৫. মুক্তিলাভের পর

মুক্তিলাভের পর

মোমা অর্থাৎ নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ম অভ্ মডার্ন আর্টে ‘পথের পাঁচালি’র আন্তর্জাতিক উদ্বোধনের পরে তিন হপ্তা কেটে গেল। কিন্তু ছবিটা যে ওদের কেমন লেগেছে, তার কোনও খবরই ইতিমধ্যে এসে পৌঁছল না। ব্যাপার দেখে একটা হতাশার ভাব আমার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম যে, তাই তো, কেতাদুরস্ত যে আমেরিকানরা স্যুটে-বুটে সজ্জিত হয়ে চিত্তবিনোদনের আশায় ছবি দেখতে গেছে, ভারতীয় গ্রামের এক চাষি-গেরস্তের ছবি তাদের কেমনই বা লাগতে পারে! তার উপরে আবার এমন ছবি, যাতে সাব-টাইটেল পর্যন্ত নেই! এ-ছবি তাদের ভাল লাগবার কথা নয়, লাগেওনি নিশ্চয়, আর মনরো হুইলার এই ব্যর্থ বিড়ম্বনার কথাটা আমাকে জানাতে বড়ই সংকোচ বোধ করছেন।

একেবারে হঠাৎই এই সময় হুইলারের কাছ থেকে একটা তারবার্তা এসে পৌঁছল। “আ ট্রায়াম্‌ফ অভ্ ইমাজিনেটিভ ফোটোগ্রাফি।” তারবার্তাটা সুব্রত মিত্রের হাতে তুলে দিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিলাম। এর পরে আসে অ্যান রেজরের চিঠি। দীর্ঘ চিঠি। ছবিটা দেখে সে নিজে কতটা অভিভূত হয়েছে আর দর্শকদেরও যে কী ভাল লেগেছে এই ছবি, চিঠিতে তার বিস্তারিত বর্ণনা। চিঠিখানা সবাইকে দেখালাম। একটা বড় রকমের তৃপ্তি বোধ করেছিলাম এই চিঠি পেয়ে।

কথাটা ক্রমে ছড়িয়ে যায়। সবাই প্রশ্ন করতে থাকে, কলকাতায় এ ছবি কবে মুক্তিলাভ করবে। এ হল মে মাসের কথা। চিত্র পরিবেশনার ব্যাপারে তখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

ছবি তো শুধু তৈরি করলেই হয় না, তার কতকগুলি ব্যবহারিক ব্যবসায়িক দিক রয়েছে। কিন্তু সে সম্পর্কে কিছুই আমার জানা নেই। পার্সেন্টেজ, মিনিমাম গ্যারান্টি, প্রিন্ট ও পাবলিসিটি, এ-সবের বিন্দুবিসর্গও যেহেতু আমি বুঝি না, ব্যাপারটা তাই পুরোপুরি অনিল চৌধুরির হাতে ছেড়ে দিই।

ইতিমধ্যে আমি কিমারের কাজে ফিরে গিয়েছি। মাসান্তে মাইনেটাও পেয়ে যাচ্ছি। সেখানে নিকলসন স্বভাবতই আমার এই ছবির কাজটা সম্পর্কে খুব কৌতূহলী ছিলেন। নিউ ইয়র্কে ছবির যে উদ্বোধন হল, তার কথাও তিনি শুনেছিলেন এর মধ্যে। তাঁর কৌতূহল দেখে তাঁকে ও আমাদের কয়েকজন ক্লায়েন্টকে একদিন ছবিটা দেখাবার ব্যবস্থা করি। ছবির মধ্যে কে কী বলছে, সাব-টাইটেল না থাকায় নিচু গলায় আমাকেই সেটা বলে যেতে হবে।

ছবি দেখানো শেষ হল। আলো জ্বলতে দেখি, নিকলসনের চোখ লাল, দৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে। খুবই আন্তরিকভাবে আমার হাত ধরে তিনি ঝাঁকিয়ে দিলেন। বিদেশিদেরও যে এ-ছবি ভাল লাগতে পারে, এতে যেন আবার নতুন করে তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

