৪. প্রতীক্ষার অবসান

প্রতীক্ষার অবসান

১৯৫৪ সালের গোড়ার দিকে আমাদের কাজের প্রথম পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই আবার আমরা শুটিং শুরু করি। পকেটে টাকা রয়েছে, দলের লোকেদেরও তাই কাজে এখন চতুর্গুণ উৎসাহ। গোড়ার দিকে যখন কাজ চলছিল, বংশী আর সুব্রত তখন দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ছাড়া আর কিছুই পেত না। এখন, অঙ্কটা যতই ছোট হোক, দলের আর-সকলের মতো তারাও কিছু টাকা পাচ্ছে।

আমাদের কপাল ভাল, গত আট মাসে দুর্গা আর অপুর চেহারা তেমন পালটায়নি। তবে ইন্দির ঠাকরুনের মাথার চুল ইতিমধ্যে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সেটাকে ছেঁটে ছোট করবার ভার পড়ল আমার সহকারী শান্তি চাটুজ্যের উপর। কাঁচি পাওয়া গেল না, শান্তি তাই একখানা ব্লেড দিয়েই তাঁর চুল কেটে দেয়। চুনিবালার উদ্যম আর উৎসাহে দেখা গেল একটুকুও ভাটা পড়েনি।

কাজ শুরু করেই স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, গত আট মাসে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। প্রবেশ-প্রস্থানের ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য তখনও মাঝে-মধ্যে একটা-দুটো ভুল হচ্ছিল আমার। (কোনও শটে যদি কাউকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়, তো পরের শটে তাকে ঢুকতে হবে বাঁ দিক দিয়ে, এই ধরনের সব ব্যাপার আর কী।) তবে নিমাই রায় চটপট সেগুলো ধরিয়ে দিচ্ছিল। নিমাই রায় এ-ছবির প্রথম সহকারী ক্যামেরাম্যান। যাদের নিয়ে দল গড়েছিলাম, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিনের অভিজ্ঞতা ছিল এই নিমাইয়েরই।

আমরা ঠিক করি যে, রাত্রির দৃশ্য তোলা হবে স্টুডিয়োর ভিতরে। বংশী তার জন্য বোড়ালের বাড়ির আদলে স্টুডিয়োর মধ্যে তিনটে ঘর বানিয়ে দেয়। তার কাজ তো একেবারে নিখুঁত, এ-ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। হুবহু যেন বোড়ালের সেই বাড়ি। তিনটে ঘরের যোগসম্পর্কের ব্যাপারটা ঠিকমতো ছকে নিয়ে স্টুডিয়োর ঘরগুলোকে একেবারে সেইভাবেই সে গড়ে তুলতে পেরেছিল। এমনকি, দেওয়ালের আস্তরও সেইরকম।

স্টুডিয়ো লাইটিংয়ের কাজে সুব্রতর তখন কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে ব্যাপারটা সে চটপট ধরে নেয়। কেরোসিনের লণ্ঠন কিংবা কুপি থেকে ধোঁয়া উঠে যে একটা ম্লান অনুজ্জ্বল পরিবেশের সৃষ্টি হয়, তারই সাহায্যে সে ছায়াময় শটগুলি তুলছিল। তাতে দৃশ্যগুলো অনেকখানি বাস্তবসম্মত দেখাচ্ছিল।

এই সময়ের শুটিংয়ের অনেক ঘটনার স্মৃতিই আজও উজ্জ্বল, অনেক কথাই স্পষ্ট মনে পড়ে। ইস্কুল-মাস্টারের দৃশ্যটি চমৎকার এসে গিয়েছিল, এ-দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ও হয়েছিল দুর্দান্ত। সেদিনকার কাজকর্ম শেষ হয়ে যাবার পরে তিনি বলেছিলেন যে, তিরিশ বছর ধরে ফিল্মে অভিনয় করছেন, কিন্তু তার মধ্যে এমন কাজ আর একটিও পাননি।

