ত্রয়োদশ অধ্যায় – স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ও আদর্শিক কারণে আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন
- ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন ও তার মন্ত্রী পরিষদ ঢাকায় এলেন ২২শে ডিসেম্বর।
- জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এককভাবে ক্ষমতায় বসানো হল ইয়াহিয়া খানের এলএফও-এর আওতায় নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগকে।
- আওয়ামী লীগের আদর্শিক দেউলিয়াপনা।
- দেশ স্বাধীন হলেও শাসকশ্রেণীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটল না।
- ‘৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের কোন উল্লেখ ছিল না, কিন্তু দেশে ফিরেই সমাজতন্ত্রের জিকির তুলল আওয়ামী লীগ।
- নীতি-আদর্শের ককটেল মুজিববাদের ধুম্রজালকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনে সংকট।
- ৩রা জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার।
- ১০ই জানুয়ারী ভারত হয়ে দেশে ফিরলেন শেখ মুজিব।
- ছাত্রলীগের ভাঙ্গন।
- ভারতীয় শাসনতন্ত্রের স্ববিরোধী চার মূলনীতিকে বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভ হিসাবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।
- জাতীয় পরিচিতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়।
- দেশের ভৌগলিক পরিসীমা নিয়েও চক্রান্ত।
- মাওলানা ভাসানীর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী।
- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর আত্মপ্রকাশ।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের অধিনে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের LFO ( Legal Frame Work) এর আওতায় পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার ওয়াদা করে নির্বাচন করেন শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার প্রধান হবার জন্যই জনগণ তাকে সে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে ২৫-২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙ্গালী জাতির উপর শ্বেত সন্ত্রাস চালিয়ে অস্ত্রের জোরে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়ে পড়ে অর্থহীন। বাংলাদেশের আপামর জনগণ পাকিস্তানী আচমকা হামলা ও শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যখন মরণপন করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে : আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। সশস্ত্র সংগ্রামের কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না বলেই তাদের দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে হয়। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিজয়ের পিছনে রয়েছে সমগ্র জাতির অবদান। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্বের একমাত্র দাবিদার হয়ে কোন যৌক্তিকতায় আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দলীয়ভাবে কব্জা করে নিল তার জবাব অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে দেশপ্রেমিক ঐতিহাসিকদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে জনাব এ কে খন্দোকার ও মাঈদুল হাসানের মধ্যে প্রায় চার ঘন্টা দীর্ঘ এক আলাপ হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত সম্পর্কের মূল্যায়নের জন্য সেই আলোচনার সারাংশ এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যুদ্ধকালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ এবং জনাব মাঈদুল হাসান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে একজন পরামর্শদাতা। তাদের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্নেল ওসমানীকে বাইপাস করে মূলতঃ যোগাযোগ রক্ষা করতেন জনাব তাজুদ্দিন এবং খন্দোকার সাহেবের সাথে। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে বেশিরভাগ আলোচনাও হত গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার সাহেবের সাথেই। জেনারেল অরোরা, ব্রিগেডিয়ার জ্যাকব, ব্রিগেডিয়ার গুপ্তই ছিলেন মূলতঃ তাদের counter part.
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে বীর বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন তার যথার্থ মূল্য ভারত কখনোই দিতে চায়নি। এ নিয়ে মুক্তি ফৌজের কমান্ডারদের সাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রথম থেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনার জন্য মুজিবনগরে (৮নং থিয়েটার রোড) কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে একটি হেডকোয়টার্স স্থাপন করা হলেও জনাব ওসমানীর কর্মক্ষমতা ছিল সীমিত। জুলাই মাস অব্দি মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডাররা হেডকোয়াটার্স এর কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্যই পাননি সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য। বিভিন্ন সেক্টরে কমান্ডাররা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উদ্যোগেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ প্রসঙ্গে এভিএম খন্দোকার বলেন, “আমি যখন কোলকাতায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখলাম যে, হেডকোয়াটার্সের সাথে সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই এবং এ পর্যায়ে ভারত আমাদের সংগ্রামে তেমন কোন সাহায্যই দেয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে কোন সঠিক নীতিও গড়ে তুলতে পারেনি তারা। তবে তারা তখন চাচ্ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ইস্যুটা জিয়ে থাক। ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা চাচ্ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা এবং গতি- প্রকৃতি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের বুঝে নিয়ে তারা তাদের নীতি চূড়ান্ত করবেন। চুড়ান্ত নীতি নির্ধারন করার সময় পর্যন্ত সমস্ত বিষয়টাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তারা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং সেনা বাহিনীর এ ধরণের মানসিকতার ফলে ভারতীয় সেনা বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে বৈরীভাব এবং রেষারেষি পরবর্তিকালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর মধ্যে যে ভারত বিরোধী মনোভাব দেখা যায় সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই crystallize করে।” এ প্রসঙ্গে জনাব খন্দোকার আরও বলেন, “মুক্তিফৌজ এবং ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে বিরোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকেই দাঁনা বেধে উঠেছিল বিভিন্ন কারণে। ঐ সেন্টিমেন্ট, আবেগ-অনুভূতি বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন Disapointment এর মধ্য দিয়ে ক্রমশঃ আরো বেড়েছে।” মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্য ও সহযোগিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার বলেছেন, “মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট পর্যন্ত ভারতের Involvement ছিল অতি সামান্য। যা ছিল তা মোটামুটিভাবে মুক্তি বাহিনীর জন্য কিছু যৎসামান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, কিছু Logistical support এর বেশি কিছুই নয়। মুক্তিফৌজ কমান্ডারদের মূলতঃ শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সম্ভারের উপর নির্ভর করেই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল স্বাধীনতা সংগ্ৰাম।”
মুক্তিফৌজ সেক্টর কমান্ডারদের জুলাই মাসের কনফারেন্সের কথা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা হিসেবে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হবে। এ প্রসঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “সেক্টর কমান্ডারদের মিটিং এর পর একদিন জেনারেল অরোরা এলেন। মিটিং হল। কর্নেল ওসমানীর সাথে সেই মিটিং এ আমিও উপস্থিত ছিলাম। মিটিং এ আলোচনার মূল বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে কতজনকে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কোথায় কোথায় ট্রেনিং দেওয়া হবে, কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কি করে রিক্রুটমেন্ট করা হবে, কতদিন ট্রেনিং দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। জেনারেল অরোরা প্রস্তাব দিলেন পাঁচ হাজার গেরিলা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলেই হবে। শুনে কর্নেল ওসমানী এবং আমি দু’জনেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি বলেই ফেললাম এত অল্প সংখ্যক গেরিলা দিয়ে কি হবে? জবাবে জেনারেল অরোরা বললেন. “These are the people who will go inside bleed the enemy and all those things.” কর্নেল ওসমানী জেনারেল অরোরাকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন তার দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার দরকার। সেক্টর কমান্ডারদের সদ্য সমাপ্ত কনফারেন্সে সেটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাই হোক ট্রেনিং শুরু হল। ট্রেনিং শেষ করে গেরিলারা ফিরে আসল। কিন্তু তারপর একটা বিরাট সমস্যা দেখা দিল। এ সমস্যাটার জন্য পুরোপুরি দায়ী ভারত সরকার। ট্রেনিং এর পর ভারতীয় আর্মি সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের অধিনে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এতে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল। ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের বিভিন্ন সেক্টর থেকে রিক্রুট করা হয়েছিল। ট্রেনিং-এর পর তারা স্ব স্ব সেক্টরে ফিরে গিয়ে তাদের প্রিয় সেক্টর কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করবে এটাই ছিল তাদের আশা। ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করতে তারা রাজি হল না। ভারতীয় বাহিনী ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেশের ভেতরে তাদের কমান্ডের আওতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেটা আমাদের হেডকোয়াটার্সকেও জানতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কিছু জায়গায় জোর করে ইন্ডিয়ান কমান্ডাররা গেরিলাদের পাঠায় মূলতঃ লুটপাট করে নিয়ে আসার জন্য। যুক্তি হিসেবে তাদের বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চালাতে হাতিয়ারপাতির সাথে টাকা-পয়সারও প্রয়োজন রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এ ধরণের অমানবিক অপারেশন এবং ইন্ডিয়ান আর্মির অধিনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে তাদের নিজ নিজ সেক্টরে পালিয়ে যায়। এর ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া even at a later date was very bad মুক্তিযোদ্ধারা did not like the way Indian Army wanted them to be used. অল্প সময়ের মধ্যেই সব সেক্টরে এ সম্পর্কে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হয়। এ খবর জানাজানি হয়ে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর কমান্ডারদের দাবি অনুযায়ী আমাদের হেডকোয়াটার্স থেকে চাপ দেয়া হল, ‘আমাদের এই ট্রেইন্ড গেরিলাদের বাংলাদেশী কমান্ডারদের হাতে না দিলে This will be a disaster and catastrophe. বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত গেরিলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডারদের হাতে দিতেই হবে। এ সম্পর্কে ভারতীয় মিলিটারী হাইকমান্ডের প্রথম থেকেই প্রচুর reluctance থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনিচ্ছাসত্ত্বে নেহায়েত নিরূপায় হয়েই আমাদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য মুক্তিফৌজদের কাউন্টার ফোর্স হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী (RAW) এবং সেনা বাহিনীর মিলিত চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল বিএলএফ। সে এক অন্য অধ্যায় : ভারতীয় নেতৃত্বের এ ধরণের মনোভাবের দু’টো কারণ হতে পারে। প্রথমত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফিল্ড কমান্ডারস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেনি। তাই তারা সবসময় মনে করত এদের উপর নির্ভর করা যায় না। দ্বিতীয়ত: তাদের মনে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত তাদের সরাসরি যুদ্ধের বিজয় ফল হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে বাংলাদেশ। তাই পাক বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য গেরিলা বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের শুধু ব্যবহার করতে হবে সীমিত লক্ষ্যে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বৃহৎ অংশ এবং সদস্যরা চেয়েছিলেন দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম পরিচালনা করে নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা স্বাধীন করবেন তাদের মাতৃভূমি। কিন্তু তেমনটি হয়নি। আমার মনে হয় এখানেই মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও সেনা বাহিনীর মধ্যে একটা Credibility Gap হয়ে গেছে। আমাদের সামরিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করব। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত মুক্তিকামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করলে আমরা অবশ্যই সে সাহায্যকে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু necessarily this is our struggle and we have to fight it ourselves. তাছাড়া শুধু ভারত কেন? পৃথিবীর যে কোন দেশ আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করতে চাইলে আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করব। মোটকথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে ভারত ও আমাদের মধ্যে approach of mutual confidence ছিল না বা কখনো গড়ে উঠেনি because of their overall policy. একথাও সত্য যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক সেক্টরে ইন্ডিয়ান কমান্ডারদের কার্যকলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। সত্যিকথা বলতে গেলে ৯ই আগষ্ট রুশ- ভারত চুক্তি সই হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের চেষ্টায়। ৯ই আগষ্টের পরই ভারত সরাসরিভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করে এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ইন্ডিয়ান আর্মি really started taking closer interest.”
মাঈদুল হাসান এ পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন, “ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ বোধ হয় স্বাধীনতা পেত না, কি বলেন?” খন্দোকার সাহেব মাঈদুল হাসান সাহেবের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, “যদিও মুজিবনগরের অনেকে এমনকি আমাদের মন্ত্রীসভার অনেকেই হতাশা বোধ করতেন, সংসদ সদস্যদের অনেকেই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ফিরে যাবার চিন্তা-ভাবনাও করছিলেন। মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় আস্থাহীন হয়ে হতাশা বোধ করতেন। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের কথা শুনলেই আতঁকে উঠতেন। ভাবতেন কি হচ্ছে। দেশে বোধ হয় আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতা বেড়ে গেলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে বলে যুক্তির অবতারণা করে যারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের সে যুক্তি ছিল সম্পূর্ণ ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পক্ষান্তরে আমরা যদি আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা প্রথম থেকেই বাড়াতে সক্ষম হতাম তবে আমাদের প্রচন্ড গেরিলা তৎপরতার মুখে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পন করতে হত মুক্তি ফৌজের কাছে। কারণ They had no chance to fight. Their moral was completely shattered and the losses would have been unacceptable to them.” (সংবাদ ২৬শে মার্চ ১৯৯০)।
জনাব মাঈদুল হাসান জবাবে বলেছিলেন, “আপনার চিন্তা-ভাবনায় যুক্তি থাকলেও ভারতীয়রা ভেবেছিলেন অন্যরকম। তারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে ছোট করে দেখাতে এবং বিশ্ব পরিসরে পাক-ভারত যুদ্ধের ফল হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে। এতে ভারত এক ঢিলে দুই পাখি বধ করতে সক্ষম হয়।
প্রথমত: ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে উপমহাদেশের প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ভারত।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার যৌক্তিকতা অর্জন করে।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মাঝে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ তাদের সরকারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ২২শে ডিসেম্বর ঢাকায় আগমন করেন। ঢাকায় এসেই তাজুদ্দিন সরকার ঘোষণা করে, “তাদের সরকার বিপ্লবী সরকার। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।” বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় অস্থানীয়দের স্থলে বাংলাদেশী বুর্জুয়াদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হল। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখা শুরু করলেন। ঠিক যেভাবে পাকিস্তানীরা দেখতো তাদের আপন স্বার্থ। পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। তা যাক, কিন্তু শত্রুতো থাকতে হবে। শত্রু এখন কে? শত্রু এখন জনগণ। জনসাধারনের পক্ষের শক্তিকে উৎখাত করার তৎপরতা চালানো হল সরাসরিভাবে। তেমনি চললো তাদেরকে নিজেদের লেজুড়ে পরিণত করার চক্রান্ত। জনগণ যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার এবং নিজেদের বাচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। তাই তাদেরকে শুধু ধোকা দেবার জন্যই সমাজতন্ত্রকে আওয়ামী লীগ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল নিজেদের স্বার্থেই। যদিও ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের কোন অঙ্গীকার ছিল না। সমাজতন্ত্রের শৃঙ্খলে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই নিজেদের বন্দী করতে আগ্রহী ছিল না। তাদের সর্বকালের দাবি ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। জনাব প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল তৎকালীন প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারী বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দল অন্যান্যদের সাথে প্রশ্ন তোলে। তারা বলে, “আওয়ামী লীগ সরকার বিপ্লবী সরকার হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি বিপ্লবই হয়ে থাকে তবে সে বিপ্লব শুধু আওয়ামী লীগই করেনি, করেছে এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। আর তাই সকল দলের প্রতিনিধি নিয়েই গঠন করতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সরকার।” তাদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ভারতীয় সাহায্যে প্রবাসকালের একলা চলো নীতিই ধরে রাখে। মস্কোপন্থী মোজাফফর ও মনিসিং গং ক্ষমতার অংশ না পেয়েও যুদ্ধকালীন সময় থেকেই তাদের বিদেশী মুরুব্বীদের ইচ্ছানুসারে আওয়ামী লীগ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে থাকে নির্লজ্জভাবে। ভারতীয় রাজনীতিতে সিপিআই যেভাবে কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত হয় ঠিক সে অবস্থাই হয়েছিল মোজাফফর ন্যাপ এবং মনিসিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টির বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
বাংলাদেশ নামে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু শাসক বুর্জুয়াদের মধ্যে জাতীয় চেতনার উম্মেষ ঘটল না। তাদের চরিত্রে রয়ে গেল মুৎসুদ্দী ধামাধরার প্রবণতা। আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কোন অবস্থাতেই ভবিষ্যতে মার্কিন সাহায্য বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না এই সাহসী সরকারি ঘোষণা মুজিবনগরে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেই বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি মার্কিন সাহয্য গ্রহণ করবেন। যুদ্ধের সময় ভারত বিরোধী ছিলেন যেসব বিত্তবানেরা তাদের বেশিরভাগই ভারতপ্রেমিক হয়ে দাড়ালেন রাতারাতি। প্রতিযোগিতার দৌড় শুরু হল ভারতীয় মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী গোষ্ঠির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে অল্প সময়ে চোরাকারবারের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবার। যে আওয়ামী লীগ চিরকাল ছিল মার্কিন ঘেষা, আমেরিকার প্রশ্নে যেখানে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানীর থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে, সেই আওয়ামী লীগ এর এতটুকু কষ্ট হল না সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুরাগী হয়ে পড়ে ভারতের সাথে চুক্তির দাসখত লিখে দিতে। মূলকথা মুরুব্বী চাই। ‘স্বাধীন হয়েও স্বাধীন নয়, স্থানীয় বটে তবে জাতীয় নয়’ প্রকৃতির আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করেছিল জাতীয় অর্থনীতিকে তাদের দলীয় নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্যই। রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে পাকিস্তানী বণিক সম্প্রদায় এবং শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ব্যবসা কেন্দ্র এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের পার্টির সদস্য ও সহযোগীদের পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। ব্যাবসা-বানিজ্যের লাইসেন্স পারমিটও দেয়া হয় অব্যবসায়ী অনভিজ্ঞ পার্টি টাউটদের। অর্থনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দলীয় সদস্যদের নব্য পুঁজিপতি হবার সুযোগ করে দেয়া হল সেই আদিম পদ্ধতিতে। এভাবেই একাত্তরের আগের অধ্যায়ে পাকিস্তানীরা লুট করেছে বাংলাদেশকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজতন্ত্রের ধুম্রজাল সৃষ্টি করে শুরু হল বাঙ্গালী নব্য পুজিঁপতিদের লুণ্ঠন। গরীব দেশবাসী আরো গরীব হল। জাতীয় অর্থনৈতিক মেরুদন্ড গেল ভেঙ্গে। রুশ-ভারতের চাপে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হিসেবে গ্রহণ করে সমাজতন্ত্রের অসাড়তাই প্ৰমাণ করেছিল আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ প্রচার করেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা খাঁটি সমাজতন্ত্রই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য কিছু নয়। তার এসব বক্তব্য ও প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের ক্ষমতার অর্ন্তদ্বন্দ্বগুলো ক্রমান্বয়ে উম্মোচিত হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান সমস্যার মোকাবেলার জন্য ১৯৭২ সালের ১০ই মে চট্টগ্রামে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের লেজুড় দল ন্যাপের সভাপতি জনাব মোজাফফর আহমদ সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানাতে বাধ্য হন।
আগেই বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অনাস্থা ও যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ উপদেষ্টা ভারতের অন্যতম কূটনীতিবিদ জনাব ডিপি ধরের পরামর্শে এবং বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতায় মুক্তি বাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ভারতীয় সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছিল বিএলএফ পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী। বাংলাদেশের চারজন ছাত্রনেতা ভারতীয় সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই চতুরঙ্গ তোফায়েল, রাজ্জাক, শেখ মনি ও আব্দুর রাজ্জাক পরবর্তিকালে বাংলাদেশের ‘চার খলিফা’ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। তাদেরই একজন জনাব তোফায়েলকে দিয়ে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ এ ঘোষণা করা হল, “মুজিববাদ কায়েম করব। মুজিববাদের চার স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।” তিনি মুজিববাদের একটি ব্যাখ্যাও দিলেন। তিনি বললেন, “মহান মার্কিন নেতা আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার জনগণকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কিন্তু সমাজতন্ত্র দিতে পারেননি। কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের স্থপতি কিন্তু তার দর্শনে ছিল না গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা। মুজিববাদে রয়েছে দু’টোই গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। সুতরাং মুজিববাদ বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ কিংবা রাজনৈতিক দর্শন।” তিনি আরো বলেন, “পুজিঁবাদ ও কম্যুনিজমের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে মুজিববাদ কায়েম করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে।” তিনি বাংলাদেশের জনগণকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ‘জাতীয় বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। জনাব তাজুদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই জনাব তোফায়েলের মাধ্যমে মুজিববাদ নামক এক উদ্ভট এবং অদ্ভূত রাজনৈতিক দর্শনের উপস্থাপনা করা হয়।
৩রা জানুয়ারী ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হবে বলে খবর প্রচার করে। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেই জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবকে ছেড়ে না দিলে তিনি ৯০,০০০ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের একজনকেও ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবেও তিনি আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে এবং বিশ্ব পরিসরে ভীষণ বেকায়দায় পরবেন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার ব্যাপারে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও তার আলোচনা হয় পর্দার অন্তরালে। শেখ মুজিবরের মুক্তির ব্যাপারে দি নিউইয়র্কস টাইমস ৩রা জানুয়ারী লেখে, “It is in everyone’s interest that Sheikh Mujib be returned to Dhaka as quickly as possible.” শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বোঝাপড়ার পর জনাব ভুট্টোর আদেশে ৮ই জানুয়ারী সকালে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। লন্ডন পৌঁছালে বেগম মুজিব টেলিফোনে তাকে সোজা বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেই তিনি ঢাকায় যাবেন। লন্ডন থেকেই টেলিফোনে মুজিব ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, “আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।” জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, “দীর্ঘ ২৫ বছরের তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে ইতিহাসের গতি বদলিয়ে দেয়ার জন্য আপনি আমার অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানবেন।”
তার মুক্তির খবরে খুশি হল আপামর জনসাধারণ। অনেকেই ভাবল শেখ মুজিব ফিরে এলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। জননেতা শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের গণবিরোধী নীতি ও ভারতের কাছে তাদের দেয়া দাসখত কিছুতেই মেনে নেবেন না। তিনি জণগণের আশা-আকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনে নতুন করে বাংলাদেশ-ভারত নীতি পূনর্নির্ধারণ করবেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোন প্রকার আপোষ করা কিছুতেই সম্ভব নয় শেখ মুজিবের পক্ষে। দলীয় স্বার্থের সংকীর্ণতার উর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকেই তুলে ধরবেন তিনি। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন তিনি। কিন্তু লন্ডন থেকে সোজা বাংলাদেশে আসার অনুরোধ উপেক্ষা করে দিল্লী যাবার তার সিদ্ধান্তে হতাশ এবং অবাক হলেন দেশবাসী। সেখানে শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা জানাতেই যাননি শেখ মুজিব। সেটা টেলিফোনেই জানিয়েছিলেন লন্ডন থেকে। তার দিল্লী যাবার আসল উদ্দেশ্য ছিল ইন্দিরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করা যে, তার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যেকার সব বোঝাপড়া এবং মৈত্রী চুক্তিকে তিনিও মেনে নেবেন। এভাবেই শ্রীমতি গান্ধীকে ব্যক্তিগতভাবে সম্ভ্রষ্ট করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেন শেখ মুজিব। তার এ ধরণের আচরনে সবাই বুঝতে পারলেন জাতীয় স্বার্থের বলি দিয়ে দলীয় স্বার্থের নামবলি গায়ে জড়িয়ে জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ক্ষমতার জন্য দলীয় নেতা হয়ে গেলেন নির্দ্বিধায়। জনগণের বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করলেন না জনগণের নয়নের মণি শেখ মুজিব। এভাবেই সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে শুরু হল জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার এক অদ্ভূত উপাখ্যান। ৬ই জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে স্বয়ং শেখ মুজিব বললেন, “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে; তবে সেটা হবে স্থানীয়ভিত্তিক। তারপরই শুরু হল মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার তান্ডবলীলা। মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, হবুমন্ত্রী, দলীয় নেতা, হবুনেতা, পাতিনেতার দল চরম প্রতিযোগিতায় দেশময় চিৎকার করে ত্রাসের সৃষ্টি করলেন এই বলে, “মুজিববাদ কায়েম কর। যে কেউ মুজিববাদের বিরোধিতা করবে তার ‘বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া হবে।” ১৯৭২ সালের ৯ই এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা জনাব কামরুজ্জামান এলান করলেন, “প্রতি থানায় থানায় মুজিববাদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।” তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী জুলাই মাসে বললেন, “মুজিববাদ বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক;” মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গড়ে তোলা হল একের পর এক বেসামরিক পেটোয়া বাহিনী। আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয়বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী। এছাড়া প্রভাবশালী নেতারাও গড়ে তোলেন তাদের নিজস্ব ঠেঙ্গারে বাহিনী।
১৯৭২ সালের প্রায় গোড়া থেকেই মুজিববাদ নিয়ে ছাত্রলীগের মাঝে দেখা দেয় সংকট। সৃষ্টি করে অনৈক্য। ‘৭২ সালের ১২ই মে ছাত্রলীগের চার নেতা খোলাখুলিভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পরেন। জনাব রব ও শাহজাহান সিরাজ বললেন, “মুজিববাদে তারা বিশ্বাসী নন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই আসিবে জনমুক্তি।” অপরদিকে আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী ঘোষণা দিলেন, “যে কোন মূল্যে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সংকট দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে মুজিববাদী ও মুজিববাদ বিরোধী ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে। বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে যখন দুই গ্রুপই আলাদাভাবে মহাসম্মেলনের আয়োজন করে। শেখ মুজিব অবশ্য মাখনদের সম্মেলনই নিজে উদ্বোধন করেন :
ছাত্রলীগের ভাঙ্গনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক লীগেও কোন্দল ঘনীভূত হয়। ফলে শ্রমিক লীগও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। মুজিববাদ বিরোধী ছাত্রলীগ এবং তাদের সমর্থক শ্রমিক লীগ তৎকালীন গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জানান। তখন থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। একদিকে মুজিববাদ অপরদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। আসম রব ১৯৭২ সালের ৩রা মার্চ এক ভাষণে বলেন, “জীবনে সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য জাতি যখন আর একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে মুহূর্তে বেশ কিছু সংখ্যক সরকারি আমলা, শিল্পপতি, আওয়ামী লীগসহ কিছু রাজনৈতিক লোকজন জাতীয় বিপ্লবের নামে আমাদের এই প্রস্তুতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে চলেছে এবং গণবিরোধী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। ৮ই মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, “পতাকা বদল হলেই জনগণের মুক্তি আসে না, তার জন্য দরকার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী।” এর জবাবে ‘৭২ সালের ৫ই মে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “মুজিববাদের প্রতি হুমকি বিপ্লবীদের সমাজতন্ত্রের প্রতিই হুমকি স্বরূপ।” ২৩শে মে ‘৭২ তৎকালীন আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান এবং পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আব্দুর রাজ্জাক দিন তারিখ দিয়ে ঘোষণা করেন, “৭ই জুন থেকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।” ১৩ই জুন গৃহিত এক প্রস্তাবে মাখন সিদ্দিকী গ্রুপ দাবি করে, “মুজিববাদের চার নীতির উপর ভিত্তি করে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে।” ৬ই জুলাই তোফায়েল আহমদ কুমিল্লার এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, “যারা বিদেশী মতবাদ প্রচার করছেন তারা দেশের জনগণের বন্ধু নয়, তারা জাতীয় শত্রু। মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সব সমস্যার সমাধান এবং মুজিববাদ দেশে সমৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। একই জনসভায় জনাব আবদুর রাজ্জাক বলেন, “আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবো কিভাবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে।” ১৬ই জুলাই নেতা জিল্লুর রহমান বললেন, “মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। মুজিববাদ বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকঙ্খার প্রতীক। এর বাস্তবায়নের মধ্যেই মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি নিহিত।” একই দিনে ঢাকায় মাখন সিদ্দিকী গ্রুপ ছাত্রলীগের এক সভায় গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয়, “মাওবাদী বিভ্রান্ত নেতৃত্ব, সিআইএ-র এজেন্ট দল ও ছাত্রলীগ নামধারী বহিষ্কৃত নেতৃত্ব, পলাতক আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তি কমিটির মেম্বার, মুসলিম লীগারস, জামায়াত, নেজাম, জমিয়তে ওলামা, পিডিপি সহ প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বানচাল করতে চায়।”
২৪শে জুলাই ‘৭২ ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দী উভয় গ্রুপের মধ্যে বায়তুল মোকাররমে গোলাগুলি হল। ২১শে জুলাই ছাত্রলীগ মুজিববাদী অংশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করা হয়। একই দিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রলীগ রব গ্রুপের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। সেই সম্মেলনে জনাব আসম রব ঘোষণা করেন, “কার্ল মার্কসের পর সমাজতন্ত্রের কোন নতুন সংজ্ঞা কেউ দিতে পারে না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার রূপরেখাই চূড়ান্ত এবং আমাদের এই বাংলাদেশে সেই সমাজতন্ত্রই কায়েম করা হবে।” জনাব রব দৃঢ়ভাবে বললেন, “মুজিবাদের ককটেল কোন সমাজতান্ত্রিক রূপরেখা নয়।”
২৪শে জুলাই ৭২ মুজিববাদী ছাত্রলীগের একটি মিছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে পল্টন ময়দানে রব গ্রুপ ছাত্রলীগের একটি সভার উপর চড়াও হয়। তাদের হামলায় জনাব রবসহ শতাধিক ছাত্র আহত হন। পরে আহতদের একজন ছাত্র হাসপাতালে মারা যায়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার পড়াশুনার জন্য একশতটি বৃত্তি দেয়। মেধা অনুসারে একশত জন ছাত্র নির্বাচিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। ৮ই জুলাই নির্বাচিত তালিকা থেকে হঠাৎ করে অন্যায়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৪১ জনকে বাদ দিয়ে নতুন করে তাদের জায়গায় অন্য ৪১ জনকে নির্বাচিত করা হয়। মুজিববাদে বিশ্বাসী ছিল না বলেই প্রথম নির্বাচিত ৪১ জনকে বাদ দেয়া হয়। ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়েও মুজিববাদকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। নেতাদের বিবৃতি বক্তব্যে এ আন্তঃবিরোধ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১৯৭২ সালের ১৮ই জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চট্টগ্রামে ঘোষণা করলেন, “গণতন্ত্রের নীতি ও আদর্শেই দেশ পরিচালিত হবে।” তার একদিন আগে ঠাকুরগাঁয়ে এক জনসভায় লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী বললেন, “মুজিববাদের চার নীতি দ্বারাই দেশ চালিত হবে।” তার কয়েকদিন পর ৩১শে জুলাই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটিতে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মুজিববাদ কায়েমের শপথ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। ১২ই আগষ্ট অর্থমন্ত্রী ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ভাওয়ালের এক জনসভায় বললেন, “সমাজতন্ত্রের প্রতি বাধা আসলে গণতন্ত্র ত্যাগ করব।” ২০শে আগষ্ট আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধার করা আদর্শ এবং মাওবাদী চক্রান্ত।” রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, “গণতন্ত্র কায়েম হবে।” মন্ত্রী বলেন, “সমাজতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনে গণতন্ত্র ত্যাগ করব।।” শীর্ষ নেতা শেখ মুজিব বলেন, “দু’টাকে মিলিয়ে মুজিববাদ কায়েম করা হবে।।।” এভাবেই দেশে সৃষ্টি করা হল আদর্শগত বিভ্রান্তিকর এক চরম অবস্থা। আর এ বিভ্রান্তির ফলে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই নয় সমস্ত জাতি হল দ্বিধা-বিভক্ত।
ভারতে দাসখত লিখে দিয়ে, ভারতীয় শাসনতন্ত্রের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র গলধঃকরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগ সরকার স্ববিরোধী ঐ চার নীতিকে শাসনতন্ত্রের চার স্তম্ভে পরিণত করে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখিত গণবিরোধী নীতিগুলোর ককটেল ফর্মুলা দিয়ে দেশ শাসন করে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা ও সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টার ফলে দেশ ও জাতির অবস্থা কি হয়েছিল সেটা অনুধাবন করার জন্য নীতিগুলোর কিছুটা বিশ্লেষন দরকার। জনাব তোফায়েল আমদের দাম্ভিক বক্তব্য, “সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র একসাথে কায়েম করে মুজিববাদকে বিশ্বের তৃতীয় রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।” এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুযায়ী বলতে হয়, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দু’টো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দর্শন। গণতন্ত্রে মূল প্রেরনা এসেছে মানুষের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে। “Man is born free and shall die free.” রাষ্ট্রকাঠামোর Basic structure that is economics 4 super structure that is politics এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের থাকবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, থাকবে তাদের মেধা ও কর্মশক্তির বিকাশের অবাধ পরিবেশ, থাকবে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। এ নীতির উপরই গড়ে উঠেছে পশ্চিমা দেশগুলোর ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও তাদের কৃষ্টি এবং সভ্যতা। বিকশিত হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। গণতান্ত্রিক সভ্যতার anti thesis হিসেবেই কার্ল মার্কস উপস্থাপন করেন সাম্যবাদ
সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক দর্শন। ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরনের Transitionary phase-কে বলা হয় সমাজতান্ত্রিক অধ্যায়। সমাজতন্ত্রকে কার্যকরী করার জন্য কেড়ে নেয়া হয় ব্যক্তি স্বাধীনতা। জাতীয় পরিসরে চাপিয়ে দেয়া হয় একটি বিশেষ শ্রেণীর একনায়কত্ব। রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে উৎপাদন যন্ত্রগুলোর ভাগ্য বিধাতা হয়ে উঠেন দলীয় নেতারা। উৎপাদন শক্তির স্বাভাবিক বিকাশের সব সম্ভবনা ও পথ রূদ্ধ করে দেয়া হয়। Insentive হীন উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের মাত্রা কমে যায়। অস্বাভাবিকভাবে মানুষকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালানো হয় যন্ত্রে। যান্ত্রিক জীবনের বিভীষিকার চাপে জনগণের কর্মস্পৃহা লোপ পায়। সাধারণ জনগণের শ্রমের ফলে অর্জিত সম্পদের ভোগী হয়ে উঠেন রাজনৈতিক পার্টির নেতারা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আমলাতন্ত্র। জনসাধারনের জীবনযাত্রার মান কমে যায় ক্রমান্বয়ে। ফলে ঘনীভূত হয়ে উঠে সামাজিক ক্ষোভ। তারই বর্হিপ্রকাশ সামাজিক বিপ্লবের স্রোতে ঠুনকো তাসের প্রাসাদের মত ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা।
সমাজতন্ত্রের নিঃসাড়তা আজ বিশ্ব পরিসরে প্রমাণিত হয়েছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয়ের ফলে। সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতারা আজ সমাজতন্ত্রের আদর্শকে আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির নীতিকে গ্রহণ করে অতীত ভুলেরই শুধু প্রায়শ্চিত্ত করছেন তা নয়: তারা এটাও পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছেন গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলে সমাজতন্ত্রকে বর্জন করাটা হয়ে উঠে অপরিহার্য। এ দু’য়ের সহাবস্থান বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। প্রতিটি মানুষ তার আপন স্বাতন্ত্রে বিকশিত। এ প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দর্শন। তাই আজও মানুষের কাছে আবেদন রয়েছে এ দর্শনের। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করে মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা এবং যন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন করার ফলেই সমাজতন্ত্র দর্শন হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের জনগণ ও ঠিক একই কারণে মেনে নেয়নি সমাজতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া নীতি। বিশ্বাস করেনি আওয়ামী লীগের জগাখিচুড়ী মুজিববাদী আদর্শের ভাওতাবাজী।
এবার আলোচনা করা যাক ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতার আক্ষরিক মানেটা আজ অব্দি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যদি বোঝানো হয় সব ধর্ম থেকে সমদূরত্ব বজিয়ে চলা, তাহলে সেটা হয়ে পড়ে ধর্মহীনতারই শামিল। বর্তমান আধুনিক বিশ্বেও প্রতিটি মানুষ কোন না কোন আদর্শ এবং বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকে। তারা বাঁচার উৎপ্রেরনাও পেয়ে থাকে সে সমস্ত বিশ্বাস এবং আদর্শ থেকে। কেউ কি কোন আদর্শ কিংবা বিশ্বাস ছাড়া এ পৃথিবীতে জীবনধারণ করতে পারে? হয়তো বা পারে। তবে আমার জানা মতে তেমন কোন ব্যক্তির সাক্ষাত আজঅব্দি আমি পাইনি। বিশ্বাস অনেক প্রকার হতে পারে। যেমন:- ধর্মীয় বিশ্বাস, মানবতাবাদ, এথিজম বা নিরশ্বরবাদ, এনিমিজম, পৌত্তলিকতাবাদ প্রভৃতি। যে যাই বিশ্বাস করুক না কেন সেটা ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। প্রত্যেকের কাছে তার বিশ্বাস তার জীবন ধর্ম। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা জণগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার অর্থ দাড়িয়েছিল জনগণকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস থেকে জোর করে নিরপেক্ষ রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এ ধরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সরকারিভাবে শাসনতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়ের লোকের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাসের অবমাননা করেছিল। বাংলাদেশের ধর্মভীরু জনতা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের এ অবমাননা কিছুতেই মেনে নেয়নি। প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্ম পালন করার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে এ দেশের মানুষ চিরকাল। তাছাড়া ধর্মীয়
সহনশীলতার এক গৌরবময় ঐতিহ্য বাংলাদেশী জনগণ আদিকাল থেকে বহন করে এসেছে। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ধর্মীয় আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক হিংসাত্বক হানাহানি এমনকি ধর্মীয় যুদ্ধও হয়েছে। বর্তমান ভারতেও সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা ঘটছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রদায় শান্তিতে বসবাস করেছে যুগ যুগ ধরে, নির্ভয়ে, আপন ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে। এটা ঐতিহাসিক সত্য এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গৌরব। এ গৌরবকে কলুশিত করার জন্য সাম্প্রদায়ীকতাকে উসকে দিয়ে কায়েমী স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে অনেকেই। কিন্তু তাদের সব চক্রান্তই ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলাদেশের সচেতন জনতা। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়। ধর্ম বাঙ্গালী মুসলমানদের কাছে শুধুমাত্র একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই নয়, ধর্ম হচ্ছে তাদের জীবন আদর্শ (Way of Life)। তারা মনেপ্রানে ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন তাই তারা পালন করে বিচার বিবেচনা করে। ইসলাম ধর্মে অন্য ধর্মালম্বীদের ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে শুধু তাই নয়; সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের প্রতি মুসলমানদের কিংবা মুসলমান রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব সে সম্পর্কেও পরিষ্কার নির্দেশ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে। সে অবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি শাসনতন্ত্রে গ্রহণ করা ছিল নিঃপ্রয়োজন। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের জীবনধারার আলোকে প্রণীত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র এটাই ছিল জনতার আশা ও আকাঙ্খা।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতীয় পরিচিতি এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে শোরগোল তুলল। কিন্তু তারা পূর্বতন ঐতিহাসিক বাংলাদেশের এই মানবগোষ্ঠির জাতীয়তার মূল ও ভিত্তি সম্পর্কে কিছুই বলল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুযোগে অনেকেই আবার সরবে মেতে উঠল। তারা বলে বেড়াতে লাগল, “মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি উপমহাদেশে সংগঠিত হয়েছিল এবং পরিণতিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল, সেই দ্বি- জাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।” অর্থাৎ পক্ষান্তরে তারা এটাই বলার চেষ্টা করল যে, ১৯৪৮ সালে ভারত বিভক্তি অন্যায়ভাবে করা হয়েছিল।
এ ধরণের উক্তি নেহায়েত অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ধরণের বক্তব্যে অখন্ড ভারতের প্রবক্তাদের প্রচারণারই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকালে কংগ্রেস অনুসৃত অখন্ড ভারত এবং মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব এই বিষয় দুইটির একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।
প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ থেকেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠি তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে বসবাস করে এসেছে। শুধুমাত্র বহিরাগত বিজাতীয় শক্তিরাই তাদের শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য অস্ত্রের বলে দেশীও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই উপমহাদেশে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। বৈদিক যুগে আর্য্য ভাষীদের আগমনের কাল থেকে বৃটিশ ঔপনিবেশবাদের শাসনকাল পর্যন্ত ইতিহাস ঘাটলে এই সত্য অতি সহজেই অনুধাবন করা যায়।
আদিকালের বর্ণ হিন্দুরা রামরাজ্য কায়েমের ধুঁয়া তুলে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি আফগান এবং মুঘল শাসকরাও। একমাত্র বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদই আধুনিক উচ্চতর মানের সমরাস্ত্র এবং বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বদৌলতে পুরো উপমহাদেশকে একটি প্রশাসনিক রাষ্ট্রের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। অতএব যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, একক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক।
উনিশের দশকে বৃটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির আন্দোলন যখন দানা বেধে উঠছিল তখনই পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত বর্ণ হিন্দুদের নেতৃত্বে সৃষ্টি করা হয় কংগ্রেস পার্টি বৃটিশ প্ররোচণায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার স্বাধীনতার দাবিকে উপেক্ষা করে বৃটিশ সৃষ্ট Indian Union-কে অটুট রেখে স্বাধীনতার পর তাদের ক্ষমতায় বসানো। এর ফলে বর্ণ হিন্দুরা দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন অখন্ড ভারতে রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা দেখতে পায়। তাদের প্রতি বৃটিশ সহযোগিতার কারণ ছিল মূলতঃ দু’টি।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উপমহাদেশ দখল করতে হয়েছিল মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে। ফলে মুসলমানরা হয়ে উঠে তাদের চোখের বালি। প্রতিহিংসার রোষানলে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের ঘৃনা ও সন্দেহ করতে থাকে। পক্ষান্তরে হিন্দুরা বৃটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সাহায্যই করেছিল মুসলমানদের পরাস্ত করে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে। পুরস্কার স্বরূপ মুসলমানদের ধনসম্পদ হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বৃটিশ অনুকম্পা ও মদদপুষ্ট হিন্দুরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়। মুসলমানরা হয়ে পরে নিঃস্ব ও ক্ষমতাহীন। সুদীর্ঘ দুই’শ বছরের বৃটিশ গোলামীর ইতিহাসে হিন্দু সম্প্রদায় বরাবরই ছিল বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির সহযোগী মিত্রশক্তি আর মুসলমানরা পরিণত হয় নিগৃহ ও করুণার পাত্রে। পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠা উচ্চবিত্ত বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুগত্য সম্পর্কে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠি ছিলেন নিশ্চিত (Convinced)। তাই তারা চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ঐ শ্রেণীকেই অধিষ্ঠিত করতে, যাতে করে সমগ্র উপমহাদেশে তাদের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ কায়েম রাখা সম্ভব হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কংগ্রেসকে জাতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি ছিল তাদের সমগ্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাবিদার বানাবার পূর্বশর্ত। সেটা অর্জন করার জন্য ধর্মীয় চেতনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অতি কৌশলে ‘বন্দে মাতরম’, ‘ভারতমাতা’, ‘হিন্দুস্থান’, ‘জয় হিন্দ’ ইত্যাদি শ্লোগান তুলে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন ও আনুগত্য লাভ করে কংগ্রেসকে একমাত্র জাতীয় দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ‘নব্য চানক্যরা’। but every action has an equal and opposite reaction. বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনের গায়ে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী কংগ্রেস যখন হিন্দু ধর্মের নামাবলী একতরফাভাবে চাপিয়ে দিল তখন সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠিগুলো নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে শংকিত হয়ে হয়ে উঠে।
এই অবস্থায় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হয়ে জোর আন্দোলন গড়ে তোলে। এই প্রেক্ষাপটেই কংগ্রেসের মোকাবিলায় মুসলমানদের দাবিকে রাজনৈতিক রূপ দেবার জন্যই গঠন করা হয়েছিল রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের অখন্ড ভারত তত্ত্বের মোকাবিলায় মুসলিম লীগ প্রচার করেছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান, এই দু’টো দাবিতে হিন্দু-মুসলমান এই দুই ধর্ম গোষ্ঠির মেরুকরণ ভয়াবহ সংঘাতের রূপ ধারণ করে। সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে দু’পক্ষেই। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয়েছিল বৃটিশ সরকারকে। তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নেয়া হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা দ্বি-জাতি তত্ত্বকে খন্ডিত করেছে তবে যুক্তিগত কারণেই মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অখন্ড ভারত তত্ত্বকেও খন্ডিত করেছে একইভাবে।
কিন্তু আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসাড়তা নয় বরং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে ভারত একটি বহুজাতিক দেশ। একই সাথে এটাও প্রমাণিত হয় যে, শুধুমাত্র বিশেষ একটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে কোন জাতিসত্ত্বা গড়ে উঠতে পারে না। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে মূল ভূ-খন্ড, ভাষা, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও একইভাবে প্রভাব রাখে। নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠি, সম্প্রদায়, জাত, কুল নির্বিশেষে যখন কোন জনগোষ্ঠি এক সামগ্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে তখনই জাতীয়তাবাদ প্রাণ পায়। জাতীয়তাবাদ মূলতঃ এক ধরণের অনুভূতি, এক ধরণের মানসিকতা, এক ধরণের জাগ্রত চেতনা, যার সৃষ্টি হয় জনসমষ্টির প্রবাহমান ঐতিহাসিক জীবনধারায়। জাতীয় সংগ্রামের ধারায় গতিশীলতা অর্জন করার জন্য কখন কোন উপাদানটা বিশেষ ভূমিকা রাখবে সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সময়, বাস্তব পরিস্থিতি, জনগণের প্রত্যাশা এবং নেতাদের উপর।
অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমানের উপভোগ বা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙ্গীন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা। এ ধরণের ঐক্যবদ্ধ চেতনা যখন কোন জনসমষ্টিকে একত্রিত করে তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। সামগ্রিক সত্ত্বা হিসাবে তা বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হয় আর তারই ফলে একটি জাতি সবরকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আদর্শিক ও দৈহিকভাবে প্রস্তুত হয়।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এখনও প্রচুর বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিভ্রান্তিকে আরো জটিল করে তুলেছেন তাদের ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। এ বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বুদ্ধিজীবিদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজন তাও প্রায় অনুপস্থিত। পরিষ্কারভাবে সত্যকে আমাদের জানতে হবে। আমাদের জাতীয়তাবাদ কি? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ? না বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ?
প্রাচীন বঙ্গ অববাহিকা ও তৎসংলগ্ন ভূ-ভাগ যে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন এবং সুপরিচিত স্ব-বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল অঞ্চল ছিল তার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে বিধৃত রয়েছে। (খ্রীষ্টপূর্ব ১৪০০-১০০০ সালের মধ্যে) ঐতরেয় অরণ্যকে বঙ্গের কথা রয়েছে। মহাভারত ও হরিবংশেও দেখা যায় বঙ্গ প্রসঙ্গ। সুতরাং বঙ্গ জনপদকে নেহায়েত অর্বাচীন বলে আখ্যায়িত করার কোন কারণ নেই। রামায়নেও বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রাচীন জনপদ হিসেবে বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। এ দেশের দু’কুল পাত্রোর্ন ক্ষৌম কার্পাসিক বস্ত্র বয়ন শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলেও কৌটিল্য বয়ান করেছেন। বরাহ মিহির (৫০০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে) তার বৃহৎ সংহিতা গ্রন্থে পূর্বাঞ্চলীয় দেশ অর্থাৎ বঙ্গ দেশ, পরবর্তিকালে বাংলাদেশের অন্তর্গত যে কয়টি জনপদের নাম করেছেন সেগুলো হল: হরিকল, গৌতক, পৌণ্ড্র, বঙ্গ, বর্ধমান, তাম্রলিপ্তি, সমতট ও উপবঙ্গ। সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় যশোর, খুলনা সংলগ্ন দক্ষিন বঙ্গের কিছু অংশকে উপ-বঙ্গরূপে শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের আর একটি প্রাচীন জনপদ সুহ্মের কথাও ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের এবং আদিকালের বঙ্গ দেশের পশ্চিম এলাকার নাম ছিল সুন্ধ্র, অঙ্গ, বর্তমান মিথিলা ও কলিঙ্গ উড়িষ্যা প্রদেশের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের তথা বঙ্গ দেশের অর্ন্তভূক্ত ছিল।
হিম যুগের পর থেকে বাংলাদেশ কখনও জনশূন্য থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানবগোষ্ঠির মতো বাংলাদেশেও আদিম মানব সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছিল। কারণ, এখানেও প্রত্ন ও নব্য প্রস্তর এবং তাম্র যুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পোদ, বাউড়ী, কোল, ভীল, মুন্ডা, সাওঁতাল, সাবর, পুলিন্দ, হাড়ি ডোম, চন্ডাল, রাজবংশী সমুদয় অন্ত্যজ জাতির সমষ্টিই বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। ভাষার ও আকৃতির মূলগত ঐক্য হতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, এই সমুদয় জাতি একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠির বংশধর। এই মানবগোষ্ঠির সাথে অস্ট্রেলিয়ার অদিবাসীদের চেহারার এবং ভাষার মিল পাওয়া গিয়েছিল বলে এদের বলা হয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অষ্ট্ৰিক।
বাংলাদেশের দোরগোড়ায় রাজমহল পাহাড়। সেখানে বন-জঙ্গলের অধিবাসী পাহাড়ীদের ছোট্ট-খাট্টো গড়ন, চেহারা, গায়ের রং মিশমিশে কালো, নাক থেবড়া। বেদ এবং নিষাদে যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে হুবহু মেলে সিংহলের ভেড্ডাদের। ফলে এদের নৃ-তাত্ত্বিক নাম হয় ভেড্ডিড। নিষাদ জাতি বলেও তারা আখ্যায়িত হয়েছে। প্রাচীন বাংলাদেশের নানা জায়গায় নানারকম পরিবেশে এবং জল হাওয়ায় নানান দলে ভাগ হয়ে মানুষ বসবাস করত। পরে তাদের রক্তে বহিরাগতদের নানা রক্তের ধারা এসে মিশেছে। বাচঁবার আলাদা আলাদা ধরণের দরুন এবং রক্তের মেশামেশি হওয়ায় স্থানভেদে চেহারায় নানারকম ধাঁচ সৃষ্টি হয়েছে। মনের গড়নে, মুখের ভাষায়, সভ্যতার বাস্তব উপাদানে তার প্রচুর ছাপ আছে। বাংলাদেশের মাটির গুন আর সেই মাটিতে নানা জাতের মেলামেশা এরই মধ্যে বাংলাদেশী জনপ্রকৃতির বৈচিত্র আর ঐক্যের গোড়া খুঁজে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগন আর্য্য জাতির বংশগত নন। বাংলা ভাষার বিশ্লেষন করে পন্ডিতগণ এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। উপরন্তু দ্রাবিড় বা আর্য্য আসলে নরগোষ্ঠির নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠির নাম মাত্র। একই নরগোষ্ঠির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার চলন থাকতে পারে। কাজেই শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে কোন নরগোষ্ঠির নামকরণ সঠিক নয়।
আসমুদ্রহিমাচল আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। প্রশ্ন দেখা দেয় বাংলা অথবা বাঙ্গালা এবং বাঙ্গালী শব্দের উৎপত্তি হল কি করে? বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এই সমস্ত শব্দের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক। জনাব আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাংলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী শব্দের উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হল:- প্রাচীন বঙ্গ শব্দের সাথে আল শব্দ যুক্ত করে সুলতান শামসুদ্দিন বাঙ্গালী শব্দের চয়ন করেন। আল শব্দের অর্থ পানি রোধ করার ছোট-বড় বাঁধ।
অন্যদিকে সুকুমার সেনের অভিমত হল প্রথমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালাহ্ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম শাসন আমলে পারসিক বাঙ্গালাহ্ উচ্চারণ থেকে পুর্তুগীজরা বানিয়েছে বেঙ্গল এবং ইংরেজদের হাতে পড়ে বঙ্গ পরিণত হয়েছিল বেঙ্গলী বা বাঙ্গালীতে।
বাংলাদেশী জনগণের বাসভূমির রয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সীমানা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সীমা সংক্ষেপে বলতে গেলে, উত্তরে হিমালয় ও তার গায়ে নেপাল, সিকিম ও ভূটান রাজ্য, উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারভঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সীমান্তবর্তী সমভূমি, পূর্ব দিকে গারো, খাসিয়া, জৈন্তিয়া, ত্রিপুরা, আসাম, চট্টগ্রামের শৈলশ্রেণী বেয়ে দক্ষিনে সমুদ্র পর্যন্ত। পশ্চিমে রাজমহল, সাওঁতাল পরগনা, ছোট নাগপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চলসমূহ, বিহারের বীরভূম, মানভূম, ধলভূম, কেওজ্ঞর, ময়ূরভজ্ঞের অরণ্যময় মালভূমি, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর। এই সীমারেখার মধ্যেই প্রাচীন বাংলাদেশের বা বঙ্গের গৌড়, পুণ্ড্র, বারেন্দ্র, রাড়, সুন্ধ্র, তাম্রলিপ্ত, সমতট, বঙ্গ, বাঙ্গাল, হরিকল প্রভৃতি জনপদ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশীরা। কোল, ভীল, শবার, পুলিন্দ, হাড়ী, ডোম, চন্ডাল, সাওঁতাল, মুন্ডা, ওরাঁও, ভূমিজ, বাগদী, বাউড়ী, পোদ, মালপাহাড়ী প্রমুখ অস্তজ জনগোষ্ঠির মিলন এবং তাদের রক্তের সাথে বহিরাগত নানা রক্তের ধারা এসে মিশে এক হয়ে সৃষ্টি হয় বঙ্গবাসী অথবা বাংলাদেশী জাতিসত্ত্বার। সময়ের স্রোতে রাষ্ট্র বিধাতাদের হাতে বাংলাদেশীদের আবাসভূমি বাংলাদেশ খন্ড-বিখন্ড হলেও তার ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সীমারেখা মুছে ফেলতে পারবে না কেউ কোনদিন। রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অপরিবর্তনীয় নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রাচীন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ জনপদগুলো গড়েছেন। রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন, জন্ম দিয়েছেন বিস্ময়কর সংস্কৃতি ও শিল্প ঐতিহ্যের। এ ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় অধিকার। আজ রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে গোষ্ঠি স্বার্থে অযথা যতই যুক্তিহীন বিতর্কের অবতারনা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সচেতন জনগণকে বোকা বানিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সম্ভব হবে না বেশি দিন। তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং ন্যায্য অধিকার ভবিষ্যতে একদিন না একদিন আদায় করে ছাড়বেই ইনশাল্লাহ্। পূর্ণ মর্যাদায় একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত বাংলাদেশ এবং আমরাও বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হব গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের কোন কোন পর্যায়ে বাংলা ভাষা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এ কথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বললে সেটা হবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়ে উঠা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর একটি ভাষাগোষ্ঠির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ, বাঙ্গালী কোন নরগোষ্ঠির নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠির নাম মাত্র।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিসীমা নিয়ে ১৯৭১ সালে প্রথম চক্রান্ত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপ নির্ধারন নিয়ে। সরকারিভাবে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকার যে রূপায়ন করা হয়েছিল সেটা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্য তার মাঝে হলদে রঙের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ। কিন্তু সচেতন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা চক্রান্তকারীদের সব চক্রান্তের মূলে কুঠারাঘাত করে সেই জাতীয় পতাকা প্রত্যাখান করেন এবং বর্তমানের জাতীয় পতাকার রূপ গ্রহণ করতে সরকারকে বাধ্য করেন। সবুজ বাংলার পটভূমিকায় উদিয়মান রক্তিম সূর্য। উদিয়মান সূর্য ক্রমশঃ পূর্ণতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে আর তার আলোকে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে আদি বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গরূপ। এটা লেখকের অবাস্তব স্বপ্ন নয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ভবিষ্যতে একদিন এই স্বপ্ন রূপান্তরিত হবে বাস্তব সত্যে।
বাংলাদেশী জনগণের দরদী মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী তার মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে শেষবারের মত আমায় বাংলাদেশী জনগণের মরন-বাচন সমস্যা নিয়ে যে সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা থেকে পাঠকগণ বর্ষিয়ান নেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ভাবনার গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারবেন বলেই ঘটনাটির অবতারনা করলাম। পাঠকগণ উপলব্ধি করতে পারবেন তার বাস্তব জ্ঞানের প্রসারতা:-
১৯৭৬ সালের আগষ্ট মাসে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন অপারেশনের জন্য। আমিও তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিলাম। খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খবর পেয়েই তিনি একদিন আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সাংবাদিক জনাব গাজীউল হাসান খানের মাধ্যমে ডেকে পাঠান। সময়মত আমি ও গাজী তার ফ্ল্যাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম সকাল ১০টার দিকে। হাসপাতাল থেকে অপারেশনের পর বাংলাদেশ দূতাবাসই তাকে সেই ফ্ল্যাটে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম তার পুত্র জনাব নাসের খান ভাসানী মাওলানা সাহেবের ঘরে উপস্থিত রয়েছেন। হুজুর আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবছিলেন। অপারেশনের ক্ষত তখনও শুকায়নি। চলাফেরা, পথ্য সব কিছুই রেসট্রিকটেড। আমরা এসেছি শুনে তিনি চোখ মেলে আমাকে ইশারায় তার বিছানায় গিয়ে বসতে বললেন। আমি তার আদেশ অনুযায়ী তাঁর শিয়রে গিয়ে বসলাম। গাজী কাছেই একটা চেয়ার টেনে নিল। সালাম দোয়ার পর হুজুর জিজ্ঞেস করলেন,
—নাস্তা করছস?
—হ্যাঁ হুজুর, নাস্তা কইরাই আইছি। জবাব দিলাম।
—ভালো কথা। তাইলে আমারে নাস্তা খাওয়া। আমি ডিম খামু। স্বল্প দূরে দাড়িয়ে থাকা জনাব নাসের ভাসানীর সাথে চোখাচোখি হল। নিচুগলায় তিনি আপত্তি জানালেন। বললেন,
—ডাক্তারকে না জানিয়ে ডিম দেয়া ঠিক হবে না। ক্ষেপে গেলেন মাওলানা। জেদ ধরে বসলেন ডিম তিনি আজ খাবেনই। অগত্যা দু’টো ডিমের পোঁচ করে আনলেন নাসের ভাসানী। ডিমের প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ইশারায় সেটা আমাকে দিতে বলে তাকে বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিলেন মাওলানা নাসের ভাসানী চলে গেলেন। গাজী বসে আছে চুপচাপ। হুজুর বললেন,
—নে শুরু কর। খাওয়াইয়া দে।
আমি আস্তে একটু একটু করে চামচ দিয়ে তাঁকে ডিম খাওয়াতে শুরু করলাম। এ বয়সে অপারেশনের ধকলে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কথা বলছিলেন অতি ক্ষীণ স্বরে। খাওয়ার ফাঁকেই তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে নিলেন লন্ডনে কবে এলাম? কেন এলাম? পরিবার কোথায়? সবকিছুরই সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম। খাওয়া শেষে মুখ ধুইয়ে মুছে দিলাম। খাওয়ার পর কিছু ঔষধ খাওয়ার ছিল সেগুলোও তাকে খাইয়ে দিলাম। এবার তাকে কিছুটা relaxed মনে হচ্ছিল। পাশে বসে আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, মাওলানা যেন কোন এক গভীরে তলিয়ে গেছেন। বেশ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করেই বলা শুরু করলেন-
—বাবা, ৯৭ বছরের বেশি বয়স হইয়া গেছে। কবে আছি, কবে নাই কে জানে। তবে একটা কথা তোরে কইয়া যাইবার চাই। এ বুড়া সারাজীবনে যা করতে পারে নাই তুই ও তোর সাথীরা সেটা কইরা বাংলাদেশের ১০কোটি জনগণরে বাচাঁইছোস জালেমের হাত থ্যাইকা। এ বুইড়া তোদের দোয়া দিতাছে, আল্লাহ তোদের হায়াত দারাজ করুক। বলেই তিনি আমার মাথায় গায়ে তার ক্ষীণ হাত বুলিয়ে শরীরে, বুকে ফুঁক দিলেন। তার চোখের কোল ঘেষে তখন পানি বেরিয়ে এসেছে : চোখ বোঁজা অবস্থায় তিনি আমার জন্য দোয়া করছিলেন বিড়বিড় করে। কাছে বসেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না কোন সুরা বা আয়াত পড়ছিলেন তিনি। আমি তার অশ্রুধারা মুছিয়ে দিয়ে আবেগে বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। আমার প্রতি তার স্নেহ ও মমতা দেখে আমার চোখ দু’টোও অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কেমন যেন এক ঐশ্বরিক স্তব্ধতায় মহীয়ান হয়ে চোখ বুজে ছিলেন কিংবদন্তীর নায়ক বাংলাদেশের মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী। সে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তার হাত ধরে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। তিনি চোখ খুললেন,
—বাবা, তোর জায়গা লন্ডন না, দেশে যাইতে হইবো।
হুজুরের কথার জবাব কি দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে সময় আমাদের সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ভাবছিলাম হুজুরকে সব খুলে বলবো কিনা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনিই বলে উঠলেন,
—জিয়ার সাথে মতের অমিল হইছে; সেইডা আমি জানি; কিন্তু জিয়ারই সব ভুল আমি গিয়া তারে বুঝামু। কথা শুনলে ভালো আর না বুঝলে আমি জানি কি করতে অইবো। তুই তৈরি থাকিছ। তবে বাবাজান একটা কথা। বুড়া মানুষের কথাটা মন দিয়া হুনিস। যে কাজ শুরু করছস তার শেষ বহুদূরে। বাংলাদেশের মধ্যেই চোখ বন্ধ কইরা উট পাখি হইয়া বইসা থাকলে চলব না। চোখ খুইলা চাইতে হইবো সীমানার বাইরে। কথাটা একটু ভাল কইরা চিন্তা কইরা দেখিছ।
কথা বলতে বলতে তিনি বেশ কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। আমি আস্তে আস্তে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
—হুজুর আপনি দোয়া করবেন যাতে আমি আমার নিয়তে কায়েম থাকতে পারি আল্লাহ্পাক যেন আমারে সুযোগ দেন যাতে একজন মুজাহিদ হিসাবে আপনার ইশারা অনুযায়ী সঠিক রাস্তায় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে প্রয়োজনে কোরবান করতে পারি।
আমার জবাব শুনে বিছানায় শুয়েই তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় আমার বুক ভরে উঠেছিল। ডাক্তার এসে গেছে। আমাদের বিদায় নিতে হবে। সালাম করে আমি আর গাজী বেরিয়ে এলাম। বুকের মাঝে গেঁথে নিয়ে এলাম মহান নেতার অমূল্য দিক নির্দেশ। সেটাই মাওলানা ভাসানীর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। এর অল্প কিছুদিন পরই তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে……..রাজেউন)। তার মৃত্যুতে জাতি হিসেবে আমরা হারালাম একজন জনদরদী অভিজ্ঞ মুরুব্বী এবং দূরদর্শিতা সম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ।
১৯৭২ সালের প্রায় গোড়া থেকেই দেশে মহা-অরাজকতার সৃষ্টি হয়। খুন, রাহাজানী, মুনাফাখোরী, গুন্ডামি দিন দিন বাড়তে থাকে। যুদ্ধকালীন সময় চক্রান্তকারী যুব ও ছাত্রনেতারা তাদের কায়েমী স্বার্থ ও দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে ভারত সরকারের অনুগ্রহ লাভ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহায়তায় মুজিব বাহিনী পরে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজের মাথা নত করে দিয়েছিল। তাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের অবমাননা করে তাদের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার এক কলংকিত অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
২২শে ডিসেম্বর প্রবাসী সরকার ঢাকায় এসেই অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু শেখ মনি, তোফায়েল, আব্দুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ যুব ও ছাত্রনেতারা সরকারের সে আদেশ অমান্য করে। ১৬ই ডিসেম্বর অসংখ্য তরুণ মুজিব বাহিনীতে যোগদান করে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। এদের অধিকাংশই ছিল রাজাকার, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি জনধিকৃত বাহিনীর সদস্য। ছাত্র যুব নেতৃবৃন্দ তখন তাদের বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই এ সমস্ত সমাজ বিরোধীদের দলে টেনে নেন। এদের জনগণ পরবর্তিকালে ১৬ ডিভিশন নামে অভিহিত করে। যুব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে ফিরেই মুজিব পরিবারের অনুকম্পা ও সহানুভূতি লাভের আশায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদ সম্পর্কে কদর্য্য প্রচারণা নতুন করে শুরু করেন। তারা বলেন, “শেখ মুজিবের প্রতি তাজুদ্দিনের কোন আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি একাই হতে চান।” তারা আরো বলেন, “শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক সেটাও জনাব তাজুদ্দিন স্বীকার করেন না। তাছাড়া শেখ মুজিবকে উপেক্ষা করার আর একটি নজির এই যে, তিনি তাকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী না করে ক্ষমতার অভিলাষে নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী বানান এবং শেখ মুজিবকে শুধুমাত্র সাংবিধানিক ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার উদ্দেশ্য সৎ হলে তিনি শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে নিজে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রবাসী সরকার পরিচালনা করতে পারতেন।” এমনিভাবে তাজুদ্দিনের প্রতি শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের মন বিষিয়ে তুলেছিলেন তারা। শেখ মনির এতে মুখ্য ভূমিকা ছিল। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফেরার পর উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন। শেখ মুজিব যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রাম কালের নয় মাস নির্বাসিত ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে সেই অনুপস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তারা। তার সামনে কেঁদে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার নাটক করে এদের অনেকেই বলেছিলেন, “আপনার ভাবমূর্তি ও নেতৃত্ব রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাজুদ্দিনের বিরাগভাজন হয়েছি আমরা। তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। শেখ কামালকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবার হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। শুধু আমাদের বিরোধিতায়ই সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা জোর করে তাকে মুজিবনগর হেডকোয়াটার্স এ কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসাবে রেখেছিলাম।” আরো অনেক কিছু বলে তার কান ভারী করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুচক্রী ক্ষমতালিপ্সু যুব নেতৃবৃন্দ। শেখ মুজিব তাদের কথার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পেলেন না। কেননা, তার পরিবারের সদস্যগণ আরো রূঢ় ভাষায় তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে তাদের
মনের খেদ প্রকাশ করেন শেখ মুজিবের কাছে। এর ফলেই দেশে ফেরার মাত্র একদিন পরই ১১ই জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিব তার দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত সহকর্মী জনাব তাজুদ্দিনকে অপসারন করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন। জনাব তাজুদ্দিনকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ না দিলেও তাকে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলতে লাগলেন শেখ মুজিব। প্রশাসনিক ব্যাপারে আবার তিনি যুব নেতৃবৃন্দের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। ফলে যুব নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিসরে সর্বময় ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাদের মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হল। কিন্তু শেখ মুজিবের এ ধরণের আচরণে মনোক্ষুন্ন হলেন দলের বর্ষিয়ান নেতারা।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের উপর বর্বর নির্যাতন শুরু হয়। এ নির্যাতনে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বাহিনীই অংশগ্রহণ করেনি, তাতে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন লাঠিয়াল ও বেআইনী সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী। রাজনৈতিক নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ তোলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়্যারম্যান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, ছাত্রলীগের রব-সিরাজ গ্রুপ। তারা আওয়ামী সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাড়াবার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানান। তারা বিবৃতি সমাবেশের মাধ্যমে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ও সংগ্রামী ছাত্রজনতার প্রতিরোধ শক্তিকে শেষ করে দেবার জন্য মাত্র ৯মাস আগে নির্যাতন এবং পুলিশ ও সেনা বাহিনীরা বেপরোয়া গুলি চালনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতেন যারা; ক্ষমতায় আসীন হয়ে গত মাসেই প্রায় ডজনখানেক জায়গায় ছাত্রজনতার সমাবেশে ও মিছিলে গুলি চালিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন দল দখলদার বাহিনীর দালালদের সহায়তায় প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ছাত্র, বিরোধী দলীয় কর্মী ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দায়ের করে তাদের গ্রেফতার করছেন। রাজনৈতিক নেতারা রাজধানী থেকে সরকারি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মী, ছাত্র, যুবকদের শায়েস্তা করার জন্য গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে তাদের অযথা হয়রানি করছেন।”
১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর মেজর (অবঃ) এমএ জলিল ও আসম আব্দুর রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এ দলের মূল দার্শনিক গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান ওরফে ‘কাপালিক’। পার্টি গঠনের কয়েকদিন আগে জনাব সিরাজুল আলম খানের তত্ত্বাবধানে গণকন্ঠ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যদিও গণকণ্ঠ প্রকাশলগ্নে শেখ মুজিব কাগজটিকে আশীবাদ দিয়েছিলেন; কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই গণকণ্ঠ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ বাণী প্রচার করতে শুরু করে এবং পরবর্তিকালে জাসদের মুখপাত্র হিসেবে বেরুতে থাকে। এতে শেখ মুজিব ভীষণভাবে চটে যান। ২১শে জুলাই ছাত্রলীগের পল্টন ময়দানের সম্মেলনের উদ্ধোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে রব গ্রুপ ও গণকন্ঠের সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, “৭০ মন গরুর গোস্ত, ৭০ মন খাসীর গোস্ত, টাকা কোথা থ্যাইকা আসে? তিরিশ বছর রাজনীতি করলাম একটা পত্রিকা বার করতে পারলাম না। এক ইঞ্চি বিজ্ঞাপন নাই। আমরা কিছু বুঝি না?” এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লাইন প্রচার করার নীতি গ্রহণ করায় গণকন্ঠ সত্যিই এক ইঞ্চি সরকারি বিজ্ঞাপন কখনোই পায়নি। জনাব সিরাজুল আলম খান জনাব রব ছিলেন দু’জন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। মেজর জলিল ছিলেন দেশপ্রেমিক একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তি সংগ্রামে তিনি ছিলেন নবম সেক্টরের কমান্ডার। গেরিলা এ্যাডভাইজার হিসেবে তার সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক এই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের মুরুব্বী ভারত সরকার বিশেষ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রথম থেকেই বিরূপভাব পোষণ করত। তাদের মতে মেজর জলিল ছিলেন একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী এবং আপোষহীন চরমপন্থী প্রকৃতির মুক্তিযোদ্ধা। তাই একটি অতি সামান্য অযুহাতে সংগ্রামের প্রথম পর্যায়েই তাকে সেক্টর কামান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রবাসী সরকার। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য কমান্ডারদের চাপে তাদের সে চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। এর বিশদ বিবরণ আগেই দেয়া হয়েছে।