৩. ফেড্ ইন, ফেড্ আউট

ফেড ইন, ফেড আউট

গোড়ায়-গোড়ায় ঠিক করেছিলাম, ‘পথের পাঁচালি’র কাহিনীটা যেমন-যেমন এগিয়েছে, শুটিংও হবে যথাসম্ভব সেই ধারা অনুযায়ী। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই টের পেয়ে যাই যে, কাজ করতে-করতেই শেখার কাজটা চলতে থাকবে। এর আগে যে বছরের পর বছর হলিউডের ফিল্ম দেখেছি, আর অন্ধকার হল্-এ বসে খুঁটিনাটি কত কিছু নোট করেছি, তাতে মোটামুটি জানা গেছে যে, ছবির বিষয়টা মার্কিন জীবনের হলে তার শুটিং কীভাবে করতে হয়। সে-ক্ষেত্রে ভারতীয় জীবন, বাঙালি জীবন, সর্বোপরি গ্রাম্য জীবন নিয়ে কীভাবে ছবি তুলতে হয়, সেইটে এবারে জানা দরকার। কয়েকটা দৃশ্যের কথা বলি। রেলগাড়ি, ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু, দুর্গা হার চুরি করেছে শুনে চুলের মুঠি ধরে তার মা তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছে, বৃষ্টির মধ্যে দুর্গার উচ্ছল নাচ, তার অসুখে পড়া, মারা যাওয়া, হরিহরের ফিরে আসা, ফিরে এসে দুর্গার মৃত্যুর খবর শোনা, সর্বজয়ার কান্নায় ভেঙে পড়া—এর প্রতিটিই অতি কঠিন দৃশ্য, আর এগুলির সবই রয়েছে ছবির দ্বিতীয়ার্ধে। এ-সব দৃশ্য তোলবার জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার, ভেবেছিলাম যে, মাসখানেক শুটিং করলেই সেটা আমার হয়ে যাবে। বোড়ালের বাড়িটার ব্যাপারে যা-যা অদল-বদল করা দরকার, বংশী তা ইতিমধ্যে অতি চমৎকারভাবে করে ফেলেছিল। ক্ষেত্র প্রস্তুত দেখে আমরাও ঠিক করলাম যে, শুটিংয়ের কাজ ওইখান থেকেই শুরু হবে।

মস্ত একটা বাধা তো পেরিয়ে আসা গেল। কিন্তু গ্রামজীবন বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, সে-বিষয়ে অন্তত তখনও পর্যন্ত কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। বংশী যখন বাড়িটা নিয়ে তার কাজ করছিল, তখন অবশ্য মাঝে-মাঝেই সেখানে গিয়েছি। সেখানকার লোকজনদের সঙ্গে কিছু-কিছু পরিচয়ও হয়েছে, তারা তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চা আর ঘরে-তৈরি মিষ্টিও যে আমাদের খাওয়ায়নি তা নয়। ফলে উপন্যাসের মধ্যে যে জীবনের বর্ণনা পাচ্ছি আমরা, ধীরে-ধীরে তার সম্পর্কে একটা ধারণাও আমাদের গড়ে উঠেছিল। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এ আমি তো লিখেছিলাম যে, এই কাহিনীর যেটা বীজ, তার বিষয়ে কোনও প্রত্যক্ষ ধারণা আমার ছিল না। ফলে মূল বইয়ে যে বর্ণনা পাচ্ছি, তারই উপরে নির্ভর করতে হয় আমাকে। বইখানিকে অবশ্য বাংলার গ্রাম-জীবনের বিশ্বকোষ বললেই হয়। তবে শুধু তারই উপরে নির্ভর করলে যে চলবে না, তাও আমি জানতাম। আরও বহু জিনিস আছে যা আমায় নিজেকেই আবিষ্কার করতে হবে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাকে ঠিকমতো বুঝতে গিয়ে দেখলাম আমার চোখের সামনে এক আশ্চর্য জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে। শহরে আমার জন্ম, শহরেই আমি বড় হয়ে উঠেছি। আমার কাছে, এই স্বাদ আর বিন্যাস একেবারেই নতুন, এর মূল্যবোধও সম্পূর্ণ আলাদা। মনে হত, সবকিছু ছুঁয়ে দেখি, ভাল করে বুঝে দেখি; যে-সব খুঁটিনাটি কাজকর্ম, শারীরিক ভঙ্গিমা আর কথাবার্তার ভিতর দিয়ে উন্মোচিত হচ্ছে এখানকার জীবনধারা, সেগুলির উপরে নজর রাখি। গ্রামীণ পরিবেশের যে রহস্য, সেটা বুঝে নিতে চাইতাম। সেই পরিবেশ দৃশ্যময়, কিন্তু নিঃশব্দ। প্রত্যুষ আর প্রদোষকালের মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, সেটা বোঝা চাই। বর্ষার প্রথম বর্ষণের আগে যে একটা ধূসর গুমটভাব দেখা দেয়, চতুর্দিক জুড়ে বিরাজ করতে থাকে শব্দহীন এক স্থিরতা, সেটা ধরা চাই। বসন্তকালের রোদ্দুর আর শরতের রোদ্দুর কি একইরকম? যতই সব নজর করে দেখি, ততই সেই জগৎ আমার কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। অতি-নৈকট্য নাকি বিরূপতার জন্ম দেয়। না, তা নয়, আমার ক্ষেত্রে এই নৈকট্য থেকে ভালবাসা জন্ম নিয়েছিল। গ্রামজীবনকে আমি ভালবেসেছিলাম, তাকে বুঝতে ও তার সম্পর্কে সহিষ্ণু হতে শিখেছিলাম।

‘পথের পাঁচালি’ কীভাবে তুলেছিলাম, তার কোনও ডায়েরি আমি রাখিনি। ফলে, রানার টাকা নিয়ে কবে আমি ফের শুটিং শুরু করি, তা আমি সঠিক বলতে পারব না। শুধু এইটুকু মনে আছে যে, সালটা ১৯৫৩, আর কলকাতায় সেটা মরশুমের গোড়ার দিক। সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে এইটে ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, প্রোফেশনালিজ্‌ম বা পেশাদারি দক্ষতা বলতে যা বোঝায়, সে বস্তুটা আমাদের মধ্যে একেবারেই ছিল না। একটা কর্মসূচি আমরা খাড়া করেছিলাম মাত্র। কিন্তু এই কাজটা অমুক দিনে অমুক সময়ে করতেই হবে, তার আর কোনও নড়চড় হবে না, এমন কোনও বাঁধাবাঁধি তাতে রাখা হয়নি। তা ছাড়া, আগেই বলেছি, তেমন কোনও চিত্রনাট্যও আমাদের ছিল না, যেটা অনুসরণ করে শুটিংয়ের কাজ চলবে। আসলে, কোন্ শটটা কেমন হবে, সেটা ছবি এঁকে দেখাবার একটা অভ্যাস ইতিমধ্যে আমার হয়ে গিয়েছিল। দেখে মনে হত, গল্পটা যেন পরপর ছবি এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্পাদনা কেমন হবে, এ থেকে তারও আন্দাজ পাওয়া যেত। সুব্রত, বংশী আর আমার প্রথম সহকারী শান্তি এতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। সত্যি বলতে কী, তাদের মনে হত যে, টাইপ-করা চিত্রনাট্যের চেয়ে বরং এই ছবিগুলির ভিতর দিয়েই আমার বক্তব্য অনেক বেশি প্রকাশ পাচ্ছে, এতেই তাদের কাজের সুবিধে। শুটিংয়ের দিন-কয়েক আগে কিছু লিখিত নোট তাদের হাতে তুলে দেওয়া হত। সংলাপ থাকত যথাসম্ভব কম। যেটুকু থাকত, তাও বই থেকে সরাসরি নেওয়া। একটা দৃশ্যের জন্য খুবই সহজ-সরল কিছু কথাবার্তার দরকার হওয়ায় আমার লেখক-সহকারী আশিসকে আমি সেটা লিখে দিতে বলি। তাতে সে চড়া রকমের একটা সাহিত্যিক সংলাপ লিখে দেয়। সংলাপটা পড়ে তাকেই সেটা আমি ফিরিয়ে দিই। আসল কথাটা এই যে, ফিল্ম তৈরি করার সমস্যাগুলি যখন আপনার চোখের আড়ালে চলে যায়, ক্যামেরার গুরুত্বও তখন আপনার কাছে ক্রমেই খাটো হয়ে আসতে থাকে। ওটা তো আর কিছুই নয়, একটা যন্ত্র মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল সত্য। বাস্, সত্যটাকে আঁকড়ে ধরুন, অমনি সব কালজয়ী শিল্পকীর্তি আপনার হাতে তৈরি হতে থাকবে। কিন্তু এই যে আমাদের বিশ্বাস, এর চেয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস আর কিছুই হয় না। যখনই আপনি সেট্-এ গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তেপায়া ওই যন্ত্রটিই তখন প্রভু। তাকে নিয়েই তখন সমস্যার পর সমস্যা। কোথায় তাকে বসাবেন? উঁচুতে, না নিচুতে? কাছে, না দূরে? ডলিতে, না মাটিতে? থার্টি ফাইভ-এই কাজ হবে? নাকি একটু পিছু হটে ফিফটির ব্যবস্থা করবেন? অ্যাকশনের খুব কাছাকাছি চলে গেলে দৃশ্যটার যে আবেগ, ক্যামেরায় তার সবখানি হয়তো ধরা যাবে না। আবার খুব দূরে চলে গেলেও দেখা যাবে, দৃশ্যটা বড় ঠাণ্ডা মেরে গেছে, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এই যে সব সমস্যা, চটপট এর সমাধান খুঁজে নেওয়া চাই। দেরি করলে রোদ্দুর সরে যাবে, দোনোমনার ফল দাঁড়াবে শূন্য।

বোড়ালে প্রথম দিনের শুটিংয়ের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। দুর্গা আর ইন্দির ঠাকরুনকে নিয়ে ফিল্মের সেটি প্রথম দৃশ্য। দুর্গার বয়েস তখন মাত্র ৪/৫ বছর। ছেলেবেলার সেই দুর্গার চরিত্রে নামানো হয়েছিল করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে রুনকিকে। ইন্দির, ঠাকরুন তাঁর ঘরের বারান্দায় বসে দুধে-ভেজানো মুড়ি খাচ্ছেন, আর বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে দুর্গা। আশা করছে, মুড়ির কিছুটা ভাগ সেও পাবে। এই যে দৃশ্য, এতে ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে চুনিবালার কোনও সমস্যাই নেই। তাঁকে শুধু একটাই লাইন বলতে হবে: “ওই দ্যাখো —তোর জন্যি তো রাখলাম না এট্টুকুও! দাঁড়া!” বাকি সময়টা তিনি শুধু খেয়ে যাবেন, একজন অভিনেত্রীর কাছে এর চেয়ে সহজ কাজ আর হয় না। কাশবনে অপুর হাঁটা দেখে কিন্তু একটা শিক্ষা আমার হয়েছিল। আমি বুঝেছিলাম, দুর্গা যদি কিছুই কাজ না করে এই দৃশ্যে স্রেফ বসে-বসে ইন্দির-ঠাকরুনের খাওয়া দেখে যায়, তা হলে সেটাও খুব নিষ্প্রাণ ঠেকবে। আমি তাই তাকে একটা ‘কাজ’ জুটিয়ে দিই। তাকে রুপুলি রঙের একটা ফিতে দিয়ে বলি, ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের তর্জনীতে সে যেন এই ফিতেটা আস্তে-আস্তে জড়াতে আর খুলতে থাকে। তা হলেই এমনটা দেখাবে যেন তার অর্ধেকটা মন রয়েছে এই কাজে আর অর্ধেকটা রয়েছে ইন্দির ঠাকরুনের খাওয়ার দিকে। এইভাবেই শটটা নিই। তাতে ব্যাপারটা এতই উতরে যায় যে, ক্যামেরা বন্ধ করতেও ভুলে যাই আমি। সেটা যেমন চলছিল, তেমন চলতেই থাকে। বংশী সেটা লক্ষ করে চেঁচিয়ে ওঠে: “কী হল মানিক? ‘কাট্’ বলো!” (মানিক আমার ডাকনাম। )

লোকেশনে আমরা কাজ করতাম সকালবেলার আলোটাকে কাজে লাগিয়ে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের ট্যাক্সিতে তুলে লোকেশনে এনে জমা দেওয়া—এটা ছিল অনিলবাবুর কাজ। ফলে একেবারে কাকভোরে তাঁকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হত। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। অনিলবাবুর অবশ্য একটা অ্যালার্ম ক্লক ছিল। কিন্তু তাঁর মনে হয় যে, ওটার উপরেও পুরোপুরি নির্ভর করা চলে না। তখন সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি একটা অদ্ভুত উপায় ঠাওরান। লোকেশন-শুটিংয়ের জন্য যে শিখ ট্যাক্সি-ড্রাইভারটি আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, তার নাম বচন সিং। অনিলবাবু তাকে বলেন যে, মাঝরাত্তিরের পরে তো আর ও-রাস্তায় ট্রাম চলে না, তখন তাকে গিয়ে ট্রাম-লাইনের উপরে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। অনিলবাবু ঘুমোবেন সেই ট্যাক্সিরই মধ্যে। ওখানে প্রথম ট্রাম আসে ভোর পাঁচটায়। ট্রামের ঘণ্টি তখন জোরে-জোরে বাজলে সেই শব্দ শুনে আর ঘুম ভাঙতে কোনও অসুবিধে হবে না।

শুটিংয়ের ব্যাপারটা শিগগিরই একটা নিয়মের মধ্যে এসে যায়। আমরা গিয়ে লোকেশনে পৌঁছতাম আটটা নাগাদ। গিয়ে চা-শিঙাড়া খেয়ে কাজে লেগে যেতাম। সুব্রত লেন্স আর ফিল্টার পরিষ্কার করে নিত। বাড়ির একটা ঘরে থাকত সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ভূপেন ঘোষের কিনেভক্স রেকর্ডার। সেটা সে ঠিকঠাক করে রাখত। এই যে ঘরটার কথা বলছি, বোড়ালের বাড়িতে এটা আগে থেকেই ছিল। হরিহরদের শোবার ঘরটা আমরা তৈরি করে নিয়েছিলাম, এটা তার পিছন-দিককার ঘর। কাজের জন্যে আমরা যখন তৈরি হচ্ছি, গ্রামের লোকেরা ততক্ষণে এসে বাড়ির মধ্যে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। তারই মধ্যে রিহার্সাল শুরু করে দিতাম আমি। ক্যামেরা পয়েন্ট আর লেন্সের ব্যাপারটাও ঠিক করে ফেলতাম।

এই সময়ে আমরা একটা মিচেল ক্যামেরা ব্যবহার করতাম। এটা আমরা একটা স্টুডিয়ো থেকে ভাড়া করেছিলাম। ক্যামেরার সঙ্গে পুরো এক সেট লেন্সও পাওয়া গিয়েছিল। সকালের যে আলোটা কাজের উপযোগী, সেটা পাওয়া মাত্র শুরু হত শুটিং। দুপুর একটা নাগাদ বেজায় গরম লাগত। ওই সময়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য কাজ থামিয়ে আমরা দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতাম। তারপর, যতক্ষণ আলো পাচ্ছি, ততক্ষণ আবার শুটিং চলত।

রোজ যতটা কাজ হচ্ছে, বাড়ি ফেরার পথে ল্যাবোরেটরিতে তার ফিল্ম আমরা জমা দিয়ে যেতাম। দু’তিন দিন বাদে দেখতাম তার রাশ্। তাতে দেখতাম সবই ঠিক আছে। করুণা শহরের মেয়ে। কিন্তু শহুরে হাবভাব বিসর্জন দিয়ে দিব্যি সে যেন সর্বজয়ার একেবারের অন্তরাত্মার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। কানু বন্দ্যোপাধ্যায় পেশাদার অভিনেতা। আমরা ওই যে বিনা মেক-আপে অভিনয় করাচ্ছিলাম, তাঁর মতে ওটা ঘোর উদ্ভট একটা কান্ড। এই নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতুনির অন্ত ছিল না। বিভূতিভূষণের লেখা সংলাপ বলতে যে বড্ড সময় লাগে, এটা নিয়েও তাঁর আপত্তি ছিল।

অপুকে দিয়ে অভিনয়ের কাজটা যাতে ঠিকমতো করিয়ে নিতে পারি, তার জন্য আমাকে নানা রকম কায়দা-কৌশল করতে হয়েছিল। দুর্গার ভূমিকায় যে অভিনয় করে, তার ক্ষেত্রে সে-সবের দরকার হয়নি। চোদ্দো-বছরের এই মেয়েটির মধ্যে বড় অভিনেত্রী হবার প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। ভূমিকার সঙ্গে নিজেকে সে যে একাত্ম করে নিতে পেরেছে, তাতে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। মেয়েটি অভিনয় করছিল চমৎকার। তবে সবচেয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করছিলেন চুনিবালা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই তো ইন্দির ঠাকরুন, একেবারে উপন্যাসের পাতা থেকে নেমে এসেছেন। তিরিশটা বছর একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসে ছিলেন চুনিবালা। তারপর কাজের জগতে ফিরে আসতে পেরে কী যে খুশি হয়েছেন, সে তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ইন্দির ঠাকরুনের ভূমিকার সঙ্গে নিজেকে তিনি ইতিমধ্যেই মিশিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁকে নিয়ে তাই কোনও ঝামেলাই আমাদের হয়নি। শুধু বিকেলের চায়ের সঙ্গে আফিমের বড়িটি পেলেই তিনি খুশি। একদিন ওই বড়িটি খেতে তিনি ভুলে যান। সেদিন তাঁর প্রায় মূর্ছা যাবার উপক্রম হয়।

এক দিকে যেমন কাজ এগোচ্ছিল, অন্য দিকে তেমন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছিল আমাদের রেস্ত। এরই মধ্যে একদিন রানার শেষ ফিল্মটি মুক্তি পায়। সেটি একেবারে ফ্লপ। তখনও কিছু বিকল্প দৃশ্যের শুটিং আমরা করে উঠতে পারিনি।

সপ্তাহ কয়েকের মধ্যেই আমাদের পুঁজি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। রানা জানাল, ছবি তোলবার বাদবাকি খরচা সে দিতে পারবে না, এবারে সে তার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবে।

ঠিক তার আগের দিনই একটা দৃশ্যের আধখানা আমরা তুলেছি। ভাবছিলাম যে, বাকি অর্ধেকটা এবারে শেষ করা দরকার। অনিল চৌধুরি তাই রানাকে বললেন যে, অন্তত একটা দিনের শুটিং বাবদে আড়াইশো টাকা সে দিক। তাতে রানা জানায়, টাকাটা জোগাড় করবার জন্যে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। কিন্তু শুটিংয়ের দিন হাত উলটে সে বলল, “দুঃখিত অনিলবাবু, একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা পাব বলে ভেবেছিলুম, কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি। আপনাকে ওই আড়াইশো টাকাও আমি দিতে পারছি না।” কিন্তু একে তো শুটিংয়ের সব উদ্যোগ-আয়োজন করা হয়ে গিয়েছে, তার উপরে আবার বর্ষা নামবার আগেই এই দৃশ্যটা শেষ করা দরকার, তা নইলে পরে ঝামেলায় পড়ব, এই অবস্থায় উপায়ান্তর দেখে অনিলবাবু গিয়ে আমার স্ত্রীকে বলেন, তিনি যদি তাঁর গোটাকয়েক গয়না দেন তো সেগুলো বাঁধা রেখে কিছু টাকার জোগাড় হয়তো করা যায়। মা’কে কিছু না জানিয়ে বিজয়া তক্ষুনি অনিলবাবুকে তাঁর বেশ-কিছু গয়না দিয়ে দেন। অনিলবাবুও সেই গয়না বাঁধা দিয়ে বারো শো টাকা ধার করে আনেন। এই টাকাটা দিয়ে আরও তিন-চার দিন আমাদের শুটিং চলল। তারপরেই ফের কাজ বন্ধ। বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে, আমরা আমাদের সামর্থ্যের একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছি। চোখের জল ফেলে সবাই যে যার স্বাভাবিক কাজকর্মের বৃত্তে ফিরে গেল। আমিও ফিরে এলাম কিমার কোম্পানির ডেস্কে।

যেটুকু যা ছবি ইতিমধ্যে তুলেছিলাম, পরে এডিট করে দেখা গেল, তাতে হাজার-চারেক ফুটের মতো কাজ হয়েছে। তার মানে গোটা ছবির মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ। দেখে মনে হল, বেশ নিখুঁত কাজ। অবশ্য এর বিষয়বস্তুর চরিত্র প্রচলিত বাংলা ছবি থেকে একেবারেই আলাদা। এমনও একটা আশা জেগেছিল যে, কে জানে, এই আংশিক কাজটা যদি দেখাই, তা হলে কোনও প্রযোজক হয়তো বাদবাকি কাজের জন্য টাকা ঢালতে রাজিও হয়ে যেতে পারে।

কেউই রাজি হল না। চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে কখনও-না-কখনও কোনও-না-কোনও পর্যায়ে যাঁরা টাকা ঢেলেছেন, এমন মানুষদের কাউকেই ওই ফুটেজ দেখাতে বাকি রাখিনি। কিন্তু সকলের মুখেই এক কথা। এমন কথা, যাতে একেবারে দমে যেতে হয়। “কে আসবে ওই বুড়িকে দেখতে? প্রেমের ব্যাপার-ট্যাপার নেই কেন? গানও তো নেই।”

ঠিক এই সময়েই অনিল চৌধুরির চরিত্রের এমন একটা দিক আমি দেখতে পাই, যে-দিকটা তাঁর আছে বলে কখনও ভাবিনি। যেই তিনি দেখলেন যে, টাকাকড়ির সমস্ত উৎস শুকিয়ে গিয়েছে, আর ফিল্মটাও উঠেছে শিকেয়, অমনি তিনি আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন। ফলে, অন্য-কোনও প্রোডিউসার যে ধরতে পারব এমন আশাও আর রইল না।

পুরো আট মাস সেই সময়ে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন অনিলবাবু। তারপর হঠাৎই আবার একদিন এসে উদয় হন। এসে দুঃসাহসিক একটা প্রস্তাব করে বসেন। বলেন যে, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করে আমার সমস্যার কথাটা তাঁকে বলতে হবে।

ডাক্তার রায় ভারতের সবচেয়ে নামজাদা চিকিৎসকদের একজন। এমনকি গান্ধীজিরও তিনি চিকিৎসা করেছেন। যা-ই হোক, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ইংরেজ আমলে তৈরি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসে রাজ্যশাসন করেন। ওই বাড়িরই এক কেরানি-ভদ্রলোক আমাদের অনিল চৌধুরির বন্ধু। অনিলকে তিনিই বলেন যে, ফিল্মটা শেষ করবার জন্যে কিছু টাকা চাই তো, তার জন্যে বিধানচন্দ্রকে গিয়ে ধরলেই তো হয়, তা হলেই একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। ভদ্রলোকের যুক্তি: বিধানবাবুও ব্রাহ্ম, আমিও ব্রাহ্ম। অনিলবাবু যখন এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তখন আমার মা’ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

অনিলবাবুর কথা শুনে মা বললেন, “এই নিয়ে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে কথা বলতে হলে তার সবচেয়ে ভাল উপায় হল আমার বন্ধু বেলার মাধ্যমে তাঁর কাছে যাওয়া।” কর্নেল জে. এল. সেনের স্ত্রী শ্রীমতী বেলা সেনের বয়েস তখন পঞ্চান্ন ছাড়িয়েছে; তিনি আমার মায়ের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। যেমন ডাক্তার রায় কিংবা আমরা, এই সেন-পরিবারও তেমন ব্রাহ্ম সমাজের মানুষ। সম্প্রদায়টা বড় নয় বলে অধিকাংশ ব্রাহ্ম পরিবারই পরস্পরকে অল্পবিস্তর চেনে। ডাক্তার রায় অকৃতদার পুরুষ। সেন-পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠও বটেন। তাঁর উপরে শ্রীমতী বেলা সেনের বেশ খানিকটা প্রভাবও ছিল।

মা গিয়ে দেখা করলেন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে। তারপর বাড়িতে ফিরে জানালেন, বেলা দেবী বলেছেন যে, ডাক্তার রায়ের কাছে কথাটা তিনি পাড়বেন। এর দিন কয়েক বাদেই মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে খবর এল যে, ‘পথের পাঁচালি’ নিয়ে তিনি কথা বলতে চান, সুতরাং আমি যেন তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার রায়ের দফতরে গিয়ে হাজির হই। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে কাজ কদ্দুর কী হয়েছে তা জানাই। শ্ৰীমতী বেলা সেনের জ্যেষ্ঠা কন্যা সেখানে হাজির ছিলেন। ডাক্তার রায় যে বিভূতিভূষণের কিংবা তাঁর এই বিখ্যাত উপন্যাসের নামও শোনেননি, এটা জেনে তিনি তাজ্জব হয়ে যান। বেলা দেবীর এই কন্যাটির নাম অর্চনা। শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী মেয়ে। বেশ জোর দিয়েই তিনি বলেন যে, এটি একটি কালজয়ী উপন্যাস। সেইসঙ্গে এটাও জানিয়ে দেন যে, এর থেকে চমৎকার ফিল্ম হতে পারে। গল্পটা আমি সংক্ষেপে ডাক্তার রায়কে শুনিয়ে দিই, সৌভাগ্যবশত ও-কাজটা করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। সংক্ষিপ্তসার শুনে ডাক্তার রায় বললেন, “গল্পের শেষটা তো দেখছি দুঃখের। পরিবারটি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে কাশী চলে যাচ্ছে। এটা কেন হবে? গাঁয়ের অন্য সব লোক কি তাদের ওখানেই থেকে যেতে বলতে পারে না? নতুন করে আবার ঘরবাড়ি তুলতে তাদের সাহায্য করতে পারে না? আমরা তো সমষ্টি উন্নয়নের কাজ চালাচ্ছি। তার সপক্ষে ভাল কিছু কথা তোমার এই ছবির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারো না তুমি?” শুনে অর্চনা আমার পক্ষ নিয়ে বললেন, “কাহিনীর শেষটা কী, তা সবাই জানে। বেশ নাড়া দেবার মতন উপসংহার। ওটা যদি পালটে দেওয়া হয় তো যেমন পাঠকদের তরফ থেকে তেমন লেখকের পরিবার থেকেও আপত্তি উঠবে।

“তা তো হল,” ডাক্তার রায় বললেন, “তবে এই ছবির পিছনে যদি টাকা ঢালতে হয়, তবে এক ওই কমিউনিটি ডেভেলাপমেন্ট প্রোজেক্টের খাতেই সেটা ঢালতে হবে। ফিচার ফিল্মের পিছনে অর্থব্যয়ের অন্য কোনও ব্যবস্থাই আমাদের নেই।” আমি বললাম, “শেষটা যদি পালটাই তো ফিল্মের ক্ষেত্রে সেটা হবে একটা কালাপাহাড়ি কাণ্ড। ওটা করতে পারব না। তবে টাকাটা কোন্ খাতে দেবেন, তা নিয়ে আমার কিছু বলবার নেই।”

কথাটা ডাক্তার রায়ের মনে ধরল। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করতেন না। এ-ক্ষেত্রেও চটপট মনঃস্থির করে ফেললেন। বললেন, ঠিক আছে, “তবে যেটুকু ফিল্ম তুলেছ, আমাদের হোম পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টের মাথুরকে সেটা একবার দেখাতে হবে।” ডাক্তার রায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এর পর আমি মিঃ মাথুরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ছবি যতটা তুলেছি, কলকাতার একটা মিনিয়েচার সিনেমা-হলে সেই ফুটেজ দেখাবার ব্যবস্থা হয়। মিঃ মাথুর সেটা দেখতে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন বিশিষ্ট নাট্যকার মন্মথ রায়। ফুটেজ দেখে মন্মথ রায় দারুণ খুশি হন। মাথুর কিন্তু কোনও মন্তব্য করেন না। পরে জানতে পারি যে, এই ফিল্ম সম্পর্কে ডাক্তার রায়ের কাছে তিনি খুব খারাপ রিপোর্ট দিয়েছিলেন। ডাক্তার রায় যে মাথুরের কথার থেকে মন্মথ রায়ের কথাটাকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য ভেবেছিলেন, সে আমাদের সৌভাগ্য।

সরকারের আইন বিভাগের মিঃ মিত্র এর পরে লম্বা একটা চুক্তিপত্র তৈরি করে ফেলেন। আমাদের ছবি তৈরির বাজেট ছিল সত্তর হাজার টাকার। সরকারের কাছে সেটাই আমরা দাখিল করি। তার ভিতর থেকে চিত্ৰস্বত্ব বাবদে বিভূতিভূষণের স্ত্রীর প্রাপ্য যেমন মেটাতে হবে, তেমন ফেরত দিতে হবে রানা দত্তের চল্লিশ হাজার টাকা। একমাত্র আমার জন্যেই সেখানে কোনও বরাদ্দ নেই, এই পর্যায়ে একমাত্র আমিই কিছু পাব না। কিমার কোম্পানির কাছ থেকে আমার মাস-মাইনেটা আমি অবশ্য তখনও পাচ্ছি। চুক্তিপত্র তৈরি করার সময় আমি প্রস্তাব করি যে, বিদেশে যদি এ-ছবি বিক্রি হয়, তা হলে অন্তত সেই বাবদে প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ যেন আমি পাই। মিঃ মাথুর তাতে রাজিও হলেন। কিন্তু চুক্তিপত্র তৈরি হবার পরে দেখা গেল যে, ওটার কোনও উল্লেখই তার মধ্যে নেই। এ নিয়ে প্রশ্ন করতে মিঃ মাথুর বললেন যে, এটা একটা সামান্য ব্যাপার, ফিল্মটা তো আগে তৈরি হোক, তখন এটার ব্যবস্থা করা যাবে। ভদ্রলোককে আমি বিশ্বাস করেছিলাম।

কিমারে এর মধ্যে ফের ম্যানেজার বদল হয়েছিল। ম্যানেজার পদে কেনেথ ডে’র জায়গায় নিকলসন বলে যিনি এসেছিলেন, তিনি আর্মি-ফেরতা মানুষ। রোগা, লম্বা, নাকের তলায় দু’দিকে বাঁকানো হ্যান্ডল-বার গোঁফ। আগের ম্যানেজারের মতো মিঃ নিকলসনও দেখলাম আমার কাজকর্ম খুবই পছন্দ করছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও আমার গড়ে ওঠে। ক্যালিগ্রাফি অর্থাৎ শিল্পিত হস্তাক্ষর রচনায় ইনি ছিলেন দারুণ দক্ষ। হস্তাক্ষর-শিল্পের যে কালক্রমে কীভাবে বিবর্তন ঘটেছে, একটা মোটা অ্যালবামে তার নিদর্শন ইনি তৈরি করে তুলছিলেন। সেগুলি দেখলেই বোঝা যেত যে, ইনি একজন উঁচু দরের শিল্পী। আমার ফিল্মের ব্যাপারে যে নতুন অবস্থার উদ্‌ভব হয়েছে, সেটা তো এখন এঁকে জানানো দরকার। ইতিমধ্যে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, সবেতন ওই এক মাসের ছুটিতে আর চলবে না। এদিকে আবার সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হল, তাতে একসঙ্গে নয়, টাকাটা মিলবে খেপে-খেপে। সেটা কতটা নিয়মিত মিলবে, তা কে জানে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে, যেমন-যেমন টাকা আসবে, তেমন-তেমন ফিল্মের কাজ করতে পারব।

নিকলসনের সঙ্গে এই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা হল। গল্পটার একটা সংক্ষিপ্তসার তিনি শুনতে চেয়েছিলেন। শুনে তিনি অভিভূত হলেন। বললেন, “বুঝতে পারছি, তোমাকে ‘না’ বলে কোনও লাভ নেই। এই রকমের একটা অনিশ্চিত ব্যাপার মাথার মধ্যে নিয়ে কি আর ডেস্কে বসে কাজ করা যায়? তা তুমি পারবে না। যখনই দরকার হবে, ছুটি নাও। আমি তোমার বেতন ঠিকই দিয়ে যাব।” এ তো দৈব আশীর্বাদের মতন ব্যাপার! খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম। ধন্যবাদ জানাবার সময় নিকলসনকে সে-কথা বলতে ভুলিনি। আজ যখন সেইসব দিনের কথা ভাবি, তখন মনে হয়, ডাক্তার রায় ও মিঃ নিকলসন, এই দুটি মানুষের জন্যই ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটা তোলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

স্ত্রীর গয়না বাঁধা দেওয়ার পর শুটিংয়ের খরচ মেটাতে কিছু রেকর্ড আর দুষ্প্রাপ্য কিছু বই আমাকে বিক্রি করতে হয়েছিল। প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়ার পর গয়নাগুলোকে ছাড়িয়ে আনি। তবে বই ও রেকর্ড আর উদ্ধার করা যায়নি।

এরই মধ্যে, ১৯৫৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় আমাদের ছেলে সন্দীপ।

ডাক্তার রায় তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আগে আর-একটা ঘটনা ঘটেছিল। দুর্বল মানুষের মনে কীভাবে যে কুসংস্কার তার শিকড় ছড়ায়, এই ঘটনা থেকেই সেটা বোঝা যাবে। ব্যাপারটা খুলে বলি।

একদিন সকালে ঘুম ভাঙতে আমার পিছন দিককার জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা সাদা রঙের প্যাঁচা তার বাইরের দিকের পাল্লার উপরে বসে আছে। প্যাঁচাটার দৃষ্টি দেখলাম আমার দিকেই নিবদ্ধ। ভাল করে দেখবার জন্য নিঃশব্দে আমি জানলার কাছে এগিয়ে যাই, কিন্তু প্যাঁচাটা তাতে একটুও নড়ে না। নজর করে তাকে দেখছি, এমন সময় আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ কানে আসে। আমাদের বাড়িটা বড় রাস্তার পিছন দিকে হলেও কাছাকাছি তা অন্তত ডজনখানেক ফ্ল্যাট থেকে দেখা যায়। দেখলাম, সেই সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা খুব আদর করে পাখিটাকে ডাকছে।

আমার স্ত্রী ইতিমধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পাখিটাকে কেন্দ্র করে কেন যে এত উত্তেজনা, সেটা একেবারে একইসঙ্গে আমরা বুঝে যাই। সাদা প্যাঁচা অর্থাৎ শঙ্খপ্যাঁচা হল লক্ষ্মীর বাহন, আর লক্ষ্মী হলেন সৌভাগ্য আর সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সুতরাং, সেই দেবীর বাহন যে আমাদের জানলার পাল্লায় এসে বসেছে, প্রতিবেশীদের মনে এতে কিঞ্চিৎ ঈর্ষার উদ্রেক তো হতেই পারে।

কিন্তু যতই তারা চেঁচাক, ডাকুক কিংবা জোরগলায় শিস দিক, প্যাঁচাটি একেবারে নির্বিকার। স্থির দৃষ্টিতে যেমন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তেমন তাকিয়েই রইল। লাইকা ক্যামেরা বার করে তার একটা ছবি তুললাম আমি। তাতে ‘ক্লিক’ করে যে শব্দটা হল, তাতেও তার কোনও বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। যে অবস্থায় ছিল, ঠিক সেই অবস্থাতেই পুরো দু’সপ্তাহ সেই প্যাঁচা আমাদের জানলার পাল্লায় বসে থাকে। তারপর একদিন দেখি, প্যাঁচাটি সেখানে নেই। রাতের অন্ধকারে সে চলে যেত কি না, তা আমি জানি না। আমি শুধু এইটুকুই জানি যে, যতদিন সে ছিল, ততদিন রোজ সকালে দেখতে পেতাম, একই জায়গায় বসে একেবারে সেইরকম স্থিরদৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

প্যাঁচাটা চলে যাবার পরে-পরেই একদিন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় আমাকে ডেকে পাঠান। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। যাতে না কুসংস্কারের খপ্পরে পড়ি, তার জন্য সর্বরকমের যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা আমি বুঝতে চেয়েছি। তবে হাজার যুক্তি দিয়েও এই তাজ্জব ব্যাপারের কোনও ব্যাখ্যা এখনও খুঁজে পাইনি।

শুটিংয়ের ব্যাপারে এই যে দেরি হয়ে গেল, এখন বুঝতে পারি যে, এক দিক দিয়ে এতে আমার উপকারই হয়েছিল। ইতিমধ্যে আমার কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসেছিলাম আমি। বিজ্ঞাপনের ডিজাইন আর বইয়ের অলঙ্করণে মন দিয়েছিলাম। সত্যের খাতিরে অবশ্য একটা কথা স্বীকার করব। সেটা এই যে, ফিল্মের কাজটা যে আবার শুরু করা যাবে, এই আশাটা আমার মনের মধ্যে ছিলই। একটা ব্যাপার অবশ্য আমাকে ভাবাচ্ছিল। অপু আর দুর্গার বয়েস তো বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে কন্টিনুইটি বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যাপারে না ঝামেলা দেখা দেয়। সমস্যা চুনিবালাকে নিয়েও। তাঁর একটা অপারেশন হবে। তার পরেও তাঁর কাজের উৎসাহ থাকবে তো? তা ছাড়া, দলের লোকদের নিয়েও চিন্তা ছিল বই কী। আমার কাজে আটকে আছেন বলেই তাঁদের কেউ কেউ অন্যান্য কোম্পানির কাজে তেমনভাবে জড়িয়ে পড়তে পারছেন না। এগুলি বাদ দিলে, কিছু-কিছু ব্যাপারে আমাদের সুবিধাও হয়েছিল।

মাঝে-মাঝেই বোড়ালে আমাদের লোকেশনে যেতাম আমরা। পুরনো কথা ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতাম। সেইসঙ্গে লক্ষ রাখতাম, লোকেশনের যেন কোনও অদল-বদল না ঘটে। এটা দেখে আমরা খুশি হচ্ছিলাম যে, জায়গাটার উপর এমন একটা পোড়-খাওয়া ছাপ পড়ছিল যা শুধু সময়ের পক্ষেই ফেলা সম্ভব। তার মানে আবার যখন আমরা কাজ শুরু করব, তখন এটাকে আর নিছক সেট্ বলে কারও মনে হবে না। ফুটেজে কয়েকটা ত্রুটিও আমার ও আমার এডিটরের চোখে ধরা পড়েছিল। সম্পাদনার ভার যাঁর হাতে, এর পরে তাঁকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এই ধরনের ত্রুটি আর না থাকতে পারে। স্ক্রিপটের অনেকটা তো আমার মাথার মধ্যেই ধরা ছিল। এই যে অনেকটা সময় পাওয়া গেল, এটা কাজে লাগিয়ে তাকে আরও ভালভাবে দাঁড় করাই। তাতে সেটা আগের তুলনায় দ্বিগুণ ঝকঝকে হয়ে ওঠে।

সেই সময়ে বংশী, সুব্রত আর আমি একদিন বোড়ালে গিয়ে চুপচাপ একটা পুকুরের ধারে বসে আছি। এক-আধটা কথাও বলছি মাঝেমধ্যে। পানাপুকুর। সেই ঘন পানার দিকে একটা-দুটো ঢিলও ছুড়ে মারছিলাম। এটা করছিলাম খানিকটা অন্যমনস্কভাবেই। একবার হঠাৎ চোখে পড়ল যে, ঢিলটা গিয়ে পানার উপরে পড়তে সেটা একটু কেঁপে উঠল। তাতে একটা ফাটল দেখা দিল। তারপর দেখলাম, ঢিলটা ডুবে যেতেই পানার সেই ফাটলটা আবার আস্তে-আস্তে বুজে যাচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে কেমন যেন শিরশির করে উঠল আমার শরীর। মনে হল, দারুণ একটা আইডিয়া আমি পেয়ে গেছি। ছবির মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্য রয়েছে, সেখানে এটাকে কাজে লাগাতে হবে। দৃশ্যটা আছে ছবির শেষের দিকে। এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে দুর্গা যে হারটা চুরি করে এনেছিল, একেবারে হঠাৎই সেটা খুঁজে পেয়েছে অপু। কিন্তু এই খোঁজ পাওয়ার কথাটা সে কাউকে জানায় না। বাড়ির পিছনে একটা ঝোপের মধ্যে হারটা সে ছুড়ে ফেলে দেয়। বইয়ে অন্তত এই কথাই রয়েছে। আমার মনের মধ্যেও এতদিন এই দৃশ্যটাকে আমি এমনভাবেই ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু এবারে মনে হল, পানাপুকুরের গহ্বরে আমার ঢিলগুলি যেভাবে তলিয়ে গেছে, হারটাও সেইভাবে তলিয়ে যাচ্ছে আর চিরকালের মতো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একটি গোপন কথা, এইভাবে যদি দেখানো যায়, দৃশ্যটার অভিঘাত তা হলে আরও জোরালো হয়ে উঠতে পারে।

একটা ফিল্মের মধ্যে কোন্ শট ঠিক কোথায় শেষ হবে, সেটা বুঝিয়ে বলা ভারী কঠিন। যেখানে ‘কাট’ করা উচিত, তার পরে সামান্য কয়েকটা ফ্রেম বাড়তি রাখলেও ফিল্মের ছন্দটাই নষ্ট হতে পারে। একটুক্ষণ বাড়তি চললেও মনে হতে পারে, বড্ড বেশিক্ষণ ধরে চলছে। যে-ফিল্মে সংলাপ খুবই কম রাখা হয়, তার ক্ষেত্রে এ-কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। অন্যান্য দিকও ভাবার আছে। নির্বাক ছবিতে যদি ধ্বনি যোজনা করা হয়—কথা নয়, শুধুই ধ্বনি—তা হলে তার ধার বা তীক্ষ্ণতা যে আরও বেড়ে যায়, তা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছিলাম। মনে হল, ‘পথের পাঁচালি’তেও রয়েছে এমন অনেক দৃশ্য, মিউজিকের কথা বাদ দিলেও কেবল সাউন্ড ইফেক্ট বা ধ্বনি যোজনার ব্যবস্থা করে যেগুলির আবেদন আরও বাড়িয়ে দেওয়া যায়। তার জন্য সর্বাগ্রে দরকার গ্রামীণ পরিবেশে কী কী শব্দ সাধারণত শোনা যায়, সেটা লক্ষ করা। গাছপালা যখন রয়েছে, তখন পাখির ডাককে তো কাজে লাগানোই যায়। কিন্তু সেটারও একটা মাত্রা থাকা দরকার। নইলে একঘেয়ে হয়ে পড়বে।

টাকার প্রতীক্ষায় থাকতে-থাকতেই এই সময় মাঝে-মাঝে আমি গ্রামে চলে যেতাম। কান খোলা রাখতাম। মন দিয়ে শুনতাম চারপাশের শব্দ। কী কী সাউণ্ড ইফেক্ট কাজে লাগবে, সব লিখে রাখতাম। বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায়, লম্বা-লম্বা বাঁশ তখন এ ওর উপরে নুয়ে পড়ে। তাতে এক ধরনের ককানির মতো আওয়াজ হয়। পদ্মদিঘির উপর দিয়ে বাতাস বইলে পদ্মপাতাগুলি পতপত শব্দ করে। সকাল হচ্ছে, এটা পাখির ডাকের ভিতর দিয়ে ধরা যায়। যেমন কাকের ডাক। সন্ধ্যা হলে কাছে ও দূরে শাঁখ বাজে, ঝিঁঝি ডাকে। রাত যে গভীর, এটা বোঝা যায় প্যাঁচা আর শেয়ালের ডাকের ভিতর দিয়ে। গল্পের মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দের কথা পাচ্ছি। দূর দিয়ে ট্রেন চলে যাবার শব্দ। এটা সন্ধ্যার সময় শোনা যায়। মাত্র একবারই এই শব্দটা শোনা যায় কাছ থেকে। বাঙালি বাড়িতে বক্স-হারমনিয়ম বাজিয়ে গান করার খুব চল দেখা যায়। এই গানের সময় সাধারণত সন্ধ্যা। নতুন করে আবার শুটিং শুরু হবে, এই প্রতীক্ষায় যখন রয়েছি, এ-সব তথ্যও তখনই আমি খাতায় টুকে রেখেছিলাম।

চুক্তিপত্র সই হবার পরেই অনিল চৌধুরি আমাদের শিল্পীদের গিয়ে খবর দিতে শুরু করেন যে, শিগগিরই আবার শুটিং শুরু হবে। একমাত্র দুর্গার বাবা সেই প্রাক্তন ফুটবলার তখন বড় নৈরাশ্যজনক একটা মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, “লেবু কচলে আপনারা একেবারে তেতো করে ফেলেছেন। আর কত তেতো করবেন মশাই?” কিন্তু দুর্গা নিজে তো খুশি হয়েছিলই, তার মা আর তার বড় বোনেরাও যে খবরটা পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন, তাও বলব।

আরও কয়েকটি চরিত্রের জন্য আরও কয়েকজন অভিনেতা ঠিক করার কাজ তখনও বাকি। ছবিতে একটি ইস্কুল-মাস্টারের চরিত্র রয়েছে। ইনি মাস্টারিও করেন, আবার মুদিখানাও চালান। ছাত্র ঠেঙানোর বেতটি রেখে দেন চিনির বস্তার উপর। কৌতুকাভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে আমি এই চরিত্রটা দেব বলে ঠিক করি। ভদ্রলোকের মুখ-চোখের হাবভাবে কৌতুকের ভাব চমৎকার ফোটে। তা ছাড়া বিস্তর বাংলা ছবিতে ছোটখাটো নানা চরিত্রে ইনি অভিনয় করেছেন। ছবিতে এ ছাড়াও জনাকয়েক বৃদ্ধের দেখা মেলে। হরিহর গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শুনে এঁরা তাঁকে নিবৃত্ত করতে আসেন। ঠিক করি যে, বোড়াল গ্রামেরই এমন কিছু বাসিন্দাকে আমি এ-সব চরিত্রে নামাব, যাঁরা জীবনে কখনও অভিনয় করেননি। ছবিতে এক টেকো বুড়োকেও দেখা যায়। একটা পুকুরের ধারে বসে ছিপ ফেলে ইনি মাছ ধরছিলেন। ছিপ-হাতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, এই সময়ে হঠাৎ মাথায় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই এঁর ঘুম ভেঙে যায়। বোড়াল গ্রামে একজনকে দেখে মনে হয়েছিল যে, এই চরিত্রে এঁকে বেশ মানাবে। কিন্তু তাঁর নাম তো আমি জানি না। এইটুকু শুধু মনে আছে যে, প্রথম-প্রথম পরপর কয়েক দিন ইনি আমাদের শুটিং দেখতে এসেছিলেন। কী করে এখন তাঁকে খুঁজে বার করি? যথাসাধ্য তাঁর বর্ণনা সবাইকে দেওয়া গেল। বেঁটে, মোটা, গাল দুটো ফোলামতন, মাথায় টাক, গোঁফ আছে। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। ফলে আমাকে আর-এক রাস্তা ধরতে হল। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে স্রেফ স্মৃতির উপরে নির্ভর করে একটা মুখ এঁকে বললাম, “এইরকম দেখতে।” বাস্, আর বলতে হল না। ছবি দেখেই বোড়ালের বাসিন্দারা চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে, এ তো আমাদের হরিবাবু!” তক্ষুনি তাঁরা গিয়ে হরিবাবুকে এনে হাজির করলেন আমার সামনে। বোড়ালে কাজের বছরগুলিতে এই কাজটার জন্যেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি খাতির পাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *