৮. অপুর পুনর্জীবন

অপুর পুনর্জীবন

‘পরশপাথর’ ও ‘জলসাঘর’ ছবিতে যাঁদের নামিয়েছিলাম, তাঁরা সবাই পেশাদার অভিনেতা। এবারে ‘অপুর সংসার’-এর—অপুকে নিয়ে তৃতীয় ছবির ওই নামই দিয়েছিলাম—বিভিন্ন চরিত্রে প্রধানত ফের তাঁদের নামাব বলে ঠিক করি, যাঁরা পেশাদার নন। নতুন মুখ চাইছিলাম বিশেষ করে অপু, তার স্ত্রী অপর্ণা, তার ছেলে কাজল আর অপুর বন্ধু পুলুর জন্য। অন্য সব চরিত্রে পেশাদার অভিনেতা নিতে আমার আপত্তি ছিল না। ‘অপরাজিত’ ছবি তুলবার সময় কিশোর অপুর চরিত্রে নামাবার জন্য যখন ওই বয়সের ছেলের খোঁজ চলছিল, তখন প্রোডাকশনের ব্যাপারে আমার সহকারী নিতাই দত্ত এক তরুণকে আমার কাছে নিয়ে আসে। এর নাম শুনলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চেহারার দিক দিয়ে সৌমিত্র ঠিকই ছিল, কিন্তু চরিত্রটির তুলনায় বয়স একটু বেশি, কুড়ি বছর। সৌমিত্র সদ্য তখন কলেজ থেকে বেরিয়েছে। তাকে সেদিন ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। এবারে তাকে আবার ডেকে পাঠিয়ে প্রধান ভূমিকাটা দিতে চাই। তখন সে রেডিয়োতে ঘোষকের কাজ করে, তবে অভিনয়ে খুব আগ্রহ। শিশির ভাদুড়ি মশাইয়ের একটা নাটকে শুনলাম ছোটখাটো একটা ভূমিকায় ইতিমধ্যে অভিনয়ও করেছে।

অপর্ণার খোঁজ এত সহজে মেলেনি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে যাদের বয়স, অপুর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে ইচ্ছুক হলে তারা যেন তাদের ফোটোগ্রাফ পাঠায়। ফোটোসহ আবেদন এসেছিল হাজারেরও বেশি। কিন্তু একজনকেও ডেকে পাঠাবার যোগ্য বলে মনে হল না। অবস্থা দেখে আবার যখন হতাশ হবার উপক্রম, তখন খবর পাওয়া গেল যে, সি.এল.টি.’র বা চিলড্রেন’স লিট্‌ল থিয়েটারের এক অনুষ্ঠানে শর্মিলা ঠাকুর নামে একটি মেয়েকে নাচতে দেখা গেছে। এও শোনা গেল যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তা ছাড়া, অভিনয় এ-মেয়ে ভালই করবে বলে আশা করা যায়। মেয়েটির বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। জিজ্ঞেস করি, অপুকে নিয়ে আর একটি যে ছবি হচ্ছে, তার একটি প্রধান ভূমিকায় তাঁদের মেয়েটিকে আমরা হয়তো নির্বাচন করতে পারি, সুতরাং তাকে দেখার একটা ব্যবস্থা হতে পারে কি না। শর্মিলার যে একটি ছোট বোন আছে, সেই ছোট বোন যে একটা ছবিতে ইতিমধ্যে নেমেছে, আর সেই ছবির সূত্রেই যে ছবি বিশ্বাস মশাইকে বিদেশে যেতে হয়েছিল, এ-সব খবর অবশ্য আগেই শুনেছিলাম আমরা। সুতরাং, অপর্ণার ভূমিকায় শর্মিলাকে যদি আমাদের পছন্দ হয়, তবে তার বাবা-মায়ের তরফে যে কোনও আপত্তি হবে না, এমন একটা আশা আমাদের ছিলই।

ঠাকুর-দম্পতি তাঁদের মেয়েকে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন। শর্মিলার পরনে হলুদ রঙের ফ্রক, তাতে তার বয়স মনে হচ্ছিল তেরো-চোদ্দোর বেশি হবে না। মেয়েটিকে যে অপুর বউ হিসেবে কল্পনা করতে অসুবিধা হচ্ছিল, সেটা আরও ওই পোশাকের জন্য। শর্মিলার বব-ছাঁটের চুলও অপর্ণার পক্ষে ঘোর বেমানান। অথচ মেয়েটির মুখচোখ আর গড়ন একেবারে মানানসই। আমার স্ত্রী যে একে অপর্ণা হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না, সে তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আমার কিন্তু মেয়েটির চোখ দুটি দেখে মনে হচ্ছিল যে, একে নাকচ করা উচিত হবে না। স্ত্রীকে ডেকে বললাম, এক কাজ করো, গ্রামের মেয়েরা সাধারণত যেমন শাড়ি পরে, সেই রকমের একটা সাধারণ সুতির ডুরে শাড়ি একে পরিয়ে দাও, চুলটাও ঝুঁটি বেঁধে দাও, তারপর ওকে বসবার ঘরে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণ ওর বাবা-মা’র সঙ্গে ওখানে বসে কথা বলি।

পোশাক পালটাতেই যেন ম্যাজিকের মতন কাজ হল। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরবামাত্র শর্মিলা হয়ে গেল আদ্যন্ত অপর্ণা। তার চালচলনও এখন একেবারে অন্যরকম। ফ্রকে যাকে তেরো বছরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল, এখন তার বয়স বেড়ে গেছে আরও চার বছর। শর্মিলা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে অভিনয় করতে হয়, সেটা কি আমি তাকে দেখিয়ে দেব? উত্তরে আমি বললাম, ও নিয়ে তাকে একটুও ভাবতে হবে না।