দর্শকের কৌতূহল কেড়ে নেবার মতন একটি দৃশ্য রয়েছে মিঠাইওয়ালা চিনিবাসকে নিয়ে। কাঁধে বাঁক, তার দু’দিকে শিকে, তাতে মাটির হাঁড়ির মধ্যে মিঠাই নিয়ে সে ফিরি করে বেড়ায়। মোটামতন যে হাসিখুশি মানুষটিকে এই ভূমিকায় আমরা নামাই, অভিনয়ে কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। ভদ্রলোককে কিন্তু দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল। পথের ধারে হরিহরের বাড়ি। সেইখান দিয়ে যেতে-যেতে চিনিবাস হাঁক দিয়ে ঘণ্টা নাড়ে। শুনে দুর্গা আর অপু ছুটে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উৎসুক চোখে চিনিবাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা তারা ভালই জানে যে, মিষ্টি কেনবার মতো পয়সা তাদের নেই। চিনিবাস আবার হাঁক দেয়। দুর্গা মাথা নাড়ে। চিনিবাস এগিয়ে যায়। বাঁকের দু’দিকে দুলতে থাকে তার মিঠাইয়ের হাঁড়ি। দৃশ্যটা এতই লোভ জাগিয়ে দেয় যে, দুর্গা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নিজেরা না-ই কিনুক, অন্যেরা মিষ্টি কিনছে, এটা দেখবে বলে চিনিবাসের পিছু নেয়। তার সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়তে থাকে অপু। বইয়ের মধ্যে এই ঘটনার এই রকমের বর্ণনা রয়েছে। আমার মনে হল, বাড়ির পোষা কুকুরটাও যদি ওদের সঙ্গ নেয়, দৃশ্যটা তা হলে আরও জমে উঠতে পারে। প্রথম যখন আমরা বোড়ালে যাই, তখন সেখানে হল্‌দেটে রঙের একটা নেড়িকুত্তা দেখেছিলাম। আমাদের গোটাকয়েক শটে সেটাকে রাখাও হয়েছিল। ট্রেনিং-পাওয়া কুকুর নয় ঠিকই, তবে কিনা এর আগে যে-সব শটে সে ছিল, তাতে ট্রেনিং-পাওয়া কুকুরের দরকারও ছিল না। এবারে কিন্তু এই দৃশ্যে তাকে অভিনয়ও করতে হবে। অপু আর দুর্গার পিছনে একটা গাছতলায় সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকবে। তারপর যেই দুর্গা ছুট লাগাবে চিনিবাসের পিছনে, কুকুরটাও অমনি লাফিয়ে উঠে দুর্গার পিছু নেবে। অর্থাৎ চিনিবাসের পিছনে অপু, তার পিছনে দুর্গা, তার পিছনে কুকুর। ছবিতে এই দৃশ্যটিকে এইভাবেই ধরা হয়েছে। কুকুরটিকে নিয়ে দিনভর কাজ করাতে হয়েছিল। কিছুতেই তাকে দুর্গার পিছু নেওয়ানো যাচ্ছে না দেখে মোক্ষম একটা উপায় ঠাওরাতে হয়। দুর্গাকে বলি, হাত দুখানা সে পিছনে রেখে এগোক, আর হাতের মধ্যে থাক্ একটা মিষ্টি, কুকুরটা তা হলেই তার পিছু নেবে।

দুর্গা হাঁটছে আর কুকুরটা তার পিছু নিয়েছে, এইভাবে বার কয়েক রিহার্সাল দেওয়া হল। কিন্তু ঠিক এইভাবে তো দৃশ্যটা আমি চাইছিলাম না। আমি চাইছিলাম, দুর্গা চিনিবাসের দিকে ছুট লাগাতেই কুকুরটাও অমনি লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিচ্ছে, একই শটে এই ব্যাপারটাকে ধরতে হবে। কিন্তু সেটা আর হচ্ছিল না। ক্যামেরার পিছনে একজনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল, যাতে ঠিক সময়ে সে কুকুরটাকে ডাকে। এই যে গোটা ব্যাপারটা, এটাকে ঠিকঠাক ধরবার জন্য আমাদের মোট এগারোটা টেক্-এর দরকার হয়েছিল। মিছিল চলেছে, পুকুরের জলে পড়েছে তার ছায়া—পরপর অনেকগুলো শট, আর তার প্রত্যেকটিই দুর্দান্ত। উল্লেখ করতে হবে যে, কুকুরটি এর একটিতেও কোনও বেয়াড়াপনা করেনি।

পাশ্চাত্ত্যে যাঁরা ছবি তোলেন, তাঁদের কাজের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে যে, চতুষ্পদ প্রাণীকে দিয়ে ছবির কাজ করাবার ব্যাপারে এগারোটা টেক্ এমন-কিছু বেশি নয়। উইলিয়াম ওয়াইলার নাকি তাঁর এক অভিনেতাকে একবার বলেছিলেন যে, এগারো নম্বর টেক্-এ সে যা অভিনয় করেছে, তার সঙ্গে পঁচিশ নম্বর টেক্-এর অভিনয়টা সে একবার তুলনা করে দেখুক।

পেশাদার অভিনেতাদের ব্যাপারে আমার নিজের যা অভিজ্ঞতা, তাতে বলতে পারি, এঁদের ক্ষেত্রে প্রথম ‘টেক্’টাই সাধারণত সেরা ‘টেক্’। সেটা তেমন উতরোয়নি মনে হলে অবশ্য আর-একটা ‘টেক্’ না নিয়ে ছাড়ি না। যাঁরা পেশাদার নন, তাঁদের বেলায় অবশ্য আরও ‘টেক্’-এর দরকার হয়। তবে দুটোর বেশি ‘টেক্’-এর দরকার আমার বড় একটা হয়নি, অন্তত ‘পথের পাঁচালি’তে তো নয়ই।

ইতিমধ্যে আমাদের টাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে, আগেই বলেছি, টাকাটা আসত খেপে-খেপে। প্রতি খেপে যে টাকা পেতাম, সেটা কীভাবে খরচ হল, তার একটা হিসেব দাখিল করতে হত আমাদের। সরকারি দফতর সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করত। তার পর আসত পরের কিস্তির টাকা। হিসেব পরীক্ষার কাজ শেষ হতে-হতে কখনও-কখনও মাসাধিক কাল সময় লেগে যেত। ফলে, শুটিং তো বন্ধ থাকতই, সৃষ্টি হত আরও নানা ঝঞ্ঝাট-ঝামেলার। শুটিংয়ের কথায় বলি, চিনিবাসের সঙ্গে একদিন শুটিংয়ের পরেই টাকা ফুরিয়ে যায়। যে-দৃশ্যে চিনিবাস গিয়ে বড়লোক মুখুজ্যে পরিবারের বাড়িতে পৌঁছেছে, এদিকে অপু আর দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে গেটের ধারে, সেটা এখনও তোলা বাকি। টাকার অভাবে সেটা বন্ধ রাখতে হয়। এদিকে, চিনিবাসের ভূমিকায় যাঁকে নামানো হয়েছিল, পরের কিস্তির টাকা আসতে-আসতে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে তিনি মারা যান। সৌভাগ্যক্রমে চিনিবাসকে এখানে সামনের দিক থেকে দেখাবার দরকার হয়নি, পিছনের দিক থেকে দেখানো হয়। দুই চিনিবাস যে এক নয়, সেটা তাই দর্শকরা টের পাননি।

মুষলধার বৃষ্টির দৃশ্য নিয়েও সমস্যায় পড়তে হয়। বৃষ্টির মধ্যে দুর্গার উচ্ছল আত্মহারা নাচ, গাছতলায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটি শিশু, আর ক্যামেরা প্যান করা হচ্ছে গোটা পরিবেশের উপর দিয়ে—হ্যাঁ, সেই দৃশ্যটির কথা বলছি। ওই রকমের বৃষ্টি তো জুলাই অগস্ট মাসেই পড়ে, তা সেই সময়ে সরকারি দফতর ব্যস্ত ছিলেন আমাদের হিসেব পরীক্ষার কাজে। ফলে, পরের কিস্তির টাকা যখন এল, বর্ষাকাল তখন শেষ হয়ে গেছে। অগত্যা বাচ্চা দুটিকে নিয়ে রোজই আমাদের তখন লোকেশনে যেতে হত। বর্ষা ফুরোবার পরেও অমন বৃষ্টি কখনও-কখনও নামে; সেই আশাতেই যেতাম।

যেতাম, এবং, বৃষ্টি না-ই হোক, বর্ষাকালে প্রকৃতির রূপের তো একটা মস্ত পরিবর্তন ঘটে যায়, আশেপাশে ঘুরে-ঘুরে তার ছবি তুলতাম। জলের মধ্যে পদ্ম আর শাপলার ছবি; পুকুরে পত্রপল্লবের উপরে নেচে বেড়াচ্ছে ফড়িং, তার ছবি; বাতাসে কাঁপছে, পদ্মপাতা, তার ছবি। পুরো তিন দিন ধরে এইসব ছবি তখন আমরা তুলেছি। বইয়ে নেই, চিত্রনাট্যেও নেই; তা না-ই থাক, ‘পথের পাঁচালি’র বিভিন্ন দৃশ্যে এগুলি ছড়িয়ে আছে।

শেষ পর্যন্ত মধ্য-শরতে অক্টোবর মাসে একদিন মুষলধারে বৃষ্টি নামল। চলল এক ঘণ্টারও বেশি। যেন আমাদেরই জন্য দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখা হয়েছিল এই অঝোর বৃষ্টিধারা। ক্যামেরায় যা চমৎকার এসে যায়।

আমাদের হাতে যখন টাকা ছিল, গ্রীষ্মকালের সেই প্রথম দিককার দিনগুলির কথা মনে পড়ে। গ্রীষ্মদিনে একটা গুমট বিষাদের ছোঁয়া থাকেই। দুর্গার মৃত্যুর পরের কিছু দৃশ্য তখন আমরা তুলেছিলাম। ওই সময়কার প্রতিটি দৃশ্যেই যাতে একটা বিষাদের ছোঁয়া লেগে থাকে, সেটা ভেবেই দৃশ্যগুলির শুটিং ওই সময়ে করা হয়েছিল।

১৯৫৪ সালের শরৎকালে এমন একটা ঘটনা ঘটে, আমাদের ফিল্মের দিক থেকে যা খুবই তাৎপর্যময়। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ম অভ মডার্ন আর্টের অন্যতম ডিরেক্টর মনরো হুইলার ওই সময় কলকাতায় আসেন। ভারতীয় জীবন যার মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে, তাঁর সংগ্রহশালায় এমন কিছু নিদর্শনের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চেয়েছিলেন, সেই সূত্রেই তাঁর এখানে আসা। কিমারের আপিসে এসে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি যে একটি ছবি তুলছি, এটা শুনে তিনি খুব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “ছবির কিছু স্টিল আমাকে দেখানো যায়?”

তাঁকে কয়েকটি স্টিল দেখাই। তাতে তাঁর আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বলেন, পরের বছর মে মাসে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে; তাতে আমাদের এই ফিল্মটি তিনি দেখাতে চান। মনে-মনে একটা হিসেব কষে নিয়ে আমি বলি যে, আমাদের ফিল্ম তার মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। শুনে তিনি বলেন, তা হলে তো কথাই নেই, এ-ছবির বিশ্ব-উদ্বোধন তা হলে মোমাতেই (মিউজিয়ম অভ মডার্ন আর্ট) হবে। কথা পাকা হয়ে গেল, তবে কাগজেপত্রে সই-টই কিছু হল না। কলকাতা ছাড়ার আগে হুইলার বলে গেলেন, তিনি যোগাযোগ রাখবেন।

কথাটা মিঃ মাথুরকে জানিয়ে বললাম যে, টাকাটা এবারে তাড়াতাড়ি দেবার ব্যবস্থা হোক, কেননা কথা যখন দিয়েছি তখন সময়মতো কাজটা আমি শেষ করতে চাই। ব্যাপারটা আমার কাছে যেন দৈব আশীর্বাদের মতন মনে হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, পরিকল্পনামতো সব কাজ যদি ঠিকঠাক চলে, তা হলে এরই সূত্রে আমাদের কাছে বিশ্ব-বাজারের দরজা খুলে যাওয়া সম্ভব। ফিল্মের কাজ ইতিমধ্যে যেটুকু হয়েছে, রাফ-কাটের হিসেবে তার দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ন’ হাজার ফুটের মতো। কাজ যা করেছি, তার জন্যে মনে-মনে নিজেকেই তারিফ জানাচ্ছিলাম। পর্দায় যা ফুটল, তাতে ইউনিটের সবাই দেখলাম আনন্দে-উত্তেজনায় টগবগ করছে। সত্যি বলতে কী, এ-ছবির সঙ্গে ভারতে বা পৃথিবীতে তোলা কোনো ছবিরই মিল নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমার উপরে হলিউডের রেনোয়ার কি ডি’সিকার প্রভাব থাকা সত্ত্বেও এ-ছবি একেবারে হাড়ে-মজ্জায় ভারতীয়।

এর মাস কয়েক পরে আমরা যখন ‘পথের পাঁচালি’র শেষ পর্যায়ের কাজ করছি, সেই সময় জন হিউস্টন কলকাতায় আসেন। তাঁর ‘দ্য মালটিজ ফ্যাকন’ ও ‘দ্য ট্রেজার অফ সিয়েরা মাদ্‌রে’ ছবি আমি দেখেছি। দেখে মুগ্ধও হয়েছি। ফিল্ম নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, আমার বন্ধু রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁদেরই একজন। তিনি তখন ওয়াল্টার টমসনের পাবলিক রিলেশানস অফিসার। কোম্পানির এক ক্লায়েন্টের কাছে তিনি খবর পান যে, জন হিউস্টন কলকাতায় আসছেন, কেউ একজন যদি এয়ারপোর্টে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন তো ভাল হয়। রাধাপ্রসাদ আমাকে এই খবরটা দিয়ে জানালেন যে, হিউস্টন আমার অসমাপ্ত ফিল্মের কথা শুনেছেন, আমার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান।

হিউস্টনের ইচ্ছে ছিল রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’ কাহিনীটির ভিত্তিতে হামফ্রে বোগার্টকে নিয়ে একটি ছবি করবেন। তার জন্য কাঠমাণ্ডুতে গিয়ে লোকেশন বাছাই করতে হবে। তিনি যে কলকাতায় এসেছিলেন, এটাই তার মূল কারণ।

কলকাতায় এসে রেনোয়া উঠেছিলেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। হিউস্টনও ওই একই হোটেলে ওঠেন। সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ভদ্রলোক বলেন, “আপনি তা হলে ছবি করছেন? গুপ্ত আমাকে আপনার ছবির কথা সংক্ষেপে বলেছেন। শুনে তো আমার বেশ ভালই লাগল। তা ছবির খানিকটা অংশ আমাকে দেখাতে পারেন?” বললাম, রাফ-কাটের অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়, প্রিন্টিংও সব জায়গা একইরকম হয়নি, তা ছাড়া সাউন্ডের ব্যাপারটাকেও খুব-একটা ভাল বলা যাচ্ছে না। শুনে তিনি বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না। “ওর থেকেই যা বুঝবার আমি বুঝে নেব। আমি নিজেও তো ছবি করি।”

হিউস্টনকে আমি মোটামুটি আধ ঘণ্টার মতো দৈর্ঘ্যের রাফ-কাট্ দেখাই। দেখাতে গিয়ে যে-সব জায়গায় সংলাপ রয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে সেইসব দৃশ্য আমি বাছাই করি, চোখের চাহিদাই যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে। কাশবনের ধার দিয়ে রেলগাড়ি যাবার দৃশ্যটিও তার মধ্যে ছিল। ছবি দেখে হিউস্টনের যে খুবই ভাল লেগেছে, তা তাঁর কথা থেকে বুঝতে পারি। বলেন, “কঠোর বাস্তবের সিরিয়াস ছবি। পশ্চিমে এর কদর হওয়া উচিত।” পরে প্রকাশ পায় যে, তিনি মনরো হুইলারের বন্ধু। হুইলারই তাঁকে বলেছেন যে, কলকাতায় এসে তিনি যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, ছবির কাজ কদ্দুর এগোল তার খোঁজ নেন আর সম্ভব হলে খানিকটা ফুটেজও যেন দেখেন।

দেশে ফিরে গিয়ে হুইলারের কাছে তিনি আমাদের কাজের খুব প্রশংসা করেন। হুইলারও চিঠি লিখে জানতে চান আমাদের কাজ কীরকম এগোচ্ছে। উত্তরে আমি তাঁকে লিখি যে, এমন সব অসুবিধের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে, যার উপরে আমার কোনও হাত নেই। তবে এ-সব অসুবিধে সত্ত্বেও ছবির প্রিন্ট আমি ঠিক সময়মতো পাঠিয়ে দেব।

শুটিং ক্রমে শেষ হয়ে আসছিল। এবারে আবহ সংগীতের কথাটা নিয়ে ভাবা দরকার। আমি যে এ-ব্যাপারে রবিশংকরের কথা ভাবছিলাম, তার একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে আমি ভালই চিনি। আর অন্য কারণ, যে যন্ত্র তিনি বাজান সেই সেতারের ঝংকার আমার ভাল লাগে। আমি আশা করছিলাম যে, এটাকে তিনি কাজে লাগাবেন।

রবিশংকর তখন দিল্লিতে থাকতেন। আবহসংগীতের কাজটা করে দিতে তিনি রাজি হবেন কি না জানতে চেয়ে তাঁকে আমি চিঠি লিখি। রবিশংকর এককথায় রাজি হয়ে যান। কোন সময়ে তাঁকে দরকার হবে, সেটা তাঁকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে তিনি জানান যে, ওটা নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না।

ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর দৃশ্যের শট আগেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দৃশ্যটাকে সম্পূর্ণতা দিতে যে মেজাজ তৈরি করা দরকার তা তখনও করে উঠতে সফল হইনি। গ্রামের লোকেরা তাঁর শবদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্যের শট নেওয়া তখনও বাকি রয়েছে। শবদেহ বহনের জন্য খাট চাই, কিন্তু গরিব লোকেদের তো খাট কেনার সামর্থ্য নেই, তারা বাঁশে করেই শব বহন করে। শবদেহটাকে দড়ি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে বেঁধে নেয়, যাতে সেটা ছিটকে পড়ে না যায়। ইন্দির ঠাকরুনের শবও ওইভাবেই বহন করা হবে।

শুটিংয়ের কাজ খাতায়-পত্রে শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ইন্দির ঠাকরুনকে দিয়ে এই শেষ দিনের কাজটুকু তখনও করিয়ে নেওয়া বাকি, স্রেফ এরই জন্যে অনিলবাবু তাঁকে নিয়ে আসতে যান। অনিলবাবুকে বলে দিয়েছিলাম, কাজটা কী, ইন্দির ঠাকরুনকে তিনি যেন তা না বলেন। “শুধু এইটুকু বলবেন যে, খুবই সহজ শুটিং, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।”

চুনিবালা এলেন। এসে দেখলেন, উঠোনের উপরে একটা বাঁশের খাটিয়া আর তার পাশে একতাল দড়ি পড়ে আছে। আস্তে-আস্তে তাঁর মুখেচোখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বললেন, “তোমরা আমাকে দাহ করতে নিয়ে যাবে, কেমন? আমি ছাড়া আর কোন্ জ্যান্ত মানুষের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে? এসো, বাঁধো আমাকে!”

খাটিয়াটাকে চারজনে মিলে একটু উঁচু করে ধরতেই চুনিবালা গিয়ে তার উপরে শুয়ে পড়লেন। দড়ি দিয়ে তাঁর শরীরটাকে জড়িয়ে নিয়ে গিঁট দিল শান্তি। শীতকালের এক ভোরবেলায় এই শটটা নেওয়া হয়। তাতে দেখা যায় যে, খাটিয়া নিয়ে শববাহীরা কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।

শট নেওয়া হল। তারপর খাটিয়াটাকে আবার ফিরিয়ে এনে রাখা হল মাটির উপরে। দেখলাম, চুনিবালা তখনও একেবারে নিস্পন্দ হয়ে তার উপরে শুয়ে আছেন। শট নেওয়া যে হয়ে গেছে এটা তাঁকে বলতে তবে তিনি চোখ খুলে নড়েচড়ে উঠে বসেন।

প্রিন্টের ডেলিভারি কখন দিলে তবে সেটা উদ্বোধনের আগে নিউইয়র্কে পৌঁছবে, সেটা আমরা হিসেব করে নিয়েছিলাম। দেখা গেল, হাতে আর তিন মাস সময় আছে। তার মধ্যে এডিটরকে নিয়ে বসে রাফ-কাট্‌টা আমাকে আর-একবার দেখতে হবে, ভুলচুক থাকলে শোধরাতে হবে, ফাইনাল কাটের সঙ্গে সংগতি রেখে মিউজিক আর সাউন্ড ইফেক্টের ব্যাপারগুলো চেক করতে হবে (বিশেষ করে চেক করতে হবে সেই সাউন্ড ইফেক্ট, টেলিগ্রাফের থামের শোঁশোঁ শব্দটাকে তখনও যা ঠিক ধরতে পারেনি), আর শেষ করতে হবে মিক্সিং আর প্রিন্টিংয়ের কাজ। সাব-টাইটেল করার সময় যে পাওয়া যাবে না, হুইলারকে তা আমি বলেই রেখেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, সাব-টাইটেল ছাড়াই তিনি ফিল্মটা দেখাবেন।

রাফ-কাট্‌গুলি নতুন করে যখন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছি, তখন ছবির গোড়ার দিকের কয়েকটা ত্রুটি আমার চোখে পড়ে। কিন্তু তখন আর তা শোধরাবার উপায় নেই, কেননা শোধরাতে গেলে আবার নতুন করে শুটিং করার দরকার হত। ত্রুটিগুলোর জন্য দায়ী অবশ্য আমারই অনভিজ্ঞতা। এগুলি বহুলাংশেই এইজন্য ঘটেছে যে, হয় ঠিক জায়গায় ক্যামেরা বসাইনি, আর নয়তো লেন্স ব্যবহারে গণ্ডগোল ছিল। ছবির দ্বিতীয়ার্ধ দেখে সে-ক্ষেত্রে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, এটা অনেক পাকা হাতের কাজ। শুটিংয়ে যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে সেটা ভালই উত্‌রেছে।

রবিশংকর কলকাতায় এলেন মাত্র দু’দিনের জন্য। তার মধ্যে আবার একটা সন্ধ্যায় তিনি একটা অনুষ্ঠান করবেন। আমাদের জন্য যে কাজ তিনি করবেন, তাতে যে শুধুই ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র দরকার, এটা তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন। সেই অনুযায়ী বংশীবাদক অলোক দে’র সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি আগে ফিল্মের জন্যে যন্ত্রশিল্পী সরবরাহও করেছেন। রবিশংকর উঠেছিলেন তাঁর এক সংগীতশিল্পী বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। বিভূতিভূষণের বইখানা তিনি পড়েননি, তবে বইখানা যে খুব ভাল, তা জানেন। এটাও জানেন যে, এর বিষয়বস্তু আঞ্চলিক, পটভূমি একটি গ্রাম, আর দারিদ্র্যের মধ্যে একটি অল্পবয়সী ছেলের বড় হয়ে ওঠার কাহিনী এটি।

রবিশংকর প্রথমেই যা বললেন তা এই: “তোমার ছবির একটা সংগীত-রূপ আমি ভেবে রেখেছি।” বলেই তিনি একটা সুর ভেঁজে আমাকে শোনান। আমি তো অভিভূত। সুন্দর সুর, একেবারে এই ছবির উপযোগী। কোন পন্থায় তিনি তাঁর কাজটা করবেন, এর পরে তা নিয়ে তিনি কিছু আলোচনা করেন। আমি জানতাম যে, কাজটা গতানুগতিক হবে না। রবিশংকর এর আগেও অবশ্য গোটা দুয়েক ছবিতে কাজ করেছেন, তাতে লাগিয়েছেন হালকা কিছু সুর। কিন্তু তা হোক, ছবিটা আগে তাঁর দেখা দরকার, একমাত্র তা হলেই তিনি বুঝতে পারবেন যে, এর ঠিক কোথায়-কোথায় সুর লাগাতে হবে। সংগীতের দৈর্ঘ্য কোথায় কতটা হবে, সেটাও জেনে নিতে পারবেন তিনি, আর সেই ফাঁক ভরাট করার কথাটা মনে রেখে সংগীত রচনা করতে ও মহড়া দিতে পারবেন। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে তো তা হবার নয়। রবিশংকর তো মাত্র একটাই দিন দিতে পারছেন আমাকে। এদিকে আবার সংগীতের আঙ্গিকে তাঁর দক্ষতা এতই উঁচু স্তরের যে, কোনও বাঁধাবাঁধির মধ্যে তাঁকে আটকে রাখাটাও ঠিক হবে না। বস্তুত, এই কথা ভেবেই, কী পদ্ধতিতে তিনি কী করবেন, তা নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন আমি তুলিনি। তিনি কী করেন সেটাই দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আমাদের হাতে মাত্র একটা দিন সময়। দ্বিতীয় দিনে রবিশংকরের অন্য জায়গায় অনুষ্ঠান রয়েছে, সুতরাং প্রথম দিনেই আমাদের কাজটা তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিতে হবে। সেদিনই বিকেলে তাই ছবিটা দেখানোর ব্যবস্থা হয়। অলোক দে নিজে একজন চমৎকার বংশীবাদক। তাঁকে বলে দেওয়া হয়, অন্যান্য যন্ত্রশিল্পীকে নিয়ে বিকেল চারটেয় তিনি যেন স্টুডিয়োয় চলে আসেন। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে সেতার (যা রবিশংকর নিজেই বাজাবেন), তারসানাই, চমং (তারের ঝাঁঝ) আর কাচারি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্যের জন্য আমি একটা সুরমূর্ছনার কথা ভেবে রেখেছিলাম। এটাও ঠিক করে রেখেছিলাম, রবিশংকরকে ওই সুরটাই ওখানে ব্যবহার করতে বলব। এটা হল সেই দৃশ্য, হরিহর যেখানে বেশ কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে তারপর ঘরে ফিরছেন, তারপর তাঁর স্ত্রীর কাছে শুনছেন যে, দুর্গা বেঁচে নেই।

এই দৃশ্যে প্রথম কয়েকটা মিনিট সর্বজয়া কোনও কথাই বলেন না। হরিহর তাতে ভাবেন যে, ফিরতে দেরি হয়েছে বলে সর্বজয়া ক্ষুব্ধ, আর সেইজন্যই তিনি চুপ করে আছেন। কিন্তু হরিহর যখন সর্বজয়ার দিকে একটা শাড়ি এগিয়ে ধরে বলেন যে, শাড়িখানা তিনি দুর্গার জন্যে কিনে এনেছেন, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেন না সর্বজয়া, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যেমন বললাম ঠিক সেইভাবেই এই দৃশ্যটা আমি তুলেছিলাম। সবই একেবারে ঠিকঠাক এসেও গিয়েছিল। শুধু ওই কান্নায় ভেঙে পড়ে শোকার্ত বিলাপের অংশটুকু বাদে। মনে হচ্ছিল বিলাপটা এখানে ঠিক যাচ্ছে না। তখন মুখের কথার অংশটা বাদ দিয়ে ছবিটা আবার দেখি। তাতে মনে হয়, চোখের দিক থেকে শটটা একেবারে নিখুঁত। এটা দেখে ঠিক করি যে, বিলাপের বদলে এখানে তারসানাইয়ের এমন একটা তীব্র সুরমূর্ছনা বসিয়ে দেব, যার ভিতর দিয়েই ওই আর্ত বিলাপের একটা দ্যোতনা এসে যাবে।

রাফ কাটের অর্ধেকটারও খানিক বেশি অংশ রবিশংকর দেখেছিলেন। দেখে খুব খুশিও হয়েছিলেন। গোটা ছবিটা দেখবার মতো এবং দেখে সবটা ধরে নেবার মতো সময় তো তাঁর নেই, ফলে কোথায়-কোথায় সুর লাগাবার দরকার হবে তাও বুঝে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায়, আমিই আমার জ্ঞানবুদ্ধিমতো তাঁকে বলে দিই যে, কোথায়-কোথায় সুর লাগানো দরকার। ছবির অন্তত গোটা ছয়েক জায়গায় সুর যোজনা একেবারে না হলেই নয়। বাদবাকি জায়গাগুলোর জন্য এই রকমের একটা ব্যবস্থা হয় যে, সেতারে নানা ধরনের গতি ও মেজাজের এমন কয়েকটি গত্ তিনি তৈরি করে দেবেন, যার কোনওটারই দৈর্ঘ্য মিনিট তিনেকের বেশি হওয়ার দরকার নেই। চূড়ান্ত এডিটিংয়ের সময় সেগুলো আমরা জায়গা বুঝে এক-একটাকে বসিয়ে নেব।

এক-একটা গত্ বাজাবার আগে তক্ষুনি-তক্ষুনি তার স্বরলিপি তৈরি করে বাদ্যযন্ত্রীদের হাতে সেগুলি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তবু মিউজিক রেকর্ডিংয়ে মোটমাট এগারো ঘণ্টা সময় লাগে। বিকেল ছ’টায় যা শুরু হয়েছিল, তা শেষ হতে-হতে রাত পুইয়ে যায়। এই একটানা পরিশ্রমে আমরা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আনন্দও নেহাত কম হয়নি। বাজনার প্রায় সবটাই লাগছিল আশ্চর্য রকমের ভাল। বিলাপের দৃশ্যে যে তারসানাই বাজে সেটি বাজিয়েছিলেন দক্ষিণামোহন ঠাকুর। তারসানাই যন্ত্রের তিনি এক সেরা শিল্পী। আমি চাইছিলাম যে, দ্রুত লয়ের এই ঝালার কাজ পুরো দু’মিনিট ধরে চলুক। এর রাগটা রবিশংকরই ঠিক করে দেন—পটদীপ। তবে কখন কীভাবে এটা কাজে লাগানো হবে, তা তিনি জানতেন না, কেননা ‘পথের পাঁচালি’র যেটুকু তিনি দেখেছিলেন, ওই দৃশ্যটা তার মধ্যে ছিল না।

মিঠাইওয়ালা কাঁধে বাঁক নিয়ে মিঠাই ফিরি করছে, ‘পথের পাঁচালি’র এটিও একটি উল্লেখযোগ্য দৃশ্য। এই দৃশ্যের জন্যও আমরা মিউজিকের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু রবিশংকরের হাতে সময় এত কম ছিল যে, এটা তিনি করে যেতে পারেননি। আমি চাইছিলাম, মিঠাইওয়ালার পদক্ষেপের যে ছন্দ, তার সঙ্গে সংগতি রেখে একটা বাজনার ব্যবস্থা হোক। আমাদের ক্যামেরাম্যান সুব্রতই ঠিক করে দেয় বাজনাটা কেমন হবে। সে একজন নিপুণ সেতারশিল্পীও বটে। এর ফলে রবিশংকরকে একটা সমস্যায় পড়তে হয়। ১৯৫৮ সালে, ‘পথের পাঁচালি’ আমেরিকায় মুক্তিলাভের পরে, তিনি যখন সে দেশ সফরে যান, তখন সেখানে এক জায়গায় তাঁর অনুষ্ঠান চলার সময় শ্রোতাদের মধ্যে থেকে কেউ-একজন তাঁকে অনুরোধ করে বসে যে, মিঠাইওয়ালার দৃশ্যে যে গত্‌টা তিনি বাজিয়েছিলেন সেটা একবার বাজিয়ে শোনান। তখনও রবিশংকর ছবিটা দেখেননি। ফলে কী যে সেখানে বাজানো হয়েছে, তা তিনি জানতেন না। যা-ই হোক, কী বাজিয়েছিলেন মনে পড়ছে না, এই কথা বলে তাঁকে তখনকার মতো অবস্থাটা সামলে নিতে হয়।

ছবির চূড়ান্ত এডিটিংয়ের দায়িত্ব এডিটরের হাতে ছেড়ে না দিয়ে আমিও সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকব, এটা আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ শেষ করে ফিল্মটাকে প্যান-অ্যাম বিমান কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে, যাতে উদ্বোধনের আগেই সেটা নিউ ইয়র্কে পৌঁছে যায়। হাতে তখন আর সময় রয়েছে মাত্র তিন হপ্তা। আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত সুভাষ ঘোষাল ছিলেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা জে ওয়াল্টার টমসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মী। তিনি কোম্পানির কলকাতা আপিসের ম্যানেজার চালর্স মুরহাউসের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করেন যে, ছবির প্রিন্ট প্যান-অ্যামই নিউইয়র্কে পৌঁছে দেবে। নিউ ইয়র্কে জে ওয়াল্টার টমসন কোম্পানির বড়কর্তার মেয়ে অ্যান রেজর শুনলাম মনরো হুইলারের বন্ধু। মনরো হুইলারকে তিনি নাকি আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন যে, চিন্তার কিছু নেই, প্রিন্ট যাতে সময়মতো নিউ ইয়র্কে পৌঁছে যায়, তাঁর বাবার আপিস থেকেই তার ব্যবস্থা করা হবে।

আমার সব সময়ই বিশ্বাস ছিল, মানুষ যদি রোজ আট ঘণ্টা ঘুমোয়, তবে তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ স্রেফ ঘুমিয়েই কেটে যায়। ‘পথের পাঁচালি’তে ধ্বনি সংযোজন ও চূড়ান্ত এডিটিংয়ের কাজে সব মিলিয়ে সময় লেগেছিল দশ দিন। এই দশ দিন আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আর আমার এডিটর দুলাল দত্ত ঘুমিয়েছিলেন মাত্র আধ ঘণ্টা। যে ঘরে কাটিংয়ের কাজ চলছিল, শেষ পর্যন্ত আর না-পেরে, তার মেঝের উপরে, রাশি-রাশি ছড়ানো-ছিটোনো টুকরো-টুকরো ফিল্মের মধ্যেই তিনি শুয়ে পড়েন। আমি তাঁকে মৃদু গোটাকয় ঠেলা দিতে তিনি চোখ না খুলেই জড়িত গলায় বলেন, “আর নয়, সত্যিই আর পারছি না।” কিন্তু তার পরেই, বলতে গেলে প্রায় অমানুষিক চেষ্টায়, তিনি উঠে বসে ফের কাজে লেগে যান। ইউনিটের অন্য সব কর্মী আর আমার সহকর্মীরাও এই ক’টা দিন নামমাত্র ঘুমিয়েছে। কেউ মেঝের উপরেই ঘুমিয়েছে, কেউ টেবিলের উপরে, কেউ বা খান দুই-তিন হাতলবিহীন চেয়ার জোড়া দিয়ে।

বাইরে দুরন্ত ঝড় আর ঘরের মধ্যে রোগশয্যায় শুয়ে আছে দুর্গা, দৃশ্যগুলির মিক্সিংয়ের কাজ এইখানেই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কাজটা এত কঠিন এইজন্য যে, একইসঙ্গে এখানে অনেক রকম সাউন্ড ইফেক্টের দরকার হচ্ছিল। বাজ পড়ার শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, ঝোড়ো বাতাসে দরজা-জানলা বারবার নড়ে ওঠার শব্দ। তারই মধ্যে দুর্গার কাতরানি, তারই মধ্যে সর্বজয়া মেঝের উপর দিয়ে তোরঙ্গ টেনে এনে দরজার পাল্লায় লাগিয়ে দিচ্ছেন যাতে ঝড়ের ধাক্কায় দরজা ভেঙে না পড়ে।

সাউন্ড-মিক্সিংয়ের প্রথম চেষ্টার ফল যা দাঁড়াল, তাতে আমরা প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। শব্দগুলির মধ্যে তো একটা সমন্বয় ঘটানো চাই, সেটা তখনও ঘটানো যায়নি, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই সেগুলি একটা খাপছাড়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, ধ্বনিহীন অবস্থায় যে দৃশ্যগুলিকে নিখুঁত লাগছিল, শব্দগুলিই যেন তার সৌষম্যকে একেবারে তছনছ করে দিতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করি যে, সাউন্ড ইফেক্টের একটা লুপ বানিয়ে নেব। লুপ আর কিছুই নয়, এক টুকরো ফিল্মের দুই প্রান্তকে জুড়ে দেওয়া। এইভাবে জুড়ে নিলে একই শব্দ বারবার আবর্তিত হতে থাকে। ধরা যাক, ঝোড়ো হাওয়ায় আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে দরজার পাল্লা। তার যে শব্দ হচ্ছে, ঠিকমতো যদি তার লুপ করে সেটা চালানো হয় তো সেই একই শব্দ ঘুরে-ঘুরে হতে থাকবে। বৃষ্টি পড়ার শব্দকেও এইভাবে লুপ করে দেখানো যায় যে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের শব্দ হচ্ছে। এমনভাবে অবশ্য সেটা দেখাতে হবে, যাতে ঘনঘন বিদ্যুচ্চমকের সঙ্গেই সেটা সবাই শুনতে পায়। সাউন্ড ইফেক্টের এই যে ব্যাপার, এটা যাতে একেবারে নিখুঁত হয়, তার জন্য সেদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একনাগাড়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছিল। কাজ শেষ হতে-হতে রাত তিনটে বেজে যায়। ইউনিটের লোকেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছি শুধু আমরা দুজন। আমি আর আমার এডিটর দুলাল দত্ত।

‘পথের পাঁচালি’র প্রথম প্রিন্ট তৈরি করতে করতেও রাত প্রায় কাবার হয়ে যায়। পরদিন সকালেই প্রিন্ট পৌঁছে দিতে হবে প্যান অ্যামের আপিসে। ছবিটা যে একবার দেখব, তারও সময় তখন আর নেই। আমাদের কারও পক্ষেই ও ছবি তখন আর দেখা সম্ভব হয়নি। সকালবেলায় আমি আর অনিলবাবু একটা ট্রাঙ্কে করে প্যান অ্যামের আপিসে প্রিন্ট পৌঁছে দিয়ে আসি। এ-ব্যাপারে যে-সব কাগজপত্র তৈরি করা দরকার, তা জে ওয়াল্টার টমসনের আপিস থেকেই ইতিমধ্যে করে দেওয়া হয়েছিল। আমার শরীর তখন আর বইছে না, প্যান অ্যামের আপিসে গিয়ে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলতে-বলতেই কাউন্টারে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কাজকর্ম যেটুকু যা বাকি ছিল, তা অনিলবাবুই করেন। তারপর তিনিই আমাকে জাগিয়ে দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *