এখন সাঁতার কাটা সহজ হয়ে গেছে। হাবীবুল কুদ্দুস সাহায্যের জন্য চীৎকার করতে শুরু করেন। হাবীবুল কুদ্দুসের দেহটা নিস্তেজ হয়ে আসে। যোহরাও তার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময় একটা নৌকা তার নিকটে এসে যায়। কানে শব্দ ভেসে আসে- কে? হাবীবুল কুদ্দুস শেষবারের মতো অবশ হাতটা উপরে তোলে খপ করে নৌকার কিনারা ধরে ফেলে বলে ওঠেন- ওকে আমার পিঠ থেকে তুলে নাও। নৌকার লোকেরা যোহরাকে টেনে উপড়ে তুলে নেয়। মেয়েটা চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছে। নৌকাটা তারই বাহিনীর। এখানেই তাদের চৌকি। তারা হাবীবুল কুদ্দুসের ডাকে এদিকে এসেছে।
চৌকিতে পৌঁছে হাবীবুল কুদ্দুস জানান, আমি নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুস। চৌকির কমান্ডার তাকে চিনে ফেলেন এবং অত্যন্ত বিস্মিত হন। যোহরা অচেতন পড়ে আছে। হাবীবুল কুদ্দুস তাকে উপুড় করে শুইয়ে পিঠ ও পাজরে সজোরে চাপ দেন। তাতে মুখ ও নাকের পথে অনেক পানি বেরিয়ে আসে। তবে এখনো তার সংজ্ঞা ফিরে আসেনি। হাবীবুল কুদ্দুস কমান্ডারকে বললেন, দুটি বড় নৌকায় দশ দশজন করে সৈনিক আরোহণ করাও এবং পার্বত্য অঞ্চলের দিকে রওনা হও। তিনি জানান, পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে যে পুরাতন জীর্ণ প্রাসাদ আছে, তাতে দশ বারোজন খৃস্টান সন্ত্রাসী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। তাদেরকে তুলে আনতে হবে। আমার স্থল পথের রাস্তাটা জানা নেই।
আমি চিনি- কমান্ডার বললো- স্থল পথেই যাওয়া সহজ হবে।
বিশজন অশ্বারোহীর সম্মুখে হাবীবুল কুদ্দুস ও চৌকির কমান্ডার। ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। আবছা অন্ধকার। তারা পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়েছে। নীরবতার খাতিরে ঘোড়াগুলো বাইরেই রেখে তারা পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। নদী হাবীবুল কুদ্দুসের দৈহিক শক্তি চুষে নিয়েছিলো। তারপরও হাঁটছেন তিনি। স্ত্রীকে অচেতন অবস্থায় চৌকিতে রেখে এসেছেন। স্ত্রীকে সারিয়ে তোলার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার। পাহাড়-টিলার সরু অলি-গলি অতিক্রম করে এগিয়ে যায় তারা। কিছুক্ষণ পর প্রাসাদ চোখে পড়তে শুরু করে।
সবার আগে হাবীবুল কুদ্দুস খৃস্টানকে দেখতে পায়। তার পা দুটো টলমল করছে। মাথাটা এদিক-ওদিক দুলছে। তাকে পাকড়াও করা হলো। সে বিড় বিড় করে ওঠে। সাত-আটজন লোক রাতে যেখানে শুয়েছিলো, সেখানেই অচেতন পড়ে আছে। এক কক্ষে সুদানী, মিসরী এবং মেয়ে দুটো বস্ত্র ও বেহুশ পড়ে আছে। সৈনিকরা তাদের প্রত্যেককে তুলে নেয়। তাদের মালামাল তুলে নেয়া হলো। সব কজনকে ঘোড়ার পিঠে তুলে চৌকিতে নিয়ে আসা হলো। অততক্ষণে যোহরার চৈতন্যও ফিরে এসেছে।
দুপুরের পর থেকে বন্দিদের হুঁশ ফিরে আসতে শুরু করেছে। এখন তারা কায়রোর পথে। লোকগুলো ঘোড়ার সঙ্গে বাধা। বিশজন সৈনিক তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাবীবুল কুদ্দুস তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। কাফেলা চলতে থাকে।
মধ্যরাতের পর আলী বিন সুফিয়ানের চাকর তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে বললো, গবর্নর আপনাকে ডেকেছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গবর্নরের কক্ষে চলে যান। গিয়াস বিলবীসও সেখানে উপস্থিত। হাবীবুল কুদ্দুসকে উপবিষ্ট দেখে আলী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। হাবীবুল কুদ্দুস সেই সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নাম বললেন, যাদের ব্যাপারে খৃস্টান সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে জেনে এসেছেন। এরা বিশ্বাসঘাতক। এদের বিদ্রোহ সফল করে ভোলার কাজে অংশগ্রহণের কথা ছিলো। ভারপ্রাপ্ত গবর্নর তকিউদ্দীনের নির্দেশে লোকগুলো ঘরে ঘরে তৎক্ষণাৎ হানা দেয়া হলো এবং সব কজনকে গ্রেফতার করা হলো। তাদের ঘর থেকে যেসব হীরা-জহরত, সোনা মাণিক্য উদ্ধার হয়েছে, তা-ই তাদের অপরাধ প্রমাণ করছিলো।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী হাল অবরোধের লক্ষ্যে নগরীর সন্নিকটে আল-আখদার নামক স্থানে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছেন। তিনি সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিজ বাহিনীর কিছু কিছু সৈন্য তলব করে এনেছেন। হাল্ব সম্পর্কে সালারদের বলে রেখেছেন, এই নগরীর সাধারণ মানুষ মরণপণ লড়াই করবে, যেমনটি প্রথমবারের অবরোধে করেছিলো। যদিও ভেতর থেকে তার গোয়েন্দারা রিপোর্ট করেছিলো, কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধে হাবের অধিবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেছে। সুলতান সতর্ক থাকার পক্ষপাতি। ওখানকার শাসক এখন ইমাদুদ্দীন, যিনি শাসক হিসেবে জনগণের প্রিয় নন। তারপরও সুলতান আইউবী আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হতে চাচ্ছেন না। তিনি এদিক ওদিক থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে আল-আখদারে অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
সুলতান আইউবী তার সালারদের সর্বশেষ নির্দেশনা প্রদান করছেন। তাদের জানান কায়রো থেকে দূত এসেছে। দূতের নিয়ে আসা পত্রখানা পাঠ করার পর সুলতানের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি উচ্চস্বরে বলে ওঠেন- আমার মন বলছিলো হাবীবুল কুদ্দুস আমাকে ধোকা দেবে না। আল্লাহ ইসলামের প্রতিজন কন্যাকে যোহরার জযবা ও ঈমান দান করুন।
আলী বিন সুফিয়ান নায়েব সালার হাবীবুল কুদ্দুসের ফিরে আসার সমস্ত কাহিনী লিখে পাঠিয়েছেন। পত্রে তার স্ত্রী যোহরার কথাও উল্লেখ করেছেন। সুলতান তৎক্ষণাৎ পত্রের উত্তর লেখান। তাতে গ্রেফতারকৃত গাদ্দারদের শাস্তির কথাও উল্লেখ করেন। তাদেরকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ঘোড়া শহরে শহরে হাঁকাও। গাদ্দারদের গায়ের গোশত হাড়ি থেকে আলাদা না হওয়া পর্যন্ত ঘোড়া যেনো না থামে।
দুদিন পর সুলতান আইউবী হাবের উপর চড়াও হন। অবরোধ নয়- আক্রমণ অভিষান। বড় মিনজানিকের সাহায্যে নগরীর ফটকের উপর পাথর ও তরল দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করা হয়। নগরীর পাঁচিলের উপর এবং ভেতরেও পাতিল নিক্ষেপ করে অগ্নিতীরের বৃষ্টিবর্ষণ করা হয়। দেয়াল ভাঙার জন্য নিয়োজিত সেনারা দেয়াল ভাঙতে শুরু করে। কিন্তু নগরবাসী ও ফৌজের পক্ষ থেকে তেমন শক্ত প্রতিরোধ এলো না। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় লিখেছেন, হাবের শাসনকর্তা ইমাদুদ্দীনের আমীর-উজীরগণ তাঁর সহযোগিদের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি খৃস্টানদের থেকে সামরিক সাহায্য ছাড়াও বহু সোনা-জহরত গ্রহণ করেছিলেন। তার আমীর-উজীরদের লোভাতুর দৃষ্টি সেই সম্পদের উপর নিবদ্ধ { ভাগ দাও তো যুদ্ধ করবো। অন্যথায় নয়। তারা এমন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে বসে যে, সুলতান আইউবীর আক্রমণের ভয়ে পূর্ব থেকেই তটস্থ ইমাদুদ্দীন আরো সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন।
ইমাদুদ্দীন হাবের দুর্গপতি হুসামুদ্দীনকে এই আবেদন নিয়ে আইউবীর নিকট প্রেরণ করেন যে, আপনি আমাকে মসুলের সামান্য একটু অঞ্চল দান করুন। সুলতান আইউবী তার আবেদন মঞ্জুর করে নেন। এ সংবাদ নগরীতে ছড়িয়ে পড়লে জনতা ইমাদুদ্দীনের বাসভবনের সম্মুখে এসে জড়ো হয়। ইমাদুদ্দীন ঘোষণা করে দেন, হ্যাঁ, আমি হাবের ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। তোমরা প্রতিনিধি প্রেরণ করে আইউবীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নাও।
নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইযযুদ্দীন জ্বরদুক এবং যাইনুদ্দীকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করে সুলতান আইউবীর নিকট প্রেরণ করেন। তারা ১১৮৩ সালের ১১ জুন মোতাবেক ৫৭৯ হিজরীর ১৭ সংকর সুলতান আইউবীর নিকট গিয়ে পৌঁছেন। তারা হাবের সকল সৈন্যকে নগরীর বাইরে ডেকে এনে সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দেন। ফৌজের সঙ্গে হাবের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং আমীর-উজীরগণও বেরিয়ে আসেন। সুলতান আইউবী তাদের প্রত্যেককে মূল্যবান পোশাক উপহার দেন।
আক্রমণের ষষ্ঠ দিন। সুলতান আইউবী জয়ের আনন্দে উফুল্ল। এমন সময় সংবাদ আসে, স্বীয় ভাই তাজুল মুলক- যিনি এই যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন- শাহাদাতবরণ করেছেন। সুলতানের আনন্দ বেদনায় পরিণত হয়ে যায়। তাজুল মুলুকের জানাযায় ইমাদুদ্দীনও অংশগ্রহণ করেন। তারপর তিনি হাব থেকে বেরিয়ে যান। সুলতান আইউবী হালবের শাসন ক্ষমতা বুঝে নেন। বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ভাষ্যমতে, যেসব সৈন্য দীর্ঘদিন যাবত লাগাতার যুদ্ধ করে আসছিলো, সুলতান তাদেরকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। নিজে হাবের প্রশাসনিক কার্যক্রম গোছানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। গন্তব্য তার বাইতুল মুকাদ্দাস।