সৌমিত্রর এক বন্ধুর ছেলেকে আমি অপর্ণার ছেলের ভূমিকায় নামাই। ছেলেটির বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। তার কাছে কোনও অভিনয় আশা করা চলে না, তা আমি করিওনি। তবে বয়স যতই কম হোক, কিংবা যতই অবাধ্য হোক, বাচ্চাকে ঠিকমতো কাজে লাগানোর ব্যাপারে যে ইতিমধ্যে আমি বেশ-কিছুটা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম, সেটা বলব।

অপুর বন্ধু পুলুর ভূমিকায় যাকে নির্বাচন করি, অভিনয়ের ব্যাপারে তারও কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না। মধুর স্বভাবের তরুণ। চেহারার দিক থেকে অপুর সঙ্গে তার একেবারেই কোনও মিল নেই।

চিত্রনাট্য লিখবার সময়ই ভেবে রেখেছিলাম যে, কলকাতায় অপুর এক-ঘরের ফ্ল্যাটটা হবে একেবারে রেল-লাইনের ধারে। ‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’, দুটি ছবিতেই রেলগাড়ির একটা কাব্যময় ভূমিকা রয়েছে। তবে একইসঙ্গে একটা পার্থক্যও তো আমি দেখাতে চাইছিলাম। সেটা এই যে, এখানে আমি নাগরিক জীবনযাত্রা দেখাব। তা হোক, রেলগাড়িই যে এই তিনটে ছবিকে একটা যোগ-সূত্রে বেঁধে রাখবে, তা জানতাম।

টালা জায়গাটা হচ্ছে কলকাতার একেবারে উত্তর প্রান্তে। সেখানে ওই রকমের একটা বাড়ি আমরা পেয়েও যাই। ছাতের উপরে ছোট্ট ঘর। পাশেই রেল-লাইন। সেখানে রেলগাড়ির শান্টিং চলছে। সোজা কথায় বলি, রেলগাড়ির স্বাভাবিক বর্ণময় অস্তিত্ব এ-ছবিতে সারাক্ষণ টের পাওয়া যাবে। ছবিতে এ-ঘরের বেশ-কিছু দৃশ্য দেখা যাবে। যেমন দিনের বেলার, তেমন রাতের দৃশ্য। আমার আর্ট ডিরেক্টর বংশীকে তাই স্টুডিয়োর মধ্যেই ঠিক ওই রকম একটি ঘর বানিয়ে ফেলতে বলি।

টালার ওই লোকেশনে অপুকে নিয়ে আমরা তখন সবেমাত্র একটা দিনের কাজ করেছি, এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটা আমন্ত্রণ-লিপি পাই। চিঠিটা এসেছে ভার্মন্টের রবার্ট ফ্লহার্টি ফাউন্ডেশন থেকে। তাতে আমাকে ফ্লহার্টি সেমিনারে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি লিখেছেন স্বয়ং মিসেস ফ্লহার্টি। তিনি জানাচ্ছেন যে, ‘পথের পাঁচালি’ দেখে তাঁর দারুণ ভাল লেগেছিল, এখন আমি যদি এই সেমিনারে যোগ দিই তো তিনি খুব খুশি হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। ‘পথের পাঁচালি’র একজন পরিবেশক পাওয়া গিয়েছিল ও-দেশে। ভদ্রলোকের নাম এডওয়ার্ড হ্যারিসন। তাঁর ইচ্ছা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার অবস্থানকালেই ছবিটি ও-দেশে মুক্তিলাভ করবে। আমি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম দুই উপকূলেই মাস খানেক থাকতে পারি, কলকাতার ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস তার জন্য একটা গ্র্যান্টের ব্যবস্থা করে দেয়। এর অর্থ আমি হলিউডে থাকতে ও সেখানে আমার ছবি দেখাতে পারব। সুযোগটা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ‘অপুর সংসার’-এর কাজ নাহয় মাসখানেক বন্ধ থাকবে। ফিরে এসে আবার শুরু করলেই হল।

সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে পৌঁছই। সেদিন সেখানে বেশ গরম পড়েছিল। এড হ্যারিসন অর্থাৎ সেই পরিবেশক ভদ্রলোক এয়ারপোর্টে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। খাঁটি নিউইয়র্কার বলতে যা বোঝায়, এড সেই ধরনের মানুষ। যে ছবি তাঁর ভাল লেগেছে, একমাত্র সেই ছবিই তিনি পরিবেশন করেন। এর আগে যে-সব ছবি তিনি পরিবেশন করেছেন, তার মধ্যে আছে ‘রশোমন’, ‘উগাত্‌সু মনোগাতারি’ আর ‘উম্বার্টো ডি’। এবারে তাঁর তালিকায় আমার ছবিটিও যুক্ত হল। খুব শিগগিরই এটি নিউ ইয়র্কে মুক্তিলাভ করবে।

আমার এক বন্ধু—বিদ্যুৎ সরকার—নিউ ইয়র্কে থাকেন। পেশায় ইনি সাংবাদিক। তাঁর ফ্ল্যাটে থাকবার জন্য আগেই তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। এয়ারপোর্টেও এসেছিলেন তিনি। এড হ্যারিসনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বিদ্যুতের সঙ্গে তাঁর ফ্ল্যাটে চলে যাই। ফ্ল্যাটবাড়িটি সেন্ট্রাল পার্কের সামনে। বিদ্যুৎ থাকেন পাঁচতলায়। লিফ্‌ট না থাকায় ভারী সুটকেস বয়ে পাঁচতলায় উঠতে ঘাম ছুটে যায়।

এডের ভাই জ্যাক শিল্পরসিক মানুষ। খুব শিগগিরই আমি বুঝে গেলাম যে, পরিবেশনার জন্য কোন্ কোন্ ফিল্ম নেওয়া যেতে পারে, সেটা ঠিক করবার ব্যাপারে এড অনেকটাই তাঁর ভাইয়ের পরামর্শের উপরে নির্ভরশীল। এড ও জ্যাকের মাধ্যমে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা জনাকয় সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্যাডি চাইয়েফ্‌স্কি, সিডনি লুমেট আর ইলিয়া কাজান। কাজান আমাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। সেখানে আলাপ হয় লি স্ট্রাসবার্গ ও তাঁর কন্যা সুসানের সঙ্গে। স্ট্রাসবার্গ হচ্ছেন ‘মেথড’ স্কুল অফ অ্যাক্টিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা। ক্রমে এসে পড়ে ‘পথের পাঁচালি’র মুক্তিলাভের দিন। যে ছবিঘরে এটি দেখানো হয়, তার নাম ‘ফিফ্‌থ অ্যাভিনিউ প্লেহাউস’। এডকে নিয়ে সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত হই। তার ঠিক আগেই শেষ হয়েছে একটা শো, হলের ভিতর থেকে দর্শকরা সার বেঁধে বেরিয়ে আসছেন। দেখলাম, তাঁদের অনেকের চোখেই জল। আগের শোয়ে এসে এক কৃষ্ণাঙ্গ দম্পতি শুনেছিলেন যে, সন্ধ্যার দিকের শোয়ে আমি হাজির থাকব। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসেন তাঁরা। আমার হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে বলেন, শুধু এই কথাটা আমাকে বলবার জন্য তাঁরা বসে আছেন যে, এত ভাল ছবি তাঁরা এর আগে আর দেখেননি। শুনে আমি অভিভূত হই।

এ যখনকার কথা বলছি, নিই ইয়র্ক টাইমস-এর বসলি ক্রোথারকে তখন সবচেয়ে প্রভাবশালী সমালোচক বলে গণ্য করা হত। লোকে বলত, ক্রোথার যা লেখেন, তারই উপরে ঠিক হয়ে যায় যে, কোন্‌ ছবিটা চলবে আর কোন্‌টা চলবে না।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ তাঁর সমালোচনা বার হল। এরই জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন এড। কিন্তু কাগজ আসতে ক্রোথারের সমালোচনা পড়ে আমাদের তো চক্ষুঃস্থির। যাচ্ছেতাই নিন্দে করে তিনি বলেছেন যে, এ এতই ‘অ্যামেচারিশ’ ছবি যে, রাফ কাট্‌ হিসেবেও হলিউডে এটা চলবে না। এই সমালোচনা বেরোবার পরে-পরেই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ দর্শকদের প্রতিবাদপত্র বার হতে থাকে। তাতে বলা হয়, ক্রোথার মারাত্মক ভুল করেছেন। একটা ‘মাস্টারপিস’কে হত্যা করেছেন তিনি। একই ছবির সমালোচক দু’দুবার সমালোচনা করলেন, এমন নজির নেই। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সেই নজিরই স্থাপিত হল। ক্রোথার লিখলেন তাঁর দ্বিতীয় সমালোচনা। তাতে বললেন, ছবিটা যখন প্রথমবার দেখেন, তখন তাঁর মন-মেজাজ ভাল ছিল না। এবারে দ্বিতীয়বার দেখে তিনি নিঃসংশয় হয়েছেন যে, সত্যিই এ একটা উঁচু দরের কাজ।

ফিফ্‌থ অ্যাভিনিউ প্লেহাউস-এ কোনও ছবি দীর্ঘদিন ধরে চলবার যে রেকর্ড, এর আগে সেটা ছিল ‘দ্য ক্যাবিনেট অভ্‌ ডক্টর ক্যালিগরি’র। ‘পথের পাঁচালি’ সেটা ভেঙে দেয়। ছবিটা সেখানে টানা ৩৬ সপ্তাহ চলেছিল।

নিউ ইয়র্ক থেকে ভার্মন্টে যাই। সেখানে রবার্ট ফ্লহার্টির বিধবা পত্নী ফ্রাঁসেজ ও তাঁর দেবর ডেভিডের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। সময়টা খুবই সুন্দরভাবে কাটতে থাকে। ফ্রাঁসেজ ও তাঁর দেবর ডেভিড ইতিমধ্যে ‘পথের পাঁচালি’ দেখেছেন। ওঁদের ধারণা, ফ্লহার্টি যেমন গ্রামে গিয়ে সত্যিকারের গ্রামবাসীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিতেন, এ-ছবিতে আমিও সেই একই পদ্ধতিতে কাজ করেছি। এটা যে ভুল ধারণা, সেটা ওঁদের বোঝাবার কাজটা খুব সহজ হয়নি।

সেমিনারে বক্তৃতা ছিল মাত্র একটাই। আমন্ত্রণে যাঁরা সাড়া দেন, তাঁরা এসেছিলেন। ফ্লহার্টির তোলা ছবিগুলিও সেখানে দেখানো হয়। তার মধ্যে আমার খুব ভাল লেগেছিল ‘দ্য ম্যান অভ্‌ আরান’ ছবিটি। এ-ছবি আমি আগে দেখিনি। ভার্মন্ট থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসি। তারপর সেখান থেকে যাই হলিউডে। হলিউডে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার গ্র্যান্টের মধ্যেই ছিল। সেখানে স্ক্রিনরাইটার্স গিল্ডের প্রেক্ষাগারে ‘পথের পাঁচালি’ দেখানো হয়। ছবি দেখে জর্জ স্টিভন্‌স ও আরও অনেকে আমাকে হার্দ্য অভিনন্দন জানান। সেখানে যে হাসিখুশি মানুষটি আমাকে সকলের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন, তিনি একজন আইরিশ শিল্পী। হলিউডের পরিবেশে তাঁকে যেন ঠিক মানাচ্ছিল না। জর্জের সঙ্গে পরে আমার বেশ ভাব হয়ে যায়। পরে জর্জই আমাকে বিলি ওয়াইল্ডারের ছবি ‘সাম লাইক ইট হট’-এর শুটিং দেখতে নিয়ে যান। বিলি ওয়াইল্ডার আমার সর্বকালের প্রিয় পরিচালক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঠিক এক মাস বাদে ফিরে আসি। এসেই শুরু করি ‘অপুর সংসার’-এর কাজ।

‘পথের পাঁচালি’ অথবা ‘অপরাজিত’র তুলনায় অনেক বেশিসংখ্যক লোকেশনের দরকার হয়েছিল ‘অপুর সংসার’-এর বেলায়। অপু কলকাতায় থাকে, গোড়ার দিকে সেখানে তাকে চাকরির জন্য হাঁটাহাঁটিও করতে দেখা যায়। সুতরাং লোকেশন হিসেবে কলকাতার কয়েকটা জায়গা বাছতে হয়। রেল-লাইনের কথা আগেই বলেছি। লাইনের উপরে ওভারব্রিজ। ওভারব্রিজে উঠে খানিকটা এগিয়ে সে নীচে নেমে রেল-লাইনের ধার দিয়ে কয়েক শো গজ হেঁটে ডাইনে ঘুরে তার বাড়িতে পৌঁছয়। বাড়িটা নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায়। ওদিকে আবার অপুর বিয়েটা যে-গ্রামে হয়, সেখানে নদী থাকবে। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে নদী রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাখা হয়নি। অথচ বাংলার গ্রামে নদী থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পাশ দিয়ে নদী চলে গেছে, এবারে তাই এমন একটা গ্রাম চাইছিলাম। অপর্ণার মৃত্যুর পর নানান জায়গায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় অপু। লোকেশনের তালিকায় সে-সবও এসে যাচ্ছে। সমুদ্রতীর, গহন অরণ্য, পাহাড়চূড়া—সবই চাই। তারপর চাই সেই জায়গাটাও, যেখানে একটা কয়লাখনিতে অপু চাকরি নেবে। তা ছাড়া বন্ধু পুলুর সঙ্গে যেখানে তার দেখা হবে আর পুলু তাকে দেশে ফিরে গিয়ে তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে বলবে, সেই জায়গাটাও চাই।

কলকাতার লোকেশন-বাছাই শেষ হতে আমরা নদীর খোঁজে লেগে যাই। বিস্তর নদী দেখার পর শেষপর্যন্ত মহেশগঞ্জ গ্রামে জলঙ্গী নদী আমাদের ভাল লেগে যায়। (এখানেই বিয়ে হবে অপুর।) জায়গাটার খোঁজ পেয়েছিলাম আমাদের এক বন্ধুর কাছে। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওখানকার জমিদার। এও শুনলাম যে, জমিদারবাড়ির একটা অংশ এখনও নাকি ভেঙে পড়েনি। তারই মধ্যে আমাদের ইউনিটের লোকজন আর অভিনেতাদের জায়গা হয়ে যাবে। লোকেশনটা একেবারে নিখুঁত। নদীও ঠিক এইরকমই চাইছিলাম। সরু নদী, দু’ ধারে হলুদ সর্ষেখেত, তারই মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। নদীর মধ্যে নৌকোও চোখে পড়ল। তাতে মনে হল, অপু তার বন্ধুর সঙ্গে যদি খানিকটা পথ নৌকো করে আসে তো বেশ হয়। কলকাতা থেকে দুই বন্ধু যে গ্রাম পর্যন্ত আসবে, এই যাত্রাপথটায় তা হলে একটা বৈচিত্র্য আসে।

জমিদারবাড়িটা দেখলাম। বেশ প্রশস্ত দোতলা বাড়ি। ধারেকাছে ভাঙাচোরা আর মাত্র একটিই পাকা বাড়ি চোখে পড়ল। সেটি নদীর ধারে এক নীলকুঠি। আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলা ও বিহারে ব্যাপকভাবে নীলের চাষ চলত। নীলকর সাহেবদের কথা সবাই জানেন, তারা ছিল একেবারে আলাদা ধাতের লোক। আমরা ঠিক করি যে, এই পুরনো বাড়িতেই বসানো হবে অপুর বিয়ের আসর। তার জন্য বাড়িটার যা অদল-বদল করা দরকার, সেটা আমরা করে নেব। মেরামতের দরকার হবে শুধু সামনের বারান্দা আর কম্পাউন্ডের। আর আসল বাড়ি তো স্টুডিয়োর মধ্যেই তৈরি হবে।

কয়লাখনির লোকেশনের জন্য আমরা মধ্যপ্রদেশের যে জায়গাটায় যাই, তার নাম চিরিমিরি। ‘পরশপাথর’-এর প্রযোজক লাহিড়িরা সেখানে মস্ত একটা কয়লাখনির মালিক। চিরিমিরি শহরের গোড়াপত্তনও হয়েছিল তাঁদেরই হাতে। তবে এ-সব লোকেশনে যাওয়ার আগে আমরা কলকাতার দৃশ্যগুলির শুটিংয়ের কাজে ফের লেগে যাই। প্রথমাংশেই রয়েছে অপুর ঘরের দৃশ্য। ছাতের ঘর। বাড়িটা উত্তর কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায়, রেললাইনের ধারে।

বধূবেশে বাপের বাড়ি থেকে অপুর সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর সেই বাড়িতে এসে ঢুকছে, প্রথম দিনের শুটিংয়েই এটা থাকবে। অপুর পক্ষে অবস্থাটা বেশ অস্বস্তিকর, কেননা সে বিয়েবাড়িতে অতিথি হিসেবে গিয়েছিল মাত্র, বিয়ে করতে যায়নি। বউকে নিয়ে সে যখন এসে পৌঁছয়, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, পুরুষরা যে-যার কর্মস্থলে, বাড়িটা মোটামুটি শান্ত। শুধু একটা সেলাইকলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ির ধাপে সাবধানে পা ফেলে সে উপরে উঠতে থাকে। তার পিছনে-পিছনে উঠতে থাকে অপর্ণা। সে নববধূর বেশে সজ্জিত, মাথায় একটা টোপরও রয়েছে। তাকে ঘরের মধ্যে রেখে, ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া মেটাবার জন্য, অপুকে ফের নীচে নেমে আসতে হয়। অচেনা পরিবেশে মিনিট কয়েক একেবারে একা দাঁড়িয়ে থাকে অপর্ণা। তার চোখ দুটি ধীরে-ধীরে জলে ভরে যায়। আস্তে-আস্তে সে একটা জানলার তেলাঞ্চির উপরে বসে। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে।

শর্মিলা স্টুডিয়োতে এসে পৌঁছবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে বলে দিয়েছিলাম যে, তার এই প্রথম দিনের দৃশ্যটাই হবে সবচেয়ে কঠিন দৃশ্য। এর পরে যে-সব দৃশ্য আসবে, এর তুলনায় সেগুলো মনে হবে অনেক সহজ। কথাটা শর্মিলা শুনল, কিন্তু কিছু বলল না। শটটা নেবার আগে আমার সহকারীদের আমি জানিয়ে দিই যে, এটা নেবার সময় সারাক্ষণই আমি চেঁচিয়ে তাদের নির্দেশ দিতে থাকব, শর্মিলার কান্নার শব্দটা তাই এখন ধরা হবে না, ওটা পরে ডাব করে নেওয়া হবে।

দৃশ্যটার জন্য কোনও রিহার্সল দেওয়া হয়নি। চেঁচিয়ে শর্মিলাকে বলি যে, নিজেকে আর সামলাতে পারছে না, এইভাবে সে যেন কেঁদেই যেতে থাকে। কান্নাটা প্রায় মিনিট দুয়েক চলেছিল। তারপর তাকে বলি, এইবারে সে নিজেকে সামলে নিক। এটা সে চমৎকারভাবে করল। তারপর, চিত্রনাট্যে যেমন লেখা রয়েছে সেই অনুযায়ী পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকাল নীচের দিকে। নীচে বস্তিতে এক মা তার শিশুর সঙ্গে খেলছে। খিলখিল করে হাসছে শিশুটি।

মা আর শিশুর এই যে আনন্দময় দৃশ্যটি, এটা দেখে সে বল পায়। এই পরিবেশের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেবার বল। চোখের জল মুছে সে জানলা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অপু ফিরে আসে। জিজ্ঞেস করে, “তোমার খুব খারাপ লাগছে, না?” ম্লান হেসে মাথা নাড়ে অপর্ণা।

এর পরেই আসছে তাদের বিবাহিত জীবনের দৃশ্য। কথা হচ্ছে, দাম্পত্য সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা, তার আভাস দেব কী করে? পাশ্চাত্ত্যের চিত্র-পরিচালকদের অনেক সুবিধে। আলিঙ্গন, চুম্বন, শয্যায় দুজনের ঘনিষ্ঠতা, নানাভাবে ওটা তাঁরা দেখাতে পারেন। আমাদের ছবিতে ও-সব দেখানো যায় না। এ যখনকার কথা, সেন্সরশিপের কাঁচি তখন চুম্বনকে ছেঁটে দিত। তবে এতে যে শিল্পীর স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, এমন কথা আমার কখনওই মনে হয়নি। চুম্বনের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা দেখানো, এ তো অতি সোজা ব্যাপার। আমিও একই ঘনিষ্ঠতার আভাস দেব, তবে অন্যভাবে, অত সিধে-সহজ পথে নয়। ও আভাস চাউনির মাধ্যমেও অনেকখানি দেওয়া যায়। কিন্তু তা ছাড়াও রয়েছে অন্য নানা উপায়। অবিবাহিত মানুষের ঘরের চেহারা সাধারণত যেমন হয়ে থাকে, ছবির গোড়ায় অপুর ঘরের সেই রকম চেহারাই আমরা দেখতে পাই। এখন কিন্তু বিছানায় দেখা যাচ্ছে একটার বদলে দুটো বালিশ। আরও কিছু-কিছু পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। জানলায় যে পর্দা ঝুলছে, সেটা ময়লা নয়, পরিষ্কার। জানলার তেলাঞ্চিতে ছোট্ট একটা ফুলগাছের টব। এখন আর এটা অবিবাহিত লোকের অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন ঘর নয়, মেয়েলি হাতের ছোঁয়া লেগে ফিটফাট পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। ক্যামেরার কাজের ভিতর দিয়ে এই পরিবর্তনটাকে আভাসিত করা যায়। সকালে ঘুম ভাঙবার পর অপু দেখতে পায়, দুই বালিশের মাঝখানে একটা চুলের কাঁটা পড়ে রয়েছে। অপর্ণা তার আগেই ঘুম থেকে উঠে লেগে গেছে সংসারের কাজে। সে যে উনুন ধরাচ্ছে, বিছানা থেকেই দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে অপু তা দেখতে পায়। সে যে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অপর্ণা তা টের পেয়ে বলে, “হাঁ করে দেখছ কী? আমি কি নতুন নাকি?” অপু হাসে। নিশ্চিন্ত চিত্তে সে চুলের কাঁটাটাকে ঘোরাতে থাকে। তারপর হাত থেকে সেটা নামিয়ে রেখে বালিশের তলা থেকে তার সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে নেয়। প্যাকেট খুলে দেখতে পায় অপর্ণার হাতে লেখা একটা চিরকুট রয়েছে তার মধ্যে। চিরকুটে লেখা, “খাবার পরে একটা করে —কথা দিয়েছ।” প্যাকেটটা বন্ধ করে অপু। তারপর সেটাকে আবার বালিশের তলায় রেখে দেয়।

প্যারিসে রেনোয়াকে এ-ছবি দেখাবার পরে তিনি বলেছিলেন, “আলিঙ্গনের দৃশ্য পর্যন্ত তুমি একবারও দেখাওনি। কিন্তু ঘনিষ্ঠতার আভাসটা তাতেও ঠিকই এসেছে।”

‘অপুর সংসার’-এ একটা মৃত্যুর ঘটনা আছে। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণা মারা যায়। তবে ফিল্মে সেটা দেখানো হয় না। অপর্ণার ছোট ভাই এসে অপুকে এই মৃত্যুর খবর দেয়। এ ছবির এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এটা আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম যে, খুবই আনন্দময় ও কাব্যিক একটা দৃশ্যের পরে-পরে, মস্ত একটা ধাক্কার মতো, আসবে এই ভয়ঙ্কর দুঃখের মুহূর্তটি।

একটা আপিসে কেরানির কাজ করে অপু। সেখানে তার নামে চিঠি এসেছে। অপর্ণার চিঠি। চিঠিখানা তার পকেটেই রয়েছে, কিন্তু সেটা না-পড়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। আপিসের ছুটির সময় ক্রমেই এগিয়ে আসছে। অপু আর ধৈর্য ধরতে পারছে না। পকেট থেকে চিঠি বার করে সে পড়তে শুরু করে।

খুবই সরল, মর্মস্পর্শী চিঠি। চিঠিখানা অপর্ণার গলায় শোনা যায়। কিন্তু একটা লাইনের পরে আর সে-চিঠি পড়া যায় না। কেননা, আর-এক কেরানি শান্ত প্রকৃতির বাধ্য বউ নিয়ে তার জ্বালার কথা অপুকে শোনাতে শুরু করে দেয়।

আপিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়, ভিড়ের ট্রামে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই অপু আবার পকেট থেকে বার করে চিঠিখানা। ভিড়ভাট্টার শব্দ ছাপিয়ে চিঠির ভিতর দিয়ে আবার ভেসে ওঠে অপর্ণার শান্ত মধুর গলা। কিন্তু এবারেও দেখা যায়, অপুর ঘাড়ের উপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে এক সহযাত্রী চিঠিখানা পড়বার চেষ্টা করছে। ফলে অপু আবার চিঠি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয়।

ওভারব্রিজ থেকে খানিকটা দূরে তার বাড়ি। মাঝখানে রেল-লাইন। শেষ পর্যন্ত ওই রেল-লাইনের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চিঠিটা শেষ করার সুযোগ পায়। অপর্ণার কণ্ঠস্বর তখনও তার কানে বাজছে। অপু তার ফ্ল্যাটে পৌঁছয়, কিন্তু দরজা খুলে ঘরে ঢুকবার আগেই সে দেখতে পায় যে, অপর্ণার ভাই ছাতে দাঁড়িয়ে আছে। অপুর মুখের হাসি মুছে যায়। অপর্ণার ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অপু। কিন্তু সে কিছু বলে না, শুধু অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। “কী হয়েছে?” অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করে অপু। অপর্ণার ভাই পুরো একটা বাক্য পর্যন্ত বলতে পারে না। কিন্তু যেটুকু বলে, তা-ই যথেষ্ট। কী যে হয়েছে, অপু বুঝে যায়।

এই অবস্থায় কী হতে পারে, তা নিয়ে দিনের পর দিন চিন্তা করেছিলাম। যে মেয়ে তার জীবনে সুখ নিয়ে এসেছিল, শান্তি নিয়ে এসেছিল, বাড়ি কাকে বলে, সে সম্পর্কে তার ধারণায় যোগ করেছিল একটা নতুন মাত্রা, তার মৃত্যুর খবর শুনে কী প্রতিক্রিয়া হবে একজন তরুণের? মৃত্যুর খবরটা যে দিচ্ছে, তার প্রতিই বা সেই মুহূর্তে কী মনোভাব হবে তার?

কথাটা যতই ভাবি, ততই মনে হয় যে, অপু যদি কাণ্ডজ্ঞান হারায়, তবে সেই মুহূর্তে সেটাই হবে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। খবরটা যে নিয়ে এসেছে, অপুর ক্রোধ ধাবিত হবে তারই দিকে। অন্ধ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকেই সে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দেবে। তাতেই যেন সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে তার, সে আর দাঁড়িয়ে থাকতেও পারবে না, টলতে-টলতে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়বে।

শটটা আমি এইভাবেই নিই। বাঙালি সমালোচকদের প্রায় প্রত্যেকের দ্বারাই এটি সমালোচিত হয়। তাঁরা বলেন, অপু ভদ্র ঘরের শান্ত প্রকৃতির ছেলে, সে যে ওইভাবে থাপ্পড় মারবে, এটা খুবই বেখাপ্পা ব্যাপার। আমি এখানে অবশ্য শুধু বাঙালি সমালোচকদের কথাই বললাম।

যা-ই হোক, শোকাচ্ছন্ন অপু এর পরে কয়েকটা দিন বিছানা ছেড়ে নড়ে না। একই বাড়ির নীচতলায় যে বিধবা ভদ্রমহিলাটি থাকেন, থালায় করে অপুর জন্য দুপুরবেলায় ভাত বেড়ে আনেন তিনি। অপুকে বলেন যে, এইভাবে ভেঙে পড়া ঠিক নয়। বলেন, “তুমি পুরুষ মানুষ, তোমার ভাবনা কী বাবা? বলে —বজায় থাকুক চুড়ো বাঁশি, মিলবে কত সেবাদাসী। একটা ছেড়ে দশটা বিয়ে করো না কেন?…” টিনের চেয়ারে ভাতের থালা নামিয়ে রেখে তিনি চলে যান। কাছেই একটা বেড়াল ঘুরঘুর করছে। বেড়ালটাকে আমি ওখানে ইচ্ছে করেই রেখেছিলাম। চাইছিলাম যে, ভদ্রমহিলা ঘর থেকে চলে যাবার পর সে চেয়ারের উপরে লাফিয়ে পড়ে থালায় মুখ দিয়ে খেতে শুরু করবে। কিন্তু সেটা আর হল না। আমাকে কিছু না-জানিয়ে বেড়ালটাকে কেউ আগে থাকতেই পেট পুরে খাইয়ে রেখেছিল। ফলে কিছুতেই তাকে দিয়ে আর থালায় মুখ দেবার কাজটা করিয়ে নেওয়া গেল না।

একটা সময়ে অপু অবশ্য বিছানা থেকে ওঠে। কিন্তু শোকে সে এখনও মুহ্যমান। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি যে ভাবলেশহীন, এইটে দেখাবার জন্য ক্যামেরা গিয়ে দাড়ি কামাবার আয়নার উপরে স্থির হয়। বাইরে থেকে ঠিক এই সময়েই ভেসে আসে ট্রেনের হুইস্‌লের শব্দ। অপু শোনে। তার একটা প্রতিক্রিয়া হয়। ক্যামেরা তার মুখের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা দেখি, তার চোখের চাউনি পালটে গেছে।

পর্দাটা এই সময়ে সাদা হয়ে যায়। শব্দ শুনে বোঝা যায়, একটা রেলগাড়ি এগিয়ে আসছে। পর্দার উপরের দিকটা আকাশ। পর্দার নীচের দিক থেকে ধোঁয়া উঠে আকাশে ছড়িয়ে যায়। ক্যামেরা অপুর দিকে ঘোরে। তাকে আমরা কাছ থেকে দেখতে পাই। বুঝতে পারি, সে রেল-লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

ধোঁয়া ক্রমে এগিয়ে আসে। একটু পরে ইঞ্জিনটাকে দেখা যায়। ভীষণ শব্দ করে ইঞ্জিনটা এসে পড়ে। অপুর মুখ এখনও ভাবলেশহীন। আস্তে-আস্তে সে লাইনের দিকে ঝোঁকে। বোঝা যায়, সে রেলগাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে।

ঠিক তক্ষুনি একটা তীব্র চিৎকার শোনা যায়। একটা শুয়োরের চিৎকার। শুয়োরটা রেলের চাকায় কাটা পড়েছে। একইসঙ্গে কেটে গেছে অপুর আচ্ছন্ন ভাবটা। ভেঙে গেছে তার আত্মহত্যার সংকল্প।

ছবির অর্ধাংশ এখানেই শেষ হয়। কাজটা এখানে যেভাবে করেছি, তাতে খুশি হয়েছিলাম। বিশেষ করে আরও এইজন্য ভাল লাগছিল যে, একটা মস্ত অংশ জুড়ে যত কথার ভিড় ছিল তা এখানে একদম ছাঁটাই করে দিতে পারা গেছে।

অর্থচিন্তা না থাকায় যে-দিন যে-কাজ করবার কথা, এবারে ঠিক সেইদিনই সে-কাজ করা গেছে, টাকার জন্য আমাদের ঠাসা কর্মসূচি কখনও বানচাল হয়নি। তবে তারই মধ্যে মাঝে-মাঝে কল্পনাতীত এমন সব পরিস্থিতির উদ্‌ভব হত, যাতে মসৃণভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না, কাজের ব্যাঘাত ঘটে। সেই রকমের একটা ঘটনার কথা এখানে বলছি। এতে বাঙালি চরিত্রের এমন একটা দিকের পরিচয় পাওয়া যাবে, যা খুব প্রশংসনীয় নয়।

ঘটনাটা ঘটে বরযাত্রী আসার দৃশ্যকে কেন্দ্র করে। পালকির মধ্যে বর, ব্যান্ডপার্টি বাজাচ্ছে, ‘হি ইজ আ জলি গুড ফেলো’র সুর, বরযাত্রীরা বিয়েবাড়ির দিকে এগোচ্ছে,—এই দৃশ্যটি তুলবার জন্য জনা-পঞ্চাশেক এক্সট্রার দরকার হয়। এদের আমরা কৃষ্ণনগর শহর থেকে জোগাড় করি। যে গ্রামে আমাদের প্রায় সমস্ত শুটিং হবার কথা, সেখান থেকে কৃষ্ণনগর জায়গাটার দূরত্ব খুব বেশি নয়। কৃষ্ণনগরের কাছেই নবদ্বীপ। ইতিহাসের দিক থেকে দুটো শহরেরই বেশ গুরুত্ব রয়েছে।

যেদিন বরযাত্রী আসার শুটিং হবে, সেদিন আমরা দৃশ্যটিকে ঠিকমতো তৈরি করে তুলছি, এমন সময় হঠাৎ শ’খানেক যুবক এসে সেখানে হানা দেয়। যেদিক থেকে এরা এসেছিল, তাতে আন্দাজ করা গেল যে, এরা নবদ্বীপের লোক, এক্সট্রা হিসেবে নেওয়া হয়নি বলে প্রতিবাদ জানাতে এসেছে। নদীর ধারে একটা ট্রলির মধ্যে রাখা ছিল আমাদের ক্যামেরা। এরা নদীর বাঁধ ধরে উঠে এসে ক্যামেরাটিকে তো বটেই, সেইসঙ্গে আমাদের ইউনিটের সমস্ত কর্মীকে ঘেরাও করে ফেলে।

লোকগুলির আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখে মনে হল, একটা দাঙ্গা না-বাধিয়ে এরা ছাড়বে না। পরের দৃশ্যে নেওয়া হবে বলে বিস্তর বুঝিয়ে-শুঝিয়ে এদের ঠাণ্ডা করি। কিন্তু ততক্ষণে আকাশের আলো মিলিয়ে এসেছে, ফলে সেদিন শটটা আর নেওয়া গেল না।

আর-একটা বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছিল নদীর উপরে। দৃশ্যটা এইরকম: অপু আর পুলু ছোট একটা নৌকোতে করে গ্রামের দিকে আসছে। অপু একটা উপন্যাস লিখেছে। পুলুকে তার পাণ্ডুলিপিটা পড়তে দিয়েছে সে। পুলু সেই পাণ্ডুলিপিটা পড়ছে আর অপু বাঁশি বাজাচ্ছে।

নৌকোয় আছে তারা দুই বন্ধু, বুড়ো মাঝি, ক্যামেরাম্যান সুব্রত, সাউণ্ড-রেকর্ডিস্ট দুর্গাদাস আর আমার সহকারী শৈলেন দত্ত। সেইসঙ্গে আমিও আছি। অর্থাৎ নৌকো একেবারে বোঝাই। নৌকোর একদিকে আমরা জড়সড় হয়ে বসে আছি। অন্য দিকে দুই বন্ধু। তাদের অভিনয় দেখছি আমরা। এ পর্যন্ত সব ভালই চলছিল। হঠাৎ শৈলেন চেঁচিয়ে ওঠে। আমি বলি ‘কাট্‌’। বলেই মুখ ফিরিয়ে সেই বস্তুটি দেখতে পাই, যা দেখে শৈলেন চেঁচিয়ে উঠেছে।

পিছন থেকে এসে পড়েছে বিশাল একটি নৌকো। আমাদের ছোট্ট নৌকোটির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল বলে। নৌকোটি বড় বলেই তার গতিপথ পালটানো শক্ত। আর সেটি আসছেও একেবারে তরতর করে।

এই অবস্থায় কে যে কী করব, আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারি না। শুধু এটা বুঝি যে, সংঘর্ষ একেবারে অনিবার্য। আর ওই পেল্লায় নৌকোর সঙ্গে যদি ধাক্কা লাগে, তা হলে আমাদের এই ছোট্ট নৌকোটার দশা কী হবে, তাও বুঝি। বড় নৌকোটা ওদিকে সেই ঝড়ের গতিতেই আসছে। ধাক্কাটা তা হলে লাগবেই। দম বন্ধ করে আমরা অপেক্ষা করি সেই বিপর্যয়ের। ঠিক এই সময়েই শৈলেন এমন একটা দুঃসাহসের কাজ করে বসে, যা সে করতে পারে বলে কখনও ভাবিনি। সে লাফিয়ে উঠে বড়-নৌকোটাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে যায়। কিন্তু দু’ হাত দিয়ে সে যখন বড়-নৌকোটাকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, তার নিজেরই পায়ের ঠেলায় আমাদের নৌকোটা তখন অনেকখানি সরে যায়। তাতে আমাদের নৌকোটা আর ধাক্কা খায় না বটে, কিন্তু দুই নৌকোর মাঝখানে সৃষ্টি হয় বেশ-কিছুটা ব্যবধানের। ফলে, আমাদের নৌকো থেকে শৈলেনের পা সরে যাওয়ায় সে নদীর মধ্যে পড়ে যায়। তার নোটবইটিও জলে পড়ে। কন্টিনুইটির খুঁটিনাটি তথ্যগুলি সে ওই নোটবইয়ের মধ্যেই টুকে রাখত। যা-ই হোক, বিপর্যয়ের হাত থেকে একেবারে এক চুলের জন্য বেঁচে যাই আমরা। এমন অভিজ্ঞতা আর কখনও হয়নি।

অপুর খোঁজ করতে-করতে পুলু সেই কয়লাখনিতে গিয়ে হাজির হয়েছিল। তারই পীড়াপীড়িতে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অপু তার ছেলের দায়িত্ব নিতে আসে। ছেলের নাম কাজল। কাজলের ঘরে ঢুকে অপু তাকে বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। হাঁটাচলার মতন ঘুমেরও আছে একটা স্বাভাবিকতা। ছবিতে সেই স্বাভাবিকতাকে ধরা ভারী শক্ত ব্যাপার। বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায় সেটা আরও শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। তাদের চোখ ঠিকমতো বোজে না, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারটাও ঠিক স্বাভাবিক হতে চায় না। কাজলের ভূমিকায় যাকে নামাই, সেই সাড়ে চার বছরের বাচ্চাটির ক্ষেত্রে আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি বলেই আগে থাকতে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়েছিল। অপু ঘরে ঢোকে, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তার ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে একটা মমতা ফুটে ওঠে। পরের শটে দেখা যায়, কাজল জেগে উঠে দেখছে যে, তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে অচেনা একটা লোক। ক্যামেরার মুখ আমরা কাজলের দিকে ঘোরাই, আমার সহকারী তার পা ধরে ঝাঁকুনি লাগায়। কাজল জেগে ওঠে। পর্দায় এর চেয়ে বিশ্বাসজনকভাবে আর কাউকে কখনও আমি জেগে উঠতে দেখিনি।

পরের দৃশ্যে অপু একটু সামনের দিকে ঝুঁকে কাজলের মাথা ছোঁয়। কিন্তু অপু তো তার সম্পূর্ণ অচেনা, কাজল তাই ভয় পেয়ে তার বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

শুটিংয়ের ব্যাপারে আর কোনও ঝামেলা হয়নি। রবিশঙ্করেরও এবারে কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। তিনি তাই পুরো আবহসংগীত রচনা করে দেন। চমৎকার কাজ করেছিলেন তিনি। সব কাজ শেষ হতে পুরো তিন শিফট সময় লাগে।

‘থার্ড টাইম লাকি’ বলে একটা কথা আছে না? অপু-সিরিজে ‘অপুর সংসার’ আমার তৃতীয় ছবি। এ-ছবি রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পায়। তা ছাড়া, বছরের সবচেয়ে মৌলিক চলচ্চিত্র হিসাবে পায় ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সাদারল্যান্ড ট্রোফি। ঘরে বাইরে, সবাই আমাদের কাজের খুব প্রশংসা করেছিলেন। তা ছাড়া বক্স অফিসের বিরাট সাফল্যও এ-ছবি পেয়েছিল।

বাংলা ছবির নায়ক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আকর্ষণ এর পরে খুব বেড়ে যায়। শর্মিলা ঠাকুরও বোম্বাইয়ে গিয়ে চিত্র-জগতে বিপুল সমাদর পায়। তবে এর পরেও যখনই ডেকেছি, তখনই সে আমার ছবিতে কাজ করবার জন্য বোম্বাই থেকে কলকাতায় চলে এসেছে।

——

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *