পঞ্চম অধ্যায় – বৈদ্যনাথ তলায় গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পিঠস্থান কোলকাতা। কর্নেল ওসমানীর সাথে আলোচনা
- সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য স্বপ্নপুরী কোলকাতা।
- ৫৮ নং বালিগঞ্জ।
- স্বাগতম জানালেন জনাব তাজুদ্দিন এবং কর্নেল ওসমানী।
- জনাব আর আই চৌধুরীর বাসায় ফোন করে অপ্রত্যাশিতভাবে বাপ্পির কন্ঠ শুনতে পেলাম।
- ৩ নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ ভিআইপিদের একটি শরনার্থী শিবির।
- ২৫-২৬শে মার্চ কালোরাত্রির জীবন্ত সাক্ষী খালাম্মা, বাপ্পি এবং নিম্মী।
- বাপ্পিদের রোমাঞ্চকর পালানোর কাহিনী।
- মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কর্নেল ওসমানীর ধারণা ও পরিকল্পনা।
- কমান্ডারদের গ্রেন্ড কনফারেন্সের আভাস।
- ভারতীয় নীল নকশা অনুযায়ী বিএলএফ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কর্নেল ওসমানী এবং জনাব তাজুদ্দিনকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে।
- বিএলএফ সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললাম কর্নেল ওসমানীকে।
- যুদ্ধকালে কোলকাতার নার্ভ সেন্টার- ৫৮ বালিগঞ্জ, ৩ নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ, প্রিন্সেপ স্ট্রিটের বামপন্থীদের আড্ডা, বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র, ১৯ নং সার্কাস এ্যাভেনিউ ও পরে ৮ নং থিয়েটার রোড।
- বিভিন্ন সূত্রে অনেক গোপন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করে জানালাম কর্নেল ওসমানীকে। তিনি সেগুলো জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিনকে।
- বিষয়গুলো নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করেও কোন জবাব পাননি প্রধানমন্ত্রী।
দুপুরের পর আমাদের বিমান এসে পৌঁছলো দমদম এয়ার পোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে শিয়ালদাহ ষ্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে আমাদের উঠান হল। খাওয়া-দাওয়ার পর বিকেলের দিকে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য মুজিবনগর সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক এল হোটেলে। যারা এসেছিলেন তারা ব্রিগেডিয়ার নারায়ণের সাথে একান্তভাবে কিছু কথাবার্তা বলে আমাদের তৈরি হয়ে নিতে বললেন। তৈরি হয়েই ছিলাম। বাইরে দু’টো গাড়ি অপেক্ষা করছিল। ব্রিগেডিয়ার নারায়ণ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বললেন, “Well I shall say good bye and good luck to you. আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি না। “I Shall go back to Delhi.” খুব খারাপ লাগছিল ব্রিগেডিয়ারকে বিদায় দিতে। এতদিন একসাথে থাকাতে ভীষণ আপন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দিল্লীর মাটিতে পা দেবার পর থেকে আজঅব্দি সবসময়ে তিনি ছিলেন ছায়ার মত। আমাদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব তিনি পূরণ করেছিলেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। তিনজনই তাকে জড়িয়ে ধরলাম একে একে। গাড়িতে উঠার আগে বললাম, “স্যার বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে; না হলেও আপনার কথা মনে থাকবে চিরকাল। মনে থাকবে আপনার আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালবাসা।” ট্যাক্সি দু’টো বেরিয়ে এল হোটেলের ফটক দিয়ে। পেছনে ফিরে দেখলাম ব্রিগেডিয়ার তখনও দাড়িয়ে আছেন পোর্চে। সাথের ভদ্রলোক আমাদের তার পরিচয় দেননি। আমরাও জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, “এটাই কোলকাতা মহানগরী। পথিমধ্যে শহরের বেশ কিছু অংশ তোমরা দেখতে পারবে।” কোলকাতা স্বপ্নপূরী। পৃথিবীর বৃহত্তম নগরী কোলকাতা। ছোটকালে স্কুলে জেনারেল নলেজ বইতে পড়েছিলাম পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে কোলকাতা মহানগরী একটি। বেশ কৌতূহল নিয়েই চারিদিকে চুপচাপ তাকিয়ে দেখছিলাম। অসংখ্য লোক ছুটে চলেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। একই রাস্তায় চলেছে পদযাত্রী, ইলেকট্রিক ট্রাম, মানুষ টানা রিকশা, মোটর গাড়ি, বাস সব মিলিয়ে অকল্পনীয় যানজটের মধ্য দিয়ে ভেপু বাজাতে বাজাতে আমাদের গাড়ি দু’টো অতি মন্থর গতিতে চলেছে। মাঝে মধ্যে ড্রাইভার মুখ বার করে রিকশা কিংবা পদযাত্রীদের দায়িত্বহীন চাল-চলনের জন্য বিরক্ত হয়ে গালাগালি করছিল। লোকের ভীড় ছাড়াও যে জিনিসটি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল সেটা হল, রাস্তার দু’ধারের প্রায় সব দোকান-পাট, অফিস-আদালত, রাস্তার নাম সবই হিন্দি অথবা ইংরেজীতে লিখা। লোকের প্রচন্ড ভীড়, যানবাহনের exhaust থেকে বেরিয়ে আসা গরম দূষিত বায়ু এবং গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে ইতিমধ্যেই ঘেমে উঠেছিলাম। গাড়ির জানালা খোলা রেখেও তেমন বিশেষ কোন ফায়দা হচ্ছিল না। স্বপ্নপূরী বলে কথিত কোলকাতা শহরের জৌলুসও ঠিক তেমন একটা চোখে পড়ল না। সবখানেই কেমন যেন একটা দারিদ্রের ছাপ। বৃটিশ আমলের বাড়ি-ঘরগুলো সবই জীর্ন প্রায়। তাদের পাশাপাশি যে সমস্ত আধুনিক দালানকোঠা উঠেছে সেগুলো দেখেই বোঝা যায় The city is quite unplanned. রাস্তাঘাটের অবস্থাও মেইনটেনেন্সের অভাবে শোচনীয়। Full of bumps and pot holes. অনেক রাস্তা ঘুরে গড়ের মাঠের কাছ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। এ জায়গাটা নাকি শহরের কেন্দ্রস্থল। একদিকে সব অফিস বিল্ডিংস। নামী-দামী দোকানের সারি। বড় বড় রেস্তোরা, মাঠের অন্যপ্রান্তে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল। অন্যপ্রান্ত ঘেষে রাস্তা চলে গেছে গঙ্গার ধারে। পার্ক স্ট্রিট রয়েছে একদিকে। মাঠটি বেশ বড়। ফুলের কেয়ারী ও বড় বড় গাছপালা রয়েছে মাঠে। কোন কোন জায়গায় বসার বন্দোবস্তও রয়েছে। সে সমস্ত জায়গায় অনেক লোক বসেছিল। শ্রান্ত পথযাত্রী, অফিস-আদালতের নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী, নারী-পুরুষের দল, বেকার লোকজন, স্কুল-কলেজ থেকে পালিয়ে আসা কপোত-কপোতির দল সবার জন্যই গড়ের মাঠ একটি আকর্ষণীয় জায়গা। গড়ের মাঠ ছেড়ে পার্ক সার্কাস হয়ে আমাদের গাড়ি এসে থামল বালিগঞ্জের ৫৮নং বাড়ির সামনে। আধুনিক কায়দায় তৈরি দ্বিতল বাড়ি। চারিদিকে বেশ উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়িটির সামনে এক চিলতে একটা উঠোন উঠোনের মাঝখানে একটি ফ্ল্যাগপোলে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত তার মাঝে হলুদ বাংলাদেশের ম্যাপ। গেটের বাইরে ছোট-খাট একটা জটলা। গাড়ির হর্ণের শব্দ পেয়ে ভিতর থেকে সেন্ট্রি গেট খুলে দিল। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। সাথের ভদ্রলোক বললেন, “মুজিবনগর সরকারের পিঠস্থানে পৌঁছে গেছি আমরা।” এটাই মুজিবনগর সরকারের প্রধান কেন্দ্রস্থল। বাড়িটির পাশে এবং পেছনে যে জায়গা রয়েছে তাতে খাটানো হয়েছে কয়েকটি তাবু। গেট পাহারা দিচ্ছে বিএসএফ (BSF)-এর সেন্ট্রি। নিরাপত্তার জন্য চার কোনায় অবজারভেশন সেন্ট্রিপোষ্ট এবং বাংকার খনন করা হয়েছে। লোকের ভীড়ে পুরো বাড়িটাই গমগম করছে। দেশে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম অথচ সরকার অবস্থান নিয়েছেন কোলকাতার বালিগঞ্জে। ব্যাপারটা ঠিক সঙ্গতিপূর্ণ মনে হল না। সাথের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম,
—কর্নেল ওসমানী কোথায়?
—এখানেই তিনি থাকেন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিনের সাথে। জবাব দিলেন তিনি।
আমরা তাকে অনুসরন করে দোতালার একটি কামরায় গিয়ে বসলাম। ভদ্রলোক আমাদের বসিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন অন্য একটি কামরায়। সেখানে বসেছিলেন কর্নেল ওসমানী, আমরা ঢুকতেই তিনি উঠে এসে আমাদের স্বাগতম জানালেন। ঘরটির একপ্রান্তে একটি চৌকি তার উপর বিছানাপাতা; সাথেই একটা আলনা তাতে কয়েকটি কাপড় ভাঁজ করে রাখা। একটি ষ্টাডি টেবিল কয়েকটি চেয়ার ও একপাশে একটি লম্বা বেঞ্চ ছাড়া ঘরে আর কিছুই ছিল না। “Well boys. This is my office cum residence. Please seat down.” আমরা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসলাম। আমরা কখন কোলকাতায় এসে পৌঁছেছি? সফর কেমন ছিল? দিল্লীতে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমাদের সময় কেমন কেটেছে? এ সমস্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি বললেন, “আগামী দিনের করণীয় সম্পর্কে রাতে আলাপ হবে বিস্তারিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাবিনেট মিটিং শুরু হবে তাতে আমাকেও থাকতে হবে তাই এখন কোন কিছুই আলাপ করা সম্ভব নয়। মিটিং শুরু হবার আগেই তোমাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎকারটা করিয়ে দেয়া ভাল হবে। চল ওঠা যাক।” তার নির্দেশে আমরা উঠে দাড়ালাম, তিনি তার ব্রিফকেসে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভরে নিয়ে আমাদের সাথে করে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেটা প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন সাহেবের ঘর। কর্নেল ওসমানীর ঘরের মত একই রকমের আসবাবপত্র। চৌকির উপর কাত হয়ে শুয়ে জনাব তাজুদ্দিন কি যেন পড়ছিলেন। পরনে ফুল প্যান্ট ও হাফহাতা শার্ট আমাদের দেখে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন তিনি। সৌজন্য ও কুশলাদি বিনিময়ের পর কর্নেল ওসমানী জনাব তাজুদ্দিনকে জানালেন আজ রাতেই তিনি আমাদের ভবিষ্যত কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করবেন। ঘন্টাখানেক পর আমরা তার ঘর থেকে বেরিয়ে জনাব ওসমানীর কামরায় চলে এলাম। ওনারা দু’জন ক্যাবিনেট মিটিং এর জন্য চলে গেলেন। কর্নেল ওসমানী যাবার আগে বলে গিয়েছেন ফিরে এসে একসাথে রাতের খাবার খাবেন। ইতিমধ্যে আমাদের করার কিছু নেই। তার ঘরে দু’টো টেলিফোন। দু’টোই ডাইরেক্ট লাইন। ভাবলাম দিল্লী থেকে সেই একবার কথা বলার পর জনাব আর আই চৌধুরীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফোন করে আমাদের কোলকাতা পৌঁছার সংবাদটা তাকে দেয়া উচিত। সাথে সাথে বাপ্পি নিম্মীদের কোন খবর আছে কিনা সেটাও জেনে নেয়া যাক। ফোন তুলে ডায়াল করলাম তার বাসায়।
—হ্যালো। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল বাপ্পির কন্ঠস্বর। কোন ভুল নয়। অপ্রত্যাশিত হলেও বাপ্পির গলাই বটে।।
—ডালিম বলছি, দোস্ত তুই কোলকাতায় কবে এলি?
—একি ডালিম। কোথা থেকে? বাপ্পির আবেগ মিশ্রিত জিজ্ঞাসা।
—এইতো তোদের কোলকাতা থেকেই বলছি। তা তোরা সবাই ভালতো? প্রশ্ন করলাম।
—হ্যা ভাল। মা, নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে এসেছি বহুকষ্টে। কি করে এলাম সে এক কাহিনী। সাক্ষাৎ-এ সব বলব। আসার আগে তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। সবাই ভাল আছে। চাচা (আমার আব্বা) তোর ব্যাপারে বিশেষ চিন্তিত। অনেকদিন যাবত কোন খবরা-খবর বা চিঠিপত্র পাচ্ছেন না তাই। স্বপন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে গেরিলা হিসাবে। বদি, রুমি, জুয়েল, কাজি, বাদল, চুন্নু, আলম, মেওয়া ওরা সবাই রয়েছে একসাথে। বর্তমানে মেলাঘরে ট্রেনিং-এ আছে। ট্রেনিং শেষে ওরা সবাই ঢাকায় অপারেশন করার দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যাবে। তুই কোথায় আছিস বলতো? অসুবিধে না হলে চলে আয়। আমাদের বাসা ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ। পার্ক সার্কাস ময়দানের দক্ষিন দিকে একটা লাল দোতলা বিল্ডিং। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাড়ি এটা। সব ট্যাক্সিওয়ালাই চেনে, আসতে অসুবিধে হবে না। অসুবিধে হবে মনে হলে ঠিকানা বল আমিই এসে নিয়ে যাব।
—না, না তোর আসতে হবে না। তবে দেখা করতে হলে এখনই আসতে হবে। কারণ, রাতে জরুরী একটা মিটিং আছে। মিটিং এরপর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কোথায় যাব, কি করব তার কোন ঠিক নেই।
—তাহলে সময় নষ্ট না করে এক্ষুনি চলে আয়।
—বেশ তাই হবে।
টেলিফোন নামিয়ে মতি ও নূরকে জিজ্ঞেস করলাম আমার সাথে যাবে কিনা? ওদেরও কোন কিছু করার নেই। ওরা খুশি হয়েই আমার সাথে যেতে রাজি হল। কর্নেল ওসমানীর ব্যায়ারাটাকে বললাম, বিশেষ কাজে আমরা বাইরে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে টেলিফোন করব কর্নেল সাহেব ফিরলেন কিনা জানতে। ব্যায়ারা জবাব দিল, “ক্যাবিনেট মিটিং ভাঙবে অনেক রাতে।” আমরা বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসলাম। ঠিকানা বলতেই ড্রাইভার ট্যাক্সি চালিয়ে দিল। বুঝলাম অতি সহজেই সে ঠিকানা চিনতে পেরেছে। বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা একটা বেশ বড়সড় লাল রঙের দোতালা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম। ড্রাইভার বলল, বাড়িটাই ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ। ভাড়া মিটিয়ে গেটের কাছে আসতেই দেখলাম বাড়িটি Heavily protected by armed police. একজন হাবিলদার আমাদের পরিচয় জানতে চাইলো। বললাম, আমরা বাংলাদেশী, বাপ্পির বন্ধু। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে সে ভেতরে চলে গেল। মুহূর্তে বাপ্পি দৌড়ে দোতালা থেকে নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে আমরা কিছুক্ষণ দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়েছিলাম। আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ভাবতেই পারিনি কোলকাতায় এভাবে দেখা হবে। কিছুক্ষণ পর দু’জনেই সামলে নিলাম। বাপ্পি this is লেফটেন্যান্ট মতি and this is লেফটেন্যান্ট নূর। আমরা তিনজন একই সাথে কোয়েটা থেকে পালিয়ে এসেছি। দিল্লীতে কিছুদিন থেকে মাত্র এসে পৌঁছেছি কোলকাতায়। উঠেছি তথাকথিত প্রবাসী বাংলাদেশী সরকারের পিঠস্থান ৫৮নং বালিগঞ্জে। বাপ্পি নূর ও মতির সাথে কোলাকুলি করে আমাদের সবাইকে নিয়ে দোতালায় উঠে বারান্দায় রাখা সোফাতে বসিয়ে ভেতরে গেল খবরটা দিতে। খবর পেয়ে জনাব আর আই চৌধুরী, খালাম্মা, বাপ্পির ছোট বোন মানুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমরা সবাই সালাম করলাম। সবাই আমাদের দেখে ভীষণ খুশি। বাড়িতে লোকজন গমগম করছে। বাপ্পি এক ফাকে বলল, “আমাদের বাসায় প্রায় ১৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সবাই বাবা-মার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব।” আমাদের আসার খবর মুহূর্তে সমস্ত বাড়িতে রটে গেল। অনেকেই এসে ভীড় করলেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা আর্মি অফিসারদের স্বচক্ষে দেখতে। যারা এলেন তাদের সাথে বাপ্পি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। সেদিনের পরিচিতজনদের মাঝে ছিলেন কোলকাতা মিশনের থার্ড সেক্রেটারী আনওয়ারুল করিম চৌধুরী জয়, জনাব খালেক ও তার পরিবার, বেগম সাজেদা চৌধুরী ও তার স্বামী জনাব গোলাম আকবর চৌধুরী, জনাব মোস্তাকিম চৌধুরী এবং তার স্ত্রী এ্যনা খালা, রাফি আকতার ডলি, জনাব আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী, জনাব আলী আকবর খান, জনাব খসরুজ্জামান ও তার স্ত্রী লুসী খালা, জনাব মামুনুর রশিদ ও তার স্ত্রী রাকা, জনাব ব্রজেন দাস, কামাল সিদ্দিকী প্রমুখ। অনেকে এলেও নিম্মীর দেখা নেই। মনটা উস করছিল। বাপ্পি আস্তে করে বলল ও বাসায় নেই। অল্পক্ষণ পরে হাপাতে হাপঁতে নিম্মী এসে হাজির। আমাকে দেখে বেচারী অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে দেখছিল। চোখ দু’টো ওর টলটল করে উঠেছিল। অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—তুমি এখানে কেমন করে?
—পালিয়ে এসেছি সুদূর কোয়েটা থেকে আমরা তিনজন। আজই কোলকাতায় এসে পৌঁছেছি দিল্লী থেকে।
সবাই আমরা কি করে পালালাম সে বৃত্তান্ত শুনতে খুবই আগ্রহী। ঠিক সেই মুহূর্তে ওসমস্ত ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতে মন চাইছিল না। খালাম্মা বোধ হয় ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনের অবস্থা। তিনিই আমাকে উদ্ধার করলেন। বললেন “ওরা তো এইমাত্র এল। ওদের একটু বিশ্রাম নিতে দাও। পরে সময় করে ওদের গল্প শোনা যাবে একদিন। এসো বাবারা ভেতরে এস।” বলে আমাদের ভেতরের বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হঠাৎ করে রসভঙ্গ হওয়ায় কিছুটা নিরাস হয়েই যেন সবাই যার যার ঘরে চলে গেলেন। ভেতরের ঘরে গিয়ে বসলাম আমরা, বাপ্পি, নিম্মী, মানু, খালাম্মা ও চাচা। অল্প কিছুক্ষণ পর চাচা কি একটা কাজে উঠে চলে গেলেন। খালাম্মা গেলেন চা নাস্তার যোগাড়ে। রইলাম শুধু আমরা।
নিম্মীর চেহারা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম সুদূর কোয়েটা থেকে কোলকাতায় এসে তার সামনে আমি উপস্থিত হয়েছি এটা সে তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
—কোয়েটা থেকে এতবড় ঝুঁকি নিয়ে তুমি কি করে চলে এলে? প্রশ্ন করল নিম্মী।
— No risk no gain. ওখানে পচে মরার চেয়ে পালিয়ে আসাটা কি ভাল হয়নি? তোমরাও তো পালিয়ে এসেছ যথেষ্ট ঝুকিঁ নিয়েই? উল্টো তাকেই প্রশ্ন করলাম।
—এবার বল তোদের কাহিনী শোনা যাক। বাপ্পি আবদার জানাল।
—আমাদের কাহিনী শোনাতে অনেক সময় লাগবে। আজ বরং তোদের পালাবার কাহিনী ও ঢাকায় ২৫শে মার্চের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শোনা যাক। বাপ্পির আবদারের জবাবে বললাম।
—বলিসনে ভাই সে রাতের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা, স্মরন করলে, এখনও গা শিউরে উঠে।
খালাম্মা চা-নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বাপ্পি তাদের কথা বলতে শুরু করল। আমরা আগ্রহ নিয়ে চুপ করে শুনতে লাগলাম।
—ফেব্রুয়ারীর শেষে মা (খালাম্মা) কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য দেশের অবস্থা দেখে শুনে প্রয়োজন হলে আমাকে ও নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে যাবেন। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টা অব্দি তিনি শেখ সাহেবের বাসাতেই ছিলেন। ৩২নং ধানমন্ডি থেকে লালবাগের বাসায় ফেরেন রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। বাসায় ফেরার পর সবাই তাকে ধরে বসলাম নেতা কি বললেন? মা শুকনো বিচলিত কণ্ঠে জবাব দিলেন, “নেতাকে অনেক বোঝানোর পরও তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে রাজি হলেন না। পার্টির নেতা কর্মীরা, ছাত্রনেতারা, অন্যান্য অনেকেই আসন্ন সামরিক অভিযান সম্পর্কে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, পাক বাহিনী যদি জনগণের উপর ঝাপিয়েই পড়ে তখন জনগণের পাশে থেকে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন সেটাই তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানের এক কথা, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অস্ত্রের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। পাক বাহিনী নিরীহ জনগণের উপর শ্বেত সন্ত্রাসের ষ্টিম রোলার চালিয়ে দেবে এ ধারণা সম্পর্কেও তার দ্বি-মত ছিল। তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন, প্রয়োজনবোধে সামরিক জান্তা তাকে বন্দী করবে কারণ তাদের বিরোধ তার সাথে। কিন্তু অনেকেই যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে বর্তমানের দ্বন্দ্ব শুধু সামরিক জান্তা ও শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়: আজকের দ্বন্দ্ব সামরিক জান্তা এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। এ সত্যকে অস্বীকার করা হবে মারাত্মক ভুল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ স্বাধীনতার জন্য উম্মুখ। যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতেও তারা প্রস্তুত। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে তাদেরকে সংগঠিত করে যে কোন অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকা : সামরিক অভিযানের মোকাবেলায় প্রয়োজনবোধে অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে হতে পারে। এর জন্য মানসিকভাবে নেতৃত্ব ও জনগণকে তৈরি থেকে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতিও নেয়া উচিত। এতেই কমবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি, জনগণ ছিনিয়ে নিতে পারবে তাদের ইন্সিত স্বাধীনতা। কিন্তু শেখ মুজিব কোন যুক্তিই গ্রহণ করলেন না। তার শেষ কথা, ২৭শে মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে।’ এ কর্মসূচী ঘোষণা করে তিনি সবাইকে বিদায় করলেন। ঘোষণার সাথে এটাও তিনি বলেছিলেন, ‘পাক বাহিনীর আক্রমণের ভয় যারা করেন তারা গোপন আস্তানায় গা ঢাকা দিতে পারেন। সেদিন রাতে যারা ৩২নং ধানমন্ডিতে সমবেত হয়েছিলেন তারা তার নেতিবাচক মনোভাবে হতাশ হয়েই ফিরে গিয়েছিলেন তার ঘোষণা শোনার পর। মাও ফিরে এসেছিলেন চিন্তিত মন নিয়ে যেখানে সবাই ধারণা করছে পাক বাহিনী সামরিক অভিযান চালাবে সেখানে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কি কোন কিছুই করার নেই? জনগণকে সে ধরণের শ্বেত সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করার কোন দায়িত্বই কি নেই জনাব শেখ মুজিব ও তার দলের? তাহলে সেই চরম পরিস্থিতির হাত থেকে সাধারণ নিরস্ত্র জনগণকে বাচাবে কোন নেতৃত্ব? শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকেই তো নেতৃত্বের স্থানে মেনে নিয়েছে দেশবাসী। তাদের ডাকেই তো সাড়া দিয়ে সংগ্রামকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে জনগণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। সংগ্রামের চরম পর্যায়ে কেন তবে নেতা শেখ মুজিব পিছিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে আগে ঠেলে দিয়ে? এ সমস্ত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে না পেয়ে মা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল; আতংকিত হয়ে উঠেছিল তার স্পর্শকাতর মন। সচেতন বিবেক তার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না নেতার এ ধরণের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। সব বৃত্তান্ত শুনে আমরা সবাই হতবাক। এটাই যদি শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তবে কি আর করার আছে? শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় অতিবাহিত করা ছাড়া কিছুই করার নেই। একমাত্র সময়ই বলতে পারবে শেখ মুজিবের চিন্তা-ভাবনা ও তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কতটুকু।
মার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ রাতটা সবাই জেগেই কাটাব ঠিক হল। বাবুন ও আমি খাবার পর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বের হলাম অবস্থা বুঝে আসার জন্য। রাত প্রায় ১১.৩০ মিনিটের দিকে ফিরে এসে জানালাম নিউমার্কেট, ইউনিভার্সিটি এলাকায় আমি টহল দিচ্ছে। রেডিও ষ্টেশনেও কড়া আর্মি নিরাপত্তা বহাল করা হয়েছে। সমস্ত শহর ছেয়ে গেছে আর্মিতে। রাত বেশ গভীর। হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ করে কিছু একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হল। শব্দটা ভালো করে শুনে আমি বললাম, শহরে ট্যাংক নামানো হয়েছে। ঐ বিকট ঘড়ঘড় শব্দটা ট্যাংক চলার শব্দ। শহরে এত রাতে ট্যাংক কেন। এক অজানা আশংকায় সবার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল। দেয়াল ঘড়িটাতে সময় এগিয়ে চলছে টিক্টিক্। রাত প্রায় বারোটা। আচমকা রাতের নিরবতা ভেঙ্গে গর্জে উঠল কামান, মর্টার, ট্যাংক, মেশিনগান, রিকয়েলেস্ রাইফেল। কেঁপে উঠল গোটা ঢাকা শহর। জানালার কয়েকটি কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ভূ-কম্পনে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পরলাম ঘরের মেঝেতে। আমি তড়িৎ গতিতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। সবরকম অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বাঙ্গালী জাতির উপর। গোলাগুলির আওয়াজ আসছে সবদিক থেকেই। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম, সমস্ত আকাশ ফ্লেয়ার ও ট্রেসারের আলোতে উদ্ভাসিত। আগুনের ফুলকির মত ছুটে চলেছে অগুনিত ট্রেসার বুলেট। আজিমপুর, নিউমার্কেট, পিলখানা, ইউনিভার্সিটি এলাকায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আকাশে পেঁচিয়ে উঠে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী, অল্পক্ষণ পরে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গেল মানুষের মরনকান্না. আহতের আর্তনাদ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মৃত্যু যন্ত্রণার হাহাকার পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। শ্বেত সন্ত্রাসের পাশবিক তান্ডবলীলায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পরে থাকলাম সবাই। এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল হল। পোড়া বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। রেডিও খুলতেই শোনা গেল বিশেষ জরুরী ঘোষণা, গতকাল মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনগণকে বাইরে বেরুতে মানা করা হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে না জড়ানোর জন্য হুশিয়ার করে দেয়। হচ্ছে সবাইকে। কারফিউ জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্যে, কিছুই করার নেই। শেখ মুজিব ও তার দলের চিন্তা-ভাবনা ভুল প্রমাণিত হল। আমরা সবাই নেতার কথাই ভাবছিলাম। ক্ষণিকের জন্য মনে ভেসে উঠেছিল তার চেহারাটা। নেতা কি অবস্থায় আছেন? আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দই বা কোথায়? কারফিউ চলছে। বেরুবার কোন উপায় নেই। বাসায় দরজা-জানালা বন্ধ করে পুরো ২৬শে মার্চ সবাই অন্তরীন হয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার পর আবার গোলাগুলি, আর্তনাদ, মিলিটারি বহনকারী যানবাহন চলাচলের শব্দ, ভারী বুটের আওয়াজ রাস্তায় : নিশ্চুপ হয়ে আলো নিভিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দোয়া-কালাম পড়তে থাকলেন সবাই। অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। যে কোন মুহূর্তে দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে জল্লাদ বাহিনী। শুরু হতে পারে লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ। বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিলাম আমি, বাবুন, মুন্নি, নুন্নি এবং মাও। মেয়েদের সবাইকে ছাদে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে রাখা হল। চরম যে কোন অঘটন ঘটার প্রতীক্ষায় অসহায় চেতনাহীন অবস্থায় বসে রইলেন মুরুব্বীরা। সময় কাটছিল না কিছুতেই। ভোর হল একসময়। সূর্যের আলোয় প্রাণ ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলাম সবাই। রেডিও খুলতেই ঘোষণা শোনা গেল, সরকার কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিয়েছে সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে। ঘর থেকে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ৫-৬ জন ইপিআর এবং বাঙ্গালী সৈনিকদের একটি ছোট দল ছুটে আসছে দেখতে পেলাম। তাদের মধ্যে দু’জন গুরুতরভাবে আহত। রক্তে ভেসে গেছে ওদের পরিধেয় কাপড়-চোপড়। কাছাকাছি পৌঁছে তাদের একজন আকুতি জানাল,
—ভাই একটু পানি দেন। বললাম,
—নিশ্চয়ই। আসুন আমাদের বাসায়।
—না ভাই, আমাদের সময় নেই। অতি কষ্টে পালিয়ে বেঁচেছি। নদীর ওপারে না পৌঁছার আগে আমরা নিরাপদ নই। খান সেনারা আমাদের মত সবাইকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে রক্ষা নেই। কুকুরের মত গুলি করে মারবে।
—আমি দৌড়ে গিয়ে বাবুনের সহায়তায় বালতি করে পানি এনে তাদের খাওয়ালাম। পানি খাবার পর ওরা কিছুটা প্রকৃতস্থ হল।
—আপনাদের এ অবস্থা কেন? জিজ্ঞেস করলাম।
—ভাই হানাদার বাহিনী সব শেষ করে ফেলেছে। তারা মাঝরাতে অতর্কিতে হামলা করে পিলখানা, পুলিশ লাইন ও ক্যান্টনমেন্টের বাঙ্গালী ইউনিটগুলির উপর। ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে হাজার হাজার সৈনিক। যারা পেরেছে তারা পালিয়ে বেচেঁছে আমাদের মত। বস্তিগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলগুলোকে গোলার ঘায়ে ধুলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। মারা গেছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। সমস্ত শহরে আর্মি টহল দিচ্ছে। কাউকে দেখে এতটুকু সন্দেহ হলেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। আপনাদের মত তরুণরাই ওদের টার্গেট। ভাই আপনারাও পালান। চলে যান শহর ছেড়ে গ্রামে। হানাদার বাহিনীর কবল থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আপনাদের মত তরুণ যুবকদের প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা চলি ভাই। বেঁচে থাকলে দেখা হবে ইনশাল্লাহ্।
বিদায় জানিয়ে একইভাবে দৌড়ে চলে গেল ওরা। জোয়ান ভাইদের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সবাই। একি ব্যাপার। কি করে এতটা বর্বর আর হিংস্র হয়ে উঠতে পারল পাকিস্তানের শাসকরা। তাদের হঠকারী পদক্ষেপ পাকিস্তানের অখন্ডতার মূলেই কুঠারাঘাত হেনেছে। এরপর পূর্ব পাকিস্তান কোনক্রমেই আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করেই এই ন্যাক্কারজনক শ্বেত সন্ত্রাসের জবাব দিতে হবে। কারফিউ উঠিয়ে নেয়ার সুযোগে বাইরে বেরিয়ে অবস্থাটা স্বচক্ষে একটু দেখে আসার ইচ্ছে হল। বাসায় ফিরে প্রস্তাবটা দিতেই মা, বাবুন এবং নিম্মী সঙ্গে যেতে চাইলো। কোন যুক্তিই তারা শুনলনা। একা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না ওরা। অগত্যা চারজনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। রাস্তায় অসম্ভব ভীড়। লোকজন, যানবাহন সবই ছুটে চলেছে উর্ধ্বশ্বাসে। সবাই চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ বেরিয়েছে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। বাসার কাছের বস্তি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত বস্তি লোকশূন্য। নিউমার্কেটের পাশে, কাটাবন, নীলক্ষেত বস্তিরও একই অবস্থা। সমস্ত পিলখানা আর্মি ঘিরে রেখেছে। প্রতিটি রাস্তায় মেশিনগান ফিট করা খান সেনা বহনকারী ট্রাকগুলো টহল দিচ্ছে। রাস্তার স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি এলাকা একদম ফাঁকা। থমথম করছে। ইকবাল হল (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রস্থল), জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল মর্টার ও ট্যাংক ফায়ারে ইট ও কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হলগুলোর মাঠে বুলড্রেজার দিয়ে গণকবর খুঁড়ে পুতে দেয়া হয়েছে মৃত ব্যক্তিদের লাশগুলো। রোকেয়া হলের কাছে এ ধরণের একটি গণকবরে তাড়াহুড়া করে পুঁতে রাখা একটি লাশের দু’টো পা বেরিয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। দেখে আতঁকে উঠলাম সবাই। মিলিটারি গাড়িগুলো থেকে খান সেনারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। হঠাৎ মার খেয়াল হল এভাবে ঘোরাফেরা করাটা মোটেও নিরাপদ নয়। বাসাবো, রামপুরা টিভি ষ্টেশন, কমলাপুর রেল ষ্টেশন, রেডিও ষ্টেশন ঘিরে রেখেছে শত শত আর্মি। কালো পোষাক পরিহিত মিলিশিয়া বাহিনীকেও নামানো হয়েছে। সব জায়গায় বস্তিগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে দু’রাতের মধ্যেই। মালিবাগে তোদের বাসায় সবার খবর নিতে গেলাম। আমাদের দেখে চাচা অবাক হয়ে গেলেন। ভীষণ রেগে গিয়ে মাকে বললেন, ‘কোন সাহসে আপনারা বেরিয়েছেন? এক্ষুনি ফিরে যান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যান নদী পার হয়ে। আমরাও সরে পড়ছি। ঢাকা শহর মোটেও নিরাপদ নয়। চাচার কথা শুনে তক্ষুনি আমরা ফিরে এলাম লালবাগে। ঘটনার ব্যাপকতা জোয়ান ভাইদের বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি। বাসায় ফিরে সবাই সেদিনই বুড়িগঙ্গা পার হয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। আশ্রয় নিয়েছিলাম পরিচিত একজনের বাড়িতে। সেখানে আমাদের থাকতে হয় তিনদিন তিনরাত। ইতিমধ্যে শহরের পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। পুরো ঢাকা শহর আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমরা আবার ফিরে এলাম লালবাগে। বাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে থাকলে কর্তৃপক্ষের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে ভেবেই আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। চাচা পদস্থ সরকারি চাকুরে। সরকারি কর্মচারীদের যার যার চাকুরিস্থলে অবিলম্বে যোগদান করার জন্য রেডিও, টেলিভিশনে ক্রমাগত নির্দেশ জারি করা হচ্ছিল; ফলে বাধ্য হয়ে চাচারাও ঢাকায় ফিরে আসেন কয়েকদিন পর। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বেতার থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ডাক দেশের জনগণ শুনতে পেয়েছে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর বাঙ্গালী সেনারা। ঢাকা পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সংগ্রামী বাঙ্গালী সেনারা দখল করে নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও মফস্বলের অন্যান্য শহরগুলো। তাদের সাথে স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতায় সাড়া দিয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কর্মী, ছাত্র জনতা। সব জায়গায় শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম। সদ্য সংগঠিত মুক্তি বাহিনী প্রবল বিক্রমে প্রতিহত করে চলেছিল পাক বাহিনীর আক্রমণ। সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন বিভিন্ন স্থানে, নিজ উদ্যোগে। প্রধান শহরগুলো পুনর্দখল করার জন্য ঢাকা থেকে Re-inforcement পাঠানো হচ্ছিল বিপুল সংখ্যায়। পরিণামে প্রধান শহরগুলো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পাক বাহিনী মুক্তিফৌজের হাত থেকে পূনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়। Defensive tactics গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে নিজেদের দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক ইউনিট সীমান্ত ক্রস করে ভারতে গিয়ে স্থাপন করেন তাদের Re- organization ক্যাম্প। পাক বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রাণ ভয়ে হাজার হাজার শরনার্থী ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। শরনার্থীদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের। ভারত সরকার তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানায়। মানবিক কারণের অযুহাতে শরনার্থীদের আশ্রয় দেবার সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা যার যার ফৌজ নিয়ে ভারতের মাটিতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সুসজ্জিত এবং সুশিক্ষিত পাক বাহিনীকে তাৎক্ষনিক সম্মুখ সমরে পরাস্থ করা কিছুতেই সম্ভব ছিলনা বলেই নিজেদের Re-organize করে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমেই পাক বাহিনীকে পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব। জাতি যখন মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত তখন ১৭ই এপ্রিল ভারত সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করেই গঠন করে প্রবাসে অস্থায়ী সরকার। দেশবাসী সে খবর জানতে পারে বিদেশী প্রচার মাধ্যমের প্রচারণায়। কোলকাতার মিশনের ডিফেকশনের খবরও আমরা জানতে পারি। এ খবর জানার পর পরিবারের সবাই বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাবাও ডিফেক্ট করেছেন সবার সাথে। খবর পেলাম তার এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান সরকার। প্রতিশোধের আক্রোশে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিশ্চয়ই গ্রহণ করবে সামরিক জান্তা। সবাই একমত হলেন, আমাদের আর লালবাগে থাকা ঠিক হবে না। সরে পরতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি, মা ও নিম্মী বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমাদেরই এক ফুপুর বাড়ি। কোন জায়গায় বেশিদিন একনাগাড়ে থাকা ঠিক নয়। তাই আমরা পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম বাড়ি থেকে বাড়ি। এভাবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম আনু মামার বাড়ি, শহিদ মামার শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয় অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার পেরু মামার বাড়িতে। সে বাড়িতেই ঘটল বিভ্রাট। একদিন গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার এলেন পেরু মামার বাসায় কোন এক কাজে। সেখানে ঘটনাক্রমে তিনি মাকে হঠাৎ করে দেখে ফেলেন। মিসেস চৌধুরীকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হল না তার। সন্দেহপ্রবন হয়ে ফিরে গেলেন ভদ্রলোক। তিনি জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তরে খবরটা পৌঁছে দেন। পরদিনই পেরু মামার বাড়ি ও লালবাগের বাসায় একই সাথে রেইড করা হল আমাদের খোঁজে। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবসাব বুঝে আমরা ভদ্রলোক চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পেরু মামার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। এভাবে আমরা বেঁচে যাই সে যাত্রায়। এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা গেল পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিশোধ হিংসায় হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশে আর থাকা সম্ভব নয়। পালিয়ে যেতে হবে সীমান্ত পেরিয়ে ইতিমধ্যে স্বপন, বদি ওরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমিও যাব তাদের সাথে। মা বাধ সাধলেন, মুক্তিযুদ্ধে যাবে সেতো গর্বের কথা। কিন্তু তার আগে আমাদের কোলকাতায় তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। আমাদের পৌঁছে দিয়ে তুমি যুদ্ধে যাবে তার আগে নয়।’ মার যুক্তিসঙ্গত অনুরোধ উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। মা ও সমর্থ বোনের পালিয়ে যাবার দায়িত্ব যার তার উপর বিশ্বাস করে দিয়ে দেয়া চলে না। আমাকেই নিতে হবে এ কঠিন দায়িত্ব। পালাবার পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঠিক করা হয় ঢাকা থেকে পালিয়ে যাব নানা বাড়ি নবীনগর। সেখান থেকে সুযোগ মত কসবা সেক্টর দিয়ে আগরতলায় পাড়ি জমাতে হবে। নবীনগর থেকে কি করে বর্ডার ক্রস করতে হবে সেটা নবীনগর গিয়েই ঠিক করতে হবে অবস্থা বুঝে। আনু মামা,আলতু নানাকে সঙ্গে নিয়ে মা, নিম্মী ও আমি এক রাতে নরসিংদী হয়ে নবীনগর এসে পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে নরসিংদীর গাড়িতে। সেখান থেকে লঞ্চে নবীনগর একদম বাড়ির ঘাটে। নবীনগর গ্রামে খান সেনারা তখনও হানা দেয়নি। কিন্তু তবুও দলে দলে হিন্দুরা সব বসতবাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল ভারতে। বর্ধিষ্ণু নবীনগর গ্রামে খাঁ বাড়ি বিশেষ পরিচিত। বড় আব্বা ও নানা দাপটশালী জমিদার হিসাবে এক কালে দশ গ্রামে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বড় আব্বাকে বৃটিশ সরকার খেতাবেও ভূষিত করেছিল। প্রাসাদপোম জমিদার বাড়ির সামনে জোড়া দীঘি। নবীনগরের মুক্ত পরিবেশে পৌঁছে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম। আনু মামা দু’একদিন বিশ্রাম করে ঢাকায় ফিরে গেলেন। তার পুরো পরিবার তখনও রয়েছে সেখানে। খান সেনাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে আমরা পালিয়ে আসতে পারায় বাড়ির সবাই মহাখুশি। নবীনগরের শান্ত পরিবেশ এবং প্রকৃতির নির্মল সংস্পর্শে কয়েক দিনেই ভুলে গেলাম ঢাকার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। ২৫-২৬শে মার্চ রাতের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার বিড়ম্বনা, ২৭শে মার্চ সকালের তিক্ততা সবকিছুই দুঃস্বপ্নের মত অতীত হয়ে গিয়েছিল আমাদের কাছে। সনাতন দা গ্রামের বাড়ির মুরুব্বীদের একজন। পুরনো বিশ্বাসভাজন আপনজন। বংশানুক্রমে তারা খাঁ বাড়ির জমিদারী তদারক করে এসেছেন। তিনিই সব দায়িত্ব নিলেন আমাদের বর্ডার পার করে দেবার। সার্বিক দেখাশুনা ও পালাবার পরিকল্পনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারিনী সবার অতি আদরের ছোট নানী বেগম আমির আলী খান ও কবির। ছোট নানীর বড় ছেলে, হবিগঞ্জের এসডিও (SDO) জনাব আকবর আলী খান (খসরু মামা) খান সেনাদের শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। ঠিক হল আগরতলাতে খসরু মামার কাছেই যাব আমরা। একই গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মোমেন আমাদের গাইড হয়ে সঙ্গে যাবে। সনাতন দা যাত্রার সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী তরুণ যুবক মোমেন অসীম সাহসীও বটে। ইতিমধ্যেই সে কয়েকটি শরনার্থী দলকে আগরতলায় নিজ তদারকিতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে খান সেনাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। কসবা সেক্টর দিয়ে আগরতলা পৌঁছানোর চোরা রাস্তাগুলো ওর নখদর্পণে। ঠিক হল নৌকাযোগে মেঘনা, তিতাস পাড়ি দিয়ে খরস্রোতা গোমতী নদী বেয়ে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া GT Road পর্যন্ত গিয়ে তারপর পদযাত্রা। বর্ডার পার হওয়ার পর পথিমধ্যে পড়বে একটি বড়সড় বাজার। সেখান থেকে ভাড়াটে গাড়িতে আগরতলা। বড় একটা গয়না নৌকা ঠিক করলেন নানী ও সনাতন দা। মাঝি-মাল্লারা সবাই অত্যন্ত বিশ্বস্ত। দুর্যোগপূর্ণ এক ঝড়ের রাতে আল্লাহ্ নাম করে মোমেন, কবির ও আলতু নানাকে সঙ্গে করে নৌকায় উঠে পাড়ি জমালাম এক অজানা ঠিকানায়। দুর্যোগের রাতে খান সেনাদের চোখ অতি সহজেই ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেই ঝড়ের রাতে নৌকা যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বদর বদর বলে মাঝি-মাল্লার মেঘনার উত্তাল বুকে অন্ধকারে নৌকা ভাসিয়ে দিল। ভাল করে সাঁতার জানিনা আমি ও নিম্মী দু’জনেই। ঝড়ো হাওয়ায় মেঘনা হয়ে উঠেছে বিক্ষুব্ধ। বিশাল ঢেউয়ের পাহাড় ভেঙ্গে নৌকা এগিয়ে চললো দুলতে দুলতে। ঢেউয়ের দোলা ও ঝড়ের তীব্রতার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে আল্লাহ্-রাসূলকে স্মরন করতে থাকলাম সবাই। এমনি করে সারারাত একটানা নৌকা বেয়ে ফজরের ওয়াক্তে এক জায়গায় নৌকা ভেড়ালো মাঝিরা। সেখানে নেমে পড়তে হল সবাইকে। শুরু হল পদযাত্রা। ধানক্ষেত, পাটক্ষেতের আলের উপর দিয়ে, কাদা পলির উপর দিয়ে খালি পায়ে হেটে পাহাড়ী টিলাগুলো পার হচ্ছিলাম। পরনে সবার গ্রাম্য লেবাস। দুপুরের আগেই GT Road এর কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। একটি পাটক্ষেতের মধ্যে সবাইকে লুকিয়ে রেখে মোমেন আর আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তাটা রেকি করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলাম আমরা। রাস্তা ক্লিয়ার। ক্ষিপ্র গতিতে রাস্তা পার হয়ে দূরে চলে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দূরের জঙ্গলে গা ঢাকা দেবার আগে খান সেনাদের দৃষ্টিতে পড়লে রক্ষে নেই। নিঃঘাত মৃত্যু। পরি কি মরি সবাই দৌড়ে ছুটে চলেছি রাস্তা ক্রস করার জন্য। আর একটু গেলেই উচু রাস্তা। হঠাৎ মোমেন বলে উঠল, ‘সবাই শুয়ে পড়ুন, খান সেনাদের টহল গাড়ি আসছে।’ তার নির্দেশে সবাই ধানক্ষেতের কাঁদা পানিতে অসাড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে যতটুকু দৃষ্টি যায় ছোট ছোট পাহাড়, টিলা, ধান আর পাটের ক্ষেত। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ধানক্ষেতের কাদা-পানিতে মুখগুজে পড়ে থেকে সবাই প্রমাদ গুনছিলাম, ‘যদি টহলদার খান সেনারা দেখে ফেলে।” ভয়ে নিম্মীর দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আল্লাহ্ই বাঁচানে ওয়ালা। খান সেনাদের গাড়িটা অল্প কয়গজ দূর দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল। ওরা ধানক্ষেতে পড়ে থাকা মানুষগুলি দেখতে পেল না। গাড়িটি অনেক দূরে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলে সবাই উঠে এক দৌড়ে রাস্তা ক্রস করে অপরদিকের পাটক্ষেতে গিয়ে বসে পড়লাম। একটু দম নেয়া দরকার। মা বেচারীর ডান পা টা কিছুদিন আগে ভেঙ্গে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটির সিড়ি থেকে পিছলিয়ে গিয়ে। ভাঙ্গা পা’টা দুনিয়ে ফুলে উঠেছে। অসম্ভব সহ্য শক্তি মার। মুখ ফুটে কখনও নিজের অসুবিধার কথা ব্যক্ত করে না। তাই শুধু বলল, একটু দম নেয়া যাক। আমি ও নিম্মী মার পায়ের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম হাটতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে তাঁর। বুঝতে পারলেও কিছুই করার নেই। বাকিটা পথ হেটেই যেতে হবে তাঁকে। মাঝামাঝি পথ অতিক্রম করেছি আমরা। এখন থেকে বাকি পথের সবটুকুই পাহাড়ী উচু-নিচু পিচ্ছিল পথ। সবাই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না। মাকে উৎসাহ দেবার জন্য হেসে বললাম, ‘মা তুমি দেখছি হাটাতে আমাদেরকেও হার মানিয়ে দিলে। কষ্ট হচ্ছেনা তো?” কোন জবাব না দিয়ে মা উঠে দাড়াল। আবার শুরু হল হাটা। হাটতে হাটতে সন্ধ্যার সময় আমরা পৌঁছলাম সেই বাজারে। বর্ডার এলাকার বাজার। কিন্তু শরণার্থীদের ভীড়ে পুরো বাজারটাই গমগম করছে। চালের বস্তা ভর্তি অসংখ্য ট্রাক দাড়িয়ে আছে। মোমেন বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেছি।’ ঐ চাল বাংলাদেশ থেকে স্মাগলড হয়ে চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়। কিছুদূর এগুতেই বাজারের অন্যপ্রান্তে একইভাবে দাড়িয়ে আছে পাট ভর্তি ট্রাকের সারি। ওগুলোও পাচাঁর হচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই। দীর্ঘপথ চলায় সবাই তখন পরিশ্রান্ত। একটা চায়ের দোকানে বসে পানি, কিছু চা-নাস্তা খেলাম সবাই। খাওয়া শেষে একটি পুরনো জিপ গাড়ি ভাড়া করে আগরতলার পথে রওনা হলাম। ছোট্ট জিপটাতে প্রায় ১২জন যাত্রী ঠাসাঠাসি করে ঢোকালো ড্রাইভার। কিছুই বলার নেই। এটাই রীতি। বাজার থেকে আগরতলার দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল। পুরনো সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার আমলের জিপ। ১২-১৪ জন যাত্রীর ভারে আর্তনাদ করতে করতে কোনমতে এগিয়ে চললো আগরতলার পথে। কিছুদূর যাবার পর গাড়ি থামিয়ে বনেট খুলে পানি ঢেলে বুড়ো ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করতে হচ্ছিল বারবার। এভাবেই অতি কষ্টে রাত প্রায় ১২টায় আমরা এসে পৌঁছালাম আগরতলা শহরে। শহর থেকে ৫-৬ মাইল দূরে এক পোড়া রাজবাড়িতে খসরু মামা ও আরো কয়েকজন পদস্থ বাঙ্গালী অফিসার সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। মোমেন জায়গাটা আগেই দেখে গেছে। জিপ থেকে নেমে রিক্সা করে চলে গেলাম সেই আস্তানায়। রাজবাড়িতে পৌঁছে খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হল না খসরু মামাকে। খসরু মামা আমাদের সবাইকে দেখে অবাক,
—হেনা বুজি আপনারা?
—হ্যাঁ পালিয়ে এলাম। মোমেনই নিয়ে এসেছে আমাদের। ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
—কথা পরে হবে। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিন। মামা বললেন।
পথের ক্লান্তি, টেনশন, পেটের ক্ষুধা সব মিলিয়ে সবার অবস্থাই কাহিল। শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। মামার কথা অনুযায়ী রাজবাড়ির পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে সবাই ফিরে এসে দেখলাম, মামা ইতিমধ্যেই গরম ভাত, ডিম ভাজি এবং ডালের বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। সেগুলো অমৃত মনে করে সবাই গোগ্রাসে পেট পুরে খেলাম। খাওয়া শেষে মামার ঘরেই ঢালা বিছানায় শুয়ে পড়লাম সটান। শোয়া মাত্রই গভীর ঘুমে চেতনা হারালাম সবাই। আল্লাহ্ তায়ালার পরম করুণায় ভালভাবেই আমরা পৌঁছে গেলাম নিরাপদ আশ্রয়ে।
পরদিন সকালে খসরু মামা কোলকাতায় যোগাযোগ করে চাচাকে বাপ্পিদের পৌঁছার সংবাদ দিয়েছিলেন। বাপ্পিরা নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌঁছেছে জানতে পেরে জনাব চৌধুরী আশ্বস্ত হলেন। ওদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোলকাতায় আনাবার বন্দোবস্ত করবেন বলে খসরু মামাকে জানালেন জনাব চৌধুরী। ৪-৫ দিনের মধ্যেই প্লেনে করে বাপ্পিদের কোলকাতায় যাবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সেই পর্যায়ে বাপ্পি খালাম্মাকে জানাল, সে কোলকাতায় যাবে না। আগরতলাতে ওদের সাথে দেখা হয়েছিল মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দার, ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম শিশু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। তাদের কাছ থেকে বাপ্পি জানতে পারে স্বপন, বদি ওরা সব তখনও মেলাঘর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাপ্পি ঠিক করল সেও মেলাঘর গিয়ে ওদের সাথে ক্যাম্প যোগ দেবে। খালাম্মা তাতে বাধ সাধলেন। তাঁর এক কথা কোলকাতা অব্দি ওদের পৌঁছে দেবার দায়িত্ব বাপ্পির। কোলকাতা পৌঁছাবার পরই বাপ্পি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারবে: তার আগে নয়। বাপ্পির মনে ভয় ছিল কোলকাতায় একবার গেলে ওর আর যুদ্ধে যাওয়া হবে না। জনাব চৌধুরীকেও কিছুতেই রাজি করাতে পারবে না। এ ব্যাপারে কোন যুক্তিই তিনি মানবেন না। তাই একদিন সকালে বাপ্পি কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে চলে গেল মেলাঘর ক্যাম্পে। খালাম্মা এতে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। খসরু মামা, জনাব তৌফিক ইমাম ও অন্যান্য সবাই খালাম্মাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু খালাম্মার এক কথা, ‘বাপ্পিকে কোলকাত। পর্যন্ত সাথে যেতে হবে।’ অগত্যা ক্যাপ্টেন শিশুকে ডাকা হল। তিনি দূর সর্ম্পকে বাপ্পিদের আত্মীয় i খালাম্মা শিশুকেই ধরে বসলেন, ‘যে করেই হউক বাপ্পিকে মেলাঘর থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অগত্যা ক্যাপ্টেন শিশুকে তাই করতে হল। অবশ্য বাপ্পিকে বুঝিয়ে রাজি করাতে অনেক কষ্ট হয়েছিল ক্যাপ্টেন শিশুর। এরপর খালাম্মাদের সাথে বাপ্পিকেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কোলকাতায় চলে আসতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে খসরু মামা ও জনাব তৌফিক ইমামও সপরিবারে কোলকাতায় চলে এসে মুজিবনগর সরকারে যোগদান করেন। কোলকাতায় পৌঁছার পর চাচার একগুয়েমির ফলে বাপ্পিকেও ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যোগ দিতে হয়েছিল হেডকোয়াটার্সেই।
বাপ্পিদের গল্প শুনে সেদিন আমরা বিদায় নিয়ে ফিরে এসেছিলাম ৫৮নং বালিগঞ্জে। সেখানে পৌঁছে দেখি কর্নেল ওসমানী তখন পর্যন্ত ফেরেননি। রাত ৯টার দিকে ফিরে এলেন তিনি। আমরা একসাথে ডিনার করলাম। ডিনার শেষে আমাদের নিয়ে বসলেন তিনি। সর্বপ্রথম কিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল এবং শুরু থেকে কি অবস্থায় রয়েছে যুদ্ধ বর্তমানে, সে বিষয় বিশদ বিবরণ দিলেন কর্নেল ওসমানী।
তিনি শুরু করলেন, “তোমাদের মনে রাখতে হবে ২৫শে মার্চের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের পর ২৬শে মার্চ থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিক, প্রাক্তন ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বীর জোয়ানরা। ২৬-২৭শে মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে বীর জোয়ানদের সঙ্গে স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র, যুবক এবং আপামর জনসাধারণ। সর্বপ্রথম যুদ্ধ হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে। আর এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলতে থাকে মে মাস পর্যন্ত। শত্রুকে ছাউনিতে যথাসম্ভব আবদ্ধ রাখা এবং যোগাযোগের কেন্দ্রসমূহ তাদের কব্জা করতে না দেয়ার জন্য নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা হচ্ছিল। নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, যত বেশি বাধা সৃষ্টি করা যায় তা সৃষ্টি করা হবে। যে সমস্ত ন্যাচারাল অবসট্যাকল রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে, সাথে সাথে শত্রুর প্রান্ত ভাগে এবং যোগাযোগের পথে আঘাত হানতে হবে। মূলতঃ এটাই ছিল নিয়মিত বাহিনীর রণকৌশল। সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথেই এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি রেজিমেন্টকে দু’টি ব্রিগেডের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হয়। সংখ্যায় কম থাকায় নিয়মিত বাহিনীর রণকৌশলে পরে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। কমান্ডাররা ছোট ছোট পেট্রোল বা ছোট ছোট কোম্পানী, প্লাটুনের অংশ দিয়ে শত্রুপক্ষের তুলনামূলক অধিক সংখ্যক সৈন্যকে Engaged করে রাখছিলেন। একই সাথে শত্রুর উপর আচমকা হামলাও চালানো হচ্ছিল। এভাবেই চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর, খুলনাতে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছিল। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা বুঝতে পারছিলেন, কেবলমাত্র নিয়মিত পন্থায় যুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়। কারণ তখনকার পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিল সর্বমোট ৫টি ব্যাটালিয়ন। তাদের সাথে ছিল ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র, যুবক ও জনতা। কমান্ডাররা ছাত্র যুবকদের অল্প কিছুদিনের ট্রেনিং দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এ ধরণের শক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর ৩-৪টি ডিভিশনকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাদের উপর্যপরি আক্রমণের মুখে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ ক্রমশঃই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সে ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের এই বিশাল শক্তিকে ধ্বংস করে দেশকে স্বাধীন করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তখনই কমান্ডাররা অনুভব করেন তাদের প্রস্তুত হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের জন্য। এই পাঁচটি ব্যাটালিয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে হবে এক বিশাল গেরিলা বাহিনী। একমাত্র বিশাল গণবাহিনীই পারবে শত্রুপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নিউট্রেলাইজড করতে। এ গণবাহিনী এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যেমন মানুষের পেটের অন্ত্রে একটি শক্তিশালী জীবানু অন্ত্রটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তেমনি ভেতর থেকে শক্তিশালী দক্ষ গেরিলা বাহিনী শত্রুর অস্ত্রকেও বিনষ্ট করে দেবে। এছাড়া দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। কারণ শত্রুপক্ষের সংখ্যা বেশি। ওদের বিমান বাহিনী রয়েছে তাছাড়া সম্বলও তাদের অনেক বেশি
কর্নেল ওসমানীর কথা শুনে মনে প্রশ্ন দেখা দিল? ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী যদি নিরীহ জনগণের উপর পৈশাচিক শ্বেত সন্ত্রাস না চালাত; একই সাথে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ এবং অন্যান্য সামরিক ইউনিটগুলোর বাঙ্গালী সদস্যদের উপর হামলা না চালাত: তবে কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটত? স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বাঙ্গালী বীর জোয়ানরা? এ ধাঁধাঁর জবাব ঐতিহাসিকরাই আগামীতে খুঁজে বের করবেন সে বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চললাম। কর্নেল ওসমানী বলে চলেছেন, “আমার বিশ্বাস ক্লাসিক্যাল গেরিলা ওয়ারফেয়ার করে দেশ মুক্ত করতে হলে বহুদিন যুদ্ধ করতে হবে এবং ইতিমধ্যে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ জনসম্পদ। সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে।
জনাব ওসমানীর কথায় টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী চিন্তাধারা পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ল। পৃথিবীর কোন জাতি তাদের মুক্তি অল্পত্যাগে পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। যারা হয়তো বা পেয়েছেন তাদের সে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়নি। প্রসুতির আতুঁর ঘর থেকেই বিভিন্ন চক্রান্তের স্বীকারে পরিণত হয়েছে তাদের সে স্বাধীনতা। ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতার সুফল জাতীয় মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। নেতৃত্ব পৌঁছে দিতে পারেননি স্বাধীনতার সুফল জনগণের ঘরে ঘরে। অদৃশ্য কলকাঠির নড়াচাড়ায় যে সমস্ত দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে; সে সমস্ত দেশের পুতুল সরকারগুলোর কাছ থেকে জনগণ পেয়েছে শুধুই বঞ্চনা, প্রতারণা আর দারিদ্রের অভিশাপ
আবার কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য শুনতে মনযোগ দিলাম, “যুদ্ধকে স্বল্পস্থায়ী করার জন্য এপ্রিল মাসেই আমার মাথায় একটি প্ল্যান এসেছে। একাটি বড় গেরিলা বাহিনী গঠন করে ভেতর থেকে শত্রুর আঁতে আঘাত হানতে হবে এবং পাশাপাশি নিয়মিত বাহিনীর ছোট ছোট ইউনিট অর্থাৎ কোম্পানী বা প্লাটুন দিয়ে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং বিচ্ছিন্ন হবার জন্য তাকে বাধ্য করতে হবে, যাতে করে কনসেনট্রেটেড অবস্থা থেকে তারা ডিসর্পাসড হয়ে যায়। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে তাদের সংখ্যাগরিষ্টতা অকেজো হয়ে পড়বে। শত্রুপক্ষ ছোট ছোট গ্রুপে নিজেদের কমিট করতে বাধ্য হবে। তখন গেরিলা পদ্ধতিতে তার যোগাযোগের রাস্তা, বেতার সংযোগ, রি-ইনফোর্সমেন্টের পথ ধ্বংস করে তাকে ছোট ছোট পকেটে আইসোলেটেড করে চরম আঘাতে তাদের ধ্বংস করতে হবে। এজন্য আমার নিয়মিত বাহিনীরও প্রয়োজন রয়েছে। আমার এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিটেইলড প্ল্যান ইতিমধ্যেই অস্থায়ী সরকার এবং মিত্রদের কাছে পেশ করেছি। তাতে আমি উল্লেখ করেছি, কমপক্ষে দু’লাখের মত গেরিলা বাহিনী এবং ২৫ হাজারের মত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে কমান্ডারদের অধিনে যে সমস্ত মুক্তিফৌজ রয়েছে তাদের ছাড়া এই নূন্যতম শক্তি আমাকে অবশ্যই গড়ে তোলার অনুমতি দিতে হবে। বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে রয়েছে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ তাদের আমি বলি নিয়মিত বাহিনী। সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র যুবকদের বলি অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা তাদের বলেন FF ( Freedom Fighters) আমার মতে পরীক্ষিত যোগ্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সাথে নতুন রিক্রুটেড বীর জোয়ানদের ট্রেনিং দিয়ে তিনটি নিয়মিত ইনফ্যানট্রি ব্রিগেড গঠন করার পরিকল্পনা নিতে হবে। নিয়মিত বাহিনীর বাকি সদস্যরা Sector troops হিসাবে স্থানীয় কমান্ডারদের অধিনে থাকবে। তাদের মূল দায়িত্ব হবে গেরিলাদের জন্য বেইস তৈরি করে তাদের ট্রেনিং দেয়া এবং দেশের ভেতর ছোট ছোট গ্রুপে তাদের induct করা। গেরিলাদের Operation co-ordinate করার দায়িত্ব থাকবে সেক্টর কমান্ডারদের উপর। সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্যের জন্য গেরিলা অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হবে। সমগ্র বাংলাদেশের রনাঙ্গনকে তিনি ১১টি সেক্টরে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেক্টরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকবেন একজন সেক্টর কমান্ডার। সেক্টরগুলোর হেডকায়ার্টার্স স্থাপিত হবে বাংলাদেশের ভেতর মুক্তাঞ্চলে। সেক্টরগুলোই হবে গেরিলা যুদ্ধের মূল ভিত্তি। কারণ, বাংলাদেশের মত এত বড় একটা থিয়েটার অর্থাৎ দেশব্যাপী রণক্ষেত্রে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা ও ব্যাপক দূরত্ব। কেন্দ্রীভূতভাবে দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে যুক্ত সামরিক সদর দফতর, উপযুক্ত সামরিক অফিসার ও ষ্টাফ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সম্পদ এবং সঙ্গতির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। আমার থাকবে ১০জন অফিসার বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র বাহিনীর হেডকোয়াটার্স। এত বড় একটা বিরাট অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধে একটি মাত্র কেন্দ্র থেকে দৈনন্দিন আদেশ, নির্দেশ প্রেরণ করা ও সে অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তবও বটে। তাই আমি আমার কমান্ডারদের কাছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচ্য বিষয়ের সঠিক মূল্যায়ন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমের কোন কোন পথ উম্মুক্ত রয়েছে ইত্যদি বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য যথাশীঘ্র সম্ভব সেক্টর কমান্ডারদের একটি জরুরী বৈঠক তলব করার চিন্তা-ভাবনা করছি। জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের বাহিনীর করণীয়, বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনার নীতি নির্দেশ জারি করার দায়িত্ব হবে আমার হেডকোয়াটার্সের। আমাদের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারের নীতি নির্ধারণ ও স্থানীয়ভাবে তাদের দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। সেক্টর কমান্ডারদের সাথে লিয়াঁজো অফিসার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার ইচ্ছা রয়েছে আমার। এছাড়া আমার কমান্ডারদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা এবং যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি এক সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরে যাতায়াতও করব প্রয়োজনে।” কর্নেল ওসমানীর যুদ্ধ প্রস্তুতির বিশদ বিবরণ আমরা তিনজনই মনযোগ দিয়ে শুনলাম। তার বক্তব্যে সামরিক প্রস্তুতির বিশদ বিবরণ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের মূল বিষয় তথা রাজনৈতিক দিকটির সম্পর্কে তেমন কিছুই বললেন না তিনি।
যে কোন জাতির মুক্তি সংগ্রামকে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সফল করে তোলার জন্য রাজনৈতিক আদর্শ ও নেতৃত্বের ভূমিকা মূখ্য। জনগণকে সাথে নিয়েই সংগঠিত করা হয় গেরিলা যুদ্ধ। জনগণকে গেরিলা যুদ্ধে আকৃষ্ট করতে হয় রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে। কারণ রাজনৈতিক নীতি আদর্শের মাধ্যমেই জনগণ দেখতে পায় তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন এবং বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি। তাই অতি প্রয়োজনের খাতিরেই জনগণের মুক্তি ও তাদের আশা-আকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে নীতি ও আদর্শ প্রণয়ন করে জাতীয় পরিসরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য গঠন করতে হয় সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। এ সরকার সাধারণতঃ গঠিত হয় পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে। এটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত জনযুদ্ধের প্রক্রিয়া। সমসাময়িক পৃথিবীতে সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে পরীক্ষিত এ প্রক্রিয়ার বিপক্ষে একদলীয় একটি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সফলভাবে এগিয়ে নেয়া কি করে সম্ভব? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্ম হয়েছে দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশার জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আদর্শ এবং নীতিমালায় সর্বস্তরের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন নেই। আওয়ামী লীগ মূলতঃ বাংলাদেশের উঠতি বুজুয়া এবং পাতি বুজুয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দল। সেক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণকে সশস্ত্র সংগ্রামে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একক সরকার নেতৃত্ব দেবে কোন যুক্তিতে? ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে, ধর্মীয় আদর্শের আওতায় পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে সে দাবিতে। সেখানে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কোন অঙ্গীকার ছিল না। কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য থেকে একটি বিষয়ও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আহ্বানে শুরু হয়নি। স্বাধীনতার প্রথম ডাক দিয়েছিলেন অখ্যাত এক তরুণ মেজর জিয়াউর রহমান আর তার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ। তাদের অংশগ্রহণে বাঙ্গালী বীর সৈনিক ও নওজোয়ানরা সংগঠিত করেছিলেন প্রতিরোধ মুক্তি সংগ্রাম বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারাই অগ্রণী হয়ে স্বীয় উদ্যোগে গঠন করে তুলেছিলেন মুক্তিফৌজ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয়া তো দূরের কথা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও শেখ মুজিব কখনোই চিন্তা করেননি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা। তাই ছিল না তাদের কোন পূর্ব প্রস্তুতি। তাদের পার্টি মেনিফেষ্টো, নির্বাচনী প্রচারণা এবং পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া শাহীর সাথে তাদের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও অন্যান্য কার্যক্রম থেকে এ সত্যই প্রমাণিত হয়। এ সত্যকে অস্বীকার করে আজ কোন অধিকারে প্রবাসে দলীয় অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের সকল কৃতিত্বের একচ্ছত্র দাবিদার হয়ে উঠলেন তারা?
“মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। অনেকেরই বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগ একাই মুক্তিযুদ্ধ করবে। অন্য কোন দল বা গোষ্ঠি করুক তা হবে না। (দৈনিক ইনকিলাবের সাথে জনাব শান্তিময় রায়ের সাক্ষাৎকার)।
এ ধরণের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের অধিনেই দেশ স্বাধীন করে গণমুক্তির স্বপ্ন দেখছেন কর্নেল ওসমানী। পরিকল্পনা করেছেন গেরিলা যুদ্ধ করার। অবশ্য তাঁর কথার ফাকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের পক্ষপাতী তিনি ও তার সরকার নন। তার মানেই বা কি? তবে কি পর্দার অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য কোন ষড়যন্ত্র চলছে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতীয় সরকারের বোঝাপড়ার মাধ্যমে? তড়িঘড়ি করে অস্থায়ী দলীয় সরকার কায়েম করার মত তাড়াহুড়া করে স্বাভাবিক পরিণতির পরিবর্তে অস্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশকে তথাকথিত স্বাধীনতা প্রদানের ফন্দি আটা হচ্ছে কি সবার অলক্ষ্যে? ভারতীয় নীল নকশা যা আমরা দিল্লীতে অনুভব করে এসেছি তার সাথে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলাম। তবে কি কর্নেল ওসমানীও ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নেরই একজন? এ কথা বিশ্বাস করতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কর্নেল ওসমানীকে আমরা চিনি একজন নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, স্বাধীনচেতা একজন বাঙ্গালী সৈনিক হিসেবে। অবসর গ্রহণের পর হালে রাজনীতিতে যোগদান করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাই বলে কোন লোকের চরিত্রতো রাতারাতি সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় না। তার বেলাই বা সেটা কি করে সম্ভব? একবার ভাবলাম আমাদের দিল্লীর অভিজ্ঞতা তাকে সম্পূর্ণ খুলে বলে আমাদের মনোভাব পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করি। আবার ভাবলাম আগে তার কাছ থেকে বুঝে নিতে হবে তিনি এসবের সাথে কতটুকু জড়িত। সেটা না বুঝে সবকিছু খুলে বললে হিতে বিপরীতও হতে পারে। আমরা তিনজনই মহা বিপদের সম্মুখীন হতে পারি। প্রাসঙ্গিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উভয় সংকটে পড়লাম।
আলোচনাকালে কর্নেল ওসমানী হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, “I have decided to send you and Moti as Guerilla Advisor to the sector commanders and Noor shall be at the HQ as my ADC & Personal Staff Officer (PSO).”
তার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কি অবাক কান্ড। তাহলে কর্নেল ওসমানী আমাদেরকে নিয়ে ভারতীয় সরকার এবং প্রবাসী সরকার কি ভাবছে সে সম্পর্কে কি কিছুই জানেন না? মনে খটকা লাগল। মনে করলাম আমাদের ব্যাপারে হয়তো বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্বয়ং তাজুদ্দিন ও ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। জনাব তাজুদ্দিন তখন পর্যন্ত কর্নেল ওসমানীকে তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছুই জানাননি। আশ্চর্য। মুক্তিফৌজের কমান্ডার-ইন-চীফ এর কাছে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) নামের স্পেশাল পলিটিক্যাল ফোর্স গঠনের ব্যাপারে সবকিছুই গোপন রেখেছেন অস্থায়ী সরকার প্রধান জনাব তাজুদ্দিন আহমদ। তার মানে এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকেও বিশ্বাস করেনি ভারত এবং আওয়ামী লীগ সরকার।
মনে আশার সঞ্চার হল। কর্নেল ওসমানী নীল নকশার প্রণেতাদের একজন নয়। নিশ্চিন্ত হলাম। তাকে বিশ্বাস করে সবকিছুই বলা যায়। বেচারা কর্নেল ওসামানী। তাকে Side track করে ইতিমধ্যেই অন্য খেলা শুরু হয়ে গেছে অথচ তিনি তার কিছুই জানেন না। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমি বললাম,
—স্যার আপনি আমাদের গেরিলা অ্যাডভাইজার হিসাবে নিয়োগ করতে চাচ্ছেন এতে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্যার, জনাব প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের নিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করছেন। আপনি কি BLF গঠন করার ব্যাপারে কিছুই জানেন না?
—What is BLF? Can you frankly tell me what is going on? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
—নিশ্চয়ই বলবো sir. আপনাকে বিশ্বাস করে সবকিছুই খুলে বলবো। মুক্তিযুদ্ধের কর্ণধার হিসেবে আপনার উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। জাতির সাথে আপনি কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না সেটা আমাদের বধ্যমূল ধারণা। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যে কোন চক্রান্তকে নস্যাত করে দেবার মত দৃঢ়তাও আপনার রয়েছে, সে ব্যাপারেও আমরা তিনজনই একমত। আমাদের অনুরোধ সবকিছু শুনে আপনি উত্তেজিত না হয়ে অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে চিন্তা করবেন ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে; যে কোন অসতর্ক পদক্ষেপের চরম মূল্য দিতে হতে পারে আমাদের সবার।
— I promise you. It will be just between me and you three. Now, let me hear everything that you want to tell in details. তার অভয় অঙ্গীকারে আন্তরিকতার আবেদন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল। আমি বলতে লাগলাম,
—স্যার, দিল্লীতে আমাদের সময় কেটেছে জেনারেল ওবান সিং ও তার সহকর্মীদের সাথে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদির প্রশিক্ষণ ছাড়াও রাজনৈতিক মটিভেশন দেয়া হয়েছে আমাদের। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ বর্তমান অবস্থায় গঠিত মুক্তি বাহিনীর বেশিরভাগ কর্মকর্তা এবং সদস্যদের পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি তাদের সার্বিক আনুগত্য সম্পর্কেও তারা সন্দিহান। প্রবাসী আওয়ামী সরকার ও তাদের দল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কার্যকরী effective নেতৃত্ব সফলতার সাথে কতটুকু দিতে পারবে সে সম্পর্কেও ভারত সরকার সুনিশ্চিত নয়। রাজনৈতিক দল হিসাবে চারিত্রিক দুর্বলতা আওয়ামী লীগের রয়েছে প্রচুর, আদর্শগতভাবে রক্তক্ষয়ী একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবার মত মানসিকতা ও প্রস্তুতি কিংবা চরম ত্যাগ স্বীকার করার মত চারিত্রিক গুনাবলীও নেই দলের বেশিরভাগ সদস্যদের মধ্যে। সেক্ষেত্রে এ সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লে নেতৃত্ব চলে যেতে পারে আওয়ামী লীগের হাত থেকে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে মূলতঃ দু’টি শক্তি। চরমপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা অথবা প্রাক্তন সেনা বাহিনী, আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তি বাহিনীর মধ্যে এদের অবস্থান অতি সুদৃঢ়। দীর্ঘকালীন যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে তাদের শক্তি যাবে বেড়ে। পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। সেই অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোও কেন্দ্রিয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে তারা বিশেষভাবে চিন্তিত। যেহেতু ভারত সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বাইরে অন্য কাউকেই বিশ্বাস করছে না, সে জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে একমাত্র আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত করতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধাত্তোর উভয় অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য বিশেষভাবে গঠন করা হবে একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী। বাহিনীর নাম হবে BLF ( Bangladesh Liberation Force) এ বাহিনীর সংখ্যা হবে প্রায় এক লক্ষ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এবং কেন্দ্রিয় যুব এবং ছাত্র নেতারাই বিভিন্ন অঞ্চল এবং যুব শিবির এবং শরনার্থী শিবির থেকে রিক্রুটমেন্টে সহযোগিতা করবেন এই BLF গঠনের ব্যাপারে। রিক্রুটেড সদস্যদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থার ভার গ্রহণ করবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা। ট্রেনিং শেষে ওদের ভরন-পোষণ এবং deployment করা প্রভৃতি বিষয়ে সবকিছুই করবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ বাহিনী সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ এবং আমরা তিনজন ছাড়া কেউ কিছু জানতে পারবে না। আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে ভারতীয় সেনা বাহিনী ও প্রধানমন্ত্রীর মাঝে লিয়াজো অফিসার হিসেবে। এ বাহিনীর মূল কাজ হবে স্বাধীনতা উত্তরকালে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থেকে আওয়ামী লীগ এবং তদীয় সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা। পরে প্রয়োজনে এ বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হতে পারে মুজিব বাহিনী। কোন সন্দেহ অথবা ভুল বোঝাবুঝির উদ্রেক যাতে না হয় তার জন্য যুক্তি হিসাবে প্রচার চালানো হবে. এ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে বিশেষ এক প্রয়োজনে। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাকুঠির থেকে মুক্ত করে আনার জন্য এদের দায়িত্ব দেয়া হবে। রিক্রুটমেন্টে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সরকার ইতিমধ্যেই চারজন যুব ও ছাত্রনেতাকে সিলেক্ট করে নিয়েছে। তারা হলেন জনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং জনাব তোফায়েল আহমদ (পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের কাছে ‘চার খলিফা’ বলে পরিচিতি লাভ করেন)। RAW (Research and Analysis Wing) ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্সীর প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেরাদুনের অদূরে চাকুরাউল-এ এদের ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা ট্রেনিং দেবে। ট্রেনিং পর্যায়ে এবং পরবর্তিকালে ওদের Re-organize করার দায়িত্বে ভারতীয়দের সাথে আমাদেরও থাকতে হবে। মানে পর্যায়ক্রমে আমরাও হয়ে পড়বো মুজিব বাহিনীর সদস্য।
আমাদের কথা শুনে কর্নেল ওসমানী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হতবাক হয়ে বললেন,
— How strange। এ সমস্ত ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। I must find out from the Prime Minister how much does he know?
—অবশ্যই তা আপনাকে জানতে হবে তবে সেটা করতে হবে বিশেষ সতকর্তার সাথে। অত্যন্ত সেনসেটিভ ব্যাপার। তাই বুঝে শুনে কথা বলতে হবে আপনাকে। জনাব তাজুদ্দিনের সাথে আপনার আলাপের পরই না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নেব কি করা যায়।
সেদিনের মত আমাদের একান্ত বৈঠক শেষ হল। কর্নেল ওসমানী শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলেন। আমরা তার ঘরের অপরপ্রান্তে মেঝেতে বিছানা পেতে তিনজনই শুয়ে পরলাম। পরদিন সকালেই কর্নেল ওসামানী জনাব তাজুদ্দিনের কাছে গিয়ে গত রাতের আলোচনা সম্পর্কে আলাপ করে ফিরে এসে জানালেন,
—প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
—এ কি করে সম্ভব। দিল্লীতে আমাদের বলা হয়েছে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সবকিছুই জানেন।
— No. Boys. He is as much as in dark as I am. And I don’t think he is lieing. এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে তিনি যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করবেন। of course not exposing anyone. তোমরাও যদি আরো কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পার তবে আমাকে জানাবে। Prime Minister wants to know everything about this nefarious plan. তোমাদের ব্যক্তিগত কার্যক্রম সম্পর্কে ভেবেচিন্তে আমাকে জানিও তোমরা কি করবে? বললেন তিনি।
এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে, BLF পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী গঠন এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW সম্পর্কে জেনারেল অরোরার মন্তব্য তুলে ধরা হল:-
মুজিব বাহিনী এমন এক বাহিনী যা মুক্তি বাহিনী থেকে ছিল একেবারেই আলাদা। আমি এই বাহিনী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। একদল ছাত্র যারা নির্বাচনের সময় মুজিবের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে তারা অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এই তরুণ অংশ আমাদের ইনটেলিজেন্সকে জানায় তারাই মুজিবের প্রকৃত সমর্থক। তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভালো যুদ্ধ করতে পারবে। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। তবে মুক্তি বাহিনীর সাথে যখন তাদের গোলমাল হয় তখন প্রবাসী সরকার (তাজুদ্দিনের সরকার) এ বাহিনী সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চায়। আমি আমাদের চীফ অফ ষ্টাফ জেনারেল মানিক শ’-কে এ ব্যাপারে জানাতে বলি। তিনিই আমাকে জানান যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW এই বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই বাহিনী নিয়ে সমস্যা যখন বাড়তে থাকে তখন দূর্গা প্রসাদ ধর (ইন্দিরা গান্ধীর তৎকালীন মূখ্যসচিব) আমাকে জানালেন, ‘মুজিব বাহিনীর ব্যাপারটা বাংলাদেশ সরকারকে না জানানোর কোন বিশেষ সিদ্ধান্ত নেই। ব্যাপারটা পরিস্থিতির জন্যই বর্তমানে গোপন রাখা হয়েছে মাত্র।’ (বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতিচারন শিরোনামে নিখিল চক্রবর্তীকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার।)
দু’একদিন কোলকাতার বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মহলে ঘোরাফেরা করে বেশকিছু চমকপ্রদ খবর যোগাড় করতে পেরেছিলাম। বাপ্পিদের বাসা, ১৯নং সার্কাস এ্যাভেনিউর বাংলাদেশ মিশন, প্রিন্সেপ স্ট্রীটের বামপন্থীদের আড্ডা, শিয়ালদাহতে প্রবাসী বাঙ্গালী তরুণদের আড্ডা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বেতারের অফিস প্রভৃতি স্থানগুলো থেকেই পেয়েছিলাম খবরগুলো।
তাজুদ্দিনের হঠাৎ করে প্রবাসী সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা আওয়ামী লীগের অনেকেই পছন্দ করেনি। তাদের মধ্যে ছিলেন যুব ও ছাত্রনেতাদের অনেকেই। অনেক সাংসদ এবং আওয়ামী লীগের নেতারাও এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, শাহ্জাহান সিরাজ, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ যুব ও ছাত্রনেতারা সবাই প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন।
তাদের পরোক্ষভাবে মদদ যোগাচ্ছিলেন জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আবদুল আজিজ, মনসুর আলী, জনাব নজরুল ইসলাম প্রমুখ। জনাব তাজুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জেনারেল অরোরার মন্তব্য, “আওয়ামী লীগের যুবনেতারা তাকে পছন্দ করত না।” (বাংলাদেশের যুদ্ধের স্মৃতিচারন শিরোনামে নিখিল চক্ৰবৰ্ত্তীকে দেয়া জেনারেল অরোরার সক্ষাৎকার। )
সাধারণভাবে যুবনেতাদের অনেকেই সেদিন ভেবেছিলেন শেখ মুজিব আর জীবিত নেই। মুজিবর রহমানের অবর্তমানে তাজুদ্দিন তাদের প্রভাবকে তেমন একটা মেনে চলবেন না। শেখ মুজিব কাছে থাকলে এ সমস্ত যুব এবং ছাত্রনেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের কর্তৃত্ব অতি সহজেই স্থাপন করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু তাজুদ্দিন তাদের সাথে অন্য সুরে কথা বলছেন। তাদের হাতে ক্রিয়াণক হয়ে সংগ্রামের সব নেতৃত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তাদের সংগ্রামী ভূমিকাকেও ছোট করে দেখছেন জনাব তাজুদ্দিন। সরকার পরিচালনায় যুব ও ছাত্রনেতাদের মতামত তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছেন। তাজুদ্দিনের ধৃষ্টতার শেষ নেই। তিনি সরকার প্রধান থাকার কারণে তাদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মীয়-স্বজনকেও যথাযথ মর্যাদা দান না করে তাদের উপেক্ষা করেছেন। তাদের উপেক্ষা করা, পরোক্ষভাবে শেখ মুজিবকেই উপেক্ষা করার সমতুল্য। অতএব, যে কোন মূল্যে তাজুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অপসারন করতে হবে। মেতে উঠলেন তারা এক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতা দিল্লী গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাকে জানান যে তারা শেখ মুজিবর রহমানের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। পাক বাহিনীর হাতে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের পেছনে জনাব তাজুদ্দিনের হাত রয়েছে। গ্রেফতারের আগে শেখ মুজিব তাদের সে কথা জানিয়ে তাদেরকে ভারত সরকারের সহায়তায় স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়ে যান। জনাব তাজুদ্দিনের উপর বাংলাদেশ থেকে আগত বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক সাংসদদের সমর্থনও নেই। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীত্ব করার কোন অধিকার নেই তাজুদ্দিন সাহেবের। তাদের বক্তব্যের সমর্থনে তারা মুজিবর রহমানের ভগ্নিপতি জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের একটি চিঠি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে প্রদান করেন এবং শেখ মুজিবের জেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে তার সম্মুখে উপস্থিত করেন। তারা শ্রীমতি গান্ধীকে এ কথা বলেও হুঁশিয়ার করে দেন যে তাজুদ্দিন যদি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকেন তবে ভারতের স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ জনাব তাজুদ্দিন শেখ মুজিবের নীতি আদর্শ কিছুতেই বাস্তবায়িত করবেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দু’পক্ষের স্বার্থে তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে আগত মুজিব ভক্ত এবং তাদের অনুগত তরুণদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার জন্য তারা শ্রীমতি গান্ধীর কাছে আবেদন জানান। তারা বলেন, শুধুমাত্র এ ধরণের শক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমেই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ এবং বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মধ্যে অর্থবহ সম্পর্ক বজিয়ে রাখা সম্ভব। তা না হলে অচিরেই ভারত বিদ্বেষীদের চক্রান্তের শিকারে পরিণত হবে আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের এ অনুরোধ সাগ্রহে গ্রহণ করেন শ্রীমতি গান্ধী। সুদূর প্রসারী নীল নকশার কথা চিন্তা করেই Devide and Rule নীতির প্রয়োগের জন্য BLF পরবর্তিতে নাম বদলিয়ে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি করে সেকেন্ড ফ্রন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল BLF ওরফে মুজিব বাহিনী। এ তথ্যগুলোও জনাব ওসমানীকে জানাই আমরা। তিনি সেগুলো জনাব তাজুদ্দিনকে জানান। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন নাকি এ সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে দিল্লীতে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং এর প্রতিবিধানের দাবি জানান। কিন্তু জনাব হাকসার, ডিপিধর, ‘র’ এর রমানাথ রাও এবং জেনারেল ওবান সিং এ ব্যাপারে তাজুদ্দিনকে এড়িয়ে গিয়ে নিরব থাকেন। ফিরে এসে কর্নেল ওসমানীকে সে কথাই বলেছিলেন জনাব তাজুদ্দিন। আমরা পরে কর্নেল ওসমানীর কাছ থেকে তার ব্যাখ্যা জানতে পারি। পরবর্তী পর্যায়ে মুজিব বাহিনীকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ফোর্সেস হেডকোয়টার্স এর নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন কর্নেল ওসমানী। কিন্তু তার কোন চেষ্টাই ফলপ্রসু হয়নি। নিতান্ত অপারগ হয়েই কর্নেল ওসমানীকে BLF তথা মুজিব বাহিনী সৃষ্টি করার ভারতীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়।