১. পশ্চাৎপট

পশ্চাৎপট

১৯৫২ সালের শরৎকালের এক বিকেলবেলায়, দীর্ঘ সাদা কাশফুলে ছাওয়া এক মাঠের মধ্যে আমি শুরু করেছিলাম ‘পথের পাঁচালি’র শুটিং। চলচ্চিত্র নির্মাণকেই যে আমার পেশা হিসাবে গ্রহণ করব, তার এক বছর আগে পর্যন্ত এমন কথা আমি ভাবিনি। যে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে দশ বছর কাজ করেছি, সেখানে তখন আমি আর্ট ডিরেক্টর। পাকা চাকরি। তখনই অবশ্য আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম যে, বিজ্ঞাপন-জগতের শিল্পীদের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই, যাঁরা টাকা ঢালছেন, সেই বিজ্ঞাপনদাতাদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী তাঁদের কাজ করতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চাকরিটা আমি করে যাচ্ছিলাম। তার কারণ, এই ধারণা নিয়ে আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম যে, একজন যুবকের জীবনে আর্থিক নিরাপত্তার দামই সবচেয়ে বেশি, তার চেয়ে বেশি দামি আর কিছুই হতে পারে না।

আমার বাবা কি ঠাকুর্দা কখনও চাকরি করেননি। ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভা ছিল রেনেসাঁসের সময়কার মানুষদের প্রতিভার মতোই বহুমুখী। তিনি লিখতেন, ছবি আঁকতেন, বেহালা বাজাতেন, গান রচনা করতেন। হাফটোন ব্লক তৈরির ব্যাপারে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। তিনি যে ছাপাখানা বসিয়েছিলেন, অচিরে তা দেশের সেরা ছাপাখানা বলে গণ্য হয়। ১৯১৫ সালে, ৫২ বছর বয়সে, আমার জন্মের ছ’ বছর আগে, তিনি মারা যান। তাঁর বড় ছেলে সুকুমার আমার বাবা। ছাপার কাজ শিখবার জন্য ঠাকুর্দা তাঁর এই বড় ছেলেকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে ম্যাঞ্চেস্টার স্কুল অব প্রিন্টিং টেকনোলজির শেষ পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। ঠাকুর্দার জীবদ্দশাতেই তিনি দেশে ফেরেন, তারপর বিয়ে করে যোগ দেন তাঁর বাবার ব্যবসায়ে।

আমার জন্ম ১৯২১ সালে। সেই বছরই বাবার কালাজ্বর হয়। কালাজ্বরের তখন কোনও চিকিৎসা ছিল না। আড়াই বছর ধরে তিনি এই রোগে ভোগেন। যখন একটু ভাল থাকতেন, তখনই ছাপাখানার কাজের দেখাশুনো করতেন। সেইসঙ্গে ‘সন্দেশ’-এর জন্য লিখতেন ছড়া আর গল্প। আঁকতেন ছবিও। ‘সন্দেশ’ ছোটদের কাগজ। আমার ঠাকুর্দা এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা।

বাবা মারা যান ছত্রিশ বছর বয়সে। ছাপাখানাটা তাঁর মৃত্যুর পরে আর বছর তিনেক চলেছিল। তারপর ব্যবসার হাত-বদল হতে উত্তর কলকাতার মস্ত বড় বাড়ি ছেড়ে আমাদের উঠে আসতে হয়।

আমি আমার বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাকে নিয়ে মা তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে চলে এলেন। আমার এই মামা থাকতেন শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। তিনি যদি না অত উদারভাবে সেদিন আমাদের আশ্রয় দিতেন, আমাদের জীবনে তা হলে তার পরিণতি হত ভয়াবহ। মামার দিক থেকে এটা ছিল প্রত্যুপকারের ব্যাপার। কলকাতায় তাঁর ছাত্রাবস্থায় বাবার কাছে তিনি যে সাহায্য পেয়েছিলেন, এ তারই প্রতিদান। তখনও তিনি বিয়ে করেননি। কাজ করতেন একটা বিমা-কোম্পানির আপিসে। অবিবাহিতা এক বোনের প্রতিপালনের দায়িত্বও তাঁকে বহন করতে হত। সেই অবস্থায় মা এসে তাঁর ভাইয়ের সংসারের কাজকর্ম, নিত্যদিনের খরচপত্র, রান্নাবান্না, ইত্যাদির দায়িত্বভার নিজের হাতে তুলে নিলেন। সংসারের রোজগার বাড়াবার জন্যে এক বিধবাশ্রমে গিয়ে সূচিশিল্প শেখাবার কাজও নিয়ে নিলেন তিনি। তার জন্য নিত্য তাঁকে শহরের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত বাসে যাতায়াত করতে হত।

কিন্তু এই যে আমার জীবনের পশ্চাৎপট, এর মধ্যে সিনেমা কী করে জায়গা করে নিল?

উত্তরে বলি, যখন ইস্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই আমি চলচ্চিত্রের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কোথায় পড়াশুনোয় মন দেব, তা নয়, পাঠ্যবই শিকেয় তুলে তখনই আমি সাগ্রহে পড়ছি ‘পিকচারগোয়ার’ আর ‘ফোটোপ্লে’; হেড্ডা হপার আর লুয়েলা পার্সন্‌সের লেখায় যে-সব হলিউডি গুজব থাকত, গোগ্রাসে সেগুলো গিলে চলেছি। ডিয়েনা ডার্কিন যে আমার প্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর চেহারা কিংবা অভিনয়-নৈপুণ্যই তার একমাত্র কারণ নয়, তাঁর ‘সোপ্রানো’ কণ্ঠের কাজ ছিল চমৎকার। ফ্রেড অ্যাস্টেয়ার আর জিঞ্জার রজার্সও ছিলেন আমার প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী। এঁদের প্রতিটি ছবিই যে আমি বারবার দেখেছি, সে শুধু এইজন্য যে, আর্ভিং বার্লিন আর জেরোম কার্নের দেওয়া সুরের রহস্যকে আমি তখন আমার অন্তর দিয়ে বুঝে নিতে চাইছিলাম।

আমার কলেজ-জীবনের যখন সূচনা, তখনই কোনও একটা সময়ে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুটা পালটে যায়। তারকা নয়, আমার মন চলে যায় পরিচালকদের দিকে। এটা হয়েছিল সম্ভবত দুটি বই পড়বার ফলে। চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক দিক নিয়ে এই যে দুখানি বই, এর লেখক পুডভকিন। তখনই আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, গ্রেটা গার্বো, মারলিন ডিয়েট্রিখ, গ্যারি কুপার কি ক্যারি গ্র্যান্ট সম্পর্কে আমার আগ্রহ ক্রমে ঝিমিয়ে পড়ছে, আর তার জায়গায় আর্নস্ট লুবিশ, জন ফোর্ড, ফ্র্যাংক কাপরা, উইলিয়াম ওয়াইলার কি জর্জ স্টিভেন্‌স সম্পর্কে এসে যাচ্ছে একটা আগ্রহের জোয়ার। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকার একটি সংখ্যা এই সময় হঠাৎ আমার হাতে এসে যায় ও আমি তার গ্রাহক হই। উত্তেজনায় আমি তখন টগবগ করে ফুটছি। যেন একটা নতুন জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। নাম-জাদা সব অভিনেতা-অভিনেত্রী কী করছেন না করছেন, চলচ্চিত্রে শুধু তাতেই আর তখন আটকে থাকছে না আমার আগ্রহ, একইসঙ্গে নজর করে দেখছি যে, ক্যামেরাটাকে কোথায় কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, কোন্ দৃশ্য কোথায় ‘কাট্’ করা হচ্ছে, ছবির গল্পাংশ কীভাবে উন্মোচিত হচ্ছে, আর কী কী সেই বৈশিষ্ট্য, যা একজন পরিচালকের কাজকে আর-একজনের কাজ থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

আর-একটা বিষয়ও ইতিমধ্যে দখল করেছিল আমার কল্পনাকে। যেমন চলচ্চিত্র, তেমন তাতেও আমি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। বিষয়টা হচ্ছে পাশ্চাত্ত্যের ধ্রুপদী সংগীত। ভারতীয় সংগীত, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের আবহের মধ্যে আমি বড় হয়ে উঠেছি। আমার মাতৃকুলে বলতে গেলে প্রায় সকলেরই ছিল স্বাভাবিক গানের গলা। তবে, খুব ছেলেবেলায়, রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি ওয়াল্‌জ আর মার্চও শুনতাম। জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা খেলনা-গ্রামোফোন পেয়েছিলাম আমি। তার রেকর্ড ছিল আজকালকার কমপ্যাক্ট ডিস্কের মতন। তাতেই বাজত এই সুর। অর্থাৎ পাশ্চাত্ত্য সংগীতে রপ্ত হবার যে সুযোগ, সেটা আমার সেই ছেলেবেলাতেই ঘটেছিল।

ভোর্জাকের নিউ ওয়র্লড সিম্ফনি, চাইকোভ্‌স্কির পিয়ানো কনচের্টো, লিট্‌সের হাঙ্গারিয়ান র‍্যাপসডি—জনপ্রিয় এই যে সব ক্ল্যাসিক্স, ইস্কুলে পড়বার সময়ে এগুলির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। শুনে একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। হাত-খরচার পয়সা জমিয়ে তখন থেকেই রেকর্ড কিনতে শুরু করি। প্রথম-প্রথম তো অল্প-দামে পাওয়া যায় বলে চোরাবাজার থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড রেকর্ড কিনতাম। হিজ মাস্টার্স ভয়েস বার করেছিল বেঠোফেনের এগমন্ট ও কোরিওলান ওভারচার্স-এর রেকর্ড। কালো লেবেলের সেই রেকর্ডের প্রতিটি যে আট আনা (সেই সময়কার হিসাবে দু’ পেনি) দিয়ে কিনেছিলাম, সেটা মনে আছে। পরে সিম্ফনি ও কনচের্টোর বিভিন্ন নতুন রেকর্ড কিনি, তবে পয়সায় কুলোত না বলে প্রথম দিকে কোনও মাসেই একটার বেশি মুভমেন্টের রেকর্ড কেনা সম্ভব হত না। চাকরিতে ঢোকার পরে তবেই রেকর্ডের পুরো সেট কিনতে পারি। টোভির চার-ভলুমে লেখা ‘এসেজ ইন মিউজিক্যাল অ্যানালিসিস’ ততদিনে আমার শয্যাসঙ্গী হয়েছে। একইসঙ্গে, মিনিয়েচার স্কোর-এর দিকে চোখ রেখে রেকর্ড শোনা, এটাও আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

ফিল্ম আর পাশ্চাত্ত্য সংগীত, এ দুটি ব্যাপারেই এত সময় চলে যেত যে, পড়াশোনায় তখন আর বিশেষ মন দিতে পারিনি। ট্রিগোনোমেট্রি, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির দাপট সহ্য করে বিজ্ঞান নিয়ে আমার কলেজ-জীবনের প্রথম দুটো বছর কোনও রকমে কাটিয়ে দিই।

কলেজের থার্ড ইয়ারে উঠেই ঠিক করি, আর সায়েন্স নয়, এবারে হিউম্যানিটিজের কোনও বিষয় নিয়ে ডিগ্রি করব। বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ আমার পিতৃবন্ধু। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের তিনি প্রধান কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ইকনমিক্স নিয়ে যদি পড়ি তো বি.এ. পাশ করবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর ইনস্টিটিউটে আমার চাকরি হয়ে যাবে। ‘চাকরি’ শব্দটা তখন জাদুর কাজ করত। তাতেই ভুলে গিয়ে আমি তাঁর কথায় রাজি হয়ে যাই। পরে অবশ্য এর জন্যে অনেক আক্ষেপ করেছি। ইকনমিক্স আমার একটুও ভাল লাগত না। স্রেফ মুখস্থবিদ্যার জোরে একটা সেকেন্ড ক্লাস অনার্স পেয়ে পাশ করি।

আমার বয়স তখন আঠারো বছর। তখনই ঠিক করি যে, আর পড়ব না। কিন্তু পড়াশুনো ছেড়ে অত অল্প বয়সেই আমি চাকরির চেষ্টায় লেগে যাব, মা এটা পছন্দ করেননি। তাঁর ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে গিয়ে সেখানকার ছাত্র হয়ে আমি ছবি আঁকা শিখি। রবীন্দ্রনাথ আমার ঠাকুর্দার বন্ধুস্থানীয় ও সমসাময়িক। বাবার লেখা উদ্ভট ছড়ারও তিনি ছিলেন মস্ত অনুরাগী।

সাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই রবীন্দ্রনাথের দখল ছিল অসামান্য রকমের। শেষ বয়সে উদ্ভট ছড়াও কিছু লিখেছিলেন। তবে একইসঙ্গে স্বীকার করতেন যে, এ-ক্ষেত্রে সুকুমারই সম্রাট।

মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, আমি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হব। ঠাকুর্দা ও বাবা, দুজনেই ছবি আঁকতেন। পেইন্টিং আর ইলাস্ট্রেশান, দুই ধরনের কাজই করেছেন তাঁরা। আঁকার ব্যাপারে আমারও একটা স্বাভাবিক ঝোঁক তো ছিলই। মায়ের কথাটা তাই আমার মনে ধরল; ভেবে দেখলাম যে, ভারতীয় শিল্পবিদ্যায় হাতেখড়ি হয়ে গেলে সে নেহাত মন্দ হবে না। তবে কিনা পেইন্টার হয়ে উঠব এমন চিন্তা কখনওই হয়নি, ও ব্যাপারে বস্তুত কোনও আকর্ষণই আমি বোধ করিনি।

অতএব ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হই। পাঁচ বছরের কোর্স। শেষ করলে একটা ডিপ্লোমা পাওয়া যায়। শিল্পকলার শিক্ষক হতে চাইলে সেটা কাজেও লাগে। কিন্তু আমি তা হতে চাইনি, তাই আড়াই বছর বাদেই আমি সেখান থেকে চলে আসি। তবে এই আড়াই বছরের মূল্য আমার জীবনে কম নয়। শিল্পকলার ক্ষেত্রে পশ্চিমী ঐতিহ্যের যে প্রভাব, এতদিন আমার চেতনাকে তা-ই পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছিল। মুগ্ধ হয়ে দেখেছি রেমব্রান্ট আর দা ভিঞ্চির শিল্পকলা। এবারে প্রাচ্য পৃথিবীর শিল্পকলার ঐশ্বর্যময় জগতের দরজাটা আমার চোখের সামনে খুলে গেল। চিনে ল্যান্ডস্কেপ, জাপানি কাঠখোদাই আর ভারতীয় মিনিয়েচার হঠাৎ ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিল আমার চেতনাকে। প্রাচীন শিল্পৈশ্বর্যের জন্যে ভারতবর্ষের যে-সব জায়গার খুব খ্যাতি, তিনজন বন্ধুর সঙ্গে সেই সময়েই আমি সেখানে যাই। অজন্তা, ইলোরা আর খাজুরাহো দেখে আমার চোখ খুলে যায়।

শান্তিনিকেতনে থাকাটা আর-এক দিক থেকেও আমার জীবনে খুব কাজে লেগেছিল। আমাদের ক্যাম্পাসের চার দিকেই তো গ্রামের ছড়াছড়ি। স্কেচ করবার জন্যে প্রায়ই তখন আমরা সেইসব গ্রামে চলে যেতাম। আমি শহরে জন্মেছি। বড় হয়ে উঠেছিও শহরেই। গ্রাম-বাংলার রূপ-বৈচিত্র্যের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটল।

শান্তিনিকেতনে থাকার ফলে যে পাশ্চাত্ত্য সংগীতের ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটে যায়নি, এটাকে একটা সৌভাগ্যের ব্যাপারই বলতে হবে। অ্যালেক্স অ্যারনসন নামে যে জার্মন-ইহুদি অধ্যাপক সেখানে ইংরেজি পড়াতেন, তাঁর সংগ্রহে ছিল বেশ কিছু ক্ল্যাসিক্যাল রেকর্ড। আর ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের একটি পোর্টেবল গ্রামোফোন। ফলে তাঁরই বাড়িতে আমার অধিকাংশ সন্ধ্যা তখন কেটেছে। গ্রামোফোনে চেম্বার মিউজিক বাজত। বিভোর হয়ে শুনেছি।

শান্তিনিকেতনে থাকার একটা খারাপ দিকও ছিল। সেটা আমি অনুভব করতাম। ১৯৪১ সাল, বিশ্বযুদ্ধ একেবারে আমাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে। অথচ শান্তিনিকেতনে চলছে সেই একই রকমের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রা। ক্যাম্পাসের মধ্যে দৈনন্দিন প্রার্থনাসভা, সংগীত কি নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান—সবই একেবারে নিয়মমাফিক চলছে। চতুর্দিকের বাস্তব ঘটনাস্রোতের সঙ্গে এর কোনও সংগতি আমি খুঁজে পেতাম না। শান্তিনিকেতনে সিনেমা-হল্ নেই, ওদিকে কলকাতার হলে দেখানো হচ্ছে ‘সিটিজেন কেন’, এটা ভেবেও অস্থির-অস্থির লাগত। আর্টস ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে অবশ্য সিনেমার উপরে কিছু বইপত্র ছিল। অগত্যা সে-সব পড়েই তখন দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি। যা পড়েছিলাম, তার মধ্যে দুখানা বইয়ের নাম করি: পল রথার ‘দ্য ফিল্ম টিল নাউ’ আর রেমন্ড স্পটিসউডের ‘এ গ্রামার অব দ্য ফিল্ম’। এ দুটি বই পড়ার ফলে ফিল্ম বিষয়ে আমার জ্ঞান অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল ঠিকই, তবে নিজে চলচ্চিত্র বানাব, এমন কোনও প্রেরণা এর থেকে আমি পাইনি। বরং এই রকমের একটা ইচ্ছা জেগেছিল যে, চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সেটা ছড়িয়ে দেব, শেষপর্যন্ত যার ফলে নিশ্চয় বাংলা চলচ্ছবি তো বটেই, এমনকি ভারতীয় চলচ্ছবিরও উৎকর্ষ অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটা যে কীভাবে করব, সে-বিষয়ে—অন্তত তখনও পর্যন্ত—কোনও ধারণাই আমার ছিল না।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর বাদে কলকাতার উপরে জাপানিরা যে-দিন বোমাবর্ষণ করে, সেই দিনই আমি শান্তিনিকেতন ছাড়ি। আমার শিক্ষক নন্দলাল বসুকে আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, পেইন্টার হবার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। ফলে, কোর্স শেষ না করেই যে আমি চলে এলাম, তিনি এতে বাধা দেননি। তবে বলেছিলেন যে, আড়াই বছরের মধ্যেই আমার আঁকার ক্ষমতার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, এবং জাপানি ক্যালিগ্রাফিক তুলি ব্যবহারেও আমি রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছি। আমি যে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হতে চাই, এটা শুনে তিনি তাঁর শুভেচ্ছা জানান।

যে-দিন আমি কলকাতায় পৌঁছই, এই শহরটার উপরে জাপানিরা সেদিন দ্বিতীয়বার বোমাবর্ষণ করে। এতক্ষণে আমার মনে হল যে, হ্যাঁ, যেখানে ঘটনা ঘটছে, সেখানে এসেই পৌঁছেছি বটে। কলকাতা আর সে-কলকাতা নেই, পালটে গেছে তার চেহারা। রাস্তাঘাটে গিসগিস করছে মার্কিন সৈন্য। এদিকে বোমার ভয়ে অর্ধেক লোক শহর ছেড়ে চলে গেছে। যারা ছবির ভক্ত, তাদের পক্ষে আবার এটাই ছিল মস্ত সুসময়। কথাটা এইজন্য বলছি যে, হলিউডের টাটকা সব ছবি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর এখানে একইসঙ্গে ছাড়া হচ্ছিল। সে-সব ছবি তখন একটার পর একটা আশ মিটিয়ে দেখে নিয়েছি। এদিকে আবার এই চিন্তাটাও দেখা দিয়েছিল যে, এবারে একটা চাকরি না-পেলেই নয়।

তখনও আমি মামাবাড়িতেই থাকি। মামা অবশ্য ইতিমধ্যে দক্ষিণ কলকাতার এক সচ্ছল মধ্যবিত্ত পাড়ায় তাঁর নিজের বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। তিনতলা বাড়ি, জায়গাও প্রচুর। সেই যে আমরা মামাবাড়িতে উঠে আসি, তার অল্প কিছুকাল পরেই আমার মামা বিয়ে করেন। ইতিমধ্যে তাঁর চারটি সন্তানও হয়েছে। তা ছাড়া আমার বড়মামা মারা যাওয়ায় মামিমা তাঁর দুই মেয়ে জয়া আর বিজয়াকে নিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন। আমরা সবাই তার ফলে একই বাড়িতে থাকি তখন। মা সেই বিধবাশ্রমে সূচিশিল্প শেখাবার কাজটা তখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে তো রোজগার খুব-একটা হত না। সব দেখেশুনে বুঝতে পারলাম যে, এবারে আমার চাকরিতে না ঢুকলেই নয়।

খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে সেই সময়ে লক্ষ করি যে, কিছু-কিছু বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে যে-রকমের মিল দেখা যায়, তেমন মিল। পরে আবিষ্কার করি যে, ও-সব বিজ্ঞাপন একই প্রতিষ্ঠানের তৈরি। ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান, নাম ডি. জে. কিমার অ্যান্ড কোম্পানি। মনে হল, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এঁরা বেশি উদ্যোগী। বিজ্ঞাপনগুলি যে একজন বাঙালি শিল্পীর হাতের কাজ, সেটাও শিগগিরই জানা গেল। আরও খোঁজখবর করে জানতে পারলাম যে, এই বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কলকাতা আপিসের ম্যানেজার এক বাঙালি ভদ্রলোক। নাম ডি. কে. গুপ্ত। এও জানা গেল যে, ইনি যাঁর বড় ভাই, তাঁকে আমরা অনেককাল যাবৎ চিনি। এদিকে আবার গুপ্ত-পরিবারের বন্ধু ললিত মিত্র মশাই আমার মামারও বন্ধু বটেন। এই ললিত মিত্রই আমাকে একদিন ডি. কে. গুপ্তর কাছে নিয়ে গেলেন। পরিচয় হিসাবে বলা হল যে, আমি সুকুমার রায়ের ছেলে। কথাটা শুনবামাত্র ডি. কে. গুপ্তর চোখ যে কেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, সেটা আমি পরে বুঝতে পারি। যা-ই হোক, আমার আঁকা কিছু ড্রইং আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। গুপ্ত সেগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে বললেন যে, কোনও একটা পণ্যদ্রব্যের কথা কল্পনা করে নিয়ে তার উপরে আমাকে ছ’টা বিজ্ঞাপন তৈরি করে তাঁকে দেখাতে হবে। বাড়ি ফিরে আমি একটা পারফিউমের কথা ভেবে নিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য ছ’খানা স্কেচ তৈরি করি। কপির সঙ্গে ব্যবহার করবার জন্য প্রতিটির ব্রাশ ড্রইংও করে দিই। বিজ্ঞাপনের ক্যাপশনও আমিই তৈরি করে দিয়েছিলাম।

গুপ্তকে সেগুলি দেখাতে তিনি একদিন কিমারের আপিসে এসে তাঁদের ব্রিটিশ ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ ব্রুমের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তবে, একইসঙ্গে আমাকে সাবধান করে দেন, “আপনাকে যদি নেওয়া হয়ও, তো যে মাইনে দেবে, সেটা কিন্তু খুবই কম।”

মিঃ ব্রুম বললেন, আমার মাস-মাইনে হবে পঁয়ষট্টি টাকা, তার সঙ্গে পনরো টাকা মাগ্‌গি ভাতা পাব। “তবে নিজেকে যদি যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন তো টাকার জন্যে কোথাও কিছু আটকে থাকবে না।”

শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার চার মাস বাদে ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে আমি কিমারের কাজে যোগ দিই।

অন্নদা মুন্সি তখন কিমারের আর্ট ডিরেক্টর। সাগ্রহে আমি তাঁর শিক্ষানবিশি করতে থাকি। তার কারণ, তিন-তিনটে বছর শান্তিনিকেতনে ছিলাম বটে, কিন্তু বিজ্ঞাপনের লেআউট করবার যে শিক্ষা, শান্তিনিকেতন সেটা আমাকে শেখায়নি। ক্যাপশান, কপি, ইলাসট্রেশন, লোগো—এ-সব একেবারেই অন্য রকমের শিক্ষার ব্যাপার। পেইন্টিংয়ের কম্পোজিশনের যে রীতি, এ-ক্ষেত্রেও যে সেটাই অনুসৃত হবে, তার কোনও মানে নেই।

মুন্সি ছিলেন পানাসক্ত মানুষ। সকালে যখন আসতেন, তখন জিন অ্যান্ড লাইমের গন্ধ পাওয়া যেত। কিন্তু কাজে ছিলেন দারুণ দক্ষ। বস্তুত এই কারণেই ব্রুম তাঁর দোষের দিকটা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। যে ডি. কে. গুপ্তর মাধ্যমে আমি চাকরি পেয়েছি, ব্রুম তাঁকেও খুব পছন্দ করতেন। আর-সকলের দেখাদেখি আমিও তাঁকে ডি. কে. বলতে শুরু করি। নজর-কাড়া ক্যাপশন উদ্ভাবনের ব্যাপারটা ডি. কে.র বেশ ভালই আসত। বিজ্ঞাপনের জগতে সবাই বেশ মান্যি করতেন তাঁকে।

ডি. কে.র আসল আগ্রহ যে পুস্তক-প্রকাশনায়, কিছুদিনের মধ্যেই সেটা আমি বুঝতে পারি। এর অল্পকাল বাদে, কিমারের অন্যতম কর্তাব্যক্তির দায়িত্বভার হাতে থাকা অবস্থাতেই, তিনি সিগনেট প্রেস নাম দিয়ে এক প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানের পত্তন করলেন। আমাকে দিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইনের ভার, আর ছাপা বাঁধাই ইত্যাদি তত্ত্বাবধানের ভার নিলেন নিজেই। প্রথমেই যে কয়েকখানা বই তিনি প্রকাশ করলেন, প্রকাশনা-জগতে তাতে একেবারে হইচই পড়ে যায়। আমার অবদানও নগণ্য ছিল না। বিশুদ্ধ বঙ্গীয় মোটিফের অলঙ্কৃত প্রচ্ছদ, হাতের লেখার ছাঁদে গ্রন্থ-নাম, সেইসঙ্গে কখনও-কখনও তুলি কিংবা কলমে আঁকা ছবি,—বইয়ে এ-কাজ আমিই প্রথম করি।

এর থেকেই উদ্ভব হল এক অদ্ভূত পরিস্থিতির। একইসঙ্গে আমি বিজ্ঞাপনের লে-আউট আর বুক-ডিজাইন এই দু’দুটো কাজ করছি। আর কোথায় বসে তা করছি? না মিঃ ব্রুমের চোখের সামনে কিমারের স্টুডিয়োর ডেস্কে বসে। মিঃ ব্রুম এ-ব্যাপারে যে উদার সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন, ভারতীয় কর্মচারীদের সম্পর্কে কোনও ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তির আচরণে সেটা প্রত্যাশিত ছিল না।

গোড়ার দিকে কবিতার বই প্রকাশই ছিল সিগনেট প্রেসের বৈশিষ্ট্য। এ যখনকার কথা বলছি, কবিতার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ তখন বড়-একটা হত না, কবিরা কোনও রয়্যালটিও পেতেন না তাঁদের বইয়ের জন্য। এই যে অবস্থা, ডি. কে. এটাকেই পালটে দেন। কবিতার বই এতই পরিপাটি করে ছাপতেন তিনি আর তার প্রচারেও এত যত্ন নিতেন যে, সে-সব বই বেস্ট-সেলার হয়ে উঠতে লাগল।

এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ডি. কে. অবশ্য গদ্যগ্রন্থ প্রকাশ করতেও শুরু করেন। তখন যে-সব উপন্যাস কিংবা গল্প-সংগ্রহ তিনি প্রকাশ করেন, তার ডিজাইনও আমারই করা। ১৯৪৪ সালেই ডি. কে. স্থির করেছিলেন যে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালি’ বইখানার একটি কিশোরপাঠ্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তিনি বার করবেন। মূল বইখানা আমার পড়া ছিল না। আসলে, সংগীত আর চলচ্চিত্রই তখন আমার তাবৎ আগ্রহ অধিকার করে ছিল। বই যা-কিছু পড়তাম, মূলত তা ওই দুটি বিষয়ে। সেইসঙ্গে অবশ্য হালকা কিছু ইংরেজি গল্প-উপন্যাসও তখন পড়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, রবীন্দ্রনাথেরও অনেক লেখাই তখনও পর্যন্ত আমার পড়া হয়নি। এই ত্রুটির কথাটা জানতে পেরে ডি. কে. তো প্রথমে আমাকে খুব একচোট বকাঝকা করলেন, তারপর মূল ‘পথের পাঁচালি’ বইয়ের একটা কপি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন যে, বইখানা যেন আমি পড়ে ফেলি। “কারণ, এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ছবি তোমাকেই আঁকতে হবে।”

বইখানা পড়ে তো আমি মুগ্ধ। বুঝতে পারি, এ একেবারে সত্যিকারের সাহিত্যকীর্তি। একদিক থেকে গ্রামজীবনের এক বিরাট দর্পণও বটে। যে ব্রাহ্মণ-পরিবারের জীবনকে কেন্দ্র করে এটি লেখা হয়েছে, তার কর্তার বৃত্তি নেহাতই পুরুতগিরি। সংসারে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী, দুটি ছেলেমেয়ে আর এক দূর সম্পর্কের বৃদ্ধা দিদি। দু’ মুঠো অন্নের জোগাড় করতেই এই সংসারটিকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। প্রতিটি চরিত্রই বিস্ময়করভাবে জীবন্ত। শুধু এই সংসারের চরিত্রগুলি নয়, কাহিনীর সূত্রে অন্যান্য যে-সব চরিত্র এসেছে, তারাও প্রত্যেকেই এই বইয়ের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ফুটেছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি। আবার তারই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে হার্দ্য উষ্ণতা, মানবিকতা আর কাব্যগুণ। আর এই সবকিছু মিলেই এটি এক মহান সাহিত্যকৃতির মহিমা পেয়ে যাচ্ছে।

মূল ‘পথের পাঁচালি’ পড়বার পরে আমি তার সংক্ষিপ্ত সংস্করণটিও পড়ে ফেলি। পড়ে বুঝতে পারি যে, সংক্ষেপণের কাজটা অতি সুন্দরভাবে করা হয়েছে। তিনশো পৃষ্ঠার বইকে নামিয়ে আনা হয়েছে একশো পৃষ্ঠায়। অথচ যেগুলি প্রধান চরিত্র তার একটিও বাদ পড়েনি, প্রধান-প্রধান ঘটনাগুলোরও সবই বজায় রয়েছে। মূল বইয়ের তা প্রায় এক তৃতীয়াংশই ব্যয়িত হয়েছে পরিবারটির জীবনযাপনের বর্ণনায়। পরিবারটি তাদের গ্রাম থেকে কাশীতে চলে যাবার পরবর্তী যে কাহিনী, তা বর্ণিত হয়েছে আর-একটি বইয়ে। তার নাম ‘অপরাজিত’। সংক্ষেপিত কাহিনী শেষ হচ্ছে কাশী-যাত্রার সঙ্গে-সঙ্গেই। ডি. কে. নিজেও ছিলেন চলচ্চিত্রের অনুরাগী। কিমারে যোগ দেবার আগে বছর কয়েকের জন্য একটি সিনেমা-পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি একদিন আমাকে বলেন যে, ‘পথের পাঁচালি’র এই যে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, এর ভিত্তিতে চমৎকার একটা ফিল্ম তৈরি হতে পারে। কথাটা আমার মনে ধরেছিল। যা-ই হোক, সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্য অতঃপর আমি ছবি আঁকতে লেগে যাই।

ডি. কে. এর পরে যা করেন, তার জন্য আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ‘আবোল-তাবোল’ আর ‘হ-য-ব-র-ল’ নামে আমার বাবার যে দুটি বই রয়েছে, তা তিনি প্রকাশ করেন। এককালে যা আমাদের প্রতিষ্ঠান ছিল, সেই ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স থেকে এই বই দুটি প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি পরে বিক্রি হয়ে যায়। বর্তমান মালিকরা বই দুটি বিক্রি করতেন ঠিকই, কিন্তু তার বাবদে আমাদের একটি পয়সাও দিতেন না। ডি. কে. এই মর্মে কাগজে বিজ্ঞাপন দেন যে, সিগনেট প্রেস এই বই দুখানি প্রকাশ করতে চলেছে। ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স থেকে এ-ব্যাপারে কোনও বাধা দেওয়া হল না। ফলে সিগনেট প্রেস থেকে যথাসময়ে বই দুখানি বেরিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল যে, দুটিই বেস্ট-সেলার। বাবার বই থেকে ছাব্বিশ বছরের মধ্যে সেই আমি প্রথম রয়্যালটি পাই।

কমার্শিয়াল আর্ট আমার জীবিকা। তারই থেকে আমার উদরান্নের সংস্থান হচ্ছে। অথচ আমার মন পড়ে রয়েছে সংগীতে আর চলচ্চিত্রে। দুটি ব্যাপারেই কিছু সহমর্মী মানুষের সন্ধান আমি পেয়েছিলাম। মোটামুটি সেই সময়েই একদিন ‘সমসাময়িক’ নামে এক ত্রৈমাসিক সাংস্কৃতিক পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ আমার চোখে পড়ে। লেখকের নাম ‘একেলা’। প্রবন্ধটিতে তিনি পাশ্চাত্ত্য ধ্রুপদী সংগীত সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধিৎসার কথা সবিস্তারে লিখেছিলেন। ‘সমসাময়িক’-এর মাত্র দুটি সংখ্যা বেরিয়েছিল, কাগজটি তারপর বন্ধ হয়ে যায়। এটি সম্পাদনা করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। খুবই শিক্ষিত মানুষ তিনি। খোঁজখবর করে জানা গেল যে, ‘একেলা’ তাঁরই ছদ্মনাম। এটা জানবার পরে আমি একদিন তাঁর দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে যাই। বাড়ির ভৃত্য আমাকে বৈঠকখানা-ঘরে নিয়ে যায়। নাকের নীচে বাটারফ্লাই গোঁফ, চৌধুরীমশাই সেখানে বসে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। ঘরের এক কোণে মস্ত-চোঙা-লাগানো একটা গ্রামোফোন। কম্পটন ম্যাকেঞ্জির সম্পাদনায় ‘গ্রামোফোন’ বলে যে পত্রিকা বার হত, আমি তার গ্রাহক। তাতে এই রকমের গ্রামোফোনের বিজ্ঞাপন দেখেছি। তাই দেখামাত্র চিনতে পারলাম এটা ই. এম. জি.র একটা হাতে-তৈরি মডেল। ঘরের এক দিকের দেওয়ালে উইনস্টন চার্চিলের মস্ত একটা ছবি ঝুলছে। অন্য দেওয়ালে ঝুলছে ‘মোনা লিসা’র একটি মেডিচি-প্রিন্ট।

নিজের পরিচয় দিয়ে চৌধুরীমশাইকে জানালাম যে, ছদ্মনামে প্রকাশিত তাঁর লেখাটি আমি পড়েছি। এও বললাম যে, আমারও ওই একই রোগ, আমিও পাশ্চাত্ত্য ধ্রুপদী সংগীতের ভক্ত। শুনে তিনি হেসে বললেন, “যাক, আমি তা হলে একলা নই!”

চৌধুরীমশাইয়ের বাড়িতে সেদিন ঘণ্টাখানেক ছিলাম। বাঁশের পিন লাগিয়ে তিনি তাঁর গ্রামোফোন-যন্ত্রে কিছু রেকর্ড বাজিয়ে শোনালেন। তার মধ্যে হাইডনের কোয়ার্টেটও ছিল। সেটা যখন বাজছে, তখন চৌধুরীমশাইয়ের আট-বছরের পুত্রটি এসে ঘরে ঢুকে বলে, “বাবা, এ তো ওপাস ওআন, নাম্বার ওয়ান! তা-ই না?” বলা বাহুল্য, ছেলেটি ভুল বলেনি।

উঠে আসবার আগে সেদিন জিজ্ঞেস করি যে, রেকর্ড শুনবার জন্যে মাঝে-মধ্যে তাঁর বাড়িতে আসতে পারি কি না। চৌধুরীমশাই বললেন, “যখনই ইচ্ছে হয় সন্ধের দিকে চলে আসবেন।” পরে তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অভ অ্যান আন্‌নোন ইন্ডিয়ান’ পড়ে জানতে পারি যে, সেই সময়ে খুবই কষ্টেসৃষ্টে তাঁকে সংসার চালাতে হচ্ছিল। যেদিন তাঁর বাড়িতে যাই, সেদিন অবশ্য তাক-ভরা দুষ্প্রাপ্য বই, গ্রামোফোনের পাশে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা রেকর্ড আর ছেলেপুলেদের দেখে তাঁর এই কষ্টের দিকটা আন্দাজ করা যায়নি।

সেই সময়ে যে-সব সম-মনস্ক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল, তাঁদেরই আর-একজন হচ্ছেন নর্মান ক্লেয়ার। বয়সে ইনি অবশ্য চৌধুরীমশাইয়ের চেয়ে অনেক ছোট। কলকাতায় মোতায়েন ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের ইনটেলিজেন্সে ইনি কাজ করতেন। এঁর সঙ্গে যোগাযোগ হবার পরে দেখতে পাই যে, আমাদের মানসিকতা মোটামুটি একই রকমের। ফলে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেরি হয়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা দাবা খেলেছি, কিংবা গান শুনেছি। যুদ্ধ শেষ হবার পরে তিনি এ-দেশ থেকে বিদায় নেন।

একইসঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয় আমারই মতো ফিল্ম-পাগল কিছু মানুষের সঙ্গে। শনিবার বিকেলে ফিল্ম দেখা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তারই সূত্রে এঁদের সন্ধান পেয়ে যাই। এঁদের মধ্যে বংশী চন্দ্রগুপ্তের—পরে যিনি আমার ছবির আর্ট ডিরেক্টর হন—নামই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁর সঙ্গে অবশ্য চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে আলাপ হয়নি। সেই সময়ে, মাঝে-মধ্যে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফর্মেশন সার্ভিসের লাইব্রেরিতে যেতাম। এটা যেতাম বিশেষ করে ‘থিয়েটার আর্টস’ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যা পড়বার জন্যে। সেখানেই বংশীর সঙ্গে আলাপ হয়। ঘাড়-অব্দি-নেমে-আসা চুল দেখে বংশীকে প্রথমটায় নাচিয়ে ভেবেছিলাম। পরে শুনলাম, নাচিয়ে নয়, আঁকিয়ে। কাশ্মির থেকে ১৯৪৩ সালে সে কলকাতায় আসে। তারপর ক্যালকাটা গ্রুপের সদস্য হয়ে যায়। পেইন্টার হিসাবে বংশী ছিল শক্তিমান, তবে ছবি এঁকে এখন পয়সা পাওয়া যায়, তখন যেত না। বংশী অবশ্য লড়াই করবার জন্যে তৈরি হয়েই এখানে এসেছিল। আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখন সে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এক-কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকে, তাতে আসবাবপত্র কিছু নেই, দু’ বেলার খাবার পাড়ার একটা রেস্টোরান্ট থেকে খেয়ে আসে। যেমন আমি, তেমন সেও দেখলাম চলচ্চিত্র-শিল্পের মস্ত ভক্ত, অতএব আমাদের সম্পর্কটা গোড়ার থেকেই দিব্যি জমে যায়। এ-দেশে যে-সব ফিল্ম তখন তৈরি হত, তা ছিল আমাদের দুজনেরই ঘোর অপছন্দের ব্যাপার; এবং দুজনেই ভাবতাম এ নিয়ে কিছু একটা করা দরকার।

চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যে তিনটি ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে দুটির গুরুত্ব আন্তর্জাতিক। তৃতীয়টির গুরুত্ব সে-ক্ষেত্রে খানিকটা ব্যক্তিগত ধরনের।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল। গান্ধীজি নিহত হলেন আটচল্লিশের সূচনায়। তার আগের বছর অর্থাৎ সাতচল্লিশেই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়। শান্তিনিকেতনে থাকতে প্রায়ই ভাবতাম যে, দর্শকদের মনে যাতে ছবির ভালমন্দ সম্পর্কে একটা বোধ জন্মায়, তার জন্য কিছু করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই এটা একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রথমে ভেবেছিলাম যে, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখব ক্যালকাটা ফিল্ম ক্লাব। কিন্তু কলকাতায় তখনও যে একটি ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চালু ছিল, তার নামের আদ্যক্ষর যেহেতু সি. এফ. সি., তাই সাব্যস্ত হয় যে, ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি নাম রাখাই ঠিক হবে। বংশী চন্দ্রগুপ্ত অবশ্যই তার একজন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। অন্য কিছু-কিছু মানুষকেও আমি আমাদের দলে টানতে পেরেছিলাম। যেমন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। এঁর জীবনের প্রথম দিকটা কেটেছে বিহারের হাজারিবাগে। সেখানে দু’তিনটি সিনেমা-হল ছিল বটে, কিন্তু তাতে বিদেশি ফিল্ম দেখানো হত না। ফলে চ্যাপলিনের কোনও ছবি দেখার সুযোগ তখনও চিদানন্দর ঘটেনি। এ যখনকার কথা, তখন অবশ্য কলকাতার একটা কলেজে তিনি ইংরেজি পড়াচ্ছেন। তাঁকে আমি আগে থাকতেই চিনতাম। ফিল্ম দেখার উত্তেজনা ও আনন্দের কথা বুঝিয়ে বলতে তাঁর কাছে বেশ সাড়া পাওয়া গেল। তিনি আবার তাঁর উৎসাহের ছোঁয়াটা তাঁর দুই সতীর্থের মনে লাগিয়ে দেন। এঁদের একজনের নাম মনোজ মজুমদার। আমি যখন ‘পথের পাঁচালি’ ছবি করব বলে ঠিক করি, তখন এঁর কাছে খুব সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল।

পঁচিশজন সদস্য নিয়ে আমাদের ফিল্ম সোসাইটির পত্তন হয়। সদস্য-সংখ্যার যে খামতি, উৎসাহে-উদ্দীপনায় সেটা পুষিয়ে গিয়েছিল। সাধারণত আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আমরা ১৬ মিলিমিটারের ফিল্ম দেখতাম। যে-সব ফিল্ম দেখতাম, তার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতাম নিজেদের মধ্যে। যে-সব ছবি সম্পর্কে মনে হত অন্যদেরও এগুলি দেখা দরকার, সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে সেগুলি দেখবার জন্য সদস্যদের মধ্যে তার কিছু টিকিট বেঁটে দেওয়া হত।

মনে আছে যে, আমরা প্রথম দেখিয়েছিলাম আইজেনস্টাইনের ক্ল্যাসিক ছবি ‘ব্যাট্‌লশিপ পোটেমকিন’। এর প্রিন্ট আমরা ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্‌স্টিটিউটের কাছ থেকে জোগাড় করি। কথা ছিল যে, এর বাবদে যা তাঁদের প্রাপ্য, আমাদের তবিলে কিছু টাকাপয়সা জমা পড়লেই তা আমরা মিটিয়ে দেব। সেই পাওনা আমরা কোনও দিনই মেটাতে পারিনি, আর ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটও তার জন্যে আমাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। মোটামুটি এই সময়েই সিনেমা বিষয়ে আমি আমার প্রথম প্রবন্ধ লিখি। লেখার নাম ‘হোয়াট ইজ রং উইথ ইন্ডিয়ান ফিল্মস?’। লেখাটি স্টেট্‌সম্যান পত্রিকায় ছাপা হয়। তাতে আরও নানা কথার মধ্যে আমি বলেছিলাম:

“গড়পড়তা মার্কিন ফিল্ম যে মডেল হিসাবে খারাপ, সেটা বোঝা দরকার। কথাটা এইজন্য বলছি যে, ওতে যে জীবনবিন্যাস দেখানো হয়, আমাদের জীবনবিন্যাসের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। তা ছাড়া, হলিউডের ছবির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার কারিগরি নৈপুণ্যে, আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় যা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। সুতরাং ওই চাকচিক্য নয়, ভারতীয় সিনেমার আজ যা চাই, তা হল আরও কল্পনাশক্তি, আরও সততা, এবং এই মাধ্যমের যা যা সীমাবদ্ধতা তার যথার্থ উপলব্ধি।

“ছবি বানাবার জন্য যে-সব যন্ত্রপাতি দরকার হয়, তা যে আমাদের নেই, তা নয়, আছে। কথাটা শুনে আমাদের যন্ত্রশিল্পীরা হয়তো আপত্তি করবেন, তবু বলি, যার জন্যে বিশেষ ধরনের কারিগরি সাহায্য চাই, সেই ক্রেন-শট, প্রসেস শট ইত্যাদির উপযোগিতা নিশ্চয় আছে, তবে ওগুলো যে অপরিহার্য, তা কিছুতেই বলা চলে না। বস্তুত, যেটুকু যা যন্ত্রপাতি আছে আমাদের, সেগুলোকে বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার করা চাই, নানা ক্ষেত্রে তা যে করা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্তও আছে বই কী। সর্বোপরি আমাদের সিনেমার যা চাই, তা হল একটা নিজস্ব শৈলী, একটা বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গি, একটা আপন রূপ—যাতে ছবি দেখামাত্র একেবারে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, এটা ভারতীয় সিনেমাই বটে।”

*

আমার জীবনের সব থেকে নাটকীয় ঘটনাগুলির মধ্যে একটি হল জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তাঁর ‘দ্য রিভার’ ছবির লোকেশন বাছাই করতে আর সেই ছবিতে অভিনয় করবার জন্য কাকে-কাকে নেওয়া হবে সেটা ঠিক করতে ১৯৪৯ সনে তিনি কলকাতায় আসেন।

ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছিল বলি। একদিন সকালবেলায় স্টেট্‌সম্যান পত্রিকার ব্যক্তিগত কলামের উপরে চোখ বুলোতে-বুলোতে অল্প কয়েক লাইনের একটি বিজ্ঞপ্তিতে আমার নজর আটকে যায়। তাতে বলা হয়েছিল যে, জাঁ রেনোয়া গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে রয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি যে একটি ফিল্ম তুলছেন, তার শুটিং হবে এ-দেশে, আর সেই ছবিতে অভিনয় করবার জন্য এখানেই তিনি কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন করবেন।

আমার আপিস থেকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। কালক্ষেপ না করে আমি হোটেলে চলে যাই; রেনোয়ার সঙ্গে দেখা করে বলি যে, আমি তাঁর কাজের খুবই অনুরাগী। আসলে তাঁর কাজের মধ্যে তখনও পর্যন্ত একমাত্র হলিউডের ফিল্মগুলিই আমার দেখা হয়েছে, তার মধ্যে আবার ‘দ্য সাদার্নার’ ছবিটি আমার বিশেষ প্রিয়। এই ছবিটি দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, ফিল্মের চরিত্রগুলির মধ্যে কেউ পুরোপুরি ভাল হবে আর কেউ পুরোপুরি মন্দ, এমনটা হবার কোনও দরকারই করে না, ভালয়-মন্দে মেশানো মানুষও তারা হতে পারে। বাইরের দৃশ্য দেখাতে হলে স্টুডিয়োর মধ্যে তার নকল সেট না বানিয়ে দৃশ্যগুলির শুটিং যে বাইরে গিয়ে লোকেশন বেছে সেখানে করাই শ্রেয়, সেটাও ওই ছবি দেখে বুঝি।

রেনোয়া বেশ হৃদ্যতার সঙ্গেই আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। একজন ভারতীয় যে তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে এত-সব খবর রাখে, তাতে বিস্ময় প্রকাশও করলেন তিনি। ব্রাজিলিয়ান স্ত্রী দিদো, দীর্ঘদিনের ফরাসি আর্ট-ডিরেক্টর ইউজেন লুরিয়ে আর ক্যামেরাম্যান ক্লাইড দে’ভিনাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। শুনলাম যে, আপাতত তাঁরা মাসখানেক এখানে কাটিয়ে তারপর ফিরে যাবেন। শুটিংয়ের জন্যে ফিরে আসবেন পরের বছর। ব্রিটিশ ফিল্ম ম্যাগাজিন ‘সিকোয়েন্স’-এ আমি রেনোয়ার সঙ্গে আমার এই সাক্ষাৎকারের বিষয়ে লিখেছিলাম। তাতে বলি: “রেনোয়া মানুষটি এতই বিনয়ী আর নম্র যে, আমার মনে হচ্ছিল, কথাবার্তায় যদি না অতিমাত্রায় সতর্ক থাকি তো সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে-করতে এক সময়ে হয়তো আমিই ওঁকে উপদেশ-পরামর্শ দিতে শুরু করব।”

কলকাতার কাছাকাছি জায়গাগুলোতে রেনোয়া তাঁর লোকেশন বাছাই করতে যেতেন। সেই সময়ে বার কয়েক তাঁর সঙ্গী হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। চাকরি করতাম বলে আমার পক্ষে অবশ্য একমাত্র সপ্তাহান্তিক দিনগুলোতেই তাঁর সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হত। দীর্ঘ পথের সারাটা সময়ই নানারকম প্রশ্ন করতাম তাঁকে। প্রশ্ন তাঁর ফরাসি ও মার্কিন, দ্বিবিধ ছবি নিয়েই। তিনি ধীরস্থিরভাবে প্রতিটি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিতেন। নিও-রিয়ালিস্টদের আগেই যে তিনি সরাসরি লোকেশনে গিয়ে শুটিং করতে শুরু করেন, এবং ‘দ্য রুলস্ অভ্ দ্য গেম’-এ ডিপ ফোকাস ব্যবহার করেন অরসন ওয়েলসের ‘সিটিজেন কেন’-এর অন্তত চার বছর আগেই, এটা আমি তাঁরই কাছে জানতে পারি। মাঠ-ময়দান, মানুষজন, পাকা বাড়ি, কুঁড়েঘর, কচুরিপানায় ভর্তি ডোবার ধারে কলাগাছের ঝাড়—এ-সব দৃশ্য এত খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তিনি দেখতেন যে আমার তাক লেগে যেত। কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ-হঠাৎ বলে উঠতেন, ‘আঃ’ ‘উঃ’! বুঝতাম যে, মস্ত এক চিত্রকরের চোখ দিয়ে দেখছেন বলেই বিস্ময়সূচক ওই ধ্বনিগুলি তাঁর গলা থেকে মাঝে-মাঝে বেরিয়ে আসছে। তাঁর এই প্রতিক্রিয়া দেখে আমারও চোখ খুলে যাচ্ছিল। ছবি তোলবার ভাবনাটা যে তিনিই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেন, তাও স্বীকার করব। আমি চলচ্চিত্রকার হতে চাই কি না, বস্তুত এই প্রশ্নটা তিনি আমাকে করেছিলেন। উত্তরে আমি বলি, “হ্যাঁ।” তাতে তিনি বললেন, “কোনও বিষয় পেয়েছ?” উত্তরে ‘পথের পাঁচালি’র কাহিনীটা খুব সংক্ষেপে আমি তাঁকে জানাই। ওই কাহিনী নিয়ে একটা ছবি তৈরি করার ইচ্ছেটা তো ইতিমধ্যে আমাকে পেয়ে বসেছিল। রেনোয়ার সঙ্গে গাড়িতে করে ওই যে গ্রামাঞ্চলের পথ ধরে যাচ্ছিলাম আমি, তখন ওই ছবির ভাবনাই অধিকার করে রেখেছিল আমার চিত্তকে। বড় উপন্যাসটি নয়, ভাবছিলাম তার সংক্ষিপ্ত সংস্করণের কথা, কেননা চিত্রনাট্যের সঙ্গে এটিরই ছিল সাযুজ্য। রেনোয়া আমাকে উৎসাহ দেন। তাঁকে আমি কয়েকটি বাংলা ফিল্ম দেখাই। তাতে তিনি বলেন, যা আমাদের বিষয়, তাতে মার্কিন চলচ্চিত্রের নকলনবিশি করা আমাদের উচিত হবে না। “হলিউডের যে জগৎ, তা থেকে তোমরা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়াতে পারো।”

হলিউডে ফিরে যাবার আগে রেনোয়া আমাকে তাঁর একটি ফোটোগ্রাফ দেন। পিছনে লেখা: “মানিক রায়কে। তার বিয়ের অপেক্ষায় থাকব।

জাঁ রেনোয়া।”

আমার বড়মামার ছোট মেয়েকে আমি বিয়ে করি। ইনি আমাদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন। ফিল্মে আর সংগীতে আমাদের রুচি ছিল একই জাতের। এই ধরনের বিয়েতে প্রচলিত প্রথার সায় নেই বটে, তবে আমার মায়ের তরফে এতে কোনও আপত্তি ওঠেনি। আমার রোজগার ইতিমধ্যে বেড়ে গিয়েছিল, ফলে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে উঠে যাওয়া আমাদের পক্ষে তখন আর শক্ত ছিল না। বস্তুত, বিয়ের আগেই মা’কে নিয়ে আমি আলাদা ফ্ল্যাটে উঠে যাই। তবে বিবাহিত একজন লোকের থাকবার পক্ষে সেটা বড্ড ছোট। ফলে কিছুদিন বাদেই ফের আমরা ফ্ল্যাট পালটাই। এই নতুন ফ্ল্যাটটি শহরের আরও দক্ষিণ দিকে। সেখান থেকে হেঁটে আমার মামাবাড়িতে যাওয়া যায়।

ইতিমধ্যে আমার আর-একটা কাজ জুটে গিয়েছিল। স্রেফ মজা লাগত বলে এই সময়ে আমি চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চিত্রনির্মাণকেই যে আমার বৃত্তি হিসাবে বেছে নেব এবং নিষ্কৃতি পাব সেইসব বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের নির্বুদ্ধিতা থেকে, আমার চমৎকার কয়েকটা বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেন বাতিল করে দিয়ে যাঁরা আমার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিলেন—তখনও অবশ্য তা আমি জানতাম না। জন গ্যাসনার ও ডাডলি নিকল্‌স-এর লেখা ‘টুয়েন্টি বেস্ট ফিল্ম প্লেজ’-এর নতুন একটা শক্ত মলাটের কপি ইতিমধ্যে আমি জোগাড় করে ফেলেছিলাম। বইখানা আমি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়ে ফেলি। যে-সব ফিল্ম আমার চেনা, চিত্রনাট্য পড়ার ফলে সেগুলো যেন আমার চোখের সামনে একেবারে জ্যান্ত হয়ে ধরা দেয়। চিত্রনাট্যগুলির পেশাদারি নৈপুণ্য একেবারে প্রশ্নাতীত। পড়ে আমার খুবই উপকার হয়েছিল। এমনকি, একটা চলচ্চিত্র সফল হওয়ার মূলে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কৃতিত্ব যে চিত্রনাট্যকারেরই, এই স্বীকৃতিটা যে কেন তাঁরা পান না, এটা ভেবেই অবাক লাগছিল আমার। ‘মিঃ স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। ওর কৃতিত্ব যতটা ফ্র্যাংক কাপরার, ততটাই চিত্রনাট্যকার সিডনি বুকম্যানের। যা-ই হোক, এর পরে আমি একটার-পর-একটা চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি। সেগুলির কোনওটা নিয়েই যে ফিল্ম করব, এমন কোনও ভাবনা অবশ্য তখনও আমার মাথায় ঢোকেনি।

অমুক গল্প কি তমুক উপন্যাস নিয়ে ফিল্ম হচ্ছে, সাধারণত এই রকমের কোনও ঘোষণা কেউ করলেই হল, অমনি আমি লিখে ফেলতাম যে, আমার বিবেচনায় ফিল্মটা কীভাবে তৈরি করা উচিত। তারপর ফিল্মটি যখন মুক্তি পেত, তখন পর্দায় যা ফুটল, তার সঙ্গে মেলাতাম আমার লেখাগুলিকে। শুধু তা-ই নয়, তৈরি করে ফেলতাম দ্বিতীয় একটি চিত্রনাট্য। মনে হত, ছবিটি যেভাবে করা হয়েছে তার বদলে আমার মতন করে করলে অনেক ভাল হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেছি, আমার ধারণাই ঠিক।

অন্য একটা ছবির ব্যাপারে এই সময়ে আমি জড়িয়ে পড়ি। কথা ছিল যে, সে-ছবির চিত্রনাট্য আমি লিখব, আর আমার বন্ধু হরিসাধন দাশগুপ্ত হবেন পরিচালক। হরিসাধন সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন। কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চিত্ৰস্বত্ব তিনি কিনে রেখেছিলেন। একজন প্রযোজকও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তিনি। ভদ্রলোকের পদবি মজুমদার। ব্যবসায়ী মানুষ। কথা হল আমার লেখা চিত্রনাট্যটি আমি তাঁকে পড়ে শোনাব। তা সেটা যথারীতি শোনানোও হল। মজুমদার মশাইয়ের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল চিত্রনাট্য তাঁর পছন্দ হয়েছে। সেই অনুযায়ী চুক্তিপত্রও সই হয়ে গেল। তাতে বলা হল যে, চিত্রনাট্য রচনা বাবদে আমি আর পরিচালনা বাবদে হরিসাধন দু’ হাজার টাকা করে পাব। ভূমিকা বেঁটে দেবার কাজও অতঃপর সমাধা হয়ে যায়। তারপর সদ্য যখন শুটিং-পর্ব শুরু হতে চলেছে, সেই সময়ে মজুমদার হঠাৎ বলে বসলেন যে, চিত্রনাট্যের ব্যাপারে তিনি তাঁর এক আস্থাভাজন বন্ধুর মতামতটা একবার জেনে নিতে চান। বন্ধুটি ডাক্তার, সেকালের এক নামজাদা যৌনব্যাধি-বিশেষজ্ঞ।

ফলে সেই যৌনব্যাধি-বিশেষজ্ঞের সামনে নতুন করে আবার পড়ে শোনাতে হল আমার চিত্রনাট্য। ডাক্তারবাবু বললেন, কয়েকটা জায়গায় একটু পালটানো দরকার। মজুমদার তাতে সায় দিলেন। আমি বললাম, ভেবে দেখি কী করা যায়। ফিল্ম তৈরির কাজটা যাতে শুরু করা যায়, তার জন্য হরিসাধন চাইছিলেন যে, অদল-বদলের কাজটা যেন আমি তাড়াতাড়ি করে ফেলি। এদিকে আমার যৌবন-বয়সের আত্মমর্যাদায় ঘা লাগছিল বলে আমি মোটেই অদলবদল করতে চাইছিলাম না। পরিণামে গোটা ব্যাপারটাই ভেস্তে যায়। এই নিয়ে হরিসাধনের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটে, বছর খানেক তিনি আমার সঙ্গে তখন বাক্যালাপ পর্যন্ত করেননি। আজ বুঝতে পারি যে, ছবিটা যে তখন তৈরি হয়নি, সেটা ভালই হয়েছিল। পঁয়ত্রিশ বছর বাদে যখন ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটি তুলি, যৌবনে লেখা সেই চিত্রনাট্যটি তখন একবার দেখে নিয়েছিলাম। দেখে মনে হল, সেটা একেবারেই হলিউডগন্ধী কাঁচা হাতের কাজ হয়েছিল। ওই চিত্রনাট্য অনুযায়ী ছবি তৈরি হলে আমাদের দুজনেরই সুনাম নষ্ট হত, এবং চিত্রনির্মাণকেই আমার বৃত্তি করব বলে যা-ই তখন ভেবে থাকি না কেন, তাতে একেবারে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে যেত।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি গল্প এই সময়ে পড়েছিলাম। এক জমিদারি এস্টেটের ইংরেজ ম্যানেজার যখন প্রজাদের উপরে অত্যাচার চালাচ্ছে, তখন এক তেজি যুবক কীভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তা-ই নিয়ে এই গল্প। আমার সেই সময়কার বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী একে একটা বিরাট বিষয় বলে মনে হয়েছিল। বাস্, ঝোঁকের মাথায় তৎক্ষণাৎ আমি একজন প্রযোজকের খোঁজ করতে লেগে যাই। এটাও ঠিক করে ফেলি যে, এ-ছবি আমি নিজেই পরিচালনা করব। জনৈক শুভার্থীর চেষ্টায় প্রযোজকও একজন পাওয়া গেল। প্রযোজক ভদ্রলোক এক বাঙালি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘Büher & Co.’। (হ্যাঁ, ইউ-এর মাথায় ওই উমলাউট অর্থাৎ ফুট্‌কি দুটি ছিল বটে।) মালিকের পদবি অবশ্য Büher নয়, বাঙালিদের অমন পদবি হয়ও না, তিনি বসু-বংশের সন্তান।

চিত্রনাট্য পড়ে শোনাবার জন্য যথারীতি তাঁর বাড়িতে একদিন আমার ডাক পড়ল। গিয়ে দেখি, মস্ত বড় এক কনফারেন্স টেবিলের মাথার দিকে এক বেঁটে-মোটা ভদ্রলোক বসে আছেন। চিত্রনাট্য পড়ে শোনাবার জন্য যাতে খুব বেশি গলা চড়াতে না হয়, তার জন্য আমি তাঁর কাছাকাছি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ি। আমার ডাইনে যিনি বসে ছিলেন, তিনি সেকালের এক নামজাদা পেশাদার চিত্রনাট্য-রচয়িতা। ফিট-দুরস্ত মানুষ, পরনে পাটভাঙা ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, সামনে টেবিলের উপরে প্লেয়ার্স নাম্বার থ্রি সিগারেটের সাদা টিন। বাঁ দিকে বসে আছেন বাংলা ফিল্মের এক বিখ্যাত পরিচালক। দুজনেরই চেহারা আমার চেনা। বোসমশাই তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার কোনও দরকার বোধ করলেন না। স্রেফ আমাকে চিত্রনাট্যটি পড়ে শোনাতে বললেন। পুরো চিত্রনাট্য নয়, কয়েক শিট কাগজে তার একটা সংক্ষিপ্ত খসড়া লিখে সেটাই পিন দিয়ে গেঁথে আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে যে-সব ফাঁক থেকে যায়, এটা জানতাম যে, স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে সেগুলো ভরাট করে নিতে পারব।

যা-ই হোক, আমি পড়তে শুরু করার আগেই ডিরেক্টর ভদ্রলোক আমার কাঁধের উপরে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার চিত্রনাট্যে ক’টা ক্লাইম্যাক্স, সেটা গুনে দেখেছেন তো?” বললাম, না, আমি গুনে দেখিনি, তবে আমি তো পড়ে শোনাচ্ছি, সেই সময়ে যদি ইচ্ছে হয় তো তিনি গুনে দেখতে পারেন। পরিচালক আমার কথা শুনে খুশি হয়েছেন বলে মনে হল না। ভদ্রলোক দেখলাম সংখ্যায় বিশ্বাসী; সম্ভবত মনে করেন যে, ক্লাইম্যাক্সগুলোকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলে তবেই চিত্রনাট্য সফল হয়, নইলে হয় না।

আমি তো চিত্রনাট্য পড়তে শুরু করে দিলাম। ডিরেক্টর ভদ্রলোক আমার কাঁধের উপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছিলেন যে, চিত্রনাট্যের কাগজে আমি কী কী নোট করে রেখেছি। মাঝে-মাঝে আমাকে থামিয়েও দিচ্ছিলেন তিনি। একবার বললেন, “আচ্ছা, এই যে আপনার লেখার মধ্যে মাঝে-মাঝে ‘ফেড আউট’ ‘ডিজল্‌ভ’ এই সব কথা দেখছি, এগুলোর মানে আপনি জানেন তো?” কথাটার উত্তর না-দিয়ে বিরক্তভাবে একটুক্ষণ থেমে থেকে, আবার আমি পড়তে শুরু করি।

ফিল্মের শেষের দিকে এই রকমের একটা দৃশ্য রয়েছে যে, কৌশলের খেলায় ম্যানেজারটির হার হয়েছে, এখন সে ভয়ে জড়সড়, আর এই অবস্থায় তার সামনে দাঁড়িয়ে সেই তেজি যুবকটি দু’-চার কথায় একটা বক্তৃতা ঝেড়ে দেয়। উত্তরে, গোড়ার দিকে যে খুব লম্ফঝম্প করছিল, হেরে গিয়ে সেই ইংরেজ ম্যানেজারটির মুখে আর কোনও কথা জোগায় না।

পড়া শেষ হবার পরে বোসমশাইয়ের প্রথম মন্তব্য: “কিন্তু ছেলেটাকে দিয়ে ওইখেনে একবার ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বলিয়ে নেবেন তো।” ১৯৪২ সালের অগস্ট আন্দোলনের জন্য গান্ধীজি এই স্লোগানটি উদ্‌ভাবন করেছিলেন। তাতে ইংরেজদের বলা হয়েছিল, এক্ষুনি যদি না তারা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেয় তো কংগ্রেস এক ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হবে।

“হ্যাঁ, কুইট ইন্ডিয়া,” বোসমশাই আবার বললেন, “ছেলেটাকে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বলতেই হবে।” তা যদি সে না-ই বলে তো কী হবে, এই প্রশ্ন করতে গিয়েও সেদিন সামলে যাই। উঠে পড়বার আগে শুধু বলে আসি যে, ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব। মিঃ Büher বোসের সঙ্গে আর এর পরে আমার দেখা হয়নি।

পরের বছরই রেনোয়া সদলবলে শুটিং করতে আসেন। আমার বন্ধু বংশী ইতিমধ্যে গোটা দুই বাংলা ছবিতে আর্ট ডিরেক্টরের কাজ করেছিল। এবারে সে ‘দ্য রিভার’ ছবির আর্ট ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়—প্রোডাকশন ডিজাইনার লুরিয়ের অধীনে তাকে কাজ করতে হবে। হরিসাধন কাজ পেলেন রেনোয়ার একজন সহকারী হিসেবে। ছবির চিত্রনাট্যের একটি কপি আমাকে পড়তে দেওয়া হয়েছিল। উপন্যাসের লেখিকা রুমার গডেনের সহযোগিতায় হলিউডে বসে রেনোয়া এই চিত্রনাট্য তৈরি করেন।

রেনোয়া তাঁর শুটিংয়ের কাজ কীভাবে করেন, নিয়মিত গিয়ে সেটা দেখবার জন্য আমার আগ্রহের অন্ত ছিল না। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাকে যেহেতু (বিলিতি এক আমদানি-কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে) আমাদের কোম্পানির আর্ট ডিরেক্টর করে দেওয়া হয়েছিল, তাই সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে মাত্র বার দুয়েক গিয়ে শুটিং দেখি। বংশী অবশ্য শুটিং শেষ হবার পরে রোজই সন্ধ্যার দিকে একবার এসে রেনোয়ার কাজকর্মের পদ্ধতির কথা বিস্তারিতভাবে আমাকে বলে যেত। আমি সে-সব সাগ্রহে শুনতাম।

তবে এইভাবে আর কতদিন চলে। ব্রুম ইতিমধ্যে আভাস দিয়ে রেখেছিলেন যে, তিনি আমাকে কিছু দিনের জন্য লন্ডনে পাঠাতে চান। সেখানে কিমারের হেড আপিসে আমাকে কাজ করতে হবে। এবারে তিনি জানালেন যে, প্ল্যান রেডি। ১৯৫০ সালের এপ্রিলে জাহাজে সস্ত্রীক আমি লন্ডনে যাব। সেখানে থাকতে হবে পাঁচ মাস। তারপর ইউরোপের যে-যে জায়গা আমরা দেখতে চাই, মাস খানেকের জন্য সেখানে থাকব। এমন সুযোগ ছাড়া যায় না, তা সে রেনোয়ার কাজ দেখার সুযোগ ঘটুক আর না-ই ঘটুক। ইউরোপের যেগুলো কালজয়ী চলচ্চিত্র, তা দেখবার সুযোগ তো ঘটে না, এবারে সেগুলো দেখতে পাব। সুযোগ ঘটবে ‘সিকোয়েন্স’ পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলবার। গ্যাভিন ল্যাম্বার্ট, লিন্ডসে অ্যান্ডারসন আর পিটার এরিকসন, অল্পবয়সী এই তিনটি উৎসাহী মানুষ চলচ্চিত্র সম্পর্কে এই নতুন পত্রিকাটি বার করেছেন। তা ছাড়া, এতদিন গ্রামোফোন-রেকর্ড শুনেই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে, এবারে হল্-এ বসে কনসার্ট শোনা যাবে। তা ছাড়া দেখা যাবে ইংরেজদের সেরা কিছু নাট্যাভিনয়। এও তো এক মস্ত সুযোগ। একটু আগে যে তিন সম্পাদকের নাম করেছি, তাঁদের বিষয়ে একটা লেখা ইতিমধ্যে পড়েছিলাম। তা ছাড়া ‘ভোগ’ পত্রিকায় ‘পিপ্‌ল আর টকিং অ্যাবাউট’ বিভাগে এঁদের ছবিও দেখতে পাই। আমি আমার চাঁদা পাঠিয়ে দিই। প্রথম যে-সংখ্যার পত্রিকাটি এল, সেটি দেখে মনে হল, হ্যাঁ, আমার মনের মতন কাগজ বটে। পরে আমি প্রধান সম্পাদক ল্যাম্বার্টকে একটা চিঠি লিখি। তাতে জিজ্ঞেস করি, কলকাতায় এসে রেনোয়া যে কাজ করছেন, সেই বিষয়ে আমি যদি একটা লেখা পাঠাই, তাঁরা ছাপবেন কি না। চিঠির উত্তর আসে লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের কাছ থেকে। জানা গেল যে, ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর ভাই থাকেন ভারতবর্ষে। লিন্ডসের নিজেরও জন্ম বাঙ্গালোরে। তেইশ বছর বয়সে তিনি এ-দেশ থেকে বিদায় নেন। যা-ই হোক, ‘সিকোয়েন্স’ আমার লেখাটি ছেপেছিল, আর আমিও উদ্‌গ্রীব ছিলাম তার তিন সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে।

আমার ২৯তম জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে, মালপত্র নিয়ে সস্ত্রীক আমি রেলগাড়িতে উঠে কলম্বোর পথে রওনা হই। ঠিক ছিল যে, সেখান থেকে ‘পি অ্যান্ড ও’ কোম্পানির জাহাজ ‘মালোজা’য় উঠে আমরা লন্ডন যাত্রা করব।

লন্ডনে পৌঁছতে আমাদের লেগেছিল মোট ষোলো দিন। এই ষোলোটা দিন যে কী আনন্দে কেটেছিল, তা যাঁরা শুধুই প্লেনে যাতায়াত করেন, বর্ণনা দিয়ে সেটা তাঁদের বোঝানো সম্ভব নয়। ডেকের কর্মী আর ওয়েটাররা সবাই ইংরেজ। তারা যে আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছে, এটাই ছিল প্রথম চমক। জাহাজের মধ্যে ‘হাউসি, হাউসি’, ‘ডেক কয়েট’, ‘টেবল টেনিস’, ‘ফ্যান্সি ড্রেস বল’ ইত্যাদি সব খেলা আর আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা তো ছিলই, লাইনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম নেওয়াটাও কিছু কম মজার ব্যাপার ছিল না। তা ছাড়া দেখানো হত হলিউডের নতুন-নতুন ছবি। ডেকের উপরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেও চমৎকার লাগত। জাহাজযাত্রায় হাতে যে প্রচুর সময় থাকবে, সেটা জানতাম বলে সঙ্গে একটা নোটবই নিয়েছিলাম। ‘পথের পাঁচালি’ নিয়ে ছবি তুলবার ব্যাপারে আমার চিন্তাভাবনাগুলো সেখানে লিখে রাখতাম।

এ নিয়ে আমার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আগে আলোচনা করেছি। বংশী তো খুবই উত্তেজিত। সে কাশ্মিরি, বাংলা জানে না, তাই বইখানা তার পড়া হয়নি; তবে বিশেষ কয়েকটা দৃশ্যের বর্ণনা আমি তাকে দিয়েছিলাম। এই যেমন প্রথম রেলগাড়ি দেখা, বুড়ি পিসির মৃত্যু, চুরি-করা হার, বৃষ্টি, ঝড়, দুর্গার মৃত্যু। শুনে-শুনে বংশীর বিশ্বাস জন্মে যায় যে, এটা দারুণ ছবি হবে। তার কথা: আপিস থেকে ছুটি নিয়ে ছবিটা শেষ করে তারপর আবার আপিসে জয়েন করলেই তো হয়। কাজটা কীভাবে হবে, সেটা আমি মোটামুটি ঠিকই করে রেখেছিলাম। বিভিন্ন চরিত্রে যারা অভিনয় করবে, তাদের অধিকাংশ আগে কখনও কোনও ছবিতে নামেনি, মেক-আপ বলে কিছু থাকবে না, শুটিং হবে লোকেশনে। এ-সব কথা বংশীকে জানিয়ে তার মতামত চাইতে সে যা বলেছিল, তাতে আমি অবাক। “ওই করে ছবি করা যায় নাকি? অ্যামেচার অভিনেতারা তাদের সংলাপ বলতে গিয়ে গণ্ডগোল করবে, লোকেশনে শুটিং করতে গেলে দরকার-মতো লাইট পাওয়া যাবে না, বৃষ্টি-বাদলার দিনে আলো এত কম পাওয়া যাবে যে, তার মধ্যে শুটিং করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।” শুনে বুঝে গেলাম, আমাদের ছবিগুলো যে এত কৃত্রিম ঠেকে, এই ধরনের বিশ্বাসই তার কারণ।

একটা বুধবারে আমরা পোর্টসমাউথে পৌঁছই। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে হ্যাম্পস্টেডে এসে নামি। এর আগে নর্মান ক্লেয়ারের কথা বলেছি। সে-ই ব্যবস্থা করে রেখেছিল যে, গেস্ট হিসাবে আমরা তার মায়ের বাড়িতে থাকব। বাড়িটা উইলোবি রোডে। তিনতলা বাড়ি। তার তৃতীয় তলাটা আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক পা হাঁটলেই হ্যাম্পস্টেড হিথ। বাড়িতে আমরা ছাড়া এক বৃদ্ধ দম্পতি থাকতেন। তা ছাড়া থাকত একটি মেয়ে। সে কোন এক আপিসে কাজ করত। নর্মানের বিধবা মা’ও ওই একই বাড়িতে থাকতেন। তাঁর একটি পোষা লাব্রাডর কুকুর ছিল। নাম ব্রিকা। নর্মান তার স্ত্রী জুনকে নিয়ে তখন রিজেন্টস পার্কের কাছে একটা ফ্ল্যাটে থাকত।

কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের জীবন একটা নির্দিষ্ট খাতের মধ্যে এসে যায়। কিমারের হেড আপিসের আয়তন যে তাদের কলকাতার আপিসের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র, এটা দেখে অবশ্য অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই অবাক-ভাবটা কেটে যেতে বেশ সময়ও লেগেছিল। স্টুডিয়োটা দেখলাম খুবই ছোট, জনাকয় ভারতীয় শিল্পী সেখানে কাজ করেন। আর্ট ডিরেক্টর বুলও দেখলাম সেখানেই বসেন। মাথায় বিশ্রী বোলার হ্যাট, হাতে গোটানো-ছাতা, মানুষটিকে দেখে আমার ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। শিল্পী নয়, ব্যাঙ্কের কর্মচারীর মতো দেখতে। সত্যি বলতে কী, ব্যাঙ্কের কাজে ঢুকলেই বোধহয় এঁর ভাল হত। কথাটা এইজন্য বলছি যে, বিজ্ঞাপনের যে-সব লে-আউট ইনি করতেন, সেগুলি হত অতি বিচ্ছিরি। বুঝে গেলাম যে, আমাদের এই লন্ডন-আপিস থেকে কিছুই আমার শিখবার নেই, দু’চারটে জিনিস বরং আমিই এঁদের শেখাতে পারি।

একে তো শিল্পী হিসাবে বাজে, তার উপরে আবার বুল দেখলাম মানুষ হিসাবেও যেমন উদ্ধত, তেমন ভোঁতা। ইচ্ছা করেই আমার সঙ্গে ইনি একটু খারাপ ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। পাশের ঘর থেকে একদিন শুনতে পাই, টেলিফোনে যেন কাকে তিনি বলছেন যে, অবজার্ভার পত্রিকায় যে পোস্টারটা বেরিয়েছে সেটা ওঁরই করা। শুনে তো আমি স্তম্ভিত। আসলে ওটা আমার করা ডিজাইন। অথচ সেটাকেই তিনি কিনা নিজের কাজ বলে চালিয়ে দিলেন! এর পরেই একদিন বুলের সঙ্গে আমার সংঘর্ষ ঘটে যায়, ফলে কিমার থেকে আমি বেরিয়ে আসি। ব্রুমকে চিঠি লিখে জানাই যে, আমাকে বেনসনের হয়ে কাজ করতে দিলে ভাল হয়। বেনসন খুবই বড় এজেন্সি, ব্যবসায়িক সূত্রে কিমারের সঙ্গে তারা যুক্তও বটে। উত্তরে ব্রুম আমাকে তার করে জানান, আমার যা ইচ্ছা, তা-ই যেন আমি করি; বেনসনের সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর কথাও হয়ে গেছে। সেই অনুযায়ী বেনসনের আর্ট ডিরেক্টরের কাছে গিয়ে তাঁকে আমি আমার কিছু কাজ দেখাই। সে-সব দেখে বেনসনের যিনি তখনকার সেরা শিল্পী, সেই জনের সঙ্গে একই ঘরে তিনি আমার একটা ডেস্কের ব্যবস্থা করে দেন। জনের সঙ্গে দু’চার দিনের মধ্যেই আমার বন্ধুত্ব জমে যায়। লন্ডন থেকে কলকাতায় ফিরে আমি যে-সব ইলাসট্রেশনের কাজ করেছিলাম, তাতে জনের প্রভাব বেশ স্পষ্ট।

লন্ডনে থাকতে ‘সিকোয়েন্স’ পত্রিকার লিন্ডসে আর গ্যাভিনের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ হয়েছিল। ওঁদের হ্যানোভার টেরাস মিউজের বাড়িতে ফিল্মের আলোচনায় তখন আমার অনেক সন্ধ্যা কেটেছে। পিটার এরিকসনের সঙ্গে অবশ্য কোনওদিনই আমার দেখা হয়নি। তবে পেনেলোপি হুস্টনের সঙ্গে দেখা হত। ইনিও ছিলেন ‘সিকোয়েন্স’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মী। লিন্ডসের এক পার্টিতে গিয়ে একবার ফিল্ম-জগতের বিস্তর লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তার মধ্যে ক্যাথারিন দ্য লা রোশ আর থরোল্ড ডিকিনসনের কথা মনে পড়ছে। ক্যাথারিনের চিত্র-সমালোচনা আমার খুব ভাল লাগত। আর থরোল্ড ডিকিনসন তো বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর। তাঁর পরিচালিত ছবি ‘কুইন অভ স্পেডস’ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

বিদেশে ছিলাম ছ’ মাস। তার মধ্যে আমরা মোট নিরানব্বইটা ফিল্ম দেখি। এই প্রথম বিদেশযাত্রাই সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে আমার জীবনে। নর্মান আর জুনের সঙ্গে মেফেয়ারের কার্জন সিনেমায় একদিন পরপর দুটো ফিল্ম দেখা হয়ে যায়। এই জোড়া-ফিল্ম হল ‘আ নাইট অ্যাট দ্য অপেরা’ আর ‘বাইসিক্‌ল থিফ’। ফিল্ম দেখে এত আনন্দ আর কখনও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। ‘আ নাইট অ্যাট দ্য অপেরা’ ছবিটি আমি তার আগেও দেখেছিলাম। এখন দ্বিতীয়বার দেখে যেন আরও মজা পাওয়া গেল। তবে মনের উপরে সত্যিকারের যে অভিঘাত, সেটা অনুভব করেছিলাম ‘বাইসিক্‌ল থিফ’ দেখে। এই যে আশ্চর্য ছবি, এটা আমি একেবারে ঠিক-সময়েই দেখেছিলাম। যে আবেদন রয়েছে এই ছবির মধ্যে, ভাষায় তাকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার চেয়েও যা আশ্চর্যের ব্যাপার, তা এই যে, আমার তোলা ছবিতে যা আমি করতে চাইছিলাম, ডি সিকা ঠিক সেটাই এখানে করে দেখিয়েছেন, এবং তাতে সফলও হয়েছেন অপরিমেয়ভাবে। কে বলেছে অনভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে অভিনয় করানো যায় না? কে বলেছে বৃষ্টির মধ্যে শুটিং করা যায় না? কে বলেছে মেক-আপ চাই-ই চাই? আর হ্যাঁ, কে বলেছে যে, ছবির কাজে ছিমছাম-ভাবটা থাকতেই হবে, ফিল্ম তোলার এটাই একটা শর্ত? আমি শুনেছিলাম যে, যুদ্ধোত্তর ইতালিতে ভাল-জাতের নেগেটিভ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে পুরনো নিকৃষ্ট নেগেটিভের সাহায্যেই ‘বাইসিক্‌ল থিফ’ তোলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এর কাহিনী এমন মসৃণভাবে এগিয়েছে আর এর সম্পাদনার কাজটাও এত নিপুণ হাতে করা হয়েছে যে, নেগেটিভ ভাল না খারাপ, তাতে কিছু যায় আসে না, ওটা এখানে কোনও ধর্তব্য ব্যাপারই নয়। সত্যি বলতে কী, ডি সিকা তার সমস্ত সহানুভূতি ঢেলে দিয়ে দারিদ্র্যের যে ছবি এখানে আঁকতে চেয়েছিলেন, ছবির মধ্যে গ্রেনগুলো থাকায় সেটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে।

পরে আমরা রেনোয়ার ফরাসি ফিল্মগুলোও দেখি। তাতে রেনোয়া সম্পর্কে আমার অনুরাগের ভিত আরও পোক্ত হয়। তবে যে প্রমাণটা আমি চাইছিলাম, সেটা আমি ‘বাইসিক্‌ল থিফ’-এই পেয়েছি।

কন্টিনেন্টে আমরা একটা মাস ছিলাম। পারি, ভেনিস, লুসার্ন আর সলজবুর্গ, এই চার জায়গার প্রতিটিতে এক সপ্তাহ করে কাটাই। শেষ দুটো জায়গায় গিয়েছিলাম সেখানকার মিউজিক ফেস্টিভ্যালের টানে। এ-ক্ষেত্রে ইউরোপের যা শ্রেষ্ঠ দান, তা আস্বাদ করবার সুযোগ তখন ঘটেছে।

তারপর লন্ডনে ফিরে জাহাজে উঠি। ‘চুসান’ একেবারে ঝকঝকে নতুন জাহাজ। এই তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা। দেশে ফেরার পথে, জাহাজে বসেই, শেষ করে ফেলি ‘পথের পাঁচালি’র খসড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *