৭. পতন-অভ্যুদয়

পতন-অভ্যুদয়

‘পথের পাঁচালি’ যেখানে মুক্তি পেয়েছিল, ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে ‘অপরাজিত’ও সেই তিন ছবিঘরে একইসঙ্গে মুক্তি পায়। এটা ঘটল আমরা ছবিটা শুরু করবার আট মাস বাদে। মুক্তিলাভের আগে অনেকটা সময় হাতে পাওয়া গিয়েছিল বলে এবারে আর-চূড়ান্ত এডিটিংয়ের কাজটা তাড়াহুড়ো করে করতে হয়নি। ছবিটি কলকাতায় মুক্তিলাভের আগে দিল্লি থেকে খবর আসে যে, নেহরু আর আমাদের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ছবিটি দেখতে চান। একটা প্রিন্ট নিয়ে ১১ অক্টোবর আমি বিমানযোগে দিল্লি চলে যাই। রাষ্ট্রপতির যে ব্যক্তিগত প্রেক্ষাগার রয়েছে, সেখানে ছবিটি দেখানো হয়। প্রেক্ষাগারে ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন, তা ছাড়া এসেছিলেন জনাকয় সরকারি লোকজন। ছোট্ট প্রেক্ষাগারটি তাতেই ভরে যায়। প্রোজেকটারের গণ্ডগোলের জন্য ছবির প্রদর্শন মিনিট পনরোর জন্য ব্যাহত হয়েছিল। কী হয়েছে সেটা দেখবার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আমি প্রোজেকশন-যন্ত্রের কাছে ছুটে যাই। যন্ত্রে যে গণ্ডগোল ঘটেছিল, সেটা অবশ্য ছোটখাটো ধরনের। শিগগিরই সেটা মেরামতও হয়ে যায়। প্রোজেকশনের ব্যাপারে তারপরে আর কোনও বিভ্রাট ঘটেনি। ছবি শেষ হয়ে যাবার পরে নেহরু এসে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এর পরে অপুর কী হবে?”

এর পরে যাঁরা ছবিটি দেখবেন, তাঁদের মনেও যে এই একই জিজ্ঞাসা জাগতে পারে, এটা তখনও বুঝতে পারিনি। নেহরুর প্রশ্নের উত্তরে তাই বলি, অপুকে নিয়ে তৃতীয় ছবি করবার কোনও পরিকল্পনা আমার নেই।

ছবির মুক্তির আগে সাধারণত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ডেকে আমি ছবিটা তাঁদের একবার দেখাই। এবারেও সেটা করেছিলাম। ‘নিউ এম্পায়ার’-এ আসনের সংখ্যা ন’শোর মতন। ছবিটা সেখানে তাঁদের দেখানো হল। সবাই খুব খুশি। অনেক প্রশংসা করলেন তাঁরা।

সাংবাদিকরাও ছবি দেখে যৎপরোনাস্তি খুশি হলেন। তাঁদের স্বীকার করতে হল যে, ‘পথের পাঁচালি’র সাফল্য একটা হঠাৎ-ঘটে-যাওয়া ব্যাপার নয়, আবারও আমি একটা চমৎকার ছবি তৈরি করেছি। প্রথম কয়েক সপ্তাহ প্রচণ্ড ভিড়। কিন্তু তারপরেই টিকিট বিক্রির হার পড়ে যেতে থাকে। সাত সপ্তাহের পর ছবিটি তুলে নেওয়া হয়। ব্যাপারটা তখন খুব ভাবিয়ে তুলেছিল আমাকে। শুধু আমাকে নয়, গোটা ইউনিট আর বাড়ির লোকজনেরাও এই নিয়ে বড় দুর্ভাবনায় পড়ে যান। সমস্যাটা কী, এমন হল কেন? চিন্তাভাবনা করে আমার যা মনে হয়েছিল, তা বলি।

চিত্ররূপটা লোকের মনে ধরেনি। দর্শকদের মনে হয়েছিল যে, আলাদা দুটো ফিল্মে তাঁরা আলাদা দুই অপুকে দেখছেন। অথচ তাঁরা হয়তো একই অপুকে দেখতে পেলে খুশি হতেন। সেইসঙ্গে আর-একটা কথাও আমার মনে হয়। সেটা এই যে, বড্ড-অপুর সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কটা তাঁদের কাছে বড়-বেশি হৃদয়হীন বলে মনে হয়েছে। মা ও ছেলের যে সম্পর্ক দেখতে তাঁরা অভ্যস্ত, সেটা কোমল রঙে আঁকা। যে মা তাঁর ছেলের জন্য নিজের গোটা জীবনটাকেই উৎসর্গ করে দিয়েছেন, পনরো-বছর বয়সের একটি ছেলে কী করে সেই মায়ের প্রতি এত হৃদয়হীন আচরণ করতে পারে? সত্যকথাটা তা হলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, ‘অপরাজিত’-এ যে মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক চিত্রিত হয়েছে, বাঙালি দর্শকসমাজ তার জন্য প্রস্তুত নয়। সাধারণ দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে বসে ‘অপরাজিত’ দেখতে-দেখতে এমনও আমার মনে হয় যে, ছবিতে কিছু ত্রুটি রয়েছে। এর জন্য সংগতভাবেই রবিশঙ্করকে দায়ী করা যায়। এবারেও তিনি তাড়াহুড়ো করে কাজ করেছিলেন। কয়েকটা দৃশ্যে আবহসংগীত যোজনার দরকার ছিল, কিন্তু তাও তিনি আমাকে তৈরি করে দেননি। সে-সব দৃশ্যে নৈঃশব্দ্য খুবই পীড়াদায়ক। আবহসংগীত যোজিত হলে এমনটা হত না, দর্শকদের মনে সেগুলি আরও ছাপ ফেলত পারত। তবু, যেটুকু তিনি করেছেন, তার জন্যই তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যে-সময়ের কথা বলছি, রবিশঙ্কর তখন দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, সব সময়ে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারই মধ্যে আদৌ যে কিছুটা সময় তিনি আমার জন্য বার করতে পেরেছিলেন, তা-ই কি কম?

এর পরে কী ছবি করা যায়, ক্রমাগত তা-ই নিয়ে তখন মাথা ঘামাচ্ছি। আমার ছবি সর্বসাধারণের জন্য নয়, ও শুধু মুষ্টিমেয় বোদ্ধার জন্য—এইভাবে কখনও আমি চিহ্নিত হতে চাইনি। বরং সব সময়ে এটাই আমি ভেবেছি যে, দর্শক-সমাজের কথা মনে রেখেই ছবি করতে হবে। পরিচালক যে তাঁর উদ্‌ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাবেন, তার জন্য তো অন্যের উপরে নির্ভর করতে হবে তাঁকে। অন্যের উপরে মানে এমন কারও উপরে, যিনি রসদ জোগাবেন। অতএব পরিচালককে চেষ্টা করতে হবে যাতে খরচটা উঠে আসে। টাকা ঢেলে যদি লাভ না হয়, তবে টাকা ঢালতে কেউ রাজি হবে কেন?

আগেই বলেছি, প্লাস্টার-বাঁধা অবস্থায় যখন শয্যাশায়ী ছিলাম, তখন প্রচুর বাংলা গল্প-উপন্যাস আমি পড়ে ফেলি। উদ্দেশ্য ছিল এমন কোনও কাহিনী খোঁজা, যা থেকে ছবি তৈরি হতে পারে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি অসাধারণ গল্পের সন্ধান সেই সময়ে পেয়ে যাই। গল্পটির নাম ‘জলসাঘর’। এর নায়ক এক সংগীতপ্রেমিক জমিদার। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেকে পালটাতে তিনি রাজি নন। তার ফলও ভোগ করতে হয় তাঁকে। চরিত্রাভিনেতার উপযোগী ভয়ঙ্কর একটি ভূমিকা তো এতে আছেই, সংগত কারণেই নৃত্যগীতের অবকাশও এখানে প্রচুর। ঠিক এই ধরনের ভূমিকার উপযুক্ত একজন অভিনেতা আমাদের আছেনও। তিনি ছবি বিশ্বাস। একে তো তাঁর অভিনয়-প্রতিভা খুবই উঁচু দরের, তার উপরে আবার তিনি খুব জনপ্রিয়ও। গল্পটিকে নিয়ে প্রাথমিক কাজ করতে বসে যাই। এটাই হবে আমার পরবর্তী ছবি।

‘জলসাঘর’-এর চিত্রনাট্য লিখতে বসে দেখি যে, যা হলে জনপ্রিয় হয়, চিত্রনাট্য ঠিক সেই রকমের চেহারা নিতে চাইছে না। চেহারা নেয় সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের চিত্র হিসেবে। তবে সংগীতসমৃদ্ধ। তার জন্য শুদ্ধ রাগপ্রধান কণ্ঠ- ও যন্ত্র-সংগীতের এমন কয়েকজন শিল্পীর সাহায্য নিই, যাঁদের দক্ষতা একেবারে প্রথম শ্রেণীর। অর্থাৎ ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, আমাদের দর্শকসমাজ যে-রকমের বাঁধাধরা ছকে অভ্যস্থ, তারই মধ্যে ছবি তৈরি করব বলে ঠিক করেছিলাম বটে, কিন্তু কার্যত আমার চিত্রনাট্য তার থেকে একেবারে সরে আসে। তখন অবশ্য সেটা বুঝতে পারিনি।

ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের গল্পের জন্য ক্ষয়িষ্ণু প্রাসাদোপম অট্টালিকা চাই। সেটা খুঁজে বার করতে বঙ্গভূমির প্রায় অর্ধেকটা আমরা চষে ফেলি। শেষ পর্যন্ত নিমতিতা বলে একটা জায়গায় তার সন্ধান মেলে। কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠে অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। চৌধুরি-পরিবার এ-বাড়ির মালিক। আমাদের তাঁরা সাদর অভ্যর্থনা জানান। বাড়ির সামনের দিক ও দোতলার প্রশস্ত বারান্দাটা যে আমরা ব্যবহার করতে চাই, এই প্রস্তাবে তাঁদের রাজি করাতে কোনও অসুবিধা হয়নি। দোতলার বারান্দা থেকে নদী দেখা যায়। নদীর ওপারে বাংলাদেশ।

ছবি বিশ্বাস মশাই এ-ছবির নায়ক অর্থাৎ জমিদারের ভূমিকায় নামতে রাজি হয়েছিলেন। তার জন্য ঘোড়ায় চড়াও শিখছিলেন তিনি। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে জানান যে, বার্লিন যাবার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। সেখানকার চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা-বিভাগে তাঁর অভিনীত একটা ছবি দেখানো হবে। সেই ছবির জন্যই তাঁর যাওয়া। বললেন, “এর আগে তো কখনও বিদেশে যাইনি। কদ্দিন যে বাইরে থাকব, তাও জানি না। ”

ফলে যা অবস্থা দাঁড়াল, তা আমাকে দমিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ছবি বিশ্বাস মশাইকে ‘না’ও তো বলা যায় না। ঠিক করলাম যে, উনি যখন যেতে চাইছেন, তখন যেতে দেওয়াই ভাল, উনি চলে গেলে নাহয় আর-একটা ছবি ধরে সেটার কাজ শেষ করব। তারপরে আবার শুরু করা যাবে ‘জলসাঘর’-এর কাজ। মোট কথা, উনি ফিরে না-আসা পর্যন্ত একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে আমি রাজি নই।

যে-সব গল্প পড়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল একটা রূপক-ধাঁচের রসরচনা। নাম ‘পরশপাথর’। এটি আমাদের বিখ্যাত রসরচনাকার পরশুরামের লেখা। গল্পটা এক ব্যাঙ্কের কেরানিকে নিয়ে। দৈবাৎ তিনি একটি পরশপাথর পেয়ে যান। যে-কোনও লোহায় তা ছোঁয়ানো মাত্র সেটা সোনা হয়ে যায়। ওই করে তিনি বিরাট ধনী হয়ে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু বিলাস-বৈভবে তাঁর অরুচি আসে, তা ছাড়া এটাও তিনি দেখতে পান যে, অত্যধিক বিত্ত তাঁর স্বস্তি ঘুচিয়ে দিয়েছে। এইসব দেখে তিনি ফিরে যান তাঁর মধ্যবিত্ত জীবনে।