অ্যাডভারটাইজিং ক্লাব আমাকে একটা অনুরোধ করেন এই সময়ে। বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এই ক্লাবের সদস্য। ক্লাব থেকে অনুরোধ আসে, ‘পথের পাঁচালি’র একটা বিশেষ শোয়ের ব্যবস্থা তাঁরা করতে চান। তাতে ক্লাবের সদস্যরা আর কিছু আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত থাকবেন। আমি এতে রাজি হয়ে যাই। আমাকে বলা হল, অর্ডনান্স ক্লাবে ছবিটি তাঁরা দেখাবেন। তারপর ক্লাবের মাঠে ব্যবস্থা থাকবে বুফে ডিনারের।

ছবির প্রদর্শন শুরু হবার একটু আগে সস্ত্রীক আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। গিয়ে যা দেখি, তাতে দমে যাই। কাঠের মেঝে, তার উপরে কয়েক সারি চেয়ার পাতা। কেউ হাঁটাচলা করলে কিংবা চেয়ারে বসে সামান্য নড়াচড়া করলেও কাঠের মেঝে থেকে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠতে থাকে। চেয়ারের সারির মাঝমধ্যিখানে বসানো হয়েছে ৩৫ মিলিমিটারের প্রোজেক্টর।

প্রেক্ষাগার তো খানিক বাদেই ভর্তি হয়ে গেল। দর্শকদের মধ্যে কিছু বিদেশিও চোখে পড়ল। কর্তাব্যক্তিরাও সস্ত্রীক এসে গেলেন। সময়মতোই শুরু হল ছবির প্রদর্শন। তবে প্রোজেক্টর থেকে যে-পরিমাণ শব্দ নির্গত হচ্ছিল, তাতে ছবির সংলাপ কিংবা অন্যান্য সাউন্ড-ইফেক্ট খুব-একটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল না। পর্দায় ছবিও যা ফুটছিল, তা তেমন স্পষ্ট নয়। ব্যাপার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি ভাবতে থাকি যে, যত তাড়াতাড়ি এই অগ্নিপরীক্ষা এখন শেষ হয়, ততই মঙ্গল।

‘পথের পাঁচালি’র দৈর্ঘ্য দু’ ঘণ্টা। অর্ডনান্স ক্লাবের সেই দু’ ঘণ্টা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দু’ ঘণ্টাগুলোর একটি, তাতে সন্দেহ করি না। ছবি শেষ হতে আলো জ্বলে। অল্পসল্প চাপা হাততালিও পড়ে।

দেখে একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম যে, শো শেষ হবার পর জনাকয় বিদেশি দর্শক আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং বললেন যে, ছবিটা তাঁদের খুবই ভাল লেগেছে। কিন্তু সে তো শুধুই বিদেশিরা। বাঙালি দর্শকরা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলেন আমাকে। টেবিলে যেখানে ডিনার সাজানো রয়েছে, সরাসরি সেখানে গিয়ে লাইন লাগালেন তাঁরা। এইমাত্র যে ছবিটা তাঁরা দেখলেন, যেন সে সম্পর্কে একটাও প্রশংসার কথা তাঁদের বলবার নেই। কাঁটায় খাবার তুলে তাঁরা মুখের মধ্যে চালান করছেন, হরেক রকমের গালগল্প করছেন নিজেদের মধ্যে, কিন্তু ছবিটা নিয়ে যেন বলার মতো কোনও কথাই নেই।

পরের দিন যথারীতি আপিসে যাই। কিমারের তখনকার আপিস থেকে কিছুটা হেঁটেই কফি হাউসে পৌঁছে যাওয়া যেত। দুপুরের হাল্কা লাঞ্চ সাধারণত ওখানেই আমি সেরে নিতাম। কর্মজীবনের সেই একেবারে সূচনা থেকেই এই অভ্যাসটা আমার হয়ে যায়। জনা ছয়েক বন্ধুও সেখানে আসত। ফলে বেশ আড্ডাও হত কিছুক্ষণের জন্য। খাওয়া হত, গল্পগুজব হত, দিব্যি কেটে যেত সময়টা। সেদিনও দুপুরবেলায় আপিস থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে গিয়েছি। সেখানে আমার বন্ধু জে ওয়াল্টার টমসনের সুভাষ ঘোষালের সঙ্গে দেখা। অর্ডনান্স ক্লাবে সেদিন প্রোজেক্টর আর কাঠের মেঝের আওয়াজ ছাড়া আর কী সমস্যা হয়েছিল, সুভাষের কাছে তা শুনতে পাই। দর্শকদের মতটা নাকি মোটামুটি এই যে, ছবিটা বড্ডই লম্বা। যেমন ধরা যাক (সুভাষের নয়, এটা অন্য কারও কথা), ওই যে সব জলের পোকা আর ফড়িং, ওগুলো ওখানে কী করছিল? কাহিনীর সঙ্গে ওদের কিসের সম্পর্ক? কথাটা শুনে আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লাম, কিছু বললাম না। ভাবছিলাম যে, এই যদি হয় শিক্ষিত বাঙালি দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, সাধারণ দর্শকদের কাছে তা হলে এ-ছবির ভবিষ্যৎ কী?

এ-প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য আমাকে ২৬ অগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন চুক্তিবদ্ধ ছিল যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিউজ-রিলগুলো তারাই তুলবে। ‘পথের পাঁচালি’র বাংলা পরিবেশন-স্বত্ব তারাই পায়। এটাই স্বাভাবিক। ঠিক হয়, কলকাতায় যে-সব ছবিঘর রয়েছে তারই একটি চেনে এ-ছবি দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর কলকাতায় একইসঙ্গে মুক্তিলাভ করবে।

মুক্তিলাভের অনেক আগেই, বিজ্ঞাপনী প্রচারকর্মে আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, বিলবোর্ডের পাঁচটা ডিজাইন আমি তৈরি করে রেখেছিলাম। শহরের পাঁচটা জায়গায় সেগুলো প্রদর্শিত হবে। শহরের একেবারে কেন্দ্রে, চৌরঙ্গিতে, প্রদর্শনের জন্য যে ছবির ডিজাইন করেছিলাম, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সেটি কুড়ি ফুট বাই আট ফুট। তাতে বর্ষাকালের কালো বিশাল একখানা মেঘের তলায় ছুটন্ত অবস্থায় অপু আর দুর্গাকে দেখা যাচ্ছে। দুটি মাত্র শব্দ লেখা আছে সেখানে: ‘পথের পাঁচালি’। ছবিটির মুক্তিলাভের আগে মাস দুয়েক ধরে এই বিলবোর্ড নিয়ে লোকে আলোচনা করে।

দক্ষিণ কলকাতায় এ-ছবির মুক্তির দিনে যেন একটা উৎসবের মতন পরিবেশ হয়েছিল। আমন্ত্রিত সাংবাদিকরা তো এসেছিলেনই, সেইসঙ্গে এসেছিলেন আমাদের অনেক আত্মীয়বান্ধব, লেখক, সমালোচক আর সিনেমা-জগতের লোকজনেরা।

যে সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। অর্ডনান্স ক্লাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম, তার তিক্ত স্মৃতি তাতে মুছে যায়। অল্পবয়সী যে-সব ছেলেমেয়েকে আমি চিনি না পর্যন্ত, আমাকে একটু ছোঁবার জন্যে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে যায় তাদের মধ্যে। সাফল্য যে কী জিনিস, তা আমি বুঝতে পারি। ব্যাপার দেখে মিঃ মাথুরও অমনি ভোল পাল্টে আমার দিকে চলে আসেন। তাঁরও মুখে দেখলাম প্রশংসা ধরছে না, উৎসাহের আতিশয্যে আমার হাত ধরে তিনি ঝাঁকাতে থাকেন। সরকার থেকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে এই ছবি তৈরি করার জন্য, তা যে অনেকগুণ হয়ে ফিরে আসবে, এটা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন।

উদ্বোধনী দিনটির কথা ছেড়ে দিয়ে বলি, প্রথম দু’ সপ্তাহ এ-ছবি মোটামুটি ভালই চলেছিল। যে-চেনে ছবিটি মুক্তিলাভ করে, তাতে মোট ছ’ সপ্তাহের বুকিং ছিল আমাদের। সপ্তম সপ্তাহ থেকে বুকিং ছিল এস. এস. ভাসানের। ইনি দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত প্রযোজক, অনেকটা ডি মিলের মতো জাঁকজমকের ছবি করেন, সদ্য যে ছবিটি তাঁর প্রযোজনায় তখন তৈরি হয়েছে, বুকিং অনুযায়ী ‘পথের পাঁচালি’ তুলে নিয়ে সেই ছবিটিই সপ্তম সপ্তাহ থেকে দেখাবার কথা। এদিকে আবার তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তিনটি ছবিঘরেই ‘পথের পাঁচালি’র টিকিট বিক্রির হার হঠাৎ বেড়ে যায়, আর তারপরেই দেখা যায় যে, ছবিটি সর্বত্র পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে চলছে। প্রতিটি শোতেই হাউস ফুল।

এই অবস্থায় অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন চেন পালটাতে বাধ্য হয়। ছবিটিকে তারা নিয়ে যায় অন্য একটি চেনে। সেখানে আরও সাত সপ্তাহ ছবিটি চলেছিল। অর্থাৎ যাকে বক্স অফিস হিট বলা হয়, ‘পথের পাঁচালি’ ঠিক তা-ই হয়ে দাঁড়ায়।

যা-ই হোক, ছ’ সপ্তাহের পরে তো আগের চেন থেকে ছবিটিকে তুলে নেওয়া হয়। তার পরদিন সাত-সকালে আমাদের বাড়ির কাজের লোকটি এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলে যে, এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। চটপট জামাকাপড় পালটে বাইরের ঘরে এসে ধুতি-পরা এক ভদ্রলোককে দেখতে পাই। দেখে মনে হল দক্ষিণ-ভারতীয়। চেহারায় এ ছাড়া আর কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। চুপচাপ একটা সোফায় তিনি বসে ছিলেন। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “আপনিই কি মিঃ সত্যজিৎ রায়?” বললাম, “হ্যাঁ।” ভদ্রলোক তাতে বললেন, “আমার নাম এস. এস. ভাসান। আমি ‘ইনসানিয়াত’ ছবির পরিচালক।” শুনে বললাম, তাঁর মতন বিখ্যাত পরিচালক যে আমার বাড়িতে এসেছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু এত সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কারণ কী, তা তো বুঝতে পারছি না।

“কারণ তো আপনিই।” মিঃ ভাসান বললেন, “গতকাল রাতে আপনার ছবিটি আমি দেখে এসেছি। আগে যদি জানতে পারতাম যে, অমন ছবিকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় আমার ছবি দেখানো হবে, তা হলে আমি ‘ইনসানিয়াত’-এর মুক্তির দিন পিছিয়ে দিতাম। সত্যিই একটা মহৎ ছবি আপনি তৈরি করেছেন।”

কথাটা শুনে অভিভূত বোধ করি। মিঃ ভাসানকে এক কাপ কফি খেয়ে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আর দাঁড়ালেন না। কথাটা বলেই বিদায় নিলেন।

কাগজে-কাগজে ‘পথের পাঁচালি’র অকুণ্ঠ প্রশংসা হয়েছিল। সমালোচকদের বিশেষণের ভাঁড়ার ফুরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। পরে অন্যান্য শহরে এ-ছবি সাব-টাইটেল ছাড়াই দেখানো হতে থাকে। সাব-টাইটেলের ব্যবস্থা করা যায়নি, তার একমাত্র কারণ, টাকা ছিল না। তা সত্ত্বেও, যাঁরা বাংলা বোঝেন না, তাঁদের মধ্যেও এ-ছবি একই রকমের সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিল।

উপর্যুপরি এর পরে সম্বর্ধনার ব্যবস্থা হতে থাকে আমাদের। সম্বর্ধনা একা আমার নয়, আমার সঙ্গে আমাদের ইউনিটের কর্মীদের আর সেইসঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও। যেমন প্রকাশ্য তেমন ঘরোয়া সম্বর্ধনা। সেনেট হলেও একটা সম্বর্ধনার আয়োজন হয়েছিল, ছাত্রসমাজ তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। দিল্লিতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ‘পথের পাঁচালি’ দেখানো হয়েছিল। এক জায়গায় মারি সিটনও এ-ছবি দেখেন। তিনি এ-দেশে এসেছিলেন চলচ্চিত্র, বিশেষ করে আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র, সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে। দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। ছবিটা তাঁর ভাল তো অবশ্যই লেগেছিল। কিন্তু শুধু তা-ই নয়, বললেন যে, অবিমিশ্র দারিদ্র্যের ছবি বলে যদি কোনও সমস্যা দেখা দেয়, তবে ছবিটির সপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনও সওয়াল করতে হলে তিনি তা করবেন। এ ব্যাপারে যা-কিছু করা দরকার, সবই তিনি করতে রাজি। বললাম, যে কারণের কথা তিনি বললেন, তারই জন্যে যে জনাকয় মন্ত্রী এই ছবিটির উপরে খাপ্পা হয়ে আছেন, এমন আমি শুনেছি। সংশ্লিষ্ট দফতরে তৎক্ষণাৎ একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেন মারি সিটন। তাতে ছবিটির প্রভূত প্রশংসা করে তিনি মন্তব্য করেন, তা-ই যদি হয়, তবু এ-ছবি বিদেশে দেখানো দরকার।

এক বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে এ-ছবি ডঃ বিধানচন্দ্র রায়কে দেখানো হয়েছিল। দেখে তিনি মুগ্ধও হয়েছিলেন। এর মাস কয়েক বাদে তিনি আমাকে বলেন যে, পণ্ডিত নেহরু শিগগিরই কলকাতায় আসছেন, তখন যেন ছবিটি তাঁকে দেখাবার ব্যবস্থা করি।

লাইটহাউসের মিনিয়েচার হল-এ নেহরু তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে ছবিটি দেখেন। ডাক্তার রায় ও আমি বাংলা থেকে মাঝে-মাঝে ইংরেজিতে অনুবাদ করে কাহিনীর সূত্রটা তাঁকে ধরিয়ে দিই। তিনিও ছবিটি দেখে অভিভূত হন। পরে, ১৯৫৬ সালে, কান চলচ্চিত্র উৎসবে এ-ছবি পাঠানো হবে কি না এই প্রশ্ন উঠলে যাঁরা এর বিরোধিতা করেছিলেন, নেহরু তাঁদের চুপ করিয়ে দেন।

উৎসবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছিলেন, (বোম্বাইয়ের) বাঙালি চিত্র-প্রযোজক হিতেন চৌধুরি। ইনি আমার চেনা মানুষ। ‘পথের পাঁচালি’র হয়ে ইনি খুব লড়ে গিয়েছিলেন। কান থেকে ইনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ওই কান থেকেই এক চিঠি লিখে ইনি আমাকে জানান যে, ছবিটির জন্য ভারত সরকার কিছুই করছেন না। অন্তত একটা পার্টির আয়োজন, যা সবাই করে, তাও এঁরা করেননি।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে এক ছুটির দিনে ছবিটি দেখানো হয়। তাও আবার দেখানো হয়েছিল মধ্যরাতে। ‘পথের পাঁচালি’র আগে সেদিন আরও চারটি ফিচার ফিল্ম দেখানো হয়। তার মধ্যে চতুর্থটি ছিল কুরোসাওয়ার নতুন একটি ছবি, উৎসবে যার বিশেষ কদর হয়নি। জুরি-মেম্বারদের অধিকাংশই সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমার বন্ধু লিন্ডসে অ্যান্ডারসন, লটি আইসনার, আঁদ্রে বাজিন, জর্জ সাদুল ও জিন মস্কোভিত্‌স। এঁরা সবাই ছবিটি নিয়ে কথা বলেন। জুলে দাস্যাঁও এঁদের সঙ্গে যোগ দেন। অল্প যে ক’জন জুরি-মেম্বার আমার ছবিটি দেখেছিলেন, দাস্যাঁ তাঁদের অন্যতম। উৎসব-কমিটিকে এঁরা চাপ দেন। তাঁদের বলে দেন যে, জুরি-মেম্বারদের উপস্থিতিতে এ-ছবি আবার দেখাতে হবে। ফলে, বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ছবিটি আবার দেখানো হয়। তাতে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ হিসাবে ‘পথের পাঁচালি’ পায় স্পেশ্যাল জুরি পুরস্কার। একেবারে অবজ্ঞাত হওয়ার চেয়ে এ বরং অনেক ভাল। যেমন দেশে তেমন বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবেও ‘পথের পাঁচালি’ এর পরে ডজন খানেক পুরস্কার পেয়েছে। ম্যানিলার উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসাবে চুনিবালা একটি বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিলেন।

‘পথের পাঁচালি’ মুক্তিলাভের অল্প কিছুদিন আগে চুনিবালা একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসেন, পড়ে গিয়ে তাঁর ‘হিপবোন’ ভেঙে যায়। ফলে তাঁর জন্য ব্যবস্থা করা হয় বিশেষ প্রদর্শনীর। ১৬ মিলিমিটারের একটা প্রিন্ট করিয়ে সেটা তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হয়। পুরস্কার পাবার অল্প কয়েকটা দিন বাদেই তিনি মারা যান।

কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম যে, বিজ্ঞাপন-আপিসের কাজটা ছেড়ে দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণকেই আমার সর্বসময়ের কাজ করে নেব। ‘পথের পাঁচালি’র সাফল্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। এতে আমার স্ত্রীর সম্মতি ছিল। মা সে-ক্ষেত্রে গোড়ার দিকে রাজি না-হলেও পরে আর কোনও আপত্তি করেননি। নানা কাগজে ‘পথের পাঁচালি’র যে-সব সমালোচনা বার হচ্ছিল, লাল মলাটের বড় একখানা খাতায় তিনি ইতিমধ্যেই সেগুলিকে খুব নিপুণ হাতে সেঁটে রাখতে লেগে গিয়েছিলেন।

কিন্তু অত ভাল একটা চাকরি যে ছেড়ে দেব, তার আগে তো পরের ছবিটা করবার মতো একটা গল্পের খোঁজ পাওয়া চাই। সেইসঙ্গে চাই এমন কাউকে, ছবির পিছনে যিনি টাকা ঢালতে রাজি হবেন। ‘পথের পাঁচালি’ সফল হওয়ায় অবশ্য এই ভরসাটা ছিল যে, পরের ছবিটা তুলতে আর এত বেগ পেতে হবে না।

তার প্রমাণও পাওয়া গেল। প্রযোজক মুরলীধর চাটুজ্যে জানালেন যে, তাঁর কোম্পানি এম. পি. প্রোডাকসন্সের ব্যানারে যদি ছবি তুলি তো পরপর পাঁচটা ছবি তুলবার টাকা তিনি জোগাবেন। শর্তগুলি কী হবে, তা নিয়ে চাটুজ্যেমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অনিলবাবুকে। কিন্তু টেকনিশিয়ানদের জন্য অনিলবাবু যে টাকা চান, চাটুজ্যে তাতে রাজি না-হওয়ায় আলোচনা ভেস্তে যায়।

এদিকে আমি একটার পর একটা বাংলা উপন্যাস পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার কোনওটাই আমার মনঃপূত হচ্ছিল না। ফিল্ম করবার জন্য কেউ যখন গল্প খুঁজতে বসে, তখন ঠিক কী ধরনের গল্প সে চায়? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। অনেক সময় হয়তো গোটা গল্পটাই আদ্যন্ত একেবারে ফিল্মের উপযোগী। আবার এমনও হয় যে, অনেক চরিত্রের মধ্যে একটি চরিত্রকে অথবা চরিত্রগুলির মধ্যে যে সম্পর্কের সংঘাত চলছে সেই সংঘাতকে একটু আলাদা করে মনে ধরে। কিংবা গল্পের মধ্যে যে-সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা, তার মধ্যে একটি—মাত্র একটিই—পরিস্থিতি আমাদের ভাল লেগে যায়। মনে হয়, এর মধ্যে একটা মৌলিক ভাবনার ব্যাপার রয়েছে কিংবা এটা খুবই চিত্তাকর্ষক, এবং এটাকে কেন্দ্র করেই একটা গল্প গড়ে তোলা যায়। যখন ‘পথের পাঁচালি’ পড়ি, ও বইয়ের কয়েকটা ব্যাপারই আমাকে তখন খুব আকর্ষণ করেছিল। দুটো মৃত্যু, তুমুল বৃষ্টি, বুড়ি পিসি, সর্বজয়া-চরিত্রের দুটো দিক—একটা দিক মমতাময়, অন্যটা নিষ্ঠুর—এই সবকিছুর দ্বারাই আমি আকৃষ্ট হই। শেষ পর্যন্ত যে মনস্থ করি অপুকে নিয়েই আর-একটা ছবি তুলব, তারও এই একই কারণ। “অপরাজিত’র মধ্যে অপুর চরিত্রের এমন একটা দিকের সন্ধান পাই, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বইয়ের মধ্যে সেই দিকটার উদ্‌ঘাটন হয়েছে খুবই নাটকীয়ভাবে। সেখান থেকেই খানিকটা অংশ তুলে দিচ্ছি: “সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সহিত পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা আনন্দ-মিশ্রিত—এমনকি মায়ের মৃত্যু-সংবাদ প্রথম যখন সে তেলি-বাড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিশ্বাস…একটা বাঁধন-ছেঁড়ার উল্লাস—অতি অল্পক্ষণের জন্য—নিজের অজ্ঞাতসারে। তাহার পরই নিজের মনোভাবে তাহার দুঃখ ও আতঙ্ক উপস্থিত হইল। এ কী! সে চায় কী! মা যে নিজেকে একেবারে বিলোপ করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহার সুবিধার জন্য! মা কি তাহার জীবনপথের বাধা?—কেমন করিয়া সে এমন নিষ্ঠুর, এমন হৃদয়হীন—। তবুও সত্যকে সে অস্বীকার করিতে পারিল না। মাকে এত ভালবাসিত তো, কিন্তু মায়ের মৃত্যু-সংবাদটা প্রথমে যে একটা উল্লাসের স্পর্শ মনে আনিয়াছিল—ইহা সত্য—সত্য—তাহাকে উড়াইয়া দিবার উপায় নাই।”

ছবিতে অবশ্য এমন কোনও দৃশ্য নেই। কিন্তু অপু যে বড় হচ্ছে আর সেইসঙ্গে সরে যাচ্ছে তার মায়ের কাছ থেকে, এটা সেখানে দেখানো হয়েছে। এটা যে ধীরে-ধীরে বুঝতে পারছেন সর্বজয়া, এই উপলব্ধির উপরেও বেশ জোর পড়েছে ছবিতে।

‘অপরাজিত’র কাহিনী যেভাবে সাজিয়ে নিলে তার থেকে ছবি হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল তাতে ছবির সূচনা হয় কাশীতে। হরিহর সেখানে পুরোহিতের কাজ করেন, সেইসঙ্গে গঙ্গার ঘাটে শাস্ত্রপাঠ করে শোনান। অপুর বয়স তখন মাত্র দশ বছর। ছবির শেষে দেখি, সে কলেজের ছাত্র। মায়ের মৃত্যুর পরে সে গ্রামের আত্মীয়-বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে একজন অনাথ হিসেবেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। এই কাহিনীর মানবিক আবেদন খুবই তীব্র। তবে সে-কথা যদি ছেড়েও দিই, তো বলব, কাশীর পটভূমিকায় ছবির প্রথমাংশ করার যে ভাবনা, সেটা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। এর আগেও আমি কাশীতে গিয়েছি। তাই জানি যে, ক্যামেরার দৃষ্টিতে ওর চেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তা ছাড়া, ‘পথের পাঁচালি’র মতোই ‘অপরাজিত’র মধ্যেও আছে দুটি মৃত্যু। ছবির মাঝামাঝি জায়গায় হরিহরের মৃত্যু আর শেষের দিকে সর্বজয়ার। দুটি মৃত্যু বিভূতিভূষণ অতি মর্মগ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করেছেন। মৃত্যুর দৃশ্য চলচ্চিত্রকারদের চিরকালই খুব টানে। এখানে তাঁরা তাঁদের কল্পনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাবার মতো একটা জায়গা পেয়ে যান। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।

‘অপরাজিত’ই যে করব, এটা স্থির হওয়ার আগে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটা গল্প পড়েছিলাম। চলচ্চিত্রের উপযোগী বিষয় হিসাবে সেটিও আমাকে খুব আকর্ষণ করে। শেষ পর্যন্ত ষাটের দশকের গোড়ার দিকে সেই গল্প নিয়ে আমি ‘মহানগর’ ছবিটি তৈরি করি। গল্পের মধ্যে বাবার যে চরিত্র, তিনি একজন ইস্কুলমাস্টার। এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আমি বাংলা নাটকের গুরুস্থানীয় অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়িকে অনুরোধ করি। এর আগে ‘পথের পাঁচালি’ দেখে শিশিরবাবু আমাকে ডেকে পাঠিয়ে ছবিটি সম্পর্কে অনেক প্রশংসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ইস্কুলমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করতে অনুরোধ করায় তিনি হেসে বললেন, “সত্যজিৎ, ফিল্মের যা-কিছু কাজ, তা যে একা পরিচালকই করেন, সে-কথা যেমন আমিও জানি, তেমন তুমিও জানো। তা হলে আর আমাকে তোমার দরকার হচ্ছে কেন?” যা-ই হোক, ‘মহানগর’-এর কাজ তখনকার মতো মুলতুবি থাকে।

চলচ্চিত্র নির্মাণকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে আমি ‘অপরাজিত’ ছবিটি তৈরি করব বলে স্থির করি। নিকলসন আমাকে আন্তরিক শুভেচ্ছায় বিদায় অভিনন্দন জানান। স্টুডিয়োর সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি কিমার ছেড়ে চলে আসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *