চতুর্দশ অধ্যায় – মিত্র বাহিনীর নজীরবিহীন লুটপাট ও আওয়ামী দুঃশাসন
- বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী।
- মেজর জলিল বীরউত্তম কে গ্রেফতার করা হয়।
- দেশের সার্বিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।
- বিরোধী দলগুলোর উপর চালানো হল অত্যাচারের ষ্টিমরোলার।
- ৭ই মার্চ রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ জারি, গঠিত হয় সেচ্ছাসেবক বাহিনী, লাল বাহিনী এবং আরো অনেক প্রাইভেট পেটোয়া বাহিনী।
- জনগণ পরিণত হয় শত্রুতে।
- সোভিয়েত এবং ভারতীয় নৌ-বহর চট্টগ্রাম বন্দর দখল করে নেয়।
- সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা সব রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে হল কলাগাছ।
- শেখ মনির নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী যুব লীগ।
- ১লা জানুয়ারী ১৯৭৩, ঢাকার রাজপথ আবার রক্তে রঞ্জিত হল।
- শেখ মুজিবকে দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব উঠিয়ে নেয়া হয় এবং একইসাথে তার ডাকসুর আজীবন সদস্যপদও বাতিল করা হয়।
- প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন ১৯৭৩ এর নির্বাচন।
- সংসদে সংবিধান গৃহিত হয়।
- বাকশালের বীজ নিহিত ছিল রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ জারির মধ্যে।
- রক্ষীবাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের কয়েকটি বিবরণ।
- ৩১শে মার্চ ১৯৭৪ মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি গঠিত হয়।
- সেনা বাহিনীর দেশব্যাপী অস্ত্র তাশী এবং চোরাচালান বিরোধী অভিযান।
- মাওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দী করা হয়।
- ১৯৭৪ এর ভয়াবহ বন্যা।
- রিলিফ দুর্নীতির জন্য ১ লক্ষেরও বেশি লোক অনাহারে মারা যায়।
- ১৯৭৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী বিশেষ ক্ষমতা আইন পাশ এবং ২৮শে ডিসেম্বর জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
- বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ।
যুদ্ধ শেষে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর সমস্ত হাতিয়ার, গোলাবারুদ, ভারী অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ সরঞ্জাম এমনকি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মেশিনপত্র সব কিছু ভারতে নিয়ে যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক মেজর জলিল বাধা দেন। তার উদাহরণ থেকে প্রেরণা পেয়ে অন্যান্য সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররাও একইভাবে ভারতে সবকিছু পাচারের বিরোধিতা করেন। মিত্রবাহিনীর লুটপাটের বিরোধিতা করার জন্য ভারত সরকারের ইশারায় প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে ছলনার মাধ্যমে গ্রেফতার করে। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১১ই মার্চ তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে তার সেক্টর বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করা হয়। সেনা বাহিনীর তরফ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেজর জলিলের মুক্তির জন্য আবেদন জানানো হয়। সরকার জনগণের প্রতিক্রিয়ার জবাবে বলে, “তার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। সামরিক আইনে তার সেই সমস্ত অপরাধের বিচার হবে।” সরকারি এই ঘোষণায় প্রতিবাদ আরো জোরালো হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষেপে উঠেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড বিক্ষোভ ও জনমতের চাপের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বাধ্য হয়ে সরকারকে পরে বিনাশর্তে মেজর জলিলকে মুক্তি দিতে হয়।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন বেসামরিক বাহিনীর তৎপরতা ভীষণভাবে বেড়ে উঠে। ৯ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আওয়ামী লীগ বিশ্বের নব মতবাদ মুজিববাদ বাংলার ঘরে ঘরে প্রচারের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” বাহিনীর জেলা প্রধান ও উপ-প্রধানদের এক সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রতিটি ইউনিয়নে লাঠিসহ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং দেয়া হবে। তারপর ট্রেনিং শুরু হয়। ইতিমধ্যে জাতীয় শ্রমি লীগ প্রধান আব্দুল মান্নান এক লাখ সদস্যের সমন্বয়ে গঠন করেন লালবাহিনী। ১লা মে ১৯৭২ এ লালবাহিনীর জঙ্গী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, “৭ই জুন থেকে তারা সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন। এ অভিযানকে সার্থক করে তোলার জন্য ৪ঠা জুন তারা সরকারের কাছে গ্রেফতার, মারপিট, আটক করা, শাস্তি দেয়া প্রভৃতি ক্ষমতার দাবি জানান। দেশের প্রচলিত আইন থাকতে এ ধরণের দাবি জানিয়ে আইনকে নিজেদের হাতেই তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন তারা। আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযান শুরু হওয়ার ৭দিন পর খুলনায় লালবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষ ঘটে দেশের আরো অনেক জায়গায়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ক্ষমতার দাপটে তারা সাধারণ মানুষের উপর চালাতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। অবস্থার এতই অবনতি ঘটে যে, আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম মোজাফফর ন্যাপ প্রধান ২০শে জুলাই সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে বিভিন্ন দলীয় বাহিনীর বেআইনী কার্যকলাপ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান। তিনি বলেন, “কোন এক বিশেষ দলের স্বেচ্ছাসেবক এবং অন্যান্য বাহিনী বেআইনী কার্যকলাপ ও নানারকম দুষ্কর্মে লিপ্ত রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল, তার সংশ্লিষ্ট ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের সাথে জড়িত বাহিনীগুলো দলীয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখছে না। তারা সরকারি প্রশাসনকে উপেক্ষা করে নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার ও জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ও প্রশাসন ঐ সমস্ত বেআইনী কার্যকলাপ সম্পর্কে রহস্যময় নিরবতা পালন করছেন।” তিনি এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের আহ্বান জানান। ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠা করার এ সংগ্রাম পরিচালনা কালেই আওয়ামী লীগ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে। এ সময়ের খবরের কাগজগুলোতে প্রতিদিন খবর বের হত গুপ্ত হত্যা, রাহাজানী, ডাকাতি, হাইজ্যাকিং এবং গণপিটুনীতে মানুষ মারা যাবার খবর। সরকারি হিসাবে ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে ‘৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত হত্যা হয়েছে ২০৩৫টি, কিডন্যাপিং হয়েছে ৩৩৭টি, ধর্ষণ হয়েছে ১৯০ জনের, ডাকাতির সংখ্যা ৪৯০৭টি এবং আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে ৪৯২৫ জন নিরীহ ব্যক্তি।
১৯৭৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যে ৬০টি থানা লুট করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ারে মনে করেছিলাম আমাদের সকল সংকীর্ণতা ধুয়ে মুছে গেছে। ভেবেছিলাম একটা সুস্থ ভিত্তির উপর জাতিকে নুতন করে গড়ে তোলার সুযোগ আমরা পাব। কিন্তু আজাদী লাভের পর একমাস না যেতে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধের উম্মাদনা, অভিজ্ঞতা, রক্তপাত আমাদের শাসকগোষ্ঠির চরিত্রকে এতটুকু বদলাতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে হৃদয়হীনতাই রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে নিয়ামক হয়ে দাঁড়াল। সেই অভিশাপ থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন লক্ষণও দেখা গেল না। স্বাধীনতার পর দু’বছর না যেতেই ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাটে যখন গন্ডায় গন্ডায় অনাহারে মৃতের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল তখন দেখেছি কি নিশ্চিন্তে অচিন্তনীয় বিলাসের স্রোতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রয়েছেন নব্য বিত্তশালীরা। বিদেশের টেলিভিশনে ধরা পড়েছে একপাশে না খেয়ে মরা লাশের স্তুপ ও অন্যপাশে বিকট কুৎসিত আলোকে সজ্জিত মন্ডপে বিবাহ অনুষ্ঠানে ভূরি-ভোজনের ছবি। এ হৃদয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠে সংগ্রামের সাথীদের মাঝে কোন্দল সৃষ্টি করে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্যে। আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এ হৃদয়হীনতা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর একটি ব্যাপার। আর্থিক লোভ-লালসা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের উগ্র বাসনাই এই হৃদয়হীনতার প্রধান কারণ। দেশের গণ মানুষের দুর্গতির সত্যিকারের অংশীদার হওয়াই যে সুষ্ঠ রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার আদর্শিক পূর্বশর্ত শুধুমাত্র চটকদার আমদানি করা বুলি নয়, এ সত্যটি আজঅব্দি রাজনৈতিক নেতারা কিংবা কর্মীদের বৃহৎ অংশ উপলব্দি করতে পারেননি। করলেও বাস্তবে এই নীতি কার্যে পরিণত করা হয়নি। এজন্যেই আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে গণমানুষের সীমাহীন ত্যাগ থাকা সত্ত্বেও তাদের ইম্পিত ফল তারা লাভ করতে পারেননি আজঅব্দি। তাদের প্রতিটি সংগ্রাম প্রতারণার অন্ধ গলিতে হারিয়ে গেছে বারবার।
১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সংবিধান এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের LFO ( Legal Frame Work) এর আওতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল। ১২ই অক্টোবরের সংসদ অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন প্রণীত সংবিধান গৃহিত হয়। যদিও সংবিধানে সরাসরিভাবে মুজিববাদের উল্লেখ ছিল না তবুও মুজিববাদের মূলনীতির উপর তথা ভারতীয় সংবিধানের নীতিমালার উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বা শাসনতন্ত্র। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়, “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল –জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সে সমস্ত আদর্শই এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” কিন্তু সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় রাষ্ট্রের চার মূলনীতির সুস্পষ্ট স্ব-বিরোধিতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতন্ত্রের কথাই ধরা যাক:-
সংবিধানের ১০নং ধারায় উল্লেখ করা হয় যে, “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়নুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” কিন্তু সংবিধানের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে, বাংলাদেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ করা হবে। অথচ ব্যক্তিগত মালিকানা সমাজতন্ত্রের আদর্শের সাথে সম্পুর্ণ সামঞ্জস্যহীন। সংবিধানের ১৩ নং ধারায় বলা হয়:-
১৩। উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদন ব্যবস্থা সমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা নিম্মরূপ হইবে :-
(ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা: অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠ ও গতিশীল রাষ্ট্রীয় ও সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা I
(খ) সমবায় মালিকানা: আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সমবায় সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায় সমূহের মালিকানা।
(গ) ব্যক্তিগত মালিকানা: আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা I
সংবিধানের ৪২নং ধারায় আরো বলা হয়:-
৪২। আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও বিলি ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতিত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ব বা দখল করা যাইবে না।
আওয়ামী লীগের ‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দিন ওমর সাপ্তাহিক স্বাধিকারে ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পদক্ষেপ হিসাবে জাতীয়করণের নীতি সত্যিকার অর্থে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য গৃহিত হয়নি। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করা মানেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়; রাষ্ট্রায়ত্বকরণ মানেই সমাজতন্ত্র নয়। রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত না এক বিশেষ চরিত্রর রূপ পরিগ্রহ করেছে, শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটিয়ে তা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের কথা বলা শঠতা ও বাচালতা ব্যতিত আর কিছুই নয়। বুর্জুয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে কোন কিছু রাষ্ট্রীয়করণের অর্থ সমাজতন্ত্রের পথে পদক্ষেপ নয় বরং তা হল সমাজতন্ত্রের উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে কৃষক-শ্রমিক-জনগণকে সরিয়ে রাখার অপচেষ্টা। আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজতন্ত্রের নীতি দেশে আজ যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছে সেটা বিস্ময়কর নয় বরং অতি স্বাভাবিক। কারণ, যে রাষ্ট্র আজ বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি জাতীয়করণ করছে; সে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে শ্রমিক- কৃষক শ্রেণী নেই আছে বুর্জুয়া সামন্ত শ্রেণী। কাজেই তাদের নিজেদের দ্বারা রচিত যে কোন নীতির মত এই জাতীয়করণের নীতিও তাদের শ্রেণীর স্বার্থই উদ্ধার করছে। সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করে তারা যে জাতীয়করণ প্রথা প্রবর্তন করেছে তাতে জনগণের কোন উপকার হচ্ছে না। বরং তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই এ নীতির ফলে সরকারি দল ও তাদের দোসররা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে অবাধে লুটপাট করে দেশীয় সম্পদ উজাড় করে চলেছে। আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ প্রসঙ্গে তাদের ভূমি নীতির চরম ব্যর্থতাও আজ বাস্তব সত্য। আমাদের কৃষি সমস্যার যা বর্তমান চরিত্র তাতে পঁচিশ বিঘা জমির খাজনা মাফ উৎপাদন ব্যবস্থা অথবা কৃষকের অবস্থার কোন পরিবর্তনই আনতে পারে না। তাছাড়া কৃষকদের বিশাল অংশ ভূমিহীন ও বর্গা চাষীদের এ খাজনা মওকুফের ফায়দা একেবারেই স্পর্শ করে না। তাদেরকে যা কিছুটা স্পর্শ করতো তা হল সরকারের অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের নীতি। কিন্তু এই অতিরিক্ত জমি সরকার কর্তৃক সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে পরিবার প্রতি জমির ঊর্ধ্বতন পরিমাণ একশত বিঘা ধার্য করে দেয়া। তাদের এই নীতির ফলে একদিকে যেমন জমির মালিকরা নানা প্রকার ফন্দির মাধ্যমে শুধু পরিবার প্রতি একশ বিঘা নয় আরও অনেক বেশি জমি নিজেদের হাতে রাখতে পারবে তেমনি অন্যদিকে বর্গা প্রথার মাধ্যমে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের উপর নিজেদের সামন্ত শোষণও কায়েম রাখতে সক্ষম হবে। সামন্ত শোষণের ফলে কায়েম থাকবে মহাজনী শোষণ। এইভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বর্গাধারী এবং মহাজনী প্রথার আধিপত্য বজিয়ে রেখে কৃষকদের শ্রেণী শত্রুরা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব বজিয়ে রাখবে সনাতনী কায়দায়। ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্লথ গতি হতে বাধ্য। এ অবস্থার ফলে একদিকে যেমন খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে না তেমনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিদেশের উপর নির্ভরতাও কমবে না।” সরকারি ভূমি নীতির ব্যর্থতার এই দিকটি পরিষ্কার হয়ে পড়ায় বিরোধী দলসমূহ এমনকি বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি (মনি সিং), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ইত্যাদি আধা-সরকারি দলগুলো পর্যন্ত সরকারের সমালোচনা না করে পারেনি।
মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ প্রণীত সংবিধানের নিম্নে বর্ণিত তিনটি ধারা পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যাবে কি করে অতি কৌশলে আওয়ামী সরকার নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে।
৩৫। (ক) অপরাধ দায়যুক্ত কার্য সংগঠনকালে বলবত ছিল। এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যাতিত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ সংগঠনকালে বলবত সেই আইন বলে যে দন্ড দেয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিকার বা তাহা হইতে ভিন্ন কোন দন্ড দেয়া যাইবে না।
(খ) এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ করা যাইবে না।
(গ) ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ন্যায়পীঠে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, জননিরাপত্তার বা নৈতিকতার কারণে বা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে গোপনে কার্যধারা পরিচালনার জন্য সংসদ আইনের ধারা বিধান প্রণয়ন করিতে পারিবেন।
(ঘ) কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
(ঙ) কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক অথবা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনূরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।
(চ) জনস্বার্থ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।
৩৭। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোকসভায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।
উল্লেখিত ধারাগুলো সংবিধানে থাকলে জনগণের মৌলিক অধিকার মূলতঃ কেতাবী আকারে পরিণত হয়। ৩৫নং ধারায় প্রকাশ্য ও নিরপেক্ষ বিচারের অধিকার দেয়া হয় ঠিকই। কিন্তু জননিরাপত্তা, নৈতিকতা ও যুক্তিসঙ্গত কারণে গোপন বিচার অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে বিধান রাখা হয়। কিন্তু ঐ যুক্তিসঙ্গত কারণটি যুক্তিগত কিনা, তা নির্ধারন করার দায়িত্ব কোন কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়নি সংবিধানে। ফলে মূল ক্ষমতা পক্ষান্তরে চলে যায় সরকারের হাতেই। অতি কৌশলে ৩৬ ও ৩৭নং ধারায় যুক্তিসঙ্গত কথাটি যোগ করে মূলতঃ মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয় জনগণের কাছ থেকে। সংবাদপত্র, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে সংবিধানের ৩৯নং ধারায় বলা হয়।
৩৯। (ক) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
(খ) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচণা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে:- প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দান করা হইলো।
এই ধারা অনুযায়ী কোন বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র কিছু লিখতে পারবে না। অর্থাৎ সরকার যাকে বন্ধুরাষ্ট্র বলে মনে করবে তার সম্পর্কে কোন বক্তব্য কেউ উচ্চারণ ও প্রকাশ করতে পারবে না। সংবিধানের ৬৩(গ) ধারায় বলা হয়:- যুদ্ধ কিংবা আক্রমণ বা সশস্ত্র বিদ্রোহকালে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে সংসদের কোন আইনকে এই সংবিধানের আওতায় অবৈধ প্রমাণিত করার জন্য কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাইবে না। এ ধারায় যুদ্ধ ও আক্রমণের সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রশ্নটি কৌশলে যেমন জড়িত করে দেয়া হয়েছে তেমনি বলা হয়েছে যে ঐ ধরণের অবস্থায় সংসদ যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবে এবং সংবিধানের ধারা মতে এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাইবে না। সংবিধানের উল্লেখিত ধারাসমূহ পরবর্তিকালে বিরোধীদের দমন করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করে। তারা আইয়ূব আমলের ‘জননিরাপত্তার’ ধূয়াঁ তুলে অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের নাগরিকত্বও অন্যায়ভাবে হরণ করে। পাক স্বৈরশাসনের আমলে যেভাবে বিরোধীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হত, ‘৭২ এর সংবিধানে ৬৩(গ) ধারা প্রবর্তণের মাধ্যমে ঠিক সেই ব্যবস্থাটিকেই অব্যাহত রাখা হয়।
ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন ভাইস চেয়্যারম্যান ডাঃ আলীম আল রাজি সংবিধানের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, “তাড়াহুড়া করে সংবিধান রচনায় কোন বাহাদুরী নেই এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ক্ষমতায় গেলে এই সংবিধানকে চৈত্র মাসের তুলোর মত ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে।” ১৮ই অক্টোবর ১৯৭২ শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের মুখপাত্র এই সংবিধানকে ‘পরিত্যাক্ত সম্পত্তি গ্রাস করার সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেন। সংবিধানে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ও বিনা বিচারে আটক রাখার বিধি বহাল থাকে। আওয়ামী লীগের দোসর মনিসিং ও মোজাফফর গংরাও জনগণের মনোভাব বুঝে সংবিধানের কিছু কিছু ধারা অগণতান্ত্রিক বলে এলান করতে বাধ্য হন। লেনিনবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টির অমল সেন বলেন, “এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক তো নয়ই এমনকি অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যে ধরণের গণতান্ত্রিক ও ফান্ডামেন্টাল সাংবিধানিক অধিকার থাকে তাও নেই। মোজাফফর ন্যাপ সংবিধানের উপর জনমত যাচাই করার আহ্বান জানান। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা আসম আব্দুর রব বলেন, “সংবিধানে জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন নেই।” সংবিধানের ৪২ ও ৪৭নং ধারার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দু’জন সদস্য আপত্তি তোলেন। ধারাগুলো ছিল ব্যক্তি মালিকানা প্রসঙ্গে। ৭০নং ধারার পক্ষে বিপক্ষে আওয়ামী লীগ সদস্যগণ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েন। চারজন প্রতিবাদ করে বলেন, “এই ধারা গণতান্ত্রিক সকল নীতিকে ভঙ্গ করেছে এবং এতে করে ভোটারদের ভোটাধিকার এর প্রতি ও অমর্যাদা প্রদর্শিত হয়েছে। এটাও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণেরই সামিল।” ৭০নং ধারায় বলা হয় যে, কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়ে কেউ যদি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন এবং পরবর্তিকালে যদি পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কৃত করা হয় অথবা তিনি পদত্যাগ করেন তবে তার সংসদ পদ বাতিল হয়ে যাবে। মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সংবিধান গঠনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “বর্তমান সংসদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের LFO (Legal Frame Work) এর অধিনে সংগঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের LFO মোতাবেক নির্বাচিত জাতীয় সংসদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা। আওয়ামী লীগ দল হিসাবে ছয় দফার ভিত্তিতে জনগণের কাছ থেকে ভোট গ্রহণ করেছিল। ছয় দফার দাবি ছিল পাকিস্তানের ভৌগলিক অখন্ডতা বজিয়ে রেখে প্রদেশ ভিত্তিক পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন কায়েম করা। অতএব স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কোন বৈধ অধিকার তাদের নেই। তিনি সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশন গঠন করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, জাতীয় কনভেনশনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিই থাকবে না তাতে বিভিন্ন সংগঠন যাদের সদস্যরা জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের প্রতিনিধিদেরও অর্ন্তভুক্ত করতে হবে : এ ধরণের জাতীয় কনভেনশনের দ্বারা প্রণীত সংবিধান পরে গণভোটের মাধ্যমে গৃহিত হবে।” যদি এমনটি না করা হয় তবে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের দলীয় সংবিধানকে তিনি এবং তার পার্টি কিছুতেই মেনে নেবেন না বলেও তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তার এ অভিমতকে সমর্থন জানায় বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল বাশার। তিনি আরো বলেন, “এ সংবিধান গণতান্ত্রিক নয়, সমাজতান্ত্রিকও নয়। এ সংবিধানে গণমানুষের নুন্যতম দাবি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার কোন প্রতিশ্রুতি নেই।”
বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টির মতে বর্তমান সংবিধানে আইয়ূব আমলে যতটুকু মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণের জন্য দেয়া হয়েছিল সেটুকুও দেয়া হয়নি। ভাসানী ন্যাপ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, শ্রমিক-কৃষক-সমাজবাদী দল, বিভিন্ন প্রগতিশীল গণসংগঠন ও রাজনৈতিক দল
গণবিরোধী এই সংবিধানের বিরুদ্ধে দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের নেতা জনাব মনসুর আলী বলেন, “সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয় করা হয়েছে।” ‘৭২ এর সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালে সংসদ অধিবেশনে দুই ঘন্টারও কম সময়ে সংবিধানটি গৃহিত হয়। সংবিধানের মূল চার নীতি যার মাধ্যমে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞায় আওয়ামী লীগ মাঠে নামল: সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে সেই চার নীতির স্ববিরোধিতা ও গণস্বার্থ বিরোধী চরিত্রের কিছুটা বিশ্লেষন পাঠকদের অবগতির জন্য তুলে ধরা হল। এ সম্পর্কে আরো বিশদ বিশ্লেষনের অবকাশ রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাংবিধানিক পন্ডিতগণই সে দায়িত্ব পূরণ করবেন আশা করি। নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতেই যে কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। তাই এ ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষন না করলে আমরা এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কেন সে সময় সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে পড়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক কারণ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হব। শুধু তাই নয়; জাতি হিসেবে আজ স্বাধীনতার দুই দশক পরেও কেন আমরা কোন ক্ষেত্রেই আশানুযায়ী ফল লাভে ব্যর্থ হলাম সেটা ও বুঝতে পারব না। অতীতের ফলশ্রুতি বর্তমান আর তার উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যত।
১৯৭২ সালের যে কোন জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানী, আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। প্রতিদিন দেশের শহরগুলোতে ঘটছিল প্রকাশ্য খুন, ডাকাতি ও রাহাজানীর ঘটনা। গ্রামে-গঞ্জেও চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। ক্রমবর্ধমান এ ত্রাসের নাগপাশে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কাল অতিবাহিত করছিল। যখন জনগণের পরনে কাপড় নেই তখনই ঘটেছিল সুতা নিয়ে কেলেংকারী। পেটে যখন ভাত নেই তখন লাখ লাখ টন বিদেশী সাহায্যে প্রাপ্ত খাদ্য নির্বিবাদে পাচাঁর হয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে।
মজলুম নেতা ভাসানী অবাধে চোরাচালানের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি আওয়াজ তোলেন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের বিরুদ্ধে। জবাবে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চীন ও পাকিস্তানের দালাল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে ১৯৬৮-১৯৬৯ এর সাড়া জাগানো আন্দোলনকালে বরফের উপর আঘাত করেছিলেন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি তার নাম মাওলানা ভাসানী। মাওলানার সার্বজনীন আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতেই ছাত্ররা দিলেন ১১ দফা। তারই নির্দেশে ন্যাপ তার নিজস্ব ১৪ দফা বাদ দিয়ে ১১ দফাকেই তাদের দাবি হিসাবে গ্রহণ করে। ঊনসত্তোরের কারাবন্দী মুজিবর রহমানকে মুক্ত করার দুর্বার গণ আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন এই মাওলানা ভাসানীই। ১৬ই ফেব্রুয়ারী পল্টনের বিশাল জনসভায় তিনি বজ্রকণ্ঠে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মত জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে বের করে আনব।” তার মতো একজন অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনৈতিক উদারপন্থী নেতাকে সাম্প্রদায়ীক উস্কানিদাতা বলে গালাগালি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি শাসক দল। এই গালাগাল পর্ব শুরু করেন তরুণ নেতারা। পরে প্রবীণরাও ক্রমে তাদের সাথে যোগদান করেন। মার্চের শুরু থেকেই খবর আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে- মানুষ মরছে অনাহারে, না খেয়ে। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষ অবস্থা। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে স্থানে স্থানে। এ অবস্থায় ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্রও স্বীকার করেন যে, চোরাচালান হচ্ছে ব্যাপক হারে। তারা বলেন, “সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেলেই এই চোরাচালান বন্ধ হবে।” এ বক্তব্য দূতাবাস থেকে দেয়া হয় ২৩-৩-১৯৭২ তারিখে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পরে দেশের সব জায়গায়, সর্বস্তরে।
১৯৭২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব তার সংসদ সদস্যদের প্রতি এক নির্দেশ জারি করে বলেন, “চাকুরি, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির জন্য কেউ সুপারিশ করবেন না। প্রশাসনকে চলতে দিন।” ১১ই মার্চ দৈনিক বাংলায় এক খবর বের হয় সিগারেটের পারমিট নিয়ে, “বাংলাদেশ ট্যোবাকো কোম্পানীর ২৫জন ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগের জন্য কর্তৃপক্ষ তিন হাজার সুপারিশপত্র পেয়েছেন। সুপারিশকারীরা প্রত্যেকেই এমন প্রভাবশালী যে, কোম্পানী কাকে ছেড়ে কাকে ডিলারশীপ দেবেন সে সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না।” ৬ই জুন চোরাচালানের স্বর্গ সিলেট থেকে দৈনিক বাংলার প্রতিনিধি খবর পাঠান যে, গ্রেফতারকৃত চোরাচালানীরা প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপে ছাড়া পাচ্ছে। একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে সরকারের পারমিটবাজী নীতির সূচনায়। সুতার পারমিট যে পাচ্ছে তার তাঁত নেই, কেরসিনের পারমিট যে পেল সে কোন ডিলার নয়। পারমিট দেয়া হল অব্যবসায়ী রাজনৈতিক টাউটবাজদের খুশি করার জন্য। ফলে দুর্ভোগ গিয়ে বর্তাল জনগণের উপর। পারমিট হাত বদল প্রথায় জিনিষপত্রের দাম বেড়ে গেল কয়েকগুন। কাপড়ের অভাবে মা-বোনেরা দিনের বেলায় ঘর থেকে বেরুতে পারতেন ন।। মেয়ে-মা একখানি কাপড় গোসল করে পালা বদলিয়ে পরছে। এ সমস্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। ঠিক সেই সময় সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে ভারত থেকে আনল ‘সুন্দরী শাড়ী’। যে শাড়ীতে হাঁটু ঢাকে না, পর্দাও হয় না। ভারতীয় দূতাবাস বলল টিসিবি দেখেই এনেছে এই শাড়ী। টিসিবি কোন জবাব দিতে পারল না। এ অবস্থায় সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে যখন দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হচ্ছে; তখন ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ আওয়ামী লীগ, মোজফফর ন্যাপ আর সিপিবি মিলে গঠিত হয় ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। অল্পদিনের মধ্যেই ঐক্যজোটে ফাঁটল দেখা দেয়। প্রথম দিকে মোজফফর সাহেব ও মতিয়া চৌধুরী ঘোষণা করেন, “আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, অন্য কিছু নয়।” ন্যাপের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী ঘোষণা করেন, “স্বাধীনতা কেউ একলা আনেনি। তাই কেউ যথেচ্ছাভাবে এটা ভোগ করতে পারে না।” (দৈনিক বাংলা ২৩- ৩-১৯৭২)। কিন্তু ২০শে মে ১৯৭২ ন্যাপ (মোজাফফর) কাউন্সিল অধিবেশনে সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এবং প্রশাসন থেকে আইন বিভাগকে পৃথক রাখার আহ্বান জানান। ২১শে মে মোজাফফর সাহেব স্বয়ং এক জনসভায় বলেন, “চরম খাদ্যাভাবে
་
মানুষের চোখে ঘুম নেই। দুর্নীতি, রিলিফ চুরি, এমপিদের অপকর্ম, স্বজনপ্রীতি, অবিচার, বাধাহীন লুটপাট, রাহাজানী, চোরাকারবারীদের দৌরাত্ত্বের জন্য জনগণের মনে শান্তি নেই।”
ইতিমধ্যে সারা দেশে বিরোধীদের উপর চলতে থাকে হয়রানি ও নির্যাতন। আওয়ামী লীগের দোসর হয়েও ন্যাপ কর্মীরা এ হয়রানি থেকে রেহাই পাননি। ‘৭২ সালের ৮ই জুলাই মোজাফফর ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শ্রী পঙ্কজ ভট্টাচাৰ্য এক বিবৃতিতে বলেন, “ন্যাপ কর্মীরা দুর্নীতি, অরাজকতা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণের পর বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনযন্ত্র তাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। স্বার্থবাদী মহল ন্যাপ অফিসে হামলা চালাচ্ছে ও কর্মীদের জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে।” ৩১শে জুলাই অধ্যাপক মোজফফর বড় বেশি সাহসী হয়ে ঘোষণা করে বসলেন, “আমাদের দল আর মনি সিংয়ের কম্যুনিষ্ট পার্টি ছাড়া আর কোনো বামপন্থী দল দেশে নেই।” ১৬ই আগষ্ট সরকারের কাছে দেয়া এক স্মারকলিপিতে মোজফ্ফর ন্যাপ ঘোষণা করেন যে, “সরকার কোন প্রতিশ্রুতিই পালন করেননি। স্বাধীনতার পর সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও গণবিরোধী তৎপরতা রোধে সরকারের অনিচ্ছা ও অক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি।” ২০শে আগষ্ট ন্যাপ মোজফফর সিপিবি এবং ছাত্র ইউনিয়ন দ্রব্যমূল্য হ্রাস ও দুর্নীতি রোধের জন্য গণআন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২৭শে আগষ্ট পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে মোজাফফর আহমদ বলেন, “আপনি ভাত দিতে পারবেন না তবে কিল মারার গোসাই কেন? চোখ থাকতে দেখছেন না, কান থাকতে শুনছেন না কেন? দুর্নীতিবাজ এমপিএ, আড়তদার, মুনাফাখোর, দালাল কর্মচারীদের শাস্তি দেয়া হয় না কেন? শুধুমাত্র কয়েকটি ভাল কথা ও ঘোষণা ছাড়া সত্যিকার অর্থে জনগণ কি পেয়েছে?” সে দিনের একই জনসভায় মতিয়া চৌধুরী বলেন, “বাইশ পরিবারের বদলে ২২’শত পরিবার গড়ে তোলা হচ্ছে।
কিন্তু রাজনীতির বিচিত্র খেলায় তারপরও অদৃশ্য সংকেতে মোজফফর ন্যাপ এবং মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টির গাটছড়া বাঁধা থাকে আওয়ামী লীগের সাথে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাওলানা ভাসানী ও জাসদের বিরুদ্ধে জোরেসোরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের আওয়াজ আওয়ামী লীগকেও ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর মোজাফফর ন্যাপ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আওয়ামী লীগকে সমর্থন, কখনো আওয়ামী লীগের বিরোধিতা, একবার বাকশালে যোগদান আবার আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যাবার চিন্তা-ভাবনা; এই নিয়েই মোজাফফর ন্যাপের বিচিত্র ইতিহাস।।
১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐ দিন ভিয়েতনামে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে মস্কোপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ভিয়েতনাম দিবস’ পালনের ডাক দেয়। এ উপলক্ষে ঐ দিন ছাত্র ইউনিয়ন এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি প্রেসক্লাবের বিপরীত দিকে অবস্থিত তৎকালীন মার্কিন তথ্য সার্ভিস ইউএসআইএস (ইউসিস) দফতরের সামনে এসে ভীষণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে কার্দুনে গ্যাস বা লাঠিচার্জ ছাড়াই নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী বিনা উস্কানিতে ছাত্র মিছিলের উপর বর্বরোচিতভাবে গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ দর্শনের (অনার্স) ছাত্র মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদেরুল ইসলাম নামক অপর আর একজন ছাত্র। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাজপথে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার এই বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়ে আসে পরের দিনের সংবাদপত্রগুলিতে। নূরুল আমিন, আইয়ূব খান, মোনেম খান, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান আমলে তাদের নির্যাতনমূলক গণবিরোধী স্বৈরশাসনের জন্য ধিকৃত হয়েছিল জনগণের কাছে। একই ন্যাক্কারজনক বর্বরতার জন্য এদেশের মানুষ ধিক্কার দিল আওয়ামী লীগ সরকারকে। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের পরই আওয়ামী লীগ সরকারের এহেন প্রকাশ্যে ছাত্র হত্যা হতবাক করে দিয়েছিল দেশবাসীকে। উৎকণ্ঠায় আতংকিত হয়ে পড়ে তারা। প্রেসক্লাবের বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা। সাংবাদিকরা স্তব্ধ হয়ে অবলোকন করেন পুলিশের বর্বরোচিত প্রাণহানিকর আচরণ। সেদিন পুলিশী নির্যাতনের হাত থেকে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফাররাও রেহাই পাননি মুজিব সরকারের পুলিশ বাহিনী উপস্থিত প্রেস ফটোগ্রাফারদের হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে নির্মমভাবে। সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান এই পুলিশী সন্ত্রাসের ব্যাপারে কোন বিবৃতি দেবারই প্রয়োজন বোধ করেননি সেদিন। গুলি চালনার খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, যানবাহন সব কিছুই বন্ধ হয়ে যায় সারা শহরে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে হাজার হাজার লোক ছুটে আসে ইট দিয়ে ঘেরা রক্তে রঞ্জিত রাজপথের অংশ দেখার জন্য। শহরের অলিতে-গলিতে মানুষ পুলিশের পাশবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মৌন মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পরদিন ২রা জানুয়ারী এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঐদিন প্রফেসর মোজফফর আহমদ ঘোষণা করলেন, “আওয়ামী লীগের ছাত্র হত্যা ইয়াহিয়া-মোনেম স্বৈরাচারী সরকারের কার্যকলাপেরই নামান্তর। আমরা দেশবাসীর দাবির সঙ্গে একাত্মা হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আশু পদত্যাগ দাবি করছি।” তিনি আরো বলেন, “নূরুল আমিন সরকারের ভাগ্যে যে পরিণতি ঘটেছিল, শেখ মুজিবের ভাগ্যেও সেই একই পরিণতি অনিবার্য।
৩রা জানুয়ারী পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সভায় ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা করেন, “দরকার হলে আরো রক্ত দেব। তবুও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবই।” ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ- সভাপতি সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন।
রাজনীতির পরিহাস, ১৯৭২ সালের ৬ই মে এই ছাত্রনেতাই শেখ মুজিবর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। জনাব সেলিম ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও প্রত্যাহার করে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, “সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করা চলবে না।” তিনি বাড়িতে, অফিস-আদালতে ও দোকানে টানানো শেখ মুজিবর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলারও আহ্বান জানান। একই দিনে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা মনি সিং বলেন, “বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ অযোগ্য।” ২রা জানুয়ারী শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি এক বিবৃতিতে বলেন, “পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুবলীগ ও বহু দেশপ্রেমিক গ্রুপ সহ জনগণের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিন্দা প্রকাশ করছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি জাতি আজ যখন ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগকে অভিনন্দিত করছে এসময় জনগণকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে দিয়ে এক শ্রেণীর অরাজকতা সৃষ্টিকারী পুঁজিবাদের ধারক ও ভাসানীর পরিচালনায় উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টিকারী আল বদর, রাজাকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েছে। এই বিশেষ অরাজকতা সৃষ্টিকারী শক্তিগুলো তথাকথিত বিরোধী দলের ছদ্মাবরণে এমন আচরণ প্রদর্শন করছে যা খুবই উল্কানিমূলক এবং তারা দেশের শান্তি বিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র করছে বলে ধরে নেয়া যায়। এসব শক্তি সমাজতান্ত্রিক রীতি-নীতির প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দু’জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে প্রহার ও একজনকে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। তারা মোজাফফর ন্যাপের অফিসের সামনে ছাত্রলীগের একটি মিছিলের উপরও হামলা চালিয়েছে। তারা তেঁজগাও শিল্প এলাকা ও ঢাকেশ্বরী কটন মিলে খোলা অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছে। এমনকি ন্যাপ সভাপতি মোজাফফর আহমদের ন্যায় লোকও ব্যক্তিগতভাবে একটি সংবাদপত্র অফিসে হামলা চালাবার চেষ্টা করেছে।
৩রা জানুয়ারী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়, “ঢাকায় ২রা জানুয়ারী পূর্ণ হরতাল পালনের নামে মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া, মেনন ও মাহাবুবউল্লাহ গ্রুপদ্বয় এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত অংশের কর্মী নামধারী ফ্যাসিবাদী গুন্ডারা মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও চকবাজার এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উপর নগ্ন হামলা চালায়। পাটুয়াটুলী এলাকায় মোজাফফর ন্যাপের গুন্ডারা ছাত্রলীগের আঞ্চলিক শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মীর জাহানকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন মুজিববাদী ছাত্রলীগ এই হত্যার প্রতিবাদে এক জঙ্গী মিছিল বের করে।
৩রা জানুয়ারী কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে মুজিববাদী ছাত্রলীগ আয়োজিত এক প্ৰতিবাদ সভায় ছাত্রলীগ সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশোভনীয় উক্তি উচ্চারণের জন্য ন্যাপ মোজাফফর, জাসদ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের আগামী ৭ই জানুয়ারীর মধ্যে জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “যদি ক্ষমা না চাওয়া হয় তাহলে জনতা ৭ই জানুয়ারীর পর থেকে বাংলার মাটিতে ন্যাপ মোজাফ্ফর, জাসদ ও ছাত্র ইউনিয়নের কোন জনসভা অনুষ্ঠিত হতে দেবে না।” তিনি আরো বলেন, “যেসব লোক মন্ত্রী হবার খায়েসে সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য সরকারের কাছে শতবার তোষামোদ করছেন, তারা এবং তাদের ছত্রছায়ায় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন আজ গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশোভন উক্তি করার সাহস পাচ্ছেন।” তিনি ঘোষণা করেন, “আজ বৃহঃস্পতিবার ৪ঠা জানুয়ারী থেকে যে পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর নামের পূর্ণ মর্যাদা দেবে না সংগ্রামী জনতা বাংলার মাটিতে সেই পত্রিকার অস্তিত্ব রাখবে না।” তিনি আরো বলেন,”বঙ্গবন্ধুকে ডাকসুর আজীবন সদস্য করা হয়েছে ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে। সুতরাং সেখানে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা অন্য কারো নেই। বর্তমান ডাকসু যেহেতু ছাত্রসমাজের মতবিরোধী কাজ করছে এবং তাদের আস্থা ও ভালোবাসা হারিয়েছে তাই এই ডাকুস বাতিল।” ছাত্রনেতারা এই তৎপরতাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে ডাকসু অফিসও তছনছ করে ফেলা হয়।
ঐ দিনই বাংলার বাণীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলার দায়ে এক ব্যক্তির কান কেটে দেয়া হয়েছে। পরদিন ঐ একই পত্রিকা খবর ছাপে যে, একই কারণে রংপুরে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
৫ই জানুয়ারী পল্টনে ছাত্রলীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাত্রলীগ নেতার। শ্লোগান দেন, “রব-ভাসানী- মোজফফর, বাংলার তিন মীরজাফর।
৬ই জানুয়ারী গোপালগঞ্জের এক জনসভায় শেখ মুজিবর রহমান বলেন, “স্বার্থান্বেষী মহল নির্বাচনের প্রাক্কালে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ ও আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে। চরম দুঃখের দিনগুলিতে এসব লোকদের খুঁজেও পাওয়া যায়নাই। তারা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশে যাতে বিদেশ থেকে কোন সাহায্য না আসতে পারে সেই উদ্দেশ্যে বিশ্বে বাঙ্গালী জাতির মর্যাদা ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করছে।
বিস্ময়কর ও চরম নির্লজ্জভাবে ৬ই জানুয়ারী এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ন্যাপের মোজফফর আহমদ তাদের ৭ই জানুয়ারীর প্রস্তাবিত জনসভা বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি সম্মেলনে স্বীকার করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি ভয় পেয়েছেন। ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে মোজাফফর সাহেব বাংলাদেশ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেননি। ভিয়েতনামের প্রশ্নও তোলেননি এবং ছাত্রহত্যার বিচারও চাননি।
৮ই জানুয়ারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ অতি চমকপ্রদভাবে আইয়ূব-ইয়াহিয়া সরকারের নামান্তর শেখ মুজিব সরকারের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলেন, “কেউ কেউ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে।” একই দিনে মনি সিং-এর কম্যুনিষ্ট পার্টির সম্পাদক বারীন দত্ত ওরফে আবদুস সালাম বলেন, “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী, চীন ও পাকিস্তানী চরেরা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।” তিনি স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবার জন্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার আহবান জানান। সম্মেলনের শুরুতেই জনাব দত্ত বলেন, “কোন প্রশ্ন করবেন না কেবল শুনে যান।” এবং সত্যি সত্যি সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের অবকাশ না দিয়েই সম্মেলন শেষ করে দেয়া হয়। এরপর এই দুই দল আওয়ামী লীগের সাথে আপোষ করার জন্য বিভিন্ন মহলে জোর তদবীর করতে থাকে। তারই এক পর্যায়ে ২২শে জানুয়ারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ লাভ করেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি তার সরকার বিরোধী বক্তব্য ও তৎপরতার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেন। একই দিন মনি সিং জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে আপোষ আলোচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে এই দুই দলই বাকশালে যোগদান করে।
কিন্তু নিহত ছাত্র মতিউল ও কাদের হত্যার তদন্ত রিপোর্ট ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত অপ্রকাশিত থেকে যায়। অনেকের মতে আপোষের শর্ত হিসেবে তারা ঐ হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করবেন না বলে সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে ১লা জানুয়ারীর ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে কমিটির দায়িত্বে ছিল পুলিশ। কি এবং কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল সেটাই তদন্ত করা ছিল কমিটির দায়িত্ব দোষীদের খুঁজে বের করা নয়। সেই কমিটি আদৌ কোন তদন্ত করেছে কি না তা এ দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি। শহীদ মতিউল কাদেরের পিতামাতা তাদের সন্তান হত্যার সুবিচার হতে আজও বঞ্চিত।
১৯৭২ সালের শেষে সংসদের এক অধিবেশনে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ দেশে সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
১৯৭২ সালের ১১ই নভেম্বর মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ। নূরে আলম সিদ্দিকীও যোগ দেন এই যুবলীগে। নির্বাচনী প্রচারণা চলতে থাকে। মোজাফফর ন্যাপ ও মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টি অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনী জোট গঠন করতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ ১লা জানুয়ারীর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে দেশব্যাপী স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়াকে নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত বলে অভিহিত করতে থাকে। ২০শে জানুয়ারী যুবলীগের সভায় বিরোধীদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচন সম্পর্কে লীগ নেতারা প্রচার করতে থাকেন যে এই নির্বাচন হবে মুজিববাদের উপর ম্যান্ডেট : ২রা ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ মুজিববাদের উপর রায় চাইবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও তারা মুজিববাদের উপর রায় চায়।
‘৭২ সালের ২১শে নভেম্বর অধ্যাপক মোজফফর আহমদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। তার জবাবে ২২শে নভেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান ঘোষণা করেন, “নির্বাচনের আগে মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করবে না। পদত্যাগ করার কোনো কারণ নেই।”
‘৭৩ এর নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল নিয়েও অভিযোগ এসেছিল অনেক। ৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল অভিযোগ করে যে, জায়গায় জায়গায় তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। তারা এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনারের হস্তক্ষেপ কামনা করলে জনাব জিল্লুর রহমান বলেন, “নির্বাচনে ভরাডুবি জেনে জাসদ নির্বাচন বর্জনের পথ খুঁজছে।” ইতিমধ্যে সারাদেশ থেকে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের খবর আসতে থাকে। ৪ঠা মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অভিযোগ করে যে, ক্ষমতাসীন দল ত্রাস সৃষ্টি করে একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ৩রা মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় বলেন, “গত এক বছরে অবাধ লুটতরাজ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর রিলিফ চুরির বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ এবার বঙ্গবন্ধুকে একমাত্র পুজিঁ করে জনতার কাছে ভোট চাইতে এসেছে। একদিকে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে আওয়ামী মন্ত্রীরা ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছেন শ্লোগান দিয়ে, ‘সামনে আছে জোর লড়াই, বঙ্গবন্ধু অস্ত্র চাই।’ এটা কোন ধরণের গণতন্ত্র?”
৫ই মার্চ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, “নিশ্চিত ভরাডুবি জেনে বেসামাল মুজিববাদীরা গতকাল রোববার (৪ঠা মার্চ) সন্ধ্যায় আবার তারাবো বাজারে ন্যাপের নির্বাচনী প্রচার মিছিলের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ১৫ থেকে ২০ রাউন্ড ষ্টেনগান ও পিস্তলের গুলি ছোঁড়ে। তারা স্থানীয় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের অফিসের মূল্যবান কাগজপত্র, পোষ্টার, আসবাবপত্র লুটপাট ও তছনছ করে এবং ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে অগ্নি সংযোগ করে ভস্মীভূত করে। মুজিববাদীরা জনৈক ন্যাপ কর্মীর দোকানও লুট করে।”
৭ই মার্চ একতরফা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সম্পর্কে দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক গণকন্ঠের প্রতিবেদনে সন্ত্রাস, গুন্ডামি, নির্যাতন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পোলিং এজেন্ট প্রহৃত, খুন প্রভৃতির খবর ছাপা হয় : ৮ই মার্চের দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল : সিলেট-১ কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাই’, ‘পটুয়াখালীতে ব্যালট পেপার ছিনতাই’, ‘চট্টগ্রামে ৩১টি ব্যালট পেপারসহ ২ব্যক্তি গ্রেফতার’, ‘ধামরাইতে রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাস’, ‘ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে’, ‘নির্বাচন দারুন অবাধ হয়েছে, ‘একজন একাধিকবার অবাধে ভোট দিতে পেরেছে’, ‘জাসদের দু’জন কর্মী হাইজ্যাক’, ‘ঢাকার একটি কেন্দ্রে সন্ত্রাস ও গুলি’, ‘পটিয়ায় ভোট সন্ত্রাসী-মাস্তানরাই দিয়েছে’, ‘কুমিল্লা শহরে ব্যাপক সন্ত্রাস’, ‘নির্বাচন প্রহসনে পরিণত’, ‘কালিগঞ্জে সন্ত্রাস’, ‘রাজশাহী ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস’, ‘ভোট নাট্যের দু’টি দৃশ্য’ প্রভৃতি।
৯ই মার্চ ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য্য এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, “কমপক্ষে ৭০টি আসনে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সুনিশ্চিত বিজয়কে শাসকদল ক্ষমতার চরম অপব্যবহার, ভুয়া ভোট, পোলিং বুথ দখল, পোলিং এজেন্ট অপহরণ, বিদেশী সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘ, সরকারি গাড়ি ও রেডক্রসের গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রসমূহে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোর পূর্বক পরাজিত করেছে।”
৯ই মার্চ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাসদ সভাপতি মেজর (অবঃ) জলিল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যেভাবে নির্বাচনের সময় প্রচলিত কোন ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন এতে আমি তাকে জাতির পিতা বলতে ঘৃনাবোধ করি।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচনের দিন গণভবনেই নির্বাচনী কন্ট্রোলরুম স্থাপিত হয়েছিল এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিরোধী দলের প্রার্থীরা যখন ভোট গননায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই অকস্মাৎ বেতার টেলিভিশনে এই সকল কেন্দ্রের ফলাফল প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সন্দেহজনকভাবে দীর্ঘ সময় পর নিজেদের পছন্দসই ভোটের সংখ্যা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।” জাসদ সভাপতি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের তাবেদার বলে অভিহিত করে তাদের নির্বাচনী বিজয়কে হিটলার, মুসোলিনী, চিয়াংকাই সেকের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করেন :
৯ই জুলাই প্রেসক্লাবে ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন সহ-সভাপতি ডাঃ আলিম আল রাজি বলেন, “ক্ষমতাসীন সরকার এক দলীয় স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিগত নির্বাচনে ক্ষমতার প্রকাশ্য অপব্যবহার, সন্ত্রাস সৃষ্টি, শক্তি প্রয়োগ করে ভুয়া ভোটদান, বিপুল অর্থ ব্যায়, বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসহ সকল প্রচার মাধ্যমের ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে।” বিরোধী দলগুলো যাতে জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য ক্ষমতাসীন দল তাদের নিজস্ব রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনীর হাতে বিপুল অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণকে ভোটাদানে বিরতই শুধু করেনি; হয়রানির এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি সকল প্রচার মাধ্যম সরকারি দলের দলীয় স্বার্থে যদেচ্ছা ব্যবহারের উল্লেখ করে প্রচার মাধ্যমকে এক ‘ব্যাবিলিয়ন ক্যাপটিভ প্রেস’ বলে অভিহিত করেন। জানুয়ারীতে প্রকাশ্যে রাজপথে দু’জন ছাত্র হত্যার কথা উল্লেখ করে ডাঃ রাজি বলেন, “ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকার যেভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, দু’শ বছরের ইতিহাসে তার নজির নেই।” তিনি হুশিয়ারীও উচ্চারণ করে বলেন, “বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত অন্ধকার।” নীল নকশার আওতায় সুপরিকল্পিত উপায়ে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র ছিনিয়ে নেবার উক্ত প্রচেষ্টা পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে সত্য হয়ে উঠে।
একতরফা পাতানো খেলার নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯১টিতে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্র থেকে প্রথমে ন্যাপের মোশতাক আহমদ চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও পরে তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। সবকয়টি বিরোধী দল এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। মোশতাক আহমদ চৌধুরী এই নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রীট আবেদন করেন। সম্পূর্ণ আইন বিভাগ তখন পুরোপুরিভাবে দলীয় স্বার্থের অনুগত বিধায় মোশতাক চৌধুরীর রীটের পরিপ্রেক্ষিতে কোন সুবিচার পাওয়া সম্ভব হয়নি।
১০ই মার্চ এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় লীগের প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খান নির্বাচন প্রচারাভিযানের সময়, নির্বাচনের দিন ও ফলাফল ঘোষণার পর তার নির্বাচনী এলাকা ধামরাইতে সংগঠিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা কর্মী ও রক্ষীবাহিনীর সার্বিক সন্ত্রাসকে “দুঃস্বপ্নের কালোরাত্রি” বলে আখ্যায়িত করেন
১১ই মার্চ যুবলীগের নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “৭ই মার্চের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, তারা রাজাকার, আল বদর, স্বাধীনতার শত্রু। এইসব বিদেশী চরদের মুজিববাদের নিড়ানী দিয়ে উৎখাত করা হবে।” পরদিন বায়তুল মোকাররমে শেখ ফজলুল হক মনি মুজিববাদ বিরোধীদের উৎখাত করার জন্য যুদ্ধ পরিচালনার কথা ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল ৩০ হাজারেরও বেশি লোককে। দেশপ্রেমিক বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শ্রমিক নেতা, ছাত্রসমাজ, আইন- শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যবর্গও এই শ্বেতসন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পাননি। জাতীয় পরিসরে যেখানেই কেউ স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করেছেন অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে নতুবা তাকে হতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতনের শিকার।
১৯৭৩ সালে ঐ সময়ের উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক সাংবাদিক জনাব আবুল মনসুর আহমদ দৈনিক ইত্তেফাকে বিভিন্ন বিষয়ে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে অসীম সাহসের পরিচয় দেন।
‘আজ আর একচেঞ্জ অব হার্ট নয়, চাই চেক অফ হার্ট’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি বলেন, “মানুষের হৃদয়ের চার চেম্বারের মতই আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির সকল ক্ষেত্রেই চারটি করিয়া চেম্বার আছে। প্রথমত: আমাদের সংবিধান দাড়াইয়া আছে চারটি স্বতন্ত্র মজবুত মূল নৈতিক খুঁটির উপর। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ (জাতীয়তা তন্ত্রই বেশি শুদ্ধ হইত) ও ধর্মনিরপেক্ষতা (এখানেও তন্ত্রযোগ করিলে ভাল হইত)। এই চারটি নৈতিক খুটিকে ‘স্বতন্ত্র’ বলিলাম এই দন্ডে যে, সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, ওই চারটি খুঁটি এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। খুঁটিগুলির উচ্চতা সমান নয় বলিয়াই তারা এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। নীতি ও পন্থা হিসাবে এই চার বস্তুর মিল নাই একথাই বোধ করি সমালোচকরা বলিতে চান। তার মানে হৃদপিন্ডের চারটি চেম্বারের মধ্যে যেমন সহযোজক দরজা (কানেকটিং ভালব) আছে, আমাদের চার নীতির মধ্যে তেমন কোন কানেকটিং ভালব নাই। তারপর সংবিধানের বেলাতেও আমরা প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে টানিয়া বুনিয়া চারি চক্রে আনিবার চেষ্টা করিয়াছি এবং যথাসম্ভব সফলও হইয়াছি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রচলিত এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ ও জুডিশিয়ারী এই তিনটি ইন্সটিটিউশনকে ‘নির্বাহী বিভাগ’, ‘আইন বিভাগ’ ও ‘বিচার বিভাগ’ নামে সংবিধানে গুঞ্জায়েস করিয়াছি সত্য; কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে যা অত্যাবশ্যক অথচ সংবিধানের কর্মবিভাগ বা দেশরক্ষা বিভাগে যার বিধান করা সম্ভব ছিলনা: সেই রূপ একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করিয়া আমরা রাষ্ট্রকে চারটি শক্তি স্তম্ভের উপর দাড় করাইয়াছি : এই চারটি শক্তি স্তম্ভের সাথে পাঠকগণ চারটি মূলনীতি স্তম্ভের সাথে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবেন না।”
তার ঐ দীর্ঘ প্রবন্ধে শিল্পকারখানা সম্পর্কে জনাব আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের অনুকরণে আমরা শুধু আমাদের জাতীয় জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, পার্টি জীবনে ও সামাজিক জীবনে চার-বর্ণের প্রবর্তন করিয়াই ক্ষান্ত হইনাই। অর্থনৈতিক জীবনেও উহার সম্প্রসারন করিয়াছি। মিনস অফ প্রডাকশন’ অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানাকে সংবিধানেই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছি। যথা: রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা। এই তিন শ্রেণীর মালিকানা ছাড়া আর সব সম্পত্তি যা প্রডাকটিভ নয়, সেগুলি অটোমেটিক্যালী ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকার ব্যবস্থা করিয়া গোটা সম্পত্তি জগতকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া হৃদয়ের চার চেম্বারের সামাঞ্জস্য বিধান করিয়াছি। যাতে মিল কারখানাদির ‘মিনস্ অফ প্রডাকশনকে’ হরতাল স্ট্রাইকারদের দ্বারা আন প্রডাকটিভ করিয়া অন্য প্রকার মালিকানার সৃষ্টি করিতে কেউ না পারে এবং ঐ পন্থায় চার প্রকার মূলনীতিতে যাতে কেউ বত্যয় ঘটাইতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আমরা হরতাল-স্ট্রাইককে ন্যাশনালাইজ করিয়া ফেলিয়াছি। সরকারি দল ছাড়া অপর সকলের হরতাল স্ট্রাইক নিষিদ্ধ করিয়াছি।”
প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রশ্নে একই প্রবন্ধে জনাব আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের এই সামগ্রিক ও সার্বজনীন আকর্ষণ দেখিয়া বিদেশী বন্ধুরা বিস্মিত হইতে পারেন। কিন্তু তাদের সেই বিস্ময় সেই মুহূর্তেই কাটিয়া যাইবে যখন তারা জানতে পারিবেন যে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতার নেতৃত্ব কেবলমাত্র আমাদের হৃদয়ের উপরই নির্ভরশীল। আমাদের নেতা প্রেমিক; তিনি দেশবাসীকে ভালোবাসেন; দেশবাসী তাকে ভালোবাসে। এ দেশে নেতা আর জনতার মধ্যে ভালোবাসা-বাসি ছাড়া আর কোন বৈষয়িক স্বার্থের সম্পর্ক নাই। পুরোটাই হৃদয়ের ব্যাপার। তাই হৃদয়ের চার চেম্বারের সাথে মিল রাখিয়াই আমাদের সামগ্রিক জীবনকে চার ভাগে বিভক্ত করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমাদের রাষ্ট্রীয় আর্থিক জীবনকে উপরের তলা নীচের তলা এই দুই তলা বিশিষ্ট করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমরা উভয় তলাতেই অর্থাৎ অবিকল ভেনট্রিকস উভয়টাতেই লেফট রাইট রাখিয়াছি। সাধারণত: নেতার ভালোবাসা-বাসির ব্যাপারই হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের আসক্ত করিয়াছে ঠিকই। কিন্তু চারের প্রতি আকৃষ্ট হইবার আমাদের আরও কারণ আছে। আমাদের রাষ্ট্র সেক্যিউলার হইলেও আমরা নিজেরা আজও ধর্মবিরোধী হইনাই। ধর্মনিরপেক্ষ হইয়াছি মাত্র। আমাদের মধ্যে বিপুল মেজরিটি লোকই মুসলমান। আমরা মুসলমানেরা এখনও ধর্ম ছাড়িনাই। তাই চারের মায়াও ছাড়িতে পারিনাই। আমাদের চার কিতাব, চার কলেমা, চার ফেরেশতা, চার মাযহাব, চার খলিফা, চার ইমাম এ অবস্থায় রাষ্ট্রের চার মূলনীতি, সমাজের চার মালিকানা নীতি, পলিটিকস এ চার পার্টি নীতি। এসবে আমাদের আকর্ষণ সহজাত। শুধু মুসলমানরা হইবে কেন? আমাদের দেশের হিন্দুদের ধর্মেও চারের প্রাধান্য রহিয়াছে। তাদের চার বেদ, চার বর্ন, চার যুগ এমনই চার যোগও আছে। এইভাবে আমরা চারের গোলকধাধায় ঢুকিয়াছি। সরকারি দফতরে চার তাসের কর্মচারী বহাল হওয়ায় বাজারে আমরা চার কায়দায় ব্যবসা চালু করিয়াছি। কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, মজুতদারী ও চোরাচালানী আমরা ছাড়তে পারি না এই চারের মায়াতেই।
হার্টের চার চেম্বারের সবচেয়ে বড় ত্রুটি দেখা দিয়াছে ‘জাতির পিতা’ ও তার সন্তানদের সম্পর্কের মধ্যে। জাতির পিতা তার সন্তানদের ভালোবাসেন, সন্তানরাও পিতাকে ভালোবাসে। সবাই পিতাকে অন্তর দিয়া ভালোবাসে বলিয়াই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা—প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিণামে খুন-খারাবী। জাতির পিতা খুন-খারাবী বন্ধ করিতে সন্তানদের প্রথমে অনুরোধ পরে নির্দেশ অবশেষে ধমক দিয়েছেন। কিন্তু সন্তানেরা পিতার কথা শুনিতেছে না। পিতা ও কঠোর হইয়া সন্তানদের শাস্তি দিতে পারিতেছেন না। এটা ঘটিতেছে হৃদয়ের জন্যই। বিশেষত: হৃদয়ের চারটি চেম্বারের দোষেই। জাতির পিতা সকলের কল্যাণের জন্য যতই চেঞ্জ অফ হার্টের কথা বলিতেছেন সন্তানেরা ততই স্টেনগানের সাহায্যে এক্সচেঞ্জ অফ হার্ট করিতেছে। এটা অধিক দিন চলিতে দিলে সকলেরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যাইবে।” এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পর জনাব মনসুরের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে নানারকমের কটুক্তি শুরু হয়।
বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বীজ নিহিত ছিল ১৯৭২ সালের ৭ই মার্চ রক্ষীবাহিনী আদেশ জারি করার মধ্যে। তারই সূত্র ধরে ‘৭২ সালের এপ্রিলে শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধকরণ এবং প্রেসিডেন্টের ৯নং ও ৫০নং (৭২) আদেশ জারি হয় এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ গঠন করে একদলীয় বাকশাল। যাতে যোগ দিয়েছিল মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টি, মোজাফফর আহমদের ন্যাপ আর আতাউর রহমানের জাতীয় লীগ।
১৯৭৪ সালের বাকশাল গঠনের আগে আওয়ামী লীগ কোনদিন একদলীয় শাসনের কথা বলেনি। বরং অধিক হারে বলেছে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা, সংসদের সার্বভৌমত্বের কথা, বলেছে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের কথা, বলেছে সংবাদপত্রে স্বাধীনতার কথা, বলেছে আইনের শাসনের কথা। জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ এমনকি মোজফফর আহমদ পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন, “সরকার একদলীয় শাসন কায়েম করতে চায়।” মাওলানা ভাসানী নিরন্তন প্রতিবাদ করেছেন এই সরকারের গণবিরোধী নীতির, নিষ্পেষনের, দলীয় দুর্নীতির। আতাউর রহমান খান চতুর্থ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু মোজাফফর আহমদ ৪/৪/৭৩ তাদের কাউন্সিল অধিবেশনে সংসদীয় গণতন্ত্রের শপথ ঘোষণা করলেও ১৯৭৩ থেকেই মূলতঃ একদলীয় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘৭৩ সালের ৩০শে এপ্রিল ভাসানী ন্যাপের সহ-সভাপতি ডাঃ আলিম আল রাজি পল্টনের এক জনসভায় অভিযোগ করেন যে, বিরোধী দলগুলোর উপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখছে। তিনি বিনা বিচারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাবি করেন। একই অভিযোগ করে জাসদ। একই অভিযোগ করেন তৎকালীন জাতীয় লীগের অলি আহাদ।
এই সময় ১৯৭৩ সালের ১৫ই মে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। একই সময় ১৭ই মে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে গঠন করে কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এটাই বাকশালের সঙ্গে মস্কোপন্থী কম্যুনিষ্টদের বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রথম আলামত। মাওলানার অনশনকে কেন্দ্র করে তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, হবুমন্ত্রীরা মাওলানা ভাসানীকে আর এক দফা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট, রাজাকারদের দালাল ও দেশের স্বাধীনতা নস্যাত করার চক্রান্তকারী বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। মাওলানা ভাসানীর ডাকে ২১শে মে সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ভাসানী ন্যাপের তদানীন্তন নেতা কাজী জাফরের অভিযোগ অনুযায়ী হরতালকে বানচাল করার জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মুজিববাদীরা সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল।
মাওলানা যখন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক মুক্তির দাবি নিয়ে অনশন করে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময়ই ২২শে মে ঐক্য জোটের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হল। আওয়ামী লীগ মোজাফফর ন্যাপ, মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টি, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে উল্লেখ্য, এরা সবাই পরে বাকশালে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত এক সভায় তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নস্যাতের ষড়যন্ত্রকারী চীন, মার্কিন ও পাকিস্তানের দালালদের প্রতিহত করার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। বক্তারা সমাবেশে মাওলানা ভাসানীর অনশনকে মূলধন করে রাষ্ট্র বিরোধী ব্যক্তিরা তৎপরতা শুরু করেছে বলে সোচ্চার দাবি তোলেন। একই সভায় মোজাফফর আহমদ বলেন, “অনেকে সরকারের বিরোধিতা করছে এই কারণে যে পাকিস্তানে ভাঙ্গা হয়েছে। কেউ কেউ আবার শিল্প জাতীয়করণের জন্য সরকারের বিরোধিতা করছে। আমরা এদের সঙ্গে একমত নই। এছাড়া যে গণতন্ত্রে দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব হয় এবং মজলুম জনতার মুক্তি আসে না, সে গণতন্ত্রকে আমরা পদাঘাত করি। কম্যুনিষ্ট পার্টি প্রধান মনি সিং বলেন, “মাওলানার অনশন খাদ্যাভাবের জন্য নয়, দেশকে বিপাকে ফেলার জন্য।”
এ সময়ে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। জনতার সাথে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ বাধে বিভিন্ন স্থানে। শহরবাসীরা ঐসব হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। ৮ই জুন মাইজদীতে জনতার সাথে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটে। ৯ই জুন ঐ হামলা ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়। এর পিছনে কোনো রাজনৈতিক উস্কানি ছিল না। ঐ দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার তদন্ত করার জন্য মাইজদী যেতে বাধ্য হন। তারপর ১০ই জুন ‘৭৩ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল ঘোষণা করেন, “মাইজদীর ঘটনার জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।” কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল সে খবর কোথাও ছাপা হয়নি। আজঅব্দি জানতে পারেননি এদেশের নির্যাতিত জনগণ সেখানে কি ঘটেছিল।
১০ই জুন বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত কম্যুনিষ্ট পার্টির এক সভায় দলীয় প্রধান জনাব মনি সিং উচ্চকণ্ঠে বলেন, “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদী চীনের নেতৃত্ব এবং তাদের দেশীয় সহযোগী ভাসানী ন্যাপ উগ্রপন্থী জাসদ, মুসলিম লীগ ও জামায়াতপন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।” এরপর ১৯৭৩ সালের ১৯ই জুন ঢাকার প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় নির্দেশ জারি করেন, “শহরে বিনা অনুমতিতে মাইক ব্যবহার করা যাবে না।” মাইক ব্যবহারের উপর এই নিষেধাজ্ঞা ছিল সুস্পষ্টভাবে বিরোধী দলের জনসভার উপর। মোজাফফর ন্যাপ বা সিপিবি-এর কোন প্রতিবাদ করেনি। বরং ২৪শে জুন মোজাফফর ন্যাপের সভায় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, “তার দল বাস্তব অবস্থাতে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।” ঐ জনসভাতেও তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীকে সাম্রাজ্যবাদের চর বলে অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে মজুতদারী, চোরাচালানী, দুর্নীতিতে ছেয়ে যায় দেশ। রক্ষীবাহিনীর হামলা ও হত্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের ২৭শে জুন পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুসারে দেখা গেল যে, ‘৭২ সালের তুলনায় দ্রব্যমূল্য চার’শ গুন বেড়েছে।
এই সময় ২৯শে জুন চট্টগ্রামে ঘটে এক চমকপ্রদ ঘটনা : চট্টগামের ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর বাসের উপর রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণে নিহত হয় একজন কর্মচারী। গুরুতর আহত হয় দু’জন শ্রমিক। ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর একটি বাস কর্মচারীদের রিফাইনারীতে নিয়ে যাবার পথে রক্ষীবাহিনীর একটি ট্রাককে ওভারটেক করে। এ কারণে রক্ষীবাহিনীর ক্রুদ্ধ সদস্যরা একটি রেল ক্রসিংয়ের মুখে ঐ গাড়ি ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এমনি সামান্য ছুতোতেই রক্ষীবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে স্বাধীন এ দেশের সাধারণ মানুষকে।
এই সময় দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক নির্মল সেন (অনিকেত) মার্চের নির্বাচনের ক’দিন পরে লিখেছিলেন, “আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই” শীর্ষক একটি উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ। লেখায় তিনি এক সপ্তাহের একটি ঠিকুজি তুলে ধরেন ১৩টি হত্যাকান্ডের। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন যে, এ খবর সব খবর নয়। সব খবর সংবাদপত্রে পৌঁছে না। সব খবর পৌঁছে না থানায়। দূর-দূরান্ত থেকে কে দেয় কার খবর? আর দিতে গেলে জীবনের যে ঝুঁকি আছে সে ঝুঁকি নিতেই বা কতজন রাজি? এই নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করে নির্মল সেন জানতে চেয়েছিলেন –
(১) ১৯৭২ সাল হতে আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়টি হত্যাকান্ডের কিনারা হয়েছে?
(২) কয়জন হত্যাকারী গ্রেফতার হয়েছে?
(৩) ক’টি গাড়ি হাইজ্যাক হয়েছে? সে হাইজ্যাকার কারা? কি তাদের পরিচয়? কি তাদের ঠিকানা?
(৪) কারা গ্রেফতার হয়েছে?
(৫) পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে, অভিযুক্তদের ধরা হলে ফোনের জন্য তাদের মুক্তি দিতে হয়। এ অভিযোগ কতটুকু সত্য? এই ফোন কারা করে থাকেন?
তিনি বলেন, “খুঁজে দেখতে হবে এই হত্যাকারীরা কাদের প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। নইলে দিনের পর দিন হত্যা, রাহাজানীর খবর বের হয়? অথচ একটি অপরাধীরও শাস্তি হয় না। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি করে?” এ প্রশ্ন শুধু নির্মল সেনেরই ছিল না এ প্রশ্ন ছিল দেশের জনগণেরও। আওয়ামী লীগ সরকার এ প্রশ্নগুলোর কোন জবাব দিতে পারেনি।
চট্টগ্রামের রিফাইনারী কর্মচারীদের উপর গুলিবর্ষণের অকারণ হত্যার জন্য রক্ষীবাহিনীর কেউ সাজা পায়নি। উপরন্তু ১৯৭৩ সালের ২৭শে জুলাই প্রেসিডেন্টের অগণতান্ত্রিক ৫০নং ধারা অনুযায়ী রক্ষীবাহিনীকে দেয়া হল নতুন ক্ষমতা। তাতে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি লিডার ও তার উপরস্থ সকল অফিসারকে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া অপরাধ করেছে সন্দেহে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও তল্লাশীর ক্ষমতা দেয়া হয়। ২০শে জুলাই ভাসানী ন্যাপের ডাঃ আলিম আল রাজি প্রেসিডেন্টের ৫০নং আদেশ বাতিলের দাবি করেন। তিনি বলেন, “ঐ ধারার যথেচ্ছা প্রয়োগ করে বিরোধীদের বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল আটক রাখা হচ্ছে।” ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ঐ ধারার প্রতিবাদ করেন। এমনকি ১৯৭৩ সালের ১৮ই অক্টোবরে সংসদে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ইত্তেফাক সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনও প্রেসিডেন্টের ৫০নং অধ্যাদেশের প্রতিবাদ করে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “এই আইনে গ্রেফতারের বিধান আছে কিন্তু জামিনের বিধান নাই। ফলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের বিদ্বেষই প্রধান হয়ে উঠেছে এবং এর ফলে অনেকেই দুস্কৃতিকারী হচ্ছে। দেশে ৫০নং অধ্যাদেশের যথেচ্ছা ব্যবহার হচ্ছে।” বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনিও ৫০নং অধ্যাদেশের সংশোধনী দাবি করেন। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, এতবড় একটি অগণতান্ত্রিক কালা-কানুনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেনি ।
এরপর ১৯৭৩ সালের ২৯শে আগষ্ট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, অন্ন-বস্ত্রের দাবিতে, কালা-কানুন রোধ ও নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন। তার ক’দিন আগ থেকে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ বিবৃতি দিয়ে জনসাধারণের প্রতি এই জনবিরোধী হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান জানান। ত্রিদলীয় ঐক্য জোটের সভায় হরতালের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করা হয়। পংকজ ভট্টাচার্য্য বলেন, “জাসদ ও ভাসানী ন্যাপ বাংলাদেশকে মার্কিন পদানত করতে চায়।” কিন্তু সরকারি পক্ষের সব চেষ্টার ফলেও হরতাল পুরোপুরি সফল হয়। হরতালের দিন ঐক্যজোটের লোকেরা সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে হরতালকে বানচাল করার প্রয়াস চালায়। তার বিবরণ পরদিন কিছু কিছু কাগজে ছাপা হয়। এভাবে গণতন্ত্রকে বিকলাঙ্গ করার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়। .
১৯৭৩ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর অধিবেশনে সংসদকে নির্যাতনমূলক আটক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। প্রেসিডেন্টকে জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। সংসদের সকল বিরোধী ও নির্দলীয় সদস্য এ সময়ে ওয়াক আউট করেন। দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল যখন দাবি করছে যে, প্রেসিডেন্টের ৫০নং ধারায় বহু লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে; আওয়ামী লীগ সদস্যরাও যখন একথার সত্যতা স্বীকার করছিলেন সেই সময় ৪ঠা অক্টোবর সংসদে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্টমন্ত্রী জনাব আব্দুল মালেক উকিল বললেন যে রাজনৈতিক কারণে কাউকে আটক করা হয়নি। এদিকে ২৯শে সেপ্টেম্বর জনাব উকিল ঘোষণা করেন, “থানায় থানায় দুর্বৃত্তের তালিকা তৈরি হচ্ছে। সারাদেশ থেকে দুস্কৃতিকারীদের উৎখাত করা হবে।” তার ক’দিন পর ১২ই অক্টোবর বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে যে, “থানায় থানায় রক্ষীবাহিনী বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করছে।” এরপর ১৪ই অক্টোবর ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের (মনি, মোজাফফর, আওয়ামী লীগ) ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, “চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে দেশ গঠন, দেশের সংহতি ও স্বাধীনতা রক্ষা, দুষ্কৃতিকারী, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, মুজদদার, সাম্রাজ্যবাদদের দোসর, স্বাধীনতার শত্রুদের উৎখাত করার ক্ষেত্রে এই তিনটি দল ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে যাবে। জোটের কেন্দ্রিয় কমিটিতে আওয়ামী লীগের সদস্য থাকবে ১১ জন, মোজাফফর ন্যাপের ৫ জন এবং মনিসিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টির ৩ জন।”
১৫ই অক্টোবর ন্যাপের মোজাফফর আহমদ ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ সুবিমল দত্তের সঙ্গে দেখা করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করেন। ২১শে অক্টোবর ঐক্যজোটের কেন্দ্রিয় কমিটি গঠিত হয়। তাতে আওয়ামী লীগের জনাব জিল্লুর রহমান আহ্বায়ক হন। মোজাফফর আহমদ ও মনি সিং থাকেন ঐ কমিটিতে। ইতিমধ্যে ১৮ই অক্টোবর জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান অভিযোগ করেন যে, “দুষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে বিরোধী দলীয় কর্মীদের উপর পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন চলছে। সরকার অস্ত্র দিচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। এ পদক্ষেপ দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ২১শে অক্টোবর অভিযোগ করে যে, রক্ষীবাহিনী তাদের রাজবাড়ি জেলা শাখার সম্পাদককে গ্রেফতার করে পিটিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছে। ২৪শে অক্টোবর তারা অভিযোগ করেন যে, বাগমারার জাসদ নেতাকে রক্ষীবাহিনী খুন করেছে। একই অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যজোটের মোজাফফর ন্যাপ, ১৬ই অক্টোবর পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকে রক্ষীবাহিনীর গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করে জেলা ন্যাপ কমিটি একটি বিবৃতি দেন। ২রা নভেম্বর মোজাফফর ন্যাপের সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য্য অভিযোগ করেন যে, তার কর্মীদের উপর রক্ষীবাহিনীর হামলা, হত্যা, নির্যাতন চলছে। তিনি বলেন, “১লা নভেম্বর সুনামগঞ্জ মহকুমার ন্যাপ প্রধান বন্ধু দাসকে রক্ষীবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পীরগাছার ন্যাপ কর্মীদের নির্বিচারে মারধর করা হয়েছে। ৩০শে অক্টোবর নাটোরে ন্যাপ কর্মীকে রক্ষীবাহিনী অপহরণ করেছে।” সেই সঙ্গে পংকজ ভট্টাচাৰ্য্য অনুনয় করেন যে, এদের উপর হামলা হলে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের শক্তিই বৃদ্ধি পাবে।
‘৭৩ সালের ২৫শে অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মালেক উকিল জানান, “গ্রামরক্ষী দল গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে শর্টগান দেয়া হবে। কাজের মেয়াদ শেষ হলে এসব অস্ত্র থানায় জমা দেয়া হবে।” তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেন, “এ ব্যাপারে মহকুমা হাকিমের অনুমোদন সাপেক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং এম পির সাথে আলোচনা করে গ্রামরক্ষী দল গঠনের জন্য ওসির প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
এরপর ২৯শে নভেম্বর সরকারের অস্ত্র সংক্রান্ত এক ঘোষণায় বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রীগণ, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা লাইসেন্স ছাড়াই নিষিদ্ধ (প্রোহিবেটেড বোরের) অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন।” এর বৈধতার প্রশ্ন ছাড়াও এই সিদ্ধান্ত থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠে যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটেছিল।
১২ই নভেম্বর নজীরবিহীনভাবে বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির কংগ্রেস উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বয়ং। সেখানে মনি সিং বলেন, “ঐক্যজোটের ঘোষণায় যাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (ভাসানী ন্যাপ ও জাসদ সহ) আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফলতা লাভ করতে পারি তাহলে দেশে বিপ্লবের বিরাট অগ্রগতি হবে। এটি আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।” ৭ই ডিসেম্বর ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ঘোষণা করে, “সমাজতন্ত্রের পথ বাধামুক্ত করা হবে। সরকারের নীতিসমূহ বাস্তবায়ন প্রতিটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য।”
ইতিমধ্যে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। সরকারি প্রশাসকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে।
দুর্নীতির অভিযোগ আসে। অবাধ লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে জনগণ। আকাশচুম্বি দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। চার মাসে সরকার ৬৩ কোটি টাকা ছাড়ে বাজারে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর ঘটে ব্যাংক ডাকাতির প্রচেষ্টায় এক চমকপ্রদ ঘটনা। দুস্কৃতিকারীদের সাথে গুলি বিনিময়ের পর পুলিশ ছয়জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। পরে অবশ্য পুলিশ জানায়, “দুস্কৃতিকারীদের তাড়া করার সময় এরা আকস্মিকভাবে গুলিবিদ্ধ হন।”
১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার রেল, পাটকল, বিদ্যুৎ, বিআরটিসি, স্বাস্থ্য দপ্তর, নৌ পরিবহন সংস্থা প্রভৃতি স্থানে শ্রমিকদের ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে দেয়। এ সময় পাটগুদামে প্রায় আগুন লাগা প্রতিদিনের খবরে রূপ নেয়। কোটি কোটি টাকার পাট পুড়িয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ এমপি শ্রমিক লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য মালিকরা পাট পোড়াচ্ছে।” এই অবস্থায় ২৪শে ডিসেম্বর ‘৭৩ প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিদায় নিতে হয়। তিনি প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভেঙ্গে স্পীকারের কাছে তার পদত্যাগপত্র না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন। পদত্যাগপত্রে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে লেখেন, “আপনার সঙ্গে আলোচনার পর এবং জরুরী জাতীয় স্বার্থে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি।” তারপর স্পীকার মোহাম্মদউল্লাহ্ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ এর শেষদিকে স্বরাষ্টমন্ত্রী ঢাকার কমলাপুরে এক জনসভায় বলেন, “দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রয়োজনবোধে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে অস্ত্র দেয়া হবে।” কত অস্ত্ৰ এইসব বাহিনীর হাতে দেয়া হয়েছিল সেটা আজ অব্দি দেশবাসী ৩০ হাজারেরও বেশি দেশপ্রেমিকের প্রাণের বিনিময়েও জানতে পারেনি।
বাকশালে প্রাথমিক পর্ব ১৯৭৩ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। ১৯৭৪ সালে শুরু হয় এর ব্যাপক প্রস্তুতি পর্ব। ‘৭৪ সালের ১৩ই জানুয়ারী জাসদ ঘোষণা করে যে, ২০শে জানুয়ারী পল্টনে তারা জনসভা করবে। উক্ত জনসভা ভন্ডুল করতে আওয়ামী লীগও একই দিনে পল্টনে জনসভা ডাকে। এ নিয়ে প্রচন্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এক নির্দেশে ১৪ই জানুয়ারী থেকে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। পরে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। ২০শে জানুয়ারী রাজশাহীতেও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৪ই জানুয়ারী জাসদ এই ১৪৪ ধারা জারির তীব্র প্রতিবাদ করে এবং এই ধারা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ১৬ই জানুয়ারী জাসদের ঢাকা নগর শাখার সহ-সম্পাদক অপহৃত হন। ১৮ই জানুয়ারী জাসদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ে, লাঠিচার্জ করে এবং বহু কর্মীকে গ্রেফতার করে। জাসদের ডাকে ২০শে জানুয়ারী ‘৭৪ সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ঐ দিন বিকেলে তারা এক বিরাট জঙ্গী মশাল মিছিল রাজধানীর রাজপথে বের করে। সকাল থেকেই বিপুল সংখ্যক রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তারা মিছিলের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। পরদিন এক সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয় মিছিলকালে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ঐ প্রেসনোটের পাশে দৈনিক ইত্তেফাক সচিত্র খবর পরিবেশন করে যে পঞ্চাশ ব্যক্তি আহত হয়েছে এবং দু’জনের অবস্থা গুরুতর। চিত্রে দেখা যায় আওয়ামী সরকারের রক্ষীবাহিনী বায়তুল মোকাররমের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীদের উপরও হামলা চালাচ্ছে। জাসদ দাবি করে ঐদিন তাদের এক হাজারেরও বেশি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২রা ফেব্রুয়ারী জাসদের সহ-সভাপতি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির গুলিতে নিহত হন।
এ সময় ১৯৭৪ সালের ১৫ই জানুয়ারী জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে। সংসদের স্পীকার হন জনাব আব্দুল মালেক উকিল। এই অধিবেশনেই মোহাম্মদউল্লাহকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করে। ২৮শে জানুয়ারী আব্দুল মালেকের স্পীকারিত্বের সময় প্রথম যে আইনটি তিনি কণ্ঠ ভোটে পাশ করেন তা ছিল রক্ষীবাহিনী আইন। বিলটি ছিল চরমভাবে গণবিরোধী এবং এতে রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, তল্লাশী ও আটক করার ক্ষমতা দান করা হয়। বিরোধীদলের সদস্যরা এর প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেন। বিলটি উত্থাপন করেন তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর। বিরোধী দলের সদস্যদের ওয়াক আউটের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
‘৭৩ সালের প্রারম্ভ থেকেই গ্রামে গ্রামে চলে রক্ষীবাহিনীর বর্বর, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক অভিযান। মুজিব আমলের স্বৈরাচার ও বিরোধী নির্যাতনের একটি দলিল আত্মগোপনকারী কম্যুনিষ্ট নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী শ্রীমতি অরুণা সেনের বিবৃতি। অরুনা সেন, রানী সিংহ ও হনুফা বেগমকে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার রামভদ্রপুর গ্রাম থেকে রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করেনি। তাদেরকে কোন আদালতেও হাজির করেননি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় এবং পরে সুপ্রীম কোর্টে তাদের পক্ষে রীট আবেদন করার পর কোর্টের নির্দেশে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার শুনানির সময় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণযোগ্য অভিযোগ আনতে অক্ষম হওয়ায় সুপ্রীম কোর্ট অবিলম্বে তাদের তিনজনকেই বিনা শর্তে মুক্তিদানের নির্দেশ দেন। অরুণা সেন ও অন্যান্যদের পক্ষে এই মামলা পরিচালনা করেছিলেন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিষ্টার জমিরুদ্দিন সরকার।
মুক্তি পাবার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-নির্যাতনের স্বরূপ প্রকাশের জন্য শ্রীমতি অরুণা সেনের সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “গত ১৭ই আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লোকেরা আমাদের গ্রামের ওপর হামলা করে। ঐদিন ছিল দূর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। খুব ভোরে আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে বেদম মারপিট করে। লক্ষণ নামের একটি কলেজের ছাত্র ও আমাকে ধরে তারা নড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী শান্তি সেন ও পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? বলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের ধরিয়ে দিন। আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। লক্ষণকে সেদিন, রেখে পরদিন ছেড়ে দেয়। সে যখন বাড়ি ফেরে, দেখি বেদম মারের ফলে সে গুরুতররূপে আহত ও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। চার/পাঁচ দিন পর আবার তারা আমাদের গ্রামের উপর হামলা চালায়। অনেক বাড়ি তল্লাশী করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামের দু’জন যুবককে তারা মারতে মারতে নিয়ে যায়। আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। তাদের আত্মীয়রা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের খোঁজ করলে বলে দেওয়া হয় তারা সেখানে নেই। তাদেরকে খুন করে গুম করে ফেলা হয়েছে বলেই মনে হয়। এরপর মাঝে মাঝেই তারা গ্রামে এসে যুবক ছেলেদের খোঁজ করত।
গত ৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ রাতে রক্ষীবাহিনী এসে সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। ভোরে আমাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম, গ্রামের উপস্থিত প্রায় অধিকাংশ সক্ষম দেহী পুরুষ এমনকি বালকদের পর্যন্ত এনে হাজির করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হোসেন খাঁ সবকিছুর তদারকি করছে। আমার সামনে রক্ষীবাহিনী উপস্থিত সকলকে বেদম মারপিট শুরু করে। শুনলাম এদের ধরতে গিয়ে বাড়ির মেয়ে-ছেলেদেরও তারা মারধর করে এবং অনেকক্ষেত্রে অশালীন আচরণ করেছে। এরপর আমাকে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার হুকুম করল পানিতে নেমে দাড়াতে। সেখানে নাকি আমাকে গুলি করা হবে। আমি নিজেই পানির দিকে নেমে গেলাম। ওরা রাইফেল উচিয়ে তাক করল গুলি করবে বলে। কিন্তু পরস্পর কী সব বলাবলি করে রাইফেল নামিয়ে নিল। আমি কাদা-পানিতে দাড়িয়েই থাকলাম। কমান্ডার গ্রেফতার করা সবাইকে হিন্দু মুসলমান দুই কাতারে ভাগ করে দাড় করালো। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বলল, ‘মালাউনরা আমাদের দুশমন। তাদের ক্ষমা করা হবে না। তোমরা মুসলমানরা মালাউনদের সাথে থেকো না। তোমাদের এবারের মত মাফ করে দেয়া হল।’ এই বলে কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফা নামের দু’জন মুসলমান যুবককে রেখে বাকি সবাইকে এক একটা বেতের বাড়ি দিয়ে বলল, ‘ছুটে পালাও’। তারা ছুটে পালিয়ে গেল। আমার পাক বাহিনীর কথা মনে পড়ল। তারাও বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভক্ত করতে এমনিভাবে সাম্প্রদায়ীকতার আশ্রয় নিয়েছিল। পার্থক্য শুধু তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়ীকতার আশ্রয় নিত আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধব্জাধারীরা ভন্ডামীর আশ্রয় নিচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফাসহ ২০জন হিন্দু যুবককে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হল। তিনজন ছাড়া এরা সবাই পেশায় জেলে। মাছ ধরে কোনরকমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সব আকুল হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকল। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। সন্ধ্যার সময় কলিমুদ্দিন, মোস্তফা, গোবিন্দনাগ ও হরিপদ ঘোষ ছাড়া বাকি সবাই গ্রামে ফিরে এল। আমি গেলাম তাদের দেখতে। দেখলাম তারা সবাই চলতে অক্ষম। সর্বাঙ্গ ফুলে গেছে তাদের। বেত ও বন্দুকের দাগ শরীর কেটে বসে গেছে। চোখ-মুখ ফোলা : হাতপায়ের গিরোতে রক্ত জমে আছে। তাদের কাছে শুনলাম, সারাদিন দফায় দফায় তাদের চাবুক মেরেছে। গলা ও পায়ের সঙ্গে দড়ি বেধে পানিতে বার বার ছুড়ে ফেলে ডুবিয়েছে। পিঠের নিচে ও বুকের উপর পা দিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন লোক তাদের উপর উঠে দাড়িয়েছে। মই দিয়ে ডলেছে। এদের অনেককেই আত্মীয়রা বয়ে এনেছে। এদের অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, যারা দিনরাত্রি পরিশ্রম করেও একবেলা পেটপুরে খেতে পায়না, অনাহার, দুঃখ-দারিদ্রের জ্বালায় আজ অর্ধমৃত তাদের ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’-র অবসান কবে হবে? যে শাসকরা মানুষের সামান্য প্রয়োজন ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানী, শোষণ, নির্যাতন যারা বন্ধ করতে পারছে না, তারা কোন অধিকারে আজ নিঃস্ব মানুষের উপর চালাচ্ছে এই বর্বর নির্যাতন? অবশেষে চরম নির্যাতন আমার উপরও নেমে এল। ৬ই ফেব্রুয়ারীর রাতে ভোর না হতেই রক্ষীবাহিনী ঘুম থেকে আমাকে তুলল। আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলে দেখলাম রানীও রয়েছে। আমাদের নিয়ে তারা দুই মাইল দূরে ভেদরগঞ্জ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হল। রাস্তায় তারা রানীর প্রতি নানারকমের অশ্লীল উক্তি করেছিল। ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলাম সেখানে কলিমুদ্দিন, মোস্তফা, গোবিন্দনাগ এবং হরিপদও রয়েছে। বুঝতে পারলাম তাদের উপর চরম দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে। বিশেষ করে কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফাকেই বেশি অসুস্থ্য দেখলাম। কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফা দুই ভাই। এদের সংসারে আর কোন সক্ষম ব্যক্তি নেই। অপরের জমিতে চাষ করে ওরা কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা বিবাহিত ও ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জনক। আমরা ক্যাম্পে আসতেই অনেক রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের ঘিরে দাড়াল : কেউ অশ্লীল মন্তব্য করে, কেউ চুল ধরে টানে, কেউ চড় মারে, কেউ খোঁচা দেয়। এমন সব বর্বরতা। কিছুক্ষণ পর আমাদের রোদের মধ্যে বসিয়ে রেখে তারা চলে গেল। সন্ধ্যায় আমাকে উপরে দোতালায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম রানীর হৃদয়বিদারী চিৎকার। প্রায় আধঘন্টা পর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে থেমে গেল। নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছিল বেতের সপাং সপাং শব্দ আর পাশবিক গর্জন। রানীকে যখন এনে তারা কামরার মধ্যে ফেলল, রাত্রি তখন কত জানিনা। রানীর অচৈতন্য দেহ তখন বেতের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝড়ছে। জ্ঞান ফিরলে রানী পানি চাইলো, আমি তাকে পানি খাওয়ালাম। রানী আস্তে আস্তে কথা বলতে পারল। রাত্রি তখন ভোর হয়ে এসেছে। রানীর মুখে শুনলাম উপরে ভেদরগঞ্জ ও ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সম্পাদকরা এবং ঐ দুই স্থানের ক্যাম্প কমান্ডাররা উপস্থিত ছিল। তারা শান্তি সেন ও চঞ্চলকে ধরিয়ে দিতে বলে এবং অস্ত্র কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করে। রানী কিছুই জানে না বলায় তাকে এমন সব অশ্লীল কথা বলে যা কোন সভ্য মানুষের পক্ষে বলা তো দূরের কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ ও গালি বর্ষণের পর ভেদগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার বেত নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাতাড়ি এমন পেটাতে থাকে যে তিনখানা বেত ভেঙ্গে যায়। আবার জিজ্ঞাসা করে, শান্তি ও চঞ্চল কোথায়? রানীর একই উত্তর : ক্ষীপ্ত হয়ে রানীকে তারা সিলিং এর সাথে ঝুলিয়ে দেয় এবং দুই কমান্ডার এবার একই সাথে চাবুক দিয়ে পেটাতে শুরু করে। মারার সময় অসহ্য যন্ত্রণায় রানী বলেছিল, ‘আমাকে এভাবে না মেরে গুলি করে মেরে ফেলুন।’ জবাবে একজন বলে, ‘সরকারের একটা গুলির দাম আছে। তোকে সাতদিন ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলব। এখন পর্যন্ত মারার দেখেছোটা কি?’ অল্পক্ষণ পরেই রানী অচেতন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের চাবুক চালানো বন্ধ হয়নি। যখন জ্ঞান ফেরে রানী দেখে সে মেঝেতে পরে আছে। পানি চাইলে তারা তাকে পানি দেয় নাই। ৮ই ফেব্রুয়ারী প্রথমে আমাকে ও পরে রানীকে দোতালায় নেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী ফজলু মিঞা ও ভেদরগঞ্জের সেক্রেটারী হোসেন খাঁ। তারা চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে বলল, তোমার স্বামী ও ছেলেকে ধরিয়ে দাও। অস্ত্র কোথায় আছে বলে দাও। তারা ডাকাত, অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে। আমি বললাম, তারা ডাকাত নয়। তারা সৎ দেশপ্রেমিক, আমার স্বামী রাজনীতি করেন এ কথা কে না জানে। দেশের সাধারণ লোকের অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় তিনি। রানীকে তারা একই প্রশ্ন করেন। রানী কিছুই জানে না বলায় তারা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে। ডামুড্যা ক্যাম্পের কমান্ডার করম আলী এবং ভেদরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার ফজলুর রহমান আমাদের অশ্লীল গালাগাল দিতে শুরু করে এবং আমাকে ও রানীকে একসঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে রানীর বস্ত্র খুলে নেয়। তারপর আমাদের দু’জনকে দু’দিক থেকে চাবুক মারতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান হলে দেখি দু’জনেই মেঝেতে পরে আছি। রানীর সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার গায়ে কাপড় থাকায় অপেক্ষাকৃত কম আহত হয়েছি। তবুও এই রুগ্ন বৃদ্ধ দেহে এই আঘাতই মর্মান্তিক। সর্বাঙ্গ ব্যাথায় জর্জরিত। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। নড়বার ক্ষমতা নেই। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে নারকীয় হাসি হাসছে। এদের হুকুমে দু’জন সিপাই আমাকে টেনে তুলল। আমি অতিকষ্টে দাড়াতে পারলাম। রানী পারল না। দু’জন রক্ষী তার দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলল ও তার গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিল। তারপর টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে এল। কমান্ডার পেছন থেকে নির্দেশ দেয় ওকে ভালো করে হাটা নয়তো মরে যাবে। সকালে কমান্ডার কয়জন রক্ষীসহ রানীকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হল। বলল, ‘বাচঁবিতো না, চল তোর মাকে দেখিয়ে আনি।’ রানীর সর্বাঙ্গ ফুলে কালো হয়ে গিয়েছে। পা ফেলবার ক্ষমতা নেই। সে অবস্থায় তাকে হেচঁড়াতে হেচঁড়াতে দু’মাইল পথ টেনে নিয়ে যাওয়া হল। রানীর মা রানীকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে যান। কমান্ডার রানীকে তার মার মাথায় পানি দিতে বলে। রানীর মার জ্ঞান এলে রানীর চেহারা এমন কেন জিজ্ঞেস করায় কমান্ডার বলে পুকুর ঘাটে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। রানীকে ছেড়ে দেবার অনুরোধ জানালে কমান্ডার বলে ‘খাসী খাওয়ালে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।’ এরপর আবার দু’মাইল রাস্তা হেঁচড়াতে হেচঁড়াতে তাকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হল। ঐ দিন ছিল ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪। হনুফাকেও তারা ধরে নিয়ে এল ঐদিন। করিম নামের আর একটি কৃষক যুবককেও ওরা ধরে এনেছে দেখলাম রামভদ্রপুর থেকে। তাকে এত মারা হয়েছে যে তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। নড়িয়া থানার পন্ডিতসার থেকেও একজন স্কুল শিক্ষক ও দু’জন যুবককে এনেছে দেখলাম। বিপ্লব নামের একটি ছেলে নাকি মারের চোটে পথেই মারা যায়। রক্ষীবাহিনীর সিপাইরা বলাবলি করছিল। একজন জল্লাদ গর্জন করে বলছিল, ‘দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে।’ শুনেছি মতি নামের আর একটি যুবককেও তারা পিটিয়ে মেরেছে। আর আমাদের ধরে আনার দু’দিন আগে কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটাবার পর হাত-পা বেধে দোতালার ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে। ৯ তারিখ দুপুরের অল্প পরে তারা হনুফা, রানী ও আমাকে নিয়ে গেল পুকুরের ধারে। সেখানে আমাদের একদফা বেত দিয়ে পিটিয়ে চুবানোর জন্য পানিতে নামাল। প্রথমে ওরা আমাদের সাতরাতে বাধ্য করল। আমরা ক্লান্ত হয়ে কিনারায় উঠতে চেষ্টা করি, ওরা আমাদের বাঁশ দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিশ্রান্ত হয়ে যখন আমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না তখন পানি থেকে তুলে আবার বেত মারতে থাকে। শেষের দিকে আমরা যখন আর সাতরাতে পারছিলাম না, তখন আমাদের পানিতে ডুবিয়ে দেহের উপর দু’পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকত।
এভাবে আমাদের তিন দফা পেটানো ও চুবানো হয়। কিছুক্ষণ আগেই করিম মারের চোটে মরে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে আর একটি অল্প বয়সী যুবককে চুবিয়ে অচেতন করে ফেলেছিল। তাকে ঘাটলার উপর ফেলে রাখে। আমার আঁচল দিয়ে গা মোছানোর সময় হঠাৎ ছেলেটি চোখ খুলে তাকায়। আমি চোখের জল রাখতে পারলাম না। রক্ষীরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি ছেলেটাকে নাকি মেরে ফেলেছে। সন্ধ্যার অল্প আগে আমাদের পানি থেকে তুলে ভিজা কাপড়েই থাকতে বাধ্য করল। দারুন শীতে আমরা কাঁপছি। প্রচন্ড জ্বর এসে গেছে সকলের। এমনি করেই রাতভর ছালার চটের উপর পরে থাকলাম। পরদিন রাতে রানীকে আবার নিয়ে গেল দোতালায়। সেখানে আবার তাকে ঝুলিয়ে বেত মারল। ১১ তারিখে আবার রানীর ওপর চলল একই অত্যাচার। রানী জ্ঞান হারাল। রক্ষী সিপাইদের বলাবলি করতে শুনলাম রানী মরে গিয়েছে’। রানীর কাছে শুনলাম তার যখন জ্ঞান হল তখন সে দেখে তার পাশে ডাক্তার বসা। রানী জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কে,আমি কোথায়?’ ডাক্তার জবাব দেয়, ‘আমি ডাক্তার, তুমি কথা বলো না।’ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে গেলে রানীকে তারা ধরাধরি করে নিচে আমাদের কাছে নিয়ে এল।
একজন সিপাই রানী ও হনুফাকে বলল, ‘তোরাতো মরেই যাবি। তার আগে আমরা প্রতি রাতে পাঁচজন করে তোদের ভোগ করব। তারা অবশ্য ‘ভোগ’ শব্দটি বলে নাই, বলেছিল অতি অশ্লীল কথা। একদিন রাতে দু’জন রক্ষী সিপাই ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দেয় এবং রানী ও হনুফার মুখ চেপে ধরে। ধস্তাধস্তি করে তারা ছুটে গিয়ে চিৎকার করে। চিৎকার শুনে ক্যাম্পের অন্য রক্ষীরা ছুটে আসে। কমান্ডারও আসে। ওরা তাকে সব বললে সে বলে, ‘খবরদার এ কথা প্রকাশ করবি না। তাহলে মেরে ফেলব।’
রক্ষী সিপাইদের কারও কারও মাঝে মানবতাবোধের লক্ষণ পাচ্ছিলাম। তাদেরই একজন সিপাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছ?’ প্রশ্ন শুনে সে চমকে উঠল। বলল, ‘বাংলাদেশে লেখাপড়া দিয়ে কি করব? আমরা জল্লাদ, জল্লাদের আবার লেখাপড়ার দরকার কি?’ এই বলে সে দে ছুট্। মনে হয় যেন চাবুক খেয়ে একটি ছাগল ছুটে পালাল। রক্ষী সিপাইদের কানাঘুষায় শুনছিলাম, আমাকে আর হনুফাকে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেবে আর রানী ও অন্যান্য পুরুষ বন্দীকে মেরে ফেলা হবে। ১২ই ফেব্রুয়ারী আমাকে ও হনুফাকে নিয়ে রক্ষীরা রওনা দিল। আমরা রানীকে ফেলে যেতে আপত্তি জানালাম। রানীও আমাদের সাথে যেতে খুব কান্নাকাটি করছিল। কমান্ডারের কাছে অনুনয়-বিনয় করছিল। কমান্ডার তার সহকর্মীদের সাথে কি যেন আলাপ করে সেদিন আমাদের পাঠানো স্থগিত রাখল। ১২তারিখ রাতেও ওরা আবার রানীকে ঝুলিয়ে হান্টার দিয়ে পেটায়। ১৩ তারিখে তারা রানীকে মারে না, কিন্তু নির্যাতনের নতুন কৌশল নেয়। দম বন্ধ করে রাখে। জোর করে চেপে ধরে রাখে নাক-মুখ-চোখ। এমনি করে জ্ঞান হারালে ওরা তাকে ছেড়ে দেয়।
১৯শে ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে ওরা আমাদের তিনজনকে নিয়েই রওনা দিল প্রায় চার মাইল দূরে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। কলিমুদ্দিন, মোস্তফা, গোবিন্দ ও হরিপদ থেকে গেল। রক্ষীরা বলাবলি করছিল তাদের মেরে ফেলা হবে। আমরা কিছুদূর এলে ক্যাম্পের দিক থেকে চারবার গুলির আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম ওদের বুজি মেরে ফেলল। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আমাদের শরীরের অবস্থা এমন ছিল যে, হাটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবু আমরা বাধ্য হচ্ছিলাম হাটতে। বোধ হয় আমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। বোধ হয় বেঁচে যাব। এ চিন্তাই আমাদের হাটতে শক্তি যোগাচ্ছিল। অনেক রাতে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ রেখে স্পীডবোট করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। সমস্তক্ষণ আমাদের কম্বল চাপা দিয়ে মুর্দার মত ঢেকে রাখা হল। বেদনা জর্জরিত ক্ষত-বিক্ষত শরীর। তার উপর কম্বল চাপা থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। যেন জ্যান্ত কবর। সমস্ত দিন আমাদের ওভাবেই রাখল। খেতে দিল না। শেষরাতে আবার কম্বল চাপা দিয়ে জিপে করে ঢাকার দিকে রওনা দিল। আবার সেই সুদীর্ঘ পথ জ্যান্ত কবরের যন্ত্রণা। ঢাকায় আমাদের প্রথমে রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে গেল। সে আমাদের খুব ধমকাল। সেখান থেকে নিয়ে গেল তেজগাঁ থানায়, তারপর লালবাগ থানায়। রাতে সেখানে থাকলাম। পরদিন পাঠাল সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে পাঁচদিন রাখার পর আমাদের নিয়ে এল তেজগাঁ গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে। জেলে আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের মত রাখা হত। দিনরাত সেলে বন্দী। একই আহার্য দেয়া হত। সেখানে রাজনৈতিক অভিযোগে আরোও বন্দিনী আছেন। তার মধ্যে ১৭ই মার্চে গ্রেফতারকৃত জাসদ নেত্রী মোমতাজ বেগম আছেন : অস্ত্র আইনে সাজাপ্রাপ্ত পারভীন : আরও একজন আছেন নাম রুমা। সবাইকেই তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী করে রাখা হয়েছে। সাধারণ কয়েদীদের মত খাটানো হচ্ছে। এর উপর জমাদারনীরা (মেয়ে সিপাই জমাদার) তাদের নিজেদের জামা-কাপড় সেলাই, কাথা সেলাই, কাপড়-চোপড় ধোয়ানো সবকিছুই মেয়ে কয়েদীদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দীরাও রেহাই পাচ্ছেন না।”
এমনই হাজার হাজার করুণ কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসন আমলে বাংলাদেশে। যার সবগুলো গুমড়ে মরেছে নির্বিচারে, প্রকাশিত হতে পারেনি। রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার আর একটি চিত্র তুলে ধরা যাক। ঘটনাটি ঘটেছিল পাবনার বাজিতপুরের কোরাটিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আলীর ছেলে রশীদকে খুন করার কাহিনী।
আবদুল আলীর সাক্ষাৎকারটা ছিল নিম্নরূপ : –
“আমার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল, ‘মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলবো।’ আমি কি তা পারি। আমি যে বাপ। কিন্তু অকথ্য নির্যাতন কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে ছেলের মাথা কেটে দিয়েছি। রশীদ নাকি রাজনীতি করত আমি জানতাম না। একদিন মাতু আর শাহজাহান এসে ধরে নিয়ে গেল। আওয়ামী লীগ অফিসে সারারাত ওরা ওকে বেদম মার মারল। সকালে বলল এক হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। রশীদ স্বীকার করে এল এক হাজার টাকা দেবার। আমার কাছে টাকা চাইল। কিন্তু আমি দিন আনি দিন খাই, মজুর মানুষ। হঠাৎ তিন দিনের মধ্যে এক হাজার টাকা কোত্থেকে দেব? বললাম, তুই বরং পালিয়ে সিলেট চলে যা। রশীদ সিলেট চলে গেল। কিন্তু ১০-১২ দিন পর ফিরে এসে বলল, ‘বাবা মন মানেনা তোমাদের ফেলে থাকতে।’ সিলেট থেকে ফেরার পরই কঠিন অসুখে পড়ল। টাইফয়েড। অসুখ সারার পর একদিন তার মাকে বলল, ‘মা আজ ভাত খাব।’ তার মা শৈলমাছ দিয়ে তরকারী রানল। এমন সময় আওয়ামী লীগের পান্ডারা রক্ষীবাহিনীসহ বাড়ি ঘেরাও করল। অসুস্থ্য মানুষ। কোন রকমে বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে দৌড় দিল। বাবা আমার জানত না সেখানেও ঘাপটি মেরে বসে আছে আজরাইল। পাষন্ডরা দৌড়ে এসে ধরল তাকে। রশীদ সিরাজের পা ধরে বলল, ‘সিরাজ ভাই, বিমারী মানুষ আমায় ছেড়ে দেন।’ ছাড়ল না। তারপর বাপ-বেটা দু’জনকেই বেধে মার শুরু করল। কত হাতে পায়ে ধরলাম। এরপর মাতু গুলি করল রশীদকে। ঢলে পড়ল রশীদ। আমি নির্বাক তাকিয়ে রইলাম। মরার পর একজন বলল, ‘চল ওর কল্পাটা নিয়ে যাই ফুটবল খেলব।’ মাতু বলল, হ্যাঁ। তাই নেব। তবে ওর কল্পা আমরা কাটব না। তার বাবা কেটে দেবে।’ বলেই আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল কেটে দিতে। আমার মুখে রা নেই। বলে কি পাষন্ডগুলো? চুপ করে আছি দেখে বেদম পেটাতে শুরু করল। বুড়ো মানুষ কতক্ষণ আর সহ্য হয়। সিরাজ এসে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, ‘এক্ষুনি কাট, নইলে তোকেও গুলি করব।’ ইতিমধ্যে দেড় ঘন্টার মত সময় পার হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম না কাটলে ওরা সত্যি আমাকেও মেরে ফেলবে কিনা? শেষে কুঠার দিয়ে কেটে দিলাম মাথা। নিয়ে সউল্লাসে চলে গেল তারা। আল্লায় কি সহ্য করব?”
‘৭৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী আব্দুল মালেক উকিলের স্পীকারিত্বে বিশেষ ক্ষমতা আইন পাশ হয়। যার অর্ন্তভূক্ত ছিল নির্যাতনমূলক আটক আইন আর প্রেস সেন্সরশীপের ব্যবস্থা, সংগঠন গঠনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ ও নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা। বিরোধী সদস্যরা একে আর একটি কালা-কানুন বলে অভিহিত করে ওয়াক আউট করেন। এ সম্পর্কে জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, “জনসাধারণের জন্য এই দিনটি একটি কালো দিন এবং বিলটি কৃষ্ণতার বিল। এটি সাংবাদিকদের দমনের একটি নিকৃষ্ট ব্যবস্থা।” তিনি বলেন, “জনসাধারণ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সদস্যগণকে কালো আইন প্রণয়নের জন্য ভোট দেয়নি। যদি তাই হয় দেশে আবার নির্বাচন দিন।” তিনি বলেন, “পাক আমলে এই আইনে নাশকতামূলক কাজের অভিযোগে শেখ মুজিব, তাজুদ্দিন গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। আওয়ামী লীগের মুজিব সরকার একের পর এক কালা-কানুন জারি করে যাচ্ছে, কিন্তু এতেও কোন ফল হবে না।”
ইতিমধ্যে দ্রব্যমূল্য ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে প্রতিদিন। বাজার থেকে নতুন নতুন পণ্য উধাও হতে থাকে। এ সময় চার আনা সেরের লবনের দাম বেড়ে হয় ৬০টাকা। পাঁচ টাকা সেরের শুকনো মরিচের ছটাক হয় ৮টাকা। শীঘ্রই দেশে অধিক মূল্যেও আর লবন পাওয়া যাবে না এ মর্মে সাক্ষাৎকার দেয়ায় ঢাকা বণিক সমিতির সভাপতি খন্দোকার আব্দুস সাত্তারকে পুলিশ ২৭শে জুলাই গ্রেফতার করে। লবনের এই কেলেঙ্কারীর খবর ছাপার জন্য দৈনিক পূর্বদেশ বাকশাল গঠনের পর সরকার বন্ধ করে দেয়। পত্রিকার দু’জন সাংবাদিক চাকুরী হারান। সভ্য দুনিয়ায় আওয়ামী লীগের এই কেলেঙ্কারীর কোন নজির নেই।
১৭ই মার্চ ‘৭৪ পল্টনে জাসদ এক জনসভার ডাক দেয়। জনসভার পর জাসদ সরকারি নির্যাতনের প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করতে যায়। সেখানে পুলিশের গুলিতে সরকারি হিসাবে নিহত হয় ৬ জন, আহত হয় শতাধিক। জাসদ দাবি করে ঐ গুলিবর্ষণের ফলে তাদের ৫০জন কর্মী নিহত হয়েছেন। সেখান থেকে আসম আব্দুর রবসহ জাসদের প্রায় সব নেতাই আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। জাসদের এই মিছিলের উপর রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক ইত্তেফাক। সেদিনই সরকার জাসদের মুখপাত্র দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক দেশের বিশিষ্ট কবি আল মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। ফলে পরদিন গণকন্ঠ প্রকাশিত হতে পারেনি। মোজাফফর ন্যাপ জাসদের এই মিছিলকে হঠকারী ও উস্কানিমূলক বলে অভিহিত করে এর নিন্দা করে। সিপিবি বলে, “জাসদ অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় মেতেছে।” মনি সিং জনগণের কাছে এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করার আহ্বান জানান। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দলের ফলে ১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ৭জন ছাত্র নিহত হয়। এভাবেই প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল অন্য কেউ নয় আওয়ামী লীগেরই ছাত্র সংগঠন। রক্তের সেই হোলি খেলার তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সময়ের সাথে।
এ সময় ৩১শে মার্চ ১৯৭৪, জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সভায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ডঃ আহমদ শরীফ। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন কবি সিকান্দার আবু জাফর। এ ছাড়া মীর্জা গোলাম হাফিজকে আইন পর্যালোচনা সাব কমিটির, ডঃ আহমদ শরীফকে প্রকাশনা সাব কমিটির, বিনোদ দাশগুপ্তকে তথ্য অনুসন্ধান সাব কমিটির চেয়ারম্যান, এনায়েতউল্লাহ খানকে কোষাধ্যক্ষ, মওদুদ আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও সৈয়দ জাফরকে সহ-সম্পাদক নির্বাচিত করে ৩৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির ঐ সভায় জনগণের মৌলিক অধিকার ও তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি বিশেষ প্রস্তাবও গৃহিত হয়। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল
(১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘গণতন্ত্র’ রাষ্ট্রের একটি নিয়ামক নীতি হিসাবে সংযোজিত হয়েছে। ৩১,৩২ এবং ৩৩ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শাসনতন্ত্র মোতাবেক জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে এবং প্রত্যেক নাগরিকই নিজেকে গ্রেফতার ও আটকের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আইনের সাহায্য প্রার্থনা করার অধিকার ভোগ করবেন।
(২) কিন্তু এরূপ সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা সত্ত্বেও উপরোক্ত শাসনতান্ত্রিক ওয়াদা এবং নাগরিক অধিকার খেলাপ করা হচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত খবর পাওয়া যায়। এসব খবরে জানা যায় যে, কোন আদালতে হাজির না করেই অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং যে সব সংস্থার নাগরিকদের অধিকার রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার কথা তাদের হাতেই অনেক লোক শারীরিকভাবে গুম হয়ে যাচ্ছে।
(৩) কাজেই যেসব দায়িত্বশীল নাগরিক আইনের শাসনের বিশ্বাসী তাদের মতামত সংগঠিত করা দরকার। এবং এই কাজের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও শান্তিকামী ব্যাপক জণগণের মৌলিক অধিকার হরণের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অভিহিত করে জনমত সংগঠিত করা প্রয়োজন। যাতে শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত আইনের শাসনের নিশ্চয়তাকে নগ্নভাবে উপেক্ষা করে যে ব্যক্তি নিপীড়নের কাজ চলছে তা প্রতিরোধ করা যায়।
(৪) এর সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিগণকে বিনা বিচারেই ধরে রাখা এবং অনেককেই আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই সাজা দেয়া হচ্ছে। সুতরাং এ ধরণের আটক ব্যক্তিদেরকে আইনের সাহায্য দেয়া প্রয়োজন।
(৫) আইনের এই সাহায্য দেয়ার জন্য উপযুক্ত সংগঠন ও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। (৬) তহবিল ছাড়া সংগঠনের প্রয়োজনীয় কাজ যথাযথভাবে চালানো সম্ভব নয়। কাজেই সুষ্টভাবে এই কাজ চালানোর জন্য একটি তহবিল সৃষ্টি করাও প্রয়োজন।
(৭) এই কমিটির কাজ শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কমিটিকে একটি কার্যকর সংগঠন পরিণত করার জন্য এবং সারাদেশের জনগণ যাতে আইনের সাহায্য পেতে পারে তার জন্য জেলা পর্যায়ে এমনকি তার নিম্ন পর্যায়ে ও এই কমিটি গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে নিম্ন আদালতেও জনগণ আইনের সাহায্য লাভ করতে পারে।
(৮) এই সংগঠন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিক অধিকার রক্ষামূলক সমিতিগুলোর সঙ্গেও ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখবে। ঐ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত প্রস্তাবলী ছিল নিম্নরূপ :-
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১,৩২ এবং ৩৩ নং ধারায় ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কে যে সমস্ত অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে সেগুলো নানান সরকারি বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রের দ্বারা খর্ব বা হরণ করা হচ্ছে শুধু তাই নয়; নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত অনেক অধিকারকে ইতিমধ্যেই কাগুজে অধিকারে পরিণত করা হয়েছে। এই সভা সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সমস্ত আইন প্রত্যাহার করে নেয়া এবং বিভিন্ন সরকারি বাহিনীও প্রশাসন যন্ত্র কর্তৃক ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ ও হামলা বন্ধ করার জন্য সাধারণভাবে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তিকে কোন কারণ না দেখিয়ে অনির্দিষ্টিকালের জন্য আটক রাখা, যে কোন সংবাদপত্রকে যে কোন সময় বন্ধ করে দেয়া এবং ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহের উপর যে কোন প্রকার হামলার তীব্র নিন্দা করা হচ্ছে। সভা বিশেষ ক্ষমতা আইনকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং বর্তমান সংবিধানের বিরোধী বলে মনে করছে এবং তা বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
রক্ষীবাহিনী আইনের মাধ্যমে যে সমস্ত ক্ষমতা রক্ষীবাহিনীর হাতে অর্পন করা হয়েছে সে ক্ষমতাগুলি এতকাল পুলিশের হাতেই একান্তভাবে ন্যস্ত ছিল। যে ক্ষমতা পুলিশের হাতে এতকাল ন্যস্ত ছিল এবং এখনও ন্যস্ত আছে সে একই ক্ষমতা আবার একটি নতুন বাহিনীর হাতে আইনের মাধ্যমে নতুন করে অর্পন করার উদ্দেশ্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রচেষ্টা নয় বরং নানা ক্ষেত্রে যারা সরকারি নীতির সমালোচনা ও বিরোধিতা করবে তাদের ব্যক্তিগত অধিকার হরণ এবং তাদের উপর রাজনৈতিক নির্যাতন পরিচালনা করাই হল এর প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে সংবাদপত্রে বহু বিবরণ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। কমিটি রক্ষীবাহিনীর এই নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করছে এবং রক্ষীবাহিনী আইন বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
সভা বর্তমান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য ব্যক্তিকে বিনা বিচারে এবং কোন কারণ না দেখিয়ে এ দেশের নাগরিকদের জেলে আটক রাখার নীতি ও কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করছে এবং বিনা বিচারে আটক সকল বন্দীর আশু মুক্তির দাবি জানাচ্ছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত হয়েছে। সংবাদপত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সরকার বিভিন্ন বিরোধী মতালম্বী সংবাদপত্রের ওপর নিয়মিত হামলা করে সংবাদপত্র সম্পাদক ও কর্মীদের উপর রাজনৈতিক নির্যাতন চালাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে প্রচলিত সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহ নিজেরাই খর্ব ও হরণ করেছে। দৈনিক গণকন্ঠের ওপর সাম্প্রতিক হামলা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই সভা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির কার্যকরী সংসদের সদস্য গণকণ্ঠ সম্পাদক জনাব আল মাহমুদসহ অন্যান্য আটক বা গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রাপ্ত সংবাদপত্র কর্মীদের মুক্তি ও তাদের বিরুদ্ধে জারিকৃত পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। পরবর্তিতে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি সরকারের বিরুদ্ধে বহু হামলা পরিচালনা করে। এসবের মধ্যে জাসদ নেতা শাহজাহান সিরাজের মামলাও ছিল। বহুক্ষেত্রে কমিটি সাফল্য লাভ করে।
দেশে মানবিক ও মৌলিক অধিকার যখন পর্যদুস্ত, বর্বর রক্ষীবাহিনীর মধ্যযুগীয় অত্যাচারে যখন কম্যুনিষ্ট পার্টির অকৃত্রিম দোসর মোজাফফর ন্যাপও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিবৃতি দিয়ে, তখন একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই নির্যাতনে মদদ দানের উদ্দেশ্যে গৃহিত এই প্রস্তাব যে কতটা ঘৃণ্য তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
এদিকে সরকারের নির্দেশে সেনা বাহিনী সারাদেশে ব্যাপক অস্ত্র তল্লাশী ও চোরাচালান বিরোধী অভিযান পরিচলানা শুরু করে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার করতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে মে মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এ মাসেই সেনা বাহিনীর অভিযানের ফলে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যা মমতাজ বেগমের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মওজুদ করা প্রচুর পরিমাণে রিলিফের সামগ্রী ও গুড়া দুধ তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। সেনা বাহিনী ও জনমতের চাপে মমতাজ বেগমকে সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য আবার তার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আওয়ামী লীগের দু’সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে পরে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে বাকশালে তার নাম অর্ন্তভুক্ত হওয়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তার বাড়িতে বেআইনী অস্ত্রশস্ত্র আওয়ামী শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জ্ঞাতসারেই মওজুত করা হয়েছিল। সেনা বাহিনীর অভিযানে যখন ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরা নেতৃবৃন্দের স্বরূপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল ঠিক তখনই ১৪ই মে মাওলানা ভাসানী সরকারের দুরভিসন্ধি প্রকাশ করে বলেন, “যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে।” এর কয়েকদিন পর আওয়ামী লীগ সরকার সত্যিই যৌথ অভিযান বন্ধ করে দেয়। এতে জনগণ ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে দেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির অস্বাভাবিক অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় টাউট, মজুদদার, মুনাফাখোর আর অস্ত্রধারীরা তাদের কুকর্ম অবাধে চালিয়ে যেতে থাকে। সারাদেশে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ২৯শে জুন মাওলানা ভাসানী জনসভার চেষ্টা করলে তাকে গৃহবন্দী করে সন্তোষে আটক করে রাখা হয়। একই সাথে অলি আহাদ ও মশিউর রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও সেদিন গ্রেফতার করা হয়। তখন সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছিল। ঐ বাজেটে পোচকার্ড, চা, চিনি, সিমেন্ট, ঢেউটিন, রং, রেডিও, টিভির দাম বৃদ্ধি করা হয় এবং রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়। সংসদের এই অধিবেশনেই ২রা জুলাই ‘৭৪ আতাউর রহমান খান অভিযোগ করেন, “দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ সংকুচিত।” তিনি আরো বলেন, “ভোটের পর এমপিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নয়; বটগাছ হয়েছে।” তিনি প্রশ্ন করেন, “তিন হাজার কোটি টাকার বিদেশী সাহায্য গেল কোথায়?” সরকারি হিসাব মতে যুদ্ধে নাকি দেশের এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
২রা জুলাই মাওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ রাখার প্রশ্নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী বলেন, “ভাসানী নিরাপত্তার জন্য পুলিশ চেয়েছিল। দেশের যে কোন সাংবাদিক সন্তোষে গিয়ে ভাসানীর অবস্থা দেখে আসতে পারেন যে তিনি গৃহবন্দী নন।” তার পরদিনই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা ২রা জুলাই মাওলানা ভাসানীর স্বহস্তে লেখা একটি চিঠি ছাপে। ঐ চিঠিতে মাওলানা শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন, “২৯শে জুন আমার ঐক্য ফ্রন্ট কর্মীদের ওপর রমনা থানার পুলিশ যে দুর্ব্যবহার এবং প্রহার করেছে তার তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দানের দাবি জানাচ্ছি। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দী এবং আমাদের ঐক্য ফ্রন্ট এবং ছাত্র, কর্মী ও নেতাদের আশু মুক্তি দানের দাবি জানাচ্ছি। ২৯শে জুন দিবাগত রাত আড়াইটার সময় জনাব মশিউর রহমানের বাড়িতে বহু পুলিশ ও উচ্চপদস্ত পুলিশ অফিসার ঢাকার এডিসির দস্ত খতযুক্ত ডিটেনশনের অর্ডার দেখিয়ে ৩০দিনের জন্য ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখার জন্য আমাকে গ্রেফতার করে। পরে সেন্ট্রাল জেলে না নিয়ে সন্তোষে কড়া পুলিশ পাহারায় আমাকে নজরবন্দী করে রাখে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, আইয়ূব শাহীর আমলে তোমার (শেখ মুজিব) বাসার নিকট ৮জন পুলিশ, ২জন হাবিলদার, ১জন সাব-ইন্সপেক্টরের পাহারায় তোমাকে ধানমন্ডিতে নজরবন্দী করে রেখেছিল। আজ তোমার আমলে সন্তোষে অসংখ্য পুলিশ, হাবিলদার, এসআই, আরআই, একজন ডেপুটি সুপার দ্বারা আমার বাসার চারদিক ঘিরে রেখেছ, এমনকি পায়খানা- পেশাবখানাও বাদ পরেনাই। আমার গরু ঘরেও পুলিশ আছে। সরকারের কোন ঘরের ব্যবস্থা নাই। আমার মেহমানখানা ও ছেলে-মেয়ে থাকার ঘরেও পুলিশ পাহারা আছে। একজন ডিআইবি ওয়াচার আমার ঘরের দরজার সামনে (আমার বিবাহিতা মেয়ের জন্য এই ঘর) সর্বদা পাহারায় থাকে। বাইরে ভিতরে বাসার লোকজন ডেপুটি সুপারের পারমিশন নিয়ে যাতায়াত করে। তোমার (শেখ মুজিব) আমলে আমি অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করব এটা কল্পনাও করিনি। অদৃষ্টের পরিহাস। তাই তুমি যত শীঘ্র পার অনুগ্রহ করে আমার বাড়ির মেয়েদের পর্দাপুষিদা রক্ষার জন্য নিজস্ব ঘর কিংবা তাম্বুর ব্যবস্থা করে পুলিশ ও অফিসারদের রাখার ব্যবস্থা করবা। অথবা টাঙ্গাইল বা অন্য কোন স্থানে আমার পরিবারবর্গসহ থাকার স্থান পরিবর্তন করার ব্যবস্থা অতিসত্ত্বর করবা।”
এই চিঠি যে দিন প্রকাশিত হয়, সেদিনই ইত্তেফাকসহ কয়েকটি পত্রিকার প্রতিনিধি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথামত মাওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার নিতে সন্তোষ যান। তখন ভাসানীর বাড়িতে পাহারারত এক পুলিশ অফিসার একজন ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেলেন। তাদের সঙ্গে মাওলানাকে সাক্ষাত করতে দিতেও অস্বীকার করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। মাওলানা ভাসানী প্রতিনিধিগণকে কি অবস্থায় তিনি আছেন তা দেখে যেতে বলেন। ৪ঠা জুলাই সে খবর পত্রিকায় ছাপা হয়। ২০শে জুলাই সাংবাদিকরা আবার মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তাদের জানান যে, মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাংবাদিকদের ও রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাতের অনুমতি নেই।
আগষ্ট মাসে দেশে বন্যা শুরু হয়। আসে বিস্তর রিলিফ। রিলিফ নিয়ে লুটপাটের কাহিনী পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের সংবাদপত্রসমূহে। অবাধ লুটপাট চলে বাঁশ, টিন, খাদ্যসামগ্রী, রিলিফের ঔষধপত্র এবং কম্বল নিয়ে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ছাপা হয় ক্ষুধাতুর মানুষের ছবি। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথা গোজাঁর ঠাই নেই। কোটি কোটি লোক হয় ক্ষতিগ্রস্থ ও বাস্তুহারা। ৩রা আগষ্ট ইত্তেফাকে ছাপা হয় এসব ছবি। দৈনিক বাংলায় খবর বের হয়, বমি খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ রেডক্রস সম্পর্কে প্রকাশিত হয় চুরি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অসংখ্য অভিযোগ। গ্রামে-গঞ্জে রেডক্রস প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফার নামে ছড়া বের হয়। আতাউর রহমান খান রেডক্রসের অসাধু তৎপরতার প্রতিবাদ করেন। দুর্নীতির অভিযোগ করেন। ১০ই আগষ্টের ইত্তেফাকে সে বিবৃতি ছাপা হয়। ১৩ তারিখ সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যায় যে, সারাদেশের মানুষ কচু-ঘেচু খেয়ে জীবনধারণ করছে। আতাউর রহমান খান অভিযোগ করেন যে, বিরোধী দলীয় সদস্যদের ত্রান সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করছে। জনাব খান ১১ই আগষ্ট কাগজে বিবৃতি দেন যে, দুনিয়ায় এমন কোন নজির নেই যে রেডক্রস সমিতির চেয়ারম্যান কোন দলীয় লোক হয়। তিনি একজন বিচারপতি অথবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে এ সমিতির দায়িত্ব দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
গ্রাম থেকে, উপদ্রুত এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে আসতে থাকে। ঢাকা শহরে ১৩৫টি রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১২ আগষ্ট যাত্রাবাড়ির রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণকারীরা বলেন যে, তিনদিনে তাদের জন্য একমুঠো খাবারও বরাদ্দ করা হয়নি। ১৬ই আগষ্ট আইসিআরসির সদস্য মিঃ এলভিন কাজ পরিদর্শনের জন্য আদমজী রিলিফ ক্যাম্পে গেলে লোকেরা কমিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চুরি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করে। এলভিন চলে এলে কমিটির চেয়ারম্যান তার গুন্ডা বাহিনী দ্বারা অভিযোগকারীদের উপর হামলা চালায়। এতে ছুরিকাহত দুই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খাওয়ার অনুপযুক্ত পচা বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। তা থেকে ক্যাম্পগুলোতে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয়। মরতে থাকে মানুষ।
মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। সে সময়কার পত্রিকার পাতা উল্টালে গা শিউরে উঠে। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ কেড়ে নেয় লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। হাজার হাজার চাষী যারা একদা কষে ধরতো লাঙ্গল, মাঠ ভরে তুলত সবুজ শস্যের সমারোহে, তারা ভিক্ষার জন্য শহরের মানুষের কাছে হাত পাতে। ফিরে যায় ভিক্ষা না পেয়ে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন ঢাকা শহর থেকেই তিরিশ থেকে চল্লিশটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছিল। সে কাহিনী ও ছবি আছে সেই সময়কার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পাতায় পাতায়। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় ৩-৪ জন লোক মারা যেতে থাকে অনাহারে। এর এক পর্যায়ে আঞ্জুমানের লাশ দাফনের কথা খবরের কাগজে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি আদেশে। আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর মাস অব্দি প্রতিটি জেলা থেকে খবর আসতে থাকে যে, শত শত লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে। ভাত নেই, কাপড় নেই, বাসস্থান নেই। ১০ই সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক ছবি ছাপে- মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে গ্রামের কোন কুল বধু। চট পরে ভিক্ষার আশায় সন্তান কোলে ঘুরে ফিরছে অসহায় জননী। গৃহবধুরা ক্ষুধার জালায় হচ্ছে প্রমোদবালা। রিলিফের কেলেঙ্কারীর খবর ছাপা হচ্ছিল খবরের কাগজে। কিন্তু অপরাধী ব্যক্তিদের একজনেরও বিচার হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি কখনো। কেন হয়নি সে খবরও সংবাদপত্রের পাতায় আসেনি। উত্তরাঞ্চলে পানির দামে বিক্রি হতে থাকে জমি। অসংখ্য সম্ভ্রান্ত কৃষক চাষাভিক্ষুকে পরিণত হন। সে সময়ের ২২শে সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররমে দুই শতাধিক উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ নারী পুরুষ অন্নবস্ত্রের দাবিতে মিছিল করে। গ্রাম থেকে আসা অসহায় মানুষের আর্তনাদ একটুও কম্পিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগের শাসককূলের হৃদয়। আর সেই সময়েই শেখ মুজিবের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৫৫ পাউন্ড ওজনের কেক কাটেন শেখ মুজিব নিজেই।
২৩শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে ৪৩০০ লঙ্গরখানা খোলার কথা ঘোষণা করা হয়। সে সমস্ত লঙ্গরখানার ইতিহাস আর এক করুণ কেলেঙ্কারীর ইতিহাস। নওগাঁর আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ২৪শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি দিয়ে জানান যে, সারা জেলার মানুষ গত ৩-৪ দিন ধরে না খেয়ে আছে। চালের সের সাত টাকা। তার ক’দিন পরেই ৬ই অক্টেবর ইত্তেফাক খবর দেয় যে, ২১ লাখ টাকার বিদেশী মদ ও সিগারেট আমদানি করা হয়েছে সরকারি টাকায়।
ঐ দিনই খাদ্যমন্ত্রী বললেন, “তখন পর্যন্ত অনাহারে কতলোক মরেছে সরকারের তা জানা নেই। প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবর অতিরঞ্জিত।” তবে তিনি স্বীকার করেন চোরাচালান কিছুটা হয়েছে।
৮ই অক্টোবর অধ্যাপক আবুল ফজলসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ জন শিক্ষক এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির জীবনে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রতি এত অনাসক্তি, এত অবজ্ঞা, এত অদ্ভুত রকম ঔদাসীন্য কখনও দেখা গেছে বলে মনে হয় না। নিজের প্রতি আস্থাহীন জাতি যে কী রকম জড় পদার্থে পরিণত হতে পারে বর্তমান বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই একাত্মতা, ত্যাগের মহৎ শক্তির সেই প্রচন্ডতা পরবর্তিকালে সিদ্ধান্তহীনতায়, ভুল সিদ্ধান্তে, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় আর গুটিকতক লোকের লাগামহীন দুর্নীতির সয়লাবে সব ধুয়ে গেছে। দেশের নেতৃত্বের প্রতি এই জাতীয় দুর্দিনে আমাদের আকুল প্রার্থনা, জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিতে আস্থাবান হওয়ার পরিবেশ ফিরিয়ে দিন।”
৮ই অক্টোবর ১৯৭৪ শ্রমিক লীগের আব্দুল মান্নান এমপি জানান, “লবনের দুঃষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল প্রকার খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, মজুতদার উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ২টাকা মন দরে লবন কিনে থাকে। সরকারিভাবে মজুতদারদের জন্য অশোধিত লবনের দাম ১৫ টাকা আর শোধিত লবনের দাম ৫৫ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “অশোধিত লবনের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবন পাওয়া যাবে। প্রকাশ, এ ব্যাপারে নাকি আমাদের দলীয় কোন কোন সংসদ সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।”
১৩ই অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায় যে, প্রতিদিন গড়ে ৮৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হচ্ছে। ২৭শে অক্টোবর খবর আসে জামালপুরে প্রতিদিন অনাহারে শতাধিক লোক মারা যাচ্ছে। সরকার এই মৃত্যুকে পুষ্টিহীনতা বলে অভিহিত করে। অনাহারে মানুষ মরছে সরকার সেটা অস্বীকার করে। ২৫শে অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্রে বের হয় ট্রাক বোঝাই ধানচাল ভারতে পাচার হচ্ছে। দিনাজপুরে চালের সের ৮ টাকা। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানিকগঞ্জের এক পরিবারের ৭জন আত্মহত্যা করেছে। এসময়ে ২৫শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব কামরুজ্জামান দাবি করেন, “দেশের প্রচলিত আইনে চোরাচালানীদের দমন করা হচ্ছে না। কয়েক মাস আগে সংসদে চোরাচালানীদের গুলি করে হত্যা করার বিধান পাশ হয়। কিন্তু কাউকে কোন দিন ঐ বিধানে হত্যা করা হয়নি।” একই সঙ্গে কামরুজ্জামান অবশ্য বলেন, “দলের ভেতর থেকে দলের সমালোচনা চলবে না।” তখন থেকে আওয়ামী লীগের ভেতরেও কোন্দল দানা বেঁধে উঠে। সেই ক্রান্তিলগ্নে ২৬শে অক্টোবর ‘৭৪ স্বাধীনতা সংগ্রামকালের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে মন্ত্রীত্ব হারান। জনাব তাজুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না।” ঢাকার এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মতে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদের যে ইমেজ গড়ে উঠে তা পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবর রহমান সহ্য করতে পারছিলেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবের চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নকে বড় করে দেখার জন্য বেগম মুজিবও তাজুদ্দিনকে সহ্য করতে পারতেন না বলে জানা যায়। তাজুদ্দিন সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে চলে যায়। তাজুদ্দিন আহমদ বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটি থেকেও পরবর্তিতে বাদ পড়েন।
২৯শে অক্টোবর সারাদেশে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই দিন মজুতদারী আর কালোবাজারের দায়ে আওয়ামী লীগের আর একজন সংসদ সদস্য গ্রেফতার হন। ৩০ তারিখে লবন মজুতের জন্য আওয়ামী লীগের এমপি ডঃ শামসুদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।
এ অবস্থায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির উদ্যোগে ১লা নভেম্বর ১৯৭৪ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে শিক্ষক, আইনজীবি, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চিত্রশিল্পী ও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান মন্বন্তর প্রতিরোধের জন্য আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে এক বিরাট সমাবেশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবিদের এত বিরাট সমাবেশ ইতিপূর্বে আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির’ সভাপতি সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দুই ঘন্টার উপর এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এডভোকেট মির্জা গোলাম হাফিজ, ডঃ আহমদ শরীফ, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েত উল্লাহ খান, কামরুন্নাহার লাইলী, নিজামুদ্দিন আহমদ, মহিউদ্দিন আলমগীর, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির মুহাম্মদ জাকারিয়া এবং বদরুদ্দিন উমর। সমাবেশে বিদ্যমান মন্বন্তর পরিস্থিতি ও মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ১৭টি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সমাবেশের পর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে একটি মিছিল বের হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায় এবং সেখানেই সমাবেশের কর্মসূচী শেষ হয়। সমাবেশে গৃহিত প্রস্তাববলীর বিবরণ:-
১৯৭৪ সালের ১লা নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মন্বন্তরের গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতাকেও অতিক্রম করেছে এবং এই মম্বন্তর, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্টি হয়নি বরং শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগীদের গণবিরোধী নীতি ও কর্মকান্ডেরই প্রত্যক্ষ পরিণতি। সমাবেশের প্রস্তাবে এই মন্বন্তরকে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা’ বলে বর্ণনা না করে একে মন্বন্তর বলে ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে বৈদেশিক সাহায্যের একটি শ্বেতপত্র ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের প্রস্তাবে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনে সরকারের বিরোধিতার নিন্দা করে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করার দাবি জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহের প্রতি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও রেশনিং এলাকা সম্প্রসারন ও টেষ্ট রিলিফ চালু করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশের প্রস্তাবে লঙ্গরখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। মন্বন্তর প্রতিরোধ আন্দোলন সমাবেশে রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়। রাজনৈতিক নির্যাতন বন্ধ ও মিথ্যা মামলায় আটক ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি জানানো হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর থেকে এদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সাল থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত যতগুলো সরকার এসেছে তাদের প্রত্যেকের প্রতিশ্রুতি ছিল মানুষ মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তারা নিশ্চিত করবে। কিন্তু প্রায় সব সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য জারি করেছে নতুন কালা-কানুন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল কুশাসন, কালা-কানুন, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীর প্রতিবাদ। স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগ। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের মানুষ আশা করেছিল এবার সত্যিকারের মুক্তি আসবে সর্বোপরিসরে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়েই আওয়ামী লীগ সরকার যার উপর হামলা চালায় সেও সংবাদপত্রই। আইয়ূব শাহীর কুখ্যাত ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিনেন্সের বদলে আওয়ামী লীগ জারি করল প্রিন্টিং প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’, যা আইয়ূব শাহীর কালা-কানুন অপেক্ষাও ছিল ঘৃণ্য ও বর্বর। তাছাড়া বিরোধী সংবাদপত্র অফিসে পুলিশী হামলা ছিল মুজিব আমলের নিয়মিত ঘটনা।
আওয়ামী লীগের জনাব মনসুর আলী ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারী পাবনায় ঘোষণা করেছিলেন, “সরকার সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।” ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করার পরও তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ বলেছিলেন, “সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়।” আবার ১৯৭৫ সালের জুনে সকল সংবাদপত্র বন্ধ ঘোষণার পর বাকশালের তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী বলেছিলেন, “নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই সংবাদপত্র প্রকাশনা বাতিল করা হয়েছে। আর কোন সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না।” এভাবেই যাত্রার শুরু ও শেষ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ‘সোনার হরিণ’ কোনদিন ধরা দেয়নি। বাক স্বাধীনতা ও ‘সোনার হরিণ’ হয়েই থাকে জনগণের কাছে।
তৎকালীন আওয়ামী মন্ত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা। ‘৭২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “শুধু প্রশংসা নয়; সরকারের ভুলত্রুটিও তুলে ধরুন।” ৫ই মার্চ তৎকালীন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “সরকার সংবাদপত্রের উপর বিধি-নিষেধ আরোপের চেষ্টা করলে ছাত্রসমাজই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে।” আর ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ’ করে যখন ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ পাস করা হয় সেই অধিবেশনে নূরে আলম সিদ্দিকীসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকামী মন্ত্রী, নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা ও এমপিরা উপস্থিত ছিলেন কিন্তু কেউই এর প্রতিবাদ করেননি ১৯৭৩ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর যখন গণবিরোধী ও মৌলিক অধিকার বিরোধী প্রিন্টিং প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ পাস হয় তখন তার পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন তথাকথিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকামীরা। তখন তাদের আর আন্দোলন করার কথা মনে থাকেনি। ১৯৭২ সালের ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সমাজসেবা সম্পাদক জনাব একেএম ওবায়েদুর রহমান বলেছিলেন, “সংবাদপত্রের সমালোচনা গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ এবং গণতন্ত্রের সুষ্ঠ বিকাশের জন্য এর ভূমিকা অপরিসীম।” ১৫ই এপ্রিল ‘৭২ তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, “সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” ৪ঠা মে সংসদের তৎকালীন স্পীকার মাহমুদ উল্লাহ বলেন, “দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সরকারের পক্ষেই যাক আর বিপক্ষেই যাক সাংবাদিকদের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই হবে।” কিন্তু ২২শে মে আসে একটি সংবাদ- “গণপরিষদ সদস্যের সাথে বচসার কারণে সাতক্ষীরায় একজন সাংবাদিক গ্রেফতার।” ২৯শে মে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, “আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করে আসছি যে, গণশক্তি (সাম্যবাদী দলের জনাব তোয়াহা সম্পাদিত) নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এখনও পূর্ব বাংলা নাম ব্যবহার করছে। তাছাড়া হক কথা, চরমপত্র ও হলিডে নামক অপর তিনটি পত্রিকাও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করছে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে। তারা বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করছে এবং এখন দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই সমস্ত পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলী কি এত সহজেই ভুলে গেছেন যে গত বছর এই সময়ে উক্ত বন্ধুরাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কী বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন? আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র চার মাসের মধ্যে কী করে এই কতিপয় পত্রিকা এত অকৃতজ্ঞ হতে পারে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিষ্ঠিত সরকারের দেয়া গণতন্ত্রের জন্যই কি তারা এই স্পর্ধা পাচ্ছে? আমি তাদের সাবধান করে দিতে চাই গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে এভাবে গণবিরোধী ও বিদেশী চক্রান্ত সহ্য করা হবে না। কারণ এই জঘণ্য ষড়যন্ত্র আমাদের প্রতিও বন্ধুরাষ্ট্র সমূহের প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ : আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে এই সমস্ত পত্রিকার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি। সরকার যদি এর আশু ব্যবস্থা না করেন তবে জনগণই ঐ পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” তার এই হুমকি পরে হয়রানিতে রূপান্তরিত হয়। সেই প্রেক্ষিতে ২০শে জুন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির কাছে বাস্তবধর্মী সত্য তুলে ধরতে সাংবাদিকরা কারো হস্তক্ষেপ বা হুমকির কাছে মাথা নোয়াবে না।” তারা বিবৃতিতে আরো বলেন, “এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে বিভিন্ন মহল সংবাদ প্রকাশের জন্য হুমকির আশ্রয় নিচ্ছে। বিগত দিনে এ ধরণের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক ইউনিয়ন হুমকি প্রদানকারীদের সংবাদ ছাপাতে অস্বীকার করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের প্রচেষ্টা যাতে না করা হয় তার জন্য ইউনিয়ন সকল মহলের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছে।”
সরকার এসবে কর্ণপাত করার কোন প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি। ‘৭২ সালের ২১শে জুন হক কথার সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ই জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় শেখ মুজিবর রহমান এরপরও প্রতিশ্রুতি দেন, “সরকার কোনদিনই সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না।” একই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “তথাকথিত প্রগতিবাদীরা সরকারের সমালোচনা শুরু করেছে। এদের সমালোচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত হানছে। এ ধরণের ফ্রি-ষ্টাইল কোন সরকার সহ্য করবে না।” তারপর আগষ্ট মাসে দৈনিক বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট কোরবান আলী বলেন, “সংবাদপত্রকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে না।” এরপর ৬ই সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির জারিকৃত বিশেষ ক্ষমতা আইনে সাপ্তাহিক মুখপাত্র ও স্পোকসম্যান সম্পাদক ফয়জুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের দেশবাংলা অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হুমকি ও চাপের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। ৬ই অক্টোবর এই প্রেক্ষিতে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে দাবি জানান, “আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন পত্রিকা বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করে দেয়া পত্রিকাগুলোকে আদালতে মামলা করতে দেয়ার অধিকার দিতে হবে। অবিলম্বে ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ বাতিল করতে হবে।” সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি, হয়রানির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার ‘৭২ সালের অক্টোবরে এক আদেশ জারি করে। ঐ নির্দেশে বলা হয়, “সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেতার, টিভি ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের চিন্তা ও মতামত প্রকাশের পূর্বে সরকারি অনুমোদন নিতে হবে। পূর্বানুমতি ছাড়া তারা তাদের বক্তব্য কিংবা প্রতিবেদন কোথাও ছাপাতে পারবেন না।
এই হিসাবে ঐ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লেখাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ২৬শে অক্টোবর ডঃ আহমদ শরীফসহ ৫জন বুদ্ধিজীবি এই সরকারি নির্দেশের প্রতিবাদ করেন। দেশে প্রণীত সংবিধানে কিন্তু প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিনেন্সের কোন হেরফের না করে সেটাকে তেমন ভাবেই বহাল রাখা হয়েছিল। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাশিম সংবিধান সম্পর্কে বলেন, “এতে বাক-স্বাধীনতা অস্বীকৃত হয়েছে এবং দেশ আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”
১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে ইউএসআইএস অফিসের সামনে পুলিশ দুইজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। দৈনিক বাংলা সেদিন বিকেলে একটি টেলিগ্রাম বের করে। এর জন্য দৈনিক বাংলার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান এবং সম্পাদক আব্দুল তোয়াব খান চাকুরিচ্যুত হন। দৈনিক বাংলার সাংবাদিক, শ্রমিক এবং কর্মচারীরা ৪ঠা জানুয়ারী শেখ মুজিবের কাছে ঐ দু’জন সাংবাদিককে পুনর্বহালের দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমান ২রা জানুয়ারীর পত্রিকাটি স্বহস্তে তুলে নিয়ে বলেন, “আমার কাগজে এসব কি লিখছো? তোমাদের যদি কোন নীতি থাকে প্রেসক্লাবে ফলাইও, নিজের ড্রইংরুমে ফলাইও। আমার কাগজে এসব চলবে না।” ঐ দিন জাতি জানতে পারলো সরকার নিয়ন্ত্রিত সবগুলো কাগজের মালিক হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে। পরিহাস। এর মাত্র ৯ দিন আগে ২২শে ডিসেম্বর ‘৭২ তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী ঘোষণা করেছিলেন, “সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতায় সরকার বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করবেন না। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন।” অনেক চেষ্টা করেও ঐ দু’জন চাকুরিচ্যুত সাংবাদিককে আর দৈনিক বাংলায় পুননিয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
৫ই জানুয়ারী ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহীদুল ইসলাম পল্টন ময়দানে বলেন, “দৈনিক বাংলা পত্রিকা থেকে দু’জন পাকিস্তানী দালালকে অপসারণ করা হয়েছে।” তিনি অভিযোগ তোলেন, “অন্যান্য পত্রিকাতেও পাকিস্তানী দালাল রয়েছে।” তিনি বলেন, “১৫ই মার্চ থেকে ছাত্রলীগ এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে।” শহীদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নামের আগে ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ না লিখলে পত্রিকার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।” এরপরও জনাব এম আর সিদ্দিকী ও শেখ আব্দুল আজিজ বলতে থাকেন, “সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর।” এ ধরণের বিপরীতধর্মী বক্তব্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকে শোনা যেতে থাকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে দলের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও সংবাদপত্রের উপর আওয়ামী সরকারের হামলা বিভিন্ন কৌশলে চলতে থাকে। জাসদের দৈনিক মুখপত্র গণকণ্ঠ পত্রিকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রেস জনতা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজেস থেকে প্রকাশিত হত। ২৯শে মার্চ ঐ সংস্থায় সরকার একজন নতুন প্রশাসক নিয়োগ করেন। নতুন প্রশাসক নিয়োজিত হওয়ার পরই ঐ পত্রিকার সাংবাদিকসহ সকল কর্মীদের ওখান থেকে বের করে দেন। ৩১শে মার্চ গণকন্ঠের সাংবাদিক ও কর্মীদের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিবাদ সভা এবং প্রতীক ধর্মঘট করে। ১৩ই মে দৈনিক স্বদেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮ই জুন প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স বলে সরকার নয়াযুগ সম্পাদককে গ্রেফতার করে। ইতিমধ্যে হক কথা, মুখপত্র, স্পোকসম্যান, লাল পতাকা, গণশক্তি প্রভৃতি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়।
‘৭৩ সালের ২৯শে জুন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন শিল্পমন্ত্রীর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কটূক্তির জবাবে বলেন, “সত্য বলা বিপদজনক হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা হুমকির মুখে সীমিত স্বাধীনতায় কাজ করছি।” ৫ই জুলাই সংসদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শেখ আজিজ আবারও বলেন, “দেশে সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।” এরপর ১২ই আগষ্ট সরকার বিনা নোটিশে চট্টগ্রামের দেশবাংলা পত্রিকাটি জোর করে বন্ধ করে দেন। ২৩শে নভেম্বর সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকাকে আদালতের ইনজাংশন উপেক্ষা করে বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশবাংলার সম্পাদককে রাষ্ট্রপতির ৪০নং আদেশ বলে গ্রেফতার করা হয়। এর একদিন পর ১৪ই আগষ্ট আওয়ামী লীগের তথ্যমন্ত্রী বলেন, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বর্তমান সরকারের ঈমানের অঙ্গ।” আওয়ামী লীগ সরকারের এ রকম নির্লজ্জ আচরনের নজির বৃটিশ অথবা পাকিস্তান আমলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশবাংলার বিরুদ্ধে গৃহিত ব্যবস্থার জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৭শে আগষ্ট বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্মল সেন বলেন,
‘চোরাচালানীদের জন্য গৃহিত রাষ্ট্রপতির ৫০নং ধারা বলে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা চলবে না।” ২৮শে আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার ‘প্রিন্টিং প্রেসেস এন্ড পাবলিকেশন (রেজিষ্ট্রেশন এন্ড ডিক্লারেশন) অর্ডিন্যান্স ৭৩’ নামে একটি গণবিরোধী কালা-কানুন জারি করে আগের ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্সের’ স্থলাভিষিক্ত করেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশনে ঐ অর্ডিন্যান্সটি পাশ করা হয়। এই অর্ডিন্যান্স এর উপর বক্তৃতাকালে স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল বলেন, “রাষ্ট্রবিরোধী কোন প্রকাশনা সহ্য করা হবে না।” তিনি বলেন, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ এ বিলের উদ্দেশ্য নয়। তবে অন্য সব দেশের মত সংবাদপত্রের যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ থাকা বাঞ্ছনীয়।” বিলের উপর আলোচনাকালে জাসদের আবদুল্লাহ সরকার বলেন, “এই বিল আইয়ূব আমলের কালা-কানুনের সমতুল্য। এর মাধ্যমে সরকারের গুনকীর্তন ছাড়া আর কিছুই সম্ভব না।” তিনি বলেন, “রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করলে জনগণই ঐ সংবাদপত্র প্রত্যাখান করবে। আইনের দরকার হবে না।” এর জবাবে মালেক উকিল বলেন, “কাউকে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা ও সৌজন্যতার পরিপন্থী আলোচনা বা সংবাদ প্রকাশ করতে দেয়া হবে না।” হলিডে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হলিডে সম্পাদক জনাব এনায়েত উল্লাহ খানকে তিনি জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে জনাব মালেক উকিল অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। সংসদে এ ধরণের অশালীন উক্তির নজির বিশ্বের কোন সভ্য দেশে নেই। মালেক উকিল মিথ্যে বলেন, “এই অর্ডিন্যান্স নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।” বিএফইউজ ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘৭৩ এক প্রতিবাদলিপিতে অস্বীকার করে বলেন, “এই অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে কোন সাংবাদিকের সাথে আলোচনা করা হয়নি। এছাড়া অবৈধ সন্তান কথাটি সংসদে, কোন ভদ্র সমাজে ব্যবহার করা হয় না। এটি সভ্য জগতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই উক্তি অশালীন, সভ্যতা বিবর্জিত এবং কদর্য।” এ প্রেক্ষিতে হলিডে সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান এক বিবৃতিতে বলেন, “হলিডে বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।” একই সময়ে সরকারের ভারত প্রীতি চরম আকার ধারণ করে। “ভারতের বিরুদ্ধে তথা বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাউকে কোন কথা বলতে দেয়া হবে না”-এ ধরণের হুমকি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও হবু মন্ত্রীরা উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন। তখন কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ভারতকে বাংলাদেশের মুক্তিদাতা বলে অভিহিত করে একটি নিবন্ধ লেখে। এতে ‘মাওলানার জেহাদী জিগির’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে মাওলানা ভাসানীর প্রতি অশালীন উক্তি করা হয়। ৫ই আগষ্ট ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বলেন, “ভারত বাংলাদেশের মুক্তিদাতা এ কথায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের প্রতিই কটাক্ষ করা হয়েছে।’ সারাদেশে এর স্বপক্ষে সমর্থন গর্জে উঠে। কিন্তু আওয়ামী নেতারা, মনি-মোজাফফর গংরা কেউই সেদিন ঐ উক্তির বিরোধিতা করে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। তবে কি এদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন কৃতিত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের আছে বলে আওয়ামী লীগ বা তার দোসররা বিশ্বাস করে না?
ইতিমধ্যে বার বার গণকন্ঠ পত্রিকার উপর হামলা চলে। হামলা হুমকি আসে অন্যান্য পত্রিকার উপরও। ‘৭৪ সালের ১৬ই জানুয়ারী এই প্রেক্ষিতে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেন, “বিভিন্ন মহলের নিকট হতে সাংবাদিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, ঘোষিত ও অঘোষিত নানারকম হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই বলেই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।”
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারীর ২ তারিখে সংসদের অধিবেশনে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ৭৪’ পাস করা হয়। ১০ই ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেন, “বিএফইউজ অতীব ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছে যে, অধুনা সমাপ্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’ পাস করে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নয়া বিধি-নিষেধ আরোপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে কুখ্যাত আইয়ূব প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স এর জঘণ্যতম ধারাগুলোও অব্যাহত রয়েছে। এই আইনে সংবাদ প্রকাশে বাধা আরোপ যে কোন সংবাদ প্রকাশের জন্য এমনকি এই আইন রচনার পূর্বে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য ও ছাপাখানার মুদ্রাকর, প্রকাশক, রিপোর্টার এবং সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এই আইনের শর্তানুযায়ী সরকার দৃশ্য, অদৃশ্য, সত্য বা মিথ্যা যে কোন সংবাদ আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী মনে করলে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। বিএফইউজ একদিকে আইয়ূবী কালা-কানুন বাতিল অপরদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের নামে কালা-কানুনটি আবার চাপিয়ে দেবার এই ব্যবস্থাকে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ বলে মনে করে এবং সরকারের এই দ্বিমুখী নীতির তীব্র নিন্দা করছে। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছে যে বিশেষ ক্ষমতা আইন পাসের মাত্র একদিন পূর্বে প্রেস কাউন্সিল গঠনের আইন পাস করা হয়। বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও প্রেস কাউন্সিল গঠনের আইন পরস্পর বিরোধী। বিশেষ ক্ষমতা আইনের খড়গ ঝুলিয়ে রেখে প্রেস কাউন্সিল গঠন আইনের কোন সার্থকতা নেই। বিএফইউজ তাই অবিলম্বে বিশেষ ক্ষমতা আইন তুলে নেবার আহ্বান জানাচ্ছে।
এরপর ‘৭৪ সালের ১৭ই মার্চ জাসদের জনসভাকে কেন্দ্র করে ঘটে আর একদফা হয়রানি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করতে গিয়ে বহু জাসদ কর্মী নিহত হয়। গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮ই মার্চ জিপিও-র বিপরীত দিকে কসকোর দোকানের উপর তলায় অবস্থিত জাসদ অফিস আওয়ামী গুন্ডারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদ ও অন্যান্য সাংবাদিক কর্মচারী গ্রেফতার হন। তারপর জুলাই মাসে মাওলানা ভাসানীর পত্রিকা প্রাচ্য বার্তার সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় চট্টগ্রামের ইষ্টার্ণ একজামিনার পত্রিকা। এরপর ১৬ই ডিসেম্বর ‘৭৪ সিরাজ সিকদার সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপার জন্য ঢাকার সাপ্তাহিক অভিমত পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকারি ব্যবস্থা নেয়া হয়। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয় এর সম্পাদক আলী আশরাফ এর বিরুদ্ধে। এই প্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের ৬, ৭ ও ৮ই জুলাই বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদের ৩দিন ব্যাপী অধিবেশন বসে। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদের তৎকালীন সভাপতি নির্মল সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ অধিবেশনে গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয় :
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বক্তব্য হচ্ছে, দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাংবাদিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে। সাংবাদিকদের রুটি- রুজির সংগ্রামে সমর্থন যুগিয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আইয়ূব আমলের কালা-কানুন ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের সংগ্রামে একাত্মতা জানিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকরা আশা করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হরণ করা হবে না, সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ হবে, ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ বাতিল হবে, সরকার কোন সিদ্ধান্তই একতরফাভাবে সাংবাদিকদের উপর চাপিয়ে দেবে না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে আইয়ূবের কালা-কানুনের আশ্রয় নিয়ে সরকার কতিপয় পত্রিকা বন্ধ করেছেন। সম্পাদকদের কারাবন্দী করেছেন। স্বাধীনতার দেড় বছরের মধ্যেও ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ বাতিল সম্পর্কে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। অথচ এই কালা-কানুন বাতিল করা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার। বিস্ময়ের হলেও সত্য যে, কোন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সরকার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে কোন বিষয়েই আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেননি। প্রত্যেকটি বিষয়ে এবং ক্ষেত্রে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ‘প্রেস এন্ড প্রিন্টিং প্রসেস এ্যাক্ট’ জারি করে এই এ্যাক্ট-এ আইয়ূব আমলের কালা-কানুনের বহু ধারাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জানুয়ারীতে সংসদে গৃহিত বিশেষ ক্ষমতা আইনে শুধুমাত্র আইয়ূব আমলের কালা-কানুন নয় ব্রিটিশ আমল থেকে আইয়ূব আমল পর্যন্ত সংবাদপত্র দমনের জন্য যত আইন প্রণীত হয়েছিল তার প্রতিটি ধারাও এ আইনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশবাসীর কাছে আমাদের প্রশ্ন- এ পরিস্থিতিতে’ সংবাদপত্রে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের অবকাশ কোথায়? দুঃখ শুধু এখানেই না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেশে সেনা বাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্তকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সমর্থন জানানো হল। অথচ সেনা বাহিনী নিয়োগের সাথে সাথে সাংবাদিকদের ডেকে বলা হল যে, সংশ্লিষ্ট মহলের অনুমতি ব্যাতিরেকে সেনা বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে কোন সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। আমাদের জিজ্ঞাসা- এই পরিস্থিতিতে সহযোগিতার অবকাশ কোথায়? বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের সুযোগ কোথায়? আলোচনা-সমালোচনায় সেনা বাহিনীর যে অভিযান সার্থক হতে পারত; একতরফা সরকারি প্রচারণার কবলে পড়ে সে অভিযান আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের পরিস্থিতি। এ প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারসহ দেশের সকল সরকার সমর্থক ও বিরোধী দলের প্রতি আমাদের আবেদন, আপনারা পরিস্থিতি অনুধাবন করুন। আপনাদের দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছেন।”
দেশবাসীর মৌলিক অধিকার প্রশ্নে জুলাই মাসে ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি’-র কার্যনিবাহী পরিষদ জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং এ বিষয়ে সরকারি নীতি লক্ষ্য করে এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সরকার বিরোধী মতামত ও সরকার বিরোধী ব্যক্তিদের দমন করার জন্য রক্ষীবাহিনীকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারা ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এর অস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে সজ্জিত করেছেন। বাহ্যতঃ সমাজ বিরোধী লোকদের মোকাবেলা করার জন্য প্রণীত এই আইন বস্তুত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন নির্যাতনের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এর স্কুল ও দারুন অপব্যবহার এবং গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বেপরোয়া রক্ষীবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে সরকার মূলতঃ ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সব ধরণের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং রক্ষীবাহিনী আইনের মধ্যেও তাদেরকে আদালতে উপস্থিত করার যে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে তা না করে তাদের উপর তারা হিংসাত্মক শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মীদের উপর অস্বাভাবিক নির্যাতন ও তাদের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির কাহিনী বিভিন্ন সংবাদপত্রে এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের মাধ্যমেও ফাঁস হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলীয় মতামতকে দমনের চেষ্টা করছেন শুধু তাদেরকে জেলে দিয়ে এবং নির্যাতন ও শারীরিকভাবে খতম করেই নয়; তারা এর জন্য ১৪৪ ধারাও দেশব্যাপী জারি করেছেন। বাহ্যতঃ এটা তারা করেছেন দুই মাস পূর্বে আরম্ভ করা তাদের তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সুবিধার জন্য। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হল এ দেশে বিরোধী মতামত প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে সংগঠিত হতে না দেওয়া। আর একটি বিষয়ে আমরা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। একমাত্র সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই মত প্রকাশে যারা ইচ্ছুক তাদেরকে তা প্রকাশ করার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে ভয়ানক রকম কড়াকড়ি করে এবং নিউজপ্রিন্টের কোটা দিতে অস্বীকার করে সরকার বর্তমানে বিরোধী দলীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোর প্রকাশনা ক্ষেত্রে নিদারুন অসুবিধার সৃষ্টি করেছেন। উপরে উল্লেখিত ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি কারাগারের অবস্থার উন্নতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের আশু মুক্তি দাবি করছে।
সংবাদপত্রের উপর এই ধরণের নির্যাতন চলাকালে সরকার ২৮শে জুলাই ‘৭৪ নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণাদেশ জারি করে সংবাদপত্রের উপর আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেন। দেশের সাংবাদিক ইউনিয়নসমূহ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ (মনি-মোজাফফর গং ছাড়া), সংবাদপত্র পরিষদ এই নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের দাবি জানান। কিন্তু কোন ফল হয়নি। নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আদেশ বলে সরকার এর সরবরাহ সীমিত করেন। বরাদ্দ কমিয়ে দেন এবং বই-পুস্তক এই কাগজে ছাপানো বন্ধ করে দেন। ফলে ১৯শে নভেম্বর ‘৭৪ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায় যে, নিউজপ্রিন্ট মিলে ৪৬ লাখ টাকার নিউজপ্রিন্ট অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। তারপর ‘৭৪ এর ২০শে নভেম্বর সংসদে ছাপাখানা ও প্রকাশনা বিলে এক নতুন ধারাও যুক্ত হয়। ঐ ধারায় বলা হয় যে, যদি কোন সংবাদপত্রে এমন কিছু প্রকাশ করা হয় যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনের শাসন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পরিপন্থী বা কোন অপরাধ সংগঠনে কোন ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে অথবা যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রীতির সম্পর্ক বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়, তা হলে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট উক্ত পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করতে পারবেন। বিলের উপর আলোচনাকালে বিরোধী সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার বলেন, “এই আইনের বলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়েছিল। দেশ হতে পাট পাচার, সার কারখানায় বিষ্ফোরন, বিদেশী ব্যাংকে মন্ত্রীদের অর্থ জমানোর খবর যাতে কেউ ছাপাতে না পারে তার জন্যই এই আইন।” বিরোধী সদস্যরা এর প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেন।
২৮শে ডিসেম্বর ‘৭৪ দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ২রা জানুয়ারী ‘৭৫ বিনা বিচারে গুলি করে ন্যাক্কারজনকভাবে হত্যা করা হয় রাজবন্দী সিরাজ সিকদারকে।
সরকারিভাবে বলা হয় যে, সিরাজ সিকদারকে আটক করার পর রাতে সাভার এলাকায় তার গুপ্ত ঘাঁটিতে অনুসন্ধান চালাতে পুলিশ তাকে সঙ্গে করে সাভারের দিকে যাচ্ছিল। পথে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। পলায়নরত ব্যক্তিকে গুলি করলে গুলি লাগার কথা পেছনে কিন্তু সিরাজ সিকদারের মৃতদেহে গুলির ক্ষত পাওয়া গিয়েছিল তার বুকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্ভেন্ট জহুরুল হক পালাতে গেলে তাকে গুলি করা হয় বলে আইয়ূব সরকার দাবি করেছিলেন। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।” সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর সেই শেখ মুজিবই পার্লামেন্টে দম্ভ করে অতি নির্লজ্জভাবে বললেন, “কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার?”
‘৭৫ এর ৩রা জানুয়ারী জারি করা হয় জরুরী ক্ষমতাবিধি। তাতে পুলিশকে যে কোন লোককে বিন। ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়। ২৪শে জানুয়ারী ‘৭৫ ঘোষণা করা হয় একদলীয় শাসন বাকশাল। তারপর ‘৭৫ সালের ১৬ই জুন জারি করা হয় সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল অধ্যাদেশ। সারাদেশে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে চালু রাখা হয়। গণতন্ত্রের কবরের উপর এভাবেই দেয়া হয় সিমেন্টের ঢাল ই। সারাদেশে নেমে আসে স্বৈরতন্ত্রের রুদ্ধশ্বাস অবস্থা।