সপ্তম অধ্যায় – মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব
- প্রবাসী বাঙ্গালী ডঃ জাফরুরা ও ডঃ মুবিনের নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় ফিল্ড হাসপাতালটি স্থাপিত হয় বিশ্রামগঞ্জে।
- জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন সপরিবারে মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও দুই জন সৈনিক।
- পরের দলটিতে পালিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ ान, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর ও ক্যাপ্টেন খায়রুল আনাম।
- ফ্রন্টলাইন কমান্ডারদের সবক্ষেত্রেই নিজেদের উদ্যোগ ও চেষ্টার উপর নির্ভরশীল হয়েই সংগঠিত করতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ।
- রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তাঞ্চলে প্রশাসক এবং সেক্টরে পলিটিক্যাল কমিসার করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে ব্যর্থ হয় প্রবাসী সরকার।
- মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ভারতীয় বাহিনী অগণিত মুক্তিকামী যোদ্ধা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের নিধন করে।
- সমমনা কমান্ডাররা ভারতীয় নীল নকশার বিরোধিতা করার জন্য অধিনস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় মটিভেশন এবং ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে তাদের ন্যাচারাল লিডার হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র সংগ্রহের ব্যাপারে পরে আমাদের হয়েছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা। কখনোই আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রসদপত্র পাইনি। যা পেয়েছি তার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। নিঃসন্দেহে এ সমস্যার কারণে আমাদের যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় শত্রুর হাতে মার খেতে হয়েছিল অনেকক্ষেত্রে। পরবর্তিকালে কমান্ডাররা ক্রমান্বয়ে নিজেরাই সব ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যান। শত্রুপক্ষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রই ছিল আমাদের হাতিয়ারের মূল উৎস। এতে করে আমাদের পাঁচমিশালী হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। ফলে গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের নিদারুণ সংকটে পড়তে হত। যানবাহনের সমস্যা ছিল অতি প্রকট। আমরা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা এবং মুক্তাঞ্চল থেকে কব্জা করা গাড়িগুলোর উপরই নির্ভরশীল ছিলাম। এদের রক্ষনা- বেক্ষনের দায়িত্বও নিতে হয় কমান্ডারদেরকেই : আমাদের চিকিৎসার সমস্যাও ছিল প্রকট। ভারতীয় হাসপাতালগুলো প্রায় সময় ভরে থাকত শরনার্থীতে।
যুদ্ধকালীন সময় সবচেয়ে বড় ফিল্ড হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২নং সেক্টরের বিশ্রামগঞ্জে। বৃটেন থেকে আগত ডাঃ জাফরুল্লাহ, ডাঃ মোমেন এবং তাদের আরও কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের উদ্যোগে এবং প্রবাসী বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী হিতৈশীদের সাহায্যে এই বেসরকারি ফিল্ড হাসপাতাল অতি কষ্টে স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে তারা অমূল্য অবদান রাখেন। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে খুব কম সংখ্যক চিকিৎসকই যুদ্ধে যোগদান করে। তাই তাদের ঘাটতি পূরণ করতে হয়েছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে। তাদের নিঃস্বার্থ প্রাণঢালা সেবার কথা মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই ভুলতে পারবেন না।
এ ধরণের আরো অনেক সমস্যা ও সমাধানের উপায় কনফারেন্সে যদিও বা আলোচিত হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সব চাহিদাই পূরণ করা হবে বলে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধারা কখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই পায়নি। ঠিক সময়মত পাওয়া যায়নি অতি প্রয়োজনীয় যুদ্ধসম্ভার। বর্ষাকালে জরুরী ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আচ্ছাদন নির্মানের কথা থাকলেও সে আচ্ছাদন তৈরি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযোদ্ধারা হাড়কাপুনী শীতে রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। তাবু এবং শীতবস্ত্রের পর্যাপ্ত কোন বন্দোবস্তই করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। কম্বলের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধারা। অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন আধপেটা খেয়ে, খালিগায়ে, খালিপায়ে। সব কষ্ট, সব অসুবিধা তারা হাসিমুখে মোকাবেলা করেছিলেন একটি স্বপ্নের নেশায়। সে স্বপ্ন- স্বাধীন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ।
জুলাই মাসে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন তাহের, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী এবং মেজর মঞ্জুর-তার পরিবার এবং দু’জন সৈনিক দেহরক্ষী : তারা শিয়ালকোট সেক্টর দিয়ে পালিয়ে আসেন। তাদের পর আরো যারা পালিয়ে আসেন তারা হলেন- ক্যাপ্টেন খায়রুল আনাম, ক্যাপ্টেন পাশা, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, লেঃ বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন ফারুক রহমান, ক্যাপ্টেন রশিদ, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর প্রমুখ। কনফারেন্সের সুযোগে অনেকের সাথেই আমাদের মত বিনিময় হয় ভারতীয় নীল নকশার প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে। যাদের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলাম শুধু তাদের সাথেই গোপনে আলোচনা করা হয়েছিল এই অতি স্পর্শকাতর বিষয়টি। মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন জলিল এবং উইং কমান্ডার বাশার এর অন্যতম। পরবর্তী পর্যায়ে মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন তাহের, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন রশিদ, ক্যাপ্টেন মহসীন, লেফটেন্যান্ট হুদা, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী ছাড়াও যাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তাদের সাথেও বিস্তারিত আলোচনা হয়। পর্দার অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন মহল, অস্থায়ী সরকার ও ভারতীয় প্রশাসনের চক্রান্ত ও স্বার্থ নিয়ে আলোচনার ফলে কতগুলো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত সরকারের নীতি এবং মুজিবনগর সরকারের অযোগ্যতাকে নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করা ঠিক হবে না। আমাদের বিভিন্ন মহলের উদ্দেশ্য এবং তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চক্রান্তের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে। একইসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠন করে তাদেরকে সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে চক্রান্তের বিভিন্ন দিক। তাদের মটিভেট করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে সব চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীতে রাজধানী বদলের জন্য যুদ্ধ করছি না আমরা, প্রয়োজনে পাক বাহিনীর সাথে সাথে অবস্থা অনুযায়ী ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের। আট কোটি বাঙ্গালীর জন্য হাসিল করতে হবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি যথার্থ স্বাধীন বাংলাদেশ। কোন করদ রাজ্য কিংবা নামেমাত্র স্বাধীনতা নয়, চাই প্রকৃত স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তি। প্রত্যেক কমান্ডারকে তার কর্মদক্ষতা, শৌর্য-বীর্য, সাংগঠনিক দক্ষতা, আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশপ্রেম, রণযোগ্যতা, সাহস ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তাঙ্গনের জনগণের হৃদয়ে নেতৃত্বের স্থান করে নিতে হবে যাতে করে যুদ্ধত্তোর পর্বে প্রয়োজনে যে কোন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে তৈরি করে তুলতে হবে জনগণের Natural Leader হিসেবে। এভাবেই সম্ভব হবে নিজেদের শক্তির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। এভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারলে ভবিষ্যতে যে কোন হুমকির মোকাবেলায় জনগণকে সাথে নিয়ে পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হবেন যে কোন ক্রান্তিলগ্নে। স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের সংগ্রামে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন।