দ্বিতীয় অধ্যায় – ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ও পরিণতি
- ভোটের আগে ভাতের দাবিতে মাওলানা ভাসানী নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালেন।
- দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল।
- পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস্ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
- সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার উদ্যোগ।
- আলোচনাকালে বিভিন্ন গোষ্ঠি এবং ব্যক্তির চক্রান্তমূলক কার্যক্রম।
- জাতীয় সংকটের একটা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাবার পথে বাঁধা হয়ে উঠে দুই অঞ্চলের দুই নেতা শেখ মুজিব এবং জেডএ ভূট্টোর উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতার মোহ ও অনমনীয়তা।
- স্বায়ত্ব শাসনের দাবি যুক্তিগত কারণেই স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়।
- অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিবেশে দেশের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার শেষ প্রচেষ্টা।
- সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব এবং রাজনীতিবিদদেরকেই এর জন্য দায়ী করেন।
- পাকিস্তানের ভাঙ্গন অনিবার্য ছিল না।
- অস্ত্রের জোরে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তান বিভক্তি অবধারিত করে তোলে।
১৯৭০ এর নভেম্বর/ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবর রহমানের ৩টি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় অত্যন্ত প্রীতিকর পরিবেশের মধ্যে। বৈঠকে মুক্তিব প্ৰতিজ্ঞা করেন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর সংসদে উত্থাপনের আগে তিনি সেটা প্রেসিডেন্টকে দেখাবেন তার সম্মতির জন্য। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন ৬ দফা পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার জন্য প্রণীত হয়নি। তিনি আরো বলেছিলেন, তার ৬ দফা এবং প্রেসিডেন্টের এলএফও-তে বর্ণিত ৫ নীতির উপর ভিত্তি করেই তিনি তৈরি করবেন দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট সন্তুষ্টচিত্তে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে যান। শেখ মুজিবের সাথে তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করার পর তার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মায় যে, সাধারণ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত সঠিক এবং একমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমেই পাকিস্তানের ঐক্য বজিয়ে রাখা সম্ভব।
নির্বাচনী প্রচারণার গতিধারা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এটাই পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, মুজিবের মত একচ্ছত্র আধিপত্য পশ্চিম পাকিস্তানের কোন নেতাই অর্জন করতে পারবেন না। তুলনামূলকভাবে জনাব ভুট্টোর জনপ্রিয়তা বেশি হলেও জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপ্রিয় দলগুলোও বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাছাড়া ওয়ালী খানের ন্যাপ (মস্কোপন্থী) উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে জনপ্রিয় দল হিসাবে প্রমাণিত হয়। জনাব ভুট্টোর ইন্ডিয়া বিরোধী প্রচারণা পাঞ্জাবে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তাছাড়া জনাব ভুট্টো জেনারেল পীরজাদার মাধ্যমে জান্তার জেনারেল ওমর, জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল হামিদ প্রমূখের সাথে নিয়মিত গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। জেনারেল শের আলী জামায়াতে ইসলামী দলের একজন পরোক্ষ সমর্থক ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণা যতই এগিয়ে চলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টোর জনপ্রিয়তা ততই বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পাঞ্জাবে ভারত বিরোধী বক্তব্য, তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান জনগণকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলাপের মাধ্যমে জাতীয় সমস্যার সমাধানের উদ্যোগকে জান্তার অনেক জেনারেলই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন যে আলোচনার মাধ্যমে সামরিক শাসনের দুর্বলতাই প্রকাশ করা হচ্ছিল। তাদের মতে শক্ত হাতে সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্ত ানের কতিপয় দেশদ্রোহী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে শায়েস্তা করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনা খুব একটা কষ্টকর ব্যাপার নয়। তারা মনে করতেন মুজিবসহ কিছু নেতাদের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে সঠিকভাবে অবগত করালে তারা বুঝতে পারবে যে, মুজিব ও তার সহকর্মীরা দেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে ভারতীয় সাহায্য নিয়ে। এর ফলে নিশ্চয়ই মুজিব জনসমর্থন হারাবেন। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করলেই পূর্ব পাকিস্তানের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাদের এ ধরণের চিন্তা-ভাবনায় জেনারেলদের পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন অবস্থার জটিলতা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাবই প্রকাশ পায়। গণতান্ত্রিক গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে গণভোটের মাধ্যমে অবাধ সাধারণ নির্বাচন করা তখন ছিল একান্তভাবে প্রয়োজন। পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বশীল সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের প্রচলন করার অঙ্গীকার নিয়ে। কায়েদে আযম জিন্নাহ্ পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করেছিলেন, “পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই গড়ে উঠবে।”
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানে গণভোটের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন করে কোন সরকার গঠিত হয়নি। সর্বপ্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন করা হয় বৃটিশ আমলে ১৯৪৬ সালে সীমিত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। এরপর ১৯৫১ এবং ১৯৫৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে প্রাদেশিক নির্বাচন করা হলেও কেন্দ্রিয় সরকার গঠন করা হয় প্রাদেশিক সংসদ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে। ১৯৫১ এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষভাবে সংগঠিত হয়নি। নির্বাচন দু’টি ছিল প্রহসন মাত্র। সরকারি দলের কারচুপি, প্রশাসন যন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভূয়া ভোট প্রদান, বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের অযথা হয়রানি এবং কিডন্যাপিং এমনকি প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে নির্বাচনের প্রাক্কালে কারাবন্দী করে সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জঘণ্য প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন দু’টো গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এ ধরণের অবস্থার মধ্যেও ১৯৫৪ সালে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর এবং সচেতন বাঙ্গালীরা সরকারি দল মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচনে জয়ী করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অচিরেই নির্বাচিত এ সরকারকে চক্রান্তের মাধ্যমে উৎখাত করে গণতন্ত্রের কবর দিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ক্ষমতায় আসীন হয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান বুনিয়াদি গণতন্ত্র নামে এক নতুন পন্থার উদ্ভাবন করে বেসিক ডেমোক্র্যাটদের পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় সরকার গঠন করেন। পরোক্ষ ভোটের যে নির্বাচন হয় তাতে জনগণের ইচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। ফলে আইয়ূব খানের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক সরকারকেও প্রতিনিধিত্বকারী সরকার বলে অভিহিত করা যায় না। আইয়ূব খানের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক সরকারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারনের জন্য জনাব জাষ্টিস ছাত্তারের অধিনে দুইজন হাইকোর্ট জর্জ নিয়ে একটি কমিটি বানানো হয়। দু’জন সদস্যের একজন ছিলেন পূর্ব এবং আর একজন ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ইলেকশান কমিশন কর্তৃক নতুন ভোটার লিষ্ট তৈরি করা এবং নির্বাচনী এলাকা নির্ধারন কমিটি কর্তৃক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারন করার পদক্ষেপ জাতীয় পরিসরে অভিনন্দিত হয়। নির্বাচনের জন্য প্রেসিডেন্ট এর প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলোতে জনগণ আনন্দিত হয়। সামরিক শাসন জারি করার পর সব দেশেই অবাধ রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক আইনের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার অধিকার রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছিলেন। অবশ্য মার্শাল’ল রেগুলেশন ৬০অনুযায়ী বর্ণিত নীতিগুলো মেনে নিয়েই রাজনৈতিক কর্মকান্ড করার অধিকার লাভ করে রাজনৈতিক দলগুলো। রেগুলেশন ৬০-এ বলা হয় যে কোন ব্যক্তি কিংবা দল হিংসাত্মক কোন কর্মকান্ড, আঞ্চলিক বিদ্বেষ কিংবা পাকিস্তানের আদর্শের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য রাখতে পারবে না। ধর্মের ব্যাপারেও কোন মন্তব্য রাখা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণায় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ রেগুলেশন ৬০-এর খেলাপ করেন। তারা সভা-সমাবেশে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী বক্তব্য রেখে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। তরুণ ছাত্র সমাজ এবং শ্রমিকরা জঙ্গীভাব ধারণ করে প্রতিপক্ষের সভা-সমাবেশ ভন্ডুল করে দিতে থাকে। তারা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মাধ্যমে লুট-পাট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করে। এ সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক জান্তার অনেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দুর্বল বলে অভিযুক্ত করেন। তাদের এই অভিযোগকে খন্ডাতে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে বলতে হয় তার ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনৈতিক সরকার কায়েমের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সৎ ইচ্ছাকে তার দুর্বলতা বলে কেউ মনে করলে সেটা ভুল হবে। তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে শেখ মুজিব এবং ভুট্টোকে অনুরোধ করেন যাতে তারা সহনশীলতার সাথে এবং শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে এটাই প্রমাণ করেন যে জাতি হিসেবে পাকিস্তানবাসীরা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রমনা এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত। কিন্ত তার এ আন্তরিক অনুরোধ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন নেতার উপরই তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিভিন্ন পার্টির কার্যকলাপই এর পক্ষে যুক্তি দেয়।
১৯৭০ এর নির্বাচনে সর্বমোট ২৪টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে অনেকগুলো দলই ছিল অতি ক্ষুদ্র এবং রাজনৈতিক তৎপরতা কিংবা সাংগঠনিক শক্তির দিক দিয়ে প্রায় অনুল্লেখযোগ্য। প্রতিটি পার্টিকে একটি করে নির্বাচন প্রতীক বরাদ্দ করা হয় ইলেকশান কমিশন থেকে।
অনুন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষিতের হার অত্যন্ত কম বিধায় লোকজন তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের নাম পড়তে পারেন না বলে প্রতিটি দলের জন্য নির্বাচন প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। ভোটাররা প্রতীক দেখেই নিজ পছন্দের দলকে ভোট দান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৩৮টি আসনের জন্য মোট ৮৪০ জন দলীয় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিযোগিতা করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনে দলীয় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মোট ৭৮১ জন প্রতিযোগিতা করেন।
পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ তখন তিন খন্ডে বিভক্ত। জামায়াতে ইসলামী এবং জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম দু’টি মুখ্য দক্ষিনপন্থী দলের জন্ম ইতিহাস শুরু হয় স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই। স্বাধীনতার পর সৃষ্ট আওয়ামী লীগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে পুরনো এবং সর্ববৃহৎ সংগঠন। অতি অল্প সময়ে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ভুট্টোর পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় : পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তান যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিশেষ বন্ধুরাষ্ট্র রূপে সম্পর্ক স্থাপন করে তখন থেকেই পাকিস্তানে কম্যুনিষ্ট পার্টিগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বি-খন্ডিত হয়ে যায়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় মস্কোপন্থী এবং পিকিংপন্থী হিসাবে। ১৯৪৭ সালের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অংশ বিশেষের নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস রাখা হয়। ৭০ দশকের পাকিস্তানের রাজনীতির দু’টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য :-
প্রথমত: জাতীয় পরিসরে পাকিস্তানের দুই অংশের কোন রাজনৈতিক দলেরই তেমন কোন প্রভাব ছিল না।
দ্বিতীয়ত: ব্যক্তি হিসাবে কোন রাজনৈতিক নেতারই জাতীয় পরিসরে পাকিস্তানের দুই অংশে কোন জনপ্রিয়তা ছিল না।
শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং দল হিসাবে গড়ে উঠে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টো ও তার পার্টি পিপিপি অন্যান্য দক্ষিনপন্থী দলগুলোকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং দল হিসেবে আবির্ভূত হয় ফলে নির্বাচনী প্রচারণার সাথে সাথে পাকিস্তানের দুই অংশে আঞ্চলিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াও বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতি হুমকি স্বরূপ এ ধরণের প্রক্রিয়ায় অনেকেই বিশেষভাবে শংকিত হয়ে পরে। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে যে দুইটি রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে জয়লাভ করে তারা প্রকৃত অর্থে আঞ্চলিক দল হিসাবেই বিজয়ী হয়: জাতীয় দল হিসাবে নয়। এখানে পাকিস্তানের শেষ অঙ্কের দুই নায়ক ও তাদের রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্ৰ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি:- শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনী প্রচারণা ছিল সম্পূর্ণভাবে ৬ দফা ভিত্তিক। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমান জনগণের ধর্মীয় চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “ইসলাম আমাদের ধর্ম। কোরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আইন দেশের শাসনতন্ত্রে সংযোজিত হতে দেবে না বলে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ।”
পরে অবশ্য এ বক্তব্যের মাধ্যমে দেয়া ওয়াদার তিনি বরখেলাফ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর মুজিব রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভূত চাপিয়ে দেন গোটা দেশবাসীর উপর। নির্বাচনী প্রচারণাকালে শেখ মুজিব পরিষ্কার করে জনসভায় বক্তৃতা করেন, “৬ দফা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য তৈরি হয়নি। পাকিস্তানের ফেডারেল গভার্নমেন্টকে কার্যকরী করার জন্যই ৬ দফা প্রণীত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে টিকে থাকার জন্য। কোন শক্তিই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একই শেখ মুজিব বলেন, ১৯৬৮ সাল থেকেই নাকি তিনি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি আরো বলেন, “১৯৪৮ সালেই সূত্রপাত ঘটে স্বাধীনতা আন্দোলনের। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ এর গণআন্দোলনে পরিপক্কতা লাভ করে স্বাধীনতার চেতনা। ফলে ১৯৭১ এ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ।”
মুজিব চরিত্রের দ্বৈততা পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ে উল্লেখিত বক্তব্যগুলো থেকে। নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ান আমার পবিত্র কর্তব্য।”
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে স্বয়ং তিনিই সরকার প্রধান হিসাবে জাতীয় নীতি হিসাবে সমাজতন্ত্রের জোয়াল তুলে দিলেন জাতির ঘাড়ে। যার কুফল আজও বয়ে চলেছে বাংলাদেশী জনগণ। শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রচারণা মূল বিষয়বস্তু ছিল পাকিস্তান বিরোধী বক্তব্য। দীর্ঘ দিনের পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির কুশাসন, বঞ্চনা ও শোষণের জাল থেকে বাঙ্গালী জাতিকে মুক্ত করে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি জনগণের কাছে ভোট দাবি করেন। এ সময়ে ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রী পরিষদের তথ্যমন্ত্রী জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা বোঝার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী এক সফরসূচী গ্রহণ করেন। সব জায়গায় সফরকালে তিনি স্থানীয় প্রশাসক, জনগণের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বুঝতে পারেন শেখ মুজিবের সোনার বাংলা কায়েমের আবেদন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে আওয়ামী লীগ সার্বিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে এ আবেদন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তারা শ্লোগান দিচ্ছে ‘জয়বাংলা’ : এ ধরণের প্রচারণা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে ভেবে জনাব চৌধুরি প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেন মুজিবকে ডেকে পরিষ্কারভাবে জিজ্ঞাসা করতে মুজিব তার ৬ দফার পরিবর্তন করে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখবেন কিনা? শেখ মুজিব যদি ৬ দফায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে অসম্মত হন তবে প্রেসিডেন্টের পক্ষে উচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে বাঙ্গালী মুসলমানদের অভিমত নেয়া। তারা কি পাকিস্তানের ঐক্য বজায়ে রেখে স্বায়ত্বশাসন চায়, নাকি স্বাধীনতা চায়? এ প্রসঙ্গে জনাব চৌধুরি প্রেসিডেন্টকে আলজেরীয় সংকটের মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট ডিগ্যলের সাহসী পদক্ষেপের কথাও স্মরন করিয়ে দেন। ইতিমধ্যে মাওলানা ভাসানী ঘুর্নিঝড়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ শ্লোগান তুলে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাড়িয়েছেন। মস্কোপন্থী ন্যাপের স্বঘোষিত ‘প্রফেসর’ মোজাফ্ফর আহমদের তেমন কোন জনসমর্থন তখন পূর্ব পাকিস্ত ানে ছিল না। অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো তখন শতভাগে বিভক্ত। তদপুরি জনাব আসানের আমলে প্রশাসন বামপন্থীদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জনাব আসানের বাম বিদ্বেষের কারণ ছিল SEATO এর সাথে তার ব্যক্তিগত দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। সামরিক জান্তার সদস্যদের রাজনৈতিক এবং আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাবেই জনাব আহ্সান কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধে এমন এক সময় অভিযান পরিচালনা করেছিলেন যখন গণচীন পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র রূপে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে আসানের মাওলানা ভাসানী বিদ্বেষ কিংবা কম্যুনিষ্ট বিদ্বেষ নীতি পাকিস্তান-চীন সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে। গভর্ণর আসানের অধিনে কম্যুনিষ্ট নিধনযজ্ঞে অনেক চীনপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে আত্মাহুতি দিতে হয়। ফলে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে জনাব ভুট্টো যখন পিকিং যান ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের সমর্থন লাভ করার আশায় তখন চীনা নেতৃবৃন্দ তাকে জানান পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য চীনপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তারা ৬০জন নেতার নামের একটি লিষ্টও জনাব ভুট্টোর কাছে পেশ করেন। এদিকে মস্কোপন্থী দলগুলো তখন পড়েছে এক মহাবিপাকে I তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলনা কাকে সমর্থন করলে তাদের সুবিধা হবে। এতদিন মস্কো পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপকেই সমর্থন যুগিয়ে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই মস্কো বেতার থেকে ১৬ই আগষ্ট ১৯৭০-এ এক ঘোষণায় বলা হল, “আওয়ামী লীগে লুকায়িত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির মুখোশ আজ খুলে গেছে। তারা আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে দেশকে দ্বি-খন্ডিত করার চক্রান্ত করছে। শেখ মুজিব এবং তার দল আজ পূর্ব পাকিস্তানে বাম এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।” ১৯৬৭ সালে মস্কোর মনোভাব আওয়ামী লীগের প্রতি ছিল বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতীয় প্রীতির ফলে মস্কো তার মনোভাবও পরিবর্তন করে। শেখ মুজিব সর্বদাই চীনের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন। পাকিস্তান-চীন বন্ধুত্বকে তিনি উস্কানিমূলক বলেই মনে করতেন। রাজনৈতিক দলগুলো তখন মুজিবের মোকাবেলা করতে অসমর্থ। আর্থিক এবং সাংগঠনিক দুর্বলতাই ছিল এর মূল কারণ। পূর্ব পাকিস্তানের শহুরে বুদ্ধিজীবি, ছাত্র সমাজ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আমলাদের বৃহৎ অংশ তখন শেখ মুজিবের পক্ষে। গণমাধ্যমগুলোও তখন ঝুঁকে পড়েছে শেখ মুজিবের প্রতি। সর্বোপরি গভর্ণর আহ্সান স্বয়ং তখন মুজিবের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল। মুজিবের প্রতি তার মনোভাব অনুকূল বুঝতে পেরে পুরো প্রশাসন তখন মুজিব ও তার দলের সাথে সহযোগিতা করে চলেছে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে মুজিব হয়ে উঠেন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নেতা আর তার দল হয়ে উঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন।
এবার আলোচনায় আসা যাক ভুট্টো ও তার নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের বিষয়ে :-
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলে সমগ্র জনগণকে মুজিব যেভাবে নিজের দলের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন ভুট্টোর পক্ষে তেমন একটি মাত্র শ্লোগানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সমগ্র জনগণকে তার দলের প্রতি আকৃষ্ট করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের রাজনৈতিক চাহিদা ছিল ভিন্ন। তাই ভুট্টোকে চার প্রদেশের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখেই ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন প্রকার প্রচারণার সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। তাই তাকে ভারত বিরোধী বক্তৃতা করতে হয়। বলতে হয় ‘ওয়ান ইউনিটের’ বিরুদ্ধে। একদিকে তাকে খুশি রাখতে হয় জমিদার শ্রেণীকে অপর দিকে তাকে বলতে হয় ভূমি সংস্কারের পক্ষে, ইসলামপন্থীদের খুশি করতে গিয়ে তাকে বলতে হয় ইসলামিক সমাজতন্ত্রের কথা। উপরন্ত্র জেনারেলদের মন যুগিয়ে চলতে গিয়েও তাকে অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়। তার মুখ্য শ্লোগান ছিল, “ইসলাম আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের নীতি, সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি।” তিনি আর্থসামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে ইসলামিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ভুট্টো কিন্তু মুজিবের ৬ দফা সম্পর্কে কোন বক্তব্যই তার প্রচারণায় বলেননি। এ ব্যাপারে তিনি আগা-গোড়াই কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবার ব্যাপারেও তার কোন গরজ পরিলক্ষিত হয়নি। এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে তার ক্ষমতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে তোলাই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের ঐক্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। যদিও পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার প্রশ্নটিই ছিল তখনকার মূল রাজনৈতিক সমস্যা। দক্ষিনপন্থী এবং মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা তুলনামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাল হলেও ভুট্টোর প্রগতিশীল চিন্তাধারার মোকাবেলায় তারা তাদের পুরোনো ধ্যান-ধারণা যেমন: ইসলামী আদর্শ, শক্তিশালী কেন্দ্রিয় সরকার প্রভৃতি শ্লোগান দিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হন। দীর্ঘ আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান বেড়ে গিয়েছিল। পুরনো কথায় কিংবা শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের মন যোগানো পুরনো নেতাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন জনাব ভুট্টো। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলে গিয়ে সেই অঞ্চলের জনগণের দাবি-দাওয়ার উপর ভিত্তি করে তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। বক্তা হিসাবে তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের সমতুল্য। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বিমোহিত করতে সক্ষম হয়। তার আবেদনে বিশেষ করে সাড়া দেয় ছাত্র ও তরুণ সমাজ।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি শেখ মুজিবের বিজয় সুনিশ্চিত বলে প্রচারণা করতে শুরু করে। শেখ মুজিব নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে জয়লাভ করবেন এ বিষয়ে সবাই তখন প্রায় একমত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রেসিডেন্ট জনসনের আমলে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে পাকিস্তান-চীন বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে নিক্সন প্রেসিডেন্ট হবার পরপরই সম্পর্ক আবার উষ্ণ হয়ে উঠে। তখন জনাব এ ব্লাড ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তার সন্দেহজনক কার্যকলাপ পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে পরিগনিত হয়। তিনি শেখ মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেন। তিনি ও তার প্ররোচণায় ফোর্ড ফাউন্ডেশন এর আর্থিক মদদপুষ্ট কয়েকজন মার্কিন ইকনোমিষ্ট শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থন যোগাতে থাকেন।
তারা গোপনে মুজিবের সাথে নিয়মিত সাক্ষাত করতে থাকেন। তাদের এই সাক্ষাৎকারের খবর সরকার জানতে পারে। মিঃ এ ব্লাডকে এ ধরণের কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জনাব ফারল্যান্ড মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, বিচ্ছিন্নবাদী কোন প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র কোনরূপ সাহায্য কিংবা সহযোগিতা করবে না; কোনরূপ সহানুভূতিও প্রদর্শন করা হবে না। ইতিমধ্যে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭০ এক ঘোষণায় জাতীয় পরিষদের জন্য ৭ই ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক নির্বাচনের দিন ১৭ই ডিসেম্বর ধার্য করে। সরকার এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিজেদের নির্বাচনী ঘোষণাপত্র ও নীতিমালা জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো যথা- রেডিও, এবং টিভি-র মাধ্যমে প্রচারণার সুযোগ দেয়া হবে। প্রথমবারের মত পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতারা এ ধরণের সুযোগ পায়। আইয়ূব আমলে কিংবা এর আগে বিরোধী দলীয় নেতারা এ ধরণের সুযোগ থেকে সবসময়েই বঞ্চিত থেকেছে। ২৮শে অক্টোবর থেকে ১৯শে নভেম্বর ১৯৭০ সময়কালের মধ্যে ১৪টি রাজনৈতিক দলের নেতারা এই সুযোগ গ্রহণ করে। প্রচারণা শুরু করেন শেখ মুজিবর রহমন এবং প্রচারণা শেষ হয় সিন্ধু ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেতা জনাব জিএম সাঈদের বক্তৃতার মাধ্যমে। সভা-সমাবেশে প্রদত্ত রাজনৈতিক বক্তৃতার উপর ভিত্তি করেই নেতারা তাদের বক্তব্য রাখেন। এই সময়ে আমি এবোটাবাদে পিটি কোর্সে ডিটেলড হয়ে এসেছি। পিটি স্কুল কাকুলে এসে পরিচয় হল ক্যাপ্টেন রফিক (স্কুলের সিআই), PMA-তে প্লাটুন কমান্ডার মেজর সালাম এর সাথে। কোর্সে সাথী হিসেবে পেলাম লেফটেন্যান্ট রফিককে। আমার চাচাতো ভাই মুনিরুল ইসলাম চৌধুরী (মুন্না) তখন PMA-তে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। অনেকের সাথে পরিচয় হলেও ক্যাপ্টেন রফিক এবং মেজর সালামের সাথেই বিশেষ ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে। লেফটেন্যান্ট রফিকের সাথেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অবসর সময়ে ক্যাপ্টেন রফিকের মেসে কিংবা মেজর সালামের বাসায় জমিয়ে আড্ডা দেয়া হয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যত নির্বাচন নিয়ে সবাই সমভাবে উদগ্রীব। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে এ নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় বয়ে যায় আমাদের আড্ডায়। ক্যাপ্টেন রফিকের ঘরে নিয়মিত শুনতাম টিভিতে প্রচারিত নেতাদের নির্বাচনী বক্তৃতা সবাই একত্রিত হয়ে। যদিও তখন মাওলানা ভাসানী নির্বাচনের বিপক্ষে তবুও তার বক্তব্য দেশের দুই অংশের জনগণ এবং আমরা বিশেষ মনযোগের সাথে শুনেছিলাম। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি বাংলা এবং উর্দূতে তার বক্তব্য রেখেছিলেন। দেশের দুই অংশেই তার বক্তৃতা প্ৰশংসিত হয়েছিল। শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টোর বক্তৃতাও আমরা গভীর উৎসাহের সাথে শুনেছিলাম। টিভিতে জনাব ভুট্টোর উপস্থাপনা শেখ মুজিবের চেয়ে বেশি চটকদার হয়েছিল। বক্তৃতায় সব নেতারাই দেশের সব সমস্যা নিয়েই কথা রাখলেন।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম, ভূমি সংষ্কার নীতি, শিক্ষা নীতি, পররাষ্ট্র নীতি, শাসনতন্ত্র কোন কিছুই বাদ পড়েনি তাদের বক্তব্যে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কথা বললেও শেখ মুজিবের বক্তব্যের প্রধান বিষয় ছিল বাঙ্গালী- জাতীয়তাবাদ এবং আঞ্চলিক বৈষম্য কেন্দ্রিক। পক্ষান্তরে ভুট্টোর মূল বক্তব্য ছিল ইসলামিক সমাজতন্ত্র, পাক-ভারত সমস্যা এবং কাশ্মীর নিয়ে। দক্ষিনপন্থী দলগুলোর প্রধান বক্তব্য ছিল ইসলামিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বিদেশী মতবাদের হাত থেকে ইসলামকে বাচানোর আহ্বান। জনাব ওয়ালী খান আঞ্চলিক অধিকার এবং বঞ্চনার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তার বক্তৃতায়। মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী রাজনৈতিক কিংবা শাসনতান্ত্রিক এ দু’টোর কোনটার বিষয়েই তেমন কিছু বলেননি। তার বক্তব্যের সারবস্তু ছিল মেহনতী মানুষের দাবি। সমাজের নিচুস্তরের গণ-মানুষের কথাই পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠে তার কথায়। বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার ফলে দেশব্যাপী নির্বাচনী জোয়ারের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শহুরে লোকজন সার্বিক নির্বাচনী অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে। ৩রা ডিসেম্বর ইলেকশনের ৪দিন আগে প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আবেদন জানান তারা যেন সংযম এবং সহনশীলতার সাথে দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সরকারের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত করতে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন। তিনি আবারও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল আছেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সব সন্দেহের অবসান ঘটবে। ইতিমধ্যে ২৭শে নভেম্বর ১৯৭০ ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে সায়ত্ব শাসনের পূর্ণ অধিকার দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পান সেটা ব্যক্তিগতভাবে তিনিও সমর্থন করেন।” তিনি আরও বলেন, “পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্বের বাস্তবতায় এভাবেই পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাখা সম্ভব।
৭ই ডিসেম্বর দেশব্যপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব এবং আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয়ে জনগণ খুব একটা বিস্মিত হয়নি। আওয়ামী লীগের জয় ছিল সুনিশ্চিত। পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টা আসনের ১৬০টাতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করে। বাকি দু’জন ছিলেন জনাব নূরুল আমিন এবং চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একটি আসনও লাভ করতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানে ইসলাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোর পরাজয় ঘটে। আশ্চর্যজনকভাবে অপাঞ্জাবী জনাব ভুট্টো এবং তার দল অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি আসনেই পিপিপি প্রার্থীরা জয়ী হয়। বাকি ৫৭টি আসন ৭টি রাজনৈতিক দল এবং ১৫জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়। আওয়ামী লীগের মত একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন দলও পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসন লাভ করতে পারেনি। ফলে মুজিব ও ভুট্টো যথাক্রমে হয়ে উঠেন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মূল নেতা। অনেকেই মনে করেছিল নির্বাচনের ফলাফল প্রেসিডেন্টকে চমকে দিয়েছিল; কিন্তু তা নয়। প্রেসিডেন্ট এবং জান্তার সবাই নিশ্চিত ছিলেন নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগই জয়ী হবে। সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবই হবেন মুখ্য নেতা সেটা বুঝেই নির্বাচন দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন শেখ মুজিব নির্বাচনের পর তার ওয়াদা অনুযায়ী ৬দফার পরিবর্তন করে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবেন। তার দেয়া কথার পরিপ্রেক্ষিতে এবং তার প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের সাথে সাথে প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল।
ইলেকশন শেষ হওয়ার পরপরই আমার কোর্স শেষ হয়ে যায়। কোয়েটা থেকে ইতিমধ্যেই আমাকে জানানো হয়েছে OW & ITC কোর্সের জন্য আবার আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ফিরে গিয়েই (School Of Infantry & Tactics) স্কুল অফ ইনফ্যানট্রি এন্ড ট্যাকটিকস্-এ যোগ দিতে হবে। এই খবর পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি কোর্সে যোগ দেবার আগেই ১৫ দিনের জন্য হলেও ছুটিতে ঢাকায় যাব সরেজমিনে সবকিছু দেখে আসার জন্য। সেভাবে ছুটির আবেদন করায় ছুটি মঞ্জুর হয়ে যায়। কোর্স শেষে কাকুল থেকেই ৩ সপ্তাহের ছুটিতে ঢাকায় যাই জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে। ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই বুঝতে পারি রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত। সবাই ভাবছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বাঙ্গালীদের হাতে দিতেই হবে সামরিক জান্তাকে। দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের পর দেশ শাসনের সুযোগ পাবে পূর্ব পাকিস্তানবাসী। বিভিন্ন মহলের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলোচনায় বুঝতে পারলাম সবাই ধরেই নিয়েছে শেখ মুজিবই হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী: এর কোন গত্যান্তর নেই। শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পাকিস্তানও টিকবে না বলেও অভিমত প্রকাশ করল অনেকেই। কিন্তু একান্তই যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয় তখন মোকাবেলায় রাজনৈতিকভাবে কি করবে আওয়ামী লীগ কিংবা অবস্থাই বা কোথায় গিয়ে কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে সে সম্পর্কে কারো কোন পরিষ্কার ধারণা আছে বলে মনে হল না। পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কোন পরিকল্পনা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আদৌ আছে কিনা সেটাও বোঝা গেল না। সেই সময় হঠাৎ করেই বাপ্পিদের বাসায় একদিন শেখ কামালের সাথে দেখা হয়ে গেল। সাক্ষাৎ-এ আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম,
—৬ দফার প্রশ্নে কোন মত বিরোধের ফলে সামরিক জাভা ক্ষমতা হস্তান্তর নাও করতে পারে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কি স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাবে? সেই পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে প্রস্তুত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কি আওয়ামী লীগ? সামরিক অভিযান চালানো হলে অবস্থা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তার মোকাবেলায় সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবার জন্য যে মন-মানসিকতার প্রয়োজন সেটা আওয়ামী লীগের মত দলের আছে কি? জনাব শেখ মুজিবই বা কি ভাবছেন? আলাপ হচ্ছিল খোলামেলা ঘরোয়া পরিবেশে একটু ভেবে নিয়ে শেখ কামাল জবাবে বলল,
—বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানসহ সমগ্র পাকিস্তানে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে যেভাবে সহযোগিতা করেছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সদিচ্ছা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সামরিক জান্তার আছে বলেই আওযামী লীগ বিশ্বাস করে। নির্বাচন হওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব সামরিক সরকারের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়; তাছাড়া এই বিষয়ে আলাপের জন্য প্রেসিডেন্ট শীঘ্রই ঢাকায় আসছেন। জানাল কামাল।
তার কথা থেকে বুঝতে পারলাম ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রায় নিশ্চিত এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে তারা তেমন কিছুই চিন্তা করছে না। প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ মুজিবের আসন্ন বৈঠকের উপরও আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে আশাবাদী। তার বক্তব্য থেকে বুঝতে পারলাম আপোষরফার মাধ্যমে যেভাবে নির্বাচন সম্ভব হয়েছে সেভাবেই ৬দফার বিষয়েও আপোষের মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তরও সম্ভব হবে সেই মনোভাবই পোষণ করছেন শেখ মুজিব এবং আওয়ামী নেতৃবৃন্দ। তার মানে প্রেসিডেন্টকে দেয়া কথা অনুযায়ী ৬দফাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে শেখ মুজিব শুধুমাত্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই হবেন তাই নয়, পাকিস্তানের অখন্ডতাও বজায়ে রাখবেন তিনি সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেল শেখ কামালের কথায়। পরিশেষে কামালকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম.
—ধরো যে কোন কারণেই হোক না কেন, শেষঅব্দি বর্তমান সরকার শেখ সাহেবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে যদি সামরিকভাবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে সেই অবস্থায় তাদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্য জনগণকে তৈরি করে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য আওয়ামী লীগ কি প্রস্তুত?
জবাবে শেখ কামাল বলল,
—শেখ সাহেব চক্রান্তকারী নন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে স্বায়ত্বশাসন কায়েম করার জন্যই ৬দফা; পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার জন্য ৬দফা নয়। কামাল আরো বলেছিল,
—আব্বাকে চক্রান্তকারী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে প্রতিপন্য করার হীন চক্রান্ত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেভাবে ভবিষ্যতেও সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমি জানতে চেয়েছিলাম,
—নির্বাচনের আগ থেকেই সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্বাভাবিক হারে সামরিক ইউনিট পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করছে এ ব্যাপারে তারা অবগত আছে কিনা এবং এই ধরণের সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্যই বা কি? জবাবে কামাল বলেছিল,
—৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত বলে যে দাবি উঠে সে পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্যই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এটাতো জনগণেরই বিজয়।
তার এই বক্তব্য থেকেও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার কোন পরিকল্পনা ছিল না। তাদের চিন্তা-ভাবনায় এ ধরণের অসচ্ছতার কারণেই ২৫-২৬শে মার্চ রাতের শ্বেতন্ত্রাসের মুখে অসহায় হয়ে পড়েছিল সমগ্র জাতি। আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিতে। ‘আমি অস্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না’ বক্তব্য রেখে বন্দী হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেচেছিলেন শেখ মুজিব। কোন অনুরোধ কোন যুক্তিই মানতে রাজি হননি জনগণের ‘নয়নের মণি’ শেখ মুজিব।। সেই মুজিবই পরবর্তিকালে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং মূল নায়ক সাজাতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি নির্লজ্জের মতো। আগরতলা ষড়যন্ত্রের আর্কিট্যাক্ট হিসাবে বাহবা কুড়াতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। মুজিব চরিত্রের এহেন সুবিধাবাদী বৈশিষ্ট্য তার পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
খুব তাড়াতাড়িই আমার ছুটি শেষ হয়ে গেল। ছুটি বাড়াবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কোয়েটায় ফিরতে বাধ্য হলাম। ফিরে আসার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমার কোর্স শুরু হয়ে গেল। স্থানীয় অফিসার হিসাবে মেসে থেকেই কোর্স করব ঠিক করলাম। কোয়েটার সব বাঙ্গালীরাই আমার ফিরে আসার প্রতিক্ষায় উদগ্রীব হয়েছিলেন। ফেরার পর প্রায় সবার সাথেই দেশ থেকে যা বুঝে এসেছি সে বিষয়ে আলাপ হল। আওয়ামী লীগের অসচ্ছ চিন্তা-ভাবনা এবং সরকার সম্পর্কে অযৌক্তিক আশাবাদের কথা শুনে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। যেকোন সামরিক অভিযানের ফল কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ বুঝতে না পারলেও আমাদের সেটা বুঝতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। অনেকেই উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার শেখ কামালের মতই আশাবাদ ব্যক্ত করেন, সরকার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে নিশ্চয়ই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। শেখ মুজিবও তার কথামত ৬দফার পরিবর্তন করে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। ফলে দেশ বিভক্তির হাত থেকে বেচেঁ যাবে পাকিস্তান।” দেশ থেকে ফিরে আসার পর মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গেল। অস্বস্তিকর পরিবেশে আশা-নিরাশা বুকে ধরে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম আগামী দিনের ঘটনা প্রবাহের দিকে।
নির্বাচনের পরপরই প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান। তিনি সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেন। তিনি চাচ্ছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে মুজিব ও ভূট্টোর সাথে আলোচনা শুরু করতে। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের এক পরিবারের সদস্য মোহাম্মদ হারুনের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান মুজিবকে ইসলামাবাদ আসার নিমন্ত্রণ জানান। (হারুণ পরিবারের সাথে শেখ মুজিবের অস্বাভাবিক এবং রহস্যজনক সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।) হবু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ইসলামাবাদ আসতে রাজি হলেন না। তার এই সিদ্ধান্তে অনেকেই মনে করলেন ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদের পরিবর্তে ঢাকাতেই সব আলোচনা হোক সেটাই চাচ্ছেন। যাই হোক, মুজিব ইসলামাবাদ আসতে রাজি না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেই ঢাকায় যেতে হয়েছিল আলোচনার জন্য। তিনি ১৯৭১ সালের ১২ই জানুয়ারী ঢাকায় গমন করেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ এবং শাসনতন্ত্র বিষয়ক প্রধান পরামর্শদাতা জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরীর দ্বারা শাসনতন্ত্রের একটা খসড়াও তৈরি করেন। এই খসড়ার উপর ভিত্তি করেই তিনি তার আলোচনা করবেন ঠিক করেছিলেন। খসড়াটার রূপরেখা ছিল :–
(১) কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট পরিসীমা সংবিধানে থাকবে। বাকি সব ক্ষমতাই থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশগুলোর জন্য কোন ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে রাখতে হলে তার জন্য আলাদা পরিসীমা নির্ধারন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে নির্ধারিত ক্ষমতা ছাড়া সব ক্ষমতাই থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
(২) কেন্দ্রের হাতে থাকবে মাত্র কয়েকটি বিষয়। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষমতাই থাকবে প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে। নূন্যতম ৫-৬টি বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে।
(৩) (ক) শাসনতন্ত্রে এমন কোন বিশেষ বিধি রাখা যাবে না যার দ্বারা জাতীয় সংহতি, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সমন্বয় কিংবা সম্পূরকতার অযুহাতে কেন্দ্রিয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারে। ১৯৬২ সালের সংবিধানে এ ধরণের বিধি জনগণের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
(খ) আজকের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক বিষয়ই কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সম্পর্কের মূল বিষয় বিধায় শাসনতন্ত্রে এ সম্পর্কে নিম্মে বর্ণিত নীতিগুলোর সংযোজন অপরিহার্য:-
(১) কেন্দ্রিয় সম্পদ (বৈদেশিক সাহায্য এবং মুদ্রাসহ) পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মাঝে জনসংখ্যানুপাতে বরাদ্দ করার বিধান থাকতে হবে। বৈদেশিক ঋন ও সাহায্য কেন্দ্রিয় সরকারের মাধ্যমে গৃহিত হবে। এবং এ বিষয়ে সব চুক্তি করার অধিকার থাকবে কেন্দ্রের হাতে।
(২) কেন্দ্রিয় খরচ, রাজস্ব এবং উন্নয়ন খাতের সব খরচা জনসংখ্যানুপাতে কিংবা আধাআধিভাবে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মাঝে ভাগ করার বিধি সংবিধানে থাকতে হবে।
(৩) রাজস্ব ব্যবস্থা হবে প্রদেশভিত্তিক। সব রকম কর কিংবা রাজস্ব আদায় করার ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। কেন্দ্রিয় সরকারের জন্য রাজস্বের একটি অংশ বরাদ্দ করে দিতে হবে শাসনতন্ত্রে।
(৪) কেন্দ্রিয় সরকারের প্রশাসনিক বিভাগগুলো (সাংবিধানিক, প্রশাসনিক এবং আইন বিভাগ) পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা এবং ইসলামাবাদে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে করে ভৌগলিক দূরত্বের ফলে দেশের দু’টি অংশ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন মনে না করে। কেন্দ্রিয় বিষয় সক্রান্ত বিভাগীয় দফতর ঢাকাতেও রাখতে হবে।
(৫) কেন্দ্রিয় সরকারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে লোক নিয়োগও পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ থেকে জনসংখ্যানুপাতে কিংবা আধাআধিভাবে করার বিধান সংবিধানে রাখতে হবে।
(৬) কেন্দ্রিয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে জয়েন সেক্রেটারী এবং তার উপর সর্বোপরিসরে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের আনুপাতিক বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ গ্রহণের সুষ্পষ্ট বিধান থাকতে হবে।
জনাব চৌধুরী খসড়া রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য অধিকার থেকে সর্বদাই বঞ্চিত হয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক বরাদ্দ, রাজস্ব বন্টন, উন্নয়ন খাতে ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রা এবং সাহায্য প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের পশ্চাতভূমিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে এ দুঃখজনক অবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। ক্রমান্বয়ে এই বৈষম্য দূরীকরণের নীতি গ্রহণ করার কোন বিকল্প নেই। এই সত্যকে মেনে নিয়ে সার্বিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমেই পাকিস্তানের ঐক্য বজায়ে রেখে দেশকে শক্তিশালী করা সম্ভব। আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন করতে পারলেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে আন্তরিক এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে জাতীয় ঐক্য এবং একাত্মতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিগত দুই দশকের শোষণ- নিপীড়নের জ্বালা ভুলে তারা আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব ত্যাগ করে পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন। শাসনতন্ত্রে অর্থনৈতিক এবং রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থার বিশদ বিবরণ রাখা সম্ভব নয় তাই শাসনতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের উপর দায়িত্ব আরোপ করা হবে যাতে করে উক্ত সংগঠন এমনভাবে আইন এবং নীতি প্রণয়ন করবে যাতে অতীতের শোষণ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। জনাব চৌধুরী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে খসড়াটি ১৯৭০ সালের ১১ই ডিসেম্বর পেশ করেন। প্রেসিডেন্ট জনাব চৌধুরীর খসড়ার সাথে একমত প্রকাশ করে জনাব চৌধুরীর কাছে একটি পত্র লিখেছিলেন। ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জনাব চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন আলোচনাকালে শেখ মুজিব তার ওয়াদা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রণীত শাসনতন্ত্রের খসড়া নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে মত বিনিময় করবেন এবং সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের জনাব চৌধুরী এবং তাদের প্রণীত খসড়াটির প্রয়োজন হবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জনাব শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১২ই জানুয়ারী। তাদের ঐ একান্ত বৈঠক হয়েছিল ৩ঘন্টারও বেশি সময় নিয়ে। ঐ মিটিং-এ কোন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। মিটিং এর পরপরই প্রেসিডেন্ট তার সংবিধান বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মন্ত্রী জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরীকে তলব করেন। তিনি তাকে বলেন, “শেখ মুজিব আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাকে বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি। সে তার কথার বরখেলাপ করেছে। পরামর্শদাতাদের অনেকেই তাকে বিশ্বাস করতে মানা করেছিলেন; কিন্তু আমি তাদের উপদেশ উপেক্ষা করে তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার আন্তরিকতাকে মুজিব দুর্বলতা মনে করে ভুল করেছে।” আলোচনার সারবস্তু অনুযায়ী শেখ মুজিব পূর্বকথামত প্রেসিডেন্টকে শাসরতন্ত্রের খসড়া দেখাতে অস্বীকার করেন। তিনি পরিষ্কারভাবে প্রেসিডেন্টকে বলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে তিনিই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার কিছুই নেই। প্রেসিডেন্টের এখন একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে অতিসত্ত্বর জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত করা। তিনি প্রেসিডেন্টকে সতর্কবাণী উচ্চারন করে বলেন, “অবিলম্বে সংসদ অধিবেশন শুরু করতে ব্যর্থ হলে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকবেন তিনিই।”
শেখ মুজিবের এ ধরণের মনোভাবের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভীষণভাবে মর্মাহত হন। এতে জান্তার ভিতরেও তার অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে। পূর্বে বর্ণিত অধ্যায় থেকে দেখা যাবে ইয়াহিয়া খান মুজিবের প্রায় সব দাবিই মেনে নিয়েছিলেন। কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’টো বিষয়ে কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও মূলতঃ বলা যায় প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট কোন দ্বিমত পোষণ করেননি। তার প্রণীত খসড়া অনুযায়ী বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা এবং মুদ্রা এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সবকিছুই তিনি প্রাদেশিক সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। ঐ মূল তিনটি বিষয়ের আনুসাঙ্গিক আরো কয়েকটি বিষয়কেও তিনি কেন্দ্রের অধীন রাখতে চেয়েছিলেন। যেমন:- পাসপোর্ট, ন্যাশনালিটি, ইমিগ্রেশন। কেন্দ্রের হাতে রাজস্ব আদায়ের কোন ক্ষমতা থাকবেনা বিধায় সংবিধানে তিনি কেন্দ্রের আর্থিক সংকুলানের গ্যারান্টি দাবি করেন। তিনি চেয়েছিলেন সংবিধানে আইন প্রবর্তন করতে হবে যে প্রতিটি প্রদেশ নিজেস্ব আয় থেকে নির্ধারিত একটি অংশ কেন্দ্রকে দিতে বাধ্য থাকবে। কেন্দ্রের স্বতন্ত্রতা বজায়ে রেখে কেন্দ্র যাতে করে তার নিজস্ব দায়িত্বসমূহ পালন করতে পারে সে জন্যই প্রেসিডেন্ট ঐ দাবি জানিয়েছিলেন। বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিন্নমুখীতা ও স্বতন্ত্রতা মেনে নেননি। এ ব্যাপারে তার মতামত ছিল নিম্মরূপ : –
প্রাদেশিক সরকারগুলো তাদের স্বতন্ত্র বানিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিনিধি বিদেশের দূতাবাসে প্রেরণ করতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্র নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বানিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সবরকম তৎপরতাই প্রাদেশিক সরকার করতে পারবেন। কেন্দ্রের নীতির পরিপন্থী কোন কার্যক্রম প্রাদেশিক সরকার করতে পারবেন না তা সেটা যতই লাভজনক হোক না কেন। প্রথম বৈঠকের বিপর্যয়ের পরও প্রেসিডেন্টে ও শেখ মুজিবের মাঝে আরো কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বৈঠকগুলোর গতিধারা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে সংঘাতের পথেই ধাবিত হচ্ছে। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, “মুজিবের সাথে তার প্রয়োজনীয় আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন সাংবাদিক সম্মেলনে। তিনি বলেন, “শেখ মুজিব যখন ক্ষমতা নেবেন তখন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। খুব শীঘ্রই শেখ মুজিব তার সরকার কায়েম করবেন। কিন্তু ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মাঝে যে সমঝোতা হয়েছিল সে অনুযায়ী সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন সরকার প্রধান আর ইয়াহিয়া খান হবেন সাংবিধানিক রাষ্ট্রপ্রধান। এই ধরণের সমঝোতা বর্তমান থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্টের ঐ ধরণের ইঙ্গিত শংকিত করে তুলেছিল জনগণকে। তাহলে কি দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মাঝে যে বিশ্বাস এবং আন্তরিক নির্ভরশীলতা জন্মেছিল তার ভিত ধ্বসে গেছে? তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মতভেদ। এর পরিণতি কি হবে? ঢাকা ত্যাগের আগে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে জনাব ভুট্টো এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সাথে মত বিনিময় করবেন এবং তাদের অনুরোধ করবেন যাতে তারা ঢাকায় এসে শেখ মুজিবকে বোঝান যে, জাতীয় স্বার্থে তাকে আরো যুক্তিসঙ্গত আচরণ করতে হবে। তা না হলে যে বিপর্যয় দেখা দিবে তার জন্য দেশের সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই জাতির কাছে জবাবদিহি হতে হবে। ১২ই জানুয়ারীর বৈঠকের বিপর্যয়ের পর জনাব চৌধুরী ছুটে গিয়েছিলেন মন্ত্রীসভার সদস্য জনাব হাফিজুদ্দিনের কাছে। সবকিছু বুঝিয়ে বলে তিনি জনাব হাফিজুদ্দিনকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিবকে বোঝাতে। শেখ মুজিবের সাথে জনাব হাফিজুদ্দিনের সম্পর্ক ছিল অতি ঘনিষ্ঠ। জনাব হাফিজুদ্দিন শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেছিলেন।
সেই বৈঠকে জনাব তাজুদ্দিনও (পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল) উপস্থিত ছিলেন। জনাব হাফিজুদ্দিন শেখ সাহেবকে তার দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে তাদের প্রণীত খসড়া শাসনতন্ত্র দেখাবার অনুরোধ জানান। শেখ সাহেব জবাবে পরিষ্কারভাবে কিছুই বলেননি। তবে জনাব তাজুদ্দিন উত্তর দিয়েছিলেন। পরিষ্কার ভাষায় তিনি বলেন, “শেখ মুজিব এমন কোন কথা কাউকে দেননি। শাসনতন্ত্রের খসড়া কাউকে দেখাবার দায়ভারও আওয়ামী লীগের নেই। এ ধরণের দাবি নেহায়েতই যুক্তিহীন।”
ঢাকা থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে দেখা করার জন্য গেলেন লারকানায়। আলোচনাকালে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট-মুজিব বৈঠকের ব্যর্থতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। জেনারেল হামিদ খান এবং জেনারেল পীরজাদা প্রেসিডেন্টের সাথে লারকানায় যান। ইতিমধ্যে জনাব ভুট্টো শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় পৌঁছান ২৭শে জানুয়ারী। ভুট্টো ও মুজিব তিন দফা বৈঠকে মিলিত হন। শেখ মুজিবের বাসভবনে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হলেও মূল বিষয়গুলোর উপর কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তারা ব্যর্থ হন। শেখ মুজিব পরিষ্কারভাবে ভুট্টোকে জানান ৬ দফার ব্যাপারে তিনি কোন আপোষ করবেন না। জবাবে জনাব ভুট্টো বলেছিলেন, “৬ দফার আড়ালে বিচ্ছিন্নতাবাদের আভাষ রয়েছে বিধায় ৬ দফা ভিত্তিক কোন শাসনতন্ত্রের পক্ষে তিনি বা তার দল কোনরূপ সমর্থন দিতে অপারগ। এভাবেই পাকিস্তানের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের মাঝে অতি প্রয়োজনীয় কোনরূপ রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। সেই সময় পর্দার অন্তরালে থেকে জনাব হারুণ এক বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছিলেন। তিনি অতিকৌশলে জনাব ভুট্টোকে শেখ মুজিবের কাছে সরকারের দালাল হিসেবে প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে বরাবরই শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছিলেন। পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাস এবং সন্দেহের কারণেই সব আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। আলোচনা প্রসঙ্গে পরে জনাব ভুট্টো বলেন, “শেখ মুজিব জাতির উপর জোর করে ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেবার চক্রান্ত করছেন। তার চেষ্টা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসিয়ে তার প্রণীত শাসনতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাশ করিয়ে তার জোঁয়ালে জাতিকে আবদ্ধ করা। তিনি জনগণকে ৬ দফার মূল উদ্দেশ্য বুঝবার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে নারাজ।” জনাব ভুট্টোর ঢাকা থেকে ফেরার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই লারকানা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক কারণেই শেখ মুজিব লারকানা বৈঠক সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেন। লারকানা বৈঠক সম্পর্কে ভুট্টো বলেন, “আমরা ৬ দফার তাৎপর্য নিয়ে মত বিনিময় করেছি। ৬ দফার মূল উদ্দেশ্য বিশ্লেষন করে আমরা শংকিত হয়ে পড়েছি। তথাপি প্রেসিডেন্টকে কথা দিয়েছি বর্তমান সমস্যার একটা আপোষভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।”
লারকানা বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি ইসলামাবাদে জান্তার আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। জেনারেলরা সিদ্ধান্ত নিলেন, শেখ মুজিবের অনমনীয়তার মোকাবেলা করা হবে দৃঢ়তার সাথে। ভুট্টোর উস্কানিমূলক উক্তিগুলো উপেক্ষা করে চলেছিলেন জান্তার যুদ্ধবাজ জেনারেল হামিদ, ওমর, গুলহাসান এবং পীরজাদা প্রমুখ। তারা ভুট্টোকেই পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী একমাত্র রাজনীতিবিদ ও নেতা মনে করতে থাকায় অবস্থা আরো জটিল হয়ে উঠে। এই বৈঠকেই মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুজিবের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং এডমিরাল আসানকে তিরষ্কারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল জান্তার অন্যান্য জেনারেলদের ঐ বৈঠকে। এর ফলে এডমিরাল আসান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পদে নিয়োগ করা হয় কট্টরপন্থী জেনারেল টিক্কা খানকে। ১৭ই ফেব্রুয়ারী ক্যাবিনেট বিলুপ্ত করা হয়। ক্যাবিনেট বিলুপ্তির ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্যদের তার পরামর্শমন্ডলীর সদস্য হওয়ার আহ্বান জানান। জনাব এহসানুল হক এবং জাষ্টিস কর্নওয়ালিস ব্যতিত অন্য সবাই তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিবের বারংবার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, “৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্টের ঐ ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “তার ও শেখ মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে কোন সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসতে পারে না। সংসদ কার্যক্রমের উপরও একটা বোঝাপড়া হওয়া উচিত।” তিনি হুমকি দেন, “আমার দাবি অবহেলিত হলে করাচী থেকে খাইবার পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে।” জনাব ভুট্টো ভাল করেই জানতেন জান্তার বেশিরভাগ জেনারেল তার পক্ষে রয়েছেন। তিনি আরো জানতেন, শেখ মুজিবের অনমনীয় ভাবের ফলে জান্তার মধ্যে প্রেসিডেন্টের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক ব্যর্থ হবার পরই জেনারেলরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংবিধানের বিষয়ে তারা আর নিরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবেন না। এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে জেনারেল হামিদকে প্রেসিডেন্ট বানাবার কথাও চিন্তা করেছিলেন জান্তার জেনারেলরা। কিন্ত চীন-মার্কিন সম্পর্কের ব্যাপারে নিক্সন কর্তৃক ইয়াহিয়া খানকে প্রদত্ত দায়িত্বের কথা ভেবেই পরিশেষে জেনারেলরা ঐ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে বিরত থাকেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষমতাহীন বিব্রত প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর একান্ত বিরোধিতার মুখে ১লা মার্চ এক ঘোষণায় ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী করতে বাধ্য হন। জেনারেল পীরজাদা ও ভুট্টো মিলিতভাবে প্রেসিডেন্টের ১লা মার্চের ভাষণ তৈরি করেন বলে পরে জানা যায়। জাতীয় সংসদ অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা শোনার পরমুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে non co-operation movement কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কেন্দ্রের সাথে সব সম্পকই প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থার মধ্যেও মুজিব- ইয়াহিয়া যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে। ৭ই মার্চের জনসভার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে দীর্ঘ আলাপ করেন। আলোচনার ধারা ছিল সৌহার্দপূর্ণ। দু’জনেই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে অনুরোধ করেন যাতে মুজিব এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়বে। উত্তরে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় এসে বিষ্ফোরম্মুখ অবস্থা স্বচক্ষে দেখে যাবার আমন্ত্রন জানান।
৭ই মার্চ শেখ মুজিব ঐতিহাসিক জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। প্রেসিডেন্টের ২৫শে মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জনসভায় চার দফা দাবি পেশ করেন। তিনি ঘোষণা দেন তার চার দফা দাবি ভবিষ্যতে সংসদ অধিবেশনে যোগদানের পূর্ব শর্ত হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
তার ঘোষিত চারটি শর্ত ছিল নিম্নরূপ:-
১। অবিলম্বে মার্শাল’ল উঠিয়ে নিতে হবে।
২। আর্মিকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
৩। আর্মি এ্যাকশানের ফলে যে প্রাণহানি ঘটেছে তার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এ দাবিসমূহ পূরণ না করা পর্যন্ত non co-operation movement চলবে। এভাবেই ৩রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ মধ্যরাত অব্দি মুজিবের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্যারালাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্রোহ উম্মুখ পূর্ব পাকিস্তানের অশান্ত পরিবেশে শেখ মুজিবর রহমান হয়ে উঠেন ডিফেক্টো রাষ্ট্রপ্রধান। মুমুর্ষ রুগীকে বাচাবার শেষ চেষ্টার মত পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্চের ১৫ তারিখে ঢাকায় আসেন। সে দিনই শেখ মুজিব এক উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, “জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের জনগণ, বেসামরিক আমলা, অফিস-আদালত এবং মিল-ফ্যাক্টরির শ্রমিকগণ, কৃষক এবং ছাত্র সমাজ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন যে, আত্মসমর্পন করার চেয়ে তারা জীবনাহুতি দিতে প্রস্তুত। বাঙ্গালীর স্বাধীনতার চেতনাকে কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যাবে না। সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবেই চলবে।” বাংলাদেশকে পরিচালিত করার জন্য শেখ মুজিব ৩১টি আদেশ জারি করেন। সরকারি এবং আধা-সরকারি সমস্ত অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। দুই অংশের মধ্যে শুধুমাত্র টেলিফোন, টেলেক্স এবং ওয়্যারলেস এর মাধ্যমে যোগাযোগ বহাল থাকবে। এভাবে স্বাধীনতার চেতনা ক্রমশঃ বাস্তবাকার ধারণ করতে শুরু করে। সেনা বাহিনী ছাড়া সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন শেখ মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। বিদেশী খবর সংস্থাগুলিও একই অভিমত প্রকাশ করেন। যেমন: মার্চের ৯ তারিখে ডেইলী টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শেখ মুজিবর রহমান প্রায় স্বাধীনতাই ঘোষণা করেছেন।” একইদিন এডিটোরিয়ালে লেখা হয়, “ইতিমধ্যেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের নামও শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ বলে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র একটি পতাকাও সৃষ্টি হয়েছে।” একই ধরণের খবর দি ইকনোমিষ্ট (১৩ই মার্চ সংখ্যা) এ প্রকাশিত হয়। ১৫ই মার্চ দি টাইমস অভিমত প্রকাশ করে, “পাকিস্তান আজ ধ্বংসের পথে।” ইতিমধ্যে একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার ভারতের উপর দিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানের ক্রান্তিলগ্নে ভারত সরকারের এ ধরণের চরম সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য পাকিস্তান বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেন এর মধ্যস্ততার জন্য আকুল আবেদন জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়নকেও আবেদন জানানো হয় এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। জাতিসংঘের মহাসচিব মধ্যস্থতা করার জন্য সম্মতি জানান। কিন্তু ভারত সরকার এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ অথবা মধ্যস্থতার চরম বিরোধিতা করে এবং নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। পরবর্তিকালে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফলে জানা যায় হাইজ্যাকাররা ছিল সবাই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে গৃহিত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। শেখ মুজিব ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার সমর্থন করে বলেন, “হাইজ্যাক ঘটনা পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা হস্থান্তর না করার একটি কূটকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন আন্তরিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন তখন শেখ মুজিবের এ ধরণের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ নিষিদ্ধ করার ভারতীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে শেখ মুজিবের সমর্থন জান্তার ভেতর জেনারেলদের শেখ মুজিব সম্পর্কে পুষিত সন্দেহকেই জোরদার করে। শেখ মুজিব ভারতের দালাল এ ধারণা জেনারেলদের অনেকের মনেই বদ্ধমূল হয়ে উঠে। হাইজ্যাক প্রসঙ্গে ভুট্টোর বক্তব্যও ছিল নেহায়েত দায়িত্বহীন। তিনি হাইজ্যাকারদের ‘পাকিস্তানী’ ঘোষণা করে তাদের ‘জাতীয় বীর’ আখ্যায়িত করেন। জাতীয় স্বাধীনতা এবং সংহতির প্রতি হুমকি স্বরূপ ভারতীয় পদক্ষেপের প্রসঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদ্বয়ের এ ধরণের প্রতিক্রিয়ায় তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাই প্রকাশিত হয়। জাতীয় সংসদ অধিবেশনের আগে কিংবা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে কোনরূপ বোঝাপড়ার আগে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের শেখ মুজিবের দাবির সমালোচনা করে জনাব ভুট্টো যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন সেটাও ছিল দুঃখজনক এবং হতাশাব্যাঞ্জক। ১৪ই মার্চ শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবার শেষ চেষ্টা করার জন্য প্রেসিডেন্ট যখন ঢাকার পথে ঠিক তখন জনাব ভুট্টো এক বিবৃতিতে বলেন, “শেখ মুজিবের দাবি অনুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়ে সমঝোতার আগেই যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে একই সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টির হাতে।” ১৫ই মার্চ তার বিবৃতিতে তিনি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, “পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্বের সত্যকে মেনে নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কায়েমের প্রশ্ন অবান্তর হয়ে দাড়ায়।
১৫ই মার্চ এমন এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে পৌঁছান যখন পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব স্বাধীনতা প্রায় ঘোষণা করেছেন অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টো ‘দুই সরকারের’ পক্ষে বক্তব্য দিয়ে দেশের বিভক্তি প্রায় স্বীকার করে নিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃবৃন্দ তখনও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানের ঐক্য এবং সংহতি বজিয়ে রাখার। ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোকে ঢাকায় আসবার জন্য অনুরোধ জানান। জবাবে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে বলেন শেখ মুজিব যখন প্রচ্ছন্ন ভাবে স্বাধীনতাই ঘোষণা করে বসেছেন তখন ঢাকায় গিয়ে আলোচনা করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এতে কোন ফায়দাও হবে না। তার এ ধরণের মনোভাব থেকে এটাই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, জনাব ভুট্টোর কাছে তখন পাকিস্তানের অখন্ডতার চেয়ে ক্ষমতাই বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা লাভের জন্য দুই অংশের দুই নেতাই মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের উদ্দেশ্যমূলক কার্যক্রমের ফলে দেশ এবং জাতির কি অবস্থা হবে সে ব্যাপারে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। ক্ষমতার অন্ধ মোহে তারা বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপকেও মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করছিলেন না।
প্রেসিডেন্ট যখন ঢাকায় তখন থেকেই সামরিক জান্তা contingency plan বানাতে শুরু করে। প্ল্যান অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশ পথে কলম্বো হয়ে আর্মি রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। ভারত সরকার শ্রীলংকা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কলম্বো হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করার। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কলম্বো সরকার ভারতীয় চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারলেন অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। জনগণ বিক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষ্ফোরম্মুখ। তার কাছে মনে হল তিনি যেন ভিন্ন কোন দেশে এসেছেন। তার অতি চেনা পূর্ব পাকিস্তান যেন এটা নয়। যাই হোক, প্রতিকূল অবস্থার মাঝেই ১৬ই মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিবের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন সকাল ১১টায় শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি ভবনে এলেন বৈঠকের জন্য। তার গাড়িতে উড়ছিল একটি কালো পতাকা। আগের সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে শহীদদের স্মরনে ঐ কালো পতাকা গাড়িতে লাগানো হয়েছিল। বৈঠকে শেখ মুজিব অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং মার্শাল’ল উঠিয়ে নেবার দাবিসহ তার ৪ দফা প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য ১৯৬৯-৭০ সালে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রণীত শাসনতন্ত্রের খসড়ার উপর ভিত্তি করে কোন আলোচনার অবকাশ আর তখন ছিল না। ফলে প্রেসিডেন্ট এর পক্ষে শুধু দু’টোই রাস্তা খোলা ছিল –
১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া।
২। শেখ মুজিবের বিদ্রোহের বিরূদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কিন্তু যে কোন প্রকার সামরিক পদক্ষেপে প্রাণহানীই শুধু ঘটবে না পরিশেষে এ ধরণের পদক্ষেপের পরিণতিই বা কি হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে এক কঠিন সমস্যার মুখাপেক্ষী হন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। জান্তার কট্টরপন্থী জেনারেলদের মধ্যে অনেকেই যেমন: জেনারেল হামিদ খান প্রমুখরা ভেবেছিলেন ৭২ ঘন্টার মধ্যেই সামরিক অভিযান চালিয়ে তারা বাঙ্গালীদের বিদ্রোহ দমন করতে পারবেন। ১৯৬৯ সালের মার্শাল’ল প্রয়োগের সফলতাই তাদের মাঝে এ ধরণের ধারণা সুদৃঢ় করেছিল। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন যে ১৯৬৯ সালের মার্শাল’ল-কে বাঙ্গালী জনগণ মেনে নিয়েছিল তখনই যখন পর্দার অন্তরালে জান্তা প্রধান অতিসত্ত্বর জাতীয় নির্বাচন সংগঠিত করে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তখন তুঙ্গে। সারা পূর্ব পাকিস্তানে তখন স্বাধীনতার দাবি জনগণের মাঝে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সংঘাতের পথ বর্জন করার জন্য আকুল নিবেদন জানান। বৈঠকে মুজিবকে সিদ্ধান্তহীন মনে হয়। ঘটনা প্রবাহের চরম পরিণতি কি হবে সে সম্পর্কে তিনিও ছিলেন শংকিত। মুখে বিপ্লবী বাণী উচ্চারণ করলেও চারিত্রিকভাবে শেখ মুজিব ছিলেন সুবিধাবাদী দুর্বল ও ভীরু চরিত্রের রাজনীতিবিদ। ফলে অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য ইয়াহিয়া-মুজিব যখন আলোচনায় ব্যস্ত তখন যুদ্ধবাজ জেনারেলরা বাঙালী জাতিকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা প্রণয়নে ছিলেন ব্যস্ত। এ অবস্থায় ২০শে মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মধ্যে শাসনতন্ত্র বিষয়ে একটি আপোষ সমঝোতা হয়েছে; যার মধ্যে মুজিবের ৬ দফার প্রতিফলন ঘটেছে। মার্শল’ল অবিলম্বে উঠিয়ে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারেও একটি সমাধান প্রেসিডেন্ট ও জনাব মুজিবর রহমান মেনে নিয়েছেন বলেও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়।
ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে একটি ঘোষণাপত্রের খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, কেন্দ্রিয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকেই মনোনীত করা হবে। জাতীয় সংসদকে দুইটি কমিশনে ভাগ করা হবে। কমিশন দুইটি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় বিধি নির্ধারন করবেন; যা পরে শাসনতন্ত্রের অংশ হিসেবে পরিগনিত হবে। এর ভিত্তিতেই জাতীয় অধিবেশনে দেশের জন্য নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে। খসড়া ঘোষণাপত্রে জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরি প্রণীত ১৯৭১ জানুয়ারীর শাসনতন্ত্র বিষয়ে খসড়ার আলোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। খসড়ায় মুজিবের ৬ দফার প্রায় সবটাই গৃহিত হয় পাকিস্তানের ঐক্য বজিয়ে রেখে। কিন্তু খসড়া ঘোষণাপত্র সম্পর্কে জান্তার জেনারেলরা নেতিবাচক অভিমত পোষণ করে আসছিলেন গোড়া থেকেই। তাদের মতে চাপে পড়েই প্রেসিডেন্ট এ ধরণের ঘোষণাপত্র তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে তাদের কাছে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাপত্রের তেমন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। পরবর্তিকালে তাদের এ ধরণের মানসিকতা এবং প্রজ্ঞার অভাবেই জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়।
ঢাকার আলোচনায় আবার ফিরে যাওয়া যাক। ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে তখন প্রতিদিন বৈঠক হচ্ছিল সকাল-বিকাল। আলোচনা চলছিল দুই পর্যায়ে। প্রেসিডেন্ট এবং মুজিবর রহমানের মধ্যে এবং দুই পক্ষের বিশেষজ্ঞদের মাঝে। প্রেসিডেন্টের পক্ষে বিশেষজ্ঞ ছিলেন জাষ্টিস কর্নওয়ালিস, জেনারেল পীরজাদা, জনাব এম এম আহমদ। চতুর্থ সদস্য ছিলেন কর্নেল হাসান। জান্তার মূল সদস্যদের মাঝে জেনারেল হামিদ, জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিট্টা প্রমুখ সবাই তখন ঢাকায়। তারা তখন নিয়মিত নিজেদের মধ্যে এবং প্রেসিডেন্ট এর সাথে আলোচনা করছিলেন সার্বিক অবস্থার গতিপ্রবাহ নিয়ে। আলোচনায় কেন্দ্র ও প্রাদেশিক অর্থনীতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ভবিষ্যত সম্পর্কের বিষয়গুলিই মূলতঃ প্রাধান্য পাচ্ছিল।
কর্নেল হাসানের মতে প্রেসিডেন্ট যখন শেখ মুজিবের দাবিগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে একের পর এক মেনে নিচ্ছিলেন তখন জেনারেলরা প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, জাতীয় সরকারকে দুর্বল করা হলে তার পরিণতির জন্য প্রেসিডেন্টকেই দায়ী থাকতে হবে :
পাকিস্তান আর্মির গর্বিত জেনারেলরা মনে করতেন জাতীয় মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব শুধু তাদেরই; পঞ্চাশ দশকে আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জাতীয় স্বার্থের একচ্ছত্র ধারক ও বাহক হয়ে উঠে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী। সর্বোপরিসরে রাজনীতিবিদদের তারা করুণার চোখেই দেখতেন। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের কোন ভূমিকা আছে এটা তারা নির্দ্বিধায় অবিশ্বাস করতেন। অবশ্য এর ব্যাতিক্রমও ছিল। সেনা বাহিনীর অনেকেই চাইছিলেন বর্তমান সমস্যার একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানই হওয়া উচিত। সমাধান অবশ্যই পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তখনকার পরিবেশে সেনা বাহিনীর বৃহৎ অংশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ সানন্দে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। তবে শর্ত ছিল একটাই শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখতে হবে। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও পাকিস্ত ানকে দ্বি-খন্ডিত করার পক্ষে ছিল না। তাদের দাবি ছিল সত্যিকারের নির্ভেজাল স্বায়ত্ব শাসন। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তারা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তারা চাইছিল অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে। কিন্তু সাধারণ জনগণের ইচ্ছার তখন কোন দাম ছিল না। পাকিস্তানের ভাগ্য তখন সুষ্পষ্টভাবে নির্ভর করছিল দুই রাজনৈতিক নেতার উপর। পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টো আর পূর্ব পাকিস্তানে জনাব শেখ মুজিব। কিন্তু উচ্চাভিলাসী দুই নেতাই তখন ক্ষমতার লোভে অন্ধ। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতাই তখন তাদের কাছে মুখ্য। ১৯৭০এর নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারনী বড় সমাবেশ প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। ঐদিন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান স্বয়ং শেখ মুজিব। এই শপথের শেষ বাক্যটি ছিল : ““জয় বাংলা”, “জয় পাকিস্তান’।” (দৈনিক পাকিস্তান ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১)। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের বিবরণী সম্পর্কে দৈনিক পাকিস্তানের ভাষ্য :
দেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়া শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক বিজয়কে সুসংহত করার স্বার্থে সন্ত্রাসবাদী দালালদের বাড়াবাড়ি দমনের জন্য দেশবাসীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন,”ইউনিয়নে-ইউনিয়নে, মহল্লায়-মহল্লায়, আওয়ামী লীগ গঠন করুন এবং রাতের অন্ধকারে যাহারা ছোরা মারে তাদের খতম করার জন্য প্রস্তুত হন।” রাতের অন্ধকারে যাহারা ছোরা মারে, মানুষ মারে সেই সব বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “চোরের মত রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করিয়া বিপ্লব হয় না। বিপ্লব চোরের কাজ নয়।” সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালালদের খতম করার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে বাশেঁর লাঠি এবং সুন্দরী কাঠের লাঠি বানাইবার পরামর্শ দেন। শেখ মুজিব বলেন, “প্রত্যেকের হাতে আমি হয় বাশেঁর; নয় সুন্দরী কাঠের লাঠি দেখিতে চাই।” উপরোক্ত দু’টো ঘটনার প্রথমটি অর্থাৎ শপথে ‘জয় পাকিস্তান’ যোগ করে দিয়ে স্পষ্টতঃ তিনি পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য অক্ষুন্ন রেখেছেন। দ্বিতীয় ঘটনাটিও এই আনুগত্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কেননা পাকিস্তানের অখন্ডতার মূলে আঘাত হেনে তথা ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ কায়েমের প্রস্তাব তুলে সশস্ত্র যুদ্ধের কর্মসূচী দিয়েছিলেন যে সমস্ত বিপ্লবীরা শেখ মুজিবের কাছে তারা হলেন সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালাল। স্বাধীনতাকামী এই সন্ত্রাসবাদীদের খতম করার জন্য বাঁশ ও সুন্দরী কাঠের লাঠির ব্যাপক আয়োজন করেছিলেন তিনি। একই ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শেখ মুজিব। এ সম্পর্কে ঐদিনের পাকিস্তান অবজারভারের প্রতিবেদন, “Sheikh Mujib thanked President Yahiya for fulfilling his commitment in holding the elections. However, he said that there was a section among his subordinates who are still conspiring to undo the election results.” বক্তব্যটা পরিষ্কার। শেখ মুজিবের এ অভিনন্দন যে যথার্থই অভিনন্দন ছিল তার প্রমাণ জেনারেল ইয়াহিয়া খানও রেখেছিলেন ১৩ই ফেব্রুয়ারী তার নির্দেশের মাধ্যমে। তিনি নির্দেশ দেন ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে। ২২শে ফেব্রুয়ারী তিনি তার মন্ত্রী পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঘোষণা দিলেন, “৬ দফা কারও উপর চাপিয়ে দেয়া হবে না।” (দি ডেইলী ডন, ১লা মার্চ ১৯৭১) এই ডন পত্রিকাটির মালিক হচ্ছে কুখ্যাত ২২ পরিবারের অন্যতম হারুণ পরিবার। এই হারুণ পরিবারেরই আর একটি প্রতিষ্ঠান আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে শেখ মুজিব বিনা কাজে কিন্তু মোটা বেতনে একটা চাকুরী করতেন। সে যাই হোক, ৬ দফার প্রশ্নে শেখ মুজিবের এই নমনীয়তা কেবল যে এ সংক্রান্ত তার পূর্ববর্তী বক্তব্য কিংবা আন্দোলনকারীদের আশা-আকাঙ্খার পরিপন্থী ছিল তাই নয়; বরঞ্চ পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সুস্পষ্ট প্রয়াসও ছিল। অর্থাৎ তার এ বক্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতির প্রমাণ। প্রেসিডেন্টের ১৩ই ফেব্রুয়ারীর ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করেন জনাব ভুট্টো। তিনি এই বলে হুমকি দেন, “যদি পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত কোন প্রতিনিধি ৩রা মার্চের অধিবেশনে অংশ গ্রহণ করার জন্য ঢাকায় যায় তবে তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে।” জনাব ভুট্টোর কট্টোর বিরোধিতার মুখে প্রেসিডেন্ট ১লা মার্চ এক বিবৃতির মাধ্যমে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন বাধ্য হয়েই। এর ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা হয়েছিল তার মর্মবাণী ছিল একটাই – স্বাধীন বাংলাদেশ।
২রা মার্চ বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজের পক্ষ থেকে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এই পতাকা উত্তোলনের জন্য শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে যে ভর্ৎসনা করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ শ্রোতা ও দর্শক আজও অনেকেই বেঁচে আছেন। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। এ জনসভায় ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, সভা শেষে শেখ মুজিব মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বক্তৃতার এক পর্যায়ে স্বয়ং শেখ মুজিবই মিছিলের কর্মসূচী বাতিল করেন। কারণ হিসেবে তিনি তৎকালীন আইজি পুলিশ জনাব তসলিমুদ্দিন সাহেবের বরাত দিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দকে বলেন, তার কাছে গোয়েন্দা বিভাগের খবর রয়েছে মিছিলে যোগদান করলে তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র এটেছে সামরিক শাসকগোষ্ঠি।
অত্যন্ত চতুর যুক্তি। সত্যিই কি জীবন নাশের হুমকির মুখে তিনি মিছিলের কর্মসূচী বাতিল ঘোষণা করেছিলেন নাকি স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠই তার কারণ ছিল সেটা গবেষণার বিষয়।
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দেন। এই ভাষণেই তিনি সর্বপ্রথম স্বাধীনতার কথাটি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
অবশ্য ভাষণের সমাপ্তিতে একই সাথে তিনি শ্লোগান দেন, “জয় বাংলা, জয় পাঞ্জাব, জয় সিন্ধু, জয় বেলুচিস্তান, জয় সীমান্ত প্রদেশ, জয় পাকিস্তান।”
একই ভাষণে এ ধরণের স্ববিরোধী বক্তব্যকে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে গ্রহণ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সেটা বিবেচনা করার ভার পাঠকগণের উপরই ছেড়ে দিলাম। আশ্চর্য্যজনক হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ‘দলিলপত্র’ নামক প্রকাশিত গ্রন্থে ঐ কয়টি শ্লোগানের উল্লেখ নেই। এর রহস্য কি? তবে এ শ্লোগানগুলো দিয়ে যে শেখ মুজিব তার ভাষণ শেষ উচ্চারণ করেছিলেন তার সাক্ষী হিসেবে বর্তমান রয়েছে সে সময়কার পত্র-পত্রিকা ও সেই জনসমাবেশে যারা উপস্থিত ছিলেন সেই সব ব্যক্তিবর্গ।
১৪ই মার্চ শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এর পরই ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৬ই মার্চ ১১টায় জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিব দেড় ঘন্টা কোন সাহায্যকারী ছাড়া রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ১৭ই মার্চ একইভাবে একান্ত বৈঠক হয়। এটাও ছিল সাহায্যকারী ছাড়া। মুজিব-ইয়াহিয়ার তৃতীয় দফার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় ১৯শে মার্চ শুক্রবার। এ দিন রাতে দুই পক্ষের ৩ জন করে উপদেষ্টা আলাদা বৈঠকে মিলিত হন। ২০শে মার্চ শনিবার আওয়ামী লীগের ৬ জন শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী নিয়ে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট আলোচনা করেন এবং পরে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের শেখ মুজিব বলেন, “আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।” তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথে তিনি এগুচ্ছেন।” এই বৈঠকের পর পাকিস্তানের খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশ পায় যে, মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মাঝে একটা বড় রকমের সমঝোতা হয়েছে। এ সম্পর্কে দি ডনে পরিবেশিত খবরটি ছিল, “Mr. Bhutto held a night long session on Monday with his party man examining the terms of the broad agreement and understanding reached between President Yahiya Khan and Sheikh Mujibur Rahman to end the present political crisis in the country.” (The Dawn, 25 March 1971) এই ব্রড এগ্রিমেন্ট সম্পর্কে শেখ মুজিব কিংবা তার আওয়ামী লীগ আজ পর্যন্ত খোলামেলা কিছুই দেশবাসীকে জানায়নি। আজঅব্দি দেশবাসীকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হল কেন?
২৫শে মার্চ রাতে আত্মসমর্পন বা গ্রেফতারের আগে বিশ্ববিখ্যাত ফরাসী দৈনিক লা’ মন্ডের সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেন, “Is the Pakistan govt. not aware that I am the only one able to save East Pakistan from Communists?” অর্থাৎ কম্যুনিষ্টদের খপ্পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার তিনিই একমাত্র ভরসা। তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন বিকল্প নেই। সাক্ষাৎকারটি না’ মন্ডেতে ছাপা হয় ৩১শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে।
২৫শে মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করে। এর আগেই শেখ মুজিব তার সহকর্মীদেরকে সরে পড়ার এবং জান বাচঁবার উপদেশ দিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনদের এমনকি তার গাভীটিকেও অন্যত্র সরিয়ে দেন। এমনকি তার বহুল পরিচিত বডিগার্ডকেও রাত সাড়ে ১০টার পর ৩২নং ধানমন্ডিতে আর দেখা যায়নি। পাকিস্তান আর্মি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি জায়গায় অভিযান চালিয়ে শেষ রাতের দিকে ৩২নং ধানমন্ডির বাসা থেকে শেখ সাহেবকে নিয়ে যায়। এদিকে চলতে থাকে একনাগাড়ে নির্বিকার পাশবিক গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস বেগম ফজিলাতুন নেসা (শেখ মুজিবর রহমানের স্ত্রী), শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পাকিস্তান সরকারের ভাতায় ঢাকা শহরে নিরাপদ জীবন যাপন করেছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবন ধারায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। পিজি হাসপাতালে শেখ মুজিবের বৃদ্ধা মা-বাবার চিকিৎসা হয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এবং শেখ হাসিনা এবং তার মা তাদের দেখতেও গেছেন হাসপাতালে ভিআইপি দর্শনার্থীর মত। কোন কোন দিন হাসপাতালে রাত্রিও কাটিয়েছেন নির্বিঘ্নে।
উপরোল্লিখিত ঘটনাবলী লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার পরোক্ষ ইংগিত প্রদান করা ছাড়া শেখ মুজিব একাত্তরের ৩রা জানুয়ারী থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী কোন অবস্থান গ্রহণ করেননি। শুধু ২১শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের বিশেষ জরুরী বৈঠকেই ঘটেছিল এর ব্যাতিক্রম।
শেখ মুজিবের বিশেষজ্ঞদের মাঝে ছিলেন জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ, জনাব নজরুল ইসলাম, জনাব মোশতাক আহমদ, জনাব কামারুজ্জামান, জনাব মনসুর আলী প্রমুখ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ। শাসনতন্ত্র বিষয়ে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন জনাব কামাল হোসেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ তাদের সাহায্য করেছিলেন। যদিও এদের কেউই প্রত্যক্ষভাবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছিলেন না তবুও তারা কট্টর দাবিগুলোর ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। তাদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করছিলেন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক মদদপুষ্ট কয়েকজন বিদেশী অর্থনীতিবিদ। প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবের মধ্যে বৈঠক চলে ২২শে মার্চ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরাও ঢাকায় আগমন করেন। ২১শে মার্চ জনাব ভুট্টো তার দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ মুজিবের বোঝাপড়া হয়ে যাচ্ছে মনে করেই ভুট্টো হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ঢাকায় এসে হাজির হন। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আলোচনাকালে তার উপস্থিতি ছিল নির্দ্বিধায় বিশেষ প্রয়োজনীয়। তাই তার ঢাকা আগমনে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ঘটনা ঘটে হিতে বিপরীত। ঢাকায় পৌঁছেই তিনি প্রেসিডেন্টের প্রণীত বসড়া ঘোষণাপত্রের তীব্র সমালোচনা করেন। ঘোষণাপত্রের অনেক বিষয়ে তিনি আপত্তি জানান। তিনি দাবি করেন জাতীয় গণপরিষদ বসার আগে মার্শাল’ল উঠিয়ে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি হবে। ফলে আইনগত শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষণাপত্রও তার বৈধতা হারাবে। অতএব, জাতীয় সংসদের অনুমোদন নিয়েই সবকিছু করার দাবি জানান তিনি।
তার এ ধরণের নেতিবাচক মনোভাব ও কার্যক্রম সমঝোতার প্রক্রিয়ায় শুধু যে বাধার সৃষ্টি করছিল তাই নয় অবস্থাকে করে তুলেছিল স্থবির। যাই হোক, প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে ২২শে মার্চ ইয়াহিয়া, মুজিব এবং ভূট্টোর সম্মিলিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। বৈঠকের ঠিক আগের দিন এক হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা ঘটে। শেখ মুজিব হঠাৎ করে প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের এক প্রস্তাব পাঠান। প্রেসিডেন্টের সম্মতি পেয়ে শেখ মুজিব জনাব তাজুদ্দিনকে সঙ্গে করে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রেসিডেন্ট এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। বৈঠকে মিলিত হয়ে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টকে জানান আওয়ামী লীগ চায় আলাদাভাবে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রিয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করতে তিনি অপারগ। তার মানে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দেশকে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ভীষণভাবে আশাহত হয়ে পড়েন। তার দাবি প্রত্যাহার করার অনুরোধ করেন। তিনি তাকে এটিও স্মরন করিয়ে দেন যে, রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর কারার জন্য তিনি জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেশকে দ্বি-খন্ডিত করার কোন অধিকার তার নেই। তিনি শেখ মুজিবকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে আরো বলেন, “তার বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ অবশ্যই শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে।” এভাবেই ২১শে মার্চের বৈঠকে অনেকদিনের প্রচেষ্টার ফলে গড়ে উঠা বিশ্বাস, আস্থা এবং সমঝোতার ভিত ভেঙ্গে চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে যায়। আলোচনা হয়ে উঠে অর্থহীন।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হল, হঠাৎ করে শেখ মুজিব এ ধরণের ডিগবাজি খেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করলেন কেন? তিনিতো সেই একই ব্যক্তি; যিনি সবসময়ই সামরিক জান্তাকে বলে এসেছেন পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করা তার রাজনীতি নয়। ‘৭০ এর নির্বাচনে তিনি ভোটারদের কাছ থেকে ভোট গ্রহণ করেছিলেন এই বলে, “পাকিস্তান টিকে থাকাবার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। কোন শক্তিই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে না।” (শেখ মুজিবের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণ) শেখ মুজিব খুব ভালোভাবেই জানতেন পাকিস্তানের শাসকমন্ডলী পাকিস্তানের অখন্ডতার প্রশ্নে কোন আপোষ করবেন না। সর্বশক্তি দিয়ে তারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবেন আর তার পরিণতি হবে ভয়ংকর।
মন্ত্রীত্বের ইস্যু তুলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচিত হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টকে ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী-মুজিব। কেননা, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তির বিকাশ আমেরিকার জন্য দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠে ছিল। এই দুই নেতা সেখানে আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্ট দু’টোকে ভেঙ্গে আমেরিকার উদ্বেগের অবসান ঘটান। এভাবেই সূচিত হয় সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই সম্পর্কের বন্ধন আরো পোক্ত হয় হারুণ পরিবারের সাথে সখ্যতার মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান ক্ষমতায় এসে যে সমস্ত সম্মানিত ব্যক্তিকে দুর্নীতির দায়ে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করেছিলেন তার মধ্যে হারুণ পরিবারে একজন বহুল পরিচিত সদস্যও অর্ন্তভুক্ত ছিলেন। শুধু কি তাই? পরিবারের প্রধান জনাব ইউসুফ হারুণকে দেশান্তরী হয়ে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল অনেকদিন। জনাব ভুট্টো পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তিনি CIA-এর দালাল। জেনারেল আইয়ূব খান অবশ্য নিজেও ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকার পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়ে কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে যুদ্ধ জোটের প্রধান শরিক আমেরিকার পাকিস্তানের প্রতি আচরণ আইয়ূব খানের মনঃপুত হয়নি। তার এই অসন্তোষ লিখিতভাবে আমেরিকাকে জানিয়ে দিয়ে একই সাথে তৎকালীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জানি দুশমন কম্যুনিষ্ট গণচীনের সাথে দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়নে যত্নবান হয়েছিলেন জেনারেল আইয়ূব। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এই উদ্যোগ আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় তার এই ‘বেয়াদবীর’ সমুচিত সাজা দেবার জন্য আমেরিকা আইয়ূব বিরোধী চক্রান্তে মেতে উঠে। তাদের এই প্রচেষ্টায় যোগ দেয় আমেরিকার পুরনো এবং বিশ্বস্ত – আস্থাভাজন আলফা ইন্সুরেন্সের বেতনভূক নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং বিদগ্ধ হারুণ পরিবার। আর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ঘোষিত ৬ দফা হচ্ছে তারই ফসল। ৬ দফা অতি উগ্র কর্মসূচী হলেও শেখ মুজিব ৬ দফাকে কখনোই পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির বিপরীতে দাঁড় করাননি। যে মুহূর্তে আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় পকিস্তানের জাতীয় সংহতি বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে সে মুহূর্তেই শেখ মুজিব সংহতির পক্ষে দাড়িয়েছেন। ৬ দফাকে মূলতঃ সাধারণ নির্বাচনের বৈতরণী হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন জনাব শেখ মুজিব। কারণ, আইয়ূব খানকে শায়েস্তা করার জন্যই ৬ দফার পেছনে আমেরিকান সমর্থন ছিল কিন্তু ৬ দফার দ্বারা পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার ইচেছ ছিল না আমেরিকার। এই ব্যাপারে শেখ মুজিবকে পরিষ্কারভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জনাব জে. ফারল্যান্ড। জনাব ফারল্যান্ড মার্চ মাসের উত্তাল অবস্থায় ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সাথে দুইবার গোপনে এবং একান্তভাবে সাক্ষাত করেন বুড়িগঙ্গায় নৌ বিহারের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরি তার ‘লাষ্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তানে’ লিখেছেন, “মার্কিন রাষ্ট্রদূত জনাব জে ফারল্যান্ড মার্চ মাসে ঢাকায় এসে মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে পরিষ্কারভাবে বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান সংকটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি আভ্যন্তরীন সংকট বলেই মনে করে এবং এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শেখ মুজিব কোন সাহায্যই আশা করতে পারেন না যা পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী বলে বিবেচিত হবে। এতসমস্ত পরিষ্কার জানার পরও শেখ মুজিব কোন সাহসে ২১শে মার্চ সবরকম বোঝাপড়ার উপর পানি ঢেলে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে চতুরতার সাথে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে কনফেডারেশনের আচ্ছাদনে পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার প্রস্তাব রেখেছিলেন? এই সাহসের মূল উৎস ও সমর্থন সম্পর্কে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জনাব জে. ফারল্যান্ড পরবর্তিকালে লন্ডনে জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরিকে বলেছিলেন, “আমি যখন ঢাকায় একাত্তরের মার্চ মাসে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, পাকিস্তানের স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমে তাকে যুক্তরাষ্ট্র কোন প্রকার সাহায্য করবেনা তখন মুজিব বেশ কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার প্রতি সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন ও পূর্ণ সহযোগিতা ছিল সুনিশ্চিত। ‘৭০ এর নির্বাচনের পর মস্কোপন্থী পার্টিগুলো মস্কোর ইঙ্গিতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে সার্বিকভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে থাকে। তাদের মাধ্যমেই শেখ মুজিব মস্কোর সমর্থন পেয়েছিলেন। ভারতের সমর্থন আদায়ের যোগসুত্র ছিল জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ।” (পাকিস্তান সরকারের অপ্রকাশিত নথিপত্র)
‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ‘৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর ‘আসসালামু আলাইকুম’ ঘোষণা, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, সিরাজ সিকদারের জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচী ঘোষণা, কাজী জাফরের স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলার কর্মসূচী, ‘৭০ সালের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ঘোষণা, ‘৭০ সালে পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ঘোষণা, ‘৭১ এর নববর্ষে মুজাহিদ সংঘের স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের রূপরেখা প্রকাশ, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের বিপ্লবী সরকার কায়েমের আহ্বান, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গ্রুপের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত গেরিলা যুদ্ধের সূচনা প্রভৃতি ঘটনার কথা বাদ দিলেও নিঃসংশয়ে বলা যায়- ‘৭১ এর ১লা মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল তার মর্মবাণী ছিল:- কোন সমঝোতা নয়, আপোষ নয়, চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। আপোষহীন এই গণচেতনার প্রচন্ড চাপের মুখে যে কোন আপোষ ফমূলা বাস্তবায়িত করা শেখ মুজিবের পক্ষে হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজের নিম্নে প্রদত্ত বক্তব্যটি প্রানিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “এটা সঠিক যে আওয়ামী লীগের বিরাট অংশ আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে ৬ দফার সঙ্গে আপোষ করে পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় ক্ষমতায় যাওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এক পর্যায়ে আমাদের অজ্ঞাতে শেখ মুজিবকেও তাদের প্রস্তাব মানতে বাধ্য করে। গোলটেবিলের আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং পিপলস পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত গোপন থাকলেও যেদিন আমরা এই সিদ্ধান্ত জেনে ফেলি সেই দিনই রাত ১০টায় আমরা কয়েকজন ধানমন্ডির এক বাসায় বৈঠক করি এবং দীর্ঘ আলোচনার পর রাত ১টার দিকে আমরা কোরআন স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করি এবং রাত দেড়টায় শেখ মুজিবের বাসভবনে যাই ও তার সাথে সাক্ষাৎ করে সরাসরি একথাই বলি, “আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করলে আপনার সাথে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।” শাহজাহান সিরাজ তখন ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। (‘একাত্তরের গণহত্যা আসল নায়ক কে? লেখকঃ আব্দুর রহিম আজাদ)
উল্লেখিত জনাব শাহজাহান সিরাজের বক্তব্য থেকে তখনকার সময়ে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উপর স্বাধীনতার দাবির চাপের প্রচন্ডতা ও গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। সার্বিক অবস্থা তখন সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই বাস্তবতা শেখ মুজিব ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। তাদের এই নাজুক ও অসহায় অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে অতি চতুরতার সাথে সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতার মোক্ষম টোপটি ফেলেছিল ভারত ও রাশিয়া। তাদের দেশীয় দালালরা মুমুর্ষ রোগীর মত শেখ মুজিবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচতে হলে এই টোপ গলধঃকরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বরাবরই স্ববিরোধী ও দোদুল্যমান সুবিধাবাদী চরিত্রের অধিকারী শেখ মুজিব স্বীয় ও দলীয় স্বার্থের খাতিরে ২১শে মার্চ বৈঠকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তবু ও ২২শে মার্চ ত্রি-পাক্ষিয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের বিবরণ দিতে গিয়ে পরে জনাব ভুট্টো বলেন, “বৈঠকে শেখ মুজিব সরাসরি আমাকে প্রস্তাব দেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেবেন তিনি। তার মতে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এড়াবার জন্য অন্য কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।” জনাব ভূট্টো আরো বলেন, “শেখ মুজিবের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার জানিয়ে দেই এ প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ এ প্রস্তাব পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার চক্রান্ত।”
২৩শে মার্চ। এ দিনটি পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটা শুধু প্রজাতন্ত্র দিবসই নয়, এ দিনেই পাকিস্তানের স্থপতি জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঘোষণা করেছিলেন ভারতের মুসলমানেরা তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। এ ঘোষণার দিনটি পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই মহাসমোরহে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ছিল ব্যাতিক্রম 1 ক্যান্টনমেন্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি অফিস-আদালত এবং অন্যান্য সরকারি ভবনগুলোতে মুজিবের নির্দেশে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে উড়িয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের পতাকা। মুজিব তার বাসভবনে বাঙ্গালী ছাত্র জনতার জঙ্গী মিছিল থেকে অভিবাদন গ্রহণ করেন। ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাছাড়া শেখ মুজিবের ঐ দিনের বিজ্ঞপ্তি এবং বক্তৃতাগুলিও ছিল নেহায়েত উস্কানিমূলক। এতে করে জান্তার ভিতরের মুজিব বিরোধী চক্রের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো দৃঢ়তা লাভ করে। এভাবে ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের ইতিহাসে এক আশংকাজনক অবস্থার সৃষ্টি করে। একই দিনে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের ঘোষণাপত্রের পরিপন্থী তার প্রণীত শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞদের কাছে পেশ করেন। শেখ মুজিব তার খসড়ায় পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেন। এভাবেই প্রেসিডেন্টের কাছে তথা সমগ্র জাতির কাছে তার দেওয়া কথার বরখেলাপ করে তিনি পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন। প্রেসিডেন্ট মুজিবের প্রতারণায় হতাশ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তার এক সহকর্মীর সাথে আলাপকালে তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে উক্তি করেন, “ওরা সৈনিক নয়। তারা চতুর রাজনীতিবিদ। তাদের কথার কোন দাম নেই। স্বার্থের জন্য তারা সবকিছুই করতে পারে।”
এভাবেই সব আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করে ইসলামাবাদ ফিরে আসেন। ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট এবং ভুট্টো ঢাকা আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য শেখ মুজিবকেই সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন। শেখ মুজিবকে তিনি বেঈমান বলেও আখ্যায়িত করেন। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, “মুজিবের প্রস্তাব ছিল দেশকে দ্বি-খন্ডিত করার এক সূক্ষ পরিকল্পনা। তার একগুয়েমী, অনমনীয়তা এবং যুক্তিযোগ্য আলোচনায় অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শেখ মুজিব এবং তার রাজনৈতিক দল জাতির চরম শত্রু। সে পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করতে চায়। তার অভিসন্ধি জাতীয় স্বাধীনতা ও সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ। তার এ ধরণের পরিকল্পনা ও কার্যকলাপের সমুচিত জবাব দেয়া হবে।”
এ ভাষণের জবাবে জনাব তাজুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রমাণ করে তিনি ও তার জেনারেলরা কখনো আন্তরিকভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান চাননি। আলোচনার মাধ্যমে সামরিক প্রস্তুতির জন্য তারা শুধু সময় নিচ্ছিলেন। আলোচনার সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি করে সৈন্য ও গোলাবারুদ মজুদ করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙ্গালীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনকে গুলির আঘাতে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য চলেছে গভীর ষড়যন্ত্র। এটা নিঃসন্দেহে জাতির সাথে বেঈমানীর এক চরম নিদর্শন। সামরিক শ্বেতসন্ত্রাসের নীলনকশা চূড়ান্ত করার জন্যই প্রেসিডেন্ট আলোচনার বাহানায় ঢাকায় আগমন করেন।”
পাকিস্তানের মত একটি বহুজাতিক দেশের জন্য শুরু থেকেই প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর মধ্যে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল এবং পরিকল্পনা নির্ধারনের জন্য যে সহযোগিতা অতি আবশ্যক ছিল তা নিশ্চিত করার জন্য নিম্মে বর্ণিত বিষয়গুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত ছিল জাতীয় পরিসরে
১। সব জাতীয় এলিট শ্রেণীর সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বকারী সরকার কায়েম করা।
২। বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে ঐক্যমত্য এবং একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩। সর্বক্ষেত্রে একতা ভিত্তিক সহজলভ্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
৪। জাতির লক্ষ্য এবং আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর জনগণকে অনুপ্রানিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করা।
৫। যে কোন বিচ্ছিন্নবাদী প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া; বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয় এবং তা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই।
৬। অর্থনৈতিক সুবিধাদি যাতে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছে তা নিশ্চিত করা। আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়নের সুফল সমভাবে যাতে সব জাতিগোষ্ঠিই উপভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জাতীয় এলিট শ্রেণীগুলো কর্তৃক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জনগণের মাঝে জাতীয় সম্পদ ও সুবিধাদির সুষম বন্টন নিশ্চিত করা।
এ ধরণের কৌশল এবং পরিকল্পনা সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই ছিল না, কিন্তু এর ফলে আশা করা যেত জাতীয় রাজনৈতিক অবকাঠামোতে বর্জনের পরিবর্তে ঐক্যের মাধ্যমে বহুজাতিক দেশের অখন্ডতা বজিয়ে রাখা।
ধারণা করা চলে, ন্যায্য অধিকার পাবার জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার জনগোষ্ঠি কিছুকাল হয়তো বা প্রলম্বিত শিল্পায়নের পরিকল্পনা এবং স্তিমিত আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকেও মেনে নিত। যে কোন ব্যক্তির পক্ষে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে দরিদ্র হয়ে থাকাটা সহনীয় হয় তখনই যখন তার পড়শীরা সমাজে অর্জিত ধন-সম্পদের বড়াই করার সুযোগ না পায়। একটি দেশ উন্নত হতে পারে শুধুমাত্র ঐক্যের ভিত্তিতে। বৈষম্য এবং বিভক্তি এক অথবা একাধিক জাতিগত রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠিরই হয় সমূহ ক্ষতি। এ জন্যই বহুজাতিক একটি দেশের এলিট শ্রেণীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা অপরিহার্য হয়ে দাড়ায় শ্রেণী স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ দু’টোই বজিয়ে রাখার জন্য। কোন এক বিশেষ পর্যায়ে তারা অবশ্যই নিজ নিজ জাতি স্বার্থে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু কোনক্রমেই তাদের একে অপরের সহ্যশক্তি ও বোঝাপড়ার ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। তেমনটি হলে বিচ্ছিন্নবাদের বিপদসংকুল একতরফা রাস্তা অবশ্যই খুলে যাবে :
তথাকথিত ইসলাম ও ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্বজাধারী পাঞ্জাবী-মোহাজের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রিয় সরকার শুরু থেকেই বাঙ্গালীদের নিঃস্ব, হীনমনা এবং পশ্চাদমুখী জনগোষ্ঠি হিসাবে গন্য করে আসছিলেন। তারা মনে করতেন বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস্তানের উপর একটি বোঝাস্বরূপ। তারা বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে বাঙ্গালীর জাতিগত চেতনা এবং তাদের হিন্দুয়ানী মনোভাব সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাই হোক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আইয়ূব খানের প্রণীত অর্থনীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প উদ্যোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঐ সমস্ত উদীয়মান শিল্প উদ্যোগীরা সরকারি মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠা পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তাদের সাথে হাত মেলান। সমস্ত বাঙ্গালী শিল্পপতিরা ইম্পোর্ট লাইসেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার কোটা বাড়াবার জন্য ঐ আন্দোলনকে কেন্দ্রের উপর চাপ প্রয়োগকারী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। শেষ পর্যায়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাঙ্গালী জাতির বিভিন্ন শ্রেণীকে একক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী এলিট শাসক শ্রেণী অসঙ্গতভাবে তাদের বাঙ্গালী দোসরদের হীনমন্য, পশ্চাদমূখী এবং হিন্দু মনোভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত করেন। এই ধরণের মনোভাব বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। তদপুরি শেখ মুজিবের বিচার দেশের নাজুক ঐক্যের উপর হানে চরম আঘাত। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় মুজিবের ৬ দফায় কোন নতুন কিছু ছিল না। অতীতে বহুবার এ ধরণের দাবিসমূহ বাঙ্গালী সাংসদগন কেন্দ্রিয় সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘোষণার সময়টি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘোষণাটি করা হয় এমন এক সময় যখন সারা দেশ জুড়ে এক জটিল রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজমান। দেশ জুড়ে জনগণ তখন আইয়ূব শাহীর নিষ্পেষন এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
আইয়ূব শাহী আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন প্রচেষ্টাতো করেইনি বরং পাঞ্জাবী- মোহাজের এলিট শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থকে লালন করে তাদের আধিপত্যকে আরো সুসংহত করে তোলে। সামরিক শাসনকালে কেন্দ্রিয় প্রশাসনে বাঙ্গালীদের প্রতিনিধিত্ব একরকম ছিল না বললেই চলে। ষাটের দশকে যখন বাঙ্গালীদের ধৈর্য্যের বাধঁ প্ৰায় ভেঙ্গে পড়ছিল ঠিক তখনই পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাসঘাতক এবং শত্রুশক্তি ভারতের দালাল হিসাবে আখ্যায়িত করার ফলে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। বাংলাভাষী জনগণ যার। দ্ব্যর্থহীনভাবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন তারা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে এ ধরণের ব্যবহার কখনোই প্রত্যাশা করেনি। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সত্যটিই অতি সহজে ভুলে গিয়েছিলেন পশ্চিমা শাসকগণ। যদিও বাহ্যিকভাবে মুজিবের দাবিগুলো ছিল চরম প্রকৃতির। পাকিস্তান তখনও ছিল অতিপ্রিয় প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছে; বাঙ্গালী জনগণ শুধু চেয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মত প্রকাশের ন্যায্য অধিকার তারা চেয়েছিল সাম্য ও সংহতির উপর একটি রাজনৈতিক কাঠামো।
তারা চাইছিল স্বৈরাচারী একনায়কত্বের পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক সরকার। স্বৈরাচারী একনায়কত্ব তাদের অতীতের হিন্দু আধিপত্য ও অত্যাচার এবং ঔপনিবেশিক শোষণকেই জোরালোভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল। এ থেকে এটাই পরিষ্কারভাবে বলা চলে, বাঙ্গালীরা সুচিন্তিত কতগুলো লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্যই মূলতঃ সংগ্রাম করছিল। কোন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করার জন্য নয়। এটা জোর দিয়েই বলা চলে যে, আইয়ূব শাহীর পতনকালে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা মোটেই অবধারিত পরিণতি ছিল না। জাতীয় রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বাঙ্গালীদের অংশদারিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে ক্ষমতাধর শাসকচক্র বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের আন্দোলনের প্রতিই ঠেলে দিয়েছিল এবং তাদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈষম্যকে পূর্ণঃজীবিত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে বাধ্য করেছিল জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে। এ থেকে পরিশেষে এটাই বলা চলে যে অসম উন্নয়নই বাধ্য করেছিল বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিবর্তে বাঙ্গালীত্বকে উকে দিতে। বাঙ্গালীত্বের চেতনাই তখন আঠারমত বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের সাথে এক অটুট বন্ধনে বেধেছিল। অসম উন্নয়ন, শোষণ, বঞ্চনা, এবং নৃতাত্ত্বিক চেতনা ঐ ধরণের লোভী জোঁক যা একে অপরকে শুষে বেঁচে থাকে সেই সময় অব্দি যখন সশস্ত্র সংঘাত অথবা গণঅভ্যুত্থানের বিকল্প কোন পথই খোলা থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্য পাকিস্তানও ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে অপরিহার্য এক মহা বিপর্যয়ের অপেক্ষা করছিল ষাটের দশকের শেষে। অন্তিম অবস্থায় সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বন্দুকের জোরে করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর আর্মি ক্র্যাকডাউন। পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাঙ্গালীদের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য বর্বরোচিত সশস্ত্র অভিযান শুরু করে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে। এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে দেশ বিভক্তি।