ছবি বিশ্বাস চলে যাবার পরে প্রমোদ লাহিড়িকে আমরা আমাদের এই নতুন ছবির প্রযোজক হিসেবে পাই। তাঁর কোম্পানির নাম এল. বি. ফিল্মস ইন্টারন্যাশনাল। ব্যাঙ্কের কেরানির ভূমিকায় নির্বাচন করি তুলসী চক্রবর্তী মশাইকে। তাঁর ছেচল্লিশ বছরের অভিনেতা-জীবনে এই প্রথম তিনি এমন একটি সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেলেন, যা তাঁর প্রতিভার যোগ্য। ‘পরশপাথর’-এর কাজ অত্যন্ত দ্রুত ও মসৃণভাবে শেষ হয়। কিন্তু এ-ছবি মুক্তিলাভের আগে ‘ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব’-এ যোগ দেবার জন্য আমি আমন্ত্রিত হই। উৎসবে দেখানো হবে আমার ‘অপরাজিত’। ছবিটির পরিবেশন-ভার শান্তি চৌধুরিকে দেওয়া হয়। ইনি একজন খাঁটি চলচ্চিত্রপ্রেমিক মানুষ, অথোপার্জনের ব্যক্তিগত কিছু ব্যবস্থাও এঁর আছে। ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গ্লাসগো গিয়েছিলেন। সম্প্রতি সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ও ‘অপরাজিত’ দেখে ইনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নেন যে, এঁর জীবনটাই তার ফলে পালটে যায়। ভদ্রলোক ঠিক করেন, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ফিল্মের লাইনে আসবেন। প্রথমেই খুলবেন একটা ডিসট্রিবিউশন কোম্পানি, আর প্রথমেই যে-ছবি পরিবেশনার দায়িত্ব নেবেন তা হল ‘অপরাজিত’। ছবিটির একটি প্রিন্ট সঙ্গে নিয়ে শান্তি রোম রওনা হন। সেখানে ইতালীয় ভাষায় তিনি এর সাব-টাইটেলের ব্যবস্থা করবেন। আমি যাত্রা করি তার দু’ হপ্তা বাদে। গিয়ে দেখি সাব-টাইটেল করা হয়ে গেছে। রোম থেকে আমরা দু’জন ট্রেনে ভেনিস যাই।

অল্প দৈর্ঘ্যের ফিল্মটার যে বিভাগ, তার অন্যতম প্রতিযোগী হিসেবে আমার বন্ধু লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ছবি ‘এভ্‌রি ডে একসেপ্ট ক্রিসমাস’ যে এই উৎসবে দেখানো হবে, তা আমি জানতাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আর-এক জায়গায় যাবার কথা আছে বলে লিন্ডসে এখানে আসতে পারবে না। এটা সে চিঠি লিখে আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল। সেইসঙ্গে অবশ্য এও জানিয়েছিল যে, সে না এলেও তার দুই বন্ধু জিন মস্কোভিত্‌স আর লটি আইসনার ভেনিসে আসবেন। ‘পথের পাঁচালি’ এঁদের দুজনেরই ভাল লেগেছিল।

খালের ধারে একটা ছোট হোটেলে আমরা উঠি। প্রথমেই খোঁজ করি যে, প্রতিযোগিতাটা এখানে কী রকম, এবং আর কী কী ছবি প্রতিযোগিতায় এসেছে। তালিকায় দেখি, নামজাদা সব পরিচালক এখানে ছবি পাঠিয়েছেন। দেখে দমে যাই। কুরোসাওয়া, ভিসকন্তি, জিনেমান, নিকোলাস রে আর আঁদ্রে কায়াতের মতো পরিচালকদের ছবি যেখানে দেখানো হবে, সেখানে আমাদের আর কী আশা করা সম্ভব? জুরি-সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পেনেলোপি হুস্টন। তাঁকে ভালই চিনতাম।

ছবি দেখানো হচ্ছিল পালাজোতে। বিশাল জায়গা, হাজার তিনেক মানুষ সেখানে ধরে যায়। প্রদর্শনীতে কেতা মেনে চলতে হয়। ফলে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমাকে সাদা প্রিন্স-কোট আর কালো ট্রাউজার্স পরতে হয়েছিল।

জিন আর লটির সঙ্গে চটপট বন্ধুত্ব হয়ে যায়। জিন হচ্ছেন ‘ভ্যারাইটি’ পত্রিকার চিত্র-সমালোচক। লটি মূলত জার্মন। এককালে বার্লিনে থাকতেন। পরে হিটলারের আমলে বার্লিন ছেড়ে প্যারিসে চলে আসেন। বয়স ষাটের উপরে। মধুর স্বভাবের ভদ্রমহিলা। প্রকৃত ফিল্ম-বোদ্ধাও বটেন।

আমার ছবিটি ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম দিনে দেখানো হয়। সাব-টাইটেল নিয়ে শন্তি যা করেছিলেন, ছবিটাকে বোঝার ব্যাপারে তাতে আদৌ কোনও সুবিধে হয়নি। সাব-টাইটেলের কাজটা তিনিই দেখে দেন। কিন্তু লেখাগুলো পর্দায় ফুটে উঠবার পরে এত দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছিল যে, সেগুলো পড়াই যাচ্ছিল না। শান্তির যুক্তি, লেখাগুলোকে বেশিক্ষণ ধরে রাখলে ছবি দেখার অসুবিধা হয়। সেটা তিনি করতে চাননি। তা সে যা-ই হোক, হরিহরের মৃত্যুর সময়ে ওই যে পায়রাগুলো মাটি ছেড়ে একইসঙ্গে উড়াল দেয়, সেই দৃশ্যটিতে দর্শকরা দেখলাম একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাততালি দিয়ে উঠলেন। ছবি শেষ হতেও ফের সেইরকম হাততালি পড়ল। প্রেক্ষাগৃহ থেকে আমরা এরপর বেরিয়ে আসি। পেনেলোপি দৌড়ে আমার কাছে চলে আসেন। এসে অস্ফুট গলায় বলেন, “তোমাকে বলাটা আমার ঠিক হচ্ছে না; তবু বলি, দারুণ ছবি করেছ!” পরে, প্রেক্ষাগারে দর্শকদের যারা আসন দেখিয়ে দেয়, সেই রকমের একটি মেয়েও শুনলাম আর-একজনকে বলছে যে, সে ‘ভারী সুন্দর একটি ভারতীয় ছবি’ দেখেছে। কথাটা ভুলে যাইনি।

কী যে ভাবব, বুঝতে পারছিলাম না। যে-সব ছবি এখানে দেখানো হচ্ছে, মনে-মনে তার সঙ্গে আমার ছবিটিকে তুলনা করে দেখার চেষ্টা করি। ভাবি আমার ছবিতে কীসের অভাব রয়েছে। সত্যি বলতে কী, পরিচালকরা যতই নামজাদা হোন, তাতে খুব-একটা আমি দমে যাইনি। তবু বলি, কুরোসাওয়ার ‘থ্রোন অভ্‌ ব্লাড’-এর কথাটা অবশ্যই আলাদা। তার একটা দৃশ্যের উল্লেখ করি। তীর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে ম্যাকবেথকে, আর পিছন থেকে তীরবিদ্ধ ম্যাকবেথকে দেখাচ্ছে একটা শজারুর মতো। মৃত্যুর ওই দৃশ্যটাই তো অবিস্মরণীয়।

পরদিন সকালে সাংবাদিক বৈঠকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, অপুকে নিয়ে একটা ট্রিলজির কথা ভাবছি কি না। উত্তরে, আশ্চর্য ব্যাপার, আমি বললাম, “হ্যাঁ।” কেন যে বললাম, তা আমি আজও জানি না। হয়তো ভেবেছিলাম যে, ‘হ্যাঁ’ বললে তবেই আমার জবাবটা বেশ জুতসই হয়। উত্তরটা কিন্তু খুব ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। আর আমিও দেখলাম, ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে বেশ গেঁথে গেছে। অথচ ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের বাদবাকি অংশের মধ্যে তৃতীয় একটা ছবি করবার মতো উপাদান সত্যিই আছে কি না, তাও তখন আমার জানা নেই।

‘অপরাজিত’ যেদিন দেখানো হয়, স্থানীয় কাগজগুলিতে তার পরদিন ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বেরিয়েছিল। একটা কাগজে তো এই ছবিকেই দেওয়া হয়েছিল পাঁচটা তারা। অর্থাৎ সেরা গোত্রের ছবি।

উৎসবের শেষ দিনে আমি আর শান্তি একটা কফিখানায় বসে কফি খাচ্ছি, এমন সময় বেশ বয়স্ক একজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে, মাথাটা একটু নুইয়ে, আমাদের অভিবাদন জানালেন, তারপর আমার কানের কাছে তাঁর মুখটাকে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললেন, “সিংহগর্জন শুনতে পাচ্ছি।” ভেনিস চলচ্চিত্রোৎসবের পুরস্কার হল সেন্ট মার্কের স্বর্ণসিংহ। পালাজোর হল্‌-এ সেটিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর আসতে-যেতে সেটির দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে আমরা তাকাচ্ছি।

যা-ই হোক, খবরটা যে পাকা, সেদিনই সন্ধ্যায় সুন্দরী একটি তরুণী এসে তা আমাদের জানিয়ে দেন। ইনি উৎসবেরই কর্মী। যেহেতু পুরস্কার-বিতরণ সভার কাজ চলবে ইতালীয় ভাষায়, সেখানে আমাকে কখন কী করতে হবে, তাও তিনি ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যান। যা শুনলাম, তা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। অবশ্য শান্তি ততক্ষণে সেই তরুণীর দুই গালে চুমু দিয়েছেন।

বিচারকমণ্ডলীর প্রধান হচ্ছেন রেনে ক্লেয়ার। পুরস্কার বিতরণ সভায় গিয়ে দেখি, উৎসবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনিও মঞ্চের উপরে বসে আছেন। শ্রেষ্ঠ ফিচার-ফিল্মের নির্মাতা হিসেবে স্বর্ণসিংহটি আমি গ্রহণ করি। তিন লাইনের একটি বক্তৃতাও দিতে হয় আমাকে। আমার পরে ভিসকন্তির হাতে ‘পদ্মসিংহ’ তুলে দেওয়া হয়। এটি তিনি পান ডস্টয়েভ্‌স্কির কাহিনীর ভিত্তিতে নির্মিত চিত্র ‘হোয়াইট নাইট্‌স’-এর জন্য। ভিসকন্তি তাঁর বক্তৃতায় ‘অপরাজিত’ সম্পর্কে কিছু বাঁকা মন্তব্য করেন। অনেকের কাছেই এটা অযাচিত ও কুরুচিকর ঠেকেছিল। স্বর্ণসিংহ ছাড়াও দুটি পুরস্কার পায় ‘অপরাজিত’—ক্রিটিক্‌স অ্যাওয়ার্ড ও সিনেমা নুওভো অ্যাওয়ার্ড। বিখ্যাত বামপন্থী ফিল্ম জার্নাল ‘সিনেমা নুওভো’ থেকে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। এর সম্পাদক মশাই অনুরোধ করেন, তাঁর কাগজ বেরোলে যেন দেখি।

আমার সম্মানে একটা ডিনারও দেওয়া হয়েছিল।

স্বর্ণসিংহটি যে পাথরের স্ল্যাবের উপরে বসানো, সেটি বড্ড ভারী। তার জন্য বাড়তি মালের মাসুল দিতে হয়। কলকাতায় পৌঁছে দেখি, বিমানবন্দরে বিশাল ভিড়। এঁরা আমাকে অভ্যর্থন জানাতে এসেছেন। দেখে অভিভূত হই।

পরে কলকাতার মেয়রের তরফে আমাকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয়।

কলকাতার বক্স-অফিসে ‘অপরাজিত’ সুবিধে করতে পারেনি। তাতে আমার আত্মবিশ্বাস একটা ধাক্কা খেয়েছিল। ভেনিসে জয়লাভের পরে মনে হল যে, ওটা কোনও ব্যাপারই নয়।

বিদেশ থেকে আমার প্রত্যাবর্তনের মাসখানেক বাদে ‘পরশপাথর’ মুক্তিলাভ করে। কাগজে-কাগজে এ-ছবির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হয়। তুলসী চক্রবর্তী যে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ছবিটা তবু দারুণরকম জনপ্রিয় হয়নি। লাহিড়ি এই ছবির পিছনে যে টাকা ঢেলেছিলেন, সেটা উঠে এল না। যে ছকে ফেলে তৈরি করলে ছবি এখানে জনপ্রিয় হয়, আবারও দেখা গেল যে, আমার ছবি সেই ছক থেকে বড্ড বেশি দূরে সরে এসেছে।

ছবি বিশ্বাস ইতিমধ্যে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে ‘জলসাঘর’-এর কাজ আবার নতুন করে আমরা শুরু করি। বারবার একই ধরনের কাজ করব, এমন ইচ্ছা আমার একেবারেই ছিল না। ‘জলসাঘর’ যে শুধু ‘পরশপাথর’ থেকে আলাদা ছবি, তা নয়, অপুকে নিয়ে তোলা ছবিগুলি থেকেও আলাদা। এ-ছবিতে চরিত্র মাত্র পাঁচটি। জমিদারের ছেলের ছোট্ট একটি ভূমিকা আছে এই ছবিতে। তাতে ‘অপরাজিত’র সেই পিনাকীকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

‘জলসাঘর’-এ যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই পেশাদার অভিনেতা। এ আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। জমিদারের পতনটা বিষয় হিসাবে এতই মহিমাব্যঞ্জক যে, শেষ দৃশ্যের ঠিক আগের দৃশ্যটায় আমাকে খুব ভাবনাচিন্তা করতে হয়েছিল। ওর মধ্যে এমন একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা রয়েছে, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। দৃশ্যটি জমিদারের জলসাঘরের সর্বশেষ মজলিশে নাচগানের অনুষ্ঠানের পরে দেখা যায়। শূন্য ঘরে জমিদারবাবু মদ্যপান করে চলেছেন। রাত শেষ হয়ে এল। একটা-একটা করে নিভে যাচ্ছে ঝাড়লণ্ঠন আর দেওয়ালগিরির বাতি। মত্ত জমিদারবাবু এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত। বাতিগুলি দপদপ করে শেষবারের মতন আলো ছড়িয়ে নিভে যাচ্ছে, আর তাঁর মনে হচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে এসেছে তাঁরও আয়ু।

ছবি বিশ্বাস এ-ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনয় সকলেরই ভাল লেগেছিল। সমালোচকরাও প্রশংসা করেন ‘জলসাঘর’ ছবির। প্রথম পাঁচ সপ্তাহ এ-ছবি চলেওছিল দারুণ ভাল। রোজই ‘হাউস ফুল’। তারপর, যা খুবই স্বাভাবিক, উৎসাহটা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে, ছবিটারও আয়ুষ্কাল, একদিন ফুরিয়ে যায়।

‘জলসাঘর’ তুলেছিলাম খুবই কম টাকায়। মোটা খরচ বলতে ছবি বিশ্বাসের ফি। আর হ্যাঁ, বংশী তার স্বাভাবিক দক্ষতায় স্টুডিয়োর মধ্যে যে জাঁকজমকে-ভরা জলসাঘরটি বানিয়ে তোলে, তার জন্যও বেশ দরাজ হাতে খরচা করতে হয়েছিল। অন্য সব খরচ ছিল নামমাত্র। ফলে লোকসান বিশেষ হয়নি। তাও যেটুকু যা হয়েছিল, পরে সেটা বেশ ভালরকমেই পূরণ হয়ে যায়।

যা-ই হোক, বক্স-অফিসে তিন-তিন বার মার খেয়ে যাওয়ায় তখন এমন একটা ছবি তোলা দরকার হয়ে পড়ে, যা সমালোচকদেরও খুশি করবে, আবার একইসঙ্গে বেশ জনপ্রিয়ও হবে। ভেনিসের সাংবাদিক সম্মেলনে ওই যে বলেছিলাম অপুকে নিয়ে তৃতীয় ছবি করব, সে-কথা মনে পড়ে যায়। ফলে ‘অপরাজিত’ বইখানা ফের পড়তে বসি।

মাত্র একবার পড়েই আমার বিষয়বস্তু আমি পেয়ে যাই। আগে এটা ভাবিনি কেন? ভাবা উচিত ছিল। যে অপু বড় হয়ে উঠেছে, শহরে থাকে, এবারে সে-ই হবে ছবির কেন্দ্র-চরিত্র। যেভাবে তার বিয়ে হয়, তার মধ্যেও তো সিনেমার মালমশলা রয়েছে। এটা যে-সময়ের কাহিনী, ভালবেসে বিয়ে করাটা তখন স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। হিন্দু পরিবারে বিয়ের ব্যাপারটা সাধারণত অভিভাবকরাই ঠিক করে দিতেন। তার জন্য অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই একজন পেশাদার ঘটকের সাহায্য নেওয়া হত। তবে এ-সব বিয়ে প্রায়ক্ষেত্রেই সুখের হত না। বধূটি বলি হত স্বামীর বিকৃত যৌনকামনার। তবে ব্যতিক্রমও দেখা যেত বই কী। যে-বিয়ে অভিভাবকদের ইচ্ছায় হচ্ছে, তাতেও লাগত ভালবাসার ছোঁয়া। স্ত্রী সে-ক্ষেত্রে স্বামীর দাসী না হয়ে প্রকৃত অর্থে সহধর্মিণী হত, তার সুখ-দুঃখের সে হত সমান অংশীদার।

অপুর ক্ষেত্রে দেখছি, সে তার এক বন্ধুর মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে বন্ধুর মামাবাড়ির গ্রামে গিয়েছিল। বরপক্ষ এসে পৌঁছবার পরে দেখা যায়, পাত্রটি উন্মাদ। মেয়ের মা এই পাত্রের হাতে তাঁর মেয়েকে সমর্পণ করতে রাজি হন না। এদিকে লগ্ন পার হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে ভণ্ডুল হবার উপক্রম হয়, কেননা হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী লগ্নভ্রষ্টা কন্যাকে আর পাত্রস্থ করা চলে না। লগ্ন থাকতে-থাকতেই তাই দ্বিতীয় কোনও পাত্র খুঁজে বার করা চাই। নইলে এ-মেয়ে সারা জীবন কুমারীই থেকে যাবে।

অপু তখনও পাত্রীকে দেখেনি। তবু মেয়েটির কথা ভেবে সহানুভূতি জাগে তার মনে। আর সেইজন্য তাকে বিয়ে করতে সে রাজিও হয়ে যায়। বিয়ের পর কয়েকটা মাস আনন্দে কাটে। তারপর পিত্রালয়ে গিয়ে, প্রথম সন্তানের জন্ম দেবার সময়, মেয়েটির মৃত্যু হয়।

গভীর শোকে ভেঙে পড়ে অপু। যে সন্তানের জন্ম হয়েছে, তাকে সে গ্রহণ করতে চায় না। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য এই সন্তানটিকেই সে দায়ী করে। সে কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে দেশের নানা জায়গায় ঘুরতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের এক কয়লাখনিতে চাকরি নিতে বাধ্য হয়। পাঁচটা বছর কেটে যায়। অপুর সেই বন্ধু তাকে খুঁজে বার করে। ছেলের দায়িত্ব নেবার জন্য অনুরোধ করে তাকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অপুকে তার শ্বশুরালয়ে যেতে হয়। সেখানে সে দেখতে পায় তার ছেলেকে। দেখামাত্র বাৎসল্যে ভরে ওঠে তার মন। ছেলে তাকে, বাবা হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। মামাবাডির আশ্রয় ছেড়ে অপুর সঙ্গেই সে চলে যায়।

ফিল্মের জন্য এর চেয়ে ভাল গল্প আর হয় না। খুব দ্রুত আমি এর চিত্রনাট্য লিখে ফেলি। এবারে ব্যবস্থা হয় নতুন পরিবেশক ছায়াবাণী প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে। ঠিক হয় যে, সত্যজিৎ রায় প্রোডাকসন্স—এই ব্যানারে ছবিটি তোলা হবে। টাকাটা তাঁরাই দেবেন। লাভের শতকরা ৫০ ভাগ আমি পাব। এ হল ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়কার কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *