২. পাঁচালির সূচনা পর্ব

পাঁচালির সূচনা পর্ব

বেনসনে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে যে আমি উপকৃত হয়েছিলাম, তাতে সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ড থেকে ফিরবার পরে বিজ্ঞাপনের কয়েকটা সেরা ক্যাম্পেন আমি তৈরি করে দিই। আমার মনের মধ্যে একটা বড় রকমের আশাও তখন জেগে উঠেছে। ভাবছিলাম যে, অনেক দিন তো চাকরি করা গেল, এবারে আমি নিজের মর্জি-মাফিক চলব। কাজ করব প্রকাশের অন্য মাধ্যমে, অন্য রকমের যন্ত্রপাতি নিয়ে। ক্যামেরার কাজ সম্পর্কে ইতিমধ্যে একটা স্পষ্ট ধারণা আমার হয়েছে। আমার ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড একটা লাইকা। অঁরি কার্তিয়ের-ব্রেসঁই যে সেরা ফোটোগ্রাফার, এটা বুঝে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি। আমি চাইছিলাম, আমার তোলা ফিল্ম দেখে সবাই বুঝবে যে, স্বাভাবিক আলোতেই এটা তোলা হয়েছে। কার্তিয়ের-ব্রেসঁ যেমন তোলেন।

তাঁর ফিল্মের কাজ শেষ করে রেনোয়া ইতিমধ্যে ভারতবর্ষ থেকে চলে গিয়েছেন। বংশীরও অভিজ্ঞতা বেড়েছে তাঁর সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে। যেমন আমি, তেমন সেও তখন সত্যিকারের ভাল কিছু কাজ করবার জন্য উদ্‌গ্রীব। এদিকে আবার আমাদের ফিল্ম সোসাইটিরও ইতিমধ্যে কিছুটা বাড়বৃদ্ধি হয়েছে। দেশে ফিরবার পরে সোসাইটির তরফে আমরা একটা বুলেটিন প্রকাশ করতে শুরু করি। তার ডিজাইনটা আমারই করা। ইতালিতে যে নব্যরীতির ফিল্ম তোলা হচ্ছিল, লন্ডনে থাকতে তার একটা রেট্রোসপেকটিভ আমি দেখেছিলাম। সোসাইটির বুলেটিনে তাই নিয়ে একটা নিবন্ধও আমি লিখি। শোনা যাচ্ছিল, সরকারি উদ্যোগে শিগগিরই একটা আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবের অনুষ্ঠান হবে। কথাটা শুনে আমাদের বুলেটিনে বিদেশি ফিল্মের একটা তালিকা আমরা বেশ ফলাও করে ছাপি, এবং সেখানে বলি যে, উৎসবে এই ছবিগুলি দেখানো চাই।

গুজব সাধারণত সত্যি হয় না। তবে এ-ক্ষেত্রে হয়েছিল। ফিল্ম উৎসব অনুষ্ঠিত হল, তার সূত্রে গজিয়েও উঠল বিস্তর চলচ্চিত্র-রসিক। ভারতবর্ষের প্রতিটি বড় শহরে, উৎসবের অঙ্গ হিসাবে, বিস্তর ছবি তখন দেখানো হয়। সেই সময়ে এক হল্ থেকে অন্য হলে প্রায় পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছি আমরা। গড়পড়তায় রোজ তখন গোটা-চারেক করে ছবি দেখছি।

ছবির বিচারে এ ছিল একটা সেরা উৎসব। কুরোসাওয়ার ‘রসোমন’, ডি সিকার ‘মিরাক্‌ল ইন মিলান’, টাটির ‘জুর দ্য ফেত’, রসেলিনির ‘ওপ্‌ন সিটি’ ছাড়াও এসেছিল নামজাদা পরিচালকদের তোলা অসামান্য সব ছবি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবচেয়ে অভিভূত হয়েছিলাম ‘রসোমন’ দেখে। আগের বছরে ভেনিসের উৎসবেও যে এ-ছবি খুব প্রশংসা পেয়েছিল, তা আমি জানতাম। তবে, কী তীব্র আবেদনে যে এ-ছবি আলোড়িত, স্বচক্ষে না দেখলে তা আন্দাজ করা যায় না। ‘রসোমন’ দেখে বোঝা গেল যে, জাপান অনেক কাল ধরেই এই ধরনের উঁচু মানের ছবি তৈরি করে যাচ্ছে।

চলচ্চিত্র-উৎসব শেষ হবার পর আর এ-বিষয়ে আমার মনে কোনও সংশয় রইল না যে, আমি ছবিই তুলব। ‘পথের পাঁচালি’ হবে আমার প্রথম ছবি। ছবি যদি ভাল না হয় তো মাথা নিচু করে ফিরে যাব কিমারের কাজে। আর যদি উত্‌রে যায় তো একটার-পর-একটা ছবি তুলে যাব। কিন্তু প্রশ্ন হল, কাজটা শুরু করব কীভাবে? ব্রুম কিংবা তাঁর পরে যিনি কিমারের কর্তা হয়ে আসবেন, তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবার মতো সময় তখনও আসেনি। ব্রুম যে শিগগিরই ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেবেন, এইটুকুই মাত্র শুনেছিলাম।

‘পথের পাঁচালি’র পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য কখনও তৈরি করা হয়নি। থাকবার মধ্যে ছিল শুধু একতাড়া কাগজে লেখা কিছু নোট আর কিছু স্কেচ। ছবিতে এই কাহিনী কোথায় কীভাবে ফুটবে, সেটা বুঝবার জন্য পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্যের দরকারও যে আমার ছিল না, তার কারণ, একে তো পুরো কাহিনীটাই আমার মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল, তার উপরে আবার ডি.কে.র করা সারাংশ আর চিত্রনাট্যের মূল উপাদানের মধ্যে সাযুজ্যও ছিল কম নয়। সে-কথা আগেই বলেছি। ছবির কাহিনী থেকে মূল বইয়ের প্রচুর চরিত্র বাদ দেওয়া হয়। পুরুতঠাকুর হরিহর রায় ও তাঁর পরিবার, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী সর্বজয়া, মেয়ে দুর্গা, ছেলে অপু, আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক দূর সম্পর্কের দিদি ইন্দির ঠাকরুন,—হরিহরের ছেলেমেয়েরা যাঁকে পিসি বলে ডাকে—বাস্, মূলত এই কটি চরিত্রকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ছবির কাহিনী। ছবির পক্ষে অপ্রয়োজনীয় বলে মূল বইয়ের একটানা অনেক বাগ্‌বিস্তার বর্জন করে ঘটনাগুলিকে আমি একটু অন্যভাবে সাজিয়ে নিই, ফলে ছবির কাহিনীতে একটা নতুন বুনট তৈরি হয়ে ওঠে। পিসিটিকে যে আমি আরও অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখি, তার কারণ আমি জানতাম যে, নানা রকমের নাটকীয় ঘটনায় ভরা ওই পরিবেশ থেকে যদি হঠাৎ তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় তো দর্শকদের পক্ষে সেটা একটা নৈরাশ্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মূল বইয়ে অপুর জন্মের কিছুদিন বাদেই তিনি মারা যান। সে-ক্ষেত্রে ছবিতে তিনি যখন মারা যান, দুর্গার বয়স তখন দশ-এগারো। একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে অপু আর দুর্গা তাঁর মৃতদেহ দেখতে পায়। মৃত্যু যে কী, তা তারা সেই প্রথম জানল।

দুর্গার মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়েও একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটাই। জংলা জায়গা, প্রবল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে, আর তারই মধ্যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে দুর্গা। ফলে নিউমোনিয়া হয়ে সে মারা যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার ফলেই যে তার মৃত্যু ঘটল, মূল বইয়ে তা দেখানো হয়নি। ঝড়ের দৃশ্যের পরে-পরেই তার অসুস্থ হওয়া—এটা আমিই দেখাই। জঙ্গলে ঝড়বাদলের মধ্যে তার ওই আত্মহারা নাচ, দুর্গার মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে এটাকেই আমি তুলে ধরি। দুর্গার মৃত্যুর পরে আমার কাহিনীতে ধীরে-ধীরে উপসংহার টানি এবং দেখাই পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে হরিহর তার পরিবার নিয়ে কাশীতে চলে যাচ্ছেন।

‘পথের পাঁচালি’র চেহারা যে সাধারণ বাংলা ফিল্মের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে, তা আমি জানতাম। ফলে দৃশ্যের পর দৃশ্যে কাহিনী কীভাবে এগোবে, সেটা দেখিয়ে দেবার জন্য পারম্পর্য বজায় রেখে বিস্তারিতভাবে আমি তার স্কেচ করে ফেলব বলে মনস্থ করি। সে-কাজ করবার পরে খেয়াল হয় যে, টাকা জোগাবার লোক পাওয়ার আগে উপন্যাসের চিত্ৰস্বত্বটা আমার পাওয়া দরকার। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, বিদেশ থেকে আমি ফিরে আসবার পরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ মারা যান। চিত্রস্বত্বের জন্য তাঁর অবর্তমানে এবারে আমাকে তাঁর বিধবা পত্নীর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

যা-ই হোক, যে পরিকল্পনা আমি করে রেখেছিলাম, তাতে সবসময়েই চলচ্চিত্রে-উৎসাহী কিছু তরুণের সমর্থন আমি পেয়েছি। সেইসঙ্গে এটাও উল্লেখ করব, যে-কাজ আমি করতে চাইছিলাম এবং যে-ভাবে সেটা করতে চাইছিলাম, আমার স্ত্রীরও তাতে পূর্ণ সমর্থন ছিল। আপত্তি উঠেছিল মায়ের দিক থেকে। তাঁর আপত্তি এইখানে যে, যাতে আমার আয়ের অঙ্ক লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে, সেই পাকা চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এমন একটা কাজ আমি করতে চলেছি, আমাদের পরিবারে আর-কেউ যা ইতিপূর্বে করেননি। এদিকে আমাকে সমর্থন করে চলেছে বংশী চন্দ্রগুপ্ত আর সুব্রত মিত্র। সুব্রতর বয়স তখন বছর কুড়ি। ক্যামেরাম্যান হবার বাসনা ছিল তার। সেইজন্যই, রেনোয়ার অনুমতি নিয়ে সে ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার কাজ নিয়মিত দেখেছে। তা ছাড়া ছিলেন তরুণ লেখক আশিস বর্মন। এঁর একটা ব্যবসাও ছিল। লাঞ্চের সময়ে আমাদের আপিসের কর্মীদের ইনি স্যান্ডুইচ সরবরাহ করতেন। কাজের দিনে রোজই কিমারে আসতেন। আমারই মতো, ছবি তুলবার স্বপ্ন দেখতেন ইনিও। বলা বাহুল্য, ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের প্রত্যেকেরই নৈতিক সমর্থন ছিল আমার পরিকল্পনায়। সাগ্রহে তাঁরা প্রতীক্ষা করছিলেন, কবে আমি ছবি তোলার কাজ শুরু করব। এখানে বলা দরকার, এ-ব্যাপারে ডি. কে.ও ছিলেন আমার মস্ত সমর্থক। তাঁর দাবি শুধু একটাই। কিমারের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয় হোক, কিন্তু সিগনেট প্রেসের সঙ্গে সম্পর্কটা যেন বজায় থাকে।

নানা ধরনের, নানা মেজাজের বই লিখেছেন বিভূতিভূষণ। তার মধ্যে কয়েকটি তো তাঁর মস্ত কীর্তি। তবে তাঁর অবস্থা বিশেষ সচ্ছল ছিল না। দেশের নানা জায়গায় নানা রকমের কাজ করবার পরে তিনি স্কুল-মাস্টারির কাজ করতে শুরু করেন। বিভূতিভূষণের জন্ম ব্রাহ্মণ-বংশে। ‘পথের পাঁচালি’র অপুর বাবার মতো বিভূতিভূষণের বাবার বৃত্তিও ছিল যজমানি। অল্পবয়সে বিভূতিভূষণের বিয়ে হয়েছিল, তবে বিয়ের পর এক বছরের মধ্যেই তাঁর স্ত্রী-বিয়োগ হয়। তারও বাইশ বছর বাদে তিনি দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করেন।

‘পথের পাঁচালি’র চিত্ৰস্বত্ব নিয়ে কথা বলবার জন্য আমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী শ্রীমতী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাই। বইখানার সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্য আমি যে-সব ছবি এঁকে দিয়েছিলাম, ভদ্রমহিলা জানালেন যে, সেগুলি তাঁর খুবই ভাল লেগেছে। একইসঙ্গে বললেন যে, আমার বাবা আর ঠাকুর্দার লেখারও তিনি মস্ত ভক্ত। আমাদের প্রতি তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই সৌজন্যপূর্ণ। ফিল্ম তুলবার জন্য যে টাকা দরকার, সেটা যদি আমাদের জোগাড় হয়ে যায়, তো চিত্ৰস্বত্ব নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না, এই আশ্বাসও তাঁর কাছে পাওয়া গেল। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই চণ্ডীদাস চট্টোপাধ্যায় বললেন, আমাদের কাজ কীভাবে এগোচ্ছে, সে-বিষয়ে তাঁকে যেন ওয়াকিবহাল রাখি। এর পরে আমরা প্রযোজক খুঁজতে লেগে যাই।

প্রথমে যাই মিঃ বি. এন. সরকারের কাছে। হলিউডের দুনিয়ায় লুই বি. মেয়ারের যে-রকমের নামডাক, বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে নিউ থিয়েটার্সের মিঃ সরকারের খ্যাতি অনেকটা সেই রকমের। ভদ্রলোক আস্ত একটা স্টুডিয়ো আর ল্যাবরেটরির মালিক, তার উপরে আবার বাংলা সিনেমার নামজাদা সব অভিনেতা-অভিনেত্রী আর ডাকসাইটে সব পরিচালক তাঁর কাছে বাঁধা-মাইনের চাকরি করেন। মিঃ সরকারের সেই আগেকার প্রতিপত্তি অবশ্য সেই সময়ে আর ছিল না, তবে গিয়ে-গিয়েও যেটুকু যা ছিল, তাও নেহাত কম নয়। স্কেচবুকখানা সঙ্গে নিয়ে আমি একদিন তাঁর আপিসে গিয়ে দেখা করি। মিঃ সরকার অতি সজ্জন, খুবই সহৃদয়ভাবে আমাকে তাঁর ঘরে বসিয়ে আমার যা বক্তব্য সবই মন দিয়ে শুনলেন, তারপর দুঃখপ্রকাশ করে বললেন যে, তিনি দুঃখিত, কিন্তু সদ্য একটা বড়-রকমের প্রোডাকশনে তিনি হাত দিয়েছেন, সুতরাং ঠিক এক্ষুনি তিনি আমাকে সাহায্য করতে পারছেন না। তারপর সস্নেহে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ছ’মাস বাদে আমি যেন তাঁর সঙ্গে আবার দেখা করি, তখন তিনি নিশ্চিত আমাকে সাহায্য করবার চেষ্টা করবেন।

এর পরে যে সচ্ছল প্রযোজকের কাছে যাই, তিনি হলেন কল্পনা মুভিজের মিঃ ভট্টাচার্য। ছবিটা আমি কীভাবে তুলতে চাইছি, তিনি তা শুনলেন, আমার করা স্কেচগুলিও দেখলেন, তারপর বললেন যে, হ্যাঁ, এ-ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ রয়েছে। তবে কিনা, মনঃস্থির করবার জন্য দিন দশেক সময় চাই। ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হল, একটু যেন আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বললাম, ঠিক আছে, দশ দিন বাদে আবার আমি যোগাযোগ করব। এর তিন দিন বাদেই বিভূতিভূষণের শ্যালক চণ্ডীদাস চাটুজ্যে মশাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন যে, ওঁরা একটা সমস্যায় পড়ে গেছেন। কী সমস্যা? না ‘পথের পাঁচালি’র চিত্ৰস্বত্ব নিয়ে কথা বলবার জন্য কল্পনা মুভিজের মিঃ ভট্টাচার্য গিয়ে শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। নামজাদা ডিরেক্টর দেবকী বসুকে দিয়ে তাঁরা ছবিটা তোলাবেন। শুনে, উৎকণ্ঠাভরে জিজ্ঞেস করলাম, “মিসেস ব্যানার্জি তাতে কী বললেন?” চণ্ডীবাবু বললেন, তিনি তাতে রাজি হননি। মিঃ ভট্টাচার্যকে তিনি বলে দিয়েছেন যে, এ-ছবি সত্যজিৎ রায়ই তুলবেন; আর-কেউ এ-ছবি তুলুন, এটা তিনি চান না। প্রযোজকের তালিকা থেকে মিঃ ভট্টাচার্যকে অতএব ছাঁটাই করতে হল।

দ্বিতীয় দফার এই নৈরাশ্যের পরে এল তৃতীয় দফার নৈরাশ্য। এবারে যে প্রোডিউসারটি আমার বাড়িতে আসেন, দেখতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হলেও বস্তুত তিনি ডায়াবিটিসের রোগী। চিত্রনাট্য শুনতে-শুনতে তিন-তিন বার তিনি আমাকে বাধা দেন, কেননা তাঁর টয়লেটে যাবার দরকার হয়েছিল। চিত্রনাট্য তাঁর পছন্দ হয়, কিন্তু যে-ছবি একেবারেই গতানুগতিক নয়, তার পিছনে টাকা ঢালবার মতন উৎসাহ তাঁর ছিল না।

এই সব অভিজ্ঞতার ফলে আমি একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই। এই সময়ে একদিন আশিস বর্মন এসে আমাকে বলেন যে, কেটারিং ব্যবসায় অনিল চৌধুরি বলে এক ভদ্রলোক তাঁকে সাহায্য করেন, আর এই অনিল চৌধুরির সঙ্গে এক অল্পবয়সী প্রযোজকের চেনাশুনো রয়েছে। সদ্য ইনি একটা নতুন ছবিতে টাকা ঢেলেছেন, এখন আমার কাজে টাকা ঢালতেও এঁকে হয়তো রাজি করানো যেতে পারে।

অনিল চৌধুরির সঙ্গে পরিচয় হল। ভদ্রলোক মোটামুটি আমারই বয়সী। কথা বলে মনে হয় বুদ্ধিমান মানুষ। অনিলবাবু আমাকে তাঁর সেই প্রোডিউসার বন্ধুর কাছে নিয়ে যান। তিনি তখন মধ্য কলকাতার এক জরাজীর্ণ হোটেলে থাকতেন।

পথের পাঁচালি-র সংগীত-গ্রহণ: লেখক, অলোক দে ও রবিশঙ্কর।

লেখক: লণ্ডন ১৯৫০।

পথের পাঁচালি-র আউটডোর: পরিচালক দুর্গাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, পাশে অপু।

লণ্ডনের রিজেন্টস্ পার্কে লেখক, বিজয়া, নর্মান ও তার মা।

অপুর সংসার: অপু-অপর্ণা।

ক্যামেরায় লেখক, পাশে সুব্রত মিত্র।

অপু ও কাজল।

অপুর সংসার: অপর্ণা ও তার মা।

পথের পাঁচালি: পরিচালক সর্বজয়াকে নির্দেশ দিচ্ছেন।

অপরাজিত: কাশীর ঘাটে ছোট অপু।

অপুর সংসার: কাজলের ভূমিকায় অলোক চক্রবর্তী।

পথের পাঁচালির আউটডোর: কাশবনের পাশে।

শুটিং-এর প্রস্তুতি: দুর্গা, ইন্দির, সুব্রত মিত্র ও পরিচালক।

পথের পাঁচালি: সর্বজয়া ও পরিচালক।

শর্মিলা ঠাকুর, অপুর সংসার-এ মনোনয়নের সময়ে লেখকের তোলা ছবি।

অপুর সংসার: লোকেশনে বংশী, সৌমিত্র ও শর্মিলা।

পথের পাঁচালি: লেখক, সুব্রত মিত্র ও শান্তি চ্যাটার্জি।

‘পথের পাঁচালি’র চিত্রনাট্য দেখে অনিলবাবু খুবই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তাঁর বন্ধু মিঃ দাসের কাছ থেকে কিন্তু স্পষ্ট কোনও আশ্বাস পাওয়া গেল না। পরে তিনি অনিলবাবুকে বলেন যে, তাঁর প্রযোজিত যে ছবিটি সদ্য মুক্তিলাভ করেছে, তার থেকে ভাল রকমের লাভ হলে আমাদের ছবিতে তিনি টাকা খাটাতে পারবেন। কিন্তু তার সেই ছবিতে লাভ হল না, সেটা একেবারেই মার খেয়ে গেল। ফলে দাসও জানালেন যে, আমাদের ছবির জন্য টাকা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। অবশ্য অনিলবাবু আমার সঙ্গে রয়ে গেলেন।

কিন্তু এত সব যে ধাক্কা খাচ্ছিলাম, আমার উৎসাহ তাতেও ঝিমিয়ে যায়নি। প্রযোজক ধরবার চেষ্টা চালাতে-চালাতেই আমি কোন্ চরিত্রে কে অভিনয় করবেন, সেটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি। আমি চাইছিলাম এমন সব অভিনেতা-অভিনেত্রী, যাঁরা পেশাদার নন। আবার একইসঙ্গে এটাও আমি বুঝতে পারছিলাম যে, কয়েকটি চরিত্রে—যেমন বাবা মা আর বুড়ি পিসির চরিত্রে—অভিনয় করবার জন্য পেশাদারি দক্ষতার দরকার হবে। ‘বাইসিক্‌ল থিফ’-এ যাঁকে দৈবজ্ঞের ভূমিকায় নামানো হয়েছিল, তিনিই ছিলেন ও-ছবির একমাত্র পেশাদার অভিনেত্রী। মা সর্বজয়ার ভূমিকায় আমি সে-ক্ষেত্রে আমার এক বন্ধুপত্নীকে দিয়ে অভিনয় করাব বলে ঠিক করি। ইতিপূর্বে ইনি মঞ্চে বার কয়েক অভিনয় করেছেন। গ্রামের বউ-মানুষ বলতে যা বুঝি, এই ভদ্রমহিলা অবশ্য মোটেই সেই গোত্রের নন। ইনি শহুরে পরিবারের গ্র্যাজুয়েট মহিলা। তা সে যা-ই হোক, আমার মনে হয়েছিল যে, চেহারার দিক থেকে ওই ভূমিকায় এঁকে ঠিকই মানিয়ে যাবে। এঁর জামাকাপড় যদি বেখাপ্পা না হয়, সেইসঙ্গে গ্রামের এই জাতীয় চরিত্রের পক্ষে যে-কাজ যে-ভাবে করা স্বাভাবিক, সেই কাজ যদি সেইভাবে করিয়ে নেওয়া হয় এঁকে দিয়ে, আর সংলাপের কথাগুলো যদি ইনি ঠিকঠাক বলতে পারেন, তা হলে আর কোনও অসুবিধা হবে না। বাবার ভূমিকায় আমরা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেব বলে মনস্থ করি। ইনি পেশাদার অভিনেতা। নাটক আর ছবি, দুই ক্ষেত্রে অভিনয়েরই অভিজ্ঞতা এঁর আছে। হরিহরের চরিত্রে এঁকে চমৎকার মানাবে।

পুত্রকন্যার ভূমিকায় কারা অভিনয় করবে, এবারে চলতে থাকে তার খোঁজ। আমার চাই বছর-ছয়েকের একটি ছেলে, আর মোটামুটি এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে। ভারতে চিত্রাভিনয় শেখাবার কোনও ব্যবস্থা তখন ছিল না। সেটা থাকলে শিক্ষার্থীদের ছবির অ্যালবামও পাওয়া যেত আর তা থেকে বাছাই করে নেওয়া যেত। শিশু-অভিনেতা খুঁজে বার করবার উপায় মাত্র দুটি। হয় ইস্কুলে-ইস্কুলে ওই বয়সের শিশুর খোঁজ করো, আর নয়তো কাগজে বিজ্ঞাপন দাও। ইস্কুলে খোঁজ করার পরিশ্রমটা অপুর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হল। ফলে আমরা এই মর্মে একটা বিজ্ঞাপন দিলাম যে, অভিভাবকরা তাঁদের ছ’-সাত বছর বয়সের ছেলেদের নিয়ে যেন অমুক দিন অমুক সময়ে অমুক ঠিকানায় চলে আসেন। ছেলেটির রং হওয়া চাই ফর্সা, চেহারা হওয়া চাই সুশ্রী, তা ছাড়া অভিনয়ের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতাও তার থাকা চাই। আমাদের ফ্ল্যাটটি ছোট। সেখানে ইন্টারভিউ নেওয়া সম্ভব নয় বলে একটা বড় মাপের ঘরের ব্যবস্থা করতে হল। ঘরটা যার মাধ্যমে পাই, সেও ছাত্র। তার সঙ্গে আমার মিল এইখানে যে, যেমন আমি, তেমন সেও চলচ্চিত্র আর পাশ্চাত্ত্য ধ্রুপদী সংগীতের অনুরাগী।

বিজ্ঞাপনে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল বটে, কিন্তু প্রার্থীদের প্রায় সকলেই খারিজ হয়ে গেল পত্রপাঠ। তার মধ্যে একটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। ঘাড়ে পাউডার মাখা, দেখেই বোঝা যায়, সেলুন থেকে ছোট করে চুল ছাঁটিয়ে এসেছে। একটা হতাশা যে আস্তে-আস্তে আমার উপর ভর করছে, এই ঘটনার পর সেটা আমি প্রথম অনুভব করি। আর তার পরে-পরেই হঠাৎ আমার স্ত্রী একদিন অপুর দেখা পেয়ে যান। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের খেলার মাঠে ছেলেটি তার দাদা আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছে, এই সময়ে সে তাঁর চোখে পড়ে। আমাকে ডেকে দেখাবামাত্র বুঝলাম যে, তাঁর ভুল হয়নি। চেহারার দিক থেকে অপুর ভূমিকায় একে চমৎকার মানাবে।

ছেলেটির নাম সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। ইস্কুলে যায়? হ্যাঁ। মঞ্চে উঠে কখনও অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করেছে? না। একটা ছবির মুখ্য কোনও ভূমিকায় যদি তাকে অভিনয় করতে বলা হয়, তো কেমন লাগবে তার? এ ব্যাপারে তার নিজের কোনও মতামত আছে বলে মনে হল না। বাবা-মা যদি রাজি হন তো সেও রাজি। “মা যা করতে বলবেন, তা-ই করব।”

দুর্গার খোঁজ পাওয়াটাও দেখা গেল একই রকমের শক্ত ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আশিস বর্মন এসে একটা আশার কথা শোনালেন। মেয়েদের একটা ইস্কুলের এক শিক্ষয়িত্রীকে তিনি চেনেন। সেখানে গিয়ে তিনি এমন একটি ছাত্রীর দেখা পেয়েছেন, দুর্গার ভূমিকায় যাকে নাকি দিব্যি মানিয়ে যাবে।

বর্মন ঠিকই বলেছিলেন। খোঁজখবর করে জানা গেল যে, মেয়েটির বাবা এককালে ফুটবল খেলতেন। বুক ডিজাইনার হিসাবে আমার খ্যাতির কথা তিনি শুনেছেন, যে-কোনও রবিবারের সকালে যদি তাঁর বাড়িতে যাই তো এই নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। তা-ই গেলাম, মেয়েটির বাপ-মা’র সঙ্গে কথা বললাম, চা খেলাম। উমা দাশগুপ্ত তাঁদের ছোট মেয়ে। তাকে দেখবামাত্র ঠিক করে ফেললাম যে, ছবিটা তোলা আদৌ যদি সম্ভব হয় তো দুর্গার ভূমিকায় একেই নামাব। লাইকা ক্যামেরাটা সঙ্গেই ছিল। বাড়ির ছাতে গিয়ে সেই ক্যামেরা দিয়ে মেয়েটির কয়েকটি ছবি তুলি। মেয়েটি একটু লাজুক প্রকৃতির। অথচ দুর্গা তো ওই যাকে বলে দস্যি-মেয়ে। উমাকে তাই ভেংচি কাটতে বলি। তা মুখবিকৃতি করতে মেয়েটির কোনও সংকোচ দেখা গেল না।

অপু আর দুর্গার ঝামেলা তো মিটল। বাকি রইলেন বুড়ি পিসি। মনে হল তাঁর খোঁজ আর-একটু সময় নিয়ে করলেও চলবে। প্রযোজক যদি জোগাড় হয়ে যায় তো বাচ্চা দুটিকে নিয়ে শুটিংয়ের কাজ শুরু করে দেব। এমন বিস্তর দৃশ্য তো রয়েছে, যেখানে শুধু ওই বাচ্চা দুটিই থাকবে, আর-কেউ থাকবে না।

‘পথের পাঁচালি’র বাজেট ছিল মাত্র সত্তর হাজার টাকার। কিন্তু এই যে সামান্য অঙ্কের বাজেট, এটা দেখেও মামুলি অনেক প্রযোজকের মনে হয়েছিল যে, বড্ড বেশি ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। “আপনাদের ছবিতে না আছে স্টার, না আছে গান, এমনকি মারপিটের দৃশ্যও নেই। তা হলে এত খরচা হবে কেন? অঙ্কটাকে আর-একটু নামিয়ে আনতে পারেন না?”

এই সব শুনে, খরচ কমাবার জন্যে এমন সব উপায়ের কথা আমার মাথায় আসে, তখনকার দিনে যা একেবার উদ্ভট বলে গণ্য হত। ঠিক করলাম যে, আমাদের শুটিং করব ষোলো মিলিমিটারে, তারপর হল্-এ মুক্তিলাভের সময় সেটাকেই পঁয়ত্রিশ মিলিমিটারে ‘ব্লো আপ’ করে নেব। তাতে খরচ পড়বে অর্ধেকেরও কম। তা যদি হয়, তবে একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?

সে এক দারুণ উত্তেজনার সময়। এক বন্ধু একটা ‘বোলেক্স’ ধার দেন। সেইসঙ্গে কিছু নেগেটিভও কিনে ফেলা হয়। তারপর সেইসব নিয়ে, পরীক্ষামূলক কিছু শট নেবার জন্যে, আমরা একটা গ্রামে চলে যাই। সুব্রত মিত্র তো ক্লড রেনোয়ার কাজ দেখবার সুযোগ পেয়েছিল, সেও আমাদের সঙ্গে যায়। এটা ইতিমধ্যে ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, সে-ই হবে এ-ছবির ক্যামেরাম্যান। শুনে সে প্রথমটায় একটু গাঁইগুঁই করেছিল। তাতে তাকে বকুনি দিয়ে বলি, “এতে এত ভাববার কিছু নেই। স্টিল ফোটোগ্রাফির ব্যাপারটা তুমি ভালই জানো। এই যে লোকেশনে গিয়ে মুভি ক্যামেরায় ছবি তোলা, এটা তো তারই ঠিক পরের ধাপ। মিটার দিয়ে আলোটা মেপে নেবে, তারপর লেন্স আর অ্যাপারচারের ঢাকনা সরিয়ে তুলে যাবে তোমার ছবি। ক্যামেরার কাজের রহস্য নিয়ে পেশাদার ফোটোগ্রাফাররা যে-সব বড়-বড় কথা বলেন, তা স্রেফ অর্থহীন বুকনি ছাড়া আর কিস্যু নয়।”

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবনে যেখানে শিক্ষকতা করতেন, তাঁর প্রিয় সেই গোপালনগর গ্রামটাই আমরা বেছে নিই আমাদের কাজের জন্য। বইয়ের মধ্যে যে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের কথা তিনি বলেছেন, তারই মেজাজ রয়েছে এই গোপালনগরে। তখন একেবারে ভরা বর্ষার সময়। হাঁটুভর কাদা ভেঙে আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। তারপর একটা পুকুরে পা ধুয়ে শুরু করলাম আমাদের ফোটোগ্রাফি। ক্যামেরার কাজ আমি সেদিন নিজেই করি। বাইরের উঠোনের একদিকে একটা বাঁশঝাড়। তার মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। ম্লান হয়ে এসেছে দিনের আলো। ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ম্লান আলো আর সেই বৃষ্টির মধ্যেই আমি ছবি তুলেছিলাম। তোলা হয়েছিল আশপাশের কিছু ডিটেল্‌সের দৃশ্যও। বাতাসে কাঁপছে পদ্মপাতা, পুকুরের জলে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা, হাওয়া লেগে কলার পাতা দুলছে, এই রকমের কয়েকটা দৃশ্য সেদিন তুলে নেওয়া হয়।

ষোলো মিলিমিটারে দেখা গেল, ছবিগুলি একেবারে চমৎকার এসেছে। যেমনটা ভেবেছিলাম, ঠিক সেইরকম। কিন্তু কলকাতায় তো একে পঁয়ত্রিশ মিলিমিটারে ব্লো আপ করবার কোনও ব্যবস্থা নেই, তাই বোম্বাইয়ের এক ল্যাবরেটরিতে এগুলো পাঠাতে হয়। যখন সেগুলি ফিরে এল, তখন দেখলাম, কৌশলটা আদপেই খাটেনি। প্রতি সেকেন্ডে চব্বিশটা ফ্রেম, এই স্পিডে আমরা ছবি তুলি। কিন্তু ব্লো আপ করে ব্যাপারটা যা দাঁড়ায়, তাতে মনে হল অনুপাতটা হয়েছে সেকেন্ডে তিরিশটা ফ্রেমের মতো। ফলে স্পিড একটা দারুণ গোলমাল বাধিয়েছে। বোম্বাইয়ের ল্যাবরেটরিকে এই নিয়ে প্রশ্ন করে জানা গেল, তাঁরা তাঁদের সাধ্যমতো কাজ করেছেন। অর্থাৎ সমস্যাটা রয়েই গেল, অবস্থা সেই যথাপূর্বম্।

অনিল চৌধুরি ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন প্রযোজকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তবে তাঁদের কাউকেই আমাদের ছবির পিছনে টাকা ঢালতে রাজি করানো যায়নি। একটা ব্যাপার ক্রমেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। সেটা এই যে, নিজেরাই যদি না ছবির কিছুটা অংশ তুলে নিয়ে প্রযোজকদের দেখাতে পারি, তা হলে তাঁরা আমাদের উপরে আস্থা স্থাপন করবেন না। আমরা যে বিশ্বাসযোগ্য, হাতে-কলমে তার প্রমাণ দিতে না পারলে তাঁদের ভুল ধারণাটা বেড়েই যাবে। সত্যিই তো, ছবি তুলবার ব্যাপারে কোনও অভিজ্ঞতাই তো আমাদের নেই। প্রযোজকরা তা হলে আমাদের মুখের কথার উপরে নির্ভর করবে কেন? সেটা করবে, যদি তারা বোঝে যে, ছবি তুলবার কায়দা-কৌশল আমরা ঠিকই জানি। বাচ্চা দুটিকে নিয়ে আমাদের ফিল্মের একটা অংশ তুলে যদি তাদের দেখাতে পারি, তা হলে সেটা তারা বুঝতে পারবে। কিন্তু তার জন্য তো নিজেদেরই কিছু টাকা ঢালা দরকার। সে-টাকা আসবে কোথা থেকে?

হঠাৎই মনে পড়ে যায় যে, আমার একটা ইনসিওরেন্স পলিসি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, পলিসিটা বাঁধা দিয়ে আমি সাত হাজার টাকা পেতে পারি। সেই টাকা দিয়ে কিনতে পারি কিছু ফিল্ম আর ভাড়া করতে পারি একটা ক্যামেরা। এমন জনাকয় বন্ধু ও আত্মীয়ের কাছেও হাজার খানেক করে টাকা ধার চাই, যাঁদের অবস্থা আমাদের চেয়ে সচ্ছল। বলি যে, প্রযোজক জুটবামাত্র টাকাটা আমরা শোধ করে দেব। আমাদের উপরে এঁদের প্রত্যেকেরই আস্থা ছিল। যে-টাকা তাঁরা দিচ্ছেন, সেটা যে জলে যাবে না, কাজে লাগবে, এটাও তাঁরা জানতেন। সব মিলিয়ে আমাদের সতেরো হাজার টাকার জোগাড় হয়ে যায়।

বারো শো টাকায় তখন কোডাক কোম্পানির এক রোল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নেগেটিভ পাওয়া যেত। হিসেব করে দেখলাম, হাতে যা টাকা রয়েছে, তাতে এক সপ্তাহ আমরা শুটিং চালিয়ে যেতে পারব। ঠিক করা হল, প্রথমেই তুলে ফেলব এমন কয়েকটা দৃশ্য, যাতে কোনও সংলাপ থাকবে না। এটা ঠিক করি এই কারণে যে, সাউন্ড-রেকর্ডিস্টের খরচ জোগাবার সাধ্য তখন আমাদের ছিল না। কোন দৃশ্য তুলব? না শিশু দুটি যখন প্রথম রেলগাড়ি দেখছে। মনে-মনে আমি দৃশ্যটা এইভাবে রচনা করে রেখেছিলাম যে, ধবধবে সাদা কাশফুলে ছাওয়া মস্ত একটা মাঠে দাঁড়িয়ে চলন্ত রেলগাড়িটা তারা দেখবে। এদিকে সাদা কাশফুল আর ওদিকে, রেলগাড়ির কালো ধোঁয়া, দুয়ে মিলে একটা কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যও তাতে ফুটবে। কাশফুল শরৎকালে ফোটে; থাকে মোটামুটি মাস-দুয়েক। জায়গামতো পৌঁছে শুনলাম, কলকাতা থেকে পঁয়ষট্টি মাইল দূরে একটা ট্রেন আছে, আর তার লাইন গিয়েছে কাশে-ছাওয়া মাঠের ধার-বরাবর। যে-রকম দৃশ্যের কথা ভাবছিলাম, তার শুটিংয়ের পক্ষে এ একেবারে আদর্শ জায়গা।

শিশু দুটিকে দেবার মতন টাকা আমাদের ছিল। দুর্গা যে ঠিকঠাক অভিনয় করবে, তাতে আমার সন্দেহ ছিল না। সংশয় ছিল অপুকে নিয়ে। তবে তার অভিনয়ও যাতে নিখুঁত হয়, তার জন্য আমার তরফে যেটুক-যা করা দরকার, সেটা করতে তৈরি ছিলাম আমি।

ক্যামেরার জন্য আমরা একটা প্রাইভেট ফোটোগ্রাফিক স্টুডিয়োতে যাই। ফিল্ম-স্টুডিয়োগুলিতে সাধারণত আগেকার আমলের ‘মিচেল’ ক্যামেরা ব্যবহার করা হত। সে-ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে এঁরা ছত্রিশ মিলিমিটারের ‘ওয়াল’ ক্যামেরা আমদানি করেছেন। স্টুডিয়োর ফোটোগ্রাফার অসিত সেন আমাদের বন্ধু। তা ছাড়া তিনি আমাদের ফিল্ম সোসাইটির সদস্যও বটেন। পরের দিকে তিনি নিজেও বেশ-কিছু ফিল্ম তুলেছিলেন। তাঁরই সুবাদে সেই ‘ওয়াল’ ক্যামেরাটা আমরা খুব অল্প ভাড়ায় পেয়ে যাই।

ছবি তোলার ব্যাপারটা নিয়ে কিমারের ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনার সময় তখনও আসেনি। (ব্রুম ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছিলেন, আর তাঁর জায়গায় এসে গিয়েছিলেন কেনেথ ডে।) ঠিক ছিল যে, একটা রবিবারে গিয়ে আমরা ছবি তুলব। আর যদি দরকার হয় তো পরপর দু’তিন রবিবার সেখানে যাওয়া যাবে।

সাতাশে অক্টোবর আমার স্ত্রীর জন্মদিন। ১৯৫২ সালের ওই রবিবারেই ক্যামেরা ক্রু আর দুটি শিশু উমা দাশগুপ্ত ও সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আমরা লোকেশনের দিকে রওনা হই। পৌঁছতে-পৌঁছতে দুপুর হয়ে যায়। চটপট দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা কাজে নেমে পড়ি। গল্পাংশটা এখানে এইরকম: বেলা একটু বাড়তে অপুর সঙ্গে দুর্গার একটা খিটিমিটি লেগে যায়। জিভ বার করে ভাইকে ভেংচি কেটে দৌড়ে পালায় দুর্গা। শোধ নেবার জন্যে অপু তার পিছনে ছোটে। কাশফুলে ছাওয়া মাঠের মধ্যে তারা পৌঁছে যায়। সেখানে একটা টেলিগ্রাফের খুঁটি দেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। খুঁটিতে কান লাগিয়ে দুর্গা একটা রহস্যময় শোঁশোঁ শব্দ শোনে। অপুও খুঁটিতে কান লাগায়। দুর্গা সেখান থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে একখানা আখ চিবোতে থাকে। পথের ধারের খেত থেকে সে আখখানা তুলে এনেছিল। অপু এবারে দৌড়ে চলে আসে তার দিদির কাছে। দিদির সঙ্গে সে ভাব করে নিতে চায়। ঠিক এই সময়েই শোনা যায় একটা রেলগাড়ির ঝিক-ঝিক শব্দ। দুর্গাই শব্দটা প্রথম শুনেছে। রেলগাড়িটা ক্রমে এগিয়ে আসে। অবাক বিস্ময়ে দুজনে দেখতে থাকে লৌহময় সেই যন্ত্রদানবকে। তাদের বাড়ির থেকেও রেলগাড়ির শব্দ শোনা যায় বটে, কিন্তু রেলগাড়ি যে কেমন জিনিস, তা তারা এই প্রথম দেখল।

ঠিক করেছিলাম যে, প্রথম দিনে শুধুই টেলিগ্রাফের খুঁটির দৃশ্যটা তোলা হবে। লম্বা কাশফুলের জঙ্গলের মধ্যে দিদিকে হারিয়ে ফেলেছে অপু, তারপর খানিক বাদে তাকে আবার দেখতে পেয়েছে।

নিয়মিত কাজের লোকজন আমাদের ছিল না। বংশীর সাহায্য অবশ্য সব ব্যাপারেই পাওয়া যেত। তা ছাড়া ছিলেন প্রোডাকশন কন্ট্রোলার অনিল চৌধুরি (এখনও তিনি আমার ছবিতে ওই একই কাজ করে যাচ্ছেন), আশিস বর্মন আর সুব্রত মিত্র। ক্যামেরার সঙ্গে অসিত সেনও এসে যান। আর-কিছু নয়, নৈতিক সমর্থনটা তিনি জুগিয়ে যেতেন।

কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু হাঁটছে। খানিকক্ষণের জন্য চোখের আড়ালে চলে গেছে দিদি। অপু তাকে ডাকছে। প্রথম দিনের শুটিংয়ে এই দৃশ্যটা রাখা হয়। যখন-যখন দরকার হবে, চেঁচিয়ে আমি যেন ‘অ্যাকশন’ কি ‘কাট্’ বলি, বংশী এটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল।

‘ওয়াল’ ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারে চোখ রাখল সুব্রত। অনিলবাবু তাঁর ক্ল্যাপস্টিক এগিয়ে ধরলেন। হ্যাঁ, কাজ চালাবার মতন করে তখনকার মতো একজোড়া ক্ল্যাপস্টিক আমরা তৈরি করে নিয়েছিলাম। অপু এসে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, “অ্যাকশন!”

কিন্তু যা ভেবেছিলাম, তা আর হল কোথায়? দেখা গেল, যে-রকম ভঙ্গিতে হাঁটলে স্বাভাবিক হয়, অপু মোটেই সেভাবে হাঁটছে না। এমন আড়ষ্ট তার হাঁটার ভঙ্গি যে, মনে হয় যেন নিশিতে-পাওয়া অবস্থায় পা ফেলছে। অথচ, তাকে যে খানিক হেঁটেই থেমে দাঁড়াতে হবে, দিদির খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাতে হবে, তারপর ফের এগিয়ে যেতে হবে, এটা তাকে বলে দেওয়া হয়েছিল। তা সে করছে না, আর তার বদলে যা সে করছে, দামি নেগেটিভ খরচা করে তা-ই কিনা ধরে রাখা হচ্ছে ক্যামেরায়। বংশী বলেছিল, “পছন্দ না-হলেই ‘কাট্’ বলবে!” দ্বিরুক্তি না করে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “কাট্!”

একটা শিক্ষা হল। সেটা এই যে, এতদিনকার যা-কিছু প্রস্তুতি, তা জলে গেছে। অন্ধকার হল-এ বসে বছরের পর বছর ফিল্ম দেখতে-দেখতে ভেবেছি, কীভাবে একটা দৃশ্য ‘টেক্’ করতে হয়, কষ্ট করে পড়েছি পুডভকিন, আইজেনস্টাইন, রথা আর স্পটিসউডের লেখা, সেইসঙ্গে দেশি ফিল্ম সম্পর্কে আমার বিতৃষ্ণার কথাটাও কখনও গোপন করিনি। কিন্তু তার নিট ফল কী হল? না এমন একটা শট তুললাম, যার থেকে নিষ্প্রাণ ও নিরর্থক শটের কথা কল্পনাই করা যায় না। তবে একইসঙ্গে এটাও বলব যে, ত্রুটিটা যে শুধরে নেওয়া যাবে, এটা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। আসলে, একটা বাচ্চা ছেলের হাঁটাচলার মতো সামান্য একটা অ্যাকশনকেও বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখানোর কাজটা যে এত কঠিন, এই ধারণাই তখন আমার ছিল না।

এটা বোঝার পরে অপুর ভূমিকায় সুবীরকে সাহায্য করবার জন্য আমি কিছু কৌশল খাটাই। যেখান দিয়ে সুবীর হেঁটে যাবে, সেই কাশবনের মধ্যেই এদিকে-ওদিকে খানিক-খানিক দূরত্বে দাঁড় করিয়ে দিই অনিলবাবু, বংশী আর আশিসকে। সুবীর যখন হেঁটে যাবে, তখন, একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর, পরপর তারা সুবীরের নাম ধরে ডাকবে। আর সুবীরও সেই ডাক শুনে, যেদিক থেকে ডাকটা আসছে, মুখ ফিরিয়ে সেই দিকে একবার তাকাবে। তবে তার হাঁটা তাই বলে থেমে যাবে না। তার পথের উপরে এখানে-ওখানে কয়েকটা শুকনো ডালও ফেলে রাখবার ব্যবস্থা করি আমি। যেগুলি তাকে লাফিয়ে পার হতে হবে।

দৃশ্যটা দ্বিতীয়বার তোলা হয়। যেমন বলে দিয়েছিলাম, তিন সহকারী সেইমতো সুবীরের নাম ধরে ডাকে। সুবীরও সেই ডাক শুনে মুখ ঘোরায়। এটাই পরে যখন পর্দায় দেখা যাবে, তখন মনে হবে, দুর্গার খোঁজ করতে-করতে অনিশ্চিতভাবে পা ফেলে সে সামনে এগোচ্ছে। দৃশ্যটা একেবারে নিখুঁতভাবে এসে গেল। সহজাত অভিনয়-প্রতিভা যার নেই, এমন একটি বাচ্চা-ছেলেকে দিয়ে কীভাবে অভিনয় করিয়ে নিতে হয়, এটা আবিষ্কার করে ফেলেছি, তাই খুব সহজেই সে-দিন আমি ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারতাম। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি অভিব্যক্তি যাতে সহজ ও স্বাভাবিক বলে মনে হয়, তার জন্য, ‘পথের পাঁচালি’ তুলতে-তুলতে, এই রকমের নানা কৌশল আমাকে খাটাতে হয়েছে। সৌভাগ্যের কথা, সুবীরের চেহারাটা ঐ ভূমিকায় খুবই মানানসই ছিল, নইলে সেদিন সর্বনাশ ঘটে যেত!

দৃশ্যটা সেদিন চমৎকার এসে যায়। যা ভেবেছিলাম, তার এক-তৃতীয়াংশের মতো শুটিং হল। হাতে তখনও বেশ-কিছু টাকা রয়েছে। আর ফিল্ম যা মজুত রয়েছে, তাতে পরপর আরও দুই রবিবার শুটিং করা যাবে।

নেগেটিভগুলি ইতিমধ্যে ডেভেলাপ ও প্রিন্ট করা হল। কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে একটা ল্যাবরেটরিতে তার রাশ্ও দেখলাম আমরা। দেখে মনে হল, কাজ বেশ ভালই হয়েছে। পরের রবিবারের আগে আর শুটিং নেই, তাই যেটুকু যা কাজ হয়েছে, ইতিমধ্যে তার এডিটিংয়ের জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বংশী আমার সঙ্গে এক চিত্র-সম্পাদকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম দুলাল দত্ত। এ যখনকার কথা, দত্তমশাই তখন সবে একটা ফিচার-ফিল্ম সম্পাদনা করেছেন। তবে অ্যামেচার হিসেবে তার আগেও তিনি গোটা কয়েক ছবির এডিটিং করেছিলেন বটে। এখন অবশ্য তিনি একজন অগ্রগণ্য চিত্র-সম্পাদক। এডিটিংয়ের জন্য একটা মুভিয়োলা মেশিন ভাড়া করে পারম্পর্য অনুযায়ী আমাদের শটগুলোকে জোড়া লাগাতে বসে যাই।

এখানে পাওয়া গেল আর-একটা শিক্ষা। এমন শিক্ষা, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। জুড়তে হলে কাটাছেঁড়া করতে হয়। কিন্তু সে-কাজ করতে বসে দেখি, শটগুলোর কোনওখানেই কাটা চলছে না। কথাটাকে ঘুরিয়ে বলতে পারি, যে-রকম নির্দেশ দিয়েছিলাম, ঠিক সেইভাবেই শটগুলি নেওয়া হয়েছে, কিন্তু জুড়ে দেবার পরে আর সেগুলি মসৃণ একটা স্রোতোধারার মতন বয়ে যাচ্ছে না। এটাও বুঝলাম যে, ওই কাটছাঁটের বিধানটা সর্ব অবস্থায় প্রযোজ্য হতে পারে না। একটি চরিত্র আর-একটি চরিত্রের অনুসরণ করছে, এই অবস্থায় দুটি চরিত্র সম্পর্কেই দর্শকদের আগ্রহ সমান মাত্রায় বজায় রেখে এবং সিনেমার দিক থেকে দৃশ্যটিকে কৌতূহলোদ্দীপক করে ছবি তোলা, স্রেফ এই একটা কাজ নিয়েই দেখা দিতে পারে এত সব সমস্যা যে, তাই নিয়ে ফিল্মের ব্যাকরণবিদ্‌দের পক্ষে পুরো একটা অধ্যায় লিখে ফেলা সম্ভব।

ভেবেছিলাম, দৃশ্যটি নিয়ে যে কাজ চলছে, সেটাকে এগিয়ে নিতে পরের রবিবারেও তো আমরা একই লোকেশনে শুটিং করতে যাচ্ছি, তখন এ-সব ত্রুটি শুধরে নেব। কিন্তু সেই রবিবারে যথাস্থানে গিয়ে যা দেখলাম, তার কথা ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকায় আমার নিবন্ধে আমি ইতিপূর্বেই জানিয়েছি। নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশটা এখানে তুলে দিচ্ছি:

“পরের রবিবারেও আমরা সেই একই লোকেশনে যাই। কিন্তু সত্যিই কি এটা সেই একই জায়গা? এ তো বিশ্বাসই করা যায় না। আগের বারে যে জায়গাটাকে সাদা কাশফুলের এক বিশাল সমুদ্র বলে মনে হয়েছিল, এখন তো সেখানে পাঁশুটে ঘাস ছাড়া আর কিছুই নেই। কাশ যে মরশুমি ফুল, তা আমরা ভালই জানি, কিন্তু সেই ফুল তো এত স্বল্পায়ু হতে পারে না। তা হলে? উত্তরটা এক স্থানীয় চাষির কাছে পাওয়া গেল। সে বলল, কাশ হচ্ছে গোরু-মোষের খাদ্য। আগের দিন বিস্তর গোরু আর মোষ ওখানে চরতে এসেছিল। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের দৃশ্যটিকে তারা খেয়ে ফেলেছে।”

এ একটা বিরাট রকমের ধাক্কা, যার সামাল দিতে সেই প্রথম আমি অবস্থা বুঝে একটা আপোস-রফার কথা ভাবি। একবার মনে হল, কাশফুলের ব্যাপারটাই একেবারে বাদ দিয়ে দিই। যা করলে ছবিটার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ভেবেছিলাম যে, ধান কাটার সময় তো প্রায় এসে গেছে। রেলগাড়িটা একটা ধানখেতের পাশ দিয়ে চলে যাবে, আর ছেলেমেয়ে দুটি দূর থেকে দেখবে সেই দৃশ্য। আমার মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনটা চলে যাচ্ছে, আর দূরে দাঁড়িয়ে অপু আর দুর্গা সেই দৃশ্য দেখছে, এমন একটা শট বস্তুত নিয়েছিলাম। ওয়াল ক্যামেরাটা পাইনি বলে একটা হ্যান্ড হেল্ড আইমো ক্যামেরা আমরা ব্যবহার করি। এই আইমো ক্যামেরায় ২.৫ মিলিমিটারের একটাই মাত্র ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স। ক্যামেরা ব্যবহারে কোনও ভুলচুক হয়নি। কিন্তু লেন্সটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে কেবল ট্রেনটির উপর। ফলে, দেখা গেল, যা-কিছু গুরুত্ব, সেটা ওই রেলগাড়ির উপরে পড়েছে। ফলে শটটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একেবারেই গুরুত্বহীন। তখনই প্রতিজ্ঞা করি, ঢের হয়েছে, ভুলেও আর কখনও আপোসের পথে হাঁটব না। এটাও ঠিক হয় যে, আপাতত কিছুদিনের জন্য শুটিং বন্ধ থাকবে, আমরা এখন অন্য কয়েকটা ব্যাপারে মন দেব। এই যেমন জনাকয় সহকারী জোগাড় করব, একজন সাউন্ড-রেকর্ডিস্ট খুঁজে নেব, অন্যান্য চরিত্রে কারা অভিনয় করবেন সেটা ঠিক করব। সর্বোপরি খোঁজ করব, বুড়ি পিসির ভূমিকায় কাকে নামানো যায়। উপন্যাসের ঘটনাস্থল নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম; সুতরাং ওই রকমের একটা গ্রামও ইতিমধ্যে খুঁজে বার করা চাই।

শেষ পর্যন্ত যে গ্রামটা আমাদের পছন্দ হয়, আমাদের ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য মনোজ মজুমদার তার খোঁজ দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র চার মাইল। তাতে সুবিধে এই যে, নিত্য সেখানে আমরা যেতে পারব। গ্রামের নাম বোড়াল। মনোজের এক আত্মীয় সেখানে থাকেন। এক বিকেলে মনোজ তাঁর বাড়িতে আমাদের নিয়েও যান। বোড়াল বেশ বড় গ্রাম। একটা স্কুলও সেখানে রয়েছে। গ্রামের একটা অংশ দেখতে অনেকটা ছোটখাটো শহরের মতো। ঠিক এই ধরনের গ্রামে আমাদের চলবে না। এদিকে আবার আমগাছ, বাঁশঝাড়, ফাঁকা মাঠ, পুকুর, ডোবা, জলের মধ্যে পদ্মফুল, খোড়ো চালের মাটির ঘর, এইসব দেখে মনে হল, এটাই তো আমরা চাইছিলাম। উপন্যাসের গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গিয়েছে। এখানে একটা নদী থাকলে ভাল হত। কিন্তু নেই যখন, তখন কী আর করা, ওটা আমরা বাদ দেব বলে ঠিক করলাম। আসলে কলকাতার এত কাছে যে একটা গ্রামের খোঁজ মিলেছে, এটাই তো মস্ত বড় ভাগ্যের ব্যাপার।

বোড়ালে একটা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি আমাদের চোখে পড়ে। বাড়ি মানে দুটো ঘর আর একফালি বারান্দা। বইয়ে হরিহরের বাড়ির যে বর্ণনা আছে, তার সঙ্গে এটা মিলে যায়। উঠোনের একধারে একটা খোড়ো ঘরের ধ্বংসাবশেষও রয়েছে। ওটাই হবে বুড়ি পিসির থাকার জায়গা। হেঁশেল নেই। কিন্তু উঠোনে যে জায়গা রয়েছে, তাতে অক্লেশেই একটা হেঁশেল ওখানে বানিয়ে নেওয়া যায়। বংশী বলল, ওটা সে খুব সহজেই বানিয়ে দিতে পারবে। শুটিং শুরু করবার আগে অবশ্য গোটা জায়গাটাকে পরিষ্কার করে একটু অদলবদল করে নেওয়া দরকার। সেইসঙ্গে সদর-দরজা সমেত একটা পাঁচিলের ঘেরও চাই। খোঁজ করে জানা গেল যে, কে এক ঘোষাল এই বাড়ির মালিক। তিনি দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। আর-একটু খোঁজ করে তাঁর ঠিকানাটাও জোগাড় করা গেল। আর কালবিলম্ব না-করে আমরা গিয়ে ঘোষালমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর বোড়ালের বাড়িটা যে আমাদের দরকার, এটা শুনে প্রথমটায় তিনি একটু দোনোমনা করতে থাকেন, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলেন না।

গোড়াতে দরজার কাছে তাঁর ছেলের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। ছেলে আমাদের আসার কারণ জিজ্ঞেস করে, তারপর সব শুনে ছোট্টমতন একটা শোবার ঘরে আমাদের নিয়ে যায়।

ঘরের মধ্যে শুয়ে আছেন তার বাবা। দেখলেই বোঝা যায় যে, ভদ্রলোক শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আমাদের আসার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করে বিনীতভাবে তাঁকে বলি যে, আমরা একটা ফিল্ম তুলছি, তার জন্যে তাঁর বোড়ালের ভেঙে-পড়া বাড়িটা আমরা ব্যবহার করতে চাই।

“ভাঙা বাড়ি?” শ্বাসকষ্টের রুগিটি একেবারে হুঙ্কার ছেড়ে তাঁর বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। “কে বলেছে ওটা ভাঙা বাড়ি? চমৎকার বাড়ি আমার।”

এ ব্যাপারে কোনও তর্ক না-করাই যে শ্রেয়, সেটা বুঝে নিয়ে আমরা বলি, “কথা হচ্ছে ওখানে শুটিং করবার জন্য আপনার অনুমতি পাওয়া দরকার।”

“তা বাড়িটা কদ্দিন ব্যবহার করবেন?”

“তা তো এক্ষুনি বলতে পারছি না। এই ধরুন চার-ছ মাস লেগে যেতে পারে।”

আরও কিছু কথা। আরও কিছু খক্-খক্ কাসি। কাসির দমক থামবার পর ঘোষালমশাই বললেন, “মাস-মাস যদি পঞ্চাশ টাকা করে ভাড়া দেন তো বাড়িটা আপনাদের ব্যবহার করতে দেব।”

অনিল চৌধুরি বললেন, “আমাদের শুটিং শেষ হয়ে যাবার পর বাড়িটা তো আপনি আগের মতোই ব্যবহার করতে পারবেন।”

“ও-বাড়ি ব্যবহার করতে আমার বয়েই গেছে।” ঘোষালমশাই ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন যে, তাঁর কথা শেষ হয়েছে। আমরাও উঠে পড়লাম। ছেলেটি দরজা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এল। আমরা জায়গাটা পরিষ্কার করার আর কিছু-কিছু জিনিস বানিয়ে নেবার কাজ তাড়াতাড়ি শুরু করতে চাই। তাতে ছেলেটি বলল দু’-এক দিনের মধ্যে আমরা তার সঙ্গে এ-ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পারি। এটাও সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল যে, শুটিং শুরু হবার দিন থেকে নয়, বাড়ির কাজে যেদিন থেকে আমরা হাত দেব, সেদিন থেকেই ভাড়া দিতে হবে।

বংশী আর অনিলবাবু তার এক হপ্তার মধ্যেই কাজে লেগে যায়। নিত্য তারা বোড়ালে যাতায়াত করতে থাকে, আর আগের সেই দু’দিনের শুটিংয়ের পরে যে-টাকাটা থেকে গিয়েছিল, তাই দিয়ে মজুর খাটিয়ে জায়গাটা ঠিক করে ফেলে। বোড়ালের বাসিন্দাদের পক্ষেও আমাদের শুটিং একটা বিরাট উত্তেজনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে যেন এটাই একটা জোয়ার এনে দিয়েছিল। বোড়ালের লোকদের মধ্যে দুজন ছিলেন একটু ছিটেল গোছের। দুজনের একজন স্বভাবকবি। লোকেশনের একেবারে পাশেই ইনি থাকতেন। মাঝে-মাঝেই যে ইনি তারস্বরে কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন, সেটা অবশ্য তখনও আমরা টের পাইনি। পরে আমরা বুঝতে পারি যে, শুটিংয়ের সময়ে ইনি কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন। অন্যজন মাঝে-মাঝে হাঁক ছাড়তেন: “ফিল্মের দল এয়েচে—বল্লম নিয়ে লাপিয়ে পড়ো।” ভদ্রলোকের নাম সুবোধ চট্টোপাধ্যায়। পরের দিকে এঁর সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব জমে যায়। প্রায় সর্বক্ষণই ইনি এই বলে গজর-গজর করতেন যে, আত্মীয়স্বজনরা এঁর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে।

বংশী আর অনিলবাবু যখন হরিহরের বাড়িটিকে শুটিংয়ের উপযোগী করে তুলছে, আমি তখন বাদবাকি ভূমিকাগুলির কোনটা কাকে দেব, তা-ই ভাবছি। অথচ প্রযোজক যে একজন পাওয়া যাবে, তার কোনও লক্ষণ তখনও দেখছি না। সেই সময় একটা বুদ্ধি মাথায় আসে।

মধ্যবয়সী যে ভদ্রলোকের সঙ্গে এই সময়ে আমি দেখা করি তাঁর নাম শিশির মল্লিক। আগে থাকতেই এঁকে আমরা চিনতাম। সেই সময়ে ‘স্টার’ই ছিল কলকাতার একমাত্র শীতাতপনিয়ন্ত্রিত থিয়েটার-হল। আর এই ভদ্রলোকই তখন তার মালিক। ছবি তোলার ব্যাপারটা নিয়ে এর আগে আমি মল্লিকমশাইকে কিছু বলিনি। এখন মনে হল, ভদ্রলোককে একটু বাজিয়ে দেখলে হয়। একদিন তাঁকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বইটা তাঁর পড়া ছিল। তাই নিয়ে যে আমি ছবি তুলতে চাই, এটা শুনে ভদ্রলোক একটু কৌতূহল বোধ করছেন বলে মনে হল। মল্লিকমশাই আমার পূর্বপুরুষদের চেনেন। মার্জিত রুচির শিক্ষিত মানুষ। চিত্রনাট্যের বিন্যাসটা কীভাবে করেছি, সেটা বেশ উৎসাহের সঙ্গে তাঁকে বুঝিয়ে বলা গেল। দুর্গার মৃত্যু পর্যন্ত দৃশ্যগুলিকে বর্ণনা করে গেলাম ধাপে-ধাপে। তাতে কাজ হল। আমার কথা যখন শেষ হল, ভদ্রলোকের চোখে তখন জল এসে গেছে। বললেন যে, এত ভাল চিত্রনাট্য তিনি এর আগে কখনও শোনেননি। তাঁর নিজের অবশ্য চিত্র-প্রযোজক হবার ইচ্ছা নেই, তবে রানা দত্ত অ্যান্ড কোং বলে এক নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের তিনি চেনেন, আমার ছবিতে তাঁরা যাতে টাকা ঢালেন, তার জন্যে তিনি জোর সুপারিশ করবেন। মল্লিকমশাইয়ের কাছে এটাও জানা গেল, সদ্য একটা হিট-ছবি তুলে তাঁরা এখন দ্বিতীয় ছবিতে টাকা ঢেলেছেন, তবে তৃতীয় ছবিতে লাগাবার মতো আর্থিক ক্ষমতাও তাঁদের আছে। রানাবাবুর সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, একটা কাজের মতো কাজ করছি আমরা। প্রথম কিস্তিতে রানাবাবু আমাদের চল্লিশ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। একইসঙ্গে খুবই কুণ্ঠিতভাবে বলেন যে, যা আমরা চেয়েছি, তার সবটা দিতে পারলেই তিনি খুশি হতেন, তবে যদি তিনি বুঝতে পারেন ভাল একটা ছবি করবার মতো পেশাদারি দক্ষতা আছে আমাদের, তা হলে বাদবাকি টাকাটাও তিনি নিশ্চয় দেবেন। আমার তো তখন ‘হুর্‌রে’ বলে চেঁচিয়ে উঠবার অবস্থা। অনেক কষ্টে উচ্ছ্বাস চেপে রেখে বললাম যে, বাড়ির যে মেরামতি চলছে, সেটা শেষ হবামাত্র আমরা ছবির কাজ শুরু করে দেব।

প্রোডাকশনের ব্যাপারে যে-সব ফাঁক রয়ে গেছে, সেগুলি ভরাট করাই এখন প্রথম কাজ। বংশী যোগাযোগ করল শান্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সহকারী পরিচালক হিসেবে এঁর বেশ ভাল রকমের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বুঝতেই পেরেছিলাম যে আমার একজন অভিজ্ঞ সহকারী চাই। এটা চাই ছবির কন্টিনুইটি বা পারম্পর্য রক্ষার জন্য। পারম্পর্য রক্ষার কাজটা বেশ কঠিন, ও-কাজ অভিজ্ঞ লোক ছাড়া হবার নয়। ছবি তো একটানা তোলা হয় না, তোলা হয় টুকরো-টুকরো করে। অনেক সময় একটা অ্যাকশনকে ভেঙে দিয়ে চলে যেতে হয় অন্য একটা শটে। পরে এমনভাবে সেই টুকরোগুলিকে কাটছাঁট করে জোড়া লাগাতে হয়, যাতে অ্যাকশনগুলির মধ্যে কোনও অসঙ্গতি না ঘটে। শটগুলি যে সেইভাবেই তোলা হচ্ছে, সেটা দেখবার জন্যই চাই একজন পাকাপোক্ত সহকারী পরিচালক। শান্তি এ-দিকটায় নজর রাখত। নতুন আর-একজন সহকারী পাওয়া গেল একাধারে কেটারিং ব্যবসার মালিক ও লেখক আশিস বর্মনকে। আরও অনেকের মতো তাঁকেও এই সময়ে টাকাপয়সা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ বিনাবাক্যে তিনি তাঁর কেটারিংয়ের ব্যবসার পাট তুলে দিয়ে আমাদের কাজে লেগে পড়েন। শান্তি সে-ক্ষেত্রে পেশাদার লোক, তা ছাড়া সেই সময়ে তার খুব টানাটানিও চলছিল, ফলে তার জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করতেই হয়। চুনিবালার কথায় একটু পরে আসব। আপাতত বলি, তাঁকেও রোজ তখন কুড়ি টাকা করে দিতে হত। কিছু টাকা দিতে হত শব্দযন্ত্রীদেরও। উপরন্তু ফিল্মের দাম, ক্যামেরার ভাড়া, ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্টদের প্রাপ্য, যাতায়াতের খরচা আর বোড়ালের সেই বাড়ির বাবদে মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার ব্যাপারটা তো ছিলই। খরচা-পাতি আরও নানা রকমের। রানাবাবুর কাছ থেকে পুরো টাকাটা না-পাওয়া পর্যন্ত যার হিল্লে হওয়া সম্ভব ছিল না।

এই সময়েই আমার মনে হয় যে, কিমারে আমার ম্যানেজারের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলা দরকার। মিঃ ডে’র সঙ্গে দেখা করে আমি তাঁকে সব জানাই। বলি যে, বিনা বেতনে আমার এক মাস ছুটি চাই। সেই সঙ্গে এই অনুমতি চাই যে, ছুটি ফুরোবার পরে রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে আমি শুটিং করব। ফিল্মের মাধ্যমে নিজের সৃষ্টিবাসনাকে প্রকাশ করবার যে তাগিদ আমি অনুভব করছিলাম, সেটা তাঁকে বুঝিয়ে বলি। এও বলি যে, এখনই আমি চাকরি ছাড়ছি না। তবু যে ছুটিটা চাইছি, তার কারণ, কাজটা যে আমি করতে পারি, তার প্রমাণ হিসেবেই ছবির খানিকটা অংশ আমাকে খুব তাড়াতাড়ি এখন তুলে ফেলতে হবে। মিঃ ডে আমার বক্তব্য সহানুভূতির সঙ্গে শুনলেন। তারপর বললেন, “তোমাকে বাধা দিয়ে যে কোনও লাভ হবে না, সেটা বুঝতে পারছি। তবে তোমার কাছে এই আশ্বাসটা আমি চাইছি যে, এখানকার চাকরিটা তুমি ছেড়ে দেবে না। যেমন আমার তেমন কিমারেরও তোমাকে দিয়ে দরকার রয়েছে।” তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে কিমারের সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি চলে আসি।

পেশাদারদের মধ্যে অর্থাৎ চলচ্চিত্র ও মঞ্চে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁদের মধ্য থেকে দুজন অভিনেত্রীকে আমরা বেছে নিই। এঁরা হলেন রেবা দেবী ও অপর্ণা দেবী। দুজনেই অভিনয় করবেন হরিহরের প্রতিবেশিনীর ভূমিকায়। তফাত এই যে, একজন সর্বজয়ার প্রতি সহানুভূতিশীলা, আর অন্যজন যেমন স্বার্থপর তেমন নীচ স্বভাবের। এই দ্বিতীয়জন হচ্ছেন বিস্তর জমির মালিক এক ধনী ব্যক্তির স্ত্রী। এই রেবা দেবী আমাদের একজন অভিনেত্রীর খোঁজ করতে বলেন। শুনলাম, মঞ্চে তিনি তিরিশ বছর অভিনয় করেছেন, কিন্তু তাঁর কথা কেউ মনে রাখেনি। রেবা দেবী বলেন, “এখন তাঁর বয়েস তা ধরুন আশি বছর তো হবেই। অনেককাল তিনি অভিনয় করেননি। তবে এটা জানি যে, তিনি বেঁচে আছেন।” নিভাননী দেবীর (ইনিও একজন অভিনেত্রী) কাছে যে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে, এটাও রেবা দেবীর কাছে জানা গেল। নিভাননী দেবী তখন শহরের আর-এক প্রান্তে থাকেন। তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশের কোঠায়। তবে মঞ্চে ও পর্দায় তখনও তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। ঠিকানা জোগাড় করে অনিলবাবু বংশী আর আমি এক রবিবারের সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।

এককালের অভিনেত্রী চুনিবালার কথা জিজ্ঞেস করতে নিভাননী বললেন, “যাক্, শেষপর্যন্ত আমার মায়ের কথা তা হলে আপনাদের মনে পড়ল।” নিভাননী কিন্তু সত্যি-সত্যি চুনিবালার মেয়ে নন। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা আর ভালবাসার টানেই চুনিবালাকে তিনি ‘মা’ বলে ডাকেন। বললেন, “আপনারা বসুন, চা খান, ততক্ষণে আমি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসি।”

বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। দেওয়ালে প্রচুর ছবি ঝুলছে। সবই পুরনো দিনের ফোটোগ্রাফ। একটা ফোটোগ্রাফে দেখা যাচ্ছে যে, শার্ট আর ধুতি পরা এক ভদ্রলোকের পায়ের কাছে নিভাননী বসে আছেন। নিভাননী যে এঁরই আশ্রয়ে আছেন, তা বুঝতে কোনও অসুবিধে নেই। অন্যান্য ফোটোগ্রাফে হরেক রকমের পোশাকে নিভাননীকে দেখা যাচ্ছে। নানা চলচ্চিত্রে আর নাটকে যে-সব চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, এগুলি তারই ছবি। আমাদের মাথার উপরে ঘুরছে চার-ব্লেডওয়ালা পুরনো একটা ফ্যান। তাতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হচ্ছে। চুপচাপ আমরা চুনিবালার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একটু বাদেই তিনি এসে গেলেন। পরনে সাদা থান। বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহ, গাল দুটি বসে গেছে, সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ফোকলা হাসি।

“দাঁড়াবেন না, বসুন আপনারা, বসুন।” চুনিবালা বললেন। একটিও কথা না-বলে চুপচাপ আমি বৃদ্ধাটিকে দেখে যেতে লাগলাম। কথা বলবার কোনও উপায়ও অবশ্য আমার তখন ছিল না, কেননা চুনিবালা ইতিমধ্যে গড়গড় করে নিজের বিষয়ে কথা বলতে লেগে গিয়েছিলেন সময়কালে কী সব বড়-বড় ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তারপর বয়স যখন চলে গেল, নায়িকার ভূমিকায় নামবার কোনও উপায় রইল না, তখন ছেঁড়া ন্যাতার মতন কীভাবে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছে,—সেইসব কথা।

নিভাননীই তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “মা, এনারা সিনেমার লোক। তোমাকে একটা পার্ট দেবেন। তাই নিয়ে কথা বলতে এয়েচেন।”

“তা আমার বয়েস তো আশি হল, এই বয়েসে আবার কী পার্ট করব?”

বললাম, “আশি বছর বয়সের এক বৃদ্ধার পার্ট। ”

“এ যা বললেন, এর তো কোনও জবাব নেই।” চুনিবালা হেসে বললেন।

রাজি তো হয়েছেন, এবারে এঁকে একটা প্রশ্ন করা দরকার। বুড়ি পিসির ভূমিকায় যে চেহারার দিক দিয়ে এঁকে দারুণ মানিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। খুবই জরুরি প্রশ্ন। সরাসরি তাই বললাম, “অভিনয়ের সময় ঘোরাফেরা হাঁটাচলা করতে-করতে আপনাকে কথা বলতে হবে। তা কথাগুলি আপনি মনে রাখতে পারবেন তো?”

“তা কেন পারব না? আমার স্মরণশক্তি তো নষ্ট হয়নি, বাবারা। দাঁড়ান, একটা ছড়া আপনাদের শুনিয়ে দিচ্ছি।”

আস্ত একটা ঘুমপাড়ানি ছড়া আমাদের শুনিয়ে দিলেন চুনিবালা। তাও আবার গানের মতন সুর করে শোনালেন। আমরা তো স্তম্ভিত। চেনা ছড়া। আমার ধারণা ছিল, ছ’ লাইনের ছড়া এটা। কিন্তু চুনিবালা দেখলাম কুড়ি লাইনেরও বেশি গাইলেন। আমার মাথায় ততক্ষণে আর-একটা চিন্তাও ঢুকে পড়েছে। ভদ্রমহিলা যখন গান গাইতে জানেন, বুড়ি পিসিকে তখন গান গাইবার একটা সুযোগ দিলেই তো হয়। সে তো দারুণ মর্মস্পর্শী একটা ব্যাপার হবে।

“কোথায় শুটিং হবে, বাবারা?” প্রশ্নটা চুনিবালার।

বললাম, “স্টুডিয়োতে নয়, একটা কুঁড়েঘরে। গল্পটা এক পুরুতঠাকুরের সংসার নিয়ে। সম্পর্কে আপনি তার দিদি। সেই বুড়ি দিদির ভূমিকায় আপনি অভিনয় করবেন। জায়গাটা এখান থেকে মাইল-পনেরো দূরে। গাড়িতে করে সরাসরি সেখানে আপনাকে নিয়ে যাব আমরা, তারপর সন্ধের মধ্যেই কাজ শেষ করে এখানে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। ধকলটা আপনি সহ্য করতে পারবেন তো?”

“তা পারব। বোধহয় ঠিক এই রকমের একটা সুযোগের জন্যেই শরীরের শেষ শক্তিটুকুকে ধরে রেখেছি। কিন্তু কী জানো বাবারা, আমার গায়ের চামড়া এখন খসখসে হয়ে গেছে। যারা অ্যাকটিং করে, তাদের গায়ের চামড়া মোলায়েম হওয়া চাই। তা আমাকে তোমরা রং-টং মাখিয়ে দেবে তো?”

বললাম, “না, আমাদের ছবিতে ও-সবের দরকার হবে না।”

চুনিবালাকে অতঃপর বুঝিয়ে বললাম যে, গতানুগতিক পথে না-হেঁটে একেবারে নতুন পদ্ধতিতে আমরা কাজ করতে চাইছি।

এতক্ষণ একেবারে নিঃশব্দে আমাদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলেন নিভাননী। এবারে তিনি মুখ খুললেন। বললেন, “রোজকার কাজের জন্য ওঁকে আপনারা দশটা করে টাকা দিতে পারবেন তো?”

অনিলবাবু বললেন, “কুড়ি টাকা করে দেব।”

বাস্, আর-কিছু বলবার দরকার হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *